পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪১

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

এর কোনো কোনোটিতে পুত্র দেবেন্দ্রনাথকেও যুক্ত করেছিলেন দ্বারকানাথ, অর্থাৎ আত্মজীবনীতে এসব ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। তবু সেই স্বাভাবিক সুযোগটি নিতে চাননি দেবেন্দ্রনাথ। বিস্ময়ের কারণ এখানেই শেষ নয়। দেবেন্দ্রনাথ যা-ও বা কিছু উল্লেখ করেছেন পিতার (আপেক্ষিক নীরবতা সত্ত্বেও), কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলির বিপুলায়তন আত্মজৈবনিক অংশে (চিঠিপত্রসহ বলছি) একবারের জন্যে হলেও কোথাও কোনো উল্লেখ নেই দ্বারকানাথের। আমি কি ভুল বললাম, বা বাড়িয়ে বললাম? এই নিস্তব্ধতার কার্যকারণ সূত্র খুঁজে পাওয়া ভার। বা খুঁজে পাওয়া গেলেও- একটা তো প্রচলিত মত আছেই যে, দ্বারকানাথ অজস্র দায়-দেনার ভার ঠাকুরবাড়ির উত্তরাধিকারীদের ওপরে দিয়ে গেছেন- এর যৌক্তিকতার পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাময় বিকাশে যে বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিকতার ছায়া দেখতে পাই, সেই ছায়া বিশালদেহী দ্বারকানাথ ঠাকুরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অবচেতন মনে তিনি অস্বীকৃত অন্যজন- তার সত্তার ‘অপর’; তার এত কাছের মানুষ হয়েও যিনি সারাজীবন দূরলোকের নক্ষত্রের মতো অজ্ঞেয় ও রহস্যময় থেকে গেলেন। কেনসাল গ্রিনের নির্জন কবরস্থানের নির্জনতম স্থানে তার মরণোত্তর ছাইভস্ম সমাহিত করে রাখা হয়েছে। সেই সমাধির পরিচয়পত্রে দ্বারকানাথের নামোল্লেখ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই, রাবীন্দ্রিক সূত্রের উল্লেখ তো নেই-ই। না কোনো গানের লাইন, বা কোনো কবিতার চরণ উৎকীর্ণ হয়ে রয়েছে দ্বারকানাথের সমাধিতে। তার মধ্যেই সেদিন চোখে পড়েছিল কে বা কারা যেন রেখে গেছে- ততক্ষণে বাসি হয়ে যাওয়া- দুটি নাম-না-জানা ফুল। বিচিত্র এ মানবজীবন ও তার পরিণতি।

৪. কুই ব্রানলি মিউজিয়াম :আফ্রিকা ও পিকাসো

গান্ধীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আপনার মত কী?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্যাট উড বি এ গুড আইডিয়া।’ পাশ্চাত্যে সভ্যতা আসলে তো ভালোই হয়। আসলে ‘ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনে’র কথাটা এখনও পর্যন্ত কেবল ‘আইডিয়ার’ পর্যায়েই রয়ে গেছে। লুভর মিউজিয়াম দেখার পর কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এসে এই কথাটাই বারবার মনে এলো। স্বাভাবিকভাবেই ‘মোনালিসার ছবি’ দেখার জন্যে লুভর মিউজিয়ামে পর্যটকদের হুড়াহুড়ি। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সবাইকে- একটা ছবি অতি দ্রুত সেলফিতে তুলেই বা ক্যামেরাবন্দি করেই লাইন ধরে এগিয়ে যেতে হবে পরের জনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্যে। লুভর-এ মোনালিসা ছাড়াও আরও অনেক কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে। বিশেষ করে গ্রিক রোমান আর্টের নিদর্শন ছড়ানো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার কোনো শিল্পকলা লুভর-এর মতো ‘মেইনস্ট্রিম’ মিউজিয়ামে নেই। একসময় ছিল সেগুলো- বেসমেন্টে- ‘মাইনাস-১’ ফ্লোরে। সে নিয়ে সমালোচনা ওঠায় শেষ পর্যন্ত যেসব শিল্পকলা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্যত্র। তার মধ্যে যেগুলো পাশ্চাত্যের চোখে ‘প্রিমিটিভ আর্ট’ রূপে অভিহিত, তাদের এক জায়গায় জড়ো করে তৈরি হয়েছে ‘কুই ব্রানলি’ মিউজিয়াম। প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাকের নামে হয়েছে এই জাদুঘর- তিনি এসব ‘প্রিমিটিভ আর্টের’ সংগ্রাহক ও গুণগ্রাহী ছিলেন এ কথা মনে করে।

লুভর মিউজিয়ামের সামনে পাগল-করা যে ভিড়, তার লেশমাত্র নেই কুই ব্রানলিতে। সুনসান নিস্তব্ধতা সেখানে বিরাজ করছে। টিকিট কাটার সময় বললাম, ‘অনেক আশা নিয়ে এসেছি এখানে। অনেক গল্প শুনেছি এই মিউজিয়াম নিয়ে।’ বিক্রেতা এক ফরাসি তরুণ। হেসে বললেন, ‘আমরা যারা এখানে কাজ করি, তারাও খুব গর্বিত এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে।’ আসলে এখানে না এলে ‘আধুনিক’ চিত্রকলার জন্মের ইতিহাস আড়ালেই থেকে যেত। পাশ্চাত্যের কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট এবং সুররিয়ালিস্ট চিত্রকলার সূতিকাগার হলো আফ্রিকা-পলিনেশিয়া-লাতিন আমেরিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ বা ‘আদিম’ চিত্রকলা। এ জিনিস এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না! বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, আফ্রিকার ‘ট্রাইবাল’ আর্টের কথা। এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পানেননি পিকাসো, মাতিস, ব্রাক, পল ক্লী, মডিলিয়ানি প্রমুখ। প্রকৃতপক্ষে কে নয়? তৃতীয় বিশ্বের ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘ট্রাইবাল’ আর্টের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি কাজিমির মালেভিচ, মার্ক শাগাল, সালভাদর ডালি, এর্নস্ট কিরশ্‌নের (kirchner), এমিল নলডে (Nolde), ‘আর্ট ব্রুট’ আন্দোলনের জঁ দুবুফে (Dubuffet), এমনকি ভাসিলি কান্ডিনস্কী ও জোসেফ এলবার্স। এই প্রভাবের গভীরতা এত ব্যাপক, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে- এতসব প্রভাব বিস্তারের পরও আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার লোকশিল্পকে এখনও কেন ‘প্রিমিটিভ’ এবং ‘ট্রাইবাল’ আর্ট বা আর্ট-ফর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছে? কেন এসব শিল্পকর্মকে ‘আধুনিক’ শিল্পকলার অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে না?

এর কারণ দার্শনিক ও রাজনৈতিক। পৌলমি সাহা তার ‘এন এমপায়ার অব টাচ্‌’ বইতে যোগ করেন এক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য। ১৯৩১ সালের মে মাসে মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। এই উপলক্ষে গিরীন্দ্রশেখর বোসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান সাইকোএনালাইটেকাল সোসাইটি হাতির দাঁতের করা একটি ৯ ইঞ্চির বিষ্ণুমূর্তি তাকে উপহার দেয়। এর আগে গিরীন্দ্রশেখর এবং ফ্রয়েডের মধ্যে বিশ বছর ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটি পেয়ে ফ্রয়েড গিরীন্দ্রশেখরকে লেখেন :

যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি এই উপহারটিকে সানন্দে ‘উপভোগ’ করব। এটি আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মনঃসমীক্ষণ ছড়িয়ে পড়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে : ‘The statuette is charming. I gave it the place of honor on my desk. As long as I can enjoy life it will recall to my mind the progress of psychoanalysis, the proud conquest it has made in foreign countries and the kind of feelings for me it has aroused in some of my contemporaries at least.’ উদ্ধৃত অংশের মধ্যে উপহার প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাপূর্ণ স্বীকৃতি আছে। কিন্তু আমার খটকা লেগেছিল ‘ঢ়ৎড়ঁফ পড়হয়ঁবংঃ’ শব্দবন্ধের ব্যবহারে। ফ্রয়েড-গিরিন্দ্রশেখরের পত্রালাপ থেকে এটা নিশ্চিত যে, বিনিময় হচ্ছিল শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে নয়। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণের বিপরীতে গিরীন্দ্রশেখর একটি ভিন্ন ধরনের মনোবীক্ষণের- তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি’র সম্ভাবনা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণ বিদ্যাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমীক্ষণ বিদ্যা, এটা গিরীন্দ্রশেখর মনে করতেন না। ফ্রয়েড-পরবর্তী মনঃসমীক্ষণ বিদ্যায় গিরীন্দ্রশেখরের যথাযথ স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী এ নিয়ে বেশকিছু কাল আগে একটি চমকপ্রদ শিরোনামে বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য স্যাভেজ ফ্রয়েড’। সেখানে ট্রাডিশন ও মডার্নিটিকে একই সত্তার মধ্যে বিচরণ করতে দেখা যায়। সত্যজিৎ রায় ট্রাডিশনটি প্রকাশ করেন তার সিনেমার মাধ্যমে; আর মডার্নিটিকে প্রকাশ করেন তার ‘ডিটেকটিভ’ গল্পের মাধ্যমে। কিন্তু ‘সত্তার বিভক্তি’ এখানে আমার আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে আমি শুধু লক্ষ্য করব যে, নন্দী দেখিয়েছেন, কীভাবে ফ্রয়েড পাশ্চাত্যের তথাকথিত মডার্নিটি বা সিভিলাইজেশনকে আক্রমণ করেছেন। মানবিক উদ্বেগ, অবসাদ, কামনা-বাসনা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রকারান্তরে আঘাত করেছেন বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী এনলাইটেনমেন্টের ঐতিহ্যকে। ফ্রয়েড কখনও বেকন বা হবসের মতো মানুষকে ‘বৈজ্ঞানিক মানব’ হিসেবে দেখেননি। এ জন্যে তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে পাশ্চাত্যে। নন্দীর কথা হলো, এই একই যুক্তিতে তৃতীয় বিশ্বের বা ভারতবর্ষের ঐতিহ্য-সংলগ্নতা, কোমলচিত্ততা ও যুক্তি-রহিত মরমিবাদকে পাশ্চাত্যের চোখে ঠেকেছে বর্বর বা স্যাভেজ প্রথা বলে। এই একই যুক্তিতে গিরীন্দ্রশেখর ও তার মনোবিদ্যাকেও ‘স্যাভেজ’ বলা হবে। নন্দীর যুক্তি হচ্ছে, পাশ্চাত্যের অতিশয় বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রযুক্তি ও যুক্তির প্রভাব তার মানবিক চরিত্রে নানা উপসর্গের সৃষ্টি করেছে। ফ্রয়েড তার ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মনোবিকলন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামাজিক উপসর্গে পরিণত হচ্ছে। প্রাচ্যের বিশ্বাস-নির্ভর ঐতিহ্যকে পাশ্চাত্যের যুক্তি-নির্ভর ঐতিহ্যের একটি সমালোচনা হিসেবে দেখেছেন নন্দী। অর্থাৎ, ‘স্যাভেজ ফ্রয়েড’ এই শিরোনামের মাধ্যমে নন্দী দেখাচ্ছেন যে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকেই একমাত্র ‘সভ্যতা’ বলে জ্ঞান করা যায় না। বিশ্বাসের ঐতিহ্যের মধ্যেও ‘সভ্যতা’ আবিস্কৃত হতে পারে। কে সভ্য, আর কে অসভ্য তা ঠিক করার ভার পাশ্চাত্যকে কেউ দেয়নি। উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল আফ্রিকার অধিবাসীদের ‘স্যাভেজ’ বলেছিলেন। তাই যদি হবে, তাহলে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট পিকাসোর মতো শিল্পীর আধুনিকতম চিত্রকলাকে প্রভাবিত করে কী করে? বা পলিনেশীয় আর্ট কীভাবে আচ্ছন্ন করে পল গগাঁকে? বা নর্থ আফ্রিকা ও মেডেটেরিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতি কী করে প্রভাব বিস্তার করে সেজান ও মাতিসের ওপরে? বা পল ক্লী-র জ্যামিতির মধ্যে কী করে আমরা খুঁজে পাই সাহারা অঞ্চলের ইন্ট্রিকেট আঁকিবুঁকি? ফ্রয়েড-গিরীন্দ্রশেখরের মনোবিকলন আধো-ঘুমে আধো-জাগরণে কী করে স্থান করে নেয় সুররিয়ালিস্ট চিত্রকর্মে? আন্দ্রে ব্রেতো, ডালি, মেক্সিকোর তামায়ো (Tamayo) বা কিউবার উইলফ্রেডো লাম (Wilfred lam) এরা সবাই ‘প্রিমিটিভ’-এর কাছে ঋণী। সে ক্ষেত্রে প্রিমিটিভই তো আধুনিক চিত্রকর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাই নয় কি?

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪০

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

ইউরোপ যা কিছু করে দেখিয়েছে তাকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, তাকে আমরা উচ্চ মূল্যায়ন করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভারতবর্ষ যা তৈরি করেছে তাকে আমরা পরিত্যাজ্য বলে ভাবব। আমরা যেমন তোমাদের বিষয়ে করি, সেভাবে তোমরা যদি আমাদের সংগীতকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে, তাহলে দেখতে তোমাদের সংগীতে যেমন, আমাদের সংগীতেও সুরের, ছন্দের, তালের কোনো কিছুরই কমতি নেই। আর তোমরা যদি আমাদের কবিতা, আমাদের ধর্ম, আমাদের দর্শন নিয়ে চর্চা করতে তাহলে দেখতে পেতে যে তোমরা যা ভাবছ সেরকম কোনো বর্বর বা তস্কর কোনোটাই আমরা নই। আমরা ততটুকুই জানি, আমাদের কাছে ততটুকুই অজ্ঞেয়, যতটুকু তোমরা জানো বা তোমাদের কাছে যা অজ্ঞেয়। হয়তো অজ্ঞেয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা তোমাদের চেয়ে আরেকটু গভীরতর।’

দ্বারকানাথের মর্মদাহ ম্যাক্সমুলার সম্ভবত শেষ বয়সে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তা নইলে কথাগুলো এত সবিস্তারে তার স্মৃতিচারণায় তিনি উল্লেখ করার তাড়না অনুভব করবেন কেন? তার স্মৃতিচারণামূলক বইটি প্রকাশ পায় ১৮৯৯ সালে। এর পরের বছরই ম্যাক্সমুলারের মৃত্যু হয়। ততদিনে উপনিবেশের শাসন-শোষণ আরও বর্বরতর হয়েছে আফ্রিকায়, আর সূক্ষ্ণতর হয়েছে এশিয়ায় বা এই উপমহাদেশে। এক কথায়, ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন আরও নির্দয় হয়েছে বিশ্বব্যাপী। উপনিবেশ দখলের ও ভাগবাটোয়ারার লড়াই আরও তীব্র হয়েছে ১৯০০ সালের পরবর্তী পৃথিবীতে। এ সময়েই রবীন্দ্রনাথ লিখবেন ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের প্রফেটিক পঙ্‌ক্তিমালা : ‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে / অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে/ অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী/ ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী/ তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে/ গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।’ পদ্মাপাড়ের নির্জন ভুবনে ঢুকে পড়েছে ঔপনিবেশিক রূঢ় বাস্তবতা।

দ্বারকানাথের মুখ দিয়ে যদিও বলানো হচ্ছে কিন্তু কথাগুলো ততদিনে ম্যাক্সমুলারেরও বলার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং সেই কথাগুলো তিনি বলেছেন যুধ্যমান পাশ্চাত্যকে। শুধু নিজের জানাই জানা নয়, অপরের জানাও জানা। আধুনিকতার ঐতিহ্যের প্রতি সবারই অধিকার কি প্রাচ্যের, কি পাশ্চাত্যের। শুধু পাশ্চাত্য জ্ঞানের আহরণ করবে, আর আমরা কেবল তার ক্রমাগত ভোগ করে চিরস্থায়ীভাবে ঋণী থেকে যাব- এরকম অসম-সম্পর্কে দ্বারকানাথের আস্থা ছিল না। পাশ্চাত্যকে অস্বীকার যেমন করব না, তেমনি প্রাচ্যকেও অস্বীকৃতির অপমানে থাকতে দেব না। দ্বারকানাথের ক্ষোভমিশ্রিত তিরস্কার বাণী বহুকাল পর্যন্ত শেল হয়ে বেজেছে ম্যাক্সমুলারের বুকে। তিনি শেষাবধি স্বীকার করেছেন : ‘He was not far wrong’- দ্বারকানাথ সেদিন ১৮৪৪ সালের প্যারিসে বসে তাহলে খুব একটা ভুল বলেননি!

বিত্তবৈভবের মধ্যে দিন কাটালেও দ্বারকানাথের জীবনের শেষ বছরগুলো অর্থনৈতিকভাবে সুখের ছিল না। কিন্তু পতনের দিকটি তিনি যথাসম্ভব আড়ালেই রেখেছিলেন। শুধু ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ নন, ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গেও তার সখ্য হয়েছিল। ১৮৪২ সালে যখন তিনি নিজের জাহাজে করে লন্ডনে যান, ততদিনে ইংল্যান্ডের রানী হয়েছেন তরুণী ভিক্টোরিয়া। ১৮৩৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া রানী হিসেবে অভিষিক্ত হন। ইংল্যান্ডে পা রাখার পরপরই দ্বারকানাথের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হন রানী। ২৩ বছর বয়সী সম্রাজ্ঞীর মনে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আসা বিদেশি দ্বারকানাথকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। রানী তাকে তার ব্যক্তিগত প্রতিকৃতি সম্বলিত মোড়ক উপহার দেন। তবে দুর্ভাগ্য, ১৮৪৫ সালে দ্বারকানাথের ব্যবসায় এক দুর্বিপাক নেমে আসে। ১৮৪৭ সালের স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের ফলে তার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। এই ১৮৪৫-৪৭ পর্বে বিশ্বজোড়াই মন্দা নেমে এসেছিল। তখনও ‘লিমিটেড কোম্পানি’ আইন প্রবর্তিত হয়নি ইউরোপে বা ভারতবর্ষে। এর ফলে অনেক উদ্যোক্তা, শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী দেউলিয়াত্ব বরণ করেন। হয়তো এই অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাবেই দ্বারকানাথ লন্ডনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং ১৮৪৬ সালে তার মৃত্যু হয়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে দ্বারকানাথ তারা বন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের স্মরণে ব্রিস্টল শহরে তার কবরের ওপরে একটি সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। তবে তিনি নিজেও যে ইংল্যান্ডের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন- এ কথা হয়তো কখনও ভাবেননি। আমি যখন ২০১২ সালে লন্ডনের ‘কেনসাল গ্রিন’ কবরস্থানে দ্বারকানাথের সমাধি দেখতে যাই, তখন বারবার এ কথা মনে হয়েছিল আমাদের দেশের আধুনিকতার দুই পথিকৃৎ বিদেশের মাটির নির্জনেই থেকে গেলেন।

দ্বারকানাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষে আধুনিক কয়লা খনির ব্যবসা তার হাত দিয়েই শুরু; আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবসায় তিনি সেকালের বাঙালি-ভারতীয়দের মধ্যে অগ্রগণ্য; দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাষ্পচালিত স্টিমার ও আন্তঃমহাদেশীয় জাহাজ খাতেও তার স্থান সবার ওপরে। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা। সংগীতে তার অনন্যসাধারণ দখল ছিল। ভারতীয় রাগ-সংগীতের বিষয়ে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, গণিতের ক্ষেত্রে শূন্যের অবদান যেমন যুগান্তকারী, তেমনি ‘সংগীত-রত্নাকর’-এর মতো ‘ট্রেজারি অব সিম্ম্ফোনি’ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ইতিহাসেই এক অতি বিরল সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের সংগীতকলা হয়তো প্রাচ্যের সংগীতকলার কাছেই ঋণী। দ্বারকানাথের যুক্তি আমতা আমতা করে মেনে নিচ্ছেন বা অনেকটাই স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন জার্মানির এই তরুণ সংস্কৃতজ্ঞ। ম্যাক্সমুলার বলছেন, পাশ্চাত্যকে এ রকম ঋণ স্বীকার করতে হতেই পারে একদিন। সংগীতের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়াটাও আদৌ বিচিত্র নয় : ‘In itself such a borrowing has nothing incredible in it, for we know that our figures, not excluding the naught, traveled on the same road, from the Indian to the Persians, the Arabs, the Spaniards, and the Italians’, এবং এটুকু বলে তার দ্বিধার জায়গাটুকু স্পষ্ট করছেন : “ভারতীয় সংগীতের ‘সা রে গা মা পা ধা নি’- এই সাতটি ‘নোট’ যে কালক্রমে ইতালীয় সংগীতে এসে ‘দো রে মি ফা সল লা সি’ ধারার সাতটি ‘নোটে’ পর্যবসিত হয়েছে, তার জন্য আরও ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দিতে হবে।” যেন দ্বারকানাথকে খণ্ডন করার জন্যই বলছেন : ‘শূন্যের আবিস্কারের জন্য ওই মহান দেশটির প্রতি গণিতবিদ মাত্রেরই অপার কৃতজ্ঞতা রয়ে গেছে। শূন্যের এই আবিস্কার গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় আবিস্কারের একটি। পাশ্চাত্যের প্রতি এটা প্রাচ্যের দান, সন্দেহ নেই। তবে বিঠোফেনের সিম্ম্ফোনির পেছনে ভারতীয় [সংগীত-রত্নাকরের] দান রয়েছে কি-না তার উত্তরের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

এই তর্কালাপের সত্য-মিথ্যা, তথ্য বা তত্ত্ব আলোচনা করা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু কথাগুলো উঠেছে দ্বারকানাথের সঙ্গে ম্যাক্সমুলারের সংগীত নিয়ে বাহাসের সূত্রে, সেটাই আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া। ম্যাক্সমুলার যখন মারা যান, তখন তার কাছে তরুণ রবীন্দ্রনাথ প্রায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তিত্ব। তার স্মৃতিচারণায় রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ নেই। অথচ তার মৃত্যুর ১৩ বছর পরেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবেন। দ্বারকানাথের সংগীত-প্রতিভা তার কনিষ্ঠতম নাতির মধ্যে বহুগুণে লালিত হয়ে বিকশিত হবে। ম্যাক্সমুলারের অবশ্য সেই পরিচয় পাওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু দ্বারকানাথ-ম্যাক্সমুলারের আলাপের অংশবিশেষ শোনার পর রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর উত্থান আর অতটা বিস্ময়কর ঠেকে না আমাদের কাছে।

তবে একটি কথা না বললেই নয়। যে প্রসঙ্গ আগেই তোলা উচিত ছিল সম্ভবত, সেই ‘রুমের ভেতরের বড় হাতিটার’ [বিগ এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম] কথাই বেমালুম ভুলে ছিলাম। দেবেন্দ্রনাথ আত্মজীবনীতে তার বাবা দ্বারকানাথের দুই-তিনবার উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনা থেকে পিতার প্রতি উচ্ছ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় না; তবে নিষ্ঠাবান বড় ছেলের দায়িত্ববোধের একটা ছবি ফুটে ওঠে। এর বেশি কিছু নয়। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। কোন কার্য্যোপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিবার জন্য আমাকেই বাড়ী বাড়ী যাইতে হইত।’ অথবা অন্যত্র বলেছেন, ‘শৈশবকাল অবধি আমার রামমোহন রায়ের সহিত সংশ্রব। আমি তাহার স্কুলে পড়িতাম। তখন আরও ভাল স্কুল ছিল… কিন্তু আমার পিতা রামমোহন রায়ের অনুরোধে আমাকে ঐ স্কুলে দেন।’ এসব বিবরণে কচিৎ-কদাচিৎ দ্বারকানাথের প্রসঙ্গ চলে এলেও তার সঙ্গে সম্পর্কের অতিরিক্ত কোনো ঘটনা, সংলাপ বা মানবিক আদান-প্রদানের মুহূর্ত দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীতে নেই। রামমোহন রায়কে নিয়ে একটি গোটা পরিচ্ছেদ লেখা হয়েছে। তার স্বর্গত দিদিমা অলকা সুন্দরীর সঙ্গে মধুর সম্পর্কের বিবরণী তার আত্মজীবনীর শুরু; তার আধ্যাত্মিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের চমৎকার উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু কোথাও দ্বারকানাথের সশরীরী উপস্থিতি নেই। যেন তার কোনো পারিবারিক জীবন ছিল না, যেন পুরোটাই তিনি ছিলেন ‘বাইরের জগতের মানুষ’।

অথচ বহির্বিশ্ব তাকে কী চোখে দেখত তার সামান্য পরিচয় আমি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা ‘দানবীর’, ‘দয়ার সাগর’ ইত্যাদি অভিধা প্রয়োগ করি হাজী মুহম্মদ মহসীন বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে। কিন্তু অন্য সব গুণের বা অর্জনের কথা বাদ দিলেও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা দানের প্রশ্নে দ্বারকানাথের তুলনা সেকালে (এবং একালেও) খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। দ্বারকানাথ অপব্যয়ী ছিলেন না- উদ্যোক্তা ছিলেন। কিন্তু উদ্যোক্তা হয়েও সামাজিক দায়বদ্ধতা সারাজীবন নীরবেই পালন করে এসেছেন। এ নিয়ে ঢাকঢোল পেটানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথের বিলাতযাত্রার সময়ে (যেবার তিনি তরুণী সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন) তার দানশীলতার প্রশংসা করে ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকাটি যা লিখেছিল, তা আমাদের সবার জানা প্রয়োজন। পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থরক্ষা করত এবং ভারতীয়দের প্রতি সাধারণভাবে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ ও প্রচার করত। এহেন ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ যা লিখেছিল, তাতে করে দ্বারকানাথের একটি অনালোচিত দিক ফুটে ওঠে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি আমি তুলে ধরতে চাই :

‘To describe Dwarkanath’s public charities would be to enumerate every charitable institutions in Calcutta… Nor must we forget that he has taken lead in every institution, those to Christian Missionaries perhaps excepted, which has been established with a view to the improvement of the country; that he has been foremost in promoting education, more especially is fostering the Medical College, by the bestowal of prizes on the most successful students. He has not only therefore given largely but wisely.’ শেষের লাইনটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো।

কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরি- যা এখন ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ রূপে পরিচিত- প্রতিষ্ঠায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন দ্বারকানাথ। ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের দু’জন ছাত্রকে প্রতি বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষায় পাঠানো ও পড়ানোর সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনি বহন করেন। ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটিকে ১৮৩৮ সালের মূল্যে এক লাখ টাকা [দশ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং] দান করেন তিনি; এর কাজ ছিল দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সব অন্ধ-আঁতুড়দের সাহায্য করা।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৩. কলোনিয়াল এনকাউন্টার

প্যারিসে যে-ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে এসেছিলাম তার সঙ্গে কীভাবে যেন জড়িয়ে আছে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম। ১৮৪৪ সালে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে এই প্যারিসেই দেখা হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের। ম্যাক্সমুলার তখন প্যারিসে অবস্থান করছিলেন ঋজ্ঞ্বেদের পাণ্ডুলিপি ‘প্রস্তুত করার’ কাজে। স্মর্তব্য, ঋজ্ঞ্বেদের কোনো প্রকাশিত লিপি ছিল না এর আগে। যদিও হস্তাক্ষরে লিপিবদ্ধ বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি ছিল লন্ডন, বার্লিন ও প্যারিসে। সেসব থেকে সায়নের টীকা-ভাষ্যসহ একটি গ্রহণযোগ্য প্রকাশনার উদ্যোগ নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরই ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে নিয়োগ পান ম্যাক্সমুলার- প্রায় বিশ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি পুস্তকাকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ‘দ্য সেক্রেড বুকস্‌ অব দি ইস্ট’ শিরোনামে এই গ্রন্থমালা তারই পরিণতি। এর মধ্যে বেদের চার খণ্ড ও আঠাশটি উপনিষদ বিশেষভাবে ম্যাক্সমুলারের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত। এই কাজেরই সুবাদে তরুণ ম্যাক্সমুলার প্যারিসে গিয়েছিলেন ফরাসি প্রাচ্যবিদ অধ্যাপক বার্নফের (Burnof) বক্তৃতামালা শুনতে। কলেজ দ্য ফ্রান্স (College de France)-এ এই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন বার্নফ। এই সেই কলেজ দ্য ফ্রান্স, যেখানে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পড়াবেন আলথুসার, ফুকো ও দেরিদা। এখানে শুধু যোগ করি যে, প্রফেসর বার্নফের সঙ্গে দেখা করার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও। এবং বার্নফের সূত্রেই দ্বারকানাথের সঙ্গে পরিচিত হন ম্যাক্সমুলার। এ প্রসঙ্গে ম্যাক্সমুলার লিখেছেন :

“I was then attending Professor Burnouf’s lectures at the college de France, and as the Indian visitor had brought letters of introduction to that great French savant, I too was introduced to the Indian stranger, and soon came to know him well. He was the representative of one of the greatest and richest families in India.”

এই দ্বারকানাথ-ম্যাক্সমুলারের মধ্যকার প্যারিস-সাক্ষাৎকেই আমি বলছি ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’। কথাটা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের একটি লেখা থেকে ধার করা। যেটা তিনি লিখেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদের বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনির বিশ্নেষণ করতে গিয়ে। ১৮৪৪ সালের প্রায় সুদীর্ঘ ৫০ বছর পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথ সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তাকে উপনিবেশ শাসনের কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক ধরনের ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ ছাড়া অন্য কোনো অভিধায় অভিহিত করার কথা আমার মনে আসেনি। এই সাক্ষাৎকারে বাদ-প্রতিবাদ, যোগ-অভিযোগ, দ্বন্দ্ব-মধুরতা, ঐক্য ও অনৈক্য সব উপাদানকেই শনাক্ত করা যায়। উপরে যেখানে ইংরেজিতে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে এটা স্পষ্ট যে, দেখা হচ্ছে দুই স্বগোত্রীয় বা সতীর্থের মধ্যে নয়; সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে দ্বারকানাথের ‘বিদেশি’ ভাবমূর্তি- ‘দি ইন্ডিয়ান স্ট্রেঞ্জার’ উপাধি। একে বহিরাগত বা আউটসাইডার হিসেবেও অনুবাদ করা চলে। ‘আমারই মতো, কিন্তু আমাদের কেউ নয়’- এটাই হচ্ছে ম্যাক্সমুলারের চোখে দ্বারকানাথের প্রাথমিক পরিচয়। যে-ভারতবর্ষকে নিয়ে ম্যাক্সমুলার আজীবন গবেষণা করেছেন সেই ভারতবর্ষের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধির মধ্যে নিজেরই ‘অপর’ দেখছেন ম্যাক্সমুলার। দ্বারকানাথ তার কাছে একাধারে নিকটজন ও অন্যজন। এই ‘অপরায়নের’ কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, কেননা আমরা একটু পরেই দেখব, বুদ্ধিবৃত্তিতে পণ্ডিতপ্রবর ম্যাক্সমুলারের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই দ্বারকানাথ। এই ‘অপরায়নের’ মূল কারণ আসলে দুই ব্যক্তিসত্তার মধ্যে ‘ঔপনিবেশিক’ শাসক-শাসিতের ব্যবধান।

দ্বারকানাথ ঠাকুর যে কত বিষয়ে গুণান্বিত ছিলেন তা ম্যাক্সমুলারের সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকেও ফুটে ওঠে। তার ব্যবসা-বাণিজ্যে ঈর্ষণীয় সাফল্যের কথা অন্যত্র সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’-এর ২য় খণ্ডে ‘বাঙ্গালী শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণীর ইতিহাস’ প্রবন্ধে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুরকে তার আমলের শীর্ষস্থানীয় ‘বুর্জোয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। তার নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠান, উত্থান ও পতনের কিছু বিশ্নেষণও সেখানে রয়েছে। এর একটি তাৎপর্য যে, রবীন্দ্রনাথকে যারা কেবল ‘জমিদার’ (সেই অর্থে সামন্তবাদী) রবীন্দ্রনাথ হিসেবে দেখতে চান, তারা ভুল করেন। রবীন্দ্রনাথের অভ্যুদয়ের পেছনে দ্বারকানাথের ‘বুর্জোয়া’ সত্তা সক্রিয় পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে। ঠাকুরবাড়ির মডার্নিটিকে বুঝতে গেলে দ্বারকানাথের জীবন ও চিন্তাভাবনাকে আমাদের সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করতে হবে। হয়তো নতুনভাবে তার মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু এখানে আমি দ্বারকানাথের অর্থনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত দিতে বসিনি। যারা উৎসাহী তারা কৃষ্ণ কৃপালিনীর ‘দ্বারকানাথ টেগোর : আ ফরগটেন পাইওনিয়ার’ এই প্রায়-বিস্মৃত বইটি দেখতে পারেন। প্যারিসে বসে ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথকে- তার কাছের কিন্তু দূরভুবনের ‘অপরকে’- কীভাবে দেখছেন তার প্রতিই আমি এখানে কেবল দৃষ্টি দেব।

পরস্পর মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে দু’জনের বয়সটাও আমলে আনা প্রয়োজন। ১৮৪৪ সালে দ্বারকানাথের বয়স ছিল ৫০, আর ম্যাক্সমুলারের ২৩। ফলে আলোচনাটি সমকক্ষ সমবয়সীদের মধ্যে হয়নি। তরুণ ম্যাক্সমুলারকে উপনিবেশের প্রতি পাশ্চাত্যের আচরণ বিষয়ে বেশ কিছু কথা- কিছুটা অনুযোগ, কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই- জানিয়েছেন দ্বারকানাথ। তার নিজের জীবনে ইউরোপকে যেমনভাবে চিনেছিলেন তারই নির্যাস ছিল সেসব তিরস্কারে। এই কথাবার্তার দু’বছরের মাথায় মৃত্যু হবে দ্বারকানাথের। ফলে শুধু কথার কথা নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে দ্বারকানাথের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার ‘সার-সংক্ষেপ’ হিসেবেও একে পড়া চলে।

প্রথমেই ম্যাক্সমুলার যেটা লক্ষ্য করছেন সেটা দ্বারকানাথের বিত্তবৈভব নয়- সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, সংগীত, সমসাময়িক ইউরোপীয় পত্রপত্রিকা ও রাজনীতির ওপরে তার বিস্ময়কর দখল। সংস্কৃতজ্ঞ ম্যাক্সমুলার বলেছেন, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ ছিলেন না ঠিক, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য-সম্ভার সম্পর্কে অপরিচিত ছিলেন না।’ প্যারিসের ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রান্স (Institute de France)- যাদের আমন্ত্রণে প্যারিসে যাই এবারে- সেখানকার অধ্যাপক বার্নফ সংস্কৃত ভাগবৎ-পুরাণের একটি চমকপ্রদ ফরাসি অনুবাদ করেছিলেন। সে বইটি বার্নফ দ্বারকানাথকে উপহার দেন। বইটির একদিকে ছিল মূল সংস্কৃত পাঠ, অন্যদিকে ফরাসিতে অনুবাদ। এর ফরাসি পাতার অংশে হাত বুলাতে বুলাতে দ্বারকানাথ বলেছিলেন, ‘আহ্‌, যদি আমি ভাষাটা আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারতাম।’ ম্যাক্সমুলার বলছেন যে সংস্কৃত ভাষা নয়, ‘আরও ভালোভাবে ফরাসি ভাষা জানার জন্য’ কতটা উৎসাহ ছিল তার। ম্যাক্সমুলার আরও লিখেছেন, তিনি প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে ‘স্কলার’ ছিলেন না বা ছিলেন না তার নিজের ধর্ম বা নিজের সাহিত্য যে-ভাষায় লেখা হয়েছে সে-সম্পর্কে মনোযোগী। কিন্তু যেইমাত্র অধ্যাপক বার্নফের থেকে তিনি শুনলেন যে ম্যাক্সমুলার বেদের পাণ্ডুলিপি সংকলন করছেন প্যারিসে বসেই, অমনি তার সব মনোযোগ গিয়ে পড়ল তরুণ গবেষকের প্রতি। প্যারিসে তিনি থাকতেন সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে। সেখানে তাকে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাতেন দ্বারকানাথ। ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্পর্কে, এর আচার-প্রথা সম্পর্কে গল্প করতেন তিনি। এতে ম্যাক্সমুলারেরও লাভ হতো। স্বয়ং ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সেই সভায় আমন্ত্রিত সব অতিথিকে রাজকীয় শাল উপহার দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। পরাধীন ভারতবর্ষের মান-সম্মান রাখার জন্যই তিনি এটা করেছিলেন। মাসে ২০০ পাউন্ডের বেতন নিয়ে কাজ করা ম্যাক্সমুলারের কাছে (যে-বেতনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীও কাজ করত না তখন) দ্বারকানাথের বৈভবপূর্ণ সাহচর্য নিশ্চয়ই অভাবনীয় ছিল। কিন্তু বিত্তবৈভব নয়, দ্বারকানাথের অন্যবিধ গুণের পর্যালোচনাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ম্যাক্সমুলারের স্মৃতিচারণায়। তবু দ্বারকানাথের অভিজাত শ্রেণিতে পদচারণার একটি উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ম্যাক্সমুলার লিখছেন :

‘Darkanath Tagore lived in a truly magnificent Oriental style while at Paris. The king, Louis Philippe, received him, nay, he honoured him, if I remember right, by his presence and that of his Court at a grand evening party. The room was hung with Indian shawls, then the height of ambition of every French lady. And what was their delight when the Indian Prince placed a shawl on the shoulders of each lady as she left the room!

দু’জনার মধ্যে আলোচনা ভালোই চলছিল ভারতীয় সাহিত্য, ধর্ম, কৃষ্টি ও সভ্যতা নিয়ে। গোল বাধল সংগীতের ক্ষেত্রে। দ্বারকানাথ পাশ্চাত্য কবিতা ও সংগীতের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে ইতালীয় ও ফরাসি সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছিল তার। ম্যাক্সমুলার লিখেছেন, ‘আমি পিয়ানো বাজাতাম, আর তিনি গান শোনাতেন। আমি দেখলাম, তার শুধু ভালো গানের গলা আছে তা-ই নয়, এ বিষয়ে তিনি খুব প্রশিক্ষিতও। গানের বিষয়ে আমাদের সম্পর্কটা খুব জমে উঠেছিল। একবার তার ইতালীয় গানের অনুরুক্তি নিয়ে প্রশংসা করার পর আমি তাকে অনুরোধ করলাম একটা খাঁটি ভারতীয় সংগীত শোনাতে। তিনি যেটা গাইলেন সেটা আসলে ভারতীয় নয়, ফার্সি একটি গান, যার মধ্যে না আছে স্টাইল, না আছে কোনো চরিত্র।’ সম্ভবত তাকে কোনো রাগপ্রধান উত্তর ভারতীয় (হিন্দুস্তানি) সংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তরুণ ম্যাক্সমুলার তাতে নিরস্ত হবার নন। “আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, অন্য কোনো ‘প্রকৃত’ ভারতীয় সংগীত তিনি জানেন কিনা। উত্তরে তিনি হাসলেন এবং পাশ কাটানোর মতো বললেন, ‘ও তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।’ আমি তারপরও অনুরোধ করতে থাকলে তিনি পিয়ানোতে গিয়ে বসলেন, কিছুক্ষণ গুনগুন করার পর বাজাতে শুরু করলেন এবং গান করতে লাগলেন। সত্যি বলতে কি, আমি সেদিন কিছুটা হোঁচটই খেয়েছিলাম। যা শুনলাম তাতে আমি না- পেলাম কোনো সুর, না-কোনো তাল, না-কোনো ছন্দ। সে কথা তাকে বলাতে তিনি বারবার অস্বীকারমূলক মাথা নাড়তে লাগলেন।” প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার অনৈক্যের মূল কোথায় তা জানার জন্য ম্যাক্সমুলারকে দ্বারকানাথ ঠাকুর সেদিন যা বলেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। দ্বারকানাথ তরুণ সংস্কৃতজ্ঞ ও প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সমুলারকে যা বলেছিলেন তা এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে উদ্ধৃত হতে পারত। দ্বারকানাথের বক্তব্য ম্যাক্সমুলারের বয়ানেই শোনা যাক এবারে :

‘তোমরা সবাই একই রকম। কোনো কিছু ঠেকলে বা সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের প্রীত না করলে, তোমরা মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নাও। আমি যখন প্রথম ইতালীয় সংগীত শুনি, আমার কাছে সেটা কোনো সংগীত বলেই মনে হয়নি। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, চেষ্টা করে গেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা আমার ভালো লাগছে বা তোমরা যাকে বলো সমজদার হওয়া সেভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। এই যেটা বললাম সেটা অন্য সব কিছুর জন্যও খাটে। তোমরা বলো যে আমাদের ধর্ম কোনো ধর্মই নয়, আমাদের কবিতা কোনো কবিতাই নয়, আমাদের দর্শন কোনো দর্শনই নয়।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

২. লোহানীর স্বীকৃতির প্রশ্ন

১৯৮৭ সালে ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যার জন্য লোহানীর ওপরে মতিউর রহমানের সঙ্গে মিলে আমি একটি পরিচিতিমূলক লেখা তৈরি করি। আশির দশকে বসে জানা সম্ভব ছিল না লোহানীর কোথায় এবং কীভাবে মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ মহাফেজখানার তরফে তখন যেটা জানানো হয়, সেটা হলো একটা ‘ওয়ান-ওয়ে টিকিট’ কেটে রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ২০০৩ সালে আলোকচিত্রী ডেভিড কিং ‘অর্ডিনারি সিটিজেনস :দ্য ভিকটিম অব স্টালিন’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। তিরিশের শুদ্ধি অভিযানের যুগে তৎকালীন সোভিয়েত পার্টির সদস্য এবং অসদস্য সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যারা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের নাম ও ছবি সংবলিত বই ছিল এটি। কিং-এর বইয়ের ১৩৫নং পাতায় হঠাৎই আবিস্কৃত হন লোহানী। যারা নেপথ্য কাহিনি জানেন না, তাদের পক্ষে বোঝা শক্ত যে, এই লোহানী আমাদেরই সিরাজগঞ্জের লোহানী। কেননা, সেখানেও তার পরিচিতি হিসেবে লেখা নিম্নরূপ :

‘১৮৯২ সালে ভারতে জন্ম। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।’

বিষণ্ণ সে পোর্ট্রেট। বোঝা যায় যে, এনকেভেদের (কেজিবির পূর্বসূরি) জেলে অত্যাচারের এক ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই যেন আর অবশিষ্ট নেই। এমনটাই লাগছে জিনোভিয়েভ-এর ছবিও। ১৯১৯ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত কমিনটার্নের চেয়ারম্যান জিনোভিয়েভ। স্টালিনের কীর্তির বিরুদ্ধাচরণের দায়ে তাকে ১৯২৭ সালে বহিস্কার করা হয়। ১৯৩৬ সালে শুদ্ধি অভিযানের প্রথম ধাপে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। ঠিক তারই দু’বছর পরে লোহানীর মৃত্যু হয়-ওই ফায়ারিং স্কোয়াডেই। জিনোভিয়েভ ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য- রাজনৈতিক মতপার্থক্য গুরুতর আকার ধারণ করেছিল ২০-এর দশকের শেষে। কিন্তু লোহানী তিরিশের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু তার মৃত্যু হলো কেন এমনভাবে? গোপেন চক্রবর্তীর মতো তিনিও তো অব্যাহতি পেয়ে যেতে পারতেন রুদ্ররোষ থেকে।

আমার অনুমান সেটা হয়নি দুই কারণে। প্রথমত, তিনি এমএন রায়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন একটা বড় সময় পর্যন্ত। ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব জাসেস’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এমএন রায়; কিন্তু প্যারিস থেকে সেটি প্রকাশ করার দায়িত্ব ছিল লোহানীরই ওপরে। প্যারিসের পাট গুটিয়ে এক সময় লোহানীকে চলে আসতে হয় মস্কোয়। ততদিনে এমএন রায়ের সঙ্গে সোভিয়েত পার্টির বিরোধ তুঙ্গে। বিশের দশকে চীনের প্রতি কমিনটার্নের নীতিনির্ধারণের নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিলেন রায়। এটা শেষ পর্যন্ত হটকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ট্রটক্সি-পন্থি ‘পারমানেন্ট রিভ্যুলিউশন’-র ধারার প্রতিও সহানুভূতি ছিল তার। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রটস্কি রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হন, প্রায় একই সময়ে এমএন রায়কেও কমিনটার্ন থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে ট্রটস্কি-এমএন রায়-লোহানী এমন একটি যোগসূত্র টানা বিচিত্র ছিল না এনকেভেদের গোয়েন্দাদের পক্ষে। বিশেষত ১৯৩৮ সালে এর দায়িত্ব যখন গিয়ে পড়ে ইয়েজভের ওপরে। ১৯৩৮-৪০ পর্বে ইয়েজভের হাতেই পরিচালিত হয় সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৩৪-৩৬ পর্বে ইয়াগোদার এনকেভেদে এবং ১৯৪০-৫৩ পর্বে বেরিয়া’র কেজিবির তুলনায় অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল ইয়েজভের এনকেভেদে। রুশ ভাষায় ইয়েজভের কাল বা ‘ইয়েজভশিনা’ নামে একটি প্রবাদবাক্যই চালু হয়ে গেছে নিষ্ঠুর শাসন বোঝাতে। ফলে এ সময়ে ট্রটস্কির বা এমএন রায়ের সঙ্গে কোনো প্রকার সুদূর বা নিকট সংশ্নিষ্টতাও লোহানীর জন্য চরম আশঙ্কার কারণ হতে পারত।

দ্বিতীয় একটি কারণও ক্রিয়াশীল ছিল। লোহানী ১৯২১ সালে মস্কোয় প্রথমবারের মতো আসার আগে বার্লিনে অবস্থান করছিলেন। বার্লিনে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি ‘গ্রুপ’ গড়ে উঠেছিল। বার্লিনে ১৯১৬-১৮ সাল থেকেই এরা জড়ো হতে থাকেন; তার কারণ- এখানে বিপ্লব-পরিস্থিতির সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের পর ইউরোপের সবচেয়ে সফল বিপ্লবের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বার্লিনে। এখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের সময় থেকেই। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের বেশিরভাগ নেতাই ছিলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ভেতরে বিপ্লব আশঙ্কা আরও তীব্র হতে থাকে। ‘স্পাটার্ক’ গ্রুপের নেতৃত্বে চলে আসেন কার্ল লিবক্‌নেখট, রোজা লুক্সেমবার্গ। এরা অক্টোবরের বিপ্লবের ধারায় ‘বিশ্ব-বিপ্লবকে’ সম্পন্ন করার স্বপ্ন দেখতেন। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি এ রকম একটি প্রায়-সফল অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কাইজারের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন কার্ল ও রোজা দু’জনেই। এই অভ্যুত্থানের পটভূমিকায় রচিত হয়েছে আলফ্রেড ডবলিনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বার্লিন আলেকজান্ডার প্লাজ’। বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাজ বা স্কয়ারের চারপাশে শ্রমজীবী মানুষের বসবাস (যেমন আমাদের একদার তেজগাঁও, টঙ্গী, ডেমরা বা হাল আমলের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল)। এই উপন্যাস কতটা মৌলিক ও চিত্তাকর্ষক তা বোঝানোর জন্য বলি যে, একে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তুলনা করেছেন জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের সঙ্গে; অন্যরা এর বর্ণনারীতির সঙ্গে প্রতিতুলনা করেছেন কাফকার বর্ণনারীতির। ২০০২ সালের এক জরিপে এই বইটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০টি বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (যা এখনও বাংলায় অনূদিত হয়নি)। এই আলেকজান্ডার প্লাজ-এর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের টানে লন্ডন ছেড়ে ১৯১৮ সালেই বার্লিনে চলে এসেছিলেন লোহানী। সেখানে এসে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের (সরোজিনী নাইডুর ভাই) বিপ্লবী গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৯ সালের কার্ল লিবক্‌নেখট ও রোজা লুক্সেমবুর্গের বিপ্লব-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এই জার্মান-গ্রুপ অন্যত্র সরে পড়তে বাধ্য হয়- প্রথমে প্যারিসে এবং পরে রাশিয়ায়। সেভাবেই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মস্কোয় আসেন লোহানী ১৯২১ সালে। তখনও তারা ‘কমিউনিস্ট’ হননি- তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল ব্রিটিশ-শাসন থেকে পরাধীন ভারতবর্ষকে মুক্ত করা। সে লক্ষ্যে নতুন রাশিয়ার সাহায্য কামনা করছিলেন তারা এবং সে কারণেই লেনিনের সঙ্গে তারা দেখা করতে চেয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভারতবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের একত্র করার জন্যই বার্লিন-কমিটির পত্তন হয়েছিল এবং বীরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বার্লিন গ্রুপ’ এ লক্ষ্যেই কাজ করছিল। ১৯২১ সালে লোহানী যখন মস্কোয়, তখন তিনি তিরিশের কোঠাও পার হননি।

বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘ক্যারিশম্যাটিক’ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ‘চ্যাট্টো’ নামে সবাই ডাকত তাকে। তিরিশের যুগে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর যাদেরই ‘জার্মান কানেকশন’ ছিল তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো রাশিয়ায়। কিরভের মৃত্যুর পর শুদ্ধি অভিযানের মাত্রা বেড়ে যায়। সর্বত্র জার্মান গুপ্তচর খুঁজতে থাকে এনকেভেদে। এরই ধারাবাহিকতায় বীরেন্দ্রনাথকে জার্মান গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তিনি ছিলেন একশো শতাংশ বিপ্লবী, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ‘লীগ এগেইনস্ট ইম্পেরিয়ালিজম’ আহূত ১৯২৭ সালের ব্রাসেলস কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন তিনি। যেখানে তরুণ নেহেরু অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩০-৩২-এর মধ্যে ‘ইনপ্রেকর’-এর পাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘অতি-বাম’ নীতির বিরুদ্ধে ২৮টির মতো প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন চীনের ভাবী প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কমিনটার্নের সেক্রেটারি-জেনারেল জর্জি ডিমিট্রভকে ১৯৩৫ সালে দুঃখ করে জানিয়ে ছিলেন যে, ‘কমিনটার্নের সক্রিয় কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’ তাকে। ত্রূক্রপস্কায়াকেও চিঠি লিখেছিলেন এই মর্মে। শেষের দিকে তার গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত। ক্লিমেন্স পাম ডাট (রজনী পাম ডাট-এর ভাই) লিখেছেন যে, চ্যাট্টোকে তিনি ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে লেনিনগ্রাদের একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর এথনোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে ‘শেষবার দেখেছিলেন’। এহেন বীরেন্দ্রনাথকে ১৯৩৭ সালের ১৫ জুলাই গ্রেপ্তার করা হলো ‘গণশত্রু’ অভিযোগে, কেননা তিনি জার্মানদের হয়ে ‘গুপ্তচর বৃত্তি করেছেন’। এই মিথ্যে অভিযোগে ১৯৩৭ সালের ৩১ আগস্ট মৃত্যু হলো তার ফায়ারিং স্কোয়াডে। সেই তালিকায় ছিলেন আরও ১৮৪ জন; এই নির্দেশে স্বাক্ষর করেন স্তালিন, মলোটভ, ভরশিলব, জদানভ ও কাগানোভিচ। চ্যাট্টো যখন চলে গেলেন, লোহানীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, তার ওপরেও এনকেভেদে-এর করাল ছায়া নেমে আসছে। যে কোনো অনুসন্ধানে চ্যাট্টোর কর্মকাণ্ডের ইতিহাস খুঁড়লেই লোহানীর নামও চলে আসবে। সে সময়ে লোহানীকেও নজরদারির মধ্যে থাকতে হতো। চ্যাট্টোকে কমিনটার্নের কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর লোহানীকেও ক্রমশ কমিনটার্নের বলয় থেকে সরিয়ে আনা হয়। তিনি কেবল মাঝে মাঝে অনুবাদের কাজ করতেন- ব্যাপারটা এই পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লোহানি গ্রেপ্তার হন ‘প্রতি-বিপ্লবী’ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। পাবনার সিরাজগঞ্জ থেকে মস্কোর লুবিয়ানকা জেল- এভাবেই নির্বাপিত হয় লোহানীর ৪৬ বছরের জীবন।

চ্যাট্টো মারা যাওয়ার প্রায় বিশ বছর পরে রাশিয়ায় সরকারি সফরে আসেন নেহেরু। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চান তিনি। কেজিবি মহলে (ততদিনে এনকেভেদে-র নতুন নাম কেজিবি) এই নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। তারই পরিণতিতে সোভিয়েত পার্টি স্বীকার করে নেয় যে, শুদ্ধি-অভিযানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন বীরেন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে অবনী মুখার্জীর নামও উঠে আসে। গুপ্তচরবৃত্তির সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ (Rehabilitation) করা হয় তাদের। কিন্তু সেই সনদপত্রে লোহানীর নাম ছিল না। পূর্ববঙ্গের লোহানীর কথা নেহেরুর কানে কেউ তোলেনি। শত শত অন্যায় মৃত্যুর মিছিলে লোহানীর নামও তখন সোভিয়েত নেতৃত্বের দৃষ্টি এড়িয়ে থাকবে। যদি স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী কখনও মস্কো সফরে যান, যদি তারা লোহানীর ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ চান, তবে তারা বর্তমান রাশিয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে লোহানীর বিষয়টি তুলতে পারেন। ঠিক যেমনভাবে ভিন্ন মতাদর্শের হয়েও নেহেরু ক্রুশেভের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুতিনের কাছে লোহানীর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন। তাহলে শুধু লোহানীর মরণোত্তর স্বীকৃতিই নয়, তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের দেখাও মিলতে পারে রাশিয়ার স্টেট হিস্টোরি আর্কাইভ থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় এটা আশা করাই যেতে পারে।

তবে বেসরকারিভাবে ‘মস্কো নিউজ’ একটি কাজ করেছিল। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে এটি প্রকাশিত হয়। সেখানে আরও কয়েকজন ভারতের বিপ্লবীদের সঙ্গে লোহানীর নামও উঠে আসে। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে তালাশ করতে গিয়ে রুশ ভাষার ইন্টারনেটে ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ (রাসত্রিয়েলনিয়ে স্পিসকি) পাই। এর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য, যেখানে লোহানী মস্কোর কোন সড়কের কোন বাড়িতে বাস করতেন এবং কোন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে সে তথ্যও দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫৭ সালেই তাকে ‘Rehabilitated’ করা হয়েছে সোভিয়েত রাষ্ট্রের তরফে- এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সংযোজন করা হয়েছে। তার মানে, সোভিয়েত বা রাশিয়ার সরকারের কাছে লোহানী তার সম্মান মরণোত্তরভাবে হলেও ফিরে পেয়েছেন। তাকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে বিস্মৃতির গর্ভ থেকে। শুধু আমাদের রাষ্ট্রের বা ইতিহাসের কাছেই তার যথাযথ পুনরুদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশের কাছে তিনি এখনও শুধু একটি নাম, শুধুই নাম। এখানে তিনি বিস্মৃতির অতলে ধূসর হয়ে আছেন অনাদরে-অবহেলায়। ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ থেকে পুরো উদ্ৃব্দতিটি অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি :

‘লুহানী গুলাম আম্বিয়া খান।

১৮৯২ সালে জন্ম, সিরাজগঞ্জ শহরে, রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির (বলসেভিক)-এর সদস্য; সোভিয়েত রেডিও-কমিটির অনুবাদক।

বাস করতেন :মস্কো বলশই ইওঝেনস্কি পেরুলক; হাউস ১৬/৬, ফ্ল্যাট ৩৬।

গ্রেপ্তার : ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।

অভিযুক্ত :১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর (‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউ. এস. এস. আর’ কর্তৃক অভিযুক্ত); অভিযোগ : গুপ্তচরবৃত্তি।

১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু।

কবর :মস্কো অঞ্চলের (অবলান্তের) ‘কম্যুনারকা’ গোরস্তান। ১৯৫৭ সালের ৯ জুলাই ‘রি-হেভিলিটেটেড’; ‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউএসএসআর-র আদেশ বলে।’

মানুষের জীবন এমনিতেই বিস্ময়কর। বিংশ শতকের বিপ্লবীদের জীবন আরও বিস্ময়কর। [ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৮

লোহানীর প্যারিস

অধ্যাপক ফিলিপ বেনোয়া আমার প্রায় সমবয়েসী। কৃত্তিবাস রামায়ণ নিয়ে মৌলিক গবেষণা রয়েছে তার। যে রামায়ণকে আমরা ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ’ বলে জানি, তার কোনো মূল পাঠ কোথাও পাওয়া যায়নি। ষোড়শ শতকের এই বাঙালি মহাকবি সম্পর্কে প্রায় কিছুই আমরা জানি না বলতে গেলে। ব্রিটিশরা এ দেশে আসার পরে শ্রীরামপুরের ডেনিশ মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় কৃত্তিবাসের রামায়ণ। সেটিই বাংলায় প্রকাশিত প্রথম বই। শুধুমাত্র এ কারণেই কৃত্তিবাস সম্পর্কে আমাদের আরেকটু উৎসাহী হওয়া দরকার। ষোড়শ শতকের পরের দুইশ’ বছরে কৃত্তিবাসের রচনার বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে পাঠের তারতম্য দেখা যায়। বেনোয়া জানালেন যে, এগুলোর মধ্যে কোনটা ‘মূল’, সেটা প্রমাণ করা কঠিন। রামায়ণের আদি-স্রষ্টা বাল্মীকির মতোই বাংলায় রামায়ণের স্রষ্টা কৃত্তিবাসের জীবন আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে অদ্যাবধি। বেনোয়া বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃত্তিবাসের রামায়ণের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্নেষণ করেছেন। তাকে প্রশ্ন করি, ‘কাশিরাম দাস নিয়ে কি কোনো কাজ হয়েছে?’ বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশিরাম দাস সম্পর্কেও কোনো গবেষণা কাজ হয়নি এখন পর্যন্ত- বেনোয়ার স্পষ্ট উত্তর। বুঝলাম, কৃত্তিবাসের রামায়ণ বা কাশিরাম দাসের মহাভারত এখনও রূপকথার জগতের মতো আমাদের স্মৃতিতে বা শ্রুতিতেই রয়ে গেছে কেবল। এখানেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য। ভারতে হিন্দুত্ব নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে। সেখানে হিন্দুত্ববাদীরা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মসীযুদ্ধ করছেন। কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করে চলেছেন পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা। সে নিয়েও আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অন্ত নেই। আমরা যত তাড়াতাড়ি এডোয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ পড়ে প্রাচ্যবিদদের কাজগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকি, তার সিকি ভাগ কষ্টও করতে চাই না নিজেদের সাহিত্য-ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে প্রাচ্যবিদদের মতো মৌলিক গবেষণা করার পেছনে। অধ্যাপক বেনোয়াকে দুই দশক ধরে সংস্কৃত পড়তে হয়েছে, তারপর তিনি ‘প্রাচ্যবিদ’ হয়েছেন। আমার মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, মধ্যযুগের বাংলা নিয়ে ভালো গবেষণা হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে দ্রুত। কেননা ‘এখনকার গবেষকেরা কেউ কষ্ট করে সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষা শিখতে শ্রম দিতে নারাজ।’

বেনোয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল প্যারিসে মেট্রো ‘বিবিলিওতেক নাসিওনাল’-এর কাছাকাছি একটি স্থানে। প্যারিসে এসে আমাকে জানতে হচ্ছে কৃত্তিবাস ও কাশিরাম দাসের কথা। এ ধরনের আলাপ তো ঢাকাতেও উত্তরার জসীম উদ্‌দীনের মোড়ে দাঁড়িয়ে হতে পারত। বেনোয়া শুধু কৃত্তিবাসই জানেন না, তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও খবর রাখেন। কথায় কথায় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা উঠল। বললাম, ‘রুদ্র আর আমি একই ক্লাসে একই কলেজে একই সময়ে পড়েছি। ও ছিল আর্টসের ছাত্র, আর আমি সায়েন্সে। ওর গোড়ার দিককার কবিতাগুলো লেখা হতো যখন, তখন থেকে আমার সঙ্গে পরিচয়। ‘তখন’ শব্দকে ‘তখোন’ করে লিখত। তাই নিয়ে সমালোচনা করতাম ওকে আমরা। নিজের কবিতা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা ছিল তার। তারপরও কবি হওয়ার জন্য মাঝ-দুপুরের রৌদ্রের ভেতরে সে ঝাঁকড়া চুল নিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে গেছে ঢাকার রাস্তায়।’ শুনে হাসলেন বেনোয়া। পরিস্কার বাংলায় বললেন, ‘রুদ্রর কবিতা আমি পড়েছি। ও খুবই শক্তিশালী কবি।’

সতেরো বছর পরে প্যারিসে আসা। এখানে বসেই মার্কস রচনা করেন তার ১৮৪৪ সালের ‘ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’, যা ‘প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’ হিসেবে ছাত্রাবস্থায় জেনেছিলাম। তরুণ মার্কসের ‘মানবতাবাদী’ রচনার সারসংক্ষেপ এখানে- এই প্যারিসে বসেই। এখানেই জন্ম নিয়েছে তার বিখ্যাত ‘এলিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতাবাদ বিষয়ক তত্ত্ব। জন স্টুয়ার্ট মিলের আগে এখানেই প্রথম তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতা’ বা ফ্রিডম সম্পর্কে ভাবনা-উদ্রেককারী ইস্তেহার। এই প্যারিস তরুণ মার্কসের যেমন, তেমনি মার্কসের প্রায় সমান বয়েসী কবি শার্ল বোদলেয়ারেরও। প্যারিস মানেই বোদলেয়ারের প্যারিস- তার বিখ্যাত রচনা ‘Paris Spleen’ এই শহরকে ঘিরেই। যারা আক্রান্ত- কবিতা দীর্ঘকাল পড়েননি, তাদের উচিত বোদলেয়ারের এই ৫০টি ছোট ছোট গদ্য-কবিতার সংকলন দিয়ে নিমগ্ন-পাঠ শুরু করা। তার মৃত্যুর দু’বছর পরে ১৮৬৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়। বোদলেয়ার ১৮৪৮ সালের বিপ্লব-প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেননি। কিন্তু এর জোরালো সমর্থক ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, প্যারিস যতই আধুনিক হয়ে উঠছে ততই সেখানে বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। এই উপলব্ধি সবচেয়ে তীব্রভাবে প্রকাশিত হয় তার Le Spleen de Paris বইটিতে। বইটির শিরোনামে ‘Spleen’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ প্লীহা, তবে অ্যানাটমির এই ‘অর্গানটি’ কবির আরাধ্য বিষয় নয়। ঝঢ়ষববহ শব্দটির অন্য একটি অর্থও রয়েছে। সেটি হলো- ‘কোনো আপতিক কারণ ছাড়াই বিষণ্ণতা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণাবোধ।’ আধুনিকতার পথে সৃষ্ট বৈষম্যকে সেভাবেই দেখেছেন বোদলেয়ার। এ বইয়ের একটি কবিতার নাম ‘Eyes of the Poor’। ঝকঝকে নতুন একটি কাব্যের দিকে তাকিয়ে আছে একটি দরিদ্র পরিবার। সেটা দেখে বাক্যের ভেতরে বসা কবি বিচলিত বোধ করছেন : ‘Not only was I moved by that family of eyes, but I felt a little ashamed of our glasses and decanters, larger than our thrist….’। এ রকম বৈষম্যের পরিবেশে সুস্থির থাকা, সুস্থ থাকা কঠিন। সে জন্যই বোদলেয়ার বলছেন, যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলছেন, ‘তোমাকে সবসময় বুঁদ হয়ে থাকতে হবে… সময় তোমার কাঁধের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এবং তুমি ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছ নিচে, মাটির দিকে; তোমাকে বুঁদ হয়ে থাকতে হবে বিরতিহীনভাবে।’ এই বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিয়েনেশন মার্কসীয়। যারা অন্য বোধের চর্চা করছেন, তাদেরকে মনে রাখতে হবে, মার্কসের ‘প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’ আর বোদলেয়ারের ‘প্যারিস স্পিল্গন’ একই সময় ও মনোভূমি থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত।

যখন সতেরো বছর আগে প্যারিসে আসি OECD-র একটি ‘ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এর আলোচক হিসেবে, তখন আমার মাথায় ছিল মার্কসের প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট আর বোদলেয়ারের প্যারিস। আসার আগে অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খান (স্যার) বলে দিয়েছিলেন, Louvre দেখার আগে D’orsay মিউজিয়াম দেখে আসবেন। দু’দিন থাকছেন, সে কারণেই বলছি। D’orsay-তে সব ইম্প্রেশনিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকর্ম এক জায়গায় পেয়ে যাবেন।’ অধ্যাপক খান নিজে একজন চিত্রশিল্পী; ইমপ্রেশনিজম ধারার ছবি আঁকার নিরিবিলি চর্চা করে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে। তার কথামতো সেবার D’orsay মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। একটা পুরো বিকেল সেখানে কাটিয়েছি। পুরোনো একটি রেলস্টেশনকে কীভাবে কেবল উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে ‘মিউজিয়ামে’ রূপান্তর করে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যায়, তার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা এটি। সেবার তাতেই এতটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে Louvre ও তার মোনালিসা আমার অধরাই থেকে গিয়েছিল। তার পরও এতগুলো বছর বাদে প্যারিসে আসার পরে আমার প্রথমেই মনে পড়ল ফ্রান্সের ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা বিবিলিওতেক নাসিওনালের কথাই। আমার অবচেতন মনের ভেতরেও কোথাও এর সূত্র ছিল নিশ্চয়ই। সেদিন অধ্যাপক ফিলিপ বেনোয়ারের সঙ্গে কৃত্তিবাস বিষয়ক আলাপ করতে করতে তিনি হঠাৎ আমাকে দেখালেন লাইব্রেরিটি। ‘ঐ যে দেখছেন, আধখোলা বইয়ের মতো বিল্ডিং তিনটি, ওটাই ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরি।’ আর আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল গ্যাব্রিয়েলা লোহানীর চিঠিটির কথা।

গ্যাব্রিয়েলা লোহানী ১৯২৫ সালের দিকের একটি চিঠিতে পাবনায় তার শাশুড়িকে লিখছেন প্যারিস থেকে। যার মমার্থ হলো- ‘মাজু (লোহানী) খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে একটি বইয়ের ওপরে।’ বোঝা যাচ্ছে, গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী শুধু প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি; একটি ‘বই লেখার’ কাজেও ব্যাপৃত ছিলেন সে সময়ে। তার মানে, ১৯২৪-২৫ সালে প্যারিসে অবস্থানকালেই এই লেখা তিনি শুরু করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে যখন প্রথম গ্যাব্রিয়েলার চিঠিটি পড়ি, তখনই আমার মনে হয়েছিল, এই বইটি হয়তো প্রকাশিত হয়েছে পরে এবং হয়ে থাকলে তা হয়তো বিবিলিওতেক নাসিওনালের সংগ্রহশালায় পাওয়া যেতেও পারে। স্বয়ং এমএন রায় যার সম্পর্কে তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, বিভিন্ন ভাষাভাষী লোহানীর বুদ্ধি ছিল ‘তরোয়ালের মত ধারালো’। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লোহানীর জার্মান, ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা নিয়ে তার আত্মজৈবনিক রচনা ‘যাত্রী’তে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। এমএন রায় ধারণা করেছেন যে, ১৯২১ সালে লেনিনকে পাঠানো ‘থিসিস অন ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চেনস’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ‘বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, গোলাম আম্বিয়া লোহানী ও পাণ্ডুরাঙ্গ খানখোজে’ ত্রয়ীর নাম-সংবলিত হলেও আসলে রচনাটি লোহানীরই- ওদের মধ্যে আর কারও এটা লেখার ক্ষমতা ছিল না। গঙ্গাধর অধিকারী কর্তৃক নানা খণ্ডে সম্পাদিত ‘হিস্টরি অব কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া’ বইতে লোহানীর নানা উল্লেখ রয়েছে এবং তার বিভিন্ন ইংরেজি রচনা সেখানে সংকলিতও হয়েছে। যদিও রুশ, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় লেখা তার বিভিন্ন রচনা এখনও সংকলিত হওয়ার অপেক্ষায়। এই লোহানীর জন্ম বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। শিক্ষাগ্রহণ আলিগড়ে এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে; একাধারে মার্কস, মিল, লেনিন ও কেইনস্‌ বিভিন্ন স্কুলের রচনাবলির সঙ্গে তিনি ছিলেন পরিচিত, স্তালিনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৩৮ সালের এক দিনে বুখারিনের মতো ভিন্নমতাবলম্বী অন্য কমরেডদের সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। আমাদের দেশের মুক্তি-সংগ্রামের স্মৃতি-মিউজিয়ামের অন্তত কোনো একটি কর্নারে, কোনো একটি পাদটিকায়, কোনো একটি ব্যানারে বা বইতে তার নাম থাকার কথা ছিল। তিনিই ছিলেন, কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদেরও আগে প্রথম বাঙালি মুসলিম কম্যুনিস্ট। এবং ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অনেক আগেই তত্ত্বে-তথ্যে-মননে জ্বলজ্বল করা এক নাম। যারা ১৯২৮ সালে কমিনটার্নের ষষ্ঠ কংগ্রেসে ডি-কলোনাইজেশন প্রশ্নে অটো কুমিনিন-লোহানীর বিতর্ক পড়েছেন (অধিকারীর বইতে তা যথাবিহিতভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) তারাই এর পাণ্ডিত্যে বিস্মিত হবেন। লোহানীর নাম, তার জীবনী এবং প্রকাশিত/অপ্রকাশিত লেখার সংকলন আমাদের স্মৃতির আড়ালে থেকে যাবে- এটা সহজে মেনে নেওয়া যায় না। কোনো স্কুলের পাঠ্যবইতে তার নাম কখনও উচ্চারিত হবে না- এটাও অপ্রত্যাশিত। লোহানীর ফরাসি স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলা লোহানী জানিয়েছিলেন, প্যারিস থেকে ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব মাসেস’ সাময়িকীটি প্রকাশের পাশাপাশি তখন একটি ‘বইয়ের ওপরেও’ কাজ করছিলেন লোহানী। তার অদেখা শাশুড়ি মাকে মিথ্যে কথা কেন বলবেন তিনি? হয়তো প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে অথবা মস্কোর ইতিহাস বিষয়ক মহাফেজখানায় তার বইটির একদিন ঠিক খোঁজ মিলবে। ঠিক যেমন আবুল হাসান ‘এপিটাফ’-এ লিখেছিলেন, ‘একদিন আকাশ আলো মিলে যায়, মেলে’; তেমনভাবেই লোহানী আমাদের ইতিহাসে-সাহিত্যে হবেন একদিন স্বতঃপ্রকাশিত।

[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৭

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৪. অন্যান্য প্রসঙ্গ

এদোয়ার্দো গালিয়েনো ঘণ্টাখানেক বলেছিলেন সেদিন ‘পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ’-এর সন্ধ্যায়। আমার থেকে-থেকে চোখ চলে যাচ্ছিল গালিয়েনোর ঢেউ খেলানো সাদা পশমের মতো চুলের দিকে। ‘মিররস’-এর অনুকরণে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কিছু লেখার পরিকল্পনা তার রয়েছে কি-না জানার জন্য প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব, কিন্তু আমার পড়াশোনা কম এই এলাকা নিয়ে।’ তারপর উল্টো আমাকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন- ‘তারচে’ বরং আপনি আগ্রহ নিয়ে করুন না কেন সেটা?’ পরে অবশ্য বুঝেছি যে, কথাটা নিতান্ত বিনয়ের সৌজন্য থেকেই বলা। এই ভূখণ্ড সম্পর্কে- এমনকি বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোই জানতেন তিনি। তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘হান্টার অব স্টোরিস’ বইতে হঠাৎ পেয়ে যাই বাংলাদেশের উল্লেখ :

‘২০১২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এক ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে ১১০ জন শ্রমিক মারা যায়। এ ধরনের ঘাম-ঝরানো কারখানাতে অধিকার বা নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরের বছরের এপ্রিলে দগ্ধ হয়ে মারা যায় আরও ১ হাজার ১২৭ জন শ্রমিক আরেকটি এমনই ঘাম ঝরানো ফ্যাক্টরিতে। ইতিহাসে যেসব দাসের কথা আমরা পড়তে পাই, এরাও তেমনি আধুনিক যুগের অদৃশ্য দাস। তাদের অস্তিত্বের মতোই তাদের বেতনও দৃশ্যমান নয়। যেমন নয় দৈনিক এক ডলারে বেঁচে থাকা। যেটা প্রকাশ্যে দেখা যায় তাহলো এদেরই হাতে তৈরি করা পোশাক-সামগ্রী, তাদের গায়ে সুদৃশ্য দামের ট্যাগ লাগানো, আর যেগুলো বিক্রি হচ্ছে ওয়ালমার্ট, জেসি পেনি, সিয়ার্স, বেনটেন, এইচ অ্যান্ড এম প্রভৃতি বিপণিবিতানে।’

নায়লা কবীর অবশ্য গালিয়েনোর ‘অদৃশ্য দাস’ বলার সাথে সহমত করবেন না। নায়লা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে দীর্ঘকাল ধরে পড়াচ্ছেন। বর্তমানে ফেমিনিস্ট ইকোনমিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের সভাপতিও তিনি। বাংলাদেশের এই সুযোগ্য সন্তান শুধু বাংলাদেশের নারীদের ওপরেই মৌলিক গবেষণা করেননি। নারীবাদী অর্থনীতি বা ফেমিনিস্ট ইকোনমিক্সের ওপরে তার গবেষণা কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ও পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ইংরেজিতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারেন, তেমনি বলিষ্ঠ তার লেখনী। ২০০০ সালে নায়লা কবীর একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য পাওয়ার টু চুজ’ (Power to choose)। সেখানে তার মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল যে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নারী-শ্রমিকরা ফ্যাক্টরির পরিবেশে কাজ করার সুবাদে ‘ক্ষমতায়িত হয়ে উঠেছে- অন্তত সুদূর লন্ডনে ঘরে বসে কাজ করছে এমন বাঙালি নারী-শ্রমিকদের তুলনায়। অর্থনৈতিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ- বিশেষত ঘরের বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর বিচরণ- তার জীবনমানের উন্নতি ও তাকে ‘ক্ষমতাবান’ করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; এটিই ছিল নায়লার মূল তর্ক। গালিয়েনো অবশ্য লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতার সাক্ষী, তিনি হয়তো নায়লাকে বলতেন, ‘অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নারীকে ক্ষমতাবান করে ঠিকই, কিন্তু সবই নির্ভর করছে তার দর-কষাকষির ক্ষমতার ওপরে।’ এ দেশের পোশাক-শিল্পের নারীরা এখনও সেই ক্ষমতা পুরোপুরি অর্জন করেননি তাদের ‘দেশি মালিক’ আর ‘বিদেশি ক্রেতাদের’ সঙ্গে দর-কষাকষি করার ক্ষেত্রে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরে বিদেশি ক্রেতারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ইনিশিয়েটিভের। এতে ইমারত সুরক্ষা, অগ্নিনির্বাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা শুভ পরিবর্তন আসলেও নারী পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সামান্যই বেড়েছে। শ্রমবহির্ভূত কাজের পরিবেশেও খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।

গালিয়েনো নিজের জীবনের টুকরো-টাকরা স্মৃতি নিয়ে কিছু খণ্ডদৃশ্য লিখেছেন। তার ‘মেমরি অব ফায়ার’ বইটির শেষ খণ্ডে সামরিক শাসিত উরুগুয়ের ‘কনিষ্ঠতম রাজনৈতিক বন্দি’ সম্পর্কে একটি এন্ট্রি রয়েছে। সে ছিল পাঁচ বছরের একটি মেয়ে, তার অপরাধ ছিল একটাই :তার নাম রাখা হয়েছিল ‘মাইলাই’। ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে মার্কিন সেনা দল মাইলাই নামে গোটা একটা গ্রামকেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উরুগুয়েতে তখন চলছে প্রবল সামরিক শাসন। মাইলাই নাম উচ্চারণও তখন অপরাধ। আর সেখানে কিনা জলজ্যান্ত একটি মেয়ে- হোক না সে পাঁচ বছরের মেয়ে; এই নাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (বা পার্কে-মাঠে-কিন্ডারগার্টেনে দাপটের সঙ্গে হেসেখেলে দিন কাটাচ্ছে)। গালিয়েনো লিখেছেন যে, বইটি বেরুনোর পর অনেক বাবা-মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। তারাও তাদের নবজাতকের নাম ‘মাইলাই’ রাখতে চান। কিন্তু প্রশাসন তাতে বাগড়া দিচ্ছে। এমনকি ১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার এক মা তাকে লিখেছেন, ‘আমার মেয়েকে এখনও নথিবদ্ধ করা যায়নি।’ জন্ম ও মৃত্যুর রেজিস্ট্রি করা এখন এ দেশেও বাধ্যতামূলক। লাতিন আমেরিকায় তা আগেই চালু হয়েছিল আমাদের দেশের তুলনায়। আন-ডকুমেন্টেড থেকে গেছে তার মেয়ে অদ্যাবধি- এই ছিল পাঠিকার অভিযোগ। এসব দেশে নাম তালিকাভুক্ত করাতে গেলে সমস্যা অনেক। কোনো সেইন্টের নাম নিতে চাইলে কাজটা সহজ হয়ে যেত। কিন্তু মাইলাই তো সে রকম কোনো নাম নয়। একে পাওয়া যাবে না অভিধানে, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রির ইতোমধ্যে তালিকাবদ্ধ নামের সারিতেও এর দেখা মিলবে না। মাইলাই-এর কোনো অধিকার নেই কার্যত নিজেকে মাইলাই বলে ডাকার।

একবার চিলির সালভাদর আয়েন্দের সঙ্গে সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল গালিয়েনোর। নিজ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এক রক্তাক্ত ক্যু-তে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিহত হন আয়েন্দে। সেটাই বলতে গেলে প্রথম ‘নয়-এগারো’। এই ক্যুর পেছনে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের সরাসরি প্ররোচনা ছিল। যা হোক, গালিয়েনো যে ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন তা এর বেশ কিছুকাল আগে, তখনও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। তখন ছিল শীতের সময়। চিলির দক্ষিণের প্রদেশ পুন্টা আরেনাতে সবে বরফ পড়তে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে বাইরের তুলার মতো বরফ নেমে আসার দৃশ্য দেখতে দেখতে আয়েন্দে তার নির্বাচনী বক্তৃতার একটি খসড়া দেখালেন গালিয়েনোকে। আগামীকালই একটি বক্তৃতা দিতে হবে তাকে। বক্তৃতা যথারীতি হলো। কিন্তু গালিয়েনো খেয়াল করলেন যে, আয়েন্দের বক্তৃতায় কী করে যেন একটি নতুন লাইন ঢুকে গেছে। যেটা গতকাল রাতে পড়া খসড়ার মধ্যে ছিল না। সমবেত জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি শুনতে পেলেন আয়েন্দে বলছেন :’যেসব ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন, সেসবের জন্যে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে অর্থ রয়েছে।’ এটা কি ছিল কোনো অনিচ্ছাকৃত ভবিষ্যদ্বাণী, কে জানে!

লোর্কা নিয়েও একাধিক গল্প বলেছেন তিনি। ফ্রাংকোর স্পেনে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কার মৃত্যুর পর অনেককাল তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি। তার জনপ্রিয় নাটকগুলো নিষিদ্ধ ছিল। লোর্কার মৃত্যুর বহু বছর পরে- ফ্রাংকো তখনও জীবিত- উরুগুয়ের এক নাট্য দল গেল মাদ্রিদে। সাহস করে লোর্কার একটি নাটক মঞ্চস্থ করল তারা। নাটকের শেষে চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কোনো হাততালি শোনা গেল না। দর্শক সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে পা দিয়ে মেঝের ওপরে এক সাথে শব্দ করতে লাগল অনেকক্ষণ। নাটকের কুশীলবরা প্রথমে বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে। এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছে দর্শকরা! তাদের অভিনয় কলাকৌশল কি সেরূপ হয়নি? তাহলে এমন ধরনের ব্যবহার কেন দর্শকদের? বহু দিন পরে কুশীলবদের একজন এদোয়ার্দো গালিয়েনোকে বুঝিয়েছিলেন যে, পা দিয়ে শব্দ কেন তুলেছিলেন মাদ্রিদের দর্শকরা? তারা লোর্কার জন্য সেই শব্দ তুলে হল প্রকম্পিত করেছিলেন সেদিন। লোর্কা, যাকে কেবল বামেদের সমর্থক এবং বৃত্তের বাইরের মানুষ হওয়ার অভিযোগে অযথা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাকে বলেছিলেন দর্শকরা- ‘ফেদেরিকো, দ্যাখো, তুমি এখনও আমাদের মধ্যে কীভাবে বেঁচে আছ।’ এই গল্পটা গালিয়েনো বর্ণনা করছিলেন মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে। সেদিনের সন্ধ্যায় গালিয়েনোর বক্তৃতা পাঠ শেষে অবাক করা কাণ্ড ঘটল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অনুষ্ঠানে সমবেত ছয় হাজার মানুষের পায়ের শব্দে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠেছিল। তারাও বলতে চেয়েছিল- ‘গালিয়েনো, তুমি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছ।’

[এই বিষয় সমাপ্ত]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

স্বৈরশাসকদের নিয়ে এদোয়ার্দো গালিয়েনোর অতি-উৎসাহের কারণ দ্বি-বিধ। প্রথম কারণটি ব্যক্তিগত। তিনি ছিলেন বামপন্থি সাংবাদিক ও লেখক। যে বছর আয়েন্দের চিলিতে পিনোশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, সে বছরই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয় উরুগুয়ে নামক দেশটিতে। গালিয়েনোর জন্মভূূমি উরুগুয়েতে, সেখানেই ‘মিছিল’ বা ‘মার্চ’ [স্পেনীয় ভাষায় Marcha] পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তার খ্যাতি লাভ। এই পত্রিকায় মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতো লেখকরা নিয়মিত লিখতেন। যা হোক, উরুগুয়েতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে গালিয়েনোকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছাড়া পেয়ে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যেতে হয় তাকে। সেখানে উদ্বাস্তু জীবনের মধ্যেই ‘ক্রাইসিস’ নামে একটি বামধারার পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিন বছর না যেতেই ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনাতেও একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ডানপন্থি এই ক্যুর নেতৃত্ব দেন লে. জেনারেল ভিদেলা। ইসাবেলা পেরন-এর সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল ভিদেলা ক্ষমতায় আসেন। কথিত আছে, এই ক্যুর পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার আর্জেন্টিনার সামরিক নেতৃত্বের সাথে বেশ কয়েক বার ‘মিটিং’ করেন এবং বলেন, তাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ‘নিষ্ফ্ক্রিয় করে দেওয়া’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরোধী দলনের অভিযোগ ওঠার আগেভাগেই এ কাজটি সেরে ফেলার পরামর্শ দেন কিসিঞ্জার। এ রকম পরিস্থিতিতে আবারও দেশ ছাড়তে হয় গালিয়েনোকে। এবার তিনি পাড়ি জমান স্পেনের উদ্দেশে। এই স্পেনে বসেই তিনি লেখেন তার বিখ্যাত ট্রিলজি ‘মেমোরি অব ফায়ার’- বহ্ন্যুৎসবের স্মৃতি। আমাদের এখানে হলে হয়তো আমরা বলতাম ‘আগুন-জলের গল্প’। কেবল ১৯৮৫ সালেই গালিয়েনো ফিরতে পারেন নিজের দেশে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্তেভিদিয়োতে। গণতন্ত্র সবে ফিরতে শুরু করেছে সেখানে। এই সেই দেশ, যেখানে কোনো মানবিক অধিকারে রীতি-নীতি মানা হয়নি। উরুগুয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদককে হেলিকপ্টারের সাথে বেঁধে এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এ রকম শুনেছি। কিন্তু গালিয়েনোর কাছে উরুগুয়ে নয়, সমগ্র লাতিন মহাদেশের পর্যায়ক্রমিক সামরিক স্বৈরশাসনের অভ্যুদয়ই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং এ কারণেই তার লেখা পত্রে স্বৈরশাসকদের প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়।

কিন্তু এর পেছনে দ্বিতীয় কারণও ছিল। যদি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা তার না-ও থাকত, তাহলেও এদোয়ার্দো গালিয়েনো সম্ভবত এভাবেই লিখতেন বা ভাবতেন। দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রবল উপস্থিতির পেছনে অনেকটি কারণ কাজ করে থাকবে। এই মহাদেশে প্রথমে কলোনিয়াল অভিযান চালায় স্পেনীয়রা (এবং পর্তুগিজরা)। মায়া, ইনকা, আজটেক প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতা অধ্যুষিত মহাদেশকে স্বর্ণখনির লোভে পদানত করার জন্য সামরিক অভিযান চালায় তারা। স্থানীয় অধিবাসীদের রাজত্বগুলো ছলে-বলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গালিয়েনো নানা অনু-গল্পে এই গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ও কাহিনী লিখেছেন। ১৫৩৩ সালে স্পেনীয় কনকুইস্তাদর বা বিজয়-পিপাসু ফ্রান্সিসকো পিসারো পেরু অধিকার করে নেন। এই যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালের ইউরোপ থেকে ‘আমদানি করা’ মহামারিতে নিহত হয় পেরুর ৯০ শতাংশ স্থানীয় জনসাধারণ, যাদের অধিকাংশই ছিল ইনকা সম্প্রদায়ভুক্ত। ইনকাদের সম্রাট আতাহুয়ালপাকে [Atahualpa] নির্মমভাবে খুন করা হয়। গালিয়েনো এই শঠতাপূর্ণ বিজয় নিয়ে লিখেছেন, আর সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে- এই পেরুর ইনকাদের থেকে ইউরোপ এবং এক পর্যায়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে আলুর চাষ। আজকে যাকে ‘মেডিকেল মারিজুয়ানা’ হিসেবে প্রচার করা হয়, তারও আদিভূমি পেরুতে।

লাতিন আমেরিকায় এই আদিম, বর্বরতম ঔপনিবেশিক অভিযানের স্মৃতি গালিয়েনো ভুলে দিতে চাননি। এর সাথে তিনি সংযুক্ত করেন পরবর্তীকালের (উনিশ-বিশ শতকের) ‘অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিস্তার। তখন আর উপনিবেশবাদ শুধু স্বর্ণখনির লোভে সীমিত নেই।

৩. সাম্রাজ্য :প্রেম নাকি প্রতারণা?

‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল’ প্রবন্ধে মার্কস এ রকম মন্তব্য করেছিলেন যে, এই শাসনের ফলে যেমন ভারতবাসীর ওপরে দুর্গতি নেমে এসেছে, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায় এর আবদ্ধ নিশ্চলা জীবনে সূচিত হচ্ছে প্রগতির ধারা। প্রত্যন্ত উপনিবেশে পাশ্চাত্য-আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে, ভেঙে পড়ছে তার চিরাচরিত পেছনে-টানা মূল্যবোধের প্রাচ্যীয় জগৎ। যিনি ধ্বংস করেন, তিনিই আবার সৃষ্টি করছেন। উপনিবেশে ব্রিটিশ শাসনের এই দ্বিবিধ ফলাফল যুগপৎ বিনাশী ও সৃষ্টিশীল, একাধারে ধ্বংসাত্মক ও কল্যাণকামী ভূমিকা সম্পর্কে মার্কসের মূল্যায়ন নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। এ প্রশ্নে এসে এদোয়ার্দো গালিয়েনো মার্কসকেও ছেড়ে কথা বলতেন না। মার্কস যদি বলে থাকেন যে, এযাবৎকালের ইতিহাস মূলত শ্রেণিযুদ্ধের ইতিহাস; তাহলে গালিয়েনো ভাবতেন, এযাবৎকালের ইতিহাস মূলত এক জাতির তরফে অন্য জাতির ওপর অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখানোর ইতিহাস। সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা-বলয়ের বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে। এখানে প্রেম নেই; থাকলেও তা সাময়িক; অপ্রেমই এখানে মূল সুর; প্রতারণাই এখানে চরম পরিণাম। এ জন্যই অনেকটা আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে গালিয়েনো সাম্রাজ্যের শঠতার কাহিনী একের পর এক লিখে গেছেন। এক পর্যায়ে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে বাংলার ওপরে। এই ঔপনিবেশিক গল্পের শুরু ইংলন্ডে আর শেষ ঢাকায়।

মুক্ত বাণিজ্য নামক এক রূপকথার জন্ম কীভাবে ইংলন্ডে জন্ম নিল; প্রথমে সে বয়ান করেছেন গালিয়েনো। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা প্রথম জেমস ও প্রথম চার্লসের শাসনামলে ব্রিটেনের ‘শিশু-শিল্প’কে রক্ষার জন্য নানাবিধ সংরক্ষণমূলক নীতি হাতে নেয় ইংরেজ সরকার। তারা কাঁচামাল হিসেবে পশম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়; বিলাসবহুল পোশাক তৈরিতেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বস্ত্রের ব্যবহার অপরিহার্য এ নিয়ম করে; ফ্রান্স ও হল্যান্ডের মতো দেশ থেকে শিল্পপণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের আগেও অর্থনৈতিক চিন্তা ছিল, কিন্তু তা ছিল মূলত সংরক্ষণমূলক [যাকে বলে ‘প্রোটেকশনিস্ট’] নীতিকে ঘিরে। এ রকমই একজন চিন্তক ছিলেন সপ্তদশ শতকের শুরুতে ‘রবিনসন ক্রুসো’র রচয়িতা ড্যানিয়েল ডেফো। গল্পের বই ছাড়াও অর্থনীতির নানা বিষয়ে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। এরই একটিতে তিনি বলেন, ব্রিটিশ টেক্সটাইল শিল্পকে গতিশীল করার জন্য ইংরেজ সরকারের ‘সংরক্ষণমূলক’ নীতি খুবই কার্যকর ছিল। ইংরেজ রাজারা ‘শুল্ক্কের দেয়াল’ নির্মাণ না করলে এবং স্থানীয় শিল্পকে উপযুক্ত কর-প্রণোদনা না দিলে এই শিল্পের বিকাশ সম্ভবপর ছিল না। এই বিকাশ এতটাই ত্বরান্বিত হয়েছে যে আগামী দিনে বিশ্বের প্রতিটি দেশ বা উপনিবেশ ‘ব্রিটিশ পণ্যের ওপরেই নির্ভরশীল থাকবে।’ ডেফোর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল বলতে হয়। কেননা, পরবর্তী দুশো বছর ধরে ব্রিটেন যা করে বড় হয়েছে, তারই উল্টোটা প্রয়োগ করেছে সে অন্যদের প্রতি। অবস্থানিরপেক্ষভাবে প্রচার করেছে ‘অবাধ বাণিজ্য’-এর জয়গান। জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিখ লিস্ট এটা দেখে বলেছিলেন, ‘উপরে উঠিয়ে মইটা ফেলে দিয়েছে ইংরেজরা।’ রাতের বেলায় যখন গরিব দেশগুলোর ঘুম হয় না, তখন ধনী দেশের মন্ত্রণাদাতারা মুক্ত বাণিজ্যের রূপকথা শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে থাকে।

এই রূপকথাই অন্য রকম শোনায় ঔপনিবেশিক বাংলার পটভূমিতে। গালিয়েনো লিখেছেন যে, বাংলা থেকে সুতি ও রেশমি কাপড় আমদানিতে প্রথমদিকে অতি-উচ্চ হারে শুল্ক্ক বসানো হতো। ১৬৮৫ সাল থেকে এই শুল্ক্ক বসানো হতে থাকে, এক পর্যায়ে কাপড় আমদানি প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়। এত বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও ইংলন্ডে শিল্প-বিপ্লব শুরু হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত-বাংলার বস্ত্রশিল্প বেঁচে ছিল। ম্যানচেস্টার থেকে বস্ত্র যখন বাংলায় আসত, তখন তাতে কিন্তু আমদানি শুল্ক্ক বসানো হয়নি। কারণ ততদিনে ফ্রি-মার্কেটের তত্ত্ব রুলিং আইডিওলজি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনে। গুণগত মান ভালো থাকার জন্যে এবং স্বল্প উৎপাদন মূল্যের কারণে অসম প্রতিযোগিতার ভেতরেও অনেক দিন টিকে ছিল বাংলার বস্ত্র উৎপাদকরা। উনিশ শতকের গোড়াতে যখন ওদের ওপরে এক বিষম করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখনই কেবল ওরা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এই বি-শিল্পায়নের পরিবেশে ম্যানচেস্টারের টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বাংলার বাজার ও ঘরে ঢুকতে থাকে। ঢাকার ওপরে এই অসম প্রতিযোগিতার ফল হয়েছিল মারাত্মক। গালিয়েনো লিখেছেন :

‘প্রবাদপ্রতিম লর্ড ক্লাইভ যে ঢাকাকে [সমৃদ্ধি-ঐশ্বর্য] লন্ডন ও ম্যানচেস্টার শহরের সাথে তুলনা করতেন, সেই শহরটি এই পর্যায়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনই শহর ছেড়ে চলে যায়। তারপরও বাংলার শিল্প খাতের কেন্দ্র ছিল ঢাকা, তবে তা বস্ত্রশিল্পের জন্য নয়; আফিম উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই আফিমের অতিরিক্ত সেবন করতে গিয়েই এক সময় মৃত্যু হয় ক্লাইভের।’

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী নিয়ে আরো অনেক গল্প আছে গালিয়েনোর ঝুলিতে। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’ বইটিকে তিনি উপনিবেশ-অভিযানের ন্যারেটিভ হিসেবে পাঠ করেছেন। এর লেখক জোনাথান সুইফট্‌-এর মনে কী ছিল, তা জানা যায় না। তবে অনেক সময় তাকে মনে হয় আসলে তিনি একজন ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ লেখক; উপনিবেশবাদবিরোধী চিন্তাবিদ। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’এ-র সর্বশেষ পরিচ্ছেদে কীভাবে কিছু বর্বর জলদস্যুর হাতে স্থানীয় অধিবাসীরা পরাজিত হলো এবং নেটিভদের দেশকে এক অবাধ লুণ্ঠণক্ষেত্র তথা উপনিবেশে পরিণত করা হলো, তার প্রায় পরাবাস্তববাদী বর্ণনা রয়েছে। মূলের বর্ণনাটি এতই তীক্ষষ্ট ও মর্মভেদী যে অনুবাদে তা হারিয়ে যাক সেটা আমি চাই না :

A crew of pirates goes on shore to rob and plunder, they see a harmless people, are entertained with kindness; they give the country a new name; they take formal possession of it for their king; they set up a rotten plank, or a stone, for a memorial.
Here commences a new dominion, acquired with a title by divine right. Natives are driven out or destroyed; their princes tortured to discover their gold; a free license given to all acts of inhumanity and lust, the earth reeking with the blood of its inhabitants : and this execrable crew of butchers, employed in so pious an expedition, is a modern colony, sent to convert and civilize an idolatrous and barbarous people!

সন্দেহ কি, জোনাথান সুইফটকে এক সময় ‘উন্মাদ’ বলে অভিহিত করা হবে খোদ ব্রিটেনে।

[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৫

২. এদোয়ার্দো গালিয়েনোর জীবন

পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ-এ সেদিন ছিল এদোয়ার্দো গালিয়েনোর ‘মিররস্‌’ বই নিয়ে ভাষণ; গালিয়েনোর গল্প বলার ধরনে এক ‘রহস্যময় জাদু’ থাকে- এরকম একটি আপ্তবাক্য বলেছিলেন ঔপন্যাসিক ইসাবেলা আয়েন্দে। গালিয়েনো কাজ করতে চান ভাস্করের মতো। প্রথমে তিনি ইতিহাস, প্রবন্ধ বা লোককাহিনি ঘেঁটে ‘তথ্য’ আহরণ করেন, তারপর তিনি তৈরি করেন এর প্রথম-পাঠ। সেই পাঠের ওপরে তিনি অনেক বছর ধরে কাজ করতে থাকেন যতক্ষণ-না এর বর্ণনাভঙ্গি, বক্তব্য, বক্তব্যের প্রধান ও অপ্রধান মুহূর্ত তার মনোমত হয়ে দাঁড়ায়। তার অনু-রচনাগুলো অনেকটা গানের মতো- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ- পর্যায়ক্রমে তা ধ্বনি থেকে কবিতায় পরিণত হয়। একজন প্রাবন্ধিককে প্রথমাবধি একজন ‘স্টাইলিস্ট’ হতেই হয়। রিল্ক্কের মতো তিনিও লিখে রেখে যেতে পারতেন- ‘একজন তরুণ প্রাবন্ধিকের প্রতি’ কোনো গাঢ় উপদেশাবলি। যেমন, ধরা যাক, তিনি লিখতে চান স্পেনের দোর্দণ্ড প্রতাপ জেনারেল ফ্রাংকো সম্পর্কে। স্পেনের বিখ্যাত রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ারে রিপাবলিকপন্থিদের হারিয়ে জেনারেল ফ্রাংকো ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৩৯ সালে, এবং ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন নিরঙ্কুশ ডিক্টেটরশিপ অব্যাহত রেখে। না-প্রাচ্য না-পাশ্চাত্য কোনো শক্তিই তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারেনি। এহেন প্রতাপশালী জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোকে নিয়ে এক পাতার মধ্যে কী লেখা যায়, যা হবে তার নিষ্ঠুর চরিত্রের ইঙ্গিতবাহী, আবার একই সঙ্গে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য? গালিয়েনো এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন, তারপর তার মনে হয়েছে জেনারেল ফ্রাংকোর পক্ষীশিকার নিয়েই বরং লেখা যাক। বিবরণীটি অনেকটা এরকম, তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘হান্টার অব স্টোরিস্‌’ থেকে সংগৃহীত :

‘বধ করার মধ্যে একটা নিষ্ঠুর আনন্দ রয়েছে। তা সে নোংরা ঘেঁটে বেড়ানো কাক বা সরোবরের রাজহংসী বা একজন গণতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রী যে-ই হোক না কেন। তবে কোয়েল পাখি শিকারে ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর বিশেষ আগ্রহ ছিল বরাবর। ১৯৫৯ সালের অক্টোবরের এক দিনে জেনারেল ফ্রাংকো ৪ হাজার ৬০০টি কোয়েল পাখি বধ করেছিলেন, তারই করা পূর্বতন সব রেকর্ড ভেঙে।

আলোকচিত্রী শিল্পীরা সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে অমর করে রেখেছিলেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে বিজয়ী বেশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পায়ের নিচে লুটোপুটি খাচ্ছে তার যুদ্ধজয়ের সামগ্রী- মৃত চোখ-উল্টে পড়া অসংখ্য কোয়েল পাখি।’

এসব ক্ষেত্রে এদোয়ার্দো গালিয়েনো যেটা করে থাকেন, তিনি যুক্ত করেন অনেক প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ। যেমন ডিক্টেটরদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত খাটো ছিলেন ফ্রাংকো- পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি, যেখানে হিটলার ছিলেন পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি, আর মুসোলিনি- পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ফটোগ্রাফাররা এমনভাবে ছবি তুলতেন যাতে করে এই অপেক্ষাকৃত খর্বকায় একনায়কদের বেশি খাটো না দেখায়। আমাদের দেশেও অনেক খর্বকায় জেনারেল ছিলেন- যারা সময় সময় ডিক্টেটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছেন- তারাও অত্যন্ত ক্যামেরা সচেতন ছিলেন। ‘তৃতীয় মাত্রা’য় একবার এক-এগারোর অন্যতম নায়ক জেনারেল মইন-এর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। তখন দেখে মনেই হয়নি যে তিনি এতটা খর্বকায়। আসলে ক্ষমতার লেন্স আর ফটোগ্রাফারদের লেন্স দুই-ই এই জেনারেলদের সুউচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করায়।

অন্যত্র, গালিয়েনো এক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ সামরিক ডিক্টেটরের কথা বলেছেন, যার নাম আউগুস্তো পিনোচেট বা পিনোশে। চিলির এই নির্মম মিলিটারি ডিক্টেটর তার জীবদ্দশায় হাজার হাজার বই সংগ্রহ করেন তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির জন্য। রাজকোষের অনেক অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি, সেসবের অনেকটাই সময়মতো আমেরিকার রিগস ব্যাংকের ডলার-অ্যাকাউন্টে পাচার করেছেন তিনি। তবে জনতার অর্থ নিয়ে তিনি প্রচুর বইও কিনেছেন। তিনি বই কিনতেন পড়ার জন্য নয়, শুধু ‘সংগ্রহ’ করার জন্য। কে জানে এই ডিক্টেটরের বুকের ভেতরে বইয়ের জন্য হাহাকার কী কারণে বাসা বেঁধেছিল! পিনোশের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে শুধু নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ওপরেই ৮৮৭টি বই ছিল। মূল্যবান চামড়ায় বাঁধানো সেসব খণ্ড। আর গ্রন্থাগারের বইয়ের তাকে তাকে বোনাপার্টের অনেক মূর্তি সসম্মানে রাখা হয়েছিল। সংগৃহীত প্রতিটি বইয়ে পিনোশের ব্যক্তিগত মোড়ক বসানো। যেন ভাবীকাল তাকে এভাবেই মনে রাখে। জেনারেল পিনোশে-র এই কখনোই না-পড়া গ্রন্থরাজি এখন বিরাজ করছে চিলির সামরিক বাহিনীর ওয়ার কলেজের ‘প্রেসিডেন্ট আউগুস্তো পিনোশে উগার্তে লাইব্রেরি’তে। এই লাইব্রেরিটি পিনোশে নিজেই তৈরি করেছিলেন- ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের ‘আলোকপ্রাপ্তি’র জন্য।

এদোয়ার্দো গালিয়েনো কাউকেই কোনো কিছুকেই তার ক্ষুরধার বিশ্নেষণের জরিপ থেকে বাদ দেননি। ‘মিররস্‌’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন ইংরেজ দার্শনিক জন লক-এর কথা। ‘স্বাধীনতা’র দার্শনিক বললে লক-এর কথাই প্রথমে মনে পড়বে। তার লেখায় তিনি অবাধ বাণিজ্য, কারখানা, অবাধ প্রতিযোগিতা, ‘অবাধ নিয়োগ ও ছাঁটাই’ এসবের প্রয়োজনীয়তা অবাধে লিখে গেছেন। সেই সাথে বলেছেন অবাধে বিনিয়োগ করার স্বাধীনতার কথাও। তিনি যখন ‘এন এসে কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’-এর মতো দার্শনিক গ্রন্থ লিখছেন, সে সময়েই ‘রয়াল আফ্রিকান কোম্পানি’র স্টক কেনার ক্ষেত্রে তার সঞ্চয়কে ব্যয় করেন। গালিয়েনো লিখছেন, এই কোম্পানির যৌথ মালিকানায় ছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবার এবং মুক্ত-বাণিজ্যপন্থি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াস অ্যান্ড র‌্যাশনাল’ বণিকগোষ্ঠী। এই কোম্পানির মূল কাজ ছিল আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কালো মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে কিনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা।

এ রকম দ্বিচারিতা আরেকজন ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মধ্যেও ছিল। সারাজীবন তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করে গিয়েছেন; একপর্যায়ে কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকও হন। কোম্পানির চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও এর নীতি নির্ধারণে মিলের পরোক্ষ ভূমিকা অব্যাহত ছিল। ১৮৬০-এর দশকে অন লিবার্টি, অন রিপ্রেজেন্টেটিভ গভর্নমেন্ট, ‘নারীমুক্তি’, এমনকি ‘সমাজতন্ত্র’ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। সারা বিশ্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে একটা ‘সভ্য চেহারা’ দেওয়া ছিল তার অন্যতম বড় কীর্তি। ঔপনিবেশিক দ্বিচারিতার অনেকগুলো উদাহরণ দিয়েছেন গালিয়েনো। ক্রীতদাসের প্রথা একসময় ইংল্যান্ডে এবং তার দেখাদেখি সারা ইউরোপেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গেল। রোমক সাম্রাজ্যের পতনের একটি কারণ ছিল ক্রীতদাসের বিদ্রোহ। চার্চ ঘোষণা দিয়েছিল, যে কাউকে ক্রীতদাস করা ঈশ্বরের চোখে ঘোরতর অন্যায় কাজ। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিচারকেরা রায় দিলেন, ক্রীতদাস নিয়ে বাণিজ্য (স্লেভ-ট্রেড) করা আইনত গর্হিতকর অপরাধ। মনে হতে পারে যে, এর পর ‘ক্রীতদাস-বাণিজ্য’ উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই বাণিজ্য থামল না। ষোড়শ, সপ্তদশ, অষ্টাদশ, এমনকি উনিশ শতকেও এই বাণিজ্য শুধু-ই থেমে থাকেনি তা-ই নয়, আফ্রিকায় উপনিবেশ সম্প্রসারণের সাথে সাথে ক্রীতদাসের বাণিজ্য নজিরবিহীনভাবে বেড়ে গেল। আগে ক্রীতদাস কেনা হতো কেবল উপকূলীয় বন্দর এলাকা থেকে। আফ্রিকার ভেতর প্রদেশে যাওয়ার ফলে উন্মোচিত হলো তার সমৃদ্ধ খনিজসম্পদ, তাতে করে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্রুত পরিণত করা হলো ক্রীতদাসে, যাদের জোরপূর্বক খাটানো হতো খনিগুলোতে। এই ক্রীতদাসদের একটা অংশকে আবার ‘আন্তঃমহাদেশীয়’ স্লেভ-ট্রেডে ব্যবহার করা হতো : লাভজনকভাবে খনিও চলত, আমেরিকার সাথে বহির্বাণিজ্যও নির্বিঘ্নে চলত ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয়ের সুবাদে।

১৮৮৫ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ ভাগাভাগির সম্মেলন। ইংরেজ, ফরাসি, বেলজীয়, ওলন্দাজ, জার্মান প্রভৃতি পরাশক্তির মধ্যে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের ভাগবাটোয়ারার সম্মেলন ছিল এটিই। এই সম্মেলনে বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের সম্মানে তাকে উপহার দেওয়া হলো ‘কঙ্গো’ নামক দেশটি- তার ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ হিসেবে। অচিরেই তিনি দুর্গম কঙ্গোকে একটি বাণিজ্য-ক্ষেত্র করে তুললেন। কঙ্গো হয়ে দাঁড়াল ‘হাতির দাঁতের’ সবচেয়ে বড় রপ্তানির উৎস; কঙ্গো থেকে সুলভে এবং প্রচুর পরিমাণে আসতে থাকল ‘রাবার’, যেটি সদ্য-আবিস্কৃত মোটরগাড়ির টায়ার হিসেবে বিশ্বজুড়ে ব্যবহূত হতে থাকে; কঙ্গো থেকে অবাধে আমদানি হতে থাকল রক্তমুখী হীরে- আমেরিকা-ইউরোপে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য আংটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। এসবই হলো কঙ্গোর জনসাধারণকে ক্রীতদাস বানিয়ে অর্থাৎ ক্রীতদাস শ্রমের সুবাদে। ইতিহাসের বইপত্রে ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত তিরিশ বছরকে বলা হয়ে থাকে ‘নিখিল বিশ্ব-শান্তির যুগ’, যা কেবল ভেঙে যায় প্রথম মহাযুদ্ধের পরেই। জার্মানি তার আফ্রিকার উপনিবেশগুলো হারায়, আর ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-বেলজিয়াম তাদের উপনিবেশের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়।

কীভাবে সম্ভব হলো উনিশ শতকের পটভূমিতে সভ্য ইউরোপ, আধুনিক ইউরোপ, বিজ্ঞানমনস্ক ইউরোপ, শিল্পোন্নত ইউরোপের দ্বারা এই ‘ক্রীতদাস-নির্ভর’ অর্থনীতির পরিচালনা? এর অন্তর্নিহিত যুক্তি-জাল পাওয়া যায় জন স্টুয়ার্ট মিলের রচনায়। তিনি সারাবিশ্বের মানবগোষ্ঠীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন : সভ্য, আধাসভ্য ও অসভ্য। ‘সভ্য’ হচ্ছে ইউরোপ, সমগ্র বিশ্ববাসীকে সভ্য করার দায়িত্ব তার। ‘আধাসভ্য’ হচ্ছে ভারতবর্ষ- সেখানে ‘সংহত’ ধরনের নীতি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী মিল। আর ‘অসভ্য’ হচ্ছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আদিবাসী স্থানীয় জনগোষ্ঠী- তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রূঢ় ও কর্কশ আচরণে পিছু-পা না হতে বলছেন মিল। তার আগে অবশ্য এ রকম কথা আরো কেউ কেউ বলেছেন। দার্শনিক হেগেল লক্ষ্য করেছিলেন যে, আফ্রিকার কোনো ‘ইতিহাস নেই’, একে শুধু ‘বর্বরতা আর নৃশংসতার’ কেস-স্টাডি হিসেবে পড়া চলে। দার্শনিক জীবতাত্ত্বিক, নৃতত্ত্ববিদ এবং উনিশ শতকের ‘ভিক্টোরিয়ান যুগের’ অন্যতম প্রধান লিবারেল তাত্ত্বিক হার্বার্ট স্পেন্সার অনেকটা ভেবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সভ্যতার উচিত হবে ‘পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সব অনগ্রসর জাতিকে মুছে ফেলা’, প্রগতির রথের নিচে এসব বাধাকে চূর্ণ না করতে পারলে সভ্যতাকে অগ্রসর করা যাবে না।

বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডকে নিয়ে কঙ্গোর গল্প বলতে গিয়ে অবধারিতভাবে একসময় চলে এসেছে ঔপন্যাসিক জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’-এর কথা। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে কুর্টজ, যার সাইড-পেশা হচ্ছে হাঁতির দাঁতের ব্যবসা করা। কনরাড নিজে কঙ্গোতে গিয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক বাহিনীতে কর্মরত অফিসার ক্যাপ্টেন লিওন রোম-কে মনে রেখে তিনি গড়ে তুলেছিলেন কুর্টজ-এর চরিত্র। কুর্টজ-এর শাসনে কোনো নেটিভই সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না- চারপেয়ে জন্তুর মতো অবস্থানে থেকে নেটিভরা কুর্টজ-এর আদেশ গ্রহণ করত। তার প্রাসাদোপম গৃহে প্রবেশের মুখে ফুল দিয়ে সাজানো ছিল পর পর বিশটি ধাপ, প্রতিটি ধাপের মধ্যে থাকত একটি কালো মানুষের বিদ্রোহী কাটামুণ্ডু। যখন তিনি ক্রীতদাস বা হাতি শিকার না করতেন, অর্থাৎ অবসর সময়ে, ক্যাপ্টেন কুর্টজ আঁকতেন নিসর্গ-চিত্র, রচনা করতেন কবিতা, সংগ্রহ করতেন প্রজাপতি। এইভাবে সভ্যতা আর অসভ্যতা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করত তার মধ্যে। কনরাডের চোখে, কুর্টজই ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদ, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলছেন- ‘ছোট ইংরেজ’।
[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৪
১. পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ

ওয়াশিংটন ডিসির ভেননেস্‌ ও টেনলিটাউন মেট্রোর মাঝখানে ফুটফুটে বইয়ের দোকান পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ। দুই মেট্রোর মাঝখানের হাঁটাপথে বাস্তবিকই এক মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে। উপর-নিচ মিলিয়ে বেশ দীর্ঘ পরিসরের দোকান, তাতে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন বিষয়ের বই। এ রকম বইয়ের দোকান কি আমাদের দেশেও নেই? আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু যেটা পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজকে আর দশটা বইয়ের দোকান বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট বুক স্টোর থেকে আলাদা করে, সেটা হলো তার ধারাবাহিক সেমিনার- বিভিন্ন বইকে ঘিরে আলোচনা-চক্র। আর সেসব বইয়ের আলোচনা করেন লেখকেরা নিজেই, পরে থাকে প্রশ্নোত্তর পর্ব, সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের অনুষ্ঠান। শুরু হয় সন্ধ্যে ৬টার দিকে। প্রতি মাসে অন্তত আটটা বইয়ের আলোচনা হয়। শিল্প-সাহিত্যের বইয়ের তাকগুলো যেখানে, সেখানেই শেল্কম্ফ সরিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। মোটামুটি একশ’টা চেয়ারের ব্যবস্থা, তবে সে রকম আলোচক হলে চারপাশে বইয়ের তাক ধরে সামনে-পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে আরও অনেক লোক। কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে আরও বেশি আগ্রহী শ্রোতার ভিড় জমাবার সম্ভাবনা যেখানে- সেখানে বইয়ের আলোচনা স্থানান্তরিত হয় সিক্সথ স্ট্রিটের চার্চের ভেতরে। যে রকমটা হয়েছিল সালমান রুশদীর বেলায়। অরুন্ধতী রায়ের নতুন উপন্যাসের জন্যও বড় জায়গার প্রয়োজন হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটনের স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের আলোচনাও হয়েছিল ওই চার্চে। কিন্তু বেশিরভাগ লেখক-ঔপন্যাসিক ‘মেমোয়ারিস্ট’-কবি-ইতিহাসবিদ-প্রবন্ধকাররাই পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজের অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। কে আসেননি এখানে? স্তালিন-জীবনীকার স্টিফেন কতকিন, অর্থনীতিবদ পল ক্রুগম্যান, পোয়েট লোরিয়েট ট্রেসি স্মিথ, প্রবন্ধকার টা-নাহাসি কোটস, ‘এক্সিট ওয়েস্ট’-এর লেখক মোহ্‌সিন হামিদ- সবাই আগ্রহ নিয়ে থাকেন এখানে এসে নিজের সৃষ্টিকর্মের ওপরে কিছু বলার জন্য। ক্লিনটন, বুশ, ওবামা, ট্রাম্প যিনিই প্রেসিডেন্ট থাকুন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই লাইব্রেরি বা বুক স্টোরকেন্দ্রিক ‘সাব-কালচারটি’ এখনও আগের মতোই জীবন্ত হয়ে রয়েছে। শুধু পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ নয়, বড়-ছোট শহরের বইয়ের দোকানকে ঘিরে আলোচনা-চক্র (এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিডিং ক্লাবের মতো পাঠচক্র) ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে গত একশ’ বছর ধরে।

এ রকমই একটি বইয়ের আলোচনায় এসেছিলেন এদোয়ার্দো গালিয়েনো (Eduardo Galeano)। ২০০৯ সালের শীতের এক সন্ধ্যায় গালিয়েনো আসবেন পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজে- এটা জেনে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি। গালিয়েনোকে স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার এই সম্ভাবনাকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করা চলে না। লাতিন আমেরিকার ডিক্টেটরশিপ ও তার প্রতি মার্কিনিদের অব্যাহত নির্বিচার সমর্থন নিয়ে তার ‘ওপেন ভেইনস্‌ অব লাতিন আমেরিকা’ ছাড়ার পর থেকেই তার প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠি। আমাদের দেশে আমরা যেহেতু সুদীর্ঘকাল সামরিক বাহিনীর দীর্ঘ ছায়ায় কাটিয়েছি (এবং এখনও তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির গুজবের রেশ শহর-ঢাকার বুক থেকে মিলিয়ে যায়নি) লাতিন আমেরিকার ডিক্টেটরশিপ ও সামরিকতন্ত্র নিয়ে বেশি করে জানার স্বাভাবিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রজন্মের মধ্যে। একাত্তরের স্বাধীনতা তো মিলিটারি ডিক্টেটরশিপের বিরুদ্ধে এক সুদীর্ঘ লড়াইয়েরই ফসল। পঁচাত্তরের পরে ক্যু-পাল্টা ক্যু, জেনারেলদের আমল, সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, বেসামরিক সরকার-প্রশাসনের প্রতি ঠান্ডা যুদ্ধের কায়দায় বিভিন্ন পর্বের সামরিক চাপ আমাদের প্রজন্মের প্রতি পাকিস্তানের সামরিক অর্থনীতির ওপরে বিশেষজ্ঞ আয়েশা সিদ্দিকার সাবধানবাণী ‘কখনও সামরিকতন্ত্রকে খাল কেটে কুমিরের মতো ডেকে এনো না’, এক-এগারোর হুমকি-ধামকি, সেলিঞ্জারের অ্যাংরি ইয়াংম্যানের মতো দেশোদ্ধারে ব্রতী মিথিক্যাল অ্যাংরি ইয়াং অফিসারবৃন্দ- এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতেই আমাদের জীবন প্রায় কেটে গেল। সন্দেহ কী যে আমাদের মধ্যে ওই তরুণ বয়সেই আগ্রহ সৃষ্টি হবে চিলির নেরুদার কবিতা আর তার প্রতিপক্ষ জেনারেলদের প্রতি বা কলম্বিয়ার মার্কেজের উপন্যাস আর তার নিঃসঙ্গ কর্নেলের প্রতি, পেরুর ভার্গাস ইয়োসার উপন্যাস, নিকারাগুয়ার এর্নেস্তো কার্দেনালের কবিতা, ইকুয়েডরের অসওয়াল্কেন্ধা গইয়াসামিন (Guayasamin)-এর চিত্রকর্ম, মেক্সিকোর গল্পকার কার্লোস দ্য ফুয়েন্তেস, কবি অক্টাভিও পাজ, সেন্টার-পেরিফেরি স্কুলের লাতিন আমেরিকার ‘ডিপেনডেন্‌সিরা’ তত্ত্বের প্রণেতারা (লাকলাউ, কারদোসো), উরুগুয়ের প্রাবন্ধিক-সাহিত্যিক এদোয়ার্দো গালিয়েনো এবং সেই সূত্রে সমগ্র লাতিন মহাদেশই আমাদের আত্মার কাছাকাছি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আজ সামরিকতন্ত্র কেবল টিকে আছে আফ্রিকার কিছু দেশে :সারা লাতিন আমেরিকাতেই দুর্বল হোক সবল হোক বিরাজ করছে নানা চরিত্রের গণতন্ত্র। পূর্ব এশিয়ার একদা-সামরিকতন্ত্র অধ্যুষিত দেশগুলোতেও এসেছে গণতান্ত্রিক শাসন, যদিও দেশভেদে তার গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু অনেকটাই প্রশ্নকীর্ণ। এক সময় সুদীর্ঘকাল একচ্ছত্র শাসন করা সামরিকতন্ত্র এখন পিছু হটেছে দক্ষিণ এশিয়াতেও- যেমন পাকিস্তানে। তবে সর্বত্র পিছু হটলেও সামরিকতন্ত্রের নেপথ্য-প্রভাব কমেনি। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ এখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে, সে একাই সামরিকতন্ত্রকে মোকাবিলা করতে পারবে। গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ যদি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটের’ আদলে গড়ে উঠতে পারে, যদি তার কল্যাণকামী দিকটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তবেই জনগণ কেবল সেই গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সঙ্গী হবে। এবং সম্ভাব্য সামরিক-হুমকি বা ‘এক-এগারো’র বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু যদি এ দেশের পুঁজিবাদ ক্রমেই অতি-ধনীদের করালগ্রাসে চলে যায়, তবে নেমে আসতে পারে মাৎস্যন্যায়। যার অপেক্ষায় থাকবে সামরিকতন্ত্রের ঝুঁকি। এটাই লাতিন আমেরিকার শিক্ষা। এ নিয়েই সারা জীবন গল্প, অনুগল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস, দর্শন লিখে গেছেন এদোয়ার্দো গালিয়েনো। তার স্মৃতি এক গোটা জনগোষ্ঠীর স্মৃতির মতন। কিছুই ভোলা হয়নি তাতে, কোনো প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গই বাদ পড়েনি, মণি-মুক্তার মতো সেসব অভিজ্ঞতার স্মৃতি-বিস্মৃতি সংকলন করেছেন গালিয়েনো। আমাকেও বলেছিলেন, ‘আপনি এ রকম একটা চেষ্টা করে দেখুন না কেন দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে? আপনাদেরও তো রয়েছে- আমি জানি- কত বলা কত না-বলা সংগ্রামের ইতিহাস, কথা ও কাহিনি।’
[ক্রমশ]

পভার্টি ট্র্যাপ ও আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য: সিলেটে রবীন্দ্রনাথের ভাষণ (Poverty Trap and Poverty of Aspiration: Tagore in Sylhet)

পর্ব ::৩৩

৫. আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য

কিন্তু শ্রীহট্ট কলেজে তার ভাষণের উদ্দেশ্য ছিল অন্যত্র নিহিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নয়, উন্নয়নের দৃষ্টিকোণকেই রবীন্দ্রনাথ সেখানে বেশি করে প্রাধান্য দিয়েছেন। দরিদ্ররা যে চিরকালেই দারিদ্র্যের ফাঁদে থেকে যায়, তার মূল কারণের মধ্যে ‘আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য’ও একটি। সাম্প্রতিক উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রেও ‘পভার্টি অব এসপিরেশন’ একটি স্বীকৃত ধারণা। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার সহকর্মীদের একটি বড় পর্যবেক্ষণ হলো- গরিবরা গরিব শুধু তাদের বৈষয়িক অবস্থার কারণে নয়, এর মূলে রয়েছে তাদের উপরে-ওঠার উচ্চাকাঙ্খার অভাব। একবার সেই আকাঙ্খাকে প্ররোচিত করতে পারলে-সেটা ‘ক্ষুদ্র প্রণোদনা’ দিয়েই অর্জন সম্ভবুদরিদ্রের মৃদুমন্দ চলাকে বৃহৎ উল্লম্ম্ফনে পরিবর্তন করা যায়। এটাকে অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন-‘উদ্বুদ্ধকরণের অর্থনীতি’ বা nudge-economics. যার মাধ্যমে গরিব মানুষের আচরণ-কার্যকলাপের ধরন-ধারণা পরিবর্তন করা সম্ভব। যাতে করে তারা দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে একশো বছর আগেই এই দারিদ্র্য-ফাঁদের তত্ত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি শ্রীহট্ট ভাষণে সেদিন বলেছিলেন :’যদি মূলের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখব আমাদের যে দারিদ্র্য সে আত্মারই দারিদ্র্য। …নদী যখন মরে যায় তখন দেখতে পাই গর্ত এবং বালি, সেই শূন্যতার সেই শুস্কতার অস্তিত্ব নিয়ে বিলাপ করবার কথা নেই। আসল বিলাপের কারণ নদীর সচল ধারার অভাব নিয়ে। আত্মার সচল প্রবাহ যখন শুস্ক তখনি আচারের নীরস নিশ্চলতা।’

আচারের নিশ্চলতা আসে গতানুগতিকতার বৃত্তে নিজেকে বেঁধে ফেলার মানসিকতার কারণে। রবীন্দ্রনাথ এর কারণ অন্যত্র দেখেছিলেন আমাদের বহুধা-বিভক্ত জাত-পাতসর্বস্ব ধর্মাচারের মধ্যে। ‘আকাঙ্ক্ষা’ প্রবন্ধে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন শিক্ষা-ব্যবস্থার দীনতা নিয়ে। কোন জাতিকে যদি ধ্বংস করে দিতে চাও তাহলে তার শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ভেতর-থেকে ধ্বংস করে দাও- এই ছিল তার মত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এ প্রসঙ্গে :’আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময়ে বড় বয়সে সংসারের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙ্খার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়। তখন আমাদের বিষয়বুদ্ধি, অর্থাৎ ছোট বুদ্ধিটাই বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড় রাস্তায় চলবার পাথেয় ভার হালকা করে দিই।’

এই বলে রবীন্দ্রনাথ তার নিজের গড়া শান্তিনিকেতনের উদাহরণ টেনে আনলেন। সেখানেও কিছুতেই ছাত্র-ছাত্রীদের পুঁথিগত বিদ্যার প্রভাব থেকে সরিয়ে আনা যাচ্ছিল না। ‘নিজের বিদ্যালয়ে ছোট ছোট বালকদের মধ্যেই সেটা আমি অনুভব করি। প্রথমে কয় বৎসর একরকম বেশ চলে কিন্তু ছেলেরা যেই থার্ড ক্লাসে গিয়ে পৌঁছয় অমনি বিদ্যা অর্জন সম্বন্ধে তাদের বিষয়বুদ্ধি জেগে ওঠে। অমনি তারা হিসাব করতে শিখতে বসে। তখন থেকে তারা বলতে আরম্ভ করে, আমরা শিখব না, আমরা পাস করব। অর্থাৎ যে পথে যথাসম্ভব কম জেনে যতদূর সম্ভব বেশি মার্ক পাওয়া যায় আমরা সেই পথে চলব।’

একেই অর্থনীতিবিদ ল্যান্ট প্রিচেট আখ্যায়িত করেছেন ‘জানার সংকট’ বা লার্নিং ক্রাইসিস বলে। আমরা ডিগ্রি পাচ্ছি, কিন্তু যা জানা দরকার ছিল তা জানছি না। রবীন্দ্রনাথ একে কেবল উন্নতমানের শিক্ষা-পদ্ধতি বা ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’-এর সমস্যা হিসেবে দেখছেন না। বেশি করে জানার ইচ্ছাটাই মরে যাচ্ছে, বিশেষ করে এটা মরে যাচ্ছে গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য। কোন ভাবে পাশ করে সরকারী চাকুরে হওয়ার ইঁদুর-দৌড়ে গরিব-মধ্যবিত্ত সবাই নিয়োজিত। জানার জন্য জানা- এই আকাঙ্খা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। এ-ই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চরম দুর্ভাবনা।

শিক্ষার নানা আনুষ্ঠানিক ধাপ অতিক্রম করা হচ্ছে, কিন্তু জ্ঞান বাড়ছে না, ‘জানার সংকট’ থেকে যাচ্ছে- এর ফলে একভাবে দেখলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লেও দেশ থেকে অন্ধকার দূর হচ্ছে না। দেশের উন্নয়নে এই শিক্ষা যথাযথ অবদান রাখতে পারছে না। আর সেটা দেখে যারা দেশের বাজেট প্রণয়ন করেন, তারা শিক্ষার পেছনে বাজেট-বরাদ্দ বাড়াতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এক ধরনের বিষ-বৃত্তের সৃষ্টি হচ্ছে এতে। শুধু পরীক্ষা-পাসের শিক্ষায় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে; কিন্তু দেশ ও দশের উন্নয়ন বেগবান হয় কিনা- সে প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের সংশয় ছিল। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘আকাঙ্ক্ষা’ ভাষণে স্পষ্ট করে তার ভিন্নমত উত্থাপন করেছেন : ‘যে দেশে বিদ্যালয়ে কেবল দেখতে পাই, ছাত্র নোটবুকের পত্রপুট মেলে ধরে বিদ্যার মুষ্টি ভিক্ষা করছে, কিম্বা পরীক্ষার পাসের দিকে তাকিয়ে টেক্‌স্‌ট্‌ বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যার উঞ্ছবৃত্তিতে নিযুক্ত; যে দেশে মানুষের বড় প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্রেই পরের কাছে ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, নিজের হাতে দেশের লোকে দেশকে কিছুই দিচ্ছে না- না স্বাস্থ্য, না অন্ন, না জ্ঞান, না শক্তি; যে দেশে কর্মের ক্ষেত্রে সংকীর্ণ, কর্মের চেষ্টা দুর্বল, যে দেশে শিল্পকলায় মানুষ আপন প্রাণ মন আত্মার আনন্দকে নব নব রূপে সৃষ্টি করছে না; যে দেশে অভ্যাসের বন্ধনে সংস্কারের জালে মানুষের মন এবং অনুষ্ঠান বদ্ধবিজড়িত; যে দেশে প্রশ্ন করা, বিচার করা, নূতন করে চিন্তা করা, ও সেই চিন্তা ব্যবহারে প্রয়োগ করা কেবল যে নেই তা নয় সেটা নিষিদ্ধ এবং নিন্দনীয়, সেই দেশে আপন সমাজে আত্মাকে দেখতে পায় না, কেবল হাতের হাতকড়া, পায়ের বেড়ি এবং মৃতযুগের আবর্জনা-রাশিকেই চারদিকে দেখতে পায়, জড় বিধিকে দেখে, জাগ্রত বিধাতাকে দেখে না।’

পরীক্ষা-পাসের দাসত্ব থেকে জানার বা জ্ঞানের সংকট শুধু আর শিক্ষা ক্ষেত্রের দীনতায় সীমিত রইল না। এই শিক্ষার সংকটের কারণে ভিন্ন রুচির মানুষের জন্ম হলো, যার হাত দিয়ে উন্নয়ন বেগবান করা প্রায় অসম্ভব। এ কথা রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য লেখাতেও নানাভাবে বলেছেন। শিক্ষাকে তাৎক্ষণিকের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করতে চাইলে হিতে বিপরীত ঘটে। রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাকাহিনী’ এ প্রসঙ্গে মনে পড়বে। ‘আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক ভাষণের দু’বছর পূর্বে ‘সবুজপত্র’ সাময়িকীতে প্রকাশিত রূপক-গল্পে তিনি লিখেছিলেন :’এক যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত; শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত; জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে। রাজা বলিলেন, ‘এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।’ মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও।’ এর ফল কী হয়েছিল, তা আমাদের জানা। পাখিকে পুঁথি-শিক্ষা দিতে গিয়ে রাশি রাশি পুঁথির পাতা তাকে গেলানো হলো। জীবনাবসান হলো তার এক পর্যায়ে। পরীক্ষা-পাসের তাড়নায় একালের ছাত্র-ছাত্রীদেরও তোতাকাহিনীর পাখির দশা হওয়ার উপক্রম। তাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেতে বসেছে, মহৎ কিছু করার স্বপ্ন প্রায় অবলুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ যে-যুগে এসব কথা বলেছিলেন, আজ সে কথা এই ‘ম্যাস এডুকেশন’-এর যুগে আরো প্রাসঙ্গিক। জনমানসে শিক্ষার যে বাসনা জেগেছে, সেটাকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে, কীভাবে শিক্ষার সাধনাকে অন্তত দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তনগুলোতে উৎসাহিত করা যায় সেদিকটি নিয়েও রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাবতে বলেছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি ‘নালন্দা বিক্রমশীলা তক্ষশীলা’র উদাহরণ টেনে বিশ্ববিদ্যালয়কে তত্ত্বজ্ঞানীদের মিলনক্ষেত্র করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন; আবার অন্যদিকে যারা উচ্চশিক্ষার সোপানে উন্নীত হবে না, তাদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার চেয়েছেন। জ্ঞানের বৈষয়িক দিককে তিনি অস্বীকার করেন নি। তিনি জ্ঞানের সাধনার দিকের সর্বাত্মক বিকাশ চেয়েছিলেন কেবল। ইউরোপের ছকে নয়, আমাদের দেশের আদলে আমাদের প্রয়োজন মাথায় রেখে আমরা যেন বিদ্যায়তন গড়ে তুলি; সেটা তিনি চেয়েছিলেন। অথচ আমরা একে একে দেশের উচ্চ বিদ্যায়তনগুলো শেষ করে দিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছেন: ‘যে-জ্ঞান আমাদের সত্যের দিকে নিয়ে যায় গোড়া থেকেই সেই জ্ঞানের সঙ্গে অসত্য ব্যবহার। এর কি অভিশাপ আমাদের দেশের পরে লাগছে না? এই জন্যেই কি জ্ঞানের যজ্ঞে আমরা ভিক্ষার ঝুলি হাতে দূরে বাইরে বসে নেই? আপিসের বড় বাবু হয়েই কি আমাদের এই অপমান ঘুচবে? …সব বড় দেশে যে বড় আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আপন শক্তিতে আপন ভাবনায় আপন হাতে সৃষ্টি করবারই গৌরব দান করে আমরা সেই আকাঙ্ক্ষাকেই কেবল যে বিসর্জন করছি তা নয়, দল বেঁধে লোক ডেকে বিসর্জনের ঢাক পিটিয়ে সেই তালে তাণ্ডব নৃত্য করছি।’ এখনো সেই তাণ্ডব নৃত্যই আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে।

৬. আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য থেকে পরনির্ভরতা

একশো বছর আগে সিলেটে রবীন্দ্রনাথ যে আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্যের কথা বলেছিলেন, তার ফলে শুধু চাকরি খোঁজা তরুণ সম্প্রদায়েরই সৃষ্টি হচ্ছে না, ‘বড় কিছু’ করার ইচ্ছেও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এর থেকে জন্ম নিয়েছে এক অভূতপূর্ব পরনির্ভরশীল মানসিকতার। সিলেটে আসার কয়েক বছর আগে একটি প্রবন্ধে তিনি ভরসার ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাবের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছিলেন :

“আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, অপরে আমাদের শক্তি সম্বন্ধে সর্বদা সন্দেহ প্রকাশ করে বলিয়াই এবং সেই সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণ করিবার কোনো ক্ষেত্র পাই না বলিয়াই অন্তরে তন্তরে নিজের সম্বন্ধেও একটা সন্দেহ বদ্ধমূল হইয়া যায়। এমনি করিয়া আপনার প্রতি যে লোক বিশ্বাস হারায় সে কোনো বড়ো নদী পাড়ি দিবার চেষ্টা পর্যন্তও করিতে পারে না; অতি ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে ডাঙ্গার কাছে কাছে সে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং তাহাতেই সে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকে এবং যেদিন সে কোনো গতিকে কাগবাজার হইতে বরানগর পর্যন্ত উজান ঠেলিয়া যাইতে পারে সেদিন সে মনে করে, ‘আমি অবিকল কলম্বাসের সমতুল্য কীর্তি করিয়াছি।”

চাকরি লাভের জন্য যে শিক্ষা তাতে শিক্ষার চেয়ে চাকরির প্রাপ্তিই বড় লক্ষ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়ো, ডেপুটি মুনসেফের চেয়ে বড়ো’- এটাই আমাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে। কেননা, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জাতি হিসেবে, সমষ্টি হিসেবে, আরো উপরে, ঐ উপরে ওঠার।’ ‘পাখির ছানা তো বিএ পাস করিয়া উড়িতে শেখে না; উড়িতে পায় বলিয়াই উড়িতে শেখে।’ কিন্তু আমাদের উড়বার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। রাষ্ট্রজীবনে জ্ঞান-তপস্যার স্বীকৃতি ও গুরুত্ব কমে এসেছে। অনুকৃতিকেই আমরা পরম আরাধ্য বলে বিবেচনা করছি। এভাবে চললে দেশ হিসেবেও আমরা পিছিয়ে যাব, পেছনের সারিতে পড়ে থাকব চিরকাল। রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানজগতের পরনির্ভরতাকে শেষের বিচারে আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্যের সাথে যুক্ত করে দেখেছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটা পাঠ করলে সে বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে না :’যে ইতিহাস ইংরেজি কেতাবে পড়িয়াছি তাহাই আমাদের একমাত্র ইতিহাসের বিদ্যা, যে পলিটিক্যাল ইকোনমি মুখস্থ করিয়াছি তাহাই আমাদের একমাত্র পলিটিক্যাল ইকোনমি। যাহা কিছু পড়িয়াছি তাহা আমাদিগকে ভূতের মতো পাইয়া বসিয়াছে… আমরা মনে করিতেছি। পলিটিক্যাল সভ্যতা ছাড়া সভ্যতার আর কোনো আকার হইতেই পারে না।… মানুষ যদি এমন করিয়া শিক্ষার নীচে চাপা পড়িয়া যায়, সেটাকে কোনোমতেই মঙ্গল বলিতে পারি না।… আমরা জগতের ইতিহাসকে নিজের স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখিতে সাহস করিলাম কৈ, আমরা পলিটিক্যাল ইকোনমিকে নিজের স্বাধীন গবেষণার দ্বারা যাচাই করিলাম কোথায়?’

[এই বিষয় সমাপ্ত]