খেলায় এখন হাফ টাইম : প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের এখনও সময় আছে

বিনায়ক সেন, অজয় দাশগুপ্ত | তারিখ: ১০ জুন ২০১২

জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। এ সময়ে বিরোধীরা সংসদে ছিল না এবং বাজেট আলোচনায় অংশ নেবে, এমন সম্ভাবনাও প্রায় নেই। এ নিয়ে যা কিছু পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা, সেটা দেখছি সংসদের বাইরে। এতে একাডেমিক চর্চা আছে, অর্থনীতিবিদদের আলোচনা আছে। রাজনীতিকরা তো মুখর আছেনই। আলোচনায় জোর পড়ছে মোট দেশজ প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কত হয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়েছে কি-না, আগামী বছর প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশে নেওয়া এবং মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে কি-না এবং এ ধরনের আরও কিছু বিষয়ে। তবে আমাদের মনে হয়, আমজনতা যাদের বলি তাদের ঠিক পরিসংখ্যানের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে ততটা মাথাব্যথা থাকে না। তারা চায় প্রতিদিন প্রয়োজন পড়ে এমন পণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় থাকুক, আইন-শৃঙ্খলা ভালো থাকুক, জীবনযাপন সহজ থাকুক।
অর্থনীতি যেভাবে চলছে তাতে কেউ আশাবাদের কথা বলতে পারেন, কেউবা হতাশার দিকটিকেই বড় করে দেখবেন। এ ছাড়া নিরন্তর সংশয়বাদীরা তো রয়েছেনই। তারা এমনকি চূড়ান্ত হিসাবের জন্য অপেক্ষা করতেও রাজি নন। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে যখন প্রথমে ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলো, তখন তারা বলতে থাকলেন_ হতেই পারে না। বস্তুতপক্ষে ওই বছরে চূড়ান্ত হিসাবে এই ৬.৭ শতাংশ হারেই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। এ বছরেও অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরে বলা হতে থাকল সরকারের ঋণের চাপ, মূল্যস্ফীতি, ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমতে থাকা, কুইক রেন্টালজনিত সমস্যা, বৈদেশিক সাহায্য কম আসা ইত্যাদি কারণে অচিরেই সংকট নেমে আসবে। এমন অবস্থা ২০০৭-০৮ সময়েও ছিল। সেটা অনেকটা বৈদেশিক সহায়তায় কাটিয়ে ওঠা গেছে। এবারেও গত তিন-চার মাসে পরিস্থিতির কিছুটা রাশ টানা সম্ভব হয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা এবং আমদানি হ্রাস ও রফতানি বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে মূল্যস্ফীতি কমেছে, টাকা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রয়েছে। বিশ্বব্যাংকও সর্বশেষ প্রতিবেদনে এর প্রশংসা করেছে। এ ধরনের নীতি-কৌশলও কিন্তু অর্থনীতির পণ্ডিতদের জন্য উদাহরণ হতে পারে।
এবারে বাজেটের প্রসঙ্গে আসি। অর্থনীতিতে কী ভালো হয়েছে, সেটা কেউ স্বীকার করতে পারেন, না-ও পারেন। মন্দ দিক প্রসঙ্গেও একই কথা। কিন্তু চলতি প্রসঙ্গে ব্যস্ত থেকে যেন আরও ভালো করার জন্য কী করা দরকার এবং কীভাবে করা দরকার সে আলোচনা থেকে নিজেদের সরিয়ে না রাখি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কাঠামোগত সংস্কার। এটি করা না গেলে অর্থনীতিতে টেকসই গতিশীলতা আসবে না, সেটা অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ বড়ই কম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিদেশি সহায়তা চলতি বছরে কম এসেছে। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে বাজেটে বিদেশি ঋণ-অনুদানের পরিমাণ থাকত জিডিপির ১০ শতাংশের মতো। কিন্তু এবারে মিলেছে ১.৩ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মিলেছে ১.৩৪ শতাংশ। যখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিরূপ থাকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে, আমদানি ব্যয় বাড়ে_ এ ধরনের পরিস্থিতিতে বছরে ১০০-১৫০ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা পেলেই রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের ঘাটতি মেটানো যেত। ফলে ফিসকাল ঘাটতি মেটানোর অপর উৎস অভ্যন্তরীণ সূত্রের ওপর (ব্যাংকিং ও অ-ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের অপেক্ষাকৃত বেশি সুদে ঋণ গ্রহণ) এভাবে চাপ পড়ত না। এখন প্রশ্ন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ১০০-১৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তা জোগাতে কেন পারছি না? বাজেটে এ নিয়ে আলোচনা থাকা উচিত ছিল, কিন্তু নেই। শুধু এ বছর নয়, আগেও মেলেনি। কী কারণে পাওয়া যায়নি সেটা তুলে ধরা হলে জনগণ বুঝতে পারত যে এ জন্য কে দায়ী এবং কেনই বা ঋণ-নির্ভর বাজেট (যেটা জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন)। এটা মস্ত ধাঁধা যে সরকার একদিকে বিদেশি সাহায্য সংগ্রহ করতে পারছে না, অন্যদিকে পাইপলাইনে প্রচুর অর্থ-প্রস্তাব জমা পড়ে আছে। একদিকে আমরা বিদেশি সাহায্য চাইছি, একই সঙ্গে ঘরের দোরে এ সাহায্য প্রস্তাব নিয়ে কেউ কেউ হাজির থাকলেও সেটা নিতে পারছি না।
যদি সক্ষমতার অভাব হয়ে থাকে, তাহলে সমাধান হচ্ছে এটি বাড়াতে হবে। কোন কোন মন্ত্রণালয়ে বৈদেশিক সহায়তাধীন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি ঘাটতি সেটা নিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের অধীনে সভা হতে পারে। দরকার মনে করলে পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য এ সক্ষমতাকে পদোন্নতি ও অন্যান্য সুবিধার শর্ত করা যায়।
যদি দেখা যায়, দাতাদের কোনো কোনো শর্ত অযৌক্তিক, যেমনটি অতীতে দেখেছি_ সেটাও জনগণকে বলা দরকার। তাহলে দাতারাও বড় মুখে বলতে পারবে না যে বাংলাদেশ সরকার ঋণ-অনুদান ব্যবহার করতে অসমর্থ।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসবে_ আমাদের প্রশাসনিক দক্ষতা কি কমে গেছে? যদি এটা হয়ে থাকে তার সমাধান হচ্ছে দক্ষ ও সৎ ব্যক্তিদের এসব প্রকল্পে দায়িত্ব প্রদান করা। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে যে ধরনের প্রশ্ন উঠেছে তেমনটি ঘটতে থাকলে কখনোই ছাড় মিলবে না, এটাই এখনকার বাস্তবতা। স্পষ্টতই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ব্যতিরেকে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মিলবে, এমন সম্ভাবনা কম।
কাঠামোগত সংস্কার প্রশ্নে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাঁধা হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জন কম থাকছে। সাধারণত সৎ বা অসৎ যে কোনো লোকেরই বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা থাকে। ঠিকাদার টাকা ব্যয় না করলে কীভাবে লাভবান হবে? তারা কেন এপ্রিলের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ এবং জুনের মধ্যে ১০০ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পারবে না? যদি ১০০ শতাংশ ব্যয় করা হয় তাহলে প্রশ্ন আসবে_ গুণ-মান ঠিক আছে তো? আমাদের অর্থমন্ত্রীর বাজেটে এটা কখনও সংযোজিত হতে দেখা যায়নি যে, বড় বড় কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে কী অগ্রগতি হয়েছে। কাজ শেষ করা গেলেই যেখানে বিল মিলবে, সেখানে কেন পুরো অর্থ ব্যয় করা যায় না_ এ রহস্যের জট খোলা দরকার। একান্তই যদি আমাদের সচিবালয়কেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় সরকারের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা থাকে তাহলে ১০-১৫ শতাংশ কাজ স্থানীয় সরকারের হাতে তুলে দিতে সমস্যা কোথায়? ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনগুলোকে এ ভার দেওয়া যেতে পারে। তারা স্থানীয় বাস্তবতার নিরিখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করবে। এভাবে ফিসকাল বিকেন্দ্রীকরণ করে সমস্যার সমাধান মিলতে পারে। ভারতের কেরালা রাজ্যে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় সরকারের কাছে দেওয়া হয়। উন্নত দেশগুলোতে এর হার আরও বেশি।
প্রশ্ন আসতে পারে স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা রয়েছে কি-না। এ ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব হতে পারে_ কেন্দ্রীয় সরকার দেবে ৮০ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার ২০ শতাংশ। নিজস্ব রাজস্ব আয় থেকে তারা এ অর্থের জোগান দেবে। গত এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে থাকছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কর আদায়ের সুযোগ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে ট্যাক্স-কোড কিছুটা বদলাতে হবে_ স্থানীয় সরকারের কোন কর্তৃপক্ষ কী ধরনের কর আদায় করতে পারবে সে বিষয়টি এতে স্পষ্ট করা থাকবে। লোকাল গভর্নমেন্ট সাপোর্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প রয়েছে, যার উদ্দেশ্য স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো। প্রকৃতই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ১০-১৫ শতাংশ বিকেন্দ্রীকরণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাটতি স্থানীয় সরকার কর্তৃক পূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
তৃতীয় যে সংস্কারের প্রশ্নটি তুলতে চাই সেটা হচ্ছে ঢাকার অভ্যন্তরে এবং বাইরের জেলা-উপজেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। এ লক্ষ্য অর্জন কেবল সম্পদ বরাদ্দের বিষয় নয়। যারা বস্তিতে থাকে, তারা কি এভাবে থাকতে চায়? প্রকৃতপক্ষে তারা কাজের স্থলের কাছাকাছি থাকতে চায়। দূরে থেকেও যদি সহজে আসা-যাওয়া করা যায়, তাহলে সে বিকল্প অবশ্যই বিবেচনায় থাকত। শ্রীলংকার কলম্বো শহরে দেখেছি গল এক্সপ্রেস অনেকেরই পছন্দ। এতে চেপে সকালে অনেকে রাজধানীতে আসে এবং সন্ধ্যায় ফিরে যায়। এর প্রভাব কলম্বোতে যানজট নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। শহরের ভেতরে ও বাইরে যোগাযোগ বাড়ানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও রয়েছে। আমাদের জাতীয়তাবাদ এক। রাজধানী এক। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-গরিব_ সবাই এক সমাজের অংশীদার। বিদেশে গেলে দেখি, সব ধরনের নাগরিক বাস-ট্রাম-রেলগাড়ি-মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে-ফেরি_ এসব যান ব্যবহার বেশি করে। কিন্তু আমাদের দেশে চলার পথেই শ্রেণী বিভাজন স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। গরিবরা পায়ে হাঁটে, নিম্নবিত্তরা বাসে চাপে, মধ্যবিত্তরা রিকশা-সিএনজি ব্যবহার করে। আর সচ্ছলরা চাপে প্রাইভেট কার কিংবা সিএনজিতে। যেখানে উন্নত পুুঁজিবাদী দেশগুলোতে পরিবহনের ক্ষেত্রে চালু রয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সেখানে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজ দাবি করেও পরিবহনের ক্ষেত্রে চালু রেখেছি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং দিনে দিনে তা প্রকট হচ্ছে। আমাদের জাতীয় বাজেটে এমন কোনো প্রস্তাব নেই যাতে গণপরিবহন ব্যবস্থা সুলভ হতে পারে। এ জন্য যে বিনিয়োগ সুবিধা দরকার, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। যদি আমরা এ পথে অগ্রসর হই, জাতীয় সঞ্চয়েও তার প্রভাব পড়বে। অনেক অনেক নারী-পুরুষ ব্যক্তিগত যানবাহন ছেড়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে শুরু করলে পারিবারিক ও জাতীয় সঞ্চয় বাড়বে।
দুঃখের বিষয় যে অবকাঠামো খাতের বেশ কয়েকটি প্রকল্প অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও তার বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের ধারেকাছেও নেই। যেমন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের সড়ক পথ, বুড়িগঙ্গা নদীর নাব্যতা বাড়ানো, রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ এবং রেল যোগাযোগের প্রসার। এসব ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হচ্ছে তার প্রধান কারণ অর্থের অপ্রতুলতা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ-আয়োজনের অভাবও গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু কেন হলো না, সে বিষয়ে সরকার জনগণের কাছে সঠিক তথ্য জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। ত্রুটি কোথায় ছিল এবং তার নিরসনে যে পদক্ষেপ নেওয়া হলো দাতারা কেন তাতে সন্তুষ্ট হলো না? এটি ছিল আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বব্যাংকের বৃহত্তম আর্থিক প্রকল্প। স্বল্প সুদে ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ না পেলে এ ধরনের প্রকল্প লাভজনক হয় না। মালয়েশিয়া বা অন্য দেশ থেকে বেশি সুদে ঋণ নেওয়া হলে তা পরিশোধের জন্য টোলের হার বাড়াতে হবে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুতে নামমাত্র সুদে ঋণের কারণেই টোলের হার কম রাখা সম্ভব হচ্ছে। এ বছরের বাজেটে পদ্মা সেতু খাতে ৮০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ ধরনের বরাদ্দ রাখা হলে ২০ বছরের বেশি সময় দরকার হবে সেতু নির্মাণে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলেই ফেলি। বড় বড় প্রকল্পে কেবল সরকারি নিরীক্ষা যথেষ্ট নয়। প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে কি-না, বাস্তবায়ন ঠিকভাবে হয়েছে কি-না_ এসব দেখার জন্য স্বাধীন সংস্থাকে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। আমাদের বোধকরি তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো শক্তিশালী উন্নয়ন কর্মসূচি মূল্যায়ন কমিশন দরকার, যার কাজ হবে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পর্কে সরেজমিন মূল্যায়ন শেষে অভিমত প্রদান। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান উন্নত দেশগুলোতে রয়েছে। তারা সরকার ও গণমাধ্যমকে পর্যালোচনার ফল জানাবে। এমনকি বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রকল্পগুলোর বিষয়েও এ দুটি সংস্থার স্বাধীন মূল্যায়ন টিম রয়েছে, যারা বোর্ডে সরাসরি প্রতিবেদন পাঠায়।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রসঙ্গে উদ্যোগ নেই, সেটা বলেছি। সরকার নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেনি যা এতক্ষণ যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলো তা দূর করায় সহায়ক হতে পারে। শুধু তাই নয়, তারা চলতি দক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথভাবে চলার ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এখন দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নেই। ফলে কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং কর্মসংস্থান পরিস্থিতি উন্নত না হলে দুই দিক থেকেই জনগণের সমস্যা। বর্তমানে স্বনিয়োজিত ও মজুরিভিত্তিক_ এই দু’ভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মজুরিভিত্তিক কাজে সরকারের তেমন উদ্যোগ নিতে হয় না। এটা করে বেসরকারি খাত। যেমন কৃষি। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ভালো। কৃষি মজুররা দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করে। শহর এলাকায় নির্মাণ খাতে কাজ মেলে এবং মজুরির হার ভালো। স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গ্রামে ক্ষুদ্রঋণের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কৃষি খাতের মতো এ ক্ষেত্রেও দুই দশক ধরে চলছে নীরব কর্মযজ্ঞ। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের নামে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু অযাচিত উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়, যা স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান পরিস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ গ্রামীণ ব্যাংক এবং তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গত বছর সরকারের তদন্ত কমিটি এবং এ বছর তদন্ত কমিশন গঠন। এর ফলে অন্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো কিছুটা হলেও ভীত হয়ে পড়তে পারে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সম্মান ও মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে এই নাগরিক আশঙ্কা বাদ দিলেও স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের বৃহত্তর তাগিদ থেকে এ বিষয়টি তুলে ধরছি। আশ্চর্যের কথা এই যে, যে আর্থিক সংস্থার স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন নেই সেখানে যখন অহেতুক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে_ এর বিপরীতে সরকারি ঋণদানকারী যেসব সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য প্রকৃতই ঝুঁকিতে তাদের জন্য কোনো কমিটি-কমিশন সরকার গঠন করছে না। আশির দশকে মন্দ ঋণের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সে সময়ে এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। এখনকার অবস্থা তখনকার তুলনায় কিছুটা ভালো হলেও অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, এমন প্রবণতা লক্ষণীয়। এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে তিন ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। এক. বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে শ্রেণীবদ্ধ ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পেঁৗছেছে। এর মধ্যে যৎসামান্য নগদ আদায়_ ১০ শতাংশ বা তার কম। বাকি সবটাই পুনঃতফসিল। এ ক্ষেত্রে নিয়ম যেখানে সর্বোচ্চ তিনবার করার, সেখানে ৮-১০ বারও করা হচ্ছে। এতে করে তারল্য সংকটের কারণে নতুন ঋণগ্রহীতার কাছে তহবিল পুনঃচক্রায়িত করা যাচ্ছে না। এ ধরনের পুনঃতফসিলের কারণে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব অনেকখানি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দুই. যেসব ঋণ গত কয়েক বছরে দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশ উৎপাদনমুখী খাতে দেওয়া হয়েছে কি-না, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে কতটা দেওয়া হয়েছে তার মূল্যায়ন কোনো সরকারি প্রতিবেদনে পাওয়া যায় না। এ জন্য কোনো কাজ হচ্ছে বলেও এ মুহূর্তে জানা নেই।
তিন. সরকারি এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালক হিসেবে যারা রয়েছেন তাদের অনেকের পেশাগত ব্যাংকিংয়ের পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে, রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য। এটাও লক্ষণীয় যে, যখন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ তহবিলের জন্য অর্থ সংকটে ভুগছে সেখানে নতুন করে কোন বিবেচনায় কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হলো। এর পেছনে দৃঢ় অর্থনৈতিক যুক্তি মেলে না। যুক্তি মিলত যদি এসব ব্যাংক এমন কোনো খাতের জন্য নির্দিষ্ট থাকত কিংবা নতুন কোনো ফিন্যান্সিয়াল প্রডাক্ট বাজারে আনত_ যেমন : ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ, আদিবাসী, চর এলাকা কিংবা স্থানীয় সরকারের জন্য অর্থায়ন। অতীতে বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংক কোনো না কোনো রাজনৈতিক কানেকশনে অনুমতি পেয়েছে, এটা বড় করে দেখতে চাই না। কিন্তু দক্ষতার প্রশ্ন তো তোলা উচিত।
বাজেট আলোচনায় গরিবদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রসঙ্গ থাকেই। ধরে নেওয়া হবে, প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে যতটা কর্মসংস্থান হবে তার বাইরে যারা থাকবে তাদের এ বেষ্টনীর মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া হবে। নব্বইয়ের দশকে বাজেটে এ বাবদ জিডিপির ০.৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকত (বাজেটের ৫ শতাংশ)। এখন তা জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে (মোট সরকারি ব্যয়ের ১৬-১৮ শতাংশ)। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে উইন উইন কৌশল মনে হতে পারে। কিন্তু কার্যত কি তাই? এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এর তিনটি কারণ তুলে ধরব। এক. এসব কর্মসূচিতে যে পরিমাণ মাসিক সুবিধা দেওয়া হয় তা অতি নগণ্য। ৩০০-৫০০ টাকার বিধবা ভাতা কিংবা অন্য কোনো হেডে সহায়তার পরিমাণ এক বা দেড় দিনের কৃষি মজুরির সমান। এতে দরিদ্রের পক্ষে মই ধরে ওপরে ওঠার সুযোগ নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে, এ ধরনের কর্মসূচি, বিশেষ করে খাদ্যভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটে, যার পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অনেক এলাকায় অবহেলিত জনগোষ্ঠী এসব কর্মসূচির আওতায় আসতে পারে না। তৃতীয় সমস্যা যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ_ বাজেট মানেই গরিবমুখীনতা, এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে না পারা। আর্থিক বরাদ্দ না বাড়িয়েও অনেক উপায়ে দারিদ্র্য নিরসন করা সম্ভব। যেমন খাস জমি বিতরণ। যে খাস জমি সরকারের হাতে রয়েছে তা নিয়ম অনুযায়ী ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করা চাই। অনেক গবেষণায় প্রমাণিত, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় এ ব্যবস্থায় অনেক পরিবার উপকৃত হয়েছে। এ বিষয়টি আমাদের বাজেট আলোচনায় যেমন অনুপস্থিত তেমনি মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এ নিয়ে তাগিদ দেখা যায় না। অথচ মাত্র দুই দশক আগে আমাদের বাবা-দাদারাই তো কৃষি কাজে নিযুক্ত ছিলেন! এ ধরনের শ্রেণী বিস্মৃতি সত্যিই বিস্ময়কর। তাছাড়া শহর ও গ্রামের মধ্যেও রয়েছে বিস্মৃতি। শহরের দরিদ্ররা যেন দরিদ্র নয়, তারা যেন অনুপ্রবেশকারী। গ্রামের দরিদ্রদের জন্য যা কিছু ব্যবস্থা সেসব শহরের দরিদ্রদের জন্য বন্ধ। দিনবদলের এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সরকারের কাছে এটা আশা করিনি।
একটি সাবেকী মত হচ্ছে প্রবৃদ্ধি আবশ্যকীয়, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। এখন মত বদল হচ্ছে। যে প্রবৃদ্ধি পরিবেশ ধ্বংস করে, প্রাকৃতিক সম্পদ অবক্ষয় করে সে প্রবৃদ্ধি যেমন স্থায়িত্বশীল হয় না, তেমনি তা হয় বৈষম্যবর্ধক ও জনকল্যাণ বিরোধী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুরাগ নদ ভরাট করে নির্মাণ শিল্পের বিকাশ। হাইপোথেটিক্যালি বলা যায়, বুড়িগঙ্গা ভরাট করে শিল্প নগরী করা হলে সেটা কি মেনে নেব? বিদেশি বিনিয়োগ অবাধ হলে প্রবৃদ্ধি চীনের মতো ১০-১১ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সমাজের অকল্যাণ হতে পারে, পরিবেশের সর্বনাশ হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাজেটের কোথাও পরিবেশসম্মত উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বলা নেই। বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পরিবেশ সহনশীল প্রবৃদ্ধির কৌশল বাস্তবায়ন সহজ নয়। এ জন্য যেমন কর প্রশাসনে গ্রিন ট্যাক্স বড় ভূমিকা পালন করবে, তেমনি পরিবেশ দূষণকারী সব নির্মাণ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে বন্ধ করা হবে। এ ক্ষেত্রে সংস্কার ছাড়া জলবায়ু বিপন্ন এ দেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বশীল জনকল্যাণমুখী প্রবৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব।
আমাদের জন্য দুঃখের বিষয় যে একটি রাজনৈতিক সরকার উন্নয়নকে কেবল ৫ বছরের মেয়াদেই সীমিত দেখতে চায়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের যতটা সুযোগ প্রথম বছরে থাকে, নির্বাচনের আগে দুই বছরে সে তাগিদ ফুরিয়ে যায়। বর্তমান সরকার প্রথম দুই বছরে মন দিয়েছে শেয়ারবাজারে কৃত্রিম তেজীভাব সৃষ্টি করে চটজলদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তড়িঘড়ি সমাধানের প্রতি। যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার তুলে ধরা জরুরি ছিল, তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় চলে যায় পেছনের সারিতে। শেয়ারবাজার ও কুইক রেন্টাল সরকারকে বিপদে ফেলেছে। তবে খেলায় এখন হাফ টাইমের বিরতি চলছে। এখনও সময় আছে, যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা এতক্ষণ তুলে ধরলাম সেদিকে মনোযোগ দিলে সরকার হয়তো ক্রমশ লুপ্ত জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

ড. বিনায়ক সেন : অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক এবং গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক

তিমিরবিনাশী দুই কবি

বিনায়ক সেন

দু’জনেই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। বিদেশী অনুষঙ্গে তাদের মননচর্চা ছাত্রাবস্থা থেকেই বিশিষ্ট হয়ে উঠছিল। মালার্মে-ভালেরী তো ছিলেনই, আরো ছিলেন রিল্কে, ইয়েটস, এলিয়ট, এলুয়ার, আরাগঁ, অডেন। জীবনানন্দের জন্য বাড়তি প্রেরণা ছিলেন কীটস; শামসুর রাহমানের জন্য পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতার ঋতুবদলের প্রধান উৎস বোদলেয়ার। উভয়ের জন্যই এক অভিন্ন আশ্রয়স্থল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শামসুর রাহমান তার নানা কবিতায় বেশুমার ব্যবহার করেন অগ্রজ ও সমসাময়িক কবিদের নাম। শুধু য়ুরোপীয় সাহিত্যের সূত্রে নয়, হাত বাড়ান তার বাইরেও যেমন জালালুদ্দিন রুমী, নাজিম হিকমত, গার্সিয়া লোরকা, পাবলো নেরুদা, সেজার ভায়েহো। জীবনানন্দ এটা প্রায় কখনোই করেননি এত গভীরভাবে বিদেশী সাহিত্য পড়া ও পড়ানোর মধ্যে নিমজ্জিত থেকেও। ব্যতিক্রম হয় শুধু রবীন্দ্রনাথের বেলায়। দু’জনের কবিতায় নানা সময়ে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ। তবে গদ্য রচনায় ও পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায় জীবনানন্দ নিবিষ্ট আলোচনা করছেন বিদেশী নক্ষত্রমণ্ডলের সেখানে ইয়েটস, রিল্কে, হার্ডি, হাউসম্যান, সিটওয়েল, এলিয়ট, পাউন্ড, ডে-লুইস, স্পেন্ডর, অডেন, কামিংস কেউ বাদ পড়ছেন না। দু’জনেই আবার সমসাময়িকদের রচনা নিয়ে মনোযোগী আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছেন। জীবনানন্দ নিয়ে সুধীন্দ্রনাথ কোনো অব্যাখ্যাত কারণে একটি বাক্যও মন্তব্য করেননি [অন্তত তার জীবদ্দশায়]। সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জীবনানন্দ উচ্ছ্বসিত আলোচনা করেছেন এমনকি কাব্যবিচারে তাকে স্থান দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু-অমিয় চক্রবর্তীর উপরে। শোনা যাক তারই অননুকরণীয় কণ্ঠে :

‘সুধীন্দ্রনাথ আজকাল কবিতা লেখা একদম ছেড়ে দিয়েছেন। এই কবির প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিস। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশী-বিদেশী খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। … আধুনিক সাহিত্যের প্রায় কারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ; তার নিজের এষণার কবিতালোকে তিনি আধুনিক প্রায় সকল কবির চেয়েই বেশি আন্তরিক নন কি?’

‘সুধীন্দ্রীয় কাব্য’ এই অভিধাও জীবনানন্দেরই দেয়া। এই কাব্য একাধারে ‘নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক’। শামসুর রাহমানও তার সমসাময়িক ও তরুণ প্রজন্মের কবি-শিল্পী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে উৎসর্গ করেছেন স্মরণীয় সব কবিতা। এতে হয়তো বিস্ময়ের কিছু নেই :শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৫টি। [এর সমতুল্য কাব্যগ্রন্থ রচনা কোনো বাঙালি কবিরই আজো নেই)। কিন্তু মনের বিশাল উদারতাও ছিল সমকালীনের প্রতি এত ঘনিষ্ঠ মনোযোগের পেছনে একটা কারণ। রশীদ করীম [যিনি শামসুর রাহমান সম্পর্কে একাধিক নিবিষ্ট লেখার জন্ম দিয়েছেন তার কাব্যকৃতির নানা দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে] আড্ডার ছলে জানাচ্ছেন ‘বেচারা শামসুর রাহমান একবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নামের সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে রশীদ করীমের নামটি উচ্চারণ করে বড়ই নাকাল হয়েছিলেন।’ ঐ লেখাতেই রশীদ করীম জানিয়েছেন যে শামসুর রাহমান তাকে রহস্য করে বলেছেন, ‘আমার সাম্প্রতিক লেখাগুলোতে আপনাদের নাম বড় বেশি উলি্লখিত হচ্ছে। কিছুদিন একেবারে ‘ব্ল্যাক-আউট’ করতে হবে। নামগুলো শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ এবং আরো কিছু কিছু নাম’। এর সত্যতায় সন্দেহের কিছু নেই। শামসুর রাহমানের নিজের সৃষ্ট ক্ষুদ্রায়তন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সমসাময়িক ও তরুণ প্রজন্মের দেশী-বিদেশী কবি-সাহিত্যিকের ওপরে আলোচনা।

জীবনানন্দকে পারলে সবাই কোন না কোন সময়ে, কখনো কোন কারণ ছাড়াই, ঠুকেছেন। অনেক ক্ষেত্রে ঠোকা হয়েছে পরস্পরবিরোধী কারণে ও উপলক্ষে। কেন আরো বেশি করে জনগণের কবি হয়ে উঠতে পারেননি এই অভিযোগে কবিকে ‘তুলোধোনা’ করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জীবনানন্দর মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণায় সুভাষ লিখেছেন, ‘আমি আকথা কুকথা লিখলেও আমার প্রতি স্নেহ-মমতায় কোনো টান পড়েনি’ এবং এমন আভাস দিয়েছেন যে, তার পূর্বতন সমালোচনাটুকু লেখা হয়েছিল ‘সাতটি তারার তিমির’ না পড়েই! আবার, ‘সাতটি তারার তিমির’ ও এর পরবর্তী সময়ে সমাজ-ইতিহাস-দর্শনবিদ্ধ কবিতা লেখার কারণে ‘কবিতা’ পত্রিকার গোষ্ঠী [বুদ্ধদেব বসুসহ] তাদের প্রাক্তন সমর্থন ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। বুদ্ধদেবের এই ক্রমনিরাসক্তি জীবনানন্দের চোখ এড়ায়নি। প্রভাকর সেনকে লেখা ১৯৪৬ সালের এক চিঠিতে জীবনানন্দ আক্ষেপহীনভাবে বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে প্রগতির ও বুদ্ধদেব বসুর কাছে আমার কবিতা ঢের বেশি আশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল … অতএব সাহস ও সততা দেখাবার সুযোগ লাভ করে চরিতার্থ হলাম বুদ্ধদেব বাবুর বিচারশক্তির ও হৃদয়বুদ্ধির; আমার কবিতার জন্য বেশ বড় স্থান দিয়েছিলেন তিনি ‘প্রগতি’তে এবং পরে ‘কবিতা’য় প্রথম দিক দিয়ে। তারপরে ‘বনলতা সেন’-এর পরবর্তী কাব্যে আমি তার পৃথিবীর অপরিচিত, আমার নিজেরও পৃথিবীর বাইরে চলে গেছি বলে মনে করেন তিনি। এর বিপরীতে ‘পূর্বাশা’ [ও ‘নিরুক্ত’]পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করেছেন যে, জীবনানন্দের শেষের দিকের কবিতায় বরং তার ‘পারিপাশর্ি্বক চেতনা প্রৌঢ় পরিণতি’ লাভ করেছে। এই প্রশংসায় অবশ্য পুরোপুরি সায় ছিল না জীবনানন্দের কেননা সমাজ-ইতিহাস চেতনার বাইরে আরো কয়েকটি নতুন ‘সুর’ রয়ে গেছে আবিষ্কারের অপেক্ষায় এমনটা তার মনে হয়েছিল। ‘সাতটি তারার তিমির’ এর কবিতা রূপ নিয়েছে ‘দার্শনিকতায় এবং সে দর্শনও অবোধ্য’ এই অভিযোগ উঠেছে আবু সঈদ আয়ুব, অশোক মিত্র, তরুণতর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছ থেকে। যদিও কবির মৃত্যুর পর নীরেন্দ্রনাথ তার পূর্বতন অবস্থান কিছুটা শুধরে নিয়ে বলেছেন :’তার এই সময়ের কবিতা যদি আমাদের কাছে ঈষৎ দুর্বোধ্য লাগে তার ভাবনানিব্যাসকে যদি ঈষৎ অসচ্ছ অস্পষ্ট অবয়ব বলে মনে হয় তাতে বিস্ময়বোধের কারণ নেই। তার কারণ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে মহৎ কবিমাত্রেই আমাদের থেকে দু-দশ বছর সামনে এগিয়ে থাকেন।’
তুলনামূলকভাবে ছোট পরিসরে শামসুর রাহমানকেও কাছের ও দূরের বলয় থেকে নানা বিরুদ্ধ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রেমের বনাম রাজনৈতিক কবিতা, তাৎকাল্য প্রবণতা বনাম কালোত্তীর্ণতা, নগরকেন্দ্রিকতা বনাম বৃহত্তর জনজীবন মুখীনতা, বিদেশী উপমা-উৎপ্রেক্ষা বনাম লোকজ উপমা অনুষঙ্গের অনুসৃতি, স্লোগান-ধর্মী বনাম শিল্পকলাসম্মত বিধি, নিজের কাব্যকলার ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি বনাম ক্রমাগত নবায়ন নানা কারণে [এবং কখনো কোন কারণ ছাড়াই] কবিকে এ দেশে বিভিন্ন অসুখী সমালোচনার তোপে পড়তে হয়েছে। তবে এসব কাব্যবিচার নিয়ে দু’জনের মধ্যেই এক ধরনের নির্লিপ্তি অনুভব করা যায়। আধুনিক বাংলা কবিতার দুই প্রধান স্থপতি রবীন্দ্র-উত্তর যুগের জীবনানন্দ দাশ ও জীবনানন্দ-উত্তর যুগের শামসুর রাহমান দু’জনেই সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হয়েও ছিলেন মূলত আত্মবৃত কবি। অন্নদাশংকর রায় জীবনানন্দকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসেবে, আর শামসুর রাহমান আমরণ কবিতারই ধ্যান করেছেন। দু’জনেই ছিলেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের সচরাচর নিঃসঙ্গকামিতার মাপকাঠিতেও ‘পাবলিক লাইফ’ থেকে অনেকটাই দূরত্বে। জীবনানন্দের শেষের দিকের কবিতাগুলোয় আদর্শগত অবস্থান এক নিজস্ব প্রগতিবাদী দৃষ্টিকোণে বিবর্তিত হচ্ছিল, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক ক্যাম্পে তিনি ছিলেন না। শামসুর রাহমান নানা প্রগতিবাদী আন্দোলন ও অবস্থানের সাথে কবিতার মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে ছিলেন একান্ত নির্জনতাপ্রিয়। জীবনানন্দের মধ্যে এটা তীব্র মাত্রায় ছিল বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘যে অতিলৌকিক আবহাওয়া তার কবিতার, তা-ই যেন মানুষটিকেও ঘিরে থাকত সবসময় তার ব্যবধান অতিক্রম করতে ব্যক্তিগত জীবনে আমি পারিনি। সমসাময়িক অন্য কোনো সাহিত্যিকও না।’

কবির সাথে আমার যৎসামান্য যে পরিচয় ঘটেছিল তাতে আমার ধারণা হয়েছে, শামসুর রাহমানও ছিলেন দিনের অধিকাংশ প্রহর নিরালায় থাকতে ভালোবাসেন এমন একজন মানুষ। বিশ্বসাহিত্যের উপরে অগাধ দখল সত্ত্বেও কখনো তাকে সেসব নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি বা কেউ দেখেছে বলে শুনিনি। নিজস্ব পড়াশোনাটাকে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই রেখে দিতেন অন্যের কাছে শুনতেই চাইতেন বেশি। তার ক্ষুদ্রায়তন প্রবন্ধগুচ্ছ তার নানা ধরনের পড়াশোনার বিশেষত কবিতার পঠন-পাঠনের নানা অভিজ্ঞতার সামান্যই তুলে ধরেছে।

একবার রবার্ট ব্লাই-এর অনুবাদে সেজার ভায়েহোর একটি কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে শামসুর রাহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘প্যারিসে মারা যাব আমি কোন বৃষ্টির সন্ধ্যায়’ কবিতাটি তার চোখে পড়েছে কিনা। উত্তরে মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনি জানালেন, ওটি তার একটি প্রিয় কবিতা এবং ওর প্রভাবে তিনি ষাটের দশকের শেষে নিজেই একটি কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। নাজিম হিকমতেরও নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন তিনি এবং শেষের দিকের বেশ কিছু কবিতায় নাজিমের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। আসলে, জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমান উভয়ের কবিতাতে নানা মহাদেশ থেকে আলো ঠিকরে পড়েছে, কিন্তু নিজেদের তারা উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন কেবল এই কারণে যে নিজেদেরকে তারা বদ্ধ পুকুরে ঘেরাও করে রাখতে চাননি। তার এক কবিতায় শামসুর রাহমান বলেছেন, বিশ্ব-সভ্যতার নানা সময়ের অনেক প্রতিভার কাছে দায়বদ্ধ বলেই তিনি প্রতিক্রিয়ার হুমকির মুখে পিছু হটতে চান না। তাছাড়া বিদেশী অনুষঙ্গ কিংবা চিত্রকল্প ব্যবহার করার আরেকটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘পাঠকের মানসিক দিগন্তকে একটুখানি প্রসারিত করে দেয়া।’ এ বিষয়ে আল মাহমুদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার কিছুটা মতভিন্নতা ছিল বলে রশীদ করীম জানিয়েছেন আমাদের। এই সূত্রেই আমরা বাংলা কবিতায় ব্রাকের মাছ, সেজানের আপেল আর মাতিস-শাগালের কুহকিনীদের আকাশে উড়তে দেখেছি।

২. জীবনানন্দকে যারা গাঁও-গেরামের কবি, আধুনিকতা-বিচ্ছিন্ন নির্জনতার কবি বলে মনে করেন এখনো এ রকম রয়ে গেছেন কেউ কেউ তারা তার যুক্তিধর্মী মানসগঠনকে ভুলে যান। পারিবারিক পটভূমির বিষয়টিও সময় সময় তাদের খেয়ালে থাকে না। জীবনানন্দের যুক্তিধর্মী মানসগঠন [যার জমিন ছেলেবেলাতেই নির্মিত হয়ে গিয়েছিল] সম্পর্কে প্রথমেই মনে রাখবার বিষয় হলো এই পরিবারের ব্রাহ্ম-সমাজীয় পটভূমি। বাবা সত্যনন্দ দাশ শুধু ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতার দায়িত্বই পালন করেননি, তাকে ঘিরে ‘এক উন্মেষধর্মী সংঘ গড়ে উঠেছিল সেখানে সাহিত্যিক, শৈল্পিক, নৈতিক, রাষ্ট্রীয় আলোচনায় বিকেলবেলা ও রাত্রিগুলো যেন কেমন একটি স্বাধিকার ফিরে পেত।’ তাছাড়া তার ধর্মজীবনও ছিল লক্ষ্য করার। শুধু যে বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের তিনি আচার্য ও বক্তা ছিলেন তা-ই নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিল। জীবনানন্দের বর্ণনায়, তার পিতা ‘সেকালের ঊনবিংশ শতাব্দীর ডারউইন, হাক্সলি, মিল এঁদের মতামত যেমন পর্যালোচনা করেছেন, তেমনই ওয়েলস-রাসেল এমনকি আধুনিক রাশিয়ার নববিধানের সঙ্গেও তিনি অপরিচিত ছিলেন না।’ পিতার ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁর ধর্মবিশ্বাস কোনো দিন আঘাত পেতে ভয় পেত না। ব্রাহ্মসমাজের পুরাচার্যদের কাছ থেকে ও নিজের পিতার কাছ থেকে যে ধর্মবিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন পুনরায় নিজের অন্বেষায় সে জিনিস অর্জন না করে ভোগ করবার মতোন অলস পাণ্ডিত্য তাঁর কোনো দিন ছিল না।’ এই ব্রহ্মবাদী পিতার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েই জীবনানন্দের ‘সজাগ প্রাজ্ঞ মন ইতিহাসধারার মুখোমুখি বসে ব্যক্তিগত দুঃখকে কখনো আক্ষেপে পরিণত হতে দেয়নি।’ সাহিত্যের আদি মূল্যবোধও তিনি পেয়েছিলেন কিছুটা পিতার এবং কিছুটা তার মা’র বাবা চন্দ্রনাথ দাশ ও মা কুসুম কুমারীর কাছ থেকে। কুসুম কুমারী বিদুষী ছিলেন :’বাবা-র ও পিসেমশায়ের অবর্তমানে তিনি বরিশাল-এর ব্রাহ্মসমাজে আচার্যের কাজ করতেন।’ কুসুমকুমারী কবিতা লিখতেন, তার সন্তানদের চেয়ে পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, যদিও বিয়ের কারণে এন্ট্রান্স দেওয়া হয়নি, তারপরও তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব অনুভব করা যায় সামান্য কয়েকটি বাক্যে।

চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে জীবনানন্দ একটি কবিতা লিখেছিলেন, সেটি পড়ে মা লিখলেন :’চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছ, ভালোই করেছ। কিন্তু রামমোহন-এর ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে। মহর্ষির ওপরেও।’ ছেলেবেলায় ঘুমানোর আগে বসে থাকতেন কখন মা দিনের সব কাজ শেষ করে ঘরে আসবেন। ‘সমস্ত দিনের শেষে দু’চারটে পত্র-পত্রিকা-বই নিয়ে’ মা পড়ছেন। আর মায়ের ‘মুখচোখের সামনের সেই প্রদীপটির দিকে তাকিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছেন’ এই ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকের সেই অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর স্মৃতিচারণ। অন্যদিকে এটাও কবির মনে হয়েছে যে, কুসুমকুমারী যখন সময় সময় ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, তখন ‘সেই আরাধনা উপাসনা আশ্চর্য নির্ঝরের মতো ধ্বনিত হয়ে তবুও ধ্বনির অতীত অর্থগৌরবের দিকে আমাদের মর্ম ফিরিয়ে রাখত; কোথাও ঠেকতেন না। তাল কেটে যেত না পুনরুক্তি ছিল না, কিন্তু যে সাহিত্যিকের ও কবির গরিমা তার প্রাপ্য ছিল, সেটাকে অন্তর্দমিত করে রাখলেন তিনি প্রকাশ্য কোনো পুরস্কার নিতে গেলেন না।’ আর পিতার ক্ষেত্রে যে ‘ভারতীয় দর্শন ও ভারতবর্ষের উপনিষদই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণের জিনিস ছিল’ একথা তো আগেই জানিয়েছেন। তবে বাড়তি যে উপাদানটি লক্ষ্য করার তাহলো পিতাকে নিয়ে কবির নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাটি : ‘প্রায় রোজ শেষরাতে বিশেষত হেমন্তকালে ও শীতকালে উপনিষদ-এর শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে তিনি আমাদের অপরূপ সূর্য-চেতনার প্রভাতে নিয়ে আসতেন।’ জীবনানন্দের এই স্মৃতিচারণা না বুঝলে কীভাবে তার ভেতরের যুক্তিধর্মী মানস ও নন্দনতাত্তি্বক অনুভব গড়ে উঠেছিল, তার উৎস নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এমনকি কিছু কিছু রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতি জীবনানন্দীয় সন্দেহের পেছনে তার পিতৃদেবের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল বলে আজ মনে হয়।

সত্যানন্দ দাশের ভাবাদর্শ নিয়ে বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন, ‘বিদেশের আগে নিজের দেশের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক দুরবস্থা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েও তিনি প্রচলিত ন্যাশনালিজম ও স্বদেশপ্রীতির ভিতরের পার্থক্য অনুভব করতেন। তথাকথিত ন্যাশনালিজমকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখলেও দেশাত্মবোধ তাঁর কাছে গৌরবের জিনিস ছিল। রাষ্ট্রিক আন্দোলনে তিনি নিবেদনের বা ভিক্ষা মানসিকতার পক্ষপাতী ছিলেন না। জনসাধারণের সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যে একটি বিভেদ রয়ে গেছে, তা না ঘোচালে অল্পস্বল্প বা বিশেষ রাষ্ট্রিক পরিবর্তনেও যে কোনও দেশেরই স্থায়ী মঙ্গল হবে না। এ-সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন। দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ পর্বের জাতীয়তাবাদের সমালোচনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ সত্যানন্দ দাশের সূত্রে জীবনানন্দকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র পর্বে এসে নেশনের ব্যভিচার নিয়ে যেসব কবিতা জীবনানন্দ পরবর্তীতে লিখেছিলেন তার পূর্বসাক্ষ্য এখানেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। শামসুর রাহমান সে তুলনায় ভিন্ন ঘরানার মানুষ। কিন্তু নিজের মা, বাবা, ভাই, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে অনেকগুলো স্মরণীয় ও পৃথকভাবে আলোচ্য কবিতা লিখেছেন তিনি সারা জীবনে। মাকে নিয়ে তার বিখ্যাত কবিতা ‘কখনো আমার মাকে’ কাব্যজীবনের প্রথম পর্বেই রচিত হয়ে গিয়েছিল। কুসুমকুমারীর মত কবিতা লিখতেন না তিনি, এমনকি গুনগুনিয়ে গানও করতে শোনেননি মাকে। কিন্তু জীবনের সংকটময় মুহূর্তে নৈতিক সাহস যুগিয়েছেন তিনিই কবিকে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হামলায় কায়রোয় ছুরিকাহত হয়েছিলেন নাগিব মাহফুজ, সেই একইভাবে একই যুগে এ রকম হামলার মুখোমুখি হয়েছিলেন এদেশে হুমায়ুন আজাদ ও শামসুর রাহমান। সেই আতঙ্কের রেশ ও মহাপতনের শব্দ শোনা যায় কবির শেষ দিককার কাব্যগ্রন্থগুলোয়। তবে সেখানেও তার আঁকড়ে-ধরার উৎসমূল তার মা। মার সাথে হয়তো কোনদিন আর দেখা হবে না জেনেও স্বপ্নে তিনি শুনতে পান মা তাকে ভরসা দিচ্ছেন, বলছেন, যতক্ষণ তিনি সত্যের পথে অছেন, কোন ভয় নেই তার। অন্যত্র, মাতামহীর টাইপরাইটার অলৌকিকভাবে আবৃত্তি করতে থাকে কোরানের আয়াত, আওড়ায় ফার্সি বয়েত। কবির স্বপ্নের দ্বীপে তার মাতামহী হয়ে দাঁড়ান প্রজ্ঞাবান প্রস্পেরো। আর এসবই ধরা পড়ে কবির কাছে যখন তিনি ভাবছিলেন উপনিষদ তর্জমা করার সময় যুবরাজ দারাশিকোর মনে কি ভাবনার দোলা দিচ্ছিল, অথবা কী রকম জীবন ছিল সেইসব ইহুদীদের যারা আউসভিৎসের কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন।

৩. ২০ শে মে ১৯৫৩’র চিঠিতে সুরজিৎ দাশগুপ্তকে জীবনানন্দ লেখেন, ‘আমার কবিতা সম্বন্ধে নানা জায়গায় নানা রকম লেখা দেখেছি/মন্তব্য শুনেছি; প্রায় চোদ্দআনি আমার কাছে অসার বলে মনে হয়েছে।’ অসারত্বের একটি নবতর নমুনা পাওয়া যায় ঐ উক্তির পাঁচ বছর পরে বেরুনো সুকুমার সেন-এর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে। ততদিনে কবি বেঁচে নেই। জীবনানন্দের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি গোবিন্দচন্দ্র দাসের সাথে কবির নৈকট্য দাবী করে বসেন : ‘গোবিন্দচন্দ্র দাসের পর জীবনানন্দই একমাত্র যাহার রচনায় পূর্ববঙ্গের নিজস্ব আবেষ্টনের রূপ ও রস ধরিয়াছে। তবে জীবনানন্দের অবলম্বিত বিশিষ্ট শিল্পকৌশলে সে প্রাকৃতিক আবেষ্টন শেষ অবধি কতকগুলি যেন সিম্বলে বিধৃত হইয়া হারাইয়া গিয়াছে’। এখন বোঝা যায় কেন অধ্যাপকদের উদ্দেশ্য করে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা’!

বেঁচে থাকলে গোবিন্দচন্দ্র দাসের সাথে তুলনা জীবনানন্দকে আরো বেশি আহত করত কেননা সহজাত বা স্বভাবকবিত্ব বিষয়টিকে বরাবরই প্রতিভার নিতান্ত প্রাথমিক লক্ষণ বলে জ্ঞান করেছেন তিনি। সহজাতের হাত ধরে চূড়ান্ত পরিণতিতে পেঁৗছানো দুরূহ। ‘কবিতা, তার আলোচনা’ প্রবন্ধে তিনি সহজ কবিগুণকে আরো দর্শন সচেতন ও জ্ঞানশুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ‘পৃথিবীর ও নিজের জীবনের ক্রমিক অভিজ্ঞতায়, কোন অভিজ্ঞতার কী মূল্য সেই চেতনায়, বিজ্ঞান কী দিতে পারছে, পারবে, জ্ঞান কী দিল’ এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে তরুণ কবিস্বভাবকে ‘আরো সজাগ ও তপঃশক্তিশীলভাবে শিক্ষিত ও অনুভূতিঘন ও সুস্পষ্ট’ করে তোলার পরামর্শ ছিল তার। তার মানে এই নয় যে, কবিকে তিনি বৈজ্ঞানিক, অর্থনীতিবিদ বা দার্শনিক হয়ে যেতে বলছেন। সেখানে একটা সীমারেখা টানতেই হয়েছে তাকে : ‘দার্শনিকের মতো এতটা সচেতন ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নয় কান্ট’এর মতো বা মার্ক্স’এর মতো নয়’, কিন্তু তবুও আরো প্রশিক্ষিতভাবে অগ্রসর হতে বলছেন তরুণ কবিকে এবং এ পথেই কেবল নিজেকে সফল ও শুদ্ধ করে নেয়া সম্ভব। তরুণ-কবির কাছে রিল্কে যে-উপদেশ দিয়েছিলেন, সেভাবেও এই রচনাটিকে দেখতে পারি আমরা। বাংলাদেশে মনন-বিরোধী চর্চার একটা ধারা বেশ কিছুকাল ধরে চালু হতে শুরু করেছে মনন-বিরোধী এক ‘বাউলিয়ানার চর্চা’ বলা যেতে পারে একে। জীবনানন্দের প্রবন্ধ-সমগ্র ঘাঁটলে এ রকম ধারার প্রতি তার সায় থাকত না এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বনলতা সেন-উত্তর জীবনানন্দের প্রেক্ষিতে তো এটা নিদ্বর্িধায় বলা যায়। লোককবি ও কবিতা সম্পর্কে তার বক্তব্য অশ্রদ্বেয় কিছু ছিল না, কিন্তু একে শিল্পের আদর্শকল্প ভাবতে চাননি কখনোই : ‘লোক কবিতা বলতে না বোঝায় আমাদের দেশে সেটা ভালো জিনিস, কিন্তু নিজের স্বভাবগুণকে আরও শিক্ষিত, ক্রমেই বেশি-শিক্ষিত করে নিয়ে ঢের বেশি পরিণতির পথে চালিয়ে নিতে পারা যায়। অনেক বৈষ্ণব কবির সহজাত কবিত্ব ছিল শিক্ষিত হয়েছিলেন কিন্তু ততবেশি শিক্ষিত দেশ, সমাজ, সে কালের বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক জ্ঞান ও প্রস্থান সম্পর্কে শিক্ষাদীক্ষায় সে-রকম কিছু সিদ্ধ-হয়ে উঠতে পারেন নি’। যারা মৌলিকভাবেই লোক দর্শনের অনুচিন্তন করেছিলেন সন্ত কবীর, দাদূ থেকে শুরু করে লালন ও হাসনরাজা তাদের কবিতায় ও গানে জীবনের ক্রমিক অভিজ্ঞতা, দর্শন ও জ্ঞানচর্চা অকৃত্রিমভাবে বিকাশমান হয়েছে। অথেনটিসিটি-এর কোন খামতি ছিল না তাতে। হুমায়ূন আহমেদের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবনে যুক্তির বাইরের হিমু ও যুক্তির ভেতরের মিসির আলী পরস্পরের সমর্থক হিসাবে কাজ করে যায়। সেখানেও অথেনটিসিটির-এর কোন ঘাটতি নেই। তবে র‌্যাশনালিজম পাশ্চাত্যের বিশেষ মানসিক গড়ন নয়, যেমন নয় মরমীবাদ প্রাচ্যের একচেটিয়া অধিকারে বীজগণিতের বীজ যেমন পাই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সভ্যতার চর্চায়, তেমনি ক্যালকুলাসের উদ্বোধন হয়েছিল মঞ্জুলা, দ্বিতীয় আর্যভট্ট ও দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য্যের রচনা। থিওসফিক্যাল সোসাইটিগুলো বাজার পেয়েছিল পাশ্চাত্যেই [সে সুবাদে উনিশ-বিশ শতকে এদেশের নাগরিক বাবু সমাজে প্লানচেট-এর বেহ্তর আমদানি হয়েছিল]। সম্প্রতি ইংলন্ডের এক দোকানদারনী আমাকে বুঝিয়েছেন যে প্রাচ্যে তোমরা চর্চা করো মিস্টিকের, আর পাশ্চাত্যে আমরা চর্চা করি ম্যাজিকের। সুতরাং স্বভাবগুণকে মরমীগুণের আধার হিসেবে দেখে ভক্তিবাদেই প্রাচ্যের মুক্তি; এতে সায় থাকার কোন কথা ছিল না জীবনানন্দের ক্ষেত্রে। সমসাময়িক ইতিহাস, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্ম, রাজনীতি সমস্ত জটিল বর্তমানকে কবিতার অনুভবে আরো ভালোভাবে ব্যক্ত কী করে করা যায় সে রকম একটা চ্যালেঞ্জ বুকে নিয়ে জীবনানন্দ ধূসর পাণ্ডুলিপি-বনলতা সেন-এর চিরচেনা ভূমি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিছক পর্বান্তর নয়_ ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটির তারার তিমির’ ও [মরণোত্তর] ‘বেলা অবেলা ও কালবেলা’ ছিল সেই সচেতন সিদ্ধান্তেরই কতিপয় শিল্প-প্রকল্প। এতে করে শিল্পোত্তীর্ণতার সফলতা-ব্যর্থতার যেসব অনিশ্চয়তা থাকল সেসব ঝুঁকি নিয়েই তিনি কাজ করেছেন।

এক ভিন্ন পটভূমি থেকে শামসুর রাহমানও নিজেকে সঙ্গী করেছিলেন ঐ একই অভিযানে। তিনিও বিশ্বাস করতেন আধুনিকতার থেকে পিছিয়ে নয়, আধুনিকতার বাইরে নয়, এক ‘অন্য আধুনিকতার’ জন্ম দিয়েই কাব্যের [ও সমাজেরও] মুক্তি ঘটবে। যে তিমিরবিনাশী ‘আশা-ভরসার সমাজের’ স্বপ্ন দেখতেন জীবনানন্দ তা একদিনে হবার ছিল না। সে তো বার্লিনের দেয়ালের পতনের এবং ওয়াল স্ট্রিটের অধুনাতন বিপর্যয়ের পর আজ আমরা সহজেই বুঝতে পারি। যে ধরনের সমাজে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি ঘটবে, সে ‘অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’ এ রকম একটি জ্ঞান-আশ্রিত মানবিক সমাজ জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমানের আদর্শস্থানীয় ছিল। জ্ঞানের বিহনে যেমন প্রেম নেই, প্রেমের বিহনে তেমনি জ্ঞানও সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু : ‘এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কংকাল।’ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শামসুর রাহমান হঠাৎই আবার জীবনানন্দীয় সুরে বলে ওঠেন : ‘হয়তো তখন আরও অগ্রসর মানব-মানবী জন্ম নেবে।’ তবে দু’জনে এই উপলব্ধিতে পেঁৗছেছিলেন যার যার নিজস্ব যানে করে।

৪. দুর্বোধ্যতার যে অভিযোগই আবু সঈদ আইয়ুব আনুন না কেন, বা [এর বিপরীতে] স্বভাব-কবিত্বের যে তকমাই সুকুমার সেন দিতে চান না কেন, জীবনানন্দের মৃত্যুর পরবর্তী তিন দশকে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের মতোই অমোঘ ও ‘সর্বনেশে’ হয়ে উঠছে জীবনানন্দের প্রভাব। শুরু হয়ে গেছে জীবনানন্দের যুগ। অশোক মিত্র ১৯৬৫ সালে তারইকৃত পূর্বতন তিক্ত সমালোচনার মোড় ঘুরিয়ে ‘ভয়ে ভয়ে’ বললেন, ‘আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগেকার রবীন্দ্রানুস্মৃতির মতোই, বর্তমানের জীবনানন্দীয় ঘোর, আমার ধারণায়, বাংলা কাব্যকে এক জায়গায় আটকে রেখেছে, জীবনানন্দকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে না আসতে পারলে মুক্তি অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের সৃষ্টি জ্যোতির্ময়তম। কিন্তু সে জন্যই বলছি, তাঁর সর্ব সমাচ্ছন্ন করা প্রভাব পরম সর্বনাশের ব্যাপার।’ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ যিনি রচনা করেছেন এ কথা অবশ্য তার বহু আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। সেই যে জীবনানন্দের কবিতায় ‘রূপালী স্নান’ করে উঠে নিজের স্বভূমির দিকে পা বাড়ালেন কিছু ফলদ ব্যতিক্রম বাদ দিলে মূলত শামসুর রাহমান জীবনানন্দের প্রভাব থেকে নিজেকে সচেতনভাবেই আগলে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘আমার নিজের কবিসত্তার বিকাশের তাগিদে কখনও কখনও স্বেচ্ছায় জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার থেকে কিয়দ্দূরে থেকেছি কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখাইনি কস্মিনকালেও।’ পরের দিকে ‘নিদ্রার কুয়াশায়’ কবিতা-আকারে বলেছেন, ‘অম্লান জীবনানন্দ, পল এলুয়ার, ইয়েটস্ ফেলেছেন নিরিবিলি ছায়া’ তাঁর কোনো কোনো কবিতায়। ‘নেমকহারাম নই, করবো না অস্বীকার’ বলেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পাঠকদের যে এক কবিতার থেকে অন্য কবিতার জন্ম হতে পারে, যেমন এক শলাকার আগুন থেকে অন্য শলাকায় আগুন নেওয়া যেতে পারে। এ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় নিরর্থক ঝড় তোলা।

শামসুর রাহমান যে জীবনানন্দকে পাশে সরিয়ে তার নিজস্ব ভূ-ভাগ দখলের দিকে অনায়াসে এগিয়ে যেতে পারলেন তার একটা বড় কারণ ছিল ষাটের দশকের স্বাধিকার-প্রমত্ত আন্দোলন। ‘বাংলাদেশ’ এই দেশের কাব্যভুবনের নিভৃত নায়ক শামসুর রাহমানকে দিয়ে ক্রমাগতভাবে মোহন শব্দাবলি লিখিয়ে নিচ্ছিল যার অভিজ্ঞতা জীবনানন্দের মধ্যে থাকার কথা ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন ও স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রের কাঠামো-উপরিকাঠামোজুড়ে কুরে কুরে খাওয়া সন্ত্রাস, অপশাসন ও অগণতান্ত্রিকতা, আর এসবের বিপরীতে ‘গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান’ শামসুর রাহমানের দুই-তৃতীয়াংশ কাব্যসম্ভারের বিশেষ চরিত্র নির্ধারণ করে দিয়েছে। কবির শেষ দিন পর্যন্ত এ কথা বলা যায়।

এর বিপরীতে জীবনানন্দের শেষ জীবনের কবিতা ক্লিষ্ট হয়েছে দেশভাগের আগে ও পরের রাজনীতি, দাঙ্গা, মন্বন্তর ও উদ্বাস্তুতার ছায়ায়। শহীদ কাদরীকে কলকাতা ছেড়ে এসে ঢাকায় নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে হয়েছে তার গোড়ার দিকের কবিতায় যুদ্ধের যে ছায়াপাত ঘটে যাকে তিনি ‘উত্তরাধিকার’ বলছেন র্যাঁবোর মতো তা হলো দেশভাগের আগে-পরের যুদ্ধের ছায়া, নরকের ঋতু। শামসুর রাহমানকে তুলনীয়ভাবে দেশান্তরিত হতে হয়নি। কিন্তু জীবনানন্দকে ছেড়ে আসতে হয়েছে পূর্ববঙ্গ, বরিশাল, ধানসিঁড়ি; ছেড়ে আসতে হয়েছে ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশন, ব্রাহ্মসমাজ, নারকেল-সুপারির বন, যেখানে ‘এক মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে’ছিল। তার শেষ জীবনের কবিতার লাইনের অর্থদ্যোতনা, অস্পষ্টতা, জটিলতা ও দ্বন্দ্বের যে ক্রমাগত বিরোধাভাস পাই এর পেছনে উপদ্রুত উদ্বাস্তু জীবন, কলকাতায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার তুমুল প্রাণপাত প্রচেষ্টা, অর্থনৈতিক টানাপড়েনের গ্গ্নানি, যুদ্ধ-মন্বন্তর-দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশভাগ আর এসবের সাথে জড়িত পথনির্দেশহীনতা বেশ কিছুটা পরিমাণে দায়ী। শামসুর রাহমান ও জীবনানন্দ দু’জনেই এক অর্থে জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিজেকে ‘নিজভূমে পরবাসী’ বলে মনে করে থাকবেন। শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা শেষ দিককার একটি কবিতায় স্পষ্ট করে শামসুর রাহমান বলেছিলেনও সে কথা। তবে দু’জনেই ছিলেন তিমিরবিনাশী সমাজের বিপরীতে নিষ্কম্প দাঁড়ানো তিমিরবিনাশী সমাজের অভ্যুদয়ের আশায়।

অর্থনৈতিক হতাশাবাদ প্রসঙ্গে আরও একবার

বিনায়ক সেন
দ্রুত উপরে উঠছে বাংলাদেশ?

দৈনিক বণিক বার্তা খুলে শিরোনাম দেখলাম ‘ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে বাংলাদেশ’। কিছুকাল আগেও যারা বাংলাদেশ নিয়ে প্রবল হতাশায় ভুগছিলেন দেশটিকে পারলে ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলে দিচ্ছিলেন তাদের নিরন্তর সংশয়বাদের বিপরীতে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক এইচএসবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০ : ফ্রম দ্য টপ ৩০ টু দ্য টপ ১০০’ গবেষণা প্রতিবেদনে আগামী চার দশকে চীন, ভারতসহ ২৬টি দেশ দ্রুতগতিতে বড় হবে। বাংলাদেশ এর অন্যতম।

এইচএসবিসির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে কেমন? চলতি দশকে দাঁড়াবে ৩.৬ শতাংশ, ২০২০-৩০ দশকে ৪.৪ শতাংশ, ২০৩০-৫০ পর্বে ৫ থেকে ৫.৫ শতাংশ। চলতি দশকের জন্য এই প্রক্ষেপণ ২০০০-এর দশকে অর্জিত মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় বরং সামান্য কম [গত দশকে ছিল প্রায় ৪.৩ শতাংশ]। এর থেকে দুটো দিক বের হয়ে আসে : এক. গত এক দশকে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার [উন্নয়নের গতি] বিশ্ব মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবং এ কারণেই বাংলাদেশকে ২০০০-২০৫০ সালের সম্ভাব্য অগ্রযাত্রা বিবেচনায় ‘দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী অর্থনীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুই. প্রবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনায় খুব স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিকোণে সব সময় আটকে থাকলে একটা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে যাচাই করা যায় না।

এদেশের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, আজও নৈরাশ্যবাদ ও আশাবাদ উভয়ের ক্ষেত্রেই আমাদের বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা প্রতিষ্ঠানের সাক্ষ্য মানতে হচ্ছে। সত্তরের দশকে কিসিঞ্জার এদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন বলে কথিত আছে; অন্যরা বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ‘উন্নয়নের টেস্ট কেইস’। এই শেষোক্ত কথাটি যারা বলেছিলেন সেই ফাল্যান্ড ও পারকিনসন এরই মধ্যে তাদের মত

বদল করেছেন, এমনকি কিসিঞ্জারও তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়েছেন। তার ‘অন চায়না’ শীর্ষক সাম্প্রতিক বইয়ে চীন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, চীন থেকে স্বল্প মজুরিভিত্তিক যেসব রফতানিন হতো তা ক্রমেই ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের নিরন্তর সংশয়বাদ আরও প্রবলতর আকার ধারণ করছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশের জন্য বোধকরি একই সঙ্গে এত তীব্রভাবে আশা ও নিরাশার পূর্বাভাস উচ্চারিত হয়নি।

২. আধুনিক ও সনাতনী হতাশাবাদ

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘আধুনিক’ হতাশাবাদের মূল কারণ রাজনৈতিক। একে ‘আধুনিক’ তথা ভিন্ন চরিত্রের মনে করেছি কেননা ‘সনাতনী’ হতাশাবাদের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক। ফাল্যান্ড-পারকিনসন যখন এদেশকে ‘টেস্ট কেইস’ ভেবেছিলেন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে জিম বয়েস যখন ‘অচলাবস্থা’ দেখেছিলেন কৃষি খাতে, ডেমোগ্রাফার মিড কেইন যখন জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মধ্যে পর্যুদস্ত দেখেছিলেন সকল উন্নয়ন প্রয়াসকে, ইতিহাসবিদ ভ্যান শ্যান্ডেল যখন মনে করেছিলেন বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ, তখন তা অর্থনৈতিক যুক্তিতেই বলেছিলেন। এমনকি আমরাও যখন আশির দশকে অর্থনীতি নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তখন [বর্তমান লেখকসহ] ভাবতাম এদেশ সেভাবে কখনও উঠে দাঁড়াবে না কোনো র‌্যাডিকেল রাজনৈতিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া। বা উঠে দাঁড়ালেও তা হবে ক্ষণকালের জন্য উত্থান, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আবার তা তলিয়ে যাবে নিচে। নইলে গার্মেন্ট শিল্পের অমিত সম্ভাবনাময় বিকাশ আশির দশকেই কেন আমরা অনুমান করতে পারিনি? কেন আমরা বুঝতে পারিনি যে লুটেরা ধনিক শ্রেণীর একাংশ_ ড্যানি রডরিকের ‘সেল্ফ ডিসকভারি’র ফর্মুলা মেনে পরিণত হবে উৎপাদনশীল ধনিকে? গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যরেখার নিচের মানুষের অনুপাত গত দুই দশকে প্রায় অর্ধেক কমে যাবে কেন তার আন্দাজ পাইনি আগে? সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৮৪ সালে ক্ষেতমজুর সমিতি দাবি জানিয়েছিল যে ক্ষেতমজুরদের অন্তত ৩ কেজি চালের সমান মজুরি দিতে হবে; আজ ২০১২ সালে এসে দেখছি এই ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বাজারেও ক্ষেতমজুররা যা উপার্জন করছেন তা ৬ কেজি চালের উপরে উঠে গেছে। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে এবং সেই সূত্রে স্বাস্থ্য-পুষ্টি সূচকে শুভ প্রভাব পড়বে_ এটা আমরা অনুমান করতে পেরেছিলাম নব্বই দশকের গোড়াতেই। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের শিক্ষার হার ছেলেদের অর্জনকে ছাড়িয়ে যাবে, এটা ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু কেন? লেনিন তার গোড়ার দিকের একটি রচনায় নারফনিকদের নিরন্তর হতাশাবাদের বিরুদ্ধে জোর কলম ধরেছিলেন। কেননা মার্কসের মতো তিনিও মানতেন যে, প্রাক-পুঁজিবাদের মধ্যে আটকে না পড়ে পুঁজিবাদের আধুনিক অস্থিরতাকে বরং আশ্রয় করা ভালো। আমাদেরও ভাবতে হবে, আমরা যারা নিরন্তর হতাশাবাদী তারা কি এখনও আমাদের রাষ্ট্রকে ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র মনে করি? আমরা কি সত্যি সত্যি মনে করি যে গণতন্ত্রের দুই দশক পরে এই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা আজ অন্তর্হিত? নাকি সেই সম্ভাবনা কখনও ছিল না এই রাষ্ট্রের জেনেটিক কোডে? যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের দরজা কুলুপ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের দরজা বাইরে থেকে খোলা সহজ নয়_ এ রকম একটা কথা সূরা বাকারার শুরুতে আছে।

৩. নিটশের সুপার-হিউম্যান তত্ত্ব ও প্রধানমন্ত্রী

আমার ধারণা, আমরা আজ যে আধুনিক হতাশাবাদ দেখছি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তার মূল কারণ রাজনৈতিক। আমরা রাষ্ট্রের তথা সরকারের রাজনৈতিক সমালোচনা করছি অর্থনৈতিক সূচক ব্যবহার করে। ফলে যে সব সূচকে অর্থশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে হতাশার কোনো কারণ নেই সেখানেও আমরা আশাহীনতার অন্ধকার খুঁজে বেড়াচ্ছি এবং এজন্য রাষ্ট্রের সমালোচকদের শুধু দায়ী করাটা অন্যায় হবে। রাষ্ট্র নিজেই এমন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে, যা সুশাসনের সরাসরি লঙ্ঘন।

আজ যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবার কাছে এসে বলতেন, গত দু-তিন বছরে অনেক সুশাসনগত ব্যত্যয় ঘটেছে, যার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না এবং এসব ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবে ব্যবস্থা নেবেন, তাহলে হয়তো অর্থনৈতিক সমালোচনার সুরও অনেকটা বদলে যেত। মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে চলতে দিয়েও তার প্রতি সহৃদয় আচরণ না করা, আইন-শৃঙ্খলার বড় বড় বিপর্যয়ের ঘটনায় ত্বরিত ব্যবস্থা না নেওয়া, বিরোধী দলের প্রধান নেত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের প্রতি সর্বোচ্চ সহনশীলতা ও সম্মান প্রদর্শন না করা, অধ্যাপক ইউনূসসহ সিভিল সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বদের যাতে কোনো কারণে সম্মানহানি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা, সরকারের অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এসব ব্যক্তিত্বের মতামত মন দিয়ে শোনা ও তা যতটা সম্ভব আমলে নেওয়া, অতীতে কে বা কারা কীভাবে বা কখন কী বলেছিলেন সে কথা ধরে বসে না থেকে কে দীর্ঘমেয়াদের বন্ধু তা বোঝার মত প্রজ্ঞা ও উদারতা দেখানো, গরিব-মেহনতি মানুষের জীবন কীভাবে কাটছে তা দেখার জন্য মাঝে মাঝে মাঠ পর্যায়ে [প্রয়োজনে আরব্য রজনী খ্যাত আব্বাসীয় বাদশাহ হারুনুর রশিদের মতো ছদ্মবেশে] গিয়ে সরেজমিন অভিজ্ঞতা নেওয়া, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন কেবল নয়, এসব প্রতিবেদন যাচাইয়ের জন্য হলেও দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে স্থানীয় পর্যায়ের জনগণের [এমনকি দলের সাধারণ সদস্যদের] মতামত গত দু’বছরে কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে তা সরাসরি নিজ কানে শোনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এই ডিজিটাল যুগে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে প্রধানমন্ত্রীকে সবসময় যে ঢাকা ছেড়ে মফস্বলে, মাঠে, বাজারে যেতে হবে তা নয়, ঢাকায় বসেই নিয়মিতভাবে তিনি দ্বৈবচয়নে মনোনীত জেলা ও উপজেলায় দলের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার আশঙ্কাজনক হ্রাসের খবর জানতে পারতেন, কারা এর জন্য দায়ী সে সম্পর্কে তার কাছে জনগণই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে পারত এবং তিনিও বুঝতে পারতেন খেলার এই হাফ-টাইমে সরকারের ও দলের কোথায় কী পরিবর্তন আনতে হবে। তারপরও হয়তো শেষরক্ষা হবে না আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক সরকারই পরপর দু’বার নির্বাচনে জিততে পারেনি; কিন্তু তার মনে হয়তো সান্ত্বনা থাকবে যে, যতটুকু সম্ভব ছিল তার পক্ষে তিনি তা করার চেষ্টা করেছেন।

দুঃখের বিষয়, শুধু যে উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেননি তা-ই নয়, এসব পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণ হিসেবে আবার তাকেই বেশি করে দায়ী করা হচ্ছে! এমনকি অর্থনীতির কিছু দুর্বিপাক, যেমন পদ্মা সেতু, অধ্যাপক ইউনূস, বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ কমে আসা, ভারতীয় বিনিয়োগ তথা তিস্তাসহ নানা অমীমাংসিত ইস্যু, চাই কি শেয়ারবাজারের প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের শাস্তি হওয়া এ সব কিছুর জন্যই সমালোচনার তীর ছোড়া হচ্ছে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর দিকেই বেশি বেশি করে। যত না এটা প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে তার চেয়ে এটা বেশি করে বলা হচ্ছে অপ্রকাশ্যে। আমি জানি না, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব তথ্য কেউ এরই মধ্যে জানিয়েছেন কি-না, বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব তথ্য তাদের কোনো প্রতিবেদনের অংশ করেছে কি-না। দেশের সব ঋণাত্মক নীতি, অসফলতা ও দুর্বিপাকের দায় কেন আমাদের গণতন্ত্রে কেবল প্রধানমন্ত্রীর ওপরেই বর্তাবে? নিটশের সুপার-হিউম্যান তত্ত্ব মানলেই কেবল কেউ এরকম চিন্তা করতে পারে। কেননা সুপার-হিউম্যান মানলেই কেবল পূর্ববর্তী সরকারের মতো দোষ বেগম জিয়া ও বর্তমান সরকারের যত দোষ-ত্রুটির দায়ভার শেখ হাসিনার কাঁধে চাপাতে পারি আমরা! ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ ও সুপার-হিউম্যান তত্ত্ব এ দুটি পরস্পরবিরোধী ঝোঁক আমাদের গণতন্ত্রকে বারবারই এক বিপদসংকুল খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে।

৪. কৌটিল্য, আবুল ফজল ও সুশাসন

কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ রাজাকে প্রজাহিতৈষী হতে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জনগণের অবস্থা ও মনোভাব সম্পর্কে সার্বক্ষণিক পরিসংখ্যান সংগ্রহের জন্য। মৌর্য সাম্রাজ্যের এই তাত্তি্বক ও পরামর্শক বহু বছর আগে যা লিখে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা সম্পর্কে তার মূল্য এখনও অপরিসীম। এর মধ্যে একটি সুদূরপ্রসারী পরামর্শ ছিল রাজন্যবর্গ, অমাত্য ও রাজ-কর্মচারীদের দুর্নীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের নিয়মিত পরিবীক্ষণ করার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও তথ্যপ্রবাহের যুগে এ ধরনের পরিবীক্ষণের তথ্যাদি জনসমক্ষে তুলে ধরা একটি বাড়তি তাগিদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও তার দলের সব সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তা স্বাধীনতার পর সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।

কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এর নজির বাদ দিলেও মধ্যযুগের খ্যাতনামা পণ্ডিত আবুল ফজলের যুক্তিও এ ক্ষেত্রে একই রূপ। রাহুল সাংকৃত্যায়ন লিখেছেন, “যদি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আমাদের জন্য তৎকালীন রাজনীতি ও অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয়ের ভাণ্ডার হয়, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ ও ‘আইনে-আকবরী’ তদপেক্ষাও অনেক বড় ভাণ্ডার।” সেই আবুল ফজল যিনি মারা গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুবরাজ সেলিমের [পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীর] প্ররোচনায়, যেমনটা মারা গিয়েছিলেন সেনেকা আততায়ীর হাতে। সেই আবুল ফজল, যার মৃত্যুতে শিশুর মতো কেঁদে উঠেছিলেন সম্রাট আকবর এবং তিনিও আবুল ফজলের মৃত্যুর তিন-চার বছরের মধ্যেই মারা যান। এটা ছিল সেই যুগ, যখন ভারতবর্ষ সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বিন্দুতে পেঁৗছেছিল এবং যখন ইউরোপে নেমে এসেছিল অন্ধকার, বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার যুগ। ব্রিটিশরা অবিভক্ত ভারতবর্ষের শাসনভার নেওয়ার পর প্রথমেই যেটা করে তা হলো আবুল ফজলের রচনাবলির অনুবাদ। যেমন আকবর তার আমলে আবুল ফজলকে বলেছিলেন সংস্কৃত থেকে ‘পঞ্চতন্ত্র’ হিতোপদেশসমূহ সহজ করে অনুবাদ করতে। জন স্টুয়ার্ট মিল যেমন নয় বছর না পেরোতেই পিতা জেমস মিলের কাছে শিক্ষা নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন নানা ভাষায় পারদর্শী, আবুল ফজলও তার পিতা পণ্ডিত সুবরকের অধীনে শিক্ষা গ্রহণের ফলে দশ না পেরোতেই হয়ে ওঠেন আল্লামা এবং বিশ বছর বয়সে স্থান পান আকবরের মন্ত্রিসভায়। আমি সেই আবুল ফজলের কথা বলছি যার পরামর্শ ছিল বিদেশের ভাষা-প্রযুক্তি-আইডিয়ার কাছে দেশকে উন্মুক্ত করে দেওয়া, তেমনি স্বদেশের ভেতরে ধর্মীয় ভেদ, জাত-পাত, বিভিন্ন ভাষার দেয়াল ভেদ করে একটি মাল্টিপল আইডেন্টিটির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বৈদেশিক নীতি সর্বত্রই তিনি তার পরামর্শের ছাপ রেখে গেছেন। তারই পরামর্শে আব্বাসীয় বাদশাহ হারুনুর রশিদের আমলের মতো মোগল বাদশাহ আকবরও তার নবরত্নের কাউকে নিয়ে ছদ্মবেশে বের হতেন দেশের অর্থনীতি ও জনগণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে ও স্বকর্ণে শুনতে। এটাই ছিল ‘পার্টিসিপেটরি অবজারভেশনি’-এর ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশের ভবিষ্যৎ শাসকদের প্রতি আবুল ফজলের পহেলা সবক। সুশাসনের এসব উদাহরণ আমাদের দেশেই, আমাদের ইতিহাসেই রয়েছে। এর জন্য বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর হাত থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে কেন কেবল? বাইবেলে আছে, যা তোমার আছে তা-ই তোমাকে কেবল দেওয়া হবে। এখনও সময় পার হয়ে যায়নি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের ক্ষেত্রে শক্ত হাতে হাল ধরার। ভুল-ত্রুটির জন্য জনগণের কাছে খোলা মনে দাঁড়িয়ে দেশের সমস্যাগুলো তুলে ধরে বিরোধী দলের সঙ্গে মিলে-মিশে একটি সহনীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। আমাকে অনেকেই বলেছেন, এটা একটা স্বপ্ন কেবল এটা কখনও বাস্তবায়িত হওয়ার নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, তিনি শেষ পর্যন্ত আশা ছাড়তে রাজি নন মানুষের ওপর থেকে।

একে একে নিভে যাচ্ছে বাতি?

বিনায়ক সেন

অর্থশাস্ত্র যদি বিষণ্ন বিষয় হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সেই অর্থশাস্ত্রের সবচেয়ে বিষণ্ন অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে দুই কীর্তিমান বিদেশি অর্থনীতিবিদ লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন করা গেলে উন্নয়নের কম-দুরূহ সমস্যাকেও সমাধান করা সম্ভব। এই অর্থে বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষা ক্ষেত্র বলা যেতে পারে।’ স্বাধীনতার চলি্লশ বছরেও দেশটিকে নিয়ে হতাশাবাদের ধ্বনি বন্ধ হলো না। আমরা যদি শিখরের দ্বারপ্রান্তেও এসে কখনও পেঁৗছাই তাহলেও আমাদের দুর্গম অভিযান যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে দেখছেন তারা বলবেন, ‘এই তো, যাক না আরও একটু ওপরে তারপরেই দেখবে ওটা কীভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে খাদে পড়ে যায় নির্ঘাত’! আর সে হতাশার সুরও ছিল একেক দশকে একেক রকম।

প্রথমে [সত্তর দশকেই] শোনা গেল জনসংখ্যা নিয়ে হতাশাবাদ। আদিতেই ছিল জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব, তার ওপর অব্যাহত হারে দ্রুত জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি_ এ দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হয়েছে এক ‘ম্যালথাসীয় বিষবৃত্ত’, যার থেকে বেরোনোর সম্ভাবনা নেই এ দেশের। তারপর শোনা গেল কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদন নিয়ে হতাশাবাদ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সেই হতাশাবাদের গুঞ্জন আরও উস্কে দিয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করা এই কৃষি-হতাশাবাদের মোদ্দা কথা ছিল_ এ দেশের কৃষিতে উৎপাদন-সম্পর্ক এতটাই শোষণমূলক [আধা-সামন্তবাদী, আধা-পুঁজিবাদী] যে, এখানে গরিব কৃষকদের পক্ষে উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধান বীজ ফলানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর ধনী কৃষকদের আগ্রহ যেহেতু কৃষির চেয়ে অকৃষির দিকে [অধিকন্তু সামন্তবাদী জোতদারদের মতো সুলভে উদ্বৃত্ত আহরণের প্রতি], সুতরাং কৃষির আধুনিকায়নের সম্ভাবনাও এখানে সুদূরপরাহত। ‘শৃঙ্খলে বাঁধা এ দেশের কৃষি’_ এ রকম বললেন কেউ; অন্য একজন লিখলেন, ঔপনিবেশিক কাঠামোয় ‘অচলাবস্থাই’ এ দেশের কৃষির নিয়তি। আরও কেউ কেউ পূর্বাভাস দিলেন আশু অনিবার্য দুর্ভিক্ষের। রফতানিমুখী উন্নয়ন নিয়েও হতাশা ব্যক্ত হলো আশির দশকে। তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া [বা পরবর্তী যুগের চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড] এসব পূর্ব এশীয় দেশকে অনুসরণ করে এই দুর্ভাগা ভূখণ্ড কখনোই রফতানিমুখী উন্নয়নের ছকে সাফল্য পাবে না_ এই ছিল মত। এবং এই নৈরাশ্যের মূলে ছিল বাংলাদেশে লুটেরা ধনিক শ্রেণীর আধিপত্য এবং উৎপাদনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উদ্যোক্তাদের অভাব। আর শেষোক্তরা না থাকলে প্রাথমিক পণ্য [কৃষিজ পণ্য] রফতানিকারক দেশ থেকে শিল্পপণ্য রফতানিকারকের তালিকায় নাম লেখানো শক্ত। হতাশাবাদ গড়ে উঠেছিল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও। বাইরের পর্যবেক্ষকদের চোখে আমাদের নারীরা ইতিহাসের অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত যেন; পর্দার আড়ালেই তাদের জীবনযাপন। ফলে তাদের পক্ষে উৎপাদনমুখী খাতে অংশ নেওয়া প্রায় অসম্ভব মনে করা হতো সত্তরের দশকে। নারী শিক্ষার বিষয়ে সাফল্য কখনও আসবে_ এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে অংশ নেবে_ এটিও ছিল তাদের চিন্তার বাইরে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দড়ি বানানো বা চিড়া-মুড়ি বানানো ছাড়া গ্রামবাংলার নারীদের পক্ষে আর কী করা সম্ভব_ এ কথা নব্বইয়ের দশকেও শোনা গেছে! নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে নৈরাশ্য জনসংখ্যা নিয়ে নৈরাশ্যের যুক্তিকে আরও সবল করেছিল, যেমন প্রশ্নকীর্ণ করেছিল শিল্পপণ্য রফতানিতে এ দেশের সম্ভাবনাকেও।

গত দুই দশকের বাস্তব তথ্য পরিসংখ্যান অবশ্য জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন, রফতানিমুখী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে হতাশার রায়কে ইতিমধ্যেই মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। তারপরও হতাশাবাদীরা আশ্বস্ত হতে পারেননি। ২০০০-এর দশক থেকে বিশেষভাবে শোনা যাচ্ছে সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে নৈরাশ্য। এবারে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে এ দেশের কিছু কিছু চেঁচিয়ে বলার মতো সাফল্য আর আগের মতো অস্বীকার করছেন না। কিন্তু এবারে তাদের যুক্তি ভর্তৃহরির নন্দনতত্ত্বের চেয়েও সূক্ষ্ম : সুশাসনের অভাবের কারণে_ বিশেষত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভেতরকার পরস্পর বিধ্বংসী অস্থিরতার কারণে এসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের আসলে কোনো স্থিরতা বা নিশ্চয়তা নেই। এই মতে, যতটুকু সাফল্য অর্জিত বাংলাদেশের এ পর্যন্ত, সেসবই ক্ষণস্থায়ী পরিণতি মাত্র। অচিরেই অস্থিরতা ও নৈরাজ্য গ্রাস করবে এই ভূখণ্ডকে। এদের মধ্যে যারা দীর্ঘমেয়াদি পরিণাম নিয়ে ভাবেন, তারা এই রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন পরিবেশগত হুমকিকে। পুরো দেশটা ভাসছে নূহের নৌকায় এবং সেই ভাসমান নৌকার ওপরে থেকেই আমরা ভ্রাতৃদ্রোহী যুদ্ধে লিপ্ত_ এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখাতে চান তারা আমাদের।

২. যে বছর চলে গেল অর্থাৎ ২০১১ খ্রিস্টীয় সালে আরও একটি ক্ষুদ্রমাপের নৈরাশ্য যুক্ত হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে হতাশা। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে; বৈদেশিক সাহায্য সেভাবে আসছে না; বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে যাচ্ছে; টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে; রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি আর সমালে উঠতে পারছে না আমদানি ব্যয়ের চাহিদা; সরকার ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নতুন করে সরবরাহ করেছে ঠিকই; কিন্তু নতুন বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো [যেমন কুইক রেন্টাল] চালু রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাড়তি তেল আমদানির কারণে। তেলের দামও বিশ্ববাজারে বাড়ন্ত, তাই বর্ধিত হারে ডলার গুনতে হচ্ছে, আবার ভর্তুকি কিছুটা কমাতে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে দেশের ভেতরের মূল্যস্ফীতি; বৈদেশিক অর্থায়নের আকস্মিক হ্রাসের মুখে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের দুটো প্রধান উৎস [যথাক্রমে, কর আহরণ ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধার কর্জ]_ এদের মধ্যে বাধ্য হয়ে অনেক বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের ওপর। রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর এই পদ্ধতি যেমন আরও উস্কে দেবে মূল্যস্ফীতিকে, তেমনি আগামী বছরগুলোর বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাবদ সুদাসল মেটানোর ক্ষেত্রেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে ২০১১-১২ অর্থবছরের এডিপি কাটছাঁট করার দিকে অগ্রসর হতে হবে অচিরেই [যেসব চলক ওপরে বলা হলো এরা পরস্পর সম্পর্কিত]। সেই সঙ্গে বাড়তি দুর্ভাবনার মতো সুপ্ত হয়ে থাকবে শেয়ারবাজারের সংকট-মোকাবেলা ও তাকে চাঙ্গা করে রাখার চ্যালেঞ্জ। মোটাদাগে এই হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশার মূল সুর। তবে এর বিপরীতে অর্থনীতিতে অন্য প্রবণতাও আছে, যা না বললে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে যথার্থভাবে বোঝার এবং তা মোকাবেলা করার কাজটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গত ডিসেম্বর মাসেরই কোনো একটি দিনে একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের শিরোনাম ছিল_ ‘দাম নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকারে ছিল, উদ্যোগ ছিল না’! এর উপ-শিরোনামে বলা হলো কীভাবে বর্তমান সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি ২০০৯ সালের জানুয়ারির ৬ শতাংশ থেকে এখন দাঁড়িয়েছে ১১.৬ শতাংশে। ঠিক একই দিনে, ওই বাংলা দৈনিকের সহযাত্রী ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম ছিল_ ‘অর্থনীতিতে এ বছরেও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা’! দুটো শিরোনামের মধ্যেই পুরো সত্য নেই। একদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা, অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা_ এই দুটো প্রবণতাই সত্য বর্তমান [২০১১-১২] অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য। এবং এই কারণে এটা আরেকটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

৩. আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, আমাদের অর্থনীতি আর আগেকার মতো কৃষিনির্ভর অর্থনীতি নেই। এই অর্থনীতির চাকাকে অনেকটাই এখন বিশ্বমানে তাল রেখে চলতে হচ্ছে। এতকাল আমরা বিশ্বায়নের বাইরে থেকে বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখেছি [সভা-সেমিনার, টক-শো বা আই-ফোনে ইন্টারনেটে এর কথা বলেছি, পড়েছি বা শুনেছি]। এখন আমরা গোলকায়নের কেন্দ্রের ভেতরে : ‘সমুদ্র পাড়ি দেওয়া শেষ, এখন প্রকৃত যাত্রার শুরু’ জর্জ লুকাচের সেই প্রবচনের মতো। ফলে বিশ্বায়নের সুবাদে বাড়তি প্রবৃদ্ধি অর্জন যেমন আমাদের সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতা, তেমনি বিশ্বায়নের ঝুঁকিরও আমরা নিত্য মুখোমুখি। সেই ঝুঁকির প্রথম বড় তিক্ত স্বাদ আমরা গ্রহণ করছি এখন_ যার শুরু ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দিয়ে [যার কবলে হিমশিম খাচ্ছে আমেরিকা ও হাল আমলের ইউরো জোনভুক্ত দেশগুলো কম-বেশি]। এখানে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, বাড়তি প্রবৃদ্ধি গ্রহণের পাশাপাশি উচ্চ প্রবৃদ্ধির বেদনাকেও স্বীকার করে নেওয়া ও সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের ওপর সেই বেদনার ভারকে যথাসম্ভব সহনীয় করে তোলা, যতদিন পর্যন্ত বিশ্ব পরিস্থিতি আবারও মন্দা কাটিয়ে না উঠছে।

দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনীতি একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করেছে। এটা শুধু আমাদের অর্থনীতি নয়, ভারত ও শ্রীলংকার মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ২০০০-এর দশকের শুরুতে শুধু ২-৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে স্বাভাবিক ধরা হতো; দ্বিতীয়ার্ধে তা বেড়ে ৫-৬ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা ও মূল্যস্ফীতি একে ১০ শতাংশের ওপরে নিয়ে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশেই।

আরব অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি, কিন্তু সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির চাপও সেখানে যুক্ত হয়ে থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে কী করে মূল্যস্ফীতিকে সামাল দেওয়া যায়?

তৃতীয়ত, সনাতনী মনিটারিস্টদের মতে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ‘সামগ্রিক চাহিদা’কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; বিশেষত সরকারি ব্যয়জনিত সৃষ্ট চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এই মতের পরিপ্রেক্ষিতে এর সার্বিক প্রয়োজন মেনে নিয়েও আরেকটু সৃষ্টিশীল হয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। এই সরকারের প্রথম তিন বছরে বেশকিছুটা সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি নিয়ে চলা হচ্ছিল এবং এর সুফল উচ্চ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি। তখন এই নীতি নিয়ে চলা সম্ভব হয়েছিল। তার বড় দুটি কারণ ছিল বৈদেশিক সাহায্যের অব্যাহত প্রবাহ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার বর্ধিত জোগান। এই দুটো ক্ষেত্রেই চলতি অর্থবছরে ভাটা পড়ায় সরকারকে তার অবস্থান কিছুটা বদলাতে হবেই এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয়হীনতা। যেমন_ রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে যতটা পারা যায় অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কুইক রেন্টালের দ্বারা প্রদত্ত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কেননা, সরকার যে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ নিচ্ছে তার একটি বড় কারণ তেল-বিদ্যুতের ওপর অব্যাহত ভর্তুকি রাখা প্রয়োজনীয়। এই ভর্তুকি প্রত্যাহারের ফলে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কিছুটা বাড়লেও তাকে ‘মন্দ বছরের দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম’ হিসেবেই দেখতে হবে।

চতুর্থত, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি মানে এই নয় যে, এডিপি কাটছাঁট করতে হবে। এডিপি যতটা পারা যায় রক্ষা করতে হবে অন্য সব অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনে। যেসব মেগা প্রকল্প সবার চোখে পড়ে [যেমন_ শহর এলাকার অত্যাধুনিক হাইওয়ে, ফ্লাইওভার বা মেগা আন্তঃসড়ক প্রকল্প] সেগুলোর প্রবৃদ্ধি-অভিঘাত ও বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্যের ওপর অভিঘাত বিচার করে প্রয়োজনে সেসব আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। তবে এডিপির যেসব প্রকল্প বৃহত্তর জনসাধারণকে উপকৃত করবে_ যেমন কৃষি, গ্রাম উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় অবকাঠামো প্রভৃতি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্ষা করতে হবে। কেননা, এসব খাতে সরকারি ব্যয় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, জনগণের সঞ্চয় বাড়াতে সাহায্য করে। এই কারণে ২০১১-১২ অর্থবছরে কেইনসীয় [প্রবৃদ্ধি-বর্ধক] ও মনিটারিস্ট [মূল্যস্ফীতি-সংকোচক] নীতিমালার মধ্যে এক ধরনের বাস্তবোচিত মিশ্রণকে অনুসরণ করা যেতে পারে।

পঞ্চমত, এটা সুবিদিত যে, বাংলাদেশ ব্যাংককে তার মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক সরকারের রাজস্ব-বিনিয়োগের পলিটিক্যাল ইকোনমির মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংক দক্ষতার সঙ্গে তার মুদ্রানীতি পরিচালনা করছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধারায় অবমূল্যায়িত হচ্ছে [একে জোর করে আটকে ধরে রাখার নীতি হতো সর্বনাশা!]। এর ফলে আশা করা যায়, আমদানি নিরুৎসাহিত হবে এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ভারসাম্যে উন্নতি ঘটবে। টাকার বর্তমান অবমূল্যায়নের ধারাকে সরকারের ব্যর্থতা মনে করলে তা হবে এক ধরনের জনতুষ্টিবাদী ভাঁওতাবাজির ফাঁদে পা দেওয়া। সরকার যদি তার মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয়সাধন করতে পারে এবং রাজস্বনীতির মধ্যে জনগণের জন্য সুফলদায়ী বিনিয়োগকে বিশ্বমন্দার [বিশেষত ইউরো-জোনের মন্দার] বছরেও রক্ষা করতে পারে, তবে ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে উচ্চারিত এই নতুন হতাশাবাদও ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হবে।

সবশেষে বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে আরও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা চাই, যেমন চলা চাই রাজনৈতিক বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে আরও শিষ্টাচারসম্মত ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। বিশ্বায়নের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ছিদ্রযুক্ত জাহাজ নিয়ে চললে শুধু সমুদ্রকে দায়ী করলে অব্যাহতি পাওয়া যায় না_ এ কথা রবীন্দ্রনাথ কত আগে বলে গিয়েছেন। কিসিঞ্জার ‘চীন সম্পর্কে’ তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থে বলেছেন যে, পাশ্চাত্য যেখানে প্রতিপক্ষকে শুধু যুদ্ধ করে পরাস্ত করতে শিখেছে [ভন ক্লসউইটজদের মন্ত্রণা মেনে], চীন সেখানে যুদ্ধ না করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে শিখেছে [সুন-জু-এর মতো যুদ্ধ বিশারদদের তত্ত্ব মেনে]। এ কারণে পাশ্চাত্য দাবার চালকে শিরোধার্য বলে রপ্ত করেছে, যেখানে চীন ‘ওয়ে চি’ নামক খেলাকে আদর্শস্থানীয় মনে করেছে। এই ‘ওয়ে চি’ খেলার বিশেষত্ব হচ্ছে, প্রতিপক্ষের চালকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি্বকভাবে বানচাল করে দেওয়া এবং ক্রমে তার অবস্থানকে ঘেরাও করা। ‘যখন যুদ্ধ করবে, তখন ভান ধরবে যে তুমি যুদ্ধ করছ না; আর যখন যুদ্ধ করবে না তখন ভান ধরবে যাতে মনে হয় তুমি বুঝি যুদ্ধ করছ।’ ওই ছলনার দরকার। কেননা, কিসিঞ্জার আজ বার্ধক্যে এসে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সুন-জুর কথা_ যুদ্ধের চেয়ে ধ্বংসাত্মক আর কিছুই হতে পারে না। সে কারণে শান্তিই শিরোধার্য, শান্তিকেই যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। ‘মহাভারত’-এও দেখি : কৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডবের জন্য শুধু পাঁচটি গ্রাম চেয়ে কুরু-পাণ্ডবের মধ্যকার ভ্রাতৃদ্রোহী মহাযুদ্ধ নিবারণ করতে চেয়েছিলেন।

এসব বলা এই কারণে যে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সুস্থিরতা না থাকলে শুধু অর্থনৈতিক নীতিমালা দিয়ে [তার যে রূপই আমরা এ দেশ এ বছরে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করি না কেন] দেশের অর্থনৈতিক শান্তি বা অর্থনৈতিক সুস্থিরতা আসবে না বা তা রক্ষা করা যাবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা এখনও সুন-জু থেকে শিক্ষা নিতে অনেকখানিই পিছিয়ে রয়েছি।

ইস্তাম্বুল সিম্ফোনি: নাজিম হিকমতের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ :বিনায়ক সেন
“তুমি বলেছিলে :’যদি ওরা তোমাকে মেরে ফেলে আমি বাঁচব না!’ কিন্তু তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা আমার, বাতাসে কালো ধোঁয়ার মতো মুছে যাবে আমার স্মৃতিগুলো। [কেননা] বিংশ শতকে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।” এই লাইন ক’টি যার লেখা তিনিই তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত।

বেট্রল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, জর্জি আমাদু, পাবলো পিকাসো, ইলিয়া এরেনবুর্গ, পল রোবসন, ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রিয় কবির সারিতে ছিল নাজিম হিকমতের নাম। নাজিমের একটি কবিতা এভাবে আশা প্রকাশ করেছে :’আমি মরতে চাই না, কিন্তু যদি মৃত্যু আসে, তবু আমি বেঁচে থাকব তোমাদের মাঝে, আমি বেঁচে থাকব আরাগঁর কবিতায়, তার ঠিক সেই লাইনটিতে যেখানে সে আসন্ন সুখের দিনগুলোর কথা লিখেছে। আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আর রোবসনের গানে’। ১৯৫০ সালে নেরুদা এই বলে তাকে সম্মানিত করেছিলেন :’নাজিমের কবিতায় সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে’।

চিরটা কাল বামপন্থার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু ভিন্ন ধরনের বামপন্থি ছিলেন তিনি। স্তালিনকে ঘিরে ব্যক্তি-পূজার নিন্দা করেছিলেন স্তালিনের জীবদ্দশাতেই খোদ মস্কোতে বসেই। স্তালিনের গোয়েন্দা দফতরের প্রধান বেরিয়ার গুপ্তচরেরা তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকত_ এ কথা ইয়েভতুশেঙ্কো জানিয়েছেন ‘রোমান্টিক কম্যুনিস্ট’ বইয়ের ভূমিকায়। পূর্ব-পশ্চিম সব মহাদেশ থেকে কবিতার উপকরণ আহরণ করেছেন তিনি। তার প্রিয় তিনজন কবি ছিলেন তিন ভিন্ন ভুবনের। তুরস্কের সূফী-সন্ত জালালুদ্দিন রুমি, ফরাসি আধুনিকতার শার্ল বোদলেয়ার, আর রুশ বিপ্লবের ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। যদিও নাজিম বলবেন, এরা আসলে এক ভূগোলেরই অধিবাসী_ তিনজনই তাদের কালের মানবচিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘মানবের মানচিত্র’ নামে পরবর্তীতে নাজিম নিজেই লিখেন একটি মহাকাব্য যা এখনও বাংলায় অনূদিত হতে বাকি।

বামপন্থার আদর্শের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে নাজিমকে তুরস্কের সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। পুরো মেয়াদ অবশ্য কারাবাসে থাকতে হয়নি কবিকে। প্রকৃতপক্ষে ১৭ বছর জেলে ছিলেন তিনি। এর আবার ১৩ বছর ছিল বিরতিহীন_ ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫১ সাল অব্দি। জেল পর্ব ছিল তার লেখার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্ব। ১৯৩৮ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সামরিক একাডেমীর ক্যাডেটদের উস্কে দিয়েছেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেসব ক্যাডেট নাকি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল! জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো পিকাসো, ত্রিস্তান জারা তার মুক্তির জন্য বিশ্ব-জনমত গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জনমতের চাপে ছাড়া পেলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে থাকতে পারলেন না বাদবাকি জীবন। ১৯৫১ সালেই তাকে যেতে হলো নির্বাসনে। সেই কারণটা জানা গেল ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তুরস্কের ওরহান পামুকের সুবাদে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে পামুক শুধু একদিনের জন্য ইস্তাম্বুলের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সম্পাদক হলেন। জার্নালিজমের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু এর আগে কখনও সরাসরি সাংবাদিকতায় আসেননি। সম্পাদক হয়ে রোববারের প্রথম পাতাজুড়ে প্রকাশ করলেন একজনের ছবি। ছবির নিচে লেখা_ ‘থুথু ফেলো এতে’। ছবিটা কবি নাজিম হিকমতের। ১৯৫১ সালে তুরস্কের সরকারি কাগজগুলো এভাবেই নাজিমের ছবি ছাপিয়ে জনগণকে উস্কানি দিয়েছিল ছবিটাকে ঘৃণা করতে। দৃশ্যত নাজিমের অপরাধ ছিল দুটি। প্রথম অপরাধ, ১৯১৫ সালে আরমেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য [যার দায় তুরস্কের সরকার এখনও স্বীকার করেনি] তিনি জনগণের হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় অপরাধ, কুর্দিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। পামুক তার সম্পাদকীয়তে আরও লিখলেন, ‘সেই ১৯৫১ সাল থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিকের সম্পর্কটা [নাজিমের বিরুদ্ধে ৫০ বছর আগে যেমন ছিল] তেমনই রয়ে গেছে।’

নাজিমের কবিতায় রাষ্ট্রের কাছে ঘা-খাওয়া এক শান্ত, গর্বিত এবং লড়াকু মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু তার কবিতার প্রধান সুর বিষণ্ন। তিনি অপেক্ষা করে থাকেন সেই দিনের মুখ চেয়ে, যেখানে প্রতিটা মানুষ বেড়ে উঠবে ‘বৃক্ষের মতো একা স্বাধীন সত্তা নিয়ে, কিন্তু থাকবে অরণ্যের যৌথ চেতনায়।’ ১৯০২ সালে তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয় নাজিম হিকমতের জন্ম। যেখানে জন্ম সেখানে আর ফেরা হয়নি কোনদিন। বলতেনও_ ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না’। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন জেলে থাকতেই। কিন্তু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন আরও অনেক বছর। তার জেল পর্বের একটি কবিতা বলেছিল :’আমরা ভেঙে পড়ব না, শত্রুদের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্যে হলেও অতিরিক্ত একটি দিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।’ ১৯৬৩ সালে মস্কোয় এক রোদেলা সকালে বেরিয়েছেন প্রতিদিনের মতো দৈনিক খবরের কাগজ আনতে। বাসার সামনেই চিঠিপত্র রাখার বাক্স। কাগজটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়লেন।

এর বছর দুই আগে, ১৯৬১ সালে নিজের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী বলে গিয়েছিলেন তিনি কবিতার আকারে। কন্সতান্তিন সিমোনভ থেকে এডোয়ার্ড হির্শ_ সবাই বলবেন, এটিও নাজিমের বিস্ময়কর রচনাশৈলীর একটি উদাহরণ। পাবলো নেরুদার মতো নাজিম হিকমত কোনো বিশদ আত্মস্মৃতি রেখে যাননি তার ঘটনাবহুল জীবনের ওপর। অবশ্য অন্যরা পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে লিখবেন। যেমন বের হবে ঔপন্যাসিক ওরহান কেমালের ‘নাজিম হিকমতের সাথে জেলে’ বা তার পত্নী পিরাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ। তারপরও নাজিমের কবিতাই হবে তার সবচেয়ে অনুপ্রাণিত জীবনী, এবং একই সঙ্গে তার সময়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্মৃতিকথা।

এ রকম কিছু কবিতা এখানে [যার কয়েকটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি] রুশ ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে নতুনভাবে ভাষান্তর করা হলো বাংলায়।