বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
সংবিধান গ্রহণের শেষ কার্যদিবসে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্মরণীয়ভাবে বলেছিলেন (এই বক্তব্যের পরই বঙ্গবন্ধু তাঁর সমাপনী ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ান):
“মাননীয় স্পীকার, স্যার, আজকের এই শেষ দিনে আমি কিছু বক্তব্য রাখতে ইচ্ছা করে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারি। আজকে শেষ দিনে আমরা আমাদের মনের আকাঙ্ক্ষা, আমাদের মনের অভিব্যক্তি-প্রকাশের শেষ পর্যায়ে এসেছি। আজকের এই শেষ দিনে আমাদের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর যে মনের কথা, যে মনের অভিব্যক্তি, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কথা এই মহান গণপরিষদে এক পবিত্র দলিলে আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি- যে দলিলে থাকে মানুষের চলার পথের ইঙ্গিত। মানব-মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের বাস্তকব রূপ আজকে এই মহান্‌ গণপরিষদে আমরা দিতে যাচ্ছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, এই গণপরিষদের একজন নির্দলীয় সদস্য হিসাবে আমি যে আলোচনা করেছি এই সংবিধানের উপর, সেখানে আমার মনের যে অভিব্যক্তি, মনের যে আবেগ, মনের যে ধারণা, সেটাই আমি সরল মনে ব্যক্ত করেছি আমার বক্তব্যে- একজন সম্পূর্ণ সরল মনের মতো। সেখানে ছিল না কোন উদ্দেশ্যমূলক কথা, সেখানে ছিল দেশকে আমি যেভাবে ভালবেসেছি, যেভাবে আমার মনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি, যেভাবে আমি কোটি মানুষের একজন হয়ে দেখেছি, সেইভাবেই এই মহান্‌ গণপরিষদে বলেছি। মাননীয় স্পীকার, স্যার, আমি নির্দলীয় সদস্য হিসাবে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছি এবং আমাকে মাননীয় সদস্য-সদস্যা ভাই-বোন, মাননীয় স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকার যে সময় দিয়েছিলেন কথা বলার, সেটা আমি মনে করি, এই মহান গণপরিষদে গণতান্ত্রিক অধিকারের একটা ঐতিহাসিক স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। মাননীয় স্পীকার সাহেব, আজ যে সংবিধান এই মহান্‌ গণপরিষদে গৃহীত হবার শেষ পর্যায়ে রয়েছে, সেই সংবিধানে বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র উত্তরণ হবে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশে। মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র হবে, দেশে অভাব থাকবে না, হাহাকার থাকবে না, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না, হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ- কিছুই থাকবে না। শুধু থাকবে মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি, মায়া, মমতা এবং তার দ্বারা এক নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। মানবতার একটা ইতিহাস থাকবে এবং তাতে লেখা থাকবে “সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই”। আমি আজ কামনা করি, তাই হোক। আসুন, শপথ করি, যেন আমাদের চেষ্টা সফল হয়, যেন শোষণহীন সমাজ বাস্তবে রূপায়িত হয়। আর যেন রাস্তায় রাস্তায় শ্নোগান না হয়, “আমাদের দাবী মানতে হবে”। আর যেন মিছিল না হয়, “আমাদের দাবী মানতে হবে”, “সংগ্রামে চলবে, সংগ্রাম চলবেই” বলে। সেই অবস্থা আর যেন না হয়। আমরা যেন আমাদের জন্মভূমি গড়ার কাজে ভাল করে মনোনিবেশ করতে পারি। আজ এই সংবিধান যাদের রক্তে এল, তাদের কথা যেন ভুলে না যাই। অতীতের ভুলের ইতিহাস, অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা, অতীতের মানব-সভ্যতা, মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার যে সংগ্রামে, আজ এই সংবিধানে তা সন্নিবেশ করে আমাদের ইতিহাস বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, যাতে আমাদের এই ইতিহাস বিশ্বের মধ্যে অনন্য হয়ে থাকতে পারে। আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাঁদেরকে, যাঁরা নিজেদের জীবন বলি দিয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন এবং এ দেশ থেকে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যে সব ভাই-বোন সেই সরকারের কঠোর নির্যাতন সহ্য করেছিল, সে সব ভাই-বোনকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। স্বাধীনতার জন্য যে সব মা-বোন রক্ত দিল, যার জন্য আজ আমরা এই গণপরিষদে দাঁড়াতে পেরেছি, সেই মা-বোনদেরকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সেই সব বীর মুক্তি-পাগল লোকদের, যাঁরা আজ পঙ্গু হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যার জন্য তাঁরা অসীম দুঃখ-কষ্টে কালাতিপাত করেছেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ছাত্র-সমাজকে, শ্রদ্ধা নিবেদন করছি বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দকে, শ্রদ্ধা নিবেদন করছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীকে। সর্বশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি জাতির শ্রদ্ধেয় পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর নেতৃত্বে আজ এই মহান্‌ গণপরিষদে কোটি কোটি মানুষের জন্য এই পবিত্র দলিল রচিত হয়েছে।”
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, এসব কথা যিনি সংবিধান গ্রহণের শেষ কার্যদিবসে বলবেন, তাকে কেন শেখ মুজিব ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলবেন। আর বললেই বা তিনি শুনবেন কেন, বা কেনই বা চূড়ান্ত সংবিধানে স্বাক্ষর করবেন? মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাকশালেও যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে এবং ‘দ্বিতীয় বিপ্লবকে’ সমর্থন করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে লেখা ছিল ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান’ করার লক্ষ্য। এতে করে পার্বত্যবাসী ও সমতলবাসী সকল উপজাতি-সম্প্রদায়কেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এক্ষেত্রে ১৪ক ধারা হিসেবে সংশোধনী যেটি এনেছিলেন তাতে সংযোজন করতে চেয়েছিলেন নিল্ফেম্নাক্ত অংশ:
‘সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ও অনগ্রসর জাতিসমূহের (ক) ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণ করা হইবে; (খ) শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ-অধিকার দেওয়া হইবে; এবং (গ) অগ্রসর জাতিসমূহের সহিত সমান পর্যায়ে উন্নীত হইবার পরিপূর্ণ সুযোগ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা বিধান করিবেন।’
কিন্তু এই সংশোধনী আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কেবল ‘মনস্তাত্ত্বিক কারণ’ ছাড়া। অন্যান্য ধারায় এসব অধিকারকে বাংলাদেশের সকল অধিবাসীর জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন, ১৯নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে অঞ্চলগত সমতা বিধানের কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে- ‘প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে (১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না,’ এবং (২) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’। এবং অবশ্যই মনে করতে হবে সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ উপধারা যেখানে স্পষ্ট করা বলা ছিল যে ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ অর্থাৎ লারমা যেটা চেয়েছিলেন সেটা অন্যভাবে অন্যান্য ধারার মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীর জন্য নিশ্চিত করা হয়েছিল। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠীর যাতে অংশগ্রহণ থাকে সেজন্য ২৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল:
‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই (ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আগে উল্লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন একটি দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন। পূর্বতন ১৯৫৬ বা ১৯৬২-এর সংবিধানে পার্বত্যবাসীর বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যে এনে সার্বিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এটি তিনি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন। পুরো উদ্ধৃতিটি প্রাসংগিক বিধায় তুলে ধরা হলো:
‘জনাব স্পীকার সাহেব, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মাননীয় সদস্য সেই এলাকা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন যে, বৃটিশ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সে এলাকার যে একটা ইতিহাস ছিল, সংবিধানে তা উল্লেখ করা হয়নি। আগে সে এলাকার ব্যাপারে যে বিশেষ বিধান ছিল, এ সংবিধানে তা নেই। আমি এ কথা স্বীকার করছি, কিন্তু সেই সঙ্গে আমি এ কথাও বলতে চাই যে, আগে সে এলাকার লোকদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছিল। এ সম্বন্ধে আমরা দেখতে পারি ভারত শাসন আইনের ৯২ ধারা। সে ইতিহাস আমরা সংবিধানে লিখিনি। ৯২ ধারায় এগুলোকে ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ বলা হত। তাতে বলা আছে:
“The executive authority of a Province extends to excluded and partially excluded areas therein, but, not withstanding anything in this Act, no Act of the Federal Legislature or of the Provincial Legislature, shall apply to an excluded area or a partially excluded area…”
আইনের কোন ‘প্রটেকশন’ তাঁদের ছিল না। কোন আইন তাঁদের সম্পর্কে করা যেত না। আরও আছে:
“Governor may make regulation for the peace and good government of any area in a Province which is for the time being an excluded area, or a partially excluded area,…”
তখন তাঁরা সংসদের আওতা থেকে সম্পূর্ণ বাইরে ছিলেন। তাঁরা আইনের আশ্রয়ের বাইরে ছিলেন। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানের ২২১ অনুচ্ছেদে এটা দেখতে পাই। তাঁদের আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করে সেখানে গভর্নরের শাসন চালু রাখার বিধান করা হয়েছিল। সংসদ তাঁদের ব্যাপারে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারতেন না। তাঁরা আদালতের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত থাকতেন। হাইকোর্টে মামলা করতে পারতেন না। ফাঁসির অর্ডার হলেও হাইকোর্টে যেতে পারতেন না। সচেতনভাবেই আমরা সেই ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দিতে চাই। কারণ, এই সব বিধানের সাহায্যে তাঁদের নানাভাবে শোষণ করা সম্ভব হয়েছিল। দুঃখজনক যে, তাঁরা শোষিত হয়েছেন, তাঁদের শোষণ করা হয়েছে। মাননীয় সদস্য সেই শোষণের কথা বলেছেন। বিশেষ বিধান থাকার ফলেই শোষণ করা সম্ভব হত। ঔপনিবেশিক শাসকরা অন্যায়ভাবে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করত, এক অংশের বিরুদ্ধে অন্য অংশকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করত। দেশের অন্যান্য নাগরিকের সমান অধিকার তাঁদের দেওয়া হয়নি। আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং তাঁদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রেখেছিল এবং আমাদের শাসন ও শোষণ করত। বিশেষ বিধান থাকার ফলেই আমাদের শোষণ করা সম্ভব হত। আজ বাংলাদেশের সব অঞ্চলের জনসাধারণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আমরা সবাই আজ এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের নাগরিক পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর বা পটুয়াখালী- এই সব এলাকার যেখানেই থাকুন না কেন, সবাই সমান মর্যাদা ভোগ করবেন। তার পরেও দেশের অনগ্রসর লোকদের জন্য বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। আমি আপনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাননীয় সদস্যের কাছে আবেদন করব, তিনি যেন অতীতের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের কথা চিরদিনের জন্য ভুলে যান। বাংলাদেশের সবাই যাতে স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারে, সেজন্য সকলে মিলে কাজ করার সময় এসেছে।’
তারপরও মানবেন্দ্র লারমার ওয়াকআউট ঠেকানো যায়নি। অনেকটা যেন অভিমান করেই তিনি সংসদ-কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরে আবার আসলেন বটে, কিন্তু দাগ, একটা দাগ, তার মনের মধ্যে থেকে গিয়েছিল।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আবুল ফজল একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ‘শেখ মুজিব :তাঁকে যেমন দেখেছি’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, কিন্তু মূল লেখাগুলো রচিত হয়েছে বেশ আগেই। লেখাগুলো স্মৃতিচারণমূলক- অনেকক্ষেত্রে ‘রোজনামচা’ থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দেওয়া। ১৯৭৬ সালের ২৬ আগস্ট একটি রোজনামচায় তিনি লিখেছেন:
‘নিঃসন্দেহে শেখ ছিলেন এ যুগের সর্বপ্রধান বাঙালী। যে সর্বপ্রধান বাঙালীকে আমরা বাঙালীরাই কি না নিজের হাতে হত্যা করলাম! আশ্চর্য, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হলো। বাঙালীকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতে কে জুগিয়েছিল সাহস? শেখ মুজিব নয় কি? বজ্রগর্ভ আর অমিত প্রেরণার উৎস ‘জয় বাংলা’ শ্নোগান কে তুলে দিয়েছিল বাঙালীর মুখে? শেখ মুজিব নয় কি? জিন্দাবাদে সে জোর, সে চেতনা, সে উদ্দীপনা কোথায়? জয় বাংলা প্রদীপ্ত শিখা, জিন্দাবাদ ধার করা এক মৃত বুলি। গ্রাম বাংলার শতকরা নব্বইজন যার অর্থই বুঝে না। এ যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালী মুসলমান শেখ মুজিব- এ কথা বল্লে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয় না। হিন্দু বাঙালীয়ানা আর মুসলমান বাঙালীয়ানায় কিছুটা পার্থক্য আছে। তাই মুসলমান কথাটা যোগ করলাম। তবে এ পার্থক্য সবসময় বিরোধমূলক নয়। শেখ মুজিবের বেলায় যেমন তা ছিল না। তাঁর সমগ্র মুসলমানিত্ব নিয়েই তিনি এক পরিপূর্ণ বাঙালী ছিলেন। এমন বাঙালী বিরল। এ বিরল বাঙালীটিকেই কি না হত্যা করা হয়েছে। আমরা নিজেরাই করেছি। এ যেন নিজের অঙ্গ নিজে ছেদন করা।’
এই অনুশোচনা ও পিতৃহত্যার গ্লানি জাতির বিবেককে প্রতি মুহূর্ত দংশন করছে এটা বারবার ওই পুস্তকে উচ্চারিত হয়েছে। এটা কাকতালীয় নয় যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানীর নাম ‘মুজিব নগর’ করা হয়েছিল- সেটা আর কারও নামে নয়, শেখ মুজিবের নামেই। অন্যত্র আবুল ফজল লিখেছেন: ‘এ স্বাধীনতার জন্য আমরা শেখ মুজিবের কাছে ঋণী। তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নাম যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে এবং অনুপস্থিতিতে যে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল তাঁকেই করা হয়েছিল সে সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করেছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে, সে সরকারের বাস্তব বা কাল্পনিক রাজধানীর নাম ‘মুজিব নগর’ হয়েছিল। অন্য নাম কারো মাথায় আসেনি।’ ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবরের রোজনামচায় তিনি আরও লিখেছেন:
‘সাম্প্রতিক ঘটনায় শেখ সাহেবের হত্যা সম্পর্কে আমি অনবরত বিবেকের একটা দংশন অনুভব করছি। এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছেন না, এ ভাবা যায় ন। আশ্চর্য, মননশীল লেখক-শিল্পীদের মধ্যেও তেমন একটা সাড়া দেখা যায়নি এ নিয়ে।… এত বড় একক ট্র্যাজিক ঘটনা তাঁরা আর কোথায় খুঁজে পাবেন লেখার জন্য?’
আবুল ফজল বারে বারে এটাই বলতে চেয়েছেন, বাঙালিদের জন্য একটি নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমি শেখ মুজিবই দিয়ে গেছেন, অথচ তাকেই আমরা কী অবহেলাই না করেছি তার মৃত্যুর পর- অনেক অনেক দিন পর্যন্ত! প্রশ্ন উঠতে পারে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গড়া ‘বাঙালিদের’ জন্য এক স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি তার মধ্যে কি ‘অন্য জাতি-উপজাতি’ও পড়েন? এ নিয়ে কিছুটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে গত তিন দশকে। সে বিষয়ে দ্রুত আলোকপাত করতে চাই।
এর আগে এ বিষয়ে ইংগিত দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে বঙ্গবন্ধুর ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলার মানুষ’ এই শব্দযুগলের মধ্যে বৃহত্তর পরিচিতির আভাস পাই। এই পরিচিতিকে (আইডেনটিটি) কেবল নিছক ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ (মেজোরিটারিয়ান) জনগোষ্ঠীর পরিচয় হিসেবে নির্দিষ্ট করা চলে না। এর মধ্যে প্রথাগত-অর্থে যারা বাঙালি তারাও আছেন, আবার যারা মাতৃভাষা হিসেবে বাঙালি নন, তারাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে ধরনের ‘মহাজাতি’ গঠনের কল্পনা করেছিলেন, শেখ মুজিবের কাছে ‘বাঙালি’ ছিল তেমনি এক মহাজাতিক প্রকল্প। যার মধ্যে বাঙালি হিন্দুরাও পড়েন, বাঙালি মুসলিমও পড়েন। কারও কারও কানে এটা কষ্টকল্পিত দাবি বলে মনে হতে পারে, সে জন্যে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নেওয়া এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবের বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরছি। এই ভাষণের প্রেক্ষাপটটি বলি। এর একদিন আগেই নির্দলীয় সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার ‘ডিসেন্ট’ ব্যক্ত করেছেন। তিনি গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন:
‘এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এই খসড়া সংবিধানে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলের কোন কথা নাই।… পার্বত্য চট্টগ্রাম হল বিভিন্ন জাতি-সত্তার ইতিহাস। কেমন করে সেই ইতিহাস আমাদের সংবিধানের পাতায় স্থান পেল না, তা আমি ভাবতে পারি না। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে-পড়া, নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।’ এর কিছু পরে লারমা যোগ করলেন- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা ইতিহাস আছে এবং সেই ইতিহাসকে কেন এই সংবিধানে সংযোজিত করা হল না?… এই সংবিধানে মানুষের মনের কথা লেখা হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মেথর, কামার, কুমার, মাঝি-মাল্লার জন্য কোন অধিকার রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের অধিকারের কথাও সংবিধানে লেখা হয়নি।’ এর পর সভা পরদিন সকাল পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেদিনের বক্তব্য পুনরুক্তিমূলক ও আবেগ-আক্রান্ত ছিল। কিন্তু আবেগের আতিশয্যের কারণেই এই কথাগুলোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো হেতু নেই। রাজনীতিতে ‘পার্সেপশন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এটা ভেবেই তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান এর পরের দিন একটি পরিশীলিত প্রত্যুত্তর দিলেন লারমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে, ‘সংবিধানে সবকিছু লেখা থাকে না এবং সব কথা লিখেই শুধু মানুষের কল্যাণ সাধন করা যায় না। সংবিধানের পরে আসে আইন, আসে আরও অনেক কর্তব্য।’ দ্বিতীয়ত, তিনি লারমাকে ‘আঞ্চলিকতার’ কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। লারমাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন যে, ‘আমার বন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সদস্য গণপরিষদে তাঁর অঞ্চলের কথা বলেছেন। তাতে আপত্তি নাই। কথা বলা খারাপ নয়। তবে আঞ্চলিকতা পরিহার করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যে আঞ্চলিকতা মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।’
তৃতীয়ত, কামারুজ্জামান বললেন যে, জাতীয় পরিকল্পনার চৌহদ্দি গোটা বাংলাদেশ জুড়েই। সেই পরিকল্পনা পার্বত্যবাসীদের বাদ দিয়ে নয়। তাদের উন্নতির রাস্তা ঐ জাতীয় পরিকল্পনার নির্দেশিত পথেই নিহিত। তিনি বললেন, ‘কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, এই সমাজের কোনো অংশ অবহেলিত ও উপেক্ষিত হলে ক্ষমতাসীন সরকার যদি সেই অবহেলিত, উপেক্ষিত মানুষের জন্য কোন কিছু না করে, তাহলে তা হবে অন্যায়। আমরা কল্পনা করেছি সমস্ত অঞ্চলকে একটা অঞ্চল হিসাবে। তাই আগামী দিনে আমাদের [পার্বত্য] বন্ধুদের পরিস্কার নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, এই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন আঞ্চলিকতা থাকবে না। এই বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলকে একটি অঞ্চল হিসাবে পরিকল্পনা করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি সামাজিক জীব হিসেবে কল্পনা করে উন্নত করা হবে।’
চতুর্থত, লারমাকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন যে, ‘ইতিহাস আমরা জানি, ইতিহাস আমরা অস্বীকার করি না।’ এদিকে ‘আমাদের সুতীক্ষষ্ট দৃষ্টি আছে’ এবং এটাও ঠিক যে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন অঞ্চলের প্রতি যদি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে অন্যায় করা হবে’। কেননা, তাতে করে ‘সেই ব্যাধি শুধু সেই অঞ্চলেই থাকবে না- সেই ব্যাধি বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে, সারা বাংলাদেশেই ছাড়িয়ে পড়বে।’
সবশেষ, তিনি মহাজাতির মধ্যে বিভিন্ন জাতির সহাবস্থানের ইনোভেটিভ যুক্তিটি পেশ করলেন। এটি হচ্ছে ‘সেলিব্রেটিং ডাইভার্সিটির’ যুক্তি :’আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাইরাও অধিকার পাবেন। কোন অংশ হতেই তাঁরা বঞ্চিত হবেন না। বাঙালী হিসাবে আমরা বেঁচে থাকব। একটা জাতির অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বৈচিত্র্য অনেক বেশী, মাধুর্য অনেক বেশী। এই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে শুধু এক জাতি, এক কৃষ্টি, এক সংস্কৃতি- তা নয়। বহু অঞ্চলের বহু মানুষ আছে, তাদের নিজস্ব অনেক কিছু আছে। শত বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকব। কিন্তু সর্বোপরি থাকবে আমাদের বাঙালী জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদ অক্ষুণ্ণ রেখে সেই জাতির অভ্যন্তরের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমরা সম-দৃষ্টি রেখে আমাদের জাতীয়তাবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করব।’
এর থেকে কি কোনোভাবে এই অনুমান করা চলে যে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা পার্বত্যবাসীকে সমতলবাসী হয়ে যেতে বলেছেন, বা পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছেন? অথচ এরকমই অবাস্তব অভিযোগ তোলা হয়েছে পরবর্তীকালে কোনো কোনো মহল থেকে। এমনকি শেখ মুজিবকেও এ পরিপ্রেক্ষিতে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হননি। সেটা করা যেতেই পারে যদি তার পেছনে জোরালো যুক্তি থাকে। দুঃখের বিষয়, অতীতে এই বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দেওয়া হয়নি। যেমন, পার্বত্য ইস্যুতে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত লেখিকা তার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পন্ন পি,এইচ,ডি অভিসন্দর্ভে এই মর্মে অভিযোগ তুলেছেন যে শেখ মুজিব পাহাড়ি জনগণকে তাদের পৃথক পরিচিতি/আত্মসত্তা (আইডেনটিটি) ‘ভুলে গিয়ে বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছেন। মূল ইংরেজিতে বিবরণটি এই রকম: ‘He therefore asked the Hill people to forget about their separate identity and to become Bengalis’ এর সপক্ষে লেখিকা আমেনা মোহসীন সমর্থন হিসেবে দেখিয়েছেন একটি মাত্র তথ্যসূত্রের উৎস। সেটি হচ্ছে, অনন্ত বিহারী খীসার সঙ্গে সাক্ষাৎকার (যেটি ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে নেওয়া)। লেখিকা আমাদের জানিয়েছেন যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা। স্বাধীনতার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য বক্তৃতা-বিবৃতি বিচার করেও অনন্ত বিহারী খীসার বক্তব্যের সমর্থনে কোনো লাইন আমি অদ্যাবধি খুঁজে পাইনি। এমনকি এই মর্মে কোনো ইংগিতও পাইনি। এটি যদি শেখ মুজিবের চিন্তার একটি ‘স্তম্ভ’ হতো তাহলে কোথাও না কোথাও এর চিহ্ন (ঃৎধপব) থাকত। বরং এর বিপরীতেই তথ্য-প্রমাণের পাল্লা ভারী। শেখ মুজিব পূর্বাপর দেশের অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠী নিয়ে তার উন্নয়ন-বাসনা ব্যক্ত করেছেন, এবং আন্তরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ।
প্রথমত, যে সভার বরাত দিয়ে কথিত ‘বাঙালি হয়ে যেতে’ বলা হয়েছে তা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার এক মাস পরে। এর পরে ১১ এপ্রিল ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। কয়েক মাস কাজের পরে কমিটি তৎকালীন বাংলাদেশ গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধানটি উত্থাপন করে এবং অনেক আলাপ-আলোচনার পর সেটি ৪ নভেম্বর সংশোধিত হয়ে গৃহীত হয়। এখন দেখা যাক যে খসড়া সংবিধানে, গণপরিষদ বিতর্কে বা চূড়ান্তভাবে গৃহীত সংবিধানের পাঠে কোথাও পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলা হয়েছিল কিনা বা সেরকম ইংগিত দেওয়া হয়েছিল কিনা। বা কেউ সেরকম ইংগিত দিয়ে থাকলেও তা গণপরিষদের অনুমোদন পেয়েছিল কিনা। সেরকম কিছু সংবিধানে থাকলে বা গণপরিষদ বিতর্কের প্রধান সুর হয়ে দাঁড়ালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কথায় ও কাজে তা প্রতিফলিত হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু তা কি আমরা দেখতে পাই? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাহাত্তর সালের সংবিধানের গৃহীত চূড়ান্ত পাঠে সই করেছিলেন। শুধু সই করা নয়, এই সংবিধানের বিভিন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে তিনি সহমতও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে গভীর বোঝাবুঝির কারণে তিনি আস্থা রাখতে পেরেছিলেন যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে সংবিধান তৈরি হয়েছে তারই পথরেখা ধরে লারমার স্বপ্নেরও বাস্তবায়ন ঘটবে তথা পাহাড়ি জনগণের জীবনের আমূল উন্নয়নও ঘটবে।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৯৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


এ জন্যই ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়েছে তার প্রিয় গান, যেখানে রয়েছে প্রকৃতি আর প্রকৃতি : আকাশ, বাতাস, বাঁশি, বটমূল, খেলাধুলা, মায়ের কোল প্রভৃতি শব্দাবলি। অন্যান্য দেশের জাতীয় সংগীতে যেমন বাজে রণ-দুন্দুভি, জাতীয় শৌর্য-বীর্যের কথা, এখানে তেমনটা নয়। আমাদের জাতীয় সংগীত যে জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে আছে, তাতে রয়েছে স্বদেশ-জননী তথা ভূ-প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি। বঙ্গবন্ধু বলছেন যে, এই অনুভূতিটাই জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান প্রেরণা।

ইকোলজিক্যাল এই অনুভূতির পাশাপাশি রয়েছে পূর্ববাংলার জনগণের একত্র-সংগ্রামের ইতিহাস, যার কথা আমি পূর্বেই বলেছি। এই সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির অংশগ্রহণের স্মৃতি। তার একটি মর্মন্তুদ বিবরণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবরের বক্তৃতায় :

‘জনাব স্পিকার সাহেব, সত্য আজ বলতে গিয়ে দুইটা জিনিস আমার সামনে আসে। একদিকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন, আর একদিকে আমার মনে আনন্দের বান বয়ে যায়। দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন এইজন্য বলি যে, আপনারা জানেন- জনাব স্পিকার সাহেব, আপনি আমার সঙ্গে বিশ বছর থেকে রাজনীতি করছেন, অন্তত বিশ বছরের ইতিহাস আপনি জানেন যে, দীর্ঘ বিশ বছর পর্যন্ত এদেশের জনসাধারণ শাসনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে, অনেক রক্তের খেলা হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাংলার ঘরে-ঘরে আজ মাতৃহারা, পুত্রহারার আর্তনাদ। লক্ষ লক্ষ বোন আজ বিধবা। হাজার হাজার গৃহ আজ ধূলিসাৎ। কত রক্ত বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে, স্পিকার সাহেব, সে কথা চিন্তা করলে বক্তৃতা করতে আমি পারি না।’

আমি জানি না, আমাদের  memory short  কিনা! বাংলার মানুষ ভুলে যায় কিনা! কিন্তু এমন ইতিহাস আমরা পেয়েছি। একটা ঘটনা মনে আছে। এক ছেলেু সে আমার কর্মী। মিলিটারি তাকে ধরে বলল : ‘জয় বাংলা’ বলতে পারবি না। সে বলল : “জয় বাংলা!” তখন তার একটা হাত কেটে দেওয়া হলো। বলল : আর ‘জয় বাংলা’ বলবি? সে বলল: “জয় বাংলা!” তখন তার বাম হাতটি কেটে দেওয়া হলো। তার দুইখানা হাত কেটে দেওয়া হলেও সে বলল : “জয় বাংলা!” তার একখানা কান কেটে দিল। বলল : আর বলবি ‘জয় বাংলা’? সে বলল : “জয় বাংলা!” তার আর একখানা কান কেটে দিল। বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? ছেলেটি বলল : “জয় বাংলা!” তারপর তার একখানা পা কেটে দিল। বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? ছেলেটি বলল : “জয় বাংলা!” তার বাম পা কেটে ফেলে দিল। তখন তার জ্ঞান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাকে বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল : “জয় বাংলা! জয় বাংলা!”

‘আমার সোনার বাংলা’ গানে প্রতিফলিত নিসর্গ-স্বদেশ-জননী নিয়ে সংবেদনবোধ বা ওপরে বর্ণিত অংশে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কাহিনি উভয়েই ‘দেশপ্রেম’-এর অনুভূতির দৃষ্টান্ত। সূক্ষ্ণভাবে দেখলে এ কথাও বলতে হয় যে, ‘দেশপ্রেম’ আর ‘জাতীয়তাবাদ’ এক নয়, কাছাকাছিও নয়। নেশন, ন্যাশনালিটি, নেশন-স্টেট ও ন্যাশনালিজমু এই চারটি ধ্যান-ধারণা একই পরিবারভুক্ত। উনিশ শতকের ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসেু নেশন-স্টেট গড়ার পর্বেু আমরা এসব ধারণার উত্থান দেখতে পাই। যখন নেশন-স্টেট ধারণার জন্মই হয়নি, তখনও দেশের মানুষের মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ ছিল। দেশচিন্তা করার জন্য কাউকে কোনো-না-কোনো জাতীয়তাবাদের আশ্রিত হতে হবে- ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। রবীন্দ্রনাথ কখনোই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাননি। যখনই এর মুখোমুখি হয়েছেন, তখনই তিনি ন্যাশনালিজম বা নেশন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি মনে করতেন এই উপমহাদেশ কখনোই ‘নেশন’ ছিল নাুন্যাশনালিজমের পথে হাঁটেনি। প্রাচীন বা মধ্যযুগে অনেকবারই এই ভূভাগ বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং সেটা প্রতিহত করতে দেশের মানুষেরা সেকালের রাজাদের পেছনে সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেটা কোনো ন্যাশনালিজমের কারণে নয়ু নিখাদ দেশপ্রেমের কারণে। প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য ‘বাইরের শক্তি’ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশপ্রেমিকদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু দেশপ্রেম আরও বড় জাগতিক বোধ যাকে শুধু প্রতিরোধ বা যুদ্ধের ভাষায় সীমাবদ্ধ করা চলে না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় যেমন ‘গুরুমশাই, দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে’, যেখানে নৈশ পাঠশালায় মাস্টারমশাই দেশের মানচিত্র ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাচ্ছেন। দেশের মানচিত্র হচ্ছে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ, আর মানচিত্রের ভেতরের অদৃশ্য মানুষেরা হচ্ছে দেশপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ যেমন নিত্যদিনের এবং চিরকালের পরিবেশ-প্রকৃতি, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলার’ সনেটগুচ্ছ, তেমনি বাংলার নিসর্গ, নদী ও ইতিহাস। কিন্তু কোনো চিহ্ন নেই তাতে জাতীয়তাবাদের, অন্তত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ-এর অর্থে। ‘রূপসী বাংলা’ কোনো নেশন-স্টেট গড়ে তুলতে চায়নিু তবে এটা পড়তে থাকলে আমরা আবহমান বাংলা ও তার নিসর্গে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। এবং এ কারণেই কবি বলতে পারেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর মুখ খুঁজিতে চাই না আর।’ এটা দেশপ্রেমু কোনো জাতীয়তাবাদী স্টম্ফুরণ নয়। তারপরও মুজিবকে বাঙালি ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়েছে। কেননা তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে বিচরণ করছেন এবং অন্য কোনো শব্দবন্ধ তার ও তার পরিপার্শ্বের রাজনীতিকদের জানা নেই বলে। কিন্তু শব্দটি ব্যবহার করলেও তার অভিপ্রায় ভিন্ন। সে জন্যই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন জাতীয়তাবাদ মানে ‘আমার বাংলা’, ‘বাংলার মাটি’, বাংলার মানুষ’। এর বেশি কিছু তিনি দাবি করেননি। তার কাছে বাংলার মানুষই সব; এমনকি ‘বাঙালি’ এই আত্মপরিচয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘বাংলা’ শব্দটি, এবং এই বাংলায় বসবাসরত মানুষেরা। সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ এই আবহমান বাংলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট টাইম-লাইন বেঁধে দিয়েছেু বলেছে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার কথা ও তার মৌলিক চারটি আদর্শের কথা। কিন্তু জাতীয়তাবাদ এসেছে ‘জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম’-এর অধীনস্থ ধারণা হিসেবেইু কোনো আলাদা রাজনৈতিক ‘আইডিওলজি’ হিসেবে নয়।  ‘National liberation struggle’ শব্দবন্ধটি জাতীয়তাবাদের আগে স্বীকৃত হয়েছে সংবিধানের Preamble-র প্রথম স্তবকেই; জাতীয়তাবাদ এসেছে কেবল এর দ্বিতীয় স্তবকে। অন্য তিনটি আদর্শু সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ এসেছে, এবং জাতীয়তাবাদের চৌহদ্দিও বেঁধে দেওয়া হয়েছে ওই তিনটি আদর্শের দ্বারা। অর্থাৎ ইচ্ছা করলেই উগ্র-জাতীয়তাবাদ বা কেবল বুলি-কপচানো বাঙালি/বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হওয়ার উপায় আর থাকছে না। কেননা, এদেশের জাতীয়তাবাদের যে-নামকরণই হোক না কেন, তাকে শেষ পর্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে অন্য তিনটি আদর্শের সাথে। স্পষ্টতই উনিশ শতকের ইউরোপীয় নেশন-স্টেট ধারণা থেকে এই জাতীয়তাবাদের পরিসর মৌলিকভাবে ভিন্নতর। ইউরোপে যখন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন সর্বজনীন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা এসব ধ্যান-ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এসব ধারণা ইউরোপে এসেছে আরও অনেক পরে। কিন্তু বাংলাদেশে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নেই সর্বাধুনিক আদর্শসমূহ স্বীকৃত হয়েছিল এবং সেসব আদর্শ উঠে এসেছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নানা পর্যায়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক দর্শন-গ্রন্থের পাতা থেকে সেসব কপি করা হয়নি- এটাই এখানে বলার কথা।

‘ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজম’ অর্থাৎ বাংলার ভূ-প্রকৃতির নৈসর্গিক অনুভূতিসঞ্জাত জাতীয়তাবাদ বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। বাঙলা-বাঙালি এই শব্দযুগলকে ঘিরে ‘অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ’ বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ ধারণার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু এর বাইরেও জাতীয়তাবাদ ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। সেটি হচ্ছে ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু এর সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে আমি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তুলে দিতে চাই। ইলিয়াস তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন :

‘জাতীয়তাবাদ আপনার মতবাদের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আপনি তো জানেন জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়? তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের প্রতি আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?’

বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন : ‘আপনি ঠিক বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউর্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরায়েলের ইহুদিবাদের মতো অতি জঘন্যরূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থি ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতো উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তার বিকাশ ধারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্রবাদ ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূলশক্তি। তারা গণতন্ত্রের শত্রু, সমাজতন্ত্রেরও শত্রু। তাদের জাতীয়তাবাদ শোষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শোষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হবার কোনো ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।’

ইলিয়াসের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল : ‘বিশ্ব সমাজকে একটি সমাজ এবং বিশ্ব মানবকে যদি একটি গোষ্ঠী ধরে নিই, তবে কি জাতীয়তাবাদের চেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ উন্নতির পর্যায়ে নয়?’

বঙ্গবন্ধু এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দিলেন : ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ এদেশের মাটিতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। তাকে নির্মূল করে তবেই এদেশের শ্রেণি চেতনার বিকাশ সাধন সম্ভবপর। আর একমাত্র শ্রেণি চেতনাই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্বশর্ত। এ দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, শ্রেণি চেতনা বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রধান অন্তরায়। আর সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার রণকৌশল হিসেবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকরী হলে, আমার বিশ্বাস, এ দেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে।’

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুজিব জাতীয়তাবাদকে অবিমিশ্র মঙ্গল হিসেবে দেখছেন না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরাধীন জাতি একসময় জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেয়। সেই অধস্তন জনগোষ্ঠীর লড়াকু জাতীয়তাবাদকেই ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’ বলছেন তিনি। কিন্তু বিকাশের ধারা সেখানেই থেমে থাকছে না। যখন শ্রেণিচেতনার বিকাশ হবে, তখন শোষিতের জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের রূপ নেবে। কিন্তু শ্রেণিচেতনার বিকাশ অতটা সহজসাধ্য নয় যখন কিনা ‘আইডেনটিটি পলিটিক্স’ প্রাধান্যে চলে আসে। আইডেনটিটি তথা জাত-পাত, রেস, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা যখন আবেগের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়, তখন শ্রেণিচেতনা পিছু হটতে থাকে রাজনীতির মাঠ থেকে। সে অবস্থায় ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার’ একটি রণকৌশল হতে পারে শোষিতের জাতীয়তাবাদ।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এজন্যেই সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ অংশে বাংলাদেশের যে-জনগণের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ধর্ম-নির্বিশেষে আপামর মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলকেই অংগীকৃত করা হয়েছে। তাদের পরিচয় তারা সবাই বাঙালি জাতির অংশ, যারা এক নতুন পৃথিবীর রচনা করতে চলেছে, যারা জন্ম দিয়েছে এক নতুন বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের। এই জাতি-রাষ্ট্রের একটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে- ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’। ১৯০৫ সালের ‘বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ বা ১৯৪৭ সালের জিন্নাহ্‌র ‘টু নেশন’ভিত্তিক ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’- এই দুই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনোটারই লক্ষ্য ছিল না পূর্ববঙ্গের জনপদের সমগ্র বাঙালিকে এক পতাকা তলে একত্র করা। অথবা এর লক্ষ্য ছিল না গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা। এটি যুক্ত হয়েছে পরে- পাকিস্তান সৃষ্টির পরে প্রতিবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে- নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি হিন্দু একত্র হয়েছে। এবং এমনভাবে একত্র হয়েছে যেটি বাঙালির বিগত ‘হাজার বছরের’ জীবনযাত্রায় দেখা যায়নি। ধর্ম-জাতি-ভাষা এসব নিয়ে বিভেদ-বোধ জিইয়ে রেখে সফল জাতি-নির্মাণ করা যায় না। এসব বিভেদ-বোধ রেখে সমাজতন্ত্রের দিকে তথা সমতামুখীন সমাজের দিকেও অগ্রসর হওয়া যায় না। এখানেই সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাসংগিকতা।
এক হিসেবে ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ শব্দ দুটো সাংকেতিক শব্দ :’অসাম্প্রদায়িক’ সমাজ গড়ার কোড ওয়ার্ড। সাম্প্রদায়িকতার দিকে যখন সামাজিক দাঁড়িপাল্লার এক প্রান্ত ঝুঁকে পড়ে, তাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আনার জন্য ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ এই দুটি শব্দই যথেষ্ট। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু নানা বক্তৃতায় বাংলা, বাঙালি, বাংলার নদী, বাংলার মানুষ, বাংলার গ্রাম, বাংলার ভূপ্রকৃতি এসব অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পেছনে জাতি-নির্মাণের চিন্তা তার মধ্যে কাজ করেছিল, কিন্তু তারও চেয়ে বেশি কাজ করেছিল অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা বিকাশের রাজনৈতিক তাগিদ। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বক্তৃতা শেষে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (ডাকসুর তৎকালীন ভিপি) যখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও শোষণহীন সমাজের পক্ষে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু তার কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটু জয় বাংলা স্লোগানটাও দিও সেলিম, অসাম্প্রদায়িকতার জন্য এটা দরকার।’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের বিরোধী ছিলেন না মুজিব, কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা তিনি বুঝতেন। তাই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত থাক’ এসব ‘বামপন্থি’ স্লোগানের পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটাও দিতে বলেছিলেন। কেননা এতে করে শ্রেণিচেতনার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনারও বিকাশ ঘটবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু শোষিত জাতির জাতীয়তাবাদ ছিল না তার জন্য, এটা ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি।
বাংলা ও বাঙালি নিয়ে শেখ মুজিব গভীরভাবে ভেবেছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম চালাতে গিয়ে। এই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিস্কার করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথও নতুনভাবে প্রতিভাত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের কাছে। ১৯৫০ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ অবধি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গান নানাভাবে ব্যবহূত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে। এই গানগুলো প্রথমে যে-প্রেক্ষিতেই রচিত হোক না কেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকের নতুনতর প্রেক্ষিতে তা অন্য অর্থ ও মাত্রা পেয়েছে এটিও লক্ষ্য করার মতো। এখানে ‘প্রেক্ষিতের’ তাৎপর্য ‘পাঠকে’ পুনর্নির্মিত করেছে: context এসে :  text-র অর্থ ও ব্যবহার দুইই বদলে দিচ্ছে। একটি উদাহরণ দেব এখানে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র মঞ্চ থেকে ‘গণতন্ত্র বাঁচাও আন্দোলন’ করা হয়েছিল, যার থিম সং ছিলু’উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’। রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে পটভূমিতে রেখে বোঝানো হচ্ছিল এই বুঝি মোদি আসছেন রথে চড়ে! এর থেকে কেউ বলতে পারেন যে গানটির মধ্যে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদের প্রতি অনুরক্তি ছিল কবির, নইলে বিজেপির মঞ্চ থেকে তা ব্যবহার হলো কী করে? এরকম অদ্ভুত ও অযৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় গানটি অন্য প্রেক্ষিতেও আগে গাওয়া হয়েছে। সন্‌জীদা খাতুন লিখেছেন :”একাত্তরের জানুয়ারি থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত চলছিল। মুজিব-ইয়াহিয়া সংলাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক আর দ্রোহের গান চলছে। শান্ত-স্বভাবের ছাত্রী সেলিনা মালেকও গাইছে, ‘ওরে আগুন আমার ভাই’; ইফ্‌ফাত গাইছে, ‘যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না’; ইকবাল গাইছে, ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’। সাবিনা-শাহনাজরাও দেশপ্রেমের গান গাইছে। আজাদ রহমান দৃপ্ত সুরের সম্মেলক গান করাচ্ছেন। রেডিওতে চলছে সমর দাসদের রক্ত গরম করা গান। রেডিওর ওই সব টেপ নিয়েই তাহের সুলতান-আশফাকুর রহমানরা সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারে সেই সব গান চালান।” ইকবাল আহমেদ যখন ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ওই যে তিনি ওই যে বাহির পথে’ বলে গান করছেন, তখন দর্শক-শ্রোতারা সত্যি সত্যি যেন দেখতে পাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলা এক মহানায়কের মহাযাত্রা। যেন মহাভারতের রথের চাকা নয়, এই বাংলাদেশেই রচিত হতে যাচ্ছে অন্য এক আসন্ন যুদ্ধের মহাকাব্য।
Context ভেদে কী করে : text-র অর্থ বদলে যায় সেটির আরেকটি নমুনা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। ষাটের দশকে ও ১৯৭১ সালে গানটি অনেক বারই গাওয়া হয়েছে। কেউ তখন প্রশ্ন তোলেনি যে এসব গান ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে রচিত। বাংলা যাতে বিভক্ত না হয় তার জন্যেই এই গানগুলো আদিতে রচিত হয়েছিল। সেই যুক্তিতে এই গানগুলোকে পূর্ব বাংলার মুসলিম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সমর্থন দেওয়ার কথা নয়। কেননা তারা তো তখন বঙ্গভঙ্গ করার পক্ষে ছিলেন। অথচ কী অনায়াসে ১৯০৫ সালের সেসব গানগুলোকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৯৫০-১৯৬০ দশকের আন্দোলন সংগ্রামে। এসব গানের ব্যবহারের প্রতিবাদ করে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরও তখন শোনা যায়নি প্রগতিবাদী জাতীয়তাবাদী শিবিরে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সবাই এই গানগুলো গেয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথকে আমরা কীভাবে সেদিন দেখেছি, তার গানকে ব্যাখ্যা করেছি বা যাকে বলে নিজেদের করে নিয়েছি (appropriate করেছি)-সেটি ছিল আমাদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, দ্বিজেন্দ্রলালও গাওয়া হয়েছে, নজরুল তো ছিলেনই পূর্বাপর। যেমন, ১৯৬৯ সালে ছায়ানট পাঁচ দিন ধরে ‘গীতোৎসব’ করেছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। এতে শেষ গান ছিল যথাক্রমে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা,’ ‘আমার সোনার বাংলা’, আর ‘দুর্গমগিরি-কান্তার-মরু’। শ্রোতাদর্শক সুদ্ধ সবাই দাঁড়িয়ে সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছিল বোধকরি সেই প্রথম।
এই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহ ও প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছিল। এমনকি যে-ভার্শানটি এখন জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হয় সেটিও অনুমোদিত হয়েছিল তাঁরই সিদ্ধান্তে! সন্‌জীদা খাতুনের বর্ণনায় সেই ইতিহাস শুনব আমরা:
”১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ একগুচ্ছ বাউল সুরের দেশাত্মবোধক গান লেখেন। এখন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনার প্রসঙ্গ। গানটির উৎস এবং সাংগীতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় না গিয়ে, সংশ্নিষ্ট কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করব। ১৯৫৭ সালের প্রথমার্ধে ঢাকায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাসুদ্ধ প্রাদেশিক নেতাদের এক বৈঠক হয়েছিল। সংশ্নিষ্ট সবার জন্য কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সে সভায় আমার গান গাওয়ার কথা ছিল। সেই সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে অনুরোধ পাঠান। এর তাৎপর্য তখন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের কাছে ‘সোনার বাংলা’ বিষয়ে বাঙালির আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এ দেশের নেতা। এর কিছুদিন আগে ২৩ মার্চ পূর্ববঙ্গের নাম পূর্ব পাকিস্তান করে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছিল। আঞ্চলিক স্বাধীনতার জন্য উত্তাল আন্দোলনের সময়ে বঙ্গবন্ধু সব সময় জাহিদুর রহিমকে এই গান গাওয়ার জন্য খবর পাঠাতেন। রেসকোর্সের ময়দানে তাঁর সভায় জাহিদ যে কতবার ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছে! এ গানের আবেগ বাঙালিকে আমূল নাড়া দিয়েছে। পাকিস্তানি বিরূপ প্রচারণা রবীন্দ্রসংগীত আর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছিল। জনপ্রিয় নেতার বাঙালি স্বার্থ সংরক্ষণমূলক বক্তৃতার সঙ্গে এই বাংলাপ্রীতির গান সব মানুষকে অনেকভাবে আকর্ষণ করল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাই মাঠের রাখালও স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে উঠেছে। দেশের সর্বজনের অন্তর থেকে উৎসারিত এই গান তাই হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা বাঙালির যাবতীয় আন্দোলনের শিল্পীরা ওই গান গেয়েছেন বারবার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর আর স্বরলিপি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ক্যাবিনেট ডিভিশনের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রায় দেন, যে সুর গেয়ে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, তা-ই আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর। ঘটনা এই যে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ড থেকে যে সুর শুনে শিল্পীরা গানটি তুলেছিলেন, সে সুর থেকে নিজেরাই খানিকটা সরে যান।
বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমাদের ভুলের অপরাধকে মুছে দিয়েছিল। আজও সেই সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে চলেছি আমরা।”
বাংলা ভাষা, বাঙালির সাধারণ সুখ-দুঃখের অনুভূতি, বাংলার গান, বাংলার প্রকৃতি-এই নিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদের মধ্যে একদিকে আছে স্বদেশবোধ-যাকে আমরা দেশপ্রেম বলি, অন্যদিকে আছে বাংলার নদী-মাঠ ভূপ্রকৃতি-যাকে আমরা ইকোলজি বা পরিবেশ-প্রকৃতি বলি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে এক-অর্থে ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজম, পরিবেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। বাংলার পরিবেশ সম্পর্কে বিশেষ নৈসর্গিক অনুভূতি আছে বলেই আমরা বিশিষ্ট জাতি। এর বাইরে গিয়ে তত্ত্ব-রচনা করতে চাননি তিনি। বলেছিলেনও সেকথা :’জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা না-ই বা দিলাম।’ কিন্তু সংজ্ঞা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতি-সম্পর্কে আসলে একটি নতুন বোধের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন-সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না।’ কিসের সেই অনুভূতি? একটি হচ্ছে বাংলার নদী-নালা মাঠ-ঘাট বিল-হাওর বাংলার গ্রাম এসব নিয়ে অভিন্ন অনুভূতি।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১২. বাঙালি জাতীয়তাবাদ :কয়েকটি অবহেলিত প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের জনগণের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা আধুনিক যুগের, নেশন অর্থে ‘জাতি’- এই ধারণাটিও আধুনিক কালের। বাংলায় জাতির তিনটি অর্থ :একটি হচ্ছে বর্ণ, অন্যটি Race এবং আরেকটি হচ্ছে Nation। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “স্বীকার করিতে হইবে, বাংলায় ‘নেশন’ কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায়, এবং জাতি বলিতে ইংরাজিতে যাহাকে race বলে, তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা ‘জাতি’ শব্দ ইংরাজি ‘রেস’ শব্দের প্রতিশব্দের ব্যবহার করিব এবং নেশনকে নেশনই বলিব।” জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার আগেও জাতি জেগে উঠতে পারে। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক সময়ে ‘জাতি’ জেগে ওঠার চেষ্টা করে। পাকিস্তান আমলে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ক্রমে দানা বেঁধে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাজ করে গেছে পাকিস্তানি ‘রাষ্ট্র’। এটাকে বলা যায়ু ‘স্টেট অ্যাগেইনস্ট নেশন’ (শব্দবন্ধটি ঐতিহাসিক আহমেদ কামালের)। যখন কোনো জাতি ভিনদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে ওঠে, তখন সে নিজেই জন্ম দেয় এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের (নেশন-স্টেটের)। বাঙালি জাতি যেমন পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র-জাতি হচ্ছে বাঙালি জাতি, বাঙালি জাতির গড়ে ওঠার প্রধান সময় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বে। অর্থাৎ রাষ্ট্র-জাতি হিসেবে বাঙালি নেশন আধুনিকতম নেশন। এই কথাটায় কারও কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেবেু তাহলে কি বাঙালি জাতি চর্যাপদ বা প্রাক-চর্যাপদকাল থেকে চলে আসা একটি আবহমান বাঙালি জাতির অংশ নয়? এ প্রশ্নটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, বাঙালি জাতির ‘হাজার বছরের’ ইতিহাস। সেটা হাজার বছরের কেন, আরও প্রাচীনতম সময়েরও বলে দাবি করা যেতে পারে। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে যেমন প্রাচীন যুগের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে দাবিটা হবে বাঙালি ‘নেশনের’ ক্ষেত্রে নয়ু এই জনপদের ‘মানুষের’ ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য হবে। অভিন্ন ইতিহাস, অভিন্ন আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের স্মৃতিু এসব বৈশিষ্ট্যকে ‘নেশন’ হিসেবে দাবি করার পেছনে বড় লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নস্ট রেনাঁ। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি- এসব ঐতিহাসিক স্থানে পরিব্রাজক হিসেবে আমরা যখন জড়ো হই, আমরা তখন তার ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক কারুকার্য বা কীর্তিতে বিস্মিত হই। কিন্তু সেসব স্থানের সঙ্গে আমাদের আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের কোনো স্মৃতি আমরা নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাই না। ওই সব জনপদের স্মৃতি আমাদের ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক একসময়ের ধারক, কিন্তু তারা আমাদের সাম্প্রতিকতম জাতি-গঠনের ‘অংশ’ নয়। আমরা তাদের সম্পর্কে জেনেছি মূলত বইয়ের মাধ্যমে বা হয়তো কোনো সাংস্কৃতিক উপকরণের (গান, পালা, মৃৎশিল্প ইত্যাদি) মাধ্যমে। এদেরকে আমরা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান হিসেবে ধরব, কিন্তু বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞানের সূত্র এদের মধ্যে নিহিত নেই। সেই অর্থে শুধু বাঙালি জাতি বলে নয়, কোনো নেশন বা জাতিই ‘প্রাচীন’ নয়, কেননা নেশন অর্থে জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠার কালই শুরু হয়েছে কেবল ‘আধুনিক’ সময়ে। ‘আধুনিক’ বলতে ইউরোপের পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট ও শিল্পবিপ্লব-উত্তর সময়ে। ভারতের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে আরও অনেক পরেু উনিশ শতকের শেষের দিকে বা বিংশ শতকের শুরুর দশকে।
এ জন্যই রামমোহন রায়-দ্বারকানাথ ঠাকুর-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় জাতির বা নেশনের কোনো ‘স্বপ্ন’ দেখতে পাই না। এর কারণ, ‘নেশন’ এই বোধটাই তখন আমাদের মধ্যে জন্মায়নি। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যে বাঙালি নেশন ধারণ করে আছে, তার সূত্রপাত ভারতের চেয়েও আরেকটু পরেু গত শতকের চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে যার বিস্তৃতি। সেই অর্থে আমরা নবীন বা নবীনতম জাতি। এতে আমাদের সংকুচিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর কোনো জাতিই প্রাচীন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি তার নতুন বইতে (যার নাম The Truths and Lies of Nationalism as Narrated by Charvak) ) দেখিয়েছেন যে- ’no one, not even Indians, can claim to be part of an ancient nation’ সব জাতি-রাষ্ট্রই, সব নেশনই আধুনিককালের সৃষ্টিু কেউই প্রাচীন জাতি-রাষ্ট্র বা জাতি নয়। আমরা এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা বহুকাল ধরে বহু সাম্রাজ্যের পালাবদলের সাক্ষী হয়ে এই জনপদে বাস করছি এবং সেই অর্থে আমাদের প্রাচীন বা প্রাচীনতম শিকড় রয়ে গেছে এই বাংলার ভূপ্রকৃতির মধ্যে; কিন্তু আমরা ‘প্রাচীন জাতি’ নই। আমরা আধুনিক পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট কালে, আধুনিকতম ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে, সৃষ্ট একটি নবীন জাতি যে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে তার নিজের জন্য একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পেরেছে। এতে আমাদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার কিছু নেই; বরং চলতি সময়ের উপাখ্যান হিসেবে আমাদের জাতীয় জাগরণের ইতিহাস, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সফলতা এবং তার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুু এই ন্যারেটিভের দিকে সমূহ দৃষ্টি দেওয়াই হচ্ছে সঠিক রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাহাত্তরের সংবিধানের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে মূল বক্তব্য সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আহ্বান জানায়। একটু সবিস্তারে এ নিয়ে বলতে চাই।
কেন উনিশ-বিশ শতকের আগে এই উপমহাদেশের জনগণ কোনো ‘নেশন’ ছিল না, এই দাবি কারও কারও কাছে অসংগত বলে মনে হতে পারে। মৌর্য, গুপ্ত, সুলতানি আমল, মোগল, মারাঠা, নবাবি আমল এরা কি একেকটি সাম্রাজ্য, কীর্তিমান রাজ্য বা ‘ ’great state’-এর উদাহরণ নয়? নিশ্চিতভাবেই এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কেউ কেউ ‘বিশাল সাম্রাজ্য’ও স্থাপন করেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কিন্তু ‘নেশন’ ছিল না। এর কারণ, এই সাম্রাজ্যগুলো এই ভূখণ্ডের ও জনপদের অধিবাসীদের ওপরে শাসন করেছে সামরিক শক্তির জোরে এবং ‘খাজনা আদায়’ করে। এই সাম্রাজ্যগুলো ইতিহাসের নানা পর্বে যেসব রাষ্ট্রের পত্তন করেছিল, সেসব রাষ্ট্র কেবল বহিঃস্থ শক্তি হিসেবে আমাদের ওপরে প্রভুত্ব বা রাজত্ব করেছে। আমাদের ভূখণ্ডের সমাজের কাছে, সমাজের চোখে এসব রাষ্ট্র ছিল external force বহিঃস্থ শক্তি কেবল। এ জন্যই কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, রাজা যায়, রাজা আসে। এই পালাবদলে জনসমাজের কোনো দায় নেইু কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। জাতি নির্মাণ তখনই সফল হয়, যখন কিনা রাষ্ট্র তার শাসনকার্য নির্বাহ করে জনগণের ‘সম্মতিতে’। যখন জনগণ ‘উপর থেকে’ চাপিয়ে দেওয়া শাসনকে ‘নিচে থেকে’ সম্মতি (consent) দিয়ে স্বীকৃতি জানায়। নিচে থেকে সম্মতিদানের প্রক্রিয়ায় যে রাষ্ট্রের জন্ম, সেটিই কেবল সফল নেশন-স্টেটের জন্ম দিতে পারে। নিচে থেকে জেগে ওঠা জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তখন সফল জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়, যেমনটা হয়েছে আধুনিক যুগে উনিশ-বিশ শতক থেকে নানা মহাদেশে, নানা দেশের বেলায়। এককথায়, শাসনকার্য যখন জনগণের ‘সম্মতি’ ছাড়া পরিচালিত হয়ু যাকে ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘ডোমিন্যান্স উইদাউট হেজমনি’ু তখন অধীন জাতির জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় না।
এই ‘সম্মতির’ কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের ‘সম্মতি’ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর জন্যই সংবিধানের শুরুতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে এই ‘প্রস্তাবনার’ সংযোজন। কেননা, জনগণের ‘সম্মতি’ (consent) ছাড়া সাম্রাজ্য হয়, কিন্তু জাতি-রাষ্ট্র হয় না। সেই অর্থে, জনসম্মতি পায়নি বলে ১৯৪৭-৭১ পর্বে ‘পাকিস্তান’ কোনো জাতি-রাষ্ট্র হতে পারেনি। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক ‘সাম্রাজ্য’ হিসেবে সে থেকে গেছেু অন্তত পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই প্রস্তাবনার মাধ্যমেই বাঙালি জাতির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের ‘গণপ্রজাতান্ত্রিকতা’ ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা বা রুশ বিপ্লবের মতোই এ দেশের জনগণের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান ঘোষণা হচ্ছে এই ‘প্রস্তাবনা’। যেখানে বলা ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি, আদর্শ, মূলনীতিসংবলিত এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের কথা। সেই সংজ্ঞায় আবহমানকাল ধরে চলে আসা ‘হাজার বছরের’ বাঙালি জাতির কথা বলা ছিল না। বলা হয়েছিল নিকট অতীতের সংগ্রামরত পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতির কথা। পুরোটা পড়লে সন্দেহ থাকে না যে, কথা হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বে এই জনপদের অধিবাসীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং তার মাধ্যমে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন :
“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলু জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাু যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সংগতিরক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
এতদ্দ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।”
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটুকু ইঙ্গিত মেলে যে, বাঙালি জাতির ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামই’ এই নতুন জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ ও পরবর্তী ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল। কেউ যদি বলেন যে, এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আসলে সূচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে বা তারও আগে ১৮৫৭ বা ১৭৫৭ সালে, তা হবে অতিকথন দোষে দুষ্ট। কেননা, ওই প্রস্তাবনাতেই দ্বিতীয় স্তবকে স্পষ্ট করা হয়েছে এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চালিকাশক্তির কথা। এই মুক্তিসংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করেছিল কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শু জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গ করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী) বা যারা বঙ্গভঙ্গ না করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী) এরা কেউই উপরোক্ত চার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল না। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটাই তখন পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ করা বা না-করার দলের নেতা বা তাত্ত্বিকদের মধ্যে জন্ম হয়নি। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যা ছিল তা হলো বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম ‘সম্প্রদায়ের’ মধ্যে সম্প্রদায়গত স্বার্থের লড়াই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল (হিন্দু) জমিদার বনাম (মুসলিম) কৃষকের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব, (হিন্দু) মধ্যবিত্ত বনাম (মুসলিম) মধ্যবিত্ত স্তরের অর্থনৈতিক স্বার্থ (ব্যবসা, চাকরি, জমি) সংক্রান্ত বিরোধ। এটা দুই ‘নেশনের’ মধ্যকার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল নাু তা জিন্নাহ সাহেব যাই বলুন না কেন। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি বিভক্তভাবে কোনো জাতি নির্মাণ করতে পারেনি ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে। ১৯৪৭-এর পরে যে জাতি নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের বৈরী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তাতে বাঙালি মুসলিমের প্রধান অবদান ছিলু কেননা পূর্ববঙ্গের প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল তারা ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাগের সময়ে। কিন্তু ১৯৪৭-৭১ পর্বে বাঙালির মুসলিমের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অমুসলিম জনগোষ্ঠীও অবজেকটিভ কারণেই সহযোগী ভূমিকা পালন করেছিল। দেশভাগের পরে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিভিন্ন কারণে একটি অংশের দেশত্যাগের পরেও বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ছিল পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ (১৯৬১ সালের সেন্সাস অনুসারে)। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানের ‘মেজোরিটি’ অংশ পূর্ব বাংলার অধিবাসীু সংখ্যাগরিষ্ঠতার গাণিতিক যুক্তিটি অকাট্য বলে প্রমাণ করা গিয়েছিল কেবল এই জনপদের বাঙালি মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে একত্র করেই। জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকতর সম্পদ বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর (কেননা তারা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ)ু এই যুক্তি কেবল তখনই খাটে, যখন ‘বাঙালি’ বলতে আমরা শুধু বাঙালি মুসলিম নয়, বাঙালি হিন্দু ও অপরাপর ধর্মাবলম্বী অংশকেও হিসেবে ধরি। এটাই হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বের ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালি জাতিকে একত্র করার এবং পরস্পরের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করার ‘গাণিতিক ভিত্তি’।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এক অর্থে, মওলানা ভাসানীর মধ্যে ‘দ্বৈত-সত্ত্বা’ বিরাজ করছিল। একদিকে তিনি ছিলেন সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ‘মজলুম জননেতা’। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন স্বভাবজ ধর্মগুরু- একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। এই ‘দ্বৈততা’ তাকে কৃষক-জীবনের সাথে অঙ্গীকৃত করেছিল। তিনি ছিলেন এই অর্থে (গ্রামসির ভাষ্যে) একজন ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল অব পেজেন্ট ক্লাস’। তবে দ্বৈততা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্ব ধর্মের মানুষকে সমানাধিকার দান এবং (সেই অর্থে) ধর্মনিরপেক্ষতাকে জোরেশোরে তুলে ধরার প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। ‘রবুবিয়ত’ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য বা লেখা পড়লে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। রবুবিয়ত প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই এখানে। মওলানা ভাসানীর এই উপলব্ধির রাজনৈতিক তাৎপর্যের দিকে সাম্প্রতিককালে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসল কথা হলো, ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শের ওপরে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রভাব পড়েছিল। মার্কসবাদী ও অমার্কসবাদী উভয় সূত্র থেকেই ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ গড়ার স্বপ্ন তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। ন্যাপ গঠনের সময়ে ভাসানীর দর্শনে প্রগতি পন্থার ‘মার্কসবাদী’ প্রভাবের সূত্র আগেই উল্লেখ করেছি। এবার অমার্কসবাদী সূত্রের প্রভাবের কথা বলব।
আসামের বিপ্লবী দার্শনিক আল্লামা আজাদ সোবহানীর সাথে ১৯৪৬ সালের একটি সাক্ষাতের গভীর অভিঘাত পড়েছিল মওলানা ভাসানীর ভেতরে। আগেই বলেছি, ভাসানী মুসলিম লীগ ঘরানা থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করেননি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অসহযোগ আন্দোলনের নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা হাসরত মোহানী প্রমুখের চিন্তা ও চর্চা তার জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। ভাসানী এ নিয়ে লিখেছেন, আল্লামা আজাদ সোবহানী বলিলেন, ‘তবে আজ ওয়াদা কর তুমি রাজনৈতিক জীবনে যত কলাকৌশলই নাও না কেন মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম করিয়া যাইবা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়িল ১৯৩৫ সালে আমরুহাতে ১৭ জন আলেম রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্তের কথা। মনে পড়িল মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধী প্রমুখের সাথে আমার যোগাযোগ ও ওয়াদার কথা। আমার মনে পড়িল খিলাফত আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর সাহচর্যের কথা। আমি দেখিলাম যৌবনের উচ্ছ্বাস শেষে যে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম আজ প্রৌঢ় জীবনে সেই রাজনৈতিক দর্শনের দাওয়াতই আসিয়াছে।’ এই দর্শনের বিবরণ দেওয়া সহজসাধ্য নয়। এখানে বাহাত্তরের সংবিধানের সমতাবাদী চিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আলোচনার প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর ‘পালনবাদ’ (বা অন্যত্র যাকে বলেছি ‘caring state) সেটির সাযুজ্য স্থাপন করাই আমার মূল লক্ষ্য।
পালনবাদের মূল কথা হলো যে এই জগতের কোনো কিছুই অহেতুক সৃষ্টি হয়নি। ‘সকল কিছুর অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না, সবকিছুকে বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন-পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে-রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রাব্বানিয়া। সে-রাষ্ট্রে থাকিবে স্রষ্টার পালনবাদ- মানুষের শাসনবাদ নহে।’
এই পালনবাদের প্রয়োগ ও আদর্শ হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। এই বিষয়ে মওলানা ভাসানী লিখেছেন : ‘সকল সমস্যার সমাধান হইবে মানবজাতি যদি রবুবিয়তের অর্থাৎ স্রষ্টার পালনবাদের আদর্শে হুকমত কায়েম করিতে পারে। শিক্ষা-দীক্ষা, খাওয়াপরা, ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই- মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন ভেদাভেদ নাই ঠিক তেমনি হুকুমতে রব্বানিয়ায় সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে। আজ আর কোনো সন্দেহ নাই। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে শাসন, শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া মানবজাতিকে সুখী করিতে পারে।’
এখানে দ্রষ্টব্য যে ভাসানী রবুবিয়তের আদর্শ বলতে গিয়ে যেমন পবিত্র গ্রন্থের সাক্ষ্য টেনে আনছেন, তেমনি স্মরণ করছেন ফরাসী বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের’ বাণী। ভাসানী এরপরে বলবেন ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’ উচ্ছেদের কথাও। যেটি এমনকি প্রথাগত বামপন্থিরাও (সংগত কারণেই) উচ্চারণ করেননি। মার্কস বা লেনিন কেউ সবধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ চাননি। কিন্তু ভাসানী এখানে অনেক বেশি ‘চরমপন্থি’- অন্তত ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের প্রশ্নে। তার বয়ানেই শোনা যাক :
‘আমি যখন হুকুমতে রব্বানিয়ার কথা বলি তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থি রাজনীতিবিদরাই বিরোধিতা করেন না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থি একশ্রেণির আলেম-ওলামা এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। তাই আল্লাহর নামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন বটে কিন্তু তাহাদের মতে উহা আল্লাহর নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেম-ওলামারা সবকিছুতে আল্লাহর মালিকানা মানিয়া লইয়া থাকেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না। এইভাবে হুকুমতে রব্বানিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুইটি মতবাদ রহিয়াছে ইহা আমার অনুসারীদিগকে বুঝিয়া লইতে হইবে।’
মওলানা ভাসানীর এই নিজস্ব দর্শনে বামপন্থি চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে সরলীকৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা ভুল তথ্যের প্রকাশ দেখা যায়। মার্কসীয় দর্শনে- অন্তত সমাজতন্ত্রের পর্যায়ে- ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’ বা পুুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানা অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পূর্ণ উচ্ছেদ আবশ্যিক নয়। আর ‘পার্সোনাল প্রপার্টি’ অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের তো প্রশ্নই ওঠেনি কোনদিন। প্রাইভেট প্রপার্টি অর্থে ব্যক্তিগত মালিকানা লেনিনের নিউ ইকনমিক পলিসি, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নানা পর্বে, দেং শিয়াও পিং উত্তর চীনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতায় ভালোভাবেই স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে কালক্ষেপণ করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, ‘রবুবিয়তের’ কথা বলতে গিয়ে ভাসানী শুধু একটি বিশেষ ধর্মের কথাই বলেননি। তিনি বারবার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে অনুসৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সংজ্ঞা অনুসারী- তিনি সকল ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখছেন। আমার বক্তব্যের সপক্ষে আমি ভাসানীর এপ্রিল ১৯৭৪ সালের ভাষণ থেকে নিল্ফেম্নাক্ত উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই :
‘আমি চাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েম করিয়া হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব চাহিদা পূরণ করিতে। ইহার সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নাই। তাই সকল ধর্মাবলম্বী উহার উপকারিতা ভোগ করিতে পারিবে। নিজ নিজ ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটিবে ইহাই আমার কামনা। যে-কেউ প্রশ্ন করিতে পারেন হুকুমতে রব্বানিয়া কীভাবে অমুসলমানদেরকে আপন করিয়া লইবে? যাহারা রবুবিয়তের মর্ম বুঝেন না তাহাদের এই প্রশ্ন করা খুবই স্বাভাবিক। রবুবিয়ত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া অর্থাৎ যে-দেশে রবুবিয়তের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে, কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, বিবর্তনকারী প্রভু, হিন্দুর জন্য তিনি একই বিধানে আলো-হাওয়া, ফল, পানি, বস্ত্র, খাদ্য সবই জোগাইতেছেন। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারে।’
যদি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা- যেভাবে সংবিধানে তা দেওয়া আছে- আমরা বিবেচনা করি, অর্থাৎ যেখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মের অপব্যবহার রোধ এসবকে তুলে ধরা হয়েছে- সেটি মানার জন্য নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস রেখেই সমতাবাদী সমাজ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হওয়া চলে। এর সাথে ধর্মহীনতা, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। মওলানা ভাসানীর বিশেষ ধরনের সমতাবাদী চিন্তা (তার ‘রবুবিয়তের’ তত্ত্ব সহ) এই চলার পথে সহজেই অঙ্গীকৃত হতে পারে। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ভাসানী এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর সর্বমানববোধের সাথে ইসলামী মরমি দর্শন, মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সুফিদর্শন, পরবর্তী কালের নদীয়াকেন্দ্রিক শ্রীচৈতন্য ও তৎপরবর্তী বাংলার বৃহত্তর বাউল-ফকিরি ঘরানার মূল কথা- অর্থাৎ ‘সবাইকে সমভাবে দেখা’- এর মৌলিক ঐক্যসূত্র রয়েছে। তবে ভাসানী অহিংসা-নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে গান্ধীর থেকে তিনি সুভাষ বসু, খ্রুশেভের থেকে তিনি মাওকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আজীবন বিপ্লবীদের অনুগামী। বিনা কারণে টাইম তাকে অভিহিত করেনি ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বলে।
পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথমত ও প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। মূলধারার রাজনীতিকে পুনর্গঠন করে ধাপে ধাপে তিনি প্রথমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তীতে একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভাসানীর ইসলাম বা রবুবিয়তের দর্শনের মূল সর্বমানববাদী বক্তব্যে তার আপত্তি থাকার কথা ছিল না। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সবল সমাজ গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সব ধারা ও উপধারাকেই যৌক্তিক স্থান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এইসব ধারা ও উপধারার মূল কথা হচ্ছে- সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করে সেকথা বললেন :
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ তারপরে আরো কিছু কথা বলার পরে তিনি বললেন :
‘আমি সর্বশেষ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করব, যেন এই দায়িত্ব আমরা সুচারুরূপে পালন করতে পারি। যে শহীদেরা আত্মাহুতি দিয়েছেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত সমাজের, আজকের বাংলাদেশের জনগণ আশা করে, যে সংবিধান-কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই হবে তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন। আমি আল্লাহর নিকট আবার প্রার্থনা করি, যেন বাংলাদেশের জনগণের আশা পূর্ণ হয়।…জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মওলানা তর্কবাগীশ সাহেব মোনাজাত করে দোয়া করবেন।’
এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সমাপনী বক্তব্যের শেষ ক’টি লাইন। ধর্মনিরপেক্ষতার এই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার পরও এ নিয়ে যারা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তারা অবুদ্ধির বশবর্তী হয়ে সেটা করেছেন অতীতে (এবং এখনো ইউটিউবে-ফেসবুকে সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ জুড়ে করে যাচ্ছেন)। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা এই মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন দিবারাত্রি। তাদেরকে বোঝানো শক্ত। জ্ঞানমার্গ বা যুক্তি দিয়ে সবাইকে সবকিছু বোঝানো যায় না। না বুঝতে চাওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ, শ্রেণিগত স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ থাকে। ‘আইডিওলজি’ মোহমুক্তভাবে অনেক সময় সত্যকে দেখতে দেয় না। পারস্য-যাত্রীর শেষে রবীন্দ্রনাথ এদের উদ্দেশ্য করেই একটি গদ্য-কবিতায় বলেছিলেন :
‘হায় মানুষ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং-এর পুষ্টির জন্য নয়;
যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন;
ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্রিত মানুষ জানে না
মানুষের জগৎটা যে কী, তা পশু কেমন করে জানবে।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৯২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


১৯৮২ সালে দৈনিক সংবাদের একটি লেখায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দীন এ বিষয়ে লিখেছেন:

‘বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি [ভাসানী] পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির উদ্দেশে তাঁর সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ঐ আসসালামু আলাইকুম তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতা এবং যাঁদের উদ্দেশে উচ্চারিত হয়েছিল তাঁরা উভয় পক্ষই উপলব্ধি করেছিলেন। আমার ক্ষুদ্র মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তজ্জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ঐ ‘আসসালামু আলাইকুম’ ধ্বনির মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।’

আবু জাফর শামসুদ্দীনের অনুভূতিটি কিছুটা অতিরঞ্জিত। রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ১৯৪৭-৭০ পর্বের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ধারা-উপধারার মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে জেগে উঠতে দেখা যায়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান (ও ক্রমবর্ধমান) বৈষ্যম্যের প্রেক্ষিতের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যেও এই বৈষম্য-বোধ ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু মওলানা ভাসানীর কণ্ঠে বেজে ওঠা কাগমারীর ডাক ‘আসসালামু আলাইকুম’ তৎকালীন রাজনৈতিক মহলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ভাসানীর ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার প্রত্যুত্তরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বিবৃতি দিতে হয়েছিল। দলের যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সামাদ এক বিবৃতিতে বলেন:

‘সম্প্রতি কাগমারীতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনকে কেন্দ্র করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি সর্বজননন্দিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের হীন অপপ্রচার তাঁহাকে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করিতেছে। …আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষের প্রাণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রথম হইতেই সন্নিবেশিত রহিয়াছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে ২১ দফার মধ্যে দেশরক্ষা, মুদ্রা ও বৈদেশিক বিষয় ব্যতীত আর সমগ্র বিষয় প্রদেশের হাতে ছাড়িয়া দেওয়ার পক্ষে পূর্ববাংলার সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ তাহাদের চূড়ান্ত রায় প্রদান করিয়াছে। …শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেব তাঁহার সারগর্ভ বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের উপর বিশেষ জোর দিয়া বলেন যে, গত এক বৎসর মুসলিম লীগ বিভিন্ন দিক দিয়া পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করিয়াছে। পূর্ব বাংলা আজ শ্মশানে পরিণত হইয়াছে। …এরপরেও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকরা পূর্ব পাকিস্তান শোষণ করিতে থাকে তাহা হইলে এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর পূর্ব বাংলার সচেতন জনসাধারণ অপেক্ষা করিয়া অতীতের ন্যায় শোষকদিগকে বলিবে ‘আস্‌সালামু আলাইকুম।’

স্টকহোম শাস্তি সম্মেলনে বিশ্ব শান্তির জন্য ভাসানী বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবেগময় ভাষায় বলেছিলেন: “ইসলাম আমার ধর্ম। ইসলাম আমার দর্শন। ইসলাম আমার সাধনা। আর যে ইসলামের উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘সলম’ থেকে যার অর্থই হচ্ছে শান্তি। কাজেই আমি বিশ্বাস করি কোনো মুসলমানই শান্তির প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। …শান্তির ধর্মের অনুগামীরূপে বাকি জীবনটি আমার উৎসর্গ করেছি শান্তির কাজে, মানবতার কাজে। বিশ্বব্যাপী আজকে শান্তি আন্দোলন আমার কাছে তাই ধর্মীয় কর্তব্য।”

কাগমারী সম্মেলনেও ভাসানী ধর্মীয় প্রতীক অবলম্বন করেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’ জানালেন। ধর্মে বিশ্বাস এই দুই উদাহরণেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কনটেন্ট তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। স্টকহোম এবং কাগমারী উভয় সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও বিশ্বশান্তির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। তিনি তার ধর্ম পরিচয় ব্যবহার করেছেন সক্রিয়ভাবে সাম্রাজ্য, সাম্প্রদায়িকতা ও অশান্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধারাটিকে এই আলোকেও বিচার করতে হবে।

চতুর্থত, ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই মওলানা ভাসানী ঢাকা ‘নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন’ শীর্ষক এক সভা আয়োজন করেন। এটি ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের প্রস্তুতি সম্মেলন। সেখানে প্রদত্ত ভাষণেও ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনৈতিক দর্শনের তাৎপর্যপূর্ণ সংশ্লেষণ দেখতে পাই। সেখানে ভাসানী বলেন :’পাক-ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বহু লোকের বহু ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস আমাদের সম্মুখে মওজুদ আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত ত্যাগী ও দেশপ্রেমিকদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতার পূর্বে অথবা কিছুদিন পরেই আমাদিগকে চিরদিনের জন্য তাহাদের সাধনা ও আদর্শ হইতে বঞ্চিত করিয়া আল্লাহর ইচ্ছায় পরলোকগমন করিয়াছেন। আজ যাঁহারা পাকিস্তানের কর্ণধার ইহাদের মধ্যে যখনই যে দল ক্ষমতা দখল করিয়াছে তাহাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন যাহারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো প্রকারের কোরবানি বা নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। নির্যাতিত নেতা যেরূপভাবে দেশের নির্যাতিত জনসাধারণের প্রতি দরদ রাখে যাহারা জীবনে কখনো জালেমের জুলুমে পতিত হন নাই তাহাদের পক্ষে দেশের প্রতি সেরূপ দরদ রাখা সম্ভবপর নহে।’

ন্যাপের গঠনতন্ত্রে জনকল্যাণমুখী, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বিভিন্ন ধারা যুক্ত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্চারণ না করলেও গঠনতন্ত্র পড়লে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরই অনুরূপ স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের ভিত্তি হিসেবে। সেখানে স্পষ্ট করে ‘লক্ষ্য’ হিসেবে বলা ছিল :

‘শাসনতান্ত্রিক, আইনসম্মত ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল প্রচার বিদেশি প্রভাব হইতে মুক্ত করিয়া পাকিস্তানে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কায়েম করা যাহাতে রাষ্ট্রের জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থাকিবে না এবং সকল প্রকার নির্যাতন ও শোষণের অবসান হইবে। ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সমাজব্যবস্থায় আইনের দৃষ্টিতে প্রতিটি লোকের সমান অধিকার এবং ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতিধর্ম ও সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের চাকরি, আশ্রয়, শিক্ষা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ধর্মীয় অধিকার প্রয়োগের পূর্ণ অধিকার থাকিবে।’

ন্যাপের গঠনতন্ত্রেও বলা ছিল ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের’ কথা: ‘ফেডারেল সরকারের অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য নিল্ফেম্নাক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করা হইবে: পাকিস্টত্মানের উভয় অংশকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দান। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা শুধু এই তিনটি ছাড়া অন্যান্য সকল বিষয়ের পরিচালনভার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের উপর ন্যস্ত করা। …অবিলম্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে উল্লিখিত মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল নাগরিক যাহাতে স্ব-স্ব নিয়ম-কানুন পালন করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করা।’

বস্তুতপক্ষে পথ ও রণকৌশলের কিছুটা পার্থক্য সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে রাষ্ট্র নির্মাণ ও শোষণমুক্ত জনকল্যাণমুখী সামাজিক ন্যায়বিচারের ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারার অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ও তৎপরবর্তী ৬ দফার লক্ষ্য, আদর্শ, কর্মসূচি ও আন্দোলনের সাথে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের একটি বরাবর পরস্পর-সহানুভূতিশীল পরিপূরক অবস্থান ছিল। মাঝে মাঝে ন্যাপের ‘হঠকারী বামপন্থি’দের অংশের চাপ এবং আওয়ামী লীগের ‘রক্ষণশীল ডানপন্থি’ অংশের চাপ এই দুই দলকে রণকৌশলের প্রশ্নে বিপরীতমুখী অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু মূল স্রোতধারার মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলের প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। একেক সময়ে এ-ও আমার মনে হয়েছে যেন মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৬ দফা পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রাম-নির্বাচন ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে আগাম শলা পরামর্শ করেই রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন। যা আপাতদৃষ্টিতে কখনো কখনো পরস্পরবিরোধী বলে মনে হলেও আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গতিমুখকে কণ্টকমুক্ত ও অগ্রগামী করে রেখেছিল। মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে সাময়িককালের জন্যে হলেও ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ নীতি গ্রহণের জন্য অভিযোগ তোলা হয়েছে কোন কোন ভাষ্যে। আবার সেই মওলানা ভাসানীকে ১৯৬৮-৬৯ সালে (বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে বন্দি) আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবকে ‘জেলের তালা ভেঙে’ কারামুক্ত করার ক্ষেত্রে এবং আইয়ুবশাহি পতনের ক্ষেত্রে তার অবিশ্রান্ত ভূমিকা ভুলে যাবার নয়। আইয়ুবের পতনের পর সাপ্তাহিক টাইম তাকে ‘পোয়েট অব ভায়োলেন্স’ আখ্যা দিয়ে লিখেছিল:

“Wreathed by a wispy beard, his face reflects an almost otherworldly serenity. As he plays with his grandchildren in a tiny village 60 miles north of the East Pakistan capital of Dacca, Abdul Hamid Bhashani, 86, looks the part of a Moslem maulana or guru, and to millions of Bengali peasants, he is. But the kindly grandfather is also Pakistan’s most outspoken advocate of violence. As much as any one man, Bhashani inspired the riots that last month forced President Ayub Khan to step down from the presidency. Now Bhashani is the most severe single threat to a fragile peace brought to the troubled and geographically divided land by the imposition of martial law. Under fear of harsh penalties, Pakistan’s other politicians, including Bhashani’s chief Bengali rival, moderate Sheikh Mujibur Rahman, have kept silent. Not Bhashani, who continues to receive newsmen and followers at his bamboo-walled hut.”

১৯৬৯ সালের ১৮ই এপ্রিল শুক্রবার সংখ্যার সাপ্তাহিক টাইম সাময়িকীর রিপোর্টার ডেন কগিন যেটা বুঝতে পারেননি যে, এই আপাত-মডারেট বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তখন ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের। ধাপে ধাপে ক্রেসেন্ডোর মতো উচ্চতায় তিনি নিয়ে যাবেন এই সংগ্রামকে তার অন্তিম লক্ষ্যের দিকে। এই যাত্রায় মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়লেও তার হাত ছাড়বেন না মওলানা ভাসানী, কেননা তিনি জানেন যে তার দল ন্যাপের ইয়াং টার্কস্‌রা নয়, তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সকল সহযোদ্ধার মধ্যে কেবল অনুজপ্রতিম মুজিবই পারেন এই বিপুল চড়াই-উৎরাইয়ের সংগ্রামে লক্ষ্য না হারিয়ে নেতৃত্ব দিতে। বলেছিলেনও ভাসানী এ নিয়েু বঙ্গবন্ধুর মতো জন-উদ্দীপক সাংগঠনিক প্রতিভা তার পরবর্তী প্রজন্মের আর কারো মধ্যে তিনি খুঁজে পাননি। ভাসানীকে বিদেশিরা নাম দিয়েছিল প্রফেট অব ভায়োলেন্স, আর বঙ্গবন্ধুকে তারা নাম দিয়েছিল পোয়েট অব পলিটিক্স বলে।

কেউ কেউ বলে থাকেন যে, মওলানা ভাসানী নাকি বঙ্গবন্ধু ও তার দলকে প্রায় শতভাগ জয়ী করার জন্যই ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ন্যাপকে অংশগ্রহণ করতে দেননি। ইতোপূর্বেই আমি উল্লেখ করেছি যে, এ নিয়ে কমরেড হায়দার আকবর খান রনোকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। তারা তখন ভাসানী ন্যাপের মধ্যেই ছিলেন। রনো আমাকে বলেছেন যে, ভাসানীর এই অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ছিল তার ‘গ্রেটেস্ট পলিটিক্যাল ব্লান্ডার’। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করে আমারও সে কথা মনে হয়েছে। ভাসানীর ন্যাপ অংশ নিলেও বঙ্গবন্ধু ও তার আওয়ামী লীগের তৎকালীন বিপুল ও অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তার মুখে সর্বোচ্চ ১৫-২০টির বেশি সিট পাওয়া সম্ভব ছিল না ১৯৭০-র নির্বাচনে। কিন্তু পরবর্তীকালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদে সংবিধান ও অন্যান্য পলিসি ডিবেটে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের থেকে নির্বাচিত ‘প্রগতিশীল’ সদস্যরা গঠনমূলক কিন্তু সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা রাখতে পারতেন। শুধু ন্যাপের (মোজাফ্‌ফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা পার্বত্য অঞ্চল থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র লারমার ওপরে নির্ভর করতে হতো না ‘বিরোধী কণ্ঠস্বরের’ জন্য।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারির প্রচারপত্রে ভাসানী নিল্ফেম্নাক্ত আহ্বান জানান : ‘দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি হইতে সপ্তাহব্যাপী সন্তোষ কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করিয়াছি। দল, মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করিয়া জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।’ ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয় : ‘* সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক। * ঐতিহাসিক মহান ২১ দফা আদায়ের ডাক। * চাষি, মজুর, কামার, কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সকল শ্রেণির মিলনের ডাক। * পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠনের ডাক। * ২১ দফার পূর্ণ রূপায়ণের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ, ইহা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই।’
সম্মেলনের প্রাক্কালে ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন : ‘আমি কোনো প্রকার যুদ্ধজোটে বিশ্বাস করি না। বিশ্বশান্তির পরিপন্থি যে কোনো প্রকার যুদ্ধজোট মানব সভ্যতা ও মুক্তির পথে বাধাস্বরূপ। …যত কঠিন বাধাই আসুক না কেন, আমি পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত কল্যাণের জন্য স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সংগ্রাম করিয়া যাইব। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, এই নীতি পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত মুক্তি ও শান্তির পথ প্রশস্ত করিবে।’
৭ ফেব্রুয়ারি সকালে কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয় সন্তোষের জমিদারদের একটি ভবনে। অধিবেশনে ৮৯৬ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনে ভাসানী একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যাতে তিনি বলেন : ‘জনসাধারণের অগাধ বিশ্বাস ছিল তখন মুসলিম লীগের উপর।…কিন্তু মাত্র ৯টি বছর না যেতেই আজ মুসলিম লীগ জনসাধারণের মন থেকে ধুয়েমুছে গেল। এত বড় একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এরূপ অবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।’ ঐ ভাষণেই আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘সাবধান হওয়া সহজ হবে’ বলে তিনি মুসলিম লীগের ভুল ও পতনের কারণগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “প্রথমত, ক্ষমতা তাদের মাথা গুলিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তারা ব্যক্তিগত ও দলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনলেন। তৃতীয়ত, মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশই ‘রাজনৈতিক সভা-সমিতিকে প্রধানত ধর্মমূলক ওয়াজ-নসিহতের জলসা’য় পরিণত করলেন। চতুর্থত, মুসলমানের আল্লাহ এক, ধর্ম এক, রসুল এক এবং কেতাব এক- এই যুক্তিতে রাজনৈতিক দলও হবে এক বলে প্রচার চালালেন তারা। একই যুক্তিতে তারা বলে যেতে লাগলেন, বিরোধী দল মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী। পঞ্চমত, মুসলিম লীগের কর্ণধারগণ পাকিস্তান তাদের ব্যক্তিগত জমিদারি মনে করে নিজেদের ব্যাংক ব্যালান্স এবং সম্পত্তি ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্রের ধন ও সম্পদ নির্লজ্জ লুণ্ঠনে মত্ত হলেন। তা অতীতের সমস্ত রাজনৈতিক অসততা, দুর্নীতি, ফেরেববাজি ও চুরিচামারিকে হার মানাবে।”
এর পর মওলানা তার নিজের দলের সরকার সম্পর্কে বলেন : ‘বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাষ্ট্রের জন্য সরকারি দলের মতোই সমান প্রয়োজন বলে মনে করতে হবে।… মোটকথা, পূর্ণ পার্লামেন্টারি শাসন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে আমাদের লক্ষ্যস্থল। এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক কাজ বাকি। একুশ দফা ওয়াদার মূল দফা এবং আওয়ামী লীগ মেনিফেস্টোরও প্রধান কথা হলো পররাষ্ট্র, মুদ্রা এবং দেশরক্ষা বিভাগ ছাড়া আর সব বিভাগের ভার প্রদেশকে দিতে হবে। কারণ, যতদিন না পূর্ব পাকিস্তান তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার পূর্ণ ক্ষমতা পাচ্ছে; যতদিন না শিল্প ও বাণিজ্য, রেলওয়ে, পোস্ট অফিস প্রভৃতি বিভাগের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে আসছে; যতদিন না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক বিচারে দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইউনিট বলে স্বীকার করা হচ্ছে; ততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সম্ভব নয়।’
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা নিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দীন তার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সম্মেলনের তোরণগুলোর নাম-নির্বাচনের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল :
‘যতদূর মনে পড়ছে তার মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল প্রমুখের নাম বহনকারী তোরণও ছিল। ১৯১৯-২১ এবং ১৯৩০-৩২ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের প্রতি মওলানা ভাসানী বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করতেন। মওলানা সাহেব স্থাপিত কাগমারী কলেজের নাম মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ। মোট কথা, কাগমারীর আয়োজন ছিল অভূর্তপূর্ব।’
আরেক নেতা নূরুল হক চৌধুরী তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন :’আমি ডেলিগেট হিসেবে সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম। টাঙ্গাইলে ঢুকেই দেখি হজরত মোহাম্মদ তোরণ, তারপর তোরণ আর তোরণ। গান্ধী তোরণ, মওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, নজরুল তোরণ, ইকবাল তোরণ, নেতাজি সুভাষ বসু তোরণ, হাজি শরীয়ত তোরণ, তিতুমীর তোরণ, নেহরু তোরণ, হাজি মোহাম্মদ মুহসীন তোরণ, সিআর দাশ তোরণ, লেনিন তোরণ, স্ট্যালিন তোরণ, মাও সে তুং তোরণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন, শেলি, হালি, রুমি, ইমাম আবু হানিফা, গাজ্জালি তোরণ- টাঙ্গাইল থেকে সন্তোষ পর্যন্ত মোট ৫১টি তোরণ। সর্বশেষ তোরণ ছিল কায়েদ-ই আযম তোরণ।’
কাগমারী সম্মেলনের স্বাগত ভাষণে মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের সাথে এই সম্মেলনের নিকট সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। তার ভাষণে উঠে আসে বার্ট্রান্ড রাসেল, পাবলো নেরুদা, ম্যাক্সিম গোর্কির কথা। এখানে উল্লেখ্য এর তিন বছর আগে ১৯৫৪ সালে স্টকহোমের শান্তি সম্মেলনে ভাসানী বিশ্ব শান্তি পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই বিশ্ব শান্তি পরিষদই পরবর্তী সময়ে (১৯৭৩ সালে) বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে সম্মানিত করেছিল। স্টকহোমে ভাসানীর সফরসঙ্গী ছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ শীর্ষক বইয়ে ভাসানীর সফর সম্পর্কে একটি অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে মওলানার সাথে তার হোটেলে এসে সাক্ষাৎ করেন বিশ্বের দুই বিখ্যাত কবিু তুরস্কের নির্বাসিত কবি নাজিম হিকমত ও চিলির নির্বাসিত কবি পাবলো নেরুদা। ইলিয়াসের ভাষ্যে মওলানা ভাসানী যখন ‘পরস্পরের নিকট হতে বিদায় নিচ্ছিলেন তখন তিন মনীষীর মুখেই ফুটে উঠেছিলো শান্তি ও সান্তনার প্রদীপ্ত আভা।’ স্টকহোমের ভাষণে ভাসানী বলেছিলেন: “বন্ধুগণ, আজ থেকে সাত বছর আগে এই স্টকহোম শহর থেকেই সর্বপ্রথম উত্থিত হয় শান্তির আওয়াজ। ‘স্টকহোম আবেদন’ নামে খ্যাত শান্তির আবেদনে স্বাক্ষর দান ও স্বাক্ষর সংগ্রহে সেদিন যারা উদ্যোগী হয়েছিলেন, আমি তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনকে যিনি আমরণ সংগ্রাম করেছেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমি অভিনন্দন জানাই বিশ্ব-সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ-কে যিনি ছিলেন বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। আমি শ্রদ্ধা জানাই বৈজ্ঞানিক জুলিও কুরিকে যাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা মানবতাকে হানাহানি ও রক্তারক্তি থেকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীর বুকে শাশ্বত শান্তির নির্মল পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমি শ্রদ্ধা জানাই সোভিয়েত ইউনিয়নের কালজয়ী ঔপন্যাসিক ইলিয়া ইরেনবুর্গকে যার অমর লেখনী আজ নিয়োজিত মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ ও চিরস্থায়ী মৈত্রী স্থাপনের কাজে।” একই কথা ভাসানী বললেন কাগমারী সম্মেলনে। স্টকহোম সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন: ‘সাল্ফ্রাজ্যবাদের ইতিহাস কপটতার ইতিহাস। সকল মানুষকে সকল কালের জন্য সে ইতিহাস প্রবঞ্চিত করতে পারে না বটে কিন্তু সাময়িকভাবে হলেও সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন দেশে কতিপয় ভাড়াটে সমর্থক জোগাড় করতে সমর্থ হয়।…আজ সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ সকল প্রকার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিপক্ষে। …সে জনতার মিছিলে শরিক হয়েছেন আমেরিকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক হেমিংওয়ে, হাওয়ার্ড ফাস্ট, সংগীতজ্ঞ পল রবসন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন আর রোজেনবার্গ দম্পতির মতো অসংখ্য পরিবার।’ কাগমারী সম্মেলনের ভাষণে ভাসানী এর সাথে যুক্ত করলেন সাম্প্রদায়িক সমস্যার কথা। সম্মেলনের প্রত্যক্ষদর্শী আবু জাফর শামসুদ্দিনের মতে ভাসানী এই সম্মেলনে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যার ওপরে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন:\হ’ভাসানী বলেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যা আজ পাকিস্তান ও ভারতের জনগণের সবচেয়ে বড় দুশমন। এই সমস্যা নির্মূল করতে না পারলে এই দুই দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। তাদের সমস্ত উন্নয়নের উদ্যোগ বরবাদ হয়ে যাবে।…আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বাস করে থাকে। পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যদিও এটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ দেশ হিন্দুর, বৌদ্ধদের, খ্রিষ্টানদের, আদিবাসী-উপজাতীয় সকলের।…তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তান বৈরিতা দুই দেশকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করবে।…তিনি এদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের কারণগুলো খুঁজে বের করার কথাও বলেন।’
কাগমারী সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন ঔপন্যাসিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ। এই সম্মেলনে একদিন ভাসানীর সাথে তারাশঙ্করের কথা হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ জানিয়েছেন, মওলানা তারাশঙ্করকে বলেন, ‘যে সকল হিন্দু বাড়িঘর ফেলে এখান থেকে ভারতে চলে গিয়েছে তাদের আবার ফেরত আসা উচিত। আমরা তাদের পূর্ণ মর্যাদায় স্বদেশে বসবাসের ব্যবস্থা করব। ভারত থেকে যে সকল মুসলমান মোহাজের এখানে আসবে তারাও এক ভিন্ন সংস্কৃতিতে আরামে নেই। ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগের বিরুদ্ধে দু’দেশের সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।’
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ও বিশ্ব আঞ্চলিক শান্তির সপক্ষে প্রদত্ত জোরালো যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষণশীল মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। দৈনিক আজাদ তার সম্পাদকীয়তে লিখেছিল: ‘মওলানা ভাসানীর ভাষণে এমন কতকগুলি উক্তি আছে, যাতে সত্যভাবে পাকিস্তানীমাত্রই শঙ্কিত না হইয়া পারেন না। মোছলেম লীগের নিন্দায় মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে একেবারে পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছেন: তা হোন, কিন্তু বেসামাল হইয়া তিনি এমন কথাও বলিয়া ফেলিয়াছেন: প্রাক-পাকিস্তান যুগেও মোছলেম লীগের কোনো অস্তিবাচক জীবনদর্শন ছিল না। প্রধানত বিদ্বেষকে অলম্বন করে সেদিন আমাদের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে। জিঘাংসার নিবৃত্তি হলে আমরা কী গড়ে তুলব সেদিন এ কথা আমাদের কোনো নেতা চিন্তা করেননি এবং চিন্তা করেননি বলেই পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত সত্যকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলো না।’
১৯৫৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক আজাদের ঐ দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে মওলানা ভাসানীর মূল প্রক্রিয়াকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল: “পাকিস্তান সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করেন বলিয়াই কি মওলানা ভাসানী ইহাকে আজ রসাতলে লইয়া যাইবার মতলব আঁটিয়াছেন? তাঁর এই মতলব ধরা পড়িয়াছে তাঁর আর একটি উক্তিতে। তিনি বলিয়াছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ যদি বন্ধ না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসিবে, যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানকে জানাইবে ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে।”
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আসল অর্থ হচ্ছে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- এরা সবাই মানুষ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে মানবিকতাবাদ (হিউম্যানিজম)। এটা বোঝার জন্য ইউরোপীয় রেনেসাঁর মানবিকতাবাদী দর্শন বোঝার দরকার নাই। আমাদের সমাজের ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত জনজীবনের মৌলিক মানবিকতাবাদকে উপলব্ধি করাই যথেষ্ট। এ জন্যই আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও অন্য ধর্মের লোককে আপনার আত্মীয় ও প্রতিবেশী বলে জ্ঞান করেছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে সময় সময় আচ্ছন্ন করেছে বটে, কিন্তু আমাদের ধর্ম-সম্প্রদায়ে মিলনের ইতিহাসই হচ্ছে মৌলিক ধারক। এ কথা রবীন্দ্রনাথও গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণি’ বইটির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনে নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। … বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই একত্র হয়েছে, অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। … এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়। বিবাদে বিরোধে বর্বরতা।’ এই মানবিকতাকে তুলে ধরতেই সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আলাদা করে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়েছিল।
আজকে কালক্রমে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের প্লাবনে ধর্মনিরপেক্ষতার আদি-প্রতিশ্রুতি অনেকটাই সাইডলাইনে চলে গেছে বলে মনে হতে পারে। এক সময় (১৯৬৬ সালে) বদরুদ্দীন উমর লিখতে পেরেছিলেন অবলীলায় ‘স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের বাস্তব জীবনক্ষেত্রে যা কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে তাদের কোনোটিই কিন্তু ধর্মচিন্তার ফল নয়। … এ দেশের মুখ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনসমূহ- যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, শিল্পোন্নয়ন ও সমতা রক্ষার আন্দোলন ইত্যাদি ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ নয়। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে এগুলির আবেদন প্রায় ধর্মবিরোধী। ধর্মীয় আন্দোলনের প্রচেষ্টা যে ইদানীং কিছু কিছু হয়নি তা নয়। কিন্তু এ আন্দোলনের মধ্যে আগেকার সেই জৌলুস এবং মোহমুগ্ধতা আর থাকেনি। জীবনের সাথে এ জাতীয় আন্দোলনের যোগাযোগ যেন আজ অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। এ কারণেই এ দেশে ধর্মীয় বাধানিষেধ এবং নানা সংস্কার সত্ত্বেও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় চিন্তার সে পূর্ব আবেদন আর নেই।’
ওপরের কথাগুলো লিখিত হয়েছে ১৯৬৬ সালে। সেদিনের তুলনায় আজকের অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে ঘরে-বাইরে। সম্প্রতি স্বয়ং বদরুদ্দীন উমরও আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বইটি আজকের প্রেক্ষিতে লিখলে কথাগুলো অন্যভাবে বলতেন।
ধর্মবিশ্বাসী হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানোর আরো একটি উদাহরণ মওলানা ভাসানী। সময় সময় রাজনৈতিক কোন কোন অব্যাখ্যাত স্ব-বিরোধিতা বলে মনে হতে পারে ভাসানীর কিছু কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে কোন সন্দেহ নেই যে মওলানা ভাসানী ছিলেন এদেশের ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক, সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থের জন্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই করা এক ব্যতিক্রমী ও বর্ণিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ভাসানীর সুদীর্ঘ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জীবনের এবং জীবন-দর্শনের মূল্যায়ন করার স্থান এখানে সীমিত। এ নিয়ে একটি বড় পরিসরের বিশ্নেষণমূলক কাজ হওয়া দরকার। আমি এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির সাপেক্ষে কয়েকটি মন্তব্য রাখছি কেবল।
প্রথমত, মওলানা ভাসানীর মানস-গঠনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রভাব এসেছিল। রাজনৈতিক জীবনের সূচনা পর্বেই তিনি ভিন্ন ধারার পথিক ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাকে প্রভাবিত করেছিলেন, এটা জানা যায়। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কোন দলের সাথেই তিনি ঘনিষ্ঠ হতে চাননি। চরমপন্থি বিপ্লববাদীদের দলেও তিনি নিজেকে দেখতে চাননি। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আলোচনা তাকে টানত, কিন্তু তার অবস্থানও তাকে কাছে টানতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন :
“ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘সাহস ও আপসহীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা পছন্দ হয়, কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি শুধু মুসলমানদের জন্যেই কথা বলেন এবং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নিন্দা করেন। যে-সকল হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা শুধু হিন্দুদের জন্যে কথা বলে যে-ভুলটা করেছেন; সিরাজীও শুধু তার নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা বলে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করছেন। যদিও মুসলমানদের পক্ষেও তখন কথা বলার লোকের প্রয়োজন ছিল। আবদুল হামিদ [ভাসানী] অত্যাচারিত ও দরিদ্রের পক্ষেু সেই অত্যাচারিত ও দরিদ্রের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দু’সম্প্রদায়েরই মানুষ আছে, তবে ঘটনাক্রমে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি।”
মওলানা ভাসানী আজীবন ধর্মান্তরের বিরোধিতা করে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ একটি তথ্য উল্লেখ করেছেন : ‘পীর হিসেবে তাঁর মুরিদান ও ভক্তের মধ্যে হিন্দু মুসলমান নানা সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল। ১৯৬৯-এ আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের মধ্যে একদিন সন্তোষে রমেশ দেবনাথ নামে এক দরিদ্র হিন্দু সস্ত্রীক গিয়ে ভাসানীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তিনি জানতে চান, তাদের কী পেশা। তারা জানান যে, তারা জাতে যোগী (নিম্নবর্ণের হিন্দু) কিন্তু এক সময় স্বর্ণকার ছিলেন। এখন আর সোনা-রূপার অলংকার কেউ বানাতে আসে না। জমিজমা তেমন নেই। অনেক ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। মওলানা তাদের জিজ্ঞেস করেন, মুসলমান হলে তাদের আয় বাড়বে কিনা, আল্লাহ খুশি হয়ে তাদের ধনদৌলত দেবেন কিনা? তারা মাথা নিচু করে নিরুত্তর থাকেন। ভাসানী তাদের বলেন, ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানে অধিকাংশ মুসলমান কী সুখে আছে দেখছো না? পড়ালেখা কিছু জানলে বাড়িতে গিয়ে নিজের ধর্মগ্রন্থ গীতা পড়ো গিয়ে; দুনিয়াতে কোনো ধর্মই খারাপ নয়। গুরুকে প্রণাম করে দেবনাথ দম্পতি বিদায় নেন।’
সৈয়দ আবুল মকসুদের বয়ানে ভাসানীর ধর্মান্তরের বিরোধিতা প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায় কাজী আনোয়ার-উল-হকের কাছে। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ভাসানী কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখানে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য যান আনোয়ার-উল-হক, তখন তিনি পুলিশের ডিআইডি (বিশেষ শাখা)। হাসপাতালের কেবিনে ভাসানী তার কাছে অতীত দিনের স্মৃতিচারণে বসেন। তিনি আসামের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আসামে আমার মুরিদদের মধ্যে হিন্দুও ছিলো, মুসলমানও ছিলো। আমি ধর্মান্তর পছন্দ করি না। অনেক মুসলমান নেতা আমাকে ধর্মান্তরের জন্য পরামর্শ দিতেন। আমি রাজি হইনি। ১৯৩৫ থেকে ‘৪৭ পর্যন্ত বারো বছরে যদি আমি চাইতাম তবে লাখ লাখ আদিবাসী ও হিন্দুকে আমি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতাম। আসামকে পূর্ব বাংলার মতোই মুসলমান মেজরিটি প্রভিন্স বানাতে পারতাম। জীবনে একজন হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীকে আমি মুসলমান করিনি। তাতে লাভ কী? আমার হিন্দু শিষ্যদের ঠিকমতো তাদের ধর্মকর্ম করার পরামর্শ দিতাম।’
ভাসানী প্রায়ই বলতেন, ‘দুনিয়ায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত, জালেম আর মজলুম। জালেম হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক; তার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম চলবেই।’
দ্বিতীয়ত, সুবিদিত যে ভাসানীই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। আবার তারই সভাপতিত্বে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নামকরণ বদলের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই কাউন্সিল অধিবেশনে অসাম্প্রদায়িক রূপান্তরের লক্ষ্যে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবেই ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম হয় আওয়ামী লীগ। সেই অধিবেশনেই, যেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন- গৃহীত হয় প্রস্তাব, যেখানে বলা হয়েছিল :’পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হইয়াছে।’ অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা পূর্বাপর বহমান ছিল। সেই অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভাসানী বলেন :’এই দুই বছরের ভেতর আমি ইউরোপের নানান দেশ ভ্রমণ করিয়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়ভাবে পরিচিত হইবার ও নানা প্রকারের তথ্য সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়াছি এবং সেই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় এই অভিজ্ঞতা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণের পথে সহায়তা করিবে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।
পাকিস্তান অর্জনের সময় যে বিরাট উন্মাদনা আট কোটি মানুষের জীবনকে নবচেতনা ও বিরাট সম্ভাবনার আশায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সে আশা-আকাঙ্ক্ষা মানুষের অবসন্ন ও হতাশ প্রাণে এক রঙিন স্বপ্নের সৃষ্টি করিয়াছিল, নবলব্ধ পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নর-নারীর প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর দেশকে সুখী সমৃদ্ধশালী করিয়া স্বর্গরাজ্য করিবার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করিয়াছিল। আট বছরের লীগশাহির কুশাসন ও অমানুষিক অত্যাচার, অবিচার, দুর্নীতি, বেইমানি, দাগাবাজি সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনার স্বপ্নকে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিল।….আমরা মুসলমানু পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করা হইবে এই চিৎকার উঠিতেছে কিন্তু ইসলামী জীবন-যাপন করিবার কথা কাহারও মনে হইতেছে না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অত্যাচার, অবিচার অবাধে চলিতেছে। ঘোড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি, মদ্যপান, জুয়া প্রভৃতি অন্যায় কার্য দেশে কেবল চলিতেছেই না; সরকারও যেন ইহার পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছেন। পাপের ভারে দেশ ধ্বংসের পথে।… দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র গঠনের কথা বলা হইতেছে। পাকিস্তানে শুধু মুসলমানই পাকিস্তানি নহে; বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু সকলেই পাকিস্তানি জাতি। পাকিস্তানে চারি জাতির বাস যাহারা কল্পনা করেন তাহারা ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে চতুষ্পদের স্থান বলিয়া ছাড়িবেন, এই ভয় হয়। পাকিস্তানে মুসলমান শতকরা আশিজন, এমতাবস্থায় পৃথক নির্বাচনের দাবি আমাদের পক্ষে অযৌক্তিক। দুই জাতির ভিত্তিতে আমরা পাকিস্তান সংগ্রাম করিয়াছিলাম এই যুক্তির ভিত্তিতে- হিন্দুরা যদি হিন্দু পাকিস্তান বা পাক হিন্দুস্তান নামে ভিন্ন প্রদেশের দাবি করিয়া বসেন তাহা হইলে কোন যুক্তি দ্বারা তাহার প্রতিবাদ করিতে পারি। এই প্রসঙ্গে আমরা কায়েদে আযমের বাণীর কথা উল্লেখ করিতে চাই। তিনি বলিয়াছিলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক ভিত্তিতে মুসলমান ও হিন্দু নিজেদের জাতীয়তা ভুলিয়া শুধু পাকিস্তানিই হইবেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আর অন্য কোনো দেশ নাগরিকদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে নাই। ইহা সভ্যতার পরিপন্থি। যুক্ত নির্বাচন প্রথা না হইলে চেকোশ্নোভাকিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইবে। …বন্ধুগণ, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করার একটা প্রশ্ন দুই বছর পূর্বেই উঠিয়াছে এবং বিগত কাউন্সিল অধিবেশনে শাসনতন্ত্র [গঠনতন্ত্র] গৃহীত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নাম সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করিবার ভার আমার উপর ন্যস্ত করা হইয়াছিল। আমি ভিন্ন ভিন্ন জেলা, মহকুমা আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, দেশের অধিকাংশ লোকই, বিশেষত কর্মীদের বহুলাংশই প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক করার শুধু পক্ষপাতীই নন; জোর দাবিও জানাইয়াছেন।’
তৃতীয়ত, পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে ভাসানীর আহ্বানে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
ধর্ম নিরপেক্ষতার আরো একটি মানে ‘ইহজাগতিকতা’, কিন্তু ইহজাগতিকতার পরিধি সীমিত থেকেছে রাজনীতিতে ধর্মকে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শের মধ্যে এবং এটি এসেছে কেবল পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্যের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অনেক সময় ধর্মকে যুক্তির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধর্ম-নির্বিশেষে সমতার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছে বাহাত্তরের সংবিধান। ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি অর্থ হচ্ছেু সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বা নন-ডিসক্রিমিনেশন প্রিন্সিপাল। সব মিলিয়ে আমরা পাচ্ছি ধর্মনিরপেক্ষতার তিনটি দিক: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো; ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করার ইহজাগতিক বোধ; এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান অধিকার। এই তিনটি দিক মেলালে আমরা আমাদের দেশের মতো করে সেক্যুলারিজমের একটি আদল খুঁজে পাই। এরই প্রতিফলন হয়েছে সংবিধানের ১২ নং ধারায়:
‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’
ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারাটিকে এর আগের ১১ নং ধারার অধীনে দেখতে হবে, যেখানে রয়েছে ‘মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তার’, এবং ‘মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ নিশ্চিত করার কথা।
সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ধর্মকে রাজনীতির সাথে যুক্ত না করা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান নেওয়া এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে (এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও) সমান অধিকার- ধর্মনিরপেক্ষতার এই তিনটি দিক রক্ষার জন্য নাস্তিক হওয়ারও দরকার নেই। ধর্মহীন বা ধর্মচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা নেই। একজন প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তার বিশ্বাসে অনড় থেকেও এই তিনটি দিকই রাষ্ট্রের কাছে মনে-প্রাণে প্রত্যাশা করতে পারেন। আমাদের মা-নানীরা ধর্মবিশ্বাসী হয়েও আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সকল ধর্মের মানুষের যার যার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা স্বীকার করে গেছেন। যারা রাজনীতিতে নেমে কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের বা সম্প্রদায়ের মানুষকে অধিকারহীন করতে চায়, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধাতে চায়, তাদের প্রতি আমাদের পিতৃপুরুষেরা সশঙ্কিত মনোভাব প্রকাশ করতেন এবং তাদের সংস্পর্শ পরিত্যাজ্য জ্ঞান করতেন। সেকালে অনেক স্থানে যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পাশাপাশি বাস করতেন, তাদের অনেকেরই মধ্যে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সাথে সাথে এক ধরনের ‘মিশ্র’ সামাজিক-ধর্মীয় আচার গড়ে উঠেছিল। ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে বলি, আমি যে-আবহাওয়ায় বড় হয়েছি, তাতে করে পাড়ায় মিলাদ হলে বা শবেবরাতের সময়, ঈদের পরবে নিত্যই দাওয়াত মিলত প্রতিবেশী মুসলিম পরিবারদের থেকে। তাদের কাউকে ডাকতাম খালাম্মা, কাউকে পিসিমা বলে, তারা আবার আমার মা-বাবাকে ডাকতেন মাসিমা-মামাবাবু বলে। বাবার এমনি একজন বোন ছিলেন। যাদের সাথে পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেই সুদূর ১৯৪৩ সাল থেকে। এই ধর্মবোন-ধর্মভাই শুধু স্বধর্মের অনাত্মীয় লোকদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল না; ভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যেই দেখা যেত। আমাদের জীবন-চর্চা ছিল আত্যন্তিকভাবেই ধর্মাশ্রিত এবং তা কখনও কখনও নিজ ধর্ম ছাপিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাসকেও স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে প্রকাশ পেত। গভীর ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি এক ধরনের মিশ্র-আচার বা ‘সংকট’ মনোবৃত্তি হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেই ছিল। এটা শুধু তথাকথিত ‘নীচু’ জাতের মানুষদের মধ্যেই ছিল তা নয়; মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র’ জাতের মানুষদের মধ্যেও ছিল। আমার মা প্রতিটি পারিবারিক সংকটে-উৎসবে মিরপুরের ‘ঠান্ডা পীরের’ মাজারে বা হাইকোর্টের ‘গরম পীরের’ মাজারে মানত রাখতেন এবং ছোটবেলা থেকেই এই দুই জায়গায় যাওয়া আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কীভাবে মা তার প্রতি-মঙ্গলবারের মঙ্গলচণ্ডী পূজার সাথে পীর-মাজার সংস্কৃতিকে মেলাতেন তা একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, তিনি কোনো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিলেন না। এর বড় প্রমাণ বাংলার পুথি-সাহিত্য। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ‘সংকর’ সামাজিক-ধর্মীয় বিশ্বাস-আচারের দৃষ্টান্ত ধারণ করে আছে মধ্য যুগের বাংলা (ও অন্য ভাষার) পুঁথিসমূহ। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের যুক্ত সাধনা’; রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ‘হান্ড্রেড সংস অব কবীর’ অনুবাদ; দুই বাংলার বাউল-ফকির ঘরানার গান বড় নিদর্শন। যেমন, দাদূ ও কবীর ছিলেন ‘সংকর’ ঐতিহ্যের প্রতীক। এক জায়গায় কবীর বলছেন, ‘আমি সংস্কৃত ভাষা শিখেছি যাতে করে সবাই আমাকে জ্ঞানী বলতে পারে, কিন্তু এই ভাষা শিখে কী লাভ যখন আমি দিকশূন্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি?’ এর কয়েক শতাব্দী পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আত্মজীবনী’ লিখতে গিয়ে শুধু উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তৃপ্ত হবেন না; তিনি পরে পরেই ফিরে যাবেন হাফিজের বাণীর কাছে। এক জায়গায় দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন কী করে তিনি সিমলার শীতের রাত্রিতে আরাধনার কালে ব্রহ্মসংগীত ও হাফিজের গান একই সাথে করতেন। উদ্ৃব্দতিটি বড়, কিন্তু ‘সংকর ঐতিহ্যের’ স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে তাতে :
‘আমি কম্বল জড়াইয়া বিছানায় বসিয়া সকল ভুলিয়া অর্ধেক রাত্রি পর্যন্ত ব্রহ্মসংগীত ও হাফেজের কবিতা গান করিতাম-
য়া রব, আঁ শমে শব্‌-আফ্‌রোজ কে কাশানা-এ-কীস্ত্‌?
জানে-মা গোখ্‌ৎ বে-পুর্সীদ কে জানানা-এ-কীস্ত্‌?
[অর্থাৎ] যে দীপ রাত্রিকে দিন করে, সে দীপ কাহার ঘরে?
আমার তো তাতে প্রাণ দগ্ধ হলো, জিজ্ঞাসা করি তাহা প্রিয় হলো কার?’
হাফিজের প্রতি মুগ্ধতা দেবেন্দ্রনাথের লেখার ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়েছে (আমি শুধু স্থানাভাবে দেবেন্দ্রনাথের অনুবাদে হাফিজের বাংলাটাই তুলে ধরছি) :
‘আজ আমার ও সভাতে দীপ আনিও না।
আজিকার রাত্রিতে সেই পূর্ণচন্দ্র আমার বন্ধু এখানে বিরাজমান।’
তারপর দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন :
‘অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, যাহা মূলতত্ত্ব, তাহার উল্টা ভাবনা মনেতেও স্থান পাইতে পারে না; তাহা কোনো মনুষ্যের ব্যক্তিগত সংস্কার নহে, তাহা সকল কালে নির্বিশেষে সর্ববাদী-সম্মত; মূলতত্ত্বের প্রামাণিকতা আর কাহারো উপর নির্ভর করে না। তাহা আপনি আপনার প্রমাণ। তাহা স্বতঃসিদ্ধ, যেহেতু ইহা আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাতে প্রতিষ্ঠিত।’
একই লেখাতে/স্তবকে দেবেন্দ্রনাথ উপনিষদ ও হাফিজের গানকে সাক্ষী মানছেন এটাও তাৎপর্য্যপূর্ণ :
‘আমার প্রতি উপনিষদের উপদেশ এই :
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং। ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন কর। আমি ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন করিলাম। আমি এই তিমিরাতীত আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে জানিয়াছি।’
এটা বলেই তিনি আবারও হাফিজের শরণাপন্ন হলেন :
‘বাদ্‌ অজ্‌-ঈ র্নূ‌ ব-আফাক দেহেম অজ্‌ দিলে খেশ্‌,
কে ব-খুর্শীদ্‌ রসীদেম্‌ ও গোর্রা‌ আর্খি‌ শুদ্‌।
[অর্থাৎ] এখন অবধি জ্যোতি আমার হৃদয় হইতে পৃথিবীতে ছড়াইব, যেহেতুক আমি সূর্য্যেতে পঁহুছিয়াছি ও অন্ধকার বিনাশ হইয়াছে।’
মধ্যযুগের কবীর বা ঊনবিংশ শতকের দেবেন্দ্রনাথ কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন হিন্দু-মুসলিম যুক্ত সাধনার ও ‘সংকর’ সামাজিক ধর্মীয় বিশ্বাসের ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে। দীনেশচন্দ্র সেন ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্য মুসলমানদের অবদান’ গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন :
‘আমরা শিক্ষিত-সম্প্রদায় বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের মালিক। খনির মধ্যে খনির ন্যায় আমাদের পল্লীতে পল্লীতে বঙ্গ-ভারতীয় যে অজস্র দান পড়িয়া আছে তাহা আমরা দেখি নাই, শুনি নাই … এইরূপ শত শত গীতিকা ও কথা আছে। তাহাদের অনেকগুলি নবম দশম শতাব্দীর; হিন্দু-মুসলমানের পৃথক ছাপমারা তাহারা নয়- তাহারা উভয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব। এই বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক বাঙালী। আমি শুধু মুসলমান কবিদের কয়েকটি রচনার নমুনা দিলাম, তাহাও অতি অল্প সংখ্যক। অপ্রকাশিত বহু গীতিকা আমার কাছেই আছে- বাঙালার পল্লী-দরদী লোক যদি খুঁজিয়া বেড়ান, তবে এখনও বৃদ্ধ গায়েন অনেকে আছেন- যাহাদের নিকট হইতে এখনও শত শত কাহিনি ও গীতিকার উদ্ধার হইতে পারে। … হিন্দুদের রচিত মহুয়া, কাজলরেখা, চন্দ্রাবতী, কমলা, কেনারাম, মালঞ্চমালা প্রভৃতি অনেক গীতিকা ও রূপকথা আছে- মূলত তাহাদের সঙ্গে মুসলমানগণের রচিত কাব্যগুলোর প্রভেদ অল্প- একই ধাঁচের লেখা, একই সুর, একই আদর্শ।’ এই যে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত-সাধনা- এই অভিন্ন ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্য- এটিও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটি দিক। ধর্মনিরপেক্ষতার এই মিলিত চর্চার সাংস্কৃতিক পটভূমিটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এজন্যেই ‘হাসিনা’ তথ্যচিত্রে যখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান বেজে ওঠে (পান্নালালের গাওয়া) ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা’, তখন সুরেই আবিষ্ট হয়ে থাকি আমরা। এটা যে শ্যামা-সংগীত কে তার ধার ধারতে এসেছে? বঙ্গবন্ধুর মানস-গঠনে এই হিন্দু-মুসলিম একত্র-সংস্কৃতির আবহাওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছে। এটা না বুঝলে শুধু সংস্কৃতি-বিরহিত শুস্ক তত্ত্ব-আদর্শের নিরিখে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির গূঢ় অর্থটি বোঝা যাবে না।
কেন অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ এত বড় করে দেখা দিয়েছিল তা একজন রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখছেন গোপালগঞ্জের জনৈক চন্দ্র ঘোষের কথা, যিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী :’জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হতো না। জুতা পরতেন না, খরম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন।’ এহেন ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তান আমলে। একসময় তাকে, শেখ মুজিবকে এবং ফণী মজুমদারকে একই সেলে রাখা হয়। সেবার বঙ্গবন্ধুর প্রচণ্ড জ্বর এলো জেলে :
“রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে, দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণী বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন। কখনও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন ‘জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না।’ ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফণী বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে?”
এই চন্দ্র বাবুকে আরেকবার ফরিদপুর জেলে পেলেন মুজিব। ততদিনে চন্দ্র বাবুর শরীরের চরম অবনতি হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে অনুমতি দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নেই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই। সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’ চন্দ্র ঘোষ তরুণ মুজিবুরকে বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনো দিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।”
এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’
[ক্রমশ]