নিজস্ব উদ্যোগ দ্রুতই নেয়া প্রয়োজন

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থ নেবে না সরকার— এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কথাটি আজ থেকে প্রায় সাত-আট মাস আগে বণিক বার্তাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে উল্লেখ করেছিলাম। কীভাবে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব, সেটিও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম সেখানে। বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরবে না এবং নিজস্ব অর্থায়নেই এটি নির্মাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কাজ নিজস্ব অর্থায়নে করার প্রয়োজন নেই।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ৮ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ মুদ্রায় জোগান দিতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এটি বড় কিছু নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখনো আছে। এর পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার বা তার কিছু বেশি হবে। সময় অতিবাহিত হওয়ায় ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে। বিদেশী মুদ্রার ৫০ শতাংশ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সহজেই জোগানো সম্ভব। আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ১৩-১৪ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সপ্রবাহও ভালো। আমদানি এবার কম হয়েছে আমাদের। ফলে রিজার্ভ থেকে প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা কঠিন হবে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে চার বছরে অর্থাত্ ২ বিলিয়ন ডলার আমাদের একসঙ্গে ব্যয় করতে হবে না। প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিদেশী মুদ্রার জোগান দিতে হবে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ‘ডলার বন্ড’ ছেড়ে সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানে ৬-৮ শতাংশ সুদ দেয়ারও প্রয়োজন নেই।

আমি সম্প্রতি ম্যানচেস্টারে গিয়েছিলাম, সেখানকার বিশেষজ্ঞ ও বসবাসকারীরা আমাকে বলেছেন, ২-৩ শতাংশ সুদ দিলেই ডলার বন্ড বিক্রি করা যাবে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সুদ পাওয়া যায় দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে ২-৩ শতাংশ সুদ ঘোষণা করলেই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। সেখানকার বাঙালিদের কাছ থেকেই অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। অনেক বাঙালি রেস্টুরেন্ট মালিক আমার কাছে তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই বলছেন, বন্ডের অর্থ সুদসহ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপবে। বিষয়টি ঠিক নয়। প্রতি মাসে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে এবং রফতানি থেকে যে অর্থ পাচ্ছি, তার সামান্য অংশই ব্যয় করতে হবে বন্ডের সুদসহ আসল পরিশোধে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ ও রফতানি আয় বাড়ছে। ফলে বন্ডের অর্থ ও সুদ পরিশোধকে বোঝা ভাবার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি না। এটি পরিশোধে অনেক বছর সময়ও পাওয়া যাবে।

বড় বিষয় হলো সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উদ্যোগ নেয়া ও তা দ্রুত বাস্তবায়নের প্রশ্ন। নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার কথা, যেটি এক বছর আগে বলেছিলাম; তখন নেয়া গেলে আরো ভালো হতো। সরকার উদ্যোগও নিয়েছিল; কিন্তু পরে সেখান থেকে পিছিয়ে আসে। এখন আবার বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে তেমন কিছু করা যাবে না সত্য; তবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করা সম্ভব এ সময়ের মধ্যেই। প্রতীকী হলেও কিছু কাজ শুরু করা উচিত। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল করতে এর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পদ্মা সেতু থেকে হাই রিটার্নও মিলবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও স্বীকার করেছেন, এ সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিকভাবে পদ্মা সেতু না হওয়ার যে মাশুল, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তা দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারে না। সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকে অগ্রসর না হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরও রাজনৈতিক সমর্থন হারানোর শঙ্কা রয়েছে। দুটি কারণ মিলেই রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকেই যাওয়া উচিত। অন্যরা যে বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন যেমন— অর্থায়ন, এগুলো বড় বিষয় নয়; অন্তত দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায়। অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞও এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে মত দিচ্ছেন। তারাও দীর্ঘমেয়াদে পদ্মা সেতু ও রাজনীতির বিষয়টি অনুধাবন করছেন। সন্দেহ নেই, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা বজায় রাখায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

পদ্মা সেতুটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ইস্যু নয়, এটি জাতীয় বিষয়। এক্ষেত্রে বড় দুই রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো নির্মাণ ও এর উন্নয়ন কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে তাদের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাও জরুরি। বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলে আগামী সরকার সেটি চালিয়ে যাবে, তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম কিন্তু সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। এক সরকারের নেয়া কর্মসূচি অন্য সরকার বন্ধ করছে না; বরং এটি সম্প্রসারণ করছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ বর্তমান সরকার নিলেও আগামী সরকারকে তা চালিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। কাজ শুরুর পর বিশ্বব্যাংকও পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হতে পারে। আমরা আহ্বানও জানাতে পারি। যমুনা নদীতে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংক পরে যুক্ত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণ স্থগিত রাখলে অর্থনৈতিক তো বটে, রাজনৈতিক-সামাজিকভাবেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে।

দারিদ্র্য কমলেও আয়-বৈষম্য বাড়ছে

সমকাল প্রতিবেদক
শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে দারিদ্র্য কমেছে। এটি গর্বের বিষয় হলেও আত্মতুষ্টির কিছু নেই। কেননা দারিদ্র্য হ্রাসের পাশাপাশি ধনী-গরিবের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। শহর এবং গ্রামে উভয় ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। মূলত সম্পদের অসম বণ্টন ও অবৈধ আয়ের উৎসের কারণে আয় বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন তারা। ‘দারিদ্র্য বিমোচন : কোথায় আমাদের অবস্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খোন্দকার। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু কাওসার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিই আমাদের উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতি কমাতে পারলে জনগণ উন্নয়নের সুফল আরও বেশি পেত। প্রায় তিন ঘণ্টার প্রাণবন্ত আলোচনায় দারিদ্র্যের কারণ এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, দারিদ্র্য নিরসন করতে হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে হলে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। কারণ আয় বৈষম্য থেকে দারিদ্র্যের উৎপত্তি। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ার পেছনে কারণগুলো তুলে ধরেন বক্তারা।

তারা বলেন, প্রভাবশালীরা জমি দখল, জলাশয় দখল করে সম্পদ তৈরি করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না। এসব অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীদের সম্পদ আরও বাড়ছে। অথচ গরিবের কাজের সুযোগ নেই, শিক্ষা নেই, ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, ব্যাংক থেকে ঋণের সুযোগও তাদের নেই। ফলে দরিদ্র মানুষগুলোর জীবনের পরিবর্তন হচ্ছে না। দারিদ্র্য দূর করতে উৎপাদনমুখী কাজে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তারা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খোন্দকার অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, গুলশান ক্লাবে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। যারা জুয়া খেলার পেছনে কোটি টাকা খরচ করে বুঝতে হবে তারা কত বড়লোক। তিনি বলেন, দারিদ্র্য মাপার বিষয় নয়, এটি অনুধাবনের বিষয়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা অনুধাবন করা গেলে সত্যিকার অর্থে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মন্ত্রী বলেন, ২০০৫ সালের তুলনায় দারিদ্র্য আরও কমেছে। শিগগির এ ঘোষণা দেওয়া হবে।

ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব এখনও প্রকাশ করা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়াতে পারে ৩২ শতাংশ। যদি তাই হয় তাহলে দুই বছরে কমবে ৮ শতাংশ, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কারণ নেই। আমাদের এখনও অনেক কিছু করণীয় আছে।

অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন বলেন, দারিদ্র্য কমেছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় হলেও সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যার একটি ফ্ল্যাট ছিল তার ১০টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। অথচ গরিবরা ক্রমেই গরিব হচ্ছে। আয়কর ফাঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল, ঋণ পরিশোধ না করা ইত্যাদি অবৈধ কাজের মাধ্যমে বিত্তশালীরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দারিদ্র্য নিয়ে ভাবতে হলে বৈষম্য কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত ৫ কোটি লোক দরিদ্র। কাজেই আমাদের আত্মতুষ্টির কারণ নেই। দারিদ্র্য কমাতে হলে গরিবদের উৎপাদনমুখী কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি। ড.ফরাস উদ্দিন মনে করেন, দারিদ্র্যের মূল কারণ কাজের সুযোগের অভাব। যারা গরিব তাদের সম্পদও নেই, নেই কাজের সুযোগও। দারিদ্র্যকে বহুমাত্রিক অভিশাপ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। দারিদ্র্য কমাতে শিক্ষা বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ভোকেশনাল শিক্ষা ফ্রি করার প্রস্তাব করেন তিনি।

ড. সেলিম রায়হান দারিদ্র্য হ্রাসের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ১৯৯০-এর দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০০০ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। ২০০৫ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ। এলডিসিভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ অগ্রগতি অনেক ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অর্জন কম নয় কেলেঙ্কারিও আছে

জাকির হোসেন

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিশ্ব অর্থনীতি ছিল মন্দার কবলে। আশঙ্কা করা হয়েছিল_ মন্দার বিলম্বিত প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষত রফতানি ও রেমিট্যান্স খাত বড় ধাক্কা খাবে। এ আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়নি। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের চেষ্টার পাশাপাশি মন্দা মোকাবেলায় সরকারের সহায়কনীতি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার অর্থবছরে (২০০৮-০৯) রফতানিতে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়। পরের প্রতিটি অর্থবছরে রফতানি আগের তুলনায় বেড়েছে। বলা যায়, সরকারের চার বছরে সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। এ সময়ে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়; কমেছে দারিদ্র্য হার। কৃষি উৎপাদনে ভালো সাফল্য এসেছে।
গত চার বছরে অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। তবে শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্কের মতো একের পর এক কেলেঙ্কারি অর্থনীতির সাফল্যকে ম্লান করেছে। এ ছাড়া সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবেশের

সূচকে কিছুটা অবনতি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিরও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্থনীতির জন্য নানা সংস্কারের ব্যাপক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বেসরকারিকরণ, প্রশাসনে দক্ষতা, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংস্কার ত্বরান্বিত হয়নি।

মতামত জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মন্দা-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। এ সময়কালে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রশংসাযোগ্য। রফতানি বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের আরও অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন চীনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক। কৃষি প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটা দাগে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়নি। তারপরও জনমনে কিছু বিষয়ে অসন্তুষ্টি আছে।

কী সেই অসন্তুষ্টি_ জানতে চাইলে বিনায়ক সেন বলেন, গত দশকে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। ফলে মানুষের প্রত্যাশার চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সে চাপের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংস্কৃতি তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মানুষ দিনবদলের সরকারের কাছে আরও কিছু প্রত্যাশা করেছিল। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল, একটা কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। বিনিয়োগে বড় ধরনের অগ্রগতির কথা ছিল, যা হয়নি। বিনিয়োগের হার গত কয়েক বছরে একই রকম রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এডিপি বাস্তবায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রত্যাশিত সংস্কার হয়নি। শেয়ারবাজারে ধস, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের তহবিল লোপাটসহ কিছু বিষয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর্থিক খাতের নানা সংকট সামষ্টিক অর্থনীতিকে মাঝে মধ্যে ঝামেলায় ফেলেছে।

একের পর এক কেলেঙ্কারি :অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার শেয়ারবাজারে ধসের মাধ্যমে প্রথম বড় ধাক্কা খায়। ২০১০ সালের শেষে বড় ধরনের ধস নামে শেয়ারবাজারে। ফুলে-ফেঁপে ওঠা সূচকের ধারাবাহিক পতনে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এই ধসের পেছনে একটি প্রভাবশালী অশুভ চক্রের কারসাজি ছিল, যা পরবর্তীকালে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে। গত দুই বছরে সরকারের নানা পদক্ষেপেও শেয়ারবাজারের সংকট দূর হয়নি। বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থাবান হতে পারছেন না।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর পদ্মা সেতু নিয়ে বিপাকে পড়ে সরকার। মহাজোট সরকারের চার বছর নিয়ে সমকালের সাম্প্রতিক এক জরিপে বেশির ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে জটিলতার প্রধান দায় সরকারের।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ফলে আর্থিক খাতে সরকারের মনোযোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগের কারণে সরকার সমালোচিত হয়। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে একটি চক্র জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ করে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হলমার্কই নেয় দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এটি ছিল ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে ডেসটিনি গ্রুপও নানা কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়। এই গ্রুপের এমডিসহ শীর্ষ কর্তারা এখন কারাগারে।

চাঙ্গা হয়নি বিনিয়োগ :জিডিপিতে বিনিয়োগের অংশ ২৪ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও একই হারে বিনিয়োগ হয়। বাংলাদেশকে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর বর্তমান অবস্থায় ওই হারে বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক হিসাবে গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ১৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মনোভাব স্পষ্ট। সম্প্রতি খেলাপি ঋণও অনেক বেড়ে গেছে। ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যেতে পারে।

কিছু স্বস্তিকর পরিসংখ্যান :মন্দার শুরুতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে চলে যায়। এর পরের তিন বছরে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৬৭৬ ডলার। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪৮ ডলার। মন্দা-পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী ছিল। একটি অর্থবছর বাদে এ খাতে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। সরকার বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে পেরেছে। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে।

দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ কমেনি :সমকালের জরিপে প্রশ্ন ছিল_ দ্রব্যমূল্য চার বছর আগের তুলনায় এখন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে কি-না। এর উত্তরে ৫৫ শতাংশ ‘না’ বলেছেন। কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে_ এমন উত্তর দিয়েছেন ৩১ শতাংশ। চালের দাম কিছুটা কমলেও বাস্তবতা এমনই। আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৬২ শতাংশে। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে।

বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, গত এক বছরে মিনিকেট, নাজিরশাইল, আমন, পাইজাম, স্বর্ণাসহ নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের দরকারি চালের দাম কমেছে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। চাল ছাড়া অন্যান্য নিত্যপণ্য যেমন_ আটা, ডাল, সয়াবিন তেল, ডিম, মাছ, মাংস, সবজি প্রভৃতির দাম বেড়েছে।

প্রথম আলো বাজেট সংলাপ ২০১২-১৩: বাজেটে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১৫-০৬-২০১২
null
আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও অর্থনীতির কোনো অঙ্কই বলছে না যে তা অর্জন করা সহজ হবে।
প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ‘প্রথম আলো বাজেট সংলাপ, ২০১২-১৩’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলা হয়। আলোচনায় অংশ নেন দেশের তিনজন বিশেষজ্ঞ। বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার জন্যই এই সংলাপের আয়োজন করা হয়। আলোচকেরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এ ছাড়া বাজেট কাঠামো এবং এর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, তিনটি অনুমান সত্য হলে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই হারে প্রবৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব, তার কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আরোপিতভাবে এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
আকবর আলি খান তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই প্রবৃদ্ধি নিয়ে বলেন, ‘আমরা যখন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলি, তখন কেউ কেউ বলে, সেটা নিয়ে এত কথা বলার কী আছে। বছর শেষে প্রবৃদ্ধি যা হওয়ার তা-ই হয়। আসলে এ নিয়ে কথা বলার কারণ হলো, প্রবৃদ্ধি সব সময় সরলরৈখিকভাবে আসে না। যদি তা-ই হতো, তাহলে অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব থাক আর মনা পাগলাই থাক, প্রবৃদ্ধির হার একই থাকবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, যদি তিনটি অনুমান সত্য হয়, তাহলে নতুন বাজেটে প্রক্ষেপিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। সেগুলো হলো: আসছে অর্থবছরে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে না, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ২০ শতাংশ হারে কমবে এবং মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালিত হবে।
আকবর আলি খান আরও বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীকে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভালো ভালো কথা বলার জন্য। এটিতে কোনো সমস্যা দেখি না। অর্থমন্ত্রী যদি ভালো কথা না বলেন, তাহলে সকলের মাঝে একধরনের নৈরাশ্য তৈরি হবে। তবে অর্থমন্ত্রীকে খেয়াল রাখতে হবে, ভালো কথা বলতে গিয়ে তিনি যেন অতিরঞ্জিত কোনো কথা বলে না ফেলেন। যদি সেটি হয়, তাহলে তিনি খেলো হয়ে যাবেন। অর্থমন্ত্রীর এবারের পুরো বাজেট বক্তব্য পড়ে আমার মনে হয়েছে, তাঁর বক্তব্যে বিশ্বাসযোগ্যতার বেশ অভাব আছে।’
আকবর আলি খান বলেন, গত মার্চে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) লেখা চিঠিতে অর্থমন্ত্রী নিজেই বৈদেশিক মুদ্রার সংকট প্রলম্বিত হবে বলে মত দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অর্থনীতির কিছু সংকটের কথাও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি ও বাজেটের আকার নিয়ে আমার তেমন কোনো বিরোধিতা নেই। ঘাটতি বেশি হলেই একেবারে আসমান ভেঙে পড়বে না। আবার উচ্চাভিলাষী বাজেট—এই বক্তব্যের সঙ্গেও আমি একমত নই।’
সাবেক এই অর্থসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যে অবকাঠামোর উন্নয়ন দরকার, তার জন্য বড় বাজেটই বরং দরকার। তবে উদ্বেগের জায়গা হলো, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি। এই ঘাটতি অর্থনীতির বড় নিয়ামক। আমি যদি দেখি সহজে ডলার ধার পাওয়া যাচ্ছে, তাহলে আমি বলব ১০-১২ শতাংশ বাজেট ঘাটতিও কোনো বিষয় নয়।’
আকবর আলি খান আরও বলেন, ‘অনেক সরকারি কর্তাব্যক্তি বলেন, “আইএমএফের ঋণ নিয়েছি তাতে সমস্যা কী। ব্যাংকের কাছ থেকেও আমরা ঋণ নিই।” কিন্তু আমি বলি, আইএমএফ ব্যাংকও না, হাসপাতালও না। সেখানে তারাই যায়, যারা ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকার উপযুক্ত। অর্থমন্ত্রী অর্থনীতির সংকট দূর করতে যে ডাক্তারের (আইএমএফ) কাছে গেছেন, তিনি বলেছেন, আগামী বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর আমাদের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। তিনি এও বলেন, সরকার তো আমাদের কথা শুনে না। তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের কথা না শুনে যদি আইএমএফের কথাগুলো ঠিকমতো শুনে, সেটিও মঙ্গলজনক হবে। আমরাও চাই আইএমএফের সঙ্গে করা চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হোক। সেটি হলে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি পাব।’
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়নের বিষয়ে সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, এডিপি বাস্তবায়নে বড় সমস্যা, সময়মতো টেন্ডার-প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া। চার মাসের সময় দিয়ে টেন্ডার যদি চার মাসে সম্পন্ন করা না যায়, তাহলে কোনো ভদ্রলোকই ব্যবসা করতে আসবেন না।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে আকবর আলি বলেন, মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে দু-তিন কোটি মানুষ মূল্যস্ফীতির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাকি ১২ কোটি হয়তো মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কিছুটা খাপখাইয়ে নিতে পারে।
এর আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাজেটের বিভিন্ন দিকের প্রাক্কলনে সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে আগামীতে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সরকার বলছে, ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কীভাবে সম্ভব, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই, যেখানে তিন বছর ধরেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক এবং রেমিট্যান্স-প্রবাহও সন্তোষজনক নয়।
মোস্তাফিজুর রহমান বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন, আগামীতে জনপ্রশাসনে এমন কী বিপ্লব হয়ে যাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। সুশাসন ও বিভিন্ন সংস্কারের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক মোস্তাফিজ অবশ্য বলেন, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়-ব্যয় ইত্যাদিতে বাংলাদেশ ভালো করেছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে প্রতি দশকে এক শতাংশ করে। প্রতি সাত বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ এবং প্রতি ২১ বছরে তা আট গুণ হওয়ার উদাহরণ অনেক দেশই তৈরি করেছে। বাংলাদেশের পক্ষেও এ রকম অর্জন করা অসম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আরোপিতভাবে এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, গত দুই দশকের প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির প্রবণতাকে বিবেচনায় নিলে তা ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ হওয়াই যথেষ্ট ছিল। তবে আগামীতে তা যদি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হয়, সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ হবে।
বৈদেশিক সাহায্য প্রসঙ্গে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, ‘২০০৬ সালে কিন্তু সাহায্য বেশ এসেছিল। হঠাৎ করে কী হলো। এখন আমাদের মধ্যেই হতাশার সুর যে আগামীতেও এ সাহায্য খুব বেশি আসবে না।’ বিনায়ক সেনের প্রশ্ন, ‘এটা কি পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার কারণে, নাকি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সবকিছুই গোলমেলে লাগছে।’
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিনায়ক সেন বলেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়িত না হওয়ার কোনো যোগাযোগ নেই। দুর্নীতিবাজ আমলা হলে বরং শতভাগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করত। কারণ, কাজ হলেই না হয় কিছু পাওয়া যায়।’ এ বিষয়ে বিনায়ক সেন বলেন, আমলারা কি ইংরেজি বোঝেন না, না দাতাদের ভাষা বোঝেন না—প্রশ্ন তোলা যায়। তবে এই যদি কেন্দ্রীয় সরকারের বাস্তবতা হয়, বাস্তবায়নের দায়িত্ব বরং স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়।
দেশে অদ্ভুত এক রাজনৈতিক দর্শন কাজ করছে মন্তব্য করে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘সামাজিক ন্যায়বিচার কথাটি কি এখন শুনতে পান? এখন তো সবই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী।’ অবকাঠামো বলতে শুধু সড়ক অবকাঠামো বোঝানো হয়ে থাকে—এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বিনায়ক সেন বলেন, ‘অথচ যেকোনো ভালো শহরের বৈশিষ্ট্য হলো এমন গণপরিবহন থাকা, যাতে দূর-দূরান্ত থেকে শহরে এসে কাজ সেরে আবার তাঁরা শহরের বাইরে চলে যেতে পারেন।’
খেলাপি ঋণ দুই থেকে তিনবার পুনঃ তফসিল করা যেতে পারে, ১০ থেকে ১২ বার নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ফল কী, প্রবাসী-আয়ের সুফল সরাসরি পাওয়া যাচ্ছে না—এসব বিষয় উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের ফলে কী পরিবর্তন হয়েছে বা দেশের উন্নয়নে এসব প্রতিবেদন কীভাবে অবদান রাখছে, তা নিয়ে গবেষণার তাগিদ দেন বিনায়ক সেন।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। সঞ্চালক ছিলেন বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন। এ ছাড়া প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, উপসম্পাদক আনিসুল হক, প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহিছ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কোনো স্থায়ী সমাধান নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ২১-০৬-২০১২

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তাঁরা এ খাতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
পাশাপাশি তাঁরা এ-ও বলেছেন, দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। স্বল্প সময়ের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি চালু থাকতে পারে। তবে প্রকৃত উন্নয়নের পথে যেতে হলে দরকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আর এ জন্য সবার আগে শিক্ষার উন্নয়নে নজর দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক, শিক্ষা খাতে তিন বছর ধরেই বাজেটে বরাদ্দ কমছে।
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল বুধবার ‘অতিদারিদ্র্য নিরসন: সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ব্র্যাক অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জের সহযোগিতায় প্রথম আলো বৈঠকটির আয়োজন করে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী ও হোসেন জিল্লুর রহমান, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম নুরুন্নবী, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন, বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি সাপোর্ট প্রোগ্রামের চিফ অব পার্টি আখতার আহমেদ, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির পরিচালক শীপা হাফিজা, প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক প্রমুখ।
টেকসই নিরাপত্তা: রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, দারিদ্র্য নিরসনই মূল কথা নয়। গতানুগতিক দারিদ্র্য নিরসনের চিন্তার বাইরে গিয়ে গোটা বিষয়কে দেখা দরকার সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী এখন আর টেবিলের এক পাশে পড়ে থাকা বিষয় নয়। এ বিষয়ে গত ৩০ বছরে আমরা কী করলাম, তার হিসাব মেলানো দরকার।’ তিনি বলেন, ‘ভারত এ বিষয়ে সাংবিধানিক অধিকার তৈরির পর বাস্তবায়নের দিকে গেছে। আর আমরা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করছি।’ তিনি বলেন, খোলাবাজারে চাল বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা যাবে না।
মাহবুব হোসেন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি আরও ২০ থেকে ৩০ বছর চালিয়ে নিতে হবে। তিনি মনে করেন, এ খাতে বাজেট বরাদ্দ ঠিকই আছে। দরকার মূলত কর্মসূচিগুলোর কর্মদক্ষতা। অনেক কর্মসূচি রয়েছে ত্রাণ হিসেবে। পানিতে ডুবে গেলে মানুষের নাকটা যেমন শুধু ভেসে থাকে, অনেকটা সে রকম। এ থেকে উত্তরণ দরকার।
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে দারিদ্র্য নিরসন হবে। সরকারের অন্য খাতগুলোকেও সমানভাবে কাজ করতে হবে।’
শীপা হাফিজা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর কোনো তথ্যভান্ডারই এখনো তৈরি হয়নি। তা ছাড়া যেসব কর্মসূচি আছে, সেগুলোতে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নীতি গ্রহণ করা দরকার আসলে ‘মানুষ’কে মাথায় রেখে, যা খুব বেশি হয় না।
আনিসুল হক বলেন, যমুনা সেতু হওয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। তৈরি পোশাক কারখানা, নির্মাণ শ্রমিক, ভুট্টা চাষ, পোলট্রি ইত্যাদিতে উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কর্মসূচিগুলো বেশির ভাগই প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ হলেই যেন সব শেষ হয়ে যায়। আর যেখানে যত বেশি প্রকল্প, সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবও তত বেশি।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক কারণেও কিছু কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। যেমন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’। ফলাফল কী হবে, এখনই বলা যাবে না। আবার কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেখানে তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য ঘুষ দেওয়া-নেওয়া হয়।
আখতার আহমেদ বলেন, সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
নগর দারিদ্র্য: বিনায়ক সেন বলেন, নগর দরিদ্ররা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, নগর দরিদ্ররা গ্রামে চলে গেলে নগরের ওপর চাপ কমত, তাদের জীবনও আরও সুন্দর হতে পারত। তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কয়েক বছর আগে নগর দরিদ্রদের জন্য অস্থায়ীভাবে নগরে জমি বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিল। একে ‘সর্বনাশা প্রস্তাব’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক কষ্টে তা রোধ করা গেছে। একবার বরাদ্দ দিলে তাদের আর উচ্ছেদ করা যেত না। রাজনৈতিক হলেও নানা প্রণোদনা দিয়ে নগর দরিদ্রদের গ্রামে পাঠানোর জন্য যে ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার অনেক সুফল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শিক্ষার উন্নয়ন: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, শিক্ষা এবং একমাত্র শিক্ষার উন্নয়নই হতে পারে দারিদ্র্য নিরসনের অন্যতম উপায়। এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে তা-ই হয়েছে। তিনি বলেন, কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কর্মসংস্থানের বিশাল আয়োজন করা না গেলে কিছুই হবে না।
অথচ বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ তিন বছর ধরেই কমছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের যে ধারণা, তাতে এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না।’
আখতার আহমেদ বলেন, শিক্ষা খাতে বৃত্তিজাতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু পুষ্টির বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। অথচ শিক্ষা ও পুষ্টি—এ দুই খাতেই সমান নজর দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম বলেন, জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারলে এর চেয়ে বেশিও অর্জন করা সম্ভব।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: সব পরিকল্পনার মধ্যেই জনসংখ্যাকে রাখতে হবে বলে মনে করেন এ কে এম নুরুন্নবী। তিনি বলেন, কোনো ক্ষেত্রেই সঠিক কোনো তথ্য নেই। কারণ, সরকারি উৎসগুলোর মধ্যেই সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, জন্ম নিবন্ধনটাও কার্যকরভাবে করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
নুরুন্নবী আরও বলেন, এখন থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিতে পারলে আগামী ১০ বছরে দেশ বয়স্ক লোকের ভারে ভরে যাবে। শুরু হয়ে যাবে অরাজকতা।
কিছু পরামর্শ: হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে যায় হঠাৎ অসুখ বিসুখে পড়লে, ওষুধের খরচের কারণে। অথচ এ বিষয়ে কোনো কর্মসূচি নেই। অক্টোবর-নভেম্বরে মৌসুমি দরিদ্রদের কোনো কাজ থাকে না। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ও মানুষের কিছু করার থাকে না। তাদের জন্যও কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল একেবারে না খাওয়াটাই ছিল সমস্যা। এখন সমস্যা পুষ্টিহীনতা।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সরকারের ওপরই চাপটা বেশি। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম বিত্তশালীদের এ ব্যাপারে চাপ দেয় না। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কেন তাঁদের অনীহা বুঝতে পারছি না।’
ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ২০০১ সালের হিসাবে দেশে ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।
বিনায়ক সেন বলেন, ধনিক শ্রেণীর সম্পদের ওপর থেকে কর আদায় করে তা সহজেই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ব্যয় করা যায়।

রবীন্দ্রনাথে অবগাহন

বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ২০-০৬-২০১১

নিজের আঁকা ছবিতে তিনি রহস্যময়। সেই ছবি মঞ্চে, চারপাশের দেয়ালে। সঙ্গে উৎকীর্ণ তাঁর রচনার অংশ। রবির সেই বাণী স্পষ্ট, বাইরের ঝলমলে রবির আলোর মতোই অম্লান। তাতেই অবগাহন করে কাটল সারা বেলা, এই সময়ে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার অনুসন্ধান প্রয়াসে।
প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত ‘রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে’ শীর্ষক দুই দিনের সেমিনারের গতকাল রোববার ছিল সমাপনী। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উইন্ডি টাউন মিলনায়তনে কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এই সেমিনারে গতকালও চারটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ নানা শ্রেণীর রবীন্দ্র-অনুরাগী শ্রোতা দিনভর নিমগ্ন ছিলেন বিদগ্ধজনের নানামাত্রিক রবীন্দ্র-বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের জীবনে এখনো সত্য ও সুন্দরের ফল্গুধারার মতো বহমান, সে কথাই নানাজনের মুখে ঘুরেফিরে এসেছিল বিভিন্নভাবে। সত্য ও সুন্দরের প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারায় না।

রবীন্দ্রনাথের নাটক
সকাল ১০টায় আলোচনার পালা শুরু হয়েছিল নাটক বিষয়ে। অধ্যাপক অনুপম সেন ছিলেন সভাপতি। প্রবন্ধ পড়েন নাট্যজন আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নাট্যরচনায় ছিলেন বৈচিত্র্যসন্ধানী এবং সেই কারণে তাঁর নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। তাঁর সমগ্র নাট্যসাহিত্যে পাই ধর্মীয় ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকারও। চিরনতুন এবং চিরপ্রাসঙ্গিক।’ তিনি বিভিন্ন নাটকের সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে, নাট্যনির্দেশনা ও মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতার উল্লেখের মাধ্যমে আলোচনাকে রসগ্রাহী করে তুলেছিলেন।
পরে এ প্রসঙ্গে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেছেন, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংখ্যা ৭৮টি। স্বাধীনতার পর ৪০টি মূল নাটক এবং ৩৪টি রূপান্তরিত মিলিয়ে ৭৪টি নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে। নাটকে তিনি বিশ্বনাগরিকতাবাদী।
অভিনয়শিল্পী সারা যাকেরও রবীন্দ্রনাটক নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাঁর নাটকে আমরা লক্ষ করি, সব সময় তিনি সমাজের কোনো একটি বড় বাধা বা শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয় তুলে ধরেছেন। সে কারণে তাঁর নাটক সাধারণ দর্শকও সহজেই গ্রহণ করতে পারে। তবে সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে যদি উপস্থাপনার রাবীন্দ্রিক রীতি ভেঙে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা যায়, তবে নব নব রূপে তাঁকে আবিষ্কার করা সম্ভব।’
ড. আফসার আহমেদ বলেন, ইউরোপীয় রীতির প্রসেনিয়াম থেকে বাংলা নাটক যে বেরিয়ে এসেছে, রবীন্দ্রনাথের হাতেই তার সূচনা হয়েছিল। তিনি সংগীতকেন্দ্রিক আসরনির্ভর দেশীয় ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির আঙ্গিকে নাট্য রচনা করেছেন। তাঁর চিত্রকল্প আরোপিত নয়, দৃশ্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি করেছেন, তা সহজেই দর্শকচিত্ত স্পর্শ করেছে।
সভাপতি অনুপম সেন বলেছেন, তাঁর নাটক সাংকেতিক বা রূপকধর্মী। এই নাটকের মৌলিকতা অতুলনীয়। বিশ্বনাট্যসাহিত্যে এমন নাটক বিরল। তিনি একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী হয়েও আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাঙালিকত্বকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার সমাজের প্রতিটি মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। নাটকে সেই বিশ্বাস পরস্ফুিট করে তুলেছেন। তিনি কেবল এই সময়েই প্রাসঙ্গিক নন, তিনি কালজয়ী।

রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়
চা পানের পরে ‘রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়’ বিষয়ে দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে।
ড. আকবর আলি খান দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, তবে তিনি সেটি সামনে রেখে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা করেন। কবির পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। কারণ এ সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণার অভাব আছে। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন। জমিদার বললেই মনে হয় উৎপীড়ক। কিন্তু তিনি উৎপীড়ক নন, নিজেই উৎপীড়িত ছিলেন পীরালি বংশের কারণে। প্রায় ৩০০ বছর আগে তাঁর পূর্বপুরুষ কলকাতায় গেলেও কুলীন ব্রাহ্মণেরা তাঁদের জাতে নেননি। ব্রাহ্মণেরা তাঁদের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতেন না। বিয়ের কনে আনতে হতো পূর্ববঙ্গের পাড়াগাঁ থেকে। রবীন্দ্রনাথের জন্যই তা করা হয়েছিল। জাতিভেদের কুফল সারা জীবন ভোগ করেছেন। অন্যদিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর বড় জমিদার ছিলেন, তিনি তা ছিলেন না। বছরে তাঁর জমিদারির আয় হতো ৪৫ হাজার টাকা। সেই টাকা সংসারে ভাগ হয়ে যেত পাঁচ পরিবারে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেতন ছিল বার্ষিক ৪৮ হাজার এবং অধ্যাপকের বেতন ছিল নয় হাজার ৬০০ টাকা।’ এমন আরও অনেক তথ্য উপস্থাপন করে তিনি বলেছেন, কবির পরিবার ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই। কাজেই সাধারণ মানুষের দুরবস্থা যে তিনি জানতেন না, তা নয়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি মানুষের দুর্দশা উপলব্ধি করেছেন এবং সাহিত্যে তা তুলে ধরেছেন।
এরপর প্রাবন্ধিক বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ মার্ক্স বা গান্ধীর দৃষ্টিতে পশ্চিমকে দেখেননি। পুরো গ্রহণ বা বর্জনে তাঁর সায় ছিল না। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় চেয়েছিলেন। নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা উন্নয়ন বলতে যে ধরনের মানব উন্নয়ন, শিক্ষা, ক্ষমতায়ন—এসবের কথা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের মানবমুক্তির ভাবনাতেও তা-ই ছিল। তাঁর কথাই আজ আলোচিত হচ্ছে। তবে বর্ণবাদ বিলোপের ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি। নারীর সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ভেবেছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে হূদয় নিয়েই তিনি বেশি ভাবিত ছিলেন। অবশ্য তিনি সব ক্ষেত্রেই তাঁর কালকে অতিক্রম করে যাবেন, এমন দাবি করাও তাঁর প্রতি অবিচার করা। তাঁর কাছে আদর্শের চেয়ে মানুষ ছিল বড়। এই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি সোচ্চার ছিলেন। যেসব সমস্যার সরাসরি সমাধান তিনি দেননি, তা তাঁর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে। এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা।
আলোচনায় অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, সমাজের চেয়ে ব্যক্তিমানুষ তাঁর কাছে বড় ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তি মানুষ সমাজের অণু। এই অণুগুলো বদলালে সমাজ বদলাবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রেও পরিবর্তন আসবে। মনুষ্যত্ব অর্জনের কত পন্থা আছে, মানুষ কত উচ্চে উঠতে পারে, তিনি সেই সন্ধানই করেছেন। মনে রাখতে হবে, তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না, সমাজসংস্কারকও ছিলেন না। তিনি সংস্কারক ছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতির।
ড. মালেকা বেগম বলেন, ‘নারীবাদ মানবতাবাদের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি মানবতার কথা বলেছেন। আন্দোলনের পথে নেমে তাই আমরা তাঁর কথা বাদ দিতে পারি না। তিনি কিছু লুকোননি। সরাসরি স্পষ্ট করে বলেছেন, আমাদের সমাজে যেটার অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর বক্তব্যকে সামগ্রিক ভাবনার আলোকে নিয়ে লক্ষ করেছি, সেখানে আছে সমাজবদলের দলিল।’
অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, ‘তিনি ব্যক্তির ওপর সমষ্টির প্রাধান্য পছন্দ করেননি। তিনি ভাবতেন, মানুষ নেই তো সত্যও নেই। এই মানুষকেই তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান করার কথা বলেছেন। বিশেষত, গ্রামের মানুষের ক্ষেত্রে যেভাবে বলেছেন, রাজনীতিকদের তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।’
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া যাবে না—রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যক্তি একাকী অনেক কিছু করতে পারে না, রাষ্ট্রের সাহায্য প্রয়োজন হয়। তবে সমাজকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতেন না তিনি। তাঁর কাছে সমাজ বড়, রাষ্ট্র নয়। সমাজের অনেক অসংগতি তিনি মানেননি। মানলে সেসব নিয়ে লিখতেন না। সেই লেখায় সত্যমূল্য না থাকলে তা হয় ছলনা। তাঁর লেখা ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ কথাটি আজ প্রবাদের মতোই সত্য। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধ চলছে, কর্মহীন বেকার যুবক ছুটছে, নিষ্ফল মাথা কুটছে—এগুলো সবই সত্যি। এসবই তার মনুষ্যত্বের দায় বহন করে। এই সত্যের জন্য, এই সমাজ ভাঙার শক্তির জন্যই রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হয়।

রবীন্দ্রনাথের জাতিভাবনা
দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা ছিল মিলনায়তনেই। খাবারের পর তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় এই দুই দিনের সেমিনারের আহ্বায়ক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে।
রবীন্দ্রনাথের জাতিভাবনা নিয়ে প্রবন্ধ পড়েন ড. বিনায়ক সেন। দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এ পর্বে। প্রাবন্ধিক বলেছেন, ‘জাতি’ না বলে রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’ বলতে চেয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে ১৮৮৫-১৯১০ পর্যন্ত ছিল এই ‘নেশন’-এর প্রতি গভীর মোহ। ভাষা দিয়েই তাঁর এই মোহ শুরু হয়েছিল। তিনি নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় করে মহাজাতি গঠন করতে চেয়েছেন। এই মোহ ভেঙেছে ১৯১০-৪১ কালপর্যায়ে। তিনি তখন ‘নো নেশন’-এর পক্ষে কথা বলেছেন। প্রাচ্যে সমাজকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সমাজ গঠিত হয়। তিনি এই দুয়ের মধ্যে একটি সমন্বয় চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলেছেন ‘ট্র্যাজিক হিরো’।
আলোচনায় অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক মতপ্রকাশের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনেকবার নিন্দিত হয়েছেন। আমাদের সমাজে ভাষাগত, ধর্মীয়, স্থানীয়—বহু ধরনের ঐক্য ছিল। এই ঐক্যের বোধকে তিনি জাতীয়তাবোধ বলেছেন। উগ্র জাতীয়তা গ্রহণ করেননি। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকার লক্ষ করেছিলেন। সমন্বয়ের পথ ধরেই বাঙালিকে উন্নত হওয়ার কথা বলেছিলেন।’
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আমরা বাংলায় কথা বলি তাই আমাদের বাঙালি বলা হয়। কিন্তু বলাই যেতে পারে, ১৯৪৭ সালের পরে বাঙালি জাতি বলে আর কিছু নেই। কারণ, তারপর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। নতুন পরিস্থিতিতে আমরা লড়াই করে যে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি, সেই রবীন্দ্রনাথও অন্য রকম।’
ড. রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জাতিসত্তার ভিতর থেকে আন্তর্জাতিকতার বিষয়টি দেখেছেন। আমরা জাতিসত্তাকে বিকশিত করছি না—এই আক্ষেপ তাঁর ছিল। “বাংলাদেশ” নামটি তাঁর রচনাতেই সবচেয়ে বেশি এসেছে।’
সভাপতি আনিসুজ্জামান বলেন, ইউরোপীয় ও ভারতীয় রাষ্ট্রভাবনায় পার্থক্য ছিল। মোগল-আফগান শাসনের সময় যে সমস্যা হয়নি, ইংরেজ শাসনামলে তা দেখা দিয়েছিল। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রে সংঘবদ্ধ সংস্থা। এর লক্ষ্য রাজনীতি ও ব্যবসা পরিচালনা। ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে অন্য দেশ দখল করে সংঘাতের দিকে চলে যায়। অন্যের দেশ দখল করার নীতিকে রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেননি। তিনি জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে আত্মশক্তি জোগানোর কথা বলেছেন, যাকে আজ আমরা জনগণের ক্ষমতায়ন বলছি। তবে সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি অনেক কিছুই এড়াতে পারেননি।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
শেষ অধিবেশনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিষয়ে। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অসুস্থতার কারণে আসেননি। সেটি পাঠ করেছেন মারুফা রহমান। প্রবন্ধকার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ পেশাজীবী তৈরির জন্য শিক্ষার কথা ভাবেননি। শিক্ষা কোনো গণ্ডিতে বা ছকে বাঁধা যায়—এমন কথা তাঁর ভাবনাতেই আসেনি। তাঁর কাছে পড়ানোর বিষয়, ধরন বা উপকরণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো চর্চা ও সাধনায় নিরত শিক্ষকের সহূদয় সক্রিয় সাহচর্য। তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তি ও আনন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আলোচক দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানুষকে বদলে পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
অধ্যাপক মোহীত উল আলম বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মৌলিক শিক্ষাভাবনার সঙ্গে আমাদের ভাবনা মেলে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার ভৌত পরিকাঠামোর অভাব আছে।’
অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘আমরা বৃত্তিজীবী চাই, মানুষ চাই না। শিক্ষার মূল আদর্শ হারিয়ে ফেলেছি।’
সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সফল মানুষ হওয়ার কথা অনেকে বলেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রেনেসাঁ-মানব। তিনি জীবনের সব সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষ যেন তাঁর জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে, তেমন শিক্ষা চেয়েছিলেন।
অধিবেশন সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই দুই দিনের আটটি সেমিনারের প্রবন্ধ ও আলোচনাগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হবে। আগামী ২২ শ্রাবণ কবির প্রয়াণ দিবসে বইটি প্রকাশিত হবে।

‘২০০১ সালেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল’/‘ভারতের সঙ্গে আমাদের ৩টি কাঁটাতারের বাধা আছে’ -ড. বিনায়ক সেনের সাথে সাক্ষাত্কার

ড. বিনায়ক সেন। অর্থনীতিবিদ।  বিশ্বব্যাংকে সিনিয়র ইকোনোমিষ্ট হিসেবে যুক্ত র্ছিলেন ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনডিপিসহ বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩)। বাংলাদেশের প্রথম অন্তবর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিসি)-এ গবেষণা পরিচালক এর দায়িত্বে রয়েছেন।

উন্নয়ন গবেষণায় ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’, ‘জন ক্ষমতায়ন’, ‘নৈতিকতা ও উন্নয়ন’ ইত্যাদি বিষয় তাঁর আগ্রহ ও ভাবনার জায়গা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘প্রতিচিন্তা’-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাহরাম খান

সাপ্তাহিক : পুরনো বছরের শেষে এবং নতুন বছরের শুরুতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। কেউ বলছেন আমরা বড় ধরনের সমস্যায় আছি এবং সহসাই উত্তরণ ঘটবে না। আবার অনেকে বলছেন সমস্যা আছে তবে সঙ্কট নেই। আপনার দৃষ্টিতে দেশের অর্থনীতি কোন জায়গায় আছে বলে মনে করেন?

ড. বিনায়ক সেন : প্রশ্নটা যত ভালো বা সুন্দর এর উত্তরটা ততই কঠিন। আমি হতাশাবাদীদের দলে পড়ি না। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশাবাদের যে গল্প উঠেছে আমার মন তাতে পুরোপুরি সায় দেয় না। আমাদের অর্থনীতি নিয়ে চরম হতাশাবাদের যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনি অযৌক্তিক আশাবাদেরও কোনো কারণ নেই। প্রথমত, এই সরকারের প্রথম তিন বছর মুদ্রা সম্প্রসারণ নীতি নিয়ে চলছিল। এর মূল লক্ষ্যটা ছিল যাতে প্রবৃদ্ধি আরো বেগবান করা যায়। প্রাইভেট সেক্টরে প্রতি বছর ২৪ থেকে ২৬ শতাংশ ঋণ প্রদান করা হয়েছে। যা হোক, ২০০৯-২০১১ পর্বে সম্প্রসারণশীল মুদ্রাস্ফীতির কারণে বর্তমানে সরকারের সঙ্গে আইএমএফ-এর দরকষাকষি চলছে। ২০০১-১১ পর্বে ব্রোড মানি (গ২)  সরবরাহ ছিল ২২-২৩ শতাংশ। এখন আইএমএফ বলছে এই মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধিকে ১০-১২ শতাংশে নামিয়ে আনতে। সেটা উচিত হবে না। সরকার তাই সঠিকভাবেই যুক্তি দেখিয়েছে যে প্রবৃদ্ধি যেহেতু ৬ শতাংশ বা তার উপরে, আর মূল্যস্ফীতি যেহেতু ১০ শতাংশ বা তার উপরে, সেহেতু মুদ্রা সরবরাহ ১৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা ঠিক হবে না। এতে করে প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধিও গতিশীল হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বেগবান করার ঝোঁকটা সরকারের শুরু থেকেই ছিল। বাংলাদেশের গত দুই দশকের দিকে  তাকালে দেখা যাবে আমরা একটা রুদ্ধ পথে চলেছি (টাইট-রোপ ওয়াকিং করেছি)। এর মধ্যেও আমরা অনেক অর্জন করেছি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল)সহ বেশ কিছু ইতিবাচক অর্জন হয়েছে। এসব অর্জনের সঙ্গে আরেকটি বিষয় হলো আমাদের সরকারের ব্যয়ের পরিধিটা তুলনামূলকভাবে ছিল সীমিত। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সরকারি ব্যয় যেখানে জিডিপির ২০ শতাংশ বা তার বেশি, সেখানে আমাদের দেশে বহু বছর ধরে সেটা ১৫-১৭ শতাংশের মধ্যে আছে। এর জন্য বড় কারণ হলো অবশ্য কর আদায় কম হওয়া। দ্বিতীয়ত, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় কখনোই এমন পর্যায়ে যায়নি যেটা দিয়ে ৯-১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। এবার রেমিট্যান্স, বৈদেশিক সাহায্য এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে। ঠিক ২০০১ সালেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষে এসে। এরপর ক্ষমতায় আসা বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একটা অভিযোগ করতেন যে শূন্য কোষাগার রেখে গেছে আওয়ামী লীগ। সেই সময়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতারা ঢাকায় এসে কড়াশর্তে ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করে। ২০০২ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ায় সেই সমস্যা থেকে অনেকটা উত্তরণ হয়েছিল। আজ দশ বছর পর এসেও বৈদেশিক সাহায্য, রেমিট্যান্স রপ্তানি এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়াতে আগের পরিস্থিতি আবার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই স্বল্পমেয়াদি মূল সমস্যাটি হচ্ছে, হঠাৎ করে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদটা কমে যাওয়া। এর ফলে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যের উপর চাপ পড়েছে। টাকা-ডলারের বিনিময় হারে প্রভাব পড়েছে।

তাই সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে ২০১১-১২ অর্থবছরটা একটু কঠিন বছর হিসেবেই বিবেচিত হবে। তবে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা খেসারত দিয়ে হলেও সামষ্টিক অর্থনীতিকে সন্তোষজনক জায়গায় আনতে হবে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতিটা কমাতে হবে। আমদানি কমিয়ে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। আমদানি কমালে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারপরও এই উদ্যোগগুলো নিতে হবে অনেকটা বাধ্য হয়েই।

সাপ্তাহিক : আওয়ামী লীগ ২০০১ এর মতো এবারও একই সমস্যায় দুর্বলতা দেখাল। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি বলেই কি এই অবস্থা?

বিনায়ক সেন : এটা শুধু আওয়ামী লীগের জন্য না। সব সরকারের আমলেই কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা বলে এসেছি। এক দশক আগে আমি এবং বর্তমান বিআইডিএসের মহাপরিচালক মুস্তফা মুজেরি ২০০৩ সালে সরকারের পক্ষ হয়ে আইপিআরএসপি করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম তেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের বাজারেও বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে আমাদেরও কমাতে হবে। কারণ তেলের ভর্তুকির সুবিধা শুধু গরিব মানুষ পায় না। এই সুবিধার বেশিরভাগ ধনী মানুষ পায়। তাছাড়া তেল আমাদের নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য না। এর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে যদি আরো বেশি সুযোগ দেয়া হয় সেটা ভালো উদ্যোগ হবে। কারণ এর পুরোটার সুফল ভোগ করে গরিব মানুষেরা।

সাপ্তাহিক : আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাটা কি পর্যায়ে আছে?

বিনায়ক সেন : সাধারণভাবে বলতে গেলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা একটা প্রবল চাপের মধ্যে আছি। তবে এই চাপটা বৈশ্বিক অর্থনীতির ব্যতিক্রম ধারায় নয়। কারণ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে প্রতিবেশী দেশগুলোও এই সমস্যা মোকাবিলা করছে। আমাদের ওপর এই চাপটা যে আসবে তা বছরের শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। বিশেষ করে গত বছরের (২০১১) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আমাদের বলেছিলেন, সামনের বছরটা আমাদের জন্য একটু চাপের হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের দিকে যেন একটু বেশি নজর দেয়া হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় বাড়তি উদ্যোগ না নিলে সমস্যা হতে পারে। তাই হয়েছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা সমস্যায় রেমিট্যান্স প্রবাহের ছন্দপতন এই সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে আমরা মনে করেছিলাম। যদি তথ্যগত দিক বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বিগত ছয় মাসে আমরা তেমন কোনো বৈদেশিক সাহায্য পাইনি। উপরন্তু নানান ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আমরা আরো বেশি দিয়ে দিয়েছি। আরেকটা বিষয় হলো ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার ব্যাপারটিকে অনেকেই বড় করে দেখাচ্ছেন। এটা মূলত জনতুষ্টিবাদী পপুলিস্ট মত প্রচার ছাড়া আর কিছু না। বর্তমান সমস্যার এটা কারণ নয়, সমস্যা মোকাবিলার একটি উপায় মাত্র। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে মার্শাল-লার্নার কন্ডিশনের কথা আমরা জানি। অবমূল্যায়নের মাধ্যমে আমদানি নিরুৎসাহিত হয়ে রপ্তানি উৎসাহিত হবে, যা চলতি বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করবে।

তাই আমি মনে করি, বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক ভাঙ্গাগড়া চলছে তার শুরু যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে। এখন চলছে ইউরোপে। ভবিষ্যতে এটা ব্যাপক আকারে হলে আমাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। তবে আমরা যেসব প্রোডাক্ট নিয়ে রপ্তানি বাজারে আছি সেগুলো খুব বেশি প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। হিসাব কষে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিতে হবে।

সাপ্তাহিক : অনেকে বলছেন এডিপি কাটছাঁট করতে হবে…

বিনায়ক সেন : এডিপি কাটছাঁট জনতুষ্টিবাদী পপুলিস্ট কথা হিসেবে বিবেচিত। আমাদের ১৬৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে মাত্র চারভাগের একভাগ এডিপি বরাদ্দে থাকে। এর মধ্যে দশ ভাগ বাস্তবায়ন হয় না। সেই জায়গায় কাটছাঁট করলে তো গরিবের ওপর চাপ পড়বে। যেমন ধরুন একটা কালভার্ট যদি কোনো গ্রামে তৈরি হয় তাহলে একজন নিজের হাতে টাকা না থাকলেও গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা রিকশাভ্যান কিনবে। তার হাতে টাকা আসবে। নিজে চলবে, ঋণের কিস্তি দিবে আবার সঞ্চয়ও করবে। এই যে একটা প্রভাব, এটা কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই এডিপি খাতে হাত দেয়ার আগে চিন্তা করতে হবে। তবে কিছু মেগা প্রজেক্টের ক্ষেত্রে কাটছাঁটের চিন্তা করা যেতে পারে। সরকারের চলতি ব্যয়কে চরমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যয়-সাশ্রয়মূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সরকার অপ্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ বন্ধ রাখতে পারে যেগুলো গ্রামীণ অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তাই আমি মনে করি গ্রামীণ অবকাঠামো কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে কোনো কাটছাঁট করা ঠিক হবে না। কারণ এগুলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সঞ্চয়ে অবদান রাখে।

ফিসক্যাল পলিসি এবং মনিটরিং পলিসির মধ্যে একটা সঙ্গতিহীনতা আছে এখনো। কারণ আমাদের দেশে সামষ্টিক অর্থনীতিতে সমন্বয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মেকানিজম কাজ করছে না। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার মতো আমাদের পরিকল্পনা কমিশনে কোনো দক্ষ অর্থনীতিবিদ ও প্রযুক্তিবিদ নেই। আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ে কোনো অর্থ উপদেষ্টা নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও কুশলী অর্থনীতিবিদ পরামর্শকদের দ্বারা যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। অথচ এর সবই রয়েছে ভারতে ও পাকিস্তানে। এই কারণেই বলছি, অর্থনীতিতে নিবিড় তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই।

সরকারকে চিন্তা করতে হয় তার ঋণের বিষয়ে। এই ঋণ কিসের জন্য? যদি উৎপাদনমুখী খাতের জন্য হয় তাহলে অন্য কথা, যেমন বিদ্যুৎ খাতে। আর যদি অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য ঋণ হয় তাহলে সমালোচনার অনেক জায়গা আছে। আবার বিদ্যুৎ নিয়ে যারা এখন উচ্চবাচ্য করছেন তারাই কিন্তু কয়েক বছর আগে এগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। প্রয়োজনের বাইরে কথা বললে তো হবে না।  কুইক রেন্টাল ব্যয়বহুল পদ্ধতি ঠিকই, কিন্তু কুইক রেন্টাল পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন করে যে বিদ্যুৎ এলো তার প্রবৃদ্ধি-অভিঘাতও বিবেচনায় নিতে হবে।

সাপ্তাহিক : ২০০৭ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দাবস্থা শুরু হয়েছিল সেই সময়ে বাংলাদেশ ভালো করেছে। এবার আমরা চাপে পড়লাম কেন?

বিনায়ক সেন : গত দশকের শেষ দিকে যে বিশ্বমন্দা আমরা আমেরিকায় দেখেছি তা প্রথমে হাউজিং সেক্টরের সমস্যা নিয়ে শুরু হয়। এরপর আক্রান্ত হয় ঐ দেশের ব্যাংক সেক্টর, এরপর সেটি উৎপাদন খাতকে প্রভাবিত করা শুরু করে। শ্রমের বাজারের উপরও প্রভাব পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। ফলে পুরো অর্থনীতিকে চাপে ফেলে। আর সেই সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দাবস্থা চলছিল তখন আমাদের দেশে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি যে কোনো কারণেই হোক বৈদেশিক সাহায্যের গতিটা ভালো ছিল। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সের প্রবাহও সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বৈদেশিক সাহায্যও প্রতিকূলে যায়, একই সঙ্গে রেমিট্যান্সও কমতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে আরব-অসন্তোষকে কেন্দ্র করে।

আবার চলতি অর্থবছরের আগের বছরে আমাদের রপ্তানির বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ছিল ৪১ শতাংশ। যা ছিল অভাবনীয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এটা এখন কমছে, কমে এখন ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তখন তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে গিয়েছিল। এখন সেটা বাড়ছে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমরা কোনো সরকারের আমলেই সফল হইনি। তবে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কয়েকটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ও বর্তমান সমস্যায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান রেখেছে। যেমনÑ পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অধ্যাপক ইউনূস ও তার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত ঝামেলা এবং রাজনৈতিকভাবে অহেতুক অসময়োপযোগী বাগ্বিতণ্ডা। এগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব বেশি অর্থনৈতিক বিষয় মনে না হলেও সামগ্রিকভাবে এসব বিষয় সমস্যায় পুষ্টি যোগায়। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এটা সরকারকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে প্রবৃদ্ধি বাড়া সত্ত্বেও, দারিদ্র্য ক্রমাগত কমা সত্ত্বেও, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সাফল্য সত্ত্বেও কোনো নির্বাচিত সরকারকেই জনগণ পরপর দু’বার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেনি। এর কারণ কি? এটা একটা ধাঁধা। আমার ধারণা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা বিনয়ী, কতটা আন্তরিক, কতটা শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যবহার করেন সেসব সূচককে জনগণ খুবই গুরুত্ব দেয় পুনরায় ভোট দিয়ে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে। এখন যে সমস্যা চলছে তার শেষ এখানেই নয়। ইউরোপের সমস্যা যদি গ্রিস-ইটালি ছাড়িয়ে ফ্রান্স-জার্মানিতে ছড়ায়, সেটা আমাদের জন্য আরো বড় হুমকি হতে পারে। যদিও এমনটা হবেই এমন মনে করছি না। আবার যদি হয়ও তাহলে আমাদের যেসব খাতে উৎপাদন-রপ্তানি আছে সেগুলো বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। তাই খুব বেশি চিন্তা না নিয়ে আমাদের সতর্ক হয়ে চলতে হবে। সতর্কতা সবসময়ই অবলম্বন করা প্রয়োজন কি কথায়, কি কাজে।

সাপ্তাহিক : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমস্যার ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ সমস্যা তৈরি করল কেন? এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন কিভাবে সম্ভব?

বিনায়ক সেন :  বৈদেশিক সাহায্য এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের অর্জনগুলো আন্তর্জাতিক সমাজে ঠিকমতো তুলে ধরা হচ্ছে না। না হয় আমাদের এই অবস্থা থাকবে কেন? আমরা কি আফ্রিকার দেশ? আন্তর্জাতিকভাবেই তো আমাদের স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে যে এমডিজি অর্জন, জেন্ডার সমতা, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, দারিদ্র্য নিরসন, ঋণের পরিশোধ এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বেশি। এখন কোথায় একজন মন্ত্রীকে ঘিরে বিতর্ক হলো সেই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে সবকিছু থেমে যাবে এটা তো ঠিক না। হ্যাঁ দুর্নীতি হলে সেটাও আমরা আমলে নেব। তার মানে এই নয় যে, একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে সরকার অনেক বেশি সময় নিয়েছে। কিন্তু আমরা ক্রমাগত খারাপ করছি বিষয়টা সে রকম নয়। যেমন মুডিস (আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা) টিআই (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) এসব সংস্থার রেটিংয়েও আমরা ভালো করছি। ঋণ, ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রেও আমরা ভালো করছি। তাহলে আমরাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকার কথা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে। তবে বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে দাতাদের মনস্তত্ত্বের প্রতি আরো নজর দেয়া উচিত ছিল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বিতর্কিত যে মন্ত্রীকে সরানো হলো তাকে আইসিটি খাতের দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল না। শুধু এ কারণে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রায় পাস হয়ে যাওয়া ৮০ মিলিয়ন ডলারের একটি বৈদেশিক সাহায্য বিশ্বব্যাংকের বোর্ড বাতিল করে দেয়। অথচ এই সাহায্যটি এখন পাওয়া গেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ পরিস্থিতি আরো সহনীয় পর্যায়ে আসত। আমার মতে, এরকম বিতর্কিত ব্যক্তিকে এখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না দেয়াই দেশের স্বার্থে  উচিত ছিল। অবস্থা ভালো হলে এসব ব্যক্তির অন্যত্র ব্যবহার হতে পারত।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় পাইপলাইনে অনেক সাহায্য-সহযোগিতা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে সেগুলো ঠিকমতো আসে না কেন? এর জন্য দরকার উচ্চপর্যায়ের উদ্যোগ। যেমনটা ঐতিহাসিকভাবে সিঙ্গাপুরে কোরিয়ায় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সচিবদের টার্গেট দেয়া হোক যে, এই সময়ের মধ্যে পাইপলাইনে আটকে থাকা সাহায্যকে ছাড়িয়ে আনার কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। সেজন্য বিদেশিরা কি কিভাবে পেতে চায় সেগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তিনি (সচিব) ব্যবস্থা করবেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সচিবদের বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের (প্রকল্প পরিচালকদের) ইনসেনটিভের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ক্রাইসিস নতুন কিছুর জন্ম দেয়। সে রকম মৌলিক উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। রাজনীতিবিদদের এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। শুধু যে নিয়মে ছিলাম ঘুরেফিরে সেই নিয়মেই থাকব এটা হতে পারে না। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে হবে বা রাখব না এসব বিষয় নিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলে হবে না। রাজনীতিবিদদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত হতে হবে। বর্তমানে যে চাপের মুখে অর্থনীতি এখনই অর্থনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করার সময়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে এটা করা যায়, প্রকল্প-সাহায্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা করা যায়। কর আদায়ের ক্ষেত্রে এটা করা যায়। এটাই এখন জনদাবি নাগরিক সমাজের দাবি হওয়া উচিত। দেশের উন্নতির সঙ্গে এটি গভীরভাবে জড়িত। শুধু অর্থমন্ত্রী অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবেন আর মাথা ঘামাবেন বিষয়টা ঠিক না। আইন প্রণেতা, সরকারি দল, বিরোধী দল সবাইকে এই বিষয়গুলোকে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সেসব দেশেই বৈদেশিক সাহায্য বিনিয়োগের সুন্দর ধারাবাহিকতা থাকে।

সাপ্তাহিক : প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না থাকলেও দেশ চলেছে। এখনো চলতে কোনো সমস্যা হবে না…

বিনায়ক সেন : রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ফোরামে নানান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী এই কথা কোন দৃষ্টি থেকে বলেছেন সেটা আমি জানি না। কিন্তু তিনি যদি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনায় এরকম কথা বলতেন তাহলে আমরা সেটা নিয়ে কথা তুলতাম তবে এই ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ আমি দিতে চাই। চীন ১৯৯৫ সাল থেকেই এলডিসি থেকে বেরিয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু সেই সময়েও তারা বিশ্বব্যাংকের কাছে বলেছিল যে, আমাদের দেশে অনেক দরিদ্র লোকজন আছে তাই ওউঅ ঋণের মতো সহজ শর্তে ১% সুদের ঋণটা চালু রাখা হোক। দেখুন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তখন তারা যে অবস্থায় ছিল তখন ঐ ঋণ না পেলেও যে খুব সমস্যা হতো তা কিন্তু নয়। অথচ তারা বলেছে, চেয়েছে। আমার কথা হচ্ছে আমাদের ভেতরে কি শক্তি আছে সেটা তো নিজেরা বুঝব। তাই বলে সুবিধাজনক সুযোগ ছাড়ব কেন? ঠিক আছে আমাদের কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক অর্জন আছে। খাদ্য ঘাটতির কারণে যে রাজনৈতিক সমস্যা হয় এরকম কোনো পরিস্থিতিতে হয়ত আমরা নেই। তাই বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার চেয়ে সামনের দিনে এই পরিস্থিতিকে কিভাবে আরো শক্ত করা যায় সেই উদ্যোগ নেয়া দরকার। তাই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক জায়গা থেকে আমরা সামনের দিনের ইতিবাচক অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করার দিকনির্দেশনা পেলে বেশি উপকৃত হব।

সাপ্তাহিক : সামষ্টিক অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টা যদি বুঝিয়ে বলেন।

বিনায়ক সেন : সামষ্টিক অর্থনীতি হলো অর্থনীতির আর্থিক খাত, রিয়েল সেক্টর বা উৎপাদনশীল খাত, বৈদেশিক খাত সব দিকের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা। এখানে একটা সূচক আরেকটার উপর নির্ভরশীল। ফলে যে কোনো একটি বা দুটি বিষয় যখন তার স্বাভাবিকতা হারায় তখন বাকি সূচকগুলোও প্রভাবিত হয়। তেমনি এখন আমাদের যে অব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে তার মানে অর্থনীতির সব শাখা এলোমেলো হয়ে যায়নি। বরং যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আশাব্যঞ্জক বা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকার কথা ছিল সেটা হয়নি। যার কারণে সামগ্রিকভাবে প্রভাব পড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির কাজ শুধু মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখা না। বরং প্রবৃদ্ধি গতিশীল রেখে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন এবার আমাদের সরকারের ঋণগ্রহণ হয়েছে অনেক বেশি, ফলে প্রকল্প অব্যবস্থাপনা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস এসব ইস্যু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে এত হৈ হুল্লোড় করার কিছু নেই। বেশি গ্রোথ যখন হয় তখন মূল্যস্ফীতি একটু বেশি থাকে। এখন যে মুদ্রা সংকোচন নীতিতে চলছে তা ঠিক পথেই চলছে। আমি আশাবাদী আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই আমরা আইএমএফ-এর থেকে বাজেট সহায়তা পাব যেসব পদক্ষেপ আমরা বাস্তবোচিতভাবে নিচ্ছি সেই সুবাদে। এবং তখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ পরিস্থিতির ওপর চাপও অনেকটা কমে আসবে। তবে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় না থাকলে মুদ্রা সংকোচন নীতি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা যাবে না, যতটা প্রয়োজন সেভাবে।

সাপ্তাহিক : আপনি বলছেন বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে নিতে। কিন্তু স্বাভাবিক দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভর্তুকি তুলে দেয়াটা কি যুক্তিসঙ্গত?

বিনায়ক সেন : এটা ঠিক যে ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে প্রধানত এর ব্যবহারকারীরা একটু চাপে পড়বে। কিন্তু ভর্তুকি দিয়ে অর্থনীতিকে যদি আরো বেশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে যাই তাহলে এর জন্য সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যেমন ভর্তুকি দেয়াতে যারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তারা উপকৃত হচ্ছেন। কিন্তু সরকার তো শুধু তাদের নয়। ফলে ভর্তুকির ভার বহন করছেন বিদ্যুৎ যারা ব্যবহার করেন না তারাও। সে জন্যই আমি বলছি মন্দার বছরে অর্থনীতির চাপটাকে সবাই শেয়ার করে নিলে উত্তরণ সহজ হয়। একইসঙ্গে আমি আগে বলেছি যে, কাটছাঁটের বছরেও যেন কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে যাতে কাটছাঁট না করা হয়। এখন প্রবৃদ্ধিকে কিছুটা কমিয়ে এনে হলেও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা জরুরি। সেখানে বেহিসেবিভাবে চলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের অর্থনীতি সেই চাপ সামলাতে পারবে না। এই বাস্তবতা সবাইকে বুঝতে হবে। এ নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ নেই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি যেমন বাড়ছে মানুষের ন্যূনতম আয়ও কিন্তু বাড়ছে। আগে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে কৃষি মজুরির সমন্বয় হতে ৩-৪ বছর লাগত। এখন সেটা ১-২ বছরের মধ্যে সমন্বয় হয়। অর্থাৎ দ্রুত সমন্বয় হয়। যেমন পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিকশাওয়ালারা তাদের ভাড়া বাড়িয়ে দেন। কৃষি শ্রমিকরা তাদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে দেয়। এখন কৃষি মজুরদের দৈনিক মজুরির রেট ২০০-৩০০ টাকা। এতে করে এখন ৫-৭ কেজি চাল হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে ক্ষেতমজুর সমিতি আড়াই সের চালকে ন্যূনতম মজুরি করার কথা ভেবেছিল। ফলে দাম যতই বাড়–ক মানুষ সেটাতে মোটামুটি মানিয়ে নিতে পারছে। এখন সঞ্চয় বিনিয়োগের শক্ত ভিত্তিতে আমরা এমন এক অর্থনীতিতে আছি যেখানে শুধু মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভেঙে পড়ব না। তাই সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভর্তুকি কত কমিয়ে আনতে পারে সরকার।

সাপ্তাহিক : ব্যাংকিং খাতের ক্ষেত্রে গত বছরটা কেমন গেল?

বিনায়ক সেন : এটা একটা ভালো প্রশ্ন। ব্যাংকিং একটা অজানা খাতে পরিণত হয়েছে। ’৮০ দশকে ব্যাংকিং সেক্টরে বড় আলোচনা ছিল এই খাতের টাকা যাচ্ছে কোথায়? এই লুটেরারা কারা? ’৯০ এর দশকে এটা কিছুটা কমে এসেছে। তবে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের নিয়ে কথা উঠেছে। কিন্তু ২০০০ এর দশকে কারা কি করছে তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি আমি যতটুকু অনুমান করতে পারি গত এক দশকে আর্থিক খাত নিয়ে যতগুলো সংবাদ শিরোনাম হয়েছে তার বেশিরভাগই হয়েছে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বা বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে। ব্যাংকিং খাতের বিষয়টি তেমন আলোচনায় আসেনি। এই প্রাইভেট সেক্টরের বৃহৎ ঋণের প্রবাহ এটা গেছে তাদের কাছে? এমনকি সরকারি ঋণের ক্ষেত্রেও ওঠানামাটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তলিয়ে দেখার বিষয়।

আমার ধারণা মন্দা ঋণকে যেভাবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বিষয়টা সেরকম নয়। মনে হচ্ছে ক্যাশ রিকভারি নয়, মূলত রিশিডিউলিং ও মন্দ ঋণ মওকুফ (রাইট অফ) করে মন্দ ঋণকে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক নিয়োগ এবং তাদের সম্পর্কে যেসব খবর শোনা যায় তাতে এই সন্দেহটা বাড়ে। তবে আশির দশকের তুলনায় এখন একটু পার্থক্য আছে। যেমন আগে বড় ধরনের ঋণ নিয়ে সেগুলো দিয়ে গাড়ি-বাড়ি, ভোগ বিলাসিতায় ব্যবহার করে ঋণটাকে প্রথমেই মন্দা বানিয়ে ফেলা হতো। এখনকার সময়ে ঋণগ্রহীতারা কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিচ্ছে। কেউ গার্মেন্টস বা রপ্তানিমুখী ব্যবসা করছে কেউ দেশের ভেতরের অর্থনীতিতেও টাকাটা কাজে লাগাচ্ছে, তারপরও এর ওপর যদি নজরদারি থাকে তাহলে আরো উন্নতি হবে সন্দেহ নেই।
সাপ্তাহিক : আর ব্যাংকগুলো যে শেয়ারবাজারে গেল…

বিনায়ক সেন : শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়ার বিরোধী ছিলাম আমি। শেয়ার মার্কেট তার নিজস্ব গতিতে চলবে। সেখানে ব্যাংকের মতো বৃহৎ পুঁজির প্রতিষ্ঠান ঢুকলে বাজার আরো তেজী হবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়ে ভুল সিগনালে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। হয়েছেও তাই। আরেকটা হলো কর মওকুফ করা। ব্যাংকে এফডিআর করলেও আমাকে কর দিতে হয়। অথচ শেয়ার মার্কেটের বড় বড় পুঁজির লোকেরা কোনো কর দেবে না এটা কিভাবে হয়? ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি হতে পারে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কিভাবে হলো। তিনি  বললেন, কিভাবে কিভাবে জানি এটা হয়ে গেছে।

তারপর আসুন সঙ্কট উত্তরণে কমিটি গঠন বিষয়ে। তারাও পুঁজিবাজারে ব্যাংককে জড়িত করে রাখল এবং পুঁজিবাজারে আয়কৃত অর্থ করমুক্ত রাখল, উপরন্তু কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগও রাখা হলো। তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে বিশৃঙ্খলাটা পুঁজিবাজারে তৈরি হয়েছে সেখান থেকে তারা কি শিক্ষা গ্রহণ করল? আবার বিভিন্ন ধরনের ফান্ড তৈরি করে বাজার দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো কোনো দীর্ঘমেয়াদি ফল দেবে না। মানুষের আস্থাই হলো এই বাজারের বড় মূলধন। আমার মূল কথা হলো, ব্যাংক খাতকে পুঁজিবাজারের থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবেÑ বিশেষত, সেকেন্ডারি মার্কেটে তারা বিনিয়োগ করতে পারবে না। আরেকবার পুঁজিবাজারে ধস নামলে সমগ্র ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সাপ্তাহিক : ইব্রাহীম খালেদের তৈরি প্রতিবেদন কতটুকু আমলে নেয়া হয়েছে?

বিনায়ক সেন : ওঁর প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে তাদেরই কেউ কেউ মার্কেট পুনর্গঠনে দায়িত্ব পেয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায় সরকার কতটুকু বিষয়টা আমলে নিয়েছেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর মতো সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে যেখানে মীমাংসা করার জন্য জড়িত করা হলো সেখানেও প্রধান দুটি ভুল শোধরানো হয়নি। তার একটা হলো ব্যাংক খাতকে জড়িত রাখা হলো এবং কর মওকুফের সঙ্গে কালো টাকাও ছাড় পেল।

সাপ্তাহিক : শেয়ারবাজারের অব্যবস্থাপনাকে বর্তমান সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা বলে অনেকের অভিযোগ…

বিনায়ক সেন : শুধু শেয়ারবাজার না। আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে বর্তমান সরকারের কয়েকটি ভুলকে উপলব্ধি করি। প্রথমত, পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতা তৈরির নেপথ্য কারিগররা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্বিতীয়ত ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তির সঙ্গে অহেতুক বিতর্কে জড়ানো যেটা আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব রাখছে। তৃতীয়ত, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যেভাবে তাদের আপত্তি জানিয়েছে (সাধারণত তারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে বলার চেয়ে আগে সরকারকে গোপনে জানায়)। তারপরও সরকার ঐ মন্ত্রীকে সময়মতো সরায়নি এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত ঝামেলা। এসব মামলার বিষয় দুদক দেখবে। এগুলো নিয়ে হৈ চৈ করা সরকারের কাজ নয়। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ করার চেয়ে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করা উচিত ছিল। এখনও সময় আছে সতর্ক হওয়ার। রাজনৈতিক শান্তি না থাকলে অর্থনৈতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না। অন্যদিকে, সামনের নির্বাচন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে হবে নাকি অ-তত্ত্বাবধায়কে হবে সেটা নিয়ে বিতণ্ডায় থাকা আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। অথচ এসব বিতর্কে সরকার তার যথেষ্ট শক্তি ক্ষয় করছে। বিরোধী দলও এই অভিযোগের বাইরে নয়। কিন্তু এসব সমস্যাকে আমি সরকারের স্বেচ্ছাকৃত ভুল বলব। যেগুলো থেকে দূরে থাকা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

সাপ্তাহিক : পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন একদিকে অনেক টাকা লুটেরা গোষ্ঠী নিয়ে গেল। অন্যদিকে সরকার বিভিন্ন খাতের টাকা ফান্ড করে বাজারকে তেজি করার চেষ্টা করছে। যেখানে দোষীদের বিচার তো হয়ইনি উপরন্তু আরেক কালো টাকার গোষ্ঠীকে অবাধে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখেন?

বিনায়ক সেন : কালো টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে যে এই সমস্যার সমাধান হবে না সেটা অনেক অর্থনীতিবিদ ইতোমধ্যে বলেছেন। এটা নিয়ে আর ব্যাখ্যা করার দরকার নেই বলে আমার মনে হয়। আমার কথা হচ্ছে আমাদের এখানে ন্যূনতম সুশাসন নিশ্চিত করার মানসিকতা না থাকায় কালো-সাদা টাকার মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই। যে কারণে বলা যায় কালো টাকা অলস পড়ে নেই। কোনো না কোনো খাতে সেটা ব্যবহার হচ্ছে। আমি মনে করি ফাইনান্সিয়াল সেক্টরের মধ্যে ক্যাপিটাল মার্কেট একটি অংশ মাত্র। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে যারা তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থান করতে চেয়েছিলেন তারা ভুল করেছেন। তাছাড়া আমাদের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন তারা পুঁজিবাজারের মাধ্যমে কিন্তু উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেনি যেমন, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। তাদের উন্নয়ন হয়েছে মূলত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এবং ব্যাংক খাতের সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এটা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য।

পুঁজিবাজার নিয়ে আমাদের ঐতিহাসিক দুর্ভাগ্য আছে। ১৮৪৭ সালে প্রথম বাঙালি শিল্প উদ্যোক্তাদের বড় ধাক্কা দেয় শেয়ার মার্কেট। দ্বারকানাথ ঠাকুরদের সব কোম্পানি ধ্বংস হয় পুঁজিবাজারের অভাবনীয় দরপতনের কারণে। পুঁজিবাজারের আরেকটি বড় পতন আমাদের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময়। বর্তমান সময়েও আমাদের পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে তেমন কোনো অবদান রাখেনি। আমাদের উন্নয়ন মূল অবদান রেখেছে সরকারি বিনিয়োগ, ব্যাংকিং খাত এবং আমাদের রপ্তানি।

তবে পুঁজিবাজারে আমাদের বৃহৎ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জড়িত করতে পারলে ইতিবাচক ফল হতো। যেমন ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ কম-বেশি বেক্সিমকোর সমান। বা কিছু বৃহৎ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে যেগুলো সারা বছরই ভালো উৎপাদনে থাকে তাদেরকে যদি পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ত করা যায় এবং এসব প্রতিষ্ঠানের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রাইমারি শেয়ার যদি ক্ষুদ্রঋণের পরিবার বা শ্রমিক পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হতো তাহলে পুঁজিবাজারে নতুন প্রাইমারি শেয়ার যেমন আসত, তেমনি এসব প্রতিষ্ঠানের গরিব সদস্যরাও ডিভিডেন্ড আয় থেকে বাড়তি উপার্জন করতে সক্ষম হতেন। ফলে কর্মীদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা বেড়ে কাজের গতিকে প্রভাবিত করত। এগুলোকে আমি প্রাইমারি মার্কেটে যুক্ত থাকার বিষয়ে বলছি। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে কিছু সতেজ রক্ত প্রবাহিত হতো যা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করত, আস্থা বাড়ত।

সাপ্তাহিক :  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাকে কিভাবে দেখছেন?

বিনায়ক সেন : আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নেই। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শুধু দোষারোপ করলে চলবে না। পৃথিবীর যেসব অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার পথে বা এখন শক্তিশালী সেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের মতো করে চলে। কিন্তু আমাদের সরকারের একটা ব্যাংকিং বিভাগ আছে। সেখানে নিজেদের দলীয় অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়ে সব নিজেদের মতো পরিচালনা করতে চায়। দলীয় লোক নিয়োগ দিতেও আপত্তি থাকত না যদি তারা সংশ্লিষ্ট খাতের যোগ্য ব্যক্তি হতেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি বিষয়কে ইতিবাচক উল্লেখ করতেই হবে তার একটি হলো জোর করে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা তারা করেনি। দ্বিতীয়ত পরিস্থিতি অনুযায়ী মুদ্রা সংকোচন নীতি নিয়ে চলেছে। এখন সরকার যদি তার ব্যয়ে কোনো কাটছাঁট না করে আগের মতোই চলতে চায়, ব্যাংক ঋণ নিতে থাকে তাহলে তো সমস্যা হবেই। আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মাঝে কোনো সমন্বয় নেই।

সাপ্তাহিক : আমাদের সরকারি ব্যয় কি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি?

বিনায়ক সেন : সাধারণত ২০-২১ শতাংশ সরকারি ব্যয় থাকে। সে তুলনায় আমাদের কমই হয়। কিন্তু যেহেতু আমরা একটু চাপে আছি সেই ক্ষেত্রে এদিক-সেদিক কাটছাঁটের চিন্তা করতে হবে মন্দা বছরের তাড়নায়। তবে গ্রাম উন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব রক্ষা করতে হবে। কারণ এগুলো সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ে অবদান রাখে।

সাপ্তাহিক : আপনি বলছেন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি ঠিক রাখতে, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ নেয়া বন্ধ করতে। তাহলে সরকার টাকা পাবে কোথায়?

বিনায়ক সেন : সরকারের হাতে যেসব মেগা প্রজেক্ট আছে সেগুলোকে আপাতত বন্ধ রেখে, যতটা সম্ভব সরকারি ব্যয় কমিয়ে এবং ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে সরকারকে একটা সমন্বয়ের মধ্যে আসতে হবে। এখন ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়ার কথা বললেই অনেকেই হৈ চৈ করে ওঠেন। কিন্তু আমি এক মধ্য খামারের কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি। তারা বলছে সারের ভর্তুকি উঠিয়ে দিলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। কারণ কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন। এখন পণ্যের দাম বাড়ছে অনেক বেশি অথচ আমাদের ভর্তুকি মানসিকতা কমছে না। এটা ঠিক না। নব্বইয়ের দশকে ধানের দাম তেমন পেত না কৃষক। এখন তো ভালো পাচ্ছে। তাই কৃষিপণ্যের তুলনামূলক উচ্চ দামের স্তরে প্রবেশ করেও আমাদের ভর্তুকি মানসিকতা থাকবে ২০ বছর আগের মতোÑ এটা কিভাবে হয়?

সাপ্তাহিক : সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য আর কি করা যেতে পারে?

বিনায়ক সেন : খুব দুঃখের বিষয় হলো আমরা যখন আর্থিক বছর নিয়ে আলোচনা করছি তখন মূল উপজীব্য হচ্ছে রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক সাহায্য ইত্যাদি। কিন্তু ইতিবাচক অর্থে মূল আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত ছিল রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর। এর কারণ হচ্ছে কর আদায়ে আমরা পারদর্শী নই। আমেরিকাতে এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কর গোয়েন্দা হিসেবে। আমাদের দেশেও কর সেভাবে আদায় হচ্ছে না। একদিকে মানুষ কর দিতে আগ্রহী না। অন্যদিকে করনীতিতে থাকছে বিশাল ফাঁকির সুযোগ। না হয় আমরা এত পিছিয়ে থাকতাম না। নানান বিষয়ে কমিশন হয় একটা কর কমিশন করে এর আইনসহ সংশ্লিষ্ট দিকগুলো দেখলেই হয়। এটা করা হবে না। বলা হয় দুর্নীতি আমাদের বড় সমস্যা। আমি বলি অত্যন্ত দক্ষ এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক কর গোয়েন্দা নিয়োগ করুন। দেখবেন দৃশ্য পাল্টে যাবে। আর শুধু গতানুগতিক পদ্ধতিতে কর আদায় করলে হবে না। আধুনিক অনেক চিন্তা-চেতনা ও পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ হচ্ছে সেগুলো দেখেও আমাদের জন্য উপযুক্ত একটি পদ্ধতি বেছে নিতে পারি। কর আদায় বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো না গেলে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা কাটবে না, বা মন্দার বছরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা আগামীতেও থেকে যাবে।

সাপ্তাহিক :  দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে বলে অভিযোগ অনেকের…

বিনায়ক সেন : পাকিস্তান আমলে যেমন মুষ্টিমেয় পরিবারের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত ছিল আমাদের দেশে তেমনটি তৈরি হয়েছে কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। ১৯৮৮ সালে আমি এবং এমএম আকাশ একটি কাজ করেছিলাম। সেখানে ৩৬টি পরিবারের বিষয় এসেছিল। এখন এ বিষয়ে কোনো কাজ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে যে পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা হয়েছে তাতে এই সংখ্যা বেড়েছে অনেক তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তবে একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয় বেড়ে জীবনযাত্রাও পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে অতি উচ্চবিত্ত এবং অতি দরিদ্রদের আয় বেড়েছে। বেকায়দায় আছে মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তদের আবার দুটি শ্রেণী মনে করি আমি। একটা উচ্চমধ্যবিত্ত, আরেকটি হলো মধ্য মধ্যবিত্ত। মধ্য মধ্যবিত্ত তুলনামূলকভাবে সমস্যায়। জিনিসপত্রের দাম ওঠানামা করলে উচ্চবিত্তের জন্য কোনো সমস্যা না। উচ্চমধ্যবিত্তও তেমন কোনো প্রভাবিত হয় না। কিন্তু মধ্য-মধ্যবিত্তের আয় নির্দিষ্ট হওয়াতে সমস্যায় পড়ে। অন্যদিকে মজুরি শ্রমনির্ভর গরিব শ্রেণীর অনেকেই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের মজুরির সামঞ্জস্য করতে পারে খুব দ্রুত, তাই তারাও একটা ব্যালেন্সের মধ্যে থাকতে পারে। সামনের দিনে দারিদ্র্য বিমোচনকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হয়। কিন্তু আমার মতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান। কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ বয়সে তরুণ, তারা পর্যায়ক্রমে চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে। সেখানে তারা প্রথমেই বড় ধরনের বৈষম্যের শিকার হবে শিক্ষার দিক দিয়ে। যেমনটা বর্তমানে হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। অর্থাৎ কে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছেন সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা হবে। বাংলা মাধ্যমে পড়েছে  না ইংরেজি  মাধ্যমে পড়েছে। এখন একজন মধ্যবিত্তের সাধ্য নেই তার সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবে। তাই এক দেশে অনেক ধারায় শিক্ষা অর্জন হচ্ছে। যা বৈষম্যের সঙ্গে অদক্ষতা তৈরি করে। এই বিষয়টা দেখতে হবে। আরেকটি হলো কারিগরি শিক্ষা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অথবা বৃত্তি দিয়ে মেয়েদের পড়িয়ে বসিয়ে রাখলে হবে না। এসব করে আমরা এমডিজি অর্জন করতে পারব, কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে। পড়াশোনা করে তারা শুধু ভালো মা হবে নাকি উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগবে এটা দেখতে হবে। কারণ যে মেয়েটি শিক্ষার্জন করেছে তার মনমানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে নিশ্চয়ই। তার মতের প্রাধান্য দিতে হবে। না হয় অসন্তোষ বাড়বে। ইনক্লুসিভ গ্রোথ-এর জন্য মহিলারা যাতে শ্রমবাজারে আরো বর্ধিত আকারে অংশ নিতে পারেন সেদিকে নজর রাখা জরুরি।

সাপ্তাহিক : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। এই দুইয়ের মিশ্রণও খুব ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এসবের বাইরে নতুন কিছু চিন্তার জায়গা আছে কি?

বিনায়ক সেন : বর্তমান বিশ্বে অনেক ধরনের গণতন্ত্র আছে। আবার নানান ধরনের সমাজতন্ত্রও আছে। এগুলো মানুষকে পরিতৃপ্তি না দিলেও নতুন পথ না থাকায় মন্দের ভালোর মধ্যে থাকছে। তবে মানুষের মাঝে যে আকাক্সক্ষা দেখা যায় সেটা হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসন তাদের পছন্দ। গণতন্ত্র মানে অবাধ নির্বাচন শুধু নয়, এটি গণতন্ত্রের সংকীর্ণ সংজ্ঞা। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করা। এটাই গণতন্ত্রের আধুনিকতম ধারণা। একদিন ভোট দিলেই মানুষের কাজ শেষ বিষয়টা এরকম নয়। যেমন এখন বলা হয় আমেরিকায় গণতন্ত্র থাকলেও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র নেই। অন্যদিকে চীনে গণতন্ত্র না থাকলেও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র আছে। এখন কথা হচ্ছে দুটি প্রক্রিয়াতেই মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। এ জন্য আমরা নিজেও এটা নিয়ে লিখেছি প্রতিচিন্তা নামক একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। এই দুটি ধারার বাইরে তৃতীয় আরেকটি ধারাতে আমরা প্রচেষ্টা চালাতে পারি। বর্তমান বিশ্বে চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে ইত্যাদি ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো আমেরিকার প্রতি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি রেখে, আইএমএফের সহযোগিতা না নিয়েও অর্থনৈতিকভাবে ভালো করছে। জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে। সামরিক বাহিনীর শাসনকে সাংবিধানিকভাবে প্রত্যাখান করেছে। আমি বলছি না তাদেরটাই শেষ পথ কিন্তু তারা এগুলো দিয়ে ভালো করছেন। তেমনি আমরা জনঅধিকারের ভাষায় নতুন পথে চলতে পারি কিনা সেই চেষ্টায় যাওয়া উচিত। গরিবরা শুধু কোনোমতে বেঁচে থাকবে আর ধনীরা আরো ধনী হতে থাকবে এটা হওয়া উচিত না।

সাপ্তাহিক : অতি ধনীদের জীবযাপন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

বিনায়ক সেন : সম্প্রতি ভারতের ধনীদের বিষয়ে অরুন্ধতী রায় তাঁর ব্রোকেন রিপাবলিক বইতে লিখেছেন যে ভারতের অতি ধনীরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছেন। তারা সামাজিক খবর তো রাখেনই না, সেই ভাষাও বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। তেমনিভাবে আমাদের বাংলাদেশের অতি উচ্চবিত্তদেরও এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত একটা উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে আমাদের দুজন বন্ধু দেশের বাইরে থেকে দীর্ঘদিন পর আসছেন। সে উপলক্ষে কয়েকজন মিলে শতাধিক লোকের আয়োজন করলেন ঢাকা ক্লাবে। আমাকে দাওয়াত করল। কার্ডে ড্রেস কোড নিয়েও কিছু নির্দেশনা আছে। আমি বললাম যে, এই অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের স্বাগত জানানোর কাজটা আমি করতে পারব না। তারা আমার বন্ধুÑ তাদের সঙ্গে কথা হবে পারিবারিক পরিবেশে। আর যদি সবাই মিলে বিশেষ আয়োজন বা গেট টুগেদারের আয়োজন করি তাহলে অন্য জায়গায় করা যায়। ঢাকা ক্লাবের মতো এত ব্যয়বহুল জায়গায় কেন? এই যে আমাদের শ্রেণী উত্তরণ এবং চরিত্র পরিবর্তন তা সত্যিই অভাবনীয়।

সাপ্তাহিক : ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট প্রসঙ্গে আপনার মত কি?

বিনায়ক সেন : ভারতের সঙ্গে আমাদের ৩টি কাঁটাতারের বাধা রয়েছে। একটি হচ্ছে ভৌগোলিক কাঁটাতারের বেড়া- যা দিয়ে আমাদের দেশের সীমান্তের চারপাশে বেড়া তৈরি করে আমাদের ভূখ-কে সন্ত্রাসী ভূখ- মনে করে অভিবাসীদের যাওয়া-আসা বন্ধ করতে চেয়েছে। অর্থাৎ ভৌগোলিক কাঁটাতার প্রমাণ করে যে তারা আমাদেরকে আস্থায় নেয়নি। দ্বিতীয় কাঁটাতারটি হচ্ছে মানসিক। আমাদের এখানে অবাধে ভারতীয় চ্যানেল দেখানো হচ্ছে, অথচ আমাদের কোনো চ্যানেল সে দেশে প্রদর্শিত হয় না। আমাদের উন্নতি, আমাদের নাটক, আমাদের গান, আমাদের সমাজ নিয়ে জানবার কোনো সম্ভাবনাই নেই সাধারণ ভারতবাসীর। এই কাঁটাতারটি আরো মর্মান্তিক। তৃতীয় কাঁটাতারটি হচ্ছে বিনিয়োগের কাঁটাতার। আমাদের দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে যে ভারসাম্যহীনতা অনেক দিন ধরে চলছে তা কমিয়ে আনার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেভাবে সেটা হচ্ছে না। বরং টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা নিয়ে প্রহসনÑ এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হচ্ছে। আমি মনে করি, এই তিনটি কাঁটাতার ভৌগোলিক, মানসিক ও বিনিয়োগের কাঁটাতার দূর না হওয়া পর্যন্ত ট্রানজিট সুবিধে তড়িঘড়ি করে দেয়া উচিত হবে না। কাঁটাতার উঠিয়ে নিলে ট্রানজিট দেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। কাটাঁতার উঠিয়ে নেয়ার বিনিময়ে ট্রানজিট এই হচ্ছে আমার প্রস্তাব।

ছবি : কাজী তাইফুর

প্রথম আলো গোলটেবিল – বৈঠক ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন

১৩ মার্চ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো:

যাঁরা অংশ নিলেন
অধ্যাপক রেহমান সোবহান – চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
হোসেন জিল্লুর রহমান – সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ড. সিদ্দিক ওসমানী – অধ্যাপক, স্কুল অব ইকোনমিকস, ইউনিভার্সিটি অব আলস্টার, ইউকে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ – সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ড. বাকী খলিলী – অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. মাহবুব হোসেন – নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
ড. সৈয়দ এম হাশেমী – পরিচালক, ব্র্যাক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট
মোস্তফা কে মুজেরী – মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
ড. সাজ্জাদ জহির – পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
এম এম আকাশ – অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিনায়ক সেন – গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)

সূচনা বক্তব্য
মতিউর রহমান – সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম – যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
মতিউর রহমান
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, দারিদ্র্যের হার এখন ৪০ শতাংশের নিচে। এখানে ক্ষুদ্রঋণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।
১৯৯০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ১৮ বছরে বাংলাদেশের প্রায় ২০ লাখ দরিদ্র পরিবার দৈনিক সোয়া এক ডলারের বেশি (প্রায় ১০০ টাকার ওপর) খরচ করার সামর্থ্য অর্জন করেছে, অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমা পার হতে পেরেছে।
নারীর আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হচ্ছে, যা একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ, সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারমুক্ত চিন্তার প্রসার এবং গ্রামাঞ্চলে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা দূর করার একটি অন্যতম শর্ত সৃষ্টি করছে।
শুধু ঋণ প্রদানই নয়, সেই সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে ঋণের টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন সম্পর্কেও পরামর্শ দেওয়া হয়, যা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বেসরকারি সংগঠনগুলো করে থাকে। এখানেই সাধারণ ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের পার্থক্য। ক্ষুদ্রঋণ মানুষকে উৎপাদনশীল কার্যক্রমে নিয়োজিত করে, তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে।
তবে সমস্যাও আছে। সুদের হার বেশি বলে সমালোচনাও রয়েছে। সম্প্রতি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে মতবিনিময় করে সর্বোচ্চ সুদের হার ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।
ক্ষুদ্রঋণ হয়তো দারিদ্র্য চিরতরে দূর করতে পারে না, কিন্তু গরিব মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নির্মূলের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত সৃষ্টি করে। অনেকে দারিদ্র্যচক্র ভেঙে বেরিয়েও আসে। তা ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে।
ক্ষুদ্রঋণের সমস্যা যেমন আছে, তেমনই সম্ভাবনাও বিপুল। সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ বিতর্ক জোরেশোরে উঠতে দেখা গেছে। সবকিছুর পরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্রঋণ আমাদের দেশে সফলতা নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে এর মাধ্যমে অনেক সুনাম আমাদের অর্জিত হয়েছে।
সম্প্রতি দেশে ও বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। আজকের আলোচনায় আপনাদের বক্তব্যের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে মানুষের মনে যেসব প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবে তারা। আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেনকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

বিনায়ক সেন
ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেন ‘গোড়ার কথা’য় ফিরে যেতে হচ্ছে? সত্যের ওপর কারও একচেটিয়া অধিকার (মনোপলি) নেই, বিশেষজ্ঞদেরও নেই। তার পরও কেন বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হওয়া, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সাম্প্রতিককালে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কতগুলো অভিযোগ শুনতে পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে গবেষণালব্ধ পেশাগত জ্ঞানের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে হালকা আলোচনাই প্রধান ধারা হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। এযাবৎ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অসংখ্য গবেষণাপত্র দেশে-বিদেশে রচিত হয়েছে। সেসব গবেষণার আলোকে প্রচণ্ডভাবে নিস্পৃহ, নির্মোহ ও তলদর্শী আলোচনা করার তাগিদ থেকে আমরা আজকের এই সংলাপে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। ওপর-ভাসা ধ্যান-ধারণার ‘জনতুষ্টি জ্ঞান’ ও পেশাগত জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা এর একটি বড় লক্ষ্য। সে কারণে আমাদের সীমিত উদ্দেশ্য—ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে গবেষণাপত্রাদি থেকে আমরা যতটুকু জানি, তা যথাযথভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা। কাজটি করা গবেষক-অর্থনীতিবিদদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব।
গত ১০ বছরে উন্নত দেশগুলোয় উন্নয়ন অর্থনীতি শুধু নয়, অর্থশাস্ত্রের এমন কোনো সিরিয়াস-ধর্মী পাঠ্যবই (গ্র্যাজুয়েট ও আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে) পাওয়া যাবে না, যেখানে অন্তত একটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ নেই ক্ষুদ্রঋণের ওপর। তাত্ত্বিকভাবেই ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ও এ দেশে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণসংক্রান্ত তত্ত্বসমুদয় কোনো ভুঁইফোড় বিষয় নয়। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ক্রমে পরিপক্ব ও পরিশীলিত হলেই তা কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায় স্থান পায়।
কোনো সিরিয়াস একাডেমিক গবেষণাপত্রেই এই দাবি করা হয়নি যে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমেই কেবল দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। বরং যেটা দেখানো হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ একটি সহায়ক হাতিয়ার। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে যেটা বলা হয়েছে, তাকে কয়েকটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়।
প্রথম ভাগ: ক্ষুদ্রঋণ হচ্ছে দরিদ্রদের জন্য একটি ‘টেকসই’ ব্যাংকিং-ব্যবস্থা। ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, এটি প্রথাগত ব্যাংকিং-ব্যবস্থা যাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না, সেই জামানতবিহীন নিঃস্ব গোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিংসেবা পৌঁছে দেয়। এর থেকে প্রমাণিত হয়েছে, গরিবেরাও ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত। প্রায় দুই কোটি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে থাকে। একাধিক সংস্থা থেকে যাঁরা ঋণ নেন, তাঁদের সংখ্যা সামঞ্জস্য করে এই হিসাব করা হয়েছে। দরিদ্রদের ব্যাংকিং-চাহিদা মেটানোর একটি সাসটেইনেবল সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করাই ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। সাসটেইনেবল বা ‘টেকসই ব্যাংকিং সার্ভিস’ শব্দবন্ধের ওপর আমরা জোর দিতে চাই। ব্যবস্থাটি টেকসই এই অর্থে যে তা এনজিও, বেসরকারি ও সরকারি যেকোনো খাতেই প্রয়োগ সম্ভব এবং যেকোনো ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক পরিসরেই পরিচালিত হওয়া সম্ভব। ক্ষুদ্রঋণের ছকের আদি প্রাণপুরুষ গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বারা এই মডেল উদ্ভাবিত হলেও পরে তা যেমন বিভিন্ন এনজিও গ্রহণ করেছে, তেমনই অনুসৃত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ঋণ কার্যক্রমের ভেতরেও। বাংলাদেশে এই কার্যক্রম ক্ষুদ্রঋণের মূলধারার প্রতিষ্ঠান ‘মুনাফার ভিত্তিতে নয়’ (নট ফর প্রফিট)—এ ভিত্তিতে পরিচালনা করে আসছে। বাংলাদেশের বাইরে অন্যত্র (যথা—ভারতে বা লাতিন আমেরিকায়) ‘মুনাফার ভিত্তিতে’ (ফর প্রফিট) পরিচালিত করছে, সে রকম ব্যক্তি খাতের উদ্যোগেও ক্ষুদ্রঋণ মডেল অনুসৃত হয়েছে। চীন থেকে আমেরিকায়, তৃতীয় বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্ব—অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ফারাক থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণের মডেল চালু হয়েছে এবং সেসব কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। এটি মডেলটির ‘টেকসই’ দিকের প্রতি নির্দেশ করে।
দ্বিতীয় ভাগ: দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের অবদান। ক্ষুদ্রঋণ শুধু দরিদ্রদের জন্য টেকসই ব্যাংকিং-ব্যবস্থাই নয়, এটি দারিদ্র্য দূরীকরণেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। গত তিন দশকে বিভিন্ন গবেষণাপত্রের একটি প্রধান ঝোঁক ছিল এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা বা অবদানকে স্পষ্ট করার ওপর। ক্ষুদ্রঋণ কীভাবে অকৃষি খাতনির্ভর হয়ে পরিচালিত হচ্ছে, কীভাবে কৃষি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় তা পরিবর্তন আনছে, কীভাবে শ্রমের বাজারের ওপর প্রভাব রাখছে—এসবই এই আলোচনার অংশ। এখানে আজ যেসব বিশেষজ্ঞ সমবেত হয়েছেন, তাঁরা সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, যা আজকের আলোচনায় উঠে আসবে বলে আশা করছি। এখানে যেটা যোগ করা দরকার তা হলো, প্রথমত, ক্ষুদ্রঋণের অবদান আলোচনার জন্য শুধু দারিদ্র্যরেখাকেন্দ্রিক (পোভার্টি লাইন) ভাবনাই যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্যরেখার ওপর ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগীদের অংশ ‘কতটা পরিমাণে উঠে গেল’ সে রকম সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারের জন্য সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। এর কারণ, ক্ষুদ্রঋণ যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই প্রথমাবধি দারিদ্র্যরেখার অনেক নিচে বাস করছিলেন। ফলে ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা নিয়ে তাঁদের অনেকে দারিদ্র্যরেখা অতিক্রম করতে না পারলেও দারিদ্র্যের ভেতরে থেকেও তাঁদের আয় বা ভোগ বা সম্পদ বাড়াতে পেরেছেন। শুধু দারিদ্র্যরেখাকেন্দ্রিক ‘হেডকাউন্ট ইনডেক্স’-এর সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপে তা ধরা না-ও পড়তে পারে। এ জন্য বিভিন্ন গবেষণাপত্রে ইনকাম মবিলিটির নানা সূচক (যথা—‘পোভার্টি গ্যাপ’ সূচক এবং ‘দারিদ্র্যের তীব্রতা’ সূচক) ব্যবহূত হয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদান যথাযথভাবে পরিমাপ করার জন্য চাই একই ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা পরিবারকে কালানুক্রমে পর্যবেক্ষণ করা। অর্থাৎ চাই ‘প্যানেল ডেটা’। তা ছাড়া চাই, যারা ক্ষুদ্রঋণ পায়নি, সেসব পরিবারকেও কালানুক্রমে অনুসরণ করা অর্থাৎ দরকার যথাযথ ‘কন্ট্রোল’। এভাবেই ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগী ও সুবিধাভোগী নয় এমন পরিবারের তুলনামূলক বিচারপূর্বক উপসংহারে আসা যাবে দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ প্রকৃতপক্ষে অবদান রাখতে পেরেছে কি না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রকম কয়েকটি প্যানেল স্টাডিজের বিশ্লেষণ থেকে এটা দেখা গেছে, দারিদ্র্য দূরীকরণেও ক্ষুদ্রঋণের অবদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। মাহবুব হোসেন পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৮-২০০৭ কালপর্বে গ্রামীণ দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কমেছে। দারিদ্র্য মোট যতটুকু কমেছে, তার অন্তত এক-চতুর্থাংশ কমেছে কেবল ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে। আলোচকেরা নিশ্চয়ই এর ওপর আলোকপাত করবেন।
তৃতীয় ভাগ: ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষের সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। শুধু দারিদ্র্য নয়, দরিদ্রের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদানপ্রাপ্ত গবেষণাপত্রাদির অভিনিবেশের বিষয় ছিল। এ দেশে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার এক বিপুল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নারী। শুধু এই নিরিখেই নারীর সামাজিক বিকাশে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। রক্ষণশীল অনেক চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ক্ষুদ্রঋণের নারীরা ঘরের বাইরের জগতে পা ফেলতে শুরু করেছেন। এমনকি যখন নারীদের নেওয়া ঋণ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিয়ে ব্যবহার করেছেন, তাতেও গৃহে ও গৃহের বাইরে নারীদের মর্যাদা বেড়েছে, ‘ভয়েস’ ও ‘প্রভাব’ বেড়েছে তাঁদের। আশির দশকের গোড়ার দিকে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অর্ধেক ছিল নারী। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এই অংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯০ শতাংশে। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার দেখাদেখি মূলধারার অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানেও নারীকেই ক্ষুদ্রঋণের এজেন্সি বা চালিকাশক্তি হিসেবে দাঁড় করায়। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসচেতনতা বৃদ্ধিও ছিল একটি আবশ্যিক উপকরণ। এর ফলে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগী পরিবারে জন্মনিয়ন্ত্রণের হার, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার হার ও শিশুপুষ্টি বেড়েছে। কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। বাংলাদেশে আয়ের বিচারে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকায়ও (যেমন—রাজশাহী বিভাগে) এটা দেখা গেছে। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে ক্ষমতায়নের এসব প্রবণতা স্পষ্ট।
যে বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়, ক্ষুদ্রঋণে উত্তরণের (গ্র্যাজুয়েশন) বিষয়টি কীভাবে ধরতে পারি। গবেষণাপত্রাদি থেকে এটাও দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সচলতা অর্জন করে ক্রমশ একটি গোষ্ঠী ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ নিয়েছে এবং ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান (মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ) কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রথাগত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম মূলত আত্মকর্মসংস্থানমূলক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি কোনো পরিবারের একমাত্র বা প্রধান আয়ের উৎস নয়, বরং একটি ‘বাড়তি আয়ের’ উৎস কেবল। গড়পড়তায় ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ যেখানে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের (মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ) ঋণের পরিমাণ সেখানে হয়তো ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সবাই অবশ্য এই উত্তরণ ঘটাতে পারেননি। সবাই এই উত্তরণ ঘটাতে পারবেন, সেটা আশা করাও যুক্তিসংগত নয়—কেননা, সবারই সমান মাত্রার ‘এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’ অর্জনের গুণ নেই। তার পরও অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের এক হিসাবে, এ দেশের প্রায় দুই কোটি ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা পরিবারের প্রায় ৮ শতাংশ মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ ঋণ নিয়েছে। এসব মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজে যদি তিন-চারজনের কর্মসংস্থান ঘটে, তাহলেও এতে যে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, তা দেশের মোট শ্রমশক্তির ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরি কর্মসংস্থানের নিরিখেও ক্ষুদ্রঋণের উত্তরসূরি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে আমরা জানি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মজুরি শ্রমভিত্তিক কর্মসংস্থান প্রধান ভূমিকা দেশে দেশে পালন করে আসছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রবণতাকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের (এসএমই) ভূমিকাকে আরও বেগবান করে তোলা সম্ভব। আমরা আশা করছি, আজকের আলোচনায় এ বিষয়গুলোও স্থান পাবে। কোন ‘নিয়ত’ থেকে আমরা এ ধরনের বিতর্কে অংশ নেব, তা বিতর্কের বিষয়বস্তু থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা নয়।
তবে ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে কয়েকটি বিতর্ককে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষুদ্রঋণসংক্রান্ত মূল বিতর্ক দানা বাঁধছে অন্যখানে। এর মধ্যে রয়েছে এসব কার্যক্রমের সুদের হার বা সার্ভিস চার্জের প্রসঙ্গ, এসব কার্যক্রমের পরিচালনা ব্যয়ের প্রসঙ্গ, এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আন্তসম্পর্ক এবং সবশেষে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক। এসব বিতর্কে প্রবেশের আগে বিতর্কের দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রথমে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।
এক. ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নির্ণয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিচালনা ব্যয়ের প্রসঙ্গ। অনেকেই বলেছেন, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার আরও কমিয়ে আনা উচিত। যেহেতু বৃহৎ ঋণের পরিচালনার চেয়ে নিবিড় তদারকির কারণে ক্ষুদ্রঋণের পরিচালনা ব্যয় বেশি পড়ে, এতে করে সুদের হার কমানোর বিষয়টি পরিচালনা ব্যয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পরিচালনা ব্যয়ের বড় অংশ যদি সরকার ভর্তুকি দিতে রাজি হয়, তাহলে এর সুদের হার অনেকখানি, এমনকি জিরো ইন্টারেস্ট রেটের কাছাকাছি পর্যন্ত কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। এর কারণ, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, এ দেশে মূলধারার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো (গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা প্রভৃতি) পরিচালনা ব্যয়ের নিরিখে তুলনামূলকভাবে দক্ষ (ইফিশিয়েন্ট)। সুতরাং সংস্থা পর্যায়ে পরিচালনা ব্যয় কমানোর খুব একটা অবকাশ এখানে নেই। ফলে পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে এনে সুদের হার কমানোর অবকাশও এ দেশে কম, যদি না সরকার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে ভর্তুকির সহায়তা দিতে।
দুই. ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সুদের হার কিছুটা বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে মূলধারার ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিগুলো কিছুটা ‘মার্জিন’ তুলে রাখে স্বাস্থ্যবিমা, শিক্ষা এবং ঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য। যেহেতু বাংলাদেশে এখনো সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু হয়নি এবং নানা স্তরে শিক্ষার সুযোগও সবার জন্য চালু হয়নি, সেহেতু এখানে সরকারের একটি কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ছাড়া এ রকম ‘মার্জিন’ আকস্মিকভাবে উঠিয়ে নেওয়া সামাজিকভাবে অভিপ্রেত নয়।
তিন. অনেক সময় বলা হয়, বছরের পর বছর ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার পরও কেন গরিবি অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হলো না। এই যুক্তিটিও তলিয়ে দেখার। প্রথমত, আগেই বলা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র পরিবারের জন্য ‘বাড়তি আয়’-এর উৎস কেবল। এই আয় ‘বাড়তি’ হলেও গরিবদের জন্য সংকট মোচনে অত্যন্ত জরুরি এবং সময় সময় তা ক্ষুধা ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে থাকে। একে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যায় না। স্থায়িত্বশীল দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে ক্ষুদ্রঋণ এভাবে একটি ‘মঞ্চ’ (প্লাটফরম) তৈরি করে দেয়, যার ওপর দাঁড়িয়ে গরিবদের পক্ষে অন্যান্য বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও প্রতিবছর উন্নয়ন বাজেটের অধীনে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, যার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে (অন্তত খাতাপত্রে) ‘প্রত্যক্ষ দারিদ্র্য দূরীকরণ’ কর্মসূচির পেছনে। বছরের পর বছর এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও সরকারি উন্নয়ন বাজেট কেন গরিবি অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন করতে পারল না—এ প্রশ্ন সরকারের ক্ষেত্রেও উঠতে পারে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, সরকারি সামাজিক বেষ্টনী সর্বোচ্চ কেবল ১০ শতাংশ পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। লক্ষণীয়, ক্ষুদ্রঋণ খাত বাবদ বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা চক্রায়িত তহবিল হিসেবে দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ বছর বছর তা ব্যবহূত হচ্ছে; পক্ষান্তরে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় মূলত এককালীন ব্যয়। ক্ষুদ্রঋণ তহবিলের একাংশ আসছে পিকেএসএফ (সরকার) থেকে, কিছুটা আসছে দাতাদের কাছ থেকে, আর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ আসছে ঋণগ্রহীতাদের ‘নিজস্ব সঞ্চয়’ থেকে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের ক্ষেত্রে এই ‘নিজস্ব সঞ্চয়’-এর পরিমাণ তুলনামূলক আরও বেশি (প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ)। কেননা, এসব কার্যক্রম অন্যান্যের তুলনায় আরও আগে শুরু হয়েছিল। গরিবেরা যে নিজেরাও সঞ্চয় করতে পারে এবং উত্তরোত্তর তারা প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয়ে অভ্যস্ত হচ্ছে—এটা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এর জন্য কিছুটা কৃতিত্ব ক্ষুদ্রঋণ দাবি করতেই পারে। মোদ্দাকথা, ক্ষুদ্রঋণকে সরকার পরিচালিত সামাজিক বেষ্টনী-ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড় না করিয়ে পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার এখানে সুযোগ নেই—উভয়ের মধ্যে আন্তসম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা এবং উভয়ের সামর্থ্য আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পলিসি-প্রণেতাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া কাম্য।
ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প (সাবস্টিটিউট) সরকারি সামাজিক বেষ্টনী কর্মসূচি নয়। বরং মহাজনি ঋণই হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণের সাবস্টিটিউট। গবেষণাপত্রাদির একটি সাধারণ (কমন) পর্যবেক্ষণ হলো, ক্ষুদ্রঋণ যেখানে গেছে, সেখানেই তা মহাজনি ঋণের পরিধি সংকুচিত করেছে। সিডরের (২০০৭) সময় একপর্যায়ে সিডর এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার কার্যক্রমকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। পরে দেখা গেছে, এর সুযোগ নিয়েছে মহাজনি ঋণ। মাসিক সুদের হারে বিরাট পার্থক্য ছাড়াও এই দুই ব্যবস্থার অভিপ্রায়ে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চায় না যে গরিবেরা ঋণখেলাপি হোক। পক্ষান্তরে, মহাজন এটা চায়। কেননা, গরিবেরা ঋণখেলাপি হলে তারই লাভ—সে সেখানে বেগার শ্রম, আগাম শ্রম, আগাম ফসল বিক্রির সুবিধা নিতে পারবে। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণের বিরুদ্ধে যখন ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে প্রয়োজন হলে ‘চাল খুলে নেওয়া’র অভিযোগ শোনা যায়, তার পেছনে রয়েছে ঋণ-শৃঙ্খলা আরোপের তাগিদ। অন্যদিকে মহাজন নিজেই ঋণখেলাপির প্রবণতাকে উৎসাহিত করে। এ কারণে মহাজনি ঋণের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের মিল খোঁজার চেষ্টা তাত্ত্বিক বা যৌক্তিক নিরিখে অন্যায় ও অযৌক্তিক তুলনা ছাড়া কিছু নয়। এ ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট পলিসি-প্রণেতাদের দৃষ্টি আরও নির্মোহ ও আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রঋণ মডেলের প্রভাব সরকারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও শুভ প্রভাব বয়ে নিয়ে আসতে পারে। ক্ষুদ্রঋণের জামানতবিহীন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে আস্থার ওপর ভিত্তি করে, এককথায় সামাজিক পুঁজির ওপর ভিত্তি করে। প্রতিবছর ১৭ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ‘ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিল’ পরিচালিত হচ্ছে কেবল এ আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া কোনো ‘লিকেজ’ বা দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়নি। গ্রুপের সামনে, সামাজিকভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে, ঋণ দেওয়া ও আদায়ের প্রক্রিয়ায় থাকে যেমন স্বচ্ছতা, তেমনই থাকে সামাজিক চাপ ও দায়বদ্ধতা। স্বচ্ছতা, সামাজিক চাপ ও দায়বদ্ধতা এবং আস্থাই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের চালিকাশক্তি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে উন্মুক্ত সভা ডেকে কৃষিঋণ বণ্টনের যে প্রথা চালু হয়েছে, এতে করে ক্ষুদ্রঋণের থেকে স্বচ্ছতা ও সামাজিক পুঁজির ধারণার প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে করে সরকারেরই লাভ হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের ভিত্তি যে আস্থা, সেটাকে কোনোভাবেই অপপ্রচারের মাধ্যমে বা বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্রয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করা সমীচীন হবে না কোনো বিচারেই। এর সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের জনক হিসেবে এ দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির বিষয়টিও জড়িত, তা না বললেও চলে। ক্ষুদ্রঋণ যখন আবারও কাঠগড়ায়, তখন এ বিষয়ে আজকের আলোচকেরা আরও আলোকপাত করবেন সে আশা করছি।

সালেহউদ্দিন আহমেদ
ক্ষুদ্রঋণ প্রচলনের আগে দরিদ্রদের জন্য আর্থিক সেবা পাওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না আমাদের দেশে। বহু মডেল হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। ক্ষুদ্রঋণ সমাজে গরিব লোকের কাছে সদর দরজার মতো। ক্ষুদ্রঋণ হলো দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য শক্তিশালী মাধ্যম, তবে এটি কখনোই একমাত্র মাধ্যম নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের দিকে লক্ষ করলে কুমিল্লা মডেলসহ বিভিন্ন মডেল (বিআরডিবি) দেখলে বোঝা যায়, সেখানে এই ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ যে আঙ্গিকে বা ব্যবস্থাপনায় করা হয়েছে, সেখানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা প্রক্রিয়া দাঁড় করিয়ে দিল গ্রামীণ ব্যাংক। আমাদের মতো এ বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে প্রতিদিন দেশের আনাচকানাচে লোকজন নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এত সুশৃঙ্খলভাবে করছে, যা অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এটি আমাদের সামাজিক মূলধন (সোশ্যাল ক্যাপিটাল)। ক্ষুদ্রঋণ বিভিন্ন দিক থেকে সমাজের ওপর প্রভাব রাখছে। যখন সার্বিকভাবে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়, তখন যারা ঋণগ্রহীতা, তাদের অবস্থা আগের থেকে কতটুকু পরিবর্তন হলো—এসব বিষয় আসে। ক্ষুদ্রঋণ সমাজের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলছে, সে প্রশ্ন তোলার আগে উপলব্ধি করা উচিত, ক্ষুদ্রঋণ না থাকলে আসলে কী হতো আমাদের সমাজে। আমি মনে করি, ক্ষুদ্রঋণ না থাকলে মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে যে নিজের ওপর আত্মনির্ভরশীলতা ও সাহস বেড়েছে, তা ব্যাহত হতো। ক্ষুদ্রঋণের কিছু প্রভাব খোলা চোখে দেখা যায়; আবার কিছু আছে উপলব্ধি করতে হয়। শুধু পরিসংখ্যান, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক দেখা যায়, যদি ক্ষুদ্রঋণকে অন্যান্য যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যদি আরও সমন্বয় করা যায়, তবে সমাজের ওপর এই ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব আরও বাড়বে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সময়ে ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (এমএফআই) ভাবছে, কমার্শিয়ালের দিকে যাবে। ক্ষুদ্রঋণকে বাড়িয়ে একটু বাণিজ্যিক দিকে যাওয়ার চিন্তাভাবনা তারা করছে। এ চিন্তাধারণাটা সমাজের ওপর ক্ষুদ্রঋণের যে ইতিবাচক প্রভাব, তা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অনেকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে কমার্শিয়ালরূপে (মুনাফার জন্য ও বাণিজ্যিকভাবে) নিয়ে আসার কথা বলছেন।
ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বলা হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না, কিন্তু বিষয়টি সঠিক নয়। ক্ষুদ্রঋণের সেবামাশুল সহনীয় পর্যায়ে আনা দরকার। এ জন্য ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে। যদিও বাংলাদেশে এর সুযোগ অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে বলতে চাই, সেখানে ক্ষুদ্রঋণের প্রকল্পের মধ্যে কমার্শিয়াল মনোভাব প্রবেশ করেছিল বলে সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ ব্যর্থ হয়েছে বলে একে দোষারোপ করা ঠিক নয়। ক্ষুদ্রঋণের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা এনে ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর মধ্যে আনা উচিত। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিবিষয়ক আন্তর্জাতিক মানক্রমে (ব্যাসেল) ক্ষুদ্রঋণকে আনার চেষ্টা চলছে। এটা ঠিক হবে না। কেননা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাপনা আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এক নয়। ক্ষুদ্রঋণে একটি সামাজিক অঙ্গীকার থাকে, আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফামুখী চেষ্টা থাকে।
ক্ষুদ্রঋণকে রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনা উচিত। তবে এই রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কটি যেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো না হয়। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি যেন ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে না রাখে, যাতে এর সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাডাম স্মিথের একটি কথা বলতে চাই, ‘টাকা টাকা বানায়’। কিছু থাকলে তবেই কিছু পাওয়া যায়। ছোট্ট একটি পুঁজি পেতে প্রাথমিক সাহস পাওয়াই সবচেয়ে কষ্ট। ক্ষুদ্রঋণকে এই ক্ষুদ্র পুঁজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

রেহমান সোবহান
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার কিছু মতামত আছে। এখন ২০১১ সালের মাঝখানে আমরা অবস্থান করছি। আশির দশকের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা এখন অনেক পরিণত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দৃঢ়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণের টাকা ফেরত নেওয়া নিয়ে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বক্তারা এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন এবং বলবেন। বর্তমান সময়ের বিতর্কের মূল ইস্যু হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের শর্তাবলি এবং ঋণের টাকা সংগ্রহে মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ড। একে ব্লাড সাকার সিনড্রোম বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণের টাকা ফেরত নেওয়ার পদ্ধতিতে জটিলতা রয়েছে। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা এখানে বেশি সুখকর নয়।
আলাপ-আলোচনার মধ্যে অনেকে ক্ষুদ্রঋণের টাকা ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের সুষম প্রয়োগ এবং নতুন বিধিনিষেধের কথা বলেছেন। আরেকটি বিতর্ক হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মালিক কারা। আমার মত যে ঋণগ্রহীতারাই হচ্ছে শেয়ারের মূল মালিক বা অংশীদার। এ ক্ষেত্রে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের কথা বলা যায়, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মুম্বাই শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর আইপিও ছাড়া হচ্ছে। আমাদের দেশের গ্রামীণ মডেল ও ব্র্যাক মডেল ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সমাজে পরিবর্তন এনেছে।

সৈয়দ এম হাশেমী
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমালোচকেরা প্রায়ই বলেন, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস পায়, তার প্রমাণ খুবই কম রয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব খুবই ক্ষীণ। তাঁদের মত হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ শিক্ষাক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য বিষয়ে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, দারিদ্র্য দূরীকরণে একক কোনো সমাধান দিতে পারে না। বরং এটি শুধু দারিদ্র্য তৈরি এবং পুনর্গঠন করে বহুভাবে। কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের বহুমাত্রিক প্রয়োগ রয়েছে। যদিও দারিদ্র্য দূরীকরণের দিক থেকে এটি সীমিত। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বাজার যদি সীমিত হয়, তাহলে তাদের দ্রব্য কে কিনবে? ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক দিকগুলোর উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব?
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হয়েছে অনেকাংশে। যদিও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার চাহিদা অনেকটা নিশ্চিত করেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ভোক্তাদের বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। তারা পূর্ববর্তী বেকার অবস্থার চেয়ে বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে মানুষের অর্থ উপার্জন, নারীর ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণরূপে আনতে পারেনি। তবে এটি অনেক ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি সময়ের ব্যাপার। এটি খুব দ্রুত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সময়ের। প্রথমত, নিশ্চিত করতে হবে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের জন্য সরকারি আর্থিক সাহায্য দিতে হবে শর্ত ছাড়া। বিশ্বায়নের এই যুগে যদিও বেসরকারি তহবিল এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে তাদের আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে।
ক্ষুদ্রঋণের সমালোচকেরা এবং তাঁদের অনুসারীরা ক্ষুদ্রঋণের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে প্রশংসা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে ত্বরান্বিত করার একটি প্রক্রিয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা নিয়ে আমাদের দেশে যে কার্যক্রম রয়েছে, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ হারে সুদ গ্রহণ করছে বলে প্রায়ই অভিযোগ আসে। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনপ্রণেতা বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ রয়েছে যে তারা বেশি সুদ আদায় করে। অনেক ক্ষেত্রে ‘সুদখোর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মহাজনেরা ঐতিহাসিকভাবে দরিদ্র জনগণকে শোষণ করে আসছেন। তাদের সম্পদ, জমিজমা, এমনকি বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য করেছেন তাঁরা। এ জন্য সরকারের কাছে সুদের এই উচ্চ হার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নৈতিক দাবি করা হচ্ছে। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, আর তা হলো, দরিদ্র মানুষের ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প একমাত্র পথ হলো মহাজনি বা সুদখোরদের কাছ থেকে মাসিক ১০ শতাংশ বেশি সুদহারে ঋণ গ্রহণ করা, যা বছরে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ক্ষুদ্রঋণ শুরু বা প্রসারণের কারণ হলো, বাণিজ্যিক ব্যাংকের হার দরিদ্র মানুষের জন্য সহজলভ্য নয়।
অন্ধ্র প্রদেশে কৃষকেরা ঋণ শোধ করতে পারছেন না বলে তাঁরা আত্মহত্যা করছেন। যদিও কৃষকদের সরকারি ভর্তুকি হিসেবে সহজ শর্তে ঋণগুলো একসঙ্গে দেওয়ার ফলে সেটা তাঁদের ওপর ঋণের বোঝা হয়ে পড়ছে। কৃষি খাতে সমস্যার কারণে এসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে যাচ্ছে। তবে ভর্তুকি হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হলে সবাই পাবে না। বাণিজ্যিকীকরণের দিকে গেলেই তা সম্ভব হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও প্রযুক্তির দরকার। আর্থিক খাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার।
গরিব মানুষের যে অর্থনৈতিক চাহিদা রয়েছে তা কখনো ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করা যাবে না। আমি আজকে অসুস্থতার কারণে কাজে যেতে পারব না, কিন্তু আমার ভাতের প্রয়োজন। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। সুতরাং তাদের অবশ্যই ক্ষুদ্রঋণ প্রয়োজন পড়ে। গরিব মানুষকে এখন পর্যন্ত সব রকমের অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে পারিনি। সত্যিকার অর্থের গরিব মানুষের জীবনে কী চাহিদা তা বুঝতে হবে।

রেহমান সোবহান
বক্তারা অন্ধ্র প্রদেশের কথা উল্লেখ করেছেন। আরও আলোচনা শুরু করার আগে আমি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। আমি অন্ধ্র প্রদেশে গিয়েছিলাম সেলফ হেল্প গ্রুপ নিয়ে কাজ করার জন্য। সেখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। প্রথমটি হলো, একটি জেলায় দূরবর্তী গ্রামে ঘুরছিলাম। আমাকে যখন বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়, তখন তাদের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য আগ্রহ দেখা গেল না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাকে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়। সেখানকার গ্রামের কাজ আর নারীদের মধ্যে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচয়ই যথেষ্ট। এটা আমার জন্য একটা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। আরেকটি ঘটনা হলো, যখন আমি সেলফ হেল্প গ্রুপের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন আরেকটি প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়। তাদের ১০ মিলিয়ন সদস্য আছে। এটা অনেকটা রিটেইল ব্যাংকের মতো।
এ ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশের সরকার এনজিও গ্রুপগুলোকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে। সোসাইটি ফর দি এলিমিনেশন অব রুরাল পোভার্টির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান থাকেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এ ছাড়া অনেক সরকারি কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত। যেটা বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সর্বশেষ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যখন সরকারি পরিচালনায় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটা অনেকটা ভর্তুকি পর্যায়ের। অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কাজ করলে সেখানে আসলে ঋণ-ভর্তুকি দেওয়া হয়। যার ফলে সেখানে ইন্টারেস্ট রেট বাণিজ্যিকভাবে অনেকটা কম। ব্যাংক এখানে ঋণের সুদের হার কম হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে, দরিদ্র নারীদের উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করা যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বল্প সুদ গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠছে। যখন আমি অন্ধ্র প্রদেশে ছিলাম, আমরা একটা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের অফিস দেখেছিলাম, সেটা অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণ। যেখানে এসএইচজির সঙ্গে মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের বিশাল পার্থক্যও দেখা যায়।
সেখানে এসএইচজি একটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। কারণ, তারা মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কম সুদ নিয়ে থাকে। আমরা এখানে দেখছি, কীভাবে মাইক্রোফিন্যান্স অর্গানাইজেশন এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণের ওপর কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের এসকেএস মাইক্রোফিন্যান্সের কথা বলা যায়। যারা ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি আইপিওর মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে থাকে; ভারতে এসএইচজির সফলতা অনেক বেশি। তারা ভারতের প্রায় সব গ্রামে বিস্তৃত। এ রকম মাইক্রোক্রেডিটের বৈচিত্র্যের কারণে অন্ধ্র মডেল এখন পরিচিত। এখন সব জায়গায় এসএইচজি স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে।

সিদ্দিক ওসমানী
ক্ষুদ্রঋণে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে গণমাধ্যমে কিংবা নানাভাবে, সেই বিভ্রান্তিগুলো দূর করার লক্ষ্যেই আজকের এই আলোচনা। জনসমক্ষে যাতে এই বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরা যায়, তার চেষ্টা করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যতের কিছু ইস্যু নিয়েও আমি বলব। বিভ্রান্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এত চড়া সুদ কেন? অনেকে বলেন, ক্ষুদ্রঋণ ভালো প্রক্রিয়া, কিন্তু এর সুদের হার অত্যধিক, তাঁরা কখনো বলেন না কিসের মাপকাঠিতে ক্ষুদ্রঋণে চড়া সুদ নেওয়া হয়, তার ব্যাখ্যা দেন না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেখানে ধনীদের ১২-১৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ দিচ্ছে, সেখানে গরিবেরা কেন ২৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ নেবে। যাঁরা এ প্রশ্নটি করেন, তাঁরা কখনো ভাবেন না যখন ক্ষুদ্রঋণ ছিল না, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তো গরিব লোকদের ঋণ দেয়নি। কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার ঋণ দেয়, তবে তাদের পরিচালনা ব্যয় এত হবে যে তারা ৪০ শতাংশ হার সুদ দিয়ে সে ব্যয় বহন করতে পারবে না। সে জায়গায় একটা শূন্যতা পূরণ করেছিল সুদখোর বা মহাজনেরা। তাঁরা ১০০-১৫০ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দিতেন। এ থেকে মুক্তির জন্য ক্ষুদ্রঋণ কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা ব্যয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করা অযৌক্তিক।
আরেকটি কথা বলা হয়, যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নেন, তাঁদের বছরের পর বছর এই ঋণের বোঝা বয়ে চলতে হয়। তাঁরা ঋণ থেকে বের হতে পারেন না। এ কারণে সমালোচকেরা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, উচ্চ সুদের হারের কারণে তাঁরা বছরের পর বছর ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাহলে যাঁরা শিল্পকারখানা কিংবা ব্যবসা করছেন, তাঁরাও তো বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যদি এসব শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা পেয়ে থাকেন, তবে কেন এসব গরিব লোক ঋণ পাওয়ার সুবিধা পাবেন না। কিন্তু যাঁরা বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে শোধ দিতে পারছেন না? অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ দিতে পারলেই তিনি আবার নতুন করে ঋণ নিতে পারেন। অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্ট, ঋণগ্রহীতারা এই সুদ বহন করেও ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন। যাঁরা নতুন ঋণ পাওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন, যাঁরা ঋণ নিচ্ছেন তাঁদের শোধ দেওয়ার যোগ্যতা কতখানি, সে তুলনায় ঋণের বোঝা কতখানি—এসব বিতর্ক নিয়ে আশির দশকে আলোচনা হয়ে গেছে। সেগুলো আমরা অনেকে ইচ্ছে করেই ভুলে থাকতে চাই। ক্ষুদ্রঋণ যেসব উৎপাদন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে, সেখানে তাঁরা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন। বিনিয়োগের রেট অব রিটার্নের সঙ্গে রেট অব ইন্টারেস্টের তুলনা করতে হবে। এ তুলনা অনেক আগেই করে দেখা গেছে, সুদের হারের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারের ফলে রিটার্নের হার অনেক বেশি। ক্ষুদ্রঋণ যাঁরা উৎপাদন খাতে ব্যবহার করছেন, তাঁদের আমরা গবেষণার জন্য প্রশ্ন করেছি, কত হারে সুদ হলে আপনাদের এ ব্যবসা লাভবান হবে। তাঁদের অধিকাংশ যে সুদের হারের কথা বলেছেন, তা বর্তমান সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সবাই তো ঋণ নিয়ে উৎপাদন খাতে ব্যবহার করছেন না। কেউ চিকিৎসা, বাড়ি তৈরি কিংবা ভোগের খাতে ব্যবহার করছেন। সব ক্ষেত্রে সরাসরি ঋণের কোনো রিটার্ন রেট আমরা পাচ্ছি না। এসব ক্ষেত্রে তার সার্বিক আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার অন্যান্য আয়-ব্যয় মিলিয়ে তাঁরা অধিকাংশ ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন।
আমরা জানি, অনেকে ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছেন। যাঁরা ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, কী কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২ শতাংশ লোক শুধু অত্যধিক সুদের হারকে দায়ী করেছেন। অধিকাংশই আর্থসামাজিক বিবিধ কারণেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কখনোই দায়ী নয়। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন কোনো গরিব মানুষ, সে জন্য আইন করা দরকার। ঋণখেলাপি বড়লোক হলে তাঁদের রক্ষার জন্য ‘দেউলিয়া আইন’ আছে। কিন্তু গরিবের জন্য সে রকম কোনো আইন নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ খেলাপি হলে এর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় ক্ষুদ্রঋণের ওপর। ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা দরকার সরকারের। পৃথিবীর সব দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার অনেক কম। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা ব্যয় কমানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
দারিদ্র্যের ওপর ক্ষুদ্রঋণ কতটুকু প্রভাব রাখতে পারছে—এ প্রসঙ্গে অনেকে যুক্তি দাঁড় করান, এত এত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হলো, কিন্তু দেশ থেকে দারিদ্র্য তো দূর হলো না। রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক উঁচু অবস্থান থেকেও এসব কথা বলা হচ্ছে। তাহলে রাজনৈতিক সরকারগুলো রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রতিবছর দারিদ্র্য দূরীকরণে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, তার সবই কি বৃথা গেছে?
দারিদ্র্য বিমোচন শুধু ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের একার দায়িত্ব নয়। প্রতিবছর সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, কই, দারিদ্র্য তো নাটকীয়ভাবে দূর হচ্ছে না। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণ না পেলে দরিদ্র মানুষ আকস্মিক বিপদ-আপদে তাঁদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে দেন। তাঁরা দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে হারিয়ে যান। অনেকে বলেন, ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবেন। তিনি কখনোই এটি বলেননি যে শুধু ক্ষুদ্রঋণ দিয়েই দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানো যাবে। তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকাণ্ড, যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি—এগুলো আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, শুধু ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করলেই হতো।
ক্ষুদ্রঋণ একটি সম্পূরক পদ্ধতি, যেটি সরকার ও অন্যান্য এনজিও দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কাজ করছে। ক্ষুদ্রঋণ যাঁরা পাচ্ছেন, সময়ের সঙ্গে তাঁদের কী পরিবর্তন হচ্ছে, আর যাঁরা ঋণ পাচ্ছেন না, তাঁদের অবস্থার কী পরিবর্তন হচ্ছে, তা তুলনা করলেই ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব বের হয়ে আসবে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের ওপর মাহবুব হোসেন এবং আবদুল বায়েসের লেখা বইটি বের হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘১৯৮৮ থেকে ২০০৮—এই ২০ বছরে যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছেন এবং যাঁরা ঋণ নেননি, তাঁদের কী পরিবর্তন হয়েছে। দেখা গেছে, দুই পক্ষেরই দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছেন, তাঁদের দারিদ্র্য কমার হার যাঁরা ঋণ নেননি তাঁদের তুলনায় অধিক।’
ক্ষুদ্রঋণ সব সময় সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। সে পরিবর্তন রাতারাতি করা সম্ভব নয়। ৭-৮ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চার-পাঁচজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। এভাবে এ খাত থেকে পল্লি অঞ্চলে ২০ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ কোন পথে যাবে, বাণিজ্যিক নাকি নিজস্ব মালিকানায়—এসব বিচারের আগে সমাজের ওপর ক্ষুদ্রঋণের প্রভাবকে স্বীকার করে নিতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা খাতে উপকৃত হচ্ছেন। যাঁরা ঋণ নেন, তাঁরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ঋণ নেন। কেউ আয় বৃদ্ধির জন্য নেন, কেউ বাড়ি ঠিক করার জন্য, কেউ বা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ঋণ নেন। যদি ক্ষুদ্রঋণ না থাকত, তবে তাঁরা তাঁদের যা সহায়-সম্বল ছিল তা-ই বিক্রি করে দারিদ্র্যের গভীর তলে হারিয়ে যেত। এসব দিক বিবেচনা করে আয়ের দিক থেকে, ভোগের দিক থেকে, সম্পদ রক্ষার দিক থেকে ক্ষুদ্রঋণের যে ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা মাথায় রেখে ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ কোন মডেলে গেলে এই ইতিবাচক প্রভাব আরও সুদৃঢ় হবে, তা ঠিক করতে হবে। আমাদের সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক দিক চিন্তা করে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা নিতে হবে।

মাহবুব হোসেন
আশির দশকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমি গবেষণা করেছি। বর্তমানে ব্র্যাকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ক্ষুদ্রঋণকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কেন দারিদ্র্য বিমোচনে নাটকীয় পরিবর্তন নেই। বাংলাদেশের তিন কোটি পরিবারের মধ্যে প্রায় দুই কোটিই ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এসেছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ১৭ হাজার কোটি টাকা মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কৃষিঋণের মাধ্যমে ১১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উন্নয়নধারার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। এই যে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষায় সুযোগ দেওয়ার ফলে সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় ড. এ আর খান একটি গবেষণা করেছিলেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল, প্রায় ৭৫ শতাংশ লোকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। আশির দশক থেকে ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন শুরু হয়। সে সময়ও আমরা দেখেছি, প্রায় ৬০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। সম্প্রতি (২০১০ সালে) পারিবারিক আয়-ব্যয়ের হিসাবে প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ পরিবার এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আমাদের আশা ছিল, হয়তো ১০ থেকে ১৫ শতাংশের নিচে দারিদ্র্যসীমা নেমে আসবে, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। শুধু ক্ষুদ্রঋণই দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করছে না। এ ছাড়া সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য। আমরা জানি, সত্তর-আশির দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৬.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আমাদের কৃষি উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টরে গরিব লোকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ সবকিছু দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাব রাখছে।
আমাদের গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটেছে। আগে যারা কৃষিতে দিনমজুরি করত, গ্রামীণ রাস্তাঘাট হওয়ার ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজ করে, তাদের আয় বৃদ্ধি করছে। এ ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এমনকি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁরাও বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সার্বিক উন্নয়নের ফলে আগে ১ শতাংশ হারে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমত, এখন দেড় শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমছে। সারা দেশে ক্ষুদ্রঋণ ছড়িয়ে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচন হলো কোথায়—এমন কথা হচ্ছে সরকারের উচ্চ মহলে। এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরও পড়ে। তারা যে প্রতিবছর এত টাকা খরচ করল, সেটা গেল কোথায়? দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব যেমন রয়েছে, পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবও রয়েছে। দারিদ্র্যের হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনাও আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশে বড় সাফল্য। আমরা শুধু দারিদ্র্যসীমার ওপর কতজন উঠল, সে হিসাব করি। কিন্তু কতজন মানুষের আগের অবস্থান থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সে হিসাব করলে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব বুঝতে পারব। দারিদ্র্যসীমার হিসাবমতে, মাথাপিছু প্রতিদিন আয় এক ডলার হলে, পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাব করলে মাসে প্রায় ১০ থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা লাগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে। বছরে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে। আমরা যে ক্ষুদ্রঋণ গড় পাই, মাথাপিছু প্রায় ১২ হাজার টাকা। এই ১২ হাজার টাকার সঙ্গে তার বার্ষিক সুদ যদি তিন হাজার টাকাও ধরি, তবে এর দারিদ্র্যসীমা পার হতে প্রায় ২৫ বছর লাগার কথা। দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে, আস্তে আস্তে ওপরে ওঠা। অনেকে ১০-১৫ বার ঋণ নিয়ে অথবা আরও দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। আরেকটি হিসাব করা হয়, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য, সেটি হলো পোভার্টি গ্যাপ রেশিও। অর্থাৎ পোভার্টি লাইনের তুলনায় আয়ের পার্থক্য কতটুকু আছে—এ হিসাবটি যদি আমরা লক্ষ করি, তবে ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দারিদ্র্য নিরসনে বেশ ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।
ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের সুদ আদায়ের জন্য মাঠপর্যায়ে প্রায়ই জোরজবরদস্তি কিংবা অত্যাচারের কথা বলা হয়। আমরা যাঁরা উচ্চপর্যায়ে আছি, যা পছন্দ করি, তা মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত ব্র্যাকে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মীর কিংবা গ্রামীণে ২৫ হাজার কর্মীর পক্ষে বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য। ফলে ক্ষুদ্রঋণ আদায়ে মাঠকর্মীদের চাপ প্রয়োগ করার কথা অস্বীকার করা যায় না। প্রতিবছর কতটা ক্ষুদ্রঋণ বাড়ানো সম্ভব, সে হিসাবটা না করে যদি রাতারাতি ক্ষুদ্রঋণ বাড়ানোর চেষ্টা করি, তবে এ সমস্যাটা সৃষ্টি হবেই। ২০০২ সালের পর থেকে দেখেছি, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন এনজিওকে অর্থ দিয়ে, ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে আসছে। যেহেতু তারা দেখছে, ক্ষুদ্রঋণে ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ রিকভারি পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং তারা এসব এনজিও এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিচ্ছে। এর আগে লোন ফান্ডের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। আগে ইচ্ছা করলেই ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো বড় আকারে সম্প্রসারণ করতে পারত না। কেননা, লোন ফান্ড কিছুটা পিকেএসএফ কিংবা দাতা সংস্থা থেকে নিতে হতো। এর ওপর নির্ভর করত তারা কতটা সম্প্রসারণ করবে। কিন্তু বর্তমানে এই সীমাবদ্ধতা না থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, মাঠকর্মীরা বোঝেন না যে ঋণ যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা প্রকৃতভাবে ঋণ ব্যবহার করে পরিশোধ করতে পারবেন কি না। এ ছাড়া পিকেএসএফকে দিয়ে গ্রামীণ পর্যায়ে স্থানীয় ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা হয়েছে। এতে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির ফলে একজন সদস্যকে আরেকজন নিয়ে নিচ্ছে বা ঋণে ওভারলেপিং দেখা যাচ্ছে। ফলে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে মাঠকর্মীরা চাপ প্রয়োগ করছেন। উচ্চপর্যায়ে নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তা মানছেন না। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু ব্যবসায় সফল হতে পারেন না। ফলে একবার ব্যবসায় ব্যর্থ হলে তাঁরা আর উঠে আসতে পারেন না। কারণ, তাঁরা যে অবস্থান থেকে ঋণ নেন, তাঁদের কোনো সম্ভাবনাই থাকে না আবার নতুন করে শুরু করার।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সাধারণত নেতিবাচক সংবাদ বেশি প্রচার করে। কিন্তু বাংলাদেশের দুই কোটি ঋণগ্রহীতা পরিবারের যদি ৫ শতাংশ সফল হয়, তবে ওই ১০ লাখ পরিবারের যে ভাগ্যোন্নয়ন ঘটছে, সে বিষয়গুলো কিন্তু গণমাধ্যমে সাধারণত প্রচার হয় না। অনেকেই কিন্তু নিজে আত্মনির্ভরশীল হচ্ছেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে। তাঁরা পাশাপাশি দরিদ্র সমাজে অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে এ দেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি শুরু হয়েছে। এটি লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা তাদের মূল লক্ষ্য নয়। এভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যের বিচ্যুতি হচ্ছে। কিন্তু আশির দশকে মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ। আশির দশকে সামাজিক উন্নয়নের জন্য সপ্তাহে ঋণগ্রহীতারা একত্র হয়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতেন। তাঁরা নিজেরা সচেতন হতেন। কিন্তু বর্তমানে এগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমাদের গ্রামীণ সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো তাদের মূল লক্ষ্যের দিকে নজর রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য।

এম এম আকাশ
ক্ষুদ্রঋণ যখন শুরু হলো, তখন দাতারা টাকা দিত। সুতরাং কস্ট অব ফান্ড ছিল শূন্য। সুদের হার কম ছিল। তখন শুধু ট্রানজ্যাকশন খরচ ছিল। কেউ কেউ অল্প লাভ করলে তা খরচ করত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে। মানুষ ভাবল যে এটি ভালো কাজ। মানুষ মহাজনের ঋণ থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু আস্তে আস্তে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দাতারা ফান্ড দেওয়া কমিয়ে আনে তাদের নিজস্ব সমস্যার কারণে। ড. ইউনূস অবশ্য প্রথম থেকেই বলেছেন, তিনি ব্যবসা করবেন এবং তা থেকে যতটুকু লাভ হবে, তা দিয়ে তিনি সমাজের উপকার করবেন। অর্থাৎ তাঁর সামাজিক উপকার ও আর্থিক লাভের মধ্যে তিনি ভারসাম্য রেখে এগোতে চেয়েছিলেন।
অন্য উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, যদি দাতাদের অনুদান না পাওয়া যায় এবং ব্র্যাক কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়া হয়, তখন কস্ট অব ফান্ডই হবে শতকরা ১২ টাকা। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে ১০০ টাকা মাঠপর্যায়ে পৌঁছানোর ডেলিভারি খরচ। এই খরচের মাত্রাও নির্ভর করবে মাঠপর্যায়ে কর্মীদের কর্মদক্ষতার ওপর এবং রেট অব রিকভারি অর্থাৎ ঠিকমতো টাকা ওঠানোর ওপর। এ খরচ আরও নির্ভর করবে কর্মকর্তাদের বেতনের ওপর। এই সব কটি খরচের সঙ্গে যদি এনজিও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আনুষঙ্গিক পাজেরো গাড়ির খরচ কিংবা দেশের বাইরে ঘোরাফেরার খরচ সংযুক্ত হয়, তবে ক্ষুদ্রঋণের ডেলিভারি খরচই এনজিওভেদে ১৬ থেকে ৩০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে। তখন মোট সুদের হার বেড়ে ২৮=(১৬+১২) থেকে ৪২=(১২+৩০) শতাংশ হয়ে যাবে। যদি মাত্র ৫ শতাংশ মুনাফাও যুক্ত হয়, তাহলেও সুদের হার উচ্চ ব্যয় ও মুনাফাসহ প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে কম সুদ (২০%) নিচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। বেশির ভাগ এনজিও নিচ্ছে ৩০ শতাংশ। অবশ্য আগামী জুন থেকে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ সুদের সীমা কার্যকর করতে হবে সবাইকে।
কিছু কিছু দেশে স্টক মার্কেট থেকে টাকা নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। এদের কাছে ক্ষুদ্রঋণ একটি লোভনীয় ব্যবসা। বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষুদ্রঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে। এরা চাইছে সর্বোচ্চ মুনাফা, এসব কারণে সুদের হার অবাধে বাড়ছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা যে টাকা শোধ দিচ্ছে, তা কিস্তিতে দিচ্ছে। যার ফলে অন ব্যালান্স সব সময় ঋণদাতার কাছে অর্ধেক ফান্ড থেকে যাচ্ছে। সুতরাং ডিকলাইনিং ব্যালান্স মেথডে সুদের হার ফ্ল্যাট রেটের দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ফ্ল্যাট রেটে মেপে সুদের হার দেখানোটা ঠিক হচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো এনজিওকেও ডিকলাইনিং ব্যালান্সে সুদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের রেটের চেয়ে ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বেশি হবে, কিন্তু ট্রানজ্যাকশন কস্টের দোহাই দিয়ে যথেচ্ছা বেশি সুদের হার নিতে পারি না। সুদ যত বেশি নেব, তত আমি লাভ করব। আমি যুক্তি দেখাতে পারব, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার কিংবা সম্পদ বাড়াতে পারছি। আবার কম লাভে সন্তুষ্ট থেকে কম সুদও নিতে পারি। তা ছাড়া অতিরিক্ত লাভ দিয়ে নতুনভাবে ফান্ড করে আবার ঋণ দিতে পারি। তাতে কস্ট অব ফান্ড কমে, সুদও কমতে পারে। এগুলো আসলে যা হচ্ছে তা সর্বদা স্বচ্ছ নয়। আসলে যত দিন যাচ্ছে ততই ক্ষুদ্রঋণকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্রঋণ দাতা সংস্থাগুলোর সুদের হারের মধ্যে প্রচুর ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। এসব জায়গায় ক্ষুদ্রঋণের নিয়ন্ত্রণকারী রেগুলেটরি অথরিটিকে দেখতে হবে আসলে প্রকৃত সুদের হার কত হওয়া উচিত।
ড. ইউনূস বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক তিনি নন, গ্রামের ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারাই এর মালিক। যদি গ্রামীণ ব্যাংক সুদ বেশি নেয়, মুনাফা বেশি করে তবে তা পাবে সেই ঋণগ্রহীতারাই। সুতরাং গরিবেরাই এই লাভের অংশ পাবেন। কিন্তু অন্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো এই দাবিটুকুও করতে পারবে না। এর পরও খোদ গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানার চরিত্র কতটা ফরমাল আর কতটা অ্যাকচুয়াল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অনেক এনজিও শুধু দরিদ্রদের জন্য কাজ করছে বললেও কেউ কেউ উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল। যদি এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে, তবে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। যদি কোনো এনজিও বলে, আমি ব্যবসা করব, সামাজিক উদ্দেশ্য আমার নেই, তবে তাকে অবশ্যই ট্যাক্স (কর) দিতে হবে। আর যদি কোনো এনজিও বলে, আমি সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রেখে কাজ করব, তবে তার কার্যপ্রক্রিয়া, সুদের হার ভিন্ন হতে হবে। তবে গ্রামীণ ব্যাংক যেমন ফান্ড সংগ্রহ করতে পারে গ্রামাঞ্চলের লোকদের কাছ থেকে, অন্যরা তা পারে না। গ্রামের একজন অসদস্য ধনী লোক গ্রামীণ ব্যাংকে টাকা ডিপোজিট করে সুদ পান, ওই আয়ের জন্য তাঁকে কোনো কর দিতে হয় না। যদি একই লোক বাণিজ্যিক বা কৃষি ব্যাংকে টাকা সঞ্চয় করতেন, তবে তাঁকে এর জন্য কর দিতে হতো। ফলে গ্রামীণ ব্যাংকে বেশি সঞ্চয় জমা হচ্ছে, তাতে তাঁর কস্ট অব ফান্ডও কম হচ্ছে, সুদও তিনি অন্যদের চেয়ে কম রাখতে পারছেন। কিন্তু এতে গ্রামে আবার অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ছাড়া আমরা দেখছি, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন অসম সুযোগ-সুবিধা কিংবা কমবেশি চাপ প্রয়োগ করা হয় কিংবা তাদের সম্পর্কে ভুল ভাবমূর্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়, সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের নিরপেক্ষ আলোচনায় বসে ঠিক করতে হবে, আসলে কে কী করতে চায় এবং কে কী করছে, তা ঠিক করে সেই অনুযায়ী একটি একক রেগুলেটরি কাঠামোর মধ্যে সবাইকে আনতে হবে। এমআরএ এই কাজটা শুরু করতে পারে।

সাজ্জাদ জহির
টেকসই ব্যাংকিং-ব্যবস্থা চালু করা এবং জামানতবিহীন ঋণসুবিধা দেওয়া। বিশেষ করে, ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফাইন্যান্স কিছুদিন আগে এই অঞ্চলের দেশগুলোর অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশের সেভিংস টু লোন রেশিও প্রায় ৫৩ শতাংশ; ভারতের ক্ষেত্রে এটি ৩ শতাংশ। এটি হচ্ছে বড় পার্থক্য। অন্ধ্র প্রদেশ নিয়ে যে প্রশ্নটি উঠেছে, এ জন্য ইকুইটির ওপর যেখানে অর্থায়ন করা হয়েছিল, সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল যে অন্ধ্র প্রদেশে কোনো সেভিংস করা যাবে না।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ভিন্ন ধরনের। আমরা সেলফ হেল্প গ্রুপের নামে অনেক কিছু বলতে পারি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ভালো দিকগুলো নিয়ে।
আমাদের ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। ক্ষুদ্রঋণ হলো সেবা বিতরণের উদ্ভাবনী উদ্যোগ। কিন্তু এটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে না।
ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে মার্কসের পুঁজিবাদ সম্পর্কে তত্ত্বের কাঠামো যদি মনে রাখি, তবে দেখি, পিকেএসএফ যখন কথা বলছে, তখন তাদের মনে থাকে না যে তারাও কিন্তু লভ্যাংশের একটা অংশবিশেষ নিজে রেখে দিচ্ছে, যা দিয়ে তারা পুঁজি বাড়াচ্ছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন ঋণ দেয়, তখন তাদের একসঙ্গে ৫০-১০০ কোটি টাকা এককালীন ঋণ দেয়, ফলে ট্রানজ্যাকশন খরচ কম হয়। কারণ, ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কম থাকে এবং তাঁরা ব্যাংকে এসে ঋণ নেন এবং বছর শেষে ব্যাংকে এসে ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু যখন এই ৫০-১০০ কোটি টাকা ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে ১০-১২ হাজার টাকা করে ঋণ দিতে যায়, তখন অনেক লোকের সঙ্গে কাজ করতে হয়, ফলে ট্রানজ্যাকশন খরচ অনেক বেড়ে যায়। আবার টাকাটা সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তিতে সংগ্রহ করা হয়। কারণ, তাঁরা বছর শেষে একসঙ্গে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। ফলে নিয়মিত ঋণগ্রহীতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর যে বিপুল লোকবল লাগে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের এত লোকবল দরকার হয় না। এ কারণেই ক্ষুদ্রঋণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ব্র্যাকের কথা বলি, তাদের ৩০-৩৫ হাজার কর্মচারী আছেন, তাঁদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সংখ্যা খুবই সীমিত। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অত্যধিক, যাঁদের বেতন স্কেল সরকারি স্কেলের কাছাকাছি। আরেকটি দিক হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে চালাতে চাইলে অবশ্যই কর্মদক্ষ ব্যক্তি প্রয়োজন উচ্চপর্যায়ে। আর বর্তমান শ্রমবাজারে কর্মদক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য অবশ্যই বেশি টাকা বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
১৯৯৯ সালে আইআরপিএসপির যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য আমাদের কী করা উচিত, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা চলছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আরেক ধাপে উন্নয়নের জন্য কিংবা নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। অর্থাৎ পুঁজির বিকাশটার দিকে লক্ষ রাখা। স্ট্যাটিকভাবে ক্ষুদ্রঋণকে দেখতে যাওয়ার মানসিকতা আমাদের ক্ষতি করেছে। এ জন্য উপযুক্ত বিধি কাঠামোর দরকার, অর্থাৎ যে কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজির বিকাশকে সহযোগিতা করবে। এই জায়গায় সরকারি প্রশাসন থেকে শুরু করে দাতারাসহ সবাইকে নজর দিতে হবে।
আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতে কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে আমাদের কারও কোনো চিন্তা নেই। আমরা যাঁরা নীতিনির্ধারণ করি বা যাঁরা তা প্রয়োগ করেন, তাঁদের সীমিত জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বড় আকারে আইনি পথ বেছে নিই, সেখানে বিপদ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও আইনি পথে বেঁধে রাখতে পারিনি।
ডিপোজিটের ওপর কত হারে সুদ দিতে হবে, তাও আইনিভাবে বাঁধতে পারিনি। সেখানে আমরা কি আইনি পথটি নেব, না বিকল্প কোনো পথ আছে? সেটি হলো, পিকেএসএফ সরকারের মাধ্যমে ভর্তুকি দিতে পারে। সেখানে সরকার কোনো একটি জিনিসের সরবরাহ বাড়িয়ে বা কমিয়ে দাম ওঠানামা করাতে পারে। পিকেএসএফের মতো একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে তারা অনেক প্রভাব ফেলতে পারে ঋণবাজারে। আমি মনে করি, তার মাধ্যমে সুদের হারের ওপর প্রভাব রাখা যেত। কিন্তু তা না করে আইনি পথ নেওয়ার বিপদটা হচ্ছে, প্রতিদিনই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, আমরা তো স্ট্যাটিক অবস্থার মধ্যে নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংক এখন সঞ্চয়কারীদের ১৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে, সেখানে যদি ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়, তার সুদের হার ১৫ শতাংশের কম হবে না।
এর ওপর নির্ভর করে যদি কেউ বলে গরিব মানুষের কাছে ঋণের জোগান নিশ্চিত করব। তাহলে আইন করে ২৭ শতাংশ হারে সুদে দেওয়া অবান্তর হয়ে পড়বে। সুতরাং আইনি পদ্ধতির চেয়ে পিকেএসএফের মাধ্যমে ঋণবাজারে প্রভাব ফেলার উদ্দেশ্যটা বেশি কার্যকর হবে। যদি ক্ষুদ্রঋণকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক করে দেখতে না পারি, তবে সমস্যা হবে; প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজির বিকাশের দিকে তাকানো দরকার। অন্ধ্র প্রদেশে ভুল ধারণা করে অতিরিক্ত মাত্রায় ঋণ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে বাণিজ্যিক দিকটিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। আশির দশকে গ্রামীণ যখন ঋণ দেওয়া শুরু করল, তখন এনজিওগুলো তাদের সদস্যদের ঋণ দেওয়া শুরু করল। নব্বইয়ের দশকে পিকেএসএফ যখন আরও সম্প্রসারণ করল, তখন আরও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেল। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে অন্যান্য সেবার যে আন্তসম্পর্ক, যেটি আমাদের দেশে ঘটেছে, সেটি লক্ষণীয় বিষয়। দেখা গেছে, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক দিক আছে। পাশাপাশি সামাজিক দিকও রয়েছে। বাণিজ্যিক দিকগুলো কীভাবে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়, এই প্রয়োজনীয় বিধিকাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। এই জায়গায় ব্যর্থতার কারণে নানা রকমে রূপ নিতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনায় এসেছিল, আসলে সামাজিক ব্যবসা করার জন্য যদি কেউ উদ্যোগ নেয়, যে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো ডিভিডেন্ড নেয় না, সেটি আবার পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে, তবে কেন তাদের কোম্পানি হিসেবে ওপেন বুক করার পরও ৪২ শতাংশ বা ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
যদি আইনি পথগুলো সহনশীল করা না হয়, তবে এ খাতে আমাদের যে অর্জন, তা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বহু ধরনের সেবা দেওয়ার ক্ষমতা দিন দিন কমে আসছে। উপযুক্ত বিধি-কাঠামো না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নসাধন হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

হোসেন জিল্লুর রহমান
ক্ষুদ্রঋণ একাই দারিদ্র্য বিমোচন করে ফেলবে, এটা ঠিক নয়। দারিদ্র্য বিমোচন একটি প্রক্রিয়া বা সিঁড়ি। আজকে আলোচনায় বেশ কিছু দিক উঠে এসেছে। প্রথমত, ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে কতটুকু প্রভাব রাখতে পেরেছে বা পারছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কীভাবে আরও উন্নয়ন করা এবং টেকসই করা যায় কি না। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার বিভিন্ন দিকের উন্নয়ন কীভাবে করা যায়—এসব বিষয়। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ডিসকোর্স। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে যে বিতর্ক তা শুধু নয়, আরও অন্যান্য বিতর্কের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের দিকগুলো তুলে আনা দরকার। আমাদের সামাজিক পরিবর্তন কারা নিয়ে আসবে, তাদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী। বিশেষ করে, সামাজিক উদ্যোগ তার স্বাধীনতা বা সৃষ্টিশীলতা কীভাবে দেখা হবে, নাকি আমরা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রনির্ভর কিছু চিন্তাভাবনা নিয়ে এই বিষয়গুলো দেখব।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের যে অবস্থা, সেখানে দারিদ্র্য বলতে সম্পদের অভাবই নয়, বিপন্নতাও—এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিনিয়ত গরিব মানুষ যেকোনো বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন—অসুস্থতা, গরু মরে যাওয়া, ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া, মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া। এসব বিপদ মোকাবিলার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হয় গরিব মানুষের। ফলে এসব বিপদ থেকে মুক্তির জন্য তাঁদের শেষ সম্বল বিক্রি করে সামাজিক অবস্থান থেকে আরও নিচে নামতে হয়। সুতরাং এসব বিপদ থেকে রক্ষার জন্য ক্ষুদ্রঋণ দরকার হয়। আমাদের গড় আয়ের এক-পঞ্চমাংশ অর্থ এ ধরনের হঠাৎ বিপদে খরচ হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন হলো কি না, এ প্রশ্ন বিচারে অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দারিদ্র্য থেকে বের হওয়ার মানেটা কী, তার একটা চিত্র তুলে ধরা। গতকাল দরিদ্র ছিলাম, কিন্তু আগামীকাল দরিদ্র নই—এভাবে কখনো দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। দারিদ্র্য বিমোচন একটি প্রক্রিয়া বা সিঁড়ি। একেক ধাপ পেরিয়ে ওপরে উঠতে হবে। আমরা এখন গাইবান্ধা কিংবা কয়েকটি জায়গায় শুধু মঙ্গা দেখি, কিন্তু নব্বইয়ের দশকে কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, নোয়াখালীতেও মঙ্গা দেখা যেত। মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে এ চিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে। আমরা যখন ক্ষুদ্রঋণের দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাবের কথা বলব, তখন আমাদের চিন্তা করতে হবে, দারিদ্র্য বিমোচন একটি প্রক্রিয়া, যা ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে অতিক্রম করতে হবে।
আবার ক্ষুদ্রঋণ কিছুই করতে পারেনি—উঁচু জায়গায় বসে এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সত্তরের দশকে এরিক ইয়ানসেন বই লিখেছিলেন, সেখানে বলেছিলেন, মানিকগঞ্জে দারিদ্র্যের চিত্র কোনো দিনই বদলাবে না। কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি এসে মানিকগঞ্জের দারিদ্র্য পরিস্থিতি দেখে বিস্মিত হয়েছেন। সুতরাং আমাদের সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু পরিবর্তনের মাপকাঠি পরিমাপের জন্য সূচকের বিষয়গুলো নিয়ে যখন আলোচনা করব, তখন সরাসরি প্রভাবের সূচকের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ প্রভাবের সূচকগুলো বিবেচনা করতে হবে। নব্বইয়ের দশকে একটি ডেটা সংগ্রহের সময় ঝুপড়ি একটি ক্যাটাগরি রেখেছিলাম, সেখানে ২৫ শতাংশ ছিল ঝুপড়ি। কিন্তু এখন বসতবাড়ির মধ্যে ঝুপড়ি খুঁজেই পাওয়া যাবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করছে ক্ষুদ্রঋণ। এ ধরনের উদ্যোগ বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। পল্লি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য জয় করার আস্থা বাড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের অধিকাংশই ক্ষুদ্রঋণ-প্রক্রিয়ার পটভূমি থেকে এসেছেন। ক্ষুদ্রঋণ শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয়, নানা মাত্রিক সামাজিক পরিবর্তন আনছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার লক্ষ্যগুলো পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ এত দিন শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। ক্ষুদ্রঋণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে এগুলো যুক্ত করা উচিত, যা মুহাম্মদ ইউনূসের ধারণায় অনেক আগেই ছিল।
এলজিইডি যে গ্রামীণ রাস্তার উন্নয়ন করেছে, এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টি নব্বইয়ের প্রথম দিকে বিএনপি সরকার গ্রহণ করেছিল এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ড সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগী চিন্তার কারণেই সম্ভব হয়েছে। আসলে গরিবেরা নিজেরাই ভালো জানে, কী করলে তারা সবচেয়ে ভালো সুযোগ পাবে। সুতরাং যেসব আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গরিবদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে তুমি এটা করতে পারবে না, এটা করো—এ ধরনের সব কটি প্রকল্পই ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ গরিবদের নিজস্ব চিন্তাধারণা পরস্ফুিটনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা দেওয়া দরকার।

মোস্তফা কে মুজেরী
আশির দশকের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তবে দেখব, যখন ক্ষুদ্রঋণ শুরু হয়েছিল, সে সময় যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির হারও কম ছিল। তখন ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব মিলিয়ে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের যে গতি, তা তেমন একটা অগ্রসর হতে পারেনি। নব্বইয়ের দশকে এসে দারিদ্র্য সম্পর্কে ধারণায় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সে পরিবর্তন শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে হয়েছে তা নয়, সে সময় আমাদের দেশে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যায়। কৃষি ও অন্যান্য খাতে নীতিগত নানা সংস্কার তখন হয়েছিল। বিশেষ করে, গ্রামীণ অকৃষি খাতে যে প্রবৃদ্ধি, এ ধরনের বিষয়ে অগ্রগতির কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নব্বইয়ের দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে, সামাজিক খাতে যে পরিবর্তন যেমন—জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, মানব পুঁজির বিস্তৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্যান্য সেবা খাতে ব্যাপক উন্নতি দৃশ্যমান হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এসব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের সম্পর্ক যথেষ্ট ছিল। ক্ষুদ্রঋণ একটি প্যাকেজ হিসেবে ছিল আশির দশকের দিকে। তখন ঋণের সঙ্গে সঙ্গে মানব উন্নয়নের জন্য অন্যান্য সেবা পাওয়ার যে সুযোগ মাঠপর্যায়ে ছিল, যা নব্বইয়ের দশকে সামাজিক পরিবর্তনের যে সূচনা, সেখানে ক্ষুদ্রঋণের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। ২০০০ সালের পরে ঋণের বিস্তৃতি বেড়েছে। যেগুলো কম দরিদ্র এলাকা ছিল, সেসব স্থানে ২০০০ সালের পরে ক্ষুদ্রঋণ বেশি পরিমাণে গেছে। অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ কম গেছে। এ কারণে যে এলাকায় বেশি ক্ষুদ্রঋণ গেছে, সেসব এলাকায় দারিদ্র্য নিরসনে দ্রুত পরিবর্তন দেখা গেছে। চরম দরিদ্র এলাকায়ও ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আয় বৃদ্ধি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ ভূমিকা রেখেছে। ক্ষুদ্রঋণের যে মডেলগুলো আগে ছিল, সেগুলোতে কিন্তু অনেক পরিবর্তন এখন এসেছে। যেমন—অতিদরিদ্র মানুষের কাছে সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। যেমন—পিকেএসএফের প্রাইম মডেল বিভিন্ন সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে।
আজকাল ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কিংবা বিজনেস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। এগুলো ঋণগ্রহীতাদের তৈরি করছে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য। সব ঋণগ্রহীতাই যে সমানভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, তা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ, এ ক্ষেত্রে তার স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ক্ষুদ্রঋণের অনেকাংশ নির্ভর করে।
দারিদ্র্য হচ্ছে বহুমাত্রিক ধারণা। দারিদ্র্যের বহুমাত্রাকে যদি আমরা স্বীকার করি, তবে এটা স্পষ্ট যে শুধু ক্ষুদ্রঋণই আমাদের দারিদ্র্য দূর করবে, এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ, বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যা রয়েছে দারিদ্র্যের জন্য। আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমতা এনে, দারিদ্র্য দূর করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণকে শুধু ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর ফলে আমাদের সামাজিক যেসব সুফল আসছে, যেমন—নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে, সেগুলোর দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। ক্ষুদ্রঋণের একটি গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার। দারিদ্র্য বিমোচনের যেসব নীতিমালা করছি, সেখানে ক্ষুদ্রঋণকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। আমরা ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকাকে বাইরে রেখে দিচ্ছি। এ কারণে ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারত, সেটি সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষুদ্রঋণ এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। এটি ক্ষুদ্রঋণকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করছে। ক্ষুদ্রঋণ মাঠপর্যায়ে গিয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটাকে খাটো করে দেখলে হবে না।

বাকী খলিলী
বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমি চিন্তিত এই খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে কি না। গত দিনগুলোতে ক্ষুদ্রঋণ আমাদের সামাজিক পরিবর্তনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা হয়, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কতটুকু প্রভাব রাখতে পেরেছে। কিন্তু সরকার নিজেকে দারিদ্র্য বিমোচন থেকে দূরে রাখছে। আমার কাছে অবাক লাগে যখন দেখি, দারিদ্র্য বিমোচনের দায়ভার শুধু ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার সঙ্গে সরকারের ভূমিকাকে যদি সমন্বয় করা যেত, তবে আমার মনে হয় সমাজ পরিবর্তনে ক্ষুদ্রঋণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। সরকার যদি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে বসে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার সমন্বিত উদ্যোগ নিত, তবে দারিদ্র্য বিমোচন অতিদ্রুত এগিয়ে যেত।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমার হিসাবমতে, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ২৩ শতাংশের কম হওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ হলো পরিচালনা ব্যয়। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সবচেয়ে কম।
আমরা শুধু ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের ব্যর্থতার দিকগুলো তুলে ধরি, কিন্তু গরিব মানুষগুলো যে কতটুকু সঞ্চয় করেছেন, তার হিসাব কখনো দেখি না। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩১ বিলিয়ন বা ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি নিট সঞ্চয় করেছেন তাঁরা। গরিব মানুষের পক্ষে সঞ্চয় করা সম্ভব নয়, যদি তাঁরা লাভ না করতে পারেন।
প্রায়ই অভিযোগ ওঠে যে গরিব মানুষ একটি ঋণ নিয়ে অন্য আরেকটি ঋণ পরিশোধ করেন। আমরা আসলে গরিব মানুষের সম্পর্কে কী ধারণা করি যে তাঁরা বোকা? যদি তাঁরা জানেন যে একটি ঋণ নিয়ে সমস্যায় পড়বেন, তবে তাঁরা কি নতুন করে ঋণ নেবেন? সুতরাং তাঁদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা আছে বলেই ঋণ নেন। প্রশ্ন হতে পারে, কেন ঋণ ওভারলেপিং হয়েছে। আজকে আমার যে আয়, যদি কালকে বড় কোনো অসুখ হয়, তবে আমার বর্তমান অবস্থা খারাপ হবে—এটাই স্বাভাবিক। ওভারলেপিংয়ের পেছনে কয়েকটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, পূর্ববর্তী ঋণ পরিশোধ করার জন্য। দ্বিতীয়ত, বিপদ থেকে মুক্তির জন্য, তা স্বাস্থ্যগত কিংবা অর্থনৈতিক। তৃতীয়ত, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য। তবে ব্যবসা সম্প্রসারণের কারণে একাধিক প্রতিষ্ঠানে ঋণগ্রহীতাদের সদস্য হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এর হার প্রায় ৮০ শতাংশ। আর একটি ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ পরিশোধ করার হার ১৩ শতাংশ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, গ্রামের পাকা রাস্তার পাশে কিংবা দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো একাধিক হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে অনেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারে না। আমি পাবনার বেড়া উপজেলায় একজন নারীর বাসায় গিয়েছিলাম; তিনি ২০ বছর ধরে সদস্য ছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কী করলেন এত দিনে? তিনি বললেন, তাঁর মেয়েকে মাস্টারবাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন, এ জন্য এক লাখ টাকা যৌতুক দিয়েছেন। তাঁর স্বামীর চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি এসব টাকাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সঞ্চয় করে দিয়েছেন। যদি এই টাকাগুলো তাঁর হাতে থাকত, তবে তিনি উৎপাদন খাতে লাগাতে পারলে তাঁর উন্নয়ন সম্ভব হতো। আমরা কখনো সফল ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করি না। ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, যেন এগুলো নিয়ে বিতর্ক-বিভ্রান্তি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া না হয়। সরকারকে অনুরোধ করব, এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে, যে কারণে এ খাত ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়ে।

রেহমান সোবহান
এখানে একাডেমিক পর্যায়ে অনেকে এসেছেন, কথা বলেছেন, তাঁদের মতামত দিয়েছেন। কিন্তু এখানে নন-একাডেমিক অর্থাৎ যাঁরা বাস্তবে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তাঁদের বক্তব্য বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা উচিত ছিল। একাডেমিক তত্ত্ব আর বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সব সময় কিছুটা মিল-অমিল থাকে। এ জন্য এখানে কিছু আলোচনা বাদ পড়ে যেতে পারে।
এখানে বলতে চাই, একজন পিএইচডি গবেষকের কথা বলেছেন বক্তারা, তিনি সত্তরের দশকে বিআইডিএসে গবেষণা করার সময় এমন একজন নারীর সন্ধান পেয়েছিলেন, তিনি তখন খুব গরিব ছিলেন এবং বর্তমানে তাঁর এক ছেলে বিদেশে থাকে এবং পাকা বাড়িতে থাকেন। এ রকম অনেক উদাহরণ আনা যায়, যাঁরা ক্ষুদ্রঋণের আওতায় উন্নয়নের ধারা রেখেছেন।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে যে বিশাল ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেওয়া হয় না, তা নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। প্রথাগত ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষকে ঋণ দেয় না। যেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমাজের শিকড়ে গিয়ে ঋণের ভিত্তি চালু করেছে।
ক্ষুদ্রঋণ কখনো দারিদ্র্য বিমোচন সম্পূর্ণভাবে করতে পারবে না। ক্ষুদ্রঋণ উন্নয়নে সহায়তা করার একটা উন্নত মাধ্যম। গ্রামীণ লোকজনকে সরাসরি বাজেট দিয়ে দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ লোকজনকে উন্নয়নের ধারায় আনা সম্ভব। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে এত সমালোচনা হলেও তিনি তো সমগ্র বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রচলনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত। ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে কিছুটা নীতিমালা থাকা উচিত। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি সম্মান রেখে ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ও কমিটির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত নয়।
প্রচলিত ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছেন না প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দরিদ্র মানুষ যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন, তাঁদের বিদ্যমান ব্যাংকিং-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ক্ষুদ্রঋণ দিয়েই শুধু দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়, এর পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো বাজার-সুবিধাসহ অন্যান্য আর্থসামাজিক বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। আর এগুলো করার মূল দায়িত্ব সরকারের। দারিদ্র্য বিমোচনের সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ হলো একজন মানুষের দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার ন্যূনতম সুবিধা।

আব্দুল কাইয়ুম
প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষ, কুসংস্কারাচ্ছন মানুষ অগ্রসর হয়ে আসছে; ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা মানুষকে সহজে বিভ্রান্ত করে না। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দারিদ্র্য দূর করার ব্যাপারে আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি চাহিদা পূরণ হলে, নতুন চাহিদা দেখা দেয়। দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ক্রমান্বয়ে তা দূর হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আজকের আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।