মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫৪

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৭. মহামারী ও আধুনিক সাহিত্যের ধারা :এলিয়ট ও ইয়েটস্‌

১৯২২ সাল। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের জন্মবছর এটি। একই বছরে প্রকাশিত হয় টি. এস. এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস্‌’ উপন্যাস, আর ভার্জিনিয়া উলফ্‌-এর ‘মিসেস ডেলাওয়ে’। এর তিন বছর আগে ইয়েটস্‌ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’। এই সবগুলোর পেছনে কাজ করেছে একটাই ‘ইউনিফাইং থিম’ বা প্ররোচনা- মহামারীর অশুভ ছায়া। ২০১৮ সালের ঠিক একশ’ বছর আগে বিশ্বজুড়ে যে মহামারী সংঘটিত হয়েছিল, তার নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু। তা নিয়ে ২০১৮ সালে কোনো কোনো সংবাদপত্রে ছোট্ট নিবন্ধ বেরিয়েছে, কিন্তু বড় আকারে কোনো আলোচনা চোখে পড়েনি। অথচ এই স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গিয়েছিল সে সময় বিশ্বের ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ; আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। বস্তুত ১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর পরে স্প্যানিশ ফ্লুর মতো ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা নিয়ে আর কোনো মহামারী আত্মপ্রকাশ করেনি। এই ফ্লুতে যত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, সমগ্র প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ মিলিয়েও এত লোকের মৃত্যু ঘটেনি। তাহলে এই মহামারী নিয়ে এত নিস্তব্ধতা কেন? একটা কারণ হতে পারে- আর সেটা ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছিলেন, যার সহজীকৃত মর্মার্থ হলো-‘Silences about public horrors can permit human societies to cope with collective recovery and to progress’|  জীবনানন্দও বলেছিলেন বুঝি এই মর্মে- ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’ হয়তো-বা তা-ই। কিন্তু সমসাময়িক এলিয়ট, উলফ্‌ বা ইয়েটসের পক্ষে এই অদৃষ্টপূর্ব মহামারীকে ভুলে যাওয়া কঠিন ছিল।

এলিয়ট আর তার স্ত্রী ভিভিয়ান এলিয়ট দুজনেই ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যখন এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করছিলেন তারা, তখনই তিনি ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ শেষ করার কাজে হাত দেন। মহামারী যে প্রবলভাবে আক্রান্ত করেছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সাহিত্য ও শিল্পের ধারাকে সেটা শুধু সম্প্রতি সাহিত্য-সমালোচনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। যেন দান্তের ইনফার্নোর মতো মড়ক লেগেছে লন্ডন শহরে, সেভাবেই কবি এলিয়টের চোখের সামনে মৃত্যুর মিছিল ভেসে উঠছে :

‘Unreal City,
Under the brown fog of a winter dawn,
A crowd flowed over London Bridge, so many,
I had not thought death had undone- so many.
Sighs, short and infrequent, were exhaled,
And each man fixed his eyes before his feet.
Flowed up the hill and down King William Street.’

সবাই জানেন যে, এলিয়ট ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যগ্রন্থে ধাঁধার মতো করে বলেছিলেন :

‘April is the cruelest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.’

এপ্রিল কেন ‘সবচেয়ে নিষ্ঠুর’ মাস হতে যাবে? যে-জমি উর্বরা সেখানে এপ্রিল মাসে বসন্ত সমাগত হয়, পশ্চিমের দেশগুলোয় বরফ গলতে শুরু করে, আর বরফের নিচ থেকে মাথা তুলতে শুরু করে হরিৎ তৃণ-গুল্ম, নানা বর্ণের ফুল, আসে নতুন ফসলের মৌসুম। কিন্তু বন্ধ্যাজমিতে (ওয়েস্ট ল্যান্ড তো অপুষ্পক জমি) এপ্রিল মাস মিছেমিছি বসন্তের আশা জোগায়- সেখানে নতুন করে কিছুই জেগে ওঠে না- না-পুষ্প না-পত্রালি না-মৌমাছির গুঞ্জন না-প্রজাপতির আলোড়ন। সেদিক থেকে এপ্রিল যেন আমাদের অপূর্ণতাকে না-পূরণ হওয়া সম্ভাবনাগুলোকে নিয়ে কর্কশ ঠাট্টা করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো কিছু আশা করাই অন্যায় বা আশা করলে তা হবে ভুল কিছুর জন্য আশা করা। বহু পরে তিনি এ কারণেই কি বলবেন ‘ফোর কোয়াট্রেটস’ কাব্যগ্রন্থে –  ‘Hope would be hope for the wrong thing’?  তার পরও একসময় মহামারী শেষ হয়, মৃত্যুর স্রোতের ভেতর থেকে জীবনের হাত জাগতে দেখা যায়, ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতার শেষে হিমালয়ের চূড়ায় জড়ো হয় মেঘদল, শোনা যায় বজ্রপাত – বৃষ্টির শব্দ, আর নতুন জীবনের পদধ্বনি।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পূর্বে প্রকাশিতের পর

মহামারি-পরবর্তীকালে চার্চের প্রভাব এতটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, তাকে কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে না পারলে জন-অসন্তোষ বেড়ে যেতে পারত এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জনবিদ্রোহের সূচনা হতে পারত। এ কারণেই চার্চসমূহকে অর্থ-সাহায্য করার জন্য ওরা এত উদগ্রীব হয়েছিলেন :
Yet, perhaps even more than this, the frenzied charity in which the rich of Europe indulged during and after the Block Death demonstrated their faith in the one institution where it seemed a proper sense of social discipline survived. Discredited the Church might be in the eyes of many but, to the nobles and the monied elite, it was still the dyke which held back the flood of anarchic insurrection unless it were shored up then everything, it seemed, might be swept away.

১৬৬৫ সালের প্লেগের অনুরূপ ফলেও অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, ধারণা করা যায় ১৮৩০-এর দশকের কলেরার প্রকোপ নিয়েও এমনটা ভাবা চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে লন্ডনের গ্রেট প্লেগ-এর তুলনায় ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে সাক্ষী মেনেছেন গুটিবসন্তের মহামারীকে। উদাহরণত, ১৬৮৮ সালেরGlorious Revolution ছিল প্রথম বড় আকারের অভিঘাত-সম্পন্ন ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ (দ্বিতীয়টি ছিল, ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা-ঘোষণা, এবং তৃতীয়টি ছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব)। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাজশক্তির নিরঙ্কুশ দাপুটে ক্ষমতা অনেকখানি কমে যায়, এবং ধনাঢ্য বণিক-শিল্পপতি বুর্জোয়া-শ্রেণির প্রভাবাধীন ‘সংসদের’ রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়ে যায়। জায়মান বুর্জোয়ার অর্থনৈতিক অধিকার/ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়, যা ছিল ধনবাদী বিকাশের পক্ষে খুবই সহায়ক (যার প্রমাণ মেলে শিল্প-স্থাপনে জমি-অধিগ্রহণ বা Land-enclosure নীতি-বাস্তবায়নের মধ্যে)। যেটা আমাদের সচরাচর বোধের বাইরে ছিল, এই Glorious Revolution-কে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল গুটি-বসন্তের মহামারী। ব্যাপারটি কাকতালীয়, কিন্তু ঘটনা-প্রবাহ বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘প্লেগস্‌ অ্যান্ড পক্সেস :দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিউম্যান হিস্টরি অন এপিডেমিক ডিসিসেস’ গ্রন্থের লেখক আলফ্রেড বোলেট (Bollet) জানিয়েছেন এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে। আমি এখানে তার বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি :

‘রাজপরিবারের ওপরে বসন্তের মহামারির প্রভাব প্রায়শ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২৯ বছর বয়সে প্রথম এলিজাবেথ ১৫৬২ সালে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন… ১৬৬০ সালে দ্বিতীয় চার্লস যখন ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন সিংহাসনের দখল নিতে, হেগ শহর থেকে তার দলবল জল-বসন্তের মহামারির বীজ বয়ে নিয়ে এসেছিল। তাতে চার্লসের সেই ভাই (গ্লুস্টেরের ডিউক) এবং প্রিন্সেস মেরি মৃত্যুবরণ করেন। স্যামুয়েল পেপিস (Pepys)-এর দিনলিপি লন্ডনে ১৬৬১ সালের গুটি-বসন্তের প্রাদুর্ভাবের বর্ণনা দিয়েছে।…এই মহামারীর কারণে ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারেও পরিবর্তন আসে। ১৬৮৮ সালে রোমান ক্যাথলিক ধারার অনুসারী রাজা জেমস দ্বিতীয়কে গ্লোরিয়াস রিভোলিউশনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় (জেমস ফ্রান্স পালিয়ে যান)। তখন জেমসের কন্যা মেরি ও তার স্বামী উইলিয়াম সিংহাসন লাভ করেন। তারা দুজনেই ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট ধারায় বিশ্বাসী। কিন্তু ১৬৯৪ সালে মেরি গুটি-বসন্তে মৃত্যুবরণ করেন কোনো সন্তানাদি না রেখেই। উইলিয়াম (William. III নামে পরিচিত- ইনি ছিলেন মেরি স্টুয়ার্টের ছেলে) ১৭০২ সালে মারা গেলে মেরির ছোট বোন এ্যান (Anne) সিংহাসনে বসেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবারও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয় যখন এ্যানের ছেলে বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে জল-বসন্তে মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে সংসদে আইন পর্যন্ত পাস হয় যে, পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়া এরপর রাজপরিবারের কোন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বিদেশে ভ্রমণ করতে পারবেন না। এ্যানের মৃত্যুর পরে ব্রিটিশ রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন জার্মানিতে বাসরত রাজা জর্জ প্রথম। তারা বাড়িতে জার্মান ভাষায় কথা বলতেন। পরে এরাই ইরেজি আদব-কায়দা-ভাষা আয়ত্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন উইন্ডসর ঘরানা (বা The Windsors) যার উত্তরসূরি হচ্ছেন বর্তমানে ইংল্যান্ডের রানী।’ দেখা যাচ্ছে, জল-বসন্ত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫২

পূর্বে প্রকাশিতের পর

নিম্নবর্গের দেব-দেবীর পূজা-অর্চনাকে পাছে কেউ ‘এশিয়াটিক বারবারিজম’-এর উদাহরণ হিসেবে খাটো করেন সে জন্য বলে রাখি যে, প্লেগ-তাড়িত ক্যাথলিক ইউরোপে খ্রিষ্টের অনুসারীদের মধ্যে রোগ-নিরাময়ের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মহাত্মাদের কাছে ‘প্রার্থনা করার’ রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকার ১৯ মার্চ ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এক চিত্তাকর্ষক নিবন্ধ- ‘দ্য বেস্ট সেইন্টস্‌ টু প্রে ডিউরিং আ পেনডেমিক’। তাতে বলা হয় যে প্লেগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য সেইন্ট হলেন সেইন্ট সিবাসটিয়ান। খ্রিষ্টীয় তৃতীয়য় শতকের এই পুণ্যাত্মাকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে মনে করা হতো। সিবাসটিয়ানের অর্চনার প্রমাণ মেলে রোমে ৬৮০ সালে, মিলানে ১৫৭৫ সালে, লিসবোঁয়াতে ১৫৯৯ সালের প্লেগের দিনগুলোতে। প্লেগের মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমন আরেকজন ছিলেন সেইন্ট রোস (St Roch)। ইতালির এই পুণ্যাত্মার কাছে বিশ্বাসীরা আজও দুর্দৈবে পড়লে প্রার্থনা করে থাকে :

“O Blessed St. Roch,
Patron of the Sick,
Have pity on those
Who lie upon a bed of suffering.

Your Power Was so great
When you were in this world,
That by the sign of the Cross,
Many were healed of their diseases.

Now that you were in heaven,
Your power is not less.
Offer, then, to God
Our sighs and tears.
And obtain for us that health we seek
Through Christ Our Lord
Amen.”

এই তালিকায় নারী সেইন্টারাও রয়েছেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সেইন্ট রোজালিয়ার নাম। যারা গসপেল অব মেরির খ্রিষ্ট-সহকর্মী মেরি মাগদালেনার কথা মনে রাখেন, তারাই জেনেছেন যে এই পুণ্যাত্মা নারীর নাম নিলে মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অন্তত এই ধারার বিশ্বাসীদের তাই অভিমত।

মুসলিম ঐতিহ্যেও আধ্যাত্মিক গুণাবলিসম্পন্ন অনেক পুণ্যাত্মা মহাপুরুষ পীর-আউলিয়া ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসেছেন যাদের আশ্চর্যজনক ‘নিরাময় ক্ষমতা’ (হিলিং পাওয়ার) ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিত্যদিনের অসুখে-বিসুখে পড়লে এসব পুণ্যাত্মাগণের সমাধিস্থল বা মাজারশরিফে গিয়ে মানত করার লোক-ঐতিহ্য ছিল বা এখনও আছে। পূর্ব বাংলায় এই পরম্পরা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। ‘মুসলিম সেইন্টস্‌ অব সাউথ এশিয়া : দ্য ইলেভেনথ্‌ টু ফিফটিনথ্‌ সেনচুরিস্‌’ গ্রন্থে আনা সুভরভা লিখেছেন, মধ্যযুগে ‘প্লেগের মহামারীতে দিল্লির লোকজন একত্রিত হয়ে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি-র মাজারে জিয়ারত করতে গিয়েছিল।’ সাধারণ মানুষের কাছে এসব পুণ্যাত্মা ব্যক্তিবর্গের আবেদন ছিল ভরসা-প্রার্থনার একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে। রিচার্ড ইটন তার সুবিখ্যাত বইতে (‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’) পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় (বিশেষত দক্ষিণ বঙ্গে), মাজারের তুলনামূলক অধিক সমাবেশ দেখিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জঙ্গল কেটে বসত গড়ার ক্ষেত্রে তারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এবং মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকার কারণে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার সহজতর হয়েছিল। কিষণ চন্দর হয়তো অতিশয়োক্তি করেছেন, কিন্তু দুর্দৈবের মুখে তার মা’র বিভিন্নমুখী ধর্মবিশ্বাস একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সাধারণ মানুষই বিপদ থেকে বাঁচতে সব উৎসের দিকেই হাত বাড়াতেন। এখন হয়তো ‘শিক্ষিতের’ হার বাড়ার সাথে সাথে বহুত্ববাদী প্রবণতা অনেকখানি কমে এসেছে, তার পরেও তা পরিদৃষ্ট হয়। পুরো উদ্ধৃতিটি দেওয়া প্রয়োজন। কিষণ চন্দর তার মা সম্পর্কে লিখেছেন :

‘Creating for sacred places ran in my mummy’s blood. She did not read books on national unity, did not hear speeches on religious tolerance and did not know words like humanism and equality of people….To make up for it she visited Hindu temple as well as Sikh gurdwara, prayed to Hindu gods and made offerings at the mazars of Muslim saints—and all this also ran in her blood. Thus, like her, lived whole generation in old, illiterate, undivided India and by their efforts in the course of many centuries was the composite national culture was created’.

উপরের আলোচনা থেকে মনে হতে পারে, মানুষজন মহামারীর প্রভাবে আরও বেশি করে নিয়তিবাদের তাদের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, বাহ্যিক ধর্মাচরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, লোকজ দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যেতে পারে। তারা মনে করতে পারে যে মহামারী হচ্ছে পাপবিদ্ধ মানুষের ওপরে নেমে আসা অভিশাপ (যেমন করে গান্ধী ১৯৩২ সালের বিহারের ভূমিকম্পকে অতিরিক্ত জাত-পাত মানার জন্য বিধাতার ক্রুদ্ধ অভিশাপ বলে ভেবেছিলেন এবং এই মর্মে রবীন্দ্রনাথের তিরস্কারও কুড়িয়েছিলেন) যেন এক অদৃশ্য অনিয়ন্ত্রণক্ষম শক্তি আমাদের জীবন ও ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে- বিজ্ঞান যার কাছে অসহায়, রাষ্ট্র যার কাছে পরাস্ত, ব্যক্তিস্বরূপ যার কাছে অগ্রাহ্য। চারদিকের অসুখ-বিসুখে ক্লান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা’ এমন ধারণা করাও অযৌক্তিক নয়। মহামারীর ইতিহাস অবশ্য দু’ধরনের প্রবণতাই দেখায়। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুই ধারাকেই সামনে মেলে ধরে।

যেমন, ১৩৪৬-৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথ অভিহিত প্লেগের ফলে বিশ্বাসের বন্ধন অনেকখানি আলগা হয়ে এসেছিল। মধ্যযুগকে যে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়ে থাকে তার বড় একটি কারণ ছিল ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব। এই অন্ধকার যুগের পরেই রেনেসাঁ-পর্বের শুরু। প্লেগের কালো মহামারীর ৫০ বছরের মধ্যেই কতকগুলো পরিবর্তন দেখা দেয়। প্রথমত, জনসংখ্যা হঠাৎ করে কমে যাওয়ায় সামন্ত-ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়। ইংল্যান্ডের কৃষিতে দাসপ্রথার ব্যবস্থা (তথাকথিত  Villianage System) উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। এর একটা বড় কারণ মহামারী-পরিস্থিতিতে শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মজুরির হার বেড়ে যায়, কৃষিতে ‘মুক্ত শ্রমের’ চলাচল অবাধ হতে থাকে, কৃষিকাজ আর সামন্তদের জন্য আগের মতো লাভজনক হতে পারে না। কৃষিতে ভাগ বা বর্গা-ব্যবস্থার বিকাশ হতে থাকে। এর ফলে, যারা মহামারীর পরে বেঁচে রইল, তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকে। দ্বিতীয়ত, সামন্তবাদের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ছিল প্রাত্যহিক জীবনে (ক্যাথলিক) চার্চের প্রবল প্রভাব। মধ্যযুগের ‘পাপ-পুণ্যের থিওরি’ দিয়ে মহামারীর আক্রমণকে আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। অসুখ হলে এটা বিধাতার অভিশাপ, এবং এজন্য অনুতাপ ও ক্ষমা চাওয়ার যে প্রথা মধ্যযুগে সূচিত হয়েছিল, তা অনেকটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। চার্চের সাথে জড়িত অনেক ধর্মযাজকই তখন প্লেগের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্লেগ পুণ্যাত্মা-পাপাত্মা কাউকেই নিস্তার দেয়নি। সাধারণ ধর্মবিশ্বাসের জন্য এটি ছিল একটি বড় আঘাত। এর মানে এই নয় যে, ধর্মবিশ্বাস মহামারী-পরবর্তী যুগে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মধ্যযুগে জনজীবনের ওপরে ধর্মের যে-প্রবল সর্বগ্রাসী প্রভাব ছিল তা আর মহামারী-পরবর্তী যুগে সেভাবে থাকেনি। এক্ষেত্রে ১৩৪৬-৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে, তেমনি হিসাবে নিতে হবে ১৬৬৫ সালের লন্ডনের গ্রেট প্লেগকে। এ দুইয়ের মধ্যকার তিনশ’ বছরে ছোট-বড় আরও অনেক প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে ইউরোপে। তা ছাড়া, প্লেগ ছাড়া জল-বসন্তও হুমকি হিসেবে ছিল, এটাও মনে রাখতে হয়। মোট কথা, মহামারীর প্রভাবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালিতে জেগে ওঠা রেনেসাঁর ধারা (লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির যুগ) বা ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে রেনেসাঁর ধারা (শেক্সপিয়রের যুগ) ‘মানবতাবাদকে’ শিরোধার্য করেছিল- দেবত্ববাদকে নয়। ঈশ্বরের পাশাপাশি মানুষের গল্পকথা তাই এই পর্বের চিত্রকর্মে, কবিতায়, নাটকে ও গল্পে উঠে এসেছে। একেই সমালোচকরা ‘Renaissance Humanism’  বলেছেন। এর প্রভাবেই আমরা পেয়েছি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও বতিচেল্লির চিত্রকর্ম, বোকাচিও (Bocaccio)-র অমর সৃষ্টি ‘ডেকামরন, চসারের ‘ক্যান্টরবিউরি টেলস্‌’, আর শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়র’ (যা লেখা হয়েছিল ১৬০৬ সালের প্লেগের সময়ে যখন লন্ডনের গ্লোব থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায় এবং যেখানে শেক্সসপিয়রের নাটক মঞ্চন্থ হতো) ও তার অন্যান্য ট্র্যাজেডিতে বিধৃত মানবতাবাদ। তৃতীয়ত, কালো মৃত্যু শুধু মানবতাবাদের পথই প্রশস্ত করেনি বা চার্চের ওপরে সর্বজনীন আস্থায় চিড় ধরায়নি, রাষ্ট্র বা রাজশক্তির ন্যায্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। মহামারীর কালে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটল, অনেক ধর্মযাজক আর্তের সেবা দিয়ে মারা গেলেন, শহর জনশূন্য হয়ে গেল, গ্রাম উজাড় হলো, আর রাজন্য বর্গ লোকালয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে আশ্রয় নিলেন। অন্ধকার যুগের মহামারী হিসেবে প্লেগ যেভাবে রাজশক্তির ন্যায্যতাকে নাড়া দিয়েছে, তা থেকে সামলে উঠতে বহু বছর/শতাব্দী লেগেছিল ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহকে।

উপরের কথাগুলোর সমর্থন পাওয়া যায় প্লেগের সামাজিক ইতিহাসের বিশ্নেষক ফিলিপ জিগলার (Ziegler)-এর বইয়ের মাধ্যমে। আমি তিনটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তার লেখা থেকে তুলে দিতে চাই। মহামারী যে কীভাবে নৈতিক অবস্থার অধঃপতন ঘটায় সে সম্পর্কে জিগলার বলছেন :

‘The plague not only depopulates and kills; it gnaws the moral stamina and frequently destroys it entirely; thus the sudden demoralization of Roman society from the period of Mark Anthony may be explained by the Oriental plague… In such epidemics the best were invariably carried off and the survivors deteriorated morally. Times of plague are always those in which the bestial and diabolical side of human nature gains the upper hand.’

১৩৪৬-৪৮ সালের প্লেগের পরের কয়েক দশকে অবক্ষয়, অধঃপতন, এমনকি ভোগবাদের দিকে প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল বলে জিগলার মনে করেছেন। উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য :

‘Contemporary chronicles abound in accusations that the years which followed the Black Death were stamped with decadence and rich in every kind of vice. The crime rate soared; blasphemy and sacrilege were a commonplace; the rules of sexual morality were floated; the pursuit of money became the be-all and end-all of people’s lives…Who could doubt that humanity was slipping towards perdition when women appeared in public wearing artificial hair and low-necked blouses and with their breasts laced so high ‘that a candlestick could actually be put on them’.

আবারও বলছি, তার মানে এই যে, ধর্ম-কর্ম সমাজজীবন থেকে মহামারীর কারণে উঠে গেল। চার্চের ভাবমূর্তি ও আধ্যাত্মিক প্রভাবে চিড় ধরলেও চার্চের সংখ্যা আগে বেড়ে গিয়েছিল। জিগলার এই মুহূর্তকে শনাক্ত করেছেন এভাবে: ‘Paradoxically, the decades that followed the plague saw not only a decline in the prestige and spiritual authority of the Church but also a growth of religious fervor. One example of this was the large number of chantry Chapels which were opened all over England…. In Italy, nearly, fifty new religious holidays were created’, পাছে ঈশ্বরের কোপানল আরেকবার এসে পড়ে মর্ত্যবাসীর ওপরে! এই প্যারাডক্সের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিগলার বলেছেন যে, মহামারীর কারণে ধনী ব্যক্তিরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তারা ভাবতে শুরু করেছিলেন নানা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদের মধ্যে বুঝি ‘পাপের গ্লানি’ লেগে আছে। চার্চকে সেই অর্থের কিয়দংশ যদি দান করা যায়, তাতে বুঝি তাদের অপরাধের বোঝা কিছুটা হাল্ক্কা হয়! অবশ্য জিগলার এর পেছনে আরও নিগূঢ় অভিপ্রায় দেখেছেন।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫১

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৬. নিম্নবর্গের প্রতিক্রিয়া

স্থানীয় জনগণের মধ্যে জনস্বাস্থ্য- কার্যক্রমের কার্যত অনুপস্থিতির ফল হয়েছিল মারাত্মক। তাদের বড় একটি অংশ ঝুঁকে পড়েছিল বিভিন্ন রোগের দেবদেবীর (দেবীরই প্রাবল্য সে তালিকায় অবশ্য বেশি) সাধনায়, আর ক্ষুদ্র একটি অংশ রমেশ বা জগমোহনের মতো নিয়োজিত ছিল আত্মশক্তি-অনুপ্রাণিত স্বনির্ভর স্বাস্থ্য কার্যক্রমে। এদের একটি ধারা ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদকে’ প্রতিহত করতে চেয়েছে অনেকটা ভাবাদর্শগত বা রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত হয়েই। এ প্রসঙ্গে ১৯৩০-র দশকে প্রকাশিত ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ উল্লেখ করা যেতে পারে।

সাধারণ পঞ্জিকার তুলনায় এই ‘স্বাস্থ্য-গীতার’ পার্থক্য ছিল এই যে, এখানে শুধু গ্রহ-তিথির আসা-যাওয়ার সংবাদই থাকত না, স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া হতো। গীতার সদুপদেশ কে-ই বা শুনে বা মনে রাখে, কেননা তার বক্তব্য বেশ জটিল। পঞ্জিকাকে যদি ‘স্বাস্থ্য-গীতা’ করে তোলা যায়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ বৃহত্তর (শিক্ষিত) জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সেসব স্বাস্থ্য-পরামর্শের মধ্যে দুটি ধারা ছিল। একটি হচ্ছে, বিদেশি বিশেষত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সমালোচনা; অপরটি হচ্ছে দেশীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রশংসা। বিদেশি চিকিৎসার পদ্ধতি এ দেশে অচল, কেননা বিদেশি জীবনচর্চার ধরন এ দেশের জল-হাওয়ার সাথে মিলবে না। এ দেশের মানুষের শরীরের উন্নতির জন্য চাই এর সংস্কৃতি-ধর্ম-পরিবেশের উপযোগী স্বাস্থ্য-জ্ঞান। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সমর্থকরা যেভাবে টীকা দিয়ে বা সুঁই ফুটিয়ে রোগ নিরাময় করতে চাচ্ছে, এটা আপামর জনগণের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাদের রক্ষা করার জন্য আছে এ দেশেরই শত শত বছর ধরে চলে আসা প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র। এই অভিমত স্পষ্টতই ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের তত্ত্বকে এরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন- প্রায় ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’ বলে ভেবেছেন- এক প্রকার ‘স্বাস্থ্য-সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার ও বায়ো-পাওয়ার ধারণার থেকে এই প্রতিরোধের ডিসকোর্স একেবারেই আলাদা। একে নিছক আধুনিকতার’ সাথে ‘প্রাক্‌-আধুনিকতার’ দ্বন্দ্ব, বা ‘প্রগতিপন্থা’ আর ‘রক্ষণশীলতার’ মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল করা হবে। এই দ্বন্দ্ব তৈরিই হতো না, বা হলেও এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না, যদি উনিশ-বিশ শতকে এ দেশের মহামারি বা মারির উদ্ভব মোকাবিলায় ইংরেজ সরকার প্রকৃত অর্থেই জনগণের স্বাস্থ্য-পরিস্থিতি বা জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতেন।

এ ক্ষেত্রে আমি মো. উমর মুশতাকের ‘পাবলিক হেলথ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া : এ ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব দ্য হিস্টরি অন মেডিকেল স্টাডিসেস অ্যান্ড ডিজিজ প্রিভেনশন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধটির সাহায্য নিয়েছি। সবিস্তারে বলি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে ১৮৬৮ সালে বাংলায় একটি পৃথক ‘সিভিল মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট’ গঠিত হয় এবং ১৮৬৯ সালে একটি ‘পাবলিক হেলথ কমিশনার’-এর পদ সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত এই বিভাগ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। কেবলমাত্র ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সাংবিধানিক সংস্কারের পরেই সুস্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ বিভাগের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৮০ সালে পৌরসভা এলাকায় এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বাসরত সকল শিশুদের জন্য টীকাদান বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এর প্রয়োগ সীমিত ছিল মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮০-৮১ সালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে টীকাদানের হার ছিল মাত্র ২.৭ শতাংশ; ১৯০২-০৩ সালে তা সামান্য বেড়ে ৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এর একটা বড় কারণ, উপনিবেশের গ্রামাঞ্চল এই টীকা কার্যক্রমের বাইরে ছিল। অথচ কিছুদিন পর পর মহামারির মুখোমুখি হতে হয়েছে উপনিবেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে। যেমন, প্লেগ হয়েছে ১৮১২ সালে গুজরাটে ও সিন্ধু প্রদেশে (প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছিল এর তাণ্ডবলীলা); হয়েছে ১৮২৮-২৯ সালে পাঞ্জাবে; ১৮৩৬ সালে রাজপুতানায়; ১৮৯৬ সাল থেকে ব্যুবনিক প্লেগ প্রথমে মারাত্মক আকার ধারণ করে বোম্বাই, পুনে, কলকাতা ও করাচির মতো বড় বড় শহরে এবং পরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে যায়। এক হিসাবে, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত প্লেগের কারণে মারা যায় প্রায় ২০ লাখ লোক। এবার আসি কলেরার প্রসঙ্গে। ১৮১৭-২১ সালজুড়ে মহামারি হিসেবে কলেরা বাংলা থেকে শুরু হয়ে এক সময় সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর জন্য দায়ী করা হয় ট্রপিক্যাল দেশের জন-হাওয়াকে এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে দলবেঁধে মেলা উদযাপন, ধর্মীয় উৎসব পালন, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি ‘সাংস্কৃতিক উপাদানকে’। ১৮৬৮ সালে এসে কলেরা মহামারির কারণ খতিয়ে দেখতে সর্বপ্রথম ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি করে

ঔপনিবেশিক সরকার। কলেরা রোধে বিশুদ্ধ পানীয়জল এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থার আদৌ কোনো দরকার আছে কিনা এ নিয়েও কমিটির মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৮৬২ সাল থেকে ১৮৮২ সালের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে, পাঞ্জাবে, বাংলায় কলেরা প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিয়েছিল। একই কথা খাটে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে। তবে এ ক্ষেত্রে ১৮৮১ সালের পর থেকে কিছুটা ‘ব্রেক-থ্রু’ হয়। সেটা ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসেসের অধীনে সদ্য যোগ দেওয়া সার্জেন্ট মেজর রোনাল্ড রসের গবেষণার কারণে। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় এনোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট ছড়ানোর চক্র তিনি আবিস্কার করেছিলেন (এর জন্য ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান)। কুইনাইনের বড়ি চালু হওয়ার পরও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ চলতেই থাকে। তার একটি বড় কারণ হলো মশার বিস্তার রোধে ব্যর্থতা এবং ‘ড্রেইনেজ সিস্টেমের’ শোচনীয় পরিস্থিতি। এত সাতকাহন সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ হলো, উনিশ-বিশ শতকে (স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত) কি জনস্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে, কি বিভিন্ন মহামারির বিস্তাররোধে তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়নি উপনিবেশের পটভূমিতে। ঔপনিবেশিক সরকারের কাছ থেকে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের অভিজ্ঞতা কেবল পেয়েছে এ দেশের জনগণ, কোনো ‘বায়ো-পাওয়ার’-এর অভিজ্ঞতা মেলেনি তাদের। সন্দেহ কী, স্থানীয় জনগণের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসা-পদ্ধতি ও পাশ্চাত্যের প্রচার করা ‘জনস্বাস্থ্যের’ ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরূপ ও প্রতিরোধী মনোভাব এখানে গড়ে উঠবে। সেকালের পঞ্জিকা ঘাটলে এ রকম প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তকে শনাক্ত করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের ‘পাঁজিতে স্বাস্থ্যচর্চা’ প্রবন্ধের ওপরে (গৌতম ভদ্র সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত) আমি নির্ভর করেছি।

মহামারির মুখে পড়ে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জয়গান গাওয়া হয়েছে এভাবে :

‘যুগে যুগে সামাজিক রাষ্ট্রীয় আকার,

কিছু কিছু রূপান্তর হয় বটে তার।

অবিকৃত কিন্তু স্বাস্থ্য-বিধি সনাতন;

হাসিমুখে বলিয়াছি সে সব বচন,

চরক, সুশ্রুত, অত্রী, হায়ীত, নারদ,

মনু, পরাশর আদি লিখেছে বিশদ,

আয়ু রক্ষণের কত মহামূল্য কথা!

ঘটে দুঃখ সে সবার করিলে অন্যথা।’

যেটা বিস্ময়কর, মহামারির কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে সনাতন ধর্মের পতন এবং ক্রমবর্ধমান অনৈতিকতাকে। অবশ্য পাশাপাশি পাশ্চাত্যের জীবাণু তত্ত্বেরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অগ্রাধিকার স্বীকার করেই। ধর্মের পতন এবং নৈতিকতার স্খলন যে-স্বাস্থ্যহানির জন্য দায়ী তাতে স্বাস্থ্য-গীতার লেখকদের মনে কোনো সন্দেহ নেই:

‘বিরুদ্ধ ভোজন আর অহিত ভোজন,

অসাধু আলাপ, বৃথা কালের যাপন;

পুস্করিণীতে শৌচত্যাগ, ঘরে থুথু ফেলা,

বাসিমুখে পানাহার, নিদ্রা সন্ধ্যা বেলা,

অবৈধ সঙ্গম আদি বদভ্যাস হয়;-

জানিবে শাস্ত্রীয় বাক্য মিথ্যা ইহা নয়।’

পাশ্চাত্যের জীবাণু-তত্ত্বের সাথে মেশানো হয়েছে প্রাচ্যের আয়ুর্বেদশাস্ত্র। এসেছে মহামারি প্রতিরোধের প্রসঙ্গ :

‘এইবার বলি কিছু জীবাণু-জীবন;

বিবিধ রোগের যারা প্রধান কারণ।

আয়ুর্বেদে ইহাদেরই সূক্ষ্ণ কৃমি নাম,

এদেরই মারণ-মন্ত্র দেছে যজু: সাম।

যত কিছু সংক্রামক প্রাণহারী ব্যাধি,

এই সূক্ষ্ণ জীবদান সে সবার আদি।

বিসূচিকা, ক্ষয়কাস, ম্যালেরিয়া আর,

দাঁতের গোড়ার রোগ, ধনুষ্টংকার,

তালু-ক্ষত, বাতশ্নেষ্ফ্মা, আর কালাজ্বর,

আমাশয় আদি জন্মে জীবাণু-ভিতর।

চর্ম্মচক্ষে ইহাদের দেখা নাহি যায়;

নিতে হয় অণুবীক্ষ্য-যন্ত্রের সহায়।’

দেখা যাচ্ছে, ১৯২৬ সালের এই পঞ্জিকাটিতে যে ধরনের ‘স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদ’ প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে যেমন আছে সনাতনী রক্ষণশীলতা, তেমনি আছে আধুনিক বিজ্ঞানকে স্বীকার করার দৃষ্টিভঙ্গি। আয়ুর্বেদ এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের মধ্যে একটা সংশ্নেষণ করে ভারতীয় ধারার একটা আধুনিকতা সৃষ্টিরও চেষ্টা পাই এতে। এই ‘স্বাস্থ্যধর্ম গৃহ পঞ্জিকা’ বের করেছিলেন কার্তিক চন্দ্র বসু- তিনি নিজে পাশ্চাত্য ডাক্তারি বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন এবং ১৮৯৯ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুবিখ্যাত বেঙ্গল কেমিক্যালসে যোগ দেন। একপর্যায়ে রোগ নিরূপণ ও ভেষজ ওষুধ তৈরি করার জন্য নিজেই শুরু করেন ‘বোসেজ ল্যাবরেটরি।’ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে ভেষজ তত্ত্বের মিল ঘটিয়ে নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি। এভাবেই মহামারি স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিল।

তবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য-জাতীয়তাবাদের সাথে শহরের এবং গ্রামের নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। প্রতিদিনের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামের মধ্যে যখন তারা মারি বা মহামারিতে আক্রান্ত হতেন, তখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল দূরের ঈশ্বর যাকে তারা নানা দেব-দেবীর বিগ্রহ মূর্তিতে পূজা করত। এই ঐতিহ্য পুরাকাল থেকেই চলে আসছে। কুশান যুগে যক্ষ-দেবী হারিতি (ঐধৎরঃর)-এর পূজা করা হতো – ইনি তুষ্ট থাকলে সকল আপদ-বালাই থেকে রক্ষা করতেন। এর মধ্যে ছিল গুটি-বসন্ত, উচ্চহারে শিশু-মৃত্যু, জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃ-মৃত্যু প্রভৃতি। কথিত আছে, পরে তিনি বুদ্ধদেবের শিষ্যা হয়ে বৌদ্ধ দেবী হয়ে ওঠেন। কনিস্ক সাম্রাজ্যে গুটি-বসন্তের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন বৌদ্ধ -স্তুপার ভেতরে হারিতিকে উৎসর্গ করা বিগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়। হারিতি দেবীর ক্ষমতা ছিল জ্বরের উচ্চমাত্রাকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার- এর ফলে যে কোন জ্বরকে শীতল করার দেবী হিসেবেও তাকে দেখা হয়। পরবর্তীতে এই হারিতি দেবীই বাংলায় এসে হয়ে ওঠেন লোক-দেবী শীতলা-নামের ভেতরেই তার ক্ষমতার উল্লেখ রয়েছে। ‘শীতল করে দিতে পারেন’ সব জ্বরকে, এবং এভাবেই তিনি সারিয়ে তোলেন জ্বরের রোগীকে। শুধু গুটিবসন্ত নয়, সকল জ্বরের উপশমের দেবী হচ্ছেন এই শীতলা দেবী। অন্ত্যজ শ্রেণীর নাপিত, মুচি, কামার, কুমোর, চর্মকার প্রভৃতি পেশাবর্গের মধ্যে (সাধারণভাবে দক্ষিণবঙ্গের কৃষক শ্রেণীর ভেতরে) শীতলা দেবীকে জাগ্রত দেবী হিসেবে সাড়ম্বরে পূজা করা হয়ে থাকে এখনো। লোক-কল্পনায় কোন অজ্ঞাত কারণে শীতলা দেবীর বাহন হচ্ছে গাধা-হয়তো ভারবাহী প্রাণীকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়েছে বাহন রূপে। গুটিবসন্ত ও হামের দেবী যেমন শীতলা, তেমনি কলেরার দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ওলাই চন্ডী (হিন্দুদের মধ্যে) এবং ওলা বিবি (মুসলমানদের মধ্যে)। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক রালফ নিকোলাস মনে করেন যে, বাংলায় লোক-দেবী হিসেবে মনসা ও শীতলা উভয় দেবীরই পূজা বলেও শীতলাই খানিকটা এগিয়ে আছেন। অন্য কিছু চর্চায়, সর্পদেবী মনসা ও ষষ্ঠীর সাথে শীতলা দেবীকে অভিন্ত জ্ঞান করা হয়েছে। বোম্বাইয়ের পূর্ব-কথিত ১৮৯৯ সালের প্লেগের সময়ে এক ‘প্লেগমাতার’ আবির্ভাব হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’, কিন্তু তার পূজা হতো শীতলা মন্দিরে। এ নিয়ে ও.ঔ.ঈধঃধহধপয তার ‘ প্লেগ এন্ড দ্যা ইন্ডিয়ান ভিলেজ : ১৮১৬-১৯১৪’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তবে শীতলা দেবীর নাম প্রদেশ-ভেদে ভিন্ন হতে পারে। তামিলনাড়ূতে বসন্ত রোগের দেবীর নাম মারি আম্মা, দক্ষিণ আরকটে তার নাম কান্নি আম্মা। নাম যা-ই হোক, এই সকল লোকদেবীর পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্য একটাই- জনস্বাস্থ্য- সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মহামারি থেকে রক্ষা করা।

[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো- ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে।’ এভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন, সামার রিসোর্ট ইত্যাদি। এক কথায়, প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর হলো, ঔপনিবেশিক আমলের জনস্বাস্থ্য নীতি ছিল বৈষম্যমূলক এবং সেখানে জনগণের কোনো স্থান ছিল না। এটি ছিল মূলত এলিটদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য নীতি। জনগণ পেত তার নিজস্ব বিশ্বাসে-চর্চায় ঘেরা এক সংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাৎপদ স্বাস্থ্য খাত, আর এলিটরা পেত সেকালের মানদণ্ডে আধুনিক ও উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা।
এই দ্বৈত খাতবিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য চিন্তা উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্রেও পরিলক্ষিত হয়। এ দেশে তাই দেখতে পাচ্ছি যে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা’ গড়ে ওঠেনি, যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই নূ্যনতম এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন নির্ভরযোগ্যভাবে। কেন গড়ে ওঠেনি তার একটা কারণ বোধ করি এই যে, এলিটরা ভেবেছিলেন তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য ‘জনস্বাস্থ্য’ জাতীয় কোনো ব্যবস্থার আদৌ দরকার নেই। সে রকম বিপদ এলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা লাভ করা যাবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর তো এমন কিছু দূরত্বে অবস্থান করছে না! কিন্তু এখন করোনাকালের লকডাউনের কারণে তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ। এখন বুঝি তারা বুঝতে পারছে, আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশের ভেতরেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বর্তমানের মহামারি-সংকট তো নয়ই, ভবিষ্যতের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিও মোকাবিলা করা যাবে না। কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে আদৌ আশাবাদী নই। বিল গেটসের মতো আমিও মনে করি, পরিবর্তন আসে তবেই যদি মনে থাকে। কিন্তু মানুষের স্মৃতি খুবই স্বল্পায়ু।
৫. মহামারির প্রভাব : রাষ্ট্রে-দর্শনে
প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারির প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়েছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। এই প্রভাব যেমন পড়েছে সমাজে-রাষ্ট্রে, তেমনি সাহিত্যে-দর্শনে। সামগ্রিকভাবে মানবজীবনের ইতিহাসে। অতীত আলোচনার একটি তাৎপর্য ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তার সুবিখ্যাত ‘রেকুইম ফর এ নান’ উপন্যাসের একটি উক্তি অনেকটা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে- The past is never dead. It’s not even past| এবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ব্যক্তি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেছিলেন এ কথা জানতে চেয়ে, কেন তাদের রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে বাধ্য করছে? স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে তাদের কি মুক্ত থাকার অধিকার নেই? এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফিরে যেতে হলো অতীতে- ১৮৯৭ সালের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্যাক্ট’কে সাক্ষী মানতে হলো। মমতা বললেন, ‘যাতে কেউই আরোগ্য লাভ না করে কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যেতে না পারে- জনগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে- [১৮৯৭ সালের] আইন পুনরুজ্জীবিত করা হলো।’
অতীত যদিও নবায়িত হয়ে ফিরে আসে পুনরায়, অবস্থাভেদে তার প্রত্যাবর্তনের ‘ইমপ্যাক্ট’ হয় বিভিন্ন রকম। মহামারির অভিঘাত বিভিন্ন সমাজে ও কালে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে এসেছে। মহামারি প্রতিরোধে ইউরোপের চিন্তার বিবর্তন উঠে এসেছে মিশেল ফুকোর লেখায়। লন্ডনের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’ (যা ছিল ব্যুবনিক প্লেগ)-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে লন্ডন শহরে ১৬৬৫ সালে। এতে শহরটির ১৫ শতাংশ নাগরিকই মৃত্যুবরণ করেন। এই প্লেগে আরও অনেক বেশি লোকের মৃত্যু হতে পারত, কিন্তু অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে পারে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং রাজা (দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্ব তখন) তার সভাসদসহ অক্সফোর্ডে পালিয়ে যান। আজকে যেখানে অলগেট (Aldgate)- যেখানে এখন অধিকাংশ বাঙালি ও অভিবাসী বাস করেন- সেই এলাকাটিকে প্লেগে নিহতদের গণকবর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন। এ রকমই আরেকটি গণকবর ক্ষেত্র ছিল ফিনস্‌বিউরি ফিল্ডস্‌। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল জনতার প্রতিক্রিয়া। যে বাড়িতে কোনো প্লেগের রোগী পাওয়া যেত সেই বাড়িকে বাইরের থেকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হতো। এতে করে ওই খানার অন্যান্য সদস্যেরও মৃত্যু হতো- প্লেগে অথবা অনাহারে! ঠিক পরের বছরে (১৬৬৬ সালে) লন্ডনে অগ্নিকাণ্ডে তার পুরো কেন্দ্রস্থলই ভস্মীভূত হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, এই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল প্লেগবাহী ইঁদুরেরা। এই প্লেগ হওয়ার প্রায় ৬০ বছর পরে রবিনসন ক্রুসোর লেখক ড্যানিয়েল ড্যাফো লেখেন ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’। ড্যাফো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, কিন্তু এমনভাবে লিখেছেন বিবরণী যেন তিনি ঘটনা-পরম্পরার সামনেই অবস্থান করেছিলেন।
১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ আর ১৬৬৫ সালের ‘গ্রেট প্লেগ’ দুটিই ছিল প্লেগের মহামারি। এই অভিজ্ঞতা থেকে দুটো সুস্পষ্ট প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা রাষ্ট্রকে স্বৈরাচারী ক্ষমতা-প্রয়োগের পরিবর্তে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power)  বা জনজীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা আচরণভিত্তিক ক্ষমতা-প্রয়োগের দিকে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন আসত না যদি-না প্লেগের মতো মহামারি হতো। এই মহামারির সুবাদে রাষ্ট্র বাধ্য করে নাগরিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলতে। নাগরিকদের সমন্ত জীবনচর্চা তখন থেকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ মডেলে আবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে বশীভূত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যস্ততায়। উদ্ভাবিত হয় জবরদস্তিমূলক কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকার’ (বা সেলফ আইসোলেশন) অভ্যাস। করোনারকালেও এখন আমরা এদেশে বা বিশ্বজুড়েই ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের প্রয়োগ দেখছি। বিদেশফেরত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবর্গ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বলেছেন যে তাদেরকে এয়ারপোর্টে ‘১৪ দিনের’ সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে এবং সেটি তারা এখন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। করোনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রেরও একটি নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর বলয়। প্রতিদিন রোগতত্ত্ব বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য-বুলেটিন পড়ে শোনাচ্ছে টিভিতে এবং নাগরিকরা তা শুনে তাদের প্রাত্যহিকের জীবনযাপনে স্বাস্থবিধি মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন- অন্তত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায়। কোয়ারেন্টাইন বা সেলফ্‌ কোয়ারেন্টাইনে থাকছে সংক্রমিত খানাসমূহ (ব্যক্তি বা পরিবার), কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সমগ্র পাড়া বা গোটা এলাকাই। এভাবেই শৃঙ্খলাবদ্ধ নাগরিকে পরিণত হচ্ছি আমরা- হয়তো ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন বা সিঙ্গাপুরের মতো অতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নই এখনও- কিন্তু গতিমুখটা সেদিকেই। একটা চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞানকে অবলম্বন করে এই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে রাষ্ট্র। এটি খারাপ না ভালো- সে বিবেচনায় ফুকো যাননি। তিনি শুধু দেখিয়েছেন কীভাবে ডেসপট বা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন করার পরিবর্তে অন্য ধরনের বিশেষায়িত ‘ক্ষমতারও’ উদ্ভব হয় এবং রাষ্ট্র তার প্রজাকুলের ওপরে প্রভুত্ব করার জন্য একটি বাড়তি হাতিয়ার পেয়ে যায়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে প্লেগ নামক মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রচলিত দমনমূলক যন্ত্রগুলোর পাশাপাশি এই অদৃষ্টপূর্ব শৃঙ্খলাপরায়ণ অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজের উদ্ভব হয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দীপেশ চক্রবর্তী ও অন্যদের সূত্র ধরে উপনিবেশিক পটভূমিতে মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে আমরা ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এরই প্রয়োগ দেখেছি। যার ভিত্তি ছিল কোয়ারেন্টাইন মডেল এবং শ্বেতাঙ্গদের জন্য ‘বিচ্ছিন্ন থাকার’ ক্যান্টনমেন্ট মডেল- যা নেটিভদের কাছ থেকে উপনিবেশের অফিসার-সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
তবে ১৮২৬-৩৭ সালের একের পর এক বিধ্বংসী কলেরা মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খোদ ইংল্যান্ডেই এই কোয়ারেন্টাইন ও সেলফ আইসোলেশনভিত্তিক ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর মডেল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই মহামারিকে ‘এশিয়াটিক কলেরা প্যানডেমিক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় যেহেতু এটার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বঙ্গদেশে। বাংলায় এই মহামারির শুরু ১৮১৭-২৪ কালপর্বে; ধীরে ধীরে তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের জন্য হয়তো কার্যকর ছিল, কিন্তু কলেরা কোয়ারেন্টাইন মানে না। এর জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আরও সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির। ঠিক এ রকম সন্ধিক্ষণে জন্ম নিল আরেক অদৃষ্টপূর্ব অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজ- যার ভিত্তি হলো ‘বায়ো-পাওয়ার’  (Bio-Power)। এর মানে এই নয় যে আগের শৃঙ্খলাপরায়ণতাভিত্তিক ক্ষমতার প্রয়োগ বা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার রাষ্ট্র-ক্ষমতার বলয় থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষা না করে আর কাজ চালানো যাচ্ছিল না। কলেরা, বসন্ত, হাম, যক্ষ্ণা প্রভৃতি রোগের ঘন ঘন প্রাদুর্ভাব রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল Bio-Power-র কথা ভাবতে। ১৮৩০-র দশকে চার্টিস্টদের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল শ্রমিকদের বাসস্থানের সমস্যা- তাদের জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা ছিল কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারির প্রজনন ক্ষেত্র। শ্রমিকদের অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে তরুণ মার্কস লিখেছেন সে সময়ে ‘দ্য হাউসিং প্রবলেমস্‌’, আর তরুণ অ্যাংগেলস্‌ লিখেছেন ‘কন্ডিশনস্‌ অব ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’। এক কথায়,  Disciplinary Power স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র হেজিমনি হারাল নতুন পরিস্থিতিতে। তবে এর প্রয়োগ যথারীতি চলতে থাকল জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত কল-কারখানায়, জেলখানায় এবং বিদ্যানিকেতনে (ফুকো সে সম্পর্কে আলাদা করে লিখেছেন তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে)।
১৮৯৭ সালের ঔপনিবেশিক ভারতের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্য্যাক্ট’ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারকে তুলে ধরেছে। প্লেগে সংক্রমিত হলে সরকারি পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে বেঁধে হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছে সেখানে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় পুরোটাজুড়েই এই জোর করে ‘বিচ্ছিন্ন রাখার’ নীতিই কার্যকর ছিল। আমরা আগেই দেখেছি, প্রকৃত অর্থে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি, বা উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির বহুল প্রসার করার দিকে অগ্রসর হয়নি উপনিবেশের সরকার। সেটা হলে আমরা ঔপনিবেশিক বায়ো-পাওয়ারকে বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখতে পেতাম। ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিসেস অ্যাক্ট যখন প্রণীত হচ্ছে, তার পরের বছরেই কলকাতায় প্লেগের আক্রমণ হবে, আর ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে লেগে যাবে প্লেগ নিয়ে দাঙ্গা। অর্থাৎ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের ‘ডিসিপ্লিন’ উপনিবেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) গ্রন্থে ভূদেব এ নিয়ে ইতিপূর্বেই কড়া অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, ভারতবর্ষে ৬০ বছর ও তার ওপরে বয়স্ক লোকের সংখ্যা (১৮৮১ সালের আদমশুমাুরি অনুযায়ী) মাত্র ৪ শতাংশ। এর কারণ, এখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, এবং অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দুর্ভিক্ষে অথবা কিছুদিন পর পর ঘটে যাওয়া মারি-মহামারিতে ভারতবর্ষের মানুষ অকালেই মারা যাচ্ছে। ভূদেব অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘অনূ্যন পাঁচ কোটি ভারতবাসী অর্ধাশনে জীবনযাপন করে… এক প্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগারো বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাহার পরেই একটি করিয়া মহামারি আসিয়া উপস্থিত হয়।’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। প্রায় একই সময়ে লেখা ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কেন ‘চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু’ লিখেছেন তার কারণটি বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
ফুকোর ভাষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে মহামারি রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন ও ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। রানী ভিক্টোরিয়া উনিশ শতকে লন্ডন শহরে পয়ঃনিস্কাশন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এভাবেই সেখানে গড়ে ওঠে আন্ডারগ্রাউন্ড স্যুয়ারেজ সিস্টেম (যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে জার্মান বিমান হামলার সময় রাত্রিকালীন ‘শেল্টার’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল)। এই যে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলো মহামারি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য তাকেই ফুকো বলেছেন ইরড়-চড়বিৎ। উপনিবেশের দেশগুলো এই ইরড়-চড়বিৎ-এর সুবিধাটুকু পায়নি।
[ক্রমশ]

মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

মহামারি প্রতিরোধ :ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভূমিকা
উপরের সব প্রশ্নের এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির কয়েকটি দিকের প্রতি সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জন্য ‘জনস্বাস্থ্যের’ বিষয়টি ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। বাণিজ্য করতে এসে বঙ্গদেশে তিনটি গ্রাম নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন তার কাজ-কর্ম শুরু করে তখনও ‘জনস্বাস্থ্য’ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হারানোর পর বাংলায় (এবং বাংলাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য প্রদেশ) অবাধ উপনিবেশ স্থাপনের সুযোগ এলো কোম্পানির সামনে প্রথম বারের মতো। আরো বেশি বেশি করে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দিল। কোম্পানি শাসনের অংশ হিসেবে দাঁড় করাতে হলো এক নতুন আমলাতন্ত্রের। এ জন্য অনেক শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী বিলেত থেকে এলেন; তা ছাড়া ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা তো ছিলেনই, যারা নতুন উপনিবেশে এসে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই ঔপনির্বেশিক কর্মযজ্ঞের পথে প্রধান বাধা হয়ে দঁড়িয়েছিল এদেশের আলো-হাওয়া। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘শরীর, সম্পদ ও রাষ্ট্র :ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জন সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, জনস্বাস্থ্যের মূল নিহিত ছিল ‘একটি নিতান্তই সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনীতিক প্রশ্নে : শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কি গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়তে পারবেন?’ এই প্রয়োজন মেটাতেই ১৭৬৮ সালে প্রকাশিত হয় জে. লিন্ড রচিত বই- এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেটস। এর কয়েক বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিকেল সার্ভিস চালু হয় ১৭৬৪ সালে। সে সময়কার ‘রুলিং আইডিয়া’ ছিল- গরম দেশগুলোর আবহাওয়া শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্য আখেরে অস্বাস্থ্যকর। ফলে সেখানে তাদের দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব চালানো কঠিন। এই থিওরির ভিত্তি ছিল- ‘মায়াস্‌মা’ বা পূতিবাষ্প তত্ত্ব। মায়াস্‌মা বা অশুভ হাওয়া-তত্ত্বের জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর ইউরোপে, যখন ‘কালো মৃত্যু’র (Black Death) করাল-গ্রাসে ইউরোপের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৩৪৬-৪৮ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে প্লেগের কারণে এই মৃত্যু ঘটে। এর আগেও প্লেগ এসেছিল ইউরোপে, কিন্তু সেবার চীন থেকে প্লেগের যে স্ট্রেইনটি আসে তা লণ্ডভণ্ড করে দেয় ইউরোপের সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির সবকিছু। সে সময়ের বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার মান আজকের মতো ছিল না। সে জন্যই অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বের মূল কথা ছিল, প্লেগ ও কলেরার মতো রোগগুলি পচনশীল দেহ (মানুষ বা প্রাণী) থেকে বাতাসে ছড়ায় এবং একবার সেই ‘খারাপ বাতাস’ গায়ে লাগলে মানুষ তাতে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ১৮৬০ সালে যখন ‘জীবাণু-তত্ত্ব’ আবিস্কৃত হলো তখন জন্ম হলো এক নতুন শাস্ত্রের, যার নাম ট্রপিক্যাল মেডিসিন। পচনশীল শরীর এবং হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো এই শরীর-নির্গত অশুভ বাষ্পকণা- এর বিপরীতে পরবর্তীকালে এসেছিল জীবাণু-তত্ত্ব অর্থাৎ প্লেগ, কলেরা, বসন্ত প্রতিটি রোগের পেছনে রয়েছে বিশেষ বিশেষ জীবাণুর ক্রিয়াশীলতা। প্রতিটি মারি, মহামারি বা গুরুতর ব্যাধির মূলে আসলে কাজ করছে ভিন্ন ভিন্ন জীবাণু। এই তত্ত্ব আবিস্কারের ফলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল- অন্তত স্বাস্থ্যগত দিক থেকে। ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৮ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি এখন স্থির নিশ্চিত যে, শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে গ্রীষ্ফ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনা করা সম্ভব।’ কিন্তু এ কথা তো বলা হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধ-জয়ের প্রায় দেড়শ’ বছর পরে। ১৮ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এবং প্রায় উনিশ শতকজুড়ে তাহলে জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটিকে সামাল দেওয়া হয়েছিল কী করে? নাকি জনস্বাস্থ্য বলতে সে রকম কিছু ছিলই না তখন?
সমসাময়িক নানা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে কোম্পানির সৈন্যদের মহামারি থেকে রক্ষা করাই ছিল জনস্বাস্থ্যের মূল মনোযোগের বিষয়। ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে ইউরোপীয় সৈন্য ও অফিসারদের মধ্যে মৃত্যুর ৯৪ শতাংশই ছিল নানাবিধ অসুখের কারণে। এর মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া জাতীয় জ্বর, কলেরা, রক্ত-আমাশা, উদরাময় প্রভৃতি অসুখ। এসব অসুখ থেকে বাঁচার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় ছিল উপনিবেশের প্রজাদের বাসস্থানের পরিবেশের উন্নতি ও উন্নত স্বাস্থ্যবিধির প্রবর্তন (যথা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিস্কাশন, যেখানে সেখানে থুতু-কফ না ফেলা, স্যানিটেশন, হাত ধোয়ার অভ্যাস ইত্যাদি)। এটা হলে কিছুদিন পরপর সংক্রামক মারির আশঙ্কা অনেকখানি লুপ্ত হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষে এ-দায়িত্ব পালন করা কঠিন। তার উদ্দেশ্য এখানে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা নয়, বরং অশুভ হাওয়া-তত্ত্ব মেনে কী করে শোষণের মাত্রা আরো তীব্র করে সম্পদ-পাচার দ্রুত গতিতে নিষ্পন্ন করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা। আইনের প্রয়োগের সূত্রে বলা হলেও এর বৃহত্তর তাৎপর্য রয়ে গেছে। উনিশ শতকের মানদণ্ড অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের যেসব রীতি ইংল্যান্ডে প্রয়োগ করা হয়েছে, পরাধীন ভারতবর্ষে তা একেবারেই অনুসৃত হয়নি। আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হয়নি। পার্থ চ্যাটার্জী একেই বলেছিলেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। উনিশ শতকজুড়েই বাংলাদেশের গ্রাম ছিল একটি উপেক্ষিত বিষয়- বিশেষত জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (১৮৮২) গ্রন্থটির কোন কোন অংশে রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর না করে ‘পরিবার’কে সক্রিয় করতে চাওয়া হয়েছে এই কারণেই। মমার্থ এই যে, ঔপনিবেশিক রাজশক্তির কাছে জনস্বাস্থ্য-রক্ষা কর্মসূচি প্রত্যাশা করে লাভ নেই। ভারতবাসীকে বাঁচাতে হলে পারিবারিক পর্যায়েই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, নতুবা কলেরা-বসন্তে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ভূদেবের গ্রন্থের পঞ্চদশ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পরিচ্ছন্নতা’। সেখানে বিবরণটি এই রকম :
‘দেহ এবং গৃহস্থিত সমুদয় সামগ্রী সুবিশুদ্ধ এবং সুপরিস্কৃৃত রাখিবার অবশ্যকর্ত্তব্যতাও শাস্ত্রে যথোচিত পরিমাণে উল্লিখিত আছে। গৃহের এবং গৃহস্থিত দ্রব্যের যথোচিত বিলেপন ও সন্মার্জ্জনাদি, স্নান, ভোজন, আচমন, বস্ত্রাদির পরিবর্ত্তন প্রভৃতি ব্যাপার আমাদিগের অবশ্যকরণীয় প্রাত্যহিক কার্য্যের মধ্যেই নির্দিষ্ট। বিশেষত :গৃহস্থের বাটীতে দেববিগ্রহ ও ঠাকুরঘর রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া সচল গৃহস্থেরই শুচিতার এবং পরিচ্ছন্নতার এক একটি আদর্শ পাইবার উপায় করা হইয়াছে। ঠাকুরঘর যেভাবে রাখ, আজকের সকল ঘর সেইভাবে রাখিলেই হইল। বস্তুত :শুচিতাপ্রিয় য়িহুদীদিগের মধ্যে সংক্রামক রোগ অল্প হয়। তাহার কারণ এই যে, গৃহে এবং গৃহোপকরণ সমস্ত অতি সুপরিস্কৃৃত করিয়া রাখিবার নিমিত্ত উহাদিগের ধর্মশাস্ত্রে আদেশ আছে, এবং য়িহুদীরা আপনাদের শাস্ত্রের আদেশ সমস্ত ভক্তিপূর্বক প্রতিপালন করে।’
তবে ভূদেব এটাও লক্ষ্য করেছেন- অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় উন্নতি ঘটানো একান্তভাবেই কঠিন। ‘পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকিতে সকলেই চায়- উহা ধর্ম্ম্য, স্বাস্থ্যকর এবং সাক্ষাৎ সুখপ্রদ। কিন্তু এ কথাও বলি, পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হইয়া থাকা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাধ্য ব্যাপার; লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্ন হওয়া সম্যক ঘটিয়া উঠে না।’ অবশ্য যদি রাষ্ট্রতরফে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ব্যাপক জন-সচেতনা কার্যক্রম পরিচালিত হত বা আধুনিক যুগের ন্যায় স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, আবর্জনা পয়ঃনিস্কাশন প্রণালী, সুপেয় ও নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হত, তাহলে গরীবরাও পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রমে সমান তালে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে এটা আশা করা সম্ভব ছিল না।
১৯১২ সালে এদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম পাবলিক হেলথ্‌ ডাইরেক্টরেট-এর প্রতিষ্ঠা হয়। কলেরা, বসন্ত, প্লেগ জাতীয় মহামারিতে অনেক সেনা সদস্যের মৃত্যু এই প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে। অবশ্য এতে করে জনগণের স্বাস্থ্যে কোন গুণগত পরিবর্তন আসেনি। এদেশের জনসাধারণকে মারি বা মহামারি মোকাবিলায় মূলত নিজের চেষ্টার ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছে। পাবলিক হেলথ্‌ ডিপার্টমেন্ট ‘স্বাস্থ্যবিধি’ লিখে প্রচার করেনি। তাই ভূদেবের মতো প্রাচীনপন্থি পণ্ডিতকে ‘রোগীর সেবা’ করার বিধান লিখতে হয়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভূদেবকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে :
‘গৃহস্বামী সকলকে সতর্ক করিয়া দিবেন, যেন পীড়িতের বিছানা, বালিস, বস্ত্রাদি বাটীর অপর কাহার বস্ত্রাদির সহিত না মিশে-তাহার মল, মূত্র, ক্লেদাদি বাটী হইতে অধিক দূরে নিক্ষিপ্ত এবং পরিস্কৃৃত হয়- তাহার ব্যবহূত পাত্রাদি বাটীর সাধারণ পাত্রাদি হইতে স্বতন্ত্র থাকে- এবং সেবকেরা যতদূর পারেন, যে কাপড়ে … ঘরে থাকেন, সে কাপড় না ছাড়িয়া বাটীর অপর লোকের …ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না আইসেন।’ এ যেন হাল আমলের করোনার কালের ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বিধিমালা তৈরি করছেন ভূদেব মুখ্যোপাধ্যায়।
তবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র একেবারেই এদেশীয় জনগণের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিরুত্তাপ ছিল, তা নয়। রাষ্ট্রের নিস্পৃহ হওয়ার উপায় ছিল না যখন কোন সামাজিক বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বড় আকারের সমাবেশ করার আশংকা তৈরি করত। বিশেষত, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে, এই সচেতনতা আরো তীক্ষষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেসব স্থানে প্রচুর জনসমাবেশ হতো, ঔপনিবেশিক সরকার সেসব স্থানের ওপরে কড়া নজরদারি রাখতেন। সাব-অলটার্ন হিস্টোরিয়ান ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন যে, ইংরেজ সরকার হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, এলাহাবাদের প্রয়োগের মেলা, পুরীর জগন্নাথধাম, অল্প্রব্দপ্রদেশের তিরুপতি, তামিলদেশের কাঞ্চিপুরম, মহারাষ্ট্রের নাসিক প্রভৃতি ধর্মীয় মেলা ও তীর্থস্থানে বড় ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি দেখতেন। এসব উৎসব এলেই তারা ‘নার্ভাস’ বোধ করতেন। গণহারে যেহেতু তখন প্রতিষেধক ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না- সময়টাকে মোটা দাগে ‘প্রি-ভ্যাকসিনেশন যুগ’ বলতে পারি- উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া ঔপনিবেশিক সরকারের বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দল বেঁধে তীর্থযাত্রা, গঙ্গায় স্নান, ঈদের বড় জমায়েত ইত্যাদি সামাজিক প্রথায় হাত দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিরতই থাকতে হয় রাষ্ট্রপক্ষকে। বিশেষত ১৮৯৯ সালের প্লেগ দমনের একটা পর্যায়ে বোম্বাই ও অন্যান্য শহরে যখন দাঙ্গা বেধে যায়, তার পরে আর রাষ্ট্রশক্তি জনজীবনে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেনি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনযাত্রায় উদ্ধুদ্ধ করা নয় (যা ছিল ভূদেব, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের উদ্দেশ্য)। বরং নিজেদেরকেই মহামারি বা মারির ‘অশুভ হাওয়া’ থেকে রক্ষা করা। এলক্ষ্যেই ইংরেজ সৈন্য, অফিসার ও রাজকর্মচারীরা যেখানে থাকতেন, সেগুলোকে ‘মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট’-এর আদলে শহরের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি শহরে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় ইংরেজদের চলা-ফেরা, রাস্তা-ঘাট, বাসস্থান, ক্লাব, খেলার মাঠের জন্য স্বতন্ত্র এলাকা, যার সংস্পর্শে আসার কোন সুযোগ ছিল না ‘নেটিভদের’। ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো – ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে…ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা।
[ক্রমশ]

মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল

এ সময়ই পদ্মা বোট থেকে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় প্লেগ ত খুব জেগে উঠচে। আপনার বুঝি স্থানত্যাগ করতে সম্মত নন?’

এ প্রসংগে নিবেদিতার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিবেকানন্দের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস মার্গারেট নোবল আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। বিবেকানন্দ ওর নাম দেন- ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় পা রাখলেন, তখন চতুর্দিকে প্লেগের পদধ্বনি। ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গাও হয়। কলকাতা তথা বঙ্গদেশেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। ‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ :এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ বইতে দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষে অমানুষিক সেবাকাজ চালিয়ে কলকাতায় ফিরে নিবেদিতা ম্যালেরিয়া ও “ব্রেন ফিভারে” [সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া অথবা এন্‌কেফেলাইটিস] শয্যাশায়ী।’ সেসময় মানে ১৯০৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লিখেছিলেন- ‘নিবেদিতা যে আপনার ওখানে পীড়িত অবস্থায় তাহা আমি জানিতাম না – আমি একখানা বই চাহিয়া তাঁহাকে কলিকাতার ঠিকানায় কয়েকদিন হইল পত্র লিখিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া এমন ব্যবস্থা করিবেন যে, পত্রের যেন তিনি কোন নোটিস না লন। তাঁহাকে আমার সাদর নমস্কার জানাইবেন এবং বলিবেন যে, উৎসুক চিত্তে তাঁহার আরোগ্য প্রত্যাশায় রহিলাম।’ নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ। সুহৃদ জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমে নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোটে অতিথি হয়েও গিয়েছিলেন তিনি, পূর্ববঙ্গের কৃষকদের অন্তঃপুরে গিয়ে আপনজনের মত করে গ্রামের মা-বোনদের সাথে কথা বলেছেন। গেছেন অনেকবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও। এই যাওয়ার পেছনে ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের পরিবারকুলের একাংশকে বিবেকানন্দ-নিবেদিতার সংঘ-কার্যক্রমে “দলে ভেড়ানোর” ইচ্ছেও তার থাকা অসম্ভব ছিল না। সরলা দেবীকে তো প্রায় দলে টেনেই নিয়েছিলেন। এ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের সাথে মনোমালিন্য হতে পারে তার। তার ছোট মেয়েকে (মীরা?) ইংরেজি শেখানোর জন্য অনুরোধ নিবেদিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেটাও একটা কারণ হতে পারে। নিবেদিতার প্রত্যাখ্যান ছিল তীক্ষষ্ট, এমনকি রূঢ়:’সে কি! ঠাকুরবংশের মেয়েকে একটি বিলাতী খুকি বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে!’ শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য-বিমুগ্ধতার প্রতি কটাক্ষ করে আইরীশ নিবেদিতা বললেন :”ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফোটবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?” এই অসংকোচে মত রাখার প্রবণতা নিবেদিতার মধ্যে ছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথে জাগতিক আধ্যাত্মিক মত ও পথ নিয়ে মাঝেমাঝেই তুমুল তর্ক বেঁধে যেত। তার সবটুকু আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু জেনেছি যে (সাহিত্যিক বনফুলের স্মৃতিচারণার সুবাদে), ‘গোরা’ উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিতে নিবেদিতাই পীড়াপিড়ি করেছিলেন এবং এর ফলে উপন্যাসের বিয়োগান্ত পরিণতি একটি ইতিবাচক সমাপ্তিতে শেষ হয়। বনফুল লিখেছেন :

“[গোরার ] শেষটা বদল দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। নিবেদিতা নাছোড় হয়ে ধরে বসল। আবার ঢেলে সাজালাম সব।”

“গোরার শেষটা অন্যরকম ছিল?”

“হ্যাঁ। আমি গল্পটা বিয়োগান্ত করেছিলাম।…গল্পটা ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীতে বেরুচ্ছিল। কিন্তু ওটা আগেই লেখা হয়েছিল আমার। নিবেদিতা তখন বলল- গোরার শেষটা কী রকম করেছেন দেখি। দেখালাম। পড়েই সে বলে উঠল- না না, এ রকম হতে পারে না। ওদের মিলন না হলে বড়ই নিদারুণ ব্যাপার হবে যে। বাস্তব জগতে যা ঘটে না কাব্যের জগতেও কবি সেটা ঘটিয়ে দেবেন না? কাব্যের ও জগৎ তো আপনার সৃষ্টি, ওখানে আপনি অত নিষ্ঠুর হবেন না। ওদের মিলন ঘটিয়ে দিন। দিতেই হবে। এমন জেদ করতে লাগলে যে রাজি হতে হলো। সবটা আবার ঢেলে সাজালাম।” গোরা উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন তা আর কারো জন্য তিনি কখনো করেননি। এর একটি কারণ হতে পারে, দেশব্রতী গোরার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন নিবেদিতারই কাছ থেকে। শিল্পী নন্দলাল বসু স্মৃতিচারণা করেছেন পদ্মায় বোটে করে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও নিবেদিতার আলাপচারিতা সম্পর্কে :’তাহাদের আলোচনার বিষয় আমি কিছু জানি না। তবে শুনেছি, ‘গোরা’ উপন্যাসের hero গোরা সিস্টারকে মনে করে করেছিলেন।’ আমার ধারণা, নিবেদিতার আদর্শ-রূপ তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৮৯৮ সালে কলকাতার প্লেগের সময়ে। ভয়-ভ্রুক্ষেপহীনভাবে নিবেদিতা তখন প্রকৃতই আর্তের ‘ভগিনী’ হয়ে প্লেগের মত মহামারীর কালে বিপন্নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই তেজোদৃপ্ত মূর্তি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ এবং সন্ন্যাসিনীর মত ত্যাগী পথচলা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মত ছিল না।

প্লেগের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে সেসময়ই। এর আগে প্লেগ সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা, ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করা, আর্তজনের পাশে দাঁড়ানো তার এই প্রথম এবং তা সিস্টার নিবেদিতার সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। এ সম্পর্কে প্রথমে শুনব এডওয়ার্ড টমসনের (বিখ্যাত ইংরেজ বামপন্থী দার্শনিক ই, পি, টমসনের পিতা) ভাষ্যে। টমসন লিখেছেন : ‘That year [1998] plague broke out in Calcutta; she [Sister Nivedita] organized relief work, assisted by Tagore’ । দ্বিতীয় উৎস শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণা :’সেইসময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।’ পরের বছরে, অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে প্লেগ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছিল কলকাতায়। প্লেগের টিকা দিতে জনগণের একাংশের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা ছিল। যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, সেখানে বিদেশী শাসকের টিকা নিয়ে শেষটায় ‘জাত খোয়াতে হবে নাকি’, এই অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। ‘ঈধষপঁঃঃধ ঘড়ঃবং নু ধহ ঊহমষরংয খধফু’ শীর্ষক রচনায় নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন যে, কয়েকটি পরিবার, বিশেষত ঠাকুর পরিবার দৃঢ়তার সহিত এই বিক্ষোভ প্রশমন করিতে চাহিয়াছেন’। ১৯০৯-এ গোরা প্রকাশের দু’বছরের মাথাতেই নিবেদিতার মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির চমকপ্রদ অনুবাদ নিবেদিতারই করা (তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়)। তিনিই রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম অনুবাদিকা। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু- রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার নাম দিয়েছিলেন- লোকমাতা।

আমি বলতে চাইছি যে, মহামারীর ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো, গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস। মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় তার ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায় (স্বদেশী সমাজ, লোকহিত প্রভৃতি প্রবন্ধে), এমনকি তার এই সময়কার দেশাত্মবোধক গানের বিচ্ছিন্ন চরণে। রোগক্লিষ্ট আর্তমানবতার বেদনাকে অনন্ত শক্তির বোধে রূপান্তরের জন্যই রচিত হয় তার নৈবেদ্য ও গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও সংগীত। মারী ও মহামারী তার সৃষ্টিশীলতাকে মানবতাবাদের দিকে প্রভাবিত করেছে।

এই মানবতাবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জগমোহন চরিত্র। তিনি আস্তিক বা নাস্তিক সে পরিচয় গৌণ। তার পরিচয় তিনি প্লেগের দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি। এক-অর্থে, নাস্তিক জগমোহন আস্তিক নিবেদিতার কাউন্টার-পয়েন্ট। সেই ১৮৯৮ সালে- যে বছরে কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল- নিবেদিতাও রাস্তায় নেমেছিলেন, জগমোহনও রাস্তায় নেমেছিলেন। নিবেদিতা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু জগমোহন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিবরণটা এই :

‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তক্‌মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তাঁর প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেইসঙ্গে তাঁরও গুষ্টিসুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত। ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, কালনায় গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, যদি-

জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?

কাদের?

ঐ-যে চামারদের।’

একথা শুনে হরিমোহন তার ছেলে শচীশকে বললেন তার সাথে গঙ্গার ধারের বাড়িতে চলে যেতে।

[ক্রমশ]

সাম্প্রতিকের তর্ক ও বিতর্ক

পর্ব ::৪৭

১. তর্কটা কী নিয়ে?

এই লেখাটি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্রের পিছু-হটার উদ্বেগজনক পরিণতি নিয়ে। এই প্রতিপাদ্যটি কিছু তাত্ত্বিক মীমাংসা, কিছু সাম্প্রতিক বইয়ের আলোচনা, কিছু কেস-স্টাডি, কিছু পরিসংখ্যানগত তথ্য-উপাত্ত ও কিছু অনুমান দিয়ে নানাভাবে বলার চেষ্টা হয়েছে (বলা দরকার এ লেখাটির একটি আদি রূপ এর আগে ‘সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশ হয়ে ছিল)। অবশ্য গণতন্ত্রের পিছু-হটাকে প্রমাণ করার জন্য আরও তত্ত্ব ও তথ্যের কাঠখড় পোড়াতে হবে। সেটা স্বীকার করে নিয়েই নির্দিষ্ট করে তিনটি কথা বলতে চেয়েছি।

প্রথমত, গণতন্ত্র ‘পিছু হটছে’ (যাকে Democratic Recession বা Backsliding বলেছেন স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যারি ডায়মন্ড)। এই পিছু-হটা কেবল নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়, বা নির্দিষ্ট কিছু মাথাপিছু আয়ের গ্রুপে সীমিত নেই। এটা যেমন ঘটছে ‘প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে’ (যেখানে অনেক দশক ধরে গণতন্ত্র বিরাজ করছে, যেমন ইউরোপ-আমেরিকার ‘উন্নত জীবনযাত্রার’ দেশগুলোয়), তেমনি ঘটছে ‘দুর্বল গণতন্ত্রে’ (যেখানে দুই বা বড় জোর তিন দশক ধরে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, যেমন অধিকাংশ ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোয়)। প্রতিষ্ঠিত ও দুর্বল গণতন্ত্রের মাঝামাঝি স্তরে রয়েছে পূর্ব ইউরোপের তুলনামূলকভাবে (তৃতীয় বিশ্বের তুলনায়) বেশি শিক্ষা-দীক্ষার কিন্তু মাঝারি-আয়ের দেশগুলো। যারা স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে নতুন রাজনৈতিক কাঠামোয় বিকশিত হতে শুরু করেছে। এসব দেশের সদ্য-বিকশিত গণতন্ত্র এর মধ্যে পিছু হটতে শুরু করেছে কম-বেশি। এই তিন ধারার দেশই পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথে রয়েছে, যদিও পুঁজিবাদের চর্চায় এরা নানা স্তরে অবস্থান করছে। এর অর্থ হলো যে, পুঁজিবাদ সত্ত্বেও গণতন্ত্র পিছু হটছে। বুর্জোয়াদের শাসনে বুর্জোয়া গণতন্ত্র আর নিরাপদে থাকছে না।

দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের পিছু-হটা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হলেও বিভিন্ন দেশে পিছু-হটার কারণ একরূপ নয়। তবে উপসর্গ বা কারণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও অন্তত এটুকু স্পষ্ট যে, পিছু-হটার পেছনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়া বা কমার কোনো যোগসূত্র নেই। গত দুই দশক ধরেই পিছু-হটার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল নানা দেশে। উঁচু আয়, নিচু আয়, দ্রুত প্রবৃদ্ধি, শ্নথ প্রবৃদ্ধি- সব রকমের ‘কনটেক্সটে’ গণতন্ত্রের পিছু-হটা দেখতে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, বলতে চাচ্ছি যে, এখানে অর্থনৈতিক ‘ডিটারমিনিজমের’ কোনো সুযোগ নেই। ভাবাদর্শ বা মতাদর্শ, ‘পাওয়ার অব আইডিয়া’; গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া; আত্মসত্তার রাজনীতি; রাষ্ট্রের কোন কোন দিকের ক্রম-বিলীয়মান ভূমিকা, আবার কোন কোন দিকের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা; এক কথায়, রাষ্ট্র ও পুরসমাজের (State-Civil Society) মধ্যকার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস, অনেক কিছুই হয়তো এই গণতন্ত্রের পিছু-হটার ওপরে প্রভাব রাখছে। আমি এ লেখায় সেসব সম্ভাব্য প্রভাবকের তেমন কোনো বিশ্নেষণ করতে যাইনি। আমি শুধু দেখাতে চেয়েছি যে, খরঢ়ংবঃ-কথিত আশাবাদের কোনো সুযোগ নেই এখানে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় নিম্ন-আয়ের থেকে মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক উন্নয়ন হবে তথা সবলতর গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটবে, এ রকম যুক্তির পেছনে কোনো তথ্যগত ভিত্তি সেভাবে নেই। উন্নয়নের ধারায় একসময়ে অপেক্ষাকৃত সুশাসনের স্তরে (বা সুশাসিত রাষ্ট্রের দিকে) যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু অনিবার্যভাবে আরও গণতন্ত্রের দিকে উত্তরণ সম্ভব, সে রকম কোনো প্রবণতা এখানে কাজ করছে না। এ রকম কোনো গ্যারান্টিও তত্ত্বে বা তথ্যে নেই :প্রগতির রথের ঘোড়া সামনেও যেতে পারে, পেছনেও যেতে পারে। অমর্ত্য সেন যাকে বলেছেন, ‘Government by Discussion’ সেই গণতন্ত্র অনেক জিডিপি আহরণের পরও দূর নক্ষত্রের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। সন্দেহ কী, কিছুটা ভিন্ন-অর্থে দার্শনিক জাঁক দেরিদাও বলবেন- সেই গণতন্ত্র ভূ-ভারতে কেন, এই ভূলোকেও প্রায় কোথাও নেই, এবং কোনো লাগসই শিরোনাম না পেয়ে এর নাম দেবেন ‘Democracy-to-come’!

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ এই বিশ্বজোড়া গণতন্ত্রের সামগ্রিক পিছু-হটার বা Democratic Recession-এর বাইরে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এই পিছু-হটার মধ্যেও ‘প্রগতিশীল উপাদানগুলোকে’ শনাক্ত করা বা তাদের পক্ষে সমর্থন জোরালো করা সম্ভব। বাংলাদেশ কি রুয়ান্ডার মতো হবে, নাকি ঘানার মতো হবে? তুরস্ক নাকি তিউনিশিয়ার মতো হবে? ইন্দোনেশিয়ার নাকি থাইল্যান্ডের মতো অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে? ইকুয়েডর নাকি ভেনেজুয়েলাকে অনুসরণ করবে? চিলি নাকি আর্জেন্টিনার মতো হবে? স্লোভেনিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রের মতো হবে, নাকি হবে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো? এই দেশগুলো ‘লিবারেল ডেমোক্রেসি’ ও ‘ইলেকটরাল ডেমোক্রেসি’ যে কোনো নিরিখেই পিছু হটেছে গণতন্ত্রের সূচকে, কিন্তু এদের মধ্যে রাজনৈতিক উন্নয়নের স্তরে কী বিপুল পার্থক্য! এই Choice-এর অবকাশ তো বাংলাদেশের জন্য এখনও রয়ে গেছে। এদিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাও প্রবন্ধটির একটি উদ্দেশ্য।

লেখাটি ৫টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়ে প্রারম্ভিক যুক্তি ও বক্তব্য উপস্থাপনার পরে দ্বিতীয় অধ্যায়ে গণতন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে এথেনিয়ান ডেমোক্রেসির যুগের ক্ল্যাসিক চিন্তাবিদদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমি বলার চেষ্টা করছি যে, ইলেকটরাল ডেমোক্রেসির বাইরে গিয়ে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। যদি নির্বাচনী গণতন্ত্রে কোনো দেশ ভালো ‘স্কোর’ করেও থাকে, কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদারনৈতিক চর্চা ও মূল্যবোধ ‘লিবারেল ডেমোক্রেসির’ নিরিখে উত্তরোত্তর ‘রক্ষণশীল’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হতে থাকে, তাহলে সে দেশটিতে গণতন্ত্রের সংকট দানা বাঁধতে বাধ্য। অর্থনীতিবিদ ডানি রডরিকের পথ ধরে আমি বলার চেষ্টা করছি যে, ‘লিবারেল ডেমোক্রেসিই’ শ্রেষ্ঠতর, এবং সমাজে ‘লিবারেল আইডিয়া’-এর ভূমিকা গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ অধ্যায়ে বেশকিছু তথ্য ও উপাত্ত জড়ো করা হয়েছে দেশে দেশে গণতন্ত্রের পিছু-হটা সম্পর্কে। এটি হচ্ছে এই লেখার মূল ‘ইমপিরিক্যাল’ অংশ। পঞ্চম অধ্যায়ে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রের পিছু-হটার সামগ্রিক প্রবণতার মধ্যে আদৌ কতটুকু কী করা সম্ভব- উন্নয়নের ফলাফলকে আরও জনকল্যাণমুখী করার ক্ষেত্রে- সে বিষয়ে কিছুটা জল্পনা থাকছে।

২. গ্রিক দেবী ডেমোক্রেটিয়া

গণতন্ত্রের দেবীর নাম গ্রিকরা দিয়েছিল ‘ডেমোক্রেটিয়া’। এথোনিয়ান দেব-দেবীর মধ্যে তার অবস্থান মধ্যম সারিতে। সবার ওপরেও নয়, সবার নিচেও নয়। প্রায় ষাট বছর আগে ‘ইন ডিফেন্স অব পলিটিক্স’ বইতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বানার্ড ক্রিক এই দেবীকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে : ‘She is everybody’s mistress and yet somehow retains her magic even when a lover sees that her favours are being, in his light, illicity shared by many another.’ গণতন্ত্রের দেবী সবারই উপপত্নী, এবং প্রত্যেকেই তার আবেদনময়ী আচরণে মোহমুগ্ধ কথাটা নির্দয় শোনায়। কিন্তু লন্ডনের সুবিখ্যাত বার্কবেক কলেজের (যেখানে দার্শনিক জিজেক অধ্যাপনা করেন) অধ্যাপক ক্রিক সাহেব বিনা কারণে কথাটা উচ্চারণ করেননি। প্রত্যেকেই এই দেবীর কাছে প্রসাদ চেয়েছেন যার যার মতো করে, আর প্রত্যেকেই কিছু না-কিছু পেয়ে প্রীত হয়েছেন এমনই সহৃদয়া ডেমোক্রেটিয়া দেবী। সেই থেকে বিশেষণের কমতি নেই। এথেনিয়ান ডেমোক্রেসি, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র, ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি, লিবারেল ডেমোক্রেসি, রিপ্রেজেন্টেটিভ ডেমোক্রেসি, ইললিবারেল ডেমোক্রেসি, র‌্যাডিকেল ডেমোক্রেসি, ‘ডেমোক্রেসি-টু-কাম’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ডাকা হয়েছে তাকে। এই নামকরণের ইতিহাস ও ট্যাক্সোনমি একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে।

যে নামে দেবীকে ডাকা হচ্ছে, সেই স্বরূপেই তার ভক্তরা তাকে দেখতে চান। অন্য কোনো নামে বা অভিব্যক্তিতে তাকে দেখতে চান না তারা। রূপে-রসে-গন্ধে এসব নামকরণ এতটাই পৃথক যে, এদের মধ্যে প্রায় ভাব-বিনিময় চলে না। একটা উদাহরণ দিই। একসময় মার্কসবাদীরা বলতেন, গণতন্ত্র বলতে যার ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে সেটা আদৌ ‘প্রকৃত’ গণতন্ত্র নয়; সেটা হচ্ছে আসলে ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্র। কথাটা মার্কসও তার নানা লেখায় ব্যবহার করেছেন। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ বিদায় নিলেন। এই বিপ্লব গভীরতর সমাজ-পরিবর্তন আনল না যদিও, কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকারের একটা বার্তা ইউরোপে ছড়িয়ে দিল। বার্তাটি পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির। বলা দরকার, ফরাসি বিপ্লবের সময়ে উচ্চারিত ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি’ শ্নোগানের মধ্যে যে ইকুয়ালিটি তা হচ্ছে পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটি নিয়ে। পরবর্তীতে মার্কস সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের যে অর্থনৈতিক ইকুয়ালিটির কথা তুলবেন এটা তার থেকে আলাদা। মার্কস ও এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ম্যানিফ্যাস্টোর পাতায় পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির পাশাপাশি ইকোনমিক ইকুয়ালিটির কথা বলেছিলেন। প্রথম ধারণাটি, তার চোখে, নিতান্তই সংকীর্ণ ধারণা; অর্থনৈতিক সমতা ছাড়া রাজনৈতিক সমতা অর্থহীন। সেই থেকে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুত পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটিকে মার্কসের অনুসারীরা ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলে জেনে এসেছেন। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বামধারার চিন্তাবিদেরা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেও ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে দেখবেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দার্শনিকেরা (থিওডর এডোর্নো বা ম্যাক্স হর্কহেইমার) বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে কীভাবে অ-গণতন্ত্রের তথা স্বৈরতন্ত্রের বিষবৃক্ষ বড় হচ্ছে তা বড় আকারে দেখালেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কাছে ঋণ ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তেমনভাবে স্বীকার করেননি। তার পরও বলতে হয় ফুকোর গণতন্ত্রবিরোধী ধারণা জার্মান দার্শনিকদের কাছ থেকেই পাওয়া। গণতন্ত্র-এর ধারণাকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন ফুকো, যা প্রায় মার্কসের রক্ষণশীলতাকেও ছাড়িয়ে যায়। পুরো উদ্ধৃতিটি তাই তুলে দিচ্ছি :

‘If one understands by democracy the effective exercise of power by a population which is neither divided nor hierarchically ordered in classes, it is quite clear that we are very far from democracy. It is only too clear that we are living under a regime of a dictatorship of class, of a power of class which imposes itself by violence, even when the instruments of this violence are institutional and constitutional; and to that degree, there isn’t any question of democracy for us.’

নোয়াম চমস্কির সঙ্গে বিতর্কে ফুকো এ কথা বলেছিলেন ১৯৭১ সালে- তার মৃত্যুর ১৩ বছর আগে। তাহলে উনিশ শতকের মার্কসের তুলনায় বিশ শতকের সত্তর দশকেও এসে দেখা যাচ্ছে উন্নত দেশের গণতন্ত্রে খুব একটা ‘ইতিবাচক কিছ’ু অর্জিত হয়নি! ফুকোর শব্দ ব্যবহারটিও দেখুন : সত্তর দশকেও তিনি দেখছেন উন্নত আধুনিক গণতন্ত্রের পেছনে ধনিক শ্রেণির ক্ষমতার দাপট- ‘ডিক্টেটরশিপ অব ক্লাস’।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৬

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সাহিত্যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক রূপায়ণের ক্ষেত্রে এক আধুনিক বোধের জন্ম দিয়েছিল। সমালোচকেরা এদের মধ্যকার সম্পর্ককে কী নামে ডাকবেন, সেটা বুঝি এখনও পুরোপুরি স্থির করতে পারেননি। কেউ একে বলেছেন- গভীর দার্শনিক ও আত্মিক যোগাযোগ; কেউ বলেছেন ‘প্লাতোনিক প্রেম’; কেউ বা সন্দেহ করেছেন- এর চেয়ে আরও বেশি কিছুর। আমি এই শেষোক্ত দলে পড়ি। আঁদ্রে জিদ ভিক্টোরিয়ার প্রগাঢ় জ্ঞানচর্চার পরিধি দেখে বলেছিলেন- ‘ওকাম্পো যেন নিজেই এক পুরাণ গ্রন্থ।’ মান রে’র (Man Ray) মতো শিল্পী যার পোর্ট্রেট ছবি তুলেছেন; যিনি লাতিন আমেরিকার নবধারার সাহিত্য-আন্দোলনের পথিকৃৎ ‘Sur’ পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক; একজন পুরোধা নারীবাদী; তুখোড় সাহিত্য-সমালোচক; বোর্হেসের মতো সাহিত্যিকের সঙ্গে যার রয়েছে দীর্ঘ কথোপকথনের অনন্য দলিল; একজন বহু ভাষাভাষী সুন্দরী ও বিদূষী (রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলের সব আধুনিকা নারীদের চেয়ে যিনি আধুনিকতমা ও জ্ঞানে-রুচিতে প্রাগ্রসরা) এবং সর্বোপরি বিশ্বস্ত ও মমতাময়ী- তার প্রতি নিঃসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের আকৃষ্ট না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না সেদিন। পরবর্তী দিনগুলোয় এই আকর্ষণ গভীর আস্থার, বন্ধুত্বের ও ভালোবাসার সম্পর্কে পরিণত হয়েছে (এটা কোন ধরনের প্রেম বা প্রেম হয়ে থাকলে তার সামনে সতর্ক ‘এপিথেট’ বসানোর কষ্টকর চেষ্টা কিছুটা হাস্যকরও ঠেকে) চিত্রকর্মে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ সেই তরুণ বয়স থেকেই। লেখার ফাঁকে ফাঁকেই তিনি বিরতিহীনভাবে মুখ, মুখোশ, জীবজন্তু, পৌরাণিক বা অবচেতন মনের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এমন কিছু আঁকছেন বা আঁকিবুঁকি করে আসছেন। এটা একসময় নেশায় পেয়ে বসে কবিকে। ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ নিজের ভেতরে একদিন হঠাৎই আবিস্কার করলেন স্ব-অস্তিত্বে ও স্ব-মহিমায় বিশ্বাসী এক চিত্রশিল্পীর :’ছবির নেশার আমার কাব্যের উপর কিছু উৎপাত বাধিয়েচে। অধিক বয়সে তরুণী ভার্য্যায় মানুষকে অভিভূত করে এমন একটা প্রবাদ আছে। আমার প্রাচীনাটি এই তরুণীটির সঙ্গে পেরে উঠচে না।’ ওকাম্পোর লেখায় সেই নেশার আদি-মুহূর্তের বিবরণ রয়েছে। ওকাম্পো লিখেছেন (গণেশ পাইনের সুবাদে সে তথ্য তুলে দিচ্ছি)-

‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকত, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন …লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্র জুড়ে দিয়ে তার উপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকেই বেরিয়ে আসত সব রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। …এই ছোট খাতাটিই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’ পরবর্তীকালে দেশে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিজয়াকে লিখেছিলেন, ‘তুলি দিয়ে আমি ছবি আঁকব না, যে কলম দিয়ে কথার কাব্য লিখি, সেই কলমে রং এবং রেখার কাব্য লিখতে পারি কিনা, তারই একটা পরীক্ষা চালাতে চাই।’

এককথায়, রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার উন্মেষ-পর্বের সাক্ষী ছিলেন বিজয়া। যখন সত্যি সত্যি রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রকর’ হয়ে উঠলেন, তখন এই বিজয়াই সমস্ত সহায়সম্বল নিয়ে এগিয়ে এলেন। আর্জেন্টিনায় যে দু’মাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া সব খরচ চালিয়ে ছিলেন ওকাম্পো। এজন্যে তাকে তার মহা মূল্যবান হিরের আংটিটি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। ১৯৩০ সালে প্যারিসে কবির চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য শুধু সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে ছুটে আসাই নয়, তাকে অনেক অর্থ-ব্যয়ও করতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এই মর্মে :’ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, তাহলে ছবি ভালোই হোক মন্দই হোক কারও চোখে পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল, ঘর পেলে ছবির প্রদর্শনী আপনি ঘটে- অত্যন্ত ভুল। …ভিক্তোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে। এখানকার গুণীজ্ঞানীদের ও জানে- ডাক দিলেই তারা আসে।’ ওকাম্পো ‘ডাক দিলেই’ প্যারিসের এলিট বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা ‘ছুটে আসে’- এই একটি কথার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন বিজয়ার আকর্ষণী বিদূষী সত্ত্বাকে।

প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২ মে। ১২৬টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল তাতে। এর সমস্ত আয়োজন/ ব্যবস্থা করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। শুধু রবীন্দ্রনাথের ডাকেই এটা করেছিলেন তিনি। অন্য কোনো কারণে আসেননি। আর্জেন্টিনা থেকে শুধু একটা প্রদর্শনী আয়োজন করার জন্যই তিনি সেবার প্যারিসে এসেছিলেন। ওটা অ্যারোপ্লেন-যুগের আগের কথা, এ কথাও মনে রাখতে হবে। একে যদি আমরা গাঢ় প্রেমের চিহ্ন হিসেবে না দেখি, তাহলে ‘প্রেম’ কাকে বলব? রবীন্দ্রনাথ প্যারিস ছেড়ে যান ১১ মে। প্যারিসের গ্যার দ্যু পর্দ রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শেষবারের মতো তার দেখা হয়েছিল ভিক্টোরিয়ার সাথে। এর ঠিক চার মাসের মাথায় রবীন্দ্রনাথ (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩০) যাবেন বিপ্লব-উত্তর রাশিয়া দেখতে। ভিক্টোরিয়া ফিরে যাবেন বুয়েনস এয়ার্সে। কিন্তু অপ্রত্যক্ষে থেকেও দু’জনের মধ্যে পত্রালাপ ও মৌনালাপ আমৃত্যু চলতেই থাকবে। দু’তরফ থেকেই দেখা এর সম্পূর্ণ চিত্র অবশ্য এখনও আমরা পাইনি।

কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে আফ্রিকা, পলিনেশিয়া, ওশেনিয়া, লাতিন আমেরিকার আজটেক, মায়া, ইনকা, বৃহত্তর অর্থে তৃতীয় বিশ্বের আদিবাসী সংস্কৃতির প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছিল, ‘আধুনিকতার’ পেছনে ‘অনাধুনিকের’ একটি বড় ধরনের অবদান রয়ে গেছে। এটা চেঁচিয়ে চলা দরকার। এই ‘অবদান’ যেমন পাই পাশ্চাত্যের সেজান-পরবর্তী পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট ও বিমূর্ত চিত্রকলায়, তেমনি পাই এই ভূভাগের বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায়। শিল্প-সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামী সঠিকভাবেই এর কুললক্ষণ শনাক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো হচ্ছে, ‘genuine examples of modern primitive art.’ পক্ষান্তরে, ইউরোপের প্রিমিটিভ আর্টের আধুনিক অনুসারীরা বরং ‘More calculated primitivisms, archaisms, and pseudo-barbarisms’-র নিদর্শনই তুলে ধরেছেন। কথাটায় হয়তো অতিশয়োক্তি রয়েছে। পিকাসো, মাতিস, মদিলিয়ানি, নোল্‌দে, ক্লি, ক্রিশ্‌নের বা মিরো প্রিমিটিভিজমের সিরিয়াস চর্চাই করেছেন এবং আধুনিক শিল্পকলায় নবধারার বিপ্লবের সূচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের কাজের গুরুত্বকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি কোনো ভুল বা ‘বিভ্রান্তিকর’ (কথাটা ডাইসন-অধিকারীর) ব্যাখ্যা দিয়ে যাননি। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক প্রিমিটিভ ‘ছবির রবীন্দ্রনাথ’ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার ‘ফর্মাল’ অনুশীলন না করেই কী করে আঁকার জগতে প্রবেশ করতে পারলেন? এর উত্তর কিছুটা মেলে শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কথায় :’আমাদের দেশে মডার্ন যে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে, সেটা গুরুদেবই করছেন। একটা লোকের ভেতরে যদি চরম সেন্স অব রিজন, মিউজিক, কালার থাকে তার অ্যাকাডেমিক ট্রেনিং দরকার হয় না।’ তবে প্রথাগত অনুশীলন না থাকলেও ইউরোপের সর্বাধুনিক চিত্রকলার প্রতিলিপি তিনি সংগ্রহ করে দেখতেন; রোদ্যাঁর সাথে তিনি দেখা করেছেন, কান্ডিনস্কি ও বাউহাউস স্কুলের প্রদর্শনী স্বচক্ষে দেখেছেন; Kathe Kollwitz-র মতো শিল্পীরা তার সাথে দেখা করেছেন এবং তার সাথে ছবির ভাবনার বিনিময় করেছেন। পঞ্চাশে নোবেল-প্রাপ্তির পরে সত্তরে তার চিত্রকর্মই ছিল রবীন্দ্রনাথের- তার ভাষাতেই বলছি- ‘শেষ কীর্ত্তি’। এই সৃষ্টিসম্ভারকে তার নিজের দেশে অনেকেই বুঝতে পারেনি সে সময়ে; বিদেশেও অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। যেমন, আমেরিকায়, যেখানে তখন পর্যন্ত কিউবিস্ট বা এক্সপ্রেশনিস্ট আর্ট সমাদৃত হতে শুরু করেনি। আমেরিকায় ছবির রাজ্যে বিপ্লব ঘটবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে। তখন জ্যাকসন পোলককে কেন্দ্র করে বেরিয়ে আসবে একঝাঁক নতুন প্রজন্মের শিল্পী- জন্ম হবে আর্টের আরেক নবধারা, যার নাম দেওয়া হবে ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম’। সর্বাধুনিক রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা হয়তো বুঝতে পেরেছিল ফ্রান্স, কিছুটা পরিমাণে জার্মানি ও রাশিয়া (হ্যাঁ, মালেভিচ-লিসিৎস্কি-শাগাল-ওসিপা জাদকিনের রাশিয়া)। আমেরিকা তখনও ইউরোপের তুলনায় শিল্পকলার রুচিতে অনেক পিছিয়ে। কবি পল ভ্যালেরি প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী দেখে বলেছিলেন, ‘ইওর পিকচার্স উইল বি অ্যা লেসন টু আওয়ার আর্টিস্টস্‌’। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার ছবিতে যাদের অনীহা, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিরুদ্ধতার কারণে নয়, নিতান্তই ‘চিত্রদর্শনের অভিজ্ঞতার’ অভাবের কারণে। আর সে কারণেই বলতে পেরেছিলেন যে, ‘সে জন্য এ দেশে আমাদের রচনা অনেকদিন পর্যন্ত অপরিচিত থাকবে।’ হয়তো ‘আমার মৃত্যুর পর ওর (রবীন্দ্রনাথের ছবির) আবরণ মোচন করো- তখন ওর মূল্য হবে ঐতিহাসিক দিক থেকে।’ উপমহাদেশের আধুনিকতম চিত্রকলার একজন পুরোধা শিল্পী গণেশ পাইন রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে বলেছেন, তার ছবি এতই একক ও স্বয়ম্ভু, এ দিয়ে ‘কোনো ঘরানা আপাতত তৈরি করা যায়নি।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘কেউ যদি তার ছবি দেখে বলতেন সুন্দর হয়েছে, তৎক্ষণাৎ সেই ছবির উপর কালি ঢেলে দিতেন তিনি এবং সেই অন্ধকারের মধ্যেই সন্ধান করতেন তার ‘সুন্দর’-এর।’ ঠিক প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের নাম-না-জানা অগণিত শিল্পীর মতো। নিজেকে তিনি কখনও কখনও বলেছেন এক ‘আজগুবি ছবি-আঁকিয়ে’ বলে। কিন্তু আমরা তো এখন বুঝতে পারি ধারাবাহিকভাবে খাপছাড়া ও আজগুবি ছবি এঁকে যাওয়া কত কঠিন। অবনীন্দ্রনাথ এদিকটি বুঝতে হয়তো ভুলই করেছেন। নইলে তিনি রানী চন্দকে বলবেন কেন- ‘একটা ঢেউ উঠেছে, প্রিমিটিভ, ক্রুড, এই সব আঁকতে হবে। তাতে কী আছে, না, ‘স্ট্রেংথ’ আছে। সেটা ভুল। প্রকৃতিতে তো তা নেই। …একটা জিনিস যখন অসম্পূর্ণ অবস্থায় থাকে, সেটাকেই বলে ক্রুড। …’স্ট্রেংথ’ থাকবে ভিতরে, কিন্তু বাইরে থাকবে সৌন্দর্যের আবরণ।’ ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে গ্রেবো মূর্তির মধ্যে যে ম্যাজিক, যে সম্মোহনের প্রভা দেখেছিলেন পিকাসো, সেটিই আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মে। প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী দেখার পর চিত্রকর আঁদ্রে কার্পেলেসের কথায় পিকাসোর বিস্ময়-বিমুগ্ধ অভিজ্ঞতারই অনুরণন পাই। কার্পেলেস প্যারিস-প্রদর্শনীটির ছবিগুলো দেখে রথীন্দ্রনাথকে যা লিখেছিলেন, তা সম্পূর্ণ উদ্ৃব্দতির দাবি করে:

‘They are far beyond what I expected and dreamt ofÑ You are rightÑ RothiÑ It is some thing newÑ uniqueÑ grandÑ Not only will they be a treat for the admirers but they will be the bestÑ long awaited lesson for the western artists. What they have been looking for, struggling for, what they have failed to expressÑ (because abstraction needs genius to find the means of making it tangible) [Tagore] has attained it in one unique flight. His pictures have the freshness, the mysterious strength of the early primitive expressions of art …They are modern bccause they bring the message of something entirely original.’

প্রিমিটিভ কিন্তু মডার্ন, পুরাতনী কিন্তু সাম্প্রতিক- এই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের অর্ধচেতন অবচেতন সচেতন আঁকিবুঁকি থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত স্ব-উদ্ভাবিত চিত্রকলা।

[এই বিষয় সমাপ্ত]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

‘জার্মান এক্সপ্রেশনিজম :প্রিমিটিভিজম অ্যান্ড মডার্নিটি’ বইয়ের লেখক জিল লয়েড এ বিষয়ে লিখেছেন যে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল অজন্তার গুহাচিত্র :
‘Once again a composite notion of the ‘primitive’ emerges, and it is difficult to distinguish between the exotic and ‘Gothic’ stimuli. For example, the characteristic combination of green and purple that Kirchner began to use at this date is usually associated with the colour illustrations of the Ajanta temple paintings he knew from the Dresden library.’

রবীন্দ্রনাথ এই ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘মডার্ন’-এর মধ্যকার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি এই উপমহাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে সর্বপ্রথম অনুভব করেছিলেন। সমালোচকেরা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের নানা ছবির অদ্ভুত জীবজন্তুর সমাবেশ শুধু অন্যমনস্ক আঁকিবুঁকি (doodles) থেকে উৎসারিত হয়নি। উদাহরণত, তার ২২৩২-সংখ্যক ছবিটির সাথে তুলনীয় হয়েছে পল ক্লি-র ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটি। এই বিশেষ ছবিটি যখন ১৯৩০-এ প্যারিসে প্রদর্শিত হয়, তখন ব্যাখ্যা হিসেবে তাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘I have searched out the cave of the primitive/ in my mind/ with its etchings of animals.’ পরে কবি নিজেই দিয়েছেন এর বাংলা তর্জমা :’বিস্মৃত যুগে গুহাবাসীদের মন/ যে ছবি লিখিত ভিত্তির কোণে/ অবসরকালে বিনা প্রয়োজনে/ সেই ছবি আমি আপনার মনে/ করেছি অন্বেষণ।’ রবীন্দ্রনাথের ‘প্রিমিটিভ’ মনের প্রকাশ পাওয়া যায় ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থে তার বিচিত্রবিধ ড্রইং-এর ভেতরেও। কাইয়ুম চৌধুরীও লিখেছেন, “পল ক্লির কলমে করা ড্রইংয়ের ছায়া ‘খাপছাড়া’ ও সে বইয়ের ইলাস্ট্রেশনে দেখতে পাওয়া যায়।”

আগেই বলেছি, চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ যেদিকে পা ফেলেছিলেন তা তার নিজ দেশের সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে বা শিল্পরসিক মহলে তেমন একটা নাড়া দিতে পারেনি। এদিক থেকেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিঃসঙ্গ শিল্পী। বিদেশেও তার বন্ধুদের অনেকেই এই নব্যধারার শিল্পকলার জগতের সাথে সম্যক পরিচিত ছিলেন না। এমনকি রোমাঁ রোলাঁ বা রোটেনস্টাইনের মতো রবি-ঘনিষ্ঠ প্রাচীনপন্থিরা। এখানেও তার নির্জনতা চোখে পড়ার মতো (ব্যতিক্রমদের মধ্যে ছিলেন পল ভালেরি বা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মতো ব্যক্তিত্বরা- সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি)। তার চিত্রকর্মকে ধৈর্য ধরে বোঝার চেষ্টা ছিল না প্রায় সমসামরিক কারও মধ্যেই- বিশেষত এ দেশে। প্রগতি-কল্লোল-পরিচয় যুগের আধুনিক কবিদের সাথে গদ্যকবিতা ও এলিয়ট নিয়ে তার যা-ও বা এক ধরনের সংলাপ বা বিতর্ক হচ্ছিল, চিত্রকলায় তিনি ছিলেন তার স্বদেশে প্রায় নির্বাসিত। ছবি আঁকাকে নিতান্ত কবির খামখেয়ালিপনা বলে মনে করা হতো। এ নিয়ে তার কিছু ক্ষোভও ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। ১৯২২ সালে কলকাতায় সাম্প্রতিক ইউরোপীয় চিত্রকলার- বিশেষত ‘বাউহাউস’ স্কুলের এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকর্মের যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়- তার প্রধান প্ররোচনা ও উৎসাহ এসেছিল রবীন্দ্রনাথের তরফ থেকেই এ কথা এখন অনায়াসে বলা চলে। এ তথ্যও রয়েছে যে, ‘রবীন্দ্রনাথ নাকি শান্তিনিকেতনে বাউহাউস একটি শাখাও খুলতে চেয়েছিলেন।’ এই কলকাতা প্রদর্শনীর জন্য ‘বাউহাউস কর্তৃপক্ষ’ যেসব ছবি পাঠিয়েছিল তার মধ্যে ছিল অসাধারণ সব নাম :’পল ক্লির নয়টি জলরং, কান্ডিনস্কির চারটি জলরং, ফাইনিঙ্গারের উনিশটি ড্রইং ও ষোলোটি উডকাট, এটেনের তেইশটি ড্রইং, গেরহার্দ মার্কসের বিশটি জলরং, জর্জ ম্যুচের নয়টি এচিং, লোথার স্ট্ক্রেয়ারের সাতটি ছাপাই ছবি, সোফিয়ে কর্নারের দুটি জলরং, মাগ্রিট টেরি এডলারের কিছু কাজ প্রভৃতি।’ সুশোভন অধিকারী আরও জানিয়েছেন যে, ‘স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি পল ক্লি ও কান্ডিনস্কির একটি করে ছবি কিনেছিলেন।’ দুঃখের বিষয়, এ প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বাউহাউস কর্তৃপক্ষ উপরোক্ত কোনো একটি ছবিও ফেরত পায়নি! এমনকি, রবীন্দ্রনাথের ইতোপূর্বে ক্রয় করা ক্লি ও কান্ডিনস্কির ছবি দুটোরও কোনো হদিস মেলেনি। এত সবকিছুর পরও সমসাময়িক উপমহাদেশের চিত্রকলার ওপরে বাউহাউস প্রদর্শনীর প্রভাব খুব সামান্যই পড়েছিল, বা পড়ে থাকলেও তার প্রতিঘাত ভারতীয় চিত্রকলায় সঞ্চারিত হয়েছিল খুবই সন্তর্পণে। এটাও রবীন্দ্রনাথকে বিমর্ষ করে থাকবে। পরের আট বছরে কবি নিজেই যখন সর্বাধুনিক ধরনে ছবি আঁকতে লেগে গেলেন, সেটা নিয়েও উপর-ভাসা মন্তব্য ছাড়া কোনো গভীর সমাদরের আভাস পাই না আমরা। কাকা রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রসঙ্গে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় বলেছিলেন, ‘ওগুলো ছবি নয়, যেন অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎসার।’ এ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবির কোনো মূল্যায়ন বুঝতে পারি না আমরা। গণেশ পাইন বলেছেন, ‘স্বদেশ তার চিত্রাবলীকে তাঁর ঈপ্সিত অভ্যর্থনা দেয়নি।’ এর একটা কারণ হতে পারে, আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের আধুনিক ও সাম্প্রতিক চিত্রকলা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচয় না থাকা। রবীন্দ্রনাথের সেটা ছিল। গণেশ পাইন লিখেছেন, ‘পশ্চিমি নব্য শিল্পের নানা ধারার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ এবং দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল, এ কথা আমরা জানি। …বহুবার গেছেন প্রতীচীর শিল্পতীর্থ পারী নগরীতে …নানা প্রদর্শশালায় দেখেছেন …ইম্প্রেশনিস্ট, পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট, আর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট।’ ১৯২৫-এ সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ লিখতে পেরেছেন, ‘য়ুরোপে আজকাল চিত্রকলার ইতিহাসে একটা বিপ্লব এসেছে। …আধুনিক কলারসজ্ঞ মানুষ বলছেন, আদিকালের মানুষ তার অশিক্ষিত পটুত্বে বিরলরেখায় যে রকম সাদাসিধে ছবি আঁকত, ছবির সেই গোড়াকার ছাঁদের মধ্যে ফিরে না গেলে এই অবান্তরভারপীড়িত আর্টের উদ্ধার নেই।’ অর্থাৎ প্রিমিটিভ আর্টের প্রতারক সরলতার মধ্যে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আধুনিক শিল্পকলার ‘মুক্তি নেই’। এই উপলব্ধি যেমন সাম্প্রতিক শিল্পকলার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিরলরেখার ‘মিনিমালিজমে’ ফিরে তাকানোও সমানভাবে দরকার ছিল।

রবীন্দ্রনাথ হুয়ান মিরোর (Joan Miro) মিনিমালিস্ট ও শিশু সারল্যে ভরা ছবিগুলো দেখেছিলেন কিনা আমরা জানি না। প্যারিসে অবশ্য মিরোর নামাঙ্কিত বাগানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তি পরবর্তীতে স্থাপিত হয়েছে। মিরোর মতই ছবির সেই ‘গোড়াকার ছাঁদের’ দিকে ফিরে যাওয়ার একটা সচেতন চেষ্টা ছিল তার মধ্যে। কিন্তু এর যোগ্য সমাদর মেলেনি তার দৈশিক পরিপার্শ্বের কাছ থেকে। কলকাতায় তার ছবির প্রথম প্রদর্শনী সমসাময়িকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘তিনসঙ্গী’র অভীক চরিত্রটি এ নিয়ে খেদোক্তি করেছে :’আমি যে আর্টিস্ট এ পরিচয়ে তোমাদের একটুও শ্রদ্ধা নেই। এ আমার চিরদুঃখের কথা। আমি নিশ্চিত করে জানি, একদিন সেই রসজ্ঞ দেশের গুণী লোকেরা আমাকে স্বীকার করে নেবে, যাদের স্বীকৃতির খাঁটি মূল্য আছে।’ শুধু উপন্যাসের মাধ্যমে নয়, এ কথা পত্রালাপেও জানিয়েছেন। প্যারিসে চিত্র-প্রদর্শনীর বছরেই কবি নিজেই এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন নির্মলাকুমারী (রানী) মহলানবিশকে। প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও অর্থনীতিবিদ (পরবর্তীতে নেহরুর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ‘আর্কিটেক্ট’) প্রশান্তচন্দ মহলানবিশ-এর সহধর্মিণী বলে নয়, তার নিজস্ব মননশীলতার কারণেই রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রিয় পাত্রী ছিলেন নির্মলাকুমারী। ১৯৩০ সালের আগস্ট মাসের এই চিঠিতে কবি জানাচ্ছেন :’জর্মনিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতটা আশা করি তোমরা বোঝো। …আমার দেশের সঙ্গে আমার চিত্রভারতীর সম্বন্ধ নেই বলে মনে হয়। …ছবি যখন আঁকি তখন রেখা বলো রঙ বলো কোনো বিশেষ প্রদেশের পরিচয় নিয়ে আসে না। অতএব, এ জিনিসটা যারা পছন্দ করে তাদেরই, আমি বাঙ্গালি বলে এটা আপন হতেই বাঙ্গালির জিনিস নয়। এই জন্যে স্বতঃই এই ছবিগুলিকে আমি পশ্চিমের হাতে দান করেছি। …আমি যে শতকরা একশো হারে বাঙ্গালি নই, আমি যে সমান পরিমাণে য়ুরোপেরও, এই কথাটারই প্রমাণ হোক আমার ছবি দিয়ে।’ শেষের লাইনটি লক্ষ্য করার মতো। এই কথা শতভাগ খাটে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, অমর্ত্য সেন, রণজিৎ গুহসহ সব প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে। এদেরকে কোনো ‘জাতীয়তাবাদী’ কালো বাক্সে বন্দি করা যাবে না।

এই একই কথা বলেছেন ১৯৩০ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও। জার্মানিতে তার ছবিগুলো দেখে সবাই খুব প্রশংসা করেছে, অথচ দেশে সেগুলো গুরুত্ব পায়নি :’আশা হচ্ছে এগুলো রসিকের দৃষ্টিগোচর হবে। পণ করেচি “আমার জন্মভূমিতে” ফিরিয়ে নিয়ে যাব না- অযোগ্য অভাজনদের স্থূল হস্তাবলেপ অসহ্য হয়ে এসেচে।’ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন নিজের ছবি সম্পর্কে- বিদেশের মাটিতেই ছবিগুলো রেখে দিতে চান :’আমার পরম সৌভাগ্য এই যে আমাদের নিজপারের ঘাট পেরিয়ে এসেচি। আমার এই শেষ কীর্ত্তি এই দেশেই রেখে যাব।’ রানী মহলানবিশকে এমনভাবে বলেছেন যেন এ বিষয়ে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন :’আমার ছবিগুলোকে স্বদেশে কদাচ নিয়ে যাব না- পশ্চিম সাগরের পারে সমস্ত উজাড় করে দিয়ে তবে ফিরব।’ ততদিনে চিত্রকলা যে তার ‘শেষ কীর্ত্তি’ সেটা আমাদের জানা হয়ে গেছে। এর কারণও লিখেছেন- ‘যাই হোক ইন্ডিয়ান আর্ট যাকে বলে সেটা আমার আনাড়ি কলমে প্রকাশ পায়নি’, অর্থাৎ প্রথাগত ভারতীয় চিত্রকলা বলতে যে ‘রিয়ালিস্টিক’ ধরনের শিল্পকর্ম বোঝানো হয়ে থাকে (রবি বর্মা যার বড় উদাহরণ ছিলেন উনিশ শতকের শেষ ভাগে), সে রকম আদৌ নয় রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম। বা অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল স্কুলের’ আর্টের ধারাতেও তিনি নেই। আর সেজন্যেই এটা হয়তো পাশ্চাত্যের রসজ্ঞ মহলে বিশেষ আগ্রহের বিষয়বস্তু হতে পারে। ফ্রান্সে তার ছবির প্রদর্শনী নিয়ে ইন্দিরা দেবীকে ২৭ মে ১৯৩০ তারিখে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের মত কড়া হাকিমের দরবারেও শিরোপা মিলেচে- কিছুমাত্র কার্পণ্য করেনি’, আর জার্মানিতো তার দ্বার খুলে দিয়েছে বার্লিনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের ছবি কিনে। এজন্যেই রানী মহলানবিশকে লেখা ১৮ আগস্ট ১৯৩০-এর চিঠিতে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ বলতে দ্বিধা করেননি যে ‘এই যাত্রায় আগেরবারের চেয়ে জর্মনির অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে আমার প্রবেশাধিকার ঘটেছে। ওদের কাছাকাছি এসেছি।’ ১৯১৬ সালে কবি তার কন্যা মীরা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘চিত্রবিদ্যা ত আমার বিদ্যা নয়, যদি তা হত তাহলে একবার দেখাতুম আমি কি করতে পারতুম।’ শেষ পর্যন্ত উক্ত চিঠি লেখার ১৪ বছরের মধ্যেই তিনি দেখিয়ে ছেড়েছিলেন যে চিত্রকলার শাখাতেও তিনি কতটা স্বতন্ত্র, মৌলিক এবং সর্বাধুনিক হতে পারেন।

এ সবকিছুই অবশ্য হতো না যদি তিনি ঠিক সময়ে তার আর্জেন্টিনার ‘বিজয়া’ তথা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সমর্থন ও সহায়তা না পেতেন। ‘প্যারিস ১৯৩০’ মানেই ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথের প্যারিস- এটা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। এই গল্পের বীজ বোনা হয়েছিল আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ার্সের অদূরের সাবার্বে সান-ইসিদ্রার এক নির্জন প্রাসাদোপম বাড়িতে (প্রায় দুই মাস ছিলেন কবি যেখানে ভিক্টোরিয়ার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে)। তখন বিজয়ার বয়স ৩৪, রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৩। এই সাক্ষাৎ-এর কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছিল।

[ক্রমশ]