‘কতদূর এগোলো মানুষ’- এই পঙ্ক্তিটি লিখেছিলেন কবি আল মাহমুদ। আজ পঞ্চাশ বছর পরে আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি যে, কতদূর এগোলো দেশ, মানুষ, সমাজ? সেটা বুঝতে গেলে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা পরিসংখ্যান বা সূচক দিয়ে সেই পথপরিক্রমার গল্পগাথা রচনা করতে পারি। আমরা ইচ্ছে করলে গাণিতিক মডেল দিয়ে সেই পথপরিক্রমার ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারি। ইচ্ছে করলে অতিব্যক্তিক পর্যায়ে অতিতুচ্ছ মানুষের জীবনের পথপরিক্রমা দিয়েও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমাকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। যেমন আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষেরও জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক জীবনের পথপরিক্রমার বিভিন্ন পর্যায়কে মেলানো সম্ভব।
আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে- যে বছর আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলেন। ১৯৬৪ সালে যখন আমার ৬ বছর বয়স- আওয়ামী লীগ নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হলো এবং তার সাধারণ সম্পাদক হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় জীবনের এই ইতিবাচক রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি দুটো ঋণাত্মক ঘটনাও সে বছর ঘটেছিল। ১৯৬৪ সালেই ঘটে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ‘বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু এবং আরও অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক মানুষই তখন রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এক অর্থে সেটিই ছিল ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের শুরুর পর্যায়।
দ্বিতীয় ঋণাত্মক ঘটনাটি ঘটে যখন ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মস্কো এবং চীনের শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। সেটিও ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করেছিল। মস্কোপন্থি এবং চীনপন্থি বিভাজনে দুর্বল হয়ে পড়েছিল প্রগতিশীল শক্তির আন্দোলন; যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেশে এখনও চলছে।
১৯৬৯ সালে আমি সর্বপ্রথম নিজেকে পত্রিকার পাঠক হিসেবে আবিস্কার করি। তখন বাসায় পূর্বদেশ আসত এবং সেই পূর্বদেশের পাতায় আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণী প্রতিদিন ছাপা হতো। অতিআগ্রহ নিয়ে সেটি আমি পড়তাম। তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে রাজনীতির প্রতি একটু একটু করে জানা-বোঝার আগ্রহ আমার বাড়তে থাকে।
সত্তর সালের মধ্যে আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে এক ধরনের রাজনৈতিক মনোজাগতিক বিপ্লব ঘটে যায়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতন হয়, শেখ মুজিব জেল থেকে বের হয়ে আসেন। ১৯৭০ সালে আসাদ মারা যান। যে রাস্তা দিয়ে আমরা প্রতিদিন বাসে করে স্কুলে যেতাম, সেই আইয়ুব গেটের নাম আমাদের চোখের সামনে আসাদ গেটে রূপান্তরিত হয়। সে বছরই ঘূর্ণিঝড় প্রবলভাবে নাড়া দেয় আমাদের সবাইকে। আমরা পয়ষট্টি সালে একবার অনুভব করেছিলাম যে, নিজেদেরকে আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। কেননা তখন পাক-ভারত যুদ্ধ চলছিল পশ্চিম ফ্রন্টে। সে সময় পূর্ব ফ্রন্ট ছিল অরক্ষিত। ১৯৭০ সালে দ্বিতীয়বার আমরা অনুভব করলাম যে, আমরা অরক্ষিত। ঘূর্ণিঝড়ে এত বড় সংখ্যক মানুষ (প্রায় ৫ লাখ) মারা গেল- অথচ তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী প্রায় এগিয়েই এলো না। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও তীব্রতর হয়েছিল সেদিন। আমি অনেকটা মনে করি বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণের পেছনে এবং সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে এই ঘূর্ণিঝড়ের পরোক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকা কাজ করে থাকবে।
এই প্রথম আমরা চোখের সামনে দেখতে পেলাম ঘূর্ণিঝড়ে নিহত এত অসংখ্য মানুষের ছবি। পত্রিকার পাতায়, কবিতার পঙ্ক্তিতে, রাজনৈতিক চায়ের আড্ডায় সর্বত্র এই বোধটা গভীরভাবে সঞ্চারিত হলো। তাই আজকে যখন আমরা বলি, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা থেকে ১৯৭১- এই পাঁচ বছরের মধ্যে কী করে একটি জনগোষ্ঠী একটি বিচ্ছিন্নতাবাদের চেতনায় দীক্ষিত হলো এবং একটি নতুনতর রাষ্ট্রের জন্ম দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, তার কার্যকারণ খুঁজতে হবে এই সমস্ত ঘটনার অভিঘাতের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, এই সমস্ত আপাত তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে কতগুলো মূল্যবোধও এখন আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। সেই মূল্যবোধগুলো আমরা একদিনে পাইনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ আমরা ছেষষ্টি সাল থেকে সর্বপ্রথম প্রবলভাবে জাগ্রত হতে দেখলাম, যার সূত্রপাত হয়েছিল আটচল্লিশ-বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেই সমস্ত ঘটনার অভিঘাতে জাতীয়তাবাদ আরও বেশি শানিত রূপ ধারণ করে, যার একটা প্রাথমিক বিবরণী আমরা পাই শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থে।
সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটি কে কখন প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন জানা নেই, কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতা বোধের আন্দোলন গভীরতর বিকাশ পায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে। এই সময়েই আধুনিক বাংলা কবিতারও বিপুল প্রসার ঘটে। আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন অনেক বেশি সেক্যুলার চেতনায় ঋদ্ধ হতে থাকে। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যখন বঙ্গবন্ধু সরাসরিভাবে অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার পক্ষে উচ্চারণ করেন, তখন তা একেবারেই রাজনৈতিক অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে একটি ক্রমান্বয়ে পরিণতিপ্রাপ্ত অনুভূতির যৌক্তিক প্রতিষ্ঠা। এভাবেই আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িকতাবোধ এবং সেক্যুলার রাজনীতির প্রাথমিক ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা পায়। সত্তর সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তার স্বাক্ষর আমরা পাই। সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং তারও আগের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু সমতাবাদী সমাজের আকাঙ্ক্ষা তথা সমাজতন্ত্রের কথাটা জোরেশোরে এবং স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন। আর গণতন্ত্রের কথাতো পূর্বাপর দাবি হিসেবে ছিলই।
পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটি হয়েছিল ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার ভিত্তিতে। কিন্তু ধর্ম নির্বিশেষে যে নির্বাচন প্রথা, সত্তরের নির্বাচনেই সেটি প্রথম বাস্তবায়িত হয়। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্বোধন কিন্তু প্রথম ঘটে সত্তর সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এবং সেই নির্বাচনের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সেটি পরোক্ষ স্বীকৃতি লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেরো। এই তেরো বছর বয়সে চিত্রপরিচালক তারকোভস্কির ‘ইভানভের শৈশবকালের’ মতন চোখ দিয়ে আমি দেখেছিলাম যুদ্ধের সন্ত্রাস, বিদ্রোহ, গ্লানি ও ভয়। এই সমস্ত অনুভূতি তখন আমাকে তাড়া করে ফিরেছিল। এরই মধ্যে আমার বড় ভাই যুদ্ধে গেলেন। আমার বাবা মুজিবনগর সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে উত্তর-পূর্ব সেক্টরের বিভিন্ন ক্যাম্পের দেখাশোনার কাজ করছেন। যুদ্ধের ভেতরে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জয়বাংলা’ ইত্যাদি পত্রিকা- যেখানে রণাঙ্গনের খবরাখবর থাকত। আমি সেগুলো নিয়মিত পাঠ করতাম। সেই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা তো থাকতই।
আমার এবং আমার মতো অনেক মানুষের মনেই তখন একটা স্বাধীন উদারনৈতিক বাংলাদেশের রূপকল্প মনের মধ্যে জেগে ওঠে। ১৯৭২ সালে আমরা যে বাংলাদেশ পাই, তার প্রথম একটা মৌলিক উপাদান ছিল এই স্বাধীনতা এবং উদার নৈতিকতাসমৃদ্ধ বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় যে মৌলিক উপাদান আমরা দেখতে পাই তা হলো, রাতারাতি যেন বদলে গিয়েছিল জনচৈতন্যের চেহারা। সেদিনের জনআকাঙ্ক্ষার কথাটি হয়তো আজকে গালভারী কথার মতো শোনায়, কিন্তু জনআকাঙ্ক্ষা সত্যি সত্যি তখন একটা শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। সকল মানুষের চোখেই ১৯৭২ সালের সেই সময়ে দ্রুত বড় হয়ে ওঠার একটা আকাঙ্ক্ষা বা এক জীবনে এই অর্জনগুলো সম্ভব- সেই প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছিল। কিন্তু এই শুভবোধের পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য যে জনআকাঙ্ক্ষার বিস্ম্ফোরণের প্রয়োজন, তার পাশাপাশি তখন আমরা প্রাথমিক নৈরাজ্যেরও বিস্তার ঘটতে দেখি। ১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। একদল ছাত্রের ধর্মঘটের কারণে সেই সময় অধিকাংশ দিনই কোনো ক্লাস হচ্ছে না; এমনকি প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার যে ক্লাস টেস্ট, সেটিও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তখনই আমরা জাসদ এবং এ জাতীয় সংগঠনের অভ্যুদয় দেখি এবং তাদের রাজনীতির প্রভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর একটা ঘোরতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বৈকি। প্রাথমিকভাবে কেউ কেউ এসব সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হলেও পরবর্তীকালে এর কারণে একটা বড় অংশ তরুণের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যারা এর আঁচ বাঁচিয়ে চলতে পেরেছিলাম বা শিখেছিলাম- তাদের ঠাঁই হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল বা আমেরিকান সেন্টার লাইব্রেরির ভেতরে। কেননা তখন কলেজে প্রায় কোনো লেখাপড়াই হতো না। এই একই সময়ে আমরা দেখতে পাই নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা। তার মধ্যে হঠাৎ বিত্তের ঝলকানি, ব্রিফকেস ব্যবসায়ীর হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা বা অবাঙালি মালিকানাধীন পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে বসা ইত্যাদিও রয়েছে। একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই চরমপন্থি বিভিন্ন রাজনীতির বিকাশ, যার ফলে অনেক রকমের গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছিল সাধারণ মানুষসহ অনেক রাজনীতিবিদ। একটা হিসাবে দেখা যায় যে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার রাজনৈতিক ব্যক্তি বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মী গুপ্ত হত্যায় নিহত হয়েছিলেন।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ আমাদের আরেকটা দিক থেকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। আমরা এর আগে কখনও চোখের সামনে দুর্ভিক্ষের মৃত্যু দেখতে পাইনি। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র জয়গুনের চরিত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বা তারও আগে ‘অশনিসংকেত’ বা তারাশঙ্করের ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে ঢাকার মতন শহরে ঢাকা কলেজের সামনে সমগ্র জনকোলাহলের মধ্যে মানুষ মারা যাচ্ছে বা বস্ত্রহীন মানুষ হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে- এই দৃশ্য দেখা আমার সেবারই প্রথম। এখন বুঝতে পারি খাদ্য সাহায্যের ওপরে নির্ভরতা কী ভয়ানকভাবে একটি রাষ্ট্র বা জাতিকে পঙ্গু করে দেয়। বাহাত্তরের খরা, তিয়াত্তর সালের বন্যা এবং চুয়াত্তরের উপর্যুপরি দুইবারের বিধ্বংসী বন্যায় সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বণ্টন ব্যবস্থা এবং উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার কোথাও গিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। রাশিয়া নিজেই তখন আমেরিকার কাছ থেকে গম সাহায্য নিচ্ছিল। আমেরিকার কাছে সাহায্য চাওয়ায় চুয়াত্তরের জুন মাসে সোজা বলে দিয়েছিল যে, যেহেতু কিউবাতে বাংলাদেশ পাট রপ্তানি করেছে, সেহেতু তাকে পিএল ৪৮০-এর শর্ত অনুযায়ী কোনো খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সরকার তখন বলেছিল, ‘এই নিয়ম আমাদের জানা ছিল না; ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে যখন আমরা কিউবাতে পাট রপ্তানি করি, তখনতো সেই তথ্য আপনারা জানতেন। কিন্তু তখনতো আপনারা বলেননি।’ পরবর্তীকালে [অমর্ত্য সেনের স্ত্রী] অর্থনৈতিক চিন্তক, ঐতিহাসিক এমা রথচাইল্ড ফরেন এফেয়ার্স সাময়িকীতে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি লেখায় বলেছিলেন, কিউবায় রপ্তানির কারণে পিএল ৪৮০-এর খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না- এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত অবস্থান। কেননা মিসর বাংলাদেশেরও আগে কিউবাতে পাট রপ্তানি করেছিল, তবু পিএল ৪৮০-এর অধীনে তার খাদ্য সাহায্য পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশকে এক প্রকার শাস্তি দেবার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে তিনি ধারণা করেন। এরকমই ছিল সেই সময়ের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ খুবই সীমিত ছিল। সুতরাং বহির্বাণিজ্য সূত্রে খাদ্য শস্য ক্রয় করে বণ্টনের সুযোগ ছিল সীমিত। একাধিক বক্তৃতা, আলোচনায়, সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার অসহায়তার কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভিক্ষুক জাতির কোনো মান-ইজ্জত থাকে না। আমি জায়গায় জায়গায় গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারব না।
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সাময়িককালের জন্য-মতান্তরে ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য-বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেন। এর প্রধান কারণ ছিল- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নয়। এ নিয়েও একটি ভ্রান্ত প্রচারণা দেশ চালু আছে। কেননা তখন ১৯৭৩ সালের নির্বাচন অনুযায়ী পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের ছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব বা আইন পাস করার জন্য তার জরুরি অবস্থা বা বাকশাল জাতীয় ব্যবস্থা বা অন্য কোনো অথরিটিরিয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কারণ, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব ছিল। সুতরাং এর তাগিদটা রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার কারণে উদ্ভূত হয়নি। মূলত উদ্ভূত হয়েছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে সাময়িক সময়ের জন্য কড়া শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করানোর জন্য; কক্ষচ্যুত রেলগাড়িকে রেললাইনের ওপরে তোলার জন্য। এবং ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসেও এটির সিদ্ধান্ত হয়নি। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল ১৯৭৪ সালের গোড়া থেকেই। তৎকালীন নেতৃত্ব-যার মধ্যে সিপিবি এবং ন্যাপও রয়েছে- তারা বুঝতে পারছিলেন যে দেশটাকে একটা ডামাডোলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে এবং এটাকে রোখার জন্য জুন মাস থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিবি এবং ন্যাপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এই আলোচনায় অংশ নেন। দেশে যে একটা জরুরি অবস্থা আনা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে বামপন্থি সমালোচকেরা শুধু নয় দক্ষিণপন্থি সমালোচকদেরও যেমন খন্দকার আব্দুল হামিদকে লিখতে দেখেছি। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি লিখেছেন, ‘শোনা যাইতেছে দেশে ইমার্জেন্সি আসিতেছে’। অর্থাৎ, অবস্থা যে ক্রমশ ওই আপৎকালীন জরুরি অবস্থার টিপিং পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছিল, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমি বিশেষভাবে এ কথাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, বাকশালের পুনরুদ্ধার কর্মসূচির মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ছিল, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। যেমন আমাদের সংবিধানে যে চার মূলনীতি গৃহীত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- তার বিশদ মূল্যায়ন করার চেষ্টা এই কর্মসূচিতে রয়েছে। যেমন মালিকানা সম্পর্কের ব্যাপারে সংবিধানে বলা হয়েছে, আমাদের তিন ধরনের মালিকানা থাকতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানা। এ সমবায় মালিকানার আইডিয়াটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করা হয় বাকশালের কর্মসূচিতে। যেমন প্রতিটি জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়নে সম্ভব হলে পরীক্ষামূলকভাবে একটি করে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ করা যায় কিনা, তার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ জমি যার তারই থাকবে, কিন্তু জমির অংশ, শ্রমের অংশ এবং পুঁজির অংশ সবটা মিলিয়ে কৃষি খাতে একটা বণ্টননীতি করা যায় কিনা, সেটার কথা তিনি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে বলেছিলেন। বলেননি যে এটাই সর্বত্র একবারে চালু হয়ে যেতে হবে, বলেছিলেন পরীক্ষা করে দেখা যাক। কেন এটা করতে হবে? কারণ, বাংলাদেশে একটা বড় বাস্তবতা হচ্ছে যে, এ দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের প্রতি বর্গকিলোমিটারে যদি ১২০০ জন মানুষ বসবাস করে, ভারতে বাস করে ৪০০ জন। এর থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশ কীরকম ঘনবসতির দেশ। সেই দেশে জমির সিলিং দিয়ে জমি পুনর্বণ্টন করার যে প্রথাগত নিয়ম চালু আছে নানা দেশে, সেই নিয়ম বাস্তবায়ন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং সংগত কারণেই এখানে কিছু সমবায় উদ্যোগকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে তখনও কিন্তু নগরায়ণ তেমনভাবে হয়নি। তখন নগরে জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫ শতাংশ। সুতরাং এমন নয় যে, গ্রামের মানুষ বা কৃষি খাতের মানুষকে সরিয়ে আমরা রাতারাতি নগরের মানুষে পরিণত করতে পারতাম। আজকের এই নগরায়ণ তখন ছিল না। যেটি এখন অনেকটা সহজতর হয়েছে, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এখন গ্রামে থেকেও একটা পরিবারের কোনো সদস্য শহরে এসে কাজ করতে পারেন, গ্রামে টাকা পাঠাতে পারেন। অথবা অনেক ক্ষেত্রে তারা বিদেশে যেতে পারেন। কিংবা কেউ কেউ ধীরে ধীরে শহরে পুরোপুরি স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারেন। এই সুযোগটা তখন ছিল না। সুতরাং একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে সমবায় কর্মসূচিটিকে সর্বাত্মকভাবে প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই সমর্থন জানিয়েছিলেন। আমার জানা মতে তখনকার দিনের প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ, দেশ নিয়ে চিন্তা করেন এমন মানুষেরা জানিয়েছিলেন যে, এই কো-অপারেটিভ এক্সপেরিমেন্ট করা যেতে পারে। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল, যাতে অংশগ্রহণ করেন রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ বহু দেশের অর্থনীতিবিদেরা। সম্মেলনের এক পর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সেই দলের নেতা অস্টিন রবিনসন তখন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন যে, ‘আপনি যে সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন সেটি কি আমদের একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, ‘আমাদের সমাজতন্ত্র হলো বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র, বাংলাদেশের মতো করে সমাজতন্ত্র। এর বেশি অতিরিক্ত কোনো সংজ্ঞার দরকার নেই।’ তখন এ সম্পর্কে অস্টিন রবিনসন বলেছিলেন, শেখ মুজিবের এই উত্তরটি কোনো চতুর উত্তর ছিল না, এটি প্রকৃতপক্ষেই বাস্তব জ্ঞানভিত্তিক উত্তর ছিল, কেননা বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা সমতামুখী সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা কোনো গতবাধা মডেল অনুসরণ করে হতে পারে না। কিংবা রাশিয়া বা ভিয়েতনাম ধরে এটাকে অনুসরণ করা যেতে পারে না। বাংলাদেশের মনমানসিকতার সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, ক্যাপাসিটি- এসব মিলিয়েই সেটা গড়ে উঠতে হবে।

সব সময় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমরা কোনো উন্নত আধুনিক পুঁজিবাদী দেশের বা কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের বা কোনো দেশেরই মডেল অনুকরণ করে বড় হতে পারব না। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার আছে। সেদিক থেকে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ অনেকটা দেং শিয়াও পিং-এর বাংলাদেশ। সেখানে মূল জোরটা দেওয়া হবে কাজটা সফল হলো কিনা তার ওপরে। বেড়াল সাদা না কালো সেই আলোচনাটা অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার চাইতে বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বেড়ালটি ইঁদুর মারতে পারে কিনা। দেং শিয়াও পিং-এর মতোই বঙ্গবন্ধুর একটি বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান ছিল, সজাগ টনটনে। এবং সে জন্যই তিনি ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগের সীমা প্রথমে ২৫ লাখ, পরে ৩ কোটি, তারপরে ৩০ কোটি পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের ৩ কোটি বা ৩০ কোটি আজকের যুগে একশ-দুশ কোটি টাকার সমতুল্য। সুতরাং এটা মনে রাখতে হবে যে, তিনি মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোক্তার বিকাশ পরিপূর্ণভাবে চেয়েছিলেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে ওই সিলিংটাকে তিনি আরও পর্যালোচনা করার পক্ষপাতি ছিলেন। কালক্রমে এটা সংসদে রিভাইজড হবে সেটাই ছিল আইডিয়া।
বাংলাদেশ যে আজকে এতদূর এগিয়েছে তার একটা বড় কারণ হলো- বাংলাদেশের যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তারা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। তারা একপেশে, শুধু বাজারমুখী অর্থনীতি বা শুধু রাষ্ট্রনির্ভর অর্থনীতির পেছনে ছোটেননি। এটা বিশেষভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
একাত্তরে স্বাধীনতা যদি বাংলাদেশের প্রথম মৌলিক অর্জন হয়, বাঙালি জাতির পক্ষে দ্বিতীয় মৌলিক অর্জন হচ্ছে ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে। নব্বই সালে আমার বয়স ৩২ বছর। তখন এই বয়সের আশপাশে যাদের বয়স তারা প্রায় সকলেই সেদিন ঢাকার রাস্তায় ছিলেন। এবং তারা সকলেই সেদিন দ্বিতীয়বারের স্বাধীনতা অর্জনকে উপলব্ধি করেছিলেন। মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের এই পরাজয়টি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এর মধ্য দিয়ে মিলিটারি শাসন অনিবার্য নয় এবং তা ছাড়াই যে সিভিলিয়ান শাসনে দেশ পরিচালিত হতে পারে এমন একটি মূল্যবোধের জন্ম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ পনেরো বছর পরে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রতি একটা অঙ্গীকারের সূচনা হয়। এবং আমাদের আজকের যে অর্থনৈতিক অর্জন তার সূচনাটা হয় মূলত নব্বই দশক থেকেই।
এখন পরিসংখ্যানের প্রশ্নে আসি। আমরা যদি নব্বই সাল থেকে আন্তদেশ শুমারির একটা বিচার-বিশ্নেষণ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাবো, যে সমস্ত খাতে অর্থনৈতিক সামাজিক সাফল্য আমাদের এসেছে- তার সূচনা নব্বই দশক থেকে হাঁটিহাঁটি করে শুরু হলেও মূলত এই সাফল্যের মূল অভিঘাত এসে পড়েছে দু’হাজার দশের দশকে। সেটা আমরা শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বলি, গড় আয়ুস্কালের ক্ষেত্রে বলি, মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বলি, নারী শ্রমের অংশগ্রহণ হারের ক্ষেত্রে বলি, জিডিপি গ্রোথের উল্লম্ম্ফনের ক্ষেত্রে বলি, দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে বলি, জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিস্তারের ক্ষেত্রে বলি এই সমস্ত ক্ষেত্রেই আমরা এক সময় যে দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেই পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে আছি। এমনকি পাশের বৃহৎ দেশ ভারত তার তুলনায় আমরা অনেক সামাজিক সূচকে এগিয়ে আছি, যার সঙ্গে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি জড়িত। এমনকি অর্থনৈতিক সূচকেও ভারতের সঙ্গে যে ব্যবধান আমাদের ছিল, ধরা যাক মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে ব্যবধান- সেটিও আমরা লক্ষণীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে পেরেছি। সেটা পিপিপি হিসেবেই বলা হোক বা সাধারণভাবে কারেন্ট ইউএস ডলারের বিচারেই বলা হোক। এমনকি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, কারেন্ট ইউএস ডলারে ভারতের মাথাপিছু আয়কেও আমরা টেক্কা দিয়েছি। এই পরিবর্তনগুলো সহসা অর্জিত হয়নি। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে কাজ করেছে চারটি ফ্যাক্টর। একটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা; যেটা দিয়ে আমি বাহাত্তর সালের কথা বলে শুরু করেছিলাম। জনগণের আকাঙ্ক্ষার এই ফ্যাক্টর আর সমস্ত ক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। দ্বিতীয় ফ্যাক্টর কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি। উচ্চ আকাঙ্ক্ষার কারণে জনগণ আর নিজেকে প্রথাগত পেশায় আবদ্ধ রাখতে চাইছে না। সে আর মান্ধাতা আমলের কৃষিতে বিশ্বাসী নয়। সে চাইছে নতুন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে এবং এরই ফলে আমরা দেখতে পাই যে, কৃষিখাতে একটা বিরাট প্রযুক্তিগত বিকাশ ঘটে গেছে। যে কৃষিক্ষেত্রে আগে লাঙল ছাড়া চাষ করা যেত না, সেখানে প্রায় সর্বত্রই এখন পাওয়ার টিলারের ব্যবহার। যেখানে আমরা গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না, সেখানে এখন আমরা পোলট্রি, লাইভস্টক এমনকি গো-পালন সেক্টরেও অভাবিত উন্নতি করেছি গত পাঁচ-সাত বছরে। মৎস্য উৎপাদন এবং মাথাপিছু মাছের ভোগের পরিমাণেও আমরা এগিয়ে আছি। এই সবটাই ঘটেছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে। মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে, তার বদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা না থাকলে এত দ্রুত এটা সম্ভব হতো না। এর পেছনে আরও একটা প্রাতিষ্ঠানিক কারণের উল্লেখ করতে চাই, আমাদের দেশে প্রথাগতভাবে যেটা সত্তরের দশকে ভুলভাবে ভাবা হয়েছিল যে, কৃষিতে সামন্তবাদী অবশেষ রয়ে গেছে। অথচ যেখানে সামন্তবাদী অবশেষের প্রাবল্য ভারত ও পাকিস্তানের কৃষিখাতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। আধা সামন্তবাদের প্রাবল্য আমাদের দেশে বলতে গেলে আজ নেই। আমাদের দেশের শ্রমিক অনেক বেশি চলমান, তারা অনেক বেশি বিদেশ ও শহরমুখীন। আমাদের গ্রামের যে মান্ধাতা আমলের ক্ষমতা কাঠামো, আশি-নব্বই দশকে তাকে অতি সহজেই চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়েছে এবং এর ফলে দেখা যাচ্ছে যে বর্গা বাজারে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। আগে যেখানে বর্গাচাষি, ভাগচাষি ছিল প্রধান প্রথা, সেখানে চলে এসেছে চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে বার্ষিক চুক্তির বদলে সিজনাল চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং এই চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের অধীনে যে জমি- সেটিতো কমেইনি, বরং ১৯৮৮ সালের ২৩ শতাংশের বদলে এখন প্রায় ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই ৫০ শতাংশের মধ্যে প্রায় অর্ধেক জমি চাষাবাদ করছেন কার্যত ভূমিহীন বর্গাচাষিরা। এটি যে কতবড় সামাজিক উত্থান এবং পরিবর্তনের নির্দেশক, তা বলে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না। আমি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, গ্রামজীবনে একে একটি সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক অর্জন হিসেবে শনাক্ত করতে চাই।
তৃতীয় যে অর্জনটি গ্রামে হয়েছে, এবং যার প্রভাব আমরা আগামীতেও দেখতে পাবো- সেটি হচ্ছে ‘মিশ্র ধরনের’ খানার উদ্ভব। এই ধরনের খানাগুলো ঠিক কৃষিতেও পুরোপুরি নয়, অকৃষিতেও পুরোপুরি নয়। যে খানাগুলোর কিছু সদস্য কৃষিতে নিয়োজিত, কিছু সদস্য অকৃষিতে নিয়োজিত। এই খানাগুলোকে আমি মিশ্র খানা বলছি। মিশ্র খানার শতকরা হার গত এক দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এদের আরও বেশি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং তার জন্য আমাদের ছোট শহরগুলোর উন্নয়ন আবশ্যক। কেননা মিশ্র খানাগুলো বাস করে গ্রামাঞ্চলে। তারা যদি অকৃষি খাতে আরও বেশি যুক্ত হয়, তাহলে সবচাইতে ভালো হয় গ্রামের বাইরে ছোট ছোট শহরে কাজ করে দিনের শেষে যাতে ঘরে ফিরে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। যেটা শ্রীলঙ্কাতে আছে। যেহেতু শ্রীলঙ্কাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক বেশি সমৃদ্ধ, তারা সকালে গিয়ে রাতে রেলে করে ঘরে ফিরে আসতে পারে। এই রকম ব্যবস্থা যদি চালু করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে আগামী এক দশকে এই মিশ্র খানার পরিমাণ আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
চতুর্থ যে বিষয়টি এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে, সেটি আমাদের নারী শ্রমশক্তির বিকাশ। আমাদের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৩৬ শতাংশ। সেটি ভারতের ৩০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। এবং পাকিস্তানের চাইতে তো অনেক বেশিই। এটি এমনকি সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই হারটিকে আরও উন্নত করা প্রয়োজন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মালয়েশিয়ার ৫৫ শতাংশ বা চীনের ৬০ শতাংশের হারে নিয়ে যেতে গেলে আমাদের আরও কসরত করতে হবে। কিন্তু যতটুকু প্রসারিত হয়েছে সেটির অর্থনৈতিক সামাজিক অভিঘাত খুবই লক্ষণীয়। সেটি কেবল সমাজের জন্যই শুভ হয়নি, যারা এই পরিবর্তনটা এনেছেন সেই নারীদের জীবনেই শুভ ফল বয়ে এনেছে। আমাদের দেশ এখন অনেকখানি এগিয়ে গেছে মূলত এই জেন্ডার ডেভেলপমেন্টের কারণে। এই অর্থে একজন সমাজবিজ্ঞানী সম্প্রতি বলেছেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন কি মূলত নারীনির্ভর উন্নয়ন? এই কথাটির মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে কিন্তু এর মধ্যে সত্যতা অনেকখানি। একে আরও সবল এবং সফল করতে হবে এবং এটা হতে পেরেছে দুই-তিনটা পার্শ্ব ফ্যাক্টরের কারণে। তার মধ্যে একটা অবশ্যই রপ্তানিমুখীন শিল্পের বিকাশ-যেটিকে আমরা গার্মেন্ট শিল্প হিসেবে দেখি। যদিও এখন অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও এটি ঘটছে। এর পেছনে কিছুটা গ্রামপর্যায়ে ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধিও অবদান রেখেছে। অনেক ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা নারীর ক্ষেত্রে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সরবরাহ বেড়েছে এবং তারা নানা ধরনের উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছেন। লাইভস্টক ও পোলট্রি সেক্টরের বিকাশও এ ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। এমনকি কৃষিখাতেও অনেক নারী এগিয়ে এসেছেন। এবং এর মাধ্যমে এক ধরনের ফেমিনাইজেশন ঘটছে গ্রামাঞ্চলের কৃষি এবং অকৃষি খাতে, সেটিও লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু এটাকে আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন, বিশেষত আমি মনে করি ঢাকায় মধ্যবিত্ত নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের হার বরং একটু কম। সেইখানে আমাদের জড়তাটা কাটিয়ে ওঠা দরকার এবং এক্ষেত্রে সহায়তার দিগন্ত আরও প্রসারিত করা দরকার।
গত পঞ্চাশ বছরে অনেক বঞ্চনা নিরাশার মধ্য দিয়ে আমাদের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আমাদের কৃষি নিয়ে নৈরাশ্য ছিল; কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না, কারণ কৃষির উৎপাদন সম্পর্ক হচ্ছে আধা সামন্ততান্ত্রিক। শিল্প খাত নিয়ে নৈরাশ্য ছিল যে, বলা হতো বাঙালিরা প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যোক্তা। তারা আধুনিক শিল্প-কলকারখানা চালাতে জানে না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও নৈরাশ্য ছিল। কেননা আমাদের দেশ এমনিতেই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের নৈরাশ্য ছিল প্রবৃদ্ধি নিয়ে, কেননা এখানে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর ফলে শুধু যে ফসলহানি হয় তাই নয়, কোনো আধুনিক শিল্পোদ্যোক্তাও এখানে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। বন্যায় তার ব্যবসা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এমন অনেক নৈরাশ্যকে আমাদের দেখতে হয়েছে আমাদেরই জীবদ্দশায় গত পঞ্চাশ বছরে। এবং সত্তর-আশি-নব্বই দশকে এই নৈরাশ্যবাদগুলো ছিল খুবই প্রবল, যার চিহ্ন আমরা খুঁজে পাই তৎকালীন সমসাময়িক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাহিত্যে। এখন অবশ্য একটা উল্টো সুর বইছে। এখন আমরা সর্বত্র আশাবাদের কথা শুনছি। ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা শুনছি। এখন অনেকেই আছেন যারা ইতিবাচকতার কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়েন। তারা বলতে চান যে, সব পরিবর্তনতো ইতিবাচক হয়নি। এখনও তো অনেক পরিবর্তন বাকি এবং সেটা হওয়া সম্ভব নয়, কেননা বিভিন্ন সমস্যা আমাদের জর্জরিত করছে। এর মধ্যে সমস্যা রয়েছে সুশাসন নিয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে, উন্নত মানের শিক্ষা নিয়ে, স্বাস্থ্যসেবার পরিধি নিয়ে, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ নিয়ে আছে এক ধরনের ব্যর্থতাবোধ। আমার কথা হচ্ছে- এই ধরনের আশা এবং নিরাশার মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী ২০ বছর চলতে হবে। আশার দিকটিকেও আমাদের সংহত করতে হবে, নিরাশার দিকটিকেও আমাদের যথাসম্ভব উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো জাতির বিকাশ সহসা এবং অতিদ্রুত করা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের অধিবাসীদের যখন এই প্রশ্ন করা হয় যে, তারা কীভাবে উন্নয়ন করল- তখন তারা বলে, ‘আমাদের এই যে উন্নয়ন আপনারা দেখছেন, সেটা করতে গিয়ে আমাদের বাবা-মা, পিতামহ-পিতামহীদের পিঠ ভেঙে গেছে। তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এবং এই অমানুষিক খাটুনিতে তারা জীবনে আর কোনো কিছু পাননি। স্বপ্ন দেখেছেন, কষ্ট করেছেন কিন্তু বাস্তব জীবনে নিজেরা আর কোনো কিছু ভোগ করে যেতে পারেননি। তারা সব কিছু করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।’ অর্থাৎ সেখানে একটা-দুইটা প্রজন্ম এমন অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। যখন আমরা অতিদ্রুত কোনো কিছু অর্জন করতে চাই বা পারি না বলে হতাশা বোধ করি- তখন আমাদেরও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম। এবং এই পরিশ্রম করার মানেই হচ্ছে যে, কিছু অর্জনের জন্য একটা সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিশ্রম করে যাওয়া। সেই সময়টাতো আমাদের নিজেদের দিতে হবে। তাই বলছি, আমাদের যে অস্থিরতা, আমাদের যে অসম্পূর্ণতা, আমাদের যে তীক্ষষ্ট ব্যর্থতাবোধ- সেটাকে পরিশীলিত করতে হবে ইতিহাসের মাপকাঠিতে। যে জিনিসটা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে অর্জন সম্ভব, সেটি হয়তো আপনি চাইতে পারেন বিশ-ত্রিশ বছরে। কিন্তু পাঁচ বা দশ বছরের মধ্যেই সেটা নাটকীয়ভাবে চাইতে পারেন না। আপনাকে সেই ফল পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা আর পরিশ্রম করতে হবে। আমি মনে করি যে, একটা জাতির মধ্যে সেই ধৈর্য ও স্থৈর্য থাকা প্রয়োজন। আমি আমার জীবদ্দশায় অনেক সফলতা দেখতে চেয়েছিলাম- যার কিছু কিছু দেখতে পেয়েছি। কখনও ভাবিনি নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য শাসনের অবসান হবে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সারাজীবন ধরেই দেখব দক্ষিণ অফ্রিকায় সাদা এবং কালোদের এই বিভাজন চলছে। কিন্তু সেই বিভাজন টেকেনি। আমি আমার জীবদ্দশায় কখনও ভাবিনি যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রথাগত সমাজতন্ত্রের দেশগুলো এক-দুই বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ে বিলীন হয়ে যাবে। সেটাও দেখেছি। সুতরাং কিছু কিছু ভালো যা আমরা ভাবিনি কিন্তু ঘটেছে, কিছু কিছু অভাবনীয় ঘটনা যা ভাবিনি সেগুলোও ঘটেছে। আমাদের কিছু পাওয়া এবং কিছু না পাওয়াটাকে মেনে নিতে হবে। এবং অপেক্ষা করতে হবে আরও ভালো দিনের জন্য; আর তার জন্য পরিশ্রম করে যেতে হবে। সেটা আমার জীবদ্দশায় হোক বা না হোক।
লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতি
বিশ্নেষক