বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আসল অর্থ হচ্ছে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- এরা সবাই মানুষ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে মানবিকতাবাদ (হিউম্যানিজম)। এটা বোঝার জন্য ইউরোপীয় রেনেসাঁর মানবিকতাবাদী দর্শন বোঝার দরকার নাই। আমাদের সমাজের ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত জনজীবনের মৌলিক মানবিকতাবাদকে উপলব্ধি করাই যথেষ্ট। এ জন্যই আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও অন্য ধর্মের লোককে আপনার আত্মীয় ও প্রতিবেশী বলে জ্ঞান করেছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে সময় সময় আচ্ছন্ন করেছে বটে, কিন্তু আমাদের ধর্ম-সম্প্রদায়ে মিলনের ইতিহাসই হচ্ছে মৌলিক ধারক। এ কথা রবীন্দ্রনাথও গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণি’ বইটির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন, তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনে নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। … বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই একত্র হয়েছে, অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। … এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়। বিবাদে বিরোধে বর্বরতা।’ এই মানবিকতাকে তুলে ধরতেই সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আলাদা করে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়েছিল।
আজকে কালক্রমে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের প্লাবনে ধর্মনিরপেক্ষতার আদি-প্রতিশ্রুতি অনেকটাই সাইডলাইনে চলে গেছে বলে মনে হতে পারে। এক সময় (১৯৬৬ সালে) বদরুদ্দীন উমর লিখতে পেরেছিলেন অবলীলায় ‘স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের বাস্তব জীবনক্ষেত্রে যা কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে তাদের কোনোটিই কিন্তু ধর্মচিন্তার ফল নয়। … এ দেশের মুখ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনসমূহ- যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, শিল্পোন্নয়ন ও সমতা রক্ষার আন্দোলন ইত্যাদি ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ নয়। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে এগুলির আবেদন প্রায় ধর্মবিরোধী। ধর্মীয় আন্দোলনের প্রচেষ্টা যে ইদানীং কিছু কিছু হয়নি তা নয়। কিন্তু এ আন্দোলনের মধ্যে আগেকার সেই জৌলুস এবং মোহমুগ্ধতা আর থাকেনি। জীবনের সাথে এ জাতীয় আন্দোলনের যোগাযোগ যেন আজ অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। এ কারণেই এ দেশে ধর্মীয় বাধানিষেধ এবং নানা সংস্কার সত্ত্বেও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় চিন্তার সে পূর্ব আবেদন আর নেই।’
ওপরের কথাগুলো লিখিত হয়েছে ১৯৬৬ সালে। সেদিনের তুলনায় আজকের অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে ঘরে-বাইরে। সম্প্রতি স্বয়ং বদরুদ্দীন উমরও আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বইটি আজকের প্রেক্ষিতে লিখলে কথাগুলো অন্যভাবে বলতেন।
ধর্মবিশ্বাসী হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে শক্ত অবস্থানে দাঁড়ানোর আরো একটি উদাহরণ মওলানা ভাসানী। সময় সময় রাজনৈতিক কোন কোন অব্যাখ্যাত স্ব-বিরোধিতা বলে মনে হতে পারে ভাসানীর কিছু কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে কোন সন্দেহ নেই যে মওলানা ভাসানী ছিলেন এদেশের ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক, সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানো, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থের জন্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই করা এক ব্যতিক্রমী ও বর্ণিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ভাসানীর সুদীর্ঘ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জীবনের এবং জীবন-দর্শনের মূল্যায়ন করার স্থান এখানে সীমিত। এ নিয়ে একটি বড় পরিসরের বিশ্নেষণমূলক কাজ হওয়া দরকার। আমি এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির সাপেক্ষে কয়েকটি মন্তব্য রাখছি কেবল।
প্রথমত, মওলানা ভাসানীর মানস-গঠনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রভাব এসেছিল। রাজনৈতিক জীবনের সূচনা পর্বেই তিনি ভিন্ন ধারার পথিক ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাকে প্রভাবিত করেছিলেন, এটা জানা যায়। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কোন দলের সাথেই তিনি ঘনিষ্ঠ হতে চাননি। চরমপন্থি বিপ্লববাদীদের দলেও তিনি নিজেকে দেখতে চাননি। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আলোচনা তাকে টানত, কিন্তু তার অবস্থানও তাকে কাছে টানতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন :
“ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘সাহস ও আপসহীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা পছন্দ হয়, কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি শুধু মুসলমানদের জন্যেই কথা বলেন এবং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নিন্দা করেন। যে-সকল হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা শুধু হিন্দুদের জন্যে কথা বলে যে-ভুলটা করেছেন; সিরাজীও শুধু তার নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা বলে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করছেন। যদিও মুসলমানদের পক্ষেও তখন কথা বলার লোকের প্রয়োজন ছিল। আবদুল হামিদ [ভাসানী] অত্যাচারিত ও দরিদ্রের পক্ষেু সেই অত্যাচারিত ও দরিদ্রের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দু’সম্প্রদায়েরই মানুষ আছে, তবে ঘটনাক্রমে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি।”
মওলানা ভাসানী আজীবন ধর্মান্তরের বিরোধিতা করে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ একটি তথ্য উল্লেখ করেছেন : ‘পীর হিসেবে তাঁর মুরিদান ও ভক্তের মধ্যে হিন্দু মুসলমান নানা সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল। ১৯৬৯-এ আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের মধ্যে একদিন সন্তোষে রমেশ দেবনাথ নামে এক দরিদ্র হিন্দু সস্ত্রীক গিয়ে ভাসানীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তিনি জানতে চান, তাদের কী পেশা। তারা জানান যে, তারা জাতে যোগী (নিম্নবর্ণের হিন্দু) কিন্তু এক সময় স্বর্ণকার ছিলেন। এখন আর সোনা-রূপার অলংকার কেউ বানাতে আসে না। জমিজমা তেমন নেই। অনেক ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে। মওলানা তাদের জিজ্ঞেস করেন, মুসলমান হলে তাদের আয় বাড়বে কিনা, আল্লাহ খুশি হয়ে তাদের ধনদৌলত দেবেন কিনা? তারা মাথা নিচু করে নিরুত্তর থাকেন। ভাসানী তাদের বলেন, ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানে অধিকাংশ মুসলমান কী সুখে আছে দেখছো না? পড়ালেখা কিছু জানলে বাড়িতে গিয়ে নিজের ধর্মগ্রন্থ গীতা পড়ো গিয়ে; দুনিয়াতে কোনো ধর্মই খারাপ নয়। গুরুকে প্রণাম করে দেবনাথ দম্পতি বিদায় নেন।’
সৈয়দ আবুল মকসুদের বয়ানে ভাসানীর ধর্মান্তরের বিরোধিতা প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায় কাজী আনোয়ার-উল-হকের কাছে। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ভাসানী কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখানে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য যান আনোয়ার-উল-হক, তখন তিনি পুলিশের ডিআইডি (বিশেষ শাখা)। হাসপাতালের কেবিনে ভাসানী তার কাছে অতীত দিনের স্মৃতিচারণে বসেন। তিনি আসামের আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আসামে আমার মুরিদদের মধ্যে হিন্দুও ছিলো, মুসলমানও ছিলো। আমি ধর্মান্তর পছন্দ করি না। অনেক মুসলমান নেতা আমাকে ধর্মান্তরের জন্য পরামর্শ দিতেন। আমি রাজি হইনি। ১৯৩৫ থেকে ‘৪৭ পর্যন্ত বারো বছরে যদি আমি চাইতাম তবে লাখ লাখ আদিবাসী ও হিন্দুকে আমি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতাম। আসামকে পূর্ব বাংলার মতোই মুসলমান মেজরিটি প্রভিন্স বানাতে পারতাম। জীবনে একজন হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীকে আমি মুসলমান করিনি। তাতে লাভ কী? আমার হিন্দু শিষ্যদের ঠিকমতো তাদের ধর্মকর্ম করার পরামর্শ দিতাম।’
ভাসানী প্রায়ই বলতেন, ‘দুনিয়ায় মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত, জালেম আর মজলুম। জালেম হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক; তার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম চলবেই।’
দ্বিতীয়ত, সুবিদিত যে ভাসানীই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। আবার তারই সভাপতিত্বে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নামকরণ বদলের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই কাউন্সিল অধিবেশনে অসাম্প্রদায়িক রূপান্তরের লক্ষ্যে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবেই ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম হয় আওয়ামী লীগ। সেই অধিবেশনেই, যেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন- গৃহীত হয় প্রস্তাব, যেখানে বলা হয়েছিল :’পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হইয়াছে।’ অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা পূর্বাপর বহমান ছিল। সেই অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভাসানী বলেন :’এই দুই বছরের ভেতর আমি ইউরোপের নানান দেশ ভ্রমণ করিয়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়ভাবে পরিচিত হইবার ও নানা প্রকারের তথ্য সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়াছি এবং সেই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় এই অভিজ্ঞতা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণের পথে সহায়তা করিবে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।
পাকিস্তান অর্জনের সময় যে বিরাট উন্মাদনা আট কোটি মানুষের জীবনকে নবচেতনা ও বিরাট সম্ভাবনার আশায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সে আশা-আকাঙ্ক্ষা মানুষের অবসন্ন ও হতাশ প্রাণে এক রঙিন স্বপ্নের সৃষ্টি করিয়াছিল, নবলব্ধ পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নর-নারীর প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর দেশকে সুখী সমৃদ্ধশালী করিয়া স্বর্গরাজ্য করিবার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করিয়াছিল। আট বছরের লীগশাহির কুশাসন ও অমানুষিক অত্যাচার, অবিচার, দুর্নীতি, বেইমানি, দাগাবাজি সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনার স্বপ্নকে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিল।….আমরা মুসলমানু পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করা হইবে এই চিৎকার উঠিতেছে কিন্তু ইসলামী জীবন-যাপন করিবার কথা কাহারও মনে হইতেছে না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অত্যাচার, অবিচার অবাধে চলিতেছে। ঘোড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি, মদ্যপান, জুয়া প্রভৃতি অন্যায় কার্য দেশে কেবল চলিতেছেই না; সরকারও যেন ইহার পৃষ্ঠপোষকতা করিতেছেন। পাপের ভারে দেশ ধ্বংসের পথে।… দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র গঠনের কথা বলা হইতেছে। পাকিস্তানে শুধু মুসলমানই পাকিস্তানি নহে; বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু সকলেই পাকিস্তানি জাতি। পাকিস্তানে চারি জাতির বাস যাহারা কল্পনা করেন তাহারা ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে চতুষ্পদের স্থান বলিয়া ছাড়িবেন, এই ভয় হয়। পাকিস্তানে মুসলমান শতকরা আশিজন, এমতাবস্থায় পৃথক নির্বাচনের দাবি আমাদের পক্ষে অযৌক্তিক। দুই জাতির ভিত্তিতে আমরা পাকিস্তান সংগ্রাম করিয়াছিলাম এই যুক্তির ভিত্তিতে- হিন্দুরা যদি হিন্দু পাকিস্তান বা পাক হিন্দুস্তান নামে ভিন্ন প্রদেশের দাবি করিয়া বসেন তাহা হইলে কোন যুক্তি দ্বারা তাহার প্রতিবাদ করিতে পারি। এই প্রসঙ্গে আমরা কায়েদে আযমের বাণীর কথা উল্লেখ করিতে চাই। তিনি বলিয়াছিলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক ভিত্তিতে মুসলমান ও হিন্দু নিজেদের জাতীয়তা ভুলিয়া শুধু পাকিস্তানিই হইবেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আর অন্য কোনো দেশ নাগরিকদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে নাই। ইহা সভ্যতার পরিপন্থি। যুক্ত নির্বাচন প্রথা না হইলে চেকোশ্নোভাকিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইবে। …বন্ধুগণ, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করার একটা প্রশ্ন দুই বছর পূর্বেই উঠিয়াছে এবং বিগত কাউন্সিল অধিবেশনে শাসনতন্ত্র [গঠনতন্ত্র] গৃহীত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নাম সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করিবার ভার আমার উপর ন্যস্ত করা হইয়াছিল। আমি ভিন্ন ভিন্ন জেলা, মহকুমা আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, দেশের অধিকাংশ লোকই, বিশেষত কর্মীদের বহুলাংশই প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক করার শুধু পক্ষপাতীই নন; জোর দাবিও জানাইয়াছেন।’
তৃতীয়ত, পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে ভাসানীর আহ্বানে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
ধর্ম নিরপেক্ষতার আরো একটি মানে ‘ইহজাগতিকতা’, কিন্তু ইহজাগতিকতার পরিধি সীমিত থেকেছে রাজনীতিতে ধর্মকে সম্পৃক্ত না করার পরামর্শের মধ্যে এবং এটি এসেছে কেবল পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বা সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্যের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অনেক সময় ধর্মকে যুক্তির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধর্ম-নির্বিশেষে সমতার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছে বাহাত্তরের সংবিধান। ধর্মনিরপেক্ষতার আরেকটি অর্থ হচ্ছেু সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বা নন-ডিসক্রিমিনেশন প্রিন্সিপাল। সব মিলিয়ে আমরা পাচ্ছি ধর্মনিরপেক্ষতার তিনটি দিক: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো; ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার না করার ইহজাগতিক বোধ; এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান অধিকার। এই তিনটি দিক মেলালে আমরা আমাদের দেশের মতো করে সেক্যুলারিজমের একটি আদল খুঁজে পাই। এরই প্রতিফলন হয়েছে সংবিধানের ১২ নং ধারায়:
‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’
ধর্মনিরপেক্ষতার এই ধারাটিকে এর আগের ১১ নং ধারার অধীনে দেখতে হবে, যেখানে রয়েছে ‘মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তার’, এবং ‘মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ’ নিশ্চিত করার কথা।
সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ধর্মকে রাজনীতির সাথে যুক্ত না করা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান নেওয়া এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে (এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও) সমান অধিকার- ধর্মনিরপেক্ষতার এই তিনটি দিক রক্ষার জন্য নাস্তিক হওয়ারও দরকার নেই। ধর্মহীন বা ধর্মচ্যুত হওয়ারও আশঙ্কা নেই। একজন প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তার বিশ্বাসে অনড় থেকেও এই তিনটি দিকই রাষ্ট্রের কাছে মনে-প্রাণে প্রত্যাশা করতে পারেন। আমাদের মা-নানীরা ধর্মবিশ্বাসী হয়েও আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সকল ধর্মের মানুষের যার যার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা স্বীকার করে গেছেন। যারা রাজনীতিতে নেমে কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের বা সম্প্রদায়ের মানুষকে অধিকারহীন করতে চায়, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধাতে চায়, তাদের প্রতি আমাদের পিতৃপুরুষেরা সশঙ্কিত মনোভাব প্রকাশ করতেন এবং তাদের সংস্পর্শ পরিত্যাজ্য জ্ঞান করতেন। সেকালে অনেক স্থানে যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা পাশাপাশি বাস করতেন, তাদের অনেকেরই মধ্যে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সাথে সাথে এক ধরনের ‘মিশ্র’ সামাজিক-ধর্মীয় আচার গড়ে উঠেছিল। ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে বলি, আমি যে-আবহাওয়ায় বড় হয়েছি, তাতে করে পাড়ায় মিলাদ হলে বা শবেবরাতের সময়, ঈদের পরবে নিত্যই দাওয়াত মিলত প্রতিবেশী মুসলিম পরিবারদের থেকে। তাদের কাউকে ডাকতাম খালাম্মা, কাউকে পিসিমা বলে, তারা আবার আমার মা-বাবাকে ডাকতেন মাসিমা-মামাবাবু বলে। বাবার এমনি একজন বোন ছিলেন। যাদের সাথে পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেই সুদূর ১৯৪৩ সাল থেকে। এই ধর্মবোন-ধর্মভাই শুধু স্বধর্মের অনাত্মীয় লোকদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল না; ভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যেই দেখা যেত। আমাদের জীবন-চর্চা ছিল আত্যন্তিকভাবেই ধর্মাশ্রিত এবং তা কখনও কখনও নিজ ধর্ম ছাপিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাসকেও স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে প্রকাশ পেত। গভীর ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি এক ধরনের মিশ্র-আচার বা ‘সংকট’ মনোবৃত্তি হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেই ছিল। এটা শুধু তথাকথিত ‘নীচু’ জাতের মানুষদের মধ্যেই ছিল তা নয়; মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র’ জাতের মানুষদের মধ্যেও ছিল। আমার মা প্রতিটি পারিবারিক সংকটে-উৎসবে মিরপুরের ‘ঠান্ডা পীরের’ মাজারে বা হাইকোর্টের ‘গরম পীরের’ মাজারে মানত রাখতেন এবং ছোটবেলা থেকেই এই দুই জায়গায় যাওয়া আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কীভাবে মা তার প্রতি-মঙ্গলবারের মঙ্গলচণ্ডী পূজার সাথে পীর-মাজার সংস্কৃতিকে মেলাতেন তা একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, তিনি কোনো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিলেন না। এর বড় প্রমাণ বাংলার পুথি-সাহিত্য। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ‘সংকর’ সামাজিক-ধর্মীয় বিশ্বাস-আচারের দৃষ্টান্ত ধারণ করে আছে মধ্য যুগের বাংলা (ও অন্য ভাষার) পুঁথিসমূহ। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের যুক্ত সাধনা’; রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ‘হান্ড্রেড সংস অব কবীর’ অনুবাদ; দুই বাংলার বাউল-ফকির ঘরানার গান বড় নিদর্শন। যেমন, দাদূ ও কবীর ছিলেন ‘সংকর’ ঐতিহ্যের প্রতীক। এক জায়গায় কবীর বলছেন, ‘আমি সংস্কৃত ভাষা শিখেছি যাতে করে সবাই আমাকে জ্ঞানী বলতে পারে, কিন্তু এই ভাষা শিখে কী লাভ যখন আমি দিকশূন্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি?’ এর কয়েক শতাব্দী পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘আত্মজীবনী’ লিখতে গিয়ে শুধু উপনিষদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তৃপ্ত হবেন না; তিনি পরে পরেই ফিরে যাবেন হাফিজের বাণীর কাছে। এক জায়গায় দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন কী করে তিনি সিমলার শীতের রাত্রিতে আরাধনার কালে ব্রহ্মসংগীত ও হাফিজের গান একই সাথে করতেন। উদ্ৃব্দতিটি বড়, কিন্তু ‘সংকর ঐতিহ্যের’ স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে তাতে :
‘আমি কম্বল জড়াইয়া বিছানায় বসিয়া সকল ভুলিয়া অর্ধেক রাত্রি পর্যন্ত ব্রহ্মসংগীত ও হাফেজের কবিতা গান করিতাম-
য়া রব, আঁ শমে শব্‌-আফ্‌রোজ কে কাশানা-এ-কীস্ত্‌?
জানে-মা গোখ্‌ৎ বে-পুর্সীদ কে জানানা-এ-কীস্ত্‌?
[অর্থাৎ] যে দীপ রাত্রিকে দিন করে, সে দীপ কাহার ঘরে?
আমার তো তাতে প্রাণ দগ্ধ হলো, জিজ্ঞাসা করি তাহা প্রিয় হলো কার?’
হাফিজের প্রতি মুগ্ধতা দেবেন্দ্রনাথের লেখার ছত্রে ছত্রে ঝরে পড়েছে (আমি শুধু স্থানাভাবে দেবেন্দ্রনাথের অনুবাদে হাফিজের বাংলাটাই তুলে ধরছি) :
‘আজ আমার ও সভাতে দীপ আনিও না।
আজিকার রাত্রিতে সেই পূর্ণচন্দ্র আমার বন্ধু এখানে বিরাজমান।’
তারপর দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন :
‘অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, যাহা মূলতত্ত্ব, তাহার উল্টা ভাবনা মনেতেও স্থান পাইতে পারে না; তাহা কোনো মনুষ্যের ব্যক্তিগত সংস্কার নহে, তাহা সকল কালে নির্বিশেষে সর্ববাদী-সম্মত; মূলতত্ত্বের প্রামাণিকতা আর কাহারো উপর নির্ভর করে না। তাহা আপনি আপনার প্রমাণ। তাহা স্বতঃসিদ্ধ, যেহেতু ইহা আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাতে প্রতিষ্ঠিত।’
একই লেখাতে/স্তবকে দেবেন্দ্রনাথ উপনিষদ ও হাফিজের গানকে সাক্ষী মানছেন এটাও তাৎপর্য্যপূর্ণ :
‘আমার প্রতি উপনিষদের উপদেশ এই :
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং। ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন কর। আমি ঈশ্বরের দ্বারা এই সকল আচ্ছাদন করিলাম। আমি এই তিমিরাতীত আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষকে জানিয়াছি।’
এটা বলেই তিনি আবারও হাফিজের শরণাপন্ন হলেন :
‘বাদ্‌ অজ্‌-ঈ র্নূ‌ ব-আফাক দেহেম অজ্‌ দিলে খেশ্‌,
কে ব-খুর্শীদ্‌ রসীদেম্‌ ও গোর্রা‌ আর্খি‌ শুদ্‌।
[অর্থাৎ] এখন অবধি জ্যোতি আমার হৃদয় হইতে পৃথিবীতে ছড়াইব, যেহেতুক আমি সূর্য্যেতে পঁহুছিয়াছি ও অন্ধকার বিনাশ হইয়াছে।’
মধ্যযুগের কবীর বা ঊনবিংশ শতকের দেবেন্দ্রনাথ কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন হিন্দু-মুসলিম যুক্ত সাধনার ও ‘সংকর’ সামাজিক ধর্মীয় বিশ্বাসের ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে। দীনেশচন্দ্র সেন ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্য মুসলমানদের অবদান’ গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন :
‘আমরা শিক্ষিত-সম্প্রদায় বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের মালিক। খনির মধ্যে খনির ন্যায় আমাদের পল্লীতে পল্লীতে বঙ্গ-ভারতীয় যে অজস্র দান পড়িয়া আছে তাহা আমরা দেখি নাই, শুনি নাই … এইরূপ শত শত গীতিকা ও কথা আছে। তাহাদের অনেকগুলি নবম দশম শতাব্দীর; হিন্দু-মুসলমানের পৃথক ছাপমারা তাহারা নয়- তাহারা উভয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব। এই বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক বাঙালী। আমি শুধু মুসলমান কবিদের কয়েকটি রচনার নমুনা দিলাম, তাহাও অতি অল্প সংখ্যক। অপ্রকাশিত বহু গীতিকা আমার কাছেই আছে- বাঙালার পল্লী-দরদী লোক যদি খুঁজিয়া বেড়ান, তবে এখনও বৃদ্ধ গায়েন অনেকে আছেন- যাহাদের নিকট হইতে এখনও শত শত কাহিনি ও গীতিকার উদ্ধার হইতে পারে। … হিন্দুদের রচিত মহুয়া, কাজলরেখা, চন্দ্রাবতী, কমলা, কেনারাম, মালঞ্চমালা প্রভৃতি অনেক গীতিকা ও রূপকথা আছে- মূলত তাহাদের সঙ্গে মুসলমানগণের রচিত কাব্যগুলোর প্রভেদ অল্প- একই ধাঁচের লেখা, একই সুর, একই আদর্শ।’ এই যে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত-সাধনা- এই অভিন্ন ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্য- এটিও বাংলাদেশের সাংবিধানিক ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটি দিক। ধর্মনিরপেক্ষতার এই মিলিত চর্চার সাংস্কৃতিক পটভূমিটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এজন্যেই ‘হাসিনা’ তথ্যচিত্রে যখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রিয় গান বেজে ওঠে (পান্নালালের গাওয়া) ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা’, তখন সুরেই আবিষ্ট হয়ে থাকি আমরা। এটা যে শ্যামা-সংগীত কে তার ধার ধারতে এসেছে? বঙ্গবন্ধুর মানস-গঠনে এই হিন্দু-মুসলিম একত্র-সংস্কৃতির আবহাওয়া সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছে। এটা না বুঝলে শুধু সংস্কৃতি-বিরহিত শুস্ক তত্ত্ব-আদর্শের নিরিখে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির গূঢ় অর্থটি বোঝা যাবে না।
কেন অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ এত বড় করে দেখা দিয়েছিল তা একজন রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখছেন গোপালগঞ্জের জনৈক চন্দ্র ঘোষের কথা, যিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী :’জীবনে রাজনীতি করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর মতো একখানা কাপড় পরতেন, একখানা কাপড় গায়ে দিতেন। শীতের সময়ও তার কোনো ব্যতিক্রম হতো না। জুতা পরতেন না, খরম পায়ে দিতেন। গোপালগঞ্জ মহকুমায় তিনি অনেক স্কুল করেছেন। কাশিয়ানী থানার রামদিয়া গ্রামে একটা ডিগ্রি কলেজ করেছেন। অনেক খাল কেটেছেন, রাস্তা করেছেন। এই সমস্ত কাজই তিনি করতেন।’ এহেন ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তান আমলে। একসময় তাকে, শেখ মুজিবকে এবং ফণী মজুমদারকে একই সেলে রাখা হয়। সেবার বঙ্গবন্ধুর প্রচণ্ড জ্বর এলো জেলে :
“রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে, দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণী বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিন দিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন। কখনও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরোধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরোধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন ‘জীবনভরই তো এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না।’ ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফণী বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে?”
এই চন্দ্র বাবুকে আরেকবার ফরিদপুর জেলে পেলেন মুজিব। ততদিনে চন্দ্র বাবুর শরীরের চরম অবনতি হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে অনুমতি দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নেই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই। সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’ চন্দ্র ঘোষ তরুণ মুজিবুরকে বললেন, “ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনো দিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।”
এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এর সারার্থ :বাজেটের যত ভর্তুকি, যত সহায়তা তার লক্ষ্য হবে সর্বপ্রথমে অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাওয়া। স্পষ্টতই এটি প্রথাগত পুঁজিবাদের ধারণার বাইরে, যেখানে ধনী ক্রমেই ধনী হচ্ছে আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে বা গরিবী যেখানে সেভাবে হটছে না। রাউলসের বণ্টননীতি মানলে সমাজে আয়-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য এবং সুযোগ-বৈষম্য ক্রমান্বয়ে কমে আসার কথা। সেজন্যই তাকে যথার্থভাবে পুঁজিবাদের উদারনৈতিক সমালোচক বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাউলসের Maximin প্রিন্সিপালের ছায়াপাত দেখি বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্যেও, যেমন এর ১৪নং ধারায়। এটি সরাসরিভাবে ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ‘ঘোষণা ও কর্মসূচি’ এবং ১৯৭০ সালের ‘নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো’ থেকে নেওয়া :’রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’
এখানে Maximin প্রিন্সিপালের সাথে মিল এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এটা আরও স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার মতো করে রাউলসের লিবার্টি ও ইক্যুইটি প্রিন্সিপালকে সমন্বয় সাধন করলেন। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের সাথে আমাদের সমাজের গণতন্ত্রের পার্থক্য কোথায় তা নির্দেশ করলেন এবং সেই গণতন্ত্রে যেন দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত দুঃখী মানুষ সর্বাগ্রে রাষ্ট্রের তরফে সুরক্ষা পায় সেদিকটি তুলে ধরলেন। সেই প্রথম যেখানে তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রকল্পটি তত্ত্বগত দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরেছিলেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে দেওয়ার মতো- পাঠকই রাউলসের তত্ত্বের আলোকে তা বিচার করুন:
‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র; যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে দেখা যায়, সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিবাদীদের Protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে যেসব  Provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ Protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে- ওই শোষকরা যাতে Protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের [গণতন্ত্রের] পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক ঝপযবফঁষব-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে… শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’
বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ ধারণাটি বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার তিন বছর পূর্বেই তার চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ যেমন ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’ থেকে আলাদা, তেমনি প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের ‘প্রলেতারীয় গণতন্ত্র’ থেকেও আলাদা। শেষের বিচারে, মানুষের সবকিছুই চাই। শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-কর্মসংস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য পেলেই তার চলে না, তার চাই ইচ্ছেমতো লেখার কবিতার খাতা, দেশ-পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, কারখানা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের অধিকার, তার চাই স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার। যেটি না থাকলেু বঙ্গবন্ধু নয়াচীন ভ্রমণের কালে বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের মন ‘পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়’। সেজন্যই সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের ব্যবস্থাপত্রকে তিনি ছক বা ‘মডেল’ হিসেবে অনুসরণ করতে চাননি। তার শোষিতের গণতন্ত্র যে ধরনের অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে সেটাও একান্ত ভাবেই বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব রাজনৈতিক উপলব্ধিজাত। সেদিনের সমাপনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশে সমতাবাদী বিকাশের পথ অন্য সব দেশের অনুসরণে নির্মিত হবে না : গণতন্ত্রের মতোই ‘সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ, এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজ স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাইু সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পাশে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। …বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না, তা যাঁরা করেছেন, তাঁরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। …সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখেstep by step  এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা নয় মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাইু আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-র মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
এই যে দেশের মানুষের মনোভাব, পরিবেশ, প্রকৃতি, ‘কাস্টম’, অর্থনৈতিক অবস্থা, ‘কালচার’ এসব শুধু সমাজতন্ত্রের আদি রূপকল্পকেই প্রভাব করবে তা-ই নয়, এটি দেশের মানদণ্ডে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কী, এদেশের মতো করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, এবং এদেশের সাথে মানানসই ‘জাতীয়তাবাদ’ নির্মাণেও অভিঘাত ফেলবে। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, রূপান্তরবাদী দল ও রাজনৈতিক মতাদর্শের কাজ হবে বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে step by step এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সব কিছু বিবেচনা করে। ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সমতামুখী সমাজের চিন্তার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাহাত্তরের সংবিধানেই প্রথম আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় অনেকবারই এই শব্দটি ব্যবহূত হয়েছে। কিন্তু কথাটির উৎপত্তি মুক্তিযুদ্ধেরও আগে। সেক্যুলারিজমের বাংলা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি চালু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কালেই, তবে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি প্রবেশ করেছিল ষাটের দশকেই। একটি উদাহরণ দিই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ের পর আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭০ সালে ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ২৫শে ডিসেম্বর সংখ্যায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এর নাম ছিলু ‘সাধারণ নির্বাচনে সেক্যুলারিজমের জয়’। তার বিশ্নেষণের সমস্ত দিকের সাথে একমত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু স্বঘোষিত ‘ইসলাম পছন্দ’ দলগুলোর বিপরীতে আওয়ামী লীগের জয়কে তিনি দেখছেন সেক্যুলারিজমের বিজয় হিসেবেু এটাই এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দুই মূল ধারার লড়াইয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিজয়কে তিনি সমগ্র পাকিস্তানের জন্যই আধুনিক প্রগতিবাদের বিজয় হিসেবে দেখছেন। এমনকি দেশভাগ-উত্তর জিন্নাহকেও তিনি সেক্যুলারিজমের পথিকৃৎ বা স্থপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে দিচ্ছি :
‘সাম্প্রতিক নির্বাচন ছিল একাধিক দিক হইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলাফল পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে তাই একাধিক শুভ সূচনা করিয়াছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান এই যে, এই নির্বাচনে সেক্যুলারিজমের জয় হইয়াছে। সেক্যুলারিজমই ছিল জাতির পিতার নসিহত ও ওসিয়ত। কাজেই এই নির্বাচনে কায়েদের জয় হইয়াছে। জনমতের দিক হইতে আধুনিক প্রগতিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান টিকিয়া গিয়াছে।’
এই আশ্চর্যজনক দাবির সপক্ষে আবুল মনসুর আহমদ যুক্তি দিচ্ছেন এভাবে:
‘এই নির্বাচনের ফলাফল আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবন দর্শনের শুভ সূচনার যে তাৎপর্য বহন করিতেছে, সে কথাই আজ আমি বলিতেছি। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ও পশ্চিম পাকিস্তানের পিপল্‌স পার্টির বিরুদ্ধে যাঁরা নির্বাচনে লড়াই করিয়াছেন, তাঁদের মধ্যে এই একটি বাদে আর সবাই ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবিকেই নির্বাচনের ইস্যু করিয়াছিলেন। নিজেদের তাঁরা ‘ইসলাম পছন্দ’ আখ্যা দিয়াছেন। …আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পিপলস পার্টি, জাতীয় লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দল রাজনীতিতে ধর্মের আমদানী সমর্থন করে না বলিয়াই ‘ইসলাম-পছন্দেরা’ ইহাদিগকে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করিয়াছেন। এই সব দলকে ভোট দিলে পাকিস্তানে ইসলাম থাকিবে না, পাকিস্তান কুফরের মুল্লুক হইয়া যাইবে, এই ধরনের সাংঘাতিক সাংঘাতিক কথা বলিয়া ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করিয়াছেন। এইভাবে তাঁরা দেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছিলেন যে, নির্বাচনটা যেন ইসলাম ও কুফরের মধ্যে একটা জেহাদ। একটা ধর্মযুদ্ধ। …’ইসলাম-পছন্দরা’ সত্যই হারিয়া গিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা কার্যত নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও তাঁরা নগণ্য হইয়া পড়িয়াছেন।’
এরপর আবুল মনসুর আহমদ সেক্যুলারিজমের বঙ্গানুবাদ হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। আবারও তার লেখাটিতে ফিরে যেতে হয় :
‘কিন্তু আসল সত্য কথা কি? পাকিস্তানে ইসলাম সগৌরবে বহাল আছে। মুসলিম দেশবাসী সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগকে এবং বিপুলভাবে পিপলস পার্টিকে ভোট দিয়াও ধর্ম হিসাবেও ঈমান আমানে সহিসালামতে আগের মতো ঈমানদার মুসলমান রহিয়াছেন। আওয়ামী লীগসহ সকল ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী রাজনৈতিক দলই বলিয়াছেন, তাঁরা ধর্ম বিরোধী নন, তাঁরাও পাক্কা ঈমানদার মুসলমান। তাঁরা নির্বাচিত হইয়া ক্ষমতায় গেলে ধর্মবিরোধী কোনো আইন রচনা ও কাজ সম্পাদন করিবেন না। ‘ইসলাম পছন্দ’রা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবাদীদের এসব কথা বিশ্বাস না করিবার জন্য মুসলমান ভোটারদের তাগিদ দিয়াছেন। মুসলিম ভোটাররা তাদের নির্দেশ অমান্য করিয়াছেন। তাঁদের কথিত ইসলামবিরোধীদের জিতিয়াই দিয়াছেন। তাতেও ইসলাম খতম হয় নাই, হইবার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যায় নাই। বরঞ্চ এটাই প্রমাণিত হইল যে, ‘ইসলাম পছন্দরাই’ মুসলিম ভোটারদের ধোঁকা দিয়াছিলেন, আর আওয়ামীসহ অন্যান্য সেক্যুলারিস্ট পার্টিরাই সত্য কথা বলিয়াছিলেন। ফলে এই দাঁড়াইল যে, নির্বাচনে ইসলামকে ইস্যু খাড়া করিয়াও ধর্মীয় রাজনীতিবিদদের কোনো লাভ হয় নাই। খামাখা তাঁরা পবিত্র ধর্মের অমর্যাদা করিলেন।’
এটাই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির একটি ব্যাখ্যা। এ কথাটাই প্রথমে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সমাপনী ভাষণে:
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবেু তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবেু কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবেু তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রীস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবেু কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচারু এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’
ধর্মকে সংকীর্ণ স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজনীতির সাথে জড়িত না করা এটি ধর্মনিরপেক্ষতার একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা এবং তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এটি পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বড় আকারে বলা ছিল।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
আর সকল ধারাই- রাউলস্‌ের যুক্তি অনুসারে ;Freestanding’ -দেশ-কাল-শ্রেণি-জাতি-গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত: its content is set out independently of the comprehensive doctrines that citizens affirm.
তার মানে কি আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের বাহাত্তরের সংবিধান জন রাউলস্‌ের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? এটা ঠিক যে, জন রাউলস বিশ শতকের সেরা রাজনৈতিক দার্শনিক (পলিটিক্যাল ফিলোসফার) – এ কথা অমর্ত্য সেন বহু আগেই স্বীকার করে গেছেন। তার ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইটি রাউলস্‌কেই উৎসর্গ করা। রাউলস্‌ের ক্লাসিক গ্রন্থ ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ এর শিরোনামের সঙ্গে সেনের বইটির নামকরণে সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। রাউলস্‌ের বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭১ সালে, আমাদের সংবিধান প্রণয়নের ঠিক আগের বছরে। সরাসরিভাবে জন রাউলস্‌ের রাজনৈতিক দর্শন-পলিটিক্যাল লিবেরালিজম-সংবিধানকে প্রভাবিত করেছিল এমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি এবং সেই দাবিও আমি তুলছি না এখানে। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, বাহাত্তরের সংবিধানের কাঠামো, তার ধারা-উপধারার নির্মাণ, তার সমতাবাদী স্বাধীন ন্যায়ানুগ সমাজের ধারণা জন রাউলস্‌ের পলিটিক্যাল ফিলোসফির সঙ্গে খুব বেশি সংগতিপূর্ণ। এই মৌলিক দিকটি দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। রাউলস্‌ যে লিবারেল মতবাদের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভারতসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংবিধানেরই তলদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে। সেসব অভিজ্ঞতাকে রাউলস্‌ কেবল আরও যুক্তিনিষ্ঠ, সমন্বিত ও প্রসারিত করে ব্যক্ত করেছিলেন তার লেখায়। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সেকালের লিগ্যাল জুরিস্টদের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলে থাকবে। যেমন, রাউলস্‌ ‘স্বাধীনতার’ ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন যে, সকল নাগরিকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, পেশা বাছাইয়ের স্বাধীনতা থাকবে। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ ধারাসমূহে যথাক্রমে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য রোধ, সরকারি নিয়োগ লাভে সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের সমতা, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ, জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধকরণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এদের প্রায় প্রতিটিতেই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু তাকে পড়তে হচ্ছে রাউলস্‌ের ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের’ আলোকেই। স্বাধীনতা মানে অবাধ স্বাধীনতা নয়- যুক্তিসংগত স্বাধীনতা। যাতে স্বাধীনতার সীমা চরমপন্থার দিকে না গড়ায়। এটি স্পষ্টতই রাউলস্‌-ধারার লিবারেল রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাবসঞ্জাত। বস্তুত, বাহাত্তরের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ের (২৬ থেকে ৪৭ ধারা পর্যন্ত) মোট ২১টি ধারার ৫টি বাদে ( অর্থাৎ ৪, ২৯, ৩০, ৪২ ও ৪৭ ধারা বাদে) ১৬টি ধারাই সিভিল ও পলিটিক্যাল লিবার্টির সঙ্গে সরাসরিভাবে সংযুক্ত। এটাও সংবিধানের চরিত্রের ‘লিবারেল’ দিকটির প্রতি নির্দেশ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান কেবল রাউলসের পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের সাথে তুলনীয় করে দেখলে চলবে না, এর অর্থনৈতিক-সামাজিক কমিটমেন্ট আরও বেশি গভীর। সেটা আমরা ইতোপূর্বেই ১০নং ধারার ‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটির আলোচনায় প্রত্যক্ষ করেছি। এ ছাড়া ১৫নং ধারার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ প্রতিশ্রুতির মধ্যে বিবৃত হতে দেখেছি। তার মধ্যে বিশেষভাবে আলাদা করে উল্লেখিত হয়েছে, সাধারণ মানুষের ‘পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের কথা, যা রাষ্ট্রের ‘অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য’ হিসেবে নির্দেশিত হয়েছে ১৮নং ধারায়। সেই সঙ্গে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ (১৫নং ধারা); ‘সুযোগের সমতা এবং ‘সম্পদের বণ্টন’ (১৯নং ধারা) প্রভৃতি দিকের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছি। এই চিন্তাগুলো যেমন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার তলদেশ থেকে উঠে এসেছে, তেমনি এদের পূর্ব চিহ্নসমূহ পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের আদি উচ্চারণেও পাওয়া যায়। এক অর্থে মার্কসের চিন্তা ও পরবর্তীকালের রাউলসের মতন উদারনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে একটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জন রাউলস বা আজকের যুগের মাইকেল স্যান্ডেল যেসব কথা বলছেন বৈষম্যের প্রশ্নে এসে, তাতে মার্কসবাদীদের অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। যেমন- রাউলস তার লেখায় পরিস্কার করে ‘সুযোগের সমতার’ কথা বলেছেন, ‘সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের’ দাবি তুলেছেন; বিশেষ করে সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের কথা বলেছেন। এবং এটা করতে গিয়ে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিতদের। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে গরিব অগ্রাধিকার পাবে, সেটা রাউলসের সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত চিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ১৯৭১ সালের ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ বইটিতে এবং পরবর্তীতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে তার ‘জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস’ বইয়ে তিনি তার সোশ্যাল জাস্টিস তত্ত্বের ‘দুই নীতিমালা’ ব্যক্ত করেন। এই দুটি প্রিন্সিপালের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সকলের জন্য ‘সমান মৌলিক স্বাধীনতা’ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘সকলের জন্য সুযোগে ন্যায্য সমতাবিধান’, অর্থাৎ ‘ফেয়ার ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’ নিশ্চিত করা এবং ‘সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত অংশের কাছে সবচেয়ে বেশি সুবিধে পৌঁছে দেওয়া।’ ইংরেজিতে দাঁড়ায় নিম্নরূপ :
‘First Principle’: Each person has the same indivisible claim to a fully adequate scheme of equal basic liberties, which scheme is compatible with the same scheme of liberties for all
Second Principle : Social and economic inequalities are to satisfy two conditions:
a. They are to be attached to offices and positions open to all under conditions of fair equality of opportunity;
b. They are to be to the greatest benefit of the least-advantaged members of society (the difference principle)’

প্রথম ও দ্বিতীয় নীতিমালার মধ্যে সংঘর্ষ লাগলে প্রথম নীতিমালাটি অগ্রাধিকার পাবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকার রক্ষা করার কথা বলে রাজনৈতিক মৌলিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। এটা পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের ধারার একটি মৌলিক দাবি- যেটি বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই। সেখানে বিধৃত মৌলিক অধিকারসমূহের অধিকাংশই সিভিল ও পলিটিক্যাল লিবার্টি সম্পর্কিত (অবশ্যই ইতোপূর্বে আলোচিত ‘যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ’ সাপেক্ষে)। অর্থনৈতিক অধিকারের তুলনায় রাজনৈতিক-নাগরিক অধিকারকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার এই ধারা অবশ্যই অনেক কট্টর মার্কসবাদীরা (লেনিনবাদীরা সমর্থন করবেন না। কোনো বিশেষ অবস্থার চাপে, একটা নির্দিষ্ট আপৎকালীন সময়ের জন্যে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে (যেমন- অতিমাত্রায় করারোপ করা হতে পারে, বা অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রসাধন করতে হতে পারে)। এ রকমটা দেখা গেছে শিল্পায়নের সময়ে ১৯২৫-১৯৩৬ কালপর্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নে, অথবা মহাযুদ্ধকালীন সময়ে পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ অবস্থার চাপে পড়ে, যুদ্ধোত্তরকালে বা কোনো একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আপৎকালীন সময়ের জন্য নাগরিক মৌলিক স্বাধীনতার কোনো কোনো দিক থেকে সরে আসতে হতে পারে। ৯-১১ পরবর্তীকালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ও ইরাক-যুদ্ধ এসব পর্বে খোদ যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে নাগরিকদের মৌলিক সিভিল পলিটিক্যাল লিবার্টিসমূহ সাধারণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। নাগরিকদের পত্রালাপ, ফোনালাপ, ইন্টারনেট ব্যবহার, চলাফেরা ইত্যাদির ওপরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি করা হয়েছে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। পুঁজিবাদের এই নজরদারি প্রবণতাকে এখন এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। একে ‘সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। কেউ কেউ এই প্রবণতার মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অসুখের ছায়াপাত দেখছেন। দার্শনিক মিশেল ফুকো এসব ঘটার ৩০-৪০ বছর পূর্বেই তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে ‘আই অব পাওয়ার’ বা চবহড়ঢ়ঃরপড়হ-এর সম্ভাব্যতা আধুনিক পুঁজিবাদের জেনেটিক কোডে আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটলেও- আকছার এ রকম ঘটছে বলেই- রাউলস মৌলিক স্বাধীনতার নীতিমালাকে অপরাপর নীতিমালার সঙ্গে এক কাতারে দেখার পক্ষপাতী নন। স্বাধীনতা বনাম উন্নয়ন প্রশ্নে কোনো বাস্তবিক ট্রেড অফ দেখতে নারাজ রাউলস (এবং অমর্ত্য সেনের মতো লিবারেল দার্শনিকেরা)। এর বিপরীতে হবস, মার্কস, লেনিন, ফুকো প্রমুখ দার্শনিকেরা স্বাধীনতাকে অতটা শীর্ষস্থানে তুলতে রাজি নন, যদি না অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলো আগে প্রতিষ্ঠিত হয় বা করা যায়।
রাউলস অর্থনৈতিক সাম্যের আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাম্য নিশ্চিত করতে চান এবং এ দুইয়ের মাঝে কোনো ক্ষেত্রেই ‘ট্রেড-অফ’ করা যাবে না- এই হচ্ছে তার সুচিন্তিত মত। কিন্তু এর বিপরীতে মার্কস থেকে ফুকো অবধি দার্শনিকেরা ভিন্ন মত রেখেছেন। তাদের মোটা দাগের বক্তব্য হলো, সবার জন্য সমান মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আগে- হয়তো নিশ্চিত করার জন্যই-প্রয়োজন সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক অধিকার। ভাত, কাপড়, জমি, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রভৃতি অধিকারকে আগে প্রতিষ্ঠা করা। কবি নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেছিলেন, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’ ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’- এই স্লোগান উঠেছিল দেশভাগের পরপরই। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের পটভূমিতে এই স্লোগান ওঠা তখন অস্বাভাবিক ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের একপর্যায়ে অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিকে স্বয়ং শেখ মুজিব আন্দোলনের সম্মুখভাগে নিয়ে এসেছিলেন। ‘দুই অর্থনীতি’ শীর্ষক ন্যারেটিভ ছয় দফার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার মৌলিক যুক্তিভিত্তি জুগিয়েছিল। সেদিনের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল অর্থনৈতিক দাবি রক্ষার মোড়কেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আওয়ামী লীগ কেবল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমির স্লোগান তুলেছিল; আর বামপন্থিরা কেবল অর্থনৈতিক অধিকারের কথায় সরব হয়েছিল। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রাজনৈতিক স্বাধিকার-স্বাধীনতার পদক্ষেপই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের যুক্তির জরিসুতো দিয়ে বোনা। এমনকি ছয় দফার দলিলটিরও শিরোনাম ছিল : ‘ছয় দফা- আমাদের বাঁচার লড়াই’, যেখানে দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বর্ণনা ছিল। আমি বলতে চাইছি, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষত ষাটের উত্তাল দশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার উভয়ই দাপটের সঙ্গে উপস্থিত ছিল : এ দুইয়ের মধ্যে কোনো ‘ট্রেড-অফ’ করা হয়নি। এখানে মার্কসও ছিলেন, রাউলসও ছিলেন। এই দুটো ধারাকে ধারণ করেছিলেন মুজিব ও তার নিকটতম আদর্শিক সহকর্মীরা।
তবে একটি প্রশ্নে রাউলসের সাথে মার্কসের কোনো বিরোধ হতো না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রাউলস সমাজের সকল নাগরিকের মধ্যে সুযোগের ন্যায্য সমতা এবং সম্পদ বণ্টনে ন্যায্য সমতা চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি এই ন্যায্য সমতা বাস্তবায়নের পথে সর্বাগ্রে অতিদরিদ্র এবং সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক দিকটি রাউলসের পূর্বে কথিত ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপাল’ (যাকে আজকের পরিভাষায় প্রায়োরিটি প্রিন্সিপাল বা টার্গেটিং প্রিন্সিপালও বলা যায়) থেকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রের কাছে যদি সম্পদ কম থাকে, তবে সংকটের সময়ে কাকে সে সর্বাগ্রে সাহায্য করবে? এ প্রশ্নে রাউলসের উত্তরে কোনো অস্পষ্টতা নেই : দরিদ্রদের এবং অতিদরিদ্রদের প্রতি রাষ্ট্র সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়াবে। এজন্যেই এই রাষ্ট্র শুধু ‘ইগালিটারিয়ান’ নয়, এটি ‘জাস্ট’ও- হতদরিদ্রদের স্বার্থে রাষ্ট্র ইনসাফের বা সামাজিক ন্যায়-নীতি পরিচালনা করবে। এর থেকেই জন্ম হয়েছে রাউলসের বিখ্যাত আপ্তবাক্য-‘Maximum benefits to the minimum advantaged’  (Maximin) প্রিন্সিপালও বলা হয় একে)।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
যেমন লিবার্টি প্রিন্সিপাল যেসব ধারাতে প্রতিফলিত হয়েছে, তার প্রতিটিতেই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষ’-এর শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতা নিঃশর্ত নয়। এটা দেখা যায় চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৬), সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৮), বাক্‌-স্বাধীনতা ও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৯), পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৪০), সম্পত্তির অধিকার (অনুচ্ছেদ-৪২), গৃহে নিরাপত্তা এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৪৩) প্রভৃতি ধারাসমূহের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ একদিকে যেমন নাগরিক অধিকার আছে, তেমনি অন্যদিকে জনকল্যাণের স্বার্থে, রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের কাছে দাবিও আছে। সেজন্য নাগরিকদের অধিকার কতখানি খর্ব করা যাবে, তা আদালত বলে দেবেন, ঠিক করবেন। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো উৎসের উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল। যেমন- পূর্ব জার্মানির উদাহরণ টেনে বলা হয়েছিল যে, অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বলে কিছু থাকতে পারে না, গ্রহণীয় হতে পারে না। পূর্ব জার্মানির সংবিধানের-১১ অনুচ্ছেদের (১) নং দফায় আছে : ‘All Germans enjoy freedom of movement throughout the fedual tertiary.’ এটা বলেই ঐ অনুচ্ছেদের (২) নং দফায় বলা হয়েছে : ‘Whatever abuses freedom of expression, freedom of opinion, freedom of teaching, freedom of assembly, freedom of association… forfeits these basic rights’। শুধু প্রথাগত সমাজতন্ত্রের দেশ নয়, এ ক্ষেত্রে পুুঁজিবাদী দেশেরও উদাহরণ টানা হয়েছে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ ব্যাখা করার জন্য। জাপানের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদাহরণ টেনে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের পেছনের যুক্তিটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে মূল জোরটা হয়েছে ‘যুক্তিসংগত’ শব্দটার প্রতি : ‘The fundamental text applied by the supreme Court is that any restriction is valid unless it exceeds the limit of reasonableness or the necessities of public welfare. The Supreme Court has consistently held that restrictions may be imposed to protect the public welfare.’
এখানে মূল বিতর্কটা হচ্ছে ‘reasonableness’ শব্দটা নিয়ে। কে নির্ধারণ করবে কোনটা এবং কত দূর পর্যন্ত যুক্তিসংগত?
আসলে ‘যুক্তিসংগত’ কথাটার মধ্যেই একটি মৌলিক ইনডিটারমিনেসি রয়ে গেছে। যেমন, জন রাউলস্‌ তার ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ বইতে ‘রিজোনেবল প্লুরালিজম’কে স্বীকার করে গেছেন। অর্থাৎ একটি উদারনৈতিক সমাজে একটি নির্দিষ্ট ‘যুক্তিসংগত’ চৌহদ্দির মধ্যে সকল মতাদর্শকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। এর চৌহদ্দিই কীভাবে নির্ণীত হবে? আমরা সবাই জানি যে সমাজের প্রতিটি যুক্তিবাদী ব্যক্তিরই নিজস্ব ধর্ম-বিশ্বাস, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মত, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি- এক কথায় নিজস্ব ওয়ার্ল্ড আউটলুক বা বিশ্ববীক্ষা রয়ে গেছে। প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষেরই জীবন, ঈশ্বর, ভাল-মন্দ জ্ঞান, জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কে একটি ‘নিজস্ব’ ধ্যান-ধারণা রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। এ রকম মত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত বিভিন্নতা নিয়ে- তাও আবার শ্রেণিবিভক্ত-সমাজে কোনো অভিন্ন ‘পাবলিক গুড’ বা জনস্বার্থের দর্শন কী করে ব্যক্ত করা সম্ভব? তার চেয়েও বড় কথা হলো, এ রকম একটি বিভক্ত সমাজে কী করে একটি অভিন্ন সংবিধান বা রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতি প্রণয়ন করা সম্ভব? এ ক্ষেত্রে রাউলস যুক্তি দিচ্ছেন যে, বিভক্তি সত্ত্বেও একটি সামাজিক ঐকমত্যে মেলা সম্ভব, কেননা যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করেন এমন কেউই নিজের সকল মতকে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দিতে চাইতে পারেন না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন মতের যৌক্তিক বিরুদ্ধতা বা বিভিন্নতা স্বীকার করে নিতে হবে, তবে সেই বিরুদ্ধতা বা মতভিন্নতা ‘যৌক্তিক দাবি’ হতে হবে।
এর মাধ্যমে রাউলস আশা করছেন যে, ‘The religious, moral and philosophical doctrines that citizens accept will themselves endorse toleration and accept the essentials of a democratic regime.’ ‘পরমত সহিষ্ণুতা’ ছাড়া কোনো উদারনৈতিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে না- এই লিবারেল মত রাউলসের চিন্তার কর্নার-স্টোন। সেজন্যই তিনি চাইছেন যাতে ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে’ সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বস্তরে স্বীকৃতি দিতে। যেমন- ধর্ম-মতবাদের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের মানে হবে ‘reasonable Catholicism, a reasonable interpretation of Islam, a reasonable atheism’ ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। তবে তার পরও সমস্যা থেকে যায় এই ব্যাখ্যায়। যুক্তিসংগতভাবে চিন্তাভাবনা করেন এমন একজন ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী কী করে যুক্তিসংগত চিন্তা করেন এমন অন্য ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিক্য-দর্শনে বিশ্বাসীর আদর্শে আস্থা স্থাপন করবেন? যতই যুক্তিসংগতভাবে পেশ করা হোক না কেন, কোনো বিশেষ ধর্মমত বা আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি করা আইন-আদালত, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে কী করে এক ভিন্ন ধর্মের বা ভিন্ন আদর্শের লোক (যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করেন এমন লোকের কথাই বলছি) মেনে নিতে পারেন বা নেবেন? কোন বিশেষ ধর্ম, মতাদর্শ বা মতবাদ প্রকারান্তরে আসলে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান-ধারণার ভুবন বা বিশ্ববীক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এরা সবাই নিজেকে একেকটি ‘Comprehensive doctrine’ বলে দাবি করেন। যা সকলের কাছে ১০০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য হবে না কখনোই : ‘No comprehensive doctrine can be accepted by all reasonable citizens, and so no comprehensive doctrine can serve as the basis for the legitimate use of coercive political power.’

রাউলস বলছেন যে, কোনো একটি বিশেষ ধর্মমতের ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্রের ন্যায্যতা বা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, সেটা অন্য ধর্মের বিশ্বাসীরা মানতে না-ও চাইতে পারেন। যদি নাস্তিক্য মতবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, তবে আস্তিক্যবাদীরা তা মানতে না-ও চাইতে পারেন। যদি ফ্যাসিবাদ, স্তালিনবাদ বা মাওবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, তবে বিরুদ্ধ-মতাদর্শের ব্যক্তিরা তা মানতে না-ও চাইতে পারেন। কেননা, ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা বিশেষ নৃতাত্ত্বিক জাতি বা বর্ণ-সম্প্রদায়ের মতবাদ বা আদর্শ এতটাই বিশিষ্ট এবং (comprehensive অর্থে) বিস্তৃত/স্বয়ংসম্পূর্ণ যে, সেখানে অন্য মতের/আদর্শের লোকদের শামিল করানো কঠিন। তাহলে সমাজের সব মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো যাবে কিসের ভিত্তিতে, আর সেই ভিত্তিটাই যে ন্যায্য ভিত্তি হবে তা প্রতিপন্ন করা যাবে কীভাবে?
এর কোনো সহজ উত্তর রাউলস্‌ দিতে পারেননি। তার উত্তর হচ্ছে- রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি হবে ‘পাবলিক পলিটিক্যাল কালচার’ দ্বারা, যার ভিত্তি নিহিত সমাজের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, প্রতিষ্ঠানাদির ঐতিহ্য, দর্শন, অনুশীলন ইত্যাদি বিচিত্রবিধ উপাদানের চর্চার মধ্যে। যত বিভিন্নই হোক এসব ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক উপাদান দেশে দেশে, কোনো সমাজে পাবলিক কালচার যথাযথ কাজ করছে কিনা তা জানার উপায় হলো ইনসাফ বা ন্যায়বিচার সম্পর্কে সেই দেশে বা সমাজে কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। এই ইনসাফের বোধ- যাকে রাউলস বলেছেন ‘পলিটিক্যল কনসেপশন অব জাস্টিস’- তার তিনটি প্রধান উপাদান :নাগরিকেরা নানা দিক থেকে কতটা স্বাধীন (Free); কতটা সমান (Equal); এবং পরস্পরের প্রতি আচরণে কতটা ন্যায়ানুগ (Fair)। এই ফ্রিডম, ইকুয়ালিটি ও ফেয়ারনেস তিনটি মৌল ধারণার ওপরে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ‘পাবলিক পলিটিক্যাল কালচার’ দাঁড়িয়ে আছে/থাকে।
আসলে রাউলস্‌ যখন তার লিবারেল সোসাইটির প্রকল্প তুলে ধরেছেন, তিনি নাগরিকদের কল্পনা করছেন এক যুক্তিবাদী মনের নিজস্ব ‘ধ্যান-ধারণা-নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি হিসেবে। সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে নাগরিকেরা একটি অভিন্ন বিবেচনায় উপনীত হচ্ছেন তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস, নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, নিজস্ব অভিরুচি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বাদ দিয়ে নয়, কিন্তু এসবকে তিনি সচেতনভাবেই আমলে নিচ্ছেন না সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি কোনো বিশেষ ধর্মের লোক হতে পারি, অথবা কোনো বিশেষ মতাদর্শের সমর্থক হতে পারি, কিন্তু রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি রচনা করতে গিয়ে আমি আমার একান্ত ধর্মবিশ্বাস বা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শকে ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর করতে চাচ্ছি না সচেতনভাবেই। কেননা, আমি যদি তা করি, তাহলে অন্যরাও তাই করবে এবং এর ফলে সমবেতভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো ‘সামাজিক চুক্তি’ বা সংবিধানে পৌঁছানোই যাবে না। এ জন্যেই আমাকে পরমতসহিষ্ণু হতে হচ্ছে, ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে’ আশ্রয় করতে হচ্ছে, নিজের মতবাদকে প্রতিনিধিত্বশীল দাবি করা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। এ জন্যেই রাউলস্‌ের মতে সামাজিক ন্যায়ের যে ধারণাকে গণতান্ত্রিক সংবিধান তুলে ধরে তা বিশেষ ধর্ম-রাজনৈতিক মতাদর্শ-দল-মত-কেন্দ্রিক নয়, তা বিভিন্ন বিরুদ্ধ মতের মধ্যে কোনো মধ্যপন্থার আপস-মীমাংসাও নয়; পূর্বে-উল্লেখিত ‘স্বাধীনতা’, ‘সমতা’ ও ‘ন্যায্যতা’ সম্পর্কে তা একটি ‘নূ্যনতম অভিন্ন উপলব্ধিকে’ ব্যক্ত করে মাত্র। যাকে রাউলস্‌ বলেছেন বিভিন্ন পরমত-সহিষ্ণু মতের মধ্যে ‘Overlapping consensus” বলে। এবং এটা করতে গিয়ে নাগরিকদের (বা নাগরিকদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের) নিজেদেরকে চিন্তা করতে হয় Reasonable Citizens হিসেবে- দল-মতের ঊর্ধ্বে ওঠা একেকজন Abstract thinker হিসেবে। এ জন্যেই রাউলস্‌ের সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে এভাবে :
‘Rawls’s Political conception of justice is not derived from any comprehensive doctrine, nor is it a compromise among the world views that happen to exist in society at the moment. Rather,  a Political conception of justice is freestanding: its content is set out independently of the comprehensive doctrines that citizens affirm. Reasonable citizens, who want to cooperate with one another  on mutually acceptable terms, will see that a freestanding political conception generated from ideas in the public political culture is the only basis for cooperation that all citizens can reasonably be expected to endorse. The use of coercive political power guided by the principles of a political conception of justice will therefore be legitimate.’

এর মানে এই নয় যে, সামাজিক ন্যায়ের ধারণার মধ্যে স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায্যতা এই তিনটি ভাবের দেশগত-কালগত প্রকাশে সেই জনগোষ্ঠী, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি প্রভৃতি দেশজ, সামাজিক বা ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরের কোনো প্রভাব পড়বে না। রাউলস্‌ সেটা স্বীকার করে নিয়েও বলছেন যে, দেশ-কাল-সমাজের প্রভাব পড়লেও তার চৌহদ্দি নির্ধারিত হবে ওই ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের’ দ্বারাই; কেউ যদি চরমপন্থি কোনো ভাবধারা প্রকাশ করে তাকে কোনোভাবেই আমল দেওয়া হবে না সামাজিক চুক্তি বা সংবিধান নির্মাণের সময়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রস্তুতের কালেও ১৯৭২ সালে এমনি যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে আশ্রয় করা হয়েছিল। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে যেখানে মৌলিক অধিকারগুলো বিধৃত হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘যুক্তিসংগত’ আবরণের বেড়া দিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে ঐ চরমপন্থা থেকে রক্ষা করার জন্যই। ‘মৌলিক অধিকারের’ ও ‘মৌলিক নীতিমালা’ ব্যক্ত করার সময়ে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী, ধর্মমত, রাজনৈতিক আদর্শ বা অভিরুচিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়েছে কেবলমাত্র ‘প্রস্তাবনা’ অংশে। সংবিধানের ‘প্রথম ভাগে’ যেখানে প্রজাতন্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানেই কেবল ‘বাংলাদেশ’ ধারণাটিকে ইতিহাস-ভূগোলের দ্বারা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংবিধানের ‘দ্বিতীয় ভাগের’ ৮ থেকে ২৫ ধারার মধ্যে কেবল ৯নং ধারায় জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাঙালি জাতির’ উল্লেখ রয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ দাবী অতটুকুতেই সীমিত রাখা হয়েছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


বঙ্গবন্ধু নাগরিকের কল্যাণ, স্বাধীনতা ও ‘অধিকারের’ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রের বিষয়টিকে আত্মস্থ করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল- সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধান করা এবং ক্রমান্বয়ে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা (যেটা এখন এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রায় বিধৃত হয়েছে)। ডানপন্থীদের অভিযোগ হলো তাহলে ১৯৭২ সালে এত তড়িঘড়ি করে কেনই-বা ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া হলো? প্রথমত, পুঁজির ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সম্পদের অধিকতর সুষম বন্টন নিশ্চিত করা দুরূহ। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশেও বাইশ পরিবারের মতো অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটুক, সেটি বঙ্গবন্ধু কখনোই চাননি। এজন্যই, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যক্তি-পুঁজিকে সর্বতো উপায়ে সহায়তা দেওয়া হয়, কিন্তু বৃহৎ ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কালক্রমে (১৯৭৪ সালেই) বৃহৎ ব্যক্তি পুঁজির ‘সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা তখনকার দিনের বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার বিকাশের জন্য যথেষ্ট পরিসরই দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ ‘রপ্তানিমূলক’ শিল্পে এবং সাম্প্রতিক দশকে ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখিন’ শিল্পে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, সুস্থ ব্যক্তি খাতের বিকাশের পথে বিনিয়োগের সিলিং-জনিত প্রতিবন্ধকতা কৃত্রিম ভাবে আরোপ করার প্রয়োজনীয়তাও অনেক আগেই নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ব্যক্তি-পুঁজির ওপরে রাষ্ট্রের ‘নজরদারি’র প্রয়োজনীয়তাও সেই সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে? ‘মার্কেট-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া এবং ‘বিজনেস-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া তো সমার্থক শব্দ নয়। ২০১০ এর দশকের অভিজ্ঞতা এখানে মিশ্র তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে। ব্যক্তি খাতের সাফল্যের পাশাপাশি সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যক্তি খাতের দায়-দেনাও (Default) বিস্তর এবং ক্রমবর্ধমান। যে হারে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে ২০১০ এর দশকে, সেই হারে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি (৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিল অনুযায়ী এই অনুপাত জিডিপির ৮ শতাংশেই থমকে আছে)। ফলে সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বা Common Goods সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি। ‘মার্কেট-ইকোনমি’ হওয়ার পাশাপাশি আমরা যেন অতি দ্রুত ‘মার্কেট-সোসাইটি’তে পরিণত হচ্ছি। মার্কেট-ইকোনমি আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার এদেশে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা যেন উত্তরোত্তর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে কেবল মার্কেট-সোসাইটিতে রূপান্তরিত না হই। শেষোক্ত সমাজে সবকিছু, সব মূল্যবোধই, শেষপর্যন্ত ‘কেনা-বেচা’র সামগ্রীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে- সেটা বিদ্যাদান, চিকিৎসা দান থেকে শুরু করে ‘সামাজিক উদ্যোগ’, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা কার্যক্রম পর্যন্ত। এ ধরনের সমাজ শেষাবধি মানুষের বাসযোগ্য ভূমি থাকে না। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে এ ধরনের ডিস্টোপিয়ান ‘মার্কেট-সোসাইটি’র কোনো স্থান ছিল না। এজন্যই তাকে জনগণের তদারকি, জনগণের মালিকানা ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে তার অবস্থান নৈয়ায়িক দার্শনিক জন রাউলস, অমর্ত্য সেন ও মাইকেল স্যান্ডেলের অনুবর্তী। আমাদের সমাজের স্বভাবজ ধর্মবিহিত মূল্যবোধ এই অবস্থানের প্রতিই সমর্থন জানায়।
সংবিধানের ২০নং অনুচ্ছেদের যোগ্য/ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার বন্টননীতির পেছনে সরাসরিভাবে অন্যবিধ সূত্রের প্রভাবও কাজ করেছিলো। বাহাত্তরের গণপরিষদ বিতর্কে বেরিয়ে এসেছিলো যে এর সাথে সোভিয়েতের ১৯৩৬ সালের সংবিধানের সাদৃশ্য রয়েছে। উদাহরণত, সোভিয়েত ইউনিয়নের উক্ত সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিলো : ুঞযব ঢ়ৎরহপরঢ়ষব ধঢ়ঢ়ষরবফ রহ :যব টঝঝজ রং : “The principle applied in the USSR is that of socialism: ÔFrom each according to his ability, to each according to his work.”
এটা বাহাত্তর সালে গণপরিষদ বিতর্কে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু সেটা ২০ (১) অনুচ্ছেদে এই শ্রম-অনুযায়ী বণ্টনের নীতি অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ১৯৩৬ সালের সোভিয়েত সংবিধান বিবেচনায় নেওয়া ছাড়াও অন্য অনেক দেশের সংবিধানের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেছিলেন। এ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ৩০ অক্টোবর ১৯৭২ ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন :
‘প্রথমে আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই, যে মূলনীতিকে আমরা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছি, সেই মূলনীতির আদর্শের ভিত্তিতে আমরা সংবিধান রচনা করেছি। যাঁরা তা স্বীকার করবে না, তাঁদেরকে আমি গোটা সংবিধান নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করতে বলব। আমার মনে হয়, এই সব সমালোচনা করার আগে তাঁরা যদি অন্যান্য দেশের সংবিধান পরীক্ষা করে দেখতেন, তাহলে অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটত। তাহলে উপযুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা সংবিধানটি বিচার করতে পারতেন।’
কোন কোন দেশের সংবিধান সেদিনের সংসদে আলোচনা হয়েছিল? সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৩৬ সালের সংবিধানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাজউদ্দীন আহমদ, আছাদুজ্জামান খান প্রমুখ জিডিআর অর্থাৎ, পূর্ব জার্মানির ১৯৪৯ সালের সংবিধানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের উদাহরণ এসেছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ থেকে। অন্যান্য দেশের মধ্যে বড় করে এসেছিল চীন, পশ্চিম জার্মানি ও জাপানের কথা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। বার কয়েক অবশ্য লেবার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লিখিত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রায় সকলেই অবগত ও সচেতন ছিলেন। একটি উদাহরণ দেই। গণপরিষদ সদস্য আবু মো: সুবেদ আলী (ঢাকা-১০) সংবিধানের মডেল কোন দেশ থেকে এসেছে ঐ প্রশ্নে বলেছিলেন: “আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করিনি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটেও’ বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করিনি।” অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সবার অভিজ্ঞতাই বিবেচনায় নিয়েছিল, কিন্তু অভিপ্রায়ে এবং নির্মাণে এটি ছিল একান্তভাবেই বাংলাদেশের মনোভূমি ও ভূগোল-ইতিহাসের ফসল। একটা প্রশ্ন এখানে না এসে পারে না। এই যে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার দিকে হাত বাড়ানো- তা কি একই ইস্যুতে, নাকি নানা ইস্যুতে?
প্রথমত, জিডিআর, পোল্যান্ড ও চীনের প্রসঙ্গ এসেছিল ‘মিশ্র মালিকানা’ ব্যবস্থার ন্যায্যতা সপ্রমাণিত করতে। এই তিনটি দেশই সমাজতান্ত্রিক হয়েও মিশ্র-মালিকানাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিল। এটা প্রমাণ করার জন্য গণপরিষদের সদস্যরা এসব দেশের সংবিধান থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, লিবার্টি প্রিন্সিপালের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ যে আরোপ করা প্রয়োজন তা প্রমাণ করার জন্য পূর্ব ইউরোপীয় ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সংবিধানের ধারাসমূহের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়েছে। এর থেকে বাদ পড়েনি জাপানের সংবিধানও। মৌলিক অধিকারের চৌহদ্দি বেঁধে দেওয়ার ক্ষেত্রে জাপানের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়েছে। যেমন, জাপানের সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে : :‘These fundamental human rights guaranteed to the people by this constitution shall be conferred upon the people of this and future generations as eternal and inviolate rights.’ কিন্তু ১২নং অনুচ্ছেদে তার পরক্ষণেই বলা হয়েছে :‘The freedom and rights … shall be maintained by the constant endeavour of the people who shall refrain from any abuse of these freedoms and rights and shall always be repressible for utilizing them for the public welfare.’ এই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানেও।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৪

পূর্বে প্রকাশিতের পর
অর্থাৎ, নারী-পুরুষ, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমান কর্মের জন্য অসমান পারিশ্রমিক সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। এখানে এসডিজির ৫নং লক্ষ্যমাত্রা (Gender Equality) এবং ৮নং (Decent Work & Economic Growth)-এর সাদৃশ্য দৃশ্যমান।
বাহাত্তরের সংবিধানের অতিগুরুত্বপূর্ণ ২০নং ধারা নিয়ে আরও কয়েকটি কথা যোগ করা দরকার। ২০নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারার ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’- এই নীতি কোন সূত্র থেকে আহরিত হয়েছিল? ইংরেজি পাঠে এই নীতিটিকে লেখা হয়েছিল এভাবে :
everyone shall be paid for his work on the basis of the principle ‘from each according to his abilities, to each according to his work’.

প্রত্যেকে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হবেন এবং প্রত্যেকে যে যার কর্ম/শ্রম/অবদান (work/labour/contribution) অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবেন- এই বণ্টন নীতি এলো কোথা থেকে? এই বণ্টন-সূত্রের পেছনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রভাব এসেছিল, সন্দেহ নেই। তার মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তার দীর্ঘ ঐতিহ্য, যা বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল পাশ্চাত্যের সমতাবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্রে স্থাপিত করে। কথাটা কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি করে।
যোগ্য/সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়াকে সমাজতান্ত্রিক বণ্টন নীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। এ নিয়ে বিতর্কাতীতভাবে ঐকমত্য বিরাজ করছে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি-তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের মধ্যে। এবং এ বিষয়ে আলোচনা উঠলে প্রথমেই সবাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন কার্ল মার্কসের জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত রচনা ‘ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম’ লেখাটির প্রতি। ১৮৭৫ সালের এই লেখাটিতে মার্কস ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজের দুই স্তরের প্রতি ইঙ্গিত করেন (পরবর্তীকালে, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়ে লেনিন ১৯১৭ সালে একে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্নেষণ করেন)। প্রথম বা নিচের স্তরে সমাজ যখন কেবল পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হতে শুরু করেছে- তখন আয়-উপার্জনের প্রধানতম উৎস হবে শ্রম-সূত্রে প্রাপ্ত আয়। এই সমাজে আয়-বণ্টন নির্ধারিত হবে যথাসাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রমের পরিমাণ ও গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার নীতির মাধ্যমে। শ্রম বলতে এখানে শুধু কায়িক শ্রমের মজুরদের বোঝানো হচ্ছে না। এখানে মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের সঙ্গে জড়িত ‘হোয়াইট কলার’ শ্রমিক প্রাতিষ্ঠানিক তথা সেবা খাতের কারিগররাও অন্তর্ভুক্ত। সৃষ্টিশীল শ্রমের শিল্পীরাও এখানে রয়েছেন। এই প্রথম স্তরের সমাজটিকেই সাধারণত ‘সমাজতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ ধরনের সমাজেও আয়ের বণ্টনে অসমতা থাকবে, কেননা প্রত্যেকের কাজের সামর্থ্য, পরিমাণ ও কাজের গুণাবলি (উৎকর্ষতা, উপাদনশীলতা, দক্ষতা) সমান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ ধরনের সমাজে শ্রমজনিত পার্থক্য সূত্রে যেটুকু আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তা পুঁজিবাদী সমাজের আয়-বৈষম্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ার কথা। এর কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রম ছাড়াও শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা-পার্থক্যের কারণেই অনেক আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। উদাহরণত, অনেক বেশি জমি থাকার কারণে কোনোরূপ শ্রম না দিয়েও কেউ ওই জমিকে কেবল ভাড়া খাটিয়ে অনেক আয় করতে পারেন। যেটা একজন ভূমিহীন চাষির পক্ষ করা সম্ভব নয়; তার পক্ষে মজুরি-শ্রমের কাজে নিয়োজিত হয়েই কেবল উপার্জন করা সম্ভব। একই ভাবে, একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে নিয়মিত পরিশ্রম করেই আয়-উপার্জন করতে হয়। কিন্তু একাধিক গার্মেন্টস কারখানার মালিক যিনি তাকে হয়তো তার ফ্যাক্টরিতে কোনো শ্রম না দিয়েই বা সামান্য শ্রম দিয়েই শুধু মালিক হওয়ার কারণেই অনেক বেশি আয় করা সম্ভব। শুধু কৃষি জমি নয়, অন্যান্য সম্পদ ভাড়া খাটিয়েও-এবং তেমন কোনো প্রত্যক্ষ শ্রম বা তদারকি শ্রম না করেও- অনেক আয় উপার্জন করা সম্ভব, যাকে আমরা ‘ভাড়াজীবী আয়’ (Rentier Income) বলতে পারি। গত এক দশক আগে আমি একজনকে চিনতাম, যার ঢাকা শহরে ৬৫টির মতো ফ্ল্যাট ছিল। এখন হয়তো তার ফ্ল্যাটের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এসব ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে এবং তেমন কোনো প্রত্যক্ষ শ্রম করা ছাড়াই সেই লোক প্রতি মাসে অনেক আয় করে থাকে। আমাদের দেশে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার বিষয়টি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক কথায়, ‘প্রোপার্টি ইনকাম’ আয়ের একটি প্রধান উৎস এ ধরনের সমাজে। তবে এখানে দুটো ফুটনোট রাখা দরকার। প্রথম ফুটনোটটি হলো, এমন কোনো ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যে পুঁজির মালিক কেবলই ভাড়া খাটিয়ে বা অন্যকে দিয়ে মজুর খাটিয়েই আয়-উপার্জন করে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এদের একটা অংশকেই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় নামতে হয় বা নতুন কোনো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে অবলম্বন করতে হয়। এর জন্য তাকে সময় সময় ঝুঁকি নিতে হয়, যথেষ্ট উদ্ভাবনী শ্রমও ব্যয় করতে হয়- যাকে আমরা এক কথায় শিল্পোদ্যোক্তা  (entrepreneurship) ফ্যাক্টরের ‘অবদান’ বলতে পারি। মার্কসও এটা প্রকান্তরে স্বীকার করে গেছেন নতুন প্রযুক্তি ও নতুন প্রোডাক্টের উদ্ভাবনের মাধ্যমে সাময়িককালের জন্য হলেও ‘surplus profit’ আহরণের সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে।
দ্বিতীয় ফুটনোটটি হলো- এরকম ধারণা আঁকড়ে ধরে রাখা উচিত নয় যে, সমাজতন্ত্রের নাগরিকেরা শুধু আয় করতে পারবেন কাজ করারই সুবাদে। শ্রমবহির্ভূত অন্যবিধ আয়েরও সুযোগ রয়েছে তাদের।Democratic Propertied Income স্কুলের চিন্তকেরা এরকম প্রস্তাব দিয়েছেন যে, সামাজিক মালিকানার অংশ হিসেবে প্রতিটি নাগরিকই রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার capital stock থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘ডিভিডেন্ড আয়’ লাভ করতে পারবেন। আর সমবায়ী মালিকানার ক্ষেত্রে প্রতিটি সমবায়ের সদস্য তার সমবায়ের পুঁজি খাটানো বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘ডিভিডেন্ড আয়’ লাভ করতে পারবেন। মার্কেট সোশ্যালিজমের প্রবক্তা জন রোমার  (Roemer) যে ‘কুপন সোশ্যালিজম’-এর প্রস্তাব করেছিলেন তা ডেমোক্রেটিক propertied income-এরই একটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। এসব চিন্তা শুধু ইউটোপিয়ান জল্পনা-কল্পনা নয়। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে যখন শিল্পায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে প্রবল জনঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, তখন ২০০৮ সালের দিকে ইকনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় বেশ কিছু খ্যাতনামা বাঙালি অর্থনীতিবিদ একত্রে একটি রচনায় প্রস্তাব রেখেছিলেন যে, এই উদ্যোগের ফলে যারা জমি হারাবেন তাদেরকে তাদের জমিতে স্থাপিত কল-কারখানার ‘ইকুইটি-মূলধনের’ অংশীদার করা হোক। তাতে করে তারা (এবং তাদের উত্তর পুরুষেরা) সেই ইকুইটি মূলধনের ওপরে ‘মালিকানা বাবদ’ নির্দিষ্ট পরিমাণে ডিভিডেন্ড ইনকাম পাবেন। পরবর্তীকালে, একই ধরনের প্রস্তাব রেখেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের জন্য। পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের মজুরি এমনিতেই বেশি নয়, তার কারণ এই শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হয়। যার জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মজুরি দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। এই অবস্থার কিছুটা নিরসন ঘটে যদি উপরোক্ত শিল্পসমূহে ইকুইটির অংশীদারে পরিণত করা যায় ওই নারী শ্রমিকদের। এর ফলে তাদের আয়ের দ্বিবিধ উৎস হতে পারে শ্রম সূত্রে প্রাপ্ত আয় ও শ্রমবহির্ভূত ইকুইটি সূত্রে মালিকানা বাবদ প্রাপ্ত আয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শ্রম-অনুযায়ী পারিশ্রমিকের পাশাপাশি পুঁজির মালিকানার অংশীদার হিসেবে ডিভিডেন্ড ইনকামের লাভের সুযোগ যৌক্তিকভাবেই নিহিত হয়েছিল। Democratic Propertied Income-এর ধারণা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে টমাস পিকেটি, এন্থনি এটকিনসন প্রমুখের লেখায়। আজকে যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (UBI)-এর ধারণা জোরেশোরে সর্বত্র স্বীকৃত হচ্ছে তারও পেছনে রয়েছে সমাজের নাগরিক হিসেবে Social Product-এর অংশীদার হিসেবে প্রত্যেকেরই নূ্যনতম আয় পাওয়ার অধিকারের দাবি। UBI সকলই পাবেন- তা তিনি শ্রম করুন বা নাই করুন। UBI-এর মতো সর্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত মানের ও সুলভ মূল্যের গণপরিবহন ব্যবস্থা শ্রম সূত্রের বাইরে প্রাপ্তব্য আয়ের উদাহরণ মাত্র। এসব উদাহরণ শুধু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘নাগরিক’ হওয়ার জন্য বাড়তি আয় উপার্জনের (বা ব্যয় সাশ্রয়ের) সুবিধা পাওয়ার অধিকারবোধকে ইঙ্গিত করে। এ ধরনের সুবিধার যতই সম্প্রসারণ হচ্ছে ততই যেন এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে যে, মানুষকে শুধু শ্রমিক হিসেবে দেখার আগে তাকে প্রথমে ‘পূর্ণ অধিকার বিশিষ্ট নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। UBI, সর্বজনীন চিকিৎসা, সর্বজনীন শিক্ষা, সর্বজনীন সুরক্ষা, সর্বজনীন গণপরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি শ্রমের পরিমাণ ও গুণের ওপর নির্ভর না করে মানুষের ‘চাহিদার’ ওপরে নির্ভর করবে। এছাড়াও আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম ও বিনোদনের অবকাশ পাওয়ার অধিকারের কথা। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের ব্যবস্থা থেকে ইতোমধ্যেই বর্তমান বিশ্ব ‘সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও চাহিদা অনুযায়ী বণ্টনের’ ব্যবস্থার দিকে চলা শুরু করেছে। এই উত্তরণ সবচেয়ে বেশি সার্থক হয় যখন (ক) সমাজ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উচ্চস্তরে পৌঁছায় এবং যখন (খ) সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সর্বস্তরে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই স্তরকেই মার্কস নতুন সমাজের দ্বিতীয় ও উচ্চতম স্তর তথা সাম্যবাদী সমাজ বলেছেন। Ability/Labour স্তর থেকে Ability/Need স্তরে সমাজের এই ক্রমান্বয় কিন্তু অবধারিত বিকাশকে স্বীকার করে নিয়েই বাহাত্তরের সংবিধানের ১০নং অনুচ্ছেদের Just and egalitarian socity
এবং ২০ নং অনুচ্ছেদের Principle ‘from each acording to his abilities to each acording to his work’ এর বিধান সংযোজিত হয়েছে- এটা মনে রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত অর্থনৈতিক দর্শনের প্রেক্ষিতে দুটো অভিযোগের কথা তুলতে চাই। একটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘বামপন্থী’ অবস্থান থেকে; আরেকটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘ডানপন্থী’ অবস্থান থেকে। ‘বামপন্থী’ অভিযোগের মর্মার্থ হলো, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৫নং ধারার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’, ১৭নং ধারার ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ১৮নং ধারার ‘জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা’, ১৯নং ধারার ‘সুযোগের সমতা’ এবং ২০নং ধারার ‘কর্মের অধিকার ও সম্মান’ এসবই সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূলনীতি’র অধ্যায়ে সন্নিবেশিত কেবল। এইসব ‘ভালো ভালো’ কথাগুলো সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে স্থান পায়নি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে স্থান পেলে এসবের বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রের সচেষ্ট দায়বদ্ধতা থাকত। বঙ্গবন্ধু (ও তার নিকটতম সহকর্মীরা) এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। পাল্টা যুক্তি তারা দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালেই- গণপরিষদে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন। তাদের যুক্তি ছিল, ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে যেসব অধিকার দেওয়া আছে সেগুলোর আশু বাস্তবায়ন না ঘটলে বা ব্যত্যয় ঘটলে তার জন্য নাগরিকেরা অবিলম্বে কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি সুবিধা সকলের জন্য আশু-ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিত করার সম্ভব নয় বলেই এসব উন্নয়ন-ধারাকে রাষ্ট্রের ‘মৌলিক নীতিমালার’ ভেতরে রাখা হয়েছে ‘ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য অধিকার’ হিসেবে, বা যাকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেছেন- ‘progressively realizable rights’। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির সাথে সাথে রাষ্ট্রের ব্যয় বরাদ্দের সক্ষমতা বাড়তে থাকলে এসব অধ্যায়কে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা সহজতর হবে।
এবারে আসি ‘ডানপন্থী’ অভিযোগের বিষয়ে। ইতোপূর্বে আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধু তার ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’কে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাননি। এরিক ওলিন রাইট (wright) দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ভিত্তিক ব্যবস্থা হচ্ছে একটি রাষ্ট্রতন্ত্র (statism)-এটি সমাজতন্ত্র নয়। সমাজতন্ত্রের মূল সারবস্তু হচ্ছে সমাজ ও সমাজের স্বার্থে অর্থনীতি পরিচালনা করা-সেখানে সমাজই মুখ্য। রাষ্ট্র মুখ্য নয়। এ চিন্তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ভাবনার বিরুদ্ধে সমাজনির্ভর ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় (যেটি রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ পর্বের চিন্তাতেও দেখতে পাই)। [ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


কিন্তু দেখা গেল এই ঘোষণার পরেও দরিদ্র শ্রেণি থেকে আসা এবং অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠী সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারল না। সামরিক দক্ষতা অর্জনের জন্য শারীরিক সক্ষমতা ও পারঙ্গমতা একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ- যেটা অপুষ্টি ও অসুখে ভোগা জনগোষ্ঠীর পক্ষে অর্জন করা স্বাভাবিকভাবেই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে সুযোগের সমতা নীতি ঘোষণার আগে ও পরে সামরিক বাহিনীতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ করাকে নিশ্চিত করা গেল না। বাহিনীটি মূলত অবস্থাপন্ন শ্রেণি বা গোত্রের মধ্যেই সীমিত হয়ে থাকল। বার্নার্ড উইলিয়ামস এখানে যে উদাহরণ টেনেছেন তা একেবারে বিরল নয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ দমনে পাঞ্জাবের যোদ্ধা-শ্রেণিকে ব্যবহার করা হয়েছিল দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের নানা এলাকায়। এর পুরস্কারস্বরূপ সেন্ট্রাল পাঞ্জাবে সেনা সদস্যদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধরনের ভূস্বামী তথা সামরিক শ্রেণি বা গোত্রের জন্ম হয় পাঞ্জাব প্রদেশে ঔপনিবেশিক পরিচর্যায়। এই শ্রেণিটিই পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে দেশভাগের পর থেকে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। সমাজতাত্ত্বিক হামজা আলাভী এদিকটির প্রতি দৃষ্টিপাত করেছিলেন। এখনও সেন্ট্রাল পাঞ্জাবের অবস্থাপন্ন ঘরের এক ভাই যায় কৃষি ব্যবস্থাপনায়, আরেক ভাই যায় সামরিক বাহিনীতে এবং অন্য কোনো ভাই যায় বেসামরিক সরকারি চাকরিতে।
শিক্ষা, চিকিৎসা ও চাকরি ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ ঘোষিত হয়ে আসছে প্রায় প্রতিটি দেশেই। বিলেতে-আমেরিকায় বিভিন্ন করপোরেট সেক্টরের বিজ্ঞাপনে এখন লেখা থাকে ‘আমরা সুযোগের সমতার নীতিতে বিশ্বাসী’। কিন্তু সমস্যার গভীরে না পৌঁছানোর কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সুযোগের সমতার নীতি পর্যবসিত হয় ‘প্রতীকী সমতার’ নীতিতে। যাকে সমতার সাহিত্যে বলা হয়েছে  formal equality of opportunity বলে। এর বিপরীতে ন্যায়বাদী দার্শনিকেরা প্রস্তাব করেছেন ‘প্রকৃত সমতা’ বা  substantive equality of opportunity-র কথা। এবং খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে বাহাত্তরের সংবিধানে প্রতীকী সমতা নয়, প্রকৃত সমতার কথাই বোঝানো হয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে ১৯নং অনুচ্ছেদের ২নং ধারা, যেখানে অবস্থাজনিত কারণে সৃষ্ট অসাম্যকে দূর করার জন্য সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রণিধানযোগ্য :
‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুযোগের ‘প্রকৃত সমতা’ অর্জনের চ্যালেঞ্জটি আরও ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করা দরকার। কতটুকু বৈষম্য আমরা স্বীকার করে নিতে পারি? নৈয়ায়িক দার্শনিকদের জন্য এটা একটা বড় প্রশ্ন। সুযোগের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেই বৈষম্য দূরীভূত হয়ে যাবে না। একটি সবার জন্য উন্মুক্ত দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ প্রথম হয়, কেউ লক্ষ্যে পৌঁছায় সবার শেষে। এ ধরনের বৈষম্যকে প্রকৃত অর্থে অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্য বলা চলে না। নৈয়ায়িকেরা সেই বৈষম্যকেই স্বীকার করতে রাজি যেটুকু মানুষে মানুষে ‘উদ্যমের ফারাকের’ কারণে সৃষ্টি হয়। যে-বৈষম্য ‘অবস্থার চাপে’ পড়ে সৃষ্টি হয় সেটি নিরসনযোগ্য বৈষম্য। যদি গ্রামের স্কুল থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীকে (যার পরিবারে বা যার স্কুলে ইংরেজি শেখার কোনো আয়োজন বা পরিস্থিতি নেই) শহরের স্কুল থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করতে হয় এমন এক পরীক্ষায় যেখানে ইংরেজিতেই কেবল পরীক্ষাপত্র করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীর হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা জন রোমার (Roemer) যাকে বলেছেন ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’, বা এলিজাবেথ এন্ডারসন যাকে বলেছেন ‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম (Luck egalitarianism), সেটি এ ক্ষেত্রে রক্ষিত হয়নি।
‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম’-এর মূল কথা হলো নিম্নরূপ :’While inequalities are unjust if they derive from differences in people’s circumstances-because circumstances are a matter of brute luck– they are just if the are the product of people’s voluntary choice.’

অর্থাৎ শুধুমাত্র নিজস্ব নির্বাচন বা পছন্দের কারণে অথবা উদ্যমের তারতম্যের কারণে যদি কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রেও কথা থাকে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে থাকে স্কুলের বাইরে ‘প্রাইভেট ক্লাস’ করার কারণে। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের সে-সংগতি নেই। জেরাল্ড কোহেন (G. A. Cohen) এরকম ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম’-র নীতি দাবি করে যে রাষ্ট্র এ ধরনের সমস্যা সুরাহা করার চেষ্টা করবে বা অন্তত সমাধান করতে সচেষ্ট হবে। যেমন, এই উদাহরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল ছুটির পরে নিখরচায় বাড়তি কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করবে এবং এর জন্য যে বাড়তি ব্যয় হবে তার দায়িত্ব নেবে। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণার তারতম্যের কারণে যে-বৈষম্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে শিক্ষা ক্ষেত্রে, তার বেলায় কী করা হবে? দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিতের পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাবা-মার অনুপ্রেরণা ও পরিবারের কারণে পড়াশোনায় অনেক বেশি তৎপর হয়ে থাকে। খেটে-খাওয়া মজুর পরিবারের বাবা-মা উভয়েই হাড়ভাঙা খাটুনির সঙ্গে জড়িত। সারাদিনের শেষে সন্তানদের ‘হোমওয়ার্ক’ দেখার সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে। লাক্‌-ইগালিটারিয়ানিজম বলে যে এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের অনেক কিছু করার আছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রি-স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা চালু করলে অনুপ্রেরণা বা উৎসাহের ক্ষেত্রে খামতি অনেকটুকু কমে আসবে। পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিভা বিকাশে সহায়ক এবং আত্মবিশ্বাস জোগায় যেটা স্কুলের পারফরম্যান্সেও প্রতিফলিত হতে বাধ্য। কভিডের সময় আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি যে, অনলাইন এডুকেশনের ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বৈষম্য আসলেই প্রকট। করোনার সময়ে যখন লকডাউনের কারণে স্কুলে পাঠদান বন্ধ রইল, ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনলাইনে ঠিকই ক্লাস করতে পারল। ও-লেভেল এ-লেভেল পরীক্ষা দিতে পারল। গরিব পরিবারে একটি করে মোবাইল আছে বটে, কিন্তু স্মার্টফোনের সুবিধা এখনও অত্যন্ত কম। শহর এলাকার বাইরে ইন্টারনেট স্পিডও তুলনামূলকভাবে কম। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ করা প্রয়োজন যাতে করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের সুযোগের সমান অধিকার নিশ্চিত হয় শিক্ষার মতো অধিকারের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, নৈয়ায়িক দার্শনিকদের সূত্র ধরে- ‘সুযোগের সমতা’ বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯তম অনুচ্ছেদে কোনো প্রতীকী অর্থে বলা হয়নি। এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি। যেটি সুযোগের সমতা বিধানে অবস্থার চাপে সৃষ্ট বৈষম্য বা ‘নির্দয় দুর্ভাগ্য’ (Brute luck) জনিত বৈষম্যকে দূরীভূত করে সবার জন্য সুযোগের দ্বার সমানভাবে খোলা রাখতে বদ্ধপরিকর। এক কথায়, ১৯নং অনুচ্ছেদ শুধু non-discrimination principle-এর ঘোষণাতেই আটকে থাকেনি। ১৯ নং অনুচ্ছেদের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার’ কথা, আর এর ২ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের কথা’। ১নং ধারায় বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ আজকে যেটা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস-এর ১নং (No Poverty) ২নং  (Zero Hunger), ৩নং (Good Health & Well-being), ৪নং (Quality Education),
, ৫নং (Gender Equality), ৬নং  (Clean Water and Sanitation), ৭নং (Affordable & Clean Energy), এবং ৮নং (Decent Work & Economic Growth) লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, ‘৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এবং ৭২ সালের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ পূরণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে’ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা এবং এর মাধ্যমে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করার কথা। শুধু বিষয়টাকে মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যেই সীমিত রাখা হয়নি। সেখানে আরও বলা ছিল ‘কর্মের অধিকার’ নিশ্চিত করার কথা এবং ‘যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার’ প্রদানের গুরুত্ব। যারা পিছিয়ে পড়ে থাকবেন দারিদ্র্যের বিষ-বৃত্তের ভেতরে, তাদের প্রতি রাষ্ট্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হাল-আমলের তথাকথিত ‘সোশ্যাল প্রটেকশন’ কর্মসূচির বহু আগেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের চিন্তায় এসেছিল পিছনে-পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা, যার সংজ্ঞা ছিল নিম্নরূপ:
‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।’
শুধু ‘সুযোগের সমতার’ অধিকার নয়, আরও বেশি কিছু ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে। তিনি বুঝেছিলেন যে ইক্যুয়ালিটি অব অপরচুনিটি সুষম বণ্টনের সমাজের দিকে এগোনোর একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত বটে, কিন্তু যথেষ্ট পূর্বশর্ত নয়। সমাজের একটি মুষ্টিমেয় অংশই উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ লাভ করে দরিদ্র দশা থেকে সচ্ছল দশায় উন্নীত হতে পারবে। সকলের ক্ষেত্রে অদৃষ্ট সমান প্রসন্ন হয় না, সকলের ন্যাচারাল বুৎপত্তি বা প্রতিভাও সমান নয়। কিন্তু তাই বলে কি যারা দীনের চেয়ে দীন, যারা আজীবন কায়িক শ্রমের ভেতরে, খেটে-খাওয়া মানুষ যাদের বলি, তাদের কাজের কি মূল্যায়ন করা হবে না? তারা কি ফ্রন্টলাইন বা এসেনসিয়াল ওয়ার্কার্স হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হবেন না? তাদের কি সমান নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা  (Common Good) পাওয়ার অধিকার নেই? বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে বিশেষ করে ১৪ নং অনুচ্ছেদের প্রস্তাব করেছিলেন:
‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে, এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’
এবং তার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে মেহনতি মানুষকে সহায়তা করতে হবে, দেখভাল করতে হবে। আজকের Universal Basic Income-র ধারণার পূর্বছায়াও আমরা এখানে দেখতে পাই। অন্যত্র- ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রকারান্তরে তিনি উল্লেখ করলেন ‘equality of outcomes’-এর কথা। এটি এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রা ‘বৈষম্য হ্রাস করা’র সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সেদিন তিনি বলেছিলেন:
‘এই সরকার ন্যায়ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেইসব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যারা পাটচাষিদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন, তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতোমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশে মানুষ মানুষে, ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।’
বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধিই বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(২) ধারায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ করার জন্য এবং নাগরিকদের মধ্যে ‘সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত’ করার জন্য ‘সর্বত্র সুষম সুযোগ-সুবিধাদান’ প্রদানে রাষ্ট্রের তরফে ‘কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার কথা। পরিশেষে, ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের কথা:
‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে এবং প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এই নীতির ভিত্তিতে ‘প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


প্রথমটি ছিল- সকলের জন্য সমান লিবার্টি বা স্বাধীনতার প্রস্তাব। দ্বিতীয়টি ছিল- সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কত দূর পর্যন্ত স্বীকার্য তা নিয়ে তার উপলব্ধি। ‘সবচেয়ে গরিবকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা’ দিতে হবে সবার আগে, সবার জন্য ‘মৌলিক চাহিদা’ পূরণের ক্ষেত্রে- এটি তার ন্যায়বাদী সমাজের একটি প্রধান পূর্বশর্ত ছিল। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, তার নির্দেশিত মুক্ত ও সামাজিক ন্যায়ের সমাজেও মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত হয়েছিল। যেমন, বহুত্ববাদিতা তিনি চেয়েছেন, কিন্তু সেই বহুত্ববাদিতাকে হতে হবে যুক্তিযুক্ত- এজন্যই তার নাম দিয়েছেন ‘Reasonable Pluralism’ বলে। কিন্তু কোনটা (এবং কতদূর পর্যন্ত) হবে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদ, তার সীমানা নির্ধারণ কেবল মাত্র জনগণের মধ্যে মুক্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পন্ন করা সম্ভব। অমর্ত্য সেন যাকে (জন স্টুয়ার্ট মিলের অনুসরণে) বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি সরকার-ব্যবস্থা যেখানে সবকিছু পরিচালনা করা হয় ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে’ (‘রুলিং বাই ডিসকাশন’)। সংসদ সেরূপ মুক্ত পর্যালোচনার জন্য একটি প্রধানতম প্ল্যাটফর্ম। এটি বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাদের একটি মৌল পূর্বানুমান  (Premise)।
Lost in Translation দিয়ে এই অধ্যায়টি শুরু করেছিলাম। এবারে অনুবাদের একটি সমস্যা দিয়ে নতুন প্রসঙ্গে যেতে চাই। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে, ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটির অনুবাদ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্যে সমার্থক ব্যঞ্জনা পায়নি। বাংলা পাঠে সমাজতন্ত্র ধারণাটি অনেক বেশি ‘র‌্যাডিকেল’ ইংরেজি পাঠের তুলনায়। র‌্যাডিকেল এই অর্থে যে, বাংলা ভাষ্যটি অনেক বেশি যুগান্তকারী, বিপ্লবাত্মক ও ‘সুদূরের পিয়াসী’। ইংরেজি পাঠ সে তুলনায় অনেক বেশি ধীরে-চলা নীতির, সংস্কারবাদী ও আশু কর্মসূচির। এটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
১০ নং আর্টিকেল-এর ইংরেজি পাঠে লেখা হয়েছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ : ‘Socialist economic system’, ‘attainment of a just and egalitarian society’ Ges ‘free from the exploitation of man by man’। এই প্রতিটি বাক্যাংশই অনেক অর্থের ভারে নুয়ে আছে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেম establish করার’ যথার্থ অর্থ কী তা ধ্রুপদি মার্কসবাদে নির্দিষ্ট করা ছিল না। মার্কসবাদ ছাড়া অন্যান্য ধারার সমাজতন্ত্রেও অর্থটি নির্দিষ্ট হয়ে নেই। যেমন, জন স্টুয়ার্ট মিল নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতেন, সমাজতন্ত্র নিয়ে তার ট্রিটিজ রয়েছে। কিন্তু সেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ‘ফেবিয়ান সোশ্যালিজম’-এর ফারাক আছে। আধুনিক অর্থনীতির জনক আলফ্রেড মার্শাল অর্থশাস্ত্রে নব্য-ধ্রুপদি ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু সমাজ-চিন্তায় তিনি নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবেই দেখেছেন। ‘টু মার্শালস’ বইতে মার্শালের দ্বৈত-চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্লুমসবিউরি গ্রুপের বিদগ্ধ সদস্য ও দিকপাল অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস প্রথাগত সমাজতন্ত্রের কট্টর সমালোচক ছিলেন, কিন্তু নিজেকে তিনি ‘বামধারার’ অর্থনীতিবিদ হিসেবেই ভাবতেন, বিশেষত অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রশ্নে জোরালো অবস্থান নিয়ে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেমের’ অন্য একটি প্রচলিত অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’-এর মডেল অনুসরণ করা। কিন্তু সেটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা সংবিধানের আলোচনায় আগেভাগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সে ধরনের মডেল এদেশে হবার নয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনগ্রসর পটভূমিতে সে ধরনের উন্নয়নের ছকে ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অর্থনীতি’র মডেলকে আশ্রয় করে এগোবার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ১৯৭৩ সালে গৃহীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলেও সেই বাস্তববোধের স্বীকৃতি ছিল। এখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য রাস্তা দেখতে হবে, যাতে করে ন্যায়ানুগ, সমতাবাদী ও শোষণমুক্ত সমাজ কালক্রমে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটি’ বাক্যাংশ নিয়েও বাংলা ও ইংরেজি পাঠে বড় রকমের ধন্দের সৃষ্টি হলো। ড. আনিসুজ্জামান কমিটি ‘জাস্ট’-এর বঙ্গানুবাদ ঠিকই করলেন ‘ন্যায়ানুগ’, কিন্তু গোল বাধল ‘ইগালিটারিয়ান’ শব্দটির বাংলা নিয়ে। ড. কামাল লিখলেন ‘egalitarian society’; ড. আনিসুজ্জামান লিখলেন ‘সাম্যবাদী সমাজ’। আপাতঃদৃষ্টিতে দুটোকেই সমার্থক শব্দ মনে হলেও এরা আদৌ সমার্থক নয় বর্ণে-গন্ধে, ঐতিহ্যে, পরম্পরায়। egalitarianism নানা ধারার মতবাদেই, নানা ধরনের সংবিধানেই আছে। যে কোনো ‘লিবারেল বুর্জোয়া’ ধারার টেক্সটেই ‘egalitarian society’ শব্দবন্ধটি খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিকও নয়। এর একটা কারণ- অর্থনীতিতে না হোক, রাজনীতিতে egalitarianism অর্থাৎ Political equality, এবং মৌলিক অধিকারের equality প্রতিশ্রুত হয়ে থাকে। এর শুরু ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের দর্শনে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এটি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করেছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যার স্লোগান ছিল- ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি’। ইকুয়ালিটি ফরাসি উচ্চারণে হয় ‘ইগালিতে’- সেখান থেকে ইংরেজিতে তার পুনর্জন্ম egalitarian ব্যাঞ্জনায়। আমি বলতে চাইছি, কী ঐতিহাসিকভাবে এবং ব্যুৎপত্তিগতভাবে ড. কামাল যখন   just and egalitarian society ব্যবহার করে ছিলেন তিনি কমিউনিস্ট অর্থে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অর্থে খুব সম্ভবত ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছিলেন লিবারেল পলিটিক্যাল ফিলোসফির পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির বহুল প্রচলিত অর্থে। ফরাসি বিপ্লবের Spirit-এ। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামানের হাতে পড়ে সেটা হয়ে গেল- ‘সাম্যবাদী সমাজ’। তিনি এর পরিবর্তে ‘সমতাবাদী সমাজ’, ‘সুষম বণ্টনের সমাজ’ নানা ধরনের বিকল্প ভাবতে পারতেন বা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি হাত বাড়ালেন এমন একটি শব্দের প্রতি যার অর্থ বহুকাল ধরে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সংজ্ঞায়িত হয়ে আছে। মার্কসবাদী প্রগতিবাদী দর্শনের যে কোনো টেক্সটে যখন ‘সাম্যবাদী সমাজ’ শব্দটি লেখা হয়, তখন তার একটিই (বা প্রধানতম) মানে হচ্ছে- মার্কস-এঙ্গেলসের নির্দেশিত পথের ‘সাম্যবাদী সমাজ’। যে সাম্যবাদী সমাজের দুই ধাপ- প্রথমটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত নিচু পর্যায়ে)। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাম্যবাদী সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত উঁচু পর্যায়ে)। এটি হতেই পারে না যে ড. আনিসুজ্জামান বা তার সহ-অনুবাদকগণ ‘সাম্যবাদী সমাজ’ লেখার ‘ছায়া-অর্থ’ বা  Connotation জানতেন না। অন্তত ড. আনিসুজ্জামান- যিনি এক সময়ে (পঞ্চাশের দশকে) কিছুকালের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন (এবং পরবর্তীকালেও এ ধারার সংলগ্ন আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন)- সাম্যবাদী সমাজ লেখার গভীরতর তাৎপর্য ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন বা বুঝতে পারার কথা।
প্রশ্ন উঠবে, অনুবাদটি যে যথাযথ হলো না আক্ষরিক ও রাজনৈতিক উভয় অর্থে, সেটি আনিসুজ্জামানের হাত থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হলেও সংবিধান-কমিটির অন্য সদস্যদের তো এই অনুবাদের দার্শনিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য চোখে পড়ার কথা। তাহলে সেটি নিয়ে সেদিনের গণপরিষদে তর্ক ওঠেনি কেন? সংবিধান-কমিটিতেও এ নিয়ে বাদানুবাদ হতে পারত অল্পবিস্তর। সেটা হয়েছিল কিনা আজ সেটা জানবার প্রায় উপায় নেই। আমরা শুধু এটুকু জানি যে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা ড. কামাল হোসেন কেউই  egalitarian society-র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সাম্যবাদী সমাজ’ প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে আপত্তি জানাননি। হতে পারে তারাও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দেশটিকে ওইরকম একটি আদর্শ বা আদর্শায়িত সমাজের দিকেই কালক্রমে- অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও চড়াই-উৎরাইয়ের ক্লেশ-যন্ত্রণা স্বীকার করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই এই যাত্রা হতো গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণ করে- অগণতান্ত্রিক পরমত অসহিষ্ণু পথে নয়- সন্দেহ নেই। সমতামুখী সমাজের দিকেই এগোতে চেয়েছিলেন তারা। অন্তত সেরকম স্বপ্ন তাদের ছিল। সে জন্যেই আনিসুজ্জামানের অনুবাদে তারা আপত্তি জানাননি সেদিন কেউই।
১০. ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘শ্রম-অনুযায়ী বণ্টন’
আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাভিত্তিক সমাজ নয়। সমাজতন্ত্রকে এমনকি শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা নিরিখে বিচার করা চলে না। মালিকানার বিচার সমাজতন্ত্রের একটি মূল দিক। তবে একমাত্র দিক নয়, প্রধানতম দিকও নয়। এর কারণ সমাজতন্ত্র প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক নাগরিককে ‘সুযোগের সমতা’র অধিকার। সুযোগের সমতা বা equality of opportunity সমাজতন্ত্রের মৌলিক শর্তের একটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত। সমাজতন্ত্রের চরিত্রে রয়েছে ‘সামাজিক মালিকানা’ (যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানার নানা দেশ-কাল ভেদে বিভিন্ন মিশ্রণ)। কিন্তু সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একটা বিশেষ লক্ষ্যে, আর সেটা হচ্ছে সকল নাগরিকের মধ্যে ‘সুযোগের সমান অধিকারের’ প্রতিষ্ঠা করা। মালিকানা- তা সে রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তি মালিকানাই হোক- কেবল উদ্দেশ্য সিদ্ধির ‘উপায়’ মাত্র। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে সমাজতন্ত্রের চরিত্রে বিকৃতি দেখা দিতে বাধ্য। নানা দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার অভিজ্ঞতায় এটা দেখা গেছে- কখনও ‘স্তালিনীয় সমাজতন্ত্রে’র মডেলে পণ্য-অর্থ সম্পর্ককে হালকা করে দেখার মাধ্যমে। কখনও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ওপরে মাত্রাতিরিক্ত জোর দিয়ে, কখনও না-পরিকল্পনা না-বাজার এমন একটা জগাখিচুড়িপূর্ণ ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ কর্মসূচি হাতে নিয়ে (যেমনটা হয়েছিল গর্বাচেভের সংস্কার-প্রচেষ্টার আমলে)। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ প্রায় প্রতিটি ‘সমাজতান্ত্রিক দেশেই’ মালিকানা সম্পর্কের বিশুদ্ধতা রক্ষায় বেশি তৎপর হতে গিয়ে আসল উদ্দেশ্য জনকল্যাণ থেকে দৃষ্টি সরে গেছে সময় সময়। সে জন্যেই সমাজতন্ত্র কী তা বোঝার জন্য consequentialist দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রকে টিকতে হলে তাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলতে শিখতে হবে। যার ইঙ্গিত রেখেছিলেন মার্কস ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ যেখানে সমাজতন্ত্রকে ক্রমশ মানবচাহিদামুখীন (Need based society) সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন মার্কস। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রণেতারা ও বঙ্গবন্ধু ‘অধিকারের ভাষাতেই’ সমাজতন্ত্রকে দেখতে চেয়েছেন- শুধু মালিকানা-সম্পর্কের নিরিখে দেখতে চাননি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সংবিধানের ১৯ এবং ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ। এ নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা সীমিত রাখব। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যার জন্য এ দুই অনুচ্ছেদের পদ্ধতিগত গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯নং অনুচ্ছেদে ১নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার কথা’, আর ২নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের’ কথা। ১নং ধারায় অতি সংক্ষেপে বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ অতি সংক্ষেপেই চুম্বক-বাক্য হিসেবে ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটির’ কথা লেখা হয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা না করেই। কোন কোন সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা হবে বা বেশি জোর দেওয়া হবে, কতটুকু সমতা বিধান করা হবে (কতটা গভীর গিয়ে বৈষম্যের প্রশ্নটি সমাধা করা হবে); কোন কোন ক্ষেত্রে সমতা-বিধানের প্রশ্নটি সবার আগে সমাধান করা জরুরি, এবং কী ধরনের সুযোগের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্নটি ক্রমান্বয়ে অর্জিত হবে এসব প্রশ্নই প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভেতরে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা, গণ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। তার কিছু কিছু দিকের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে গেলে প্রথমেই এসে পড়ে সুযোগের ক্ষেত্রে ‘আদি-বৈষম্য’ (initial inequality) দূর করার সমস্যাটি। এ ক্ষেত্রে বার্নার্ড উইলিয়ামস একটি উপদেশ দিয়েছেন। ধরা যাক কোনো একটি দেশে নীতি-নির্ধারকেরা ঠিক করলেন যে কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় বা বিশেষ কোনো যোদ্ধা-শ্রেণি বা গোত্র (ইংরেজিতে যাকে বলে- warrior class) থেকেই সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হবে ব্যাপারটা এমন নয়। এবার থেকে সমাজের সকল স্তরের মানুষেরাই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ‘সমান সুযোগ’ পাবেন। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ পূর্ব-ঘোষিত হলো।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত বাধা অপসারণের জন্য তারা বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্র বা লিবারেল ডেমোক্রেসির গণ্ডি ছাড়িয়ে এক র‌্যাডিকেল ধারার গণতন্ত্রের (Radical Democracy) জন্ম দিচ্ছেন। একেই বঙ্গবন্ধু অভিহিত করেছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে। পরবর্তী অধ্যায়ে- বাকশালের আলোচনায়, এ নিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে উৎক্রমণের আরও কিছু উদাহরণ ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে।
যে যুক্তির বলে ভারতে ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনকে নাকচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাকে তিক্ত অভিজ্ঞতা বলেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম- সেটি ৪৭নং অনুচ্ছেদের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারত। বিদেশে বসে পরিত্যক্ত শিল্পকারখানার অবাঙালি মালিকেরা দিন গুনছিলেন কবে তারা বাংলাদেশে এসে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি পেশ করবেন ভারতীয় রায়ের যুক্তি দেখিয়ে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা এই বিপদের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই বিপদ শুধু অবাঙালি মালিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দেশি শিল্প-মালিকদের নিয়েও উৎকণ্ঠার কারণ ছিল। এর একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাই ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণায়। তিনি লিখেছেন:’১৯৭৩ সালের শেষের দিকে মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তখন জাতীয়করণকৃত জুটমিলগুলোতে সাবেক মালিকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সাবেক মালিকরা ১৮টি মিলের যাবতীয় অর্থ একই দিনে উঠিয়ে মিলগুলো দেউলিয়া করার উদ্যোগ নেন। পূর্ব রাতে এ সংবাদ নিয়ে ফরাসউদ্দিন (বঙ্গবন্ধুর পিএস এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর)-এর সাথে দেখা করে তাকে ঘটনা খুলে বলি। তিনি ডিসিকে টেলিফোন করে, ঐ সকল জুটমিলের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ব্যবস্থা করেন।’ এতে করে অ্যান্টি-ন্যাশনালাইজেশন লবির অপতৎপরতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সন্দেহ কী, এসব ঝুঁকি এড়াতেই সেদিন ৪৭নং অনুচ্ছেদের সংযোজন করতে হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে।
ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন সম্পর্কিত ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ নিয়ে আরও কিছু তথ্য যোগ করা দরকার এখানে। জাস্টিস হেদায়েতুল্লাহর ভূমিকা সম্পর্কে সৈয়দ নজরুল সেদিন যা বলেছিলেন তার সবটাই সত্য নয়। আসলে যা হয়েছিল তা ঘটনা প্রবাহের কাছাকাছি- কিন্তু খানিকটা অন্যরকম। ১৯৬৯ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ইস্তফা দিলেন। এর দু’দিনের মাথায় ঘোষিত হলো ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনের নীতি। এই নীতির ঘোষণা পেয়ে তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জাস্টিস মো. হেদায়েতুল্লাহ (তিনি ততদিনে প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন) পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর ঠিক দু’দিন আগে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। এই অর্ডিন্যান্সে জাতীয়করণের ফলে গৃহীত ব্যাংকসমূহের মালিকদের ‘পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার প্রভিশন রাখা ছিল না। এই অধ্যাদেশকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ব্যাংক অব বরোদার মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার রুস্তম কুপার সাহেব সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। এর ওপরে ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘কুপার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া :ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন কেইস’ মর্মে এক ঐতিহাসিক রায় হয়। ১১ জন বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় প্রদানে অংশগ্রহণ করেন এবং ১০ :১ রায়ে তারা অধ্যাদেশটি বহাল রাখেন। কিন্তু বহাল রাখলেও তারা কতকগুলো মন্তব্য করেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে কিছু জরুরি পরিবর্তন আনতে হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানে। যেমন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কুপারের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি এ কথা বলা হলেও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল যে সাধারণভাবে ‘ ‘It was not binding upon the Supreme court to reject the claim for enforcement of a shareholder’s fundamental rights, if in the process of violaton of his rights, the rights of his company were also being violated.’ ভারতীয় সংবিধানে বহুদিন পর্যন্ত জরমযঃ : Right to Property-কে 19(1)(F) ) ধারা অনুসারে ‘মৌলিক অধিকার-র অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। পরবর্তীকালে বিশেষ করে ‘কেশবানন্দ ভারতীর’ রায়ের পরে- এই ধারাটিকে বাদ দিতে হয় ভারতীয় সংবিধান থেকে। একইভাবে আগে Article 31 অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তা করতে গেলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হতো যার কাছ থেকে সম্পদ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তাকে। সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করেন যে, যার সম্পত্তি গ্রহণ করা হচ্ছে তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। এখানে ‘কোম্পানিকে’ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, আর ভারতীয় সম্পত্তি আইন বলে ‘কোম্পানি’ কোনো নাগরিক নয়, এবং সেহেতু কোম্পানির কোনো প্রচলিত নাগরিক অধিকার এ ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়নি। এর অর্থ- অন্য কোনো ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি জাতীয়করণ করার প্রশ্ন দেখা দেয়, তবে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কাজ বলে পরিগণিত হবে। এসব আশঙ্কা এড়ানোর জন্য ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায় থেকে 19(1)(F) ধারা বাদ দেওয়া হয়। এরকম আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয় সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে। এটাকেই ড. কামাল হোসেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ বলেছেন, এবং এ লক্ষ্যে বাহাত্তরের সংবিধানে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৪২(১) ধারা রেখেও ৪২(২) ধারা সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং আলাদা করে গুরুত্ব সহকারে ৪৭নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়।
ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন রায়ের সময় ভারতের সরকার পক্ষ থেকে এ যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, এ রকম জাতীয়করণ চাইলে রাষ্ট্র করতেই পারে, কেননা ‘There was an obligation upon the state to achieve a socialistic society with principles of egelitarianism’। যদিও ভারতীয় সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি যুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে, এর পরিস্কার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের ভুবনেশ্বর কংগ্রেসে। সেই কংগ্রেসে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সোশ্যালিজম’ নামে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তৎকালীন কংগ্রেস পার্টি। তার পর থেকেই এর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্তি দেখা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার যুক্তিটি তেমন গুরুত্ব পায়নি, বরং যুক্তি দেওয়া হয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে সম্পত্তির অধিকারকে সংরক্ষণ করার প্রতি। ‘উদ্দেশ্য’ (Objective)-র বদলে জোর দেওয়া হয়েছিল ‘পরিণাম’  (Effect)-র প্রতি : ‘The court struck down the ‘object’ test and laid down the ‘effect’ test. The effect test would now look into the effect of any particular legislative Act, rather than looking at the objective with which it had been formulated. Thes, if any Act of the legislature, even at a remote stage, violated the Fundamental Rights of the citizens, then, it was liable to be struck down.’ বাংলাদেশেও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ এ রকমটাই ভেবেছেন- শুধু একটি মাত্র ক্ষেত্রকে তারা ব্যতিক্রমের তালিকায় রেখেছেন। সমাজতন্ত্রের নির্মাণের জন্য তারা প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এরকম বিষয়টি ‘মৌলিক অধিকারের’ অধ্যায়ে ৪২(২) এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে, ভারতীয় সংবিধানও 19(1)(F) এবং Article 31 বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পথই অনুসরণ করেছে। এই প্রেক্ষিতেই ড. কামাল হোসেন তার ৩০ অক্টোবরের ভাষণে বলেছিলেন ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা :
‘মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনি নিশ্চয় জানেন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের ইতিহাস। যখন তারা জমিদারি আইন সংশোধন করতে যান, তখন সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট সেটাকে নাকচ করে দেন। তারপর, তাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বলবৎ করতে হয়। … যখন ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছিল, তখনও সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দেন। … তারপর ২৬ নম্বর সংশোধনীতে এসে তারা মোটামুটি বলে দিয়েছেন যে, সংসদ আইন করে সেখানে মূলনীতি ঘোষণা করে দিতে পারবেন। মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য এটা করা হয়েছে। এটা আদালতের বিবেচনার বাইরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের একটা সুবিধা হয়েছে এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পঁচিশ বছর পরে ভারতকে যেটা সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে করতে হয়েছে, আমরা সেটা এখনই সঙ্গে সঙ্গে করে নিতে পেরেছি।’
এখানে বলা দরকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-র কথা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সংবিধানে রয়েছে। ভারতে ১৯৬৩ সালের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘reasonable restrictions on the exercise of the right’  বিষয়টিকে আরও জোরদার করা হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটাকে আরও বেশি করে মূলনীতি সমতাবাদী লক্ষ্যের অধীনস্থ করা হয়। এই সংশোধনী বলে কোন কিছু যদি ‘egalitarian social order’ -এর মূলনীতির পরিপন্থী হয় তবে তা বাতিলযোগ্য হবে। দেশজ রাজ্যসমূহের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে এই বলে যে, এ ধরনের স্বাধীন রাজ্য ব্যবস্থা- : the concept of rulershi-সমতাবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় :’The concept of rulership, with privy purses and special privileges unrelated to any current functions and social purposes, is incompatible with an egalitarian social order’, এবং সে কারণে এসব বাড়তি সুবিধাভোগের অধিকার- তা ‘ব্যক্তিগত অধিকার’ বলে আগে ভাবা হলেও এখন থেকে প্রত্যাহূত হলো। ভারতীয় সংবিধানের এই অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল সংবিধান প্রণেতাদের কাছে। বোঝাই যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যক্তি স্বাধীনতার ডিসকোর্সের ভেতরে আবদ্ধ ছিলেন না বা থাকতে চাননি। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা সমাজতান্ত্রিক তথা সমতাবাদী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। এ দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তাদের পক্ষপাতিত্ব ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতিই। তাজউদ্দীন আহমদও ড. কামালের মতোই- এমনকি আরও এগিয়ে গিয়ে ভেবেছেন। এজন্যই তার ৩০ অক্টোবরের বক্তৃতাতে উঠে এসেছে ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা :
‘আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্কারভাবে সমাজতন্ত্র কী, তা বলে দিয়েছে … সেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি আমরা করতে যাচ্ছি, যা এই সংবিধানে রয়েছে। … সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এই রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিকে আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা, যাতে … মৌলিক অধিকার … এতে অন্তরায় সৃষ্টি না করে। যারা প্রগতিবাদী বলে দাবি করেন, তারা সমালোচনা করছেন এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নয় বলে। আমি জানি না, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, সে পরিকল্পনা কেউ যদি দিতে পারতেন, তাহলে এই পরিষদ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন।’
এই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন সংবিধানের লিবার্টি প্রিন্সিপাল ও সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে একত্রিত করে ছুড়ে দিয়েছেন আরও একটি চ্যালেঞ্জ। তবে সেটা গণতন্ত্রীদের প্রতি :
‘সমাজতন্ত্রের পথে যাতে কোনোরূপ অন্তরায় সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা আমরা ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে করেছি। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ করে মৌলিক অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর চেয়ে কম সীমাবদ্ধতা পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংবিধানে আছে বলে আমি জানি না। যদি কেউ আমাদের দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা উপকৃত হব। কেবল দুই-একটা ক্ষেত্রে দাঁড়ি-কমার কমবেশি হতে পারে। বাধানিষেধ ছাড়া কোনো দেশে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়নি, হতে পারে না।’
এ-ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ এ দুই মৌলিক মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্যতা অর্জনের ও তা গতিশীলভাবে রক্ষা করে অগ্রসর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। বাহাত্তরের সংবিধানের ঠিক এক বছর আগে দার্শনিক জন রাউলস ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন তার দিকনির্দেশকারী বই- ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’। ন্যায়ানুগ ও গরিবমুখিন সমাজের ন্যায়বাদী তত্ত্ব রচনার সময় তিনি লিবার্টি প্রিন্সিপালকে সোশ্যাল জাস্টিস তথা বণ্টনগত ন্যায় (Distributive Justice)-র প্রিন্সিপলের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
[ক্রমশ]