পর্ব ::৫৯
পূর্বে প্রকাশিতের পর
প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ ও ‘বাঙালি-পেট্রিয়াটিজম’ প্রবন্ধ দুটি পাঠে বোঝা যায় প্রথাগত সমাজতন্ত্রী না হয়েও কী করে সমাজতন্ত্রী হওয়া যায়। সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রের কথা বলেও কী করে সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সুষম বণ্টনের পক্ষে দাঁড়ানো যায়। যেমনটা ছিলেন বঙ্গবন্ধু- তার সমাজতন্ত্র ছিল কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র, যাকে তিনি একপর্যায়ে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা তার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্যারাডাইমের একটি মৌলিক ধারণা। এটি স্পষ্টতই বিলেতের ‘লেবার পার্টির সমাজতন্ত্র’ থেকে মৌলিকভাবে পৃথক একটি নিজস্ব উদ্ভাবন। এ নিয়ে পরবর্তীকালে আরো কিছু কথা যোগ করব। কিন্তু আপাতত এটুকু বলব যে, পাকিস্তানের বৃহৎ ভূস্বামী-জমিদার-জায়গিরদারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যেমন প্রকাশ্যেই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন- সেই সামন্তবাদবিরোধী অবস্থানটি বাঙালির সাম্যচিন্তায় পূর্বাপর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। বঙ্কিমের সাম্যচিন্তার প্রসঙ্গ এ ক্ষেত্রে পূর্বেই উল্লেখ করেছি। রমেশচন্দ্র দত্তের ‘দ্য পেজেন্ট্রি অব বেংগল’ বইটির কথাও বড় করে উল্লেখ করতে হয়। এর কিছুকাল আগে বঙ্কিম-ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র ‘দ্য বেঙ্গল রায়তস’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন পল্লীসমাজ পুনর্গঠনবিষয়ক তার অসংখ্য রচনা ও চিঠিপত্র। ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী কৃষকের স্বার্থ-রক্ষার প্রশ্ন তোলাতেই তাকে ‘বলশেভিক জুজুর’ ভয় দেখানো হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী যেখানে ছিলেন Peasant Proprietorship-র পক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আরো এক ধাপ এগিয়ে। অর্থনৈতিক বিচারে সমবায়ী মালিকানার কার্যকারিতা নিয়ে অনেক তর্ক উঠতে পারে। কিন্তু এটা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একধরনের ‘যৌথ খামারের’ পক্ষে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ‘মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ’ চিন্তার মৌলিক মিল দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার নয়। বাকশালের সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম বৈঠকে কৃষিতে দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্ক বলতে গিয়ে তিনি বললেন যে, অন্তত নিরীক্ষামূলকভাবে হলেও ৬০ থেকে ১০০টা কো-অপারেটিভ করে দেখা হবে যে এই সিস্টেম আদৌ কাজ করে কিনা :
‘আমি জাম্প করতে চাই না। আমি জাম্প করবার মানুষ নই …। আমি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট নই। … সেই জন্য আমি বলে দিয়েছি, ৬০টা ৭৫ কি ১০০টা কো-অপারেটিভ করবো। এই কো-অপারেটিভ যদি দরকার হয়, সেন্ট্রাল কমিটির এক একজন মেম্বার এক একটা চার্জে থাকবেন। … ওয়ান্স ইউ আর সাকসেসফুল অ্যাবাউট দিস মাল্টিপারপাস সোসাইটি, দেশের মানুষকে একতাবদ্ধ করা যাবে। বদমায়েশ একদল লোক, জমি সব শেখ সাহেব নিয়ে যাবে বলে তারা প্রপাগান্ডা করে। জমি নেবো না। তোমরা চেষ্টা করবে, একসঙ্গে ফসল উৎপাদন করবে, তোমার শেয়ার তুমি নেবে। … জমি নেবো না, জমি থাকবে। কিন্তু জমির একটা লিমিট আছে তোমাদের রাখার। আইন হয়েছে, ১০০ বিঘার বেশি রাখতে পারবে না। সেটা আমরা ফলো করবার চেষ্টা করবো এবং আস্তে আস্তে যদি ফ্লাড বন্ধ করতে পারি, সেচের ব্যবস্থা করতে পারি, ফার্টিলাইজার দিতে পারি, নিশ্চয়ই আমরা চিন্তা করবো, আরো কতদূর কী করতে পারি। কেননা, আমার দেশের জমির মধ্যে পার্থক্য আছে। এখন আমি যদি সুনামগঞ্জের জমি যেখানে তিনবার বছরে বন্যা হয়, এক বছর ফসল হয়- নর্থ বেঙ্গলের জমি আর বরিশালের জমি, চিটাগাং হিল ট্রাক্টের জমি। আর অন্য সব জমি এক পর্যায়ে দেখতে চাই তাহলে অসুবিধা হবে। আমার স্টাডির প্রয়োজন আছে। কোন জায়গায় কত পরিমাণে ফসল হতে পারে।’ এ ধরনের নিরীক্ষামূলক সমবায়ের চিন্তা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও পাই। ১৯০৮ সালে পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে তিনি যৌথ চাষাবাদের প্রস্তাব রেখেছিলেন এবং এই যৌথ পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য দেশের গ্রামাঞ্চলকে একেকটা অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছিলেন। প্রথমে দেবো যৌথ চাষাচাদের ভিত্তিতে সমবায় প্রতিষ্ঠার উদ্ৃব্দতি এবং পরে দেবো গ্রামকে ঘিরে অর্থনৈতিক জীবন সক্রিয় করার বিবরণী। যৌথতা ছাড়া যে সার্বিক গ্রামীণ পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তি নেই এটা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ :
‘জোতদার ও চাষা রায়ত যতদিন প্রত্যেকে স্বতন্ত্র থাকিয়া চাষাবাস করিবে ততদিন তাহাদের অসচ্ছল অবস্থা কিছুতেই ঘুচিবে না। পৃথিবীতে চারিদিকে সকলেই জোট বাঁধিয়া প্রবল হইয়া উঠিতেছে; এমন অবস্থায় যাহারাই বিচ্ছিন্ন এককভাবে থাকিবে, তাহাদিগকে চিরদিনই অন্যের গোলামি ও মজুরি করিয়া মরিতেই হইবে। … অদ্যকার দিনে যাহার যতটুকু ক্ষমতা আছে সমস্ত একত্র মিলাইয়া বাঁধ বাঁধিবার সময় আসিয়াছে। এ না হইলে ঢালু পথ দিয়া আমাদের ছোটো ছোটো সামর্থ্য ও সম্বলের ধারা বাহির হইয়া গিয়া অন্যের জলাশয় পূর্ণ করিবে। … য়ুরোপে আমেরিকার কৃষির নানা প্রকার মিতশ্রমিক যন্ত্র বাহির হইয়াছে- নিতান্ত দারিদ্র্যবশত সে সমস্ত আমাদের কোনো কাজেই লাগিতেছে না- অল্প জমি ও অল্প শক্তি লইয়া সে সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব নহে। যদি এক-একটি মণ্ডলী অথবা এক-একটি গ্রামের সকলে সমবেত হইয়া নিজেদের সমস্ত জমি একত্র মিলাইয়া দিয়া কৃষিকার্যে প্রবৃত্ত হয়, তবে আধুনিক যন্ত্রাদির সাহায্যে অনেক খরচ বাঁচিয়া ও কাজের সুবিধা লইয়া তাহারা লাভবান হইতে পারে। … পাটের ক্ষেত সমস্ত এক করিয়া লইলে প্রেসের সাহায্যে তাহারা নিজেরাই পাট বাঁধাই করিয়া লইতে পারে। গোয়ালারা একত্র হইয়া জোট করিলে গো-পালন ও মাখন, ঘৃত প্রভৃতি প্রস্তুত করা সস্তায় ও ভালোমতো সম্পন্ন হয়।’
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি গোটা গ্রামজীবনের বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাকে ঘিরে। সেখানে তিনি বলছেন যে, প্রতিটি গ্রাম বা কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা ‘মণ্ডলী’ হবে এক ধরনের Local State. মনে রাখতে হবে, ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সংস্কারের অধীন প্রস্তাবিত ইউনিয়ন বোর্ডের ১১ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ এই প্রস্তাব রাখছেন। পাঠকই বিবেচনা করে দেখুন :
‘দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজন সাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতগুলো পল্লী লইয়া এক-একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের এবং অভাবমোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারে, তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে।’
একে Local Self Government না বলে Local Self Governance-এর মডেলই বলা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা, পরাধীন ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ চাননি গ্রামের স্ব-শাসনের ব্যবস্থার মধ্যে সরকার বাহাদুরের অনুপ্রবেশ ঘটুক। Governmentalization বা সর্বত্র সরকারীকরণের বিরুদ্ধে ছিলেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ Governmentalization-র বিরোধী ছিলেন : পঞ্চায়েতের মধ্যে সরকারের বেনো জল একবার ‘ঢুকিলে পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েতত্ব ঘুচিল’- এ রকম সতর্কবাণী তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন তার ‘স্বদেশী সমাজ’ ও অন্যান্য রচনায়। যা হোক, পাবনা সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন :
‘নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাংক স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হইবে। প্রত্যেক মণ্ডলীর একটি করিয়া সাধারণ মণ্ডপ থাকিবে, যেখানে কর্মে ও আমোদে সকলে একত্র হইবার স্থান পাইবে এবং সেইখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানেরা মিলিয়া সালিশের দ্বারা গ্রামের বিবাদ ও মামলা মিটাইয়া দিবে।’
দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে মণ্ডলীকে নিছক গ্রাম-সভার একটি প্রাতিষ্ঠানিক পাটাতন বলে ভাবেননি, এমনকি আজকের যুগের ‘ইউনিয়ন কাউন্সিল’ রূপেও ভাবেননি। তিনি প্রতিটি গ্রাম মণ্ডলীকেই একটি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ স্ব-শাসিত ‘সর্বপ্রকার প্রয়োজন-সাধনক্ষম’ করে গড়ে উঠতে দেখতে চেয়েছিলেন। এসব প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন (Institutional development) ছাড়া গ্রামের কৃষকের জীবনের মৌলিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়- এই ছিল তার সুচিন্তিত মত। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পরের লেখাগুলোয় আরও বিস্তৃতভাবে রবীন্দ্রনাথ যৌথ-চাষাবাদ, বহুমুখী সমবায় ও স্বশাসিত গ্রাম-পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে লিখেছেন। দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের কবি-খ্যাতি তার এই গুরুত্বপূর্ণ সাম্যবাদী লেখাগুলোকে এতদিন প্রায় আড়াল করে রেখেছিল। ফলে বাঙালি নীতিপ্রণেতাদের এদিকে বিশেষ নজর পড়েনি। ১৯১৮ সালে লেখা তার ‘সমবায়’ প্রবন্ধটি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নিরীক্ষামূলক মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ব্যবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের উদ্দেশ করে বলছেন :
‘যাহা একজনে না পারে তাহা পঞ্চাশ জনে জোট বাঁধিলেই হইতে পারে। তোমরা যে পঞ্চাশ জনে চিরকাল পাশাপাশি পৃথক পৃথক চাষ করিয়া আসিতেছ, তোমরা তোমাদের সমস্ত জমি হাল-লাঙ্গল গোলাঘর পরিশ্রম একত্র করিতে পারিলেই গরিব হইয়াও বড়ো মূলধনের সুযোগ আপনিই পাইবে। যখন কল-আনাইয়া লওয়া, কলে কাজ করা- কিছুই কঠিন হইবে না। কোনো চাষীর গোয়ালে যদি তার নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক সের মাত্র দুধ বাড়তি থাকে, সে দুধ লইয়া সে ব্যবসা করিতে পারে না। কিন্তু একশো দেড়শো চাষী এমন বাড়তি দুধ একত্র করিলে মাখন-তোলা কল আনাইয়া ঘিয়ের ব্যবসা চালাইতে পারে। য়ুরোপে এই প্রণালীর ব্যবসা অনেক জায়গায় চলিতেছে। ডেনমার্ক প্রভৃতি ছোটো-ছোটো দেশে সাধারণ লোকে এইরূপে জোট বাঁধিয়া মাখন পনির ক্ষীর প্রভৃতির ব্যবসা খুলিয়া দেশ হইতে দারিদ্র্য একেবারে দূর করিয়া দিয়াছে। এই সকল ব্যবসায়ের যোগে সেখানকার সামান্য চাষী ও সামান্য গোয়ালা সমস্ত পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে আপন বৃহৎ সম্বন্ধ বুঝিতে পারিয়াছে। এমনি করিয়া শুধু টাকায় নয়, মনে ও শিক্ষায় সে বড়ো হইয়াছে। এমনি করিয়া অনেক গৃহস্থ অনেক মানুষ একজোট হইয়া জীবিকা নির্বাহ করিবার যে উপায় তাহাকেই য়ুরোপে আজকাল কো-অপারেটিভ-প্রণালী এবং বাংলায় ‘সমবায়’ নাম দেওয়া হইয়াছে। আমার কাছে মনে হয়, এই কো-অপারেটিভ প্রণালীই আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায়।’
এই সমবায়ী মালিকানাই বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানের ‘Fundamental Principles of State Policy’ অধ্যায়ের ১৩নং আর্টিকেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কথাটি ছিল এরূপ : ‘Co-operative Ownership, that is Ownership by Co-operatives on behalf of their members & within such limits as may be prescribed by law’। অর্থাৎ, সমবায়ী মালিকানার পরিধি ছিল ব্যাপক- তা যে কোনো খাতেই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। পরবর্তীকালে এই সমবায়ী মালিকানা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে ও বাকশালের মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ধারণার প্রয়োগে আরও সমৃদ্ধ করার প্রয়াস ছিল। সমবায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর নিজের প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই গ্রামাঞ্চলে সমবায় নিয়ে নিরীক্ষামূলক কাজকর্ম নিয়ে তার মধ্যে গভীর আগ্রহ দেখা দেয়। এ রকমই একটি নিরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অর্থনীতিবিদ মো. আনিসুর রহমান। এটা ছিল গ্রামকে ‘স্বনির্ভর’ করার আন্দোলন সম্পর্কিত একটি নিরীক্ষামূলক উদ্যোগ। এ ধরনের উদ্যোগে শুধু গ্রামবাসীরাই উদ্যোগী হয়েছিলেন তাই নয়, গ্রামের স্বনির্ভর কর্মকাণ্ডে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে সম্পৃক্ত হতে পারেন, তারও নতুন উদাহরণ তৈরি হচ্ছিল। ফিরে যাই চুয়াত্তরের জানুয়ারিতে, যখন আনিসুর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথন হচ্ছে গ্রামের উন্নয়নকে ঘিরে, ততদিনে আনিসুর রহমান পরিকল্পনা কমিশনের কাজ ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় ফিরে গেছেন। দু’জনের কথোপকথনের বিষয়বস্তু গ্রাম। আনিসুর রহমানের ‘পথে যা পেয়েছি’ থেকে উদ্ধৃতি করছি। আনিসুর রহমানকে দেখে বঙ্গবন্ধু সস্নেহে তাকে তার পাশে বসালেন। বললেন, ‘এতদিন আসেননি কেন?
আনিসুর রহমান- ‘আপনি এত ব্যস্ত মানুষ, খামাখা এসে আপনাকে বিরক্ত করব কেন?’
বঙ্গবন্ধু- ‘আপনার গ্রামের কাজ কেমন চলছে?
আনিসুর রহমান-‘চলছে একরকম।’
বঙ্গবন্ধু- ‘জানেন, আমার একটা আইডিয়া আছে। আমার দুটা গ্রাম আছে, … এ দুটো আমার নিজের গ্রাম, আমি সেখানে যাই, গ্রামের লোকেরা আসে, আমার কথা শোনে। চলেন এক দিন গ্রাম দুটোতে আমি আর আপনি যাই, আপনি আপনার সব গ্রাম-উন্নয়নের আইডিয়া বলবেন, তারা শুনবে।’
[ক্রমশ]
Category Archives: Non-Fiction
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৫৮
পূর্বে প্রকাশিতের পর
১৯২০ সালেই প্রমথ চৌধুরী বলছেন যে স্বাতন্ত্র্য-চর্চা ফুটিয়ে তোলা গেলেই কেবল প্রদেশে-প্রদেশে, জাতিতে-জাতিতে ঐক্যের অন্যরকম সম্ভাবনা বা ভিত্তি তৈরি হবে :তখন ভারতবর্ষের নানা জাতি একাকার হবার চেষ্টা করবে না। পরস্পরের ভিতর ঐক্য স্থাপন করবার চেষ্টা করবে। আজকের দিনের কনগ্রেসি ঐক্যের সঙ্গে সে ঐক্যের আকাশপাতাল প্রভেদ হবে।… এক জেলে পাঁচজন কয়েদির মিলন আর এক সমাজের পাঁচজন স্বাধীন লোকের মিলনের ভিতর যে প্রভেদ আছে, আজকের ভারতের নানা জাতির কন্গ্রেসী মিলনের সঙ্গে কালকের স্বরাজ্যবাদী জাতিদের মিলনের সেই প্রভেদ থাকবে। তখন প্রাদেশিক পেট্রিয়টিজমের ভিত্তির ওপরেই বাক্যগত নয়, বস্তুগত ভারতবর্ষীয় পেট্রিয়টিজম গড়ে উঠবে।’ প্রমথের চিন্তা অনুসরণ করলে দেখা যায় যে, এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্র- এ রকম চিন্তাই হচ্ছে ‘সেলফডিটারমিনেশন-বিরোধী ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়ালিজম’। এই কৃত্রিম একত্ব থেকে বেরিয়ে এসে যার যার প্রাদেশিক ন্যাশনালিজমের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক-রাষ্ট্রিক বিকাশ কামনা করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। বেঁচে থাকলে শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের যুক্ত-বাংলাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে সায় থাকত তার, এটাও অনুমান করা অসঙ্গত নয়। এজন্যই তিনি নিদ্র্বিধায় বলতে পেরেছেন, ‘বাঙালির ন্যাশনালিজমের আদর্শ যে কি, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সমগ্র ভারতবাসীকে ডোরকৌপীন পরানো আমাদের আদর্শ হতে পারে না।… আমার শেষ কথা এই যে, যে দেশকে আমি অন্তরের সহিত ভালোবাসি, সে বর্তমান বাংলাও নয়, অতীত বাংলাও নয়- ভবিষ্যৎ বাংলা, অর্থাৎ যে বাংলা আমাদের হাতে ও মনে গড়ে উঠেছে।’
যদিও দেশভাগের আগে ও পরের ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে গড়িয়ে গেল। ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের মূল ভার্সনে ‘states’ শব্দের বদলে ১৯৪৬ সালে প্রতিস্থাপিত হলো ‘state’ শব্দটি। জিন্নাহ বললেন যে, ১৯৪০-র states আসলে ছিল একটি মুদ্রণজনিত প্রমাদ- a typographical error! বাংলার কংগ্রেসি নেতারাও শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের যুক্তবঙ্গের প্রস্তাব সমর্থন করতে চাইলেন না। নেহেরু পূর্বাপর প্রাদেশিক সেলফ-ডিটারমিনেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। প্রমথ চৌধুরীর প্রদেশভিত্তিক স্বরাজ-রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শেখ মুজিব এই রাজনৈতিক পরিণতিকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন :”কাউন্সিল প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে ‘স্টেটস’ লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট’ লেখা হয় তার প্রতিবাদ করলেন; তবুও তা পাস হয়ে গেল।” এর অর্থ হলো, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে একাধিক পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল, তা আর থাকল না। কলমের এক খোঁচায় ১৯৪৬ সালের দিল্লি কনভেনশনে কেবল মাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু এ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি বললেন, ‘১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে, সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না এটা চিন্তাবিদেরা ভেবে দেখবেন।’ পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালের ২১ দফায় এবং ১৯৬৬ সালের ৬ দফায় মূল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাওয়া হয়েছিল।
এত সাতকাহনের উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, শেখ মুজিব ও তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের সহকর্মীদের ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছুটা পিছিয়ে গিয়েই প্রমথ চৌধুরী কথিত ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের’ সাধনা করতে হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী যাকে বলেছিলেন ‘প্রাদেশিক স্বরাজ’, পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে তার রূপরেখা গোড়া থেকে দাঁড় করাতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এই আন্দোলন ক্রমশ লাহোর প্রস্তাবের সংকীর্ণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বিকভাবে বাঙালির ন্যাশনালিজমের আদর্শকে এক রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদনের কালে সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এই জাতীয়তাবাদকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন :
“জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, অনেক মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা নাই বা দিলাম। আমি শুধু বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন- সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হল অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদও আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক-জাতি হয়েছে। অনেক দেশই আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে- তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। সেজন্য আজ বাঙালী জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালী, আমার ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’। এর মধ্যে যদি কেউ আজকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন তুলতে চান, তাহলে তাকে আমি অনুরোধ করব, মেহেরবানি করে আগুন নিয়ে খেলবেন না।”
বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই সংজ্ঞায় প্রমথ চৌধুরীর কোনো আপত্তি থাকত না। রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে সহমত হতেন। কারণ এই জাতীয়তাবাদ (প্রমথের ভাষায়) ‘আমাদের হাতে ও মনে গড়ে উঠেছে।’ এই জাতীয়তাবাদ আমাদের ‘সেলফ-রিয়ালাইজেশনের’ ফসল। এ কথাটিও প্রমথ চৌধুরীর- ‘জাতির পক্ষে একমাত্র আদর্শ হচ্ছে সেলফ-রিয়ালাইজেশন।’ কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর চিন্তায় ‘প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বরাজ-গঠন’ এই নভেল আইডিয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণই এখানে আমার একমাত্র বা প্রধান লক্ষ্য নয়। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও মধ্যপন্থার মানুষ। অবাধ পুঁজিবাদও চান না, আবার একনায়কত্ব-ভিত্তিক সমাজতন্ত্রও চান না। তিনিও অন্য এক সমাজতন্ত্র খুঁজছেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের তিন বছরের মাথাতেই প্রমথ চৌধুরী রূপক অর্থে যা লিখলেন তার সমসাময়িক তুলনা মেলা ভার। অন্তত এই উদ্ধৃতিটি বড় করে দেওয়ার দাবি রাখে :
‘একটা কথার অর্থ পরিস্কার করা দরকার, সে কথাটা হচ্ছে স্বার্থ।… এ তো হবারই কথা। আমরা যখন প্রাণী, ও প্রাণের সর্বপ্রধান চেষ্টা যখন আত্মরক্ষা করা, তখন অন্ন আমাদের চাইই চাই। আর পলিটিক্সের যত বড়ো বড়ো কথা আছে তার আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক খোলস ছাড়িয়ে নিলে কি দেখা যায় না যে, তার ভিতরকার মোটা কথা হচ্ছে অন্ন? আজকের দিনে পৃথিবীতে পলিটিক্সের দুটি বড় কথা হচ্ছে ক্যাপিটালিজম এবং বলশেভিজম, বাদবাকি আর যতরকম ism আছে সে সবই হয় ক্যাপিটালিজম নয় বলশেভিজমের কোঠায় পড়ে। হাল পলিটিক্সের এই দুই ধর্ম এতই পরস্পরবিরোধী যে, উভয়ের মধ্যে অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে আজ জীবনমরণের যুদ্ধ চলছে। অথচ এই উভয় পলিটিক্যাল ধর্মের ভিতর একই জিনিস আছে এবং সে জিনিস হচ্ছে অন্ন। তবে মানবজাতি যে দুভাগ হয়ে পড়েছে সে ঐ অন্নের ভাগ নিয়ে। ক্যাপিটালিজমের মূল সূত্র হচ্ছে অল্প লোকের বহু অন্ন, আর বলশেভিজমের মূল সূত্র হচ্ছে, বহু লোকের যথেষ্ট অন্ন। আমার বিশ্বাস এ দুয়ের কোনোটিই টিকবে না। কেননা, ক্যাপিটালিজম ভুলে গিয়েছে যে, রুটি সকলেরই চাই, আর বলশেভিজম মনে রাখেনি Man does not live by bread alone, অর্থাৎ, মানুষের মন বলেও একটা জিনিস আছে, অতএব, পেটের খোরাক ছাড়া মানুষের মনের খোরাকও চাই, নচেৎ মানুষ পশুর সঙ্গে নির্বিশেষ হয়ে পড়ে।’ কিছু আগেই আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধু নয়া চীনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন যে, অন্নের সাথে স্বাধীনতা না পেলে মানুষের মন ‘পাথরের মত’ শুস্ক হয়ে যায়।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে লেখা প্রবন্ধটিতে যখন পড়ি অবাধ পুঁজিবাদ ও একনায়কত্ব-ভিত্তিক সমাজতন্ত্র ‘কোনটিই টিকবে না’, তখন প্রমথের বিশ্নেষণকে প্রফেটিক মনে না হয়ে পারে না। তার মানে এই নয় যে, বলশেভিজমের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী কোনো প্রগতিশীল উপাদান খুঁজে পাননি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রায়ত বা কৃষককে জমির মালিকানা দেওয়ার প্রশ্ন উঠলেই বলশেভিজম বা সমাজতন্ত্রের হাত আবিস্কার করা হত তাতে। ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী এ বিষয়ে বলছেন :
‘দেখা গেল যে, রায়তদের শিক্ষার দাবি ও স্বাস্থ্যের দাবি সকলেই মঞ্জুর করেন, কিন্তু তাদের স্বত্বের দাবির কথা কানে ঢোকবামাত্র চমকে ওঠেন, এমন লোকের এ দেশে অভাব নেই। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অনেকে আবার প্রজার পক্ষ যারা সমর্থন করতে উদ্যত হন তাদের বুদ্ধি ও চরিত্রের উপর নানারূপ দোষারোপ করতে ক্ষণমাত্র দ্বিধা করেন না। যে প্রজার অধিকারের কথা তোলে, কারো মতে সে বলশেভিক, কারো মতে সে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শত্রু, আবার কারো মতে-বা সে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর-এক সম্প্রদায়ের মারামারি-কাটাকাটির পক্ষপাতী। এরা যদি একটু ভেবে দেখেন তা হলেই দেখতে পাবেন যে, এ সকল অপবাদ কতদূর অমূলক। প্রথমত, বলশেভিক জন্তুটি যে কি, তা তারাও জানেন না আমরাও জানি নে। জুজুর ভয় ভদ্রলোকের পক্ষে অপরকে দেখানোও যেমন অনুচিত, নিজে পাওয়াও তেমনি ছেলেমি।’
প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ লিখিত হয় ১৯১৯ সালে, আর রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে ১৯১৭ সালে। দু’বছরের মধ্যেই ‘বলশেভিক জুজুর’ আলোচনা বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে বিশেষ তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল, দেখা যাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধেই সর্বপ্রথম বাংলার কৃষকের কাছে জমি হস্তান্তর করার দাবি জানানো হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ভূমি সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছিল। যেটা বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও ‘সাম্য’ প্রবন্ধে সরাসরিভাবে বলা হয়নি আগে। সেসব লেখায় মূলত রায়তদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর ঋজু চিন্তায় এ গদ্যে স্পষ্ট করে দাবিটা তোলা হয়েছিল সেদিন। বাঙালির সাম্য-চিন্তায় তার অনন্যসাধারণ অবস্থান এতে করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে :
‘আমাদের জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে কিসের বিশেষ অভাব আছে জানেন?- স্বাধিকারের জ্ঞান। মনস্তত্ত্ববিদেরা জানেন যে, স্বত্বের জ্ঞান থেকেই মানুষের অধিকারের জ্ঞান জন্মায়।… এ দেশের কৃষকদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক লোকের জমি তার নিজস্ব সম্পত্তি। বাংলার প্রজা যদি জমি হস্তান্তর করবার, গাছ কাটবার, কোঠা বাড়ি করবার, কুয়ো খোঁড়বার অধিকার পায়, এবং সেই সঙ্গে তার জোত মৌরসী-মোকবরি হয়, তাহলে সে ইংরেজিতে যাকে বলে peasant proprietor তাই হয়ে উঠবে। প্রজা জমির মালিক হয়ে উঠলে জাতির শক্তি ও দেশের ঐশ্বর্য যে কতদূর বেড়ে যায় তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ বর্তমান ফ্রান্স। আর প্রজাকে স্বত্বহীন ও দরিদ্র করে রাখলে তার ফল যে কী হয়, তারও জাজ্বল্যমান উদাহরণ বর্তমান রাশিয়া।’ প্রমথ চৌধুরী প্রথাগত কোনো সমাজতন্ত্রী ছিলেন না (প্রবন্ধটি যখন লেখা হয়েছে ভারতে বা বাংলায় তখনো কমিউনিস্ট পার্টি গঠিতই হয়নি)। তিনি ছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেসির পক্ষের লোক, কিন্তু ‘দ্য ল্যান্ড কোয়েশ্চনস’কে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সুতীব্র ভাষায় তিনি সামন্তবাদকে আক্রমণ করেছিলেন। খোদ কৃষকের হাতে জমির স্বত্ব দেওয়ার নীতিকে সমর্থন করেছিলেন সামাজিক ন্যায়ের তাগিদে। এজন্যে তাকে ‘বলশেভিক জুজুর’ ভয় দেখানো হলেও তিনি পিছু হটেননি। তিনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলার মতো মানুষ নন। রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলে তার অবস্থান (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদুষী কন্যা ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন)। তার কাছে উচ্চকণ্ঠের স্লোগান-তোলা সমাজতন্ত্র আশাও করতে পারি না আমরা। তার পরও তাকে বলতে হয়েছিল :
‘যারা বলশেভিজমের ভয়ে কাতর তাদের অনুরোধ করি যে, তারা বাংলার রায়তকে বাংলার peasant proprietor করবার জন্য তৎপর হোন। যেরকম দিনকাল পড়েছে, তাতে করে মানুষকে আর দাস ও দরিদ্র করে রাখা চলবে না। প্রজাকে এসব অধিকার আমরা যদি আজ দিতে প্রস্তুত না হই তো কাল তারা তা নিতে প্রস্তুত হবে।’
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৫৭
পূর্বে প্রকাশিতের পর
মুজিব সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই।… সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়। সেজন্য পহেলা Step, যাকে প্রথম Step বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি।… এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী Climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে Step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে… বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না। তা যারা করেছেন, তারা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। কারণ লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না- যেমন আন্দোলন হয় না। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে Step by step এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না… কোনোকিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-র মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
এত দীর্ঘ উদ্ৃব্দতি দেওয়ার পেছনে আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দেখানো যে, ‘সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে গভীরভাবেই ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তত্ত্বের ‘লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না।’ গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে গেলে মানব-প্রকৃতি ও দেশজ ইতিহাস-সংস্কৃতি- ‘কাস্টম’ বিবেচেনায় নিতে হয়, এই দিকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমার উদ্দেশ্য। একে শুধু হাল আমলের Social Democracy বললে ভুল হবে, আবার প্রথাগত Soviet-style Socialism বললেও ভুল হবে। একটা পশ্চাৎপদ দেশে গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র গড়তে হলে ধাপে ধাপে Step by Step লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয় নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে। এটা বঙ্গবন্ধুর সাম্যচিন্তার একটি বিশিষ্ট দিক।
মানব-প্রকৃতি ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনার কথা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও উঠে এসেছিল স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্রের আলোচনা করতে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন (পরবর্তীকালের বঙ্গবন্ধুর মতোই) যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মডেল ‘মানব প্রকৃতি’কে পুরোপুরি অস্বীকার করে টিকতে পারবে না:
‘যে কোনো মতবাদ মানুষ সম্বন্ধীয় তার প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মানবপ্রকৃতি। এই মানবপ্রকৃতির সঙ্গে তার সামঞ্জস্য কী পরিমাণে ঘটবে, তার সিদ্ধান্ত হতে সময় লাগে। তত্ত্বটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার পূর্বে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তবুও সে সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে। কেবলমাত্র লজিক দিয়ে বা অঙ্ক কষে নয়, মানবপ্রকৃতিকে সামনে রেখে। মানুষের মধ্যে দুটো দিক আছে- একদিকে সে স্বতন্ত্র, আর একদিকে সে সকলের সঙ্গে যুক্ত। এর একটাকে বাদ দিলে যেটা বাকি থাকে, সেটা অবাস্তব।… ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যখন উৎকট স্বার্থপরতায় পৌঁছিয়ে সমাজে নানা প্রকার উৎপাত মথিত করে, তখন উপদেষ্টা বলেন, স্বার্থ থেকে স্ব-টাকে এক কোপে দাও উড়িয়ে, তা হলেই সমস্ত ঠিক চলবে। তাতে হয়তো উৎপাত কমতে পারে। কিন্তু চলা বন্ধ হওয়া অসম্ভব নয়।’
অর্থাৎ মানুষের স্বার্থ ও নিঃস্বার্থ দুই দিকের দিকে লক্ষ্য করেই নতুন ধারার সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। মানুষের স্বার্থপরতা ‘ডিমান্ড’ করে যাতে করে ব্যক্তি উদ্যোগ ও এডাম স্মিথের ‘বাজার-অর্থনীতি’ তথা ‘অদৃশ্য-হাত’ (Invisible Hand)-এর ক্রিয়াকলাপ যেন সম্পূর্ণ রুদ্ধ না হয়ে যায়। ব্যক্তি উদ্যোগের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেও সামষ্টিক কল্যাণ ও পরার্থপরতাকে লালন করা সম্ভব। প্রথম দিকটি অর্থাৎ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য রক্ষা লিবারেল ডেমোক্রেসির ‘লিবার্টি প্রিন্সিপাল’কে নির্দেশ করছে। আবার ‘উৎকট স্বার্থপরতা’ সমাজের জন্য ক্ষতিকর- সে রকম লাগামছাড়া ‘লোভ’কে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। এটি সমাজতন্ত্রের ‘সামাজিক কল্যাণ’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের’ দিকে নির্দেশ করছে।
এক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালে চীনে গিয়ে নয়াচীনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের চোখে পড়েছিল। তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্র’ নির্মাণের ধারণাকে বোঝার জন্য চীনের অভিজ্ঞতাকে এক মূল্যবান সূচক হিসেবে দেখতে পারি। বলা দরকার, নয়াচীনের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা শেখ মুজিব নিছক ভ্রমণ কাহিনি লেখার জন্য করেননি। এর পেছনে ছিল দেশের অবস্থার সাথে সেদিনের চীনের পরিস্থিতিকে মিলিয়ে দেখার প্রবল রাজনৈতিক তাগিদ। ১৯৫২ সালে মুজিব লিখেছেন তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনায়:
‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল, এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।… একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।’
এই যে জাতীয় ধন-সম্পদ-ক্ষমতা একটা বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে চলে যাওয়া- যাকে আমরা ইতিপূর্বে Concentration of Economic Power বলে শনাক্ত করেছি- সেটা সার্বিক বিবেচনায় গ্রামজীবন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে উঠে আসা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কোনো তত্ত্বের সাহায্য ছাড়াই সেদিন অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া কলকাতায় পড়াশোনাকালে মেট্রোপলিটান মন ও সংবেদনশীলতা তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলে থাকবে। ফজলুল হক-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে রাজনৈতিক নৈকট্যের কারণে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ঘরানার সাথে তার অন্তরঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে উঠেছিল। ফলে ঐ তুলনামূলক তরুণ বয়সেই তার মনে কতিপয় এলিট গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক বিত্ত ও ক্ষমতার ঘনীভবন বিষয়টিকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি এবং এটি পরবর্তীতে তার সাম্যচিন্তার একটি বিশিষ্ট স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়।
এর পরপরই চলে এলো একটি অসাধারণ ‘পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’ যা Early-Mujib ও Late-Mujib-এর মধ্যে সাম্যচিন্তার যোগসূত্র স্থাপন করে দেয়। এই কথাগুলো ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের বিশ্বাসের কথা, তার মনের কথা, কাউকে শোনাবার জন্য নয়, নিজের চিন্তাকে একটি স্থায়ী উপলব্ধির কাঠামো দেওয়ার প্রয়াস, সেটি কখনোই তার মন থেকে মুছে যায়নি, আমৃত্যু যাকে তিনি লালন করেছেন। এখানে তার ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ৃব্দতি দিচ্ছি :
‘চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সকল কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদী সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।’
এই ম্যানিফেস্টো-ধারার বিবৃতিকে নিছক ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’-এর অনুবর্তী বললে বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ধারণাটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করা হয়। আবার একে প্রথাগত সোভিয়েত-চীনের ধারার সমাজতন্ত্র বললেও অন্যায় হবে। এখানেই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ বিশেষত্ব। কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাক এটা যেমন তিনি চান না, তেমনি চান না কোনো একনায়কত্বের শাসন। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আর একটা তর্কের বিষয় হচ্ছে ডিক্টেটরশিপ অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যাপারে নায়কতন্ত্র নিয়ে। কোনো বিষয়েই নায়কিয়ানা আমি পছন্দ করি নে।… একনায়কতার বিপদ আছে বিস্তর।’ মনে রাখতে হবে, তখনো ত্রিশের দশকের স্ট্যালিনীয় শুদ্ধি অভিযানগুলো শুরু হয়নি। ১৯৩৬-৩৮ পর্বের এই Purge-এর কারণে অনেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন ও ভিন্নমত প্রকাশের নীতি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে সোভিয়েত ইউনিয়নে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর প্রাথমিক আলামত তখনই আঁচ করেছিলেন :’ডিক্টেটরশিপ একটা মস্ত আপদ। সে কথা আমি মানি এবং সেই আপদের বহু অত্যাচার রাশিয়ায় আজ ঘটছে- সে কথাও আমি বিশ্বাস করি।’ নয়াচীন ভ্রমণকালে মুজিবও এটা লক্ষ্য করেছেন। ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থে তিনি বলছেন : ‘ভাত কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।’
৪. সাম্যচিন্তার অন্যান্য উৎস ও বঙ্গবন্ধু
ভাত-কাপড়ের অর্থনৈতিক অধিকার চাই, আবার চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও চাই- বঙ্গবন্ধুর এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা আরেকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর লেখায় কিছুটা ভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি হচ্ছেন প্রমথ চৌধুরী। তার বৈদগ্ধ্যের কথা এক স্তবকে বা এক প্রবন্ধে বলে শেষ করার নয়। বাংলায় আমরা যে বর্তমানে ‘শুদ্ধ চলিত’ রীতিতে গদ্য লিখি, তার উদ্ভাবক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর সম্পাদনায় ‘সবুজপত্র’ বাংলায় শুদ্ধ চলিত রীতিতে প্রকাশিত গদ্য লেখার প্রধান বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথও তার গদ্যরীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাধু-ভাষার দাঁতভাঙা গদ্যের দেয়াল ভেঙে বাংলা ভাষাকে চলিত রীতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহসকে এক নিঃশব্দ সামাজিক বিপ্লবের সাথে তুলনা করা চলে। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রমথনাথ সবুজপত্রকে ‘যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য-সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। প্রচলিত অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষণীর মধ্যে তা সম্ভবপর হতে পারত না। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথর প্রধান কৃতিত্ব। আমি তার কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনও কুণ্ঠিত হইনি।’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বছর সাতেকের ছোট প্রমথ চৌধুরী দেশভাগের এক বছর আগে ১৯৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ ও ‘গল্পসংগ্রহ’ পড়লে বোঝা যায় কী বিপুল পরিমাণে পড়াশোনা ছিল তার। শুধু শুদ্ধ চলিত রীতির গদ্যের উদ্ভাবনেই নয়, রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কার নিয়ে তার বিশিষ্ট মত ছিল। উদাহরণত, ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজম’ প্রবন্ধে তিনি অভিন্ন ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ একচ্ছত্র দাপটের বিপরীতে ‘প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদের’ সপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তিনি স্মরণীয়ভাবে বলেছিলেন যে, ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের মূলে আছে বাঙালি জাতির স্বীয় স্বাতন্ত্র্যজ্ঞান। Self-determination of small nations-এর মতানুসারে বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের বিশেষ সার্থকতা আছে। … বহুকে এক করবার চেষ্টা ভালো, কিন্তু একাকার করবার চেষ্টা মারাত্মক, কেননা তার উপায় হচ্ছে জবরদস্তি। … বাংলার সঙ্গে মাদ্রাজের যে প্রভেদ ইংলন্ডের সঙ্গে হল্যান্ডের সে প্রভেদ নেই, এমনকি, ফ্রান্সের সঙ্গে জর্মানিরও সে প্রভেদ নেই। তবে যে প্রাদেশিক পেট্রিয়টিজমের নাম শুনলে এক দলের পলিটিশিয়ানরা আঁতকে ওঠেন, তার কারণ তাদের বিশ্বাস ও মনোভাব জাতীয় স্বার্থপরতার পরিচয় দেয়।’ এই সমালোচনার তীর কংগ্রেসি হেজিমনির বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত। প্রমথ চৌধুরী চান প্রতিটি প্রদেশ তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ওঠে দাঁড়াক এবং যার যার স্বাতন্ত্র্য-চর্চার সফলতা লাভ করে তারা বিভিন্ন প্রদেশের বা জাতির ভেতরে ‘ঐক্য স্থাপনের’ চেষ্টা করুক। প্রমথ চৌধুরী তার কল্পনায় কার্যত স্বাধীন ভারতবর্ষকে বিভিন্ন প্রদেশভিত্তিক রাষ্ট্রের সহযোগে এক ধরনের loose fedaration হিসেবে ভেবেছিলেন- যেখানে প্রতিটা প্রদেশ অবিভক্ত থেকে যার যার প্রাদেশিক বিশিষ্টতা নিয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্রভাবে প্রথমে উঠে দাঁড়াবে।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৫৬
পূর্বে প্রকাশিতের পর
সেই একই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রাস্তা নাই, ঘাট নাই, রেলওয়ে ব্রিজ এখন পর্যন্ত সারতে পারি নাই, পোর্ট রাশিয়ারা সেরে দিচ্ছে একটা, রেললাইন পাকা এখনও হয় নাই। চরিত্র এত জঘন্য খারাপ হইয়া গেছে, পকেটমার ধরি, চোর ধরি। লজ্জায় মরে যাই। … পুলিশ নিয়া নকল বন্ধ করতে হয় আমার, এ কথা কার কাছে কব গিয়া।’
এ তো গেল যাদের অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে তাদের ‘লেভেলে’ বিকাশমান সমস্যার কথা। সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসের ভাষণে যারা পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন তাদের ‘লেভেলের’ সমস্যা বা সমাজ বদলের ক্ষেত্রে কমিটমেন্টের কথা পাড়লেন বঙ্গবন্ধু। সেখানেও ছাত্রলীগের সভায় দেওয়া বক্তৃতাকে স্মরণ করলেন, বললেন- সমাজতন্ত্রের পথ অত্যন্ত দীর্ঘ, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরুতে হবে :
‘পরিস্কার কথা আমার, স্যোশিয়ালিজমের যাবার [পথ], স্যোশিয়ালিজম এত সোজা না। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। সে পদক্ষেপ নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। বাধা আমাদের আসবেই। যাদের কাছ থেকে আমরা সম্পদ নিয়েছি, যারা এখানে সম্পদ ফেলে গেছে, তাদের দালালরা, বিদেশি শক্তিরা, তারা আজকে চেষ্টা করছে আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক ইকোনমির [ধারা] বানচাল করার জন্য। … [তাই বলছিলাম] স্যোশালিজমের রাস্তা এত সোজা নয়, এটা বড় কঠিন রাস্তা।… স্যোশালিজম যেখানে শুরু হয়েছে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নে আজ ৫৫ বৎসর [পার] হয়ে গেছে, স্যোশালিজম করতে পারেনি। এখনও ঘাত-প্রতিঘাতে অগ্রসর হচ্ছে, নতুন নতুন তাদের পথ জানতে হচ্ছে। এ রাস্তা সোজা রাস্তা নয়, এ রাস্তা কঠিন রাস্তা।’
নিজেকে কখনোই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘তাত্ত্বিক’ বলে ভাবেননি তিনি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রণয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন- ২১ দফা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু ২১ দফা বা ৬ দফা কোনোটাতেই সরাসরিভাবে সমাজতন্ত্র ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা ছিল না। এগুলো কালের বিবর্তনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে যুক্ত হয়েছে। এখানেও তিনি ছিলেন দীর্ঘ পথের যাত্রী- তাড়াহুড়া করে কোনো কিছু ‘উপর থেকে’ চাপিয়ে দিতে চাননি। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়তে চাননি। জনগণ তার নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ক্রমশ মুজিবের চার স্তম্ভের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে একত্রিত হয়েছে এবং সমবেত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার পূর্বে (১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর) শাসনতন্ত্রের খসড়ার কাজ বঙ্গবন্ধু শুরু করে দিয়েছিলেন তার কিছু নিকট সহকর্মীদের নিয়ে। সেখানে রাজনৈতিক নেতা, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মতামত নিয়েছেন। সেই দলিলে প্রথম বারের মতো বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা ফুটে উঠেছিল। সেখানে বলা ছিল ‘যথার্থ সজীব গণতন্ত্র’-এর কথা- এমন একটা গণতন্ত্র ‘যেখানে জনগণ স্বাধীনতা ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং ন্যায় ও সাম্য বিরাজ করবে।’ সেখানে আরও বলা ছিল :
‘শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প- যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথ বণ্টনের বিধান থাকবে। … আমাদের কাজ হলো গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন। সংগ্রাম ও ত্যাগ ব্যতীত দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া মিথ্যা অঙ্গীকারের শামিল।’
বিভিন্ন নেতিবাচক ধারার সমাজতন্ত্রের সমালোচনাও তিনি করেছেন। দেশের একাংশ সমাজবাদীদের মধ্যে হঠকারিতা ও পদস্খলন দেখে সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি তিরস্কার করে বলেছিলেন :
‘বুঝি না ভাই, আমি একটু কনফিউজড হয়ে যাই, আমি বুঝি না… আপনারা বড় বড় ফিলোসোফার আছেন, বড় বড় থিওরিস্ট আছেন, বড় বড় কবি আছেন, অনেক লেখাপড়া করেছেন, আপনারা বুঝতে পারেন, আমি অতখানি বুঝি না। আমি সোজা বুঝি যে, সাম্প্রদায়িক আর সমাজতন্ত্র পাশাপাশি চলতে পারে কেমন কইরা আমি জানি না, আমি শিখি নাই আমার রাজনৈতিক জীবনে।’ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর স্লোগান তুলেছিল এক হঠকারী পক্ষ, আরেক পক্ষ গণচীনের স্বীকৃতি আসেনি বলে চরম বিরুদ্ধাচরণের নীতি অবলম্বন করেছিল। সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছিল যারা তাদের সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তি মিলে যাচ্ছিল অভিন্ন স্বার্থের টানে। অন্যদিকে সোভিয়েত ‘সামাজিক সংশোধনবাদের’ বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আরেক পক্ষ পরোক্ষভাবে দেশে সন্ত্রাস-গুপ্তহত্যাকে উস্কে দিয়েছিল অতি-বামপন্থার নামে। এদেরকে লক্ষ্য করেই মুজিব বলেছিলেন সেদিন : ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেছি, [কিন্তু] গণতন্ত্র অর্থ [যা ইচ্ছা বলার] লাইসেন্স নয়। আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলার সামর্থ্য কারও নাই। রাষ্ট্রীয় মূল নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো ক্ষমতা নাই। যখন শাসনতন্ত্রে আমাদের চারটা স্তম্ভ রয়েছে, [তার] বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা কখনো নাই। একদিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলবে আর আরেক দিকে গোপনে সাম্রাজ্যবাদের সাথে হাত মিলাবে।’ ছদ্ম-প্রগতিশীলরা যে দেশের শত্রু সে ব্যাপারে সতর্ক করলেন সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে এসে : ‘কমিউনিস্ট পার্টির মনোপলি আপনাদের এখন আর নেই বলে মনে হচ্ছে সবার কাছে। কারণ, এত কমিউনিস্ট, গোপনে গোপনে এত কমিউনিস্ট আর এত সোশ্যালিস্ট পার্টি আর এত প্রগ্রেসিভ পার্টি হয়ে গেছে যে মুসিবতে পড়ে গেছি আমরা। তবে আমরা এইটুকু বুঝি যে, আপনাদের সঙ্গে আমাদের নীতির মিল আছে। … আমার মনে হয় জনাব মার্কস, মার্কস বাহাদুর বোধহয় বিপদে পড়ে গেছেন। তাকে নিয়ে আপনারা আমরা [এমন] টানাটানি শুরু করে দিয়েছি যে, তার কোনো আর সীমা নাই। কত যে মার্কস পার্টি বাংলাদেশে হয়েছে তার কোনো সীমা নাই।’
বোঝাই যাচ্ছে, অনেকগুলো ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ- এসব নিয়ে লড়াই তো ছিলই। কিন্তু তার সাথে যুক্ত হয়েছিল অতি বামপন্থার অন্তর্ঘাতী তৎপরতা ও অতি-ডানপন্থি উগ্র মতবাদের সাথে বাড়তি লড়াইয়ের চাপ। গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রের নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের সামাজিক সুস্থিরতা ও সামাজিক সহিষ্ণুতার প্রয়োজন, সে ধরনের সামাজিক পুঁজি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল, এসব শক্তির অশুভ তৎপরতার দ্বারা। ১৯১৮ সালে লেনিন গুলিবিদ্ধ হলেন এ রকমই অতি-বামপন্থি শক্তির দ্বারা; তারপর তিনি আর সম্পূর্ণ সুস্থ হননি কখনোই। ১৯২৪ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। মুজিবও ১৯৭৫ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে এক আততায়ী বাহিনীর হাতে মারা যান। আমেরিকায় একজন প্রেসিডেন্টের টার্ম চার বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনককে আমরা রাষ্ট্র চালানোর জন্য, তার আকাঙ্ক্ষার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চার বছর সময়ও দেইনি, দিতে চাইনি আমরা।
৩. রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ও বঙ্গবন্ধুর নয়াচীন
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এক জায়গায় আমরা বঙ্গবন্ধুর সামন্ততন্ত্রবিরোধী অবস্থানের সাথে বঙ্কিমের জমিদারবিরোধী অবস্থানের একটি তুলনা টেনেছি। গণতন্ত্র চাই, আবার সমাজতন্ত্রও চাই- একাধারে লিবারেল ডেমোক্রেসি ও অর্থনৈতিক সুষম বণ্টনের সামাজিক ন্যয্যতা দুই-ই আমাদের দরকার- বঙ্গবন্ধুর এই মৌলিক উপলব্ধির পেছনে বাঙালির সাম্যচিন্তার দীর্ঘ ঐতিহ্য ক্রিয়াশীল ছিল। একে শুধু ‘সাম্যচিন্তা’ বলাও যথেষ্ট নয়- এটা বাঙালির দীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম’ বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের এক সমৃদ্ধ পরম্পরা। আমার যুক্তির সপক্ষে আমি যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও কাজী আবদুল ওদুদের সাম্যচিন্তার বিশিষ্ট প্রবণতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব বঙ্গবন্ধুর চিন্তার সাথে তুলনাক্রমে।
সুবিদিত যে, রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় যান ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে, আর মুজিব চীনে যান ১৯৫২ সালের অক্টোবরে। চীনে যাওয়ার আগে প্রায় আড়াই বছর বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছে জেলে- ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় পদচারণার প্রেক্ষিতে। প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক ধারার শাসনের ভালো ও মন্দ দুটি দিকের প্রতিই তারা দৃষ্টিপাত করেছেন। রাশিয়া সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সেখানে না গেলে তার এ জন্মের ‘তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ’ থেকে যেত। সমাজতন্ত্রের পরিবেশে মধ্য এশিয়ার অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী- যাদের অধিকাংশই মুসলমান- দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছিল। রাশিয়ার সর্বত্র প্রাথমিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সাংস্কৃতিক বিনোদন-কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনের অভাব পূরণ করার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছিল। এর ফলে সেখানে আপামর জনগোষ্ঠীর ভেতরে সর্বজনীন উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠছিল এবং প্রকৃত অর্থেই এক গণশক্তির জাগরণ দেখা দিয়েছিল। এসব প্রশংসার পরে সমালোচনার কথাটিও তুললেন রবীন্দ্রনাথ। বহুল ব্যবহূত উদ্ৃব্দতিটি আরও একবার এখানে স্মরণ করতে চাই :
‘সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে মার্কসীয় অর্থনৈতিক মতটা সম্পূর্ণ গ্রাহ্য কি-না সে কথা বলবার সময় আজও আসেনি; কেননা এ মত এতদিন প্রধানত পুঁথির মধ্যেই টলে টলে বেড়াচ্ছিল। এমন বৃহৎ ক্ষেত্রে এত বড়ো সাহসের সঙ্গে ছাড়া পায়নি। যে প্রবল লোভের কাছে এই মত প্রথম থেকেই সাংঘাতিক বাধা পেত, সেই লোভকেই এরা সাংঘাতিকভাবে সরিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার ভিতর দিয়ে পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এ মতের কতটুকু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আজ নিশ্চিত কেউ বলতে পারে না। কিন্তু এ কথাটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে, রাশিয়ায় জনসাধারণ এতকাল পরে যে শিক্ষা নির্বাচিত ও প্রচুরভাবে পাচ্ছে তাতে করে তাদের মনুষ্যত্ব স্থায়ীভাবে উৎকর্ষ ও সম্মান লাভ করল।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে সুদূর ত্রিশের দশকেই স্তালিনের আমলের বলশেভিক অর্থনৈতিক মত, পরিচালনা-পদ্ধতি ও মালিকানা-সম্পর্কের প্রয়োগ এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। এই পদ্ধতি কালের বিচারে টিকবে কি-না এ নিয়ে তার মনে সংশয় ছিল- যা পরবর্তীকালে ‘স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্র’-এর পতনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্রের সম্পর্কে কবির প্রধান সমালোচনা ছিল এই যে, এটি মানুষের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধের বিরোধী এবং সেই সূত্রে মানবপ্রকৃতিরও বিরোধী। মানুষের মধ্যে পরার্থপরতা আছে বটে, কিন্তু স্বার্থপরতাও একটি মৌলিক দিক। এই কথাটা এসেছে লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রেরণা থেকে। অর্থনীতিতে ব্যক্তি উদ্যোগের স্বীকৃতি ছাড়া শুধু রাষ্ট্রনির্ভর উন্নয়নের পথে জনগণের মুক্তি আসবে না। রাষ্ট্রনির্ভর উদ্যোগ ও ব্যক্তিনির্ভর উদ্যোগ- এর মধ্যে কোনো একটি দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লেই বিপদ। কোনো একটি পক্ষে বেশি রং চড়ে গেলেই চিত্রকর্মটি নষ্ট হওয়ার জোগাড় হয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মধ্যে আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই- যা পরবর্তীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘পরিকল্পনা’ চাই, ‘Planned Econmic Growth’ চাই, কিন্তু তা নতুন ব্যক্তি-উদ্যোগকে বিনষ্ট করে নয়। এই চিন্তাই বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে ও প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলে ফুটে উঠেছে। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতটা জেনে আসি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
‘বলশেভিক অর্থনীতি সম্বন্ধে আমার মত কী, এ কথা অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে থাকেন। আমার ভয় এই যে, আমরা চিরদিন শাস্ত্রশাসিত পান্ডাচালিত দেশ, বিদেশের আমদানি বচনকে একেবারেই বেদবাক্য বলে মেনে নেবার দিকেই আমাদের মুগ্ধ মনের ঝোঁক। গুরুমন্ত্রের মোহ থেকে সামলিয়ে নিয়ে আমাদের বলা দরকার যে, প্রয়োগের দ্বারাই মতের বিচার হতে পারে। এখনও পরীক্ষা শেষ হয়নি।’
প্রয়োগই অর্থনৈতিক মত কার্যকর কিনা তা যাচাই করার মোক্ষম উপায়, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রয়োগকর্তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সময় দিতে হবে বৈকি। পরীক্ষায় ভুল প্রমাণিত হলে নতুন পথের খোঁজে বেরোতে হবে- এই ছিল লেনিনের, বুখারিনের, রবীন্দ্রনাথের এবং বঙ্গবন্ধুরও মত। পরিবর্তনের ধারাতেই ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্র’কে দেখতে হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো পূর্বনির্ধারিত ‘মডেল’ ধরে বঙ্গবন্ধু অগ্রসর হতে চাননি। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধানের ওপরে চূড়ান্ত ভাষণে মুজিব তুলে ধরলেন তার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
‘এখন আমাদের একটা স্লোগান। আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪টা স্তম্ভ। আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। …এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ। দ্বিতীয় স্তম্ভ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না। এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। …কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সে দেশে গণতন্ত্র নেই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্রকে কায়েম করব। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। …গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে। চতুর্থত, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। … এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। … সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ।’ -বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে (১৯৭২ সালের ৭ জুন)
১. অন্য ধরনের সমাজতন্ত্র
‘আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪টা স্তম্ভ’- চার দফাই বলা যায় একে। দফাগুলো হচ্ছে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি আপ্তবাক্যের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক নতুন ‘প্যারাডাইমের’ জন্ম দিলেন। ১৯৭১ সালের পূর্বে ছিল ৬ দফার সংগ্রাম; ১৯৭১ সালের পরে শুরু হয়েছে ৪ দফার সংগ্রাম। সমাজতন্ত্র চাই সেই সাথে চাই গণতন্ত্রও। লিবারেল ডেমোক্রেসির সাথে সমাজতন্ত্রের সমন্বয়। অবাধ ধনতন্ত্রের পথেও হাঁটবো না, আবার একনায়কত্বশীল সমাজতন্ত্রের পথেও হাঁটবো না। এ দুয়ের মাঝামাঝি পথ ধরে চলব। জাতীয়তাবাদ চাই, কিন্তু সেই সাথে চাই ধর্মনিরপেক্ষতাকেও। তাহলে জাতীয়তাবাদ উগ্র আকার ধারণ করবে না, সাম্প্রদায়িকতা শাখা খুলতে পারবে না। যখন বলছেন যে এই সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র, তখন তিনি সমাজতন্ত্রকে আসলে প্রোথিত করছেন বাংলার সভ্যতায়- বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যে। কিন্তু সেই সাথে এ কথা ভুলে যাননি বাইরের দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক চর্চার প্রধান সমস্যা। সেখানে গণতন্ত্রের বা লিবারেল ডেমোক্রেসির অনুশীলন নেই। সেখানে মানব প্রকৃতিকে অস্বীকার করা হচ্ছে। একই সাথে ‘চারটি দফা’ দেওয়া শুধু নয়- একই সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন চার চারটি ফ্রন্টে। প্রথম ফ্রন্টের লড়াইয়ে বাঙালি মুসলিম ও অমুসলিমকে বলছেন- তুমি গোটা বাঙালি ‘সভ্যতার’ উত্তরাধিকারী হও। তুমি হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যের সমান অংশীদার। এবং সে জন্যই শ্মশান-বাংলাকে ‘সোনার বাংলা’ করার জন্য বেছে নিয়েছেন ষাটের দশকের একটি বহুল ব্যবহূত গান- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ দ্বিতীয় ফ্রন্টের লড়াইয়ে শোষক ভূস্বামী, পুঁজিপতি ও আমলা শ্রেণিকে বলছেন- এবার ক্ষান্ত হও। অন্যায়ভাবে আর দেশের বাইরে উদ্বৃত্ত পাচার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অনুপার্জিত অর্থ আহরণ করতে দেব না। নৈসর্গিক বৈষম্যের অতিরিক্ত কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রশয় দেব না; অন্যদের দারিদ্র্যে রেখে ধনীদের আমি আর ধনসম্পদ বাড়াতে দেব না। ‘বাংলার কৃষক, মজুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এ দেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।’ তৃতীয় ফ্রন্টের লড়াই হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা তথা ‘লিবার্টি প্রিন্সিপালকে’ ঘিরে। শুধু ভোটের অধিকার নয়, যুক্তিসঙ্গত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বাকস্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ সংগঠন করার মতো মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা চাই। একই সাথে রাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্রায়ণ’- ক্রমান্বয়ে বিচার ও নির্বাহী বিভাগের পৃথকীকরণ, স্থানীয় গণতন্ত্রের বিকাশ, সংসদকে সার্বভৌম করে গড়ে তোলা। লড়াইয়ের চতুর্থ ফ্রন্টও খুলেছেন তিনি। ধর্মের ভিত্তিতে সাতচল্লিশের দেশ-ভাগের ইতিহাসকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে চান তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করতে চান। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা তার মনে খুবই জীবন্ত। গণতান্ত্রিক কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম হলেই পাকিস্তান সরকার বলে বেড়াত- ‘ইসলাম বিপন্ন’। সর্বত্র ভারতের ‘ষড়যন্ত্রের হাত’ আবিস্কার করা হতো। সে জন্যই বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার একটা মানে আছে। এর মানে হলো, সকলের যার যার ধর্ম পালনের অধিকারের পাশাপাশি কাউকেই ‘ধর্মের নামে রাজনীতি’ করতে দেওয়া হবে না। কাউকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। মুজিব বরাবর স্পষ্টভাষী, সোজা-সাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করেন। এই বিষয়ে তাকে টলানো যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, তখনও বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়নি। ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কেবল। এটি চূড়ান্ত হতে হতে ওই বছরের নভেম্বর হয়ে যাবে। বাহাত্তরের সংবিধান গৃহীত হবে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর, আর কার্যকর হবে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। এই সংবিধানের Preamble-এ ঘোষিত হবে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব ঘোষিত চার দফা বা ৪ স্তম্ভের কথা, -অবিকল ১৯৭২ সালের ৭ জুনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ভাষণে বিবৃত পর্যায়ক্রমতা রক্ষা করে। প্রথমে আসবে জাতীয়তাবাদ, পরে সমাজতন্ত্র, তারপরে গণতন্ত্র এবং সবশেষে, ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চারটি আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও একত্রিত করেছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। এ জন্যই এদের স্থান হয়েছে প্রারম্ভিকীতে (Preamble)। এটা একান্তভাবেই বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্ভাবন, পৃথিবীর অন্য কোনো সংবিধানে নেই। এমনকি ড. আম্বেদকরের নেতৃত্বে পাঁচ বছর ধরে তৈরি করা ভারতীয় সংবিধানের ঘোষণাপত্রে কোথাও ‘সমাজতন্ত্র’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ছিল না। ১৯৭৬ সালে এসে ৪২তম সংশোধনীর দ্বারা (তখন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামল)। এই দুটি শব্দ ভারতীয় সংবিধানের প্রারম্ভিকীতে (Preamble) সংযোজিত হয়। পারস্পরিক প্রভাবের প্রশ্নই যদি ওঠে, এ ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেনি, বরং বাংলাদেশই ভারতকে প্রভাবিত করেছে। উভয় দেশের প্রতিতুলনাটি সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরা হলো :
বাংলাদেশ (১৯৭২) : ‘Pledging that the high ideals of nationalism, socialism, democracy and secularism, which inspired our heroic people to dedicate themselves to, and our brave martyrs to sacrifice their lives in the national liberation struggle, shall be the fundamental principles of the constitution.’
ভারত (১৯৫১) : ‘We, the people of India, having solemnly resolved to constitute India into a sovereign democratic republic and to secure to all its citizens : Justice, social, economic and political; Liberty of thought, expression, belief, truth and worship; Equality of states and opportunity; and to promote among them all Fraternity assuring the dignity of the individual and the unity of the Nation.’
ভারত (১৯৭৬-২০১৫) : ‘We, the people of India having solemnly resolved to constitute India into a sovereign socialist secular democratic republic and to secure to all its citizens : বাদ বাকি অংশ আগের উদ্ৃব্দতিটির মতোই।
এখানে এ-ও বলা দরকার, শুধু যে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ভারতীয় সংবিধানের আদিরূপে ছিল না, তা-ই নয়। সেখানে বিধৃত নীতিমালা ও আদর্শ- যার মধ্যে রয়েছে ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক তিনটি আদর্শ যথাক্রমে লিবার্টি, ইকুয়ালিটি ও ফ্রেটারনিটি- কোনোটিকেই সংবিধানের ‘মৌলিক নীতিমালা’ ( Fundamental Principles ) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাড়তি যে চতুর্থ আদর্শটি (অর্থাৎ Justice ) সংযোজিত হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানের Preamble-এ সেটিও এই স্বীকৃতি পায়নি। সেদিক থেকে দেখলে দেখা যায় যে, নেহরু-আম্বেদকরের সংবিধানের থেকে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধান ছিল অনেক বেশি প্রাগ্রসর চিন্তার ফসল। আমরা শুধু চারটি আদর্শকে চারটি স্তম্ভ হিসেবেই ঘোষিত করিনি; এগুলোকে ‘মৌলিক নীতিমালা’ হিসেবেও গ্রহণ করেছি। এর অর্থ, এ দেশ যতদিন থাকবে তার প্রতিটি নিয়ম ও আইন-কানুন এই মৌলিক নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, বাহাত্তরের সংবিধানের তুলনামূলক প্রাগ্রসরতার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নিজের অবদান কতটুকু? তথ্য-উপাত্ত বিচার করে দেখছি যে, এই সংবিধানের Preamble-এর মধ্যে বিধৃত চার দফা, ৪ স্তম্ভ বা আদর্শ প্রায় সর্বাংশেই বঙ্গবন্ধুর অবদান। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের আগেই মুজিব এই মৌলিক ফর্মুলেশন করেছিলেন। এই ৪ স্তম্ভের সর্বপ্রথম উল্লেখ তিনি করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু তখন লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে স্টপ-ওভার করেছিলেন। সেই যাত্রা বিরতিরকালে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় উঠে এসেছিল মূল আদর্শের কথা:
‘আমি বিশ্বাস করি, সেকুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোস্যালিজমে।’
এরপর ১০ জানুয়ারি যখন মুক্ত স্বদেশে পা রাখলেন, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই ঐতিহাসিক ভাষণে প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে উচ্চারিত হলো চার স্তম্ভের কথা :
‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’
এর এক মাস পরই ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে জনসভায় এই একই কথা আরও স্পষ্ট করে বললেন:
‘বাংলাদেশ চারটি স্তম্ভের ওপর চলবে- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এর মধ্যে কোনো কিন্তু ফিন্তু নাই। এর মধ্যে কেউ হাত লাগাতে পারবে না। এটা সোজাসুজি আমরা করব। আর আপনারা জানেন আমি সোজা মানুষ, সোজা কথা বলি, যা বলি যেটা বলি, যেটা বুঝি এবং সেটা করি। এর মধ্যে আমি ভয়ও করি না কাউকে এবং করবও না। আমার সোনার বাংলা সত্যি আমার সোনার বাংলা। তাই আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত করেছি- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় বড় ভালোবাসি।’
এরপর থেকে যতবারই রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রশ্ন উঠেছে, আমৃত্যু তিনি তার বিশ্বাসের চার জায়গার কথাই বলে গেছেন।
এই চারটি আদর্শের মধ্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় (একইভাবে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি পরস্পরের সীমানা বেঁধে দিয়েছে)। একই সাথে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে পেতে চাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে গভীর মৌলিক উপলব্ধি কাজ করে থাকবে। মুজিব প্রথাগত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছিলেন। কোনো বামপন্থি বা কমিউনিস্ট আন্দোলন বা সংগঠন থেকে উদ্ভূত হননি। তাহলে তিনি কেন সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং কেন গণতন্ত্রকে সমাজতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হিসেবে ভেবেছিলেন, এটা বোঝাটা জরুরি। কেউ বলতে পারেন যে তিনি আসলে ছিলেন একজন আপাদমস্তক ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’। শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি বটে, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষাকে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির (বা ‘সামাজিক গণতন্ত্র’)। অনুবর্তী মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংসস্থান প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন যেন সকল মানুষের করায়ত্ত হয়। এর জন্য রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ভূমিকা প্রয়োজন। এটা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ‘সোশ্যাল’ দিকটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার, মানুষ শুধু অন্নে-বস্ত্রে বাঁচে না, তার দরকার ব্যক্তিস্বাধীনতাও। ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধ। এটা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ‘ডেমোক্রেসি’ দিকটির কথা মনে করিয়ে দেয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ। প্রথাগত রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের ( state socialism ) মডেল প্রায় কোথাও নেই আজ, অন্যদিকে অবাধ ধনবাদী বিকাশের ‘নিওলিবারেল’ পথ একের পর এক সংকটের জন্ম দিয়ে চলেছে গোটা বিশ্বে। বৈষম্য বাড়ছে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, গণতন্ত্র নানা দেশে পিছু হটছে, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত, পরিবেশ বিপর্যস্ত। এক কথায় ব্যক্তিস্বার্থের পুঁজিবাদ গণতন্ত্র ও মানবকল্যাণের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। সেদিনও কি এ বিষয়গুলো এতটা স্পষ্ট ছিল আজকের মতো? অথচ এই দুটো প্রবণতাই ষাটের দশকেই বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনীতি সচেতন সহকর্মীদের চোখে পড়েছিল (আমি এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন প্রমুখের কথা উল্লেখ করতে চাই)। হয়তো সে কারণেই সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র উভয় আদর্শের একত্র-সমাবেশকেই তারা নতুন সমাজ-রাষ্ট্রের একান্ত পূর্বশর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। হাংগেরি-চেকোশ্নোভাকিয়ায় গণ-অসন্তোষ দমনে সোভিয়েতের ট্যাংক গিয়েছিল- সেটা সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ভিয়েতনামে-কম্বোডিয়ায় মার্কিন সামরিক আগ্রাসন এক দশকব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। সেটা উদার পুঁজিবাদের যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে ফেলেছিল। গণচীন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াল না এবং এর আগেও ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আয়ুব’ নীতি থেকে দেশটি সরে আসেনি তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। অর্থাৎ পুঁজিবাদী-সমাজতন্ত্রী দুই শিবিরেই পদস্খলন ঘটেছে এটা তত্ত্ব দিয়ে না হোক, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা তখন অনুধাবন করে থাকবেন। ফলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই দুই বিরোধী সত্ত্বাকে এক সূত্রে গাঁথার রাজনৈতিক-দার্শনিক অভিপ্রায় সেকালের (এবং একালের) বিচারে দুঃসাহসিকভাবে মৌলিক প্রস্তাব বলে মনে হতে পারে। বাস্তবে এর নির্মাণের অভিজ্ঞতা যা-ই হোক, এর চিন্তার মৌলিকত্ব ও সাম্প্রতিক তাৎপর্যকে আমরা কোনো মতেই অস্বীকার করতে পারি না। স্বাধীনতার সেই ঊষালগ্নেই সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এই দুই বিপ্রতীপ সত্ত্বাকে মেলানোর কথা তারা বলেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত প্রস্তাব’-এর ওপরে আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধান রচনার মূল দিকনির্দেশনা দিয়ে গেলেন। সংবিধানের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধারা-উপধারা পরবর্তীতে অনেক কিছু সংযোজিত হবে, কিন্তু আদি দিকনির্দেশনা এসেছিল তারই কাছ থেকে। উদ্ৃব্দতিটি প্রাসঙ্গিক মনে করছি এখানে :
‘জনাব স্পিকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। … আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’
এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনই স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব গৃহীত হলো, যার শেষ স্তবকে বাংলাদেশের সমগ্র মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে চার স্তম্ভের কথা উল্লিখিত হলো এভাবে :
‘এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।’
২. বাঙালির সাম্য চিন্তা ও বঙ্গবন্ধু
অনুন্নত দেশের পটভূমিতে মুজিব প্রায় দুই অসম্ভব আদর্শ তথা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে এক সূত্রে বাঁধতে চাইলেন। আপাতদৃষ্টিতে এটি তত্ত্ববিরোধী অসম্ভব প্রস্তাব। বুর্জোয়া বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরেই পূর্ণ গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব হয়, এরিস্টটল থেকে হবস ও মিল প্রমুখ মনীষীর এ-ই ছিল মত। অন্যদিকে মার্কস স্বয়ং ভেবেছিলেন যে, পুঁজিবাদের পরিণত বিকাশের স্তরেই কেবল সমাজতন্ত্রের প্রকৃত অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়া সম্ভব হয়। পরে লেনিন এই মত থেকে সরে আসলেও ভাবতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র গড়তে এক-দুই দশক নয়, প্রায় ষাট-সত্তর বছর লেগে যেতে পারে। সে তুলনায় বাংলাদেশ তো ১৯৭২ সালে ছিল বিকাশের অনেক নিচু পর্যায়ে। তার ওপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবকাঠামো প্রায় পুরোটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এ রকম পর্যায়ে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের কল্পনা করাও সহজ নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তরের সংবিধানের আদি রূপকারেরা এটা সম্ভবপর বলে ভেবেছিলেন এবং একটি আদর্শের জন্য অন্য আদর্শটিকে তারা পরিত্যাগ করতে চাননি।
এ ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, বঙ্গবন্ধু ও তার কাছের বৃত্তের আদর্শ-সচেতন সহকর্মীরা যদি গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই চাইলেন তাহলে তারা সমাজতন্ত্রের ধারণার আরেকটু স্পষ্টতর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ দিলেন না কেন? তাদের কাছে তো দুটিই পথই খোলা ছিল থিওর্যাটিক্যালি। একটি হলো ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বেরিয়ে আসা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ পথ। নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন- এসব দেশের ‘সামাজিক গণতন্ত্র’ বাহাত্তরের সংবিধান রচনাকালে কিছুটা হলেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব উন্নত দেশের সায়ের-সুবোদের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর মডেল অনুন্নত কৃষি বা কৃষক-প্রধান বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে প্রচণ্ড সংশয় ছিল সংবিধানের রূপকার ও পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত তারা ওয়েলফেয়ার স্টেটকে উন্নত পুঁজিবাদের মডেল হিসেবেই দেখেছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানের একটা বড় বিশেষত্ব ছিল এর কোথাও একবারের জন্য হলেও পুঁজিবাদের প্রশংসা করা হয়নি বা সাফাই গাওয়া হয়নি। অথচ ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দের ব্যবহারে কোথাও কোনো কুণ্ঠাবোধ দেখা যায় না। বোঝা যায়, সার্বিকভাবে সেদিনের গণপরিষদে সমাজতন্ত্রের পক্ষে একটা নিরঙ্কুশ সমর্থন বিরাজ করছিল। যেটা আজকের অবস্থান থেকে দুর্বোধ্য ঠেকবে। বরং পুরো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ফর্মুলা নিয়েই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ ছিল সকলের। খসড়া সংবিধানের ওপরে আলোচনা করতে গিয়ে এম মনসুর আলী (১৯৭৫ সালে জেলে চার শহীদ নেতার এক নেতা) বলেছিলেন, ‘একমাত্র বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে এই যে গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান এবং অগ্রসর হওয়া এটা সম্ভব। … সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যদি গণতন্ত্র না থাকে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে প্রকৃত সমাজতন্ত্র হতে পারে না। কারণ সমাজতন্ত্রের মূল ভিত্তি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ এ ধরনের চিন্তা ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম ধারার থেকে অনেক দূরে।
অন্য অর্থটি হলো, অনুন্নত দেশের পটভূমিতে এক ধরনের সমাজতন্ত্র অভিমুখীনতার পথ। যেটার শুরু হতে পারত, লেনিনীয় ধারার ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ (বা NEP ) দিয়ে। গৃহযুদ্ধের পরে রাশিয়ায় লেনিন ১৯২১ সালে উপলব্ধি করেন যে, পুঁজিবাদকে আংশিক পুনরুজ্জীবন করা ছাড়া, কৃষকদের ব্যক্তি উদ্যোগকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ওপরে নির্ভর করে সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়া যাবে না। রাশিয়ার ক্ষেত্রেই যদি এই উপলব্ধি হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী অনেকাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশে শিল্প-ব্যবসা খাতে পুঁজিবাদের আংশিক পুনরুজ্জীবন ছাড়া, গ্রাম ও কৃষকমুখী কর্মোদ্যোগ ছাড়া, সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া কী করে সম্ভব? তদুপরি, রাষ্ট্রায়ত্ত খাত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ‘ম্যানেজেরিয়াল ক্লাস’ তখনও পর্যন্ত গড়ে তোলা যায়নি, শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করে দক্ষ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার প্রাগ্রসর সহকর্মীরা এসব সমস্যা সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন না। এ জন্যই ১৯৭৪ সালেই বেসরকারি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ‘নিউ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট পলিসি ১৯৭৪’-এর মাধ্যমে পূর্বেকার ২৫ লাখ থেকে ৩ কোটি এবং পরবর্তী সময় ১০ কোটিতে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আজকের মূল্যমানে সিপিআই ধরে হিসাব করবে এটা অন্তত ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী হাতে নেওয়ার এক বছরের মধ্যেই বেসরকারি শিল্প-বাণিজ্য বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছিল। নতুন বেসরকারি খাত বা বিনিয়োগকে কোনোভাবেই নিরুৎসাহিত করা হয়নি। পরিকল্পনাবিদরা মেনে নিয়েছিলেন যে, পুঁজিবাদের আংশিক পুনরুজ্জীবন ছাড়া সমাজতন্ত্র-অভিমুখীন কৃষি-প্রধান অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যাবে না। এ জন্যই সংবিধানের ১৩নং ধারায় উপস্থাপন করা হয়েছিল ‘মিশ্র-অর্থনীতি’র কাঠামো, যেখানে ছিল তিন ধরনের মালিকানা-সম্পর্কের উপস্থিতি- রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিমালিকানা। সুতরাং লেনিনীয় নিউ ইকোনমিক পলিসির দৃষ্টিকোণ থেকেও বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের অর্থনৈতিক দর্শনে ‘সেন্স অব রিয়ালিজম’-এর কোনো খামতি ছিল না। তা-ই যদি হয় তবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পথকে নিছক একটি ‘মিশ্র-অর্থনীতি’ (Mixed Economy) ধারার ব্যবস্থা বলতে বাধা ছিল কোথায়? যে দল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে একত্রে পেতে চায়, যে দল বিভিন্ন মালিকানার মিশ্রণকে মেনে নেয়, তার পক্ষে ‘মিশ্র অর্থনীতি’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করাই ছিল প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক পদক্ষেপ।
এর একটি উত্তর ড. কামাল হোসেন আমাকে দিয়েছেন। তার উত্তর ছিল, গণতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্র মিলিয়ে যে সমাজ ব্যবস্থা আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলাম, সেটাকে শুধু ‘মিশ্র অর্থনীতি’ বলা আমাদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। সেভাবে দেখলে তো পৃথিবীর প্রায় সব ধারার দেশই ‘মিশ্র অর্থনীতির’ দেশ : ‘We did not use the term mixed economy as it does not spell out specifically the objectices and time periods during which these goals were to be pursued’. আমি তাকে অবশ্য জিজ্ঞেস করলাম, কী করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এত নিশ্চিতভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ‘সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভবপর হয়েছিল? কী করে এত দ্বিধাহীনভাবে ‘সমাজতন্ত্রের’ পক্ষে সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার কাছের বৃত্তের নেতৃত্ব দাঁড়াতে পেয়েছিলেন? বাহাত্তরের খসড়া সংবিধান প্রস্তুতের ক্ষেত্রে অন্যতম মূল ভূমিকা ছিল যার, সেই ড. কামাল হোসেন যে উত্তর দিয়েছিলেন আমাকে তা বর্তমান আলোচনার জন্য পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :
‘The Political discourse in the late Fifties and Sixties gave importance to political Freedom but emphasized that such freedom would not lead to concentration of Economic Power in the hands of a privileged elite.’
এর থেকে ধারণা করি যে, গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্র হচ্ছে সেই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থা, যেখানে কোনো সুবিধাভোগী এলিটের কাছে অর্থনৈতিক বিত্ত ও ক্ষমতা ঘনীভূত ও কেন্দ্রীভূত হতে দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে এই অবস্থায় সাধারণ আপামর জনগণের মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদা যথা- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করা হবে। মোটামুটি এই দাঁড়ায় তাহলে ‘Socialist orientation within a democratic framework’ বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কেজো সংজ্ঞা।
এই সংজ্ঞায় বঙ্গবন্ধুর কোনো আপত্তি ছিল না অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন- তা সে শিল্প-বাণিজ্য খাতে ‘বাইশ পরিবার’ সৃষ্টির মাধ্যমেই হোক, বা কৃষি খাতে জমিদার-জায়গিরদার শ্রেণি সৃষ্টির সুবাদেই হোক- তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন গোড়া থেকেই সোচ্চার। জমিদার-জায়গিরদার শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি সম্পর্কে পাকিস্তান পার্লামেন্টে উত্থাপিত সংবিধানের খসড়ার ওপরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ১৯৫৬ সালে মুজিব বলেছিলেন যে, পাকিস্তানে এ রকম সামন্তবাদের কোনো স্থান নেই। যেখানে এসব বৃহৎ ভূস্বামীরা তাদের প্রতিপত্তি বাড়িয়েই চলেছে, অথচ সাধারণ চাষিরা খেটেই মরছে। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশেই এই বৃহৎ ভূস্বামী শ্রেণি নানাভাবে তাদের প্রভাব খাটাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানে এদের প্রভাব এখন আরও অনেক বেশি। এর জন্য তিনি ইসলামী ন্যায়-নীতির দ্বারস্থ হলেন। সামন্তবাদবিরোধী সমতাবাদী চিন্তার বিকাশের জন্য মুজিবের বক্তব্য থেকে পুরো উদ্ৃব্দতিটা তুলে ধরতে চাই। বৃহৎ ভূস্বামীরা কী করে পারেন তাদের সামন্তবাদ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ইসলামিক ন্যায়-নীতিভিত্তিক কোন যুক্তি দিতে? এই প্রশ্ন রাখলেন তিনি। আর তাদের জমির ওপরে সর্বোচ্চ মালিকানার ‘সিলিং’ দিয়ে যে পরিমান উদ্ৃব্দত জমি পাওয়া যাবে তা তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়েই কেবল নেওয়া যেতে পারে- এই যুক্তির সাথেও সহমত হলেন না তিনি। ‘মার্কেট-বেইজড কোন ক্ষতিপূরণ কীভাবে আর্থিকভাবে ক্ষতি ‘সাসটেইন’ করা সম্ভব? এই ছিল মুজিবের যুক্তি। এই যুক্তিকে নানা দেশের ভূমি-সংস্কারের অভিজ্ঞতাও সমর্থন করে। পুনর্বণ্টনমূলক কর্মসূচি ‘নন-মার্কেট’ নীতিমালার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়েছে রাশিয়ায়, চীনে, ভিয়েতনামে, এমনকি পাশের দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যে। মুজিব সেদিন বলেছিলেন, পাঞ্জাবে, ফ্রন্টিয়ার প্রদেশে, সিন্ধু প্রদেশে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে যেদিকে দু’চোখ যায় কেবল একজন বা দু’জন ভূস্বামীরই সম্পতি নজরে পড়ে। এটা কীভাবে ইসলামের ন্যায়-নীতি (বা সাম্যের যে কোনো ন্যায়-নীতির) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ÔCan they produce anything to support them in their feudalism of jagirdaris and zamirdaris; [They say] “Nobody can take the property of a zamindar without providing Compensation”? Who will give the compensation- the people who have tilled and toiled… Islam means equal distribution of wealth. Do they contemplate distributing the wealth of the country to the poor cultivators? What do we find in the punjab, Frontier and in sind? You tour for a whole day and you see the property of one man. Whose property- Talpur’s property; whole property- Daultana’s property; Mian Iftikharuddin’s property. It is not the property of the man who works on the field; it is not the property of the poor “Mussulman”.
কৃষিতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন (concentration) বা সামন্তবাদের বিরুদ্ধে মুজিবের স্পষ্ট অবস্থান একদিক থেকে দেখলে আমাদেরকে বঙ্কিমের সাম্য-চিন্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে বঙ্কিম লিখেছিলেন : “জীবের শত্রু জীব; মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য; বাঙ্গালী কৃষকের শত্রু বাঙ্গালী ভূস্বামী। ব্যাঘ্রাদি বৃহজ্জন্তু, ছাগাদি ক্ষুদ্র জন্তুগণকে ভক্ষণ করে; রোহিতাদি বৃহৎ মৎস্য, সফরীদিগকে ভক্ষণ করে; জমিদার নামক বড় মানুষ, কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষণ করে।” পরবর্তীতে ‘সাম্য’ প্রবন্ধে ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশোর Le Contract social গ্রন্থের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, ‘এ দেশে এবং অন্য দেশে সচরাচর সম্পত্তি ব্যক্তিবিশেষের। আমার বাড়ি, তোমার ভূমি, তাহার বৃক্ষ। কিন্তু ইহা ভিন্ন আর কোনো প্রকার সম্পত্তি হইতে পারে না, এমত নহে। ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি না হইয়া, সর্বলোক সাধারণের সম্পত্তি হইতে পারে। এই সর্বলোক পালিকা বসুন্ধরা কাহারও একার জন্য সৃষ্ট হয় নাই বা দশ পনের জন ভূম্যধিকারীর জন্য সৃষ্ট হয় নাই। অতএব ভূমির উপর সকলেরই সমান অধিকার থাকা কর্তব্য।’ রুশোর এ চিন্তা স্বাধীনতার-পরবর্তী ভূমি-সংস্কারের চিন্তার পেছনে পরোক্ষভাবে তাত্ত্বিক যুক্তি দেখিয়ে থাকবে পরোক্ষভাব- কেননা রুশোর প্রভাব যেমন পরেছিল ফরাসি বিপ্লবের ওপরে, তেমনি মার্কস ও পরবর্তী যুগের সমাজতন্ত্রীদের ওপরে। বঙ্কিম লিখেছিলেন, ÔLe Contract social গ্রন্থের চরম ফল ষোড়শ লুইর সিংহাসন চ্যুতি এবং প্রাণদণ্ড। ফরাসি বিপ্লবে যাহা কিছু ঘটিয়াছিল, তাহার মূল এই গ্রন্থে।’ শুধু এখানেই রুশোর প্রভাব সীমিত নয় : “কিন্তু ‘ভূমি সাধারণের’ এই কথা বলিয়া রুশো যে মহাবৃক্ষের বীজ বপন করিয়াছিলেন, তাহার নিত্যনতুন ফল ফলিতে লাগিল। অদ্যপি তাহার ফলে ইউরোপ পরিপূর্ণ। ‘কম্যুনিজম’ সেই বৃক্ষের ফল। ‘ইন্টারন্যাশনল’ সেই বৃক্ষের ফল।” একাধারে রুশো ও জন স্টুয়ার্ট মিলের ভাবশিষ্য বঙ্কিম ‘কম্যুনিস্ট’ ছিলেন না। তিনি ছিলেন- আজকের যুগের নিরিখে একজন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী। মুজিব চিন্তা-চেতনায় (এবং বাস্তব কাজে) কতিপয় এলিটের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন যথাসাধ্য। এ কাজে তার সফলতা এসেছিল কতটুকু, সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তিনি সর্বাংশ সফল হতে পারেননি বা তাকে সফল হতে দেওয়া হয়নি- এই বিতর্ক আজও আমাদের ক্ষত-বিক্ষত করে। কিন্তু তার আন্তরিকতায় কোনো খামতি ছিল না। পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক বিত্ত ও ক্ষমতা একশ’ বা হাজার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাক- এটা তিনি কখনও চাননি। এ ব্যাপারে তার নিজের মনে এবং কর্মপরিকল্পনায় কোনো সংশয় ছিল না। তিনি বঙ্কিমের মতো রুশো বা মিলকে সাক্ষী মানেননি, বা কমিউনিস্টদের মতো মার্কস বা মাও থেকে উদ্ৃব্দতি দেননি (যদিও আমরা পরে দেখাব যে তাঁর বাহাত্তরের সংবিধানে লিবারেল ও সোশ্যালিস্ট এমন অনেক চিন্তারই ছাপ রয়ে গেছে)। মুজিব এসব থিওরির জল-হাওয়াতেই মানুষ বা এসব থিওরি থেকে উদ্ৃব্দতি দেওয়া মানুষদের কাছের বৃত্তেরই মানুষ ছিলেন। সমাজতন্ত্রের বণ্টন-নীতি- ‘সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রম অনুযায়ী বণ্টন’- বাহাত্তরের সংবিধানের ২০নং আর্টিকেলে স্পষ্ট করে লেখা আছে : ‘Work is a right, a duty and matter of honour for every citizen who is capable of working and everyone shall be paid for his work on the basis of the principle from each according to his abilities, to each according to his work’.
এই বণ্টন-নীতিটি হুবহু মার্কসের ‘ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম’ রচনা থেকে নেওয়া। ভারতীয় সংবিধানে ফরাসি বিপ্লবের লিবার্টি, ইকুয়ালিটি ও ফ্রেটারনিটির কথা আছে, কিন্তু মার্কসের শ্রম অনুযায়ী বণ্টন-নীতির কোনো উল্লেখ কোথাও নেই। এই তাৎপর্যপূর্ণ বণ্টন-নীতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর সাম্য-চিন্তায় পূর্ণ সমর্থন ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, বাহাত্তরের সংবিধানে এই বণ্টন-নীতির প্রতি এতদিন সেভাবে আলোকপাত করা হয়নি। যারা ইতোপূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার ‘সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি’ নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাদের অনেকেরই এটি দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্কিমের মতো করে রুশো-মিল না আওড়ালেও বঙ্গবন্ধু প্রায় নিঃশব্দে সামাজিক ন্যায়ের (Social Justice) একটি নতুন ঐতিহ্য রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। এক হিসেবে, তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের আদর্শ সচেতন সহকর্মীরা (তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন প্রমুখ) জাঁ জাক রুশো, জন স্টুয়ার্ট মিল ও কার্ল মার্কস- লিবারেল ও সমাজতন্ত্রী ধারার মূল চিন্তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার পরিকল্পনাবিদদের মধ্যেও (ডিগ্রির তারতম্য মেনে নিয়েই বলছি।) লিবারেল ডেমোক্রেসি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি মেলানোর আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা ছিল। তত্ত্বালাপের নিকট বৃত্তে বাস করে বঙ্গবন্ধু ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ ভবিষ্যৎকে কীভাবে দেখতেন তা নিচের উদ্ৃব্দতিগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে তিনি চটজলদি কোনো সমাধান খোঁজেননি সেটাও পরিস্কার হয়ে ওঠে। হঠকারী সমাজতন্ত্রীরা, ছদ্ম-সমাজতন্ত্রীরা যে চলার পথে সমস্যা তৈরি করছে সেটাও তিনি রাখঢাক না করেই প্রকাশ করেছেন। ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে এবং ১৯৭৪ সালের ৪ ডিসেম্বর সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস, বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র গড়ার সমস্যাকে তুলে ধরে। উদ্ৃব্দতিগুলো পর্যায়ক্রমে সাজালে তার মনের ভাবনা ও দুর্ভাবনাগুলো উপলব্ধি করা যায়। এ রকম কনফেশানস রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।
১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :
‘ছাত্র ভাইরা দেশের অবস্থা ভালো না। চোরের জ্বালায় আমি অস্থির হয়ে গেছি। যেদিকে তাকাই সেদিকে চোর দেখি। … কার কাছে ভার দেবো? যার কাছে ভার দেই, সেই করে চুরি। … আমি বাজে কথা বলি না। আমি বলেছিলাম, সোনার মানুষ দেও যদি, সোনার বাংলা গড়তে পারি। আর না হলে পারব না। শেখ মুজিবকে বাইট্টা খাওয়াইলেও হবে না। … এখানে আমাদের প্রয়োজন জনমত সৃষ্টি করা। … সমাজতন্ত্র করতে হলে ডিসিপ্লিন দরকার। … সোজা রাস্তা নাই সমাজতন্ত্রে। … আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। … শোষণহীন সমাজ, সুষম বণ্টন। সম্পদের মালিক জনগণ, তোমরা তা বিশ্বাস কর। সোজা পথ নাই- অনেক রাস্তা আছে, যেতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধের পরের দু-তিন বছরে পুরোনা সমাজ-কাঠামো ও মূল্যবোধ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। এর ফলে একদিকে যেমন দেখা দিয়েছিল নতুন আদর্শগত ও প্রগতিশীল রূপান্তরের সম্ভাবনা, তেমনি অন্যদিকে দেখা দিচ্ছিল নেতিবাচক দিকগুলো। মুজিবের কথাই অন্যভাবে- অন্য এক পরিস্থিতিতে- প্রকাশ করেছিলেন লেনিন ইতোপূর্বে ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে:
‘All the elements of disintegration of the old society … are bound to ‘reveal themselves’ during such a profound revolution. And these elements of disintegration cannot ‘reveal themselves’ otherwise than in an increase of crime, hooliganism, corruption, profiteering and outrage of every kind. To put these down requires time and requires an iron hand.’
কিন্তু ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধু ্তুরৎড়হ যধহফ্থর রক্ষায় অগ্রসর হতে পাননি। তিনি লিবারেল ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করেন, তিনি ইমার্জেন্সিতে বিশ্বাসে করেন না। কিন্তু উদারনৈতিকতাবাদ উপজীব্য করে কত দিন চলতে পারবেন, এ নিয়ে এরই মধ্যে তাঁর মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। সেদিনের ছাত্র-সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘… স্বাধীনতা নাই’ এখন খবরের কাগজে ছাপে, কিন্তু দুঃখের বিষয় বলতে হয়, আজও ইমার্জেন্সি পাকিস্তানে আছে। আজও ইমার্জেন্সি ভারতবর্ষে আছে। কিন্তু আমি শেখ মুজিবুর রহমান, আমার সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে বলেই তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র দিয়েছি। কিন্তু ইমার্জেন্সি দেই নাই। … যা আছে সম্পদ, বাংলার মানুষের। তা যদি ভাগ করে দেই এবং তা-ই ভাগ ভাগ কইরা মিল্লা মিশ্যা খেতে হবে আমাদের।’
[ক্রমশ]
মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল
পর্ব :: ৫৫
পূর্বে প্রকাশিতের পর
১৯১৯ সালে লেখা ইয়েটস্-এর ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ তার বিখ্যাত কবিতাগুলোর একটি। আদি-খসড়ায় এর নাম রাখা হয়েছিল ‘দ্য সেকেন্ড বার্থ’- দ্বিতীয় জন্ম বা পুনর্জন্ম। কবিতাটির সাথে ১৯১৮-১৯ সালের স্পেনিশ ফ্লু-র সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। কবিতাটি লেখার কয়েক সপ্তাহে আগে ইয়েটস্-এর স্ত্রী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে উপনীত হন। তার স্ত্রী যখন জ্বরে কাঁপছিলেন, তখনই তার মাথায় ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’-এর আইডিয়াটা আসে। এর বিখ্যাত শুরুর চরণগুলি পাঠকদের কাছে অতি-পরিচিত-জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ ইয়েটস্-এর এই কবিতার প্রতি গাঢ় অনুরাগ থেকেই নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল:
‘Turning and turning in the widening gyre
The falcon cannot hear the falconer;
Things fall apart; the centre cannot hold;
Mere anarchy is loosed upon the world,
The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere
The ceremony of innocence is drowned;
The best lack all conviction, while the worst
Are full of passionate intensity.’
এলিয়ট বা ইয়েটস্-এর কবিতায় মহামারী পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ে দুই মহাযুদ্ধের মাঝের দুই শক্তিশালী সাহিত্য-কর্মে। প্রথমটি হলো, ১৯৩৮ সালে লেখা বের্টোল্ট ব্রেখট-এর ‘লাইফ অব গ্যালিলিও’, আর ১৯৪১ সালে লিখতে শুরু করা আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ (১৯৪৭ সালে প্রকাশিত) উপন্যাস। ‘গ্যালিলিও’ ব্রেখটের শ্রেষ্ঠ নাটক, আর ‘প্লেগ’-কে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ‘সেরা উপন্যাস’ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। দুটো সম্পর্কেই একটু বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করতে চাই।
গ্যালিলিও নাটকের পটভূমি মোটামুটিভাবে সকলেরই জানা। গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমির (১০০-১৭০) সময় থেকে এই বিশ্বাস চলে আসছিল যে, পৃথিবীই স্থির হয়ে আছে- মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু আসলে পৃথিবীই আর সূর্য পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে। শুধু টলেমি হলে তাকে বাধা দেওয়া অত শক্ত হতো না, কিন্তু অ্যারিস্টটল স্বয়ং এই ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন। টলেমির তত্ত্বের পেছনে অ্যারিস্টটলের মতো একজন ক্ষমতাধর ‘অথরিটি’র সমর্থন এই তত্ত্বকে ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। চার্চও এই তত্ত্বকে সর্বাংশে গ্রহণ করেছিল- রোমক সাল্ফ্রাজ্যের পতনের পরে যখন খ্রিষ্টধর্ম পরাক্রমশালী হয়ে দাঁড়ায় আদি মধ্যযুগে। তা ছাড়া, সূর্য যে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে- এটা তো প্রতিদিনের নিত্য অভিজ্ঞতার সাথে মেলে। আমরা কি প্রতিদিন এটাই দেখি না যে, সূর্য ‘ভোরে উঠছে’ আর সন্ধ্যাবেলায় ‘অস্ত যাচ্ছে’। বহুকাল পরে মার্কস এই সূর্য-প্রদক্ষিণের উদাহরণ টেনে অবশ্য বলবেন যে, যদি ‘অ্যাপিয়ারেন্স’ (প্রতীয়মানতা) আর ‘রিয়েলিটি’ (বাস্তবতা) একই হতো, তাহলে বিজ্ঞানের কোনো দরকারই থাকত না! ‘If appearance and reality were the same, the need for science would be superfluous। কিন্তু এ কথা গ্যালিলিওর সময়ে উচ্চারণ করা সহজ ছিল না। গ্যালিলিওর সময়কাল বলতে বোঝাচ্ছি, ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ভাগ আর সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগ (তার জন্ম ১৫৬৫, আর মৃত্যু ১৬৪২ সাল)। ব্রেখটের নাটকের প্রথম দৃশ্যের শুরু হয় ১৬০৯ সালে। আর শেষ দৃশ্য জমে উঠেছে ১৬৪২ সালকে ঘিরে। ‘গ্যালিলিও গ্যালিলি’ তার পুরো নাম। তাকে যদিও আধুনিক পদার্থ বিদ্যার জনক হিসেবে মান্য করা হয়, কিন্তু পদার্থবিদ্যা তো সেভাবে ‘শাস্ত্র’ হিসেবে তখনও গড়ে ওঠেনি। ব্রেখট তাকে দেখিয়েছেন প্রথমে পাদুয়ার (পরে ফ্লোরেন্সের) বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের একজন অধ্যাপক হিসেবেই। নাটক থেকে আমরা জানতে পারি যে, সপ্তাহে দুটো লেকচার দিতে হয় তাকে- প্রতিটা লেকচার দু’ঘণ্টা করে। এই করে যা পান, তাতে তার সংসার চলে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (Procurator)–এর অকাট্য পাল্টা যুক্তি, ‘আপনার যা খ্যাতি তাতে তো অনেক প্রাইভেট ছাত্র জোটার কথা।’ শুনে গ্যালিলিও যা বলেছিলেন তাতে করে বাংলাদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথে এক জায়গায় বড্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়:
‘Too many, sir, I teach and I teach and when am I supposed to learn?… I am stupid. I understand absolutely nothing. So I’m compelled to fill the gaps in my knowledge. And when am I supposed to do that? When am I to get on with any research? Sir, my branch of knowledge is still avid to know. The greatest problems still find us with nothing but hypotheses to go on’.
এহেন গ্যালিলিও একদিন দাবি করে বসলেন যে, টলেমির তত্ত্ব সঠিক নয়। দূরবীন ব্যবহার করে এবং অঙ্ক কষে তিনি দেখালেন যে আসলে সূর্য নয়, পৃথিবীই তার চারপাশ দিয়ে ঘরছে। সেই সাথে ঘুরছে আরও কিছু গ্রহ। এটি ছিল আদিতে কোপেরনিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) তত্ত্ব, তাকে সপ্রমাণিত করেছিলেন গ্যালিলিও একশ’ বছর পরে। এর জন্য পাদুয়া ছাড়তে হলো তাকে; কিন্তু ফ্লোরেন্সে গিয়েও তার তত্ত্ব নিরাপদ আশ্রয় পেল না। একপর্যায়ে রোমের ভ্যাটিকান চার্চে ডাক পড়ল তার। যখন কিছুতেই তাকে বাগ মানানো যাচ্ছিল না, তখন ভ্যাটিকানের পোপ বললেন, দৈহিক অত্যাচার কী করে করা হয় সেইসব যন্ত্রপাতি ওকে দেখান, তাহলেই সে বুঝতে পারবে। সংলাপটি ঐতিহাসিক :
‘The Pope: At the very most he can be shown the instruments.
The Inquisitor: That will be enough, your Holiness, Instruments are Mr. Galilei’s speciality.’
নাটকের শেষ অঙ্কের আগের অঙ্কে গ্যালিলিও তার শিষ্য অন্দ্রেয়ার সাথে কথা বলছেন। পোপের হুমকির মুখে তিনি শেষপর্যন্ত স্বীকার করে নেন যে তিনি ভুল ভেবেছেন- টলেমিই সঠিক। বিজ্ঞানকে এভাবে অস্বীকার করে ঠিক করেছিলেন কি গ্যালিলিও? এটাই এই নাটকের অন্যতম প্রধান প্রশ্ন। গ্যালিলিওর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্ররা তার পিছু হটার মধ্যে কাপুরুষতা দেখেছিলেন। গ্যালিলিও আত্মসমর্পণ করেছেন ক্ষমতার কাছে- তিনি আপসকারী, Conformist। ফলে অন্দ্রেয়ার মতো অনেক শিষ্য গ্যালিলিওকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন নজরবন্দি (এমনকি গৃহবন্দিও বলা যায় তাকে); শুধু খাবার-দাবার, আর লেখার জন্য কালি-কলম-কাগজ দেওয়া হতো তাকে, অবশ্য সে সবও ‘সেন্সসরশিপের’ মধ্য দিয়ে যেত। যেমনটা হয়েছিল মুসোলিনির জেলে আবদ্ধ গ্রামসির বেলায়। যেটা কেউই ভাবেনি- তার শত্রুরা তো বটেই, মিত্ররাও ঘুণাক্ষরে কল্পনা করেনি গ্যালিলিও এরই মধ্যে সকলের অজ্ঞাতসার রচনা করে ফেলেছেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ-Discorsi বা ‘ডিসকোর্সেস’। একটা খেলনা গোলকের ভেতরে এই রচনার পাতাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি এতদিন। অন্দ্রেয়া তার সাথে বহু বছর বাদে দেখা করতে এলে তাকে এর পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে দেন, যাতে সে হল্যান্ডে গিয়ে এর প্রকাশনার ব্যবস্থা করতে পারে। উৎফুল্ল অন্দ্রেয়া বুঝতে পারল কেন গ্যালিলিও সেদিন আরেকজন গিওরদানো ব্রুনো (Bruno) (যাকে কোপেরনিকাসের তত্ত্ব প্রচারের জন্য আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল চার্চের আদেশে) তার মতো হতে চাননি। আপস করে যে সময় পেয়েছিলেন গ্যালিলিও, সেটি তিনি ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানের কাজে। সংলাপটি তাৎপর্য্যপূর্ণ:
‘Andrea: You gained the leisure to write a scientific work which could be written by nobody else. If you had ended up at the stake in a halo of flames the other side would have won.
Galileo: They did win…
Andrea: Why did you recant, then?
Galileo: I recanted because I was afraid of physical pain.
Andrea: No!
Galileo: They showed me the instruments.
Andrea: So it wasn’t, planned?
Galileo: It was not.’
মনে হয়, গ্যালিলিও নাটকটি লিখে এক ঢিলে তিন পাখি মারতে চেয়েছিলেন ব্রেখট। প্রথমত, বিশ্বাস ও যুক্তির লড়াই যেটা আদি-মধ্যযুগ থেকেই চলছিল- সেই সামন্তবাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞান-ভিত্তিক মানবতাবাদকে ক্ষত-বিক্ষত হতে দেখানো। দ্বিতীয়ত, এই নাটকটি যখন লেখা হয়েছিল, তখন মস্কোর শো-ট্রায়ালগুলো শুরু হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য সব স্বীকারোক্তি দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুবরণ করেছেন লেনিনের পলিটব্যুরোর সহকর্মীরা- জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, রাদেক, বুখারিন, টমস্কি প্রমুখ। তাদের শুধু instruments দেখানো হয়নি, প্রচণ্ড দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছিল সেদিন। এটি ছিল ব্রেখটের তরফে স্তালিনবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পরবর্তী সময়ে পূর্ব জার্মানিতে বসবাস করলেও, স্তালিন-সম্পর্কে কোনো মতিভ্রম হয়নি তার ১৯৩৬-৩৮ সালের শো-ট্রায়াল গুলো দেখার পরে। আমার যুক্তির সপক্ষে এ-ও বলব যে, পূর্ব ইউরোপের সব দেশে ব্রেখটের সব নাটকের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল গ্যালিলিও নাটকটি। সেটা এমনি এমনি নয়। এর মধ্যে দর্শকরা স্তালিনবাদের সমালোচনা দেখতে পেতেন, যার প্রভাব স্তালিনের মৃত্যুর পরেও চলছিল পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। তৃতীয়ত, এই নাটকটির উদ্দেশ্য হলো ম্যাকার্থিবাদের হুমকি ও নজরদারির বিপদ সম্পর্কে দর্শক-পাঠকদের সজাগ করে দেওয়া। জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর বামপন্থি নাট্যকার ও কবি হিসেবে ব্রেখট প্রথমে স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং পরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর্বে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। যুদ্ধ চলাকালীন তার প্রতি কড়া নজর রাখত এফবিআই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছুদিন পরে যখন ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ শুরু হলো, এবং সিনেটর ম্যাকার্থির নেতৃত্বে বাম ও কমিউনিস্টদের খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছিল, তখন ব্রেখটকেও মার্কিন কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়। আমেরিকার ন্যুয়র্কে প্রায় একই সময়ে ১৯৪৮ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিল তার ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি। যে আমেরিকা Freedom of Trade-র কথা বলে বেড়ায় সেখানে Freedom of Research (thought) কোথায়- এটি পরোক্ষ ভাবে গ্যালিলিওর বরাত দিয়ে বলেছেন লেখক। ম্যাকার্থি কমিটির কাছে সাক্ষ্যদানের কিছুদিনের পরেই পূর্ব জার্মানিতে চলে যান ব্রেখট এবং গঠন করেন তার জগদ্বিখ্যাত ‘বার্লিনার এনসেম্বল’ (Berliner Ensemble) নাট্যগোষ্ঠী।
মহামারীর কথা বলতে গিয়ে এত সাতকাহন কেন করলাম ‘গ্যালিলিও’ নাটকের আখ্যানভাগ নিয়ে? কারণ, গ্যালিলিও নাটকের সময়কাল ১৬০৯ থেকে ১৬৪২ অবধি। কয়েক বছর পরপর প্লেগ দেখা দিয়েছে তার স্বদেশ-ভূমি ইতালিতে এই সময়ে। নাটকটির ৫ম অঙ্কটি পুরোটা প্লেগকে ঘিরে (ইতালিতে সবচেয়ে বিধ্বংসী প্লেগ হয়েছিল ১৬২৯ সালে; এই নাটকে প্লেগের দৃশ্যটি ১৬১০-১৬১৬ সালের মধ্যকার কোনো একটা সময়ের)। সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে যাচ্ছে বিত্তবান সবাই- রাজ কর্মচারী, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ সকলেই। গ্যালিলিও তার মেয়ে ভার্জিনিয়াকেও পাঠিয়ে দিয়েছেন, এমনকি তার গৃহকর্মীদেরও তিনি বাসায় রাখেননি। খালি গৃহে তিনি একা থেকে গিয়েছিলেন- তার গবেষণা-কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অঙ্কটিতে অনেক মানবিক করুণা-শুশ্রূষার মুহূর্ত রয়েছে। মনে হয় ব্রেখট অবিচলিত অনমনীয় গ্যালিলিওকে ঝঃড়রপ-র মতো দৃঢ়তায় আঁকতে চেয়েছেন। কয়েকটি নির্বাচিত দৃশ্য তুলে ধরি।
– গ্যালিলিও তার দীর্ঘকালের গৃহপরিচারিকা মিসেস Sarti-কে ভর্ৎসনা করে বলেছেন কেন তাকে এই মুহূর্তেই ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে যেতে হবে:
Mrs. Sarti: But who’s going to see you get your meals?
Galileo: You’re crazy. Staying in this city in order to cook!
Picking up his notes:
Don’t think I’m a complete fool, Mrs. Sarti. I can’t abandon these observations. I have powerful enemies and I must collect proofs for certain hypotheses.
Mrs. Sarti: You don’t have to justify yourself. But it’s not exactly sensible.’
-পেস্নগের মধ্যে জনমানবহীন বাসা থেকে পাড়ার ভেতরেই বেরিয়েছেন গ্যালিলিও। উদ্দেশ্য- খাবারের খোঁজ করা। বিশেষত দুধের অভাব, আর এমনিতে খেতে গ্যালিলিও বড় ভালোবাসেন। দেখছেন, সামনের রাস্তা দিয়ে দু’জন মিশনারি নান যাচ্ছেন।
Galileo: Could you please tell me, sister, where I can buy some milk? The milk women didn’t come this morning, and my housekeeper has left.
One Nun: The only shops open are in the lower town.
[এমন সময়ে পাশের বাড়ির জানালা খুলে এক মহিলা গলা বাড়াল।]
Galileo: Have you heard anything about my housekeeper?
Women: Your housekeeper collapsed in the street up there. She must have realized….
[মহিলা এই বলে জানালা বন্ধ করতেই কোথা থেকে দু’জন সৈন্য সামনে উপস্থিত হলো। তারা তাদের লম্বা বল্লম দিয়ে গ্যালিলিওকে বাধ্য করল আবার ঘরের ভেতরে চলে যেতে। বাইরে থেকে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিল]
Soldiers: Get right back indoors!
-[ সৈন্যরা চলে যেতে আরেকটা ঘরের জানালা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো এক বৃদ্ধার মুখ]
Galileo: That must be a fire back there.
Old woman: They’ve stopped putting them out where there’s any risk of infection. All they can think about is the plague.
Galileo: Just like them. It’s their whole system of government. Chopping us off like the diseased branch of some barren figtree.
[ কোথায় যেন ঘটর ঘটর টিন পেটানোর শব্দ হচ্ছিল]
Galileo: What’s that?
Old woman: They’re trying to make noises to drive away the clouds with the plague seeds in them.
এ হলো ‘খারাপ বায়ু (বা ‘Miasma’) তত্ত্ব যার মাধ্যমে প্লেগের সংক্রমণ ছড়ায়। সেকালে লোকেরা বিশ্বাস করত আকাশের কিছু কিছু মেঘ ‘প্লেগের বীজ’ বহন করে দেশে-দেশান্তরে মহামারী ছড়িয়ে দেয়। এর কথা পাঠকদের এর আগেই বলেছি।
গ্যালিলিও নাটকে দীর্ঘ সময় ধরে প্লেগের দৃশ্যাবলি দেখানো হচ্ছিল তার সম্ভাব্য কারণ ছিল বোধকরি এই যে, গবেষণায় ব্রতী বিজ্ঞানী শত মহামারী দুর্যোগ সত্ত্বেও তার গবেষণাগার ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে রাজি ছিলেন না এটা তুলে ধরা। জীবনের শেষ ভাগে এসে তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল সত্যানুসন্ধান। নশ্বর দেহের সকল ঝুঁকি নিয়ে তিনি এরই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন প্লেগের মতো ভয়ংকর মহামারীর মধ্যে বসে। কিন্তু, আমার ধারণা, গোটা নাটকের পটভূমি হিসেবে প্লেগের ছায়াকে বেছে নেওয়ার পেছনে ব্রেখটের মনে অন্য উদ্দেশ্যও কাজ করছিল। বাইরের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্লেগের চেয়েও ভয়ংকর ছিল সেকালের অন্ধ অযৌক্তিক কর্ণপাতহীন বিশ্বাস ও সেই অন্ধ বিশ্বাসের নিরঙ্কুশ শাসনের প্লেগ। এই প্লেগের বীজকে সহজে চোখে দেখা যায় না, এই মহামারী মানুষকে জৈবিক অর্থে মারে না। অন্ধ বিশ্বাসের ক্ষমতা তিলে তিলে মারে মানুষকে মানসিক দিক থেকে। ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ারে’ ডানিয়েল ড্যাফো লিখেছেন- লন্ডনের ১৬৬৫ সালের প্লেগের বছরের আগে ও পরে গণক, ওঝা, হাতুড়ে ডাক্তার, তুকতাক্ জানা লোকের সংখ্যা ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে, ষোড়শ শতকের শেষ ভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত একশ’-দেড়শ’ বছরে একের এক ছোট-বড় আকারের প্লেগ অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউরোপের দেশে দেশে। আর সেই সাথে চলেছে ‘উইচ হান্ট’: চারপাশে শয়তানের ভক্ত ডাকিনী-যোগিনীদের খুঁজে খুঁজে ফাঁসি দেওয়া বা পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এলিজাবেথের মৃত্যুর পরে ১৬০৬ সালে ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন জেমস-প্রথম (এর আগে তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাজা মেরি স্টুয়ার্টের পুত্র)। এই জেমস-প্রথম একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম-‘ডেমনোলজি’। স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাজা প্লেগের দুর্বিপাকের সময়ে ডাইনি পোড়ানোর আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই এটা ঘটেছিল, যেমন প্রসার পেয়েছিল ১৯৩০-র দশকে কঁ কষীঁ কষধহ আন্দোলন গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাবে। ব্রেখট তার নাটকে সেভাবে এদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেননি- শুধু টিনের ড্রাম পিটিয়ে দুষ্ট অশুভ প্লেগের বীজবাহী মেঘকে শহরের বুক থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থার কথা একটি চরিত্রের বরাত দিয়ে আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু মধ্যযুগের চার্চ স্বয়ং যেভাবে সুযুক্তির চেয়ে মন্দ-যুক্তিকে, প্রায়শ অযৌক্তিককে প্রশ্রয় দিচ্ছিল- সেটি সমাজ-শরীরকে মহামারীর চেয়ে আরও বেশি বিপন্ন করে তুলেছিল।
এতে চার্চের যতটা ক্ষতি হচ্ছিল, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার। গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিস্কার করেছিলেন, কিন্তু তার কালের দার্শনিক, গণিতবিদ, তাত্ত্বিকরা সেই যন্ত্রে চোখ রাখতে চাননি। গ্যালিলিও দুঃখ করে বলেছেন যে, তারা এমন ভাব করছে যেন অ্যারিস্টটলের কথাই শেষ কথা! ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, তাদেরকে:
‘Gentlemen, to believe in the authority of Aristotle is one thing, tangible facts are another…I offer any observations and everyone laughs: I offer my telescope so they can see for themselves, and everyone quotes Aristotle.’
এ-ই হচ্ছে ‘ডগমার’ প্রভাব যা প্লেগের প্রভাবের চেয়েও সুদূরপ্রসারী- যা কুরে কুরে খায় আমাদের মন ও মননের সজীব প্রবৃত্তিকে। গ্যালিলিওর উক্তি তাই এখনও আমাদের কানে বাজে: ‘সত্য ক্ষমতার বৃত্ত থেকে নয়- সময়ের বৃত্ত থেকে জন্ম নেয়’ (Truth is born of the times, not of authority)।
এবার আসি আলবেয়ার কাম্যুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসের প্রসঙ্গে। নামেই বোঝা যাচ্ছে লেখাটি মহামারী নিয়ে। ১৯৪১ সালে যখন এই উপন্যাস লেখা শুরু করেন, তখন কাম্যুর বয়স মাত্র ২৮। ১৯৪৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়; অবশ্য তার আগেই বেরিয়ে গেছে তার ‘মিথ অব সিসিফাস’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ ও ‘আউটসাইডার উপন্যাস’। এই তিনটি লেখাই কাম্যু তার বিশেষ ঘরানার ‘অস্তিত্ববাদী’ দর্শন প্রকাশ করার জন্য লিখেছিলেন। প্রথম দুটি একই বছরে (১৯৪২) প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে। ১৯৭৬ সালে আউটসাইডার নিয়ে – ইমতিয়াজ আহমেদের সাথে যৌথ ভাবে- একটি দীর্ঘ লেখা লিখি। যার নাম ছিল “দ্য এসেন্স অব আলবেয়ার কাম্যু’স্ পেসিমিজম”- তৎকালীন হলিডে পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে তা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে আমরা বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, ‘কাম্যুর নৈরাশ্যবাদ এক বিশেষ ধরনের নৈরাশ্য থেকে জন্ম নিয়েছে- যার নাম Solar Pessimism এবং যার মোদ্দাকথা হচ্ছে- এই পৃথিবীটা সূর্যের ওপরে নির্ভর করে বেঁচে আছে। প্রতিদিন হাজার হাজার তারার জন্ম হচ্ছে, হাজার হাজার তারার মৃত্যু হচ্ছে। সেই অমোঘ নিয়মে সূর্য নামক নক্ষত্রটিরও মৃত্যু একদিন ঘটবেই- এমনই অর্থহীন নশ্বর মানবজীবন। একটা হ্যালির ধূমকেতুর মতো কোনো এস্টরয়েড যদি দৈবাৎ পতিত হয় পৃথিবীতে, তাহলে ডাইনোসররা যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, আমরাও সেভাবে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারি প্রজাতি হিসেবে। এই কথাগুলো যখন লিখি তখন মিথ অব সিসিফাস পড়া ছিল আমার, কিন্তু প্লেগ তখনো অপঠিত থেকে গিয়েছিল। আজ মনে হয়, প্লেগ পড়া থাকলে কাম্যুর দর্শনবোধকে শুধু ‘Solar Pessimism’-র মধ্যে আটকে রেখে দিতে পারতাম না। আমাদের সমসাময়িক কালে কাম্যুর দর্শনবোধকে খান মোহাম্মদ ফারাবী ঠিকই চিনে নিতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মৃত্যুচিহ্নিত পৃথিবীতে জীবনের নিকটতম তুলনা শিল্প।’ এটা অবশ্য আদিতে নিটশেরই কথা। সুইজারল্যান্ডের বাসেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে নিটশে সুরকার ভাগনার (Wagner) ও তার অপেরার ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। জীবনে পরিত্রাণহীন দুঃখ-যন্ত্রণাই নিত্য-সঙ্গী- একে কেবল অতিক্রম করা যায় শিল্প-সংগীত দিয়ে। কাম্যুর ওপরে নিটশের গভীর প্রভাব ছিল।
প্লেগ উপন্যাসে লেখকের ভেতরের কথা তা-ই। আমাদের জীবন মোটামুটি ভাবে বলা যায় প্রায়-সবসময়ই একটি খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এই খাদ হতে পারে যে কোনো ধরনের দুর্দৈব, দুর্বিপাক বা দুর্যোগ সংবলিত কোনো ঘটনা; এক অর্থে ঘটনাও নয়- পলকা কোনো সুতোর গ্রন্থি ছিঁড়ে যাওয়া কেবল। এটা হতে পারে আকস্মিক দাঙ্গা, অপ্রত্যাশিত কোনো বৈশ্বিক বা স্থানিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, কোনো অনির্দেশ্য করাল ব্যাধি, কোনো মহামারী, জানা-অজানা স্ট্রেইনের ভাইরাস, কোনো জলোচ্ছ্বাস, কোনো উমপুন, কোনো সর্বগ্রাসী বন্যা, পাহাড় থেকে হঠাৎ নেমে আসা ঢল, প্রখর খরা, আকস্মিক পঙ্গপালের আক্রমণে নেমে আসা খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ, কোনো চোরাগুপ্তা ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থানের অপারেশন সার্চলাইট হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাথার ওপরে বিদ্যুতের জীবন্ত তার ছিঁড়ে পড়া, অথবা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র মতো গাছের নিচে দাঁড়ানো লোকটির মতো বজ্রপাতে ভস্মীভূত হওয়া, গ্যাসের চুলা বা এসির মোটর ফেটে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ড অথবা এক তারা-ঝিলমিল রাতে গাড়িতে-বাসে ঢুলতে ঢুলতে সড়ক দুর্ঘটনা, ট্রেনের লাইন ভেঙে পড়া, আকাশ থেকে অজ্ঞাত কারণে প্লেন ভেঙে পড়া, অথবা রৌদ্র-ঝলমলে দিনে বিদেশি শহরের স্কোয়ারে বেড়ানোর সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ, অথবা ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের মতো হঠাৎ চর জেগে স্টিমারের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা ভুলে থাকি- হয়তো ভুলেই থাকতে চাই যে সবসময় যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ঘটনা,মারাত্মক অসুখ আমাদের নিত্যসঙ্গী। ছায়ার মতো দুর্বিপাক আমাদের পিছু পিছু হাঁটছে। আমাদের জীবন আসলে পদ্মপাতার জল। কাম্যু সেটিকে বলেছেন এভাবে- Our lives are fundamentally on the edge of what can be termed as `the absurd’।
উপরের যে-দুর্বিপাকগুলোর কথা বলা হলো তাতে যে কেউ কোনোদিন ব্যক্তিগত বা সমবেতভাবে ‘আক্রান্ত’ হবো, তা কেউ আমরা বিশ্বাস করি না। এ রকম ঘটে থাকে শুনেছি, দেখেছি বা জেনেছি, তবে কিনা এটা ‘আমার জন্য ঘটা সম্ভব নয়, বা ঘটার সম্ভাবনা এতই কম যাকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি। সে রকম ঘটনাকেই ‘অসম্ভব’ (absurd) ধরে নিয়ে আমরা জীবনের পথে চলি। ‘প্লেগ’ উপন্যাসের গল্প গড়ে উঠেছে আলজেরিয়ার সমুদ্র-উপকূলবর্তী শহর ওরান (Oran)-কে ঘিরে। এর অধিবাসীরা কখনো মনে করেনি তাদের শহরে প্লেগের মহামারীর মতো কোনো দুর্দৈব নেমে আসতে পারে। মহামারী সে তো পুরাকালের গল্পের মতো। প্লেগ তো আর দুনিয়াতে নেই- অন্তত পাশ্চাত্যে নেই। এখন প্লেন চলছে মাথার ওপরে, ফোন এসেছে, ট্রাম চলছে, সংবাদপত্র পাঠ হচ্ছে- নিশ্চয়ই সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপের মতো প্লেগের মহামারী দেখা দিতে পারে না এই ‘আধুনিক’ সময়ে? উপন্যাসের এক চরিত্র বলছে, ‘যা হচ্ছে তা প্লেগ হওয়া অসম্ভব- কেননা সবাই জানে পাশ্চাত্য থেকে মহামারী অবলুপ্ত হয়ে গেছে কবেই।’ তার পরপরই লেখক ন্যারেটরের কণ্ঠস্বরে বলছেন, ‘তা অবশ্য ঠিক- কেবল মৃতরাই সে কথা জানত না!’ অন্যত্র লেখক বলছেন (এই উপন্যাসে বর্ণনাকারী হিসেবে তাকে ঘন ঘন আসতে হয়েছে):
‘Pestilence is so common, there have been as many plagues in the world as there have been wars, yet plagues and wars always find people equally unprepared when war breaks out people say: ‘It won’t last, it’s too stupid’. And war is certainly too stupid, but that doesn’t prevent it from lasting.’
ওরান শহরের লোকেরা মনে করত এই মহামারী একটা দুঃস্বপ্নের মতো একদিন কেটে যাবে। তা ছাড়া তারা ভাবত, অন্য সব শহরের তুলনায় তারা এমন বেশি গোনাহ্-এর কাজ করেনি যে, তাদের ওপরেই ঈশ্বরের অভিশাপ বর্ষিত হতে হবে:
‘They continued with business, with making arrangements for travel and holding opinions. Why should they have thought about the plague, which negates the future, negates journeys and debate? They considered themselves free and no one will ever be free as long as there is plague, pestilence and famine.’
ওরান শহরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী ব্যুবনিক প্লেগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এ বই লেখার জন্য কাম্যু প্লেগ-সংক্রান্ত প্রায় সব জরুরি বইই পড়ে ফেলেছিলেন। কালো মৃত্যু, ১৬২৯ সালের ইতালির প্লেগ, ১৬৬৫ সালের লন্ডন-প্লেগ, ১৮-১৯ শতকের চীনের প্লেগ সম্পর্কে তাকে পড়তে হয়েছিল। একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে যে, নাজি-অধিকৃত প্যারিস/ফ্রান্সকে কাম্যু একটি প্লেগ-কবলিত অবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন। ফরাসি মুক্তিযুদ্ধের পত্রিকা ‘কমবেট’-এর সম্পাদক হিসেবে- Ressistance Fighter হিসেবে তিনি প্লেগের মতো উপন্যাসে হাত দিয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণেই। পুতুল ঠরপযু-সরকার তখন ফ্রান্সে ক্ষমতায়, যার পেছনে কাঠখড়ি নাড়ছে নাজি জার্মানি। এরকম অবস্থায় একদল ফরাসি প্রায় উদ্যমই হারিয়ে বসে নাজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কাম্যুর মতো তরুণ যুবশক্তি তবু মাথা নত করেনি। এই উপন্যাসের মূল নায়ক ডাক্তার রুয়ো (জরবীঁ) প্লেগের মহামারী দেখে পিছপা হননি। মহামারীকে বিধাতার অভিশাপ হিসেবে দেখেননি তিনি। এর মধ্যে দিয়ে কোন ‘নিখিল অভিপ্রায়’ ব্যক্ত হয়েছে- সেটা তিনি মনে করেননি। আজ করোনার কালেও আমরা দেখতে পাচ্ছি- যার-তার করোনার হচ্ছে। যেকোনো লোকই এতে মারা যেতে পারে- এর মধ্যে কোনো ‘ডিজাইন’ নেই, কোনো বাছবিচার নেই, ‘Suffering is randomly distributed’। এর মধ্যে কোনো নীতিনৈতিকতার উপাদান নেই, এর প্রাদুর্ভাব যেকোনো ভাবেই ঘটছে- is simply absurd and that is the kindest thing one can say of it. ডাক্তার তার পরও কাজ করে গেছেন: দিন নেই, রাত্রি নেই পরিশ্রম করেছেন আর্তের সেবার জন্য। রবীন্দ্রনাথের বাসবদত্তাকে মনে আছে? ডাক্তার রুয়ো কোন সন্ন্যাসী উপগুপ্তের মতো পুণ্যবান লোক নন। মারীগুটিকায় ভরে যাওয়া বাসবদত্তার কাছে কিনি কোন পুণ্যাত্মা হয়ে দাঁড়াননি। তিনি এ কাজ করেছেন নিছকই ‘ঔচিত্যবোধে’, তার সুরুচি তাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে থাকতে বাধ্য করেছে। কোনো জরা-ক্লিষ্ট রোগীকে ফেলে যাওয়া শোভন নয়। এই একান্ত শোভনীয়তাবোধ (যাকে আমি ঔচিত্যবোধ বলেছি) ডাক্তারকে চালিত করেছে। বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় অংশে ন্যারেটর লিখছেন: ‘This whole thing is not about heroism. It’s about decency. It may seem a ridiculous idea, but the only way to fight the plague is with decency.’ আমি এ-ও মনে করি-এই decency নিছক আনুষ্ঠানিক বিধিমালা নির্দিষ্ট দায়িত্ববোধ বা হিপোক্রিট শপথের মধ্যে ব্যক্ত Responsibility থেকে কিছুটা ভিন্ন একটি বিষয়। ইউনাইটেড হসপিটালে সম্প্রতি আইসোলেশন বেডে ৫ জন করোনার রোগী অগ্নিকাণ্ডে মারা গেলেন। তখন সেখানে তাদের দেখাশোনা করার জন্য কোনো ডাক্তার বা নার্স ছিল না। এটা বিধিসম্মত দায়িত্ববোধের অভাব নাকি করোনার রোগী চিকিৎসার বিষয়ে প্রবল অনীহা সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১৬-১৭ বছরের যে-তরুণ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, তারও মনে ভয় ছিল মারা যাওয়ার। মৃত্যুভয় কার না থাকে? কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসতে তার মন সায় দেয়নি (আমার বড় ভাই এমন একটি উদাহরণ ছিলেন)। এ রকম অনেক উদাহরণ আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি। কেন তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে আসতে পারেনি, তার সম্যক কারণ অজ্ঞাত। কোনো জাতীয়তাবাদ বা আবেগ-উদ্বেলিত দেশপ্রেম নয়, হয়তো কাম্যুর কথিত ফবপবহপু বা ঔচিত্যবোধ তাদের সেদিন চালিত করে থাকবে। ওরান শহরের প্লেগ বা আমাদের করোনাকালের ডা. রুয়োর মতো অসংখ্য যোদ্ধার মাথাতেও হয়তো সে রকম কোনো বোধ আজ কাজ করছে।
মহামারীর আরও অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে আছে আধুনিক ইংরেজি, কন্টিনেন্টাল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে। জোসেফ কনরাডের নানা উপন্যাসে, কাফকার দর্শনে-রচনায়, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ এবং ‘হানেড্রড ইয়ার্স অব সলিচুড’, সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপাখ্যানে বড় ভাবে এসেছে জানা ও অজানা মহামারীর অশুভ ছায়া। নাট্যকার চেখভ মারা গিয়েছিলেন যক্ষ্ণা মহামারীতে; কবি গিয়ম আপলেনিয়র, চিত্রকর গুস্তাভ ক্লিমট্ ও সমাজতাত্ত্বিক ম্যাপ ওয়েবার মারা যান স্প্যানিশ ফ্লুতে; এপপ্রেশোনিস্ট ইগন শিয়েল তিনিও মারা যান একই কারণে। চিত্রকর মুনচ (Edvard Munch)-এর Self-Portrait with the Spanish Flu, Self-Portrait after the Spanish Flu I AviI ও আরও কিছু চিত্রকর্ম ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর প্রভাবেই তৈরি হয়েছিল। মহামারীর অসুখ দীর্ঘ ছায়া ফেলে ভার্জিনিয়া ওলফের জীবনে, বিশেষত তার প্রবন্ধে যার নাম অন বিইং ইল। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘গণশত্রু’ (ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল’-এর রূপান্তর) কলেরা মহামারীকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। অন্ধ বিশ্বাস, প্রচলিত ক্ষমতা, বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা এবং জনগণের প্রতিরোধ সব তর্কই চলে এসেছে তার ছবিতে। এসব রচনাই বিশদ পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে যা আপাতত মুলতবি রইল।
ভবিষ্যতই বলবে যে করোনা মহামারীর পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজ ইতিহাসের কোন ধারাকে শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত করবে। আমাদের দেশে করোনার সংকট কি বড় ধরনের সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি হবে- যেমন এটা ঘটে ছিল ১৯১৮-১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ে রাশিয়ায় ও ইউরোপে? নাকি, এখানে নেমে আসবে অরাজক পরিস্থিতি ও চরমপন্থার রাজনীতি, অথবা এর বিপরীতে আসবে কোন স্বৈরতন্ত্রের উত্থান? পোস্ট-করোনা বিশ্বের অংশ হিসেবে আমরা কি মননে-সমাজে-রাষ্ট্রচিন্তায় বিজ্ঞান দ্বারা চালিত হবো নাকি অন্ধ বিশ্বাসের নিয়তিবাদে আস্থা রেখে আরও একটি প্রলয়ের দিকে এগিয়ে যাব? আমাদের নৈতিকতায় কি আরও স্খলন হবে নাকি আমরা সহমর্মী যূথবদ্ধতায় আরও সাহসী হয়ে উঠব- আগামী দিনের যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায়? আমরা কি অবাধ তথ্য-প্রবাহকে উৎসাহিত করব যাতে করে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো দক্ষ ও মানবিক হতে পারে? নাকি আমরা ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত কেন্দ্রীভবন করে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে চলব? ব্যক্তিজীবনে আমরা কি করোনার আগে যেমন, তেমনই আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী পরস্পর-বিচ্ছিন্ন পরমাণু-সদৃশ জীবন যাপন করে চলব, নাকি হবো সামাজিক দায়িত্ব পালনে যত্নশীল এবং ‘অপরের’ অভাব ও সমস্যার প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ? আমরা আসলেই একটা ইতিহাসের মধ্যে আছি।
[এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত]
মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল
পর্ব ::৫৪
পূর্বে প্রকাশিতের পর
৭. মহামারী ও আধুনিক সাহিত্যের ধারা :এলিয়ট ও ইয়েটস্
১৯২২ সাল। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের জন্মবছর এটি। একই বছরে প্রকাশিত হয় টি. এস. এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস্’ উপন্যাস, আর ভার্জিনিয়া উলফ্-এর ‘মিসেস ডেলাওয়ে’। এর তিন বছর আগে ইয়েটস্ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’। এই সবগুলোর পেছনে কাজ করেছে একটাই ‘ইউনিফাইং থিম’ বা প্ররোচনা- মহামারীর অশুভ ছায়া। ২০১৮ সালের ঠিক একশ’ বছর আগে বিশ্বজুড়ে যে মহামারী সংঘটিত হয়েছিল, তার নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু। তা নিয়ে ২০১৮ সালে কোনো কোনো সংবাদপত্রে ছোট্ট নিবন্ধ বেরিয়েছে, কিন্তু বড় আকারে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। অথচ এই স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গিয়েছিল সে সময় বিশ্বের ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ; আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। বস্তুত ১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর পরে স্প্যানিশ ফ্লুর মতো ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা নিয়ে আর কোনো মহামারী আত্মপ্রকাশ করেনি। এই ফ্লুতে যত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, সমগ্র প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ মিলিয়েও এত লোকের মৃত্যু ঘটেনি। তাহলে এই মহামারী নিয়ে এত নিস্তব্ধতা কেন? একটা কারণ হতে পারে- আর সেটা ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছিলেন, যার সহজীকৃত মর্মার্থ হলো-‘Silences about public horrors can permit human societies to cope with collective recovery and to progress’| জীবনানন্দও বলেছিলেন বুঝি এই মর্মে- ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’ হয়তো-বা তা-ই। কিন্তু সমসাময়িক এলিয়ট, উলফ্ বা ইয়েটসের পক্ষে এই অদৃষ্টপূর্ব মহামারীকে ভুলে যাওয়া কঠিন ছিল।
এলিয়ট আর তার স্ত্রী ভিভিয়ান এলিয়ট দুজনেই ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যখন এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করছিলেন তারা, তখনই তিনি ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ শেষ করার কাজে হাত দেন। মহামারী যে প্রবলভাবে আক্রান্ত করেছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সাহিত্য ও শিল্পের ধারাকে সেটা শুধু সম্প্রতি সাহিত্য-সমালোচনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। যেন দান্তের ইনফার্নোর মতো মড়ক লেগেছে লন্ডন শহরে, সেভাবেই কবি এলিয়টের চোখের সামনে মৃত্যুর মিছিল ভেসে উঠছে :
‘Unreal City,
Under the brown fog of a winter dawn,
A crowd flowed over London Bridge, so many,
I had not thought death had undone- so many.
Sighs, short and infrequent, were exhaled,
And each man fixed his eyes before his feet.
Flowed up the hill and down King William Street.’
সবাই জানেন যে, এলিয়ট ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যগ্রন্থে ধাঁধার মতো করে বলেছিলেন :
‘April is the cruelest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.’
এপ্রিল কেন ‘সবচেয়ে নিষ্ঠুর’ মাস হতে যাবে? যে-জমি উর্বরা সেখানে এপ্রিল মাসে বসন্ত সমাগত হয়, পশ্চিমের দেশগুলোয় বরফ গলতে শুরু করে, আর বরফের নিচ থেকে মাথা তুলতে শুরু করে হরিৎ তৃণ-গুল্ম, নানা বর্ণের ফুল, আসে নতুন ফসলের মৌসুম। কিন্তু বন্ধ্যাজমিতে (ওয়েস্ট ল্যান্ড তো অপুষ্পক জমি) এপ্রিল মাস মিছেমিছি বসন্তের আশা জোগায়- সেখানে নতুন করে কিছুই জেগে ওঠে না- না-পুষ্প না-পত্রালি না-মৌমাছির গুঞ্জন না-প্রজাপতির আলোড়ন। সেদিক থেকে এপ্রিল যেন আমাদের অপূর্ণতাকে না-পূরণ হওয়া সম্ভাবনাগুলোকে নিয়ে কর্কশ ঠাট্টা করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো কিছু আশা করাই অন্যায় বা আশা করলে তা হবে ভুল কিছুর জন্য আশা করা। বহু পরে তিনি এ কারণেই কি বলবেন ‘ফোর কোয়াট্রেটস’ কাব্যগ্রন্থে – ‘Hope would be hope for the wrong thing’? তার পরও একসময় মহামারী শেষ হয়, মৃত্যুর স্রোতের ভেতর থেকে জীবনের হাত জাগতে দেখা যায়, ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতার শেষে হিমালয়ের চূড়ায় জড়ো হয় মেঘদল, শোনা যায় বজ্রপাত – বৃষ্টির শব্দ, আর নতুন জীবনের পদধ্বনি।
[ক্রমশ]
মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল
পূর্বে প্রকাশিতের পর
মহামারি-পরবর্তীকালে চার্চের প্রভাব এতটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, তাকে কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে না পারলে জন-অসন্তোষ বেড়ে যেতে পারত এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জনবিদ্রোহের সূচনা হতে পারত। এ কারণেই চার্চসমূহকে অর্থ-সাহায্য করার জন্য ওরা এত উদগ্রীব হয়েছিলেন :
Yet, perhaps even more than this, the frenzied charity in which the rich of Europe indulged during and after the Block Death demonstrated their faith in the one institution where it seemed a proper sense of social discipline survived. Discredited the Church might be in the eyes of many but, to the nobles and the monied elite, it was still the dyke which held back the flood of anarchic insurrection unless it were shored up then everything, it seemed, might be swept away.
১৬৬৫ সালের প্লেগের অনুরূপ ফলেও অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, ধারণা করা যায় ১৮৩০-এর দশকের কলেরার প্রকোপ নিয়েও এমনটা ভাবা চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে লন্ডনের গ্রেট প্লেগ-এর তুলনায় ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে সাক্ষী মেনেছেন গুটিবসন্তের মহামারীকে। উদাহরণত, ১৬৮৮ সালেরGlorious Revolution ছিল প্রথম বড় আকারের অভিঘাত-সম্পন্ন ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ (দ্বিতীয়টি ছিল, ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা-ঘোষণা, এবং তৃতীয়টি ছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব)। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাজশক্তির নিরঙ্কুশ দাপুটে ক্ষমতা অনেকখানি কমে যায়, এবং ধনাঢ্য বণিক-শিল্পপতি বুর্জোয়া-শ্রেণির প্রভাবাধীন ‘সংসদের’ রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়ে যায়। জায়মান বুর্জোয়ার অর্থনৈতিক অধিকার/ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়, যা ছিল ধনবাদী বিকাশের পক্ষে খুবই সহায়ক (যার প্রমাণ মেলে শিল্প-স্থাপনে জমি-অধিগ্রহণ বা Land-enclosure নীতি-বাস্তবায়নের মধ্যে)। যেটা আমাদের সচরাচর বোধের বাইরে ছিল, এই Glorious Revolution-কে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল গুটি-বসন্তের মহামারী। ব্যাপারটি কাকতালীয়, কিন্তু ঘটনা-প্রবাহ বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘প্লেগস্ অ্যান্ড পক্সেস :দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিউম্যান হিস্টরি অন এপিডেমিক ডিসিসেস’ গ্রন্থের লেখক আলফ্রেড বোলেট (Bollet) জানিয়েছেন এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে। আমি এখানে তার বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি :
‘রাজপরিবারের ওপরে বসন্তের মহামারির প্রভাব প্রায়শ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২৯ বছর বয়সে প্রথম এলিজাবেথ ১৫৬২ সালে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন… ১৬৬০ সালে দ্বিতীয় চার্লস যখন ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন সিংহাসনের দখল নিতে, হেগ শহর থেকে তার দলবল জল-বসন্তের মহামারির বীজ বয়ে নিয়ে এসেছিল। তাতে চার্লসের সেই ভাই (গ্লুস্টেরের ডিউক) এবং প্রিন্সেস মেরি মৃত্যুবরণ করেন। স্যামুয়েল পেপিস (Pepys)-এর দিনলিপি লন্ডনে ১৬৬১ সালের গুটি-বসন্তের প্রাদুর্ভাবের বর্ণনা দিয়েছে।…এই মহামারীর কারণে ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারেও পরিবর্তন আসে। ১৬৮৮ সালে রোমান ক্যাথলিক ধারার অনুসারী রাজা জেমস দ্বিতীয়কে গ্লোরিয়াস রিভোলিউশনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় (জেমস ফ্রান্স পালিয়ে যান)। তখন জেমসের কন্যা মেরি ও তার স্বামী উইলিয়াম সিংহাসন লাভ করেন। তারা দুজনেই ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট ধারায় বিশ্বাসী। কিন্তু ১৬৯৪ সালে মেরি গুটি-বসন্তে মৃত্যুবরণ করেন কোনো সন্তানাদি না রেখেই। উইলিয়াম (William. III নামে পরিচিত- ইনি ছিলেন মেরি স্টুয়ার্টের ছেলে) ১৭০২ সালে মারা গেলে মেরির ছোট বোন এ্যান (Anne) সিংহাসনে বসেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবারও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয় যখন এ্যানের ছেলে বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে জল-বসন্তে মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে সংসদে আইন পর্যন্ত পাস হয় যে, পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়া এরপর রাজপরিবারের কোন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বিদেশে ভ্রমণ করতে পারবেন না। এ্যানের মৃত্যুর পরে ব্রিটিশ রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন জার্মানিতে বাসরত রাজা জর্জ প্রথম। তারা বাড়িতে জার্মান ভাষায় কথা বলতেন। পরে এরাই ইরেজি আদব-কায়দা-ভাষা আয়ত্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন উইন্ডসর ঘরানা (বা The Windsors) যার উত্তরসূরি হচ্ছেন বর্তমানে ইংল্যান্ডের রানী।’ দেখা যাচ্ছে, জল-বসন্ত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে।
[ক্রমশ]
মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল
পর্ব ::৫২
পূর্বে প্রকাশিতের পর
নিম্নবর্গের দেব-দেবীর পূজা-অর্চনাকে পাছে কেউ ‘এশিয়াটিক বারবারিজম’-এর উদাহরণ হিসেবে খাটো করেন সে জন্য বলে রাখি যে, প্লেগ-তাড়িত ক্যাথলিক ইউরোপে খ্রিষ্টের অনুসারীদের মধ্যে রোগ-নিরাময়ের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মহাত্মাদের কাছে ‘প্রার্থনা করার’ রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকার ১৯ মার্চ ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এক চিত্তাকর্ষক নিবন্ধ- ‘দ্য বেস্ট সেইন্টস্ টু প্রে ডিউরিং আ পেনডেমিক’। তাতে বলা হয় যে প্লেগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য সেইন্ট হলেন সেইন্ট সিবাসটিয়ান। খ্রিষ্টীয় তৃতীয়য় শতকের এই পুণ্যাত্মাকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে মনে করা হতো। সিবাসটিয়ানের অর্চনার প্রমাণ মেলে রোমে ৬৮০ সালে, মিলানে ১৫৭৫ সালে, লিসবোঁয়াতে ১৫৯৯ সালের প্লেগের দিনগুলোতে। প্লেগের মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমন আরেকজন ছিলেন সেইন্ট রোস (St Roch)। ইতালির এই পুণ্যাত্মার কাছে বিশ্বাসীরা আজও দুর্দৈবে পড়লে প্রার্থনা করে থাকে :
“O Blessed St. Roch,
Patron of the Sick,
Have pity on those
Who lie upon a bed of suffering.
Your Power Was so great
When you were in this world,
That by the sign of the Cross,
Many were healed of their diseases.
Now that you were in heaven,
Your power is not less.
Offer, then, to God
Our sighs and tears.
And obtain for us that health we seek
Through Christ Our Lord
Amen.”
এই তালিকায় নারী সেইন্টারাও রয়েছেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সেইন্ট রোজালিয়ার নাম। যারা গসপেল অব মেরির খ্রিষ্ট-সহকর্মী মেরি মাগদালেনার কথা মনে রাখেন, তারাই জেনেছেন যে এই পুণ্যাত্মা নারীর নাম নিলে মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অন্তত এই ধারার বিশ্বাসীদের তাই অভিমত।
মুসলিম ঐতিহ্যেও আধ্যাত্মিক গুণাবলিসম্পন্ন অনেক পুণ্যাত্মা মহাপুরুষ পীর-আউলিয়া ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসেছেন যাদের আশ্চর্যজনক ‘নিরাময় ক্ষমতা’ (হিলিং পাওয়ার) ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিত্যদিনের অসুখে-বিসুখে পড়লে এসব পুণ্যাত্মাগণের সমাধিস্থল বা মাজারশরিফে গিয়ে মানত করার লোক-ঐতিহ্য ছিল বা এখনও আছে। পূর্ব বাংলায় এই পরম্পরা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। ‘মুসলিম সেইন্টস্ অব সাউথ এশিয়া : দ্য ইলেভেনথ্ টু ফিফটিনথ্ সেনচুরিস্’ গ্রন্থে আনা সুভরভা লিখেছেন, মধ্যযুগে ‘প্লেগের মহামারীতে দিল্লির লোকজন একত্রিত হয়ে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি-র মাজারে জিয়ারত করতে গিয়েছিল।’ সাধারণ মানুষের কাছে এসব পুণ্যাত্মা ব্যক্তিবর্গের আবেদন ছিল ভরসা-প্রার্থনার একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে। রিচার্ড ইটন তার সুবিখ্যাত বইতে (‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’) পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় (বিশেষত দক্ষিণ বঙ্গে), মাজারের তুলনামূলক অধিক সমাবেশ দেখিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জঙ্গল কেটে বসত গড়ার ক্ষেত্রে তারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এবং মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকার কারণে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার সহজতর হয়েছিল। কিষণ চন্দর হয়তো অতিশয়োক্তি করেছেন, কিন্তু দুর্দৈবের মুখে তার মা’র বিভিন্নমুখী ধর্মবিশ্বাস একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সাধারণ মানুষই বিপদ থেকে বাঁচতে সব উৎসের দিকেই হাত বাড়াতেন। এখন হয়তো ‘শিক্ষিতের’ হার বাড়ার সাথে সাথে বহুত্ববাদী প্রবণতা অনেকখানি কমে এসেছে, তার পরেও তা পরিদৃষ্ট হয়। পুরো উদ্ধৃতিটি দেওয়া প্রয়োজন। কিষণ চন্দর তার মা সম্পর্কে লিখেছেন :
‘Creating for sacred places ran in my mummy’s blood. She did not read books on national unity, did not hear speeches on religious tolerance and did not know words like humanism and equality of people….To make up for it she visited Hindu temple as well as Sikh gurdwara, prayed to Hindu gods and made offerings at the mazars of Muslim saints—and all this also ran in her blood. Thus, like her, lived whole generation in old, illiterate, undivided India and by their efforts in the course of many centuries was the composite national culture was created’.
উপরের আলোচনা থেকে মনে হতে পারে, মানুষজন মহামারীর প্রভাবে আরও বেশি করে নিয়তিবাদের তাদের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, বাহ্যিক ধর্মাচরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, লোকজ দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যেতে পারে। তারা মনে করতে পারে যে মহামারী হচ্ছে পাপবিদ্ধ মানুষের ওপরে নেমে আসা অভিশাপ (যেমন করে গান্ধী ১৯৩২ সালের বিহারের ভূমিকম্পকে অতিরিক্ত জাত-পাত মানার জন্য বিধাতার ক্রুদ্ধ অভিশাপ বলে ভেবেছিলেন এবং এই মর্মে রবীন্দ্রনাথের তিরস্কারও কুড়িয়েছিলেন) যেন এক অদৃশ্য অনিয়ন্ত্রণক্ষম শক্তি আমাদের জীবন ও ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে- বিজ্ঞান যার কাছে অসহায়, রাষ্ট্র যার কাছে পরাস্ত, ব্যক্তিস্বরূপ যার কাছে অগ্রাহ্য। চারদিকের অসুখ-বিসুখে ক্লান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা’ এমন ধারণা করাও অযৌক্তিক নয়। মহামারীর ইতিহাস অবশ্য দু’ধরনের প্রবণতাই দেখায়। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুই ধারাকেই সামনে মেলে ধরে।
যেমন, ১৩৪৬-৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথ অভিহিত প্লেগের ফলে বিশ্বাসের বন্ধন অনেকখানি আলগা হয়ে এসেছিল। মধ্যযুগকে যে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়ে থাকে তার বড় একটি কারণ ছিল ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব। এই অন্ধকার যুগের পরেই রেনেসাঁ-পর্বের শুরু। প্লেগের কালো মহামারীর ৫০ বছরের মধ্যেই কতকগুলো পরিবর্তন দেখা দেয়। প্রথমত, জনসংখ্যা হঠাৎ করে কমে যাওয়ায় সামন্ত-ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়। ইংল্যান্ডের কৃষিতে দাসপ্রথার ব্যবস্থা (তথাকথিত Villianage System) উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। এর একটা বড় কারণ মহামারী-পরিস্থিতিতে শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মজুরির হার বেড়ে যায়, কৃষিতে ‘মুক্ত শ্রমের’ চলাচল অবাধ হতে থাকে, কৃষিকাজ আর সামন্তদের জন্য আগের মতো লাভজনক হতে পারে না। কৃষিতে ভাগ বা বর্গা-ব্যবস্থার বিকাশ হতে থাকে। এর ফলে, যারা মহামারীর পরে বেঁচে রইল, তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকে। দ্বিতীয়ত, সামন্তবাদের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ছিল প্রাত্যহিক জীবনে (ক্যাথলিক) চার্চের প্রবল প্রভাব। মধ্যযুগের ‘পাপ-পুণ্যের থিওরি’ দিয়ে মহামারীর আক্রমণকে আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। অসুখ হলে এটা বিধাতার অভিশাপ, এবং এজন্য অনুতাপ ও ক্ষমা চাওয়ার যে প্রথা মধ্যযুগে সূচিত হয়েছিল, তা অনেকটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। চার্চের সাথে জড়িত অনেক ধর্মযাজকই তখন প্লেগের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্লেগ পুণ্যাত্মা-পাপাত্মা কাউকেই নিস্তার দেয়নি। সাধারণ ধর্মবিশ্বাসের জন্য এটি ছিল একটি বড় আঘাত। এর মানে এই নয় যে, ধর্মবিশ্বাস মহামারী-পরবর্তী যুগে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মধ্যযুগে জনজীবনের ওপরে ধর্মের যে-প্রবল সর্বগ্রাসী প্রভাব ছিল তা আর মহামারী-পরবর্তী যুগে সেভাবে থাকেনি। এক্ষেত্রে ১৩৪৬-৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে, তেমনি হিসাবে নিতে হবে ১৬৬৫ সালের লন্ডনের গ্রেট প্লেগকে। এ দুইয়ের মধ্যকার তিনশ’ বছরে ছোট-বড় আরও অনেক প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে ইউরোপে। তা ছাড়া, প্লেগ ছাড়া জল-বসন্তও হুমকি হিসেবে ছিল, এটাও মনে রাখতে হয়। মোট কথা, মহামারীর প্রভাবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালিতে জেগে ওঠা রেনেসাঁর ধারা (লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির যুগ) বা ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে রেনেসাঁর ধারা (শেক্সপিয়রের যুগ) ‘মানবতাবাদকে’ শিরোধার্য করেছিল- দেবত্ববাদকে নয়। ঈশ্বরের পাশাপাশি মানুষের গল্পকথা তাই এই পর্বের চিত্রকর্মে, কবিতায়, নাটকে ও গল্পে উঠে এসেছে। একেই সমালোচকরা ‘Renaissance Humanism’ বলেছেন। এর প্রভাবেই আমরা পেয়েছি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও বতিচেল্লির চিত্রকর্ম, বোকাচিও (Bocaccio)-র অমর সৃষ্টি ‘ডেকামরন, চসারের ‘ক্যান্টরবিউরি টেলস্’, আর শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়র’ (যা লেখা হয়েছিল ১৬০৬ সালের প্লেগের সময়ে যখন লন্ডনের গ্লোব থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায় এবং যেখানে শেক্সসপিয়রের নাটক মঞ্চন্থ হতো) ও তার অন্যান্য ট্র্যাজেডিতে বিধৃত মানবতাবাদ। তৃতীয়ত, কালো মৃত্যু শুধু মানবতাবাদের পথই প্রশস্ত করেনি বা চার্চের ওপরে সর্বজনীন আস্থায় চিড় ধরায়নি, রাষ্ট্র বা রাজশক্তির ন্যায্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। মহামারীর কালে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটল, অনেক ধর্মযাজক আর্তের সেবা দিয়ে মারা গেলেন, শহর জনশূন্য হয়ে গেল, গ্রাম উজাড় হলো, আর রাজন্য বর্গ লোকালয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে আশ্রয় নিলেন। অন্ধকার যুগের মহামারী হিসেবে প্লেগ যেভাবে রাজশক্তির ন্যায্যতাকে নাড়া দিয়েছে, তা থেকে সামলে উঠতে বহু বছর/শতাব্দী লেগেছিল ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহকে।
উপরের কথাগুলোর সমর্থন পাওয়া যায় প্লেগের সামাজিক ইতিহাসের বিশ্নেষক ফিলিপ জিগলার (Ziegler)-এর বইয়ের মাধ্যমে। আমি তিনটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তার লেখা থেকে তুলে দিতে চাই। মহামারী যে কীভাবে নৈতিক অবস্থার অধঃপতন ঘটায় সে সম্পর্কে জিগলার বলছেন :
‘The plague not only depopulates and kills; it gnaws the moral stamina and frequently destroys it entirely; thus the sudden demoralization of Roman society from the period of Mark Anthony may be explained by the Oriental plague… In such epidemics the best were invariably carried off and the survivors deteriorated morally. Times of plague are always those in which the bestial and diabolical side of human nature gains the upper hand.’
১৩৪৬-৪৮ সালের প্লেগের পরের কয়েক দশকে অবক্ষয়, অধঃপতন, এমনকি ভোগবাদের দিকে প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল বলে জিগলার মনে করেছেন। উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য :
‘Contemporary chronicles abound in accusations that the years which followed the Black Death were stamped with decadence and rich in every kind of vice. The crime rate soared; blasphemy and sacrilege were a commonplace; the rules of sexual morality were floated; the pursuit of money became the be-all and end-all of people’s lives…Who could doubt that humanity was slipping towards perdition when women appeared in public wearing artificial hair and low-necked blouses and with their breasts laced so high ‘that a candlestick could actually be put on them’.
আবারও বলছি, তার মানে এই যে, ধর্ম-কর্ম সমাজজীবন থেকে মহামারীর কারণে উঠে গেল। চার্চের ভাবমূর্তি ও আধ্যাত্মিক প্রভাবে চিড় ধরলেও চার্চের সংখ্যা আগে বেড়ে গিয়েছিল। জিগলার এই মুহূর্তকে শনাক্ত করেছেন এভাবে: ‘Paradoxically, the decades that followed the plague saw not only a decline in the prestige and spiritual authority of the Church but also a growth of religious fervor. One example of this was the large number of chantry Chapels which were opened all over England…. In Italy, nearly, fifty new religious holidays were created’, পাছে ঈশ্বরের কোপানল আরেকবার এসে পড়ে মর্ত্যবাসীর ওপরে! এই প্যারাডক্সের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিগলার বলেছেন যে, মহামারীর কারণে ধনী ব্যক্তিরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা ভাবতে শুরু করেছিলেন নানা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদের মধ্যে বুঝি ‘পাপের গ্লানি’ লেগে আছে। চার্চকে সেই অর্থের কিয়দংশ যদি দান করা যায়, তাতে বুঝি তাদের অপরাধের বোঝা কিছুটা হাল্ক্কা হয়! অবশ্য জিগলার এর পেছনে আরও নিগূঢ় অভিপ্রায় দেখেছেন।
[ক্রমশ]
মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল
পর্ব ::৫১
পূর্বে প্রকাশিতের পর
৬. নিম্নবর্গের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় জনগণের মধ্যে জনস্বাস্থ্য- কার্যক্রমের কার্যত অনুপস্থিতির ফল হয়েছিল মারাত্মক। তাদের বড় একটি অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বিভিন্ন রোগের দেবদেবীর (দেবীরই প্রাবল্য সে তালিকায় অবশ্য বেশি) সাধনায়, আর ক্ষুদ্র একটি অংশ রমেশ বা জগমোহনের মতো নিয়োজিত ছিল আত্মশক্তি-অনুপ্রাণিত স্বনির্ভর স্বাস্থ্য কার্যক্রমে। এদের একটি ধারা ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদকে’ প্রতিহত করতে চেয়েছে অনেকটা ভাবাদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত হয়েই। এ প্রসঙ্গে ১৯৩০-র দশকে প্রকাশিত ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ উল্লেখ করা যেতে পারে।
সাধারণ পঞ্জিকার তুলনায় এই ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ পার্থক্য ছিল এই যে, এখানে শুধু গ্রহ-তিথির আসা-যাওয়ার সংবাদই থাকত না, স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া হতো। গীতার সদুপদেশ কে-ই বা শুনে বা মনে রাখে, কেননা তার বক্তব্য বেশ জটিল। পঞ্জিকাকে যদি ‘স্বাস্থ্য-গীতা’ করে তোলা যায়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ বৃহত্তর (শিক্ষিত) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সেসব স্বাস্থ্য-পরামর্শের মধ্যে দুটি ধারা ছিল। একটি হচ্ছে, বিদেশি বিশেষত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা; অপরটি হচ্ছে দেশীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রশংসা। বিদেশি চিকিৎসার পদ্ধতি এ দেশে অচল, কেননা বিদেশি জীবনচর্চার ধরন এ দেশের জল-হাওয়ার সাথে মিলবে না। এ দেশের মানুষের শরীরের উন্নতির জন্য চাই এর সংস্কৃতি-ধর্ম-পরিবেশের উপযোগী স্বাস্থ্য-জ্ঞান। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সমর্থকরা যেভাবে টীকা দিয়ে বা সুঁই ফুটিয়ে রোগ নিরাময় করতে চাচ্ছে, এটা আপামর জনগণের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাদের রক্ষা করার জন্য আছে এ দেশেরই শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র। এই অভিমত স্পষ্টতই ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের তত্ত্বকে এরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন- প্রায় ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’ বলে ভেবেছেন- এক প্রকার ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার ও বায়ো-পাওয়ার ধারণার থেকে এই প্রতিরোধের ডিসকোর্স একেবারেই আলাদা। একে নিছক আধুনিকতার’ সাথে ‘প্রাক্-আধুনিকতার’ দ্বন্দ্ব, বা ‘প্রগতিপন্থা’ আর ‘রক্ষণশীলতার’ মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল করা হবে। এই দ্বন্দ্ব তৈরিই হতো না, বা হলেও এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না, যদি উনিশ-বিশ শতকে এ দেশের মহামারি বা মারির উদ্ভব মোকাবিলায় ইংরেজ সরকার প্রকৃত অর্থেই জনগণের স্বাস্থ্য-পরিস্থিতি বা জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতেন।
এ ক্ষেত্রে আমি মো. উমর মুশতাকের ‘পাবলিক হেলথ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া : এ ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব দ্য হিস্টরি অন মেডিকেল স্টাডিসেস অ্যান্ড ডিজিজ প্রিভেনশন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধটির সাহায্য নিয়েছি। সবিস্তারে বলি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে ১৮৬৮ সালে বাংলায় একটি পৃথক ‘সিভিল মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ গঠিত হয় এবং ১৮৬৯ সালে একটি ‘পাবলিক হেলথ কমিশনার’-এর পদ সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই বিভাগ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। কেবলমাত্র ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সাংবিধানিক সংস্কারের পরেই সুস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ বিভাগের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৮০ সালে পৌরসভা এলাকায় এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বাসরত সকল শিশুদের জন্য টীকাদান বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এর প্রয়োগ সীমিত ছিল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮০-৮১ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে টীকাদানের হার ছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ; ১৯০২-০৩ সালে তা সামান্য বেড়ে ৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ, উপনিবেশের গ্রামাঞ্চল এই টীকা কার্যক্রমের বাইরে ছিল। অথচ কিছুদিন পর পর মহামারির মুখোমুখি হতে হয়েছে উপনিবেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে। যেমন, প্লেগ হয়েছে ১৮১২ সালে গুজরাটে ও সিন্ধু প্রদেশে (প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছিল এর তাণ্ডবলীলা); হয়েছে ১৮২৮-২৯ সালে পাঞ্জাবে; ১৮৩৬ সালে রাজপুতানায়; ১৮৯৬ সাল থেকে ব্যুবনিক প্লেগ প্রথমে মারাত্মক আকার ধারণ করে বোম্বাই, পুনে, কলকাতা ও করাচির মতো বড় বড় শহরে এবং পরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে যায়। এক হিসাবে, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্লেগের কারণে মারা যায় প্রায় ২০ লাখ লোক। এবার আসি কলেরার প্রসঙ্গে। ১৮১৭-২১ সালজুড়ে মহামারি হিসেবে কলেরা বাংলা থেকে শুরু হয়ে এক সময় সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর জন্য দায়ী করা হয় ট্রপিক্যাল দেশের জন-হাওয়াকে এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে দলবেঁধে মেলা উদযাপন, ধর্মীয় উৎসব পালন, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি ‘সাংস্কৃতিক উপাদানকে’। ১৮৬৮ সালে এসে কলেরা মহামারির কারণ খতিয়ে দেখতে সর্বপ্রথম ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি করে
ঔপনিবেশিক সরকার। কলেরা রোধে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা এ নিয়েও কমিটির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৮৬২ সাল থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে, পাঞ্জাবে, বাংলায় কলেরা প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিয়েছিল। একই কথা খাটে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে। তবে এ ক্ষেত্রে ১৮৮১ সালের পর থেকে কিছুটা ‘ব্রেক-থ্রু’ হয়। সেটা ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসেসের অধীনে সদ্য যোগ দেওয়া সার্জেন্ট মেজর রোনাল্ড রসের গবেষণার কারণে। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় এনোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট ছড়ানোর চক্র তিনি আবিস্কার করেছিলেন (এর জন্য ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান)। কুইনাইনের বড়ি চালু হওয়ার পরও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ চলতেই থাকে। তার একটি বড় কারণ হলো মশার বিস্তার রোধে ব্যর্থতা এবং ‘ড্রেইনেজ সিস্টেমের’ শোচনীয় পরিস্থিতি। এত সাতকাহন সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ হলো, উনিশ-বিশ শতকে (স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত) কি জনস্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে, কি বিভিন্ন মহামারির বিস্তাররোধে তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়নি উপনিবেশের পটভূমিতে। ঔপনিবেশিক সরকারের কাছ থেকে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা কেবল পেয়েছে এ দেশের জনগণ, কোনো ‘বায়ো-পাওয়ার’-এর অভিজ্ঞতা মেলেনি তাদের। সন্দেহ কী, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা-পদ্ধতি ও পাশ্চাত্যের প্রচার করা ‘জনস্বাস্থ্যের’ ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরূপ ও প্রতিরোধী মনোভাব এখানে গড়ে উঠবে। সেকালের পঞ্জিকা ঘাটলে এ রকম প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তকে শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের ‘পাঁজিতে স্বাস্থ্যচর্চা’ প্রবন্ধের ওপরে (গৌতম ভদ্র সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত) আমি নির্ভর করেছি।
মহামারির মুখে পড়ে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জয়গান গাওয়া হয়েছে এভাবে :
‘যুগে যুগে সামাজিক রাষ্ট্রীয় আকার,
কিছু কিছু রূপান্তর হয় বটে তার।
অবিকৃত কিন্তু স্বাস্থ্য-বিধি সনাতন;
হাসিমুখে বলিয়াছি সে সব বচন,
চরক, সুশ্রুত, অত্রী, হায়ীত, নারদ,
মনু, পরাশর আদি লিখেছে বিশদ,
আয়ু রক্ষণের কত মহামূল্য কথা!
ঘটে দুঃখ সে সবার করিলে অন্যথা।’
যেটা বিস্ময়কর, মহামারির কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে সনাতন ধর্মের পতন এবং ক্রমবর্ধমান অনৈতিকতাকে। অবশ্য পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জীবাণু তত্ত্বেরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অগ্রাধিকার স্বীকার করেই। ধর্মের পতন এবং নৈতিকতার স্খলন যে-স্বাস্থ্যহানির জন্য দায়ী তাতে স্বাস্থ্য-গীতার লেখকদের মনে কোনো সন্দেহ নেই:
‘বিরুদ্ধ ভোজন আর অহিত ভোজন,
অসাধু আলাপ, বৃথা কালের যাপন;
পুস্করিণীতে শৌচত্যাগ, ঘরে থুথু ফেলা,
বাসিমুখে পানাহার, নিদ্রা সন্ধ্যা বেলা,
অবৈধ সঙ্গম আদি বদভ্যাস হয়;-
জানিবে শাস্ত্রীয় বাক্য মিথ্যা ইহা নয়।’
পাশ্চাত্যের জীবাণু-তত্ত্বের সাথে মেশানো হয়েছে প্রাচ্যের আয়ুর্বেদশাস্ত্র। এসেছে মহামারি প্রতিরোধের প্রসঙ্গ :
‘এইবার বলি কিছু জীবাণু-জীবন;
বিবিধ রোগের যারা প্রধান কারণ।
আয়ুর্বেদে ইহাদেরই সূক্ষ্ণ কৃমি নাম,
এদেরই মারণ-মন্ত্র দেছে যজু: সাম।
যত কিছু সংক্রামক প্রাণহারী ব্যাধি,
এই সূক্ষ্ণ জীবদান সে সবার আদি।
বিসূচিকা, ক্ষয়কাস, ম্যালেরিয়া আর,
দাঁতের গোড়ার রোগ, ধনুষ্টংকার,
তালু-ক্ষত, বাতশ্নেষ্ফ্মা, আর কালাজ্বর,
আমাশয় আদি জন্মে জীবাণু-ভিতর।
চর্ম্মচক্ষে ইহাদের দেখা নাহি যায়;
নিতে হয় অণুবীক্ষ্য-যন্ত্রের সহায়।’
দেখা যাচ্ছে, ১৯২৬ সালের এই পঞ্জিকাটিতে যে ধরনের ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’ প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে যেমন আছে সনাতনী রক্ষণশীলতা, তেমনি আছে আধুনিক বিজ্ঞানকে স্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গি। আয়ুর্বেদ এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মধ্যে একটা সংশ্নেষণ করে ভারতীয় ধারার একটা আধুনিকতা সৃষ্টিরও চেষ্টা পাই এতে। এই ‘স্বাস্থ্যধর্ম গৃহ পঞ্জিকা’ বের করেছিলেন কার্তিক চন্দ্র বসু- তিনি নিজে পাশ্চাত্য ডাক্তারি বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন এবং ১৮৯৯ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুবিখ্যাত বেঙ্গল কেমিক্যালসে যোগ দেন। একপর্যায়ে রোগ নিরূপণ ও ভেষজ ওষুধ তৈরি করার জন্য নিজেই শুরু করেন ‘বোসেজ ল্যাবরেটরি।’ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে ভেষজ তত্ত্বের মিল ঘটিয়ে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এভাবেই মহামারি স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিল।
তবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদের সাথে শহরের এবং গ্রামের নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রতিদিনের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামের মধ্যে যখন তারা মারি বা মহামারিতে আক্রান্ত হতেন, তখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল দূরের ঈশ্বর যাকে তারা নানা দেব-দেবীর বিগ্রহ মূর্তিতে পূজা করত। এই ঐতিহ্য পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। কুশান যুগে যক্ষ-দেবী হারিতি (ঐধৎরঃর)-এর পূজা করা হতো – ইনি তুষ্ট থাকলে সকল আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করতেন। এর মধ্যে ছিল গুটি-বসন্ত, উচ্চহারে শিশু-মৃত্যু, জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃ-মৃত্যু প্রভৃতি। কথিত আছে, পরে তিনি বুদ্ধদেবের শিষ্যা হয়ে বৌদ্ধ দেবী হয়ে ওঠেন। কনিস্ক সাম্রাজ্যে গুটি-বসন্তের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বৌদ্ধ -স্তুপার ভেতরে হারিতিকে উৎসর্গ করা বিগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়। হারিতি দেবীর ক্ষমতা ছিল জ্বরের উচ্চমাত্রাকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার- এর ফলে যে কোন জ্বরকে শীতল করার দেবী হিসেবেও তাকে দেখা হয়। পরবর্তীতে এই হারিতি দেবীই বাংলায় এসে হয়ে ওঠেন লোক-দেবী শীতলা-নামের ভেতরেই তার ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে। ‘শীতল করে দিতে পারেন’ সব জ্বরকে, এবং এভাবেই তিনি সারিয়ে তোলেন জ্বরের রোগীকে। শুধু গুটিবসন্ত নয়, সকল জ্বরের উপশমের দেবী হচ্ছেন এই শীতলা দেবী। অন্ত্যজ শ্রেণীর নাপিত, মুচি, কামার, কুমোর, চর্মকার প্রভৃতি পেশাবর্গের মধ্যে (সাধারণভাবে দক্ষিণবঙ্গের কৃষক শ্রেণীর ভেতরে) শীতলা দেবীকে জাগ্রত দেবী হিসেবে সাড়ম্বরে পূজা করা হয়ে থাকে এখনো। লোক-কল্পনায় কোন অজ্ঞাত কারণে শীতলা দেবীর বাহন হচ্ছে গাধা-হয়তো ভারবাহী প্রাণীকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়েছে বাহন রূপে। গুটিবসন্ত ও হামের দেবী যেমন শীতলা, তেমনি কলেরার দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ওলাই চন্ডী (হিন্দুদের মধ্যে) এবং ওলা বিবি (মুসলমানদের মধ্যে)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক রালফ নিকোলাস মনে করেন যে, বাংলায় লোক-দেবী হিসেবে মনসা ও শীতলা উভয় দেবীরই পূজা বলেও শীতলাই খানিকটা এগিয়ে আছেন। অন্য কিছু চর্চায়, সর্পদেবী মনসা ও ষষ্ঠীর সাথে শীতলা দেবীকে অভিন্ত জ্ঞান করা হয়েছে। বোম্বাইয়ের পূর্ব-কথিত ১৮৯৯ সালের প্লেগের সময়ে এক ‘প্লেগমাতার’ আবির্ভাব হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’, কিন্তু তার পূজা হতো শীতলা মন্দিরে। এ নিয়ে ও.ঔ.ঈধঃধহধপয তার ‘ প্লেগ এন্ড দ্যা ইন্ডিয়ান ভিলেজ : ১৮১৬-১৯১৪’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তবে শীতলা দেবীর নাম প্রদেশ-ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তামিলনাড়ূতে বসন্ত রোগের দেবীর নাম মারি আম্মা, দক্ষিণ আরকটে তার নাম কান্নি আম্মা। নাম যা-ই হোক, এই সকল লোকদেবীর পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্য একটাই- জনস্বাস্থ্য- সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মহামারি থেকে রক্ষা করা।
[ক্রমশ]