উটপাখি: ধ্বংসের সমান অংশীদার (The Ostrich)

বিনায়ক সেন

১. আমার বন্ধুদের লড়াই
বাংলাদেশে এখন, এই মুহূর্তে, ‘সেক্যুলারপন্থি’দের সঙ্গে ‘গণতন্ত্রপন্থি’দের লড়াই প্রবল আকার ধারণ করেছে। অস্বীকার করব না যে, এই লড়াই নিয়ে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এখন এক ধরনের নৈতিক মুছিবতের মধ্যে আছি। আমার প্রিয় বন্ধুদের একটি দল যে কোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করে ছাড়বেই। তাঁদের যুক্তি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ সমাধা না করা গেলে দেশে সেক্যুলারিজম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। এর জন্য সাময়িকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেও তারা রাজি। আমার প্রিয় বন্ধুদের অন্য একটি দল যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের যুক্তি, অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ একটি নির্বাচন করা না গেলে দেশ প্রবল সংকটের মধ্যে পড়বে। কেননা এতে করে সরকার লেজিটিমেসির অভাবে ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনে তারা সেক্যুলারিজমকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। এমনকি এর জন্য এমন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও তারা মেনে নিতে রাজি, যেটি হয়তো হবে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন নিয়ে, হয়তো যুদ্ধাপরাধের বিচার সুদীর্ঘ কালের জন্য স্থগিত বা শ্লথ করার বিনিময়েই। সত্যের খাতিরে অবশ্য বলা দরকার, আমার বন্ধুদের দু’দলই যুদ্ধাপরাধের বিচার ও গণতন্ত্র উভয়েরই বাস্তবায়ন চান, কিন্তু এ দুই লক্ষ্যের মধ্যে যদি সংঘর্ষ বাধে তাহলে তাদের একেকজনের পক্ষপাতিত্ব থাকবে একেক দিকে। ইয়েভতুশেঙ্কো তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব শুধু ভালো আর মন্দের মধ্যে হয় না। অনেক রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব ঘটে থাকে [কম] ভালো আর [বেশি] ভালোর মধ্যে। ভালো আর মন্দের লড়াই এ দেশকে অতীতে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। ভালো আর ভালোর লড়াই এবার এ দেশকে খাদের ভেতরে ফেলে দিতে চলেছে।

২. ভুলগুলো কোথায় হয়েছিল
ভুলের সূত্রপাত হয়েছিল সত্তর দশকেই। পঁচাত্তরে মুজিব প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে নিহত হলেন। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রতিশ্রুতি_ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র_ রাষ্ট্র যদি দীর্ঘদিন ধরে ধারণ করতে পারত তাহলে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারায় এরই মধ্যে একটি সবল গণতান্ত্রিক [পুঁজিবাদী] সমাজ ও অর্থনীতি এ দেশে গড়ে উঠত। উন্নয়নের নিচু পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে অবিকশিত। তখন সক্ষম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব সময়ের আগে এগিয়ে থাকার কারণে_ যাকে আমরা ‘দূরদর্শিতা’ বলি_ ‘প্রতিষ্ঠানের ঘাটতি’ অনেকটাই পুষিয়ে নিতে পারে। উপনিবেশ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার আদি পর্যায়ে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ায় [ভারতে] জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব এবং সেসব দেশের রূপান্তরধর্মী আর্থ-সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব দেশের কোনো কোনোটিতে ছিল একদলীয় শাসন, কোনোটিতে ছিল গণতন্ত্র, আবার কোনো কোনোটিতে সক্রিয় ছিল সামরিক নেতৃত্ব। প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব যাই হোক, একটি বিষয় ছিল অভিন্ন। দীর্ঘ সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এসব দেশে অব্যাহত ছিল জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের শাসন, যারা গোড়াতে উপনিবেশের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল বা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকা এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আদি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বর্ণবৈষম্যবাদের রাজনৈতিক অবসানের পর থেকেই আজ পর্যন্ত সক্রিয় ও ক্ষমতাসীন রয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক বর্ণবৈষম্যবাদের অবসানের লক্ষ্যের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপথগামী না হয়ে অব্যাহতভাবে এগোতে পেরেছে। কেন উন্নয়নের গোড়ার পর্যায়ে আদি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্য উপনিবেশ-উত্তর পূর্ব এশিয়া বা ভারতের দিকে তাকানোরও প্রয়োজন নেই। উন্নত দেশগুলোর যখন পুঁজিবাদ সংহত ও বিকাশমান করা প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল, সেখানেও একই অভিজ্ঞতাকে আদি পর্যায়ে দেখতে পাই। বোনাপার্টের ফ্রান্স, বিসমার্কের জার্মানি বা মেইজির জাপান এর উজ্জ্বল উদাহরণ। সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে বলতে পারি যে, লেনিন যদি বিপ্লবের সাত বছরের মাথায় মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা না যেতেন, রাশিয়া আরও উন্নত ও আকর্ষণীয় সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের সঙ্গে অগ্রসর হতে পারত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ‘মুক্তিযুদ্ধ নামক বিপ্লবে’র চার বছরের মাথায় আমরা হারালাম মুজিবকে শুধু নয়, নির্মমতম জেলহত্যার মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতৃত্বকেও। মৃত্যুকালে মুজিবের বয়স হয়েছিল ৫৫, আর তাজউদ্দীনের ৫০। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোড়ার পর্বে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের এই শূন্যতা অর্থনৈতিকভাবে পুঁজিবাদকে দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল করতে দেয়নি। অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে এদেশকে সুস্থ ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক’ ধারায় বিকশিত হতে দেয়নি। এ দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীল সম্ভাবনাগুলোকেও করেছে পরবর্তী দশকে অনেকটাই পথহারা। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পরপরই এক বছরের মাথায় জিন্নাহর মৃত্যু সে দেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল, যার অনুরণন এখনও চলছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদি-চেতনার বাস্তবায়নকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। মুজিব-তাজউদ্দীন যেখানে নেই সেরকম ভূমিকা পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। পরবর্তী শাসনামল প্রমাণ করে তাঁর সে দক্ষতাও ছিল। এর ফলে সুস্থ ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রাজনৈতিক পূর্বশর্ত হিসেবে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের কাম্য ভূমিকা তাঁর কাছ থেকেও আসতে পারত। কিন্তু বাড়তি দুর্ভাগ্য এ দেশের। জিয়া সে ধারায় এগোতে পারলেন না। সে পথে এগোতে চেয়েছিলেন কি-না পুরোপুরি, সে তর্কের এখনও মীমাংসা হয়নি। আমাকে আদিতে সিপিবি-ঘরানার একজন [প্রাক্তন] বামপন্থি নেতা বলেছেন, ক্ষমতায় আসার পরপরই জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী ও বাম নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সোভিয়েত পার্টি সত্তরের দশকে জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা জাতীয়তাবাদী শক্তির অংশ হিসেবেই দেখেছিল। জিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তিদের একটি বৃহত্তর সমঝোতার সম্ভাবনা তখন সৃষ্টি হয়েছিল। এই পটভূমিতেই জিয়ার খালকাটা বিপ্লবকে ও হ্যাঁ-না ভোটে জিয়াকে তৎকালীন সিপিবির নেতৃত্ব সমর্থন দিয়ে থাকবেন। কিন্তু সমঝোতার এই সম্ভাবনা স্থায়ী হয়নি। তা ছাড়া জিয়া নিজেই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির অস্তিত্ব অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাহেরের মৃত্যু ছিল এরই ধারাবাহিকতায়।আমি বলতে চাইছি, মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বাম ধারার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সমঝোতা ও ঐক্যের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়া এ দেশের রাজনৈতিক বিকাশের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী অশুভ প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে এ দেশের রাজনীতির প্রধানতম দ্বন্দ্ব_ ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থানের ঝুঁকি_ মোকাবেলা করা একা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী শক্তির পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এর জন্য কতটা জিয়া নিজে দায়ী, আর কতটা বাম প্রগতিশীলরা দায়ী, তা রাজনৈতিক ইতিহাসবিদরা একদিন নির্ধারণ করবেন। জিয়া ও মূলধারার মুক্তিযুদ্ধের শক্তির মধ্যে সেদিন ওই সমঝোতা হলে দেশে আরও আগে সুস্থ পুঁজিবাদী ধারা গড়ে উঠতে পারত এবং পুঁজিবাদী ধারার বিকাশও হতো আরও বেগবান। রাষ্ট্রও হতো আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজ-সংস্কৃতি হতো আরও বেশি উদার ও অন্তর্ভুক্তি-প্রবণ। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হতো আরও বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও সহনশীল। পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতেই আরও বেশি দক্ষ ও গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই প্রধান দলই তখনও থাকত, কিন্তু দুটো দলই [বা তার সৃষ্ট জোটই] হতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। দুটো দলই তখন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধারণ করত সমানভাবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে পূর্বাপর সমানভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকত। দুটো দলকেই সমানভাবে পাওয়া যেত মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সোচ্চার। দুটো দলের মধ্যেই এখনও যারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছেন তারা এই না হতে পারার মর্মবেদনা বুঝবেন।জিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী ও বাম প্রগতিশীল শক্তির সমঝোতার সম্ভাবনা বাস্তবায়ন না হতে পারার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকবে। যেমন_ জিয়া-সরকারের চরিত্র গোড়া থেকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধীকারী শাহ আজিজুর রহমানের জিয়া-সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ ছিল একটি সামান্য উদাহরণ। শুধু সরকারের চরিত্রে নয়, দলের চরিত্রের ওপরও এটি দীর্ঘমেয়াদি অশুভ প্রভাব ফেলে। নবগঠিত দল বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এক অস্বস্তিকর সহাবস্থানে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়। দলটিতে দেখা দেয় প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের প্রবণতা। এর সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে ২০০১-২০০৬ পর্বে। বিএনপির নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযুদ্ধের শক্তি প্রথমবারের মতো তখন বুঝতে পারছিলেন জোটের ভেতর ও বাইরে ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রবল অস্তিত্ব। এ নিয়ে তাদের মধ্যে নীরব অভিযোগ ও মনোকষ্ট দেখেছি। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে এ অবস্থানটি তখন তাদের নীরবে সয়ে নিতে হয়েছিল। এ অবস্থা এখনও চলছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ডানপন্থি শক্তির সঙ্গে জোটের ভেতরে ও বাইরে সমঝোতা করে চলা ছাড়া যেন এ মুহূর্তে তাদের গত্যন্তর নেই! এ নিয়ে প্রবলভাবে চিন্তিত বিএনপির ভেতরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও নেতৃত্ব। দলটি যখন প্রবল সরকারি চাপের মুখে তখন ডানপন্থি শক্তিকে মোকাবেলা করার বিষয়টিকে তারা ‘ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছে’ যেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বিএনপি আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে ছাড় শুধু নয়, তার ওপর চরমভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি সাধারণ সাংগঠনিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রাখার জন্য। এমন অমাবস্যায় দলটি এর আগে কখনও পড়েনি। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। গত দুই বছরে বিএনপির রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বেড়েছে মূলত সরকারের অজনপ্রিয়তার কারণে। অবাধ ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে বিএনপি এককভাবেই ক্ষমতায় আসীন হতে পারত বা তার কাছাকাছি অবস্থানে যেতে পারত। ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধার তার কোনো দরকার ছিল না। সত্তর দশকেও দলটি গড়ার সময় এ রকম ছাড় দেওয়ার দরকার ছিল না, এখনও সে প্রয়োজনীয়তা এ দলটির নেই। দুঃখের বিষয়, আমার প্রিয় বন্ধুদের যে অংশটি গণতন্ত্রপন্থি তারা এ নিয়ে ততটা সোচ্চার নন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার পেছনে সরকারের একগুঁয়েমি যেমন দায়ী, ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে প্রধান বিরোধী দলও যে সমান দায়ী, সে কথা তাঁরা জোরের সঙ্গে বলতে চান না। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গ্রামগঞ্জে-মফস্বল শহরে এমনকি রাজধানীর বুকে যেভাবে সহিংসতা করেছে তাতে যে কোনো নাগরিক বিপন্ন বোধ না করে পারবেন না। দেশের কিছু কিছু এলাকা সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী_ এ রকম কিছু জেলা, এই অশুভ শক্তির ‘মুক্তাঞ্চলে’ পরিণত হয়েছে। দেশের ভেতরে কিছু কিছু স্থানের খবর পড়ে মনে হয় এগুলো বাংলাদেশে নয়, বরং আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কঙ্গো বা সুদানের খবর পড়ছি। বাংলাদেশ যে আজ ‘সহিংস দেশে’র পরিচিতি পাচ্ছে এর পেছনে কি এই অশুভ শক্তির উত্থান প্রধানত দায়ী নয়? সরকারের একতরফা নির্বাচন করার কৌশলকে বর্তমান সংকটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনকে কি সমানভাবে দায়ী করা যুক্তিসঙ্গত ছিল না? এপক্ষকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বললে ওপক্ষও কি ‘ফ্যাসিবাদী’ বলার যথেষ্ট কারণ ইতিমধ্যেই সৃষ্টি করে থাকেনি? সেদিক থেকে দেখলে ২০১৩ সালের শেষে ২৮ ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিপিডি-টিআইবি প্রমুখ আয়োজিত ‘নাগরিক সভা’ আমাদেরকে একরূপ হতাশই করেছে।

৩. একটি শেষ মুহূর্তের অসম্পূর্ণ সংলাপ
এ নিয়ে যা লিখছি তা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও টিভিতে দেখানো খবর এবং মুখ্য উদ্যোক্তাদের একাধিক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এতে করে পুরো চিত্রটা পাওয়া নাও যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই সেদিনের ‘নাগরিক সভা’য় সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দুর্ভাবনা। যেখানে আরও কিছুদিন নির্বাচন পেছানোর সাংবিধানিক সুযোগ ছিল, সেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ রেখে নির্বাচন করলে যে সংকট কাটবে না, এটিই ছিল আলোচনার প্রধান সুর। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপন্ন হবে না, রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে না, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। সংলাপে বিদ্বজ্জনরা এ নিয়ে চিন্তিত মন্তব্য করেছেন। এ রকম চলতে থাকলে তৃতীয় কোনো অসাংবিধানিক শক্তি চলে আসতে পারে এক পর্যায়ে, এ আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যেন কার্যত সৃষ্টি করেছে আরও একটি এক-এগারোর আশঙ্কা, সুতরাং এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়_ এ যুক্তিও পরোক্ষভাবে শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যেন কিছু কথা, কিছু নাগরিক সামাজিক কমিটমেন্টের ভাষ্য আমরা শুনতে চেয়েছিলাম রাজধানীর এই উচ্চবর্গের মানুষ, তথা বিদ্বজ্জনদের কাছ থেকে।কী বলা হয়েছিল সেদিন, তার চেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কী তাঁরা বলেননি সেদিন। কেউ কেউ হয়তো বলে থাকবেন, কিন্তু সেটি ওই আলোচনার প্রধান সুর ছিল না। প্রথমত, সময়ের বিচারে নাগরিক সভাটি দেরিতে, বড় দেরিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি তাদের শুরু করা উচিত ছিল বছর খানেক বা তারও আগে। এতে করে নাগরিক সমাজ আরও নানা বিষয়ে প্রভাব ফেলার বা অন্তত নিজেদের বিবেকি মত রাখার সুযোগ পেতেন। উদাহরণত, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তারা বছর খানেক আগেই সভা ডাকতে পারতেন। গণজাগরণ মঞ্চের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও তারা বিতর্ক করতে পারতেন। চরম ডানপন্থি শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা প্রধান বিরোধী গণতান্ত্রিক দলের পক্ষে সমীচীন হয়েছে কি-না সে প্রশ্নে তারা দিনব্যাপী আলোচনা-ডায়ালগ করতে পারতেন। কেন এসব বিষয় নিয়ে তারা উচ্চকিত হননি তা তারাই জানেন। দেশের পরিস্থিতি তাহলে হয়তো এ পর্যায়ে গড়াত না। দ্বিতীয়ত, অগণতান্ত্রিকতা আজ সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। সরকার যেমন ‘অগণতান্ত্রিক’ আচরণ করেছে, বিরোধী দলের আন্দোলনেও ‘অগণতান্ত্রিক’ আচরণ স্পষ্ট। গত এক বছর ধরে আন্দোলনের নামে যে হারে সহিংসতা হয়েছে জেলায় জেলায়, তাতে বিরোধী রাজনীতির ‘অগণতান্ত্রিকতা’ দৃশ্যমান। তৃতীয়ত, ধরা যাক, এই মুহূর্তে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলো। এবং এও ধরে নেওয়া যাক, আগের নির্বাচনগুলোয় গত দুই দশকে যেমনটা ঘটেছে, বিরোধী জোট এবারে জয়ী হলো। কিন্তু তাতে করে গণতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠা হবে তারই বা নিশ্চয়তা কী? সহিংস অগণতান্ত্রিকতার অনুশীলন করে যে অশুভ শক্তিকে আমরা প্রশ্রয় পেতে দেখলাম তারা তো তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবে। সেটাই কি আমরা চাই? আমরা কি চাই যুদ্ধাপরাধের বিচার_ ৪২ বছর পরে যে কোনো কারণেই হোক যখন সবে শুরু হয়েছে_ থেমে যাক? একবার অপরাধীদের হাতে ক্ষমতা গেলে বা তারা ছাড়া পেলে কী ভয়ঙ্কর অমাবস্যা নেমে আসবে এ দেশে, এ নিয়ে তো চরম দুর্ভাবনা নাগরিক সভার উদ্যোক্তাদের কথায় এবং বার্তায় দেখতে পেলাম না। চতুর্থত, উদ্যোক্তারা তো একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’র কথা বলতে পারতেন। যে চুক্তিতে বলা হতো, অবাধ, স্বচ্ছ ও সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য নয়। যে চুক্তিতে এ-ও বলা হতো, চরম ডানপন্থি সহিংস শক্তির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদচারণা গ্রহণযোগ্য নয়। জন রাউলসের ‘রিজনিবল প্লুরালিজম’ সংজ্ঞায় এই সহিংস শক্তি পড়ে না। যে চুক্তিতে বলা হতো, অসাম্প্রদায়িকতা ও সেক্যুলার মূল্যবোধ ছাড়া নির্বাচনী গণতন্ত্র কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র হতে পারে না। যে চুক্তিতে বলা হতো যে, বাহাত্তরের মূল চারটি নীতি আসলে পরস্পরের পরিপূরক। সমাজতন্ত্র ছাড়া যেমন গণতন্ত্র জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, তেমনি গণতন্ত্র ছাড়া সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজম ছাড়া জাতীয়তবাদ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর শাসনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। সেক্যুলারিজম বর্ণবৈষম্যবাদের মতো ধর্মবৈষম্যবাদের আশঙ্কাকে দূর করে। এবং সবশেষে নাগরিক সভার অনেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত প্রার্থীদের ‘হলফনামার’ সূত্র ধরে একহাত নিয়েছেন সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের। বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে সম্ভবত অবৈধ উপায়ে সম্পদ আহরণের সম্ভাবনার কথা। এই উদ্বেগে কারও আপত্তি থাকার কথা নয় সাধারণভাবে। কিন্তু এই উদ্বেগ আরও বিস্তৃত পরিসরে ব্যক্ত হওয়া উচিত ছিল। নাগরিক সভার উচ্চবর্গের অংশগ্রহণকারীরা বলতে পারতেন, হলফনামায় যে সম্পদ আহরণের চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা সাধারণভাবে কম-বেশি সত্য উচ্চবর্গের সবার ক্ষেত্রেই। যারাই এ সময়ে [গত এক দশকে] রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাশালী হয়েছেন_ তা তিনি সরকার দলেই থাকুন, আর বিরোধী দলেই থাকুন_ তাঁরাই দ্রুত অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ_ এ তিনের বরপুত্র হয়েছেন তাঁরা। প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থাকা যে উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজ সেদিনের নাগরিক সভায় অংশ নিয়েছিলেন তারাও হয়তো কম-বেশি এই সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়ার বাইরে নন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে সরকারদলীয় প্রার্থীদের সম্পদ হয়তো বেড়েছে ৭ গুণ, সে তুলনায় বিরোধীদলীয় সদস্যদের সম্পদ হয়তো বেড়েছে ৪ গুণ এবং উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজের সদস্যদের বেড়েছে হয়তো ২ অথবা ৩ গুণ [নাগরিক সমাজের যে অংশটি ব্যবসায়ী শিল্পপতি তাদেরকে এখানে ইচ্ছে করেই বাদ রাখছি]। একই সময়ে আমলাদের অর্থবিত্তও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে থাকবে। করপোরেট ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যারা তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। সংখ্যাগুলো কাল্পনিক, কিন্তু সমাজে আয় ও সম্পদ-বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করার সুবাদে বলতে পারি_ এ ধরনের প্যাটার্ন বাস্তবতার বাইরে নয়। এ প্রশ্নেও বলতে বাধ্য, সেদিনের নাগরিক সভার হলফনামা সম্পর্কিত আলোচনা নিতান্ত একপেশে মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গগুলো আগামীতে উপস্থাপনের সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি।কিন্তু আমি এসব কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কে? আমি তো উটপাখি, সমাজের-ইতিহাসের ওপর দিয়ে ঝড়-ঝঞ্ছা যখন বয়ে যাবে তখন আমার বালিতে মুখ গুঁজে থাকার কথা। ‘উটপাখী’ কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশিদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার/তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।/অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ বাংলাদেশ নাকি ধ্বংসের কিনারে গিয়ে বারবার ফিরে আসে। কিন্তু এ রকম কোনো মৌল সূত্রের রক্ষাকবচ আসলে নেই। যা ঘটছে এখন বাংলাদেশে, যা ঘটতে যাচ্ছে, তার জন্য সমানভাবে দায়ী থাকবে সরকার, বিরোধী দল ও সিভিল সমাজ। শুনেছি, উটপাখিরাও আসলে বালিতে মুখ লুকায় না। বালিতে তারা মুখ গুঁজে ডিমকে রক্ষা করার জন্য। নিতান্ত জীবন-চর্চার প্রয়োজনেই। তাই উটপাখিদের তুলনা দেওয়াটা তাদের জন্য হবে অপমানকর। সরদার ফজলুল করীম এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মানুষ আসলে মানুষকে মারতে পারে না। হয় মানুষ অমানুষকে [পশুকে] মারে, অথবা অমানুষ [পশু] মানুষকে মারে। আমরা এই ভয়াবহ সমীকরণের মধ্যে বাস করছি।

লেখক
প্রাবন্ধিক
অর্থনীতিবিদ

Original post on Samakal here.

রাষ্ট্র ও নিরাশ্রয়

মোহভঙ্গের কবিতা

বিনায়ক সেন

১. নাদের আলি, আমি আর কত বড় হব?

১৯৭২ সালে, মনে পড়ে, প্রথম আমাদের হাতে আসে রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের কাব্য-সমগ্র। এর ভূমিকায় জীবনানন্দের কবিতা ও কাব্যবিশ্বাসের গভীর ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল। প্রগতিশীল সমাজ পরিবর্তনের পক্ষের শক্তি ও আত্মিক সমর্থক হিসেবেই কবিকে চিহ্নিত করেছিলেন এই বামপন্থী সাহিত্য-সমালোচক। ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ থেকে উদৃব্দতি দিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর বক্তব্য সপ্রমাণিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভূমিকাটি পড়ে সে সময় আমার মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অগ্রণী ‘মার্কসবাদী’ সমালোচক হয়েও তিনি ‘অমার্কসবাদী’ জীবনানন্দের প্রতি এত উৎসাহ নিয়েছিলেন কেন? এটুকু তো জানাই ছিল যে, জীবনানন্দ আদর্শে আস্থাবান কোনো সমর সেন, অরুণ মিত্র বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় নন। জীবদ্দশায় কোনো মার্কসবাদী পার্টি বা ঐ ধারার সাহিত্য-গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিলেন না তিনি। ‘নির্জনতম কবি’র যে শিরোপা বুদ্ধদেব বসু তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন তাতে অন্যকিছু তাঁকে ভাবা সহজ ছিল না। তার ওপরে যোগ হয়েছিল তাঁর ‘রূপসী বাংলা’র ক্রমবর্ধমান অতুল জনপ্রিয়তা। সদ্য স্বাধীন দেশে মনে হতো ‘রূপসী বাংলা’ যেন বাংলাদেশকে স্মরণ করেই এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা আগাম ভেবেই কবি লিখেছিলেন! এ দেশের নদী-নালা, মাঠ-পুকুর, বৃক্ষলতা, পাখ-পাখালি, আদিগন্ত ছড়িয়ে থাকা সবুজ ধানক্ষেত, বাংলার রূপকথা ও কিংবদন্তিমালা, কৃষি ও কৃষকের জীবন, গ্রাম ছেড়ে আসা শহরের উঠতি মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও টানাপড়েন_ সব মিলিয়ে তখন ‘রূপসী বাংলা’র কবিকে মনে হতো পূর্ববর্তী এক অন্য ভুবনের মানুষ। এর মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শের চিহ্ন খোঁজা মনে হয়েছিল কষ্টকল্পনাই। এর কিছুদিন পরেই হাতে পেলাম আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘শুদ্ধতম কবি’। সৈয়দের গদ্যের ছটা আর জীবনানন্দের কবিতার ওপর ভিনদেশি প্রভাবের নিপুণ বিশ্লেষণ আমাদের প্রজন্মকে বিমোহিত করেছিল। সৈয়দ তাঁর লেখায় জীবনানন্দের কবিকৃতির ওপর জোর দিয়েছেন মূলত আঙ্গিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। কবির সামাজিক আকাঙ্ক্ষাকে বিশেষ কোনো গোচরে আনেননি তিনিও। ফলে জীবনানন্দের ‘অরাজনৈতিক’ ভাবমূর্তি আরও প্রবলভাবে গেড়ে বসে আমাদের তৎকালীন ধারণার মধ্যে। কিন্তু আর কেউ নন, স্বয়ং রণেশ দাশগুপ্ত জীবনানন্দ দাশের কাব্য-সমগ্রের প্রবল ইতিবাচক ভূমিকা লিখেছেন_ এই খটকাটি শেষ পর্যন্ত থেকেই যায় মনের মধ্যে। তাহলে কি জীবনানন্দ সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তা সম্পূর্ণ নয়? তাঁর কাব্যজীবনের পেছনে [সে সময় তাঁর গদ্য রচনাগুলোর অস্তিত্ব আমরা জানতাম না] রয়ে গেছে সমাজ-রাষ্ট্রবিষয়ক কোনো নিভৃত সমাচার? তখন দেশভাগ, দেশান্তর, উদ্বাস্তু জীবন_ ১৯৪৭-এর এসব রাষ্ট্রিক ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে ভাবার তাগিদ তৈরি হয়নি। বরিশালে বিএম কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, সেখানেই বেশিরভাগ কবিতা লিখেছেন, দেশ ভাগের পর কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন, এবং ঐ শহরেই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে এক ট্রাম-দুর্ঘটনায় মারা যান। জীবনানন্দবিষয়ক আত্মজৈবনিক তথ্য এটুকুতেই সীমিত ছিল। এ বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ তো বটেই, রণেশ দাশগুপ্তও বিস্তৃত করে কিছু জানাননি তখন। ক্লিনটন বুথ সিলির জীবনানন্দ জীবনী তখনও আসতে বাকি।

এ রকম অনবধানতা ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরেও। সত্তরের দশকে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক উৎসবে, পাড়ার ‘বিচিত্রানুষ্ঠানে’ [তখনও পাড়াকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদি হতো এ দেশে] আবৃত্তিযোগ্য কবিতার প্রথম সারিতে থাকত ‘কেউ কথা রাখেনি’। আমরা তখন কেউই বিশেষ খেয়াল করিনি এর অন্যতম চরিত্র নাদের আলিকে, যে কবিকে তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তা-ও আবার যা তা বিল নয়, সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর নাকি একসঙ্গে খেলা করত। এ নিয়ে সুনীলের ব্যাখ্যা পরে শুনেছি : ‘পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা করার ছবিটা মোটেই কাল্পনিক নয়। এ রকম দেখাই যায় মাঝে মাঝে। তবে, পদ্মফুলের বদলে শালুক হতে পারে, আর সাপ হলো খুব সম্ভবত জলঢোড়া।’ ‘তিন প্রহরের বিল’ যে মাদারীপুরের পূর্ব মাইজপাড়ার অপসৃত কোনো এক ব্রাহ্মণপল্লীর কাছেই, সে কথা তখন কারও মাথায় আসেনি। কবিতাটিতে শুধু পূর্ববঙ্গ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দেশভাগ-পরবর্তী শহর কলকাতার কঠিন উদ্বাস্তু জীবনের কথাও। আর ছিল বঞ্চনা থেকে উত্থিত শ্রেণী-বৈষম্য চেতনা_ সেটিও বহু পরে চোখে পড়েছে। চৌধুরীদের বিশাল ভবনের ভেতরে চলছে রাশ-উৎসব, তার গেটে দাঁড়িয়ে কবি দেখছেন সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা কত-না আমোদে হাসছে, তাঁর কৈশোরক অস্তিত্বের দিকে তারা কেউ ফিরেও তাকায়নি! ‘বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস একদিন আমরাও’_ এ শ্রেণী-বৈষম্য চেতনা নয়তো কী!
১৯৭২ সালের জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছে শামসুর রাহমানের ‘স্যামসন’। মুক্তিযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু ন’মাস ধরে পুরো দেশটাকে বন্দিশিবির বানানোর ক্ষোভ তখনও যায়নি। ‘ক্ষমতামাতাল জঙ্গি হে প্রভুরা ভেবেছো তোমরা, তোমাদের হোমরা-চোমরা সভাসদ, চাটুকার সবাই অক্ষত থেকে যাবে চিরদিন?’ এই ত্রুক্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ স্বর প্রাত্যহিকতার জগৎ থেকে তুলে নিয়ে কবিতায় সাজানো হয়েছিল। ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন নবজাত রাষ্ট্রের প্রধান কবিকণ্ঠটি। অসহায় অন্ধ শৃঙ্খলিত মিল্টন-বর্ণিত প্যারাডাইস লস্টের ‘স্যামসন’-এর তুলনায় এ এক অন্য স্যামসন প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে। তখন সত্যই ছিল প্রদীপ্ত হওয়ার সময়। ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়ে এটাই ছিল প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা, সার্থকতমও। এর আগে বাংলা কবিতায় এই স্বর শোনা যায়নি:

‘আমাকে করেছো অন্ধ, যেন আর নানা দুষ্কৃতি
তোমাদের কিছুতেই না পড়ে আমার চোখে। স্মৃতি
তাও কি পারবে মুছে দিতে? যা দেখেছি এতদিন_
পাইকারি হত্যা দিগ্গি্বদিক রমণীদলন আর ক্ষান্তিহীন
রক্তাক্ত দস্যুতা তোমাদের, বিধ্বস্ত শহর, অগণিত
দগ্ধ গ্রাম, অসহায় মানুষ, তাড়িত, ক্লান্ত; ভীত
_এই কি যথেষ্ট নয়? পারবে কি এসব ভীষণ
দৃশ্যাবলি আমূল উপড়ে নিতে আমার দু-চোখের মতন?
দৃষ্টি নেই, কিন্তু আজো রক্তের সুতীব্র ঘ্রাণ পাই,
কানে আসে আর্তনাদ ঘনঘন, যতই সাফাই
তোমরা গাও না কেন, সব কিছু বুঝি ঠিকই…’

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে স্বাধীনতা সাম্যের স্পৃহা জাগে, কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ’ এই তিন উপাদানের সম্মোহক প্রভাবে পড়ে যারা হয়তো সমাজ-রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে পারতেন, সংকটে পথ দেখাতে পারতেন, তারাও সে পথ ছেড়ে চলে গেছেন অন্য এক বলয়ে। এলিট আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগহীনতা এখন এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, আজ তারা দুই ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী :পরস্পরের ভাষা বুঝতেও তারা অক্ষম। শামসুর রাহমানের কবিতা রাষ্ট্র তথা এলিট শ্রেণীর এই ব্যর্থতাকে তুলে ধরে।

সত্তর দশক থেকে শুরু করে শামসুর রাহমানের কবিতায় ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসা নিরাশার ছায়া তাঁর কবিতার বইয়ের নিরাশাকরোজ্জ্বল নামকরণের মধ্যেই সুস্পষ্ট। ধারাবাহিকভাবে শোক, ক্ষোভ ও বেদনার পতাকা উড়িয়েছে তাঁর কবিতার বইগুলি : দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, আমি অনাহারী, শূন্যতায় তুমি শোকসভা, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে, অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই, শিরোনাম মনে পড়ে না, ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ, এক ফোঁটা কেমন অনল, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার, খুব বেশি ভালো থাকতে নেই, ধ্বংসের কিনারে বসে, গৃহযুদ্ধের আগে, খণ্ডিত গৌরব, হরিণের হাড়, উজাড় বাগানে, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি, ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে, গন্তব্য নাই বা থাকুক, গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান ইত্যাদি।

জীবনানন্দের কোনো মোহ ছিল না ১৯৪৭ নিয়ে, সুনীলের মোহভঙ্গ হয়েছিল পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে_ তারও পেছনে ছিল দেশভাগজনিত মানবিক বিপর্যয়। শামসুর রাহমানকে দেশভাগের সূত্রে দেশান্তরিত হয়ে আসতে হয়নি এ দেশে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে ঘিরে যে প্রচণ্ড আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে, তাকে ক্রমশ বিলীন হতে দেখেছেন তিনি। নিজেকে দেশান্তরিত উদ্বাস্তু মনে করার কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু তিনি ছিলেন দেশের ভেতরেই মানসিক এক উদ্বাস্তু, একধরনের ‘ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পারসন’। বাংলা সাহিত্যের তিনজন প্রধান কবিরই মোহভঙ্গ হয়েছিল আধুনিক রাষ্ট্রের বিষয়ে। ঔপনিবেশিকতার অবসান হলেই নবযুগের সূচনা হবে রাতারাতি_ এ কথা তিনজনের কেউই চিন্তা করতেন না। তবে নবযুগের আকাশে পূর্ণিমা না আসুক ঘোর কৃষ্ণপক্ষে তা ঢেকে যাবে না, এটাও তাঁরা বিশ্বাস করতেন। বাস্তবতা ছিল আরও নির্মম। এ কথা মেনে নিতে তাদের কষ্ট হওয়ারই কথা। তিনজনার কষ্টের কার্যকারণ এক নয়; যে সময়ে তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পরিণতি প্রাপ্তি তা-ও ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভূগোলের। তারপরও তা একই কষ্টের গল্প। নিরাশ্রয়ের কষ্ট ছিল তিনজনেরই জীবনে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন, কবির মৃত্যু না হলে ফুল জন্মায় না। এই তিন বাঙালি কবির মৃত্যুতে পৃথিবীতে তিনটি আশ্চর্য জাতের গোলাপের জন্ম হয়েছিল।

২. বিভিন্ন কোরাস

‘তরুণ’ ও ‘পরিণত’ মার্কসের মধ্যে যেমন, তরুণ ও পরিণত জীবনানন্দের মধ্যেও বোধকরি সে রকম একটি বিভাজন রেখা রয়ে গেছে। অনেকটা ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার যেমন বলেছিলেন_ জীবনের দুই পর্বের রচনার মধ্যে এপিস্টেমোলজিক্যাল ব্রেক বা জ্ঞানতাত্তি্বক ছেদ! তাঁর কাব্যজীবনের ‘আগের’ নাকি ‘পরের’ পর্বটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ_ এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। ‘বনলতা সেন’ ও তার পূর্ববর্তী কবিতাকে বুদ্ধদেব বসু অনেক বড় করে দেখেছিলেন। বুদ্ধদেবের কথা উল্লেখ করেই জীবনানন্দ এক চিঠিতে প্রভাকর সেনকে জানিয়েছিলেন, “আমার কবিতার জন্য বেশ বড় স্থান দিয়েছিলেন তিনি প্রগতিতে এবং পরে ‘কবিতা’য় প্রথম দিক দিয়ে। তারপরে ‘বনলতা সেন’-এর পরবর্তী কাব্যে আমি তাঁর পৃথিবীর অপরিচিত, আমার নিজেরও পৃথিবীর বাইরে চলে গেছি বলে মনে করেন তিনি।” সবাই অবশ্য এ ধারণায় শামিল ছিলেন না। অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বনলতা সেন পরবর্তী যুগের কবিতাই বরং জীবনানন্দের শ্রেয়তর অবদান। এ মতটিকেও অগ্রাহ্য করেননি জীবনানন্দ। ঐ একই চিঠিতে জানাতে ভোলেননি যে, ‘নিরুক্ত ও পূর্বাশা’র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করেন আমার শেষের দিকের কবিতায় আমার পারিপাশর্ি্বক চেতনা পৌঢ় পরিণতি লাভ করেছে। এ পারিপাশর্ি্বকতা অবশ্য সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে। তরুণতর কবিরা অবশ্য এসব মূল্যায়ন নিয়ে মাথা থামাননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘জীবৎকালে তেমন কিছু স্বীকৃতিও পাননি তিনি।… মৃত্যুর পরে অনেক পত্রিকাই তাঁকে অগ্রাহ্য করে, কোনো কোনোটি আবার তাঁর সম্পর্কে ভুলভাল বিবরণও ছাপে। অথচ তখন জীবনানন্দ দাশই ক্রমশ হয়ে উঠছেন আমাদের প্রধান আরাধ্য পুরুষ। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা কবিতার ভাষা আমূল বদলে ফেলার কৃতিত্বের কারণে’ এই সম্মান।

একই চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ টেনে তাঁর কাব্যজীবনের দুই পর্যায় সম্পর্কে দুই ভিন্ন ও বিপরীতধর্মী মূল্যায়ন লক্ষ্য করার পর অবশেষে জীবনানন্দ যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায়_ তিনি একই সঙ্গে বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন কোরাসের লোক, বহুবিধ কণ্ঠস্বরকে ধারণ করতে আগ্রহী এবং অনবরত নতুন পথ খুঁজে চলেছেন। শুধু আঙ্গিকের নিরীক্ষায় নয়, বিষয়বস্তু বা চেতনার নানা চিত্রণেও তিনি উৎসাহী। বুদ্ধদেব ও সঞ্জয় যা বলেছেন তাঁর সম্পর্কে, তাকে তিনি অস্বীকার করছেন না, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। কেননা, তার ভাষায়, ‘আরও দু’চার রকম চেতনা আছে, আজও যাদের কবিতায় শুদ্ধ করে নিয়ে নির্ণয় করে দেখতে আমি ভালোবাসি।’ সেই চেতনাগুলোর প্রকৃতি বা প্রকার নিয়ে কবি আর কিছু বলেননি। কিন্তু নতুনতর বক্তব্য, উপলব্ধি বা দর্শন কী করে শিল্পসম্মত করে কবিতায় তুলে আনা যায়, তারই অবিরাম তালাশের মধ্যে আছেন, এটুকু অন্তত ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্বেই জানিয়েছিলেন তিনি_ ‘কেহ যাহা জানে নাই কোন এক বাণী/আমি বয়ে আনি।’ এটা শুধু আত্মপ্রকাশের ঘোষণা ছিল না, তার সারা জীবনের অঙ্গীকারও ছিল। নতুনতর ‘বাণী’ উপলব্ধি ও চেতনাকে কবিতার ‘ফর্মে’ ধরার জন্য অনবরত নিরীক্ষার মধ্যেই আমৃত্যু থাকতে হয়েছে তাকে। কখনও সফল হয়েছেন, কখনও হননি ততটা_ সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।

শুধু চিঠির জনান্তিকে নয়, তাঁর কাব্যচর্চার বিভিন্ন ও বিপরীতধর্মী মূল্যায়নের বিষয়টি প্রকাশ্যেও আনলেন এক পর্যায়ে। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় লিখলেন : ‘আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারও মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরও নানা রকম আখ্যা চোখে পড়েছে।’ এসব আখ্যা অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কবি, কিন্তু এটুকু কেবল তার পাঠক-সমালোচকদের জানাতে চাইছেন যে, এসব অভিধাই ‘আংশিকভাবে সত্য_ কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।’ এখানে ‘সমগ্র কাব্য’ বলতে শুধু গ্রন্থিত কবিতাকে বুঝলে চলবে না, অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত কবিতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় গ্রন্থর্ভূত কবিতার সংখ্যা ১৬২। ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর হিসাব থেকে জানা যায়, জীবনানন্দের অগ্রন্থিত ও আবিষ্কৃত কবিতার সংখ্যা হবে প্রায় ৬৬০ [এখন আরও বেশি] অর্থাৎ জীবদ্দশায় গ্রন্থর্ভূত কবিতার তুলনায় চার গুণেরও বেশি।

‘অগ্রন্থিত জীবনানন্দ’-এর বিশ্লেষণ স্বতন্ত্র মনোযোগের দাবিদার_ সে কাজ এখনও বাকি অথবা হয়ত সবে শুরু হয়েছে। অগ্রন্থিত কবিতার বিপুল সম্ভারকে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে রচনার কাল-নিরূপণ একটি বড় সমস্যা। উদাহরণত, তার ‘ছায়া আবছায়া’ [প্রতিক্ষণ থেকে ২০০৪ সালে ভূমেন্দ্র গুহ ও গৌতম মিত্র সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত] সংকলনটি পড়ে মনে হয় বিভিন্ন সময়ের রচনা, তাঁর ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র মতোই। শেষোক্ত কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল ১৯৩৪ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর থেকে মনে হয় কাব্যের ‘আদি পর্যায়’ ও ‘অন্তিম পর্যায়’ এই বিভাজন রেখা কবি তার নিজের ক্ষেত্রে হয়তো স্বীকার করতে চাননি। হয়তো সেটা চৈতন্যের [শিল্প-চৈতন্য, ব্যক্তি-চৈতন্য ও সমাজ-চৈতন্যের] বিভিন্ন প্রবণতা ও ধারাকে তিনি একই সময়ে নিজের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখেছিলেন বলে।

‘অগ্রন্থিত জীবনানন্দ’ আলোচনার আরও একটি বড় প্রশ্ন হলো, গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত/অপ্রকাশিত কবি-সত্তা কি একই ভাবনা-চিন্তা দর্শন ও বিবর্তনকে তুলে ধরছে, নাকি জীবনানন্দের কাব্য-চর্চায় আগে জানা যায়নি এমন কোনো দিককে [নিরীক্ষামূলক হয়ত-বা] নির্দেশ করছে? জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটা যে অবান্তর নয় তার বড় প্রমাণ ‘রূপসী বাংলা’। ১৯৩৪ সালের মার্চ মাসে এর কবিতাগুলো লেখা হয়, অথচ জীবদ্দশায় এর অস্তিত্ব অনুমান পর্যন্ত করা যায়নি। আর এ কথা তো সুবিদিত যে, জীবনানন্দের জনপ্রিয়তার পেছনে ‘বনলতা সেন’ যেমন, ‘রূপসী বাংলা’ও বড় ভূমিকা রেখেছে। অপ্রকাশিত জীবনানন্দের মধ্যে রূপসী বাংলার মতো নতুনতর কোনো চেতনা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে হয়তো-বা; সে সম্ভাবনা বিপুল পরিমাণ অগ্রন্থিত কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রবল। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে জীবনানন্দের গদ্য-রচনা প্রকাশের পর। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এতগুলো গল্প ও উপন্যাস প্রায় প্রকাশযোগ্য করে গড়ে তুলে শেষ পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দিয়েছিলেন, যেমন অবলীলায় তিনি বাক্সবন্দি করে রেখেছিলেন তার কবিতার অজস্র পাণ্ডুলিপি। এ-ও একধরনের মমিকরণ [মামিফিকেশন]_ দীর্ঘকাল পরে কোনো প্রত্নতাত্তি্বক সেসব মমিকে খুঁড়ে বের করবেন সে রকম কোনো প্রত্যাশায়? এসব রচনা প্রকাশের পর প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটবার পর প্রশ্ন উঠছে। জীবনানন্দের গল্প ও উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর কবিতার আন্তঃসম্পর্ক কী তা নিয়ে। গদ্য-পদ্যের সম্পর্কের আলোচনা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিচারের জন্য তেমন আবশ্যিক বিষয় নয়, যতটা জরুরি তা জীবনানন্দের ক্ষেত্রে। কেননা, এক অর্থে জীবনানন্দের কবিতা ও গল্প-উপন্যাস একই বিষয়-ভাবনার দুই শিল্পিত উৎসারণ।

৩. ইতিহাসের অবসাদের সময়

রহস্য শেষ পর্যন্ত অধরা থাকে বলেই কবিতা রহস্যময়ী এবং রহস্যের কারণেই পদ্য-রচনাটি ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে। কেননা, কবিতা তা যতই আটপৌঢ়ে বিষয়ের আর মুখের কথার কাছাকাছি হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত শিল্পসম্মত হয় কোনো [অব্যাখ্যাত] রহস্যের কারণে। ‘কবিতার কথা’য় সেই রহস্যময়ীর উল্লেখ আছে। জীবনানন্দের গদ্য-পাঠ তাঁর কবিতার রহস্য-ঘেরা মনোভূমিকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। কবিতা বিচারের জন্য কবির ‘হৃদয়ে’ কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার উপাদান কীভাবে কাজ করছে তা দেখার ‘স্বতন্ত্র সারবত্তা’ আছে_ এ কথা জীবনানন্দ নিজেই ‘কবিতার কথা’য় বলেছিলেন। কবির কল্পনার ভেতরে ‘চিন্তা ও অভিজ্ঞতা’ খুঁজে পাওয়ার জন্য আমরা দ্বারস্থ হতে পারি তাঁর গদ্য-রচনার কাছে। গল্প-উপন্যাসগুলো ধারাবাহিকভাবে পড়তে শুরু করলে স্পষ্ট হয় কেন জীবনানন্দের তিরিশের কবিতা বদলে গেল চলি্লশে এসে, বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশভাগ ও এর পরবর্তী সময়ের চাপে। গদ্য-পাঠের এই অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় তার পদ্যের মোড়-পরিবর্তন ও তার কার্যকারণ। কবির এই পালাবদল ইতিহাস-চেতনার সূত্রে ততটা নয়, যতটা সমকালীন সমাজ-রাষ্ট্র রাজনীতির সূত্রে প্রাপ্ত। সঞ্জয় ভট্টাচার্য যেমন বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। ‘অনেক মৃত্যু পার হয়ে এসেছি আমরা, অনেক শেষ দেখার প্রাণ বিনিময় করে এসেছি_ স্বদেশী সন্ত্রাসবাদে, মারীতে, মন্বন্তরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, দাঙ্গায়।’ সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে জীবনানন্দকেও যেতে হয়েছে। এ কারণেই চলি্লশের গদ্য-রচনাগুলোর কাছে বারবার ফিরে যেতে হয় আমাদের [যাই কি আমরা সেভাবে?]। তার ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কবিতাগুচ্ছের পূর্ণতর উপলব্ধির জন্য। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য কেননা তিনি মনে করতেন ‘কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ ব্যক্তি-জীবনে বৈবাহিক অবসাদ যেমন, সমাজ-রাষ্ট্রের পালাবদলে ঝক্কিও তেমনি তাকে প্রবলভাবে সামলে চলতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় উদ্বাস্তু-প্রায় জীবনযাপনের এদিক-ওদিক মেলাবার চেষ্টাতেই বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর অন্তঃকরণ। এর একটি বিশ্বস্ত চিত্র পাই তার সে সময়কার গদ্য রচনায়।

‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র তীক্ষষ্ট রাজনৈতিক বোধ কোনো বিশেষ সমাজ-দর্শনের তাগিদে স্ফূরিত হয়নি। এটি জীবনানন্দের একান্ত নির্দলীয় প্রগতিশীল চেতনা, যাকে চলি্লশের যুগের বামপন্থিরা কেউ কেউ চিনতে ভুল করেছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা ননি ভৌমিকের কাছে অপরিচিত ঠেকেছিল প্রখ্যাত বাম-ডান মতাদর্শকের বাইরে একটি তৃতীয় অবস্থানের খোঁজার চেষ্টা। আর কংগ্রেসি বলয়ের সজনীকান্ত দাস দক্ষিণপন্থি রক্ষণশীলতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চলছিলেন_ পূর্বাপর সেটি তিরিশের যুগেই ‘শনিবারের চিঠি’র আক্রমণাত্মক নন্দনতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। জীবনানন্দ কোনো শিবিরেই ভরসা পাননি, যদিও তার মতাদর্শ ছিল সমাজ-প্রগতিকে লক্ষ্য করে : অসাম্প্রদায়িক, গরিব মানুষের প্রতি সহমর্মী, বৈষম্য-বিরোধী, নারীমুক্তির পক্ষে, ব্যক্তি ও সমাজের শুভবুদ্ধির জন্য সচেষ্ট এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা-মদমত্ত পরাক্রমশীলতার বিরুদ্ধে। ‘সময়ের তীরে’ কবিতায় তিনি সবাইকেই একহাত নিলেন, আমেরিকা-ভারত-রাশিয়া কোথাও মানুষের সর্বাত্মক মুক্তির প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত হতে দেখেননি বলে। উদৃব্দতিটা এ রকম [কত আগে লেখা এই সত্যভাষণ ভাবা যায়!]:

‘তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস-ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম,
কিংবা ভারতের;
অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতন্বী সূর্যশিখার কোনো স্থান আছে
যার মানে পবিত্রতা শান্তি শক্তি শুভ্রতা_ সকলের জন্যে!
নিঃসীম শূন্যে শূন্যের সংঘর্ষে স্বতরুৎসারা নীলিমার মতো কোনো রাষ্ট্র কি নেই আজ আর
কোনো নগরী নেই
সৃষ্টির মরালীকে যা বহন করে চলেছে মধু বাতাসে
নক্ষত্রে_ লোক থেকে সূর্যলোকান্তরে!’

সত্যিই তো কোথাও কী এমন রাষ্ট্র নেই আজ আর অথবা এমন কোনো নগরী নেই যেখানে সকলের জন্য রয়েছে ‘শান্তি শক্তি শুভ্রতার’ আয়োজন! এই কথাগুলো ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্বের আস্থাবান লাইন ‘প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ’ এর প্যাস্টোরাল দৃশ্য থেকে কতটাই আলাদা! এই পরিবর্তন কবির চিন্তায় এলো কী করে? এর একটি পূর্বাভাস পাওয়া যায় জীবনানন্দের গদ্য রচনায়, বিশেষত সময়কালীন উপন্যাসে। চলি্লশের দশকের কবিতা ও উপন্যাসগুলো পাশাপাশি পাঠ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এর মধ্যে আবার ১৯৪৮ সাল জীবনানন্দের সৃষ্টিকর্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরই প্রকাশিত হয় ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ এবং রচিত হয় ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র বেশকিছু কবিতা। রাজনীতি, রাষ্ট্র, নগর, দেশভাগ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, বাণিজ্য, স্বাধীনতা, যন্ত্র-সভ্যতা প্রভৃতি সমসাময়িক প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে এতে। আছে ‘পাওয়ার ও পার্টি পলিটিক্সে’র কথাও। এখানে কবির বর্ণনাভঙ্গি তির্যক, স্বর কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের, কখনও অনুকম্পার, পরিহাসের। এ এক অন্য জীবনানন্দের নির্মাণ, যা বিচলিত করেছিল বুদ্ধদেব বসুকে [‘কি লিখছেন জীবনানন্দ আজকাল!’]। ঐ ১৯৪৮ সালেই_ আমাদের এখন জানা হয়েছে জীবনানন্দ লিখলেন চার চারটি উপন্যাস : [আরও বেশি হয়তো বা] ‘সুতীর্থ’, ‘জলপাইহাটি’, ‘মাল্যবান’ ও ‘বাসমতীর উপাখ্যান’। আমি শুধু শেষের উপন্যাসটি ধরে কিছু উদাহরণ দেব জীবনানন্দের কাজে গদ্য-পদ্যের যোগসূত্র দেখানোর জন্য। অন্যান্য উপন্যাসও একই যোগসূত্রকে তুলে ধরে।
সমকালীনতায় ক্রমশ তলিয়ে যাওয়ার পর্বান্তগুলো স্পষ্ট হয় ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসে। মানুষের মধ্যে অবিরাম প্রীতির অভাব দেখে ব্যথিত কবির মন_ কবিতা ও উপন্যাস দুই বর্ণনা রীতিতেই তা ফুটে উঠেছে। ‘কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই’ কবিতায় যেমন, উপন্যাসেও সেই হতাশা_ নিরাশ্বাস এসেছে। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’-এ এই নিরাশার উৎস সমকালীন রাজনীতি, দেশভাগ, দাঙ্গা আর ইতিমধ্যেই ফিকে হয়ে আসা ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার আনন্দ। দেশভাগের পর দেশের চেহারা কী রকম দাঁড়াবে তা নিয়ে কোনো আশাবাদ ছিল না তাঁর মনে। একধরনের নৈর্ব্যক্তিক নির্লিপ্তি নিয়ে তিনি ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও স্বাধীনতাকে গ্রহণ করেছিলেন। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসের একটি অংশ নিম্নরূপ:

‘শিগগিরই তো দেশ স্বাধীন হবে।’

‘সে ভিড়ের মধ্যে আমাদের কোনো স্থান হবে না।’

‘এই বলছ? কী করে বুঝলে?’ রমা বললে, ‘চোখে বুঝি দূরের জিনিস দেখতে পাও?’

‘হ্যাঁ, নির্ঘাত। মিলিটারিতে চেষ্টা করলে অবিশ্যি কমিশন পাওয়া যেত, মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার বয়স নেই। অন্য কোনো কাজ পাওয়া যাবে না। যেসব ছেলের পরীক্ষার খাতা দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। চাকরি ও ব্যবসার বাজারে ওদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল; কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ওরা পথ কেটে নিতে জানে, স্বাধীন ভারতে ওদের সুবিধা হবে।’

‘ওদের সুবিধে হবে বলতে চাও বুঝি তুমি?’ রমা যেন অবহিত হয়ে স্ফটিকের ভেতর দিয়ে গ্গ্নানিকর ভবিষ্যৎটাকে দেখে, তবুও সেটাকে অবিশ্বাস করবার চেষ্টা করে বললে।

‘হ্যাঁ, ওদের; আর ওদের মতন ছোকরা আর বুড়োদের। কিন্তু আমাদের কোনো মীমাংসা হবে না। মীমাংসার ভার যাদের ওপরে বাংলাদেশের সেসব অন্ধদের তো এখনই দেখছি আমি; রাতারাতি ভোল বদলাবে এরা। এদের আওতায় সমস্ত দেশ অন্ধ, খোঁড়া, নুলো, বোবায় ভরে যাবে, টাকা চাকরি ব্যবসা, সবই ওদের; দেশ স্বাধীন হলো বলে ভালো লাগবে আমাদের। কিন্তু অন্যসব দিক দিয়ে খুবই খারাপ লাগবে। সপরিবারে মরেও যেতে পারি।… স্বাধীনতার কোনো সেবকও আমাদের দিকে ফিরে তাকাতে যাবে না।’

ভাবতে কিছুটা অবাক লাগে যে, স্বাধীনতার এক বছর না যেতেই ঔপনিবেশিকতা-উত্তর ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ সম্পর্কে কী রকম মোহভঙ্গ হয়েছিল জীবনানন্দের। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন:

‘… পুলিশ সেক্রেটারিয়েট সবই বেশ জুতিয়ে সুখে থাকবে।’

‘জুতিয়ে?… তাহলে দুঃখ হবে কাদের?’

‘যারা দুঃখের জন্য জন্মেছিল তাদের।… ব্রিটিশ আমলে যারা ঘাড় পেতে দুঃখ সহ্য করেছিল এবারেও বহন করবার ক্ষমতায় খুব সম্ভব আরও বেশি দুঃখ সহ্য করতে হবে তাদের। কিন্তু আরও খানিকটা চোখ খুলে যাবে তাদের, মানুষের জীবন সম্বন্ধে, আশা ও আশাবাদ সম্বন্ধে যা ভুল বুঝেছিল শুধরে নিতে পারবে, আরও স্পষ্ট একটা দার্শনিক সংস্থানে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে মনে হচ্ছে।’

আমি বলতে চাইছি, জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ স্বাধীনতা-উত্তর [ঔপনিবেশিকতা-উত্তর] ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ সম্পর্কে মোহভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। তিনি যে সমাজকে প্রতিষ্ঠা হতে দেখতে চেয়েছিলেন তা ‘পাওয়ার, প্রফিট আর প্রিভিলেজ’_ এই তিনের অশুভ প্রভাবের বাইরের সমাজ। তবে তা প্রখ্যাত বামপন্থার প্রগতিশীল সমাজের ধারণার মধ্যেও সীমিত থাকেনি। কেননা একমাত্র মার্কসকেই তিনি আঁকড়ে ছিলেন না তাঁর শ্রেয়তর সমাজকে সংজ্ঞায়িত করার প্রশ্নে। উপন্যাসে বলেছেন যে, ইউরোপের স্কিনোজা, ফ্রয়েড, মার্কস, আইনস্টাইন আর ‘আমাদের দেশের আগের কালের পণ্ডিতরা যা রেখে গেছেন।’ তার ভিত্তিতে সেই সমাজের সংজ্ঞায়নের কাজ শুরু করতে হবে। এ কারণেই বারেবারে তাঁর এই সময়কার কবিতায় ফিরে এসেছে জ্ঞানসমাজের কথা, নিছক জ্ঞানের নয়, হৃদয়ের শুভ্রতা-শুদ্ধ জ্ঞান চর্চার কথা। সে সমাজ গড়াও সহসা সম্ভব নয়, সে অনেক শত শতাব্দীর ‘মনীষীদের কাজ’_ এ রকম বলেছেন কবিতায়। এ-ও আধুনিতারই নির্মাণ, তবে যুদ্ধ আর বাণিজ্যকে অবলম্বন করা কোনো বণিক-আধুনিকতার নয়। এটি অন্য এক ‘বিকল্প আধুনিতা’র নির্মাণ। বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যের ‘প্রয়াণপটভূমি’ কবিতায় তাঁর স্বভাবজ ভঙ্গিতে বলছেন [আমি নির্বাচিত অংশ গদ্যকারে তুলে ধরছি]: ‘মানবহৃদয়, দিন কি শুধু গেল? শতাব্দী কি চলে গেল! আজকে যখন সান্ত্বনা কম, নিরাশা ঢের, চেতনা কালজয়ী হতে গিয়ে প্রতি পদেই আঘাত পেয়ে অমেয় কথা ভাবে। ইতিহাসের ব্যাপক অবসাদের সময় এখন, তবু নরনারীর ভিড় নব নবীন প্রাক্ সাধনার;_ নিজের মনের সচল পৃথিবীকে ক্রেমলিনে লন্ডনে দেখে তবুও তারা আরো নতুন অমল পৃথিবীর।’ না, জীবনানন্দের কবিতাকে শুধু নির্জন ইতিহাসচেতনার জন্য স্মরণ করলে ভুল হবে। নিছক মতাদর্শগত প্রগতিশীলতার মধ্যেও বদ্ধ ছিলেন না তিনি। বাসমতীর উপাখ্যানে আমরা এ নিয়ে স্পষ্ট বাদানুবাদ পড়ি:

‘সুমিতা কমিউনিজম নিয়ে আছে। ওর সঙ্গে মনে বনে না আমার।’

‘আমি ভেবেছিলুম তুমিও কমিউনিস্ট।’

‘সেটা ভুল ভেবেছিলেন।’

‘তুমি কংগ্রেসের?’

‘না।’

‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম’ প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ পরে বললেন, ‘যেন কংগ্রেস-কমিউনিজম ছাড়া আর পৃথিবী নেই।’

‘আছে, সেখানে পলিটিক্সও আছে হয়তো_ কিন্তু আজকালকার চারদিককার সব চালু পলিটিক্স নেই।’

‘রাজনীতি বলতে এক ভিন্ন ধরনের বোধকে জীবনানন্দ ধারণ করেছিলেন ভেতরে। তার বর্ণনা-বিশ্লেষণ পাই তাঁর গদ্য-রচনায়। এই বর্ণনা-বিশ্লেষণকে বাদ দিয়ে পাশ কাটিয়ে আমরা বুঝতে পারব না পুরোপুরি_ কেন তিনি লিখেছিলেন, এত অনায়াসে সেকালে বসেই লিখতে পেরেছিলেন বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যের ‘সামান্য মানুষ’ কবিতার শেষ স্তবকটি:

‘প্রতিটি মাঘের হাওয়া ফাল্গুনের আগে এসে দোলায় সে সব।
আমাদের পাওয়ার ও পার্টি-পলিটিক্স
জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরেক রকম শ্রীছাঁদ।
কমিটি মিটিং ভেঙে আকাশে তাকালে মনে পড়ে_
সে আর সপ্তমী তিথি : চাঁদ।’

৪. যার যা হারিয়ে গেছে

দেশভাগ জীবনানন্দকে বিপর্যস্ত করেছিল, কিন্তু ততদিনে তার কবিখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত, ফলে চাকরি জুটিয়ে যাহোক সংসার চালানোর মতো অবস্থা তিনি করে নিতে পেরেছিলেন। অনটন ছিল। কিন্তু তার ভেতরেই অফুরন্ত সৃষ্টির মধ্যে ব্যাপৃত ছিলেন তিনি আমৃত্যু। দেশভাগের রাজনীতি ও উদ্বাস্তুতা এসব তিনি যথাসম্ভব যুক্তি-জিজ্ঞাসা দিয়ে মোকাবেলা করেছিলেন। তা ছাড়া কলকাতা তাঁর কাছে অপরিচিত কোনো শহর ছিল না। এই শহরেই তিনি তিরিশের দশকের গোড়ায় বেশকিছু দিন ছিলেন। ‘কল্লোল’ ও ‘কালি-কলম’ যুগের অংশীদারও ছিলেন তিনি। অধ্যাপনা করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন, খুব কাছ থেকে নগর-জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। ফলে চলি্লশের দশকের শেষে যখন কলকাতায় এলেন পারিপাশর্ি্বককে [পরিবর্তন সত্ত্বেও] চিনতে-বুঝতে অসুবিধে হয়নি তাঁর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলকভাবে কঠিন। দেশভাগ তাঁর জন্য আরও বেশি ক্লেশকর অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে এসেছিল। আক্ষরিক অর্থেই প্রথম দিকে ‘রিফিউজি’ বা শরণার্থী হিসেবেই নিজেকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। এখানে আমার শুধু যোগ করার_ দেশভাগের অভিজ্ঞতা তার কবিতা ও গদ্যরচনাকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করেছে। যার অমোচনীয় প্রভাব বিস্তৃত ছিল তাঁর জীবনে, আমৃত্যু। সুনীলের সৃষ্টির এই বিশেষ দিকটি নিয়ে আরও বেশি করে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এদিক থেকে কবিদের মধ্যে বাংলাদেশে তার নিকটতম তুলনা হবেন সম্ভবত শহীদ কাদরী। গদ্য-রচনায় হাত দেননি যদিও, কিন্তু শহীদ কাদরীর পঞ্চাশের দশকে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসা তার চৈতন্যের ওপরে গভীর আত্মজৈবনিক প্রভাব ফেলেছিল। শহীদের ‘উত্তরাধিকার’-এর বহু কবিতায় দেশভাগ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তুতার ছাপ রয়ে গেছে। ‘কলকাতা’ দেশভাগ-উত্তর শহীদ কাদরীর জন্য ফরাসি মনোবিজ্ঞানী দার্শনিক লাকাঁর উদ্ভাবিত ‘অপর’-এর মতো কাজ করেছে। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশও তেমনি ‘অপর’ হয়ে থেকে গেছে সুনীলের রচনায়।

দেশভাগের অভিঘাত সুনীলের জীবনে সরাসরিভাবে পড়েনি। জয় গোস্বামীর ‘নন্দর মা’ কবিতায় যেভাবে শরণার্থীদের দেশত্যাগ করতে হয়েছিল, সুনীলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। সুনীলের বাবা দেশভাগের আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সুনীলরা সপরিবারে সেখানেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তবে সরাসরিভাবে না হলেও দেশভাগের অপ্রত্যক্ষ অভিঘাত হয়েছিল প্রবল ও সুদূরপ্রসারী। এ নিয়ে সুনীল বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ আত্মজৈবনিক গদ্য ও কবিতা লিখেছেন। ‘ইতিহাসের পরিহাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলাম, পূর্ব বাংলায় আমাদের নিজস্ব বাড়িঘর, বাগান, পুকুর অন্য একটি রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে গেছে। সেখানে ফিরে যেতে হলে আমাদের একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। আমরা আর ফিরে যাইনি।’ ব্যবহারিক জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশভাগ সুনীলের কৈশোর-যৌবনকে আক্রান্ত করেছিল দু’ভাবে। প্রথমত, পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে আর আসার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-শরিকরা দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। এর চাপ সুনীলের পরিবারের ওপরও পড়েছিল। সুনীলের বর্ণনায় তার একটি চিত্র পাই:

‘দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারটিও উদ্বাস্তু হয়ে গেল বটে, কিন্তু আমরা কোনো সরকারি সাহায্য নিইনি, জবরদখল কলোনিগুলোতেও আশ্রয় নিতে হয়নি। আমার বাবার একটি স্কুল মাস্টারির চাকরি ছিল, তখনকার দিনে তার মাইনে ছিল যৎসামান্য। আমাদের চার ভাইবোন ও মা ছাড়াও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত কিছু কিছু আত্মীয়স্বজনকে সেই সময় আশ্রয় দিতে হয়েছিল, সবাই মিলে আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম এবং কোনোক্রমে আত্মসম্মান বজায় রেখে বেঁচে ছিলাম। আমি তখন ১৩ বছরের কিশোর, দারিদ্র্যের কষ্ট বিশেষ অনুভব করতাম না, কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরুলে কিংবা স্কুলে গেলে টের পেতাম, অন্যরা আমাদের বহিরাগত বলে মনে করে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা যখন এক কোটির কাছাকাছি হয়ে গেল, সেই বিরাট সংখ্যার মানুষ সারা পশ্চিম বাংলায় বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছিল, তখন আমার সহপাঠীদের কেউ কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলত, আমিও সেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের একজন। অবিভক্ত বাংলায় আমি ছিলাম যাদের সঙ্গে সমান সমান, বাংলা ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়ে গেলাম তাদের চোখে অবাঞ্ছিত। আমাদের কৈশোর হলো খুব সংক্ষিপ্ত। আমাদের গুরুজনরা অনবরত বলতেন, যে কোনো উপায়ে যে কোনো একটা জীবিকা জোগাড় করো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানে বাঁচার একমাত্র উপায় খুব দ্রুত উদ্বাস্তু পরিচয়টা মুছে ফেলে মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যাওয়া। স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই আমি জীবিকা অর্জন শুরু করি, কিন্তু উদ্বাস্তু পরিচয়টা কখনও মুছে ফেলতে পারিনি।’

দেশভাগের প্রভাব পড়েছিল সুনীলের সাহিত্য জীবনেও। সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’-এর পটভূমিকা দেশভাগ ও দেশত্যাগের পরবর্তী ‘শিকড়হীনতা’। তাঁর ‘অর্জুন’ উপন্যাসে রয়েছে উদ্বাস্তু কলোনির গল্প। পরবর্তীকালে এই সময় নিয়ে লেখা ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে দেশভাগের আখ্যান বিবৃত হয়েছে। দুই বাংলার মানুষের জীবন সমান্তরালভাবে বর্ণিত হয়েছে আরও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে। তবে শুধু গদ্য রচনায় নয়, কবিতায়ও প্রভাব পড়েছে দেশভাগ ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত উদ্বাস্তু জীবনের। উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যা পরবর্তীতে সিপিএমের জন্য বড় শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সুনীলের ব্যাখ্যায়, ‘বাংলা ভাগের জন্য কংগ্রেস দলকে দায়ী করে উদ্বাস্তুরা প্রথম থেকেই সরকারবিরোধী, সেই সুযোগ নিল বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি। পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুত্থান ও শক্তিবৃদ্ধির মূলে আছে উদ্বাস্তুরা। ক্রমে কমিউনিস্টরা পশ্চিম বাংলার ক্ষমতা দখল করে ওদেরই সাহায্যে, যাদের বলা যেতে পারে ‘এক্সটারনাল প্রলেতারিয়েত।’ দেশভাগ, উদ্বাস্তুতা ও বিপন্ন সময়ের সঙ্গে নকশাল আন্দোলনেরও যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন সুনীল। মন্তব্যটা তাৎপর্যপূর্ণ নকশাল আন্দোলনের সামাজিক পটভূমি বোঝার জন্য:

‘একটা সময় তো আমরা বাউণ্ডুলের মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতাম।… কারণ সময়টাই তখন ছিল খুব অস্থির। ভবিষ্যৎ-টৎ খুব বেশি দেখতে পেত না কেউ।… আমাদের সময় সবটাই অনিশ্চিত। কিছু পরে নকশাল আন্দোলন তো ওই অস্থিরতা থেকেই শুরু। আমাদের তখন একটু বয়স হয়ে গিয়েছে। সত্তর সালে যদি আমাদের আর একটু কম বয়স হতো তো আমরাও নকশাল করতাম। পঞ্চাশের দশকে আমরা রাজনীতির দিকে ছুটিনি। তার বদলে ভাষা নিয়ে যত ভাঙচুর করেছি। ভাষার মধ্যেই গুলি চালিয়েছি, বোমা ফাটিয়েছি। ওই সময় একটা কবিতাতে লিখেছিলাম, ‘আমিও পৃথিবী, স্বর্গ, কলেজ স্ট্রিটের মহাঅগি্নকাণ্ড দেখে শিল্পকে প্রহার করি, ভেঙেচুরে নষ্ট করি, লাথি মেরে নরকে পাঠাই’_ ওটা কিন্তু এক ধরনের নকশাল অ্যাটিটিউডই বটে। আমাদের দিচ্ছে না কিছু করতে। কাজেই আমরা সব ভেঙেচুরে নষ্ট করে যাব। এই অস্থিরতা বোধ আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াত।’ এই অস্থিরতাবোধ_ যার জন্ম হয়েছিল দেশভাগ, উদ্বাস্তুতা ও অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে_ ক্রমশ সৃষ্টি করেছিল এক নতুন নান্দনিক চেতনারও। এর অনিবার্য পরিণতি_ ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর অভ্যুদয়। এঁদের দ্রোহ শুধু সমকালীন সমাজের চলতি সংস্কার বা রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে চালিত ছিল না। এঁরা উদ্বাস্তু সময়ের সন্তান বলেই পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষদের সাংস্কৃতিকভাবে সহমর্মী করে তুলতে চেয়েছিলেন। ততদিনে পূর্ববঙ্গে ঘটে গেছে বাহান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাস’-এর প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন:

‘কৃত্তিবাস বাংলাদেশের তরুণতম কবিদের মুখপত্র।… বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে পাকিস্তানের কবিদের স্থান প্রায় অনুল্লেখ্য। তাতে কোনো দুঃখ থাকত না_ যদি না তাদের কেউ কেউ আশ্চর্য সার্থক কবিতাও লিখতেন। বাংলাদেশের শারীরিক মানচিত্রের মতোই কাব্যের মানচিত্রও খণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু উভয় বঙ্গে বাংলা ভাষার পূর্ণ অধিকার সম্বন্ধে যেন আমাদের কখনও না সন্দিগ্ধ হতে হয়। পাকিস্তানের তরুণ কবিরা আমাদের সমদলীয়, সহকর্মীও।’

এরই মধ্যে পূর্ববঙ্গে প্রকাশ পাবে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘নতুন কবিতা’। সেখানে এবং কৃত্তিবাসে অচিরেই লিখবেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ। পূর্ববঙ্গ অবশ্য এগুবে তার নিজস্ব নিয়মে, নিজের শক্তিতে, নিজের পরিণতির দিকে_ অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনেক চড়াই-উৎরাই, অনেক রক্ত আর অশ্রুর মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেটা অন্য ইতিহাস। ‘দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন ও সুনীলের সাহিত্যকর্ম’ নিয়ে মোটামুটি একটি গবেষণাগ্রন্থ লিখে ফেলা যায় [কেউ নিশ্চয় করবেন আগামীতে]। এত অসংখ্য বার এসবের উল্লেখ রয়ে গেছে বলে সুনীলের গদ্যে ও কবিতায়! শেষ দিকের কবিতাগুলোতে তো বারবার ফিরে এসেছে এসব প্রসঙ্গ তাঁর স্মৃতি-সত্তার অনুষঙ্গ হয়ে। ‘ভালবাসার খণ্ডকাব্য’ গ্রন্থের ‘ভোরবেলার স্বপ্ন’ কবিতাটি তারই একটি উদাহরণ। সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক সবাই উপস্থিত। কবি ভাবছেন :

“দু’পাশে কিসের এত ধ্বংসস্তূপ?
নিবেদিতা বললেন, এটা কোন দেশ, চিনতে পারছি না।
গান লিখছেন রবীন্দ্রনাথ আর গুন গুন করে সুর ভাজছেন
এক সময়, মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন খুব মৃদু কণ্ঠে
তোমরা দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পারলে না?
কৃষ্ণনগরের বাড়িতে দিলীপকে গান শেখাচ্ছেন তার বাবা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
আচমকা থেমে গিয়ে হা-হা করে হাসতে লাগলেন দ্বিজেন্দ্রলাল
জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ
কী ভেবে লিখেছিলাম, আর আজ তার কী অর্থ
সকল দেশের রানী যে চাকরানী হতে চলেছে এই দেশ?
… … … … …
জীবনানন্দ কালি ঢেলে দিচ্ছেন রূপসী বাংলার পাণ্ডুলিপিতে
হঠাৎ আপন মনে বলে উঠলেন মহাপৃথিবী না ছাই!
জন্মভূমিটাই থাকল না!
… … … … …
বিভূতিভূষণ দাঁড়িয়ে আছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে
বারবার ডাকছেন অপু, অপু, ছেলেরা কেউ গ্রাহ্য করছে না
… … … … …
রেডিওর সামনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ
শুনছেন নিজেরই গান
… … … … …
এক সময় খেয়াল হলো। তাঁর একটা গান তো কেউ আর গায় না
সীমান্তের ওপারেও না, এ পারেও না
সহ্য করতে পারবেন না বলে এতদিন সীমান্ত দেখতে যাননি
আজ গিয়ে দাঁড়ালেন সেখানে
এখন শিলাইদহে যেতে তাঁর ভিসা লাগবে
নিজেই গলা খুলে ধরলেন তার সেই প্রিয় গানটি
বাঙালির গান, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক…
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক…
এ কী রবীন্দ্রনাথ কাঁদছেন?”

মৃত্যুর বছরখানেক আগে প্রকাশিত হয় সুনীলের ‘বালুকণার মতন অ-সামান্য’ কাব্যগ্রন্থটি। এটি ‘প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও কবিতাপ্রেমী’ রণজিৎ গুহকে উৎসর্গ করা। সেখানে আবারও তিনি একই থিমে ফিরে আসলেন, এবারে আত্মজৈবনিক সূত্রে [যা আগে গদ্য-রচনায় আমরা লক্ষ্য করেছি]:

‘আমার বাবা মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,
আমি বাড়ি যাচ্ছি!
তখন আমরা সামান্য ভাড়া বাড়িতে থাকি
পূর্ববঙ্গের দেশের বাড়ির কথা বাবা কখনও
উচ্চারণ করতেন না
তবু মৃত্যুর আগে… বাবা… বাড়ির স্বপ্ন
সে কোন স্বপ্নের দেশে ছিল আমাদের সেই বাড়ি।
… … … … …
এই দেশ বিভাগ, বাংলা-বিভাগ এখনও
শেল হয়ে বিঁধে আছে আমার বুকে
এটা ইতিহাস, মেনে নেওয়াও তো উচিত
কিন্তু যখনই ভাবি, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে
কী করতেন
বাংলা ছিল যার প্রাণ, তিনি কি আর একদিনও
বাঁচতেন
মাঝে মাঝে এইসব ইতিহাসের মুখে
জুতো মারতে ইচ্ছে হয় না?’

এই ন্যারেটিভের বিপরীতেও অবশ্য অন্য ন্যারেটিভ রয়েছে। সীমান্তজুড়ে নির্মিত হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, তাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঝুলে আছে ফেলানী। তিস্তার হিস্যা পায় না বাংলাদেশের জনপদ। অবৈধ সীমান্ত-বাণিজ্য চলে অবাধে। সুন্দরবন নষ্ট করার আন্তঃরাষ্ট্রীয় আয়োজন হয় রামপালে, কিন্তু এদেশের কোনো বাংলা টিভি চ্যানেলই প্রদর্শিত হয় না বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গে! চলি্লশ বছর পরেও ছিটমহলের সামান্য কিছু সংখ্যক মানুষের মানবিক দাবি পূরিত হয় না। দেশভরা শুধু স্মৃতি নয়। তা এখনও আমাদের আধুনিক রাষ্ট্র-ইতিহাসকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সুনীল কি এসব সাম্প্রতিক ও ততটা সাম্প্রতিক নয় তেমন বিষয়গুলো নিয়ে গদ্যাকারে বা কবিতার শব্দে সাজিয়ে কিছু লিখেছিলেন? অথবা লেখার কথা ভাবছিলেন, জানতে ইচ্ছে করে।

৫. প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে

শামসুর রাহমান সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা মন্তব্য করেছিলেন, যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লেখার অতুলনীয় ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। বাস্তবিক, সৃষ্টির প্রাচুর্যে শুধু একজনের সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে, তিনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের সৌভাগ্য যে, গত চার দশকে আমাদের কবিতার ভুবনে সক্রিয় ছিলেন শামসুর রাহমান আর আমাদের গল্প-উপন্যাসের ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ। বহু সংস্কৃতির এদেশে ‘সেক্যুলার’ প্রাণশক্তির নিভৃত কেন্দ্রে ছিলেন এঁরাই। এক দাপুটে রাষ্ট্র আর বহুগাঠনিক দ্বন্দ্বে বিকীর্ণ সমাজের পরিবেশ এদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। কবিতার ঐতিহ্য ও মৌলিকতার বিষয়ে ভাবনায় শামসুর রাহমান তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। গ্যেটে যেমন অনুরক্ত হয়েছিলেন কালিদাস ও হাফিজের কবিতার প্রতি, শামসুর রাহমান হাত বাড়িয়ে ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের বিপুল ভাণ্ডারের দিকে। সেই সঙ্গে এদেশের ও এ জনপদের সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ছিল। একদিকে পারিবারিক আবহর কারণে ঊর্দু ভাষা ছিল তার অনায়াস আয়ত্তে, অন্যদিকে ইংরেজি ছিল তার পাঠের মাধ্যম। কখনও ভাষা-ব্যবহারে জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি। তরুণতর কবিদের কাছে তাঁর পরামর্শ ছিল, যা কিছু মূল্যবান তা যে উৎসেরই হোক না কেন তাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে উদার অবস্থান গ্রহণের: ‘আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে, বিদেশি সাহিত্য পরিক্রমায় আমরা যত পারদর্শীই হই না কেন, স্বদেশের নানা পুরাণ, লৌকিক কাব্য এবং বিভিন্ন যুগের কাব্যস্মৃতির প্রতি আনুগত্য না থাকলে কাব্যক্ষেত্রে অসামান্য সিদ্ধি লাভ অসম্ভব।’ এক্ষেত্রে স্বদেশীয় সাহিত্যকে ‘হিন্দু যুগ’ ও ‘মুসলিম যুগ’ করে পাঠ করার সাম্প্রদায়িক প্রবণতার চরম বিরোধী ছিলেন তিনি। আত্মপরিচয়ের [আইডেনটিটি] ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিজীবনে যেমন, কবিতার ক্ষেত্রেও বিচিত্র সব সূত্র, উৎস ও ঐতিহ্য থেকে আহরণ করেছেন বিষয়-চিন্তা, শব্দাবলি, উপমা, প্রেক্ষিত ও চিত্রকল্প। লালন-বর্ণিত চৈতন্য প্লাবিত নদীয়ার ‘তিন পাগলের’ কথাই তিনি শুধু জানতেন না, জানতেন সুফী সূত্রও_ মৌলানা জালালুদ্দিন রুমী, হাফিজ, নানা মাহজাবের ও ঘরানার চিন্তা দর্শন। কিন্তু এ নিয়ে আতিশয্য ছিল না তার মধ্যে_ সেটা বাউল-দর্শন হোক আর সুফী সন্ত-সাধুদের দর্শনই হোক। ‘স্বদেশীয়’ বলতেই জাতীয়তাবাদী যে অবস্থানের মানসিকতা বঙ্গভঙ্গ আমল থেকে এদেশে চালু আছে তাতে তার অন্তরাত্মা সায় দেয়নি। সেটা কূপমণ্ডূকতায় বিশ্বাস করতেন না বলে। অথচ আমাদের জাতীয় সংগ্রামে ও প্রগতিশীল জন-আন্দোলনে তাঁর কবিতাই ছিল রাজনৈতিক প্রেরণার বড় একটি উৎস। সাংস্কৃতিক কোনো নির্দিষ্ট ঘরানা নিয়েই বাড়াবাড়ি করা তাঁর রুচিবিরুদ্ধ ছিল। তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন স্বদেশে_ রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, আর বিদেশে_ রুমী, বোদলেয়ার, এলিয়ট, ইয়েটস ও নেরুদা। কিন্তু এঁদের কারোকেই অনুসরণ করেননি তাঁর কাব্যজীবনে। কাব্যকৃতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিষয়ের বিচিত্রবিধ অভিগামিতায় তিনি প্রায় একাই বাংলাদেশের কবিতাকে আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক যুগে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী, ফ্যাসিবাদবিরোধী ও ধর্মান্ধতাবিরোধী অবস্থাতে। তরুণতর কবিদের বলেছিলেন_ সিরিল কনোলির সূত্র ধরে_ সুরা, নারী লোলুপতা ও সাংবাদিকতা কবিতার শত্রু, এই তালিকায় তিনি যোগ করেছিলেন_ ‘ফ্যাসিবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর উত্থানের পেছনেই সাংস্কৃতিক-দার্শনিক রেনেসাঁ কাজ করে। ১৯৪৭ সালের পরে এদেশের জনগোষ্ঠীর ‘উত্থানের’ পেছনেও সাংস্কৃতিক ‘রেনেসাঁ’ আন্দোলন ক্রিয়াশীল ছিল। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে গড়ে উঠে তা একুশ শতাব্দীতে পেঁৗছেছে। এই ইতিহাস লিখতে গেলে শামসুর রাহমানের কবিতার ছায়ায় আমাদের দাঁড়াতেই হবে। তারপরও তাঁকে জীবনের শেষ দশ-পনেরো বছর রাষ্ট্রের নিরাশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। সন্ত্রাস শেষ পর্যন্ত কবিকেও ছুঁলো। অতর্কিত প্রাণনাশের ভয় ঢুকে পড়েছে তাঁর নিত্যকার জীবনযাপনের মধ্যে। ব্যক্তি মানুষ যে কত বিপন্ন, কত অসহায়-আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতাসীন বলয়ের হুমকির মুখে_ এটা তারই একটি দৃষ্টান্ত।

শামসুর রাহমানের শেষ দিকের কাব্যগ্রন্থগুলোতে এক সদা-সশংক সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। নাগিব মাহফুজকে নব্বই দশকের গোড়ায় ছুরিকাহত করেছিল মিসরের মৌলবাদী শক্তি। শামসুর রাহমানের ওপরও এ রকম আক্রমণের চেষ্টা করা হয় নব্বই দশকের শেষ দিকে। ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে তার সে সময়কার মনোভাব ফুটে উঠেছে :

‘আজকাল রাতের বেশিরভাগ সময় নির্ঘুম কাটে। যেটুকু ঘুমাই,
হিজিবিজি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে নয়, জাগ্রত অবস্থাতেই প্রায়শই
একটি ধাবমান/ধারালো কুড়াল নাচতে থাকে দৃষ্টিপথে। এক
হিংস্র তরুণ ধেয়ে আসছে আমার দিকে। মূর্তিমান এক
বিভীষিকা দেখে আমি পাথরের মতো স্থির, বাকশক্তিরহিত।’

নিজেকে মার্চেন্ট অব ভেনিসের অ্যান্টোনিওর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে অ্যান্টোনিও এক জায়গায় বলছেন, ‘আই নো নট হোয়াট আই এম সো স্যাড।’ এর প্রভাব কবিতাতেও পড়েছে:

“ভোরবেলা কারা এসে ঘরে ঢুকে পড়ে; চোখ দুটি
কচলাতে কচলাতে দেখি,_ কয়েকটি রুক্ষ পশু
মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে যাও
এই ঘর ছেড়ে,
এখানে থাকার অধিকার বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে,
তুমি বনবাদাড়ে আস্তানা খুঁজে নাও।’

বিভ্রান্ত, নির্বাক আমি চেয়ে থাকি হাবার ধরনে, ভয়ঙ্কর
ভূমিকম্প ভীষণ দুলিয়ে
এবং ধুলিয়ে দেয় সবকিছু; তাসের ঘরের
মতো ধসে পড়ে চতুর্দিক, ‘গীতবিতান’ এবং
গালিবের গজল নিমেষে মুছে যায়…”

এ রকম উদাহরণ যত্রতত্র তাঁর কবিতার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া একদার সাজানো ঘর-গৃহস্থালিজুড়ে।

শামসুর রাহমানের এই ভীত-সন্ত্রস্ত কবিতাগুলোকে শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার স্মারক হিসেবে না দেখে এই সময়ের রাষ্ট্রের সমাজ-বিরুদ্ধ নাগরিক-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হিসেবে আমরা পড়তে পারি। ১৯৪৭-উত্তর আধুনিক [ভারতীয়] রাষ্ট্র নিয়ে জীবনানন্দের মধ্যে কোনো মোহ ছিল না। দেশভাগের মধ্য দিয়ে মানব-ভূখণ্ড গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই যে দুর্দশায় ও বিপর্যয়ে পতিত হয়েছিল তা শুধু জিডিপি-এর স্বল্পকালীন পতনে এবং একপর্যায়ে এর পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। একেকটা পরিবারের জন্য, ব্যক্তিজীবনের জন্য, এই দেশভাগের প্রতিক্রিয়া শুধু একপুরুষে নয়, পুরুষানুক্রমে চলেছে। আধুনিক রাষ্ট্র সেই ক্ষতিটুকু ‘জনকল্যাণ’ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি_ এমনকি স্বীকারও করেনি যে, দেশভাগের ফলে বৈষয়িক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তের এপারের ও ওপারের দু’তরফের জনগোষ্ঠী। সুনীল লিখেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা অনেক বেশি আধুনিক ও মহৎ’ আদর্শ হতে পারে, কিন্তু ‘নেহরুর… সেই মহৎ আদর্শের দাম দিতে কয়েক কোটি মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ দাঙ্গায় কিংবা অনাহারে কিংবা রোগ-ভোগে প্রাণ দিয়েছে।’

এ তো গেল সেকালের কথা। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরও আমাদের কালেও নিঃসহায় মানুষের বিপন্নতা কমেনি সীমান্তের এপারে বা ওপারে। রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বলা হয় [শুনেছি], যুধ্যমান মানব-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রলয় থামাতেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। কিন্তু কালক্রমে আধুনিক রাষ্ট্র_ এই আধুনিক বণিক রাষ্ট্র_ নিজেই নেমেছে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকায় : মানব-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। রাষ্ট্র আর দুর্বলের আশ্রয়দাতা নয়, নিরাশ্রয়ের জনক। এ রকম রাষ্ট্রের প্রতি মোহভঙ্গ হতে বাধ্য। জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই মোহভঙ্গেরই কবিতা ও গদ্য লিখে গেছেন তাঁদের যার যার জীবনের শেষ অধ্যায়ে।

জনজীবনের অর্থনীতি

বিনায়ক সেন

১. মিল ও অমিল

প্রতিটি শাস্ত্রই তার নিজের চারদিকে একটা সীমারেখা এঁকে দেয় বা বেড়া তুলে দেয়, যাতে করে বেড়ার ভেতর থেকে কেউ বাইরে যেতে না পারে, বা বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। রামায়ণে সীতার দেবর লক্ষ্মণ সীতার ভিটের চারদিকে একটি রেখা টেনে দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত যে-ই আসুক না কেন, সীতা যেন ঐ রেখার বাইরে পা না রাখেন। তাহলেই তিনি বিপদমুক্ত থাকবেন। বাংলা প্রবচনে একেই বলা হয়েছে_ লক্ষ্মণরেখা। শাস্ত্রগুলোও তেমনি তার চতুর্দিকে লক্ষ্মণরেখা এঁকে নিজেকে অন্য শাস্ত্রের প্রভাবমুক্ত বা ‘বিপদমুক্ত’ রাখতে চেয়েছে। বিশেষত এটা ঘটে এনলাইটেনমেন্ট-পরবর্তী ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে যখন শাস্ত্রগুলো ক্রমান্বয়ে একাডেমিক সনদ দানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ‘ফ্যাকাল্টি’ হতে থাকে। বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিটি শাস্ত্রকেই তার নিজস্ব গণ্ডী দাঁড় করাতে হয়েছিল, সন্দেহ নেই। তবে সমাজে অত্যধিক শ্রম-বিভাজনের কারণে অতিমাত্রায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে কোথাও কোনো সার্বিক দার্শনিক (নৈতিক) ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে কি-না_ এ প্রশ্ন এডাম স্মিথ তার ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ বইতেই তুলেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে নীতিশাস্ত্র (ও অন্যান্য শাস্ত্রের) বিচ্ছিন্নতার কারণে ক্ষতি হয়েছে যেমন অর্থশাস্ত্রের, তেমনি নীতিশাস্ত্রেরও। এরকম একটি মত জোরে-শোরে উত্থাপন করেছিলেন অমর্ত্য সেন তার ‘এথিকস্ অ্যান্ড ইকোনমিক্স’ গ্রন্থে। আমি এসব সূত্র ধরে এই লেখায় মোটের উপর বলতে চেয়েছি যে, সাহিত্যের সঙ্গে অর্থশাস্ত্রের বিচ্ছিন্নতার কারণে অর্থনীতি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনাও বেশ কিছুটা পরিমাণে ‘সংকীর্ণ’ হয়ে পড়েছে। এতে করে ক্ষতি হয়েছে দুই পক্ষেই। সাহিত্যে সর্বাধিুনিক অর্থনৈতিক চিন্তাগুলো সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। আবার অর্থশাস্ত্রেও সাহিত্যে বিবৃত জনজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে শাস্ত্রটির জনবিচ্ছিন্ন বিদ্যায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটাকে এক ধরনের ‘একাডেমিক প্রটেকশনিজম’-এর ফলপরিণাম হিসেবে দেখা যেতে পারে।

অথচ সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও এ দুই মানবিক বিদ্যার (হিউম্যানিটিক) মধ্যে ‘নাড়ির বন্ধনকে’ অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘সাহিত্য’ বলতে আমি মহাকাব্য, পুঁথি, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ সবকিছুকেই এক জায়গায় জড়ো করছি। বাংলায় ইকোনমিক্স শব্দটার ভাষান্তরে অর্থনীতি ও অর্থশাস্ত্র দুই-ই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দ্বিত্বতা এড়ানোর জন্য আমি এখানে ইকোনমিক্স অর্থে অর্থশাস্ত্র আর ইকোনমি অর্থে অর্থনীতি ব্যবহার করছি। সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল দেখতে পাওয়া যায় বিষয়বস্তুর অভিন্ন ঝোঁকের মধ্যেই। উন্নয়ন ও সাম্যের ধারণা দুই বিদ্যার ক্ষেত্রেই অভিনিবেশের বিষয়। কোন নীতি জনহিতৈষী বা কোন নীতিই বা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর_ এসব আলাপ উভয়বিধ বিদ্যারই চর্চার বিষয়। এটা ঠিক যে, জনজীবনের যেসব ধারণা সাহিত্যে অনায়াসে চলে আসে, তাকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করে বিচারের প্রয়াস চলে অর্থশাস্ত্রে। শুধু বিশেষভাবে সংজ্ঞার ঝোঁক নয়, বিচার-পদ্ধতিতেও গাণিতিক ও ইকোনমেট্রিক মডেল নির্মাণ ও পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ যোগ করা হয় আধুনিক অর্থশাস্ত্রে। তারপরও সমাজ-প্রগতির বা অধোগতির তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি কার্য-কারণ বোঝার তাগিদ পাওয়া যায় সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্র উভয়ের মধ্যেই। একই ভাষার রকমফের সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেমন দুই ভিন্ন জাতি, ঠিক তেমনভাবেই একই ঝোঁক ও মূল্যবোধ ধারণ করা সত্ত্বেও সাহিত্য ও অর্থশাস্ত্র দুই ভিন্ন বিদ্যার আদল পায়। এই মৌলিক মিলের জায়গাটিকে ধরে রাখতে পারলে দুই বিদ্যারই বিকাশে তা আরো পুষ্টি জোগাবে সেটি এখানে আরো একবার মনে করিয়ে দেওয়া। এই মৌলিক মিলের অনেক উদাহরণ রয়ে গেছে বাঙালির অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্যের নানা উদাহরণের মধ্যে পাওয়া যাবে প্রাগ্রসর অর্থনৈতিক চিন্তার পদচ্ছাপ (ফুটপ্রিন্টস)। আবার সাহিত্যের অভিজ্ঞতার মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক অর্থনৈতিক কূটভাষের সরল সূত্র। এমনকি অনেক অর্থনৈতিক নীতিমালার সম্ভাব্য ধারণা-অভিজ্ঞান। এ রকম দুটো উদাহরণ হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস। এ দুটি লেখার সূত্র ধরে আমি পরবর্তী দুই অধ্যায়ে সাহিত্যে অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে কিছু বাড়তি প্রসঙ্গের উল্লেখ করব।

২. স্মিথ, ডিকেন্স, মিল ও বঙ্কিম

খোলা বাজার বা অবাধ বাজার-অর্থনীতি নিয়ে আমাদের জনমনে কম-বেশি ভুল-শুদ্ধ একটা ধারণা চালু আছে। বিশেষ কতগুলো শর্তসাপেক্ষে এ অবাধ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার অর্থনীতি হচ্ছে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সমাধানের পথ_ এরকম একটি বক্তব্যের শাস্ত্রীয় সূচনা হয় স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ বইয়ে। এই বাজার-অর্থনীতি কোনো সর্বজ্ঞ পরিকল্পনাকারীর হাত ধরে কাজ করে না। বস্তুত কেউই এর পরিচালনার দায়িত্বে নেই। সমাজের সব ইকোনমিক এজেন্টেই স্বীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে যুক্ত হন। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তির স্বপ্রণোদিত উদ্যমের ফল হয় সামগ্রিকভাবে সবার জন্য শুভ। এই চমৎকার পরিণতির পেছনে কোনো নিখিল প্রজ্ঞার হাত নেই_ যা আছে তা হলো বাজারের অদৃশ্য হাতের জাদু। সেই থেকে স্মিথের ইনভিজিবল হ্যান্ড-এর তত্ত্ব অর্থশাস্ত্রে চালু হয়ে রয়েছে। বাজারের এই ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্ব অনেকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে এ পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার নজর কেড়েছে দার্শনিক মিশেল ফুকোর একটি বিশ্লেষণ। তিনি এক জায়গায় বলছেন যে, অদৃশ্য হাত-এর তত্ত্বে রাজা বা সার্বভৌম ক্ষমতা পুরোপুরি অস্বীকৃত। রাজা রাষ্ট্রের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা বা রাষ্ট্রক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অপ্রয়োজনীয় সত্তা। অর্থাৎ ফুকোর ব্যাখ্যায়, সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে যাওয়ার এক পর্যায়ে রাজার অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংকুচিত করার জন্য ১৬৮৮ সালের ‘গ্গ্নোরিয়াস রিভুল্যুশন’ যেসব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিল তারই সর্বোচ্চ তাত্তি্বক স্বীকৃতি মেলে ১৭৭৬ সালে স্মিথের লেখায় বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্বে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাজার যদি কোনো আবশ্যিক ভূমিকা না-ই থাকে, তাহলে তার অস্তিত্বের একটি বড় অংশই মহিমা হারিয়ে ফেলে। এদিক থেকে দেখলে ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্ব আসলে একটি অন্তর্ঘাতমূলক রাজদ্রোহী তাত্তি্বক তৎপরতা_ সর্বময় ক্ষমতার মালিক রাজা বা সার্বভৌমের বিরুদ্ধে। ফুকো তাই লিখেছেন, ‘ইকোনমিক্স ইজ আ ডিসিপ্লিন উইদাউট টোটালিটি।’ আমার নড়বড়ে অনুবাদে তা দাঁড়ায় এমন :’অর্থশাস্ত্র হচ্ছে এমন একটি বিদ্যা যা রাজার পক্ষে গোটা রাষ্ট্রকে শাসন করা সম্ভব এ রকম সার্বভৌম-কেন্দ্রিক ধারণাকে সরাসরি নাকচ করে।… উদারনৈতিকতাবাদের জন্মই এই সূত্রে। এক দিকে আইনের যুক্তিতে গোটা সমাজের উপরে সার্বভৌম ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, আর অন্যদিকে আধিপত্যের হাত গলে যাওয়া অসংখ্য নাগরিকের/প্রজার বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক স্বার্থের (স্বাধীন) অন্বেষণ। এ দুই প্রবণতার মধ্যে মৌলিক বিরোধ রয়ে গেছে।’

বাজারের অদৃশ্য হাতের তত্ত্বকে এভাবে র‌্যাডিক্যাল ধারায় মহিমান্বিত করার চেষ্টা সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে টমাস কার্লাইল এই অদৃশ্য হাতের তত্ত্বকে নির্ভর করা শাস্ত্রটিকেই অভিহিত করলেন ‘এক বিষণ্ন বিজ্ঞান’ (ডিসমাল সায়েন্স) হিসেবে। অন্যদিকে অলিভার টুইস্ট, ব্রিক হাউস, হার্ড টাইমস প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে চার্লস ডিকেন্স ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রকে অস্বীকার করে দেখালেন যে, সমাজের কল্যাণসাধন এই অর্থশাস্ত্রের অভিপ্রায় নয়। শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্য, বৈষম্য এসব অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়ে উঠল তার উপন্যাসে। পরিবেশ দূষণ, অনগ্রসর নগর পরিকল্পনা, কারখানায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধিমালার অনুপস্থিতি, জনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা_ এসব বিতর্ক জন্মে উঠেছিল ইউরোপে আরও পরে; কিন্তু ডিকেন্সের লেখায় এসব বিতর্কের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ডিকেন্সের এই লেখাগুলো যখন প্রকাশিক হচ্ছে, ততদিনে আত্মপ্রকাশ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কার্লাইল ও ডিকেন্সের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। কার্লাইল ১৮৪৯ সালে অর্থশাস্ত্রকে বলেছেন, ‘বিষণ্ন বিজ্ঞান’; এর ঠিক এক বছর আগে, ১৮৪৮ সালে বেরিয়েছে জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’। বইটি মৌলিক গোত্রের না হলেও স্মিথ-রিকাভো-ম্যালথাসের ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রকে সুপাঠ্যবই হিসেবে বিন্যস্ত করেছিলেন মিল। পরবর্তী প্রায় একশ’ বছর ধরে বাংলার (ও ভারতের) জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিকরা যেমন, উচ্চপর্যায়ের সরকারি চাকরি-প্রার্থী এদেশের ভদ্র সম্প্রদায়ের প্রায় সবাইকেই মিলের বইটির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল অর্থশাস্ত্রের পরীক্ষায় পাসের জন্য। বঙ্কিমের অর্থনৈতিক চিন্তাতেও এ বইয়ের গভীর প্রভাব ছিল। তবে বঙ্কিম তার বিভিন্ন লেখায় ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে আরও কিছু প্রসঙ্গের সূত্রপাত করেন, যা তার চিন্তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

অন্যত্র আমি বঙ্কিমচন্দ্রের ১৮৭২ সালের লেখা ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ এবং সে লেখায় অর্থশাস্ত্রীয় বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে আমি তিনটি প্রসঙ্গের পুনরুক্তি করা প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমত, দেশের শ্রীবৃদ্ধির (এখনকার পরিভাষায়_ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) প্রশ্নটিকে তিনি সরাসরিভাবে সম্পদ-বণ্টন তথা ভূমি-বণ্টন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করেছিলেন। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বললেন, ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, আমাদের দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে… আমাদের দেশের বড় মঙ্গল হইতেছে।’ কী মঙ্গল, তা-ও বললেন। চাষের অধীনে জমি বাড়ছে, রেললাইন বসেছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, বাণিজ্য দ্রব্য নিয়ে স্টিমার চলছে নদীবক্ষে, শহরে সন্ধ্যার পরে গ্রামের আলো জ্বলছে, ‘ফুলিস্কেপ কাগজে বঙ্গদর্শনের জন্য সমাজতত্ত্ব’ লেখা হচ্ছে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হচ্ছে, সাহেবদের আসবাবপত্র আসছে, সেই সাথে তাদের আদব-কায়দাও আসছে। এসব বলার পরই এল তার পয়লা সওয়াল : ‘এরই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞসার আছে, কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায় খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্ম্ম বিশিষ্ট বলছে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে, উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?… দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন?… যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই সেখানে দেশের কোন মঙ্গল নাই।’ অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো সামগ্রিক সূচকই উন্নয়নের সূচক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কতটা গরিবমুখিন হচ্ছে সেটিই প্রধান বিচার্য।

দ্বিতীয়ত, ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন করেছিল তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন বঙ্কিম। আজকের ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা সে যুগেও ছিল রক্ষণশীল ও জমিদারি ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সমর্থক। এদের সমালোচনা করে বঙ্কিম প্রজাওয়ারী (রায়তওয়ারী) ব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি দিলেন। তার ভাষায়, লর্ড কর্নওয়ালিস ‘মহাভ্রমে পতিত হইয়া প্রজাদিগের আরও গুরুতর সর্বনাশ করিলেন’_ তিনি ‘রাজস্বের কন্ট্রাক্টরদিগকে ভূস্বামী করিলেন’। অথচ, ”প্রজারাই চিরকালের ভূস্বামী; জমিদারেরা কস্মিনকালে কেহ নহেন_ কেবল সরকারি তহশীলদার। কর্নওয়ালিশ যথার্থ ভূস্বামীর নিকট হইতে ভূমি কাড়িয়া লইয়া তহশীলদারকে দিলেন… এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বঙ্গদেশের অধঃপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মাত্র কস্মিনকালে ফিরিবে না।” সম্পত্তির উপর মালিকানার ধরন যে অর্থশাস্ত্রের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা, এখানে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, এই অবস্থার যে দ্রুত নিরসন করা যাচ্ছে না, তার কারণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগী শুধু জমিদারেরা নন, উচ্চ শ্রেণীর কৃতবিদ্য লোকেরাও অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র সম্প্রদায় তথা বাবুরা (এ ‘বাবুদের’ নিয়ে তার একটি স্বতন্ত্র তীক্ষষ্ট ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধও রয়েছে)। বঙ্গদর্শন পত্রিকার শুরুতে ‘পত্রসূচনা’য় বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্ট করে জানালেন যে, বাঙালির উন্নতি বলতে তিনি কখনোই কেবল সুশিক্ষিতের উন্নতি বোঝাচ্ছেন না। তার ভাষ্যে, ‘সমগ্র বাঙালির উন্নতি না হইলে দেশের কোন মঙ্গল নাই। সমস্ত দেশের লোক ইংরেজি বুঝে না, কস্মিনকালে বুঝিবে, এ মত প্রত্যাশা করা যায় না।… সুতরাং বাঙ্গালায় যে কথা উক্ত না হইবে, তাহা তিন কোটি বাঙ্গালী কখন বুঝিবে না, বা শুনিবে না। এখনও শুনে না, ভবিষ্যতে কোন কালেও শুনিবে না। যে কথা দেশের সকল লোকে বুঝে না, বা শুনে না, সে কথায় সামাজিক বিশেষ কোন উন্নতির সম্ভাবনা নাই’। দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিম বাংলা ভাষার জনভিত্তিক প্রসারকে উন্নতির আরম্ভ-বিন্দু হিসেবে দেখেছেন এমনকি অধস্তন ও কৃতবিদ্য শ্রেণীর মধ্যে। ‘সমকক্ষতা’ স্থাপনের একটি পাটাতন হিসেবে দেখেছেন। ভূমি-বণ্টনের অনাব্যতার প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি ভাষায় সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে তিনি শুধু অর্থনৈতিক সমতা-অর্জনের উপায় হিসেবে নয়, দেশের উন্নতির ভিত্তি হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। এভাবে তিনি কার্লাইল-ডিকেন্সের ‘বিষণ্ন বিজ্ঞান’ সমালোচনার উত্তর খুঁজছেন উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে। বেন্থাম-মিলের উপযোগীবাদী তত্ত্বকে তিনি সজোরে নাড়া দিচ্ছেন গুরু-শিষ্যের মধ্যকার সমীহ ভাবকে বজায় রেখেই। মিলের ইউটিলিটারিয়ান দর্শন নিয়ে তিনি কমলাকান্তের দফতরেও পরিহাস করেছেন। তার ভাষ্যে আবারও ফিরে যাই ‘এরূপ কখন কোন দেশে হয় নাই যে, ইতর লোক চিরকাল এক অবস্থায় রহিল, ভদ্রলোকদিগের অবিরত শ্রীবৃদ্ধি হইতে লাগিল। বরং যে যে সমাজের বিশেষ উন্নতি হইয়াছে, সেই সেই সমাজে উভয় সম্প্রদায় সমকক্ষ, বিমিশ্রিত এবং সহৃদয়তাসম্পন্ন। যতদিন এই ভাব ঘটে নাই_ যতদিন উভয়ে পার্থক্য ছিল, ততদিন উন্নতি ঘটে নাই। যখন উভয় সম্প্রদায়ের সামঞ্জস্য হইল, সেই দিন হইতে শ্রীবৃদ্ধি আরম্ভ।’ এক অর্থে ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের যে-উদ্বোধন ঘটেছিল স্মিথ-রিকার্ডো-মিলের হাত ধরে, তার মধ্যে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্র ছিল না। এবারে উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রের কিছু মৌলিক উপাদানের প্রতি ইঙ্গিত দিলেন বাংলার প্রথম অর্থশাস্ত্রবিশারদ বঙ্কিমচন্দ্র। তার কথিত সহৃদয়তাসম্পন্ন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকেও হাল আমলের ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ তত্ত্বের পূর্বলেখ বলে মনে হয়।

দুর্ভাগ্য যেটা, তা হলো বাঙালি বলতে বঙ্কিমচন্দ্র বর্ণ-নির্বিশেষে ধর্ম-নির্বিশেষে অভিন্ন জাতিসত্তা বোঝাননি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এই অন্ধত্ব বিশেষ করে দেখা দিয়েছিল বাংলার মুসলমান সমাজকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে। দেশের শ্রীবৃদ্ধির অসঙ্গতির আলোচনায় পরান মণ্ডল, হাসিম শেখ ও রাজা কৈবর্ত্তের উল্লেখ তবু পাই, কিন্তু জাতি-নির্মাণের প্রকল্পে কোথাও ‘হাসিম শেখ’কে দেখতে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক চিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র সমতাবাদী, কিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় তিনি যে নেশনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেখানে মুসলমানদের স্থান করে দেননি। ১৯৬৪ সালে আবুজাফর শামসুদ্দীন এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ফরাসি বিপ্লব নিয়ে পড়েছেন। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কেও জানতেন, সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি নিয়েও কখনও কখনও প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে হিন্দুর ধর্মীয় পুনরুত্থান ছাড়া আর কিছুই যে বুঝতে পারেননি এটি একটি ঐতিহাসিক আশ্চর্য! এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রথমবারের মতো উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রে যে বাঙালি চিন্তকের মধ্যে মৌলিকত্ত্ব কিছুটা লক্ষ্য করা যায়, সেই চিন্তকের মধ্যেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে সুগভীর ফাটল থেকে গিয়েছিল। ফলে কার্লাইল-ডিকেন্সের বিষণ্নতার কলঙ্ক থেকে অর্থশাস্ত্রকে মুক্ত করা বঙ্কিমের মতো তীক্ষষ্টধীর পক্ষেও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এক অর্থে এটি একটি ব্যর্থতার মডেল হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তী বছরগুলোয়। অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রাগ্রসর ধারণার আশ্রয়ের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে অনগ্রসর ধারণাকে লালন করার এই পরস্পরবিরোধী ধারা উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেক বাঙালির তত্ত্ব চর্চার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মোরশেদ শফিউল হাসানের অধুনাকালের গবেষণা ‘পূর্ব বাঙলায় চিন্তাচর্চা ১৯৪৭-১৯৭০ : দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া’ গ্রন্থে যেসব আকর-উপাদান জড়ো করা হয়েছে, তাতে করে পাকিস্তান-উত্তর পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাঙালি মুসলিম ‘রেনেসাঁ’ পর্বের বিভিন্ন মুসলমান চিন্তাবিদের মধ্যেও বঙ্কিম-প্রদর্শিত ফাটলের পথ ধরে চলবার প্রবণতা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। আকরম খাঁ থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ থেকে আবুল ফজল কেউই বঙ্কিম-প্রদর্শিত স্ববিরোধিতার পথ থেকে নিজেদেরকে আড়াল করতে পারেননি।

৩. দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি

অমর্ত্য সেন যেসব কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ নিয়ে তাঁর মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস্’। যেটা লক্ষ্য করার তাহলো দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যেসব রচনা পাওয়া যায় তার মধ্যে সেন-উলি্লখিত কার্যকারণের একটি পূর্ব অনুমান মেলে। ১৭৭০-এর মহামন্বন্তর (যার ফলে, সরকারি হিসাবেই অবিভক্ত বাংলার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী মৃত্যুবরণ করেছিলেন) অমর্ত্য সেনের গ্রন্থের আলোচনায় আসেনি। যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়নি উনিশ শতকের অন্তত ৫টি দুর্ভিক্ষ, যথাক্রমে ১৮৬৫/৬৬, ১৮৭৩/৭৪, ১৮৮৪, ১৮৯১/৯২ ও ১৮৯৫/৯৭। তিনি তার গ্রন্থে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর ও বাংলাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ ও সংঘটন।

তবে সাহিত্যের আকর-উপাদান খুঁজলে বাংলার বিভিন্ন দুর্ভিক্ষের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়, যাতে শুধু সেনের এনটাইটেলমেন্ট তত্ত্বের প্রমাণ্যতাই মেলে না, পাওয়া যায় আরও বাড়তি কিছু উপাদানের অস্তিত্ব। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি মুসলমান-বিদ্বেষী উপাদানের কারণে এখন অনেকটাই অর্থনৈতিক ডিসকোর্সের বাইরে। এমনকি অর্থশাস্ত্রের ছাত্রছাত্রীরাও দুর্ভিক্ষের অর্থনীতি বোঝার প্রয়োজনে কদাচিৎ ‘আনন্দমঠ’ পড়ে দেখতে চান। বঙ্কিম অবশ্য ‘আনন্দমঠ’ লিখেছিলেন ১৭৭০-এর মহামন্বন্তর ঘটে যাওয়ার একশো বছর পরে (১৮৮০ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত)। এই দুর্ভিক্ষের আকর-উপাদান তিনি জড়ো করেছিলেন হান্টার সাহেবের লেখা ‘দ্য এনালস্ অব রুরাল বেঙ্গল’ পড়ে। দুর্ভিক্ষ বোঝার দৃষ্টিকোন থেকে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি পড়লে কয়েকটি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে।

প্রথমত, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের পেছনে প্রকৃতিসৃষ্ট কিছু উপাদান (যেমন দুর্ভিক্ষের আগের পরপর তিনটি বছরেই ভালো ফসল না হওয়া) ক্রিয়াশীল থাকলেও একে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষই বলতে চেয়েছেন লেখক। সামগ্রিকভাবে সুশাসনের অভাব একটি বড় কারণ ছিল এই দুর্ভিক্ষের পেছনে। মনে রাখতে হবে যে এই সময়ে কোম্পানির শাসনের গোড়া পত্তন হচ্ছিল। ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের পর, বিশেষত ১৭৬৫ সালের পর থেকে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসন গেড়ে বসতে থাকে। ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ হয় এমনই একটি উত্তরণকালীন পর্যায়ে_ যখন না কোম্পানি না দেশীয় নবাবেরা (যেমন রেজা খাঁ) পূর্ণ শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হচ্ছিলেন। আর উত্তরণকালীন পর্যায়ের সুযোগ নিয়ে শাসনব্যবস্থায় অরাজকতা নেমে এসেছিল। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা সরাসরিভাবে মহাজনী কারবারে যেমন, তেমনি প্রত্যক্ষভাবে লুণ্ঠনকার্যেও জড়িত হয়ে পড়েন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট-এর কালে এডমন্ড বার্কের উত্থাপিত অভিযোগে এটি ছিল একটি বড় বিষয়। দ্বিতীয়ত, প্রচণ্ড খরার মুখে বাংলার ‘চৈতালি’ শস্যের বিনষ্ট হওয়ার পরিস্থিতিতে সরকার বছরের গোড়াতেই কোম্পানির সেনাবাহিনীর জন্য ‘৮০ হাজার মণ চাল মজুদ করার’ নীতি নেয়। ফলে বাজারে দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো চালের সরবরাহ আরও কমে যায়। তৃতীয়ত, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসে ব্যাপকভাবে কুটিরশিল্পের ধ্বংসের কারণে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে রাজস্ব-সংগ্রহের ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। মোগল আমলে গোটা গ্রাম সমষ্টিগতভাবে রাজস্ব দিত। গ্রামপ্রধান সে রাজস্ব সংগ্রহ করে মোগল সরকারের ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। উত্তরণশীল এই পর্বে গ্রামভিত্তিক রাজস্ব সংগ্রহের পরিবর্তে ব্যক্তি বা পরিবারভিত্তিক রাজস্ব-ব্যবস্থা চালু হলো এবং সেটাও করা হলো ভিন্ন উপায়ে। আগে যেখানে উৎপাদিত শস্যের হিসাবে খাজনা দেওয়া হতো, এখন সেটা হতে থাকল নগদ অর্থে। দুর্ভিক্ষের আলামত সত্ত্বেও রাজস্ব-সংগ্রহের মোট পরিমাণ কমল না। আকাড়ার সময়ের সুযোগ নিয়ে মজুদদারি করে চালের ব্যবসায় এ সময়ে বিনিয়োগ করেছিলেন রাজকর্মচারীরা। সুপ্রকাশ রায় তার ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইতে জানিয়েছেন যে, ‘বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক, তাহাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান, চাউল ক্রয় করিতে লাগিল’। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রশাসনিক নির্দেশে আন্তঃজেলা খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র নিজেই যেখানে মজুদদারি, ব্যবসায় নিয়োজিত সেখানে শুধু বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’কে এখানে দোষ দেওয়া চলে না। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল আন্তঃজেলা খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানি অবাধ করে দেওয়ার পক্ষে জোরালো অভিমত রেখেছিলেন।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এসব উপাদান ছাড়াও আরও রয়েছে দুর্ভিক্ষের ক্রমবিস্তৃতির বিবরণ, এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের মাংস মানুষে খাওয়ার আতঙ্ক উদ্রেককারী উল্লেখ। দীর্ঘ উদ্ধৃতির এখানে সুযোগ নেই, তারপরও একটি ছোট্ট বিবরণ দিচ্ছি যার থেকে দুর্ভিক্ষের বিস্তৃতির বিভিন্ন পর্যায়কে বিশ্লেষণাত্মক উপায়ে শনাক্ত করা সম্ভব:

‘অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে-কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না। মাঠে ধান্য সকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল। রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহির জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল। তারপর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল। তারপর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না, [ওদিকে সরকার] একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয় দিল।… লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিত আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়! উপবাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপরে রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল, গোরু বেচিল, লাঙল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কেনে! খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাষ খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল।… অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’

১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষের যে বিবরণ ‘আনন্দমঠ’-এ পাই তার সঙ্গে বিভূতিভূষণের ‘অশনিসংকেত’-এর তুলনা করলে আধুনিক দুর্ভিক্ষের সঙ্গে অষ্টাদশ-উনিশ শতকের দুর্ভিক্ষের বেশ কিছু মিল ও অমিল চোখে পড়বে। যারা চরম দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে অর্থশাস্ত্রীয় গবেষণায় উৎসাহী তাদের জন্য। এরকম সাহিত্যিক তুলনা-প্রতিতুলনা বিরল অন্তর্দৃষ্টি জোগাতে পারে। ‘অশনিসংকেত’ উপন্যাসে (দুর্ভিক্ষ যখন দানা বাঁধছে) গঙ্গাচরণ চালের ব্যবসায়ী কুণ্ডু মশায়কে জিজ্ঞেস করলেন_ ‘ধান চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?’ উত্তরে কুণ্ডু মশায় বললেন, ‘কি করবো বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুঠ হবার পর কি করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন। সবারই সে দশা। তারপর শুনচি পুলিসে নিয়ে যাবে চাল কম দমে মিলিটারির জন্যে’। জাপানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে রেঙ্গুন থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেল, জাপানের সঙ্গে আরও বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ইচ্ছে করেই ভেঙে দেওয়া হলো। মজুদদারি ব্যবসা তো ছিলই। সাধারণ ব্যবসায়ী ও কিছুটা অবস্থাপন্ন গৃহস্থেরাও যাকে বলে ‘প্যানিক হোর্ডিং’ করা শুরু করল। সরকার বাহাদুর নিজেই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আমদানিকৃত চালের একটা বড় অংশ পাঠিয়ে দিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত সেনাদের কাছে। এই নীতির জন্য সাম্প্রতিক এক গবেষণায় চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। আর দেশের ভেতরে বড় বড় আড়তদারকে বাধ্য করা হলো সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে। এই ধান ক্রয় করা হতো কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে_ এর মধ্যে সে সময় বড় ভূমিকা পালন করেছিল পরবর্তীকালের শিল্পপতি ইস্পাহানির মতো ব্যবসায়ী গ্রুপেরা। অর্থনীতিবিদ আবদুল্লাহ্ ফারুক তার ‘কয়েকজন বাঙালী শিল্পোদ্যোক্তার জীবনী’ বইতে জানিয়েছেন যে, এ সময় মজুদদারি ও ফাটকাবাজি ব্যবসায় লগি্ন করে লাভবান হয়েছিলেন ‘দানবীর’ রণদাপ্রসাদ সাহারাও। তাই উপন্যাসে কুণ্ডু মশাইকে গঙ্গাচরণ বলছেন, ‘বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক। নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে’। উত্তরে কুণ্ডু মশাই বললেন, ‘বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কন্ট্রাক্টরদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি।’

তারাশংকরের ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম থেকে বিজয় নীলাকে লিখেছে, ‘এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি_ ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজমা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত ধান টেনে নিচ্ছে।’ সরবরাহে ঘাটতির কারণে বাজারে চালের দামও বাড়ছিল দ্রুত হারে। সুব্রত রায় চৌধুরী তার ‘কথাসাহিত্য মন্বন্তরের দিনগুলিতে’ বইতে বিভূতিভূষণের ‘অশনিসংকেত’ থেকে চালের দামবৃদ্ধি সম্পর্কে একটি সারণি উপস্থাপন করেছেন। তাতে দেখা যায়, সে বছর ফাল্গুনে চালের দর মণপ্রতি ছিল ৬ টাকা, সেটা চৈত্রের শেষে দাঁড়ায় ২০ টাকা। আশ্বিন মাসে অনঙ্গ বৌ মতিকে বলছে যে, চালের দাম দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকায়। অন্যদিকে, উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের পারিশ্রমিক ছিল নিম্নরূপ_ গঙ্গাচরণের ক্ষেত্রে মাসিক আয় ১২ টাকা, দুর্গা পণ্ডিত পেতেন মাসে ৬ টাকা ৪৫ পয়া, নবীন বাড়ূই পেতেন দৈনিক ১৬ আনা করে, আর জেলে বৌ আরও কম_ দৈনিক ১০-১২ আনা করে। চালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এদের সকলেরই প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছিল কয়েক মাসের মধ্যেই। এক পর্যায়ে নবীন বাড়ূই, জেলে বৌ বা মতি মুচিনীর হাতে কোনো কাজও ছিল না। মতি তো মারাই গেল। অর্থাৎ সাহিত্যেও অমর্ত্য সেন-ব্যাখ্যাত এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্ট তত্ত্বের ন্যারেটিভ বিশ্বস্ততার সঙ্গে রূপায়িত হচ্ছিল।

দুঃখের বিষয়, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজটি বঙ্কিমচন্দ্র ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে যে কাজটি বিভূতিভূষণ (বা তারাশংকর) করেছিলেন ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে বা অন্যত্র কোনো বিশ্বস্ত সাহিত্যিকে বিবরণী আমরা পাইনি এখনো। সত্তর-আশি দশকের বাংলাদেশের অব্যাহত সুশাসনহীনতা, রাজনৈতিক খুন ও গুমখুন, সামরিক শাসনের অভ্যুদয়, লুটপাটের অর্থনীতি এরকম নানা উপসর্গের পেছনে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও দুর্ভিক্ষজনিত মূল্যবোধের ক্ষয় একটি মৌলিক বিনাশের সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। অন্তত এমনটাই আমার কাছে মনে হয়েছে। ১৯৭৪ নিয়ে নীরবতা এদেশের সাহিত্য ও অর্থনীতি চর্চা উভয়ের ক্ষেত্রেই ফলদায়ী হয়নি। কবিরা স্পষ্টভাষী বলে সে সময়ে কিছুটা পরিমাণে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। রফিক আজাদ যেমন লিখেছিলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’। শহীদ কাদরীও তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম দেন_ ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’। শামসুর রাহমানও লিখেছেন, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ বা ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’র মতো কাব্য-শিরোনাম। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। সাধারণভাবে আমাদের সুবাধ্য সুশীল সমাজ ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ও তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো অব্যাখ্যাত কারণে নীরব থাকাটাকেই শ্রেয়তর অবস্থান বলে মনে করেছে।

লেখক
গবেষক
প্রাবন্ধিক

উত্তর আধুনিকতার পাঠ

বিনায়ক সেন

১. আধুনিক যুগের ‘অবসান’ নেই?

ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে সময়কে তিন ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে_ যথাক্রমে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে আধুনিক যুগের জন্ম এবং পাঠ্যবইয়ের যুক্তি অনুসারে এই যুগ এখনও চলছে। আধুনিক যুগের অবসান নেই। এক অর্থে আধুনিক যুগে উত্তরণের পর থেকে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। এখন বড়জোর যেটা চলতে পারে তাহলো মূল ইতিহাসের বাইরে থেকে যাওয়া বিশ্বের অধিকাংশ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মেষশাবকের মতো ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন। পাশ্চাত্যের যুক্তি_ সেটা সম্ভব কেবল আধুনিকায়নের মাধ্যমে। এটা শুধু এন্ড অব হিস্ট্রিখ্যাত ফুকোয়ামার যুক্তি নয়, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর এনলাইটেনমেন্ট তাত্তি্বকদের প্রায় সবাই কমবেশি এই মতে জড়ো হয়েছিলেন। তার মানে এই নয় যে, এদের মধ্যে মতবিভেদ ছিল না। কিন্তু তা ছিল আধুনিকায়নের মধ্যেই মতবিভেদ। এনার্কিজম, সিন্ডিক্যালিজম, বলশেভিজম নানা মতবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল উন্নত-মাঝারি, পুঁজিবাদী নানা দেশে এই সময়ে। তবে এসব ডিসকোর্সে উপনিবেশের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না, কেননা উপনিবেশের অধিবাসীদের এনলাইটেনমেন্ট-পরবর্তী ইউরোপ কখনও সমকক্ষ মানুষ বলেই স্বীকার করেনি। নইলে আমাদের ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’ বলে ভাবাটাই সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। আরিস্ততলের গণতন্ত্রে যেমন দাসত্বের স্থান ছিল না, কান্ট-হেগেলের বিশ্ব-ইতিহাসে বা বৃহত্তর অর্থে বিশ্ব-শান্তির চর্চায় উপনিবেশের নিজস্ব কোনো কণ্ঠস্বর ছিল না। আর বোবা ভাবলে বা করে রাখলে যা হয়, উপনিবেশ সম্পর্কে এক ধরনের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মিথ্যাচারকে ক্রমাগতভাগে পুনরুৎপাদিত করা হচ্ছিল ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা প্রাচ্যবিদ্যা নামক জ্ঞান কাণ্ডে। এসব তথ্য অবশ্য আমাদের ইতিমধ্যে এডোয়ার্ড সাইদের রচনা ও রণজিৎ গুহের নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার কল্যাণে জানা হয়ে গেছে। এরা যেসব প্রশ্ন তুলেছেন তার আদি-প্রেরণা হিসেবে ছিলেন এবং আছেন মার্কস।

আধুনিকতা অথবা উত্তর-আধুনিকতা যে পথেই আপনি থাকুন না কেন মার্কসের কাছেই আপনাকে ফিরে যেতে হবে। অন্তত মার্কসের স্টেশনে কিছুক্ষণ হলেও আপনাকে জিরোতে হবে। এর কারণ, মার্কসের রচনাবলীর মধ্যে যেমন পাওয়া যাবে আধুনিকতার অনিবার্যতা, তেমনি পাওয়া যাবে এর সমালোচনাও। অনেক সময় তিনি তার লেখায় যেসব উপমা ব্যবহার করেছেন তা নিয়েই শতখানেক পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখা হয়েছে। একটা উদাহরণ দেই। মার্কস এক পর্যায়ে বলেছিলেন, হেগেলের রচনায় ডায়ালেকটিকসের তত্ত্ব ‘মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে’। তার মানে এখন তাকে ‘সোজা করে নিলেই’ বস্তুবাদী ডায়ালেকটিকসকে নিষ্কাষণ করা যাবে। এ রকম একটা ব্যাখ্যা হতেই পারে। যেমন, একটা ব্যাখ্যা হতে পারে হেগেলের মন ভাববাদী, কিন্তু তার পদ্ধতি ডায়ালেকটিক্যাল যাতে কোনো ভুল নেই। ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার এতে বাধ সাধলেন। তার যুক্তি, মাথার উপরে দাঁড়ানো হেগেলীয় পদ্ধতিকে সোজা করে নিতে গেলে নাট-বল্টু সবকিছুতে এলোমেলো হয়ে যায়। মার্কসীয় ডায়ালেকটিকস হেগেলের লেখা থেকে নয়, মার্কসের নিজের লেখা থেকেই আবিষ্কার [নিষ্কাষণ] করে নিতে হবে। সে সূত্রে তিনি মার্কসের মধ্যেই হেগেলীয় ‘তরুণ মার্কস’ আর স্বকীয় মহিমায় ভাস্বর ‘পরিণত মার্কস’_ এ দুইয়ের মধ্যে খুঁজে পেলেন ‘জ্ঞানতাত্তি্বক ভেদরেখা’ [এপিস্টেমোলজিক্যাল ব্রেক] । যা হোক এসব তর্ক ও ধন্দের কারণে মার্কসকে কখনও আধুনিকতাবাদীরা তাদের দলে টানার চেষ্টা করেছেন। উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের অনেকেই মার্কসের রচনায় আধুনিকায়নের ‘নষ্ট রক্ত’ খুঁজে পেয়েছেন। আবার ফ্রেডেরিক জেমেসনের মত উত্তর-আধুনিক মার্কসবাদীরা মার্কসকে তাদের আদি-প্রেরণা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অন্যরা যারা প্রথম দিকে বেশ সোচ্চারেই মার্কস-বিরোধী ছিলেন বা সেদিকেই তাদের কণ্ঠ বেশি করে শোনা গেছিল, পরবর্তীতে তারাও তাদের মত কিছুটা বদলেছেন। বিশেষভাবে এটা ঘটেছে ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদার রচনায়_ স্পেক্টর অব মার্কস গ্রন্থের পর থেকে। ফুকোর শেষের দিকে রচনায় জোরেশোরে ফিরে এসেছে ইতিহাসে কর্তার [সাবজেক্ট] ভূমিকা, ফলে মার্কসের রচনার মতোই তরুণ ফুকো ও পরিণত ফুকোর মধ্যে বেশ খানিকটা ভেদরেখা সৃষ্টি হয়ে গেছে।

এসব বিভিন্নবিধ সমালোচনা ও পাল্টা সমালোচনার পেছনে মূল তাগিদ হচ্ছে সমাজকে বদলানো। আর সমাজকে বদলাতে গেলে প্রথাগত ব্যবস্থার দুই প্রধান সহায়ক শক্তি_ রাষ্ট্রযন্ত্র ও অর্থনীতি_ এদেরকেও যে বদলাতে হয়। আর এই পাল্টে দেয়ার ব্যাপারটা তো পুরোনো দালান ভেঙে নতুন দালান করার প্রকল্প নয়। একেক রাষ্ট্র ও একেক অর্থনীতি একেক ধরনের সমাজ ও সেই সঙ্গে একেক ধরনের ‘মানব’ তৈরি করে থাকে। আমরা যে কথার কথা হিসেবে বলি, উনি বেশ সনাতনী ধারার লোক, উনি বেশ চলতি হাওয়ার পন্থী সেসব আদৌ কথার কথা নয়।

আধুনিকায়নের মধ্যে থাকতে থাকতে আমাদের অন্দর-মহলেও আধুনিকায়ন ঢুকে পড়ে। চিন্তা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাই, কিন্তু মনের জানালা দিয়ে আধুনিকায়নের স্বপ্ন কুয়াশার মতো ঢুকতে থাকে। ঢাকার রাস্তায় হাঁটি, কিন্তু মনে মনে ঢাকা শহরকে দেখি না, আসলে হাঁটতে থাকি ম্যানহ্যাটানের ফুটপাতে। এদেশ এগুচ্ছে; তার বিলবোর্ড করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি বা আইফেল টাওয়ারের কথা। গ্রাম-বাংলার তপ্ত দুপুরের রোদে কাজ থামিয়ে ক্ষেতের পাশেই গামছা বিছিয়ে নামাজ পড়ছে যে বৃদ্ধ কৃষক তার মুখচ্ছবি আমাদের বিলবোর্ড থেকে হারিয়ে যায়। রণে-বনে- সংকটে আমরা পীর-মুর্শিদ বা পুণ্যধামে ছুটি না আর। নবযুগের পীর-আউলিয়া ড্যান মজীনারা আমাদের আশ্বস্ত করেন। কোন পথ ধরে এগুলে আমরা পাশ্চাত্যের গুডবুকে থাকব, জিএসপি সুবিধে বাতিল হবে না, বা পাব ‘মডারেট মুসলিম ডেমোক্রেসি’র খেতাব, আর কি করা গেলে ওবামা বা নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন ঢাকায়, এমডিজিতে সাফল্যের করণে_ চাই কি শান্তির নোবেল_ এসব আমাদের রাষ্ট্রীয় তৎপরতার একটি প্রধান সাফল্য-সূচকে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট ইংরেজ বড় ইংরেজ’ ধারণা অনুসরণ করে বলা যেতে পারে ‘ছোট আধুনিকতা’ [তৃতীয় বিশ্ব] বনাম ‘বড় আধুনিকতা’ [পশ্চাত্য] এই খেলাই চলছে এখন।

২. আধুনিকতার আদি প্রতিশ্রুতি

‘আধুনিকতার’ কোন একক সংজ্ঞা নেই। অর্থশাস্ত্রে আধুনিকায়ন [মডার্নাইজেশন] বলতে নগরায়ন, শিল্পায়ন প্রভৃতি ধারণা ব্যক্ত হয়ে থাকে। সমাজতত্ত্বে [ইংরেজিতে_ সোশ্যাল থিওরি] আধুনিকতা বা মডার্নিটি আবার ‘পুঁজিবাদ’ ধারণার সমার্থক। উত্তর-আধুনিকেরা অবশ্য পরবর্তীতে দেখিয়েছেন যে, প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ধারণাতেও আধুনিকতার মন্দ অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। পুঁজিবাদের মতো প্রথাগত সমাজতন্ত্রেও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নির্মাণে, শিল্পায়নের পরিকল্পনায়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে, নগর-ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রায় একই ধারার প্রযুক্তি-নির্ভর অবিবেচক মানসিকতা, একই ধরনের প্রবৃদ্ধি [গ্রোথ] মুখীনতাকে মানব-কল্যাণের উপরেও স্থান দেওয়া হয়েছিল। স্তালিনের শাসনামলেই ‘আদি সমাজতান্ত্রিক পুঁজি সঞ্চায়নের’ মাধ্যমে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবৃদ্ধিশীল দেশে পরিণত হয়েছিল ১৯২৬-৩৬ পর্বে। এই অভিজ্ঞতা পরবর্র্তীতে ফেলদ্ম্যান-হ্যারড ডোমার প্রবৃদ্ধি-মডেলের উপত্তিগত ভিত্তি যুগিয়েছিলেন। এটা করতে গিয়ে যে অমানুষিক খেসারত দিতে হয়েছিল সেটা বড় বিবেচনা নয় এখানে। এর মধ্য দিয়ে প্রথাগত সমাজতন্ত্রে ক্রমশ স্থান করে নেয় যন্ত্র-মানব, যন্ত্রের রাজত্ব, বৃহত্তর-অর্থে ‘কলের নেশন’। ‘রক্তকরবী’র রাজা যেমন অনুভব করেছিলেন তারই সৃষ্ট যন্ত্র আর তার বশ্যতা মানছে না সেভাবেই একপর্যায়ে বিপর্যস্ত বোধ করেছিল প্রথাগত সমাজতন্ত্র। ক্রমশ প্রকৃতির প্রতি মেষপালকের মমতাময় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে জায়গা করে নিতে থাকে যন্ত্র-মানবের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। ‘আই-রোবট’ সিরিজের লেখক আইজাক আসিমভ যেসব রোবটিক্যাল প্রিন্সিপলের কথা বলে গেছেন_ যা নিয়ে একুশ শতকে আমাদের আরও ভাবতে হবে_ সেসব নিয়ম মানেনি কলের রাজত্বের নব্য শাসকেরা। এর ফলেই নিয়ম উনিশ-বিশ শতকের পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয় ব্যবস্থাই ধারাবাহিকভাবে সংকটে পড়েছে।

এনলাইটেনমেন্টের তাত্তি্বকরা আধুনিকায়নের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই যুগ এখনও আমাদের দেখতে বাকি। উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের একটি বড় অংশই সে কথা মনে করেছেন। টেকনোলজিক্যাল মেন, ওয়ান-ডাইমেনশনাল মেন, ডেথ অব মেন_ এসব ধারণার মধ্য দিয়ে সমালোচকেরা চেয়েছেন সভ্যতার নতুন পর্যায়। দেরিদাঁ যাকে সুন্দর করে বলেছেন একটি আপ্ত-বাক্যে_ ‘যে গণতন্ত্র আসতে বাকি’ [ডেমোক্রেসি-টু-কাম]। অর্থাৎ এখন গণতন্ত্রের নামে উন্নত বিশ্বে [এবং সারা বিশ্বে] যা চলছে তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। আধুনিকতার মধ্যেই যারা বিকল্প সম্ভাবনা খোঁজেন সে রকম একজন জার্মান দার্শনিক হাবেরমাস_ তারও বক্তব্য এটাই। পাবলিক রিজন বা তর্ক-বিতর্ক-সমালোচনার মধ্য দিয়ে সিভিল সমাজ নতুন কোন পথ খুঁজে নেবে ইউরোপে যা পাশ্চাত্যের অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র ও অসাম্যকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। বোদ্রিলার থেকে লিওতার পর্যন্ত ‘খাঁটি’ চরম উত্তর-আধুনিকতাবাদীরাও এতে হয়তো সায় দিতেও পারেন।

৩. ‘আধুনিকতা’ কি করতে চাইছে?

যে বিষয়ে সংজ্ঞা দেওয়াই কঠিন তা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করাই এক ঝুঁকিপূর্ণ প্রস্তাব। আধুনিকতার সরলতম সংজ্ঞায় মৌল উপাদানকে [দাবিকে] চিহ্নিত করা যেতে পারে। তার মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া হচ্ছে আধুনিকতার প্রথম দাবিটি। সেটি হচ্ছে, সব ধরনের সমাজকেই একটি অভিন্ন ছাঁচে ঢালার চেষ্টা, বা সমসত্ত্বতার [হোমজেনিটি] দাবি। মনে করুন, আপনি গত এক মাসে বিভিন্ন মহাদেশের বেশক’টি দেশের বড় বড় শহরেই ঘুরে এলেন। প্রতিটা শহরেই আপনি থেকেছেন পাঁচতারা হোটেলে। প্রতিটা হোটেলেই যে রুমে আপনি ছিলেন তাতে ছিল একই ধারার টিভি, বাথরুমের অভিন্ন ফিটিংস, কার্পেটিং এবং দেয়ালে প্রায় একই ধারার আধুনিক চিত্রকর্ম। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে যে রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেলেন সেটিও [ধরা যাক] ছিল ম্যাকডোনাল্ডস বা কেএফসি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলেন একই ধারার বিমানে করে, একই ধরনের সিটে বসে, একই ধরনের হলিউডি বা বলিউডি সিনেমা দেখতে দেখতে এবং প্রায় একই ধরনের স্ন্যাক ও পানীয় খেতে খেতে। এমনকি প্রায় একই ধরনের হাসি হেসে প্রায় একই ধরনের পোশাকের ও চেহারার বিমানবালা আপনাকে জানালো তার মাপা অভিবাদন। প্রায় একই চেহারার বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আপনি প্রায় একই রঙের ক্যাবে করে শহরময় ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেখানে সর্বত্র দেখেছেন একই ধরনের কোম্পানির বিজ্ঞাপন সংবলিত বিলবোর্ড। এত ‘সমসত্ত্বতার’ মধ্যে চলতে চলতে, বাস করতে করতে, একসময় আপনার হঠাৎ মনে হতেই পারে যে আপনি আসলে কোথাও যাননি, একই জায়গাতেই রয়ে গেছেন। আপনি আসলে টেরই পাচ্ছেন না কখন আপনি মেক্সিকো সিটিতে, কখন ন্যুয়র্কে, লন্ডনে, বার্লিনে, জোহানেসবার্গে, দুবাইয়ে, দিলি্লতে, ব্যাংককে বা সিডনিতে আছেন। এসব শহরের যে সার্কিটে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাতে করে স্থানের ও সময়ের কোনো বিশিষ্টতা খুঁজে পাচ্ছেন না আর [একমাত্র গায়ের রঙে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা ছাড়া]। কেননা, পোশাকে-আশাকেও সর্বত্র আপনি যাদের দেখছেন তারা প্রায় একই ধাঁচের জিনস, টপস, সানগ্গ্নাস পরে হালফিলের ল্যাপটপ বা আই-প্যাড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই গল্পটা কল্পিত হলেও অবাস্তব বা অবিশ্বাস্য নয়। আধুনিকতা নিয়ে ভাবতে গেলে আমরা এমনই এক সমসত্ত্ব সমাজকে [জগতকে] কল্পনা করি। এই হচ্ছে আধুনিকায়নের পয়লা নম্বর দাবি। পুঁজিবাদ সারা বিশ্বকেই তার নিজের ছাঁচে গড়ে-পিটে তুলবে তা সে আদিবাসী-অধ্যুষিত অরণ্যই হোক, কৃষক-সমাজই হোক, আর নোমাডিক বা বেদুইন পশুপালক গোত্রই হোক। সুদূর জাভা থেকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, দূরবর্তী পাপুয়া নিউগিনি থেকে আন্দিস পর্বতমালা, ভারতবর্ষ থেকে সাহারা অঞ্চলবর্তী আফ্রিকা_ সর্বত্রই শিল্প-পুঁজি, বণিক-পুঁজি বহুজাতিক পুঁজি তার বাজারের সন্ধানে অনুপ্রবেশ করবে, বদলে দেবে প্রাগ-পুঁজিবাদী দৃশ্যপট এবং দেখাবে একটাই সিনেমা_ মেড ইন ইউএসএ বা মেড ইন ইউরোপ। সমসত্ত্বতার এই দাবিতে ক্ষুব্ধ উত্তর-আধুনিকেরা। তাদের বক্তব্য এর ফলে হ্রাস পাচ্ছে জীবনবৈচিত্র্য, সামাজিক বৈচিত্র্য, প্রতিভার বৈচিত্র্য। এই আধুনিকতা আসলে সৃষ্টিশীলতা বিনাশী, কেননা এটা ব্যক্তিক/আঞ্চলিক সংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে বিনষ্ট করছে। তাছাড়া সমসত্ত্ব ছকে ‘উন্নয়ন’ সম্ভব নয়, যেমন এক সাইজের জ্যাকেটে সবাইকে কাপড় পরানো চলে না। যদিও ওয়াশিংটন কনসেসাস সেটাই করতে চেয়েছিল গত দু’দশক ধরে। আধুনিক সরল সমসত্ত্বতার বিপরীতে উত্তর-আধুনিকেরা চেয়েছেন জটিলতর অসমসত্ত্বতা, বিভিন্ন কোরাস, ভিন্ন ভিন্ন পথে চলার নমনীয়তা।

আধুনিকতার দ্বিতীয় দাবিটি ক্ষমতা-সম্পর্কিত। এককেন্দ্রিক বা কেন্দ্রীয় ক্ষমতার প্রতি আধুনিকতার পক্ষপাতিত্ব। এর সবচেয়ে কাছের উদাহরণ_ আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা। সমাজে বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতার অস্তিত্ব থাকলেও রাষ্ট্র্রের ক্ষমতা সমাজের আর সব ক্ষমতার উপরে। সবার উপরে রাষ্ট্র সত্য তাহার উপরে নাই_ এটি হচ্ছে আধুনিক চণ্ডীদাসের স্ল্নোগান। প্রথাগত সমাজতন্ত্রেও একই চেহারা। পার্টির বা এর পলিটব্যুরো সেখানে ক্ষমতার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। তুলনায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশে অনেক বেশি বিকেন্দ্রীভবন থাকলেও সেখানেও রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী-নির্ভর সরকার ব্যবস্থা কেন্দ্রাতীগ ক্ষমতার প্রায়োগ করে থাকে। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের পর এক বিশ্বের ধারণা সারাবিশ্বে ক্ষমতার এককেন্দ্রিক প্রয়োগকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। বিশ্বব্যাংকে বিশ্বের প্রায় সব দেশই সদস্য। কিন্তু সেখানে এক দেশ এক ভোট প্রথা নেই। বিশ্বব্যাংকের তহবিলে যার হিস্যা যত বেশি তার তত বেশি ভোট। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে একাই প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভোটে ক্ষমতাবান। অর্থাৎ সবই সমান, বলা হলেও আধুনিক গণতন্ত্রে কেউ কেউ ‘বেশি সমান’। এ ধরনের গণতন্ত্রে এক মানুষ-এক ভোট ব্যবস্থার পরিবর্তে কার্যত প্রবর্তিত হয় এক ডলার-এক ভোট ব্যবস্থা অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষমতা যার যত বেশি তার হাতে তত বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের পটভূমিতে স্টিগলিৎজ মহাশয় এই বিষয়টিকে নতুন করে সামনে এনেছেন।

আধুনিকতার এই দ্বিতীয় দাবিটিকেও মেনে নিতে পারেননি উত্তর-আধুনিকেরা। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এ কালের পুঁজিবাদের সঙ্গে সেকালের পুঁজিবাদের পার্থক্য ঘটে গেছে গত কয়েক দশকে। সেকালের পুঁজিবাদে ক্ষমতার প্রয়োগ হতো এক-কেন্দ্র থেকে। কিন্তু এ কালের পুঁজিবাদে ক্ষমতা আর এক কেন্দ্রে সীমিত নেই; ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র ও উৎস ছড়িয়ে আছে নানা স্থানে। এটি ছড়িয়ে আছে স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্বাস্থ্যনিবাসে, জেলখানায়, পুলিশ ও সামরিক দপ্তরে, পরিবারের ভেতরে, বাজারের সিন্ডিকেটে, টেলিভিশনের চ্যানেলে, পত্রিকার সম্পাদকীয়তে, খেলার মাঠে অর্থাৎ ক্ষমতা প্রায় সর্বত্র বিরাজমান। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রভুত্বশীল শ্রেণীর ক্ষমতার চর্চাকে পূর্ণ গণতন্ত্রায়ন করতে গেলে বা জনমানুষের স্বার্থের সম্পূর্ণ অনুকূলে নিতে গেলে শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতাকে বা রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্রায়ন করলে চলবে না। সমাজের আর বাদবাকি যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা উপরে উল্লেখ করা হলো তার প্রতিটাতেই গণতন্ত্রায়ন সাধিত হতে হবে। মিশেল ফুকো যেমন দাবি করেছেন, ক্ষমতা শুধু কেন্দ্রে থাকে না; এটা বহমান রয়েছে শিরায়-উপশিরায়-তন্তুতে_স্নায়ুকোষে-ডিএনএ-তে। উত্তর-আধুনিকেরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতার এই সর্বব্যাপী অস্তিত্বের কারণে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলালেই ক্ষমতার অবলুপ্তি ঘটে না, এতে করে বড়জোর ক্ষমতার হাতবদল ঘটে মাত্র। এই সূত্রে তাঁরা প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মধ্যে ক্ষমতার আরও বোঝা হয়ে ‘গেড়ে বসাকে’ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। জারতন্ত্র সরিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলেও ক্ষমতার দাপট কমেনি। পার্টি ও রাষ্ট্রের একশ্রেণীর আমলাদের হাত দিয়ে ক্ষমতার চর্চা চলেছে। এর কারণ, সমাজের নানা স্তরে জারতন্ত্রের শেকড় রয়ে গিয়েছিল অথবা নতুন করে পার্টিতন্ত্র সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার ক্ষমতার শেকড় ছড়িয়েছিল। মার্কস কথিত ‘ফ্রি এসোসিয়েশন অব ফ্রি প্রোডিউসার্স’ আর করা যায়নি। এ তো গেল প্রথাগত সমাজতন্ত্রের কথা। উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ক্ষেত্রে ক্ষমতা চর্চার আরও সূক্ষাতিসূক্ষ্ম শেকড়ের প্রতি ইঙ্গিত করেন ফুকো ও তার অনুসারীরা। যেমন ফুকোর একটি প্রসিদ্ধ বক্তব্য হচ্ছে, ক্ষমতাসীনেরা টিকে থাকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়, সত্য-উদ্ভাবনের মাধ্যমে। বস্তুগত উৎপাদনের মতো ‘সত্য-উৎপাদন’ পুুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য। এসব সত্য আপাত দৃষ্টিতে স্থান-কাল নিরপেক্ষ উদাহরণ মনে হলেও এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে ক্ষমতা-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। আবদুল মান্নান সৈয়দ যেমন লিখেছিলেন, ‘সত্যের মত বদমাশ’। এমনকি নিরীহতম গবেষণা-কাণ্ড যেটি তার মধ্য দিয়েও এমন সব সত্য উদ্ভাবন বা নির্মাণ করা হচ্ছে যার আসল লক্ষ্য_ মানবকে আরও বেশি করে শাস্ত্রের অধীনে আনা, এনে তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা, তাকে মুক্ত করা নয়। ফুকো যেমন চিকিৎসা-শাস্ত্রের ইতিহাস ঘেঁটে জানিয়েছেন, ‘স্বাভাবিক’ ও ‘অস্বাভাবিক’ ব্যবহারকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে নতুন মনোবিদ্যায়। ব্যবহারের ‘স্বাভাবিকীকরণের’ [নর্মালাইজেশন] মাধ্যমে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সংক্ষুব্ধ শক্তিকে বশীভূত করা হয়েছে বিভিন্ন বিদ্যার, বিজ্ঞানের, রীতির, আচারের সমবেত প্রয়োগের মাধ্যমে। এর ফলে এক পর্যায়ে খাঁচার সব দরোজা খুলে দিলেও বনের পাখি আর উড়ে যেতে পারছে না_ স্বেচ্ছায় সে থেকে যাচ্ছে গৃহপালিত পাখি হিসেবেই।

উত্তর-আধুনিকেরা এই সত্য-উৎপাদনের তত্ত্ব ও তার ফল-পরিণামের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক হিসেবে ফিরে যাচ্ছেন আন্তোনিও গ্রামসির সর্বেশ্বরতার [হেজিমনি] তত্ত্বে। আল থুসারের ‘আইডিওলজিক্যাল এপারেটাস অব স্টেট’ ধারণারও এটি কিছুটা অনুবর্তী। তবে গ্রামসি ও আল থুসার দুজনেই সত্য [বা ভাবাদর্শ] উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্র-ক্ষমতার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচ্ছন্ন প্ররোচণা হিসেবে দেখেছিলেন। উত্তর-আধুনিক তাত্তি্বকদের কাছে, সত্য-উৎপাদন কেবল রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন চক্রের সজ্ঞান ষড়যন্ত্রের পরিণাম নয়। রোগ-জীবাণুর মতো তত্ত্ব বা সত্য নিজেই ক্ষমতার ধারক-বাহক হয়ে উঠতে পারে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে_ তাতে রাষ্ট্রের বিশেষ দপ্তরের ষড়যন্ত্রের বা সালতামামির প্রয়োজন নেই। এর মধ্য দিয়ে উত্তর-আধুনিকেরা নিজস্ব মূল্যেই তত্ত্ব নির্মাণ, মতাদর্শ প্রচার, বিশ্বাস ও ভাবাদর্শ_ জ্ঞানচর্চার যে কোন রূপকেই_ আরও বেশি ঘনিষ্ঠ ভাবে, জোরালো ভাবে, বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

তবে একটি প্রশ্নে আধুনিকতাবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী উভয়েই এক-অবস্থানে। উভয়েই মনে করেছেন যে একালের পুঁজিবাদে সবকিছুই পরিণত হয়েছে পণ্যে। শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান মানব-সৃষ্টির কোনো শাখাই আর মার্কস-কথিত পণ্যমোহবদ্ধতার [কমোডিটি ফেটিশিজম] বাইরে, থাকছে না। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, সব কিছুই যদি পণ্য হয় [যেমন চে গুয়েভারার বিপ্লবী প্রতিকৃতির পোস্টার] তাহলে মানব-মুক্তি আসবে কোন পথে? যদি সমাজের সব খাতই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়ে থাকে তাহলে প্রতিরোধ দানা বাঁধবে কি করে? এর উত্তরে ফুকো বলেছিলেন, যেখানেই ক্ষমতা সেখানেই প্রতিরোধ দানা বেঁধে ওঠে। মানুষের মধ্যে কোথাও স্বভূমির অস্তিত্ব থেকে যায় সমস্ত বন্দিদশার মধ্যেও। যেখানে পাখা মেলে মুক্তির বাসনা। ফুকো নিজেকে কখনো উত্তর-আধুনিক বলে দাবি করেননি। তবে ফুকো বা উত্তর-আধুনিকেরা ‘আধুনিকতার’ যে সমালোচনা নির্মাণ করেছিলেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে। তাঁরা প্রায় কেউই উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের বাইরের তৃতীয় বিশ্বের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিতে পারেননি। শেষোক্ত ক্ষেত্রে জোরেশোরে এগিয়ে আসে উত্তর-উপনিবেশিক সমাজের তাত্তি্বকেরা। উত্তর-উপনিবেশিকতাকে [পোস্ট কলোনিয়ালিটি] বিচারের মধ্যে এনে তারা পুঁজিবাদী আধুনিকতার আরেকটি চেহারা তুলে ধরেন। এই চেহারাটি মূলত ‘কপট, প্রতারক ও মায়াবী’ আধুনিকতার, যার মোদ্দা কথা হলো : হয় ছলে, নয় বলে, যে কোনো কৌশলে সাম্রাজ্য বিস্তার করো, অথবা প্রয়োজনে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম_ এমন শক্তিকে যে কোনো উপায়ে দুর্বল করে দাও। বাংলার উপনিবেশিক আমলের একটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় টেনে আনছি। এর মধ্য দিয়ে উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশের পরিসরে আধুনিক ক্ষমতা-সম্পর্কের ‘কপট প্রতারক ও মায়াবী’ চরিত্রটি কিছুটা হলেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

৪. আধুনিকতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ

উনিশ শতকের তিরিশের দশকের কথা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলছে। উপনিবেশ ভারতের শিক্ষাদানের ভাষা, পাঠ্যসূচি ও সাহিত্য কীভাবে গড়ে তোলা উচিত তা নিয়ে জোর তর্ক চলছে ইংরেজদের মধ্যে। তর্কটা হচ্ছে ওরিয়েন্টালিস্ট ও এংলিসিস্টদের মধ্যে। কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনের সদস্যরা এ নিয়ে প্রায় সমান ভাগে বিভক্ত। ১৮৩৫ সালে লিপিবদ্ধ এর কার্যবিবরণী থেকে জানা যাচ্ছে, কমিটির অর্ধেক সদস্যরা ইংরেজিতে শিক্ষাদানের পক্ষে রায় দিয়েছেন। বাকি অর্ধেকের রায় নেটিভদের মধ্যে প্রচলিত শিক্ষারীতির পক্ষে। আরবি ও সংস্কৃত ভাষায় পাঠদান অব্যাহত থাকুক_ এটাই তারা চাইছেন। তরুণ জন স্টুয়ার্ট মিলও এই শেষোক্ত দলের পক্ষ হয়ে কলম ধরেছেন। এই বিতর্কের দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছেন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক নিজেও। বিদগ্ধ টমাস বেবিংটন ম্যাকলে চান নেটিভদের মধ্যে এংলিসিস্ট সাহেবদের একটি দেশীয় শ্রেণী গড়ে তুলতে। তাঁর লক্ষ্য, উপনিবেশ ভারতে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে কেবল ইউরোপীয় সাহিত্যের পাঠদান করা। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এ পথেই কেবল শিক্ষার বিস্তার ঘটতে পারে উপনিবেশে। আলোকপ্রাপ্তি হতে পারে স্থানীয় অধিবাসীদের। এভাবেই বর্বরতার যুগ থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে আধুনিকতায়। বিতর্কের এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাকলে সাহেব যা বললেন, তা পরবর্তী প্রজন্মের ইংরেজ শাসকদের জন্য ‘ম্যানিফেস্টো’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মোটা দাগে সেটা শোনালো এ রকম : ‘আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আসলে কোন ভাষা জানাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? অবশ্য সংস্কৃত বা আরবি কোনো ভাষাই আমার জানা নেই। তবে, এসব ভাষার কতটুকু অন্তর্নিহিত মূল্য তা যাচাইয়ের জন্য যা করার তার সবই আমি করেছি। আরবি ও সংস্কৃত ভাষা থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ গ্রন্থগুলো আমি পড়েছি। যারা এসব ভাষায় কথা বলে থাকেন তাদের সঙ্গে আমি আলাপ-আলোচনা করেছি। যারা প্রাচ্যবিদ বলে পরিচিত, প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে তাদের জ্ঞানকে আমি মান্য করি। এসব প্রাচ্যবিদের মধ্যে আমি আজ পর্যন্ত একজনকেও পাইনি যিনি অস্বীকার করেছেন যে, একটি ভালো ইউপরোপীয় গ্রন্থাগারের যে কোনো তাকও ভারতবর্ষ ও আরব ভূভাগের সমগ্র নেটিভ সাহিত্যের সমান মূল্যবান!’ ম্যাকলে সেদিন যা বললেন, তার একদশকের মধ্যে বাংলায় শুরু হলো ‘রেনেসাঁ’। ১৮৫০-এর দশকে রেলগাড়িও এলো এদেশে। এরপর থেকে গ্রাম হয়ে গেল অজপাড়া-গাঁ, আর শহর হয়ে পড়ল আধুনিকতার কেন্দ্র। সেদিনের নবজাগরণের নায়কেরা ম্যাকলের কথাতেই আস্থা আনলেন। তাঁদের সবারই স্বপ্ন ছিল, ম্যাকলে বর্ণিত ইউরোপীয় ভাষা-সাহিত্য-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ওপর ভর করে ‘আধুনিক জাতি’ হিসেবে একদিন জগৎ সভায় তাঁদের সমাজ স্থান করে নেবে। ঔপনিবেশিক চিন্তার সঙ্গে আমাদের নাড়ির বন্ধনের সেখানেই সূত্রপাত। আধুনিকতার স্বপ্ন দেখার শুরু সে সময়েই। বিষয়টা তাহলে দাঁড়াচ্ছে_ আমাদের জীনের সমস্যা।

এর পরবর্তী একশ বছর ধরে ‘আধুনিক’ শব্দটা এতটাই প্রবলভাবে আক্রান্ত করেছিল আমাদের যে তা’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘সভ্যতা’ বা সিভিলাইজেশনের নামান্তর। উনিশ-বিশ শতকের ভদ্রসম্প্রদায় বা ভদ্রলোক এসব শব্দবন্ধের মধ্যে যে ভদ্রতার ‘ধারণা’ মিশে ছিল তাকে ওই আধুনিকতার বাইরে আর কল্পনা করা যাচ্ছিল না। যুক্তিটা ছিল এ রকম : প্রাগ-আধুনিকেরা প্রাচীনপন্থি, রক্ষণশীল, পুরনো সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ জীব; যেন তারা প্রায় অসভ্য, আন-সিভিলাইজড। এর বিপরীতে আধুনিকেরা হচ্ছে প্রগতিপন্থি, চলতি হাওয়ার দল, বিজ্ঞানমনস্ক, জাত-পাত না-মানা বিদ্রোহী; যেন তারাই একমাত্র সভ্য, সিভিলাইজড। এ রকম দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ল বাংলার বিদ্বৎসমাজ_ প্রথমে হিন্দুরা, পরে একপর্যায়ে এই বিভক্তি দেখা দিল কালক্রমে মুসলমান সমাজেও। অবশ্য কারও কারও মতিভ্রমও হলো_ একবার কেউ এ দলে নাম লেখালেন, আরেকবার অন্য দলে ভিড়ে গেলেন। যেমনটা হলো কেশবচন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র ও মীর মশাররফ হোসেনের ক্ষেত্রে। কিন্তু আধুনিকতাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের শিবিরবিভক্তির কয়েকটি বেদনাদায়ক ও সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া দেখা গেল অন্যত্র, যার প্রভাব বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য ভালো হয়নি।

প্রথমত, ইউরোপীয় ধারা মেনে চললে আধুনিক, নইলে তা রক্ষণশীল ও অনাধুনিক_ এ রকম একটি চটকজলদি সমীকরণ তাঁবু গাড়ল প্রথাগত জ্ঞানচর্চায়। এমনকি মনের ভুবনেও_ সেটা কিছুটা জ্ঞাতসারে, কিছুটা অজ্ঞাতসারে। প্রাগ-আধুনিক হয়েও তো সভ্য, ভদ্র ও বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায়। যেতে পারে। এ রকম সম্ভাবনাকে মেনে নেওয়া আর সহজে সম্ভব হলো না। শুধুমাত্র এই কারণেই ভূদেব মুখোপাধ্যায়_ যিনি ধর্ম ও পরিবার চিন্তায় সনাতনীয় হলেও ছিলেন হিন্দু ও মুসলমান এ দুই ধর্মের মধ্যে ব্যবহারিক, জ্ঞানগত ও আত্মিক যোগসূত্র স্থাপনে বিশ্বাসী ও উদগ্রীব_ তার সমসাময়িক বঙ্কিমের মতো তেমন কোনো গুরুত্ব পেলেন না বাংলার বিদ্বৎসমাজে। বঙ্কিমকে উপর্যুপরি ‘আনন্দমঠ’ ও ‘কৃষ্ণচরিত্র’ লেখার পরও সে রকম কোনো অপযশ কুড়াতে হলো না তাঁর স্বধর্মীদের কাছ থেকে। অথচ, ভূদেব ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’-এর মতো মৌলিক গ্রন্থ লিখেও পেলেন না সামাজিক বিজ্ঞানীর যথাবিহীত সম্মান। অর্থশাস্ত্রে বঙ্কিমের তুলনায় তাঁর অধিকতর বুৎপত্তিও আড়ালেই থেকে গেল। এর কারণ, বঙ্কিমচন্দ্রকে বরাবর দেখা হয়েছে ঔপনিবেশিক ভারতের এক পথিকৃৎ ‘আধুনিক চিন্তক’-এর ভূমিকায় [যে আধুনিকতার সংজ্ঞা আবার উপযোগবাদী মিল বেন্থাম দ্বারা নির্দিষ্ট]।

দ্বিতীয়ত, প্রাগ-আধুনিক মানেই প্রাচীনপন্থি ও রক্ষণশীল এ রকম মনে করার কারণে যা-কিছু ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের বাইরে, তাকেই অস্বীকার বা খাটো করে দেখার একটা প্রবণতা দেখা দিল। মহামতি কৌটিল্য যে কিসিঞ্জারের মতোই ‘আধুনিক’ হতে পারেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা তত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিস্তারে সে সম্ভাবনাকে আমলে নেওয়া হলো না। আকবর বাদশাহ ও আবুল ফজল মিলে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে নমুনা খাড়া করেছিলেন তা ইউরোপীয় ‘সেক্যুলার’ আদর্শের তুলনায় কোনো অংশে কম আদরণীয় অর্জন ছিল না_ সেটাও আমরা অনেককাল পর্যন্ত মনে রাখিনি। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে চেষ্টা করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য_ বিশ্ব সভ্যতার এ দুই ঐতিহ্যের মধ্যে সভ্যতার ‘সমকক্ষতা’ প্রতিষ্ঠা করতে। ইউরোপের মানবতন্ত্রের সাথে বাংলার আউল-বাউল-সহজিয়া ধারার ‘মনের মানুষ’-এর মানবতন্ত্রের মধ্যে ‘সমকক্ষতা’ প্রতিষ্ঠা করা ও তাঁর দর্শনচিন্তার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। এককথায়, তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপীয় আধুনিকতার সঙ্গে বাংলার আধুনিকতাকে সমকক্ষতার ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করতে। কিন্তু তার কথা আমরাও শুনতে চাইনি, আর ইউরোপীয় মনীষা শুনতে চাইলেও তা বুঝতে অপারগ থেকেছে। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো রবীন্দ্রনাথও যে মুক্ত-চিন্তক বা ‘ফ্রি-থিংকার’ হতে পারেন, সেভাবেও আমরা তাকে বিচার করতে পারি_ সেসব কোনো সম্ভাবনা আমাদের মনে জাগেনি। ১৮৩৫ সালের কার্যবিবরণীতে ম্যাকলে তাঁর ভাষণে যেমন বলেছিলেন, প্রাচ্যের আছে কেবল কিছু মহান কবি, কিন্তু তারা তো কল্পনার রাজ্যে বিরাজ করে থাকেন মাত্র। জ্ঞানের রাজ্যে তাদের কোনো দক্ষতা নেই। রবীন্দ্রনাথকেও আমরা সেভাবেই কমবেশি কবির শিরোপা পরিয়ে দিয়ে জ্ঞানচর্চার মূলক্ষেত্র থেকে সরিয়ে রেখেছি।

প্রাগ-আধুনিককে খাটো করে দেখার কারণে তৃতীয় যে সমস্যা দেখা দিল তা হলো, ইউরোপীয় আধুনিকতাকে বাস্তবের চেয়ে অনেক বড়ো ও মহার্ঘ করে আমরা দেখতে শুরু করলাম। এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। এখনও বিশ্বব্যাংক বা মার্কিন দূতাবাস বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু বললে আমরা ‘তা ঠিক, তা ঠিক’ করতে থাকি। উপনিবেশে ইউরোপ যেসব নিয়ম-কানুন, রাষ্ট্রযন্ত্র, তত্ত্ব ও আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা শুরু করল তাকেই আমরা নির্বিচারে মেনে নিতে শুরু করলাম ‘আধুনিক মানুষ’ হওয়ার সাধনায়। ইউরোপ যখন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর গুরত্ব দিতে শুরু করল উনিশ শতকে, উপনিবেশে তারা গ্রহণ করল ভিন্ন নীতি। এ ক্ষেত্রে তারা নিল কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতাবান করার নীতি। সেই পথ ধরে আমরাও ভাবতে শুরু করলাম যে, আধুনিক রাষ্ট্র মানে আসলে এটি একটি কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা। ইউরোপ উনিশ শতকের শেষ থেকে নিজের দেশে আস্তে আস্তে গণশিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, গণস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবস্থা চালু করতে শুরু করল। কিন্তু উপনিবেশে সেসব ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠাই পেতে দিল না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রে স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতো ইউরোপীয় শাসকদের কেউ কেউ আদিতে চেয়েছিলেন কৃষিতে স্ব-আবাদি ব্যক্তি মালিকানাধীন খামার প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু কার্যত যা গড়ে উঠল তা হচ্ছে এক আধা-সামন্তবাদী ব্যবস্থা, যার মূল অভিপ্রায় ছিল এক অনুগত ও বাধ্যগত দেশীয় শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা করা। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার আশ্রয়েই এ দেশে গড়ে উঠল এক জনবিচ্ছিন্ন কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র যেটা আদৌ খোদ ইউরোপে প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল না। এককথায়, ঔপনিবেশিক আধুনিকতাকেই ‘আধুনিকতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত’ মনে করে আমরা না-পেলাম প্রাগ-আধুনিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ মনীষার ছায়া, না-পেলাম ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের সেরা অন্তর্দৃষ্টি। এর বড় প্রমাণ, প্রত্যক্ষ উপনিবেশের অবসানের পরেও আমরা নিজেদের মতো করে উন্নয়ন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদি ভাবতে ও গড়ে তুলতে উদ্যোগী হলাম না। ‘ইউরোপ উদ্ভাবন করবে এবং আমরা কেবল তার প্রয়োগ করব’, অর্থাৎ আমরা চিরকালই থাকব হাত পেতে_ এই মানসিক ছক থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমাদের হলো না। আমরাও অনেক খাতে উদ্ভাবন করব এবং বাদবাকি বিশ্ব তা প্রয়োগ করবে_ এ রকম কোনো জ্ঞানভিত্তিক অভিমান আমাদের মধ্যে আজও এলো না। ফলে একজন দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ, একজন দ্বিতীয় সত্যেন বোস, একজন দ্বিতীয় মুহাম্মদ ইউনূস_ যারা সারা বিশ্বে বঙ্গ, বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশকে সৃষ্টিশীলতার মানদণ্ডে অতীতে ও সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠা করেছেন_ তারা শুধু ব্যতিক্রমী উদাহরণই হয়ে থাকলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কত কথা হচ্ছে এখন। বলা হচ্ছে, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। অথচ আজকের ঢাকা শহর যতই ‘আধুনিক’ বলে নিজেকে দাবি করুক না কেন, এখানে আজও প্রতিষ্ঠা পায় না অন্তত একটি দ্বিতল বা ত্রিতল বই-পত্রের ভবন, যেখানে থাকবে নানা দেশের ও শাস্ত্রের বই, যার নিকটতম তুলনা হতে পারে আমেরিকা বা ইউরোপের কোনো বার্নস-এন্ড-নোবলস বা ওয়াটারস্টোনস। অর্থাৎ আধুনিকায়নের মন্ত্রটাও আমরা সঠিকভাবে আওড়াতে পারিনি।

আধুনিকতার মূল সমস্যাটা রামমোহন রায় বা দ্বারকানাথ ঠাকুর ঠিকই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ইউরোপীয় বা বৃহত্তর অর্থে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, সে যা বলে, যা আদর্শ হিসেবে প্রচার করে, সেটা সে আসলে মেনে চলতে চায় না। অর্থাৎ নিজের খেলার নিয়ম সে নিজেই বারবার ভাঙে। এটা রামমোহনের বুঝতে দেরি হয়নি। রামমোহন যেমন ছিলেন আপাতদৃষ্টিতে ম্যাকলের পক্ষে। তাঁর যুক্তি ছিল, উপনিষদ, ইসলাম ও ইউনিটেরিয়ান চার্চের মধ্যে রয়েছে একেশ্বরবাদী মতাদর্শের ঐক্য। ইংরেজরা যদি ইংরেজি স্কুল ও ইংরেজি মাধ্যমে বিদ্যাদান করতে চায়, তবে তাই হোক। কিন্তু রামমোহনের শর্ত হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ করা চলবে না_ চাই সবার জন্যে ইংরেজি শিক্ষা, চাই বেশি বেশি করে স্কুল, গুণগত মানের স্কুল। রামমোহন অনুসারী দ্বারকানাথও চেয়েছিলেন, বাংলায় শুধু বণিক-পুঁজির নয়, শিল্প-পুঁজিরও বিকাশ হোক। তিনি নিজে ছিলেন ১৮৩০-৪০ দশকের সবচেয়ে প্রাগ্রসর ব্যবসায়ী_ প্রথম বৃহৎ বাঙালি বুর্জোয়া।

প্যারিসের এক হোটেলে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দ্বারকানাথ জানিয়েছিলেন, প্রথাগত ধর্মীয় আচার-বিচার তিনি মানেন না এবং প্রয়োজনে তিনি ইউরোপীয় যুক্তিবাদী আদর্শে ভারতীয় সনাতন ধর্ম-কর্মকে বদলে নিতেও রাজি। এ জন্যে তিনি পণ্ডিতবর্গকে মাইনে দিয়ে পুষছেনও। তারপরও একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কিছুটা মতানৈক্য হয়েই গেল পণ্ডিতপ্রবর ম্যাক্সমুলারের। তার সমসাময়িকদের কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে ম্যাক্সমুলারকে ডাকতেন ‘মোক্ষমুলার’, যেন এই জার্মান পণ্ডিতের লেখা পড়লে মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটবে। দ্বারকানাথ স্রেফ জানিয়ে দিলেন_ এবং গেয়েও শোনালেন_ ম্যাক্সমুলার ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের কিছুই বোঝেন না, কিন্তু তিনি ঠিকই পাশ্চত্যের রাগ-সঙ্গীত বোঝেন ও এর রস গ্রহণে পুরোপুরি সক্ষম। অর্থাৎ বিদ্যার্জনে বরং দ্বারকানাথ কিছুটা এগিয়েই ছিলেন। পাশ্চাত্যের আধুনিকতা আত্মস্থ করেও আমাদের বাড়তি কিছু দেওয়ার এখনও বহুকিছু আছে. যেমন ম্যাক্সমুলারের মতো পণ্ডিতকেও শেখানোর মতো কিছু ছিল দ্বারকানাথের।

রামমোহন-দ্বারকানাথের যৌথভাবে নির্মিত আধুনিকতা-প্রকল্পের ফাঁদে অবশ্য পা দেয়নি সদাসতর্ক ঔপনিবেশিক শক্তি। ইংরেজি ভাষাকে জনগণের স্তরে ছড়িয়ে পড়তে দেয়নি ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী। বাংলায় ইংরেজি স্কুলের সংখ্যা ছিল বরাবরই অতিসীমিত, এখনও তাই। তাছাড়া সাধারণভাবে এ দেশে স্কুলের প্রসারই ছিল সীমিত। অন্যদিকে বিদেশি রীতিনীতি মেনে কারবারি ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন এনে এ দেশের শিল্প-বাণিজ্যকে গতিশীল করতে চেয়েছিলেন দ্বারকানাথ। ১৮৪৭-এর বিশ্ব স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের পর বাংলার শিল্পখাত আর সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত। বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তি মুখে বলেছে যে তারা চায় অবাধ বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠা, কিন্তু কার্যত তারা শিল্পায়নকে আরও নিরুৎসাহিতই করেছে এই পর্বে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনামূলক সুবিধাতত্ত্ব জন স্টুয়ার্ট মিলের পাঠ্যবইয়ে বড় আকারে থাকলেও উপনিবেশে এর প্রয়োগ হয়েছিল অত্যন্ত বেদনাদায়কভাবে। আধুনিকতা ও পুঁজিবাদ ‘তার নিজের আদলে বিশ্বকে গড়ে নিতে চায়’_ এনলাইটেনমেন্টের এই মন্ত্রে পুঁজিবাদ নিজেই বিশ্বাস করেনি। পুঁজিবাদ বা আধুনিকতা ‘যা বলে সে আসলে তা না’। যখনই পাশ্চাত্যের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেছে, খেলার নিয়ম ভাঙা হয়েছে, অথবা নতুন নিয়মের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গ সূত্রে বলে রাখি, পুঁজিবাদের খেলায় ক্রমশ ‘সমকক্ষ’ হওয়ার সাধনায় নামা চীন এখন রামমোহন-দ্বারকানাথের সমস্যাটা নতুন করে বুঝতে পারছে। আধুনিকতা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিশ্বকে সেটা সে রক্ষা করেনি। আসলে সেরকম প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সে পারে না, কেননা তা পুরোপুরি রক্ষা করতে গেলে ক্ষমতার চর্চা করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর ক্ষমতা প্রয়োগই তো আধুনিকতার অপ্রকাশ্য লক্ষ্য। উত্তর-আধুনিকবাদী দার্শনিকদের এই সমালোচনা মানি না মানি কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার নয়।

দারিদ্র্য কমলেও আয়-বৈষম্য বাড়ছে

সমকাল প্রতিবেদক
শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে দারিদ্র্য কমেছে। এটি গর্বের বিষয় হলেও আত্মতুষ্টির কিছু নেই। কেননা দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি ধনী-গরিবের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। শহর এবং গ্রামে উভয় ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। মূলত সম্পদের অসম বণ্টন ও অবৈধ আয়ের উৎসের কারণে আয় বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন তারা। ‘দারিদ্র্য বিমোচন : কোথায় আমাদের অবস্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খোন্দকার। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু কাওসার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিই আমাদের উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতি কমাতে পারলে জনগণ উন্নয়নের সুফল আরও বেশি পেত। প্রায় তিন ঘণ্টার প্রাণবন্ত আলোচনায় দারিদ্র্যের কারণ এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে হলে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। কারণ আয় বৈষম্য থেকে দারিদ্র্যের উৎপত্তি। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ার পেছনে কারণগুলো তুলে ধরেন বক্তারা।

তারা বলেন, প্রভাবশালীরা জমি দখল, জলাশয় দখল করে সম্পদ তৈরি করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। এসব অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীদের সম্পদ আরও বাড়ছে। অথচ গরিবের কাজের সুযোগ নেই, শিক্ষা নেই, ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, ব্যাংক থেকে ঋণের সুযোগও তাদের নেই। ফলে দরিদ্র মানুষগুলোর জীবনের পরিবর্তন হচ্ছে না। দারিদ্র্য দূর করতে উৎপাদনমুখী কাজে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তারা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খোন্দকার অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, গুলশান ক্লাবে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। যারা জুয়া খেলার পেছনে কোটি টাকা খরচ করে বুঝতে হবে তারা কত বড়লোক। তিনি বলেন, দারিদ্র্য মাপার বিষয় নয়, এটি অনুধাবনের বিষয়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা অনুধাবন করা গেলে সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মন্ত্রী বলেন, ২০০৫ সালের তুলনায় দারিদ্র্য আরও কমেছে। শিগগির এ ঘোষণা দেওয়া হবে।

ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব এখনও প্রকাশ করা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়াতে পারে ৩২ শতাংশ। যদি তাই হয় তাহলে দুই বছরে কমবে ৮ শতাংশ, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কারণ নেই। আমাদের এখনও অনেক কিছু করণীয় আছে।

অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন বলেন, দারিদ্র্য কমেছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হলেও সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যার একটি ফ্ল্যাট ছিল তার ১০টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। অথচ গরিবরা ক্রমেই গরিব হচ্ছে। আয়কর ফাঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল, ঋণ পরিশোধ না করা ইত্যাদি অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতে হলে বৈষম্য কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত ৫ কোটি লোক দরিদ্র। কাজেই আমাদের আত্মতুষ্টির কারণ নেই। দারিদ্র্য কমাতে হলে গরিবদের উৎপাদনমুখী কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি। ড.ফরাস উদ্দিন মনে করেন, দারিদ্র্যের মূল কারণ কাজের সুযোগের অভাব। যারা গরিব তাদের সম্পদও নেই, নেই কাজের সুযোগও। দারিদ্র্যকে বহুমাত্রিক অভিশাপ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। দারিদ্র্য কমাতে শিক্ষা বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ভোকেশনাল শিক্ষা ফ্রি করার প্রস্তাব করেন তিনি।

ড. সেলিম রায়হান দারিদ্র্য হ্রাসের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ১৯৯০-এর দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০০০ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। ২০০৫ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ। এলডিসিভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ অগ্রগতি অনেক ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অর্জন কম নয় কেলেঙ্কারিও আছে

জাকির হোসেন

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিশ্ব অর্থনীতি ছিল মন্দার কবলে। আশঙ্কা করা হয়েছিল_ মন্দার বিলম্বিত প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষত রফতানি ও রেমিট্যান্স খাত বড় ধাক্কা খাবে। এ আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়নি। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের চেষ্টার পাশাপাশি মন্দা মোকাবেলায় সরকারের সহায়কনীতি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার অর্থবছরে (২০০৮-০৯) রফতানিতে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়। পরের প্রতিটি অর্থবছরে রফতানি আগের তুলনায় বেড়েছে। বলা যায়, সরকারের চার বছরে সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। এ সময়ে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়; কমেছে দারিদ্র্য হার। কৃষি উৎপাদনে ভালো সাফল্য এসেছে।
গত চার বছরে অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। তবে শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্কের মতো একের পর এক কেলেঙ্কারি অর্থনীতির সাফল্যকে ম্লান করেছে। এ ছাড়া সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবেশের

সূচকে কিছুটা অবনতি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিরও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্থনীতির জন্য নানা সংস্কারের ব্যাপক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বেসরকারিকরণ, প্রশাসনে দক্ষতা, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংস্কার ত্বরান্বিত হয়নি।

মতামত জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মন্দা-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। এ সময়কালে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রশংসাযোগ্য। রফতানি বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের আরও অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন চীনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক। কৃষি প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটা দাগে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়নি। তারপরও জনমনে কিছু বিষয়ে অসন্তুষ্টি আছে।

কী সেই অসন্তুষ্টি_ জানতে চাইলে বিনায়ক সেন বলেন, গত দশকে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। ফলে মানুষের প্রত্যাশার চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সে চাপের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংস্কৃতি তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মানুষ দিনবদলের সরকারের কাছে আরও কিছু প্রত্যাশা করেছিল। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল, একটা কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। বিনিয়োগে বড় ধরনের অগ্রগতির কথা ছিল, যা হয়নি। বিনিয়োগের হার গত কয়েক বছরে একই রকম রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এডিপি বাস্তবায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রত্যাশিত সংস্কার হয়নি। শেয়ারবাজারে ধস, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের তহবিল লোপাটসহ কিছু বিষয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর্থিক খাতের নানা সংকট সামষ্টিক অর্থনীতিকে মাঝে মধ্যে ঝামেলায় ফেলেছে।

একের পর এক কেলেঙ্কারি :অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার শেয়ারবাজারে ধসের মাধ্যমে প্রথম বড় ধাক্কা খায়। ২০১০ সালের শেষে বড় ধরনের ধস নামে শেয়ারবাজারে। ফুলে-ফেঁপে ওঠা সূচকের ধারাবাহিক পতনে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এই ধসের পেছনে একটি প্রভাবশালী অশুভ চক্রের কারসাজি ছিল, যা পরবর্তীকালে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে। গত দুই বছরে সরকারের নানা পদক্ষেপেও শেয়ারবাজারের সংকট দূর হয়নি। বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থাবান হতে পারছেন না।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর পদ্মা সেতু নিয়ে বিপাকে পড়ে সরকার। মহাজোট সরকারের চার বছর নিয়ে সমকালের সাম্প্রতিক এক জরিপে বেশির ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে জটিলতার প্রধান দায় সরকারের।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ফলে আর্থিক খাতে সরকারের মনোযোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগের কারণে সরকার সমালোচিত হয়। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে একটি চক্র জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ করে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হলমার্কই নেয় দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এটি ছিল ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে ডেসটিনি গ্রুপও নানা কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়। এই গ্রুপের এমডিসহ শীর্ষ কর্তারা এখন কারাগারে।

চাঙ্গা হয়নি বিনিয়োগ :জিডিপিতে বিনিয়োগের অংশ ২৪ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও একই হারে বিনিয়োগ হয়। বাংলাদেশকে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর বর্তমান অবস্থায় ওই হারে বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক হিসাবে গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ১৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মনোভাব স্পষ্ট। সম্প্রতি খেলাপি ঋণও অনেক বেড়ে গেছে। ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যেতে পারে।

কিছু স্বস্তিকর পরিসংখ্যান :মন্দার শুরুতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে চলে যায়। এর পরের তিন বছরে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৬৭৬ ডলার। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪৮ ডলার। মন্দা-পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী ছিল। একটি অর্থবছর বাদে এ খাতে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। সরকার বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে পেরেছে। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে।

দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ কমেনি :সমকালের জরিপে প্রশ্ন ছিল_ দ্রব্যমূল্য চার বছর আগের তুলনায় এখন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে কি-না। এর উত্তরে ৫৫ শতাংশ ‘না’ বলেছেন। কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে_ এমন উত্তর দিয়েছেন ৩১ শতাংশ। চালের দাম কিছুটা কমলেও বাস্তবতা এমনই। আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৬২ শতাংশে। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে।

বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, গত এক বছরে মিনিকেট, নাজিরশাইল, আমন, পাইজাম, স্বর্ণাসহ নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের দরকারি চালের দাম কমেছে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। চাল ছাড়া অন্যান্য নিত্যপণ্য যেমন_ আটা, ডাল, সয়াবিন তেল, ডিম, মাছ, মাংস, সবজি প্রভৃতির দাম বেড়েছে।

মধ্যাহ্নের সমাজ

বিনায়ক সেন

১.
কেন মধ্যাহ্ন উপন্যাসটি লিখতে হলো_ তাকে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সময়কে’ ধারণ করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। সচরাচর যেসব বিষয় নিয়ে তার চরিত্ররা মাথা ঘামায় না- রাজনীতি, কাল, সমাজ- সে সবকিছুকে আর গল্পের বাইরে রাখা গেল না। কেননা, গল্পটাই কতদূর এগুলো মানুষ- তা নিয়ে। ১৯০৫ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের সমাজ কীভাবে বদলে যেতে থাকল এ রকম কোনো ইতিহাসবোধে তাকে পেয়ে বসেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি-প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরীফকে জানিয়েছিলেন যে, নিজের জীবন ভাঙিয়ে আর কত উপন্যাস লেখা যায়! সে জন্যেই নাকি তাকে একা এবং কয়েকজন, সেই সময়, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ও ‘প্রথম আলো’র মতো ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জন্য বিষয়টা এমন নয়। তিনি খুব সচেতন প্রয়োজনেই এই ইতিহাস-প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন বোধ করি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ব্যাখ্যাটা এরকম :’আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ [!] এই সব অতি প্রয়োজনীয় [?] বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। ইদানীং মনে হয়, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তো বা ব্রেনের কোথাও শর্ট সার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়_ চেষ্টা করে দেখি, সমস্যাটাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহ্নেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সালে কাহিনী শুরু করে এগুতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তার পরেও…’

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘তারপরেও’ বলতে গল্প ছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে কোনো নতুন সচেতনতার প্রতি কি তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন? আর ইতিহাস-গল্প মিলিয়ে যদি কিছু লিখবেন তাহলে ১৯০৫ সাল থেকেই তা শুরু করবেন কেন? সময় ধরার ইচ্ছের কথা বলছেন, কিন্তু কোন কালপর্বে শুরু করে কোথায় তার যতি টানবেন, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে যে-সময়কে অনুভব করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ অবধি। কেন এই বিশেষ সময়ের টানাপোড়েনের মধ্যে তাকে প্রবেশ করতে হলো_ সেটা একটা প্রশ্ন। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, উপন্যাসটিতে যে সমাজকে তিনি এঁকেছেন, সেই সমাজচিত্র সে সমাজকল্পিত, না বাস্তব_ সে প্রশ্নে পরে আসা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্রটাকে তিনি কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে আঁকলেন? আজকের যুগের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিচালিত সমাজের প্রেক্ষিতে মধ্যাহ্নের সমাজকে মনে হবে কোন অচিনপুরের গল্প_ এক আধুনিক ইউটোপিয়া। এই উপন্যাস ভর করে আছে আদর্শস্থানীয় দুই চরিত্রের ওপরে, যার একজন হরিচরণ সাহা এবং অন্যজন মওলানা ইদ্রিস। এই দুই শুভবোধসম্পন্ন মানুষ_ বস্তুত নিয়ত এবাদতে রত সূফী-সন্তই বলা চলে তাদের_ যারা সবসময়েই কী করে মানুষের উপকার করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত, তারাই উপন্যাসের ঘটনাবলির ওপরে বৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন শুরুর লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের শুরু হয় যে-পুকুরঘাটে, দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ হয় একই পুকুরঘাটে; কেবল শুরুর দৃশ্যে ছিলেন হরিচরণ, শেষের দৃশ্যে মওলানা ইদ্রিস। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র_ ভালো স্বভাবের ও মন্দ স্বভাবের চরিত্ররা সবাই এদেরকে নিয়েই, এদেরকে পাশে রেখেই যার যার জীবন কাটায়, যার যার মতো করে মৃত্যুবরণ করে।

মধ্যাহ্নের সমাজের বড় শক্তি তার অন্তর্নিহিত নৈতিক শ্রেয়বোধ। এর প্রধান উৎস হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিসের মতো মানুষেরা হলেও অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষ যারা, তারাও প্রবল মানবিকতায় আক্রান্ত। তারা পারতপক্ষে অন্যায় করেন না, বা করলেও পরিহার্য বলে আত্মগ্গ্নানিতে ভুগতে থাকেন। জুলেখা, শরীফা, মনিশংকর, শিবশংকর, আতর_ এরা সবাই পৃথিবীতে ভালোমানুষের পাল্লা ভারী করেছে। আর লাবুস তো জুলেখার পুত্র সন্তান হলেও আসলে হরিচরণ-মওলানা ইদ্রিসের আধ্যাত্মিক সন্তান। লাবুস শহরে এলে কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটত, খুবই স্বাভাবিক হতো তার হিমু-হওয়া! তার মানে এই নয় যে, এই সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত ছিল না। সংঘাত-দ্বন্দ্ব-অনাচার ছিল যদিও, কিন্তু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। হরিচরণের নিজের পাটের আড়ত রয়েছে, ‘সাহা’ যেহেতু সেহেতু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা তার উপার্জনের স্বাভাবিক উৎস। সুতরাং বাণিজ্যবিরোধী ছিল না ওই সমাজ। যে অঞ্চল নিয়ে এই উপন্যাস তার হাওরেই সওদাগররা ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় তাদের নৌবাণিজ্যের নাও ভাসিয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্যের ধারা থাকলেও এ ধরনের সমাজে টাকার শক্তিতে মানুষের ক্ষমতাকে মাপা হয়নি। শশাংক পালের মতো জমিদার বা ধনু শেখের মতো কুটিল ব্যবসায়ী মানুষও সমীহ করে চলেছে হরিচরণকে_ সেটা তার অর্থের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি তার নৈতিক স্বভাবের কারণে। আরেকটি দিক হচ্ছে, মধ্যাহ্নের সমাজে স্বার্থপরতাই ব্যক্তির একমাত্র প্রণোদনা নয়; এখানে পরার্থপরতার বোধ সহজাতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বিভিন্ন স্তরে। বলা বাহুল্য, একুশ শতকের আজকের এই অপরাহ্নের সমাজ বাণিজ্যিক বোধের সমাজ। ঊনিশ-বিশ শতকের [অন্তত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ও মোটা দাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত] অপেক্ষাকৃত নির্দোষ পৃথিবীর মূল্যবোধের থেকে আজকের এই সমাজ মৌলিকভাবেই আলাদা। মধ্যাহ্নে অনায়াসে সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণী ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে। এখানে বৃক্ষের অসুখ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, জুলেখা গায় উকিল মুন্সি ও রাধারমণের গান, রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদের হাহাকার, হাওরের ঢেউয়ে বেজে ওঠে। সেটা যে কেবল নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য_ তা মনে করেননি লেখক। ব্যাপক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আদান-প্রদানকে ধারণ করেছিল এই মধ্যাহ্নের সমাজ। সেখানে কোন চিহ্নটা কার, বা কোন গানের লাইনটা কোন সম্প্রদায়ের জীবনবোধ থেকে উঠে এসেছে_ সেটা হিন্দুর নাকি মুসলমানের, মজুরের নাকি অবস্থাপন্ন কৃষকের_ সেটা বের করাটা দুরূহ। ওই সমাজের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসেনি।

এ রকম সমাজের কাহিনী কি ইউটোপিয়ার মতো শোনাচ্ছে? হোক ইউটোপিয়া, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই কল্পকথা নির্মাণে [নাকি বাস্তবেই গল্পটা এভাবেই তিনি শুনেছিলেন] এত শ্রম ও মেধা ঢালবেন কেন? আমার ধারণা, মধ্যাহ্নের ভূমিকায় পুরো কারণটা হুমায়ূন আহমেদ বলেননি। শুধু ‘সময়’কে ধরার জন্য ওই বিশেষ কালপর্বের প্রতি চোখ ফেরাননি তিনি; আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল তার। কোনো অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল আমাদের মন ও মননকে নাড়া দেওয়ার জন্যে। হয়তো উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সমাজের অন্তরাল প্রাণশক্তির উৎস কোথায়, তা দেখানো চোখে আঙ্গুল দিয়ে।

২.
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিষ্কৃতি নাই।’ মধ্যাহ্ন উপন্যাসে সেই পাপকে অবলীলাক্রমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পাপের মধ্যে সহাবস্থানকেই চূড়ান্ত মানেনি। শশাংক পালের মতো অত্যাচারী জমিদারেরা এতকাল নিরীহ রায়তের পেছনে লেগেছে। তার মৃত্যুর পরে ধনু শেখের মতো ব্যবসায়ীরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। শশাংক পালের যোগাযোগ ছিল কোলকাতার প্রশাসনের সাথে, ধনু শেখ নিয়েছে মুসলিম লীগের আশ্রয়। স্বদেশী আন্দোলনের তাড়া খাওয়া বিপ্লবীর হাতে আহত হতে হয় তাকে; শেষ পর্যন্ত এলাকার মানুষই দাঙ্গা ঘটানোর ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাকে দায়ী করে এবং তার ক্ষমতার ভিত দুর্বল করে দেয়। আর শশাংক পালের মৃত্যু হয় কোনো অব্যাখ্যাত ব্যাধিতে। শশাংক পাল_ ধনু শেখের প্ররোচনার কারণে হোক, আর দুই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমে বেড়ে যাওয়া ভেদবুদ্ধির কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মধ্যাহ্নের সমাজেও ঢুকতে থাকে। রাতের অন্ধকারে একদল আরেক দলের লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়, একপক্ষ আরেক পক্ষের জাতিনাশ ধর্মনাশ করে, বাড়িতে আগুন লাগায়, পুলিশের কাছে মিথ্যে মামলা দিয়ে, হুমকি দিয়ে এলাকা পরিত্যাগে বাধ্য করে, নষ্ট মেয়ের অপবাদ দেয়, হাওরের নির্জনে এনে ধর্ষণ করে, জায়গা-জমি বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এসবই হয়, কিন্তু এটা মধ্যাহ্নের সমাজের অন্দরমহলকে ছুঁতে পারে না। কোনো লৌকিক বা অলৌকিক কারণে এর মানুষগুলো পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে।
পরস্পরের পাশে সহায়-সমর্থনের উদাহরণ অনেক এই উপন্যাসে। আমি এখানে দু’একটি উদাহরণ দেব। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মওলানা ইদ্রিস রওনা হয়েছেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের দিকে। পথ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বগুড়ার পরিবর্তে রংপুরে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে রাত হলে তাকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এসেছে একটি হিন্দু পরিবার। লক্ষণ দাসের পরিবার কাছেরই এক মন্দিরের সেবায়েত। ঐ বাড়ীতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার। খাবারেরও ব্যবস্থা হয়েছে_ অবশ্য রাখা হয়েছে উঠানেই। লোকটা তাকে বলেছে, ‘মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।’ মওলানা তাতেই খুশী। তিনি নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে দোয়া চাইলেন যাতে এই পরোপকারী পরিবারটির প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। এ সময়ে কপালে চওড়া করে সিন্দুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মওলানার সামনে এসে দাঁড়াল প্রায় বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকে। মওলানার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল চলে যেতে : ‘দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকাপয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন’।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যে পাপ আছে তা অস্বীকার না করে স্বীকার করাই ভাল, স্বীকার করলে যদি আমরা পরিত্রাণের পথ পাই। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেও, করার মাঝেই, থমকে দাঁড়িয়েছে অথবা স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ধনু শেখ এলাকার মসজিদের ইমাম নিয়ামত হোসেনকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘জুম্মার নামাজের পরে তুমি সুন্দর কইরা ওয়াজ করবা। তুমি বলবা সব মুসলমানের দায়িত্ব নিজেদের রক্ষা করা। পরিবার রক্ষা করা এবং পাকিস্তান হাসেলের জন্য কাজ করা। … তার জন্যে প্রয়োজনে রক্তপাত করতে হবে। শহীদ হতে হবে। বলতে পারবা না?’ আপাতত সম্মতি দিলেও চে’গুয়েভারার চেয়ে কোন অংশে কম যান না ইমাম নিয়ামত হোসেন। রাতের অন্ধকারে মনিশংকরের কাছে গিয়ে বলে দিয়েছেন, কাল জুম্মার নামাজের পরে দাঙ্গা শুরু হবে। শুধু তা-ই নয়, পরদিন জুম্মার নামাজ শেষে ইমাম নিয়ামত মওলানা ইদ্রিসকে আমন্ত্রণ জানালেন কিছু বলার জন্যে। ইদ্রিসকে বহুদিন ধরে হরিচরণ সাহার বাসায় আশ্রয়ের পর থেকেই হিন্দুদের সঙ্গে উঠা-বসা করার জন্যে একঘরে করে রেখেছে ধনু শেখ। মওলানা ইদ্রিস দাঙ্গা ঘটানোর পরিস্থিতি বদলাতে উঠে দাঁড়িয়ে সুরা হুজুরাত এর তের নম্বর আয়াতের স্মরণ করলেন, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করে পরে বিভক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন জাতিতে ও গোত্রে, যাতে তারা ‘একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে’। দোয়া পাঠের সময় ইমাম নিয়ামত হোসেন প্রার্থনা করলেন যেন বান্ধবপুরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না হয়।

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে প্রাত্যহিক আচার-অনুষ্ঠানের ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে এক উদারনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এলাকায়। অত্যাচারী শশাংক পাল মারা যাওয়ার পর তার মুখাগি্ন করতে তার স্বধর্মের কেউ রাজী হলো না। হয়তো তিনি সারাজীবন অবিশ্বাসী নাস্তিক ছিলেন বলে, হয়তো অত্যাচারী ছিলেন বলে। মুসলমান হয়ে মওলানা ইদ্রিস এগিয়ে এলেন এক্ষেত্রে। সমস্যা হলো পুরোহিতের সাথে তাকেও কিছু মন্ত্র পড়তে হলো শেষকৃত্যের প্রয়োজনে। এর জন্যে কাফের বলে ফতোয়া দেওয়া হলো তার বিরুদ্ধে। লাবুস এসে প্রতিবাদ করে বলল, ‘লাশের মুখে আগুন দিয়েছে। লাশের আবার হিন্দু মুসলমান কী? লাশ নামাজ কালাম পড়ে না। মন্দিরে ঘণ্টাও বাজায় না’। অন্যত্র, লাবুস ও ইদ্রিসের মধ্যে অন্য একটি ধর্মীয় আলাপের বিনিময় হয়। ইদ্রিসের শিশুবয়সী মেয়ে পুষ্পরাণীকে দুধ খাওয়ানোর কেউ নেই। তার স্ত্রী জুলেখা তাকে পরিত্যাগ করে গেছেন। এদিকে গ্রামের বাগাদিপাড়ার মেয়ে ষোল সতেরো বয়সী কালী গতকালই তার মেয়েকে হারিয়েছে। পুষ্পরাণীকে পেয়ে সাগ্রহে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে সে। এরপর হুমায়ূন আহমেদের কণ্ঠেই শোনা যাক : ‘মাওলানা ইদ্রিস লাবুসের কাছে হিন্দু-মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দু-মুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই। লাবুসের কথায় মাওলানা হকচকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেননি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।’ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাত্যহিকের সাংস্কৃতিক ব্যবহারিক বিনিময়ের এ রকম অনেক উদাহরণ আরো ছড়িয়ে আছে। আজকের এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির যুগে ধর্ম-ধর্ম করে আমাদের নগর ও গ্রামের জীবন এখন ব্যতিব্যস্ত। লাবুস-মওলানা ইদ্রিস হরিচরণের মতো চরিত্ররা কি আছে এখনো আমাদের আশেপাশে কোথাও?

৩.
তাহলে দাঁড়াচ্ছে, হিন্দু-মুসলমানে মিলে একটা যে অভিন্ন সংস্কৃতি, তলার দিকে গড়ে উঠেছিল, শত কংগ্রেসী লীগ রাজনীতির ডামাডোলেও যেটা পুরোপুরি ধসে যায়নি, সে রকম কোন শুভনীতিবোধসম্পন্ন অস্তিত্বকেই অমাদের ‘মধ্যাহ্ন’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণযুগ’ বলছেন লেখক? আজ সেই মধ্যাহ্ন গড়িয়ে এই সমাজ_ এই তিমিরবিলাসী সমাজ উপনীত হয়েছে তার অপরাহ্নে। ‘অপরাহ্ন’ কথাটা আমি ‘লেইট ক্যাপিটলিজম’-এর তাত্তি্বক সাহিত্য-সমালোচক ফ্রেডেরিক জেমসনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। বণিজ্যনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে, শিল্পকেও মানবসত্ত্বাকে ক্রমাগত ‘ব্যবহৃত-ব্যবহৃত’ করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বর্জ্যের মতো পাগলার লেগুনের মতো অন্ধকার কোণে। হুমায়ূন আহমেদ এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীনির্ভর সমাজকে মন থেকে কখনো মেনে নিতে পারেননি। হিমুকে দিয়েছেন এই বাণিজ্যিক সমাজকে বিদ্রূপ করার মনোমুগ্ধকর ক্ষমতা। ‘অয়োময়’-এর মীর্জা হেরে যাচ্ছে উঠতি বণিক শ্রেণীর কাছে, যেভাবে ধনু শেখের কাছে হেরে গিয়েছিল শশাংক পাল। তবু স্রষ্টার পক্ষপাতিত্ব পরাজিতের দিকেই। সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর শেষ দৃশ্যে বিশ্বাম্ভর কোথায় মিলিয়ে যান সে খবর আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমাদের মনে থেকে যায় শেষ সঙ্গীত সভার নৃত্যগীতের রেশ। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষে আমরা জানতে পেরেছি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ আসন্ন, ভিটেমাটি ছাড়ছে দু’তরফেই, নতুন রাষ্ট্রজীবনের শুরু হবে সীমান্তের দু’দিকেই। পাকিস্তান হচ্ছে ‘কৃষকের ইউটোপিয়া’ গবেষকরা রায় দিয়েছেন, শুধু কিছু মানুষের মনে শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। হরিচরণ সাহা মারা গেছেন, লাবুস মৃত্যুশয্যায়, মওলানা ইদ্রিস সবচেয়ে বেশি নিরাশ্রয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই।’ হরিচরণ ও মওলানা ইদ্রিস ছিলেন এই পাপবিদ্ধ সমাজের রক্ষাকবচ_ তারা আঁকড়ে ছিলেন সমাজের ভালোত্বকে শুভবোধকে, মঙ্গলকামনাকে। তারা সমাজকে অন্ধকারর্ খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে দেননি।

মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষটা এ রকম। লাবুস, যে কিনা আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎকে নায়কের মতো লালন করেছে, সে মারা যাচ্ছে। কোনো অব্যাখ্যাত অসুখে তাকে আক্রান্ত করেছে। অসুখ নিয়েই সে এসেছে নির্জন পুকুরের ঘাটে এবং সেখানে হঠাৎই সে তার মৃত মাকে দেখতে পাচ্ছে কাছে। একপর্যায়ে মা’র কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার এই মৃত মার নাম জুলেখা। যিনি জীবিত থাকাকালে স্বয়ং উকিল মুন্সীকে গান শুনিয়েছেন এবং নজরুল যাকে দিয়ে কলকাতায় গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি এবারে গুনগুন করে গান ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বইটির শেষ দুটি লাইন, যা পড়তে থাকলে এখনো আমি এক অনির্বচনীয় শিহরণ অনুভব করি : ‘মওলানা ইদ্রিস ঘর থেকে বের হয়েছেন, হাদিস উদ্দিন বের হয়েছে। পুকুরঘাট থেকে যে সুরধ্বনি বের হয়ে আসছে, তার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনোখানে।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোসেন মিয়া ময়নাদ্বীপের সমতাবাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হুমায়ূন আহমেদের বান্ধবপুর তেমনি একটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্র, সেখানে সব গোত্রের ও বর্ণের মানুষেরা মানবিক মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরবে। তবে এই অপরাহ্নের সমাজের কাছে হুমায়ূনের এই ইতিহাসপাঠ কল্পজগতের ভাষ্য বলে মনে হতে পারে।

অর্থনীতি ও রাজনীতির ধাঁধা

বিনায়ক সেন, অজয় দাশগুপ্ত

সামনে বাজেট রয়েছে। কিন্তু সরকারের চতুর্থ বছরটা উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়নের বছর নয়। এর পরিবর্তে আগের বছরগুলোর সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতি এসেছে তা বজায় রাখা, বাজেট ঘাটতি কমানো, বিনিময় হারে অবনতি ঘটতে না দেওয়া, রফতানি উৎসাহিত করা_ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা জরুরি। নির্বাচনের আগের বাজেটে জনতুষ্টিমূলক প্রকল্প গ্রহণের চাপ থাকবে। এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতি ব্যাহত হতে পারে। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে ঋণ বাড়ালেও সমস্যা দেখা দিতে পারে আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি বড় ধাঁধা বা পাজল দিয়েই লেখাটা শুরু করি। অর্থনীতিবিদ যারা, দেশ-দুনিয়ার অর্থ নিয়ে চর্চা করেন যারা, তাদের বিবেচনায় গত দুই যুগে বাংলাদেশে অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। যেমন প্রবৃদ্ধির হার ভালো, দারিদ্র্য হ্রাসের হার বাড়ছে, সামাজিক সূচকে রয়েছে সফলতা। অর্থনীতিবিদরা এসব অর্জনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আলোচ্য সময়ে দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে। গণমাধ্যম যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেছে। নিয়মিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং সরকার পরিবর্তনের এটাই একমাত্র পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এ অর্জনের পরও কোনো ক্ষমতাসীন দল বা জোট দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হতে পারছে না কেন? তাহলে কি অর্থনীতিবিদদের কাছে যেসব সূচক গুরুত্বপূর্ণ শাসকদের মূল্যায়নে; নাগরিকরা একই সূচকের ওপর নির্ভর করে না?

যে কোনো দল সাধারণ নির্বাচনে যাওয়ার আগে ইশতেহার ঘোষণা করে এবং তাতে দরিদ্র মানুষের সহায়তার জন্য বিভিন্ন অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এসবের বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে সে বিষয়ে তারা খেয়াল রাখে। এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান অন্য অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় ভিন্ন। বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামে তারা সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। সাধারণ নির্বাচনেও বাংলাদেশের ভোটার উপস্থিতির হার যথেষ্ট বেশি। এখানকার নাগরিকরা ধরেই নেয় যে, ম্যাক্রো অর্থনীতি এবং সামাজিক সূচকগুলো ক্রমাগত ভালো হতে থাকবে এবং এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। সম্ভবত সরকার সম্পর্কে চূড়ান্ত মূল্যায়নে তারা এসবকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায় না। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য। সামাজিক খাতেও রয়েছে সাফল্য। কিন্তু পাশাপাশি গত দুই দশকে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আয়-বৈষম্য বেড়েছে এবং এটা জনমনে অসন্তোষ ও হতাশার সৃষ্টি করছে। যদিও এ সময়ে দারিদ্র্য কমছে, কিন্তু জনসাধারণ আপেক্ষিক বৈষম্য বেড়ে যাওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। মজুরি হার বেড়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা-পুষ্টির ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটছে। কিন্তু এগুলোর যতটা না গুরুত্ব, সেটা ছাপিয়ে ওঠে ‘আমার চেয়ে তার বেশি উন্নতির’ প্রশ্নটি। এ বিষয়টি তারা ভালো চোখে দেখে না। এখানে আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে। যদি এ আয়-বৈষম্য অধিকতর শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে ঘটত সেটা সহনশীল হতো। কিন্তু বাস্তবে এ বৈষম্যের পেছনে হিউম্যান ক্যাপিটাল বা মানব পুঁজির যতটা না অবদান, ব্যবসায়িক দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা যতটা না কাজ করে, তার অনেক বেশি কাজ করে দুর্নীতি। সহজ কথায় বলা যায়, অনুপার্জিত আয়ের মাধ্যমে কিছু লোক বাড়তি সম্পদ সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, রাজধানী ঢাকায় এখন সাধারণ মানের একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্যও ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা ব্যয় পড়ে। যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ আয়ও যাদের, তাদের পক্ষে এ আয় থেকে সঞ্চয় করে এত দামের ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়।

একটি জেলা সদরে সাম্প্রতিক সফর থেকে জানা গেছে যে, রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোকের হাতে পাজেরো বা এ ধরনের দামি গাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ চলে আসে, যা জনগণের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকে। পরিশ্রম, দক্ষতা বা উন্নত শিক্ষার জন্য এসব অর্জন নয়, বরং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই এর মূলে। জনগণের মধ্যে সম্পদের যে বৈষম্য, তার পেছনে দুর্নীতির রয়েছে বড় ভূমিকা_ সেটা বুঝতে পারে বলেই জনমন বিষিয়ে যায়। আর এ কারণেই নির্বাচনের সময়ে সরকারের ম্যাক্রো অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সাফল্য এখন পর্যন্ত বড় হয়ে দেখা দেয় না। এটাও লক্ষ্য করা হয় যে, অনেকেই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত বলে জনগণ মনে করে এবং এসব করেও তারা দিব্যি থাকতে পারে। তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত এবং পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় রাজনীতিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ কারণেই যে সরকার ক্ষমতায় থাকছে, নির্বাচনকালে জনগণের বড় অংশ তার বিপরীতে চলে যাচ্ছে।

এই যে ধাঁধা, তার নিরসন করতে হলে যে দুর্নীতির মাধ্যমে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট কিছু লোক নিজের সম্পদ বাড়িয়ে নিচ্ছে, তার অবসান ঘটানো আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। নির্বাচন হয় বিভিন্ন সংসদীয় আসনে প্রার্থীদের মধ্যে। কিন্তু এমনকি দলের প্রধান নেতার জনপ্রিয়তা থাকলেও নির্বাচনে সেটা নিয়ামক থাকে না। বরং দায়ভার নিতে হয় পুরো দলকে।
সরকার বলতে পারে যে, বৈষম্য কমাতে তারা চেষ্টা করছে। এর উদাহরণ হিসেবে সামাজিক বেষ্টনী কর্মসূচির নজির টানা হয়। এ ধরনের অন্তত ৮০-৮৫টি কর্মসূচির কথা তারা বলতেও পারে। এতে ব্যয় হয় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ অর্থ। এ থেকে সমস্ত সুবিধা চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে কি-না, কোনো লিকেজ আছে কি-না সে প্রশ্ন রয়েছে। যদি ধরেও নিই যে, লিকেজ নেই অর্থাৎ দুর্নীতি-অনিয়ম হয় না এবং বয়স্ক ভাতা, ছাত্রী উপবৃত্তি, মঙ্গা এলাকার বিশেষ কর্মসূচির পূর্ণ সুফল সংশ্লিষ্টরা পাচ্ছে; তাহলেও এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ প্রতীকই থেকে যায় এবং তা দিয়ে জীবন খুব একটা বদলানো যায় না। তাতে হয়তো ক্ষুধা কিছুটা লাঘব হয়, কিন্তু আয়-বৈষম্য কমে না। ইউরোপের অনেক দেশে বিশেষত ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলোতে এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে এ ধরনের লক্ষ্য অর্জন করা গেছে। এর কারণ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে তাদের বাজেটের ২ শতাংশ নয়, বরং ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের হাতে এত সম্পদ নেই যে, রাজস্ব বাজেট থেকে এ অর্থ বরাদ্দ করা যাবে। আমাদের কর রাজস্ব আদায় সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। তারপরও এর পরিমাণ জিডিপির ১০-১১ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এ কারণে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, বাজেটের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য কতটা কমানো যাবে। একটি উদাহরণ দিই। যে সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি, তার ওপর ১০ শতাংশ হারে সারচার্জ বসানোর একটি পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে। কিন্তু অর্থবছরের ৯ মাসে তা থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৭০ কোটি টাকার মতো এবং দিয়েছে ১১শ’র মতো পরিবার। এত কম অর্থ আদায় হওয়ার কারণ সম্পত্তির মূল্য ধরা হয়েছে উৎস ধরে। ১০ বা ১৫ বছর আগে যে দামে তা কেনা, সেটাই উৎস মূল্য। কর আদায়ে নানাবিধ জটিলতা বাদ দিলেও কেবল মূল্য কম ধরায় অনেক ধনবান ব্যক্তিই সারচার্জের আওতায় আসছে না। বর্ধিত কর পাওয়া গেলে তা দিয়ে অনেক ধরনের কাজ সম্পন্ন করা যায়। যেমন স্বাস্থ্য বীমা। ভারতে বেশিরভাগ রাজ্যে এটা চালু আছে। বাংলাদেশেও কোনো কোনো এনজিও পাইলট প্রকল্প নিয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প চালু হলে দরিদ্রদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে আসে এবং বিপদে পড়ে সামান্য সম্পদ বিক্রি করতে হবে না।

সামনে বাজেট রয়েছে। কিন্তু সরকারের চতুর্থ বছরটা উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়নের বছর নয়। এর পরিবর্তে আগের বছরগুলোর সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতি এসেছে তা বজায় রাখা, বাজেট ঘাটতি কমানো, বিনিময় হারে অবনতি ঘটতে না দেওয়া, রফতানি উৎসাহিত করা_ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা জরুরি। নির্বাচনের আগের বাজেটে জনতুষ্টিমূলক প্রকল্প গ্রহণের চাপ থাকবে। এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতি ব্যাহত হতে পারে। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে ঋণ বাড়ালেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আমরা জানি, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের তিনটি উৎস_ বৈদেশিক ঋণ-অনুদান, আর্থিক খাত-ব্যাংক ব্যবস্থা এবং কর রাজস্ব। কিন্তু কর রাজস্ব স্বল্প মেয়াদে খুব একটা বাড়ানো সম্ভব নয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতি চাইলে প্রথম ও দ্বিতীয় উৎসের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু এ বছর বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ-অনুদান নেতিবাচক। অর্থাৎ নতুন করে যা প্রাপ্তি তার চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে গেছে পুরনো ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে। যেহেতু বৈদেশিক সাহায্য সেভাবে আসেনি, তাই সরকারকে কম সময়ে বেশি ঋণ নিতে হয়েছে এবং আরও ঋণের জন্য হাত বাড়াতে হবে। ফলে ঝুঁকি রয়েছে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার। এ অবস্থায় বৈদেশিক সহায়তা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হওয়ার বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে বোঝাপড়ার কারণে এ বছর ৯০ কোটি ডলারের (তিন বছরে এ ঋণ দেওয়া হবে) প্রথম কিস্তি মিলেছে। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে বড় ধরনের অর্থায়ন স্থগিত হয়ে আছে এবং দাতারা এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছে। বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে আগামী কয়েক মাসে নাটকীয় পরিবর্তনের আশা দূরাশা। এ অবস্থায় সরকারের সামনে বিকল্প হচ্ছে নিজের চাহিদা কমিয়ে আনা। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোও একই লক্ষ্য থেকে করা। এক হিসেবে দেখা যায়, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও ভর্তুকি থাকবে এবং এ খাতে আগামী বছর ৬৪১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে।

সরকার কুইক রেন্টাল সূত্রে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এসব প্রকল্প চালু রাখতে হলে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানির জন্য বিপুল অর্থ দরকার হয়। কিন্তু সরকারের হাতে এ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নেই। উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেও জনগণকে তার সুফল দেওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে সরকার ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছে এবং দাতাদের পরামর্শও তেমনই। কিন্তু তাতে জনমনে প্রভাব পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ৭৭ শতাংশ জনগণের আস্থা রয়েছে_ গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জনমতের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গ্যালাপ পোলের জরিপে এ কথা বলা হলেও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার কারণে এখন তা হ্রাস পাওয়ার কথা।

প্রশ্ন উঠতে পারে_ এ ধরনের পরিস্থিতি কি আগে ঘটেনি? ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গম-চালের দাম বেড়েছিল। সে সময় বিশ্বব্যাংকের তরফে বাজেট সহায়তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার সেটা পায়নি। ফলে সামষ্টিক খাতের ওপর চাপ সামলাতে অভ্যন্তরীণ সূত্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। রফতানি বাড়ছে। প্রবাসীরাও ভালো অর্থ পাঠাচ্ছে। কিন্তু সরকার বৈদেশিক সূত্রে বড় ধরনের রিলিফ পাবে_ এমন আশা কম। এ কারণেই বৈদেশিক সাহায্যদাতাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা দরকার। অর্থনীতির তাগিদই ঠিক করে দেবে রাজনৈতিক কৌশল, এমনটাই স্বাভাবিক ছিল। এ বছরের জানুয়ারিতে সমকালে ‘একে একে নিভে যাচ্ছে বাতি’ শিরোনামের লেখার (লেখক বিনায়ক সেন) ভাবনায় ছিল যে সরকার নমনীয় হবে। কিন্তু গত ২-৩ মাসের ঘটনাবলিতে দেখা যাচ্ছে, সরকার সে পথে এগোচ্ছে না। অর্থাৎ এখনও হার্ডলাইনেই চলেছে।

প্রকৃতই আয়-বৈষম্য হ্রাসে সরকারের হাতে হাতিয়ার কম। গত এক দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। কৃষিতে প্রবৃদ্ধি ভালো। কৃষকের দাবি, এখন ধানের ন্যায্যমূল্য। এ খাতে প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারে চাপ অপেক্ষাকৃত কম থাকছে।
সার্বিক প্রবৃদ্ধির হার এখনও সন্তোষজনক বলব। কয়েক বছরে সাড়ে পাঁচ-ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অনেকেই মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে মজুরি বাড়িয়ে নিতে পারছে। ধান কাটার সময়ে দিনে চার-পাঁচশ’ টাকা আয় করা সম্ভব। এ সময়ে মাসে ২০ দিন কাজ করেই ৩-৪ মাসের মতো চাল ঘরে তোলা যায়। ধানের চাতালে দেখেছি, নারী শ্রমিকরা কাজ থাকুক আর না থাকুক, বছরজুড়ে দিনে ১১০-১২০ টাকা আয় করতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে পাঁচ-ছয় শতাংশ হলেও গ্রামের দরিদ্ররা ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। শহরে বসবাস করে এমন অনেক লোক এখন গ্রামের জমি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ক্ষুদ্র কৃষক বা ক্ষেতমজুরদের চাষাবাদের জন্য দেয়। এর পেছনে অন্যান্য উৎসের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির ভূমিকা রয়েছে।

নির্মাণ খাতের চিত্রও ভালো। এর প্রভাব পড়ছে শহরের দরিদ্রদের একটি অংশের ওপর। সার্বিক অর্থনৈতিক এ চিত্র অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। বিদেশিরা কে, কোথায়, কী বললেন কিংবা ট্রান্সপারেন্সির সূচকে কী বলা হলো, তার চেয়েও বড় ফ্যাক্টর হচ্ছে অর্থনীতির নিজস্ব ডিনামিক্স।

তবে আমরা যদি সংস্কারের ক্ষুধা হারিয়ে না ফেলতাম, তাহলে আরও কিছু অর্জন সম্ভব হতো। এটা বলা হয়ে থাকে যে, যখন সম্পদ থাকে না তখন ভাবসম্পদ বিনিয়োগ করে সুফল পাওয়া যায়। আমরা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্ধেকও বাস্তবায়ন করতে পারি না। এ অবস্থা অনেক বছর ধরে চললেও আমরা কেন প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হচ্ছি? জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে_ এটা কেন যথাসময়ে উদ্যোক্তারা ও সরকার বুঝতে পারল না? কুইক রেন্টালের ভায়াবিলিটি হিসাব করার সময় ২০০৭-০৮ সময়ে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য কেন বিবেচনায় নেওয়া হলো না? অনেকের অভিযোগ, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ে কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। ঋণ কোথায় দেওয়া হবে এবং কোথায় নয়, ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে সেটা মূল্যায়ন করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে অপেশাদারিত্ব কাঙ্ক্ষিত নয় এবং এর পরিবর্তন এমনকি ক্ষমতার শেষ বছরেও করা সম্ভব। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ কমিটি রয়েছে। এমনকি নামজাদা অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিংও ড. কৌশিক বসুসহ অনেকের পরামর্শ নেন নিয়মিত।

বৈষম্য রোধে সরকার ভূমি সংস্কারের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে। এক সময়ে বলা হতো. কলকাতাকেন্দ্রিক বাবুরা কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে না। কিন্তু এখন কেন অনেকে কৃষক শ্রেণী থেকে উঠে এসে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হতে গিয়ে কৃষকের স্বার্থ ভুলে যান? কেন তাদের কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের প্রতি মমত্ববোধ থাকবে না? খাসজমি সরকারের হাতে যেটুকু রয়েছে সেটা পুনর্বণ্টন বিষয়ে অবশ্যই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে। এর ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন হার অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে। ইউরোপ যে ইউরোপ হলো তার বড় প্রাতিষ্ঠানিক কারণ উনিশ ও বিশ শতকে স্থানীয় সরকার নিয়ে চর্চা। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। আমরা বিকেন্দ্রীকরণের এসব শিক্ষা জানা থাকলেও তা গ্রহণ করছি না? স্থানীয় সরকার যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এখন বড় ধরনের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত এবং তাদের সক্ষমতা বাড়াতে ইউএনডিপি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ রয়েছে। স্থানীয় সরকারকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও যুক্ত করা গেলে গ্রামের জনগণ বুঝতে পারবে যে, তাদের উন্নয়নে সরকার অর্থ বরাদ্দ করছে এবং তা কাজে লাগানো হচ্ছে। এমনকি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের অবস্থার পরিবর্তনও স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে করা সম্ভব।

আমরা মনে করি, বর্তমান বাজেটের মধ্যে সরকার আরেকটু গ্রামমুখী হতে পারে। বৈষম্য কমিয়ে জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হতে পারে। সময় যে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে_ সেটা নিশ্চয়ই তারা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে।

ড. বিনায়ক সেন :গবেষণা পরিচালক, বিআইডিএস
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক