দুর্গতির বছরে অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় প্রাধান্য দিতে হবে


অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. বিনায়ক সেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের  (বিআইডিএস) মহাপরিচালক। তাঁর মৌলিক গবেষণার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, বৈষম্য, শ্রমবাজার, সামাজিক সুরক্ষা, মানব উন্নয়ন, সুশাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ইত্যাদি। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৩০টির বেশি গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত তিন দশকে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। দেশের গত তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ‘অর্থনীতিবিদ প্যানেল’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। বিনায়ক সেন ১৯৮২ সালে রাশিয়ার মস্কো লমনসভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে এমএসসি এবং ১৯৮৫ সালে ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

সমকাল: এবারের জাতীয় বাজেটকে মোটাদাগে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

বিনায়ক সেন: বর্তমান বিশ্ব এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো কোনো বাজেট হয়তো দেওয়া যেত। তবে যেটি দেওয়া হয়েছে, তা একেবারে খারাপ হয়নি। গত কয়েক মাস দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান ওঠানামার কারণে আশঙ্কা করা হয়েছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল এ বছর অর্জিত হবে না। আমার মনে হয়, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেখার কোনো কারণ নেই।

এর পেছনে আমি দুটো কারণ বলছি। গত কয়েক বছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার একই রকম আছে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বিনিয়োগের হার ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বিনিয়োগের হার মোটামুটি একই হওয়ার পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখনও ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, কখনও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, কখনও ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, কখনও ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং এবার বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বেশ ওঠানামা ছিল। এর মানে শুধু বিনিয়োগের হার দ্বারাই প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত হয় না। বাহ্যিক অভিঘাত এলে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিনিয়োগ একই থাকলে যদি উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং অন্যান্য সামাজিক সূচক শক্তিশালী থাকে, অর্থাৎ আমরা যাকে রেজিলিয়েন্স বা ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বলি, সেটি থাকলে প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকে। তা ছাড়া এ বছর পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে প্রবৃদ্ধির ওপর কিছুটা বাড়তি সুফল আমরা দেখতে পাব। তবে কৃচ্ছ্র সাধনের এ বছরে চাহিদা ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, এখন তো একটা অভিঘাত এসেছে। তবে এটি কভিডের মতো অভিঘাত কিনা দেখতে হবে। আমার মতে, অবশ্যই নয়। কভিডের অভিঘাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। এখনকার যে অভিঘাত, তা সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ তেল, গ্যাস এবং খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা আমদানিনির্ভর। কিন্তু খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর নই। চালের ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। গম কিছুটা আমদানি করতে হয়। সেটারও একটা রাস্তা আমরা বের করেছি। ভারত থেকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনেক গম আমদানি করছি। এ কারণে খাদ্যশস্যের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। চালের দাম তিন থেকে চার টাকার মতো কেজিতে বেড়েছে। যদি আমরা চালের সরকারি সংগ্রহ বা ক্রয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারি, তাহলে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অনেকটা সহজ হবে। তবে আমাদের মজুত করার ক্ষমতা সীমিত। ২০ লাখ টনের মতো চাল মজুত করার সামর্থ্য আছে। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, এ বছর ২০ লাখ থেকে ৩১ লাখ টন মজুত করার সামর্থ্য অর্জন করা হবে। এটি আগেই করা উচিত ছিল। ১০ বছর ধরে আটটি সাইলো নির্মাণাধীন। আশুগঞ্জ এবং আরও দুয়েকটা হয়তো দ্রুত হয়ে যাবে। বাকিগুলোর কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে। সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সমগ্র উৎপাদনের ৬ শতাংশের মতো ক্রয় করে। আমাদের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ঝুঁকি বিবেচনায় এটি অন্তত ১০ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। তাহলে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকবে না। তবে এ বছর উপর্যুপরি বন্যা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে আমন উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে।

আমার মতে, এবারের বাজেট ভারসাম্যপূর্ণ। আমদানির রাশ টানা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের উৎপাদনকে সহায়তা করার পদক্ষেপ রয়েছে। দেশীয় শিল্পের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।

সমকাল: আপনি কি মনে করেন, বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?

বিনায়ক সেন: বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বছর যত না প্রবৃদ্ধির বছর, তার চাইতে বেশি হলো সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষার বছর। দুর্গতির বছরে এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার প্রধান সূচক তিনটি- মূল্যস্ম্ফীতির হার, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্য এবং বাজেট ঘাটতি সহনীয় রাখা। তিনটি ক্ষেত্রেই আমরা যথাসময়ে উদ্যোগ নিয়েছি। খাদ্যশস্যের মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ভালো। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। সরকার বলেছে, ধাপে ধাপে অল্প করে দাম সমন্বয় করা হবে। বাজেট ঘাটতি মোটামুটি একটা সীমার মধ্যে (জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ) রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারি ব্যয়ের হার কমিয়ে আনা হয়েছে, যা অস্বস্তির বছরে বাজেটের একটা ভালো দিক। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আগামী অর্থবছরে যা কমিয়ে ১৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর মানে, সচেতনভাবে সরকারি ব্যয়ের অনুপাত কমানো হয়েছে। এর পেছনে কারণ হলো, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত আকাঙ্ক্ষা করতেন, সরকারি ব্যয় জিডিপির ২০ শতাংশে উন্নীত হোক। ভারতে যেখানে এটি ২৪ শতাংশ। বেশি ব্যয় করলে সরকার জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু এ বছর সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ব্যয় বাড়ানোর চাইতে ব্যবহারের ওপর এবং অসমাপ্ত অগ্রাধিকার প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমদানিনির্ভর নয় এমন খাত, বিশেষ করে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন উৎসাহিত করা হয়েছে এবং পোশাক ও পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি খাতের মধ্যে আয়করের হারে সমতা আনা হয়েছে। এর ফলে রপ্তানি একদিকে বাড়বে, অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রেমিট্যান্স বাড়বে। সেই সঙ্গে আমদানির চাহিদা, যা গত বছরে সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৬০ শতাংশের মতো বেড়েছিল, সেখানে রাশ টানা হয়েছে বাজেটের আগেই। এখন হয়তো এটি ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের মধ্যে নেমে যাবে বলে মনে হয়। এসব উদ্যোগ না নিলে চলতি হিসাবে ঘাটতি জিডিপির ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ হয়ে যেত। এখন মনে হচ্ছে, ঘাটতি ২ থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে থাকবে। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে, বিনিময় হার বাড়িয়ে এবং বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এলসি মার্জিনের হার বাড়ানো হয়েছে। তবে এগুলো দুর্বল ‘পলিসি ইনস্ট্রুমেন্ট’। এ কারণে টাকার বাজার নির্ধারিত মূল্যমানের দিকেই যেতে হয়েছে।

বাজেট ঘাটতির ক্ষেত্রেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে মূল্যস্ম্ফীতির হার আগামী অর্থবছরে বড় কোনো মাথাব্যথার কারণ হবে বলে মনে হয় না, যদি বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ না করে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো মূল্যস্ম্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা। যদি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যেও থাকে তাহলে দুর্গতির বছরে তা খারাপ নয়। ২০১০-এর দশকের প্রথমার্ধে মূল্যস্ফীতির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ ছিল। এর কারণ ছিল, ২০০৭-০৮ এর অর্থনৈতিক সংকটের রেশ চলছিল। এর পরে কিছুটা কমে আসে। এখন আবার বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশে একটু বাড়বে, এটা স্বাভাবিক।

সব মিলিয়ে বলব, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে বাজেট দেওয়া হয়েছে। এখন বুঝতে হবে, স্থিতিশীলতা না হয় অর্জিত হলো; প্রবৃদ্ধি কি সাড়ে ৭ শতাংশ অর্জিত হবে? প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। দুর্গতির বছরে যদি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশও হয় এবং সেই প্রবৃদ্ধি যদি কম বৈষম্যপূর্ণ থাকে, তাহলে বৈষম্যযুক্ত সাড়ে ৭ শতাংশের চেয়েও তা ভালো।

সমকাল: বাজেট কি বৈষম্য কমানোর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে বলে মনে হয়?

বিনায়ক সেন: বৈষম্য কমানোর প্রবৃদ্ধির দিকে যদি আমরা যেতে চাই তাহলে যেগুলো বৈষম্য বাড়ায়, এমন পদক্ষেপ বাদ দিতে হবে। পুরো বাজেট বক্তৃতায় সম্পদ করের কোনো আলাপ দেখলাম না। দ্বিতীয় কথা হলো, আর্থিক খাত নিয়ে তেমন কোনো আলাপ নেই। মন্দ ঋণ নিয়ে কিছু বলা হয়নি। যদিও এটি বাজেটের বিষয় নয়। তবে বাজেটের ওপর পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। মাঝে মাঝে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মন্দ ঋণ মওকুফ করে দিতে হয়। অন্যদিকে যদি খেলাপি ঋণ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায় অথবা দেশের ভেতর থেকে ফেরত না আসে, তাহলে উৎপাদনশীল ঋণগ্রহীতারা ঠিকমতো ঋণ পান না। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং কর প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অর্থমন্ত্রী যদি বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার পরিকল্পনা করেন, তাহলে দেশের ভেতরে যাঁরা টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন, তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারছেন না কেন?

আমার মতে, বৈষম্য কমাতে যাঁদের সুবাদে জিডিপি বাড়ছে, তাঁদের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখনও ১০০ টাকা। কিছু সুবিধা মিলিয়ে বড়জোর ২০০ টাকা হতে পারে। এটা তো হতে পারে না। শিল্প শ্রমিক বিশেষত পোশাক শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৫ বছর কর্মক্ষম থাকে। যে সময়টা তারা কর্মক্ষেত্রে ঢোকে, তখন হলো পড়ার সময়। আমার ধারণা, একটা সময়ে তাদের মোবিলিটি আটকে যায়। তারা গ্রামে চলে যায় কিংবা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে অন্য খাতে কাজ করে। সুতরাং তাদের জন্য শুধু সামাজিক সুরক্ষা নয়; নৈশকালীন শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দেশ গঠনের জন্য জার্মানি এবং ব্রিটেনে এটি ব্যাপকভাবে করা হয়েছে। সুতরাং শিল্পায়নের পাশাপাশি শ্রমিক পরিবারের জন্য নৈশকালীন সাধারণ শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার জন্য সার্বিক একটি পরিকল্পনা নিতে হবে। তাদের জন্য বহু কিছু করার বাকি।

সমকাল: সামাজিক নিরাপত্তা খাত তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে অনেকে বলছেন। আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।

বিনায়ক সেন: সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হবে। সবার জন্য একটা পেনশন স্কিমের দিকে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। আগামী অর্থবছরে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, তা দেখার বিষয়। তবে অভিপ্রায়টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা নিঃসন্দেহে অনেক বড় উদ্যোগ।

আমার মতে, প্রবৃদ্ধি সুষম করতে হলে এত সম্পদ, এত প্রবৃদ্ধি যাদের জন্য, সেই শিল্প শ্রমিকদের জন্য বাড়তি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে শিল্প খাত। ১৯৯১-৯২ সালে ম্যানুফাকচারিং বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে তা হয়েছে ২০ শতাংশ। শিল্প খাতে শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে, জিডিপিতে অবদানও বেড়েছে। উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সামাজিক অভিঘাতের দিক থেকে শিল্প খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শ্রমিক পরিবার কমবেশি বঞ্চিত। মূলত সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গ্রাম ঘিরে এবং শহরের কিছু বস্তিবাসী এর মধ্যে রয়েছে। আমার প্রস্তাব, ৫০ লাখ পোশাক শ্রমিক এবং এর বাইরের ৩০ লাখ শ্রমিকের জন্য অন্তত চাল-ডাল-ভোজ্যতেলের রেশন ব্যবস্থা চালু করা হোক। এটি করা সহজ। আমরা নগর দরিদ্রদের তালিকা নেই বলে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করছি। টার্গেটিং কীভাবে করব, কখন হবে টার্গেটিং- এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। এ জন্য নির্দিষ্টভাবে আশুলিয়া, টঙ্গী, ডেমরা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা বৃহৎ শিল্পকারখানা এলাকায় যেখানে প্রচুর শ্রমিক পরিবার বাস করে, সেখানে রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ জন্য নতুন করে কোনো টার্গেটিং লাগবে না। এতেশিল্প মালিকদেরও লাভ হবে। কারণ, মজুরি না বাড়লেও রেশন চালু হলে শ্রমিকদের জন্য মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়া সহজ হবে। এ জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটলে হবে না। একটি সুসমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে করতে হবে।

সমকাল: বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতা দানের উদ্যোগকে কীভাবে দেখেন?

বিনায়ক সেন: পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ এখনকার সময়ের জন্য মোটামুটি ভালো এই বিবেচনায় যে, এতে যদি কিছু টাকা ফেরত আসে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি একটি মরিয়া চেষ্টা। পানামা পেপারসে যাঁদের নাম আছে, বিদেশে যাঁরা ব্যাংকে টাকা রেখেছেন, তাঁরা ফেরত আনবেন বলে মনে হয় না। নিয়ে আসার ইচ্ছা থাকলে তো তাঁরা এখনই পারেন। ওই টাকা তাঁরা বিদেশ থেকে নিয়ে এসে কালো টাকা সাদা করার বিধানের সুযোগ নিতে পারেন। আমার মনে হয়, দেশের ভেতরে যে টাকা কালো হয়ে আছে এবং সাদা করা হয়নি, সেই টাকা হুন্ডি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে এবং সাদা হয়ে সগর্বে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে আবার দেশে ঢুকবে। কিছু লোক হয়তো আসলেই বিদেশে থাকা সম্পদ দেশে এনে বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি ঘটবে বেশি।

সমকাল: শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা আরেকটু অগ্রাধিকার পেতে পারত কিনা?

বিনায়ক সেন: বাজেটের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়েনি। শিক্ষায় সামান্য বেড়েছে, তবে প্রাথমিক শিক্ষায়। সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমেছে। এ রকম একটি সংকোচনের বছরে কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি কাটছাঁট করা উচিত হয়নি। অসহায় মানুষের জন্য ৫০০ টাকা কিংবা ৭০০ টাকা করে ভাতা অনেক বছর ধরে চলছে। এটি অবশ্যই বাড়ানো উচিত। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের যে বাজেট, তা তো অর্ধেকের মতো খরচই হয় না। বাজেটে যে ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানো অর্থাৎ তাদের ব্যয় করার সামর্থ্য বাড়ানো। সরকার যদি তা করতে পারে তাহলে অন্তত যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা খরচ হবে। সরকার শহর এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক চালুর চিন্তা করতে পারে। কভিডের সময় দেখা গেছে, শহরের মানুষের জন্য কোনো কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক নেই। অন্যদিকে পুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক বেশি বৈষম্য বিদ্যমান। শহর এলাকায় সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবার এবং সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে খর্বকায় শিশু থাকার পার্থক্য তিন গুণ। ধনী-গরিবের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে এত!

আমি একটি বিশেষ প্রস্তাব করতে চাই এবং তা হলো শিক্ষাকেন্দ্রিক একটি ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন চ্যানেল চালু করা। ভারত এবারের বাজেটে উন্নয়নকেন্দ্রিক একটি টিভি চ্যানেল চালুর ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষার জন্য টিভি চ্যানেল চালু করলে এ খাতে ঘাটতি কমানো এবং ধনী ও গরিবের বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

বিনায়ক সেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

Extra push can erase extreme poverty in urban areas

An additional push can help Bangladesh bring down the number of urban extreme poor across the country by 2021, a leading economist said yesterday.

Bangladesh had 7.7 percent urban extreme poor in 2010, according to the government’s statistical agency.

Binayak Sen, research director of Bangladesh Institute of Development Studies or BIDS, said the number came down to 4.98 percent in 2016, as per his own projection.

“So, urban extreme poverty eradication is around the corner, with a little extra push, before 2021,” he said at a workshop at The Daily Star Centre in Dhaka yesterday.

Urban consumption poverty eradication is also possible well before the UN-set deadline of 2030, as it came down to 14 percent this year from 21.3 percent in 2010, he added.

The sustainable development goals called for eradication of extreme poverty for all people everywhere by 2030; internationally, poverty incidence below 3 percent is considered zero poverty, he said.

“But in a highly populated country like Bangladesh, 3 percent of the total population is a huge number. So, we have to work in both urban and rural areas to bring down the poverty level to zero percent to attain the SDG target on poverty.” Sen, however, said multiple risks persist.

“The issue is not just poverty reduction via temporary poverty escape, but one of permanent poverty escape.”

Apart from consumption poverty eradication, other deprivations in areas such as quality of education, health, nutrition, housing and transport have to be taken into consideration, according to Sen.

“The issue is to transform a middle income country into a middle class country.”

Mihir Kanti Majumder, chairman of Palli Sanchay Bank, said the declining trend of extreme poverty is encouraging.

If the country can reap the benefit of the demographic dividends, develop skills of the youth population, and properly use its resources, Bangladesh would become a developed country, he added.

“So, we need a concerted effort on fronts such as education and health. Agricultural machination is a must as many people are leaving the agricultural sector and engaging in non-farm activities.”

At the workshop, Sen presented an impact of a project run by Dushtha Shasthya Kendra (DSK) with support from the Shiree project funded by UKaid from the Department for International Development and the Bangladesh government.

‘Moving from extreme poverty through economic empowerment’ started in 2009 and worked in several slums such as Karail, Kamrangirchar, Lalbag, Hazaribag, Mohammadpur and Mirpur. The project ended in 2016.

Under the project, a non-refundable fund of Tk 14,000 was transferred to the beneficiaries. They were given training on income generation and were given access to health care facilities, said Masudul Quader, chief executive of DSK.

“There are many people who are not deemed credit worthy or don’t know how to utilise the credit properly, largely because of a lack of capacity. We have identified them. Now they are able to run businesses on their own,” he said.

Under the project, 30,000 households have come out of extreme poverty, said Prof Mahfuza Khanam, vice-president of DSK.

Sen first conducted pilot surveys in the slums in 2011. In December, he carried out a final survey to measure the impact of the project. This time, the number of households was 950, including 200 households under a control group.

The study showed annual income, savings and capital formation and assets have gone up for the beneficiaries compared to the controlled group. Access to sanitation and washing habits also improved.

Beneficiary households registered 24 percent higher income compared to controlled households. The weekly consumption propensity for protein and micronutrient-rich items such as eggs, meat, dairy products and fruits is significantly higher in case of programme members, said Sen.

“The members also have higher aspiration than the non-members for their children.”

Sen said: “It seems that DSK-Shiree should now try to lift their members from moderate poverty given their past success in attacking urban extreme poverty.”

“Yesterday’s extreme poor are today’s moderate poor, and they are already dreaming of becoming a part of the middle class. Can we support their aspiration?”

Mofizul Islam, director general of the Department of Cooperatives, said it is really tough to reduce urban extreme poverty compared to rural extreme poverty, as most poor people live illegally or do informal trades. “DSK-Shiree has done the difficult task.”

Setara Begum, a community leader in the city’s Karail slum, said she has been living in the slum for 25 years after she lost her home in Barguna to river waters.

“I have been given training. I have been given Tk 14,000 as grants, which I used to start a teashop. I also started selling saris with their help,” she said.

“If the government can allocate land to the rich, why can’t it do the same for the poor?”

“But we are always fearful that the slums might be demolished anytime.”

“If the slum is demolished, there will be no place for us to go. We don’t want to become zero from hero.”

Source: Daily Star

এমডিজির গতানুগতিক পন্থায় এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়

বিনায়ক সেনসহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের সাফল্য এবং এসডিজিতে (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) প্রবেশ উপলক্ষে প্রথম আলোর সঙ্গে উন্নয়নের পথযাত্রা নিয়ে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সমতামুখী প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তিনি। এর আগে ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও বইপত্রে তাঁর ৫০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম আলো : যাকে বলা হয় বাংলাদেশ প্যারাডক্স বা ধাঁধা—দুর্নীতি ও দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের উন্নতি বিস্ময়কর। এমডিজির সাফল্যে জাতিসংঘের স্বীকৃতির লগ্নে এই ধাঁধাটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বিনায়ক সেন : এই স্বীকৃতির শুরুটা ২০০০–এর দশকে। আমি কিন্তু আরেকটু পেছনে থেকে আসতে চাই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজির অগ্রগতি পরিমাপ করা হয় নব্বই সালের অবস্থার নিরিখে। অথচ নব্বই পর্যন্ত বহির্বিশ্বে ধারণা ছিল, বাংলাদেশ খুব একটা এগোচ্ছে না। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তি এ ধারণাকে জোরের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করেন, তিনি আবু আবদুল্লাহ। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ২৫ বছর, একটি ইতিবাচক প্রেক্ষিত’ প্রবন্ধে তিনি দেখান, ওই ধারণা বেঠিক। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে তিনি দেখান সামগ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাথমিকে ভর্তি, শিশুমৃত্যুর হারসহ আরও কিছু সূচকে মাথাপিছু আয়ের সাপেক্ষে বাংলাদেশ সম্ভাব্য অর্জনের তুলনায় বেশি আগুয়ান। এরপর ২০০৪ সালে ফরাসি অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ লিখলেন: বাংলাদেশ শোজ দ্য ওয়ে। তাঁর দাবি, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে, বিশেষ করে মৌলিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ও অমর্ত্য সেনের যৌথ গ্রন্থ অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন-এ আরও পরিসংখ্যান দিয়ে দাবিটাকে তিনি জোরালো ভিত্তি দেন। সুতরাং ধারাবাহিক উন্নতির সমান্তরালে ধারাবাহিক স্বীকৃতিও আসছিল। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হলেন। এতে আমি অন্তত বিস্মিত হইনি। ২০০১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের শুরুতেই আমরা কিন্তু এই সাফল্যের পূর্বাভাস দেখিয়েছিলাম। সুতরাং তিন দশক ধরেই বাংলাদেশের সাফল্যের পাণ্ডুলিপি রচিত হয়ে আসছে।
প্রথম আলো : এই তিন দশকের প্রচেষ্টা ও সাফল্যের ইতিহাসে অনেকগুলো সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিভেদ সত্ত্বেও তার মানে প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা ছিল?
বিনায়ক সেন : তার মানে এমডিজি রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। যে-ই সরকারে থাকুক, তারা মনে করেছে এমডিজিতে আরও সাফল্য মানে জনগণের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা, আরও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। এভাবে উন্নয়নের ফলাফল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে উঠল। শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে এক সরকারের কর্মসূচি পরের সরকার বাতিল না করে বরং আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে এবং সেটার বাহবা নেওয়ারও চেষ্টা করেছে। নব্বইয়ের পর কয়েকবার সরকার পরিবর্তন হলেও এই প্রতিযোগিতা বহাল থেকেছে। তবে সত্য যে, এই প্রচেষ্টার সূত্রপাত সত্তরের দশকে। বিশেষ করে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পরে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এই উপলব্ধিতে আসেন যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য উৎপাদন ও নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। খাদ্য উৎপাদন না বাড়ালে খাদ্য-দারিদ্র্য কমবে না। আবার নারীশিক্ষার প্রসার না ঘটলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হবে না। সুতরাং এমডিজি প্রবর্তনের আগেই নব্বইয়ের দশকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কতগুলো কর্মসূচি চালু হয়েছিল। যেমন আশির দশকে টিকাদান কর্মসূচি, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা নব্বই দশকে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু হয় আশির দশকের শেষে। এসবই প্রমাণ করে, অঘোষিতভাবে হলেও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা সামাজিক চুক্তি হয়ে ছিল যে কিছু বিষয়ে আমরা অগ্রগতি ঘটাব। এটাই আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের অর্থনৈতিক মূল্যবোধ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই মূল্যবোধ আরও দৃঢ় হয়েছে।
প্রথম আলো : নব্বইয়ের দশকে একগুচ্ছ নতুন অর্থনৈতিক চালক, যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মসূচি, বাজার, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদির কী ভূমিকা?
বিনায়ক সেন : এ অর্জন একক চালিকাশক্তি দিয়েও হয়নি, এক পথেও হয়নি। সরকারি খাতের পাশাপাশি এনজিও খাতেরও সমান্তরাল অবদান ছিল। এনজিও-জিও সহযোগিতার যুক্তি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। অমর্ত্য সেন যে পাবলিক অ্যাকশনের কথা বলেন, তার মধ্যে সরকারের পাশাপাশি এনজিও, বৃহত্তর অর্থে স্থানীয় জনগণ ও সামাজিক উদ্যোগও আছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় পাবলিক অ্যাকশনের ধারণা আরও প্রসারিত হয়েছে। এখন সবার হাতে মুঠোফোন, গণযোগাযোগ নিবিড়। এই সুবাদে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়টা একজন স্বাস্থ্যকর্মীর যাওয়া না যাওয়ার ওপর এখন আর পুরোটা নির্ভরশীল নয়। জনবসতির ঘনত্ব বেশি থাকায় তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি, নারীশিক্ষা, ছোট পরিবার, পরিচ্ছন্নতার স্লোগান—এখন বাস-স্কুটারের পেছনে লেখা থাকতে দেখা যায়। একে বলা যায় দেখা থেকে শেখা।
প্রথম আলো : এমডিজি পূরণের পর কী কী ঘাটতি রয়ে গেল?
বিনায়ক সেন : তিনটি ক্ষেত্রে ঘাটতি চিহ্নিত করতে চাই। প্রধান হচ্ছে, পরিমাণে এগোলেও গুণগত মান অর্জিত হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ভালো, কিন্তু সমাপ্তির হার ভালো না। শিক্ষার মানও ভালো না। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অষ্টম শ্রেণি পাস করলে ছেলেমেয়েরা পঞ্চম শ্রেণির জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। তার মানে যারা পঞ্চম শ্রেণির আগে ঝরে যাচ্ছে, কিংবা যারা শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যাচ্ছে, তারা তৃতীয় শ্রেণির পর্যায়ে পড়ে থাকছে। এটা গুণগত মানের প্রশ্ন। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা প্রতিষেধকে সাফল্য অর্জন করেছি, কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি। এটা বেশি প্রযোজ্য গরিবদের বেলায়। এরপর আসে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সামাজিক অসাম্য। ডিএইচএস দেখাচ্ছে, তলার ১০ শতাংশের সঙ্গে উচ্চের ১০ শতাংশের মধ্যে এখনো প্রচণ্ড বৈষম্য বিদ্যমান। হাওর ও পার্বত্য দুর্গম এলাকায় সেবাগুলো যায়নি। সুশাসনগত সমস্যা, তথা দুর্নীতি ও দলীয়পনা রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ স্তরেই কর্মসূচিগুলো থেমে গেছে।
প্রথম আলো : এমডিজির পর এসডিজি ঠিক করা হলো ১৫ বছরের জন্য। দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, এসডিজিতে লক্ষ্যমাত্রা বিমূর্ত ও কর্মপন্থা অবাস্তব।
বিনায়ক সেন : এমডিজির এই ঘাটতিগুলো এসডিজিতে অর্জনের লক্ষ্য হিসেবে রাখা আছে। এমডিজির আটটি লক্ষ্য ছিল, এসডিজিতে ১৭টি। এমডিজিতে দারিদ্র্য নিয়ে কথা ছিল, কিন্তু বৈষম্য নিয়ে কথা ছিল না। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে তিনটা দিকে আমি বিশেষভাবে উৎসাহী: যেমন ১০ নম্বর লক্ষ্যে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশের আয়বৃদ্ধির হার জাতীয় আয়বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হতে হবে। অর্থাৎ দরিদ্রতম ৪০ শতাংশের আয়বৃদ্ধি জাতীয় আয়বৃদ্ধির চেয়ে বেশি হওয়া দরকার। এই লক্ষ্যটা তাৎপর্যপূর্ণ। এর পাশাপাশি বলা হয়েছে টেকসই উন্নয়নের কথা। টেকসই উন্নয়ন বলতে সামাজিক সংহতিমূলক সামগ্রিক উন্নয়ন বোঝায়। আমরা অনেকেই এই চ্যালেঞ্জটাকে লক্ষ্য হিসেবে নেওয়ার জন্য পাঁচ-সাত বছর ধরে বলে আসছি। আমরা চাইছি আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য, ভোগবৈষম্য কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার পথনির্দেশ।
প্রথম আলো : আমরা এখন নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ, এ পর্যায়ে জনগণ তো জীবনযাপনের সংগতিপূর্ণভাবে উচ্চমান ও অধিকার দাবি করবে?
বিনায়ক সেন : বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৩০-এর মধ্যে দারিদ্র্য ৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে পারলেই ধরে নেওয়া হবে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ৩ শতাংশ জনসংখ্যাও কিন্তু বিরাট আকারের। এসডিজির ৪ নম্বরে বলা হয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা। তার মানে এমডিজির যে অসম্পূর্ণতা ছিল, এখানে সেটাকে লক্ষ্য ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান আন্তর্জাতিকভাবে যাচাইয়ের পদ্ধতি নেই। এখন পৃথিবীর প্রায় ৭০টির মতো দেশ আন্তর্জাতিক মান যাচাইয়ের অংশ। ভারতের দুটি রাজ্য এর অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষার মানের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এ ধরনের আন্তর্জাতিক যাচাইব্যবস্থার অংশ করতে হবে। যখন বলছি যে আমরা নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরিত হয়েছি, তখন তো এসব মান অর্জন জরুরি। আবারও বলছি, মানের দিকটা অর্জিত হবে না, যদি এক নম্বর লক্ষ্য দারিদ্র্য নির্মূল এবং ১০ নম্বর লক্ষ্য আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা না যায়।
প্রথম আলো : এমডিজি পূরণ হয়েছে, কারণ বিশ্বের দারিদ্র্যের বিপুল অংশের যেখানে বাস ছিল, সেই চীন একাই তা দূর করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশের বেলায়ও ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরিত হয়েছে। তাই এমডিজি ও এসডিজির পুরোনো পদ্ধতি কতটা কার্যকর?
বিনায়ক সেন : পুরোনো পদ্ধতির কিছু কিছু কাজে লাগবে যেমন এনজিওগুলোর অংশগ্রহণ বা বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলেও খরচ বাড়াতে হবে। তেমনি দারিদ্র্য হ্রাস থেকে সম্পূর্ণ দূরীকরণ করতে চাইলেও বিপুল ব্যয় চাই। পুরোটাই শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে সম্পদের যথাযথ সমাবেশের ওপর। আগের তুলনায় অনেক বেশি দরিদ্র মানুষের প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে বা তাদের সব সহায়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো : পশ্চিমা সরকারগুলোর তরফে এমডিজিতে তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এসেছে প্রতিশ্রুতির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। দারিদ্র্য নিরসনে বৈশ্বিকভাবে বছরে যে ৬৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, তা কোথা থেকে আসবে?
বিনায়ক সেন : দেশীয় স্তরে বলতে পারি যে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপির বর্তমান ১২ থেকে ১৩ শতাংশ দিয়ে এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়। ন্যূনতম সুশাসন বজায় রেখে কীভাবে আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারি এবং আয়বৃদ্ধিকে যথাযথ করারোপ করে দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয় করতে পারি। অর্থাৎ মোটামুটি আইনশৃঙ্খলা, মোটামুটি সুশাসনের মাধ্যমে উন্নতির মাধ্যমে যে আয় সৃষ্টি হবে, তার ওপর আগের চেয়ে আরও বড় আকারে করারোপ করতে হবে। আর তা ব্যয় করতে হবে সামাজিক শিক্ষা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ খাতে। সুতরাং ধনীদের ওপর আগের ছেয়ে বেশি করারোপ করতে হবে। পাশাপাশি চেষ্টা করতে হবে ন্যূনতম সুশাসন থেকে পূর্ণ সুশাসন ও ন্যূনতম গণতন্ত্র থেকে পূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণের। উন্নয়নের ধারা ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রেখেই তা করতে হবে। এভাবে গণতন্ত্র ও সুশাসনের চাহিদা যত বাড়বে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের দাবিও তত বাড়বে। যেমন আমি আশা করছি আগামী ১৫ বছরে এসডিজি যখন বাস্তবায়িত হবে, তার মধ্যে তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আকার ও চাহিদা বাড়তে থাকবে। এই বর্ধিত চাপের কারণেই আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি গতিশীল, জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক হতে বাধ্য হবে। এই বাস্তবতাকে আমাদের রাজনৈতিক কর্তারা আমলে নেবেন আশা করি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।

প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হওয়া অবাস্তব নয়

Dr. Binayak Sen photoপ্রস্তাবিত বাজেট, দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত, দুর্নীতি, সুশাসন, রাজস্ব সংগ্রহসহ ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সমতামুখী প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করছেন তিনি। বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের এই সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা জার্নাল ও বইপত্রে ৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

প্রথম আলো : প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?
বিনায়ক সেন : বাজেট নিয়ে আশির দশকে, এমনকি ষাটের দশকেও সমালোচনা থাকত। এখন তা ছিদ্রান্বেষী নিন্দা ও লাগামছাড়া স্তাবকতা—এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যেখানে যতটুকু ভালো হয়েছে, তা বলা উচিত। আর মন্দ হলে মন্দ বলতে হবে। একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, শক্তিশালী দিককেও দুর্বলতম বলা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমার কাছে পরিহার্য। যেমন ধরুন, আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরাটা খুবই বাস্তবোচিত হয়েছে। প্রথমত, প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাভাবিক বছর পেলে ৭ শতাংশ অর্জন করা অবাস্তব নয়। দ্বিতীয়ত, ঘাটতি বাজেট ১৫ বছর ধরেই ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতিও ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে আশা করা যায় দেশে ভালো ফলন ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার কারণে।
প্রথম আলো : তিনটি কারণকে বিবেচনায় নিয়েই আপনার এত বড় আশাবাদ? সার্বিকভাবে দেশের মৌলিক বাজেট–শৃঙ্খলা কি ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন : আমি বলব সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট–শৃঙ্খলা একরকম ঠিকই আছে। এখন যদি দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারল না, তখন ব্যয়ের কাঠামো কাটছাঁট করতে হবে। আর এই কাটছাঁটের পরও যদি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে, প্রবৃদ্ধির হার যদি ৭ শতাংশ অর্জন করা যায়, মূল্যস্ফীতি যদি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে আমি এটাকে সময়োচিত ও বাস্তবোচিত বাজেটই বলব। এটা বলার পরই আমি মূল কথাটি বলতে চাইছি।
প্রথম আলো : সেটা কী?
বিনায়ক সেন : মূল কথাটা হচ্ছে আমরা এখনো আলোচনাটা সাধারণ মানের প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আটকে রাখছি। সমতামুখী প্রবৃদ্ধি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছি না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির তিনটি মাত্রা রয়েছে। একটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা। প্রবৃদ্ধিকে ওঠা–নামা থেকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধিকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, অর্থাৎ এতে সমাজের সবার ও দেশের সব অঞ্চলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে আয়বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ যত দিন যাচ্ছে, তত আমরা অধিক বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হতে পারছি কি না। ২০১০ সালের আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, আয়বৈষম্যের সূচক বেশ উঁচু পর্যায়ে চলে গেছে।
প্রথম আলো : সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা কতটুকু কী করতে পারছি?
বিনায়ক সেন : প্রথমটি মোটামুটি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্বশীলতা অর্জনে ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের। অনেকেই একে ৬ শতাংশের ফাঁদ বলছেন, কিন্তু আমি ‘ফাঁদ’ বলতে রাজি নই। একনাগাড়ে প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশ হার অর্জনের দেশ খুব বেশি নেই। এক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সংকটও তৈরি হয়েছে। সবকিছুর পরও স্থায়িত্বশীলতার নিক্তিতে আমাদের অর্জন বেশ ভালোই বলা যায়।
প্রথম আলো : বাকি দুটির অবস্থা তাহলে ভালো নয়?
বিনায়ক সেন : না, সেটা না। যেমন অংশগ্রহণমূলক দিক থেকে আমি বলব আংশিক সাফল্য এসেছে। দুই দশক আগেও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৫ শতাংশ। এখন ৩৩-৩৪ শতাংশ। এটা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা গেলে প্রবৃদ্ধি যেমন ত্বরান্বিত হবে, আয়ও বাড়বে। আবার যুবশক্তির মধ্যে পোশাক ও কৃষি খাতের অদক্ষ-আধা দক্ষ শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণ থেকে সাফল্য পাইনি। কারণ, আমাদের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সব কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে চালিত। এবারের বাজেট বক্তব্যে অবশ্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে বণ্টনবৈষম্য দূর করার ইঙ্গিত রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অর্থায়নে একটা আলাদা কৌশলপত্র হওয়ার কথা। সেটা যদি সত্যি হয়, এবার থেকেই যেন বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের জন্য রাখা হয়। ভারতের কেরালায় যা আছে এক-তৃতীয়াংশ।
প্রথম আলো : সে হিসাবে বাজেটের মোট আকার থেকে স্থানীয় সরকারের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
বিনায়ক সেন : হ্যাঁ। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের জন্য থাকতে পারে। বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা থাকতে পারে নগরাঞ্চলের জন্য। এতে লাভ যেটা হবে, প্রতিবছর বাজেট বাস্তবায়ন করতে না পারার যে সমালোচনা আছে, সেটা দূর হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে না, ততটুকু বরাদ্দ দিলেও একটা কাজ হবে। আর তাতে দরিদ্র অঞ্চল, বিশেষ করে হাওর, লবণাক্তপ্রবণ, বন ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষও সমানভাবে উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে।
প্রথম আলো : বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বললেন না?
বিনায়ক সেন : বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। সম্পদবৈষম্যকে যদি আঘাত করতে হয়, তাহলে সম্পদের ওপর আয়কর সারচার্জ সংগ্রহের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করতে হবে। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়। ফলে মাত্র ১০ হাজার লোক এই আয়কর সারচার্জ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদের মালিক মাত্র ১০ হাজার লোক—এটা অবিশ্বাস্য।
প্রথম আলো : সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন থেকে সরকার কীভাবে লাভবান হতে পারে?
বিনায়ক সেন : এতে রাজস্ব আয় বাড়বে, যা বৈষম্যহীন প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি কয়েক বছরে দেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে। তাঁদের কাছ থেকে আয়কর সারচার্জ এবং/অথবা প্রত্যক্ষ সম্পদ-করের মাধ্যমে (যা এখনো বাজেটে নেই) অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করা সম্ভব। তবে দুই বছর ধরেই একটি ভালো দিক লক্ষ করছি। এখন প্রত্যক্ষ বা আয়করকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগ সমতামুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনেরই উদ্যোগ। পোশাকশিল্পসহ প্রতিষ্ঠিত রপ্তানি খাতগুলো থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ১ শতাংশ হারে কর বসানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রবৃদ্ধিকে সমতামুখী করবে। আর শিশু-শিল্প হলে কর-রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যারা ভালো প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তাদের থেকে কিছুটা আয়কর আদায় করা জরুরি।
প্রথম আলো : কিন্তু মানুষের প্রথম চাওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও যানজট নিরসন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে—আমাদের এখন সে ধরনের অবকাঠামো দরকার। আবার প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাও বড় কথা। মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তাদের সমস্যার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আগে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ছিল কৃষি অর্থনীতি ও রপ্তানি, এখন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে হবে নগর অর্থনীতি ও রপ্তানি। ফলে নগরে ও নগরবাসীর জন্য এখন বেশি হারে বিনিয়োগ করতে হবে। যানজট নগরবাসীর কর্মজীবনের বড় একটা সময় খেয়ে ফেলছে। বাজেটে যানজট নিরসনে বা নগর অর্থনীতি উন্নয়নে তেমন কোনো কৌশলগত নির্দেশনা নেই। ঢাকার বাইরে শহরগুলোর অবকাঠামোগত পরিবেশ আরও খারাপ, অথচ শহরেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি করে জড়ো হচ্ছে। আর অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতির একটা উদ্যোগ সরকার নিলেও এর কোনো ফল দেখা যায়নি। পিপিপিতে ৪৩টি প্রকল্প নিয়ে অর্থমন্ত্রী আর জানালেন না কোনটির কী হাল? বিদ্যুৎ যেমন জাতীয় তাগিদ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, অবকাঠামো খাতেরও একই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
প্রথম আলো : তাহলেই কি সমতামুখী প্রবৃদ্ধি আসবে?
বিনায়ক সেন : না। সমতামুখী প্রবৃদ্ধির জন্য আরও দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভালো বরাদ্দ। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রয়োজনের ধারে-কাছেই তিনি যেতে পারেননি। স্বাস্থ্য খাতেরও একই অবস্থা। এ দুই খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতায় বিস্মিত না হয়ে পারি না। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা মাসে ৩০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে রাজি থাকলেও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা পলিসি চালু করা যায়নি।
শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও রয়েছে। যেমন মাদ্রাসাশিক্ষা থেকে সবচেয়ে কম ফল (রিটার্ন) পাওয়া যায়। অথচ মাদ্রাসাশিক্ষা-ব্যবস্থায় যদি কারিগরি শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়, ভালো ফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় আমাদের বুয়েট ভালো, ঢাকা মেডিকেল কলেজও (ডিএমসি) ভালো। দরকার ছিল বুয়েটের মতো আরও পাঁচটা ‘বুয়েট’ করা, ডিএমসির মতো পাঁচটা ‘ডিএমসি’ করা। ভারতে যেমন করে প্রথম সারির বেশ কিছু আইআইএম, আইআইটি ও মেডিকেল কলেজ আছে। সেদিকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছি না। মোটের ওপর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আগামী ১০ বছরে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রিকার্ডো হাউসম্যান সম্প্রতি হিসাব করে বলেছেন, শ্রমশক্তির মান গড়ে তিন বছর স্কুলশিক্ষা থেকে আট বছর স্কুলশিক্ষার মানে উত্তীর্ণ করতে পারলে জিডিপির আকার শুধু এ কারণেই দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
প্রথম আলো : আমাদের আর্থিক খাত কি ঠিকভাবে চলছে? দুর্নীতি কী করে কমবে, সুশাসনের কী হলো?
বিনায়ক সেন : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কর-রেয়াত এবং ব্যাংকঋণ—এ দুই বিকল্পের ক্ষেত্রে একজন শিল্পপতি যদি দেখেন ব্যাংকঋণ ফেরত দিতে হচ্ছে না, তখন কর-প্রণোদনা কাজ করবে না। কর-প্রণোদনার নীতি আর্থিক-প্রণোদনার নীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আর্থিক খাতে এখনো শৃঙ্খলার অভাব। উচ্চ খেলাপি ঋণের হার থেকে আমরা বের হতে পারছি না। উচিত হবে সোনালী ব্যাংককে হাতে রেখে বাকিগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। কেননা, সরকারি খাতেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ বেশি। অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, বেসরকারীকরণের পর তা যেন গুটি কয়েক মুখচেনা শিল্প-ব্যাংক পরিবারের কাছে চলে না যায়।
দুর্নীতি হ্রাস বা সুশাসন চালু সরকার চাইলে অনেকখানিই পারবে। বলছি না যে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খাতভিত্তিক সুশাসন তো আমরা চাইতেই পারি; অন্তত কয়েকটি খাতে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে যারা টাকা কামাচ্ছে, তাদেরও ধরা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যৌথভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নজরদারি করলে অবৈধ উপায়ে টাকা কামানো, কর ফাঁকি দেওয়া ও খেলাপি হওয়া—এসব রোধ করা অনেকখানিই সম্ভব।
প্রথম আলো : করদাতার সংখ্যা সরকার তেমন বাড়াতে পারছে না। কোনো পরামর্শ?
বিনায়ক সেন : ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। আরও চার কোটি মানুষ আছে দারিদ্র্যঝুঁকিতে। বাকি থাকল আট কোটি মানুষ, তথা ১ কোটি ৬০ লাখ পরিবার (পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাবে)। পরিবারে যদি একজন আয় করেন, তাহলেও আয়করের আওতায় আসতে পারেন ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যক্তি। এর মধ্যে শহরবাসী ৫০ লাখ। অথচ বর্তমানে আয়কর দেন কেবল ১০ লাখ লোক। শুধু নগরমুখী করেও প্রায় পাঁচ গুণ আয়করদাতা বাড়ানো সম্ভব। তাই বলব যে উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস সম্প্রসারিত না করে শহর পর্যায়ে এর কার্যক্রম আরও জোরদার করা হোক।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কীভাবে দেখছেন?
বিনায়ক সেন : নদী আমাদের প্রাণ, ট্রানজিট তাঁদের প্রাণ। কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকে আমরা তাঁদের পানির বিনিময়ে ট্রানজিট দিতে পারি।
প্রথম আলো : আপনাকে বাজেট প্রণয়নের দায়িত্ব দিলে কোন খাতে অগ্রাধিকার দিতেন?
বিনায়ক সেন : অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে। অবকাঠামো উন্নয়নের গুরুত্বের কথা যদি বলি, দেখুন, এক যমুনা সেতুর কারণে আশির দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ থেকে আমরা ২০০০ সালের পর ৫-এর ওপরে উঠেছি। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হলে নিশ্চয়ই ৭-এর ওপরে ওঠা সহজ হবে। আর নীল (সমুদ্র) অর্থনীতি চাঙা করতে পারলে তো কথাই নেই।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।

বিশেষ সাক্ষাৎকার: রাজনীতিকে যে বাস্তবতা বুঝতে হবে

বিনায়ক সেন অর্থনীতিবিদ। এখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩)। বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) প্রণয়নে জড়িত ছিলেন, ছিলেন ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্যানেল অব ইকোনমিস্টের সদস্য এবং বর্তমানে বেতন ও চাকরি কমিশনের সদস্য। দারিদ্র্য, বৈষম্য, মানব উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি তাঁর গবেষণার বিষয়। এ নিয়ে তাঁর ৫০টিরও বেশি প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থ ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে তাঁর অনুরাগের প্রকাশ হিসেবে লিখছেন সাহিত্য-ঘেঁষা প্রবন্ধ। তাঁর লেখালেখির ই-ঠিকানা binayaksenbd.com

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি যতটা, রাজনীতি তার বিপরীতে চলছে কেন?

বিনায়ক সেন: রাজনৈতিক উন্নতি কখনোই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেনি কোনো দেশে। আমি সেই আদি মার্ক্সীয় ধারণার বিশ্বাসী যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি অনেকটা ঘটার পরই রাজনৈতিক উন্নতি আসে। উন্নত দেশগুলোয় উনিশ শতকজুড়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আজকের অর্থে সর্বজনীন ভোটাধিকারের গণতন্ত্র তখন ছিল না। পূর্ব এশিয়ার উত্থিত দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নতির পরই গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথমত, এখন বেশি করে গণতন্ত্রের প্রশ্নটা সর্বত্র উঠছে কেন? বাংলাদেশে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, যখন আমরা সত্যি সত্যি রাজনৈতিক উন্নতি আশা করতে পারি? আমার চলতি গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি, ১৯৯১-২০১০ পর্বে অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে (যাদের আয় মাথাপিছু দৈনিক দুই থেকে চার পিপিপি ডলারের মধ্যে)। প্রায় তিন গুণের মতো বৃদ্ধি পাওয়া এই মধ্যবিত্তের একটা অংশ আবার গত দুই দশকে শহরমুখী ও বিদেশমুখী হয়েছে। এই বিস্তৃত ও সক্রিয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী গণতন্ত্রের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। এরা পরিবর্তনের সামাজিক ভরকেন্দ্র। এদের মধ্যে রাজনীতির উন্নতি দেখার বাড়তি প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথম আলো: পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এখনকার চেয়ে কম সংখ্যানুপাতে মধ্যবিত্ত থাকার পরও তো রাজনীতি বিকশিত হয়েছিল।

বিনায়ক সেন: হ্যাঁ, স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে ‘সংখ্যানুপাতের স্বল্পতা’ রাজনৈতিক উন্নতির বাধা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত তখন ও এখনকার মধ্যবিত্তের চরিত্রের গুণগত পার্থক্য। তখনকার মধ্যবিত্ত ছিল প্রথম প্রজন্মের কৃষক সন্তান। তাদের পক্ষে কৃষকের জাতীয়তাবাদকে, তার আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করা সহজতর ছিল। গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত যতই এগিয়েছে, কৃষকের সঙ্গে তার যোগসূত্র ততই দুর্বল হয়েছে। এই নতুন মধ্যবিত্তের বেড়ে ওঠা শহরে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আবহে তারা লালিত। তারা থাকছে ঢাকা শহরে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনি ও প্যারিসে। কৃষক বিচ্ছিন্নতা এদের কুল-লক্ষণ। তার পরও যতটা রাজনৈতিক উন্নতির জন্য তারা সোচ্চার হতে পারত, সেটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না বিলাসবহুল জীবনচর্চার কারণে। আমাদের এখানে চরিত্রের স্থিরতা নেই, শ্রেণী-চরিত্রেরও স্থিরতা নেই। শ্রেণী-বিভাজন ও সামাজিক সচলতা এত দ্রুত হলে বোধ করি এই হয়। এখানে বুদ্ধিজীবীরা আমলা হতে চায়, আমলারা হতে চায় ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। এ অবস্থায় দ্রুত রাজনৈতিক উন্নতি আশা করা যায় না।

প্রথম আলো: তাহলে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার রাজনৈতিক পূর্বশর্ত কীভাবে তৈরি হবে? স্থিতিশীলতা ও উন্নতির জন্য কী ধরনের পরিবর্তন দরকার হবে?

বিনায়ক সেন: আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নজর কেড়েছি; কিন্তু রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে হুতু-তুতসি ধরনের বিরোধাত্মক সমাজে পরিণত হতে পারি। এরও মূলে রয়েছে দ্রুত হারে ও অবৈধ পন্থায় সংগৃহীত অর্থবিত্তের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য। এই অবৈধ বৈষম্যই রাজনৈতিক বিরোধাত্মক সমাজের মূলে প্ররোচনা জোগাচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে প্রতিষ্ঠা করে এই অবৈধ বৈষম্যের মোকাবিলা করা যাবে না। যিনি আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে যাবেন, তাঁর শাসনের নৈতিক বৈধতা থাকা জরুরি। মানুষ অবৈধ শাসনের আইন ও শৃঙ্খলার যুক্তি মানতে চায় না। এ অবস্থায় দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় যেখানেই অবৈধ ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ দানা বাঁধে। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর দুটি বিপরীতমুখী চিন্তাধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসন। এমন ছিল ষাট-সত্তরের দশকের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বা যেমনটা এখনো আছে চীনে ও ভিয়েতনামে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পূর্ণতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুশাসন, যা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দিতে পারে। এটি অবশ্যই শ্রেয়তর সমাধান, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে এটা কার্যকর হতে পারে না।

কর্তৃত্ববাদী শাসন বেশি দিন টেকে না, আবার পূর্ণ গণতন্ত্রেও হঠাৎ করে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেই একধরনের মাঝামাঝি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও কেউ বলেছেন একে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র, আবার কেউ বলেছেন সংকর গণতন্ত্র। এর নানা প্রকারভেদ আছে। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ এক দলই ক্ষমতায় ছিল। ভারতে কংগ্রেস প্রথম দিকে প্রায় টানা ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। মিশ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন মিশ্র গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক উন্নতির পথ-বিকল্প খোঁজার সুযোগ রয়ে গেছে। আমাদের দেশে গত দুই দশকে যা ছিল তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। একে নির্জলা কর্তৃত্ববাদী শাসন বলাও ভুল, আবার বিশুদ্ধ গণতন্ত্র বলাও ভুল। উন্নয়নের এই পর্যায়ে এটাই আমাদের বিধিলিপি। এই ধারাকে রাজনৈতিকভাবে আরও উন্নত করে সহনীয় ধারার মিশ্র বা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। তা করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি আরও বেগবান হবে। এ ব্যাপারে আমরাই হতে পারি তৃতীয় বিশ্বের কাছে মিশ্র গণতন্ত্রের এক নতুন রোল মডেল। কিন্তু ব্যর্থ হলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমরাও অসহিঞ্চু বা অত্যাচারী গণতন্ত্রের স্থায়ী ঝুঁকিতে পড়ে যাব।

প্রথম আলো: কিন্তু এই প্রক্রিয়া কি নির্বাচনকে এড়িয়ে চালানো সম্ভব? বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা কি সম্ভব?

বিনায়ক সেন: কারা ক্ষমতাসীন হবে, তার জন্য অবাধে নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, ক্ষমতার শাসনেরও রাজনৈতিক উন্নতি চাই। কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উন্নতি আনতে হলে দলীয় প্রার্থীদের গুণগত মান বৃদ্ধি করাই পরীক্ষিত পথ। নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয় ও অর্থায়ন (ক্যামপেইন ফাইন্যান্স) ব্যবস্থার সংস্কার করা এর পূর্বশর্ত। ২০০৭ সালের দিকে এ নিয়ে আলাপ শুরু হলে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রাথমিক আগ্রহও দেখিয়েছিলেন। সেই আগ্রহ আবার জাগানো দরকার। এখন তো মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীর গুণগত মানের চেয়ে অর্থবিত্ত ও পেশিশক্তিকে প্রায়ই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর ফলে খারাপ প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কাঠামোগতভাবে থেকে যায়। মনোনয়ন-বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে এই সূত্রেই। এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই হয় না, রাজনৈতিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হয়।

সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের আরও একটি দিক হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল না হলেও কিছুটা পরিবর্তন। যেমন, দলে ধারাবাহিকভাবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করা। আমরা গণমাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চার দৃশ্য দেখতে চাই—সেটা শুধু প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, নীতিমালা নিয়ে দলের ভেতরে বিতর্ক বা মতপার্থক্য বিষয়েও। কর্তৃত্ববাদী মিশ্র গণতন্ত্র মানে এককেন্দ্রিক শাসন নয়। ১৬ কোটি মানুষের দেশকে এক কেন্দ্র থেকে যথাযথ শাসন করা সম্ভব নয়। কেন উপজেলা-কাঠামো শুধু নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে থাকবে? কেন বিভাগীয় পার্লামেন্ট ধরনের কাঠামো গড়ে তোলা যাবে না? কেন শহর-প্রশাসনে আরও গভীরে বিকেন্দ্রীভবন হবে না? এর ফলে শুধু প্রশাসনের মানই বাড়বে না, জাতীয় সংসদেরও মান বাড়বে।
আরেকটি অনালোচিত দিক হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। আওয়ামী লীগ জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, বিএনপি জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, আর বাদবাকি ২০ শতাংশ দলীয় সমর্থক নন—তাঁরা পারফরম্যান্স বুঝে ভোট দেন। এই সুইং ভোটাররাই সরকারের বদল আনেন। কিন্তু সংসদে আসনের ফলাফলে এটা প্রতিফলিত হয় না। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একটা প্রস্তাব হচ্ছে, ৩০০টি আসনে যেমন হচ্ছে তেমনই ধারার ভোট হোক; কিন্তু এর অতিরিক্ত আরও ১৫০টি আসনের বণ্টন বা নির্বাচন হোক জাতীয়ভাবে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে। এভাবে দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারবে। এই ‘মিশ্র’ নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে যেমন রাজনীতিতে ভারসাম্যআসবে, তেমনি দুই প্রধান দলের মধ্যে সাংঘর্ষিক উত্তাপও কমে আসবে বলে অনুমান করি। এককথায়, কর্তৃত্ববাদী শাসন ও পূর্ণ গণতন্ত্রের মাঝামাঝি যে সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের কথা বললাম, সেখানে রাজনৈতিক উন্নতি ঘটানোর ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অনেক অবকাশ রয়ে গেছে।

প্রথম আলো: দুটি ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে অন্তহীন শত্রুতার রাজনৈতিক ব্যাকরণ না বদলিয়ে তা কি সম্ভব?

বিনায়ক সেন: কেবল ৪০ শতাংশ সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করা যেমন সম্ভব নয়, অন্যদিকে ৪০ শতাংশ নিয়ে বিএনপির পক্ষেও জাতির প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়। এটি হচ্ছে মৌলিক সমকক্ষতার প্রশ্ন। এর থেকে চারটি কথা বলতে চাই। এক. আ.লীগকে যত দ্রুত সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও আলোচনা শুরু করতে হবে। এ পথেই দলের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিহিত। দুই. বিএনপিকে ইতিহাসের দাবিকে বুঝতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ধারারই অংশ। তাদের এই ক্ষেত্রটিকে পুনরায় অধিকার করতে হবে। গত দুই দশকে যে তরুণ প্রজন্ম আধুনিকতার ধারায় বিকশিত হয়েছে, এটি তাদেরও প্রাণের দাবি। তিন. ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একটি মাত্র অর্থ বা ব্যাখ্যা হতে পারে না। ভারতে ১৯৪৭-র ‘স্বাধীনতার চেতনা’ নিয়ে বিতর্ক নেই। সেখানে গান্ধীর পাশাপাশি ‘বামপন্থী’ নেহরু ও ‘ডানপন্থী’ প্যাটেলের চেতনাও আছে, দলিত প্রতিনিধি আম্বেদকরে নেতাজি সুভাষ বসুর চেতনাও আছে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাও আছে। সেভাবে আ.লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়াও বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুজিবের পাশাপাশি ভাসানীর চেতনার বিশিষ্টতার অবকাশ রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর কোনো দলের একচেটিয়া চলতে পারে না। অন্যদিকে সব দলকেই দলীয় মতপার্থক্য সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাবাদর্শিক জমিনেই দাঁড়াতে হবে।

চার. জন রাউলস তাঁর ‘রিজনেবল প্লুরালিজম’-এর ধারণায় ধর্মীয় দল ও ধারাকেও স্থান দিয়েছেন—যদি তারা বর্ণবাদী, সামপ্রদায়িক বা জাতিবিদ্বেষী মতবাদ প্রচার না করে। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-বাস্তবতায় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নির্যাতিতের পক্ষে যেমন দাঁড়িয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমাদের দেশে জামায়াতে ইসলামী ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর ধারায় রয়েছে এবং এর সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু একাত্তরকে অস্বীকার করে স্বীয় মতাদর্শের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দলটির পক্ষে কী করে সম্ভব? একাত্তরের কৃত অপরাধ ও ভুলত্রুটি এবং প্রকৃত যুদ্ধাপরাধের স্বচ্ছ বিচারের বিষয়ে দলটিকে নতুন করে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক ও ভিন্নমত-সহিষ্ণুু সমাজের বিকাশের স্বার্থে এটাই তো কাম্য। দেশটা তো সবার—‘৩৬ জাতি না হলে নাকি রাজ্য চলে না।’ দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শান্তি নেমে আসুক, সেটা তো আমরা সবাই চাই। চাই কি?

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

বিনায়ক সেন: ধন্যবাদ।

নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু করার বিকল্প নেই

ড. বিনায়ক সেন, অর্থনীতিবিদ। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকে সিনিয়র ইকোনমিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনডিপিসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩।) বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) প্রণয়নে অন্যদের সঙ্গে ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। উন্নয়ন গবেষণায় ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’, ‘জন ক্ষমতায়ন’, ‘নৈতিকতা ও উন্নয়ন’ ইত্যাদি বিষয় তাঁর আগ্রহ ও ভাবনার জায়গা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো : অর্থনীতির জন্য বড় বড় ঘটনা যেগুলো, যেমন পদ্মা সেতু প্রকল্প, জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত, হল-মার্ক, শেয়ার মার্কেটের মতো ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ এসব দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত।

বিনায়ক সেন : এই পরিপ্রেক্ষিতে কৌটিল্য বলেছিলেন, যাঁরা তত্ত্বজ্ঞানী হয়েছেন, তাঁদের সমদর্শী হওয়া চাই। গ্লাসটা যে অর্ধেকের বেশি ভর্তি, সেটাও দেখতে হবে। যে বড় বড় উপসর্গের কথা বললেন, সেগুলো এই সরকারের শাসনকালের নেতিবাচক দিক। কিন্তু কোনো শাসনামল বিচারের প্রচলিত রীতি হলো, সেই আমলে প্রবৃদ্ধির হার কেমন ছিল? দারিদ্র্য দূরীকরণ, আয়বৈষম্য কমানো, সামাজিক সেবা সম্পর্কেও বলতে হবে। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে পশ্চিমা জগৎসহ চীন ও ভারতের প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসে। বাংলাদেশ এই সময়ে ৬ শতাংশের সামান্য ওপরে প্রবৃদ্ধিশীল ছিল। এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের ওপরে। বৈশ্বিক স্তরেও বাংলাদেশের সূচক ওপরে ছিল। এ সময়ে রেমিট্যান্সের অব্যাহত প্রবাহ অবকাঠামো নির্মাণে কাজে লেগেছে, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বিশেষত গার্মেন্টসে যা কর্মসংস্থান করেছে, খাদ্য উৎপাদনে অগ্রগতির কারণে খাদ্য আমদানি কম করতে হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শক্ত পর্যায়ে এসেছে। মজুরি অনেক বেড়েছে। শহরের ইনফরমাল ব্যবসা ও সেবা খাতও আগের থেকে শক্তিশালী। আর এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা গেছে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মাধ্যমে। প্রথম দুই বছরে মুদ্রানীতি সংকট সৃষ্টি করলেও গত এক বছরে সংযত নীতি নেওয়ার সুফলও সমাজে পড়েছে।

প্রথম আলো : কিন্তু প্রবৃদ্ধির চরিত্র নিয়েও কথা থাকে। বৈষম্য এবং সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় বেড়েছে। আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক ভিত্তিটাই তো দাঁড়িয়ে আছে সস্তা শ্রম ও বিল-নদী-বন তথা প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠনের মাধ্যমে।

বিনায়ক সেন : প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, একই সঙ্গে সমাজে তীব্রভাবে আয়বৈষম্যও বাড়ছে। এখন আয়বৈষম্যের জিনি সূচক ৪৮-৫০ শতাংশ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়বৈষম্যের সূচকের চেয়েও বেশি। প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও আয়বৈষম্য বাড়া কেন মানুষ মেনে নিচ্ছে? না মানলে এই প্রবৃদ্ধি তো টেকসই হতো না। দুটো কারণ কাজ করছে মনে হয়, আপেক্ষিক বৈষম্য বাড়লেও অ্যাবসলিউট বৈষম্য কমছে। দুই দশকে চরম দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর মাধ্যমে মানুষ কিছুটা সান্ত্বনা পাচ্ছে। আমাদের দেশ কিন্তু ভারত বা পাকিস্তানের মতো আদিতে অতি বৈষম্যপরায়ণ নয়। এখানে বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, জাতিসহ বিভিন্ন রকম বিভাজনের তীব্রতা অনেক কম। বৈষম্য কমার পাশাপাশি গত দুই দশকে সামাজিক গতিশীলতাও বেড়েছে। ১০ বছর আগে যারা চরম দরিদ্র ছিল, ২০১২ সালে তাদের ৫০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে, ১০ বছর আগে যারা দরিদ্র ছিল, তাদের ৩৫ শতাংশ ছিল, তারা এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে গিয়েছে, ১০ বছর আগে যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ছিল, তাদের ১০ শতাংশ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে গিয়েছে। সামগ্রিকভাবে শুধু দারিদ্র্য সূচক বা এমডিজি সূচকে নয়, সচলতার সূচকেও অর্জন হয়েছে। এসব অর্জনের কারণে আয়বৈষম্য বাড়া সত্ত্বেও আপাতত মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা বাড়ছে।

প্রথম আলো : এটা কি একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দুর্নীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে না? দুর্নীতির মাধ্যমে ভালো থাকার চেষ্টা করে পরিবর্তনের চেষ্টা থেকে সরে যাচ্ছে কি না?
বিনায়ক সেন : সম্প্রতি ভারতের সমাজবিজ্ঞানী আশীষ নন্দী এ ব্যাপারে একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি ইজ আ ইকুলাইজিং ফোর্স। দরিদ্রের কাছে নেটওয়ার্কিংয়ের অস্ত্র নেই, তার আছে দুর্নীতির অস্ত্র। যারা আমাদের মতো উচ্চ-মধ্যবিত্ত, যারা নেটওয়ার্কিং সোসাইটির মধ্যে বাস করে, তারা দুর্নীতি না করে ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানো যায়, ভালো চাকরি পাইয়ে দেওয়া যায়, ওমুক ক্লাব তমুক ক্লাবে জড়িত হওয়া যায়, ভালো থাকা যায়। দরিদ্রদের পক্ষে দুর্নীতিই হচ্ছে আয়-উপার্জনের বাইরে একমাত্র অবলম্বন। যাঁরা শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত সমাজের কথা বলেন, তাঁদের আমি ভয় পাই। একমাত্র স্ট্যালিনিজমের মাধ্যমেই শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া গিয়েছিল। সেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করা হলেও দুর্নীতিকে লেশমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। বিদেশিরা আমাদের চাবুক মারার একটা অস্ত্র হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগকে ব্যবহার করে। অনেকে বলেন, দুর্নীতি না হলে বাংলাদেশে আরও প্রবৃদ্ধি হতো। এটা একটা মিথ। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হারের কোনো সম্পর্ক নেই। যেটার সম্পর্ক আছে তা হলো মাথাপিছু আয়ের। অর্থাৎ আপনি যখন পর্তুগালের মতো স্তরে মাথাপিছু আয় তুলতে পারবেন, তখন আপনার সমাজ মোটামুটিভাবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজে পরিণত হবে। আমাদের উন্নয়ন বাড়ানোয়, অবকাঠামো প্রতিবন্ধক আছে, সেসব ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্নীতির ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার মানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক হিসেবে আমাদের বলতেই হবে। আমি হার্টের অসুখে হাসপাতালে গিয়ে দেখি যন্ত্র কাজ করছে না, তার বিরুদ্ধে বলতেই হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দুর্নীতিকে জড়িয়ে বলা ঠিক নয়।

প্রথম আলো : প্রবৃদ্ধি বাড়লে তো বিনিয়োগও বাড়ার কথা। কিন্তু ভোগবিলাসে অথবা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে পুঁজি। এটা কেন?

বিনায়ক সেন : গত ৩০ বছরের বিনিয়োগ ঋণের সঙ্গে মধ্যমেয়াদি ঋণের সম্পর্ক বিচার করেন তাহলে দেখবেন, সেগুলো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োজিত হয়নি। এর পেছনে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতিও কিছুটা দায়ী। এ কারণে পুঁজি চলে গেছে রিয়েল এস্টেটে বা ভোগবিলাসে। বিনিয়োগের ৩০ বছরের সিরিজ বিচার করলে দুটো উল্লম্ফন দেখতে পাব, আশির দশকে বিনিয়োগের হার জিডিপির অনুপাতে ছিল ১২-১৩ শতাংশ। নব্বই দশকে এটা লাফিয়ে ১৭-১৮ শতাংশে উঠে যায়। নব্বই দশকে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বেশ কিছু স্থিতিশীলতার নীতি নেওয়া হয়। যমুনা সেতু নির্মাণও বিনিয়োগের হার বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় উল্লম্ফন হয় ২০০৩-০৪ দিকে। তখন ১৭-১৮ থেকে বেড়ে ২৩-২৪ শতাংশে চলে যায়। সেই অবস্থা এখনো বিরাজ করছে। যাঁরা বলছেন নীতিমালার কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না, তা ঠিক নয়। এর জন্য চমৎকার অনুঘটক ছিল রেমিট্যান্সের প্রবাহ এবং রপ্তানিমুখী গার্মেন্টের বিকাশ। ২০০৫-এ কোটা উঠে যাওয়ার পরও এই শিল্প বিকশিত হয়। এখন আমাদের প্রয়োজন আরেকটা বড় কোনো চালকের উদ্ভব। সেটা হতে পারে রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টের মতো আরেকটা বড় কোনো ধাক্কা। সেটা ইলেকট্রনিকস অ্যাসেম্বলিং সেক্টরে হতে পারে, তথ্যপ্রযুক্তি হতে পারে। এখন আমাদের চাই আরেকটা নতুন খাত। এ রকম ঘটনা ছাড়া বিনিয়োগ ৩০-৪০ শতাংশে যেতে পারব ভারতের মতো। ভারতেও এভাবে বহুমুখী বিনিয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগ বেড়েছে। খেয়াল করার বিষয়, আমাদের অর্থনীতিবিদেরা কিন্তু গার্মেন্ট খাত কিংবা প্রবাসী শ্রম খাতে সাফল্যের কোনো অনুমান আগাম করতে পারেননি। আমার মনে হয়, এ রকম তৃতীয় একটি খাত হয়তো আমাদের অগোচরে বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সরকার ও পরিকল্পনাবিদদের উচিত সেই সম্ভাবনাটা খুঁজে বের করা।

প্রথম আলো : জ্বালানি ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক স্বার্থে দুর্নীতির পাশাপাশি পাবলিক সেক্টরকে প্রাইভেট মুনাফার জন্য সাজানোর ভুল নীতি আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। যেমন কুইক রেন্টালের কথা বলা যায়। দিনের পর দিন সংকটের সুরাহা না করে একটা যেনতেন সমাধান গিলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কী বলবেন?

বিনায়ক সেন : এসব সমস্যা গত দুই দশক ধরে জমে হয়েছে। কুইক রেন্টাল সমাধান নয়। কিন্তু আপৎকালীন এই ব্যবস্থারও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফল আছে। গার্মেন্ট শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতো কি না, মেপে মেপে বলা উচিত। তবে কুইক রেন্টালের পাশাপাশি অন্যান্য স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগও পাশাপাশি শুরু করা উচিত ছিল। বিকল্প নিয়ে উদ্যোগ অনেক দেরিতে আসছে বা আসেইনি। এর দায়ভাগ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা তার আগের বিএনপি সরকারও দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সমাধান নিয়ে উদ্যোগী হননি। উচিত ছিল নাগরিক সমাজ, অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনেক আগেই বসা। তা করা হলে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে থাকত। এই খাতে ন্যূনতম পরিচালন ক্ষমতার প্রমাণ আমরা রাখতে পারিনি। অন্যদিকে দুর্নীতি হয় বলে বিশ্বব্যাংক-এডিবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কখনো বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। অন্যদিকে নিজেরাও গ্যাস ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারিনি। মধ্য আয়ের দেশের কাছাকাছি যেতে হলে বাস্তবোচিত জ্বালানি নীতি এখনই নিতে হবে।

প্রথম আলো : বিশ্বব্যাংক তো সরে গেল। আপনি বেশ আগে থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কিসের ভরসায়?

বিনায়ক সেন : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার কথা, যেটি এক বছর আগে বলেছিলাম; তখন নেওয়া গেলে আরও ভালো হতো। সরকার উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে যায়। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে আমরা একটা সেতু নির্মাণ করতে পারব না, তা নয়। আমাদের বিশেষজ্ঞ আছেন। আর অর্থ, যা প্রয়োজন, তা খুব বড় নয়। এক বিলিয়ন ডলার বা আট হাজার কোটি টাকা স্থানীয় মুদ্রায়, আর দুই বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রায়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কথাটি আজ থেকে সাত-আট মাস আগে বণিক বার্তাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলাম, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরবে না এবং নিজস্ব অর্থায়নেই এটি নির্মাণ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এটি বড় কিছু নয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে পাঁচ বছরে, অর্থাৎ দুই বিলিয়ন ডলার আমাদের একসঙ্গে ব্যয় করতে হবে না। এই পরিমাণ অর্থ তিন মাসের আমদানি-ব্যয়েরও কম। প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রার জোগান দিতে হবে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ‘ডলার বন্ড’ ছেড়ে সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানে ৬ থেকে ৮ শতাংশ সুদ দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। বিদেশি মুদ্রার ৫০ শতাংশ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সহজেই জোগানো যায়। বতর্মানে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ১৩-১৪ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স-প্রবাহও বেশ। এ বছরে আমদানি ব্যয়ও ছিল কম। ফলে রিজার্ভ থেকে ফিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা মোটেই কঠিন নয়। প্রবাসী অনেক বিশেষজ্ঞ ও বসবাসকারী আমাকে বলেছেন, ২-৩ শতাংশ সুদ দিলেই ডলার বন্ড বিক্রি করা যাবে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সুদ পাওয়া যায় দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে ২-৩ শতাংশ সুদ ঘোষণা করলেই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানকার বাঙালিরাই দেবে। অনেকে বলছেন, বন্ডের অর্থ সুদসহ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপবে। আসলে প্রতি মাসে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি থেকে পাওয়া অর্থের সামান্য অংশই ব্যয় হবে বন্ডের সুদসহ আসল পরিশোধে। পরিশোধে অনেক বছর সময়ও পাওয়া যাবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা বজায় রাখায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রথম আলো : কিন্তু সামর্থ্যের চেয়েও বড় হয়ে উঠছে সরকারের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা।

বিনায়ক সেন : বড় বিষয় হলো ঝুঁকি নয়, সরকারের দোদুল্যমানতা বা মনস্থির করতে না পারা। এটা সুশাসনের পরিচয় নয়। বর্তমান সরকারের বাকি মেয়াদে হয়তো বড় ধাপ ফেলা যাবে না। তবে প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করা সম্ভব। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির চাকা গতিশীল করতে এর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পদ্মা সেতু থেকে হাই রিটার্নও মিলবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও স্বীকার করেছেন, এ সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতু না হলে রাজনৈতিক মাশুলও সরকারের জন্য চড়া হয়ে যাবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সমর্থন হারানোর শঙ্কা রয়েছে। দুটি কারণ মিলিয়েই রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকেই যাওয়া উচিত। এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ইস্যু নয়, এটি জাতীয় বিষয়। এ ক্ষেত্রে বড় দুই রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো নির্মাণ ও এর উন্নয়ন কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাও জরুরি। বর্তমান সরকার সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলে আগামী সরকার সেটি চালিয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক সরকারের নেওয়া কর্মসূচি অন্য সরকার তো বন্ধ করছে না; বরং সম্প্রসারণ করছে। কাজ শুরুর পর বিশ্বব্যাংকও আবার পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। যমুনা সেতুর বেলায়ও বিশ্বব্যাংক পরে যুক্ত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণ স্থগিত রাখলে অর্থনৈতিক তো বটে, রাজনৈতিক-সামাজিকভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।

প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।

বিনায়ক সেন : ধন্যবাদ।

নিজস্ব উদ্যোগ দ্রুতই নেয়া প্রয়োজন

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থ নেবে না সরকার— এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কথাটি আজ থেকে প্রায় সাত-আট মাস আগে বণিক বার্তাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে উল্লেখ করেছিলাম। কীভাবে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব, সেটিও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম সেখানে। বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরবে না এবং নিজস্ব অর্থায়নেই এটি নির্মাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কাজ নিজস্ব অর্থায়নে করার প্রয়োজন নেই।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ৮ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ মুদ্রায় জোগান দিতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এটি বড় কিছু নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখনো আছে। এর পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার বা তার কিছু বেশি হবে। সময় অতিবাহিত হওয়ায় ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে। বিদেশী মুদ্রার ৫০ শতাংশ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সহজেই জোগানো সম্ভব। আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ১৩-১৪ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সপ্রবাহও ভালো। আমদানি এবার কম হয়েছে আমাদের। ফলে রিজার্ভ থেকে প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা কঠিন হবে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে চার বছরে অর্থাত্ ২ বিলিয়ন ডলার আমাদের একসঙ্গে ব্যয় করতে হবে না। প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিদেশী মুদ্রার জোগান দিতে হবে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ‘ডলার বন্ড’ ছেড়ে সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানে ৬-৮ শতাংশ সুদ দেয়ারও প্রয়োজন নেই।

আমি সম্প্রতি ম্যানচেস্টারে গিয়েছিলাম, সেখানকার বিশেষজ্ঞ ও বসবাসকারীরা আমাকে বলেছেন, ২-৩ শতাংশ সুদ দিলেই ডলার বন্ড বিক্রি করা যাবে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সুদ পাওয়া যায় দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে ২-৩ শতাংশ সুদ ঘোষণা করলেই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানকার বাঙালিদের কাছ থেকেই অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। অনেক বাঙালি রেস্টুরেন্ট মালিক আমার কাছে তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই বলছেন, বন্ডের অর্থ সুদসহ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপবে। বিষয়টি ঠিক নয়। প্রতি মাসে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে এবং রফতানি থেকে যে অর্থ পাচ্ছি, তার সামান্য অংশই ব্যয় করতে হবে বন্ডের সুদসহ আসল পরিশোধে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ ও রফতানি আয় বাড়ছে। ফলে বন্ডের অর্থ ও সুদ পরিশোধকে বোঝা ভাবার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি না। এটি পরিশোধে অনেক বছর সময়ও পাওয়া যাবে।

বড় বিষয় হলো সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উদ্যোগ নেয়া ও তা দ্রুত বাস্তবায়নের প্রশ্ন। নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার কথা, যেটি এক বছর আগে বলেছিলাম; তখন নেয়া গেলে আরো ভালো হতো। সরকার উদ্যোগও নিয়েছিল; কিন্তু পরে সেখান থেকে পিছিয়ে আসে। এখন আবার বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে তেমন কিছু করা যাবে না সত্য; তবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করা সম্ভব এ সময়ের মধ্যেই। প্রতীকী হলেও কিছু কাজ শুরু করা উচিত। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল করতে এর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পদ্মা সেতু থেকে হাই রিটার্নও মিলবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও স্বীকার করেছেন, এ সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিকভাবে পদ্মা সেতু না হওয়ার যে মাশুল, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তা দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারে না। সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকে অগ্রসর না হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরও রাজনৈতিক সমর্থন হারানোর শঙ্কা রয়েছে। দুটি কারণ মিলেই রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকেই যাওয়া উচিত। অন্যরা যে বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন যেমন— অর্থায়ন, এগুলো বড় বিষয় নয়; অন্তত দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায়। অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞও এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে মত দিচ্ছেন। তারাও দীর্ঘমেয়াদে পদ্মা সেতু ও রাজনীতির বিষয়টি অনুধাবন করছেন। সন্দেহ নেই, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা বজায় রাখায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

পদ্মা সেতুটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ইস্যু নয়, এটি জাতীয় বিষয়। এক্ষেত্রে বড় দুই রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো নির্মাণ ও এর উন্নয়ন কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাও জরুরি। বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলে আগামী সরকার সেটি চালিয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম কিন্তু সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। এক সরকারের নেয়া কর্মসূচি অন্য সরকার বন্ধ করছে না; বরং এটি সম্প্রসারণ করছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ বর্তমান সরকার নিলেও আগামী সরকারকে তা চালিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। কাজ শুরুর পর বিশ্বব্যাংকও পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। আমরা আহ্বানও জানাতে পারি। যমুনা নদীতে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংক পরে যুক্ত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণ স্থগিত রাখলে অর্থনৈতিক তো বটে, রাজনৈতিক-সামাজিকভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে।