মহামারি, সাহিত্য ও করোনার কাল

পর্ব ::৫০
পূর্বে প্রকাশিতের পর
ক্লাবের বাইরে যে লেখা থাকত ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট অ্যালাউড’- এটা হয়তো ক্যান্টনমেন্ট-মডেলে আবদ্ধ থাকার জনস্বাস্থ্য-নীতিরই এক অন্য প্রকাশ। দীপেশ চক্রবর্তী তাই লিখেছেন :১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্‌ ম্যানুয়ালে লেখা হলো- ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে।’ এভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন, সামার রিসোর্ট ইত্যাদি। এক কথায়, প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর হলো, ঔপনিবেশিক আমলের জনস্বাস্থ্য নীতি ছিল বৈষম্যমূলক এবং সেখানে জনগণের কোনো স্থান ছিল না। এটি ছিল মূলত এলিটদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য নীতি। জনগণ পেত তার নিজস্ব বিশ্বাসে-চর্চায় ঘেরা এক সংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাৎপদ স্বাস্থ্য খাত, আর এলিটরা পেত সেকালের মানদণ্ডে আধুনিক ও উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা।
এই দ্বৈত খাতবিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য চিন্তা উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্রেও পরিলক্ষিত হয়। এ দেশে তাই দেখতে পাচ্ছি যে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা’ গড়ে ওঠেনি, যেখানে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই নূ্যনতম এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাবেন নির্ভরযোগ্যভাবে। কেন গড়ে ওঠেনি তার একটা কারণ বোধ করি এই যে, এলিটরা ভেবেছিলেন তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য ‘জনস্বাস্থ্য’ জাতীয় কোনো ব্যবস্থার আদৌ দরকার নেই। সে রকম বিপদ এলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা লাভ করা যাবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর তো এমন কিছু দূরত্বে অবস্থান করছে না! কিন্তু এখন করোনাকালের লকডাউনের কারণে তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ। এখন বুঝি তারা বুঝতে পারছে, আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশের ভেতরেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া বর্তমানের মহামারি-সংকট তো নয়ই, ভবিষ্যতের কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিও মোকাবিলা করা যাবে না। কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে আদৌ আশাবাদী নই। বিল গেটসের মতো আমিও মনে করি, পরিবর্তন আসে তবেই যদি মনে থাকে। কিন্তু মানুষের স্মৃতি খুবই স্বল্পায়ু।
৫. মহামারির প্রভাব : রাষ্ট্রে-দর্শনে
প্লেগ, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি মহামারির প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়েছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। এই প্রভাব যেমন পড়েছে সমাজে-রাষ্ট্রে, তেমনি সাহিত্যে-দর্শনে। সামগ্রিকভাবে মানবজীবনের ইতিহাসে। অতীত আলোচনার একটি তাৎপর্য ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তার সুবিখ্যাত ‘রেকুইম ফর এ নান’ উপন্যাসের একটি উক্তি অনেকটা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে- The past is never dead. It’s not even past| এবার করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ব্যক্তি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেছিলেন এ কথা জানতে চেয়ে, কেন তাদের রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে ‘কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে বাধ্য করছে? স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে তাদের কি মুক্ত থাকার অধিকার নেই? এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফিরে যেতে হলো অতীতে- ১৮৯৭ সালের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্যাক্ট’কে সাক্ষী মানতে হলো। মমতা বললেন, ‘যাতে কেউই আরোগ্য লাভ না করে কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যেতে না পারে- জনগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে- [১৮৯৭ সালের] আইন পুনরুজ্জীবিত করা হলো।’
অতীত যদিও নবায়িত হয়ে ফিরে আসে পুনরায়, অবস্থাভেদে তার প্রত্যাবর্তনের ‘ইমপ্যাক্ট’ হয় বিভিন্ন রকম। মহামারির অভিঘাত বিভিন্ন সমাজে ও কালে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে এসেছে। মহামারি প্রতিরোধে ইউরোপের চিন্তার বিবর্তন উঠে এসেছে মিশেল ফুকোর লেখায়। লন্ডনের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ’ (যা ছিল ব্যুবনিক প্লেগ)-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে লন্ডন শহরে ১৬৬৫ সালে। এতে শহরটির ১৫ শতাংশ নাগরিকই মৃত্যুবরণ করেন। এই প্লেগে আরও অনেক বেশি লোকের মৃত্যু হতে পারত, কিন্তু অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে পারে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং রাজা (দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্ব তখন) তার সভাসদসহ অক্সফোর্ডে পালিয়ে যান। আজকে যেখানে অলগেট (Aldgate)- যেখানে এখন অধিকাংশ বাঙালি ও অভিবাসী বাস করেন- সেই এলাকাটিকে প্লেগে নিহতদের গণকবর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেদিন। এ রকমই আরেকটি গণকবর ক্ষেত্র ছিল ফিনস্‌বিউরি ফিল্ডস্‌। সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিল জনতার প্রতিক্রিয়া। যে বাড়িতে কোনো প্লেগের রোগী পাওয়া যেত সেই বাড়িকে বাইরের থেকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হতো। এতে করে ওই খানার অন্যান্য সদস্যেরও মৃত্যু হতো- প্লেগে অথবা অনাহারে! ঠিক পরের বছরে (১৬৬৬ সালে) লন্ডনে অগ্নিকাণ্ডে তার পুরো কেন্দ্রস্থলই ভস্মীভূত হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, এই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল প্লেগবাহী ইঁদুরেরা। এই প্লেগ হওয়ার প্রায় ৬০ বছর পরে রবিনসন ক্রুসোর লেখক ড্যানিয়েল ড্যাফো লেখেন ‘এ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’। ড্যাফো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, কিন্তু এমনভাবে লিখেছেন বিবরণী যেন তিনি ঘটনা-পরম্পরার সামনেই অবস্থান করেছিলেন।
১৩৪৬-৪৮ সালের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ আর ১৬৬৫ সালের ‘গ্রেট প্লেগ’ দুটিই ছিল প্লেগের মহামারি। এই অভিজ্ঞতা থেকে দুটো সুস্পষ্ট প্রবণতা বেরিয়ে আসে, যা রাষ্ট্রকে স্বৈরাচারী ক্ষমতা-প্রয়োগের পরিবর্তে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power)  বা জনজীবনে নিয়ম-শৃঙ্খলা আচরণভিত্তিক ক্ষমতা-প্রয়োগের দিকে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন আসত না যদি-না প্লেগের মতো মহামারি হতো। এই মহামারির সুবাদে রাষ্ট্র বাধ্য করে নাগরিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলতে। নাগরিকদের সমন্ত জীবনচর্চা তখন থেকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ মডেলে আবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে বশীভূত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যস্ততায়। উদ্ভাবিত হয় জবরদস্তিমূলক কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকার’ (বা সেলফ আইসোলেশন) অভ্যাস। করোনারকালেও এখন আমরা এদেশে বা বিশ্বজুড়েই ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের প্রয়োগ দেখছি। বিদেশফেরত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবর্গ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই বলেছেন যে তাদেরকে এয়ারপোর্টে ‘১৪ দিনের’ সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে এবং সেটি তারা এখন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। করোনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রেরও একটি নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর বলয়। প্রতিদিন রোগতত্ত্ব বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য-বুলেটিন পড়ে শোনাচ্ছে টিভিতে এবং নাগরিকরা তা শুনে তাদের প্রাত্যহিকের জীবনযাপনে স্বাস্থবিধি মেনে চলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন- অন্তত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায়। কোয়ারেন্টাইন বা সেলফ্‌ কোয়ারেন্টাইনে থাকছে সংক্রমিত খানাসমূহ (ব্যক্তি বা পরিবার), কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সমগ্র পাড়া বা গোটা এলাকাই। এভাবেই শৃঙ্খলাবদ্ধ নাগরিকে পরিণত হচ্ছি আমরা- হয়তো ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন বা সিঙ্গাপুরের মতো অতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নই এখনও- কিন্তু গতিমুখটা সেদিকেই। একটা চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞানকে অবলম্বন করে এই ক্ষমতার প্রয়োগ করছে রাষ্ট্র। এটি খারাপ না ভালো- সে বিবেচনায় ফুকো যাননি। তিনি শুধু দেখিয়েছেন কীভাবে ডেসপট বা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন করার পরিবর্তে অন্য ধরনের বিশেষায়িত ‘ক্ষমতারও’ উদ্ভব হয় এবং রাষ্ট্র তার প্রজাকুলের ওপরে প্রভুত্ব করার জন্য একটি বাড়তি হাতিয়ার পেয়ে যায়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে প্লেগ নামক মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রচলিত দমনমূলক যন্ত্রগুলোর পাশাপাশি এই অদৃষ্টপূর্ব শৃঙ্খলাপরায়ণ অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজের উদ্ভব হয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দীপেশ চক্রবর্তী ও অন্যদের সূত্র ধরে উপনিবেশিক পটভূমিতে মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে আমরা ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এরই প্রয়োগ দেখেছি। যার ভিত্তি ছিল কোয়ারেন্টাইন মডেল এবং শ্বেতাঙ্গদের জন্য ‘বিচ্ছিন্ন থাকার’ ক্যান্টনমেন্ট মডেল- যা নেটিভদের কাছ থেকে উপনিবেশের অফিসার-সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
তবে ১৮২৬-৩৭ সালের একের পর এক বিধ্বংসী কলেরা মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খোদ ইংল্যান্ডেই এই কোয়ারেন্টাইন ও সেলফ আইসোলেশনভিত্তিক ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’-এর মডেল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই মহামারিকে ‘এশিয়াটিক কলেরা প্যানডেমিক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় যেহেতু এটার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বঙ্গদেশে। বাংলায় এই মহামারির শুরু ১৮১৭-২৪ কালপর্বে; ধীরে ধীরে তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগের জন্য হয়তো কার্যকর ছিল, কিন্তু কলেরা কোয়ারেন্টাইন মানে না। এর জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আরও সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির। ঠিক এ রকম সন্ধিক্ষণে জন্ম নিল আরেক অদৃষ্টপূর্ব অভিব্যক্তি, ক্ষমতা ও সমাজ- যার ভিত্তি হলো ‘বায়ো-পাওয়ার’  (Bio-Power)। এর মানে এই নয় যে আগের শৃঙ্খলাপরায়ণতাভিত্তিক ক্ষমতার প্রয়োগ বা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার রাষ্ট্র-ক্ষমতার বলয় থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষা না করে আর কাজ চালানো যাচ্ছিল না। কলেরা, বসন্ত, হাম, যক্ষ্ণা প্রভৃতি রোগের ঘন ঘন প্রাদুর্ভাব রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল Bio-Power-র কথা ভাবতে। ১৮৩০-র দশকে চার্টিস্টদের আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল শ্রমিকদের বাসস্থানের সমস্যা- তাদের জীবনযাপনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা ছিল কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারির প্রজনন ক্ষেত্র। শ্রমিকদের অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে তরুণ মার্কস লিখেছেন সে সময়ে ‘দ্য হাউসিং প্রবলেমস্‌’, আর তরুণ অ্যাংগেলস্‌ লিখেছেন ‘কন্ডিশনস্‌ অব ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড’। এক কথায়,  Disciplinary Power স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র হেজিমনি হারাল নতুন পরিস্থিতিতে। তবে এর প্রয়োগ যথারীতি চলতে থাকল জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত কল-কারখানায়, জেলখানায় এবং বিদ্যানিকেতনে (ফুকো সে সম্পর্কে আলাদা করে লিখেছেন তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে)।
১৮৯৭ সালের ঔপনিবেশিক ভারতের ‘এপিডেমিক ডিসিসেস অ্য্যাক্ট’ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারকে তুলে ধরেছে। প্লেগে সংক্রমিত হলে সরকারি পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে বেঁধে হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছে সেখানে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় পুরোটাজুড়েই এই জোর করে ‘বিচ্ছিন্ন রাখার’ নীতিই কার্যকর ছিল। আমরা আগেই দেখেছি, প্রকৃত অর্থে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি, বা উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির বহুল প্রসার করার দিকে অগ্রসর হয়নি উপনিবেশের সরকার। সেটা হলে আমরা ঔপনিবেশিক বায়ো-পাওয়ারকে বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখতে পেতাম। ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিসেস অ্যাক্ট যখন প্রণীত হচ্ছে, তার পরের বছরেই কলকাতায় প্লেগের আক্রমণ হবে, আর ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে লেগে যাবে প্লেগ নিয়ে দাঙ্গা। অর্থাৎ ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারের ‘ডিসিপ্লিন’ উপনিবেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২) গ্রন্থে ভূদেব এ নিয়ে ইতিপূর্বেই কড়া অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, ভারতবর্ষে ৬০ বছর ও তার ওপরে বয়স্ক লোকের সংখ্যা (১৮৮১ সালের আদমশুমাুরি অনুযায়ী) মাত্র ৪ শতাংশ। এর কারণ, এখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি, এবং অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দুর্ভিক্ষে অথবা কিছুদিন পর পর ঘটে যাওয়া মারি-মহামারিতে ভারতবর্ষের মানুষ অকালেই মারা যাচ্ছে। ভূদেব অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘অনূ্যন পাঁচ কোটি ভারতবাসী অর্ধাশনে জীবনযাপন করে… এক প্রকার নিশ্চয় হইয়াই গিয়াছে যে, প্রতি দশ এগারো বৎসর অন্তর ভারতবর্ষে একটি করিয়া বৃহৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাহার পরেই একটি করিয়া মহামারি আসিয়া উপস্থিত হয়।’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। প্রায় একই সময়ে লেখা ‘এবার ফেরাও মোরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কেন ‘চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু’ লিখেছেন তার কারণটি বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।
ফুকোর ভাষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই কীভাবে মহামারি রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন ও ধারণাকে বদলে দিয়েছিল। রানী ভিক্টোরিয়া উনিশ শতকে লন্ডন শহরে পয়ঃনিস্কাশন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এভাবেই সেখানে গড়ে ওঠে আন্ডারগ্রাউন্ড স্যুয়ারেজ সিস্টেম (যেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে জার্মান বিমান হামলার সময় রাত্রিকালীন ‘শেল্টার’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল)। এই যে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলো মহামারি থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য তাকেই ফুকো বলেছেন ইরড়-চড়বিৎ। উপনিবেশের দেশগুলো এই ইরড়-চড়বিৎ-এর সুবিধাটুকু পায়নি।
[ক্রমশ]

Leave a comment