জনগণের অবস্থা জলেপড়া পিঁপড়ের মতো

তারিখ: ০৯-০৬-২০১২

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নিরন্তর সংশয়বাদের কোনো কারণ নেই। নিরন্তর সংশয়বাদ অর্থনীতিবিদদের বস্তুনিষ্ঠতাকে ক্ষুণ্ন করে। বাজেট আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে অনেক সময় অনেকেই সংশয় ব্যক্ত করে থাকেন। এবং সেটা একসময় পাভলোভীয় মনস্তত্ত্বের ধারা অনুসারে একটি স্বভাবে পরিণত হয়। আমি বাজেটকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক কালের দুটি উদাহরণ দেব। যখন গত বছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন ২০১০-১১ অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটি বিতর্ক হয়েছিল। সংশয়বাদীরা তখন বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কোনোভাবেই হতে পারে না; বরং এটা হবে ৬ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন চূড়ান্ত হিসাবে দেখা গেল, ২০১০-১১-অর্থবছের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশই হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি খুব সাম্প্রতিক কালের। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে। বৈদেশিক সাহায্য না আসা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকারকে উপায়ান্তর না দেখে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অনেক বেশি হারে ঋণ নিতে হয়। সংশয়বাদীরা তখন বলতে থাকেন, অচিরেই অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। যেন চারদিকের সব বাতি একে একে নিভে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরের কয়েক মাসে সংযত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি গ্রহণ করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার অনেকটাই ফিরিয়ে আনতে পারা গেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের অর্থনীতিতে সংযত মুদ্রানীতি যে আদৌ কাজ করে, তা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। এর স্বীকৃতি মিলেছে এ মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে আবার বেশ কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হারও বেশ কিছুটা কমে এসেছে এবং সামগ্রিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এবং লেনদেনের ভারসাম্য বেশ কিছুটা উন্নত হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির সংশয়বাদের বিপরীতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার প্রাথমিকভাবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে, যা হয়তো চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়বে। এই ৬ দশমিক ৩ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বাদে অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। সুতরাং ঘনায়মান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার এই সাফল্য কিছুটা হলেও সবাইকে স্বীকার করতে হবে। সেটা সংশয়বাদীরা মুখে বলুন বা না-ই বলুন। বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সব সময়ই খাদের কিনার থেকে সাফল্যের সঙ্গে ফিরে আসতে পেরেছে। এটাও আমাদের অর্থনীতির উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতার আরেকটা দিক।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটকে যাঁরা রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের জন্য উচ্চাভিলাষী বলছেন, তাঁদের পক্ষে যুক্তি মেলে না। এর কারণ, গত অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যয় ও জিডিপির অনুপাত ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ, এবারও এই অনুপাত ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। তবে বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে সংগত কারণেই বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে: ক. আমাদের দেশের বাজেটের অর্থায়ন দুই দশক আগে ছিল বৈদেশিক সাহার্য্যনির্ভর, এখন তা হয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণনির্ভর; খ. এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষমতা বাড়েনি; গ. গেল অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে আরও প্রতিকূল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে—যেমন, ইউরো জোনের সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে; সিরিয়া, চাই কি ইরানকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণে আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। ঘ. কয়েক বছর ধরে কৃষি উৎপাদন প্রাকৃতিক দুর্যোগমুক্ত ছিল, এ ক্ষেত্রে মন্দভাগ্য দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। এসব কারণে আমার মোটা দাগের অভিমত হলো, এই বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সর্বাগ্রে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ধরে রাখা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত (যখন মূল্যস্ফীতি আবার ৫-৭ শতাংশে ফিরে আসবে এবং বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা পুরোপুরি অর্জিত হবে) করার পরই কেবল উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার দিকে অগ্রসর হওয়া। প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে এনেও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা চাই। আমার ধারণা, এবারের বাজেট বক্তৃতায় একদিকে সংযত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কথা বলে গেল অর্থবছরের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার থেকে আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশে উল্লম্ফনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবানুগ নয়। এটা সম্ভবত করা হয়েছে জনতুষ্টির কথা ভেবে। অর্থমন্ত্রী এটা না করলেও পারতেন। এখানে আমার প্রধান আপত্তি দুটি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার যুক্তি ছাড়াও আরও দুটি বাড়তি উদ্বেগ এখানে রয়েছে। প্রথমত, শুধু প্রবৃদ্ধিই জীবনযাত্রার কল্যাণ বয়ে আনে না। প্রবৃদ্ধি কল্যাণ বয়ে আনবে কি না, সেটা নির্ভর করে শুধু প্রবৃদ্ধির হারের ওপর নয়, প্রবৃদ্ধির চরিত্রের ওপর। যেমন, পরিবেশ ধ্বংস করে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে চাইলে তা জনগণের অকল্যাণ বয়ে আনে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পকে (খাল-বিল-নদী-জলাশয়, বনভূমি ইত্যাদি) উৎসাহিত করে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারের প্রস্তাব করা হলে সমাজে আয় ও সম্পদবৈষম্য দ্রুত হারে বাড়তে থাকে, যেটা বাংলাদেশে এক দশক ধরে ঘটছে। বাজেট বক্তৃতায় ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আয় ও সম্পদবৈষম্য বৃদ্ধির প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এবার আসি বাজেট থেকে জনসাধারণ কী প্রত্যাশা জানিয়েছিল এবং কী তারা পেতে যাচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে। প্রথমেই লক্ষ করার বিষয়, সেটা হলো বাজেট নিয়ে জনসাধারণের প্রত্যাশা অত্যন্ত সীমিত হয়ে আসছে। জনমানুষ হচ্ছে জলে পড়া পিঁপড়ের মতো, তারা শুধু এটুকুই আশা করে যে রাষ্ট্র তাদের ডাঙায় তুলে দেবে। তাহলে তারা নিজেরাই চলতে পারবে। তারা চাইছে দ্রব্যমূল্যের সহনীয় পরিস্থিতি। প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, না ৭ দশমিক ২ শতাংশ হলো, এ নিয়ে তাদের তেমন উদ্বিগ্ন বা বিতর্কিত হতে দেখা যায় না অর্থনীতিবিদদের মতো। দ্বিতীয়ত, এযাবৎ প্রতিটি সরকারই প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিছুটা করে দারিদ্র্য কমিয়েছে, বেশ কিছুটা মানবসম্পদ উন্নয়ন করেছে, কিন্তু তাতে সাধারণ জনগণ খুশি হয়ে পর পর দুবার কোনো রাজনৈতিক সরকারকে নির্বাচনে জয়ী করেনি। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বাধা। এর দুটি সম্ভাব্য উত্তর আমি এখানে নিবেদন করতে পারি। এক. জনসাধারণ রাজনৈতিক সরকারকে মূল্যায়ন করে প্রবৃদ্ধির জাতীয় অর্থনৈতিক সূচকে নয়, তারা জোর দেয় বেশি করে অন-অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ওপরে, যেমন: সুশাসন, মানবাধিকার, মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, রাজনীতিবিদদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ তথা তাঁদের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, শিষ্টাচার ইত্যাদি। দুই. আরেকটি বড় কারণ হতে পারে, অর্থনৈতিক সূচকে ভালো করার পরও প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো (এখানে ভালোর সংজ্ঞা হচ্ছে সৎ ও যোগ্য। যিনি নির্বাচনে টাকা ও পেশিশক্তির জোরে জয়লাভ করেন, তাঁকে এখানে ভালো প্রার্থী হিসেবে ধরা হচ্ছে না) প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয় না। তারা যাঁদের মনোনয়ন দেয়, তাঁদের একটি বড় অংশই হচ্ছেন মনোনয়ন-বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে আসা ‘খারাপ’ প্রার্থী এবং এই খারাপ প্রার্থীরা যখন জয়লাভ করেন, তাঁরা অর্থনৈতিক সুশাসন এবং মাঠপর্যায়ে বাজেটের বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। নথিপত্রে হয়তো বাজেট ঠিকই বাস্তবায়িত হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে দুর্নীতি ঢুকে পড়ে।
জনসাধারণ বাজেটের কাছে চায় পুনর্বণ্টনমূলক নীতি, বাজেটের একটি প্রধান কাজও হচ্ছে তা-ই। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, গেল বছরের বাজেটে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পত্তি যাঁদের রয়েছে, এই সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে কম, মাত্র চার হাজার; তাঁদের কাছ থেকে প্রদত্ত করের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সারচার্জ এসেছে মাত্র ৪৫-৫০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বাজেটে উচিত ছিল, বাজারের চলতি মূল্যে সম্পত্তির মূল্যায়ন করা। তা করা হলে দেখা যেত, এই সারচার্জের আওতায় অন্তত দুই থেকে তিন লাখ লোক চলে আসত, তার ফলে সারচার্জ তথা ‘প্রপার্টি ট্যাক্স’ (বাংলাদেশে এখনো কোনো প্রপার্টি ট্যাক্স চালু হয়নি, যেটা উন্নত সব দেশে রয়েছে) বাবদ হয়তো অতিরিক্ত ৬০০-৭০০ কোটি টাকা চলে আসত। এবং এই টাকা দিয়ে শহর ও গ্রামের হতদরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য সম্পদ সৃষ্টি (ব্র্যাকের টিইউপি কর্মসূচির মতো) করার উদ্যোগ নেওয়া যেত। এবারের বাজেটে আমি হতাশ হয়েছি দেখে যে ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি পুনর্বণ্টনের কোনো কর্মসূচিকে সমর্থন দেওয়া হয়নি বা এ মর্মে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সমর্থনের কথাও বলা হয়নি; বরং বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও গরিবমুখিনতা সীমাবদ্ধ থেকেছে কিছু সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির মধ্যে এবং এসব কর্মসূচিও গরিব মানুষের তাৎপর্যপূণভাবে সাহায্য করতে পারে না। কারণ, এসব কর্মসূচিতে প্রদত্ত মাসিক সুবিধার পরিমাণ এক-দেড় দিনের কৃষি-মজুরির চেয়ে কম।
সর্বশেষে বলব, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্যও আমাদের বৈদেশিক সাহায্য দরকার। এবং সে জন্য বৈদেশিক সাহায্যদাতাদের মনস্তত্ত্বও আমাদের বুঝতে হবে। গত বছর এ ক্ষেত্রে আমরা সফল হইনি। আগামী বছরে সফল হতেই হবে। নইলে বাজেটের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়ে পড়বে আবারও। দুঃখের বিষয়, এই সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষুধা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ১৬ কোটি মানুষের দেশের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ দরকার (যেমন, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোকে বাজেটের মোট ব্যয়ের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সরাসরি ‘ম্যাচিং গ্রান্ট’ হিসেবে বরাদ্দ করা), সে সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ নেই। আমি তাতে বিস্মিত হইনি। কেননা, আমরা বাস করছি পল ক্রুগম্যানের ভাষায়, এক ‘ক্রমবিলীয়মান প্রত্যাশার যুগে’।
 বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ। গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।

Leave a comment