দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কোনো স্থায়ী সমাধান নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ২১-০৬-২০১২

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তাঁরা এ খাতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
পাশাপাশি তাঁরা এ-ও বলেছেন, দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। স্বল্প সময়ের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি চালু থাকতে পারে। তবে প্রকৃত উন্নয়নের পথে যেতে হলে দরকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আর এ জন্য সবার আগে শিক্ষার উন্নয়নে নজর দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক, শিক্ষা খাতে তিন বছর ধরেই বাজেটে বরাদ্দ কমছে।
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল বুধবার ‘অতিদারিদ্র্য নিরসন: সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ব্র্যাক অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জের সহযোগিতায় প্রথম আলো বৈঠকটির আয়োজন করে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী ও হোসেন জিল্লুর রহমান, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম নুরুন্নবী, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন, বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি সাপোর্ট প্রোগ্রামের চিফ অব পার্টি আখতার আহমেদ, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির পরিচালক শীপা হাফিজা, প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক প্রমুখ।
টেকসই নিরাপত্তা: রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, দারিদ্র্য নিরসনই মূল কথা নয়। গতানুগতিক দারিদ্র্য নিরসনের চিন্তার বাইরে গিয়ে গোটা বিষয়কে দেখা দরকার সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী এখন আর টেবিলের এক পাশে পড়ে থাকা বিষয় নয়। এ বিষয়ে গত ৩০ বছরে আমরা কী করলাম, তার হিসাব মেলানো দরকার।’ তিনি বলেন, ‘ভারত এ বিষয়ে সাংবিধানিক অধিকার তৈরির পর বাস্তবায়নের দিকে গেছে। আর আমরা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করছি।’ তিনি বলেন, খোলাবাজারে চাল বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা যাবে না।
মাহবুব হোসেন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি আরও ২০ থেকে ৩০ বছর চালিয়ে নিতে হবে। তিনি মনে করেন, এ খাতে বাজেট বরাদ্দ ঠিকই আছে। দরকার মূলত কর্মসূচিগুলোর কর্মদক্ষতা। অনেক কর্মসূচি রয়েছে ত্রাণ হিসেবে। পানিতে ডুবে গেলে মানুষের নাকটা যেমন শুধু ভেসে থাকে, অনেকটা সে রকম। এ থেকে উত্তরণ দরকার।
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে দারিদ্র্য নিরসন হবে। সরকারের অন্য খাতগুলোকেও সমানভাবে কাজ করতে হবে।’
শীপা হাফিজা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর কোনো তথ্যভান্ডারই এখনো তৈরি হয়নি। তা ছাড়া যেসব কর্মসূচি আছে, সেগুলোতে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নীতি গ্রহণ করা দরকার আসলে ‘মানুষ’কে মাথায় রেখে, যা খুব বেশি হয় না।
আনিসুল হক বলেন, যমুনা সেতু হওয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। তৈরি পোশাক কারখানা, নির্মাণ শ্রমিক, ভুট্টা চাষ, পোলট্রি ইত্যাদিতে উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কর্মসূচিগুলো বেশির ভাগই প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ হলেই যেন সব শেষ হয়ে যায়। আর যেখানে যত বেশি প্রকল্প, সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবও তত বেশি।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক কারণেও কিছু কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। যেমন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’। ফলাফল কী হবে, এখনই বলা যাবে না। আবার কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেখানে তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য ঘুষ দেওয়া-নেওয়া হয়।
আখতার আহমেদ বলেন, সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
নগর দারিদ্র্য: বিনায়ক সেন বলেন, নগর দরিদ্ররা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, নগর দরিদ্ররা গ্রামে চলে গেলে নগরের ওপর চাপ কমত, তাদের জীবনও আরও সুন্দর হতে পারত। তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কয়েক বছর আগে নগর দরিদ্রদের জন্য অস্থায়ীভাবে নগরে জমি বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিল। একে ‘সর্বনাশা প্রস্তাব’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক কষ্টে তা রোধ করা গেছে। একবার বরাদ্দ দিলে তাদের আর উচ্ছেদ করা যেত না। রাজনৈতিক হলেও নানা প্রণোদনা দিয়ে নগর দরিদ্রদের গ্রামে পাঠানোর জন্য যে ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার অনেক সুফল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শিক্ষার উন্নয়ন: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, শিক্ষা এবং একমাত্র শিক্ষার উন্নয়নই হতে পারে দারিদ্র্য নিরসনের অন্যতম উপায়। এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে তা-ই হয়েছে। তিনি বলেন, কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কর্মসংস্থানের বিশাল আয়োজন করা না গেলে কিছুই হবে না।
অথচ বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ তিন বছর ধরেই কমছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের যে ধারণা, তাতে এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না।’
আখতার আহমেদ বলেন, শিক্ষা খাতে বৃত্তিজাতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু পুষ্টির বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। অথচ শিক্ষা ও পুষ্টি—এ দুই খাতেই সমান নজর দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম বলেন, জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারলে এর চেয়ে বেশিও অর্জন করা সম্ভব।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: সব পরিকল্পনার মধ্যেই জনসংখ্যাকে রাখতে হবে বলে মনে করেন এ কে এম নুরুন্নবী। তিনি বলেন, কোনো ক্ষেত্রেই সঠিক কোনো তথ্য নেই। কারণ, সরকারি উৎসগুলোর মধ্যেই সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, জন্ম নিবন্ধনটাও কার্যকরভাবে করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
নুরুন্নবী আরও বলেন, এখন থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিতে পারলে আগামী ১০ বছরে দেশ বয়স্ক লোকের ভারে ভরে যাবে। শুরু হয়ে যাবে অরাজকতা।
কিছু পরামর্শ: হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে যায় হঠাৎ অসুখ বিসুখে পড়লে, ওষুধের খরচের কারণে। অথচ এ বিষয়ে কোনো কর্মসূচি নেই। অক্টোবর-নভেম্বরে মৌসুমি দরিদ্রদের কোনো কাজ থাকে না। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ও মানুষের কিছু করার থাকে না। তাদের জন্যও কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল একেবারে না খাওয়াটাই ছিল সমস্যা। এখন সমস্যা পুষ্টিহীনতা।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সরকারের ওপরই চাপটা বেশি। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম বিত্তশালীদের এ ব্যাপারে চাপ দেয় না। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কেন তাঁদের অনীহা বুঝতে পারছি না।’
ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ২০০১ সালের হিসাবে দেশে ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।
বিনায়ক সেন বলেন, ধনিক শ্রেণীর সম্পদের ওপর থেকে কর আদায় করে তা সহজেই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ব্যয় করা যায়।

রবীন্দ্রনাথে অবগাহন

বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ২০-০৬-২০১১

নিজের আঁকা ছবিতে তিনি রহস্যময়। সেই ছবি মঞ্চে, চারপাশের দেয়ালে। সঙ্গে উৎকীর্ণ তাঁর রচনার অংশ। রবির সেই বাণী স্পষ্ট, বাইরের ঝলমলে রবির আলোর মতোই অম্লান। তাতেই অবগাহন করে কাটল সারা বেলা, এই সময়ে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার অনুসন্ধান প্রয়াসে।
প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত ‘রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে’ শীর্ষক দুই দিনের সেমিনারের গতকাল রোববার ছিল সমাপনী। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উইন্ডি টাউন মিলনায়তনে কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এই সেমিনারে গতকালও চারটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ নানা শ্রেণীর রবীন্দ্র-অনুরাগী শ্রোতা দিনভর নিমগ্ন ছিলেন বিদগ্ধজনের নানামাত্রিক রবীন্দ্র-বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের জীবনে এখনো সত্য ও সুন্দরের ফল্গুধারার মতো বহমান, সে কথাই নানাজনের মুখে ঘুরেফিরে এসেছিল বিভিন্নভাবে। সত্য ও সুন্দরের প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারায় না।

রবীন্দ্রনাথের নাটক
সকাল ১০টায় আলোচনার পালা শুরু হয়েছিল নাটক বিষয়ে। অধ্যাপক অনুপম সেন ছিলেন সভাপতি। প্রবন্ধ পড়েন নাট্যজন আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নাট্যরচনায় ছিলেন বৈচিত্র্যসন্ধানী এবং সেই কারণে তাঁর নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। তাঁর সমগ্র নাট্যসাহিত্যে পাই ধর্মীয় ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকারও। চিরনতুন এবং চিরপ্রাসঙ্গিক।’ তিনি বিভিন্ন নাটকের সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে, নাট্যনির্দেশনা ও মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতার উল্লেখের মাধ্যমে আলোচনাকে রসগ্রাহী করে তুলেছিলেন।
পরে এ প্রসঙ্গে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেছেন, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংখ্যা ৭৮টি। স্বাধীনতার পর ৪০টি মূল নাটক এবং ৩৪টি রূপান্তরিত মিলিয়ে ৭৪টি নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে। নাটকে তিনি বিশ্বনাগরিকতাবাদী।
অভিনয়শিল্পী সারা যাকেরও রবীন্দ্রনাটক নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাঁর নাটকে আমরা লক্ষ করি, সব সময় তিনি সমাজের কোনো একটি বড় বাধা বা শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয় তুলে ধরেছেন। সে কারণে তাঁর নাটক সাধারণ দর্শকও সহজেই গ্রহণ করতে পারে। তবে সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে যদি উপস্থাপনার রাবীন্দ্রিক রীতি ভেঙে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা যায়, তবে নব নব রূপে তাঁকে আবিষ্কার করা সম্ভব।’
ড. আফসার আহমেদ বলেন, ইউরোপীয় রীতির প্রসেনিয়াম থেকে বাংলা নাটক যে বেরিয়ে এসেছে, রবীন্দ্রনাথের হাতেই তার সূচনা হয়েছিল। তিনি সংগীতকেন্দ্রিক আসরনির্ভর দেশীয় ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির আঙ্গিকে নাট্য রচনা করেছেন। তাঁর চিত্রকল্প আরোপিত নয়, দৃশ্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি করেছেন, তা সহজেই দর্শকচিত্ত স্পর্শ করেছে।
সভাপতি অনুপম সেন বলেছেন, তাঁর নাটক সাংকেতিক বা রূপকধর্মী। এই নাটকের মৌলিকতা অতুলনীয়। বিশ্বনাট্যসাহিত্যে এমন নাটক বিরল। তিনি একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী হয়েও আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাঙালিকত্বকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার সমাজের প্রতিটি মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। নাটকে সেই বিশ্বাস পরস্ফুিট করে তুলেছেন। তিনি কেবল এই সময়েই প্রাসঙ্গিক নন, তিনি কালজয়ী।

রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়
চা পানের পরে ‘রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়’ বিষয়ে দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে।
ড. আকবর আলি খান দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, তবে তিনি সেটি সামনে রেখে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা করেন। কবির পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। কারণ এ সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণার অভাব আছে। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন। জমিদার বললেই মনে হয় উৎপীড়ক। কিন্তু তিনি উৎপীড়ক নন, নিজেই উৎপীড়িত ছিলেন পীরালি বংশের কারণে। প্রায় ৩০০ বছর আগে তাঁর পূর্বপুরুষ কলকাতায় গেলেও কুলীন ব্রাহ্মণেরা তাঁদের জাতে নেননি। ব্রাহ্মণেরা তাঁদের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতেন না। বিয়ের কনে আনতে হতো পূর্ববঙ্গের পাড়াগাঁ থেকে। রবীন্দ্রনাথের জন্যই তা করা হয়েছিল। জাতিভেদের কুফল সারা জীবন ভোগ করেছেন। অন্যদিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর বড় জমিদার ছিলেন, তিনি তা ছিলেন না। বছরে তাঁর জমিদারির আয় হতো ৪৫ হাজার টাকা। সেই টাকা সংসারে ভাগ হয়ে যেত পাঁচ পরিবারে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেতন ছিল বার্ষিক ৪৮ হাজার এবং অধ্যাপকের বেতন ছিল নয় হাজার ৬০০ টাকা।’ এমন আরও অনেক তথ্য উপস্থাপন করে তিনি বলেছেন, কবির পরিবার ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই। কাজেই সাধারণ মানুষের দুরবস্থা যে তিনি জানতেন না, তা নয়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি মানুষের দুর্দশা উপলব্ধি করেছেন এবং সাহিত্যে তা তুলে ধরেছেন।
এরপর প্রাবন্ধিক বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ মার্ক্স বা গান্ধীর দৃষ্টিতে পশ্চিমকে দেখেননি। পুরো গ্রহণ বা বর্জনে তাঁর সায় ছিল না। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় চেয়েছিলেন। নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা উন্নয়ন বলতে যে ধরনের মানব উন্নয়ন, শিক্ষা, ক্ষমতায়ন—এসবের কথা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের মানবমুক্তির ভাবনাতেও তা-ই ছিল। তাঁর কথাই আজ আলোচিত হচ্ছে। তবে বর্ণবাদ বিলোপের ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি। নারীর সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ভেবেছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে হূদয় নিয়েই তিনি বেশি ভাবিত ছিলেন। অবশ্য তিনি সব ক্ষেত্রেই তাঁর কালকে অতিক্রম করে যাবেন, এমন দাবি করাও তাঁর প্রতি অবিচার করা। তাঁর কাছে আদর্শের চেয়ে মানুষ ছিল বড়। এই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি সোচ্চার ছিলেন। যেসব সমস্যার সরাসরি সমাধান তিনি দেননি, তা তাঁর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে। এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা।
আলোচনায় অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, সমাজের চেয়ে ব্যক্তিমানুষ তাঁর কাছে বড় ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তি মানুষ সমাজের অণু। এই অণুগুলো বদলালে সমাজ বদলাবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রেও পরিবর্তন আসবে। মনুষ্যত্ব অর্জনের কত পন্থা আছে, মানুষ কত উচ্চে উঠতে পারে, তিনি সেই সন্ধানই করেছেন। মনে রাখতে হবে, তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না, সমাজসংস্কারকও ছিলেন না। তিনি সংস্কারক ছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতির।
ড. মালেকা বেগম বলেন, ‘নারীবাদ মানবতাবাদের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি মানবতার কথা বলেছেন। আন্দোলনের পথে নেমে তাই আমরা তাঁর কথা বাদ দিতে পারি না। তিনি কিছু লুকোননি। সরাসরি স্পষ্ট করে বলেছেন, আমাদের সমাজে যেটার অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর বক্তব্যকে সামগ্রিক ভাবনার আলোকে নিয়ে লক্ষ করেছি, সেখানে আছে সমাজবদলের দলিল।’
অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, ‘তিনি ব্যক্তির ওপর সমষ্টির প্রাধান্য পছন্দ করেননি। তিনি ভাবতেন, মানুষ নেই তো সত্যও নেই। এই মানুষকেই তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান করার কথা বলেছেন। বিশেষত, গ্রামের মানুষের ক্ষেত্রে যেভাবে বলেছেন, রাজনীতিকদের তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।’
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া যাবে না—রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যক্তি একাকী অনেক কিছু করতে পারে না, রাষ্ট্রের সাহায্য প্রয়োজন হয়। তবে সমাজকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতেন না তিনি। তাঁর কাছে সমাজ বড়, রাষ্ট্র নয়। সমাজের অনেক অসংগতি তিনি মানেননি। মানলে সেসব নিয়ে লিখতেন না। সেই লেখায় সত্যমূল্য না থাকলে তা হয় ছলনা। তাঁর লেখা ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ কথাটি আজ প্রবাদের মতোই সত্য। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধ চলছে, কর্মহীন বেকার যুবক ছুটছে, নিষ্ফল মাথা কুটছে—এগুলো সবই সত্যি। এসবই তার মনুষ্যত্বের দায় বহন করে। এই সত্যের জন্য, এই সমাজ ভাঙার শক্তির জন্যই রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হয়।

রবীন্দ্রনাথের জাতিভাবনা
দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা ছিল মিলনায়তনেই। খাবারের পর তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় এই দুই দিনের সেমিনারের আহ্বায়ক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে।
রবীন্দ্রনাথের জাতিভাবনা নিয়ে প্রবন্ধ পড়েন ড. বিনায়ক সেন। দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এ পর্বে। প্রাবন্ধিক বলেছেন, ‘জাতি’ না বলে রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’ বলতে চেয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে ১৮৮৫-১৯১০ পর্যন্ত ছিল এই ‘নেশন’-এর প্রতি গভীর মোহ। ভাষা দিয়েই তাঁর এই মোহ শুরু হয়েছিল। তিনি নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় করে মহাজাতি গঠন করতে চেয়েছেন। এই মোহ ভেঙেছে ১৯১০-৪১ কালপর্যায়ে। তিনি তখন ‘নো নেশন’-এর পক্ষে কথা বলেছেন। প্রাচ্যে সমাজকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সমাজ গঠিত হয়। তিনি এই দুয়ের মধ্যে একটি সমন্বয় চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলেছেন ‘ট্র্যাজিক হিরো’।
আলোচনায় অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক মতপ্রকাশের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনেকবার নিন্দিত হয়েছেন। আমাদের সমাজে ভাষাগত, ধর্মীয়, স্থানীয়—বহু ধরনের ঐক্য ছিল। এই ঐক্যের বোধকে তিনি জাতীয়তাবোধ বলেছেন। উগ্র জাতীয়তা গ্রহণ করেননি। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকার লক্ষ করেছিলেন। সমন্বয়ের পথ ধরেই বাঙালিকে উন্নত হওয়ার কথা বলেছিলেন।’
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আমরা বাংলায় কথা বলি তাই আমাদের বাঙালি বলা হয়। কিন্তু বলাই যেতে পারে, ১৯৪৭ সালের পরে বাঙালি জাতি বলে আর কিছু নেই। কারণ, তারপর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। নতুন পরিস্থিতিতে আমরা লড়াই করে যে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি, সেই রবীন্দ্রনাথও অন্য রকম।’
ড. রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জাতিসত্তার ভিতর থেকে আন্তর্জাতিকতার বিষয়টি দেখেছেন। আমরা জাতিসত্তাকে বিকশিত করছি না—এই আক্ষেপ তাঁর ছিল। “বাংলাদেশ” নামটি তাঁর রচনাতেই সবচেয়ে বেশি এসেছে।’
সভাপতি আনিসুজ্জামান বলেন, ইউরোপীয় ও ভারতীয় রাষ্ট্রভাবনায় পার্থক্য ছিল। মোগল-আফগান শাসনের সময় যে সমস্যা হয়নি, ইংরেজ শাসনামলে তা দেখা দিয়েছিল। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রে সংঘবদ্ধ সংস্থা। এর লক্ষ্য রাজনীতি ও ব্যবসা পরিচালনা। ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে অন্য দেশ দখল করে সংঘাতের দিকে চলে যায়। অন্যের দেশ দখল করার নীতিকে রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেননি। তিনি জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে আত্মশক্তি জোগানোর কথা বলেছেন, যাকে আজ আমরা জনগণের ক্ষমতায়ন বলছি। তবে সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি অনেক কিছুই এড়াতে পারেননি।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
শেষ অধিবেশনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিষয়ে। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অসুস্থতার কারণে আসেননি। সেটি পাঠ করেছেন মারুফা রহমান। প্রবন্ধকার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ পেশাজীবী তৈরির জন্য শিক্ষার কথা ভাবেননি। শিক্ষা কোনো গণ্ডিতে বা ছকে বাঁধা যায়—এমন কথা তাঁর ভাবনাতেই আসেনি। তাঁর কাছে পড়ানোর বিষয়, ধরন বা উপকরণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো চর্চা ও সাধনায় নিরত শিক্ষকের সহূদয় সক্রিয় সাহচর্য। তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তি ও আনন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আলোচক দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানুষকে বদলে পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
অধ্যাপক মোহীত উল আলম বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মৌলিক শিক্ষাভাবনার সঙ্গে আমাদের ভাবনা মেলে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার ভৌত পরিকাঠামোর অভাব আছে।’
অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘আমরা বৃত্তিজীবী চাই, মানুষ চাই না। শিক্ষার মূল আদর্শ হারিয়ে ফেলেছি।’
সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সফল মানুষ হওয়ার কথা অনেকে বলেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রেনেসাঁ-মানব। তিনি জীবনের সব সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষ যেন তাঁর জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে, তেমন শিক্ষা চেয়েছিলেন।
অধিবেশন সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই দুই দিনের আটটি সেমিনারের প্রবন্ধ ও আলোচনাগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হবে। আগামী ২২ শ্রাবণ কবির প্রয়াণ দিবসে বইটি প্রকাশিত হবে।