পভার্টি ট্র্যাপ ও আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য: সিলেটে রবীন্দ্রনাথের ভাষণ (Poverty Trap and Poverty of Aspiration: Tagore in Sylhet)

পর্ব ::৩২

১. অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার ‘পভার্টি ট্র্যাপের’ তত্ত্ব

২০১৯ সালের অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার সহকর্মীদের গবেষণার একটি মূল বিষয় ছিল ‘পভার্টি ট্র্যাপের’ তত্ত্ব। দরিদ্ররা কী করে দীর্ঘকালের জন্য দারিদ্র্যের ‘ফাঁদে’ পড়ে যান- অনেক ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিকভাবেই সেই ফাঁদে জীবন কাটান- এ কথা অভিজিৎ ব্যানার্জি, এস্থার ডুফলো ও মাইকেল ক্রেমারের আগে অনেকেই বলেছিলেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যের বিশেষত্ব হলো যে, তারা দেখিয়েছেন এই ফাঁদ থেকে উত্তরণও সম্ভবপর, তবে তার জন্য সামান্য প্ররোচনা বা উদ্বুদ্ধকরণের প্রয়োজন। এটা ‘বাইরের থেকে’ দিতে পারলে দরিদ্ররা ফাঁদ সম্পর্কিত জড় নিশ্চল অবস্থা কাটিয়ে উঠে উপরে ওঠার প্রেরণা পাবেন এবং এতে করে তাদের অবস্থানের নাটকীয় পরিবর্তন করা সম্ভব। ব্যানার্জি ও তার সহকর্মীদের পভার্টি ট্র্যাপ ও তার উত্তরণে ‘সামান্য প্ররোচনা’র তত্ত্ব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতাকে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে। মনের জড়তা কাটিয়ে ওঠা গেলে দারিদ্র্যের জড়তাও দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার সহকর্মীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, মনের জড়তা কোনো মনোবিকলনের বিষয় নয়। বিভিন্ন ‘প্রতিষ্ঠানের’ বা ইনস্টিটিউশনের অনুপস্থিতির কারণে এই জড়তা স্থায়ী আকার ধারণ করে। এক্ষেত্রে তারা নানা উদাহরণ দেখিয়েছেন। দরিদ্ররা সঞ্চয় কম করে তা এই কারণে নয় যে, তাদের আয় কম বা সঞ্চয়ের তাৎপর্য তারা বোঝে না। কিন্তু তারা যেটুকু সঞ্চয় করতে পারে তা এতই সামান্য যে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সেই সঞ্চয় আমানত হিসেবে নিতে আগ্রহী থাকে না। ফলে, হয় তাকে সেই ক্ষুদ্রতম সঞ্চয়কে বাঁশের খুঁটিতে রেখে দিতে হবে (চুরি যায় কি-না এ রকম নিত্য অনিশ্চয়তার মধ্যে), নতুবা তাকে সেই সঞ্চয় অতি তাড়াতাড়ি ভেঙে ফেলে ‘খেয়ে’ ফেলতে হবে। বিদ্যা-অর্জনের ক্ষেত্রেও এই যুক্তি খাটে। অতিদরিদ্ররা অক্ষরজ্ঞান, ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে চায় না তার কারণ বেশি ক্লাসে পড়ানোর ইচ্ছার সঙ্গে প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়ানোসহ ‘বাড়তি খরচের’ বোঝা এসে পড়ে। তারা ছেলেমেয়েদের সম্ভাব্য যেসব স্কুলে পাঠাতে পারত, সেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষাও এমন কোনো গুণে-মানের নয়। ফলে চাকরি ক্ষেত্রে শহরের অপেক্ষাকৃত ধনী ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকার সম্ভাবনা গরিবদের ক্ষেত্রে খুবই কম। আর তাই গরিবদের প্রায়ই আগে বলতে শুনেছি, এত পড়িয়ে কী হবে, তার চেয়ে ক্ষেত-কৃষি বা নিদেনপক্ষে ছোটখাটো ব্যবসাটাই ভালো করে করুক। এইভাবে কম ও নিচু মানের শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে বংশানুক্রমিকভাবে দারিদ্র্যে থেকে যাওয়ার ‘ফাঁদ’-এর সৃষ্টি হয়।

অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার সহকর্মীদের আগে এমনকি সমাজতত্ত্ববিদ অর্জুন আপ্পাদুরাই-এরও আগে (‘যিনি ক্যাপাসিটি টু এসপায়ার’ এই শব্দবন্ধটি চয়ন করেছিলেন এবং যাকে ভিত্তি করে দেবরাজ রায় প্রমুখেরা ‘এসপিরেশন ট্র্যাপ’ এর প্রবন্ধ লিখেছিলেন)- পভার্টি ট্র্যাপের অন্য একটি উৎসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেটি হচ্ছে ‘আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য’ বা পভার্টি অব এসপিরেশন। এই চিন্তাটি তিনি দুই অর্থে ব্যক্ত করেছিলেন। একটি হচ্ছে, দরিদ্ররা দরিদ্র থেকে যাচ্ছে ‘ভরসার’ অভাবে, অনেক ক্ষেত্রে তার ‘আত্মশক্তি’র চিন্তাকে ভরসার দারিদ্র্য হিসেবেও পাঠ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি একদিন একটি গ্রামের উন্নতি করতে গিয়েছিলুম। গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসা করলুম, ‘সেদিন তোদের পাড়ায় আগুন লাগল, একখানা চালাও বাঁচাতে পারলি নে কেন?’ তারা বলল, ‘কপাল!’ আমি বললেম, ‘কপাল নয় রে, কুয়োর অভাব। পাড়ায় একখানা কুয়ো দিস নে কেন?’ তারা তখনি বললে, ‘আজ্ঞে, কর্তার ইচ্ছে হলেই হয়।’ একথা বলার পর রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছেন, ‘যাদের ঘরে আগুন লাগাবার বেলায় থাকে দৈব তাদেরই জল দান করবার ভার কোনো-একটি কর্তার।’ অর্থাৎ নিজের ওপরে ভরসা নেই লোক সাধারণের। সেখানে রয়েছে ‘কালেটিভ অ্যাকশনের’ সমস্যা। তার পেছনে রয়েছে ভরসার অভাব, যার মূলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য।

সিলেটে রবীন্দ্রনাথের ভাষণে আমরা স্পষ্ট করে ‘আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য’-এর কথা শুনতে পাই- কিন্তু নিজের প্রতি ভরসা বা আত্মশক্তির থেকে ভিন্নতর অর্থে। আমি সেই ধরনেরই মানুষ হই বা হয়ে পড়তে পারি যেরকম মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করি। তাই ইংরেজি প্রবাদকে মাথায় রেখে বলা যায়, স্বপ্ন দেখার আগে দেখে নিতে হবে কীসের স্বপ্ন দেখব। কেননা বলা তো যায় না স্বপ্নটা সত্যও হয়ে যেতে পারে! রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে সেরকম একটি ‘স্বপ্ন দেখার’ সংকট দেখতে পাচ্ছেন। একেই তিনি আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য বলছেন সিলেটে শ্রীহট্ট কলেজের ছাত্রদের সমাবেশে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণে। এই নিয়েই আজকের আলোচনা।

২. আজি হতে শতবর্ষ আগে

রবীন্দ্রনাথ সিলেট আসেন ১৯১৯ সালের ৪ নভেম্বর (১৯ কার্তিক) বুধবার সকালে। ৮ নভেম্বর সিলেট থেকে ত্রিপুরা রাজ-পরিবারের আমন্ত্রণে আগরতলা যান। সিলেটে অবস্থানকালে তিনি তিনটি বক্তৃতা দেন। প্রথমটি ৬ নভেম্বর সকালে টাউন হল প্রাঙ্গণে; প্রায় পাঁচ হাজার লোকের উপস্থিতিতে গণসংবর্ধনায়। সেখানে কবি যে ভাষণ দেন, তা ‘বাঙ্গালীর সাধনা’ নামে পরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই দিন সন্ধ্যা ৭টায় টাউন হলের একটি সমাবেশে রবীন্দ্রনাথ আরো একটি বক্তৃতা দেন। ‘শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের লেখক সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ এ বিষয়ে লিখেছেন, সিলেটে ‘কবি যে-সমস্ত বক্তৃতা করেছিলেন তন্মধ্যে এইটিই সবচেয়ে উদ্দীপনাপূর্ণ এবং প্রাণস্পর্শী হয়েছিল। দুঃখের বিষয় অনুলিখিত না হওয়ার দরুন কবির এই অমূল্য বক্তৃতাটি চিরস্থায়ীরূপে রক্ষিত হল না।’ রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় বক্তৃতাটি অনুষ্ঠিত হয় ৭ নভেম্বর শুক্রবার। সমাবেশটি হয় শ্রীহট্ট কলেজে। ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে তাকে নিয়ে আসে সেখানে। উপস্থিত প্রায় চার হাজার লোকের অর্ধেকই ছিল ছাত্র। সেখানে রবীন্দ্রনাথ যে-ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি পরে ‘আকাঙ্খা’ নামে ওই বছরেই ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় (পৌষ ১৩২৬) প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া আরো কয়েকটি স্থানে কবি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা এখানে আমার মনোযোগের বিষয়বস্তু নয়। আমি এখানে মূলত শ্রীহট্ট কলেজে তার ভাষণের সুবাদে রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন-চিন্তার কয়েকটি দিকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।

৩. মৌমাছির চাক

মার্কসের একটি কথা ছিল যে, অতি-দক্ষ মৌমাছির চাকের চেয়ে একজন স্বল্প-দক্ষ স্থপতিও অনেক বেশি সৃষ্টিশীল। কেননা, একজন স্থপতি গৃহ-নির্মাণের আগে একটি ছক এঁকে নেয়। সেই ছকটি আগে তার মাথায় আসে, তারপরেই কেবল সেই ছকটি বাস্তবায়ন করে। এই যে প্রথমে কল্পনা-শক্তির ফলে নির্মিত ডিজাইন, সেটি একটি ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ কেবল। কিন্তু এই বিমূর্ত চিন্তা করার সামর্থ্যের ভিত্তিতেই পরে ‘কনক্রিট’-এর ইমারত গড়ে ওঠে। অতি-দক্ষ চাক-নির্মাণে নিপুণ মৌমাছির দলের সেই অ্যাবস্ট্রাকশনের শক্তি নেই-তারা একই পথ দিয়ে ঘুরে-ফিরে একই ধরনের মৌচাক বানিয়ে থাকে একে অপরের দেখাদেখি। এখানে মৌমাছির শ্রম হচ্ছে পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রম বা ‘রিপিটেটিভ লেবর’। পক্ষান্তরে, একজন স্থপতির শ্রম হচ্ছে ‘নন-রিপিটেটিভ লেবর’ :একেকটি নকশা অপরের থেকে আলাদা, এবং সেই অর্থে অভিপ্রায়ে-ডিজাইনে-পরিণামে যেকোন স্থপতির শ্রমই সৃষ্টিশীল চরিত্রের বা ‘ক্রিয়েটিভ’। মার্কসের মত রবীন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন যাতে করে বিদ্যাপীঠগুলো সৃষ্টিশীলতার বিকাশের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। মার্কসের মতই তার এক্ষেত্রে মৌমাছির তুলনাই মনে এল :’যে সমাজে কিছুই ভাববার নেই, কিছুই করবার নেই, সমস্তই ধরাবাঁধা, সে সমাজ কি বুদ্ধিমান শক্তিমান মানুষের বাসের যোগ্য? সে সমাজ ত মৌমাছির চাক বাঁধবার জায়গা।’

আমাদের মনে, আমাদের বিদ্যায়তনে অসংখ্য এমন মৌমাছির চাক বাসা বেঁধেছে। এর মূলে রয়েছে ‘আকাঙ্খার দারিদ্র্য’। এটাই শ্রীহট্ট কলেজের সমাবেশে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের মূলকথা। সেখানে কবি ইউরোপের সভ্যতার সাথে আমাদের সভ্যতার তুলনা করে বলেছেন, ইউরোপ-যে ইউরোপ হতে পেরেছে তা মুখস্থ বা মনস্থ বিদ্যার জোরে নয়, কেবল মাত্র আকাঙ্খার জোরে। সে আকাঙ্খা কিসের তাড়নায়? সে কি কেবল শুধু পরীক্ষায় পাস করে একটা উন্নত মানের চাকুরি জোগাড়ের জন্যে? নাকি, আরো বৃহত্তর কিছু অর্জনের আশায়? এখানে রবীন্দ্রনাথের উত্তর হলো, শুধু মানব-পুঁজি বা হিউম্যান-ক্যাপিটাল আহরণের মাধ্যমে ইউরোপ আজকের পর্যায়ে পৌঁছায় নি :

‘এই যুগে সমস্ত পৃথিবীতে য়ুরোপ শিক্ষকতার ভার পেয়েছে। কেন পেয়েছে? গায়ের জোরে আর সব হতে পারে কিন্তু গায়ের জোরে গুরু হওয়া যায় না। যে মানুষ গৌরব পায় সেই গুরু হয়। যার আকাঙ্খা বড় সেই ত গৌরব পায়। য়ুরোপ বিজ্ঞান ভূগোল ইতিহাস প্রভৃতি সম্বন্ধে বেশি খবর রেখেছে বলেই আজকের দিনে মানুষের গুরু হয়েছে এ-কথা সত্য নয়। তার আকাঙ্খা বৃহৎ, তার আকাঙ্খা প্রবল; তার আকাঙ্খা কোন বাধাকে মানতে চায় না, মৃত্যুকেও না। মানুষের যে বাসনা ক্ষুদ্র স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে, সেটাকে বড় করে তুলে মানুষ বড় হয় না, ছোটই হয়ে যায়। সে যেন খাঁচার ভিতরে পাখীর ওড়া, তাতে পাখার সার্থকতা হয় না।’

৪. বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষার উৎস :ইউরোপ বনাম উপনিবেশ

প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপের মধ্যে এই বৃহত্তর ওড়ার আকাঙ্ক্ষা জাগল কেন? এর একটি সহজ উত্তর হতে পারত- ইউরোপ তার নিজের প্রয়োজনে পৃথিবীকে তার পদানত করতে চেয়েছিল। আর সে কারণেই সে ছুটে গেছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের সন্ধানে বিপদ-সংকুল সমুদ্র যাত্রায়, কখনো কলম্বাসের মত ভারত-আবিস্কারে বেরিয়ে উপনীত হয়েছে আমেরিকা মহাদেশে। কখনো ভাস্কো দা গামার মত উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে কোচিনের উপকূলে। এলিজাবেথীয় যুগে স্যার ওয়াল্টার র‌্যালে প্রমুখ পরিব্রাজনার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন রাজ-তরফে। লক্ষ্য একটাই- বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, আর সম্প্রসারণের আড়ালে উপনিবেশের স্থাপনা তথা সাম্রাজ্যের বিস্তার। ইউরোপে যখন এনলাইটেনমেন্টের দার্শনিকেরা প্রগতির মশাল জ্বেলেছেন, তা অন্তত :স্বল্প মেয়াদে মানব-মুক্তির জন্যে যতটা কাজ করেছে, তারচে বেশি করে ‘নিউ ওয়ার্ল্ডে’ উপনিবেশ স্থাপন করে ‘ওল্ড ওয়ার্ল্ড’-কে সমৃদ্ধশালী করার জন্যে। ‘আকাঙ্খা’ প্রবন্ধে ইউরোপের উচ্চকাঙ্ক্ষা ও বৃহত্তর জ্ঞানান্বেষণের পেছনে ক্ষমতালিপ্সুতার অন্তর্লীন যোগাযোগ রবীন্দ্রনাথের চোখে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। সেটা হবে আরো পরে- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে। ‘কালান্তর’-এর প্রবন্ধমালায় তার স্বীকৃতি রয়েছে। ১৯৩৭ সালে এসে কবি বলেছেন :

‘বর্তমান যুগ য়ুরোপীয় সভ্যতা-কর্তৃক সম্পূর্ণ অধিকৃত এ কথা মানতেই হবে। এই যুগ একটি বিশেষ উদ্যমশীল চিত্তপ্রকৃতির ভূমিকা সমস্ত জগতে প্রবর্তিত করেছে।’ এ কথা বলেই তিনি লক্ষ্য না করে পারলেন না :’আমি জানি, য়ুরোপীয় শিক্ষা ও সভ্যতার মহত্ত্ব সম্বন্ধে সুতীব্র প্রতিবাদ জানাবার দিন আজ এসেছে। এই সভ্যতা বস্তুগত ধন-সঞ্চয়ে ও শক্তি-আবিস্কারে অদ্ভুত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। …মানুষের দুরাকাঙ্খাকে এমন বৃহৎ আয়তনে, এমন প্রভূত পরিমাণে, এমন সর্ববাধাজয়ী নৈপুণ্যের সঙ্গে জয়যুক্ত করতে কোন দিন কোন মানুষ সক্ষম হয় নি।’ আবার এ-ও ঠিক যে, ‘হিংস্ট্রতা, লুব্ধতা, রাষ্ট্রিক কূটনীতির কুটিলতা পাশ্চাত্য মহাদেশ থেকে যেরকম প্রচণ্ড মূর্তি ধরে মানুষের স্বাধিকারকে নির্মমভাবে দলন করতে উদ্যত হয়েছে ইতিহাসে এমন আর কোন দিন হয় নি।’ ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনী ভাষণে রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলো বলেছিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, আকাঙ্ক্ষার নেশার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিক সম্পর্কেই রবীন্দ্রনাথ সমানভাবে সজাগ ছিলেন।

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::৩১

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
সবশেষে, ফোর কোয়ারটেটস্‌-এর ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস’র অংশে কৃষ্ণের নাটকীয় উল্লেখের প্রসঙ্গটি বিশদ ব্যাখার দাবি রাখে। কৃষ্ণ-অর্জুনের মধ্যকার সংলাপের এলিয়টকৃত ব্যাখ্যা খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, পুরো ফোর কোয়ারটেটস্‌-এর ডরকেন্ড নিহিত হয়ে আছে ‘মহাভারতে’র যুদ্ধক্ষেত্রে। বলা দরকার এলিয়ট সমস্ত ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে খুঁটিয়ে পড়েছিলেন ভাগবৎগীতার স্তবকসমূহ। এ বিষয়ে তার উপলব্ধি তিনি এভাবে ব্যক্ত করেছেন :”আমার অভিজ্ঞতায় দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দার্শনিক কবিতা হচ্ছে গীতার পঙ্‌ক্তিমালা। গীতার অজুর্নকে লক্ষ্য করে যে সব বক্তব্য রাখা হয় তা শুধু এলিয়টের কবিতা ও দর্শনের ওপরেই প্রভাব ফেলেনি, তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ও রাজনৈতিক মত গঠনেও ছায়া ফেলেছিল। অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘কর্মে লিপ্ত হয়েও মনের ভারসাম্য হারিয়ে না ফেলা খুবই দুস্কর, বিশেষত আমাদের জন্য। খুব উন্নত-সভ্যতার ব্যক্তিরাই সেটা পারে, যেমনটা হয়েছিল ভাগবৎগীতার নায়ক অর্জুনের ক্ষেত্রে।’ আমি কতকটা সন্দেহ করি যে, রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে গ্রহণযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি কৃষ্ণ-অর্জুন সংলাপকে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালের স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকপন্থি ও ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মধ্যকার লড়াইয়ে স্পষ্ট কোনো অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানান এলিয়ট। তিনি প্রকারান্তরে এখানে নিজেকে অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্মর্তব্য, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে অর্জুনের মনোবৈকল্য দেখা দেয়। একদিকে ভ্রাতা পান্ডবকুল, অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত কৌরবকুল- এ দুই যুধ্যমান পক্ষের মধ্যে কার পক্ষে গিয়ে দাঁড়াবেন বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন? যেকোনো পক্ষেই দাঁড়ান না কেন, তার ফল তো একটাই হবে :ভ্রাতৃনিধন ও জ্ঞাতিনিধন। তাছাড়া, যুদ্ধ হলে তা কেবল মিত্রশিবিরে বা শত্রুশিবিরের নিধনযজ্ঞেই সীমিত থাকবে না; তার প্রতিফল ছড়াবে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে। সাধারণ মানুষ যারা কোনো পক্ষেই নেই, তারা আরো বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশত্যাগ করবে বা প্রাণ হারাবে। এর দায়ভাগী কেন হতে যাবেন অর্জুন? এই প্রশ্নই তিনি করেছিলেন তার যুদ্ধসারথি শ্রীকৃষ্ণকে। এটি মহাভারত শীর্ষক মহাকাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর গীতার দর্শন-আলোচনারও মূল প্রেক্ষাপট। কিন্তু স্পেনের গৃহযুদ্ধের সাথে মহাভারতের গৃহযুদ্ধের মধ্যে তুলনীয় উপাদান খোঁজাটা খুবই কষ্টকল্পিত। স্পেনের গৃহযুদ্ধের বিবদমান পক্ষের রাজনৈতিক দর্শন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত- একপক্ষে রিপাবলিক-এর সমর্থক-দল চাইছে গণতন্ত্র ও মানবকল্যাণ; অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট শক্তির সমর্থক দল ও সামরিক বাহিনী চাইছে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের অবলুপ্তি। এ দুই শুভ ও অশুভ পক্ষের লড়াইয়ে কথিত ‘অর্জুন-বিষাদের’ প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু ফোর কোয়ারটেটস্‌ যখন এলিয়ট শেষ করে আনছেন, ততদিনে স্পেনের গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে গেছে। রিপাবলিকপন্থিরা পরাজিত হয়ে গেছেন, স্পেনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। লোরকার মতো কবিরা ফ্যাসিস্টদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে মারা গেছেন। এসব সংবাদ এলিয়টের কাছে যথারীতি পৌঁছেছে। ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে পুরো মাত্রায়। পুঁজিবাদী ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একজোটে যুদ্ধ করছে সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত রাশিয়া। তাদের লক্ষ্য একটাই :জার্মানির নাজিবাদ, ইতালির ফ্যাসিবাদ ও জাপানের সমরবাদের পতন ঘটানো। আবার নতুন করে পক্ষ-নির্বাচনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এবারে এলিয়টের মনে দ্বিধা দেখা দিয়েছে। তবে কি আগে যেটা চিন্তা করেছিলেন তা ভুল ছিল? তবে কি এই যুদ্ধে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান বলে কিছু নেই? কর্মে (অর্থাৎ যুদ্ধে) প্রবৃত্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই? অথচ এলিয়ট জানেন- প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফল তো তিনি ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডেই’ প্রত্যক্ষ করেছেন- এই যুদ্ধে মারা যাবে অগণিত মানুষ। তাহলে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করবেন কোন নৈতিকতা বোধে? এই প্রশ্নে এসে এলিয়ট দ্বিতীয়বারের মতো অর্জুন-বিষাদে আক্রান্ত হলেন এবং স্বগতোক্তির মতো করে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘ ÔI sometimes wonder if that is what Krishna meant?’ কৃষ্ণ কি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন অর্জুনকে-যুদ্ধ করো, কিন্তু নির্লিপ্ত থাকো এর ফলাফলে. কেননা এতে বিজয়ী হওয়ার গর্ববোধ নেই যেমন, এতে পরাজয়ের বিষণ্ণতাও নেই? যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এতে মোহহীনভাবে ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা না করে। এভাবেই যুদ্ধকর্মের ভেতরে প্রবেশ করেও একজন মানুষ অনাসক্ত থাকতে পারে, এবং অনাসক্ত থাকতে পারলে সেই কর্মের দোষ বা গুণ কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারে না। কর্মের সুফল পায় বিশ্ব-প্রকৃতি, সমাজ-সংসার; অশুভর পরাজয়ে শুভত্ববোধ সর্বত্রগামী হয়। ফলের ওপরে অধিকার অন্যের, বহির্লোকের, সমাজ-রাষ্ট্রের, এর ওপরে ব্যক্তির নিজের কোনো অধিকার নেই। ‘আমি মাজে মাঝে ভাবি কৃষ্ণ কি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন’- এই জন্যেই এলিয়টের মনে প্রশ্নটি জেগে উঠেছে- বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে।

এরই মধ্যে এলিয়ট গীতায় পেয়েছেন, ‘যিনি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন, মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান, তিনি যোগী, তিনি সর্বকর্মকারী’ ‘অকর্ম’ মানে রহধপঃরড়হ, আর ‘কর্ম’ মানে ধপঃরড়হ-এ দুইয়ের মধ্যে একটি ‘ভারসাম্য’ খুঁজছিলেন এলিয়ট। একথা তিনি ফোর কোয়ারটেটস-এর আগেও বলেছিলেন ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’-এ :

‘You know and do not know, what it is to act or suffer.
You know and do not know, that acting is suffering,
And suffering action. Neither does the agent suffer
Nor the patient act. But both are fixed
In an eternal action, an eteranal patience
To which all must consent that it may be willed
And which all must suffer that may will it,
That the pattern may subsist, that the wheel may turn and still
Be forever still.’

এই কবিতাংশের মধ্যে action I suffering নিয়ে যা বলা হয়েছে, ‘the wheel may turn’ বলে যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কৃষ্ণের বচনাংশ সুপ্ত হয়ে আছে। কৃষ্ণ বলেছিলেন গীতায়,’suffering is born of action… He who does not, in this world, turn the wheel thus set in motion, is evil in his nature, sensual in his delight, and… lives in vain..’ ফোর কোয়ারটেটস-এ এসে বচনাংশ নয়, পরোক্ষ ভাষণ নয়, সরাসরিভাবে কৃষ্ণ সমুপস্থিত। আমার অক্ষম অনুবাদে তা তুলে দিচ্ছি :

”মাঝে মাঝে আমার মনে হয়
কৃষ্ণ কি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন
এক ভাবে বা অন্য ভাবে:
‘কেননা ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই
কেননা ভাবীকাল লুকানো
শেষ হয়ে আসা গানের সুরে
গোলাপের নিভন্ত আলোর
অপসৃয়মান সৌরভে,
যারা এখনো জন্মায়নি
তাদের জন্য শোকে-পরিতাপে,
যে-বই কখনো খোলা হয়নি
তার হলুদ ঝলসে-যাওয়া পাতায়।
উপরে ওঠার সিঁড়ি আসলে
নিচের দিকেই ঘুরে ঘুরে নামছে।
সামনে চলা আসলে পিছনে ফেরা।
এসবই তোমার বোধের অতীত,
তবে নিশ্চিত জেনো-
সময় কারো শুশ্রূষা করে না,
এখানে সে রকম আর্ত কেউ নেই।…
কখনো ভাববে না অতীত-পুরোপুরি অতীত,
আর আগামী-কেবলি অনাগত পল।…
যা উৎসন্ন ও যা আসন্ন
তার দিকে তাকাও
সমান মন নিয়ে…
কর্ম ও অকর্মের মাঝে রয়ে গেছে
এক তৃতীয় সম্ভাবনা।…
কখনো কর্মফলের অপেক্ষায় থেকো না।…
সম্মুখে অথই পারাবার, দ্যাখো।
বিদায় নয়-শুভ হোক যাত্রা।
এই পথ চলাতেই
তোমার শেষ গন্তব্য।’
এই বলেছিলেন কৃষ্ণ সেদিন
অর্জুনকে তিরস্কার করে,
মহাযুদ্ধ কুরুক্ষেত্রের ভেতরে।”

ফোর কোয়ারটেটস্‌ পড়তে পড়তে একথা আমার বারবার মনে হয়েছে এই চরৈবতি, এই পরিব্রাজনা, এই মোহমুক্তির বাসনা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গানে কতভাবেই না বেজে উঠেছিল-এলিয়ট কি সেটা জানতেন? তিনি কি রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ পড়েছিলেন? কখনো রবীন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে উপনিষদকে দেখেছিলেন? পড়েছিলেন তার ‘রিলিজিওন অব ম্যান’, যেখানে আছে ফকির লালন ও তার বাউল সহচরদের কথা? দর্শন ও কবিতার সংশ্নেষণ করতে গিয়ে এলিয়ট প্রথাগত ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের পাঠের ওপরই কেবল জোর দিলেন। এই শাস্ত্রের বাইরের লোকজ ধর্মাচরণের দিকে নজর দিলেন না। কবীর-এর অনুবাদের পরও তাকে স্বীকার করে নিলেন না কোনো প্রবন্ধে বা কবিতায়। লালন ও তার সহচরগণের সাধনা এলিয়টের ওরিয়েন্টালিজমে শেষ পর্যন্ত অস্বীকৃতই থেকে গেল। আমরা এ প্রশ্নও না করে থাকতে পারি না যে, এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই অধ্যাত্মবাদী-একই পথের দুই পরিণাম বলা যেতে পারে-কেন তাদের মধ্যে দর্শন ও ধর্ম নিয়ে কোনো সংলাপ হলো না? সত্য কী-এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে তর্কালাপ হয়েছিল। এলিয়টের সাথে উপনিষদ, পত্রঞ্জলির যোগসূত্র, গীতার কৃষ্ণ-অর্জুন সংবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দিব্যি আলোচনা চলতে পারত। আরো ব্যাপক পরিসরে সেই তর্কালাপ হতে পারত। আমরা আগেই দেখেছি, সেই পরিবেশও ছিল। রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের কবিতা মনোযোগ সহকারে পাঠ করেছিলেন, একাধিক কবিতার অনুবাদও করেছিলেন। ওয়েস্ট ল্যান্ডের শেষ চরণে ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ ভাষ্যে রবীন্দ্রনাথের সম্ভাব্য প্রভাবের কথা বাদ দিলে এলিয়ট রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিস্ময়করভাবে নীরব।

রবীন্দ্রনাথের জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী (মীরা দেবীর স্বামী) ‘মেডিটেশন’ নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘Thoughts for Meditation : A way to Recover from within ‘১৯৫১ সালে প্রকাশিত বইটির ভূমিকা লেখেন এলিয়ট স্বয়ং। সেখানে এলিয়ট লক্ষ্য করেন যে খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ‘সুফী’ দর্শনে, ইহুদি প্রভৃতি নানা ধর্মেই ধ্যান বা মেডিটেশন-এর সুউচ্চ স্থান স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজ নিজ পথের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, যেন অন্যান্য ধর্মের পথগুলো সত্যের কোনো একটি দিকও উন্মোচিত করেনি। ‘Truth is ifself is never occult, never confined to one tradition or religion’ সত্য সংগুপ্ত নেই কোনো অজ্ঞেয় বাতেনী মন্ত্রে- কোনো বিশেষ তন্ত্র-মন্ত্রের শাখায় বা দর্শনে। তার মানে এই নয় যে, এলিয়ট প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে সহজ সমীকরণের সম্ভাবনা দেখতেন। তার মতে, বিভিন্ন ধারার মধ্যে সমীকরণ সম্ভব কেবল এসব শাস্ত্র, দর্শন ও ধর্মগ্রন্থের নিবিড়তম চর্চার মাধ্যমে-শুধু মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে নয়। দক্ষিণ এশিয়ার সমাজদেহে ও রাষ্ট্রের শরীরে বিভিন্নমুখী আলোকসম্পাত ঘটেছিল নানা দিক থেকে-সেকথা রবীন্দ্রনাথ তার নানা লেখায় বলে গেছেন। ‘শক হুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হলো লীন’ সে রকম চিন্তাধারায় রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যকেও অঙ্গীকৃত হতে দেখেছেন আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় (ভারতবর্ষ বললে তা এখন ‘মোদির ভারত’ বলে শোনাতে পারে ভেবে ‘দক্ষিণ এশিয়া’ শব্দবন্ধটিই ব্যবহার করলাম)। অর্থাৎ দেয়া-নেয়া, আমদানি-রফতানি গ্রহণ-বর্জন দুইই চলতে পারে। চলা উচিত, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে-এই ছিল রবীন্দ্রনাথের মত। এরকম কথা ওয়াল্ট হুইটম্যানও ভেবেছিলেন। নিউ ইয়র্ক ক্রমশ বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে-বিভিন্ন জাতির মানুষেরা সেখানে জড়ো হচ্ছে, এক সময় তাতে যোগ দিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী মানুষেরাও। ১৮৫০-র দশকে লেখা কবিতাটিতে হুইটম্যান বলছেন :

‘To us, then at last the Orient comes…
The Originatress comes,\
The nest of languages, the begueaters of poems….
The race of Brahma comes. ‘

হুইটম্যান-প্রভাবিত এলিয়ট আরো গভীরে গিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজেছেন। তার সংস্কৃত-অধ্যয়ন, উপনিষদ-গীতার ব্যাখ্যা, বৌদ্ধ-দর্শনের শূন্যবাদ, সুফী দর্শনের উল্লেখ্য, সবকিছুই নানাভাবেই তার কবিতার প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ উপকরণ হিসেবে এসেছে। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি নিজেকে একজন ‘দার্শনিক-কবি’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন-শুধু কবি বা শুধু দার্শনিক হিসেবে নয়। এটাই এলিয়টের ‘প্রাচ্যবাদী মুহূর্তের’ বা Orientatist Turn-র পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। এক জায়গায় এলিয়ট বলেছেন,

‘The life of a soul does not consist in the contemplation of one consistent world but in the painful task of unifying (to a greater or lesser extent) jarring and incompatible ones, and passing, when possible, from one or more discordant viewpoints to a higher which shall somehow include and transmute them.’

অর্থাৎ এলিয়ট বিশ্বাস করতেন যে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের দর্শন ও মতবাদের মধ্যে যত বাদানুবাদই থাকুকক না কেন, যত ভিন্নপথের পথিক হিসেবে তারা নিজেদের দাবি করুক না নে, একটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে-আইনস্টাইনের ‘ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরির’ মতো করে-সে সব দর্শন ও মতের মধ্যে মেলবন্ধন সম্ভব। রবীন্দ্রনাথও এমনটা মনে করেছিলেন-শেষ জীবনে প্রথাগত ধর্মের অনুশাসন ও মতবাদের থেকে সরে এসে তার মতো করে তিনি নিজস্ব একটি ধর্মমত ও দর্শন গড়ে তুলেছিলেন-যার সাক্ষ্য পাই তার ‘রিলিজিওন অব ম্যান’ বক্তৃতামালায়। এলিয়ট অবশ্য সেই পথ ধরে হাঁটেননি। তার পথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন-পড়া ছাত্রের মত-তিনি সত্যকে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন তত্ত্বও মতবাদের অলিগলিতে। এবং এই হাতড়ে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে নিজের সংশয়, আস্থা ও উপলব্ধি সংবলিত কবিতার পঙক্তিমালা সৃষ্টি করে গেছেন। দর্শন নয়, কবিতার প্রয়োজনে, একটি নতুন ধারার কবিতা লেখার জন্যেই তার যত শ্রম, আয়োজন, ও অন্তর্গত রক্তক্ষরণ। বৌদ্ধ শূন্যবাদ নিয়ে যখন একটি ‘হাইকু’ তার হাত থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হয়েছে তখন তার পেছনের দর্শন নয়। সামনের কবিতার আলোকদীপ্তি আমাদের বিমোহিত করে। তিন প্রাচ্যবাদী কি না, পাশ্চাত্য দর্শনের ছাত্র কি না, তার চেয়ে তার বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় তার কবিতার আধুনিক মনোমুগ্ধকর রূপ। ফোর কোয়ারটেটস-এর Burnt Norton-যা বৌদ্ধ-দর্শন দ্বারা গভীরভাবে সমাচ্ছন্ন-এই রূপের বর্ণনা দিয়েছে :

‘And the pool was filled with water out of sunlight,
And the lotos, rose, quietly, quietly,
The surface glittened out of heart of light,
Then a cloud passed, and the pool was empty.’

মেঘ সরে যেতেই দেখা গেল পথটিও নেই, সরোবরও নেই, আর তার কবিও অন্তর্হিত।

[এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত :আগামী পর্বে নতুন প্রসঙ্গ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::৩০

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

Doctrine of Karma ও জন্মান্তরের চক্র বড় আকারে এসেছে এলিয়টের কাব্য-নাট্য ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’-এর ভেতরে। সেখানে প্রুফ্রকের সমুদ্রতলের পরিত্যক্ত কাঁকড়া থেকে গুবরো পোকা, মাছ, হাতি হয়ে বন-মানুষ ও মানুষে রূপান্তরের পরিক্রমা উঠে এসেছে। তার প্রকাশভঙ্গি (ফর্ম/টেকনিক) অত্যন্ত আধুনিক। আমি বিক্ষিপ্ত স্মরণযোগ্য পঙ্‌ক্তি তুলে ধরছি :

‘I have lain on the floor of the sea and breathed/
with the breathing of the sea-anemone…/
I have lain in the soil and criticized the worm…/I have felt
The horn of the beetle, the scale of the riper, the/
Mobile hard insensitive skin of the elephant, the/
Evasive flank of the fish…/
I have seen/
Rings of light coiling downwards, descending/
To the horror of the ape…

এবারে আসি ওয়েস্ট ল্যান্ডের শেষাংশে এসে এলিয়টের আকস্মিক বৃহদারণ্যক উপনিষদের দিকে ফিরে তাকানো প্রসঙ্গে। যদিও কাব্যগ্রন্থের নাম নষ্ট পতিত জমি; কবিতাটির শেষাংশটি প্রাণিত পুনর্জাগরণ ও প্রতিকারের প্রার্থনায়। এ জন্যই কবি বেছে নিয়েছেন বৃহদারণ্যক উপনিষদ। এর অনুবাদ আমার সাধ্যের বাইরে। আমি শুধু ভাবের তর্জমাটুকু করে দিচ্ছি বেশ কিছুটা স্বাধীনতা নিয়ে। দীর্ঘ কবিতাটির শেষে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে, অচিরেই বৃষ্টি হবে। পুষ্প-পল্লবে ভরে যাবে পৃথিবীর উপত্যকা, সব খানা-খন্দক, মরুভূমি। এ রকম একটি দৃশ্যপটে প্রোথিত হচ্ছে লাইনগুলো :

‘গঙ্গা অর্ধমৃত, চারপাশের নুয়ে-পড়া পাতাগুলো কাঁপছে

বৃষ্টির প্রতীক্ষায়,

বহুদূরে হিমবাহের শিখরে

জড়ো হচ্ছে কালো মেঘ,

বাকরুদ্ধ বনভূমি

হাত-পা গুটিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষমাণ,

ঠিক তখনই বজ্র নির্ঘোষে বেজে উঠল দৈববাণী

দা

দত্তা :আমরা এতদিন কী দিয়েছি পৃথিবীকে?

ও বন্ধু আমার, বুকের মধ্যে রক্ত যেন শব্দ করে উঠল

এক মুহূর্তের জন্য, আসুন আত্মসমর্পণ করি এবারে

এই যুক্তি-তর্কের যুগ যা কখনোই দিতে পারবে না

আমাদের শোকসভায়

মাকড়সার মতো জাল বিছানো স্মৃতির কুণ্ডয়নে

যাকে কখনোই পাওয়া যাবে না

যা নেই আমাদের এই শূণ্য ঘরে

সিল-গালা ভাঙা চুক্তিপত্রের ভেতরে-

দা

দয়াধ্যাম :আমি শুনেছি সেই সবখোল চাবির কথা

সেই দরোজা একবারই খোলা যায়, কেবল একবারই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ

আমরা সবাই সেই চাবির আশায় প্রহর গুনছি

প্রত্যেকে যার যার কুঠরিতে বসে চাবির কথা ভাবছি

প্রত্যেকে আবদ্ধ করে রাখছি নিজেদের নিজস্ব কুঠরিতে

কেবল রাতের বেলায় চারপাশে অস্পষ্ট ধ্বনি শোনা যায়

ভেঙে-পড়া কোরিওলেনাসের অবয়ব মুহূর্তের জন্য জেগে ওঠে

দা

দময়ত্তা :নৌকা দুলে উঠেছে

যারা পাল তুলে দাঁড় টেনে নাও বাইতে জানে

তারাই দায়িত্ব নেবে এবারে বিশ্বস্ত হাতে।

দ্যাখো, সমুদ্র শান্ত, তোমারও হৃদয়

হয়তো সাড়া দিত এভাবেই

হয়তো দুলে উঠত, যদি সেই আমন্ত্রণ একবার শুনতে পেতে

যারা সবকিছুর দায়িত্ব বুঝে নিতে জানে

যদি মুহূর্তের জন্য সমর্পিত হতে তাদের কাছে…

আমি এক ছিপ-ফেলা প্রশান্তি নিয়ে তীরে বসে আছি

আমার পিছনে বিরান প্রান্তর

আমার দেশে কি শেষটায় সত্যি সত্যি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে?

লন্ডন ব্রিজ ভেঙে পড়ছে ভেঙে পড়ছে ভেঙে পড়ছে …

আজ আমার ধ্বংসের বিপরীতে গিয়ে

এই লাইন ক’টি রাখলাম…

দত্তা। দয়াধ্যাম। দময়ত্তা।

শান্তি শান্তি শান্তি।’

এখানে এলিয়টের কথিত খ্রিষ্টীয় আত্মসমর্পণ ছাড়াও উপনিষদের ওরিয়েন্টালিজম রয়েছে স্পষ্ট করেই। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দত্তা, দয়াধ্যাম ও দময়ত্তা শব্দ তিনটি এসেছে একটি উপাখ্যানের সূত্র ধরে। প্রজাপতি ব্রহ্মা একই প্রশ্ন রেখেছিলেন মানুষ, দেবতা ও অসুরদের কাছে। ‘দা’- এই অক্ষরটি ধ্বনিত হলে তিনটি দল তার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করে। এলিয়ট যাকে বলেছেন ‘What the thunder said’, তা হচ্ছে দৈববাণী এক। একই ধ্বনি শুনে মানুষ বলেছে ‘দত্তা’ বা অন্যকে দান-দক্ষিণা করার কথা। দেবগণ বলেছেন ‘দময়ত্তা’ বা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা। আর অসুরেরা বলেছে দয়াধ্যাম বা অন্যের প্রতি সদাচারপ্রবণ ও সংবেদনশীল হওয়ার কথা। যার মধ্যে যা নেই সে বুকের মধ্যে সেই ধ্বনিই বাজতে শুনেছে। মানুষ দয়া ভুলে গেছে, তাই সে শুনেছে দান-দক্ষিণার কথা। অসুরেরা অন্যের প্রতি সদা রুষ্ট, তারা শুনেছে সংবেদনশীল হওয়ার কথা। আর দেবগণ প্রায়ই আত্মগরিমায় বিভোর থাকেন- তারা শুনেছেন আত্ম-সংবরণের উপদেশ বাণী। সমগ্র মানব জাতির জন্য এই তিনটি অর্থই- be self-controlled, be charitable and be compassionate- সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপরে দাঁড়িয়ে লেখা ওয়েস্ট ল্যান্ডের ট্র্যাজিক পরিণতির শেষে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পা বাড়াতে চেয়েছেন এলিয়ট, এবং সে কারণেই বৃহদারণ্যক উপনিষদের ওই তিনটি নীতি তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’- এই সমাপ্তি চরণটি যদি রবীন্দ্রনাথের সূত্রে প্রাপ্ত না হয়ে থাকে, তাহলে এর আদি-প্রেরণা কোথা থেকে এসেছিল? এক্ষেত্রে আমার কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয় সেই উত্তরটি যেটি এলিয়টের মনন, পাঠ্যাভ্যাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগ্রহণের সাথে জড়িত। ভুলে গেলে চলবে না যে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এলিয়ট ভারতীয় দর্শন এবং প্রাচ্যীয় ভাষার ওপরে আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্স নিয়ে ছিলেন। শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য কোর্স নেননি, এ বিষয়ে তার পূর্বাপর আগ্রহ অটুট ছিল। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের নানা সূত্রের উল্লেখ ও প্রতিতুলনা করে তিনি ব্রাডলির ভাববাদের ওপরে গবেষণা করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাকে রীতিমতো হাত ধরে পথ দেখিয়েছিলেন দু’জন সেরা প্রাচ্যবিদ- তার একজন হচ্ছেন অধ্যাপক চার্লস লানমেন, যার কাছে এলিয়ট শিখেছিলেন সংস্কৃত এবং অন্যজন হচ্ছেন অধ্যাপক জেমস উড্‌স। লানমেন-এর কাছে সংস্কৃতে তিনি পাঠ করেছিলেন উপনিষদ ও ‘গীতা’, আর উড্‌স-এর কাছে অধ্যয়ন করেছিলেন পতঞ্জলির ‘যোগসূত্র’। মূল সংস্কৃতে তিনি চারটি বেদ ও আঠাশটি উপনিষদ থেকে কেবল ‘নির্বাচিত অংশই’ পাঠ করতে পেরেছিলেন (মূল সংস্কৃতে পড়াটা হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট কোর্স সমাপ্ত করার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল)। কিন্তু বাদবাকি বেদ ও উপনিষদ তিনি অনুবাদের মাধ্যমে জেনেছিলেন ম্যাক্সমুলার সম্পাদিত Sacred Books of East, চার্লস লানমেন-এর Sanskrit Reader, এবং জেমস উড্‌স-এর অনূদিত Yoga-system of Patanjali থেকে। ভারতীয় দর্শনবিষয়ক তার অধ্যয়ন ছাত্রাবস্থাতেই থেমে থাকেনি। আমৃত্যু তিনি এই বিষয়ে চর্চা করে চলছিলেন এবং এ বিষয়ে তার অর্জন ছিল প্রায় লোকচক্ষুর বাইরে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে Cleo Kearns তার ‘T. S. Eliot and Indic Traditions’ বইতে লিখেছেন তা পূর্ণাঙ্গ উদ্ধৃতির দাবি রাখে :

‘Eliot was as deeply versed in the ancient traditions of Indic thought as he was in the later and more precisely delineated tenets of Buddhism. The matrix of myth provided by the Vedas and the philosophical richness and diversity of the Upanishads repeatedly claimed his attention, and the brilliance of the orthodox Hindu systems, Sometimes parallel to, sometimes diverging from Buddhist debates, formed an important part of his philosophical training. Nor was the effect of these traditions and debates merely theoretical; their terminology, their distinctions, and at times their tone and cadence inform Eliot’s poetry at many points, providing images, aphorisms and points of view that often shape his stance toward his material, even when the material itself seems quite different in origin and intent.’

হ্যারল্ড ব্লুম যার বইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সেই অধ্যাপকের কথা মনোযোগের দাবি রাখে। অধ্যাপক keans-এর বক্তব্য হচ্ছে যে, এলিয়ট প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে ততটাই নিমজ্জিত ছিলেন যতটা তিনি পরবর্তীতে প্রভাবিত ছিলেন বৌদ্ধ দর্শনে। বেদের উপাখ্যানগুলো যেমন তার দৃষ্টি কেড়েছিল, তেমনিভাবে উপনিষদের পাতায় বিবৃত দর্শনের বৈচিত্র্য ও বিশালতা তার ওপরে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কখনও সনাতনী হিন্দু শাস্ত্রের নানা শাখা, কখনও এসবের বিরুদ্ধে তোলা বৌদ্ধ-বিতর্ক এলিয়টের দার্শনিক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। এসবের প্রভাব শুধু তত্ত্বগত ভাবলে ভুল হবে। এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল তার কাব্যজগতে- শব্দাবলির ব্যবহারে, বাক্‌প্রতিমায়, উপলব্ধির বর্ণনায়, নানা স্থানে। এলিয়টের কবিতার ব্যবহূত চিত্রকল্পে, আপ্তবাক্যে, মতামত প্রকাশের মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে এই প্রভাব। কবিতার বিষয়বস্তুকে কীভাবে তিনি জড়ো করেন তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে এসব উপাদান ছায়া ফেলেছে, এমনকি যখন এসব উপাদানের উৎপত্তিস্থল বা আয়োজন সম্পূর্ণ ভিন্ন বলয়ের আবহে গড়ে উঠেছিল তখনও।

আমার অক্ষম ও দ্রুত ভাব-তর্জমা থেকে এটুকু অন্তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আধুনিক পাশ্চাত্যের কাব্যরীতির স্রষ্টা যিনি- অন্তত পক্ষে পুরোধা ব্যক্তিত্ব যিনি- তার সৃষ্টিকর্মের পেছনে রয়ে গেছে প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট অধ্যয়ন-পাঠ ও অবস্থান। তার মতো করে তিনি তার ‘নিজস্ব প্রাচ্য’ গড়ে নিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে দার্শনিক Simon weil-i The Needs for Roots-র ভূমিকায় এলিয়ট লিখেছিলেন, ‘উপনিষদ পাঠে যতই নিমজ্জিত হওয়া যায় ততই একজন ইউরোপীয় ছাত্রের কাছে মর্মোদ্ধার করা কঠিনতর মনে হতে থাকে।’ তারপরও তিনি বার বার ছুটে গেছেন উপনিষদের দিকে, কেননা তিনি অন্যান্য ওরিয়েন্টালিস্টদের মতো বিশ্বাস করতেন এর মধ্যকার জ্ঞানে পাশ্চাত্য ‘উপকৃত’ হবে। এলিয়টের এই বিশ্বাসের ভেতরে এডওয়ার্ড সাইদ কথিত ওরিয়েন্টালিজমের ছায়া দেখতে পাবেন কেউ কেউ। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এলিয়টের বিশ্বাসের জগৎ আমাদের কাছে দূরবর্তী হতে পারে, আমরা সে বিশ্বাসকে অগ্রাহ্যও করতে পারি, কিন্তু বিষ্ণু দে’র মতো আমরা দেখতে পারি কী করে প্রাচ্যীয় দর্শন পাশ্চাত্যের কাব্য ভুবনে আধুনিকতার নতুন ভঙ্গিমা, চিত্রকল্প, অনুভব ও কণ্ঠস্বরের সৃষ্টি করছে। ক্লেদজ কুসুমের মতো অশুদ্ধ পটভূমি থেকে শুদ্ধতম কবিতার লাইন নিঃসৃত হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এলিয়টের কাব্যজগতে প্রাচ্যীয় দর্শনের প্রভাবকে আমরা বিচার করতে পারি। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো।

এলিয়টের কবিতা বুঝতে গেলে তার কবিতার পেছনের দর্শন-চিন্তাকে বোঝা দরকার। আগেই বলেছি, এই দর্শন-চিন্তার ভূমিতে ভারতীয় দর্শন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। এ নিয়ে এলিয়ট পরবর্তী সময়ে স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে :’চার্লস লানম্যান-এর অধীনে দু’বছর ধরে সংস্কৃত শিক্ষার পর এবং জেমস উডস্‌-এর অধীনে আরও এক বছর পতঞ্জলির যোগ-সূত্রের জটিল পথে চলার পরে আমার অবস্থা অনেকটা আলোকপ্রাপ্ত সাধু-সন্তদের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকেরা যা করতে চেয়েছেন; তাদের চিন্তাভাবনার সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ দিকের তুলনায় বেশির ভাগ য়ুরোপীয় দার্শনিকদেরই আজ নিতান্ত স্কুল-বালক বলে মনে হবে। সেই মহৎ প্রচেষ্টার অর্ধেকও যদি বুঝে থাকি তার ফল হয়তো এই যে, আমার মন থেকে গ্রিক থেকে শুরু করে য়ুরোপীয় দর্শনের যাবতীয় ক্যাটাগরি আর বৈশিষ্ট্যসমূহের মোহ মন থেকে মুছে গিয়েছিল।’

ভারতীয় দর্শন বলতে নির্দিষ্ট করে উপনিষদ, শংকরের অদ্বৈতবাদ, পতঞ্জলির ভাষ্যে যোগসূত্র, গীতার সকাম ও নিস্কাম কর্মফলের তত্ত্ব ও বৌদ্ধ দর্শন বিশেষ করে এলিয়টের মনকে প্রভাবিত করেছিল। এসব তাকে পড়তে হয়েছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে ব্রাডলির ওপরে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখার কালে এলিয়ট এদিক থেকে ভাগ্যবান ছিলেন। একদিকে সংস্কৃৃত ও ভারতীয় দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যেমন তিনি পেয়েছিলেন চার্লস লানম্যান ও জেমস উড্‌সের মতো অধ্যাপকবৃন্দ, অন্যদিকে পাশ্চাত্য দর্শনের শিক্ষক হিসেবে বার্ট্রান্ড রাসেলকে। লানম্যানই তাকে ‘২৮টি উপনিষদ’ থেকে বিভিন্ন নির্বাচিত অংশ বিশেষভাবে পাঠ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এর মধ্যে ছিল বৃহদারণ্যক উপনিষদের সেই বিখ্যাত অংশটি, যেটা এলিয়ট ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর শেষাংশে ব্যবহার করেন। মূল সংস্কৃতে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি ইংরেজিতে ততদিনে প্রকাশিত অনুবাদ-গ্রন্থের সহায়তা নেন। ইংরেজি ছাড়া ফরাসি ও জার্মানও জানতেন তিনি। হার্ভার্ডে প্রবেশের আগে বয়স কম হওয়ার কারণে বোস্টনের সুবিখ্যাত প্রাইভেট স্কুল মিল্টন একাডেমিতে এক বছর বাড়তি হাইস্কুলের পড়াশোনা করতে হয়েছিল এলিয়টকে। সেই ‘অতিরিক্ত’ বছরে এলিয়টের পাঠ্যসূচিতে জার্মান ভাষা-শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে পরবর্তী সময়ে পল ডিউসেন-এর (Deussen) ‘দ্য সিস্টেম অব বেদান্ত’ বইটি মূল জার্মান সংস্করণেই পাঠ করেছিলেন। এ ছাড়া ম্যাক্সমুলারের ‘দ্য সেক্রেড বুকস্‌ অব দ্য ইস্ট’ তো তার পাঠ্যসূচিতে ছিলই। হার্ভার্ডে পড়ার সময় এক সেমিস্টারের জন্য প্যারিসে আঁরি বার্গসঁর কাছে পাশ্চাত্য দর্শনও পড়তে যান এলিয়ট। আমি বলতে চাচ্ছি, ইয়েটস বাদ দিলে সমসাময়িক কবিকুলের মধ্যে ইলিয়টের মতো এতটা দর্শনে প্রশিক্ষিত কেউ ছিলেন না আমেরিকা বা ইউরোপে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য- এই উভয়বিধ দর্শনেই আগ্রহ ও ব্যুৎপত্তি দুই-ই ছিল তার এবং এটি তার আধুনিক কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে অন্তনির্হিত শক্তি ও ভরসা জুগিয়েছিল। তার বিভিন্ন পর্যায়ের কবিতায় এ কারণেই অনায়াসে প্রাচ্য দর্শন উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে গেছে। তাতে করে কবিতার আধুনিক সাজ-সজ্জায় কোনো বিরুদ্ধাচার হয়নি। একজন দক্ষ কারিগর যেমন করে থাকেন, তেমনিভাবে বিভিন্নমুখী প্রভাবকে এলিয়ট আত্মস্থ করেছেন- আবহমান সময় ও তার স্বভাবকে নৈর্ব্যক্তিক ধররে প্রায় ‘তৃতীয় নয়ন’ ব্যবহার করেই তুলে ধরেছেন।

উপনিষদের ‘কর্মফল’তত্ত্ব, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘doctrine of Karma’ এলিয়টের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কর্মফলের কারণে সুখ বা অসুখ, সত্তার জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম, যুক্ত ও বিযুক্ত কর্ম এবং এ মোহের আবরণ থেকে মুক্তি- এমনই উপনিষদের বড় অংশজুড়ে আলোচিত হয়েছে। সেটি এখানে আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমি দেখাতে চাইছি, এই আপাত নীরস এবং জটিল দর্শনের থেকে কবিতার জন্য নতুন ইমেজ-চিত্রকল্প ও উপমা এবং হয়তোবা কোনো দার্শনিক রোধ আহরণ করতে চেয়েছেন এলিয়ট। ‘লাভ সং অব প্রুফ্রক’-এ ‘doctrine of Karma’ অনুসরণে প্রুফ্রক-এর মনে হয়েছে যে, ব্যর্থ এই জীবন- যেখানে ভক্তিতেও আত্মসমর্পণ করতে পারেনি, কর্মেও মনোনিবেশ করতে পারেনি। তারচে বরং ভালো ছিল নিঃশব্দ সমুদ্রের তলদেশে পরিত্যক্ত একাকী কাঁকড়ার মতো নিজেকে টেনে বেড়ানো : ‘I should have been a pair of ragged claws/Scuttling across the floors of silent seas’ ‘জন্ম, প্রজনন ও মৃত্যু’- এ রকম একটি ক্ষান্তিহীন চক্রের ভেতর দিয়ে প্রুফ্রকের পথচলা :সময় গেলে যেমন সাধন হয় না, সাধনের সময় কখনোই আসে না প্রুফ্রকের জীবনে। এই নিষ্ম্ফলা জীবনের আর্তনাদ বেজে ওঠে :

‘There will be time, there will be time
To prepare a face to meet the faces that you meet;
There will be time to murder and create,
And time for all the works and days of hands…’

এ রকম বিফল মনুষ্য-জীবনে বারবার এসে লাভ কী? এলিয়ট তার প্রথম কাব্য-নাট্য প্রচেষ্টা ‘Sweeney Agonistes : Fragments of an Aristophanic Melodrama’তে আরও স্পষ্ট করে জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে বলছেন :

ÔI’ve been born, and once is enough
You don’t remember, but I remember,
Once is enough.’

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৮

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

লুই আরাগঁ-এর কাব্যবিচার মানলে এ কথা বোঝা কষ্ট নয় যে, কেন এলিয়ট বিষ্ণু দে বা তার সমসাময়িক প্রজন্মের কাছে ঈর্ষণীয় মানদণ্ড হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন। প্রথমত, কবিতার নতুন ‘ফর্ম’ উদ্ভাবনের এলিয়ট (তার অগ্রজ ইয়েটসর মতো) অসাধারণ অর্জন দেখিয়ে ছিলেন। তাই বিষ্ণু দে বলতে চেয়েছিলেন যে, ‘এলিয়টের ডগ্‌মা অবশ্যই আমাদের পক্ষে অগ্রাহ্য। কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর সাহায্য স্বীকার্য। … ইংরেজি, ইউরোপীয় এবং আমাদের নিজেদেরই সাহিত্যের ঐতিহ্য সন্ধানে তাই এলিয়টের নিদর্শন শ্রদ্ধেয়। এবং এ সন্ধান এক রকম নির্মাণ, কর্মিষ্ঠ পরিবর্তন, এ কথা এলিয়টই অত ভালো করে সাহিত্য প্রসঙ্গে বলেন প্রথমে। ঐতিহ্য বিচারে মার্কস যেমন করে ‘শেক্সপিয়র বালজাক, গয়টে, হায়নে কিংবা ইবসেনকে’ দেখেছিলেন, এলিয়টকেও সেভাবে দেখতে চেয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়ত, শুধু ‘কর্ম’ বিচারের মানদণ্ডে নয়, বিষ্ণু দে এলিয়টকে দেখেছিলেন একই কবিতার পতাকার তলে বিচিত্রবিধ বিষয়বস্তু সমাবেশ করার নিরিখেও। কবিতা যে শুধু আত্মকেন্দ্রিক ‘নার্সিসিস্টিক’ প্রক্রিয়ার ফসল নয়, এর ভেতর দিয়ে যে পরিপার্শ্ব জনান্তিকে কথা কয়ে ওঠে তা এলিয়টের কবিতা পড়লে বোঝা যায়। তাই বিষ্ণু দে বলেছেন, ফোর কোয়ারটেট্‌সের ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস্‌’ই এর কবিতাচতুষ্টয়ের মধ্যে সবচেয়ে আঁটসাঁট কবিতা : ‘এখানে এলিয়ট শেষ করেছেন এয়ার-রেড রাত্রির জাঁকালো বর্ণনার পরে নটিংহ্যামের রয়্যালিস্ট চ্যাপেলে প্রথম চার্লসের নৈশাভিযানে যখন অন্তর্যুদ্ধে রয়্যালিস্টরা হেরে গেল। অবিসম্বাদী কবিত্বে এলিয়ট আর্তনাদ করেছেন পার্টি-রাজনীতির নশ্বরতায়। মৃত্যুতে, কালস্রোতে রয়্যালিস্টও শূন্যে বিলীয়মান, কী হবে কিছু ক’রে, ল’ড়ে, তাই হায় হায়।’ প্রু-ফ্রকের আত্মকেন্দ্রিক জগতের চেয়ে এই বোধ অনেক দূরের। তৃতীয়ত, বিষ্ণু দে মনে করেছেন, ‘পটভূমি ভিন্ন হলেও এলিয়টের অভিজ্ঞতার তুল্য মেলে আমাদের মধ্যে।’ আর সে কারণেই এলিয়টের সব কবিতার অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ‘বাধা থাকলে তাঁর রীতি আমাদের সহায়, এমনকি তাঁর কবিতার অলঙ্কার অঙ্গবিন্যাস, জগৎ ভিন্ন হলেও।’

সবশেষ, বিষ্ণু দে দৃষ্টি দিয়েছেন এলিয়টের ওরিয়েন্টালিজমের প্রতি। আমরা সচকিত না হয়ে পারি না যখন তাকে বলতে শুনি- ‘গীতা’ এলিয়টকে ‘তাঁর কাব্যের চমকপ্রদ রসদ জুগিয়েছে’। এলিয়ট কেন এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন এ প্রশ্নও তার মনে দেখা দিয়েছিল। ‘টি এস এলিয়টের মহাপ্রস্থান’ প্রবন্ধটি শুরুই হয় এলিয়টের ‘দ্য ড্রাই স্যারভেজেস’ থেকে বহু-উদ্ধৃত লাইনটির সূত্র দিয়ে। এর বঙ্গানুবাদ আমার সাধ্যাতীত, বিষ্ণু দেও চেষ্টা করেননি।

‘I Sometimes wonder if that is what Krishna meart-Among other things- or one way of putting the same thing : That the future is a faded song, a Royl Rose or Lavender spray of wistful regret for those who are not have to regret, Pressed between yellow leaves of a book that has never been opened.
And the way up is the way down, the way forward is the way back.
You cannot face it steadily, but this thing is sure.
That time is no healer : The Patient is no longer here.

রবীন্দ্রনাথও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনমৃত্যুর ছলার অনিবার্যতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এলিয়টেও পাই সেই বেদনার্ত উপলব্ধি-‘What man has made of man!’

ফোর কোয়ারটেটস্‌-এর দ্য ড্রাই স্যালভেজেস-এ এসে আমরা যে হঠাৎ করে কৃষ্ণের রেফারেন্স পাই তা আকস্মিক- এক ধরনের নাটকীয় অনুপ্রবেশ বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের ওরিয়েন্টাল মোহ কী নেহাতই কাব্যের উদ্ভাবনী তাগিদে জন্ম নিয়েছিল। নাকি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দীর্ঘকালের পাঠ, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা? এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজব আমরা পরবর্তী অংশে।

৪. এলিয়টের ওরিয়েন্টলিজম

প্রাচ্যীয় দর্শনের প্রতি এলিয়টের মুগ্ধ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছিল দ্য ড্রাই সালভেজেসের বহু আগে থেকেই এলিয়টের হার্ভার্ড-সহপাঠী দার্শনিক রবার্ট র‌্যাট্রে ১৯৪০ সালের ৩রা মে রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে জানান একটি অবাক করা তথ্য :’আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, আমার হার্ভার্ডের জনৈক সহপাঠী সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এখন বিখ্যাত কবি-টি.এস. এলিয়ট।’ সেই সন্ধ্যা বলতে র‌্যাট্রে স্মরণ করেছেন ১৯১৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পাঠের কথা। সেই সন্ধ্যার রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন ‘দ্য প্রবলেম অব ইভিল’ (পরবর্তীতে ‘সাধনা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) বিষয়ে। প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধ সমগ্রে স্থান পেয়েছে। সেই সন্ধ্যার স্মৃতিচারণ করে র‌্যাট্রে দীর্ঘ ২৭ বছর পরে রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখছেন : এলিয়টের সাথে তিন হার্ভার্ডে ভারতীয় দর্শনের ওপরে কোর্স নিয়েছিলেন : ‘আমরা একত্রে ভারতীয় দর্শন পড়তাম। এমন হতে পারে যে ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় তার ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ চরণটি সেদিনের সন্ধ্যায় আপনার পাঠ স্পেশাল স্মৃতি থেকে উঠে এসেছিল’ আমি তার কবিতার ভক্ত নই, কিন্তু বর্তমান খ্যাতির কথা চিন্তা করে এ তথ্য জানানো প্রাসঙ্গিক মনে হলো। এটি শুধু চিঠিতে নয়, রাট্রে দ্য এনকোয়্যারার পত্রিকার (১৬ মে ১৯৪০) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখেন :’ববীন্দ্রনাথ যখন হার্ভার্ডে ছিলেন তখন অধ্যাপক ও মিসেস উড্‌স একবার তার সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য অতিথিসৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন টি. এস. এলিয়ট- তিনি আমাদের সহপাঠী ছিলেন (আমরা দুজনেই ভারতীয় দর্শন নিয়েছিলাম)। এই পার্টিতে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক উড্‌সের অনুরোধে উপনিষদ থেকে শ্নোক আবৃত্তি করেন, কোনো যন্ত্রের অনুষঙ্গ ছাড়াই খুব সহজভাবে তাঁর নিজের রচিত গান গেয়ে শোনান এবং তখনো অপ্রকাশিত ‘ডাকঘর’ নাটক থেকে পাঠ করেন। অসাধারণ কেটেছিল সেই সন্ধ্যাটি। সমীর সেনগুপ্ত রচিত ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে র‌্যাট্রে রবীন্দ্রনাথ পত্রালাপের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।

র‌্যাট্রের চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত হয়েছিলেন। এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ তিনি আগেই পাঠ করেছিলেন। কিন্তু এটি তিনিও আন্দাজ করতে পারেননি ওয়েস্ট ল্যান্ডের সমাপ্তি চরণটির পেছনে তার অপ্রত্যক্ষ অবদান ছিল। র‌্যাট্রেকে যে-চিঠি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে লেখেন, তা নিম্নরূপ :

‘আপনি মি. টি. এস. এলিয়ট সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা খুব কৌতূহলের সাথে পড়লাম- তার কাব্যের কোন কোন অংশ তাদের আলোড়ন জাগানিয়া ক্ষমতায় ও অসাধারণ শিল্প সৌকর্যে আমাকে বিস্মিত করেছে। বেশ কিছুকাল পূর্বে আমি তাঁর ‘জার্নি অব দ্য ম্যাজাই’ কবিতাটি অনুবাদ করেছি এবং র‌্যাট্রের যে-সম্ভাবনার কথা তুলেছেন তা কষ্টকল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উপনিষদের প্রতিটি মন্ত্রের সমাপ্তি হয় আনুষ্ঠানিক রীতিতে- ‘ওম শান্তি, ওম শান্তি, ওম শান্তি’ শব্দটি তিনবার উচ্চারণ করে। সেদিনও উড্‌স সাহেবের বাসায় রবীন্দ্রনাথ এটি করে থাকবেন। অন্যদিকে, এলিয়ট শুধু সেই সন্ধ্যাতেই নয়, অন্যত্রও রবীন্দ্রনাথকে শুনে থাকবেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানেও এলিয়টের উপস্থিত থাকার কথা। রবীন্দ্রনাথ হার্ভার্ডে অন্তত চারটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন- একটি অধ্যাপক উড্‌স-এর দর্শন ক্লাসে। একটি হার্ভার্ড ফিলোসফিক্যাল ক্লাবে এবং তৃতীয়টি এন্ড ওভার স্কুলের ডিভিনিটি ক্লাবে। এ ছাড়াও এমার্সন হলে Realication of Brahma নামে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্তত অধ্যাপক উড্‌সের ক্লাসে এলিয়টের উপস্থিত থাকার কথা। এই বক্তৃতাগুলো রবীন্দ্রনাথের কবি-পরিচিতির পাশাপাশি তাকে দার্শনিক-পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সন্দেহ নেই। অধ্যাপক উড্‌স কবিকে জানিয়ে ছিলেন যে তাঁর এই প্রবন্ধগুলো একত্রিত করে বই-আকারে দ্রুত প্রকাশ করা দরকার এবং তিনি স্বয়ং এক্ষেত্রে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। শুধু তা-ই নয়, এই প্রবন্ধ-সংকলনের ভূমিকাও লিখতে তার আগ্রহের কথা জানান, উড্‌স : ‘আপনাকে যেসব চিন্তাবিদ প্রভাবিত করেছেন সে সম্পর্কে আরো জানতে চাই আমি, বিশেষত কবীর-এর বিষয়ে। আপনি বা [ক্ষিতিমোহন] সেন এ ব্যাপারে তথ্য জানালে আমি আপনার দর্শনের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করতে পারতাম।’ এ কথা প্রশান্ত কুমার পাল তার ‘রবিজীবনীর’ ৬ষ্ঠ খণ্ডে জানিয়েছেন আমাদের। সে বছর রবীন্দ্রনাথ শুধু হার্ভার্ডেই নয়, আর্বানা ও শিকাগোসহ অন্যান্য শহরেও গুরুগম্ভীর দার্শনিক বিষয়ে ‘গদ্য-বক্তৃতা’ দিয়েছিলেন, যা পরে তার ‘সাধনা’ প্রবন্ধমালায় মূল ইংরেজিতেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯১২-১৩ সালের ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফরকে এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক হয়ে ওঠার বছর বলা যায়। কবি হিসেবে নোবেল প্রাপ্তির আগে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের একজন দার্শনিক হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন এ কথাও মনে হতে পারে।

তবে ওয়েস্ট র‌্যাট্রের শেষ চরণে এলিয়ট যে সহসা শান্তি-স্ত্রোত্র পাঠক করে বলে উঠলেন ‘শান্তি, শান্তি, শান্তি’ (অবশ্য ‘ওম’ শব্দটা বাদ দিয়ে) সেটা কেবল রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রাণিত হয়ে রচিত হয়েছিল। এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে। ওয়েস্ট ল্যান্ডের রচনা কাল আরো পরে-১৯২১ বা তার কিছু কাল আগে থেকে। রবীন্দ্রনাথ যখন হার্ভার্ডে গেছেন সেটা ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার সাত-আট বছর আগে। ফলে ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার কালে এত বছর আগের স্মৃতি এলিয়টের মধ্যে কাজ করছিল তা নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। সুবিদিত যে, ওয়েস্ট ল্যান্ডে পূর্ববর্তী বিভিন্ন সাহিত্যিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের পদচিহ্ন রয়ে গেছে। সেগুলো এলিয়ট রেখে-ঢেকে রাখতে চাননি। বরং বহু পাদটীকা দিয়ে পাঠককে তার শ্রমনিষ্ঠ নির্মাণের প্রতি গোড়া থেকেই সজাগ রাখতে চেয়েছেন। এলিয়টের এনসাইক্লোপেডিক মননের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার বন্ধু কবি এজরা পাউন্ডের ‘লাইন-বাই-লাইন’ ধরে গভীর পাঠ। পাউন্ডের ক্ষুরধার সমালোচনার মুখে কেটে ফেলতে হয়েছে ওয়েস্ট ল্যান্ডের আদি-পাঠের প্রায় অর্ধেক ভাগ। পাউন্ড নিজে এ নিয়ে এলিয়টকে হাস্যোচ্ছলে লিখেছেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে :

‘These are the Poems of Eliot
… … … … … …
If you must needs enquire
Know diligent Reader
That on each Occasion
Ezra performed the Caesarean Operation’

পাউন্ড বা এলিয়ট আদি-খসড়ার ওপরে সংশোধনী চলাকালে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ করেননি পাণ্ডুলিপির ভেতরে। পরবর্তীতেও এ নিয়ে দু’জনের কেউই কোনো মন্তব্য করেননি।

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

লেখাটিতে এলিয়ট এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে। সাহিত্যের প্রভাবক কী- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এখানে জীবনানন্দ। শুধুমাত্র এলিয়টের উদ্ৃব্দতির অংশটুকু ইংরেজিতে রেখে বাদবাকি অংশের প্রয়োজনীয় লাইনগুলো বাংলায় বেশ কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েই তার তর্জমা করে দিচ্ছি। এতে করে সমালোচক জীবনানন্দের বিশ্বাসের জায়গাটি কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে :

‘খুব দূরবর্তীভাবে আমি হয়ত রাজনীতির ছাত্র। অর্থনীতিবিদ হতে কখনো চেষ্টা করিনি। আধুনিক বিশ্বের নানাবিধ সমস্যার অর্থবহ ও যুক্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার বিজ্ঞান হচ্ছে এই শাস্ত্র। …. আমি জানি আধুনিক জগতের রাজনৈতিক সম্পর্কজাল ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ না বুঝতে পারলে… আজকের হতাশা ও আশা কোনোটারই সঠিক পরিমাণ করা যাবে না। কেন আমরা যারা অক্ষরজীবী- তথাকথিত ‘ম্যান অব লেটার্স’- তাদেরকে বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনীতি বা অর্থনীতির মধ্যে অবগাহন করতে হবে? … এর একটি প্রধান কারণ হয়তো এই যে, আমরা কোন পৃথিবী নেই যাকে যে কোন অর্থেই একটি বাসযোগ্য সুখী ভুবন বলা যায়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকের কার্যকারণের ঘনিষ্ঠ উপলব্ধির দ্বারা আমরা এ কথা বুঝতে পারি। এটাও জানি, এই দুর্গতির থেকে সহসা পরিত্রাণের উপায় নেই। তারপরও এ দেশের বা অন্য দেশের বা সারা পৃথিবীরই সংকট জেনে এ কথা বুঝতে পারি, ভবিষ্যতের পৃথিবীর অর্থনৈতিক ভিত্তি ত্রুটিমুক্ত করেই এবং রাজনৈতিক মাৎসন্যায় দূর করেই এগোতে হবে আমাদের। এ কাজে অক্ষরজীবীদের ভূমিকা কতটুকু তা স্পষ্ট নয়। বর্তমান সমাজের ধারায় তারা অনেকটাই ‘মিস-ফিট’। হয়ত আগামীতে অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত সমাজ এলেও শিল্পী-সাহিত্যিকদেরকে প্রথমে আবদ্ধ করে রাখা হবে। বর্তমান অবস্থায় রাজনীতির সমস্যায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের জড়িয়ে পড়তেই হবে এমন কোন কথা নেই।

তাদের শুধু মনে রাখতে হবে- কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে, সর্বত্রই পলিটিক্স হচ্ছে ‘পাওয়ার-পলিটিক্স’ কেবল এবং এই পলিটিক্সই নানা ভাবে, নানা নামে, নানা ঐতিহ্যের টানে ও ভাবাদর্শের (বিভিন্ন বিরোধী তত্ত্বের সমাবেশের) ছত্রছায়ায় অর্থনীতিতে স্থান করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই রাজনীতি ও অর্থনীতি এক বৃহদাংশ মানব জাতিকে কখনো সান্ত্বনা দিয়ে, কখনো প্রতারণা করে, কখনো অনুপ্রাণিত করে, আবার কখনো সংগ্রামের ডাক দিয়ে প্ররোচিত করে যাচ্ছে।… অক্ষরজীবীরা আধুনিক সম্পর্কজালের এই মৌলিক অসুখ অনুভব করেন- এসবের কোথাও তারাও সিস্টেমের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছেন। এখান থেকে তার পরিত্রাণ নেই- পরিত্রাণ কোথাও নেই। তার কাছে মনে হতে পারে যে, সামনেই কোন পিচঢালা, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাস্তা খোলা রয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, এ রকম কোনো পন্থা আমাদের সামনে খোলা থাকবে না, অন্তত আগামী কয়েক দশকে তার সম্ভাবনা নেই।… অক্ষরজীবীরা এই অবস্থায় তার সাহিত্য-রচনায় আগামীর সুখী সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের কাহিনী রচনা করবেন, এটা আমি প্রত্যাশা করতে পারি না। আবার তারা রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে আজকের দিনের বিরতিহীন দুঃখ-দুর্শশার খুঁটিনাটি নির্মাণে ব্যাপৃত হবেন সে বাধ্যবাধকতাও তার নেই।… সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে এক ধরনের সংকট নেমে এসেছে। বিশ্ব-জোড়া উথাল-পাথালের এই সময়ে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ভালো মানের উপন্যাসকে নিকৃষ্ট মানের উপন্যাস থেকে পৃথক করার চাবিকাঠি যেন হারিয়ে ফেলেছি; রাজনীতির শ্বাসরুদ্ধকর প্রভাব থেকে উপন্যাসকে বাঁচানো যাচ্ছে না, বা কবিতাকে অর্থনৈতিক ছায়া থেকে।… এই নতুন যুগের সঙ্গে সাহিত্যকে মানিয়ে চলতে হবে ঠিক, কিন্তু অন্যান্য যোগসূত্রকে অস্বীকার না করে, যা বর্তমানের বা ভবিষ্যতের বাইরে [এবং যা সেই অর্থে হবে- চিরকালের]।… এটা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক ব্রিটিশ সাহিত্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।’ এটা বলে জীবনানন্দ এলিয়টের ‘Triumphal march’ কবিতা থেকে একটি উদ্ৃব্দতি দিলেন :

ÔWe can wait with our stools and our sausages.
What comes first? Can you see? Tell us. It is
5,800,000 rifles and carbines,
102,000 machine guns,
28,000 trench mortars,
53,000 field and heavy guns,
I cannot tell how many projectiles, mines and fuses.

তার পরপরই জীবনানন্দের মন্তব্য হলো :”ঠিক এভাবেই যে [পরিসংখ্যান উদ্ৃব্দত করে] এখানে তাকে প্রকাশ করতে হলো সেই ভঙ্গিমাটি আমার দৃষ্টি কেড়েছে। তবে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এবং ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’-এর কবিতাগুলোর বেশিরভাগ জুড়েই রয়েছে এ ধরনের বলবার ভঙ্গি। এর পেছনে রয়েছে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার তীব্র চাপ- যার ভেতরে কবিতার ‘ফিউশন’ ঘটে থাকে। এবং সেটাই আসলে দেখার বিষয়।”

এর ছয় বছর বাদে এলিয়টের প্রসঙ্গ উঠে আসে তার ‘The Three Voices of poetry’ কাব্যবিষয়ক প্রবন্ধ-গ্রন্থের আলোচনায়। এই বক্তৃতায় এলিয়ট তিন ধরনের কবিকণ্ঠের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি স্বগতোক্তিমূলক; দ্বিতীয়টি রচিত শ্রোতাদের উদ্দেশ করে; আর তৃতীয় কবিকণ্ঠটি নৈর্ব্যক্তিক ধাঁচে গড়া। তবে জীবনানন্দ বলছেন, এসবই বিশুদ্ধ বিভাগ, অনেক কবিতাই মিশ্ররীতিতে বোনা- যেখানে কবি কখনো বলছেন, ‘নেহাতই নিজের কানে-কানে বা জনান্তিকে’, আবার কখনো বলছেন নাট্যরীতিতে- কেবল ‘নিজেকে-মাত্র স্মরণ করে নয়।’ এলিয়টের বক্তব্য হচ্ছে, ‘কবিতা ত্রিস্বরা- যদিও নিজের শ্রেণি অনুযায়ী একটা প্রধান সুর বহন করে চলেছে [প্রতিটি কবি]।’

এলিয়ট সম্পর্কে জীবনানন্দের সতর্ক প্রশস্তি ছিল। সে প্রেক্ষিতে বিষ্ণু দে-র উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো। ১৯৩২ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এলিয়ট নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন বিষ্ণু দে। এমনকি ১৯৭১ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণকালে তিনি বিশেষ করে স্মরণ করেন এলিয়টের কথা : “আবার আমি স্মরণ করি এখানে টি. এস. এলিয়টকে। তার ‘ঐতিহ্য’ ও ব্যক্তিক গুণীপনা আমাকে আবার বিকাশে সাহায্য করেছিল প্রচুর।’ এলিয়ট সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র সুবিখ্যাত প্রবন্ধ তিনটি হলো- ‘টি.এস. এলিয়টের মহাপ্রস্থান’ (‘রুচি ও প্রগতি’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), ‘টমাস স্টার্নস এলিয়ট’ (‘এলোমেলো জীবন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) এবং ‘এলিয়ট প্রসঙ্গ’। এলিয়ট সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র ঘনিষ্ঠ মনোযোগ কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। বিষ্ণু দে শুধু মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন না, মার্কসবাদ সম্পর্কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে তত্ত্ব-চিন্তা করেছিলেন। এ জন্যই যখন তিনি বলেন, ‘অজ্ঞাতসারেই এলিয়টের সমালোচনায় মার্কস অঙ্গীকৃত, তাঁর কাব্যের যুক্তিতে সাম্যবাদীর আরম্ভ, যদিও হয়ত সে-সত্য তিনি জানেন না বা মানেন না’- তাকে আমরা অযৌক্তিক দাবি বলে উড়িয়ে দিতে পারি না।

বিষ্ণু দে-র এলিয়টকে বুঝতে হলে বিষ্ণু দে-র আরাগঁকে বুঝতে হবে আগে। লুই আরাগঁ ছিলেন যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে পুরোধা কবি, পল এলুরাবের মতোই খ্যাতিমান ও প্রগতি-পন্থার পথিক। সেই আরাগঁ একদা বলেছিলেন, ‘কাব্যের ইতিহাস তার টেক্‌নিকের ইতিহাস। যারা আমাদের নীরব করতে চায় তারা সেই শ্রেণির নিকৃষ্ট লেখক, যারা কিছুই নির্মাণ করেনি, যারা শুধু গোটা কয়েক ছক টেনে প্যাঁচ কষেই ক্ষান্ত হয়। আমি ত আজ অবধি কবিতার প্রতিটি অঙ্গ বিষয়ে না-ভেবে, আগের লেখা আর পড়া কাব্যাবলি বিষয়ে সচেতন না-হ’য়ে কোন কবিতা লিখিনি।’

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism, and Tagore)

পর্ব ::২৬

[পূর্ব প্রকাশের পর]

পরবর্তী যুগে এ ‘নাউ’ ও ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর মতো সাহসী পত্রিকার সম্পাদক হয়ে সমর সেন ক্ষুরধার কলম ধরেছিলেন ঘনায়মান স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষাট-সত্তরের দশকে। বাংলায় যেমন লেখা হয়েছিল তার অনুপম গদ্য-গ্রন্থ ‘বাবু বৃত্তান্ত’, ইংরেজিতে লেখা তার কলামগুলোও ছিল তেমনিভাবে একাধারে যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ। এ যেন সমর সেন চল্লিশের যুগের ব্ল্যাক-আউটের রাত্রিতে বসে এলিয়ট পাঠ করে চলেছেন, এলিয়টের স্বকণ্ঠে আবৃত্তি শুনবেন বলে উদগ্রীব হয়ে রেডিওর সামনে বসে আছেন এবং আর সব কবিদেরও সেই আবৃত্তি শুনতে বলছেন। একগুচ্ছ উদাহরণ :

১. বুদ্ধদেব বসুকে ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসের এক চিঠিতে এলিয়টের ফোর কোয়ারটেট্‌স নিয়ে লিখছেন :’গতকাল এলিয়ট BBC-তে East Coker-এর আবৃত্তি করলেন। চমৎকার লাগল। আপনি শুনেছেন না কি? আসছে সপ্তাহে Burnt Norton পড়বেন। দিনটা এখনও announce করেনি। এলিয়টের গলায় mature melancholy উপভোগ্য।’

২. বিষুষ্ণ দে’কে ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে এক চিঠিতে লিখছেন : ‘আসছে মঙ্গলবার রাত্রি আটটার সময় (ওঝঞ) এলিয়টের একটি বক্তৃতা আছে বিবিসি থেকে।’

৩. বিষ্ণু দে’কে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আবার এক চিঠিতে লিখছেন :’মাঝে বিবিসিতে পরপর তিন সপ্তাহে এলিয়ট সাহেব East Coker, Burnt Norton ও Dry Salvages পড়বেন। সবচেয়ে ভালো হয়েছিল প্রথমটি। কিন্তু দেখলাম আপনার চেয়ে সুধীন বাবুর আবৃত্তির সঙ্গে এলিয়ট সাহেবের আরো মিল।’

সমর সেনের ওপরে এলিয়টের প্রভাব নিয়ে অমিয় কুমার বাগচী তার ‘সমর সেন ও ভারতীয় বুদ্ধিজীবীর সমস্যা’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে ইতিহাসের মধ্যে অনেক ভুলভুলাইয়া ও চোরাগলি থাকে। সে রকমই কানাগলির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর তারই যন্ত্রণাবোধ প্রকাশিত সমর সেনের কবিতায় ও গদ্যে : ‘এলিয়টের জীবনধারণ ও জীবনকৃতির সঙ্গে সমর সেনের জীবনধারণা ও জীবনপাতের ইতিহাস একেবারেই মেলে না। এলিয়টের মতো এবং এলিয়ট-প্রভাবিত আরও বিশিষ্ট বাঙালি কবির মতো তিনি জানতেন বোদ্ধা মানুষের আত্মম্ভরিতা কত ঠুনকো। কত দুর্বলাভিত্তি। কত অর্থহীন। কিন্তু এই নির্বেদ থেকে বাঁচার জন্যে অ্যাংলো-ক্যাথলিকের বিশ্বাসের কোনো ভারতীয় সংস্করণ তিনি খোঁজেন নি। প্রাচীন ভারতের স্বপ্নে নিজেকে মজিয়ে দিতে চান নি অথবা বিশুদ্ধ সংস্কৃতির পিছনে সারাজীবন ধাওয়া করে বেড়ান নি।’

মূল ইংরেজি স্তবক যেখানে এলিয়ট ইতিহাসের ভুলভুলাইয়ার কথা পেরেছিলেন, তা এই রকম। বিখ্যাত সেই উপলব্ধি :

‘After such Knowledge, what forgiveness? Think now History has many Cunning Passages, Continued corridors And issues, deceives with whispering ambitions, Guides us by vanities.’

সমর সেন (বা বিষ্ণু দে’র) জীবন চর্চা ও আদর্শ এলিয়টের থেকে পৃথক ছিল, কিন্তু তার বিষণ্ণ উচ্চারণের ধরনেরও উপলব্ধির ছায়া পড়েছিল তাদের কাব্যে।

অমন যে নিভৃতচারী জীবনানন্দ, তিনিও এলিয়টের প্রতি জানিয়েছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জীবনানন্দের নানা লেখায় এলিয়টের আলোচনা অনিবার্যভাবেই এসে পড়েছে। কবিতা কি কেবল কিছু স্মরণযোগ্য লাইনের সমাবেশ? এই প্রশ্ন তুলে জীবনানন্দ তার সমসাময়িক কাব্যধারা সম্পর্কে লিখলেন :

‘রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় উক্তির স্মরণযোগ্যতার প্রাচুর্যই খুব বেশি; ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লেভারনেস’। ঠিক সে-জিনিস নয়- তার চেয়ে খানিকটা উঁচু তারে বাঁধা লাইন ও পঙ্‌ক্তির সমষ্টিই ঢের বেশি। একেই অনেকে কবিতা বলতে চান। আধুনিক ইংরেজি কাব্যের ক্ষেত্রেও দেখি এ রকম লাইন ও ‘স্ট্যানজা’ নিয়ে, যা সৃষ্ট হচ্ছে তা-ই কাব্য বলে পরিচিত হয়ে আসছে।

এ কথা বলার পরপরই তিনি ব্যতিক্রমী কবি হিসেবে এলিয়টের উদাহরণ দিলেন :

“এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর কোনও অংশকেই বাকচাল এমনকি সহনীয় চাতুর্য বললেও অন্যায় করা হবে হয়তো, কিন্তু কানিংস ইত্যাদি অনেকের কবিতা অবান্তর চাতুরী ছাড়া আর কিছুই নয়। অডেন, স্পেন্ডর, ম্যাকনিস প্রমুখ কবির অনেক লেখাও এই ধরনের। এজরা পাউন্ড-এর আগেকার রচনাগুলো বাস্তবিকই কবিতা- তাঁর আধুনিক কাল্টোজ মহাকাব্যের অর্থ ও ইঙ্গিত বুঝবার ক্ষমতা আমাদের তো দূরের কথা, স্বয়ং ইয়েটস-এর কপালেও ঘটে ওঠেনি; এলিয়টও কি বুঝেছেন?”

স্পষ্টতই এলিয়টকে তিনি আর সকলের থেকে আলাদা সারিতে দেখেছেন তার প্রিয় কবি ইয়েটস-এর সাথে একই স্তরে। উপরের উদ্ৃব্দতি দুটো ‘উত্তর-রৈবিক বাংলা কাব্য’ (১৯৪৫) থেকে নেওয়া। জীবনানন্দের বেশিরভাগ প্রবন্ধই হয় অপ্রকাশিত থেকে গেছে তার জীবদ্দশায়, অথবা প্রকাশিত হয়েছিল কোনো কলেজ-পত্রিকায় বা স্বল্পখ্যাত স্বল্পায়ু সাময়িকীতে। এর ফলে এলিয়টের প্রতি জীবনানন্দের গভীর উপলব্ধির কথা অনেকটাই আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। যেমন, কবিতার সমালোচনায় প্রথম অধিকার কবিদেরই, এমনকি তারাই হতে পারেন কবিতার শ্রেষ্ঠ সমালোচক- এলিয়টের এই আপ্তবাক্যের প্রতি জীবনানন্দের সমর্থন ছিল। ‘কবিতা, তার আলোচনা’ (১৯৪৯) প্রবন্ধে এলিয়ট অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি লিখছেন :

‘আমাদের দেশে গত দশ-পনেরো বছরে দেখা গেছে এমন সব লোক কবিতা সঙ্গীত মজলিসি সমাজকথা দেশ-বিদেশের মাঝে ও মেজাজ সম্বন্ধে একই নিঃশ্বাসে ভাষ্যকারের ভূমিকায় এমন আশ্চর্য সিদ্ধি দেখিয়ে গেছেন যে, কবি ও কবিতা কতকগুলো কবিতার বই ও সংকলন সম্পর্কে অনেক আধাআধি সত্য ও অস্পষ্ট ধারণা এখনও জের টানছে।… এ রকম মানুষদের হাতে কোনও যুগের কোনও দশকের কাব্যের বড় সমালোচনা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। সমালোচনার ক্ষতি হবে তাতে; কবিতারও ক্ষতি হবে; পাঠকেরাও ভুল জিনিস চাইবেন কবিতার কাছ থেকে।

কবিতার সৎ সমালোচনা আসতে পারে কবিদের কাছে থেকেই- বড় কবিরাই উপহার দিতে পারবেন কাব্যের বড় সমালোচনার-এর উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দ স্মরণ করলেন এলিয়ট প্রমুখ কবিকে :

‘ইংলন্ডে কবিতার বিশেষ পাঠ- বড় সমালোচনা কবিদের দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে করা হয়েছে : ড্রাইডে-এর পর জনসন। তার পর কোলরিজ, অল্প পরিসরে খুব বিখ্যাতভাবে ওয়র্ডসওয়র্থ পত্রের ভিতর দিয়ে কিটস, ডিকেন্স-এ শেলি, পরে আর্নল্ড, ইয়েটস ও পাউন্ড- আজকাল এলিয়ট।’

এলিয়টের প্রসঙ্গ আরো বিস্তৃত হয়ে এসেছে ‘আধুনিক কবিতা’ (১৯৫০) প্রবন্ধে :

‘কিছুকাল থেকে এলিয়টকে নিয়ে নানা দিকের উৎসুক ভাবুক ও পণ্ডিত মহলে- য়ুনিভার্সিটিতেও কথাবার্তা চলছে… (এলিয়ট সম্বন্ধে কয়েকখানা প্রায়-প্রামাণ্য আলোচনার বইও ব্রিটিশ সমালোচকদের হাতে তৈরি হয়ে গিয়েছে)।’ একই প্রবন্ধে কবিদের করা কবিতার আলোচনার ভেতরে উৎকর্ষের পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে আবারো জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টের প্রসঙ্গ একযোগে টেনে আনছেন :

‘রবীন্দ্রনাথ শেলিকে আর্নল্ড-এর চেয়ে স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন এবং এলিয়ট ইংলন্ডের জর্জীয় কবি ও সমালোচকদের চেয়ে বেশি যুক্তিসিদ্ধ ভাবে। আমার মনে হয়, এলিয়ট যা পেরেছেন তার চেয়ে বেশি সংশ্নেষপূর্ণ প্রাণবত্তার ইংলন্ডের উনিশ শতকের কোনও-কোনও কবিকে ধরতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ- যদিও এলিয়ট-এর বিচার ও বিশ্নেষণ, ও যে-ভাষায় তা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই সমীচীন মেধাউজ্জ্বল স্পষ্টতার ফলে, আমরা … যা জ্ঞান লাভ করেছি- এলিয়ট-এর সমালোচনা অবর্তমান থাকলে সেটা পাওয়া কঠিন হত নিশ্চয়ই।’ তার পরপরই পাঠককে সতর্ক করে দিচ্ছেন জীবনানন্দ- ‘এলিয়ট-এর সমালোচনার পদ্ধতি ও মীমাংসার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মতভেদ রয়েছে আনেকখানি যদিও।’

এ তো গেল ‘সমালোচক’ এলিয়ট সম্পর্কে জীবনানন্দের অভিব্যক্তি। কিন্তু তার কবিতা সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন জীবনানন্দ? ১৯৩৭ সালের একটি অপ্রকাশিত লেখায় তিনি অনুভূতিকে জীবনানন্দীয় ধরনে এভাবে প্রকাশ করেছিলেন। ‘কবিতা ও কঙ্কাবতী’ শীর্ষক লেখার খসড়ায় তিনি লিখছেন :

“টি. এস. এলিয়ট-এর কবিতা সম্বন্ধে কোনও কথা বলতে আমি নানা কারণে দ্বিধা বোধ করি। কিন্তু তবুও তাঁর ‘দ্য লাভ সঙ অফ আলফ্রেড প্রুফ্রক’ পড়ে যদি তরুণ-তরুণীরা মনে করেন মানবপ্রেমের নব-সংস্কারের বাণী নিয়ে এসেছেন কবি, এসেছেন একজন নতুন সমাজ-সংস্কারক- এসো, আমরা আমাদের জীবনে তাঁর প্রেমের-সংস্কারকে প্রতিষ্ঠিত করে ক্রমে-ক্রমে ‘হলো ম্যান’ এবং ‘হলো ওম্যান’ হয়ে যাই, তা হলে বুঝতে হবে এলিয়ট-এর ছেঁড়া ছেঁড়া সৌন্দর্য-কুয়াশাকে ধরতে না পেরে হাড় নিয়ে খটখট করছে তারা। এলিয়ট-এর কবিতা যেখানে বাস্তবিকই কবিতা, সেখানে মুখ্যত সমাজ সংস্কার সৃষ্টি; শুধু বা কোনও সংস্কারই তারা নয়। কবি চিত্তের আবেগেই সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন।”

এলিয়টের কবিতার বৃহৎ পরিসর আলোচনা জীবনানন্দ করেছেন অবশ্য তার একটি স্বল্প পরিচিত ইংরেজি লেখায়। সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পাদিত ‘কনটেম্পোরারি’ বইতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, কমরেড পাবলিশার্স থেকে। এই প্রবন্ধের প্রথম লাইনটি ‘অন্য জীবনানন্দ’ সম্পর্কে আমাদেরকে সচকিত করে : : ‘I may be a student of politics- in a faint way’ । ঐ প্রবন্ধে এলিয়টকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কাব্যালোচনা করেছেন তিনি।

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৫

[পূর্ব প্রকাশের পর]

এটা বলার পর তিনি এলিয়টের প্রুফ্রক কাব্যগ্রন্থের ‘প্রিলিউড’ কবিতার প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকটি অনুবাদ করে আধুনিক কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্যের দিকটি দেখালেন। আমি শুধু প্রথম স্তবকটি মূলের ইংরেজি পাঠ ও তার রবীন্দ্র্রনাথ-কৃত অনুবাদ নিচে তুলে ধরছি।

‘The winter evening settles down
With smell of steaks in passage ways
Six o’clock.
The burnt-out ends of smoky days.
And now a gusty shower wraps
the grimy scraps
Of withered leaves about your feet
And newspapers from vacant lots
the showers beat
On broken blinds and chimney-pots,
And at the corner of the street
A lonely cab-horse steams and stamps’

রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদ :

‘এ-ঘরে ও-ঘরে যাবার রাস্তায় সিদ্ধ মাংসর গন্ধ,

তাই নিয়ে শীতের সন্ধ্যা জমে এল।

এখন ছ’টা-

ধোঁয়াটে দিন, পোড়ো বাতি, যে অংশে ঠেকল।

বাদলের হাওয়া পায়ের কাছে উড়িয়ে আনে

পোড়ো জমি থেকে ঝুলমাখা শুকনো পাতা

আর ছেঁড়া খবরের কাগজ।

ভাঙা সার্শি আর চিম্‌নির চোঙের উপর

বৃষ্টির ঝাপট লাগে,

আর রাস্তার কোণে একা দাঁড়িয়ে এক ভাড়াটে গাড়ির ঘোড়া,

ভাপ উঠছে তার গা দিয়ে আর সে মাটিতে ঠুকছে খুর।

পুনশ্চ ও পরিচয়ে প্রকাশিত অনূদিত কবিতার মধ্য দিয়ে এলিয়টের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস ভালো-লাগার যে-প্রকাশ ঘটেছিল, তা আমৃত্যু অটুট ছিল। ১৯৩৬ সালের স্পেনিশ সিভিল ওয়ারের সময় জেনারেল ফ্রাংকোর বাহিনীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’ গঠিত হয়েছিল। সেখানে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীই প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এলিয়টের বিবৃতির জন্য তাকে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাতে স্বাক্ষর করেন নি। এটি অনেক প্রগতিমনা শিল্পী-সাহিত্যিককে ক্ষুব্ধ করেছিল। এটা ঠিক যে, এজরা পাউন্ডের মত ফ্যাসিবাদী শক্তির পক্ষে এলিয়ট কখনোই ঝোঁকেন নি, কিন্তু তারপরও তার কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। অমিয় চক্রবর্তী এলিয়টের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের দিকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। বিষ্ণু দে এলিয়টের ভক্ত- সে অভিযোগ মানেন নি। বলেছিলেন, ‘পাউন্ডের মতো এলিয়ট [ফ্যাসিজমের স্নায়ুবিকারে] ঝোঁকেন নি। তাঁর বিবেচনায় ইংরেজি গির্জার আশ্রয়ে ক্যাথলিক ঐতিহ্যের নিরাপদ দিব্যভাবের আবেদন বেশি।’ রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক মত নিয়ে তরুণ কবিকুলের মধ্যকার এই বিতর্ক সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু এলিয়টের কবিকৃতির মূল্যায়নে তা কোন প্রভাব ফেলেনি। কামাখ্যাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি সেকথা নির্দি্বধায় প্রকাশ করেছেন। ১৯৪০ সালে লেখা এ চিঠিটি [শারদীয় দেশ, ১৯৭৩] এলিয়ট ও আধুনিক কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :

‘এলিয়ট অডেন প্রভৃতি আধুনিক ইংরেজ কবির মনে বর্তমান কালের দুর্যোগের যে আঘাত লেগেছে সেটা সত্য এবং প্রচণ্ড। সেই সংঘাতে চিন্তার তরঙ্গ উঠে আগেকার কালের অভ্যস্ত ভাষাধারার কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। ভঙ্গি বদল হয়েছে কিন্তু তাঁদের রচনায় এ যুগের বাণী উঠছে জেগে কতক স্পষ্ট রূপ নিয়ে কতক অস্পষ্ট ব্যঞ্জনায়। তাঁরা যথার্থ কবি এইজন্যে বাণী তাঁদের মনে আলোড়িত হয়ে উঠলে সেটা ব্যক্ত না করে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। কিন্তু যে সাহিত্যে মানুষকে বলবার মতো কোনো বাক্য দুর্নিবার হয়ে ওঠেনি কেবলমাত্র একটা এলোমেলো প্যার্টা‌ন্‌ চলেছে আঁকাবাকা আঁকজোক কেটে সেখানে মন কোন একটা দান পায় না কেবল হুঁচোট খেয়ে খেয়ে মরে। সে সাহিত্যে একটা কোনো তাৎপর্য হাৎরিয়ে বেড়ানোর মতো ক্লান্তিকর আর কিছুই নেই।’

এলিয়ট একুশের আধুনিকতার অকৃত্রিম অনুভূতিকে ব্যক্ত করছে এজন্যই তাদের কাব্য-প্রকাশ অনবদ্য হতে পেরেছে, এ-ই ছিল কবির অভিমত। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ কবিতা আর ১৯৪০ সালে লেখা উপরোক্ত চিঠির মধ্যবর্তী সময়ে এলিয়টের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের চিঠি-পত্রে এসেছে বেশ কয়েক বার। এর থেকে বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট-অনুরুক্তি সময়ের সাথে কেবল গভীরতর হয়েছে। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাই কবির সাথে অমিয় চক্রবর্তীর পত্রালাপে। বাংলার তরুণ প্রজন্মের আধুনিক কবিকুলকে তিনি অনুকৃতির পথে নয়, তাদের ‘স্বাভাবিক প্রাণগত অভিব্যক্তির’ পথে চলতে বলছেন। ১৯৩৯ সালের এই চিঠিতে কবি বলছেন :’দেশ-বিদেশ থেকে নানারকম ভাবের প্রেরণা এসে পৌঁছেচে আমার মনে এবং রচনায়, তাকে স্বীকার করে নিয়েছি, তা আমার কাব্যদেহকে হয় তো বল দিয়েছে পুষ্টি দিয়েছে কিন্তু কোনো বাইরের আদর্শ তার স্বাভাবিক রূপকে বদল করে দেয় নি। … যে কবিদের কাব্যরূপ অভিব্যক্তির প্রাণিক নিয়মপথে চলেছে তাঁদের রচনার স্বভাব আধুনিকও হতে পারে সনাতনীও হতে পারে অথবা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু তার চেহারাটা হবে তাঁদেরই, সে কখনোই এলিয়টের বা অডিনের বা এজরা পাউন্ডের ছাঁচে ঢালাই করা হতেই পারে না। … যে কবির কবিত্ব পরের চেহারা ধার করে বেড়ায় সত্যকার আধুনিক হওয়া কি তার কর্ম?’

রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনে অবিশ্রাম লেখালিখির পাশাপাশি বিরামহীনভাবে অন্যদের লেখা বই-পত্র পাঠ করে গেছেন। বিচিত্রবিধ বিষয়ে কৌতূহল ছিল তাঁর। নানাভাবে সেসব বই-পত্র সংগ্রহ করেছেন। বিশ শতকের আধুনিক ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। পাঠক রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার ইতিহাস এখনো আমাদের চোখের সামনে সম্যকভাবে ফুটে ওঠে নি। এর কিছু সংকেত পাই তার চিঠি-পত্রে। অমিয় চক্রবর্তী তাকে বিভিন্ন সূত্রের খবর পাঠাতেন, মাঝে মাঝে বই-পত্র যোগাড় করে পাঠাতেন। এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখছেন :’তুমি এখনকার ইংরেজ কবিদের যে সব নমুনা কপি করে পাঠাচ্চ পড়ে আমার খুব ভালো লাগচে,- সংশয় ছিল আমি বুঝি দূরে পড়ে গেছি, আধুনিকদের নাগাল পাব না- এই কবিতাগুলি পড়ে বুঝতে পারলুম আমার অবস্থা অত্যন্ত বেশি শোচনীয় হয়নি। তুমি যদি এই সময়ে কাছে থাকতে তোমার সাহায্যে বর্তমান সাহিত্যের তীর্থ পরিক্রমা সারতে পারতুম।’ অমিয় চক্রবর্তী তাকে এলিয়টের কাব্য-নাট্য ‘দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’ পাঠিয়েছিলেন। পড়ে কবি লিখেছেন :’ঋধসরষু জবঁহরড়হ বইখানি গভীরভাবে ভালো লেগেছে। যদি মন স্থির করতে পারি পরে তোমাকে কিছু লিখব।’ কী বলতে চেয়েছিলেন, তা আর পরে লেখা হয়ে ওঠেনি।

রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, এলিয়ট তিরিশের যুগের হিড়িক মেনে প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চান নি। এলিয়টের অনুসারীদের মধ্যে বামধারার কবি স্টিফেন স্পেন্ডারও ছিলেন। ইংরেজ ঔপন্যাসিক ই. এম. ফস্টার এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের একটি ছোট্ট সমালোচনা করেছিলেন। এদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তা এলিয়ট ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যবিশ্বাসের মিলের জায়গাটিকে বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন :

‘স্পেন্ডর ও ফস্টরের দুটি চটি বই পড়লুম। আমার নিজের মত এই যে আমরা অর্থনীতি বা ধর্মনীতিতে যে দলেরই লোক হই আমাদের সেই দলাদলি যে সাহিত্যকে বিশেষ ছাঁদে গড়ে তুলবেই এমন কোনো কথা নেই। রসের দিক থেকে মানুষের ভালমন্দ লাগা কোনো মতকে মানতে বাধ্য নয়। আমার মনটা হয়তো সোশিয়ালিস্ট, আমার কর্মক্ষেত্রে তা ভিতর থেকে প্রকাশ পেতেও পারে কিন্তু উর্বশী কবিতাকে যে স্পর্শও করে না। … মার্কসিজমের ছোঁয়াচ যদি কারো কবিতায় লাগে, অর্থাৎ কাব্যের জাত রেখে লাগে, তাহলে আপত্তির কথা নেই, কিন্তু যদি নাই লাগে তাহলে কি জাত তুলে গাল দেওয়া শোভা পায়?’

এলিয়টের ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ে নি। এর কারণ এর দীর্ঘ কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে। পড়লে সেটি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়াত বিষয়বস্তুর গুণেই। এটি ছিল এলিয়টের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এর ভাব ও ছন্দ-ব্যঞ্জনা সব ধারার কবির মধ্যেই আলোড়ন ফেলেছিল। সেই উচ্ছ্বাসের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় ‘মার্কসবাদী’ কবি সমর সেনের চিঠি-পত্রে।

৩. তরুণতর প্রজন্মের চোখে এলিয়ট

বিশেষভাবে সমর সেনের কথাইবা তুললাম কেন? তার একটা কারণ ‘বুর্জোয়া-ডেকাডেন্সের’ রূপকার এলিয়টের প্রতি সমাজ-পরিবর্তনকামী ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সাথী সমর সেন কেন উৎসুক হয়ে উঠবেন- এ নিয়ে বাড়তি কৌতূহল হতেই পারে। দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অরুণ সেনের ছেলে সমর সেন প্রথম যৌবনে কবিতা লিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এরা সকলেই সমর সেনের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। চল্লিশের যুগে বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু বরাবরই ছিলেন বৃত্তের বাইরের দলছুট মানুষ। প্রগতিশীল রাজনীতি নিয়ে পরিহাস করতে জানতেন তিনি যেমন, সবার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সংকীর্ণতা নিয়ে বিদ্রূপ করতে পিছু-পা হতেন না সেই তরুণ বয়সেই। একবার বুদ্ধদেব বসুকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়ে চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন- ‘সুকান্ত কি মহাকবি? আমার কল্পনা ও বোধশক্তি এত কমে গিয়েছে যে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি না।’ বিষ্ণু দে-কে তির্যকভাবে আখ্যায়িত করতেন ‘মহাকবি’ বলে। তার শ্নেষাত্মক বচন থেকে প্রায় কেউই রক্ষা পাননি। বিষ্ণু দেকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘ধূর্জটিবাবু আজকাল আবার সমালোচনার নামে সুধীন্দ্রনাথের চর্চা শুরু করেছেন। বাংলা কবিতা=সুধীন্দ্রনাথ; সুধীন্দ্রনাথ=ভারতীয় ঐতিহ্য। … তারপর রবীন্দ্রনাথ আবার তাঁকে কী যেন করার ভার মৃত্যুর পূর্বে দিয়ে গিয়েছেন।’ একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছেন, ‘শুনে সুখী হবেন যে রবীন্দ্র রচনাবলী মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। এখন পর্যন্ত কোনো মহান ‘সত্যের’ মুখোমুখি হইনি।’ সবাইকেই তিনি কমবেশি শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু গুরুবাদ, প্রশ্নাতীতভাবে সবাইকে মেনে নেওয়ার রীতি, চাটুকারবৃত্তি এসবের লক্ষণ দেখলে সমর সেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং মনের ভাব তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না। ভারতবর্ষের বা বাঙালির ইতিহাস তার কাছে খুব গৌরবময় মনে হতো না। ব্রেখটের মতো সমর সেনও জাতীয় ইতিহাসের মধ্যে কেবলই অত্যাচার-অবমাননা-শোষণের ছায়া দেখেছিলেন। চল্লিশ দশকের শুরুতেই তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন :

‘আমরা বাঙালী মীরজাফরী অতীত; মেকলের বিষবৃক্ষের ফল।
অনেক দিন ভেবেছি,
অনেক বার ভেবেছি:
ভবিষ্যতে বীজবাহী না হয়। এ বিষবৃক্ষ শেষ হোক…’
অন্যত্র, নতুন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে লিখেছেন,
‘মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবীতে আলো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলার ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্ত ক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক সভ্যতার রুক্ষ মরুভূমি।’
[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৪

[পূর্ব প্রকাশের পর]

২. রবীন্দ্রনাথের এলিয়ট

টি.এস. এলিয়ট নিয়ে গত এক শতাব্দী ধরে এত লেখালিখি হয়েছে যে, এ নিয়ে বাড়তি কোনো তথ্য বা তত্ত্ব যোগ করা দুরাশা মাত্র। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ যেমন, ইংরেজি কবিতার ক্ষেত্রে এলিয়টও তেমনি। তারপরও এলিয়ট পাঠে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধে যার উত্তর সহজে মেলে না। আমার কাছে প্রশ্নগুলো ধাঁধার মত মনে হয়। এই প্রশ্নগুলোকে তিনটি শিরোনামে বিন্যস্ত করা যায় :

ক. রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু এলিয়ট রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে এত নির্বিকার ছিলেন কেন? তার প্রবন্ধ-সাহিত্যে, এমনকি সম্প্রতি ৩-খণ্ডে প্রকাশিত এলিয়টের সংগৃহীত চিঠিপত্রে কোথাও রবীন্দ্রনাথের কোন উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এলিয়ট-সখা এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন, পত্রালাপ করেছেন, গিয়ে একাধিকবার সরাসরি দেখা করেছেন, কিন্তু এলিয়ট এত দৃষ্টিকটুভাবে নীরব কেন ছিলেন পূর্বাপর? অথচ দু’জনেই তো ছিলেন কম-বেশি একই পথের পথিক- একত্ববাদী (ইউনিটেরিয়ান) আদর্শে, বিশ্বজনীন চিন্তায় ও পূর্ব-পশ্চিমের যোগসূত্র স্থাপনে তৎপর?

খ. এলিয়ট পরবর্তী জীবনে খ্রিষ্টীয় ধর্মাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন, এ রকম কথা চালু রয়েছে। কিন্তু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ধর্ম, ভাষা ও দর্শনের ছাত্র হিসেবে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় বেশ কিছুটা দক্ষতা জন্মেছিল তার। পাণিনি-ভতৃহরি পাঠ করেছিলেন তিনি। পতঞ্জলির দর্শন, সাংখ্য, উপনিষদ সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন ছিল তার। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে তার বাস্তবিক অনুরাগ ছিল। এলিয়টের কবিতায় ও সামগ্রিক দর্শনবোধে প্রাচ্যবিদ্যার প্রভাব কতখানি ফলদায়ী হয়েছিল?

গ. তৃতীয় প্রশ্নটি আধুনিকতার পাশ্চাত্যনির্ভর সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা নিয়ে। আধুনিক চিত্রকলায় পিকাসোর কিউবিস্ট নিরীক্ষার ওপরে আফ্রিকার চিত্রকলার (মুখোশ ও ভাস্কর্য) প্রভাব সুবিদিত। এমনটাই ঘটেছিল পল ক্লী-র ক্ষেত্রে। এনি এলবার্সের শিল্পকলায় যেমন প্রভাব ফেলেছিল আজটেকদের আর্ট। অর্থাৎ প্রতীচ্যের আধুনিকতার নির্মাণে প্রাচ্যের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। এলিয়টের বা পাউন্ডের কাব্যচর্চায় ‘আধুনিকতার’ নির্মাণে প্রাচ্যের সরাসরি বা পরোক্ষ অবদানের যে সাক্ষ্য মেলে, তাতে করে কি পাশ্চাত্যনির্ভর আধুনিকতার ইতিহাসকেই পুনর্লিখন করার তাগিদ দেখা দেয় না? তাতে করে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী যাকে বলেছিলেন, ‘Provincializing Europe’ সে ধরনের তাগিদেরই বাড়তি সমর্থন পাওযা যায় না কি?

রবীন্দ্রনাথের তরফে এলিয়টের প্রতি মনোযোগী উৎসাহের সপক্ষে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত জড়ো করা সম্ভব। সেগুলো সংক্ষেপে একঝলক দেখে নিতে পারি।

১. বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন গদ্য কবিতা বিষয়ে লিখবার জন্য। সেই তাগিদে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার ‘গদ্যকাব্য’ প্রবন্ধটি, যেটি বুদ্ধদের-সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে (পরবর্তীকালে ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থে ‘কাব্য ও ছন্দ’ নামে প্রকাশিত)। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথ যে পত্র লেখেন তাতে এলিয়টের নাম উঠে আসে :

‘গদ্যকাব্য সম্বন্ধে তর্ক না করে যথেচ্ছা লিখে যাওয়াই ভালো। আজ যারা আপত্তি করচে কাল তারা নকল করবে। এলিয়ট প্রমুখ অনেক কবি নির্মিল নিশ্ছন্দ কবিতা লিখে চলেচেন…’

২. কবি বিষুষ্ণ দের ‘চোরাবালি’ কাব্যগ্রন্থে বিদেশি প্রসঙ্গ- অনুষঙ্গের প্রাবল্য দেখে রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি হয়েছিল। এ নিয়ে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। সেখান থেকে স্পষ্ট হয় যে, রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের Waste Land, Ash-Wednesday, Ariel Poems প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ কতটা ঘনিষ্ঠভাবে কতটা মনোযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটা তুলে ধরছি : ‘… বিষ্ণু দের লেখার একটা কারণে আমার খটকা লাগে। আমরা য়ুরোপীয় সাহিত্য এক সময়ে গভীর আনন্দ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গেই পড়েছিলুম। মনটা তার সঙ্গে ভাবের কারবার করেছিল, কিন্তু বিদেশি নামগুলো স্বভাবতই রচনার মধ্যে এসে পড়ে না। … ক্রেসিডা গ্রীক পুরাণের তর্জমা থেকে পড়েছি, তার সঙ্গে মনের এত বেশি মাখামাখি হয়নি যে, ভাবের অন্তরঙ্গমহলে যখন তখন আপনি এসে চেনা জায়গা নিতে পারে। এলিয়ট-এর কবিতার ভাষার আত্মীয়মহলে অসঙ্কোচে বিদেশি নামের বা পুরাণের ঢুকে পড়া দেখেছি, তাঁর এই বিশেষত্ব এত স্বকীয় যে, অন্য কারো পক্ষে এটা অনুকরণের সুস্পষ্ট মুদ্রাদোষ হয়ে পড়ে। এ রকম স্খলন যদি দৈবাৎ হয় তবে সেটা নিয়ে লজ্জিত হওয়া প্রত্যাশা করি কিন্তু বার বার যদি হয়, তবে সেটাকে কী বলব? বিশেষত তুলনা করে দেখলে দেখা যাবে যে, দেশীয় পুরাণ থেকে তার কবিতায় নামগুলি পথ পায় না। সহজ বলেই কি?’

এখানে বলা দরকার যে, এলিয়ট তার কবিতার নির্মাণে অন্য সূত্র থেকে (অন্য কবির লেখা, পুরান মহাকাব্য বা দার্শনিক টেক্সটের) বিচ্ছিন্ন লাইন, উপমা, চিত্রকল্প, খণ্ড সংলাপ, বাক্যাংশ প্রায়শ ব্যবহার করতেন। সেসব মৃত লাইন এলিয়টের হাতে ব্যবহূত হয়ে এক নতুন জীবন পেত; কখনো কখনো মূলের অর্থই বদলে যেত; আবার কখনো নতুনের সাহচর্যে এসে পুরাতন ভাবভঙ্গি অপ্রত্যাশিতভাবে আধুনিকতার দ্যোতনা পেত। রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন যে, এ কাজটি এলিয়ট অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সম্পাদন করেছেন বলেই এটি তার কাব্যকলার একটি জরুরি প্রকরণ-অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

৩. কবি বিষ্ণু দে এলিয়টের Ariel Poem-এর প্রথম কবিতা ‘Journey of Magi’ অনুবাদ করে ‘সংশোধনের জন্য’ রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এটির তিনটি পাঠ পাওয়া যায়। বিষ্ণু দের অনুবাদ সংশোধন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, “ইতিমধ্যে শ্রী বিষ্ণু দে ‘পুনশ্চ’-এর নকলে ‘এলিয়ট’-এর একটা তর্জ্জমা পাঠিয়াছিল, পড়ে দেখলুম। কমলি ছোড়তি নেই- গদ্যের ঘাড়ে পদ্য কামড়ে ধরেচে।” বিষ্ণু দের নিজের অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের হাতে সংশোধিত হয়ে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর আরেকটি পাঠ পাওয়া যায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘স্বগত’ প্রবন্ধমালার ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে। আর সবশেষ পাঠটি সংকলিত হয় ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ শিরোনামে। এই তিনটি পাঠের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য বয়ে গেছে। ধারণা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ সে পর্যায়ে (১৯৩০-৩১ সালের কথা হচ্ছে এখানে) বাংলায় গদ্যছন্দের প্রকাশভঙ্গি, সীমা-পরিসীমা নিয়ে অনবরত ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করে চলেছিলেন। আর এ ক্ষেত্রে তিনি এলিয়টের কবিতাকেই বিশেষ করে বেছে নিয়েছিলেন। এর থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়ার পর্বের টালমাটাল পথ চলার ছবিটিও বেশ ফুটে ওঠে। ‘জার্নি অব দি মেজাই’ কবিতাটির প্রথম স্তবকের তিনটি পাঠ যথাক্রমে নিচে তুলে ধরা হলো। সমগ্র কবিতা ধরলে পাঠান্তরের অমিল আরো বেশি করে চোখে পড়বে।

ক. বিষ্ণু দে-কৃত অনুবাদ :

‘আমাদের সে যাত্রা হিমে
বছরের সবচেয়ে খারাপ সময়ে
অভিযান ওরকম দীর্ঘ অভিযান :
পথঘাট কাদায় গভীর ক্ষুরধার হাওয়া
দুর্গম পথ, শীতের চরম।
আর উটগুলি উত্ত্যক্ত, খুরে ঘা, তেরছা মেজাজ
থেকে থেকে শুয়ে পড়ে গলন্ত বরফে।’
খ. বিষ্ণু দে-কে প্রেরিত রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক সংশোধিত পাঠ :
‘শীতরুক্ষ আমাদের যাত্রা,
ভ্রমণ দূরদেশের দিকে।
অত দীর্ঘ ভ্রমণের সময় এ তো নয় একেবারেই।
পথ দুর্গম, বাতাস ক্ষুরের মত শান দেওয়া
কনকনে শীত।
উটগুলো হয়রান, পায়ে ক্ষত, বিরক্ত বিমুখ, তারা
গলে-পড়া বরফে শুয়ে শুয়ে পড়ে।’
গ. সুধীন্দ্রনাথের ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-কৃত অনুবাদের উদ্ৃব্দতি :
‘কনকনে ঠাণ্ডায় হল আমাদের যাত্রা-
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সবচেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
উটগুলোর ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা মেজাজ চড়া,
তারা শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।’
ঘ. ‘পরিচয়’ পত্রিকায় (মাঘ-১৩৩৯), প্রকাশিত [ও ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘তীর্থযাত্রী’ নামে অন্তর্ভুক্ত] রবীন্দ্রনাথ-কৃত এলিয়টের অনুবাদ :

‘কন্‌কন্‌ে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা-
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো
শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।’
তবে ‘পুনশ্চ’ কাব্যে এলিয়টের কবিতা যে ‘তীর্থযাত্রী’ শিরোনামে অনূদিত হয়ে সমমানে স্থান পেল তা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। যে বছর পুনশ্চ প্রকাশ পায়, সে বছরই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রবন্ধ ‘আধুনিক কাব্য’ (১৯৩২)। সেখানে রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রুফ্রক’ (১৯১৭) থেকে দীর্ঘ উদ্ৃব্দতি দিচ্ছেন আধুনিক (গদ্য) কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্য। কোন বিষয়ই আর কবিতার ত্রিসীমার বাইরে থাকছে না- এটি বোঝাতে তিনি এলিয়টকেই বেছে নিয়েছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে :

‘কেউ সুন্দর, কেউ অসুন্দর; কেউ কাজের, কেউ অকাজের; কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ছুতোয় কাউকে বাতিল করে দেওয়া অসম্ভব। সাহিত্যে, চিত্রকলাতেও সেইরকম। কোনো রূপের সৃষ্টি যদি হয়ে তাকে তো আর কোনো জবাবদিহি নেই; যদি না হয়ে থাকে, যদি তার সত্তার জোর না থাকে, শুধু থাকে ভাবলালিত্য, তা হলে সেটা বর্জনীয়। এইজন্য আজকের দিনে যে সাহিত্য আধুনিকের ধর্ম মেনেছে, সে সাবেককালের কৌলীন্যের লক্ষণ সাবধানে মিলিয়ে জাত বাঁচিয়ে চলাকে অবজ্ঞা করে, তার বাছবিচার নেই। এলিয়টের কাব্য এইরকম হালের কাব্য, ব্রিজেসের কাব্য তা নয়।’

[ক্রমশ]

এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

নতুন প্রসঙ্গ

পর্ব ::২৩

১. টি.এস. এলিয়ট : আধুনিক ধারার পথিকৃৎ

‘ভালবাসার সাম্পান’ বইতে ষাট-সত্তর দশকের কবিতার আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঘুরে-ফিরে বোদলেয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন। ষাটের দশকের শুরুতে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে ‘শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা’ প্রকাশের পর দুই বাংলাতেই কবিকুলের ওপরে ফরাসি প্রভাব ঘনীভূত হয়েছিল। অধ্যাপক সায়ীদ লিখেছেন :

‘পশ্চিম ইয়োরোপ আর আমেরিকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যসর্বস্ব রুগ্‌ণ ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতি ধারার… ঘুণেধরা ও বিকারগ্রস্ত প্রবণতাগুলো… আমাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকার বিটনিকদের প্রভাব পড়েছিল সরাসরি। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ সাহিত্যের অবক্ষয়ী ধারাটি হয়ে উঠেছিল আমাদের দোসর। তবে বাইরের যেসব অবক্ষয়ী প্রভাব আমাদের সাহিত্যিকভাবে আক্রান্ত করেছিল, তার মধ্যে আমার মনে হয়, সবচেয়ে সর্বাত্মক ও গভীর ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি কবি বোদলেয়ারের প্রভাব।’

এই বিবরণীতে কোথাও টি.এস. এলিয়টের উল্লেখ নেই। পরোক্ষভাবে, এক জায়গায় ‘ফাঁপা মানুষ’ কথাটার উল্লেখ রয়েছে, যা এলিয়টের ÔWe are the hollow menÕ’-এর প্রতি ইঙ্গিত। এটি কিছুটা বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না। তিরিশের যুগে রবীন্দ্রনাথের সাথে বুদ্ধদেব বসুদের যখন চিঠিপত্রে তর্কালাপ হচ্ছে আধুনিক বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি নিয়ে, তখন প্রথমেই যে-নামটি চলে এসেছে সেটি এলিয়টের নাম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের একাধিক কবিতার অনুবাদ করেছেন; সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘স্বগত’ গ্রন্থে এলিয়টকে নিয়ে উদ্ৃব্দতি-বহুল একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন; বিষ্ণু দে আলাদা করে প্রকাশ করেছেন ‘এলিঅটের কবিতা’ শীর্ষক অনূদিত কাব্যগ্রন্থ; জীবনানন্দ দাশের একাধিক প্রবন্ধে ঘুরে-ফিরে এসেছে এলিয়টের নাম। ওয়েস্টল্যান্ড ও ফোর কোয়ারটেটস্‌ যার হাত দিয়ে বেরিয়েছে তার সম্পর্কে ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে বিস্ময়কর নীরবতা কৌতূহলোদ্দীপক, সন্দেহ নেই। বিশেষত যদি মনে রাখি যে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংকট, অবক্ষয় ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে প্রবল প্রভাববিস্তারকারী কবিতা এলিয়টের হাত দিয়েই নিষ্ফ্ক্রান্ত হয়েছিল। এই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ইংরেজিতে লিখিত হওয়ার কারণে এলিয়টের অনেক কবিতাই বা কবিতার নানা বিচ্ছিন্ন পঙ্‌ক্তিমালাই পাঠকের মুখে মুখে ফিরত। বোদলেয়ারের ক্ষেত্রে যেটা সম্ভবপর ছিল না বুদ্ধদেব বসুর অনুপম অনুবাদের পরও।

আমরা যারা সত্তর দশকে এলিয়টের কবিতার নিমগ্ন পাঠক ছিলাম, তাদের কাছে এলিয়টের স্থান ছিল হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। ‘লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’ আমরা ঘরে-বাইরে আবৃত্তি করেছি :

‘Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherised upon a table’

অথবা,

‘In the room the women come and go
Talking of Michelangelo’

অথবা,

‘I grow old… I grow old…
I shall wear the bottoms of my trousers rolled.’

বা

‘There will be time to murder and create,
And time for all the works and days of hands
That lift and drop a question on your plate;
Time for you and time for me,
And time yet for a hundred indecisions,
And for a hundred visions and revisions,
Before the taking of a toast and tea’

এবং সবশেষে

ÔNo! I am not prince Hamlet, nor was meant to be;
Am an attendant lord, one that will do
To swell a progress, start a score or twoÕ

‘প্রুফ্রক’ লেখা হয়েছিল ১৯১৭ সালে- প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতরে। এই যুদ্ধের ধংসাবশেষের ওপরে ১৯২২ সালে লেখা হয় এলিয়টের সর্বাধিক পরিচিত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড।’ এই কাব্যগ্রন্থটিও আমাদের প্রজন্মের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আধুনিকতার জন্মই বলতে গেলে হয়েছিল ঐ বছরে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাস, হারমান হেস-এর সিদ্ধার্থ, এবং বরিস পাস্তারনাকের ‘মাই লাইফ সিস্টার’ (জীবন আমার বোন)। [ঐ বছরেই প্রকাশ পায় আইনস্টাইনের ‘দ্য মিনিং অব রিলেটিভিটি]। প্রুফ্রক আমাদের মুগ্ধ করেছিল ঠিক, কিন্তু ওয়েস্ট ল্যান্ড আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কবিতার মধ্যে নাটকীয় সংলাপ স্থাপনা, উক্তি ও পুনরুক্তি, আকস্মিক দার্শনিক স্বগত সংলাপ, ঘরের ও বাইরের পৃথিবীর মধ্যকার দেয়াল ভেঙে-পড়া, প্রথাগত মূল্যবোধের বিপর্যয়, ইতি ও নেতির দ্বন্দ্বে দীর্ণ শূন্য মানুষ, সভ্যতার সংকট- এই সবই ছিল সেখানে। এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে আধুনিকতার মৌলিক অনুভব হয়েছিল। পরপর কয়েকটি বহু-উদ্ৃব্দত লাইন নিচে তুলে ধরছি :

১. April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.

২. Unreal City,
Under the brown fog of a winter dawn,
A crowd flowed over London Bridge, so many.
I had not thought death had undone so many.

৩.‘My nerves are bad to-night. Yes, bad. Stay with me.’
‘Speak to me. Why do you never speak. Speak’
‘What are you thinking of? What thinking? What?’
‘I never know what you are thinking. Think.’

৪. I think we are in rats’ alley
Where the dead men lost their bones.

৫. ‘What shall I do now? What shall I do?’
‘I shall rush out as I am, and walk the street.’
‘With my hair down, so. what shall we do tomorrow? ‘What shall we ever do?’
The hot water at ten.
And if it rains, a closed car at four.
And we shall play a game of chess.
Pressing lidless eyes and waiting for a knock upon the door.

৬. When lovely woman stoops to folly and
Paces about her room again, alone.
She smoothes her hair with automatic hand.
And puts a record on the gramophone.

৭. Who is the third who walks always beside you?
… … … … … … …
I do not know whether a man or a woman
– But who is that on the other side of you?

১০. 10. London Bridge is falling down falling down falling down
… … … … … … …
These fragments I have shored against my ruins.
… … … … … … …
Datta. Dayadhvam. Damyata.
Shantih shantih shantih

কবি নিজে ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যগ্রন্থের জন্য পাদটীকা প্রস্তুত করেছিলেন। ওয়েস্ট ল্যান্ডের আদি খসড়ার সাথে প্রকাশিত পাঠের মধ্যে স্থানে স্থানে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছিল। কিছুটা কবি এজরা পাউন্ডের খুঁটিনাটি মন্তব্যের কারণে, কিছুটা কবির নিজের পুনর্চিন্তায়। কবি-কৃত পাদটীকার সংখ্যা ছিল ৪৩৩টি; কিন্তু তাতেও এই দীর্ঘ কবিতার সম্পূর্ণ উপলব্ধি হয় না। উনিশ বছর বয়সে যখন পাঠ করেছি, তখনও ওয়েস্ট ল্যান্ড হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, যদিও সমস্ত অনুষঙ্গ সে বয়সে করায়ত্ত হয়নি। একষট্টি বছরে যখন পাঠ করেছি, তখন অনেকটাই বুঝেছি যে কোন লাইনটা কোন বই থেকে বা কোন সাহিত্যিক প্রয়োজন মেটাতে লেখা, কিন্তু তারপরও রহস্য এতটুকু কমেনি। এ বই এলিয়টকে চূড়ান্ত খ্যাতি এনে দিয়েছিল- ইংরেজি আধুনিক কাব্য চর্চার জগতে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিল শীর্ষস্থানীয় আসনে। কিন্তু তারপরও কবির যাত্রা থেমে থাকেনি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে- লেখা হবে তার ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’; এর মধ্যকার ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস’ কবিতাটি হবে তার মহত্তম সৃষ্টি।

আমার মনে পড়ে, অগ্রজ অর্থনীতিবিদ (ও কবি) আবু আবদুল্লাহর প্রিয় কাব্যগ্রন্থের একটি ছিল এলিয়টের ফোর কোয়ারটেটস্‌। আবু আবদুল্লাহর কাব্যরুচির ওপরে আমার পূর্বাপর অগাধ নির্ভরতা ছিল। এই কাব্যগ্রন্থের থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক স্তবক ও পঙ্‌ক্তিমালা তার মুখে আবৃত্তি হতে শোনা গেছে। তার বড় ভাই অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার মত তিনিও ছিলেন কবিতার বড় সমজদার ও আবৃত্তিকার। আবু আবদুল্লাহ অনর্গল পড়ে যাচ্ছেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছি :

১১. Houses live and die : there is a time for building
And a time for living and for generation

১২. There is, it seems to us,
At best, only a limited value
In the knowledge derived from experience.
The knowledge imposes a pattern, and falsifies,
For the pattern is new in every moment
And every moment is a new and shocking
Valuation of all we have been.

১৩. So here I am, in the middle way, having had twenty years
Twenty years largely wasted …
Trying to learn to use words, and every attempt
Is a wholly new start, and a different kind of failure.

১৪. We shall not cease from exploration
And the end of all our exploring
Will be to arrive where we started
And know the place for the first time.

কবি হায়াৎ সাইফের সাথে আবু আবদুল্লাহর একটি যুগলবন্দি- এক মলাটে দুই জনের আলাদা আলাদা কবিতা সংবলিত কাব্যগ্রন্থ- বেরিয়েছিল, মনে পড়ে।

[ক্রমশ]