তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।
৩. অন্য ইতিহাসের নির্মাণ ‘এ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণ বার হয় ১৯৮২ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় অমর্ত্য সেন বলেন যে ‘Ranajit Guha is, arguably, the most creative Indian historian of this century’– সম্ভবত বিশ শতকের ‘সবচেয়ে সৃষ্টিশীল’ ঐতিহাসিক এই উপমহাদেশ থেকে। এই ভূমিকায় অমর্ত্য সেন ‘রুল অব প্রপার্টি’ পর্যায়ের সাথে পরবর্তী কালের ‘সাব-অলটার্ন স্টাডিজ’ পর্যায়ের যৌক্তিক যোগসূত্র খুঁজে বার করেন। উচ্চবর্গের ইতিহাসের সাথে নিম্নবর্গের ইতিহাসের যোগসূত্রটি তাঁর চোখে ধরা পড়েছে এভাবে (উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হলেও আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক)। অমর্ত্য সেন বলছেন: “Since we often tend to see people in fairly formulaic terms, some would no doubt expect to find in A Rule of Property for Bengal a reflection of the ‘subaltern approach’, with its overarching interest in the role of the non-elite–the so-called subalterns. As I shall presently argue, those looking for such an approach need not be entirely disappointed. There are elements that link A Rule of Property and the Subaltern Studies… What, then, are these connections? To examine them, it is useful to recapitulate briefly Guha’s motivating concern in initiating the ‘subaltern studies’ : The historiography of Indian nationalism has for a long time been dominated by elitism–colonialist elitism and bourgeois-nationalist elitism… Both these varieties of elitism share the prejudice that the making of the Indian nation and the development of the consciousness–nationalism–which informed this process were exclusively or predominantly elite achievements. While A Rule of Property is virtually all about elites–their ideas, their commitments, their hopes, their doubts–it is a view of a well-meaning but ultimately fumbling elite, botching things up at the highest level. In this sense it is not a ‘pro-elite’ book. A Rule of Property brings out the difficulties and the ultimate inadequacy of economic reforms initiated by the elite and influenced by the finest elitist thinking.” এটা বলার পর অর্মত্য সেন লিখেছেন যে রণজিতের উচ্চবর্গের ব্যর্থতার আলোচনা ও নিম্নবর্গের প্রতিরোধের আলোচনার মধ্যে একটি গভীর যোগাযোগ রয়ে গেছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে গুহ দেখেন যে এই ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক তত্ত্ব, শ্রেণি-তত্ত্ব বা সামন্তবাদ-পুঁজিবাদ তত্ত্বের নিরিখে বিচার করা যাচ্ছে না। এর সাথে জড়িয়ে গেছে ঔপনিবেশিক (ও আধুনিক) ক্ষমতা-কাঠামোর মৌলিক প্রভাব। এজন্যই ‘শিব গড়তে বাঁদর’ হয়ে যাচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সামন্তবাদবিরোধী বিশ্বজনীন সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের ধ্যান-ধারণাগুলো দূরবর্তী উপনিবেশে এসে– তা সে ঢাকার বুড়িগঙ্গাই হোক, আর কলকাতার হুগলি নদীই হোক– সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চেহারা নিচ্ছে। সুস্থ নির্মাণের পরিকল্পনাও একটি অসুস্থ/বিকৃত নির্মাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। Guha explains the botched job in the following terms: “…a typically bourgeois form of knowledge was bent backwards to adjust itself to the relations of power in a ‘semi-feudal society.’ Through the relevance of ‘power relations’ we get into a territory in which the subaltern studies have taken great interest.” ‘রুল অব প্রপার্টিস’ বইয়ে ফ্রান্সিস সাহেব ও অন্যদের আলোচনা করতে গিয়ে রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন যে কী করে একটা আপাতদৃষ্টিতে ‘ভালো’ বুর্জোয়া আইডিয়া ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে এসে নিজেরই বিরুদ্ধে গিয়ে আধা-সামন্তবাদী ক্ষমতার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এই অর্থে বইটি কোনো এলিটকেন্দ্রিক আলোচনার বই নয়: এটি এলিট বা উচ্চবর্গের জ্ঞানমার্গ (Episteme) ও তার রাজনীতিরই নিকট সমালোচনা। এবং এই সূত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আলোচনার দরকার ছিল নিম্নবর্গের আলোচনা শুরু করার জন্য। কেননা, উচ্চবর্গের রাজনীতির ব্যর্থতাই নিম্নবর্গকে ইতিহাসের প্রান্তস্থল থেকে কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে। রণজিৎ উচ্চবর্গের ব্যর্থতার আলোচনা করতে গিয়েই একপর্যায়ে নিম্নবর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ার তাগিদ অনুভব করেছেন। এই পর্যায়ে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা কী নয় সে বিষয়টি আগেভাগে পরিষ্কার করা ভালো। রণজিৎ গুহ তার পূর্বে উদ্ধৃত অংশে দুই ধরনের ইতিহাসচর্চার কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে– ঔপনিবেশিক এলিটকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার ধারা। যেন ম্যাকলে সাহেব এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে কথা ভাবলেন বা জন স্টুয়ার্ট মিল কোম্পানির নীতি নিয়ে যে বিবৃতি দিলেন তার সুবাদেই ভারতবর্ষের ইতিহাসের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অথবা ঔপনিবেশিক ভারতের বড়লাট হয়ে কোন নির্দিষ্ট পর্বে যে বিশেষ ইংরেজ রাজকর্মচারী এ দেশ শাসন করতে এলেন তার ওপরেই যেন নির্ভর করছে এ দেশের ইতিহাসের ধারা। অপর ইতিহাসচর্চার ধারাটিও খুবই প্রচলিত: সেটি হচ্ছে (বুর্জোয়া) জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার ধারা। এই মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার গান্ধী যবে থেকে সাহেব-সুবোদের বেশ ছেড়ে কৃষকের বেশ ধরলেন– যবে থেকে তিনি ‘মহাত্মা’ হলেন– তখন থেকেই গণজাগরণ দেখা দিল এ ভূখণ্ডে। অথবা সাহেব-সুবোদের মতো বেশধারী জিন্নাহ যবে থেকে কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দিলেন এবং মুসলিম কৃষক জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ অংশ যখন থেকে তাঁকেই তাদের নেতা বলে মানতে শুরু করল, তখন থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে আসল গণজোয়ার আসতে শুরু করল। নেহরু ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ লিখলেন এবং জেলে বসে তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব-ইতিহাস নিয়ে ইংরেজিতে যেসব চিঠিপত্র লিখে গেলেন, তা পরোক্ষভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বৈশ্বিক পরিসরে পেশ করল। ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে সুভাষ বসুর মহা-নিষ্ক্রমণ, পরবর্তী সময়ে তাঁর জার্মানি ও জাপান যাত্রা, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন– এগুলো ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের মহাপথপরিক্রমা। বাংলাদেশেও ৬ দফা থেকে স্বাধীনতার পর্যায়ে উত্তরণ ঘটল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। এসব মিথ্যে নয়, ইতিহাসে ব্যক্তি বা নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করার নয়, কিন্তু এসবই জাতীয়তাবাদী আখ্যানের অংশ, ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যা। কিন্তু তার বাইরেও অন্য ইতিহাস রয়ে গেছে। অন্য ইতিহাস বলতে সচরাচর আমরা বুঝি ‘মার্ক্সবাদী’ ইতিহাসচর্চার ধারা, যেটি স্পষ্টতই ঔপনিবেশিক এবং ‘জাতীয়তাবাদী’ ইতিহাসচর্চা থেকে আলাদা। মার্ক্সবাদী ঘরানার মধ্যে নানা উপধারা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যেটা এখানে প্রশ্ন হিসেবে পাঠকদের মধ্যে দেখা দেবে তা হলো– এসবের মধ্যে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার স্থান কোথায়? মার্ক্সীয় ধারার থেকে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ কতটা ও কোথায় পৃথক? ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’– এই ধারার সাথেই বা এর সম্পর্ক কী রকম? সবচেয়ে সরল বা মোটাদাগের প্রভেদটা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে (যদিও আমরা অচিরেই দেখব যে মূল পার্থক্যটা সেখানে নয়)। ঔপনিবেশিক এলিটকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার ধারায় মূল আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে ঔপনিবেশিক (ইংরেজ) প্রভুদের জীবনচর্চা, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নীতিমালা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত বাদানুবাদ ইত্যাদিকে ঘিরে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার ‘নায়ক’ হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ, তাঁদের জীবন ও কর্মতৎপরতা– যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ধীরে ধীরে। মার্ক্সীয় ইতিহাসচর্চার মূলে রয়েছে তাঁর ‘শ্রেণিগত’ দৃষ্টিকোণ– ‘পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের পরিণতি’ এই ঘোষণায় আস্থা রেখে। আধুনিক সমাজে পুঁজির মালিক ও শিল্প-প্রলেতারিয়েত হচ্ছে দুই যুধ্যমান পক্ষ। সম্পত্তির ওপরে কার অধিকার তা নিয়ে যুদ্ধ চলছে। অর্থাৎ মার্ক্সীয় ইতিহাসচর্চায় শোষক ও শোষিতের মুখের চেহারাটি স্পষ্ট; সহজেই তাদের শনাক্ত করা যায়। অন্তত সেটাই এই ঘরানার ইতিহাসবিদদের প্রধান দাবি : সমস্ত শোষণের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন। এবং এই অর্থনৈতিক শোষণ যারা চালাচ্ছে এবং যাদের ওপরে চালাচ্ছে, সেটি উন্মোচন করতে পারলেই ইতিহাসের রথের ঘোড়া যে পথ বেয়ে চলেছে সেই পথকে বোঝা সম্ভব হবে। এইসবের প্রেক্ষিতে সাব-অলটার্ন স্টাডিজের অবস্থান কোথায়? ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার ইতিহাস’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে সাব-অলটার্ন ঐতিহাসিক মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকের তুলনায় বেশি অনিশ্চয়তায় ভুগবেন। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বাইরে ইতিহাসের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর খুঁজে বেড়াবেন। ইতিহাসের কর্তা হিসেবে তিনি স্পষ্ট করে কোনো নায়ককে দেখতে পাবেন না। না ঔপনিবেশিক ‘প্রভু’, না জাতীয়তাবাদী ‘লিডার’, না দলিত-শোষিত শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ‘নেতা’– কেউ তাঁর চোখে পূর্বনির্ধারিতভাবে নায়কের আসনে সমাসীন নন। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা আসলে ‘বিরোধী বা ক্রিটিকাল ইতিহাস রচনা’। পুরো উদ্ধৃতিটি আমি এখানে তুলে ধরতে চাই: “প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনার পদ্ধতি আছে, থাকবে। উচ্চবর্গের আধিপত্যও আছে, থাকবে। অন্তত ইতিহাস লিখে সে-আধিপত্যের অবসান ঘটানো যাবে না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে।
এমনকি সেরকম হবারও কোনো প্রয়োজন নেই, না রায়তের নিজস্বার্থে না সরকারের স্বার্থে।’ রণজিৎ একে যথার্থভাবেই ‘সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত’ বলেছেন এবং এই পয়েন্টে এসে ফিলিপ ফ্রান্সিসকে আমরা আর চিনতে পারি না। ফ্রান্সিসের তৃতীয় অসুবিধে ছিল যে উপনিবেশের স্থানীয় ক্ষমতা-কাঠামো আমলে না নিয়ে এডাম স্মিথের ‘লেসে-ফেয়ার’ নীতির ওপরে তিনি বেশি করে নির্ভর করেছেন। আবার জমিদারকে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার দিলেও তিনি রায়তকেও পক্ষে রাখতে চেয়েছেন, তবে নিতান্তই পরোক্ষভাবে। প্রজার সঙ্গে জমিদার কী রকম বন্দোবস্তের চুক্তি করবে তা একান্তইভাবেই জমিদারের এখতিয়ার এ কথা কয়েকবার বলার পর তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন যে চুক্তির বিষয়টা দু’পক্ষের ওপরে ছেড়ে দিলেই সবচেয়ে ভালো হয়। ফ্রান্সিস মনে করেছেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ না ঘটলে জমিদারের সঙ্গে রায়তের সম্পর্ক একটা স্বেচ্ছাচুক্তির আকার ধারণ করবে: ‘দু’পক্ষকেই যদি এভাবে নিজেদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তারা সহজেই এমন একটা চুক্তিতে আসবে যাতে উভয়েরই সুবিধা।’ জমিদার ও রায়ত– এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের চেয়ে আপসেরই সম্ভাবনা দেখেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ১৭৬৯-১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী গ্রামবাংলার অবস্থাকে তিনি সাক্ষী মেনেছেন। যুক্তিটি কৌতূহুলোদ্দীপক: ‘এ দেশের বর্তমান অবস্থায় জমিদারের চেয়ে রায়তেরই সুবিধা হবে বেশি। এতখানি জমি যেখানে পতিত পড়ে আছে এবং আবাদ করার লোক যখন এত কম, তখন চাষিকে সাধাসাধি করতে হবে।’ এ কথা ফ্রান্সিস লিখতে পারলেন কী করে? নিকট ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের প্রভাব কেটে গেলে জমির ওপর কৃষিজীবী লোকসংখ্যার চাপ আবারও বেড়ে যাবে। ফলে জমিদার রায়তের মধ্যে দরকষাকষির সুবিধা-অসুবিধার এই হিসাব পাল্টে যেতে পারে। চাষের শর্ত উত্তরোত্তর জমিদারের পক্ষে ও রায়তের বিপক্ষে চলে যেতে পারে সেই চিত্রটা ফ্রান্সিস তার হিসাবে রাখেননি। ধনিক-চাষি যেমন ক্ষেতমজুরের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিসেবে খরিদ করে, স্বত্বাধিকারী জমিদার তেমনিভাবে স্বত্বহীন রায়তের কাছ থেকে শ্রমশক্তি কিনবে। এ ক্ষেত্রে কোনো জোরাজুরি নেই, দু’পক্ষের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে অলিখিত স্বেচ্ছাচুক্তির ভিত্তিতে, যার মূলে রয়েছে ‘লেবার-মার্কেটের চাহিদা-জোগানের অমোঘ নিয়ম’। দেখা যাচ্ছে যে, ফ্রান্সিস বাংলার কৃষিতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের কল্পনা করেছেন জমিদারকে জমির মালিকানা দিয়ে আর স্বত্ববিহীন রায়তকে তার মালিকানার অধিকার কেড়ে নিয়ে সেই জমির চাষাবাদে শ্রম দিতে বাধ্য করে। রণজিৎ গুহ অনুমান করেছেন যে অর্থশাস্ত্রের ফিজিওক্রেটিক স্কুলের প্রভাবের কারণেই ফ্রান্সিস জমিদার ও রায়তের মধ্যে ওরকম শ্রম কেনা-বেচার একটি ‘স্বাধীন চুক্তি’ কল্পনা করতে পেরেছিলেন যেটা কেবল ধনতান্ত্রিক কৃষিতেই ঘটে থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, লেবার মার্কেটের চাহিদা-জোগানের ‘অমোঘ নিয়মে’ জমিদার-রায়তের মধ্যে জমির ব্যবহার নিয়ে একধরনের বন্দোবস্ত নাহয় হলো, কিন্তু জমিদার সেই চুক্তি যদি না মানে? সেক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি ছিল জমিদার ও রায়তের মধ্যকার বন্দোবস্তের শর্ত লেখা থাকবে ‘পাট্টা’ নামক দলিলে, এবং শর্তসংবলিত সেই পাট্টাকেই ‘আইনসংগত চুক্তিপত্র’ বলে গণ্য করা হবে। ৫ নভেম্বর ১৭৭৬ তারিখে ফ্রান্সিস তার লাটসভার বিবৃতিতে বললেন যে, “পাট্টাই হচ্ছে জমিদারের সঙ্গে রায়তের ‘স্বেচ্ছাচুক্তির সাক্ষ্য ও গ্যারান্টি’ এবং গভর্নমেন্টের উচিত ‘তাদের এই পারস্পরিক চুক্তিকে কার্যকরী করার জন্য বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা’ অবলম্বন করা।” কিন্তু বাস্তবে ১৭৯৩ সালের আইনে চাষিদের এ রকম অধিকার সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। জমিদার শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতার নির্ভরযোগ্য সামাজিক শক্তি হিসেবে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক যুক্তিই তখন প্রধান বিবেচনা হিসেবে কাজ করেছিল। শুধু কৃষিজমিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রবর্তন নয়, স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এর রাজস্ব-তাৎপর্য নিয়েও ভেবেছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রথম দিকে ব্রিটিশরাজের খাজনা আদায় বাড়লেও আখেরে তা কমে যাবে এটা বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয়। প্রথমত, খাজনা চিরকালের জন্য বাঁধা (যা চলতি মূল্যে স্থিরীকৃত এবং যার প্রকৃত মূল্য মূল্যস্ফীতির সাথে কমতে বাধ্য); দ্বিতীয়ত, জমিদার চাষাবাদে অনীহা দেখালে জমির উৎপাদনশীলতা (land productivity) বাড়ার সম্ভাবনা কম; তৃতীয়ত, রায়তের ওপরে নানা কায়দায় বাড়তি শোষণ এই উৎপাদনশীলতাকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসবে। এ কারণেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জমিদারি বন্দোবস্ত থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিসরে দেখলে– রাজস্ব আদায় কমই হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮৫০-এর পরে প্রবর্তিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এলাকার ‘রায়তওয়ারী’ বন্দোবস্ত থেকে। শেষোক্ত ব্যবস্থায় জমির মালিক করা হয়েছিল খোদ কৃষককেই– কোনো ওপর থেকে বসানো জমিদারকে নয়। এর ফলে ব্রিটিশরাজের রাজস্বগত আয়ই বেশি হয়েছিল তা-ই নয়, রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক উন্নয়নও বাংলার তুলনায় বেগবান হয়েছিল। অভিজিৎ ব্যানার্জীদের লেখা থেকে সেটা আজ সুপ্রমাণিত। ফ্রান্সিস কেন এই লাইনে যুক্তি দেননি তখন? ফ্রান্সিস রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের যুক্তিতে না হেঁটে ‘আসন্ন সর্বনাশকে’ প্রথমে মোকাবিলা করতে চাইলেন। তার চোখে আসন্ন সর্বনাশ ছিল– আগেই বলেছি– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অমিত রাজস্বক্ষুধা। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তার পয়লা নম্বর নালিশ ছিল ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবণতা : ‘এখন বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবৃত্তিকে অচল অটলভাবে অনুসরণ করার ফলেই এ দেশের সর্বনাশ ঘটেছে, এবং সত্যিই যে কোনো অর্থনৈতিক লাভ এতে হয় না সে কথাও অদূর ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।’ ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে ছিল খাজনার হার বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি অধুনাকালের ‘সাপ্লাই-সাইডার্স’ মতবাদের অনুসারীদের মতো। করের হার কমিয়ে মোট কর-রাজস্ব বাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাজনার হার খুব চড়া ধরে তার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে যাবার নীতি বর্জন করে তার বদলে স্বল্প হারে খাজনার পরিমাণ একেবারেই অপরিবর্তনীয়ভাবে নির্দিষ্ট করা উচিত– এই ছিল ফ্রান্সিসের প্রস্তাব। এই প্রসঙ্গে তার মতামত যে সরাসরি মঁতাস্ক্যুর কাছে ঋণী তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন: “রাজস্ব সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ও সরল নীতিটি আমি মঁতাস্ক্যুর এই সূত্রের ভিত্তিতে রচনা করেছি: ‘জনসাধারণ কতখানি দিতে পারে তা নয়, কতটা তাদের দেওয়া উচিত, তারই ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাণ স্থির করা কর্তব্য’– অর্থাৎ কতটা দিতে পারছে তা নয়, কতটা তারা সর্বদাই দিয়ে যেতে পারে তারই ভিত্তিতে।” এক কথায় ‘সরকারের মূল শাসনব্যবস্থাটিকে চালু রাখার জন্য যতটুকু না হলে নয় তারই ভিত্তিতে হিসাব করে’ রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা উচিত। এক পর্যায়ে রাজস্ব-হ্রাসের প্রসঙ্গে ফিলিপ ফ্রান্সিস মোগল আমলের নজির টেনে নিজের বক্তব্য বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। মঁতাস্ক্যু বলেছিলেন যে মোগল শাসকেরা বিজিত দেশের রাজস্বের হার ও পরিমাণ অনড়ভাবে বেঁধে দিত বলেই তাদের শাসন এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। ২২ জানুয়ারি ১৭৭৬ তারিখের পরিকল্পনায় ফ্রান্সিস এই মত উল্লেখ করে বলেন: ‘মুসলিম বিজেতারা সুপরিমিত রাজস্ব আদায় করতেন, এবং আদায়ের ব্যবস্থার মধ্যেও কোনো জটিলতা ছিল না; এই কারণে তারা অতি সহজেই আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য কায়েম রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।’ স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এমন একটি কর-রাজস্ব ব্যবস্থা চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে করের হারকে সহনীয় রাখা হবে, কর আদায়ের ব্যবস্থায় জটিলতা থাকবে না, এবং সুপরিমিতভাবে কর-রাজস্ব আদায় করা হবে। এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শাসনকার্যের স্থায়িত্ব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এই একই ধারণার দ্বারা চালিত হয়ে তিনি জমির ওপরে সমস্ত প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ কর (tax) রদ করে শুধু খাজনাকেই (Rent) স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে করভার কৃষকদের ওপর থেকে কমে যায়, আর তারা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের কৃষিকাজ চালিয়ে নিতে পারে। কৃষকদের দিয়ে বেগার খাটানোর প্রথা, যেমন তাদের দিয়ে রাস্তা বাঁধার কাজে বেগার খাটানোর (corvee) প্রথা যেটা ফ্রান্সে একদা চালু ছিল, সেসব ‘সব রকম আবওয়াব ও মাথটের উচ্ছেদ’ করার তিনি প্রস্তাব করেন। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের চোখের সামনে ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। ১৭৭৬ সালের ২২ জানুয়ারিতে তিনি বলেছেন: ‘দেশের লোক এত গরিব হয়ে পড়েছে এবং আগের তুলনায় এত কম জমিতে এখন চাষের কাজ হয় যে স্বভাবতই যেটুকু জমিতে চাষের কাজ চালু থাকে তার ওপরে করের ভার ক্রমেই বেড়ে যায়।’ ফ্রান্সিসের আলোচনার মাধ্যমে রণজিৎ গুহ কী বার্তা দিতে চাইলেন? প্রথমত, ফ্রান্সিস ছিলেন অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ধনতন্ত্রের পন্থি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষিপণ্য চলাচলের ওপরে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থার অবসান। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভ্যন্তরীণ শুল্কব্যবস্থাকে বাংলার কৃষি, শিল্প ও বহির্বাণিজ্য বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর পদক্ষেপ বলে মনে করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত প্রকার অভ্যন্তরীণ শুল্ক উচ্ছেদ করতে। আমরা দেখেছি একটু আগেই যে সমস্ত প্রকার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে ভূসম্পত্তির ওপরে একটিমাত্র কর বসিয়ে খাজনার সঙ্গে মিলিয়ে আদায় করার প্রস্তাব। সাধারণভাবে মোগল রাজশক্তির অনুসরণে তিনি চেয়েছিলেন খাজনার অপেক্ষাকৃত পরিমিত ও অপরিবর্তনীয় হার। তিনি চেয়েছিলেন ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠা; জমিদার ও রায়তের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে দরকষাকষির সম্পর্ক; এবং সেই সুবাদে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষের নিরসন, এবং ব্রিটিশরাজের আয় ও রাজনৈতিক সমর্থনের যুগপৎ সম্প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সিস ১৭৭৬ সালে লাটসভায় যে প্রস্তাব এনেছিলেন তা ছিল তখনকার বিচারে প্রাগ্রসর। সামন্ততন্ত্রের বিপরীতে ধনতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ প্রতিযোগিতামূলক ও ব্যক্তিমালিকানা নির্ভর প্রস্তাব কলোনিয়াল পরিবেশে পড়ে বিপরীতধর্মী চেহারা নিল। অবাধ প্রতিযোগিতার ধার দিয়েও গেল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা মেট্রোপলিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। উদাহরণত, ফ্রান্সিস চেয়েছিলেন কোম্পানির ‘সাপ্লাই ব্যবসা’ করার জন্য খোলা টেন্ডারে কোনোরকম বৈষম্য না রেখে সমস্ত দেশি ব্যবসায়ীকেই কনট্র্যাক্ট নেবার সুযোগ দেওয়া হোক। এতে করে কলকাতায় বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে এবং আখেরে কোম্পানিরই লাভ হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ বাণিজ্যের প্রশস্তি কোম্পানির কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থা পূর্বাপর বজায় রইল। ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা পেল বটে, কিন্তু ফ্রান্সিস যাদের ভেবে জমিদারদের কাছে ভূমির অধিকার দিতে চাইলেন তারা মূলত এই সংস্কারের বাইরে থাকল। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী হলো এক শহুরে নব্য-ধনী সম্প্রদায়, যারা ছিল কোম্পানিরই সাথে জড়িত ব্যবসায়ী-আমলা-মুৎসুদ্দী। এরাই নতুন জমিদার ও নতুন তালুকদার হয়ে রাজত্ব করবে পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে। ফ্রান্সিস যাদের মালিকানা স্বত্ব থেকে বঞ্চিত রাখলেন ধনবাদী বিকাশের যুক্তিতে, তারা কালক্রমে জমি কর্ষণের অধিকারও হারাল। ফ্রান্সিসের উদ্ভাবিত জমিদার-রায়তের ‘স্বেচ্ছা-চুক্তির’ সম্ভাবনা মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল। [ক্রমশ] তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।
আসলে ফ্রান্সিসের অসুবিধে ছিল তিনটি। ফ্রান্সিসের চোখে মূল অ্যাডভারসেরি বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অ্যাডাম স্মিথের মতো তিনিও মনে করতেন যে কোম্পানির নীতিমালা অবাধ বাণিজ্য তত্ত্বের পরিপন্থি। কোম্পানির সঙ্গে ফ্রান্সিস বা স্মিথের এই সংঘর্ষের মধ্যে উদীয়মান ‘লিবারেল গভর্নমেন্টালিটির’ সঙ্গে গেড়ে-বসা ‘কলোনিয়াল গভর্নমেন্টালিটির’ সংঘর্ষ ধরা পড়েছে। কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলার একচ্ছত্র ‘দেওয়ানী’ লাভের পর চারদিকে খাজনা আদায়ের যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল– যেটি চলে প্রায় এক দশক অবধি– তাতে করে বাংলাদেশের কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। এই অতিরিক্ত শোষণেরই পরিণতি ১৭৭০ সালের মহা-মন্বন্তর; যার ফলে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোকের প্রাণহানি ঘটে। খোদ ইংল্যান্ডে এই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফ্রান্সিস, তার বন্ধু এডমান্ড বার্ক এবং অন্য সহযোগীরা তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরাসরি এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করেন। তাদের যুক্তি– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করছে বলেই এই নির্বিচার শাসন চলতে পারছে। এর ফলে শুধু বাংলায় অপরিসীম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে তা-ই নয়, ব্রিটিশ স্বার্থেরও আখেরে ক্ষতি হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী হেস্টিংস নিজে। বঙ্কিম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন–
‘১১৭৪ সালে ফসল ভালো হয় নাই। সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল– লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল … অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।’ বঙ্কিমের বর্ণনায় শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা ছিল না, অধিকন্তু ছিল সাধারণ মানুষ যখন উপবাসে কষ্ট পাচ্ছে, তখন রাজশক্তি (প্রকারান্তরে ব্রিটিশ শাসন) ‘রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায়’ বুঝে নিচ্ছে; যখন অনাবৃষ্টিতে সামান্যই ফলন হয়েছে, তখন রাজশক্তি সিপাহিদের তথা সামরিক বাহিনীর জন্য সেই ফসল কিনে রাখছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে; এমনকি যখন লোকজন দুই বেলা করে উপবাস করছে, তখনও ‘রাজস্ব আদায়’ বন্ধ হয়নি। যাতে কোম্পানির মোট রাজস্ব আদায়ে যাতে টান না পড়ে সেজন্য উপবাসের বছরে রাজস্বের মাত্রা ‘শতকরা দশ টাকা’ হারে বৃদ্ধি করা হলো। স্পষ্টতই এখানে জোর দেওয়া হয়েছে ওয়ারেন হোস্টিংসের আমলে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও অপশাসনের ওপরে, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত দুঃখভোগকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফ্রান্সিসের প্রথম অসুবিধে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে কার্যত ‘ওরিয়েন্টাল ডেসপটিজমের’ সাথে এক কাতারে মেলানো। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বের মোগল সাম্রাজ্যে জমিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না। সব জমির মালিক ছিলেন ‘এশিয়াটিক’ মোগল-সম্রাট। রাজশক্তির রাজকর্মচারীরা জমির ইজারাদারদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে কর-রাজস্ব আদায় করতেন। ফ্রান্সিসের যুক্তি ছিল যে ১৭৬৫ সালের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল-সম্রাটের ‘স্থান গ্রহণ’ করেছে, অর্থাৎ নিজেকে সব জমির মালিক ঘোষণা করেছে। এবং জমির ইজারাদারদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো কর-রাজস্ব আদায় করছে। এই ইঙ্গিতটাই বঙ্কিমের পূর্বে-উদ্ধৃত লেখায় দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানির শাসন ও মোগল শাসন– এই দুইয়েরই মধ্যে জমিতে ব্যক্তিমালিকানা অনুপস্থিত এই সমীকরণ টেনে ফ্রান্সিস পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে বাড়তি যুক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন। এই যুক্তিতেই ফ্রান্সিস ওয়ারেন হেস্টিংসের ‘ইজারাদারি ব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। সামন্ততন্ত্রে তা সে মোগল শাসনেই হোক, আর ষোড়শ লুইয়ের ফ্রান্সেই হোক, ইজারাদারি ব্যবস্থায় সকল জমিকে ‘রাষ্ট্রের সম্পত্তি’ হিসেবে দেখা হয় ও জমিদারকে কেবল ‘রাষ্ট্রের কর্মচারী’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে, ফ্রান্সিসের পরিকল্পনায় জমি হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এবং জমিদার হবে উত্তরাধিকারসূত্রে এই সম্পত্তির মালিক। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ফ্রান্সিসের অভিযোগ ছিল যে তার আমলে নিলাম ডেকে সর্বোচ্চ খরিদ্দারের কাছে অল্প ও অনিশ্চিত মেয়াদে ভূমি ইজারা দেওয়ার প্রথা চালু করা হয়েছে। এতে করে ইজারাদারি (লিজ) পদ্ধতিতে (১) ‘মালিকানার শাশ্বত অধিকারকে’ অস্বীকার করা হয়েছে; (২) ‘রাজস্বের দাবি অত্যন্ত উঁচু হারে’ বেঁধে রাখা হয়েছে; এবং (৩) এই হারও যখন-তখন বদলে যেতে পারে, অর্থাৎ ইজারাদারি ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানার ‘স্ট্যাবিলিটি’ নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে এর পরও ইজারাদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ১৭৬৫-উত্তর বাংলাদেশে, তার কারণ তারা ভারতবর্ষের ইতিহাসের ভুল পাঠ করেছেন। যেখানে ওয়ারেন হেস্টিংসের কোম্পানি জমিতে সামন্ত মোগল যুগের ইজারাদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে, সেখানে ফ্রান্সিস চাইছেন ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠা। এ দুই আইডিয়ার সংঘাত আসলে উপনিবেশের জমিনে নব্য-সামন্তবাদের সাথে পুঁজিবাদের লড়াই। রণজিৎ গুহ স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন এই মর্মে: “ফ্রান্সিস বলেছেন যে ইজারাদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কোম্পানি ‘মালিকের কাজ’ করেছে, কারণ রাজশক্তিই জমির মালিক এই ভুল ধারণা থেকেই উক্ত ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে। এই নীতি অনুসারে উত্তরাধিকারসূত্রে যারা সম্পত্তির আইনসংগত মালিক তাদের অধিকার হরণ করে ‘সব ক্ষেত্রেই বিদেশিদের কাছে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে’; বিদেশি বলতে তিনি কলকাতার বেনেদের নাম করেছেন, কারণ তারা গ্রামবাংলার লোক নয়, অথচ স্বনামে বা শ্বেতাঙ্গদের হয়ে বেনামিতে তারাই জমি বেশি ইজারা নিত।” ফ্রান্সিসের প্রথম অসুবিধেটা তাহলে এখন বোঝা যাচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূমি-নীতিকে তিনি পছন্দ করছেন না ব্যক্তিমালিকানার প্রতি স্বীয় পক্ষপাতিত্বের কারণে। কিন্তু একই সাথে তিনি এ-ও বুঝতে পারছেন যে কোম্পানিকে ছাড়া এই মুহূর্তে উপনিবেশের সম্প্রসারণও সম্ভব নয়। ১৭৭৬ সালে ২২ জানুয়ারি ফ্রান্সিস বাংলার লাটপরিষদে যখন হেস্টিংসের ইজারাদারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তার বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন, তখন জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। ঐ বছরের ৪ জুলাই আমেরিকা তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অর্থাৎ তখন কোম্পানির ওপর নির্ভর করা ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতবর্ষ সামরিকভাবে শাসন করা সম্ভব ছিল না। এক পর্যায়ে ইয়র্কটাউনের যুদ্ধে পরাস্ত জেনারেল কর্নওয়ালিসকে ‘লর্ড’ উপাধি দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ভারতবর্ষে। এই হেস্টিংস-কর্নওয়ালিসের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অপসারণের কোনো পথ সেদিন জানা ছিল না ফ্রান্সিসের। তিনি শুধু আশা করেছিলেন যে কোম্পানির ইজারাদারি পলিসির সমালোচনার ফলে কৃষিতে ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে সমর্থন জোরালো হবে; কোম্পানি তার জমি বা কৃষি-সংক্রান্ত নীতিমালার পরিবর্তন করবে; এবং এক পর্যায়ে কোম্পানির একাধিপত্যের ওপরেও ব্রিটিশ সরকারের তীক্ষ্ম নজরদারি স্থাপিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি দেখলেন যে ইজারাদারি ব্যবস্থার সুফল পেয়েছে গ্রামবাংলার বাইরের লোকজন, যারা মূলত কোম্পানির এ দেশীয় কর্মচারী এবং যারা কলকাতায় থেকে ‘স্বনামে বা শ্বেতাঙ্গদের হয়ে বেনামিতে’ জমি ইজারা নিয়ে আসছিল। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা ফুলে-ফেঁপে উঠছিল ১৭৬৫-১৭৯৩ কালপর্বে। এদেরকেই বলা হতো তৎকালের ‘নব্য-ধনী’, যারা প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বের (পড়ন্ত) জমিদার শ্রেণি থেকে ভিন্ন চরিত্রের। এক নতুন সামাজিক বর্গ হিসেবে এরা সেই সময়ে আবির্ভূত হয়। বাংলায় কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পত্তনের সময় আদিতে যে ৬৯৩ জন বৃহৎ জমিদারি স্বত্ব লাভ করেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন প্রাক্তন-ইজারাদার তথা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কৃষি-ব্যবসার সাথে জড়িত নব্য-ধনী গোষ্ঠী। এদের কেউ কেউ শ্বেতাঙ্গদের সাথে মিলে রপ্তানি বাণিজ্যেও জড়িত ছিলেন। এরাই ছিল বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের মূল রাজনৈতিক ভিত্তি। ফলে ১৭৯৩ সালের ভূমি-নীতি বাংলায় পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের সূত্রপাত না করে পর্যবসিত হয়েছিল মার্কস-কথিত ‘ভূমি সংস্কারের এক ক্যারিক্যাচারে’।
ফ্রান্সিসের দ্বিতীয় অসুবিধে ছিল কৃষিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রশ্নটিকে তিনি শুধু জমিদারের সাথে সম্পর্কিত করে ভেবেছিলেন। রায়তের কাছে চাষযোগ্য জমিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি। আমি রায়তকে জমির মালিকানা-স্বত্ব দেওয়ার কথা তুলছি না (যদিও সেটাও একটা ইস্যু এখানে)। আমি বলছি বর্গা-চাষি হিসেবে রায়তকে জমি ‘ব্যবহারের’ চিরস্থায়ী অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে। হতে পারে যে তিনি হয়তো শুধু কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের ‘প্রুসিয়ার পথই’ মানস-কল্পনায় রেখেছেন। যার মোদ্দা কথা হলো, জমিদার-জোতদার বা বৃহৎ ভূস্বামীও জমিতে বিনিয়োগ করতে করতে একসময় পুঁজিবাদী ধনিক কৃষকে রূপান্তরিত হতে পারে। রণজিৎ অবশ্য লিখেছেন এক্ষেত্রে ফ্রান্সিস শুধু জমিদারের কথা নয়, রায়তের কথাও ভেবেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে বলতে হবে সেটা ছিল নিতান্তই একটি অর্ধ-চিন্তিত প্রকল্প। যেমন, ১৭৭৫ সালে লর্ড নর্থকে তিনি লিখেছিলেন ‘জমিদার, তালুকদার, এমনকি রায়তেরও সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করা উচিত।’ এর থেকে ধারণা হতে পারে, জমিদারকে চিরস্থায়ী ব্যক্তিমালিকানা স্বত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি বুঝি রায়ত বা প্রজাদেরকেও (tenants) রক্ষা করতে চান এক ধরনের বর্গা-নিরাপত্তা বা tenurial security দানের মাধ্যমে। কেননা, তিনি তো জানতেন যে জমিদারি স্বত্ব দিলেও এই পুরাতন জমিদার শ্রেণি জমির দেখভাল করতে পারবে না: ‘আমি শুনেছি এবং বিশ্বাসও করি যে তরুণ জমিদার সন্তানদের অধিকাংশই জড়বুদ্ধি মূর্খ। … কিন্তু উপায় কী, জমিদারি বা ইজারাদারি একটা বেছে নিতেই হবে।’ তাহলে সমাধান কী এখানে? ফ্রান্সিস একটা অনন্য সমাধান দিতে পারতেন। জমিদারদের চিরস্থায়ী মালিকানা-স্বত্ব দেওয়া হলে হোক, কিন্তু সাথে সাথে তাদের জমি যারা চাষ করবে তাদেরকেও চিরকালের বা দীর্ঘকালের জন্য ঐ জমি চাষ করার অধিকার দেওয়া হোক, যাতে করে ‘রায়ত চিরদিনের বা দীর্ঘকালের মতো জমির অধিকার ভোগ করতে পারে’– অর্থাৎ রায়তের সঙ্গেও জমির মালিকানায় না হোক, জমির ব্যবহার নিয়ে চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত করা যেত। কিন্তু কোনো রহস্যময় কারণে ফ্রান্সিস সে পথে হাঁটলেন না। জমিদারকেই জমির প্রকৃত মালিক হতে হবে, রায়তকে নয়– এই যুক্তিতে অনড় রইলেন। কোনো দ্বিধা-সংশয় না রেখে স্পষ্টই তিনি রায় দিলেন: ‘এ কথা আদৌ সত্য নয় যে রায়তই জমির স্বত্বাধিকারী। [ক্রমশ] এমনকি সেরকম হবারও কোনো প্রয়োজন নেই, না রায়তের নিজস্বার্থে না সরকারের স্বার্থে।’ রণজিৎ একে যথার্থভাবেই ‘সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত’ বলেছেন এবং এই পয়েন্টে এসে ফিলিপ ফ্রান্সিসকে আমরা আর চিনতে পারি না। ফ্রান্সিসের তৃতীয় অসুবিধে ছিল যে উপনিবেশের স্থানীয় ক্ষমতা-কাঠামো আমলে না নিয়ে এডাম স্মিথের ‘লেসে-ফেয়ার’ নীতির ওপরে তিনি বেশি করে নির্ভর করেছেন। আবার জমিদারকে ব্যক্তিমালিকানার অধিকার দিলেও তিনি রায়তকেও পক্ষে রাখতে চেয়েছেন, তবে নিতান্তই পরোক্ষভাবে। প্রজার সঙ্গে জমিদার কী রকম বন্দোবস্তের চুক্তি করবে তা একান্তইভাবেই জমিদারের এখতিয়ার এ কথা কয়েকবার বলার পর তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন যে চুক্তির বিষয়টা দু’পক্ষের ওপরে ছেড়ে দিলেই সবচেয়ে ভালো হয়। ফ্রান্সিস মনে করেছেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ না ঘটলে জমিদারের সঙ্গে রায়তের সম্পর্ক একটা স্বেচ্ছাচুক্তির আকার ধারণ করবে: ‘দু’পক্ষকেই যদি এভাবে নিজেদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে তারা সহজেই এমন একটা চুক্তিতে আসবে যাতে উভয়েরই সুবিধা।’ জমিদার ও রায়ত– এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বের চেয়ে আপসেরই সম্ভাবনা দেখেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ১৭৬৯-১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী গ্রামবাংলার অবস্থাকে তিনি সাক্ষী মেনেছেন। যুক্তিটি কৌতূহুলোদ্দীপক: ‘এ দেশের বর্তমান অবস্থায় জমিদারের চেয়ে রায়তেরই সুবিধা হবে বেশি। এতখানি জমি যেখানে পতিত পড়ে আছে এবং আবাদ করার লোক যখন এত কম, তখন চাষিকে সাধাসাধি করতে হবে।’ এ কথা ফ্রান্সিস লিখতে পারলেন কী করে? নিকট ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের প্রভাব কেটে গেলে জমির ওপর কৃষিজীবী লোকসংখ্যার চাপ আবারও বেড়ে যাবে। ফলে জমিদার রায়তের মধ্যে দরকষাকষির সুবিধা-অসুবিধার এই হিসাব পাল্টে যেতে পারে। চাষের শর্ত উত্তরোত্তর জমিদারের পক্ষে ও রায়তের বিপক্ষে চলে যেতে পারে সেই চিত্রটা ফ্রান্সিস তার হিসাবে রাখেননি। ধনিক-চাষি যেমন ক্ষেতমজুরের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিসেবে খরিদ করে, স্বত্বাধিকারী জমিদার তেমনিভাবে স্বত্বহীন রায়তের কাছ থেকে শ্রমশক্তি কিনবে। এ ক্ষেত্রে কোনো জোরাজুরি নেই, দু’পক্ষের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে অলিখিত স্বেচ্ছাচুক্তির ভিত্তিতে, যার মূলে রয়েছে ‘লেবার-মার্কেটের চাহিদা-জোগানের অমোঘ নিয়ম’। দেখা যাচ্ছে যে, ফ্রান্সিস বাংলার কৃষিতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের কল্পনা করেছেন জমিদারকে জমির মালিকানা দিয়ে আর স্বত্ববিহীন রায়তকে তার মালিকানার অধিকার কেড়ে নিয়ে সেই জমির চাষাবাদে শ্রম দিতে বাধ্য করে। রণজিৎ গুহ অনুমান করেছেন যে অর্থশাস্ত্রের ফিজিওক্রেটিক স্কুলের প্রভাবের কারণেই ফ্রান্সিস জমিদার ও রায়তের মধ্যে ওরকম শ্রম কেনা-বেচার একটি ‘স্বাধীন চুক্তি’ কল্পনা করতে পেরেছিলেন যেটা কেবল ধনতান্ত্রিক কৃষিতেই ঘটে থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, লেবার মার্কেটের চাহিদা-জোগানের ‘অমোঘ নিয়মে’ জমিদার-রায়তের মধ্যে জমির ব্যবহার নিয়ে একধরনের বন্দোবস্ত নাহয় হলো, কিন্তু জমিদার সেই চুক্তি যদি না মানে? সেক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি ছিল জমিদার ও রায়তের মধ্যকার বন্দোবস্তের শর্ত লেখা থাকবে ‘পাট্টা’ নামক দলিলে, এবং শর্তসংবলিত সেই পাট্টাকেই ‘আইনসংগত চুক্তিপত্র’ বলে গণ্য করা হবে। ৫ নভেম্বর ১৭৭৬ তারিখে ফ্রান্সিস তার লাটসভার বিবৃতিতে বললেন যে, “পাট্টাই হচ্ছে জমিদারের সঙ্গে রায়তের ‘স্বেচ্ছাচুক্তির সাক্ষ্য ও গ্যারান্টি’ এবং গভর্নমেন্টের উচিত ‘তাদের এই পারস্পরিক চুক্তিকে কার্যকরী করার জন্য বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা’ অবলম্বন করা।” কিন্তু বাস্তবে ১৭৯৩ সালের আইনে চাষিদের এ রকম অধিকার সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। জমিদার শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতার নির্ভরযোগ্য সামাজিক শক্তি হিসেবে সমর্থন দেওয়ার রাজনৈতিক যুক্তিই তখন প্রধান বিবেচনা হিসেবে কাজ করেছিল। শুধু কৃষিজমিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রবর্তন নয়, স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এর রাজস্ব-তাৎপর্য নিয়েও ভেবেছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রথম দিকে ব্রিটিশরাজের খাজনা আদায় বাড়লেও আখেরে তা কমে যাবে এটা বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয়। প্রথমত, খাজনা চিরকালের জন্য বাঁধা (যা চলতি মূল্যে স্থিরীকৃত এবং যার প্রকৃত মূল্য মূল্যস্ফীতির সাথে কমতে বাধ্য); দ্বিতীয়ত, জমিদার চাষাবাদে অনীহা দেখালে জমির উৎপাদনশীলতা (land productivity) বাড়ার সম্ভাবনা কম; তৃতীয়ত, রায়তের ওপরে নানা কায়দায় বাড়তি শোষণ এই উৎপাদনশীলতাকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসবে। এ কারণেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জমিদারি বন্দোবস্ত থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিসরে দেখলে– রাজস্ব আদায় কমই হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮৫০-এর পরে প্রবর্তিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এলাকার ‘রায়তওয়ারী’ বন্দোবস্ত থেকে। শেষোক্ত ব্যবস্থায় জমির মালিক করা হয়েছিল খোদ কৃষককেই– কোনো ওপর থেকে বসানো জমিদারকে নয়। এর ফলে ব্রিটিশরাজের রাজস্বগত আয়ই বেশি হয়েছিল তা-ই নয়, রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক উন্নয়নও বাংলার তুলনায় বেগবান হয়েছিল। অভিজিৎ ব্যানার্জীদের লেখা থেকে সেটা আজ সুপ্রমাণিত। ফ্রান্সিস কেন এই লাইনে যুক্তি দেননি তখন? ফ্রান্সিস রায়তওয়ারী বন্দোবস্তের যুক্তিতে না হেঁটে ‘আসন্ন সর্বনাশকে’ প্রথমে মোকাবিলা করতে চাইলেন। তার চোখে আসন্ন সর্বনাশ ছিল– আগেই বলেছি– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অমিত রাজস্বক্ষুধা। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তার পয়লা নম্বর নালিশ ছিল ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবণতা : ‘এখন বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবৃত্তিকে অচল অটলভাবে অনুসরণ করার ফলেই এ দেশের সর্বনাশ ঘটেছে, এবং সত্যিই যে কোনো অর্থনৈতিক লাভ এতে হয় না সে কথাও অদূর ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।’ ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে ছিল খাজনার হার বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের যুক্তি অধুনাকালের ‘সাপ্লাই-সাইডার্স’ মতবাদের অনুসারীদের মতো। করের হার কমিয়ে মোট কর-রাজস্ব বাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাজনার হার খুব চড়া ধরে তার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে যাবার নীতি বর্জন করে তার বদলে স্বল্প হারে খাজনার পরিমাণ একেবারেই অপরিবর্তনীয়ভাবে নির্দিষ্ট করা উচিত– এই ছিল ফ্রান্সিসের প্রস্তাব। এই প্রসঙ্গে তার মতামত যে সরাসরি মঁতাস্ক্যুর কাছে ঋণী তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন: “রাজস্ব সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ও সরল নীতিটি আমি মঁতাস্ক্যুর এই সূত্রের ভিত্তিতে রচনা করেছি: ‘জনসাধারণ কতখানি দিতে পারে তা নয়, কতটা তাদের দেওয়া উচিত, তারই ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাণ স্থির করা কর্তব্য’– অর্থাৎ কতটা দিতে পারছে তা নয়, কতটা তারা সর্বদাই দিয়ে যেতে পারে তারই ভিত্তিতে।” এক কথায় ‘সরকারের মূল শাসনব্যবস্থাটিকে চালু রাখার জন্য যতটুকু না হলে নয় তারই ভিত্তিতে হিসাব করে’ রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা উচিত। এক পর্যায়ে রাজস্ব-হ্রাসের প্রসঙ্গে ফিলিপ ফ্রান্সিস মোগল আমলের নজির টেনে নিজের বক্তব্য বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। মঁতাস্ক্যু বলেছিলেন যে মোগল শাসকেরা বিজিত দেশের রাজস্বের হার ও পরিমাণ অনড়ভাবে বেঁধে দিত বলেই তাদের শাসন এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। ২২ জানুয়ারি ১৭৭৬ তারিখের পরিকল্পনায় ফ্রান্সিস এই মত উল্লেখ করে বলেন: ‘মুসলিম বিজেতারা সুপরিমিত রাজস্ব আদায় করতেন, এবং আদায়ের ব্যবস্থার মধ্যেও কোনো জটিলতা ছিল না; এই কারণে তারা অতি সহজেই আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য কায়েম রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।’ স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এমন একটি কর-রাজস্ব ব্যবস্থা চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে করের হারকে সহনীয় রাখা হবে, কর আদায়ের ব্যবস্থায় জটিলতা থাকবে না, এবং সুপরিমিতভাবে কর-রাজস্ব আদায় করা হবে। এতে করে দীর্ঘ মেয়াদে শাসনকার্যের স্থায়িত্ব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এই একই ধারণার দ্বারা চালিত হয়ে তিনি জমির ওপরে সমস্ত প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ কর (tax) রদ করে শুধু খাজনাকেই (Rent) স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে করভার কৃষকদের ওপর থেকে কমে যায়, আর তারা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের কৃষিকাজ চালিয়ে নিতে পারে। কৃষকদের দিয়ে বেগার খাটানোর প্রথা, যেমন তাদের দিয়ে রাস্তা বাঁধার কাজে বেগার খাটানোর (corvee) প্রথা যেটা ফ্রান্সে একদা চালু ছিল, সেসব ‘সব রকম আবওয়াব ও মাথটের উচ্ছেদ’ করার তিনি প্রস্তাব করেন। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সিসের চোখের সামনে ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক। ১৭৭৬ সালের ২২ জানুয়ারিতে তিনি বলেছেন: ‘দেশের লোক এত গরিব হয়ে পড়েছে এবং আগের তুলনায় এত কম জমিতে এখন চাষের কাজ হয় যে স্বভাবতই যেটুকু জমিতে চাষের কাজ চালু থাকে তার ওপরে করের ভার ক্রমেই বেড়ে যায়।’ ফ্রান্সিসের আলোচনার মাধ্যমে রণজিৎ গুহ কী বার্তা দিতে চাইলেন? প্রথমত, ফ্রান্সিস ছিলেন অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ ধনতন্ত্রের পন্থি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষিপণ্য চলাচলের ওপরে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থার অবসান। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভ্যন্তরীণ শুল্কব্যবস্থাকে বাংলার কৃষি, শিল্প ও বহির্বাণিজ্য বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর পদক্ষেপ বলে মনে করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত প্রকার অভ্যন্তরীণ শুল্ক উচ্ছেদ করতে। আমরা দেখেছি একটু আগেই যে সমস্ত প্রকার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে ভূসম্পত্তির ওপরে একটিমাত্র কর বসিয়ে খাজনার সঙ্গে মিলিয়ে আদায় করার প্রস্তাব। সাধারণভাবে মোগল রাজশক্তির অনুসরণে তিনি চেয়েছিলেন খাজনার অপেক্ষাকৃত পরিমিত ও অপরিবর্তনীয় হার। তিনি চেয়েছিলেন ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রতিষ্ঠা; জমিদার ও রায়তের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে দরকষাকষির সম্পর্ক; এবং সেই সুবাদে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষের নিরসন, এবং ব্রিটিশরাজের আয় ও রাজনৈতিক সমর্থনের যুগপৎ সম্প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সিস ১৭৭৬ সালে লাটসভায় যে প্রস্তাব এনেছিলেন তা ছিল তখনকার বিচারে প্রাগ্রসর। সামন্ততন্ত্রের বিপরীতে ধনতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ প্রতিযোগিতামূলক ও ব্যক্তিমালিকানা নির্ভর প্রস্তাব কলোনিয়াল পরিবেশে পড়ে বিপরীতধর্মী চেহারা নিল। অবাধ প্রতিযোগিতার ধার দিয়েও গেল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা মেট্রোপলিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। উদাহরণত, ফ্রান্সিস চেয়েছিলেন কোম্পানির ‘সাপ্লাই ব্যবসা’ করার জন্য খোলা টেন্ডারে কোনোরকম বৈষম্য না রেখে সমস্ত দেশি ব্যবসায়ীকেই কনট্র্যাক্ট নেবার সুযোগ দেওয়া হোক। এতে করে কলকাতায় বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে এবং আখেরে কোম্পানিরই লাভ হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের অবাধ বাণিজ্যের প্রশস্তি কোম্পানির কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। অভ্যন্তরীণ শুল্ক ব্যবস্থা পূর্বাপর বজায় রইল। ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা পেল বটে, কিন্তু ফ্রান্সিস যাদের ভেবে জমিদারদের কাছে ভূমির অধিকার দিতে চাইলেন তারা মূলত এই সংস্কারের বাইরে থাকল। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী হলো এক শহুরে নব্য-ধনী সম্প্রদায়, যারা ছিল কোম্পানিরই সাথে জড়িত ব্যবসায়ী-আমলা-মুৎসুদ্দী। এরাই নতুন জমিদার ও নতুন তালুকদার হয়ে রাজত্ব করবে পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে। ফ্রান্সিস যাদের মালিকানা স্বত্ব থেকে বঞ্চিত রাখলেন ধনবাদী বিকাশের যুক্তিতে, তারা কালক্রমে জমি কর্ষণের অধিকারও হারাল। ফ্রান্সিসের উদ্ভাবিত জমিদার-রায়তের ‘স্বেচ্ছা-চুক্তির’ সম্ভাবনা মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল। তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।