নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে। নিজের ক্রিয়াকলাপের কর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করতে পারে। সে ইতিহাস কখনোই পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাসের সামগ্রিকতা অর্জন করতে পারবে না। নিম্নবর্গ কখনোই গোটা সমাজের হয়ে কথা বলতে পারবে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস তাই অনিবার্যভাবে আংশিক, অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ। … আসলে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসচর্চার মহলে যে-ভূমিকায় ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল, সেটা হয় এক ধরনের র্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাস কিংবা ‘হিস্ট্রি ফ্রম বিলো’– তল থেকে দেখা ইতিহাস। সত্তর-আশির দশকে ইউরোপে এই ধরনের ইতিহাস লেখার খুব চল হয়েছিল। ক্রিস্টোফার হিল, এডওয়ার্ড টমসন, এরিক হব্সবম প্রভৃতি ইংরেজ মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকের ধারা অনুসরণ করে অনেকেই তখন ইউরোপের পুঁজিবাদ আর যন্ত্রসভ্যতার অগ্রগতির ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যাওয়া বিস্মৃত, অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও তাদের ভিন্নতর জীবনযাত্রার কথা লিখছিলেন। এই ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’ প্রধানত ইতিহাস রচনায় বাদ পড়ে যাওয়া অনেক ঘটনা, মতাদর্শ, স্মৃতি খুঁজে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। … ‘সাবল্টার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকরাও যে ইউরোপের র্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাসের কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ তফাত ছিল। … ভারতবর্ষের মতো দেশের ক্ষেত্রে ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসকে কিন্তু এ রকম কোনো ছকের ভেতরে বেঁধে রাখা কঠিন ছিল। ভারতে পুঁজিবাদী আধুনিকতার বিবর্তনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে গল্পের শেষটা অত নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়নি। বিশ্বের অন্যত্র যা ঘটেছে, ভারতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এই ফর্মুলাটা যদি মাথায় চেপে বসে না থাকে, তাহলে ‘তল থেকে দেখা’ ভারতীয় ইতিহাসের লেখক সহজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর গবেষণার উপাদান থেকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক মৌলিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ খোলা রয়েছে। … লিবারেল জাতীয়তাবাদ এবং মার্ক্সবাদ– দুই ধরনের ইতিহাস রচনার প্রতিষ্ঠিত ছক সম্বন্ধেই ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকদের মনে সংশয় ছিল। র্যাডিক্যাল সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় নেমে তাঁরা তাঁদের বর্ণনাকে কোনো নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরিণতি আধুনিক সমাজের কোনো নির্দিষ্ট ও পরিচিত ধারণার বাস্তবায়ন, এই কাহিনিসূত্রটি তাঁরা বারবারই অস্বীকার করতে লাগলেন তাঁদের লেখায়। তাই ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাস হিসেবেও ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর লেখা বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে রইল ইতিহাসচর্চার মহলে।” ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’ (History from Below) এবং ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ (Subaltern History) এই দুই ধারার মধ্যে তাহলে দেখা যাচ্ছে কিছু পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, এ দুইয়ের মধ্যে রয়ে গেছে পটভূমিগত (Context) পার্থক্য। ‘তল দেখা ইতিহাস’ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল ইউরোপীয় বা উত্তর-আমেরিকার ‘আধুনিক’ অভিজ্ঞতার ওপরে। নিম্নবর্গের ইতিহাসের বিষয় হচ্ছে উপনিবেশ, আধা-উপনিবেশ ও উপনিবেশ-উত্তর অভিজ্ঞতা। একের অভিজ্ঞতা অন্যের সাথে মেলার কথা নয়: একটি যদি হয় সরলরেখা, অন্যটি তাহলে বক্ররেখা (crooked line)। ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো আমাদেরকে মৌলিকভাবে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করায়, যার সাথে ইউরোপ-আমেরিকার অভিজ্ঞতার কোনো তুলনাই হয় না। সেজন্যই কাছাকাছি শোনালেও ‘নিম্নবর্গের’ ইতিহাসচর্চা ও ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসচর্চা ধারণাগতভাবে ভিন্ন হতে বাধ্য। এ দুই ধারার ইতিহাসচর্চার মধ্যে দ্বিতীয় পার্থক্য অভিনিবেশের বিষয়বস্তুর মধ্যে। ‘তল থেকে দেখা’ ও ‘মার্ক্সবাদী’ ইতিহাসচর্চা উভয়েরই মূল ঝোঁকটা শ্রেণিগত বিশ্লেষণের দিকে। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা শুধু শ্রেণি নয়, তার নজর পড়ে অন্যান্য শোষণ-বঞ্চনার প্রতিও। নারীদের একান্ত নিজস্ব সংগ্রাম নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনকি যখন পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা যুদ্ধ করেছে তখনও তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর তুলে আনার আলাদা গুরুত্ব শেষ হয়ে যায় না। অধস্তনতার বেদনাকে যেমন আঁকতে হবে, তেমনি তুলে আনতে হবে তার স্ব-নিয়ন্ত্রণপ্রয়াসী (Agency) আচরণ। সেটা শুধু সুলতানা রাজিয়া বা ঝাঁসির রানীর ক্ষেত্রে নয়, ‘অশনি সংকেত’-এর অনঙ্গ-বৌ বা ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র জয়গুনের ক্ষেত্রেও। ‘ইতিহাসের ক্ষুদ্র আওয়াজ’ (The Small Voice of History) প্রবন্ধে রণজিৎ গুহ বলেছেন যে পূর্বের ঐতিহাসিক বিবরণীগুলো যেমন ছিল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক (statist), তেমনি ছিল পুরুষকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব, পার্টি, সংগঠন শব্দগুলোই ছিল বড় বেশি পুরুষঘেঁষা। এসব গল্পে নারীদের কোনো স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর ছিল না। নারীরা ছিল নিষ্ক্রিয় কর্তা, উদ্যমহীন ও ইতিহাসের বাসযাত্রায় চালকের আসন থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে বসা নীরব যাত্রীদের মতো। নিম্নবর্গের ইতিহাস এভাবে নিষ্ক্রিয়ভাবে নারীকে দেখবে না। রণজিৎ গুহ লিখেছেন : “In a new historical account this metaphysical view will clash with the idea that women were agents rather than instruments of the movement which was itself constituted by their participation. This will inevitably destroy the image of women as passive beneficiaries of a struggle for ‘equal rights’ waged by others on their behalf.” নারীদের ‘মুক্ত করতে গিয়ে’ নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক অপরাপর অধস্তন ও শোষিত ‘অপর জনগোষ্ঠীদের’ প্রতিও নজর দেবেন। এর মধ্যে প্রথমেই চলে আসে ‘নীচু জাত ও সম্প্রদায়ের’ প্রসঙ্গ। ভারতবর্ষে এই জাতপাতের ফারাক এখনও তীব্র ও সজীব; ইতিহাসে এই ফারাক আরও বেশি তীব্র ও জীবন্ত। এমনকি ‘আধুনিক’ ভোটযুদ্ধ ও নির্বাচনী ইতিহাসে উঁচু জাত বনাম নীচু জাতের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক মেরূকরণ কোনো শ্রেণি আলোচনা থেকে কম চিত্তাকর্ষক নয়। এরই সাথে যুক্ত করতে হয় স্বজাতি-ভিন্ন জাতি ব্যবধানের কথা। এককথায়, প্রতিটি বর্ণেরই নিজস্ব ব্যর্থতা ও উত্থানের কাহিনি রচনা করবে নিম্নবর্গের ইতিহাস। সব শেষে বলতে হবে আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, চেহারা-সুরতে ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংগ্রামের কথা। সংখ্যায় ক্ষুদ্র বলেই তাদেরকে আমাদের চোখে পড়ে না। প্রায় অদৃশ্য, পাহাড়ে-জঙ্গলে থাকা, আদিবাসী নৃগোষ্ঠীকে তো একেবারেই চোখে পড়ে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস এই শেষোক্ত জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষভাবে আলো ফেলবে। রণজিৎ গুহ লিখেছেন : “I feel that women’s voice, once it is heard, will activate and make audible the other small voices as well … I want historiography to push the logic of its revision to a point where the very idea of instrumentality, the last refuge of elitism, will be interrogated and re-assessed not only with regard to women but all participants.” বর্ণ, জাত বা নারী এসব সামাজিক বর্গের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার অর্থ এই নয় যে ‘শ্রেণি’ বিষয়টি নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। পার্থক্য এই যে, মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের চর্চায় শ্রেণির প্রতি যেমন একটা কেন্দ্রীয় মনোযোগ থাকে, সেরকমটা সাব–অল্টার্ন স্টাডিজের বেলায় নয়। তারা বরং উৎসাহী শ্রেণি/বর্ণ, শ্রেণি/জাত, শ্রেণি/নারী এই যুগলের মধ্যে আড়াআড়ি বিভক্তি (intersectionality)-কে ধরার জন্য। যেমন, ডোম সম্প্রদায় অর্থনৈতিক বিচারেও ‘দীনের হতে দীন’; সামাজিক বিচারেও ‘সবার অধম’; প্রকৃতপক্ষে সামাজিক কলঙ্কচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হয় তাদের সারাজীবন। কোন ধর্মীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতিকে ‘অশুচি’ বা অপবিত্র জ্ঞান করা হয় ‘ভদ্রসমাজে’। তদুপরি তাদেরকে গণ্য করা হয় (বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্ণনায়) অপরাধপ্রবণ উপজাতি বা ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ হিসেবে। অনেকটা ইউরোপের রোমা ‘জিপসি’ সম্প্রদায়ের মতো। এই ইন্টারসেকশনালিটিকে রণজিৎ গুহ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্বের বরাত দিয়ে : ‘ডোম জন্মায় অড়হর খেতে, ছোটবেলা থেকেই সে চুরি করতে শেখে। জীবনের প্রথম থেকেই সে পতিতের মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার ওপর ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে, থাকে না পরের দিনের অন্নের কোনো সংস্থান। পুলিশের তাড়নায় জীবনভর সে পালিয়ে বেড়ায় এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে। গ্রাম থেকে সে সদাই বহিষ্কৃত। … সে আছে হিন্দু ধর্মের নাগালের বাইরে। … সভ্যতার অগ্রগতি তাকে শুধু আরও অবনমনের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।’ উপরের বর্ণনায় আমরা ‘ইন্টারসেকশনালিটির’ প্রায় সবগুলো উপাদান পাই। এই অচ্ছুৎ মানুষদের ‘প্রান্তিকতাকে’ শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণিগত অবস্থান বিচার করে সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। এই কথাটা নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা জোরেশোরে বলবেন। দীপেশ চক্রবর্তীর প্রথম বই ‘রিথিংকিং ওয়ার্কিং ক্লাস হিস্ট্রি’-কে ইন্টারসেকশনালিটি ধারণার একটি আদি-প্রয়োগ হিসেবে দেখা চলে। শ্রমিক হলেই তা সবচেয়ে ‘প্রগতিশীল’ শ্রেণি এই ধারণা মার্ক্সীয় ধারায় একটি প্রগাঢ় বিশ্বাস হিসেবে কাজ করে আসছে। তাই যদি হবে তাহলে শ্রমিক এলাকায় সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত দাঙ্গা বাধে কী করে? মার্ক্সবাদীরা এ ক্ষেত্রে ‘ক্লাস-ফর-ইটসেলফ’ (সক্রিয় শ্রেণি) বনাম ‘ক্লাস-ইন-ইটসেলফ’ (নিষ্ক্রিয় শ্রেণি) বলে এই ধাঁধার মীমাংসা করার চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তাতে করে শ্রেণির মধ্যে ধর্মভেদ ও জাতপাতের সমস্যার সুরাহা হয় না। শিল্প-শ্রমিক শ্রেণি অন্যের শৃঙ্খল মোচন করতে এগিয়ে আসেনি, এমনকি নিজের শৃঙ্খলও মোচন করেনি– কিছু স্মরণীয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে। অর্থাৎ, সামাজিক মুক্তির বৃহত্তর পরিসরে ‘প্রলেতারিয়েত’ একটি বিমূর্ত রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে থেকে গেছে। এককথায়, নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক শ্রমিক শ্রেণি সম্পর্কে পূর্বানুমানভিত্তিক কোনো মহিমান্বিত ধারণা অনুসরণ করে অগ্রসর হবেন না। এটা শুধু শ্রমিক শ্রেণি নয়, সব অর্থনৈতিক শ্রেণির সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন, মার্ক্সবাদী সাহিত্যের একটি প্রধান প্রবণতা ছিল কৃষক জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক শ্রেণির তুলনায় তুলনামূলক কম প্রগতিশীল বা অনগ্রসর সামাজিক শ্রেণি হিসেবে ভাবা। চীন-ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার পরে এই প্রবণতা এখন কমে এসেছে, কিন্তু তার পরও আমাদের দেশে বিভিন্ন বাম দলের দলিলে-ঘোষণাপত্রে ‘মধ্যকৃষক হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র’ ধরনের আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষকদের দোষ যে কৃষক সর্বহারা নয়; জমির প্রতি তার ক্ষুধা পূর্বাপর– এমনকি ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। এককথায়, কৃষককে ঠিক বিশ্বাস করা চলে না জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে। অথচ আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা গেছে যে, কৃষকরাও শ্রমিকের চাইতে কম যায়নি আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে। ১৯৫২ সালের ছাত্র-আন্দোলনের ছাত্ররা ছিল কৃষকেরই সন্তান; ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাধারণ মুক্তিসেনাদের অধিকাংশই ছিল গাঁওগেরামের কৃষক। ১৯৬৯ সালে আয়ুবশাহির পতনের পেছনে যেমন ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টের শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল চল্লিশের শেষার্ধে কৃষক-আদিবাসীদের তেভাগা-টংক-নানকার আন্দোলন; যা সাতচল্লিশের পর মুসলিম লীগ সরকারের ভিত কিছুটা হলেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কোন শ্রেণি কখন বিদ্রোহ করবে বা আন্দোলন-সংগ্রামে শামিল হবে, সেটা আগে থেকে বলে দেওয়ার মতো গল্প অনুসারে পরিচালিত হয় না। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের বিদ্রোহ তো শুধু শ্রেণি-কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করাই যায় না– এ কথা নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা বলবেন। এর চেয়েও বড় কথা, কোনো একটি আন্দোলনের নাম বা ব্যানার, তার আপাত রাজনৈতিক আদর্শ বা সংগঠনের পরিচিতি যা-ই হোক না কেন, তাতে অংশগ্রহণকারী সবাই একই আদর্শ বা সংগঠনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সমবেত হন না। অংশগ্রহণকারী সবারই যার যার নিজস্ব কারণ থাকে– সেটা ব্যানার বা সংগঠনের আদর্শের সাথে মিলতেও পারে, না-ও পারে। এই যার যার ‘নিজস্ব কারণ’ বের করার দায়িত্ব নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের। একটি উদাহরণ দেব এ সূত্রে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনে নানা শ্রেণির মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন। স্বৈরাচার-বিরোধিতা ছিল প্রকাশ্য রাজনৈতিক আদর্শ– ব্যানারে ব্যানারে সে কথাই লেখা ছিল। সেসময় পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আমরা কি হলফ করে জানি যে নূর হোসেন সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্যই সেদিন সেই মিছিলে গিয়েছিলেন? আমার এখনও মনে পড়ে যেদিন এরশাদ পদত্যাগ করলেন, সেদিন ঢাকার তোপখানা রোডের মোড়ের কাছে একটি লোক বিড়বিড় করছিল– ‘আজ কেমন স্বাধীন স্বাধীন লাগছে!’ কেউ কি জানে কেন সে এই কথা বলেছিল? যেন একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চারপাশে বিরাজ করছিল এবং এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে আমরা সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন। কিন্তু এটা আমার ইন্টারপ্রিটেশন; সেই লোকটি স্বাধীনতার অন্য কোনো অর্থ তৈরি করে থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই কথাটিই বলার চেষ্টা করেছিলেন শামসুর রাহমান তাঁর ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় : ‘এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?/ এখানে তো নেই বোনাস ভাউচারের খেলা নেই’। সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করেই এ কথা বলা, কিন্তু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সেদিন যারা জড়ো হয়েছিল তাদের প্রাণ একসূত্রে বাঁধা ছিল না। কবিতাটির একটি বড় অংশ এখানে উদ্ধৃত করা প্রয়োজন : ‘এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের? এখানে তো বোনাস ভাউচারের খেলা নেই কিংবা নেই মায়া কোনো গোলটেবিলের, শাসনতন্ত্রের ভেলকিবাজি … আমি দূর পলাশতলীর হাড্ডিসার ক্লান্ত এক ফতুর কৃষক … আমি চটকলের শ্রমিক, আমি মৃত রমাকান্ত-কামারের নয়ন পুত্তলি, আমি মাটিলেপা উঠোনের উদাস কুমোর, প্রায় ক্ষ্যাপা, গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী, আমি তাঁতি সঙ্গীহীন … আমি রাজস্ব দফতরের করুণ কেরানি, মাছি-মারা তাড়া-খাওয়া, আমি ছাত্র, উজ্জ্বল তরুণ, আমি নব্য কালের লেখক, আমার হৃদয়ে চর্যাপদের হরিণী নিত্য করে আসা-যাওয়া …’ জাতীয়তাবাদী ইতিহাস-চর্চায় সব আন্দোলন-সংগ্রামকেই ‘একসূত্রে বাঁধা’ হিসেবে দেখা হয়। সেসব আন্দোলন-সংগ্রামে যোগদানের আপন আপন কারণ খুঁজে বের করার তাগিদ নেই সেখানে। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক সেই ঐক্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দেখবেন; সমগ্রের মধ্যে ভগ্নাংশকে দেখবেন; প্রতিটি কণ্ঠস্বরকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে শনাক্ত করবেন। এই মর্মে জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে (আরেকজন দিকপাল সাব-অল্টার্ন ঐতিহাসিক) লিখেছেন: ‘ভগ্নাংশের সমর্থনে : দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?’ পার্থ চ্যাটার্জী লিখেছেন আরও স্পষ্ট করে : ‘নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্রাগমেন্টস’; এর মর্মার্থ হলো– জাতি-রাষ্ট্রের নানা অংশ, গোষ্ঠী, শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার তারা আলাদা ধারা হিসেবেই শেষাবধি থেকে গেছে। একটি জাতিতে তারা মিলতে পারে নাই। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’– সেই মহামিলন রাজনৈতিক ভাষণে-দাবিতে-সংবিধানে শুধু থেকে গেছে; বাস্তবে তা হয় নাই। কেন হয় নাই সে প্রশ্নের সওয়াল-জবাব নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা করবেন। অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতি নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের বিশেষ মনোযোগ কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্বুদ্ধ? সেটা কি বস্তুবাদী নাকি ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি? হিউম্যানিজম নাকি পপুলিজম? মার্ক্সবাদ নাকি ‘ডিসিডেন্ট লেফট’? নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার পেছনে কোন দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে, সেটা জানা জরুরি বৈকি। এ বিষয়ে দীপেশ চক্রবর্তী এক জায়গায় লিখেছেন : ‘১৮৯৭ সালে বোম্বাইয়ের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ সরকারের প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তার ইতিহাস আজ কেন লিখব? নিছক নিম্নবর্গের বিরোধিতার ইতিহাস লিখতে চাই বলে? সেটা তো পপুলিজম। মানুষ হাজারো বাধার মধ্যেও তার সংগ্রামী সত্তাকে জিইয়ে রাখে, এই কথাটার পুনঃপ্রচার করতে চাই বলে? সেটা তো হিউম্যানিজম। এর বাইরেও তো একটি ইতিহাস আছে …’ এর বাইরের ইতিহাস– যাকে ‘অন্য ইতিহাস’ বলেছি এই অধ্যায়ের শুরুতে– তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন দীপেশ চক্রবর্তী। ব্যাখ্যাটি স্পষ্টতই মার্ক্সের ‘রাষ্ট্রের ক্রম-বিলুপ্তি’ (withering away of the state) তত্ত্বের দ্বারা অন্তত আংশিকভাবে প্রভাবিত। হয়তো এই চিন্তার মধ্যে ‘এনার্কিস্ট’ ধ্যান-ধারণাও কাজ করেছে। দীপেশ লিখেছেন : ‘রাষ্ট্রের ভিত্তি– লেনিন যেমন বলেছিলেন– সংগঠিত হিংসায়। হিংসার মাধ্যমেই তার জন্ম। নিজেকে বৈধ প্রমাণ করতে তাঁর কতগুলো ‘কল্যাণকর’ মতাদর্শের সাহায্য নিতে হয়। আবার এগুলোই তাঁর হাতে অস্ত্রবিশেষ। অথচ গান্ধীবাদীভাবেই ভাবুন বা মার্ক্সবাদীভাবেই ভাবুন, শেষ বিচারে মানুষের মুক্তি রাষ্ট্রের অবলুপ্তিতে ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে, তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতার চরিত্র বোঝা দরকার। এবং তেমনি বোঝা প্রয়োজন ইতিহাসে রাষ্ট্র-বিরোধিতার সূত্রগুলো কোথায়, কারণ একদিন আবার মানুষের মুক্তির কাহিনির সূত্রপাত সেইসব জায়গা থেকে করতে হবে।’ নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্রমেই মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠা ভূমিকার বিরোধিতা একটি বড় দিক রণজিৎ গুহ ও তাঁর অনুপ্রাণিত সাব-অল্টার্ন স্কুলের ঐতিহাসিকদের দর্শনে। তার মানে এই নয় যে রণজিৎ গুহ প্রথাগত মার্ক্সবাদের যুক্তি বিন্যাসের মধ্যেই আটকে থাকতে চেয়েছিলেন। ‘বামপন্থি’ তিনি (এবং তাঁর সহযোগীরা) অবশ্যই, তবে তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী বাম বা ‘ডিসিডেন্ট লেফট’ গোত্রের। রণজিৎ নিজে একসময় কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিআই)-এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন চল্লিশের দশকে এবং পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে। সেসময় তিনি চীনসহ নানা পূর্ব ইউরোপীয় দেশে সিপিআইয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রতিনিধি হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বচক্ষে দেখেছেন নতুন সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্টা এসব দেশে। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিবাদে সিপিআইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর থেকে অফিসিয়াল পার্টি লাইনের বাইরের লোক ছিলেন তিনি– বামপন্থিদের মধ্যে অনেকটাই অপাঙ্ক্তেয়। সুতরাং ডিসিডেন্ট লেফট-ই বলব তাঁকে এবং তাঁর অনুপ্রাণিত অন্য ইতিহাসের সহযোগীদের। যদিও তাঁদের ‘ডিসিডেন্ট’ হয়ে ওঠা ঘটেছিল ভিন্ন ভিন্ন কারণে। কাকতালীয়ভাবে বলি, রণজিতের প্রায় একই সময়ে মিশেল ফুকোও ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসন তাঁর ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বামপন্থি বলয়ে থাকলেও আর কখনোই পার্টির বলয়ে তিনি ফিরে যাননি। এ রকম ঘটেছিল ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত আগ্রাসনের পরেও। জাঁক দেরিদা ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির বলয় থেকে এই সময়ে বেরিয়ে আসেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সাল এই কুড়ি বছর রণজিৎ গুহের একান্ত নিরিবিলি গবেষণার জীবন। ফরাসি জানেন তিনি, ফলে ইংরেজিতে বার হবার আগেই ক্লদ-লেভি স্ট্রস, রোলা বার্থ, মিশেল ফুকো, জাঁক দেরিদা প্রমুখের লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন। মার্ক্সবাদের অনুশীলন তো পূর্বাপর ছিলই। সাথে সাথে সংস্কৃত ভাষাটাও রপ্ত করেছিলেন তরুণ বয়সেই (রণজিতের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবপ্রসাদ গুহ ছিলেন পালি ভাষার ওপরে একজন ‘অথরিটি’)। সাথে ছিল সাহিত্য পাঠের বিপুল প্রস্তুতি। এসবই তাঁকে সাহায্য করেছিল নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার প্রকল্প সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ গড়ে তুলতে।
তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।
৩. অন্য ইতিহাসের নির্মাণ ‘এ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণ বার হয় ১৯৮২ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় অমর্ত্য সেন বলেন যে ‘Ranajit Guha is, arguably, the most creative Indian historian of this century’– সম্ভবত বিশ শতকের ‘সবচেয়ে সৃষ্টিশীল’ ঐতিহাসিক এই উপমহাদেশ থেকে। এই ভূমিকায় অমর্ত্য সেন ‘রুল অব প্রপার্টি’ পর্যায়ের সাথে পরবর্তী কালের ‘সাব-অলটার্ন স্টাডিজ’ পর্যায়ের যৌক্তিক যোগসূত্র খুঁজে বার করেন। উচ্চবর্গের ইতিহাসের সাথে নিম্নবর্গের ইতিহাসের যোগসূত্রটি তাঁর চোখে ধরা পড়েছে এভাবে (উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হলেও আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক)। অমর্ত্য সেন বলছেন: “Since we often tend to see people in fairly formulaic terms, some would no doubt expect to find in A Rule of Property for Bengal a reflection of the ‘subaltern approach’, with its overarching interest in the role of the non-elite–the so-called subalterns. As I shall presently argue, those looking for such an approach need not be entirely disappointed. There are elements that link A Rule of Property and the Subaltern Studies… What, then, are these connections? To examine them, it is useful to recapitulate briefly Guha’s motivating concern in initiating the ‘subaltern studies’ : The historiography of Indian nationalism has for a long time been dominated by elitism–colonialist elitism and bourgeois-nationalist elitism… Both these varieties of elitism share the prejudice that the making of the Indian nation and the development of the consciousness–nationalism–which informed this process were exclusively or predominantly elite achievements. While A Rule of Property is virtually all about elites–their ideas, their commitments, their hopes, their doubts–it is a view of a well-meaning but ultimately fumbling elite, botching things up at the highest level. In this sense it is not a ‘pro-elite’ book. A Rule of Property brings out the difficulties and the ultimate inadequacy of economic reforms initiated by the elite and influenced by the finest elitist thinking.” এটা বলার পর অর্মত্য সেন লিখেছেন যে রণজিতের উচ্চবর্গের ব্যর্থতার আলোচনা ও নিম্নবর্গের প্রতিরোধের আলোচনার মধ্যে একটি গভীর যোগাযোগ রয়ে গেছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে গুহ দেখেন যে এই ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক তত্ত্ব, শ্রেণি-তত্ত্ব বা সামন্তবাদ-পুঁজিবাদ তত্ত্বের নিরিখে বিচার করা যাচ্ছে না। এর সাথে জড়িয়ে গেছে ঔপনিবেশিক (ও আধুনিক) ক্ষমতা-কাঠামোর মৌলিক প্রভাব। এজন্যই ‘শিব গড়তে বাঁদর’ হয়ে যাচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সামন্তবাদবিরোধী বিশ্বজনীন সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের ধ্যান-ধারণাগুলো দূরবর্তী উপনিবেশে এসে– তা সে ঢাকার বুড়িগঙ্গাই হোক, আর কলকাতার হুগলি নদীই হোক– সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চেহারা নিচ্ছে। সুস্থ নির্মাণের পরিকল্পনাও একটি অসুস্থ/বিকৃত নির্মাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। Guha explains the botched job in the following terms: “…a typically bourgeois form of knowledge was bent backwards to adjust itself to the relations of power in a ‘semi-feudal society.’ Through the relevance of ‘power relations’ we get into a territory in which the subaltern studies have taken great interest.” ‘রুল অব প্রপার্টিস’ বইয়ে ফ্রান্সিস সাহেব ও অন্যদের আলোচনা করতে গিয়ে রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন যে কী করে একটা আপাতদৃষ্টিতে ‘ভালো’ বুর্জোয়া আইডিয়া ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে এসে নিজেরই বিরুদ্ধে গিয়ে আধা-সামন্তবাদী ক্ষমতার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এই অর্থে বইটি কোনো এলিটকেন্দ্রিক আলোচনার বই নয়: এটি এলিট বা উচ্চবর্গের জ্ঞানমার্গ (Episteme) ও তার রাজনীতিরই নিকট সমালোচনা। এবং এই সূত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আলোচনার দরকার ছিল নিম্নবর্গের আলোচনা শুরু করার জন্য। কেননা, উচ্চবর্গের রাজনীতির ব্যর্থতাই নিম্নবর্গকে ইতিহাসের প্রান্তস্থল থেকে কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে। রণজিৎ উচ্চবর্গের ব্যর্থতার আলোচনা করতে গিয়েই একপর্যায়ে নিম্নবর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ার তাগিদ অনুভব করেছেন। এই পর্যায়ে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা কী নয় সে বিষয়টি আগেভাগে পরিষ্কার করা ভালো। রণজিৎ গুহ তার পূর্বে উদ্ধৃত অংশে দুই ধরনের ইতিহাসচর্চার কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে– ঔপনিবেশিক এলিটকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার ধারা। যেন ম্যাকলে সাহেব এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে কথা ভাবলেন বা জন স্টুয়ার্ট মিল কোম্পানির নীতি নিয়ে যে বিবৃতি দিলেন তার সুবাদেই ভারতবর্ষের ইতিহাসের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অথবা ঔপনিবেশিক ভারতের বড়লাট হয়ে কোন নির্দিষ্ট পর্বে যে বিশেষ ইংরেজ রাজকর্মচারী এ দেশ শাসন করতে এলেন তার ওপরেই যেন নির্ভর করছে এ দেশের ইতিহাসের ধারা। অপর ইতিহাসচর্চার ধারাটিও খুবই প্রচলিত: সেটি হচ্ছে (বুর্জোয়া) জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার ধারা। এই মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার গান্ধী যবে থেকে সাহেব-সুবোদের বেশ ছেড়ে কৃষকের বেশ ধরলেন– যবে থেকে তিনি ‘মহাত্মা’ হলেন– তখন থেকেই গণজাগরণ দেখা দিল এ ভূখণ্ডে। অথবা সাহেব-সুবোদের মতো বেশধারী জিন্নাহ যবে থেকে কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দিলেন এবং মুসলিম কৃষক জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ অংশ যখন থেকে তাঁকেই তাদের নেতা বলে মানতে শুরু করল, তখন থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে আসল গণজোয়ার আসতে শুরু করল। নেহরু ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ লিখলেন এবং জেলে বসে তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব-ইতিহাস নিয়ে ইংরেজিতে যেসব চিঠিপত্র লিখে গেলেন, তা পরোক্ষভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বৈশ্বিক পরিসরে পেশ করল। ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে সুভাষ বসুর মহা-নিষ্ক্রমণ, পরবর্তী সময়ে তাঁর জার্মানি ও জাপান যাত্রা, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন– এগুলো ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের মহাপথপরিক্রমা। বাংলাদেশেও ৬ দফা থেকে স্বাধীনতার পর্যায়ে উত্তরণ ঘটল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। এসব মিথ্যে নয়, ইতিহাসে ব্যক্তি বা নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করার নয়, কিন্তু এসবই জাতীয়তাবাদী আখ্যানের অংশ, ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যা। কিন্তু তার বাইরেও অন্য ইতিহাস রয়ে গেছে। অন্য ইতিহাস বলতে সচরাচর আমরা বুঝি ‘মার্ক্সবাদী’ ইতিহাসচর্চার ধারা, যেটি স্পষ্টতই ঔপনিবেশিক এবং ‘জাতীয়তাবাদী’ ইতিহাসচর্চা থেকে আলাদা। মার্ক্সবাদী ঘরানার মধ্যে নানা উপধারা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যেটা এখানে প্রশ্ন হিসেবে পাঠকদের মধ্যে দেখা দেবে তা হলো– এসবের মধ্যে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার স্থান কোথায়? মার্ক্সীয় ধারার থেকে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ কতটা ও কোথায় পৃথক? ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’– এই ধারার সাথেই বা এর সম্পর্ক কী রকম? সবচেয়ে সরল বা মোটাদাগের প্রভেদটা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে (যদিও আমরা অচিরেই দেখব যে মূল পার্থক্যটা সেখানে নয়)। ঔপনিবেশিক এলিটকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার ধারায় মূল আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে ঔপনিবেশিক (ইংরেজ) প্রভুদের জীবনচর্চা, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নীতিমালা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত বাদানুবাদ ইত্যাদিকে ঘিরে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার ‘নায়ক’ হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ, তাঁদের জীবন ও কর্মতৎপরতা– যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ধীরে ধীরে। মার্ক্সীয় ইতিহাসচর্চার মূলে রয়েছে তাঁর ‘শ্রেণিগত’ দৃষ্টিকোণ– ‘পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের পরিণতি’ এই ঘোষণায় আস্থা রেখে। আধুনিক সমাজে পুঁজির মালিক ও শিল্প-প্রলেতারিয়েত হচ্ছে দুই যুধ্যমান পক্ষ। সম্পত্তির ওপরে কার অধিকার তা নিয়ে যুদ্ধ চলছে। অর্থাৎ মার্ক্সীয় ইতিহাসচর্চায় শোষক ও শোষিতের মুখের চেহারাটি স্পষ্ট; সহজেই তাদের শনাক্ত করা যায়। অন্তত সেটাই এই ঘরানার ইতিহাসবিদদের প্রধান দাবি : সমস্ত শোষণের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন। এবং এই অর্থনৈতিক শোষণ যারা চালাচ্ছে এবং যাদের ওপরে চালাচ্ছে, সেটি উন্মোচন করতে পারলেই ইতিহাসের রথের ঘোড়া যে পথ বেয়ে চলেছে সেই পথকে বোঝা সম্ভব হবে। এইসবের প্রেক্ষিতে সাব-অলটার্ন স্টাডিজের অবস্থান কোথায়? ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার ইতিহাস’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে সাব-অলটার্ন ঐতিহাসিক মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকের তুলনায় বেশি অনিশ্চয়তায় ভুগবেন। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বাইরে ইতিহাসের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর খুঁজে বেড়াবেন। ইতিহাসের কর্তা হিসেবে তিনি স্পষ্ট করে কোনো নায়ককে দেখতে পাবেন না। না ঔপনিবেশিক ‘প্রভু’, না জাতীয়তাবাদী ‘লিডার’, না দলিত-শোষিত শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ‘নেতা’– কেউ তাঁর চোখে পূর্বনির্ধারিতভাবে নায়কের আসনে সমাসীন নন। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা আসলে ‘বিরোধী বা ক্রিটিকাল ইতিহাস রচনা’। পুরো উদ্ধৃতিটি আমি এখানে তুলে ধরতে চাই: “প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনার পদ্ধতি আছে, থাকবে। উচ্চবর্গের আধিপত্যও আছে, থাকবে। অন্তত ইতিহাস লিখে সে-আধিপত্যের অবসান ঘটানো যাবে না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে।
এমনকি সেরকম হবারও কোনো প্রয়োজন নেই, না রায়তের নিজস্বার্থে না সরকারের স্বার্থে।’ রণজিৎ একে যথার্থভাবেই ‘সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত’ বলেছেন এবং এই পয়েন্টে এসে ফিলিপ ফ্রান্সিসকে আমরা আর চিনতে পারি না। ফ্রান্সিসের তৃতীয় অসুবিধে ছিল যে উপনিবেশের স্থানীয় ক্ষমতা-কাঠামো আমলে না নিয়ে এডাম স্মিথের ‘লেসে-ফেয়ার’ নীতির ওপরে তিনি বেশি করে নির্ভর করেছেন। আবার জমিদারকে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার দিলেও তিনি রায়তকেও পক্ষে রাখতে চেয়েছেন, তবে নিতান্তই পরোক্ষভাবে। প্রজার সঙ্গে জমিদার কী রকম বন্দোবস্তের চুক্তি করবে তা একান্তইভাবেই জমিদারের এখতিয়ার এ কথা কয়েকবার বলার পর তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন যে চুক্তির বিষয়টা দু’পক্ষের ওপরে ছেড়ে দিলেই সবচেয়ে ভালো হয়। ফ্রান্সিস মনে করেছেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ না ঘটলে জমিদারের সঙ্গে রায়তের সম্পর্ক একটা স্বেচ্ছাচুক্তির আকার ধারণ করবে: ‘দু’পক্ষকেই যদি এভাবে নিজেদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তারা সহজেই এমন একটা চুক্তিতে আসবে যাতে উভয়েরই সুবিধা।’ জমিদার ও রায়ত– এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের চেয়ে আপসেরই সম্ভাবনা দেখেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ১৭৬৯-১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী গ্রামবাংলার অবস্থাকে তিনি সাক্ষী মেনেছেন। যুক্তিটি কৌতূহুলোদ্দীপক: ‘এ দেশের বর্তমান অবস্থায় জমিদারের চেয়ে রায়তেরই সুবিধা হবে বেশি। এতখানি জমি যেখানে পতিত পড়ে আছে এবং আবাদ করার লোক যখন এত কম, তখন চাষিকে সাধাসাধি করতে হবে।’ এ কথা ফ্রান্সিস লিখতে পারলেন কী করে? নিকট ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের প্রভাব কেটে গেলে জমির ওপর কৃষিজীবী লোকসংখ্যার চাপ আবারও বেড়ে যাবে। ফলে জমিদার রায়তের মধ্যে দরকষাকষির সুবিধা-অসুবিধার এই হিসাব পাল্টে যেতে পারে। চাষের শর্ত উত্তরোত্তর জমিদারের পক্ষে ও রায়তের বিপক্ষে চলে যেতে পারে সেই চিত্রটা ফ্রান্সিস তার হিসাবে রাখেননি। ধনিক-চাষি যেমন ক্ষেতমজুরের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিসেবে খরিদ করে, স্বত্বাধিকারী জমিদার তেমনিভাবে স্বত্বহীন রায়তের কাছ থেকে শ্রমশক্তি কিনবে। এ ক্ষেত্রে কোনো জোরাজুরি নেই, দু’পক্ষের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে অলিখিত স্বেচ্ছাচুক্তির ভিত্তিতে, যার মূলে রয়েছে ‘লেবার-মার্কেটের চাহিদা-জোগানের অমোঘ নিয়ম’। দেখা যাচ্ছে যে, ফ্রান্সিস বাংলার কৃষিতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের কল্পনা করেছেন জমিদারকে জমির মালিকানা দিয়ে আর স্বত্ববিহীন রায়তকে তার মালিকানার অধিকার কেড়ে নিয়ে সেই জমির চাষাবাদে শ্রম দিতে বাধ্য করে। রণজিৎ গুহ অনুমান করেছেন যে অর্থশাস্ত্রের ফিজিওক্রেটিক স্কুলের প্রভাবের কারণেই ফ্রান্সিস জমিদার ও রায়তের মধ্যে ওরকম শ্রম কেনা-বেচার একটি ‘স্বাধীন চুক্তি’ কল্পনা করতে পেরেছিলেন যেটা কেবল ধনতান্ত্রিক কৃষিতেই ঘটে থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, লেবার মার্কেটের চাহিদা-জোগানের ‘অমোঘ নিয়মে’ জমিদার-রায়তের মধ্যে জমির ব্যবহার নিয়ে একধরনের বন্দোবস্ত নাহয় হলো, কিন্তু জমিদার সেই চুক্তি যদি না মানে? সেক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি ছিল জমিদার ও রায়তের মধ্যকার বন্দোবস্তের শর্ত লেখা থাকবে ‘পাট্টা’ নামক দলিলে, এবং শর্তসংবলিত সেই পাট্টাকেই ‘আইনসংগত চুক্তিপত্র’ বলে গণ্য করা হবে। ৫ নভেম্বর ১৭৭৬ তারিখে ফ্রান্সিস তার লাটসভার বিবৃতিতে বললেন যে, “পাট্টাই হচ্ছে জমিদারের সঙ্গে রায়তের ‘স্বেচ্ছাচুক্তির সাক্ষ্য ও গ্যারান্টি’ এবং গভর্নমেন্টের উচিত ‘তাদের এই পারস্পরিক চুক্তিকে কার্যকরী করার জন্য বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা’ অবলম্বন করা।” কিন্তু বাস্তবে ১৭৯৩ সালের আইনে চাষিদের এ রকম অধিকার সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। জমিদার শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতার নির্ভরযোগ্য সামাজিক শক্তি হিসেবে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক যুক্তিই তখন প্রধান বিবেচনা হিসেবে কাজ করেছিল। শুধু কৃষিজমিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রবর্তন নয়, স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এর রাজস্ব-তাৎপর্য নিয়েও ভেবেছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রথম দিকে ব্রিটিশরাজের খাজনা আদায় বাড়লেও আখেরে তা কমে যাবে এটা বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয়। প্রথমত, খাজনা চিরকালের জন্য বাঁধা (যা চলতি মূল্যে স্থিরীকৃত এবং যার প্রকৃত মূল্য মূল্যস্ফীতির সাথে কমতে বাধ্য); দ্বিতীয়ত, জমিদার চাষাবাদে অনীহা দেখালে জমির উৎপাদনশীলতা (land productivity) বাড়ার সম্ভাবনা কম; তৃতীয়ত, রায়তের ওপরে নানা কায়দায় বাড়তি শোষণ এই উৎপাদনশীলতাকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসবে। এ কারণেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জমিদারি বন্দোবস্ত থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিসরে দেখলে– রাজস্ব আদায় কমই হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮৫০-এর পরে প্রবর্তিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এলাকার ‘রায়তওয়ারী’ বন্দোবস্ত থেকে। শেষোক্ত ব্যবস্থায় জমির মালিক করা হয়েছিল খোদ কৃষককেই– কোনো ওপর থেকে বসানো জমিদারকে নয়। এর ফলে ব্রিটিশরাজের রাজস্বগত আয়ই বেশি হয়েছিল তা-ই নয়, রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক উন্নয়নও বাংলার তুলনায় বেগবান হয়েছিল। অভিজিৎ ব্যানার্জীদের লেখা থেকে সেটা আজ সুপ্রমাণিত। ফ্রান্সিস কেন এই লাইনে যুক্তি দেননি তখন? ফ্রান্সিস রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের যুক্তিতে না হেঁটে ‘আসন্ন সর্বনাশকে’ প্রথমে মোকাবিলা করতে চাইলেন। তার চোখে আসন্ন সর্বনাশ ছিল– আগেই বলেছি– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অমিত রাজস্বক্ষুধা। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তার পয়লা নম্বর নালিশ ছিল ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবণতা : ‘এখন বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবৃত্তিকে অচল অটলভাবে অনুসরণ করার ফলেই এ দেশের সর্বনাশ ঘটেছে, এবং সত্যিই যে কোনো অর্থনৈতিক লাভ এতে হয় না সে কথাও অদূর ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।’ ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে ছিল খাজনার হার বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি অধুনাকালের ‘সাপ্লাই-সাইডার্স’ মতবাদের অনুসারীদের মতো। করের হার কমিয়ে মোট কর-রাজস্ব বাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাজনার হার খুব চড়া ধরে তার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে যাবার নীতি বর্জন করে তার বদলে স্বল্প হারে খাজনার পরিমাণ একেবারেই অপরিবর্তনীয়ভাবে নির্দিষ্ট করা উচিত– এই ছিল ফ্রান্সিসের প্রস্তাব। এই প্রসঙ্গে তার মতামত যে সরাসরি মঁতাস্ক্যুর কাছে ঋণী তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন: “রাজস্ব সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ও সরল নীতিটি আমি মঁতাস্ক্যুর এই সূত্রের ভিত্তিতে রচনা করেছি: ‘জনসাধারণ কতখানি দিতে পারে তা নয়, কতটা তাদের দেওয়া উচিত, তারই ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাণ স্থির করা কর্তব্য’– অর্থাৎ কতটা দিতে পারছে তা নয়, কতটা তারা সর্বদাই দিয়ে যেতে পারে তারই ভিত্তিতে।” এক কথায় ‘সরকারের মূল শাসনব্যবস্থাটিকে চালু রাখার জন্য যতটুকু না হলে নয় তারই ভিত্তিতে হিসাব করে’ রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা উচিত। এক পর্যায়ে রাজস্ব-হ্রাসের প্রসঙ্গে ফিলিপ ফ্রান্সিস মোগল আমলের নজির টেনে নিজের বক্তব্য বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। মঁতাস্ক্যু বলেছিলেন যে মোগল শাসকেরা বিজিত দেশের রাজস্বের হার ও পরিমাণ অনড়ভাবে বেঁধে দিত বলেই তাদের শাসন এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। ২২ জানুয়ারি ১৭৭৬ তারিখের পরিকল্পনায় ফ্রান্সিস এই মত উল্লেখ করে বলেন: ‘মুসলিম বিজেতারা সুপরিমিত রাজস্ব আদায় করতেন, এবং আদায়ের ব্যবস্থার মধ্যেও কোনো জটিলতা ছিল না; এই কারণে তারা অতি সহজেই আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য কায়েম রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।’ স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এমন একটি কর-রাজস্ব ব্যবস্থা চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে করের হারকে সহনীয় রাখা হবে, কর আদায়ের ব্যবস্থায় জটিলতা থাকবে না, এবং সুপরিমিতভাবে কর-রাজস্ব আদায় করা হবে। এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শাসনকার্যের স্থায়িত্ব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এই একই ধারণার দ্বারা চালিত হয়ে তিনি জমির ওপরে সমস্ত প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ কর (tax) রদ করে শুধু খাজনাকেই (Rent) স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে করভার কৃষকদের ওপর থেকে কমে যায়, আর তারা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের কৃষিকাজ চালিয়ে নিতে পারে। কৃষকদের দিয়ে বেগার খাটানোর প্রথা, যেমন তাদের দিয়ে রাস্তা বাঁধার কাজে বেগার খাটানোর (corvee) প্রথা যেটা ফ্রান্সে একদা চালু ছিল, সেসব ‘সব রকম আবওয়াব ও মাথটের উচ্ছেদ’ করার তিনি প্রস্তাব করেন। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের চোখের সামনে ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। ১৭৭৬ সালের ২২ জানুয়ারিতে তিনি বলেছেন: ‘দেশের লোক এত গরিব হয়ে পড়েছে এবং আগের তুলনায় এত কম জমিতে এখন চাষের কাজ হয় যে স্বভাবতই যেটুকু জমিতে চাষের কাজ চালু থাকে তার ওপরে করের ভার ক্রমেই বেড়ে যায়।’ ফ্রান্সিসের আলোচনার মাধ্যমে রণজিৎ গুহ কী বার্তা দিতে চাইলেন? প্রথমত, ফ্রান্সিস ছিলেন অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ধনতন্ত্রের পন্থি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষিপণ্য চলাচলের ওপরে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থার অবসান। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভ্যন্তরীণ শুল্কব্যবস্থাকে বাংলার কৃষি, শিল্প ও বহির্বাণিজ্য বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর পদক্ষেপ বলে মনে করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত প্রকার অভ্যন্তরীণ শুল্ক উচ্ছেদ করতে। আমরা দেখেছি একটু আগেই যে সমস্ত প্রকার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে ভূসম্পত্তির ওপরে একটিমাত্র কর বসিয়ে খাজনার সঙ্গে মিলিয়ে আদায় করার প্রস্তাব। সাধারণভাবে মোগল রাজশক্তির অনুসরণে তিনি চেয়েছিলেন খাজনার অপেক্ষাকৃত পরিমিত ও অপরিবর্তনীয় হার। তিনি চেয়েছিলেন ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠা; জমিদার ও রায়তের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে দরকষাকষির সম্পর্ক; এবং সেই সুবাদে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষের নিরসন, এবং ব্রিটিশরাজের আয় ও রাজনৈতিক সমর্থনের যুগপৎ সম্প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সিস ১৭৭৬ সালে লাটসভায় যে প্রস্তাব এনেছিলেন তা ছিল তখনকার বিচারে প্রাগ্রসর। সামন্ততন্ত্রের বিপরীতে ধনতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ প্রতিযোগিতামূলক ও ব্যক্তিমালিকানা নির্ভর প্রস্তাব কলোনিয়াল পরিবেশে পড়ে বিপরীতধর্মী চেহারা নিল। অবাধ প্রতিযোগিতার ধার দিয়েও গেল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা মেট্রোপলিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। উদাহরণত, ফ্রান্সিস চেয়েছিলেন কোম্পানির ‘সাপ্লাই ব্যবসা’ করার জন্য খোলা টেন্ডারে কোনোরকম বৈষম্য না রেখে সমস্ত দেশি ব্যবসায়ীকেই কনট্র্যাক্ট নেবার সুযোগ দেওয়া হোক। এতে করে কলকাতায় বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে এবং আখেরে কোম্পানিরই লাভ হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ বাণিজ্যের প্রশস্তি কোম্পানির কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থা পূর্বাপর বজায় রইল। ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা পেল বটে, কিন্তু ফ্রান্সিস যাদের ভেবে জমিদারদের কাছে ভূমির অধিকার দিতে চাইলেন তারা মূলত এই সংস্কারের বাইরে থাকল। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী হলো এক শহুরে নব্য-ধনী সম্প্রদায়, যারা ছিল কোম্পানিরই সাথে জড়িত ব্যবসায়ী-আমলা-মুৎসুদ্দী। এরাই নতুন জমিদার ও নতুন তালুকদার হয়ে রাজত্ব করবে পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে। ফ্রান্সিস যাদের মালিকানা স্বত্ব থেকে বঞ্চিত রাখলেন ধনবাদী বিকাশের যুক্তিতে, তারা কালক্রমে জমি কর্ষণের অধিকারও হারাল। ফ্রান্সিসের উদ্ভাবিত জমিদার-রায়তের ‘স্বেচ্ছা-চুক্তির’ সম্ভাবনা মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল। [ক্রমশ] তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।
আসলে ফ্রান্সিসের অসুবিধে ছিল তিনটি। ফ্রান্সিসের চোখে মূল অ্যাডভারসেরি বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অ্যাডাম স্মিথের মতো তিনিও মনে করতেন যে কোম্পানির নীতিমালা অবাধ বাণিজ্য তত্ত্বের পরিপন্থি। কোম্পানির সঙ্গে ফ্রান্সিস বা স্মিথের এই সংঘর্ষের মধ্যে উদীয়মান ‘লিবারেল গভর্নমেন্টালিটির’ সঙ্গে গেড়ে-বসা ‘কলোনিয়াল গভর্নমেন্টালিটির’ সংঘর্ষ ধরা পড়েছে। কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলার একচ্ছত্র ‘দেওয়ানী’ লাভের পর চারদিকে খাজনা আদায়ের যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল– যেটি চলে প্রায় এক দশক অবধি– তাতে করে বাংলাদেশের কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। এই অতিরিক্ত শোষণেরই পরিণতি ১৭৭০ সালের মহা-মন্বন্তর; যার ফলে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোকের প্রাণহানি ঘটে। খোদ ইংল্যান্ডে এই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফ্রান্সিস, তার বন্ধু এডমান্ড বার্ক এবং অন্য সহযোগীরা তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরাসরি এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করেন। তাদের যুক্তি– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করছে বলেই এই নির্বিচার শাসন চলতে পারছে। এর ফলে শুধু বাংলায় অপরিসীম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে তা-ই নয়, ব্রিটিশ স্বার্থেরও আখেরে ক্ষতি হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী হেস্টিংস নিজে। বঙ্কিম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন–
‘১১৭৪ সালে ফসল ভালো হয় নাই। সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল– লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল … অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।’ বঙ্কিমের বর্ণনায় শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা ছিল না, অধিকন্তু ছিল সাধারণ মানুষ যখন উপবাসে কষ্ট পাচ্ছে, তখন রাজশক্তি (প্রকারান্তরে ব্রিটিশ শাসন) ‘রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায়’ বুঝে নিচ্ছে; যখন অনাবৃষ্টিতে সামান্যই ফলন হয়েছে, তখন রাজশক্তি সিপাহিদের তথা সামরিক বাহিনীর জন্য সেই ফসল কিনে রাখছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে; এমনকি যখন লোকজন দুই বেলা করে উপবাস করছে, তখনও ‘রাজস্ব আদায়’ বন্ধ হয়নি। যাতে কোম্পানির মোট রাজস্ব আদায়ে যাতে টান না পড়ে সেজন্য উপবাসের বছরে রাজস্বের মাত্রা ‘শতকরা দশ টাকা’ হারে বৃদ্ধি করা হলো। স্পষ্টতই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে ওয়ারেন হোস্টিংসের আমলে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও অপশাসনের ওপরে, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত দুঃখভোগকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফ্রান্সিসের প্রথম অসুবিধে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে কার্যত ‘ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজমের’ সাথে এক কাতারে মেলানো। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বের মোগল সাম্রাজ্যে জমিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না। সব জমির মালিক ছিলেন ‘এশিয়াটিক’ মোগল-সম্রাট। রাজশক্তির রাজকর্মচারীরা জমির ইজারাদারদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে কর-রাজস্ব আদায় করতেন। ফ্রান্সিসের যুক্তি ছিল যে ১৭৬৫ সালের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল-সম্রাটের ‘স্থান গ্রহণ’ করেছে, অর্থাৎ নিজেকে সব জমির মালিক ঘোষণা করেছে। এবং জমির ইজারাদারদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো কর-রাজস্ব আদায় করছে। এই ইঙ্গিতটাই বঙ্কিমের পূর্বে-উদ্ধৃত লেখায় দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানির শাসন ও মোগল শাসন– এই দুইয়েরই মধ্যে জমিতে ব্যক্তিমালিকানা অনুপস্থিত এই সমীকরণ টেনে ফ্রান্সিস পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে বাড়তি যুক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। এই যুক্তিতেই ফ্রান্সিস ওয়ারেন হেস্টিংসের ‘ইজারাদারি ব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। সামন্ততন্ত্রে তা সে মোগল শাসনেই হোক, আর ষোড়শ লুইয়ের ফ্রান্সেই হোক, ইজারাদারি ব্যবস্থায় সকল জমিকে ‘রাষ্ট্রের সম্পত্তি’ হিসেবে দেখা হয় ও জমিদারকে কেবল ‘রাষ্ট্রের কর্মচারী’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে, ফ্রান্সিসের পরিকল্পনায় জমি হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এবং জমিদার হবে উত্তরাধিকারসূত্রে এই সম্পত্তির মালিক। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ফ্রান্সিসের অভিযোগ ছিল যে তার আমলে নিলাম ডেকে সর্বোচ্চ খরিদ্দারের কাছে অল্প ও অনিশ্চিত মেয়াদে ভূমি ইজারা দেওয়ার প্রথা চালু করা হয়েছে। এতে করে ইজারাদারি (লিজ) পদ্ধতিতে (১) ‘মালিকানার শাশ্বত অধিকারকে’ অস্বীকার করা হয়েছে; (২) ‘রাজস্বের দাবি অত্যন্ত উঁচু হারে’ বেঁধে রাখা হয়েছে; এবং (৩) এই হারও যখন-তখন বদলে যেতে পারে, অর্থাৎ ইজারাদারি ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার ‘স্ট্যাবিলিটি’ নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে এর পরও ইজারাদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ১৭৬৫-উত্তর বাংলাদেশে, তার কারণ তারা ভারতবর্ষের ইতিহাসের ভুল পাঠ করেছেন। যেখানে ওয়ারেন হেস্টিংসের কোম্পানি জমিতে সামন্ত মোগল যুগের ইজারাদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে, সেখানে ফ্রান্সিস চাইছেন ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠা। এ দুই আইডিয়ার সংঘাত আসলে উপনিবেশের জমিনে নব্য-সামন্তবাদের সাথে পুঁজিবাদের লড়াই। রণজিৎ গুহ স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন এই মর্মে: “ফ্রান্সিস বলেছেন যে ইজারাদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কোম্পানি ‘মালিকের কাজ’ করেছে, কারণ রাজশক্তিই জমির মালিক এই ভুল ধারণা থেকেই উক্ত ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে। এই নীতি অনুসারে উত্তরাধিকারসূত্রে যারা সম্পত্তির আইনসংগত মালিক তাদের অধিকার হরণ করে ‘সব ক্ষেত্রেই বিদেশিদের কাছে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে’; বিদেশি বলতে তিনি কলকাতার বেনেদের নাম করেছেন, কারণ তারা গ্রামবাংলার লোক নয়, অথচ স্বনামে বা শ্বেতাঙ্গদের হয়ে বেনামিতে তারাই জমি বেশি ইজারা নিত।” ফ্রান্সিসের প্রথম অসুবিধেটা তাহলে এখন বোঝা যাচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমি-নীতিকে তিনি পছন্দ করছেন না ব্যক্তিমালিকানার প্রতি স্বীয় পক্ষপাতিত্বের কারণে। কিন্তু একই সাথে তিনি এ-ও বুঝতে পারছেন যে কোম্পানিকে ছাড়া এই মুহূর্তে উপনিবেশের সম্প্রসারণও সম্ভব নয়। ১৭৭৬ সালে ২২ জানুয়ারি ফ্রান্সিস বাংলার লাটপরিষদে যখন হেস্টিংসের ইজারাদারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তার বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন, তখন জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। ঐ বছরের ৪ জুলাই আমেরিকা তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অর্থাৎ তখন কোম্পানির ওপর নির্ভর করা ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতবর্ষ সামরিকভাবে শাসন করা সম্ভব ছিল না। এক পর্যায়ে ইয়র্কটাউনের যুদ্ধে পরাস্ত জেনারেল কর্নওয়ালিসকে ‘লর্ড’ উপাধি দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ভারতবর্ষে। এই হেস্টিংস-কর্নওয়ালিসের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অপসারণের কোনো পথ সেদিন জানা ছিল না ফ্রান্সিসের। তিনি শুধু আশা করেছিলেন যে কোম্পানির ইজারাদারি পলিসির সমালোচনার ফলে কৃষিতে ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে সমর্থন জোরালো হবে; কোম্পানি তার জমি বা কৃষি-সংক্রান্ত নীতিমালার পরিবর্তন করবে; এবং এক পর্যায়ে কোম্পানির একাধিপত্যের ওপরেও ব্রিটিশ সরকারের তীক্ষ্ম নজরদারি স্থাপিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি দেখলেন যে ইজারাদারি ব্যবস্থার সুফল পেয়েছে গ্রামবাংলার বাইরের লোকজন, যারা মূলত কোম্পানির এ দেশীয় কর্মচারী এবং যারা কলকাতায় থেকে ‘স্বনামে বা শ্বেতাঙ্গদের হয়ে বেনামিতে’ জমি ইজারা নিয়ে আসছিল। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা ফুলে-ফেঁপে উঠছিল ১৭৬৫-১৭৯৩ কালপর্বে। এদেরকেই বলা হতো তৎকালের ‘নব্য-ধনী’, যারা প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বের (পড়ন্ত) জমিদার শ্রেণি থেকে ভিন্ন চরিত্রের। এক নতুন সামাজিক বর্গ হিসেবে এরা সেই সময়ে আবির্ভূত হয়। বাংলায় কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পত্তনের সময় আদিতে যে ৬৯৩ জন বৃহৎ জমিদারি স্বত্ব লাভ করেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন প্রাক্তন-ইজারাদার তথা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কৃষি-ব্যবসার সাথে জড়িত নব্য-ধনী গোষ্ঠী। এদের কেউ কেউ শ্বেতাঙ্গদের সাথে মিলে রপ্তানি বাণিজ্যেও জড়িত ছিলেন। এরাই ছিল বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের মূল রাজনৈতিক ভিত্তি। ফলে ১৭৯৩ সালের ভূমি-নীতি বাংলায় পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের সূত্রপাত না করে পর্যবসিত হয়েছিল মার্কস-কথিত ‘ভূমি সংস্কারের এক ক্যারিক্যাচারে’।
ফ্রান্সিসের দ্বিতীয় অসুবিধে ছিল কৃষিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রশ্নটিকে তিনি শুধু জমিদারের সাথে সম্পর্কিত করে ভেবেছিলেন। রায়তের কাছে চাষযোগ্য জমিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি। আমি রায়তকে জমির মালিকানা-স্বত্ব দেওয়ার কথা তুলছি না (যদিও সেটাও একটা ইস্যু এখানে)। আমি বলছি বর্গা-চাষি হিসেবে রায়তকে জমি ‘ব্যবহারের’ চিরস্থায়ী অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে। হতে পারে যে তিনি হয়তো শুধু কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের ‘প্রুসিয়ার পথই’ মানস-কল্পনায় রেখেছেন। যার মোদ্দা কথা হলো, জমিদার-জোতদার বা বৃহৎ ভূস্বামীও জমিতে বিনিয়োগ করতে করতে একসময় পুঁজিবাদী ধনিক কৃষকে রূপান্তরিত হতে পারে। রণজিৎ অবশ্য লিখেছেন এক্ষেত্রে ফ্রান্সিস শুধু জমিদারের কথা নয়, রায়তের কথাও ভেবেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে বলতে হবে সেটা ছিল নিতান্তই একটি অর্ধ-চিন্তিত প্রকল্প। যেমন, ১৭৭৫ সালে লর্ড নর্থকে তিনি লিখেছিলেন ‘জমিদার, তালুকদার, এমনকি রায়তেরও সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করা উচিত।’ এর থেকে ধারণা হতে পারে, জমিদারকে চিরস্থায়ী ব্যক্তিমালিকানা স্বত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি বুঝি রায়ত বা প্রজাদেরকেও (tenants) রক্ষা করতে চান এক ধরনের বর্গা-নিরাপত্তা বা tenurial security দানের মাধ্যমে। কেননা, তিনি তো জানতেন যে জমিদারি স্বত্ব দিলেও এই পুরাতন জমিদার শ্রেণি জমির দেখভাল করতে পারবে না: ‘আমি শুনেছি এবং বিশ্বাসও করি যে তরুণ জমিদার সন্তানদের অধিকাংশই জড়বুদ্ধি মূর্খ। … কিন্তু উপায় কী, জমিদারি বা ইজারাদারি একটা বেছে নিতেই হবে।’ তাহলে সমাধান কী এখানে? ফ্রান্সিস একটা অনন্য সমাধান দিতে পারতেন। জমিদারদের চিরস্থায়ী মালিকানা-স্বত্ব দেওয়া হলে হোক, কিন্তু সাথে সাথে তাদের জমি যারা চাষ করবে তাদেরকেও চিরকালের বা দীর্ঘকালের জন্য ঐ জমি চাষ করার অধিকার দেওয়া হোক, যাতে করে ‘রায়ত চিরদিনের বা দীর্ঘকালের মতো জমির অধিকার ভোগ করতে পারে’– অর্থাৎ রায়তের সঙ্গেও জমির মালিকানায় না হোক, জমির ব্যবহার নিয়ে চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত করা যেত। কিন্তু কোনো রহস্যময় কারণে ফ্রান্সিস সে পথে হাঁটলেন না। জমিদারকেই জমির প্রকৃত মালিক হতে হবে, রায়তকে নয়– এই যুক্তিতে অনড় রইলেন। কোনো দ্বিধা-সংশয় না রেখে স্পষ্টই তিনি রায় দিলেন: ‘এ কথা আদৌ সত্য নয় যে রায়তই জমির স্বত্বাধিকারী। [ক্রমশ] এমনকি সেরকম হবারও কোনো প্রয়োজন নেই, না রায়তের নিজস্বার্থে না সরকারের স্বার্থে।’ রণজিৎ একে যথার্থভাবেই ‘সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত’ বলেছেন এবং এই পয়েন্টে এসে ফিলিপ ফ্রান্সিসকে আমরা আর চিনতে পারি না। ফ্রান্সিসের তৃতীয় অসুবিধে ছিল যে উপনিবেশের স্থানীয় ক্ষমতা-কাঠামো আমলে না নিয়ে এডাম স্মিথের ‘লেসে-ফেয়ার’ নীতির ওপরে তিনি বেশি করে নির্ভর করেছেন। আবার জমিদারকে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার দিলেও তিনি রায়তকেও পক্ষে রাখতে চেয়েছেন, তবে নিতান্তই পরোক্ষভাবে। প্রজার সঙ্গে জমিদার কী রকম বন্দোবস্তের চুক্তি করবে তা একান্তইভাবেই জমিদারের এখতিয়ার এ কথা কয়েকবার বলার পর তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন যে চুক্তির বিষয়টা দু’পক্ষের ওপরে ছেড়ে দিলেই সবচেয়ে ভালো হয়। ফ্রান্সিস মনে করেছেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ না ঘটলে জমিদারের সঙ্গে রায়তের সম্পর্ক একটা স্বেচ্ছাচুক্তির আকার ধারণ করবে: ‘দু’পক্ষকেই যদি এভাবে নিজেদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তারা সহজেই এমন একটা চুক্তিতে আসবে যাতে উভয়েরই সুবিধা।’ জমিদার ও রায়ত– এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের চেয়ে আপসেরই সম্ভাবনা দেখেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ১৭৬৯-১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী গ্রামবাংলার অবস্থাকে তিনি সাক্ষী মেনেছেন। যুক্তিটি কৌতূহুলোদ্দীপক: ‘এ দেশের বর্তমান অবস্থায় জমিদারের চেয়ে রায়তেরই সুবিধা হবে বেশি। এতখানি জমি যেখানে পতিত পড়ে আছে এবং আবাদ করার লোক যখন এত কম, তখন চাষিকে সাধাসাধি করতে হবে।’ এ কথা ফ্রান্সিস লিখতে পারলেন কী করে? নিকট ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের প্রভাব কেটে গেলে জমির ওপর কৃষিজীবী লোকসংখ্যার চাপ আবারও বেড়ে যাবে। ফলে জমিদার রায়তের মধ্যে দরকষাকষির সুবিধা-অসুবিধার এই হিসাব পাল্টে যেতে পারে। চাষের শর্ত উত্তরোত্তর জমিদারের পক্ষে ও রায়তের বিপক্ষে চলে যেতে পারে সেই চিত্রটা ফ্রান্সিস তার হিসাবে রাখেননি। ধনিক-চাষি যেমন ক্ষেতমজুরের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিসেবে খরিদ করে, স্বত্বাধিকারী জমিদার তেমনিভাবে স্বত্বহীন রায়তের কাছ থেকে শ্রমশক্তি কিনবে। এ ক্ষেত্রে কোনো জোরাজুরি নেই, দু’পক্ষের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে অলিখিত স্বেচ্ছাচুক্তির ভিত্তিতে, যার মূলে রয়েছে ‘লেবার-মার্কেটের চাহিদা-জোগানের অমোঘ নিয়ম’। দেখা যাচ্ছে যে, ফ্রান্সিস বাংলার কৃষিতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের কল্পনা করেছেন জমিদারকে জমির মালিকানা দিয়ে আর স্বত্ববিহীন রায়তকে তার মালিকানার অধিকার কেড়ে নিয়ে সেই জমির চাষাবাদে শ্রম দিতে বাধ্য করে। রণজিৎ গুহ অনুমান করেছেন যে অর্থশাস্ত্রের ফিজিওক্রেটিক স্কুলের প্রভাবের কারণেই ফ্রান্সিস জমিদার ও রায়তের মধ্যে ওরকম শ্রম কেনা-বেচার একটি ‘স্বাধীন চুক্তি’ কল্পনা করতে পেরেছিলেন যেটা কেবল ধনতান্ত্রিক কৃষিতেই ঘটে থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, লেবার মার্কেটের চাহিদা-জোগানের ‘অমোঘ নিয়মে’ জমিদার-রায়তের মধ্যে জমির ব্যবহার নিয়ে একধরনের বন্দোবস্ত নাহয় হলো, কিন্তু জমিদার সেই চুক্তি যদি না মানে? সেক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি ছিল জমিদার ও রায়তের মধ্যকার বন্দোবস্তের শর্ত লেখা থাকবে ‘পাট্টা’ নামক দলিলে, এবং শর্তসংবলিত সেই পাট্টাকেই ‘আইনসংগত চুক্তিপত্র’ বলে গণ্য করা হবে। ৫ নভেম্বর ১৭৭৬ তারিখে ফ্রান্সিস তার লাটসভার বিবৃতিতে বললেন যে, “পাট্টাই হচ্ছে জমিদারের সঙ্গে রায়তের ‘স্বেচ্ছাচুক্তির সাক্ষ্য ও গ্যারান্টি’ এবং গভর্নমেন্টের উচিত ‘তাদের এই পারস্পরিক চুক্তিকে কার্যকরী করার জন্য বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা’ অবলম্বন করা।” কিন্তু বাস্তবে ১৭৯৩ সালের আইনে চাষিদের এ রকম অধিকার সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। জমিদার শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতার নির্ভরযোগ্য সামাজিক শক্তি হিসেবে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক যুক্তিই তখন প্রধান বিবেচনা হিসেবে কাজ করেছিল। শুধু কৃষিজমিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রবর্তন নয়, স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এর রাজস্ব-তাৎপর্য নিয়েও ভেবেছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রথম দিকে ব্রিটিশরাজের খাজনা আদায় বাড়লেও আখেরে তা কমে যাবে এটা বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয়। প্রথমত, খাজনা চিরকালের জন্য বাঁধা (যা চলতি মূল্যে স্থিরীকৃত এবং যার প্রকৃত মূল্য মূল্যস্ফীতির সাথে কমতে বাধ্য); দ্বিতীয়ত, জমিদার চাষাবাদে অনীহা দেখালে জমির উৎপাদনশীলতা (land productivity) বাড়ার সম্ভাবনা কম; তৃতীয়ত, রায়তের ওপরে নানা কায়দায় বাড়তি শোষণ এই উৎপাদনশীলতাকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসবে। এ কারণেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জমিদারি বন্দোবস্ত থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিসরে দেখলে– রাজস্ব আদায় কমই হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮৫০-এর পরে প্রবর্তিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এলাকার ‘রায়তওয়ারী’ বন্দোবস্ত থেকে। শেষোক্ত ব্যবস্থায় জমির মালিক করা হয়েছিল খোদ কৃষককেই– কোনো ওপর থেকে বসানো জমিদারকে নয়। এর ফলে ব্রিটিশরাজের রাজস্বগত আয়ই বেশি হয়েছিল তা-ই নয়, রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক উন্নয়নও বাংলার তুলনায় বেগবান হয়েছিল। অভিজিৎ ব্যানার্জীদের লেখা থেকে সেটা আজ সুপ্রমাণিত। ফ্রান্সিস কেন এই লাইনে যুক্তি দেননি তখন? ফ্রান্সিস রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের যুক্তিতে না হেঁটে ‘আসন্ন সর্বনাশকে’ প্রথমে মোকাবিলা করতে চাইলেন। তার চোখে আসন্ন সর্বনাশ ছিল– আগেই বলেছি– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অমিত রাজস্বক্ষুধা। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তার পয়লা নম্বর নালিশ ছিল ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবণতা : ‘এখন বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবৃত্তিকে অচল অটলভাবে অনুসরণ করার ফলেই এ দেশের সর্বনাশ ঘটেছে, এবং সত্যিই যে কোনো অর্থনৈতিক লাভ এতে হয় না সে কথাও অদূর ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।’ ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে ছিল খাজনার হার বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি অধুনাকালের ‘সাপ্লাই-সাইডার্স’ মতবাদের অনুসারীদের মতো। করের হার কমিয়ে মোট কর-রাজস্ব বাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাজনার হার খুব চড়া ধরে তার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে যাবার নীতি বর্জন করে তার বদলে স্বল্প হারে খাজনার পরিমাণ একেবারেই অপরিবর্তনীয়ভাবে নির্দিষ্ট করা উচিত– এই ছিল ফ্রান্সিসের প্রস্তাব। এই প্রসঙ্গে তার মতামত যে সরাসরি মঁতাস্ক্যুর কাছে ঋণী তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন: “রাজস্ব সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ও সরল নীতিটি আমি মঁতাস্ক্যুর এই সূত্রের ভিত্তিতে রচনা করেছি: ‘জনসাধারণ কতখানি দিতে পারে তা নয়, কতটা তাদের দেওয়া উচিত, তারই ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাণ স্থির করা কর্তব্য’– অর্থাৎ কতটা দিতে পারছে তা নয়, কতটা তারা সর্বদাই দিয়ে যেতে পারে তারই ভিত্তিতে।” এক কথায় ‘সরকারের মূল শাসনব্যবস্থাটিকে চালু রাখার জন্য যতটুকু না হলে নয় তারই ভিত্তিতে হিসাব করে’ রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা উচিত। এক পর্যায়ে রাজস্ব-হ্রাসের প্রসঙ্গে ফিলিপ ফ্রান্সিস মোগল আমলের নজির টেনে নিজের বক্তব্য বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। মঁতাস্ক্যু বলেছিলেন যে মোগল শাসকেরা বিজিত দেশের রাজস্বের হার ও পরিমাণ অনড়ভাবে বেঁধে দিত বলেই তাদের শাসন এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। ২২ জানুয়ারি ১৭৭৬ তারিখের পরিকল্পনায় ফ্রান্সিস এই মত উল্লেখ করে বলেন: ‘মুসলিম বিজেতারা সুপরিমিত রাজস্ব আদায় করতেন, এবং আদায়ের ব্যবস্থার মধ্যেও কোনো জটিলতা ছিল না; এই কারণে তারা অতি সহজেই আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য কায়েম রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।’ স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এমন একটি কর-রাজস্ব ব্যবস্থা চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে করের হারকে সহনীয় রাখা হবে, কর আদায়ের ব্যবস্থায় জটিলতা থাকবে না, এবং সুপরিমিতভাবে কর-রাজস্ব আদায় করা হবে। এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শাসনকার্যের স্থায়িত্ব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এই একই ধারণার দ্বারা চালিত হয়ে তিনি জমির ওপরে সমস্ত প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ কর (tax) রদ করে শুধু খাজনাকেই (Rent) স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে করভার কৃষকদের ওপর থেকে কমে যায়, আর তারা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের কৃষিকাজ চালিয়ে নিতে পারে। কৃষকদের দিয়ে বেগার খাটানোর প্রথা, যেমন তাদের দিয়ে রাস্তা বাঁধার কাজে বেগার খাটানোর (corvee) প্রথা যেটা ফ্রান্সে একদা চালু ছিল, সেসব ‘সব রকম আবওয়াব ও মাথটের উচ্ছেদ’ করার তিনি প্রস্তাব করেন। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের চোখের সামনে ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। ১৭৭৬ সালের ২২ জানুয়ারিতে তিনি বলেছেন: ‘দেশের লোক এত গরিব হয়ে পড়েছে এবং আগের তুলনায় এত কম জমিতে এখন চাষের কাজ হয় যে স্বভাবতই যেটুকু জমিতে চাষের কাজ চালু থাকে তার ওপরে করের ভার ক্রমেই বেড়ে যায়।’ ফ্রান্সিসের আলোচনার মাধ্যমে রণজিৎ গুহ কী বার্তা দিতে চাইলেন? প্রথমত, ফ্রান্সিস ছিলেন অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ধনতন্ত্রের পন্থি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষিপণ্য চলাচলের ওপরে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থার অবসান। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভ্যন্তরীণ শুল্কব্যবস্থাকে বাংলার কৃষি, শিল্প ও বহির্বাণিজ্য বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর পদক্ষেপ বলে মনে করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত প্রকার অভ্যন্তরীণ শুল্ক উচ্ছেদ করতে। আমরা দেখেছি একটু আগেই যে সমস্ত প্রকার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে ভূসম্পত্তির ওপরে একটিমাত্র কর বসিয়ে খাজনার সঙ্গে মিলিয়ে আদায় করার প্রস্তাব। সাধারণভাবে মোগল রাজশক্তির অনুসরণে তিনি চেয়েছিলেন খাজনার অপেক্ষাকৃত পরিমিত ও অপরিবর্তনীয় হার। তিনি চেয়েছিলেন ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠা; জমিদার ও রায়তের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে দরকষাকষির সম্পর্ক; এবং সেই সুবাদে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষের নিরসন, এবং ব্রিটিশরাজের আয় ও রাজনৈতিক সমর্থনের যুগপৎ সম্প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সিস ১৭৭৬ সালে লাটসভায় যে প্রস্তাব এনেছিলেন তা ছিল তখনকার বিচারে প্রাগ্রসর। সামন্ততন্ত্রের বিপরীতে ধনতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ প্রতিযোগিতামূলক ও ব্যক্তিমালিকানা নির্ভর প্রস্তাব কলোনিয়াল পরিবেশে পড়ে বিপরীতধর্মী চেহারা নিল। অবাধ প্রতিযোগিতার ধার দিয়েও গেল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা মেট্রোপলিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। উদাহরণত, ফ্রান্সিস চেয়েছিলেন কোম্পানির ‘সাপ্লাই ব্যবসা’ করার জন্য খোলা টেন্ডারে কোনোরকম বৈষম্য না রেখে সমস্ত দেশি ব্যবসায়ীকেই কনট্র্যাক্ট নেবার সুযোগ দেওয়া হোক। এতে করে কলকাতায় বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে এবং আখেরে কোম্পানিরই লাভ হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ বাণিজ্যের প্রশস্তি কোম্পানির কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থা পূর্বাপর বজায় রইল। ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা পেল বটে, কিন্তু ফ্রান্সিস যাদের ভেবে জমিদারদের কাছে ভূমির অধিকার দিতে চাইলেন তারা মূলত এই সংস্কারের বাইরে থাকল। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী হলো এক শহুরে নব্য-ধনী সম্প্রদায়, যারা ছিল কোম্পানিরই সাথে জড়িত ব্যবসায়ী-আমলা-মুৎসুদ্দী। এরাই নতুন জমিদার ও নতুন তালুকদার হয়ে রাজত্ব করবে পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে। ফ্রান্সিস যাদের মালিকানা স্বত্ব থেকে বঞ্চিত রাখলেন ধনবাদী বিকাশের যুক্তিতে, তারা কালক্রমে জমি কর্ষণের অধিকারও হারাল। ফ্রান্সিসের উদ্ভাবিত জমিদার-রায়তের ‘স্বেচ্ছা-চুক্তির’ সম্ভাবনা মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল। তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।
১। প্রান্তবর্তী মানুষ রণজিৎ গুহকে নিয়ে তাঁর প্রায় শতায়ু জীবনের অবসানের পর পত্রপত্রিকায় লেখালিখি অব্যাহত রয়েছে। জীবদ্দশাতে প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। তার পেছনে একটি কারণ ছিল যে তিনি নিজেকে কিছুটা সচেতনভাবেই যেন প্রান্তবর্তী করে রেখে দিয়েছিলেন। মেইনস্ট্রিম বনাম বিকল্প ইতিহাস-চর্চার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন আরও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা না করে তিনি নিজেকে রেখে দিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স বা অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অপেক্ষাকৃত নির্জন অবস্থানে। এটা হয়তো ছিল তাঁর সচেতন সিদ্ধান্ত। নিরিবিলি ধ্যানকেন্দ্রী দূরত্বে বসে অবলোকন করা সহজ মেইনস্ট্রিমের ইতিহাস-চর্চার গতি-প্রকৃতি। যেমন করে আদিবাসীরা ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে অবলোকন করে ঔপনিবেশিক সেনাদলকে। ‘পলিটিকস অব নোলেজের’ কথাই যদি বলি, তবে সে রাজনৈতিক লড়াইয়ে প্রান্তবর্তী মানুষদের পক্ষে লড়াইয়ে পুরোধা যোদ্ধা ছিলেন রণজিৎ গুহ। একাধারে এই যুদ্ধের পরিকল্পক, সংগঠক, নির্দেশদাতা ও যোদ্ধা। রণজিতের জন্ম হয়েছিল বরিশালের সিদ্ধকাঠিতে, মৃত্যু ভিয়েনায়। শেষের দশ-পনেরো বছর তাঁর খুব কাছের দু’তিনজন আত্মার আত্মীয় সাব-অলটার্ন স্টাডিজের সাথে যুক্ত গবেষক ছাড়া প্রায় কারও সাথেই যোগাযোগ রাখতেন না তিনি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দীপেশ চক্রবর্তী; হয়তো আরও কেউ কেউ। শুনেছি পরিবার-স্বজনদের সাথে তাঁর যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। তার কারণ জানা নেই, তবে কিছুটা যোগাযোগ বোধ করি একমাত্র তাঁর ছোট ভাইয়ের মেয়ে দেবারতির সাথে থেকে থাকবে। এর কারণ শুধু অনুমানই করা চলে। কলকাতার বনেদি মধ্যবিত্তের মধ্যে আধা-সামন্ত্রতন্ত্রের প্রভাব নানাভাবেই উঁকি-ঝুঁকি দিত এমনকি সত্তর-আশির দশকেও। ডোমেস্টিসিটির ঘেরাটোপে বদ্ধ হয়ে ছটপট করত অনেক প্রাণ– তারা সেকালের মতো অন্তঃপুরবাসিনী না হলেও তাদের গতিবিধি খড়ির গণ্ডিতে বাঁধা। ঘরের কাজ ও বাইরের কাজ উভয় দিকই তাদের সামলাতে হতো। এসব আচার রণজিতের ভালো লাগেনি, এমনকি এ নিয়ে তাঁর মাকেও অনুযোগ করতে দ্বিধা করেননি। একবার রণজিৎ তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী মেখ্টিল্ডকে নিয়ে ক্যানবেরা থেকে কলকাতায় এলেন। উদ্দেশ্য মায়ের সাথে পরিচয় করানো। এ নিয়ে রণজিতের ভাইঝি দেবারতি পরবর্তী সময়ে লিখেছে: “That visit of Jethu and Jethima was my first introduction to the idea of ‘personal is political’. During that visit, I often saw Jethu getting angry with his mother, as she made my mother had her meal at the very end after serving everyone else. The goodies, the bigger fish, the bigger glass of milk- all were for the family’s men, while most of the household chores were done by my Ma (mother) alone, day in and day out.” দেবারতি এ-ও দাবি করেছে যে, এইসব আধা-সামন্তবাদী নিগ্রহ ক্রমাগত অবলোকনের কারণেই রণজিৎ একপর্যায়ে কলকাতার হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবার বা শ্রেণির ওপরেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন : ‘Jethu blamed it on the patriarchal.’ এমনকি একপর্যায়ে, দেবারতির মা যখন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন, রণজিৎ ‘broke all his ties with his mother and never visited her again.’ মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পেছনে ছিল সামন্তবাদী মানসিকতার প্রতি তীব্র বিরুদ্ধাচরণ– তা সে ঘরেই হোক বা বাইরেই হোক। ইতিহাস-চর্চা করতে গিয়ে যিনি সবসময়ে ‘পলিটিকস অব নোলেজ’ নিয়ে সজাগ থেকেছেন, ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনেও তিনি এ বিষয়ে– বিশেষত নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে– বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। এ ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘এক্সট্রিম’ মনে হতে পারে, কিন্তু এক অর্থে তিনি চরমপন্থিই ছিলেন বিশুদ্ধতম অর্থে। রণজিৎ কথাটার মধ্যেই ‘রণ’ লুকিয়ে আছে। যুদ্ধে জয়ী হলেন কিনা, সেটা মহাকালই বলবে। কিন্তু আজীবন যুদ্ধরত ছিলেন, সেটা তাঁর পরম শত্রুও স্বীকার করতে বাধ্য। সেজন্যই মেইনস্টিম ইতিহাস-চর্চার বিপক্ষে ক্রমাগত অবস্থান নিতে পেরেছিলেন এবং নিজেকে তার জন্য তৈরি করতে পেরেছিলেন। এবং এই প্রস্তুতি পর্বে তাঁকে চলতে হয়েছিল প্রায় একাই। আমি সেই ষাট-সত্তর দশকের কথা বলছি যখন পর্যন্ত তাঁর ধারে-পিঠে তরুণ সঙ্গীরা একে একে জমায়েত হতে শুরু করেনি। তরুণ বিদগ্ধ অনুসারীগণ– যাদের তুলনায় রণজিৎ ছিলেন প্রায় দুই দশকের বেশি বয়সী– সমবেতভাবে একটি সংগঠনের শক্তি বা মহিমা এনে দিয়েছিল কলকাতার নিস্তরঙ্গ জীবনে। রণজিতের দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক নিঃসঙ্গতার অবসান ঘটেছিল সাব-অলটার্ন স্টাডিজের ঘোষণার মাধ্যমে। মধ্যযুগের ওপরে গবেষক ও ইতিহাসবিদ আব্দুল মোমিন চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, রণজিৎ গুহের সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে একঝাঁক নতুন ইতিহাসবিদের সৃষ্টি। পার্থ চ্যাটার্জি, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমীন, জ্ঞান পান্ডে– ইতিহাস-রাজনীতি-সমাজতত্ত্ব-দর্শন-সাহিত্য বিবিধ ক্ষেত্রে বিচরণ তাঁদের। কিন্তু এর শুরুটা হয়েছিল রণজিৎ গুহকে দিয়ে। বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনা দিয়ে যার সূত্রপাত।
২। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ছায়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মানে চিরকালের জন্য জমিদারি বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্তের পত্তন হয়েছিল ১৭৯৩ সালে। ওরকম একটি সুদূরবর্তী ঘটনাকে কেন্দ্র করে রণজিৎ গুহের এতটা উৎসাহ কেন– তা নিয়ে একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেননা আমরা তো জানি যে, এই দীর্ঘ সময়ে এই ব্যবস্থার ভালো-মন্দ নিয়ে লেখা তো কম হয়নি, এমনকি পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত খতিয়ান নিলেও। রণজিৎ গুহ এর একটি সমকালীন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হলো ফ্লুড কমিশনের রিপোর্ট। তখন চারদিকে একটা রব উঠল যে জমিদারি ব্যবস্থা অচিরেই উঠে যাচ্ছে বা এর বড় আকারের সংস্কার হতে যাচ্ছে। কলকাতা বা ঢাকার (হিন্দু) মধ্যবিত্ত সমাজ– যারা এই ব্যবস্থার ছায়ায় এতকাল লালিত-পালিত হয়েছে– তারা আকস্মিক ভয়ে যেন কুঁকড়ে গেল। রণজিৎ গুহ এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন: ‘আমার বাবা ছিলেন হাইকোর্টের উকিল। জীবিকার প্রয়োজনে অনেক বই পড়তেন ও কিনতেন। একদিন দেখি ফ্লুড কমিশনের রিপোর্ট ছয় খণ্ড এসে গেছে। শুনেছিলাম যে তাতে নাকি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভার পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি ছাপা হয়েছে। কৃষকসভা যে কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালিত গণ-সংগঠন তা জানা ছিল। তাই কলেজ কামিয়ে রিপোর্টটা নিয়ে বসে গেলাম। সেই পড়ার ফলেই গ্রাম-সমাজে ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আমার বালকবয়সের কৌতূহল প্রথম যৌবনে রাজনৈতিক জিজ্ঞাসায় রূপায়িত হয় এবং কালক্রমে আমাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত করে। তবে ভূমিস্বত্ব নিয়ে যে আলোচনা ও বাগ্বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছিল মহামন্দা ও মহাযুদ্ধের যুগে, তার সঙ্গে, আপাতদৃষ্টিতে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে লেখা আমার রচনার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না– না বিষয়বস্তুতে, না দৃষ্টিভঙ্গিতে। জমিদারি প্রথার তৎকালীন সংকট ও তা সমাধানের উপায় কী, তা আমার জিজ্ঞাসা নয়। আমার প্রশ্নও সেই সংকটকে ছুঁয়েছে, তবে সরলে নয় তির্যকে: অর্থাৎ সাম্প্রতিকে নয়– অতীতে দেড়শ বছরের ব্যবধানে, প্রত্যক্ষের প্রতীয়মানতায় নয়– ধারণায়, লক্ষণে নয়– কারণে। কেন, এদিক থেকে, আমার ইতিহাস-চিন্তা উন্মার্গগামী হলো? উত্তরে আমি কেবল এটুকু বলতে পারি যে, অপরিসর গ্রাম্য পরিবেশে কিছু অসংগতির আভাসে যেমন বিভ্রান্ত বোধ করেছিলাম প্রথম বয়সে, তেমনি আবার যৌবনে আরও বড় মাপের আরেকটু জটিল অসংগতি-প্যারাডক্স আমার সংশয়-প্রবণতাকে উত্তেজিত করে। আমি তখন এমএ ক্লাসে এক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকের কাছে ইংরেজ রাজত্বে বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়া নিচ্ছি। সেই সূত্রেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল প্রবক্তা ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে লাট কাউন্সিলে ওয়ারেন হেস্টিংসের মতানৈক্যের বিবরণ পড়ে আমার যেন মনে হচ্ছিল যে, রাজস্ব ও রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে বাংলার কৃষিতে এক প্রকার ধনতন্ত্রের প্রবর্তন করাই ফ্রান্সিসের উদ্দেশ্য। অথচ ফ্লুড কমিশনের রিপোর্টে সংকলিত বিবৃতিগুলো থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, সেই বন্দোবস্তের জোরেই জমিদারি প্রথা গ্রাম-সমাজে আধাসামন্ত শোষণ ও সংস্কৃতিকে এতকাল কায়েম রাখতে পেরেছে। তাহলে কি বুঝতে হবে যে মূল পরিকল্পনাটিতেই এমন কিছু স্ববিরোধিতা ছিল, যা তার ধারণারই মর্মস্থ এবং যার ফলে তত্ত্বে ও প্রয়োগে সামঞ্জস্য ঘটতে পারেনি? ভাবি, এই অসংগতি কি আমারই মিথ্যা অনুমান, নাকি ছিটেফোঁটা ঐতিহাসিক সত্য তাতে থাকলেও থাকতে পারে? কী করে সেই সংশয়ের নিরসন হয় জানি না, অথচ তা মন থেকে সরাতেও পারি না। তাই মরিয়া হয়ে অধ্যাপক মহাশয়কে একদিন জিজ্ঞেস করে বসলুম, আর তিনিও সোজাসুজি উত্তর দিলেন– থাক, এখন ওসব থাক, আগে পরীক্ষাটা ভালো করে দাও, তারপরে দেখা যাবে। তিনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার সাফল্য কামনা করেন বলেই সেই রকম উপদেশ দিলেন। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা যে বাগ মানে না। নানা বই উল্টোই, উত্তর খুঁজি। মাঝে মাঝে দু-এক ঝলক আলো এসে পড়ে এখান থেকে ওখান থেকে, মনে হয় যা ভাবছি তা হয়তো অবান্তর নয়। কিন্তু এমন কোনো তথ্য মিলছে না যে তার ওপর নির্ভর করে সঠিক কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায়।’ এই ধাঁধার কারণটি কী? এলিয়ট বলেছিলেন– ‘Between the idea and reality/Falls the Shadow’ ev ‘Between the conception and creation/Falls the Shadow’. এই ধাঁধা কি সে রকমই কিছু: ‘ভেবেছিলাম এক, আর হলো আরেক। শিব গড়তে বাঁদর গড়া?’ আপাতদৃষ্টিতে যেটি কেবল ‘আইডিয়ার ইতিহাস’, রণজিৎ গুহের হাতে পড়ে তা অন্য এক টুইস্ট পেল। প্রথম পর্যায়ের ধাঁধা ছিল এরকম। ব্রিটিশরা তো এ দেশে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রবর্তন করতে চেয়েছিল এবং তারা আশা করেছিল যে, এটি করা হলে জমিতে বিনিয়োগের প্রতি জমির মালিকের আগ্রহ বাড়বে এবং কালক্রমে একটি পুঁজিবাদী খামার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। যেমনটা হয়েছিল ইউরোপে, কিন্তু তা না হয়ে এক ধরনের ‘সামন্তবাদী’ বা ‘আধা-সামন্তবাদী’ ব্যবস্থার জন্ম হলো কেন পুঁজিবাদের পরিবর্তে? ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস। তিনি তো জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থার ঘোর সমর্থক ছিলেন। রণজিৎ তাঁকে অর্থশাস্ত্রের জনক এডাম স্মিথের সাথে অনেক ক্ষেত্রে তুলনা করেছেন প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার মানদণ্ডে। তাহলে তিনি কেন বুঝতে পারছিলেন না যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে যে-ব্যবস্থা বাংলার কৃষিতে পত্তন হতে যাচ্ছে, তা কৃষককুলের সর্বনাশ বয়ে আনবে (কতটা সর্বনাশ সেটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এর পাঠক মাত্রেই জানেন)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
জবাবে শেখ মুজিব বললেন: শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক্ষায় তোমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে চাও, করো। কিন্তু আমি সে পথেই যাব না। যে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং কৃষকের সংগঠন ও চেতনার স্তর নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, সে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় কালক্ষেপ করতে আমি রাজি নই। এক, প্রথমে পাকিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করব। দুই, এ দেশে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। তিন, সভ্য জগতে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। চার, এমন কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া উত্থাপন করতে যাচ্ছি যাতে শ্রমিক, কৃষক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মেহনতি মানুষ সকল সম্পদের মালিক হয়; রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বে সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম: উপরিউক্ত চারটি দফা যদি আদায়ই হয়, তবে সে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না, হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ধরনের একটা কিছু। কিন্তু মেহনতি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে হবে। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অবস্থান কীরূপ দাঁড়াবে সে প্রশ্নেরও বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচিতে। জবাবে মুজিব বললেন: ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত মানুষের জন্যই তো আমাদের সংগ্রাম। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এ দেশে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে যে পারা যাবে না সে সম্পর্কে আমি সজাগ, আমি নিশ্চিত।’ এই ম্যানিফেস্টো-ধারার বিবৃতিকে নিছক ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’-এর অনুবর্তী বললে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণাটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করা হবে। আবার একে প্রথাগত সোভিয়েত-চীনের ধারার সমাজতন্ত্র বললেও অন্যায় করা হবে। উভয় বিচারই তথ্যনিষ্ঠ হবে না। এখানেই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ বিশেষত্ব। কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাক এটা যেমন তিনি চান না, তেমনি চান না কোনো একনায়কত্বের শাসন। বর্তমান নিবন্ধ থেকে কয়েকটি প্রবণতা বেরিয়ে এসেছে– যা নিয়ে আরও কাজ করা দরকার– তা এই পর্যায়ে দাখিল করব। ১. উন্নত ধনতন্ত্রের বেশ কিছু দেশে যে ধরনের ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ পাই, বা প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে অতীতে (এবং বর্তমানে কোন কোন দেশে) যে ধরনের ‘স্টেট সোশ্যালিজম’ দেখতে হয়েছে, তার বাইরে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের প্রগতিশীল সহকর্মীদের। এ দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই তাঁদেরকে নতুন পথ খুঁজতে বাধ্য করেছিল। ২. এই নতুন পথের নাম ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’। বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশেই একে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ পথ হিসেবে। এই সংজ্ঞা বাহাত্তরের গণপরিষদের সংবিধান আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকট সহকর্মীরা বহুবার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘প্রস্তাবনা’ অংশে উল্লিখিত উদ্ধৃতি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে সবচেয়ে যথাযথ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে ধারণ করে: ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা‒ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ ৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহুদিন থেকে। এ বিষয়ে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন কমিটমেন্ট ছিল। এ নিয়ে প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচির’ ঘোষণায় সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট সুষ্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়। এই পূর্ব-ইতিহাস জানলে বুঝতে কষ্ট হয় না কেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের দাবি সাহসের সাথে উল্লিখিত হয়েছিল। নির্বাচনের মুখে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি নিয়েই শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সমাজতন্ত্রের ধারায় সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি তোলার জন্য অসম্ভব সৎসাহস থাকা দরকার। বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রতিকূল ও বিরূপ পরিস্থিতিতে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পরোক্ষভাবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছিল: ‘আমাদের বিশ্বাস শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব। অন্যান্য অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ এই নির্বাচনী ইশতেহারেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল ‘জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলিসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা,’ তবে এ ক্ষেত্রে ‘বেসরকারি পর্যায়ে নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুবিধে’ রাখা হয়েছিল ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য। এ ছাড়া বলা হয়েছিল ‘জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার বিলুপ্তি সাধনের কথা’। পরিষ্কারভাবে অঙ্গীকার দেওয়া হয়েছিল ‘সব প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করার কথা’ এবং সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই যাতে ‘সমান অধিকার ভোগ’ করে এই প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ ছিল। অনেকের চোখেই এটি ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ জুড়ে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তরফে প্রায় নিশ্চিতভাবেই অতিরিক্ত নির্বাচনী ঝুঁকি নেওয়া, বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে। কিন্তু সমানাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্বাপর অবিচল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের প্রতি এই অঙ্গীকার আরও গভীর হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশ পরিষদের সদস্যবর্গের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহুপূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারও মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।’ ৪. এই পর্যায়ে অবশ্য এটাও বলা দরকার যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণাটির ‘দুই অংশই’ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুনের ভাষণে স্পষ্ট করে এ কথা বলেছিলেন, ‘আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।’ এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুসারী–যিনি ‘লিবার্টি প্রিন্সিপালকে’ প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং যিনি ভেবেছিলেন ব্যক্তিস্বার্থকে বাদ দিলে প্রগতির চাকা রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার স্বাধীনতার পরে হঠাৎ করে বা কেবল বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালে গড়ে ওঠেনি। দেশি-বিদেশি পারিপার্শ্বিক শক্তির চাপে বা প্রভাবে এটি উদ্ভূত হয়নি। সংবিধানের চার স্তম্ভও তেমনি নিছক স্বাধীনতা পরবর্তীকালের উদ্ভাবন নয়। এর পেছনে ছিল দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরম্পরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫. ধারাবাহিকভাবে গড়ে ওঠা এবং ক্রমাগতভাবে উচ্চারিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পেছনে প্রেরণা এসেছিল বিভিন্ন সূত্র থেকে। নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট একটি পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল ইউরোপের– বিশেষত উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের– ‘সোশ্যাল স্টেট’, ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ প্রভৃতি ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে। পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশের তখনকার দিনের অগ্রগতিও। ১৯১৭ সালের পর থেকেই সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের তরফে কম্পিটিটিভ ‘সোশ্যাল পলিসি’ গ্রহণের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ধনবাদী নানা দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারা এবং রাশিয়া, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের নানা সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রাথমিক উন্নয়ন সাফল্য এই দুটি দিকই তৃতীয় বিশ্বের সদ্য-স্বাধীন নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারেনি। সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন মুজিবের এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেক আগে থাকতেই। এ ক্ষেত্রে পঠন-পাঠনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তো ছিলই; কাজে এসেছিল প্রত্যক্ষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও। প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৯৫২ সালে তরুণ শেখ মুজিবের নয়াচীন ভ্রমণ, যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকলে কত অনায়াসে সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘সুযোগের সমতা’ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনকে নিশ্চিত করা যায়। যদিও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে মুজিব প্রশংসার পাশাপাশি নয়াচীনের সমালোচনাও করেছেন‒ বিশেষত মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্রের অভাব ঘটছে এই আশঙ্কা করে। যে রকম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্ট্যালিনের রাশিয়ায় একনায়কের ছায়া দেখতে পেয়ে। ৬. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ওপরে পরোক্ষ প্রভাব এসেছিল বাঙালির ‘সমাজতান্ত্রিক’ ঐতিহ্য ও সাম্যচিন্তার সূত্রেও। রাজনীতি-সচেতন ও সংস্কৃতিমনা শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা বাঙালির ‘প্রগতিশীল’ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিলেন এই ঐতিহ্যের দুটি প্রধান স্তম্ভ। ‘সাম্যের’ বঙ্কিম থেকে ‘লাঙলের’ সাম্যবাদী নজরুল; ‘রাশিয়ার চিঠি’ ও ‘সভ্যতার সংকটের’ রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘সুলতানার স্বপ্নের’ বেগম রোকেয়া; ‘রায়তের কথার’ প্রমথ চৌধুরী থেকে ‘শাশ্বত বঙ্গের’ কাজী আব্দুল ওদুদ বাঙালির প্রগতিশীল চিন্তার প্রবাহে একেকটি মাইলস্টোন। এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। এদের যাপিত জীবন ও লেখনীর মধ্য থেকে একটি সমৃদ্ধ উদারনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচারমুখীন ‘সমাজতান্ত্রিক’ সমাজের আদর্শ ক্রমশ স্পষ্ট অবয়ব নিয়েছিল, যা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের মানসভুবনকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে থাকবে। বিশেষত এদের প্রায় সকলের লেখনীর মধ্যেই ছিল চোখে পড়ার মতো সামন্তবিরোধী ভাবধারা, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এর ফলে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা এবং সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতার নীতি স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সম্মুখসারির ইস্যু হিসেবে চলে আসে। এর সাথে যুক্ত করতে হয় চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। সেসব দেশ-কাঁপানো ঘটনাবলি যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ; সাতচল্লিশের দেশভাগ; পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নীতি; পঞ্চাশের দশকের নিরস্ত্রীকরণ ও বিশ্ব-শান্তি আন্দোলন; ‘বাইশ পরিবারের’ সৃষ্টি; রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ; পূর্ব বাংলার দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন; জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্য; অগণতান্ত্রিক আচরণ ও গণবিরোধী নীতি-পদক্ষেপ ইত্যাদি ছিল জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া তত্ত্বের কিছু জরুরি উপকরণ। এসবই মুজিবকে সমৃদ্ধ করেছে– পূর্বনির্ধারিতভাবে নির্দিষ্ট করেছে বাহাত্তর সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ। এসব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপাদানের বিবরণ ছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা আদলকে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তির নিরিখে ঠিক স্পষ্ট করে চেনা যায় না। ৭. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কয়েকটি মৌল বৈশিষ্ট্যকে বর্তমান প্রবন্ধে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: (ক) বিভিন্ন ধরনের মালিকানার সহাবস্থান বা ‘মিশ্র অর্থনীতি’; (খ) অর্থনৈতিক বাস্তবতাবাদ বা ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম; (গ) একচেটিয়া (মনোপলি) পুঁজির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান; (ঘ) ‘সুযোগের সমতা (ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি) ও ‘ফলাফলের সমতা’ (‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’); (ঙ) নানামাত্রিক শোষণের অবসান; (চ) তীক্ষ্ণ জোটনিরপেক্ষতা বা ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’; এবং (ছ) ক্রমান্বয়বাদীতা বা গ্র্যাজুয়ালিজম। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই বিশদ বিচার-বিশ্লেষণের দাবি করে। সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায় এরা এমন কতগুলো দিক তুলে ধরেছে; যা প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মধ্যে নেই, অথবা থাকলেও নিতান্ত অসম্পূর্ণভাবে উপস্থিত। ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে বিভিন্ন মালিকানা-সম্পর্কের একত্রে উপস্থিতি ও তার গুরুত্ব। এর অর্থ, যা কিছু সামাজিক কল্যাণ, কর্মসংস্থান ও গরিবমুখী বণ্টনের জন্য ফলদায়ী হবে সেই মালিকানা-সম্পর্ককেই জনকল্যাণের স্বার্থে স্বীকার করে নেওয়া হবে ‘পরিকল্পনা’ গ্রহণের সময়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে বা মালিকানায় থাকবে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত সকল খাত; যা সরাসরিভাবে সামষ্টিক কল্যাণের বা ‘পাবলিক গুড’-এর বণ্টনের সাথে জড়িত। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিপণন-নির্ভর ‘সমবায়ী মালিকানাকে’ উৎসাহিত করা হবে। ব্যক্তিমালিকানাকে যথাবিহিতভাবে বিকশিত হতে দেওয়া হবে, অনেক ক্ষেত্রে তাকে অগ্রাধিকারও দেওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগত পুঁজিপতি শ্রেণিকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বা প্রভাব-বিস্তার করার মতো অবস্থানে যেতে দেওয়া হবে না। ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজমের নীতি বলছে যা কিছু জনকল্যাণের জন্য উপকারী, সেই নীতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ‘পরিকল্পনা’, ‘বাজার’ এবং ‘সামাজিক উদ্যোগের’ মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কেমন দাঁড়াবে সেটি ঠিক করবে অর্থনৈতিক প্রয়োজন, প্রশাসনিক সামর্থ্য এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক বিশ্ববাস্তবতা। অর্থাৎ কোনো পূর্বনির্ধারিত ডগমা বা আইডিওলজি নয়, বাস্তবে কোন নীতি কতটা ফলপ্রসূ সেই নিরিখে নীতিমালা নেওয়া হবে বা বদলানো হবে। দারিদ্র্য নির্মূল করা এবং সব পেশার ও জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত মানব-উন্নয়ন নিশ্চিত করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়া যথাসম্ভব গরিববান্ধব প্রবৃদ্ধি ও অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টনের জন্য বাস্তবোচিত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্ত-বিরোধিতা হবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনোমতেই অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতে কতিপয় ব্যবসা-গোষ্ঠীর একচেটিয়া রাজ বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন/কেন্দ্রীভবন হতে দেওয়া যাবে না। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র তার জাতীয়করণ নীতি, কর-রাজস্ব নীতি, মুদ্রা ও আর্থিক নীতি পরিচালিত করবে। বৃহৎ শিল্প-বাণিজ্য খাতে অনাদায়ী মন্দ ও খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ জড়ো হয়ে থাকলে সেসব উদ্যোগকে ‘মিশ্র মালিকানায়’ নিয়ে আসা সম্ভব। খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ মূল্যের শেয়ার সরকারি মালিকানায় ন্যস্ত করা যায়। প্রযুক্তিগত উন্নতিতে সকল প্রকার প্রণোদনা ও উৎসাহ দেওয়া হবে সকল শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু ‘সুযোগের সমতার’ বিধান করলেই চলবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আরও সমতামুখীন হচ্ছে কিনা সমাজ-অর্থনীতি, সেটিও দেখতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত আয়-বণ্টন নীতি গ্রহণ করতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তা সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে; সবার জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বাস্তবায়ন করতে হবে; সকলের জন্য ‘গ্রহণযোগ্য’ পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে; সবার জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; মানবপুঁজি বিকাশের মাধ্যমে উন্নত পেশা বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সুবাদে আয়-বৈষম্য বিশেষত ইন্টার-জেনারেশনাল ইনইকুয়ালিটি কমিয়ে আনতে হবে। একই সাথে সমাজের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে কালক্রমে উচ্চ আয়ের মানুষের সাথে এবং অগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমপর্যায়ে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নেবে রাষ্ট্র। এর জন্য চাই প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পদকর এবং ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ঋণ’ পাওয়ার ব্যবস্থা– সর্বস্তরের পেশা ও শ্রেণির মানুষের জন্য। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে নারীদের ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষের মধ্যে নানাবিধ বৈষম্য দূরীভূত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে কোনো ছাড় নেই। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র ও তার বিদেশ নীতি পরিচালিত হবে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে। এই নীতি সবার সাথে বন্ধুত্বের নীতিতে বিশ্বাসী, তবে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী। এটি কোনো বহিঃশক্তির অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। এক কথায়, বিদেশ নীতি র্যাডিক্যাল ধারার জোটনিরপেক্ষতার অবস্থানকে অনুসরণ করবে, যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ে। সবশেষে, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কাছের ও দূরের লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় বিধান করবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কৌশলে কোনো পূর্বনির্ধারিত ছক বা মডেল নেই। এ ক্ষেত্রে কাছের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নের আশু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা আর দূরের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, যেখানে প্রাথমিক ও মৌলিক প্রয়োজনই শুধু পূরণ হবে না, জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ বৈষয়িক ও আত্মিক উভয়বিধ বিকাশকে লালন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, সে লক্ষ্যের দিকে রাতারাতি যাওয়া সম্ভব হবে না। যেতে হবে পর্যায়ক্রমে, স্টেপ-বাই-স্টেপ, প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে অতিক্রম করে, অর্থাৎ গ্র্যাজুয়ালি। কেউ বলবেন, নিও-লিবারেল গভর্নমেন্টালিটি বা বাজার অর্থনীতির যুগে এসবই স্বপ্ন, কিন্তু এটি একটি সুন্দর ও সাহসী স্বপ্ন, যার পেছনে ছোটা চলে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা ১৯৭১ সালে এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। আজকের বাংলাদেশেও এর তাৎপর্য অস্বীকার করার নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
১৬.৬। র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রগতিশীল বিদেশনীতি। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি তুলনামূলকভাবে অনালোচিত দিক। এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী অবস্থান আরও মনোযোগের দাবি রাখে। ‘এ ক্ষেত্রে কারও সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ বললে পুরোটা বলা হয় না। এ জন্য বোঝা দরকার বঙ্গবন্ধুর ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর মতো প্রাগ্রসর অবস্থানকে। এটিকে শুধু স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতায় গৃহীত এক কুশলী বৈদেশিক নীতি-পদক্ষেপ হিসেবে দেখলে খাটো করা হবে। এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান বঙ্গবন্ধুর মনে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছিল। এর স্পষ্ট প্রতিফলন প্রথম লক্ষ্য করা যায় ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। সেখানে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন ‘পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ শীর্ষক শান্তি-সম্মেলনে অংশ নিতে। তরুণ মুজিব তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, ‘আমরা শান্তি চাই’। কারণ, যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে– যে দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে।” ১৯৫২ সালে লেখা এটি, অথচ ২০২২-২৩ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে এর প্রাসঙ্গিকতা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়ে গেছে। কয়েকটি উদাহরণ:
১। ১৯৪৯ সালের ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ বলা হয়েছিল: ‘পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করার সমস্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানকে অংশীদার হইতে হইবে এবং শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সর্বব্যাপী বিজয় অভিযানকে জয়যুক্ত করিবার জন্য অন্যান্য জনগণতান্ত্রিক ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সর্বপ্রকার প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর আন্দোলন ও কর্মধারায় সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতা করিতে হইবে। দুনিয়ার সমস্ত জালিমদের সহিত সংগ্রাম করিয়া মজলুমদিগকে মুক্ত করাই হইবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য।’
২। নয়াচীন ভ্রমণের এক বছর পরে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ (শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত) বলা হয়েছিল: ‘তাই আওয়ামী লীগ … সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করিয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নীতির অনুকূলে শান্তি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। … শান্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়া আওয়ামী মুসলিম লীগ যুগ যুগব্যাপী মানুষের প্রতিভা ও সাধনার প্রতিভূ মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য বিশ্বধ্বংসী রণপাগল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ আজ নীতিগতভাবে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির মহান নেতা।’
৩। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিব উচ্চারণ করেন দলের বিদেশনীতি: ‘সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব, হিংসা কারও বিরুদ্ধে নহে (Friendship to all, Malice to none) আওয়ামী লীগ বৈদেশিক সম্পর্কে এই নীতিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা প্রদান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড় (static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষ (Dynamic) এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী। তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীননীতি গ্রহণে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসী।’
৪। ১৯৬৭ সালে গৃহীত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা অর্থাৎ (ম্যানিফেস্টো)’তে বলা হয়েছিল: ‘আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাস করে। সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং একনায়কত্বমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থন থাকিবে।’
৫। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল: “পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনোমতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না এজন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হয়। আমরা ইতোমধ্যে ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ ও অন্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে, সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।”
৬। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায়-অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ এ-ই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।
১৬.৭। গ্র্যাজুয়ালিজম বঙ্গবন্ধু তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আরেকটি মৌল বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। সেটির এককথায় নাম– ধাপে ধাপে চলা, পর্যায়ক্রমতা (ইংরেজিতে Gradualism)। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠার পথ এক দীর্ঘ অভিযাত্রার পথ। এখানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে নানামুখী কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কখনও বাঁয়ে, কখনও ডানে সরে এসে; কখনও দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে, কখনও দ্রুত পথ অতিক্রম করে চলতে হয়। এজন্য ‘বিশুদ্ধপন্থি’ হলে চলে না। একেই মাইকেল হ্যারিংটন (১৯৮৯) অভিহিত করেছিলেন ‘ভিশনারি গ্র্যাজুয়ালিজম’ বলে। এজন্যই খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে (পূর্বে-উদ্ধৃত কথোপকথনে) মুজিব বলেছিলেন, ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে’ এ দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দিকে। এই যাত্রাপথে পরিকল্পনা ও বাজার-অর্থনীতি উভয়কেই আশ্রয় করতে হয়; ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সামষ্টিক জমায়েত উভয়কেই উৎসাহিত করতে হয়; স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হয়। সমাজের aspiration এবং custom-culture কে হিসেবে নিতে হয়। এর বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের প্রথম অধ্যায়ে। যেখানে দেশের উন্নয়নের ধারা বেগবান করার জন্য ‘দূরের’ সাম্যবাদী লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ‘কাছের’ উন্নয়ন-সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিটি আমি এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে ধরছি। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কতগুলো পূর্বশর্ত আলোচিত হয়েছিল। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিলে যথার্থই বলা হয়েছিল যে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দরকার বিদ্যমান পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন: ‘Without this assessment a country may adopt a programme which is unrealistic, either too ambitious or too modest’। বলা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পূর্বশর্তগুলোকে আগে শনাক্ত করতে হবে। যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বা প্রাগ-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের উচ্ছেদ, সেটা একলহমায় করা যাবে না: ‘Depending upon the objective conditions of the society, this may have to be done in stages’। দলিলে যথার্থই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন-বৃদ্ধির ওপরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করাই হচ্ছে আশু কর্তব্য: ‘In an underdeveloped economy such as Bangladesh, the socialist transformation of the economy must accompany the growth of productive forces. It has to be clearly understood that anything which hampers increase in productivity or growth of productive forces and dissipates the meagre resources of the country in unproductive activities and unnecessary consumption is in contradiction with the basic principles of socialism.’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে বেগবান করে ‘productive forces’ কে আগে বিকশিত করে এবং পরে ‘production relations’-এর পরিবর্তনের কাজে হাত দেওয়া সম্ভবত এই ছিল পরিকল্পনাবিদদের মত। পরিকল্পনা দলিলে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আরও যে ফ্যাক্টরের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটি হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র গড়ার ক্যাডার’ গড়ে তোলা। পরবর্তীকালে বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু এই দিকটির প্রতি বিশেষ জোর দেন। পরিকল্পনা দলিলে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছিল, সমাজের মূল্যবোধ সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পক্ষে ব্যাপকভাবে না দাঁড়ালে কখনোই উত্তরণ সফল হবে না: ‘As long as the broad masses are unable to accept the norms of behaviour necessary for a radical transformation of society, no amount of socialist policy adopted by the government can usher in socialism.’ আর সমাজের মূল্যবোধ শুধু সরকারি আমলাদের কাজের মাধ্যমে পরিবর্তন হয় না। এখানে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রশিক্ষিত আত্মনিবেদিত ‘ক্যাডার’ হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এনজিও লিটারেচারের পরিভাষায় এই ক্যাডাররা সমাজ-পরিবর্তনের ‘এনিমেটার’ বা ‘catalytic agent’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা বলে পরিকল্পনা দলিলে মন্তব্য করা হয় যে, কাজটা সহজ নয় আদৌ: ‘Before socialism becomes a reality, the task is to educate the public about the need for social change. The cadres are the instruments through which the task is carried out. We must, however, be aware of the fact that a cadre is as likely to degenerate as any one else.’ কেন এসব সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছিল পরিকল্পনা দলিলে সেদিন? স্পষ্টতই, দলিল-প্রণেতারা কোনো কল্পলোকে বিচরণ করতে চাননি এবং মাঠ-পর্যায়ের বাস্তবতাকে পরিকল্পনার মধ্যে বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘আত্মোৎসর্গ’ করার আহ্বান শুধু সাময়িক কালের জন্য কাজ করে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতকে আগেই উদ্ধৃত করেছি যেখানে তিনি বলছেন স্বার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে অর্থনীতির চাকা একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানব-চরিত্রের স্বার্থপরতার দিক এবং সমাজ-কল্যাণে ব্রতী পরার্থপরতার দিক উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন করেই ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যে-কথা দিয়ে তাঁর পরিকল্পনা দলিলের ভূমিকা শেষ করেছিলেন তা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে: ‘Development is a slow and painful process. It means present sacrifice for future gains. It is specially painful for a country at a very low level of living such as Bangladesh where an increasing and significant reliance is to be placed on domestic resources for development. We can make the sacrifice, which is so essential for development, socially tolerable only if it is equitably shared by all.’ এটা বলেই তিনি সতর্ক করলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের: ‘The room for flexibility is so small, the ability of the socio-economic system to withstand the effects of mistakes and waste is so severely limited that in the use of scarce resources as well as in experimenting with new institutions, great caution and extreme care need to be exercised.’ কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার সমস্যা বঙ্গবন্ধু গভীরভাবেই জানতেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কী ধরনের অর্থনীতি সে সম্পর্কে বিদ্বজ্জনের ভেতরেই নানা মত চালু ছিল। সেই অস্পষ্ট আদলের সমাজতন্ত্রে কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেটারও কোনো রেডিমেড ব্লুপ্রিন্ট তার হাতে ছিল না সেদিন। তার চারপাশের বুদ্ধিজীবীরাও সেটা স্পষ্ট জানতেন না, যেমন জানতেন না (এবং এখনও বলতে গেলে প্রায় জানেন না) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীরা। শুধু জানতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করে গতিশীল উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর জানা ছিল যে, শোষণমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবেই, এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে আটকে থাকাটাই মানব-ইতিহাসের চূড়ান্ত বিধিলিপি নয়। এখানে ‘চ্যালেঞ্জটা’ এত বড় যে বারবার ‘চেষ্টা’ করা ছাড়া অন্য কোনো সহজ পথ খোলা নেই। ৪ নভেম্বরের গণপরিষদ বিতর্কের সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে তাঁর মনের কথাটি বলেছিলেন: ‘সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না– অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়। … সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই– সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান– ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয়। এক দিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই– আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
১৭। শেষের কথা এবার বোধ হয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। প্রথমে আসি বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতাদর্শ প্রসঙ্গে। আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছিল একটি অসাধারণ ‘পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’, যা থেকে তাঁর অর্থনৈতিক মতাদর্শের স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে-কথাগুলো এখানে তুলে ধরব তা ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের বিশ্বাসের কথা, তাঁর মনের অন্তস্তলের কথা, কাউকে শোনাবার জন্য নয়, এসব তো আদৌ প্রকাশিতব্য ছিল না। এটি নিজের চিন্তাকে কেবল একটি স্থায়ী উপলব্ধির কাঠামো দেওয়ার প্রয়াস, যেটি কখনোই তাঁর মন থেকে মুছে যায়নি, আমৃত্যু যাকে তিনি লালন করেছেন। এখানে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। প্রথমে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি: “চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদী সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।” এটিকে কাকতালীয় বিবৃতি বলে মনে করার দরকার নেই। পরবর্তীকালে, ১৯৬৪ সালের কোনো এক সময়ে শেখ মুজিবের সাথে তার কলকাতা জীবনের সতীর্থ ‘মুজিববাদ’ বইয়ের লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের বৈঠক হয়। সে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই এখানে। ‘শেখ মুজিব আমাকে বললেন : তোমরা বামপন্থিরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু করেছ, সে সংগ্রাম সম্পাদন করতে হবে আমাকেই। তাঁর মুখে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি। আমিও হেসে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম : কীভাবে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধতা করার তৃতীয় কারণটি রাজনৈতিক। ব্যক্তি-উদ্যোগের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে উৎসাহিত করতে হবে জনকল্যাণের স্বার্থে। কিন্তু দেখতে হবে এটি করতে গিয়ে ব্যক্তি-পুঁজি যেন ‘রাষ্ট্রের পলিসি’ নিয়ন্ত্রণ করার মতো রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে না পারে। রাজনীতি ও পলিসির রথের ঘোড়ার লাগাম থাকতে হবে রাজনীতিবিদ ও রাজ-কর্মচারীদেরই হাতে–সেখানে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়া চাই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা এক্ষেত্রে যেমন সজাগ ছিলেন, তেমনি চিন্তিতও ছিলেন এনিয়ে। সেজন্যেই ইতোমধ্যে উদ্ধৃত অংশে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকুই দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না।’ স্বাভাবিকভাবেই একচেটিয়া পুঁজি বা বৃহৎ শিল্প-মালিকদের পক্ষে এই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ আরও বেশি। একথা শুধু বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন আহমদই বলেননি, বলেছেন অন্য সাংসদরাও। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নিয়ে (১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর) বলেছিলেন, ‘সাবেক পাকিস্তানে যে সমস্যা ছিল, তা দূর করার জন্য যদি মহানবীর বাণীর শত ভাগের এক ভাগও মেনে নিত, তাহলে কুখ্যাত আদমজী, দাউদ, ইস্পাহানীর মতো লোক এদেশে জন্মলাভ করতে পারত না।’ দেখা যাচ্ছে যে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই সেদিনের গণপরিষদে ‘একচেটিয়া পুঁজির’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের পক্ষে সমর্থন জানানো হচ্ছিল। এজন্যেই সংবিধানের ১৩নং ধারায় বলা হয়েছিল যে, কেবল ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যেই’ ব্যক্তি মালিকানাকে অপারেট করতে দেওয়া হবে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু সমাজতন্ত্রই (প্রচলিত মডেলের তুলনায়) অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত হবে তা-ই নয়, এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকেও ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হতে হবে। সেদিনই পুঁজির অন্যায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করে তিনি প্রথম উচ্চারণ করলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি। অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাকশাল প্রবর্তনের সময় বুঝি বঙ্গবন্ধু প্রথম ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। বস্তুত এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭২ সালেই। সেদিন তিনি বলেছিলেন: ‘মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলছে দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে– ঐ শোষকরা যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারও সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয়ই আমরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইনসিওরেন্স-কোম্পানি, কাপড়ের কল, জুট-মিল, সুগার ইন্ডাস্ট্রি– সব কিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষক-গোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’ ১৬.৪। ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’ বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এসে পড়েছিল। অন্তত সেগুলোকে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। তারপরও এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘স্বকীয়তা’ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের গণপরিষদে একটি সার্বিক সচেতনতা বিরাজ করছিল। এই স্বকীয়তাকে ঢাকা থেকে নির্বাচিত আবু মো. সুবেদ আলী প্রকাশ করেছিলেন এভাবে: ‘‘আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করি নি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটে’ও বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করি নি।’’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রেরণা এসেছে। এরকম একটি প্রেরণা হচ্ছে ‘সুযোগের সমতা’। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজের সকল নাগরিকের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ সৃষ্টি করার পাশাপাশি বাস্তবে জীবনযাত্রার মানেও যতটুকু সম্ভব সমতা আনা (যাকে বলা হয়ে থাকে– ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’)। জাতিসংঘের এমডিজি ও এসডিজি-এর কল্যাণে ‘equality of opportunity’ কথাটি এখন বহুল প্রচলিত একটি ধারণা। কিন্তু এদেশে এটির প্রথম সচেতন ব্যবহার হয় ১৯৭২ সালেই। বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় প্রথম উচ্চারিত হয় ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি বা সুযোগের সমতার কথা। সেখানে বলা হয়েছিল: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। এবং এর আগে ১৫নং ধারায় এই ‘সুযোগের সমতাকে’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল: ‘(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; (খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; (গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার।’ ১৮(১) ধারায় আলাদা করে পাবলিক হেলথ্ এবং নিউট্রিশন (পুষ্টির) কথাও বলা হয়েছিল: ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘পুষ্টির’ এই সংযোজন ছিল একটি বিরল দৃষ্টান্ত। দেখা যাচ্ছে, আজকের ‘সোশ্যাল প্রটেকশনের’ অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের’ কথা বলেছিল। লক্ষণীয় যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলা হচ্ছে‒ এই রাইটস্ বেইজড্ অ্যাপ্রোচের জন্ম হবে আরও বহু পরে। একটি কথা এখানে যোগ করা দরকার। এই যে মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ‘অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-চিকিৎসার’ ধারা বা নির্দিষ্ট করে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ ১৫ ধারায় বলা হলো এগুলো এলো কোন উৎস থেকে? মার্কসের লেখাটিতে বলা ছিল যে সাম্যবাদী বিকাশের প্রথম বা নিচু পর্যায়ে বণ্টননীতি হবে নিম্নরূপ: ‘From each according to his abilities, to each according to his work’। এখানে প্রত্যেকে যেন তার সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারে, এবং কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেতে পারে–এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। মনে হতে পারে, এগুলো বুঝি ইউরোপীয় ‘সোশ্যাল স্টেট’ বা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর ধারণা থেকে উঠে এসেছে। হয়তো পশ্চিম ইউরোপের বা উত্তর ইউরোপের ‘সামাজিক গণতন্ত্রীরা’ এর পেছনে বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জুগিয়েছেন। আসলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু থেকে এসব দাবি ‘প্রাণের দাবি, বাঁচার দাবি’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছিল। বিশ্বজোড়া সমাজবদলের ডাকও এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। এই প্রশ্নের একটি মীমাংসা পাই ড. কামাল হোসেনের ব্যাখ্যায়। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন: ‘১৯, ২০, ২১ [ধারা]–এগুলোর ব্যাপারে কারও কোন আপত্তি নেই। কারণ, এগুলো বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধান থেকে সন্নিবেশিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে কর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়। সে সম্পর্কে ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে পাওয়া যায়। এটা সোভিয়েত সংবিধানে রয়েছে।’ এই ৩টি অনুচ্ছেদ (১৫, ১৯ ও ২০) সংবিধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘সমাজতান্ত্রিক ধারা’। বলে রাখি, ১৯(১) ধারায় ‘সুযোগের সমতা’ এবং ১৯(২) ধারায় ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ এবং ‘নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। যদি ১৯(১) ধারায় বলা হয়ে থাকে সুযোগের সমতা (Equality of Opportunity)-এর কথা, ১৯(২) এবং ২০(১) ধারায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘Equality of Outcome’-এর প্রতি। ২০(১) ধারায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল মার্কসের ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ লেখাটির সূত্র ধরে ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ বণ্টনের নীতি। মোদ্দা কথা, ‘সুযোগের সমতা’ যার উল্লেখ আমরা পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক দর্শনে সুপ্রচুরভাবে পাই (যেমন, জন রাউলস-এর লেখায়) বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সেখান থেকে শুরু করলেও সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেখানে দুর্ভাবনা ছিল জন্মসূত্রে সমাজের বিভিন্ন নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির দুস্তর ফারাক নিয়ে। Initial conditions- এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকলে শুধু বর্তমান সময়ে ‘সুযোগের সমতার’ দাওয়াই দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য এবং সামর্থ্যের (capability) বৈষম্য দূর করা যায় না। জন্মসূত্রে ফারাকের সাথে যুক্ত করতে হয় ‘কপালের লিখন’-এর কথাও। অনেকেই আছেন, যারা বিশুদ্ধ দুর্ভাগ্যজনিত কারণে ব্যবসায় সফল হন না, অথবা আকস্মিক ট্রমার কারণে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেন না– এককথায়, ‘সুযোগের সমতার’ সদ্ব্যবহার করতে পারেন না এক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি, শুধু ‘সুযোগের সমতা’ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। একারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা Equality of Opportunity-এর পাশাপাশি ‘Equality of Outcome’-এর সাংবিধানিক বিধান রেখে গেছেন। এজন্যে তারা ১৯(২) ধারায় ‘সম্পদের সুষম বণ্টন’ নীতি এবং ২০(১) ধারায় মার্কসের ‘শ্রম অনুযায়ী বণ্টন’ নীতি–এ দুই নীতিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আবার পাশাপাশি ১৫(ঘ) ধারায় আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা লাভের গ্যারান্টি দিয়ে গেছেন ‘অধিকারের ভাষা’ ব্যবহার করে। ১৬.৫। নানামাত্রিক শোষণের অবসান বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজের পঞ্চম বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক ও মানবিক গুরুত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না। এই বৈশিষ্ট্যের মূল কথা নিহিত ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্যে। ১৯৭২ সালের ৭ই জুনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের সরলতম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন (যেটা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি): ‘এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।’ এর পূর্বলেখ (geneological trail) অনুসরণ করলে বহু পেছনে চলে যাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালের ‘পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছিল: ‘আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।’ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ছিল ‘শোষণের অবসান অবশ্যই করতে হবে’ এবং তাতে বলা ছিল– ‘বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৪ নং ধারায় উল্লেখ আছে– এটি ড. আম্বেদকরের ভারতীয় সংবিধানেও নেই– ‘‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে–কৃষক ও শ্রমিককে–এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ সবশেষে উদ্ধৃতি দিতে চাই প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিল থেকে। সেখানে প্রথম পরিচ্ছেদের ১.১২ অধ্যায়ের শিরোনামই ছিল– শোষণের হ্রাসকরণ (reducing exploitation)। ব্যাখ্যায় বলা ছিল: ‘Under the prevailing objective conditions elements of exploitation can only be reduced in phases if the productive process is not to be disrupted।’ এখানে বিভিন্ন দলিল থেকে ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার যে অঙ্গীকার তুলে ধরা হলো তা শুধু কথার কথা ছিল না। এই অঙ্গীকার ছিল গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, ‘শোষণ’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে (সংগত কারণেই) ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামের কৃষক জনগোষ্ঠীর ওপরে সামন্তবাদী জমিদারি-জোতদারি-জায়গিরদারি শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও সকল প্রকার ‘অন-অর্থনৈতিক শোষণ’ (extra-economic exploitation) শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। অর্থাৎ শুধু উৎপাদনকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক শ্রেণিসমূহ– যথা, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ– তাদের ক্ষেত্রেই দৃষ্টি সীমিত থাকেনি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সকল প্রকার ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে অর্থনৈতিক ও অন-অর্থনৈতিক (সামাজিক, সাংস্কৃতিক) শোষণের অবসান অর্থে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে নারীর প্রতি শোষণমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির অবসানের কল্পে। আজকের যুগে সামাজিক-ধর্মীয়-ভাষাগত-জাতিগত-লিঙ্গগত শোষণ-বঞ্চনার–বৃহত্তর অর্থে, আইডেনটিটি-পলিটিক্সের ডিসকোর্সের–অন্তর্গত ন্যারেটিভ হিসেবে পড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘শোষণহীন সমাজ’ ধারণাটিকে। একে শুধু অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা ভাবা ভুল। সংবিধানের ১৪নং ধারায় কৃষক-শ্রমিকের পাশাপাশি ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের’ কথা উল্লেখ ছিল এবং তাদের ওপরে ‘সকল প্রকার শোষণের’ অবসানের সাংবিধানিক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদে বেশ বিতর্কও হয়েছিল সেদিন সাংসদদের মধ্যে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। লারমা চেয়েছিলেন ১৪নং ধারার ‘অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান’ করার প্রতিশ্রুতিকে আরও সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে। ১৪নং ধারার পর ১৪ক শীর্ষক একটি নতুন অনুচ্ছেদ তিনি সংযোগ করতে চেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে ছিল নিম্নোক্ত সংযোজনী: ‘১৪ অনুচ্ছেদের পর নিম্নরূপ নতুন অনুচ্ছেদটি সংযোজন করা হোক: ১৪ক। সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ও অনগ্রসর জাতিসমূহের (ক) ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণ করা হইবে; (খ) শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ-অধিকার দেওয়া হইবে; এবং (গ) অগ্রসর জাতিসমূহের সহিত সমান পর্যায়ে উন্নত হইবার পরিপূর্ণ সুযোগ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা বিধান করিবেন।’ শেষ পর্যন্ত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংশোধনী-প্রস্তাব গণপরিষদে গৃহীত হলো না। অথচ ভুল শব্দের ব্যবহার (‘সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর জাতি’) সত্ত্বেও একথা তো পরিষ্কার, তিনি শুধু চেয়েছিলেন যে শুধু ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে শোষণের অবসানের প্রতিশ্রুতিই নয়, সেটাকে আরও সাংবিধানিক ভাবে দৃঢ় করা হোক কংক্রিট পদক্ষেপের মাধ্যমে। সেকারণেই তিনি বলেছিলেন, (ক) অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিসংক্রান্ত ‘বিশেষ অধিকার’ সংরক্ষণ করতে হবে; এবং (খ) রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে করে কালক্রমে তারা ‘অগ্রসর’ অংশসমূহের সাথে ‘সমান পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরিপূর্ণ সুযোগ পায়’। সেদিনের আনীত সংশোধনী প্রস্তাবে ‘জাতিসমূহ’ কথাটি বাদ দিয়ে লারমার প্রস্তাবিত মূল কথাগুলো ১৪নং অনুচ্ছেদে বাড়তি অনুচ্ছেদ হিসেবে রাখলে কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না। সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদে এসব কথা তো এমনিতেই ছিল (যেমন ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে)। বরং এটা করা হলে পরবর্তীকালে সৃষ্ট জাতিগত বা নৃগোষ্ঠীগত মনঃকষ্ট তৈরি হওয়ার কোনো যৌক্তিক অবকাশই হয়তো আর থাকত না। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য ‘শোষণহীন’ সমাজ প্রতিষ্ঠার আরেকটি অর্থ হচ্ছে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা বিধান। এটি নানা অনুচ্ছেদেই এসেছে গুরুত্বের সাথে। সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকারের’ অংশে ২৮(১) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে: (১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ (২) ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টিকে শিক্ষা লাভ, বিনোদন, ‘সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা’ প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের বিষয়টি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেসম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-উপলব্ধি ছিল। এজন্যেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নিতে কালবিলম্ব করেননি বঙ্গবন্ধু। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তরুণ মুজিব লিখছেন: “পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট” এই পুরানো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিতেছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছে। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।…নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।…যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়াছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের ওপরে। নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়াছে জাতিগঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোন কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।’
কথাটা প্রথম বলেছিলেন কবি, সমালোচক ও নজরুল-বিশেষজ্ঞ আবদুল কাদির। ১৯৬৪ সালের দিকে কেন্দ্রীয় বাংলা-উন্নয়ন-বোর্ড নজরুলের সমগ্র রচনাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তার দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় কবি আবদুল কাদির লিখলেন: ‘নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের দ্বিতীয় যুগের সূচনায় যে মতবাদের প্রবক্তা হন, তা প্রত্যক্ষত: গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজম)। তাঁর পরিচালিত ‘লাঙলে’ হয়েছিল তারই কালোপযোগী কর্ষণা। ‘লাঙল’ছিল ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের’ সাপ্তাহিক মুখপত্র; ১লা পৌষ ১৩৩২ মুতাবিক ১৬ই ডিসেম্বর ১৯২৫ তারিখে প্রথম (বিশেষ) সংখ্যাতেই সে সম্প্রদায়ের ‘উদ্দেশ্য’ও ‘চরম দাবি’ বিবৃত করে নজরুল এক ইশতেহারে বলেন: ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ-স্বাধীনতা-সূচক স্বরাজ লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
কবি আবদুল কাদির আরো বললেন যে ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজমের প্রতি নজরুলের মনের প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁর ‘সাম্যবাদী’ ‘সর্বহারা’ ও ফনি-মনসা’র বহু কবিতা ও গানে সুপরিস্ফুট। তাঁর ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের ‘আনসার’- চরিত্র এই আদর্শবাদের আলোকে বিকশিত।’ এই ভূমিকাটি লিখিত হয় ১৯৬৭ সালে। অথচ ঠিক তার এক বছর আগে লিখিত ভূমিকাতে কাদির সাহেব এক দ্বিধান্বিত নজরুলের স্বরূপ তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। যেন নজরুল এটাও হতে পারেন, ওটাও হতে পারেন। এমনকি নজরুলকে জাতীয়তাবাদী তুর্কী নেতা ‘কামালপন্থী’ বলতেও তার বাধেনি । কাদির সাহেবের দোলাচলের পুরো উদ্ধৃতিটি শোনা যাক । প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তিনি নজরুলের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না এবং শেষাবধি তার নজরুল-বিচারের কম্পাস স্থির হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের নামে:
‘নজরুলের দেশাত্মবোধের স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা নানাজনে নানাভাবে করেছেন। রাজনীতিক পরাধীনতা ও আর্থনীতিক পরবশতা থেকে তিনি দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীন মুক্তি চেয়েছিলেন। তার পথও তিনি নির্দেশ করেছিলেন। সেদিনের তাঁর সেই পথকে কেউ ভেবেছেন সন্ত্রাসবাদ-কারণ তিনি ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের উদাহরণ দিয়ে তরুণদের অগ্নিমন্ত্রে আহবান করেছিলেন; কেউ ভেবেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নিয়মতান্ত্রিকতা—কারণ তিনি ‘চিত্তনামা’ লিখেছিলেন; কেউ ভেবেছেন প্যানইস্লামিজম-কারণ তিনি আনোয়ার পাশার প্রশস্তি গেয়েছিলেন; আবার কেউ ভেবেছেন মহাত্মা গান্ধীর চরকা-তত্ত্ব—কারণ তিনি গান্ধীজিকে তাঁর রচিত ‘চরকার গান’ শুনিয়ে আনন্দ দিয়েছিলেন । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এসব ভাবনার কোনোটাই সত্যের সম্পূর্ণ স্বরূপ উদ্ঘাটনের সহায় নয়। প্রকৃত পক্ষে নজরুল তাঁর সাহিত্য-জীবনের প্রথম যুগে ছিলেন কামাল-পন্থী, কামাল আতাতুর্কের সুশৃঙ্খল সংগ্রামের পথই তিনি ভেবেছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য সর্বাপেক্ষা সমীচীন পথ ৷’
১৯৬৬ সালে নজরুলকে মনে করেছেন ‘কামালপন্থী’ বলে, আবার ১৯৬৭ সালে তাকে চিহ্নিত করেছেন ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিষ্ট’ বলে। ১৯৭৭ সালে চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকায় কবি আবদুল কাদির নজরুলকে সনাক্ত করছেন সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী বলে। রাজনৈতিক নজরুলকে তিনি চিহ্নিত করছেন এভাবে: নজরুলের ‘সচেতন মনে দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও সমাজতান্ত্রিক মানবিকতা (Socialistic Humanism) রাজনৈতিক চিন্তাদর্শরূপে প্রবলতম প্রেরণার সঞ্চার করেছে।’
কাদির সাহেব কেন এতবার নজরুল সম্পর্কে মত পাল্টালেন সেটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু নজরুলের রাষ্ট্রনৈতিক মত চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ঝোঁকটি বোঝা যায়। আর সেটি হচ্ছে সমাজতন্ত্রের প্রতি নজরুলের ঝোঁক। সাধারণ জনমনে বা এমনকি শিক্ষিত পাঠক সমাজে নজরুল সম্পর্কে যে-‘বিদ্রোহী’ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সেটি বেঠিক নয়। কিন্তু তাতে করে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শের প্রধান ঝোঁককে চেনা যায় না। ‘বিদ্রোহী’ তিনি তো বটেই, কিন্তু সেই বিদ্রোহ কি ছিল শুধু রাজনৈতিক স্বরাজ বা পূর্ণ-স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ কেবল? এই বিদ্রোহের শত্রু-মিত্র কারা? এটি কি কেবল ব্যক্তি-সত্ত্বারই রুদ্র আত্মপ্রকাশ— যেমনটা পাই তার ‘অগ্নিবীণায়’? নাকি, এটি ছিল সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের পক্ষ থেকে বিদ্রোহ— কৃষক-শ্রমিক-জেলে-ছাত্র জনতার লড়াই? এককথায়, আরো বৃহত্তর সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নজরুল তার ‘বিদ্রোহ’ ও তার ‘সাম্যবাদকে’ দেখেছেন কিনা। অনেক সময় নজরুলকে ‘সাম্যবাদী’ হিসেবে অভিহিত করা হয় ঐ নামের একটি কবিতা-গুচ্ছকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ‘বিদ্রোহী কবি’র মত ‘সাম্যবাদী কবি’ এই অভিধাও নজরুলের রাজনৈতিক স্বরূপকে যথেষ্ট ভাবে প্রকাশ করে না। ‘সাম্যবাদী’কবিতাগুচ্ছের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমতামুখী (egalitarian) চিন্তার শিল্পিত প্রকাশ আছে। কিন্তু এ থেকে আমরা আঁচ করতে পারি না নজরুলের মতাদর্শগত সংশ্লিষ্টতা, সংগঠন-চর্চার ধরণ ও সচেতন রাজনৈতিক-আদর্শিক কর্মকাণ্ডের কোন আদল ৷
আমরা কতজন সবসময় মনে রাখি যে (১) তিনিই বাংলায় প্রথম লিখিত আকারে ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবী উচ্চারণ করেছিলেন; (২) তিনিই বাংলার প্রথম কবি যিনি শুধুমাত্র কবিতা লেখার জন্য এক বছর বৃটিশের জেলে কারাবন্দী ছিলেন; (৩) তিনিই প্রথম বেঙ্গল পেজেন্টস্-ওয়ার্কাস পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যা কমিনটার্ণের পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং যা ছিল ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নিকটতম পূর্বসূরী; (৪) তিনিই প্রথম বৃহৎ শিল্প-কারখানা ও পরিবহন-ব্যবস্থা ‘জাতীয়করণের’ এবং কৃষিতে ‘সমবায়ীকরণের দাবী তুলেছিলেন; (৫) তিনিই ১৯২৫ সালে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় সদস্যদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাদের লেখা নিয়মিত ছাপাতেন ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ পত্রিকায়, তার মধ্যে ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, মৌলানা হসরৎ মোহানী, আবদুল হালীম, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ । এই শেষোক্ত দলে নজরুলকে প্রকাশ্যে রাখা হয়নি শুধুমাত্র একটি কারণে: একমাত্র নজরুলই সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন কবি, সম্পাদক ও গায়ক হিসেবে। এবং কম্যুনিস্ট পার্টি তার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বৃটিশ-বিরোধী সংগ্রামে। প্রতিষ্ঠা-পর্বের কম্যুনিস্ট সদস্যরা পরবর্তীতে হয় জেলে, অথবা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে বা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন বৃটিশ আমলে ।
তারপরও যেটা এখানে লক্ষ্যনীয়, কমিউনিস্ট বা বলশেভিক মতবাদের প্রচারে, আন্দোলন-সংগঠনের কাজে নজরুল সবসময়ই সক্রিয় সাহায্য-সহায়তা যুগিয়েছেন। সেটা শুধু দূর থেকে ‘মরাল সাপোর্ট’ জানানোর ব্যাপার ছিল না। সাংগঠনিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কাজে মুজফ্ফর আহমদ তাকে নিয়ে চলতেন ও তার সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। তারা দুজনেই আরো কিছু কমরেড সহ থাকতেন কলকাতার ৩৭ হ্যারিসন রোডের বাসায় যেটি একাধারে ‘ধূমকেতু’ ও লাঙলের অফিসও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিপূর্বে অন্যান্য বাসাতেও তারা একত্রে থেকেছেন। এ ব্যাপারে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন:
‘… ১৯২০ সাল আসতেই আমি স্থির করে ফেলেছিলেম, আমার জীবনের পেশা হবে রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা নয়। উনপঞ্চাশের ব্যাটালিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা অনুসারে কলকাতায় আমার সঙ্গে থাকতে আসে। ফৌজে সে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার ছিল । কথা হয়েছিল যে নজরুল ইসলাম কলকাতায় কাব্য ও সাহিত্য চর্চা করবে এবং রাজনীতিতেও যোগ দিবে।’
এরপর একের পর এক পত্রিকা বের হতে থাকে নজরুল-মুজফ্ফর এদের দ্বৈত-প্রচেষ্টায়-যদিও অগ্রণী ও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন নজরুলই। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৯২০ সালের দিকে প্রকাশিত ‘নবযুগ’ পত্রিকাটি; যদিও সেটি সম্পাদনা করতেন নজরুল ও মুজফ্ফর, ‘প্রধান পরিচালক’ হিসেবে কেবল এ.কে. ফজলুল হকের নাম ছাপা হত । এ.কে ফজলুল হকের আর্থিক সাহায্যে পত্রিকাটি বেরুতো (তখনো তিনি ‘শেরে বাংলা’হননি)। এছাড়াও ১৯২২ সালের দিকে বেরিয়েছে ‘ধূমকেতু’, এবং ১৯২৫ সালের দিকে ‘লাঙল’ । প্রথম দুটিতে প্রধান ‘সম্পাদক’ও প্রধান লেখক ছিলেন নজরুল স্বয়ং; শেষেরটিতে সম্পাদক প্রতিকী অর্থে অন্যরা থাকলেও ‘প্রধান পরিচালক’ ও প্রধান লেখক ছিলেন নজরুলই। অর্থাৎ নজরুলকে সামনে রেখেই মুজফ্ফররা বামপন্থী ও কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
২. ‘ধূমকেতু’রনজরুল
ধূমকেতু প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২২ সালের ১১ই আগষ্ট। সপ্তাহে দু’বার করে বার হত ধূমকেতু। তার প্রচ্ছদ- পত্রে কখনো নজরুল থাকতেন ‘সারথী’ রূপে; কখনো ‘প্রতিষ্ঠাতা’ রূপে; কখনো ‘সম্পাদক’ হিসেবে ; কখনো ‘স্বত্বাধিকারী’ হিসেবে। ধূমকেতুর সবগুলো সংখ্যা এখনো গ্রন্থবদ্ধ হয় নি। কিন্তু যেগুলো পাওয়া যায় তার থেকে কয়েকটি প্রবণতা চোখে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে— (ক) ক্রমাগত ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরোধীতা; (খ) বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা; (গ) অসহযোগ আন্দোলনের ক্রিটিক্যাল পর্যালোচনা; (ঘ) মুসলিম জাহানের সংবাদ, বিশেষত: কামাল আতাতুর্ক ও তার শাসিত নব-তুরস্কের গল্প; (ঙ) প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই নারীমুক্তি সংক্রান্ত হিন্দু- মুসলিম লেখক-লেখিকার প্রবন্ধ; (চ) লেনিন, রুশ বিপ্লব ও বলশেভিকদের কথা ও কাহিনী; (ছ) দেশের ভেতরে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আন্দোলন-সংগ্রামের রিপোর্ট ও ফিচার প্রবন্ধ; এবং (জ) বিভিন্ন চলতি প্রসংগের ওপরে ধূমকেতুর ‘খাট্টামিঠা টিপ্পনী’ । এই শেষের ধারাটি ‘লাঙলে’ও চালু ছিল এবং পরবর্তী কালে এই বিশেষ ফর্মটি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকাকে প্রভাবিত করেছিল। ধূমকেতুর প্রায় সবগুলো সংখ্যা আমি খুঁটিয়ে পড়েছি। সংখ্যা ধরে ধরে এর বিস্তৃত আলোচনা এই প্রবন্ধের সামর্থ্যের বাইরে। আমি শুধু চুম্বক অংশগুলো উত্থাপন করছি ।
১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯২২ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন ধূমকেতু পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর পথ’ সম্পাদকীয়তে নজরুল বৃটিশ শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা চাইলেন । আমার জানা মতে, তার আগে আর কেউ এই বাংলায় সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেশের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ চায় নি। ‘অস্পষ্ট স্বরাজ’ নয়, স্বায়ত্তশাসন নয়, ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নয়, একেবারে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উঠল নজরুলের কাছ থেকে। তিনি সেই ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করে লিখলেন:
“সর্বপ্রথম, “ধূমকেতু” ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী ক’রে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো।… পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’
শুধু এটুকু লেখার জন্যই রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে ধূমকেতু বাজেয়াপ্ত হতে পারত এবং কবি নজরুলও জেলে যেতে পারতেন । কিন্তু জেলে তিনি গেলেন ধূমকেতুর ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২০-এর লেখাটার জন্য-তাও কবিতা লেখার জন্য। কবিতাটির নাম— ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। আপাত: দৃষ্টিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার তুলনায় নিরীহ হলেও কড়া কড়া লাইন ছিল তাতে। ‘বিদ্রোহী’কে ব্যাখ্যা করা যেত কবির ‘ব্যক্তিগত বিদ্রোহ’ বলে। সে তুলনায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’কবিতাটি রাজনৈতিক লাইনে ভরপুর। একটি উদাহরণ:
‘বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি’—এই লাইনটি একালের তরুণ পাঠকদের জন্য কিছুটা ব্যাখ্যার দাবী রাখে হয়ত। ১৯১০ থেকে ১৯৩০ পর্বটি ছিল বাংলায় তথা ভারতে বিপ্লবী ‘সন্ত্রাসবাদী’ আন্দোলনের যুগ। ধূমকেতুতে অর্ধেক পাতা জুড়ে ছাপা হত বারীন্দ্র ঘোষ (আলীপুর বোমা মামলার অভিযুক্ত বিপ্লবী ও পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই), ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, উল্লাসকর দত্ত, প্রফুল্ল চাকি, যতীন মুখুয্যে প্রমুখ বিপ্লবীদের ছবি। বারীন্দ্র ঘোষকে নজরুল তার ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন: ‘অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে/ তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে।’ ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যার পঞ্চম পাতাতেই বারীন্দ্র ঘোষের আবক্ষ ছবি ছাপা হয়েছিল, তাতে ক্যাপশন ছিল ‘বাঙ্গার প্রথম ধূমকেতু— ফাঁসির বারীন্দ্র।’ তাছাড়া ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যাতেই প্রায় অর্ধেক পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকত যা পড়লে সন্দেহ থাকে না কবির পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে । বিজ্ঞাপনে বড় বড় করে লেখা থাকত: ‘বোমার যুগের বারীন্দ্র উপেন্দ্র এবং নলিনী গুপ্ত ও সুরেশ চক্রবর্ত্তীর সব বই আমাদের নিকট পাওয়া যায়।’
এসব থেকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে কবি নজরুল সন্ত্রাসবাদীদের তীব্র দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না এবং সন্ত্রাসবাদকে আদর্শ হিসেবেও কখনো গ্রহণ করেননি । এই একই নিরিখে তাকে কামাল-পন্থীও বলা চলে না । তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সম্পর্কে প্রবল উচ্ছাস ছিল তার। ধূমকেতুর পাতায় নানা জায়গায় তার প্রমাণও রয়েছে। ধূমকেতুর ৮ম সংখ্যায় প্রথম ছাপা হলো সংবাদ যার শুরুতে ছিল ‘কামাল তু নে কামাল কিয়া ভাই’। সংবাদটা ছিল এরকম: ‘গাজী মোস্তফা কামালপাশার জয় হোক । তিনি আজ কদিন হলো বর্ঝর গ্রীসের প্রধান সেনাপতি টিকুপিসকে দশ হাজার গ্রীক সৈন্যসহ বন্দী করেছেন। ‘কামাল- বন্দনা’ নামে কবিতা বেরিয়েছে-লেখিকা সরসীবালা বসু। কামাল পাশা নিয়ে ছোট বড় নানা ধরণের সংবাদ বেরিয়েছে, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এই ধূমকেতুতেই ৮ম সংখ্যাতে বেরিয়েছে আবারো-মোসলেম ভারতে’ প্রথম প্রকাশের পর নজরুলের বিখ্যাত কবিতা কামাল পাশা । আমার ধারণা কামালপন্থার প্রশস্তির পেছনে নিছক জাতীয়তাবাদ নয়, আসলে কাজ করছিল এক প্রচ্ছন্ন কাউন্টার-ডিসকোর্স। কামাল আতাতুর্কের সাম্রাজ্যবিরোধী জাতীয়তাবাদ ও লেনিনের বলশেভিজম— এ দুইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক জোট চেয়েছিলেন তিনি । নজরুল আসলে খেলাফতপন্থীদের আর চরকাপন্থী অসহযোগীদের প্রকারান্তরে সমালোচনা করছিলেন কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের প্রশংসা করে । এজন্যই নন-ভায়োলেন্স ভিত্তিক অস্পষ্ট স্বরাজ-আন্দোলনকে সমালোচনা করেছেন নজরুল । ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় তিনি লিখেছেন: ‘তোমার হাতে-পায়ে-গৰ্দ্দানে-বাঁধা শিকলে প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে বল দেখি বীর—
“মোরা সবাই স্বাধীন সবাই রাজা।”
দেখবে, অমনি তোমার সকল শিকল সকল বাঁধন টুটে খান খান হয়ে গেছে।’ এ সম্পাদকীয় যেখানে বেরিয়েছে তারই পাশে নজরুল লিখেছেন তীব্র-তীক্ষ্ণ কবিতা: ‘রক্তাম্বর পর মা এবার/জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন।/দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন/বাজে তরবারি ঝনন্-ঝন্ ।’ স্পষ্টতঃই চরকা কাটার ধ্বনির থেকে এটি অন্য সুরের সাধনা করেছে। চরকার বা অহিংসাভিত্তিক অসহযোগের সমালোচনা শুধু নজরুল একাই করেন নি, অন্যদের দিয়ে ও সমালোচনা করিয়েছেন। যেমন, ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই বীরেন্দ্রকুমার সেন লিখছেন: ‘আজ কেবল চরকা ও অহিংসার ধূয়া ধ’রে বসে থাকলে যদি ব্যক্তি ও জাতির জীবনের সকল সমস্যার সমাধান না হয়, আমরা যদি জ্ঞান, শক্তি, ঋদ্ধি ও কল্যাণে পরিপূর্ণ হয়ে না উঠতে পারি, তাহলে যে আমাদের হাত-পা গুটিয়েই ব’সে থাকতে হবে তা বলা চলে না। অসত্যের ধ্বংসেই জগতে সত্যের ও শান্তির প্রতিষ্ঠা হ’য়ে থাকে ।’
ধূমকেতুর অধ্যায় ছিল চরকা-বিরোধী মারকুটে র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের ধারায় গড়া। সেখানে নজরুলের পদ্য ও গদ্য অস্বীকারের প্রেরণায় লেখা। সেখানে তার আবেগ বাধা-বন্ধনহীন, ক্রোধ প্রায় পৌরাণিক। আলবেয়ার কাম্যুর মত সেখানে বিদ্রোহেই মানবসত্ত্বার মুক্তি: ‘শিবকে জাগাও, শিবকে জাগাও। আপনাকে চেন। বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার, তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই। মেরে জাগাও শিবকে। লাথির মত যদি লাথি মারতে পার, তা হ’লে ভগবানও তা বুকে করে রাখে।’ কিন্তু এই র্যাডিকেল জাতীয়তাবাদের মধ্যেও একটি অধিকতর স্থায়ী নিরাবেগ সামষ্টিক সমাজবাদী আদর্শের প্রতি ঝোঁক ক্রমশ: দেখা যাচ্ছে। ধূমকেতুর পাতাতেই তা ক্রমশ: স্পষ্ট হচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি, যার থেকে নতুন সমাজ বদলের আদর্শ, বলশেভিজম ও সাম্যবাদের প্রতি অঙ্গীকার দেখা দিচ্ছে। ‘লক্ষীছাড়ার দল’ যারা নিজেদের বলছে তারা এখন বৃহত্তর সাম্যবাদী আদর্শের পাটাতন খুঁজে ফিরছে। শুধু দেশের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার জন্যও আকুতি নানা ভাবে ফুটে উঠছে। ক্রমেই ধূমকেতুর পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে নতুন আদর্শের আলোচনা। ধূমকেতুর ভাষ্যকার এক
জায়গায় ব্যঙ্গ করে বলছেন:
“সেদিন স্বরাজ-পার্কের এক সভায় এক নামজাদা অসহযোগ-পন্থী একটা জীবন্ত সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন । তাঁর মতে বলশেভিজমের ধূমকেতুটা আজ বিষবাষ্পের মতো সমগ্র রুশ মুল্লকটাকে ছারখার করে দিয়েছে। ভাগ্যে সময় থাকতে আমরা এই অহিংস অসহযোগের সুদৃঢ় কেল্লায় আশ্রয় নিয়েছিলুম-নয়ত এর ল্যাজের আগুনে গোটা আৰ্য্যাবৰ্ত্তটাই এতদিনে জ্বলে পুড়ে নাকি ভস্মপিণ্ডি হয়ে যেত!’ অন্যত্র, নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হেমন্তকুমার সরকার এমন একটি শাসনতন্ত্র চাইছেন যেখানে ‘কার্ল মার্কসের সোসিয়ালিজমের শ্রমজাত অর্থনীতিক সাম্য, মিখাইল বাকুনিনের এনার্কিজমের বাহ্যকর্তৃত্ব অপীড়িত মানবাত্মার স্বাধীন সম্মিলন, লেনিনের বলশেভিজমের ধরিত্রীভোগে সমানাধিকার-সে শাসনতন্ত্রে সমস্তই থাকবে। কলা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন মানুষের মনের খোরাক যোগাবে-কৃষক, মজুর দেহের খোরাক উৎপাদন করবে। মধ্যসত্ত্বভোগীর স্থান সে সমাজে নাই। মাথা ও হাত পা খাটিয়ে যারা খাবে তারাই বাঁচবার অধিকারী—অবশিষ্ট সকলের ধ্বংশ অবশ্যম্ভাবী।’ এই হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল ইসলাম দু’বছর বাদে পেজেন্টস-ওয়ার্কাস পার্টির দুই প্রধান কর্ণধার হয়েছিলেন। অনেক সময় পক্ষপাতিত্বের ঝোঁকটি কোনদিকে তা ছোট ছোট সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়েও বোঝা যায় । যেমন, একটি সংবাদে ৩০ শে আশ্বিন ১৩২৯ সালের ধূমকেতু লিখছে:
‘তুর্কীর সাহায্যের জন্য পেট্রোগ্রাডে জোর স্বেচ্ছাসৈনিক সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং গত সপ্তাহে ওদেসা বন্দর থেকে একদল স্বেচ্ছাসৈনিককে তুর্কীর দিকে রওনা করে দেওয়া হয়েছে। এইবার দেখছি, সত্যি সত্যিই গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম হ’য়ে দাঁড়াবে। আমাদের দেশের ছেলেরা কখন যাবে এ গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমে স্নান ক’রে পবিত্র হ’তে?’
লেনিনের সংবাদও বেরিয়েছে মন্তব্য সহ । ‘আগুণের ফুলকি’ কলামে ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই লেখা হয়েছে: ‘মস্কো থেকে খবর এসেছে যে কমিউনিস্ট দলের বৈঠকে মসিয়ঁ কামেনেভ বলেছেন যে, লেনিন খোস্ মেজাজে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী!’ যেসময়ের কথা হচ্ছে (১৯২২ সাল) তখন লেনিনের বা বলশেভিজমের প্রচার একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল ভারতবর্ষে। তবু ঝুঁকি নিয়ে নজরুল এসব সংবাদ ছাপাতে দ্বিধা করেন নি । যেমন, মঙ্গোলিয়া বলশেভিক রাশিয়ার সাহায্য পেয়ে ‘স্বাধীন’ হয়েছে এই সংবাদটি দেয়া হয়েছে এভাবে:
‘পরাধীন জাতির পরম বন্ধু বলশেভিক গবর্ণমেন্টের টাকা-কড়ি লোক-লশকরের সাহায্য পেয়ে মঙ্গোলিয়া এত দিনে দাসত্বের শৃঙ্খল খান্ খান্ ক’রে ভেঙে ফেলেছে।‘
সবচেয়ে অবাক হয়েছি ধূমকেতুর ২য় সংখ্যায় বিখ্যাত বিপ্লবী কমিউনিস্ট রোজা লুকসেমবার্গের সম্পর্কে দেড় কলাম জুড়ে শোকগাথাঁর প্রকাশ দেখে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে কাউটস্কি, লিবকনেট, লেনিন প্রমুখের সহকর্মী রোজাকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রচারের জন্য ১৯১৯ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বার্লিন শহরে। ‘বিদ্রোহী বীরাঙ্গনা’ শিরোনামে তার সম্পর্কে ‘ধূমকেতু’ এভাবে লিখেছে:
‘রোজা জাতিতে পোল। তাঁর বয়স যখন আঠার তখন তিনি [ জার শাসিত ] রুসিয়া থেকে পালিয়ে আসেন। তার পিছনে ছেনালী পুলিশের ফেউ লেগেছিল। ইটালীতে থেকে এই নারী বিপ্লববাদ প্রচার শুরু করেন কিন্তু ইটালীর গভর্ণমেন্ট তাঁর উপর খাপপা হয়ে উঠেন। তখন তিনি সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স হয়ে জার্মেনীতে আশ্রয় ল’ন। জার্মেন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্র ও অর্থনীতির আলোচনা করে তিনি উচ্চতর উপাধি পান।… রুসিয়ায় যখন বিদ্রোহের সূচনা হয় রোজা তখন তাতে যোগদান করেন। বলা বাহুল্য যে রুস গভর্ণমেন্ট তাঁকে জেলে আবদ্ধ করেন। কিন্তু পুলিশের চোখে ধুলি দিয়ে রোজা জার্মেনীতে ফিরে আসেন ৷
জার্মানীতে এসে রোজা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নানাস্থানে ধর্মঘট ঘটিয়ে কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলাই ছিল তাঁর কাজ। জেলে থেকেই তিনি জার্মান গভর্ণমেন্টের যুদ্ধ নীতির প্রতিবাদ করে বই লেখেন । Crisis of Socialism নামক বইও জেলেই লেখা হয়েছিল।… জার্মেনীর রাজতন্ত্রের বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে রোজা মুক্তিলাভ করেন, ইনি তখন সঙ্ঘবাদ (communist) প্রচার উদ্দেশ্যে একখানি সংবাদপত্র প্রচার করেন। এই কাগজে ইনি যে সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতেন তা যেমন অকাট্য যুক্তিপূর্ণ তেমনিই কার্যকরী হ’ত। জার্মেনীতে একদল লোক আছে যারা এখনও রাজ-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি। এরাই প্রতিহিংসা পরবশ হ’য়ে এই মহিলাকে গুপ্ত ভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার ইতিহাসে এই নারীর নাম চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে ।
এ দেশে কি এমনি কেউ বীরাঙ্গনা আসবে না, যাঁর চরণ-কমল স্পর্শে এই মাদীদের দেশ আবার পুরুষ হয়ে জেগে উঠবে?”
সংবাদ এসেছে মধ্য-এশিয়ায় রুশ-বিপ্লবের ঢেউ লাগা নিয়ে । এনিয়ে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে বিস্তৃত লিখবেন। কিন্তু এর পূর্বলেখ পাই নজরুলের ধূমকেতুতে। ‘আরবী কাগজ’ থেকে ‘বোখরা বিপ্লব’ শিরোনামে লেখা হয়েছে:
‘পূর্ব্ব-বোখরার উজবেগ নামে পরিচিত পাহাড়ীয়া জাতি আমিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ক’রে ব’ল । এতে অবশ্য আশ্চর্য্য হবার কিছুই নেই । আমীর দেখলেন, অবস্থা তো বড় সঙ্গীন, রুশিয়ার জার ও বিদ্রোহী নেতাদেরে ঘুষ দিয়ে আপনার প্রভূত্ব ও সিংহাসন নিরাপদ করলেন, হতভাগ্য পাহাড়ীরা তাদের নেতাদের বোকামীতে দুর্দ্দশার চরম সীমায় যেয়ে পড়ল । দেশের অজ্ঞান অন্ধকার দূর করবার জন্য শাসকসম্প্রদায় মোটেই চেষ্টা করত না কারণ লেখাপড়া শিখলে প্রজারা কর্তৃপক্ষের যথেচ্ছাচারে বাধা দিবে এ ভয়ও যে তাদের ছিল না এমন নয় ।
কিন্তু ১৯১৭ সনে যখন রুশিয়ার শ্রমজীবী ও কৃষক সম্প্রদায়ের ভিতর বিপ্লব দেখা দিল, তখন আমীর আপনার ধ্বংসোন্মুখ সিংহাসন রক্ষার জন্যে ইংরেজের শরণাপন্ন হলেন। সোভিয়েট রুশিয়ার বিদ্রোহের স্রোত যাতে করে এসে ভারতের বিপ্লবপন্থীদের সঙ্গে মিশতে না পারে এই উদ্দেশ্যে সুচতুর ইংরেজ সরকার আমীরকে মাঝখানে দাঁড় করালেন। কিন্তু লোকের ধৈর্য্যের বাঁধ আর কতদিন টিকে? ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম বোখরায় আবার বিদ্রোহের ভেরী বেজে উঠল। সপারিষদ আমীর পূর্ব্ব বোখারায়, পরে আফগানিস্থানে পলায়ন করতে বাধ্য হলেন। ফলে দেশের সমস্ত ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে এসে পড়ল ।
নতুন শাসন প্রণালী প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাতে জনসাধারণের প্রতিনিধিরাই প্রাধান্য লাভ করলে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারা রুশিয়ার শ্রমজীবী ও কৃষক সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রার্থনা করল। জনাসাধারণের ইচ্ছায় বোখারায় সোভিয়েট সাধারণ-তন্ত্র রক্ষার জন্যে যে-কোন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তারা দৃঢ় সংকল্প হ’ল। প্ৰাচীন শাসনে যে সকল অন্যায় প্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলি সমূলে ধ্বংস হ’ল। বৰ্ত্তমান সময়ে বোখারার শাসন-প্রণালী বোখারাবাসীদেরই হাতে এসে প’ড়েছে, তারা নিজেদের সুবিধা অসুবিধা অনুযায়ী আইন কানুন গ’ড়ে তুলেছে, রাজ্য পরিচালনার জন্যে তারা নিজেরাই কর্ম্মচারী নিয়োগ করে, স্বাধীনভাবে শান্তিতে জীবন যাপন করাই এখন বোখরাবাসীদের একমাত্র অভিপ্রায়।’
কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের সাথে লেনিনের রাশিয়ার মিত্রতার খবরে উল্লসিত হয়েছে ধূমকেতু। ‘কামালের বলশেভিক দোস্তী’ শিরোনাম দিয়ে বলা হয়েছে:
‘গাজী মোস্তফা কামাল পাশাকে সাহায্য করবার জন্যে বলশেভিক গবর্ণমেন্ট ইটালী থেকে বহু মেশিন-গান, মটরকার, ল্যরি ও অন্যান্য যুদ্ধোপযোগী অস্ত্র-শস্ত্র কিনে আঙ্গোরাতে [আংকারা] পাঠাচ্ছেন। একেই বলে দোস্তি ।
তোমরা দুই মিতায় এইবার দুনিয়া থেকে রাজার নাম নেস্তনাবুদ করে ফেল ত একবার ভাই । আমিন!’
কোথায় ইরানের সাথে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার চুক্তি হচ্ছে, সেনিয়ে সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রচ্ছন্নে রয়েছে কংগ্রেস-খেলাফত প্রস্তাবিত স্বরাজ-অসহযোগের ক্রিটিক । ধূমকেতু লিখছে, ‘কংগ্রেস যে-স্বরাজ চায় সে যে নিতান্তই লজ্জাস্কর স্বরাজ। ইংলন্ডের অধীনে স্বায়ত্ত-শাসন লাভ করার জন্যই কি দেশে এত আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে।… দেশ বৃটিশ সাম্রাজ্যধীনে স্বায়ত্ব-শাসন কিংবা দেশের অত্যাচারী অভিজাত শ্রেণীর শাসন চায় না-দেশ চায় দেশ-জনসাধারণের শাসন।’ আর এই সংগ্রামে ধূমকেতুর চোখে ন্যাচারাল মিত্রশক্তি হলো রুশ-বিপ্লবোত্তর রাশিয়া। এর ১৪তম সংখ্যায় এরকম সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে যে মস্কো শহরে রাশিয়ার মুসলিম জনগণ এক বিরাট মিছিল নিয়ে ইংলন্ডের দূতাবাসে গিয়ে প্রতিবাদ করেছে। উদ্দেশ্য, ইংলন্ড মুসলমান রাজ্যগুলির সম্বন্ধে যে রাজনীতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন তার তীব্র প্রতিবাদ জানানো । অন্যত্র, বলশেভিক পুস্তিকা ঘেঁটে তত্ত্ব-পরিবেশনা করা হচ্ছে সাধারণ পাঠকদের কাছে। তারই একটি নমুনা নীচে তুলে ধরলাম:
“বলসেবীর বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়
একি গো বিস্ময় ।”
‘সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের সাথে গণ-তান্ত্রিক বলশেভিক গবর্ণমেন্টের ব্যবসা-সম্পর্কীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়াতে বলশেভিকগণ পৃথিবীর সর্ব্বত্র সাম্রাজ্যবাদীগণের বিরুদ্ধে যে-প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছিলেন তা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখেছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা নববলে বলীয়ান হয়ে প্রচার কার্য্য শুরু করে দিয়েছেন।
বলশেভিক পররাষ্ট্র প্রচার বিতরণ থেকে সম্প্রতি দুটা বই প্রকাশিত হয়েছে, একটীর আকার বৃহৎ-৭০০ শত পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। রুষের ভূতপূর্ব্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ফ্রান্স প্রভৃতি রাজ্যের সাথে যে টেলিগ্রাম, গুপ্ত রিপোর্ট ও পত্রালাপ ব্যবহার হয়েছিল তার নকল এখানে সন্নিহিত হয়েছে। আর একটা হচ্ছে ভারতবর্ষে সম্বন্ধে পুস্তক। এই পুস্তকে প্রচ্ছদপটে লেখা রয়েছে -“ভারত ভারতবাসীর জন্য।”এতেও বহু চিঠিপত্র ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এই সব বই জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের বলশেভিক পূস্তকালয়ে বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে ও রাশিয়ান খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এই পুস্তকের এক জায়গায় লেখা আছে :
“আমরা-রাশিয়ান বিদ্রোহীগণ ও আর্ন্তজাতিক সোশিয়ালিষ্টগণ ভারত বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করলে কেবল যে তাকে সাদরে অভিনন্দন জানাব তা নয় বরং পরোক্ষ ও অপরোক্ষভাবে সাধ্যমত ভারতের বিদ্রোহকে সাহায্য করব; এবং ঘৃণিত ব্রিটিশের পরাধীনতা থেকে মুক্ত আজাদ করবার জন্যে ভারত বাসীকে সাহায্য করব। বহুদিনের উৎপীড়িত নির্যাতিত প্রাচ্যে বন্ধুগণের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন স্বরূপ (গুপ্ত) দলিল পত্র সম্বলিত এই পুস্তক সাদরে গ্রহণ করুন। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বিদ্রোহমূলক পন্থা কেবলমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সহায়তা করে ক্ষান্ত হবে না, এর অতিরিক্ত কিছু করবে।”
খুড়োর সাথে সাথে আমরাও ভাছি, “অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোনখানে?” কৃষকের ঐ লাঙলই যে হল বলরাম হয়ে বিশ্ব উপড়ে ফেলতে পারে, তা জানতুম না-দাদা। জানলেও বিশ্বাস করতুম না। এক কামালেই কামাল করলে আর তোমরা আর এক কামাল করলে।’
প্রথম সংখ্যাতেও লেনিনের স্বাস্থ্য নিয়ে সংবাদ এসেছিল, ১৯তম সংখ্যাতেও তাঁর সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ পেয়েছে। সম্ভবত ১৯২০ সালের কমিনটার্ণের দ্বিতীয় কংগ্রেসকে উদ্ধৃত করে কথাগুলো বলা: ‘লেনিন বেশ ভালোই আছেন। তিনি বলেন প্রাচ্যের সভায় রাশিয়ার থাকা একান্ত আবশ্যক। তিনি আগেও বলেন যে তুরস্কের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা… রাশিয়ার উদ্দেশ্য। জাতিসঙ্ঘকে তার খবরদারী করতে দেওয়া যেতে পারে না।’ এরই পাশাপাশি এ সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে ইতালীতে ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে-‘একে একে নিবিছে দেউটী’ । এরকম উদাহরণ আরো অনেক দেওয়া যায় ।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, বলশেভিজম বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নিয়ে এই কৌতূহুল এটা কি কোন বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে কিনা? এর উত্তর পরবর্তী অধ্যায়ে দেব। কিন্তু তার আগে এটা জানিয়ে রাখি যে ধূমকেতুতে নজরুল একটি ব্যাপক লেখক সমাবেশ করতে পেরেছিলেন। শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, শৈলজারঞ্জন, প্রেমাংকুর আতর্থী, শিবরাম চক্রবর্তী, মুজফ্ফর আমদ, হেমন্ত কুমার সরকার প্রমুখকে দিয়ে নানাবিধ ‘রাজনৈতিক’ বিষয়ে প্রবন্ধ গুচ্ছ লিখিয়েছেন। এবং সবগুলো লেখাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, প্রগতিপন্থী, এবং অনেকাংশে বামপন্থী চেতনায় সমৃদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, আমি ধূমকেতুর নারীমুক্তি সম্পর্কীত লেখাগুলির কথা স্মরণ করব। ১৮তম সংখ্যায় মহামায়া দেবী লিখছেন:
‘আজ এই আন্দোলনের যুগে অন্যান্য আন্দোলনের মধ্যে নারীর স্থান কোথায়; এ এক প্রধানতম আন্দোলন । আর সত্য সত্যই নারীর স্থান কোথায় আজ তা নিরুপণ করা এক মহা ব্যাপার। আর স্থান নিরুপণ করা কার দ্বারাই যে সম্ভব তাও ভাববার কথা। নারীর জীবন দিন দিনই যে সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠছে তা কোন এক নিদর্শন দেখিয়ে প্রমাণ করবার আবশ্যকই করে না। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চোখের উপর নিয়তই খাড়া রয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা মীমাংসার উপায় কি?… নারীর স্থান নির্ব্বাচন নারীকেই করতে হবে, নারীর জীবন সমস্যা নারীকেই মেটাতে হবে, নারীর সত্যকারের অধিকার নারীরই নিতে হবেঃ সত্যবস্তু প্রতিজনের নিজস্ব তা কেউ কা’কে দিতে পারে না এবং কারো কাছে দাবী করবারও নয় । হাল আমলের নারীর ‘এজেন্সি’ এবং ‘এমপাওয়ারমেন্ট’ ডিসকোর্সের সূচনা ধূমকেতুতে ।’
৩. লাঙলেরনজরুল
লাঙল প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর । এর ‘প্রধান পরিচালক’ নজরুল ইসলাম । সম্পাদক ছিলেন মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়— পল্টনে থাকতে নজরুলের সহকর্মী কমরেড। ‘লাঙল’ পর্বটি তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই পর্বে নজরুল আরো বেশি করে রুশ বিপ্লব, মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ও সাধারণ ভাবে সচেতন বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। দ্বিতীয়ত, এই পর্বে শুধু আদর্শগত ঝোঁক নয়, সাংগঠনিক ভাবেও বামপন্থী সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন নজরুল। সাধারণ সদস্য বা সমর্থক হিসেবে নয়— শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায়ের’ অন্যতম মূল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। লাঙলের প্রথম সংখ্যাতে এই নামই ছিল সংগঠনটির। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে নামকরণ হয়— ‘শ্রমিক-প্ৰজা- স্বরাজ দল’ । ইংরেজিতে ওয়াকার্স পেজেন্টস পার্টি । এই দলেরই বক্তব্য প্রচারের জন্য লাঙল বের করা। যেরকম লেনিন এক সময় বলশেভিক পার্টির মুখপাত্র হিসেবে বের করেছিলেন ইসক্রা। এ নিয়ে কোন রাখ ঢাক ছিল না নজরুলের।
লাঙল পত্রিকার শিরোনামের নীচেই লেখা ছিল-শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের মুখপাত্র । তৃতীয়ত, নজরুল শুধু লাঙলের জন্য কবিতা-গান-প্রবন্ধই রচনা করেননি, তিনি বাংলার শহর-গ্রাম চষে বেরিয়েছেন ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ’ দলের কাজে। আগেই বলেছি, এই দলটি ছিল ১৯২৫ সালে কানপুরে গঠিত ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির নিকটতম পূর্বসূরী, অনেক ক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাজ করবার জন্য ‘প্রকাশ্য ফ্রন্ট’। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ’, ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ প্রভৃতি দলের মধ্যে যেমন করে কম্যুনিষ্ট-বামপন্থীরা কাজ করতেন। লাঙলের পুস্তক-বিভাগ ছিল কলকাতার ৩৭ হ্যারিসন রোডে, যেখানে আগেই বলেছি নজরুল, মুজফ্ফর আমদ, আবদুল হালীম প্রমুখেরা একসাথে থাকতেন। সেখানে শুধু সমাজতন্ত্রী সাহিত্যই থাকত না, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী সাহিত্যও থাকত, এমনকি নারীমুক্তির সাহিত্যও থাকত। উদাহরণত, বেগম রোকেয়ার সব বই সেখানে পাওয়া যেত। লাঙলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত— ‘সুলেখিকা মিসেস আর এস হোসেন প্রণীত পদ্মরাগ (উপন্যাস); মতিচুর-১ম খণ্ড; মতিচুর-২য় খণ্ড’। এককথায়, বিশের দশকের মাঝামাঝি লাঙল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রগতিশীল চিন্তা-
বই পুস্তক, তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রমূল। সামগ্রিক আলোচনা বর্তমান প্রবন্ধের সাধ্যের বাইরে, আমি শুধু প্রধান ভাবনা, প্রধান মুহুর্তের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছি। লাঙল পত্রিকাটি ব্রিটিশ সেন্সরশীপ বা রাজরোষে পরে খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। প্রথম সংখ্যাটি বার হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫, আর শেষ সংখ্যা বার হয় ১৫ এপ্রিল ১৯২৬ । লাঙল বন্ধ হওয়ার পর ‘বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল’-এর মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘গণবাণী’। ‘লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যাতেই র্যাডিকেল সব দাবী উচ্চারিত হয়েছিল। লাঙল যাদের মুখপাত্র সেই শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের উদ্দেশ্য, নিয়মাবলী ও গঠনপ্রণালী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছিল:
‘আমেরিকা, ইংলন্ড প্রভৃতি দেশে এখন বৈশ্যের রাজত্ব। এবার শূদ্রের পালা। এবার শূদ্রের প্রয়োজনে সমাজ চলবে। হিন্দু-মুসলমান-সমস্যা, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সমস্যা সব লাঙলের ফলার মুখে লোপ পাবে। তাই আমরা লাঙলের জয়গান আরম্ভ করলাম। লাঙল নবযুগের নব দেবতা। জয় লাঙলের জয় লাঙলের দেবতার জয়!’
এই দলের উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ:
১। উদ্দেশ্য: ‘নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাসূচক স্বরাজ্য লাভই এই দলের উদ্দেশ্য।’
৩। কর্মনীতি ও সংকল্প: যেহেতু দেখা গিয়াছে যে গলাবাজি অথবা ত্রাস-নীতিতে অনিচ্ছুক আমলা-তন্ত্রের হাত হইতে স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা অতীতে কেবলই বিফল হইয়াছে; আমলা-তন্ত্রের নিকট খোসামুদি দ্বারা ভারতবর্ষের লোকের অবস্থার প্রকৃত উন্নতি আনয়ন সম্ভব নয়, কিংবা সহস্র বন্ধনে আবদ্ধ স্বদেশীয়গণের সাহায্যেই নিরস্ত্রীকৃত জনসাধারণের স্বাধীনতা গুপ্ত হত্যার সাহায্যে আসিতে পারে না; বোমা এবং পিস্তলের শক্তি অপেক্ষা বহগুণে শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের চলমান শক্তির প্রয়োগ দ্বারাই নিরস্ত্র জাতির পক্ষে স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় বলিয়া বোধ হইতেছে।
যেহেতু শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ যেমন বলিয়াছেন যে শ্রেণীগত স্বার্থত্যাগী ভদ্র যুবক, শ্রমিক ও কৃষকের সংযোগ না হইলে ভারতের মুক্তি আসিবে না ।
অতএব ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায় এই ঘোষণা করিতেছেন যে, ভারতের জাতীয় দাবী পূরণের এখনও একমাত্র অবশিষ্ট উপায় এই যে, দেশের শতকরা আশি জন যাহারা— সেই শ্রমিক ও কৃষকগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং তাহাদিগের জন্মগত অধিকার লাভে সাহায্য করা, যাহাতে তাহারা রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে আরও সচেতন হইয়া নিজের ক্ষমতায় এবং নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাশীল স্বার্থপর ব্যক্তিগণের হাত হইতে স্বাধীনতা আনিতে পারে । এবং এতদর্থে উপরোক্ত উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায় নিম্নলিখিত কর্ম সংকল্পের অবতারণা করিতেছেন ।
এই দল শ্রমিক ও কৃষকগণের স্বার্থের জন্য লড়িবেন (ভদ্র এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের যে কোনও ব্যক্তি নিজের হাত-পা বা মাথা খাটাইয়া নিজের জীবিকা অর্জন করে, তাহাকেই শ্রমিক বলিয়া গণ্য করা হইবে)।’
৪। চরম দাবী:
(ক) আধুনিক কলকারখানা, খনি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ট্রামওয়ে, স্টীমার প্রভৃতি সাধারণের হিতকারী
জিনিস, লাভের জন্য ব্যবহৃত না হইয়া দেশের উপকারের জন্য ব্যবহৃত হইবে এবং এতদ সংক্রান্ত কর্মীগণের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সম্পত্তি রূপে পরিচালিত হইবে।
(খ) ভূমির চরম স্বত্ত্ব আত্ম-অভাব-পূরণ-ক্ষম স্বায়ত্ব-শাসন-বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রের উপর বর্ত্তিবে— এই পল্লী-তন্ত্র
ভদ্র শূদ্র সকল শ্রেণীর শ্রমজীবীর হাতে থাকিবে ।
৫। এখনকার দাবী:
শ্রমিকদের জন্য দাবী
ক) জীবন-যাত্রার পক্ষে যথোপযুক্ত মুজরির একটা নিম্নতম হার আইনের দ্বারা বাঁধিয়া দেওয়া।
(খ) প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকের পক্ষে সপ্তাহে সাড়ে পাঁচদিন খাটুনি চরম বলিয়া আইন করা; নারী এবং অল্প
বয়স্ক ছেলেপিলের জন্য বিশেষ শর্ত নির্দ্ধারণ করা ।
(গ) শ্রমিকগণের আবাস, কাজের শর্ত, চিকিৎসার বন্দোবস্ত প্রভৃতি বিষয়ে কতকগুলি দাবী মালিকগণকে
আইন দ্বারা বাধ্য করিয়া পূরণ করানো।
(ঘ) অসুখ, বিসুখ, দূর্ঘটনা, বেকার অবস্থা এবং বৃদ্ধ অবস্থায় শ্রমিকগণকে রক্ষা করিবার জন্য আইন প্ৰণয়ন
ঙ) সমস্ত বড় কলকারখানায় লাভের ভাগে শ্রমিকগণকে অধিকারী করা।
চ) মালিকগণের খরচায় শ্রমজীবীগণের বাধ্যতা মূলক শিক্ষা ।
ছ) কলকারখানার নিকট হইতে বেশ্যালয়, নেশার দোকান উঠাইয়া দেওয়া ।
জ) শ্রমিকগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ।
(ঝ) শ্রমিক-সঙ্ঘ-গুলিকে আইনত মানিয়া লওয়া এবং শ্রমিকদের দাবী পূরণের জন্য ধর্মঘট করিবার অধিকার স্বীকার করা।
কৃষকদের জন্য দাবী
(ক) ভূমি-কর সম্বন্ধে একটা ঊর্দ্ধতম হার বাঁধিয়া দেওয়া এবং বাকি খাজনার সুদ ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের
সুদের হারের সহিত সমান নির্দ্ধারণ করা;
(খ) জমিতে কায়েমী স্বত্ত্ব প্রতিষ্ঠা; উচ্ছেদ নিরোধ; অন্যায় এবং বে-আইনি বাজে আদায় বন্ধ; স্বেচ্ছায় বিনা সেলামিতে হস্তান্তর করার অধিকার; গাছ কাটা, কূয়ো খোঁড়া, পুকুর কাটা, পাকা বাড়ী করার ক্ষেত্রে বিনা সেলামিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা।
(গ) জল-করে মাছ ধরিবার নির্দ্ধারিত শর্ত।
ঘ) মহাজনের সুদের চরম হার নির্দ্ধারণ;
(ঙ) কো-অপারেটিভ কৃষি-ব্যাঙ্ক স্থাপনের দ্বারা কৃষককে ঋণদান এবং মহাজন ও লোভী ব্যবসাদারগণের
হাত হইতে কৃষককে উদ্ধার ।
(চ) চাষে জন্য যন্ত্রপাতি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের মারফৎ কৃষকের নিকট বিক্রয় অথবা ব্যবহারের জন্য
ভাড়া দেওয়া। মূল্য অথবা ভাড়ার টাকা কিস্তীবন্দী হিসাবে অল্প অল্প করিয়া লওয়ার বন্দোবস্ত ।
ছ) পাটের চাষের কৃষকের উপযুক্ত লাভের বন্দোবস্ত ।
এই দলে যোগ দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ নিম্নলিখিত ঠিকানায় পত্র দিবেন:-
নজরুল ইসলাম, ৩৭ নং হ্যারিসন রোড, কলিকাতা ৷’
দলের উদ্দেশ্য ও দাবীনামা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে শ্রমিক-প্রজা পার্টির উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বা আধুনিক পরিভাষায়-জনগনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা (যেটা বিপ্লবোত্তর চীনে বা ভিয়েতনামে দেখতে পাই)। তার চাইতে লক্ষ্য করার পয়েন্ট হল যে এরকম দলে যোগ দেওয়ার জন্য সর্বাগ্রে নজরুলের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলা হচ্ছে।
অর্থাৎ নজরুল এখানে ‘সংগঠকের’ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন ।
লাঙলের পাতায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল কার্ল মার্কসের জীবনী (লেখক-দেবব্রত বসু); গোর্কির ‘মা’ (অনুবাদক- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়); কার্ল মার্কসের শিক্ষা (লেখক-মৌলবী কুদ্দীন আহ্মদ)। এছাড়াও ছিল সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “হিন্দু-মুসলমান’; নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ ও ‘কৃষাণের গান’। এই শেষের কবিতাটিতে মার্কসবাদের প্রভাব অতি-প্রত্যক্ষ:
‘চারদিক হতে ধণিক বণিক শোষণকারীর জাত
জোঁকের মতন শুছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত
বুকের কাছে মরছে খোকা, নাইক আমার হাত,
সতী মেয়ের বসন কেড়ে খেলছে খেলা খল ।’
অথবা কবিতাটির শেষের স্তবকটি যেখানে লাঙলের তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করা হচ্ছে:
‘জাগ্ রে কৃষাণ সব ত গেছে কিসের বা আর ভয়
ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়
বল্ সবে ভাই, বল্ কৃষাণের বল্ লাঙলের জয়,
দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল ।’
স্পষ্টতই নজরুল বাংলায় বা ভারতবর্ষে কৃষিবিপ্লব বা কৃষকের অভ্যূত্থান কামনা করছিলেন, কেননা শিল্প
শ্রমিকের সংখ্যা তখনো নগণ্য ছিল দেশে। যদিও তাই বলে শিল্প শ্রমিককে হাতছাড়া করতে রাজী নন তিনি। তার জন্য তো ‘কুলি-মজুর’ কবিতাটি এর আগেই লেখা হয়েছিল ‘লাঙল’ পত্রিকায়।
এই সূত্রে একটা প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নটা ১৯২৬ সালেই উঠেছিল। এই যে কৃষক-শ্রমিক নিয়ে এত লেখালেখি তা কি মেহনতী মানুষেরা বুঝতে পারবে? এটা ক্লাসিক লেনিনীয় ‘What is to be done’-র প্রশ্ন। কীভাবে মধ্যবিত্তের সাথে, বুদ্ধিজীবির সাথে শ্রমিক-কৃষকের ভাষা-বিনিময় হবে? এমনই একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন তারানাথ রায় বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের সমালোচনা করে। গায়ত্রী স্পিভাকও বহুপরে এজাতীয় একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন— ‘Can the Subalterns Speak’? ততদিনে লাঙল বন্ধ করে দিয়েছে বৃটিশ সরকার; এর পরিবর্তে বার হচ্ছে ‘গণবাণী’। তার পাতাতে নজরুল তারানাথ রায়ের লেখার জবাব দিলেন। তারানাথ রায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, কৃষক- শ্রমিকরা এসব মতবাদ বুঝবে কেমন করে? তার উত্তরে নজরুল লিখছেন : ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকেরা লেখাপড়ার সঙ্গে গোটা কয়েক মতবাদ শিখলে ওগুলো শিগগিরই বুঝতে পারবেন?’- তাঁর ইঙ্গিতটা এবং রসিকতাটা দুটোই বুঝলাম
না, বুঝলাম শুধু তাঁর জানাশোনা কতটুকু— অন্তত সেই সম্বন্ধে, যে সম্বন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি কি জানেন না যে, কোনো দেশের কোনো শ্রমিক কার্ল মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ পড়ে বুঝতে পারবে না। ঐ মতবাদটা যারা পড়বে, তারা কৃষক-শ্রমিক নয়, তারা লেনিন ল্যান্সব্যারির নমুনার লোক। কার্ল ম্যার্ক্সের মতবাদ সাধারণ শ্রমিক বুঝতে না পারলেও তা দিয়ে তাদের মঙ্গল সাধিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এ মতবাদ দিয়ে এমন কতকগুলি লোকের সৃষ্টি হয়েছে যারা জগৎটাকে উল্টে দিয়ে নতুন করে গড়তে চাচ্ছেন বা গড়ছেন। মতবাদ কোনোকালেই জনসাধারণ বুঝবে না, মতবাদ তৈরি করে তুলবে সেই রকম লোক যারা বোঝাবেন এ মতবাদের মর্ম জনসাধারণকে। ইন্জিন চালাবে ড্রাইভার কিন্তু গাড়িতে চড়বে সর্বসাধারণ। ‘গণবাণী’ও কৃষক শ্রমিকের পড়ার জন্য নয়, কৃষক-শ্রমিকদের গড়ে তুলবেন যাঁরা— ‘গণবাণী’ তাঁদেরই জন্য। কৃষক-শ্রমিক দলের মুখপাত্র, মানে তাদের বেদনাতুর হৃদয়ের মূক মুখের বাণী ‘গণবাণী’ ও তাদের বইতে না পারা ব্যথা কথায় ফুটিয়ে তুলবে ‘গণবাণী’ ।’
একথা নজরুল লিখতে পেরেছেন একারণে যে তিনি গভীর ভাবে বামপন্থাকে বুঝে ছিলেন। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সাথে সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সংযোগ ঘটাতে হবে—এই ডায়ালেকটিকস্ তিনি বুঝতেন। ধূমকেতু – লাঙল-গণবাণী পর্বের নজরুলের লেখা ও কর্মতৎপরতা অনুসরণ করলে বোঝা যায় কেন এদেশের বামপন্থী আন্দোলনের আদি পুরুষদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তাকে শুধু ‘বিদ্রোহী’ বললে, বা দরদী ‘সাম্যবাদী’ বললে তার রাজনৈতিক ভিশনকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। এমনকি ১৯৪১ সালে যখন নজরুল ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লিখছেন তখনো তার দৃষ্টি স্বচ্ছ পরিপার্শ্বের পট পরিবর্তনে ম্লান হয় নি এতটুকু। পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপনের পর তিনি বলছেন: ‘লীগ” কেন, ‘কংগ্রেস’কেও আমি কোনোদিন স্বীকার করিনি। আমার ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা তার প্রমাণ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোনোদিন লিখিনি— কিন্তু তার নেতাদের বিরুদ্ধে লিখেছি। যে কোনো আন্দোলনেরই হোক, নেতারা যদি নির্লোভ, নিরহংকার ও নির্ভয় না হন, সে আন্দোলনকে একদিন না একদিন ব্যর্থ হতেই হবে।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন:
‘আত্মত্যাগী সাধকেরাই আনিবেন বদ্ধ জীবনে প্রাণশক্তির দুর্জয় প্রবাহ। যাঁহারা নবযুগের ছেলেমেয়ে, তাঁহারা এই প্রবাহে যুক্ত হইয়া এই প্রবাহ-তরঙ্গকে গগনস্পর্শী করিয়া তুলুন— ইহাই নিপীড়িত মানবাত্মার প্ৰাৰ্থনা।‘
যতদূর বুঝতে পারি, সাপ্তাহিক লাঙলকে আপাত: দৃষ্টিতে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদলের মুখপত্র বলা হলেও (১৯২৬ সালের দিকে এসে এই নামই নেয় এটি) আসলে তা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরই ‘প্রকাশ্য ফ্রন্ট’। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হত। ১৯২৬ সালের ৬-৭ ফেব্রুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে নিখিল-বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ‘কবি নজরুল ইসলাম পরিচালিত “লাঙল” পত্রিকাকে কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপাত্ররূপে আপাতত গ্রহণ করা হউক।’ তাসত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই সেখানে কমিউনিষ্ট পার্টির নানা সংবাদ। যেমন, ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারী লাঙলের চতুর্থ সংখ্যায় প্রকাশিত হল কানপুরে ভারতীয় প্রথম কম্যুনিস্ট কনফারেন্সে গৃহীত ‘পার্টির গঠন নীতি’ বা কানপুর সম্মেলনের সভাপতির দীর্ঘ ভাষণ যার বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় ‘সাম্যবাদ কি’; । এসব হুবহু ছাপা হয়েছে লাঙলে । উদ্ধৃতিটি বড়, কিন্তু বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসংগিক:
‘যেহেতু দেশীয় ও বৈদেশিক ধনিকগণের দ্বারা এবং ভারতীয় জমীদারগণের শোষণ-বৃত্তির দ্বারা ভারতবর্ষের শ্রমিক ও কৃষকগণ মানুষের মত জীবন যাপন করিতে পারিতেছে না, যেহেতু ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রীয় দলসমূহে বর্জুয়া (অভিজাত)-দেরই সমধিক প্রভুত্ব বিদ্যমান রহিয়াছে আর এই প্রভুত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় কৃষক ও শ্রমিকগণের উন্নতির পরিপন্থী, সেই হেতু ভারতীয় কম্যুনিষ্টগণের এই সম্মিলন প্রস্তাব করিতেছে যে ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মুক্তির জন্য একটি দল গঠিত হউক। এই দল ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টি (Communist Party of India) নামে অভিহিত হইবে। এই দলের চরম উদ্দেশ্য হইবে ভারতে কৃষক ও শ্রমিকগণের সাধারণ তন্ত্র (স্বরাজ) প্রতিষ্ঠিত করা।— ভূমি, খনি, গৃহ, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে ইত্যাদি যে সমস্ত জন-সম্পদের উপর জন-সাধারণের অধিকার স্থাপিত হওয়া উচিত সেই সমস্ত সম্পদকে সর্ব্বাধিকারভুক্ত ও সর্ব্বনাগরিকের আয়ত্ব করিয়া ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মানুষের মত জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করার ব্যবস্থা করা কম্যুনিষ্ট পার্টির সাক্ষাৎ উদ্দেশ্য হইবে।
এই সমস্ত উদ্দেশ্য-সাধনে সাফল্য লাভের জন্য এই পার্টিকে সহরে ও মফস্বলে শ্রমিক ও কৃষকসম্ভব গঠিত করিতে হইবে, ডিষ্ট্রীক্ট ও তালুক বোর্ড মানুসিপালিটি ব্যবস্থাপক সভা সমূহে লোক প্রেরণ করিতে হইবে এবং এইরূপ অন্যান্য উপায় ও প্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে। কোনো সাম্প্রদায়িক সভা বা সংগঠনের সভ্য এই পার্টির সভ্য হইতে পারিবেন না। ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির কংগ্রেস বা সম্মিলনের অধিবেশন বৎসরে একবার করিয়া ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হইবে ।
ইংল্যান্ডে যে সকল কম্যুনিষ্ট সম্প্রতি কারাবদ্ধ হইয়াছেন, সম্মিলন তাঁহাদিগকে সমবেদনা জানাইতেছেন এবং ইংল্যান্ডের সরকারের এরূপ ব্যবহারের প্রতি বিরক্তি প্রদর্শন করা হইয়াছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের কম্যুনিষ্ট ও ভারতীয় সদস্য মিঃ সাকলাওয়ালাকে যে আমেরিকাতে যাইতে দেওয়া হয় নাই তৎপ্রতিও সম্মিলন বিরক্তি প্রদর্শন করিয়াছে।
নিম্নলিখিত ভারতীয় কম্যুনিষ্টগণের কারাবরণেও সম্মিলন সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছে:-
১. মোহাম্মদ আকবার খান (১০ বৎসর, এখনো কারাগারে)
২. গওহর রহমান (২ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৩. মিঞা আকবর শাহ্ (২ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৪. সৈয়দ মোহাম্মদ হাবীব (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন
৫. আব্দুল মজীদ (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৬. রফিক আমদ (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৭. ফিরোজ দীন (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
৮. মোহাম্মদ সুলতান (১ বৎসর, পুরো খাটিয়া মুক্ত হইয়াছেন)
১২. মুজফ্ফর আদ (৪ বৎসর, যক্ষ্মারোগাক্রান্ত হওয়ায় ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে)
১৩. মোহম্মদ শফীক্ (৩ বৎসর, এখনো কারাগারে)’
লক্ষ্যণীয়, এই তালিকা অনুযায়ী গোড়ার পর্বে যারা কারাবাস করেছিলেন তাদের বেশির ভাগই মুসলিম।
বামপন্থীরা সেসময়ে অসম্ভব সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। প্রকাশ্যে মুজফ্ফর আহমদ লাঙলের পাতায় লিখছেন ‘শ্ৰেণী সংগ্রাম’ এবং ‘কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন’; নজরুল লিখছেন শ্রমিকের গান’; দেব্রত বসু লিখছেন ধারাবাহিক রচনা‘লেনিন ও সোভিয়েট রুশিয়া; হৃষিকেশ সেন লিখছেন ‘বাংলার প্রজাসত্ব বিষয়ক বিধি’; সুমার চক্রবর্তী লিখেছেন ‘চীনের নবজন্ম’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। ১০ম সংখ্যায় প্রচ্ছদ নিবন্ধ হচ্ছে ছোট কিন্তু তাৎপর্য্যপূর্ণ শিরোনামের লেখা—
‘সোস্যালিজম কাকে বলে?’। অন্যদিকে, প্রায়-অপ্রত্যাশিত ভাবে বেরুচ্ছে ১৮৫৩ সালে লেখা মার্কসের প্রবন্ধের অনুবাদ— ‘ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষের একটি চিত্র’। তাছাড়া থাকছে পাতায় পাতায় বিভিন্ন জেলার প্রজা-সম্মিলনের সাংগঠনিক খবরাখবর, যার মধ্যে সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন কবি নজরুল ইসলাম নিজে, কখনো প্রধান বক্তা, কখনো সভাপতি হিসেবে। এই সবই হচ্ছে নজরুলের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় ।
ধূমকেতু আর লাঙল বাংলায় র্যাডিকেল কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের দুই বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়। ধূমকেতু আধা- জাতীয়তাবাদী আধা-বামপন্থী; লাঙল সে তুলনায় পুরোপুরি সমাজবাদে আচ্ছন্ন। নজরুল সেখানে কেবল গান করছেন না, বক্তৃতাও দিচ্ছেন, সংগঠন নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছেন; আজ এখানে, কাল ওখানে; এবং এসব করতে গিয়ে তার শরীর মাঝে মাঝেই বাগড়া দিচ্ছে। সে খবরও লাঙলে বেরুচ্ছে— কবি অসুস্থ, তিনি দুর্ভাগ্যবশত সভায় যেতে পারছেন না। তিনি সবার কাছে তার পত্রখানি পাঠিয়েছেন। যেমন, ময়মনসিংহের প্রজা সম্মিলনীতে তার যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু শরীরের অসহযোগে যেতে পারেননি সেখানে। পরিবর্তে একটি পত্র পাঠালেন— সেখান থেকেও তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব কোন দিকে তা বোঝা যায়:
‘আমার প্রিয় ময়মনসিংহের প্রজা ও শ্রমিক ভ্রাতৃবৃন্দ !
আপনারা আমার অন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, আপনাদের এই নবজাগরিত প্রাণের স্পর্শে নিজেকে পবিত্র করিয়া লইব, ধন্য হইব। কিন্তু দৈব প্রতিকূল হওয়ায় আমার সে আশা পূর্ণ হইল না । আমার শরীর আজও রীতিমত দুৰ্ব্বল, একস্থান হইতে অন্যস্থানে যাইবার মত শক্তি আমার একেবারেই নাই । আশা করি আমার এই অনিচ্ছাস্বত্ত অক্ষমতা সকলে ক্ষমা করিবেন। এই ময়মনসিংহ আমার কাছে নূতন নহে। এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ভাবে ঋণী । আমার বাল্যকালের অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে। এইখানে থাকিয়া আমি কিছুদিন লেখাপড়া করিয়া গিয়াছি। আজও আমার মনে সেই সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্কর হইয়া জ্বলিতেছে। বড় আশা করিয়াছিলাম, আমার সেই শৈশব-চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার- হৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহ-প্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব, কিন্তু তাহা হইল না, দুরদৃষ্ট আমাদের। যদি সর্ব্বশক্তিমান আল্লাহ্ দিন দেন, আমার স্বাস্থ্য ফিরিয়া পাই, তাহা হইলে আপনাদের গফরগাঁওয়ের নিখিল বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনীতে যোগদান করিয়া ও আপনাদের দর্শন লাভ করিয়া ধন্য হইব। আপনারাই দেশের প্রাণ, দেশের আশা, দেশের ভবিষ্যৎ। মাটির মায়ায় আপনাদেরই হৃদয় কাণায় কাণায় ভরপুর। মাটির খাঁটি ছেলে আপনারাই। রৌদ্রে পুড়িয়া বৃষ্টির জলে ভিজিয়া-দিন নাই রাত নাই— সৃষ্টির প্রথম দিন হইতে আপনারাই ত এই মাটির পৃথিবীকে প্রিয় সন্তানের মত লালন পালন করিয়াছেন, করিতেছেন, ও করিবেন,- আপনাদের মাঠের এক কোদাল মাটি লইলে আপনারা… শির লেন কিবা তাকে শির দেন, এত ভালবাসায় ভেজা যাদের মাটি, এক বুকের খুনে উর্ব্বর যে শস্যশ্যামল মাঠ, আপনারা আমার কৃষাণ ভাইরা ছাড়া তাহার অন্য অধিকারী কেহ নাই। আমার এই কৃষাণ ভাইদের ডাকে বর্ষায় আকাশ ভরিয়া বাদল নামে, দেব বুকের স্নেহ ধারার মতই মাঠ ঘাট পানিতে বন্যায় সয়লাব হইয়া যায়, আমার এই কৃষাণ ভাইদের আদরে সোহাগে মাঠঘাট ফুলে ফলে ফসলে শ্যাম সবুজ হইয়া উঠে,-আমার কৃষাণ ভাইদের বধূদের প্রার্থনায় কাঁচা ধান সোনার রঙে রাঙিয়া উঠে,এই মাঠকে জিজ্ঞাসা কর, মাঠে ইহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইবে,– এ মাঠ চাষার এ মাটি চাষার, এর ফুল ফল কৃষক-বধূর ।
৪. বিবিধপ্ৰসংগ
নজরুলের নিজের লেখায় সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বামপন্থা নিয়ে সুপ্রচুর উল্লেখ ও ইংগিত আছে । এর পুরো বিবরণ দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। একে শুধু বিদ্রোহী মানবতাবাদ বললে সত্যের অপলাপ করা হয় । ধূমকেতু, লাঙল ও গণবাণীর নজরুল কখনো কোমল মানবতাবাদের দ্বারস্থ হননি। সেভাবে তাকে দেখাও অন্যায় ৷ তিনি ছিলেন রুদ্রমঙ্গলের কবি। রবীন্দ্রনাথ এটা জানতেন। ধূমকেতু-র প্রথম সংখ্যা থেকেই রবীন্দ্রনাথের স্বাগতবাণী নিয়মিত ভাবে ছাপা হতো। রবীন্দ্রনাথ সত্য সত্যই বিশ্বাস করতেন যে নজরুলের ধূমকেতু অর্ধচেতনদের আঘাত করে জাগাতে পারবে :
“অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে
আছে যারা অর্ধ্বচেতন।”
তারপর যখন ধূমকেতু বন্ধ হয়ে লাঙল প্রকাশিত হলো তখনো রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে নজরুল আসলে
লাঙলকে চরকার কাউন্টার-পয়েন্ট হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মুজফ্ফর আমদের সংগী— ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির আরেক জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । নজরুল, মুজফ্ফর ও সৌমেন্দ্রনাথ মিলে যখন লাঙল বের করলেন— তাদের আসল উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের বুঝতে দেরী হয় নি। লাঙলের প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই থাকত রবীন্দ্রনাথের একটি করে উদ্ধৃতি। যেমন, একটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অন্ধকারে !
সবারে না যদি ডাক’,
এখনো সরিয়া থাক’,
আপনারে বেঁধে রাখত চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান
মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান ।‘
উল্লেখ্য, লাঙলের প্রতিটি সংখ্যাতেই পত্রিকার টাইটেলের পরেই থাকত চণ্ডীদাসের চরণ:
“শুনহ মানুষ ভাই—/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’
নজরুল তার বামপন্থাকে শুধু প্রবন্ধে নয়, চিঠিপত্রে নয়, কবিতায় বা গানে নয়, গল্প-উপন্যাসেও ধারণ
করেছেন। আবারো বলছি, এর বিশ্লেষণ গভীর মনোযোগ ও বৃহত্তর পরিসর দাবী করে। উদাহরণ এত অসংখ্য এবং এত স্পষ্ট যে এনিয়ে সামান্য ইংগিতই যথেষ্ট । ১৯২৭ সালে লেখা ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র আনসারকেই ধরা যাক। সে ছিল র্যাডিক্যাল মতের প্রবক্তা নজরুলের মতই । তার শেষ কথা ছিল এমন:
‘পরদিন সকাল না হতেই কৃষ্ণনগরে একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল! দলে দলে পুলিশ এসে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বাড়িতে খানাতল্লাশ করতে লাগল। বহু ছাত্র ও তরুণকে হাজতে পুরল ।
আনসারকে ধরবার জন্যে সশস্ত্র রিজার্ভ পুলিশ সারা রাত ধরে বাগানের গাছে, নাজির সাহেবের বাড়ির আনাচে-কানাচে পাহারা দিচ্ছিল, ভোর না হতেই তারা ঘুমন্ত আনসারকে বন্দি করল। শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গেল, নাজির সাহেবের শালা আনসার রাশিয়ার বলশেভিক চর ও বিপ্লবী নেতা। সে ছেলেমেয়ের মধ্যে কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচার করছিল এবং তাদের বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করছিল।’…পুলিশ যখন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন জনগণের দিকে তাকিয়ে আনসার বলতে লাগল, ‘বন্ধুগণ ! আমার বিদায়কালে তোমাদের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, তোমরা তোমাদের অধিকারের দাবি কিছুতেই ছেড়ো না ! তোমাদেরও হয়তো আমার মতো করেই শিকল পরে জেলে যেতে হবে, গুলি খেয়ে মরতে হবে, তোমারই দেশের লোক তোমার পথ আগলে দাঁড়াবে, সকল রকমে কষ্ট দেবে, তবু তোমরা তোমাদের পথ ছেড়ো না, এগিয়ে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত হয়ো না। আগের দল মরবে বা পথ ছাড়বে, পিছনের দল তাদের শূন্যস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে। তোমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়েই আসবে তোমাদের মুক্তি।’
এরকম কথা নজরুলের মনে বহুদিন ধরেই বাজছিল । তিনি ধূমকেতুর পর্বেই বলেছিলেন:
‘জাগো জনশক্তি! হে আমার অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক, আমার মুটে-মজুর ভাইরে ! তোমার হাতের এ-লাঙল আজ বলরাম-স্কন্ধে হলের মতো ক্ষিপ্ত তেজে গগনের মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক, এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলুক—উলটে ফেলুক! আন তোমার হাতুড়ি, ভাঙ ঐ উৎপীড়কের প্রাসাদ-ধুলায় লুটাও অর্থ-পিশাচ বল-দর্পীর শির । ছোড়ো হাতুড়ি, চালাও লাঙল, উচ্চে তুলে ধর তোমার বুকের রক্ত-মাখা লালে-লাল ঝাণ্ডা! যারা তোমাদের পায়ের তলায় এনেছে, তাদের তোমরা পায়ের তলায় আন। সকল অহঙ্কার তাদের চোখের জলে ডুবাও। নামিয়ে নিয়ে এস ঝুঁটি ধরে ঐ অর্থ-পিশাচ যক্ষগুলোকে। তোমাদের পিতৃ-পুরুষের রক্ত-মাংস-অস্থি দিয়ে ঐ যক্ষের দেউল গড়া, তোমাদের গৃহলক্ষ্মীর চোখের জল আর দুধের ছেলের হৃৎপিণ্ড নিঙড়ে তাদের ঐ লাবণ্য, ঐ কান্তি । তোমাদের অভিশাপ- তিক্ত মারি-বিষ-জ্বালা লাগিয়ে তাদের সে-কান্তি, সে-লাবণ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দাও ! ’
অনেকে মনে করতে পারেন যে বামপন্থার প্রতি নজরুলের আকর্ষণ একটি কাকতালীয় ঘটনা, সাময়িক উপসর্গ কেবল, যা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাথে বন্ধুত্বের কারনে একটা প্রভাব বিস্তার করেছিল পরবর্তী জীবনে । আসলে অন্য সব আইডিওলজির মত বামপন্থী ভাবদর্শের প্রতি আকর্ষণ হওয়ারও একটি পূর্ব-ইতিহাস থাকে। রানীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুল সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। বার্ষিক পরীক্ষার পরে ডবল প্রমোশন পেয়ে তিনি নবম শ্রেণীতে উঠে যান। সেখানে তার সহযোগী ছিলেন পরবর্তী যুগের সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। যা হোক, সেই স্কুলে নিবারণচন্দ্র ঘটক নামে নজরুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। নিবারণচন্দ্রের আদর্শের দ্বারা কিশোর নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন বিপ্লবী আদর্শের প্রতি। এটি কবি নজরুল নিজে মুজফ্ফর আদকে পল্টন থেকে ফেরার পরে বলেছিলেন । ১৯১৭ সাথে নিবারণচন্দ্র ঘটক ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা বেআইনী অস্ত্র-শস্ত্র সমেত গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাঁর পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। নিবারণচন্দ্রের প্রভাব ছিল সশস্ত বিপ্লবী জীবনের প্রতি নজরুলের আকর্ষণ সৃষ্টি করার মধ্যে সীমিত। কিন্তু আদর্শবাদী বামপন্থার প্রতি টানের পেছনে ছিল রুশ বিপ্লবের প্রভাব। নজরুল তখন পল্টন জীবনে। করাচিতে যে ব্যারাকে তারা থাকতেন সেখানে যেকোনো রকমের রাজনৈতিক সাহিত্যের প্রবেশ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও ‘গোপন সুড়ঙ্গের’ মধ্য দিয়ে সেই ব্যারাকে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক বই-পত্র ঢুকত। এসম্পর্কে নজরুলের পল্টনজীবনের সহকর্মী জমাদার শম্ভু রায়ের লেখা থেকে জানতে পারি যে নজরুল বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই রাজনৈতিক সাহিত্য বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। সেরকম এক সন্ধ্যার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। তখন সদ্য সদ্য রুশ বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছে রাশিয়ার পেট্টোগ্রাড়ে। বিষয়টি এই রকম:
‘…নজরুল সেই দিন যে-সব গান গাইল ও প্রবন্ধ পড়ল তা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গান বাজনা প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লালফৌজের দেশপ্রেম নিয়ে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এবং ঠিক নাম মনে নেই সে গোপনে আমাদের একটি পত্রিকা দেখায়। ঐ পত্রিকাতে আমরাও বিশদভাবে সংবাদটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। সে দিন সারা রাতই প্রায় হৈ হুলুড়ে আমাদের কেটে গিয়েছিল।’
১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে নজরুলের ‘ব্যথার দান’ গল্পটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। এই নামে তাঁর একটি গল্প-সংগ্রহও বার হয়। বাংলা সাহিত্য এই ‘ব্যথার দান’ গল্পেই সর্বপ্রথম ‘রেড আর্মির’(লালফৌজ) প্রসঙ্গ আসে। ১৯২০ সালে যখন এই গল্পটি প্রকাশিত হয় তখনো গৃহযুদ্ধ চলছিল বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়। এই যুদ্ধ চলছিল ‘হোয়াইট আর্মি’ আর ‘রেড আর্মি’-এর মধ্যে। হোয়াইট আর্মিকে মদদ দিচ্ছিল পশ্চিমা দেশগুলো— যারা চাইছিল রাশিয়ায় পাশ্চাত্যঘেঁষা জারতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠা । রেড আর্মি বা লাল ফৌজের প্রধান সংগঠক বা অধিনায়ক ছিলেন লেনিন-সহচর লিওন ট্রটস্কী। ট্রটস্কীর নেতৃত্বে রেড আর্মি একের পর এক জয় ছিনিয়ে নিচ্ছিল। এসব ঘটনা যুবক নজরুলকে প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত করে থাকবে। এরই ফলে বেদৌরা, দারা ও সয়ফুল মুল্কের মধ্যকার ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ‘ব্যথার দানে’ চলে আসে রেড আর্মির প্রসংগ। বাস্তবেও রেড আর্মিতে—বিশেষত মধ্য-এশিয়ার অভিযানে — অনেক ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ আর্মি ছেড়ে রুশ সেনাদলে যোগ দিতে চলে গিয়েছিল । গল্পের দুটি চরিত্র দারা ও সয়ফুল মুল্ক বেলুচিন্তান থেকে আফগান্তিানের দুর্গম এলাকা পার হয়ে তুর্কিস্তান অথবা ককেশাসে গিয়ে রেড আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং কাউন্টার-রিভোলিউশনারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। রেড আর্মিতে যোগ দেওয়ার অনুভূতিটি সয়ফুল মুল্ক এভাবে প্রকাশ করেছে:
‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করেছে, এদের এই মহান নি:স্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর করে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নি:স্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্গের একজন।’
এখানে বলে রাখা দরকার মূল গল্পের আদি-পাঠে ‘লাল ফৌজ’ কথাটা থাকলেও প্রকাশিত পাঠে ‘লালফৌজ’ কেটে দিয়ে ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ বসানো হয়েছিল। এ কাজটি করেছিলেন মুজফ্ফর আহমদ স্বয়ং। ব্রিটিশ সেন্সরশীপে শুধুমাত্র ‘রেড আর্মি’ শব্দটি ব্যবহারের জন্যই যেকোন লেখক বা প্রকাশককে জেলে যেতে হত। এমনই ছিল সেদিনের চন্ডনীতি ।
রুশ-বিপ্লব ও আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে নজরুলের সাংবাদিক কর্মতৎপরতা, তার সাংগঠনিক কাজ ও সবার উপরে তার সৃষ্টিশীল কবিতা-গান-উপন্যাস-প্রবন্ধমালা যেমন বৃটিশের রুদ্র-রোষ ডেকে এনেছিল, তেমনি বিশ্বের প্রগতিশীল বৃত্তের দৃষ্টি কেড়েছিল। কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্ণের মনোযোগ গিয়ে পড়েছিল নজরুলের লেখনীর প্রতি । তাঁর লাঙল ও ওয়াকার্স-পেজেন্টস পার্টির কর্মকান্ড কমিন্টার্ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঘনিষ্ঠ ভাবে অনুসরণ করতেন। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন যে, লাঙল পত্রিকা রুশ দেশে যেত। লেনিনগ্যান্ড ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউটের পারস্য ও ভারতীয় ভাষা সমূহের অধ্যাপক ‘দাউদ আলী দত্ত’ লাঙলের সম্পাদককে ১৯২৬ সালের চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার মনে হয়, ‘লাঙল’ই সর্বপ্রথম পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে, অর্থাৎ, আমি বলতে চাই যে ভারতের আত্মোৎপন্ন সম্পদে বঞ্চিত সম্প্রদায়ের (proletariat) জাগরণশীল শ্রেণী চৈতন্যের ‘লাঙল’ প্রথম মুখপত্র। এর উদ্দেশ্যসমূহের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে এবং ইহা সাফল্যমন্ডিত হোক্ সর্বান্ত: করণে এই কামনা আমি করছি।’
লেনিনগ্রাদ ওরিয়েন্টাল ইন্সটিটিউট সরাসরি ভাবে কমিন্টার্ণের সেক্রেটারিয়েটের জন্য কাজ করত । পরবর্তীতে এর সাথে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখার্জী, এই পূর্ববঙ্গের গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। লোহানীর একাধিক লেখা রয়েছে নজরুলের ওয়াকার্স-পেজেন্টস্ পার্টির কর্মকান্ড সম্পর্কে ।
মুজফ্ফর-নজরুল প্রতিষ্ঠিত ১৯২৮ সালের অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস্ পার্টিকে ছোট করে দেখবার উপায় নেই। এর পুর্বসূরী ছিল ১৯২৫ সালের লাঙল ও বঙ্গীয় শ্রমিক-প্রজা দল। লাঙল নিষিদ্ধ করার পর খড়গ নেমে আসে ওয়াকার্স এন্ড পেজেন্টস্ পার্টির ওপরেও। ১৯২৯ সালের মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজেন্টস পার্টি আসলে ‘ছদ্মাবরণে কমিউনিস্ট পার্টি’। ব্রিটিশের এই মূল্যায়নটি সঠিক
আগেই বলেছি, ধূমকেতু ও লাঙলের পর নজরুল ‘গণবাণী’ পত্রিকার সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন । ঐ পত্রিকার অফিসে বসেই ১৯২৬ সালে আন্তর্জাতিক সাম্যের গান ‘ইন্টারন্যাশনাল’-এর অতুলনীয় বাংলা অনুবাদ করেন ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’ যেখানে লেখা ছিল:
‘শোন্ অত্যাচারী! শোনরে সঞ্চয়ী!
ছিনু সর্ব হারা, হব সর্বজয়ী ॥
ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ
নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ।
এই “অন্তর-ন্যাশনাল সংগতি”রে
হবে নিখিল-মানব জাতি সমুদ্ধত” ॥
কমিনটার্ণের পক্ষ থেকে একাধিকবার নিমন্ত্রণও এসেছিল নজরুলের কাছে স্বাস্থ্য-পুনরুদ্ধারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে যেতে। মুজফ্ফর স্বয়ং এটি নজরুলকে বলেছিলেন। যেকোন কারণেই হোক, নজরুলের আর মস্কো যাওয়া হয় নি । সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের grand-nephew) মীরাট ষড়যন্ত্রের মামলার আগেই মস্কো চলে যান। তিনি ছিলেন সাম্যবাদী ও বামপন্থী নজরুলের একান্ত অনুরাগী। তাঁর স্মৃতিকথা ‘যাত্রী’-তে লিখেছেন:
‘[নজরুলের] প্রাণ ছিল তার ঐ হাসির মতই সরল প্রবল ও দরাজ! এই অসহ্য-মুখ-মেরে দেওয়া মিঠে ভাব নজরুলের আদবেই ছিলো না। প্রবল হোতে সে ভয় পেতো না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলাদেশে।‘
লাঙলের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। বঙ্গীয় শ্রমিক-প্রজা দলেরও তিনিই ছিলেন প্রধান পুরুষ । পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স-পেজেন্টস পার্টিরও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্ব । লাঙলের জন্য আশীর্বচনে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে হলধর বলরামের সাথে তুলনা করেছিলেন:
‘জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল
প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল ।’
শুধু নজরুলের গান-কবিতা নয়, আমরা যেন তার সাম্যবাদী আদর্শ ও জীবনের পরম অভিপ্রায় সাধারণ
মানুষের মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করা—সেটাকেও যেন মনে রাখি।
আকবর আলি খান বহুমাত্রিক সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। সাধারণত দুই ধরনের সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ দেখা যায়। একদল নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডিতেই বিচরণ করতে ভালোবাসেন, তাঁদের আমরা স্পেশালিস্ট বলি। আরেক দল আছেন, তাঁরা নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে আরও বহুবিধ ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখান, বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। আকবর আলি খান ছিলেন দ্বিতীয় ধারার সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎসাহ প্রসারিত হয়েছিল বনলতা সেন থেকে দারিদ্র্য বিশ্নেষণ অবধি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশিষ্টতা খোঁজার পাশাপাশি পরার্থপরতার অর্থনীতি অনুসন্ধান, সুশাসন সম্পর্কিত ফ্রেন্ডলি ফায়ার বইটি থেকে আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। তবে বহুবিধ বিষয়ে বিচরণ করলেও, তিনি প্রথমত ও প্রধানত ছিলেন একজন ঐতিহাসিক। ইতিহাসচিন্তা তাঁর সমাজচিন্তাকে ধারণ করেছে। তাঁর অর্থনৈতিক বিশ্নেষণকে সমৃদ্ধ করেছে। এসবই জানা কথা। আমি এখানে কয়েকটি বইয়ের সূত্রে, যে সুবাদে আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা করার, সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলব। ১. নেশনের প্রাক-ইতিহাস প্রথমেই আসি তাঁর সবচেয়ে মৌলিক ও সুবিদিত কারণে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ডিসকভারি অব বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বইটির শিরোনাম শুনে পাঠকমাত্রেরই মনে পড়তে পারে ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া শীর্ষক জওহরলাল নেহরুর বইটির কথা। জওহরলাল নেহরু লিখিত বইটি ছিল মূলত বর্ণনামূলক এবং সময়ের ধারাবাহিকতাকে ধরার চেষ্টা। পক্ষান্তরে আকবর আলি খানের ডিসকভারি অব বাংলাদেশ মূলত বিশ্নেষণাত্মক এবং তাঁর অভিনিবেশ ছিল- কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি নির্মাণ করা যায়। বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গকে ঘিরে যে ভূখণ্ড বা তার অধিবাসী যারা, তাদের যে বৈশিষ্ট্য, তা তাদেরকে ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা করে। শুধু তাই নয়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড-ভূগোলের অধিবাসীদের থেকেও তাদের বিশিষ্ট করে। সেই বিশিষ্টকরণের সূত্র খুঁজছিলেন আকবর আলি খান। সেদিক থেকে এটি একটি চমৎকার পদ্ধতিগত দৃষ্টিকোণজাত গবেষণা গ্রন্থ। এখানে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল কয়েকটি। একটি হচ্ছে- এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সবলতা ও দুর্বলতার দিক কী কী। তিনি সেই ক্ষেত্রে দেখেছিলেন- এই ভূখণ্ড লেস রেজিমেন্টেড, কম শৃঙ্খলাবদ্ধ। তিনি যেটা বলেছেন, বাংলাদেশের গ্রাম হচ্ছে ওপেন জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। এর বিপরীতে উত্তর ভারতীয় গ্রামগুলোকে বলেছেন ক্লোজড জিওগ্রাফিক্যাল সেটেলমেন্ট। সেই সমস্ত গ্রামে ঢুকতে গেলে একটা সীমানা প্রাচীর পেরোতে হয়। বাউন্ডারি দেওয়া। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের তুলনাতেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে মনে হয়েছে, সেগুলো অনেক ছড়ানো ছিটানো। সেখানে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে, ফাটল রয়ে গেছে। তিনি বলছেন, এর কারণ বোধকরি এই যে, এই গ্রামগুলো কোনো সবল ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর কখনও ছিল না বা মাথা নত করেনি। বরং অন্যান্য জায়গা থেকে অত্যাচারিত বা এক্সক্লুডেড হয়ে যারা এই ভূখণ্ডে এসেছে, তারা সহজে আশ্রয় নিতে পেরেছে। জিওগ্রাফির সঙ্গে সোশ্যাল এক্সক্লুশন এবংপলিটিক্যাল ইসলামের একটি আন্তঃসংযোগ তিনি স্থাপন করেছেন। এই সূত্রে তিনি আরও লক্ষ্য করেন, ইসলাম যে এই পূর্ববঙ্গে একাদশ শতক থেকে বিস্তার লাভ করেছিল, তার পেছনে মূলত কোন কোন উপাদান কাজ করেছে। এ নিয়ে আলাদা করে তাঁর আরেকটি বই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। যার নাম ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য :একটি ঐতিহাসিক বিশ্নেষণ’। সেখানে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য ছিল- অসির বলে ইসলাম প্রচারিত হয়নি। তখনকার যুগে বাংলার, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনপদ বলে কিছু ছিল না। এটি ছিল মূলত প্রত্যন্ত এলাকা, যেটিকে এগ্রারিয়ান ফ্রন্টিয়ার বলেছেন তিনি। এক কথায়- জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের শুরুতে আমরা যে রকম বর্ণনা পাই :জঙ্গলাকীর্ণ একটি ভূখণ্ড এবং সেখানে মূলত যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বা নির্যাতিত অথবা সহায়সম্বলহীন, মরিয়া- ডেসপারেট, সেই জনগোষ্ঠীই কেবল বাস করতে উৎসাহী হবে। এই ডেসপারেট জনগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গের তুলনামূলক অনগ্রসর, বিপৎসংকুুুল, জঙ্গলাকীর্ণ, নদীপরিকীর্ণ, শ্বাপদসংকুুল এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের জীবনধারণের জন্য বসবাসের স্বার্থে সেই জঙ্গল কেটে জনপদ গড়েছে। এই বন কেটে বসত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন একাধারে ধর্মীয় ও কৃষক নেতা। এই কৃষকদের জন্য যাঁরা বাঁচার লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে পুরোভাগে ধর্মীয় নেতারা ছিলেন। সেই সুবাদে ইসলাম এখানে সহজে বঞ্চিত, অন্ত্যজ, এক্সক্লুডেড মানুষের মাঝে আসন গাড়তে সক্ষম হয়। এই ব্যাখ্যাটি রিচার্ড ইটন আদিতে দিয়েছিলেন তাঁর দ্য রাইজ অব ইসলাম-এ দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার গ্রন্থে। কিন্তু এখানে আকবর আলি খান কিছু কারেক্টিভ এনেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় মাজারের কনসেনট্রেশন সম্পর্কিত ম্যাপ তৈরি করে দেখিয়ে বলেছেন- সর্বত্র কিন্তু পীর-আউলিয়ার সমাবেশ এক রকম ছিল না। তারপরও ইসলামের ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে। সুতরাং এটা শুধু পেজেন্ট কাম রিলিজিয়াস লিডারশিপের ব্যাপার ছিল না। এটার আরেকটা কারণ ছিল- ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে যাঁরা এই ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে নতুন ধর্ম ও রীতি অভ্যাসের ভলান্টারি অ্যাডাপটেশন। অনেকটা পুশ-পুল ইফেক্টের মতো দুটি দিকই এখানে কাজ করেছে। ওই বইতে আকবর আলি খান আরেকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, কেন আমাদের দেশে বৃহৎ অর্গানাইজেশন, সোশ্যাল অর্গানাইজেশনগুলো সফল হয় না। কেন আমাদের দেশে স্তালিনীয় কায়দার সুশৃঙ্খল দল দাঁড়ায় না। কেন আমাদের দেশে বড় যেসব উদ্যোগ আমরা নিতে চাই, সেগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাঁর ধারণা, যে কারণে আমরা অপেক্ষাকৃত মুক্তগ্রাম, মুক্তসমাজ এবং অন্যকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী (যার একটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গাকে আমরা অতি স্বল্প সময়ে আশ্রয় দিতে পেরেছি); এসব যেমন আমাদের শক্তির দিক, তেমনি আমাদের দুর্বলতার দিক হচ্ছে- আমরা কারও একক নেতৃত্ব বা লিডারশিপের ধার ধারি না। এর ফলে আমাদের ভেতর একটি সেন্ট্রিফিউগাল টেন্ডেন্সি (কেন্দ্রবিমুখী প্রবণতা) সৃষ্টি হয়। আমাদের সমাজ সংগঠনে একটি অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তাঁর উত্তর হচ্ছে, এই ধরনের সমাজ-মানসিক কাঠামোয় সেই ধরনের অর্থনৈতিক সংগঠন বেশি কার্যকর হবে, যেখানে ইন্ডিভিজুয়ালিজম, ব্যক্তি উদ্যোগ বা স্বল্প পরিসরের গ্রুপ-উদ্যোগগুলো কাজ করবে। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি দেখালেন, আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে দ্রুততম সময়ে ব্যক্তিখাত গড়ে উঠল, বিকাশপ্রাপ্ত হলো। এক কথায় বলতে গেলে মার্কেট লিবারেলিজমের পক্ষে একটা সোশিওলজিকাল আর্গুমেন্ট তিনি উপস্থাপন করলেন। আরেকটি উদাহরণ তিনি দিলেন, কেন গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্র্যাকের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো এখানে সফল হলো। কেননা এগুলোর দল সংখ্যা মূলত পাঁচ থেকে দশ, ঊর্ধ্বে ত্রিশ। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরের অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো এই অঞ্চলে কাজ করতে বেশি সক্ষম বা কাজে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা। তিনি আরও একটি যুক্তি সেখানে দিলেন, সেটি হচ্ছে- অ্যাগ্রো ইকোলজিকাল আর্গুমেন্ট। তিনি বললেন, দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতে যেখানে অপেক্ষাকৃত শুস্ক মৌসুমি এলাকা, যেখানে মূলত সারফেস ওয়াটার-নির্ভর সেচ ব্যবস্থা করতে হয় কৃষিকাজের জন্য, সে ক্ষেত্রে কৃষকদের রাষ্ট্রের ওপর অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভর করতে হয়। এই কারণে ওইসব এলাকায় আমরা ক্যানাল ইরিগেশন (খাল খনন) সিস্টেম পাই, আমরা হাইড্রোলিক সভ্যতার (জলকেন্দ্রিক সভ্যতা) নিদর্শন পাই। এর বিপরীতে আমরা যখন পূর্ব বাংলায় আসি, দেখি যে নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে এখানে গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশন অপেক্ষাকৃত সফলতা পায় এবং গ্রাউন্ডওয়াটার ইরিগেশনের মধ্যেও সেখানে ডিপ টিউবওয়েলের চাইতে দেখতে পাই শ্যালো টিউবওয়েল উদ্যোগের ছড়াছড়ি। এক কথায় বলতে গেলে, আকবর আলি খানের ইতিহাসচর্চার মধ্যে পূর্ববঙ্গের বৈশিষ্ট্য খোঁজার ক্ষেত্রে তিনি অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ইকোলজি, প্রযুক্তি, মানুষের মনস্তত্ত্বসহ বিভিন্ন ছড়ানো ছিটানো ফ্যাক্টটরকে একত্রে সন্নিবেশিত করতে পেরেছেন। এজন্য তাঁর বিচার-বিশ্নেষণগুলো অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে বলে রাখি, তিনি ভূমিকাতে আরও একটি কথা বলেছিলেন। তাঁর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করা। পরবর্তী সময়ে তিনি আমাকে একান্তেও বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মাল্টিপল থিয়েটারে হয়েছিল। মঞ্চের এক অংশের ওপর যদি কেবল আলোকপাত করা হয়, তাহলে ভুল হবে। একই সময়ে অন্য থিয়েটারগুলোতেও সেই নাটকের অন্যান্য অংশ অভিনীত হচ্ছিল। সে কারণে ওই ধরনের কম্প্রিহেনসিভ হিস্ট্রি লেখার জন্য যে ধরনের পরিশ্রম, যে ধরনের কালেক্টিভের সমবেত সাধনার প্রয়োজন, সেটি নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব হবে বলে তিনি দেখছেন না। বিশেষত সমসাময়িক রাজনীতির বাদানুবাদের কারণে; তাঁর ভাষায়- ডিউ টু কনটেম্পরারি পলিটিকাল স্কোয়াবলস। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি বসে না থেকে যেটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে- এই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ইতিহাসের একটি প্রাক-ইতিহাস রচনা করা। ডিসকভারি অব বাংলাদেশের যে উন্মোচন, সেটি প্রাক-ঐতিহাসিক ন্যারেটিভের একটি নিদর্শন। বইটি আমাকে এত বেশি আকৃষ্ট করেছিল যে আমি বইটির শুধু একটি বুক রিভিউ নয়, একটি রিভিউ আর্টিকেল রচনা করি। সেটি একটি গবেষণাধর্মী জার্নাল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। সেখানে আকবর আলি খানের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আমি কিছুটা বাহাস করার চেষ্টা করি। কিছু কিছু অভিযোগ আমি সেখানে এনেছিলাম। যেমন আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম- তিনিও বঙ্কিমের মতো আমাদের বলছেন- বাঙালির ইতিহাস নাই, এই ইতিহাস কে লিখিবে, আমি লিখিব তুমি লিখিবে; সেই রকম একটি জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার উৎসাহে তিনি এই বইটি লিখলেন কিনা? কেননা আমরা যদি দুইশ-তিনশ বছর আগে যাই, সেখানে তো ন্যাশনালিজমের- এজ আ পলিটিকাল কনসেপ্ট- কোনো স্ম্ফুরণ দেখি না। এটি তো অনেক পরের ঘটনা। রেনাঁ এবং তাঁর পরবর্তী যাঁরা পলিটিকাল ন্যাশনালিজমের প্রবক্তা, তাঁদের সময়ের ঘটনা। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে। আমার আপত্তি ছিল এই বইয়ের সাবটাইটেলে। সাবটাইটেল ছিল- এক্সপ্লরেশনস ইনটু ডাইনামিকস অব এ অব হিডেন নেশন। উনি যেটাকে হিডেন ন্যাশনালিজম বলছেন, সেটাকে ফর্মুলা হিসেবে নিলে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তা হলো, আমরা এই রকম হিডেন ন্যাশনালিজমের উৎস সন্ধানে চর্যাপদ বা তারও আগে পিছিয়ে যেতে পারি। আর এতে করে ইতিহাসের নিয়মের বরখেলাপ হয় কিনা? তদুপরি আমি কিছুটা রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম গ্রন্থের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের সমস্যাটাকে বড় করে দেখেছিলাম। জাতীয়তাবাদকে এজ এ কনসেপ্ট- স্বয়ম্ভু, অ্যাবসোলুট, অবশ্যপালনীয় কনসেপ্ট হিসেবে অন্তত তখন পর্যন্ত মনে করিনি। জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তাঁর একটি প্রধান বক্তব্য ছিল- জাতীয়তাবাদ শুধু একটি মাত্রায় গড়ে ওঠে না। সেখানে ভৌগোলিক এবং আদর্শিক- এই দুটো মাত্রাতেই প্রভাব আসে। এবং আকবর আলি খান পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছেন- এখানে ফেইথ মূলত ইসলাম হলেও, নানা ধরনের সংকর বিশ্বাসের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে ফেইথের মধ্যেও অনেক রকমের বৈচিত্র্য এসেছে। অন্যদিকে আবার আমাদের ভৌগোলিক কিছু অভিন্নতার কারণে, নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে, বন্যা-ঝড় এসব প্রাত্যহিক উপদ্রবের কারণে আমাদের কতগুলো জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে। কতগুলো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখানে আমরা দেখতে পাই, যেগুলো আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের যে পিউরিটি, তার পাশাপাশি ভৌগোলিক ইমপিউরিটির সঙ্গে মিলেমিশে মিথস্ট্ক্রিয়া তৈরি করেছে। বিশ্বাস ও বসতি- এই দুই উপাদান মিলে এমন একটি জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পূর্ববঙ্গে, যেটি অন্য কোনো ভূখণ্ডের সঙ্গে মেলে না। কারণ তারা এ দেশের মতো এতটা পরিমাণে নদীনির্ভর দেশ নয়, যতটা পরিমাণে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা ঝড়-বাদল ও নদীর ওপরে নির্ভরশীল। এটিও জাতীয়তাবাদের বিচার-বিশ্নেষণের ক্ষেত্রে তাঁর একটি অনন্য অ্যাপ্রোচ। এক অর্থে, যদিও এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক পুরোপুরি নয়, তবু না মনে করে পারছি না, আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও যখন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিতে সংসদে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন- আমার চোখে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলার মাটি, জল, নদী, আকাশ। এর বেশি আপনারা আর সংজ্ঞায়িত করতে যাবেন না। গেলেই বিপদ বাধবে। আরও বেশি ঠোকাঠুকি হবে। বঙ্গবন্ধু একটা পর্যায়ে বুঝেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করতে গেলেই বিপদের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে একটু এমবিগু্যয়াস এবং ইকোলজিকাল ফ্রেমে দেখলে অনেক বেশি নিরাপদ উপস্থাপনা হয়। আকবর আলি খানও অনেকটা এই আলোকেই বারবার জোর দিয়েছেন ফেইথ ও হ্যাবিট্যাটের মিথস্ট্ক্রিয়ার ওপরে। বিশ্বাস ও বসতির পারস্পরিক প্রভাব সমুচয়ের ওপরে। ২. স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার অর্থনীতি আকবর আলি খানের দ্বিতীয় বইটি ছিল পরার্থপরতার অর্থনীতি নিয়ে এবং নামেই এর বৈচিত্র্যের পরিচয়। আমরা জানি, আমাদের সনাতন অর্থনীতি মূলত স্বার্থপরতার অর্থনীতি। কেননা তার প্রথম সবকই হলো- এডাম স্মিথের অনুসরণে- মানুষ যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে, সেটি তার নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা প্ররোচিত হয়েই করে। কিন্তু বাজার অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের কল্যাণে বিভিন্ন স্বার্থমুখী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু স্বার্থপরতার অর্থনীতি বা ইন্ডিভিজুয়াল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিপরীতে আকবর আলি খানের বইয়ের নামটি ছিল- পরার্থপরতার অর্থনীতি। পরার্থপরতা, যেখানে স্বার্থের কোনো বালাই নেই, পরোপকার করছি নিঃস্বার্থভাবে; সেটির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা। এর মানে এই নয় যে, লেখক বলছেন, স্বার্থপরতার অর্থনীতির কোনো জায়গা নেই আমাদের জীবনে এবং আমাদেরকে সব সময় বা বেশিরভাগ সময় পরোপকার, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আর পুরো দেশ-সমাজটা এভাবে পরিচালিত হবে। এ ধরনের কোনো ইউটোপীয় ধারণায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি শুধু বলছেন, সমাজ, রাষ্ট্র বা অর্থনীতি যদি কেবল ব্যক্তিস্বার্থনির্ভর নীতিতে পরিচালিত হয়, তাতে সমাজে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না এবং এ ক্ষেত্রে তিনি কেনেথ এরোর এই উক্তি মনে করিয়ে দিয়েছেন- পুঁজিবাদকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি চালাতে হলেও, তাকে একটা পর্যায়ে নিঃস্বার্থ, জনস্বার্থমুখিন, ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিস্ট, ওয়েলফেয়ার স্টেটমূলক নীতিমালা গ্রহণ করতে হয়। এভাবে স্বার্থপরতাকে টিকিয়ে রাখতে হলেও পরার্থপরতা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে যে ধরনের পণ্যসেবা ভোগ করে থাকি, তার সবটাই বাজার থেকে প্রাপ্ত না। যেমন আইনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য, টিকাদান, জনশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা। এসব বিষয় বাজারদরে যাচাই করা যায় না। এগুলো সর্বমানুষের মৌলিক অধিকার। যেটা আমাদের সংবিধানেও আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য- এগুলো হচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন। এই বেসিক নিডস সব সময় বাজার দ্বারা প্রাপ্ত হয় না। বাজারমুখিন কর্মকাণ্ড এগুলোর প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে পারে, সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে কিন্তু শুধু বাজারনির্ভর ব্যবস্থায় কোনো দেশই ১০০ শতাংশ নিরক্ষরতা দূর করতে পারেনি, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা-মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তৃত করতে পারেনি এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও বেসিক নিরাপত্তা বিধান করতে পারেনি। এই বইটি লেখার পেছনে স্পষ্টতই দেখা যায়, সেই সময় আকবর আলি খান ভাবছিলেন কোন ধরনের সমাজ হবে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী। সেটি কি কেবলই অবাধ বাজারমুখিন অর্থনীতি হবে, সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনীতি হবে, নাকি পাশাপাশি সামাজিক দায়দায়িত্ব বহনকারী প্রতিষ্ঠানাদি সংগঠন আয়োজন গড়ে তুলবে। নিজে তিনি দীর্ঘকাল সরকারের অর্থ সচিব ছিলেন, পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। তিনি খুব কাছ থেকে সরকার ও রাষ্ট্রের কার্যাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও হয়তোবা তাঁর মনে হয়েছে, বই লিখে জানান দেওয়া উচিত- আমরা বাজার অর্থনীতির দিকে সদর্পে হাঁটছি বটে কিন্তু তার রশিটা থাকতে হবে পরার্থপর জনকল্যাণের অর্থনীতির কেন্দ্রে। এবং এ দুটোরই সম্মিলন তিনি চেয়েছেন : বাজার ও রাষ্ট্র, স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা, মানুষের ব্যক্তি প্রয়োজন ও সামষ্টিক প্রয়োজন। এক পর্যায়ে তিনি সামাজিক পুঁজি এবং এর মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়েছেন অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য। এই বইটিরও আমি একটি সমালোচনা লিখি ২০০১ সালে। এটি বিআইডিএস কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক ‘উন্নয়ন সমীক্ষা’-তে বেরোয়। সেখানে আমি এই বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে বলি, বাংলাদেশের মতো দেশে যদি আমরা ওয়েলফেয়ার স্টেট বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে আমাদের নীতিমালার মধ্যে কত শতাংশ আমরা ব্যক্তি উদ্যোগের অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি আর কত শতাংশ পরার্থপরতার অর্থনীতির নীতিমালা নিচ্ছি, সেগুলোর চুলচেরা বিশ্নেষণ হওয়া উচিত। প্রতি বছর বাজেট এলে যে কথা আমরা প্রায়ই মনে রাখি না। ৩. তার আগে চাই গণতন্ত্র ২০১০-এর দশকে এসে আকবর আলি খানের রচনায় আমরা বিষয়াদির একটা বিপুল বৈচিত্র্য দেখতে পাই। ক্রমে তিনি অর্থনৈতিক ইতিহাস, ইকোনমিক হিস্টোরিয়ান অথবা অর্থনীতিবিদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ করতে থাকেন। সেখানে তিনি যা কিছু তাঁর কাছে উৎসাহজনক মনে হয়েছে, কৌতূহলকে উস্কে দিয়েছে, তা তিনি অনুসন্ধান করতে পিছপা হননি। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে বিতর্কেরও জন্ম নিয়েছে। যেমন বনলতা সেন আলোচনায় তাঁর একটি মত হচ্ছে- বনলতা সেন বলে সত্যিই একজন ছিলেন এবং বাস্তব জীবনেই তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল। হয়তো প্রেম বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল- এ রকমও তিনি স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দিয়েছেন। থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার- এটির তিনি একটি ফ্রয়েডীয় বিশ্নেষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে তিনি ভূমেন্দ্র গুহর ‘জীবনানন্দ দাশের ডায়রি’ ব্যবহার করেছেন, যেটি অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। জীবনানন্দের কবিতা বিশ্নেষণে তথ্য বিচারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন আকবর আলি খান। সুশাসনের বিষয়টি তাঁকে বিভিন্ন সময় ভাবিয়েছে। একটা বড় কারণ, তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। স্বল্পকালীন হলেও তিনি রাষ্ট্রের উচ্চতর মহল, উচ্চতর স্তর থেকে সুশাসনের সমস্যা আমাদের মতো দেশে প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান হন। সেই কমিশনের অস্তিত্ব এখন নেই। সেখান থেকেও তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমাদের দেশে কত ধরনের রেগুলেশনের সমস্যা। রেগুলেশন বাস্তবায়নের সমস্যা। যানবাহন, রাস্তার ট্রাফিক, বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংকের ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে ওয়াসার জলের কোয়ালিটি, জনস্বাস্থ্য থেকে জনশিক্ষা- সব জায়গায়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি গুণগত মান নির্ণয়ের সমস্যা। একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, একটা প্রমিতীকরণ, একটা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ধরে গুণমানকে বজায় রাখার সমস্যা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সুশাসন নিয়ে তিনি একাধিক বই বাংলা ও ইংরেজিতে রচনা করেছেন এবং সেখানে তাঁর মূল বক্তব্য হচ্ছে- একেবারে যে রাতারাতি একটি দুঃশাসনের থেকে আমরা সুশাসনের উচ্চতম স্তরে পৌঁছে যাব, ব্যাপারটা এমন নয়। মানুষের মধ্যে সুশাসনের চাহিদা গড়ে উঠতে হয় এবং সুশাসনের চাহিদাটি গড়ে ওঠে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষা বৃদ্ধি- সেগুলোর সাপেক্ষে। কিন্তু এর মানে এ-ও নয়, আমরা নিষ্ফ্ক্রিয় বসে থাকব বা একটা দীর্ঘ সময়ের দিকে মুখ রেখে চলব এবং অজানা সুশাসনের ভবিষ্যতের দিকে এগোব। সময় লাগলেও কতিপয় ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অবিলম্বে জরুরি। যেখানে আমরা কোনোভাবে ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। যেমন- আপনি যদি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন এক্স-রে মেশিনটি ঠিকমতো কাজ করছে না, ইসিজি মেশিনটি সঠিক ফল দিচ্ছে না বা সময়মতো সেখানে জরুরি বিভাগে ডাক্তার বা নার্সকে পাচ্ছেন না, যেখানে আপনি আপনার রোগী নিয়ে এসেছেন জরুরি চিকিৎসার জন্য, সেই ধরনের সুশাসনের অভাব কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না বা সাময়িক অসুখ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একইভাবে আমরা যদি শিক্ষা ক্ষেত্রে সুশাসনের কথা বলি, ধরা যাক বেসিক এডুকেশনের ক্ষেত্রে যদি শিক্ষকের অনুপস্থিতি থাকে, যদি শিক্ষক স্কুলে না পড়িয়ে কোচিং সেন্টারে পড়াতে বেশি আগ্রহী হন, যদি কোচিং সেন্টারই স্কুলের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়- এ ধরনের সুশাসনের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশৃঙ্খলা এবং সর্বোত্তম সুশাসনের মাঝখানে আমাদের যে কোনো চয়েস নেই, তা বলা যাবে না। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবিলম্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদিও আরও বৃহত্তর বলয়ে রেগুলেশন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সময় লাগবে। তিনি এ নিয়ে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার’ বইতে। এ ক্ষেত্রে বলে রাখি, আকবর আলি খানের রচনার প্রসাদগুণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি সরসভাবে জটিল তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। সেজন্য প্রয়োজনে তিনি অনেক সময় নাসিরউদ্দিন হোজ্জার বিভিন্ন গল্প বলে বিষয়টাকে প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর লেখাতে প্রায়ই স্কিট, চুটকি নানা ধরনের এনিকডোটাল রম্য কাহিনি বা বিবরণ থাকে এবং সেটি এত বেশি প্রাসঙ্গিকভাবে আসে যে তা বিশ্নেষণেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর এ রকম একটি বই বোধ করি ২০১৩-এর দিকে বেরিয়েছিল। তার নাম আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি। যেটার রিভিউ হয়েছিল কলকাতার দেশ পত্রিকায়। দেশ পত্রিকার সমালোচক লিখেছেন, বইটি পড়ে এটুকুন অন্তত বলতে পারা যায় যে লেখক কষে বাংলা লিখতে জানেন! তাঁর লেখার যে ধারা এবং লেখার যে সরস রচনাশৈলী, তা দেখে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। সেটি মিথ্যা নয়, কারণ তাঁর অত্যন্ত সুলিখিত সাবলীল ইংরেজিতে নির্মিত রচনা এবং পরবর্তীকালে তাঁর বাংলা লেখাগুলোতেও দেখেছি হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে, সহজ যুক্তির মাধ্যমে, কখনও কোনো সামান্য উদ্ধৃতির মাধ্যমে তিনি গুরুগম্ভীর বিষয়টির অবতারণা করেছেন এবং সাধারণ পাঠকের মধ্যে সহজেই তাঁর বিষয়বস্তুটি গেঁথে যাচ্ছে। এটি তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। শেষ পর্যায়ে আকবর আলি খান অনেক লেখা লিখেছেন। এর মধ্যে একটি-দুটি বলে আমি শেষ করব। একটি হচ্ছে, দারিদ্র্য নিয়ে তিনি একটি সুবিশাল গ্রন্থ লিখেছেন এবং সেখানে তিনি দারিদ্র্যের উৎপত্তি, ইতিহাস, তার মূল্যায়ন পদ্ধতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালা- এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি নিয়ে আমি বিশদ আলোচনা এখানে করতে চাই না কিন্তু যেটি আমার বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, শেষের কয়েক বছরে তিনি বারবার গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ এনেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং আগে যদি তাঁর যুক্তি ছিল- আমাদের দেশের অধিবাসীরা অর্থনৈতিক কারণেই মার্কেট লিবারেল বা বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করতে পারে, কারণ তারা অনেক বেশি অসামষ্টিক বা অনেক বেশি ইন্ডিভিজুয়াল, ব্যক্তিকেন্দ্রিক; পরবর্তী সময়ে সেটাকে তিনি কাউন্টার পয়েন্ট ধরে লিখলেন, শুধু মার্কেট লিবারেল ক্যাপিটালিজমের পথে হাঁটলেই চলবে না, পরার্থপরতা বা জনকল্যাণের কথাও ভাবতে হবে। সেজন্য পরার্থপরতার অর্থনীতি লেখা হয়েছিল। কিন্তু মার্কেটই করি আর নন-মার্কেটই করি, উভয়টাতেই আমাদের লাগবে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, প্রমিতীকরণ, রেগুলেশন, তার বাস্তবায়ন, সুশাসনের বাস্তবায়ন। সেজন্য তিনি সুশাসনকেন্দ্রিক রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু এই সুশাসনকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে গণতন্ত্র না এলে আমাদের মতো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই কনক্লুশনটির আগে থেকে পূর্বাভাস মেলেনি। মার্কেট লিবারেলিজমের পাশাপাশি ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম, আবার এ দুইকে বাস্তবায়ন করার জন্য সুশাসনের অর্থনীতি আর সুশাসনের অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন বা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা- এটি যে প্রবলতর পূর্বশর্ত, সেটি আগে তিনি অনুধাবন করেননি। কিন্তু ২০০০ দশকের শেষের দিকে এসে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে সেটির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ যে রচনা প্রকাশিত হয়েছে সমকালে, কালের খেয়াতে গত ৯ সেপ্টেম্বর সেখানেও এর প্রমাণ মেলে। আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নিয়ে আলোচনা উপলক্ষে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছিল না বলে পাকিস্তানে ফেডারেলিজমটা টেকেনি এবং ফেডারেলিজম ভেঙে টু ইউনিটের প্রস্তাবনা করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধানে যেসব অধিকার থাকতে পারত, সেগুলো আসেনি। দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠে এবং দুই অর্থনীতি গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বৈষম্য, বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও গেড়ে বসে। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন- ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’। আকবর আলি খান লিখতে পারতেন- ‘তার আগে চাই গণতন্ত্র’। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আবুল মনসুর আহমেদের যুক্তি মেনেই বলতে হয়- গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের ধারা টিকিয়ে রাখা কঠিন। অন্য অনেক দেশে হয়তো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র ছাড়াই এবং দীর্ঘকাল সেভাবে চলতে চলতে একসময় গণতন্ত্র আঙুর ফলের মতো জনগণের পাত্রে এসে পড়ে যায়, সে রকম অবস্থা আমাদের নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের মতো মডেল নিয়ে আমরা চলতে পারব না। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’-এর মডেলটিকে আকবর আলি খান কার্যত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান। এ ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে- অন্তত আমাদের মতো দেশের যে মনস্তত্ত্ব, অস্থিরতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর কাউকে স্ট্যালিনীয় কায়দার এককেন্দ্রিক শাসনের কেন্দ্রে না মানার প্রবণতা- এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের পৃথক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় যেখানে দীর্ঘকাল, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে চলেছে একদলীয় এককেন্দ্রিক শাসন, তার সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা তাই যথাযথ হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁর কনক্লুশন মূলত দাঁড়ায় এই যে- আমাদের দেশের মুক্তি মিলবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়েই এবং এক দলের দীর্ঘকাল শাসনে না থাকার মধ্য দিয়েই এটার সফল পরিণতি হয়তো দেখা যাবে। আকবর আলি খানের এই বক্তব্যও আমাদের সচকিত করে, কেননা এখানে তিনটি কথা বলেছেন। একটি বলেছেন যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবন দরকার। ডিসেন্ট্রালাইজেশন দরকার। আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে এই ডিসেন্ট্রালাইজেশন সহসা সম্ভব নয়, সেটি পাঁচ-দশ বছরের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে হয়। কিন্তু একটি বিষয়ে তিনি কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ, সেটি হচ্ছে সময়মতো কারচুপিহীন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা। সেটি তাঁর দিক থেকে নূ্যনতম পূর্বশর্ত ওই ধরনের সুশাসনসমৃদ্ধ পরার্থপরতার মূল্যবোধে ঋদ্ধ একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থনীতির সফল বিকাশের জন্য এবং সেই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার আনতে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হার সাপেক্ষে সংসদ সদস্য বণ্টনের কথা। উইনারস টেক ইট অল- সেই ধরনের প্রচলিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি বলেছেন, আমরা কি নিউজিল্যান্ডের মতো বা অন্য যেসব দেশ আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির বিচারে সংসদে প্রার্থী সংখ্যা নির্ধারণ করবে, সেই দিকে যেতে পারি কিনা। অর্থাৎ প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনের সিস্টেমে যেতে পারি কিনা। এতে তিনি বলেছেন, প্রতিযোগী দলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে এবং অনেক বেশি স্ট্যাবল গণতন্ত্রের জন্ম হবে। তবে লেখক এ নিয়ে তাঁর শেষ কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে আরও গবেষণা করা উচিত। এ বিষয়টি নজরুল ইসলাম বা অন্যদের লেখায় আগেও এসেছিল, কিন্তু এটি দেখলাম আকবর আলি খানেও খুব বিশদভাবে এসেছে। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আরও গবেষণা জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তিনি চান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি পলিটিকাল উন্নয়ন হোক। সমানতালেই হোক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন না এলে যে অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং সামাজিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে- এ কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ৪. সংক্ষিপ্তসার এক কথায় বলতে গেলে আকবর আলি খান ছিলেন একজন বহুমাত্রিক মননের মানুষ। আটাত্তর বছরের জীবনে তিনি একাধিক ভূমিকা পালন করেছেন- কখনও সরকারি আমলা হিসেবে, কখনও শিক্ষক হিসেবে, কখনও সাহসী প্রাবন্ধিক হিসেবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তার একটা দীর্ঘমেয়াদি আঁচড়ও তাঁর মধ্যে থেকে গিয়েছিল এবং এর ফলে তাঁকে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, সেটি তিনি কখনও প্রকাশ্যে বলেননি। যেমন বলেননি শেষের দিকে তাঁর স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর কত কষ্ট হতো লিখতে এবং এক পর্যায়ে তিনি লিখতেই পারতেন না, যেহেতু তাঁর ডান হাতটাই তখন কাজ করত না। তখন তিনি মুখে বলে যেতেন এবং অন্যরা লিখতেন এবং তিনি সেটাকে সেভাবেই কারেকশন করে বা কম কারেকশন করে প্রকাশের জন্য তৈরি করতেন। এটি যে কোনো লেখকের পক্ষেই যন্ত্রণা এবং তাঁর মতো এত খুঁতখুঁতে লেখক, এত পুর্ণাঙ্গ লেখকের পক্ষে তো এ যন্ত্রণা আরও বেশি। তা সত্ত্বেও তিনি একপ্রকার নিজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেই এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার ফলে আমরা অনেক রচনা পেয়েছি। এটি আমাদেরকে তাঁকে সব সময় মনে করিয়ে দেবে। আকবর আলি খানের রচনা, তাঁর সব লেখাপত্র সবাই আরও মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, বিতর্ক করবেন, আলোচনা করবেন এবং আরও উন্নত গবেষণার দিকে অগ্রসর হবেন- এই আশা রাখছি। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্যই তাঁর রচনাবলির সংগ্রহ অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া এখন জরুরি।