হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: চতুস্পদী

চতুস্পদী
অন্যদেরও মৃত্যু এই সময়ে, কিন্তু সেসব দূর অতীতের গল্প।
এই সমাগত ঋতু–সবাই জানে–মৃত্যুর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
ইয়াকুব আল -মনসুরের নিতান্ত প্রজা আমি,
তবে কি আমারও মৃত্যু হবে গোলাপের মত, আর আরিস্ততল?

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: আদম তোমারই দেহের ছাই

আদম তোমারই দেহের ছাই
তরবারি সেভাবেই খসে পড়বে, যেভাবে বৃক্ষ থেকে ফল।
কৃষ্টালও ততটা নাজুক, যতটাই গ্রানাইট পাথর।
সব কিছুই ছাই হয় তার নিজস্ব নিয়মে।
লোহাতে যেমন লুকানো তার মর্চে-ধরা স্বভাব। ধ্বনিতে যেমন প্রতিধ্বনি।
আদি পিতা আদম –সে তোমারই দেহের ছাই।
প্রথম স্বর্গোদ্যানই হবে শেষ স্বর্গোদ্যান।
নাইটিংগেল পাখী ও গ্রীক কবি পিন্ডার দুজনই অভিন্ন কলরব।
সূর্যোদয় সূর্যাস্তরই প্রতিচ্ছবি।
মাইসেনিয়ান সম্রাট—কবরে শায়িত এক স্বর্ণালী মুখোশ মাত্র।
সবচেয়ে উঁচু দেয়ালও সবচেয়ে জরাজীর্ণ ভগ্নস্তূপ।
রাজা উরকুইজা, আততায়ীর ছোরা যাকে ছুঁতে পারেনি, তারও পরিণতি এমন।
আয়নায় যে মুখ আজকে নিজেকে দেখেছে
সে গতকালের মুখ নয়। রাত্রি তাকে বদলে ফেলেছে রাতারাতি।
কাল এভাবেই সূক্ষ্ম, অনবরত, ভাংচুর করছে আমাদের।

হিরাক্লিটাসের সেই প্রবাদের অবিরল বয়ে যাওয়া
জল যদি হতে পারতাম আমি,
যদি হতে পারতাম সেই আদি ও অকৃত্রিম অগ্নি,
কিন্তু আজ এই দীর্ঘ অফুরান দিনের শেষে
নিজেকে আমার একা লাগছে এবং মনে হচ্ছে,
আমি কখনোই আর পরিত্রাণ পাব না।

হোর্হে লুই বোর্হেসের কবিতা: সীমানাগুলো

সীমানাগুলো
ভার্লেনের একটি লাইন আর কখনোই মনে পড়বে না আমার।
কাছের একটি রাস্তা যেখানে আমার যাওয়া হবে না কোনদিন।
একটি আয়না শেষবারের মত দেখে নিল আমাকে।
একটি দরজা পৃথিবীর শেষ দিন অব্দি বন্ধ হয়ে গেল।
আমার লাইব্রেরীর অনেকগুলো বই (মিলিয়ে দেখছি এখন)
আর কখনোই খোলা হবে না।
এই গ্রীষ্মে আমার বয়স হবে পঞ্চাশ।
মৃত্যু আমাকে ব্যবহার করে চলেছে ক্রমাগত।

নাজিম হিকমতের কবিতা: রোমিও ও জুলিয়েট বিষয়ে

রোমিও ও জুলিয়েট বিষয়ে
রোমিও বা জুলিয়েট হওয়া কোন অপরাধ নয়;
ভালবাসার জন্যে মৃত্যুবরণ করাও কোন অপরাধ নয়।
যেটা দেখার, সেটা হচ্ছে—তুমি নিজে রোমিও বা জুলিয়েট
হতে পারবে কিনা,
আমি বলতে চাইছি, এসবই তোমার হৃদয়ের বিষয়-আশয়।।

যেমন, ব্যারিকেডের ভেতরে যুদ্ধ করা,
বা উত্তর মেরু অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়া,
বা ধমনীতে কোন ঔষধের
পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সম্মতি দেয়া—
এসব করতে গিয়ে মৃত্যু হয় যদি
তা কি কোন অপরাধ হবে?

রোমিও বা জুলিয়েট হওয়া কোন অপরাধ নয়;
ভালবাসার জন্যে মৃত্যুবরণ করাও কোন অপরাধ নয়।

ধরো, তুমি পৃথিবীর প্রেমে পুরোপুরি বিবশ,
কিন্তু সে তো জানেও না—তুমি বেঁচে আছো কিনা।
তুমি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে চাইছ না,
কিন্তু সে নিশ্চিত তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে—
আমি বলতে চাইছি, তুমি আপেল ভালবাসো,
তার মানে কি এই যে আপেলও তোমাকে ভালবাসবে?
আমি বলতে চাইছি, জুলিয়েট যদি রোমিওকে আর ভালবাসতে না চায়
—অথবা জুলিয়েট কখনোই যদি রোমিওকে ভাল না বাসত—
তাতেও কি সে কোন অংশে কম রোমিও হত?

রোমিও বা জুলিয়েট হওয়া কোন অপরাধ নয়;
ভালবাসার জন্যে মৃত্যুবরণ করাও কোন অপরাধ নয়।

নাজিম হিকমতের কবিতা: তোমাদের হাত আর মিথ্যে রটনাগুলো নিয়ে

তোমাদের হাত আর মিথ্যে রটনাগুলো নিয়ে
তোমাদের হাত থমথমে, যেমন হয়ে থাকে পাথরেরা;
বিষণ্ণ, যেমন জেলের ভেতরের সব গান;
জড়োসড়ো নিজের ভারে, যেমন সব ভারবাহী জীব;
তোমাদের হাত ফুলে আছে অনাহারে থাকা শিশুর চেহারার মত ।
তোমাদের হাত ছন্দময়, যেন অনায়াসে উড়ে চলা মৌমাছি;
পরিপূর্ণ, যেমন দুধে উপচে ভরা স্তন;
সাহসী, প্রকৃতির মত;
তোমাদের হাত রুক্ষ চামড়ার নিচে লুকিয়ে রাখে
তার কোমল স্পর্শ।

এই পৃথিবী কোন ষাড়ের শিঙ্গের মধ্যে নয়—
তোমাদের হাতের মধ্যেই তার ভর রেখে চলেছে।
ভাই, ও ভাই আমার,
তারা তোমাদের কাছে মিথ্যে রটাচ্ছে।
অথচ তোমরা অনাহারে আছো,
বাঁচার জন্যে পর্যাপ্ত রুটি-মাংসের প্রয়োজন যেখানে
সেখানে সাদা চাদর বিছানো টেবিলে বসে
অন্তত একবেলা ভালো করে খাওয়ার আগেই তোমরা বিদায় নিচ্ছ
এই পৃথিবী থেকে—যার প্রতিটা শাখা ফলের ভারে ঝুঁকে আছে।
ও ভাই আমার,
এশিয়া, আফ্রিকা, নিকট ও মধ্য প্রাচ্য, প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ
বা আমার দেশ
যেখানেই থাকো (তোমরাই গোটা বিশ্বের শতকরা সত্তর ভাগ),
তোমাদের হাতের মতই বুড়িয়ে গেছো তোমরা, আর সেরকমই ভুলো-মনা;
তোমাদের হাতের মতই তোমরা সজাগ, অবাক-করা, তারুণ্যে দীপ্ত ।
ও ভাই আমার,
আমার ইউরোপের ও আমেরিকার ভায়েরা,
তোমরাও চৌকশ, সাহসী, আর মনভোলা, তোমাদের হাতের মত—
তোমাদের হাতের মতই তোমাদের সহজে বশ করা যায়,
সহজেই ভোলানো যায়…

ভাই, ও ভাই আমার,
যদি চ্যানেল গুলো মিথ্যে বলে,
যদি সংবাদপত্র গুলো মিথ্যে বলে,
যদি বই গুলো মিথ্যে বলে,
যদি দেয়ালের পোস্টার আর পত্রিকার বিজ্ঞাপন গুলো মিথ্যে বলে,
যদি রূপালী চিত্রে নারীদের উরু গুলো মিথ্যে বলে,
যদি প্রার্থনা গুলো,
ঘুমপাড়ানি ছড়া গুলো,
স্বপ্ন গুলো মিথ্যে বলে,
যদি জিপসি যাদুকরেরা মিথ্যে বলে,
যদি নিরাশাকরোজ্জ্বল দিনের রাত গুলোর জ্যোছনারা মিথ্যে বলে
যদি গলার স্বর গুলো,
যদি অক্ষর গুলো মিথ্যে বলে,
যদি সবাই এবং সবকিছু মিথ্যে বলে,
তাহলে জানবে, তারা আসলে চাচ্ছে
তোমাদের হাত গুলো যেন কাদার মত সুবাধ্য থাকে,
যেন অন্ধকারের মত অন্ধ থাকে,
যেন মূক-বধির হয়ে থাকে ভেড়া বা কুকুরের মত—
যাতে তোমাদের হাত গুলো কখনো বিদ্রোহ না করে বসে।
যেন কোনদিনই এই নশ্বর, এই বাসযোগ্য পৃথিবী থেকে
(যেখানে আমরা ক্ষণকালের অতিথি)
এই বনিক সাম্রাজ্য, এই নিষ্ঠুরতা, মুছে না যায়।