বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
আর সকল ধারাই- রাউলস্‌ের যুক্তি অনুসারে ;Freestanding’ -দেশ-কাল-শ্রেণি-জাতি-গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত: its content is set out independently of the comprehensive doctrines that citizens affirm.
তার মানে কি আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের বাহাত্তরের সংবিধান জন রাউলস্‌ের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? এটা ঠিক যে, জন রাউলস বিশ শতকের সেরা রাজনৈতিক দার্শনিক (পলিটিক্যাল ফিলোসফার) – এ কথা অমর্ত্য সেন বহু আগেই স্বীকার করে গেছেন। তার ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইটি রাউলস্‌কেই উৎসর্গ করা। রাউলস্‌ের ক্লাসিক গ্রন্থ ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ এর শিরোনামের সঙ্গে সেনের বইটির নামকরণে সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। রাউলস্‌ের বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭১ সালে, আমাদের সংবিধান প্রণয়নের ঠিক আগের বছরে। সরাসরিভাবে জন রাউলস্‌ের রাজনৈতিক দর্শন-পলিটিক্যাল লিবেরালিজম-সংবিধানকে প্রভাবিত করেছিল এমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি এবং সেই দাবিও আমি তুলছি না এখানে। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, বাহাত্তরের সংবিধানের কাঠামো, তার ধারা-উপধারার নির্মাণ, তার সমতাবাদী স্বাধীন ন্যায়ানুগ সমাজের ধারণা জন রাউলস্‌ের পলিটিক্যাল ফিলোসফির সঙ্গে খুব বেশি সংগতিপূর্ণ। এই মৌলিক দিকটি দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। রাউলস্‌ যে লিবারেল মতবাদের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভারতসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংবিধানেরই তলদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে। সেসব অভিজ্ঞতাকে রাউলস্‌ কেবল আরও যুক্তিনিষ্ঠ, সমন্বিত ও প্রসারিত করে ব্যক্ত করেছিলেন তার লেখায়। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সেকালের লিগ্যাল জুরিস্টদের ওপরে গভীর প্রভাব ফেলে থাকবে। যেমন, রাউলস্‌ ‘স্বাধীনতার’ ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন যে, সকল নাগরিকেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, পেশা বাছাইয়ের স্বাধীনতা থাকবে। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ ধারাসমূহে যথাক্রমে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য রোধ, সরকারি নিয়োগ লাভে সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের সমতা, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ, জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধকরণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এদের প্রায় প্রতিটিতেই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু তাকে পড়তে হচ্ছে রাউলস্‌ের ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের’ আলোকেই। স্বাধীনতা মানে অবাধ স্বাধীনতা নয়- যুক্তিসংগত স্বাধীনতা। যাতে স্বাধীনতার সীমা চরমপন্থার দিকে না গড়ায়। এটি স্পষ্টতই রাউলস্‌-ধারার লিবারেল রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাবসঞ্জাত। বস্তুত, বাহাত্তরের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ের (২৬ থেকে ৪৭ ধারা পর্যন্ত) মোট ২১টি ধারার ৫টি বাদে ( অর্থাৎ ৪, ২৯, ৩০, ৪২ ও ৪৭ ধারা বাদে) ১৬টি ধারাই সিভিল ও পলিটিক্যাল লিবার্টির সঙ্গে সরাসরিভাবে সংযুক্ত। এটাও সংবিধানের চরিত্রের ‘লিবারেল’ দিকটির প্রতি নির্দেশ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান কেবল রাউলসের পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের সাথে তুলনীয় করে দেখলে চলবে না, এর অর্থনৈতিক-সামাজিক কমিটমেন্ট আরও বেশি গভীর। সেটা আমরা ইতোপূর্বেই ১০নং ধারার ‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটির আলোচনায় প্রত্যক্ষ করেছি। এ ছাড়া ১৫নং ধারার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ প্রতিশ্রুতির মধ্যে বিবৃত হতে দেখেছি। তার মধ্যে বিশেষভাবে আলাদা করে উল্লেখিত হয়েছে, সাধারণ মানুষের ‘পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের কথা, যা রাষ্ট্রের ‘অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য’ হিসেবে নির্দেশিত হয়েছে ১৮নং ধারায়। সেই সঙ্গে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ (১৫নং ধারা); ‘সুযোগের সমতা এবং ‘সম্পদের বণ্টন’ (১৯নং ধারা) প্রভৃতি দিকের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছি। এই চিন্তাগুলো যেমন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার তলদেশ থেকে উঠে এসেছে, তেমনি এদের পূর্ব চিহ্নসমূহ পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের আদি উচ্চারণেও পাওয়া যায়। এক অর্থে মার্কসের চিন্তা ও পরবর্তীকালের রাউলসের মতন উদারনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে একটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জন রাউলস বা আজকের যুগের মাইকেল স্যান্ডেল যেসব কথা বলছেন বৈষম্যের প্রশ্নে এসে, তাতে মার্কসবাদীদের অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। যেমন- রাউলস তার লেখায় পরিস্কার করে ‘সুযোগের সমতার’ কথা বলেছেন, ‘সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের’ দাবি তুলেছেন; বিশেষ করে সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের কথা বলেছেন। এবং এটা করতে গিয়ে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিতদের। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে গরিব অগ্রাধিকার পাবে, সেটা রাউলসের সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত চিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ১৯৭১ সালের ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ বইটিতে এবং পরবর্তীতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে তার ‘জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস’ বইয়ে তিনি তার সোশ্যাল জাস্টিস তত্ত্বের ‘দুই নীতিমালা’ ব্যক্ত করেন। এই দুটি প্রিন্সিপালের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সকলের জন্য ‘সমান মৌলিক স্বাধীনতা’ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘সকলের জন্য সুযোগে ন্যায্য সমতাবিধান’, অর্থাৎ ‘ফেয়ার ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’ নিশ্চিত করা এবং ‘সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত অংশের কাছে সবচেয়ে বেশি সুবিধে পৌঁছে দেওয়া।’ ইংরেজিতে দাঁড়ায় নিম্নরূপ :
‘First Principle’: Each person has the same indivisible claim to a fully adequate scheme of equal basic liberties, which scheme is compatible with the same scheme of liberties for all
Second Principle : Social and economic inequalities are to satisfy two conditions:
a. They are to be attached to offices and positions open to all under conditions of fair equality of opportunity;
b. They are to be to the greatest benefit of the least-advantaged members of society (the difference principle)’

প্রথম ও দ্বিতীয় নীতিমালার মধ্যে সংঘর্ষ লাগলে প্রথম নীতিমালাটি অগ্রাধিকার পাবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকার রক্ষা করার কথা বলে রাজনৈতিক মৌলিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। এটা পলিটিক্যাল লিবারেলিজমের ধারার একটি মৌলিক দাবি- যেটি বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই। সেখানে বিধৃত মৌলিক অধিকারসমূহের অধিকাংশই সিভিল ও পলিটিক্যাল লিবার্টি সম্পর্কিত (অবশ্যই ইতোপূর্বে আলোচিত ‘যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ’ সাপেক্ষে)। অর্থনৈতিক অধিকারের তুলনায় রাজনৈতিক-নাগরিক অধিকারকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার এই ধারা অবশ্যই অনেক কট্টর মার্কসবাদীরা (লেনিনবাদীরা সমর্থন করবেন না। কোনো বিশেষ অবস্থার চাপে, একটা নির্দিষ্ট আপৎকালীন সময়ের জন্যে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে (যেমন- অতিমাত্রায় করারোপ করা হতে পারে, বা অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রসাধন করতে হতে পারে)। এ রকমটা দেখা গেছে শিল্পায়নের সময়ে ১৯২৫-১৯৩৬ কালপর্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নে, অথবা মহাযুদ্ধকালীন সময়ে পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ অবস্থার চাপে পড়ে, যুদ্ধোত্তরকালে বা কোনো একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আপৎকালীন সময়ের জন্য নাগরিক মৌলিক স্বাধীনতার কোনো কোনো দিক থেকে সরে আসতে হতে পারে। ৯-১১ পরবর্তীকালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ও ইরাক-যুদ্ধ এসব পর্বে খোদ যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে নাগরিকদের মৌলিক সিভিল পলিটিক্যাল লিবার্টিসমূহ সাধারণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। নাগরিকদের পত্রালাপ, ফোনালাপ, ইন্টারনেট ব্যবহার, চলাফেরা ইত্যাদির ওপরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি করা হয়েছে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। পুঁজিবাদের এই নজরদারি প্রবণতাকে এখন এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। একে ‘সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। কেউ কেউ এই প্রবণতার মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অসুখের ছায়াপাত দেখছেন। দার্শনিক মিশেল ফুকো এসব ঘটার ৩০-৪০ বছর পূর্বেই তার ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইতে ‘আই অব পাওয়ার’ বা চবহড়ঢ়ঃরপড়হ-এর সম্ভাব্যতা আধুনিক পুঁজিবাদের জেনেটিক কোডে আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটলেও- আকছার এ রকম ঘটছে বলেই- রাউলস মৌলিক স্বাধীনতার নীতিমালাকে অপরাপর নীতিমালার সঙ্গে এক কাতারে দেখার পক্ষপাতী নন। স্বাধীনতা বনাম উন্নয়ন প্রশ্নে কোনো বাস্তবিক ট্রেড অফ দেখতে নারাজ রাউলস (এবং অমর্ত্য সেনের মতো লিবারেল দার্শনিকেরা)। এর বিপরীতে হবস, মার্কস, লেনিন, ফুকো প্রমুখ দার্শনিকেরা স্বাধীনতাকে অতটা শীর্ষস্থানে তুলতে রাজি নন, যদি না অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলো আগে প্রতিষ্ঠিত হয় বা করা যায়।
রাউলস অর্থনৈতিক সাম্যের আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাম্য নিশ্চিত করতে চান এবং এ দুইয়ের মাঝে কোনো ক্ষেত্রেই ‘ট্রেড-অফ’ করা যাবে না- এই হচ্ছে তার সুচিন্তিত মত। কিন্তু এর বিপরীতে মার্কস থেকে ফুকো অবধি দার্শনিকেরা ভিন্ন মত রেখেছেন। তাদের মোটা দাগের বক্তব্য হলো, সবার জন্য সমান মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আগে- হয়তো নিশ্চিত করার জন্যই-প্রয়োজন সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক অধিকার। ভাত, কাপড়, জমি, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রভৃতি অধিকারকে আগে প্রতিষ্ঠা করা। কবি নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেছিলেন, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’ ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’- এই স্লোগান উঠেছিল দেশভাগের পরপরই। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের পটভূমিতে এই স্লোগান ওঠা তখন অস্বাভাবিক ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের একপর্যায়ে অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিকে স্বয়ং শেখ মুজিব আন্দোলনের সম্মুখভাগে নিয়ে এসেছিলেন। ‘দুই অর্থনীতি’ শীর্ষক ন্যারেটিভ ছয় দফার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার মৌলিক যুক্তিভিত্তি জুগিয়েছিল। সেদিনের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল অর্থনৈতিক দাবি রক্ষার মোড়কেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আওয়ামী লীগ কেবল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমির স্লোগান তুলেছিল; আর বামপন্থিরা কেবল অর্থনৈতিক অধিকারের কথায় সরব হয়েছিল। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রাজনৈতিক স্বাধিকার-স্বাধীনতার পদক্ষেপই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের যুক্তির জরিসুতো দিয়ে বোনা। এমনকি ছয় দফার দলিলটিরও শিরোনাম ছিল : ‘ছয় দফা- আমাদের বাঁচার লড়াই’, যেখানে দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বর্ণনা ছিল। আমি বলতে চাইছি, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষত ষাটের উত্তাল দশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার উভয়ই দাপটের সঙ্গে উপস্থিত ছিল : এ দুইয়ের মধ্যে কোনো ‘ট্রেড-অফ’ করা হয়নি। এখানে মার্কসও ছিলেন, রাউলসও ছিলেন। এই দুটো ধারাকে ধারণ করেছিলেন মুজিব ও তার নিকটতম আদর্শিক সহকর্মীরা।
তবে একটি প্রশ্নে রাউলসের সাথে মার্কসের কোনো বিরোধ হতো না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রাউলস সমাজের সকল নাগরিকের মধ্যে সুযোগের ন্যায্য সমতা এবং সম্পদ বণ্টনে ন্যায্য সমতা চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি এই ন্যায্য সমতা বাস্তবায়নের পথে সর্বাগ্রে অতিদরিদ্র এবং সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক দিকটি রাউলসের পূর্বে কথিত ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপাল’ (যাকে আজকের পরিভাষায় প্রায়োরিটি প্রিন্সিপাল বা টার্গেটিং প্রিন্সিপালও বলা যায়) থেকে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রের কাছে যদি সম্পদ কম থাকে, তবে সংকটের সময়ে কাকে সে সর্বাগ্রে সাহায্য করবে? এ প্রশ্নে রাউলসের উত্তরে কোনো অস্পষ্টতা নেই : দরিদ্রদের এবং অতিদরিদ্রদের প্রতি রাষ্ট্র সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়াবে। এজন্যেই এই রাষ্ট্র শুধু ‘ইগালিটারিয়ান’ নয়, এটি ‘জাস্ট’ও- হতদরিদ্রদের স্বার্থে রাষ্ট্র ইনসাফের বা সামাজিক ন্যায়-নীতি পরিচালনা করবে। এর থেকেই জন্ম হয়েছে রাউলসের বিখ্যাত আপ্তবাক্য-‘Maximum benefits to the minimum advantaged’  (Maximin) প্রিন্সিপালও বলা হয় একে)।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
যেমন লিবার্টি প্রিন্সিপাল যেসব ধারাতে প্রতিফলিত হয়েছে, তার প্রতিটিতেই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষ’-এর শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতা নিঃশর্ত নয়। এটা দেখা যায় চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৬), সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৮), বাক্‌-স্বাধীনতা ও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৯), পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৪০), সম্পত্তির অধিকার (অনুচ্ছেদ-৪২), গৃহে নিরাপত্তা এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৪৩) প্রভৃতি ধারাসমূহের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ একদিকে যেমন নাগরিক অধিকার আছে, তেমনি অন্যদিকে জনকল্যাণের স্বার্থে, রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের কাছে দাবিও আছে। সেজন্য নাগরিকদের অধিকার কতখানি খর্ব করা যাবে, তা আদালত বলে দেবেন, ঠিক করবেন। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো উৎসের উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল। যেমন- পূর্ব জার্মানির উদাহরণ টেনে বলা হয়েছিল যে, অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বলে কিছু থাকতে পারে না, গ্রহণীয় হতে পারে না। পূর্ব জার্মানির সংবিধানের-১১ অনুচ্ছেদের (১) নং দফায় আছে : ‘All Germans enjoy freedom of movement throughout the fedual tertiary.’ এটা বলেই ঐ অনুচ্ছেদের (২) নং দফায় বলা হয়েছে : ‘Whatever abuses freedom of expression, freedom of opinion, freedom of teaching, freedom of assembly, freedom of association… forfeits these basic rights’। শুধু প্রথাগত সমাজতন্ত্রের দেশ নয়, এ ক্ষেত্রে পুুঁজিবাদী দেশেরও উদাহরণ টানা হয়েছে যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ ব্যাখা করার জন্য। জাপানের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদাহরণ টেনে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের পেছনের যুক্তিটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে মূল জোরটা হয়েছে ‘যুক্তিসংগত’ শব্দটার প্রতি : ‘The fundamental text applied by the supreme Court is that any restriction is valid unless it exceeds the limit of reasonableness or the necessities of public welfare. The Supreme Court has consistently held that restrictions may be imposed to protect the public welfare.’
এখানে মূল বিতর্কটা হচ্ছে ‘reasonableness’ শব্দটা নিয়ে। কে নির্ধারণ করবে কোনটা এবং কত দূর পর্যন্ত যুক্তিসংগত?
আসলে ‘যুক্তিসংগত’ কথাটার মধ্যেই একটি মৌলিক ইনডিটারমিনেসি রয়ে গেছে। যেমন, জন রাউলস্‌ তার ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ বইতে ‘রিজোনেবল প্লুরালিজম’কে স্বীকার করে গেছেন। অর্থাৎ একটি উদারনৈতিক সমাজে একটি নির্দিষ্ট ‘যুক্তিসংগত’ চৌহদ্দির মধ্যে সকল মতাদর্শকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। এর চৌহদ্দিই কীভাবে নির্ণীত হবে? আমরা সবাই জানি যে সমাজের প্রতিটি যুক্তিবাদী ব্যক্তিরই নিজস্ব ধর্ম-বিশ্বাস, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মত, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি- এক কথায় নিজস্ব ওয়ার্ল্ড আউটলুক বা বিশ্ববীক্ষা রয়ে গেছে। প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষেরই জীবন, ঈশ্বর, ভাল-মন্দ জ্ঞান, জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পর্কে একটি ‘নিজস্ব’ ধ্যান-ধারণা রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। এ রকম মত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত বিভিন্নতা নিয়ে- তাও আবার শ্রেণিবিভক্ত-সমাজে কোনো অভিন্ন ‘পাবলিক গুড’ বা জনস্বার্থের দর্শন কী করে ব্যক্ত করা সম্ভব? তার চেয়েও বড় কথা হলো, এ রকম একটি বিভক্ত সমাজে কী করে একটি অভিন্ন সংবিধান বা রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতি প্রণয়ন করা সম্ভব? এ ক্ষেত্রে রাউলস যুক্তি দিচ্ছেন যে, বিভক্তি সত্ত্বেও একটি সামাজিক ঐকমত্যে মেলা সম্ভব, কেননা যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করেন এমন কেউই নিজের সকল মতকে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দিতে চাইতে পারেন না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন মতের যৌক্তিক বিরুদ্ধতা বা বিভিন্নতা স্বীকার করে নিতে হবে, তবে সেই বিরুদ্ধতা বা মতভিন্নতা ‘যৌক্তিক দাবি’ হতে হবে।
এর মাধ্যমে রাউলস আশা করছেন যে, ‘The religious, moral and philosophical doctrines that citizens accept will themselves endorse toleration and accept the essentials of a democratic regime.’ ‘পরমত সহিষ্ণুতা’ ছাড়া কোনো উদারনৈতিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে না- এই লিবারেল মত রাউলসের চিন্তার কর্নার-স্টোন। সেজন্যই তিনি চাইছেন যাতে ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে’ সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বস্তরে স্বীকৃতি দিতে। যেমন- ধর্ম-মতবাদের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের মানে হবে ‘reasonable Catholicism, a reasonable interpretation of Islam, a reasonable atheism’ ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। তবে তার পরও সমস্যা থেকে যায় এই ব্যাখ্যায়। যুক্তিসংগতভাবে চিন্তাভাবনা করেন এমন একজন ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী কী করে যুক্তিসংগত চিন্তা করেন এমন অন্য ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিক্য-দর্শনে বিশ্বাসীর আদর্শে আস্থা স্থাপন করবেন? যতই যুক্তিসংগতভাবে পেশ করা হোক না কেন, কোনো বিশেষ ধর্মমত বা আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি করা আইন-আদালত, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে কী করে এক ভিন্ন ধর্মের বা ভিন্ন আদর্শের লোক (যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করেন এমন লোকের কথাই বলছি) মেনে নিতে পারেন বা নেবেন? কোন বিশেষ ধর্ম, মতাদর্শ বা মতবাদ প্রকারান্তরে আসলে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান-ধারণার ভুবন বা বিশ্ববীক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এরা সবাই নিজেকে একেকটি ‘Comprehensive doctrine’ বলে দাবি করেন। যা সকলের কাছে ১০০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য হবে না কখনোই : ‘No comprehensive doctrine can be accepted by all reasonable citizens, and so no comprehensive doctrine can serve as the basis for the legitimate use of coercive political power.’

রাউলস বলছেন যে, কোনো একটি বিশেষ ধর্মমতের ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্রের ন্যায্যতা বা সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, সেটা অন্য ধর্মের বিশ্বাসীরা মানতে না-ও চাইতে পারেন। যদি নাস্তিক্য মতবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, তবে আস্তিক্যবাদীরা তা মানতে না-ও চাইতে পারেন। যদি ফ্যাসিবাদ, স্তালিনবাদ বা মাওবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো হয়, তবে বিরুদ্ধ-মতাদর্শের ব্যক্তিরা তা মানতে না-ও চাইতে পারেন। কেননা, ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা বিশেষ নৃতাত্ত্বিক জাতি বা বর্ণ-সম্প্রদায়ের মতবাদ বা আদর্শ এতটাই বিশিষ্ট এবং (comprehensive অর্থে) বিস্তৃত/স্বয়ংসম্পূর্ণ যে, সেখানে অন্য মতের/আদর্শের লোকদের শামিল করানো কঠিন। তাহলে সমাজের সব মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য সাংবিধানিক ভিত্তি দাঁড় করানো যাবে কিসের ভিত্তিতে, আর সেই ভিত্তিটাই যে ন্যায্য ভিত্তি হবে তা প্রতিপন্ন করা যাবে কীভাবে?
এর কোনো সহজ উত্তর রাউলস্‌ দিতে পারেননি। তার উত্তর হচ্ছে- রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি হবে ‘পাবলিক পলিটিক্যাল কালচার’ দ্বারা, যার ভিত্তি নিহিত সমাজের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, প্রতিষ্ঠানাদির ঐতিহ্য, দর্শন, অনুশীলন ইত্যাদি বিচিত্রবিধ উপাদানের চর্চার মধ্যে। যত বিভিন্নই হোক এসব ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক উপাদান দেশে দেশে, কোনো সমাজে পাবলিক কালচার যথাযথ কাজ করছে কিনা তা জানার উপায় হলো ইনসাফ বা ন্যায়বিচার সম্পর্কে সেই দেশে বা সমাজে কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। এই ইনসাফের বোধ- যাকে রাউলস বলেছেন ‘পলিটিক্যল কনসেপশন অব জাস্টিস’- তার তিনটি প্রধান উপাদান :নাগরিকেরা নানা দিক থেকে কতটা স্বাধীন (Free); কতটা সমান (Equal); এবং পরস্পরের প্রতি আচরণে কতটা ন্যায়ানুগ (Fair)। এই ফ্রিডম, ইকুয়ালিটি ও ফেয়ারনেস তিনটি মৌল ধারণার ওপরে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ‘পাবলিক পলিটিক্যাল কালচার’ দাঁড়িয়ে আছে/থাকে।
আসলে রাউলস্‌ যখন তার লিবারেল সোসাইটির প্রকল্প তুলে ধরেছেন, তিনি নাগরিকদের কল্পনা করছেন এক যুক্তিবাদী মনের নিজস্ব ‘ধ্যান-ধারণা-নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি হিসেবে। সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে নাগরিকেরা একটি অভিন্ন বিবেচনায় উপনীত হচ্ছেন তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস, নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, নিজস্ব অভিরুচি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বাদ দিয়ে নয়, কিন্তু এসবকে তিনি সচেতনভাবেই আমলে নিচ্ছেন না সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি কোনো বিশেষ ধর্মের লোক হতে পারি, অথবা কোনো বিশেষ মতাদর্শের সমর্থক হতে পারি, কিন্তু রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তি রচনা করতে গিয়ে আমি আমার একান্ত ধর্মবিশ্বাস বা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শকে ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর করতে চাচ্ছি না সচেতনভাবেই। কেননা, আমি যদি তা করি, তাহলে অন্যরাও তাই করবে এবং এর ফলে সমবেতভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো ‘সামাজিক চুক্তি’ বা সংবিধানে পৌঁছানোই যাবে না। এ জন্যেই আমাকে পরমতসহিষ্ণু হতে হচ্ছে, ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে’ আশ্রয় করতে হচ্ছে, নিজের মতবাদকে প্রতিনিধিত্বশীল দাবি করা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। এ জন্যেই রাউলস্‌ের মতে সামাজিক ন্যায়ের যে ধারণাকে গণতান্ত্রিক সংবিধান তুলে ধরে তা বিশেষ ধর্ম-রাজনৈতিক মতাদর্শ-দল-মত-কেন্দ্রিক নয়, তা বিভিন্ন বিরুদ্ধ মতের মধ্যে কোনো মধ্যপন্থার আপস-মীমাংসাও নয়; পূর্বে-উল্লেখিত ‘স্বাধীনতা’, ‘সমতা’ ও ‘ন্যায্যতা’ সম্পর্কে তা একটি ‘নূ্যনতম অভিন্ন উপলব্ধিকে’ ব্যক্ত করে মাত্র। যাকে রাউলস্‌ বলেছেন বিভিন্ন পরমত-সহিষ্ণু মতের মধ্যে ‘Overlapping consensus” বলে। এবং এটা করতে গিয়ে নাগরিকদের (বা নাগরিকদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের) নিজেদেরকে চিন্তা করতে হয় Reasonable Citizens হিসেবে- দল-মতের ঊর্ধ্বে ওঠা একেকজন Abstract thinker হিসেবে। এ জন্যেই রাউলস্‌ের সামাজিক ন্যায় সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে এভাবে :
‘Rawls’s Political conception of justice is not derived from any comprehensive doctrine, nor is it a compromise among the world views that happen to exist in society at the moment. Rather,  a Political conception of justice is freestanding: its content is set out independently of the comprehensive doctrines that citizens affirm. Reasonable citizens, who want to cooperate with one another  on mutually acceptable terms, will see that a freestanding political conception generated from ideas in the public political culture is the only basis for cooperation that all citizens can reasonably be expected to endorse. The use of coercive political power guided by the principles of a political conception of justice will therefore be legitimate.’

এর মানে এই নয় যে, সামাজিক ন্যায়ের ধারণার মধ্যে স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায্যতা এই তিনটি ভাবের দেশগত-কালগত প্রকাশে সেই জনগোষ্ঠী, ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি প্রভৃতি দেশজ, সামাজিক বা ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরের কোনো প্রভাব পড়বে না। রাউলস্‌ সেটা স্বীকার করে নিয়েও বলছেন যে, দেশ-কাল-সমাজের প্রভাব পড়লেও তার চৌহদ্দি নির্ধারিত হবে ওই ‘যুক্তিসংগত বহুত্ববাদের’ দ্বারাই; কেউ যদি চরমপন্থি কোনো ভাবধারা প্রকাশ করে তাকে কোনোভাবেই আমল দেওয়া হবে না সামাজিক চুক্তি বা সংবিধান নির্মাণের সময়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রস্তুতের কালেও ১৯৭২ সালে এমনি যুক্তিসংগত বহুত্ববাদকে আশ্রয় করা হয়েছিল। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে যেখানে মৌলিক অধিকারগুলো বিধৃত হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘যুক্তিসংগত’ আবরণের বেড়া দিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে ঐ চরমপন্থা থেকে রক্ষা করার জন্যই। ‘মৌলিক অধিকারের’ ও ‘মৌলিক নীতিমালা’ ব্যক্ত করার সময়ে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী, ধর্মমত, রাজনৈতিক আদর্শ বা অভিরুচিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়েছে কেবলমাত্র ‘প্রস্তাবনা’ অংশে। সংবিধানের ‘প্রথম ভাগে’ যেখানে প্রজাতন্ত্রকে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানেই কেবল ‘বাংলাদেশ’ ধারণাটিকে ইতিহাস-ভূগোলের দ্বারা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংবিধানের ‘দ্বিতীয় ভাগের’ ৮ থেকে ২৫ ধারার মধ্যে কেবল ৯নং ধারায় জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাঙালি জাতির’ উল্লেখ রয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ দাবী অতটুকুতেই সীমিত রাখা হয়েছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


বঙ্গবন্ধু নাগরিকের কল্যাণ, স্বাধীনতা ও ‘অধিকারের’ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রের বিষয়টিকে আত্মস্থ করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল- সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধান করা এবং ক্রমান্বয়ে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা (যেটা এখন এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রায় বিধৃত হয়েছে)। ডানপন্থীদের অভিযোগ হলো তাহলে ১৯৭২ সালে এত তড়িঘড়ি করে কেনই-বা ব্যক্তি-পুঁজির বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া হলো? প্রথমত, পুঁজির ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সম্পদের অধিকতর সুষম বন্টন নিশ্চিত করা দুরূহ। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশেও বাইশ পরিবারের মতো অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটুক, সেটি বঙ্গবন্ধু কখনোই চাননি। এজন্যই, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যক্তি-পুঁজিকে সর্বতো উপায়ে সহায়তা দেওয়া হয়, কিন্তু বৃহৎ ব্যক্তি-পুঁজির বিকাশকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। কালক্রমে (১৯৭৪ সালেই) বৃহৎ ব্যক্তি পুঁজির ‘সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা তখনকার দিনের বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার বিকাশের জন্য যথেষ্ট পরিসরই দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ ‘রপ্তানিমূলক’ শিল্পে এবং সাম্প্রতিক দশকে ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখিন’ শিল্পে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে। সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, সুস্থ ব্যক্তি খাতের বিকাশের পথে বিনিয়োগের সিলিং-জনিত প্রতিবন্ধকতা কৃত্রিম ভাবে আরোপ করার প্রয়োজনীয়তাও অনেক আগেই নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ব্যক্তি-পুঁজির ওপরে রাষ্ট্রের ‘নজরদারি’র প্রয়োজনীয়তাও সেই সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে? ‘মার্কেট-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া এবং ‘বিজনেস-ফ্রেন্ডলি’ হওয়া তো সমার্থক শব্দ নয়। ২০১০ এর দশকের অভিজ্ঞতা এখানে মিশ্র তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে। ব্যক্তি খাতের সাফল্যের পাশাপাশি সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যক্তি খাতের দায়-দেনাও (Default) বিস্তর এবং ক্রমবর্ধমান। যে হারে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে ২০১০ এর দশকে, সেই হারে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি (৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিল অনুযায়ী এই অনুপাত জিডিপির ৮ শতাংশেই থমকে আছে)। ফলে সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বা Common Goods সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, তা এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি। ‘মার্কেট-ইকোনমি’ হওয়ার পাশাপাশি আমরা যেন অতি দ্রুত ‘মার্কেট-সোসাইটি’তে পরিণত হচ্ছি। মার্কেট-ইকোনমি আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার এদেশে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আমরা যেন উত্তরোত্তর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে কেবল মার্কেট-সোসাইটিতে রূপান্তরিত না হই। শেষোক্ত সমাজে সবকিছু, সব মূল্যবোধই, শেষপর্যন্ত ‘কেনা-বেচা’র সামগ্রীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে- সেটা বিদ্যাদান, চিকিৎসা দান থেকে শুরু করে ‘সামাজিক উদ্যোগ’, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা কার্যক্রম পর্যন্ত। এ ধরনের সমাজ শেষাবধি মানুষের বাসযোগ্য ভূমি থাকে না। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে এ ধরনের ডিস্টোপিয়ান ‘মার্কেট-সোসাইটি’র কোনো স্থান ছিল না। এজন্যই তাকে জনগণের তদারকি, জনগণের মালিকানা ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে তার অবস্থান নৈয়ায়িক দার্শনিক জন রাউলস, অমর্ত্য সেন ও মাইকেল স্যান্ডেলের অনুবর্তী। আমাদের সমাজের স্বভাবজ ধর্মবিহিত মূল্যবোধ এই অবস্থানের প্রতিই সমর্থন জানায়।
সংবিধানের ২০নং অনুচ্ছেদের যোগ্য/ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার বন্টননীতির পেছনে সরাসরিভাবে অন্যবিধ সূত্রের প্রভাবও কাজ করেছিলো। বাহাত্তরের গণপরিষদ বিতর্কে বেরিয়ে এসেছিলো যে এর সাথে সোভিয়েতের ১৯৩৬ সালের সংবিধানের সাদৃশ্য রয়েছে। উদাহরণত, সোভিয়েত ইউনিয়নের উক্ত সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিলো : ুঞযব ঢ়ৎরহপরঢ়ষব ধঢ়ঢ়ষরবফ রহ :যব টঝঝজ রং : “The principle applied in the USSR is that of socialism: ÔFrom each according to his ability, to each according to his work.”
এটা বাহাত্তর সালে গণপরিষদ বিতর্কে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু সেটা ২০ (১) অনুচ্ছেদে এই শ্রম-অনুযায়ী বণ্টনের নীতি অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ১৯৩৬ সালের সোভিয়েত সংবিধান বিবেচনায় নেওয়া ছাড়াও অন্য অনেক দেশের সংবিধানের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেছিলেন। এ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ৩০ অক্টোবর ১৯৭২ ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন :
‘প্রথমে আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই, যে মূলনীতিকে আমরা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছি, সেই মূলনীতির আদর্শের ভিত্তিতে আমরা সংবিধান রচনা করেছি। যাঁরা তা স্বীকার করবে না, তাঁদেরকে আমি গোটা সংবিধান নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করতে বলব। আমার মনে হয়, এই সব সমালোচনা করার আগে তাঁরা যদি অন্যান্য দেশের সংবিধান পরীক্ষা করে দেখতেন, তাহলে অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটত। তাহলে উপযুক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা সংবিধানটি বিচার করতে পারতেন।’
কোন কোন দেশের সংবিধান সেদিনের সংসদে আলোচনা হয়েছিল? সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৩৬ সালের সংবিধানের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাজউদ্দীন আহমদ, আছাদুজ্জামান খান প্রমুখ জিডিআর অর্থাৎ, পূর্ব জার্মানির ১৯৪৯ সালের সংবিধানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ডের উদাহরণ এসেছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ থেকে। অন্যান্য দেশের মধ্যে বড় করে এসেছিল চীন, পশ্চিম জার্মানি ও জাপানের কথা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। বার কয়েক অবশ্য লেবার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লিখিত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রায় সকলেই অবগত ও সচেতন ছিলেন। একটি উদাহরণ দেই। গণপরিষদ সদস্য আবু মো: সুবেদ আলী (ঢাকা-১০) সংবিধানের মডেল কোন দেশ থেকে এসেছে ঐ প্রশ্নে বলেছিলেন: “আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করিনি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটেও’ বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করিনি।” অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সবার অভিজ্ঞতাই বিবেচনায় নিয়েছিল, কিন্তু অভিপ্রায়ে এবং নির্মাণে এটি ছিল একান্তভাবেই বাংলাদেশের মনোভূমি ও ভূগোল-ইতিহাসের ফসল। একটা প্রশ্ন এখানে না এসে পারে না। এই যে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার দিকে হাত বাড়ানো- তা কি একই ইস্যুতে, নাকি নানা ইস্যুতে?
প্রথমত, জিডিআর, পোল্যান্ড ও চীনের প্রসঙ্গ এসেছিল ‘মিশ্র মালিকানা’ ব্যবস্থার ন্যায্যতা সপ্রমাণিত করতে। এই তিনটি দেশই সমাজতান্ত্রিক হয়েও মিশ্র-মালিকানাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিল। এটা প্রমাণ করার জন্য গণপরিষদের সদস্যরা এসব দেশের সংবিধান থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, লিবার্টি প্রিন্সিপালের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ যে আরোপ করা প্রয়োজন তা প্রমাণ করার জন্য পূর্ব ইউরোপীয় ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সংবিধানের ধারাসমূহের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়েছে। এর থেকে বাদ পড়েনি জাপানের সংবিধানও। মৌলিক অধিকারের চৌহদ্দি বেঁধে দেওয়ার ক্ষেত্রে জাপানের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়েছে। যেমন, জাপানের সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে : :‘These fundamental human rights guaranteed to the people by this constitution shall be conferred upon the people of this and future generations as eternal and inviolate rights.’ কিন্তু ১২নং অনুচ্ছেদে তার পরক্ষণেই বলা হয়েছে :‘The freedom and rights … shall be maintained by the constant endeavour of the people who shall refrain from any abuse of these freedoms and rights and shall always be repressible for utilizing them for the public welfare.’ এই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানেও।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৮৪

পূর্বে প্রকাশিতের পর
অর্থাৎ, নারী-পুরুষ, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমান কর্মের জন্য অসমান পারিশ্রমিক সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। এখানে এসডিজির ৫নং লক্ষ্যমাত্রা (Gender Equality) এবং ৮নং (Decent Work & Economic Growth)-এর সাদৃশ্য দৃশ্যমান।
বাহাত্তরের সংবিধানের অতিগুরুত্বপূর্ণ ২০নং ধারা নিয়ে আরও কয়েকটি কথা যোগ করা দরকার। ২০নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারার ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’- এই নীতি কোন সূত্র থেকে আহরিত হয়েছিল? ইংরেজি পাঠে এই নীতিটিকে লেখা হয়েছিল এভাবে :
everyone shall be paid for his work on the basis of the principle ‘from each according to his abilities, to each according to his work’.

প্রত্যেকে যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হবেন এবং প্রত্যেকে যে যার কর্ম/শ্রম/অবদান (work/labour/contribution) অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবেন- এই বণ্টন নীতি এলো কোথা থেকে? এই বণ্টন-সূত্রের পেছনে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রভাব এসেছিল, সন্দেহ নেই। তার মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তার দীর্ঘ ঐতিহ্য, যা বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল পাশ্চাত্যের সমতাবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্রে স্থাপিত করে। কথাটা কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি করে।
যোগ্য/সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়াকে সমাজতান্ত্রিক বণ্টন নীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। এ নিয়ে বিতর্কাতীতভাবে ঐকমত্য বিরাজ করছে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি-তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের মধ্যে। এবং এ বিষয়ে আলোচনা উঠলে প্রথমেই সবাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন কার্ল মার্কসের জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত রচনা ‘ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম’ লেখাটির প্রতি। ১৮৭৫ সালের এই লেখাটিতে মার্কস ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজের দুই স্তরের প্রতি ইঙ্গিত করেন (পরবর্তীকালে, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়ে লেনিন ১৯১৭ সালে একে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্নেষণ করেন)। প্রথম বা নিচের স্তরে সমাজ যখন কেবল পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হতে শুরু করেছে- তখন আয়-উপার্জনের প্রধানতম উৎস হবে শ্রম-সূত্রে প্রাপ্ত আয়। এই সমাজে আয়-বণ্টন নির্ধারিত হবে যথাসাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং শ্রমের পরিমাণ ও গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়ার নীতির মাধ্যমে। শ্রম বলতে এখানে শুধু কায়িক শ্রমের মজুরদের বোঝানো হচ্ছে না। এখানে মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের সঙ্গে জড়িত ‘হোয়াইট কলার’ শ্রমিক প্রাতিষ্ঠানিক তথা সেবা খাতের কারিগররাও অন্তর্ভুক্ত। সৃষ্টিশীল শ্রমের শিল্পীরাও এখানে রয়েছেন। এই প্রথম স্তরের সমাজটিকেই সাধারণত ‘সমাজতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ ধরনের সমাজেও আয়ের বণ্টনে অসমতা থাকবে, কেননা প্রত্যেকের কাজের সামর্থ্য, পরিমাণ ও কাজের গুণাবলি (উৎকর্ষতা, উপাদনশীলতা, দক্ষতা) সমান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ ধরনের সমাজে শ্রমজনিত পার্থক্য সূত্রে যেটুকু আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তা পুঁজিবাদী সমাজের আয়-বৈষম্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ার কথা। এর কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রম ছাড়াও শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা-পার্থক্যের কারণেই অনেক আয়-বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। উদাহরণত, অনেক বেশি জমি থাকার কারণে কোনোরূপ শ্রম না দিয়েও কেউ ওই জমিকে কেবল ভাড়া খাটিয়ে অনেক আয় করতে পারেন। যেটা একজন ভূমিহীন চাষির পক্ষ করা সম্ভব নয়; তার পক্ষে মজুরি-শ্রমের কাজে নিয়োজিত হয়েই কেবল উপার্জন করা সম্ভব। একই ভাবে, একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে নিয়মিত পরিশ্রম করেই আয়-উপার্জন করতে হয়। কিন্তু একাধিক গার্মেন্টস কারখানার মালিক যিনি তাকে হয়তো তার ফ্যাক্টরিতে কোনো শ্রম না দিয়েই বা সামান্য শ্রম দিয়েই শুধু মালিক হওয়ার কারণেই অনেক বেশি আয় করা সম্ভব। শুধু কৃষি জমি নয়, অন্যান্য সম্পদ ভাড়া খাটিয়েও-এবং তেমন কোনো প্রত্যক্ষ শ্রম বা তদারকি শ্রম না করেও- অনেক আয় উপার্জন করা সম্ভব, যাকে আমরা ‘ভাড়াজীবী আয়’ (Rentier Income) বলতে পারি। গত এক দশক আগে আমি একজনকে চিনতাম, যার ঢাকা শহরে ৬৫টির মতো ফ্ল্যাট ছিল। এখন হয়তো তার ফ্ল্যাটের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এসব ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে এবং তেমন কোনো প্রত্যক্ষ শ্রম করা ছাড়াই সেই লোক প্রতি মাসে অনেক আয় করে থাকে। আমাদের দেশে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার বিষয়টি এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক কথায়, ‘প্রোপার্টি ইনকাম’ আয়ের একটি প্রধান উৎস এ ধরনের সমাজে। তবে এখানে দুটো ফুটনোট রাখা দরকার। প্রথম ফুটনোটটি হলো, এমন কোনো ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যে পুঁজির মালিক কেবলই ভাড়া খাটিয়ে বা অন্যকে দিয়ে মজুর খাটিয়েই আয়-উপার্জন করে থাকে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এদের একটা অংশকেই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় নামতে হয় বা নতুন কোনো ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে অবলম্বন করতে হয়। এর জন্য তাকে সময় সময় ঝুঁকি নিতে হয়, যথেষ্ট উদ্ভাবনী শ্রমও ব্যয় করতে হয়- যাকে আমরা এক কথায় শিল্পোদ্যোক্তা  (entrepreneurship) ফ্যাক্টরের ‘অবদান’ বলতে পারি। মার্কসও এটা প্রকান্তরে স্বীকার করে গেছেন নতুন প্রযুক্তি ও নতুন প্রোডাক্টের উদ্ভাবনের মাধ্যমে সাময়িককালের জন্য হলেও ‘surplus profit’ আহরণের সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করে।
দ্বিতীয় ফুটনোটটি হলো- এরকম ধারণা আঁকড়ে ধরে রাখা উচিত নয় যে, সমাজতন্ত্রের নাগরিকেরা শুধু আয় করতে পারবেন কাজ করারই সুবাদে। শ্রমবহির্ভূত অন্যবিধ আয়েরও সুযোগ রয়েছে তাদের।Democratic Propertied Income স্কুলের চিন্তকেরা এরকম প্রস্তাব দিয়েছেন যে, সামাজিক মালিকানার অংশ হিসেবে প্রতিটি নাগরিকই রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার capital stock থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘ডিভিডেন্ড আয়’ লাভ করতে পারবেন। আর সমবায়ী মালিকানার ক্ষেত্রে প্রতিটি সমবায়ের সদস্য তার সমবায়ের পুঁজি খাটানো বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘ডিভিডেন্ড আয়’ লাভ করতে পারবেন। মার্কেট সোশ্যালিজমের প্রবক্তা জন রোমার  (Roemer) যে ‘কুপন সোশ্যালিজম’-এর প্রস্তাব করেছিলেন তা ডেমোক্রেটিক propertied income-এরই একটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। এসব চিন্তা শুধু ইউটোপিয়ান জল্পনা-কল্পনা নয়। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে যখন শিল্পায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে প্রবল জনঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, তখন ২০০৮ সালের দিকে ইকনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় বেশ কিছু খ্যাতনামা বাঙালি অর্থনীতিবিদ একত্রে একটি রচনায় প্রস্তাব রেখেছিলেন যে, এই উদ্যোগের ফলে যারা জমি হারাবেন তাদেরকে তাদের জমিতে স্থাপিত কল-কারখানার ‘ইকুইটি-মূলধনের’ অংশীদার করা হোক। তাতে করে তারা (এবং তাদের উত্তর পুরুষেরা) সেই ইকুইটি মূলধনের ওপরে ‘মালিকানা বাবদ’ নির্দিষ্ট পরিমাণে ডিভিডেন্ড ইনকাম পাবেন। পরবর্তীকালে, একই ধরনের প্রস্তাব রেখেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের জন্য। পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের মজুরি এমনিতেই বেশি নয়, তার কারণ এই শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হয়। যার জন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মজুরি দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। এই অবস্থার কিছুটা নিরসন ঘটে যদি উপরোক্ত শিল্পসমূহে ইকুইটির অংশীদারে পরিণত করা যায় ওই নারী শ্রমিকদের। এর ফলে তাদের আয়ের দ্বিবিধ উৎস হতে পারে শ্রম সূত্রে প্রাপ্ত আয় ও শ্রমবহির্ভূত ইকুইটি সূত্রে মালিকানা বাবদ প্রাপ্ত আয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শ্রম-অনুযায়ী পারিশ্রমিকের পাশাপাশি পুঁজির মালিকানার অংশীদার হিসেবে ডিভিডেন্ড ইনকামের লাভের সুযোগ যৌক্তিকভাবেই নিহিত হয়েছিল। Democratic Propertied Income-এর ধারণা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে টমাস পিকেটি, এন্থনি এটকিনসন প্রমুখের লেখায়। আজকে যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (UBI)-এর ধারণা জোরেশোরে সর্বত্র স্বীকৃত হচ্ছে তারও পেছনে রয়েছে সমাজের নাগরিক হিসেবে Social Product-এর অংশীদার হিসেবে প্রত্যেকেরই নূ্যনতম আয় পাওয়ার অধিকারের দাবি। UBI সকলই পাবেন- তা তিনি শ্রম করুন বা নাই করুন। UBI-এর মতো সর্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত মানের ও সুলভ মূল্যের গণপরিবহন ব্যবস্থা শ্রম সূত্রের বাইরে প্রাপ্তব্য আয়ের উদাহরণ মাত্র। এসব উদাহরণ শুধু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘নাগরিক’ হওয়ার জন্য বাড়তি আয় উপার্জনের (বা ব্যয় সাশ্রয়ের) সুবিধা পাওয়ার অধিকারবোধকে ইঙ্গিত করে। এ ধরনের সুবিধার যতই সম্প্রসারণ হচ্ছে ততই যেন এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে যে, মানুষকে শুধু শ্রমিক হিসেবে দেখার আগে তাকে প্রথমে ‘পূর্ণ অধিকার বিশিষ্ট নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। UBI, সর্বজনীন চিকিৎসা, সর্বজনীন শিক্ষা, সর্বজনীন সুরক্ষা, সর্বজনীন গণপরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি শ্রমের পরিমাণ ও গুণের ওপর নির্ভর না করে মানুষের ‘চাহিদার’ ওপরে নির্ভর করবে। এছাড়াও আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম ও বিনোদনের অবকাশ পাওয়ার অধিকারের কথা। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের ব্যবস্থা থেকে ইতোমধ্যেই বর্তমান বিশ্ব ‘সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ ও চাহিদা অনুযায়ী বণ্টনের’ ব্যবস্থার দিকে চলা শুরু করেছে। এই উত্তরণ সবচেয়ে বেশি সার্থক হয় যখন (ক) সমাজ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উচ্চস্তরে পৌঁছায় এবং যখন (খ) সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সর্বস্তরে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই স্তরকেই মার্কস নতুন সমাজের দ্বিতীয় ও উচ্চতম স্তর তথা সাম্যবাদী সমাজ বলেছেন। Ability/Labour স্তর থেকে Ability/Need স্তরে সমাজের এই ক্রমান্বয় কিন্তু অবধারিত বিকাশকে স্বীকার করে নিয়েই বাহাত্তরের সংবিধানের ১০নং অনুচ্ছেদের Just and egalitarian socity
এবং ২০ নং অনুচ্ছেদের Principle ‘from each acording to his abilities to each acording to his work’ এর বিধান সংযোজিত হয়েছে- এটা মনে রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত অর্থনৈতিক দর্শনের প্রেক্ষিতে দুটো অভিযোগের কথা তুলতে চাই। একটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘বামপন্থী’ অবস্থান থেকে; আরেকটি অভিযোগ বেশি শোনা যায় ‘ডানপন্থী’ অবস্থান থেকে। ‘বামপন্থী’ অভিযোগের মর্মার্থ হলো, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৫নং ধারার ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’, ১৭নং ধারার ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ১৮নং ধারার ‘জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা’, ১৯নং ধারার ‘সুযোগের সমতা’ এবং ২০নং ধারার ‘কর্মের অধিকার ও সম্মান’ এসবই সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূলনীতি’র অধ্যায়ে সন্নিবেশিত কেবল। এইসব ‘ভালো ভালো’ কথাগুলো সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে স্থান পায়নি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে স্থান পেলে এসবের বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রের সচেষ্ট দায়বদ্ধতা থাকত। বঙ্গবন্ধু (ও তার নিকটতম সহকর্মীরা) এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। পাল্টা যুক্তি তারা দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালেই- গণপরিষদে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন। তাদের যুক্তি ছিল, ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে যেসব অধিকার দেওয়া আছে সেগুলোর আশু বাস্তবায়ন না ঘটলে বা ব্যত্যয় ঘটলে তার জন্য নাগরিকেরা অবিলম্বে কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি সুবিধা সকলের জন্য আশু-ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পক্ষে নিশ্চিত করার সম্ভব নয় বলেই এসব উন্নয়ন-ধারাকে রাষ্ট্রের ‘মৌলিক নীতিমালার’ ভেতরে রাখা হয়েছে ‘ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য অধিকার’ হিসেবে, বা যাকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেছেন- ‘progressively realizable rights’। প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির সাথে সাথে রাষ্ট্রের ব্যয় বরাদ্দের সক্ষমতা বাড়তে থাকলে এসব অধ্যায়কে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা সহজতর হবে।
এবারে আসি ‘ডানপন্থী’ অভিযোগের বিষয়ে। ইতোপূর্বে আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধু তার ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’কে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করতে চাননি। এরিক ওলিন রাইট (wright) দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ভিত্তিক ব্যবস্থা হচ্ছে একটি রাষ্ট্রতন্ত্র (statism)-এটি সমাজতন্ত্র নয়। সমাজতন্ত্রের মূল সারবস্তু হচ্ছে সমাজ ও সমাজের স্বার্থে অর্থনীতি পরিচালনা করা-সেখানে সমাজই মুখ্য। রাষ্ট্র মুখ্য নয়। এ চিন্তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ভাবনার বিরুদ্ধে সমাজনির্ভর ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় (যেটি রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ পর্বের চিন্তাতেও দেখতে পাই)। [ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


কিন্তু দেখা গেল এই ঘোষণার পরেও দরিদ্র শ্রেণি থেকে আসা এবং অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠী সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারল না। সামরিক দক্ষতা অর্জনের জন্য শারীরিক সক্ষমতা ও পারঙ্গমতা একটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ- যেটা অপুষ্টি ও অসুখে ভোগা জনগোষ্ঠীর পক্ষে অর্জন করা স্বাভাবিকভাবেই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে সুযোগের সমতা নীতি ঘোষণার আগে ও পরে সামরিক বাহিনীতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ করাকে নিশ্চিত করা গেল না। বাহিনীটি মূলত অবস্থাপন্ন শ্রেণি বা গোত্রের মধ্যেই সীমিত হয়ে থাকল। বার্নার্ড উইলিয়ামস এখানে যে উদাহরণ টেনেছেন তা একেবারে বিরল নয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ দমনে পাঞ্জাবের যোদ্ধা-শ্রেণিকে ব্যবহার করা হয়েছিল দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের নানা এলাকায়। এর পুরস্কারস্বরূপ সেন্ট্রাল পাঞ্জাবে সেনা সদস্যদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধরনের ভূস্বামী তথা সামরিক শ্রেণি বা গোত্রের জন্ম হয় পাঞ্জাব প্রদেশে ঔপনিবেশিক পরিচর্যায়। এই শ্রেণিটিই পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে দেশভাগের পর থেকে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। সমাজতাত্ত্বিক হামজা আলাভী এদিকটির প্রতি দৃষ্টিপাত করেছিলেন। এখনও সেন্ট্রাল পাঞ্জাবের অবস্থাপন্ন ঘরের এক ভাই যায় কৃষি ব্যবস্থাপনায়, আরেক ভাই যায় সামরিক বাহিনীতে এবং অন্য কোনো ভাই যায় বেসামরিক সরকারি চাকরিতে।
শিক্ষা, চিকিৎসা ও চাকরি ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ ঘোষিত হয়ে আসছে প্রায় প্রতিটি দেশেই। বিলেতে-আমেরিকায় বিভিন্ন করপোরেট সেক্টরের বিজ্ঞাপনে এখন লেখা থাকে ‘আমরা সুযোগের সমতার নীতিতে বিশ্বাসী’। কিন্তু সমস্যার গভীরে না পৌঁছানোর কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সুযোগের সমতার নীতি পর্যবসিত হয় ‘প্রতীকী সমতার’ নীতিতে। যাকে সমতার সাহিত্যে বলা হয়েছে  formal equality of opportunity বলে। এর বিপরীতে ন্যায়বাদী দার্শনিকেরা প্রস্তাব করেছেন ‘প্রকৃত সমতা’ বা  substantive equality of opportunity-র কথা। এবং খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে বাহাত্তরের সংবিধানে প্রতীকী সমতা নয়, প্রকৃত সমতার কথাই বোঝানো হয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে ১৯নং অনুচ্ছেদের ২নং ধারা, যেখানে অবস্থাজনিত কারণে সৃষ্ট অসাম্যকে দূর করার জন্য সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রণিধানযোগ্য :
‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুযোগের ‘প্রকৃত সমতা’ অর্জনের চ্যালেঞ্জটি আরও ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করা দরকার। কতটুকু বৈষম্য আমরা স্বীকার করে নিতে পারি? নৈয়ায়িক দার্শনিকদের জন্য এটা একটা বড় প্রশ্ন। সুযোগের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেই বৈষম্য দূরীভূত হয়ে যাবে না। একটি সবার জন্য উন্মুক্ত দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ প্রথম হয়, কেউ লক্ষ্যে পৌঁছায় সবার শেষে। এ ধরনের বৈষম্যকে প্রকৃত অর্থে অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্য বলা চলে না। নৈয়ায়িকেরা সেই বৈষম্যকেই স্বীকার করতে রাজি যেটুকু মানুষে মানুষে ‘উদ্যমের ফারাকের’ কারণে সৃষ্টি হয়। যে-বৈষম্য ‘অবস্থার চাপে’ পড়ে সৃষ্টি হয় সেটি নিরসনযোগ্য বৈষম্য। যদি গ্রামের স্কুল থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীকে (যার পরিবারে বা যার স্কুলে ইংরেজি শেখার কোনো আয়োজন বা পরিস্থিতি নেই) শহরের স্কুল থেকে আগত একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করতে হয় এমন এক পরীক্ষায় যেখানে ইংরেজিতেই কেবল পরীক্ষাপত্র করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীর হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা জন রোমার (Roemer) যাকে বলেছেন ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’, বা এলিজাবেথ এন্ডারসন যাকে বলেছেন ‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম (Luck egalitarianism), সেটি এ ক্ষেত্রে রক্ষিত হয়নি।
‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম’-এর মূল কথা হলো নিম্নরূপ :’While inequalities are unjust if they derive from differences in people’s circumstances-because circumstances are a matter of brute luck– they are just if the are the product of people’s voluntary choice.’

অর্থাৎ শুধুমাত্র নিজস্ব নির্বাচন বা পছন্দের কারণে অথবা উদ্যমের তারতম্যের কারণে যদি কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রেও কথা থাকে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে থাকে স্কুলের বাইরে ‘প্রাইভেট ক্লাস’ করার কারণে। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের সে-সংগতি নেই। জেরাল্ড কোহেন (G. A. Cohen) এরকম ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ‘লাক্‌ ইগালিটারিয়ানিজম’-র নীতি দাবি করে যে রাষ্ট্র এ ধরনের সমস্যা সুরাহা করার চেষ্টা করবে বা অন্তত সমাধান করতে সচেষ্ট হবে। যেমন, এই উদাহরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল ছুটির পরে নিখরচায় বাড়তি কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করবে এবং এর জন্য যে বাড়তি ব্যয় হবে তার দায়িত্ব নেবে। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণার তারতম্যের কারণে যে-বৈষম্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে শিক্ষা ক্ষেত্রে, তার বেলায় কী করা হবে? দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিতের পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাবা-মার অনুপ্রেরণা ও পরিবারের কারণে পড়াশোনায় অনেক বেশি তৎপর হয়ে থাকে। খেটে-খাওয়া মজুর পরিবারের বাবা-মা উভয়েই হাড়ভাঙা খাটুনির সঙ্গে জড়িত। সারাদিনের শেষে সন্তানদের ‘হোমওয়ার্ক’ দেখার সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে। লাক্‌-ইগালিটারিয়ানিজম বলে যে এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের অনেক কিছু করার আছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রি-স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা চালু করলে অনুপ্রেরণা বা উৎসাহের ক্ষেত্রে খামতি অনেকটুকু কমে আসবে। পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিভা বিকাশে সহায়ক এবং আত্মবিশ্বাস জোগায় যেটা স্কুলের পারফরম্যান্সেও প্রতিফলিত হতে বাধ্য। কভিডের সময় আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি যে, অনলাইন এডুকেশনের ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বৈষম্য আসলেই প্রকট। করোনার সময়ে যখন লকডাউনের কারণে স্কুলে পাঠদান বন্ধ রইল, ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনলাইনে ঠিকই ক্লাস করতে পারল। ও-লেভেল এ-লেভেল পরীক্ষা দিতে পারল। গরিব পরিবারে একটি করে মোবাইল আছে বটে, কিন্তু স্মার্টফোনের সুবিধা এখনও অত্যন্ত কম। শহর এলাকার বাইরে ইন্টারনেট স্পিডও তুলনামূলকভাবে কম। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ করা প্রয়োজন যাতে করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের সুযোগের সমান অধিকার নিশ্চিত হয় শিক্ষার মতো অধিকারের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, নৈয়ায়িক দার্শনিকদের সূত্র ধরে- ‘সুযোগের সমতা’ বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯তম অনুচ্ছেদে কোনো প্রতীকী অর্থে বলা হয়নি। এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি। যেটি সুযোগের সমতা বিধানে অবস্থার চাপে সৃষ্ট বৈষম্য বা ‘নির্দয় দুর্ভাগ্য’ (Brute luck) জনিত বৈষম্যকে দূরীভূত করে সবার জন্য সুযোগের দ্বার সমানভাবে খোলা রাখতে বদ্ধপরিকর। এক কথায়, ১৯নং অনুচ্ছেদ শুধু non-discrimination principle-এর ঘোষণাতেই আটকে থাকেনি। ১৯ নং অনুচ্ছেদের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার’ কথা, আর এর ২ নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের কথা’। ১নং ধারায় বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ আজকে যেটা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস-এর ১নং (No Poverty) ২নং  (Zero Hunger), ৩নং (Good Health & Well-being), ৪নং (Quality Education),
, ৫নং (Gender Equality), ৬নং  (Clean Water and Sanitation), ৭নং (Affordable & Clean Energy), এবং ৮নং (Decent Work & Economic Growth) লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, ‘৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এবং ৭২ সালের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ‘মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা’ পূরণের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে’ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা এবং এর মাধ্যমে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করার কথা। শুধু বিষয়টাকে মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যেই সীমিত রাখা হয়নি। সেখানে আরও বলা ছিল ‘কর্মের অধিকার’ নিশ্চিত করার কথা এবং ‘যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার’ প্রদানের গুরুত্ব। যারা পিছিয়ে পড়ে থাকবেন দারিদ্র্যের বিষ-বৃত্তের ভেতরে, তাদের প্রতি রাষ্ট্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হাল-আমলের তথাকথিত ‘সোশ্যাল প্রটেকশন’ কর্মসূচির বহু আগেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের চিন্তায় এসেছিল পিছনে-পড়ে থাকা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার কথা, যার সংজ্ঞা ছিল নিম্নরূপ:
‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।’
শুধু ‘সুযোগের সমতার’ অধিকার নয়, আরও বেশি কিছু ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনে। তিনি বুঝেছিলেন যে ইক্যুয়ালিটি অব অপরচুনিটি সুষম বণ্টনের সমাজের দিকে এগোনোর একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত বটে, কিন্তু যথেষ্ট পূর্বশর্ত নয়। সমাজের একটি মুষ্টিমেয় অংশই উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ লাভ করে দরিদ্র দশা থেকে সচ্ছল দশায় উন্নীত হতে পারবে। সকলের ক্ষেত্রে অদৃষ্ট সমান প্রসন্ন হয় না, সকলের ন্যাচারাল বুৎপত্তি বা প্রতিভাও সমান নয়। কিন্তু তাই বলে কি যারা দীনের চেয়ে দীন, যারা আজীবন কায়িক শ্রমের ভেতরে, খেটে-খাওয়া মানুষ যাদের বলি, তাদের কাজের কি মূল্যায়ন করা হবে না? তারা কি ফ্রন্টলাইন বা এসেনসিয়াল ওয়ার্কার্স হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হবেন না? তাদের কি সমান নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা  (Common Good) পাওয়ার অধিকার নেই? বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে বিশেষ করে ১৪ নং অনুচ্ছেদের প্রস্তাব করেছিলেন:
‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে, এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’
এবং তার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে মেহনতি মানুষকে সহায়তা করতে হবে, দেখভাল করতে হবে। আজকের Universal Basic Income-র ধারণার পূর্বছায়াও আমরা এখানে দেখতে পাই। অন্যত্র- ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রকারান্তরে তিনি উল্লেখ করলেন ‘equality of outcomes’-এর কথা। এটি এসডিজির ১০নং লক্ষ্যমাত্রা ‘বৈষম্য হ্রাস করা’র সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সেদিন তিনি বলেছিলেন:
‘এই সরকার ন্যায়ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেইসব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যারা পাটচাষিদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন, তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতোমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশে মানুষ মানুষে, ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।’
বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধিই বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(২) ধারায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ করার জন্য এবং নাগরিকদের মধ্যে ‘সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত’ করার জন্য ‘সর্বত্র সুষম সুযোগ-সুবিধাদান’ প্রদানে রাষ্ট্রের তরফে ‘কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার কথা। পরিশেষে, ২০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল শ্রম অনুযায়ী বণ্টনের কথা:
‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে এবং প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এই নীতির ভিত্তিতে ‘প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


প্রথমটি ছিল- সকলের জন্য সমান লিবার্টি বা স্বাধীনতার প্রস্তাব। দ্বিতীয়টি ছিল- সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কত দূর পর্যন্ত স্বীকার্য তা নিয়ে তার উপলব্ধি। ‘সবচেয়ে গরিবকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা’ দিতে হবে সবার আগে, সবার জন্য ‘মৌলিক চাহিদা’ পূরণের ক্ষেত্রে- এটি তার ন্যায়বাদী সমাজের একটি প্রধান পূর্বশর্ত ছিল। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, তার নির্দেশিত মুক্ত ও সামাজিক ন্যায়ের সমাজেও মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ আরোপিত হয়েছিল। যেমন, বহুত্ববাদিতা তিনি চেয়েছেন, কিন্তু সেই বহুত্ববাদিতাকে হতে হবে যুক্তিযুক্ত- এজন্যই তার নাম দিয়েছেন ‘Reasonable Pluralism’ বলে। কিন্তু কোনটা (এবং কতদূর পর্যন্ত) হবে যুক্তিসংগত বহুত্ববাদ, তার সীমানা নির্ধারণ কেবল মাত্র জনগণের মধ্যে মুক্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পন্ন করা সম্ভব। অমর্ত্য সেন যাকে (জন স্টুয়ার্ট মিলের অনুসরণে) বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি সরকার-ব্যবস্থা যেখানে সবকিছু পরিচালনা করা হয় ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে’ (‘রুলিং বাই ডিসকাশন’)। সংসদ সেরূপ মুক্ত পর্যালোচনার জন্য একটি প্রধানতম প্ল্যাটফর্ম। এটি বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাদের একটি মৌল পূর্বানুমান  (Premise)।
Lost in Translation দিয়ে এই অধ্যায়টি শুরু করেছিলাম। এবারে অনুবাদের একটি সমস্যা দিয়ে নতুন প্রসঙ্গে যেতে চাই। এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে, ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটির অনুবাদ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি ভাষ্যে সমার্থক ব্যঞ্জনা পায়নি। বাংলা পাঠে সমাজতন্ত্র ধারণাটি অনেক বেশি ‘র‌্যাডিকেল’ ইংরেজি পাঠের তুলনায়। র‌্যাডিকেল এই অর্থে যে, বাংলা ভাষ্যটি অনেক বেশি যুগান্তকারী, বিপ্লবাত্মক ও ‘সুদূরের পিয়াসী’। ইংরেজি পাঠ সে তুলনায় অনেক বেশি ধীরে-চলা নীতির, সংস্কারবাদী ও আশু কর্মসূচির। এটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
১০ নং আর্টিকেল-এর ইংরেজি পাঠে লেখা হয়েছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ : ‘Socialist economic system’, ‘attainment of a just and egalitarian society’ Ges ‘free from the exploitation of man by man’। এই প্রতিটি বাক্যাংশই অনেক অর্থের ভারে নুয়ে আছে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেম establish করার’ যথার্থ অর্থ কী তা ধ্রুপদি মার্কসবাদে নির্দিষ্ট করা ছিল না। মার্কসবাদ ছাড়া অন্যান্য ধারার সমাজতন্ত্রেও অর্থটি নির্দিষ্ট হয়ে নেই। যেমন, জন স্টুয়ার্ট মিল নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবতেন, সমাজতন্ত্র নিয়ে তার ট্রিটিজ রয়েছে। কিন্তু সেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ‘ফেবিয়ান সোশ্যালিজম’-এর ফারাক আছে। আধুনিক অর্থনীতির জনক আলফ্রেড মার্শাল অর্থশাস্ত্রে নব্য-ধ্রুপদি ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু সমাজ-চিন্তায় তিনি নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবেই দেখেছেন। ‘টু মার্শালস’ বইতে মার্শালের দ্বৈত-চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্লুমসবিউরি গ্রুপের বিদগ্ধ সদস্য ও দিকপাল অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস প্রথাগত সমাজতন্ত্রের কট্টর সমালোচক ছিলেন, কিন্তু নিজেকে তিনি ‘বামধারার’ অর্থনীতিবিদ হিসেবেই ভাবতেন, বিশেষত অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রশ্নে জোরালো অবস্থান নিয়ে। ‘সোশ্যালিস্ট ইকোনমিক সিস্টেমের’ অন্য একটি প্রচলিত অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’-এর মডেল অনুসরণ করা। কিন্তু সেটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা সংবিধানের আলোচনায় আগেভাগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সে ধরনের মডেল এদেশে হবার নয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনগ্রসর পটভূমিতে সে ধরনের উন্নয়নের ছকে ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অর্থনীতি’র মডেলকে আশ্রয় করে এগোবার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ১৯৭৩ সালে গৃহীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলেও সেই বাস্তববোধের স্বীকৃতি ছিল। এখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য রাস্তা দেখতে হবে, যাতে করে ন্যায়ানুগ, সমতাবাদী ও শোষণমুক্ত সমাজ কালক্রমে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
‘জাস্ট অ্যান্ড ইগালিটারিয়ান সোসাইটি’ বাক্যাংশ নিয়েও বাংলা ও ইংরেজি পাঠে বড় রকমের ধন্দের সৃষ্টি হলো। ড. আনিসুজ্জামান কমিটি ‘জাস্ট’-এর বঙ্গানুবাদ ঠিকই করলেন ‘ন্যায়ানুগ’, কিন্তু গোল বাধল ‘ইগালিটারিয়ান’ শব্দটির বাংলা নিয়ে। ড. কামাল লিখলেন ‘egalitarian society’; ড. আনিসুজ্জামান লিখলেন ‘সাম্যবাদী সমাজ’। আপাতঃদৃষ্টিতে দুটোকেই সমার্থক শব্দ মনে হলেও এরা আদৌ সমার্থক নয় বর্ণে-গন্ধে, ঐতিহ্যে, পরম্পরায়। egalitarianism নানা ধারার মতবাদেই, নানা ধরনের সংবিধানেই আছে। যে কোনো ‘লিবারেল বুর্জোয়া’ ধারার টেক্সটেই ‘egalitarian society’ শব্দবন্ধটি খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিকও নয়। এর একটা কারণ- অর্থনীতিতে না হোক, রাজনীতিতে egalitarianism অর্থাৎ Political equality, এবং মৌলিক অধিকারের equality প্রতিশ্রুত হয়ে থাকে। এর শুরু ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের দর্শনে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এটি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করেছিল ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যার স্লোগান ছিল- ‘লিবার্টি, ইকুয়ালিটি, ফ্রেটারনিটি’। ইকুয়ালিটি ফরাসি উচ্চারণে হয় ‘ইগালিতে’- সেখান থেকে ইংরেজিতে তার পুনর্জন্ম egalitarian ব্যাঞ্জনায়। আমি বলতে চাইছি, কী ঐতিহাসিকভাবে এবং ব্যুৎপত্তিগতভাবে ড. কামাল যখন   just and egalitarian society ব্যবহার করে ছিলেন তিনি কমিউনিস্ট অর্থে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অর্থে খুব সম্ভবত ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করেছিলেন লিবারেল পলিটিক্যাল ফিলোসফির পলিটিক্যাল ইকুয়ালিটির বহুল প্রচলিত অর্থে। ফরাসি বিপ্লবের Spirit-এ। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামানের হাতে পড়ে সেটা হয়ে গেল- ‘সাম্যবাদী সমাজ’। তিনি এর পরিবর্তে ‘সমতাবাদী সমাজ’, ‘সুষম বণ্টনের সমাজ’ নানা ধরনের বিকল্প ভাবতে পারতেন বা নতুন শব্দ উদ্ভাবন করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি হাত বাড়ালেন এমন একটি শব্দের প্রতি যার অর্থ বহুকাল ধরে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে সংজ্ঞায়িত হয়ে আছে। মার্কসবাদী প্রগতিবাদী দর্শনের যে কোনো টেক্সটে যখন ‘সাম্যবাদী সমাজ’ শব্দটি লেখা হয়, তখন তার একটিই (বা প্রধানতম) মানে হচ্ছে- মার্কস-এঙ্গেলসের নির্দেশিত পথের ‘সাম্যবাদী সমাজ’। যে সাম্যবাদী সমাজের দুই ধাপ- প্রথমটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত নিচু পর্যায়ে)। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাম্যবাদী সমাজ (বিকাশের অপেক্ষাকৃত উঁচু পর্যায়ে)। এটি হতেই পারে না যে ড. আনিসুজ্জামান বা তার সহ-অনুবাদকগণ ‘সাম্যবাদী সমাজ’ লেখার ‘ছায়া-অর্থ’ বা  Connotation জানতেন না। অন্তত ড. আনিসুজ্জামান- যিনি এক সময়ে (পঞ্চাশের দশকে) কিছুকালের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন (এবং পরবর্তীকালেও এ ধারার সংলগ্ন আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন)- সাম্যবাদী সমাজ লেখার গভীরতর তাৎপর্য ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন বা বুঝতে পারার কথা।
প্রশ্ন উঠবে, অনুবাদটি যে যথাযথ হলো না আক্ষরিক ও রাজনৈতিক উভয় অর্থে, সেটি আনিসুজ্জামানের হাত থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হলেও সংবিধান-কমিটির অন্য সদস্যদের তো এই অনুবাদের দার্শনিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য চোখে পড়ার কথা। তাহলে সেটি নিয়ে সেদিনের গণপরিষদে তর্ক ওঠেনি কেন? সংবিধান-কমিটিতেও এ নিয়ে বাদানুবাদ হতে পারত অল্পবিস্তর। সেটা হয়েছিল কিনা আজ সেটা জানবার প্রায় উপায় নেই। আমরা শুধু এটুকু জানি যে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা ড. কামাল হোসেন কেউই  egalitarian society-র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সাম্যবাদী সমাজ’ প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে আপত্তি জানাননি। হতে পারে তারাও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দেশটিকে ওইরকম একটি আদর্শ বা আদর্শায়িত সমাজের দিকেই কালক্রমে- অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও চড়াই-উৎরাইয়ের ক্লেশ-যন্ত্রণা স্বীকার করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই এই যাত্রা হতো গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণ করে- অগণতান্ত্রিক পরমত অসহিষ্ণু পথে নয়- সন্দেহ নেই। সমতামুখী সমাজের দিকেই এগোতে চেয়েছিলেন তারা। অন্তত সেরকম স্বপ্ন তাদের ছিল। সে জন্যেই আনিসুজ্জামানের অনুবাদে তারা আপত্তি জানাননি সেদিন কেউই।
১০. ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘শ্রম-অনুযায়ী বণ্টন’
আগেই বলেছি, সমাজতন্ত্র মানে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাভিত্তিক সমাজ নয়। সমাজতন্ত্রকে এমনকি শুধু সম্পত্তির ওপরে মালিকানা নিরিখে বিচার করা চলে না। মালিকানার বিচার সমাজতন্ত্রের একটি মূল দিক। তবে একমাত্র দিক নয়, প্রধানতম দিকও নয়। এর কারণ সমাজতন্ত্র প্রতিশ্রুতি দেয় প্রত্যেক নাগরিককে ‘সুযোগের সমতা’র অধিকার। সুযোগের সমতা বা equality of opportunity সমাজতন্ত্রের মৌলিক শর্তের একটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত। সমাজতন্ত্রের চরিত্রে রয়েছে ‘সামাজিক মালিকানা’ (যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তি মালিকানার নানা দেশ-কাল ভেদে বিভিন্ন মিশ্রণ)। কিন্তু সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে একটা বিশেষ লক্ষ্যে, আর সেটা হচ্ছে সকল নাগরিকের মধ্যে ‘সুযোগের সমান অধিকারের’ প্রতিষ্ঠা করা। মালিকানা- তা সে রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তি মালিকানাই হোক- কেবল উদ্দেশ্য সিদ্ধির ‘উপায়’ মাত্র। উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে সমাজতন্ত্রের চরিত্রে বিকৃতি দেখা দিতে বাধ্য। নানা দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার অভিজ্ঞতায় এটা দেখা গেছে- কখনও ‘স্তালিনীয় সমাজতন্ত্রে’র মডেলে পণ্য-অর্থ সম্পর্ককে হালকা করে দেখার মাধ্যমে। কখনও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ওপরে মাত্রাতিরিক্ত জোর দিয়ে, কখনও না-পরিকল্পনা না-বাজার এমন একটা জগাখিচুড়িপূর্ণ ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’ কর্মসূচি হাতে নিয়ে (যেমনটা হয়েছিল গর্বাচেভের সংস্কার-প্রচেষ্টার আমলে)। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ প্রায় প্রতিটি ‘সমাজতান্ত্রিক দেশেই’ মালিকানা সম্পর্কের বিশুদ্ধতা রক্ষায় বেশি তৎপর হতে গিয়ে আসল উদ্দেশ্য জনকল্যাণ থেকে দৃষ্টি সরে গেছে সময় সময়। সে জন্যেই সমাজতন্ত্র কী তা বোঝার জন্য consequentialist দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রকে টিকতে হলে তাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলতে শিখতে হবে। যার ইঙ্গিত রেখেছিলেন মার্কস ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ যেখানে সমাজতন্ত্রকে ক্রমশ মানবচাহিদামুখীন (Need based society) সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন মার্কস। বাহাত্তরের সংবিধানের আদি প্রণেতারা ও বঙ্গবন্ধু ‘অধিকারের ভাষাতেই’ সমাজতন্ত্রকে দেখতে চেয়েছেন- শুধু মালিকানা-সম্পর্কের নিরিখে দেখতে চাননি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সংবিধানের ১৯ এবং ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ। এ নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা সীমিত রাখব। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যার জন্য এ দুই অনুচ্ছেদের পদ্ধতিগত গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯নং অনুচ্ছেদে ১নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুযোগের সমতার কথা’, আর ২নং ধারায় বলা হয়েছে ‘সুষম বণ্টনের’ কথা। ১নং ধারায় অতি সংক্ষেপে বলা হয়েছে : ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ অতি সংক্ষেপেই চুম্বক-বাক্য হিসেবে ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটির’ কথা লেখা হয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা না করেই। কোন কোন সুযোগের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করা হবে বা বেশি জোর দেওয়া হবে, কতটুকু সমতা বিধান করা হবে (কতটা গভীর গিয়ে বৈষম্যের প্রশ্নটি সমাধা করা হবে); কোন কোন ক্ষেত্রে সমতা-বিধানের প্রশ্নটি সবার আগে সমাধান করা জরুরি, এবং কী ধরনের সুযোগের ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্নটি ক্রমান্বয়ে অর্জিত হবে এসব প্রশ্নই প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভেতরে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা, গণ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। তার কিছু কিছু দিকের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।
সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে গেলে প্রথমেই এসে পড়ে সুযোগের ক্ষেত্রে ‘আদি-বৈষম্য’ (initial inequality) দূর করার সমস্যাটি। এ ক্ষেত্রে বার্নার্ড উইলিয়ামস একটি উপদেশ দিয়েছেন। ধরা যাক কোনো একটি দেশে নীতি-নির্ধারকেরা ঠিক করলেন যে কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় বা বিশেষ কোনো যোদ্ধা-শ্রেণি বা গোত্র (ইংরেজিতে যাকে বলে- warrior class) থেকেই সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হবে ব্যাপারটা এমন নয়। এবার থেকে সমাজের সকল স্তরের মানুষেরাই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ‘সমান সুযোগ’ পাবেন। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে ‘সুযোগের সমতা’ পূর্ব-ঘোষিত হলো।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত বাধা অপসারণের জন্য তারা বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্র বা লিবারেল ডেমোক্রেসির গণ্ডি ছাড়িয়ে এক র‌্যাডিকেল ধারার গণতন্ত্রের (Radical Democracy) জন্ম দিচ্ছেন। একেই বঙ্গবন্ধু অভিহিত করেছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে। পরবর্তী অধ্যায়ে- বাকশালের আলোচনায়, এ নিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে উৎক্রমণের আরও কিছু উদাহরণ ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে।
যে যুক্তির বলে ভারতে ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনকে নাকচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাকে তিক্ত অভিজ্ঞতা বলেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম- সেটি ৪৭নং অনুচ্ছেদের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারত। বিদেশে বসে পরিত্যক্ত শিল্পকারখানার অবাঙালি মালিকেরা দিন গুনছিলেন কবে তারা বাংলাদেশে এসে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি পেশ করবেন ভারতীয় রায়ের যুক্তি দেখিয়ে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা এই বিপদের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই বিপদ শুধু অবাঙালি মালিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দেশি শিল্প-মালিকদের নিয়েও উৎকণ্ঠার কারণ ছিল। এর একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাই ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণায়। তিনি লিখেছেন:’১৯৭৩ সালের শেষের দিকে মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তখন জাতীয়করণকৃত জুটমিলগুলোতে সাবেক মালিকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সাবেক মালিকরা ১৮টি মিলের যাবতীয় অর্থ একই দিনে উঠিয়ে মিলগুলো দেউলিয়া করার উদ্যোগ নেন। পূর্ব রাতে এ সংবাদ নিয়ে ফরাসউদ্দিন (বঙ্গবন্ধুর পিএস এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর)-এর সাথে দেখা করে তাকে ঘটনা খুলে বলি। তিনি ডিসিকে টেলিফোন করে, ঐ সকল জুটমিলের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ব্যবস্থা করেন।’ এতে করে অ্যান্টি-ন্যাশনালাইজেশন লবির অপতৎপরতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সন্দেহ কী, এসব ঝুঁকি এড়াতেই সেদিন ৪৭নং অনুচ্ছেদের সংযোজন করতে হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে।
ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন সম্পর্কিত ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ নিয়ে আরও কিছু তথ্য যোগ করা দরকার এখানে। জাস্টিস হেদায়েতুল্লাহর ভূমিকা সম্পর্কে সৈয়দ নজরুল সেদিন যা বলেছিলেন তার সবটাই সত্য নয়। আসলে যা হয়েছিল তা ঘটনা প্রবাহের কাছাকাছি- কিন্তু খানিকটা অন্যরকম। ১৯৬৯ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ইস্তফা দিলেন। এর দু’দিনের মাথায় ঘোষিত হলো ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনের নীতি। এই নীতির ঘোষণা পেয়ে তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জাস্টিস মো. হেদায়েতুল্লাহ (তিনি ততদিনে প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন) পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর ঠিক দু’দিন আগে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। এই অর্ডিন্যান্সে জাতীয়করণের ফলে গৃহীত ব্যাংকসমূহের মালিকদের ‘পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার প্রভিশন রাখা ছিল না। এই অধ্যাদেশকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ব্যাংক অব বরোদার মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার রুস্তম কুপার সাহেব সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। এর ওপরে ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘কুপার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া :ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন কেইস’ মর্মে এক ঐতিহাসিক রায় হয়। ১১ জন বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় প্রদানে অংশগ্রহণ করেন এবং ১০ :১ রায়ে তারা অধ্যাদেশটি বহাল রাখেন। কিন্তু বহাল রাখলেও তারা কতকগুলো মন্তব্য করেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে কিছু জরুরি পরিবর্তন আনতে হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানে। যেমন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কুপারের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি এ কথা বলা হলেও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল যে সাধারণভাবে ‘ ‘It was not binding upon the Supreme court to reject the claim for enforcement of a shareholder’s fundamental rights, if in the process of violaton of his rights, the rights of his company were also being violated.’ ভারতীয় সংবিধানে বহুদিন পর্যন্ত জরমযঃ : Right to Property-কে 19(1)(F) ) ধারা অনুসারে ‘মৌলিক অধিকার-র অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। পরবর্তীকালে বিশেষ করে ‘কেশবানন্দ ভারতীর’ রায়ের পরে- এই ধারাটিকে বাদ দিতে হয় ভারতীয় সংবিধান থেকে। একইভাবে আগে Article 31 অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তা করতে গেলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হতো যার কাছ থেকে সম্পদ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তাকে। সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করেন যে, যার সম্পত্তি গ্রহণ করা হচ্ছে তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। এখানে ‘কোম্পানিকে’ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, আর ভারতীয় সম্পত্তি আইন বলে ‘কোম্পানি’ কোনো নাগরিক নয়, এবং সেহেতু কোম্পানির কোনো প্রচলিত নাগরিক অধিকার এ ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়নি। এর অর্থ- অন্য কোনো ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি জাতীয়করণ করার প্রশ্ন দেখা দেয়, তবে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কাজ বলে পরিগণিত হবে। এসব আশঙ্কা এড়ানোর জন্য ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায় থেকে 19(1)(F) ধারা বাদ দেওয়া হয়। এরকম আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয় সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে। এটাকেই ড. কামাল হোসেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ বলেছেন, এবং এ লক্ষ্যে বাহাত্তরের সংবিধানে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৪২(১) ধারা রেখেও ৪২(২) ধারা সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং আলাদা করে গুরুত্ব সহকারে ৪৭নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়।
ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন রায়ের সময় ভারতের সরকার পক্ষ থেকে এ যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, এ রকম জাতীয়করণ চাইলে রাষ্ট্র করতেই পারে, কেননা ‘There was an obligation upon the state to achieve a socialistic society with principles of egelitarianism’। যদিও ভারতীয় সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি যুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে, এর পরিস্কার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের ভুবনেশ্বর কংগ্রেসে। সেই কংগ্রেসে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সোশ্যালিজম’ নামে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তৎকালীন কংগ্রেস পার্টি। তার পর থেকেই এর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্তি দেখা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার যুক্তিটি তেমন গুরুত্ব পায়নি, বরং যুক্তি দেওয়া হয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে সম্পত্তির অধিকারকে সংরক্ষণ করার প্রতি। ‘উদ্দেশ্য’ (Objective)-র বদলে জোর দেওয়া হয়েছিল ‘পরিণাম’  (Effect)-র প্রতি : ‘The court struck down the ‘object’ test and laid down the ‘effect’ test. The effect test would now look into the effect of any particular legislative Act, rather than looking at the objective with which it had been formulated. Thes, if any Act of the legislature, even at a remote stage, violated the Fundamental Rights of the citizens, then, it was liable to be struck down.’ বাংলাদেশেও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ এ রকমটাই ভেবেছেন- শুধু একটি মাত্র ক্ষেত্রকে তারা ব্যতিক্রমের তালিকায় রেখেছেন। সমাজতন্ত্রের নির্মাণের জন্য তারা প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এরকম বিষয়টি ‘মৌলিক অধিকারের’ অধ্যায়ে ৪২(২) এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে, ভারতীয় সংবিধানও 19(1)(F) এবং Article 31 বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পথই অনুসরণ করেছে। এই প্রেক্ষিতেই ড. কামাল হোসেন তার ৩০ অক্টোবরের ভাষণে বলেছিলেন ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা :
‘মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনি নিশ্চয় জানেন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের ইতিহাস। যখন তারা জমিদারি আইন সংশোধন করতে যান, তখন সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট সেটাকে নাকচ করে দেন। তারপর, তাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বলবৎ করতে হয়। … যখন ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছিল, তখনও সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দেন। … তারপর ২৬ নম্বর সংশোধনীতে এসে তারা মোটামুটি বলে দিয়েছেন যে, সংসদ আইন করে সেখানে মূলনীতি ঘোষণা করে দিতে পারবেন। মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য এটা করা হয়েছে। এটা আদালতের বিবেচনার বাইরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের একটা সুবিধা হয়েছে এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পঁচিশ বছর পরে ভারতকে যেটা সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে করতে হয়েছে, আমরা সেটা এখনই সঙ্গে সঙ্গে করে নিতে পেরেছি।’
এখানে বলা দরকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-র কথা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সংবিধানে রয়েছে। ভারতে ১৯৬৩ সালের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘reasonable restrictions on the exercise of the right’  বিষয়টিকে আরও জোরদার করা হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটাকে আরও বেশি করে মূলনীতি সমতাবাদী লক্ষ্যের অধীনস্থ করা হয়। এই সংশোধনী বলে কোন কিছু যদি ‘egalitarian social order’ -এর মূলনীতির পরিপন্থী হয় তবে তা বাতিলযোগ্য হবে। দেশজ রাজ্যসমূহের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে এই বলে যে, এ ধরনের স্বাধীন রাজ্য ব্যবস্থা- : the concept of rulershi-সমতাবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় :’The concept of rulership, with privy purses and special privileges unrelated to any current functions and social purposes, is incompatible with an egalitarian social order’, এবং সে কারণে এসব বাড়তি সুবিধাভোগের অধিকার- তা ‘ব্যক্তিগত অধিকার’ বলে আগে ভাবা হলেও এখন থেকে প্রত্যাহূত হলো। ভারতীয় সংবিধানের এই অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল সংবিধান প্রণেতাদের কাছে। বোঝাই যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যক্তি স্বাধীনতার ডিসকোর্সের ভেতরে আবদ্ধ ছিলেন না বা থাকতে চাননি। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা সমাজতান্ত্রিক তথা সমতাবাদী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। এ দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তাদের পক্ষপাতিত্ব ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতিই। তাজউদ্দীন আহমদও ড. কামালের মতোই- এমনকি আরও এগিয়ে গিয়ে ভেবেছেন। এজন্যই তার ৩০ অক্টোবরের বক্তৃতাতে উঠে এসেছে ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা :
‘আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্কারভাবে সমাজতন্ত্র কী, তা বলে দিয়েছে … সেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি আমরা করতে যাচ্ছি, যা এই সংবিধানে রয়েছে। … সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এই রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিকে আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা, যাতে … মৌলিক অধিকার … এতে অন্তরায় সৃষ্টি না করে। যারা প্রগতিবাদী বলে দাবি করেন, তারা সমালোচনা করছেন এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নয় বলে। আমি জানি না, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, সে পরিকল্পনা কেউ যদি দিতে পারতেন, তাহলে এই পরিষদ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন।’
এই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন সংবিধানের লিবার্টি প্রিন্সিপাল ও সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে একত্রিত করে ছুড়ে দিয়েছেন আরও একটি চ্যালেঞ্জ। তবে সেটা গণতন্ত্রীদের প্রতি :
‘সমাজতন্ত্রের পথে যাতে কোনোরূপ অন্তরায় সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা আমরা ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে করেছি। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ করে মৌলিক অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর চেয়ে কম সীমাবদ্ধতা পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংবিধানে আছে বলে আমি জানি না। যদি কেউ আমাদের দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা উপকৃত হব। কেবল দুই-একটা ক্ষেত্রে দাঁড়ি-কমার কমবেশি হতে পারে। বাধানিষেধ ছাড়া কোনো দেশে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়নি, হতে পারে না।’
এ-ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ এ দুই মৌলিক মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্যতা অর্জনের ও তা গতিশীলভাবে রক্ষা করে অগ্রসর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। বাহাত্তরের সংবিধানের ঠিক এক বছর আগে দার্শনিক জন রাউলস ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন তার দিকনির্দেশকারী বই- ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’। ন্যায়ানুগ ও গরিবমুখিন সমাজের ন্যায়বাদী তত্ত্ব রচনার সময় তিনি লিবার্টি প্রিন্সিপালকে সোশ্যাল জাস্টিস তথা বণ্টনগত ন্যায় (Distributive Justice)-র প্রিন্সিপলের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য যদি দরকার হয়, গণভোটে যারা প্রতিনিধি হয়ে আসবেন, তারা আইন করে ব্যক্তি সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে পারবেন। কেনো বাধা নাই। এ জন্য রক্তক্ষয়ের দরকার নাই। বিপ্লবের দরকার নাই।… বিভিন্ন দেশে সেই সব দেশের লোকদের নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, জিডিআর, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা বলছিলাম। যে কোনো সম্পত্তি, যে কোনো পদার্থ-স্থাবর অস্থাবর যাই হোক না কেন, নেওয়া যাবে। এর চেয়ে বেশি কী করা যেতে পারে? যা চীন করেনি, রাশিয়া করেনি, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ করেনি, আমরা তা করেছি। কাজেই জনাব স্পিকার সাহেব, সমাজতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, এ কথা অত্যন্ত অমূলক। বিচার করলে সে কথা মেনে নিতে পারি না। আগেও আবেদন করেছি, আপনার মাধ্যমে আবার আবেদন করব যে, তারা [বামপন্থিরা] অযথা মানুষের মনে আশা জাগিয়ে তুলবেন না। যেটা দিতে পারবেন না, যেটা সম্ভব নয়, সেটা নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। তাতে লাভ নাই।’
আছাদুজ্জামান খানের বক্তব্যে ৪২ নং অনুচ্ছেদের কথা এসেছিল ৪৭ নং অনুচ্ছেদের পাশাপাশি। ৪২নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে ৪৭ নং অনুচ্ছেদের আংশিক বিরোধ আছে। ৪২ নং অনুচ্ছেদে যে অধিকার প্রদত্ত হয়েছে, ৪৭নং অনুচ্ছেদে সেই অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এমনকি ৪২ নং অনুচ্ছেদের ১ নং দফায় যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, এর ২ নং দফায় তাকে আবার যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের মোড়কে বাঁধা হয়েছে। যেমন ৪২ (১) ধারায় নাগরিককে ‘সম্পত্তির অধিকার’ দেওয়া হয়েছে এভাবে :’আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।’ এর পরপরই বলা হয়েছে যে, ৪২ (১) দফার অধীনে প্রণীত আইনে দেশের স্বার্থে ‘ক্ষতিপূরণসহ বা বিনা ক্ষতিপূরণে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখলের বিধান করা হইবে।’ কিন্তু ‘অনুরূপ কোন আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান করা হয় নাই বলিয়া কিংবা ক্ষতিপূরণের বিধান অপর্যাপ্ত হইয়াছে বলিয়া সেই আইন সম্পর্কে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
এই র‌্যাডিকেল সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, যদিও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবের কথা বলেছেন আছাদুজ্জামান খান, ৪২ (২) ধারায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না এই বিধান রেখে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির অধিগ্রহণের বিষয়টিকে অত্যন্ত র‌্যাডিকেল এক চেহারা দেওয়া হয়েছে। এরকম অধিগ্রহণ অক্টোবর বিপ্লবোত্তর রাশিয়া বা চীনে পুঁজিবাদী সম্পত্তির বিনা শর্তে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা  expropriation-র সঙ্গে তুলনীয়। এই আইনের পেছনে প্রচ্ছন্ন পলিটিক্যাল ইকনোমি কারণ ছিল। যেসব অবাঙালি মালিক ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর তাদের কল-কারখানা ফেলে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যাওয়ার আগে তারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সব টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিদেশে থেকে তারা পাঁয়তারা করছিলেন সময়-সুযোগ বুঝে দেশের আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার, যাতে করে তারা তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন কল-কারখানাগুলো ফেরত পেতে পারেন, অথবা তারা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। সদ্য-স্বাধীন সরকারকে এই আশঙ্কা বিচলিত করেছিল। সেজন্যেই ৪২ (২) ধারার র‌্যাডিকেল অবতারণা এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের সংযুক্তি বেশি করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সেদিন।
আগেই বলেছি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে অধিকার দেওয়া হয়েছে ৪২(১) অনুচ্ছেদে। কিন্তু সেখানে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ শর্তটি আরোপিত হয়েছিল। এই শব্দবন্ধের আরোপ করা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল সেদিনের গণপরিষদে। যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে এতে করে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের গণতন্ত্রের অংশটুকু ক্ষুণ্ণ হতে পারে। যেমন মো. আবদুল আজিজ চৌধুরী (সিলেট-২১) একটি সার্বিক মন্তব্য রাখেন এ প্রেক্ষিতে :
‘জনাব স্পিকার, এই সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ হতে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিধানগুলোতে মানবিক মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে; কিন্তু সেই সঙ্গে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ-সংক্রান্ত শর্তাবলি সংযোজনের ফলে ভয় হয় যে, যে কোনো কথার বিরুদ্ধে, যে কোনো বক্তব্যের বিরুদ্ধে সরকার যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’
এই সাধারণ আশঙ্কার প্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন তার ৩০ শে অক্টোবর, ১৯৭২-এর ভাষণে যা বলেছিলেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং পূর্ণ উদ্ধৃতি দেওয়ার দাবি করে :
‘[বিভিন্ন] দেশের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বিধান পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে এসেছি, সেটা হল, কোন কোন দেশে দুইটা ‘অ্যাপ্রোচ’ লক্ষ্য করা যায়। একটা হল, আইন-সাপেক্ষ মৌলিক অধিকার-যেমন পূর্ব জার্মানি এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে রয়েছে যে, এ ব্যাপারে সংসদের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। সেখানে আইনের দ্বারা সবকিছু নির্ধারিত হতে পারবে। কোনো কিছুর ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ করা যাবে আইনের দ্বারা।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানবাধিকারের ঘোষণা। যেসব দেশে এই ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশেও আইন-পরিষদের ক্ষমতা আছে আইন করার। কিন্তু কোন রকম যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করার এখতিয়ার একমাত্র আদালতের। কোন বাধানিষেধ যুক্তিসংগত হল কিনা, সেটা বিচার করবেন আদালত। এটার দ্বারা কিন্তু মৌলিক অধিকারের পূর্ণ রক্ষা হয়।’
এই দুটো ধারার মধ্যে ২য় ধারাটি বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে, কেননা ২য় ধারার মধ্যেই গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রক্ষাকবচ নিহিত। ১ম ধারাটিতে সংসদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়- যার ফলে ইচ্ছে করলে সংসদ অধিকার ও স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে, যেটাকে আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা যায় না। পক্ষান্তরে ২য় ধারাটিতে সংসদ ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করে’ ঠিকই, কিন্তু সেটা ‘যুক্তিসংগত হল কি হল না, সেটা বিচার করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। এই অধিকার সুস্পষ্ট, সুনিশ্চিত। সংসদ এটা খর্ব করতে পারবেন না।’
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য ড. কামাল সেদিন সংবিধান শাস্ত্র থেকে ইংরেজিতে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলেন। সেটি শুনে নেওয়া দরকার।
‘The power to impose limitations may be looked at from another angle, which presents two possibilities. The first is that the legislature is given general, unrestricted Power to limit rights and freedom : they are simply made subject to the laws.  Such a formula depicts the right and freedoms of any higher safeguard, and renders them valueless.
The second possibility is that the legislature is empowered to limit the rights and freedoms only for certain clearly defined purposes : they are made subject to the laws in certain specified respects only. The universal declaration uses this formula; it permits limitations on rights and freedoms for the protection of four community interests. These interests are : (1) due recognition and respect for the rights and freedoms of others; (2) meeting the just requirements of (a) morality, (b) public order, and (c) the general welfare in a democratic society.’

এই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি অনুসরণ করলে- ড. কামালের মতে- ‘মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি রক্ষাব্যবস্থা দেওয়া সম্ভব হয় না।’ আর বাংলাদেশ তথা বাহাত্তরের সংবিধান সেই দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করেছে :সংসদ মৌলিক অধিকার দেওয়ার বেলায়-কোনো কোনো ক্ষেত্রে- ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করার বিধান রেখেছে বটে, কিন্তু তা যুক্তিসংগত হল কি হল না, সেটা বিচার করার এখতিয়ার কেবল সুপ্রীম কোর্টের।’ সেই এখতিয়ারে হাত দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই সংসদের। প্রায় প্রত্যেক অধিকারের ক্ষেত্রে এই বিধান করা হয়েছে (অবশ্য এ ক্ষেত্রে ড. কামালের একটি প্রধান অনুমান ছিল যে, সুপ্রীম কোর্ট হবে সংসদ ও সরকারী প্রশাসনের থেকে সম্পূর্ণ মাত্রায় হস্তক্ষেপমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান)। প্রত্যেক অধিকারের ক্ষেত্রে করা হয়েছে কেবল মাত্র ৪৭নং অনুচ্ছেদ ছাড়া। এই ৪৭নং অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে ড. কামাল বললেন :
“একটি মাত্র যে ব্যতিক্রম করেছি, সেটি হলো সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে। ‘আইন-সাপেক্ষে’ এবং ‘যুক্তিসংগত’ কথাটা সেখানে নেই। অন্য সবগুলির ব্যাপারে আমরা ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ রেখেছি। এটা করা হয়েছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সামনে রেখে। যাতে একটা ফর্মুলা বের করা যায়, তার একটা রূপরেখা আমরা দিয়েছি এই সংবিধানে। প্রত্যেক মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ থাকল কি থাকল না, তা নিয়ে তর্ক করার কোনই অবকাশ নেই। কারণ, সেটা আদালত দেখবেন। তবে সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে সংসদকে সার্বভৌম অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনসভা যা নির্ধারণ করে দেবেন, সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে আদালতের কোন এখতিয়ার থাকবে না। জাতীয়করণের প্রয়োজনে সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে এটা করতে হয়েছে। অন্যান্য দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করেছি।”
কী সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা যার জন্য ৪৭নং অনুচ্ছেদের মতো রক্ষাকবচ করতে হল? এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৯ অক্টোবরের ভাষণে। ১৯৬৯ সালে জাতীয়করণ করতে গিয়ে ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন : ‘যেদিন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ব্যাংক, ইনসিওরেন্স জাতীয়করণ করার জন্য আইন পাস করেছিল, সেদিন ভারতের সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিস জনাব হেদায়েতুল্লাহ তাকে নাকচ করেছিলেন এই বলে যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের প্রশ্নের এটা বিরোধী। সেজন্য আমাদের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ অত্যন্ত সজাগ এবং সচেতন ছিলেন বলে এই শাসনতন্ত্রের তৃতীয়ভাগে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং মৌলিক আদর্শের প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত করার আদর্শকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৪টি প্রাইভেট ব্যাংকের ‘জাতীয়করণ’ করেছিলেন। এই ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সমগ্র ব্যাংক খাতের ৮০-৮৫ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত। এ নিয়ে মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া যায় জয়রাম রমেশের  ‘Intertwined lives : P.N. Haksar and Indira Gandhi’
বইতে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম পূর্বে উল্লেখিত ৪৭ অনুচ্ছেদের উপ-দফাগুলো কেন সংযোজিত হয়েছে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেদিন :
‘রাষ্ট্রের মূলনীতির একটা হল সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হয় এবং মৌলিক অধিকার যাতে এর পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য অত্যন্ত দূরদৃষ্টি নিয়ে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ ৪৭ অনুচ্ছেদের (১) দফার সঙ্গে (ক), (খ), (গ), (ঙ) ও (চ) উপ-দফাগুলোকে এখানে সংযোজিত করছেন।’
অর্থাৎ, ‘লিবার্টি প্রিন্সিপল’ এবং ‘সোশ্যাল জাস্টিস প্রিন্সিপলের’ সঙ্গে কখনও সংঘর্ষ বাধলে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জাস্টিস প্রিন্সিপলকে। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণার মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ দুটি ধারণাই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মধ্যে-যেমন বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে-কখনও বিরোধ দেখা দিলে প্রায়োরিটি পাবে সমাজতন্ত্রই। যেমন পেয়েছিল ৪৭ অনুচ্ছেদ-ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপরে মালিকানার মৌলিক অধিকারের গণ্ডিকে বা দাবিকে প্রয়োজনে অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই ‘র‌্যাডিকেল’ দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা করে উল্লেখ করার মতো। বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান প্রণেতাগণ সাধারণ নির্বাচনী ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্রের কথা বলছেন না।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৭৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


নিজস্ব উদ্যোগে বা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারের স্বীকৃতি এবং সাধারণভাবে সম্পত্তির অধিকারে স্বীকৃতি লিবারেটারিয়ান ও অন্যবিধ ‘বুর্জোয়া’ গণতান্ত্রিক ধারার চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি মৌলিক ও সার্বিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যায়। এই ধারা পুঁজিবাদের উন্মেষ পর্ব থেকে আজ পর্যন্ত চলছে। এ জন্যই পুঁজিবাদকে ব্যক্তিমালিকানানির্ভর বাজার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। সম্পত্তির অধিকার শুধু উৎপাদনের উপায় (Means of Production)-এর ক্ষেত্রেই প্রসারিত হয়নি, কোনো কোনো দেশে ও কালে তা ব্যক্তি ও সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রেই প্রসারের চেষ্টা চলেছে। মার্কিন সংবিধানের সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ট অনুসারে  ‘Right to carry guns’ একটি স্বীকৃত ধারণা, যদিও বিতর্কিত ধারণা ও মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত। মিশিগান প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে ডানপন্থি লিবারটারিয়ানরা সম্পত্তির ওপরে অধিকারের যুক্তিতে ইচ্ছেমতো প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরার অধিকার রক্ষায় সাংঘাতিকভাবে সোচ্চার (এই বিশেষ ক্ষেত্রে তালিবানদের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো)। সন্দেহ কী আমাদের দেশেও সেই সুদূর বাহাত্তর সালেই ‘সম্পত্তির অধিকার’কে একপ্রকার ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে অবশ্য পালনীয় এক নীতি হিসেবেই দেখা হবে। অন্তত এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। স্বাধীন প্রকাশভঙ্গি, বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, পেশা-বৃত্তি বা বাছাইয়ের ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ স্বাধীনতা যেমন গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করা তেমনি গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনীতি পরিচালনা করার জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ- এরকম যুক্তি দেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না, বাস্তবে বাহাত্তরের সংবিধান সে পথে এগোলো না। সম্পত্তির পূর্ণ অধিকারে বাদ সাধল ৪৭নং অনুচ্ছেদ। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বা ব্যক্তিমালিকানা সম্পর্কিত ‘বুর্জোয়া’ বা লিবারটারিয়ান অধিকার সে যে নামেই তাকে অভিহিত করি না কেন, সেখানে নিরঙ্কুশ থাকল না। ৪৭নং অনুচ্ছেদ নিয়ে সে জন্যই তুলকালাম বিতর্ক হলো বাহাত্তরের গণপরিষদে (এটি এবং পরবর্তীতে আলোচ্য ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়েই সবচেয়ে বেশি তীব্র বিতর্ক হয়েছিল সেদিন)।
কী বলেছিল ৪৭নং অনুচ্ছেদ? এতে লেখা ছিল যে, রাষ্ট্রের চার মূলনীতি কার্যকর করার জন্য সংসদ প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারেও হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এই হস্তক্ষেপের ধারাটি সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদ ‘মৌলিক অধিকার’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। অর্থাৎ এটিকে কেবল সংসদেই পরিবর্তন করা যাবে- কোনো সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে এই বিধান চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। লিবারটারিয়ানরা যদি ‘মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে’ এই যুক্তিতে সম্পত্তির স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করতে চান- আর দশটা ‘হিউম্যান রাইটস’ জাতীয় বিষয়ের মতো সেটি আইনত গ্রাহ্য করা হবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা বা অন্য কোনো ব্যক্তি অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহের কোনো একটিকে (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রকে) সমুন্নত করার স্বার্থে রাষ্ট্র যদি সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ করাকে আবশ্যিক মনে করে, তবে তাকে কোনো বিচারালয়ের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। এ জন্যেই ৪৭নং অনুচ্ছেদের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনে জারিকৃত কোনো আইন ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে বর্ণিত কোনো গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে বলেই তা বাতিলযোগ্য বলে গণ্য করা হবে না। আইনি ভাষায় বক্তব্যটি এভাবে পেশ করা হয়েছে : ‘সংসদ যদি স্পষ্টরূপে ঘোষণা করেন যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোনো একটিকে কার্যকর করিবার জন্য অনুরূপ বিধান করা হইল, তাহা হইলে অনুরূপ আইন এইভাগে নিশ্চয়কৃত কোনো অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য কিংবা অনুরূপ অধিকার পূরণ বা খর্ব করিতেছে, এই কারণে বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে না।’
অর্থাৎ চার মূলনীতিকে রক্ষা করার জন্য সংসদ দেশের প্রচলিত আইনে যে কোনো সংশোধনী আনতে পারবে এবং সেই সংশোধনকৃত আইনকে কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য বিচার বিভাগে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সেটা যদি গণতান্ত্রিক অধিকার বা বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ও, তাহলেও সেটা চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে থাকবে। কী সেই বিশেষ ক্ষেত্র যেখানে লিবার্টি প্রিন্সিপলকে মান্য করা হবে না দেশের চার মূল স্তম্ভকে কার্যকর করার জন্য? এর মধ্যে রয়েছে মূলত শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারবার প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিগত মালিকানার ((Private Property) ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের তরফে হস্তক্ষেপের অধিকার। ৪৭নং ধারায় ক্ষেত্রগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্র তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে। গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আমি নিচে উপধারাগুলোকে হুবহু তুলে দিচ্ছি :
‘(ক) কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখল কিংবা সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা;
(খ) বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ উদ্যোগসম্পন্ন একাধিক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক সংযুক্তকরণ;
(গ) অনুরূপ যে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপক, এজেন্ট ও কর্মচারীদের অধিকার এবং (যে কোনো প্রকারের) শেয়ার ও স্টকের মালিকদের ভোটাধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ;
(ঘ) খনিজদ্রব্য বা খনিজ তৈল-অনুসন্ধান বা লাভের অধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ;
(ঙ) অন্যান্য ব্যক্তিকে অংশত বা সম্পূর্ণত পরিহার করিয়া সরকার কর্তৃক বা সরকারের নিজস্ব, নিয়ন্ত্রণাধীন বা ব্যবস্থাপনাধীন কোন সংস্থা কর্তৃক যে কোন কারবার, ব্যবসায়, শিল্প বা কর্মবিভাগ-চালনা, অথবা
(চ) যে কোন সম্পত্তির স্বত্ব কিংবা পেশা, বৃত্তি, কারবার বা ব্যবসায়-সংক্রান্ত যে কোনো অধিকার কিংবা কোন সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোন বাণিজ্যিক বা শিল্পগত উদ্যোগের মালিক বা কর্মচারীদের অধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ।’
এসব খাতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য আরও বলা হয়েছে যে, এসব বিধান (বা তার সংশোধনী) ‘পূর্ণভাবে বলবৎ ও কার্যকর হইতে থাকিবে এবং অনুরূপ যে কোনো আইনের কোনো বিধান কিংবা অনুরূপ কোনো আইনের কর্তৃত্বে যাহা করা হইয়াছে বা করা হয় নাই, তাহা এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না।’ অবশ্য সংসদ আগামীতে ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের এসব বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে- এই বিধানও সেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছিল যে, সম্পত্তির অধিকারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের আইনে বিধি অথবা বিধানে কোনো সংশোধনী আনতে হলে ‘সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূ্যন দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে গৃহীত না হইলে সম্মতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।’ অর্থাৎ সেটা বিল আকারে আইনি অনুমোদনের পর্যায়ে যেতে পারবে না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) সম্পত্তির ওপরে মালিকানা-অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে এবং হস্তক্ষেপ করার এই রাষ্ট্রীয় অধিকারকে আইনি ও সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছিল। এক কথায় বললে, ‘লিবার্টি প্রিন্সিপলের’ ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল ‘সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে’। রাষ্ট্রের মূলনীতি রক্ষার প্রয়োজনে ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকারের ‘বুর্জোয়া-গণ্ডি’কে সংকুচিত করা হয়েছিল ইচ্ছে করেই। লিবারটারিয়ানদের মানব-স্বাধীনতার (Human Freedom) বা ব্যক্তিস্বাধীনতার (ersonal Freedom) যুক্তিকে সেদিন শিরোধার্য করা হয়নি মালিকানা সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে মালিকানা সম্পর্কে রদবদল করা যাবে- এই মৌলিক সমতাবাদী চিন্তা থেকে (কোনো কোনো মহলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও) টলানো যায়নি বঙ্গবন্ধুকে এবং তার নিকটতম সহকর্মীদের, যারা সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিলেন পূর্বাপর। লিবারটারিয়ান মানব স্বাধীনতার যুক্তিকেই শুধু অগ্রাহ্য করা হয়নি, যারা সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সামষ্টিক ইউটিলিটির সম্প্রসারণ দেখেন, সেইসব উপযোগিতাবাদী বা ইউটিলিটারিয়ান আর্গুমেন্টকেও চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা। এ জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসংবলিত সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১০ম অনুচ্ছেদে শ্রীবৃদ্ধি (Affluence, Opulence বা Growth) নয়, শ্রীবৃদ্ধির ‘পরিণামের’ ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। এবং প্রবৃদ্ধি নয়, সাম্যবাদী সমাজলাভ করাকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই চাই, কিন্তু সেরকমের প্রবৃদ্ধি চাই, যা সামাজিক ন্যায় ও শোষণমুক্তির লক্ষ্যকে ত্বরান্বিত করবে। যে কোনো প্রকারের, যেনতেন প্রকারের প্রবৃদ্ধি অর্জন বাহাত্তরের সংবিধানের মূল লক্ষ্য ছিল না। উপযোগিতাবাদী ইউটিলিটারিয়ানরা অনেক সময়ে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, ধনীদের ওপরে করারোপ করে গরিবদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাওয়া ঠিক হবে না। কেননা এতে করে উৎপাদনে বা ব্যবসায় ধনী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমে যাবে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, উৎপাদনশীলতা কমবে, বেকারত্ব বাড়বে, এতে করে আখেরে ক্ষতি হবে গরিবদেরই। উপযোগিতাবাদীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের করারোপ স্পষ্টতই বিকৃতি-উৎপন্নকারী (distortionary) পদক্ষেপ। ‘বিকৃতি’-র মানে হচ্ছে- কোনো কর বসানো না হলে বিভিন্ন খাতে সম্পদ যেভাবে বিনিয়োজিত হতো, তা থেকে করারোপের কারণে এতটাই সরে আসতে হচ্ছে যে, এর ফলে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। লক্ষ্য করুন, ইউটিলিটারিয়ানরা যখন এ যুক্তি রাখছেন তারা incentive-এর ওপরে করের সম্ভাব্য কুপ্রভাবকে জোরেশোরে তুলে ধরছেন। তারা লিবের্টারিয়ানদের মতো মানব স্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এরকম নীতিবাদী যুক্তি প্রদর্শন করছেন না। বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ লিবের্টারিয়ানদের ‘ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের’ ফলে বেইনসাফের যুক্তি যেমন মানেননি, উপযোগিতাবাদীদের ‘বিকৃতি-উৎপন্নকারী’ যুক্তিও মানতে রাজি ছিলেন না। উৎপাদনের উপায়ের ওপরে ব্যক্তিমালিকানার স্বভাবজ ‘বুর্জোয়া’ অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে ৪৭নং অনুচ্ছেদে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে গিয়ে  Freedom বা Distortion কোনো যুক্তিকেই প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না। এটা তো তাদের জানাই ছিল যে করারোপের মতোই মালিকানা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অবাধ অনুমোদন দেওয়ার অর্থ হচ্ছে হয় পুঁজিপতিদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার শামিল (যেটা লিবের্টারিয়ানদের সওয়াল জবাব ছিল), অথবা তা ছিল বাজার অর্থনীতির ‘স্বাভাবিক’ ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে বিকৃতি সৃষ্টির নামান্তর (যেটা উপযোগিতাবাদীদের সওয়াল জবাব ছিল)। এসব জেনেও তারা ৪৭ অনুচ্ছেদ রাখতে পিছু পা হননি, তার কারণ- রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি প্রধান নীতি সমাজতন্ত্র তথা সামাজিক ন্যায় ও শোষণমুক্তির প্রতিশ্রুতিকে তারা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ও বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে সেদিনের সংসদে যে আত্ম-সমর্থনমূলক বিবৃতি তারা দিয়েছিলেন, তা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তাফসির। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এখানে শুধু তুলে ধরছি।
মধ্যপন্থি রাজনৈতিক নেতা ময়মনসিংহের আছাদুজ্জামান খান ৪৭নং অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ণ সমাজতন্ত্রের দিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যাওয়ার রাস্তা দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :’আমরা রক্তের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র চাই না। বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেছেন এবং তার চার মূলনীতির মধ্যে এ কথা রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। … এখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আসবে। … যারা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে চান, তাদের বলব, সংবিধানের অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সেটা আসতে পারে। ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান আছে। সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেওয়া চলবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রয়েছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৮

পূর্বে প্রকাশিতের পর
সংবিধানের ১০নং ধারামতে ‘শোষণমুক্ত’ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হলেও এর অর্থ উক্ত ধারায় বা অন্য কোনো ধারাতেও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা হয়নি। এটা সংবিধান প্রণেতাদের বা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা নয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রীদের মধ্যেই ঐকমত্য আগেও ছিল না, পরেও দেখা যায় না। কালক্রমে বিশেষত সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের মাধ্যমে এটুকু অন্তত প্রতীয়মান হয়েছে যে, সমাজতন্ত্র মানে কেবল উৎপাদনের সব খাতে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা’ প্রতিষ্ঠা করা নয়। আমি বরং বলব যে, সুদূর ১৯৭২ সালে বসেই বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা সমাজতন্ত্রের প্রথাগত সংজ্ঞা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য আমরা এর আগেই উদ্ৃব্দত করেছি, যেখানে তিনি বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা নয়, ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) মালিকানাও থাকতে পারে, অবশ্যই নিয়ম-নীতির চৌহদ্দি মেনে চলাসাপেক্ষে। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ও ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) মালিকানার মধ্যে সুসামঞ্জস্য থাকতে হবে এবং এ দুইয়ের পারস্পরিক অনুপাতে কালের বিচারে হ্রাসবৃদ্ধি হতে পারে। যেটাই হোক না কেন, একদিকে পুঁজিপতিদের যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে দেওয়া হবে না, আবার অন্যদিকে তাদের অন্যায় প্রভাব খাটানোর সুযোগও দেওয়া হবে না। এক ভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্রের রূপকল্প নির্মাণের জন্য তাজউদ্দীনের বক্তব্যটি পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পুনরায় স্মরণযোগ্য:
‘আজকে ব্যক্তিগত মালিকানা, ব্যক্তিগত পুঁজিতে যে সংশয়ভাব দেখা দিয়েছে, তাতে শুধু এটাই আমরা বলতে পারি, আইনের বিধান মোতাবেক ব্যক্তিগত মালিককে যেটা দেওয়া হবে সেটার মালিকানা সে নিশ্চয়ই আইনের বিধান অনুযায়ী নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে। ….কিন্তু পুঁজিপতিদের তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। … ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকু দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত শোষণ, ব্যক্তিগত বঞ্চনা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। এটা পরিস্কার থাকা ভালো।’
পরবর্তীকালে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার নানা কারণের মধ্যে একটি ছিল বাজার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে চালু না করতে পারার ব্যর্থতা। অর্থনীতির সবকিছু সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা Central Planning-র নামে ‘এক কেন্দ্র’ থেকে প্রশাসনিকভাবে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত এক পর্যায়ে সোভিয়েত ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানের রূপকারেরা এই ভুল গোড়া থেকেই পরিহার করতে পেরেছিলেন। এবং পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ের ১৩নং ধারায় রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী এবং ব্যক্তিগত মালিকানাকে যুগপৎ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে রেখে ছিলেন। এই তিনটিই ছিল সংবিধান অনুযায়ী জনগণের মালিকানার তিনটি ধরন।  Social Ownership of means of production বলতে বাহাত্তরে সংবিধানের রূপকারেরা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাকে বোঝাননি, রাষ্ট্রের মালিকানার পাশাপাশি সমবায়ী ও ব্যক্তি-মালিকানাকেও বুঝিয়েছেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের  Principles of Ownership বলতে গিয়ে ১৩নং ধারায় বলা হয়েছে, সমাজতন্ত্রের মালিকানা হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ’ : The People shall own or control the instruments and means of production and distribution, and with this end in view, ownership shall assume the following forms’- যথাক্রমে state ownership, ‘co-opertive ownership’, এবং‘private ownership’ (within such limits as may be prescribed by law) । এরকম সংজ্ঞা নিউ ইকোনমিক পলিসির লেনিনের বা সংস্কারপন্থী নিকোলাই বুখারিনের অথবা পোলিশ অর্থনীতিবিদ অস্কার ল্যাঙ্গের পছন্দ হতো তাতে আমার অন্তত সন্দেহ নেই।
সমাজতন্ত্র ও তার মধ্যে তিন ধরনের মালিকানা নিয়ে সেদিনের সংসদীয় বিতর্কে দুটি স্পষ্ট প্রবণতা দেখা যায়। একটি হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে পারে কিনা এ নিয়ে তত্ত্বগত বিতর্ক। অন্যটি হচ্ছে, এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক। প্রথম দল চাইছেন যে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তি খাত থাকুক এবং শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই নয়, একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে ব্যক্তি খাত কালক্রমে বিকাশও লাভ করুক। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও আছাদুজ্জামান খান অনেকটা এই লক্ষ্যে যুক্তির জাল বিস্তার করছিলেন। তাদের আলোচনার তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল বামধারার দল ও ভাবাদর্শের প্রতি। সংসদে যার কনক্রিট লক্ষ্যবিন্দু ছিলেন ন্যাপের সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। সংখ্যায় এরা অবশ্য ছিলেন মাইনোরিটি। অন্যদিকে, যারা বিশেষভাবে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অসম্ভব- এদের মধ্যে ছিলেন মেজোরিটি গণপরিষদ সদস্য। তারা বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ও প্রতিতুলনা টেনে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকেই ‘অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে’ বিচরণ করতে হবে এবং ‘গতিশীল ভূমিকা’ পালন করতে হবে। প্রয়োজনে এর জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এরা সে লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদের মৌলিক গুরুত্বকে জোরেশোরে তুলে ধরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ থেকে ড. কামাল হোসেন প্রাগ্রসর সব রাজনৈতিক নেতাই- যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন দীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামে- এই ৪৭নং ধারার প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলার দাবি রাখে।
বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হয়েছে তার পরিধি বিপুল। Liberty Principle-এর ক্ষেত্রে কোনো আপস না করে জোরেশোরে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। ৩৯(১) ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, এর ‘ক’ ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং এর ‘খ’ ধারায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ২৯(১) ধারায় সরকারি নিয়োগ লাভে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ এবং ৪০ অনুচ্ছেদে যে কোনো আইনসংগত পেশা, বৃত্তিগ্রহণ, কারবার বা ব্যবসা-পরিচালনার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে। সেই সঙ্গে ৪২(১) ধারায় দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে সম্পত্তির অধিকার- ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’- প্রত্যেক নাগরিককে ‘সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা’ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পত্তির ওপর অধিকারের সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজার-অর্থনৈতিক ধারায় বিকাশের জন্যও সম্পত্তির অধিকার বা property rights একটি মৌলিক ধারণা। প্রপার্টি রাইটস-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত হচ্ছে : transaction costs-এর ধারণা। কোনো সম্পত্তির ওপরে মালিকানা প্রতিষ্ঠা, মালিকানার হাতবদল এবং মালিকানা রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত খরচকে :transaction costs বলে। যে সমাজে এই সম্পত্তি সংক্রান্ত :transaction costs  কম সেই সমাজ উৎপাদন নৈপুণ্যে আরও বেশি এগিয়ে। তবে নিকোলাস স্টার্ন দেখিয়েছেন যে,  property rights শুধু ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প, কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায়ী মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-কর্মকাণ্ডের সফল পরিচালনার জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রপার্টি রাইটস বলতে স্টার্ন মূলত তিনটি অধিকারকে বুঝিয়েছেন- এর মধ্যে রয়েছে ‘Right to Manage’, ‘Right to Income’ এবং ‘Right to Protect’। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সেই প্রতিষ্ঠানটি ঠিক মতো চলতে পারে না। সেক্ষেত্রেই আমি ৪২(১) ধারায় প্রদত্ত সম্পত্তির অধিকারকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের’ মধ্যে গণ্য করেছি- শুধু পুঁজিবাদী সম্পত্তি-অধিকারের অংশ হিসেবে দেখিনি।
উপরোক্ত গণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ৪১ নং অনুচ্ছেদের ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ ধারাও। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা মনে রেখে এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের ‘যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের’ অধিকারের কথা। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী ‘কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না’- এ কথাও ৪১(২) ধারায় আলাদা করে সংযোজিত হয়েছিল। এছাড়াও সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায়ের ২৭নং ধারায় আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ২৮নং ধারায় ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যরোধ এবং ধর্ম-বর্ণ নারীপুরুষ নির্বিশেষে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা স্পষ্ট করে উল্লেখিত ছিল এই সংবিধানে। এসব কিছুকেই আমরা একদিক থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার, অন্যদিক থেকে ‘সেক্যুলার’ (ধর্ম-নির্বিশেষ) অধিকার হিসেবে পাঠ করতে পারি।
উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানের প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে Libertarian ও Economic Egalitarian (তথা মার্কসবাদীরা) এক জোটে জড়ো হবেন, তা যতই এই নৈতিক সহাবস্থান তাদের রাজনীতির পক্ষে অস্বস্তিজনক হোক না কেন। কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দেখান তাদের বক্তব্যেও সপক্ষে। যেমন, মানুষ নিজে যা উৎপাদন করে তার ওপরে তার মৌলিক অধিকার রয়েছে বা মালিকানাস্বত্ব রয়েছে- এ কথা লিবারটারিয়ানরা জোরেশোরে বলে থাকেন। এজন্যই তারা মনে করে থাকেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি-অধিকারে হস্তক্ষেপ করা মানে হচ্ছে ব্যক্তিগত মৌলিক অধিকারেই (ব্যক্তিগত স্বাধীনতা) হস্তক্ষেপ করার শামিল। অন্যদিকে, ‘আমার উৎপাদনের ওপরে কেবল আমার অধিকার’- একথাটা কট্টর বামপন্থিরা বুঝে না-বুঝে বলে থাকেন।  Right to one’s labour- এটা এই ধারার প্রগতিশীলদের এক পুরোনা দাবি। (অবশ্য উৎপাদনের ফল যদি কেবল শ্রমের ফসল না হয়ে বিভিন্ন উপাদানের সমবেত অবদানের কারণে অর্জিত হয়- যেমন, Entrepreneourship, প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনী প্রতিভার কারণে- তাহলে উৎপাদনের সবটুকু ফল কেবল আমার একথা আর বলা চলে না নিঃসংশয়ভাবে।) এরকম এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন ফার্দিনান্দ লাসাল (Lassalle)। শেষ জীবনের একটি লেখা ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ মার্কস তৎকালীন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ফার্দিনান্দ লাসাল-এর Rights to Labour তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন। ‘শ্রমিক হিসেবে আমি যা উৎপাদন করছি তার পুরোটাই কি আমার প্রাপ্য’- এ প্রশ্ন রেখে মার্কস দেখিয়েছিলেন বাস্তবে সেই উৎপাদনের কিছু অংশ যাবে পুঁজির ক্ষয়-ক্ষতি পূরণে বা নবায়নে, কিছু অংশ যাবে নতুন বিনিয়োগে, কিছু অংশ সামাজিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অবকাঠামো প্রভৃতি Social Consumption খাতে, কিছু অংশ আপৎকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায়- মোট কথা  National Accounts-এর যাবতীয় বণ্টনের নিয়ম-নীতি নিষ্ঠার সাথে পালনের পরই কেবল যা অবশিষ্ট থাকবে তা শ্রমিকদের ‘বেতন তহবিলে’ ঢুকতে পারে (অবশ্য সেই বেতন তহবিল থেকেও একটা অংশ পেনশন জাতীয় ভবিষ্য-তহবিলের বাবদ কেটে রাখতে হবে বৈকি, শ্রমিকদেরই সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনে)। দেখা যাচ্ছে, মার্কস বণ্টনের ব্যাপারটাকে সম্যকভাবে এবং সূক্ষ্ণভাবে বিচার করেছিলেন। কিন্তু সেই সূক্ষ্ণতা অনেক সময়ই পরবর্তীকালের মার্কসবাদী আলোচনায় রক্ষিত হয়নি। এ কারণেই অমর্ত্য সেন তার ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইয়ে লিখতে পেরেছেন যে, The idea of the right to the fruits of one’s labour can unite right-wing libertarians and left-wing Marxists (no matter how uncomfortable each might be in the company of the other) এবং এটা লেখার পরপরই ফুটনোটে যোগ করেছেন যে, মার্কস এরকম কোনো মতে শামিল ছিলেন না : “As, it happens, Karl Marx himself became rather sceptical of the ‘right to one’s labour’ which he came to see as a ‘bourgeois right’, to be ultimately rejected in favour of ‘distribution according to needs’, a point of view he developed with some force in his last substantial work, The Critique of the Gotha Program.”

[ক্রমশ]