বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রের অর্থ যদি হয় সামাজিক ন্যায়বিচার (সোশ্যাল জাস্টিস), আর সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থ যদি হয় ‘ন্যায়ের’ বাস্তবায়ন, তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- ন্যায় কী এবং সেই ন্যায়দর্শনের ভিত্তি কী? নিচের উদাহরণটি প্রমাণ করে, সব সময় এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। প্রায়োগিক নীতিমালা অনেক সময় ডগমাটিক হলে চলে না। অবস্থাভেদে নীতিকে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনকে আশ্রয় করে চলতে হয়। অমর্ত্য সেন একটি ছোট্ট উদাহরণের মাধ্যমে এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইতে যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের চেহারা কেমন হওয়া উচিত- তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বইতে পাত্রপাত্রীর নাম তিনি যেভাবে দিয়েছেন, এখানে আমি তা একটু বদলে দিলাম। ধরা যাক, যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের নাম আসগর, করিম ও শ্যামল। এদের মধ্যে একটি বাঁশি কে পাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসগর খুব ভালো বাঁশি বাজায়। এটা শ্যামল ও করিম উভয়েই জানে। যেহেতু এটি রাষ্ট্র থেকে দেওয়া হচ্ছে, তাই বাঁশিটা পাওয়ার অধিকার তারই। আবার করিমের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। সে কখনও এমন সুন্দর বাঁশি দেখেনি। এমন একটি বাঁশি পাওয়ার আকুতি তার মধ্যে আছে। তারও দাবি, তাকেই এটা দেওয়া হোক। আর এদের মধ্যে শ্যামলের দাবি, বাঁশি বানানো তার পিতৃপুরুষের কাজ, সে-ই এই বাঁশি বানিয়েছে। তার থেকেই রাষ্ট্র নিয়েছে, এখন দিতে চাইছে। তাই এটি তারই প্রাপ্য। এখন কার বাঁশি পাওয়া উচিত, সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে তা দেখতে চাইলে একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেক ধরনের উত্তর পাব। যিনি দক্ষতাকে সম্পদ বণ্টন বা পুনর্বণ্টনের মূল ভিত্তি বলে মনে করেন, তিনি আসগরকে বাঁশি দেওয়ার পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যারা হিতবাদী (ইউটিলিটারিয়ান) দর্শনের লোক, যাদের মধ্যে জেরেমি বেন্থাম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উদারনৈতিক বা লিবারেল দর্শনের প্রবক্তারাও পড়েন, তারা বলবেন- করিমকেই এটা দেওয়া সামাজিকভাবে ন্যায়সংগত। আবার মার্ক্সবাদীরা যুক্তি দেবেন, শ্যামলের বানানো জিনিস তাকে না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা শ্যামলেরই প্রাপ্য।
ওপরের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, সামাজিক ন্যায়ের কোনো একক বা সর্বাত্মক সংজ্ঞা নেই, যেটা দিয়ে সব রকমের বণ্টন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি। একেক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের একেক রকমের ন্যায়দর্শনের আশ্রয় নিতে হয়। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একমাত্রিক চিন্তার সুযোগ নেই। সমাজতন্ত্রের ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনের চর্চার ও অবস্থাভেদে তার বিশিষ্ট প্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন :বাঁশিটা আসগর, করিম ও শ্যামল- এই তিনজনার মধ্যে কাকে দেওয়া হবে, এই জটিল ন্যায়সংকটের পাশাপাশি আরও কয়েকটা প্রসঙ্গ অবতারণা করা যায়। বাঁশিটা কে পাবে, এর উত্তর মুলতবি থাকলেও এটা পরিস্কার যে বাঁশিটা অন্তত এমন কাউকে দেওয়া উচিত নয়, যিনি কিনা কেবল বাঁশির ‘মজুতদারী’ করেছেন। ধরা যাক, তার নাম সোহেল। অর্থাৎ তিনি আসগরের মতো দক্ষ বাঁশিবাদকও নন; করিমের মতো একটা বাঁশি হাতে পাওয়ার অভাববোধজনিত তীব্র আকুতিও তার নেই; আবার শ্যামলের মতো বাঁশিটা তিনি উৎপাদনও করেননি। তার শুধু আগ্রহ, বেশি বেশি করে বাঁশি কিনে ‘স্টক’ করে রাখা, আর দাম বেশি পেলে সেটা বিক্রি করে ‘ব্যক্তিগত মুনাফা’ বৃদ্ধি করা। মুনাফা অর্জন ছাড়া বাঁশির সুর-লহরী নিয়ে তার কোনো বাড়তি আগ্রহ নেই। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নীতি খুব পরিস্কার :আসগর, করিম বা শ্যামল যাকেই অবশেষে বাঁশিটি দেওয়া হোক না কেন, অন্তত সোহেলকে ওই বাঁশিটি দেওয়া ন্যায়সংগত হবে না। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়মীমাংসা জটিল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সোহেলের মতো লোকদের কাছে যাতে করে উত্তরোত্তর বাঁশির ঘণীভবন (কনসেন্ট্রেশন) বাড়তে না থাকে- অর্থনীতির পরিভাষায় concentration of economic power, যাতে করে সহনশীল মাত্রার মধ্যে বিরাজ করে- সেদিকে রাষ্ট্র খেয়াল রাখবে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কাছে প্রত্যাশা। ন্যায়দার্শনিক জন রাউলস আরেকটি প্রত্যাশার কথা বলেছেন। ‘টু প্রিন্সিপলস্‌ অব জাস্টিস’ নীতিতে সমাজে কতটা আয়বৈষম্য গ্রহণযোগ্য, তার একটি ফর্মুলা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের (primary goods) দরকার হয়। এই চাহিদাকে যেসব পণ্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে পড়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ‘যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর’ স্বাধীনতা, ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ প্রভৃতি। স্বাধীনতার চাহিদাকেও আমি প্রাইমারি গুডসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছি, কেননা (রাউলসের মতে) স্বাধীনতা ছাড়া শুধু অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতির সংস্থান অনেকখানি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এটা বোঝাতেই তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবন পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।’ যা হোক, রাউলসের ফর্মুলাটি হলো, সমাজের সবচেয়ে অভাবপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের ‘মৌলিক চাহিদা’ সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে (যাকে অন্যত্র তিনি ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপল’ বলেছেন)। এদের ‘মৌলিক চাহিদা’ আগে পূরণের পর সমাজে যেটুকু বৈষম্য থাকবে, তা হয়তো ‘গ্রহণযোগ্য’। সমাজতন্ত্রের ন্যায়দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মনোগ্রাহী হলেও (এ জন্যই এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে) কতগুলো সমস্যা তার পরও থেকেই যায়।
প্রথমত, এই রাউলসীয় ফর্মুলা থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে সমাজ থেকে দারিদ্র্য যদি আগে দূর যায়, তাহলে আপেক্ষিক বৈষম্য নিয়ে দুর্ভাবনার অত দরকার নেই। এটি ন্যায়ের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে, কিন্তু সমাধানটি সবার ভালো না-ও লাগতে পারে। সমাজ থেকে না হয় দারিদ্র্য মুছে গেল, তারপরও মানুষ আপেক্ষিক বৈষম্য সম্পর্কে আলাদাভাবে সংবেদনশীল। উন্নত দেশের মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলোর সিইও যে বেতন পান, সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নিচের স্তরের কর্মচারী (যিনি হয়তো দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো) পান তার চেয়েও ৪০ ভাগ কম পারিশ্রমিক। এতটা বৈষম্য সমাজে কি থাকা উচিত? এ প্রশ্নটা সমাজতন্ত্রীরা করবেন। কতটা বৈষম্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য, এটি শুধু অর্থনীতিবিদরা ঠিক করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, মৌলিক চাহিদা ও তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত যে ‘দারিদ্র্য’, তাকে আরও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে হবে। এসব চাহিদার কিছু কিছু পূরণ হবে ‘প্রাইভেট গুডস’-এর (বা বাজার থেকে অভিরুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিসপত্র বা সেবা কেনার) দ্বারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বাসস্থান এসব প্রয়োজন কি শুধু ‘প্রাইভেট গুডস’-এর বলয়ে থাকবে, নাকি সেগুলো পড়বে ‘পাবলিক গুডস’-এর বলয়ে (অথবা প্রাইভেট-পাবলিক ‘মিশ্র’ খাতে)? কানাডায়-যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য খাতকে মূলত ‘কমন গুডস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড একই পথের অনুসারী। এসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত চিকিৎসাসেবার সুযোগ সীমিত। এর অর্থ দাঁড়ায় যে এসব দেশে অসুখে ভুগলে কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বিপন্ন বোধ করেন না। কেননা, তিনি জানেন যে তার চিকিৎসাসেবার প্রায় সব দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সোভিয়েত পতনের পরও পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্য খাতকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ হিসেবেই দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিষয়টি ‘মৌলিক নীতিমালার’ অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যটি এখন ‘মৌলিক অধিকারের’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবাকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ করা হয়নি। হালআমলের ‘ওবামা কেয়ার’-এর মাধ্যমে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবাকে কোনো কোনো গ্রুপের জন্য (যেমন- ৬৫-ঊর্ধ্ব লোকেদের জন্য) নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে রাষ্ট্রের তরফে, এটা ঠিক। কিন্তু অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবাই অধিকাংশ মানুষের জন্য এখনও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এ দেশে আমেরিকার পথে (যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মূলত ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপরে নির্ভরশীল) এগোব, নাকি যুক্তরাজ্য-রাশিয়ার পথে এগোব (যেখানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র সাধারণভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার)? এই বিতর্কটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা তুলবেন।

তৃতীয়ত, কোন পণ্য, সেবা বা প্রয়োজন কতটা পরিমাণে ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকবে, তা যুগের হাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর অর্থ, আগে থেকেই ঠিক করা যাবে না যে ক, খ, গ, ঘ খাতগুলো শুধু ব্যক্তি খাতে থাকবে; আর য, র, ল, ব খাতগুলো শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকবে। সমাজতন্ত্র মানে ১০০% রাষ্ট্রায়ত্ত খাত- এ ধরনের ধারণার বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর কালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহদায়তন শিল্প খাতে কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকলেও ক্ষুদ্র-মাঝারি খাতগুলো তখন ব্যক্তি খাতে ছিল। ক্রমে ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ইনভেস্টমেন্ট সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত শতকের আশি-নব্বই দশকে আলোচনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সে সময়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যে প্রায় সব খাতের অর্থনৈতিক ইউনিটকেই কেবল ব্যক্তি খাতের জন্য সংরক্ষিত করা হতে থাকে। এতে করে বাধাবন্ধনহীন ব্যক্তিগত মুনাফাচালিত ও সংকীর্ণ স্বার্থের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। মুখে ব্যক্তি খাত বলা হলেও প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত করপোরেট ক্যাপিটালিজমের দিকেই ধাবিত হয়। ব্যাংক-বীমা খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিরাষ্ট্রীয়করণ ও অবাধ ঋণপ্রবাহের মাধ্যমে রাতারাতি এক বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে আশি-নব্বইয়ের দশকে এবং পরেও তা অব্যাহত থাকে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এই বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্বত্র সুফলদায়ী হয়নি। অনাদায়ী ও মন্দ ঋণের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেড়েছে তা-ই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ‘নিচে থেকে’ গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতেও ব্যর্থ হয় অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। এককথায়, আমরা সে সময়ে অতিমাত্রায় বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র- যেটি একটি জনকল্যাণধর্মী মিশ্র খাতের সমর্থক- এই বল্কগ্দাহীন মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের বিকাশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে।

চতুর্থত, বৈষম্য শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য আয়বহির্ভূত সূচকেও একে বিচার করতে হবে। রাউলস যখন দরিদ্রতমদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলেছিলেন, তিনি গরিব ও ধনীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষা একটি পাবলিক বা কমন গুড। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে প্রায় সবার জন্য সমান মানসম্পন্ন। উন্নত দেশে এসব স্তরে কোনো বৈষম্য করা হয় না। পাবলিক এডুকেশন (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সবার জন্য সমান গুণসম্পন্ন এবং অবৈতনিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এবং রাশিয়ায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণও অনেক ক্ষেত্রে অবৈতনিক- শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে সংগতি রেখে সেখানে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার’ কথা বললেও এখন পর্যন্ত একটি ‘কমন স্কুল সিস্টেম’ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যার মাধ্যমে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা গা ঘষাঘষি করে এক শ্রেণিতে পড়ালেখা করতে পারবে। এখন মাদ্রাসায় যায় মূলত অতিদরিদ্রদের ছেলেমেয়েরা; বাংলা মিডিয়াম স্কুলে যায় গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা; আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যায় উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম আরও সূক্ষ্ণ প্রভেদ করা সম্ভব। এর ফলে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন আয়ের মানুষের মধ্যে গভীর শ্রেণিবিভাজন ঘটে যায়। কমন স্কুল না থাকার জন্য সামাজিক (ঊর্ধ্বমুখী) সচলতা কমে যায়। নিচের আয়ের মানুষ ওপরের আয়ের স্তরে প্রবেশ লাভ করতে ব্যর্থ হয় প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তরের মধ্যে পাঠদানের গুণে-মানে বৈষম্যের কারণে। সংগত কারণেই এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আলোচনার একটি মুখ্য বিষয়বস্তু।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


অর্ধ-সত্যের ভিত্তিতে ডিজইনফরমেশন ক্যামপেইন চালানোর পটভূমি গড়ে দিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধ। ‘ঠান্ডা’ হলেও যুদ্ধের রক্তারক্তিতে সেটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়ে কম যায় না। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ওয়াশিংটন পোস্ট তড়িঘড়ি করে লিখল যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আবার সবকিছু পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে: ‘ইসলামাবাদ, পিকিং এবং ওয়াশিংটন তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করবে বলে মনে হয়।’
এই সূত্রে প্রবন্ধের লেখক লুই সিমনস্‌ মৃত্যুর কারণও নির্দিষ্ট করলেন:
‘যদিও এ অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ হিসেবে শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী শাসন, তার অযোগ্যতা এবং দুর্নীতিপরায়ণতার কথা তুলে ধরা হয়েছে, তবু প্রথম থেকেই দিল্লি-মস্কোর সঙ্গে বেশি মাখামাখির জন্য জনগণ মুজিবকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল। অতীতে যেমন দুঃখ-দুর্দশার জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যেই অর্থনৈতিক শোষণ চালু করার জন্য ভারত সরকার ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে উদ্ভূত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে ঘাত-প্রতিঘাতের জন্ম দিয়েছে, তারই ফল হচ্ছে শেখ মুজিবের পতন ও মৃত্যু।’
লুই সিমনস্‌ আরও বললেন, ‘হঠাৎ এই গতি পরিবর্তন শুধু মিসেস গান্ধীকে নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বিচলিত করতে বাধ্য। এতদিন তারা চীনকে আগলে রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এসেছিলেন।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে বৃহৎ পরাশক্তির দ্বন্দ্ব, ভারত, চীন, পাকিস্তান ইত্যাকার শক্তির ভারসাম্যের সমীকরণ জড়িত এমনটাই ইঙ্গিত করা হলো।
এটা এখন অনেকটাই স্পেকুলেশনের বিষয় যে মুজিব-হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিক্সন প্রশাসন-সিআইএ জড়িত ছিল, কী ছিল না। মিজানুর রহমান খানের গবেষণাধর্মী বইটিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। লরেন্স লিফসুলজ্‌ তার ‘বাংলাদেশ :দ্য আনফিনিশড রিভোলিউশন’ বইতে স্পষ্ট ইংগিত করেছিলেন যে সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার আয়োজন সম্পর্কে পূর্বাপর অবগত ছিল। খোন্দকার মোশতাক আমেরিকান লবির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন বহুকাল থেকেই (অন্তত ১৯৭১ সাল থেকে তো বটেই)-একথা এখন প্রমাণিত।  Rogue States এবং Killing Hope-র লেখক উইলিয়াম ব্লুমকে আমি চিঠি লিখেছিলাম মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকা প্রসঙ্গে তিনি কিছু জানেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, মুজিব-হত্যা তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল না। তিনি তার বইয়ে মূলত লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার ওপরেই মনোনিবেশ করেছেন। পক্ষান্তরে, আমার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তিগত আলাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞরা সিআইএ-র জড়িত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেননি। ঢাকায় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে অভ্যুত্থানের বিষয়টি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ন্যাপ-সিপিবির পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে অরক্ষিত থাকার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। কমরেড মণি সিংহ নিজে এ বিষয়ে বলেছিলেন, মোজাফফর আহমদও বলেছিলেন বাড়তি নিরাপত্তা গ্রহণের বিষয়ে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিংগার গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্‌স স্পষ্টত অবস্থান নিয়েছিলেন মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকার পক্ষে। সেখানে হিচেনস সরাসরিভাবে অভিযোগটি তুলেছেন: ‘Kissinger was responsible for the killing of thousands of people, including Sheikh Mujibur Rahman’। একদিন নিশ্চয়ই এর পক্ষে বা বিপক্ষে অকাট্য প্রমাণ মিলবে। কোনো গোপন উইকিলিকসে ফাঁস হয়ে পড়বে মার্কিন প্রশাসনের আর্কাইভে লুকিয়ে থাকা, এখনও অপ্রকাশিত, কোনো দলিল-পত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের দেশি-বিদেশি চক্রান্তের খুঁটিনাটি।
তবে মুজিব-হত্যার পরপরই যেভাবে ইং-মার্কিন মূলধারার পত্র-পত্রিকাগুলো সমস্বরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ক্যারেকটার-এসাসিনেশনে লেগে গিয়েছিল তা আজ কিছু অবাক করে বৈকি। তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুধু ‘ডিক্টেটর’ বলে আক্রমণ করা নয়, তার পরিবারের সদস্যদের কারও কারও প্রতি কল্পিত অভিযোগ ছড়াতেও তারা সেদিন দ্বিধা করেনি। গুজবের প্রকাশ ও প্রচার করা সাধারণত সৎ সাংবাদিকতার নিয়ম-রীতিবিরুদ্ধ। প্রায় অসভ্যতার পর্যায়ে এটি পড়ে। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্‌ পত্রিকায় কেভিন রেপার্টি মুজিব সম্পর্কে কল্পিত অভিযোগ এনে লিখেছেন :’নিজের পরিবারের লোকজনের আর্থিক স্বার্থ আদায়ের প্রতি তার নজর ছিল। তিনি নিজে ঘুষ নিয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তা নেওয়ার তো তার প্রয়োজন ছিল না।…তবে অনেকেই তার ছেলেদের এবং অন্য আত্মীয়দের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।…গল্পটি সত্য না বানানো তা বিচার করতে যাওয়া অবান্তর, কারণ বহু লোক এ গল্পের সত্যতায় বিশ্বাস করে এবং এ গল্প বহু লোকের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে।’ এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের সৎ-সাংবাদিকতার নমুনা! দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করে- কখনও শেখ মনি, কখনও গাজী গোলাম মোস্তফাকে ঘিরে গাল-গল্প বানিয়ে এবং গুজব ছড়িয়ে। এর জন্য ঢাকার তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে মুজিববিদ্বেষী মনোবৃত্তিও কম দায়ী নয়। মুজিব খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না; মুজিব বুদ্ধিজীবীদের অপছন্দ করেন; মুজিব সবসময় ইনসিকিওরিটিতে ভুগতে থাকেন; মুজিব তার অহমিকাবোধে আবদ্ধ; এসব কথা পাশ্চাত্যের অনেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনর্গল লিখতে দ্বিধা করেননি। এভাবে ‘ফেইক নিউজ’ তারা তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে শুধু ‘হক-কথা’কে দায়ী করলে ভুল করা হবে। আজ তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ ‘আমার দেখা নয়াচীন’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে সেদিনের জটিল-কুটিল সমালোচক স্বভাবের ঢাকার মধ্যবিত্তদের অনেকেরই কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটছে হয়তো। তারা এখন ভাবছেন যে শেখ মুজিবকে ‘যতটা অশিক্ষিত’ বলে মনে করে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম, ততটা অশিক্ষিত তিনি নন আসলে। চিন্তাবিদ না হলেও সবকিছু নিয়েই চিন্তা করতে পারেন দেখছি! ঢাকার মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে এই অসাধুতা গত ৫০ বছর ধরে দেখে আসছি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মুজিব নাকি ইংরেজি বলতে ভুল করেছিলেন, সে নিয়ে কী হাস্য-তামাশা সেদিন মধ্যবিত্তদের ড্রইং রুমে। আজ তারাই বলছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে আমাদের তাকে বুঝতে। হি ওয়াজ আ গ্রেট, গ্রেট ম্যান।’ এই শঠতা আমাদের পীড়া দেয়। এই মধ্যবিত্তের সঙ্গে শঠতার দৌড়ে সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটেছেন সেদিনের বিদেশি সাংবাদিকেরা। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করাই ভুল হয়েছিল এমন মন্তব্য ছিল তাদের। ১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি সংখ্যায় বোস্টন হেরাল্ড মন্তব্য করেছে:
”আরও পরিহাস এই যে, যে পাকিস্তানের উৎপীড়ন থেকে তিনি তার দেশবাসীকে মুক্ত করেছিলেন, সেই পাকিস্তান আজ অধিকতর মুক্ত এবং সমৃদ্ধ। গত সোমবার ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌’ প্রকাশ করেছে যে, তিন বছর আগে পরাজয় ও অবমাননা ভোগ সত্ত্বেও পাকিস্তান আজ অপ্রত্যাশিতভাবে এশিয়া মহাদেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সজীব দেশ হিসাবে দেখা দিয়েছে। যদিও এখনও গরিব দেশ, কিন্তু পাকিস্তানে অনাহারে লোক মরছে না। তাদের জীবনযাত্রার মান বেড়ে চলেছে এবং ‘দি টাইমস্‌’ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের সরকার ধ্বংসাবশেষ কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।…পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আদর্শবাদীরা যখন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য চিৎকার করছিল, তখন আমেরিকার উচিত ছিল, পাকিস্তানকে আরও সবল সমর্থন দেওয়া।’

অবশ্য ভুট্টোর পাকিস্তানের এই প্রশংসা অচিরেই মুছে যাবে পাশ্চাত্যের সাংবাদিকবলয় থেকে। আফগানিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াইয়ে বিশ্বস্ত সাথি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন জেনারেল জিয়াউল হক। এবং ভুট্টোকে ‘হঠকারী পপুলিস্ট’ বলে ছুড়ে দেওয়া হবে অস্বীকারের খাতায়।

১৫. বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত প্রকল্প ও আজকের বাংলাদেশ
বাকশালের মাধ্যমে সমতামুখিন সমাজের স্বপ্টম্ন বাস্তবায়নের নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা বাকশালের কর্মসূচিতে ধারণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি বড় স্তম্ভ ছিল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ। সেটি বাকশালের কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে সেভাবে আলোচনায় আসেনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ফলে বাহাত্তরের সংবিধান ও বাকশাল কর্মসূচিতে বিধৃত সমতামুখিন সমাজের সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া হয়। শুধু ভুলে যাওয়াই নয়, অর্থনীতি-রাজনীতি চলতে থাকে এক নিষ্ঠুর অমানবিক সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সে সময়ে যারা ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর গঠন বা তার কার্যাবলির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকতেন, তাদের প্রত্যেকেই নানা ধরনের দৈহিক-মানসিক-বৈষয়িক হয়রানির শিকার হতেন। আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে নিছক বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে ১৫ আগস্টের শোকসভায় উপস্থিত থাকাকে বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্ণধাররা ভালো চোখে দেখতেন না। তা সে বিলেতেই হোক, আর তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেই হোক। মৃত বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হচ্ছে, তাকে প্রতীক রেখে তরুণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হচ্ছে এক জায়গায়, তাকে মনে রেখে তারা সমতামুখিন সমাজের কথা বলছে, এটা জিয়া-এরশাদের সামরিক সরকার আর তাদের অধীন দূতাবাসগুলোর পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হতো। যারা সেদিন সেসব গোপন বা প্রকাশ্য সভায় জড়ো হতেন ওয়াশিংটনে, লন্ডনে, মস্কোয় কিংবা ঢাকায়; তারা ঝুঁকি নিয়েই অংশ নিতেন সেখানে। তাদের নামের তালিকা চলে যেত গোয়েন্দা দপ্তরে। জীবিত মুজিবের তুলনায় মৃত মুজিবের প্রভাব প্রতিবছরেই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর নাম ক্রমশ অর্থনৈতিক সমতা, সামাজিক ন্যায় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমার্থক ধারণায় পরিণত হচ্ছিল সচেতন অথবা অসচেতনভাবে। এই যোগাযোগ সময়ের সঙ্গে আরও দৃঢ় গণভিত্তি পেয়েছে। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং সমতামুখিন আকাঙ্ক্ষার আলোচনা তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’? এ প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে।
সমকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে গতিধারা বিশ্নেষণের কাজটি বর্তমান লেখার আওতার বাইরে। কিন্তু কিছু প্রাথমিক মন্তব্য করা যায়। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটি নিয়ে সর্বস্তরে (পাঠ্যবইসহ বলছি) যতটা আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল, ততটা এ দেশে এখনও হয়নি। ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের’ বর্তমান কালের চ্যালেঞ্জ আলোচনা করার জন্য নূ্যনতম শর্ত হলোু সমাজতন্ত্রকে আগে ‘কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির অংশ হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে ঠিকই (২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে), কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে করা হয়নি। গণতন্ত্র ও মার্কেট-ইকোনমি রেখে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প হতে পারে, তা নিয়ে গভীর আলোচনার দরকার রয়েছে। স্বাধীনতা, উৎপাদন-নৈপুণ্য এবং বণ্টনগত সাম্যু এই ত্রিবিধ লক্ষ্যের মধ্যে সমীকরণ কষতে হবে এবং উন্নয়নের নানামাত্রিক ঝোঁকের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। সামাজিক ন্যায়-দর্শনের একটি উদাহরণ দিয়ে সমস্যাটি চিহ্নিত করা যায়।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


কর্নেল হামিদ এ রকম একটি নির্মম ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ১৯৭৭ সালের বগুড়া সেনানিবাসের বিদ্রোহকে উপলক্ষ করে। আমি সেটি তুলে ধরছি-
”এবার শুরু হলো জিয়ার শুদ্ধি অভিযান। বিদ্রোহী বিমান ও সৈনিকদের পাকড়াও করে তাদের নির্মমভাবে ঢালাও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলো। সংক্ষিপ্ত বিচারের সুবিধার্থে মার্শাল ল’ আইন করে বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হলো। এই সময় জেনারেল এরশাদ ছিলেন ডেপুটি চিফ। তারই তত্ত্বাবধানে এসব সংক্ষিপ্ত ট্রায়াল সুষ্ঠুভাবে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। শুরু হলো ত্বরিতগতিতে বিচারের নামে প্রহসনের পালা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক শত সৈনিক ও বিমান সেনাদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। সেনা বা বিমানবাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠিত আইনকানুন এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। পাঁচটি কারাগারে একসঙ্গে ৮-১০ জন করে পর্যায়ক্রমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাতাড়ি ফায়ারিংয়ে মারা যায় শত শত। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বহুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ঢালাওভাবে গ্রেপ্তারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে। ৩ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি রাতে সেনা ও বিমানবাহিনী ব্যারাক থেকে সৈনিকদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নির্যাতন ক্যাম্পে, তারা আর ফিরে আসেনি। ক্যান্টনমেন্টজুড়ে হাহাকার। কান্নার রোল। কত সৈনিক, বিমান সেনা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলল, কতজন প্রাণ হারাল, ‘গুপ্তহত্যার’ শিকার হলো, এর কোনো হিসাব নেই। বিমানবাহিনীর কার্যক্রম ক্ষমতা নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। সরকারি হিসাব মতেই শুধু দুই মাসে ফাঁসিতে লটকানো হয় ১১৪৩ জন সৈন্যকে, যার মধ্যে বিমান সেনাই ছিল ৫৫১ জন। হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া হয়নি। তারা আজও খুঁজে ফিরে তাদের প্রিয়জনকে। কোথায় যে এত লাশ গুম করা হলো, তাও এক রহস্য। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাকি অভ্যুত্থান, তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। অনেকেরই ধারণা, এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক নিধনযজ্ঞ। মধ্যরাতে সিগন্যাল লাইন্স ও কুর্মিটোলা এয়ারফোর্স ব্যারাকে কে বা কারা স্লোগান দিয়ে আহক্ষান জানিয়ে শুরু করে বিদ্রোহ, তা আজও রহস্য।
পাক-ভারতের ইতিহাসে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানে এত লোকের ফাঁসি, হত্যা, প্রাণহানি, জেল আর কখনও ঘটেনি। কী আশ্চর্য! এতবড় মর্মান্তিক ঘটনার কখনও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। কেউ দাবিও করেনি। কী বিচিত্র এই দেশ!”

আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ও তার বাকশালের শত্রুদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। অতিদক্ষিণপন্থি স্বাধীনতাবিরোধী, অতিবামপন্থি নকশাল ধারার, জাসদ-গণবাহিনী, জাতীয়করণের ফলে ক্ষিপ্ত ধনিকগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত মধ্যবিত্ত, পাকিস্তানপন্থি, চীনপন্থি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী-বিশাল একটি স্পেকট্রাম বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে সবার আগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ, যারা কোনোমতেই বাংলাদেশের সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারে নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইসলামিক রিপাবলিকের বদলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ঘোষণা। এর গুরুত্ব শুধু দক্ষিণপন্থি পত্রিকা ইত্তেহাদ থেকেই উচ্চারিত হয়নি, এর সঙ্গে কোরাস মিলিয়েছিল বিলেত-আমেরিকার মেইনস্ট্রিম পত্রিকারাও। কর্নেল ফারুকের বয়ান দিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্টে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ইসলামবিরোধী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল :’সবশেষে মুজিব তাহার ঈমান অর্থাৎ পবিত্র ইসলামের সাথে বেঈমানী করেন।’ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিয়্যুর ২৯ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় যা লেখা হয়েছে তার মানে দাঁড়ায় যে মুজিবের ‘সাম্প্রদায়িক’ কর্মকাণ্ডের জন্যই পাকিস্তান ভেঙে যায়। উদ্ধৃতিটির কুযুক্তিটি একটু শোনা যাক আবার :’পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের জন্য সূক্ষ্ণ পদক্ষেপ নিতে শেখ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন… তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, পাকিস্তানের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী ছিল। দেশের ভাঙনকে ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ব্যর্থ হয়েছেন এমন কোনো সদিচ্ছা দেখাতে, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের আকস্মিক অভিযান নিবৃত্ত করতে পারত। এরপর যে ট্র্যাজেডি শুরু হলো তার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও ভুট্টো নিঃসন্দেহে দায়ী। তাহলেও বলতে হবে যে, শেখের বাগ্মিতার ফলেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও রক্তপাত শুরু হয় এবং তাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের একান্ত অনুগতরা নৃশংস অভিযান আরম্ভ করার অজুহাত পায়।’ দক্ষিণপন্থি সমালোচনার আরেকটি ধারা সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের অংশ করাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাঁড় করায়। ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এর সানডে টাইমস পত্রিকায় এন্থনি মাসকারেনহাস এরকম যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন :
‘মুজিবের পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশ শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবমাননা অনিশ্চয়তাসূচক প্রমাণিত হয়েছে।…এই পটভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক আহমেদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারাতি জনসমর্থন লাভ করেছেন।’
বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় একই অভিমত তুলে ধরেছিল। মার্টিন ওয়ালকট সেখানে লিখেছেন :”তাছাড়া আদর্শগত প্রশ্নও ছিল। মুজিব নতুন জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক মস্কোপন্থি রাজনীতিবিদকে স্থান দিয়েছিলেন, ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে প্রাচীনপন্থি মুসলমানগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, নতুন শাসকরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করেছেন।” বস্তুত, দলিল-পত্র ঘাটলে দেখা যায় যে দেশের ভেতরে ও বাইরের চরম দক্ষিণপন্থি ও চরম বামপন্থি শক্তি অবশেষে কৌশলগত একবিন্দুতে মিলিত হয়েছিল-সেটা হলো তীব্র ভারত ও রাশিয়ার বিরোধিতা। তাদের যুক্তি ছিল :বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্টে নিহত হয়েছেন তার কারণ তিনি নিজেই; তার সরকার এবং তার প্রস্তাবিত বাকশাল ব্যবস্থা ছিল ঘোরতরভাবে রুশ-ভারতপন্থি। এই ‘ডিসইনফরমেশন ওয়ার’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এনায়েতুল্লাহ খান ‘শেখ মুজিবের উত্থান পতন’ প্রবন্ধে তার ভাষায় বাংলাদেশের ‘মধ্যবিত্ত মানসের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেছেন নিল্ফেম্নাক্ত ভাবধারায়:
”বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের দুঃখী জনগণ এই অবাক প্রদর্শনীর মৌন দর্শক ছিলেন। তাদের নিঃশব্দ আর্তিতে ধ্বনিত হচ্ছিল কতিপয় লুটেরার অট্টরোল। আর তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র-যারা সমাজতন্ত্রের ছলে, মৈত্রীর ছদ্মবেশে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের আবডালে বাংলাদেশকে বৈদেশিক স্বার্থের অবারিত লীলাক্ষেত্রে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বাঙালি বুর্জোয়ার নিকৃষ্টতম মেরুদণ্ডবিহীন মুৎসুদ্দীকুল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি ধ্বংসকল্পে পরদেশী বাণিজ্যিক পুঁজির সেবা-দানের ভূমিকায় নিয়োজিত ছিল। এরই সাংগঠনিক রূপ ছিল ‘দেশপ্রেমিক'(?)দের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। এই ঐক্যজোটের নীলনকশা পরিশেষে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে রূপায়িত হয়। ফলতঃ বাংলাদেশ একদিকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাববলয়ে আবর্তিত হয় এবং অন্যদিকে পূর্ব ভারতের ধ্বংসোন্মুখ শিল্পকেন্দ্রের প্রায় ঔপনিবেশিক পশ্চাদভূমিতে পরিণত হয়। দেশের উৎপাদিকা শক্তিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করবার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীতে বিরল। অষ্টাদশ শতকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের লুটেরা বাণিজ্যিক পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সাদৃশ্য লক্ষণীয়।”
বাংলাদেশ সম্পর্কে এনায়েতুল্লাহ খানের উপসংহার ছিল যে এটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে যুগপৎ ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের’ (অর্থাৎ রুশ প্রভাববলয়ের) এবং ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদের’ ফাঁদে। মার্কিনপন্থি লিবারেল ও চীনপন্থি অতিবাম মহলে সে সময়ে এটি চালু থিসিস ছিল। এই মূল্যায়ন সমর্থন করেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত চীনঘেঁষা বামপন্থি পত্রিকা ফ্রনটিয়ার। এর ১৯৭৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় দেখতে পাই অনুরূপ প্রচারণা :’…ভারতীয় হস্তক্ষেপের ফলে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসীন হলো তাদের মতো স্বার্থপর নেতৃত্ব কোনো দেশে সত্যিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পর আর দেখা যায়নি। দেশটি যে অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য-সহায়তা বাংলাদেশের কোনো কাজে আসেনি। আরামদায়ক বন্দিদশা থেকে শেখ মুজিব প্রত্যাবর্তনের পর দেশের অবস্থা মন্দ থেকে মন্দতর হয়েছে।’ ফ্রন্টিয়ার যে এরকম অভিমত রাখবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সমর সেন সম্পাদিত পত্রিকাটির মতাদর্শ ছিল তখনকার মাওবাদ তথা নকশালবাড়ির পথ। এজন্যেই ১৯৭৫ সালের বাকশাল প্রবর্তনকে তারা মনে করেছেন প্রকৃত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ বলে :’ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনীতি স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। এর প্রধান দিক হচ্ছে বাংলাদেশের বামপন্থি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম।’ অতিডানপন্থি ইত্তেহাদ গ্রুপ, এনায়েতুল্লাহ খানের লিবারেল সুরের হলিডে, আর অতিবামপন্থি ফ্রন্টিয়ার একই সুরে তখন কথা বলেছে। তিন ধারাই তখন মিলে যাচ্ছিল মুজিব-সরকার উৎখাতের যৌথ প্রযোজনায়। ১৯৭৪-৭৫ সালে পাশ্চাত্য থেকে প্রকাশিত মূলধারার পত্র-পত্রিকা ঘাঁটলে আজকের যুগে যেটা ‘হাইব্রিড ওয়ার’ বলে অভিহিত হচ্ছে (যেখানে প্রথাগত যুদ্ধের সঙ্গে অপপ্রচার ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ জড়িত থাকে) তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো পাওয়া যায়। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানোর জন্য পূর্ণ সত্য বা পূর্ণ মিথ্যা কোনোটিই বলার দরকার নেই। এর জন্য ‘অর্ধ-সত্য’ বলাই যথেষ্ট-তাতে করে সত্য বলার ভানও করা যায়, আবার ডিসইনফরমেশন ক্যামপেইনও দিব্যি চালানো যায়। এনায়েতুল্লাহ খান-ফ্রন্টিয়ার বলছিলেন যে মুজিব বামপন্থি বিপ্লবীদের ধ্বংস করতে চাচ্ছেন। এবার আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণ বলতে গিয়ে গার্ডিয়ান (১৬ আগস্ট ১৯৭৫) লিখল যে, বঙ্গবন্ধুকে আসলে হত্যা করা হয়েছে তার বামপন্থি বিপ্লবী আদর্শের কারণেই। উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে। প্রগতির পথে চলার একপর্যায়ে তিনি শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনীকে চটিয়ে দিয়েছিলেন-সেটাই তার নিহত হওয়ার কারণ। ‘মুজিব নিজেই দায়ী’-অন্য কাউকে এর জন্য দায়ী করা চলে না : ‘কিন্তু নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং দেশে কিছুটা প্রগতি আনার জন্য তার শেষ পদক্ষেপেই তার পতন ডেকে এনেছে। বামপন্থি আদর্শে তিনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনী তার প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল। অথচ তাদের সমর্থনেই তিনি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ অবস্থায় মুজিব নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুঁজছিলেন। তাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্য মস্কোপন্থি দলগুলোও উৎসাহ জুগিয়েছিল।’
যুক্তি হিসেবে বলা হলো যে, গ্রামে বহুমুখী সমবায় করার সমাজতান্ত্রিক নীতিই মুজিবের সর্বনাশ ডেকে এনেছে:
‘মে মাসে মুজিব ঘোষণা করলেন যে, গ্রামে গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে কৃষি সমবায় গঠন করা হবে, গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনিক পরিবর্তন করা হবে এবং জাতীয় দল গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। সংক্ষিপ্ত হলেও এ কর্মসূচি আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী, পেশাদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেককেই আতঙ্কিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বামপন্থি হয়ে ওঠাই শেষ পর্যন্ত তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


‘ব্রেকফাস্ট উইথ ইভিল’ বইতে আশিস নন্দী যে ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটির’ কথা বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক ভায়োলেন্স একপর্যায়ে সামাজিক ভায়োলেন্সের স্লুইসগেট খুলে দেয়। ‘প্রাগ-আধুনিক’ যুগে সহিংসতা প্রকাশ পেত লাঠিসোটা, রড-হকিস্টিক, ছুরি-কিরিচ এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কচিৎ-কদাচিৎ ব্যবহূত হতো বন্দুক-পিস্তল ধরনের মারণাস্ত্র। সাদত হাসান মান্টো তার অনুগল্পগুলোয় পার্টিশন-রায়টের যে রক্তশীতল করে দেওয়া বিবরণী রেখে গেছেন তাতে লাঠিসোটা ছুরি-কৃপাণের ব্যবহারই ছিল চোখে পড়ার মতো। ষাটের দশকের শেষে নকশাবাড়ী আন্দোলনে ‘জোতদার খতমের’ কাজে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার জন্য। চারু মজুমদারপন্থিরা শ্রেণিশত্রুর গলা কাটার জন্য গ্রাম-এলাকায় ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার পাতায় এমনটাই পরে শুনেছি। অবশ্য পরে শহর এলাকার ছাত্র-যুবকরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে পাইপগান ও হাতে বানানো বোমার প্রচলন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। এই ‘টেকনিক’ আমাদের দেশেও অতি-বামপন্থিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২-৭৫ সালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে এসব ‘প্রাগ-আধুনিক’ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ব্যবহূত কিছু ‘আধুনিক’ সমরাস্ত্র যেমন এসএলআর রাইফেল ও স্টেনগান এসবেরও আংশিক প্রয়োগ হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দূর থেকে নয়, একেবারে গলাকাটা দূরত্বে এসে শ্রেণিশত্রু খতমের ধারাই ছিল সহিংসতার মূল কালচার। পরবর্তী সময়ে অতি-বাম সহিংসতার সংস্কৃতি অতি-ডানপন্থিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার সময় ‘রগ কাটা’ পদ্ধতির প্রচলন হয়। পায়ের রগ কেটে প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার পদ্ধতিকে দাবি করা হয় একই সঙ্গে আতঙ্ক লাগানো এবং এফেক্টিভ পদ্ধতি হিসেবে। টেকনিক একবার উদ্ভাবিত হলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং যে কোনো আইডিওলজি প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হলে ব্যবহূত হতে পারে।
তবে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণ-আকারে সহিংসতার প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়ে। বস্তি এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এর আগে শহরের বুকে কখনও ট্যাঙ্ক চলেনি। শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক’ ও সাঁজোয়া বাহিনী, আর গর্জে ওঠা ‘রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান’ সেদিন ‘খই ফুটিয়েছিল’ যত্রতত্র। শহরের বুকে ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান গুলি ছুড়ছে- এ দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘আধুনিক’ যুগে আমরা প্রবেশ করি। দ্বিতীয়বারের মতো এই আধুনিক সহিংসতার মুখোমুখি হই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে আবারও নামে ট্যাঙ্কের বহর (যদিও তখন জানা ছিল না যে সেগুলো গোলাবিহীন)। নামে মেশিনগান এবং ভারী মারণাস্ত্র সুসজ্জিত ঘাতক বাহিনী। প্রধান লক্ষ্য তাদের ৩২ নং সড়কের বাড়ি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে সামরিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে প্রাসাদকে লক্ষ্য করে। প্রাসাদের ভেতরে আত্মরক্ষার জন্য হাতে স্টেনগান নিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে, এবং যুদ্ধ করতে করতেই মারা গেছেন তিনি- এ কথা আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শুনেছি। সিআইএ এই অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল তা-ও জেনেছি। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এ রকম আকছার ঘটে থাকে, এমনটাই ভেবেছি। শুধু আয়েন্দের মতো নির্বাচিত সিভিলিয়ান শাসকের বিরুদ্ধে নয়, অনির্বাচিত সামরিক শাসকের বিরুদ্ধেও মিলিটারি ক্যু ঘটে থাকে। গত শতকের ৫০-৬০-৭০-৮০-র দশকের লাতিন রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্যু ঘটবে, এটা অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। ঠান্ডা যুদ্ধের বাহানায় তখন পিরিয়ডিক সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘নিউ নরমাল’ হিসেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশেও এটা কী করে ঘটতে পারে?

প্রশ্নটা বোকার মতো করলাম, নাকি এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে- সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি উদাহরণ দিই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘প্রাগ-আধুনিক’ সহিংসতার যুগে কেমন ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের একটি স্মৃতিচারণায়। ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা’ একটি অনুষ্ঠানে (বিআইডিএস আয়োজিত) তিনি বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে তার বিপদে পড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতেন। মাসে কাদের কত সাহায্য দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, তার হিসাব রাখার জন্য একটি লগবুক রাখতেন তোফায়েল আহমেদ (সে সময়ে তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব)। একদিন বঙ্গবন্ধু খাতাটি দেখতে চান। সেখানে লেখা ছিল মওলানা ভাসানী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের নাম। কারও নামের পাশে মাসিক ৫০০ টাকা, কারও নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা। শাহ আজিজ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন (পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হন)। ১৯৭২-৭৫ পর্বে ভাসানী তার প্রকাশিত ‘হক-কথা’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুজিব সরকারের সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন। দেশে উগ্র ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব প্রচারে ‘হক-কথার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাহ আজিজ, ফজলুর কাদের চৌধুরী, সবুর খান সে সময়ে জেলে ছিলেন দালাল-আইনে। মোদ্দা কথা, এখনকার রাজনৈতিক কালচার অনুযায়ী এসব বিতর্কিত ও অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে নিন্দিত অনেক ‘বিরোধী’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদার সাহায্যের তালিকায়। ৫০ বা ৬০-র দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা সরকারি দল-বিরোধী দল নির্বিশেষে- এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। একই আবহাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিব। এখন তিনি রাষ্ট্রনায়ক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক আচার-সহবত বা বৃহত্তর অর্থে নৈতিকতাবোধ তিনি ভুলে যেতে পারেন না। তোফায়েল আহমেদকে একপ্রকার তিরস্কারই করলেন লগবুকে লেখা নামগুলো দেখে। ‘এভাবে কেন এদের নামের পাশে টাকার অঙ্ক লিখে রেখেছ? পুরো নাম লিখবে না। মওলানা ভাসানী না লিখে, লিখবে এম. বি; শাহ আজিজ না লিখে লিখবে এস.এ’- সাংকেতিকভাবে নামের ও সাহায্যের রেকর্ড রাখতে বললেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈতিকতার এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। সিরাজুল আলম খান ও আ স ম রবের জাসদ তার সরকারের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছিল ১৯৭২-৭৫ পর্বে। কিন্তু এর পরও সস্নেহে তিনি তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশকে নিশ্চিহ্ন করতে চাননি। সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব বা শাজাহান সিরাজকে কারাবন্দি করা হয়নি। হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা প্রকাশ্যে যেখানেই বিচরণ করতেন, সে খবর বঙ্গবন্ধু রাখতেন কিন্তু তাদের কারাবন্দি করার প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু যারা চরম বামপন্থি বা চরম ডানপন্থি দলের বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাধ্য হয়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নয়, সে আমলের বা প্রাগ-আধুনিক পলিটিক্সের যুগে প্রায় সব জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যেই ছিল। তারা অনেকটা এপিক মহাকাব্যের রথী-মহারথীদের মতো। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ, কিন্তু যুদ্ধের পরে (অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেলে) পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ-সখ্যের সম্পর্ক থাকত। ‘মহাভারত’-এর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে কুরু-পাণ্ডবরা পরস্পরের সঙ্গে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর যুদ্ধ করেছেন। সূর্যাস্তের পরে পরস্পরের শিবিরে গিয়েছেন মৃতদের প্রতি শোক-সমবেদনা জানাতে। এই নৈতিকতা বঙ্গবন্ধু ও তার যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এবং যাদের মধ্যে সেটা দেখা যেত না, তারা রাজনৈতিক মহলে দল-নির্বিশেষে নিন্দিত হতেন।

কিন্তু এসবই প্রাগ-আধুনিক রাজনৈতিক যুগের কথা। ৭৫-এর আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তাদের প্ররোচিত বা প্রেরিত ঘাতক বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের নৈতিকতাবোধের কোনো লেশমাত্র ছিল না। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যান্ত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর গণহত্যায় কুশলী ঘাতক দলের কাছে প্রতিপক্ষ মানে শত্রুপক্ষ, আর শত্রু মানেই নিধনযোগ্য ছলে-বলে-কৌশলে। আমাদের দেশে ঘাতকরা ‘কৌশলের’ সূক্ষ্ণ আশ্রয় নেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা এর চমকপ্রদ উদাহরণ।
ঘাতকদের মধ্যে পৌরাণিক নৈতিকতাবোধ না থাকলেও পুরাণের নিকৃষ্টতর উদাহরণকে তারা গ্রহণ করেছিল। ‘মহাভারতে’ মহারথী অশ্বত্থামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও রাতের অন্ধকারে শত্রু শিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পাঁচজন সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে নয়, যুদ্ধের বাইরে তা-ও নাবালক শিশুসন্তানদের হত্যা সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যা বা ‘ব্রহ্মহত্যার’ পর্যায়ে পড়ে। ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা অশ্বত্থামার পথকেই বেছে নিয়েছিল। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, স্ত্রী-পরিজন শিশুসন্তানকেও হত্যা করেছিল, এমনকি ভ্রূণ হত্যা করতেও তাদের বাধেনি। সেরনিয়াবত বা শেখ মনির পরিবারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এসব হত্যা শুধু নির্মমতাই নয়, এটা সমস্ত ন্যায়নীতি ও ঔচিত্যবোধের বাইরে। এর জন্য অশ্বত্থামাকে যেমন পুরাণ অনুযায়ী অনন্তকাল ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটাতে হবে, তেমনি বাংলাদেশেও ১৫ আগস্টের প্রতিফল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বয়ে বেড়াতে হবে আরও দীর্ঘকাল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জেলহত্যার মতো পাশবিক হত্যাকাণ্ড। রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে সে রাতে যা ঘটেছিল তা অবিশ্বাস্য ও বর্ণনাতীত। মোসলেহউদ্দিনকে জেলগেটে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলেন না ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। কেননা সে উচ্চ স্বরে বলছিল যে জাতীয় ‘চার নেতাকে’ হত্যা করার জন্যই সে এসেছে জেলগেটে তার বাহিনীসহ এবং এসেছে প্রেসিডেন্টের আদেশেই! জেলার তখন বঙ্গভবনে যোগাযোগ করায় দাবির ন্যায্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ তার বইতে লিখেছেন এ বিষয়ে। তার বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামানের স্বহস্তে লিখিত জেলহত্যা রিপোর্টটি তুলে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বরে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয় যে চারজন সেনাসদস্যসহ ক্যাপ্টেন মোসলেহ জেলগেট পৌঁছান এবং বলেন তিনি চার বন্দি জাতীয় নেতাকে ‘গুলি করবেন’। ‘এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই।’ এই ছিল জেলারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। পরে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে প্রথমে মেজর রশিদ ও পরে প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়। কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘জেলগেট থেকে আইজি প্রিজন সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেলগেটে মোসলেহউদ্দিনের আগমন ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢোকার নির্দেশ দেন। হতবাক আইজি! খোদ প্রেসিডেন্ট বেআইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আইজি-ডিআইজি কী করতে পারে? ঘটনার ২১ বছর পর বর্তমানে জেলহত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে ছিল। এতে দেখা যায় খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদ চার জাতীয় নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন।’
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা সহিংসতার সমস্ত নিয়মনীতি অতিক্রম করে আমাদের সমাজকে সহিংস করে তোলে। এ রকম সমাজে-রাষ্ট্রে সব ধরনের সহিংসতাকেই অনুমোদন দেওয়া সম্ভব (এরই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছে)। এ ধরনের সহিংসতার সংস্কৃতি কোনো সমাজে একবার গেড়ে বসলে তার মূলোৎপাটন সহজ নয়। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ঘটেছিল বলেই নির্মমতার একটি সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রজীবনেও এক দীর্ঘ অশুভ ছায়া ফেলেছিল। ১৯৭৬-৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলের শুরুর পর্যায়ে অনেকগুলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়েছিল। সেগুলোর বিচার হয়েছিল লাতিন আমেরিকার কায়দায়- সামরিক শাসন নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেনি।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


স্বাধীনতার পরে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্যজোটের দরকার ছিল দেশকে প্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন। প্রথমে ত্রিদলীয় আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবি ঐক্যজোট ও পরে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তার স্বীকৃতি মেলে। অ-ধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রণী এমন অনেক দেশেই এটি দেখা গেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তি একত্র হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ায় এটা ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্নভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে এ ধরনের ঐক্যজোট হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ নানা ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যের নানা অভিব্যক্তি দেশে দেশে দেখা যায়। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্য-বিরোধের ‘ডায়ালেকটিক’ অবশ্য একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু, যা এই লেখার পরিধির বাইরে। এখানে শুধু এটাই যোগ করার যে এ দেশেও একপর্যায়ে এরকম ‘ঐক্যজোট’ বাড়ার প্রয়োজনীয়তা ঐতিহাসিকভাবেই দেখা দিয়েছিল (যার সমসাময়িক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়)। তবে ঐক্যজোটে যোগ দেওয়া মানে নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ নয়। বাকশালের মতো ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও অন্যান্য দলের নিজস্ব ‘রাজনৈতিক সত্তা’ বিলোপ হয়ে যায় না। ন্যাপ-সিপিবির নির্দেশে যারা সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবাই নিজ নিজ পার্টির নির্দেশেই সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। সবাই যে সাগ্রহে যুক্ত ছিলেন এমনও নয়-কিন্তু কমিউনিস্ট শৃঙ্খলা মেনে সেদিন তাদের তা করতে হয়েছিল। আবার, কেউ কেউ বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি বলে আহতও বোধ করেছিলেন। এ বিষয়ে সিপিবির নীতি ছিল পরিস্কার। দলটি ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে সমন্বয় করার লেনিনীয় নীতিতে পূর্বাপর অটুট ছিল। বাকশাল গঠন করার পরপরই ‘গোপন ও প্রকাশ্য কাজের সমন্বয়’ এ বিষয়টি চিঠির আকারে তৎকালীন সিপিবির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়:
‘যারা প্রকাশ্যে কাজ করেন একটা কথা খেয়াল রাখা দরকার যে একমাত্র নিজেদের বিশ্বাসভাজন লোক ছাড়া তারা কারও নিকট পার্টিগত পরিচিতি প্রকাশ করিবেন না। প্রত্যেক পার্টি সভ্যকেই কোন না কোন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত থাকিতে হয়। একমাত্র নিজেদের ইউনিটের সভ্য ছাড়া ও ঊধর্ক্ষতন কমিটির নির্দিষ্ট লোক ছাড়া এর অস্তিত্ব আর কারও নিকট প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এতে বিপদের আশংকা বাড়ে। ইউনিটের সভা গোপনেই করিতে হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেওয়া সত্ত্বেও বাইরে কাজ করার সময় তা আলাদাভাবে কার্যকরী করাই যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে ইউনিটের অস্তিত্ব ও সভ্যদের পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ অবস্থায় ইউনিট সভ্যদেরকে একে অন্যের সংগে পরিচয় আছে তাও অস্বীকার করতে হয়। পার্টির গোপন ও প্রকাশ্য কাজগুলি নিয়মমাফিক সুষ্ঠুভাবে চললে এবং তার ভিতরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন ঠিকমত হলে পার্টির অগ্রগতি ঠিকমত চলা সম্ভব হয়।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পরে কোনো একসময়ে সিপিবির উপরোক্ত চিঠিটি প্রমাণ করে বাকশালের ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলীয় রাজনৈতিক সত্তা ‘বিলোপ’ করেনি। নতুন পরিস্থিতিতে তারা শুধু তাদের কাজের ধারা বদলেছিল ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে নতুন ধারায় সমন্বয় সাধন করে। এ কথা সম্ভবত ন্যাপের সম্পর্কেও খাটে।
নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখা সম্পর্কে সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বাকশালের প্রগতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চরিত্র শনাক্ত করতে সিপিবি সেদিন ভুল করেনি- এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে বাকশাল সম্পর্কে পার্টির ইতিবাচক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে- সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে-সিপিবির হাতেলেখা একটি সার্কুলারে অভ্যুত্থান-উত্তর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রাখা হয়। এর থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিপিবির পূর্বাপর সমর্থনের দার্শনিক-রাজনৈতিক ভিত্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে তখন ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিপদসংকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সিপিবি তখন আন্ডাগ্রাউন্ডে। সে-রকম পরিস্থিতিতে বাকশালকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হলো:

‘৭ই নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মূলগতভাবে এই সরকার দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল।
১. এই সরকার দেশে পূর্ণভাবে সামরিক শাসন এবং সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখিয়াছে।

২. এই সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল নীতিসমূহকে বাতিল করিয়া দেশে পুঁজিবাদ নীতি অনুসরণ করিয়া সাম্রাজ্যবাদী খপ্পরে পড়িতেছে। দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, মাওবাদী, পাকিস্তানপন্থি প্রভৃতিরা এই সরকারের সমর্থক। এরা প্রগতিশীলদের নির্মূল করিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুসরণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদী চীন এই সরকারের দৃঢ় সমর্থক। ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ইহাদের মূল আওয়াজ। সাম্রাজ্যবাদ নহে, ভারতই ইহাদের মূল শত্রু।

৩. জাসদের সরকার বিরোধিতাসহ দেশে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করিতেছে। জাসদ ও চার নীতি পরিবর্তনকারী উগ্র দক্ষিণপন্থিদের চাপ বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা রহিয়াছে।

৪. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়া যে সাম্রাজ্যবাদী মাওবাদী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে তাহাকে পরাস্ত করিয়া বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অনুসারী একটি দেশপ্রেমিক সরকার কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য।

৫. বঙ্গবন্ধুর নীতির অনুসারী একটি দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও দক্ষ দেশপ্রেমিক সরকার কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া ‘দক্ষিণ প্রতিক্রিয়া ও উগ্র বামকে জনগণের মধ্যে হইতে বিচ্ছিন্ন করা’ এই আওয়াজের ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শিবিরের শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইতে।

৬. বঙ্গবন্ধুর আমলে জনগণের মধ্যে নানারূপ বিভ্রান্তি বিরাজ করিতেছিল। একদলীয় শাসন যে উন্নত ধরনের গণতন্ত্র ইহা জনসাধারণ বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি জনগণকে হতাশ করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের ব্যাপক অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়বাদী চেতনা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কূটকৌশল সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশবাসী ভারতের সাহায্য নিয়াছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদের চক্রান্ত প্রতিরোধে যে ভারত ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মৈত্রীর ও সাহায্যের প্রয়োজন আছে তারা তাহারা বুঝিয়া উঠে নাই। গণচেতনার এই দুর্বলতার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদ গ্রহণ করে।

৭. একমাত্র মুজিববাদী নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলকেই ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে।

৮. দেশপ্রেমিক শিবিরের রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্বন্ধে মোটামুটি সমঝোতা থাকিলেও কৌশল ও পদ্ধতির প্রশ্নে মতানৈক্য আছে। একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়িয়া তুলিতে না পারিলে শত্রুরা লাভবান হইবে।

৯. ইদানীংকার ঘটনাবলী প্রমাণ করিয়াছে যে (৭ নভেম্বরের পরে) সরকার নিরপেক্ষতার যে নীতি ঘোষণা করিয়াছে ইহা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তাহারা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা, মাওবাদ ও পাকিস্তানপন্থি শক্তিদের বিনা বাধায় কাজ করিতে দিতেছে, আর বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তিকে দমন করিতেছে।

১০. সরকার জাতীয়করণ নীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া ব্যক্তিগত পুঁজিকে অবাধভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করিয়া দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উপরে পুরাপুরি নির্ভর করিবার পথ গ্রহণ করিয়াছে।

১১. রাজনৈতিকভাবে ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন, সাম্প্রদায়িক নীতির অনুকরণ, সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির নজীরবিহীন প্রসার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম অবনতি যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোককে ভাবিত করিয়া তুলিতেছে।’

ওপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে সিপিবি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিল। বাকশাল-ব্যবস্থাকে এমনকি ‘উন্নত ধরনের গণতন্ত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। বাস্তবিকই ১৯৭৫ সালে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির এক এলায়েন্স গঠিত হয়েছিল, যা স্বাভাবিক নিয়মে অগ্রসর হলে দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারত।
বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিষ্ঠুর মৃত্যু সমাজের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। সমাজ-মনোবিদ আশিস নন্দী যাকে বলেছিলেন ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটি’ সেটি ভিন্নতর মাত্রা পায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে।
‘শাকের আহমেদ’ এই ছদ্মনামে সিপিবির একজন নেতা ‘মহান একুশের আবেদন ও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ’ প্রবন্ধে ৭৫-পরবর্তী সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে যা লিখেছিলেন তাতে করে ক্রমবর্ধমান নিষ্ঠুরতাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে তীব্র আকারে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে লেখক তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে:
আজ একদল বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নিয়ে বিদ্রূপ করছেন, যেন দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ জন শোষিত নির্যাতিত সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী প্রমুখ মেহনতি মানুষ আর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ জন শোষক ও নির্যাতকদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন যেন এই দুই অংশের মানুষের একই রকম অধিকারই হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এ কথা কে না বোঝেন যে শোষক আর শোষিত, নির্যাতনকারী আর নির্যাতিত যদি সমান অধিকার ভোগ করে তা হলে দেশ হতে কোনদিনও শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। শোষক ও নিপীড়কদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প গ্রহণ করা। গণতন্ত্রকে হত্যা করা তো নয়ই, বরং তাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্র, ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠার পথ।

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম থেকে আরম্ভ করে আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকরা প্রায় প্রতি দিনই ‘আইনের শাসন’ ‘ন্যায়ের শাসন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রব সেরনিয়াবাতের দুবছরের নাতিকে বা বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করল কিংবা ঢাকা জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী দশায় দেশের চারজন বিশিষ্ট নেতাকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করল সেই নরপশুদের কী করা হচ্ছে? তারা শুধু বহাল তবিয়তেই নেই, তাদের নিরাপত্তা ও বিলাস-ব্যসনের জন্য এই সরকার পাহারাদার এবং খোরপোষেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীরা এই সম্পর্কে কোন প্রতিবাদ বা দাবী উত্থাপন করা তো দূরের কথা, তারা এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চুপও নন, বরং তারা নানাভাবে সরকারের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনই করছেন। নিজের অরক্ষিত বাসগৃহে ডাকাতের মত ঢুকে সরল বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, শেখ মুজিবের সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূদের হত্যা, শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা, রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীর অতিথি ও চাকরদের হত্যা, জেলে আবদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখকে হত্যা-এই সকল জঘন্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডকে এরা সমর্থন করেন এবং এতে আনন্দ উল্লাসও প্রকাশ করেন।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


এ রকমই ছিল বাকশাল গড়ার পটভূমি। এমনটাই আমি ভাবতে চাই। বাকশালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর মধ্যে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই প্রতিশ্রুতির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর যেটা ধূসরতম দিক সেটাও ৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনের অব্যাহত নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষিতে আজ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হয়। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে এমন কিছু প্রগতিশীল সংস্কার এটি আনতে চেয়েছিল, যা পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক যে কোনো যুগের অবাধ বাজার অর্থনীতির অন্ধ অনুসরণের মানদণ্ডে আজ নিছক ঘোষণা হিসেবেও বিস্ময়কর ঠেকে বৈকি। বাহাত্তরের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে বাকশালের কর্মসূচি শুধু ধারণই করেনি, একে বাস্তবায়ন করার কনক্রিট প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সামনে সত্যি বলতে গেলে আর কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পন্থা খোলাও ছিল না সেদিন। কী করতে পারতেন তিনি সেদিন? সিপিবি-ন্যাপের বক্তব্য ছিল দেশ বাঁচানোর জন্য একটি ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ গঠন, যেখানে এ দলগুলো আরও বেশি ‘স্বতন্ত্র’ সত্তায় বিচরণ করতে পারবে। মুজিব যে কোনো কারণেই হোক সেই পথে এগোতে চাননি। তিনি একটি নতুন দল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কথিত জাতীয় ফ্রন্টের সবাই থাকবে। বিষয়টি সেদিক থেকে দেখলে একান্তভাবেই ‘ফর্মের’ বিষয়। দেশের স্বার্থে নিজেকে বা তার হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙচুর করে নতুন ‘ফর্মের’ সন্ধান করতে হয়েছিল তাকে। এ নিয়ে তার বেদনাবোধের পরিচয় পাই ২৫ জানুয়ারির (১৯৭৫) ভাষণের একাধিক মুহূর্তে। দেশের কঠিন অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বাকশালের সম্ভাব্য ভূমিকা একটি কেবল আপৎকালীন প্রয়োজনীয়তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এক গুচ্ছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদাহরণ :
১. নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন সম্পর্কে বললেন :’সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পিকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করছে, এ কথা যেন কেউ মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে।’
২. বিরাজমান রাজনৈতিক অরাজকতা নিয়ে মন্তব্য করলেন :’বিশৃঙ্খল জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আজ যাকে arrest
করব, বলবে যে, আমি অমুক পার্টির লোক। একে arrest করব, অমুক পার্টির লোক। ওকে arrest
করব, অমুক পার্টির লোক।’
৩. দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে মুজিব বলেন, ‘বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, … এই সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে Constituent Assemblyর যারা সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেও কয়েক জনকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, আমরা যা কোনোদিন দেশে শুনি নাই, ঈদের নামাজের জামাতে, এই সংসদের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাদের হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হয়েছে তাদের, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা।’
৪. পাক-মার্কিন নীতির অনুসারী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল এবং পাক-চীন নীতির অনুসারী উগ্র বামপন্থি শক্তির দিকে (এর মধ্যে জাসদকেও আগ বাড়িয়ে রাখতে হবে) ইঙ্গিত করে মুজিব বলেন, ‘কোন রাজনৈতিক দল, যাদেরকে আমরা অধিকার দিয়েছিলাম, একটা কোনোদিন condemn তারা করেছে এদের বিরুদ্ধে? না, তারা condemn করেনি। তারা মুখে বলেছে- অধিকার চাই। তারা মিটিং করেছে, সভা করেছে। পার্টি করতে তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করেছে তারা? আমরা বলেছি, যা আমাদের সংবিধানে আছে যে, ভোটের মাধ্যমে তোমরা সরকারের পরিবর্তন করতে পার। সে ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম বাই-ইলেকশনের মাধ্যমে। বাই-ইলেকশনসমূহ আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি, জনগণ তাদের ভোট না দিলে আমরা কী করব? তখন তারা বলেছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। মুখে তারা বলেছে- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি। তারা অস্ত্র জোগাড় করেছে, সেই অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে।…আর, তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ঘরে ঢুকে শৃগাল-কুকুরের মতো মানুষকে হত্যা করেছে।’
৫. বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন :’বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা hot bed of international clique হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেওয়া হয়, এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হয়।’
৬. এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দুর্গতি। এ নিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন বঙ্গবন্ধু :’আজ সত্যি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। কারণ, আমরা কী নিয়ে শুরু করেছিলাম?…আমাদের food কিনতে হয়। আমাদের food deficit কত? আমাদের এখন নানা রকম কাজ। মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যায়। আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তার পরে বাংলাদেশে হলো draught। তারপর হলো সারা দুনিয়াজুড়ে inflation।…শুধু আমরা না, সমস্ত দুনিয়ায় যারা অনুন্নত দেশ, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আসল ভয়াবহ বন্যা। এত বড় বন্যা আমার জীবনে আমি দেখেছি কিনা, সন্দেহ। না ছিল খাবার। ৫৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং relief operation চালানো হলো।…বাঁচাতে পারলাম না সকলকে।…এখনও মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। গায়ে তাদের কাপড় নাই।’
৭. এই দুঃখী মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য সাময়িককালের জন্য হলেও কিছু নতুন পরিবর্তন আনতে হয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় :’আমি একদিন তো বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব, যে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের, এবং সেজন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে।’
৮. এটা কোনো একনায়কের কথা নয়; দেশবাসীর কাছে আবেদন করছেন তিনি। ব্যাখ্যা করছেন কেন নিজের বিরুদ্ধে তাকে যেতে হচ্ছে :’আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব। আজ আপনারা constitution সংশোধন করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন, আমার দুই-তৃতীয়াংশ majority দরকার। তা আমার আছে। মাত্র ৭ জন ছাড়া সমস্ত সদস্যই আমার। তবু আপনারা amendment করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না আমার। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না- এটা কম দুঃখ নয় আমার।’
৯. এর পরে এলো ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রসঙ্গ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘প্রথম বিপ্লব’:’তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ, একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই, This is our Second Revolution। এই Revolution আমাদের এই Revolution হবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর অর্থ :অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’
১০. সবশেষে সবাইকে আহ্বান জানালেন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে :’আমি এই হাউস থেকে, জনাব স্পিকার, আপনার মাধ্যমে দেশবাসীকে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলব, যারা দেশকে ভালোবাসেন, চারটি principleকে ভালোবাসেন- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা; এই চারটিকে, তারা আসুন, কাজ করুন। দরজা খোলা আছে। সকলকেই আহ্বান জানাচ্ছি, যারা এই মতে বিশ্বাস করেন।…দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’
যদি তার এই ডাক শুনে কেউ না-ও আসে, তাহলে একলাই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে এবং স্রোতের বিপরীতে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এ জন্যই অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনে গুনগুন করে গাইছিলেন এই ভাষণের দুই সপ্তাহ আগে- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে….’। ৬-দফার সময়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র চলাকালীন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের পর্বে, ৭ মার্চের ঘোষণায়, ২৫ মার্চের কালরাতে রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্বে আলটিমেটলি এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একাই নিতে হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন সে সময়ে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ছিল কেবল তার একার। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের পর থেকেই এটা দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো পথ তার সামনে খোলা ছিল না।
আগেই বলেছি, বাকশাল বাস্তবায়ন করার সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অভিপ্রায়টি স্পষ্টই ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন। বাকশালের গঠনতন্ত্রের প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছিল সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের চেয়েও আরও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে মানবাধিকার, স্বাধীনতা, শোষণমুক্ত, সুষম বণ্টনের ‘সাম্যভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সেখানে। এর সাম্প্রতিক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ৭ জুন, ১৯৭৫ (শনিবার) বাংলাদেশ গেজেটের সংখ্যায় বিধৃত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’:
‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত একক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ- বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, নর-নারী ও ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং মানব-সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি, মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃস্টি, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন, কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতি ও অনগ্রসর জনগণের উপর শোষণ অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ক্রমিক যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের প্রসার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান, মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিকতর কর্মসংস্থান, বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ গণমুখী সার্বজনীন সুলভ গঠনাত্মক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-স্বাস্থ্য রক্ষাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণের মৌলিক সমস্যাবলির সুসমাধান, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, বিচার-ব্যবস্থার কালোপযোগী জনকল্যাণকর পরিবর্তন সাধন এবং গণজীবনের সর্বস্তর হইতে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা- এ সকল নীতিসমূহ ও উদ্দেশ্যাবলী সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে রূপায়িত করিতে…সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিবে।’
মিথ্যে ইউটোপিয়ার কথা দেশবাসীকে সেদিন শোনাচ্ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজের একান্ত বিশ্বাসের কথাই বলছিলেন। আবারও বলছি, এটি কোনো তৃতীয় বিশ্বের একনায়কের কথা নয়। বরং সমাজ বদলের লড়াইয়ে যার সামনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন একজন ডেসপারেট মানুষের উপলব্ধি ছিল কথাগুলো :
‘আজকে আমাদের কথা কী? আমাদের শোষণহীন সামাজ গড়তে হবে। এটায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজকে থেকে নয়, আপনি মেম্বার ছিলেন প্রথম দিন থেকে, স্পিকার সাহেব। আপনি জানেন, এই দল এই সংজ্ঞা নিয়ে সংগ্রাম করেছে। কারও কাছে কোনোদিন আপস করে নাই, মাথা নত করে নাই। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি, নতুন পয়সাওয়ালা এদের কাছে আমার আত্মবিক্রয় করতে হবে? এদের অধিকারের নামে এদেরকে আমরা ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দিতে পারি না। কক্ষণও না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই, দিতে পারে না।’
বাকশাল এই একক জাতীয় রাজনৈতিক দল বা মঞ্চ কি পারত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে? আয়েন্দে কি সফল হতে পারতেন? অ-ধনবাদী বিকাশের পথে চলতে আগ্রহী এমন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ প্রশ্ন আজ তোলা যায়। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেক দূর পর্যন্ত সফল হতো। উদেশ্য পূরণ হলে আবারও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পরিচিত ছকে ফিরে যেতেন তিনি। সামগ্রিক বিষয়গত ও বিষয়ীগত ফ্যাক্টর বিচার করেই এ রকম বলা যায়।
প্রথমত, যে সময়ে বাকশালের গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় (অর্থাৎ জুন, ১৯৭৫) সে সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শুভ পরিবর্তনের চিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৯৭৩/৭৪ সালের ওপেক দেশভুক্ত জোটের সিদ্ধান্ত ও তার প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি-তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা ক্রমশ কমে আসতে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। বিদেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে থাকে। খাদ্যশস্যের দাম কমে আসতে থাকে এবং এর জোগানও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ ও ৭৪ পরপর দু’বছরের বিধ্বংসী বন্যা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ পার হয়ে দেশে প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ফলনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটা ঠিক যে, উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রযুক্তি, বিশেষত শুকনো মৌসুমের বোরো ধানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সাফল্য আসে আরেকটু পরে। উফশী ধানের অধিকাংশ জাতই উদ্ভাবিত হয় ১৯৭৫ সালের পরে। যেমন, বি.আর-১ (চান্দিনা) বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালে; বি.আর-২ (মালা) ১৯৭১ সালে; বি.আর-৩ (বিপ্লব) বেরোয় ১৯৭৩ সালে; বি.আর-৪ (ব্রিশাইল) বের হয় ১৯৭৫ সালে; বি.আর-৭ (ব্রি-বালাম) ১৯৭৭ সালে; বি.আর-৮ (আশা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-৯ (সুফলা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-১০ (প্রগতি) ও বি.আর-১১ (মুক্তা) ১৯৮০ সালে। অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উফশী ধানের প্রযুক্তিতে নতুন নতুন জাত সংযোজিত হতে থাকে, যার সূচনা কেবল বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা চলে, দু-তিন বছরের মধ্যেই দেশের খাদ্য-পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চলে আসত অবজেকটিভ নিয়মেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুফল দুঃখী মানুষের মধ্যে নিজের হাতে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। এদেশের কৃষি গবেষণার ভিত্তি গড়ে ওঠা অবধি শুধু দেখে যেতে পেরেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, শুধু অর্থনৈতিক (বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটজনিত মূল্যস্ম্ফীতি বা দেশের ভেতরে কৃষিপ্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রসার) দিক নয়, সাংগঠনিক দিক থেকেও বাকশাল দু-তিন বছরের মধ্যে একটি সক্ষমতর রাজনৈতিক মঞ্চে রূপান্তরিত হতে পারত। আমার আশাবাদের কারণ, সে সময়ে বাকশালের ভেতরে সিপিবি-ন্যাপ এ দুই প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন থেকে এক ঝাঁক সাংগঠনিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে আগ্রহী হয়ে এই সমাবেশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এবং এ রকম আরও ঘটুক, তার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিকে গড়ে ওঠা স্বল্পস্থ্থায়ী আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবির ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর মূল ব্যক্তিত্বরা বাকশালের এক মঞ্চে আবার একত্র হয়েছিলেন দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের বৃহত্তর রাজনৈতিক তাগিদে। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই দলীয় পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে এক মঞ্চে জড়ো হতে চাননি ঠিক (এ প্রসঙ্গে অচিরেই আসছি), কিন্তু এই একত্র-সমাবেশের সাংগঠনিক ফলাফল হতে পারত অভূতপূর্ব। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা আন্দোলনের মূল ভরকেন্দ্রগুলো বাকশালে ধারণ করা হয়েছিল। বাকশালের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ‘পরিচালনা কমিটি’ তথা নেতৃত্বে বামপন্থিদের লক্ষণীয় উপস্থিতি ছিল। কৃষক সংগঠন পরিচালনার জন্য ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মণি সিংহ, পীর হাবিবুর রহমান, জীতেন ঘোষ, বজলুর রহমান প্রমুখ। শ্রমিক সংগঠন পরিচালনার জন্য ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মনজুরুল আহসান খান, আবদুস সালাম খান প্রমুখ। মহিলা সংগঠনের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মালেকা বেগম, আয়শা খানম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ। যুব সংগঠনের ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম, মতিউর রহমান প্রমুখ। ছাত্র সংগঠনের ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল-আলম লেনিন, মাহবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। মনে রাখতে হবে, শুধু দু’জনের অন্তর্ভুক্তি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা) ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য ‘ক্রিয়াশীল গণপরিষদ’কে মাতিয়ে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, এতজন প্রতিভাবান বামপন্ িবুদ্ধিদীপ্ত সাংগঠনিক প্রতিভা বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা অঙ্গ সংগঠন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হলে সংগঠনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে (ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে) একটি শুভ ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা অবাস্তব ছিল না। অধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রসর হওয়া এমন অনেক দেশেই এ রকম এক দল বা এক মঞ্চ গড়ার উদাহরণ ইতোপূর্বে (ও পরে) দেখা গেছে। অর্থাৎ সাংগঠনিক দিক থেকে নিতান্ত ‘হিউম্যান রিসোর্স’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও বাকশালের সাংগঠনিক রূপরেখা ও কর্মপদ্ধতি কালক্রমে যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারত।
তৃতীয়ত, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও সংগঠন-প্রক্রিয়া বাকশালের গণভিত্তিকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করতে পারত। মহকুমা প্রশাসনকে জেলা প্রশাসনে রূপান্তর করে জেলা পর্যায়ে ক্ষমতা-কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীভবন ঘটার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিচার-ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীভবনের প্রশ্নর আলোচিত হচ্ছিল। শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীভবন নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিজ নিজ এলাকায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ‘বহুমুখী সমবায়’ গড়ে তোলার জন্য। এর বস্তুগত ভিত্তি ছিল গোটা গ্রামের ‘সোশ্যাল মোবিলাইজেশন’। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে সমতামুখী সমাজের আদর্শ ও সংগঠন সম্প্রসারিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনাও খুলে যায়।
চতুর্থত, ভাবাদর্শগত লড়াইয়ের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল বাকশাল কাঠামোয়। এর গঠনতন্ত্রের ৮ম ধারায় ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, দলের সদস্য ‘নিজের রাজনৈতিক এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট থাকিবেন, দলের প্রচারিত পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য পাঠ করিবেন এবং প্রচার করিবেন।’ সেখানেও ‘গঠনমূলক আলোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য পরিচালনা পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন’ করার কথাও বলা হয়েছিল। এসব বাক্যে বামপন্থি ভাষাভঙ্গির প্রভাব আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু বাস্তবিকই নতুন দল গড়ে নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে কথা তিনি ‘৭২ সাল থেকেই অনেক বার বলে এসেছেন। সমাজতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না- এ উপলব্ধি তার বহুবার হয়ে থাকবে।
পঞ্চমত, বাকশাল কর্মসূচি সফল হওয়ার বড় চাবিকাঠি ছিলেন মুজিব নিজেই। তিনি একাই ছিলেন এ কর্মসূচির রক্ষাকবচ। এটি বাস্তবায়নে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতিও ছিল না। পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধাচরণ করলেও তিনি প্রতিকূলতার সামনে নুয়ে পড়ার মানুষ নন। তদুপরি অনেক নেতার মধ্যেই যা দেখা যায়নি অতীতে, তার ছিল প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞান। এ কথা বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জোরের সঙ্গে বলেছেন। রাজনৈতিক কলাকৌশল, সুবিবেচনাবোধ তার ও তার অগ্রজ প্রজন্মের ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের মধ্যে টানটান ছিল। অনেক বামপন্থি নেতার তুলনায় এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে ছিলেন। বাকশালের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হচ্ছে ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে। কিন্তু কার্যত এটি ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে উপদল বা গ্রুপ গড়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না থাকলেও এর উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। হায়দার আকবর খান রনো-রাশেদ খান মেনন এদেরকে দলে আকৃষ্ট করার জন্য বলেওছিলেন সেই সম্ভাবনার কথা- সে কথা কিছু আগে আমি উল্লেখ করেছি (বলশেভিক পার্টিতেও এমন আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল)। এত তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যায় বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবির তরুণ নেতৃত্বকে বাকশালের অঙ্গ সংগঠনে সম্পৃক্ত করলে সেসব প্রতিষ্ঠান আর আগের গতানুগতিক ধারায় চলতে পারবে না- এটিও তিনি হিসাবে নিয়েছিলেন। সাংগঠনিক, আদর্শিক ও মানসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি এ দুই ধারার একত্র-সমাবেশের মধ্য দিয়ে কালক্রমে একটি নতুন ‘রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি’র বিকাশ ঘটবে দলের ভেতরেই- এটা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত ছিল না। এর মধ্য দিয়ে তার নিজেরও সত্তার প্রগতিশীল রূপান্তর ঘটতে পারত; যেমনটা ঘটেছে কিউবার কাস্ত্রো বা যুগোশ্নাভিয়ার টিটোর বেলায়। আমার কল্পনায় এ রকম সম্ভাবনা অপার্থিব বলে মনে হয় না।
আগেই বলেছি, বাকশালের গঠনতন্ত্র ও সংগঠন সম্পর্কিত উপরোক্ত বিবরণীটি নিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ জুন। এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বাকশাল গঠনের একান্ত প্রাথমিক ও অস্ম্ফুট পর্যায়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অস্ম্ফুট বলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাকশালের কোনো  causal link নেই। যে জিনিস বাস্তবায়নই হয়নি, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রশ্ন ওঠে না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল না করলেও তাকে হত্যা করা হতো। হত্যা করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল তার হত্যাকারীরা বহুদিন থেকে। এখন যে প্রায়ই বলতে শুনি, সেনাবাহিনীর ‘কিছু বিপথগামী সদস্য’ ঘটনাটি ঘটিয়েছে- সেটি নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। হত্যাকারীরা বিপথগামীপাড়ার মস্তান নয় যে হুট করে এমন কাণ্ড ঘটাবে। এর পেছনে ছিল দক্ষিণপন্থি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা। এই শক্তির অবয়ব জানা বা অন্তত অনুমান করা কঠিন নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান যারা ঘটিয়েছে, যাদের সমর্থনে বা প্রত্যক্ষ মদদে ঘটিয়েছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ বাহানায়; বাংলাদেশেও তারা সেভাবে ঘটিয়েছে। শুধু আমরা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতায় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি।
পূর্বাপর বঙ্গবন্ধুর শত্রুর অভাব ছিল না। এই শত্রুদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাকশাল কর্মসূচির আগে ও পরে এরা দেশের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় ছিল। নূহের নৌকার মতো সবাইকে ক্ষমাশীল উদারতায় জলে-ডোবা থেকে নৌকায় ওঠানোর উদারতা দেখালেও তার শত্রুদের চরিত্র-বদল হয়নি। বরং কালক্রমে তারা আরও জোটবদ্ধ হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এক জায়গায় তারা ছিল একমত- যে করেই হোক শেখ মুজিবকে উৎখাত করতে হবে। এ জন্য মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে রাজনীতিকদের খুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ কাউন্টার-রিভলিউশনের কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা থেকে শত্রুরা বিরত থাকেনি। অথচ এত ঝুঁকির কথা জেনেও বঙ্গবন্ধু নিজের সিকিউরিটি বিষয়ে ছিলেন একান্তভাবেই উদাসীন। মানুষ যে জন্তু হতে পারে- সেটা তিনি জানতেন। তাই বলে তার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ অস্ত্র উঁচিয়ে ধরতে পারে- এটি তার রাজনৈতিক কল্পনার বাইরে ছিল। যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃৃতির মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন; জেল-জুলুম অতীতে সয়েছেন; জেল থেকে বেরিয়েও এসেছেন; সে রকম মানস-আবহাওয়ায় ১৫ আগস্ট কল্পনাতীত ছিল।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


নিষ্ঠুরতার কথা যেহেতু উঠলই, সেহেতু এ কথাও বলা উচিত যে এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছি। চিলিতে সালভাদর আয়েন্দে মিলিটারি ক্যুতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু তার পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততিকে খুন করা হয়নি। একই কথা খাটে প্যাট্রিস লুমুম্বা, ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখের ক্ষেত্রে। তারাও অন্যায় এবং অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু সেজন্য তার পরিবার-পরিজনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়নি। এমন যে নির্দয় স্টালিন নির্বিচারে [বা কখনও প্রহসনের বিচার অনুষ্ঠান করে] তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের একের পর এক সরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনিও সপরিবারে নিধনযজ্ঞে সায় দেননি। একে একে মারা গিয়েছিলেন জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, রাদেক, পিতাকভ, বুখারিন গত শতকের তিরিশের দশকে। ট্রটস্কিও নিহত হলেন ১৯৪০ সালে মেক্সিকোয় আততায়ীর হাতে। এসব কোনো ক্ষেত্রেই যারা নিহত হলেন অন্যায়ভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে, তাদের পরিবারবর্গকে কিন্তু নিশ্চিহ্ন করা হয়নি। তৃতীয় বিশ্বের বর্বরতম স্বৈরশাসকরা তথা সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা প্রায় কখনোই পরিবারবর্গের ওপরে চড়াও হয়নি। কেবল শেখ মুজিবের বেলায় এর ব্যতিক্রম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে শুধু নয়, তার নিকটতম পরিবারের প্রায় সবাইকে ১৫ আগস্টের সেই নিষ্ঠুরতম রাতে হত্যা করা হয়েছে; যার নিকটতম তুলনা আধুনিককালে আমি সহসা কোথাও খুঁজে পাই না। এই নিষ্ঠুর বর্বরতার কারণ কী, উৎস কী, ব্যাখ্যা কী এ প্রশ্ন তোলাই যায়। তবে এটুকু বলতে পারি, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর (আমি এর সাথে ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যাকাণ্ডকেও যোগ করব) বাঙালি জাতি আর নিজেকে নিরপরাধ বলে দাবি করতে পারবে না। ‘নিরপরাধ’ শব্দটি আমি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করছি এখানে। বোধকরি দার্শনিক হান্নাহ্‌ আরেন্ডের একটি উক্তি ছিল যে হলোকাস্টের পর মানবজাতির কেউই আর নিরপরাধ দাবি করতে পারে না- যেন সবারই হাতে লেগে আছে অদৃশ্য রক্তের দাগ। এই অমোচনীয় অপরাধবোধ সব সময় আমাদের তাড়া করে ফিরবে।


বাকশাল কর্মসূচির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন সম্ভব নয় মূলত দুই কারণে। প্রথমত, কর্মসূচিটিই বাস্তবায়ন করা যায়নি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে। শুধু বাস্তবায়নের আয়োজন বা প্রাকপ্রস্তুতি চলছিল সে সময়ে। প্রশাসনিক সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ সবেমাত্র নেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি জেলায় নিরীক্ষামূলক বহুমুখী অর্থনৈতিক সমবায় করার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল- এর বেশি কিছু নয়। কালক্রমে এই কর্মসূচির সব উপাদান জড়ো হতো, পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হতো, তখন মূল্যায়নের বা কোনো দিক বদলানোর প্রয়োজন দেখা দিলে তা করা হতে পারত। কিন্তু সেই পর্যন্ত ঘটনা গড়াতেই পারেনি। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সবগুলো কার্ড খোলা রেখেছিলেন। নিরীক্ষা সফল হলে মডেলটিকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া; আর ব্যর্থ হলে, নতুন আঙ্গিকে পুনরায় যাত্রা শুরু করা। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রকে বঙ্গবন্ধু ‘নিরীক্ষাধর্মী রাষ্ট্র’ হিসেবেই পূর্বাপর দেখেছিলেন। দ্বিতীয় যে কারণে বাকশাল কর্মসূচির মূল্যায়ন জটিল হয়ে পড়ে তা হলো এর সূচনা পর্বের আকর-উপাদানের অপ্রতুলতা। তৃতীয় বিশ্বের জাতিসমূহ আর্কাইভ-ভিত্তিক ইতিহাস বোঝে না এবং আর্কাইভ-ভিত্তিক ইতিহাস সংরক্ষণে যত্নবান নয়। উদাহরণত, ১৯৭২ সালের গণপরিষদের তরফে যে ৩১-সদস্যবিশিষ্ট ড্রাফটিং কমিটি করা হয়েছিল তার ‘সভা বিবরণী’ বা মিনিটস্‌ সংরক্ষিত হয়নি। সংবিধানের খসড়ার ওপরে যে ৯৮টি সংশোধনী প্রস্তাব গণপরিষদের বাইরের থেকে ‘জনগণের পক্ষ থেকে’ এসেছিল তারও কোনো তালিকা নেই। সেসব সংশোধনী কী নিয়ে ছিল তাও এখন জানার উপায় নেই। একমাত্র ভরসা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ‘সম্পাদকের কাছে চিঠি’ বা কোনো দল বা সংগঠনের তরফে প্রদত্ত বিবৃতি। কিন্তু তার থেকে কেবল আঁচ করা চলে, আর্কাইভিস্টের প্রয়োজন তাতে করে মেটে না। এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য বাকশালের ক্ষেত্রে। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় কে কী বলেছিলেন তা যেমন জানা যায়নি, বঙ্গবন্ধু কীভাবে কোন বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন বা কাদের সাথে আলোচনা করেছিলেন তারও কোনো বিবরণ রক্ষিত হয়নি। কোনো প্রাসঙ্গিক ডকুমেন্ট মহাফেজখানায় পরে গিয়ে থাকলেও তা আজকের দিনে ‘দেখার’ অধিকার নিতান্ত সংকুচিত। এ কথা খাটে সত্তর-আশি বা নব্বইয়ের দশকের রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। সরকারি দলিলপত্রের হয়তো কোথাও ‘সংগ্রহ’ বা ‘সঞ্চয়ন’ ঘটেছে, কিন্তু সেই অদৃশ্য আর্কাইভে গবেষকের প্রবেশাধিকার নেই বা অত্যন্ত সীমিত।


এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাকশাল কর্মসূচির নানা দিকের আলোচনা আজকের যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, আগেই বলেছি, এর পেছনের প্রধান প্রণোদনা ছিল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। একটি বৈরী পরিস্থিতির থেকে অর্থনীতির গেড়ে যাওয়া চাকাকে টেনে ওপরে তোলা। অর্থনীতিকে এবং এর সম্পর্কিত প্রশাসনকে সক্রিয় করার জন্য একটা ‘শক থেরাপির’ দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে অবস্থার দুর্বিপাক বোঝাতে এক দক্ষিণপন্থি সমালোচকের দ্বারস্থ হচ্ছি। বাকশাল প্রবর্তনের প্রায় এক বছর আগে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘মঞ্চে- নেপথ্যে’ উপসম্পাদকীয়তে লেখক দেশের প্রশাসনিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছেন। এতে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি তখন ক্রমশ অ-শাসনযোগ্য হয়ে উঠেছিল, তা অনুমান করা যায়। পুরো উদ্ধৃতিটি নিচে তুলে ধরতে চাই :
‘অনেকেই আজকাল বলেন, শুধু অর্থনীতিই ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে না, শুধু রাজনীতিই বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া উঠিতেছে না, শুধু আইনের শাসনই অপস্রিয়মাণ হইয়া পড়িতেছে না, প্রশাসনও আজ বিপর্যস্ত, ভগ্নোন্মুখ। প্রশাসনযন্ত্রের ভাঙ্গিয়া পড়ার দশা দেখা দিয়া থাকুক আর না-থাকুক, এর গতি যে নিদারুণভাবে শ্নথ হইয়া উঠিয়াছে, এর ইনিশিয়েটিভ বা উদ্যোগের যে অনেকখানি অভাব দেখা দিয়াছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। যেন একটা স্ট্যাগনেশন বা আবদ্ধতা প্রশাসন যন্ত্রকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে, সেই বেড়া হইতে উহা বাহির হইয়া আসিতে পারিতেছে না। … এক সহযোগী হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, সচিবালয়ে যে ক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত সাড়ে একচল্লিশ ঘণ্টা কাজকর্ম হওয়ার কথা, সে ক্ষেত্রে কাজের কাজ হয় মাত্র সাড়ে ষোল ঘণ্টা। বাকি পঁচিশ ঘণ্টাই ফাও। কর্মকর্তারা আসেন দেরিতে, যান সকাল-সকাল। দুই দিক দিয়াই তো আর তাহারা অ-সময়নিষ্ঠ হইতে পারেন না! কোর্ট কাচারিতে শুনি কয়েক লাখ পেন্ডিং কেস। এর পিছনে না-হয় বোধগম্য কারণ আছে- প্রয়োজনের অর্ধেকও জজ-ম্যাজিস্ট্রেট নাই। কিন্তু প্রশাসনের আপিসে আপিসে কেন শত-সহস্র পেন্ডিং ফাইল? কেন ফাইলের মুভমেন্ট এত ধীর-মন্থর? কেন ডিসিশনে এত দীর্ঘসূত্রতা? জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের না-হয় নিদারুণ অভাব আছে, কিন্তু অফিসার-কর্মচারীর তো কোনো অভাব নাই? এইটুকু দেশে শুনিয়াছি, কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়িয়া সাড়ে ছয় লাখ ছাড়াইয়া গিয়াছে। রাজস্বের সিংহভাগ ব্যয় হইতেছে অফিসার পুষিতে। তবু কেন কাজ হয় না? গলদ কোথায়? … সত্য কথা বলিতে কি, সরকারি কর্মচারীরা আজ অনেকখানি নিরুদ্যম, নিরুৎসাহ, বোধ করি, কিছুটা অসন্তুষ্টও। টোকা দিয়া দেখুন, তন্ত্রীতে যে সুর বাজে সে-সুর খুব মধুর নয়। প্রত্যেকের কি যেন একটা ক্ষোভ, আক্ষেপ, অসন্তোষ অভিযোগ। … কেন এই উদ্যম-উৎসাহের অভাব? আর এটা তো শুধু প্রশাসনেই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে এবং গোটা পাবলিক সেক্টরেও একই অবস্থা। সেখানেও কর্মোদ্যমের অভাব, উদ্যোগ ইনিশিয়েটিভের অভাব। কলকারখানা পা খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া চলিতেছে। চলিতেছে উৎপাদন হ্রাস। কোম্পানির মাল দরিয়ায় ঢালা হইতেছে। লোকসান আর ওভার-ড্রাফটের বোঝা স্টম্ফীত হইতেছে। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ব্লাড-ট্রান্সফ্যুশন দিয়া চলিতেছে পাবলিক সেক্টরের এই রক্তশূন্য রোগীকে বাঁচাইয়া রাখার চেষ্টা। আর মাঝে মাঝে দেওয়া চলিতেছে, বঙ্গবন্ধুর সারপ্রাইজ ভিজিটের শক-থিরাপি। কোথায় পাটকলে ভিজা পাট, পোড়া পাট চালানো হইতেছে, কোথায় চলিয়াছে পিলফারেজ-পাচার, কোথায় ‘নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে’ লাখ লাখ টাকার আমদানি করা কাপড় খোলা জায়গায় পড়িয়া পচিতেছে, তাহা ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে হেলিকপ্টারে ছোটাছুটি করিতে হইতেছে। প্রশাসন কোন পর্যায়ে নামিয়া আসিলে এসব ঘটনা ঘটিতে পারে এবং এসব বিষয় লইয়া দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ছোটাছুটি করিতে হয়, তাহা সহজেই অনুমেয়।’ বাকশাল কর্মসূচি প্রবর্তনের প্রাক্কালে এই পরিস্থিতির আরও অবনমন ঘটেছিল।


দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর সমতামুখী সমাজের ভাবনা বাকশাল কর্মসূচিতেও বিধৃত হতে দেখি। বাকশালকে তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলেছিলেন, যার প্রথম উচ্চারণ শুনতে পাই ১৯৭২ সালে সংবিধান গ্রহণের সময় মুজিবের ভাষণে। তিনি সেদিন যা বলেছিলেন তা ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’ সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে যায়। বাকশাল ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীভবন ও এক অভিন্ন রাজনৈতিক জোটের নতুনতর সংজ্ঞার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা ছিল। যে-অর্থে আজকের দিনেও গণচীন বা ভিয়েতনাম বুর্জোয়া-গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে, বঙ্গবন্ধুর বাকশাল করে সে রকম জনকল্যাণের পথে এগুতে চেয়েছিলেন। আগেই বলেছি, সেই পাশ কাটানোও ছিল সাময়িক সময়ের জন্য। ১৯৭২ সালে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নিয়ে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন ১৯৭৫ সালে বাকশালের তাত্ত্বিক পটভূমি হিসেবে সেই কথাগুলোকে আবারও স্মরণ করতে হবে। গরিবের জন্য কল্যাণকর আর বড়লোকের জন্য কল্যাণকর গণতন্ত্র সমার্থক গণতন্ত্র নয়। তিনি বলেছিলেন :
‘দ্বিতীয় কথা, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে দেখা যায় সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যে সব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে- ঐ শোষকরা যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারও সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয়ই আমরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইনসিওরেন্স-কোম্পানি, কাপড়ের কল, জুট-মিল, সুগার ইন্ডাস্ট্রি সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি তার মানে হলো, শোষক-গোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে। তৃতীয়- সমাজতন্ত্র। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা এগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না; তাদের আগে বোঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কী। সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না- অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়।’


আবারও দেখতে পাচ্ছি, ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন। এই শোষণমুক্ত ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ গড়ার সুরই বাকশালেরও প্রধান প্রেরণা। আপাতদৃষ্টিতে এর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘একদলীয়’ মনে হতে পারে, কিন্তু সেটা শুধু সাময়িক সময়ের জন্য। এ রকম ব্যবস্থার প্রবর্তন করে সুস্থিরতা ফিরে এলে তিনি আবার ফিরে যেতে যান বহুদলীয় বিকেন্দ্রীভূত মানবিক সমাজতন্ত্রে। লেনিনীয় নিক্তিতে বলতে হয়, বাকশাল ছিল একটি সাময়িক জরুরি অবস্থা- ‘ওয়ার কমিউনিজমের’ পর্ব। এই পর্ব থেকে রাশিয়াকে বেরিয়ে যেতে তিন বছর সময় লেগেছিল। বাংলাদেশেও তেমন একটা বিরতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের ক্ষেত্রেই একপর্যায়ে এ রকম ‘জরুরি পর্বের’ প্রয়োজন দেখা দেয়।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::১০৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


[নুরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ] … এক-অর্থে সেটা ‘স্বীকারোক্তি’র মতো শোনাবে আজ :
“দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে তিনি ইতিমধ্যেই জনগণের উদ্দেশে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনুধাবন করতে আমাদের ব্যর্থতা বা অনাগ্রহ তাঁকে ক্ষুুব্ধ করেছিল। তাঁর মত অনুযায়ী দেশ তখন বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে চরম পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, দেশে সে সময় বিরাজমান গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত পদ্ধতিই একমাত্র কার্যকর পথ। তিনি আমাদের এটা স্পষ্ট করেই বললেন যে দেশের বিদ্যমান সমস্যা এবং এর সমাধান সম্পর্কে আমাদের যথাযথ চিন্তাভাবনা নেই।
১৯৭৫ সালের ৮ জানুয়ারি আমাদের উপরিউক্ত ছুটিতে যাওয়ার আগে আমি তাঁর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেছিলাম। পার্লামেন্টে নতুন সংবিধান (বাকশাল) পাস হওয়ার সামান্য কয়েক দিন আগে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন তাঁকে বেশ বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আমি কিছু বিদায়ী কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। তিনি রুমের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানটি তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…।’
তিনি বললেন, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক বিভক্তি এবং অস্থিরতা থেকে মুক্ত করতে তিনি চূড়ান্ত উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করার কাজটি অন্ধকার ঝোড়ো রাতে ঘন ঘন বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে একটি গভীর বন অতিক্রম করার সঙ্গে তুলনীয়। এখানে বিপদ আছে, আছে অনিশ্চয়তা। তবে একই সঙ্গে একটি নতুন সকাল ও সূর্যের আলোয় ভরা নতুন গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছানোর আশাও আছে। এই কঠিন যাত্রাকে বেছে নেওয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন পথ ছিল না।”

এই কঠিন যাত্রা শুরু করাই কঠিন-এর জন্য ঝুঁকি নিতে হয়, সাহস লাগে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। অনেক সময় অনেক দূর গিয়ে দেখা যায় রাস্তাটা বন্ধ-আর এগুলো যাচ্ছে না। তখন পিছু হঠতে হয়। যারা বিপ্লবী তারা অগ্রযাত্রার অগ্রগতিতেও বিমোহিত হন না, আবার সাময়িক পরাজয়েও ভেঙে পড়েন না। তবে বাকশালের মৌলিক অর্থনৈতিক দিকগুলো যে শুধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল তা নয়। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কথাটি ১৯৭২ সালেই বলা হয়েছিল; একইভাবে ‘মাল্টিপারপাস সমবায়ের’ কথা ওই বছরেই একাধিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন। এখন আমরা সেদিকটির প্রতি নজর দেব।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি আট-দশটা দেশের মতো সাধারণ গণতন্ত্রের পথ ধরে হাঁটতে চান না। স্বাধীনতার সেই প্রথম লগ্নেই তিনি বলেছিলেন যে, গতানুগতিক ধারায় বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলানো যাবে না:
‘আমার সরকার আভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী, পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচির শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।’
সে সময়ে বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণের পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা হলেও তার চিন্তায় তখনই নতুন পথে যাত্রার অভিপ্রায় সুস্পষ্ট। ‘পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলা’; ‘সম্পদের সামাজিকীকরণ’; সমতামুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সমাজতান্ত্রিক’ অর্থনৈতিক দর্শন; ‘শোষণ ও অবিচারমুক্ত সমাজ’ গড়ার আকাঙ্ক্ষা; সামাজিকীকরণের বিষয়টিকে ‘পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি’ হিসেবে দেখার চেষ্টা; এবং এক্ষেত্রে ‘অবাস্তব তাত্ত্বিকতা’ পরিহার করে বাস্তবানুগ হওয়ার তাগিদ। বঙ্গবন্ধুর চিন্তার এই মৌলিক উপাদানগুলো তখনই জন্ম নিচ্ছিল, যা কালক্রমে আরও পরিণতি লাভ করে। বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে তার ছাপ সুস্পষ্ট।
কো-অপারেটিভ করার কথা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই স্পষ্ট করে বলেছিলেণ-বাকশালের পূর্বসূরী ছিল তার এই চিন্তা। ওই বছরের ৫ এপ্রিলের বক্তৃতায় তিনি বলেন:’কিন্তু একটা কথা, এই দেশ নতুনভাবে সাজাতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল কইরেন না। আপনাদের জমি আমি নেব না। ভয় পাইয়েন না, জমি নিয়ে যাব তা নয়। বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার আওতায় থাকবে বেকার প্রত্যেকটি মানুষ। যে মানুষ কাজ করতে পারে। তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। আলটিমেটলি প্রত্যেকটি ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা হবে। তাদের কাছে পয়সা যাবে। কাছে বেতন যাবে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল…। তা না হলে দেশ এগুনো যাবে না। এজন্যই ভিলেজে কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে, পাঁচ বৎসর মেয়াদি প্রত্যেকটি গ্রামে কয়েক হাজার থেকে পাঁচশ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কম্পলসারি কমিউনিটি হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নিবেন। একটি অংশ যাবে কো-অপারেটিভে, ঐ অংশ গভর্নমেন্টের হবে। দ্বিতীয় অংশ থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে।’
উদ্ধৃত অংশ থেকে পুরো অর্থটি স্পষ্ট হয় না। তবে এর থেকে মূল ধারণাটি অনেকখানি আঁচ করা যায়। উৎপাদনমুখী সমবায় করা হবে, জমির মালিক তার জমির পরিমাণ অনুযায়ী ফসল পাবেন, একটি অংশ যাবে কো-অপারেটিভের তহবিলে, অপর একটি অংশ যাবে থানাভিত্তিক কাউন্সিলে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু গোড়া থেকেই সমবায়ীকরণের সঙ্গে বিকেন্দ্রীভূত শাসন-ব্যবস্থার একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে এই যোগসূত্রকে আরও যুক্তিসিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমবায়ের ধারণা বঙ্গবন্ধুর মনে স্বাধীনতার পূর্বাপর সময় থেকে একটি মৌলিক অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে বিরাজ করছিল। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে রেডিও-টিভি ভাষণে মুজিব প্রথমবারের মতো ‘বহুমুখী সমবায়ের’ কথা উল্লেখ করেন। উদ্ধৃতিটি তার চিন্তারাশিকে সংক্ষেপে তুলে ধরে:
‘একটি স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জায়গিরদারী, জমিদারী, সরকারী প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত করে অবশ্যই নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’
দেখা যাচ্ছে, ‘বহুমুখী সমবায়’ গঠনের বিষয়টিকে গোড়া থেকেই বঙ্গবন্ধু কৃষির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, উৎপাদনের অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টন, সামন্তবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের বিলোপ, ভূমিহীনদের জীবন-মান উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ভেবেছিলেন। সমবায়ের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করা এবং সুষম বণ্টন অর্জন- এই দুই লক্ষ্যকেই তিনি করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তার এই চিন্তা আরও বিকশিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চের ভাষণে, বঙ্গবন্ধু তার ‘সমবায়-চিন্তা’ ও ‘বিকেন্দ্রীকরণের’ চিন্তাকে এভাবে প্রকাশ করলেন:’এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই-যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে কিন্তু একটা কথা, এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না, ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাবো। তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যান-এই বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার অংশ- যে বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে কো-অপারেটিভ-এর সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কার্স প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেওয়া হবে, তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে। আপনাদের জমির ফসল আপনি নেবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে। দ্বিতীয়, থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারী যেই হয়-একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারী। তার মধ্যে আমাদের কৃষক, শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে-তারাই থানাকে চালাবে। আর মহকুমা থাকবে না, সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমার একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল থাকবে। সব কর্মচারী এক সাথে তার মধ্যে থাকবে। এরমধ্যে পিপলস রিপ্রেজেন্টেশন হবে, তার চেয়ারম্যান থাকবে। সেখানে তারা সরকার চালাবেন-এইভাবে আমি একটি সিস্টেমের চিন্তা করছি এবং করবো বলে ইনশাআল্লাহ আমি ঠিক করেছি। আপনাদের সাহায্য ও সহানুভূতি চাই।’
বাকশালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশকে সংকটের খাদ থেকে স্বাভাবিক অগ্রযাত্রার পথে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি বিশেষভাবে জোর দেন দুটি উপাদানের ওপরে। গ্রামজীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে যৌথ-চাষাবাদের ওপরে গুরুত্ব আরোপ এবং বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন। জমির মালিকানা-সম্পর্কে হাত না দিয়েই তিনি যৌথ-আবাদের মডেলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন প্রশাসনের ও বিচার-ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ। তিনি মনে করতেন যে, দুর্ভিক্ষ-উত্তর পরিস্থিতিতে গ্রামবাংলাকে বাঁচানোর ও ধরে তুলে দাঁড়ানোর জন্যে এটাই একমাত্র উপায়। সেরকম ‘আর্জেন্সি’ নিয়েই তিনি বলেছিলেন:
“আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর উপর বাংলার মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পায়জামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য কাজ করে যেতে হবে। যুবক চাই, ছাত্র চাই, সকলকে চাই।
আর একটা কথা বলতে চাই, বিচার। বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে সেই মামলা শেষ হতে লাগে প্রায় ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই, আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস নিয়ে যাই। ঐ মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়-তিন বা চার বছরের আগে শেষ হয় না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে হবে, যে থানায় ট্রাইব্যুনাল করার চেষ্টা করছি সেখানে মানুষ এক বছর বা দেড় বছরের মধ্যে বিচার পাবে-তার বন্দোবস্ত করছি। আশা করি সেটা হবে।
তাই আমি একথা জানতে চাই আপনাদের কাছে, জানতে চাই একটি কথা। এই যে চারটি প্রোগ্রাম দিলাম, এই যে আমি কো-অপারেটিভ করবো, থানা কাউন্সিল করবো, সাবডিভিশনাল কাউন্সিল হবে, আর আমি যে আপনাদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ফসল চেয়েছি, জমিতে যে ফসল হয় তার ডবল। কল-কারখানায় কাজ-সরকারি কর্মচারী ভাইরা একটু ইনডিসিপ্লিনে এসে গেছে। অফিসে যান, কাজ করেন। আপনাদের কষ্ট আছে, আমি জানি। দুঃখী মানুষ আপনারা। আপনারা কাজ করেন। যাদের পেটে খাবার নাই, তাদের উপর ট্যাক্স বসিয়ে আমি আপনাদের পোষতে পারবো না। প্রোডাকশন বাড়লে আপনাদেরও এদের সাথে উন্নতি হবে।”
আজকাল কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সমবায়-চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এই সমবায়-চিন্তা ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি-খামার বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা সে প্রশ্ন তাদের মনে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে তিনটি দিক আমাদের বিচার করতে হবে। প্রথমত, কৃষিতে বা গ্রাম-জীবনে যৌথতার চর্চা বা সমবায়ের চর্চা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বাংলায় একটি প্রতিষ্ঠিত ঘরানা। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার ‘সমবায়’ গ্রন্থে বহুবার তার যুক্তি পেশ করেছেন। প্রমথ চৌধুরী থেকে শুরু করে স্যার আজিজুল হক সকলেই বাংলার রায়ত-কৃষকের দুর্দশার কথা আলোচনা করে কোনো-না-কোন প্রকারের সমবায়-ব্যবস্থার বা যৌথ অঙ্গীকারের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ-বেকারত্ব সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। এ কারণেই সমবায়ের ধারণাকে বঙ্গবন্ধু বা তার সমসাময়িক নেতৃত্বের কাছে অপ্রত্যাশিত কোনো ‘বিদেশী’ (ইমপোর্টেড) ধারণা বলে মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বা পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লব সমবায়ের ধারণাটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বের কাছে। বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে চীন, ভিয়েতনাম ও পূর্ব ইউরোপের অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই যৌথ চাষপ্রথা প্রবর্তনের ব্যাপারে প্রায় নিঃসংশয় ছিলেন। অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা ইতোপূর্বে করে গেছেন। আমি তার লেখার সূত্র ধরে তিনটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরছি।
প্রথমেই আসে বিশ্বব্যাংকে কর্মরত ফাল্যান্ড ও পারকিনসন দুই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদের কথা। “বাংলাদেশ-এ টেস্ট কেইস অফ ডেভেলপমেন্ট” বইতে তারা শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে পৌঁছান:
“সুতরাং প্রতীয়মান হয়, যদি আয় বিতরণ এবং নিয়োজনের সুযোগের সমস্যার সমাধান করতে হবে, তাহলে যৌথ চাষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। …এ ধরনের স্পষ্টতই সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত নাও হতে পারে। কিন্তু এই উপসংহার কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে নিঃসৃত নয়; এই উপসংহারে উপনীত হতে হয় কেননা জমি-স্বল্পতার পরিস্থিতিতে ভূমিহীনদের জীবিকা নিশ্চিত করার জন্য কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া দুরূহ।”
এর পরে আসে অধ্যাপক নূরুল ইসলামের কথা, যিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি গোড়াতে অর্থনীতিবিদ মো. আনিসুর রহমানের মতো অতটা ‘সমবায়পন্থি’ ছিলেন না। কিন্তু আলোচনার এক পর্যায়ে তিনিও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ‘যতোই জনসংখ্যা এবং তার সঙ্গে ভূমিহীন মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষুদ্রাকার জোতসমূহ আরও বিভক্ত হতে থাকবে, ততোই কোনো-না-কোনো ধরনের যৌথ ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য চাপ ও যুক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা, কেননা, এরূপ ব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান বেকারত্বকে অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছানো থেকে রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির এরূপ ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে জমির কোনো-না-কোনো ধরনের যৌথ মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আয় ও শ্রম নিয়োজন ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে কাজ করতে পারে”।
গ্রামের ‘উদ্বৃত্ত শ্রমকে’ কীভাবে উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করা যায় এটাই ছিল তাদের প্রাথমিক দুর্ভাবনা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষক আবু আবদুল্লাহ মনে করেছিলেন যে,
“ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে জমির পুনর্বিতরণ বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাবলীর সমাধান দিতে পারবে না; বরং কতক ক্ষেত্রে তা এসব সমস্যাকে আরও সংগীন করে তুলতে পারে। সুতরাং, আমাদের কৃষি সমস্যার সমাধান কোনো-না-কোনো ধরনের যৌথতামূলক ব্যবস্থার মধ্যেই খুঁজতে হবে।”
আমি বলতে চাইছি যে, বাকশালে বিধৃত বহুমুখী কো-অপারেটিভ বা সঞ্চয়ের মৌলিক চিন্তাটির পেছনে নানা সূত্র থেকেই যুক্তি-সমর্থন এসেছিল। এটা ঠিক যে সেকালের বাংলাদেশে শহরের মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ গ্রামের সনাতনি কৃষি-ব্যবস্থার সরাসরি সুবিধাভোগী ছিলেন এবং প্রস্তাবিত সমবায় ব্যবস্থায় তাদের স্বার্থহানি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাছাড়া, গ্রামীণ এলিট-শ্রেণি সমবায়-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ রোধে শহরের মধ্যবিত্তকে পূর্বাপর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। নগরের ‘মধ্যবিত্ত’ ও গ্রামের ‘এলিট’ এদের যৌথ-প্রভাবকে প্রতিহত করে নতুন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কাছে তখন তিনটি পথ খোলা ছিল- (ক) ক্রমশ নৈরাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করা, যেটা তার ও তার প্রজন্মের নেতৃত্বের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না; (খ) ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগের ধরন মেনে মার্কিন-চীন-পাকিস্তান এই অক্ষ-শক্তির কাছে নতিস্বীকার করা এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা, যেটা বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা কখনোই মেনে নিতে পারতেন না; (গ) নৈরাজ্য ও প্রতিক্রিয়ার মুখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা, যেটা বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সফল হলে দেশ আবার সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসত, আর বিফল হলে অনিবার্য ছিল চিলির কায়দায় নিষ্ঠুর ও দীর্ঘ সামরিক শাসন। বাস্তবেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশে নিষ্ঠুর সামরিক শাসন চলেছিল।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::১০৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এবারেও তাদের বেশিরভাগ নেতারই এই মনোভাব ছিল। তাছাড়া, বাকশালের কর্মসূচি ছিল অনেকাংশে র‌্যাডিকেল (বিশেষত বহুমুখী সমবায় ও বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত)। প্রচলিত আওয়ামী লীগের দলীয় ভাবনাকে সেটি অতিক্রম করে গিয়েছিল। দক্ষিণপন্থিরা এবং চরম বামপন্থিরা (তাদের নাম আজকে নাই-বা করলাম) পূর্বাপর আওয়ামী লীগ ও বাকশাল কর্মসূচির বিরুদ্ধতা করেছিল। তাদের মাথায় ঘুরছিল ভারতের ‘সম্প্রসারণবাদ’ আর সোভিয়েত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ বিরোধিতার পুরোনো স্লোগান। অথচ চীন তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি এবং ১৯৭২-৭৫ পর্বে এক কপর্দকও সহায়তা করেনি- এমনি ছিল চরম বামপন্থিদের মোহান্ধতা। পাকিস্তানবাদী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কথা নাই বললাম। আসলে সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের রাস্তা কোনো গুলশান এভিন্যুর মতো মসৃণ রাজপথ নয়। সেটা বঙ্গবন্ধু যেমন জানতেন, তেমনি তৎকালীন সিপিবি-ন্যাপ নেতৃত্বও জানতেন। এদেশের ভেতরে ও বাইরের প্রতিক্রিয়াশীলদের হুমকি থেকে বের করে নিয়ে এসে প্রগতির ধারায় পরিচালিত করতে হবে এক সর্বব্যাপী আয়োজনের মাধ্যমে এটিই ছিল প্রধান উপলব্ধি। এই পথ বিপদ-সংকুল মুজিব নিজেও সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে সেটা তিনি বলেও ছিলেন। এক ধরনের প্রিমনিশন হয়েছিল তার। যেন দেখতে পাচ্ছিলেন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নদী তিনি নৌকাযোগে পার হচ্ছেন। সেই সময়টা পার হতে পারলেই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে ঝরঝরে বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ সোনালি দিন। বাকশাল-পর্ব ছিল সেই অসমাপ্ত মহা-উৎক্রমণের পর্ব।
দেশের সংকট মোকাবিলায় সাময়িককালের জন্য হলেও বাকশালের মতো একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি- এ উপলব্ধি সিপিবি-ন্যাপ তৎকালীন ‘মস্কোপন্থি’ দল-গোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশের মধ্যেই পূর্বাপর জাগ্রত ছিল। এরা অনেকে ১৯৭২ সাল থেকেই একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে থাকবেন। মতিউর রহমানের পূর্বোক্ত লেখাতেও এর ইঙ্গিত আছে। এটা কোনো অস্বাভাবিক চিন্তা ছিল না সিপিবি-ন্যাপের জন্য। সে সময়ের ষাট-সত্তরের আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত তত্ত্ব ছিল ‘অপুঁজিবাদী বিকাশের পথ’ (যা পরে সমাজতন্ত্র-অভিমুখীনতার বা ‘সোশ্যালিস্ট ওরিয়েন্টেশন’ বলে অভিহিত হয়)। মধ্যবিত্তের প্রগতিশীল অংশের সাথে শ্রমিক-কৃষক সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ঐক্যজোট ছাড়া জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এক পর্যায়ে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে- এই আশঙ্কা ছিল তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই। সিপিবি-ন্যাপের মতো প্রগতিশীল বামপন্থি ধারাগুলো সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সাথে ‘অভিন্ন মঞ্চ’ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল ১৯৭১ সাল থেকেই। শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান নন, অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামও মনে করেছেন, বাকশালের পেছনে দেশের বামপন্থি মহল ও আন্তর্জাতিকভাবে সোভিয়েত বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর অনেকেই পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়ে থাকবে। তিনি অবশ্য সেখানে ‘জনশ্রুতির দোহাই’ দিয়েছেন তার প্রদত্ত তথ্যের উৎস সম্পর্কে বলতে গিয়ে। কিন্তু যেভাবে লিখেছেন তাতে বোঝা যায়, জনশ্রুতিকে তিনি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন। পুরো উদ্ধৃতিটি আমি তুলে ধরতে চাই। নুরুল ইসলাম লিখেছেন :
‘জনশ্রুতি ছিল, প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনীর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কাছ থেকে পরামর্শ পেয়েছিলেন। কিন্তু এ সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ কোনো জ্ঞান ছিল না। অনেকে মনে করত যে বঙ্গবন্ধু বিশেষ করে বাংলাদেশের কিছু বামপন্থি রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। হয়তো তাঁরা পূর্ব ইউরোপের একদলীয় রাষ্ট্র ও পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা পোল্যান্ড ও যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশের উদাহরণ তুলে ধরে থাকতে পারেন। সাধারণভাবে এই দেশগুলো সোভিয়েত ব্যবস্থা থেকে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারণাগুলো নিয়েছিল। তারপর কিছুটা রদবদল করে তাদের দেশে তা কার্যকর করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা তাদের পুরোনো অর্থনৈতিক কাঠামো ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রথার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সোভিয়েত ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বহুমুখী কৃষি সমবায় ও শিল্প ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের যে বিষয়গুলো রেখেছিলেন, তা পূর্ব ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়। এগুলো সবই আমার ধারণা। এ ব্যাপারে আমি সরাসরি কোনো খবর পাইনি অথবা বাম দলগুলোর সঙ্গেও আমার কোনো আলোচনা হয়নি।’
১৯৭২ সাল থেকেই জাতীয় সরকার ধরনের ঐক্যজোট গড়া এবং ১৯৭৪ থেকেই বাকশাল ধারার একটি সাময়িক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলাপ-আলোচনা চলছিল। ‘বুর্জোয়া-গণতন্ত্র’ নিয়ে বিভ্রম ছিল না সিপিবি-ন্যাপের বড় অংশের মধ্যে। যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্র রাখতেই হবে- এ রকম হঠকারী লিবারেল বিভ্রমের মায়াজালে আবদ্ধ হতে চাননি তারা। অনেক সময়ে অনেক প্রয়োজনে উন্নয়নের শুদ্ধ মানদণ্ড অনুসরণ করা সম্ভব নয়- এটা তারা জানতেন; সোভিয়েত পার্টিরও সেটা জানা ছিল। বঙ্গবন্ধুর মধ্যেও সে উপলব্ধি জেগেছিল। আগে দেশের মানুষের জন্য খাদ্য-সংস্থান করতে হবে; বণ্টন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে হবে, তারপর অন্যকিছু। ১৯৭২-৭৪ সালের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছিল, দেশকে বাঁচাতে হলে অন্য পথ নিতে হবে, কয়েক বছরের জন্য হলেও। লাইনচ্যুত রেলগাড়িকে স্বাভাবিক উন্নয়নের পথে ফিরিয়ে আনতে হলে আপাতদৃষ্টিতে কিছু ‘অস্বাভাবিক পন্থা’ অবলম্বন করতেই হয়। যে কোনো প্রবল সংকটের মুখেই মানুষকে তা করতে হয়। সেটা একটা জাতি বা দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তখন ‘গণতন্ত্র গেল, গণতন্ত্র গেল’ বলে মায়াকান্না জুড়ে দিলে প্রাগম্যাটিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেওয়া হয় না। মুশকিল হলো, লিবারেলরা বা সোশ্যাল লিবারেলরা ইতিহাসের পরিবর্তনে ‘জোর খাটানোর’ (রোল অব ফোর্স) ভূমিকাকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে অস্বীকার করে থাকেন। এংগেলসের অ্যান্টি-ডুরিং এ ক্ষেত্রে অবশ্যপাঠ্য ইতিহাসের পট-পরিবর্তনে কেন ‘শক্তি প্রয়োগের’ প্রয়োজন তা বোঝার ক্ষেত্রে।
পোস্ট-কলোনিয়াল আমলে ডোমিন্যান্স ও হেজিমনি দুইয়েরই ভূমিকা থাকে, বিশেষত উন্নয়নের শুরুর পর্যায়ে। বাংলাদেশের অবস্থাটাও সেদিন ছিল সে রকম। মনে রাখতে হবে, সাধারণভাবে বাংলাদেশ ১৯৬৯/৭০ সালের মাথাপিছু আয়কে ছুঁতে পেরেছিল ১৯৮১/৮২ সালের দিকেই কেবল। এ অর্থে ১৯৭২-১৯৮২ এই ১০ বছর ছিল বাংলাদেশের পুনর্গঠন পর্ব। এ ধরনের পর্বের ক্ষেত্রে কোনো অর্থনীতিবিদ বা পরিসংখ্যানবিদই স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের ধারণা প্রয়োগ করতে চাইবেন না। আর ১৯৭২-৭৪ পর্বের পরিস্থিতি ছিল আরও বিপদসংকুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। আমি এ ক্ষেত্রে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের সাথে একটি বড় সাদৃশ্য দেখতে পাই। দুই ক্ষেত্রেই প্রথমদিকে নিয়মতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনে চলার চেষ্টা ছিল। কিন্তু তাতে নয়া রিজিমের বিরুদ্ধাচরণ করার ক্রমবর্ধমান অপতৎপরতাকে নিরুৎসাহিত করা যায়নি। রাশিয়ায় ‘হোয়াইট টেরর’ (অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীলদের ও চরমপন্থি দলগুলোর চোরাগোপ্তা আক্রমণ) যখন ব্যাপক আকারে শুরু হলো এবং স্বয়ং লেনিন ১৯১৮ সালে এদের আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হলেন, তখন বাধ্য হয়ে শুরু করতে হয়েছিল ‘রেড টেরর’। এই একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ১৯৭১ সালের পর আওয়ামী লীগকে। ১৯৭২-৭৪ পর্বে প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মী বিভিন্ন চোরাগোপ্তা আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন। বিপ্লবোত্তর রেড টেররকেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘লাল ঘোড়া দাবড়ানোর’ কথা তুলে। এ পরিস্থিতিতে অন্য পথ অবলম্বন করা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। এটাই রূঢ় বাস্তবতা। ‘রেড টেরর’ শুরু হওয়ার পর বহির্বিশ্বে, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় লেনিনের সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে ছি ছি পড়ে গেল। লিবারেলদের মধ্যে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন নতুন সরকারের থেকে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এটি ঘটেছিল। হয়তো এদের অনেকে রাজনীতির বাইরে থেকে বাকশালের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। তাদের অবস্থা ছিল অনেকটা বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রথম বছরগুলোর বৈরী পরিবেশ হতবিহ্বল ও বিচলিত ম্যাক্সিম গোর্কির মতো। ব্যক্তিস্বাধীনতার নানা হস্তক্ষেপে গোর্কি প্রায়ই লেনিনের দ্বারস্থ হতেন। প্রতিবারই এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে অম্লমধুর বাক্য বিনিময় হতো। শেষ পর্যন্ত বিপ্লবোত্তর নতুন ব্যবস্থাকে যারা মন থেকে মানতে পারছেন না, তাদেরকে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় ১৯২১ সালে। যে স্টিমারে করে তারা দেশের বাইরে চলে যান, তার নাম দেওয়া হয় ‘ফিলোসফার’স স্টিমার’। মূলত লিবারেল রাজনীতির সাথে জড়িত বা একেবারেই যারা রাজনীতি-সচেতন নন, সেসব ঝুঁকি-এড়ানো বুদ্ধিজীবী এই স্টিমারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এদের বড় একটা অংশ বিপ্লবোত্তর রুশ সরকারের সমর্থক হিসেবে প্রবাসে আবার সক্রিয় হয়েছিলেন। বাকশালের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নমত সত্ত্বেও বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীই একে ‘আপৎকালীন ব্যবস্থা’ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। দেশ এমনই সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল যে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তারা এ রকম ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত সায় জানিয়েছিলেন বৃহত্তর প্রগতির স্বার্থে।
আগেই বলেছি, বাকশাল জাতীয় ব্যবস্থা গড়া নিয়ে ১৯৭৪ সালজুড়েই কথাবার্তা চলছিল রাজনৈতিক মহলে। সরকারের একজন তীক্ষষ্ট ও তীব্র ‘দক্ষিণপন্থি’ সমালোচক হিসেবে ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’ নামে ইত্তেফাক পত্রিকায় কলাম লিখতেন ‘স্পষ্টভাষী’ (খোন্দকার আব্দুল হামিদ)। এহেন ‘স্পষ্টভাষী’ ১৯৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল লিখেছেন :
“চারিদিকে অসংখ্য গুজব। ‘এমারজেন্সির’ নামে বলগাহীন জল্পনা-কল্পনা। আমার ওসব জল্পনা-কল্পনার প্রয়োজন নাই। দুর্নীতি, চোরাচালান, মওজুদদারী, মুনাফাখুরী, শ্বেত-সন্ত্রাস ও সমাজবিরোধী নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ দমনের জন্য সামরিক বাহিনীকে সাময়িকভাবে নামানোর প্রয়োজন বোধ করিলে সরকার তাহা করিবে, আমাদের আপত্তির কোন কারণ নাই। আমরা শুধু চাই শান্তি। আমরা সন্ত্রাস চাই না। আমরা চাই নিরাপত্তা।…’গ্যাংগ্রিন মলমে-প্রলেপে সারে না’ নিবন্ধে বলা হইয়াছে যে, এটা হইল আজিকার জরুরী কর্তব্যের এক দিক। অপর দিকটি হইতেছে অর্থনীতির পাগলা ঘোড়াকে পাকড়াও করিয়া আস্তাবলে আবদ্ধ করা, এই অর্থনৈতিক নৈরাজ্যকে দমন করা, ইহাকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরাইয়া আনা। আমি অত বড় বড় তত্ত্ব বুঝি না। কোন বিশেষ তত্ত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে আমি কোন সেট-নোশন বা পূর্ব-নির্ধারিত ধারণাও পোষণ করি না।…অতি তেজস্কর ঔষধ অতি ক্ষীণ, দুর্বল রোগীর অঙ্গে পরীক্ষা করিতে গিয়া আমরা রোগীকেই মৃতকল্প করিয়া তুলিয়াছি।…রোগী বাঁচিলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পরে অনেক পাওয়া যাইবে।…অতএব, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ইমারজেন্সি হইবে কি হইবে না, সেটা আমার ততটা বিবেচ্য নয়। আমার চোখে আজ সবচেয়ে জরুরী প্রশ্ন, এই বিশৃঙ্খল অর্থনীতির পাগলা ঘোড়াকে ডিসিপ্লিনে আনা। এই দিকটিকে উপেক্ষা করিয়া শুধু উপরদিকে ইমারজেন্সি-পাওয়ার প্রয়োগ করিলে বাঞ্ছিত ফল সম্পূর্ণ পরিমাণে লাভ করা সম্ভব নাও হইতে পারে।”
এই যদি হয় দক্ষিণপন্থি সমালোচকেরও উপলব্ধি, তবে বামপন্থি মহলে উদ্বেগ আরও গভীরতর হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এই উদ্বেগই ছিল প্রধান সুর। অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে; আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধ করতে হবে; দুর্নীতিকে প্রশমন করতে হবে; জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে- এটাই ছিল তার প্রধান বিবেচনা। রাজনীতি এখানে অর্থনীতির বোধের দ্বারা চালিত হয়েছে। লিবারেল বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই সেটি বুঝতে পারেন না। এ বিষয়ে নুরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ এখনও প্রাসঙ্গিক।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::১০২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এটাকেই বিপ্লব-উত্তরকালের পরিপ্রেক্ষিতে ‘উত্তরণশীল পর্ব’ বা ট্রানজিশন পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালের অভ্যুদয় সোভিয়েত-চীন দেশের মতো ‘আর্থ-সামাজিক’ বিপ্লব ছিল না ঠিক, কিন্তু ‘বিপ্লব’ ছিল সর্বার্থেই। এবং বিপ্লব হয়ে থাকলে তার একটি ‘উত্তরণশীল পর্ব’ থাকবেই, যার মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে অতিক্রম করতে হয় একটি ‘পুরোনো ব্যবস্থা’ থেকে ‘নতুন ব্যবস্থায়’ পৌঁছানোর জন্যে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টার মতোই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর রাস্তা কোন পিচঢালা মসৃণ পথ ছিল না। এতে ছিল চড়াই-উৎরাই-অপ্রত্যাশিত বন্যা ও দুর্ভিক্ষের ছোবল। এরকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিপ্লবের পরে অবস্থা বুঝে আঁকাবাঁকা পথের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তখন পিছু হটলে সাইডলাইনে থাকা তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ ভদ্রলোকেরা দুয়ো দুয়ো করে ব্যঙ্গ করতে থাকে। তারা তখন বলতে থাকে, ”খুব তো বড় মুখ করে ‘সমাজতন্ত্র’ করতে চেয়েছিলে, এখন বোঝ। সেই তো পিছু হটতে হচ্ছে তোমাদের। পাহাড়ে উঠতে চেয়েছিলে সাত-পাঁচ না ভেবে। অথচ এখন দেখছ রাস্তাটা ডেডএন্ডে আটকে গেছে। এখন তো তোমাদের ফিরে আসতে হবে নিচে। নামতে নামতে তারপরে বের করতে হবে আবার উপরে ওঠার রাস্তা। তা-ও খুঁজে পাবে কিনা তার কী গ্যারান্টি?” এরকম তির্যক তিরস্কার চারপাশ থেকে ধ্বনিত হতে থাকবে। বিপ্লবীদের পরাজয়ে যারা সবসময়ই এরকম অযাচিত উপদেশ আর তিরস্কার বাণী বর্ষণ করে থাকে। বঙ্গবন্ধুকেও ১৯৭২ সাল থেকেই এ ধরনের তিরস্কার-গঞ্জনার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছিল। মুজিব ঠিকই জানতেন যে এটা সেই দেশ যেখানে দশজন ভিলেন মিলে- ঘরে-বাইরের শত্রুরা একযোগে-যখন একজন নায়ককে পেটায়, তখন চারপাশের উৎসুক জনতা ভিড় করে তারিয়ে তারিয়ে সেদৃশ্য উপভোগ করে। এরাই সেই জনতা যারা সফল হলে মাথায় চড়িয়ে নাচতে থাকে, আর বিফল হলে মাটিতে মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করে না। মুজিব এটা জেনেও পিছু হটে অন্য রাস্তা খুঁজতে দেরি করেননি। ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ডেভেলপ-এরকম একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হতে চেয়েছেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ সূচনা করে। তার সহযোগীদের বলেও ছিলেন সেকথা।
দ্বিতীয় বিপ্লব যে উত্তরণশীল পর্বের একটি ‘সাময়িক কর্মসূচি’ ছিল এর নানা সাক্ষ্য পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি। প্রথম প্রমাণ হিসেবে শেখ হাসিনার নিজের স্মৃতিচারণাকে পেশ করতে চাই। ১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনা এ বিষয়ে লিখেছেন:
”আজ যখন আমরা জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছি তখন বার বার আব্বার কথা মনে পড়ছে। যখন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী দিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন এবং সকল রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে একই মঞ্চে সমবেত করে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। তখন একটা নতুন সিস্টেম দাঁড়ালো। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সারাজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, এখন এই পদ্ধতিতে কেন গেলেন?’
তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, একটা বিপ্লব হয়েছে। যে কোন বিপ্লবের পর সমাজে একটা বিবর্তন আসে, আমাদের সমাজেও আসবে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হবে এবং এর বিস্তৃতিও হবে-যার প্রভাব পড়বে সমাজ ব্যবস্থার উপর। কিছু মানুষ হঠাৎ করে প্রচুর টাকার মালিক হবে-সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব বাড়াতে নির্বাচন করবে শুধু টাকার জোরে; এর প্রভাব নির্বাচনের উপরও পড়বে। দেখা যাবে টাকা ও লাঠির জোরে নির্বাচন হচ্ছে। সত্যিকার সমাজসেবক বা দেশপ্রেমিক বা আদর্শবান যারা তারা এদের সাথে টাকা ও লাঠির জোরে পেরে উঠবে না। তাই এমন একটা ব্যবস্থা করতে চাই অন্তত কিছু দিনের জন্য যাতে কালো টাকা ও পেশিশক্তি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারে। একটা সাধারণ নির্বাচন যদি এভাবে হয় তাহলেই মানুষের চক্ষু খুলে যাবে আর মানুষকে কেউ ধোঁকা দিতে পারবে না। আর এ ব্যবস্থা মাত্র ৩/৪ বৎসরের জন্য; পরে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব।”
উপরের উদ্ধৃত অংশের সারাংসার নিহিত ছিল একটি বাক্যে। চতুর্থ সংশোধনী ও পরবর্তীকালে বাকশাল গঠন একটি প্রয়োজনীয় নিদান ছিল সেদিনের সমস্যা মোকাবিলায়। কিন্তু এটি ছিল সাময়িককালের জন্যে :’মাত্র ৩/৪ বৎসরের জন্য; পরে আবার আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব।’ এই একই কথা বলেছেন আমাকে প্রাক্তন আমলা ও অর্থমন্ত্রী এম. সাইদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের শেষ কয়েক মাসে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে থেকে কাজ করেছিলেন তিনি। একবার বঙ্গবন্ধুকে বাকশালের আয়ুস্কাল নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। উত্তরে বঙ্গবন্ধু কোনো কথা না বলে হাতের তিনটি আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন-‘তিন বছরের জন্য’। সাইদুজ্জামান আমাকে আরও জানান যে অবস্থা মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতি থেকে কিছুকালের জন্যে হলেও ‘সরে আসতে হবে’ (কেননা সব অথেনটিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেই এটা করতে হয়েছে) একথা বলেছিলেন খোদ ফিদেল ক্যাস্ট্রো নিজে। ক্যাস্ট্রো স্বয়ং এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলেন পরবর্তীকালে কানাডায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত (যিনি যুগপৎ কিউবারও দায়িত্বে ছিলেন) কর্নেল নুরুজ্জামানকে। তবে আইডিয়াটা শুধু ক্যাস্ট্রোর থেকেই উদ্গাত হয়েছিল তা নয়। অন্য উৎসের থেকেও পরোক্ষ সমর্থন মিলেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাময়িক পর্বের জন্য বাকশাল গঠনের বিষয়ে সমর্থন দিয়েছিল? এ বিষয়ে কিছুটা পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়। মতিউর রহমান তার ‘বাকশাল-কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রবন্ধে লিখেছেন: “এমন একটি কথা প্রচারিত আছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পেছনে বাংলাদেশের ‘মস্কোপন্থি’দের প্ররোচনা ছিল। এবং তাদের পরামর্শেই ওই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল সেদিন। এসব কিছুর পেছনে ‘সোভিয়েতের হাত’ রয়েছে, এমন কথাও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এর সমর্থনে কেউ কোনো সত্য তথ্য দিতে পারেনি। প্রচারিত এ তথ্য অসত্য।” এ প্রসংগে মতিউর রহমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের উদাহরণ দিয়েছেন। একাধিক বইয়ে মনিরুজ্জামান দাবি করেছেন, ”একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশের অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের ঢাকাস্থ দূতাবাসের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের দুজন বড় নেতাকে ‘এক দল’ করার জন্য প্রভাবিত করেছিল।” মতিউর রহমানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, ‘এসব তথ্যের সমর্থনে কোনো সূত্র বা তথ্য হাজির করেন নি তালুকদার মনিরুজ্জামান। সে জন্য তাঁর বইয়ের কোনো পাঠকের পক্ষে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ নেই।’
সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (১৯৭২-৭৫ পর্বে ডাকসুর সহসভাপতি) অবশ্য কিছুটা ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন বাকশাল প্রসংগে সোভিয়েত-দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। আমাকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, সোভিয়েতের বার্তা ছিল কিছু অস্পষ্ট। বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘এক দল’ করা যাবে না এমন কোনো কথা নেই বিপ্লবের জ্ঞানকোষে, আবার সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য এক দল ‘করতেই হবে’ এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। এই বার্তাই নাকি সোভিয়েত পার্টি তখন ভ্রাতৃপ্রতিম সিপিবিকে জানিয়েছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি সাপেক্ষে এক দল করলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না এমন একটি মনোভাব সোভিয়েত তরফ থেকে ব্যক্ত হয়েছিল-যেটি পূর্বে উল্লেখিত কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পরামর্শের সঙ্গে মিলে যায়। চুয়াত্তর সাল থেকেই এরকম একটি সার্বিক উপলব্ধি জেগেছিল যে গতানুগতিক বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সেটি যেমন জেগেছিল বঙ্গবন্ধুর মনে, তেমনি ন্যাপ-সিপিবির নেতৃত্বেও বড় অংশের মধ্যেই। সেটা হতে পারে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এবং সিপিবির রাজনৈতিক শক্তিকে একক প্ল্যাটফর্মে একত্র করার মাধ্যমে (নিজ নিজ দলের স্বতন্ত্র পরিচয় রাজনৈতিক মঞ্চের ভেতরে বাইরে অক্ষুণ্ণ রেখেই)। অথবা, প্রয়োজন বোধে, কৌশলগত কারণে দলীর স্বাতন্ত্র্য বাইরে প্রকাশ্য না করে আপাতদৃষ্টিতে ‘এক দল’ গড়ার মাধ্যমে। শেখ মুজিব নিজে ‘এক দলের’ মধ্যে এরকম ‘বিভিন্ন গ্রুপের’ সমাবেশ স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো স্মৃতিচারণা করেছেন যে বঙ্গবন্ধু তাঁকে এবং রাশেদ খান মেননকে বাকশালে যোগ দিতে বলেছিলেন। তখন তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আপনার দল তো নানা ধরনের লোকের খিচুড়ি। আপনার দলেই গাজী ভাইয়ের এক দল, মনি ভাইয়ের আরেক দল, তার মধ্যে আবার মস্কোপন্থিদের নিয়েছেন!… এবার আপনি বলেন, কোন উপদলের সঙ্গে থাকবো, মনি ভাইয়ের সঙ্গে, রাজ্জাক-তোফায়েলের সঙ্গে, না আর কারও সঙ্গে? আর তাদের অধীনে থাকবোই বা কেন?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোরা নিজেরাই একটা গ্রুপ হয়ে যা, সোজা চলে আসবি আমার কাছে, একেবারে আমার বেডরুমে!’ অর্থাৎ এক দলের বাতাবরণে বিভিন্ন গ্রুপের অস্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সম্ভবত সিপিবি’র তৎকালীন নেতৃত্বের মধ্যেও এরকম সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়ে থাকবে। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে থাকতে পারলে ভালো, নইলে নির্দিষ্ট গ্রুপ, ধারা, উপদল বা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে থেকে গিয়ে দেশকে আপাতত সংকটের খাদ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। চুয়াত্তরের মে মাসেই সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটি দেশের পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয় (মতিউর রহমানের বয়ান থেকে উদ্ধৃত করছি):
“বাংলাদেশের সমস্ত পরিস্থিতি আজ এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হইয়াছে।’ সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করে বলা হয়েছিল, ‘শাসক দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট ও সরকারের বহুবিধ দুর্বলতা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে কঠিন ও জটিল সমস্যা হিসেবে উপস্থিত হইয়াছে। দেশ অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।’ তাই স্বাধীনতা ও প্রগতির বিরোধী সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বক্তব্য তুলে ধরে যে, ‘একটি সার্বিক কর্মসূচির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রকৃত সৎ ও প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক দল ও ব্যক্তিদের লইয়া শরীক দলসমূহের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়া এমন একটি মৈত্রী জোট গড়িয়া তোলা প্রয়োজন, যে জোট ক্রমান্বয়ে সর্বস্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিবে এবং সিদ্ধান্ত কার্যকরীকরণের ক্ষেত্রেও যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ চুয়াত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের বেশ কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। এসব আলোচনা থেকে এটা জানা যায় যে, তিনি দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন। সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মতিউর রহমান আরও জানিয়েছেন যে, ‘বাকশাল’ একক দল গঠনের বিষয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের মধ্যে কিছু উৎসাহ ছিল তৎকালীন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য আমাকে বলেছিলেন। আর, কমরেড ফরহাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে এ প্রসঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের চিরকূট নিয়ে সকালে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের কাছে যাওয়া-আসা করেছি কয়েকবার। এটা পরিস্কার মনে আছে, জাসদ নেতা সিরাজুল আলম খানকে বাকশালে যোগ দিতে সম্মত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সে বৈঠক আমাদের বাসায় হয়েছিল। … সে সময়ে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। একাংশ একক দলে যোগ দেয়ার পক্ষে ছিলেন। তাদের মধ্যে অগ্রিম উৎসাহ ও আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। আরেক অংশের মতামত ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে। …এভাবেই মানুষের মধ্যে, এমনকি পার্টির ভেতরেও এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, কমিউনিস্ট পার্টি ‘বাকশাল’ গঠনে উদ্যোগী ছিল এবং ‘বাকশালের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে’।”
নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে বড় করে না দেখে দেশের বৃহত্তর তাগিদে বিভিন্ন প্রগতিশীল ধারা, উপধারা ও ব্যক্তিবর্গ সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সিপিবি-ন্যাপ তারপরও এটি মেনে নিয়েছিল পরিস্থিতির চাপে ও কৌশলগত কারণে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই দুটি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে স্বাধীনতার ও প্রগতির পক্ষের সকল শক্তিকে একত্র করার চেষ্টা করেছিল।
[ক্রমশ]