বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭১

পূর্বে প্রকাশিতের পর
৮. বাহাত্তরের সংবিধানের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র
বঙ্গবন্ধু মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের অনুসারী ছিলেন না। তবে সত্যের ওপরে কেবল তো ‘মার্কসবাদীদেরই’ মনোপলি নেই। পুঁজিবাদী সমাজের তুলনায় সমতাবাদী সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মতো বঙ্গবন্ধুর এই বিষয়ে চিন্তা স্বচ্ছ ছিল। যদিও তার লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত সমাজ গড়া, কিন্তু লক্ষ্যটা যে অনেক দূরের স্টেশন, এ রকম একটা কৃষিপ্রধান পশ্চাৎপদ সমাজের পটভূমিতে সহজে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেটা তিনি পঞ্চাশের দশকেই বুঝতে পেরেছিলেন। সুতরাং সমাজতন্ত্র তার কাছে কোন  End-State নয় বরং একটি Process বা দীর্ঘকালীন অভিযাত্রার মতো বিষয় বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। অর্থাৎ এটি কোনো তিন বা পাঁচ বছরে সমাধা করার মতো চ্যালেঞ্জ নয়। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ১৯৭২-৭৫ পর্বে তিনি সমাজতন্ত্র অর্জনের অনিবার্যতার পাশাপাশি এর দীর্ঘ পথযাত্রার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মার্কস বা লেনিনের মতো তত্ত্বচর্চা করেননি তিনি, কিন্তু বাস্তব কাণ্ডজ্ঞানের জোরে ‘আদর্শ’ ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য এক সুদীর্ঘ ‘প্রস্তুতি-পর্বের’ মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে পেরেছিলেন। সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১৯৭৪ সালের ৪ ডিসেম্বরের ভাষণে আবারও ফিরে যেতে হয়। সেখানে তিনি বারবার বলছেন যে গণতন্ত্রের কাঠামোয় সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা করা সহজ নয়। এমনকি যারা দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য গণতন্ত্রের হাত ছেড়ে দিয়েছিল, তারাও এখনও সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে পারেনি:
‘সোশ্যালিজম যেখানে শুরু হয়েছে সে সোভিয়েত ইউনিয়নে আজ ৫১ বৎসর হয়ে গেছে সোশ্যালিজম করতে পারে নাই। এখনও ঘাত-প্রতিঘাতে অগ্রসর হচ্ছে, নতুন নতুন পথ তাদের জানতে হচ্ছে। এ রাস্তা সোজা রাস্তা নয়, এ রাস্তা কঠিন রাস্তা।’
যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যই এটা প্রযোজ্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান এবং প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করা কতটা কঠিন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কোনো রাখঢাক করেননি :
‘পরিস্কার কথা … সোশ্যালিজম এত সোজা না। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। সে পদক্ষেপ নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। বাধা আমাদের আসবেই। যাদের কাছ থেকে আমরা সম্পদ নিয়েছি, যারা এখানে সম্পদ ফেলে গেছে, তাদের দালালরা, বিদেশি শক্তিরা তারা আজকে চেষ্টা করছে আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক ইকোনমি বানচাল করার জন্য। যাতে প্রডাকশন কম হয়, যাতে দুশমনরা খুশি হয়, মানুষের কষ্ট হয়। … এত তাড়াতাড়ি কিছু দিবার ক্ষমতা আমাদের নেই। … আমরা একটা সিস্টেম নিয়েছি। যে সিস্টেমে আমাদের কোনো অসুবিধা হতো না যদি সোশ্যালিজম না নিতাম। … যখন আমাকে আঘাত করতে হয়েছে, বুঝে শুনে আঘাত করেছি। … ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, কোম্পানি, মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট যদ্দুর পারা যায় হাতে নিয়ে নেও। কষ্ট হবে, বুঝতে হবে এক্সপিরিয়েন্স নাই। ভবিষ্যতে, অদূর ভবিষ্যতে সোশ্যালিজম [হবে বলে] আজকে লেট করা যায় না। ১০ বৎসর, ২০ বৎসর, ২৫ বৎসর পর লেট করা যায়। এইটা মানুষকে বুঝতে হবে, যারা সোশ্যালিজমে বিশ্বাস করে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা না বুঝলে উপায় নাই। সোজা রাস্তায় হয় না। সে জন্যে সে পথ আমাদের ছাড়তে হবে।’
দেখা যাচ্ছে যে, দুটো চিন্তাই বঙ্গবন্ধুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একদিকে রাতারাতি যেমন সমাজতন্ত্র গড়া যাবে না, অন্যদিকে, সমাজতন্ত্র দূরের স্টেশন বলে প্রগতিশীল পদক্ষেপ নেওয়া থেকে আজকে বিরত থাকা যাবে না। ‘দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য’ এবং ‘আসন্ন কর্তব্য’ উভয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। এবং সেই ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হবে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেই। তা-ও আবার কৃষিপ্রধান পশ্চাৎপদ সমাজের পটভূমিতেই। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় কেন মুজিবের পক্ষে সমাজতন্ত্রকে একটি  ‘end-state’ হিসেবে দেখা সম্ভব ছিল না, এবং কেন সমাজতন্ত্রকে তিনি একটি ‘চলমান প্রক্রিয়া’ হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। এর অর্থ হলো, পুঁজিবাদের ‘প্রগতিশীল’ অর্জন ও বিকাশের ধারার মধ্যেই তিনি ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপাদানগুলোকে লালন ও বৃদ্ধিশীল করতে চেয়েছিলেন। এই বিষয়টি তিনি মার্কস চর্চা করে বোঝেননি, বুঝেছিলেন ইনটুয়েটিভলি। তবে এ ধরনের ভাবনার আলো-হাওয়ার মধ্যেই তিনি বাস করছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে, এটা অনুমান করা শক্ত নয়। ১৯৭৪ সালেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন-এর উদ্যোগে কনফারেন্স ‘দ্য ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ উইদিন এ সোশ্যালিস্ট ফেমওয়ার্ক’ (পরে এটি বই আকারেও প্রকাশিত হয়)। অনুন্নত কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে ‘সমাজতান্ত্রিক রূপরেখা’ কীভাবে দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদেরা। দূরের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র এবং কাছের লক্ষ্য অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও তার প্রগতিশীল রূপান্তর- এই দুটো বিষয়ই সেই সম্মেলনে স্থান পেয়েছিল। সুতরাং দূর এবং আশু কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নানা উৎস থেকেই তথ্য ও প্রেরণা পাচ্ছিলেন। তবে এটি শুধু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্রের সার্বিক ধারণার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মার্কস-এঙ্গেলস, এমনকি লেনিন শেষ পর্যন্ত এটা মেনে নিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র বিনির্মাণকে ‘End-State’ হিসেবে না দেখে বরং ‘Process’ হিসেবেই দেখা শ্রেয়তর। তার অর্থ, পুঁজিবাদের উপাদানগুলোর পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলো অবস্থান করবে, জন্ম নেবে এবং আর্থসামাজিক রূপান্তরের ধারায় সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলো ক্রমশই জয়যুক্ত হয়ে সমাজতন্ত্রকে আখেরে বিজয়ী করবে। সমাজতন্ত্রের আদর্শকে যদি Socialism-as-an-end-state হিসেবে না দেখে Socialism-as-a-process হিসেবে দেখা যায় তাহলে বৃহৎ-উল্লম্ম্ফনমূলক হঠকারী কর্মসূচিকে যেমন পাশ কাটানো যায়, আবার পুঁজিবাদের স্বয়ংক্রিয় ও স্বতঃস্ম্ফূর্ত বিকাশের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করার নিষ্ফ্ক্রিয় অবস্থানকেও এড়ানো সম্ভব। নিউ ইকোনমিক পলিসি (NEP) নিয়ে লেনিনের নানা বক্তব্যের মধ্যে Socialism-as-a-process এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন স্পষ্ট হয়।
সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে হলে যে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে তার ইঙ্গিত লেনিনের লেখাতেই পাওয়া যায়। ইনট্রোডিউসিং নিউ ইকোনমিক পলিসি শীর্ষক ভাষণে লেনিন বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র জোতের কৃষিব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনতে কয়েকটা প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। তার মানে এটা বলছি না যে, শতাব্দী লেগে যাবে। কিন্তু আমাদের মতো এতো বড় দেশে সবাইকে ট্রাক্টর যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সুবিধা এবং বিদ্যুৎ দিতে হলে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এটাই অবজেকটিভ পরিস্থিতি।’ তার মানে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পর্ব সম্পন্ন করার বিষয়টি এক-দুই বছরের নয়, কয়েক দশকের ও প্রজন্মের ব্যাপার এটি। সেরকম সময়ে গ্রামীন অর্থনীতিতে সমবায়ী খাতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র কৃষকেরাও থেকে যাবে এক সুদীর্ঘ কাল।
পুঁজিবাদের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র অনেক দিন পর্যন্ত অবস্থান করে চলতে পারে- পুঁজিবাদের ‘ভেতর থেকেই’ যে সমাজতন্ত্রের অনেক ‘বস্তুগত ভিত্তির’ জন্ম হয় বা হতে পারে- এ কথা লেনিন অনেকবারই বলেছেন। একটি উদাহরণ কেবল এখানে দেব। অক্টোবর বিপ্লবের পরও যে নারীরা ‘স্বাধীন’ হতে পারছে না, তার কারণ বাসার কাজের বোঝা তাদের ওপরে পূর্বাপর থেকেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ করে তাকাতে বললেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশের বেশ কিছু প্রগতিশীল উদ্ভাবনের প্রতি। পুরো উদ্ৃব্দতিটি বর্তমান আলোচনার জন্য প্রণিধানযোগ্য। লেনিন লিখেছেন :
‘Do we take proper care of the shoots of communism which already exist in this sphere? Again the answer is no. Public catering establishments, nurseries, kindergartens- here we have examples of these shoots which can really emancipate women. These means are not new, they (like all the material prerequisites for socialism) were created by large-scale capitalism.’

পুঁজিবাদী দেশগুলোয় সর্বজনীন নির্বাচনী ব্যবস্থায় উত্তরণ, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা, সর্বজনীন ও মৌলিক শিক্ষাবিধির প্রচলন, বেকার ভাতা ইত্যাদি ধারণাগুলো এমনিতেই অর্জন হয়নি। এর পেছনে ছিল শ্রমিক শ্রেণির নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রাম, অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকট, বিপ্লব ও বিপ্লবপ্রচেষ্টা, যুদ্ধ ও যুদ্ধের কারণে বদলে যাওয়া সামাজিক-শ্রেণি শক্তির পুনর্বিন্যাস প্রভৃতি উপাদানের চাপ। প্যারি কমিউন না হলে বিসমার্কের জার্মানিতে (সামাজিক গণতন্ত্রীদের ক্ষমতায় আসারও ঢের আগে) ‘Social State’-এর জন্ম হতো না। ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ ধারণার পেছনে বিসমার্ক থেকে শুরু করে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সোশ্যাল ডেমোক্রেটসরা, লিবারেল কান্ট-মিল থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মার্কস-এঙ্গেলস সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে’ মার্কস-এঙ্গেলস যেসব ‘গণতান্ত্রিক দাবি’ তুলেছিলেন তা কোনো দূর-ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য বিশিষ্ট দাবি নয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, যাকে আমরা আজকে ‘Social democracy’ বলি, তার অধিকাংশ দাবিই উদারনৈতিক গণতন্ত্রী আর কট্টর সমাজতন্ত্রী মতের অনুসারীদের কখনও বিচ্ছিন্ন, কখনও সমবেত, আন্দোলন-সংগ্রামেরই ফসল। এসব Social Democratic দাবি-দাওয়ার কোনটি লিবারেলদের সংগ্রামের অর্জন, কোনটি সামাজিক গণতন্ত্রীদের বা কোনটি কমিউনিস্টদের সংগ্রামের প্রভাব সেটি চুলচেরা বিশ্নেষণ করে বলা সত্যই কঠিন কাজ। মিল, বার্নস্টাইন এবং লেনিন যথাক্রমে লিবারেল, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ও কমিউনিস্ট ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। এই ত্রিধারার মধ্য থেকেই যার যার মতো করে অতীতে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধ্যান-ধারণা বলার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে। এটুকু বলা যায়, বঙ্গবন্ধু ও তার নিকট সহযাত্রীরা মোটা দাগে এসব ধারা ও উপধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি এসব আন্দোলনের জল-হাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে পরিপকস্ফ হয়েছেন। এ কথা তিনি জানতেন যে, সব ধারার মধ্যেই শিক্ষণীয় ও বর্জনীয় দিক রয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের জন্য তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে ধ্যান-ধারণা ও অভিজ্ঞতা আহরণের পক্ষপাতী ছিলেন। এই ‘প্রাগম্যাটিক’ চিন্তাই লেনিনের ভাষায় ‘প্র্যাকটিক্যাল ইকোনমিকস’- তাকে সংবিধানের ‘৪টি স্তম্ভ’ নির্বাচনে সাহায্য করেছে। তিনি গণতন্ত্রও চান, সমাজতন্ত্রও চান। ধর্মনিরপেক্ষতাও চান, আবার বিশেষ চিহ্ন সম্বলিত জাতীয়তাবাদও অবলম্বন করতে চান। কোনোটিকেই তিনি অন্যটির চেয়ে বেশি ‘গুরুত্ব’ দিতে চান না। এই মূল আদর্শের মধ্যে আবার রয়ে গেছে নানা ধারা ও উপধারা। সেসব মিলিয়ে একটি দূরদর্শী কিন্তু বাস্তবোচিত ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ তিনি গড়তে চেয়েছিলেন। বলেও ছিলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য সব উৎসের দিকে তিনি হাত বাড়াতে প্রস্তুত। তারই প্রতিফলন ঘটে বাহাত্তরের সংবিধানে।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে (যে ভাষণে জাতীয়করণের নীতি ঘোষিত হয়) বঙ্গবন্ধু জানালেন যে, তিনি সংবিধান তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। এ নিয়ে অযথা কালক্ষেপণ করতে চান না তিনি। এ নিয়ে বিলম্ব করায় পাকিস্তান রাষ্ট্র যথাযথভাবে পরিচালিত হতে পারেনি, সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র ক্ষমতায় জেঁকে বসেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ৬-দফার ভিত্তিতে সাংবিধানিক প্রশ্নের অনিষ্পত্তির কারণে পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছিল। সে জন্যেই স্বাধীন দেশে তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়ায় একটি আধুনিক, প্রগতিশীল, কার্যকর ও ভবিষ্যৎমুখীন সংবিধান নির্মাণ। উপরোক্ত ভাষণে তিনি জানালেন : ‘বিশেষজ্ঞরা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং খসড়া শাসনতন্ত্র গণপরিষদের সামনে পেশ করা হবে। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’।
এই ভাষণের দুই সপ্তাহ পরে (১০ এপ্রিল, ১৯৭২) গণপরিষদের অধিবেশনে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ সম্পর্কিত প্রস্তাব পাস হয়। এই ঘোষণার পরের দিন (১১ এপ্রিল, ১৯৭২) সংবিধান তৈরির জন্য একটি ‘ড্রাফটিং কমিটি’ (Constitution Drafting Committee) গঠিত হয়। যার নেতৃত্ব দেন কমিটির সভাপতি হিসেবে ড. কামাল হোসেন। এ কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪ জন; সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়া বাদবাকি সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের থেকে।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

ধারাবাহিক

পর্ব ::৭০

পূর্বে প্রকাশিতের পর
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অভিজ্ঞতা জনচৈতন্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। যার প্রতিফলন এসে পড়েছিল রাজনৈতিক মতাদর্শেও। এরই যৌক্তিক আদর্শিক পরিণতি ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সেক্যুলারিজম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন আহমদ রফিক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন মতিন আহমদ চৌধুরী। এর প্রায় প্রতিটি সংখ্যা আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। ‘কনটেন্ট-এনালাইসিস’ করে দেখা যায় যে নিয়মিতভাবে তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট সংখ্যায় অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক এক দিন আগে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ ছাপা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল :’বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়িকতা বা ‘সেক্যুলারিজমের’ মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি। … গণতন্ত্র অর্থই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। যেখানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সেখানে গণতন্ত্র কোনো দিন কার্যকরী হতে পারে না। আজ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলে অসাম্প্রদায়িকতা বা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতিটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যারা আছেন তাদের মধ্যে এ প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবাই বন্ধু। আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখের সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।’
এই একত্র-বোধের চেতনা জন্ম ত্বরান্বিত হয়েছে ১৯৭১ সালের সামষ্টিক প্রতিরোধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘জয় বাংলার’ ১৫ অক্টোবর সংখ্যায়। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও নতুন বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পরস্পর-সম্পর্কিত করে দেখা হয়েছিল :
‘মাত্র চব্বিশ বছর আগে সাম্প্রদায়িক জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাম্প্রদায়িকতাকে পরিহার করে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে কাতারবন্দি হয়েছে। শুধু মাঠে ময়দানে স্ল্নোগান দেয়া নয়, একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতিয়ার হাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা করছে, প্রাণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ, বাঙালি জাতি হিসেবে প্রাণ নেয়া ও দেয়ার মিলিত রক্তধারায় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা অনন্য। সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবর রচনায় ইতিহাসের এই অনন্য অধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। … অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও শুধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই অভ্যুদয়কে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অগ্রগতি হিসেবে স্বাগত জানাতে হয়।’
দেখা যাচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘গণতন্ত্র’ অংশটিতে মূল্যবান সংযোজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের ধারায় এটি ছিল একটি মৌলিক অর্জন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘সমাজতন্ত্র’ অংশটিতেও মৌলিক উপলব্ধি এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই উচ্চারিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি। ১১ মে ১৯৭১-এর ‘জয় বাংলার’ প্রথম সংখ্যায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে লেখা :’স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’
১৯ মে ১৯৭১-র ‘জয় বাংলার’ দ্বিতীয় সংখ্যায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বললেন যে, ‘নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল তার প্রতিটি তারা পালন করবে। তিনি জানান যে, তার সরকার ভূমিহীনকে ভূমিদান, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বড় বড় শিল্প জাতীয়করণ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ আবারও দেখা যাচ্ছে ১৯৭২ সালের আগেই মুক্তিসংগ্রামের মধ্যেও ভূমিবণ্টন, জাতীয়করণ ও সমাজতন্ত্রের কথা এসেছে।
‘জয় বাংলার’ ২ জুন ১৯৭১ সংখ্যা থেকে একটি ধারাবাহিক শুরু করা হয়। যার নাম ছিল- ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক’। ৯ জুলাই পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এতে আরেকবার দলের অর্থনৈতিক নীতিমালা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দলের প্রধান মুখপত্রটিতে আবারও বলা হয় সমতামুখীন সমাজের প্রতি আওয়ামী লীগ ও মুজিবনগর সরকারের অব্যাহত কমিটমেন্টের কথা :’শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই এই অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প- যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথ বণ্টনের বিধান থাকবে।’
এই কমিটমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন ২৩ নভেম্বর। বিজয়ের প্রায় এক মাস আগের এই ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে :’আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।’
এই সমাজতন্ত্র ছিল ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে’ সমাজতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা- যেটি আওয়ামী লীগের ঘোষণা ও কর্মসূচিতে ইতিপূর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই সমাজতন্ত্রের উদ্ভবস্থল বাংলাদেশেই। এটি এমনকি সংগ্রাম চলাকালীন অন্যান্য দলের নেতারাও অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়’, এবং যোগ করেছিলেন যে, ‘এ বিপ্লব বাইরের কোনো দেশ থেকে আমদানি করা হয়নি, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে তো নয়ই।’ তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে, ‘বাংলাদেশের এ বিপ্লবের গুরুত্ব কোনো অংশেই চীন ও রাশিয়ার বিপ্লবের চেয়ে কম নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষের সর্বাত্মক বিপ্লব।’ সবাই এই ব্যাখ্যার সাথে একমত ছিলেন তা অবশ্য নয়। পার্থক্যটা ছিল সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তার মাত্রায় ও গভীরতায়। ১৮ নভেম্বর সল্টলেকে শরণার্থীদের এক জনসভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মীজানুর রহমান চৌধুরী যেমন বিকল্প ফর্মুলেশন হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র না বলে একে অভিহিত করেছিল ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ রূপে। কিন্তু পার্থক্যটা ছিল প্রবণতায় ও ঝোঁকে। কেউ ‘গণতান্ত্রিক’ উপাদানের ওপরে বেশি করে জোর দিয়েছিলেন (যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি), আবার কেউ দৃষ্টি দিচ্ছিলেন এর ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপাদানের প্রতি। কিন্তু দুটো উপাদানই অর্থনৈতিক মতাদর্শে থাকতে হবে যা নিয়ে নেতৃত্বের মধ্যে কোনো সংশয় বা বিতর্ক ছিল না। সেদিন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালেই তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ‘আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর’ আলোকে ‘আমরা ইতিমধ্যেই মুক্ত এলাকায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ কায়েমের কাজ শুরু করে দিয়েছি।’ এ বিষয়ে প্রায়-সর্বস্তরে ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করছিল এটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাও একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক উদারমনা ব্যবস্থা কামনা করতেন। একজন গেরিলা নেতা আবদুল মান্নানের উদ্ৃব্দতি দিয়েছিল ‘নিউজ উইকের’ ২২ নভেম্বর সংখ্যায়। রচনাটির শিরোনাম ছিল- ‘বাংলা :প্রতিশোধের মুহূর্ত’। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মান্নান বলছেন : ‘আমরা জয়ী হলে সত্যিকারের গণতন্ত্রই আমরা লাভ করব। অন্যান্য উন্নতিশীল রাষ্ট্রের মতো স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থাকবে, কিন্তু সাম্যবাদী নয়। আমরা একটি নতুন জাতি, বাংলাদেশের জন্যই এ লড়াই করছি।’ প্রথাগত সোভিয়েত বা চীনের সমাজতন্ত্রের মডেলের চেয়ে আলাদা করে ভাবার চেষ্টাটা এখানে লক্ষণীয়। এক কথায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র-এর সমাজবাদ নিয়ে বিভিন্নমুখী ঝোঁক বা উপলব্ধি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এবং সাধারণভাবে মুক্তিযোদ্ধা জনগণের মধ্যে বিরাজ করছিল। কিন্তু তার মধ্যে সমতাবাদী আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে ‘নূ্যনতম ঐক্যের’ জায়গাটিতে কখনও ফাটল ধরেনি, আর সেটি হচ্ছে এক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমতামুখীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এর দু’দিন আগেই বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে ভারত ও ভুটানের পক্ষ থেকে। বিজয় তখনও অর্জিত হয়নি। এই প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের পটভূমিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করলেন : ‘নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ শান্তিপূর্ণ অবস্থান, জোটনিরপেক্ষতা এবং সকল প্রকার ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী জীবন গঠনে অভিলাষী।’
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তখন ঢাকার দ্বারপ্রান্তে। বিজয় সমাগত- রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন এটা জেনে গেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে একটি দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের বহু প্রতীক্ষিত অভ্যুদয়, কিন্তু তাজউদ্দীনের মনে বিষাদের ছায়া। কেননা, মুজিব তখনও কারাগারের নির্জন সেলে বন্দি। তার ওপর থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের ঝুঁকি চলে যায়নি। অপ্রকৃতিস্থ ইয়াহিয়া কী করে বসেন তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। এই বিষাদের মধ্যেও তাজউদ্দীন নবজাত রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা আবারও স্মরণ করতে ভুললেন না। এই নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থাকলেও চার আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সেদিনের নেতৃত্ব ছিলেন বদ্ধপরিকর। পুরো উদ্ধৃতিটি নেহরুর Tryst with Destiny বক্তৃতার চেয়ে (যেটি ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত্রিতে দেওয়া হয়েছিল) কোনো অংশে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয় :’বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হলো, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দি হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক; যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যোগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।’
এ কথা বলে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর এতদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শকে দুটি বাক্যে তুলে ধরলেন :’আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট-নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধিতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।’
বঙ্গবন্ধু কারামুক্তির জন্য আরও কিছু সময় প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার মধ্যে অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসবেন ১০ই জানুয়ারি। ঘোষিত হবে তার চার মূলনীতি- যাকে তিনি অন্যত্র ‘চার দফা’ বলেছেন : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার আদর্শের ওপরে তিনি নির্দেশ দেবেন যথাসম্ভব দ্রুত সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরি করার জন্য। এবং মাত্র ৮ মাসের মধ্যে খসড়া প্রস্তুত হয়ে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে তার উপরে বিশদ আলোচনা এবং উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর গৃহীত হবে সেটি। প্রচুর শ্রম, অনেক ভাবনাচিন্তা, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা বিবেচনা, অপ্রত্যাশিত ও প্রত্যাশিত উৎস থেকে অনুপ্রাণিত তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হবে এই অনন্য দলিলে। বাঙালির সাম্যচিন্তার ক্ষেত্রে এই সংবিধান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে রয়েছে আজ অব্দি। আমরা এখন সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

জনগণের কাছে দীর্ঘকাল ধরে করা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির জন্য অর্থনীতিবিদেরা কেন জবাবদিহি করবেন? এবং তাও সময় সময় রাজনীতিবিদদের সমর্থন ছাড়া? এ রকম ধারা চলতে থাকলে ইতিহাসকে বিস্মৃতির গর্ভে ঠেলে দেওয়া হবে। হয়তো এমন সময় এক দিন আসবে যে, অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে আওয়ামী লীগ যে একদা এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখেছিল ‘স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’ কায়েম করার কথা, সেটিকে কেউ বাহাত্তর-পরবর্তী Invention বা কষ্টকল্পনা বলে চালিয়ে দিতে পারে। অবমূল্যায়িত করা হতে পারে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সমাজ প্রতিষ্ঠা করার চূড়ান্ত লক্ষ্যকে। চাই কি, এর জন্য রাজনৈতিক Scapegoat খোঁজাটাও বিচিত্র নয়।
আমি হয়তো কথাটা এখানে বাড়িয়ে বললাম। জাতীয়করণের দাবি পঞ্চাশের দশক থেকেই জানানো হচ্ছিল- বিশেষত পাটশিল্প ও পাট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। ষাটের দশকে এসে জাতীয়করণের চিন্তাটি আরও মূর্ত ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করে যখন এর প্রয়োগের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা হয় ‘মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্পের’ ক্ষেত্রে (তা সে বাঙালি বা অবাঙালি যার অধীনেই থাকুক না কেন)। আজকের পরিভাষায় যাকে বলে MSME- ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে এর আওতা থেকে মুক্ত রাখা হয়। এই ইতিহাসকে না জানলে বা অস্বীকার করলে মনে হতেই পারে যে, জাতীয়করণের শব্দটি হচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালের পদক্ষেপ মাত্র। কেবল একটি After-Thought : অবাঙালী বৃহৎ শিল্প মালিকেরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন (আর বাঙালি বৃহৎ শিল্প মালিকেরা কেউ কেউ ‘দালালি করেছেন’), সেজন্যেই বুঝি বাধ্য হয়ে Nationalise করতে হয়েছে বাহাত্তরের সরকারকে। এরকম ভাবার পেছনে কোনো যুক্তি নেই যদি আওয়ামী লীগের দলিলপত্রে জাতীয়করণের আইডিয়ার বিকাশকে দালিলিকভাবে অনুসরণ করি। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
‘১৯৭২ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু প্রথম যে কাজটি করলেন তা হলো [বৃহৎ] শিল্পের জাতীয়করণ। কারণ, এটা তার এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতিশ্রুতির অংশ ছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং ১৯৬৯ সালের এগারো দফার সময় থেকেই এই প্রতিশ্রুতি ছিল। ষাটের দশকজুড়ে তাঁর দলের এবং দেশের অন্যান্য অংশের বিবৃতি ও ঘোষণায় অসংখ্যবার বলা হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি কিছু পরিবারের হাতে থাকবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করা দরকার, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন অথবা বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অন্যান্য বিশ্নেষণ বা সুপারিশের আগেই শিল্পের জাতীয়করণ করা হয়েছিল। যদিও জনমনে এমন এক ধরনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, জাতীয়করণের নীতি নেওয়া হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী। ১৯৭২-৭৫ এবং পরবর্তীকালে প্রায়ই আমি এ রকম একটি ভুল ধারণা মানুষকে সাধারণভাবে পোষণ করতে দেখেছি।’ এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন হলেও বেদনার আভাস দেখতে পাই।
স্বাধীনতার আগে ও পরে জাতীয়করণের প্রশ্নে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন হতেই পারে, জন-মনস্তত্ত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে। এই সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে কোনো কিছুই পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে নয়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে যা বোঝানো হতো, আজকের সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তার থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। কিন্তু ইতিহাসকে ইতিহাস হিসেবেই দেখা উচিত। অর্থাৎ, অতীতের কোনো  event-কে যদি ব্যাখ্যা করতে হয় (এলান বাদিউ  event-কে যে-অর্থে ব্যবহার করেছেন আমি সেই অর্থেই বলছি) তাকে ইতিহাসের ধারাতেই ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করা উচিত সেদিনের মাপকাঠিতে, কেবল এ যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। এভাবে দেখলে সন্দেহ থাকে না যে, ৭২-পরবর্তী ন্যাশনালাইজেশন কর্মসূচি পঞ্চাশ-ষাটের দশকের আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সমমনা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলনের এক long-standing প্রতিশ্রুতির স্বাভাবিক ও অনিবার্য ফসল।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি মেনে- এক লোক এক ভোট-এর ভিত্তিতে- অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার ১৬৪টি সাধারণ আসনের মধ্যে ১৬২টি আসনে জয়লাভ করে। এর সঙ্গে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৫টি আসন যোগ করতে হবে। এই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ১৯৭০ সালের ৬ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনকে সামনে রেখে আদর্শ ও লক্ষ্যকে কীভাবে আওয়ামী লীগ সেদিন দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছিল, সেটি বিচার করা দরকার।
কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত কর্মসূচিতে আবারও ফিরে এলো সমতামুখী সমাজ গড়ার কথা। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বোঝার জন্য এটি জরুরি। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকা লিখল :
‘একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, জমিদারী, জায়গীরদারী, সরদারীর বিলোপ সাধন করিয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় সমুন্নত করার কল্যাণময় প্রতিশ্রুতি বিধৃত করিয়া নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গতকাল (শনিবার) উহার কর্মসূচি ঘোষণা করে।’
ইত্তেফাকের রিপোর্টিং থেকে দেখা যায় যে, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আদর্শ হলেও এই ব্যবস্থায় ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি সমান গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ : ‘দলীয় কর্মসূচিতে ঘোষণা করা হইয়াছে যে, দেশে ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্র’ কায়েমের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হইবে এবং এমন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা হইবে, যেখানে ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যবাদ হইবে বিঘোষিত ও আচরিত নীতি।’ সাম্যবাদের পাশাপাশি এবার ন্যায়পরায়ণতাকে (Justice) একটি আলাদা মানদণ্ড হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে এটাও লক্ষণীয়। এই যুক্ততার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ধারার তুলনায় একটা ভিন্ন মাত্রা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও ন্যায়পরায়ণতা বলতে কী বা কোনো ধরনের Social Justice কে ইঙ্গিত দেওয়া হলো তা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি। উল্লেখ্য, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার মধ্যে ইউটিলিটারিয়ান, লিবারটেরিয়ান, Kant বাদী, মার্ক্সের শ্রম-অনুযায়ী বন্টনবাদী, Rawls বাদী, অমর্ত্য সেনের চিন্তাধারার অনুসারী বিভিন্ন (অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী) ধারা-উপধারা রয়ে গেছে। বাহাত্তরের সংবিধানের আলোচনার সময়ে আমরা এদিকটায় দৃষ্টি দেব বিশেষ করে। আপাতত যেটা বলার তাহলো, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান জোর পড়েছে ‘প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের’ প্রতিষ্ঠার ওপরে। সরাসরিভাবে সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র একবার। সমতামুখীন সমাজের কথা এসেছে পরোক্ষভাবে- অনুমিত প্রসঙ্গ হিসেবে। ‘ঘোষণা ও কর্মসূচিতে’ যেভাবে এর আগে অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম’ করার কথা বলা হয়েছিল, সে রকম প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে রয়েছে। তবে প্রচুর Aesopian ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো।
১. ‘দেশে প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই গণতন্ত্রে মানুষের সকল মৌলিক স্বাধীনতা শাসনতান্ত্রিকভাবে নিশ্চিত করা হবে।’
২. ‘শোষণের অবসান অবশ্যই করতে হবে। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। জাতীয় শিল্প সম্পদের শতকরা ৬০ ভাগের অধিক আজ মাত্র দু’ডজন পরিবার করায়ত্ত করেছে। ব্যাংকিং সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ এবং বীমা সম্পদের শতকরা ৭৫ ভাগ এ দু’ডজন পরিবারের কুক্ষিগত।’
৩. ‘৬ দফাতেই রয়েছে সমাধান। … আমাদের বিশ্বাস শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব। অন্যান্য অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
৪. সরাসরিভাবে আগের মতো ‘মূল, বৃহৎ ও ভারী শিল্প’ জাতীয়করণের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি যদিও, কিন্তু এই সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইঙ্গিত ছিল। ‘জাতীয়তকরণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলোসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। অর্থনীতির এসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সাধিত হতে হবে সরকারি অর্থাৎ জনগণের মালিকানায়। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকগণ শিল্প ব্যবস্থাপনায় ও মূলধন পর্যায়ে অংশীদার হবেন। বেসরকারি পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুবিধা রয়েছে। একচেটিয়াবাদ … সম্পূর্ণরূপে বিলোপ সাধন করতে হবে।’ আলাদা করে পাট ও তুলা ব্যবসা ‘জাতীয়করণের’ কথাও বলা হয়েছিল ইশতেহারে।
৫. কৃষি খাত সম্পর্কে বলা হয়েছিল:’প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। … ভূমির সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে’, এবং ‘নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।’ শুধু ভূমি বণ্টনই নয়, ‘অবিলম্বে চাষিদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’
৬. বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বলা ছিল যে, ‘আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে। আমরা ইতিপূর্বে ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ ও অন্যান্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছি।
ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে, সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।’
সামগ্রিক বিচারে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল এক ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের’ প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সমাজ গড়ার বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন উপাদান ছিল। সেসব উপাদান আরও স্পষ্ট ও ঘনীভূত রূপ নিয়ে দেখা দেবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। বাঙালির সাম্যচিন্তার এক মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকট সহকর্মীদের তৈরি করা বাহাত্তরের সংবিধান।

৭. মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও সমতামুখীন প্রতিশ্রুতি
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার তেমন অবকাশ ছিল না। ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। পুরো বাংলাদেশ ছিল একটি বন্দিশিবির। বন্দিশিবিরের ভেতরে ও বাইরে সবাই বিজয়ের দিন গুনছিল। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরেও অনেকটা ধাপ অতিক্রম করেছিল বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য এসেছিল এই পর্বেই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে। প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষতা (সেক্যুলারিজম)-এর ধারণা নয় মাস অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে একটি মূল আদর্শে পরিণত হয় এবং গণতন্ত্রের জন্য এর সবিশেষ গুরুত্ব উপলব্ধ হয়। এর আগে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি’ শীর্ষক দলিলে বা ১৯৭০ সালের ‘নির্বাচনী ইশতেহারে’ কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম শব্দটি সরাসরিভাবে ব্যবহূত হয়নি। যে ধরনের বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে তখন কাজ করতে হয়েছিল, এ ধরনের শব্দ ব্যবহার আশা করা সম্ভবও ছিল না। তৎকালীন আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ দলিলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও সকল ধর্মের সমানাধিকারের পক্ষে স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক lexicon-এ আসেনি। সেখানে বলা হয়েছিল : ‘আওয়ামী লীগ হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক বিভেদ ও বিদ্বেষের সম্পূর্ণ বিরোধী। আওয়ামী লীগ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও মত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাসী- ইহা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাথমিক বার্তা।’
১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে কথাটা আরও পরোক্ষভাবে বলা হয়েছিল : ‘সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমরা সব সময়ই সব প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে আসছি। সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই সমান অধিকার ভোগ করবে। আইনের সমান রক্ষাকবচ সকল ক্ষেত্রেই পাবে।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৬৮


বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানতেন যে, ইতিহাস এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক উদাহরণ দিয়ে তিনি যত যুক্তিজালই বিস্তার করুন না কেন ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ পূর্ব বাংলাকে দেওয়া হবে না। আইয়ুব খান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি ছয় দফা বা সিক্স পয়েন্টের দাবির মুখোমুখি হবেন ওয়ান পয়েন্টের মাধ্যমে। আর সেটা হবে ‘গান পয়েন্ট’। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মুজিবকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল। তার পরও তিনি ৬ দফা কর্মসূচিকে সামনে তুলে ধরেছিলেন সেটা কেবলমাত্র পূর্ব বাংলার মুক্তির সংগ্রামে ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের পেছনে ব্যাপক জনসমর্থন জড়ো করার জন্যে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী যে সহজে ৬ দফার দাবি মানবে না তা তিনি জানতেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানতেন যে, ৬ দফা কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। সহজে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঝেড়ে ফেলতে পারবে না। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুযায়ী ভারতকে অখণ্ড রেখে টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায় ছিল অপেক্ষাকৃত ভারমুক্ত ‘কেন্দ্র’ (ইউনিয়ন) এবং বিকেন্দ্রীভূত শক্তিশালী ‘স্টেটস’ সমবায়ে একটি ফেডারেশন গঠন। সেদিন কংগ্রেস এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ভেস্তে যায়। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখারও একমাত্র উপায় ছিল তেমনি একটি ভারমুক্ত কেন্দ্র (ফেডারেশন) রেখে এর প্রদেশগুলোকে ৬ দফার আলোকে শক্তিশালী বিকেন্দ্রীভূত ‘স্টেটসে’ পরিণত করা। পাকিস্তানের জন্য এটা আরও বেশি জরুরি ছিল। কেননা এর দুই অংশের মধ্যে বিরাজ করছিল দেড় হাজার মাইলের ভৌগোলিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক- মানসিক দূরত্ব। এক-অর্থনীতির অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দুই দশকে ইতিমধ্যে সৃষ্ট আয়-বৈষম্য দূরীকৃত করা দুরূহ ছিল। অর্থনীতির একটি স্বীকৃত সূত্র হচ্ছে যে, অনগ্রসর ও অগ্রসর অঞ্চলের মধ্যে আয়-বৈষম্য দূর করা সম্ভব যদি দুই অঞ্চলের মধ্যে শ্রমের অবাধ সচলতা বা  Labour Mobility থাকে। বিশাল ভৌগলিক ব্যবধানের কারণে সেটা সম্ভব ছিল না। এত বিশাল ভৌগোলিক দূরত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আর কোথাও দুই ভূগোলের দুই জনগোষ্ঠী একত্রে এক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। সুতরাং ৬ দফা মেনে না নিলে পাকিস্তান ভাঙার দায়-দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপরে না পড়ে তা পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠীরই ওপরে পড়ে যায় বা তার ওপরে বর্তাবে (ঠিক যেমনটা ভারত বিভাগের মূল দায়ভার এসে পড়েছিল কংগ্রেস তথা তৎকালীন নেহরু-প্যাটেলের নেতৃত্বের ওপরে)- এটা পূর্বাহ্নেই অনুমান করা কষ্টসাধ্য ছিল বা মুজিবের পক্ষে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পাকিস্তান যেন ভেঙে যাবে এটা জেনে-বুঝেই কি বঙ্গবন্ধু তাহলে ৬ দফা দিয়েছিলেন? আমার বিশ্বাস, এ রকমটাই ভেবেছিলেন মুজিব। কিছু কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এমন ইঙ্গিত মেলে যে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা-প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই এমনকি তাকে ত্বরান্বিত করার জন্যই ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতির দাবা খেলায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাস্তবিকই মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট এক। একটি প্রমাণ এখানে উল্লেখ করব। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও তার কয়েকজন পেশাজীবী সহকর্মী মিলে তখন সত্তরের নির্বাচনে জয়ের পরে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। ৬ দফা দলিল যদিও মুজিবের মাথা থেকেই বের হয়েছিল, কিন্তু তারই দেওয়া ডিকটেশন ও গাইডলাইন অনুসরণ কওে দলিলটি লেখার কাজে সাহায্য করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্মাণের টিমেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। যা হোক, এক পর্যায়ে তারা অনুভব করলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রূপরেখা দাঁড় করানো গেলেও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সেরকম একটি ফেডারেশন আখেরে ‘সাসটেইনেবল’ হবে না। অর্থনৈতিক কার্যকারণ সূত্রেই সে ধরনের প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কিছুকালের মধ্যেই ভেঙে যেতে বাধ্য। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, ৬ দফা আপাতদৃষ্টিতে ‘বাঁচার কর্মসূচি’ হিসেবে অধিকার আদায়ের জন্য পেশ হলেও এর আসল অর্থ ছিল পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত করা। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। রেহমান সোবহান তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, টেকনিক্যালি ৬ দফাকে ফেডারেল শাসনতন্ত্রের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত এবং কার্যকর করা যেত, তবে তার জন্য পিন্ডির শাসকদের তরফ থেকে সদিচ্ছার দরকার ছিল :: ‘Our arguments indicated that a valid Constitution, which accommodated the 6-point demands, could be made operational, provided that the military, were sincere about seeking a constitutional solution to the political crisis. Our affirmation contributed to strengthening Bangabandhu’s resolve to stand firm on 6 points as a credible negotiating option. This awareness did not prejudice Bangabandhu’s scepticism over whether the realization of 6 points would be peacefully conceded by the Pakistan junta.’
কিন্তু পিন্ডির শাসকচক্রের সমর্থন পেলেও ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানকে এক রাখা যেত না। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম-যিনি ৬ দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে ১৯৬৯ সাল থেকেই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন-তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন যে, শাসনতন্ত্রে ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও বা বাস্তবে বেশিদিন কার্যকর রাখা যেত না। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক রাষ্ট্রীয় ফেডারেল কাঠামো ‘দীর্ঘমেয়াদে’ টিকে থাকতে পারত না। কথাটা তিনি পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার অবগতির জন্য পেড়েছিলেন। উত্তরে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ এই যে, ‘আপনাদেরকে শাসনতন্ত্রের রূপরেখায় ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বলা হয়েছে। সেই কাজটা আপনারা করে দিন। তাতে করে পাকিস্তান আখেরে টিকবে কি টিকবে না, সে চিন্তাটা আমার উপরে ছেড়ে দিন।’ পরবর্তীকালে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ‘ঝরী- ‘Six-Point Programme or Independence?” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের ফেডারেল কাঠামোর ভাঙন অনিবার্য ছিল। অর্থনৈতিক যুক্তি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কেন ওই ধরনের ফেডারেল কাঠামো টিকতো না। ২০২০ সালে প্রকাশিত তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছে থেকে দেখা’ বইতে উপরোক্ত অর্থনৈতিক যুক্তির ভিত্তিতে তিনি এই বলে মন্তব্য করেছেন যে, ৬ দফা কর্মসূচি হচ্ছে প্রকারান্তরে এবং ‘বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে- একটা বিরাট পদক্ষেপ।’ পুরো উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে :
‘বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ১৯৭১-পরবর্তী পাকিস্তানের সংবিধানে [৬ দফার] এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৬ দফা কর্মসূচির মূল বিষয়গুলো সম্প্রসারণ করার কাজ তিনি দিয়েছিলেন আমার কিছু সহকর্মী এবং আমাকে। … এই বিষয়গুলোর সঙ্গে তার নিজের যে লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা মিলে গিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য ছিল, সহজেই ভেঙে দেওয়া যায় এমন একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত জোট বা সংঘ তৈরি করা। … আলোচনার এক পর্যায়ে আমার মধ্যেই প্রশ্ন জাগে যে পরিচালনা কমিটির সবাই ছয় দফা দাবি পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন কিনা। আমরা তাদের ছয় দফা বাস্তবায়নের সুদূরপ্রবাসী ফলাফলের বিষয়ে অবগত করানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করি। যখন আমাদের অনুশীলন শেষ হলো, তখন জানা গেল যে ইতিমধ্যে তারা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে এবং তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু সবার আগে এবং খুব দ্রুত বিষয়টি বুঝতে পারেন। এর কারণ এই যে, তিনি এ বিষয়ে অন্যদের চেয়ে বেশি ভেবেছেন এবং বেশি সময় ব্যয় করেছেন।’
স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে ৬ দফা স্বাধীনতা অর্জনের একটি মোক্ষম এবং শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর আশু নির্বাচনী Tactical তাৎপর্যও আমাদের মনে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়ন করে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি নির্ভরযোগ্য দর কষাকষির প্ল্যাটফর্ম হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও জাতীয়তাবাদী বোধে উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করতে হয়েছিলেন। তার এই চালে পাকিস্তান পড়েছিল ফাঁপরে। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তান এক পর্যায়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভেঙে যাবে- এটা জেনে তিনি ভেতরে ভেতরে আশ্বস্তবোধ করে থাকবেন। আর ৬ দফা অস্বীকার করে যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলের তথা জাতির ওপরে জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে পূর্ব বাংলা অনিবার্যভাবেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে। বস্তুত ৬ দফা কর্মসূচির একটি রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানের সমগ্র সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে কোণঠাসা অবস্থানে নিয়ে গিয়ে আবদ্ধ করেন শেখ মুজিব। উপরোক্ত যে কোনো  variant বাস্তবায়িত হলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকে- কিছু আগে বা পরে হলেও-ঠেকানো যেত না। এদিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে একজন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। এ জন্যেই ইতিপূর্বে তাকে অভিহিত করেছি একজন ‘মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট’ বলে।
৬ দফার কর্মসূচি-সংক্রান্ত দলিল উত্থাপনের পরে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা’ (ম্যানিফেস্টো)-এর তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। সেখানে ইতিপূর্বে উল্লেখিত সকল গুরুত্বপূর্ণ সমতামুখীন নীতিমালাই স্থান পায়। ‘ছয় দফাভিত্তিক’ ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’কে শাসনতান্ত্রিক আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লিবার্টি প্রিন্সিপলকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলা হয় যে, দলটি ‘নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী’। ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে পুনরায় ঘোষিত হয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা। ১৯৬৭ সালের দলিলে এ সম্পর্কে লেখা হয় :
‘আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানে শোষণ, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্দশার হাত হইতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’
পাঠক লক্ষ্য করুন, এটি কোনো ‘খসড়া ম্যানিফেস্টো’ থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে না। এটি দলের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ সংবলিত প্রকাশিত দলিল থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। অবশ্য ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ’ বলতে কী ধরনের অর্থনীতির সমাজ তার সংজ্ঞা এখানে নেই। কিন্তু অভিপ্রায়টা তো স্পষ্ট- ‘স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা’ কায়েম করা। পাঠক আরও লক্ষ্য করুন, রাতারাতি সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে যে, এ ধরনের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই দলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’। এটাও লক্ষণীয় যে, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন শব্দবন্ধের পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীন’ শব্দটিও। ফ্রিডম বা লিবার্টি প্রিন্সিপল ছাড়া সোশ্যালিস্ট বা সোশ্যাল জাস্টিস প্রিন্সিপল অচল- এই রাজনৈতিক বিশ্বাসকে বঙ্গবন্ধু সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। এটিই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ অন্যতম মূলনীতি।
১৯৬৭ সালের নীতি ও কর্মসূচির প্রকাশিত দলিলে যথারীতি এসেছিল ‘মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্পের’ জাতীয়করণের কথা। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ১৯৬৯ সালের ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণের আগেই আওয়ামী লীগ ব্যাংক-বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণের কথা বলেছিল এই দলিলে। এর পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিকাশকেও উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছিল : ব্যক্তি খাতের ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মূলধন সরবরাহ ও অন্য সকল ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের জন্য যেসব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল, তার সবটাই পূর্ব নির্ধারিত ছিল। যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি ১৯৬৭ সালে মুদ্রিত আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা’ দলিলেই রাখঢাক না করেই আগেভাগে বলে দেওয়া হয়েছিল। তার পরও কেন জাতীয়করণ নিয়ে সিভিল সোসাইটিতে এত উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল পরবর্তীকালে, তার কারণ বোঝা ভার। এর জন্যে  ‘Nationalisation and All that’ শীর্ষক রচনা লিখতে হয়েছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানকে বিষয়টা পরিস্কার করার জন্যে। এ প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই না উঠে পারে না। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অর্থনীতিবিদদের কেন ন্যাশনালাইজেশনের প্রশ্নে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে (বা এখনও করতে হয়) সেটার কারণ বোঝা আরও দুরূহ। যদি বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করার প্রস্তাব আওয়ামী লীগের পূর্বাপর বিঘোষিত ও প্রতিশ্রুত ঘোষণা ও কর্মসূচিরই অংশ হয়ে থাকে, তবে তার জন্যে রাজনীতিবিদেরাই জবাবদিহি করবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৬৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


১৯৬৪ সালের দলিলে কৃষি-ব্যবস্থা নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানা হয়েছিল। কৃষকরা ‘দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত’ এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় Model Firm গড়ে তুলে তাদের ‘কৃষি উন্নয়নের আধুনিক পন্থা’ দেখাতে হবে- এসব বলার পর যেটা লেখা হয়েছিল, তা বর্তমান আলোচনার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ :

‘সমবায় পদ্ধতিতে আমাদের দেশে চাষাবাদের  (Co-operative Cultivation) প্রচলন করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি কৃষকের জমি গড়ে এত ক্ষুদ্র এবং তাহাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দু’ভাগ যে, সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যতীত এখানে কৃষি উন্নয়নের অন্য কোনো উপায় নেই। কৃষি ব্যাংকের, কো-অপারেটিভ ব্যাংকের এবং অন্যান্য কৃষি ঋণের টাকা কৃষকদিগকে ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ না করিয়া সমবায় পদ্ধতির কৃষির জন্য উহা ব্যয় করা উচিত। ইহার ফলে কৃষকদের প্রধান সমস্যা- মূলধন সমস্যার সমাধান সম্ভব হইবে। সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি ব্যবস্থার ফলে আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ক্রয়, উন্নত বীজ ক্রয় এবং উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা সহজ হইবে।’

এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইতিপূর্বে (১৯৪৯-৫৩ পর্বে) আলোচিত সমবায়-চিন্তা আবারও পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ফিরে এসেছে। ‘Co-operative Cultivation’-এর প্রাথমিক ভাবনার বীজ তাহলে এখানেই রোপণ করা হয়েছিল, যা কালক্রমে বাহাত্তরের সংবিধানে ‘সমবায়ী মালিকানা’ রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায় এবং পরবর্তীকালে বাকশালের ‘মাল্টি-পারপাস কো-অপারেটিভ’-এর ধারণার মধ্যে আরও স্পষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক আকার লাভ করে। কৃষকদের করের ক্ষেত্রেও এই দলিলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে, ‘যেসব কৃষকের জমি ২৫ বিঘা বা তার নিল্ফেম্ন, তাহাদের জমির ওপর অন্তত ২৫ বৎসরকাল কোনো কর ধার্য করা হইবে না।’ এটিও স্বাধীনতার পরে করনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তবে আন্তর্জাতিক নীতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ১৯৬৪ সালের দলিলে সরাসরি কোথাও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়নি। অবশ্য জোটনিরপেক্ষতার নীতি  ‘Friendship to all, Malice to none’- পূর্বাপর বজায় ছিল। কিন্তু কৌশলগত বিবেচনা থেকে পূর্বেকার দলিলপত্রের মত কোথাও ইং-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব থেকে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়নি। পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের মতো ভাবমূর্তি দাঁড় করানোর পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল শেখ মুজিব ও তার নিকট সহকর্মীদের। সেজন্যেই বোধকরি বিদেশনীতির ক্ষেত্রে পাই অপেক্ষাকৃত সংযত ও সতর্ক শব্দপ্রযোগ : ‘বিশ্ব শান্তি প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা দান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড়  (Static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষে (Dynamic)- এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী।’ বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষেই একাধারে বাস্তববাদী ও জোটনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন। সেটা ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে তার বিভিন্ন উক্তিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। ‘কারও সাথে দুশমনি’ চাই না, দেশের উন্নয়নের জন্যে সকলকেই তার দরকার- এই বাস্তববাদী মনোভাব বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পূর্বাপর অটুট ছিল। এমনকি যেসব দেশ তার জীবদ্দশায় স্বীকৃতি দেয়নি- যেমন, চীন ও সৌদি আরব- তাদের কাছেও তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং অর্থনৈতিক সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলি উপরোক্ত খসড়া ম্যানিফেস্টোর মূল প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে। ইত্তেফাক পত্রিকা ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ এই প্রস্তাবগুলোর একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। তা থেকে দেখা যায় যে, ১১নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘একমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন করিতে সক্ষম বলিয়া ধীরে ধীরে উহা প্রবর্তন’ করা প্রয়োজন। ‘ধীরে ধীরে’ শব্দের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এটাও লক্ষণীয়।

আগেই বলেছি, ১৯৬৬ সালে উত্থাপিত হয় ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি। লেখক-শেখ মুজিবুর রহমান। এই দলিলের দফা ওয়ারী আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। যেটা প্রাসঙ্গিক সেটা হলো সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার। ৬ দফা কর্মসূচির ৬নং দফা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলছেন :

‘আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না।… যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তাহার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে।’

এর থেকে বোঝা যায়, শেখ মুজিব ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে কী চোখে দেখতেন। প্রথমে ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’, এবং ক্রমান্বয়ে অতিমাত্রার ‘ব্যক্তিগত বৈষম্য’ (আয়, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য) দূর করার অভিপ্রায় ছিল তার। এখানেই ৬ দফা কর্মসূচির মধ্যে সমতামুখীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ৬ দফার মতো জাতীয় জাগরণের কর্মসূচি উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি সেই সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার কথা তুলতে ভোলেননি। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ- বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের আদর্শ বোঝার ক্ষেত্রে।

৬ দফার প্রসঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। যদিও ৬ দফা কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ হিসেবে পেশ করেছেন, কিন্তু এটি আসলে ছিল আমাদের স্বাধীনতারই দাবি। অর্থাৎ, বাহ্যত ‘অটোনমির’ কথা বলা হলেও তা আসলে ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের দিকেই অনিবার্যভাবে গড়াতো এ-ই হচ্ছে যুক্তি। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম লিখেছেন যে, ‘৬ দফা কর্মসূচি পেয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, এর ফলে নামেই কেবল পাকিস্তান এক দেশ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে এটা হবে একটা বিরাট পদক্ষেপ’। আমি একটু এগিয়ে বলতে চাই। ৬ দফা বাহ্যত যা-ই হোক, কার্যত ছিল স্বাধীনতারই দাবি। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তান অপ্রতিরোধ্যভাবে ভেঙে যেত। এই কথাটা কিছু ব্যাখ্যার দাবি করে। সরাসরি মুজিব ১৯৬৬ সালে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি করতে পারতেন না এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। পূর্ব বাংলার মানুষ তখনও লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ বাইরে গিয়ে ‘স্বাধীনতা’ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মনের দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোড়া থেকেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধতা করে আসছিল। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : ‘আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করার সাথে সাথে যে ড্রাফট পার্টি ম্যানিফেস্টো বের করেছিলাম [১৯৪৯ সালের এই ম্যানিফেস্টো সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে বিস্তৃত আলোচনা করেছি- লেখক] তাতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা থাকায় লিয়াকত আলী খান আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন।’ ১৯৫৩ সালের ‘সাংগঠনিক রিপোর্ট’ পেশ করার সময় মুজিব পুনরায় প্রসঙ্গটি স্মরণ করেন : “জেল-জুলুমের পরেও আওয়ামী লীগের অপ্রতিহত গতিতে ব্যাকুল হইয়া জনাব লিয়াকত আলীর মতো লোকও আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘শির কচাল দেঙ্গে’ ধ্বনি করিয়াও আওয়ামী লীগকে ভেস্তে দিতে পারেন নাই।” ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে মুজিব একই কথা বলেছেন : ‘নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সভায় ঘোষণা করলেন : ‘যো আওয়ামী লীগ করে গা, উচকো শির হাম কুচাল দে গা।’ আর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অধীনে স্বাধীনতা দূরে থাক, ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ দাবি তোলাও ছিল দেশদ্রোহের শামিল। তাই ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি’ দলিলে সচেতনভাবেই ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে’র শব্দবন্ধ পর্যন্ত পরিহার করে বঙ্গবন্ধু কথাটা ঘুরিয়ে বলেছেন। তার একমাত্র Tactical দাবি ছিল- ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে।’ ফেডারেটিং ইউনিটের জন্য যেসব আর্থিক-প্রশাসনিক ক্ষমতা চেয়েছিলেন এবং তার সমর্থনে মুজিব যেসব ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক উদাহরণ টেনেছিলেন তা সত্যিই উপলব্ধির বিষয়। ইতিহাস ও যুক্তির ডায়ালেকটিক্যাল অ্যাপ্রোচের এটি ছিল একটি অনন্য উদাহরণ। প্রথমত, তিনি দেখালেন যে, ৬ দফা কোনো নতুন দাবি নয়। এটি লাহোর প্রস্তাবের আলোকে তৈরি। আর লাহোর প্রস্তাব ছিল ‘কায়েদে আজমসহ সকল নেতাদের দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা’ : ‘১৯৪৬ সালের নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়েছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি।’ দ্বিতীয়, লাহোর প্রস্তাবের অরিজিনাল ভার্সনে ‘একাধিক স্টেটের সমন্বয়ে’ পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়েছিল- সেখানে ‘কেন্দ্রের’ কাছে কিছু দায়িত্ব রেখে বাদবাকি দায়িত্ব ‘স্টেটসমূহের’ কাছে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাতেও কেন্দ্রের কাছে তিনটি বিষয়- প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, ও মুদ্রানীতি রেখে বাদবাকি বিষয়ে প্রদেশগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। তবে ৬ দফায় আরও ব্যাপক ক্ষমতা চাওয়া হয়েছিল :কেন্দ্রের কাছে বা ফেডারেশন সরকারে এখতিয়ারের কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার রেখে বাদবাকি সব বিষয় (আর্থিক নীতিসহ) স্টেটসমূহের কাছে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। ৩নং দফায় আলাদা মুদ্রানীতি ও ৪নং দফায় আলাদা রাজস্ব নীতির কথা বলা হয়েছিল। যেটা লক্ষণীয় যে, এই দুটির পক্ষেই যুক্তি হিসেবে মুজিব সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের সমসাময়িক উদাহরণ টেনে এনেছিলেন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের ঐতিহাসিক উদাহরণ দেখানোর পাশাপাশি। যেমন, আলাদা মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলছেন :১৯৪৬ সালের ‘ক্যাবিনেট প্ল্যানে নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল, তাহাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। ঐ প্রস্তাব পেশ করিয়া বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চালিতে পারে। কথাটি সত্য। … অত যে শক্তিশালী দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাহাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থাৎ স্টেট রিপাবলিকসমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রী দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে।’

৪নং দফার নিজস্ব রাজস্ব নীতি গ্রহণের পক্ষে একইভাবে ঐতিহাসিক (অর্থাৎ, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান) এবং সমসাময়িক (অর্থাৎ, সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের) যুক্তি দিলেন মুজিব। ৬ দফায় দলিলে পরিস্কারভাবে লেখা আছে :

‘কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিধানে স্বীকৃত। তাহারা এ খবরও রাখেন যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান ব্রিটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই।

৩নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তাহার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েট ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর বলিয়া কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নাই। তাহাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনী ও পররাষ্ট্র দফতর কি সেজন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই।’

৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপনের সময় মুজিব পাকিস্তানের ফেডারেশন কাঠামোয় পূর্ব বাংলাকে ‘প্রদেশ’ হিসেবে না দেখে ‘স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন দলিলের সর্বত্র। এটাও কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। মুজিব জানতেন, ‘ইহাতে কায়েমি স্বার্থ শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছেন যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তাহা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। … মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাহাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয় ‘স্টেট’। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেইবা কর্তারা এত অ্যালার্জিক কেন?’

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৬
পূর্বে প্রকাশিতের পর
অর্থনীতিবিদরা দলের রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক আদর্শ নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেননি এক্ষেত্রে। রাজনীতিবিদরাই এখানে মুখ্য ও নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো পাঠ করলে এ নিয়ে কোনোই সন্দেহ থাকে না। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজনীতিবিদদের, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ মুজিবের, মূল ও নির্ধারক ভূমিকা ছিল। এ কথা খাটে ১৯৬৪ সালের ম্যানিফেস্টোর ক্ষেত্রেও। গুরুত্ব বিবেচনা করে পুরো উদ্ৃব্দতিটাই আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। দলের অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে বলা হয়েছিল :
‘আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। মূল শিল্পগুলিকে, যথা- খনিজ শিল্প, যুদ্ধের অস্ত্র-সরঞ্জাম শিল্প, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক শিল্পকে জাতীয়করণ করিতে হইবে এবং ইহাদের পরিচালনার ভার রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত করা হইবে। ব্যাংক, বীমা, গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন প্রভৃতি প্রত্যক্ষ জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবশ্যকবোধে জাতীয়করণ করা হইবে। শিল্পে ও ব্যবসায় কোনো প্রকারের একচেটিয়া অধিকার স্বীকার করা হইবে না।’
বলা বাহুল্য, এই দাবিগুলির অনেক কিছুই ১৯৪৯ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ইতিপূর্বে আলোচিত ম্যানিফেস্টোতে বীজ হিসেবে বপন করা হয়েছিল। তবে এর আগে কোনো দলিলেই এত স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে, ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুদর্শার হাত হইতে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।’ তবে এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে ঠিক কোন ধরনের ব্যবস্থা তা অবশ্য দলিলে স্পষ্ট করা হয়নি। তবে এটি যে স্তালিন আমলের সমাজতন্ত্র নয়, সেটি এর ‘মৌলিক অধিকার’ ও ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ অধ্যায় থেকেই সুস্পষ্ট হয়। এই দুটি অধ্যায়ে ‘লিবার্টি প্রিন্সিপালকে’ সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ‘একমাত্র যুদ্ধকালীন সময় ব্যতীত অন্য কোনো সময়ে এই সকল অধিকার খর্ব করা হইবে না।’ এই দলিলে আবারো মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রচিত না হইলে কোনো শাসনতন্ত্র জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হইবে না।’ এবং ২১ দফা অনুসরণ করে বলা হয়েছে যে, এমন শাসনতন্ত্র চাই যা ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, শাসনকার্যে এবং দেশরক্ষার ব্যাপারে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান’ করবে। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হলেও একটি ফেডারেল ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ কাঠামোতেই তা বাস্তবায়ন সম্ভব, এমন বিশ্বাস ছিল ১৯৬৪ সালের ম্যানিফেস্টোর প্রণেতাদের। এই দলিল পাঠে বরং উল্টো প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বৃহৎ ও পরিত্যক্ত শিল্পের ‘জাতীয়করণ’ নিয়ে এত পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল কোনো কোনো মহল থেকে? সেইসব বিরুদ্ধ সমালোচকরা কি জানতেন না যে, পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ১৯৬৪ সালের ম্যানিফেস্টোতেই ছিল দেশের বৃহৎ ও মূল শিল্পকে ‘জাতীয়করণ’ (Nationalisation) করার কথা? অর্থাৎ শেষোক্ত নীতি ১৯৭২ সালের কোনো হঠাৎ আবিস্কার নয়। শুধু মূল শিল্প নয়, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন ‘প্রত্যক্ষ জনস্বার্থমূলক’ প্রতিষ্ঠানকে ‘আবশ্যকবোধে জাতীয়করণ করা’ হবে- এ ছিল আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনেরই ঘোষিত অর্থনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচির অংশ। এবং সেটা এসেছিল-তৎকালীন পরিস্থিতিতে-সমতামুখীন অর্থনীতি গড়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই।
১৯৬৪ সালের উপরোক্ত দলিলে অর্থনৈতিক আদর্শের অংশ হিসেবে ‘দুই অর্থনীতির’ প্রসঙ্গও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য ছিল ১৯৫২ সালের পর থেকেই একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এই বৈষম্যের আলোচনাটিকে নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সেকালের প্রাগ্রসর বাঙালি জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদেরাও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেননা, এটি উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রের একটি স্বীকৃত বিষয় ছিল এবং এর গুরুত্ব বাঙালি অর্থনীতিবিদরা স্বাভাবিক কারণেই অনুধাবন করেছিলেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারও বিষয়টির গুরুত্ব এক পর্যায়ে কিছুটা হলেও (অন্ততঃ লোক দেখানোর জন্যে হলেও) অনুভব করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের গতিপ্রকৃতি মনিটর করার জন্য একাধিক কমিশন গঠন করা হয়।
প্রতিটি পাঁচসালা পরিকল্পনার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে নাকি কমছে- এটা তলিয়ে দেখা ছিল এসব কমিশনের কাজ। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশ থেকেই শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা যোগ দিতেন কমিশনের সদস্য হিসেবে। কীভাবে ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়ক বৈষম্য নিয়ে পেশাদার অর্থনীতিবিদদের কাজকর্ম পরিচালিত হতো এবং পরোক্ষভাবে তা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ডিসকোর্সের ওপর প্রভাব ফেলত তার একটি বিবরণ নুরুল ইসলামের ২০১৭ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথা থেকে পাওয়া যায় :
‘In mid-1950, there was already a great deal of unhappiness among the educated middle class about the underdevelopment of East Pakistan. This awareness was particularly acute among the economists who analysed the extent and nature of economic disparity and used to write and speak about it in their meetings and conferences. The first organized expresion of such reencutment took place in 1956 when they submitted a report at the conference of East Pakistan on the First Five Year plan of Pakistan. They enunciated that Pakistan was not one economy but consisted of two economies. They recommended a set of special measures to remove the economic disparity!’  যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে এখানে, তার প্রস্তুতির কাজে নুরুল ইসলামের সক্রিয় অবদান ছিল। এসব জ্ঞানগত উদ্যোগের ফল পরিণামে পাকিস্তান সরকার এক পর্যায়ে বাধ্য হয় স্থায়ীভাবে ‘Finance Commissions on ‘East-West Income Disparity’ এবং ‘Inter-regional Economic Policies and Resource Allocations’ গঠন করতে। ফাইন্যান্স কমিশনের বাইরেও যেসব অর্থনীতিবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তারাও এই পূর্ব-পশ্চিম আঞ্চলিক বৈষম্য বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে নজর কাড়ে ১৯৬১ সালের জুন মাসে ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনার। হাবিবুর রহমান, নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ সেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেন। হাবিবুর রহমান পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনে কর্মরত ছিলেন লাহোরে। সরকারি চাকরির ঝুঁকি নিয়েও তিনি পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের বিষয়ে তার অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্নেষণ তুলে ধরেন। তার উত্থাপিত প্রবন্ধের নাম ছিল ‘Two Economies in Pakistan’- ১৯৬১ সালের ২রা মে-তে লেখা। এছাড়াও তিনি ১৯৬১ সালের ১ আগস্ট ‘The case for Separating the Economies of East and West Pakistan’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রস্তুত করেন। ১৯৬২ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম ‘Growth Models and Pakistan’। বাঙালি এই অর্থনীতিবিদ পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের ‘ইকোনমিক রিসার্চ’ সেকশনের এবং সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে যুগপৎ দায়িত্বে ছিলেন। সরকারি চাকরিতে থেকেও ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়ে তার উপরোক্ত দুটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন এবং জেনারেল আইয়ুব খানের রোষের শিকার হন। এই পথিকৃৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদের জীবন ও কর্মের ওপরে আরও বড় পরিসরে কাজ হওয়া উচিত। সামগ্রিকভাবে ‘দুই অর্থনীতি’ সংক্রান্ত আলোচনায় যারা ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে নুরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, আখলাকুর রহমান, মোশারফ হোসেন, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান প্রত্যেকের জীবন ও কর্মের ওপর বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হওয়া দরকার।
যাহোক, কার্জন হলের সেই বিখ্যাত সেমিনারে গঠিত রেহমান সোবহানের প্রবন্ধটি পরদিন মিডিয়ার হেডলাইন হয়েছিল। এ সম্পর্কে রেহমান সোবহান এভাবে স্মৃতিচারণা করেছেন  ‘The next morning, I opened the Pakistan observer to read a fornt page headline, ‘Rehman Sobhan says Pakistan has two economies.’ সেদিন কাকতালীয়ভাবে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন আইয়ুব খান। কার্জন হলের সেমিনারের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন? উত্তরে জেনারেল আইয়ুব বললেন,‘Pakistan has only one economy.’ পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যকার আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদেরাও এক সময় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের নেতৃত্ব দানকারী মাহবুব উল হক তার ১৯৬৩ সালের ‘দ্য স্ট্র্যাটেজি অব ইকোনমিক প্ল্যানিং’ বইতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পাকিস্তানে পূর্ব-পশ্চিম অংশের মধ্যকার আঞ্চলিক বৈষম্যের ওপর।
আগেই বলেছি, অর্থনীতিবিদরা ‘দুই অর্থনীতি’ শক্তিশালী যুক্তিজাল বিভিন্ন সেমিনারে-কনফারেন্সে তুলে ধরেছিলেন, যদিও জনসমক্ষে এর সপক্ষে প্রচার-আলোচনা-মতামত গঠন করেন রাজনীতিবিদরাই। দুই অঞ্চলের মধ্যে আয়-বৈষম্য ও সম্পদ বরাদ্দ বৈষম্য শুধু নয়, বৈষম্যের সাথে সাথে বঞ্চনার রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুভূতি তারা প্রকাশ করেন দেশবাসীর সামনে। Theory-র সাথে Praxis-র যুগল সম্মিলনের এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উপরোক্ত বিষয়ে ১৯৬৪ সালের উপরোক্ত দলিলেই বলা হয়েছিল :
‘কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদসমূহে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রায় একচেটিয়া অধিকার ও প্রাধান্য বর্তমান। সরকার ব্যক্তিগত শিল্প ও শিল্পপতিকে সাহায্যের নীতি গ্রহণ করায় উক্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সহানুভূতিতে ও পক্ষপাতিত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যক্তিগত শিল্প ব্যাপকভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে। তদুপরি, পাবলিক সেক্টরেও সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়োজিত হইয়াছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হইয়াছে। এই অবস্থার প্রতিরোধ ও প্রতিকারকল্পে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা করিবার উদ্দেশ্যে শিল্প ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট (Earmarked) অর্থ পাবলিক সেক্টরে নিয়োজিত করিবার নীতি গ্রহণ করিতে হইবে। এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে দুই অর্থনীতির ভিত্তিতে একটা দীর্ঘকালীন ও কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে।’
উপরে উদ্ৃব্দত স্তবকে অর্থনৈতিক চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু তার প্রকাশ হয়েছে রাজনৈতিক ভাষায়, যেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে ‘পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য’ সৃষ্টির কথা। এর থেকে যে এক সময়ে ৬ দফা বেরিয়ে আসবে, এতে আর বিস্ময় কী! শেখ মুজিবের অসামান্য রাজনৈতিক প্রতিভা এখানেই। একটি যুক্তিনিষ্ঠ অর্থনৈতিক বিশ্নেষণ থেকে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের  ‘Logical Next-step’ হিসেবে ‘ছয় দফা’ কর্মসূচিকে বের করে আনতে পেরেছিলেন। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো থেকে ছয় দফা কর্মসূচিতে উত্তরণ ছিল সেরকম প্রত্যাশিত একটি যৌক্তিক উত্তরণ। এই ছয় দফা কর্মসূচির দলিল রাজনীতিবিদেরই চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও শ্রমের ফসল। বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরাই এই দলিল প্রস্তুত করেন। কিন্তু রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এতে মূল ও নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিব স্বয়ং। অর্থনীতিবিদরা এর নির্মাণে সরাসরিভাবে কোনো ভূমিকা রাখেননি। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম একাধিক আলাপচারিতায় এ ব্যাপারে আমাকে নিশ্চিত করেছেন। কার্যতও ৬ দফা কর্মসূচি সংবলিত মূল দলিলের- ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ৬-দফা কর্মসূচি’র লেখক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তারই পরিচিতিতে ও বয়ানে দলিলটি দেশ-জাতির কাছে উত্থাপিত হয়।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৫

পূর্বে প্রকাশিতের পর
– ‘To safeguard civil liberties, such as individual and collective freedom of belief, expression, association and organization.’
– ‘To secure the basic necessities of life of every citizen  of Pakistan namely, food, shelter, clothes, education, medical aid and the scope to earn an honest and honorable competence.’
_ ‘To relieve sufferings, propagate knowledge, promote equality and justice, banish oppression, eradicate corruptions, elevate moral and maternal standard of the people …’

এ তো গেল দলের ‘Aims and Objectives’-এর কথা| ‘Immediate Program-এর মধ্যে আবারও ধ্বনিত হলো ইতিপূর্বে শোনা আর্থ-সামাজিক দাবিগুলো।

‘Abolition of the system of zamindary without compensation and equitable distribution of land among the tillers of the soil.’
– ‘To nationalise the key industries, essential  to the life of the nation; to establish industries on Govt. initiative and also to organise, expand and encourage cottage industries, etc.’
-’To introduce free and compulsory primary education; to reorganise secondary and higher education on modern and scientific basis.’
– ‘To provide a network of Govt. charitable dispensaries to afford free medical aid all over the country.’
– ‘To fix a just and fair apportionment of all revenues betwen the centre and the provinces.’

এত দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য একটাই। সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ও চেতনায় উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং সমতামুখী অর্থনীতি পরিচালনার অঙ্গীকার দানা বেঁধে ছিল। বাহাত্তরের সংবিধানের ‘চারটি মূলস্তম্ভ’ হঠাৎ করে বা তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে উদ্ভূত হয়নি। এর পেছনে আমি দীর্ঘ পূর্বাপরতা-দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় genealogical trail-দেখতে পাই, যা শেখ মুজিব ও তার দীর্ঘকালের সহকর্মীদের মনে গভীর উপলব্ধি হয়ে মিশে ছিল। গণতন্ত্র যেমন চাই, তেমনি চাই সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষার সমাজ ও অর্থনীতি- এটা তাদের চোখে ছিল একটি স্বাভাবিক দাবি। বাহাত্তরের সংবিধানের আলোচনায় পরবর্তীতে আমরা দেখব যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের এই স্বাভাবিক দাবিকে ঘিরে বাহাত্তরের গণপরিষদে (যার সদস্যগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে এসেছিলেন) এক ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করছিল। সমাজতন্ত্রের স্তম্ভটিকে নিয়ে একটিও আপত্তি সেদিনের গণপরিষদে উচ্চারিত হয়নি। এই ব্যাপক ঐকমত্যের পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে ১৯৫০-৬০ দশকের মূলধারার রাজনীতির দলিলপত্রের আদর্শ ও কর্মসূচিকে ঘনিষ্ঠভাবে বিচার-বিশ্নেষণ করতে হবে। তারই একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি এই অধ্যায়ের বাদবাকি অংশে।
১৯৫৩ সালের ৩ জুলাই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকায়। সেখানে গৃহীত ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ বলা হচ্ছে :
‘১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবরের খাদ্য মিছিলের ওপর সরকার হামলা করিয়া মওলানা ভাসানী, জনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য বহু কর্মীকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রাখিয়াও গণতন্ত্রের দুষমন লীগ সরকার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে পারে নাই। …পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাক-ভারত মৈত্রী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ আওয়াজ তুলিয়াছিলেন… আওয়ামী মুসলিম লীগও সেই আওয়াজকে কর্মসূচিভুক্ত করে। অতঃপর পূর্ব পাক আওয়ামী মুসলিম লীগ বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ, লাঙ্গল যার জমি তার ভিত্তিতে ভূমি বণ্টন, জাতীয়করণের ভিত্তিতে শিল্পায়ন, প্রত্যেকের কাজের ব্যবস্থা- প্রত্যেকের স্বাস্থ্য, শিক্ষার নিরাপত্তার ভিত্তিতে এক কর্মসূচি গ্রহণ করে।’
অর্থাৎ দলের ‘সাংগঠনিক রিপোর্টেও’ ১৯৫৩ সালেই পুনরায় সামন্তবাদের অবসান ও ‘জাতীয়করণ’-এর ভিত্তিতে শিল্পায়নের দাবি জানানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বিদেশ নীতিতেও সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছিল সেদিন :
‘আওয়ামী লীগ ঘোষণা করিয়াছে কমনওয়েলথ-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক ত্যাগ করিতে হইবে। তারা আরও দেখিয়াছে কৃষি ও শিল্পে তারা যে প্রগতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে উহা সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একান্ত পরিপন্থী। তাই আওয়ামী লীগ কমনওয়েলথ ত্যাগই নহে- সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করিয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নীতির অনুকূলে শান্তি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে।’
দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ধারায় সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধিতা এবং শান্তি আন্দোলনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু পান বিশ্ব শান্তি পুরস্কার। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে মুজিব বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বিরল জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন। যার নামে ওই পুরস্কার তার পুরো নাম ফ্রেদেরিক জুলিও কুরি। তিনি ছিলেন একজন ফরাসি বিজ্ঞানী, ১৯৩৫ সালে তার স্ত্রী আইরিন জুলিও কুরির (দুইবার নোবেল বিজয়ী মেরি কুরির কন্যা) সাথে একত্রে ‘আর্টিফিসিয়াল রেডিও অ্যাক্টিভিটি’র ওপরে পথিকৃৎ গবেষণার জন্য রসায়ন শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান। ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সের সক্রিয় নেতা ছিলেন জুলিও কুরি। বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। এহেন গুণী ও সাহসী মানুষের নামে প্রদত্ত শান্তি পদক লাভ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এখানে মূল বক্তব্য অন্যত্র। উপরোক্ত ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ পরিস্কার ভাষায় লেখা হয়েছিল : আওয়ামী লীগ ‘বিশ্বধ্বংসী রণপাগল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে’ এবং আজ নীতিগতভাবে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ রকম একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় সংগঠক ও কালক্রমে প্রধান ব্যক্তিত্ব মুজিব যে উক্ত সাংগঠনিক রিপোর্ট লেখার দুই যুগ পরে জুলিও কুরি শান্তি পদক পাবেন তাকে যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক। পাঠকদের মনে রাখতে বলব, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের’ উক্ত সাংগঠনিক রিপোর্ট উত্থাপনকালে মুজিব ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৫ সালে দলটির নামান্তর হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘আওয়ামী লীগে’। এই রূপান্তর ঘটে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর দলের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে। দলের পক্ষ থেকে ‘বার্ষিক রিপোর্ট’ উত্থাপন করেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব স্বয়ং। সেই বার্ষিক রিপোর্টেও ‘প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িককরণের প্রসঙ্গ’ আলোচনার পাশাপাশি ইতিপূর্বে উল্লিখিত আর্থ-সামাজিক দাবিগুলো পুনরায় তোলা হয়।
যেমন, ১৯৫৫ সালে দলের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয় যে, ‘সামন্তবাদী ভূমি ব্যবস্থাই পূর্ববঙ্গের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের মূল প্রতিবন্ধক। বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সাধন ও কৃষককে জমির মালিকানা স্বত্ব দান করাই সামন্তবাদী শোষণ অবসানের প্রথম পদক্ষেপ।’ কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার ‘পূর্ববঙ্গ ভূমি দখল ও প্রজাস্বত্ব’ নামে যে আইনের জন্ম দিয়েছে তা আসলে ‘ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি প্রথাকে নতুন ধাঁচে ঢালাই করার’ পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘পাটনীতি’ সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, ‘পাট শিল্পকে জাতীয়করণ না করিলে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের সহিত সমপর্যায়ের ভিত্তিতে বাণিজ্য না করিলে পাট শিল্পের ভবিষ্যৎই নেই। এই জন্যই যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচিতে পাট জাতীয়করণ করার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল।’ এর পাশাপাশি ‘শিল্পনীতি’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তি খাতের কলকারখানা বিকাশের সমস্যা তুলে ধরা হয়। যেমন, বলা হয় যে, ‘দেশের শিল্পপতিগণ আজ এক বিরাট সংকটের সম্মুখীন। একদিকে বিদেশিদের সহিত প্রতিযোগিতায় মার খেয়ে তারা পঙ্গু, আবার অন্যদিকে দেশের বাজারের অধিকাংশ ক্রেতার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদিত দ্রব্যের কেনাবেচা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।’ এবং সবশেষে- ‘সরকারের বন্ধ্যা শিল্পনীতি এই সমস্যা প্রতিরোধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’ এ ছাড়াও ‘শ্রমনীতি’, ‘শিল্পনীতি’, ‘স্বাস্থ্য সমস্যা’, ‘বন্যা সমস্যা’, ‘মৌলিক অধিকার’ ও ‘বৈদেশিক নীতির’ আলোচনা স্থান পায় উপরোক্ত বার্ষিক রিপোর্টে। সামগ্রিকভাবে, এই দলিলে লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ইতিপূর্বে আলোচিত র‌্যাডিকেল খসড়া ম্যানিফেস্টোর তুলনায় ভাষায় ও অভিপ্রায়ে অপেক্ষাকৃত সংযত ও সতর্ক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি চোখে পড়ে এই দলিলে। সেটা সম্ভবত সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব ও তৎকালীন সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে।
১৯৬৪ সালের ‘পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো’-তে এসে অবশ্য এই ভাষাভঙ্গী পুরোপুরি পাল্টে যায়। এই লড়াকু রূপান্তরে মূল নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব। ততদিনে সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেছেন, মওলানা ভাসানী তারও বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের ৬ বছর পেরিয়ে গেছে। সারাদেশে গণতন্ত্রের দিক থেকে দেখলে এক বন্ধ্যা-পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিভক্ত ও স্থবির দশা থেকে আওয়ামী লীগকে ‘পুনরুজ্জীবিত’ করার কঠিন সংগ্রাম চালানোর দায়িত্ব প্রায় একাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্যই ১৯৬৪-এর খসড়া ম্যানিফেস্টোটি আমাদের আলোচনার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, ১৯৬৬-এর ৬ দফা প্রণয়নেরও আগে এই দলিলেই আগামী দিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের দিকনির্দেশনাগুলো প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে নির্দেশিত হয়েছে। এই যুক্তিটি বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
‘পুনরুজ্জীবিত’ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (যার কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালের ৬-৭ মার্চ) সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক পদে থাকলেও দলটির পুনরুজ্জীবনের পেছনে মূল নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা এসেছিল শেখ মুজিবের কাছ থেকেই। কমিটিতে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবেন পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এইচএম কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। এই পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সে সময়ে বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল (‘এবডো’ তখনও বিদ্যমান- যা ১৯৬৬ পর্যন্ত বলবৎ ছিল)। এখানে বলা দরকার, আইয়ুবের জারি করা রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার জন্য ‘এবডো’ আইন পাস হয় ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরই। এ রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ১৯৬৪ সালের খসড়া ম্যানিফেস্টো তথা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রস্তুত করা হয়। আমি এখানে শুধু অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রতি দৃষ্টি দেব- সমতামুখীন সমাজের আদর্শ কীভাবে এদেশে গড়ে উঠেছিল তা বোঝার তাগিদ থেকে। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ শুধু নিচে তুলে ধরা হলো।
প্রথমেই বলা দরকার, ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে এই ম্যানিফেস্টোতে ১৯৬৪ সালে যা বলা হয়েছিল, তারই প্রতিধ্বনি হয়েছিল পরবর্তীতে বাহাত্তরের সংবিধানে ও বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। এর থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২-৭৩ সালে গৃহীত ‘সমাজতান্ত্রিক’ চিন্তা-ভাবনার বীজ এই দলিলেই সুসংহতভাবে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তাতে মূল অবদান রেখেছিলেন রাজনীতিবিদরাই। ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়ে আলোচনা করা এদেশের প্রাগ্রসর ও শীর্ষস্থানীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা পরবর্তীতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের প্রদর্শিত রাজনৈতিক দর্শনের নির্দেশিত পথ ধরেই।

[ক্রমশ

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৫

পূর্বে প্রকাশিতের পর
– ‘To safeguard civil liberties, such as individual and collective freedom of belief, expression, association and organization.’
– ‘To secure the basic necessities of life of every citizen  of Pakistan namely, food, shelter, clothes, education, medical aid and the scope to earn an honest and honorable competence.’
_ ‘To relieve sufferings, propagate knowledge, promote equality and justice, banish oppression, eradicate corruptions, elevate moral and maternal standard of the people …’

এ তো গেল দলের ‘Aims and Objectives’-এর কথা| ‘Immediate Program-এর মধ্যে আবারও ধ্বনিত হলো ইতিপূর্বে শোনা আর্থ-সামাজিক দাবিগুলো।

‘Abolition of the system of zamindary without compensation and equitable distribution of land among the tillers of the soil.’
– ‘To nationalise the key industries, essential  to the life of the nation; to establish industries on Govt. initiative and also to organise, expand and encourage cottage industries, etc.’
-’To introduce free and compulsory primary education; to reorganise secondary and higher education on modern and scientific basis.’
– ‘To provide a network of Govt. charitable dispensaries to afford free medical aid all over the country.’
– ‘To fix a just and fair apportionment of all revenues betwen the centre and the provinces.’

এত দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য একটাই। সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ও চেতনায় উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং সমতামুখী অর্থনীতি পরিচালনার অঙ্গীকার দানা বেঁধে ছিল। বাহাত্তরের সংবিধানের ‘চারটি মূলস্তম্ভ’ হঠাৎ করে বা তৎকালীন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে উদ্ভূত হয়নি। এর পেছনে আমি দীর্ঘ পূর্বাপরতা-দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় genealogical trail-দেখতে পাই, যা শেখ মুজিব ও তার দীর্ঘকালের সহকর্মীদের মনে গভীর উপলব্ধি হয়ে মিশে ছিল। গণতন্ত্র যেমন চাই, তেমনি চাই সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষার সমাজ ও অর্থনীতি- এটা তাদের চোখে ছিল একটি স্বাভাবিক দাবি। বাহাত্তরের সংবিধানের আলোচনায় পরবর্তীতে আমরা দেখব যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের এই স্বাভাবিক দাবিকে ঘিরে বাহাত্তরের গণপরিষদে (যার সদস্যগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে এসেছিলেন) এক ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করছিল। সমাজতন্ত্রের স্তম্ভটিকে নিয়ে একটিও আপত্তি সেদিনের গণপরিষদে উচ্চারিত হয়নি। এই ব্যাপক ঐকমত্যের পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে ১৯৫০-৬০ দশকের মূলধারার রাজনীতির দলিলপত্রের আদর্শ ও কর্মসূচিকে ঘনিষ্ঠভাবে বিচার-বিশ্নেষণ করতে হবে। তারই একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি এই অধ্যায়ের বাদবাকি অংশে।
১৯৫৩ সালের ৩ জুলাই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকায়। সেখানে গৃহীত ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ বলা হচ্ছে :
‘১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবরের খাদ্য মিছিলের ওপর সরকার হামলা করিয়া মওলানা ভাসানী, জনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য বহু কর্মীকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রাখিয়াও গণতন্ত্রের দুষমন লীগ সরকার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে পারে নাই। …পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাক-ভারত মৈত্রী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ আওয়াজ তুলিয়াছিলেন… আওয়ামী মুসলিম লীগও সেই আওয়াজকে কর্মসূচিভুক্ত করে। অতঃপর পূর্ব পাক আওয়ামী মুসলিম লীগ বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ, লাঙ্গল যার জমি তার ভিত্তিতে ভূমি বণ্টন, জাতীয়করণের ভিত্তিতে শিল্পায়ন, প্রত্যেকের কাজের ব্যবস্থা- প্রত্যেকের স্বাস্থ্য, শিক্ষার নিরাপত্তার ভিত্তিতে এক কর্মসূচি গ্রহণ করে।’
অর্থাৎ দলের ‘সাংগঠনিক রিপোর্টেও’ ১৯৫৩ সালেই পুনরায় সামন্তবাদের অবসান ও ‘জাতীয়করণ’-এর ভিত্তিতে শিল্পায়নের দাবি জানানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বিদেশ নীতিতেও সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছিল সেদিন :
‘আওয়ামী লীগ ঘোষণা করিয়াছে কমনওয়েলথ-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক ত্যাগ করিতে হইবে। তারা আরও দেখিয়াছে কৃষি ও শিল্পে তারা যে প্রগতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে উহা সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একান্ত পরিপন্থী। তাই আওয়ামী লীগ কমনওয়েলথ ত্যাগই নহে- সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করিয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নীতির অনুকূলে শান্তি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে।’
দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ধারায় সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধিতা এবং শান্তি আন্দোলনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু পান বিশ্ব শান্তি পুরস্কার। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে মুজিব বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বিরল জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন। যার নামে ওই পুরস্কার তার পুরো নাম ফ্রেদেরিক জুলিও কুরি। তিনি ছিলেন একজন ফরাসি বিজ্ঞানী, ১৯৩৫ সালে তার স্ত্রী আইরিন জুলিও কুরির (দুইবার নোবেল বিজয়ী মেরি কুরির কন্যা) সাথে একত্রে ‘আর্টিফিসিয়াল রেডিও অ্যাক্টিভিটি’র ওপরে পথিকৃৎ গবেষণার জন্য রসায়ন শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান। ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সের সক্রিয় নেতা ছিলেন জুলিও কুরি। বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। এহেন গুণী ও সাহসী মানুষের নামে প্রদত্ত শান্তি পদক লাভ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এখানে মূল বক্তব্য অন্যত্র। উপরোক্ত ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ পরিস্কার ভাষায় লেখা হয়েছিল : আওয়ামী লীগ ‘বিশ্বধ্বংসী রণপাগল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে’ এবং আজ নীতিগতভাবে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ রকম একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় সংগঠক ও কালক্রমে প্রধান ব্যক্তিত্ব মুজিব যে উক্ত সাংগঠনিক রিপোর্ট লেখার দুই যুগ পরে জুলিও কুরি শান্তি পদক পাবেন তাকে যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক। পাঠকদের মনে রাখতে বলব, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের’ উক্ত সাংগঠনিক রিপোর্ট উত্থাপনকালে মুজিব ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৫ সালে দলটির নামান্তর হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘আওয়ামী লীগে’। এই রূপান্তর ঘটে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর দলের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে। দলের পক্ষ থেকে ‘বার্ষিক রিপোর্ট’ উত্থাপন করেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব স্বয়ং। সেই বার্ষিক রিপোর্টেও ‘প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িককরণের প্রসঙ্গ’ আলোচনার পাশাপাশি ইতিপূর্বে উল্লিখিত আর্থ-সামাজিক দাবিগুলো পুনরায় তোলা হয়।
যেমন, ১৯৫৫ সালে দলের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয় যে, ‘সামন্তবাদী ভূমি ব্যবস্থাই পূর্ববঙ্গের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের মূল প্রতিবন্ধক। বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সাধন ও কৃষককে জমির মালিকানা স্বত্ব দান করাই সামন্তবাদী শোষণ অবসানের প্রথম পদক্ষেপ।’ কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার ‘পূর্ববঙ্গ ভূমি দখল ও প্রজাস্বত্ব’ নামে যে আইনের জন্ম দিয়েছে তা আসলে ‘ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি প্রথাকে নতুন ধাঁচে ঢালাই করার’ পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘পাটনীতি’ সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, ‘পাট শিল্পকে জাতীয়করণ না করিলে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের সহিত সমপর্যায়ের ভিত্তিতে বাণিজ্য না করিলে পাট শিল্পের ভবিষ্যৎই নেই। এই জন্যই যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচিতে পাট জাতীয়করণ করার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল।’ এর পাশাপাশি ‘শিল্পনীতি’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যক্তি খাতের কলকারখানা বিকাশের সমস্যা তুলে ধরা হয়। যেমন, বলা হয় যে, ‘দেশের শিল্পপতিগণ আজ এক বিরাট সংকটের সম্মুখীন। একদিকে বিদেশিদের সহিত প্রতিযোগিতায় মার খেয়ে তারা পঙ্গু, আবার অন্যদিকে দেশের বাজারের অধিকাংশ ক্রেতার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদিত দ্রব্যের কেনাবেচা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।’ এবং সবশেষে- ‘সরকারের বন্ধ্যা শিল্পনীতি এই সমস্যা প্রতিরোধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’ এ ছাড়াও ‘শ্রমনীতি’, ‘শিল্পনীতি’, ‘স্বাস্থ্য সমস্যা’, ‘বন্যা সমস্যা’, ‘মৌলিক অধিকার’ ও ‘বৈদেশিক নীতির’ আলোচনা স্থান পায় উপরোক্ত বার্ষিক রিপোর্টে। সামগ্রিকভাবে, এই দলিলে লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের ইতিপূর্বে আলোচিত র‌্যাডিকেল খসড়া ম্যানিফেস্টোর তুলনায় ভাষায় ও অভিপ্রায়ে অপেক্ষাকৃত সংযত ও সতর্ক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি চোখে পড়ে এই দলিলে। সেটা সম্ভবত সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব ও তৎকালীন সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে।
১৯৬৪ সালের ‘পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো’-তে এসে অবশ্য এই ভাষাভঙ্গী পুরোপুরি পাল্টে যায়। এই লড়াকু রূপান্তরে মূল নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব। ততদিনে সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেছেন, মওলানা ভাসানী তারও বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের ৬ বছর পেরিয়ে গেছে। সারাদেশে গণতন্ত্রের দিক থেকে দেখলে এক বন্ধ্যা-পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিভক্ত ও স্থবির দশা থেকে আওয়ামী লীগকে ‘পুনরুজ্জীবিত’ করার কঠিন সংগ্রাম চালানোর দায়িত্ব প্রায় একাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্যই ১৯৬৪-এর খসড়া ম্যানিফেস্টোটি আমাদের আলোচনার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, ১৯৬৬-এর ৬ দফা প্রণয়নেরও আগে এই দলিলেই আগামী দিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের দিকনির্দেশনাগুলো প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে নির্দেশিত হয়েছে। এই যুক্তিটি বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
‘পুনরুজ্জীবিত’ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (যার কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালের ৬-৭ মার্চ) সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক পদে থাকলেও দলটির পুনরুজ্জীবনের পেছনে মূল নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা এসেছিল শেখ মুজিবের কাছ থেকেই। কমিটিতে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবেন পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এইচএম কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। এই পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সে সময়ে বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল (‘এবডো’ তখনও বিদ্যমান- যা ১৯৬৬ পর্যন্ত বলবৎ ছিল)। এখানে বলা দরকার, আইয়ুবের জারি করা রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার জন্য ‘এবডো’ আইন পাস হয় ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরই। এ রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ১৯৬৪ সালের খসড়া ম্যানিফেস্টো তথা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রস্তুত করা হয়। আমি এখানে শুধু অর্থনৈতিক কর্মসূচির প্রতি দৃষ্টি দেব- সমতামুখীন সমাজের আদর্শ কীভাবে এদেশে গড়ে উঠেছিল তা বোঝার তাগিদ থেকে। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ শুধু নিচে তুলে ধরা হলো।
প্রথমেই বলা দরকার, ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে এই ম্যানিফেস্টোতে ১৯৬৪ সালে যা বলা হয়েছিল, তারই প্রতিধ্বনি হয়েছিল পরবর্তীতে বাহাত্তরের সংবিধানে ও বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। এর থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২-৭৩ সালে গৃহীত ‘সমাজতান্ত্রিক’ চিন্তা-ভাবনার বীজ এই দলিলেই সুসংহতভাবে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তাতে মূল অবদান রেখেছিলেন রাজনীতিবিদরাই। ‘দুই অর্থনীতি’ বিষয়ে আলোচনা করা এদেশের প্রাগ্রসর ও শীর্ষস্থানীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা পরবর্তীতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের প্রদর্শিত রাজনৈতিক দর্শনের নির্দেশিত পথ ধরেই।

[ক্রমশ

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


যেটা লক্ষণীয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থাকার কালেই প্রগতিশীল (এবং আজকের বিচারে এক-অর্থে ‘র‌্যাডিকেল’) কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। যদিও দলিলটিতে ভাষা বা প্রতীকের ব্যবহার ছিল ধর্মীয় ‘টেক্সট’-এর আবরণে, এর মর্মবস্তু ছিল সমতাবাদী। উদাহরণত, ‘ধন-সম্পদের অধিকারকে’ মৌলিক অধিকারের (Fundamental Rights) বিষয়বস্তু করা হয়েছিল, যা এমনকি পরবর্তীকালের সেক্যুলার ঘোষণাতেও পরিদৃষ্ট হয় না। এ ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছিল তা নিম্নরূপ :

‘দুনিয়ার সব ধন-সম্পদের স্রষ্টা ও মালিক এক আল্লাহ। আসমান-জমিনে যাহা কিছু রহিয়াছে সবই আল্লাহর। সুতরাং আল্লাহ তালার প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র বা খেলাফত হইবে সমস্ত ধনসম্পদের মালিক। কোনো কিছুর উপরই ব্যক্তিবিশেষের অধিকার থাকিবে না। সে শুধু আল্লাহর খলিফা হিসেবে দুনিয়ার উপর তাহার ব্যাষ্টি ও সমষ্টিগত কল্যাণের জন্য এই ধনসম্পদ সাময়িকভাবে রাষ্ট্র বা খেলাফতের নির্দেশ ও সত্তানুযায়ী ভোগদখল করিতে পরিবে। এই মূলনীতিকে ভিত্তি করিয়াই ভূমি সংস্কার ও শিল্পের উন্নতি সাধন করিতে হইবে।’

শুধু অ্যাবস্ট্রাক্ট সমতার নীতি ঘোষণা করেই বক্তব্য সীমিত রাখা হয়নি। ‘ভূমি সংস্কার’ প্রসঙ্গে জমিদারি প্রথা ও তার আনুষঙ্গিক সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থা তথা ‘মহাজনী প্রথা, ‘মজুতদারী’, ‘মুনাফাখোরী বাজারের অস্থিরতা’ প্রভৃতি দূরীভূত করার কথা বলা হয়েছিল। শুধু যে ‘জমিদারী প্রথা অবিলম্বে বিনা খেসারতে উচ্ছেদ’ করার কথা বলা হয়েছিল তা-ই নয়। এমন সব দাবিকে দলের ম্যানিফেস্টোতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব হয়েছিল যাকে শুধু প্রগতিশীল রূপান্তরের কর্মসূচি বললে কম বলা হয়। বুর্জোয়া-গণতন্ত্রের চৌহদ্দি পেরিয়ে প্রায় র‌্যাডিকেল ধারার সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির মতো শোনাবে সেগুলো আজ। যেমন, ‘জমির পুনর্ব্যবস্থার পরিকল্পনা’ শীর্ষক অধ্যায়ের দ্বিতীয় দাবি ছিল- ‘সমস্ত কর্ষিত ও কৃষি উপযোগী অকর্ষিত জমি কৃষক মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে।’ ৩য় দাবি ছিল- ‘রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে সমবায় ও যৌথ কৃষিপ্রথা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। এই সব সমবায় ও যৌথ খামারের পরিচালনার ভার স্থানীয় কৃষকদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত থাকিবে।’ ৯ম দাবি ছিল আরও বেশি র‌্যাডিকেল- অক্টোবর-বিপ্লব পরবর্তী ডিক্রির অনুরূপ :’কালে সমস্ত ভূমিকে রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে। এবং সরকারের তত্ত্বাবধানে যৌথ ও সমবায় কৃষি প্রথার প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সেই সুদূর ১৯৪৯ সালেই আওয়ামী লীগের প্রাক-জন্মলগ্ন থেকেই গণতান্ত্রিক ভূমি-সংস্কার, সমবায়, যৌথ কৃষি প্রভৃতি ধারণার পত্তন হয়েছিল এ দেশে। পরবর্তীকালে, বাহাত্তরের সংবিধানে ও বাকশালের কর্মসূচিতে সমবায় ও গ্রাম-জীবনের পুনর্গঠনের কথা আবারও ফিরে আসবে। এসব ধারণা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত সাহায্য দেওয়ার বা ইন্দিরা কংগ্রেসের সোভিয়েতের দিকে ঝুঁকে পড়ার সাথে সম্পর্কিত নয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টো প্রণেতারা বহু আগেই গ্রামজীবনের প্রগতিশীল রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুধাবন করেছিলেন এবং সেই ডিসকোর্স তরুণ শেখ মুজিবের চেতনায়- অবচেতনায় সে সময় থেকেই অন্তর্লীন হয়ে থাকবে।

এ তো গেল কৃষি ও গ্রাম-অর্থনীতির প্রসঙ্গ। শিল্প খাত নিয়েও পাই যুগের তুলনায় এগিয়ে থাকা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা। ১৯৪৯ সালের এই ম্যানিফেস্টোতেই প্রথম শিল্প খাতে ‘জাতীয়করণের’ দাবি তোলা হয়। বাঙালির সাম্যচিন্তায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের আগেই- এমনকি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির মধ্যে যা সেভাবে আসেনি- ১৯৪৯ সালে একটি প্রগতিশীল কিন্তু বাস্তবোচিত শিল্প-উন্নয়নের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে মূল ও জরুরি শিল্পগুলো রাষ্ট্রের পরিচালনায় রেখে এবং ‘অতিরিক্ত মুনাফাখোরী প্রবৃত্তি’ নিয়ন্ত্রণে এনে জাতীয় শিল্প পুঁজির বিকাশের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছিল দলিলে। সাম্রাজ্যবাদী নির্ভরতা ছেড়ে দেশীয় শিল্পপণ্যের জন্য ‘সংরক্ষণমূলক’ নীতিমালা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ব্যাপক বিকাশ চাওয়া হয়েছিল। এসবের লক্ষ্য ছিল একটাই- ‘শিল্প ও ব্যবসায় একচেটিয়া অধিকার’ বন্ধ করা, অর্থাৎ, মনোপলি পুঁজির বিকাশকে প্রতিহত করা। অন্যদিকে, শ্রমিকদের নাগরিক সকল অধিকার-কর্মসংস্থান, ন্যায্য মজুরি, শ্রমিক সন্তানদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ও সুলভ কারিগরি শিক্ষার প্রচলন, বিনাব্যয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা, শ্রমিক পরিবারের জন্য বাসযোগ্য গৃহের বন্দোবস্ত করা ইত্যাদি দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাছে আমার কথাগুলো মূল বক্তব্যের ইচ্ছাকৃত ইন্টারপ্রিটেশন বলে মনে হয়। ইস্যুগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করে আমি সরাসরি উদ্ৃব্দতিতে যাচ্ছি। ‘শিল্প পুনর্গঠনের পরিকল্পনা’ অধ্যায়ে প্রথম দফা হিসেবেই তোলা হয়েছিল বৃহৎ শিল্প কলকারখানা ‘জাতীয়করণ’-এর কথা :

‘শিল্পগুলোকে জাতীয়করণ করিতে হইবে, যথা :খনিজ শিল্প, যুদ্ধ শিল্প, ব্যাংক, বীমা, যানবাহন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাসায়নিক শিল্প, বন-জঙ্গল, পাট, চা, চিনি জাতীয় বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বহু লোকের শ্রম যেখানে কতিপয় লোকের মুনাফার বন্দোবস্ত করিয়া দেয়, এরূপ সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্রের দখলে কিংবা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় আনিতে হইবে।’

শুধু বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণই নয়, এসব শিল্পের পরিচালনায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ও শ্রমিকদের যৌথ অংশগ্রহণের কথাও আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে ভাবা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফাতেই লেখা ছিল : ‘সমস্ত প্রধান শিল্পগুলোকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ও শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ও পরিকল্পনায় পরিচালিত করিতে হইবে।’

জাতীয়করণকৃত শিল্পের ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, এতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আলাদা করে ভাবতে হয়। ব্যক্তি-মালিকানাধীন বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের প্রশ্নটি অত কঠিন নয়- কেননা বাজার-বৃদ্ধি ও মুনাফার পরিমাণের সাথে সংগতি রেখে সেখানে নতুন বিনিয়োগ ফি বছরই ঘটে থাকে। জাতীয়করণকৃত শিল্পে আমলাতান্ত্রিক Redtape-এর জন্য সেটা অনেক সময়েই হয়ে ওঠে না, এবং এতে করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের মিলগুলোর প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতার বিচারে দীর্ঘমেয়াদে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সে কারণে তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে :’শিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও অবিলম্বে কার্যকর করিতে হইবে। … দেশের সমস্ত মূলধন রাষ্ট্রের পরিচালনায় আনিয়া ব্যাপক শিল্প সম্প্রসারণের পথ সুগম করিতে হইবে।’ শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য আরও চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। চতুর্থ দফায় সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছে : ‘বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে কারিগরী শিক্ষা কেন্দ্র খুলিয়া এবং সাহায্য ও সুবিধা দানে প্রচুর সংখ্যক যুবকের কারিগরি শিক্ষার বন্দোবস্ত করিতে হইবে।’ ষষ্ঠ দফায় একচেটিয়া পুুঁজিবাদকে নিয়ন্ত্রণে এনে বিকাশের কথা বলা হয়েছিল :’শিল্প ও ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার থাকিবে না’ এবং সপ্তম দফায় দাবি জানানো হয়েছিল :’শিল্পে মুনাফার ঊর্ধ্বতন হার আইন করিয়া নির্ধারণ করিয়া দিতে হইবে।’ শুধু দেশজ বৃহৎ কল-কারখানা জাতীয়করণ নয়, দশম দফায় বলা হয়েছিল :’সমস্ত ব্রিটিশ মার্কিন অন্যান্য বৈদেশিক ব্যবসা ও মূলধনকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে।’ রাষ্ট্রের ওপরে থাকবে ‘অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার’ (অষ্টম দফা)। সংরক্ষণমূলক শিল্পনীতির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল ১৩তম দফায় :’দেশীয় শিল্প সংরক্ষণের জন্য বিদেশি পণ্য দ্রব্যের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করিতে হইবে।’ এবং আজকের পরিভাষায় যাকে আমরা বলি ‘রেন্ট-সিকিং-এর সুযোগ’, সেটিকে ১২তম দফায় কঠোরভাবে বন্ধ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল : ‘চোরা কারবার ও অন্যান্য অবৈধ উপায়ে অর্জিত যাবতীয় ধন-সম্পদ ও মূলধন বাজেয়াপ্ত করিতে হইবে।’ দারুল ইসলামের অর্থনীতিতে সেদিন যেসব দফা সন্নিবেশিত হয়েছিল তা এক অর্থে বাহাত্তরের সংবিধান ও তৎপরবর্তী প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার থেকেও কোনো কোনো দিক থেকে অনেক বেশি র‌্যাডিকেল ধারার কর্মসূচি। আরও যেটা লক্ষণীয় যে, এসব দাবিকে কোনো এক অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুলতবি করে রাখার চেষ্টা করা হয়নি। এই দলিলের প্রণেতারা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘আশু কর্মসূচি’ অধ্যায়ে এসব মূল দাবিগুলোকে পুনরায় বিবৃত করেন। সময়টা ১৯৪৯ সাল সেটাও পাঠকদের মনে রাখতে হবে :

– ‘অবিলম্বে পাক গণপরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভা ভাঙ্গিয়া দিয়া গঠনতন্ত্র কিরূপ হইবে নির্ধারণ করিবার নিমিত্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভার সাধারণ নির্বাচন দাবি।’

– ‘অবিলম্বে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন এবং মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন দাবি।’

– ‘বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ ও প্রকৃত চাষীদের মধ্যে ভূমির পুনর্বণ্টন করিবার জন্য শক্তিশালী জনমত গঠন।’

– ‘মূল শিল্পাদির জাতীয়করণ, সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে শিল্প-প্রতিষ্ঠা, কুটির শিল্পের উন্নয়নকল্পে সাহায্য ও উৎসাহ দান এবং দেশীয় শিল্প-সংরক্ষণের জন্য বিদেশী পণ্যদ্রব্যের উপর অতিরিক্ত কর কার্যকরণ।’

– ‘কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে রাজস্বের ন্যায়সঙ্গত বিভাগ।’

– ‘জুট বোর্ডের পুনর্গঠন এবং চাষীরা যাহাতে পাটের সর্বোচ্চ মূল্য পায় তাহার ব্যবস্থা ও অবিলম্বে যথেষ্ট সংখ্যক পাটকল স্থাপনের জন্য জনমত গঠন।’

– ‘সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন জীবন-যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, আবাস, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, কাজ করার ও কাজের উপযুক্ত মজুরী, ধর্ম সভ্যতা, সংস্কৃতি ও পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা- মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, পত্রিকা ও প্রচারপত্রের স্বাধীনতা, শোভাযাত্রা, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘট করার স্বাধীনতা, সংবাদ আদান-প্রদানের স্বাধীনতা, ব্যক্তি বিশেষের মর্যাদা ও ঘরবাড়ী অক্ষুণ্ণ রাখার স্বাধীনতা, গতিবিধির স্বাধীনতা এবং রেডিও মারফত প্রচারের অধিকার প্রত্যেক পাকিস্তানবাসীকে সমান ও সহজভাবে দিতে হইবে।’

– ‘দিল্লি চুক্তিকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়া হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি স্থাপন।’

– ‘বৃটিশ কমনওয়েলথের সহিত সম্পর্কচ্ছেদ।’

– ‘আগামী তিন মাসের মধ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক কাশ্মীরে গণভোটের আয়োজন।’

– ‘গণতান্ত্রিক, মুসলিম ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন।’

– ‘ইসলামের সত্যিকার ব্যাখ্যা এবং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে ইহার বাস্তব প্রয়োগ করিয়া পাকিস্তানকে সত্যিকার ইসলামী পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র বা দারুণ ইসলাম হিসেবে গড়িয়া তুলিবার জন্য অবিরাম সংগ্রাম।’

এককথায়, ধর্মীয় ভাবাদর্শের উপমা, প্রতীক ও চিত্রকল্পের ছায়ায় এক উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও সমতামুখীন সমাজ গড়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছিল সেদিনের তরুণ শামসুল হক, শেখ মুজিব ও তাদের সহকর্মীদের ঐকমত্যের ‘খসড়া ম্যানিফেস্টো’। পরবর্তীতে এর একটি ইংরেজি সংক্ষিপ্তসার প্রকাশিত হয় ‘Draft Constitution and Rules of the East Pakistan Awami Muslim Leage’ নামে। সেখানে ইতিপূর্বে উল্লেখিত মূলধারাগুলো উপস্থাপিত হয়। কেন মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ করতে হচ্ছে সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল : ‘The orgnisation is for all the PeopleÑ the AwamÑas opposed to the pocket or the Sarkari League, which is subservient to the present rulers’. আর মূল মূল দাবিগুলো ছিল নিম্নরূপ। পুনরুক্তি সত্ত্বেও প্রসঙ্গের গুরুত্ব বিবেচনায় তা নিচে তুলে ধরছি :

– ‘To ensure that the constitution and the laws of Pakistan are founded on the principles of true democracy.’
– ‘To promote and maintain the religious, cultural, social, educational and economic interests of the Muslims of Pakistan and to ensure similar rights to other non-Muslim citizens of Pakistan’.

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬৩

পূর্বে প্রকাশিতের পর
যে চিঠির কথা মুজিব এখানে বলছেন তা কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। মুজিব এখানে একাধিক চিঠির কথা বলছেন। বস্তুতই একাধিক বার্তা দেওয়া হয়েছিল সোভিয়েতের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেই। আমরা সচরাচর যে চিঠির কথা মনে রেখেছি, তা হলো ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিলে লেখা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নির চিঠি। ইয়াহিয়াকে উদ্দেশ করে লেখা এ চিঠিতে পদগর্নি সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘চরম দুর্ভাবনা’ (Great alarm) ব্যক্ত করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে, ইয়াহিয়া জরুরি ভিত্তিতে এমন ব্যবস্থা নেবেন যাতে করে রক্তপাত ও নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করা হবে : ‘Podgorny urged Yahya to take the most urgent measures to stop the bloodshad and repression against the population in East Pakistan and for turning to methods of a peaceful political settlement.’ এটা বলে পদগর্নি এ-ও উল্লেখ করেন যে, তিনি পাকিস্তানের ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ করছেন কেবল বিশ্ব-মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে : ‘Podgorny added that he was guided by ”the genarally recognized humanitarian principles recorded in the universal declaration of human rights.’’

যেটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি সেটা হলো পদগর্নির চিঠির আগেও একটি প্রতিবাদ বার্তা গিয়েছিল রুশ প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের কাছ থেকে। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর দুই দিন বাদেই করাচিতে অবস্থানরত সোভিয়েত কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার কাছে একটি মৌখিক বার্তা পাঠান প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন। শ্রীনাথ রাঘবনের বই থেকে সেই মৌখিক বার্তার বিষয়বস্তুটি নিচে তুলে ধরছি :
‘Kosygin had stated that Òextreme measures taken by the military administration and continuation of bloodshed in East Pakistan will not solve the existing complicated problems.’’ He asked Yahya to Òtake immediate measures for the cessation of bloodshed in East Pakistan and for the resumption of negotiations.’’ পরবর্তীতে নয় মাস ধরে বাংলাদেশকে ঘিরে সোভিয়েতের উদ্যোগে অসংখ্য দ্বিপক্ষীয় পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময় চলবে ভারত সরকারের সাথে- যার সম্পর্কে মুজিব পরবর্তীকালে বিস্তারিত জেনেছিলেন। স্থানাভাবে এখানে একটি উদাহরণের কেবল উল্লেখ করব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ‘নেপথ্যের পরামর্শদাতার’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেটা এ থেকে স্পষ্ট হয়। ১৯৭১ সালের ৮ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং গিয়েছেন মস্কোয় বাংলাদেশ বিষয়ে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পূর্ব বাংলার সংকটের সমাধানের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো- এই দুটি পরস্পর সম্পর্কিত ইস্যুতে কোসিগিন পরামর্শ দিলেন আপাতত দুটি ইস্যুকে আলাদা করে নিষ্পত্তির চেষ্টা হোক। কোসিগিন বললেন,‘Refugees must go back, all of them, every one of them’- এটার ওপরেই প্রথমে জোর দিতে হবে। তবে এর সাথে সাথে দ্বিতীয় ইস্যুর ওপরেও কাজ করতে হবে। যদিও পাকিস্তান বলবে যে, রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে আসলে তার ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ নাক গলানো হচ্ছে, তা সত্ত্বেও ভারতের উচিত হবে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামে সাহায্য করে যাওয়া’ :  Kosygin suggested, Òin strict confidence’’, that India could continue to support the Bengali guerrillas as well as the mass struggle. ‘Therfore, let us not bundle the two [issues] together, but give all possible help to the democratic forces … You are a politician, you know what I am implying.” স্পষ্টতই কোসিগিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি চান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সর্বপ্রকারের সাহায্য দিতে- প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক কূটনীতিক রীতিসম্মত বাধ্যবাধতার চৌহদ্দি লঙ্ঘন না করেই। এ দেশে যারা মনে করেন এখনও যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতের ভূমিকা কেবলমাত্র সীমিত ছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের যুদ্ধের দিনগুলোতে ‘ভেটো প্রদানের’ মধ্যেই তারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নয় মাসে সোভিয়েতের নানামুখী ভূমিকার গভীরতা ও মাত্রা সম্পর্কে যথেষ্ট মাত্রায় ওয়াকিবহাল নন। এজন্যই বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সংগ্রামের মধ্যে এক আত্যন্তিক যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৬ মার্চ রাশিয়া সফর শেষে দেশে ফিরে এসে তিনি বলেছিলেন : ‘আমাদের দেশের জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম করেছে, যে রক্ত দিয়েছে, যে ত্যাগ স্বীকার করেছে সে খবর তারা জানে এবং প্রত্যেক রাশিয়ার জনগণ তা জানে। রাশিয়ার জনসাধারণ আমার বাংলার জনসাধারণকে সেজন্য শ্রদ্ধা করে। এ জন্য শ্রদ্ধা করে যে রাশিয়াও রক্তের মাধ্যমে সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লবের মাধ্যমে তার দেশকে মুক্ত করেছিল। আমার সাড়ে সাত কোটি বাংলার মানুষও রক্ত দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্ত করেছে। সেজন্য তাদের সঙ্গে আমাদের অনেকটা নীতির মিল রয়েছে।’
এই ‘নীতির মিল’-এর থেকে কোনো কোনো বিদ্বজ্জন এ রকম ইঙ্গিত করার প্রয়াস পেয়েছেন যে বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র বা বাহাত্তরের সংবিধানের সমাজতন্ত্র আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েত-ঘেঁষা নীতির রাজনৈতিক প্রভাবকেই প্রতিফলিত করেছে। খুঁটিয়ে দেখলে এ রকম সিদ্ধান্তের পেছনে তথ্য-উপাত্তের প্রমাণ মেলা ভার। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের Demonstration Effect-এর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই বাহাত্তরের সংবিধানের সমাজতন্ত্র-সম্পর্কিত ডিসকোর্সের ওপরে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্তর দশকের গোড়াকার সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রভাব নয়। লেনিনের অক্টোবর বিপ্লবের (এবং সাধারণভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ-নাজিবাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত বিশ্ব সমাজতন্ত্রের) প্রভাব অনুভূত হয়েছিল গোটা পৃথিবীতেই। ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলন, তৃতীয় বিশ্বের ঊপনিবেশবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, বিশ্বজোড়া পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী শান্তির সংগ্রাম, ষাটের দশকের ছাত্র-যুবকদের এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট আন্দোলন, হো চি মিনের ভিয়েতনাম, গণচীনের উত্থান-পর্বে সোভিয়েতের সাহায্য, ফিদেল ও চে’র কিউবার আত্মপ্রকাশ, গ্যাগারিনের মহাকাশ-যাত্রা- সবকিছুর মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বা এর উজ্জ্বল ভাবমূর্তির একটা প্রভাব পড়ে থাকবে এ দেশেও। বঙ্গবন্ধু এই প্রভাববলয়ের বাইরে ছিলেন না। স্ট্যালিনের ধারার ‘ব্যারাক সমাজতন্ত্রে’ মুজিবের কোনোদিনই আস্থা ছিল না। কিন্তু সমাজতন্ত্রের শোষণবিরোধী চরিত্রটি তার নজর কেড়েছিল সেই তরুণ বয়সেই। তারপর সময়ের সাথে সাথে এক নিজস্ব ধারার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদল তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ক্রমশ স্পষ্ট রূপ নিচ্ছিল। একে যেমন সুইডিশ মডেলের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বলা চলে না, আবার সোভিয়েত কমান্ড ইকোনমির সমাজতন্ত্রও বলা ভুল হবে। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের ভাবনায় evolutionary pattern বোঝার ক্ষেত্রে নিকটতম আকর-উৎস হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ অবধি আওয়ামী লীগের ভেতরকার দলিলপত্র। সেদিকেই আমরা এতক্ষণ দৃষ্টি দেইনি, এবং সেদিকেই এখন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হলো পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই আওয়ামী লীগের দলিলপত্রে সমাজতন্ত্রের শব্দাবলি ও ধারণার উদার ব্যবহার। এমনকি যখন আওয়ামী লীগ স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেনি, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ রূপে সবে গঠিত হচ্ছে, সেই শুরুর পর্যায়ে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সমসাময়িক তরুণ বয়সী রাজনৈতিক কর্মীরা স্বপ্ন দেখেছেন সমাজতন্ত্রের। ১৯৪৯ সালের (২৩-২৪ জুন) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘খসড়া ম্যানিফেস্টো’ নানা দিক থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দলিল। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সম্ভবত এটি রচনা করেন। রচনা যারই হোক না কেন, মুজিবের সমাজতন্ত্র ভাবনায় এটি গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং খসড়াটিকে যৌথ-ভাবনার ফসল হিসেবেও দেখা যায়। স্মর্তব্য, তখন মুসলিম লীগের শাসন চলছে পূর্ব পাকিস্তানে; দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর পাকিস্তান বাহ্যত ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষিত। তরুণ মুজিব, শামসুল হক প্রমুখ দলের সভাপতি মওলানা ভাসানীর প্রশ্রয়ে এই ইসলামী ডিসকোর্সের ভেতরে থেকেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের নতুন ভাষা নির্মাণ করছেন। সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হচ্ছে এই প্রতিবাদের ভাষাভঙ্গির ভেতরেই। একগুচ্ছ উদাহরণ:
১. সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধিতা : ‘ভারতে মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হইতে … বিরুদ্ধ পরিবেশ বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হইলেও শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র বা শুধু মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করিবার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রভাবান্বিত ইসলামবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী, ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়িয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহাদের ছিল না। … পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে দারুল ইসলাম বা সত্যিকার মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে গড়িয়া তুলিবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছে।’
২. সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও বিশ্বশান্তি : ‘সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়গুলি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড় শুরু করিয়াছে। এই তোড়জোড় প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়া বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়া এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমরসজ্জা ও যুদ্ধঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়া। … পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচিত এই সাম্রাজ্যবাদী ও যুযুৎসু প্রচেষ্টাকে নিরুৎসাহ করা এবং ইহার বিরুদ্ধে দৃঢ় পরিকল্পনা গ্রহণ করা। পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করার সমস্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানকে অংশীদার হইতে হইবে এবং শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের, সর্বব্যাপী বিজয় অভিযানকে জয়যুক্ত করিবার জন্য অন্যান্য জনতার গণতান্ত্রিক ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সর্বপ্রকার প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর আন্দোলন ও কর্মধারায় সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতা করিতে হইবে।’
৩. ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংঘ’ : (ক) ‘পাকিস্তান ব্রিটিশ কমনওয়েলথ তথা সর্বপ্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের বাহিরে একটি পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংঘ হইবে।’ দেখা যাচ্ছে যে, লাহোর প্রস্তাবের ধারায় বিভিন্ন আঞ্চলিক ইউনিটকে নিয়ে একটি ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংঘ’ গড়ার চিন্তা ছিল তরুণ মুজিব ও তার সহকর্মীদের; (খ) ‘পাকিস্তানের আঞ্চলিক ইউনিটগুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে; (গ) ‘সাধারণতন্ত্র এবং জনসাধারণের পূর্ণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে রচিত হইবে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র।’
৪. ‘কাজ করার অধিকার’ : ‘প্রত্যেক অধিবাসীরই কাজ করার অধিকার অর্থাৎ সুযোগ ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিযুক্ত হওয়ার এবং কাজের গুণ ও পরিমাণ-অনুযায়ী রাষ্ট্র-নির্ধারিত উপযুক্ত বেতন পাওয়ার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।’ বলা দরকার, এই দলীয় কাজ করার অধিকারকে ‘মৌলিক অধিকারের’ মধ্যে ফেলা হয়েছিল। মৌলিক অধিকারের মধ্যে আরও ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতা, সর্বজনীন নির্বাচনী প্রথা, খাত নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের জন্য বেকারবীমা ও পেনশন দান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার (অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং সহজলভ্য মাধ্যমিক শিক্ষা সকল নাগরিকদের জন্য), ধর্মীয় অধিকার, নারীর অধিকার (প্রত্যেক নারীকে পূর্ণতম সুযোগ ও সুবিধাদান; ‘প্রত্যেক চাকুরিয়া নারীকে সন্তান প্রসবের পূর্বে ও পরে পূর্ণ বেতনে বিদায় মঞ্জুর’)। ‘ধনসম্পদের অধিকার’; ইত্যাদি।
[ক্রমশ]