রণজিৎ গুহ ও নিম্নবর্গ নিয়ে তাঁর ইতিহাস-চর্চা

পর্ব : ০৪ [পূর্বে প্রকাশের পর]


রণজিৎ গুহ [২৩ মে ১৯২৩–২৮ এপ্রিল ২০২৩]

তপন রায়চৌধুরী গুনে দেখিয়েছেন যে বরিশালের কিছু এলাকায় জমিদার ও প্রকৃত কৃষক-প্রজার মাঝে ৩২-স্তর বিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয়েছিল উনিশ শতকে। প্রাগ-ব্রিটিশ পর্বে পুরোনো জমিদার-পুরোনো রায়তের মধ্যে (ফ্রান্সিসের ভাষায়) ‘স্বাভাবিক স্বার্থ ও সম্পর্কের যে পারস্পরিক বন্ধন ছিল’ তা প্রায় সর্বাংশে ধসে পড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে। কেন এমন হলো সে প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর– ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও ইউরোপের পুঁজিবাদ গোড়া থেকেই ভিন্ন নিয়ম মেনে অগ্রসর হচ্ছিল। একেই পার্থ চ্যাটার্জী পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন– ‘কলোনিয়াল রুল অব ডিফারেন্স’। মেট্টোপলির জন্য যে নিয়ম খাটে, কলোনির জন্য সে নিয়ম খাটে না। উপনিবেশের পরিস্থিতিতে অবাধ ধনতন্ত্রের যৌক্তিক নিয়ম কার্যকর করা যায় না। সেখানে কৃষিতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানাও সহজে চালু করা যায় না। রাজশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ আর সব বিবেচনাকে ছাড়িয়ে যায়। সেখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও কৃষকের স্বার্থ জাতীয় স্বার্থেaর মধ্যে স্থান পায় না। অন্তত বহুকাল পর্যন্ত পায়নি। যতদিন পর্যন্ত কৃষকেরা নিজেরাই তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলেছে, অথবা কখনও কখনও নীরবেই প্রতিবাদ করেছে প্রতিদিনের নিঃশব্দ প্রতিরোধে। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লেখার প্রায় কুড়ি বছর বাদে এ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। কৃষক-বিদ্রোহ (বিদ্রোহ করা ছাড়া তার আর কী উপায় থাকছে তখন) এই প্রথম বড় আকারে স্থান পাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসের আলোচনায়।

৩. অন্য ইতিহাসের নির্মাণ
‘এ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণ বার হয় ১৯৮২ সালে। এর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় অমর্ত্য সেন বলেন যে ‘Ranajit Guha is, arguably, the most creative Indian historian of this century’– সম্ভবত বিশ শতকের ‘সবচেয়ে সৃষ্টিশীল’ ঐতিহাসিক এই উপমহাদেশ থেকে। এই ভূমিকায় অমর্ত্য সেন ‘রুল অব প্রপার্টি’ পর্যায়ের সাথে পরবর্তী কালের ‘সাব-অলটার্ন স্টাডিজ’ পর্যায়ের যৌক্তিক যোগসূত্র খুঁজে বার করেন। উচ্চবর্গের ইতিহাসের সাথে নিম্নবর্গের ইতিহাসের যোগসূত্রটি তাঁর চোখে ধরা পড়েছে এভাবে (উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হলেও আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক)। অমর্ত্য সেন বলছেন:
“Since we often tend to see people in fairly formulaic terms, some would no doubt expect to find in A Rule of Property for Bengal a reflection of the ‘subaltern approach’, with its overarching interest in the role of the non-elite–the so-called subalterns. As I shall presently argue, those looking for such an approach need not be entirely disappointed. There are elements that link A Rule of Property and the Subaltern Studies…
What, then, are these connections? To examine them, it is useful to recapitulate briefly Guha’s motivating concern in initiating the ‘subaltern studies’ :
The historiography of Indian nationalism has for a long time been dominated by elitism–colonialist elitism and bourgeois-nationalist elitism… Both these varieties of elitism share the prejudice that the making of the Indian nation and the development of the consciousness–nationalism–which informed this process were exclusively or predominantly elite achievements.
While A Rule of Property is virtually all about elites–their ideas, their commitments, their hopes, their doubts–it is a view of a well-meaning but ultimately fumbling elite, botching things up at the highest level. In this sense it is not a ‘pro-elite’ book. A Rule of Property brings out the difficulties and the ultimate inadequacy of economic         reforms initiated by the elite and influenced by the finest elitist thinking.”
এটা বলার পর অর্মত্য সেন লিখেছেন যে রণজিতের উচ্চবর্গের ব্যর্থতার আলোচনা ও নিম্নবর্গের প্রতিরোধের আলোচনার মধ্যে একটি গভীর যোগাযোগ রয়ে গেছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে গুহ দেখেন যে এই ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক তত্ত্ব, শ্রেণি-তত্ত্ব বা সামন্তবাদ-পুঁজিবাদ তত্ত্বের নিরিখে বিচার করা যাচ্ছে না। এর সাথে জড়িয়ে গেছে ঔপনিবেশিক (ও আধুনিক) ক্ষমতা-কাঠামোর মৌলিক প্রভাব। এজন্যই ‘শিব গড়তে বাঁদর’ হয়ে যাচ্ছে। ফরাসি বিপ্লবের সামন্তবাদবিরোধী বিশ্বজনীন সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের ধ্যান-ধারণাগুলো দূরবর্তী উপনিবেশে এসে– তা সে ঢাকার বুড়িগঙ্গাই হোক, আর কলকাতার হুগলি নদীই হোক– সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চেহারা নিচ্ছে। সুস্থ নির্মাণের পরিকল্পনাও একটি অসুস্থ/বিকৃত নির্মাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
Guha explains the botched job in the following terms: “…a typically bourgeois form of knowledge was bent backwards to adjust itself to the relations of power in a ‘semi-feudal society.’ Through the relevance of ‘power relations’ we get into a territory in which the subaltern studies have taken great interest.”
‘রুল অব প্রপার্টিস’ বইয়ে ফ্রান্সিস সাহেব ও অন্যদের আলোচনা করতে গিয়ে রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন যে কী করে একটা আপাতদৃষ্টিতে ‘ভালো’ বুর্জোয়া আইডিয়া ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে এসে নিজেরই বিরুদ্ধে গিয়ে আধা-সামন্তবাদী ক্ষমতার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এই অর্থে বইটি কোনো এলিটকেন্দ্রিক আলোচনার বই নয়: এটি এলিট বা উচ্চবর্গের জ্ঞানমার্গ (Episteme) ও তার রাজনীতিরই নিকট সমালোচনা। এবং এই সূত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আলোচনার দরকার ছিল নিম্নবর্গের আলোচনা শুরু করার জন্য। কেননা, উচ্চবর্গের রাজনীতির ব্যর্থতাই নিম্নবর্গকে ইতিহাসের প্রান্তস্থল থেকে কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে। রণজিৎ উচ্চবর্গের ব্যর্থতার আলোচনা করতে গিয়েই একপর্যায়ে নিম্নবর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ার তাগিদ অনুভব করেছেন।
এই পর্যায়ে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা কী নয় সে বিষয়টি আগেভাগে পরিষ্কার করা ভালো। রণজিৎ গুহ তার পূর্বে উদ্ধৃত অংশে দুই ধরনের ইতিহাসচর্চার কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে– ঔপনিবেশিক এলিটকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার ধারা। যেন ম্যাকলে সাহেব এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে কথা ভাবলেন বা জন স্টুয়ার্ট মিল কোম্পানির নীতি নিয়ে যে বিবৃতি দিলেন তার সুবাদেই ভারতবর্ষের ইতিহাসের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অথবা ঔপনিবেশিক ভারতের বড়লাট হয়ে কোন নির্দিষ্ট পর্বে যে বিশেষ ইংরেজ রাজকর্মচারী এ দেশ শাসন করতে এলেন তার ওপরেই যেন নির্ভর করছে এ দেশের ইতিহাসের ধারা। অপর ইতিহাসচর্চার ধারাটিও খুবই প্রচলিত: সেটি হচ্ছে (বুর্জোয়া) জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার ধারা। এই মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার গান্ধী যবে থেকে সাহেব-সুবোদের বেশ ছেড়ে কৃষকের বেশ ধরলেন– যবে থেকে তিনি ‘মহাত্মা’ হলেন– তখন থেকেই গণজাগরণ দেখা দিল এ ভূখণ্ডে। অথবা সাহেব-সুবোদের মতো বেশধারী জিন্নাহ যবে থেকে কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দিলেন এবং মুসলিম কৃষক জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ অংশ যখন থেকে তাঁকেই তাদের নেতা বলে মানতে শুরু করল, তখন থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে আসল গণজোয়ার আসতে শুরু করল। নেহরু ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ লিখলেন এবং জেলে বসে তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব-ইতিহাস নিয়ে ইংরেজিতে যেসব চিঠিপত্র লিখে গেলেন, তা পরোক্ষভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বৈশ্বিক পরিসরে পেশ করল। ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে সুভাষ বসুর মহা-নিষ্ক্রমণ, পরবর্তী সময়ে তাঁর জার্মানি ও জাপান যাত্রা, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন– এগুলো ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের মহাপথপরিক্রমা। বাংলাদেশেও ৬ দফা থেকে স্বাধীনতার পর্যায়ে উত্তরণ ঘটল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। এসব মিথ্যে নয়, ইতিহাসে ব্যক্তি বা নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করার নয়, কিন্তু এসবই জাতীয়তাবাদী আখ্যানের অংশ, ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যা। কিন্তু তার বাইরেও অন্য ইতিহাস রয়ে গেছে।
অন্য ইতিহাস বলতে সচরাচর আমরা বুঝি ‘মার্ক্সবাদী’ ইতিহাসচর্চার ধারা, যেটি স্পষ্টতই ঔপনিবেশিক এবং ‘জাতীয়তাবাদী’ ইতিহাসচর্চা থেকে আলাদা। মার্ক্সবাদী ঘরানার মধ্যে নানা উপধারা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যেটা এখানে প্রশ্ন হিসেবে পাঠকদের মধ্যে দেখা দেবে তা হলো– এসবের মধ্যে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার স্থান কোথায়? মার্ক্সীয় ধারার থেকে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ কতটা ও কোথায় পৃথক? ‘তল থেকে দেখা ইতিহাস’– এই ধারার সাথেই বা এর সম্পর্ক কী রকম?
সবচেয়ে সরল বা মোটাদাগের প্রভেদটা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে (যদিও আমরা অচিরেই দেখব যে মূল পার্থক্যটা সেখানে নয়)। ঔপনিবেশিক এলিটকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার ধারায় মূল আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে ঔপনিবেশিক (ইংরেজ) প্রভুদের জীবনচর্চা, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নীতিমালা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত বাদানুবাদ ইত্যাদিকে ঘিরে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার ‘নায়ক’ হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ, তাঁদের জীবন ও কর্মতৎপরতা– যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ধীরে ধীরে। মার্ক্সীয় ইতিহাসচর্চার মূলে রয়েছে তাঁর ‘শ্রেণিগত’ দৃষ্টিকোণ– ‘পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণিগত দ্বন্দ্বের পরিণতি’ এই ঘোষণায় আস্থা রেখে। আধুনিক সমাজে পুঁজির মালিক ও শিল্প-প্রলেতারিয়েত হচ্ছে দুই যুধ্যমান পক্ষ। সম্পত্তির ওপরে কার অধিকার তা নিয়ে যুদ্ধ চলছে। অর্থাৎ মার্ক্সীয় ইতিহাসচর্চায় শোষক ও শোষিতের মুখের চেহারাটি স্পষ্ট; সহজেই তাদের শনাক্ত করা যায়। অন্তত সেটাই এই ঘরানার ইতিহাসবিদদের প্রধান দাবি : সমস্ত শোষণের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন। এবং এই অর্থনৈতিক শোষণ যারা চালাচ্ছে এবং যাদের ওপরে চালাচ্ছে, সেটি উন্মোচন করতে পারলেই ইতিহাসের রথের ঘোড়া যে পথ বেয়ে চলেছে সেই পথকে বোঝা সম্ভব হবে।
এইসবের প্রেক্ষিতে সাব-অলটার্ন স্টাডিজের অবস্থান কোথায়? ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার ইতিহাস’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে সাব-অলটার্ন ঐতিহাসিক মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকের তুলনায় বেশি অনিশ্চয়তায় ভুগবেন। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বাইরে ইতিহাসের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর খুঁজে বেড়াবেন। ইতিহাসের কর্তা হিসেবে তিনি স্পষ্ট করে কোনো নায়ককে দেখতে পাবেন না। না ঔপনিবেশিক ‘প্রভু’, না জাতীয়তাবাদী ‘লিডার’, না দলিত-শোষিত শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ‘নেতা’– কেউ তাঁর চোখে পূর্বনির্ধারিতভাবে নায়কের আসনে সমাসীন নন। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা আসলে ‘বিরোধী বা ক্রিটিকাল ইতিহাস রচনা’। পুরো উদ্ধৃতিটি আমি এখানে তুলে ধরতে চাই:
“প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রচনার পদ্ধতি আছে, থাকবে। উচ্চবর্গের আধিপত্যও আছে, থাকবে। অন্তত ইতিহাস লিখে সে-আধিপত্যের অবসান ঘটানো যাবে না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাহলে কী করতে পারেন? তিনি বিরোধী ইতিহাস লিখতে পারেন, যেখানে উচ্চবর্গের আধিপত্য অস্বীকার করে নিম্নবর্গ তার নিজের ঐতিহাসিক উদ্যমের কথা বলতে পারে।   

 [ক্রমশ]

Leave a comment