[তুমুল গাঢ় সমাচার ৬] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৬

[গত সংখ্যার পর]

৫.

তবে ষাটের দশকের কবিতার প্রগতিপন্থা অন্যভাবেও সংক্রমিত হয়েছিল। পঞ্চাশের যুগেই বাম-প্রগতিশীল ধারার সাথে জাতীয়তাবাদী ধারার অন্তর্লীন যোগাযোগ গড়ে উঠতে থাকে। সেটা বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে ষাটের দশকে। এই যোগাযোগ রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ক্রমশ এক নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে থাকে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকদের পক্ষ থেকে সচেতনভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারার প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী ধারার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য ছিলেন, তাদের মধ্যে শামসুর রাহমানের নাম প্রথমেই চলে আসবে। বাম-প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা শামসুর রাহমানের সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, প্রেরণা জোগাতেন, কোনো বিশেষ দিবস বা উপলক্ষে বাংলার এই প্রতিভাবান কবি যাতে কবিতা লেখেন, সে সম্পর্কে সচেতন প্ররোচনা ছিল তাদের।

যে কোনো কারণেই হোক, ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ আসেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে তার অভ্যুদয়। তবে ঘনিষ্ঠ বিচারে শামসুর রাহমানকে ছাড়া ষাটের কবিতায় আধুনিকতার নির্মাণ ও পুনর্জাগরণের বিষয়টি আলোচনা করা প্রায়-অসম্ভব। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। সে হিসেবে, বাংলা কবিতার ষাটের দশক তার হাত দিয়েই শুরু। বস্তুত, ষাটের দশকেই বের হতে থাকে সাড়া-জাগানো তার একের পর এক কাব্যগ্রন্থ :রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৬), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮) ও নিজ বাসভূমে (১৯৭০)। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় লেখা ‘বন্দীশিবির থেকে’ (১৯৭২) থেকে পেছনে ফিরে গেলে দেখা যাবে যে গোটা ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি-সংগ্রাম তার কবিতার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে গ্রন্থিত হয়ে এসেছে। রৌদ্র করোটিতেই তিনি লিখেছেন ‘লালনের গান’; রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন কবিতা যখন তার গানকে বেআইনি করা হয়েছে; ভাষা আন্দোলন ও বাংলা কবিতার অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে সমর্থন করে লিখেছেন বিধ্বস্ত নীলিমার ‘বাংলা কবিতার প্রতি’; আয়ুব শাহীর স্বৈরাচার শাসনের ছায়ায় লিখেছেন নিরালোকে দিব্যরথের ‘সকল প্রশংসা তার’; রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে মনে রেখে লিখেছেন ‘টেলেমেকাস’; গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে লিখেছেন নিজ বাসভূমের এক ঝাঁক প্রতিবাদী কবিতা- ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯’, ‘পুলিশ রিপোর্ট’, ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা’, ‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি’, ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘কী যুগে আমরা করি বাস’, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’, ‘এ যুদ্ধের শেষ নেই’, অথবা ‘আমি কথা বলাতে চাই’। ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম শামসুর রাহমানের অন্তরঙ্গে-বহিরঙ্গে যেমন অনুভবযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি এসব আন্দোলন-সংগ্রাম নিছক রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আইডেনটিটি বা আত্মসত্তা খুঁজে পেয়েছিল তার ও তার সহযাত্রীদের কবিতা-গানের মাধ্যমে।

এইসবই পুরোনো, বহু-চর্চিত প্রসঙ্গ। রাজনীতি ও সংস্কৃতি এ দুইয়ের মধ্যে ইতিহাসের গভীর এরিয়েলে অলক্ষ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যায়। শামসুর রাহমানের ষাটের দশকের লেখায় ক্রম-বাড়ন্ত রাজনৈতিক, এমনকি শ্রেণি-সচেতনতার যে লক্ষণ দেখতে পাই তার কারণ নিহিত ছিল সে সময়ের পরিবেশে, হাওয়ায়, এমনকি দেয়াল-লিখনে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝি স্পষ্ট হয়। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কবির সাথে দেখা হলে আমি বলি যে আমার বহুদিনের ইচ্ছা যে তিনি যেন সেজার ভায়েহোর একটি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ভায়েহোর কোন কবিতাটির কথা বলছেন? কবিতাটির নাম শুনে তিনি বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, এই কবিতাটির আদলে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম ষাটের দশকেই, আমার নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থে সেটি আছে। অস্বীকার করব না যে আমি কিছুটা পরিমাণে চমকে উঠেছিলাম। ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকেরা যারা এ দেশের নব-জাগরণের অধ্যায় নীরবে সৃষ্টি করেছিলেন তাদের পঠন-পাঠনে কোনো খামতি ছিল না। বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টির সাথে তাদের যেমন পরিচিতি ছিল, প্রগতিবাদী সাহিত্যের সাথেও তাদের যোগসূত্র ছিল নিবিড়। পেরুর কবি সেজার ভায়েহো মার্কসবাদে অনুপ্রাণিত কবি ছিলেন, ১৯২৮ ও ১৯২৯ সালে পরপর দু’বার তিনি রাশিয়ার নতুন নির্মাণ দেখতে যান, ১৯৩১ সালে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, ১৯৩৬-৩৯ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে তিনি দু’বছর সক্রিয় অংশ নেন জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের অংশ হয়ে। ১৯৩৮ সালে প্যারিসে ৪৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আমি ভেবেছিলাম যে শামসুর রাহমানকে আমি তার সম্ভাব্য অজানা কোনো এক কবির সম্পর্কে আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিচ্ছি। অথচ প্রায় তিন দশক আগেই কবি সেজার ভায়েহো সম্পর্কে জেনেছেন; শুধু জেনেছেন নয়, তার কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের এক শ্রেষ্ঠ কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলাদেশের ষাটের দশকের নব-জাগরণের এমনি ছিল গভীর মানবিক নির্মাণ, যা দেশ-মাটির জলে শেকড় ছাড়লেও অতিক্রম করে গিয়েছিল দেশ-কালের গণ্ডী।

সেজার ভায়েহোর কবিতাটি ছিল এ রকম :

I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in ParisÑ and I don’t step asideÑ
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.

It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.

Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also

with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads… I will die in Paris, on a rainy day
on some day I can already remember.
I will die in Paris and I don’t step aside
Perhaps on a Thursday, as today is Thursday, in autumn.

It will be a Thursday, because today, Thursday, setting down
these lines, I have put my upper arm bones on
wrong, and never so much as today have I found myself
with all the road ahead of me, alone.

Ceasar Vallejo is dead. Everyone beat him
although he never does anything to them;
they beat him hard with a stick and hard also

with a rope. These are the witnesses :
the Thursdays, and the bones of my arms,
the solitude, and the rain, and the roads…

বিষণ্ণ, অতি-ব্যক্তিক, অমোঘ পরিণতির দিকে ধাবমান, কবি-জীবনের সায়াহ্নকালীন এই উচ্চারণ তরুণতর শামসুর রাহমানের হাতে পড়ে এক অন্য রূপ পেয়েছিল। ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিবেচনা’ কবিতাটির অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি (পাঠক, পুরোটা পড়ে নেবেন, এই ভরসা রাখি) :

‘সেদিনও কি এমনি অক্লান্ত ঝরঝর বৃষ্টি হবে এ শহরে?

ঘিনঘিনে কাদা

জমবে গলির মোড়ে সেদিনও কি এমনি,

যেদিন থাকব পড়ে খাটে নিশ্চেতন,

নির্বিকার, মৃত?

আলনায় খুব

সহজে থাকবে ঝুলে সাদা জামা। বোতামের ঘরগুলো যেন

করোটির চোখ, মানে কালো গহ্বর। জুতো জোড়া

রইবে পড়ে এক কোণে, যমজ কবর। কবিতার

খাতা নগ্ন নারীর মতোই চিৎ হয়ে

উদর দেখিয়ে

টেবিলে থাকবে শুয়ে আর দেয়ালের টিকটিকি

প্রকাশ্যেই করবে সঙ্গম।

যেদিন মরব আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুশকিল।

শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?

যেবারই হোক,

সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা

না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে, পথঘাট,

পুণ্যবান শবানুগামীরা বড় বিরক্ত হবেন।’

এই সাক্ষাতের আরও কিছুকাল পরে- ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এ দেশেও বাম-প্রগতিশীল মহলে নানা জিজ্ঞাসার টানাপড়েন দেখা দিয়েছে- কবির সাথে তার শ্যামলীর বাসায় দেখা হয়েছিল। এসব ভাঙন, বিলুপ্তিবাদ, অস্থিরতা কবির ভালো লাগেনি। বেশ জোরের সাথেই অনুযোগ করেছিলেন, ‘এখন তো আর পার্টির থেকে কেউ আমার কাছে আসে না। আগে তারা কত আসতেন, আমাকে দিয়ে তারা কত কবিতা লিখিয়েছেন। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে।’

৬.

এবার বোধহয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। এই প্রবন্ধটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইটিকে উপলক্ষ করে ষাটের দশকের কবিতা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথমত, বলার কথা ছিল এই যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম এমনিতেই সফলতা পায়নি। ‘আন্দোলন’ যে ‘মুক্তি-সংগ্রামে’ পরিণত হয়েছিল তার পেছনে যেমন অর্থনীতিবিদদের গড়া ‘দুই-অর্থনীতি’ শীর্ষক বৈষম্যের তত্ত্ব যুক্তি-ভিত্তি জুগিয়েছিল ষাটের দশকের শিল্প আন্দোলন, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার আন্দোলনও কাজ করে থাকবে। আধুনিক বাংলা কবিতার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন সাংস্কৃতিক নব-জাগরণের ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল। ষাটের দশকের ‘রেনেসাঁ’ ছাড়া আমরা বিশ্বতালে তাল রেখে চলা শিখতে পারতাম না, আমাদের সেই বিরল আত্মবিশ্বাসটুকু আত্মস্থ হতো না যেটি না আসলে একটি সংগ্রামরত জাতি জগৎ-সম্মুখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, যেমন পারে না একটি অর্বাচীন বালক ভাব প্রকাশের ভাষাহীন হয়ে সৃষ্টিশীল হতে, শত মেধা থাকা সত্ত্বেও। ষাটের দশকের কবিতার ভুবন, তার শিল্পলোক, সেই বালকটিকে এক মেধাসম্পন্ন জাগতিক সম্ভাবনার একটি আত্মনির্ভর পাটাতন দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে একটি জাতি-নির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায়।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৫] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৫

[গত সংখ্যার পর]

বলেওছিলাম তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে, এ নিয়ে লিখতে। তিনি আগ্রহের সাথে তার অনন্যসাধারণ উচ্চারণে গাঢ় কণ্ঠে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন তার ‘আপনারা জানেন’ কবিতাটি। এর ফর্ম নিয়ে মৌলিকত্বের দাবি ছিল তার :

আপনারা জানেন
মহামতি প্লেটো কী বলেছেন…
দার্শনিক কান্ট কী বলেছেন…
হেগেল কী বলেছেন…
মহামতি বুদ্ধ কী বলেছেন…
দেকার্তে কিংবা
বেগর্স কী বলেছেন…
বার্ট্রান্ড রাসেল কী বলেছেন…
হোয়াইটহেড কী বলেছেন…
জীবনানন্দ দাশ কী বলেছেন…
বুদ্ধদেব বসু কিংবা বিষ্ণু দে কী বলেছেন…
কী বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ!
কী বলেছেন কবিকুল চূড়ামণি মাইকেল!
আপনারা জানেন
ঈশ্বরের পুত্র যিশু কী বলেছেন…
ইউরিপিডিস কিংবা সফোক্লিস কী বলেছেন…
মিশেল ফুকো কী বলেছেন,
দেরিদ্দা কী বলেছেন
কী বলেছেন পিকাসো
কিংবা পল এলুয়ার!
এই গ্রন্থের মহাপুরুষেরা কে কী বলেছেন
আপনার সবাই জানেন। এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য
নয়, আমি এক নগণ্য মানুষ, আমি
শুধু বলি :জলে পড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন

আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, একদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কবিতার আলোচনা করার সময় আমাদের শহীদ কাদরী পড়তে বলেছিলেন। বাংলা কবিতায় আবেগের প্রবল উত্তাপ ও আতিশয্য, এখানে তির্যক ভঙ্গিতে বলার মতো শক্তি, স্যাটায়ার-এর সংহত ক্ষমতা প্রায় দুর্লক্ষ্য। শহীদ কাদরী সেই দুর্লভতমদের একজন। এটাই ছিল স্যারের বক্তব্য। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র তির্যক কবিতাগুলোকে মনে রেখেই তিনি এ কথা বলেছিলেন। তখন আমার মনে হতো যে, বহিরঙ্গে স্যাটায়ার থাকলেও ভেতরে ভেতরে শহীদ কাদরী সময়ের সাথে আরও বেশি নিঃসঙ্গ বেদনাহত সমাজের ক্ষত সারিয়ে তোলা যায় এমন পঙ্‌ক্তিমালায় সংহতি খুঁজছিলেন। হয়তো জাগরণের পরেই আসে মোহভঙ্গের পর্ব, আমাদের জাতীয় জীবনেও এটা পর্বান্তর ঘটেছিল। যে-বই থেকে নিজের প্রিয় কবিতাটি বেছে সেদিন পড়েছিলেন তার পাতায় কিছু লিখে দিতে অনুরোধ করায় শহীদ কাদরী লিখেছিলেন- ‘এই নশ্বর গ্রহ থেকে একদিন সব স্বাক্ষরই মুছে যাবে- মনে রেখো।’

৪.

আলোচনার বাইরে থেকে গেল আরও অনেক কবি-সাহিত্যিকের রচনা- মহাদেব সাহা, মোহাম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক, অরুণাভ সরকার, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ। যেমন বাইরে থেকে গেল ষাটের দশকের চলতি সাময়িকীর প্রসঙ্গ। একুশে উপলক্ষে যেসব পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বার হতো তার মধ্যে সমাজ-বদলের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অনেক কবিতা ও গদ্য-রচনা থাকত। সেসব লেখাও পরোক্ষভাবে ষাটের দশকের নব-জাগরণে সাহায্য করেছিল। এই দশকের স্বল্পায়ু কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ‘লিটল ম্যাগাজিন’গুলোর মধ্যে ছিল সাম্প্রতিক, স্বাক্ষর, না, কালবেলা ও বক্তব্য। সংক্ষিপ্ত অথচ সংকেতবাহী নাম-সংবলিত এসব উদ্যোগ এখন পর্যন্ত ইতিহাস-গবেষকদের বা বর্তমানকালের সাহিত্য-পাঠকদের কাছ থেকে যথাযথ মনোযোগ লাভ করেনি। এসব পত্রপত্রিকা থেকে শ্রমে-নিষ্ঠায় সেরা লেখাগুলো বাছাই করে খণ্ডে খণ্ডে এক সময় সংকলন বের হবে- এটা আশা করা অন্যায় নয়। একই রকমের প্রত্যাশা ছিল ‘একতা’ পত্রিকার বিষয়েও। এই পত্রিকার পাতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে সত্তর ও আশির দশকে, পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগে যার সংকলন হওয়া জরুরি। এসব সংকলনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের নব-জাগরণের ‘প্রগতিবাদী’ ধারার একটি সমৃদ্ধ ছবি ফুটে উঠবে। আগামী দিনে বাম-প্রগতিশীল ধারার বিকাশের জন্যও এটি জরুরি।

ষাটের দশকে এই ভূখণ্ডে একজন ‘কমিটেড’ সমর সেন, দীনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো কেউ ছিলেন না। এরা সবাই জীবনের বড় সময়জুড়ে বামধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, এ দেশের গদ্যের ভুবনে একজন শহীদুল্লা কায়সার সৃষ্টিশীল ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জেলে বসে লেখা তার ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়। শ্রেণি-সংগ্রাম, অসাম্প্রদায়িকতা, সামন্ততান্ত্রিক প্রথার বিরুদ্ধে নারীর বিদ্রোহ- সব মিলিয়ে সংশপ্তক উপন্যাসটি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পটভূমি অলক্ষ্যে নির্মাণ করে দেয়। শহীদুল্লা কায়সার সরাসরিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার ভাই জহির রায়হানও একই আদর্শে প্রাণিত হয়েছিলেন এবং সাহিত্য রচনা করেছিলেন, যদিও তার প্রতিভা পূর্ণতা পেয়েছিল শিল্পকলার সেলুলয়েড মাধ্যমেই। তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শানিত করতে সাহায্য করেছিল চলচ্চিত্রের মতো জনপ্রিয় মাধ্যমে। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-চেতনার ধারায় প্রেরণা এসেছিল প্রথাগত বাম-গণতান্ত্রিক ধারার বাইরের অস্তিত্ববাদ থেকেও। আমি এই সূত্রে বিশেষ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনাবলির কথা উল্লেখ করতে চাই। অস্তিত্ববাদের ভেতরের এক বিশেষ ধারা- আলবেয়ার কাম্যুর থিওরি অব অ্যাবসার্ড ওয়ালীউল্লাহকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। ওয়ালীউল্লাহর লেখায় গদ্যকে সামনে এগিয়ে দিয়ে পিছু পিছু হাঁটে কবিতা এবং এক মোহাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করে। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র সূচনা-পর্বেই আলবেয়ার কাম্যু ভর করেন এ দেশের নব-জাগরণের নিঃশব্দ উত্থানের ওপরে। ‘যুবক শিক্ষক’ (যার নাম পুরো উপন্যাসে জানা যায় না) বাঁশঝাড়ের মধ্যে রাতের আলো-অন্ধকারে একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায় এবং দৃশ্যটি দেখে সে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ে :’যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগি-মুখে হাল্ক্কা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে। বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট মহামারী-হাহাকার দেখেছে, কিন্তু কখনও বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই। সে ছুটতেই থাকে।’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চল্লিশের দশকে সিপিআই-এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। সংশপ্তকের মার্কসীয় শ্রেণি-সংগ্রামের সাথে চাঁদের অমাবস্যার ফ্রয়েডীয় সাইকো-অ্যানালাইসিস মিলেমিশে গিয়ে পূর্ব বাংলার গদ্য-সাহিত্যের দৃষ্টিশক্তিকে প্রসারিত করে দিয়েছিল। যার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে নির্মিত হতে পেরেছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ অথবা হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’র মতো উপন্যাস।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বা শহীদুল্লা কায়সার উভয়েরই প্রগতিশীল মার্কসবাদী ভাবাদর্শের নিরিখে মানস-জমিন আগে থেকে তৈরি করা ছিল। তারা যেটা গদ্যে পেরেছিলেন, সেভাবে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে ষাটের কবিতার ভুবনে সমাজ বদলের কাব্য লিখতে খুব বেশি কেউ সক্রিয় ছিলেন না। রণেশ দাশগুপ্ত তার ‘আধুনিক বাংলা কবিতার প্রগতিতে বাংলাদেশের ধারা’ নিবন্ধে হুমায়ুন কবির ও নিয়ামত হোসেনের উল্লেখ করেছেন। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র যুবতীর মৃতদেহের মতোই হুমায়ুন কবির ‘করালী বেহুলা’ কবিতার লখিন্দরের মৃতদেহকে পড়ে থাকতে দেখেন :

‘নিথর চাঁদের রাত হরিদ্রাভ চাঁপার আকাশ

বণিক বণিতা ঘুমে জাগে একা কল্লোলিনী প্রেম

সোনার বরণ তনু ক্ষয়ে যায় বিষের ছোঁয়ায়

তখন হঠাৎ হায়! হায়, প্রাকৃত নারী কতবার হতভাগ্য হবে।!’

ষাটের দশকেই ‘কুসমিত ইস্পাত’-এর কবি হুমায়ুন কবির অনায়াসে বলে ওঠেন :

‘কলার মান্দাসে আজ বেহুলা ভাসে না বুঝি

শরীরী আগুন তার দেহ; করাল রূপালী নারী

আগুনের তরঙ্গে ফোঁপায়, বুঝি ঝড় উঠে আসে।

চম্মক নগরে থাকি বৃদ্ধ চাঁদ বণিক আমরা

বেহুলা বলয়ে শোন- খোঁজ সেই কুটিল নাগিনী

ছিন্নভিন্ন হত্যা করো, দগ্ধ করো, বিষময় দেহ।’

রণেশ দাশগুপ্ত সঙ্গত কারণেই তার নিবন্ধে উপ-শিরোনাম দিয়েছেন- ‘একটি অসমাপ্ত পর্যালোচনা’। এর কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলাদেশের নব-জাগরণে প্রগতিবাদী ধারার সম্যক মূল্যায়ন করতে হলে প্রথমে চাই এর সংকলন। তিনি ১৯৮৯ সালে এ প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা এখনও প্রাসঙ্গিক :

‘বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের আধুনিক প্রগতির কবিতার ধারাটাকে বোঝার জন্য চাই সমস্ত কবিতার সমাবেশ বা সমারোহ। চাই অন্ততপক্ষে সংকলন। … বাংলাদেশের কবিদের বই একটি-দুটি করে বেরোতে শুরু করে সাধারণত ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এর আগে এবং পরে প্রথিতযশা কবিদের লেখাও বেরিয়েছে প্রধানত ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় অথবা সাধারণভাবে অনিয়মিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় কিংবা বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাব্যপত্রে অথবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর শহীদ স্মরণিকায়। … বাংলাদেশের কবিতার জগতে রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রাম একটি আবহ গড়ে দিয়েছে, যাতে প্রথিতযশারা এবং উদীয়মানেরা হাতে হাত রাখতে ভ্রূক্ষেপ করেন না।’

রণেশ দাশগুপ্ত এর পর গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছিলেন ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘আধুনিক কবিতা’, সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিষ্ণু দে সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের কবিতা এক স্তবক’ এবং জুলাই ১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুর্গাদাস সরকার ও সনাতন কবিয়াল সম্পাদিত ‘গ্রাম থেকে সংগ্রাম’ সংকলন গ্রন্থের। এই শেষোক্ত সংকলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এ দেশের ‘মহিলা-কবিদের কবিতা-সংগ্রহ’। এর থেকে অবশ্য ষাটের দশকের কবিতার প্রগতিবাদী ধারা সম্পর্কে সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় না, কেবল আমাদের ঔৎসুক্য আরও বেড়ে যায়।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৪] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৪
[গত সংখ্যার পর]

৩. নব-জাগরণের ভাষা ও শহীদ কাদরী

শহীদ কাদরীকে আমি ‘উত্তরাধিকার’ কাব্যগ্রন্থের প্রসঙ্গ তুলে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তার ষাটের দশকের কবিতায় অবক্ষয়ের, যুদ্ধের, মড়কের, দাঙ্গার প্রভৃতি বিপর্যয়ের যত উল্লেখ, তা কতটা পরিমাণে সমকালীন বাস্তব দ্বারা চিহ্নিত, নাকি সেটা নিতান্তই তার কল্পনাপ্রসূত? নব-জাগরণের অকৃত্রিমতা বোঝার জন্য এ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া জরুরি।

‘উত্তরাধিকার’-এর একেকটি কবিতা ধরে ধরে কবি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে এই যুদ্ধ-দাংগা অবক্ষয়-বোধ ষাটের দশকের নয়, এগুলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন কলকাতার অভিজ্ঞতা দিয়ে তৈরি। উদাহরণত, নাম-কবিতায় তিনি স্মরণীয় করে লিখেছেন :

জন্মেই কুকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে-
সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিল যেন
দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে
নিমজ্জিত সবকিছু, রক্তচক্ষু সেই ব্লাক আউট আঁধারে।

এখানে সন্ত্রস্ত শহর, ব্লাক আউট আধার প্রভৃতি শব্দ ষাটের দশকের ঢাকাকে বোঝাচ্ছে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন কলকাতার দীপহীন রাত্রিকে নির্দেশ করছে। অনেক যুদ্ধ, দাঙ্গা, মহামারী ও মন্বন্তর সূচিত শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে শহীদ কাদরী শ্রান্ত-ক্লান্ত কলকাতা থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা ঢাকা শহরে এসে পা রাখলেন। দেশভাগের পরিণামে এক প্রকার উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল তাকে। এর ফলে যেসব কবিতা বেরিয়েছিল তাকে নিছক কবির ‘মনোজাত নাগরিক বিকলাঙ্গ জীবনজগতের সন্ধান’ (জনৈক সমালোচকের উক্তি তুলে ধরছি) বলে চিহ্নিত করলে পুরোটা বলা হয় না। দেশভাগের ফলে উন্মূল উৎপাটিত খসড়া জীবনের কষ্টটা তাতে চাপা পড়ে যায়। উদ্বাস্তু জীবন থেকেই উদ্বাস্তু মনের উদ্ভব। তাই তিনি ‘নপুংসক সন্তের উক্তি’ কবিতায় বলেছেন :

‘কেন এই স্বদেশ সংলগ্ন আমি, নিঃসঙ্গ উদ্বাস্তু,
জনতার আলিঙ্গনে অপ্রতিভ, অপ্রস্তুত, অনাত্মীয় একা,
আঁধার টানেলে যেন ভূতলবাসীর মতো, যেন
সদ্য, উঠে আসা কিমাকার বিভীষিকা নিদারুণ!
আমার বিকট চুলে দুঃস্বপ্নের বাসা? সবার আত্মার পাপ
আমার দুচোখে শুধু পুঞ্জ পুঞ্জ কালিমার মত লেগে আছে
জানি, এক বিবর্ণ গোষ্ঠীর গোধূলীর যে বংশজাত আমি
বস্তুতই নংপুসক, অন্ধ, কিন্তু সত্যসন্ধা দুরন্ত সন্তান।

একে কেবল স্যাড জেনারেশন, হাংরি জেনারেশন, ষাটের অবক্ষয়বাদী কবিতার ধারা বলে শনাক্ত করা চলে না। এর একটি আশু তাৎপর্য এই যে, অবক্ষয়বোধের পেছনে শুধু হই-চই, শুধু প্রথাগতকে অস্বীকার করে তারুণ্যের স্বাক্ষর রাখার তাগিদ ছিল না। এর পেছনে রাষ্ট্র-সমাজজীবনের বিপর্যয়ের যোগসূত্র ছিল। ইতিহাসের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েই তবে লেখা সম্ভব ছিল ‘উত্তরাধিকার’-এ :

‘-এইমতো জীবনের সাথে চলে কানামাছি খেলা
এবং আমাকে নিস্কপর্দক নিষ্ফ্ক্রিয়, নঞর্থক
করে রাখে; পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা!’

আগেই বলেছি, ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এক গভীর দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদ অবক্ষয়ের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। কিন্তু দেশ-ভাবনাকে নিয়েও খেলেছিলেন তারা ছন্দে-উপমায় চিত্রকল্পে-সংকেতে। এর একটা বড় কারণ ছিল ষাটের কবিদের মধ্যে প্রবল সমকালীনতাবোধ। ষাটের দশকে শুধু ছয়-দফা আন্দোলনই নয়; ১৯৬৮ থেকে শুরু করে ফ্রান্স, আমেরিকা, চেকোশ্নোভাকিয়া, সারা বিশ্বেই ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছিল; চে গুয়েভারা মারা গেলেন বলিভিয়ায়, রবার্ট কেনেডি নিহত; নিক্সন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। সত্তর সালের জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু হলো পূর্ববাংলার অসংখ্য মানুষের। আর সে বছরই নির্বাচনে জয় পেল শেখ মুজিবের দল, সেই মুজিব যিনি পান্নালালের গান ভালবাসতেন-‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা।’ এসবের প্রভাব এসে পড়েছিল কবিতার স্বগত উচ্চারণেও। শহীদ কাদরীর ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া’ এর উদাহরণ :

সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসেছে
এক দীর্ঘ সাঁজোয়া-বাহিনী
এবং হেডলাইনগুলো অনবরত বাজিয়ে চলছে সাইরেন।
একটি চুম্বনের মধ্যে সচিৎকার ঝলসে গেল কয়েকটা মুখ,
একটি নিবিড় আলিঙ্গনের আয়ুস্কালে
৬০,০০০,০০ উদ্বাস্তুর উদ্বিগ্ন দঙ্গল
লাফিয়ে উঠলো এই টেবিলের ‘পর;
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে সুখাদ্যের ধোঁয়া
কেননা এক বাচাল বাবুর্চির
সবল নেতৃত্বে
আর সুনিপুণ তত্ত্বাবধানে
আমাদের সচ্ছল কিচেনে
অনর্গল রান্না হ’য়ে চলেছে আপন-মনে
নানা ধরনের মাংস-
নাইজেরিয়ার, আমেরিকার, সায়গনের, বাংলার
কালো, শাদা, এবং ব্রাউন মাংস।

সমসাময়িক জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এই তীব্র সচেতনতা ষাটের অবক্ষয়-পেরুনো জাগরণের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। উল্লেখ্য, সে যুগে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি ছিল গর্বের সাথে ধারণ করার মতো একটি শিরস্ত্রাণ। সেটি যত-না মাওবাদ বা সোভিয়েতের কারণে (১৯৬৮ সালে চেকোশ্নোভকিয়ায় গিয়েছিল রুশি ট্যাংক- সে স্মৃতি তখনও তাজা) তারচেয়ে বেশি পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প খোঁজার তাগিদে। প্রায় একই সময়ে ইন্দিরার কংগ্রেস, ভুট্টোর পিপিপি আর মুজিবের আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রকে তার অন্যতম আত্ম-পরিচয় হিসেবে স্বীকার করে নেয়। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এই পরিবর্তন মাও সে তুং-এর ‘রেড বুক’-এর কারণে হয়নি। ষাটের দ্বিতীয় ভাগের কবিতায় সমাজ-চেতনা সে ধরনের বোধে প্রধানত চালিত হয়নি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, পাকিস্তানে ‘বাইশ পরিবার’-এর উত্থান প্রভৃতি অনুষঙ্গ ৬-দফাকে ১১-দফায় পরিণত করতে সাহায্য করেছিল। এই অর্থনৈতিক চেতনা কবিতার বলয়ে পরোক্ষ প্রভাব ফেলে থাকবে। এক অসহায় বিপর্যস্ত মানবিক বোধে ষাটের কবিরা সমাজ-পরিবর্তন ও সাম্য-ধারণার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে দাঁড়ালেও সে তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ছাড়তে চাননি। শহীদ কাদরী লিখেছেন :

চুলের চটুল অহঙ্কার সহনীয় নয় কোনো সুধীমণ্ডলীর কাছে
অতএব খাটো হতে হবে তাকে,
সমাজের দশটা মাথার মতো হতে হলে, দশটা মাথার মতো
অতএব বেঁটে হ’তে হবে তাকে
তবু সে আমার চুল
অন্ধ
মূক ও বধির চুল মাস না যেতেই
আহত অশ্বের মতো আবার লাফিয়ে উঠছে অবিরাম

শুধু শহীদ কাদরী নন; এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সামষ্টিক কল্যাণ কামনা অনায়াসে সহাবস্থান করছিল ষাটের দশকের প্রায় সব কবির মানসে-কবিতায়।

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। ষাটের প্রতিনিধিত্বশীল কন্ঠ হিসেবে শহীদ কাদরীর আলোচনা কতদূর সঙ্গত? এটা তো সবারই জানা যে, শহীদ কাদরীর সাথে ছিল শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের একদার গভীর বন্ধুত্ব, যা গড়ে উঠেছিল পঞ্চাশের দশকেই। তারপরও শহীদ কাদরীকে আলোচনায় টেনে আনা। কেননা, তিনি উভয় দশকেই তার পদচ্ছাপ রেখেছিলেন। ষাটের তরুণ ও তরুণতর কবিকুলের আড্ডায়-এমনকি সত্তরের দশকেও প্রবাসের পথে পাড়ি দেওয়া পর্যন্ত- তার ছিল নিয়মিত উপস্থিতি। এমনকি এসব আড্ডার অনেকাংশে তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। ষাট দশককে যদি জাগরণের পর্ব বলি, তাহলে সে সাংস্কৃৃতিক উত্থানের নিঃসঙ্গ যুবরাজ তিনি। এ নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাক্ষ্য তুলে ধরছি :

‘উদ্দাম বলিষ্ঠ প্রাণশক্তি নিয়ে নাইল ভ্যালিতে আসত আরও একজন, শহীদ কাদরী-আমাদের সবার বিস্ময় ও মোটামুটি কেন্দ্রীয় আকর্ষণ।… বিশ শতকী ইউরোপীয় আধুনিকতার ও ছিল প্রায় মূর্ত-প্রতীক। পড়াশোনায় ও চেতানজগতে সেই আধুনিকতাকে ও ধারণ করত। প্রথম ষাটের অনেক তরুণ-লেখকের আধুনিকতার চেতনা অনেকখানিই ওর হাত থেকে পাওয়া। আমাদের দলের কেউ ছিল না ও, কখনো হয়ওনি তা, কিন্তু যাকে ঘিরে নাইল ভ্যালির আসর সবচেয়ে উদ্দাম আর ভরাট হয়ে থাকত সে ঐ শহীদ।… কেবল ষাটের লেখকদের নয়, পঞ্চাশ-ষাটের প্রায় সব লেখকের মূলবিন্দু ছিল শহীদ। ওর বলিষ্ঠ মাদকতাপূর্ণ আকর্ষণ সবাইকে ওর দিকে টেনে নিত। আমাদের অগ্রজ লেখকদের থেকে শুরু করে সে-সময়কার তরুণতম লেখকটির যা ছিল সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত-সেই পশ্চিমি আধুনিকতার উন্মূল মনোভঙ্গি, নিঃস্বতা, বোদলেয়ার বা আমেরিকার বিটনিক সম্প্রদায়ের বেহিশেবি বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা, কাম্যুর উপন্যাসের বহিরাগত মানুষ বা এলিয়টের ফাঁপা মানুষ- সবকিছুকে নিজের ভেতর ধারণ-করা এক রহস্যময় মানুষ ছিল ও।… ওর কোনো দল ছিল না। ও ছিল একা। নিজের নিঃশব্দ একক দলের একচ্ছত্র অধিপতি।’

ষাটের রেনেসাঁর এই যোগ্যতম প্রতিনিধির মৃত্যু হয় প্রবাসেই, যদিও তখনও তিনি স্বদেশকে একটি অঙ্গুরীর মতো নৈকট্যে রেখেছিলেন। মৃত্যুর বছর কয়েক আগে নিউইয়র্কে তার বাসগৃহে এক দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল তার সাথে মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র, নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চা, হাক্সলির দ্য ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড প্রভৃতি প্রসঙ্গ নিয়ে। মিশেল ফুকো, জাঁক দেরিদা এবং অন্যান্য ফরাসি দার্শনিককে নিয়ে প্রচুর আগ্রহ ছিল তার। তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’-র অনেক কবিতায় সেসব বিষয় ঘুরে-ফিরে এসেছে। দেশভাগ, বোদলেয়ার, এলিয়ট, গিন্সবার্গ, অবক্ষয়-চেতনা, স্বদেশ-চিন্তা, প্রেম-অপ্রেম, কোলাহল-নিঃসঙ্গতা এসবের ভেতর দিয়ে একাকী অচেনা মাছের মতো তিনি চলছিলেন এক বৃহত্তর মানব-কল্যাণবোধে, দীপিত-তাপিত হয়ে; আমি ‘অন্য সাম্যবাদ’ বলব (যা প্রথাগত আদলের সমাজতন্ত্রের ধারণার বাইরে)।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ৩] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

পর্ব ::৩

[গত সংখ্যার পর]

এসব বিভিন্ন ধারার উৎস থেকে ষাটের দশকের সাহিত্য জগতে নানামুখী প্রভাব যে অনায়াসে এসে পড়তে পারছিল, তার একটা বড় কারণ ছিল এসব উৎসের মধ্যে সম্পূরক স্ববিরোধিতা। ক্লেদজ কুসুম-এর বোদলেয়ার তরুণ বয়সে ১৮৪৮ সালের বিপ্লব-প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন; এই বিপ্লবে বুক বেঁধেই মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। সার্ত্র-কাম্যু অস্তিত্ববাদী হয়েও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে নাজি-অধিকৃত ফ্রান্সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এবং নিয়মিত ‘কমবেট’ পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন; অ্যালেন গিন্সবার্গ পারিবারিক সূত্র এবং মতাদর্শগতভাবে ছিলেন বামপন্থার দিকে ঝুঁকে : পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিনাশই তার কাম্য ছিল (যদিও তার ‘অন্য বামপন্থা’ ছিল প্রথাগত বামপন্থার বাইরে)। আমি বলতে চাইছি, ষাটের কবিতা তথা সাহিত্যলোকে অবক্ষয়ের ঋতু নেমে আসার পেছনে নানাবিধ প্রেরণা ক্রিয়াশীল থাকলেও মোটের ওপর তা সমাজমুখী চিন্তা-ভাবনার দূরবর্তী ছিল না। এবং সে কারণেই রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চাপে যখন দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছিল তখন তারা সহজেই অবক্ষয়ী নেতিবাদ থেকে সমাজমুখী ইতিবাদে চলে যেতে পেরেছিলেন। তবে এই চলে যাওয়া তাদের জন্য একমুখী উৎক্রমণ ছিল না। সমাজমুখী প্রেরণার পর্বেও তারা তাদের পূর্বের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মনোভঙ্গি হারাননি। এ জন্যই নির্মলেন্দু গুণ লিখতে পেরেছিলেন ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’র এত দ্বিত্বতা-ধর্মী শিরোনাম; আবুল হাসান ‘রাজা যায় রাজা আসে’র মতো নির্বিকার পর্যবেক্ষণ, বা জন্ম নিয়েছিল আবদুল মান্নান সৈয়দের সাড়া-জাগানো গল্প-গ্রন্থ ‘সত্যের মত বদমাশ’ (যা ছিল ভুল কারণে নিষিদ্ধ বই তখনকার দিনে, এবং যা মিশেল ফুকোর ‘রিজিম অব ট্রুথ’কে একবারের জন্য হলেও মনে করাবে)। এই বিপরীত সন্নিপাতই রেনেসাঁর বৈশিষ্ট্য, যেখানে অন্তর্মুখী স্বভাব ও বহির্মুখী পদচারণা, প্রেম ও দ্রোহ, ব্যক্তিগত অবক্ষয় বোধ ও সামষ্টিক পরার্থপরতা একসাথে ক্রিয়াশীল থাকে। ষাটের প্রধান প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের জন্যই এ কথা খাটে- ওই দশকের প্রথম পর্ব-দ্বিতীয় পর্ব নির্বিশেষে। বিপরীতের একত্র-সমাবেশ এই থিসিসকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার ‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এভাবে :

‘আমাদের প্রথম তারুণ্যকে জ্বালিয়ে তুলেছিল অবক্ষয়; এ আমাদের অনুভূতিকে তীব্রভাবে উদ্দীপিত করেছিল, কিন্তু (প্রথম যৌবনের প্রচণ্ডতায় ও অপরিণতির কারণে) একে আমরা ভালভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। তাই অবক্ষয় নিয়ে আমরা হৈ-চৈ করলেও এ ধারণায় আমাদের চোখে পড়ার মতো সাফল্য কম। কিন্তু জাগরণকে আমরা দেখেছিলাম কিছুদিন পরে, সামান্য একটু পরিণত বয়সে। তা ছাড়া এর সঙ্গে শৈল্পিক দূরত্বও আমাদের ছিল দ্বিতীয় লেখকদের চেয়ে বেশি। তাই ওদের চেয়ে আমরা একে আত্মস্থ করেছিলাম অনেক বেশি নিবিড়ভাবে এবং এতে আমাদের সাফল্যও হয়েছিল ওদের চেয়ে বেশি। লেখক-জীবনের সূচনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বিশেষ করে রফিক আজাদ ছিল আমণ্ডুপদনখ অবক্ষয়ের চেতনায় প্রোথিত। কিন্তু ধীরে ধীরে গভীর দেশাত্মবোধ এবং উচ্চতর সংঘ-চেতনাকে তারা আত্মস্থ করেছিল।’

কিন্তু তার মানে কি এই যে, ষাটের দ্বিতীয় পর্বের জাতীয়তাবাদ এবং সমাজচেতনা একে একে গ্রাস করেছিল অবক্ষয়ের কবি-সাহিত্যিকদের? তারা কি হয়ে পড়েছিলেন জাতীয়তাবাদের দাস? রাষ্ট্র-ক্ষমতার জনবিচ্ছিন্ন চরিত্রকে গোড়া থেকেই কি তারা সন্দেহের চোখে দেখেননি? ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট’ বলে করেননি কি প্রতিবাদ? ‘অথেনটিক’ তথা অকৃত্রিম জাগরণের একটি কুলক্ষণই হলো তার রাজশক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য বলার ক্ষমতা। এ জন্যই রফিক আজাদ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই অনায়াসে বলতে পারেন একই সাথে আশা ও হতাশায় বিদ্ধ স্থিতধী পঙ্‌ক্তিমালা। একগুচ্ছ বিচ্ছিন্ন উদাহরণ তার ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’ (১৯৭৪) গ্রন্থ থেকে-সেসব আজও কী সাম্প্রতিক শোনায়!

যেখানে রয়েছো স্থির-মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চ’লে যাবে জীবনের দরকারি গাড়ি-
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।
আমার জীবনে স্থায়ী কোন সকাল-দুপুর নেই,
সারাক্ষণ ব্যেপে থাকে- অপরাহেপ্ত-মনোধিমণ্ডলে।
সম্পূর্ণ বর্জন নয়, গ্রহণে-বর্জনে গড়ে নেই
মানুষের বসবাসযোগ্য চিরস্থায়ী ঘর-বাড়ি;
বহিরঙ্গে নাগরিক-অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত কৃষক;
স্থান-কাল পরিপার্শ্বে নিজ হাতে চাষাবাদ করি
সামান্য আপন জমি, বর্গা-জমি চষি না কখনো।
অ্যাটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই আমি
ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে মেরু-দূর প্রভেদ মানি না।
ক্ষীয়মাণ মূল্যবোধে, সভ্যতার সমূহ সংকটে
আমি কি উদ্বিগ্ন খুব?-উদ্বিগ্নতা আমাকে সাজে কি?
রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনীতি, নেতা, নানাবিধ আইন-কানুন
নিয়ন্ত্রিত ক’রে যাচ্ছে যথারীতি প্রকাশ্য জীবন,
ভিতর-মহল জেঁকে বসে আছে লাল বর্ণমালা।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে;
ক্ষুুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন-
সম্মুখে যা-কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে;
থাকবে না কিছু বাকি- চলে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে।

যেজন প্রকৃত বিষাদগ্রস্ত সেই কেবল গভীর দেশাত্মবোধে আলোড়িত হতে পারে- এই ধূসর পাণ্ডুলিপি শুধু জীবনানন্দ লেখেননি। রফিক আজাদ যেমন ‘বেশ্যার বেড়াল’-এর মতো কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ‘গান হতে বলি’; নির্মলেন্দু গুণ যেমন লিখেছেন ‘হুলিয়া’, তেমনি দুর্ভিক্ষের ঘনায়মান দৃশ্যপটকে মনে রেখে ‘সর্বগ্রাসী হে নাগিণী’র বিখ্যাত সূচনা-পঙ্‌ক্তি (সঙ্গত কারণেই তার প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে পরবর্তীতে বিবেচিত হয়েছে)। আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’-এর পরাবাস্তববাদী ভুবনে বিচরণ করে অসাধারণ সব লাইন লিখে গেলেন। এই এক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে পরাবাস্তববাদ (ও ‘জীবন আমার বোন’-এর পাস্তেরনাক) আমাদের জাগরণের সাথী হয়ে গেল। আজও যখন পড়ি চমৎকৃত না হয়ে পারি না: ‘এই রাত্রিরা বেথেলহাম-কে ব্রথেলে পরিণত করে’; ‘সিংহের খাঁচায় বসে আমি গল্প লিখছি মনে মনে’; ‘দাও আমাকে সুযোগ বিশুদ্ধ পাগল কি বিশুদ্ধ মাতাল কি বিশুদ্ধ চরিত্রহীন কি বিশুদ্ধ ভালোমানুষের’; ‘খটখটে মাটির ভিতর উনিশ বছর আমি ছিপ ফেলে বসে আছি আত্মার সন্ধানে’; অথবা ‘পাপের ভিতর গোলাপ থাকে, এমনকি শব্দের পাপেও, কবিরা যেমন’। ১৯৬৯ সালে উত্তাল দেশের পরিস্থিতিতে তিনি যখন ভাবছেন তার নিজের জীবনের পরিণতি নিয়ে, তখনও স্বদেশ সকাল বেদনার্ত উঠে আসতে দেখতে পাই। ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসায়’ তাকে বলতে শুনি এভাবে :

আমি দীপহীন অন্ধকার ঘরে একা
এরি মাঝখানে নিজের আগুনে জ্বালিয়েছি লণ্ঠন আমার,
এই শতাব্দীর সন্ধ্যাকালে।
এ আঁধারে দু-হাত পেয়ালা করে
তারা-জ্বলা পানি খাবো বলে নেমে যাবো ভীষণ জীবনে।
আমার নিজের তৈরি, নিজের আগুনে জ্বালা
লণ্ঠন কি সঙ্গে যাবে? লণ্ঠন কি সঙ্গে সঙ্গে যাবে?
চিৎকারে ছুটেছি একটি কালো ঘোড়া, পরে নিয়ে
মানুষের ছদ্মবেশ; দীপ্র, সান্দ্র আত্মা বিক্রি করে
জীবনের লঘু-গুরু প্রত্যেকটি দোকানে ফিরেছি,
শরীরে ধারণ করে একমাত্র লাশের প্রচ্ছদ।

আর ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ পর্যায়ে এসে ভেঙে পড়বে পূর্বেকার সব মায়াবী আয়না। কালো ঘোড়া তখন উৎফুল্ল শাদা ঘোড়া হয়ে যাবে। তিনি বলে উঠবেন :

মন্বন্তর আমাকে এক জন্ম দিয়েছে
মহোত্থান আমাকে দ্বিতীয় জন্ম দিক
সমস্ত দৃশ্যচ্ছবি আমি ধরে ফেলি
কালো হাওয়া
সমস্ত শব্দমালা আমি ধরে ফেলি
লাল হাওয়া
আমি শূন্যে প্রোথিত হয়েও জাগ্রত রেখেছি আমার স্বপ্নের এ্যানটেনা
আমার হাত ফসকে শাদা একটি ঘোড়া বেরিয়ে গেছে প্রান্তরে
ফাল্কগ্দুনের এই দিন

সুবিদিত যে, ঐতিহাসিকভাবে পরাবাস্তবাদীদের মধ্যে দুই দল হয়ে গিয়েছিল। এক দল আন্দ্রে ব্রেতোর নেতৃত্বে ‘প্রগতিশীল’ রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছিলেন, ৪র্থ ইন্টারন্যাশনালের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন (এর বিনিময়ে ট্রটস্কি হাত দিয়েছিলেন ব্রেতো-রচিত সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোর খসড়ার পরিমার্জনায়)। আরেক দল থেকে গিয়েছিলেন জাগরণবিমুখ স্ব্বপ্নের মায়াচ্ছন্নতায় (এদের কেউ কেউ ভিড়ে গিয়েছিলেন সালভাদর দালির ফ্যাসিবাদী ক্যাম্পে)। ষাটের শেষের দিকে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এমনই বিভাজন হয়তো ঘটে থাকবে প্রথম ষাটের চন্দ্রাহত কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে। আদিতে পরাবাস্তববাদে আক্রান্ত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন সময়ের সাথে সাথে আরও সমাজমনস্ক থিমের মধ্যে ঢুকে গেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্য পরিবর্তনটা সাময়িক হলেও তার সমগ্র কাব্যচর্চার জন্য এটি যে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়-ফেরা, তা এখন বির্তকের ঊর্ধ্বে।

এক-অর্থে, ‘কণ্ঠস্ব্বর’-এর প্রথম সংখ্যার ম্যানিফেস্টো ধারার উচ্চারণ ও তৃতীয় সংখ্যার ম্যানিফেস্টো ধারার উচ্চারণের মধ্যে একটি বিপরীতমুখী ভাবের প্রকাশ দেখতে পাই। প্রথম ধারার উচ্চারণে ছিল শুধু শিল্প-তাড়িতদের কথা: ‘যারা সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ প্রেমিক, যারা উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী’ তাদের মানবিক শৈল্পিক স্বীকৃতির প্রচ্ছন্ন তাগিদ ছিল সেই আহ্বানে। ‘কণ্ঠস্বর’ তৃতীয় সংখ্যায় পড়ি অন্যরকম (যদিও একটি আরেকটিকে অস্বীকার করে না) প্রেরণা :’যারা জীবনকে অনুভব করতে চান শত তলে, শত পথে, বিঘ্নিত রাস্তায়; আঙ্গিকের জটিলাক্ষরে, চিন্তার বিচিত্র সরণিতে; কটু স্বাদে ও লোনা আঘ্রাণে, সততায়, শ্রদ্ধদ্ধায়, বিস্ময়ে অভিভূতিতে ও পাপে; মহত্ত্বে ও রিরংসায়; উৎকণ্ঠায় ও আলিঙ্গনে’ সেই তরুণদের ডাক দেওয়া হবে সেখানে। এই পরিবর্তনটা ঘটেছিল সমাজ-রাজনীতির পালাবদলের হাত ধরেই। এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিজের ব্যাখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ :’ষাটের দশকের বিপুল সামষ্টিক উত্থান এবং গণজোয়ারের মুখে এই জাতির সমস্ত ব্যক্তিগত বিবেচনা যখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তখনও আমাদের ধারার লেখকদের ভেতর জাতীয়তাবাদী চেতনার পাশাপাশি ব্যক্তিক মনোভঙ্গি এবং অনিকেতের চেতনা নিবিড়ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’কে আমি এর একটি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। ষাটের প্রায় প্রতিটি লেখকের লেখাতেই এই ব্যাপারটা কমবেশি ঘটেছে।’

এক হিসেবে, এটা বিতর্কাতীত বিষয় হওয়া উচিত। ব্যক্তিগত বিবেচনা ও সামষ্টিক বোধ- এ দুইয়ের মধ্যে কোন অলঙ্ঘ্য দেয়াল কল্পনা করা যায় না। ফ্রয়েড ও মার্কস উভয়েই পুঁজিবাদকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন, যে রকম জাক লাকাঁ ও মিশেল ফুকো। ব্যক্তিগত বেদনা ও সামষ্টিক ক্ষোভ এদের প্রতিতুলনা চলতে পারে কেবল সীমিত অর্থে ও পরিসরে ঘোরতর স্তালিনবাদী না হলে সবাই স্বীকার করবেন যে, মান্দেলস্টাম (যিনি গুলাগ বন্দিশিবিরে প্রাণ হারিয়েছিলেন) ও মায়াকোভস্কি (যিনি বিপ্লবকে কবিতায় ধারণ করেছিলেন) উভয়েই জলে-পড়া পিঁপড়েদের ডাঙায় তুলতে চেয়েছিলেন। আখমাতভাকে কি এক পর্যায়ে ‘বুর্জোয়া ডেকাডেন্সের’ অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়নি? তাহলে বিশেষভাবে ষাটের প্রথম ভাগের কবি-সাহিত্যিকদের কেন অবক্ষয়বাদী বলে চিহ্নিত হতে হবে এবং নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে? এই প্রেক্ষিতে আমি শহীদ কাদরীর পালাবদলকে বাড়তি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাই।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার] ষাটের দশকের কবিতা ও আমাদের আধুনিকতা (Poetry of the Sixties and Our Modernity)

তুমুল গাঢ় সমাচার: নব-জাগরণের এক বিস্মৃত অধ্যায়

১. ‘ভালবাসার সাম্পান’

নিস্তরঙ্গ ষাটের দশকের সূচনাপর্ব। ঢাকা তখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায় এক ‘মনোরম মনোটনাস’ শহর। দোর্দণ্ড প্রতাপে সে সময়ে শাসন করছেন জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালে জারি হয়েছে তার সামরিক শাসন। এর ফলে কিছুকালের জন্যে হলেও প্রচণ্ড অবসাদের ঘুম নেমে এসেছে পূর্ব পাকিস্তানে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এসব স্মৃতি ততদিনে অনেকটাই ফিকে। যেন প্রচণ্ড কোনো আঘাতে কুঁকড়ে গেছে পূর্ব বাংলার বিদ্রোহী সত্তা। পাকিস্তানের তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা চলছে, আর সেই সাথে চলছে শ্রীবৃদ্ধির আয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনের তরুণ অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানের মাহবুব উল হক লিখছেন বই দ্য স্ট্র্যাটেজি অব ইকোনমিক প্লানিং, যেখানে তিনি প্রবৃদ্ধি বেগবান করার জন্য কেন আপাতত অসম আঞ্চলিক উন্নয়ন দরকার, তার যুক্তিজাল বিস্তার করবেন। অস্থির উত্তাল পঞ্চাশের প্রথম ভাগের পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ সে সময় এক ধরনের সুস্থিতির পর্যায়ে ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। দেশের সেরা ছাত্ররা যোগ দিচ্ছেন লোভনীয় সিভিল সার্ভিসে, ‘সিএসপি’র কাতারে। অন্যরা ব্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে মানানসই কোনো চাকরি পাওয়ার খোঁজে। গুটিসুটি পাখা মেলছে এক ক্ষীণকায় বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণি- ইপিআইডিসি কর্তৃক অর্থায়িত কল-কারখানাকে কেন্দ্র করে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তখন বন্ধ্যা সময়। যেন ব্যর্থ হয়েছে ১৮৪৮ সালের ইউরোপের আন্দোলন-সংগ্রাম, ফ্রান্সে গেড়ে বসেছে লুই বোনাপার্টের দুঃশাসন, প্রতিক্রিয়ার আঘাতে অবশ অপুষ্পক পরিবেশ চারদিকে। অবধারিত চক্রে বিপ্লব-প্রয়াসের পর নেমে এসেছে পুনরুজ্জীবনের কাল। অচিরেই নিষিদ্ধ হবে রবীন্দ্রনাথের নাটকের মঞ্চায়ন, এমনকি তার গানের প্রচার। একটা ভালো কবিতা লেখার জন্য তখন সংগ্রাম করতে হবে, একটা ভালো গল্পের জন্য জীবনক্ষয়ী যুদ্ধে নামতে হবে, এমন দমবন্ধ পরিস্থিতি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর রাজনৈতিক অর্থনীতি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :

‘ষাটের দশকে আমাদের সমাজে অবক্ষয় এসেছিল দুটি পর্যায়ে। প্রথম ঢেউটি এসেছিল শ্বাস-চেপে-ধরা সামরিক নিগ্রহের হাত ধরে।… ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২-র মধ্যে ঘটেছিল মূল ঘটনাটি, যদিও এর জের চলেছিল একাত্তর অব্দি। …এর পরেরটা এসেছিল সামরিক স্বৈরশাসনের উপজাত হিশেবে। সামরিক শাসনের দম-আটকানো ও নিরানন্দ পরিবেশকে আইয়ুব খান পুষিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সমাজজীবনে অবাধ ও জবাবদিহিতাহীন বিত্তের সচ্ছল ও কল্লোলিত স্রোতধারা বইয়ে দিয়ে। অর্থ সংগ্রহের জন্য উন্নত দেশগুলোর দরজায় দরজায় ধরণা দিয়ে দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। হঠাৎ-আসা সেই সুলভ বিপুল ও অনোপার্জিত বিত্ত সমাজজীবনের বন্দরে-বন্দরে রজতধারায় সচ্ছল ঢেউ জাগিয়ে তোলে।

আমাদের জাতির সুদীর্ঘ জীবনে বিত্তের পদপাতের ঘটনা এই প্রথম। বিত্তের দাঁতাল লোভ জাতির সুপ্ত চেতনার ভেতর থেকে জেগে উঠে এই সময় হয়ে ওঠে উদ্দাম। বর্বর অবাধ অলজ্জ অপরিমেয় রজতলিপ্সার সামনে ধসে পড়ে শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভেতর থেকে গড়ে-উঠে এই সমাজের নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের দৃঢ়প্রোথিত ইমারত। সবরকম ন্যায় নীতি হাস্যকর, অর্থহীন ও পরিত্যাজ্য হয়ে পড়ে।… নতুন অর্জিত মুদ্রার সঙ্গে নতুন অর্জিত পাপ এসে প্রবেশ করে সমাজজীবনে।’

এরকম একটি পরিবেশে কতিপয় সাহিত্য-পাগল যুবক কবিতা-প্রবন্ধ-গল্পের ভুবনে দুদ্দাড় প্রবেশ করেন। তাদের দীপ্তিমান সৃষ্টিশীলতা দিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন যে তাতে করে সেদিন শুধু নক্ষত্রলোকেই তাৎক্ষণিক ঝড় ওঠেনি, মর্ত্যলোকেও জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, যার নিকটতম তুলনা কেবল হতে পারে রেনেসাঁ বা নবজাগৃতি (রেনেসাঁর ‘বুর্জোয়া’ চরিত্রের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই বলছি)। পঞ্চাশের দশকে যার শুরু, কিন্তু গোটা ষাটের দশকজুড়েই যার বিরতিহীন চর্চা চলেছে পতনে ও উত্থানে, অবক্ষয়ে ও বিদ্রোহে, স্ব্বাক্ষরে ও বক্তব্যে, এক বিচিত্রবিধ কণ্ঠস্বরে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে। ষাটের প্রথম ভাগের রচনাগুলিকে তাই শুধু অবক্ষয়ের পাঠ হিসেবে দেখা চলে না, যেমন চলে না ষাটের দ্বিতীয় ভাগের রচনাগুলিকে কেবল বিদ্রোহের চিহ্ন হিসেবে। আধুনিক কবিতার জনক শার্ল বোদলেয়ারের মধ্যে যেমন তাপ ও সন্তাপ, অবক্ষয়ী স্খলন ও অক্ষয় উত্থান পাশাপাশি কাজ করেছিল, তেমনি ষাটের সব পুরোধা কবি-সাহিত্যিকর ক্ষেত্রেই এটা সামগ্রিকভাবে খাটে।

এই প্রবন্ধে আমি আরো যেটা প্রচ্ছন্নে বলার চেষ্টষ্টা করেছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দুটি ভিন্ন যুক্তি-তর্ক আলাদাভাবে ষাটের দশকে উঠেছিল। একটি হচ্ছে, পাকিস্তানি কাঠামোর বিরুদ্ধে পরস্পর-বিরোধী দুই অর্থনৈতিক সত্তার দ্বন্দ্ব, যাকে আমরা ‘দুই-অর্থনীতি’ শীর্ষক বৈষম্যের যুক্তি হিসেবে পাঠ করেছি। ষাটের দশকের গোড়া থেকেই এই যুক্তি নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ বাঙালি অর্থনীতিবিদের লেখা থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে। এটাই শেষে পরিণতি পায় ৬-দফার দাবিসমূহে; ষাটের দশকের মধ্যভাগে। পাকিস্তানি স্ব্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পূর্ব বাংলার রেনেসাঁর জন্য দুই-অর্থনীতি শীর্ষক থিসিস ও তৎসংলগ্ন বৈষম্য-চেতনা ছিল একটি মূল স্তম্ভ্ভ। দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে, পাকিস্তানি কালচার গড়ার অবিরাম প্রয়াস ভেঙে একটি আধুনিক বাঙালি মননশীলতার মাথা তোলা, যা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে কখনো উদাসীন মাটির পিদিমের মতো, কখনো স্বেচ্ছাচারী বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল ষাটের রচনাকর্মে, বিশেষ করে সে যুগের কবিতার শরীরে। অর্থশাস্ত্রের বৈষম্য-সংবেদনশীলতা ও কবিতার আধুনিকতা এই দুটি দূরবর্তী জগতের অলক্ষ্য যোগাযোগে সৃষ্টি হলো সেই অনুপম মুহূর্তের, যাকে আমরা প্রকৃতই ‘আমাদের আধুনিকতা’ বলে দাবি করতে পারি। এই আধুনিকতা একান্তভাবেই আমাদেরই সৃষ্টি; কোনো ইউরোপের ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বা এমনকি উনিশ শতকের বাংলায় রেনেসাঁ তথা পুনরুজ্জীবনবাদী আধুনিকতার সাথে এর চরিত্র বা গতি-প্রকৃতি মেলে না। ষাটের দশকের সেদিনের তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকরা যে-আধুনিক বোধের সূচনা করে গিয়েছিলেন তার আয়োজন ছাড়া শুধু অর্থনৈতিক অসাম্যের যুক্তিতে পূর্ববাংলার জাগরণ সংঘটিত হতো না এবং সেপথ বেয়ে স্বাধীনতা শব্দটিও আমাদের করায়ত্ত হতো না। সময়ের এই গ্রন্থি থেকে দাঁড়ালে ষাটের প্রথম দিককার কবিতা-গদ্যের ভুবনের অবক্ষয়কে আর অবক্ষয় বলে মনে হয় না; বরং প্রতীতি হয় সামন্তবাদী সমাজের বিপরীতে অবক্ষয়-পেরুনো এক নিঃসঙ্গ আর্ত-দীর্ণ পথ-পরিক্রমা বলে। একইভাবে, ষাটের দ্বিতীয় ভাগের কবিতা ও গদ্য রচনাকেও নিরবচ্ছিন্ন সমাজমনস্ক বিপ্লব-অন্ব্বেষী প্রচেষ্টা বলে মনে হয় না; মাঝে মাঝেই ধরা পড়ে তার আত্ম-অনুকম্পাপ্রবণ মায়া-জাগানো শোকগ্রস্ত অন্তর্মুখী স্বভাব। এভাবেই রাষ্ট্র্রনৈতিক অন্যায় ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্বারা আহত অবক্ষয়ী মন পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়িয়েছে সত্তরে বা একাত্তরে। এভাবেই ষাটের কাব্যভুবন গভীর সমাচার সৃষ্টি করেছে, জন্ম দিয়েছে এক পরিশীলিত আধুনিক মনের, যা একটি মুক্ত সংস্কৃতির পূর্বশর্ত। এই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃৃতিক চেতনার ভিত্তিতেই আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর সংবিধানের কাঠামো গড়ে উঠেছিল। এটাই এই প্রবন্ধের মূল কথা, যার পূর্বাভাস প্রথম পেয়েছিলাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘ভালবাসার সাম্পান’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায়। পড়ে সচকিত, দীপিত, উজ্জীবিত হয়েছিলাম। আমার সরাসরি শিক্ষক তিনি। তাঁকে ঘিরে তাঁর প্রিয় ষাটের দশককেই শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো এই লেখার মাধ্যমে।

২. অবক্ষয় ও জাগরণ :বৈপরীত্যের একত্র-সমাবেশ

ষাটের প্রথম ভাগের অবক্ষয়-চেতনা যে দ্বিতীয় ভাগে এসে সমাজ-রাজনীতি বোধে দীক্ষিত-তাড়িত হতে থাকে, সেটি ছিল খুব স্বাভাবিক পালাবদল। আবদুল মান্নান সৈয়দ পরবর্তী সময়ে বহিঃপৃথিবীর এই অনুপ্রবেশ সম্পর্কে এভাবে লিখেছেন বাহাত্তরে এসে :’আমার কবিতায় বহিঃপৃথিবী আর-কখনো এতো প্রবলভাবে প্রবেশ করেনি। … এক-হিশেবে এ এক তীব্র মোড়-ফেরা।’ এরই পরিণতিতে আমরা পেলাম ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ :স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে চলাফেরার আনন্দ ও গৌরব সেখানে যতিচিহ্নহীন গদ্যকবিতার অতিব্যক্তিক চিত্রল ছন্দে ‘পাথর প্রহত হঠাৎ-উচ্ছ্বসিত ঝরনাজলের মতো’ বেজে উঠেছিল। এই উচ্ছ্বাস শুধু তার ক্ষেত্রেই ঘটেনি, এ ধরনের আবেগকে ধারণ করেছিলেন ষাটের অবক্ষয়ের সব একদা-সারথীই। এর চিহ্নসমূহ ক্রমেই পরিস্ম্ফুুট হচ্ছিল ষাটের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই। ‘কণ্ঠস্বর’ এবং ছয়-দফা ষাটের মধ্যভাগে প্রায় এক-বছরের ব্যবধানে জন্মায়। এটাকে কেবল হতাশ থেকে আশাবাদে উত্তরণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে সামষ্টিক জাতীয়তাবাদে পালাবদল বললে সবটা ধরা পড়ে না। জাগরণের জন্য প্রথমে এক সর্বব্যাপী অবক্ষয়-বোধের প্রয়োজন ছিল। নানাভাবে এই যুক্তিটিকে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।

প্রথমত, পুঁজিবাদী আধুনিকতা তথা আধুনিকতা-বোধের সাথে ‘উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার’ একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মার্কস একে ‘এলিয়েনেশন’ বলেছিলেন, আমাদের কবিকুল এই জনম-একাকিত্বকে অলজ্জিত নিনাদে প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। নিজ দেশে তারা ‘বহিরাগত’ বলে নিজেদের মনে করেছিলেন- এই ভাবটি আধুনিক বিচ্ছিন্নতার নানা উৎসের কথা মনে করায়। কাম্যুর আউটসাইডার কি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে প্রভাবিত করেনি এবং সেই সূত্রে ‘বহিরাগত’ ভাবটি কি অস্তিত্ববাদের সূত্রেই প্রতিফলিত হয়নি ষাটের দশকে-মানসে? অন্যদিকে, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্রেগরি করসো ও তাদের সহচরেরা যখন পঞ্চাশের-ষাটের পটভূমিতে আর্তরব করে উঠলেন, সেই বিটনিকদের আন্দোলন সরাসরি প্রভাব ফেলে থাকবে ষাটের কবিতায় (ষাটের দশকের শুরুতে গিন্সবার্গ কলকাতায় আসবেন, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে তার, আর কৃত্তিবাসের সাথে কণ্ঠস্বর গোষ্ঠীর, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের লালন সম্পর্কেও কবিতা লিখবেন তিনি)। অপর দিকে, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা বিত্তহীন অন্তঃসারশূন্য বিমর্ষ এক পৃথিবীকে নতুনভাবে মেলে ধরেছিল ষাটের কবিদের সামনে। বিভিন্নমুখী উৎস থেকেই ‘বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার’ শিল্প-প্রেরণা বা প্ররোচনা এসেছিল সেদিন- এটাই আমি বলতে চাই। সেখানে মার্কসের পাশাপাশি বোদলেয়ার, সার্ত্র-কাম্যুর অস্তিত্ববাদী দর্শন থেকে জাঁ ককতো ও গিন্সবার্গ সবাই ছিলেন। সেখানে গোড়া থেকেই জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথও ছিলেন (আজ মনে হয়, ‘দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ’-এর রবীন্দ্র-বিরোধিতা ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করে পাওয়ার চেষ্টা-সেটা ক্রমপ্রকাশ্য হয়েছিল-বিশেষ করে তার গানের ভুবনকে কেন্দ্র করে)। শহীদ কাদরী যেমন লিখেছিলেন আদি প্রত্যুষেই, ‘আমাদের চৈতন্যপ্রবাহে তুমি ট্রাফিক আইল্যান্ড’-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

ইশতেহার কি আমাদের জন্য (What is our manifest?)

আমরা ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে সময়ের গ্রন্থিগুলো পার হচ্ছি। অনেকটা যেন রজ্জুপথে চলা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই মহাপতনের দিকে। একটা জাতি এত দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম চাপের মধ্যে থেকে সুস্থ থাকতে পারে না। তাই সামগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনটা আর দশটা নির্বাচনের মতো গতানুগতিক নির্বাচন নয়। তার দুটি কারণ। একটি কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অচিরেই পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার যে সরকার নির্বাচিত হবে, সে সরকারই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। কেবল উৎসব উদযাপনই নয়, এর সঙ্গে আরও কিছু দায়িত্ব বা চ্যালেঞ্জও তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন- পঞ্চাশ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়েছিলাম, পঞ্চাশ বছর পরে এসে আমাদের অর্জনটাই বা কী হলো, আর আমরা সামনের পথটাই বা কীভাবে পাড়ি দেব? এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সময় এসে গেছে।

যেভাবে গত দশটি বছর পার করেছি, সামনের দশটি বছর ততটা নির্বিঘ্নে কাটবে না। সেই অর্থে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এবং এতে যে দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই তাগিদটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে এমডিজির পরে এখন এসডিজি এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজিগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা; আরেকটি হচ্ছে ২০৩০ সালে অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিটা গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি হয়। আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। অঙ্কের হিসাবে বললেও সেটি ১১ বছর। এই ১১ বছরের মধ্যেই আমাদের দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্য হ্রাসকারী দেশের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হবে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কিন্তু আলাদাভাবে কিছু লক্ষ্য গ্রহণ করেছি। যেমন এর একটি হচ্ছে, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবো।

১. আদি প্রতিশ্রুতি ও তার আজকের অর্থ

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ইশতেহারে কী থাকা উচিত, তা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হতে পারে। আমি যে আলোচনাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও অস্তিত্বগতভাবে মানুষের মতোই। তারও সত্তার পরিবর্তন হয়। মানুষের সত্তা যেমন একই রূপ থাকে না; শৈশবে-কৈশোরে, যৌবনে বা বার্ধক্যে তার রূপ বদল হয়। তেমনি রাজনৈতিক দলেরও কিন্তু সত্তার বিবর্তন হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও তার মূল নীতিমালাগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল নীতিমালার মধ্যে যেটা মৌলিক, যেটা আমাদের সংবিধানে রয়েছে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এ চারটি নীতি ১৯৭২ সালে যে অর্থ নিয়ে এসেছিল, সে অর্থ আজও তারা সমানভাবে বহন করে কি-না এবং বহন করে থাকলে এর নতুনতর অর্থ কী, সেটা খোঁজার জায়গা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচনী ইশতেহারে সে সম্পর্কে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং সুচিন্তিত বক্তব্য থাকা উচিত। যেমন ধরা যাক, আগে সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝানো হতো এবং অনেকেই বুঝতেন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং এ জাতীয় পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে যেটা এসেছিল। ধারণাটা যখন এসেছে তখনও কিন্তু বিতর্কটা হয়েছিল, এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী? এবং আমাদের গণপরিষদে একটা দীর্ঘ বিতর্কও হয়েছিল এ সমাজতন্ত্রের অর্থ কী এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সে অর্থটা কেমন, তা নিয়ে। মার্ক্স কখনও চিন্তা করেননি যে, বৈষম্য বাড়লে সমাজতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হবে আর বৈষম্য কমলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সেভাবে তিনি সমাজতন্ত্রকে সংজ্ঞায়ন করেননি। তিনি সমাজতন্ত্রকে একটি নতুন মৌলিক সভ্যতার ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। আমাদের দেশে একদিকে বাজার পুঁজিবাদকে আশ্রয় করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার আমরা সমাজতন্ত্রের কথাও বলছি। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদও থাকছে, আবার সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাও থাকছে। দুটো মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের চেহারাটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি সুইডেন বা জার্মানির মতো একটা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি! না কানাডার মতো সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র- সেটা বোঝাচ্ছি, নাকি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাচ্ছি, যেখানে ট্রাম্পচালিত সরকার আসে এবং প্রধানত নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে স্বাস্থ্য খাতের নিশ্চয়তা নেই, হাই স্কুলের পরে শিক্ষার খরচ চালানো নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আবার কানাডা, সুইডেন বা জার্মানির মতো দেশে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাগরিকদের অধিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ধারার হলেও জনগণকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মৌলিক সুবিধাদি কতটা পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত গভীরে দেওয়া হবে- সেটার ওপরে ভিত্তি করে এক দেশ কিন্তু আরেক দেশ থেকে আলাদা। আমরাও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি। বাংলাদেশ যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তার অর্থটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিজে মনে করি যে, আমাদের দেশে নিজস্ব ধরনের একটা সামাজিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বস্তুগত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। আজকের অবস্থাটা থেকে আমরা যদি একটা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট করে বলা দরকার; এবং সেটাকে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঠিক তেমনিভাবে আসে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা মানে বোঝানো হতো, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পরস্পর বিযুক্ত। ধর্ম হচ্ছে প্রাইভেট স্ম্ফিয়ারের আর রাষ্ট্রকার্য হচ্ছে পাবলিক স্ম্ফিয়ারের। সেই বিযুক্তির ধারণা থেকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞাটা আমরা পেয়েছি বা নানাভাবে এসেছে, তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধর্ম পালনের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে যেমন একটা স্লোগান প্রচলিত আছে- ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।

কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে। দার্শনিক হাবেরমাস যেমন বলেছেন, ‘উই হ্যাভ এনটার্ড ইনটু এ পোস্টসেকুলার এজ’। অর্থাৎ আমরা এখন এক ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজে বাস করছি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ যে শক্তি, তাকে এখন নতুন করে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে যেতে হচ্ছে। এই যে সংলাপে নতুন করে যেতে হচ্ছে, ধর্মীয় শক্তিকে সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্বীকার করতে হচ্ছে- এটা কিন্তু নতুন উপলব্ধি। সেটা ইউরোপে বসে ২০০৪ সালে তিনি লিখেছিলেন। কথাটা আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও সত্য এবং বাংলাদেশের জন্যও সত্য। আমরা এখন শুধু অসাম্প্রদায়িকতা এবং শুধু ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই সংজ্ঞাতে আটকে না থেকে একটু বৃহত্তর স্বার্থে চিন্তা করতে পারি- কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য শক্তিকে আমরা সামাজিক রূপান্তরের কাজে ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আমরা যে স্বীকৃতি দিয়েছি, সেটাকে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই স্বীকৃতিটা এসেছে ওই ধরনের উপলব্ধি থেকে, যাতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বীকৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে তারা মূলধারার শিক্ষাস্তরের সঙ্গে কতটুকু পরিমাণে সমান, সেটা নিরূপণের দায়িত্বও আমাদের ওপর বর্তায়। এই নিরূপণে যদি দেখা যায়, দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য রয়ে গেছে, ঘাটতি রয়ে গেছে- তাহলে সেই ঘাটতিগুলো পূরণে আরও যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। সেটাকেই মূলত প্রকৃত স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো জাতীয়তাবাদ। সমাজতন্ত্রের মতো এ বিষয়টিকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যারা ভাবেন, তারা এখন নতুন করে বলুক- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে তারা এখন কীভাবে দেখছেন? সেটা কি মুসলিম লীগের সেই মুসলিম বেঙ্গলের পুরনো ধারণার মধ্যেই আটকে আছে, নাকি তাকে আরও সম্প্রসারিত করে নতুনভাবে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দেখছেন; যে জাতীয়তাবাদের অংশ আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতল ও পাহাড়ের সবাই; নাকি যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের সবাই এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এককথায় প্রতিটি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানের মূল চারটি আদর্শের বা প্রতিশ্রুতির সমসাময়িক অর্থবহতা সম্পর্কে একটা প্রতিফলন দরকার এই নির্বাচনী ইশতেহারগুলোয়।

২. দারিদ্র্য কমছে, বৈষম্য বাড়ছে

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহারে আমাদের জন্য প্রত্যাশিত কী কী প্রসঙ্গ আসতে পারে? একটা হচ্ছে, যে অর্থনীতিতে গত এক দশকে কিছু কিছু ইতিবাচক প্রবণতা জন্ম নিয়েছে, তার মধ্যে মোটামুটি স্বীকৃত একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই যে আজকে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ করে বাড়ছে; কোনো কোনো বছর ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যাচ্ছে- এটি ভালো দিক। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা, দারিদ্র্যও ধীরে ধীরে কমে আসার কথা। বাস্তবে দারিদ্র্য কমছেও। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে পারি, মেয়েদের স্কুলগামিতার হার বাড়ছে, শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। এই যে প্রবৃদ্ধি বাড়া, দারিদ্র্য কমে আসা, মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়া- এর কারণে কতগুলো সামাজিক সূচকেও পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের সূচকে, বিশেষ করে প্রিভেনটিভ হেলথ কেয়ারে এবং শিক্ষাসূচকে আমরা অনেকগুলো ধাপ পার হচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গেই আবার জড়িত হয়ে পড়ছে কতগুলো নেতিবাচক দিক; যেগুলোকে ইতিবাচক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাচ্ছে না। অ্যাঙ্গেলসের একটা কথা ছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রভুত্ব করার সামর্থ্য কমে যায়। আমাদের দেশেও বোধকরি এটা ঘটেছে। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এর শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র যেমন লিখেছিলেন, ‘আজিকালি শোনা যায় দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ এই শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও সত্য। কিন্তু তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে, ‘কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? আমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, আমি তুমি কি দেশ! হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত- তাহাদের কি শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে?’ এই প্রশ্নটা তিনি রেখেছিলেন। এই প্রশ্নটাতে আমাদের টুইস্টটা হচ্ছে, হ্যাঁ এই শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও দারিদ্র্য কমছে। তবে সবার কমছে না, এখনও কিছু চরম দরিদ্র পরিবার রয়ে গেছে হাওর অঞ্চলে বা বিভিন্ন উপদ্রুত উপকূলে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কমছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি যেটা হচ্ছে, বৈষম্য বল্কগ্দাহীনভাবে বাড়ছে। সেটা বাড়ছে সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানেই। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, বৈষম্য ৪৪ শতাংশ থেকে এখন ৪৮ শতাংশে উপনীত হয়েছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন জিনি কোইফিশিয়েন্ট ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা অতি উচ্চ বৈষম্যের স্তরে প্রবেশ করি, যাতে শুধু লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ ও চীন প্রবেশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈষম্যের হার ৪৫ শতাংশের মতো। ইউরোপিয়ান অনেক দেশে বৈষম্যের হার আরও কম। সুতরাং যদিও আমরা নিল্ফেম্নান্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছি- তবু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের প্রবৃদ্ধির অর্জনটা অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে। সে জন্যই ইশতেহারে একটা সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, প্রবৃদ্ধি বাড়াব, দারিদ্র্য কমাব; কিন্তু বৈষম্যকে বেশিদূর বাড়তে না দিয়েই। অর্থাৎ বৈষম্যের লাগাম ধরে রেখেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াব। এটা একটা মৌলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যদি বৈষম্যকে এভাবে বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দুটো কুফল দেখা দেবে। প্রথমত, প্রবৃদ্ধি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক জিনি সূচকের বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে সামাজিক বৈষম্য। একশ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বৈষম্য। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। আমি সন্দেহ করি, সাম্প্রতিককালে যে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন- আগামীতে হয়তো আমরা এমন আরও তরুণের আন্দোলন দেখতে পাব- যার পেছনে কাজ করেছে বা করবে এই বৈষম্যের উস্কানি। তার কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখছি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির সুফলগুলো সবার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। কর্মসংস্থানগুলো গুণগত মানের হয়ে, উপযুক্ত হয়ে তার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখন একটা সামান্য ধরনের সামাজিক অস্থিরতা বা নড়াচড়াই বড় ধরনের দুর্বিপাকের আশঙ্কা বয়ে নিয়ে আসছে- এটার মূল কারণ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান যথাযথ মানের হতে পারছে না। এবং সেইসঙ্গে মানুষে মানুষে যে আয়বৈষম্য, সম্পদে বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য, যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য- এসব মানুষকে আহত করছে। সেটা নানাভাবে, নানা উপায়ে বহিঃপ্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আমাদের মতো দেশে এখনও পর্যন্ত যথার্থ অর্থে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম দাঁড়ায়নি। যেটা উন্নত বিশ্বে তো বটেই, মাঝারি উন্নত দেশেও আছে। যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই একই ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করছেন। মূলত তারা একই র‌্যাপিড ম্যাস ট্রান্সপোর্টে চড়ে কাজে যাচ্ছেন। এর ফলে একে অপরের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে যাতায়াত করতে করতে একটা অভিন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে উঠছে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিটি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা একেকটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য বাঁধা। উচ্চবিত্তরা নিজস্ব গাড়িতে চড়ছেন, মধ্যবিত্ত বাস-রিকশায় চড়ছেন, নিম্নবিত্ত হেঁটে যাচ্ছেন।

সুতরাং বৈষম্যের ব্যাপারে যে কোনো সময়ের নির্বাচনের তুলনায় এবার আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করি। তাদের ইশতেহারে চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকায় সর্বশীর্ষে এই বৈষম্য দূর করার কথা রাখা উচিত। শুধু একটি নীতি নিয়ে এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ বৃদ্ধি করা- উন্নত বাসস্থান, উন্নত শিক্ষা, উন্নত কর্মসংস্থান, উন্নত ঋণপ্রাপ্তি প্রভৃতি সুযোগ যাতে কেবল ধনীদেরই মধ্যে সীমিত না থাকে। রাষ্ট্রের পুনর্বণ্টনমূলক নীতিমালাকে, যথা- রাজস্ব-ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে ফলপ্রসূ সম্পত্তি-করের প্রবর্তন করতে হবে।

৩. ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ?

বৈষম্যের পরে আমি যে দ্বিতীয় নেতিবাচক প্রবণতার কথাটি বলছি সেটি হচ্ছে, ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদের আশঙ্কা। আমার ধারণা, আমাদের দেশে ক্রমশ একটা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ ব্যবস্থা গেড়ে বসছে। মূলত পুঁজিবাদের যে স্বাভাবিক শক্তি, নিজেকে নিজে শোধন করার যে প্রক্রিয়া- সেটা নিয়ন্ত্রিত হয় এই ঝুঁকির মাধ্যমে। পুঁজিবাদ সব সময়ই পুঁজিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ঝুঁকির সামনে ঠেলে দিয়ে। আবার বাজারের বাইরের অনেক বিষয়ও পুঁজিবাদের বিকাশে কাজ করে। যেমন আমি চাইলেই আমার পাশের জমিটা দখল করতে পারি না। আমি চাইলেই ব্যাংকের টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত না দিয়ে দিনের পর দিন চলতে পারি না। চাইলেই মুনাফা থেকে যে কর-রাজস্ব দেওয়ার কথা, তা পরিশোধ না করে বড় ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারি না। অনেক উন্নত দেশের জন্যই এসব কথা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বে তো বটেই, গত এক দশকেও দেখছি এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অর্থাৎ পুঁজিপতিদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে বাজারের যে ঝুঁকি, সেটা থাকলেও বাজারবহির্ভূত যে ঝুঁকি- অর্থাৎ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য তাকে যে ঝুঁকিগুলো বহন করতে হবে, সেগুলো কমে গেছে। তার মানে পুঁজিপতিরা এসব নিয়ম না পালন করে উল্টো এসবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। এটাকেই আমরা বলছি ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ। এই ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদেই ক্রনি পুঁজিবাদের জন্ম হয়। এবং ক্রনি পুঁজিবাদের কারণেই তারা এটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে। কারণ তারা ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। যার সুবাদে প্রচুর ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেও অনেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন বিনিয়োগগুলোর ওপর নানাভাবে এসবের প্রভাব পড়ছে। নতুন ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে, নতুন ঋণের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আইন না মানার একটা সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। আর এই সবকিছুকেই আমি সামগ্রিকভাবে ‘ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ’ নামে আখ্যায়িত করছি। এই টার্মটি ব্যবহারের সুবিধা হচ্ছে, পুঁজিবাদের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদের যে অবনতি হচ্ছে, এর মাধ্যমে সেটাকে প্রশ্ন করা সম্ভব। এ রকম ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ যদি চলে, তাহলে সেই ঝুঁকিটা আসলে সমাজকেই বহন করতে হয়। পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ঝুঁকি বহন করছে না। অথচ কথা ছিল উল্টোটা হওয়ার, যে পুঁজিপতি শ্রেণি ঝুঁকি নেবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে- এর মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে উল্টো। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ গেড়ে বসছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে চাই শক্ত মেরুদণ্ডের নিয়মনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জোট। এটা শুধু একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। আবার এটা না হলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিকাশের পরবর্তী ধাপে যেতে পারব না।

৪. রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব

এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো দূর করতে হলে নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা কোনো বায়বীয় বিষয় নিয়ে হবে না, এটা হবে সেই নির্বাচনী দর্শনের যে পুনঃসংজ্ঞায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছিলাম, সেটাকে কেন্দ্র করে। নতুন সামাজিক অঙ্গীকারটা হতে হবে এই যে, নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটাকে মোকাবেলা করার জন্যই। আমাদের নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা নতুন সামাজিক অঙ্গীকার দরকার। এর জন্য নতুনভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকাটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আগে আমরা ভাবতাম, পুঁজিবাদী দেশ হওয়ার অর্থই হচ্ছে আমরা পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুফলগুলো লাভ করব। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এখানে পদে পদে রাষ্ট্রের একটা সহায়ক ভূমিকা রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সে দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য দরকার তার তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসন। সে যাদের ওপর খবরদারি করবে, সে তাদের বন্ধু হতে পারবে না। রাষ্ট্রকে তাই একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা একটা প্রাথমিক ধাপ, যাতে করে তারা সহসাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে না পারেন। এ ছাড়া মেধাবী তরুণদের সরকারি কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থেই মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে। এবং এ আমলাতন্ত্র হতে হবে উন্নয়ন আমলাতন্ত্র। শুধু সরকারি দপ্তর বা রাষ্ট্রযন্ত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতাল- সর্বত্রই। সবখানেই আমরা দেখতে চাই সবচেয়ে যোগ্য মেধাবী নেতৃত্ব। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো উপায়েই এসব করতে হবে। আমরা যদি ছোট মাপের স্বপ্নও দেখে থাকি, বড় মাপের কিছু মানুষকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের সম্মানিত করতে হবে। সেটা না করলে আমাদের ছোট মাপের স্বপ্নও দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।

নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষেরই দায়িত্ব আছে পরস্পরের কাছাকাছি আসার। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণির এই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে হবে। এখানে কেবল পার্টির যারা বুদ্ধিজীবী তাদেরকেই নয়, ননপার্টিজান বুদ্ধিজীবীদেরও জায়গা করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেভাবেই হোক, এই দূরত্ব বেশি দিন থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। তাই আমাদের এমন একটা সামাজিক অঙ্গীকার দরকার, যেখানে সব পক্ষের প্রাজ্ঞজনের স্থান আছে। সবাই যাতে বুঝতে পারে, আমি যে রাজনৈতিক মতেরই হই না কেন, আমার একটা আলাদা আদরণীয় স্থান আছে রাষ্ট্রসভায়। এটাই ভারতবর্ষীয় রীতি :রাজন্যবর্গ সব সময়েই পণ্ডিতদের সম্মান করে এসেছেন।

৫. বহুবার বলা তবু অসমাপ্ত যে কাজগুলো

সর্বশেষ যে কথাগুলো বলতে চাই, সে কথাগুলো বহু মানুষ বহুবার বলেছেন; কিন্তু কোনো অব্যাখ্যাত কারণে তা বাস্তবায়িত হতে হতে হয়নি। সেখান থেকে তিনটা কাজের কথা আমি বলতে চাই, যা অসমাপ্ত থেকে গেছে। অথচ এর ব্যাপারে করণীয়গুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই একমত। সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ আমাদের জন্য অবশ্যপালনীয় একটা কাজ। কারণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের দেশ হচ্ছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। অষ্টম দেশ রাশিয়া! আর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মোট জনসংখ্যার আকারটাই আসলে প্রধান বিবেচ্য। এমনকি আমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারও হই, তা সত্ত্বেও সীমিত আকারে হলেও এক-তৃতীয়াংশ বাজেট নিচের দিকের সরকারগুলোকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি। এখন সেটা পুরনো ১৯ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, নাকি ৬৪ জেলাভিত্তিক সরকার হবে, সেই যৌক্তিক বিভাজনটাও করা উচিত।

দ্বিতীয়ত, এই বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে প্যারাডক্সটি হচ্ছে, যে সরকারকে আমরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন করছি, তাকে আমরা ক্ষমতায়ন করছি না। যেমন উপজেলা সরকার- নির্বাচন করেছি, ক্ষমতায়ন করিনি। অন্যদিকে যেটি নির্বাচিত এবং ক্ষমতায়িত, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ সরকার- তার ক্ষমতা অতিসংকুচিত। সে সামান্যই অর্জন করতে পারে, কারণ তার হাতে বাজেটের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু এটা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বইও লিখেছেন, অনেক সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব একটা এগোয়নি। ভারত তাদের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীতে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে যে, সেখানে তিন স্তরের সরকার হবে। আর সেই তিন স্তরের সবচেয়ে নিচের স্তর হলো গ্রাম পঞ্চায়েত। দু-একটা রাজ্য বাদ দিলে এখন সেখানে সর্বত্রই এই তিন স্তরের সরকার চলছে। এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নিয়মিতভাবেই অর্থনৈতিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। স্থানীয় স্বশাসনের এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজস্ব আহরণের পরিমাণও বেড়ে গেছে।

এর পরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, আমাদের গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। আমাদের দেশের ধনী-গরিবে বৈষম্য শুধু অর্থে নয়, সম্পদে নয়, শিক্ষার গুণেও। কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়ছে, কেউ আবার একেবারে নিম্নমানের স্কুলে পড়ছে। কেউ আবার এ দুই ধারার বাইরে মাদ্রাসায় পড়ছে। কেউ আবার একটা পাঁচমিশালির মধ্যে আছে। দেশের আগামীর সন্তানদের এ অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও সুচিন্তিত দিকনির্দেশনা থাকা উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে। যে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে কেমন দেশ চাই? আমরা কি সার্ভিস সেক্টর নেশন হবো নাকি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং নেশন হবো? এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার যে চিন্তা- তার একটা প্রতিফলন ইশতেহারে থাকবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া যেখানে প্রচলিত শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ, সেখানে অপ্রথাগত বৃত্তিমূলক শিক্ষারও প্রভূত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে, চীনের অভিজ্ঞতাও হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। আর শুধু বর্তমানে আটকে না থেকে, ২০৩০ সালে আমাদের কী ধরনের দক্ষতা লাগবে, সেই দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা এখন থেকেই তো করতে হবে।

তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সবকিছুর মূলে থাকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে যেমন একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনে বিঘ্ন ঘটে, তেমনি জাতীয় জীবনেও পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় সব সময়ই যে কোনো আলোচনায় অবকাঠামো, আইন, উন্নয়ন এসব নানা বিষয়ের আড়ালে পড়ে যায় স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্বাস্থ্য খাত নিয়েও অবশ্যই ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকা চাই। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু সময়ের দাবি অনুযায়ী যেন সে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। গরিব-মধ্যবিত্ত নাগরিকের সুচিকিৎসা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে পরিকল্পনার উপস্থিতি ইশতেহারে থাকা উচিত।

সবশেষে বলতে চাই, গত পাঁচ বছরের ম্যাক্রো পরিসংখ্যানেও আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়া সত্ত্বেও এবং দারিদ্র্য কমার পরও কিছু কিছু সূচকে একটা নিম্নগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে আমরা যদি জিডিপির অনুপাতে প্রকাশ করি, তাহলে দেখা যাবে এটা কমে গেছে। যদি আমরা রফতানি প্রবৃদ্ধি হার দেখি, সেটাও কমে গেছে। এই অবনতিশীল প্রবণতাকে ফেরাতে হবে। একই সঙ্গে বরাবরই আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ২০১০-এর দশকে খুব একটা বাড়েনি। সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি কিছুটা মেটানো গেলেও তার আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ দিকগুলোর প্রতি নতুন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রসঙ্গ থাকলে বলা যাবে যে ইশতেহার আমাদের জন্য। তবে সবকিছুই কালের এবং শ্রেণিস্বার্থের অধীন।

Original in সমকাল

Extra push can erase extreme poverty in urban areas

An additional push can help Bangladesh bring down the number of urban extreme poor across the country by 2021, a leading economist said yesterday.

Bangladesh had 7.7 percent urban extreme poor in 2010, according to the government’s statistical agency.

Binayak Sen, research director of Bangladesh Institute of Development Studies or BIDS, said the number came down to 4.98 percent in 2016, as per his own projection.

“So, urban extreme poverty eradication is around the corner, with a little extra push, before 2021,” he said at a workshop at The Daily Star Centre in Dhaka yesterday.

Urban consumption poverty eradication is also possible well before the UN-set deadline of 2030, as it came down to 14 percent this year from 21.3 percent in 2010, he added.

The sustainable development goals called for eradication of extreme poverty for all people everywhere by 2030; internationally, poverty incidence below 3 percent is considered zero poverty, he said.

“But in a highly populated country like Bangladesh, 3 percent of the total population is a huge number. So, we have to work in both urban and rural areas to bring down the poverty level to zero percent to attain the SDG target on poverty.” Sen, however, said multiple risks persist.

“The issue is not just poverty reduction via temporary poverty escape, but one of permanent poverty escape.”

Apart from consumption poverty eradication, other deprivations in areas such as quality of education, health, nutrition, housing and transport have to be taken into consideration, according to Sen.

“The issue is to transform a middle income country into a middle class country.”

Mihir Kanti Majumder, chairman of Palli Sanchay Bank, said the declining trend of extreme poverty is encouraging.

If the country can reap the benefit of the demographic dividends, develop skills of the youth population, and properly use its resources, Bangladesh would become a developed country, he added.

“So, we need a concerted effort on fronts such as education and health. Agricultural machination is a must as many people are leaving the agricultural sector and engaging in non-farm activities.”

At the workshop, Sen presented an impact of a project run by Dushtha Shasthya Kendra (DSK) with support from the Shiree project funded by UKaid from the Department for International Development and the Bangladesh government.

‘Moving from extreme poverty through economic empowerment’ started in 2009 and worked in several slums such as Karail, Kamrangirchar, Lalbag, Hazaribag, Mohammadpur and Mirpur. The project ended in 2016.

Under the project, a non-refundable fund of Tk 14,000 was transferred to the beneficiaries. They were given training on income generation and were given access to health care facilities, said Masudul Quader, chief executive of DSK.

“There are many people who are not deemed credit worthy or don’t know how to utilise the credit properly, largely because of a lack of capacity. We have identified them. Now they are able to run businesses on their own,” he said.

Under the project, 30,000 households have come out of extreme poverty, said Prof Mahfuza Khanam, vice-president of DSK.

Sen first conducted pilot surveys in the slums in 2011. In December, he carried out a final survey to measure the impact of the project. This time, the number of households was 950, including 200 households under a control group.

The study showed annual income, savings and capital formation and assets have gone up for the beneficiaries compared to the controlled group. Access to sanitation and washing habits also improved.

Beneficiary households registered 24 percent higher income compared to controlled households. The weekly consumption propensity for protein and micronutrient-rich items such as eggs, meat, dairy products and fruits is significantly higher in case of programme members, said Sen.

“The members also have higher aspiration than the non-members for their children.”

Sen said: “It seems that DSK-Shiree should now try to lift their members from moderate poverty given their past success in attacking urban extreme poverty.”

“Yesterday’s extreme poor are today’s moderate poor, and they are already dreaming of becoming a part of the middle class. Can we support their aspiration?”

Mofizul Islam, director general of the Department of Cooperatives, said it is really tough to reduce urban extreme poverty compared to rural extreme poverty, as most poor people live illegally or do informal trades. “DSK-Shiree has done the difficult task.”

Setara Begum, a community leader in the city’s Karail slum, said she has been living in the slum for 25 years after she lost her home in Barguna to river waters.

“I have been given training. I have been given Tk 14,000 as grants, which I used to start a teashop. I also started selling saris with their help,” she said.

“If the government can allocate land to the rich, why can’t it do the same for the poor?”

“But we are always fearful that the slums might be demolished anytime.”

“If the slum is demolished, there will be no place for us to go. We don’t want to become zero from hero.”

Source: Daily Star