[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৪] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৪

পূর্ব প্রকাশের পর

মাইক ডেভিস জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষকে নাম দিয়েছেন ‘ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্ট’ বলে। কৃষির ঔপনিবেশিক কাঠামোগত সংকটের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চয়তা মিশে গিয়ে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষকে প্রায় অনিবার্য করে তুলেছিল। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রকে এই সময়ে বিশেষভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখা যায় সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ-নিবারণী কর্মকাণ্ডের আলোচনায়। রমেশচন্দ্র দত্তের দ্য পেজেন্ট্রি অব বেঙ্গল প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালের ‘রিপোর্ট অব দ্য ইন্ডিয়ান ফেমিন কমিশন’। ঔপনিবেশিক শাসনের অফিসিয়াল ডিসকোর্সের অংশ হয়ে দাঁড়ায় দুর্ভিক্ষ-বিষয়ক ডিসকোর্স।

বাংলার প্রকট খাদ্যঘাটতি ও গণ-ক্ষুধার প্রভাব পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোয় আদৌ পড়েছিল কি-না এ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ একথা দাবি করেছেন যে, বিশ শতকের আগে এখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জেলাগুলোতে ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখা দেয়নি। উনিশ শতকের দুর্ভিক্ষগুলো হয়েছে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি মহাফেজখানার তথ্য-উপাত্ত বিচার করে আমার মনে হয়েছে যে, বড় আকারের দুর্ভিক্ষ উনিশ শতকের পূর্ব বাংলায় সংঘটিত না হলেও বিস্তৃত ক্ষুধার (স্টারভেশনের) দীর্ঘমেয়াদি অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোতেও। অর্থাৎ, শুধু চরম দারিদ্র্য নয়, ব্যাপক অনাহার বিরাজ করছিল এসব জেলায়, এমনকি অপেক্ষাকৃত খাদ্যে-উদ্বৃত্ত এলাকাগুলোতেও। ১৮৭০-৮০-এর দশকের স্থানীয় পত্র-পত্রিকাতে সেসব ক্ষুধা-অনাহারের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে ক্ষুধায় বা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে অসুখে প্রাণহানির সংবাদও। সেগুলো জাতীয় পর্যায়ে হেডলাইন করা সংবাদ ছিল না ঠিকই, কিন্তু এর মধ্য থেকে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা খাদ্য-নিরাপত্তার স্বস্তিকর চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সব বিবরণ পড়লে মনে হয় শুধু দারিদ্র্যে নয়, সময় সময় ক্ষুধায় কাটাতে হতো বৃহত্তর কৃষি-নির্ভর জনগোষ্ঠীকে এবং একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ‘দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে’ থাকতেন বছরের অধিকাংশ সময়। এই গবেষণার কাজে আমাকে সাহায্য করেছিলেন ইতিহাসের তরুণ গবেষক ইফাত আরা বিথী ও নবেন্দু সরকার। তাদের সহায়তায় আর্কাইভ থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তারই অংশবিশেষ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে এখানে তুলে ধরছি।

১. ১৮৭৮ সালে ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ পত্রিকার ২০ জুলাই সংখ্যায় বলা হচ্ছে :’পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে’ মধ্যবিত্তের মধ্যে খাদ্যশস্যের ক্রমান্বয়ে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের সংবাদদাতারা এ তথ্য জানাচ্ছে। … অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে; অনেকেই কয়েক দিন ধরে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।’

২. ১৮৭৮ সালের ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার ২১ জুলাই সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ঢাকার কমিশনার সাহেব গত দুর্ভিক্ষের সময়ের উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে খাদ্যশস্য কিনে তা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীদের জন্য স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করার প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত, আউশ ধান ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করা সমীচীন হবে না, কেননা এ বছরের আউশ ধানের ফলন ভালো হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়, ফলন যদি মোটামুটিও হয় তাহলেও সহসা এই শস্যের মূল্য নামতে শুরু করবে না। ততদিনে বর্তমানের দুর্গতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে, অনাহারে মৃত্যুর ঘটতে পারে কারো কারো, যা এখন আর বিরল ঘটনা নয় এই অঞ্চলে। গত সাত-আট মাস ধরে খুবই চড়া দামে চাল বিক্রি হচ্ছে; খাদ্য কিনতেই মানুষের সব টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। ১৮৭৪ সালের পরিস্থিতির তুলনায় এ বছর অবস্থা আরো খারাপ এ কথা বিবেচনা করে ঢাকাবাসীর জন্য সত্বর খাদ্যশস্য নির্ভর, ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’

৩. ১৮৭৮ সালের ভারত-মিহির পত্রিকার ২৭ জুলাই সংখ্যায় বলা হচ্ছে :’দুর্ভিক্ষের চিরস্থায়িত্ব আমাদের বিচলিত না করে পারে না। কীভাবে এটি নিবারণ করা যায় এই প্রশ্নটি জনমনে রয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ নিবারণে যে ব্যয় হবে, সরকারের পক্ষে তা কতদিন বহন করা সম্ভব? … সরকারী সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও [১৮৭৭ সালের] মাদ্রাজের দুর্ভিক্ষ তো এড়ানো গেল না- তিরিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হলো সেখানে। মানুষের মনে ক্রমশ এই ভুল ধারণাই জমাচ্ছে যে, [১৮৭৬ সালের ১লা মে] রানী ভিক্টোরিয়া যখন থেকে ভারত-সম্রাজ্ঞীর শিরোপা পরলেন তখন থেকেই ভারতবর্ষে একের পর এক বিপর্যয় নেমে আসছে।’

৪. ১৮৭৮ সালের ‘হিন্দু রঞ্জিকা’ পত্রিকার ১৪ আগস্ট সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘এদেশের ইতিহাসে এত ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ আর কখনো হয়নি… বন্যার ফলে বাংলার শস্য-ভাণ্ডাররূপে পরিচিত সিরাজগঞ্জ এবং পাবনার আউশ ও আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে; এর ফলে পুরো প্রদেশেই দুর্ভিক্ষের আশংকা দেখা দিয়েছে। … বিহারে দুর্ভিক্ষের সময় যেমন সরকারী সিদ্ধান্ত এসেছিল যে যেখানেই চালের দাম মণ প্রতি ৬ টাকায় চলে যাবে, সেখানেই দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকা ঘোষণা করা হবে। একই ধরনের ঘোষণা এখন বাংলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’

৫. ১৮৭৮ সালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার ৩০ আগস্ট সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘চালের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ধারণা হয় যে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। এমন কোন গ্রাম পাওয়া যাবে না যেখানে মণ প্রতি ৪ বা ৫ টাকার নীচে চাল বিক্রি হচ্ছে। এ রকম অবস্থায় ইউরোপে চাল রপ্তানী করা হচ্ছে। চাল রপ্তানীতে আমাদের আপত্তি থাকত না যদি দেশের ভেতরে চালের যথেষ্ট মজুদ থাকত।’

৬. ১৮৭৮ সালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার ২০ নভেম্বর সংখ্যায় বলা হচ্ছে : ‘কলেরা মারাত্মক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে চন্দননগর শহর ও তার আশে-পাশের গ্রামগুলোয়। একদিনেই মারা গেছে সত্তর জনের মত। … হুগলি নদীর দু’ধারের গ্রামগুলোতে নানা ধরনের মহামারী প্রকট। প্রতি দিন সেখানে কত জন মারা যাচ্ছে তার কোন হিসাব আমাদের কাছে নেই।’ এই ঘটনা চন্দননগর সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল নিয়ে হলেও পূর্ব বঙ্গের গ্রাম এলাকাতেও এটা ঘটেছে।

৭. ১৮৭৮ সালের ঢাকা প্রকাশ ৩রা নভেম্বর সংখ্যায় লিখেছে ‘পূর্ব বঙ্গে দুর্ভিক্ষের আশংকার’ কথা : ‘লর্ড নর্থব্রুক বলেছেন যে-স্থানে চালের দাম মণ প্রতি চার টাকায় পৌঁছাবে সেই এলাকাকেই দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা। এ রকম অবস্থা দীর্ঘ দিন ধরেই পূর্ব বঙ্গের প্রায় সমগ্র অঞ্চল জুড়েই বিরাজ করছে। ময়মনসিংহে চালের দাম মণ প্রতি ৬-৭ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। … আমরা অনেক দিন ধরে এসব এলাকার জন-দুর্দশা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছি। এক বেলা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে কাউকে, কেউ বা কিছুই খেতে পাচ্ছে না। সরকারী কর্মকর্তারা অবশ্য তারপরও ভাবছেন যে জরুরী ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর কোন দরকার নেই। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, এত চড়া দামে যারা চাল কিনতে পারছে তারা নিশ্চয়ই সম্পন্ন অবস্থাশালী। আসলে অভাবের কারণে চড়া দরে খাবার কিনতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই তাদের সর্বস্ব হারাতে বসেছে। অন্যদিকে, যারা মৃত্যুর পথে ধুঁকে ধুঁকে চলেছে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কোন মনোযোগ নেই।’ মনে হচ্ছে, এই বর্ণনায় উনিশ শতকের ‘মরা কার্তিককে’ দেখছি।

৮. ১৮৭৮ সালের ভারত মিহির ৫ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় এমনটা লিখেছে : ‘পূর্ব বঙ্গের মফস্বল থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ আসছে যে, বন্যার কারণে আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বত্র চালের দাম মণ প্রতি পাঁচ টাকায় চড়ে গেছে। কেবল মাত্র যারা পাটচাষী তাদের অবস্থা কিছুটা ভাল। তারপরও সামগ্রিক ভাবে দুর্দশার পরিমাণ কম নয়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিলাসবহুল জীবনে থেকে হয় তারা জনগণের কষ্ট বুঝতে পারছেন না, অথবা তারা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে চাইছেন না এবং সরকারের কাছে ‘অবস্থা সন্তোষজনক’ ধরনের প্রতিবেদন পাঠাচ্ছেন। স্যার এশলি এডেন গরীব মানুষের বান্ধব রূপে পরিচিত, কিন্তু তার গৃহীত পদক্ষেপগুলো সে কথা বলছে না। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আর কমিশনারদের প্রতিবেদন পেয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকছেন। কিন্তু তাকেই বা দোষারোপ করি কেন? এত ঘন ঘন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করা কোন সরকারের পক্ষে সম্ভব? স্থায়ী ভাবে রিলিফের কাজ সর্বত্র করানো যাচ্ছে না, এর সহজ ব্যাখ্যা হলো- এর জন্যে সরকারী তহবিল অপ্রতুল।’ কেননা, সরকারী ব্যয়ের বড় অংশই চলে যাচ্ছে অন্যান্য খাতে, যেমন কাবুল-যুদ্ধে। উদাহরণত, ১৮৭৮-৮০ সাল পর্বে ২য় ‘এংলো-আফগান ওয়ার’ চলছিল, যার বাবদ অনেক খরচ বেড়ে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক সরকারের। এই খরচের সিংহভাগ যুগিয়েছিল ঘন ঘন দুর্ভিক্ষের শিকার ভারতবর্ষের তথা বাংলার কৃষক-সম্প্রদায়।

৯. ১৮৭৮ সালের ২২শে নভেম্বরের ঢাকা প্রকাশ জানাচ্ছে : ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে চালের দাম কমা শুরু করলেও ঢাকা ও তার আশে-পাশের এলাকায় চাল মণ প্রতি ৭-৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার আমন ধান বন্যার কারণে সম্পূর্ণ বিনষ্ট। মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার ধানে পোকার কামড় দেখা দিয়েছে, ফলে সেখানেও ভাল ফসল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এসব বলে ঢাকা প্রকাশ যোগ করেছে, ‘আমরা এমনকি অনাহারে মৃত্যুর খবরও পেয়েছি’ (‘We have heard even of deaths from starvation’)।

১০. ১৮৭৮ সালের ১৮ই নভেম্বর সোমপ্রকাশ পত্রিকা খবর দেয় যে, বাগেরহাটের লোকজন স্থানীয় বোরো ধানের ফলন নষ্ট হওয়ায় ‘দুর্ভিক্ষের অবস্থায় উপনীত’ হয়েছে। তারপরও তাদের ওপরে বকেয়া দায়-দেনা পরিশোধের জন্য মহাজনদের কাছ থেকে নানারকমের অত্যাচার নেমে এসেছে। সোমপ্রকাশ আরো জানিয়েছে যে, ‘নিম্নবর্ণের একটি নারী ক্ষুধার জ্বালায় স্থানীয় হাটবাজারে গিয়ে তার শিশুকন্যাকে ১২ আনার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে চেয়েছে।’

১১. ১৮৭৮ সালের যে-দশটি বিবরণী উপরে পেশ করা হলো তাতে করে মনে হতে পারে, বুঝি ঐ বছরেই দুর্ভিক্ষের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। এর প্রায় এক বছর পরেও দেখি, অবস্থার কোন উন্নতি তো হয়ই নি, বরং লক্ষণীয় অবনতি ঘটেছে। যেমন, ১৮৭৯ সালের ৩০শে জুলাই মাসের হিন্দু রঞ্জিকা পত্রিকা সিরাজগঞ্জ-শাজাদপুর এলাকায় দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসতে দেখেছেন : ‘অনেক মানুষ সেখানে গাছের পাতা খেয়ে থাকছে। বাকিরা ভিক্ষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে।’ ঐ একই বছরের ২২শে আগস্টের প্রভাতী পত্রিকা লিখেছে, ‘চালের দাম যে-হারে বাড়ছে তাতে করে দুর্দশা বাড়ছে এবং সেটা যদি চলতে থাকে অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। এটা থামানো যেতে পারে কেবল মাত্র মুক্ত বাণিজ্য নীতির বিষয়ে কিছুটা হস্তক্ষেপ করেই। এদেশ থেকে যাতে চাল বাইরে রপ্তানী না হয়ে যায় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।’ পরবর্তীতে, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর আলোচনার সময়েও দেখতে পাব যে চালের রপ্তানী-বন্ধের দাবি নতুন করে উঠেছিল।

উপোসি বাংলা তথা পূর্ব বাংলার ‘নীরব অনাহারের’ যে চিত্র আমি দেখাতে সচেষ্ট হয়েছি তা ১৮৭০-৮০র দশকের কোন কথা-সাহিত্যে লিপিবদ্ধ হয়নি। রমেশচন্দ্র দত্ত বা বঙ্কিমের প্রবন্ধ-সাহিত্যে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ এসেছে কৃষক-জমিদার বৈরী সম্পর্কের আলোচনার অনুষঙ্গ হিসেবে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৩] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৩

পূর্ব প্রকাশের পর

সুবিদিত যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেপাইদের জন্য ১৭৬৪ সালেই একটি ‘মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে সরকারিভাবে বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে আলাদা ‘মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’-এর প্রবর্তন হয়। কিন্তু তার কার্যপরিধি সীমিত ছিল প্রশাসনিক কর্মচারী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যেই। এদেশবাসীর জন্য জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব তখন পর্যন্ত ছিল না। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর যখন কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে, তখন (১৮৬৯ সালে) সর্বপ্রথম ‘পাবলিক হেলথ্‌ কমিশনার’ পদের প্রবর্তন হয়। এর ফলে জনস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও জনসংখ্যার ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স’ সংগ্রহ হওয়া শুরু হতে থাকে, যদিও এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠা হয় কেবল ১৯১৯ সালের পরেই। মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সাংবিধানিক সংস্কারের অধীনে প্রদেশগুলোর হাতে জনস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। আমি বলতে চাইছি, শুধু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নয়; উনিশ শতকজুড়েই পর্যায়ক্রমে যে দুর্ভিক্ষগুলো ভারতবর্ষে (ও বাংলাদেশে) সংঘটিত হচ্ছিল, তাতে জনস্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা বা বিধিমালা কার্যত ছিল না। বাংলার গ্রাম এলাকা এসব স্বাস্থ্যবিধির সম্পূর্ণ বাইরে থেকে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে রোগ-মহামারী প্রভৃতি উপসর্গে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বঙ্কিম প্রকারান্তরে জনস্বাস্থ্যের নিদারুণ অভাব বা অনুপস্থিতির কথাই পাঠককে (ও শাসকশ্রেণি) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

তৃতীয়ত, হান্টারের বিবরণী থেকেও জানা যায়, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক। ক্যানিবালিজমের উল্লেখ রয়েছে তার লেখায়। হান্টার লিখেছেন, ্তুঅষষ :যৎড়ঁময :যব ংঃরভষরহম ংঁসসবৎ ড়ভ ১৭৭০ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব বিহঃ ড়হ ফুরহম. ঞযব যঁংনধহফ-সবহ ংড়ষফ :যবরৎ পধঃঃষব; :যবু ংড়ষফ :যবরৎ রসঢ়ষবসবহঃং ড়ভ ধমৎরপঁষঃঁৎব; :যবু ফবাড়ঁৎবফ :যবরৎ ংববফ-মৎধরহ; :যবু ংড়ষফ :যবরৎ ংড়হং ধহফ ফধঁমযঃবৎং, :রষষ হড় নুঁবৎ ড়ভ পযরষফৎবহ পড়ঁষফ নব ভড়ঁহফ;… রহ ঔঁহব ১৭৭০, :যব ৎবংরফবহঃ ধঃ :যব উঁৎনধৎ ধভভরৎসবফ :যধঃ :যব ষরারহম বিৎব ভববফরহম ড়হ :যব ফববফ.

বঙ্কিম এক পর্যায়ে হান্টারের অনুসরণ করে জন-দুর্গতির মর্মস্পশী বিবরণ দিয়েছেন! ‘লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়! উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপর রোগাক্রান্ত হইতে লাগল, গরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কিনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়।’

আনন্দমঠের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে তিনি সরসারি নর-মাংস ভক্ষণের দৃশ্যও প্রোথিত করেছেন। ধনী লোক মহেন্দ্র। কিন্তু তখন ‘ধনী নির্ধনের এক দর।’ মহেন্দ্র তার স্ত্রী কল্যাণীকে গৃহে রেখে তার শিশুকন্যার জন্য দুধ আনতে গেছেন। এরই মধ্যে তার গৃহে ঢুকে পড়েছে দস্যুর দল। ‘মনুষ্যাকৃতি বোধ হয়। কিন্তু মনুষ্যও বোধ হয় না। অতিশয় শুস্ক। শীর্ণ, অতিশয় কৃষ্ণবর্ণ, উলঙ্গ, বিকটাকার মনুষ্যের মত কি আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল।’ তারা কল্যাণী ও তার শিশুকন্যাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর বঙ্কিমের প্রায় চাক্ষুষ বর্ণনাতেই শুনুন :

“তখন আর একজন বলিল, ‘রাখ, রও। রও যদি মহামাংস খাইয়াই আজ প্রাণ রাখিতে হইবে। তবে এই বুড়ার শুক্‌ন মাংস কেন খাই? আজ যাহা লুঠিয়া আনিয়াছি, তাহাই খাইব। এসো, ঐ কচি মেয়েটাকে পোড়াইয়া খাই।’ আর একজন বলিল, ‘যাহা হয় পোড়া বাপু। আর ক্ষুধা সয় না।’ … অবস্থাবিশেষে মনুষ্য হিংস্র জন্তু মাত্র।”

চতুর্থত, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে শুধু অর্ধেক কৃষিজীবী জনগণের প্রাণনাশ ঘটে, তাই নয়। এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সারা বাংলায়। ডি-পপুলেশনের কারণে কৃষি-ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। হালচাষ করার মতো জনবলও ছিল না। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘গ্রামে গ্রামে শত শত উর্ব্বরা ভূমিখণ্ড সকল অকর্ষিত, অনুৎপাদক হইয়া পড়িয়া রহিল অথবা জঙ্গলে পুড়িয়া গেল। দেশ জঙ্গলময় হইল।… চাষায় চাষ করিয়া টাকা পায় না, জমিদারের খাজনা দিতে পারে না, জমিদারেরা রাজার খাজনা দিতে পারে না। … কাহারও ঘরে ধন নাই। যে যাহার পায় কাড়িয়া খায়।’

এ রকম অরাজক পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য লর্ড কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ব্যবস্থার পত্তন হয় ১৭৯৩ সালে। তার এক বছর আগে, ১৭৯২ সালে দারোগা ব্যবস্থার পত্তন হয় গ্রাম-এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। এ দেশের কৃষিতে ‘পুঁজিবাদী’ আদলের খামার-ব্যবস্থা নয়, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-উত্তর অরাজক রাজস্ব পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে একটি স্থিতিশীল ঔপনিবেশিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত করাই ছিল এর আশু লক্ষ্য।

৪. ১৮৭০-৮০ দশকের ‘উপোসি’ বাংলা

আগেই বলেছি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রতিক্রিয়ায় ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এসেছিল। তাতে করে সাময়িকভাবে হলেও কৃষিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছিল। মন্বন্তরের ফলে লোকশূন্য হয়ে জঙ্গলে পরিণত হওয়া জমি আবার ধীরে ধীরে আবাদযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। কিন্তু ১৭৯৩ থেকে ১৮৯৩ এই একশো বছরে সাময়িকভাবে কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত জমিদারি ব্যবস্থায় বাংলার কৃষকের আর্থিক আস্থার খুব সামান্যই উন্নতি হতে পেরে ছিল বস্তুত ১৮৫০ সালের পর থেকে কৃষকের অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকে। ১৮৬৮ সালের হান্টারের এনালস অব রুরাল বেঙ্গল-এর দুটি লেখা পরপর প্রকাশিত হয় যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একটি হচ্ছে, ১৮৭২ সালে লেখা বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’; এবং আরেকটি হচ্ছে ১৮৭৫ সালের প্রকাশিত রমেশচন্দ্র দত্তের প্রথম বই ‘দ্য পেজেন্ট্রি অব বেঙ্গল’। [অবশ্য সত্যের খাতিরে বলা দরকার যে, এই তিনটি বইয়ের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বেঙ্গল রায়তস দেয়ার রাইটস অ্যান্ড লায়াবিলিটিস’ শীর্ষক ১৮৬৪ সালের ‘ট্রিটিস’টি। অর্থনৈতিক চিন্তার ধ্রুপদী গ্রন্থ এটি।] কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত জমিদারি ব্যবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে দেশের অবকাঠামোগত উন্নতি হচ্ছিল বটে, কিন্তু রায়ত বা চাষিদের জীবনে কোনো শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি। অথচ বাংলার কৃষককুলই তো ছিল জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ ভাগ। আজকের যুগে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের সময়ে ‘শতকরা ১ ভাগ বনাম শতকরা ৯৯ ভাগের’ বৈষম্য নিয়ে যে কথা আমরা শুনেছি, তারই পূর্বলেখ যেন পাই বঙ্কিম-রমেশচন্দ্র দত্তের লেখায়। বঙ্কিম প্রবন্ধটিতে স্মরণীয় করে বলছেন : ‘ইংরাজের শাসন কৌশলে আমরা সভ্য হইতেছি। আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে। … দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ-দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।’ দেশের গড় শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু কৃষকের কাছে সেই শ্রীবৃদ্ধির সুফল পৌঁছায়নি। এরপর বঙ্কিম আসল কথাটা পাড়লেন: ‘আমরা দেখিলাম যে, দেশের অত্যন্ত শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। অসাধারণ কৃষিলক্ষ্মী দেশের প্রতি সুপ্রসন্না। তাঁহার কৃপায় অর্থবর্ষণ হইতেছে। সেই অর্থ রাজা, ভূস্বামী, বণিক, মহাজন সকলেই কুড়াইতেছে। অতএব সেই শ্রীবৃদ্ধিতে রাজা, ভূস্বামী, বণিক, মহাজন সকলেরই শ্রীবৃদ্ধি। কেবল কৃষকের শ্রীবৃদ্ধি নাই। সহস্র লোকের মধ্যে কেবল নয় শত নিরানব্বই জনের তাহাতে শ্রীবৃদ্ধি নাই। এমত শ্রীবৃদ্ধির জন্য যে জয়ধ্বনি তুলিতে চাহে, তুলুক; আমি তুলিব না। এই নয় শত নিরানব্বই জনের শ্রীবৃদ্ধি না দেখিলে আমি কাহারও জয়গান করিব না।’ অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারীরা জানলে খুশি হতেন যে তাহাদের আন্দোলনের দেড়শো বছর আগেই বাঙালি এক লেখক ৯৯ শতাংশের শ্রীবৃদ্ধি না ঘটলে সেই জাতীয় ‘উন্নয়নকে’ প্রগতি বলে সাধুবাদ জানাতে অস্বীকার করেছিলেন।

বঙ্কিম যখন থেকে বঙ্গদর্শন পত্রিকাটি প্রকাশ করছেন তার সঙ্গে অর্থনীতিবিদ-ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বিকেলে আড্ডা দিতে দিতে তারা দু’জনে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। বিশেষত তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন বাংলার কৃষকের ক্রম-অবনতিশীল অবস্থা নিয়ে। এ কারণেই সম্ভবত বঙ্কিমচন্দ্র ও রমেশচন্দ্র দত্তের উভয়েরই কৃষকবিষয়ক লেখায় জমিদারবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে অদ্ভুত মিল দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের লেখার ওপরে সমসাময়িক ঘটনাবলিও প্রভাব ফেলেছিল। ১৮৬৬ সালের উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষ, ১৮৭৩ সালে পাবনা ও রংপুরের কৃষকদের বিদ্রোহ নতুন করে কৃষকদের প্রশ্নটিকে সামনে এনে দিয়েছিল। বঙ্কিম লিখেছিলেন, ‘জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য, বাঙালি কৃষকের শত্রু বাঙালি ভূস্বামী। ব্যাঘ্রাদি বৃহজন্তু ছাগাদি ক্ষুদ্র জন্তুগণকে ভক্ষণ করে; রোহিতাদি বৃহৎ মৎস্য, সফরীদিগকে ভক্ষণ করে; জমিদার নামক, বড় মানুষ, কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষণ করে।’ সঞ্জীবচন্দ্র তার ‘বেঙ্গল রায়তস্‌’ গ্রন্থে রায়তের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : ‘লর্ড বেন্টিক বলেছেন রায়ত শব্দটির দ্বারা সমগ্র কৃষি জনগোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়ে থাকে। … তবে সাধারণ মতে ‘রায়ত’ এক নির্দিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীকেই নির্দেশ করে।’ যেমন জমিদার সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়েছে; তালুকদার জমিদারের কাছ থেকে বড় আকারের জমি পেয়েছে; আর রায়ত জমিদারের কাছ থেকে ছোট আকারের জমি পেয়েছে। রমেশচন্দ্র দত্ত তার বইটিতে দেখালেন যে, ১৮৫৯ সালের জমিদারি ব্যবস্থা সংস্কার-আইনে তিন ধরনের রায়তের অস্তিত্ব রেখে দেওয়া হয়েছে : (ক) যারা স্থায়ীভাবে জমিদারের জমি চাষাবাদের অধিকার পেয়েছে, অর্থাৎ যাদের জমিদাররা ইচ্ছা করলেই উচ্ছেদ করতে পারবে না; (খ) যারা কেবল ১২ বছরের জন্য চাষাবাদের অধিকার পেয়েছে (এর পরে তারা ওই জমি চাষ করতে পারবে কিনা তা জমিদারের ইচ্ছাধীন) এবং (গ) যাদের জন্য চাষাবাদের ক্ষেত্রে রায়তী অধিকার নির্দিষ্ট করা নেই। এই শেষোক্ত ‘আন্ডার-রায়তরাই’ ছিল সংখ্যাধিক্যে; এদের যখন-তখন জমি থেকে উচ্ছেদ করা যেতে পারত এবং এদের থেকে ইচ্ছামতো খাজনাও আদায় করা যেত। রমেশচন্দ্রের ‘দ্য পেজেন্ট্রি অব বেঙ্গল’ লেখার প্রধান প্রেরণা ছিল এই তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত অধিকারবিহীন রায়ত বা কৃষকদের জন্য ‘চিরস্থায়ী আবাদের’ অধিকার আদায় করা। অর্থাৎ, এদেরও প্রথম গ্রুপের তালিকাভুক্ত করায়। এর জন্যই তিনি নানাবিধ তর্কের জাল বিস্তার করেছিলেন বইটিতে। এক্ষেত্রে তার অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল যে, এই অধিকারহীন তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত রায়তেরাই বাংলার কৃষিতে পূর্বাপার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাচ্ছে, এরাই পর্বান্তরে দুর্ভিক্ষের শিকার হচ্ছে বা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছে।

১৮৭০-র দশকে শুধু যে পাবনা-রংপুরের কৃষকরা স্থানীয়ভাবে বিদ্রোহ করছিল তাই নয়, সে সময় এলাকা বিশেষ খাদ্যাভাবও দেখা দিচ্ছিল। এমনকি বাংলার ‘শস্যভাণ্ডার’ বলে পরিচিত পূর্ববঙ্গের খাদ্য-উৎপাদনে ‘উদ্বৃত্ত’ জেলাগুলোতেও ক্ষুধার প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছিল। ১৮৭০-র পর থেকেই বাংলা সামগ্রিকভাবে হয়ে ওঠে ‘উপোসি বাংলা’। বঙ্কিম-রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখের লেখার কৃষকদের দুর্দশার যে বর্ণনা রয়েছে, তাতে অবশ্য খাদ্যাভাব, মৌসুমি খাদ্য ঘাটতি ও অনাহারের থাকার বিশদ উল্লেখ নেই। ক্ষুধার বিস্তৃতির পেছনে যেমন ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজনিত ‘কাঠামোগত’ কারণ, তেমনি এর মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি জলবায়ু-পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা ও অনাবৃষ্টির প্রাদুর্ভাব। শেষোক্ত প্রবণতাটি শুধু বাংলায় নয়, ভারতবর্ষ ও তার বাইরের বৃহত্তর এশিয়া-আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতেই পরিদৃষ্ট হয়।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১২] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১২

পূর্ব প্রকাশের পর

অর্থনীতি ও সাহিত্যের অন্তর্লীন সম্পর্ক বিশেষ করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের আলোচনায়। ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওপরে বিশেষজ্ঞ অমিয় কুমার বাগচী অমর্ত্য সেনের লেখার এদিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ১৯৯৮ সালের একটি রচনায় সেন তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে নাট্যকার বার্নার্ড শ-এর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ নাটকটির একটি দৃশ্যের সবিস্তার উল্লেখ করেছিলেন। সেখানে আইরিশ-আমেরিকান একটি চরিত্র মেলোন এবং তার পুত্রবধূ ভায়োলেট-এর মধ্যে কথা হচ্ছে ১৮৪৭ সালের আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষ নিয়ে। কথাগুলো লক্ষ্য করার মতো।

‘মেলোন :আমার বাবা সেই কালো সাতচল্লিশের ক্ষুধার জ্বালায় মারা গিয়েছিলেন। হয়তো তুমি এর আগে এ নিয়ে শুনে থাকবে।

ভায়োলেট :সেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন?

মেলোন :না, আমি ক্ষুধার কথা বলছি। যখন কোনো দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে এবং সে দেশ থেকে খাদ্যের রফতানি চলতে থাকে, তখন কোনো দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। আমার বাবা ক্ষুধার কষ্টে মারা গেছেন, আর আমি ক্ষুধার কষ্টে আমার মায়ের হাত ধরে আমেরিকায় চলে এসেছি।’

ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু পার্থক্যটাকে বড় করে দেখার উপায় নেই। ক্ষুধার কষ্ট এক পর্যায়ে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী আকার ধারণ করলে তা দুর্ভিক্ষের রূপ নিতে পারে। অমর্ত্য সেন তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কোনো দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। মেলোন সাহেব যেটা ভেবেছেন সেটা ভুল। খাদ্য সরবরাহে ঘাটতিকেন্দ্রিক চিন্তা দিয়ে দুর্ভিক্ষের প্রকৃতিকে ঠিক বোঝা যাবে না।

ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে জর্জ বার্নার্ড শ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কথা এখানে আমরা টেনে আনতে পারি, যার প্রতিফলন ঘটেছিল সাহিত্য ও সংবাদপত্রে। সাহিত্যের এসব বিবরণী থেকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে এক বিশ্বস্ত চিত্র উঠে আসে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে :(ক) ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ (যা ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষ বা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত; (খ) ১৮৭০ দশকের খাদ্যাভাব বা গণমানুষের মধ্যে ক্ষুধার বিস্মৃতি; (গ) ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ (যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ হিসেবে পরিচিত); (ঘ) ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ (যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মন্বন্তর শুধু ঔপনিবেশিক পটভূমিতেই সংঘটিত হয়নি। উপনিবেশ-উত্তর ‘আধুনিক’ যুগেও একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হিসেবে এটি থেকে গেছে; এবং (ঙ) ২০০৭-০৮ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আকস্মিক খাদ্য ঘাটতি ও চালের মূল্য বৃদ্ধি (যার ফল-পরিণামে সামরিক বাহিনী চালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনসমর্থনের ভিত প্রবলভাবে নড়ে গিয়েছিল এবং নির্বাচনের দিকে ঝুঁকে পড়তে রাজশক্তি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল)। অবশ্যই এসব ‘এপিসোড’-এ ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের প্রকৃতি এক রূপ নয় এবং এদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বা কনটেক্সটও ভিন্ন। তবে প্রকৃতি ও প্রেক্ষিতের ভিন্নতা আমাদের অভিনিবেশের মূল বিষয়বস্তু নয়। এসব ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে, কীভাবে সাহিত্যের পাতায় সেসব বিবরণী উঠে এসেছে এবং এর থেকে সেদিনের অর্থনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে কিছু বিরল উন্মোচন হতে দেখি, যার সঙ্গে আর্কাইভে দলিলপত্র এবং সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানের সাক্ষ্যও সময় সময় নিষ্প্রভ ঠেকে।

৩. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

বাংলা সন ১১৭৬-এর (বা ইংরেজি ১৭৭০ সাল) মন্বন্তরের কারণে বাংলাদেশ ‘শ্মশানে’ পরিণত হয়। আমি সন্দেহ করি, এই ‘শ্মশান’ শব্দটির পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবহারের পেছনে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকা রয়ে গেছে গোচরে-অগোচরে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিমালা অনুসরণের পরিপ্রেক্ষিতে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ প্রকাশিত হয় এবং অচিরেই তা জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। এই স্লোগানে বর্ণিত ‘শ্মশান’ হওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরেই প্রথম। এই দুর্ভিক্ষের একশ’ বছর পরে উইলিয়াম হান্টারের ‘দ্য এনালস্‌ অব রুরাল বেঙ্গল’ (১৮৬৮) থেকে জানা যায় :১৭৭০ সালের মে মাসের পূর্বেই বাংলার ‘এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।’ হান্টারের এই বিবরণীটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসের মূল তথ্যভিত্তি জুগিয়েছিল। সম্প্রদায়গত বিভেদবাদী চিন্তার জন্য ‘আনন্দমঠ’ দুর্নাম কুড়িয়েছিল সঙ্গত কারণেই। কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে জানার জন্য এবং সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের দুর্ভিক্ষকেন্দ্রিক পটভূমি বোঝার জন্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ উপন্যাসকে আজও পাঠ করা যেতে পারে।

কীভাবে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো বাংলায়, বঙ্কিম তার বিবরণ পেশ করছেন এভাবে- আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদেই। উদ্ৃব্দতিটি দীর্ঘ। কিন্তু দুর্ভিক্ষের ঘটনা-পরম্পরার কার্য-কারণ সূত্র বোঝার জন্য তা বিশেষ সহায়ক :

‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্ফ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃণ্ময় গৃহ। মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পালাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।’

শুধু স্বল্প-বিত্ত জনগোষ্ঠী নয়, অনেক বিত্তবান পরিবারও ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। বঙ্কিমের লেখায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় :’এক বৃহৎ অট্টালিকা- তাহার বড় বড় ছড়ওয়ালা থাম দূর হইতে দেখা যায়- সেই গৃহারণ্যমধ্যে শৈলশিখরবৎ শোভা পাইতেছিল। … তাহার অভ্যন্তরে ঘরের ভিতর মধ্যাহ্নে অন্ধকার। অন্ধকারে নিশীথফুল্লকুসুমযুগলবৎ এক দম্পতি বসিয়া ভাবিতেছে। তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর।’

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নিয়ে ‘কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচিত হয়নি’- এ রকম মন্তব্য করেছেন সুব্রত রায়চৌধুরী তার ‘কথাসাহিত্য মন্বন্তরের দিনগুলিতে’। যেটুকু বিবরণ পাই তা হান্টার সাহেবের লেখা থেকে। ‘দ্য এনালস্‌ অব রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের (খরা/অনাবৃষ্টিতে ফসলহানি) কারণে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। হান্টার লিখেছেন, ‘The famine of 1770 was therefore a one year’s famine, caused by the general failure of the December harverst in 1769, and intensified by a partial failure of the crops of the previous year and the following spring’. এই ঘটনার আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষক-অর্থনীতিতে প্রবল ধস নেমে আসার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। হান্টার আরও জানিয়েছেন যে, দুর্ভিক্ষের পরের বছর প্রকৃতি মুখ তুলে তাকালেন। বর্ষা হয়ে মাটি আবারও উর্বর হওয়ার সুযোগ পেল। কিন্তু মানুষের দুর্গতি গেল না। কেননা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরস পর্যন্ত উপলব্ধি করলেন যে, চাষাবাদ করার মতো যথেষ্ট লোকবল বাংলায় আর অবশিষ্ট নেই। হান্টারের গণনামতে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ‘কৃষকদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগের’ প্রাণহানি হয়েছিল। শহর এলাকার ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের পাশাপাশি গ্রাম-এলাকার ডি-পপুলেশনের অভিঘাত এসে পড়েছিল বাংলাদেশে। ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট মোগল সম্রাট শাহ-আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ‘দেওয়ানি’ লাভ করার অধিকার পায়। দেওয়ানি অর্থাৎ খাজনার টাকা আদায় করার অধিকার লাভ। যেটা লক্ষণীয়, দেওয়ানি লাভ করার পাঁচ বছরের মাথাতেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো এক অদৃষ্টপূর্ব সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ বাংলায় নেমে আসে। এতে ইংরেজ শাসকবর্গের সুশাসনের গুণাবলির পরিচয় পাওয়া যায় না। যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়, সে দেশে রাজ্য শাসনের নৈতিক অধিকার থাকে না- সে কথা বঙ্কিম জানতেন। সেটা ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি আনন্দমঠ লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন- এমনটা ভাবাও অবাস্তব নয়। মুখে যদিও তিন বলেছেন, ‘ইংরেজকে রাজা করিব’। কিন্তু আমার ধারণা, তার উদ্দেশ্য অন্তর্ঘাতমূলক। তিনি আসলে দেখাতে চান, কোম্পানির হাতে শাসনভার চলে যাওয়ার কারণেই ছিয়াত্তরের মতো এত বড় মন্বন্তর হতে পেরেছিল। ১৭০০ থেকে ১৭৬৫ পর্যন্ত নবাবি আমলে কৃষি ব্যবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতির চিহ্ন পরিলক্ষ্য হলেও সে সময়ে বাংলায় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। তখন চরম দারিদ্র্যের প্রকোপ ছিল; সময় সময় বাংলাদেশ উপোসী থাকত, কিন্তু মন্বন্তর ছিল না। হান্টারের বর্ণনা অনুসরণ করেই তিনি ইংরেজ শাসনকে পরোক্ষে সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিম লিখেছেন- ‘১১৭৪ সালে ফসল ভালো হয় নাই। সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ্য হইল- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল… অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল। রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল। তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল। তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।’

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, বঙ্কিমের বর্ণনায় শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা ছিল না। সাধারণ মানুষ যখন উপবাসে কষ্ট পাচ্ছে, তখন রাজশক্তি (প্রকারান্তরে ব্রিটিশ শাসন) ‘রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায়’ বুঝে নিচ্ছে; যখন অনাবৃষ্টিতে সামান্যই ফলন হয়েছে, তখন রাজশক্তি সিপাহিদের তথা সামরিক বাহিনীর জন্য সেই ফসল কিনে রাখছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে; এমনকি যখন লোকজন দুই বেলা করে উপবাস করছে, তখনও ‘রাজস্ব আদায়’ বন্ধ হয়নি। যাতে কোম্পানির মোট রাজস্ব আদায়ে টান না পড়ে তাই উপবাসের বছরে রাজস্বের মাত্রা ‘শতকরা দশ টাকা’ হারে বৃদ্ধি করা হলো। স্পষ্টতই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও অপশাসনের ওপরে, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত দুঃখভোগকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এটা প্রথমত।

দ্বিতীয়ত, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের বছরে অন্যায় রাজস্ব-আদায়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ছাড়াও বঙ্কিম দুর্ভিক্ষের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের ছায়াসঙ্গী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সেটি হচ্ছে জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গ। বঙ্কিম লিখছেন :

‘খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সমর পাইল, জ্বর, ওলাওঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত :বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না, মরিলেও কেহ ফেলে না।’

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১১] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১১


নতুন প্রসঙ্গ

১. ঋণং কৃত্বা

কথাটা এর আগেও কেউ কেউ বলেছিলেন, কিন্তু কৌশিক বসু যেভাবে বলেছিলেন, তাতে অর্থনীতি ও সাহিত্যের সম্পর্কের বিষয়টা অনেকের মনেই গেঁথে গিয়েছিল। তার ‘অ্যানালাইটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স :দ্য লেস ডেভেলপড্‌ ইকোনমি রিভিজিটেড’ গ্রন্থে তিনি এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবেই শিবরাম চক্রবর্তীর ‘ঋণং কৃত্বা’ গল্পটির সবিস্তার বর্ণনা দেন। গল্পটা এমন :শিবরামের পাঁচশত টাকার জরুরি দরকার হয়ে পড়েছে মাসের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য। এ নিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। কোনো উপায় না দেখে তিনি তার বন্ধু হর্ষবর্ধনের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ধার নিতে গেলে ধার ফেরত দেওয়ারও নিশ্চয়তা থাকা চাই। অত-শত না ভেবে হর্ষবর্ধনকে তিনি বললেন, ‘বেশি নয় শ-পাঁচেক। আজ তো বুধবার, শনিবার দিনই টাকাটা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেবো।’ ধার পেলেন বটে, কিন্তু টাকা ফেরত দেবেন কী করে অত তাড়াতাড়ি? এ রকম ভাবছেন যখন, হঠাৎ রাস্তায় তার দেখা হয়ে গেল হর্ষবর্ধনের ছোট ভাই গোবর্ধনের সাথে। ‘গোবর্ধন ভায়া, যদি কথা দাও যে তোমার দাদাকে বলবে না তাহলে একটা কথা বলি।’ গোবর্ধন তাকে আশ্বস্ত করল। ‘অন্য কিছু নয়, কথাটা হচ্ছে এই, আমাকে শ-পাঁচেক টাকা ধার দিতে পার- দিন কয়েকের জন্য? আজ তো শনিবার? এই বুধবার সন্ধ্যের মধ্যেই টাকাটা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব।’ গোবর্ধনের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে শিবরাম এবার হর্ষবর্ধনকে তার ধারটা ফেরত দিয়ে দিলেন। এতে ‘ভালো ঋণ গ্রহীতা’ হিসাবে শিবরামের ওপরে আস্থা আরও বেড়ে গেল। পরের সপ্তাহে বুধবার দিনই অবশ্য আবার হর্ষবর্ধনের দ্বারস্থ হতে হলো তাকে, গোবর্ধনকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। টাকা পেয়ে গোবর্ধনও সন্তুষ্ট, তবে বুধবার টাকা ফেরত দেওয়ার কিছু পরেই আবারও ধার করতে হলো শিবরামকে- এবার শনিবার হর্ষবর্ধনকে তার ধার শোধ দেওয়ার জন্য। এইভাবে ‘হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন- শনিবার আর বুধবারের দু-ধারের টানাপড়েন’ চলতে থাকল। অনেক দিন পর্যন্‌ত এটা চলছিল। কিন্তু এভাবে কতদিন আর চালানো যায়! অর্থনীতির পরিভাষায়, এ রকম দায়দেনার চক্র ‘সাসটেইনেবল’ হয় না। এর পরের অংশ শিবরামের অননুকরণীয় ভাষায় তুলে ধরছি :

‘হর্ষবর্ধন বাবু ভাই গোবর্ধন, একটা কথা আমি বলবো, কিছু মনে করো না-‘ বলে আমি শুরু করি :’ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধন বাবুকে পাঁচশো টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধন বাবু, আপনি প্রত্যেক শনিবার পাঁচশো টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধন বাবু, আপনি বুধবার, আর গোবর্ধন, তুমি শনিবার মনে থাকবে তো?’

‘ব্যাপার কি!’ হর্ষবর্ধন তো হতভম্ব :’কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘ব্যাপার এই যে, ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।’

কৌশিক বসু এই গল্পটি প্রোথিত করেছেন তার বইয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট’ পরিচ্ছেদে। কিন্তু আমাদের দেশের সাম্প্রতিককালের একটি বহুল আলোচিত বিষয় খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রেও শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পটি শিক্ষণীয় হতে পারে। একাধিক ঋণদাতার কাছে যারা একই সময়ে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন, তারা অনেক দিন পর্যন্ত ‘শনিবার-বুধবার’ জাতীয় ঋণ-চালাচালি (Credit Juggling) করতে পারেন এবং এতে সাময়িকভাবে ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তাদের সুখ্যাতি বেড়েও যেতে পারে। এর ফলে যিনি কোনো ব্যাংকের কাছ থেকে শুধু সীমিত আকারের ঋণই প্রত্যাশা করতে পারতেন, ঋণ-চালাচালির মাধ্যমে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে তিনি বৃহদাকার ঋণ পাওয়ার পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করতে পারেন। ব্যাংকের জন্য এর মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হতে পারে মারাত্মক। কেননা, যখন এক উৎস থেকে ধার নিয়ে আরেক উৎসের ধার ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটি ধরা পড়ে তখন হয়তো বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। এই অশুভ ঋণ-চালাচালির ব্যবস্থার ফলে বড় আকারের ঋণ মন্দ ঋণে বা খেলাপি ঋণে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়। এদিকটা শিবরাম চক্রবর্তীর দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রথমবার হর্ষবর্ধনকে তার ধার ফেরত দেওয়ার পর তিনি বলছেন :

‘ভাবছেন এই যে, এই পাঁচশো টাকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ক্রেডিট খাটিয়ে এর পরে আমি ফের হাজার টাকা ধার নেবো। তারপর সেটা ফেরত দিয়ে আবার দু হাজার চাইবো। আর এমনি করে ধারটা দশ-হাজারে দাঁড় করিয়ে তারপরে আর এ-ধারই মাড়াবো না? এই তো ভাবছেন আপনি?’

এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো যেতে পারে, মাল্টিপল লেন্ডারদের মধ্যে ঋণ-চালাচালির মাধ্যমে একজন মন্দ ঋণ গ্রহীতা শুধু সাময়িক সময়ের জন্যই পার পেতে পারে। এক সময় তাকে ধরা পড়তেই হয়, যেমনটা একদিন শিবরামকে হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন উভয়েরই মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কেননা, একজনের থেকে ধার-কর্জ করে ধার শোধ করার ‘শনিবার-বুধবার’ জাতীয় ব্যবস্থা টিকে আছে একটা শর্তের ওপরে, যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন, ‘ইনফর্মেশন এসিমেট্রি’। গোবর্ধনকে শিবরাম বারবার বলে দিয়েছিলেন, তার ধার করার ব্যাপারটি যেন হর্ষবর্ধনকে জানানো না হয়। আধুনিক ব্যবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাউকে বড় আকারের ঋণ দেওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে তথ্য-বিনিময় করতে পারে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফর্মেশন ব্যুরোর সাহায্য নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিবরামের ‘শনিবার-বুধবার’ ব্যবস্থা কাজ করতে পারত না। যা হোক, ওপরে যে সম্ভাবনার কথা লিখলাম তা শুধু আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নয়; গ্রামাঞ্চলের মাইক্রো ক্রেডিট সেক্টরেও প্রযোজ্য। ‘শনিবার-বুধবার’ ব্যবস্থায় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিওর কিস্তি পরিশোধ করা খুবই সম্ভব। যদিও বিভিন্ন এনজিও উৎস থেকে একই সঙ্গে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ রয়েছে, তারপরও দেখা যায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি ঋণ গ্রহীতা বিভিন্ন সূত্রের কাছে ঋণী থাকছে। তার ন্যায়সঙ্গত কারণও রয়েছে :একজন ঋণ গ্রহীতা হয়তো তার ব্যবসা অবিলম্বে বাড়াতে চান। সে জন্য তাকে নানা উৎসের কাছে হাত বাড়াতে হয়। কিন্তু সবাই হয়তো সে কারণেই শুধু বহুবিধ উৎসের কাছে ঋণ খোঁজেন না। এক শ্রেণির ঋণ গ্রহীতা এই আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাতেও বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ লাভ করেন এবং নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে সেসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে দীর্ঘ সময় নিরাপদে কাটিয়ে দিতে পারেন। এবং এক পর্যায়ে ধরা পড়ে গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিব্যি বলে দিতে পারেন, ‘ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনারা কে কত ঋণ মওকুফ করবেন সেটা নিজেরাই ঠিক করে নিন। আপনাদের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।’ ততদিনে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এতটাই দায়দেনা জমেছে তার নামে; কোনো একক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাধ্য কী তাকে ধরে!

২. অমর্ত্য সেনের উদাহরণ

অর্থশাস্ত্র ও সাহিত্যের অন্তর্লীন সম্পর্ক অনুধাবন করার জন্য কৌশিক বসুর শিক্ষক অমর্ত্য সেনের মানব-উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়, বৈষম্য ও দুর্ভিক্ষবিষয়ক লেখাগুলোকে ‘প্রতিনিধিত্বশীল রচনা’ হিসেবে পাঠ করা যায়। কয়েকটি উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করছি। প্রথমেই মনে পড়বে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট তথা মানব-উন্নয়ন ধারণার কথা। ইউএনডিপি কর্তৃক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বা মানব-উন্নয়ন সূচকের পেছনে মৌলিক দার্শনিক প্রেরণা এসেছিল দ্বিবিধ উৎস থেকে। একটি হচ্ছে, অ্যারিস্টটলের নীতিশাস্ত্র, বিশেষত ‘নিকোমেখিয়ান এথিকস’। অন্যটি হচ্ছে, বৃহদারণ্যক উপনিষদ। প্রথম সূত্রটি অপেক্ষাকৃত আলোচিত, কিন্তু শেষের সূত্রটির প্রতি সেনই প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। গল্পটি এমন :বানপ্রস্থে যাওয়ার আগে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্ক্য তার স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে ডেকে ধন-সম্পদের বরদানের ইচ্ছা পোষণ করলেন। ‘যদি সসাগরা পৃথিবী সম্পদে-বৈভবে পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং কেবল আমারই করায়ত্ত হয়, তবে কি আমি অমরত্বপ্রাপ্ত হবো?’ মৈত্রেয়ী বরদানের পূর্বে ঋষিকে প্রশ্ন করলেন। যাজ্ঞবল্ক্ক্য বললেন, ‘না, তোমার জীবনও অন্য যে কোনো ধনী ব্যক্তির মতোই হবে সে ক্ষেত্রে। ধন-সম্পদের মাধ্যমে অমরত্ব লাভের কোনোই আশা নেই।’ সে কথা শুনে মৈত্রেয়ী তখন বলেছিলেন, ‘যে নাহং নামৃতা স্যাম তে মোহং কিম কুর্যাম? যা আমাকে অমরত্ব পেতে সাহায্য করবে না তা দিয়ে আমি কী করব?’ এ কথা উল্লেখ করার পর সেন তার ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে লিখছেন, ‘মৈত্রেয়ীর কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি আমাকে জিএনপি বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন বিচার করার পদ্ধতির বাইরে উন্নয়নের অন্য ধারণাকে খুঁজে বের করতে ও ব্যাখ্যা করতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করছিল।’ যার প্রমাণ মেলে তার ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’ বইয়ে।

অন্যত্র, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে সেন ব্যালটকেন্দ্রিক ধারণার বাইরে গিয়ে যুক্তিবাদী চর্চা, নাগরিক অধিকার, নির্ভয়ে মতপ্রকাশের ব্যক্তিস্বাধীনতা, জাত-পাত ভেদ-বুদ্ধির বাইরে সহনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা, তর্কপ্রিয়তা প্রভৃতি গুণের ওপরে জোর দিয়েছেন। পাবলিক চয়েস স্কুলের স্রষ্টা জেমস বুকাননের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে ‘গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাসন’। এসব প্রতিটি বিষয়ে সেনের নানা লেখায় দর্শন, কবিতা, ইতিহাস, পুরাণ- এক কথায় বৃহত্তর অর্থে সাহিত্য-প্রসঙ্‌েগর উল্লেখ রয়েছে। মৃত্যু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রামমোহন রায়ের বরাত দিয়ে সেন লক্ষ্য করেন, মৃত্যু ভয়াবহ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ভয়াবহতা এ কারণে নয় যে, সত্তার বিলয় হচ্ছে। ‘ভাবুন একবার, আপনার মৃত্যুর দিনে চারপাশের মানুষজন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, আর আপনি সেসব কথা ও তর্কের কোনো উত্তর বা প্রত্যুত্তর দিতে পারছেন না।’ কেন মতের ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা বা অ-সমসত্তার প্রতি জোর দেওয়া দরকার, এটা বোঝাতে তিনি আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালের একটি বিরল দৃষ্টান্তের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন সম্রাট আলেকজান্ডার। এমনিতে অ্যারিস্টটলের কাছে শিক্ষা লাভ করেছেন, তার ওপরে মহাযোদ্ধা। বীরদর্পে তিনি ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এখানে-ওখানে অভিযান করে বেড়াচ্ছেন। এক জায়গায় গিয়ে তিনি দেখলেন, কয়েকজন জৈন ধর্মাবলম্বী দার্শনিক নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে ব্যস্ত। বিশ্ববিজয়ী গ্রিক সম্রাটের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই তাদের নেই। এ রকম মনোভাবের কী কারণ তা জানতে চাইলে তাদের একজন বললেন, ‘হে সম্রাট আলেকজান্ডার [বিশেষ করে তোমার দিকেই আমাদের তাকাতে হবে কেন তা বুঝতে পারছি না।] তুমি যতটা পৃথিবীর জায়গাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছ, প্রতিটি মানুষ ততটাই জায়গার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মতোই তুমি মানুষ; পার্থক্য কেবল যে তুমি সব সময় নিজেকে অকাজে ব্যস্ত রাখছ- কোনো কাজেই আসছ না। নিজ দেশ থেকে খামোখাই কত শত মাইল দূরে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছ এখানে। এতে তোমার যেমন বিরক্তি হচ্ছে, অন্যদেরও বিরক্তি উৎপাদন করছ… অচিরেই তোমার মৃত্যু হবে, এবং তখন এই পৃথিবীর ততটাই তোমার অধীনে থাকবে যতটা দরকার কেবল তোমাকে কবরস্থ করতে।’ কথাগুলো আলেকজান্ডারের পছন্দ হয়েছিল, যদিও বাস্তবে তার পদক্ষেপগুলো ছিল জৈন দার্শনিকদের মতের সম্পূর্ণ বিপরীতে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। শাসকগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা এ রকমই হয়ে থাকেন :যে মতকে তার শ্রেষ্ঠ ও অনুকরণীয় মনে করেন, তাকে তারা কখনও অনুসরণ করেন না।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::১০

[গত সংখ্যার পর]
এটা ঠিক যে, বঙ্কিম অন্যত্র বলেছেন, ‘আকবর শাসিত ভারতবর্ষকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বলি।’ এতে রাজশক্তির সুশাসনের গুণাবলির ওপরেই গুরুত্ব বেশি করে পড়ে; তার ধর্মপরিচয় নির্ণয়ের ওপরে নয়। তবু ধর্মপরিচয় নিয়ে বঙ্কিমের নিজের ভেতরে টানাপড়েন ছিল, পাছে নিরপেক্ষ পাঠক তাকে একদেশদর্শী ভাবেন, তা নিয়ে। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের উপসংহারে তাই বঙ্কিম আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি দিচ্ছেন এভাবে :’গ্রন্থকারের বিনীত নিবেদন এই যে, কোনো পাঠক না মনে করেন যে, হিন্দু মুসলমানের কোনো প্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। হিন্দু হইলেই ভালো হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না, অথবা হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলমান হইলেই ভালো হয় না। ভালো-মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।’ কিন্তু এর থেকে বঙ্কিম ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের ‘যুক্ত সাধনা’র কোনো আদর্শ স্থাপনে এগিয়ে এলেন না। এর পরবর্তী লাইনগুলো ব্যয়িত হলো তুলনামূলক বাহুবল ও রাজকীয় গুণের তত্ত্বে, যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শতাব্দীব্যাপী এক দ্বন্দ্বাত্মক ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আচরণের কথাই কেবল তুলে ধরে। হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত যে একই সুখ-দুঃখের জীবন অতিবাহিত করে এসেছে- সে কথা রাজকীয় ইতিহাসের তুলনামূলক ভূমিকার পর্যালোচনায় চাপা পড়ে গেল। যখন হিন্দু-মুসলমানকে ইতিহাসের বলয়ে সমদর্শী চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন তখনও বঙ্কিম রাজশক্তি লাভে ইচ্ছুক পরস্পর যুধ্যমান দুই পরাশক্তি হিসেবেই তাদেরকে চিহ্নিত করেছেন :’বরং ইহাতে স্বীকার করিতে হয় যে, যখন মুসলমান এত শতাব্দী ভারতবর্ষের প্রভু ছিল, তখন রাজকীয় গুণে মুসলমান সমসাময়িক হিন্দুদিগের অপেক্ষা অবশ্য শ্রেষ্ঠ ছিল। কিন্তু ইহাও সত্য নহে যে, সকল মুসলমান রাজা সকল হিন্দু রাজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অনেক স্থলে মুসলমানরাই হিন্দুর অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অনেক স্থলে হিন্দু রাজা মুসলমান অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণের সহিত যাহার ধর্ম আছে- হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, সেই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণ থাকিতেও যাহার ধর্ম নাই-হিন্দু হউক, মুসলমান হউক-সেই নিকৃষ্ট।’ এখানে তিনি স্পষ্টতই মিল-বর্ণিত লিবার্টি ও ইকুয়ালিটির সাম্য-চিন্তা থেকে সরে এসে ধর্মকেন্দ্রিক আত্মপরিচয়ের ওপরে বিশেষ করে জোর দিচ্ছেন। যিনি ধর্মানুরাগী তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি ধর্মশূন্য তিনিই নিকৃষ্ট বললে হিন্দু-মুসলিম চলমান সমস্যার কোনো সুরাহা হয় না, বরং সমস্যার সূত্রপাত হয় কেবল, যার পরিচয় পাই পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্রনৈতিক সেক্যুলারিজমের ব্যর্থতায়।

তারপরও বঙ্কিমের জীবনের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’-এ মুসলমান ফকির চাঁদশাহের মুখ দিয়ে সীতারামের উদ্দেশে যে কথা বলা হয়, তার থেকে ভিন্ন এক রাজনৈতিক-সামাজিক সম্ভাবনা যেন উঁকি দিয়ে ওঠে :’ফকির বলিল, বাবা। শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছো, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু-মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু-মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে। সেই এক জনই হিন্দু-মুসলমানকে সৃষ্টি করিয়াছেন; যাহাকে হিন্দু করিয়াছেন, তিনিই করিয়াছেন, যাহাকে মুসলমান করিয়াছেন, সেও তিনিই করিয়াছেন। উভয়েই তাঁহার সন্তান; উভয়েই তোমার প্রজা হইবে। অতএব দেশাচারের বশীভূত হইয়া প্রভেদ করিও না। প্রজায় প্রজায় প্রভেদ পাপ। পাপের রাজ্য থাকে না।’

এ উক্তি সাতচল্লিশের পার্টিশনের কালে নেহরু, প্যাটেল ও জিন্নাহ্‌র প্রতিও বলা যেতে পারত। এই উক্তিকে যদি বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকৃত সত্তা বলে মেনে নিই, তাহলে অন্য সব অসংবেদনশীল রূঢ় উক্তি সকলকে ব্যাখ্যা করি কী করে? আনন্দমঠ-এর অরাজক পরিবেশে ভবানন্দ কি বলেনি, ‘সকল দেশে রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ। আমাদের রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ তারপর রয়েছে দাঙ্গার বিভীষিকাময় বর্ণনা, তা-ও আবার পল্লীগ্রামের পটভূমিতে :”সকলে বলিল, ‘ইংরেজ মুসলমান একত্রে পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে। সকলে একবার মুক্ত কণ্ঠে হরি হরি বল।’ গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুটিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, ‘মুই হেঁদু’।” বাংলায় পর্যায়ক্রমিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয় বিশ শতকে। কিন্তু তার আগেই বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের পাতায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন জাগে- আনন্দমঠ থেকে উপরোক্ত সন্ন্যাসী ভবানন্দ-নিঃসৃত উদ্ধৃতির বঙ্কিম আর সীতারাম থেকে পূর্বে উল্লিখিত ফকির চাঁদশাহ-নিঃসৃত উদ্ৃব্দতির বঙ্কিম কি একই ব্যক্তি, একই লেখক, একই সত্তার দুই বিপরীত বহিঃপ্রকাশ? বিশ্বাস হতে চায় না এই বিভাজন-রেখা একই সৃষ্টিশীল প্রতিভার মধ্য দিয়ে চলেছে। উনিশ শতকের বাংলায় একাধারে আধুনিকতাবাদী রেনেসাঁ ও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের যে বিকাশ ঘটে, তার মৌলিক দ্বিত্বতার প্রকাশ পাই বঙ্কিম-মানসে। এই দ্বিখণ্ডন অমোচনীয়, অপরিত্রাণযোগ্য, যা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে একটি প্রধান ধারায় পরিণত করবে তার মৃত্যুর দুই দশকের মধ্যেই। এর ত্র্যহস্পর্শ থেকে কংগ্রেস-লীগ ধারার রাজনীতিক প্রায় কেউই বাদ যাবেন না। মিল-বঙ্কিমের সত্তার বিভক্তির সূত্রেই; উদার ও অনুদার চিন্তারাজিকে একত্রে সহাবস্থানে অনুপ্রাণিত প্রদর্শিত পথেই অগ্রসর হবেন অনেক প্রাগ্রসর মুসলিম বুদ্ধিজীবীও।

৩. শেষের কথা

ফ্রয়েডের শেষ জীবনের লেখা ‘আউটলাইন অব সাইকো-অ্যানালাইসিস’-এ ‘বিভক্ত সত্তা’ বিষয়ে উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। সেখানে ফ্রয়েড দেখান কী করে সত্তা ‘নিজের ভেতরে ফাটল অথবা বিভক্তির দেয়াল তুলে দিয়ে’ ক্রমাগত দ্বৈরথের দোটানার ফলে ‘সম্ভাব্য বিনাশ থেকে নিজেকে রক্ষা করে’। এই লেখাটিকে জাক লাকাঁ ফ্রয়েডের সেরা লেখাগুলোর একটি বলে চিহ্নিত করেন। আমাদের আলোচনার জন্য ফ্রয়েডের এই ধারণাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের এক প্রধান ব্যক্তিত্ব জন স্টুয়ার্ট মিল কী করে ভারতবর্ষীয় উপনিবেশ প্রশ্নে এসে অবলীলায় ‘ভিন্ন রীতি’ অবলম্বনের পথে ওকালতি করেন। ইউরোপের জন্য ‘লিবারেল’ চিন্তা, আর ভারতবর্ষের জন্য ‘ইল-লিবারেল’ চিন্তার অনুমোদন উপনিবেশে আধুনিকতার চৌহদ্দি নিয়ন্ত্রণ করে দিয়েছিল। এই আধুনিকতা, যাকে ‘ঔপনিবেশিক আধুনিকতা’ বলা যায়- শব্দ-উপমা ব্যবহারে ইউরোপের ঝুলি থেকে নানা বুলি ধার করেছে। কিন্তু সেই সাথে তাকে এই সীমানাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে যে, ইউরোপীয় আধুনিকতার সবকিছু তার জন্য প্রযোজ্য নয়। কেন প্রযোজ্য হবে না, এ জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণ হাজির করেননি মিল। মিলের দুই সত্তা। একদিকে ইউরোপীয় উদারনৈতিক চিন্তকের ভাবমূর্তি, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুদার নীতিমালা নির্ধারণে প্রশাসনিক ভূমিকা পাশাপাশি বিরাজ করছিল কোনো দৃশ্যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি না করেই। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সত্তার ভেতরে যাতে প্রচন্ড দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি না হয় সে জন্যই সত্তা বিভক্ত হয়ে যায় দুই অচেনা প্রদেশে। এতে যুক্তিবাদিতা ও অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দুই-ই অনায়াসে মুখ দেখাদেখি না করে অনায়াসে চলতে পারে।

আমরা দেখেছি মিল-শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিভক্তির অনুবৃত্তি। ভারতবর্ষীয় জাতি-গঠন প্রকল্পে এসে আপাদমস্তক যুক্তিবাদী ‘র‌্যাশনাল’ বঙ্কিম শেষ পর্যন্ত এক দ্বিখণ্ডিত সত্তায় বিভক্ত হয়ে গেলেন। সেখানে শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীকেই জাতি গঠনের মধ্যে স্বীকার করে নেওয়া হলো; অন্যদিকে, মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ঠেলে দেওয়া হলো জাতির বাইরে, ইতিহাসের বাইরে, আধুনিকতার বাইরে ‘অপর-বর্গ’ হিসেবে। এই কাজটি করা হলো কোনো যুক্তি-তর্ক-ফয়সালার মাধ্যমে নয়; সম্পূূর্ণ একপেশে যুক্তিরহিত পদক্ষেপের মাধ্যমে। ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ নির্মাণে বঙ্কিম যতটা তার্কিক শক্তি ব্যবহার করেছেন, তার সামান্যতম নমুনাও আমরা কোথাও দেখতে পাই না মুসলমান জনগোষ্ঠীকে অপাঙ্‌ক্তেয় করার ক্ষেত্রে কোনো যুক্তি প্রদর্শনে। কেন তিনি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ভারতবর্ষীয় কমিউনিটির বাইরে দূরে সরিয়ে রাখলেন; ভারত-ইতিহাসের অন্দরমহলে স্থান দিলেন না- এ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা নেই তার।

আমি সন্দেহ করি যে, সাইকো-অ্যানালাইসিসে যদিও রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত ছিল না, তবুও তার কোনো কোনো লেখাকে ‘বিভক্ত সত্তা’র ওপরে ক্রিটিক্যাল কমেন্টারি হিসেবে দিব্যি পাঠ করা যায়। বঙ্কিম যেখানে ইউরোপীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতি গড়ার প্রকল্পে এগোবেন এবং মাতৃরূপিণী দেবী শক্তির কাছে উৎসর্গীকৃত হিন্দু জাতির আদর্শকে শেষ পর্যন্ত শ্রেয়োজ্ঞান করবেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে (স্বদেশী সমাজ পর্বের মোহভঙ্গের পর) পুনর্বিবেচনা করবেন সমগ্র জাতি গঠন প্রকল্পকেই। জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ অভিহিত করবেন ‘ভৌগোলিক অপদেবতা’ বলে; বঙ্কিম রচিত ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত যে কোনোভাবেই ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে গীত হতে পার না- এ মর্মে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে চিঠি লিখবেন। আমার এ রকমও মনে হয় যে, তার লেখায় ‘ছোট ইংরেজ’ বনাম ‘বড় ইংরেজ’ বিভাজন শুধু ইংরেজ রাজ-কর্মচারী যারা ভারত শাসন করেছেন, আর ইংরেজ সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী যাদের লেখা পড়ে ভারতবর্ষীয়রা আধুনিক সাহিত্য-দর্শনে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠেছেন, এই দুই বলয়ের বৈপরীত্য বোঝাবার জন্যই কেবল লেখা হয়নি। একই সত্তার মধ্যেই ‘ছোট ইংরেজ’ ও ‘বড় ইংরেজ’ ঢুকে যেতে পারে, বাইরের বিভক্তি তখন লিবারেল আধুনিকতার অন্তরের বিভক্তিতে পরিণত হতে পারে- এমন একটি সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি।

আমি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে সত্তার এই বিভক্তিকে কোনো সাধারণ মাপের দোলাচল, দ্বৈরথ, নিছক ‘নেতিবাচক ও ইতিবাচক’ প্রবণতার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা যায় না। ইউরোপের আধুনিকতার জন্য ‘এক নিয়ম’, আর ভারতবর্ষীয় ঔপনিবেশিক আধুনিকতার জন্য ‘অন্য নিয়ম’- মিলের এই কল্পনাকে নিছক ‘প্রগতিশীল’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ প্রবণতার দ্বন্দ্ব বললে আধুনিকতার শাসন-সংকটের গভীরে যাওয়া যায় না। ঠিক একইভাবে যুক্তিবাদী বঙ্কিম-মানসে হিন্দুদের জন্য ‘এক নিয়ম’, আর মুসলমানদের জন্য ‘অন্য নিয়ম’- এ রকম কল্পনাকেও ইতি এবং নেতির দ্বন্দ্ব বলে লঘু করা যায় না। সাধারণ মাপের মানুষ হলে যা-ও বা দেখা যেত, তাদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তীক্ষষ্টধী মনন, ইউরোপীয় ও ভারতবর্ষীয় জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের পথিকৃৎ ভূমিকার কথা মনে রাখলে তাদের ব্যক্তিগত সত্তার ফাটল আর ‘ব্যক্তিগত’ থাকে না। পরবর্তীকালের ঔপনিবেশিক শাসন ও তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্রমশ বিভেদমুখী বিকাশের জন্য এই সত্তার বিভক্তি এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারতবর্ষে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১০] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::১০

[গত সংখ্যার পর]
মিল সর্বত্রই এই সমস্যাটা এড়িয়ে গেছেন এই বলে যে, বল প্রয়োগ না করার নীতি বা ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হওয়ার নীতি ‘কেবলমাত্র সভ্য জাতিগণের’ জন্যই প্রয়োজ্য। বল প্রয়োগ বা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো উচিত কেবল অন্ধকারে আটকে থাকা বর্বর অসভ্য জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই। এ নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। এখানে যেটা নতুন করে তোলা দরকার তা হলো, কে বর্বর ও অসভ্য- এটা নির্ধারণ করবে কে? নিশ্চয় সভ্য জাতিরই মহাত্মনেরা যারা আলোকিত মানুষ, বিদ্যা-বুদ্ধিতে এগিয়ে? এ ধরনের নিয়ম করার ক্ষেত্রে মিল অবশ্য কোনো নৈতিক সমস্যা দেখেননি। অন্যত্র এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, অপরিণত শিশু বা অপ্রকৃতিস্থ লোকের ক্ষেত্রে কিসে তাদের ভালো, সেটা তাদের কাছে ছেড়ে দেওয়া চলে না। সে জন্য কিছুটা জবরদস্তি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে বৈকি। একই কথা খাটে বন্য জাতি বা স্যাভেজ, আধা-বর্বর ও বর্বর জাতি এবং জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। আফ্রিকার বেশির ভাগই প্রথমোক্ত গ্রুপে পড়ে। ভারতবর্ষ পড়ে মূলত বর্বর জাতির গ্রুপে (দু’একবার অবশ্য মিল আধা-বর্বর বা সেমি-বারবারাস অভিধাও ব্যবহার করেছেন ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে)। সভ্য ও বর্বর এবং বর্বরের মধ্যে বন্য, আধা-বর্বর ও বর্বর- এ রকম জনমিতিক শ্রেণিবিন্যাস করে একই ক্ষেত্রে ইউরোপ ও উপনিবেশের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নীতির প্রয়োগকে মিল যুক্তিসিদ্ধ করে তুলেছেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে নিয়মের কল্পনা যেমন তাকে করতে হয়েছে, তেমনি তাকে নিয়মের ব্যত্যয়ের কল্পনাও তাকে করতে হয়েছে উপনিবেশ-সমস্যা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে। যা আদিতে সৃষ্ট হয়েছিল ব্যত্যয়ের নীতি হিসেবে (‘ইউরোপে যা চলবে উপনিবেশে তা চলবে না’) উনিশ শতকের হিতবাদী লিবারেলদের লেখায়। তা-ই পরবর্তীকালে পুনর্জন্ম পেয়ে চলেছে তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে হালের লিবারেলদের উৎকণ্ঠাময় আলোচনায় (‘ইউরোপে যা চলবে বৈরী তৃতীয় বিশ্বে তা চলবে না’)।

মিলের অবস্থানে এই দ্বিত্বতা বঙ্কিমের চোখ এড়ায়নি। প্রবন্ধের শেষটায় তিনি মন্তব্য করেছেন- ‘পরিণামে একটি কথা বলা আবশ্যক যে, মিল স্বস্বভাবানুবর্তিতা বিষয়ে যে কোন বিধানের উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা কেবল সভ্যতম জাতিগণেরই উপযোগী, এই কথা বলিয়াছেন। আমরা সেই শ্রেণীর মধ্যে গণ্য কিনা, তদ্বিষয়ে অনেক মতভেদ হইতে পারে। আর মিলের মতই যে সর্ববাদী সম্মত, এ কথাও বলা যায় না; অন্য কি, লেখক নিজেই এই প্রবন্ধের সকল কথা আন্তরিক অবলম্বন করেন না। কিন্তু মিল অতি প্রধান ব্যক্তি, তাহার মত সর্বসাধারণের গোচর হইলে কোন প্রকার অমঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই।’ গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মধ্যে ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’জনিত কারণে বেশ কিছুটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল, তা এর থেকে আঁচ করা যায়। তারপরও বলতে হয় যে, মিলের অসভ্য জাতির ক্ষেত্রে বল প্রয়োগের তত্ত্বটি বঙ্কিম সুবিধামত কাজে লাগিয়েছিলেন। প্রথমত, আর্যজাতি উত্থানের জন্য বাহুবলের (ও বাক্যবল) ব্যবহার দরকার হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, বাহুবলের জন্য উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তোলার প্রেরণাও তিনি লাভ করেছিলেন মিল থেকে। সংগঠনের জন্য দরকার চরিত্র, আর চরিত্রের জন্য চাই উন্নত প্রশিক্ষণ, যার বিবরণী পাই ‘দেবী চৌধুরানী’তে।

বিবরণীটি চমকপ্রদ। ভবানী পাঠক প্রফুল্লের চরিত্র নির্মাণের জন্য প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। জাতীয়তাবাদী বাহুবল-তত্ত্বের জন্য সংগঠন ও চরিত্র নির্মাণকে বঙ্কিম এভাবে দেখেছিলেন :’প্রথম বৎসরে তুলার তোষকে বালিশে প্রফুল্ল শুইল। দ্বিতীয় বৎসরে বিচালির বালিশ, বিচালির বিছানা। তৃতীয় বৎসরে ভূমি-শয্যা। চতুর্থ বৎসরে কোমল দুগ্ধফেননিভ শয্যা। পঞ্চম বৎসরে স্বেচ্ছাচার। পঞ্চম বৎসরে প্রফুল্ল যেখানে পাইত, সেখানে শুইত। প্রথম বৎসরে ত্রিযাম নিদ্রা। দ্বিতীয় বৎসরে দ্বিযাম। তৃতীয় বৎসরে দুই দিন অন্তর রাত্রিজাগরণ। চতুর্থ বৎসরে তন্দ্রা আসিলেই নিদ্রা। পঞ্চম বৎসরে স্বেচ্ছাচার। প্রফুল্ল রাত জাগিয়া পড়িত ও পুঁথি নকল করিত।…প্রফুল্ল চারি বৎসর ধরিয়া মল্লযুদ্ধ শিখিল।…এই মত নানারূপ পরীক্ষা ও অভ্যাসের দ্বারা অতুল সম্পত্তির অধিকারিণী প্রফুল্লকে ভবানী ঠাকুর ঐশ্বর্য্যভোগের যোগ্য পাত্রী করিতে চেষ্টা করিলেন। পাঁচ বৎসরে সকল শিক্ষা শেষ হইল।’

মিলের সাম্যচিন্তা বঙ্কিমকে প্রভাবিত করেছিল। ‘সাম্য’ প্রবন্ধে বঙ্কিম প্রাকৃতিক বৈষম্য ও অপ্রাকৃত বৈষম্যের মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মে কেউ অধিকতর বলশালী, কেউ বেশি বুদ্ধিমান, কেউ অধিক সৌন্দর্যমণ্ডিত, এসব সাম্যের ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। এখানে প্রধান বিবেচনা হচ্ছে ‘অপ্রাকৃত বৈষম্য’, যার মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণে-শূদ্রে বর্ণজনিত বৈষম্য, দেশি-বিদেশি শক্তির মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য, অথবা ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার সম্পদজনিত বৈষম্য। এই শেষোক্ত অর্থগত বৈষম্যই সবচেয়ে গুরুতর। বঙ্কিম বলেছেন, ‘সমাজের উন্নতিরোধ বা অবনতির যে সকল কারণ আছে, অপ্রাকৃত বৈষম্যের আধিক্যই তাহার প্রধান। ভারতবর্ষের যে এতদিন হইতে এত দুর্দশা, সামাজিক বৈষম্যের আধিক্যই তাহার বিশিষ্ট কারণ।’ পৃথিবীর যে দেশেই এই বৈষম্যের আধিক্য ঘটেছে সে দেশেই শ্রীবৃদ্ধির গতি শ্নথ হয়ে এসেছে। ফ্রান্সের প্রসঙ্গ টেনে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন যে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারণেই সেখানে সাম্যবাদী চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল :’পঞ্চদশ লুইর রাজ্যকালে ফ্রান্সের দেশে এইরূপ গুরুতর বৈষম্য। এই বৈষম্য কদর্য, অপরিশুদ্ধ রাজশাসন-প্রণালীজনিত। রুশোর গুরুতর প্রহারে সেই রাজ্য ও রাজশাসন প্রণালী ভগ্নমূল হইল। তাঁহার মানসশিষ্যরা তাহা চূর্ণীকৃত করিল।’

‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে দেশের কৃষি ব্যবস্থার যে চিত্র বঙ্কিম এঁকেছিলেন, সেখানেও কদর্য বৈষম্যের নিদারুণ ছাপ পাওয়া যায়। তিনিও কি নিজেকে সাম্যের প্রচারক হিসেবে, রুশোর মতোই সাম্যবাদী চিন্তক হিসেবে দেখেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের পটভূমিতে? সেই জন্যই কি ‘ভূসম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব’ সম্পর্কে মিলের মতের উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন :’যিনি ন্যায়বিরুদ্ধ আইনের দোষে পিতৃ সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়াছেন বলিয়া, দোর্দণ্ড প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত মহারাজাধিরাজ প্রভৃতি উপাধি ধারণ করেন, তাঁহারও যেন স্মরণ থাকে যে, বঙ্গদেশের কৃষক পরাণ মণ্ডল তাঁহার সমকক্ষ, এবং তাঁহার ভ্রাতা। জন্ম, দোষগুণের অধীন নহে। তাহার জন্য কোনো দোষ নাই। যে সম্পত্তি তিনি একা ভোগ করিয়াছেন, পরাণ মণ্ডলও তাহার ন্যায়সঙ্গত অধিকারী।’

প্রশ্ন হচ্ছে, এ কথা যিনি বলতে পারেন, তিনি মুসলমান-বিদ্বেষী কী করে হতে পারলেন? পরাণ মণ্ডল বলার সাথে সাথে তার কি হাসিম শেখ-এর কথাও মনে পড়ল না? অপ্রাকৃত বৈষম্য নিয়ে বলতে গিয়ে যখন ব্রাহ্মণ-শূদ্র বা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের প্রসঙ্গ তুললেন, তখন কি একবার তার মনে পড়ল না হিন্দু ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সাথে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্যের কথা? শ্রেণি-প্রশ্নে যিনি এত তীক্ষষ্ট ও উদার অবস্থান গ্রহণ করেন (যার পরিচয় আমরা পেয়েছি ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও ‘সাম্য’ রচনায়) তার মন কেন আত্মসত্তার পরিচয় প্রশ্নে তথা আইডেনটিটির প্রশ্নে এসে এতটা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে? ভারতবর্ষের জাতি বা মহাজাতি গড়ার প্রকল্পে নিয়োজিত হয়ে তিনি কেন বারবার হিন্দু-ইতিহাসের থেকেই প্রেরণা নিতে তৎপর হন? শুধু তা-ই নয়; ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টিকটূ রকমের অসহিষ্ণু মনে হয় তাকে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করার ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক ও শ্রেণি-সমস্যা আলোচনার ক্ষেত্রে যিনি এত উদারনৈতিক, নারী-সমস্যা ও হিন্দু-সমাজের ভেতরকার জাত-পাতের সমস্যার আলোচনায় যিনি এতটাই মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির; মুসলমান প্রসঙ্গ এলে তিনি ততটাই অনমনীয়, অশোধনযোগ্যভাবে অসংবেদনশীল; তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। শ্রেণি-রাজনীতিকে তাই ছাপিয়ে উঠে আইডেনটিটির রাজনীতি- বঙ্কিমের সত্তার দ্বিত্বতা বা দ্বিখণ্ডন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফাটল বা দ্বিখণ্ডিত সত্তাকেই তুলে ধরে। এর ফল পরিণাম তো বঙ্কিমের মতো তীক্ষষ্টধী মানুষের কাছে অধরা থাকার কথা নয়। এর কিছু আভাস পাই বঙ্কিমের নিজের লেখাতেই। তাতে আমাদের মনোকষ্ট আরও বেড়ে যায়।

‘সীতারাম’ উপন্যাসকেই আমি এই সূত্রে বেছে নিতে চাই। তার আগে ‘আনন্দমঠ’ নিয়ে দু’একটি কথা বলা দরকার। আনন্দমঠে মুসলমান শাসনের অবসানের পর ইংরেজরাই ভারতবর্ষের শাসনভার হাতে তুলে নিয়েছিল। অর্থাৎ আনন্দমঠে হিন্দুর জয় হলো বটে, কিন্তু দেশে হিন্দুর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেল না। এর থেকে বঙ্কিম-জীবনীকার অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের সন্তানেরা অত্যাচারী মুসলমান রাজশক্তিকে পরাভূত করেছে ঠিক- কিন্তু সেই হিন্দু সন্তান সম্প্রদায়কে দেশ শাসনের অধিকার’ দেওয়া হয়নি। ইংরেজ রাজত্বকে আবশ্যক বলে ভেবেছেন বঙ্কিম। কেননা, প্রচলিত হিন্দু সমাজে নানা অনাচার ঢুকে পড়েছে, যা তাড়ানোর জন্য হলেও ইংরেজকে মিত্র হিসাবে চাই তার :’ইংরেজ আগে রাজা না হইলে আর্য ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। …তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা আর্য ধর্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত আর্য ধর্ম- ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দু ধর্ম বলে, তাহা লোপ পাইয়াছে।’ এ জন্যই বঙ্কিম আনন্দমঠ রচনার প্রারম্ভেই ঠিক করে নিয়েছেন- ‘ইংরেজকে রাজা করিব।’ এই ব্যাখ্যা ঠিক হলে বলতে হয়, বঙ্কিম মিলের পূর্ব-কথিত ‘অপরিণত শৈশব’-এর কালতত্ত্ব এবং ভারতবর্ষের জন্য ইংরেজের অধীনে থাকার ‘আবশ্যকীয় শিক্ষানবিশী পর্ব’র যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছিলেন। এর একটি সম্ভাব্য কারণ, শেষ জীবনে বঙ্কিম ক্রমশ হিন্দু ধর্মাশ্রিত আদর্শকে বড় করে দেখেছিলেন। ‘ধর্মতত্ত্ব’তে তিনি দেশপ্রেমকে ‘শ্রেষ্ঠ ধর্ম’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ‘ইউরোপ পুনঃদর্শন’ বইয়ে তপন রায় চৌধুরী বলেছেন. ‘তাঁর ব্যক্তিগত আদর্শবাদে পরিবর্তনে-কোনও অজ্ঞাত কারণে তাঁর আস্তিক্যবাদে উত্তরণ এবং পুরুষাণুক্রমিক ধর্মমতে প্রত্যাবর্তনের ফলে’ তিনি অন্তত একটি বিষয়ে ইউরোপের থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তাকে মুসলমান সম্প্রদায়কে আরও দূরে সরিয়ে দিতে হয়েছিল।

অমিত্রসূদন আরও যুক্তি দেখিয়েছেন, যেহেতু মন্বন্তরের পটভূমিতে আনন্দমঠ রচিত এবং যেহেতু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে (১১৭৬-৭৮ বঙ্গাব্দকালে) অরাজক শাসন বিরাজ করছিল, এবং যেহেতু রাজকার্যে তখন পর্যন্ত মুসলমান শাসকদেরই ‘প্রধান’ দায়-দায়িত্ব ছিল, তাই সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল এবং সে কারণেই উপন্যাসটিতে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য স্থানে স্থানে বর্ণিত হয়েছে। এই ব্যাখ্যা সঠিক বলে গ্রহণ করা যায় না। পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলায় মুসলিম শাসন অব্যাহত ছিল- কল্পনা করা দুরূহ। বস্তুত বাংলায় তখন কোম্পানির অরাজক শাসনের বিস্তার হয়েছিল, যার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলমান রাজশক্তির একাংশের সাহায্য (বাংলার সুবেদার তখন রেজা খাঁ) নিয়েছিল কোম্পানির স্থানীয় প্রভুরা। বঙ্কিম লিখেছেন, ‘মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপাচ লেখে।’ এখানে ঐতিহাসিক ত্রুটি আছে। মীরজাফর ১৭৬৫ সালেই মারা যান। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য হেস্টিংসকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। মীর কাশিমের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে বঙ্কিম প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরেছেন :’এই সময়ে যে সকল ইংরেজ বাঙ্গালায় বাস করিতেন তাঁহারা দুইটি মাত্র কার্যে অক্ষম ছিলেন। তাঁহারা লোভ সম্বরণে অক্ষম এবং পরাভব স্বীকারে অক্ষম। …তখন বাঙ্গালার বাতাসে ইংরেজদিগের অর্থাপহরণ রোগ জন্মিত…বঙ্গীয় ইংরেজদিগের মধ্যে তখন ধর্ম শব্দ লুপ্ত হইয়াছিল।’ আসল ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতে, মুসলমান রাজন্যবর্গের হাতে নয়, আর দুর্ভিক্ষে এক-তৃতীয়াংশ বাংলার মানুষ যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন তার অন্তত :অর্ধেক ভাগই ছিল বাংলার দরিদ্র মুসলমান চাষিরা। বিদ্রোহীদের মধ্যে সন্ন্যাসী ও ফকির উভয় সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৯] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::৯

[গত সংখ্যার পর]

লিবারেল মিলের আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছন্দপতন ঘটেছে যখন উপনিবেশ শাসনের ক্ষেত্রে ‘প্রতিনিধিত্বশীল’ সরকার-ব্যবস্থার বিপরীতে সরাসরি ‘স্বৈরাচারী’ (ডেসপটিজম) শাসনের সপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে বা ইউরোপে চলবে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা, কিন্তু ভারতবর্ষে বা অন্যান্য উপনিবেশগুলোয় চলবে অ-প্রতিনিধিত্বশীল ‘স্বৈরাচারী’ ব্যবস্থা- এই দ্বিত্বতা মিলের রাষ্ট্রচিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের যুক্তি নির্মাণের জন্য মিলকে এক সময় ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজমের তত্ত্বকেও আশ্রয় করতে হয়েছে। এখানে মিলের যুক্তি ছিল অনেকটা পিতা জেমস মিলের (এবং হেগেলের) অনুগামী। মিল যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন যে, যেহেতু ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশপূর্ব যুগে ‘স্বৈরাচারী’ শাসন-ব্যবস্থার অধীনে ছিল, সেহেতু ইংরেজরা নতুন করে কোনো স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করেনি সেখানে, বরং আলোকিত এক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতবর্ষীয়দের ‘সভ্য করাই’ এই শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই যুক্তি-তর্কের একটি আশু রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। রাজকর্ম পরিচালনায় জবরদস্তি বা শাসিতের জন্য অনিষ্টকর কোনো নীতিমালা (যাকে মিল বলেছেন ‘হার্ম প্রিন্সিপল’) প্রয়োগের সম্ভাব্যতা নিয়ে নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব এতে করে এড়িয়ে যাওয়া হলো। সাধারণভাবে মিলের নৈয়ায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, কোনো সভ্য জাতি বা জনগণের ওপরে অনিষ্টকর বা জবরদস্তির নীতি প্রয়োগ করা যাবে না। তবে যেসব জাতি বা জনগোষ্ঠী এখনও উন্নয়নের শৈশব-স্তরে রয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে-তাদের সম্মতি বা অসম্মতির অপেক্ষা না করেই জবরদস্তির নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষত যদি ইতিমধ্যেই তাদের স্বৈরাচারী শাসনে থাকার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে থাকে প্রাগ-উপনিবেশ পর্বে। মিলের এই চতুর নীতিটি সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের পক্ষে একটি জোরালো যুক্তি হিসেবে এখনও ব্যবহূত হয়ে থাকে। উদাহরণত, ১৮৫৯ সালের ‘এ ফিউ রিমার্কস অন নন-ইন্টারভেনশন’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, সভ্য জাতির ক্ষেত্রে ‘আমাদের ধ্যান-ধারণা আদর্শ অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে সামান্যই যুক্তি রয়েছে’, কিন্তু এ কথা খাটে না ‘সভ্যতার নিম্নতর স্তরে থাকা জনগোষ্ঠীর বেলায়’। ওদের ক্ষেত্রে ‘প্রথাগত আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতি খাটে না’; কেননা এসব ন্যায়-নীতির প্রয়োগ তো পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে হবার কথা, কিন্তু ‘বর্বর জনগোষ্ঠী কখনও সমান ন্যায়-নীতির প্রয়োগের রীতিতে বিশ্বাস করে না বা করবে বলে এমনটা আস্থা করা যায় না। তাদের মন-মানসিকতা সে রকম প্রচেষ্টা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল নয়।’ ফলে তাদের নিজেদের স্বার্থেই ‘তাদেরকে পরাভূত করতে হবে এবং বিদেশি শক্তির অধীনে রেখে দিতে হবে।’ এর মধ্যে সাম্প্রতিক কালের আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরানে হস্তক্ষেপের একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক যুক্তির খসড়া তৈরি হতে দেখি। মিল অবশ্য এ ধরনের হস্তক্ষেপকে এক ধরনের ‘পেডাগজিক্যাল হস্তক্ষেপ’ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, যেমনটা হয় গুরুকুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সম্পর্কে। ছাত্রের ভালোর জন্যই তাকে নিয়ন্ত্রণের কড়া শাসনে ও শৃঙ্খলায় বাঁধতে হয়। একই যুক্তির বলেই মিল ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে’ দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র সভ্য জাতির ক্ষেত্রেই ফ্রি-মার্কেট ইকোনমি ও রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট প্রযোজ্য; অসভ্য জাতির ক্ষেত্রে অর্থনীতিতেও চলতে পারে ফ্রি-মার্কেট ইকোনমির ব্যত্যয় এবং রাজনৈতিকভাবে স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন।

তবে উপনিবেশের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের প্রয়োগ করতে গিয়ে মিল কিছুটা নমনীয় ছিলেন নেটিভদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার নিজস্বতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে। দার্শনিক কোম্‌তের সঙ্গে চিঠিপত্রে তিনি একদিকে সমালোচনা করেছেন ভারতবর্ষের রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রথা সমূহের, যার মধ্যে রয়েছে শিশু হত্যা, ঠগি-বৃত্তি, সতীদাহ প্রথা, তুকতাক বিদ্যা, পর্দা প্রথা ইত্যাদি। অন্যদিকে মিল বুঝেছিলেন যে, এসব প্রথা বিলয়ের জন্য শুধু সহায়ক আইন জারি করাই যথেষ্ট নয়; এর জন্য ক্রমান্বয়ে সংস্কার আনতে হবে নেটিভ সমাজবলয়ে। এ ক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথম উদাহরণটি হচ্ছে, পূর্ব উল্লিখিত এংলিসিস্ট বনাম ওরিয়েন্টলিস্ট বিতর্ক। এই বিতর্কে যদিও মিল শেষ পর্যন্ত ম্যাকলে সাহেবের সঙ্গে সুর মেলান ‘বাদামি সাহেব’ তৈরি করার প্রকল্পে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু সংযোজন ছিল তার। ১৮৩৬ সালের ‘রিসেন্ট চেইঞ্জেস ইন নেটিভ এডুকেশন’ ডিসপ্যাচের খসড়ায় মিল প্রস্তাব করেন যে, (ক) এই নেটিভ সাহেবদের প্রাচ্য ভাষা ও প্রাচ্যবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হতে হবে; (খ) ভারতবর্ষের ক্লাসিক্যাল ভাষাসমূহ যথা সংস্কৃত, ফার্সি ও আরবি ভাষা জানা এবং হিন্দু-মুসলমান আইন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকাটা সঠিক বিচারকার্য পরিচালনার জন্যও অত্যাবশ্যক। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে, ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করা নিয়ে। এখানে কান্টের অনুগামী হয়েছেন মিল। কান্ট বলেছিলেন, ‘আমি যুক্তি থেকে পিছু হটে বিশ্বাসকে কিছুটা জায়গা করে দিতে বাধ্য হলাম’। যুক্তিবাদ সর্বত্র খাটে না, যুক্তিবাদেরও সীমা রয়েছে, এবং যদিও অযৌক্তিক অনেক ক্ষতিকর সামাজিক বিশ্বাস-সংস্কার রয়ে গেছে যার মূল উৎপাটন করা জরুরি, তবুও এসব বিশ্বাসের একটা গুরুত্ব রয়ে গেছে সাধারণ জনজীবনে। ১৮৫৮ সালের পিটিশনে তাই মিল জোরেশোরে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে নানাবিধ ‘ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করার যে সিদ্ধান্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অদ্যাবধি নিয়ে এসেছে’ (অবশ্যই কতিপয় ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিয়ে- যেগুলো মানবতার জন্য স্পষ্টত অত্যন্ত গর্হিতকর) তা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত রাখা দরকার।

মিলের কিছু কিছু লেখায় প্রকাশ্য বর্ণবাদেরও ছায়াপাত ঘটেছে। নেটিভ আমেরিকানদের তিনি কুঁড়ে বলেছেন; চীনাদের মধ্যে তিনি পেয়েছেন দূরদর্শিতার অভাব; ভারতবর্ষীয় ও চীনাদের মধ্যে সম্পদ-আহরণের কোনো তাগিদ দেখেননি। তবে এ ক্ষেত্রেও বলতে হয় যে, আপাতদৃষ্টিতে বর্ণবাদী কথাবার্তা সত্ত্বেও মিল স্বীকার করে গেছেন যে, এসব জাতিগত পার্থক্য মূলত উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে না ওঠার কারণেই সৃষ্ট হয়েছে। এসব পার্থক্য কোনো নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যজনিত নয়। উদাহরণত তিনি দেখিয়েছেন, নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে চীনে, ভারতবর্ষে, এমনকি য়ুরোপের অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় (যথা রাশিয়া, তুরস্ক, স্পেন, আয়ারল্যান্ড) বিরাজ করছে এমন ধরনের ভূমিসত্ত্ব আইন যার মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- ফলে তাদের মধ্যে সম্পদ-আহরণের স্পৃহা আসবে কোথা থেকে? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তিনি কর্নওয়ালিশের জমিদারি আইনের সমালোচক ছিলেন এবং সরাসরি প্রজার কাছে রায়তওয়ারি স্বত্ব দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মিল ও বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যাশিত সদৃশতা ছিল।

তারপরও সব ছাপিয়ে মিলের দ্বিত্ব-অবস্থানের দিকটিই বড় হয়ে ওঠে। সভ্য ইংরেজ জাতি স্বৈরাচারী পদ্ধতি অবলম্বন করে পদানত করে হলেও অসভ্য ভারতবর্ষকে উন্নত (নেটিভদের ভালোর জন্যই) করবে- এর সপক্ষে মিল আমৃত্যু অবিচল থেকে গেছেন। ভারতবর্ষের লোকেরা নিজেরা নিজেদের মতো করে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার-ব্যবস্থা দাঁড় করাবে ব্রিটিশ রাজশক্তির সহায়তা ছাড়াই, এটি মিলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য কোনো দিন-ক্ষণের আভাস দিতে রাজি হননি মিল। বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘প্রত্যক্ষ শাসন’ আরও দীর্ঘকালের জন্য অব্যাহত থাকুক, এর পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন তিনি। য়ুরোপের প্রাগ্রসর চিন্তাবিদের মধ্যে এই যে দ্বিত্বতা আমরা দেখতে পাই তা কোনো সাধারণ মাপের দ্বিধা, দোলাচল বা দ্বন্দ্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। একেই আমরা প্রবন্ধের শুরুতে ‘সত্তার বিভক্তি’ বলেছি যখন সত্তা উদার ও অনুদার চিন্তার বলয়ে বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। শাসক ও শাসিতের জন্য তৈরি হয় আলাদা নিয়ম-কানুন। যে রীতি ইংল্যান্ডে চলে সে যুক্তি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে চলে না। মিলের সত্তার এই দ্বৈততা ইউরোপীয় আধুনিকতারই অন্তর্গত দ্বৈততার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই দ্বৈততা ‘আমাদের ও তাদের’ এ দুই সাংস্কৃতিক ভুবনের মধ্যে একাধারে আধুনিক উদার ও ঔপনিবেশিক অনুদার নির্ভরশীলতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি করে।

২. বঙ্কিমচন্দ্রের মিল

মিলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বঙ্কিম যথার্থই শোকাভিভূত হয়েছিলেন : ‘মিলের মৃত্যু হইয়াছে! আমরা কখন তাঁহাকে চক্ষে দেখি নাই; তিনি কখন বঙ্গদর্শনের পরিচয় গ্রহণ করেন নাই। তথাপি আমাদিগের মনে হইতেছে যেন আমাদিগের কোন পরম আত্মীয়ের সহিত চির বিচ্ছেদ হইয়াছে।’ মিলের কীর্তির উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি জোর দিয়েছেন এথিকস ও ইকোনমিক্স বিষয়ে তার অবদানের ওপরে : ‘মিল অতি সূক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন নৈয়ায়িক ছিলেন। তাঁহার কৃত ইংরেজি ন্যায়শাস্ত্র এবং অর্থব্যবহারশাস্ত্র তাহার প্রধানকীর্তি। ইহাতে তিনি যে কোন নূতন কথার উদ্ভাবন করিয়াছেন তাহা নহে কিন্তু এতৎসংক্রান্ত সমুদয় কথা এমন সুশৃঙ্খল করিয়া লিখিয়াছেন এবং প্রত্যেক বিষয় এত পরিস্কার করিয়া বুঝাইয়াছেন যে তাঁহার গ্রন্থ পাঠ না করিলে কাহারই উক্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হইবেক না।’ এই প্রবন্ধেরই এক জায়গায় মিল (যিনি ব্যক্তিপ্রাধান্য-বাদী) ও কোম্‌তের (যিনি সমষ্টির স্বার্থবাদী) মধ্যে প্রতিতুলনা করে তিনি বলেছেন, ‘মতদ্বয় মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ এবং কোনটি নিকৃষ্ট তদ্বিষয়ে আমরা কোন কথা বলতে পারি না।’ অনত্র তিনি বলেছেন, ‘অর্ধেক বেন্থাম অর্ধেক কোম্‌তের’ মধ্যে ‘সমুচিত সামঞ্জস্য বিধানের কথা।’ কেননা, ‘চিত্তমধ্যে এই দুই মতের সমুচিত সামঞ্জস্যই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা।’ যা হোক, সমষ্টির স্বার্থ (কোম্‌ত) ও ব্যক্তিস্বার্থানুরাগ (বেন্থাম বা মিল) এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য করা যে ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না সে ক্ষেত্রে কী করা তা নিয়ে বঙ্কিমের দ্বিধা ছিল সে সময়ে। এই লেখার এক দশকের মধ্যেই লেখা হবে আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী ও সীতারাম উপন্যাস ত্রয়ী। তখন এসব দ্বিধা কেটে যাবে। সমষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যক্তিস্বার্থকে প্রয়োজনে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে- এই দাঁড়াবে তার অভিমত। ভক্তি ও বাহুবল সেখানে লিবারেল ইনডিভিজুয়ালিটির বদলে জায়গা করে নেবে। ব্যক্তির ইউটিলিটির বদলে সামষ্টিক ইউটিলিটির ওপরে জোর দেবেন তিনি, যার অন্য নাম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ।

শুধু আনন্দমঠ নয়। ইউটিলিটির সামষ্টিক ব্যাখ্যা কমলাকান্তর দপ্তরেও আছে। যেমন কমলাকান্তের দপ্তরে তৃতীয় সংখ্যার শিরোনাম ছিল ‘ইউটিলিটি বা উদর-দর্শন’। বঙ্কিম যেখানে ইউটিলিটারিয়ান দর্শনের সার-সংক্ষেপ টানছেন এভাবে : ‘এই মতের সার কথা এই যে যাহা হিতকর, তাহাই অনুষ্ঠেয় ও কর্তব্য। যাহা অহিতকর, তাহা বর্জনীয় এবং অকর্তব্য। হিতাহিত ফলোৎপাদকতা ভিন্ন কর্তব্যাকর্তব্যের অর্থাৎ পুণ্য পাপের- অন্য লক্ষণ নাই।’ এই দর্শনকে অস্ত্র করেই তিনি ‘কৃষ্ণ-চরিত্রে’ বললেন, ‘যাহা লোকহিতকর তাহাই ধর্ম’, অর্থাৎ ধর্মের বিচার কেবল শাস্ত্র-অনুযায়ী করা উচিত নয়। এভাবে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপিত হলো।

১২৭৯ ভাদ্র সংখ্যায় ছাপা হয় ‘স্বস্বভাবানুবর্তিতা’ মানে ইনডিভিজুয়ালিটি নিয়ে বঙ্কিমের প্রবন্ধ। সেখানে মিলের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে বঙ্কিম লিখলেন, ‘মিল বলেন যে, যাহাতে অন্য কাহার সুখের ব্যাঘাত হয়, অথবা সমাজস্থ অধিকাংশ লোকের অসুখ জন্মে, অথবা যেখানে প্রত্যেকের কিছু কিছু কষ্ট বা ক্ষতি সহ্য না করিলে সমাজ রক্ষা হয় না, এরূপ স্থলে স্বেচ্ছাচার এবং স্বস্বভাবানুবর্তিতা নিবারণের জন্য বলপ্রয়োগ করা অন্যায় নহে।’ প্রশ্ন উঠে, বলপ্রয়োগের এ নিয়মটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কি-না, নাকি সে ক্ষেত্রে মিলের অন্য নিয়মটিই কেবল খাটবে যেখানে তিনি বলছেন, ‘সকল স্ব স্ব জ্ঞান ও বিবেচনানুসারে যে মত ইচ্ছা তাহাই অবলম্বন করিবে, তাহাতে প্রচলিত মতের বিরোধীদিগের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার করা অন্যায়’? কোন নিয়মটা প্রয়োগ করা হবে নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থ?

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৮] মিলের ভারতবর্ষ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মিল (Mill’s India and Bankimchandra)

পর্ব ::৮

দীপেশ চক্রবর্তীর জন্য
এটি অনেকেই এর আগে লক্ষ্য করেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র যেন এক ব্যক্তি নন। দুই বঙ্কিম একই সত্তার মধ্যে বিচরণ করছেন। যিনি লিখেছেন ‘বঙ্গদেশের কৃষক’, ‘সাম্য’ ও ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর মতো প্রগতিশীল রচনা; তিনিই লিখেছেন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী তথা হিন্দুত্ববাদী ‘আনন্দমঠ’ ও ‘ধর্মতত্ত্ব’- ভাবা যায়! কেন এই বৈপরীত্য? এ যেন সত্তারই বিভক্তি। ড. জেকিল ও মি. হাইডের বাংলা কী, আমি জানি না। দুই বিখণ্ডিত সত্তা, যেখানে যুক্তি ও অযৌক্তিক দাবি এবং নির্মাণ পাশাপাশি চলছে কোনো রাখঢাক না করেই; কোনো স্ববিরোধিতা সম্পর্কে অবগত না হয়েই। এই লেখাটিতে আমি বলবার চেষ্টা করেছি যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সত্তার এই বিভক্তি গোটা য়ুরোপীয় আধুনিকতা ও তৎসূত্রে প্রাপ্ত জাতীয়তাবাদী সত্তারই বিভক্তি। য়ুরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট এই বিভক্তিকে ধারণ করেছিল। বঙ্কিমের মন্ত্রগুরু জন স্টুয়ার্ট মিলের মধ্যেও দেখি একই বিভাজন- যেখানে যুক্তি ও অযৌক্তিক, মানবিক ইনক্লুশন ও ঔপনিবেশিক এক্সক্লুশন, সভ্য আর অ-সভ্য জাতি ও জনগণের জন্য ভিন্ন নিয়ম-রীতি প্রয়োগের যুক্তি-তর্ক পাশাপাশি চলেছে। গুরু-শিষ্যের মধ্যকার এই মৌলিক মিল সম্পর্কে আলোকপাত করাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। একই সত্তার মধ্যে এই স্ববিরোধী আয়োজন এক সময় সৃষ্টি করে সত্তার ফাটল বা বিভক্তি, যা শেষ পর্যন্ত সংক্রমিত হয় পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্র-সংবিধান-রাজনীতিতে।

১. মিলের ভারতবর্ষ

লর্ড মেঘনাদ দেশাইকে আমি একবার প্রশ্ন করেছিলাম, লিবারেল চিন্তক জন স্টুয়ার্ট মিল কী করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো জায়গায় বছরের পর বছর ধরে কাজ করে গেলেন? শুধু কাজ করা নয়, ১৮২৩ সালে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট একজামিনার’ হিসেবে ঢোকার পর থেকে মিল পদোন্নতি পেয়ে এক পর্যায়ে কোম্পানির সর্বোচ্চ পদে ‘চিফ একজামিনার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশাইকে আমি আরও জিজ্ঞেস করেছিলাম, মিলের ভারতবর্ষ সম্পর্কিত রচনাবলি তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন কি-না এবং সে সম্পর্কে তার অভিমতই বা কী? দেশাই শুধু আমাকে বলেছিলেন, ‘চিফ একজামিনার’ হিসেবে কোম্পানি শাসনের নীতিমালা ঠিক করার ক্ষেত্রে মিলের একটি প্রধান নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা ছিল, যা মোটেই হেলাফেলা করার ব্যাপার নয়। তবে এ সম্পর্কে তার বিশেষ কিছু জানা নেই।

মিল যেসব ‘প্রগতিশীল’ ও ‘লিবারেল’ চিন্তারাজির স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তা বিষয়-বৈচিত্র্য ও আয়তনে সত্যই বিস্ময়কর। ১৮৪৩ সালের ‘এ সিস্টেম অব লজিক’, ১৮৪৮ সালের ‘প্রিন্সিপল্‌স অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’, ১৮৫৯ সালের ‘অন লিবার্টি’, ১৮৬১ সালের ‘কনসিডারেশনস অন রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট’, ‘ইউটিলিটারিয়ানিজম’, ১৮৬৯ সালের ‘দ্য সাবজেকশন অব উইমেন’, ‘সোশ্যালিজম’ এবং ১৮৭৩ সালের ‘অটোবায়োগ্রাফি’ বিবেচনায় নিলে সন্দেহ থাকে না যে, মিলকে কেন উনিশ শতকের য়ুরোপীয় লিবারেল চিন্তার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা হয়ে থাকে। এতে মিলের প্রচলিত রচনাকর্মের প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য একাধিক কূটাভাস বা প্যারাডক্সের আভাস পাই। কূটাভাস অন্তত দুটো। প্রথমত, এত উদার চিন্তা যার, তিনি তার কর্মজীবন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃত্তে কাটালেন কী করে? সেকালের ইউরোপের সূক্ষ্ণ নৈয়ায়িকদের মধ্যে যিনি অগ্রগণ্য তাকে এটা করতে গিয়ে কি নিত্যনতুন নৈতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়নি? দ্বিতীয়ত, যদি যুক্তির খাতিরে ধরেই নিই, মাসিক স্থিতিশীল আয়-উপার্জনের পথ খোলা রাখার জন্য তাকে বেছে নিতে হয়েছিল কোম্পানির ‘চাকরি’, তাহলেও বাড়তি প্রশ্ন থেকে যায়। সেই বাড়তি প্রশ্নটি হচ্ছে, ভারতবর্ষ নিয়ে মিলের রচনাগুলোর মূল ঝোঁক নিয়ে। ঔপনিবেশিক শাসনে আবদ্ধ ভারতবর্ষেও দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘব করার ক্ষেত্রে সেসব লেখা কাজ করেছিল কি-না? মিলের পক্ষ থেকে সেদিকে কোনো বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল কি-না? নাকি তিনিও ছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের হাতিয়ার কেবল?

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে লিখতে গিয়ে মিল সব সময় ভাবতে চাইতেন, শাসক জনগোষ্ঠী যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-অর্থনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা ও সমরকুশলে অপেক্ষাকৃত পরিণত ও দক্ষ জাতি, এবং এই অর্থে ‘সভ্য জাতি’, সেহেতু তাদের ওপরে নৈতিক দায়িত্ব এসে পড়ে বৈকি শাসিত ‘অসভ্য জনগোষ্ঠী’কে অন্ধকার যুগ থেকে টেনে তোলার। সাম্রাজ্যবাদ বলতে লুণ্ঠন-যুদ্ধ-শোষণের যে ক্ল্যাসিক চিত্র আমরা পাই, তা মিলের প্রকল্পের জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যে উপনিবেশ এখনও সভ্য হয়নি, তাকে তার ভালোর জন্যই উন্নত জাতি কর্তৃক শাসিত হতে হবে, এবং শাসিত থেকেই ক্রমশ তাকে ‘উন্নতির উচ্চতর স্তরে উত্তরণ’-এর চেষ্টা করা হবে। মিল বলেছেন, ‘আমরা বলতে পারি না যে এই আদর্শ নীতি ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করা গেছে। কিন্তু এ রকম নীতি না গ্রহণ করলে সর্বোচ্চ নৈতিক আস্থাটুকু শাসক শ্রেণির ওপর থেকে উঠে যাবে।’ কোম্পানি শাসন থেকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের শাসনের অধীনে ক্ষমতা-স্থানান্তরের প্রাক্কালে মিলকে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। সেখানে মিল ভারতবর্ষের ওপর কোম্পানি শাসনের সপক্ষে জোরালো ওকালতি করেন। কোম্পানির প্রত্যক্ষ ও নিবিড় শাসনের চেয়ে অপ্রত্যক্ষ ও ‘দূরত্ব থেকে’ শাসনের ফলাফল শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্যই ভালো হবে না- এমনটাই ছিল তার অভিমত। ভারতবর্ষ শাসন করা সাধারণ আমলাতন্ত্রের দ্বারা সহজসাধ্য হবে না। কেননা, মিলের মতে, ভারত-বিদ্যা দর্শন, অর্থশাস্ত্র, বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানকাণ্ডের মতোই একটি ‘বিশেষ বিদ্যা’, বিশেষ অভিনিবেশের দাবি করে, যা প্রথাগত ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের আয়ত্তে নেই, এবং যেটা শুধু আয়ত্ত করা সম্ভব ভারতবর্ষ বিষয়ে বিশেষভাবে উৎসর্গীকৃত একটি পরিচালনামণ্ডলীর মাধ্যমেই। আর সেটা কোম্পানি-শাসনের মাধ্যমেই শুধু অর্জন সম্ভব। মিলকে তখন এ প্রশ্নও করা হয়েছিল- রাজকার্যে নেটিভদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তার মত কী? নেটিভরা কি ঔপনিবেশিক সরকারের উচ্চতর বা উচ্চতম পর্যায়ে কখনো যেতে পারবে, বা সেটা হলে ইংরেজ রাজশক্তির ওপর ‘নির্ভরশীলতার’ অবস্থা তখন কোথায় দাঁড়াবে? এ ক্ষেত্রে তার স্পষ্ট উত্তর ছিল, প্রথমত, নেটিভদের যোগ্য করে তুলতে যাবতীয় প্রচেষ্টা নিতে হবে, এবং নেটিভদের মধ্যে যোগ্য লোক পাওয়া গেলে উচ্চতর পর্যায়েও তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, ‘এখনও যদিও ভারতবর্ষ সে’ অবস্থায় পৌঁছায়নি, কিন্তু একদিন যাতে সে অবস্থায় পৌঁছায় সে চেষ্টা শাসকদের তরফ থেকে থাকতে হবে।’ নইলে তাদের বর্তমান (ঔপনিবেশিক) শাসনের পক্ষে ‘নৈতিক কোনো যুক্তি’ থাকে না। অবশ্য মিল এ ক্ষেত্রে উচ্চতর পর্যায়ে ‘সামরিক’ ও ‘বেসামরিক’ নিযুক্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন :’সামরিক বাহিনী পরিচালনার ক্ষেত্রে নেটিভদের বিজড়িত করা যায় না। কেননা, সে ক্ষেত্রে ব্র্রিটিশ রাজত্ব বজায় রাখা সম্ভবপর হবে না। তবে সিভিল প্রশাসনের এক বড় অংশ নেটিভদের জন্য খুলে দেওয়া খুবই সম্ভব; কোনোরূপ ঝুঁকি ছাড়াই।’ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য করা যায় কি-না- এ প্রশ্নের উত্তরে মিল বলেছিলেন, ‘নেটিভদের থেকে গভর্নর জেনারেল হয়তো কাউকে বানানো যাবে না, তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক উচ্চতর পদেই তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আশা করা যায়, ততদিনে তারা এসব পদে যাওয়ার জন্য যোগ্য ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে। এ রকম একটি পরিবর্তন আনা শুধু সম্ভবই না; আমাদের ওপরে দায়িত্বও এসে বর্তায় এ রকম কিছু করার।’ সে প্রেক্ষিতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে- এ প্রশ্নের জবাবে মিলের উত্তর ছিল- ‘এ রকম অবস্থাতেও ভারতে ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত থাকবে যদি আমরা সতর্কতার সাথে বিষয়টা পরিচালনা করতে পারি, অন্তত ততদিন পর্যন্ত, যতদিন-না নেটিভরা আমাদের সাহায্য ছাড়াই অনুরূপ সরকার ব্যবস্থা চালানোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত হয়ে উঠছে।’

এখানে এসে মিলের প্রতিদ্বন্দ্বী মেকলে সাহেবের ‘দ্য প্রাউডেস্ট ডে’ তত্ত্বের অনুবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। একে ‘নমনীয় সাম্রাজ্যবাদ’-এর অবস্থান হিসেবে ভাবতে পারেন কেউ কেউ। বা হাল আমলের ‘সফট পাওয়ার’ তত্ত্বের পূর্বলেখও পাওয়া যেতে পারে এতে। নামকরণ যা-ই হোক, লিবারেল মিল-এর কুশলী যুক্তির জাল বিস্তারের উদ্দেশ্য পরিস্কার :সাম্রাজ্যবাদকে বাদ দিয়ে নয়, বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে সতর্কতার সাথে নমনীয় ও সূক্ষ্ণভাবে পরিচালনা করতে হবে।

সভ্য জাতির ‘সভ্যতার’ সংজ্ঞা কী ছিল, মিলের চিন্তায় এ প্রশ্ন এখানে ওঠা স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের ওপরে ব্রিটিশ জীবনযাত্রা চাপিয়ে দেওয়াকে মিল সভ্য হয়ে ওঠার মাপকাঠি ভাবতেন না। ভারত আরেকটা ইংল্যান্ড হয়ে উঠুক- সেটা তার কাম্য ছিল না। মেকলে সাহেবের মতো তিনি কখনো (অন্তত স্পষ্ট করে) বলেননি কোথাও যে, ভারতবর্ষীয়রা কালক্রমে ‘বাদামি সাহেবে’ পরিণত হলে ব্রিটিশ শাসনের নৈতিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে। মিলের মতে, ইংরেজ প্রোটেস্টান্টরা যেমন তাদের সন্তানদের রোমান ক্যাথলিক সেমিনারিতে পাঠাতে চান না, ভারতবর্ষীয়রাও তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে খ্রিষ্টান বানাতে চাইবে না; এটাই স্বাভাবিক। ১৮৩০-এর দশকে অ্যাংলিসিস্ট বনাম ওরিয়েন্টালিস্ট বিতর্কের কালে তরুণ মিল কলম ধরেছিলেন ওরিয়েন্টালিস্টদের পক্ষে; বাবা জেমস মিলের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে। মিলের কাঙ্ক্ষিত আদর্শ ‘সভ্য জাতির’ গুণাবলির তালিকায় ছিল সর্বজনমান্য সব বৈশিষ্ট্য- রুল অব ল, শান্তি ও স্থিতিশীলতা, অপরাধের অবসান, অন্যায়ের প্রতিকার, পরমতসহিষ্ণুতা, অসুখ, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সমবায়ী উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি। ফুকোর লেখা থেকে এখন আমরা জানি- নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা এটা বিভিন্নভাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন- এসব আপাত নিরীহ সুশাসনমূলক ও উন্নয়ন-উদ্যোগ সভ্যতা প্রতিষ্ঠার নামে আধুনিক রাষ্ট্রক্ষমতার কাছে বশ্যতা বা নতি স্বীকার করাকেই জায়েজ করেছে। মিল এখানে ফুকো-কথিত গভর্নমেন্টালিটিকেই ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এর পরিণতি সাধারণ মানুষের জন্য সুখকর হয়নি।

এমনকি মিল-শিষ্য বঙ্কিমের তা দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমরা দেখাইলাম যে, ব্রিটিশ রাজ্যকালে ভূমিসংক্রান্ত যে সকল আইন হইয়াছে, তাহাতে পদে পদে প্রজার অনিষ্ট হইয়াছে। প্রতি বারে দুর্বল প্রজার বল হরণ করিয়া আইনকারক বলবান জমীদারের বলবৃদ্ধি করিয়াছেন। তবে জমীদার প্রজাপীড়ন না করিবেন কেন?’ এমনকি রুল অব লর প্রবল প্রবক্তা মিলের বিরুদ্ধে গিয়ে সবিস্তারে জানাচ্ছেন, ‘কেন আইন আদালতে কৃষকের উপকার’ হয় নাই। প্রথমত, মোকদ্দমা অতিশয় ব্যয়সাধ্য। দ্বিতীয়ত, আদালত প্রায় দূরস্থিত, আর ‘যাহা দূরস্থ, তাহা কৃষকের পক্ষে উপকারী হইতে পারে না।’ তৃতীয়ত, বিলম্ব- ‘সকল আদালতেই মোকদ্দমা নিষ্পন্ন হইতে বিলম্ব হয়’, আর ‘বিলম্বে যে প্রতিকার, সে প্রতিকারকে প্রতিকার বলিয়া বোধ হয় না।’ চতুর্থত, ঔপনিবেশিক আইনের ‘অযৌক্তিকতা ও জটিলতা’। পঞ্চমত, বিচারকবর্গের অযোগ্যতা, যাহার মধ্যে অধিকাংশই ইংরেজ।”

এসব উল্লেখ করার পর বঙ্কিম যুক্তি দিচ্ছেন, এর পরও আমরা যদি ভাবি, ‘আমরা বড় সন্তুষ্ট হইলাম- কেননা, জুরির বিচার হইয়াছে- বিলাতি প্রথানুসারে বিচার হইয়াছে- আমরা বড় সভ্য হইয়া উঠিয়াছি’; তাহলে এর চেয়ে ভ্রমাত্মক আর কিছুই হতে পারে না।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৭] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৭

[গত সংখ্যার পর]
দ্বিতীয়ত, এই সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ওপরে বিশ্ব-সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধরেরা অন্তরীক্ষ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন। এর পেছনে বোদলেরীয় ক্লেদজ কুসুমের অবক্ষয়ের ছায়া যেমন ছিল, তেমনি ছিল শানিত সমাজ-মনস্কতা। সার্ত্রে ও কাম্যুর অস্তিত্ববাদ, ফ্রয়েডের মনোবিকলন ও মার্কসের সমাজ-ইতিহাস সচেতনতা একই সাথে ক্রিয়াশীল ছিল ষাটের দশকের কবিতায়। লালনও ছায়া হয়েছিলেন। ফুলের মৃত্যু না হলে দুঃখে-বিরহে যেমন কবিতার জন্ম হয় না; কবির মৃত্যু না হলে তেমনি কষ্টে-শোকে ফুলের জন্ম হয় না- এ রকম সম্ভাবনার কথা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার একটি প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ষাটের কবিকুলের জন্য অবক্ষয়বোধ ও সমাজ-বদলের নিগূঢ় অভিপ্রায় তেমনি পরস্পর-বিরোধী না হয়ে সম্পূরক সত্তার মতো কাজ করেছিল। পূর্বাপর অনিবার্য ঋতুবদল বা ভাবান্তর হিসেবেই তা চিহ্নিত হয়েছিল। যদিও নানাবিধ উৎস থেকে আলো এসে পড়েছিল এই কবিদের ওপরে, কিন্তু তারা ছিলেন নিজ নিজ ভুবনের সপ্রতিষ্ঠ কারিগর। প্রেরণা-তাড়িত হয়ে তারা তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে লিখেছিলেন, যার সাথে পাকিস্তানের রাষ্ট্র, ইতিহাস, দর্শন ও রাজনীতির আমূল বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তৃতীয়ত, যে-অর্থে এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড ও জয়েসের ইউলিসিস বিশের দশকে পাশ্চাত্য আধুনিকতার জন্ম দিয়েছে, ষাটের দশকের বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার ধারাও তেমনিভাবে পাকিস্তানি ভাবধারার বিরুদ্ধে এক অনাস্বাদিত আধুনিকতার, শিল্পরুচির ও বোধের জন্ম দিয়েছিল, যার পরিণতিতে সম্ভাব্য মনে হয়, বা সম্ভবতার হয়ে উঠেছিল বাহাত্তরের রাষ্ট্র, সংবিধান ও আজকের বাংলাদেশ।

ষাটের দশকের গোটা জীবন-যাপনকেই যেন একটি মায়াবী আয়নার মধ্যে- তার সমস্ত অমঙ্গলবোধ ও শুভত্বের বাসনা নিয়ে- প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেদিনের কবি-সাহিত্যিকেরা। অবাস্তব অমার্জনীয় মনে হয়েছিল সেদিনের পাকিস্তানি রাষ্ট্র-ব্যবস্থার আইন-টাইন, কানুন-কালাকানুন, বেশ-পরিবেশ। অলক্ষ্যেই ধসে পড়েছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের যুক্তি। সে জন্যই তারা অনায়াসে কখনও এলিয়টকে আঁকড়ে ধরে, কখনও ভায়েহোকে জড়িয়ে, কখনও রবীন্দ্রনাথের গানে উজ্জীবিত হয়ে, আবার কখনও বোদলেয়ারের কাছে ঋণস্বীকার করে নতুন একটি দেশ-সমাজ প্রার্থনা করেছেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ বাধাবন্ধনহীন মুক্ত, সৃষ্টিশীল, রহস্যময়, আপন ভুবনের সম্রাট। বিচ্ছিন্ন, একক, বহিরাগত, অচেনা বলেই এই কবিকুল বৃত্তের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র-সমাজের শাসন ও অনুশাসনকে দেখতে পেরেছিলেন। যা সম্ভব ও বাস্তব তাকে তাদের কাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়নি; আর যা অসম্ভব ও অবাস্তব তাকে তারা শ্রেয়োজ্ঞান করেছেন। প্রতিটি রেনেসাঁই অসম্ভব ও অবাস্তবকে পৃথিবীর মাটিতে ফলদায়ী বৃক্ষের মত লালনের স্বপ্ন দেখেছে। রফিক আজাদের মত ‘অসম্ভবের পায়ে’ নিজেকে উৎসর্গ করেছে। বোদলেয়ার যেমন বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বলেছেন :

‘বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ… ঐ উঁচুতে… ঐ উঁচুতে
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল।’

না ভ্রাতা, না ভগ্নি, না পিতা, না জননী, আমি বা আমরা যে রাষ্ট্রে বাস করতে চাই, তা লালনের রিপাবলিক। এভাবেই আগামীর সমাজ-রাষ্ট্রকে দেখেছেন তারা।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৬] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৬

[গত সংখ্যার পর]

৫.

তবে ষাটের দশকের কবিতার প্রগতিপন্থা অন্যভাবেও সংক্রমিত হয়েছিল। পঞ্চাশের যুগেই বাম-প্রগতিশীল ধারার সাথে জাতীয়তাবাদী ধারার অন্তর্লীন যোগাযোগ গড়ে উঠতে থাকে। সেটা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে ষাটের দশকে। এই যোগাযোগ রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ক্রমশ এক নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে থাকে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকদের পক্ষ থেকে সচেতনভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারার প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী ধারার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য ছিলেন, তাদের মধ্যে শামসুর রাহমানের নাম প্রথমেই চলে আসবে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা শামসুর রাহমানের সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, প্রেরণা জোগাতেন, কোনো বিশেষ দিবস বা উপলক্ষে বাংলার এই প্রতিভাবান কবি যাতে কবিতা লেখেন, সে সম্পর্কে সচেতন প্ররোচনা ছিল তাদের।

যে কোনো কারণেই হোক, ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ আসেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে তার অভ্যুদয়। তবে ঘনিষ্ঠ বিচারে শামসুর রাহমানকে ছাড়া ষাটের কবিতায় আধুনিকতার নির্মাণ ও পুনর্জাগরণের বিষয়টি আলোচনা করা প্রায়-অসম্ভব। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। সে হিসেবে, বাংলা কবিতার ষাটের দশক তার হাত দিয়েই শুরু। বস্তুত, ষাটের দশকেই বের হতে থাকে সাড়া-জাগানো তার একের পর এক কাব্যগ্রন্থ :রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৬), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮) ও নিজ বাসভূমে (১৯৭০)। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় লেখা ‘বন্দীশিবির থেকে’ (১৯৭২) থেকে পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে যে গোটা ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি-সংগ্রাম তার কবিতার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে গ্রন্থিত হয়ে এসেছে। রৌদ্র করোটিতেই তিনি লিখেছেন ‘লালনের গান’; রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন কবিতা যখন তার গানকে বেআইনি করা হয়েছে; ভাষা আন্দোলন ও বাংলা কবিতার অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে সমর্থন করে লিখেছেন বিধ্বস্ত নীলিমার ‘বাংলা কবিতার প্রতি’; আয়ুব শাহীর স্বৈরাচার শাসনের ছায়ায় লিখেছেন নিরালোকে দিব্যরথের ‘সকল প্রশংসা তার’; রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে মনে রেখে লিখেছেন ‘টেলেমেকাস’; গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে লিখেছেন নিজ বাসভূমের এক ঝাঁক প্রতিবাদী কবিতা- ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’, ‘পুলিশ রিপোর্ট’, ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা’, ‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি’, ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘কী যুগে আমরা করি বাস’, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’, ‘এ যুদ্ধের শেষ নেই’, অথবা ‘আমি কথা বলাতে চাই’। ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম শামসুর রাহমানের অন্তরঙ্গে-বহিরঙ্গে যেমন অনুভবযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি এসব আন্দোলন-সংগ্রাম নিছক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আইডেনটিটি বা আত্মসত্তা খুঁজে পেয়েছিল তার ও তার সহযাত্রীদের কবিতা-গানের মাধ্যমে।

এইসবই পুরোনো, বহু-চর্চিত প্রসঙ্গ। রাজনীতি ও সংস্কৃতি এ দুইয়ের মধ্যে ইতিহাসের গভীর এরিয়েলে অলক্ষ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যায়। শামসুর রাহমানের ষাটের দশকের লেখায় ক্রম-বাড়ন্ত রাজনৈতিক, এমনকি শ্রেণি-সচেতনতার যে লক্ষণ দেখতে পাই তার কারণ নিহিত ছিল সে সময়ের পরিবেশে, হাওয়ায়, এমনকি দেয়াল-লিখনে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝি স্পষ্ট হয়। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কবির সাথে দেখা হলে আমি বলি যে আমার বহুদিনের ইচ্ছা যে তিনি যেন সেজার ভায়েহোর একটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ভায়েহোর কোন কবিতাটির কথা বলছেন? কবিতাটির নাম শুনে তিনি বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, এই কবিতাটির আদলে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম ষাটের দশকেই, আমার নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থে সেটি আছে। অস্বীকার করব না যে আমি কিছুটা পরিমাণে চমকে উঠেছিলাম। ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকেরা যারা এ দেশের নব-জাগরণের অধ্যায় নীরবে সৃষ্টি করেছিলেন তাদের পঠন-পাঠনে কোনো খামতি ছিল না। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টির সাথে তাদের যেমন পরিচিতি ছিল, প্রগতিবাদী সাহিত্যের সাথেও তাদের যোগসূত্র ছিল নিবিড়। পেরুর কবি সেজার ভায়েহো মার্কসবাদে অনুপ্রাণিত কবি ছিলেন, ১৯২৮ ও ১৯২৯ সালে পরপর দু’বার তিনি রাশিয়ার নতুন নির্মাণ দেখতে যান, ১৯৩১ সালে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, ১৯৩৬-৩৯ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে তিনি দু’বছর সক্রিয় অংশ নেন জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের অংশ হয়ে। ১৯৩৮ সালে প্যারিসে ৪৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আমি ভেবেছিলাম যে শামসুর রাহমানকে আমি তার সম্ভাব্য অজানা কোনো এক কবির সম্পর্কে আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিচ্ছি। অথচ প্রায় তিন দশক আগেই কবি সেজার ভায়েহো সম্পর্কে জেনেছেন; শুধু জেনেছেন নয়, তার কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের এক শ্রেষ্ঠ কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলাদেশের ষাটের দশকের নব-জাগরণের এমনি ছিল গভীর মানবিক নির্মাণ, যা দেশ-মাটির জলে শেকড় ছাড়লেও অতিক্রম করে গিয়েছিল দেশ-কালের গণ্ডী।

সেজার ভায়েহোর কবিতাটি ছিল এ রকম :

I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in ParisÑ and I don’t step asideÑ
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.

It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.

Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also

with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads… I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in Paris and I don’t step aside
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.

It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.

Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also

with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads…

বিষণ্ণ, অতি-ব্যক্তিক, অমোঘ পরিণতির দিকে ধাবমান, কবি-জীবনের সায়াহ্নকালীন এই উচ্চারণ তরুণতর শামসুর রাহমানের হাতে পড়ে এক অন্য রূপ পেয়েছিল। ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিবেচনা’ কবিতাটির অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি (পাঠক, পুরোটা পড়ে নেবেন, এই ভরসা রাখি) :

‘সেদিনও কি এমনি অক্লান্ত ঝরঝর বৃষ্টি হবে এ শহরে?

ঘিনঘিনে কাদা

জমবে গলির মোড়ে সেদিনও কি এমনি,

যেদিন থাকব পড়ে খাটে নিশ্চেতন,

নির্বিকার, মৃত?

আলনায় খুব

সহজে থাকবে ঝুলে সাদা জামা। বোতামের ঘরগুলো যেন

করোটির চোখ, মানে কালো গহ্বর। জুতো জোড়া

রইবে পড়ে এক কোণে, যমজ কবর। কবিতার

খাতা নগ্ন নারীর মতোই চিৎ হয়ে

উদর দেখিয়ে

টেবিলে থাকবে শুয়ে আর দেয়ালের টিকটিকি

প্রকাশ্যেই করবে সঙ্গম।

যেদিন মরব আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুশকিল।

শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?

যেবারই হোক,

সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা

না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে, পথঘাট,

পুণ্যবান শবানুগামীরা বড় বিরক্ত হবেন।’

এই সাক্ষাতের আরও কিছুকাল পরে- ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এ দেশেও বাম-প্রগতিশীল মহলে নানা জিজ্ঞাসার টানাপড়েন দেখা দিয়েছে- কবির সাথে তার শ্যামলীর বাসায় দেখা হয়েছিল। এসব ভাঙন, বিলুপ্তিবাদ, অস্থিরতা কবির ভালো লাগেনি। বেশ জোরের সাথেই অনুযোগ করেছিলেন, ‘এখন তো আর পার্টির থেকে কেউ আমার কাছে আসে না। আগে তারা কত আসতেন, আমাকে দিয়ে তারা কত কবিতা লিখিয়েছেন। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে।’

৬.

এবার বোধহয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। এই প্রবন্ধটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইটিকে উপলক্ষ করে ষাটের দশকের কবিতা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথমত, বলার কথা ছিল এই যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম এমনিতেই সফলতা পায়নি। ‘আন্দোলন’ যে ‘মুক্তি-সংগ্রামে’ পরিণত হয়েছিল তার পেছনে যেমন অর্থনীতিবিদদের গড়া ‘দুই-অর্থনীতি’ শীর্ষক বৈষম্যের তত্ত্ব যুক্তি-ভিত্তি জুগিয়েছিল ষাটের দশকের শিল্প আন্দোলন, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার আন্দোলনও কাজ করে থাকবে। আধুনিক বাংলা কবিতার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল। ষাটের দশকের ‘রেনেসাঁ’ ছাড়া আমরা বিশ্বতালে তাল রেখে চলা শিখতে পারতাম না, আমাদের সেই বিরল আত্মবিশ্বাসটুকু আত্মস্থ হতো না যেটি না আসলে একটি সংগ্রামরত জাতি জগৎ-সম্মুখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, যেমন পারে না একটি অর্বাচীন বালক ভাব প্রকাশের ভাষাহীন হয়ে সৃষ্টিশীল হতে, শত মেধা থাকা সত্ত্বেও। ষাটের দশকের কবিতার ভুবন, তার শিল্পলোক, সেই বালকটিকে এক মেধাসম্পন্ন জাগতিক সম্ভাবনার একটি আত্মনির্ভর পাটাতন দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে একটি জাতি-নির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায়।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল