মহামারী, সাহিত্য ও করোনার কাল

এ সময়ই পদ্মা বোট থেকে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় প্লেগ ত খুব জেগে উঠচে। আপনার বুঝি স্থানত্যাগ করতে সম্মত নন?’

এ প্রসংগে নিবেদিতার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিবেকানন্দের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস মার্গারেট নোবল আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। বিবেকানন্দ ওর নাম দেন- ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় পা রাখলেন, তখন চতুর্দিকে প্লেগের পদধ্বনি। ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গাও হয়। কলকাতা তথা বঙ্গদেশেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। ‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ :এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ বইতে দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষে অমানুষিক সেবাকাজ চালিয়ে কলকাতায় ফিরে নিবেদিতা ম্যালেরিয়া ও “ব্রেন ফিভারে” [সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া অথবা এন্‌কেফেলাইটিস] শয্যাশায়ী।’ সেসময় মানে ১৯০৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লিখেছিলেন- ‘নিবেদিতা যে আপনার ওখানে পীড়িত অবস্থায় তাহা আমি জানিতাম না – আমি একখানা বই চাহিয়া তাঁহাকে কলিকাতার ঠিকানায় কয়েকদিন হইল পত্র লিখিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া এমন ব্যবস্থা করিবেন যে, পত্রের যেন তিনি কোন নোটিস না লন। তাঁহাকে আমার সাদর নমস্কার জানাইবেন এবং বলিবেন যে, উৎসুক চিত্তে তাঁহার আরোগ্য প্রত্যাশায় রহিলাম।’ নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যকার সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ। সুহৃদ জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমে নিবেদিতার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোটে অতিথি হয়েও গিয়েছিলেন তিনি, পূর্ববঙ্গের কৃষকদের অন্তঃপুরে গিয়ে আপনজনের মত করে গ্রামের মা-বোনদের সাথে কথা বলেছেন। গেছেন অনেকবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও। এই যাওয়ার পেছনে ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের পরিবারকুলের একাংশকে বিবেকানন্দ-নিবেদিতার সংঘ-কার্যক্রমে “দলে ভেড়ানোর” ইচ্ছেও তার থাকা অসম্ভব ছিল না। সরলা দেবীকে তো প্রায় দলে টেনেই নিয়েছিলেন। এ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের সাথে মনোমালিন্য হতে পারে তার। তার ছোট মেয়েকে (মীরা?) ইংরেজি শেখানোর জন্য অনুরোধ নিবেদিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেটাও একটা কারণ হতে পারে। নিবেদিতার প্রত্যাখ্যান ছিল তীক্ষষ্ট, এমনকি রূঢ়:’সে কি! ঠাকুরবংশের মেয়েকে একটি বিলাতী খুকি বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে!’ শুধু তা-ই নয়, রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য-বিমুগ্ধতার প্রতি কটাক্ষ করে আইরীশ নিবেদিতা বললেন :”ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফোটবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?” এই অসংকোচে মত রাখার প্রবণতা নিবেদিতার মধ্যে ছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথে জাগতিক আধ্যাত্মিক মত ও পথ নিয়ে মাঝেমাঝেই তুমুল তর্ক বেঁধে যেত। তার সবটুকু আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু জেনেছি যে (সাহিত্যিক বনফুলের স্মৃতিচারণার সুবাদে), ‘গোরা’ উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিতে নিবেদিতাই পীড়াপিড়ি করেছিলেন এবং এর ফলে উপন্যাসের বিয়োগান্ত পরিণতি একটি ইতিবাচক সমাপ্তিতে শেষ হয়। বনফুল লিখেছেন :

“[গোরার ] শেষটা বদল দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। নিবেদিতা নাছোড় হয়ে ধরে বসল। আবার ঢেলে সাজালাম সব।”

“গোরার শেষটা অন্যরকম ছিল?”

“হ্যাঁ। আমি গল্পটা বিয়োগান্ত করেছিলাম।…গল্পটা ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীতে বেরুচ্ছিল। কিন্তু ওটা আগেই লেখা হয়েছিল আমার। নিবেদিতা তখন বলল- গোরার শেষটা কী রকম করেছেন দেখি। দেখালাম। পড়েই সে বলে উঠল- না না, এ রকম হতে পারে না। ওদের মিলন না হলে বড়ই নিদারুণ ব্যাপার হবে যে। বাস্তব জগতে যা ঘটে না কাব্যের জগতেও কবি সেটা ঘটিয়ে দেবেন না? কাব্যের ও জগৎ তো আপনার সৃষ্টি, ওখানে আপনি অত নিষ্ঠুর হবেন না। ওদের মিলন ঘটিয়ে দিন। দিতেই হবে। এমন জেদ করতে লাগলে যে রাজি হতে হলো। সবটা আবার ঢেলে সাজালাম।” গোরা উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স বদলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা করেছিলেন তা আর কারো জন্য তিনি কখনো করেননি। এর একটি কারণ হতে পারে, দেশব্রতী গোরার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন নিবেদিতারই কাছ থেকে। শিল্পী নন্দলাল বসু স্মৃতিচারণা করেছেন পদ্মায় বোটে করে রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও নিবেদিতার আলাপচারিতা সম্পর্কে :’তাহাদের আলোচনার বিষয় আমি কিছু জানি না। তবে শুনেছি, ‘গোরা’ উপন্যাসের hero গোরা সিস্টারকে মনে করে করেছিলেন।’ আমার ধারণা, নিবেদিতার আদর্শ-রূপ তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৮৯৮ সালে কলকাতার প্লেগের সময়ে। ভয়-ভ্রুক্ষেপহীনভাবে নিবেদিতা তখন প্রকৃতই আর্তের ‘ভগিনী’ হয়ে প্লেগের মত মহামারীর কালে বিপন্নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই তেজোদৃপ্ত মূর্তি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ এবং সন্ন্যাসিনীর মত ত্যাগী পথচলা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মত ছিল না।

প্লেগের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে সেসময়ই। এর আগে প্লেগ সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু অত্যন্ত কাছ থেকে দেখা, ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করা, আর্তজনের পাশে দাঁড়ানো তার এই প্রথম এবং তা সিস্টার নিবেদিতার সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে। এ সম্পর্কে প্রথমে শুনব এডওয়ার্ড টমসনের (বিখ্যাত ইংরেজ বামপন্থী দার্শনিক ই, পি, টমসনের পিতা) ভাষ্যে। টমসন লিখেছেন : ‘That year [1998] plague broke out in Calcutta; she [Sister Nivedita] organized relief work, assisted by Tagore’ । দ্বিতীয় উৎস শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণা :’সেইসময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।’ পরের বছরে, অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে প্লেগ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছিল কলকাতায়। প্লেগের টিকা দিতে জনগণের একাংশের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা ছিল। যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, সেখানে বিদেশী শাসকের টিকা নিয়ে শেষটায় ‘জাত খোয়াতে হবে নাকি’, এই অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। ‘ঈধষপঁঃঃধ ঘড়ঃবং নু ধহ ঊহমষরংয খধফু’ শীর্ষক রচনায় নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন যে, কয়েকটি পরিবার, বিশেষত ঠাকুর পরিবার দৃঢ়তার সহিত এই বিক্ষোভ প্রশমন করিতে চাহিয়াছেন’। ১৯০৯-এ গোরা প্রকাশের দু’বছরের মাথাতেই নিবেদিতার মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির চমকপ্রদ অনুবাদ নিবেদিতারই করা (তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়)। তিনিই রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম অনুবাদিকা। এ কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু- রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার নাম দিয়েছিলেন- লোকমাতা।

আমি বলতে চাইছি যে, মহামারীর ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো, গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস। মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় তার ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায় (স্বদেশী সমাজ, লোকহিত প্রভৃতি প্রবন্ধে), এমনকি তার এই সময়কার দেশাত্মবোধক গানের বিচ্ছিন্ন চরণে। রোগক্লিষ্ট আর্তমানবতার বেদনাকে অনন্ত শক্তির বোধে রূপান্তরের জন্যই রচিত হয় তার নৈবেদ্য ও গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও সংগীত। মারী ও মহামারী তার সৃষ্টিশীলতাকে মানবতাবাদের দিকে প্রভাবিত করেছে।

এই মানবতাবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জগমোহন চরিত্র। তিনি আস্তিক বা নাস্তিক সে পরিচয় গৌণ। তার পরিচয় তিনি প্লেগের দুঃসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করেননি। এক-অর্থে, নাস্তিক জগমোহন আস্তিক নিবেদিতার কাউন্টার-পয়েন্ট। সেই ১৮৯৮ সালে- যে বছরে কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল- নিবেদিতাও রাস্তায় নেমেছিলেন, জগমোহনও রাস্তায় নেমেছিলেন। নিবেদিতা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু জগমোহন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বিবরণটা এই :

‘যে বছর কলিকাতা শহরে প্রথম প্লেগ দেখা দিল তখন প্লেগের চেয়ে তার রাজ-তক্‌মা-পরা চাপরাসির ভয়ে লোক ব্যস্ত হইয়াছিল। শচীশের বাপ হরিমোহন ভাবিলেন, তাঁর প্রতিবেশী চামারগুলোকে সকলের আগে প্লেগে ধরিবে, সেইসঙ্গে তাঁরও গুষ্টিসুদ্ধ সহমরণ নিশ্চিত। ঘর ছাড়িয়া পালাইবার পূর্বে তিনি একবার দাদাকে গিয়া বলিলেন, দাদা, কালনায় গঙ্গার ধারে বাড়ি পাইয়াছি, যদি-

জগমোহন বলিলেন, বিলক্ষণ! এদের ফেলিয়া যাই কী করিয়া?

কাদের?

ঐ-যে চামারদের।’

একথা শুনে হরিমোহন তার ছেলে শচীশকে বললেন তার সাথে গঙ্গার ধারের বাড়িতে চলে যেতে।

[ক্রমশ]

Leave a comment