এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৫

[পূর্ব প্রকাশের পর]

এটা বলার পর তিনি এলিয়টের প্রুফ্রক কাব্যগ্রন্থের ‘প্রিলিউড’ কবিতার প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকটি অনুবাদ করে আধুনিক কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্যের দিকটি দেখালেন। আমি শুধু প্রথম স্তবকটি মূলের ইংরেজি পাঠ ও তার রবীন্দ্র্রনাথ-কৃত অনুবাদ নিচে তুলে ধরছি।

‘The winter evening settles down
With smell of steaks in passage ways
Six o’clock.
The burnt-out ends of smoky days.
And now a gusty shower wraps
the grimy scraps
Of withered leaves about your feet
And newspapers from vacant lots
the showers beat
On broken blinds and chimney-pots,
And at the corner of the street
A lonely cab-horse steams and stamps’

রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদ :

‘এ-ঘরে ও-ঘরে যাবার রাস্তায় সিদ্ধ মাংসর গন্ধ,

তাই নিয়ে শীতের সন্ধ্যা জমে এল।

এখন ছ’টা-

ধোঁয়াটে দিন, পোড়ো বাতি, যে অংশে ঠেকল।

বাদলের হাওয়া পায়ের কাছে উড়িয়ে আনে

পোড়ো জমি থেকে ঝুলমাখা শুকনো পাতা

আর ছেঁড়া খবরের কাগজ।

ভাঙা সার্শি আর চিম্‌নির চোঙের উপর

বৃষ্টির ঝাপট লাগে,

আর রাস্তার কোণে একা দাঁড়িয়ে এক ভাড়াটে গাড়ির ঘোড়া,

ভাপ উঠছে তার গা দিয়ে আর সে মাটিতে ঠুকছে খুর।

পুনশ্চ ও পরিচয়ে প্রকাশিত অনূদিত কবিতার মধ্য দিয়ে এলিয়টের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস ভালো-লাগার যে-প্রকাশ ঘটেছিল, তা আমৃত্যু অটুট ছিল। ১৯৩৬ সালের স্পেনিশ সিভিল ওয়ারের সময় জেনারেল ফ্রাংকোর বাহিনীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’ গঠিত হয়েছিল। সেখানে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীই প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এলিয়টের বিবৃতির জন্য তাকে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাতে স্বাক্ষর করেন নি। এটি অনেক প্রগতিমনা শিল্পী-সাহিত্যিককে ক্ষুব্ধ করেছিল। এটা ঠিক যে, এজরা পাউন্ডের মত ফ্যাসিবাদী শক্তির পক্ষে এলিয়ট কখনোই ঝোঁকেন নি, কিন্তু তারপরও তার কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। অমিয় চক্রবর্তী এলিয়টের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের দিকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। বিষ্ণু দে এলিয়টের ভক্ত- সে অভিযোগ মানেন নি। বলেছিলেন, ‘পাউন্ডের মতো এলিয়ট [ফ্যাসিজমের স্নায়ুবিকারে] ঝোঁকেন নি। তাঁর বিবেচনায় ইংরেজি গির্জার আশ্রয়ে ক্যাথলিক ঐতিহ্যের নিরাপদ দিব্যভাবের আবেদন বেশি।’ রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক মত নিয়ে তরুণ কবিকুলের মধ্যকার এই বিতর্ক সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু এলিয়টের কবিকৃতির মূল্যায়নে তা কোন প্রভাব ফেলেনি। কামাখ্যাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি সেকথা নির্দি্বধায় প্রকাশ করেছেন। ১৯৪০ সালে লেখা এ চিঠিটি [শারদীয় দেশ, ১৯৭৩] এলিয়ট ও আধুনিক কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

‘এলিয়ট অডেন প্রভৃতি আধুনিক ইংরেজ কবির মনে বর্তমান কালের দুর্যোগের যে আঘাত লেগেছে সেটা সত্য এবং প্রচণ্ড। সেই সংঘাতে চিন্তার তরঙ্গ উঠে আগেকার কালের অভ্যস্ত ভাষাধারার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। ভঙ্গি বদল হয়েছে কিন্তু তাঁদের রচনায় এ যুগের বাণী উঠছে জেগে কতক স্পষ্ট রূপ নিয়ে কতক অস্পষ্ট ব্যঞ্জনায়। তাঁরা যথার্থ কবি এইজন্যে বাণী তাঁদের মনে আলোড়িত হয়ে উঠলে সেটা ব্যক্ত না করে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। কিন্তু যে সাহিত্যে মানুষকে বলবার মতো কোনো বাক্য দুর্নিবার হয়ে ওঠেনি কেবলমাত্র একটা এলোমেলো প্যার্টা‌ন্‌ চলেছে আঁকাবাকা আঁকজোক কেটে সেখানে মন কোন একটা দান পায় না কেবল হুঁচোট খেয়ে খেয়ে মরে। সে সাহিত্যে একটা কোনো তাৎপর্য হাৎরিয়ে বেড়ানোর মতো ক্লান্তিকর আর কিছুই নেই।’

এলিয়ট একুশের আধুনিকতার অকৃত্রিম অনুভূতিকে ব্যক্ত করছে এজন্যই তাদের কাব্য-প্রকাশ অনবদ্য হতে পেরেছে, এ-ই ছিল কবির অভিমত। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতা আর ১৯৪০ সালে লেখা উপরোক্ত চিঠির মধ্যবর্তী সময়ে এলিয়টের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের চিঠি-পত্রে এসেছে বেশ কয়েক বার। এর থেকে বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট-অনুরুক্তি সময়ের সাথে কেবল গভীরতর হয়েছে। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাই কবির সাথে অমিয় চক্রবর্তীর পত্রালাপে। বাংলার তরুণ প্রজন্মের আধুনিক কবিকুলকে তিনি অনুকৃতির পথে নয়, তাদের ‘স্বাভাবিক প্রাণগত অভিব্যক্তির’ পথে চলতে বলছেন। ১৯৩৯ সালের এই চিঠিতে কবি বলছেন :’দেশ-বিদেশ থেকে নানারকম ভাবের প্রেরণা এসে পৌঁছেচে আমার মনে এবং রচনায়, তাকে স্বীকার করে নিয়েছি, তা আমার কাব্যদেহকে হয় তো বল দিয়েছে পুষ্টি দিয়েছে কিন্তু কোনো বাইরের আদর্শ তার স্বাভাবিক রূপকে বদল করে দেয় নি। … যে কবিদের কাব্যরূপ অভিব্যক্তির প্রাণিক নিয়মপথে চলেছে তাঁদের রচনার স্বভাব আধুনিকও হতে পারে সনাতনীও হতে পারে অথবা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু তার চেহারাটা হবে তাঁদেরই, সে কখনোই এলিয়টের বা অডিনের বা এজরা পাউন্ডের ছাঁচে ঢালাই করা হতেই পারে না। … যে কবির কবিত্ব পরের চেহারা ধার করে বেড়ায় সত্যকার আধুনিক হওয়া কি তার কর্ম?’

রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে অবিশ্রাম লেখালিখির পাশাপাশি বিরামহীনভাবে অন্যদের লেখা বই-পত্র পাঠ করে গেছেন। বিচিত্রবিধ বিষয়ে কৌতূহল ছিল তাঁর। নানাভাবে সেসব বই-পত্র সংগ্রহ করেছেন। বিশ শতকের আধুনিক ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। পাঠক রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার ইতিহাস এখনো আমাদের চোখের সামনে সম্যকভাবে ফুটে ওঠে নি। এর কিছু সংকেত পাই তার চিঠি-পত্রে। অমিয় চক্রবর্তী তাকে বিভিন্ন সূত্রের খবর পাঠাতেন, মাঝে মাঝে বই-পত্র যোগাড় করে পাঠাতেন। এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখছেন :’তুমি এখনকার ইংরেজ কবিদের যে সব নমুনা কপি করে পাঠাচ্চ পড়ে আমার খুব ভালো লাগচে,- সংশয় ছিল আমি বুঝি দূরে পড়ে গেছি, আধুনিকদের নাগাল পাব না- এই কবিতাগুলি পড়ে বুঝতে পারলুম আমার অবস্থা অত্যন্ত বেশি শোচনীয় হয়নি। তুমি যদি এই সময়ে কাছে থাকতে তোমার সাহায্যে বর্তমান সাহিত্যের তীর্থ পরিক্রমা সারতে পারতুম।’ অমিয় চক্রবর্তী তাকে এলিয়টের কাব্য-নাট্য ‘দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’ পাঠিয়েছিলেন। পড়ে কবি লিখেছেন :’ঋধসরষু জবঁহরড়হ বইখানি গভীরভাবে ভালো লেগেছে। যদি মন স্থির করতে পারি পরে তোমাকে কিছু লিখব।’ কী বলতে চেয়েছিলেন, তা আর পরে লেখা হয়ে ওঠেনি।

রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, এলিয়ট তিরিশের যুগের হিড়িক মেনে প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চান নি। এলিয়টের অনুসারীদের মধ্যে বামধারার কবি স্টিফেন স্পেন্ডারও ছিলেন। ইংরেজ ঔপন্যাসিক ই. এম. ফস্টার এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের একটি ছোট্ট সমালোচনা করেছিলেন। এদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তা এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যবিশ্বাসের মিলের জায়গাটিকে বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন :

‘স্পেন্ডর ও ফস্টরের দুটি চটি বই পড়লুম। আমার নিজের মত এই যে আমরা অর্থনীতি বা ধর্মনীতিতে যে দলেরই লোক হই আমাদের সেই দলাদলি যে সাহিত্যকে বিশেষ ছাঁদে গড়ে তুলবেই এমন কোনো কথা নেই। রসের দিক থেকে মানুষের ভালমন্দ লাগা কোনো মতকে মানতে বাধ্য নয়। আমার মনটা হয়তো সোশিয়ালিস্ট, আমার কর্মক্ষেত্রে তা ভিতর থেকে প্রকাশ পেতেও পারে কিন্তু উর্বশী কবিতাকে যে স্পর্শও করে না। … মার্কসিজমের ছোঁয়াচ যদি কারো কবিতায় লাগে, অর্থাৎ কাব্যের জাত রেখে লাগে, তাহলে আপত্তির কথা নেই, কিন্তু যদি নাই লাগে তাহলে কি জাত তুলে গাল দেওয়া শোভা পায়?’

এলিয়টের ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ে নি। এর কারণ এর দীর্ঘ কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে। পড়লে সেটি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়াত বিষয়বস্তুর গুণেই। এটি ছিল এলিয়টের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এর ভাব ও ছন্দ-ব্যঞ্জনা সব ধারার কবির মধ্যেই আলোড়ন ফেলেছিল। সেই উচ্ছ্বাসের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় ‘মার্কসবাদী’ কবি সমর সেনের চিঠি-পত্রে।

৩. তরুণতর প্রজন্মের চোখে এলিয়ট

বিশেষভাবে সমর সেনের কথাইবা তুললাম কেন? তার একটা কারণ ‘বুর্জোয়া-ডেকাডেন্সের’ রূপকার এলিয়টের প্রতি সমাজ-পরিবর্তনকামী ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সাথী সমর সেন কেন উৎসুক হয়ে উঠবেন- এ নিয়ে বাড়তি কৌতূহল হতেই পারে। দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অরুণ সেনের ছেলে সমর সেন প্রথম যৌবনে কবিতা লিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এরা সকলেই সমর সেনের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। চল্লিশের যুগে বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু বরাবরই ছিলেন বৃত্তের বাইরের দলছুট মানুষ। প্রগতিশীল রাজনীতি নিয়ে পরিহাস করতে জানতেন তিনি যেমন, সবার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সংকীর্ণতা নিয়ে বিদ্রূপ করতে পিছু-পা হতেন না সেই তরুণ বয়সেই। একবার বুদ্ধদেব বসুকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়ে চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন- ‘সুকান্ত কি মহাকবি? আমার কল্পনা ও বোধশক্তি এত কমে গিয়েছে যে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি না।’ বিষ্ণু দে-কে তির্যকভাবে আখ্যায়িত করতেন ‘মহাকবি’ বলে। তার শ্নেষাত্মক বচন থেকে প্রায় কেউই রক্ষা পাননি। বিষ্ণু দেকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘ধূর্জটিবাবু আজকাল আবার সমালোচনার নামে সুধীন্দ্রনাথের চর্চা শুরু করেছেন। বাংলা কবিতা=সুধীন্দ্রনাথ; সুধীন্দ্রনাথ=ভারতীয় ঐতিহ্য। … তারপর রবীন্দ্রনাথ আবার তাঁকে কী যেন করার ভার মৃত্যুর পূর্বে দিয়ে গিয়েছেন।’ একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছেন, ‘শুনে সুখী হবেন যে রবীন্দ্র রচনাবলী মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। এখন পর্যন্ত কোনো মহান ‘সত্যের’ মুখোমুখি হইনি।’ সবাইকেই তিনি কমবেশি শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু গুরুবাদ, প্রশ্নাতীতভাবে সবাইকে মেনে নেওয়ার রীতি, চাটুকারবৃত্তি এসবের লক্ষণ দেখলে সমর সেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং মনের ভাব তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না। ভারতবর্ষের বা বাঙালির ইতিহাস তার কাছে খুব গৌরবময় মনে হতো না। ব্রেখটের মতো সমর সেনও জাতীয় ইতিহাসের মধ্যে কেবলই অত্যাচার-অবমাননা-শোষণের ছায়া দেখেছিলেন। চল্লিশ দশকের শুরুতেই তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন :

‘আমরা বাঙালী মীরজাফরী অতীত; মেকলের বিষবৃক্ষের ফল।
অনেক দিন ভেবেছি,
অনেক বার ভেবেছি:
ভবিষ্যতে বীজবাহী না হয়। এ বিষবৃক্ষ শেষ হোক…’
অন্যত্র, নতুন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে লিখেছেন,
‘মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবীতে আলো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলার ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্ত ক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক সভ্যতার রুক্ষ মরুভূমি।’
[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৪

[পূর্ব প্রকাশের পর]

২. রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট

টি.এস. এলিয়ট নিয়ে গত এক শতাব্দী ধরে এত লেখালিখি হয়েছে যে, এ নিয়ে বাড়তি কোনো তথ্য বা তত্ত্ব যোগ করা দুরাশা মাত্র। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ যেমন, ইংরেজি কবিতার ক্ষেত্রে এলিয়টও তেমনি। তারপরও এলিয়ট পাঠে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধে যার উত্তর সহজে মেলে না। আমার কাছে প্রশ্নগুলো ধাঁধার মত মনে হয়। এই প্রশ্নগুলোকে তিনটি শিরোনামে বিন্যস্ত করা যায় :

ক. রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু এলিয়ট রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে এত নির্বিকার ছিলেন কেন? তার প্রবন্ধ-সাহিত্যে, এমনকি সম্প্রতি ৩-খণ্ডে প্রকাশিত এলিয়টের সংগৃহীত চিঠিপত্রে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কোন উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এলিয়ট-সখা এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন, পত্রালাপ করেছেন, গিয়ে একাধিকবার সরাসরি দেখা করেছেন, কিন্তু এলিয়ট এত দৃষ্টিকটুভাবে নীরব কেন ছিলেন পূর্বাপর? অথচ দু’জনেই তো ছিলেন কম-বেশি একই পথের পথিক- একত্ববাদী (ইউনিটেরিয়ান) আদর্শে, বিশ্বজনীন চিন্তায় ও পূর্ব-পশ্চিমের যোগসূত্র স্থাপনে তৎপর?

খ. এলিয়ট পরবর্তী জীবনে খ্রিষ্টীয় ধর্মাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন, এ রকম কথা চালু রয়েছে। কিন্তু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ধর্ম, ভাষা ও দর্শনের ছাত্র হিসেবে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় বেশ কিছুটা দক্ষতা জন্মেছিল তার। পাণিনি-ভতৃহরি পাঠ করেছিলেন তিনি। পতঞ্জলির দর্শন, সাংখ্য, উপনিষদ সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন ছিল তার। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে তার বাস্তবিক অনুরাগ ছিল। এলিয়টের কবিতায় ও সামগ্রিক দর্শনবোধে প্রাচ্যবিদ্যার প্রভাব কতখানি ফলদায়ী হয়েছিল?

গ. তৃতীয় প্রশ্নটি আধুনিকতার পাশ্চাত্যনির্ভর সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। আধুনিক চিত্রকলায় পিকাসোর কিউবিস্ট নিরীক্ষার ওপরে আফ্রিকার চিত্রকলার (মুখোশ ও ভাস্কর্য) প্রভাব সুবিদিত। এমনটাই ঘটেছিল পল ক্লী-র ক্ষেত্রে। এনি এলবার্সের শিল্পকলায় যেমন প্রভাব ফেলেছিল আজটেকদের আর্ট। অর্থাৎ প্রতীচ্যের আধুনিকতার নির্মাণে প্রাচ্যের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। এলিয়টের বা পাউন্ডের কাব্যচর্চায় ‘আধুনিকতার’ নির্মাণে প্রাচ্যের সরাসরি বা পরোক্ষ অবদানের যে সাক্ষ্য মেলে, তাতে করে কি পাশ্চাত্যনির্ভর আধুনিকতার ইতিহাসকেই পুনর্লিখন করার তাগিদ দেখা দেয় না? তাতে করে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী যাকে বলেছিলেন, ‘Provincializing Europe’ সে ধরনের তাগিদেরই বাড়তি সমর্থন পাওযা যায় না কি?

রবীন্দ্রনাথের তরফে এলিয়টের প্রতি মনোযোগী উৎসাহের সপক্ষে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত জড়ো করা সম্ভব। সেগুলো সংক্ষেপে একঝলক দেখে নিতে পারি।

১. বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন গদ্য কবিতা বিষয়ে লিখবার জন্য। সেই তাগিদে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার ‘গদ্যকাব্য’ প্রবন্ধটি, যেটি বুদ্ধদের-সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে (পরবর্তীকালে ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থে ‘কাব্য ও ছন্দ’ নামে প্রকাশিত)। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ যে পত্র লেখেন তাতে এলিয়টের নাম উঠে আসে :

‘গদ্যকাব্য সম্বন্ধে তর্ক না করে যথেচ্ছা লিখে যাওয়াই ভালো। আজ যারা আপত্তি করচে কাল তারা নকল করবে। এলিয়ট প্রমুখ অনেক কবি নির্মিল নিশ্ছন্দ কবিতা লিখে চলেচেন…’

২. কবি বিষুষ্ণ দের ‘চোরাবালি’ কাব্যগ্রন্থে বিদেশি প্রসঙ্গ- অনুষঙ্গের প্রাবল্য দেখে রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি হয়েছিল। এ নিয়ে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। সেখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের Waste Land, Ash-Wednesday, Ariel Poems প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ কতটা ঘনিষ্ঠভাবে কতটা মনোযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটা তুলে ধরছি : ‘… বিষ্ণু দের লেখার একটা কারণে আমার খটকা লাগে। আমরা য়ুরোপীয় সাহিত্য এক সময়ে গভীর আনন্দ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গেই পড়েছিলুম। মনটা তার সঙ্গে ভাবের কারবার করেছিল, কিন্তু বিদেশি নামগুলো স্বভাবতই রচনার মধ্যে এসে পড়ে না। … ক্রেসিডা গ্রীক পুরাণের তর্জমা থেকে পড়েছি, তার সঙ্গে মনের এত বেশি মাখামাখি হয়নি যে, ভাবের অন্তরঙ্গমহলে যখন তখন আপনি এসে চেনা জায়গা নিতে পারে। এলিয়ট-এর কবিতার ভাষার আত্মীয়মহলে অসঙ্কোচে বিদেশি নামের বা পুরাণের ঢুকে পড়া দেখেছি, তাঁর এই বিশেষত্ব এত স্বকীয় যে, অন্য কারো পক্ষে এটা অনুকরণের সুস্পষ্ট মুদ্রাদোষ হয়ে পড়ে। এ রকম স্খলন যদি দৈবাৎ হয় তবে সেটা নিয়ে লজ্জিত হওয়া প্রত্যাশা করি কিন্তু বার বার যদি হয়, তবে সেটাকে কী বলব? বিশেষত তুলনা করে দেখলে দেখা যাবে যে, দেশীয় পুরাণ থেকে তার কবিতায় নামগুলি পথ পায় না। সহজ বলেই কি?’

এখানে বলা দরকার যে, এলিয়ট তার কবিতার নির্মাণে অন্য সূত্র থেকে (অন্য কবির লেখা, পুরান মহাকাব্য বা দার্শনিক টেক্সটের) বিচ্ছিন্ন লাইন, উপমা, চিত্রকল্প, খণ্ড সংলাপ, বাক্যাংশ প্রায়শ ব্যবহার করতেন। সেসব মৃত লাইন এলিয়টের হাতে ব্যবহূত হয়ে এক নতুন জীবন পেত; কখনো কখনো মূলের অর্থই বদলে যেত; আবার কখনো নতুনের সাহচর্যে এসে পুরাতন ভাবভঙ্গি অপ্রত্যাশিতভাবে আধুনিকতার দ্যোতনা পেত। রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, এ কাজটি এলিয়ট অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সম্পাদন করেছেন বলেই এটি তার কাব্যকলার একটি জরুরি প্রকরণ-অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

৩. কবি বিষ্ণু দে এলিয়টের Ariel Poem-এর প্রথম কবিতা ‘Journey of Magi’ অনুবাদ করে ‘সংশোধনের জন্য’ রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এটির তিনটি পাঠ পাওয়া যায়। বিষ্ণু দের অনুবাদ সংশোধন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, “ইতিমধ্যে শ্রী বিষ্ণু দে ‘পুনশ্চ’-এর নকলে ‘এলিয়ট’-এর একটা তর্জ্জমা পাঠিয়াছিল, পড়ে দেখলুম। কমলি ছোড়তি নেই- গদ্যের ঘাড়ে পদ্য কামড়ে ধরেচে।” বিষ্ণু দের নিজের অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের হাতে সংশোধিত হয়ে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর আরেকটি পাঠ পাওয়া যায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘স্বগত’ প্রবন্ধমালার ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে। আর সবশেষ পাঠটি সংকলিত হয় ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ শিরোনামে। এই তিনটি পাঠের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য বয়ে গেছে। ধারণা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ সে পর্যায়ে (১৯৩০-৩১ সালের কথা হচ্ছে এখানে) বাংলায় গদ্যছন্দের প্রকাশভঙ্গি, সীমা-পরিসীমা নিয়ে অনবরত ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করে চলেছিলেন। আর এ ক্ষেত্রে তিনি এলিয়টের কবিতাকেই বিশেষ করে বেছে নিয়েছিলেন। এর থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়ার পর্বের টালমাটাল পথ চলার ছবিটিও বেশ ফুটে ওঠে। ‘জার্নি অব দি মেজাই’ কবিতাটির প্রথম স্তবকের তিনটি পাঠ যথাক্রমে নিচে তুলে ধরা হলো। সমগ্র কবিতা ধরলে পাঠান্তরের অমিল আরো বেশি করে চোখে পড়বে।

ক. বিষ্ণু দে-কৃত অনুবাদ :

‘আমাদের সে যাত্রা হিমে
বছরের সবচেয়ে খারাপ সময়ে
অভিযান ওরকম দীর্ঘ অভিযান :
পথঘাট কাদায় গভীর ক্ষুরধার হাওয়া
দুর্গম পথ, শীতের চরম।
আর উটগুলি উত্ত্যক্ত, খুরে ঘা, তেরছা মেজাজ
থেকে থেকে শুয়ে পড়ে গলন্ত বরফে।’
খ. বিষ্ণু দে-কে প্রেরিত রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক সংশোধিত পাঠ :
‘শীতরুক্ষ আমাদের যাত্রা,
ভ্রমণ দূরদেশের দিকে।
অত দীর্ঘ ভ্রমণের সময় এ তো নয় একেবারেই।
পথ দুর্গম, বাতাস ক্ষুরের মত শান দেওয়া
কনকনে শীত।
উটগুলো হয়রান, পায়ে ক্ষত, বিরক্ত বিমুখ, তারা
গলে-পড়া বরফে শুয়ে শুয়ে পড়ে।’
গ. সুধীন্দ্রনাথের ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদের উদ্ৃব্দতি :
‘কনকনে ঠাণ্ডায় হল আমাদের যাত্রা-
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সবচেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
উটগুলোর ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা মেজাজ চড়া,
তারা শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।’
ঘ. ‘পরিচয়’ পত্রিকায় (মাঘ-১৩৩৯), প্রকাশিত [ও ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ নামে অন্তর্ভুক্ত] রবীন্দ্রনাথ-কৃত এলিয়টের অনুবাদ :

‘কন্‌কন্‌ে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা-
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো
শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।’
তবে ‘পুনশ্চ’ কাব্যে এলিয়টের কবিতা যে ‘তীর্থযাত্রী’ শিরোনামে অনূদিত হয়ে সমমানে স্থান পেল তা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। যে বছর পুনশ্চ প্রকাশ পায়, সে বছরই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রবন্ধ ‘আধুনিক কাব্য’ (১৯৩২)। সেখানে রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রুফ্রক’ (১৯১৭) থেকে দীর্ঘ উদ্ৃব্দতি দিচ্ছেন আধুনিক (গদ্য) কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্য। কোন বিষয়ই আর কবিতার ত্রিসীমার বাইরে থাকছে না- এটি বোঝাতে তিনি এলিয়টকেই বেছে নিয়েছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে :

‘কেউ সুন্দর, কেউ অসুন্দর; কেউ কাজের, কেউ অকাজের; কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ছুতোয় কাউকে বাতিল করে দেওয়া অসম্ভব। সাহিত্যে, চিত্রকলাতেও সেইরকম। কোনো রূপের সৃষ্টি যদি হয়ে তাকে তো আর কোনো জবাবদিহি নেই; যদি না হয়ে থাকে, যদি তার সত্তার জোর না থাকে, শুধু থাকে ভাবলালিত্য, তা হলে সেটা বর্জনীয়। এইজন্য আজকের দিনে যে সাহিত্য আধুনিকের ধর্ম মেনেছে, সে সাবেককালের কৌলীন্যের লক্ষণ সাবধানে মিলিয়ে জাত বাঁচিয়ে চলাকে অবজ্ঞা করে, তার বাছবিচার নেই। এলিয়টের কাব্য এইরকম হালের কাব্য, ব্রিজেসের কাব্য তা নয়।’

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

নতুন প্রসঙ্গ

পর্ব ::২৩

১. টি.এস. এলিয়ট : আধুনিক ধারার পথিকৃৎ

‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে ষাট-সত্তর দশকের কবিতার আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঘুরে-ফিরে বোদলেয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকের শুরুতে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ‘শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা’ প্রকাশের পর দুই বাংলাতেই কবিকুলের ওপরে ফরাসি প্রভাব ঘনীভূত হয়েছিল। অধ্যাপক সায়ীদ লিখেছেন :

‘পশ্চিম ইয়োরোপ আর আমেরিকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যসর্বস্ব রুগ্‌ণ ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতি ধারার… ঘুণেধরা ও বিকারগ্রস্ত প্রবণতাগুলো… আমাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকার বিটনিকদের প্রভাব পড়েছিল সরাসরি। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ সাহিত্যের অবক্ষয়ী ধারাটি হয়ে উঠেছিল আমাদের দোসর। তবে বাইরের যেসব অবক্ষয়ী প্রভাব আমাদের সাহিত্যিকভাবে আক্রান্ত করেছিল, তার মধ্যে আমার মনে হয়, সবচেয়ে সর্বাত্মক ও গভীর ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি কবি বোদলেয়ারের প্রভাব।’

এই বিবরণীতে কোথাও টি.এস. এলিয়টের উল্লেখ নেই। পরোক্ষভাবে, এক জায়গায় ‘ফাঁপা মানুষ’ কথাটার উল্লেখ রয়েছে, যা এলিয়টের ÔWe are the hollow menÕ’-এর প্রতি ইঙ্গিত। এটি কিছুটা বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না। তিরিশের যুগে রবীন্দ্রনাথের সাথে বুদ্ধদেব বসুদের যখন চিঠিপত্রে তর্কালাপ হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি নিয়ে, তখন প্রথমেই যে-নামটি চলে এসেছে সেটি এলিয়টের নাম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের একাধিক কবিতার অনুবাদ করেছেন; সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘স্বগত’ গ্রন্থে এলিয়টকে নিয়ে উদ্ৃব্দতি-বহুল একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন; বিষ্ণু দে আলাদা করে প্রকাশ করেছেন ‘এলিঅটের কবিতা’ শীর্ষক অনূদিত কাব্যগ্রন্থ; জীবনানন্দ দাশের একাধিক প্রবন্ধে ঘুরে-ফিরে এসেছে এলিয়টের নাম। ওয়েস্টল্যান্ড ও ফোর কোয়ারটেটস্‌ যার হাত দিয়ে বেরিয়েছে তার সম্পর্কে ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে বিস্ময়কর নীরবতা কৌতূহলোদ্দীপক, সন্দেহ নেই। বিশেষত যদি মনে রাখি যে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংকট, অবক্ষয় ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে প্রবল প্রভাববিস্তারকারী কবিতা এলিয়টের হাত দিয়েই নিষ্ফ্ক্রান্ত হয়েছিল। এই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ইংরেজিতে লিখিত হওয়ার কারণে এলিয়টের অনেক কবিতাই বা কবিতার নানা বিচ্ছিন্ন পঙ্‌ক্তিমালাই পাঠকের মুখে মুখে ফিরত। বোদলেয়ারের ক্ষেত্রে যেটা সম্ভবপর ছিল না বুদ্ধদেব বসুর অনুপম অনুবাদের পরও।

আমরা যারা সত্তর দশকে এলিয়টের কবিতার নিমগ্ন পাঠক ছিলাম, তাদের কাছে এলিয়টের স্থান ছিল হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। ‘লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’ আমরা ঘরে-বাইরে আবৃত্তি করেছি :

‘Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherised upon a table’

অথবা,

‘In the room the women come and go
Talking of Michelangelo’

অথবা,

‘I grow old… I grow old…
I shall wear the bottoms of my trousers rolled.’

বা

‘There will be time to murder and create,
And time for all the works and days of hands
That lift and drop a question on your plate;
Time for you and time for me,
And time yet for a hundred indecisions,
And for a hundred visions and revisions,
Before the taking of a toast and tea’

এবং সবশেষে

ÔNo! I am not prince Hamlet, nor was meant to be;
Am an attendant lord, one that will do
To swell a progress, start a score or twoÕ

‘প্রুফ্রক’ লেখা হয়েছিল ১৯১৭ সালে- প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতরে। এই যুদ্ধের ধংসাবশেষের ওপরে ১৯২২ সালে লেখা হয় এলিয়টের সর্বাধিক পরিচিত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড।’ এই কাব্যগ্রন্থটিও আমাদের প্রজন্মের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আধুনিকতার জন্মই বলতে গেলে হয়েছিল ঐ বছরে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস, হারমান হেস-এর সিদ্ধার্থ, এবং বরিস পাস্তারনাকের ‘মাই লাইফ সিস্টার’ (জীবন আমার বোন)। [ঐ বছরেই প্রকাশ পায় আইনস্টাইনের ‘দ্য মিনিং অব রিলেটিভিটি]। প্রুফ্রক আমাদের মুগ্ধ করেছিল ঠিক, কিন্তু ওয়েস্ট ল্যান্ড আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কবিতার মধ্যে নাটকীয় সংলাপ স্থাপনা, উক্তি ও পুনরুক্তি, আকস্মিক দার্শনিক স্বগত সংলাপ, ঘরের ও বাইরের পৃথিবীর মধ্যকার দেয়াল ভেঙে-পড়া, প্রথাগত মূল্যবোধের বিপর্যয়, ইতি ও নেতির দ্বন্দ্বে দীর্ণ শূন্য মানুষ, সভ্যতার সংকট- এই সবই ছিল সেখানে। এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে আধুনিকতার মৌলিক অনুভব হয়েছিল। পরপর কয়েকটি বহু-উদ্ৃব্দত লাইন নিচে তুলে ধরছি :

১. April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.

২. Unreal City,
Under the brown fog of a winter dawn,
A crowd flowed over London Bridge, so many.
I had not thought death had undone so many.

৩.‘My nerves are bad to-night. Yes, bad. Stay with me.’
‘Speak to me. Why do you never speak. Speak’
‘What are you thinking of? What thinking? What?’
‘I never know what you are thinking. Think.’

৪. I think we are in rats’ alley
Where the dead men lost their bones.

৫. ‘What shall I do now? What shall I do?’
‘I shall rush out as I am, and walk the street.’
‘With my hair down, so. what shall we do tomorrow? ‘What shall we ever do?’
The hot water at ten.
And if it rains, a closed car at four.
And we shall play a game of chess.
Pressing lidless eyes and waiting for a knock upon the door.

৬. When lovely woman stoops to folly and
Paces about her room again, alone.
She smoothes her hair with automatic hand.
And puts a record on the gramophone.

৭. Who is the third who walks always beside you?
… … … … … … …
I do not know whether a man or a woman
– But who is that on the other side of you?

১০. 10. London Bridge is falling down falling down falling down
… … … … … … …
These fragments I have shored against my ruins.
… … … … … … …
Datta. Dayadhvam. Damyata.
Shantih shantih shantih

কবি নিজে ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যগ্রন্থের জন্য পাদটীকা প্রস্তুত করেছিলেন। ওয়েস্ট ল্যান্ডের আদি খসড়ার সাথে প্রকাশিত পাঠের মধ্যে স্থানে স্থানে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছিল। কিছুটা কবি এজরা পাউন্ডের খুঁটিনাটি মন্তব্যের কারণে, কিছুটা কবির নিজের পুনর্চিন্তায়। কবি-কৃত পাদটীকার সংখ্যা ছিল ৪৩৩টি; কিন্তু তাতেও এই দীর্ঘ কবিতার সম্পূর্ণ উপলব্ধি হয় না। উনিশ বছর বয়সে যখন পাঠ করেছি, তখনও ওয়েস্ট ল্যান্ড হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, যদিও সমস্ত অনুষঙ্গ সে বয়সে করায়ত্ত হয়নি। একষট্টি বছরে যখন পাঠ করেছি, তখন অনেকটাই বুঝেছি যে কোন লাইনটা কোন বই থেকে বা কোন সাহিত্যিক প্রয়োজন মেটাতে লেখা, কিন্তু তারপরও রহস্য এতটুকু কমেনি। এ বই এলিয়টকে চূড়ান্ত খ্যাতি এনে দিয়েছিল- ইংরেজি আধুনিক কাব্য চর্চার জগতে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিল শীর্ষস্থানীয় আসনে। কিন্তু তারপরও কবির যাত্রা থেমে থাকেনি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে- লেখা হবে তার ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’; এর মধ্যকার ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস’ কবিতাটি হবে তার মহত্তম সৃষ্টি।

আমার মনে পড়ে, অগ্রজ অর্থনীতিবিদ (ও কবি) আবু আবদুল্লাহর প্রিয় কাব্যগ্রন্থের একটি ছিল এলিয়টের ফোর কোয়ারটেটস্‌। আবু আবদুল্লাহর কাব্যরুচির ওপরে আমার পূর্বাপর অগাধ নির্ভরতা ছিল। এই কাব্যগ্রন্থের থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক স্তবক ও পঙ্‌ক্তিমালা তার মুখে আবৃত্তি হতে শোনা গেছে। তার বড় ভাই অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার মত তিনিও ছিলেন কবিতার বড় সমজদার ও আবৃত্তিকার। আবু আবদুল্লাহ অনর্গল পড়ে যাচ্ছেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি :

১১. Houses live and die : there is a time for building
And a time for living and for generation

১২. There is, it seems to us,
At best, only a limited value
In the knowledge derived from experience.
The knowledge imposes a pattern, and falsifies,
For the pattern is new in every moment
And every moment is a new and shocking
Valuation of all we have been.

১৩. So here I am, in the middle way, having had twenty years
Twenty years largely wasted …
Trying to learn to use words, and every attempt
Is a wholly new start, and a different kind of failure.

১৪. We shall not cease from exploration
And the end of all our exploring
Will be to arrive where we started
And know the place for the first time.

কবি হায়াৎ সাইফের সাথে আবু আবদুল্লাহর একটি যুগলবন্দি- এক মলাটে দুই জনের আলাদা আলাদা কবিতা সংবলিত কাব্যগ্রন্থ- বেরিয়েছিল, মনে পড়ে।

[ক্রমশ]

ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিশেল ফুকো: মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা

পর্ব ::২২

[ক্রমশ]

এ জন্যই ফুকো বলছেন, ‘[Individuals] are not only its [Power’s] inert or consenting target; they are always also the elements of its articulation. In other words, individuals are the vehicles of power, not its points of applicaton.’

ঘ. চতুর্থ উপদেশ

প্রথম তিনটি বৈশিষ্ট্য থেকে ক্ষমতা-বিচারের ফুকো-নির্দেশিত চতুর্থ বৈশিষ্ট্যটি বেরিয়ে আসে। এর আগের রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনে ক্ষমতার বিশ্নেষণ করা হয়েছে ‘উপর থেকে নিচে নামতে নামতে’। ক্ষমতা কী করে রাজার ডিক্রি-জারি থেকে ‘নামতে নামতে’ প্রজার পর্ণ কুটিরে পৌঁছায়, সে ধরনের বিশ্নেষণকে ফুকো বলেছেন ‘descending analysis of power..’ আগেই বলেছি, ফুকো এ ধরনের বিশ্নেষণে উৎসাহী ছিলেন না। তিনি এর বিপরীতে ‘নিচে থেকে উপরে ওঠা’ ক্ষমতার বিশ্নেষণ করতে চান, যাকে তিনি বলেছেন- ‘ascending analysis of power..’ ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যার দাবি করে।

ধরা যাক, রাষ্ট্র-ক্ষমতার ভরকেন্দ্র- কেবিনেট, পার্লামেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার বা প্রেসিডেন্ট-এর কার্যালয়, মন্ত্রীদের দপ্তর- ছাড়াও রাজনীতির বলয়ে, অর্থনীতির মধ্যে, সমাজের পরিসরে, পরিবারের ভেতরে নানা ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগ বা চর্চা চলছে। এসব স্তরে অর্থাৎ, দলের-উপদলের পর্যায়ে, কারখানা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে, সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথা সমিতি-সংগঠন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা-মক্তব, এনজিও, মসজিদ-উপাসনালয় প্রভৃতি পর্যায়ে, বা পরিবারের ভেতরে, ক্ষমতা-প্রয়োগের কলা-কৌশলে রূঢ় অথবা সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, মমতার সাথে বা নির্মমতায়, ছোট-বড়-মাঝারি ক্ষমতার প্রয়োগ বা অনুশীলন হচ্ছে। এসব মাইক্রো পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলোতে যেসব বা যে ধারার ক্ষমতার চর্চা হচ্ছে তার টেকনিক বা কলা-কৌশলগুলো স্থির নেই- কালক্রমে দেশক্রমে সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। মাইক্রো-ক্ষমতার সেই পরিবর্তনের ধারা সবসময় যে কালক্রমে ‘আরো মানবিক’, ‘আরো প্রগতিশীল’ বা ‘আরো উন্নত’ হচ্ছে বা হবে, তা কিন্তু নয়। ফুকোর কথা হলো, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এসব মাইক্রো-পাওয়ারের পরিবর্তন-বিবর্তনের একটা ‘ট্রেকিং’ (Trekking) হওয়া দরকার। তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মাইক্রো-পাওয়ারগুলোর কীভাবে আত্তীকরণ করা হচ্ছে, বা কেন ক্ষমতার কোন ডিসকোর্স কলা-কৌশল বা ‘মেকানিজম’ কখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই বুর্জোয়া শ্রেণি রাষ্ট্র-ক্ষমতায়। সবকিছুর জন্যই শুধু বুর্জোয়া শ্রেণিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করলে আধুনিক পুঁজিবাদে ক্ষমতা-চর্চার ধারা ও পালাবদলকে বোঝা যাবে না। এটাই ফুকোর মূল বক্তব্য। কাজে লাগলে বুর্জোয়া শ্রেণি ‘সামন্তবাদী অবশেষ’কে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে; মানবিকতা ও অমানবিকতা দুয়েরই চর্চা করতে পারে। তাই ফুকো আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার এনলাইটেনমেন্ট তথা হিউম্যান রাইটস জাতীয় অধিকার-এর ডিসকোর্স বা সাংবিধানিক ভাবাদর্শের প্রতি না তাকিয়ে এর মাইক্রো-পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে কীভাবে চলছে বা ক্ষমতার চর্চা করছে, সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে বলেছেন।

ঙ. পঞ্চম উপদেশ

ফুকোর সবশেষ (পঞ্চম) পদ্ধতিগত মন্তব্যটি স্পষ্টতই মার্কস-আলথুসারের ভাবাদর্শ-সম্পর্কিত আলোচনাকে মনে রেখে করা। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে ভাবাদর্শের (Ideology) প্রচার করতে হয় এবং ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলোর তরফে যার যার নিজস্ব ভাবাদর্শ-প্রচারও অব্যাহত রয়েছে। যুগে যুগে এর ব্র্যান্ডিংও বদলায়। আমাদের দেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ যেমন একটি ভাবাদর্শের স্ট্যাটাস পেয়েছে। শান্তিনিকেতন-এর বিদ্যালয় সম্পর্কে ‘উন্মুক্ত পরিবেশে পাঠদান’-এর একটি ভাবাদর্শ কথিত রয়েছে। ভারতের রাষ্ট্র-সংবিধান বললে একটি ‘সেক্যুলার’ ভাবাদর্শের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা হয়। এসব ভাবাদর্শ বাস্তবে পালিত হচ্ছে কিনা, তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু ফুকো বলছেন, ক্ষমতা টিকে থাকে শুধু ভাবাদর্শের মাধ্যমে নয়- এটি ভাবাদর্শের চেয়ে অনেক বেশি এবং অনেক কম কিছু- ‘both much more and much less than ideology.’ ক্ষমতা টিকে থাকে ভাবাদর্শের ওপরে নয়, জ্ঞানের ওপরে নির্ভর করে। যারা ক্ষমতাবান তারা বা তাদের অধীনস্থ সংস্থাগুলো বিভিন্ন ‘বিশেষায়িত জ্ঞান’-এর অধিকারী হন। একজন নাগরিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেন না; সেটি আসে দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর একটি আবহাওয়া সংস্থা থেকেই। সুতরাং আলথুসার কথিত ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস অব স্টেট’ নয়, বরং রাষ্ট্র ‘নলেজ অ্যাপারেটাস’ তৈরি করেই ক্ষমতার চর্চা করে থাকে। এ জন্যই রাষ্ট্রের জন্য রিসার্চ পেটেন্টসের সংখ্যা, পপুলেশন সেন্সাস, পরিসংখ্যান ব্যুরো, প্রবৃদ্ধি-দারিদ্র্যের হিসাব কষা এত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফুকো বলেছেন, ‘ It is the Production of effective instruments for the formation and accumulation of knowledge- methods of observation, techniques of registration, procedures for investigation and research, apparatuses of control. All this means that power, when it is exercised through these subtle mechanisms, can not but evolve, organise and put into circulation … apparatuses of knowledge, which are not ideological constructs.’
ফুকোর এই ধারণাটিকে পরবর্তী সময়ে তিনি গভর্নমেন্টালিটি (Governmentality) এবং বায়ো-পাওয়ার (ইরড়-চড়বিৎ)-এর আলোচনায় আরও বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। এর আগে ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইয়ে তিনি ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power) বা ‘নরমালাইজিং পাওয়ার’ (Normalizing Power)-এর কথা বলেছেন। অন্যত্র, ফুকোর Panopticon ও ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের কথা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি।১

৪. ক্ষমতা ও গণতন্ত্র

সবশেষে, একটি কথা যোগ করতে চাই। এই লেখাটিতে ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ বলতে গিয়ে আমি মূলত আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকেই বুঝিয়েছি। কিন্তু ক্ষমতার প্রয়োগ-পদ্ধতি ও তার কলা-কৌশল শুধু উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। এর রেপ্লিকা দেখা যায় উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশেও; বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ফুকো অবশ্য মনে করতেন যে, পুঁজিবাদী দেশ থেকে ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের কলা-কৌশল একদা বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও আমদানি ও আয়ত্ত করেছিল, এবং বাস্তবে তা প্রয়োগ করেছিল। ফুকোকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘ক্ষমতার নজরদারির কলা-কৌশল কি আধুনিক শিল্পায়িত পুঁজিবাদী দেশের উদ্ভাবন?’ এর উত্তরে ফুকো (যিনি এক সময় তার শিক্ষক লুই আলথুসারের মতাই ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন) বলেছিলেন:’কোথায় ক্ষমতার এই কলা-কৌশলের উদ্ভাবন হয়েছিল, তা হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশে এসবের ব্যবহার শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও ক্ষমতার এই ফর্মগুলো দেখা গেছে; ক্ষমতার প্রয়োগ-কৌশল এখানে শুধু স্থান বদলেছে মাত্র।’ মিশেল ফুকো এখানে ইঙ্গিত করছিলেন যে, ক্ষমতা সমস্যাটির সমাধান শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতার হাতবদলের মাধ্যমেই সম্পন্ন হওয়ার নয়। এই সমস্যার শিকড় সমাজ-রাষ্ট্রের অত্যন্ত গভীরে রয়ে গেছে। বুর্জোয়া-রাষ্ট্রে ও প্রলেতারিয়েত-রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন শ্রেণির চরিত্র একেবারে ভিন্ন বা বিপরীত হলেও ক্ষমতার প্রয়োগ-পদ্ধতি ও কলা-কৌশলের খুব একটা হেরফের হয়নি। কথাটা নিয়ে আমরা ভেবে দেখতে পারি।

ক্ষমতার বিষয়ে ফুকোর আলাপের একটি আংশিক পাঠের চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখার মাধ্যমে। এই আলাপটি মূলত গড়ে উঠেছে ১৯৭৫ সালের ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইটিকে ঘিরে। এর পরেও ফুকো আরো ৯ বছর বেঁচে ছিলেন। সে সময়ে তিনি তার ‘বায়ো-পাওয়ার’ (যাকে তিনি বলেছেন ‘পাওয়ার ওভার লাইফ’) ধারণার সূত্রপাত করেন। এ নিয়ে অন্য কোন সুযোগে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু একটা স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর এখানেই, এখনই দেওয়া যেতে পারে। ফুকো এসব লিখেছেন কেন? ক্ষমতা বিষয়ে তার আলাপকে কেন আমাদের গুরুত্বের সাথে পাঠ করতে হবে?

এর কারণ জড়িত আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ‘গণতন্ত্র’ সমস্যাটির সাথে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার হাতবদল ঘটলেও ক্ষমতার ধরন-ধারণার ক্ষেত্রে খুব একটা ‘গণতন্ত্রায়ন’ হয় না। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হলেও তাতে ক্ষমতার খুব একটা গণতন্ত্রায়ন হয়নি। ১৯৭১ সালেই এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোয়াম চমস্কির (Chomsky) সাথে বিতর্কে মিশেল ফুকো জানিয়েছিলেন সে কথা। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কি মনে করেন, উন্নত দেশগুলোতে যে সমাজ রয়েছে তা গণতান্ত্রিক সমাজ?’ উত্তরে ফুকোর স্পষ্ট জবাব ছিল, ‘না, আমার মধ্যে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই যে, আমাদের সমাজকে কোনভাবে ‘গণতান্ত্রিক’ বলা যেতে পারে’ (No, I don’t have the least belief that one could consider our society democratic) । তারপরই তিনি ক্ষমতার প্রসঙ্গটি যোগ করলেন গণতন্ত্র-আলোচনার সাথে। ‘যদি গণতন্ত্র বলতে শ্রেণি-বিভক্তিহীন বা উচ্চ-নীচ ভেদাভেদহীন এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দ্বারা ক্ষমতার কার্যকরী প্রয়োগকেই বোঝানো হয়, তাহলে বলতেই হবে যে সেই গণতন্ত্রের থেকে আমরা যোজন যোজন দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি।’ এ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে :

‘If one understands by democracy the effective exercise of power by a population which is neither divided nor hierarchically ordered in classes, it is quite clear that we are very far from democracy. It is only too clear that we are living under a regime of a dictatorship of class, of a power of class which imposes itself by violence, even when the instruments of this violence are institutional and constitutional; and to that degree, there isn’t any question of democracy for us.’

ফুকোর এই চিন্তাধারাকে অনেকেই ‘চরমপন্থি’ অবস্থান বলে চিহ্নিত করবেন। এ রকম গণতন্ত্র পৃথিবীতে কোথায়ই বা আছে, বলবেন তারা। কেউ কেউ এর মধ্যে ‘নৈরাজ্যবাদ’-এর ছায়া দেখবেন। ফুকো অবশ্য বলবেন, নতুন ধারার চিন্তা-পদ্ধতিকে দূরে সরিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এসব লেবেলিং বা তকমার প্রয়োগ এক সনাতনি ‘ধূর্ত কৌশল’ কেবল। ‘আমাদের সমাজ এক অদ্ভুত অসুখে ভুগছে- এই অসুখের উপসর্গ দেখতে পাচ্ছি কেবল। কিন্তু এর নাম আমরা জানি না।’ ফুকোর বর্ণিত এই ‘অদ্ভুত অসুখ’-এর সাথে জীবনানন্দীয় ‘অদ্ভুত আঁধার’-এর আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে।

টিকা

১। ‘ক্ষমতার ভিন্ন পাঠ :মার্কস প্রসঙ্গে ফুকো’, সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র, ৭ম সংখ্যা, ২০১৪। [এই পর্ব সমাপ্ত]

[তুমুল গাঢ় সমাচার ২১] ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিশেল ফুকো :মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা (Foucault and Micro-power)

পর্ব ::২১

ফুকো অত্যন্ত নরমভাবে এই অভিযোগটা উত্থাপন করেছেন তাদের প্রতি :’When we say that sovereignty is the central problem of right in western societies, what we mean basically is that the essential function of the discourse and techniques of right has been to efface the domination intrinsic to power in order to present the latter at the level of appearance under two different aspects : on the one hand, as the legitimate rights of sovereignty, and on the other, as the legal obligation to obey it.’ ফুকো এই সম্পর্ককে একটি ত্রিভুজের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন :’ক্ষমতা, অধিকার ও সত্য’।

তবে, এ কথা ঠিক যে, ফুকো ম্যাক্রো পাওয়ার সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন না। রাষ্ট্র-ক্ষমতার ‘ক্ষমতা’ কীভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, প্রজাতন্ত্রের প্রজারা কতটা অধিকার ভোগ করছে, প্রজাতন্ত্রের সাথে তন্ত্রের বা ভাবাদর্শের ভূমিকা কী- এসব নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন না। তার আগ্রহের জায়গা ছিল অন্যত্র।

৩. মাইক্রো পাওয়ার নিয়ে ফুকোর পাঁচটি উপদেশ

১৯৭৬ সালের ১৪ জানুয়ারি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুকো একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন ‘মাইক্রো পাওয়ার’ বিষয়ে। সেখানে তিনি ম্যাক্রো পাওয়ার তথা রাষ্ট্র-ক্ষমতার ‘ক্ষমতা’কেন্দ্রিক আলোচনা সম্পর্কে তার নিরুৎসাহের কথা জানান। উদ্ৃব্দতিটি বড়। মূল ভাবটি অক্ষুণ্ণ রেখে আমার অনুবাদ নিচে তুলে ধরছি :

‘মধ্যযুগ থেকে অধিকারের ভাষায় ডিসকোর্স নির্মাণের যে রীতি চলে আসছে, গত কয়েক বছর ধরে সেই ধারাকে বদলে দেওয়াই ছিল আমার গবেষণার উদ্দেশ্য। আগের গবেষণা পদ্ধতিকে আমি উল্টে দিতে চেয়েছিলাম। অধিকার নয়, প্রভুত্ব করাই ছিল এর প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য- এটা দেখাতে চেয়েছিলাম এবং সেই সাথে এর নিষ্ঠুরতার দিকটিও। আমি আরও দেখাতে চেয়েছি কীভাবে আধিপত্য বিস্তারের ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে অধিকারের ডিসকোর্স কাজ করে। অধিকারের ডিসকোর্স শুধু আইন নয়, এর প্রয়োগের সাথে নানা অ্যাপারেটাস, প্রতিষ্ঠান এবং বিধিমালা জড়িত। আধিপত্য বলতে আমি কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ গ্রুপ/দলের আধিপত্য-বিস্তারকে বোঝাচ্ছি না। বরং সমাজের মধ্যে চলতে থাকা বিভিন্ন ধরনের আধিপত্য-আনুগত্য সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করছি। কেন্দ্রীয় আসনে বা সিংহাসনে থেকে রাজা যে আধিপত্য দেখান, সে সম্পর্কে কিছু বলার নেই আমার নতুন করে; কিন্তু যারা তার প্রজা তাদের মধ্যেও পরস্পরের প্রতি আধিপত্য-আনুগত্য সম্পর্কের যে বিচিত্র সমাবেশ দেখতে পাই, তা আমাকে আকর্ষণ করে।’

এক কথায়, প্রচলিত রাষ্ট্রনৈতিক মতের উদ্দেশ্য ছিল ‘সার্বভৌমতা-বশ্যতা’র সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রদান। অন্যদিকে ফুকোর উদ্দেশ্য ছিল ‘আধিপত্য-আনুগত্য’র সম্পর্কের বিশ্নেষণ করা। এ জন্য তিনি পাঁচটি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন ১৯৭৬ সালের বক্তৃতায়, যা থেকে তার দার্শনিক মতের মূল দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ক. প্রথম উপদেশ

প্রথমত, ক্ষমতাকে তার প্রধান প্রয়োগের ক্ষেত্র, অর্থাৎ রাষ্ট্র-ক্ষমতা প্রয়োগের বাইরেও অনুসন্ধান করতে হবে। যে ক্ষমতা আইনগত সিদ্ধ, যার পেছনে যথাযথ বিধিমালা ও আইন-কানুনের ভিত্তি রয়ে গেছে, সেই ক্ষমতার অনুশীলনের ধরন-ধারণা পরিস্কার। সেখানে নতুন কিছু গবেষণা কাজের সুযোগ সামান্যই। ট্রাফিক পুলিশ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে ক্ষমতার প্রয়োগ করবে, পুলিশ বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট হলে ক্ষমতার প্রয়োগ করবে, সামরিক বাহিনী দেশের অখণ্ডতা রক্ষার্থে ক্ষমতার প্রয়োগ করবে, জনপ্রশাসনের আমলারা উন্নয়নের স্বার্থে ক্ষমতার প্রয়োগ করবে; তার ন্যায্যতা প্রচলিত আইন এবং বিধিমালা দ্বারা মোটামুটি স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। অন্তত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। কিন্তু যে ক্ষমতা চোখের আড়ালে রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। এর জন্য রাষ্ট্র-যন্ত্রের বাইরে, লিবারেল ডিসকোর্সের ‘অধিকারের ভাষা’য় কথা বলার ট্র্যাডিশনের বাইরে গিয়ে, ক্ষমতা কীভাবে কাজ করছে তার তত্ত্ব-তালাশ হওয়া দরকার। শরীরের ভেতরে রক্তপ্রবাহ বড় বড় শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত হয়, তা-ই নয়; শরীরের প্রান্ততম বিন্দুতে (উপশিরা বা ক্যাপিলারি) রক্তপ্রবাহ রয়েছে। এবং ‘ক্যাপিলারিগুলো’ ঠিকমতো কাজ না করলে শরীরের সেসব স্থান বিপর্যস্ত হতে পারে। রাষ্ট্রকে শুধু যদি রাষ্ট্র-যন্ত্রের সমার্থক না ধরি, গোটা সমাজের বৃহত্তর অর্থে যদি তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে ক্ষমতার প্রবাহ শুধু মূল রাষ্ট্র-যন্ত্রের মাধ্যমে নয়, সমগ্র সমাজ-শরীরের প্রান্ততম বিন্দু তথা শিরা-উপশিরা ‘ক্যাপিলারি’ পর্যন্ত কীভাবে তা সঞ্চালিত হচ্ছে, তারও প্রকৃতি অনুধাবন করতে হবে।

ক্ষমতার ‘কেন্দ্র’ থেকে ‘প্রান্তে’ দৃষ্টি ফেরানোর এই ডাকের অর্থ দ্বিবিধ। এক, জেলা-উপজেলা, শহর বা স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাকে অবলোকন করতে হবে। কেননা, প্রাত্যহিক জীবনে এসব পর্যায়েই মানুষকে ক্ষমতার মুখোমুখি হতে হয়। রাষ্ট্রের ‘উপরের দিকে’ যতই আইন-কানুন ও বিধিমালার যুক্তি দেখানো হোক না কেন, যত ‘নিচের দিকে’ যাওয়া যায়, ততই তার ‘আইনের বাইরের চেহারাটা’ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণ, জেল-কোড বা ‘পাগলা গারদ’ নিয়ে যত আইন-বিধিমালাই লেখা হোক না কেন, এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করে বা ক্ষমতার প্রয়োগ করে (বা চলতি ভাষায়, ‘ক্ষমতা ফলায়’) তা কেবল আইনের নিরিখে বা আইনি ডিসকোর্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠান একদিনে গড়ে ওঠেনি। প্রাচীন গ্রিক-রোমান যুগ, মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগ অবধি এসব প্রতিষ্ঠান শাস্তি ও কয়েদ করে রাখার নিয়ম-পদ্ধতিতে (ইনস্ট্রুমেন্ট/টেকনিক) অনেক পরিবর্তন এনেছে। বিভিন্ন যুগের জেলখানা বা পাগলা গারদ বিভিন্ন রকম ছিল, এমনকি স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও। মানব-সভ্যতায় ‘শাস্তির ইতিহাস’ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাতে তথাকথিত বর্বরতম পদ্ধতি অনুসরণ করা থেকে শুরু করে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ কিন্তু আরও ফলপ্রসূ শাস্তির ‘আধুনিক পদ্ধতি’ অনুসরণ করা হচ্ছে। আধুনিক পুঁজিবাদ শাস্তির নিত্যনতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে, সেটা আমরা জানি (ওয়াটার বোর্ডিং, ট্রুথ-সিরাম প্রভৃতি ‘টেকনিক’-এর কথা শুনে থাকব)। ফুকোর কথা হলো, এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যুদয়, বিবর্তন এবং তাদের আধুনিক পরিণতি নিয়ে আলাদাভাবে ইতিহাসনির্ভর বিচার-বিশ্নেষণ করা দরকার। এক কথায়, ক্ষমতা যেখানে শরীরের সংস্পর্শে আসছে, যেখানে সে শরীরকে আহত করছে বা গড়ে-পিটে নিচ্ছে, ক্ষমতা-প্রয়োগের সেই চরম-বিন্দুতে (যেখানে আইনের বাধ্যবাধকতার প্রভাবও তুলনামূলক কম), সেখানে তাকে অবলোকন করা দরকার। ফুকোর কথায় :’In other words, one should try to locate power at the extreme points of its exercise, where it is always less legal in charactcr.’

খ. দ্বিতীয় উপদেশ

ফুকোর দ্বিতীয় পদ্ধতিগত মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বিশেষ যুগের বা দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে একটা সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে- রাজা কেমন ছিলেন, রাজার বিশ্বাস বা ধ্যান-ধারণা কী রকম ছিল, আসল রাজ-ক্ষমতা কি রাজার হাতে, নাকি পারিষদবর্গের হাতে, নাকি রাজার পরিবারের হাতে ছিল, রাজা তার রাজ-ক্ষমতার যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন তার উদ্দেশ্য কি ছিল রাজকোষের সম্পদ-বৃদ্ধি, নাকি জনসাধারণের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন ইত্যাদি রাজকাহনে লিপ্ত হওয়া। ফুকো এটাকে অস্বীকার করছেন না, কিন্তু তিনি বলছেন পাঠককে- ‘আমি এ ধরনের বিচার-বিশ্নেষণের পদ্ধতিতে আগ্রহী নই।’ ক্ষমতা-প্রয়োগকারী রাজার বা রাজশক্তির ‘মনে’ কী ছিল, তার ‘মহান অভিপ্রায়’-এর পেছনে সময় নষ্ট না করে বরং দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক প্রজাদের অবস্থার প্রতি। প্রাত্যহিক জীবনে মানুষ কীভাবে ‘অধীনস্থ প্রজা’য় পরিণত হচ্ছে; কী সব বৈষয়িক-মানসিক-দৈহিক-আদর্শিক-স্বাপ্নিক চাপের মুখে তারা ক্রমান্বয়ে রাজশক্তির বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছে; এবং বশ্যতার জীবনের মধ্যেই তাদের ‘সাবজেক্টিভিটি’কে সীমিত করে ফেলেছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, চেতনে বা অবচেতনে; এটা পরিস্কার করাই ছিল ফুকোর লক্ষ্য। ফুকো বলছেন, “আমার এই গবেষণা-প্রকল্প হবস্‌-এর ‘লেভিয়াথান’ সংক্রান্ত প্রকল্পের ঠিক বিপরীত। হবস্‌ যেখানে বুঝতে চাচ্ছেন কীভাবে অসংখ্য মানুষের বিভিন্ন ব্যক্তিগত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা থেকে ক্রমশ ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র স্পিরিটের উদয় হয়, আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এর উল্টোটা দেখানো। কীভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সামনে অসংখ্য মানুষ ক্রমশ পরাধীন-অধীনস্থ প্রজার অবস্থান স্বীকার করে নেয়, সেই শোচনীয় পরিণতিকে প্রত্যক্ষ করা।”

গ. তৃতীয় উপদেশ

এখান থেকেই তৃতীয় পদ্ধতিগত অনুসিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে। অধীনস্থ প্রজায় পরিণত হওয়া (যাকে ফুকো বলেছেন, ‘সাবজুগেশন’) ব্যাপারটা একপেশে নয়। অর্থাৎ, ‘উপর থেকে’ ক্ষমতার প্রয়োগ করা হচ্ছে, আর স্বাধীন সার্বভৌম মানুষ ক্রমশ তার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে একান্ত বিশ্বস্ত, অনুগত ও বাধ্যগত প্রজায় পরিণত হচ্ছে- বিষয়টা শুধু এ রকম নয়। প্রজারাও এই পরিণতির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। ফুকো বলেছেন, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে প্রজারা নিজেরাই ‘ক্ষমতার বাহক’ (Vehicles of Power) হয়ে পড়ছে। ক্ষমতা যদি শুধু রাজার হাতেই থাকত, তাহলে প্রজাদের বশ মানানো সহজ হতো না। ক্ষমতা একটা ‘নেটওয়ার্কের মতো’, মাকড়সার মতো বিচিত্র তন্তুজাল বিছিয়ে ক্ষমতা প্রতিটি ব্যক্তিকে ধারণ করে আছে অবস্থা-বিশেষে। সবাই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে, আবার অবস্থা-বিশেষে ক্ষমতার কাছে বশ্যতাও স্বীকার করছে। কর্মরত অবস্থায় একজন রাজ-কর্মচারীর প্রবল প্রতাপ, আর অবসরে যাওয়ার পর সেই একই ব্যক্তির অসহায় ক্ষমতাহীনতা এর একটি উদাহরণ। যিনি বিরোধী দলে থেকে রাষ্ট্র-যন্ত্রের নির্বিচার ক্ষমতা প্রয়োগের সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ, তিনিই আবার সরকারে গিয়ে সেই সমালোচনার কথা ভুলে যান। ফলে, ক্ষমতা প্রয়োগের ধারায় বড় আকারের কোনো সংস্কার আনা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফুকো মনে করেন, আধুনিক পুঁজিবাদী (এবং প্রথাগত সমাজতন্ত্র) দেশে ব্যক্তিসত্তা আর ব্যক্তির অধীনে নেই। এটি প্রায় পুরোপুরি ক্ষমতার অধীন Subjugated সত্তায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তির শরীর, তথাকথিত নিজস্ব স্টাইল, প্রেম-অপ্রেম, দেহভঙ্গি-মনোভঙ্গি, ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, তর্কালাপ, দর্শন, তার লেখার বিষয়বস্তু, আড্ডাস্থল, আড্ডার ধরন-ধারণা, উপন্যাসের ফর্ম, কবিতার চিত্রকল্প; এমনকি তার স্বপ্ন, ঘুমের ভেতরে হিজিবিজি প্রলাপ, নিদ্রা ও অনিদ্রার কাল, জাগরণের মুহূর্ত ও জীবিকা অন্বেষণ আজ ‘ক্ষমতার চক্ষু’র অধীনে। যদি মনে রাখি, মিডিয়াও রাজ-ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র, তাহলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ব্যক্তি হয়তো ভাবছেন, তিনি নিজের ইচ্ছায় কর্মে লিপ্ত, কিন্তু তার জাগতিক ক্রিয়া-কলাপের ছকটা আগে থেকেই সাজানো রয়েছে। সে নিজেই ক্ষমতার এই ছকে আগ্রহী কুশীলব, একজন সক্রিয় পার্টনার। হয়তো তার অস্তিত্ব-রক্ষার স্বার্থেই।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ২০] ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিশেল ফুকো :মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা (Foucault and Micro-power)

পর্ব ::২০


নতুন প্রসঙ্গ

১. ক্ষমতার ‘প্রাণভোমরা’

ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো তার বিভিন্ন আপ্তবাক্যের জন্য বিখ্যাত। তার মধ্যে একটি হলো- ‘যেখানেই ক্ষমতা [রাজ করে], সেখানেই [তার বিরুদ্ধে] প্রতিরোধ গড়ে ওঠে’। সমস্যাটা জটিল, কেননা আমরা জানি শেষ পর্যন্ত এ খেলার পরিসমাপ্তি কোথায়। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। যতদিন প্রতিরোধ প্রতিবাদী অবস্থায় থাকে, ততক্ষণ সে ঠিক পথে চলছে। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সাথে সাথে তার চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে। কেন এমন হয়, সেটা জানার জন্যই ফুকোকে পাঠ করা দরকার।

ক্ষমতা অর্থাৎ Power বিষয়টিকে ফুকো যেভাবে দেখেছেন, যত বিভিন্ন উপায়ে তার বিশ্নেষণ করেছেন, সেভাবে এর আগে কোনো দার্শনিকই ব্যাখ্যা করেননি। মার্কস যেমন পুঁজির রহস্য-উন্মোচনের জন্য পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, ফুকোও তেমনি ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার সব কথা মানতেই হবে এমন নয়। এ নিয়ে আরেক ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদার সাথে তার উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জার্মান দার্শনিক জুরগেন হাবেরমাসের সাথেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সবাই এ কথা মানছেন, তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্সিস বেকন ভেবেছেন, ‘নলেজ ইটসেল্কম্ফ ইজ পাওয়ার’। আমাদের বিদ্যালয়ে এখনও পড়ানো হয়, লেখাপড়া করলে গাড়ি-ঘোড়ার মালিক হওয়া যায়। ফুকো এসব অস্বীকার করবেন না। তিনি শুধু বলবেন, কোনটা ‘জ্ঞান’ আর কোনটা ‘অজ্ঞান’ এটা ঠিক করেছে কে? এই জ্ঞান, এই সত্য, অদৃশ্য ক্ষমতাবলয়ের বশীকরণ মন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত বিকৃত, আচ্ছন্ন হয়ে নেই তো? ফুকো এ রকম ভাবছেন, কেননা তিনি মনে করেন যে, জ্ঞান উৎপাদন ও জ্ঞান বণ্টনের প্রক্রিয়া যতটা নিরীহ ভাবি আমরা, আসলে সেসব আদৌ নিরীহ নয়। এক রক্তাক্ত সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে তবেই জ্ঞান তৈরি হচ্ছে। কোন মত ‘সত্য’ বলে স্বীকৃত হবে, আর কোন মতকে ‘সৃষ্টিছাড়া’ বলে বর্জনীয় ঘোষিত হবে, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। ফুকো এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে [অসংখ্য পরীক্ষক প্রতিদিন আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন]… সেখানে স্কুলের শিক্ষক পরীক্ষকের ভূমিকায়, ডাক্তার পরীক্ষকের ভূমিকায়, চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদ পরীক্ষকের ভূমিকায়, সমাজ-কর্মী পরীক্ষকের ভূমিকায়। এরা সবাই মিলে কোনটা স্বাভাবিক রীতিসম্মত তার একটি রাজত্ব (Reign of normality) তৈরি করেছে। এই পরীক্ষকের কাছে প্রতিটি ব্যক্তিকে তার শরীরের আচরণ, তার আচার-ব্যবহার, তার দক্ষতা, তার অর্জন সব কিছুকে অধীনস্থ করেই তবে তাকে বাঁচতে হচ্ছে।’ ফুকো এই অদৃশ্য ও দৃশ্যমান ‘পরীক্ষকদের’ থেকে আমাদের বাঁচাতে চান।

‘পাথরের কোরাস’ কবিতার শুরুর স্তবকেই টি. এস. এলিয়ট বলেছিলেন যে, জ্ঞানরাজ্যের অরণ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি:

Where is the life we have lost in living?
Where is the wisdom we have lost in knowledge?
where is the knowledge we have lost in information?

এলিয়ট জ্ঞানরাজ্যের অন্ধকার দিকের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীয় সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেননি। প্রত্যাশা করেছেন দৈবপ্রেরণার, যেখানে অপেক্ষা করে আছে। ইমানুয়েল কান্ট যাকে বলেছিলেন ঊঃবৎহধষ চবধপব- এক অনন্ত শান্তির কাল। ফুকোর মধ্যে সেই দিব্যোন্মাদ চাহনী নেই। কেননা তার চোখে, দেবতারা যেমন, ‘মানুষ’ বলতে আমরা যা ভাবি তা প্রতিনির্মিত হয়ে চলেছে। এবং এ কাজটি করেছে রাজাধিরাজ ক্ষমতা ও তার কথিত পরীক্ষকবৃন্দ। এ জন্যই ফুকো কী বলছেন তা গুরুত্বের সাথে শোনা জরুরি।

ক্ষমতা বিষয়ে ফুকোর আলাপকে (যাকে তিনি বলেছেন ‘ডিসকোর্স’, এ শব্দটি তারই উদ্ভাবন) কয়েকটি শিরোনামে ভাবা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাওয়ার, ‘ডিসিপ্লিনারি’ পাওয়ার, নরমালাইজিং পাওয়ার, ‘বায়ো পাওয়ার’ ইত্যাদি। এসব ধারণা ফুকোর বিভিন্ন পর্যায়ের লেখায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ আমি বলতে চেয়েছি, ক্ষমতা প্রসঙ্গে ফুকো চিরকাল এক রূপ ভাবতেন না। আমি এখানে ফুকোর মাইক্রো পাওয়ার ধারণার কিছুটা আলোচনা করব।

ফুকোর মাইক্রো পাওয়ারের ধারণা বোঝাতে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র একটি রূপকথাকে স্মরণ করা যেতে পারে। দৈত্যাকার ক্ষমতাকে সম্মুখ বা গেরিলা যুদ্ধে পরাস্ত করা অসম্ভব। কেননা, দৈত্যের ‘প্রাণভোমরা’ লুকিয়ে আছে অন্যত্র। গহীন বনের নির্জনতম সরোবরের তলদেশে, যেখানে রাখা একটি রুপোর কৌটো এবং যার ভেতরে বাস করে সেই প্রাণভোমরা। যদি সেই কৌটো খুঁজে পাওয়া যায় এবং একটি একটি করে সেই ভোমরের হাত-পা-ডানা ছিঁড়ে ফেলা যায়, তবেই সে দৈত্যের ধ্বংসসাধন সম্ভব। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার স্বৈরাচারকেও সেভাবে ছাড়া পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষমতার ‘প্রাণভোমরা’ ছড়িয়ে আছে নানা স্থানে- সরোবরের তলদেশে শুধু নয়, সমাজ-শরীরের সর্বত্র :বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক, জেলখানা, বিচারালয়, পত্রিকার অফিস, টিভি চ্যানেল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-এনজিও, উপাসনালয়, পাড়ার ক্লাব, মহল্লার সংগঠন, পরিবারের অভ্যন্তর, এমনকি ব্যক্তিসত্তার মধ্যেও। এসব অপ্রত্যাশিত স্থানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ক্ষমতার ফুটপ্রিন্ট! অর্থাৎ ফুকো এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, সর্বত্র অশুভ ‘ক্ষমতা-চর্চা’র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করতে পারলে শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতা বদলে সর্বাত্মক পরিবর্তন আসবে না, বা এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

২. ম্যাক্রো বনাম মাইক্রো পাওয়ার :

সাধারণত আমরা ‘পাওয়া’র বলতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা বা রাজ-ক্ষমতাকে নির্দেশ করে থাকি। এই ক্ষমতা ‘ওপর থেকে’ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এই ক্ষমতা যিনি ‘রাষ্ট্রের প্রধান’ (যেমন রাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী), তারই শুধু চর্চার বিষয় নয়, তার অধীনস্থ রাষ্ট্র-যন্ত্র (প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, বিধিমালা, আইন-কানুন) এই চর্চার অংশ। আধুনিক রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রয়োগ ও পরিধিকে ঘিরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এক আইনি আলোচনা গড়ে উঠতে থাকে। যাকে ফুকো বলেছেন ‘লিগ্যাল-জুরিডিক্যাল ডিসকোর্স’। এই আলোচনার মূল মনোযোগ ছিল রাষ্ট্র-ক্ষমতার পরিধিকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপণ করা। রাজা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারবেন না। তেমনি, প্রজারাও সকল অধিকার ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে না। এভাবে রাজা ও প্রজার মধ্যে যার যার অধিকার নির্দিষ্ট করে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি সাংবিধানিক ও আনুষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও নাগরিকদের যার যার অধিকার রক্ষাপূর্বক ক্ষমতা-প্রয়োগের স্বীকৃত কাঠামোকে নানা ধরনের রক্ষাকবচ দিয়ে আরো যুক্তিসিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। উদাহরণত, ট্রাম্পের শাসনামলে প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প তার ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। সেখানে কংগ্রেস-সিনেটের অনেক নিয়ম-নীতির রক্ষাকবচ রয়ে গেছে। তার ওপরে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের অলঙ্ঘনীয় ছায়া রয়েছে। তারপরও সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের বিধিমালা ও আইন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের (আইন-প্রণয়ন, বিচার ও প্রশাসন) মধ্যে দায়িত্ব-বণ্টন, সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি, বিভিন্ন দপ্তর-মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে মাঝে মাঝেই ‘টেনশন’ সৃষ্টি হয় এবং তা নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বলা দরকার, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা ‘অধিকারের ভাষায়’ (Rights based discourse) নির্মিত ক্ষমতা-প্রয়োগের এই ডিসকোর্সকে ফুকো অস্বীকার করছেন না। এই ক্ষমতা-প্রয়োগের অংশ হিসেবে মার্কস, গ্রামসি বা আলথুসার যখন ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস অব স্টেট’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন, সেটিকেও ফুকো অস্বীকার করছেন না। তিনি শুধু বলছেন, সুদূর প্রাচীন বা মধ্যযুগেও রাজশক্তি যে টিকে ছিল, তা শুধু কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়নি। আধিপত্য বিস্তার (ডমিনেশন) যেমন তাতে ছিল, তেমনি ছিল আধিপত্য-প্রয়োগের ন্যায্যতা সম্পর্কে ‘সত্যের প্রচার’। উল্লেখ্য, ফুকোর ‘রিজিম অব ট্রুথ’ এবং গ্রামসির ‘হেজিমনি’ ধারণার মধ্যে মিল আছে। তবে সব রিজিম অব ট্রুথ সর্বেশ্বরতা পায় না। অর্থাৎ হেজিমনিক স্তরে যেতে পারে না। তবে সব রাজাকেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সত্যের প্রচার করতে হয়েছে কম-বেশি। ফুকো বলেছেন, ÔRight in the west is the king’s Right … [The] resurrection of Roman law [in the 12th century] was the major event around which, and on whose basis, the juridical edifice which had collapsed after the fall of the Roman Empire was reconstructed.’ রোমান ল-এর পুনর্জীবনের মধ্য দিয়ে আবার মধ্যযুগের রাজ-রাজড়াদের Ôabsolute power’ প্রয়োগের আইনি ও প্রশাসনিক দিকটির সুরাহা করা হয়েছিল। কিন্তু ফুকো বলছেন, তখনও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। যেমন, ‘মহাভারত’-এর যুগে অনুশাসন-পর্বের বিষয়বস্তু ছিল, আজকের পরিভাষায়, ‘গভর্ন্যান্স’ বা সুশাসনের প্রয়োগ-বিধির আলোচনা। অর্থাৎ রাজা বা রাজশক্তি কীভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন, রাজার অধিকার কতটুকু, প্রজাদেরই বা অধিকার কতটুকু, তাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সেখানে। কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’তে এই নির্দিষ্ট অধিকারকে বিধিমালা ও আইনের মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণত, কৌটিল্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩২ রকমের দুর্নীতি শনাক্ত করেছেন এবং তার জন্য পৃথক দণ্ডের সুপারিশ করেছেন। সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার তাগিদ না থাকলে আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী লিখতেন না। একই কথা বলা যায় ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা বিষয়েও।

আধুনিক যুগের রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা যথা হবস, লক, বেন্থাম, মিল প্রমুখ যখন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক রাজশক্তির ক্ষমতার বৈধতা, গণ্ডি বা চৌহদ্দির সীমা নির্ণয় করতে কলম ধরেছেন, সেটাও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার প্রয়োজনেই। সার্বভৌম (Sovereignty) যিনি, তার ‘ন্যায়সঙ্গত’ অধিকার কতটুকু ও কী কী- এটি যেমন তাদের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি প্রজাদেরও ‘আইনসম্মত’ অধিকার কতটুকু, সেসব আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ফুকো বলছেন, এসব আলোচনা, ডিসকোর্স তথা সত্য-উৎপাদনের মধ্য দিয়ে মূল উদ্দেশ্যটা খোলাসা করে বলা হয়নি। লিবারেল বা কনজারভেটিভ সব ধারারই পলিটিক্যাল ফিলোসফাররা যার যার মতো ‘অধিকারের ভাষা’ নির্মাণ করেছেন। কিন্তু, তারা এটা করতে গিয়ে আসলে ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’কেই আড়াল করেছেন।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৯] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৮

আমার দ্বিতীয় পছন্দ হলো, মহিউদ্দিন আলমগীরের ‘ফেমিন ইন সাউথ এশিয়া : পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাস স্টারভেশন’। এটি ১৯৮০ সালে প্রকাশিত। আলমগীর বইটি লেখেন যখন তিনি বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৭০-এর দশকে। আমার তৃতীয় পছন্দ হলো, ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত মার্টিন র‌্যাভালিয়নের ‘মার্কেটস অ্যান্ড ফেমিনস্‌’। আমার তালিকার চতুর্থ অবস্থানে আছে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ১৯৭৯ সালের প্রকাশিত ‘পলিটিক্স অব ফুড অ্যান্ড ফেমিন ইন বাংলাদেশ’- এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, প্রথম তিনটির মত বই নয় যদিও, কিন্তু চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তথা মার্কিন হস্তক্ষেপের ভূমিকার বিরুদ্ধে উন্মোচনমূলক প্রথম প্রতিবাদ (ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি সাময়িকীতে প্রকাশিত)। সবশেষে উল্লেখ করব অধ্যাপক নূরুল ইসলামের ‘দ্য বার্থ অব এ নেশন : এন ইকোনমিস্ট’স টেল’ বইটির দুর্ভিক্ষ-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদটি। এর বাইরে অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী তার একাধিক লেখায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, সেনের ‘এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টে’র তত্ত্ব এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তত্ত্বীয় দিক নিয়ে বিশদভাগে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, বাংলা ১১৭৬ সালের বা বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তর নিয়ে যেখানে গবেষণাপত্রের অপ্রতুলতা রয়ে গেছে, ইংরেজি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সে প্রেক্ষিতে- বিভিন্ন নিরিখের কাজের মধ্য দিয়েই- এক বহুল আলোচিত বিষয়।

এসব লেখা-পত্র থেকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের প্রভাবক ও কার্যকারণ সম্পর্কে যেসব প্রবণতা মোটা দাগে বেরিয়ে আসে তা নিম্নরূপ। প্রথমত, উপর্যুপরি বন্যার তীব্র আঘাত। ব্রহ্মপুত্র সে বছর যেন ফুঁসে উঠেছিল। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ছিল। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের শেষের বন্যায় আউশ ধানের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। ১৭ই জুলাই দেশের সব বড় নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে, অর্থাৎ আউশ ফসল ওঠার মৌসুমেই বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ে ধানক্ষেতে-মাঠে। এই ক্ষতিটা সামাল দেওয়া যেত আমন ধানের আবাদের মাধ্যমে। কিন্তু আউশ ধান নষ্ট হওয়ার ১৫ দিনের মাথায়- অর্থাৎ জুলাইয়ের শেষে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই পানি আবার হুহু করে বাড়তে থাকে। যেসব জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি হচ্ছিল সেগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। ১লা আগস্ট চট্টগ্রাম ও সিলেটের সাথে ঢাকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বন্যার পানি বেড়ে ওঠার কারণে। ১১ই আগস্ট নাগাদ ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের সমস্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আগস্টের মাঝামাঝি বন্যার পানি বাড়তে বাড়তে সে বছরের রেকর্ড-উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছে। এতে করে নতুন বোনা আমন ধানের একটা বড় অংশ ক্ষতির কবলে পড়ে। কিন্তু মূল আঘাতটা আসে সেপ্টেম্বরে। এ সময় বন্যার পানি ধীরে ধীরে জমার কথা। কিন্তু সে বছর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আবারো বিপদসীমা অতিক্রম করে। এতে করে আগস্ট মাসের বন্যার পরে যতটুকু আমন ধান বেঁচেছিল সেটুকুও (রোপা আমনের অধিকাংশ) বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। এ রকম উপর্যুপরি বন্যার আঘাতের পর সেপ্টেম্বরের শেষে এসে দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হওয়ার সরকারি ঘোষণা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না সেদিন।

দ্বিতীয়ত, প্রায় ৬ হাজারের মতো লঙ্গরখানা খোলা না হলে আরো অনেক মৃত্যু আমাদের দেখতে হতো। সন্দেহ নেই। তবে আরো বেশি সংখ্যায় এবং দীর্ঘদিনের জন্য লঙ্গরখানা খোলার/চালু রাখার জন্য চাই প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের মজুদ, আর সেই মজুদের সরকারি ক্ষমতা কমে গিয়েছিল সে বছর আন্তর্জাতিক তথা মার্কিন ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৩ সাল থেকেই বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য ‘সাহায্য’ (ফুড এইড) হিসেবে দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মার্কিন সরকার। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে অবস্থাটা এত গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যে, বাংলাদেশ বাধ্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে খাদ্য সাহায্যের অনুরোধ জানাতে। রাশিয়া ছিল নিজেই আমেরিকা ও কানাডা থেকে খাদ্যশস্যের এক বড় আমদানিকারক। প্রায় ২ লক্ষ টন খাদ্যশস্য রাশিয়ার ক্রীত মজুদ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে প্রেরণের জন্যে এক জরুরি অনুরোধ জানানো হয়। রাশিয়া সেই ডাকে তখন সাড়াও দেয়। নইলে, ১৯৭৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসেই সেদিন এ দেশের পাবলিক রেশন প্রদানের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ নীতির ফলে (নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র তখন রাষ্ট্র-ক্ষমতায়) সে দেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানির ধারা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের আগে থেকেই ছিল নিম্নাভিমুখী। এর ফলে ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে বাংলাদেশের মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল গড়ে মাসে ২ লাখ ৩২ হাজার টন, ১৯৭৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের মার্চ পর্যন্ত তা নেমে আসে গড়ে মাসে ৭৪ হাজার টনে মাত্র। অর্থাৎ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কয়েক মাস আগে থেকেই খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এর একমাত্র বিকল্প হতে পারত আন্তর্জাতিক বাজারে গিয়ে সরাসরি খাদ্যশস্য কেনা। কিন্তু সেখানেও খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে- ১৯৭২-৭৩ সালে যার দাম ছিল টনপ্রতি ১১৫ ডলার, ১৯৭৩-৭৪ সালে তার দাম গিয়ে দাঁড়ায় টনপ্রতি ১৯৯ ডলারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য কেনার মত যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না সরকারের হাতে সেদিন। ১৯৭৩ সালের ২য় ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল যেখানে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৪ সালের ২য় ত্রৈমাসিকে সেই রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬০ মিলিয়ন ডলারে। দুর্ভিক্ষ যখন চলছিল, সেই ৩য় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে যায়- সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ৪০ মিলিয়ন ডলারে। বাড়তি খাদ্যশস্য সাহায্য পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সেদিন খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ বাড়ানোর জন্যে। কিন্তু সে সম্ভাবনাও বানচাল হয়ে যায় যখন কিউবায় পাট রপ্তানি করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ- এই অজুহাতে খাদ্যশস্য রপ্তানি করা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলার দাবি রাখে।

১৯৭৪ সালের ২৯শে মে (এরই মধ্যে তীব্র মৌসুমী বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বিধ্বংসী বন্যা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। অকস্মাৎ ডেভিড বোস্টার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের কাছে জরুরি সাক্ষাৎকার চাইলেন। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবায় ৪০ লক্ষ পাটের ব্যাগ রপ্তানির পরিকল্পনা করছে, এ রকম খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে বলে বোস্টার জানতে পেরেছেন। এটা করা হলে মার্কিন খাদ্যশস্য ‘সাহায্যের’ নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ কোনো খাদ্য-সাহায্য পাবে না। ‘পাবলিক ল ৪৮০’ অনুযায়ী শত্রু দেশ ভিয়েতনাম ও কিউবার সাথে বাণিজ্য করা কোনো দেশ মার্কিন খাদ্য-সাহায্যের সুবিধে পাবে না। এটাই সে দেশের কংগ্রেসের বিধান। তখন বোস্টারকে জানানো হল যে, (ক) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের শোচনীয় পরিস্থিতি লাঘবের জন্যে হলেও এই পাট রপ্তানি করা দরকার, এবং (খ) চাইলে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে ‘অনুমতির অব্যাহতি’ (ওয়েভার) দিতে পারেন, বিশেষত যেখানে ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ কৃষিপণ্যই কেবল রপ্তানি করা হচ্ছে দরিদ্র বাংলাদেশ থেকে। তাতে মার্কিন পক্ষের অবস্থান নমনীয় হল না। রাষ্ট্রদূত বোস্টার সাফ জানিয়ে দিলেন, যদিও পাটের থলি হয়তো বা ‘নন-স্ট্র্যাটেজিক’ কৃষিপণ্য, তবুও প্রেসিডেন্টের কথিত ‘ওয়েভার’ মেলার কোনো সম্ভাবনাই নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের উত্তরে হতবাকই হয়েছিল। কেননা, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের পর থেকেই কিউবার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছিল এবং সে সম্পর্কে গোড়া থেকেই মার্কিন কূটনীতিবিদেরা ওয়াকিবহাল ছিলেন। তদুপরি, প্রায় একই সময়ে মিসর যখন কিউবায় রপ্তানি করছিল, তখন তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। মিসর থেকে কিউবায় তুলা রপ্তানিতে সেদিন কোনো বাধা ওঠেনি; কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানিতে সেদিন প্রবল বাধা উঠেছিল। এই রহস্যের উত্তর খোঁজাও দুস্কর নয় : কিসিঞ্জারের কাছে আনোয়ার সাদাতের ‘মিসরকে’ হাতে রাখা জরুরি ছিল। আর বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া বাংলাদেশকে চাপের মুখে রেখে নতি-স্বীকার করানোর কিসিঞ্জারী নীতি পূর্বাপর তৎপর ছিল। এ কথা ক্রিস্টোফার হিচেনস তার ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয়ত, শুধু খাদ্যশস্যের সামগ্রিক মাথাপিছু প্রাপ্যতার বিষয়টিকে চুয়াত্তরের ‘দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যা’ হিসেবে নিলে সরলীকরণ করা হবে। প্রাপ্যতা একটি নির্ণায়ক, একমাত্র, এমনকি প্রধান নির্ণায়ক নাও হতে পারে। ১৯৭৪ সালের উপর্যুপরি বন্যায় প্রচুর ফসলহানির পরেও এটা বলা যেতে পারে। যেমন, ১৯৭৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতার (উৎপাদন+আমদানি) পরিমাণ ছিল ১১.৫৭ মিলিয়ন টন, ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৩৬ মিলিয়ন টনে। মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতার পরিমান (availability) ১৯৭৩ সালে ছিল দৈনিক ১৫.৩ আউন্স, যা ১৯৭৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় দৈনিক ১৫.৯ আউন্সে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দেখলে দুর্ভিক্ষের বছরে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা এর আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি বৈ কম ছিল না। জেলা পর্যায়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিসংখ্যানও এ তথ্যকে বাড়তি সমর্থন দেয়। ১৯৭৩ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ছিল প্রায় প্রতিটি জেলাতেই (কেবল বরিশাল ও পটুয়াখালী ছাড়া)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হলো দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে উপদ্রুত তিনটি বৃহত্তর জেলায়- রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে তো যায়ইনি বরং লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এ তিনটি জেলায় মাথাপিছু খাদ্যশস্য প্রাপ্যতাও ছিল ১৯৭৩ সালের তুলনায় বেশি। এর থেকে অমর্ত্য সেন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ‘খাদ্যশস্যের সামগ্রিক প্রাপ্যতা ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকে ব্যাখ্যা করতে সামান্যই সহায়ক হতে পারে।’ সেনের মতে, সে বছর উপর্যুপরি বন্যার কারণে ভিত্তহীন গ্রামীণ শ্রেণি তথা কৃষিমজুর ও স্বল্পবিত্ত বর্গাচাষিদের কর্মসংস্থানের পরিসর সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাস্তবে কমে গিয়েছিল। সেটাকে পুষিয়ে নিতে পারত পরীক্ষিত ‘পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম’ (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বা রুরাল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ইত্যাদি)। কিন্তু শেষোক্ত ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারেনি দুই কারণে : (ক) সরকারের কাছে ঐ সিস্টেমের মধ্য দিয়ে বণ্টন করার মতো যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না; (খ) ঐ সিস্টেমটি মূলত শহর এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষদের রক্ষার জন্য রেশন-ব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারেই বেশি সচেষ্ট ছিল; (গ) ছয় হাজারের মতো লঙ্গরখানা চালু হলেও তা যথেষ্ট ছিল না ব্যাপক পরিসরে দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য।

চতুর্থত, খাদ্যশস্যের বাজারে বেসরকারি খাতের মজুদদারি প্রবণতাও খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্যকে আরো বেশি করে উস্কে দিয়েছিল। মোটা চালের দামের ইনডেক্স ((Index of retail prices) যদি ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে হয় ১০০, তা আগস্ট মাসে বেড়ে হয় ১২১, সেপ্টেম্বর মাসে তা লাফ দিয়ে চড়ে যায় ১১৫-এ, আর অক্টোবর মাসে তা আরো বর্ধিত হয়ে পৌঁছায় ১৭৮-এ। কেবল মাত্র ডিসেম্বর মাসে তা আবার নেমে দাঁড়ায় ১৩৩-এ। সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের উচ্চ ও অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধি দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৮] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৮

পূর্ব প্রকাশের পর

৩. [অসুস্থ অবস্থায় মাওলানা ইদরিস শুয়ে আছেন শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তিনি একা নন, তার পাশে দুর্ভিক্ষে না খেতে পেরে মারা যাচ্ছে এমন অনেকেই শুয়ে আছে। এদেরকে আলাদা করা হয়েছে। এরপর শোনা যাক হুমায়ূনের বর্ণনায়]

‘হাসপাতালে রোগীর জায়গা নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা কিছু সাহায্যের চেষ্টা করছে। সেই সাহায্য কোনো কাজে আসছে না। মাওলানাকে সকালবেলা একটা রুটি দেওয়া হয়েছে। মাওলানা রুটি খাননি। রুটি চারপাশে পড়ে আছে, সেখানে পিঁপড়া উঠেছে। মাওলানা আছেন প্রবল ঘোরে। সারাক্ষণই তার মনে হচ্ছে মাথার ভেতর দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।’

[এরপর একটু যখন ভালো হবেন মাওলানা ইদ্রিস স্বয়ং ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসায়, তার দেখা হয়ে যাবে তরুণ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। তিনি তখন ‘গণদেবতা’ লিখছেন। যিনি কখনও হাদিস-কোরানের বাইরে কোনো গল্প-উপন্যাস পড়েন নাই, তাকে তারাশংকর পড়ে শোনাবেন ‘গণদেবতা’ স্তবক : ‘সোঁ সোঁ শব্দে প্রবল ঝড়। ঝড়ে চালের খড় উড়িতেছে, গাছের ডাল ভাঙিতেছে। বিকট শব্দে ওই কার টিনের ঘরের চাল উড়িয়া গেল।’ এ যেন গল্পের মধ্যে গল্প …]

১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এর প্রভাব সারা বাংলাতেই অনুভূত হয়েছিল। অমর্ত্য সেন তার পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন বইতে লিখেছেন যে, এই দুর্ভিক্ষ অগ্রসর হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় বিস্তৃত ছিল ১৯৪২-র শুরু থেকে ১৯৪৩-র মার্চ পর্যন্ত, যখন আদিগন্ত দুর্ভিক্ষের নগ্ন পদধ্বনি শোনা গেছে। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৪৩ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলেছে; এই পর্বে অনাহারে গ্রাম-বাংলার মানুষ মরতে শুরু করছিল। বিভৃতিভূষণের অশনি-সংকেত প্রথম পর্যায় থেকে শুরু হয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায় চলেছে ১৯৪৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৪ সালের শেষ নাগাদ। এই পর্যায়ে খাদ্য-সংকট পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মৃত্যুর হার কমার পরিবর্তে ক্রমেই বেড়ে চলছিল। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের ‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত’ জেলাদের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলী। ‘মাঝারি ক্ষতিগ্রস্ত’ এলাকার মধ্যে ছিল যশোর, খুলনা ও বরিশাল আর ‘সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত’ জেলাগুলোর মধ্যে ছিল রংপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, নদিয়া প্রভৃতি। অর্থাৎ এ তালিকা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিশেষভাবে পীড়িত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের জেলাগুলো। জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা, ঔপনিবেশিক সরকারের চাল মজুদ করার নীতি বা তথাকথিত ‘ডিনায়েল পলিসি’, চালের পণ্যবাহী ছোট-মাঝারি নৌকাগুলো (১০ জনের বেশি লোক উঠতে পারে এমন সব নৌকা) ধ্বংস করে ফেলা এসবই পূর্ববঙ্গের স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যাভাব বাড়িয়ে দিয়েছিল ও দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশরা নিজেরাই তাদের তৈরি উনিশ শতকের ‘ফেমিন কোর্ড’ অনুসরণ করেনি। করলে, পঞ্চাশের মন্বন্তর সহজেই এড়ানো যেত। শেষ পর্যন্ত এ রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন অমর্ত্য সেন।

সংকটটা আরও সহজে সমাধান করা যেত যদি প্রাদেশিক সরকার আরও সচেষ্ট হতো। বাংলায় তখন খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার। সুব্রত রায়চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের… জনবিরোধী কার্যকলাপের পাশাপাশি… নাজিমুদ্দিন সরকারও মুনাফার মৃগয়ায় মেতে ছিল। এই সময়ে ৬ টাকা বেশি দরে খাদ্য বিক্রি করে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার… ৭৫ লাখ টাকা মুনাফা করে। বেঙ্গল মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইস্পাহানীকে সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় চাল বাংলা থেকে সংগ্রহের জন্য। দুর্ভিক্ষ পরবর্তী ফেমিন কমিশনের কাছে ইস্পাহনী ঐ মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, ১৯৪২ সালের মে মাসের মধ্যেই দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ‘চল্লিশ হাজার মণ’ চাল কিনে তিনি যুদ্ধের জন্য মজুদের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ১৯৪৩ সালের মে মাস নাগাদ এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ‘২,৩৫,৫৫৭ মণ’, যা ইস্পাহানী প্রতি মণ ১৪ টাকা ১২ আনা ৭ পাই দরে বাংলা সরকারের কাছে বিক্রি করেছিল- যখন বাজার মূল্য ছিল ৩২ টাকা মণ। এতে করে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, দুর্ভিক্ষে যখন লোক মারা যাচ্ছে, তখন এত পরিমাণ চাল মজুদ করার অর্থ কী? বোঝাই যাচ্ছে, চার্চিলকে তো বটেই, তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারকেও কিছুটা দায়-দায়িত্ব নিতে হবে এই দুর্ভিক্ষ নিবারণে ব্যর্থতার জন্য। বেঙ্গল মুসলিম লীগ রিলিফ কমিটির সম্পাদক চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি পেছনে রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব না এড়ানোর জন্য লীগ নেতৃবৃন্দকে পরোক্ষভাবে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এলা সেনের পূর্বোক্ত বইটি থেকে তা তুলে দিচ্ছি :

From March or April this year (1943) People began to starve because rice had disappeared from the market and the black market rate was so high… it was beyond the reach of the people… Many people had to quit their villages in search of food in the town; these who remained in the villages had to perish… Bengal is threatened with physical extinction and moral collapse. Where will be the Muslim League if hundreds of thousands of Muslims die? What will be the meaning of Pakistan where there will be skeleton-like sub-humans in desolate villages?

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের নিয়ে কি কাঙ্ক্ষিত আদর্শের ‘পাকিস্তান’ গড়ে তোলা যাবে? এই ছিল চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রশ্ন। পরবর্তীতে, দেশভাগের পর মুসলিম লীগ যে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল তারও পেছনে ছিল সাধারণ জনমানুষের খাদ্য-সংকটের যথাযথ মোকাবেলা না করতে পারার ব্যর্থতা। সেটি আমরা বদরুদ্দিন উমরের ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’র সুবাদে অনেক আগেই জেনেছি।

তবে সরকারের বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমাজের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় অনেকেই দুর্ভিক্ষের মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিলেন। চট্টগ্রাম ছিল অত্যন্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা। সেখানে পুর সমাজ, বিশেষত প্রগতিমনা অংশের উদ্যোগে দুর্ভিক্ষ-নিবারণের চেষ্টা হয়েছিল। ‘নিচের থেকে উদ্যোগের এই উদাহরণগুলোকে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা দরকার, এতে করে দুর্যোগ প্রতিরোধে পুর সমাজের সম্ভাব্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার দিকটি স্পষ্ট হবে। সব কিছুর জন্য- অনুদান থেকে বিদ্যাদানের প্রয়োজন অবধি- রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভর করার ধারা এক রুগ্‌ণ মানসিকতার পরিচায়ক। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর স্মৃতিচারণ ‘স্মৃতির সন্ধানে’ গ্রন্থটির বিরল একটি অধ্যায়ের নাম ‘যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের খণ্ডচিত্র’। তরুণ মাহবুব উল আলম লিখছেন : ‘ইতোমধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শহরে তিনটি লঙ্গরখানা খুলি এবং কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত বেবি হোমেও নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। … দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণকার্য চালাতে গিয়ে আমি কমিউনিস্ট পার্টির আরও নিকটবর্তী হয়ে ওঠি। … এ ছাড়া আগে থেকেই আমার মামার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কল্পনা দত্ত, কল্পতরু সেনগুপ্ত … প্রমুখ কীর্তিমান পার্টি নেতাদের সঙ্গে। … একদিন মা প্রস্তাব করলেন [একজন প্রতিবেশী হিন্দু রমণী যাকে মাতৃহারা মাহবুব উল আলম ‘মা’ বলে ডাকতেন এবং যিনি ভাবতেন ‘পূর্বজন্মে’ মাহবুব নিশ্চয়ই ‘ব্রাহ্মণ ছিলেন’] চল দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্যার্থে আমরা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি। … সবাই দুর্ভিক্ষের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি নতুন মায়ের নির্দেশে কয়েকদিনের মধ্যে একটি নাটক খাড়া করলাম। দুর্ভিক্ষের ওপর বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ … নাটকের কোনো কপি ছিল না। ফলে এই নাটক রচনায় আমি কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সাহায্য নিয়েছিলাম, মনে পড়ে। খুব উৎসাহের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিম হলে আমার ‘ভাঙন’ নাটকটি অভিনীত হলো। … অনেক টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়ে, টাকাটা ত্রাণকার্যে রত বেবি হোমসহ বেশ ক’টি সাহায্য সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল।’

পুর সমাজের পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ-নিবারণে ত্রাণকার্য পরিচালিত হলেও দুর্ভিক্ষের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া চলেছি আরও বহু বছর ধরে। ১৯৪৩-৪৪ সালের পটভূমি ও কার্যকারণ সূত্র নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ততটা আলোচনা বা অনুসন্ধান হয়নি। ২০০৭ সালে এসে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘এভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের দিনগুলো শেষ হলো বটে, কিন্তু আমাদের সমাজ জীবনে তাতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ক্ষত এত বছর পরেও শুকায়নি।’ এদিকটা গবেষকদের বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

৬. ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ

সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে। ঢাকা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে। রৌদ্র ঝকঝকে দিন। মিরপুর রোড যথারীতি ব্যস্ত। রাস্তার এধারে হকারের বইপত্র দেখছি। পাশে ন্যুমার্কেটগামী রিকশার ভিড়। রাস্তার ওধারে ২ টাকা দামের কিমা পরোটা ভাজা হচ্ছে, তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হঠাৎ করে চোখে পড়ল এই শাহরিক ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে একজন তিরিশ-ঊর্ধ্ব নারী টেনে টেনে রাস্তা পার হচ্ছেন। হেঁটে নয়- শুয়ে, নিজেকেই ক্লান্তভাবে টানছেন। তার পরনে কোনো কাপড় নেই! এ রকম দৃশ্য এর আরে আমি কখনও দেখিনি। গল্পের বইতেও পড়িনি। আমার ধারণা, ঢাকা শহরও এর আগে এ রকম হতবাক করা দৃশ্য এর আগে কখনও দেখেনি। এর পরে যথারীতি আমার বাস এল। সেটায় চড়ে বাড়ি ফিরে গেছি আর সব দিনের মত। কিন্তু দৃশ্যটা এখনও জীবন্ত হয়ে আছে মনে। জিজ্ঞেস করাতে কে একজন বলল, ‘বুঝলে না। দুর্ভিক্ষ চলছে রংপুরে। এরা সেই রংপুর থেকে খাবারের খোঁজে ঢাকা শহরে চলে এসেছে।’ এরপর যতবার গেছি ঐ জায়গা দিয়ে, প্রতিবারই মনে পড়েছে সেই অজানা অনাল্ফম্নী নারীর কথা। সে বেঁচেছিল কিনা সে বছর, অথবা এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না। মহিউদ্দিন আলমগীরের হিসাব উদ্ৃব্দত করে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল প্রায় পনেরো লাখ মানুষ।’ হতে পারে, সেই নারী প্রায় ছয় হাজার লঙ্গরখানার একটিতে আশ্রয় পেয়েছিল, অথবা হতে পারে, সেই আশ্রয় পাওয়ার পরেও সে বাঁচতে পারেনি। মানুষ তো শুধু ক্ষুধায় মারা যায় না, এর সাথে জড়িয়ে থাকে, কত নিগ্রহ-অসম্মান, কত অসুখ-বিসুখ। এ জন্যেই বলে ‘নারী ও মন্বন্তর’। আমার নিজের ধারণা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের যে প্রজন্ম নিজেদের ‘লস্ট জেনারেশন’ ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল, তার পেছনে ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের এক দীর্ঘ প্রলম্বিত প্রভাব ছায়া ফেলে থাকবে। স্বাধীনতা-উত্তর যৌবনিক উচ্ছ্বাসের আনন্দময় মুহূর্তগুলো সাময়িককালের জন্যে হলেও ঢেকে গিয়েছিল দুর্ভিক্ষজনিত আতঙ্ক, বিষাদ ও হতাশায়। তর্ক উঠলেও বলা যেতে পারে, সামাজিক মূল্যবোধের প্রকৃত অবক্ষয়ের শুরু সেই থেকে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখালেখির শেষ নেই। এর কার্যকারণ, মৃত্যুর ব্যাপ্তি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফ্যাক্টরের তুলনামূলক গুরুত্ব এ নিয়ে আজও চর্চা হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল পাঁচটি রচনার এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই আসবে অমর্ত্য সেনের ‘প্রভাটি অ্যান্ড ফেমিন’ গ্রন্থটি, যার কথা এর আগে বলেছি। এটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৭] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৭

পূর্ব প্রকাশের পর

এত বেড়ে যাওয়ায় গঙ্গাচরণ যাও-বা কিছু কিনতে পারলো, নবীন পাড়ূই কিছুই কিনতে পেল না। মাছ ধরে তার যা উপার্জন তাতে করে তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে খাদ্যশস্যের মূল্য। কীভাবে অমর্ত্য সেন কথিত ‘এক্সচেঞ্জ এনটাইটেলমেন্টের’ দ্রুত অবনতি হচ্ছিল, তার বিবরণ মেলে তাদের কথায়]

‘গঙ্গাচরণ বললে- নবীন, চাল নেবে না?

– না বাবাঠাকুর। একটা সিকি কম পড়ে গেল।

– তবে তো মুশকিল। আমার কাছেও নেই যে তোমাকে দেবো।

– আধসের পুঁটিমাছ ধরেলাম সামটার বিলে। পেয়েলাম ছ’আনা। আর কাল মাছ বেচবার দরুন ছেল দশ আনা। কুড়িয়ে-বুড়িয়ে একটা টাকা এনেলাম চাল কিনতি। তা আবার চালের দাম চড়ে গেল কী করে জানব?

– তাই তো!

আধপেটা খেয়ে আছি দু’দিন। চাষিদের ঘরে ভাত আছে। আমাদের তা নেই। আমাদের কষ্ট সকলের অপেক্ষা বেশি। জলের প্রাণী, তার ওপর তো জোর নেই? ধরা না দিলে কী করছি! যেদিন পালাম সেদিন চাল আনলাম। যেদিন পালাম না সেদিন উপোস। আগে ধান-চাল ধার দিত। আজকাল কেউ কিছু দেয় না।’

৩. [চাল-সংগ্রহ অভিযানের কারণে অনেক বড় বড় দোকানেও কেনার জন্য চাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না]

‘কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার। বড় বড় তিন-চারটি দোকান খুঁজে বেড়ালে, সকলেরই এক বুলি- চাল নেই। গঙ্গাচরণের মনে পড়লো বৃদ্ধ কুণ্ডু মশায়ের কথা। …কিন্তু সেখানেও তথৈবচ। গঙ্গাচরণ দোকানঘরটিতে ঢুকবার সময় চেয়ে দেখলে বাঁ পাশের যে বাঁশের মাচায় চালের বস্তা ছাদ পর্যন্ত সাজানো থাকে। সে জায়গা একদম খালি। হাওয়া খেলচে।…

গঙ্গাচরণ বললে- কিছু চাল দিতে হবে।

– কোথায় পাব, নেই।

– এক টাকার চাল, বেশি নয়। এই লোকটাকে উপোস করে থাকতে হবে। দিতেই হবে আপনাকে।

কুণ্ডু মশায় সুর নিচু করে বললে- সন্ধ্যের পর আমার বাড়িতে যেতে বলবেন, খাবার চাল থেকে এক টাকার চাল দিয়ে দেবো এখন।

গঙ্গাচরণ বললে- ধান-চাল কোথায় গেল? আপনার এত বড় দোকানের মাচা একদম ফাঁকা কেন?

– কী করব বাপু, সেদিন পাঁচু কুণ্ডুর দোকান লুট হওয়ার পর কী করে সাহস করে মাল রাখি এখানে বলুন! সবারই সে দশা। তার ওপর শনচি পুলিশে নিয়ে যাবে চাল কম দামে মিলিটারির জন্য।…

– আমরা না খেয়ে মরব?

– যদিন থাকবে, দেবো। …

– …বুঝে কাজ করুন, কিছু চাল দেশে থাকুক, নইলে দুর্ভিক্ষ হবে যে! কী খেয়ে বাঁচবে মানুষ?

– বুঝি সব, কিন্তু আমি একা রাখলি তো হবে না। খাঁ বাবুরা এত বড় আড়তদার, সব ধান বেচে দিয়েচে গবর্নমেন্টের কনটাকটারদের কাছে। এক দানা ধান রাখেনি। এই রকম অনেকেই করেচে খবর নিয়ে দেখুন।’

৪. [মতি মুচিনী মারা যাচ্ছে। গঙ্গাচরণকে গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘বড্ড জ্বর দাদাঠাকুর, তিন দিন খাইনি, দুটো ভাত খাব।’ তার পরের বিবরণী বিভূতিভূষণের লেখাতেই শুনুন]

‘অনঙ্গ-বৌ শুনতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু সেও অত্যন্ত দুর্বল। উঠে মতির কাছে যাওয়ার শক্তি তারও নেই!

বললে- ওগো মতিকে কিছু খেতে দিয়ে এসো-

– কী দেবো?

– দুটো কলাইয়ের ডাল আছে ভিজনো। এক মুঠো দিয়ে এসো।

– ও খেয়ে কি মরবে? তার জ্বর আজ কত দিন তা কে জানে? মুখ-হাত ফুলে ঢোল হয়েচে। কেন ও খাইয়ে নিমিত্তের ভাগি হবো!

খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনঙ্গ। কিন্তু অন্য কিছুই ঘরে নেই। কী খেতে দেওয়া যায়, এক টুকরো কচু ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা রোগীর খাদ্য নয়। … ভেবেচিন্তে অনঙ্গ-বৌ বললে- হ্যাঁ গা, কচু বেটে জল দিয়ে সিদ্ধ করে দিলে রোগী খেতে পারে না?

– তা বোধ হয় পারে। মানকচু?

[ব্রাহ্মণ পণ্ডিত স্কুলের শিক্ষক গঙ্গাচরণের উনোনেরই যদি এই দশা হয় আরও নিম্ন-আয়ের সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হচ্ছিল, তা এর থেকে অনুমেয়।]

৫. [অবশেষে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা সত্য বলে প্রমাণ হলো। বিভূতিভূষণ তার অননুকরণীয় বর্ণনার সেই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা লিখছেন। সে বর্ণনা চার্চিল-কেইনস্‌ বা ঔপনিবেশিক ভারতের ভাইসরয়রা কেউ পড়েননি, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনিসংকেত’ ছবির কল্যাণে পরে মতি মুচিনীর মৃত্যুসমগ্র পশ্চিমা জগতে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল]

‘গ্রামে থাকা খুব মুশকিল হয়ে পড়লো মতি মুচিনীর মৃত্যু হওয়ার পরে। অনাহারে মৃত্যু এই প্রথম। এর আগে কেউ জানত না বা বিশ্বাসও করেনি যে অনাহারে আবার মানুষ মরতে পারে। এত ফল থাকতে গাছে গাছে, নদীর জলে এত মাছ থাকতে, বিশেষ করে এত লোক যেখানে বাস করে গ্রামে ও পাশের গ্রামে, তখন মানুষ কখনও না খেয়ে মরে? কেউ না কেউ খেতে দেবেই। না খেয়ে সত্যিই কেউ মরবে না।

কিন্তু মতি মুচিনীর ব্যাপারে সকলেই বুঝলে, না খেয়ে মানুষে তাহলে তো মরতে পারে। এত দিন যা গল্পে-কাহিনীতে শোনা যেত, আজ তা সম্ভবের গণ্ডির মধ্যে এসে পৌঁছে গেল। কই, এই যে একটা লোক মারা গেল না খেয়ে, কেউ তো তাকে খেতে দিলে না? কেউ তো তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারলে না? সকলের মনে বিষম একটা আশঙ্কার সৃষ্টি হলো। সবাই তো তাহলে না খেয়ে মরতে পারে!’

‘অশনিসংকেত’ ছাড়াও সে সময়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার ‘মন্বন্তর’ উপন্যাস (দুর্ভিক্ষের ওপরে লেখা বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকটি তখনই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল)। ১৯৪২ সালের শীত-মৌসুমের খাদ্যশস্য বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলোতে। ‘মন্বন্তরে’ তারাশঙ্কর লিখেছেন :’লোক কয়েকটি মেদিনীপুরের অধিবাসী। ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির ঢিবি হয়ে গেছে, গরু-বাছুর ভেসে গেছে, জলোচ্ছ্বাসে জমির বুকে চাপিয়ে দিয়েছে বালির রাশি। অন্ন নেই- এমনকি তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করবারও উপায় নেই- জল লবণাক্ত হয়ে গেছে।’ এই বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষের প্রাগ-পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। মন্বন্তরে বিজয়দা নীলাকে লিখছে :’এখন মাঘ মাস, এরই মধ্যে দেখছি- ধান প্রায় অন্তর্হিত হয়ে গেল। গত বছরের ডিনায়েল পলিসি, এ বছরের অজন্মা, এর ওপর চোরা বাজারের কালো কাপড় ঢাকা হাত দান টেনে নিচ্ছে।’ মন্বন্তর উপন্যাসটি সমসাময়িকতায় বিদ্ধ হলেও আদর্শ প্রচারের কারণে ততটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারেনি। তারাশঙ্কর একদিকে মহাত্মার অনুসারী, অন্যদিকে বামপন্থি চিন্তাধারার প্রভাবও স্বীকার করে নিচ্ছেন। এ দুইয়ের মিলিত উচ্ছ্বাস মাঝেমধ্যেই তার পাত্র-পাত্রীদের কথার মধ্যে উপচে পড়ে। একটি উদাহরণ দিই, শহর কলকাতায় তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনস্রোত ঢুকে পড়েছে। বাকিটা তারাশঙ্করের বর্ণনায় শুনুন :

‘নীচে পথর উপর থেকে ক্ষীণ কাতর কণ্ঠে ডাক উঠল- ভাত দাও মা চারটি, বাসি ভাত! নীলা এবং কানাইয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। এ মন্বন্তর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাসাটা তাদের কাছে অপরাধ বলে মনে হলো।

বিজয়দা লেখা সমাপ্ত করে বললো- কানাই ভাই, এইবার কাজে নেমে পড়ো, নীলা ভাই, কমরেডের সঙ্গে তুমিও লেগে পড়ো। …

নীলা এবার বললে- বলুন, কী করব? কাজ বলে দিন।

– কাজ অনেক। মানুষকে, এ মন্বন্তরের দুর্যোগ পার করে নিয়ে যেতে হবে।’

পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আরও কথাসাহিত্য লেখা হয়েছে বাংলায়। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গোপাল হালদারের ট্রিলজি- ‘পঞ্চাশের পথ’, ‘ঊনপঞ্চাশি’ ও ‘১৩৫০’। লঙ্গরখানা খোলার কথা আছে অনেক গল্পে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গ্রন্থের ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পে গ্রাম ছেড়ে নিরন্ন মানুষের অশক্ত পথচলার বিবরণ পাই। দুর্ভিক্ষের সময়ে ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এবং বামধারার ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পে তিনি লিখছেন :’তিনু কিছু বললে না। হঠাৎ কী হয়েছে তার- নদীর অপর তীর দেখবার জন্য তার মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। তার আশঙ্কা হচ্ছে- মহাসাগরের তীরে যেন বসে রয়েছে। পথ ভুল করে কি তারা সীমাহীন মহাসাগরের তীরে এসে বসেছে মরণের পারে যাবে বলে?… ক’দিন হলো মতি উধাও হয়ে গেছে গাঁ থেকে এবং তার খোঁজে সে এদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া গাঁয়ে যে রকম বীভৎস আকাল লেগেছে, সেখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।’ দুর্ভিক্ষের কারণে জমি সামান্য টিপসই দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল নিরন্ন কৃষক, এ কথা শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ আমাদের জানিয়েছে। আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ উপন্যাসে জয়গুণ ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচারণ করছে এভাবে :’পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়-কত বাড়িতে তাকে ঘুরতে হয়েচে… মাঝেমধ্যে সারারাত সারাদিন কেটেছে, একটা দানাও পড়েনি পেটে।’

হুমায়ূন আহমেদ তার ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরকে প্রোথিত করেছেন। তাতে করে দেখা যায়, শুধু পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতায় নয়, এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। চাল কিনে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের সুরক্ষিত করার জন্য ‘প্রকিউরমেন্ট পলিসি’ দুর্ভিক্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ফিরে যাই হুমায়ূনের বর্ণনায় :

১. [আর, পি, সাহার কথা মনে রেখেই কি নিচের এই স্তবকটি লিখেছিলেন হুমায়ূন? স্মর্তব্য, রণদা প্রসাদ পরে ‘দানবীর’রূপে সমধিক পরিচিতি পেলেও তার ‘প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয়ন’ হয়েছিল যুদ্ধের বাজারে- দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে- ধান-চালের মজুদদারি করেই]

‘বান্ধবপুর বাজারে এককড়ি সাহার চালের আড়ত। তিনি সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধের কারণে এখন রমরমা অবস্থা। ধান-চালের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আরও বাড়বে- এ রকম গুজব বাতাসে ভাসছে। সব চাল নাকি মিলিটারিরা কিনে নিবে।… দেশের চাল সব সরকার কিনছে। এদিকে আবার বার্মা মুলুক থেকে চাল আসা বন্ধ। জাপানিরা বার্মা দিয়ে ভাতবর্ষে ঢুকবে।’

২. [এটা গেল দুর্ভিক্ষের ‘ব্যাকগ্রাউন্ডের’ কথা। এবার হুমায়ূন দেখাবেন কী করে মজুদদারি শুরু হয়ে গেল সরকারি ক্রয়-অভিযানের আড়ালে]

‘এককড়ি হারিকেন নিভিয়ে দিয়েছেন। কেরোসিনের সাশ্রয় করতে হবে।… আধো অন্ধকারে এককড়ি দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন, চাল কিনা শুরু করো। দাম কিছু বেশি হলেও কিনবা। বড় নৌকা নিয়ে ভাটি অঞ্চলের দিকে যাও। সেখানে ধান-চাল দুইই সস্তা।’

[ক্রমশ]

Original in সমকাল

[তুমুল গাঢ় সমাচার ১৬] সাহিত্য ও অর্থনীতি: বাংলার কয়েকটি দুর্ভিক্ষ (Literature and Economics: Some of Bengal’s Famines)

পর্ব ::১৬

পূর্ব প্রকাশের পর

এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছিল হাজারের এককে। তারপর মৃত্যু এত বেড়ে গেল- এই পরিসংখ্যানের প্রকাশ এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল। তবু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের টনক নড়েনি। বাংলার কৃষককে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করাই তার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। ‘চার্চিল’স সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থে সে কথা মধুশ্রী মুখার্জি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। বাংলার কৃষককূল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তার নীতির কারণে- এ কথা শোনার পর চার্চিল বলেছিলেন, ‘গান্ধী কি বেঁচে আছে এখনও? সে মারা যায় না কেন?’

তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের শিকার তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পেছনে চার্চিলের পরোক্ষ ভূমিকায় অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়বে। অনেকেই ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের’ সীমা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়বেন। এদের কারো কারো কাছে চার্চিল অবাধ পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের মানসপুত্রের মত। তার সুস্বাদু ইতিহাস রচনা (যার জন্য সাহিত্যে নোবেলও পেয়েছিলেন তিনি) অস্বীকার করার নয়। যেমন নয় যুদ্ধকালীন সময়ে ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনুপ্রাণিত ভাষণ ও নেতৃত্ব। যুদ্ধ জয়ের পর রক্ষণশীল সরকারের পতন হল এবং তিনি আর প্রধানমন্ত্রী রইলেন না। এতেও দুঃখ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার নয় যে, চার্চিলের মত ‘লিবারেল’ রাজনীতিকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অমানবিক নীতি প্রয়োগের ধারাবাহিকতা। ইংলন্ডকে বাঁচানোর জন্য তিনি ভারতবর্ষ বা অন্যান্য উপনিবেশকে দুর্ভিক্ষের গ্রাসে ফেলে দিতে দ্বিধা করেননি। যখন তিনি যুদ্ধোত্তরকালে একনাগাড়ে ছবি এঁকেছেন (এ কাজে দক্ষতা ছিল তার); একবারও আঁকেননি জয়নুলের মত কোন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি। সেসব নিরন্ন মানুষের চিৎকার তার স্বপ্নের মধ্যে কখনো শোনা যেত কি-না এ বিবরণ জানা যায় না। ইউরোপের জন্য এক নিয়ম, আর উপনিবেশের মানুষদের বিচার করার ক্ষেত্রে অন্য নিরম- পার্থ চ্যাটার্জী যাকে বলেছেন ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’- তা চার্চিলের দুর্ভিক্ষ-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড বিশ্নেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক হিসেবে, এটিকেও ‘সত্তার বিভক্তি’ বলা যায়, যা ইতিপূর্বে আরেক জন ‘লিবারেল’ চিন্তক জন স্টুয়ার্ট মিলের আলোচনায় আমরা দেখেছি।

মধুশ্রী মুখার্জীর কাজকে অস্বীকার করা উপায় নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন নোবেল পদার্থ বিজ্ঞানী ইউইসিরো নাম্বুর অধীনে। পরে ক্যালটেক থেকে পোস্ট-ডক্টরেট করে বিখ্যাত ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ সাময়িকীর অন্যতম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বিজ্ঞান-বিষয়ক সাংবাদিকতা ও বই লেখাই তার প্রধান অভিনিবেশ। প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদ নন ঠিকই, তাই বলে তিনি দুর্ভিক্ষের অঙ্ক কষতে জানেন না, একথা বলা যাবে না। ২০০২ সালে ব্রিটেনবাসীদের মধ্যে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত জরিপে চার্চিল হয়েছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ ইংরেজ’। এহেন ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে গেলে সাহস ও দম উভয়ই থাকা চাই। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ভারত থেকে যখন প্রস্তাব গেল যে, বাংলাকে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করার জন্য মাসে অন্তত ৮০,০০০ টন খাদ্যশস্য জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা চাই; চার্চিল সেই অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছিলেন। এই তথ্য প্রাথমিক উপাত্ত ঘেঁটে মধুশ্রী সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন তার বইয়ে। চার্চিলের এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন না ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারাও। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো যেমন মনে করেছিলেন যে, ‘খাদ্যশস্য আমদানি হতে যাচ্ছে বাংলায়’- শুধুমাত্র এই খবরটি ছড়িয়ে দিলেও ‘মজুতদারির প্রবণতা কমে যেত ও চালের দাম নেমে আসত।’ অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা খাদ্যশস্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল পণ্যবাহী জাহাজের স্বল্পতা নিয়ে। কেননা, জাহাজগুলোকে তখন ব্রিটিশ উপকূলের আশে-পাশে জড়ো করে রাখা হয়েছিল। মধুশ্রী বলেছেন যে, জাহাজের স্বল্পতার ‘টেকনিক্যাল আর্গুমেন্ট’ অনেকটাই কষ্ট কল্পিত। কেননা, ততদিনে মার্কিন প্রশাসন সাহায্য হিসেবে অনেক মালবাহী জাহাজ ব্রিটেনের কাছে স্থানান্তর করেছিল। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার খবরে এমনকি ইংরেজের শত্রুপক্ষে যুদ্ধরত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পর্যন্ত অধিকৃত বার্মা থেকে কিছু চাল বাংলাতে পাঠাতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সেন্সরশিপ সে তথ্যও পুরোপুরি চেপে যায়।

এবার আসি মূল্যস্ম্ফীতির প্রসঙ্গে। শুধু যে খাদ্য-সরবরাহে অপ্রতুলতার কারণে প্রতি মাসে মূল্যস্ম্ফীতির হার বাড়ছিল, তাই নয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সচেতনভাবে গৃহীত ম্যাক্রো-ইকোনমিক পদক্ষেপও। ২০১৮ সালের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির ২০ অক্টোবর সংখ্যায় প্রখ্যাত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ ও জওহরলাল বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক ঊষা পাটনায়েক অভিযোগ করেছেন যে, বাংলার দুর্ভিক্ষ এমনিতেই হয়নি। বাংলায় দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি করে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থায়নের যোগাড়-যন্ত্র করা হয়েছিল। মানুষের ভোগের পরিমাণ কমিয়ে যুদ্ধের রসদ যোগানোর জন্য বিনিয়োগের তহবিল বাড়ানো হয়েছিল। এই ম্যাক্রো-ইকোনমিক যুক্তিটি এসেছিল অগ্রগণ্য অর্থনীতিবিদ কেইনসের লেখা থেকে। ‘ট্রিটিস অন মানি :দ্য এপ্লাইড থিওরি অব মানি’ (১৯৩০) এবং ‘হাউ টু পে ফর দ্য ওয়ার :এ রাডিকেল প্ল্যান ফর দ্য চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার’ (১৯৪০); এই দুটি লেখায় কেইনস এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কীভাবে জনগণের আয় (ভোগ) কমিয়ে তা থেকে উদ্বৃত্ত আহরণ করা যায় যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থায়নের জন্য, সেটা কেইনসের আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্রিটেনবাসীর ক্ষেত্রে এই মহৌষধির প্রয়োগ না করে তা ব্যবহার করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সাধারণ অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। বাংলার গ্রামাঞ্চলের নিরীহ জনগণের ভোগ কমিয়ে তাদেরকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়ে যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ তুলে নিয়েছিল চার্চিলের ইংরেজ সরকার। মধুশ্রী মুখার্জীর বইটি ও ঊষা পাটনায়েকের লেখাটিকে আমরা এই অর্থে সম্পূরক রচনা হিসেবে পাঠ করতে পারি।

মুখার্জী ও পাটনায়েকের লেখার মুখ্য প্রতিপাদ্যের সাথে অমর্ত্য সেন অপরিচিত নন। তার ‘পভার্টি অ্যান্ড ফেমিন’ বইয়ে পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি সাতটি কারণের কথা বলেছেন। তার মধ্যে একটি কারণ ছিল চার্চিলের নিস্পৃহতাও। যেমন, তিনি বলছেন, ‘The refusal of the British Government to permit move food imports into India throngh reallocation of shipping as an emergency measure to tackle the famine was severely criticized. Lord wavell, who became the new Viceroy at the last stage of the famine and who had to battle hard for increasing food imports into India, went on record in this context that he felt that ‘the vital problems of India are being treated by his Majesty’s Government with neglect, even sometimes with hostility and contempt’- এই শেষোক্ত উদ্ৃব্দতিটির উৎস হচ্ছে লর্ড ওয়াভেলের চিঠি, ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবরে লেখা উইনস্টন চার্চিলকে উদ্দেশ করে। অন্যদিকে, ঊষা পাটনায়েকের যুক্তি- ‘ইচ্ছে করে মূল্যস্ম্ফীতি ঘটানো হয়েছিল যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহের জন্য’- সেটিও পরোক্ষভাবে অমর্ত্য সেনের চোখে পড়েছিল। তিনি লিখছেন ::’The 1943 famine can indeed be described as a ‘boom famine’ related to powerful inflationary pressures initiated by public expenditure expansion’. তবে সব কার্যকারণের মধ্যে সেনের প্রধান গুরুত্ব এসে পড়েছিল ‘বীপযধহমব বহঃরঃষবসবহঃ’র দ্রুত অবনতির ওপরে- সামগ্রিকভাবে খাদ্যের যোগানের সাংবৎসরিক বাড়া-কমার ওপরে নয়। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রাম-বাংলা, বিশেষত মজুরি-শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল কৃষি শ্রমিক ও অসচ্ছল প্রান্তিক জোতের পরিবারেরা। এখানে সেনের মূল তর্কটা দুর্ভিক্ষের Causality বা বা মূল কার্যকারণসূত্র নিয়ে যখন দুর্ভিক্ষবিরোধী ‘পলিসির’ প্রসঙ্গ এসেছে তখন তিনিও খাদ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি, ফুড রেশনিং ব্যবস্থা, পাবলিক ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, খাদ্যশস্যের মূল্য-পরিস্থিতিকে সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আনা ইত্যাদি ‘সাপ্লাই-সাইড’ কর্মসূচির ওপরে জোর দিয়েছেন তার বইতে যথাযথভাবেই। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে শুধু সরকারি প্রশাসক, ইতিহাসবিদ, পরিসংখ্যানবিদ বা অর্থনীতিবিদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট নয়। সমসাময়িক সাহিত্য-কর্মের মধ্য দিয়ে এই দুর্ভিক্ষের চালচিত্র বিশ্বস্ততার সাথে ফুটে উঠেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ মন্ব্বন্তরের প্রাক-কথন থেকে এর ট্র্যাজিক পরিণতি অবধি পাত্র-পাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করেছিল। জাপানি আক্রমণের মুখে ১৯৪২ সালের মে মাসে ইংরেজরা বার্মা থেকে যখন পিছু হটল, তখন বার্মা থেকে চাল আমদানিও আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে দুর্গাপণ্ডিত আর গঙ্গাচরণের মধ্যে কথা হচ্ছে :

“- জাপানিরা সিঙ্গাপুর নিয়ে নিয়েছে? যুদ্ধের খবর কী?

– শুধু সিঙ্গাপুর কেন, ব্রহ্মদেশও নিয়ে নিয়েচে। জানো না সে খবর?

– না-ইয়ে-শুনি নি তো? ব্রহ্মদেশ? সে তো-

– যেখান থেকে রেঙ্গুন চাল আসে রে ভায়া। ওই যে সস্তা, মোটা মোটা আলো চাল …”

যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাদের জন্য খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে চাল কেনার ধারা তো পূর্বাপর ছিলই, জাপানি আক্রমণের মুখে এই কেনার গতিবেগ আরো বেড়ে গেল। কোনভাবেই যেন জাপানিদের কাছে চালের বাজার না চলে যায় সে জন্যে ঔপনিবেশিক সরকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরকে চাল কেনার অনুমতি দেয়। চাল বিক্রি করতে না চাইলে জবরদস্তিও হচ্ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে। এর ফলে কিছুটা অবস্থাপন্ন মানুষ যারা টাকা দিয়ে চাল কেনার সামর্থ্য রাখে, তারাও হাটে-দোকানে গিয়ে চাল পায়নি। যারা আরো অবস্থাপন্ন তাদর কাছে চাল থাকলেও চালের দাম আরো বাড়তে পারে- এই আশঙ্কায় তারাও চালের সংগ্রহ লুকিয়ে ফেলেছিল। এতে করে গঙ্গাচরণের মত ক্রয়-নির্ভর পরিবারদের অনাহারে-উপবাসের ঝুঁকিতে দিন কাটাতে হয়েছিল। বিভূতিভূষণ লিখছেন একের পর এক ঘনায়মান দুর্যোগের দৃশ্য :

১. ‘অনঙ্গ-বৌ বললে- আর দুটো ভাত মেখে নাও, ডাল দিয়ে পেট ভরে খাও-
-এ চাল দুটো ছিল বুঝি আগের দরুণ?
-হুঁ।
-কাল হবে?
-কাল হবে না। সকালে উঠেই চাল যোগাড় করো। রাতটা টেনেটুনে হয়ে গেল।
-সেই বিশ্বাস মশায়ের দরুণ ধানের চাল?
-হুঁ।

অনঙ্গ-বৌ স্বামী-পুত্রকে পেট ভরে খাইয়ে সে-রাতে এক ঘটি জল আর একটু গুড় খেয়ে উপোস করে রইলো।’

২. [পরের দিন গঙ্গাচরণ গেছে চালের খোঁজে। এক জায়গায় দেখল চাল বিক্রি হচ্ছে। একটু ক্ষণ আগেই গঙ্গাচরণ এক জেলে নবীন পাড়ূইকে বলেছে, ‘কখনো কি কেউ শুনেচে যে চালের মণ ষোল টাকা হবে।’ অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, এরই মধ্যে চালের দাম বেড়ে ‘কুড়ি টাকা মণ’ হয়ে গেছে।

[ক্রমশ]

Original in সমকাল