বিশেষ সাক্ষাৎকার: রাজনীতিকে যে বাস্তবতা বুঝতে হবে

বিনায়ক সেন অর্থনীতিবিদ। এখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩)। বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) প্রণয়নে জড়িত ছিলেন, ছিলেন ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্যানেল অব ইকোনমিস্টের সদস্য এবং বর্তমানে বেতন ও চাকরি কমিশনের সদস্য। দারিদ্র্য, বৈষম্য, মানব উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি তাঁর গবেষণার বিষয়। এ নিয়ে তাঁর ৫০টিরও বেশি প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থ ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে তাঁর অনুরাগের প্রকাশ হিসেবে লিখছেন সাহিত্য-ঘেঁষা প্রবন্ধ। তাঁর লেখালেখির ই-ঠিকানা binayaksenbd.com

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি যতটা, রাজনীতি তার বিপরীতে চলছে কেন?

বিনায়ক সেন: রাজনৈতিক উন্নতি কখনোই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেনি কোনো দেশে। আমি সেই আদি মার্ক্সীয় ধারণার বিশ্বাসী যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি অনেকটা ঘটার পরই রাজনৈতিক উন্নতি আসে। উন্নত দেশগুলোয় উনিশ শতকজুড়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আজকের অর্থে সর্বজনীন ভোটাধিকারের গণতন্ত্র তখন ছিল না। পূর্ব এশিয়ার উত্থিত দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নতির পরই গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথমত, এখন বেশি করে গণতন্ত্রের প্রশ্নটা সর্বত্র উঠছে কেন? বাংলাদেশে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, যখন আমরা সত্যি সত্যি রাজনৈতিক উন্নতি আশা করতে পারি? আমার চলতি গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি, ১৯৯১-২০১০ পর্বে অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে (যাদের আয় মাথাপিছু দৈনিক দুই থেকে চার পিপিপি ডলারের মধ্যে)। প্রায় তিন গুণের মতো বৃদ্ধি পাওয়া এই মধ্যবিত্তের একটা অংশ আবার গত দুই দশকে শহরমুখী ও বিদেশমুখী হয়েছে। এই বিস্তৃত ও সক্রিয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী গণতন্ত্রের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। এরা পরিবর্তনের সামাজিক ভরকেন্দ্র। এদের মধ্যে রাজনীতির উন্নতি দেখার বাড়তি প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথম আলো: পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এখনকার চেয়ে কম সংখ্যানুপাতে মধ্যবিত্ত থাকার পরও তো রাজনীতি বিকশিত হয়েছিল।

বিনায়ক সেন: হ্যাঁ, স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে ‘সংখ্যানুপাতের স্বল্পতা’ রাজনৈতিক উন্নতির বাধা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত তখন ও এখনকার মধ্যবিত্তের চরিত্রের গুণগত পার্থক্য। তখনকার মধ্যবিত্ত ছিল প্রথম প্রজন্মের কৃষক সন্তান। তাদের পক্ষে কৃষকের জাতীয়তাবাদকে, তার আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করা সহজতর ছিল। গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত যতই এগিয়েছে, কৃষকের সঙ্গে তার যোগসূত্র ততই দুর্বল হয়েছে। এই নতুন মধ্যবিত্তের বেড়ে ওঠা শহরে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আবহে তারা লালিত। তারা থাকছে ঢাকা শহরে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনি ও প্যারিসে। কৃষক বিচ্ছিন্নতা এদের কুল-লক্ষণ। তার পরও যতটা রাজনৈতিক উন্নতির জন্য তারা সোচ্চার হতে পারত, সেটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না বিলাসবহুল জীবনচর্চার কারণে। আমাদের এখানে চরিত্রের স্থিরতা নেই, শ্রেণী-চরিত্রেরও স্থিরতা নেই। শ্রেণী-বিভাজন ও সামাজিক সচলতা এত দ্রুত হলে বোধ করি এই হয়। এখানে বুদ্ধিজীবীরা আমলা হতে চায়, আমলারা হতে চায় ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। এ অবস্থায় দ্রুত রাজনৈতিক উন্নতি আশা করা যায় না।

প্রথম আলো: তাহলে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার রাজনৈতিক পূর্বশর্ত কীভাবে তৈরি হবে? স্থিতিশীলতা ও উন্নতির জন্য কী ধরনের পরিবর্তন দরকার হবে?

বিনায়ক সেন: আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নজর কেড়েছি; কিন্তু রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে হুতু-তুতসি ধরনের বিরোধাত্মক সমাজে পরিণত হতে পারি। এরও মূলে রয়েছে দ্রুত হারে ও অবৈধ পন্থায় সংগৃহীত অর্থবিত্তের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য। এই অবৈধ বৈষম্যই রাজনৈতিক বিরোধাত্মক সমাজের মূলে প্ররোচনা জোগাচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে প্রতিষ্ঠা করে এই অবৈধ বৈষম্যের মোকাবিলা করা যাবে না। যিনি আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে যাবেন, তাঁর শাসনের নৈতিক বৈধতা থাকা জরুরি। মানুষ অবৈধ শাসনের আইন ও শৃঙ্খলার যুক্তি মানতে চায় না। এ অবস্থায় দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় যেখানেই অবৈধ ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ দানা বাঁধে। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর দুটি বিপরীতমুখী চিন্তাধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসন। এমন ছিল ষাট-সত্তরের দশকের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বা যেমনটা এখনো আছে চীনে ও ভিয়েতনামে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পূর্ণতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুশাসন, যা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দিতে পারে। এটি অবশ্যই শ্রেয়তর সমাধান, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে এটা কার্যকর হতে পারে না।

কর্তৃত্ববাদী শাসন বেশি দিন টেকে না, আবার পূর্ণ গণতন্ত্রেও হঠাৎ করে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেই একধরনের মাঝামাঝি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও কেউ বলেছেন একে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র, আবার কেউ বলেছেন সংকর গণতন্ত্র। এর নানা প্রকারভেদ আছে। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ এক দলই ক্ষমতায় ছিল। ভারতে কংগ্রেস প্রথম দিকে প্রায় টানা ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। মিশ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন মিশ্র গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক উন্নতির পথ-বিকল্প খোঁজার সুযোগ রয়ে গেছে। আমাদের দেশে গত দুই দশকে যা ছিল তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। একে নির্জলা কর্তৃত্ববাদী শাসন বলাও ভুল, আবার বিশুদ্ধ গণতন্ত্র বলাও ভুল। উন্নয়নের এই পর্যায়ে এটাই আমাদের বিধিলিপি। এই ধারাকে রাজনৈতিকভাবে আরও উন্নত করে সহনীয় ধারার মিশ্র বা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। তা করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি আরও বেগবান হবে। এ ব্যাপারে আমরাই হতে পারি তৃতীয় বিশ্বের কাছে মিশ্র গণতন্ত্রের এক নতুন রোল মডেল। কিন্তু ব্যর্থ হলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমরাও অসহিঞ্চু বা অত্যাচারী গণতন্ত্রের স্থায়ী ঝুঁকিতে পড়ে যাব।

প্রথম আলো: কিন্তু এই প্রক্রিয়া কি নির্বাচনকে এড়িয়ে চালানো সম্ভব? বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা কি সম্ভব?

বিনায়ক সেন: কারা ক্ষমতাসীন হবে, তার জন্য অবাধে নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, ক্ষমতার শাসনেরও রাজনৈতিক উন্নতি চাই। কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উন্নতি আনতে হলে দলীয় প্রার্থীদের গুণগত মান বৃদ্ধি করাই পরীক্ষিত পথ। নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয় ও অর্থায়ন (ক্যামপেইন ফাইন্যান্স) ব্যবস্থার সংস্কার করা এর পূর্বশর্ত। ২০০৭ সালের দিকে এ নিয়ে আলাপ শুরু হলে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রাথমিক আগ্রহও দেখিয়েছিলেন। সেই আগ্রহ আবার জাগানো দরকার। এখন তো মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীর গুণগত মানের চেয়ে অর্থবিত্ত ও পেশিশক্তিকে প্রায়ই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর ফলে খারাপ প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কাঠামোগতভাবে থেকে যায়। মনোনয়ন-বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে এই সূত্রেই। এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই হয় না, রাজনৈতিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হয়।

সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের আরও একটি দিক হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল না হলেও কিছুটা পরিবর্তন। যেমন, দলে ধারাবাহিকভাবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করা। আমরা গণমাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চার দৃশ্য দেখতে চাই—সেটা শুধু প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, নীতিমালা নিয়ে দলের ভেতরে বিতর্ক বা মতপার্থক্য বিষয়েও। কর্তৃত্ববাদী মিশ্র গণতন্ত্র মানে এককেন্দ্রিক শাসন নয়। ১৬ কোটি মানুষের দেশকে এক কেন্দ্র থেকে যথাযথ শাসন করা সম্ভব নয়। কেন উপজেলা-কাঠামো শুধু নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে থাকবে? কেন বিভাগীয় পার্লামেন্ট ধরনের কাঠামো গড়ে তোলা যাবে না? কেন শহর-প্রশাসনে আরও গভীরে বিকেন্দ্রীভবন হবে না? এর ফলে শুধু প্রশাসনের মানই বাড়বে না, জাতীয় সংসদেরও মান বাড়বে।
আরেকটি অনালোচিত দিক হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। আওয়ামী লীগ জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, বিএনপি জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, আর বাদবাকি ২০ শতাংশ দলীয় সমর্থক নন—তাঁরা পারফরম্যান্স বুঝে ভোট দেন। এই সুইং ভোটাররাই সরকারের বদল আনেন। কিন্তু সংসদে আসনের ফলাফলে এটা প্রতিফলিত হয় না। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একটা প্রস্তাব হচ্ছে, ৩০০টি আসনে যেমন হচ্ছে তেমনই ধারার ভোট হোক; কিন্তু এর অতিরিক্ত আরও ১৫০টি আসনের বণ্টন বা নির্বাচন হোক জাতীয়ভাবে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে। এভাবে দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারবে। এই ‘মিশ্র’ নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে যেমন রাজনীতিতে ভারসাম্যআসবে, তেমনি দুই প্রধান দলের মধ্যে সাংঘর্ষিক উত্তাপও কমে আসবে বলে অনুমান করি। এককথায়, কর্তৃত্ববাদী শাসন ও পূর্ণ গণতন্ত্রের মাঝামাঝি যে সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের কথা বললাম, সেখানে রাজনৈতিক উন্নতি ঘটানোর ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অনেক অবকাশ রয়ে গেছে।

প্রথম আলো: দুটি ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে অন্তহীন শত্রুতার রাজনৈতিক ব্যাকরণ না বদলিয়ে তা কি সম্ভব?

বিনায়ক সেন: কেবল ৪০ শতাংশ সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করা যেমন সম্ভব নয়, অন্যদিকে ৪০ শতাংশ নিয়ে বিএনপির পক্ষেও জাতির প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়। এটি হচ্ছে মৌলিক সমকক্ষতার প্রশ্ন। এর থেকে চারটি কথা বলতে চাই। এক. আ.লীগকে যত দ্রুত সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও আলোচনা শুরু করতে হবে। এ পথেই দলের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিহিত। দুই. বিএনপিকে ইতিহাসের দাবিকে বুঝতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ধারারই অংশ। তাদের এই ক্ষেত্রটিকে পুনরায় অধিকার করতে হবে। গত দুই দশকে যে তরুণ প্রজন্ম আধুনিকতার ধারায় বিকশিত হয়েছে, এটি তাদেরও প্রাণের দাবি। তিন. ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একটি মাত্র অর্থ বা ব্যাখ্যা হতে পারে না। ভারতে ১৯৪৭-র ‘স্বাধীনতার চেতনা’ নিয়ে বিতর্ক নেই। সেখানে গান্ধীর পাশাপাশি ‘বামপন্থী’ নেহরু ও ‘ডানপন্থী’ প্যাটেলের চেতনাও আছে, দলিত প্রতিনিধি আম্বেদকরে নেতাজি সুভাষ বসুর চেতনাও আছে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাও আছে। সেভাবে আ.লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়াও বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুজিবের পাশাপাশি ভাসানীর চেতনার বিশিষ্টতার অবকাশ রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর কোনো দলের একচেটিয়া চলতে পারে না। অন্যদিকে সব দলকেই দলীয় মতপার্থক্য সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাবাদর্শিক জমিনেই দাঁড়াতে হবে।

চার. জন রাউলস তাঁর ‘রিজনেবল প্লুরালিজম’-এর ধারণায় ধর্মীয় দল ও ধারাকেও স্থান দিয়েছেন—যদি তারা বর্ণবাদী, সামপ্রদায়িক বা জাতিবিদ্বেষী মতবাদ প্রচার না করে। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-বাস্তবতায় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নির্যাতিতের পক্ষে যেমন দাঁড়িয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমাদের দেশে জামায়াতে ইসলামী ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর ধারায় রয়েছে এবং এর সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু একাত্তরকে অস্বীকার করে স্বীয় মতাদর্শের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দলটির পক্ষে কী করে সম্ভব? একাত্তরের কৃত অপরাধ ও ভুলত্রুটি এবং প্রকৃত যুদ্ধাপরাধের স্বচ্ছ বিচারের বিষয়ে দলটিকে নতুন করে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক ও ভিন্নমত-সহিষ্ণুু সমাজের বিকাশের স্বার্থে এটাই তো কাম্য। দেশটা তো সবার—‘৩৬ জাতি না হলে নাকি রাজ্য চলে না।’ দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শান্তি নেমে আসুক, সেটা তো আমরা সবাই চাই। চাই কি?

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

বিনায়ক সেন: ধন্যবাদ।

উটপাখি: ধ্বংসের সমান অংশীদার (The Ostrich)

বিনায়ক সেন

১. আমার বন্ধুদের লড়াই
বাংলাদেশে এখন, এই মুহূর্তে, ‘সেক্যুলারপন্থি’দের সঙ্গে ‘গণতন্ত্রপন্থি’দের লড়াই প্রবল আকার ধারণ করেছে। অস্বীকার করব না যে, এই লড়াই নিয়ে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এখন এক ধরনের নৈতিক মুছিবতের মধ্যে আছি। আমার প্রিয় বন্ধুদের একটি দল যে কোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করে ছাড়বেই। তাঁদের যুক্তি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ সমাধা না করা গেলে দেশে সেক্যুলারিজম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। এর জন্য সাময়িকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেও তারা রাজি। আমার প্রিয় বন্ধুদের অন্য একটি দল যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের যুক্তি, অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ একটি নির্বাচন করা না গেলে দেশ প্রবল সংকটের মধ্যে পড়বে। কেননা এতে করে সরকার লেজিটিমেসির অভাবে ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনে তারা সেক্যুলারিজমকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। এমনকি এর জন্য এমন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও তারা মেনে নিতে রাজি, যেটি হয়তো হবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন নিয়ে, হয়তো যুদ্ধাপরাধের বিচার সুদীর্ঘ কালের জন্য স্থগিত বা শ্লথ করার বিনিময়েই। সত্যের খাতিরে অবশ্য বলা দরকার, আমার বন্ধুদের দু’দলই যুদ্ধাপরাধের বিচার ও গণতন্ত্র উভয়েরই বাস্তবায়ন চান, কিন্তু এ দুই লক্ষ্যের মধ্যে যদি সংঘর্ষ বাধে তাহলে তাদের একেকজনের পক্ষপাতিত্ব থাকবে একেক দিকে। ইয়েভতুশেঙ্কো তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব শুধু ভালো আর মন্দের মধ্যে হয় না। অনেক রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব ঘটে থাকে [কম] ভালো আর [বেশি] ভালোর মধ্যে। ভালো আর মন্দের লড়াই এ দেশকে অতীতে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। ভালো আর ভালোর লড়াই এবার এ দেশকে খাদের ভেতরে ফেলে দিতে চলেছে।

২. ভুলগুলো কোথায় হয়েছিল
ভুলের সূত্রপাত হয়েছিল সত্তর দশকেই। পঁচাত্তরে মুজিব প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে নিহত হলেন। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রতিশ্রুতি_ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র_ রাষ্ট্র যদি দীর্ঘদিন ধরে ধারণ করতে পারত তাহলে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারায় এরই মধ্যে একটি সবল গণতান্ত্রিক [পুঁজিবাদী] সমাজ ও অর্থনীতি এ দেশে গড়ে উঠত। উন্নয়নের নিচু পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে অবিকশিত। তখন সক্ষম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব সময়ের আগে এগিয়ে থাকার কারণে_ যাকে আমরা ‘দূরদর্শিতা’ বলি_ ‘প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি’ অনেকটাই পুষিয়ে নিতে পারে। উপনিবেশ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার আদি পর্যায়ে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় [ভারতে] জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব এবং সেসব দেশের রূপান্তরধর্মী আর্থ-সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব দেশের কোনো কোনোটিতে ছিল একদলীয় শাসন, কোনোটিতে ছিল গণতন্ত্র, আবার কোনো কোনোটিতে সক্রিয় ছিল সামরিক নেতৃত্ব। প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব যাই হোক, একটি বিষয় ছিল অভিন্ন। দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এসব দেশে অব্যাহত ছিল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের শাসন, যারা গোড়াতে উপনিবেশের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল বা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকা এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আদি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বর্ণবৈষম্যবাদের রাজনৈতিক অবসানের পর থেকেই আজ পর্যন্ত সক্রিয় ও ক্ষমতাসীন রয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক বর্ণবৈষম্যবাদের অবসানের লক্ষ্যের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপথগামী না হয়ে অব্যাহতভাবে এগোতে পেরেছে। কেন উন্নয়নের গোড়ার পর্যায়ে আদি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্য উপনিবেশ-উত্তর পূর্ব এশিয়া বা ভারতের দিকে তাকানোরও প্রয়োজন নেই। উন্নত দেশগুলোর যখন পুঁজিবাদ সংহত ও বিকাশমান করা প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল, সেখানেও একই অভিজ্ঞতাকে আদি পর্যায়ে দেখতে পাই। বোনাপার্টের ফ্রান্স, বিসমার্কের জার্মানি বা মেইজির জাপান এর উজ্জ্বল উদাহরণ। সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে বলতে পারি যে, লেনিন যদি বিপ্লবের সাত বছরের মাথায় মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা না যেতেন, রাশিয়া আরও উন্নত ও আকর্ষণীয় সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের সঙ্গে অগ্রসর হতে পারত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধ নামক বিপ্লবে’র চার বছরের মাথায় আমরা হারালাম মুজিবকে শুধু নয়, নির্মমতম জেলহত্যার মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতৃত্বকেও। মৃত্যুকালে মুজিবের বয়স হয়েছিল ৫৫, আর তাজউদ্দীনের ৫০। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোড়ার পর্বে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের এই শূন্যতা অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদকে দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল করতে দেয়নি। অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে এদেশকে সুস্থ ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক’ ধারায় বিকশিত হতে দেয়নি। এ দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীল সম্ভাবনাগুলোকেও করেছে পরবর্তী দশকে অনেকটাই পথহারা। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পরপরই এক বছরের মাথায় জিন্নাহর মৃত্যু সে দেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল, যার অনুরণন এখনও চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদি-চেতনার বাস্তবায়নকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। মুজিব-তাজউদ্দীন যেখানে নেই সেরকম ভূমিকা পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। পরবর্তী শাসনামল প্রমাণ করে তাঁর সে দক্ষতাও ছিল। এর ফলে সুস্থ ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রাজনৈতিক পূর্বশর্ত হিসেবে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের কাম্য ভূমিকা তাঁর কাছ থেকেও আসতে পারত। কিন্তু বাড়তি দুর্ভাগ্য এ দেশের। জিয়া সে ধারায় এগোতে পারলেন না। সে পথে এগোতে চেয়েছিলেন কি-না পুরোপুরি, সে তর্কের এখনও মীমাংসা হয়নি। আমাকে আদিতে সিপিবি-ঘরানার একজন [প্রাক্তন] বামপন্থি নেতা বলেছেন, ক্ষমতায় আসার পরপরই জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী ও বাম নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সোভিয়েত পার্টি সত্তরের দশকে জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা জাতীয়তাবাদী শক্তির অংশ হিসেবেই দেখেছিল। জিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তিদের একটি বৃহত্তর সমঝোতার সম্ভাবনা তখন সৃষ্টি হয়েছিল। এই পটভূমিতেই জিয়ার খালকাটা বিপ্লবকে ও হ্যাঁ-না ভোটে জিয়াকে তৎকালীন সিপিবির নেতৃত্ব সমর্থন দিয়ে থাকবেন। কিন্তু সমঝোতার এই সম্ভাবনা স্থায়ী হয়নি। তা ছাড়া জিয়া নিজেই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির অস্তিত্ব অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাহেরের মৃত্যু ছিল এরই ধারাবাহিকতায়।আমি বলতে চাইছি, মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বাম ধারার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সমঝোতা ও ঐক্যের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়া এ দেশের রাজনৈতিক বিকাশের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী অশুভ প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে এ দেশের রাজনীতির প্রধানতম দ্বন্দ্ব_ ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থানের ঝুঁকি_ মোকাবেলা করা একা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী শক্তির পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর জন্য কতটা জিয়া নিজে দায়ী, আর কতটা বাম প্রগতিশীলরা দায়ী, তা রাজনৈতিক ইতিহাসবিদরা একদিন নির্ধারণ করবেন। জিয়া ও মূলধারার মুক্তিযুদ্ধের শক্তির মধ্যে সেদিন ওই সমঝোতা হলে দেশে আরও আগে সুস্থ পুঁজিবাদী ধারা গড়ে উঠতে পারত এবং পুঁজিবাদী ধারার বিকাশও হতো আরও বেগবান। রাষ্ট্রও হতো আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজ-সংস্কৃতি হতো আরও বেশি উদার ও অন্তর্ভুক্তি-প্রবণ। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হতো আরও বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও সহনশীল। পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতেই আরও বেশি দক্ষ ও গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই প্রধান দলই তখনও থাকত, কিন্তু দুটো দলই [বা তার সৃষ্ট জোটই] হতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। দুটো দলই তখন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করত সমানভাবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে পূর্বাপর সমানভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকত। দুটো দলকেই সমানভাবে পাওয়া যেত মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সোচ্চার। দুটো দলের মধ্যেই এখনও যারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছেন তারা এই না হতে পারার মর্মবেদনা বুঝবেন।জিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী ও বাম প্রগতিশীল শক্তির সমঝোতার সম্ভাবনা বাস্তবায়ন না হতে পারার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকবে। যেমন_ জিয়া-সরকারের চরিত্র গোড়া থেকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধীকারী শাহ আজিজুর রহমানের জিয়া-সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ ছিল একটি সামান্য উদাহরণ। শুধু সরকারের চরিত্রে নয়, দলের চরিত্রের ওপরও এটি দীর্ঘমেয়াদি অশুভ প্রভাব ফেলে। নবগঠিত দল বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এক অস্বস্তিকর সহাবস্থানে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়। দলটিতে দেখা দেয় প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের প্রবণতা। এর সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে ২০০১-২০০৬ পর্বে। বিএনপির নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযুদ্ধের শক্তি প্রথমবারের মতো তখন বুঝতে পারছিলেন জোটের ভেতর ও বাইরে ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রবল অস্তিত্ব। এ নিয়ে তাদের মধ্যে নীরব অভিযোগ ও মনোকষ্ট দেখেছি। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে এ অবস্থানটি তখন তাদের নীরবে সয়ে নিতে হয়েছিল। এ অবস্থা এখনও চলছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ডানপন্থি শক্তির সঙ্গে জোটের ভেতরে ও বাইরে সমঝোতা করে চলা ছাড়া যেন এ মুহূর্তে তাদের গত্যন্তর নেই! এ নিয়ে প্রবলভাবে চিন্তিত বিএনপির ভেতরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও নেতৃত্ব। দলটি যখন প্রবল সরকারি চাপের মুখে তখন ডানপন্থি শক্তিকে মোকাবেলা করার বিষয়টিকে তারা ‘ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছে’ যেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বিএনপি আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে ছাড় শুধু নয়, তার ওপর চরমভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি সাধারণ সাংগঠনিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রাখার জন্য। এমন অমাবস্যায় দলটি এর আগে কখনও পড়েনি। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। গত দুই বছরে বিএনপির রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বেড়েছে মূলত সরকারের অজনপ্রিয়তার কারণে। অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে বিএনপি এককভাবেই ক্ষমতায় আসীন হতে পারত বা তার কাছাকাছি অবস্থানে যেতে পারত। ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধার তার কোনো দরকার ছিল না। সত্তর দশকেও দলটি গড়ার সময় এ রকম ছাড় দেওয়ার দরকার ছিল না, এখনও সে প্রয়োজনীয়তা এ দলটির নেই। দুঃখের বিষয়, আমার প্রিয় বন্ধুদের যে অংশটি গণতন্ত্রপন্থি তারা এ নিয়ে ততটা সোচ্চার নন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার পেছনে সরকারের একগুঁয়েমি যেমন দায়ী, ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে প্রধান বিরোধী দলও যে সমান দায়ী, সে কথা তাঁরা জোরের সঙ্গে বলতে চান না। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গ্রামগঞ্জে-মফস্বল শহরে এমনকি রাজধানীর বুকে যেভাবে সহিংসতা করেছে তাতে যে কোনো নাগরিক বিপন্ন বোধ না করে পারবেন না। দেশের কিছু কিছু এলাকা সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী_ এ রকম কিছু জেলা, এই অশুভ শক্তির ‘মুক্তাঞ্চলে’ পরিণত হয়েছে। দেশের ভেতরে কিছু কিছু স্থানের খবর পড়ে মনে হয় এগুলো বাংলাদেশে নয়, বরং আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কঙ্গো বা সুদানের খবর পড়ছি। বাংলাদেশ যে আজ ‘সহিংস দেশে’র পরিচিতি পাচ্ছে এর পেছনে কি এই অশুভ শক্তির উত্থান প্রধানত দায়ী নয়? সরকারের একতরফা নির্বাচন করার কৌশলকে বর্তমান সংকটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনকে কি সমানভাবে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত ছিল না? এপক্ষকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বললে ওপক্ষও কি ‘ফ্যাসিবাদী’ বলার যথেষ্ট কারণ ইতিমধ্যেই সৃষ্টি করে থাকেনি? সেদিক থেকে দেখলে ২০১৩ সালের শেষে ২৮ ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিপিডি-টিআইবি প্রমুখ আয়োজিত ‘নাগরিক সভা’ আমাদেরকে একরূপ হতাশই করেছে।

৩. একটি শেষ মুহূর্তের অসম্পূর্ণ সংলাপ
এ নিয়ে যা লিখছি তা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও টিভিতে দেখানো খবর এবং মুখ্য উদ্যোক্তাদের একাধিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এতে করে পুরো চিত্রটা পাওয়া নাও যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই সেদিনের ‘নাগরিক সভা’য় সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দুর্ভাবনা। যেখানে আরও কিছুদিন নির্বাচন পেছানোর সাংবিধানিক সুযোগ ছিল, সেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ রেখে নির্বাচন করলে যে সংকট কাটবে না, এটিই ছিল আলোচনার প্রধান সুর। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপন্ন হবে না, রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে না, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। সংলাপে বিদ্বজ্জনরা এ নিয়ে চিন্তিত মন্তব্য করেছেন। এ রকম চলতে থাকলে তৃতীয় কোনো অসাংবিধানিক শক্তি চলে আসতে পারে এক পর্যায়ে, এ আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যেন কার্যত সৃষ্টি করেছে আরও একটি এক-এগারোর আশঙ্কা, সুতরাং এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়_ এ যুক্তিও পরোক্ষভাবে শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যেন কিছু কথা, কিছু নাগরিক সামাজিক কমিটমেন্টের ভাষ্য আমরা শুনতে চেয়েছিলাম রাজধানীর এই উচ্চবর্গের মানুষ, তথা বিদ্বজ্জনদের কাছ থেকে।কী বলা হয়েছিল সেদিন, তার চেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কী তাঁরা বলেননি সেদিন। কেউ কেউ হয়তো বলে থাকবেন, কিন্তু সেটি ওই আলোচনার প্রধান সুর ছিল না। প্রথমত, সময়ের বিচারে নাগরিক সভাটি দেরিতে, বড় দেরিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি তাদের শুরু করা উচিত ছিল বছর খানেক বা তারও আগে। এতে করে নাগরিক সমাজ আরও নানা বিষয়ে প্রভাব ফেলার বা অন্তত নিজেদের বিবেকি মত রাখার সুযোগ পেতেন। উদাহরণত, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তারা বছর খানেক আগেই সভা ডাকতে পারতেন। গণজাগরণ মঞ্চের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও তারা বিতর্ক করতে পারতেন। চরম ডানপন্থি শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা প্রধান বিরোধী গণতান্ত্রিক দলের পক্ষে সমীচীন হয়েছে কি-না সে প্রশ্নে তারা দিনব্যাপী আলোচনা-ডায়ালগ করতে পারতেন। কেন এসব বিষয় নিয়ে তারা উচ্চকিত হননি তা তারাই জানেন। দেশের পরিস্থিতি তাহলে হয়তো এ পর্যায়ে গড়াত না। দ্বিতীয়ত, অগণতান্ত্রিকতা আজ সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। সরকার যেমন ‘অগণতান্ত্রিক’ আচরণ করেছে, বিরোধী দলের আন্দোলনেও ‘অগণতান্ত্রিক’ আচরণ স্পষ্ট। গত এক বছর ধরে আন্দোলনের নামে যে হারে সহিংসতা হয়েছে জেলায় জেলায়, তাতে বিরোধী রাজনীতির ‘অগণতান্ত্রিকতা’ দৃশ্যমান। তৃতীয়ত, ধরা যাক, এই মুহূর্তে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলো। এবং এও ধরে নেওয়া যাক, আগের নির্বাচনগুলোয় গত দুই দশকে যেমনটা ঘটেছে, বিরোধী জোট এবারে জয়ী হলো। কিন্তু তাতে করে গণতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠা হবে তারই বা নিশ্চয়তা কী? সহিংস অগণতান্ত্রিকতার অনুশীলন করে যে অশুভ শক্তিকে আমরা প্রশ্রয় পেতে দেখলাম তারা তো তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবে। সেটাই কি আমরা চাই? আমরা কি চাই যুদ্ধাপরাধের বিচার_ ৪২ বছর পরে যে কোনো কারণেই হোক যখন সবে শুরু হয়েছে_ থেমে যাক? একবার অপরাধীদের হাতে ক্ষমতা গেলে বা তারা ছাড়া পেলে কী ভয়ঙ্কর অমাবস্যা নেমে আসবে এ দেশে, এ নিয়ে তো চরম দুর্ভাবনা নাগরিক সভার উদ্যোক্তাদের কথায় এবং বার্তায় দেখতে পেলাম না। চতুর্থত, উদ্যোক্তারা তো একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’র কথা বলতে পারতেন। যে চুক্তিতে বলা হতো, অবাধ, স্বচ্ছ ও সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য নয়। যে চুক্তিতে এ-ও বলা হতো, চরম ডানপন্থি সহিংস শক্তির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদচারণা গ্রহণযোগ্য নয়। জন রাউলসের ‘রিজনিবল প্লুরালিজম’ সংজ্ঞায় এই সহিংস শক্তি পড়ে না। যে চুক্তিতে বলা হতো, অসাম্প্রদায়িকতা ও সেক্যুলার মূল্যবোধ ছাড়া নির্বাচনী গণতন্ত্র কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র হতে পারে না। যে চুক্তিতে বলা হতো যে, বাহাত্তরের মূল চারটি নীতি আসলে পরস্পরের পরিপূরক। সমাজতন্ত্র ছাড়া যেমন গণতন্ত্র জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, তেমনি গণতন্ত্র ছাড়া সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজম ছাড়া জাতীয়তবাদ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজম বর্ণবৈষম্যবাদের মতো ধর্মবৈষম্যবাদের আশঙ্কাকে দূর করে। এবং সবশেষে নাগরিক সভার অনেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত প্রার্থীদের ‘হলফনামার’ সূত্র ধরে একহাত নিয়েছেন সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের। বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে সম্ভবত অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণের সম্ভাবনার কথা। এই উদ্বেগে কারও আপত্তি থাকার কথা নয় সাধারণভাবে। কিন্তু এই উদ্বেগ আরও বিস্তৃত পরিসরে ব্যক্ত হওয়া উচিত ছিল। নাগরিক সভার উচ্চবর্গের অংশগ্রহণকারীরা বলতে পারতেন, হলফনামায় যে সম্পদ আহরণের চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা সাধারণভাবে কম-বেশি সত্য উচ্চবর্গের সবার ক্ষেত্রেই। যারাই এ সময়ে [গত এক দশকে] রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাশালী হয়েছেন_ তা তিনি সরকার দলেই থাকুন, আর বিরোধী দলেই থাকুন_ তাঁরাই দ্রুত অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ_ এ তিনের বরপুত্র হয়েছেন তাঁরা। প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থাকা যে উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজ সেদিনের নাগরিক সভায় অংশ নিয়েছিলেন তারাও হয়তো কম-বেশি এই সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়ার বাইরে নন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে সরকারদলীয় প্রার্থীদের সম্পদ হয়তো বেড়েছে ৭ গুণ, সে তুলনায় বিরোধীদলীয় সদস্যদের সম্পদ হয়তো বেড়েছে ৪ গুণ এবং উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজের সদস্যদের বেড়েছে হয়তো ২ অথবা ৩ গুণ [নাগরিক সমাজের যে অংশটি ব্যবসায়ী শিল্পপতি তাদেরকে এখানে ইচ্ছে করেই বাদ রাখছি]। একই সময়ে আমলাদের অর্থবিত্তও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে থাকবে। করপোরেট ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যারা তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। সংখ্যাগুলো কাল্পনিক, কিন্তু সমাজে আয় ও সম্পদ-বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করার সুবাদে বলতে পারি_ এ ধরনের প্যাটার্ন বাস্তবতার বাইরে নয়। এ প্রশ্নেও বলতে বাধ্য, সেদিনের নাগরিক সভার হলফনামা সম্পর্কিত আলোচনা নিতান্ত একপেশে মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গগুলো আগামীতে উপস্থাপনের সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।কিন্তু আমি এসব কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কে? আমি তো উটপাখি, সমাজের-ইতিহাসের ওপর দিয়ে ঝড়-ঝঞ্ছা যখন বয়ে যাবে তখন আমার বালিতে মুখ গুঁজে থাকার কথা। ‘উটপাখী’ কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশিদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার/তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।/অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ বাংলাদেশ নাকি ধ্বংসের কিনারে গিয়ে বারবার ফিরে আসে। কিন্তু এ রকম কোনো মৌল সূত্রের রক্ষাকবচ আসলে নেই। যা ঘটছে এখন বাংলাদেশে, যা ঘটতে যাচ্ছে, তার জন্য সমানভাবে দায়ী থাকবে সরকার, বিরোধী দল ও সিভিল সমাজ। শুনেছি, উটপাখিরাও আসলে বালিতে মুখ লুকায় না। বালিতে তারা মুখ গুঁজে ডিমকে রক্ষা করার জন্য। নিতান্ত জীবন-চর্চার প্রয়োজনেই। তাই উটপাখিদের তুলনা দেওয়াটা তাদের জন্য হবে অপমানকর। সরদার ফজলুল করীম এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মানুষ আসলে মানুষকে মারতে পারে না। হয় মানুষ অমানুষকে [পশুকে] মারে, অথবা অমানুষ [পশু] মানুষকে মারে। আমরা এই ভয়াবহ সমীকরণের মধ্যে বাস করছি।

লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতিবিদ

Original post on Samakal here.

উপর্যুপরি আক্রমণ: প্রচলিত ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা

দ্বিতীয় কিস্তি (প্রথম কিস্তি)

সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ-নির্যাতন বিভিন্ন যুগে হয়েছে। তবে ধারণা করা যায় যে প্রাক-ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক, আধা-ঔপনিবেশিক ও আধুনিক আমলে এই নির্যাতনের ভিন্ন ভিন্ন কারণ ছিল। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে ২০১২ বা ২০১৩ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। এটাই এখানে আমার মূল বক্তব্য।

কিন্তু তার আগে আমাকে বাঁশখালীতে ফিরে যেতে হবে। আমি সেখানে যাইনি। অনেকের মতো আমিও সেই বিপর্যস্ত নারীকে দেখেছি টিভির পর্দায়, বিভিন্ন চ্যানেলে, দগ্ধ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় কাতরস্বরে কী যেন বলছেন এবং পরমুহূর্তে আবার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত তাঁর এত দিনকার গৃহস্থালির অবশিষ্টাংশ ও পোড়ামাটির ধুলায় ক্লান্তিতে কান্নায় শুয়ে পড়ছেন—এ রকম একটা ছোট্ট ‘ক্লিপ’ আমাদের দেখানো হয়েছে। আমি তাঁর নাম পর্যন্ত জানি না। কিন্তু মাতৃসমা এই নারী আমাকে পেয়ে জানতে চাইতেই পারেন, ‘বাবা, এই যে এসব ঘটে গেল, এটা কেন হলো, এর ব্যাখ্যা কী?’ ফলে প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলোকে আবারও বিস্মৃতি থেকে টেনে আনতে হচ্ছে কেবল তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, যেপ্রশ্ন তিনি কখনোই আমাকে করেননি বা হয়তো কাউকেই করেননি বা সম্ভবত কোনো দিনই করবেন না। তবে তাঁর ঘর-গৃহস্থালির অবশেষ দেখে এবং শুধু তাঁর নয়, অধিকাংশ মানুষ যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সম্প্রদায়কেন্দ্রিক এই আক্রমণে, তাঁদের সহায়-সম্পত্তি দেখে—এ রকম ধারণা আমার জন্মেছে যে তাঁরা কেউই উচ্চবর্গের নন। এমনকি শহরে মধ্যবিত্তের যে জীবনমান তার চেয়েও বেশ কিছুটা নিচুতেই তাঁদের অবস্থান বোধ করি। বস্তুত, আক্রমণের পর তাঁদের ঘর-গৃহস্থালির যে চেহারা দেখানো হয়েছে টিভির পর্দায় বা পত্রিকার স্থিরচিত্রে, তাতে করে প্রথমেই যে প্রশ্নটা জেগেছে আমার তা হলো—এখান থেকে লুটপাটের কী পেল দুর্বৃত্তরা? এঁরা হয়তো ভূমিহীন চরম দরিদ্র পরিবারের কেউ নন, কিন্তু মধ্যবিত্তের সম্পদ-জমি ইত্যাদি সংজ্ঞায় এঁরা পড়েন কি না এ নিয়ে শেষাবধি সন্দেহ থেকেই গেল। সম্পদ বলতে একটা ভিটেমাটি, চালাঘরের মধ্যে একটা খাট বা বড়জোর একটা আলনা, কিছু ঘটি-বাটি, একটা দুটো চেয়ার-টেবিল বা বড়জোর কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট টিভি। এঁরা গ্রামবাংলার ধ্রুপদি গরিব কৃষক বা ছোট্ট মফস্বল শহরের বা বাজার-উপজেলা কেন্দ্রের খুদে ব্যবসায়ী। প্রথাগত অর্থে সংখ্যালঘু বলতে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী যে শ্রেণীটিকে বোঝানো হয়ে থাকে, এঁদের স্থান তার থেকে অনেক নিচে—সামাজিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সম্পদ, শিক্ষার মান যেকোনো মানদণ্ডেই তাঁদের বিচার করুন না কেন। এই কারণে আমি এঁদের ‘অতি-সংখ্যালঘু’ বলছি। এরা আলট্রা-পুওরের মতোই আলট্রা-মাইনরিটি।

সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ-নির্যাতনের যেসব প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে তা উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে কোনো বিশেষ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার জন্য। এর কোনোটা লেখা হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে ঘটে যাওয়া দাঙ্গাগুলোকে বোঝার ক্ষেত্রে (যেমন ১৮৮০ সাল থেকে শুরু করে ১৯২৬-এর দাঙ্গার কারণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে)। কোনোটা লেখা হয়েছে পার্টিশনের আগের (১৯৪৬ সালের) দাঙ্গা বোঝার তাগিদ থেকে। কোনোটা লেখা হয়েছে পার্টিশনের পরের (১৯৫০ বা ১৯৬৪ সালের) দাঙ্গার প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য। স্বাধীনতার পর এ দেশে ১৯৯২ সালের বা ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ-নির্যাতন নিয়েও কিছু লেখালেখি হয়েছে। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাঁড় করানো হয়েছিল সেসব ঘটনা বোঝার ক্ষেত্রেও এগুলো যথেষ্ট ছিল কি না সে বিষয়েও আমার কিছুটা সংশয় রয়েছে। কিন্তু আমি এখানে সেসব বিচারে যাব না। আমি ধরে নেব এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ন্যায্যতা রয়েছে। আমি শুধু দেখব যে এসব ডিসকোর্স দিয়ে ২০১৩ সালের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনকে ব্যাখ্যা করা চলে কি না।

হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে একই আলো-হাওয়ার মধ্যে শত শত বছর বাস করেও ‘যাহা মনুষ্যচিত, যাহা ধর্মবিহিত’ সে রকম একটি সম্পর্ক ‘আমাদের মধ্যে হয় নাই’ এবং এই অর্থে আমাদের মধ্যে ‘একটি পাপ আছে’ ও ‘এই পাপ বহুদিন হইতে চলিয়া আসিতেছে’। এটা স্বীকার না করলে ‘এই পাপ থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নাই’। এর থেকে আভাস মেলে যে প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলেও, বিচ্ছিন্ন হলেও, মাঝেমধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে; উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে নিয়ম না-মানা চৈতন্যপন্থী, সহজিয়া ও বৈষ্ণব মতের যেমন, তেমনি সমতাবাদ অনুসারী নব্য ধর্মমত ইসলামের সঙ্গেও। তবে সে আমলে অতি-শাস্ত্র মানা বিশুদ্ধপন্থীদের সঙ্গে শাস্ত্র হুবহু না-মানা অবিশুদ্ধপন্থীদের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এক ধরনের সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মধ্যযুগীয় সমাজে; ফলে দ্বন্দ্ব থাকলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তা পর্যবসিত হয়নি সেকালে। এই অবস্থাটা উনিশ শতকের বাংলায়ও বহুকাল অবধি ছিল। ফরায়েজি-ওহাবি শুদ্ধাচরণের মতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবেই গড়ে উঠেছিল লালন ও তাঁর অনুসারীদের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। তখনকার সমাজ এ রকম নানা মতবাদ ও ঐতিহ্যকে ধারণ করতে পেরেছিল বলেই সামাজিক ভারসাম্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়নি। এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থাটা ১৮৮০ সালের পর থেকে ক্ষয়ে যেতে থাকে। এর পেছনে দায়ী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাম্প্রদায়িক উত্থান, যা বঙ্কিম-প্রদর্শিত বাহুবলের তত্ত্বকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে পরবর্তী দশকগুলোয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাঁশখালীর ওই প্রৌঢ়া নারীর পরিবারের ওপর আক্রমণ-নির্যাতনকে এই দ্বন্দ্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় কি না? প্রথমেই আমাদের মনে পড়বে জমিদার-কৃষক দ্বন্দ্বের তত্ত্বের কথা। হিন্দু জমিদার বনাম মুসলমান কৃষক এই শ্রেণীগত দ্বন্দ্বের সাম্প্রদায়িকীকরণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান অনিবার্যভাবে জন্ম নিল—এমন মত পাওয়া যাবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের রচনায়। জমিদার বনাম কৃষক এই শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব যে সাম্প্রদায়িক পরিণতিতে গড়াতে পারে তার আভাস রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে উপন্যাসে বিশদভাবেই পাওয়া যায়। তবে বাঁশখালীতে, বেগমগঞ্জে বা বাগেরহাটে যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের ঠিক ঘরে-বাইরে-এর নিখিলেশের শ্রেণীতে ফেলা যায় না—এতে আশা করি কম-বেশি সবাই একমত হবেন। ১৯০৫-০৭ সালের ‘স্বদেশি আন্দোলন’ চলাকালীন বঙ্গভঙ্গ রোধে সেভাবে মুসলমান কৃষকেরা অংশ নেয়নি। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে কৃষকেরা ভেবেছিল, বাবুরা তো এমনিতে তাদের কাছে আসেন না, ‘বাবুরা বোধকরি বিপদে পড়িয়াছে’ বলেই এখন তাদের কাছে এসে স্বদেশি প্রচারণা চালিয়ে সাহায্য চাইছেন। কিন্তু বাঁশখালীর ওই প্রৌঢ়া নারীর পরিবারকে বা উপজেলা কেন্দ্রের আক্রমণের শিকার খুদে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে ঠিক ধ্রুপদি অর্থে ‘হিন্দু বাবু’ বলা চলে না বোধকরি।

১৮৮০ সাল থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন দাঙ্গার একটি মেইনস্ট্রিম ব্যাখ্যা হলো, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণভাবে ব্যাপক কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ব্যাপক দ্বন্দ্ব ছিল এবং দ্বন্দ্ব বাড়ছিল এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও মুসলমান মধ্যবিত্ত প্রতিযোগিতা করছিল চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা খাতে নিজেদের ক্ষমতাবান করতে। একসময় সে প্রতিযোগিতা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের রূপ নেয় ও এর পরিণতিতে এমনকি তা দাঙ্গা-আক্রমণ-নির্যাতন পর্যন্ত গড়ায়। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কালপর্ব নিয়ে লেখা হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে এ রকম দ্বন্দ্বের বিস্তার কীভাবে গ্রাম এলাকায় ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছিল তার সত্যনিষ্ঠ বিবরণী পাই। ক্রমেই জমিদার নিয়ামত হোসেন ও অত্যাচারী শশাংক পালের জায়গা নিচ্ছিল উঠতি ধনিক ধনু শেখ। তবে দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে ক্রমবর্ধমান স্বার্থচিন্তার তত্ত্বও বাঁশখালী, বেগমগঞ্জ, বাগেরহাটের ২০১৩ সালের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ-নির্যাতন-দাঙ্গাকে ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে না। নির্যাতিত পরিবারগুলোকে কোনোভাবেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত বলে মনে হয়নি আমার। এরা আদৌ কোনো আকর্ষণীয় সরকারি বা বেসরকারি খাতের চাকরিতে নিয়োজিত কি না সে বিষয়েও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।

১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের দুটো বড় দাঙ্গা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের অবশিষ্ট সামাজিক ভিতকেও ভেতর থেকে নড়িয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও দেশভাগের দাঙ্গার প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠে হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিল। ১৯৪১ সালে এই বঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঠিক আগের বছরে এদের সংখ্যা ছিল ২২ শতাংশ। ১৯৭৪ সালের পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে। ২০১১ সালে এটা আরও নেমে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে। ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের দাঙ্গাগুলোর পেছনে মূলত দায়ী করা হয় বৈরী রাষ্ট্রশক্তিকে এবং সেই শক্তির সমর্থক মুসলিম লীগের রাজনীতিকে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর শত্রু-সম্পত্তি আইন যারা জমি-বাড়ির মালিক, সেসব হিন্দু পরিবারের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও দুর্বল করে দেয়। বস্তুত, দাঙ্গার মাধ্যমে যতটা ক্ষতিসাধন হয়েছে এই শ্রেণীর, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে শত্রু-সম্পত্তি আইনের প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই ব্যাখ্যাও হাল আমলের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনকে বুঝতে সাহায্য করে না। রাষ্ট্রক্ষমতায় আজ সাম্প্রদায়িক বৈরী শক্তি অধিষ্ঠিত নেই। নেই মুসলিম লীগের মতো কোনো শাসক দলও। শত্রু-সম্পত্তি আইন সাধারণভাবে সারা দেশেই এখনো বিদ্যমান—এই পাপ আপনার, আমার, সবার—কিন্তু বিশেষভাবে বাঁশখালী, বেগমগঞ্জ বা বাগেরহাটের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কেন রাষ্ট্রশক্তি বা তার সহযোগী স্থানীয় সামাজিক শ্রেণী-দলগুলো চড়াও হতে যাবে কেবল সম্পত্তি দখলের জন্য, তার সপক্ষে যুক্তি মেলা ভার। এই অতি-সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করে জামায়াত-শিবির (যদি করেও থাকে) কী ফায়দা পাবে, সেটিও কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মেথড ইন দ্য ম্যাডনেস’ সে রকম কিছু খুঁজে পাচ্ছি না এখানে। তাহলে এই অযৌক্তিককে কোন যুক্তিতে ধরব?

সাম্প্রদায়িক আক্রমণ-নির্যাতনের সর্বশেষ যে ব্যাখ্যাটি আমার হাতের কাছে রয়েছে তা হলো, উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রে এক জাতি, এক ধর্ম, এক রাষ্ট্র—এ রকম রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের চাপে এসব দুরাচার ঘটছে। এই রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ যেহেতু আত্যন্তিকভাবে কোনো বিশেষ একটা আত্মপরিচয়কেই বড় ও চূড়ান্ত করে দেখতে চায়, সেহেতু অন্যান্য আত্মপরিচয়ের জাতি, গ্রুপ বা ব্যক্তিরা হয়ে পড়ে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। একেই কালচারাল স্টাডিজ এবংবিধ বিদ্যায়তনিক পরিসরে বলা হয়ে থাকে ‘অপরায়ণ’। তবে ‘অপর’ হলেই যে ‘পর’ হবে বা ‘পর’ হলেই যে ‘শত্রু’ হবে এবং ‘শত্রু’ হলেই ‘নির্যাতনের লক্ষ্য’ হবে—এ রকম কোনো অবধারিত নিয়মনীতি অপরায়ণের সূত্রে গাঁথা নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনীতিতে সেক্যুলার বাঙালিত্ব তথা ‘ভাষাকে’ বড় করে তুলছে বলেই এর বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে রাজনীতিতে দাঁড়াতে হবে ‘ধর্মকে’ কেন্দ্র করে—এ রকম কোনো মিঠে ডায়ালেকটিক অনিবার্য নয়। এ দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে গিয়ে যিনি জাতিসংঘে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি একসময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। সদালাপী এই ব্যক্তিটি বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে ‘জল বনাম পানির’ উপমা টেনে এনেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা এত সরল ছিল না। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার ও অঞ্চলের এবং ধর্মের শব্দ এত বেশি ঢুকেছে যে এই ভাষার মিশ্র চরিত্রের ভিত্তিতে বঙ্কিমের মতো সাম্প্রদায়িক চিন্তকও একপর্যায়ে বাঙালি হিন্দুর বিশুদ্ধ ইতিহাস ব্যাখ্যা লেখা অসম্ভব বলে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ প্রবন্ধে খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে বঙ্কিম অবিমিশ্র আর্য জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির ইতিহাস লেখার বদলে একপর্যায়ে সম্ভবত ‘বহুজাতিক বাঙালি’র ইতিহাস লেখার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুসারে, ‘বাংলার স্বাধীন (মুসলমান) সুলতানদের আমলকেই বঙ্কিম প্রকৃত রেনেসাঁসের যুগ মনে করতেন’, ইত্যাদি। ভুল শুনলাম কি—‘বহুজাতিক বাঙালি’? যদি এটাই সত্য হয়, তাহলে একই সঙ্গে বাঙালি ও বাংলাদেশি, একই সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ‘বহুজাতি’ এ দেশে গড়ে উঠতে পারা যাবে না কেন? এ রকম ‘বহুজাতিক বাঙালি’তে কে সংখ্যাগুরু, কে সংখ্যালঘু—এই প্রশ্নের গুরুত্বই কমে যায়। তা ছাড়া এই ভূখণ্ডে তো বাংলা ছাড়াও অন্যান্য বহু ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছেই, তাদেরও তো এই বহুজাতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমি বাঁশখালীর ধ্বংসস্তূপের ভেতরে পোড়ামাটির গন্ধ ও কালো ধুলার মধ্যে ভূলুণ্ঠিতা মাতৃসমা ওই নারীকে এসব তত্ত্ব বোঝাব কী করে? (শেষ)

বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক।

সংখ্যালঘু বনাম আত্মপরিচয়ের স্বাধীনতা

প্রথম কিস্তি

আমি কি সংখ্যালঘু? এক অর্থে প্রশ্ন রাখাটাই হাস্যকর। আমার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া নামই বলে দিচ্ছে আমি কী। এ নিয়ে বাহাস করার অর্থই হয় না। তবে বিষয়টা অত সরল না-ও হতে পারে। আজকাল সংখ্যালঘু কথাটার ‘সংখ্যায় লঘু’ এমন একটা কোনো সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সংখ্যায় মেজরিটি হয়েও কেউ কার্যত মাইনরিটি হতে পারে। সারা বিশ্বে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি, শিশুমৃত্যুর হারে অনেক বৈষম্য থেকে যাওয়ার পরেও। তারপরও কি আমরা বলতে পারি যে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ? সংখ্যায় বেশি হওয়ার পরেও সংখ্যালঘুর মতো অধস্তন অবস্থান তাদের। তার মানে ব্যাপারটা শুধু সংখ্যায় (নিউমেরিক্যালি) বেশি-কমের বিবেচনা নয়। মূল প্রশ্নটা হচ্ছে—কে কত বেশি ক্ষমতাবান? নারীরা পুরুষদের চেয়ে এখনো কম ক্ষমতাবান বলেই সংখ্যায় বেশি হয়েও তারা সংখ্যালঘু। সুতরাং সংখ্যায় বেশি-কম যা-ই থাক না কেন, কোনো সামাজিক গোষ্ঠী বা গ্রুপ বা ব্যক্তি ‘ক্ষমতা হারিয়ে’ কীভাবে সংখ্যালঘু ‘হয়ে ওঠে’, সেটিই হচ্ছে প্রথম বিচার্য বিষয়। ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় অনেকেই বলেছেন, নারীরা ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’। যখন আপনি সংখ্যালঘু হয়ে ওঠেন, তখন আপনি নিজেকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ ভাবতে শুরু করেন। জ্যাঁ পল সার্ত্র বলেছিলেন, একজন ইহুদি হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যাকে অ্যান্টি-সেমিটিকরা ইহুদি বলে ডাকে। তাঁর কথার সূত্র ধরে বলা যায়, একজন সংখ্যালঘু হচ্ছে সেই মানুষ, যাকে একজন সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলে ডাকে, যেমন: ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কোনো ব্যক্তি নিজেকে ‘উপজাতি’ বলে পরিচিত করে না, তাকে ‘উপজাতি’ বলে কোনো বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

সমাজে প্রতিটি ব্যক্তিরই নানা পরিচয় থাকে। কোন পরিচয়ে কে কখন কতটা নিজেকে জাহির করবে, সেই স্বাধীনতাটা সবার সমান নয়। আত্মপরিচয় (আইডেনটিটি) জাহির করার স্বাধীনতা যে সমাজে যত বেশি, সেই সমাজে ব্যক্তির স্বাধীনতাও তত বেশি এবং সেই সমাজও তত বেশি উন্নত। অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইয়ে নিজের বিভিন্ন পরিচয় তুলে ধরেছেন। আমার অক্ষম অনুবাদে তা দাঁড়ায় এমন: ‘আমি একই সঙ্গে হতে পারি একজন এশীয়, একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন বাঙালি, যার রয়েছে বাংলাদেশি পূর্বপুরুষ, একজন মার্কিন দেশে বা ব্রিটেনে বসবাসকারী, একজন অর্থনীতিবিদ, দর্শনচর্চায় অনুপ্রবেশকারী, একজন লেখক, একজন সংস্কৃত ভাষায় বিশেষজ্ঞ, সেক্যুলারিজম ও গণতন্ত্রে জোরালোভাবে বিশ্বাসী, একজন পুরুষ, একজন নারীবাদী, একজন “হেটেরোসেক্সুয়াল”, কিন্তু সমকামীদের অধিকারের পক্ষাবলম্বনকারী, যার জীবনযাত্রার ধরন কোনো বিশেষ ধর্মের সঙ্গে খাপ খায় না (নন-রিলিজিয়াস), সে এসেছে হিন্দু সামাজিক পটভূমি (ব্যাকগ্রাউন্ড) থেকে, সে অ-ব্রাহ্মণ, এবং সে বিশ্বাস করে না মৃত্যু-পরবর্তী কোনো জীবনে (আফটার লাইফে), বা এই প্রশ্ন যদি তাকে করা হয়, সে এ-ও বলবে—সে বিশ্বাস করে না কোনো পূর্ব-জন্মেও। এটা হচ্ছে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ের একটি ক্ষুদ্র নমুনা-চয়ন, যার প্রতিটাতেই আমি হয়তো একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত—এবং চাইলে এ রকম আরও অনেক পরিচয়ের সদস্য হতে পারি আমি; সবকিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতির বিচারে কোন পরিচয়টা সেই মুহূর্তে আমাকে বেশি টানছে, তার ওপর।’ অমর্ত্য সেনের স্বাধীনতা আছে বিভিন্ন পরিচয়ের মধ্যে লাগসই পরিচয়টা অবস্থাভেদে, পছন্দ অনুযায়ী ও রুচির বিচারে বেছে নেওয়ার। এই ‘বাছাইয়ের স্বাধীনতা’ সবার থাকে না, সব শ্রেণীর থাকে না, সব সমাজে থাকে না।

অমর্ত্য সেন বইটি লিখেছিলেন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে প্রচারিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর তত্ত্ব। সংঘাত বলতে পাশ্চাত্য ও ইসলামি সভ্যতার মধ্যে এক মূলগত দ্বন্দ্বের ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন স্যামুয়েল হান্টিংটন ও তাঁর অনুসারীরা। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের পরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নানাভাবে পাশ্চাত্যের শত্রু বানিয়ে এই তত্ত্বকে বাস্তবেই কাজে লাগানো হয়েছিল। তারই বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা ও প্রতিবাদ হিসেবে অমর্ত্য সেন ২০০৬ সালে বইটি লিখেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, পাশ্চাত্য ও ইসলামের মধ্যে এই বিরোধ আবিষ্কার ছিল একটি দুষ্ট-পরিকল্পনা। প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্বকে এক পরাশক্তির অধীনে আনার ও সর্বত্র আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর তত্ত্ব জোরেশোরে অনুসৃত হয়েছিল। কিন্তু অমর্ত্য সেন এই বই লেখার আরও বহু বছর আগে থেকেই আমি আবছা করে বুঝতে পেরেছিলাম, প্রতিটি ব্যক্তিকেই কোনো বিশেষ আত্মপরিচয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র বা ধর্ম বেঁধে দিতে পারে না। কোন পরিচয়ে সে নিজেকে কখন পরিচিতি করাতে চায়, সেই ‘বাছাইয়ের স্বাধীনতা’ তার চাই—এটা তার মৌলিক মানবিক অধিকার। এবং সে কারণেই কৈশোর থেকেই কেউ আমাকে ‘সংখ্যালঘু’ বললে আপত্তি করেছি, পারলে প্রতিবাদ করেছি, না করলেও মেনে নিইনি।

এর জন্য আমার পারিবারিক ঐতিহ্যও কিছুটা দায়ী। আমি এখানে কোনো ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার কথা তুলছি না। আমার ধারণা, এ রকম অভিজ্ঞতা আরও অনেকের জীবনেই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সেটা মনে রেখেই দু-একটি আত্মজৈবনিক তথ্য যোগ করব এখানে। ব্যাখ্যার প্রয়োজনেই এই আত্মকথন—তার জন্য আগেই তত্ত্বজ্ঞ পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার মা ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের মধ্যে তাঁর পরিচয়কে সীমিত রাখেননি। ঈদে বা শবেবরাতের অনুষ্ঠানে নিজে উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন, বাসায় হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে দাওয়াতও দিতেন। উৎসবে বা সংকটে পড়লে মাজারে ‘মানত’ করা ছিল তাঁর সংসারের প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব কিছু ‘ভোকাবুলারি’ ছিল। হাইকোর্টের মাজার ‘গরম পীরের মাজার’, ফলে মাজারের পাশ দিয়ে গেলে হাত তুলে শ্রদ্ধা জানানো চাই। নইলে আধ্যাত্মিক গুরু রুষ্ট হবেন। মিরপুরের মাজার আবার ছিল ‘ঠান্ডা পীরের মাজার’—তিনি দুর্বাসা মুনি নন, সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে দোষ নেন না। আমাদের বাসায় জন্মাবধি দেখেছি নানা সময়ে বিভিন্ন মুসলমান আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন পুণ্যবান ব্যক্তিরা এসেছেন। তাঁদের যথাবিহিত যত্ন করা হয়েছে। ফলে নিজেকে ‘সংখ্যালঘু’ ভাবার কোনো যুক্তি শৈশব থেকেই পাইনি। মা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাতেন—যদি হিন্দু ধর্মে তাঁর অন্তর্ভুক্তিকে ভারতমুখিনতার সঙ্গে সমীকরণ করা হতো। পাড়ার বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গেলে যদি বিক্রেতা তাঁকে বলত, ‘দাদি, আপনাদের দ্যাশ থেকে আইছে।’ মা উত্তরে বলেছেন, ‘তাই নাকি, জানতাম না তো সিলেটে আজকাল এসব পেঁয়াজ হচ্ছে,’ এবং তারপরেই তিরস্কার করে বলে উঠতেন, ‘দাদির সঙ্গে ফাজলামি করার আর বিষয় পাওনি, না?’ বিক্রেতা লজ্জিত হতো, ‘না, দাদি, ভুল হয়ে গেছে’—এমনটাই বলত। তিনি বাজারের সবার কাছে ছিলেন ‘সর্বজনীন দাদি’। শুনেছি, মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ শেষবারের মতো দেখার জন্য অনেক লোক তাঁর বাসায় জড়ো হয়েছিলেন, যাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান। আমার ধারণা, আমার বাবাও এই মতেরই মানুষ ছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন—অসংখ্য ছাত্র ১৯৫৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সে প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়েছে। মানুষ বড়ই রহস্যময় জীব। আমি মৃত্যুর পরে তাঁকে একবার মাত্র স্বপ্নে দেখেছি, কিন্তু তাঁর পূর্বতন (মুসলমান) ছাত্ররা ও সহকর্মীরা—যাঁরা পরবর্তী সময়ে উচ্চতর পদে আসীন হয়েছিলেন—তাঁকে নাকি অনেকবারই স্বপ্নে দেখেছেন এবং সদা-হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবিতে দেখেছেন। তাঁরা ফোন করে বা দেখা করে আমাকে তা বলার তাগিদ অনুভব করেছেন। আমি পারমার্থিক বিষয়ে নিবিষ্ট নই, কিন্তু আমার শুধু বলার কথা—হিন্দু-মুসলমান আত্মপরিচয়ের বিভিন্নতা সেখানে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। ফলে আমার পক্ষে, নিজেকে ‘সংখ্যালঘু’ ভাবা কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

দ্বিতীয় একটি কারণও ছিল। আর সেটা মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। আমার বাবা অধ্যক্ষ বি বি সেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সংগঠকের ভূমিকায়। প্রবাসী বাংলাদেশের সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ১৯৭১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন সমগ্র নর্থ-ইস্ট সেক্টরের ‘এডুকেশন অফিসার’ হিসেবে। শিলংয়ে সে সময় বাংলাদেশ সরকারের একটি অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। কাজটা ছিল রিলিফ ও মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের পরিচালনার কাজে অংশ নেওয়া। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকায় প্রবেশ করেন। তারপর আবার ফিরে গেছেন তাঁর পূর্বতন কর্মক্ষেত্রে অধ্যক্ষ হিসেবে। এ দেশে বীরাঙ্গনাদের প্রথম কারিগরি প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯৭২-৭৩ সালে তাঁর পরিচালিত প্রতিষ্ঠানেই। মুজিবনগর সরকারে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা সবাই নাকি একটি করে ‘প্রমোশন’ পেয়েছিলেন। সেদিক থেকে তিনি ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তবে স্বীকৃতি বা পদোন্নতি নিয়ে তাঁর মনে কখনো ক্ষোভ ছিল না। এই না-পাওয়াটাকে তিনি তাঁর ‘সংখ্যালঘু’ পরিচিতির সঙ্গে কখনোই যুক্ত করেননি। দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। একবার পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যার মুখে। সেবার পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার তাঁর পাকিস্তানি বস-এর ছোট ভাই হওয়ায় তিনি প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। আরেকবার এই স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কোনো অব্যাখ্যাত কারণে ১৯৭৫-এর নভেম্বরে, সেনা-অভ্যুত্থানের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে (বর্তমান লেখকসহ)। এই গ্রেপ্তার ছিল ভুল-বোঝাবুঝির, গ্রেপ্তার এবং যাঁরা এটা করেছিলেন তাঁরা পরবর্তী সময়ে তাঁদের উপাত্তগত ভুল বুঝতে পেরে অত্যন্ত বিব্রতবোধ করেছিলেন। সে রকম শুনেছি। তবে আমার গর্বের ব্যাপার যে আমার বড় ভাই ছিলেন একজন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা। মুজিববাহিনীতে নয়, সে সুযোগও তাঁর ছিল। তিনি সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে (এফএফ) যোগ দেন ৪ নম্বর সেক্টরে। জানের তোয়াক্কা না করে তিনি যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁকে আমরা সারা শরীরে জোঁকে-খাওয়া অবস্থায় দেখতে পাই নয় মাস যুদ্ধের পরেই। কিছুদিন ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার দায়িত্বপূর্ণ কাজেও ছিলেন, কিন্তু তদানীন্তন নেতৃত্বের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৭৪ সালেই ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি নেন। সেটাও (পরে শুনেছি) স্বাধীনতার পরে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতার মুখ গলে তাঁর কানে এসে পৌঁছেছিল, বা এমনই কিছুর প্রতিবাদে। এরপর বাদবাকি জীবনটা প্রায় প্রবাসেই কাটালেন কোনো প্রবল অভিমান বুকে নিয়ে। এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের গর্বিত সদস্য হিসেবে ‘সংখ্যালঘু’ আত্মপরিচয়টা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মতো আমারও আপত্তির যথেষ্ট কারণ ছিল ও আছে।

তৃতীয় একটি কারণও রয়েছে, তবে সেটা মোটামুটি প্রকাশ্যেই ধারণ করে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং কালক্রমে কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলাম। ফলে নিজেকে ‘সংখ্যালঘু’ ভাবার কোনো কারণ ছিল না, কেননা পার্টিতে মণি সিংহ বা মোহাম্মদ ফরহাদ, জিতেন ঘোষ বা হাতেম আলী, মণিকৃষ্ণ সেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজয় রায়, মতিউর রহমান বা মনজুরুল আহসান খান—এসব নামের মধ্যে কোনো সম্প্রদায়গত বিবেচনাবোধ কখনোই মনে স্থান পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। আমার প্রথম ও প্রধান আত্মপরিচয় ছিল—আমি সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রের প্রগতির পক্ষের লোক। আমাকে ‘সংখ্যালঘু’ বললেই (বলতে পারেন অনেকেই) আমি তা মানব কেন? ঠিক একইভাবে, পারিবারিক দিক থেকে একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়ার কারণে আমার স্ত্রীও (যতই তাঁকে বোঝানো যাক) নিজেকে এখনো ‘সংখ্যালঘু’ বলে ভাবতে চান না বা পারেন না।

মোট কথা, অমর্ত্য সেনের দার্শনিক গ্রন্থটা পড়ার আগে থেকেই আমি বুঝতে শিখেছিলাম যে বিভিন্ন আত্মপরিচয়ের মধ্যে কোন পরিচয়টা কখন কী পরিমাণে আমি জাহির করব, সে স্বাধীনতাটা আমাকে দেওয়া দরকার বা আমার অর্জন করা দরকার। কিন্তু এসব কথা আমি বাঁশখালীর ওই সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া মাতৃসমা নারীটিকে বোঝাব কী করে? বস্তুত, আমি তাঁকে সংখ্যালঘুও বলতে চাইছি না। তাঁর পরনের পোশাক, তাঁর ঘর-গৃহস্থালি, তাঁর পরিবেশ-প্রকৃতি আমাকে বলে দিচ্ছে, অন্য কোনো শব্দবন্ধ প্রযুক্ত হওয়া দরকার এ ক্ষেত্রে। আমি তাঁকে অনন্যোপায় হয়ে বলছি—তিনি আসলে অতি-সংখ্যালঘু।

দ্বিতীয় কিস্তি: অতি-সংখ্যালঘুর ওপরে আক্রমণ: প্রচলিত ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক।