[তুমুল গাঢ় সমাচার ২০] ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিশেল ফুকো :মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা (Foucault and Micro-power)

পর্ব ::২০


নতুন প্রসঙ্গ

১. ক্ষমতার ‘প্রাণভোমরা’

ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো তার বিভিন্ন আপ্তবাক্যের জন্য বিখ্যাত। তার মধ্যে একটি হলো- ‘যেখানেই ক্ষমতা [রাজ করে], সেখানেই [তার বিরুদ্ধে] প্রতিরোধ গড়ে ওঠে’। সমস্যাটা জটিল, কেননা আমরা জানি শেষ পর্যন্ত এ খেলার পরিসমাপ্তি কোথায়। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। যতদিন প্রতিরোধ প্রতিবাদী অবস্থায় থাকে, ততক্ষণ সে ঠিক পথে চলছে। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সাথে সাথে তার চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে। কেন এমন হয়, সেটা জানার জন্যই ফুকোকে পাঠ করা দরকার।

ক্ষমতা অর্থাৎ Power বিষয়টিকে ফুকো যেভাবে দেখেছেন, যত বিভিন্ন উপায়ে তার বিশ্নেষণ করেছেন, সেভাবে এর আগে কোনো দার্শনিকই ব্যাখ্যা করেননি। মার্কস যেমন পুঁজির রহস্য-উন্মোচনের জন্য পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, ফুকোও তেমনি ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার সব কথা মানতেই হবে এমন নয়। এ নিয়ে আরেক ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদার সাথে তার উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জার্মান দার্শনিক জুরগেন হাবেরমাসের সাথেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সবাই এ কথা মানছেন, তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সিস বেকন ভেবেছেন, ‘নলেজ ইটসেল্কম্ফ ইজ পাওয়ার’। আমাদের বিদ্যালয়ে এখনও পড়ানো হয়, লেখাপড়া করলে গাড়ি-ঘোড়ার মালিক হওয়া যায়। ফুকো এসব অস্বীকার করবেন না। তিনি শুধু বলবেন, কোনটা ‘জ্ঞান’ আর কোনটা ‘অজ্ঞান’ এটা ঠিক করেছে কে? এই জ্ঞান, এই সত্য, অদৃশ্য ক্ষমতাবলয়ের বশীকরণ মন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত বিকৃত, আচ্ছন্ন হয়ে নেই তো? ফুকো এ রকম ভাবছেন, কেননা তিনি মনে করেন যে, জ্ঞান উৎপাদন ও জ্ঞান বণ্টনের প্রক্রিয়া যতটা নিরীহ ভাবি আমরা, আসলে সেসব আদৌ নিরীহ নয়। এক রক্তাক্ত সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে তবেই জ্ঞান তৈরি হচ্ছে। কোন মত ‘সত্য’ বলে স্বীকৃত হবে, আর কোন মতকে ‘সৃষ্টিছাড়া’ বলে বর্জনীয় ঘোষিত হবে, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। ফুকো এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে [অসংখ্য পরীক্ষক প্রতিদিন আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন]… সেখানে স্কুলের শিক্ষক পরীক্ষকের ভূমিকায়, ডাক্তার পরীক্ষকের ভূমিকায়, চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদ পরীক্ষকের ভূমিকায়, সমাজ-কর্মী পরীক্ষকের ভূমিকায়। এরা সবাই মিলে কোনটা স্বাভাবিক রীতিসম্মত তার একটি রাজত্ব (Reign of normality) তৈরি করেছে। এই পরীক্ষকের কাছে প্রতিটি ব্যক্তিকে তার শরীরের আচরণ, তার আচার-ব্যবহার, তার দক্ষতা, তার অর্জন সব কিছুকে অধীনস্থ করেই তবে তাকে বাঁচতে হচ্ছে।’ ফুকো এই অদৃশ্য ও দৃশ্যমান ‘পরীক্ষকদের’ থেকে আমাদের বাঁচাতে চান।

‘পাথরের কোরাস’ কবিতার শুরুর স্তবকেই টি. এস. এলিয়ট বলেছিলেন যে, জ্ঞানরাজ্যের অরণ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি:

Where is the life we have lost in living?
Where is the wisdom we have lost in knowledge?
where is the knowledge we have lost in information?

এলিয়ট জ্ঞানরাজ্যের অন্ধকার দিকের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীয় সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেননি। প্রত্যাশা করেছেন দৈবপ্রেরণার, যেখানে অপেক্ষা করে আছে। ইমানুয়েল কান্ট যাকে বলেছিলেন ঊঃবৎহধষ চবধপব- এক অনন্ত শান্তির কাল। ফুকোর মধ্যে সেই দিব্যোন্মাদ চাহনী নেই। কেননা তার চোখে, দেবতারা যেমন, ‘মানুষ’ বলতে আমরা যা ভাবি তা প্রতিনির্মিত হয়ে চলেছে। এবং এ কাজটি করেছে রাজাধিরাজ ক্ষমতা ও তার কথিত পরীক্ষকবৃন্দ। এ জন্যই ফুকো কী বলছেন তা গুরুত্বের সাথে শোনা জরুরি।

ক্ষমতা বিষয়ে ফুকোর আলাপকে (যাকে তিনি বলেছেন ‘ডিসকোর্স’, এ শব্দটি তারই উদ্ভাবন) কয়েকটি শিরোনামে ভাবা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাওয়ার, ‘ডিসিপ্লিনারি’ পাওয়ার, নরমালাইজিং পাওয়ার, ‘বায়ো পাওয়ার’ ইত্যাদি। এসব ধারণা ফুকোর বিভিন্ন পর্যায়ের লেখায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছি, ক্ষমতা প্রসঙ্গে ফুকো চিরকাল এক রূপ ভাবতেন না। আমি এখানে ফুকোর মাইক্রো পাওয়ার ধারণার কিছুটা আলোচনা করব।

ফুকোর মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা বোঝাতে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র একটি রূপকথাকে স্মরণ করা যেতে পারে। দৈত্যাকার ক্ষমতাকে সম্মুখ বা গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করা অসম্ভব। কেননা, দৈত্যের ‘প্রাণভোমরা’ লুকিয়ে আছে অন্যত্র। গহীন বনের নির্জনতম সরোবরের তলদেশে, যেখানে রাখা একটি রুপোর কৌটো এবং যার ভেতরে বাস করে সেই প্রাণভোমরা। যদি সেই কৌটো খুঁজে পাওয়া যায় এবং একটি একটি করে সেই ভোমরের হাত-পা-ডানা ছিঁড়ে ফেলা যায়, তবেই সে দৈত্যের ধ্বংসসাধন সম্ভব। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার স্বৈরাচারকেও সেভাবে ছাড়া পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষমতার ‘প্রাণভোমরা’ ছড়িয়ে আছে নানা স্থানে- সরোবরের তলদেশে শুধু নয়, সমাজ-শরীরের সর্বত্র :বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক, জেলখানা, বিচারালয়, পত্রিকার অফিস, টিভি চ্যানেল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-এনজিও, উপাসনালয়, পাড়ার ক্লাব, মহল্লার সংগঠন, পরিবারের অভ্যন্তর, এমনকি ব্যক্তিসত্তার মধ্যেও। এসব অপ্রত্যাশিত স্থানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ক্ষমতার ফুটপ্রিন্ট! অর্থাৎ ফুকো এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, সর্বত্র অশুভ ‘ক্ষমতা-চর্চা’র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করতে পারলে শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতা বদলে সর্বাত্মক পরিবর্তন আসবে না, বা এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

২. ম্যাক্রো বনাম মাইক্রো পাওয়ার :

সাধারণত আমরা ‘পাওয়া’র বলতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা বা রাজ-ক্ষমতাকে নির্দেশ করে থাকি। এই ক্ষমতা ‘ওপর থেকে’ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এই ক্ষমতা যিনি ‘রাষ্ট্রের প্রধান’ (যেমন রাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী), তারই শুধু চর্চার বিষয় নয়, তার অধীনস্থ রাষ্ট্র-যন্ত্র (প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, বিধিমালা, আইন-কানুন) এই চর্চার অংশ। আধুনিক রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রয়োগ ও পরিধিকে ঘিরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এক আইনি আলোচনা গড়ে উঠতে থাকে। যাকে ফুকো বলেছেন ‘লিগ্যাল-জুরিডিক্যাল ডিসকোর্স’। এই আলোচনার মূল মনোযোগ ছিল রাষ্ট্র-ক্ষমতার পরিধিকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপণ করা। রাজা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারবেন না। তেমনি, প্রজারাও সকল অধিকার ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে না। এভাবে রাজা ও প্রজার মধ্যে যার যার অধিকার নির্দিষ্ট করে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি সাংবিধানিক ও আনুষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও নাগরিকদের যার যার অধিকার রক্ষাপূর্বক ক্ষমতা-প্রয়োগের স্বীকৃত কাঠামোকে নানা ধরনের রক্ষাকবচ দিয়ে আরো যুক্তিসিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। উদাহরণত, ট্রাম্পের শাসনামলে প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প তার ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। সেখানে কংগ্রেস-সিনেটের অনেক নিয়ম-নীতির রক্ষাকবচ রয়ে গেছে। তার ওপরে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের অলঙ্ঘনীয় ছায়া রয়েছে। তারপরও সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের বিধিমালা ও আইন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের (আইন-প্রণয়ন, বিচার ও প্রশাসন) মধ্যে দায়িত্ব-বণ্টন, সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি, বিভিন্ন দপ্তর-মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে মাঝে মাঝেই ‘টেনশন’ সৃষ্টি হয় এবং তা নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বলা দরকার, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা ‘অধিকারের ভাষায়’ (Rights based discourse) নির্মিত ক্ষমতা-প্রয়োগের এই ডিসকোর্সকে ফুকো অস্বীকার করছেন না। এই ক্ষমতা-প্রয়োগের অংশ হিসেবে মার্কস, গ্রামসি বা আলথুসার যখন ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস অব স্টেট’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন, সেটিকেও ফুকো অস্বীকার করছেন না। তিনি শুধু বলছেন, সুদূর প্রাচীন বা মধ্যযুগেও রাজশক্তি যে টিকে ছিল, তা শুধু কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়নি। আধিপত্য বিস্তার (ডমিনেশন) যেমন তাতে ছিল, তেমনি ছিল আধিপত্য-প্রয়োগের ন্যায্যতা সম্পর্কে ‘সত্যের প্রচার’। উল্লেখ্য, ফুকোর ‘রিজিম অব ট্রুথ’ এবং গ্রামসির ‘হেজিমনি’ ধারণার মধ্যে মিল আছে। তবে সব রিজিম অব ট্রুথ সর্বেশ্বরতা পায় না। অর্থাৎ হেজিমনিক স্তরে যেতে পারে না। তবে সব রাজাকেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সত্যের প্রচার করতে হয়েছে কম-বেশি। ফুকো বলেছেন, ÔRight in the west is the king’s Right … [The] resurrection of Roman law [in the 12th century] was the major event around which, and on whose basis, the juridical edifice which had collapsed after the fall of the Roman Empire was reconstructed.’ রোমান ল-এর পুনর্জীবনের মধ্য দিয়ে আবার মধ্যযুগের রাজ-রাজড়াদের Ôabsolute power’ প্রয়োগের আইনি ও প্রশাসনিক দিকটির সুরাহা করা হয়েছিল। কিন্তু ফুকো বলছেন, তখনও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। যেমন, ‘মহাভারত’-এর যুগে অনুশাসন-পর্বের বিষয়বস্তু ছিল, আজকের পরিভাষায়, ‘গভর্ন্যান্স’ বা সুশাসনের প্রয়োগ-বিধির আলোচনা। অর্থাৎ রাজা বা রাজশক্তি কীভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন, রাজার অধিকার কতটুকু, প্রজাদেরই বা অধিকার কতটুকু, তাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সেখানে। কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’তে এই নির্দিষ্ট অধিকারকে বিধিমালা ও আইনের মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণত, কৌটিল্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩২ রকমের দুর্নীতি শনাক্ত করেছেন এবং তার জন্য পৃথক দণ্ডের সুপারিশ করেছেন। সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার তাগিদ না থাকলে আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী লিখতেন না। একই কথা বলা যায় ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা বিষয়েও।

আধুনিক যুগের রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা যথা হবস, লক, বেন্থাম, মিল প্রমুখ যখন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক রাজশক্তির ক্ষমতার বৈধতা, গণ্ডি বা চৌহদ্দির সীমা নির্ণয় করতে কলম ধরেছেন, সেটাও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার প্রয়োজনেই। সার্বভৌম (Sovereignty) যিনি, তার ‘ন্যায়সঙ্গত’ অধিকার কতটুকু ও কী কী- এটি যেমন তাদের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি প্রজাদেরও ‘আইনসম্মত’ অধিকার কতটুকু, সেসব আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ফুকো বলছেন, এসব আলোচনা, ডিসকোর্স তথা সত্য-উৎপাদনের মধ্য দিয়ে মূল উদ্দেশ্যটা খোলাসা করে বলা হয়নি। লিবারেল বা কনজারভেটিভ সব ধারারই পলিটিক্যাল ফিলোসফাররা যার যার মতো ‘অধিকারের ভাষা’ নির্মাণ করেছেন। কিন্তু, তারা এটা করতে গিয়ে আসলে ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’কেই আড়াল করেছেন।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s