মধ্যাহ্নের সমাজ

হুমায়ূন আহমেদ [১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২]

কেন ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসটি লিখতে হলো তাঁকে- এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সময়কে’ ধারণ করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তাঁর চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ- সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগোলো মানুষ- তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন যে, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যেই নাকি তাঁকে ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এরকম :’আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি, সময়টাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগোতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও।’
এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘তারপরেও’ বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে তাঁকে প্রবেশ করতে হলো- সেটা একটা প্রশ্ন। তার চেয়েও গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব, সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প- এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যাঁর একজন হরিচরণ সাহা এবং অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ- বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সূফী-সন্তই বলা চলে তাদের- যাঁরা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত, তাঁরাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র- ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্ররা সবাই এদের নিয়েই, এদের পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো করে মৃত্যুবরণ করে।
মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষেরা হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যাঁরা, তাঁরাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তাঁরা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না, বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর- তাঁরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছেন। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্রসন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত, খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু-হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে, ‘সাহা’ যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এই উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে- সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহেপ্তর সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। উনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান, রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার, হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে- সেটা হিন্দুর নাকি মুসলমানের, মজুরের নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের- সেটা বের করাটা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি।
এ রকম সমাজের কাহিনি কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবেই তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু ‘সময়’কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্যে। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙ্গুল দিয়ে।
২.
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিস্কৃতি নাই।’ মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশি আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল, ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে একদল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়, একপক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ, ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা দিয়ে, হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে।
পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এই উপন্যাসে। আমি এখানে দু’একটি উদাহরণ দেব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুরে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাঁকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ওই বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে- অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, ‘মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।’ মওলানা তাতেই খুশি। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন, যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে : ‘দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন’।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভালো, স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই, থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?’ আপাতত সম্মতি দিলেও চে’ গুয়েভারার চেয়ে কোনো অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুমার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুমার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্যে। ইদ্রিসকে বহুদিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্যে একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত এর তেরো নম্বর আয়াতের স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা ‘একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে’। দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগ্নি করতে তাঁর স্বধর্মের কেউ রাজি হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাঁকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এর জন্যে কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তাঁর বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, ‘লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না’। অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরানীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগাদিপাড়ার মেয়ে ষোলো-সতেরো বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরানীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক : ‘মাওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু-মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মাওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।’ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ আরও ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্ররা কি আছে এখনও আমাদের আশেপাশে কোথাও?
৩.
তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসী লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোনো শুভনীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই আমাদের ‘মধ্যাহ্ন’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণযুগ’ বলছেন লেখক? আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ- এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহেপ্ত। ‘অপরাহপ্ত’ কথাটা আমি ‘লেইট ক্যাপিটলিজম’-এর তাত্ত্বিক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বাণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকেও মানবসত্ত্বাকে ক্রমাগত ‘ব্যবহূত-ব্যবহূত’ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। ‘অয়োময়’-এর মির্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণির কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিলেন শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যে বিশ্বাম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সংগীতসভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু’তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু’দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে ‘কৃষকের ইউটোপিয়া’ গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’ হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ- তাঁরা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে শুভবোধকে, মঙ্গল কামনাকে। তাঁরা সমাজকে অন্ধকার খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি।
মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে তাকে আক্রান্ত করেছে। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎই সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। একপর্যায়ে মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার এই মৃত মার নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাঁকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনও আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি : ‘মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, সেখানে সব গোত্রের ও বর্ণের মানুষেরা মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহেপ্তর সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের মাইলফলক


পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ দেবে কী দেবে না, কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাব কী পাব না; অথবা কারও সাহায্য ছাড়া আমরা নিজেরাই সেতুটা নির্মাণ করতে পারব কিনা- এমন নানা প্রশ্নমুখর বাস্তবতার দিনে ২০১২ সালে আমি বলেছিলাম, আমাদের অসাধারণ কিছু করতে হবে। আমাদের জানান দেওয়া উচিত যে, আমরা বাঙালি জাতি- আমাদের ইচ্ছে মতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর অভ্যাসটা তোমাদের বদল করতে হবে। আমরা আর সেই আগের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাসের পাত্র হওয়া জাতি নেই। বিশ্বকে জানান দেওয়ার জন্যই হোক বা নিজেদের উন্নতির জন্যই হোক, নিজেদের শক্তি দিয়ে সেই স্বপ্টেম্নর পদ্মা সেতুটা একদিন সত্যিই বানানো সম্ভব হতে পারে- বলা যায়, এ নিয়ে আমার এক ধরনের আস্থা ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মোটা দাগে যে হিসাবগুলো সেদিন আমাদের সামনে ছিল, সেই হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে খুব সাধারণভাবেই আমার ভাবনা হয়েছিল এবং এখনও হয় যে, যাঁরা সন্দেহপ্রবণ, তাঁরা সেদিন কেন ভেবেছিলেন যে এটা আমাদের নিজেদের টাকায় করা সম্ভব নয়? আজকে আমাদের জিডিপি ৪১০ বিলিয়ন ডলার- পদ্মা সেতুর সেতু অংশের খরচ দিয়ে তাকে ভাগ করলে আসে ১ শতাংশেরও কিছুটা কম। অর্থাৎ আমরা আজকে আমাদের জিডিপি’র ১ শতাংশ খরচ করেই একটা পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারি।
২০১২ সালে এই পরিসংখ্যানগুলো হয়তো আরেকটু দুর্বল ছিল। তখনও আমাদের রপ্তানি অত বেগবান হয়নি, আমাদের রেমিট্যান্সও ততটা বেগবান ছিল না তখন, আমাদের সক্ষমতাটাও অতটা পরিস্কার হয়নি হয়তো। হয়তো সে জন্যেই আমাদের অনেকের মনে সন্দেহটা ছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাতো একটা সেতু মাত্র- এত বড় একটা দেশ, তার বৈদেশিক আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নিজের টাকায় এমন একটা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না?
আমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক সাহায্যের ছায়ায় ছিলাম। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে থাকলে যেমন অন্য চারাগাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে না, তেমনি আমাদের আত্মবিশ্বাসের চারাগুলোও এতদিন বেড়ে উঠতে পারেনি। ছায়াটা সরে যেতেই আমরা দেখতে পারলাম যে আমাদের মাথার ওপরে তো দিব্যি রোদ আছে- আমরা এখন নিজেদের মতো করেই বড় হতে পারব। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক সাহায্য ছিল আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। সেটা কমতে কমতে আজকের দিনে এসে ১ শতাংশে পরিণত হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটা পরিসংখ্যানে ঘটলেও মনের মধ্যেতো ঘটেনি এর আগে। মনে মনে হয়তো এখনও আমরা ভাবছি যে, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আমরা বোধ হয় চলতে পারব না, কেউ না করে দিলে কিংবা কেউ হাতে ধরে না শিখিয়ে দিলে আমরা হয়তো পারব না। কিন্তু দিন একটু একটু করে বদলে গেছে- আমাদের তরুণ প্রকৌশলী, যাঁরা পদ্মা সেতুর কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটাও দেখার মতো। তাঁরা অনেকেই এখন বলছেন যে, তাঁরা ভবিষ্যতে যেকোনো জটিল প্রকল্প সামাল দিতে পারবেন। এই আত্মনির্ভরতাগুলো একেকটা জাতি ধাপে ধাপে অর্জন করে থাকে। একের পর এক ধাপ পার হয়ে হয়ে কিংবা কিছু কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটা বৃহত্তম ধাপ। তার আগে যেমন ৬-দফার মাধ্যমে দুই অর্থনীতি শীর্ষক একটা যুক্তির ধাপ আমরা পার হয়ে এসেছি, যার মাধ্যমে আমাদের ভেতর স্বাধিকার আন্দোলন করার জন্য একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এগুলোই আমাদের জাতি গঠনের একেকটা মাইলফলক। আমি মনে করি আমাদের সংবিধান আমাদের জন্য যেমন একটি মাইলফলক, পদ্মা সেতুও তেমনি একটি মাইলফলক। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আসলে এত বড় রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম- মূলত তখনই আমরা এলডিসি অতিক্রম করে গিয়েছিলাম। হিসাবে আমাদের এলডিসি অতিক্রম হয়তো আরও পরে হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে এলডিসিস্তর থেকে আমরা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম, যখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন আমরা নিজেদের টাকাতেই এটা করতে পারব। সেতুর অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং অন্যান্য অনেক বিশ্নেষণের চেয়েও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি ঘটনারই যেমন একটা ব্যবহারিক মূল্য থাকে, তেমনি তার একটা আত্মন্তিক মূল্যও থাকে। পদ্মা সেতুর সেই আত্মন্তিক গুরুত্বটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। একটা কঠিন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর থেকে যার মাধ্যমে আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে, নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম একটা জাতি হিসেবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। সেখানে অনেক ঝুঁকি ছিল; এবং অনেকেই বলেছেনও যে, এই ঝুঁকি আমরা সামলাতে পারব না; কিংবা আমাদের রয়েসয়ে চলা উচিত। কেননা বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা যদি আমাদের থেকে সরে যায়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন ধসে পড়বে, আমরা না খেয়ে মারা যাব, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, আমরা নৈরাজ্যের মধ্যে গিয়ে পড়ব ইত্যাদি। কিন্তু তেমন পরিস্থিতিতেই আমরা আশার আলো দেখেছিলাম- আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছিল, আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল, রেমিট্যান্স বাড়ছিল। এ সমস্ত আরও অনেক কারণেই তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা ভাবতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে কিন্তু অতটাতো দুর্বল আমরা নই।
আমি সেদিন বলেছিলাম পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থানের জন্য আমাদের বাজেটে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, সেতুর প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় মুদ্রা এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই সংস্থান করা সম্ভব ছিল। আজকেও বলছি, স্থানীয় মুদ্রায় পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থান করা আমাদের পক্ষে তখনও কঠিন ছিল না, এখনও কঠিন নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সংস্থান নিয়ে খানিকটা প্রশ্নবোধকতা ছিল, এখন তা একেবারেই নেই। এখন আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের যে প্রবাহ, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের যে স্ট্রেংথ, আমাদের খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা- এ অবস্থায় দাঁড়িয়েই আমরা আজ জিডিপির মাত্র ২-৩ শতাংশ খরচ করে পদ্মা সেতুর মতো আরও দুইটা সেতু তৈরি করতে সক্ষম।

আমি মনে করি আমাদের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের একটা নির্দেশক হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। আমরা বলছি না যে, অন্যদের সাহায্য ছাড়া কিংবা বিদেশি প্রযুক্তি ছাড়া, বিদেশের সঙ্গে মেলবন্ধন ছাড়া আমরা সবকিছুই করে ফেলব- কিন্তু আমরা এটা বলছি যে, যদি কেউ নাও আসে তবুও এখন একলা চলার শক্তি আমাদের আছে। এটাতো আগে বলতে পারতাম না। এখন আমরা বলতে পারি। কেবল বলতেই পারি তা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তাকে সমর্থনও করে; আমাদের বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্য তাকে সমর্থন করে, আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি বা কৃৎকৌশলগত সামর্থ্য সেটাকে সমর্থন করে, আমাদের প্রকৌশলীরা সেটাকে সমর্থন করেন, অর্থনীতিবিদরা সেটাকে নিয়ে ভাবতে পারেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে আরও দূরদর্শীভাবে পথরেখা আঁকতে পারেন। এ সমস্ত বিষয়ই হচ্ছে আমাদের উন্নতির জন্য মূল্যবান উপাদান, যার মাধ্যমে মূলত একটা জাতি পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশের ৫০ বছরে সংবিধান থেকে শুরু করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ- এই যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইতিহাস।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এটা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের পর্যায়। পৃথিবীর উন্নত সব দেশেরই এসব বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাছাড়া আমাদের জনকল্পনাতেও আজ উন্নত যোগাযোগের চাহিদা ও স্বপ্টম্ন তৈরি হয়েছে। বলা যায়, যার একটা রূপান্তর হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের একটা নতুন জোয়ার তৈরিতে নিঃসন্দেহে এই সেতু অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যে জোয়ার স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক শিল্পক্ষেত্রগুলোর একটা অংশ খুলনা শহরের দিকে স্থানান্তরিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা শহরটি আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম শহরে পরিণত হবার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিরই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের নতুন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ একত্র হয়ে একটা বড় ধরনের ফলাফল এনে দেবে।
সব মিলিয়ে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, এই সেতু নির্মাণের একটা ব্যবহারিক উপকারিতা আছে- সেটা আমরা ভোগ করব; সেটা আগামীতে আরও বাড়বে, সেটা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদের স্থানীয়ভাবে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে সেতুর প্রতীকী তাৎপর্য- এর আত্মন্তিক তাৎপর্য। তা হচ্ছে যে, আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। একটা বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের টাকায় নিজেদের সেতু নির্মাণ করেছি। এটা যখন করতে পেরেছি, তাহলে আগামীতে অবশ্যই আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব।

লেখক :অর্থনীতিবিদ মহাপরিচালক, বিআইডিএস

প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি

‘কতদূর এগোলো মানুষ’- এই পঙ্‌ক্তিটি লিখেছিলেন কবি আল মাহমুদ। আজ পঞ্চাশ বছর পরে আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি যে, কতদূর এগোলো দেশ, মানুষ, সমাজ? সেটা বুঝতে গেলে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা পরিসংখ্যান বা সূচক দিয়ে সেই পথপরিক্রমার গল্পগাথা রচনা করতে পারি। আমরা ইচ্ছে করলে গাণিতিক মডেল দিয়ে সেই পথপরিক্রমার ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারি। ইচ্ছে করলে অতিব্যক্তিক পর্যায়ে অতিতুচ্ছ মানুষের জীবনের পথপরিক্রমা দিয়েও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমাকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। যেমন আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষেরও জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমার বিভিন্ন পর্যায়কে মেলানো সম্ভব।
আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে- যে বছর আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলেন। ১৯৬৪ সালে যখন আমার ৬ বছর বয়স- আওয়ামী লীগ নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হলো এবং তার সাধারণ সম্পাদক হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় জীবনের এই ইতিবাচক রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি দুটো ঋণাত্মক ঘটনাও সে বছর ঘটেছিল। ১৯৬৪ সালেই ঘটে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ‘বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু এবং আরও অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক মানুষই তখন রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এক অর্থে সেটিই ছিল ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের শুরুর পর্যায়।
দ্বিতীয় ঋণাত্মক ঘটনাটি ঘটে যখন ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মস্কো এবং চীনের শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। সেটিও ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করেছিল। মস্কোপন্থি এবং চীনপন্থি বিভাজনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল প্রগতিশীল শক্তির আন্দোলন; যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশে এখনও চলছে।
১৯৬৯ সালে আমি সর্বপ্রথম নিজেকে পত্রিকার পাঠক হিসেবে আবিস্কার করি। তখন বাসায় পূর্বদেশ আসত এবং সেই পূর্বদেশের পাতায় আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণী প্রতিদিন ছাপা হতো। অতিআগ্রহ নিয়ে সেটি আমি পড়তাম। তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে রাজনীতির প্রতি একটু একটু করে জানা-বোঝার আগ্রহ আমার বাড়তে থাকে।
সত্তর সালের মধ্যে আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে এক ধরনের রাজনৈতিক মনোজাগতিক বিপ্লব ঘটে যায়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতন হয়, শেখ মুজিব জেল থেকে বের হয়ে আসেন। ১৯৭০ সালে আসাদ মারা যান। যে রাস্তা দিয়ে আমরা প্রতিদিন বাসে করে স্কুলে যেতাম, সেই আইয়ুব গেটের নাম আমাদের চোখের সামনে আসাদ গেটে রূপান্তরিত হয়। সে বছরই ঘূর্ণিঝড় প্রবলভাবে নাড়া দেয় আমাদের সবাইকে। আমরা পয়ষট্টি সালে একবার অনুভব করেছিলাম যে, নিজেদেরকে আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। কেননা তখন পাক-ভারত যুদ্ধ চলছিল পশ্চিম ফ্রন্টে। সে সময় পূর্ব ফ্রন্ট ছিল অরক্ষিত। ১৯৭০ সালে দ্বিতীয়বার আমরা অনুভব করলাম যে, আমরা অরক্ষিত। ঘূর্ণিঝড়ে এত বড় সংখ্যক মানুষ (প্রায় ৫ লাখ) মারা গেল- অথচ তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী প্রায় এগিয়েই এলো না। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও তীব্রতর হয়েছিল সেদিন। আমি অনেকটা মনে করি বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণের পেছনে এবং সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে এই ঘূর্ণিঝড়ের পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকা কাজ করে থাকবে।
এই প্রথম আমরা চোখের সামনে দেখতে পেলাম ঘূর্ণিঝড়ে নিহত এত অসংখ্য মানুষের ছবি। পত্রিকার পাতায়, কবিতার পঙ্‌ক্তিতে, রাজনৈতিক চায়ের আড্ডায় সর্বত্র এই বোধটা গভীরভাবে সঞ্চারিত হলো। তাই আজকে যখন আমরা বলি, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা থেকে ১৯৭১- এই পাঁচ বছরের মধ্যে কী করে একটি জনগোষ্ঠী একটি বিচ্ছিন্নতাবাদের চেতনায় দীক্ষিত হলো এবং একটি নতুনতর রাষ্ট্রের জন্ম দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, তার কার্যকারণ খুঁজতে হবে এই সমস্ত ঘটনার অভিঘাতের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, এই সমস্ত আপাত তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে কতগুলো মূল্যবোধও এখন আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। সেই মূল্যবোধগুলো আমরা একদিনে পাইনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ আমরা ছেষষ্টি সাল থেকে সর্বপ্রথম প্রবলভাবে জাগ্রত হতে দেখলাম, যার সূত্রপাত হয়েছিল আটচল্লিশ-বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেই সমস্ত ঘটনার অভিঘাতে জাতীয়তাবাদ আরও বেশি শানিত রূপ ধারণ করে, যার একটা প্রাথমিক বিবরণী আমরা পাই শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থে।
সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটি কে কখন প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন জানা নেই, কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতা বোধের আন্দোলন গভীরতর বিকাশ পায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে। এই সময়েই আধুনিক বাংলা কবিতারও বিপুল প্রসার ঘটে। আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন অনেক বেশি সেক্যুলার চেতনায় ঋদ্ধ হতে থাকে। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যখন বঙ্গবন্ধু সরাসরিভাবে অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার পক্ষে উচ্চারণ করেন, তখন তা একেবারেই রাজনৈতিক অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে একটি ক্রমান্বয়ে পরিণতিপ্রাপ্ত অনুভূতির যৌক্তিক প্রতিষ্ঠা। এভাবেই আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িকতাবোধ এবং সেক্যুলার রাজনীতির প্রাথমিক ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা পায়। সত্তর সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তার স্বাক্ষর আমরা পাই। সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং তারও আগের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু সমতাবাদী সমাজের আকাঙ্ক্ষা তথা সমাজতন্ত্রের কথাটা জোরেশোরে এবং স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন। আর গণতন্ত্রের কথাতো পূর্বাপর দাবি হিসেবে ছিলই।
পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটি হয়েছিল ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার ভিত্তিতে। কিন্তু ধর্ম নির্বিশেষে যে নির্বাচন প্রথা, সত্তরের নির্বাচনেই সেটি প্রথম বাস্তবায়িত হয়। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্বোধন কিন্তু প্রথম ঘটে সত্তর সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং সেই নির্বাচনের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সেটি পরোক্ষ স্বীকৃতি লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেরো। এই তেরো বছর বয়সে চিত্রপরিচালক তারকোভস্কির ‘ইভানভের শৈশবকালের’ মতন চোখ দিয়ে আমি দেখেছিলাম যুদ্ধের সন্ত্রাস, বিদ্রোহ, গ্লানি ও ভয়। এই সমস্ত অনুভূতি তখন আমাকে তাড়া করে ফিরেছিল। এরই মধ্যে আমার বড় ভাই যুদ্ধে গেলেন। আমার বাবা মুজিবনগর সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব সেক্টরের বিভিন্ন ক্যাম্পের দেখাশোনার কাজ করছেন। যুদ্ধের ভেতরে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জয়বাংলা’ ইত্যাদি পত্রিকা- যেখানে রণাঙ্গনের খবরাখবর থাকত। আমি সেগুলো নিয়মিত পাঠ করতাম। সেই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা তো থাকতই।
আমার এবং আমার মতো অনেক মানুষের মনেই তখন একটা স্বাধীন উদারনৈতিক বাংলাদেশের রূপকল্প মনের মধ্যে জেগে ওঠে। ১৯৭২ সালে আমরা যে বাংলাদেশ পাই, তার প্রথম একটা মৌলিক উপাদান ছিল এই স্বাধীনতা এবং উদার নৈতিকতাসমৃদ্ধ বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় যে মৌলিক উপাদান আমরা দেখতে পাই তা হলো, রাতারাতি যেন বদলে গিয়েছিল জনচৈতন্যের চেহারা। সেদিনের জনআকাঙ্ক্ষার কথাটি হয়তো আজকে গালভারী কথার মতো শোনায়, কিন্তু জনআকাঙ্ক্ষা সত্যি সত্যি তখন একটা শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। সকল মানুষের চোখেই ১৯৭২ সালের সেই সময়ে দ্রুত বড় হয়ে ওঠার একটা আকাঙ্ক্ষা বা এক জীবনে এই অর্জনগুলো সম্ভব- সেই প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। কিন্তু এই শুভবোধের পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য যে জনআকাঙ্ক্ষার বিস্ম্ফোরণের প্রয়োজন, তার পাশাপাশি তখন আমরা প্রাথমিক নৈরাজ্যেরও বিস্তার ঘটতে দেখি। ১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। একদল ছাত্রের ধর্মঘটের কারণে সেই সময় অধিকাংশ দিনই কোনো ক্লাস হচ্ছে না; এমনকি প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার যে ক্লাস টেস্ট, সেটিও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তখনই আমরা জাসদ এবং এ জাতীয় সংগঠনের অভ্যুদয় দেখি এবং তাদের রাজনীতির প্রভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর একটা ঘোরতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বৈকি। প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ এসব সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হলেও পরবর্তীকালে এর কারণে একটা বড় অংশ তরুণের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যারা এর আঁচ বাঁচিয়ে চলতে পেরেছিলাম বা শিখেছিলাম- তাদের ঠাঁই হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল বা আমেরিকান সেন্টার লাইব্রেরির ভেতরে। কেননা তখন কলেজে প্রায় কোনো লেখাপড়াই হতো না। এই একই সময়ে আমরা দেখতে পাই নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা। তার মধ্যে হঠাৎ বিত্তের ঝলকানি, ব্রিফকেস ব্যবসায়ীর হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা বা অবাঙালি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে বসা ইত্যাদিও রয়েছে। একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই চরমপন্থি বিভিন্ন রাজনীতির বিকাশ, যার ফলে অনেক রকমের গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছিল সাধারণ মানুষসহ অনেক রাজনীতিবিদ। একটা হিসাবে দেখা যায় যে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার রাজনৈতিক ব্যক্তি বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মী গুপ্ত হত্যায় নিহত হয়েছিলেন।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ আমাদের আরেকটা দিক থেকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। আমরা এর আগে কখনও চোখের সামনে দুর্ভিক্ষের মৃত্যু দেখতে পাইনি। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র জয়গুনের চরিত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বা তারও আগে ‘অশনিসংকেত’ বা তারাশঙ্করের ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে ঢাকার মতন শহরে ঢাকা কলেজের সামনে সমগ্র জনকোলাহলের মধ্যে মানুষ মারা যাচ্ছে বা বস্ত্রহীন মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে- এই দৃশ্য দেখা আমার সেবারই প্রথম। এখন বুঝতে পারি খাদ্য সাহায্যের ওপরে নির্ভরতা কী ভয়ানকভাবে একটি রাষ্ট্র বা জাতিকে পঙ্গু করে দেয়। বাহাত্তরের খরা, তিয়াত্তর সালের বন্যা এবং চুয়াত্তরের উপর্যুপরি দুইবারের বিধ্বংসী বন্যায় সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বণ্টন ব্যবস্থা এবং উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার কোথাও গিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। রাশিয়া নিজেই তখন আমেরিকার কাছ থেকে গম সাহায্য নিচ্ছিল। আমেরিকার কাছে সাহায্য চাওয়ায় চুয়াত্তরের জুন মাসে সোজা বলে দিয়েছিল যে, যেহেতু কিউবাতে বাংলাদেশ পাট রপ্তানি করেছে, সেহেতু তাকে পিএল ৪৮০-এর শর্ত অনুযায়ী কোনো খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সরকার তখন বলেছিল, ‘এই নিয়ম আমাদের জানা ছিল না; ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে যখন আমরা কিউবাতে পাট রপ্তানি করি, তখনতো সেই তথ্য আপনারা জানতেন। কিন্তু তখনতো আপনারা বলেননি।’ পরবর্তীকালে [অমর্ত্য সেনের স্ত্রী] অর্থনৈতিক চিন্তক, ঐতিহাসিক এমা রথচাইল্ড ফরেন এফেয়ার্স সাময়িকীতে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি লেখায় বলেছিলেন, কিউবায় রপ্তানির কারণে পিএল ৪৮০-এর খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না- এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত অবস্থান। কেননা মিসর বাংলাদেশেরও আগে কিউবাতে পাট রপ্তানি করেছিল, তবু পিএল ৪৮০-এর অধীনে তার খাদ্য সাহায্য পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশকে এক প্রকার শাস্তি দেবার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে তিনি ধারণা করেন। এরকমই ছিল সেই সময়ের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ খুবই সীমিত ছিল। সুতরাং বহির্বাণিজ্য সূত্রে খাদ্য শস্য ক্রয় করে বণ্টনের সুযোগ ছিল সীমিত। একাধিক বক্তৃতা, আলোচনায়, সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার অসহায়তার কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভিক্ষুক জাতির কোনো মান-ইজ্জত থাকে না। আমি জায়গায় জায়গায় গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারব না।
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সাময়িককালের জন্য-মতান্তরে ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য-বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেন। এর প্রধান কারণ ছিল- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নয়। এ নিয়েও একটি ভ্রান্ত প্রচারণা দেশ চালু আছে। কেননা তখন ১৯৭৩ সালের নির্বাচন অনুযায়ী পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের ছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব বা আইন পাস করার জন্য তার জরুরি অবস্থা বা বাকশাল জাতীয় ব্যবস্থা বা অন্য কোনো অথরিটিরিয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কারণ, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব ছিল। সুতরাং এর তাগিদটা রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার কারণে উদ্ভূত হয়নি। মূলত উদ্ভূত হয়েছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে সাময়িক সময়ের জন্য কড়া শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করানোর জন্য; কক্ষচ্যুত রেলগাড়িকে রেললাইনের ওপরে তোলার জন্য। এবং ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসেও এটির সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল ১৯৭৪ সালের গোড়া থেকেই। তৎকালীন নেতৃত্ব-যার মধ্যে সিপিবি এবং ন্যাপও রয়েছে- তারা বুঝতে পারছিলেন যে দেশটাকে একটা ডামাডোলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে এবং এটাকে রোখার জন্য জুন মাস থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিবি এবং ন্যাপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এই আলোচনায় অংশ নেন। দেশে যে একটা জরুরি অবস্থা আনা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে বামপন্থি সমালোচকেরা শুধু নয় দক্ষিণপন্থি সমালোচকদেরও যেমন খন্দকার আব্দুল হামিদকে লিখতে দেখেছি। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি লিখেছেন, ‘শোনা যাইতেছে দেশে ইমার্জেন্সি আসিতেছে’। অর্থাৎ, অবস্থা যে ক্রমশ ওই আপৎকালীন জরুরি অবস্থার টিপিং পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছিল, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমি বিশেষভাবে এ কথাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, বাকশালের পুনরুদ্ধার কর্মসূচির মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ছিল, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। যেমন আমাদের সংবিধানে যে চার মূলনীতি গৃহীত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- তার বিশদ মূল্যায়ন করার চেষ্টা এই কর্মসূচিতে রয়েছে। যেমন মালিকানা সম্পর্কের ব্যাপারে সংবিধানে বলা হয়েছে, আমাদের তিন ধরনের মালিকানা থাকতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানা। এ সমবায় মালিকানার আইডিয়াটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করা হয় বাকশালের কর্মসূচিতে। যেমন প্রতিটি জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়নে সম্ভব হলে পরীক্ষামূলকভাবে একটি করে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ করা যায় কিনা, তার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ জমি যার তারই থাকবে, কিন্তু জমির অংশ, শ্রমের অংশ এবং পুঁজির অংশ সবটা মিলিয়ে কৃষি খাতে একটা বণ্টননীতি করা যায় কিনা, সেটার কথা তিনি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে বলেছিলেন। বলেননি যে এটাই সর্বত্র একবারে চালু হয়ে যেতে হবে, বলেছিলেন পরীক্ষা করে দেখা যাক। কেন এটা করতে হবে? কারণ, বাংলাদেশে একটা বড় বাস্তবতা হচ্ছে যে, এ দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের প্রতি বর্গকিলোমিটারে যদি ১২০০ জন মানুষ বসবাস করে, ভারতে বাস করে ৪০০ জন। এর থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশ কীরকম ঘনবসতির দেশ। সেই দেশে জমির সিলিং দিয়ে জমি পুনর্বণ্টন করার যে প্রথাগত নিয়ম চালু আছে নানা দেশে, সেই নিয়ম বাস্তবায়ন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং সংগত কারণেই এখানে কিছু সমবায় উদ্যোগকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে তখনও কিন্তু নগরায়ণ তেমনভাবে হয়নি। তখন নগরে জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫ শতাংশ। সুতরাং এমন নয় যে, গ্রামের মানুষ বা কৃষি খাতের মানুষকে সরিয়ে আমরা রাতারাতি নগরের মানুষে পরিণত করতে পারতাম। আজকের এই নগরায়ণ তখন ছিল না। যেটি এখন অনেকটা সহজতর হয়েছে, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এখন গ্রামে থেকেও একটা পরিবারের কোনো সদস্য শহরে এসে কাজ করতে পারেন, গ্রামে টাকা পাঠাতে পারেন। অথবা অনেক ক্ষেত্রে তারা বিদেশে যেতে পারেন। কিংবা কেউ কেউ ধীরে ধীরে শহরে পুরোপুরি স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারেন। এই সুযোগটা তখন ছিল না। সুতরাং একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে সমবায় কর্মসূচিটিকে সর্বাত্মকভাবে প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই সমর্থন জানিয়েছিলেন। আমার জানা মতে তখনকার দিনের প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ, দেশ নিয়ে চিন্তা করেন এমন মানুষেরা জানিয়েছিলেন যে, এই কো-অপারেটিভ এক্সপেরিমেন্ট করা যেতে পারে। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল, যাতে অংশগ্রহণ করেন রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ বহু দেশের অর্থনীতিবিদেরা। সম্মেলনের এক পর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সেই দলের নেতা অস্টিন রবিনসন তখন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন যে, ‘আপনি যে সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন সেটি কি আমদের একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, ‘আমাদের সমাজতন্ত্র হলো বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র, বাংলাদেশের মতো করে সমাজতন্ত্র। এর বেশি অতিরিক্ত কোনো সংজ্ঞার দরকার নেই।’ তখন এ সম্পর্কে অস্টিন রবিনসন বলেছিলেন, শেখ মুজিবের এই উত্তরটি কোনো চতুর উত্তর ছিল না, এটি প্রকৃতপক্ষেই বাস্তব জ্ঞানভিত্তিক উত্তর ছিল, কেননা বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা সমতামুখী সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা কোনো গতবাধা মডেল অনুসরণ করে হতে পারে না। কিংবা রাশিয়া বা ভিয়েতনাম ধরে এটাকে অনুসরণ করা যেতে পারে না। বাংলাদেশের মনমানসিকতার সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, ক্যাপাসিটি- এসব মিলিয়েই সেটা গড়ে উঠতে হবে।

সব সময় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা কোনো উন্নত আধুনিক পুঁজিবাদী দেশের বা কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের বা কোনো দেশেরই মডেল অনুকরণ করে বড় হতে পারব না। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার আছে। সেদিক থেকে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ অনেকটা দেং শিয়াও পিং-এর বাংলাদেশ। সেখানে মূল জোরটা দেওয়া হবে কাজটা সফল হলো কিনা তার ওপরে। বেড়াল সাদা না কালো সেই আলোচনাটা অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার চাইতে বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বেড়ালটি ইঁদুর মারতে পারে কিনা। দেং শিয়াও পিং-এর মতোই বঙ্গবন্ধুর একটি বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান ছিল, সজাগ টনটনে। এবং সে জন্যই তিনি ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগের সীমা প্রথমে ২৫ লাখ, পরে ৩ কোটি, তারপরে ৩০ কোটি পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের ৩ কোটি বা ৩০ কোটি আজকের যুগে একশ-দুশ কোটি টাকার সমতুল্য। সুতরাং এটা মনে রাখতে হবে যে, তিনি মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোক্তার বিকাশ পরিপূর্ণভাবে চেয়েছিলেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে ওই সিলিংটাকে তিনি আরও পর্যালোচনা করার পক্ষপাতি ছিলেন। কালক্রমে এটা সংসদে রিভাইজড হবে সেটাই ছিল আইডিয়া।
বাংলাদেশ যে আজকে এতদূর এগিয়েছে তার একটা বড় কারণ হলো- বাংলাদেশের যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তারা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা একপেশে, শুধু বাজারমুখী অর্থনীতি বা শুধু রাষ্ট্রনির্ভর অর্থনীতির পেছনে ছোটেননি। এটা বিশেষভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
একাত্তরে স্বাধীনতা যদি বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক অর্জন হয়, বাঙালি জাতির পক্ষে দ্বিতীয় মৌলিক অর্জন হচ্ছে ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে। নব্বই সালে আমার বয়স ৩২ বছর। তখন এই বয়সের আশপাশে যাদের বয়স তারা প্রায় সকলেই সেদিন ঢাকার রাস্তায় ছিলেন। এবং তারা সকলেই সেদিন দ্বিতীয়বারের স্বাধীনতা অর্জনকে উপলব্ধি করেছিলেন। মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের এই পরাজয়টি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এর মধ্য দিয়ে মিলিটারি শাসন অনিবার্য নয় এবং তা ছাড়াই যে সিভিলিয়ান শাসনে দেশ পরিচালিত হতে পারে এমন একটি মূল্যবোধের জন্ম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ পনেরো বছর পরে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রতি একটা অঙ্গীকারের সূচনা হয়। এবং আমাদের আজকের যে অর্থনৈতিক অর্জন তার সূচনাটা হয় মূলত নব্বই দশক থেকেই।
এখন পরিসংখ্যানের প্রশ্নে আসি। আমরা যদি নব্বই সাল থেকে আন্তদেশ শুমারির একটা বিচার-বিশ্নেষণ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাবো, যে সমস্ত খাতে অর্থনৈতিক সামাজিক সাফল্য আমাদের এসেছে- তার সূচনা নব্বই দশক থেকে হাঁটিহাঁটি করে শুরু হলেও মূলত এই সাফল্যের মূল অভিঘাত এসে পড়েছে দু’হাজার দশের দশকে। সেটা আমরা শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বলি, গড় আয়ুস্কালের ক্ষেত্রে বলি, মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বলি, নারী শ্রমের অংশগ্রহণ হারের ক্ষেত্রে বলি, জিডিপি গ্রোথের উল্লম্ম্ফনের ক্ষেত্রে বলি, দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে বলি, জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিস্তারের ক্ষেত্রে বলি এই সমস্ত ক্ষেত্রেই আমরা এক সময় যে দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেই পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে আছি। এমনকি পাশের বৃহৎ দেশ ভারত তার তুলনায় আমরা অনেক সামাজিক সূচকে এগিয়ে আছি, যার সঙ্গে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি জড়িত। এমনকি অর্থনৈতিক সূচকেও ভারতের সঙ্গে যে ব্যবধান আমাদের ছিল, ধরা যাক মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে ব্যবধান- সেটিও আমরা লক্ষণীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে পেরেছি। সেটা পিপিপি হিসেবেই বলা হোক বা সাধারণভাবে কারেন্ট ইউএস ডলারের বিচারেই বলা হোক। এমনকি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, কারেন্ট ইউএস ডলারে ভারতের মাথাপিছু আয়কেও আমরা টেক্কা দিয়েছি। এই পরিবর্তনগুলো সহসা অর্জিত হয়নি। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে কাজ করেছে চারটি ফ্যাক্টর। একটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; যেটা দিয়ে আমি বাহাত্তর সালের কথা বলে শুরু করেছিলাম। জনগণের আকাঙ্ক্ষার এই ফ্যাক্টর আর সমস্ত ক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। দ্বিতীয় ফ্যাক্টর কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি। উচ্চ আকাঙ্ক্ষার কারণে জনগণ আর নিজেকে প্রথাগত পেশায় আবদ্ধ রাখতে চাইছে না। সে আর মান্ধাতা আমলের কৃষিতে বিশ্বাসী নয়। সে চাইছে নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে এবং এরই ফলে আমরা দেখতে পাই যে, কৃষিখাতে একটা বিরাট প্রযুক্তিগত বিকাশ ঘটে গেছে। যে কৃষিক্ষেত্রে আগে লাঙল ছাড়া চাষ করা যেত না, সেখানে প্রায় সর্বত্রই এখন পাওয়ার টিলারের ব্যবহার। যেখানে আমরা গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না, সেখানে এখন আমরা পোলট্রি, লাইভস্টক এমনকি গো-পালন সেক্টরেও অভাবিত উন্নতি করেছি গত পাঁচ-সাত বছরে। মৎস্য উৎপাদন এবং মাথাপিছু মাছের ভোগের পরিমাণেও আমরা এগিয়ে আছি। এই সবটাই ঘটেছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে। মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে, তার বদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা না থাকলে এত দ্রুত এটা সম্ভব হতো না। এর পেছনে আরও একটা প্রাতিষ্ঠানিক কারণের উল্লেখ করতে চাই, আমাদের দেশে প্রথাগতভাবে যেটা সত্তরের দশকে ভুলভাবে ভাবা হয়েছিল যে, কৃষিতে সামন্তবাদী অবশেষ রয়ে গেছে। অথচ যেখানে সামন্তবাদী অবশেষের প্রাবল্য ভারত ও পাকিস্তানের কৃষিখাতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। আধা সামন্তবাদের প্রাবল্য আমাদের দেশে বলতে গেলে আজ নেই। আমাদের দেশের শ্রমিক অনেক বেশি চলমান, তারা অনেক বেশি বিদেশ ও শহরমুখীন। আমাদের গ্রামের যে মান্ধাতা আমলের ক্ষমতা কাঠামো, আশি-নব্বই দশকে তাকে অতি সহজেই চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়েছে এবং এর ফলে দেখা যাচ্ছে যে বর্গা বাজারে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। আগে যেখানে বর্গাচাষি, ভাগচাষি ছিল প্রধান প্রথা, সেখানে চলে এসেছে চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে বার্ষিক চুক্তির বদলে সিজনাল চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং এই চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের অধীনে যে জমি- সেটিতো কমেইনি, বরং ১৯৮৮ সালের ২৩ শতাংশের বদলে এখন প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই ৫০ শতাংশের মধ্যে প্রায় অর্ধেক জমি চাষাবাদ করছেন কার্যত ভূমিহীন বর্গাচাষিরা। এটি যে কতবড় সামাজিক উত্থান এবং পরিবর্তনের নির্দেশক, তা বলে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না। আমি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, গ্রামজীবনে একে একটি সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক অর্জন হিসেবে শনাক্ত করতে চাই।
তৃতীয় যে অর্জনটি গ্রামে হয়েছে, এবং যার প্রভাব আমরা আগামীতেও দেখতে পাবো- সেটি হচ্ছে ‘মিশ্র ধরনের’ খানার উদ্ভব। এই ধরনের খানাগুলো ঠিক কৃষিতেও পুরোপুরি নয়, অকৃষিতেও পুরোপুরি নয়। যে খানাগুলোর কিছু সদস্য কৃষিতে নিয়োজিত, কিছু সদস্য অকৃষিতে নিয়োজিত। এই খানাগুলোকে আমি মিশ্র খানা বলছি। মিশ্র খানার শতকরা হার গত এক দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এদের আরও বেশি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং তার জন্য আমাদের ছোট শহরগুলোর উন্নয়ন আবশ্যক। কেননা মিশ্র খানাগুলো বাস করে গ্রামাঞ্চলে। তারা যদি অকৃষি খাতে আরও বেশি যুক্ত হয়, তাহলে সবচাইতে ভালো হয় গ্রামের বাইরে ছোট ছোট শহরে কাজ করে দিনের শেষে যাতে ঘরে ফিরে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। যেটা শ্রীলঙ্কাতে আছে। যেহেতু শ্রীলঙ্কাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক বেশি সমৃদ্ধ, তারা সকালে গিয়ে রাতে রেলে করে ঘরে ফিরে আসতে পারে। এই রকম ব্যবস্থা যদি চালু করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে আগামী এক দশকে এই মিশ্র খানার পরিমাণ আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
চতুর্থ যে বিষয়টি এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে, সেটি আমাদের নারী শ্রমশক্তির বিকাশ। আমাদের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৩৬ শতাংশ। সেটি ভারতের ৩০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। এবং পাকিস্তানের চাইতে তো অনেক বেশিই। এটি এমনকি সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই হারটিকে আরও উন্নত করা প্রয়োজন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মালয়েশিয়ার ৫৫ শতাংশ বা চীনের ৬০ শতাংশের হারে নিয়ে যেতে গেলে আমাদের আরও কসরত করতে হবে। কিন্তু যতটুকু প্রসারিত হয়েছে সেটির অর্থনৈতিক সামাজিক অভিঘাত খুবই লক্ষণীয়। সেটি কেবল সমাজের জন্যই শুভ হয়নি, যারা এই পরিবর্তনটা এনেছেন সেই নারীদের জীবনেই শুভ ফল বয়ে এনেছে। আমাদের দেশ এখন অনেকখানি এগিয়ে গেছে মূলত এই জেন্ডার ডেভেলপমেন্টের কারণে। এই অর্থে একজন সমাজবিজ্ঞানী সম্প্রতি বলেছেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন কি মূলত নারীনির্ভর উন্নয়ন? এই কথাটির মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে কিন্তু এর মধ্যে সত্যতা অনেকখানি। একে আরও সবল এবং সফল করতে হবে এবং এটা হতে পেরেছে দুই-তিনটা পার্শ্ব ফ্যাক্টরের কারণে। তার মধ্যে একটা অবশ্যই রপ্তানিমুখীন শিল্পের বিকাশ-যেটিকে আমরা গার্মেন্ট শিল্প হিসেবে দেখি। যদিও এখন অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও এটি ঘটছে। এর পেছনে কিছুটা গ্রামপর্যায়ে ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধিও অবদান রেখেছে। অনেক ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা নারীর ক্ষেত্রে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সরবরাহ বেড়েছে এবং তারা নানা ধরনের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছেন। লাইভস্টক ও পোলট্রি সেক্টরের বিকাশও এ ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। এমনকি কৃষিখাতেও অনেক নারী এগিয়ে এসেছেন। এবং এর মাধ্যমে এক ধরনের ফেমিনাইজেশন ঘটছে গ্রামাঞ্চলের কৃষি এবং অকৃষি খাতে, সেটিও লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু এটাকে আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন, বিশেষত আমি মনে করি ঢাকায় মধ্যবিত্ত নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের হার বরং একটু কম। সেইখানে আমাদের জড়তাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার এবং এক্ষেত্রে সহায়তার দিগন্ত আরও প্রসারিত করা দরকার।
গত পঞ্চাশ বছরে অনেক বঞ্চনা নিরাশার মধ্য দিয়ে আমাদের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আমাদের কৃষি নিয়ে নৈরাশ্য ছিল; কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না, কারণ কৃষির উৎপাদন সম্পর্ক হচ্ছে আধা সামন্ততান্ত্রিক। শিল্প খাত নিয়ে নৈরাশ্য ছিল যে, বলা হতো বাঙালিরা প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যোক্তা। তারা আধুনিক শিল্প-কলকারখানা চালাতে জানে না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও নৈরাশ্য ছিল। কেননা আমাদের দেশ এমনিতেই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের নৈরাশ্য ছিল প্রবৃদ্ধি নিয়ে, কেননা এখানে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর ফলে শুধু যে ফসলহানি হয় তাই নয়, কোনো আধুনিক শিল্পোদ্যোক্তাও এখানে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। বন্যায় তার ব্যবসা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এমন অনেক নৈরাশ্যকে আমাদের দেখতে হয়েছে আমাদেরই জীবদ্দশায় গত পঞ্চাশ বছরে। এবং সত্তর-আশি-নব্বই দশকে এই নৈরাশ্যবাদগুলো ছিল খুবই প্রবল, যার চিহ্ন আমরা খুঁজে পাই তৎকালীন সমসাময়িক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাহিত্যে। এখন অবশ্য একটা উল্টো সুর বইছে। এখন আমরা সর্বত্র আশাবাদের কথা শুনছি। ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা শুনছি। এখন অনেকেই আছেন যারা ইতিবাচকতার কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়েন। তারা বলতে চান যে, সব পরিবর্তনতো ইতিবাচক হয়নি। এখনও তো অনেক পরিবর্তন বাকি এবং সেটা হওয়া সম্ভব নয়, কেননা বিভিন্ন সমস্যা আমাদের জর্জরিত করছে। এর মধ্যে সমস্যা রয়েছে সুশাসন নিয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে, উন্নত মানের শিক্ষা নিয়ে, স্বাস্থ্যসেবার পরিধি নিয়ে, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ নিয়ে আছে এক ধরনের ব্যর্থতাবোধ। আমার কথা হচ্ছে- এই ধরনের আশা এবং নিরাশার মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী ২০ বছর চলতে হবে। আশার দিকটিকেও আমাদের সংহত করতে হবে, নিরাশার দিকটিকেও আমাদের যথাসম্ভব উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো জাতির বিকাশ সহসা এবং অতিদ্রুত করা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের অধিবাসীদের যখন এই প্রশ্ন করা হয় যে, তারা কীভাবে উন্নয়ন করল- তখন তারা বলে, ‘আমাদের এই যে উন্নয়ন আপনারা দেখছেন, সেটা করতে গিয়ে আমাদের বাবা-মা, পিতামহ-পিতামহীদের পিঠ ভেঙে গেছে। তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এবং এই অমানুষিক খাটুনিতে তারা জীবনে আর কোনো কিছু পাননি। স্বপ্ন দেখেছেন, কষ্ট করেছেন কিন্তু বাস্তব জীবনে নিজেরা আর কোনো কিছু ভোগ করে যেতে পারেননি। তারা সব কিছু করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।’ অর্থাৎ সেখানে একটা-দুইটা প্রজন্ম এমন অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। যখন আমরা অতিদ্রুত কোনো কিছু অর্জন করতে চাই বা পারি না বলে হতাশা বোধ করি- তখন আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম। এবং এই পরিশ্রম করার মানেই হচ্ছে যে, কিছু অর্জনের জন্য একটা সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিশ্রম করে যাওয়া। সেই সময়টাতো আমাদের নিজেদের দিতে হবে। তাই বলছি, আমাদের যে অস্থিরতা, আমাদের যে অসম্পূর্ণতা, আমাদের যে তীক্ষষ্ট ব্যর্থতাবোধ- সেটাকে পরিশীলিত করতে হবে ইতিহাসের মাপকাঠিতে। যে জিনিসটা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে অর্জন সম্ভব, সেটি হয়তো আপনি চাইতে পারেন বিশ-ত্রিশ বছরে। কিন্তু পাঁচ বা দশ বছরের মধ্যেই সেটা নাটকীয়ভাবে চাইতে পারেন না। আপনাকে সেই ফল পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা আর পরিশ্রম করতে হবে। আমি মনে করি যে, একটা জাতির মধ্যে সেই ধৈর্য ও স্থৈর্য থাকা প্রয়োজন। আমি আমার জীবদ্দশায় অনেক সফলতা দেখতে চেয়েছিলাম- যার কিছু কিছু দেখতে পেয়েছি। কখনও ভাবিনি নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য শাসনের অবসান হবে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সারাজীবন ধরেই দেখব দক্ষিণ অফ্রিকায় সাদা এবং কালোদের এই বিভাজন চলছে। কিন্তু সেই বিভাজন টেকেনি। আমি আমার জীবদ্দশায় কখনও ভাবিনি যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রথাগত সমাজতন্ত্রের দেশগুলো এক-দুই বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ে বিলীন হয়ে যাবে। সেটাও দেখেছি। সুতরাং কিছু কিছু ভালো যা আমরা ভাবিনি কিন্তু ঘটেছে, কিছু কিছু অভাবনীয় ঘটনা যা ভাবিনি সেগুলোও ঘটেছে। আমাদের কিছু পাওয়া এবং কিছু না পাওয়াটাকে মেনে নিতে হবে। এবং অপেক্ষা করতে হবে আরও ভালো দিনের জন্য; আর তার জন্য পরিশ্রম করে যেতে হবে। সেটা আমার জীবদ্দশায় হোক বা না হোক।
লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি
বিশ্নেষক

বাংলাদেশ ও ভারত তুলনামূলক উন্নয়ন

বাংলাদেশ এগোচ্ছে, কিন্তু ঠিক কতটা এগোচ্ছে সেটা জানার জন্য তার আগের অবস্থার সঙ্গে পরের অবস্থার তুলনা করা যেমন জরুরি, তেমনি ওই একই সময়পর্বে অন্য দেশগুলো কেমন বা কতদূর এগিয়েছে তা জানাটা সহায়ক হতে পারে। প্রসংগ সূত্রে আজকাল প্রায়ই ভারতের সঙ্গে প্রতিতুলনা চলে আসে। জনমনে সেটা অনেককাল ধরে চলছিলই, কিন্তু অর্থশাস্ত্রে এর সূত্রপাত করেন জঁ দ্রেজ। ২০০৪ সালে একটি নিবন্ধে তিনি বাংলাদেশের হঠাৎ-উত্থান প্রত্যক্ষ করে লিখেছিলেন :’বাংলাদেশ শোজ দ্য ওয়ে’। ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু বিষয়ে শিখতে পারে এই আইডিয়াটা তারই। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেন:
‘Bangladesh is no paradise to human development…It is still one of the most deprived countries in the world. However, social indicators in Bangladesh are improving quite rapidly. Whether one looks at infant mortality, or vaccination rates, or school participation, or child nutrition, or fertility rates, the message is similar: living conditions are rapidly improving not just for a privileged elite but also for the population at large.’

এর ৯ বছর পরে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে লেখা ‘এন আনসারটেইন গ্লোরি :ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কন্ট্রাডিকশনস্‌’ বইটিতে জঁ দ্রেজ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপি-সূচক, শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতি মানদণ্ডে জীবনযাত্রার মানের মধ্যে একটি পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা উত্থাপন করেন। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান দিয়ে সে বইয়ে তারা দেখান যে মাথাপিছু আয়ে ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। মাথাপিছু জাতীয় আয়ই জীবনযাত্রার মানের একমাত্র বা প্রধান নির্দেশক নয়, একথা অমর্ত্য সেন অতীতে বহুবারই উল্লেখ করেছেন। কখনও শ্রীলঙ্কার প্রসংগ টেনেছেন, কখনও ভারতের কেরালা রাজ্যের উদাহরণ তুলে ধরেছেন। ইদানীং বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আনছেন। ২০১৩ সালের ওই বইতে দ্রেজ-সেন লিখেছেন:
‘Bangladesh has overtaken India in terms of a wide range of basic social indicators, including life expectancy, child survival, enhanced immunization rates, reduced fertility rates, and even some (not all) schooling indicators… Most social indicators now look better in Bangladesh than in India, despite Bangladesh having less than half of India’s per capita income.’

এখন এই শেষোক্ত অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। এখন অবশ্য মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় বেশ কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু সেই ব্যবধানও দ্রুত কমে আসছে। আগে (অর্থাৎ ২০১০ সালে) বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ২৮৮৩ পিপিপি ডলার (২০১৭ সালের স্থিরীকৃত মূল্যে), আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪২৩৭ পিপিপি ডলার। অর্থাৎ ভারতের মাথাপিছু আয় ২০১০ সালে বাংলাদেশের থেকে ৪৭ শতাংশ বেশি ছিল। ২০১৯ সালে (কভিডের আগেই) অবস্থাটা কিছুটা বদলে যায়। দুই দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান (পিপিপি ডলারে) নেমে গিয়েছিল ৪১ শতাংশে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিএনআই-এর সূচকে তুলনামূলক ব্যবধান ছিল আরও কম- মাত্র ২২ শতাংশ (২০২০ সালে ভারতে মাথাপিছু জিএনআই ছিল ৬০৬০ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশে ৪৯৭৬ পিপিপি ডলার)। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, পিপিপি ডলারের মাপকাঠিতেও ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় এখন আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের তুলনায় দ্বিগুণ এগিয়ে নেই। বাংলাদেশের জাতীয় আয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমেই ভারতের সঙ্গে তার ব্যবধান কমিয়ে এনেছে এবং আনছে। এর কারণ বোঝাও দুস্কর নয়। ২০১০-১৫ কালপর্বে বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় বা জিএনআই-র গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬-২০ পর্বে বাংলাদেশে এই প্রবৃদ্ধি হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশে, পক্ষান্তরে ভারতে তা দাঁড়ায় মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশে। অর্থাৎ ভারতে লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, আর বাংলাদেশে লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। এর ফলে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এটাই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা।
ক্রমশ যে বাংলাদেশ শুধু সামাজিক সূচকে নয়, মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখেও ভারতের সঙ্গে এক কদমে পা ফেলছে, তার কারণ কী? আমি তিনটি উপাদানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। প্রথমত, বাংলাদেশ ক্রমেই একটি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ন্যাশনে’ পরিণত হচ্ছে। ১৯৯০ সালে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অনুপাত ছিল ১৩ দশমিক ২ শতাংশ; সেটা বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশে। ডানি রডরিকের ভাষায় বলতে হয়, ভারতে গত তিন দশকে ‘প্রি-ম্যাচিউর ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ হয়েছে। অর্থাৎ শিল্পায়নের চাহিদা পূরণ না করেই এটি তড়িঘড়ি করে সার্ভিস সেক্টরের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে কৃষিখাতে ‘উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি’ তুলনামূলকভাবে অধিক হারে বিরাজ করছে ভারতে বাংলাদেশের তুলনায়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে কৃষিতে মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৩৮ ভাগ নিয়োজিত ছিল; ভারতে এই হার ছিল ৪৩ শতাংশ। একই কারণে, বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি ভারতের তুলনায়। ২০২০ সালে জনসংখ্যার মধ্যে নগরের অংশ শতকরা ৩৫ ভাগ, আর বাংলাদেশে ৩৮ ভাগ। অথচ ১৯৯০ সালে ভারতে নগর-জনসংখ্যার অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে বেশিই ছিল (যথাক্রমে ২৬ ভাগ ও ২০ ভাগ)। অর্থাৎ, গত তিন দশকে ভারত ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড হয়েছে শুধু নয়, এটি নগরায়ণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, শ্রমের বাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় পিছিয়েই ছিল: তখন নারীদের ক্ষেত্রে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ এবং ভারতে ৩০ শতাংশ। ২০১৯ সালে পাই এর বিপরীত চিত্র। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাংলাদেশে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে, আর ভারতে বাড়ে তো নাই, বরং কমে গেছে ২১ শতাংশে। মোটা দাগে বলা যায়, বাংলাদেশে নারীর ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ বেড়েছে ভারতের তুলনায়। এর সুফল পড়েছে চারদিকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীর স্কুলগামিতার হার এতে করে উৎসাহিত হয়েছে। ভাবা যায় যে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে এই হার ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ (ভারতে তখন ৩৫ শতাংশ)? এর পরবর্তী তিন দশকে দুই দেশেই ‘ছাত্রী উপবৃত্তি’ ও ‘সর্বশিক্ষা-অভিযান’ জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু ফলাফলে এখন এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের স্কুলগামিতার হার ৭৮ শতাংশ, ভারতে যেখানে ৭৪ শতাংশ। একই কথা খাটে শিশু পুষ্টির ক্ষেত্রেও। ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুদের মধ্যে খর্বতার হার বাংলাদেশে ছিল ৬৩ শতাংশ আর ভারতে ৬২ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই হার ভারতের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে কম (বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ, আর ভারতে ৩৫ শতাংশ)। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতি সংবেদনশীল আরও নানা সূচকে বাংলাদেশ প্রথম দিকে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও বর্তমানে এগিয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, তথ্য-উপাত্ত বিচার করে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ভারতের পতনশীল সূচক-প্রবণতার শুরু ২০১৪ সালের পর থেকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সামাজিক অগ্রগতি যেকোনো মানদণ্ডেই ২০১০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ ভারতের জন্য সন্তোষজনক ছিল না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে- যেমন ম্যানুফ্যাকচারিং জিডিপির অনুপাত, নগরায়ণ, বা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় (এবং কিছুটা অপ্রত্যাশিত) অধোগমন হয়েছে। এর প্রধান কারণ মনে হয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সূত্রে নিহিত। বিগত বছরগুলোয় অবিমৃষ্যকারী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ভারতের অর্থনীতিতে (যার মধ্যে সবার আগে আসে ‘ডিমনিটাইজেশন’ বা হঠাৎ করে পাঁচশ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়ার হঠকারী সিদ্ধান্ত)। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিছু কিছু রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপে (৩৭০ ধারা বিলোপ; ‘অনুপ্রবেশকারী খেদাও’ আন্দোলন; ‘সিএএ বিল’ ঘিরে অসহিষ্ণুতা)। সামগ্রিকভাবে, ‘হিন্দুত্ব’-এর চড়া সুরের রাজনীতি অর্থনীতির জন্যে অতিপ্রয়োজনীয় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ‘সামাজিক পুঁজিতে’ অবক্ষয় ধরিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে ‘ক্ষতিকর স্থিতাবস্থা’ থেকে অর্থনীতির জন্য ‘সহায়ক স্থিতাবস্থায়’ পৌঁছানো না গেলে অর্থনৈতিক-সামাজিক সূচকে অধোগমন ঠেকানো কঠিন।
এখানে গোড়ায় একটা আপত্তি উঠতে পারে। কেউ বলতে পারেন যে ভারত এত বড় দেশ এবং তার মধ্যে এত রাজ্যের সমাহার। তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিতুলনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত। তারচেয়ে বরং বাংলাদেশের তুলনা সাজে ভিয়েতনামের সঙ্গে। সেক্ষেত্রে বলতে হয় বাংলাদেশ ভৌগোলিক মানদণ্ডে ছোট হলেও জনসংখ্যার মানদণ্ডে ছোট নয়। এটি বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। তাছাড়া, জনঘনত্বের বিচারে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘন-জনবসতির দেশ। সেদিক থেকেও দেখা দরকার যে বাংলাদেশ প্রতিকূল ঘন-জনবসতির চাপ সহ্য করেও কীভাবে অন্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে অর্থনীতির বা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রতিযোগিতায়। সেক্ষেত্রে আমাদের শুধু তুলনামূলক মাথাপিছু জাতীয় আয়ের দিকে তাকানোই যথেষ্ট নয়। দেখতে হবে অন্যান্য সামাজিক সূচকের দিকেও। ২০১১ সালের দিকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের পাল্লা ঝুঁকে ছিল অনেক সূচকে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে অবস্থা কি এখনও আছে? যদি থাকে, তাহলে এর কারণ কী?
এই সাফল্যের অংশীদার সকলেই : রাষ্ট্র, ব্যক্তি খাত, এনজিও ও মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ। জিডিপির আন্তঃকালীন ও তুলনামূলক তুলনায় যাদের আপত্তি (আপত্তিটা অবশ্য সংগত কারণেই) তাদের বলি, এই সাফল্য দৃশ্যমান নানা সূচকেই। দ্রেজ-সেন যেসব সূচকের কথা বলেছিলেন তার প্রায় প্রতিটিতেই বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় এগিয়ে আছে। ১.৯০ পিপিপি ডলারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল ১৪ শতাংশ; ভারতে তা ছিল ২০ শতাংশ। ভারতে প্রবৃদ্ধি শুধু ২০১০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তুলনামূলকভাবে শ্নথতর হয়েছে তা-ই নয়, এর গুণগত মান বরাবরই ছিল বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা খারাপ। যেমন, ‘গ্রোথ ভলাটাইলিটি’ বা প্রবৃদ্ধির বছর-বছর অস্থিরতা বা উঠানামার সূচকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল ভারতের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল। অস্থিরতার সূচক ২০১০ দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে ছিল ০ দশমিক ৩৫, আর ভারতে ১ দশমিক ২৩। ২০১০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এটি দু’দেশেই বেড়েছে, তবে ভারতে বেড়েছে আরও বেশি হারে। ২০১৬-২০ কালপর্বে বাংলাদেশে এই সূচক গিয়ে হয়েছে ২ দশমিক ১, আর ভারতে এই সূচক পৌঁছেছে ৫ দশমিক ৮-এ। প্রবৃদ্ধির অস্থিরতা বাড়লে সমাজ-জীবনেও অস্থিরতা বাড়ে এবং সামাজিক সূচকের অগ্রগতিও আড়ষ্ট হয়ে যায়।
তাছাড়া, এটাও লক্ষ্য করার মতো ভারতে বৈষম্যের হার আমাদের দেশের তুলনায় বেশ উঁচুতে এবং এটি বরাবরের একটি প্রবণতা। ১৯৯২ সালে ভোগ-ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিমাপের জিনি-সহগ ছিল ভারতের ক্ষেত্রে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১১ সালে ভারতের ক্ষেত্রে এই জিনি সূচকের পরিমাপ হচ্ছে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বাড়েনি। ভারতের ক্ষেত্রে কোনো তথ্য নেই। কোনো অব্যাখ্যাত কারণে ২০১১ সালের পর থেকে ভারত তার ‘দারিদ্র্য পরিস্থিতি’ রিপোর্ট করা বন্ধ রেখেছে। বৈষম্যের মাত্রা বেশি থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আবেদন কমে যায়। এর ফলে সমাজে অন্যান্য বৈষম্য (জাত-পাত, ধর্মভেদ, জাতিভেদ এ জাতীয় ‘হরাইজন্টাল ইনইকুয়ালিটি’) প্ররোচিত হয়ে থাকে। বিভেদকামী রাজনীতি ও সামাজিক শক্তির বিস্তার ঘটে। ভারতের উন্নয়ন-অভিজ্ঞতায় আমরা এর চিহ্ন খুঁজে পাই। উন্নয়নের এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশকেও অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে এবং অগ্রিম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়নের প্রতিযোগিতায়-অন্য সব প্রতিযোগিতার মতই-একবার অবতীর্ণ হলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয় না।
লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি বিশ্নেষক

[তুমুল গাঢ় সমাচার ২০] ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিশেল ফুকো :মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা (Foucault and Micro-power)

পর্ব ::২০


নতুন প্রসঙ্গ

১. ক্ষমতার ‘প্রাণভোমরা’

ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো তার বিভিন্ন আপ্তবাক্যের জন্য বিখ্যাত। তার মধ্যে একটি হলো- ‘যেখানেই ক্ষমতা [রাজ করে], সেখানেই [তার বিরুদ্ধে] প্রতিরোধ গড়ে ওঠে’। সমস্যাটা জটিল, কেননা আমরা জানি শেষ পর্যন্ত এ খেলার পরিসমাপ্তি কোথায়। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। যতদিন প্রতিরোধ প্রতিবাদী অবস্থায় থাকে, ততক্ষণ সে ঠিক পথে চলছে। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সাথে সাথে তার চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে। কেন এমন হয়, সেটা জানার জন্যই ফুকোকে পাঠ করা দরকার।

ক্ষমতা অর্থাৎ Power বিষয়টিকে ফুকো যেভাবে দেখেছেন, যত বিভিন্ন উপায়ে তার বিশ্নেষণ করেছেন, সেভাবে এর আগে কোনো দার্শনিকই ব্যাখ্যা করেননি। মার্কস যেমন পুঁজির রহস্য-উন্মোচনের জন্য পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, ফুকোও তেমনি ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার সব কথা মানতেই হবে এমন নয়। এ নিয়ে আরেক ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদার সাথে তার উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জার্মান দার্শনিক জুরগেন হাবেরমাসের সাথেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সবাই এ কথা মানছেন, তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সিস বেকন ভেবেছেন, ‘নলেজ ইটসেল্কম্ফ ইজ পাওয়ার’। আমাদের বিদ্যালয়ে এখনও পড়ানো হয়, লেখাপড়া করলে গাড়ি-ঘোড়ার মালিক হওয়া যায়। ফুকো এসব অস্বীকার করবেন না। তিনি শুধু বলবেন, কোনটা ‘জ্ঞান’ আর কোনটা ‘অজ্ঞান’ এটা ঠিক করেছে কে? এই জ্ঞান, এই সত্য, অদৃশ্য ক্ষমতাবলয়ের বশীকরণ মন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত বিকৃত, আচ্ছন্ন হয়ে নেই তো? ফুকো এ রকম ভাবছেন, কেননা তিনি মনে করেন যে, জ্ঞান উৎপাদন ও জ্ঞান বণ্টনের প্রক্রিয়া যতটা নিরীহ ভাবি আমরা, আসলে সেসব আদৌ নিরীহ নয়। এক রক্তাক্ত সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে তবেই জ্ঞান তৈরি হচ্ছে। কোন মত ‘সত্য’ বলে স্বীকৃত হবে, আর কোন মতকে ‘সৃষ্টিছাড়া’ বলে বর্জনীয় ঘোষিত হবে, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। ফুকো এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে [অসংখ্য পরীক্ষক প্রতিদিন আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন]… সেখানে স্কুলের শিক্ষক পরীক্ষকের ভূমিকায়, ডাক্তার পরীক্ষকের ভূমিকায়, চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদ পরীক্ষকের ভূমিকায়, সমাজ-কর্মী পরীক্ষকের ভূমিকায়। এরা সবাই মিলে কোনটা স্বাভাবিক রীতিসম্মত তার একটি রাজত্ব (Reign of normality) তৈরি করেছে। এই পরীক্ষকের কাছে প্রতিটি ব্যক্তিকে তার শরীরের আচরণ, তার আচার-ব্যবহার, তার দক্ষতা, তার অর্জন সব কিছুকে অধীনস্থ করেই তবে তাকে বাঁচতে হচ্ছে।’ ফুকো এই অদৃশ্য ও দৃশ্যমান ‘পরীক্ষকদের’ থেকে আমাদের বাঁচাতে চান।

‘পাথরের কোরাস’ কবিতার শুরুর স্তবকেই টি. এস. এলিয়ট বলেছিলেন যে, জ্ঞানরাজ্যের অরণ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি:

Where is the life we have lost in living?
Where is the wisdom we have lost in knowledge?
where is the knowledge we have lost in information?

এলিয়ট জ্ঞানরাজ্যের অন্ধকার দিকের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীয় সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেননি। প্রত্যাশা করেছেন দৈবপ্রেরণার, যেখানে অপেক্ষা করে আছে। ইমানুয়েল কান্ট যাকে বলেছিলেন ঊঃবৎহধষ চবধপব- এক অনন্ত শান্তির কাল। ফুকোর মধ্যে সেই দিব্যোন্মাদ চাহনী নেই। কেননা তার চোখে, দেবতারা যেমন, ‘মানুষ’ বলতে আমরা যা ভাবি তা প্রতিনির্মিত হয়ে চলেছে। এবং এ কাজটি করেছে রাজাধিরাজ ক্ষমতা ও তার কথিত পরীক্ষকবৃন্দ। এ জন্যই ফুকো কী বলছেন তা গুরুত্বের সাথে শোনা জরুরি।

ক্ষমতা বিষয়ে ফুকোর আলাপকে (যাকে তিনি বলেছেন ‘ডিসকোর্স’, এ শব্দটি তারই উদ্ভাবন) কয়েকটি শিরোনামে ভাবা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাওয়ার, ‘ডিসিপ্লিনারি’ পাওয়ার, নরমালাইজিং পাওয়ার, ‘বায়ো পাওয়ার’ ইত্যাদি। এসব ধারণা ফুকোর বিভিন্ন পর্যায়ের লেখায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছি, ক্ষমতা প্রসঙ্গে ফুকো চিরকাল এক রূপ ভাবতেন না। আমি এখানে ফুকোর মাইক্রো পাওয়ার ধারণার কিছুটা আলোচনা করব।

ফুকোর মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা বোঝাতে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র একটি রূপকথাকে স্মরণ করা যেতে পারে। দৈত্যাকার ক্ষমতাকে সম্মুখ বা গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করা অসম্ভব। কেননা, দৈত্যের ‘প্রাণভোমরা’ লুকিয়ে আছে অন্যত্র। গহীন বনের নির্জনতম সরোবরের তলদেশে, যেখানে রাখা একটি রুপোর কৌটো এবং যার ভেতরে বাস করে সেই প্রাণভোমরা। যদি সেই কৌটো খুঁজে পাওয়া যায় এবং একটি একটি করে সেই ভোমরের হাত-পা-ডানা ছিঁড়ে ফেলা যায়, তবেই সে দৈত্যের ধ্বংসসাধন সম্ভব। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার স্বৈরাচারকেও সেভাবে ছাড়া পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষমতার ‘প্রাণভোমরা’ ছড়িয়ে আছে নানা স্থানে- সরোবরের তলদেশে শুধু নয়, সমাজ-শরীরের সর্বত্র :বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক, জেলখানা, বিচারালয়, পত্রিকার অফিস, টিভি চ্যানেল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-এনজিও, উপাসনালয়, পাড়ার ক্লাব, মহল্লার সংগঠন, পরিবারের অভ্যন্তর, এমনকি ব্যক্তিসত্তার মধ্যেও। এসব অপ্রত্যাশিত স্থানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ক্ষমতার ফুটপ্রিন্ট! অর্থাৎ ফুকো এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, সর্বত্র অশুভ ‘ক্ষমতা-চর্চা’র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করতে পারলে শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতা বদলে সর্বাত্মক পরিবর্তন আসবে না, বা এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

২. ম্যাক্রো বনাম মাইক্রো পাওয়ার :

সাধারণত আমরা ‘পাওয়া’র বলতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা বা রাজ-ক্ষমতাকে নির্দেশ করে থাকি। এই ক্ষমতা ‘ওপর থেকে’ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এই ক্ষমতা যিনি ‘রাষ্ট্রের প্রধান’ (যেমন রাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী), তারই শুধু চর্চার বিষয় নয়, তার অধীনস্থ রাষ্ট্র-যন্ত্র (প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, বিধিমালা, আইন-কানুন) এই চর্চার অংশ। আধুনিক রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রয়োগ ও পরিধিকে ঘিরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এক আইনি আলোচনা গড়ে উঠতে থাকে। যাকে ফুকো বলেছেন ‘লিগ্যাল-জুরিডিক্যাল ডিসকোর্স’। এই আলোচনার মূল মনোযোগ ছিল রাষ্ট্র-ক্ষমতার পরিধিকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপণ করা। রাজা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারবেন না। তেমনি, প্রজারাও সকল অধিকার ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে না। এভাবে রাজা ও প্রজার মধ্যে যার যার অধিকার নির্দিষ্ট করে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি সাংবিধানিক ও আনুষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও নাগরিকদের যার যার অধিকার রক্ষাপূর্বক ক্ষমতা-প্রয়োগের স্বীকৃত কাঠামোকে নানা ধরনের রক্ষাকবচ দিয়ে আরো যুক্তিসিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। উদাহরণত, ট্রাম্পের শাসনামলে প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প তার ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। সেখানে কংগ্রেস-সিনেটের অনেক নিয়ম-নীতির রক্ষাকবচ রয়ে গেছে। তার ওপরে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের অলঙ্ঘনীয় ছায়া রয়েছে। তারপরও সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের বিধিমালা ও আইন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের (আইন-প্রণয়ন, বিচার ও প্রশাসন) মধ্যে দায়িত্ব-বণ্টন, সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি, বিভিন্ন দপ্তর-মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে মাঝে মাঝেই ‘টেনশন’ সৃষ্টি হয় এবং তা নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বলা দরকার, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা ‘অধিকারের ভাষায়’ (Rights based discourse) নির্মিত ক্ষমতা-প্রয়োগের এই ডিসকোর্সকে ফুকো অস্বীকার করছেন না। এই ক্ষমতা-প্রয়োগের অংশ হিসেবে মার্কস, গ্রামসি বা আলথুসার যখন ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস অব স্টেট’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন, সেটিকেও ফুকো অস্বীকার করছেন না। তিনি শুধু বলছেন, সুদূর প্রাচীন বা মধ্যযুগেও রাজশক্তি যে টিকে ছিল, তা শুধু কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়নি। আধিপত্য বিস্তার (ডমিনেশন) যেমন তাতে ছিল, তেমনি ছিল আধিপত্য-প্রয়োগের ন্যায্যতা সম্পর্কে ‘সত্যের প্রচার’। উল্লেখ্য, ফুকোর ‘রিজিম অব ট্রুথ’ এবং গ্রামসির ‘হেজিমনি’ ধারণার মধ্যে মিল আছে। তবে সব রিজিম অব ট্রুথ সর্বেশ্বরতা পায় না। অর্থাৎ হেজিমনিক স্তরে যেতে পারে না। তবে সব রাজাকেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সত্যের প্রচার করতে হয়েছে কম-বেশি। ফুকো বলেছেন, ÔRight in the west is the king’s Right … [The] resurrection of Roman law [in the 12th century] was the major event around which, and on whose basis, the juridical edifice which had collapsed after the fall of the Roman Empire was reconstructed.’ রোমান ল-এর পুনর্জীবনের মধ্য দিয়ে আবার মধ্যযুগের রাজ-রাজড়াদের Ôabsolute power’ প্রয়োগের আইনি ও প্রশাসনিক দিকটির সুরাহা করা হয়েছিল। কিন্তু ফুকো বলছেন, তখনও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। যেমন, ‘মহাভারত’-এর যুগে অনুশাসন-পর্বের বিষয়বস্তু ছিল, আজকের পরিভাষায়, ‘গভর্ন্যান্স’ বা সুশাসনের প্রয়োগ-বিধির আলোচনা। অর্থাৎ রাজা বা রাজশক্তি কীভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন, রাজার অধিকার কতটুকু, প্রজাদেরই বা অধিকার কতটুকু, তাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সেখানে। কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’তে এই নির্দিষ্ট অধিকারকে বিধিমালা ও আইনের মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণত, কৌটিল্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩২ রকমের দুর্নীতি শনাক্ত করেছেন এবং তার জন্য পৃথক দণ্ডের সুপারিশ করেছেন। সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার তাগিদ না থাকলে আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী লিখতেন না। একই কথা বলা যায় ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা বিষয়েও।

আধুনিক যুগের রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা যথা হবস, লক, বেন্থাম, মিল প্রমুখ যখন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক রাজশক্তির ক্ষমতার বৈধতা, গণ্ডি বা চৌহদ্দির সীমা নির্ণয় করতে কলম ধরেছেন, সেটাও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার প্রয়োজনেই। সার্বভৌম (Sovereignty) যিনি, তার ‘ন্যায়সঙ্গত’ অধিকার কতটুকু ও কী কী- এটি যেমন তাদের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি প্রজাদেরও ‘আইনসম্মত’ অধিকার কতটুকু, সেসব আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ফুকো বলছেন, এসব আলোচনা, ডিসকোর্স তথা সত্য-উৎপাদনের মধ্য দিয়ে মূল উদ্দেশ্যটা খোলাসা করে বলা হয়নি। লিবারেল বা কনজারভেটিভ সব ধারারই পলিটিক্যাল ফিলোসফাররা যার যার মতো ‘অধিকারের ভাষা’ নির্মাণ করেছেন। কিন্তু, তারা এটা করতে গিয়ে আসলে ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’কেই আড়াল করেছেন।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৯] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৮

আমার দ্বিতীয় পছন্দ হলো, মহিউদ্দিন আলমগীরের ‘ফেমিন ইন সাউথ এশিয়া : পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাস স্টারভেশন’। এটি ১৯৮০ সালে প্রকাশিত। আলমগীর বইটি লেখেন যখন তিনি বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৭০-এর দশকে। আমার তৃতীয় পছন্দ হলো, ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত মার্টিন র‌্যাভালিয়নের ‘মার্কেটস অ্যান্ড ফেমিনস্‌’। আমার তালিকার চতুর্থ অবস্থানে আছে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ১৯৭৯ সালের প্রকাশিত ‘পলিটিক্স অব ফুড অ্যান্ড ফেমিন ইন বাংলাদেশ’- এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, প্রথম তিনটির মত বই নয় যদিও, কিন্তু চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তথা মার্কিন হস্তক্ষেপের ভূমিকার বিরুদ্ধে উন্মোচনমূলক প্রথম প্রতিবাদ (ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি সাময়িকীতে প্রকাশিত)। সবশেষে উল্লেখ করব অধ্যাপক নূরুল ইসলামের ‘দ্য বার্থ অব এ নেশন : এন ইকোনমিস্ট’স টেল’ বইটির দুর্ভিক্ষ-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদটি। এর বাইরে অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী তার একাধিক লেখায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, সেনের ‘এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টে’র তত্ত্ব এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তত্ত্বীয় দিক নিয়ে বিশদভাগে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, বাংলা ১১৭৬ সালের বা বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তর নিয়ে যেখানে গবেষণাপত্রের অপ্রতুলতা রয়ে গেছে, ইংরেজি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সে প্রেক্ষিতে- বিভিন্ন নিরিখের কাজের মধ্য দিয়েই- এক বহুল আলোচিত বিষয়।

এসব লেখা-পত্র থেকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের প্রভাবক ও কার্যকারণ সম্পর্কে যেসব প্রবণতা মোটা দাগে বেরিয়ে আসে তা নিম্নরূপ। প্রথমত, উপর্যুপরি বন্যার তীব্র আঘাত। ব্রহ্মপুত্র সে বছর যেন ফুঁসে উঠেছিল। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ছিল। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের শেষের বন্যায় আউশ ধানের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। ১৭ই জুলাই দেশের সব বড় নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে, অর্থাৎ আউশ ফসল ওঠার মৌসুমেই বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ে ধানক্ষেতে-মাঠে। এই ক্ষতিটা সামাল দেওয়া যেত আমন ধানের আবাদের মাধ্যমে। কিন্তু আউশ ধান নষ্ট হওয়ার ১৫ দিনের মাথায়- অর্থাৎ জুলাইয়ের শেষে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই পানি আবার হুহু করে বাড়তে থাকে। যেসব জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি হচ্ছিল সেগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। ১লা আগস্ট চট্টগ্রাম ও সিলেটের সাথে ঢাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বন্যার পানি বেড়ে ওঠার কারণে। ১১ই আগস্ট নাগাদ ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের সমস্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আগস্টের মাঝামাঝি বন্যার পানি বাড়তে বাড়তে সে বছরের রেকর্ড-উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছে। এতে করে নতুন বোনা আমন ধানের একটা বড় অংশ ক্ষতির কবলে পড়ে। কিন্তু মূল আঘাতটা আসে সেপ্টেম্বরে। এ সময় বন্যার পানি ধীরে ধীরে জমার কথা। কিন্তু সে বছর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আবারো বিপদসীমা অতিক্রম করে। এতে করে আগস্ট মাসের বন্যার পরে যতটুকু আমন ধান বেঁচেছিল সেটুকুও (রোপা আমনের অধিকাংশ) বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। এ রকম উপর্যুপরি বন্যার আঘাতের পর সেপ্টেম্বরের শেষে এসে দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হওয়ার সরকারি ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না সেদিন।

দ্বিতীয়ত, প্রায় ৬ হাজারের মতো লঙ্গরখানা খোলা না হলে আরো অনেক মৃত্যু আমাদের দেখতে হতো। সন্দেহ নেই। তবে আরো বেশি সংখ্যায় এবং দীর্ঘদিনের জন্য লঙ্গরখানা খোলার/চালু রাখার জন্য চাই প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের মজুদ, আর সেই মজুদের সরকারি ক্ষমতা কমে গিয়েছিল সে বছর আন্তর্জাতিক তথা মার্কিন ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৩ সাল থেকেই বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য ‘সাহায্য’ (ফুড এইড) হিসেবে দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মার্কিন সরকার। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে অবস্থাটা এত গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যে, বাংলাদেশ বাধ্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে খাদ্য সাহায্যের অনুরোধ জানাতে। রাশিয়া ছিল নিজেই আমেরিকা ও কানাডা থেকে খাদ্যশস্যের এক বড় আমদানিকারক। প্রায় ২ লক্ষ টন খাদ্যশস্য রাশিয়ার ক্রীত মজুদ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে প্রেরণের জন্যে এক জরুরি অনুরোধ জানানো হয়। রাশিয়া সেই ডাকে তখন সাড়াও দেয়। নইলে, ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসেই সেদিন এ দেশের পাবলিক রেশন প্রদানের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ নীতির ফলে (নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র তখন রাষ্ট্র-ক্ষমতায়) সে দেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানির ধারা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের আগে থেকেই ছিল নিম্নাভিমুখী। এর ফলে ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে বাংলাদেশের মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল গড়ে মাসে ২ লাখ ৩২ হাজার টন, ১৯৭৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের মার্চ পর্যন্ত তা নেমে আসে গড়ে মাসে ৭৪ হাজার টনে মাত্র। অর্থাৎ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কয়েক মাস আগে থেকেই খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এর একমাত্র বিকল্প হতে পারত আন্তর্জাতিক বাজারে গিয়ে সরাসরি খাদ্যশস্য কেনা। কিন্তু সেখানেও খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে- ১৯৭২-৭৩ সালে যার দাম ছিল টনপ্রতি ১১৫ ডলার, ১৯৭৩-৭৪ সালে তার দাম গিয়ে দাঁড়ায় টনপ্রতি ১৯৯ ডলারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য কেনার মত যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না সরকারের হাতে সেদিন। ১৯৭৩ সালের ২য় ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল যেখানে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৪ সালের ২য় ত্রৈমাসিকে সেই রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬০ মিলিয়ন ডলারে। দুর্ভিক্ষ যখন চলছিল, সেই ৩য় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে যায়- সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ৪০ মিলিয়ন ডলারে। বাড়তি খাদ্যশস্য সাহায্য পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সেদিন খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ বাড়ানোর জন্যে। কিন্তু সে সম্ভাবনাও বানচাল হয়ে যায় যখন কিউবায় পাট রপ্তানি করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ- এই অজুহাতে খাদ্যশস্য রপ্তানি করা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলার দাবি রাখে।

১৯৭৪ সালের ২৯শে মে (এরই মধ্যে তীব্র মৌসুমী বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বিধ্বংসী বন্যা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। অকস্মাৎ ডেভিড বোস্টার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের কাছে জরুরি সাক্ষাৎকার চাইলেন। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবায় ৪০ লক্ষ পাটের ব্যাগ রপ্তানির পরিকল্পনা করছে, এ রকম খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে বলে বোস্টার জানতে পেরেছেন। এটা করা হলে মার্কিন খাদ্যশস্য ‘সাহায্যের’ নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ কোনো খাদ্য-সাহায্য পাবে না। ‘পাবলিক ল ৪৮০’ অনুযায়ী শত্রু দেশ ভিয়েতনাম ও কিউবার সাথে বাণিজ্য করা কোনো দেশ মার্কিন খাদ্য-সাহায্যের সুবিধে পাবে না। এটাই সে দেশের কংগ্রেসের বিধান। তখন বোস্টারকে জানানো হল যে, (ক) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের শোচনীয় পরিস্থিতি লাঘবের জন্যে হলেও এই পাট রপ্তানি করা দরকার, এবং (খ) চাইলে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে ‘অনুমতির অব্যাহতি’ (ওয়েভার) দিতে পারেন, বিশেষত যেখানে ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ কৃষিপণ্যই কেবল রপ্তানি করা হচ্ছে দরিদ্র বাংলাদেশ থেকে। তাতে মার্কিন পক্ষের অবস্থান নমনীয় হল না। রাষ্ট্রদূত বোস্টার সাফ জানিয়ে দিলেন, যদিও পাটের থলি হয়তো বা ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ কৃষিপণ্য, তবুও প্রেসিডেন্টের কথিত ‘ওয়েভার’ মেলার কোনো সম্ভাবনাই নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের উত্তরে হতবাকই হয়েছিল। কেননা, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের পর থেকেই কিউবার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছিল এবং সে সম্পর্কে গোড়া থেকেই মার্কিন কূটনীতিবিদেরা ওয়াকিবহাল ছিলেন। তদুপরি, প্রায় একই সময়ে মিসর যখন কিউবায় রপ্তানি করছিল, তখন তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। মিসর থেকে কিউবায় তুলা রপ্তানিতে সেদিন কোনো বাধা ওঠেনি; কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানিতে সেদিন প্রবল বাধা উঠেছিল। এই রহস্যের উত্তর খোঁজাও দুস্কর নয় : কিসিঞ্জারের কাছে আনোয়ার সাদাতের ‘মিসরকে’ হাতে রাখা জরুরি ছিল। আর বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া বাংলাদেশকে চাপের মুখে রেখে নতি-স্বীকার করানোর কিসিঞ্জারী নীতি পূর্বাপর তৎপর ছিল। এ কথা ক্রিস্টোফার হিচেনস তার ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয়ত, শুধু খাদ্যশস্যের সামগ্রিক মাথাপিছু প্রাপ্যতার বিষয়টিকে চুয়াত্তরের ‘দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যা’ হিসেবে নিলে সরলীকরণ করা হবে। প্রাপ্যতা একটি নির্ণায়ক, একমাত্র, এমনকি প্রধান নির্ণায়ক নাও হতে পারে। ১৯৭৪ সালের উপর্যুপরি বন্যায় প্রচুর ফসলহানির পরেও এটা বলা যেতে পারে। যেমন, ১৯৭৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতার (উৎপাদন+আমদানি) পরিমাণ ছিল ১১.৫৭ মিলিয়ন টন, ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৩৬ মিলিয়ন টনে। মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতার পরিমান (availability) ১৯৭৩ সালে ছিল দৈনিক ১৫.৩ আউন্স, যা ১৯৭৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় দৈনিক ১৫.৯ আউন্সে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দেখলে দুর্ভিক্ষের বছরে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা এর আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি বৈ কম ছিল না। জেলা পর্যায়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিসংখ্যানও এ তথ্যকে বাড়তি সমর্থন দেয়। ১৯৭৩ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ছিল প্রায় প্রতিটি জেলাতেই (কেবল বরিশাল ও পটুয়াখালী ছাড়া)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হলো দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে উপদ্রুত তিনটি বৃহত্তর জেলায়- রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে তো যায়ইনি বরং লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এ তিনটি জেলায় মাথাপিছু খাদ্যশস্য প্রাপ্যতাও ছিল ১৯৭৩ সালের তুলনায় বেশি। এর থেকে অমর্ত্য সেন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ‘খাদ্যশস্যের সামগ্রিক প্রাপ্যতা ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকে ব্যাখ্যা করতে সামান্যই সহায়ক হতে পারে।’ সেনের মতে, সে বছর উপর্যুপরি বন্যার কারণে ভিত্তহীন গ্রামীণ শ্রেণি তথা কৃষিমজুর ও স্বল্পবিত্ত বর্গাচাষিদের কর্মসংস্থানের পরিসর সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাস্তবে কমে গিয়েছিল। সেটাকে পুষিয়ে নিতে পারত পরীক্ষিত ‘পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম’ (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বা রুরাল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ইত্যাদি)। কিন্তু শেষোক্ত ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারেনি দুই কারণে : (ক) সরকারের কাছে ঐ সিস্টেমের মধ্য দিয়ে বণ্টন করার মতো যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না; (খ) ঐ সিস্টেমটি মূলত শহর এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষদের রক্ষার জন্য রেশন-ব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারেই বেশি সচেষ্ট ছিল; (গ) ছয় হাজারের মতো লঙ্গরখানা চালু হলেও তা যথেষ্ট ছিল না ব্যাপক পরিসরে দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য।

চতুর্থত, খাদ্যশস্যের বাজারে বেসরকারি খাতের মজুদদারি প্রবণতাও খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্যকে আরো বেশি করে উস্কে দিয়েছিল। মোটা চালের দামের ইনডেক্স ((Index of retail prices) যদি ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে হয় ১০০, তা আগস্ট মাসে বেড়ে হয় ১২১, সেপ্টেম্বর মাসে তা লাফ দিয়ে চড়ে যায় ১১৫-এ, আর অক্টোবর মাসে তা আরো বর্ধিত হয়ে পৌঁছায় ১৭৮-এ। কেবল মাত্র ডিসেম্বর মাসে তা আবার নেমে দাঁড়ায় ১৩৩-এ। সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের উচ্চ ও অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধি দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৮] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৮

পূর্ব প্রকাশের পর

৩. [অসুস্থ অবস্থায় মাওলানা ইদরিস শুয়ে আছেন শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তিনি একা নন, তার পাশে দুর্ভিক্ষে না খেতে পেরে মারা যাচ্ছে এমন অনেকেই শুয়ে আছে। এদেরকে আলাদা করা হয়েছে। এরপর শোনা যাক হুমায়ূনের বর্ণনায়]

‘হাসপাতালে রোগীর জায়গা নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা কিছু সাহায্যের চেষ্টা করছে। সেই সাহায্য কোনো কাজে আসছে না। মাওলানাকে সকালবেলা একটা রুটি দেওয়া হয়েছে। মাওলানা রুটি খাননি। রুটি চারপাশে পড়ে আছে, সেখানে পিঁপড়া উঠেছে। মাওলানা আছেন প্রবল ঘোরে। সারাক্ষণই তার মনে হচ্ছে মাথার ভেতর দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।’

[এরপর একটু যখন ভালো হবেন মাওলানা ইদ্রিস স্বয়ং ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসায়, তার দেখা হয়ে যাবে তরুণ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। তিনি তখন ‘গণদেবতা’ লিখছেন। যিনি কখনও হাদিস-কোরানের বাইরে কোনো গল্প-উপন্যাস পড়েন নাই, তাকে তারাশংকর পড়ে শোনাবেন ‘গণদেবতা’ স্তবক : ‘সোঁ সোঁ শব্দে প্রবল ঝড়। ঝড়ে চালের খড় উড়িতেছে, গাছের ডাল ভাঙিতেছে। বিকট শব্দে ওই কার টিনের ঘরের চাল উড়িয়া গেল।’ এ যেন গল্পের মধ্যে গল্প …]

১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এর প্রভাব সারা বাংলাতেই অনুভূত হয়েছিল। অমর্ত্য সেন তার পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন বইতে লিখেছেন যে, এই দুর্ভিক্ষ অগ্রসর হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় বিস্তৃত ছিল ১৯৪২-র শুরু থেকে ১৯৪৩-র মার্চ পর্যন্ত, যখন আদিগন্ত দুর্ভিক্ষের নগ্ন পদধ্বনি শোনা গেছে। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৪৩ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলেছে; এই পর্বে অনাহারে গ্রাম-বাংলার মানুষ মরতে শুরু করছিল। বিভৃতিভূষণের অশনি-সংকেত প্রথম পর্যায় থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায় চলেছে ১৯৪৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৪ সালের শেষ নাগাদ। এই পর্যায়ে খাদ্য-সংকট পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মৃত্যুর হার কমার পরিবর্তে ক্রমেই বেড়ে চলছিল। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের ‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত’ জেলাদের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলী। ‘মাঝারি ক্ষতিগ্রস্ত’ এলাকার মধ্যে ছিল যশোর, খুলনা ও বরিশাল আর ‘সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত’ জেলাগুলোর মধ্যে ছিল রংপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, নদিয়া প্রভৃতি। অর্থাৎ এ তালিকা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিশেষভাবে পীড়িত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের জেলাগুলো। জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা, ঔপনিবেশিক সরকারের চাল মজুদ করার নীতি বা তথাকথিত ‘ডিনায়েল পলিসি’, চালের পণ্যবাহী ছোট-মাঝারি নৌকাগুলো (১০ জনের বেশি লোক উঠতে পারে এমন সব নৌকা) ধ্বংস করে ফেলা এসবই পূর্ববঙ্গের স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যাভাব বাড়িয়ে দিয়েছিল ও দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশরা নিজেরাই তাদের তৈরি উনিশ শতকের ‘ফেমিন কোর্ড’ অনুসরণ করেনি। করলে, পঞ্চাশের মন্বন্তর সহজেই এড়ানো যেত। শেষ পর্যন্ত এ রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন অমর্ত্য সেন।

সংকটটা আরও সহজে সমাধান করা যেত যদি প্রাদেশিক সরকার আরও সচেষ্ট হতো। বাংলায় তখন খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার। সুব্রত রায়চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের… জনবিরোধী কার্যকলাপের পাশাপাশি… নাজিমুদ্দিন সরকারও মুনাফার মৃগয়ায় মেতে ছিল। এই সময়ে ৬ টাকা বেশি দরে খাদ্য বিক্রি করে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার… ৭৫ লাখ টাকা মুনাফা করে। বেঙ্গল মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইস্পাহানীকে সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় চাল বাংলা থেকে সংগ্রহের জন্য। দুর্ভিক্ষ পরবর্তী ফেমিন কমিশনের কাছে ইস্পাহনী ঐ মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, ১৯৪২ সালের মে মাসের মধ্যেই দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ‘চল্লিশ হাজার মণ’ চাল কিনে তিনি যুদ্ধের জন্য মজুদের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ১৯৪৩ সালের মে মাস নাগাদ এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ‘২,৩৫,৫৫৭ মণ’, যা ইস্পাহানী প্রতি মণ ১৪ টাকা ১২ আনা ৭ পাই দরে বাংলা সরকারের কাছে বিক্রি করেছিল- যখন বাজার মূল্য ছিল ৩২ টাকা মণ। এতে করে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, দুর্ভিক্ষে যখন লোক মারা যাচ্ছে, তখন এত পরিমাণ চাল মজুদ করার অর্থ কী? বোঝাই যাচ্ছে, চার্চিলকে তো বটেই, তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারকেও কিছুটা দায়-দায়িত্ব নিতে হবে এই দুর্ভিক্ষ নিবারণে ব্যর্থতার জন্য। বেঙ্গল মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি পেছনে রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব না এড়ানোর জন্য লীগ নেতৃবৃন্দকে পরোক্ষভাবে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এলা সেনের পূর্বোক্ত বইটি থেকে তা তুলে দিচ্ছি :

From March or April this year (1943) People began to starve because rice had disappeared from the market and the black market rate was so high… it was beyond the reach of the people… Many people had to quit their villages in search of food in the town; these who remained in the villages had to perish… Bengal is threatened with physical extinction and moral collapse. Where will be the Muslim League if hundreds of thousands of Muslims die? What will be the meaning of Pakistan where there will be skeleton-like sub-humans in desolate villages?

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের নিয়ে কি কাঙ্ক্ষিত আদর্শের ‘পাকিস্তান’ গড়ে তোলা যাবে? এই ছিল চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রশ্ন। পরবর্তীতে, দেশভাগের পর মুসলিম লীগ যে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল তারও পেছনে ছিল সাধারণ জনমানুষের খাদ্য-সংকটের যথাযথ মোকাবেলা না করতে পারার ব্যর্থতা। সেটি আমরা বদরুদ্দিন উমরের ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’র সুবাদে অনেক আগেই জেনেছি।

তবে সরকারের বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমাজের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় অনেকেই দুর্ভিক্ষের মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিলেন। চট্টগ্রাম ছিল অত্যন্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা। সেখানে পুর সমাজ, বিশেষত প্রগতিমনা অংশের উদ্যোগে দুর্ভিক্ষ-নিবারণের চেষ্টা হয়েছিল। ‘নিচের থেকে উদ্যোগের এই উদাহরণগুলোকে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা দরকার, এতে করে দুর্যোগ প্রতিরোধে পুর সমাজের সম্ভাব্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার দিকটি স্পষ্ট হবে। সব কিছুর জন্য- অনুদান থেকে বিদ্যাদানের প্রয়োজন অবধি- রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর করার ধারা এক রুগ্‌ণ মানসিকতার পরিচায়ক। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর স্মৃতিচারণ ‘স্মৃতির সন্ধানে’ গ্রন্থটির বিরল একটি অধ্যায়ের নাম ‘যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের খণ্ডচিত্র’। তরুণ মাহবুব উল আলম লিখছেন : ‘ইতোমধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শহরে তিনটি লঙ্গরখানা খুলি এবং কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত বেবি হোমেও নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। … দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণকার্য চালাতে গিয়ে আমি কমিউনিস্ট পার্টির আরও নিকটবর্তী হয়ে ওঠি। … এ ছাড়া আগে থেকেই আমার মামার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কল্পনা দত্ত, কল্পতরু সেনগুপ্ত … প্রমুখ কীর্তিমান পার্টি নেতাদের সঙ্গে। … একদিন মা প্রস্তাব করলেন [একজন প্রতিবেশী হিন্দু রমণী যাকে মাতৃহারা মাহবুব উল আলম ‘মা’ বলে ডাকতেন এবং যিনি ভাবতেন ‘পূর্বজন্মে’ মাহবুব নিশ্চয়ই ‘ব্রাহ্মণ ছিলেন’] চল দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যার্থে আমরা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। … সবাই দুর্ভিক্ষের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি নতুন মায়ের নির্দেশে কয়েকদিনের মধ্যে একটি নাটক খাড়া করলাম। দুর্ভিক্ষের ওপর বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ … নাটকের কোনো কপি ছিল না। ফলে এই নাটক রচনায় আমি কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সাহায্য নিয়েছিলাম, মনে পড়ে। খুব উৎসাহের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিম হলে আমার ‘ভাঙন’ নাটকটি অভিনীত হলো। … অনেক টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়ে, টাকাটা ত্রাণকার্যে রত বেবি হোমসহ বেশ ক’টি সাহায্য সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল।’

পুর সমাজের পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ-নিবারণে ত্রাণকার্য পরিচালিত হলেও দুর্ভিক্ষের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া চলেছি আরও বহু বছর ধরে। ১৯৪৩-৪৪ সালের পটভূমি ও কার্যকারণ সূত্র নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ততটা আলোচনা বা অনুসন্ধান হয়নি। ২০০৭ সালে এসে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘এভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের দিনগুলো শেষ হলো বটে, কিন্তু আমাদের সমাজ জীবনে তাতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষত এত বছর পরেও শুকায়নি।’ এদিকটা গবেষকদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

৬. ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ

সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে। ঢাকা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে। রৌদ্র ঝকঝকে দিন। মিরপুর রোড যথারীতি ব্যস্ত। রাস্তার এধারে হকারের বইপত্র দেখছি। পাশে ন্যুমার্কেটগামী রিকশার ভিড়। রাস্তার ওধারে ২ টাকা দামের কিমা পরোটা ভাজা হচ্ছে, তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হঠাৎ করে চোখে পড়ল এই শাহরিক ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে একজন তিরিশ-ঊর্ধ্ব নারী টেনে টেনে রাস্তা পার হচ্ছেন। হেঁটে নয়- শুয়ে, নিজেকেই ক্লান্তভাবে টানছেন। তার পরনে কোনো কাপড় নেই! এ রকম দৃশ্য এর আরে আমি কখনও দেখিনি। গল্পের বইতেও পড়িনি। আমার ধারণা, ঢাকা শহরও এর আগে এ রকম হতবাক করা দৃশ্য এর আগে কখনও দেখেনি। এর পরে যথারীতি আমার বাস এল। সেটায় চড়ে বাড়ি ফিরে গেছি আর সব দিনের মত। কিন্তু দৃশ্যটা এখনও জীবন্ত হয়ে আছে মনে। জিজ্ঞেস করাতে কে একজন বলল, ‘বুঝলে না। দুর্ভিক্ষ চলছে রংপুরে। এরা সেই রংপুর থেকে খাবারের খোঁজে ঢাকা শহরে চলে এসেছে।’ এরপর যতবার গেছি ঐ জায়গা দিয়ে, প্রতিবারই মনে পড়েছে সেই অজানা অনাল্ফম্নী নারীর কথা। সে বেঁচেছিল কিনা সে বছর, অথবা এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না। মহিউদ্দিন আলমগীরের হিসাব উদ্ৃব্দত করে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল প্রায় পনেরো লাখ মানুষ।’ হতে পারে, সেই নারী প্রায় ছয় হাজার লঙ্গরখানার একটিতে আশ্রয় পেয়েছিল, অথবা হতে পারে, সেই আশ্রয় পাওয়ার পরেও সে বাঁচতে পারেনি। মানুষ তো শুধু ক্ষুধায় মারা যায় না, এর সাথে জড়িয়ে থাকে, কত নিগ্রহ-অসম্মান, কত অসুখ-বিসুখ। এ জন্যেই বলে ‘নারী ও মন্বন্তর’। আমার নিজের ধারণা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের যে প্রজন্ম নিজেদের ‘লস্ট জেনারেশন’ ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল, তার পেছনে ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের এক দীর্ঘ প্রলম্বিত প্রভাব ছায়া ফেলে থাকবে। স্বাধীনতা-উত্তর যৌবনিক উচ্ছ্বাসের আনন্দময় মুহূর্তগুলো সাময়িককালের জন্যে হলেও ঢেকে গিয়েছিল দুর্ভিক্ষজনিত আতঙ্ক, বিষাদ ও হতাশায়। তর্ক উঠলেও বলা যেতে পারে, সামাজিক মূল্যবোধের প্রকৃত অবক্ষয়ের শুরু সেই থেকে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখালেখির শেষ নেই। এর কার্যকারণ, মৃত্যুর ব্যাপ্তি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফ্যাক্টরের তুলনামূলক গুরুত্ব এ নিয়ে আজও চর্চা হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল পাঁচটি রচনার এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই আসবে অমর্ত্য সেনের ‘প্রভাটি অ্যান্ড ফেমিন’ গ্রন্থটি, যার কথা এর আগে বলেছি। এটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৭] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৭

পূর্ব প্রকাশের পর

এত বেড়ে যাওয়ায় গঙ্গাচরণ যাও-বা কিছু কিনতে পারলো, নবীন পাড়ূই কিছুই কিনতে পেল না। মাছ ধরে তার যা উপার্জন তাতে করে তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে খাদ্যশস্যের মূল্য। কীভাবে অমর্ত্য সেন কথিত ‘এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টের’ দ্রুত অবনতি হচ্ছিল, তার বিবরণ মেলে তাদের কথায়]

‘গঙ্গাচরণ বললে- নবীন, চাল নেবে না?

– না বাবাঠাকুর। একটা সিকি কম পড়ে গেল।

– তবে তো মুশকিল। আমার কাছেও নেই যে তোমাকে দেবো।

– আধসের পুঁটিমাছ ধরেলাম সামটার বিলে। পেয়েলাম ছ’আনা। আর কাল মাছ বেচবার দরুন ছেল দশ আনা। কুড়িয়ে-বুড়িয়ে একটা টাকা এনেলাম চাল কিনতি। তা আবার চালের দাম চড়ে গেল কী করে জানব?

– তাই তো!

আধপেটা খেয়ে আছি দু’দিন। চাষিদের ঘরে ভাত আছে। আমাদের তা নেই। আমাদের কষ্ট সকলের অপেক্ষা বেশি। জলের প্রাণী, তার ওপর তো জোর নেই? ধরা না দিলে কী করছি! যেদিন পালাম সেদিন চাল আনলাম। যেদিন পালাম না সেদিন উপোস। আগে ধান-চাল ধার দিত। আজকাল কেউ কিছু দেয় না।’

৩. [চাল-সংগ্রহ অভিযানের কারণে অনেক বড় বড় দোকানেও কেনার জন্য চাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না]

‘কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার। বড় বড় তিন-চারটি দোকান খুঁজে বেড়ালে, সকলেরই এক বুলি- চাল নেই। গঙ্গাচরণের মনে পড়লো বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায়ের কথা। …কিন্তু সেখানেও তথৈবচ। গঙ্গাচরণ দোকানঘরটিতে ঢুকবার সময় চেয়ে দেখলে বাঁ পাশের যে বাঁশের মাচায় চালের বস্তা ছাদ পর্যন্ত সাজানো থাকে। সে জায়গা একদম খালি। হাওয়া খেলচে।…

গঙ্গাচরণ বললে- কিছু চাল দিতে হবে।

– কোথায় পাব, নেই।

– এক টাকার চাল, বেশি নয়। এই লোকটাকে উপোস করে থাকতে হবে। দিতেই হবে আপনাকে।

কুণ্ডু মশায় সুর নিচু করে বললে- সন্ধ্যের পর আমার বাড়িতে যেতে বলবেন, খাবার চাল থেকে এক টাকার চাল দিয়ে দেবো এখন।

গঙ্গাচরণ বললে- ধান-চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?

– কী করব বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুট হওয়ার পর কী করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন! সবারই সে দশা। তার ওপর শনচি পুলিশে নিয়ে যাবে চাল কম দামে মিলিটারির জন্য।…

– আমরা না খেয়ে মরব?

– যদিন থাকবে, দেবো। …

– …বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক, নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে! কী খেয়ে বাঁচবে মানুষ?

– বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কনটাকটারদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি। এই রকম অনেকেই করেচে খবর নিয়ে দেখুন।’

৪. [মতি মুচিনী মারা যাচ্ছে। গঙ্গাচরণকে গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘বড্ড জ্বর দাদাঠাকুর, তিন দিন খাইনি, দুটো ভাত খাব।’ তার পরের বিবরণী বিভূতিভূষণের লেখাতেই শুনুন]

‘অনঙ্গ-বৌ শুনতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু সেও অত্যন্ত দুর্বল। উঠে মতির কাছে যাওয়ার শক্তি তারও নেই!

বললে- ওগো মতিকে কিছু খেতে দিয়ে এসো-

– কী দেবো?

– দুটো কলাইয়ের ডাল আছে ভিজনো। এক মুঠো দিয়ে এসো।

– ও খেয়ে কি মরবে? তার জ্বর আজ কত দিন তা কে জানে? মুখ-হাত ফুলে ঢোল হয়েচে। কেন ও খাইয়ে নিমিত্তের ভাগি হবো!

খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনঙ্গ। কিন্তু অন্য কিছুই ঘরে নেই। কী খেতে দেওয়া যায়, এক টুকরো কচু ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা রোগীর খাদ্য নয়। … ভেবেচিন্তে অনঙ্গ-বৌ বললে- হ্যাঁ গা, কচু বেটে জল দিয়ে সিদ্ধ করে দিলে রোগী খেতে পারে না?

– তা বোধ হয় পারে। মানকচু?

[ব্রাহ্মণ পণ্ডিত স্কুলের শিক্ষক গঙ্গাচরণের উনোনেরই যদি এই দশা হয় আরও নিম্ন-আয়ের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হচ্ছিল, তা এর থেকে অনুমেয়।]

৫. [অবশেষে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে প্রমাণ হলো। বিভূতিভূষণ তার অননুকরণীয় বর্ণনার সেই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা লিখছেন। সে বর্ণনা চার্চিল-কেইনস্‌ বা ঔপনিবেশিক ভারতের ভাইসরয়রা কেউ পড়েননি, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনিসংকেত’ ছবির কল্যাণে পরে মতি মুচিনীর মৃত্যুসমগ্র পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল]

‘গ্রামে থাকা খুব মুশকিল হয়ে পড়লো মতি মুচিনীর মৃত্যু হওয়ার পরে। অনাহারে মৃত্যু এই প্রথম। এর আগে কেউ জানত না বা বিশ্বাসও করেনি যে অনাহারে আবার মানুষ মরতে পারে। এত ফল থাকতে গাছে গাছে, নদীর জলে এত মাছ থাকতে, বিশেষ করে এত লোক যেখানে বাস করে গ্রামে ও পাশের গ্রামে, তখন মানুষ কখনও না খেয়ে মরে? কেউ না কেউ খেতে দেবেই। না খেয়ে সত্যিই কেউ মরবে না।

কিন্তু মতি মুচিনীর ব্যাপারে সকলেই বুঝলে, না খেয়ে মানুষে তাহলে তো মরতে পারে। এত দিন যা গল্পে-কাহিনীতে শোনা যেত, আজ তা সম্ভবের গণ্ডির মধ্যে এসে পৌঁছে গেল। কই, এই যে একটা লোক মারা গেল না খেয়ে, কেউ তো তাকে খেতে দিলে না? কেউ তো তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলে না? সকলের মনে বিষম একটা আশঙ্কার সৃষ্টি হলো। সবাই তো তাহলে না খেয়ে মরতে পারে!’

‘অশনিসংকেত’ ছাড়াও সে সময়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার ‘মন্বন্তর’ উপন্যাস (দুর্ভিক্ষের ওপরে লেখা বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকটি তখনই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল)। ১৯৪২ সালের শীত-মৌসুমের খাদ্যশস্য বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলোতে। ‘মন্বন্তরে’ তারাশঙ্কর লিখেছেন :’লোক কয়েকটি মেদিনীপুরের অধিবাসী। ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির ঢিবি হয়ে গেছে, গরু-বাছুর ভেসে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে জমির বুকে চাপিয়ে দিয়েছে বালির রাশি। অন্ন নেই- এমনকি তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করবারও উপায় নেই- জল লবণাক্ত হয়ে গেছে।’ এই বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষের প্রাগ-পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। মন্বন্তরে বিজয়দা নীলাকে লিখছে :’এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি- ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজন্মা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত দান টেনে নিচ্ছে।’ মন্বন্তর উপন্যাসটি সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হলেও আদর্শ প্রচারের কারণে ততটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারাশঙ্কর একদিকে মহাত্মার অনুসারী, অন্যদিকে বামপন্থি চিন্তাধারার প্রভাবও স্বীকার করে নিচ্ছেন। এ দুইয়ের মিলিত উচ্ছ্বাস মাঝেমধ্যেই তার পাত্র-পাত্রীদের কথার মধ্যে উপচে পড়ে। একটি উদাহরণ দিই, শহর কলকাতায় তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনস্রোত ঢুকে পড়েছে। বাকিটা তারাশঙ্করের বর্ণনায় শুনুন :

‘নীচে পথর উপর থেকে ক্ষীণ কাতর কণ্ঠে ডাক উঠল- ভাত দাও মা চারটি, বাসি ভাত! নীলা এবং কানাইয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। এ মন্বন্তর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাসাটা তাদের কাছে অপরাধ বলে মনে হলো।

বিজয়দা লেখা সমাপ্ত করে বললো- কানাই ভাই, এইবার কাজে নেমে পড়ো, নীলা ভাই, কমরেডের সঙ্গে তুমিও লেগে পড়ো। …

নীলা এবার বললে- বলুন, কী করব? কাজ বলে দিন।

– কাজ অনেক। মানুষকে, এ মন্বন্তরের দুর্যোগ পার করে নিয়ে যেতে হবে।’

পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আরও কথাসাহিত্য লেখা হয়েছে বাংলায়। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গোপাল হালদারের ট্রিলজি- ‘পঞ্চাশের পথ’, ‘ঊনপঞ্চাশি’ ও ‘১৩৫০’। লঙ্গরখানা খোলার কথা আছে অনেক গল্পে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গ্রন্থের ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পে গ্রাম ছেড়ে নিরন্ন মানুষের অশক্ত পথচলার বিবরণ পাই। দুর্ভিক্ষের সময়ে ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এবং বামধারার ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পে তিনি লিখছেন :’তিনু কিছু বললে না। হঠাৎ কী হয়েছে তার- নদীর অপর তীর দেখবার জন্য তার মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে- মহাসাগরের তীরে যেন বসে রয়েছে। পথ ভুল করে কি তারা সীমাহীন মহাসাগরের তীরে এসে বসেছে মরণের পারে যাবে বলে?… ক’দিন হলো মতি উধাও হয়ে গেছে গাঁ থেকে এবং তার খোঁজে সে এদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া গাঁয়ে যে রকম বীভৎস আকাল লেগেছে, সেখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।’ দুর্ভিক্ষের কারণে জমি সামান্য টিপসই দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল নিরন্ন কৃষক, এ কথা শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ আমাদের জানিয়েছে। আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ উপন্যাসে জয়গুণ ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছে এভাবে :’পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়-কত বাড়িতে তাকে ঘুরতে হয়েচে… মাঝেমধ্যে সারারাত সারাদিন কেটেছে, একটা দানাও পড়েনি পেটে।’

হুমায়ূন আহমেদ তার ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরকে প্রোথিত করেছেন। তাতে করে দেখা যায়, শুধু পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতায় নয়, এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। চাল কিনে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের সুরক্ষিত করার জন্য ‘প্রকিউরমেন্ট পলিসি’ দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ফিরে যাই হুমায়ূনের বর্ণনায় :

১. [আর, পি, সাহার কথা মনে রেখেই কি নিচের এই স্তবকটি লিখেছিলেন হুমায়ূন? স্মর্তব্য, রণদা প্রসাদ পরে ‘দানবীর’রূপে সমধিক পরিচিতি পেলেও তার ‘প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ন’ হয়েছিল যুদ্ধের বাজারে- দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে- ধান-চালের মজুদদারি করেই]

‘বান্ধবপুর বাজারে এককড়ি সাহার চালের আড়ত। তিনি সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে এখন রমরমা অবস্থা। ধান-চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আরও বাড়বে- এ রকম গুজব বাতাসে ভাসছে। সব চাল নাকি মিলিটারিরা কিনে নিবে।… দেশের চাল সব সরকার কিনছে। এদিকে আবার বার্মা মুলুক থেকে চাল আসা বন্ধ। জাপানিরা বার্মা দিয়ে ভাতবর্ষে ঢুকবে।’

২. [এটা গেল দুর্ভিক্ষের ‘ব্যাকগ্রাউন্ডের’ কথা। এবার হুমায়ূন দেখাবেন কী করে মজুদদারি শুরু হয়ে গেল সরকারি ক্রয়-অভিযানের আড়ালে]

‘এককড়ি হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছেন। কেরোসিনের সাশ্রয় করতে হবে।… আধো অন্ধকারে এককড়ি দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, চাল কিনা শুরু করো। দাম কিছু বেশি হলেও কিনবা। বড় নৌকা নিয়ে ভাটি অঞ্চলের দিকে যাও। সেখানে ধান-চাল দুইই সস্তা।’

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৬] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৬

পূর্ব প্রকাশের পর

এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছিল হাজারের এককে। তারপর মৃত্যু এত বেড়ে গেল- এই পরিসংখ্যানের প্রকাশ এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল। তবু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের টনক নড়েনি। বাংলার কৃষককে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করাই তার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। ‘চার্চিল’স সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থে সে কথা মধুশ্রী মুখার্জি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। বাংলার কৃষককূল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তার নীতির কারণে- এ কথা শোনার পর চার্চিল বলেছিলেন, ‘গান্ধী কি বেঁচে আছে এখনও? সে মারা যায় না কেন?’

তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের শিকার তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পেছনে চার্চিলের পরোক্ষ ভূমিকায় অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়বে। অনেকেই ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের’ সীমা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়বেন। এদের কারো কারো কাছে চার্চিল অবাধ পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের মানসপুত্রের মত। তার সুস্বাদু ইতিহাস রচনা (যার জন্য সাহিত্যে নোবেলও পেয়েছিলেন তিনি) অস্বীকার করার নয়। যেমন নয় যুদ্ধকালীন সময়ে ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনুপ্রাণিত ভাষণ ও নেতৃত্ব। যুদ্ধ জয়ের পর রক্ষণশীল সরকারের পতন হল এবং তিনি আর প্রধানমন্ত্রী রইলেন না। এতেও দুঃখ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার নয় যে, চার্চিলের মত ‘লিবারেল’ রাজনীতিকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অমানবিক নীতি প্রয়োগের ধারাবাহিকতা। ইংলন্ডকে বাঁচানোর জন্য তিনি ভারতবর্ষ বা অন্যান্য উপনিবেশকে দুর্ভিক্ষের গ্রাসে ফেলে দিতে দ্বিধা করেননি। যখন তিনি যুদ্ধোত্তরকালে একনাগাড়ে ছবি এঁকেছেন (এ কাজে দক্ষতা ছিল তার); একবারও আঁকেননি জয়নুলের মত কোন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি। সেসব নিরন্ন মানুষের চিৎকার তার স্বপ্নের মধ্যে কখনো শোনা যেত কি-না এ বিবরণ জানা যায় না। ইউরোপের জন্য এক নিয়ম, আর উপনিবেশের মানুষদের বিচার করার ক্ষেত্রে অন্য নিরম- পার্থ চ্যাটার্জী যাকে বলেছেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’- তা চার্চিলের দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড বিশ্নেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক হিসেবে, এটিকেও ‘সত্তার বিভক্তি’ বলা যায়, যা ইতিপূর্বে আরেক জন ‘লিবারেল’ চিন্তক জন স্টুয়ার্ট মিলের আলোচনায় আমরা দেখেছি।

মধুশ্রী মুখার্জীর কাজকে অস্বীকার করা উপায় নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন নোবেল পদার্থ বিজ্ঞানী ইউইসিরো নাম্বুর অধীনে। পরে ক্যালটেক থেকে পোস্ট-ডক্টরেট করে বিখ্যাত ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ সাময়িকীর অন্যতম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বিজ্ঞান-বিষয়ক সাংবাদিকতা ও বই লেখাই তার প্রধান অভিনিবেশ। প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ নন ঠিকই, তাই বলে তিনি দুর্ভিক্ষের অঙ্ক কষতে জানেন না, একথা বলা যাবে না। ২০০২ সালে ব্রিটেনবাসীদের মধ্যে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত জরিপে চার্চিল হয়েছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ ইংরেজ’। এহেন ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে গেলে সাহস ও দম উভয়ই থাকা চাই। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ভারত থেকে যখন প্রস্তাব গেল যে, বাংলাকে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করার জন্য মাসে অন্তত ৮০,০০০ টন খাদ্যশস্য জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা চাই; চার্চিল সেই অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছিলেন। এই তথ্য প্রাথমিক উপাত্ত ঘেঁটে মধুশ্রী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন তার বইয়ে। চার্চিলের এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন না ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারাও। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো যেমন মনে করেছিলেন যে, ‘খাদ্যশস্য আমদানি হতে যাচ্ছে বাংলায়’- শুধুমাত্র এই খবরটি ছড়িয়ে দিলেও ‘মজুতদারির প্রবণতা কমে যেত ও চালের দাম নেমে আসত।’ অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা খাদ্যশস্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল পণ্যবাহী জাহাজের স্বল্পতা নিয়ে। কেননা, জাহাজগুলোকে তখন ব্রিটিশ উপকূলের আশে-পাশে জড়ো করে রাখা হয়েছিল। মধুশ্রী বলেছেন যে, জাহাজের স্বল্পতার ‘টেকনিক্যাল আর্গুমেন্ট’ অনেকটাই কষ্ট কল্পিত। কেননা, ততদিনে মার্কিন প্রশাসন সাহায্য হিসেবে অনেক মালবাহী জাহাজ ব্রিটেনের কাছে স্থানান্তর করেছিল। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার খবরে এমনকি ইংরেজের শত্রুপক্ষে যুদ্ধরত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পর্যন্ত অধিকৃত বার্মা থেকে কিছু চাল বাংলাতে পাঠাতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সেন্সরশিপ সে তথ্যও পুরোপুরি চেপে যায়।

এবার আসি মূল্যস্ম্ফীতির প্রসঙ্গে। শুধু যে খাদ্য-সরবরাহে অপ্রতুলতার কারণে প্রতি মাসে মূল্যস্ম্ফীতির হার বাড়ছিল, তাই নয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সচেতনভাবে গৃহীত ম্যাক্রো-ইকোনমিক পদক্ষেপও। ২০১৮ সালের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ২০ অক্টোবর সংখ্যায় প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ ও জওহরলাল বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক ঊষা পাটনায়েক অভিযোগ করেছেন যে, বাংলার দুর্ভিক্ষ এমনিতেই হয়নি। বাংলায় দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থায়নের যোগাড়-যন্ত্র করা হয়েছিল। মানুষের ভোগের পরিমাণ কমিয়ে যুদ্ধের রসদ যোগানোর জন্য বিনিয়োগের তহবিল বাড়ানো হয়েছিল। এই ম্যাক্রো-ইকোনমিক যুক্তিটি এসেছিল অগ্রগণ্য অর্থনীতিবিদ কেইনসের লেখা থেকে। ‘ট্রিটিস অন মানি :দ্য এপ্লাইড থিওরি অব মানি’ (১৯৩০) এবং ‘হাউ টু পে ফর দ্য ওয়ার :এ রাডিকেল প্ল্যান ফর দ্য চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার’ (১৯৪০); এই দুটি লেখায় কেইনস এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কীভাবে জনগণের আয় (ভোগ) কমিয়ে তা থেকে উদ্বৃত্ত আহরণ করা যায় যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থায়নের জন্য, সেটা কেইনসের আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্রিটেনবাসীর ক্ষেত্রে এই মহৌষধির প্রয়োগ না করে তা ব্যবহার করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সাধারণ অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। বাংলার গ্রামাঞ্চলের নিরীহ জনগণের ভোগ কমিয়ে তাদেরকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ তুলে নিয়েছিল চার্চিলের ইংরেজ সরকার। মধুশ্রী মুখার্জীর বইটি ও ঊষা পাটনায়েকের লেখাটিকে আমরা এই অর্থে সম্পূরক রচনা হিসেবে পাঠ করতে পারি।

মুখার্জী ও পাটনায়েকের লেখার মুখ্য প্রতিপাদ্যের সাথে অমর্ত্য সেন অপরিচিত নন। তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি সাতটি কারণের কথা বলেছেন। তার মধ্যে একটি কারণ ছিল চার্চিলের নিস্পৃহতাও। যেমন, তিনি বলছেন, ‘The refusal of the British Government to permit move food imports into India throngh reallocation of shipping as an emergency measure to tackle the famine was severely criticized. Lord wavell, who became the new Viceroy at the last stage of the famine and who had to battle hard for increasing food imports into India, went on record in this context that he felt that ‘the vital problems of India are being treated by his Majesty’s Government with neglect, even sometimes with hostility and contempt’- এই শেষোক্ত উদ্ৃব্দতিটির উৎস হচ্ছে লর্ড ওয়াভেলের চিঠি, ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবরে লেখা উইনস্টন চার্চিলকে উদ্দেশ করে। অন্যদিকে, ঊষা পাটনায়েকের যুক্তি- ‘ইচ্ছে করে মূল্যস্ম্ফীতি ঘটানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহের জন্য’- সেটিও পরোক্ষভাবে অমর্ত্য সেনের চোখে পড়েছিল। তিনি লিখছেন ::’The 1943 famine can indeed be described as a ‘boom famine’ related to powerful inflationary pressures initiated by public expenditure expansion’. তবে সব কার্যকারণের মধ্যে সেনের প্রধান গুরুত্ব এসে পড়েছিল ‘বীপযধহমব বহঃরঃষবসবহঃ’র দ্রুত অবনতির ওপরে- সামগ্রিকভাবে খাদ্যের যোগানের সাংবৎসরিক বাড়া-কমার ওপরে নয়। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রাম-বাংলা, বিশেষত মজুরি-শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল কৃষি শ্রমিক ও অসচ্ছল প্রান্তিক জোতের পরিবারেরা। এখানে সেনের মূল তর্কটা দুর্ভিক্ষের Causality বা বা মূল কার্যকারণসূত্র নিয়ে যখন দুর্ভিক্ষবিরোধী ‘পলিসির’ প্রসঙ্গ এসেছে তখন তিনিও খাদ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি, ফুড রেশনিং ব্যবস্থা, পাবলিক ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, খাদ্যশস্যের মূল্য-পরিস্থিতিকে সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আনা ইত্যাদি ‘সাপ্লাই-সাইড’ কর্মসূচির ওপরে জোর দিয়েছেন তার বইতে যথাযথভাবেই। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে শুধু সরকারি প্রশাসক, ইতিহাসবিদ, পরিসংখ্যানবিদ বা অর্থনীতিবিদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট নয়। সমসাময়িক সাহিত্য-কর্মের মধ্য দিয়ে এই দুর্ভিক্ষের চালচিত্র বিশ্বস্ততার সাথে ফুটে উঠেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ মন্ব্বন্তরের প্রাক-কথন থেকে এর ট্র্যাজিক পরিণতি অবধি পাত্র-পাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করেছিল। জাপানি আক্রমণের মুখে ১৯৪২ সালের মে মাসে ইংরেজরা বার্মা থেকে যখন পিছু হটল, তখন বার্মা থেকে চাল আমদানিও আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে দুর্গাপণ্ডিত আর গঙ্গাচরণের মধ্যে কথা হচ্ছে :

“- জাপানিরা সিঙ্গাপুর নিয়ে নিয়েছে? যুদ্ধের খবর কী?

– শুধু সিঙ্গাপুর কেন, ব্রহ্মদেশও নিয়ে নিয়েচে। জানো না সে খবর?

– না-ইয়ে-শুনি নি তো? ব্রহ্মদেশ? সে তো-

– যেখান থেকে রেঙ্গুন চাল আসে রে ভায়া। ওই যে সস্তা, মোটা মোটা আলো চাল …”

যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের জন্য খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে চাল কেনার ধারা তো পূর্বাপর ছিলই, জাপানি আক্রমণের মুখে এই কেনার গতিবেগ আরো বেড়ে গেল। কোনভাবেই যেন জাপানিদের কাছে চালের বাজার না চলে যায় সে জন্যে ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরকে চাল কেনার অনুমতি দেয়। চাল বিক্রি করতে না চাইলে জবরদস্তিও হচ্ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে। এর ফলে কিছুটা অবস্থাপন্ন মানুষ যারা টাকা দিয়ে চাল কেনার সামর্থ্য রাখে, তারাও হাটে-দোকানে গিয়ে চাল পায়নি। যারা আরো অবস্থাপন্ন তাদর কাছে চাল থাকলেও চালের দাম আরো বাড়তে পারে- এই আশঙ্কায় তারাও চালের সংগ্রহ লুকিয়ে ফেলেছিল। এতে করে গঙ্গাচরণের মত ক্রয়-নির্ভর পরিবারদের অনাহারে-উপবাসের ঝুঁকিতে দিন কাটাতে হয়েছিল। বিভূতিভূষণ লিখছেন একের পর এক ঘনায়মান দুর্যোগের দৃশ্য :

১. ‘অনঙ্গ-বৌ বললে- আর দুটো ভাত মেখে নাও, ডাল দিয়ে পেট ভরে খাও-
-এ চাল দুটো ছিল বুঝি আগের দরুণ?
-হুঁ।
-কাল হবে?
-কাল হবে না। সকালে উঠেই চাল যোগাড় করো। রাতটা টেনেটুনে হয়ে গেল।
-সেই বিশ্বাস মশায়ের দরুণ ধানের চাল?
-হুঁ।

অনঙ্গ-বৌ স্বামী-পুত্রকে পেট ভরে খাইয়ে সে-রাতে এক ঘটি জল আর একটু গুড় খেয়ে উপোস করে রইলো।’

২. [পরের দিন গঙ্গাচরণ গেছে চালের খোঁজে। এক জায়গায় দেখল চাল বিক্রি হচ্ছে। একটু ক্ষণ আগেই গঙ্গাচরণ এক জেলে নবীন পাড়ূইকে বলেছে, ‘কখনো কি কেউ শুনেচে যে চালের মণ ষোল টাকা হবে।’ অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, এরই মধ্যে চালের দাম বেড়ে ‘কুড়ি টাকা মণ’ হয়ে গেছে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৫] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৫

পূর্ব প্রকাশের পর

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের প্রসঙ্গ যেভাবে সমসাময়িক কথা-সাহিত্যে প্রায়-অনুপস্থিত, ১৮৬০-১৯০০ সাল অবধি বাংলার চরম খাদ্যাভাব, মৌসুমী ক্ষুধা ও সময় সময় প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি নিয়ে অনুরূপ নীরবতা দৃশ্যমান। সমসাময়িক পত্র-সাহিত্যেও ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তিরিশ পেরুনো রবীন্দ্রনাথ যখন অবিস্মরণীয় ‘ছিন্নপত্র’ লিখছেন তার মধ্যে বাংলার মায়াময় প্রকৃতির ছবি ফুটে ওঠে, ক্ষুধা ও অনাহারের বিস্তৃতি কোথাও দেখি না। কিন্তু সম-সাময়িক পত্রিকা-সাময়িকী- বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশিত বাংলার নানা পত্র-পত্রিকা- নিজেদের সাধ্যমত দুর্ভিক্ষের আশংকার কথা জোরে-সোরে তুলে ধরেছে। তাতে প্রেরণা এসেছে নানা সূত্র থেকে। ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ উপন্যাসটির উদাহরণ এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত দাস-প্রথা বিরোধী এই উপন্যাসটি পঞ্চাশের দশকের প্রাগ্রসর বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট-র বরাত দিয়ে নরহরি কবিরাজ জানাচ্ছেন যে, এরা মনে করতেন আমেরিকার দাসদের মতই মানবেতর জীবনের পর্যায়ে নেমে গেছে বাংলার চাষীদের জীবন। এরা তাই ঠিক করলেন যে, ‘বাংলার রায়তদের সামাজিক অবস্থা’ নিয়ে রচনা-প্রতিযোগিতার আয়োজন করবেন। এতে যিনি সেরা রচনাটি লিখবেন তিনি পাবেন পাঁচশত টাকা পুরস্কার। এর বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন সেকালের উদারনৈতিক তিন ব্যক্তিত্ব : ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিশোরী চাঁদ মিত্র এবং রেভারেন্ড জেমস লং’। ১৮৫৫ সালে প্যাট্রিয়ট আরো আশা করেছিল যে, রায়তদের অবস্থা নিয়ে ‘যদি কোন উপন্যাস অদূর ভবিষ্যতে লিখিত হয়, সে লেখার মান ডিকেন্স অবধি না গড়ালেও’ তা একটি বড় কাজ হবে এবং এর মধ্য দিয়ে জমিদারী ব্যবস্থার সাথে চলতে থাকা ‘নানা জঘন্য কাজ জনসাধারণ্যে পৌঁছাবে।’ নীলদর্পণ বা জমিদার-দর্পণ-এর মধ্য দিয়ে প্যাট্রিয়ট-এর সেই আশা সেভাবে পূর্ণ হয়নি।

১৮৭০ দশকের উপোসি বাংলার দুঃখ-দুর্দশা ১৮৮০-৯০ দশক জুড়েই অব্যাহত ছিল। ১৮৯২ সালের ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ গ্রন্থে ভূদেব মুখোপাধ্যায় পরিসংখ্যান-সারণী ব্যবহার করে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়ে ভূদের যতটাই প্রাচীনপন্থী ছিলেন, অর্থনৈতিক বিষয়ে তিনি ছিলেন ততটাই আধুনিক-পন্থী। যারা তার ‘আর্থিক অবস্থা বিষয়ক’ ভবিষ্যবিচার পড়বেন, তারাই বিস্মিত হবেন তার অর্থনৈতিক চিন্তার প্রাজ্ঞতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় পেয়ে। ভূদেবের চিন্তার এই দিকটি পৃথক অভিনিবেশের দাবী রাখে। আপাতত, এটা দেখানো জরুরী যে, ১৮৯০ দশকের পটভূমিতে- অর্থাৎ উনিশ শতক যখন শেষ হয়ে আসছে- ভূদেব দুর্ভিক্ষ বিষয়ে কী বলছেন :

‘পণ্ডিতেরা গণনা করিয়াছেন যে, ৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষে পর্যাপ্ত অন্ন দুই সন্ধ্যা জুটে না! কেহ কেহ বলিয়াছেন যে, অনাহার, অল্পাহার এবং কদাহার দোষে ভারতবাসী ক্ষীণবীর্য্য এবং স্বল্পায়ু হইতেছে। একপ্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগার বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এবং তাহার পরেই একটী করিয়া মহামারী আসিয়া উপস্থিত হয়। তদ্ভিন্ন, স্থানে স্থানে অন্নকষ্ট এবং মারীভয় প্রায় প্রতিবর্ষেই দৃষ্ট হইয়া থাকে। প্রভূত ধনশালী ইউরোপের কথা ছাড়িয়া দিলেও পৃথিবীর অপর কোন দেশের অবস্থা এরূপ হইয়াছে বলিয়া শুনা যায় না।’

ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতকে হাল্ক্কা করে দেখার উপায় নেই। তার ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ প্রকাশের পর এশিয়াটিক সোসাইটির আলোচনা সভায় স্যার চার্লস এলিয়ট এরকম মন্তব্য করেছিলেন যে, ভূদেবের মত ‘এত বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ভারতে আর কেউ নেই।’ এ কথা ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী তার ‘ইউরোপ পুনর্দর্শন’ গ্রন্থে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

উপোসি বাংলা বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকার উদাহরণ টেনে আমি এ পর্যন্ত দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, উনিশ শতকের বাংলার বৃহত্তর গ্রামীণ কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী তথা রায়তদের মধ্যে ক্ষুধার ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছিল। এর প্রভাব থেকে অপেক্ষাকৃত খাদ্যে-উদ্বৃত্ত জেলাগুলোও বাদ ছিল না। পূর্ব বঙ্গের নানা জেলাতেই কখনো বন্যার কারণে, কখনো অনাবৃষ্টির কারণে ফসল হানি হয়েছে, কিন্তু জমিদারের শোষণের মাত্র কমে নি- ১৮৫৯ সালের বর্গা-স্বত্ব আইনের সংস্কার প্রচেষ্টার পরেও। গ্রামাঞ্চলে রায়তী অধিকারবিহীন (যাদেরকে টহফবৎ-জুড়ঃ বলা হয়েছে) এক নিম্নতম বর্গের সৃষ্টি হয়েছিল, যারা নেমে গিয়েছিল দারিদ্র্য-সীমার অনেক নীচে, দারিদ্র্য আর ক্ষুধার মধ্যবর্তী পর্যায়ে। এরাই ছিল উনিশ শতকের বাংলার প্রান্তিক মানুষ। ফসলহানির বছরে এরাই চলে যেত দুর্ভিক্ষাবস্থায় বা রইত দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। আমি মাঝে মাঝে সন্দেহ করি যে এক নীরব ক্ষুধা-অনাহারের বেদনা মিশে আছে উনিশ শতকীয় বাংলার ‘বাউলা’ গানে-কবিতায়। এই পৃথিবীবিমুখতা, জগৎ-সংসার ছেড়ে অচিনপুরের চিন্তা, এর পেছনে হয়ত গ্রামের নিম্নতম বর্গের সামাজিক-অর্থনৈতিক কষ্ট-বঞ্চনার অগ্রন্থিত অভিজ্ঞতা কাজ করে থাকবে। অথবা, গ্রাম-বাংলার বুক থেকে উঠে আসা এই বেদনার্ত লোকজ গানগুলো ছিল ক্ষুধাপীড়িত গ্রামীণ জন-জীবনেরই শুদ্ধতম শিল্পরূপ। এ নিয়ে বারান্তরে আলোচনা করা যাবে।

৫. পঞ্চাশের মন্বন্তর

এলা সেনের ছোটগল্প সংকলন ‘ডার্কেনিং ডেইস’ (উধৎশবহরহম উধুং) বেরিয়েছিল ১৯৪৪ সালের মে মাসে। ইংরেজিতে লেখা নয়টি গল্প ছিল তাতে। বইটির দুটি বিশেষত্ব প্রথমেই চোখে পড়বে। প্রথমত, গল্পগুলো লেখা ‘নারীর দৃষ্টিকোণ’ থেকে। কথাটা আজকের দিনে আর তেমন নতুন মনে হবে না। কিন্তু গ্রন্থ রচনার কাল ১৯৪৩-৪৪ সালে সেটা মনে রাখলে কিছুটা বিস্মিত হতেই হয়। গ্রন্থকার বলছেন : ্তুঃযরং নড়ড়শ রং ধফসরঃঃবফষু ৎিরঃঃবহ ভৎড়স ধ ড়িসধহ্থং ঢ়ড়রহঃ ড়ভ ারব,ি রভ ড়হ :যরং ধপপড়ঁহঃ ড়াবৎ-বসঢ়যধংরং রং ষধরফ ড়হ :যব ারপরংংরঃঁফবং ড়ভ ড়িসবহ ফঁৎরহম :যব ফৎবধফভঁষ ফধুং ড়ভ ষধংঃ ুবধৎ রঃ রং হড়ঃ ভড়ৎ ধিহঃ ড়ভ ধঢ়ঢ়ৎবপরধঃরড়হ ড়ভ :যব ংঁভভবৎরহমং ড়ভ সবহ্থ ইংরেজি ১৯৪৩ সালের (বাংলায় যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত) এক বছর বাদে প্রকাশিত বইটির ভূমিকার লেখিকা বলছেন : ‘দুর্ভিক্ষ এখনও কেটে যায়নি।… মহামারী এখন গ্রামের পর গ্রামে মাথা তুলছে এবং এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে চিকিৎসা সাহায্য পৌঁছায়নি। অধিকাংশই বোঝে না পুনর্বাসনের মানে কী… উটপাখির মতো মাথা গুঁজে বসে থাকলে সমাধান মিলবে না… এই বইতে আমি বলার চেষ্টা করেছি যে বড় আকারের ত্রাণ তৎপরতা হাতে নেওয়া প্রয়োজন, যদি বাংলাকে পুনর্জীবিত করতে হয়।… সরকার কি করবে বা করবে না, বা করতে পারবে না, তার জন্য বসে না থেকে অ-সরকারি ত্রাণকার্য চালিয়ে যেতে হবে।… লক্ষ্মী, যূথিকা বা সুখীর দুঃখ-যন্ত্রণাকে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।’

এলা সেনের বইটির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জয়নুল আবেদিন। দুর্ভিক্ষের যে-চিত্রকর্মগুলোর জন্য তরুণ জয়নুল (তার তখন উনত্রিশ বছর বয়স) রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সেই ছবিগুলো দিয়ে সাজানো বইটি। হলদে কাগজের ওপরে কালো (চাইনিজ ইংক) কালিতে আঁকা সেসব, প্রতিটিতে ১৯৪৩ সালের উল্লেখ রয়েছে। এলা সেন বইয়ের পরিচিতিপত্রে যোগ করেছেন, ‘উইথ ড্রইং ফ্রম লাইফ বাই জয়নুল আবেদিন’। তেরোটি ছবি, এদের বেশিরভাগই এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। আমার জানা মতে, এলা সেনের বইটিতে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো প্রথম প্রকাশিত হয়। কী করে জয়নুলের সঙ্গে এলা সেনের যোগাযোগ হলো সেটাও আমাদের আগ্রহ জাগায়। কে ছিলেন এই এলা সেন?

এলা সেনের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল সুশীল গুপ্ত’র প্রকাশনালয় দ্বারা। তার মেয়ে লীলা দাস গুপ্ত জানাচ্ছেন, “এলা সেন ছিলেন সাংবাদিক। তার স্বামী আলেক রেইড কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় কাজ করতেন। খুশওয়ান্ত সিং-এর ‘সাহিবস্‌ হু লাভড্‌ ইন্ডিয়া’ বইটিতে আলেক রেইডের উল্লেখ আছে।” পরবর্তীতে এলা সেন ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরার প্রথম জীবনীকার ছিলেন তিনিই। নারী অধিকার কর্মী ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মনিকুন্তলা সেনের বরাত দিয়ে ‘ক্যালকাটা : দ্য স্টর্মি ডেকেডস্‌’ গ্রন্থে ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার জানাচ্ছেন যে, এলা সেনের কলকাতার বাসায় বামধারার ও প্রগতিশীল মতের নারীরা প্রায়ই মিলিত হতেন। তরুণ জয়নুল আবেদিনও প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এ সময়ে। মকবুল ফিদা হুসেন ও সৈয়দ হাশিম রাজার মতো শিল্পীরা যেমন করে উন্মেষ পর্বেই প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, জয়নুলও তেমনিভাবে প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই আন্দোলন ও গোষ্ঠী গড়ে তোলার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল। পার্টির প্রেরণাতেই জয়নুল কলম-তুলি ধরেছিলেন দুর্ভিক্ষের ডকু-বিবরণী রঙে-রেখায় প্রকাশের জন্য। এ কাজে তিনি অবশ্য একা ছিলেন না। তার সঙ্গে ছিলেন শোভা সিং, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর প্রমুখ শিল্পী। এন্ড্রু হোয়াইটহেড মন্তব্য করেছেন, ‘স্পষ্টতই জয়নুল ছিলেন বামধারার পক্ষে’। পরবর্তীতে এই ‘বামপন্থি’ জয়নুল আবেদিন ‘বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার জনক হয়ে ওঠেন’।

কিন্তু এলা সেনের বইটি গল্পগ্রন্থ হলেও সেখানে একটা পরিশিষ্ট ছিল, যাতে পঞ্চাশের মন্বন্তর সম্পর্কে চলতি তথ্যের বিরল বিচার বিশ্নেষণ চিহ্নিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনথ্রোপলজি বিভাগের দ্বারা পরিচালিত জরিপের উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে : ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে মহামারীতে ‘স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পঁয়ত্রিশ লাখের বেশি।’ (ঃযব ঢ়ৎড়নধনষব :ড়ঃধষ হঁসনবৎ ড়ভ ফবধঃযং ধনড়াব :যব হড়ৎসধষ পড়সবং :ড় বিষষ ড়াবৎ :যৎবব ধহফ ধ যধষভ সরষষড়হং)। ১৯৪৩ সালের মুভমেন্টে মৃত্যুর সংখ্যা ১৯ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। পরিসংখ্যানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যই বোধকরি দুই মিলিয়ন নয়, একেবারে গুণে গুণে ১.৯ মিলিয়নের মৃত্যু সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বে উল্লিখিত জরিপের মতে, ‘এই মৃত্যুর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। অমর্ত্য সেনের মতোই লেখিকা এখানে যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, খাদ্যের উৎপাদনে স্বল্পতা নয়, খাদ্যের বণ্টনে বৈষম্য ও অব্যবস্থার কারণেই এই দুর্ভিক্ষ হয়েছে। আমেরিকার ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে জানানো হয় যে, ‘প্রকৃত পক্ষে [১৯৪৩ সালে] ভারতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৯৪২ অথবা ১৯৪১ সালের চেয়েও বেশি হয়েছিল। স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও ঘাটতি অনুভূত হলেও সেটা বড় কারণ ছিল না। মূল কারণ ছিল দুটো। একটি হচ্ছে কেন্দ্রের ব্রিটিশ সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে দায়িত্বশীল সম্পর্কের আংশিক ভেঙ্গে-পড়া। আরেকটি হচ্ছে, (প্রবল) মূল্যস্ম্ফীতি।’

সম্প্রতিকালে দুটো প্রকাশনা পঞ্চাশের মন্বন্তরের কার্যকারণের ব্যাখ্যায় উল্লেখযোগ্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মধুশ্রী মুখার্জি তার দীর্ঘকালের গবেষণা দিয়ে দেখিয়েছেন যে, জাপানি আক্রমণের ঝুঁকির মুখে ব্রিটিশ সরকার বাংলার সব উদ্বৃত্ত চাল মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের জন্য মজুদ করে রেখেছিল। তার ওপরে যাতে করে কোনো চাল বাজার-ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্য কারও হাতে চলে না যায় বা বাংলার বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি অধিকৃত অঞ্চলে চলে না যায় সে জন্য পূর্ববঙ্গের থেকে চাল রফতানিতে ব্যবহূত পণ্যবাহী ছোট ছোট নৌযানগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। সমগ্র ১৯৪৩ সাল জুড়েই কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় তিনটি পরিসংখ্যান বড় করে প্রকাশ করত- ‘গতকাল মৃত্যুর সংখ্যা’, ‘গত সপ্তাহের মৃত্যুর সংখ্যা’ এবং ‘গত মাসের মৃত্যুর সংখ্যা’।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল