মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫১

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৬. নিম্নবর্গের প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় জনগণের মধ্যে জনস্বাস্থ্য- কার্যক্রমের কার্যত অনুপস্থিতির ফল হয়েছিল মারাত্মক। তাদের বড় একটি অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বিভিন্ন রোগের দেবদেবীর (দেবীরই প্রাবল্য সে তালিকায় অবশ্য বেশি) সাধনায়, আর ক্ষুদ্র একটি অংশ রমেশ বা জগমোহনের মতো নিয়োজিত ছিল আত্মশক্তি-অনুপ্রাণিত স্বনির্ভর স্বাস্থ্য কার্যক্রমে। এদের একটি ধারা ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদকে’ প্রতিহত করতে চেয়েছে অনেকটা ভাবাদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত হয়েই। এ প্রসঙ্গে ১৯৩০-র দশকে প্রকাশিত ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ উল্লেখ করা যেতে পারে।

সাধারণ পঞ্জিকার তুলনায় এই ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ পার্থক্য ছিল এই যে, এখানে শুধু গ্রহ-তিথির আসা-যাওয়ার সংবাদই থাকত না, স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া হতো। গীতার সদুপদেশ কে-ই বা শুনে বা মনে রাখে, কেননা তার বক্তব্য বেশ জটিল। পঞ্জিকাকে যদি ‘স্বাস্থ্য-গীতা’ করে তোলা যায়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ বৃহত্তর (শিক্ষিত) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সেসব স্বাস্থ্য-পরামর্শের মধ্যে দুটি ধারা ছিল। একটি হচ্ছে, বিদেশি বিশেষত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা; অপরটি হচ্ছে দেশীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রশংসা। বিদেশি চিকিৎসার পদ্ধতি এ দেশে অচল, কেননা বিদেশি জীবনচর্চার ধরন এ দেশের জল-হাওয়ার সাথে মিলবে না। এ দেশের মানুষের শরীরের উন্নতির জন্য চাই এর সংস্কৃতি-ধর্ম-পরিবেশের উপযোগী স্বাস্থ্য-জ্ঞান। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সমর্থকরা যেভাবে টীকা দিয়ে বা সুঁই ফুটিয়ে রোগ নিরাময় করতে চাচ্ছে, এটা আপামর জনগণের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাদের রক্ষা করার জন্য আছে এ দেশেরই শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র। এই অভিমত স্পষ্টতই ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের তত্ত্বকে এরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন- প্রায় ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’ বলে ভেবেছেন- এক প্রকার ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার ও বায়ো-পাওয়ার ধারণার থেকে এই প্রতিরোধের ডিসকোর্স একেবারেই আলাদা। একে নিছক আধুনিকতার’ সাথে ‘প্রাক্‌-আধুনিকতার’ দ্বন্দ্ব, বা ‘প্রগতিপন্থা’ আর ‘রক্ষণশীলতার’ মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল করা হবে। এই দ্বন্দ্ব তৈরিই হতো না, বা হলেও এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না, যদি উনিশ-বিশ শতকে এ দেশের মহামারি বা মারির উদ্ভব মোকাবিলায় ইংরেজ সরকার প্রকৃত অর্থেই জনগণের স্বাস্থ্য-পরিস্থিতি বা জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতেন।

এ ক্ষেত্রে আমি মো. উমর মুশতাকের ‘পাবলিক হেলথ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া : এ ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব দ্য হিস্টরি অন মেডিকেল স্টাডিসেস অ্যান্ড ডিজিজ প্রিভেনশন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধটির সাহায্য নিয়েছি। সবিস্তারে বলি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে ১৮৬৮ সালে বাংলায় একটি পৃথক ‘সিভিল মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ গঠিত হয় এবং ১৮৬৯ সালে একটি ‘পাবলিক হেলথ কমিশনার’-এর পদ সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই বিভাগ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। কেবলমাত্র ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সাংবিধানিক সংস্কারের পরেই সুস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ বিভাগের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৮০ সালে পৌরসভা এলাকায় এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বাসরত সকল শিশুদের জন্য টীকাদান বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এর প্রয়োগ সীমিত ছিল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮০-৮১ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে টীকাদানের হার ছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ; ১৯০২-০৩ সালে তা সামান্য বেড়ে ৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ, উপনিবেশের গ্রামাঞ্চল এই টীকা কার্যক্রমের বাইরে ছিল। অথচ কিছুদিন পর পর মহামারির মুখোমুখি হতে হয়েছে উপনিবেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে। যেমন, প্লেগ হয়েছে ১৮১২ সালে গুজরাটে ও সিন্ধু প্রদেশে (প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছিল এর তাণ্ডবলীলা); হয়েছে ১৮২৮-২৯ সালে পাঞ্জাবে; ১৮৩৬ সালে রাজপুতানায়; ১৮৯৬ সাল থেকে ব্যুবনিক প্লেগ প্রথমে মারাত্মক আকার ধারণ করে বোম্বাই, পুনে, কলকাতা ও করাচির মতো বড় বড় শহরে এবং পরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে যায়। এক হিসাবে, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্লেগের কারণে মারা যায় প্রায় ২০ লাখ লোক। এবার আসি কলেরার প্রসঙ্গে। ১৮১৭-২১ সালজুড়ে মহামারি হিসেবে কলেরা বাংলা থেকে শুরু হয়ে এক সময় সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর জন্য দায়ী করা হয় ট্রপিক্যাল দেশের জন-হাওয়াকে এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে দলবেঁধে মেলা উদযাপন, ধর্মীয় উৎসব পালন, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি ‘সাংস্কৃতিক উপাদানকে’। ১৮৬৮ সালে এসে কলেরা মহামারির কারণ খতিয়ে দেখতে সর্বপ্রথম ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি করে

ঔপনিবেশিক সরকার। কলেরা রোধে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা এ নিয়েও কমিটির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৮৬২ সাল থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে, পাঞ্জাবে, বাংলায় কলেরা প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিয়েছিল। একই কথা খাটে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে। তবে এ ক্ষেত্রে ১৮৮১ সালের পর থেকে কিছুটা ‘ব্রেক-থ্রু’ হয়। সেটা ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসেসের অধীনে সদ্য যোগ দেওয়া সার্জেন্ট মেজর রোনাল্ড রসের গবেষণার কারণে। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় এনোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট ছড়ানোর চক্র তিনি আবিস্কার করেছিলেন (এর জন্য ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান)। কুইনাইনের বড়ি চালু হওয়ার পরও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ চলতেই থাকে। তার একটি বড় কারণ হলো মশার বিস্তার রোধে ব্যর্থতা এবং ‘ড্রেইনেজ সিস্টেমের’ শোচনীয় পরিস্থিতি। এত সাতকাহন সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ হলো, উনিশ-বিশ শতকে (স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত) কি জনস্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে, কি বিভিন্ন মহামারির বিস্তাররোধে তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়নি উপনিবেশের পটভূমিতে। ঔপনিবেশিক সরকারের কাছ থেকে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা কেবল পেয়েছে এ দেশের জনগণ, কোনো ‘বায়ো-পাওয়ার’-এর অভিজ্ঞতা মেলেনি তাদের। সন্দেহ কী, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা-পদ্ধতি ও পাশ্চাত্যের প্রচার করা ‘জনস্বাস্থ্যের’ ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরূপ ও প্রতিরোধী মনোভাব এখানে গড়ে উঠবে। সেকালের পঞ্জিকা ঘাটলে এ রকম প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তকে শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের ‘পাঁজিতে স্বাস্থ্যচর্চা’ প্রবন্ধের ওপরে (গৌতম ভদ্র সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত) আমি নির্ভর করেছি।

মহামারির মুখে পড়ে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জয়গান গাওয়া হয়েছে এভাবে :

‘যুগে যুগে সামাজিক রাষ্ট্রীয় আকার,

কিছু কিছু রূপান্তর হয় বটে তার।

অবিকৃত কিন্তু স্বাস্থ্য-বিধি সনাতন;

হাসিমুখে বলিয়াছি সে সব বচন,

চরক, সুশ্রুত, অত্রী, হায়ীত, নারদ,

মনু, পরাশর আদি লিখেছে বিশদ,

আয়ু রক্ষণের কত মহামূল্য কথা!

ঘটে দুঃখ সে সবার করিলে অন্যথা।’

যেটা বিস্ময়কর, মহামারির কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে সনাতন ধর্মের পতন এবং ক্রমবর্ধমান অনৈতিকতাকে। অবশ্য পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জীবাণু তত্ত্বেরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অগ্রাধিকার স্বীকার করেই। ধর্মের পতন এবং নৈতিকতার স্খলন যে-স্বাস্থ্যহানির জন্য দায়ী তাতে স্বাস্থ্য-গীতার লেখকদের মনে কোনো সন্দেহ নেই:

‘বিরুদ্ধ ভোজন আর অহিত ভোজন,

অসাধু আলাপ, বৃথা কালের যাপন;

পুস্করিণীতে শৌচত্যাগ, ঘরে থুথু ফেলা,

বাসিমুখে পানাহার, নিদ্রা সন্ধ্যা বেলা,

অবৈধ সঙ্গম আদি বদভ্যাস হয়;-

জানিবে শাস্ত্রীয় বাক্য মিথ্যা ইহা নয়।’

পাশ্চাত্যের জীবাণু-তত্ত্বের সাথে মেশানো হয়েছে প্রাচ্যের আয়ুর্বেদশাস্ত্র। এসেছে মহামারি প্রতিরোধের প্রসঙ্গ :

‘এইবার বলি কিছু জীবাণু-জীবন;

বিবিধ রোগের যারা প্রধান কারণ।

আয়ুর্বেদে ইহাদেরই সূক্ষ্ণ কৃমি নাম,

এদেরই মারণ-মন্ত্র দেছে যজু: সাম।

যত কিছু সংক্রামক প্রাণহারী ব্যাধি,

এই সূক্ষ্ণ জীবদান সে সবার আদি।

বিসূচিকা, ক্ষয়কাস, ম্যালেরিয়া আর,

দাঁতের গোড়ার রোগ, ধনুষ্টংকার,

তালু-ক্ষত, বাতশ্নেষ্ফ্মা, আর কালাজ্বর,

আমাশয় আদি জন্মে জীবাণু-ভিতর।

চর্ম্মচক্ষে ইহাদের দেখা নাহি যায়;

নিতে হয় অণুবীক্ষ্য-যন্ত্রের সহায়।’

দেখা যাচ্ছে, ১৯২৬ সালের এই পঞ্জিকাটিতে যে ধরনের ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’ প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে যেমন আছে সনাতনী রক্ষণশীলতা, তেমনি আছে আধুনিক বিজ্ঞানকে স্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গি। আয়ুর্বেদ এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মধ্যে একটা সংশ্নেষণ করে ভারতীয় ধারার একটা আধুনিকতা সৃষ্টিরও চেষ্টা পাই এতে। এই ‘স্বাস্থ্যধর্ম গৃহ পঞ্জিকা’ বের করেছিলেন কার্তিক চন্দ্র বসু- তিনি নিজে পাশ্চাত্য ডাক্তারি বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন এবং ১৮৯৯ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুবিখ্যাত বেঙ্গল কেমিক্যালসে যোগ দেন। একপর্যায়ে রোগ নিরূপণ ও ভেষজ ওষুধ তৈরি করার জন্য নিজেই শুরু করেন ‘বোসেজ ল্যাবরেটরি।’ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে ভেষজ তত্ত্বের মিল ঘটিয়ে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এভাবেই মহামারি স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিল।

তবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদের সাথে শহরের এবং গ্রামের নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রতিদিনের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামের মধ্যে যখন তারা মারি বা মহামারিতে আক্রান্ত হতেন, তখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল দূরের ঈশ্বর যাকে তারা নানা দেব-দেবীর বিগ্রহ মূর্তিতে পূজা করত। এই ঐতিহ্য পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। কুশান যুগে যক্ষ-দেবী হারিতি (ঐধৎরঃর)-এর পূজা করা হতো – ইনি তুষ্ট থাকলে সকল আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করতেন। এর মধ্যে ছিল গুটি-বসন্ত, উচ্চহারে শিশু-মৃত্যু, জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃ-মৃত্যু প্রভৃতি। কথিত আছে, পরে তিনি বুদ্ধদেবের শিষ্যা হয়ে বৌদ্ধ দেবী হয়ে ওঠেন। কনিস্ক সাম্রাজ্যে গুটি-বসন্তের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বৌদ্ধ -স্তুপার ভেতরে হারিতিকে উৎসর্গ করা বিগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়। হারিতি দেবীর ক্ষমতা ছিল জ্বরের উচ্চমাত্রাকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার- এর ফলে যে কোন জ্বরকে শীতল করার দেবী হিসেবেও তাকে দেখা হয়। পরবর্তীতে এই হারিতি দেবীই বাংলায় এসে হয়ে ওঠেন লোক-দেবী শীতলা-নামের ভেতরেই তার ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে। ‘শীতল করে দিতে পারেন’ সব জ্বরকে, এবং এভাবেই তিনি সারিয়ে তোলেন জ্বরের রোগীকে। শুধু গুটিবসন্ত নয়, সকল জ্বরের উপশমের দেবী হচ্ছেন এই শীতলা দেবী। অন্ত্যজ শ্রেণীর নাপিত, মুচি, কামার, কুমোর, চর্মকার প্রভৃতি পেশাবর্গের মধ্যে (সাধারণভাবে দক্ষিণবঙ্গের কৃষক শ্রেণীর ভেতরে) শীতলা দেবীকে জাগ্রত দেবী হিসেবে সাড়ম্বরে পূজা করা হয়ে থাকে এখনো। লোক-কল্পনায় কোন অজ্ঞাত কারণে শীতলা দেবীর বাহন হচ্ছে গাধা-হয়তো ভারবাহী প্রাণীকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়েছে বাহন রূপে। গুটিবসন্ত ও হামের দেবী যেমন শীতলা, তেমনি কলেরার দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ওলাই চন্ডী (হিন্দুদের মধ্যে) এবং ওলা বিবি (মুসলমানদের মধ্যে)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক রালফ নিকোলাস মনে করেন যে, বাংলায় লোক-দেবী হিসেবে মনসা ও শীতলা উভয় দেবীরই পূজা বলেও শীতলাই খানিকটা এগিয়ে আছেন। অন্য কিছু চর্চায়, সর্পদেবী মনসা ও ষষ্ঠীর সাথে শীতলা দেবীকে অভিন্ত জ্ঞান করা হয়েছে। বোম্বাইয়ের পূর্ব-কথিত ১৮৯৯ সালের প্লেগের সময়ে এক ‘প্লেগমাতার’ আবির্ভাব হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’, কিন্তু তার পূজা হতো শীতলা মন্দিরে। এ নিয়ে ও.ঔ.ঈধঃধহধপয তার ‘ প্লেগ এন্ড দ্যা ইন্ডিয়ান ভিলেজ : ১৮১৬-১৯১৪’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তবে শীতলা দেবীর নাম প্রদেশ-ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তামিলনাড়ূতে বসন্ত রোগের দেবীর নাম মারি আম্মা, দক্ষিণ আরকটে তার নাম কান্নি আম্মা। নাম যা-ই হোক, এই সকল লোকদেবীর পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্য একটাই- জনস্বাস্থ্য- সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মহামারি থেকে রক্ষা করা।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো- ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে।’ এভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন, সামার রিসোর্ট ইত্যাদি। এক কথায়, প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর হলো, ঔপনিবেশিক আমলের জনস্বাস্থ্য নীতি ছিল বৈষম্যমূলক এবং সেখানে জনগণের কোনো স্থান ছিল না। এটি ছিল মূলত এলিটদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য নীতি। জনগণ পেত তার নিজস্ব বিশ্বাসে-চর্চায় ঘেরা এক সংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাৎপদ স্বাস্থ্য খাত, আর এলিটরা পেত সেকালের মানদণ্ডে আধুনিক ও উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা।
এই দ্বৈত খাতবিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য চিন্তা উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্রেও পরিলক্ষিত হয়। এ দেশে তাই দেখতে পাচ্ছি যে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা’ গড়ে ওঠেনি, যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই নূ্যনতম এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন নির্ভরযোগ্যভাবে। কেন গড়ে ওঠেনি তার একটা কারণ বোধ করি এই যে, এলিটরা ভেবেছিলেন তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য ‘জনস্বাস্থ্য’ জাতীয় কোনো ব্যবস্থার আদৌ দরকার নেই। সে রকম বিপদ এলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা লাভ করা যাবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর তো এমন কিছু দূরত্বে অবস্থান করছে না! কিন্তু এখন করোনাকালের লকডাউনের কারণে তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ। এখন বুঝি তারা বুঝতে পারছে, আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশের ভেতরেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বর্তমানের মহামারি-সংকট তো নয়ই, ভবিষ্যতের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিও মোকাবিলা করা যাবে না। কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে আদৌ আশাবাদী নই। বিল গেটসের মতো আমিও মনে করি, পরিবর্তন আসে তবেই যদি মনে থাকে। কিন্তু মানুষের স্মৃতি খুবই স্বল্পায়ু।
৫. মহামারির প্রভাব : রাষ্ট্রে-দর্শনে
প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারির প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়েছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। এই প্রভাব যেমন পড়েছে সমাজে-রাষ্ট্রে, তেমনি সাহিত্যে-দর্শনে। সামগ্রিকভাবে মানবজীবনের ইতিহাসে। অতীত আলোচনার একটি তাৎপর্য ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তার সুবিখ্যাত ‘রেকুইম ফর এ নান’ উপন্যাসের একটি উক্তি অনেকটা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে- The past is never dead. It’s not even past| এবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ব্যক্তি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেছিলেন এ কথা জানতে চেয়ে, কেন তাদের রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে বাধ্য করছে? স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে তাদের কি মুক্ত থাকার অধিকার নেই? এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফিরে যেতে হলো অতীতে- ১৮৯৭ সালের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্যাক্ট’কে সাক্ষী মানতে হলো। মমতা বললেন, ‘যাতে কেউই আরোগ্য লাভ না করে কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যেতে না পারে- জনগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে- [১৮৯৭ সালের] আইন পুনরুজ্জীবিত করা হলো।’
অতীত যদিও নবায়িত হয়ে ফিরে আসে পুনরায়, অবস্থাভেদে তার প্রত্যাবর্তনের ‘ইমপ্যাক্ট’ হয় বিভিন্ন রকম। মহামারির অভিঘাত বিভিন্ন সমাজে ও কালে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে এসেছে। মহামারি প্রতিরোধে ইউরোপের চিন্তার বিবর্তন উঠে এসেছে মিশেল ফুকোর লেখায়। লন্ডনের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’ (যা ছিল ব্যুবনিক প্লেগ)-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে লন্ডন শহরে ১৬৬৫ সালে। এতে শহরটির ১৫ শতাংশ নাগরিকই মৃত্যুবরণ করেন। এই প্লেগে আরও অনেক বেশি লোকের মৃত্যু হতে পারত, কিন্তু অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে পারে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং রাজা (দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্ব তখন) তার সভাসদসহ অক্সফোর্ডে পালিয়ে যান। আজকে যেখানে অলগেট (Aldgate)- যেখানে এখন অধিকাংশ বাঙালি ও অভিবাসী বাস করেন- সেই এলাকাটিকে প্লেগে নিহতদের গণকবর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন। এ রকমই আরেকটি গণকবর ক্ষেত্র ছিল ফিনস্‌বিউরি ফিল্ডস্‌। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল জনতার প্রতিক্রিয়া। যে বাড়িতে কোনো প্লেগের রোগী পাওয়া যেত সেই বাড়িকে বাইরের থেকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হতো। এতে করে ওই খানার অন্যান্য সদস্যেরও মৃত্যু হতো- প্লেগে অথবা অনাহারে! ঠিক পরের বছরে (১৬৬৬ সালে) লন্ডনে অগ্নিকাণ্ডে তার পুরো কেন্দ্রস্থলই ভস্মীভূত হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, এই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল প্লেগবাহী ইঁদুরেরা। এই প্লেগ হওয়ার প্রায় ৬০ বছর পরে রবিনসন ক্রুসোর লেখক ড্যানিয়েল ড্যাফো লেখেন ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’। ড্যাফো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, কিন্তু এমনভাবে লিখেছেন বিবরণী যেন তিনি ঘটনা-পরম্পরার সামনেই অবস্থান করেছিলেন।
১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ আর ১৬৬৫ সালের ‘গ্রেট প্লেগ’ দুটিই ছিল প্লেগের মহামারি। এই অভিজ্ঞতা থেকে দুটো সুস্পষ্ট প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা রাষ্ট্রকে স্বৈরাচারী ক্ষমতা-প্রয়োগের পরিবর্তে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power)  বা জনজীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা আচরণভিত্তিক ক্ষমতা-প্রয়োগের দিকে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন আসত না যদি-না প্লেগের মতো মহামারি হতো। এই মহামারির সুবাদে রাষ্ট্র বাধ্য করে নাগরিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলতে। নাগরিকদের সমন্ত জীবনচর্চা তখন থেকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ মডেলে আবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে বশীভূত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যস্ততায়। উদ্ভাবিত হয় জবরদস্তিমূলক কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকার’ (বা সেলফ আইসোলেশন) অভ্যাস। করোনারকালেও এখন আমরা এদেশে বা বিশ্বজুড়েই ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের প্রয়োগ দেখছি। বিদেশফেরত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবর্গ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বলেছেন যে তাদেরকে এয়ারপোর্টে ‘১৪ দিনের’ সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে এবং সেটি তারা এখন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। করোনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রেরও একটি নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর বলয়। প্রতিদিন রোগতত্ত্ব বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য-বুলেটিন পড়ে শোনাচ্ছে টিভিতে এবং নাগরিকরা তা শুনে তাদের প্রাত্যহিকের জীবনযাপনে স্বাস্থবিধি মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন- অন্তত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায়। কোয়ারেন্টাইন বা সেলফ্‌ কোয়ারেন্টাইনে থাকছে সংক্রমিত খানাসমূহ (ব্যক্তি বা পরিবার), কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সমগ্র পাড়া বা গোটা এলাকাই। এভাবেই শৃঙ্খলাবদ্ধ নাগরিকে পরিণত হচ্ছি আমরা- হয়তো ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন বা সিঙ্গাপুরের মতো অতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নই এখনও- কিন্তু গতিমুখটা সেদিকেই। একটা চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞানকে অবলম্বন করে এই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে রাষ্ট্র। এটি খারাপ না ভালো- সে বিবেচনায় ফুকো যাননি। তিনি শুধু দেখিয়েছেন কীভাবে ডেসপট বা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন করার পরিবর্তে অন্য ধরনের বিশেষায়িত ‘ক্ষমতারও’ উদ্ভব হয় এবং রাষ্ট্র তার প্রজাকুলের ওপরে প্রভুত্ব করার জন্য একটি বাড়তি হাতিয়ার পেয়ে যায়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে প্লেগ নামক মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রচলিত দমনমূলক যন্ত্রগুলোর পাশাপাশি এই অদৃষ্টপূর্ব শৃঙ্খলাপরায়ণ অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজের উদ্ভব হয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দীপেশ চক্রবর্তী ও অন্যদের সূত্র ধরে উপনিবেশিক পটভূমিতে মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে আমরা ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এরই প্রয়োগ দেখেছি। যার ভিত্তি ছিল কোয়ারেন্টাইন মডেল এবং শ্বেতাঙ্গদের জন্য ‘বিচ্ছিন্ন থাকার’ ক্যান্টনমেন্ট মডেল- যা নেটিভদের কাছ থেকে উপনিবেশের অফিসার-সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
তবে ১৮২৬-৩৭ সালের একের পর এক বিধ্বংসী কলেরা মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খোদ ইংল্যান্ডেই এই কোয়ারেন্টাইন ও সেলফ আইসোলেশনভিত্তিক ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর মডেল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই মহামারিকে ‘এশিয়াটিক কলেরা প্যানডেমিক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় যেহেতু এটার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বঙ্গদেশে। বাংলায় এই মহামারির শুরু ১৮১৭-২৪ কালপর্বে; ধীরে ধীরে তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের জন্য হয়তো কার্যকর ছিল, কিন্তু কলেরা কোয়ারেন্টাইন মানে না। এর জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আরও সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির। ঠিক এ রকম সন্ধিক্ষণে জন্ম নিল আরেক অদৃষ্টপূর্ব অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজ- যার ভিত্তি হলো ‘বায়ো-পাওয়ার’  (Bio-Power)। এর মানে এই নয় যে আগের শৃঙ্খলাপরায়ণতাভিত্তিক ক্ষমতার প্রয়োগ বা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার রাষ্ট্র-ক্ষমতার বলয় থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষা না করে আর কাজ চালানো যাচ্ছিল না। কলেরা, বসন্ত, হাম, যক্ষ্ণা প্রভৃতি রোগের ঘন ঘন প্রাদুর্ভাব রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল Bio-Power-র কথা ভাবতে। ১৮৩০-র দশকে চার্টিস্টদের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল শ্রমিকদের বাসস্থানের সমস্যা- তাদের জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা ছিল কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারির প্রজনন ক্ষেত্র। শ্রমিকদের অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে তরুণ মার্কস লিখেছেন সে সময়ে ‘দ্য হাউসিং প্রবলেমস্‌’, আর তরুণ অ্যাংগেলস্‌ লিখেছেন ‘কন্ডিশনস্‌ অব ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’। এক কথায়,  Disciplinary Power স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র হেজিমনি হারাল নতুন পরিস্থিতিতে। তবে এর প্রয়োগ যথারীতি চলতে থাকল জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত কল-কারখানায়, জেলখানায় এবং বিদ্যানিকেতনে (ফুকো সে সম্পর্কে আলাদা করে লিখেছেন তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে)।
১৮৯৭ সালের ঔপনিবেশিক ভারতের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্য্যাক্ট’ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারকে তুলে ধরেছে। প্লেগে সংক্রমিত হলে সরকারি পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে বেঁধে হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছে সেখানে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় পুরোটাজুড়েই এই জোর করে ‘বিচ্ছিন্ন রাখার’ নীতিই কার্যকর ছিল। আমরা আগেই দেখেছি, প্রকৃত অর্থে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি, বা উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির বহুল প্রসার করার দিকে অগ্রসর হয়নি উপনিবেশের সরকার। সেটা হলে আমরা ঔপনিবেশিক বায়ো-পাওয়ারকে বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখতে পেতাম। ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিসেস অ্যাক্ট যখন প্রণীত হচ্ছে, তার পরের বছরেই কলকাতায় প্লেগের আক্রমণ হবে, আর ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে লেগে যাবে প্লেগ নিয়ে দাঙ্গা। অর্থাৎ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের ‘ডিসিপ্লিন’ উপনিবেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) গ্রন্থে ভূদেব এ নিয়ে ইতিপূর্বেই কড়া অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, ভারতবর্ষে ৬০ বছর ও তার ওপরে বয়স্ক লোকের সংখ্যা (১৮৮১ সালের আদমশুমাুরি অনুযায়ী) মাত্র ৪ শতাংশ। এর কারণ, এখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, এবং অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দুর্ভিক্ষে অথবা কিছুদিন পর পর ঘটে যাওয়া মারি-মহামারিতে ভারতবর্ষের মানুষ অকালেই মারা যাচ্ছে। ভূদেব অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘অনূ্যন পাঁচ কোটি ভারতবাসী অর্ধাশনে জীবনযাপন করে… এক প্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগারো বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাহার পরেই একটি করিয়া মহামারি আসিয়া উপস্থিত হয়।’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। প্রায় একই সময়ে লেখা ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কেন ‘চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু’ লিখেছেন তার কারণটি বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
ফুকোর ভাষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে মহামারি রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন ও ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। রানী ভিক্টোরিয়া উনিশ শতকে লন্ডন শহরে পয়ঃনিস্কাশন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এভাবেই সেখানে গড়ে ওঠে আন্ডারগ্রাউন্ড স্যুয়ারেজ সিস্টেম (যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে জার্মান বিমান হামলার সময় রাত্রিকালীন ‘শেল্টার’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল)। এই যে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলো মহামারি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য তাকেই ফুকো বলেছেন ইরড়-চড়বিৎ। উপনিবেশের দেশগুলো এই ইরড়-চড়বিৎ-এর সুবিধাটুকু পায়নি।
[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

মহামারি প্রতিরোধ :ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভূমিকা
উপরের সব প্রশ্নের এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির কয়েকটি দিকের প্রতি সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জন্য ‘জনস্বাস্থ্যের’ বিষয়টি ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। বাণিজ্য করতে এসে বঙ্গদেশে তিনটি গ্রাম নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন তার কাজ-কর্ম শুরু করে তখনও ‘জনস্বাস্থ্য’ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হারানোর পর বাংলায় (এবং বাংলাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য প্রদেশ) অবাধ উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ এলো কোম্পানির সামনে প্রথম বারের মতো। আরো বেশি বেশি করে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিল। কোম্পানি শাসনের অংশ হিসেবে দাঁড় করাতে হলো এক নতুন আমলাতন্ত্রের। এ জন্য অনেক শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী বিলেত থেকে এলেন; তা ছাড়া ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা তো ছিলেনই, যারা নতুন উপনিবেশে এসে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই ঔপনির্বেশিক কর্মযজ্ঞের পথে প্রধান বাধা হয়ে দঁড়িয়েছিল এদেশের আলো-হাওয়া। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘শরীর, সম্পদ ও রাষ্ট্র :ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জন সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, জনস্বাস্থ্যের মূল নিহিত ছিল ‘একটি নিতান্তই সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনীতিক প্রশ্নে : শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কি গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়তে পারবেন?’ এই প্রয়োজন মেটাতেই ১৭৬৮ সালে প্রকাশিত হয় জে. লিন্ড রচিত বই- এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেটস। এর কয়েক বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিকেল সার্ভিস চালু হয় ১৭৬৪ সালে। সে সময়কার ‘রুলিং আইডিয়া’ ছিল- গরম দেশগুলোর আবহাওয়া শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্য আখেরে অস্বাস্থ্যকর। ফলে সেখানে তাদের দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব চালানো কঠিন। এই থিওরির ভিত্তি ছিল- ‘মায়াস্‌মা’ বা পূতিবাষ্প তত্ত্ব। মায়াস্‌মা বা অশুভ হাওয়া-তত্ত্বের জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর ইউরোপে, যখন ‘কালো মৃত্যু’র (Black Death) করাল-গ্রাসে ইউরোপের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৩৪৬-৪৮ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে প্লেগের কারণে এই মৃত্যু ঘটে। এর আগেও প্লেগ এসেছিল ইউরোপে, কিন্তু সেবার চীন থেকে প্লেগের যে স্ট্রেইনটি আসে তা লণ্ডভণ্ড করে দেয় ইউরোপের সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির সবকিছু। সে সময়ের বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার মান আজকের মতো ছিল না। সে জন্যই অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, প্লেগ ও কলেরার মতো রোগগুলি পচনশীল দেহ (মানুষ বা প্রাণী) থেকে বাতাসে ছড়ায় এবং একবার সেই ‘খারাপ বাতাস’ গায়ে লাগলে মানুষ তাতে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ১৮৬০ সালে যখন ‘জীবাণু-তত্ত্ব’ আবিস্কৃত হলো তখন জন্ম হলো এক নতুন শাস্ত্রের, যার নাম ট্রপিক্যাল মেডিসিন। পচনশীল শরীর এবং হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এই শরীর-নির্গত অশুভ বাষ্পকণা- এর বিপরীতে পরবর্তীকালে এসেছিল জীবাণু-তত্ত্ব অর্থাৎ প্লেগ, কলেরা, বসন্ত প্রতিটি রোগের পেছনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ জীবাণুর ক্রিয়াশীলতা। প্রতিটি মারি, মহামারি বা গুরুতর ব্যাধির মূলে আসলে কাজ করছে ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু। এই তত্ত্ব আবিস্কারের ফলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল- অন্তত স্বাস্থ্যগত দিক থেকে। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৮ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি এখন স্থির নিশ্চিত যে, শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনা করা সম্ভব।’ কিন্তু এ কথা তো বলা হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ-জয়ের প্রায় দেড়শ’ বছর পরে। ১৮ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এবং প্রায় উনিশ শতকজুড়ে তাহলে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটিকে সামাল দেওয়া হয়েছিল কী করে? নাকি জনস্বাস্থ্য বলতে সে রকম কিছু ছিলই না তখন?
সমসাময়িক নানা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে কোম্পানির সৈন্যদের মহামারি থেকে রক্ষা করাই ছিল জনস্বাস্থ্যের মূল মনোযোগের বিষয়। ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে ইউরোপীয় সৈন্য ও অফিসারদের মধ্যে মৃত্যুর ৯৪ শতাংশই ছিল নানাবিধ অসুখের কারণে। এর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া জাতীয় জ্বর, কলেরা, রক্ত-আমাশা, উদরাময় প্রভৃতি অসুখ। এসব অসুখ থেকে বাঁচার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় ছিল উপনিবেশের প্রজাদের বাসস্থানের পরিবেশের উন্নতি ও উন্নত স্বাস্থ্যবিধির প্রবর্তন (যথা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিস্কাশন, যেখানে সেখানে থুতু-কফ না ফেলা, স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার অভ্যাস ইত্যাদি)। এটা হলে কিছুদিন পরপর সংক্রামক মারির আশঙ্কা অনেকখানি লুপ্ত হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষে এ-দায়িত্ব পালন করা কঠিন। তার উদ্দেশ্য এখানে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা নয়, বরং অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব মেনে কী করে শোষণের মাত্রা আরো তীব্র করে সম্পদ-পাচার দ্রুত গতিতে নিষ্পন্ন করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা। আইনের প্রয়োগের সূত্রে বলা হলেও এর বৃহত্তর তাৎপর্য রয়ে গেছে। উনিশ শতকের মানদণ্ড অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের যেসব রীতি ইংল্যান্ডে প্রয়োগ করা হয়েছে, পরাধীন ভারতবর্ষে তা একেবারেই অনুসৃত হয়নি। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হয়নি। পার্থ চ্যাটার্জী একেই বলেছিলেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। উনিশ শতকজুড়েই বাংলাদেশের গ্রাম ছিল একটি উপেক্ষিত বিষয়- বিশেষত জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (১৮৮২) গ্রন্থটির কোন কোন অংশে রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর না করে ‘পরিবার’কে সক্রিয় করতে চাওয়া হয়েছে এই কারণেই। মমার্থ এই যে, ঔপনিবেশিক রাজশক্তির কাছে জনস্বাস্থ্য-রক্ষা কর্মসূচি প্রত্যাশা করে লাভ নেই। ভারতবাসীকে বাঁচাতে হলে পারিবারিক পর্যায়েই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, নতুবা কলেরা-বসন্তে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ভূদেবের গ্রন্থের পঞ্চদশ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পরিচ্ছন্নতা’। সেখানে বিবরণটি এই রকম :
‘দেহ এবং গৃহস্থিত সমুদয় সামগ্রী সুবিশুদ্ধ এবং সুপরিস্কৃৃত রাখিবার অবশ্যকর্ত্তব্যতাও শাস্ত্রে যথোচিত পরিমাণে উল্লিখিত আছে। গৃহের এবং গৃহস্থিত দ্রব্যের যথোচিত বিলেপন ও সন্মার্জ্জনাদি, স্নান, ভোজন, আচমন, বস্ত্রাদির পরিবর্ত্তন প্রভৃতি ব্যাপার আমাদিগের অবশ্যকরণীয় প্রাত্যহিক কার্য্যের মধ্যেই নির্দিষ্ট। বিশেষত :গৃহস্থের বাটীতে দেববিগ্রহ ও ঠাকুরঘর রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া সচল গৃহস্থেরই শুচিতার এবং পরিচ্ছন্নতার এক একটি আদর্শ পাইবার উপায় করা হইয়াছে। ঠাকুরঘর যেভাবে রাখ, আজকের সকল ঘর সেইভাবে রাখিলেই হইল। বস্তুত :শুচিতাপ্রিয় য়িহুদীদিগের মধ্যে সংক্রামক রোগ অল্প হয়। তাহার কারণ এই যে, গৃহে এবং গৃহোপকরণ সমস্ত অতি সুপরিস্কৃৃত করিয়া রাখিবার নিমিত্ত উহাদিগের ধর্মশাস্ত্রে আদেশ আছে, এবং য়িহুদীরা আপনাদের শাস্ত্রের আদেশ সমস্ত ভক্তিপূর্বক প্রতিপালন করে।’
তবে ভূদেব এটাও লক্ষ্য করেছেন- অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় উন্নতি ঘটানো একান্তভাবেই কঠিন। ‘পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকিতে সকলেই চায়- উহা ধর্ম্ম্য, স্বাস্থ্যকর এবং সাক্ষাৎ সুখপ্রদ। কিন্তু এ কথাও বলি, পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাধ্য ব্যাপার; লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হওয়া সম্যক ঘটিয়া উঠে না।’ অবশ্য যদি রাষ্ট্রতরফে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ব্যাপক জন-সচেতনা কার্যক্রম পরিচালিত হত বা আধুনিক যুগের ন্যায় স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, আবর্জনা পয়ঃনিস্কাশন প্রণালী, সুপেয় ও নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হত, তাহলে গরীবরাও পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রমে সমান তালে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে এটা আশা করা সম্ভব ছিল না।
১৯১২ সালে এদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম পাবলিক হেলথ্‌ ডাইরেক্টরেট-এর প্রতিষ্ঠা হয়। কলেরা, বসন্ত, প্লেগ জাতীয় মহামারিতে অনেক সেনা সদস্যের মৃত্যু এই প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে। অবশ্য এতে করে জনগণের স্বাস্থ্যে কোন গুণগত পরিবর্তন আসেনি। এদেশের জনসাধারণকে মারি বা মহামারি মোকাবিলায় মূলত নিজের চেষ্টার ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছে। পাবলিক হেলথ্‌ ডিপার্টমেন্ট ‘স্বাস্থ্যবিধি’ লিখে প্রচার করেনি। তাই ভূদেবের মতো প্রাচীনপন্থি পণ্ডিতকে ‘রোগীর সেবা’ করার বিধান লিখতে হয়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভূদেবকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে :
‘গৃহস্বামী সকলকে সতর্ক করিয়া দিবেন, যেন পীড়িতের বিছানা, বালিস, বস্ত্রাদি বাটীর অপর কাহার বস্ত্রাদির সহিত না মিশে-তাহার মল, মূত্র, ক্লেদাদি বাটী হইতে অধিক দূরে নিক্ষিপ্ত এবং পরিস্কৃৃত হয়- তাহার ব্যবহূত পাত্রাদি বাটীর সাধারণ পাত্রাদি হইতে স্বতন্ত্র থাকে- এবং সেবকেরা যতদূর পারেন, যে কাপড়ে … ঘরে থাকেন, সে কাপড় না ছাড়িয়া বাটীর অপর লোকের …ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না আইসেন।’ এ যেন হাল আমলের করোনার কালের ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বিধিমালা তৈরি করছেন ভূদেব মুখ্যোপাধ্যায়।
তবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একেবারেই এদেশীয় জনগণের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিরুত্তাপ ছিল, তা নয়। রাষ্ট্রের নিস্পৃহ হওয়ার উপায় ছিল না যখন কোন সামাজিক বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বড় আকারের সমাবেশ করার আশংকা তৈরি করত। বিশেষত, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে, এই সচেতনতা আরো তীক্ষষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেসব স্থানে প্রচুর জনসমাবেশ হতো, ঔপনিবেশিক সরকার সেসব স্থানের ওপরে কড়া নজরদারি রাখতেন। সাব-অলটার্ন হিস্টোরিয়ান ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ সরকার হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, এলাহাবাদের প্রয়োগের মেলা, পুরীর জগন্নাথধাম, অল্প্রব্দপ্রদেশের তিরুপতি, তামিলদেশের কাঞ্চিপুরম, মহারাষ্ট্রের নাসিক প্রভৃতি ধর্মীয় মেলা ও তীর্থস্থানে বড় ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি দেখতেন। এসব উৎসব এলেই তারা ‘নার্ভাস’ বোধ করতেন। গণহারে যেহেতু তখন প্রতিষেধক ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না- সময়টাকে মোটা দাগে ‘প্রি-ভ্যাকসিনেশন যুগ’ বলতে পারি- উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া ঔপনিবেশিক সরকারের বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দল বেঁধে তীর্থযাত্রা, গঙ্গায় স্নান, ঈদের বড় জমায়েত ইত্যাদি সামাজিক প্রথায় হাত দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিরতই থাকতে হয় রাষ্ট্রপক্ষকে। বিশেষত ১৮৯৯ সালের প্লেগ দমনের একটা পর্যায়ে বোম্বাই ও অন্যান্য শহরে যখন দাঙ্গা বেধে যায়, তার পরে আর রাষ্ট্রশক্তি জনজীবনে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেনি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনযাত্রায় উদ্ধুদ্ধ করা নয় (যা ছিল ভূদেব, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের উদ্দেশ্য)। বরং নিজেদেরকেই মহামারি বা মারির ‘অশুভ হাওয়া’ থেকে রক্ষা করা। এলক্ষ্যেই ইংরেজ সৈন্য, অফিসার ও রাজকর্মচারীরা যেখানে থাকতেন, সেগুলোকে ‘মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট’-এর আদলে শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি শহরে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় ইংরেজদের চলা-ফেরা, রাস্তা-ঘাট, বাসস্থান, ক্লাব, খেলার মাঠের জন্য স্বতন্ত্র এলাকা, যার সংস্পর্শে আসার কোন সুযোগ ছিল না ‘নেটিভদের’। ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো – ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে…ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা।
[ক্রমশ]

মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল

এ সময়ই পদ্মা বোট থেকে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় প্লেগ ত খুব জেগে উঠচে। আপনার বুঝি স্থানত্যাগ করতে সম্মত নন?’

এ প্রসংগে নিবেদিতার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিবেকানন্দের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস মার্গারেট নোবল আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। বিবেকানন্দ ওর নাম দেন- ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় পা রাখলেন, তখন চতুর্দিকে প্লেগের পদধ্বনি। ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গাও হয়। কলকাতা তথা বঙ্গদেশেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। ‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ :এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ বইতে দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষে অমানুষিক সেবাকাজ চালিয়ে কলকাতায় ফিরে নিবেদিতা ম্যালেরিয়া ও “ব্রেন ফিভারে” [সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া অথবা এন্‌কেফেলাইটিস] শয্যাশায়ী।’ সেসময় মানে ১৯০৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লিখেছিলেন- ‘নিবেদিতা যে আপনার ওখানে পীড়িত অবস্থায় তাহা আমি জানিতাম না – আমি একখানা বই চাহিয়া তাঁহাকে কলিকাতার ঠিকানায় কয়েকদিন হইল পত্র লিখিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া এমন ব্যবস্থা করিবেন যে, পত্রের যেন তিনি কোন নোটিস না লন। তাঁহাকে আমার সাদর নমস্কার জানাইবেন এবং বলিবেন যে, উৎসুক চিত্তে তাঁহার আরোগ্য প্রত্যাশায় রহিলাম।’ নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ। সুহৃদ জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমে নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোটে অতিথি হয়েও গিয়েছিলেন তিনি, পূর্ববঙ্গের কৃষকদের অন্তঃপুরে গিয়ে আপনজনের মত করে গ্রামের মা-বোনদের সাথে কথা বলেছেন। গেছেন অনেকবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও। এই যাওয়ার পেছনে ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের পরিবারকুলের একাংশকে বিবেকানন্দ-নিবেদিতার সংঘ-কার্যক্রমে “দলে ভেড়ানোর” ইচ্ছেও তার থাকা অসম্ভব ছিল না। সরলা দেবীকে তো প্রায় দলে টেনেই নিয়েছিলেন। এ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের সাথে মনোমালিন্য হতে পারে তার। তার ছোট মেয়েকে (মীরা?) ইংরেজি শেখানোর জন্য অনুরোধ নিবেদিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেটাও একটা কারণ হতে পারে। নিবেদিতার প্রত্যাখ্যান ছিল তীক্ষষ্ট, এমনকি রূঢ়:’সে কি! ঠাকুরবংশের মেয়েকে একটি বিলাতী খুকি বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে!’ শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য-বিমুগ্ধতার প্রতি কটাক্ষ করে আইরীশ নিবেদিতা বললেন :”ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফোটবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?” এই অসংকোচে মত রাখার প্রবণতা নিবেদিতার মধ্যে ছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথে জাগতিক আধ্যাত্মিক মত ও পথ নিয়ে মাঝেমাঝেই তুমুল তর্ক বেঁধে যেত। তার সবটুকু আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু জেনেছি যে (সাহিত্যিক বনফুলের স্মৃতিচারণার সুবাদে), ‘গোরা’ উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিতে নিবেদিতাই পীড়াপিড়ি করেছিলেন এবং এর ফলে উপন্যাসের বিয়োগান্ত পরিণতি একটি ইতিবাচক সমাপ্তিতে শেষ হয়। বনফুল লিখেছেন :

“[গোরার ] শেষটা বদল দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। নিবেদিতা নাছোড় হয়ে ধরে বসল। আবার ঢেলে সাজালাম সব।”

“গোরার শেষটা অন্যরকম ছিল?”

“হ্যাঁ। আমি গল্পটা বিয়োগান্ত করেছিলাম।…গল্পটা ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীতে বেরুচ্ছিল। কিন্তু ওটা আগেই লেখা হয়েছিল আমার। নিবেদিতা তখন বলল- গোরার শেষটা কী রকম করেছেন দেখি। দেখালাম। পড়েই সে বলে উঠল- না না, এ রকম হতে পারে না। ওদের মিলন না হলে বড়ই নিদারুণ ব্যাপার হবে যে। বাস্তব জগতে যা ঘটে না কাব্যের জগতেও কবি সেটা ঘটিয়ে দেবেন না? কাব্যের ও জগৎ তো আপনার সৃষ্টি, ওখানে আপনি অত নিষ্ঠুর হবেন না। ওদের মিলন ঘটিয়ে দিন। দিতেই হবে। এমন জেদ করতে লাগলে যে রাজি হতে হলো। সবটা আবার ঢেলে সাজালাম।” গোরা উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন তা আর কারো জন্য তিনি কখনো করেননি। এর একটি কারণ হতে পারে, দেশব্রতী গোরার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন নিবেদিতারই কাছ থেকে। শিল্পী নন্দলাল বসু স্মৃতিচারণা করেছেন পদ্মায় বোটে করে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও নিবেদিতার আলাপচারিতা সম্পর্কে :’তাহাদের আলোচনার বিষয় আমি কিছু জানি না। তবে শুনেছি, ‘গোরা’ উপন্যাসের hero গোরা সিস্টারকে মনে করে করেছিলেন।’ আমার ধারণা, নিবেদিতার আদর্শ-রূপ তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৮৯৮ সালে কলকাতার প্লেগের সময়ে। ভয়-ভ্রুক্ষেপহীনভাবে নিবেদিতা তখন প্রকৃতই আর্তের ‘ভগিনী’ হয়ে প্লেগের মত মহামারীর কালে বিপন্নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই তেজোদৃপ্ত মূর্তি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ এবং সন্ন্যাসিনীর মত ত্যাগী পথচলা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মত ছিল না।

প্লেগের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে সেসময়ই। এর আগে প্লেগ সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা, ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করা, আর্তজনের পাশে দাঁড়ানো তার এই প্রথম এবং তা সিস্টার নিবেদিতার সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। এ সম্পর্কে প্রথমে শুনব এডওয়ার্ড টমসনের (বিখ্যাত ইংরেজ বামপন্থী দার্শনিক ই, পি, টমসনের পিতা) ভাষ্যে। টমসন লিখেছেন : ‘That year [1998] plague broke out in Calcutta; she [Sister Nivedita] organized relief work, assisted by Tagore’ । দ্বিতীয় উৎস শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণা :’সেইসময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।’ পরের বছরে, অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে প্লেগ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছিল কলকাতায়। প্লেগের টিকা দিতে জনগণের একাংশের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা ছিল। যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, সেখানে বিদেশী শাসকের টিকা নিয়ে শেষটায় ‘জাত খোয়াতে হবে নাকি’, এই অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। ‘ঈধষপঁঃঃধ ঘড়ঃবং নু ধহ ঊহমষরংয খধফু’ শীর্ষক রচনায় নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন যে, কয়েকটি পরিবার, বিশেষত ঠাকুর পরিবার দৃঢ়তার সহিত এই বিক্ষোভ প্রশমন করিতে চাহিয়াছেন’। ১৯০৯-এ গোরা প্রকাশের দু’বছরের মাথাতেই নিবেদিতার মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির চমকপ্রদ অনুবাদ নিবেদিতারই করা (তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়)। তিনিই রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম অনুবাদিকা। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু- রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার নাম দিয়েছিলেন- লোকমাতা।

আমি বলতে চাইছি যে, মহামারীর ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো, গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস। মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় তার ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায় (স্বদেশী সমাজ, লোকহিত প্রভৃতি প্রবন্ধে), এমনকি তার এই সময়কার দেশাত্মবোধক গানের বিচ্ছিন্ন চরণে। রোগক্লিষ্ট আর্তমানবতার বেদনাকে অনন্ত শক্তির বোধে রূপান্তরের জন্যই রচিত হয় তার নৈবেদ্য ও গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও সংগীত। মারী ও মহামারী তার সৃষ্টিশীলতাকে মানবতাবাদের দিকে প্রভাবিত করেছে।

এই মানবতাবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জগমোহন চরিত্র। তিনি আস্তিক বা নাস্তিক সে পরিচয় গৌণ। তার পরিচয় তিনি প্লেগের দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি। এক-অর্থে, নাস্তিক জগমোহন আস্তিক নিবেদিতার কাউন্টার-পয়েন্ট। সেই ১৮৯৮ সালে- যে বছরে কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল- নিবেদিতাও রাস্তায় নেমেছিলেন, জগমোহনও রাস্তায় নেমেছিলেন। নিবেদিতা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু জগমোহন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিবরণটা এই :

‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তক্‌মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তাঁর প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেইসঙ্গে তাঁরও গুষ্টিসুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত। ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, কালনায় গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, যদি-

জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?

কাদের?

ঐ-যে চামারদের।’

একথা শুনে হরিমোহন তার ছেলে শচীশকে বললেন তার সাথে গঙ্গার ধারের বাড়িতে চলে যেতে।

[ক্রমশ]

সাম্প্রতিকের তর্ক ও বিতর্ক

পর্ব ::৪৭

১. তর্কটা কী নিয়ে?

এই লেখাটি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্রের পিছু-হটার উদ্বেগজনক পরিণতি নিয়ে। এই প্রতিপাদ্যটি কিছু তাত্ত্বিক মীমাংসা, কিছু সাম্প্রতিক বইয়ের আলোচনা, কিছু কেস-স্টাডি, কিছু পরিসংখ্যানগত তথ্য-উপাত্ত ও কিছু অনুমান দিয়ে নানাভাবে বলার চেষ্টা হয়েছে (বলা দরকার এ লেখাটির একটি আদি রূপ এর আগে ‘সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশ হয়ে ছিল)। অবশ্য গণতন্ত্রের পিছু-হটাকে প্রমাণ করার জন্য আরও তত্ত্ব ও তথ্যের কাঠখড় পোড়াতে হবে। সেটা স্বীকার করে নিয়েই নির্দিষ্ট করে তিনটি কথা বলতে চেয়েছি।

প্রথমত, গণতন্ত্র ‘পিছু হটছে’ (যাকে Democratic Recession বা Backsliding বলেছেন স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যারি ডায়মন্ড)। এই পিছু-হটা কেবল নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়, বা নির্দিষ্ট কিছু মাথাপিছু আয়ের গ্রুপে সীমিত নেই। এটা যেমন ঘটছে ‘প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে’ (যেখানে অনেক দশক ধরে গণতন্ত্র বিরাজ করছে, যেমন ইউরোপ-আমেরিকার ‘উন্নত জীবনযাত্রার’ দেশগুলোয়), তেমনি ঘটছে ‘দুর্বল গণতন্ত্রে’ (যেখানে দুই বা বড় জোর তিন দশক ধরে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, যেমন অধিকাংশ ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোয়)। প্রতিষ্ঠিত ও দুর্বল গণতন্ত্রের মাঝামাঝি স্তরে রয়েছে পূর্ব ইউরোপের তুলনামূলকভাবে (তৃতীয় বিশ্বের তুলনায়) বেশি শিক্ষা-দীক্ষার কিন্তু মাঝারি-আয়ের দেশগুলো। যারা স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে নতুন রাজনৈতিক কাঠামোয় বিকশিত হতে শুরু করেছে। এসব দেশের সদ্য-বিকশিত গণতন্ত্র এর মধ্যে পিছু হটতে শুরু করেছে কম-বেশি। এই তিন ধারার দেশই পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথে রয়েছে, যদিও পুঁজিবাদের চর্চায় এরা নানা স্তরে অবস্থান করছে। এর অর্থ হলো যে, পুঁজিবাদ সত্ত্বেও গণতন্ত্র পিছু হটছে। বুর্জোয়াদের শাসনে বুর্জোয়া গণতন্ত্র আর নিরাপদে থাকছে না।

দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের পিছু-হটা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হলেও বিভিন্ন দেশে পিছু-হটার কারণ একরূপ নয়। তবে উপসর্গ বা কারণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও অন্তত এটুকু স্পষ্ট যে, পিছু-হটার পেছনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়া বা কমার কোনো যোগসূত্র নেই। গত দুই দশক ধরেই পিছু-হটার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল নানা দেশে। উঁচু আয়, নিচু আয়, দ্রুত প্রবৃদ্ধি, শ্নথ প্রবৃদ্ধি- সব রকমের ‘কনটেক্সটে’ গণতন্ত্রের পিছু-হটা দেখতে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, বলতে চাচ্ছি যে, এখানে অর্থনৈতিক ‘ডিটারমিনিজমের’ কোনো সুযোগ নেই। ভাবাদর্শ বা মতাদর্শ, ‘পাওয়ার অব আইডিয়া’; গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া; আত্মসত্তার রাজনীতি; রাষ্ট্রের কোন কোন দিকের ক্রম-বিলীয়মান ভূমিকা, আবার কোন কোন দিকের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা; এক কথায়, রাষ্ট্র ও পুরসমাজের (State-Civil Society) মধ্যকার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস, অনেক কিছুই হয়তো এই গণতন্ত্রের পিছু-হটার ওপরে প্রভাব রাখছে। আমি এ লেখায় সেসব সম্ভাব্য প্রভাবকের তেমন কোনো বিশ্নেষণ করতে যাইনি। আমি শুধু দেখাতে চেয়েছি যে, খরঢ়ংবঃ-কথিত আশাবাদের কোনো সুযোগ নেই এখানে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় নিম্ন-আয়ের থেকে মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক উন্নয়ন হবে তথা সবলতর গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটবে, এ রকম যুক্তির পেছনে কোনো তথ্যগত ভিত্তি সেভাবে নেই। উন্নয়নের ধারায় একসময়ে অপেক্ষাকৃত সুশাসনের স্তরে (বা সুশাসিত রাষ্ট্রের দিকে) যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু অনিবার্যভাবে আরও গণতন্ত্রের দিকে উত্তরণ সম্ভব, সে রকম কোনো প্রবণতা এখানে কাজ করছে না। এ রকম কোনো গ্যারান্টিও তত্ত্বে বা তথ্যে নেই :প্রগতির রথের ঘোড়া সামনেও যেতে পারে, পেছনেও যেতে পারে। অমর্ত্য সেন যাকে বলেছেন, ‘Government by Discussion’ সেই গণতন্ত্র অনেক জিডিপি আহরণের পরও দূর নক্ষত্রের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। সন্দেহ কী, কিছুটা ভিন্ন-অর্থে দার্শনিক জাঁক দেরিদাও বলবেন- সেই গণতন্ত্র ভূ-ভারতে কেন, এই ভূলোকেও প্রায় কোথাও নেই, এবং কোনো লাগসই শিরোনাম না পেয়ে এর নাম দেবেন ‘Democracy-to-come’!

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ এই বিশ্বজোড়া গণতন্ত্রের সামগ্রিক পিছু-হটার বা Democratic Recession-এর বাইরে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এই পিছু-হটার মধ্যেও ‘প্রগতিশীল উপাদানগুলোকে’ শনাক্ত করা বা তাদের পক্ষে সমর্থন জোরালো করা সম্ভব। বাংলাদেশ কি রুয়ান্ডার মতো হবে, নাকি ঘানার মতো হবে? তুরস্ক নাকি তিউনিশিয়ার মতো হবে? ইন্দোনেশিয়ার নাকি থাইল্যান্ডের মতো অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে? ইকুয়েডর নাকি ভেনেজুয়েলাকে অনুসরণ করবে? চিলি নাকি আর্জেন্টিনার মতো হবে? স্লোভেনিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রের মতো হবে, নাকি হবে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো? এই দেশগুলো ‘লিবারেল ডেমোক্রেসি’ ও ‘ইলেকটরাল ডেমোক্রেসি’ যে কোনো নিরিখেই পিছু হটেছে গণতন্ত্রের সূচকে, কিন্তু এদের মধ্যে রাজনৈতিক উন্নয়নের স্তরে কী বিপুল পার্থক্য! এই Choice-এর অবকাশ তো বাংলাদেশের জন্য এখনও রয়ে গেছে। এদিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাও প্রবন্ধটির একটি উদ্দেশ্য।

লেখাটি ৫টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়ে প্রারম্ভিক যুক্তি ও বক্তব্য উপস্থাপনার পরে দ্বিতীয় অধ্যায়ে গণতন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে এথেনিয়ান ডেমোক্রেসির যুগের ক্ল্যাসিক চিন্তাবিদদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমি বলার চেষ্টা করছি যে, ইলেকটরাল ডেমোক্রেসির বাইরে গিয়ে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। যদি নির্বাচনী গণতন্ত্রে কোনো দেশ ভালো ‘স্কোর’ করেও থাকে, কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদারনৈতিক চর্চা ও মূল্যবোধ ‘লিবারেল ডেমোক্রেসির’ নিরিখে উত্তরোত্তর ‘রক্ষণশীল’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হতে থাকে, তাহলে সে দেশটিতে গণতন্ত্রের সংকট দানা বাঁধতে বাধ্য। অর্থনীতিবিদ ডানি রডরিকের পথ ধরে আমি বলার চেষ্টা করছি যে, ‘লিবারেল ডেমোক্রেসিই’ শ্রেষ্ঠতর, এবং সমাজে ‘লিবারেল আইডিয়া’-এর ভূমিকা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ অধ্যায়ে বেশকিছু তথ্য ও উপাত্ত জড়ো করা হয়েছে দেশে দেশে গণতন্ত্রের পিছু-হটা সম্পর্কে। এটি হচ্ছে এই লেখার মূল ‘ইমপিরিক্যাল’ অংশ। পঞ্চম অধ্যায়ে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রের পিছু-হটার সামগ্রিক প্রবণতার মধ্যে আদৌ কতটুকু কী করা সম্ভব- উন্নয়নের ফলাফলকে আরও জনকল্যাণমুখী করার ক্ষেত্রে- সে বিষয়ে কিছুটা জল্পনা থাকছে।

২. গ্রিক দেবী ডেমোক্রেটিয়া

গণতন্ত্রের দেবীর নাম গ্রিকরা দিয়েছিল ‘ডেমোক্রেটিয়া’। এথোনিয়ান দেব-দেবীর মধ্যে তার অবস্থান মধ্যম সারিতে। সবার ওপরেও নয়, সবার নিচেও নয়। প্রায় ষাট বছর আগে ‘ইন ডিফেন্স অব পলিটিক্স’ বইতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বানার্ড ক্রিক এই দেবীকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে : ‘She is everybody’s mistress and yet somehow retains her magic even when a lover sees that her favours are being, in his light, illicity shared by many another.’ গণতন্ত্রের দেবী সবারই উপপত্নী, এবং প্রত্যেকেই তার আবেদনময়ী আচরণে মোহমুগ্ধ কথাটা নির্দয় শোনায়। কিন্তু লন্ডনের সুবিখ্যাত বার্কবেক কলেজের (যেখানে দার্শনিক জিজেক অধ্যাপনা করেন) অধ্যাপক ক্রিক সাহেব বিনা কারণে কথাটা উচ্চারণ করেননি। প্রত্যেকেই এই দেবীর কাছে প্রসাদ চেয়েছেন যার যার মতো করে, আর প্রত্যেকেই কিছু না-কিছু পেয়ে প্রীত হয়েছেন এমনই সহৃদয়া ডেমোক্রেটিয়া দেবী। সেই থেকে বিশেষণের কমতি নেই। এথেনিয়ান ডেমোক্রেসি, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র, ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি, লিবারেল ডেমোক্রেসি, রিপ্রেজেন্টেটিভ ডেমোক্রেসি, ইললিবারেল ডেমোক্রেসি, র‌্যাডিকেল ডেমোক্রেসি, ‘ডেমোক্রেসি-টু-কাম’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ডাকা হয়েছে তাকে। এই নামকরণের ইতিহাস ও ট্যাক্সোনমি একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে।

যে নামে দেবীকে ডাকা হচ্ছে, সেই স্বরূপেই তার ভক্তরা তাকে দেখতে চান। অন্য কোনো নামে বা অভিব্যক্তিতে তাকে দেখতে চান না তারা। রূপে-রসে-গন্ধে এসব নামকরণ এতটাই পৃথক যে, এদের মধ্যে প্রায় ভাব-বিনিময় চলে না। একটা উদাহরণ দিই। একসময় মার্কসবাদীরা বলতেন, গণতন্ত্র বলতে যার ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে সেটা আদৌ ‘প্রকৃত’ গণতন্ত্র নয়; সেটা হচ্ছে আসলে ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্র। কথাটা মার্কসও তার নানা লেখায় ব্যবহার করেছেন। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ বিদায় নিলেন। এই বিপ্লব গভীরতর সমাজ-পরিবর্তন আনল না যদিও, কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকারের একটা বার্তা ইউরোপে ছড়িয়ে দিল। বার্তাটি পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির। বলা দরকার, ফরাসি বিপ্লবের সময়ে উচ্চারিত ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি’ শ্নোগানের মধ্যে যে ইকুয়ালিটি তা হচ্ছে পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটি নিয়ে। পরবর্তীতে মার্কস সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের যে অর্থনৈতিক ইকুয়ালিটির কথা তুলবেন এটা তার থেকে আলাদা। মার্কস ও এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ম্যানিফ্যাস্টোর পাতায় পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির পাশাপাশি ইকোনমিক ইকুয়ালিটির কথা বলেছিলেন। প্রথম ধারণাটি, তার চোখে, নিতান্তই সংকীর্ণ ধারণা; অর্থনৈতিক সমতা ছাড়া রাজনৈতিক সমতা অর্থহীন। সেই থেকে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুত পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটিকে মার্কসের অনুসারীরা ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলে জেনে এসেছেন। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বামধারার চিন্তাবিদেরা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেও ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে দেখবেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দার্শনিকেরা (থিওডর এডোর্নো বা ম্যাক্স হর্কহেইমার) বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে কীভাবে অ-গণতন্ত্রের তথা স্বৈরতন্ত্রের বিষবৃক্ষ বড় হচ্ছে তা বড় আকারে দেখালেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কাছে ঋণ ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তেমনভাবে স্বীকার করেননি। তার পরও বলতে হয় ফুকোর গণতন্ত্রবিরোধী ধারণা জার্মান দার্শনিকদের কাছ থেকেই পাওয়া। গণতন্ত্র-এর ধারণাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন ফুকো, যা প্রায় মার্কসের রক্ষণশীলতাকেও ছাড়িয়ে যায়। পুরো উদ্ধৃতিটি তাই তুলে দিচ্ছি :

‘If one understands by democracy the effective exercise of power by a population which is neither divided nor hierarchically ordered in classes, it is quite clear that we are very far from democracy. It is only too clear that we are living under a regime of a dictatorship of class, of a power of class which imposes itself by violence, even when the instruments of this violence are institutional and constitutional; and to that degree, there isn’t any question of democracy for us.’

নোয়াম চমস্কির সঙ্গে বিতর্কে ফুকো এ কথা বলেছিলেন ১৯৭১ সালে- তার মৃত্যুর ১৩ বছর আগে। তাহলে উনিশ শতকের মার্কসের তুলনায় বিশ শতকের সত্তর দশকেও এসে দেখা যাচ্ছে উন্নত দেশের গণতন্ত্রে খুব একটা ‘ইতিবাচক কিছ’ু অর্জিত হয়নি! ফুকোর শব্দ ব্যবহারটিও দেখুন : সত্তর দশকেও তিনি দেখছেন উন্নত আধুনিক গণতন্ত্রের পেছনে ধনিক শ্রেণির ক্ষমতার দাপট- ‘ডিক্টেটরশিপ অব ক্লাস’।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৬

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সাহিত্যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক রূপায়ণের ক্ষেত্রে এক আধুনিক বোধের জন্ম দিয়েছিল। সমালোচকেরা এদের মধ্যকার সম্পর্ককে কী নামে ডাকবেন, সেটা বুঝি এখনও পুরোপুরি স্থির করতে পারেননি। কেউ একে বলেছেন- গভীর দার্শনিক ও আত্মিক যোগাযোগ; কেউ বলেছেন ‘প্লাতোনিক প্রেম’; কেউ বা সন্দেহ করেছেন- এর চেয়ে আরও বেশি কিছুর। আমি এই শেষোক্ত দলে পড়ি। আঁদ্রে জিদ ভিক্টোরিয়ার প্রগাঢ় জ্ঞানচর্চার পরিধি দেখে বলেছিলেন- ‘ওকাম্পো যেন নিজেই এক পুরাণ গ্রন্থ।’ মান রে’র (Man Ray) মতো শিল্পী যার পোর্ট্রেট ছবি তুলেছেন; যিনি লাতিন আমেরিকার নবধারার সাহিত্য-আন্দোলনের পথিকৃৎ ‘Sur’ পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক; একজন পুরোধা নারীবাদী; তুখোড় সাহিত্য-সমালোচক; বোর্হেসের মতো সাহিত্যিকের সঙ্গে যার রয়েছে দীর্ঘ কথোপকথনের অনন্য দলিল; একজন বহু ভাষাভাষী সুন্দরী ও বিদূষী (রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলের সব আধুনিকা নারীদের চেয়ে যিনি আধুনিকতমা ও জ্ঞানে-রুচিতে প্রাগ্রসরা) এবং সর্বোপরি বিশ্বস্ত ও মমতাময়ী- তার প্রতি নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের আকৃষ্ট না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না সেদিন। পরবর্তী দিনগুলোয় এই আকর্ষণ গভীর আস্থার, বন্ধুত্বের ও ভালোবাসার সম্পর্কে পরিণত হয়েছে (এটা কোন ধরনের প্রেম বা প্রেম হয়ে থাকলে তার সামনে সতর্ক ‘এপিথেট’ বসানোর কষ্টকর চেষ্টা কিছুটা হাস্যকরও ঠেকে) চিত্রকর্মে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ সেই তরুণ বয়স থেকেই। লেখার ফাঁকে ফাঁকেই তিনি বিরতিহীনভাবে মুখ, মুখোশ, জীবজন্তু, পৌরাণিক বা অবচেতন মনের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এমন কিছু আঁকছেন বা আঁকিবুঁকি করে আসছেন। এটা একসময় নেশায় পেয়ে বসে কবিকে। ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ নিজের ভেতরে একদিন হঠাৎই আবিস্কার করলেন স্ব-অস্তিত্বে ও স্ব-মহিমায় বিশ্বাসী এক চিত্রশিল্পীর :’ছবির নেশার আমার কাব্যের উপর কিছু উৎপাত বাধিয়েচে। অধিক বয়সে তরুণী ভার্য্যায় মানুষকে অভিভূত করে এমন একটা প্রবাদ আছে। আমার প্রাচীনাটি এই তরুণীটির সঙ্গে পেরে উঠচে না।’ ওকাম্পোর লেখায় সেই নেশার আদি-মুহূর্তের বিবরণ রয়েছে। ওকাম্পো লিখেছেন (গণেশ পাইনের সুবাদে সে তথ্য তুলে দিচ্ছি)-

‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকত, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন …লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্র জুড়ে দিয়ে তার উপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকেই বেরিয়ে আসত সব রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। …এই ছোট খাতাটিই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’ পরবর্তীকালে দেশে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিজয়াকে লিখেছিলেন, ‘তুলি দিয়ে আমি ছবি আঁকব না, যে কলম দিয়ে কথার কাব্য লিখি, সেই কলমে রং এবং রেখার কাব্য লিখতে পারি কিনা, তারই একটা পরীক্ষা চালাতে চাই।’

এককথায়, রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার উন্মেষ-পর্বের সাক্ষী ছিলেন বিজয়া। যখন সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রকর’ হয়ে উঠলেন, তখন এই বিজয়াই সমস্ত সহায়সম্বল নিয়ে এগিয়ে এলেন। আর্জেন্টিনায় যে দু’মাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া সব খরচ চালিয়ে ছিলেন ওকাম্পো। এজন্যে তাকে তার মহা মূল্যবান হিরের আংটিটি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। ১৯৩০ সালে প্যারিসে কবির চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য শুধু সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে ছুটে আসাই নয়, তাকে অনেক অর্থ-ব্যয়ও করতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এই মর্মে :’ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, তাহলে ছবি ভালোই হোক মন্দই হোক কারও চোখে পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল, ঘর পেলে ছবির প্রদর্শনী আপনি ঘটে- অত্যন্ত ভুল। …ভিক্তোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে। এখানকার গুণীজ্ঞানীদের ও জানে- ডাক দিলেই তারা আসে।’ ওকাম্পো ‘ডাক দিলেই’ প্যারিসের এলিট বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা ‘ছুটে আসে’- এই একটি কথার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন বিজয়ার আকর্ষণী বিদূষী সত্ত্বাকে।

প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২ মে। ১২৬টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল তাতে। এর সমস্ত আয়োজন/ ব্যবস্থা করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। শুধু রবীন্দ্রনাথের ডাকেই এটা করেছিলেন তিনি। অন্য কোনো কারণে আসেননি। আর্জেন্টিনা থেকে শুধু একটা প্রদর্শনী আয়োজন করার জন্যই তিনি সেবার প্যারিসে এসেছিলেন। ওটা অ্যারোপ্লেন-যুগের আগের কথা, এ কথাও মনে রাখতে হবে। একে যদি আমরা গাঢ় প্রেমের চিহ্ন হিসেবে না দেখি, তাহলে ‘প্রেম’ কাকে বলব? রবীন্দ্রনাথ প্যারিস ছেড়ে যান ১১ মে। প্যারিসের গ্যার দ্যু পর্দ রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শেষবারের মতো তার দেখা হয়েছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে। এর ঠিক চার মাসের মাথায় রবীন্দ্রনাথ (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩০) যাবেন বিপ্লব-উত্তর রাশিয়া দেখতে। ভিক্টোরিয়া ফিরে যাবেন বুয়েনস এয়ার্সে। কিন্তু অপ্রত্যক্ষে থেকেও দু’জনের মধ্যে পত্রালাপ ও মৌনালাপ আমৃত্যু চলতেই থাকবে। দু’তরফ থেকেই দেখা এর সম্পূর্ণ চিত্র অবশ্য এখনও আমরা পাইনি।

কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে আফ্রিকা, পলিনেশিয়া, ওশেনিয়া, লাতিন আমেরিকার আজটেক, মায়া, ইনকা, বৃহত্তর অর্থে তৃতীয় বিশ্বের আদিবাসী সংস্কৃতির প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছিল, ‘আধুনিকতার’ পেছনে ‘অনাধুনিকের’ একটি বড় ধরনের অবদান রয়ে গেছে। এটা চেঁচিয়ে চলা দরকার। এই ‘অবদান’ যেমন পাই পাশ্চাত্যের সেজান-পরবর্তী পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট ও বিমূর্ত চিত্রকলায়, তেমনি পাই এই ভূভাগের বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায়। শিল্প-সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামী সঠিকভাবেই এর কুললক্ষণ শনাক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো হচ্ছে, ‘genuine examples of modern primitive art.’ পক্ষান্তরে, ইউরোপের প্রিমিটিভ আর্টের আধুনিক অনুসারীরা বরং ‘More calculated primitivisms, archaisms, and pseudo-barbarisms’-র নিদর্শনই তুলে ধরেছেন। কথাটায় হয়তো অতিশয়োক্তি রয়েছে। পিকাসো, মাতিস, মদিলিয়ানি, নোল্‌দে, ক্লি, ক্রিশ্‌নের বা মিরো প্রিমিটিভিজমের সিরিয়াস চর্চাই করেছেন এবং আধুনিক শিল্পকলায় নবধারার বিপ্লবের সূচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের কাজের গুরুত্বকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি কোনো ভুল বা ‘বিভ্রান্তিকর’ (কথাটা ডাইসন-অধিকারীর) ব্যাখ্যা দিয়ে যাননি। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক প্রিমিটিভ ‘ছবির রবীন্দ্রনাথ’ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার ‘ফর্মাল’ অনুশীলন না করেই কী করে আঁকার জগতে প্রবেশ করতে পারলেন? এর উত্তর কিছুটা মেলে শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কথায় :’আমাদের দেশে মডার্ন যে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে, সেটা গুরুদেবই করছেন। একটা লোকের ভেতরে যদি চরম সেন্স অব রিজন, মিউজিক, কালার থাকে তার অ্যাকাডেমিক ট্রেনিং দরকার হয় না।’ তবে প্রথাগত অনুশীলন না থাকলেও ইউরোপের সর্বাধুনিক চিত্রকলার প্রতিলিপি তিনি সংগ্রহ করে দেখতেন; রোদ্যাঁর সাথে তিনি দেখা করেছেন, কান্ডিনস্কি ও বাউহাউস স্কুলের প্রদর্শনী স্বচক্ষে দেখেছেন; Kathe Kollwitz-র মতো শিল্পীরা তার সাথে দেখা করেছেন এবং তার সাথে ছবির ভাবনার বিনিময় করেছেন। পঞ্চাশে নোবেল-প্রাপ্তির পরে সত্তরে তার চিত্রকর্মই ছিল রবীন্দ্রনাথের- তার ভাষাতেই বলছি- ‘শেষ কীর্ত্তি’। এই সৃষ্টিসম্ভারকে তার নিজের দেশে অনেকেই বুঝতে পারেনি সে সময়ে; বিদেশেও অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। যেমন, আমেরিকায়, যেখানে তখন পর্যন্ত কিউবিস্ট বা এক্সপ্রেশনিস্ট আর্ট সমাদৃত হতে শুরু করেনি। আমেরিকায় ছবির রাজ্যে বিপ্লব ঘটবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে। তখন জ্যাকসন পোলককে কেন্দ্র করে বেরিয়ে আসবে একঝাঁক নতুন প্রজন্মের শিল্পী- জন্ম হবে আর্টের আরেক নবধারা, যার নাম দেওয়া হবে ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম’। সর্বাধুনিক রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা হয়তো বুঝতে পেরেছিল ফ্রান্স, কিছুটা পরিমাণে জার্মানি ও রাশিয়া (হ্যাঁ, মালেভিচ-লিসিৎস্কি-শাগাল-ওসিপা জাদকিনের রাশিয়া)। আমেরিকা তখনও ইউরোপের তুলনায় শিল্পকলার রুচিতে অনেক পিছিয়ে। কবি পল ভ্যালেরি প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী দেখে বলেছিলেন, ‘ইওর পিকচার্স উইল বি অ্যা লেসন টু আওয়ার আর্টিস্টস্‌’। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার ছবিতে যাদের অনীহা, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিরুদ্ধতার কারণে নয়, নিতান্তই ‘চিত্রদর্শনের অভিজ্ঞতার’ অভাবের কারণে। আর সে কারণেই বলতে পেরেছিলেন যে, ‘সে জন্য এ দেশে আমাদের রচনা অনেকদিন পর্যন্ত অপরিচিত থাকবে।’ হয়তো ‘আমার মৃত্যুর পর ওর (রবীন্দ্রনাথের ছবির) আবরণ মোচন করো- তখন ওর মূল্য হবে ঐতিহাসিক দিক থেকে।’ উপমহাদেশের আধুনিকতম চিত্রকলার একজন পুরোধা শিল্পী গণেশ পাইন রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে বলেছেন, তার ছবি এতই একক ও স্বয়ম্ভু, এ দিয়ে ‘কোনো ঘরানা আপাতত তৈরি করা যায়নি।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘কেউ যদি তার ছবি দেখে বলতেন সুন্দর হয়েছে, তৎক্ষণাৎ সেই ছবির উপর কালি ঢেলে দিতেন তিনি এবং সেই অন্ধকারের মধ্যেই সন্ধান করতেন তার ‘সুন্দর’-এর।’ ঠিক প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের নাম-না-জানা অগণিত শিল্পীর মতো। নিজেকে তিনি কখনও কখনও বলেছেন এক ‘আজগুবি ছবি-আঁকিয়ে’ বলে। কিন্তু আমরা তো এখন বুঝতে পারি ধারাবাহিকভাবে খাপছাড়া ও আজগুবি ছবি এঁকে যাওয়া কত কঠিন। অবনীন্দ্রনাথ এদিকটি বুঝতে হয়তো ভুলই করেছেন। নইলে তিনি রানী চন্দকে বলবেন কেন- ‘একটা ঢেউ উঠেছে, প্রিমিটিভ, ক্রুড, এই সব আঁকতে হবে। তাতে কী আছে, না, ‘স্ট্রেংথ’ আছে। সেটা ভুল। প্রকৃতিতে তো তা নেই। …একটা জিনিস যখন অসম্পূর্ণ অবস্থায় থাকে, সেটাকেই বলে ক্রুড। …’স্ট্রেংথ’ থাকবে ভিতরে, কিন্তু বাইরে থাকবে সৌন্দর্যের আবরণ।’ ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে গ্রেবো মূর্তির মধ্যে যে ম্যাজিক, যে সম্মোহনের প্রভা দেখেছিলেন পিকাসো, সেটিই আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মে। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী দেখার পর চিত্রকর আঁদ্রে কার্পেলেসের কথায় পিকাসোর বিস্ময়-বিমুগ্ধ অভিজ্ঞতারই অনুরণন পাই। কার্পেলেস প্যারিস-প্রদর্শনীটির ছবিগুলো দেখে রথীন্দ্রনাথকে যা লিখেছিলেন, তা সম্পূর্ণ উদ্ৃব্দতির দাবি করে:

‘They are far beyond what I expected and dreamt ofÑ You are rightÑ RothiÑ It is some thing newÑ uniqueÑ grandÑ Not only will they be a treat for the admirers but they will be the bestÑ long awaited lesson for the western artists. What they have been looking for, struggling for, what they have failed to expressÑ (because abstraction needs genius to find the means of making it tangible) [Tagore] has attained it in one unique flight. His pictures have the freshness, the mysterious strength of the early primitive expressions of art …They are modern bccause they bring the message of something entirely original.’

প্রিমিটিভ কিন্তু মডার্ন, পুরাতনী কিন্তু সাম্প্রতিক- এই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের অর্ধচেতন অবচেতন সচেতন আঁকিবুঁকি থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত স্ব-উদ্ভাবিত চিত্রকলা।

[এই বিষয় সমাপ্ত]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

‘জার্মান এক্সপ্রেশনিজম :প্রিমিটিভিজম অ্যান্ড মডার্নিটি’ বইয়ের লেখক জিল লয়েড এ বিষয়ে লিখেছেন যে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল অজন্তার গুহাচিত্র :
‘Once again a composite notion of the ‘primitive’ emerges, and it is difficult to distinguish between the exotic and ‘Gothic’ stimuli. For example, the characteristic combination of green and purple that Kirchner began to use at this date is usually associated with the colour illustrations of the Ajanta temple paintings he knew from the Dresden library.’

রবীন্দ্রনাথ এই ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘মডার্ন’-এর মধ্যকার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি এই উপমহাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে সর্বপ্রথম অনুভব করেছিলেন। সমালোচকেরা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের নানা ছবির অদ্ভুত জীবজন্তুর সমাবেশ শুধু অন্যমনস্ক আঁকিবুঁকি (doodles) থেকে উৎসারিত হয়নি। উদাহরণত, তার ২২৩২-সংখ্যক ছবিটির সাথে তুলনীয় হয়েছে পল ক্লি-র ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটি। এই বিশেষ ছবিটি যখন ১৯৩০-এ প্যারিসে প্রদর্শিত হয়, তখন ব্যাখ্যা হিসেবে তাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘I have searched out the cave of the primitive/ in my mind/ with its etchings of animals.’ পরে কবি নিজেই দিয়েছেন এর বাংলা তর্জমা :’বিস্মৃত যুগে গুহাবাসীদের মন/ যে ছবি লিখিত ভিত্তির কোণে/ অবসরকালে বিনা প্রয়োজনে/ সেই ছবি আমি আপনার মনে/ করেছি অন্বেষণ।’ রবীন্দ্রনাথের ‘প্রিমিটিভ’ মনের প্রকাশ পাওয়া যায় ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থে তার বিচিত্রবিধ ড্রইং-এর ভেতরেও। কাইয়ুম চৌধুরীও লিখেছেন, “পল ক্লির কলমে করা ড্রইংয়ের ছায়া ‘খাপছাড়া’ ও সে বইয়ের ইলাস্ট্রেশনে দেখতে পাওয়া যায়।”

আগেই বলেছি, চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ যেদিকে পা ফেলেছিলেন তা তার নিজ দেশের সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে বা শিল্পরসিক মহলে তেমন একটা নাড়া দিতে পারেনি। এদিক থেকেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিঃসঙ্গ শিল্পী। বিদেশেও তার বন্ধুদের অনেকেই এই নব্যধারার শিল্পকলার জগতের সাথে সম্যক পরিচিত ছিলেন না। এমনকি রোমাঁ রোলাঁ বা রোটেনস্টাইনের মতো রবি-ঘনিষ্ঠ প্রাচীনপন্থিরা। এখানেও তার নির্জনতা চোখে পড়ার মতো (ব্যতিক্রমদের মধ্যে ছিলেন পল ভালেরি বা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো ব্যক্তিত্বরা- সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি)। তার চিত্রকর্মকে ধৈর্য ধরে বোঝার চেষ্টা ছিল না প্রায় সমসামরিক কারও মধ্যেই- বিশেষত এ দেশে। প্রগতি-কল্লোল-পরিচয় যুগের আধুনিক কবিদের সাথে গদ্যকবিতা ও এলিয়ট নিয়ে তার যা-ও বা এক ধরনের সংলাপ বা বিতর্ক হচ্ছিল, চিত্রকলায় তিনি ছিলেন তার স্বদেশে প্রায় নির্বাসিত। ছবি আঁকাকে নিতান্ত কবির খামখেয়ালিপনা বলে মনে করা হতো। এ নিয়ে তার কিছু ক্ষোভও ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। ১৯২২ সালে কলকাতায় সাম্প্রতিক ইউরোপীয় চিত্রকলার- বিশেষত ‘বাউহাউস’ স্কুলের এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকর্মের যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়- তার প্রধান প্ররোচনা ও উৎসাহ এসেছিল রবীন্দ্রনাথের তরফ থেকেই এ কথা এখন অনায়াসে বলা চলে। এ তথ্যও রয়েছে যে, ‘রবীন্দ্রনাথ নাকি শান্তিনিকেতনে বাউহাউস একটি শাখাও খুলতে চেয়েছিলেন।’ এই কলকাতা প্রদর্শনীর জন্য ‘বাউহাউস কর্তৃপক্ষ’ যেসব ছবি পাঠিয়েছিল তার মধ্যে ছিল অসাধারণ সব নাম :’পল ক্লির নয়টি জলরং, কান্ডিনস্কির চারটি জলরং, ফাইনিঙ্গারের উনিশটি ড্রইং ও ষোলোটি উডকাট, এটেনের তেইশটি ড্রইং, গেরহার্দ মার্কসের বিশটি জলরং, জর্জ ম্যুচের নয়টি এচিং, লোথার স্ট্ক্রেয়ারের সাতটি ছাপাই ছবি, সোফিয়ে কর্নারের দুটি জলরং, মাগ্রিট টেরি এডলারের কিছু কাজ প্রভৃতি।’ সুশোভন অধিকারী আরও জানিয়েছেন যে, ‘স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি পল ক্লি ও কান্ডিনস্কির একটি করে ছবি কিনেছিলেন।’ দুঃখের বিষয়, এ প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বাউহাউস কর্তৃপক্ষ উপরোক্ত কোনো একটি ছবিও ফেরত পায়নি! এমনকি, রবীন্দ্রনাথের ইতোপূর্বে ক্রয় করা ক্লি ও কান্ডিনস্কির ছবি দুটোরও কোনো হদিস মেলেনি। এত সবকিছুর পরও সমসাময়িক উপমহাদেশের চিত্রকলার ওপরে বাউহাউস প্রদর্শনীর প্রভাব খুব সামান্যই পড়েছিল, বা পড়ে থাকলেও তার প্রতিঘাত ভারতীয় চিত্রকলায় সঞ্চারিত হয়েছিল খুবই সন্তর্পণে। এটাও রবীন্দ্রনাথকে বিমর্ষ করে থাকবে। পরের আট বছরে কবি নিজেই যখন সর্বাধুনিক ধরনে ছবি আঁকতে লেগে গেলেন, সেটা নিয়েও উপর-ভাসা মন্তব্য ছাড়া কোনো গভীর সমাদরের আভাস পাই না আমরা। কাকা রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রসঙ্গে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় বলেছিলেন, ‘ওগুলো ছবি নয়, যেন অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎসার।’ এ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবির কোনো মূল্যায়ন বুঝতে পারি না আমরা। গণেশ পাইন বলেছেন, ‘স্বদেশ তার চিত্রাবলীকে তাঁর ঈপ্সিত অভ্যর্থনা দেয়নি।’ এর একটা কারণ হতে পারে, আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের আধুনিক ও সাম্প্রতিক চিত্রকলা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচয় না থাকা। রবীন্দ্রনাথের সেটা ছিল। গণেশ পাইন লিখেছেন, ‘পশ্চিমি নব্য শিল্পের নানা ধারার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ এবং দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল, এ কথা আমরা জানি। …বহুবার গেছেন প্রতীচীর শিল্পতীর্থ পারী নগরীতে …নানা প্রদর্শশালায় দেখেছেন …ইম্প্রেশনিস্ট, পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট, আর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট।’ ১৯২৫-এ সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ লিখতে পেরেছেন, ‘য়ুরোপে আজকাল চিত্রকলার ইতিহাসে একটা বিপ্লব এসেছে। …আধুনিক কলারসজ্ঞ মানুষ বলছেন, আদিকালের মানুষ তার অশিক্ষিত পটুত্বে বিরলরেখায় যে রকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তরভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই।’ অর্থাৎ প্রিমিটিভ আর্টের প্রতারক সরলতার মধ্যে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আধুনিক শিল্পকলার ‘মুক্তি নেই’। এই উপলব্ধি যেমন সাম্প্রতিক শিল্পকলার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিরলরেখার ‘মিনিমালিজমে’ ফিরে তাকানোও সমানভাবে দরকার ছিল।

রবীন্দ্রনাথ হুয়ান মিরোর (Joan Miro) মিনিমালিস্ট ও শিশু সারল্যে ভরা ছবিগুলো দেখেছিলেন কিনা আমরা জানি না। প্যারিসে অবশ্য মিরোর নামাঙ্কিত বাগানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তি পরবর্তীতে স্থাপিত হয়েছে। মিরোর মতই ছবির সেই ‘গোড়াকার ছাঁদের’ দিকে ফিরে যাওয়ার একটা সচেতন চেষ্টা ছিল তার মধ্যে। কিন্তু এর যোগ্য সমাদর মেলেনি তার দৈশিক পরিপার্শ্বের কাছ থেকে। কলকাতায় তার ছবির প্রথম প্রদর্শনী সমসাময়িকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘তিনসঙ্গী’র অভীক চরিত্রটি এ নিয়ে খেদোক্তি করেছে :’আমি যে আর্টিস্ট এ পরিচয়ে তোমাদের একটুও শ্রদ্ধা নেই। এ আমার চিরদুঃখের কথা। আমি নিশ্চিত করে জানি, একদিন সেই রসজ্ঞ দেশের গুণী লোকেরা আমাকে স্বীকার করে নেবে, যাদের স্বীকৃতির খাঁটি মূল্য আছে।’ শুধু উপন্যাসের মাধ্যমে নয়, এ কথা পত্রালাপেও জানিয়েছেন। প্যারিসে চিত্র-প্রদর্শনীর বছরেই কবি নিজেই এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন নির্মলাকুমারী (রানী) মহলানবিশকে। প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও অর্থনীতিবিদ (পরবর্তীতে নেহরুর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ‘আর্কিটেক্ট’) প্রশান্তচন্দ মহলানবিশ-এর সহধর্মিণী বলে নয়, তার নিজস্ব মননশীলতার কারণেই রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় পাত্রী ছিলেন নির্মলাকুমারী। ১৯৩০ সালের আগস্ট মাসের এই চিঠিতে কবি জানাচ্ছেন :’জর্মনিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতটা আশা করি তোমরা বোঝো। …আমার দেশের সঙ্গে আমার চিত্রভারতীর সম্বন্ধ নেই বলে মনে হয়। …ছবি যখন আঁকি তখন রেখা বলো রঙ বলো কোনো বিশেষ প্রদেশের পরিচয় নিয়ে আসে না। অতএব, এ জিনিসটা যারা পছন্দ করে তাদেরই, আমি বাঙ্গালি বলে এটা আপন হতেই বাঙ্গালির জিনিস নয়। এই জন্যে স্বতঃই এই ছবিগুলিকে আমি পশ্চিমের হাতে দান করেছি। …আমি যে শতকরা একশো হারে বাঙ্গালি নই, আমি যে সমান পরিমাণে য়ুরোপেরও, এই কথাটারই প্রমাণ হোক আমার ছবি দিয়ে।’ শেষের লাইনটি লক্ষ্য করার মতো। এই কথা শতভাগ খাটে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, অমর্ত্য সেন, রণজিৎ গুহসহ সব প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে। এদেরকে কোনো ‘জাতীয়তাবাদী’ কালো বাক্সে বন্দি করা যাবে না।

এই একই কথা বলেছেন ১৯৩০ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও। জার্মানিতে তার ছবিগুলো দেখে সবাই খুব প্রশংসা করেছে, অথচ দেশে সেগুলো গুরুত্ব পায়নি :’আশা হচ্ছে এগুলো রসিকের দৃষ্টিগোচর হবে। পণ করেচি “আমার জন্মভূমিতে” ফিরিয়ে নিয়ে যাব না- অযোগ্য অভাজনদের স্থূল হস্তাবলেপ অসহ্য হয়ে এসেচে।’ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন নিজের ছবি সম্পর্কে- বিদেশের মাটিতেই ছবিগুলো রেখে দিতে চান :’আমার পরম সৌভাগ্য এই যে আমাদের নিজপারের ঘাট পেরিয়ে এসেচি। আমার এই শেষ কীর্ত্তি এই দেশেই রেখে যাব।’ রানী মহলানবিশকে এমনভাবে বলেছেন যেন এ বিষয়ে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন :’আমার ছবিগুলোকে স্বদেশে কদাচ নিয়ে যাব না- পশ্চিম সাগরের পারে সমস্ত উজাড় করে দিয়ে তবে ফিরব।’ ততদিনে চিত্রকলা যে তার ‘শেষ কীর্ত্তি’ সেটা আমাদের জানা হয়ে গেছে। এর কারণও লিখেছেন- ‘যাই হোক ইন্ডিয়ান আর্ট যাকে বলে সেটা আমার আনাড়ি কলমে প্রকাশ পায়নি’, অর্থাৎ প্রথাগত ভারতীয় চিত্রকলা বলতে যে ‘রিয়ালিস্টিক’ ধরনের শিল্পকর্ম বোঝানো হয়ে থাকে (রবি বর্মা যার বড় উদাহরণ ছিলেন উনিশ শতকের শেষ ভাগে), সে রকম আদৌ নয় রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম। বা অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল স্কুলের’ আর্টের ধারাতেও তিনি নেই। আর সেজন্যেই এটা হয়তো পাশ্চাত্যের রসজ্ঞ মহলে বিশেষ আগ্রহের বিষয়বস্তু হতে পারে। ফ্রান্সে তার ছবির প্রদর্শনী নিয়ে ইন্দিরা দেবীকে ২৭ মে ১৯৩০ তারিখে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের মত কড়া হাকিমের দরবারেও শিরোপা মিলেচে- কিছুমাত্র কার্পণ্য করেনি’, আর জার্মানিতো তার দ্বার খুলে দিয়েছে বার্লিনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের ছবি কিনে। এজন্যেই রানী মহলানবিশকে লেখা ১৮ আগস্ট ১৯৩০-এর চিঠিতে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ বলতে দ্বিধা করেননি যে ‘এই যাত্রায় আগেরবারের চেয়ে জর্মনির অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে আমার প্রবেশাধিকার ঘটেছে। ওদের কাছাকাছি এসেছি।’ ১৯১৬ সালে কবি তার কন্যা মীরা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘চিত্রবিদ্যা ত আমার বিদ্যা নয়, যদি তা হত তাহলে একবার দেখাতুম আমি কি করতে পারতুম।’ শেষ পর্যন্ত উক্ত চিঠি লেখার ১৪ বছরের মধ্যেই তিনি দেখিয়ে ছেড়েছিলেন যে চিত্রকলার শাখাতেও তিনি কতটা স্বতন্ত্র, মৌলিক এবং সর্বাধুনিক হতে পারেন।

এ সবকিছুই অবশ্য হতো না যদি তিনি ঠিক সময়ে তার আর্জেন্টিনার ‘বিজয়া’ তথা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সমর্থন ও সহায়তা না পেতেন। ‘প্যারিস ১৯৩০’ মানেই ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথের প্যারিস- এটা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। এই গল্পের বীজ বোনা হয়েছিল আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ার্সের অদূরের সাবার্বে সান-ইসিদ্রার এক নির্জন প্রাসাদোপম বাড়িতে (প্রায় দুই মাস ছিলেন কবি যেখানে ভিক্টোরিয়ার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে)। তখন বিজয়ার বয়স ৩৪, রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৩। এই সাক্ষাৎ-এর কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছিল।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৫. ১৯৩০ : রবীন্দ্রনাথ ও প্যারিস

একথা এখন সকলেরই জানা যে, রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই উপমহাদেশের চিত্রকলার জগতে প্রথম ‘আধুনিক ধারার’ চিত্রশিল্পী। আর প্যারিসেই তার চিত্রকর্মের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৩০ সালের মে মাসে। এর আগের এক দশকে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। শুধু নিজেই যে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তা-ই নয়, ১৯২২ সালে (জার্মানী থেকে প্রত্যাবর্তনের এক বছর বাদে) কলকাতায় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট (ISOA)-এর উদ্যোগে জার্মানির অত্যাধুনিক Bauhaus ধারার চিত্রকর্মের এক অভিনব প্রদর্শনীরও আয়োজন হয় তারই উদ্যোগে (যদিও এ নিয়ে প্রশান্ত কুমার পাল evidence-র দুর্বলতার প্রশ্ন তুলেছেন)। ‘বাউ হাউস’ শব্দটি জার্মান-এর আক্ষরিক অর্থ ‘বিল্ডিং হাউস’; অন্যভাবে বললে ‘স্থাপত্য-ভবন’। এই আন্দোলনের সাথে পল ক্লী Klee বা ক্লে), কান্ডিনস্কি, রুশ ‘কনস্ট্রাকটিভিস্ট’ আর্টিস্ট লিসিৎস্কি (Lissitzky),De Stijl (মানে ‘স্টাইল’) আন্দোলনের ডাচ পেইন্টার Thea van Doesburg, অস্ট্রিয়ার ককশকা (Osker Kokoschka) প্রমুখ জড়িত ছিলেন। ক্লী-কান্ডিনস্কির চিত্রকর্ম রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে (এবং প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়) প্রদর্শিত হলো ১৯২২ সালে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে কলকাতায়- ভাবা যায়? আজ যদি ঢাকায় কেউ ফ্রাঙ্ক স্টেলা (frank stella), রিচার্ড ডিবেনকর্ন (Diebonkorn), পিটার ব্লেইক (Blake), গেরহার্ড রিখটার (Richter), ডেভিড হকনি (Hockney), হাওয়ার্ড হচকিন (Hodgkin), বাংক্‌সি (Banksy), ইয়োশিটমো নারা (Yoshitomo Nara), কুসামা (Yayai Kusama), জুলিয়ান ওপি (opie), বারবারা রে (Rae) প্রমুখের চিত্রকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের সেদিনের আয়োজনের তাৎপর্য কিছুটা হলেও বোঝা যেতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে এই তাগিদ দেখা দিয়েছিল কেন? মানুষের মধ্যকার নানা সত্ত্বার মতো রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও নানা রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। সেখানে যেমন গীতাঞ্জলির জীবনদেবতা ছিল; লালনের মনের মানুষ ছিল; তেমনি ছিল পদ্মাপাড়ের বৃত্তান্ত, তার ছোট ছোট দুঃখ-কথা। সেভাবেই ছিল স্বদেশি যুগের গোরা; ঘরে-বাইরের বিমলা-নিখিলেশ-সন্দ্বীপ। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের পক্ষে এক সময় অবস্থান নিলেও পরে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধমালায়। Nation-র Mythology নির্মাণ করতে চাননি তিনি। যেটা বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট সচেতন বা অসচেতনভাবে করে চলেছিল। যে দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি গান্ধীর চরকা ও অসহযোগ আন্দোলনকে ‘ক্রিটিক’ করেছিলেন, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বেঙ্গল স্কুলের Neo-traditionalism কে আঘাত করলেন সর্বাধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার আফ্রিকা-প্রভাবিত প্রিমিটিভিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কেবল তার নিজের দেশের ও কাছের ভুবনের চিত্রশিল্পীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন রং-তুলি ধরলেন তিনি নিজেই। ১৯৩০ সালে ফ্রান্সে তার চিত্র-প্রদর্শনীতে এসে কবি ও শিল্প-সমালোচক পল ভালেরী রবীন্দ্রনাথের এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলা দেখে হতবাক হয়েছিলেন। জার্মানিতেও যেসব শহরে প্রদর্শনী হয়েছে, সেখানেই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক কৌতূহলের গণ্ডি ছাড়িয়ে যারপরনাই বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। এই ভূভাগের আধুনিক ও সাম্প্রতিক চিত্রকলার জনক আসলে আর কেউ নন- রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। আধুনিক চিত্রকলার চারিত্র নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। যেমন, প্রশান্ত কুমার পাল তার রবিজীবনীর ৮ম খণ্ডে জানিয়েছেন যে, কবি শিল্প-কলায় সহজ-সরল রিয়ালিস্ট ধারার অনুকৃতিকে পছন্দ করতেন না। তার বরং আগ্রহ ছিল আকৃতি ও গঠনের ভাঙচুর, অর্থাৎ ফর্মের ডি-কনস্ট্রাকশনের প্রতি। যেটি সেজান-পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি গুরুদাস মল্লিক লিপিবদ্ধ করেছেন ও প্রশান্ত কুমার পাল তা হুবহু তুলে ধরেছেন। শিল্পকলা বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের আলোচনায় কবি বললেন : ‘আর্ট অসীমের প্রকাশ; রূপ অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেইটিই যেন শেষ লক্ষ্য না হয়। নিরাকারের আভাস দেবে সে, তার ব্যতিক্রম প্রতারণা মাত্র।’- ‘Was art an expression,- accurate or artistic,- only of pleasure or pain, of an happening, historical or otherwise? No, it should ever express the infinite, revealed through either of these elements. A realistic portrayal of these could be called skill or decoration, but not art.’ এর থেকেই বোঝা যায় যে, অবনীন্দ্রনাথ নন্দলালের সনাতনী রিপ্রেজেন্টেশনাল আর্ট-কেন্দ্রিক শিল্প-চিন্তার বিপরীতে ১৯২২ সালেই রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলা নিয়ে কতটা প্রাগ্রসর চিন্তা-ভাবনা করতেন। আবারও বলছি, রবীন্দ্রনাথই এই ভূভাগ থেকে উত্থিত প্রথম সচেতনভাবে ইউরোপীয় অর্থে ‘আধুনিক’ ধারার চিত্রকর। প্রিমিটিভ ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৮২ সালে টেট গ্যালারিতে যে ৬ জন উপমহাদেশের চিত্রশিল্পী নিয়ে পুরোধা ব্রিটিশ চিত্রকর ও শিল্পী ভূপেন খাকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাওয়ার্ড হচকিন চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তার মধ্যে প্রথমেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের নাম। সেটা তার কবিখ্যাতির জন্যে নয়, প্রধানত তার মৌলিক চিত্রকর্মের স্বীকৃতিদানের তাগিদে।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে এখানে নতুন করে কিছু যোগ করার নেই। এ নিয়ে নানা গুণীজন ইতোপূর্বে আলোচনা করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী, রামকিংকর, যামিনী রায় এরা রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে লিখেছেন, মন্তব্য করেছেন- তার কোনোটি হয়তো চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের কোনো বিশেষ দিক তুলে ধরে, কোনোটি হয়তো তর্কসাপেক্ষ পর্যালোচনা। চলচ্চিত্রকার ও চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রায় যেমন আগেই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথের ছবির মৌলিকত্বের কথা। তিনি বলেছেন, ‘It is important to stress that he was uninfluenced by any painter, eastern or western.’ এটা কিছুটা বাড়িয়েই বলা। কেননা, আমরা একটু পরেই দেখব যে প্রভাব এসে পড়েছিল নানা সূত্র থেকেই।

আমি বিশেষ করে উল্লেখ করব গণেশ পাইন-এর ‘শিল্পীর দৃষ্টিতে রবীন্দ্র-চিত্রকলা’, সত্যজিৎ চৌধুরীর ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’, কাইয়ুম চৌধুরীর ‘রবিতীর্থে’, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিত্রী রবীন্দ্রনাথ :অনাগত কালের আগামবার্তা’, আবুল মনসুরের ‘রবীন্দ্রনাথ-চিত্রশিল্পী-কলাভবন পরম্পরার সম্পর্কসূত্র’, আলী আনোয়ারের ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রমালার ল্যাবিরিন্‌থ’, আনা ইসলামের ‘প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ’, সুশোভন অধিকারীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাউহাউস :কিছু চেনা, কিছু অচেনা খবর’ শীর্ষক প্রবন্ধ এবং অতি-আবশ্যিকভাবে কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীর ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো মৌলিক গবেষণা-গ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থের বিতর্কিত মন্তব্য (‘লাল রংটা রবীন্দ্রনাথের চোখে ঠিকমতো ধরা দিত না’) সত্ত্বেও এর উল্লেখ করেছি, কেননা এটি তথ্যে ঠাসা একটি গবেষণা কাজ। আমি শুধু বর্তমান আলোচনার মূল বিষয়বস্তু- আধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার ওপরে প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রভাব-এর সঙ্গে সংগতি রেখে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রতিফলন নিয়ে কিছু মন্তব্য করব। প্যারিসের কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার এই অজানা দিকটির প্রতি আমি সজাগ হয়ে উঠি।

রবীন্দ্রনাথ যে জার্মান শিল্পী এমিল নোল্ডে (Nolde)-এর এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলায় বিমোহিত হয়েছিলেন এবং তার অনেক চিত্রকর্মের মধ্যে নোল্ডের প্রভাব অনুভব করা যায়- এটি নানাজনের সাক্ষ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু নোল্ডে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কার থেকে বা কোন উৎস থেকে? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে তা হলো নোল্ডে (বা নোল্‌দে)-এর ছবিতে মুখ ও মুখোশের প্রবল উপস্থিতি, যা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মেও দেখা যায়। এ নিয়ে ডাইসন-অধিকারী তাদের বইতে লিখেছেন :’নোল্‌দের ছবির সঙ্গে [রবীন্দ্রনাথের] যে কিছু পরিচয় ছিল- অন্তত বইপত্রে প্রতিলিপির মাধ্যমে- তা সন্দেহাতীত। জার্মানিতে ভ্রমণকালে [রবীন্দ্রনাথ] কিছু মূল ছবি দেখেছিলেন এমন অনুমান করাও অসংগত নয়। ফর্মে ও থিমে নোল্‌দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু চমকপ্রদ মিল লক্ষ্য করা যায়, যা থেকে মনে হয় নোল্‌দের কিছু ছবি তিনি রীতিমতো স্টাডি করেছিলেন।’ কিন্তু নোল্‌দে কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? ডাইসন-অধিকারী ইঙ্গিত করেছেন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের প্রতি। সেটা যেমন মুখের (বা Head-স্টাডি করার) ক্ষেত্রে, তেমনি মুখের সম্প্রসারণে মুখোশের (বা Mask-স্টাডি করার) ক্ষেত্রে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি এখানে তুলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে :

“মুখের প্রসঙ্গে আরও দেখতে পাই, নোল্‌দের প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ থেকে এমন কতগুলি মনোক্রোমধর্মী স্কেচ জন্ম নেয়, যাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকের কালি-তুলির স্কেচের সাদৃশ্য লক্ষ্য করবার মতো। …তাঁর [১৯১৩/১৪ সালের] ‘একজন স্থানীয় আদিবাসীর মাথা’ বা ‘স্থানীয় আদিবাসী’-এর পাশাপাশি রাখা যায় রবীন্দ্রভবনের ১৯৩৬, ২৯৬৪, বা ৩৪৫০-র মতো ছবিকে। …মুখোশও দুই শিল্পীর মধ্যে একটা সাধারণ এলাকা। …রবীন্দ্রভবনের রেখাঙ্কনধর্মী ২৭৯৮, ২৮৫৪, বা ২৯২৫-সংখ্যক [ছবির] সঙ্গে তুলনীয় নোল্‌দের ১৯১১-র মুখোশভিত্তিক স্টিল লাইফগুলি।” নোল্‌দে-রবীন্দ্রনাথের মুখোশভিত্তিক ছবিগুলোও প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের সুবাদেই অনুপ্রাণিত :’পিকাসোর ছবিতে যেমন আফ্রিকান মুখোশের একটা স্টাইলাইজেশন ঘটে …নোল্‌দের এই ছবিগুলিতে তেমনটি হয় না। এই ছবিগুলিতে মুখোশগুলি প্রথমতঃ বর্ণোজ্জ্বল গ্রোটেস্ক নৃতাত্ত্বিক সামগ্রী হিসাবেই চিহ্নিত, যেন সংগ্রহশালার শো-কেসে সাজানো রয়েছে। আবার তাদের মধ্যে মানুষের মুখের ভাবের অতিরিক্ত অভিব্যক্তিও সঞ্চারিত করা হয়েছে, নাটকের মুখোশে যেমন।’ নোল্‌দের মুখোশগুলো রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করেছিল :নোল্‌দের ১৯১২ সালে করা ‘মানুষের মাথা’ ছবিটিতে তিনটি মাথা আঁকা হয়েছে। ‘তিন মুখে তিন রকমের রঙের প্রাধান্য’। রবীন্দ্রনাথের ২১৭৮-সংখ্যক ছবিতেও ঠিক তেমনি পাশাপাশি সাজানো তিনটি মুখোশ :’রবীন্দ্রনাথের মুখোশ-ছবিতে নোল্‌দের মতো বর্ণৌজ্জ্বল্য না পাওয়া গেলেও সারি-বাঁধা মুখোশের উপস্থিতি ভারতীয় চিত্রকলায় অভিনব। এইসব মুখোশের ঠোঁট কোথাও চাপা, কোথাও ফাঁক-করা, কোথাও বা তাদের চোখের তারা বিস্ম্ফারিত। কার্টুনঘেঁষা ভাবভঙ্গিতে এরা রবীন্দ্রচিত্রবিশ্বে এক নতুন, অদ্ভুত জগৎ রচনা করে।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট (ও আর্ট-ফর্ম) শুধু যে ব্র্যাক, মাতিস, পিকাসো, ক্লি, কিরশনের, নোল্‌দে প্রমুখকেই প্রভাবিত করেছে তা-ই নয়, এদের ছবির সুবাদে বা প্রত্যক্ষভাবে প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব এসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার ক্ষেত্রেও। এই প্রভাব রবীন্দ্রনাথকে তার নিজের মতো করে ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’ হতে সাহায্য করেছে। আমরা শুধু পাশ্চাত্যের কাছ থেকে হাত পেতে গ্রহণই করিনি, আমরাও পাশ্চাত্যকে দান করতে কার্পণ্য করিনি। এই ‘আমরা’ আসলে কারা? এই ‘আমরা’ এ যুগের (বা সে যুগের) পাশ্চাত্যের অন্ধ-অনুকরণপ্রিয় বাঙালি মধ্যবিত্ত সত্ত্বা নয়। দান এসেছিল আমাদের দেশের নিম্নবর্গ অন্ত্যজ শ্রেণির কাছ থেকেই। কিরশ্‌নের যেমন করে প্রভাবিত হয়েছিলেন অজন্তার গুহাচিত্রের নাম-না-জানা নিম্নবর্গের শিল্পীদের দ্বারা।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৩

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

আগেই বলেছি, মাতিসের কাছে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ভাস্কর্যের ‘ফর্মাল’ দিকটি বেশি করে ধরা দিয়েছিল। সামঞ্জস্যহীনতা, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে স্বাভাবিক অনুপাতের ভারসাম্যকে ইচ্ছাকৃত ভেঙে ফেলা, ‘ভয়ংকর সুন্দর’কে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা- এসব শৈল্পিক প্রয়োগকে এক স্বাধীন স্বরাট শিল্পীসত্তার প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন মাতিস। ‘ফর্মের স্বাধীনতা’ সব সময়ই মাতিসের কাছে একটি মুখ্য বিবেচনা ছিল। কিন্তু ট্রকাদেরো মিউজিয়াম হঠাৎই চোখে-পড়া আফ্রিকার ভাস্কর্য পিকাসোর কাছে মনে হয়েছিল রহস্যময় এক জাদুকরী শক্তির আধার হিসেবে। ভাস্কর্য ছাড়াও মুখোশও তাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। সম্ভবত সেখানে আইভরি কোস্ট বা লাইবেরিয়ার কোনো Grebo mask দেখে থাকবেন তিনি। যদিও ট্রাইবাল আর্টকে ‘কালো-কুচ্ছিৎ’ বলে কখনও কখনও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন পিকাসো, কিন্তু সব ছাপিয়ে তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে এসব ভাস্কর্য ও মুখোশের ‘ম্যাজিক্যাল পাওয়ার’। জাদুকরী ক্ষমতা, মায়াবী আকর্ষণ, সম্মোহিত করার মতো শক্তি- এমন সব উচ্চারণই বেরিয়েছে পিকাসোর মুখ থেকে। এদিক থেকে মাতিসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পিকাসোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রাঁসোয়া জিলোটের সঙ্গে কথোপকথনের আড়ালে স্বীকারোক্তিতে পিকাসো সেদিন যা বলেছিলেন, তা এতই তীক্ষষ্ট ও তলদর্শী, যা আমার অক্ষম অনুবাদে নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যাবে। ইংরেজি ভাষ্যেই পিকাসোর কথাটা প্রথমে শোনা যাক (জিলোট তার ‘লাইফ উইথ পিকাসো’ বইতে এ নিয়ে লিখেছেন) :

‘Men had made those masks and other subjects for a sacred purpose, a magic purpose, as a king of mediation between themselves and the unknown hostile forces that surrounded them, in order to overcome their fear and horror by giving it a form and an image. At that moment I realized that this was what painting was all about. Painting isn’t an aesthetic operation; it’s a form of magic designed as mediation between this strange, hostile world and us, a way of seizing power by giving form to our terrors as well as our desires. When I came to that realization, I knew I had found my way.’

ট্রাইবাল আর্টের মুখোমুখি হওয়ার পর পিকাসোর মনে হলো যে চিত্রকর্মের মূল উদ্দেশ্য নান্দনিক আনন্দের বিতরণ নয়। চারপাশের তৈরি জগৎ ও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মধ্যে কোনো এক রহস্যময় উপায়ে- প্রায় জাদু-বাস্তবতার কথাই এটা- ‘সেতু স্থাপন করা’ এর লক্ষ্য। যাতে করে মানুষ তার নিঃসঙ্গতার ভয়-ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারে। আবশ্যিকভাবেই, এই সেতু অলৌকিক; এই যোগাযোগ ও বিনিময় মায়াবী, সব রকম ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু ব্যাখ্যাতীত এই বাস্তবতা বা জাদু-বাস্তবতায় পৌঁছানোই শিল্পকলার আসল লক্ষ্য। গত শতকের আশির দশকে মার্কেজের উচ্চারণে এই জাদু-বাস্তবতার অন্য এক রাজনৈতিক রূপও আমরা দেখতে পাই। এবারে শুধু আফ্রিকার সঙ্গে পাশ্চাত্যের যোগসূত্র স্থাপিত হবে তা-ই নয়, গোটা লাতিন মহাদেশের শিল্প-সাহিত্য কলম্বিয়ার মার্কেজের ও পেরুর ইয়োসার গদ্যে, চিলির নেরুদা ও আর্জেন্টিনার বোর্হেসের কবিতায়, ইকুয়েডরের গুইসামিন (Guayasamin), মেস্কিকোর তামায়ো (Rutins Tamayo) ও কিউবার লামের (Wilfredo Lam) চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে শত শত বছরের সন্ত্রাস, ভয়, জড়তা ও নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠে পাদপ্রদীপের আলোয় ঝলমল করে উঠবে সাহসের সঙ্গে।

জিলোটের সঙ্গে আলাপে সেদিন পিকাসো তার সৃষ্টিশীল পথের একটি ‘মেজর টার্নিং পয়েন্ট’-এর কথা বলেছিলেন আফ্রিকান প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের আলোচনা-সূত্রে। আফ্রিকান শিল্পীরা ইউরোপের তুলনায় ভিন্ন চোখে শিল্পমাধ্যমকে দেখেন। নিছক আনন্দ-উপভোগের জন্য নয়। ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’ এ ধরনের মিথ্যা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ‘প্রিমিটিভ’ আর্টিস্টরা নেই। এটাই পিকাসোর সজাগ দৃষ্টি কেড়েছিল ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে সেদিন। পিকাসোর এই চিন্তা সমসাময়িক ফ্রান্সের স্ট্রাকচারালিস্ট এনথ্রোপলজিস্ট অন্দ্রে মালরোঁ, ক্লদ লেভি-স্ট্রস প্রমুখের নৃতাত্ত্বিক চিন্তার অনুবর্তী।

কিন্তু শুধু পিকাসো নন বিশিষ্ট এ ক্ষেত্রে। আরও অনেক সহযাত্রী রয়েছেন তার সঙ্গে। রোমানিয়ান ভাস্কর কনস্তানটিন ব্রানকুসি (Brancusi), রাশান ভদ্মামিলি কান্ডিনস্কি ও মার্ক শাগালের মতো বড় একটা সময় কাটিয়ে ছিলেন প্যারিসে। তার হাতে করা বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘এডাম ও ইভ’-এর সঙ্গে আইভরি কোস্টের কুলানগো (Kulango) ট্রাইবের কোনো নাম-না-জানা শিল্পীর হাতে গড়া মূর্তির প্রচণ্ড সাদৃশ্য। অকালমৃত আমাদেও মডিলিয়ানি চিত্রকর্মের জন্যই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তার করা অল্প কয়েকটি ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ‘স্ট্যান্ডিং ন্যুড’; এর সঙ্গে পূর্বে উল্লেখকৃত গ্যাবন দেশের Fang মূর্তিটির বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জার্মান পল ক্লি-এর কথাও এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য।

পল ক্লী-র চিত্রকর্মে বিশেষ করে নর্থ আফ্রিকার লোকজ শিল্পের প্রভাব প্রবলভাবে অনুভূত হয়। উত্তর আফ্রিকা বলতে ‘মাগরেব অঞ্চল’কে বোঝানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া। যারাই পল ক্লীর চিত্রকর্মে প্রাচীন নৃগোষ্ঠীর মতো করে হাতে আঁকা ‘প্রিমিটিভ’, চিহ্ন, জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি ও নকশা দেখে ভেবেছেন এর রহস্য কী, তারা অন্তত এটুকু বুঝেছেন যে, এ জিনিস ‘ইউরোপ’ থেকে আসেনি। রেনেসাঁ-উত্তর চিত্রকলার কোনো শিল্পগত ঐতিহ্যেই এ রকম চিহ্ন বা প্রতীকের চর্চা হয়নি। এটা উঠে এসেছে আফ্রিকার লোক-শিল্পের গভীর তলদেশ থেকে। এর ‘সর্বাধুনিক পাঠের’ মিথস্ট্ক্রিয়া থেকে। ‘দ্য ম্যাজিক অব সাইনস্‌ অ্যান্ড প্যাটার্নস্‌ ইন নর্থ আফ্রিকান আর্ট’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট লিখেছে : ‘Many of (these) shapes and symbols have a marked resemblance to Neolithic Pottery found in the region. By combining signs with magical numbers or stylizing traditional symbols, contemporary artists top the unconscious to create abstract work that references the past and Present.’
এবং এ কথা বলেই তাদের মনে পড়ে যায় পল ক্লী-র কথা :’On several visits to North Africa, German artist Paul Klee was inspired by these mystical shapes and incorporated signs, number and letters into his work.’ অবশ্যই পল ক্লী-র চিত্রকর্ম আধুনিক উত্তর আফ্রিকার চিত্রশিল্পীদের প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালে, এ কথা স্বীকার করতেই হবে আমাদের। একটা সৃষ্টিকর্মের ওপরে নানা স্থান ও উৎস থেকে আলো এসে পড়তেই পারে, কিন্তু প্রভাব-সমুচয়ের বিষয়টি কেবল একতরফাভাবে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশে এসে পড়েছে বা পড়বে, বিষয়টা এমন নয়। আফ্রিকাও পিকাসো বা ক্লীর পর্যায়ের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃতদের প্রভাবিত করতে পারে। তাদেরকে শুধু বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে নয়, ‘ফর্মের’ ভাঙচুরের ক্ষেত্রে প্ররোচিত করতে পারে, এমনকি জন্ম দিতে পারে পিকাসোর কিউবিজম বা (পল ক্লী-র বেলায়) ‘মিস্টিক্যাল এবস্ট্রাকট’ পর্বের। সেই দ্বিমুখী সম্ভাবনার কথাই আবার মনে করিয়ে দেওয়া।

কুই ব্রানলি জাদুঘরে গেলে এ রকম অনেক সদৃশ্যতার কথা মনে পড়বে। ‘1906 Blast of Negro Art in Modern Art’ নামে একটি বই লিখেছেন আর্ট হিস্টোরিয়ান ণাবং ঈৎব্থযধষবঃ. আধুনিক শিল্পকর্মে কালো আফ্রিকার শিল্পকলার বিস্ম্ফোরণ। ১৯০৬ সালটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন এ ক্ষেত্রে, কেননা ওই বছরেই মার্সাইতে ‘কলোনিয়াল এক্সিবিশনের’ আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর প্রভাব এসে পড়েছিল ব্র্যাক, মাতিস, পিকাসো, মদিলিয়ানি, পল-ক্লী প্রমুখের শিল্পকর্মে বিশেষত চিত্রকলায়। কবি গীয়ম আপোলেনিয়র আইভরি কোস্টের একটি Dan মাস্ক (Dan Tankagle) কিনেছেন সেটা আবার চিরিকোর (Giorgio de Chirico) করা আপোলেনিয়রের প্রতিকৃতির ওপরে প্রভাব ফেলেছে। তানজানিয়ার মাকন্দে (Makonde) মাস্ক। নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা (Yaruba) মাস্ক, মালির দগন (Dogon) মাস্ক, কঙ্গোর কুন্ডু-গাতা (N’kundu-Ngata) নারী-মূর্তি, কদ্ধান (Kran) মাস্ক, গ্যাবনের ফ্যাং (Fang) মাস্ক, মালির বাম্বারা (Bambara) মাস্ক, লাইবেরিয়ার গ্রেব্রো (Grebo-Kron) মাস্ক, এঙ্গোলার Tschokwe মাস্ক, আঁরি রুসো থেকে শুরু করে পিকাসো দেরাঁ থেকে লেজে (Fernand Leger), ক্লী থেকে ম্যাক্স আর্নস্ট, সবাইকে বিমোহিত করেছিল। এদিক থেকে দেখলে এই ভোগের চিত্রকলায় ও ভাস্কর্যে আফ্রিকার তুলনামূলক অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আমাদের শিল্পকলায় ‘লোকজ’ শব্দটি জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে বন্দি। যামিনী রায়কে কালীঘাটের পটশিল্পের প্রভাবে দেখতে পারি বা কামরুল হাসানকে ‘পটুয়া’ বলতে আগ্রহী হয়ে উঠি- প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রতি আমাদের উৎসাহের চৌহদ্দি ঐ পর্যন্তই। আধুনিক ভারতের বা বাংলাদেশের চিত্রকলায় ‘আফ্রিকার’ কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের দেশে আমাদের মতো করে ট্রাইবাল জীবনের ‘আধুনিক রূপায়ণ’ আছে, কিন্তু আধুনিক জীবনের ‘প্রিমিটিভ রূপায়ণ’ দুর্লভ। একজন হাল আমলের শিল্পী যখন সাঁওতাল, ম্র অথবা চকমা রমণীকে আঁকেন তখন তার লক্ষ্য থাকে আদিবাসী জীবনযাত্রার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি, পরিধানের বিশিষ্ট পোশাক বা দেহ গঠনের ভিন্নতার প্রতি। তাতে করে আধুনিক চিত্রকলার ওপরে আদিবাসী মনোজগতের, বিশ্বাসের বা সিম্বলিজমের কোনো আঁচড় পড়ে না, কোনো আলোড়ন সৃষ্টি হয় না, বা এর থেকে বলতে পারি না যে, দক্ষিণ এশিয় চিত্রকলায় ট্রাইবাল আর্টের ‘blast’ বা বিস্ম্ফোরণ হয়েছে। একজন সাঁওতাল বা মারমা রমণী হয়তো আমাদের কাছে এনথ্রোপলজিক্যাল আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু শিল্পকর্মে কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো নতুন আদর্শ বা নতুন ভাষার প্ররোচনা এতে করে সৃষ্টি হয় না। আমি যামিনী রায়ের এক্সপেরিমেন্ট অথবা ফ্রান্সিস নিউটন সুজা-র প্রিমিটিভ-প্রভাবিত চিত্রকলার কথা ভুলে যাইনি। একজন J.M.S. mari বা একজন এস. এম. সুলতান এ ভূভাগেও আছে। তারপরও বলতে হয়, যেভাবে ব্রাক-মাতিস-পিকাসো-ক্লীর কাছে ট্রাইবাল ও প্রিমিটিভ আর্ট নতুন আন্দোলন ও নতুন অভিব্যক্তির জন্ম দিল, সেভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলায় কেন প্রিমিটিভিজম ও মডার্নিজমের মধ্যে ভাবের, ভাষার এবং শুভদৃষ্টির বিনিময় হলো না, সেটা একটা ধাঁধার মতোই হয়ে থাকল।

নতুন আন্দোলন ও নতুন অভিব্যক্তি যে ট্রাইবাল ও প্রিমিটিভের গভীর তলদেশ থেকে জন্ম নিতে পারে তার জন্য ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি তাকানোর দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেই আবার ফিরে যেতে হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু ও গগনেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বেঙ্গল পেইন্টার্স’ গ্রুপকে রবীন্দ্রনাথের খুব বেশি পছন্দ হয়নি। বেঙ্গল স্কুল খুব বেশি ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারার শিল্পকলা বলে ঠেকেছিল তার কাছে। যেমন তিনি নৃত্যকলার জন্য খুঁজে এনেছিলেন মণিপুরি নৃত্যের ‘ফর্ম’, তেমনিভাবে চিত্রকলায় নতুন অভিব্যক্তির নিরন্তর সন্ধানে ছিলেন। তিনি মুকুল দে-কে জাপানে চিত্রকলা শেখানোর একটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন আর্ট-ফর্মের সন্ধান। কিন্তু তাতে তার মন সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এরপর নিজেই লেগে গেলেন রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে। দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে কোনোই মিল নেই, কিন্তু জার্মান প্রিমিটিভিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্টদের সাথে তার মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে মিলে গেল। ফিগারেটিভ, ল্যান্ডস্কেপ অথবা বিমূর্ত যে কোনো বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় দেখা গেল এক ভিন্ন ধরনের প্রভা, যার নিকটতম তুলনা কেবল পাওয়া যায় প্রিমিটিভ ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টে। [ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪২

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

পিকাসোর ‘আফ্রিকা’ দিয়েই আমি শুরু করতে চাই। যদিও পিকাসোর আগে ‘শুরুটা’ হয়েছিল। কে সূচনা করেছিলেন, সে নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে- মরিস ভদ্মামিঙ্ক (Maurice Vlamnck) এবং অন্দ্রে দেরাঁ (Andre Derain) দিয়েই। ১৯০৬ সালের শুরুর দিকে প্যারিসের একটি প্রদর্শনী থেকে দেরাঁ আফ্রিকার গ্যাবন দেশের একটি ‘ফ্যাং মুখোশ’ (Fang Mask) কেনেন। এরা দু’জনেই ছিলেন ইম্প্রেশনিজমের পরের উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ‘ফভ মুভমেন্টে’র সদস্য (Fauve painters নামে প্রসিদ্ধ)। ফরাসি ‘Fauve’
শব্দের অর্থ বন্য পশু, শিল্পকলার জগৎকে এক দানবিক শক্তি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে চেয়েছিলেন তারা; এই আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল- ১৯০৪ থেকে শুরু হয়ে ১৯১০ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত কুশীলবরা পরবর্তীকালে সেজান-পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলার নানান দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। কে নেই এর মধ্যে? মাতিস, ব্রাক, রুয়ো (Roualt), এমনকি সামান্য কালের জন্য ‘নীল পর্বের’ পিকাসো স্বয়ং। এদের কিছু মৌলিক (অ-স্বাক্ষরিত) ‘লিথোগ্রাফ’ আমার সংগ্রহে রয়েছে। এই ফভ পর্ব যখন তুঙ্গে, তখনই আফ্রিকার ‘প্রিমিটিভ’ আর্টের প্রভাব এসে পড়ে প্যারিসের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে। ফ্যাং মুখোশ কেনার কিছুদিনের মধ্যে মাতিস বেড়াতে যান আলজেরিয়ায়। সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন ভাস্কর্য (এবং ‘মুখোশ’) তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বস্তুত আমরা পিকাসোর ‘আফ্রিকা-পর্বের’ কথা আগে শুনেছি, কিন্তু মাতিসের আফ্রিকা-আবিস্কার প্রায় অজানা বা অচর্চিতই থেকে গেছে। ১৯০৬ সালের আলজেরিয়া ভ্রমণের পর মাতিসের আঁকার ধরনই বদলে গেল। উদ্ৃব্দতিটি তুলে দিচ্ছি : ‘Exposure to north African art, with its wealth of decorative patterns, helped him to simplify his drawing and I berate liberate color from its descriptive function. The trip also focused his attention on the arabesque an elegant, harmonies, S-shaped linear motif that plays a prominent part both in Islamic art and in the European academic tradition.’ এই প্রভাব এসে পড়েছিল মাতিসের Nude by the sea (১৯০৯) চিত্রকর্মে, যেখানে মোটা বলিষ্ঠ তুলিতে কালো রঙে দেহের অবয়ব স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এই ছবিতে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি কাঠের স্থির ভাস্কর্যের মতো- অবিকল পশ্চিম আফ্রিকার দণ্ডায়মান কালো কাঠের নারী মূর্তি। কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এ রকম অনেক নিদর্শন ছড়ানো। তবে আলজেরিয়া ভ্রমণের তুলনায় আরও বেশি স্পষ্ট করে আফ্রিকার প্রভাব অনুভূত হয় ১৯০৭ সালের চিত্রকর্মে, যার নাম ‘স্ট্যান্ডিং নুড’। এখানে ট্রাইবাল আর্ট, যেটা ছিল কাঠের বা প্রস্তর মূর্তি আবক্ষ, তাকে অনুবাদ করা হয়েছে রংতুলির ভাষায়- অয়েল পেইন্টিংয়ের ক্যানভাসে। ভাস্কর্য ও মুখোশ থেকে ক্যানভাসে স্থানান্তর- সংক্ষেপে এভাবেই হয় ট্রাইবাল প্রিমিটিভ আর্টের ইউরোপীয় আধুনিক চিত্রকলায় ‘আত্তীকরণ’। এর পেছনে একটি ছোট ইতিহাস রয়েছে। শিল্প সংগ্রাহক ও সমালোচক গেরট্রুড স্টেইন ছিলেন পিকাসো ও মাতিস দু’জনেরই বন্ধু। প্যারিসে অবস্থানকালে মার্কিন এই রমণী সমসাময়িক তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার আসরে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন- তার আতিথেয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও উষ্ণ সহায়-সমর্থনের জন্য। পিকাসো তাকে নিয়ে প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তার বিখ্যাত জ্যামিতিক ধারার ভাঙচুর ও ডি-কনস্ট্রাকশনের কিউবিক পদ্ধতিতে। মাতিস একবার গেরট্রুডের বাসায় যাওয়ার পথে এন্টিক শপ থেকে আফ্রিকার ছোট একটি স্ট্যাচু সংগ্রহ করেন। সেদিন গেরট্রুডের বাসায় উপস্থিত ছিলেন পিকাসোও। আফ্রিকার ট্রাইবাল ভাস্কর্য নিয়ে মাতিস-পিকাসোর আলাপ একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করে। মাতিস বলেন, ইউরোপীয় ভাস্কর্যে খুব বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, যাকে আঁকা হয়েছে তার বর্ণনার প্রতি, বিশেষত তার শরীরের গঠন-মাংসপেশি ইত্যাদি অনুষঙ্গের ওপরে। কিন্তু, দ্যাখো, আফ্রিকার ট্রাইবাল মূর্তিগুলোকে- মনে হচ্ছে কাঠ, পাথর বা মাটির ‘ম্যাটেরিয়াল’ যা-ই হোক না কেন, সেখান থেকে সরাসরিভাবে যেন কেটে তোলা হয়েছে এদের। শিল্পীর মেজাজ অনুযায়ী জ্যামিতিক ফর্ম, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে তুলনামূলক অনুপাত বেশ-কম করার ক্ষেত্রে বেশ স্বাধীনতা দেখতে পাই। ইউরোপীয় ভাস্কর্যে শরীর যেখানে ফিজিওলজির আঁটোসাঁটো গড়নের মধ্যে বন্দি, আফ্রিকার ভাস্কর্য সে তুলনায় অনেকটাই স্বাধীন। এই স্বাধীনতার দিকটি পিকাসো ও মাতিস উভয়েরই খুব মনে ধরেছিল। ভাস্কর্য শিল্পীর মনের ইচ্ছেকে প্রকাশ করছে- যাকে উপলক্ষ করে ভাস্কর্য গড়ে তোলা হচ্ছে, তা আর তার মুখ্য আগ্রহের বিষয়বস্তু থাকছে না। এটা দু’জনের কাছেই বিস্ময়কর আবিস্কার মনে হয়েছিল। পরবর্তীকালে Die Brucke (মানে, ‘সেতু’) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এরিখ হেকেল, এমিল নলডে, এর্নস্ট কিরশ্‌নের প্রমুখেরা আফ্রিকার প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাবে ইউরোপীয় চিত্রকলার মধ্যে ‘এক্সপ্রেশনিজমে’র ধারা সূচনা করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা মাতিসের বিরল ভাস্কর্য (তিনি খুব বেশি ভাস্কর্যের কাজ করেননি) ‘দ্য সারপেন্টাইন’ ও কিরশনের-এর ‘দ্য ড্যান্সিং ওমেন’-এর উল্লেখ করতে পারি।

প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব মাতিসের শিল্পকলায় আমৃত্যু সঞ্চারিত হয়েছিল। এখন যাকে বলে ‘টেক্সটাইল আর্ট’, তারও মূল প্রেরণা এসেছিল আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকা ছাড়াও পাপুয়া নিউগিনি এবং পলিনেশীয় কাপড়ের ‘ইন্ট্রিকেট’ জ্যামিতিক ডিজাইন আধুনিক শিল্পকলাকে নাড়া দিয়ে গেছে। মাতিসের শোবার ঘরের একটা দেয়ালজুড়ে ছিল এসব দেশ থেকে সংগ্রহ করা ‘টেক্সটাইল’ শিল্পকর্ম। কাপড়ের বাহারি প্যাটার্নের নকশা মাতিস তার ক্যানভাসের চিত্রকর্মের মধ্যে প্রায়ই ব্যবহার করেছেন- অবশ্যই নিজস্ব উজ্জ্বল রঙের ফোয়ারা তুলে। ‘মাতিস ঈশ্বরের পরেই সবচেয়ে ভালো রঙের ব্যবহার করতে জানেন’- এই কথাটা পিকাসো সংগত কারণেই বলেছিলেন। সেই মাতিস আফ্রিকার ‘কুবা’ (Kuba) কাপড়ের জ্যামিতিক নকশা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, ‘I never fire of looking at even the simplest of them, and waiting for something to come to me from the mystery of their instinctive geometry… I can’t wait to sea what the tapa will reveal to meÑ for its perfection’. সাম্প্রতিক কালের উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, রতন মজুমদারের আশির দশকের সাদা-কালো ছাপচিত্রে এই প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল ‘টেক্সটাইল আর্টের’ মনোমুগ্ধকর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। অন্যবিধ প্রভাবও মাতিস নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। পল গগাঁর তাহিতি-সিরিজের চিত্রকর্মের মতো মাতিসেরও নিজস্ব স্মৃতি ছিল তাহিতি নিয়ে। ১৯৩১ সালে ষাট বছরের মাতিস তাহিতিতে বেড়াতে যান। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ‘পলিনেশিয়া’ অঞ্চল (French Polynesia হিসেবে চিহ্নিত)। সেখান থেকে মাতিস নিয়ে আসেন নানা ধরনের পোশাক (Tapa Cloths), স্থানীয় রমণীদের পরনের স্কার্ট (Pareos) এবং অ্যাপ্লিকের কাজ করা কাপড় (স্থানীয় ভাষায় Tifaifai নামে পরিচিত)। সেইসঙ্গে এসেছিল যত রাজ্যের শঙ্খ, ঝিনুক ও প্রবাল পাথর। পলিনেশিয়া মাতিসের চিত্রকর্মকে জল ও আকাশের গন্ধ ও বর্ণ ধার দিয়েছিল- তার ট্রেডমার্ক নীল পটভূমিতে আঁকা সাদা জল, মাছ, ঝিনুক, কোরাল ও শঙ্খমালা। পরবর্তীকালে এই চিত্রকর্মগুলো রূপান্তর হবে তার মৃত্যুর আগের মাসগুলোয় করা বিখ্যাত ‘কাটআউট’ সিরিজে। নানা রঙের কাগজ কেটে মিলিয়ে মিলিয়ে বানানো একান্তভাবে তারই উদ্ভাবিত অশ্রুতপূর্ব শিল্পকর্ম। এ নিয়ে আমি সাক্ষী-সাবুদ উপস্থাপন করতে পারি এখানে। কবি ও ঔপন্যাসিক লুই আরাগঁ ‘মাতিসের তাহিতি’ প্রসঙ্গে এভাবে বলেছেন :
‘Whoever knows Matisse is constantly aware of the influence of that distant island on his thoughts… he tells of the light of Tahiti, the lagoon, the transparent water, the fish and the Corals in that undersea light which is like a second sky.’ তার ওশেনিয়া (Oceania) ও পলিনেশিয়া (Polynesia) সিরিজ এভাবেই গড়ে উঠেছিল। তাহিতি মাতিসকে দিয়েছিল শুদ্ধতম চিত্রকর হয়ে ওঠার সিঁড়ি। পলিনেশিয়ার এক দ্বীপে মাত্র তিন সপ্তাহ থেকেই তার মনে হলো তিনি যেন সেই সিঁড়ির ধাপগুলো দেখতে পাচ্ছেন। সহকর্মী চিত্রকর পিয়ের বনার্ডকে (Bonnard)
তিনি লিখলেন, ‘Just 20 days on a coral island: pure light, pure air, pure colour: diamond sapphire emerald turquoise. Fabulous fish.’ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, (এক বিষ্ণু দে-কে বাদ দিলে) পরবর্তীকালে শামসুর রাহমানের কবিতার যতিচিহ্নের মতো ক্রমাগত উল্লেখ করা হবে সেজান, মাতিস, ব্রাক ও পিকাসোর কথা। তার বিশ্বকে লাল-নীল-সবুজ নানা রঙে বর্ণিল করবেন এই Fauve চিত্রশিল্পীরা। শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিক চিত্রকলা একটি আগ্রহের থিম। সেখানে আরও যুক্ত হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পীরা :যামিনী রায় থেকে জয়নুল; শাগাল ও কান্ডিনস্কি থেকে শুরু করে মিরো ও ডালি। সেটি নিজস্ব মূল্যেই একটি পৃথক ও একান্ত মনোযোগের বিষয়, যা বর্তমান আলোচনার বাইরে থাকল।

অনাবিস্কৃত মাতিসে এশিয়া-আফ্রিকার প্রসঙ্গ প্রচ্ছন্নে থাকলেও ‘পিকাসোর আফ্রিকা’ বহুদিন ধরেই একটি চর্চিত বিষয়। সমালোচক ও সহচিত্রশিল্পীরা সবাই বলেছেন যে, কিউবিজমের পেছনে একটি প্রেরণা যেমন- বিজ্ঞান (বিশ্বের ‘ত্রিমাত্রিক’ ভিউ, যা দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসের তলদেশ থেকে ত্রিমাত্রিক অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা), তেমনি অন্য একটি উৎসাহ এসেছিল আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট-ফর্ম থেকে। আদিবাসীদের ভাস্কর্যের মধ্যে শারীরিক উপস্থাপনায় সচেতনভাবে বৈসাদৃশ্য, সামঞ্জস্যহীনতা, প্রতিতুলনা ও কর্কশতাকে (কুৎসিত নয়) প্রাধান্য দিয়ে ফর্মের সচেতন ভাঙচুর করা হয়েছে। অথচ তাতে করে নান্দনিক রসে ব্যাঘাত ঘটেনি :খাপছাড়া, কিন্তু সুন্দর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাঙচুর করে পুনর্নির্মাণ, একটি প্রচলিত শিল্পপদ্ধতিকে ভেঙে দেখার নতুন চোখ তৈরি করা (পাঠকের মনে পড়বে ‘Eye of Picasso’ গ্রন্থটি)- এটি আফ্রিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ আর্ট তাকে শিখিয়েছিল। কিন্তু পিকাসো নিজে এই ঋণ স্বীকার করতে আগ্রহী ছিলেন না। আফ্রিকার টোটেম তার সর্বাধুনিক কিউবিজমকে প্রেরণা জুগিয়েছে- এ কথা তিনি থিসিস আকারে বলতে পারতেন। কিন্তু বলেননি। এ নিয়ে তার স্ত্রী (যিনি নিজেও একজন উল্লেখ করার মতো শিল্পী) ফ্রাঁসোয়া জিলোট (Gilot) রাখঢাক না করেই প্রায় এভাবে বলেছেন, ‘যারা পিকাসোকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তারাই বুঝবেন কেন পিকাসোর মুখ দিয়ে ওই স্বীকারোক্তিটি বেরোয়নি। আসলে তিনি এ ব্যাপারে কেন, কোনো কিছুর জন্যই কারও কাছেই জীবনে কোনো ঋণ স্বীকার করতে চাননি।’ জিলোটের সঙ্গে পিকাসোর পরবর্তীকালে অবশ্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় (তার বৈষয়িক জীবনে এ রকম ছাড়াছাড়ির ঘটনা পৌনপুনিক)। ফলে এই ব্যাখ্যাকে পিকাসোর প্রতি সংবেদনশীল বলে গ্রহণ করা শক্ত।

আফ্রিকার ‘কোটা’ (Kota) ভাস্কর্যের প্রভাবে আঁকা হয়েছিল পিকাসোর বিভিন্ন চিত্রকর্ম। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘ড্যান্সার অব আভিগনন্‌’ ও ‘থ্রি উইমেন’ চিত্রকর্ম দুটি। কিউবিস্ট মোটিফে করা ‘গিটার’ও আরেকটি উদাহরণ। কীভাবে আফ্রিকার শিল্পকলার প্রতি পিকাসো আকৃষ্ট হন, সে গল্প জিলোটকে শুনিয়েছিলেন শিল্পী নিজেই। ১৯০৭ সালের শুরুতে প্যারিসের ‘ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে’ (যেটি এথনোগ্রাফি মিউজিয়াম নামেও পরিচিত) হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ে যায় আফ্রিকা থেকে সংগৃহীত একটি মূর্তি।

[ক্রমশ]