পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৫. ১৯৩০ : রবীন্দ্রনাথ ও প্যারিস

একথা এখন সকলেরই জানা যে, রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই উপমহাদেশের চিত্রকলার জগতে প্রথম ‘আধুনিক ধারার’ চিত্রশিল্পী। আর প্যারিসেই তার চিত্রকর্মের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৩০ সালের মে মাসে। এর আগের এক দশকে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। শুধু নিজেই যে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তা-ই নয়, ১৯২২ সালে (জার্মানী থেকে প্রত্যাবর্তনের এক বছর বাদে) কলকাতায় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট (ISOA)-এর উদ্যোগে জার্মানির অত্যাধুনিক Bauhaus ধারার চিত্রকর্মের এক অভিনব প্রদর্শনীরও আয়োজন হয় তারই উদ্যোগে (যদিও এ নিয়ে প্রশান্ত কুমার পাল evidence-র দুর্বলতার প্রশ্ন তুলেছেন)। ‘বাউ হাউস’ শব্দটি জার্মান-এর আক্ষরিক অর্থ ‘বিল্ডিং হাউস’; অন্যভাবে বললে ‘স্থাপত্য-ভবন’। এই আন্দোলনের সাথে পল ক্লী Klee বা ক্লে), কান্ডিনস্কি, রুশ ‘কনস্ট্রাকটিভিস্ট’ আর্টিস্ট লিসিৎস্কি (Lissitzky),De Stijl (মানে ‘স্টাইল’) আন্দোলনের ডাচ পেইন্টার Thea van Doesburg, অস্ট্রিয়ার ককশকা (Osker Kokoschka) প্রমুখ জড়িত ছিলেন। ক্লী-কান্ডিনস্কির চিত্রকর্ম রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে (এবং প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়) প্রদর্শিত হলো ১৯২২ সালে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে কলকাতায়- ভাবা যায়? আজ যদি ঢাকায় কেউ ফ্রাঙ্ক স্টেলা (frank stella), রিচার্ড ডিবেনকর্ন (Diebonkorn), পিটার ব্লেইক (Blake), গেরহার্ড রিখটার (Richter), ডেভিড হকনি (Hockney), হাওয়ার্ড হচকিন (Hodgkin), বাংক্‌সি (Banksy), ইয়োশিটমো নারা (Yoshitomo Nara), কুসামা (Yayai Kusama), জুলিয়ান ওপি (opie), বারবারা রে (Rae) প্রমুখের চিত্রকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের সেদিনের আয়োজনের তাৎপর্য কিছুটা হলেও বোঝা যেতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধুনিক চিত্রকলা নিয়ে এই তাগিদ দেখা দিয়েছিল কেন? মানুষের মধ্যকার নানা সত্ত্বার মতো রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও নানা রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। সেখানে যেমন গীতাঞ্জলির জীবনদেবতা ছিল; লালনের মনের মানুষ ছিল; তেমনি ছিল পদ্মাপাড়ের বৃত্তান্ত, তার ছোট ছোট দুঃখ-কথা। সেভাবেই ছিল স্বদেশি যুগের গোরা; ঘরে-বাইরের বিমলা-নিখিলেশ-সন্দ্বীপ। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের পক্ষে এক সময় অবস্থান নিলেও পরে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধমালায়। Nation-র Mythology নির্মাণ করতে চাননি তিনি। যেটা বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট সচেতন বা অসচেতনভাবে করে চলেছিল। যে দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি গান্ধীর চরকা ও অসহযোগ আন্দোলনকে ‘ক্রিটিক’ করেছিলেন, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বেঙ্গল স্কুলের Neo-traditionalism কে আঘাত করলেন সর্বাধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার আফ্রিকা-প্রভাবিত প্রিমিটিভিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কেবল তার নিজের দেশের ও কাছের ভুবনের চিত্রশিল্পীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। তাতেও যখন কাজ হলো না, তখন রং-তুলি ধরলেন তিনি নিজেই। ১৯৩০ সালে ফ্রান্সে তার চিত্র-প্রদর্শনীতে এসে কবি ও শিল্প-সমালোচক পল ভালেরী রবীন্দ্রনাথের এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলা দেখে হতবাক হয়েছিলেন। জার্মানিতেও যেসব শহরে প্রদর্শনী হয়েছে, সেখানেই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক কৌতূহলের গণ্ডি ছাড়িয়ে যারপরনাই বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। এই ভূভাগের আধুনিক ও সাম্প্রতিক চিত্রকলার জনক আসলে আর কেউ নন- রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। আধুনিক চিত্রকলার চারিত্র নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। যেমন, প্রশান্ত কুমার পাল তার রবিজীবনীর ৮ম খণ্ডে জানিয়েছেন যে, কবি শিল্প-কলায় সহজ-সরল রিয়ালিস্ট ধারার অনুকৃতিকে পছন্দ করতেন না। তার বরং আগ্রহ ছিল আকৃতি ও গঠনের ভাঙচুর, অর্থাৎ ফর্মের ডি-কনস্ট্রাকশনের প্রতি। যেটি সেজান-পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি গুরুদাস মল্লিক লিপিবদ্ধ করেছেন ও প্রশান্ত কুমার পাল তা হুবহু তুলে ধরেছেন। শিল্পকলা বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের আলোচনায় কবি বললেন : ‘আর্ট অসীমের প্রকাশ; রূপ অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেইটিই যেন শেষ লক্ষ্য না হয়। নিরাকারের আভাস দেবে সে, তার ব্যতিক্রম প্রতারণা মাত্র।’- ‘Was art an expression,- accurate or artistic,- only of pleasure or pain, of an happening, historical or otherwise? No, it should ever express the infinite, revealed through either of these elements. A realistic portrayal of these could be called skill or decoration, but not art.’ এর থেকেই বোঝা যায় যে, অবনীন্দ্রনাথ নন্দলালের সনাতনী রিপ্রেজেন্টেশনাল আর্ট-কেন্দ্রিক শিল্প-চিন্তার বিপরীতে ১৯২২ সালেই রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলা নিয়ে কতটা প্রাগ্রসর চিন্তা-ভাবনা করতেন। আবারও বলছি, রবীন্দ্রনাথই এই ভূভাগ থেকে উত্থিত প্রথম সচেতনভাবে ইউরোপীয় অর্থে ‘আধুনিক’ ধারার চিত্রকর। প্রিমিটিভ ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৮২ সালে টেট গ্যালারিতে যে ৬ জন উপমহাদেশের চিত্রশিল্পী নিয়ে পুরোধা ব্রিটিশ চিত্রকর ও শিল্পী ভূপেন খাকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাওয়ার্ড হচকিন চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তার মধ্যে প্রথমেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের নাম। সেটা তার কবিখ্যাতির জন্যে নয়, প্রধানত তার মৌলিক চিত্রকর্মের স্বীকৃতিদানের তাগিদে।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে এখানে নতুন করে কিছু যোগ করার নেই। এ নিয়ে নানা গুণীজন ইতোপূর্বে আলোচনা করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী, রামকিংকর, যামিনী রায় এরা রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে লিখেছেন, মন্তব্য করেছেন- তার কোনোটি হয়তো চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের কোনো বিশেষ দিক তুলে ধরে, কোনোটি হয়তো তর্কসাপেক্ষ পর্যালোচনা। চলচ্চিত্রকার ও চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রায় যেমন আগেই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথের ছবির মৌলিকত্বের কথা। তিনি বলেছেন, ‘It is important to stress that he was uninfluenced by any painter, eastern or western.’ এটা কিছুটা বাড়িয়েই বলা। কেননা, আমরা একটু পরেই দেখব যে প্রভাব এসে পড়েছিল নানা সূত্র থেকেই।

আমি বিশেষ করে উল্লেখ করব গণেশ পাইন-এর ‘শিল্পীর দৃষ্টিতে রবীন্দ্র-চিত্রকলা’, সত্যজিৎ চৌধুরীর ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’, কাইয়ুম চৌধুরীর ‘রবিতীর্থে’, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিত্রী রবীন্দ্রনাথ :অনাগত কালের আগামবার্তা’, আবুল মনসুরের ‘রবীন্দ্রনাথ-চিত্রশিল্পী-কলাভবন পরম্পরার সম্পর্কসূত্র’, আলী আনোয়ারের ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রমালার ল্যাবিরিন্‌থ’, আনা ইসলামের ‘প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ’, সুশোভন অধিকারীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাউহাউস :কিছু চেনা, কিছু অচেনা খবর’ শীর্ষক প্রবন্ধ এবং অতি-আবশ্যিকভাবে কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীর ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো মৌলিক গবেষণা-গ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থের বিতর্কিত মন্তব্য (‘লাল রংটা রবীন্দ্রনাথের চোখে ঠিকমতো ধরা দিত না’) সত্ত্বেও এর উল্লেখ করেছি, কেননা এটি তথ্যে ঠাসা একটি গবেষণা কাজ। আমি শুধু বর্তমান আলোচনার মূল বিষয়বস্তু- আধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার ওপরে প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রভাব-এর সঙ্গে সংগতি রেখে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রতিফলন নিয়ে কিছু মন্তব্য করব। প্যারিসের কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার এই অজানা দিকটির প্রতি আমি সজাগ হয়ে উঠি।

রবীন্দ্রনাথ যে জার্মান শিল্পী এমিল নোল্ডে (Nolde)-এর এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলায় বিমোহিত হয়েছিলেন এবং তার অনেক চিত্রকর্মের মধ্যে নোল্ডের প্রভাব অনুভব করা যায়- এটি নানাজনের সাক্ষ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু নোল্ডে নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কার থেকে বা কোন উৎস থেকে? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে তা হলো নোল্ডে (বা নোল্‌দে)-এর ছবিতে মুখ ও মুখোশের প্রবল উপস্থিতি, যা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মেও দেখা যায়। এ নিয়ে ডাইসন-অধিকারী তাদের বইতে লিখেছেন :’নোল্‌দের ছবির সঙ্গে [রবীন্দ্রনাথের] যে কিছু পরিচয় ছিল- অন্তত বইপত্রে প্রতিলিপির মাধ্যমে- তা সন্দেহাতীত। জার্মানিতে ভ্রমণকালে [রবীন্দ্রনাথ] কিছু মূল ছবি দেখেছিলেন এমন অনুমান করাও অসংগত নয়। ফর্মে ও থিমে নোল্‌দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু চমকপ্রদ মিল লক্ষ্য করা যায়, যা থেকে মনে হয় নোল্‌দের কিছু ছবি তিনি রীতিমতো স্টাডি করেছিলেন।’ কিন্তু নোল্‌দে কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? ডাইসন-অধিকারী ইঙ্গিত করেছেন প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের প্রতি। সেটা যেমন মুখের (বা Head-স্টাডি করার) ক্ষেত্রে, তেমনি মুখের সম্প্রসারণে মুখোশের (বা Mask-স্টাডি করার) ক্ষেত্রে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি এখানে তুলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে :

“মুখের প্রসঙ্গে আরও দেখতে পাই, নোল্‌দের প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ থেকে এমন কতগুলি মনোক্রোমধর্মী স্কেচ জন্ম নেয়, যাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকের কালি-তুলির স্কেচের সাদৃশ্য লক্ষ্য করবার মতো। …তাঁর [১৯১৩/১৪ সালের] ‘একজন স্থানীয় আদিবাসীর মাথা’ বা ‘স্থানীয় আদিবাসী’-এর পাশাপাশি রাখা যায় রবীন্দ্রভবনের ১৯৩৬, ২৯৬৪, বা ৩৪৫০-র মতো ছবিকে। …মুখোশও দুই শিল্পীর মধ্যে একটা সাধারণ এলাকা। …রবীন্দ্রভবনের রেখাঙ্কনধর্মী ২৭৯৮, ২৮৫৪, বা ২৯২৫-সংখ্যক [ছবির] সঙ্গে তুলনীয় নোল্‌দের ১৯১১-র মুখোশভিত্তিক স্টিল লাইফগুলি।” নোল্‌দে-রবীন্দ্রনাথের মুখোশভিত্তিক ছবিগুলোও প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের সুবাদেই অনুপ্রাণিত :’পিকাসোর ছবিতে যেমন আফ্রিকান মুখোশের একটা স্টাইলাইজেশন ঘটে …নোল্‌দের এই ছবিগুলিতে তেমনটি হয় না। এই ছবিগুলিতে মুখোশগুলি প্রথমতঃ বর্ণোজ্জ্বল গ্রোটেস্ক নৃতাত্ত্বিক সামগ্রী হিসাবেই চিহ্নিত, যেন সংগ্রহশালার শো-কেসে সাজানো রয়েছে। আবার তাদের মধ্যে মানুষের মুখের ভাবের অতিরিক্ত অভিব্যক্তিও সঞ্চারিত করা হয়েছে, নাটকের মুখোশে যেমন।’ নোল্‌দের মুখোশগুলো রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করেছিল :নোল্‌দের ১৯১২ সালে করা ‘মানুষের মাথা’ ছবিটিতে তিনটি মাথা আঁকা হয়েছে। ‘তিন মুখে তিন রকমের রঙের প্রাধান্য’। রবীন্দ্রনাথের ২১৭৮-সংখ্যক ছবিতেও ঠিক তেমনি পাশাপাশি সাজানো তিনটি মুখোশ :’রবীন্দ্রনাথের মুখোশ-ছবিতে নোল্‌দের মতো বর্ণৌজ্জ্বল্য না পাওয়া গেলেও সারি-বাঁধা মুখোশের উপস্থিতি ভারতীয় চিত্রকলায় অভিনব। এইসব মুখোশের ঠোঁট কোথাও চাপা, কোথাও ফাঁক-করা, কোথাও বা তাদের চোখের তারা বিস্ম্ফারিত। কার্টুনঘেঁষা ভাবভঙ্গিতে এরা রবীন্দ্রচিত্রবিশ্বে এক নতুন, অদ্ভুত জগৎ রচনা করে।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট (ও আর্ট-ফর্ম) শুধু যে ব্র্যাক, মাতিস, পিকাসো, ক্লি, কিরশনের, নোল্‌দে প্রমুখকেই প্রভাবিত করেছে তা-ই নয়, এদের ছবির সুবাদে বা প্রত্যক্ষভাবে প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব এসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার ক্ষেত্রেও। এই প্রভাব রবীন্দ্রনাথকে তার নিজের মতো করে ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’ হতে সাহায্য করেছে। আমরা শুধু পাশ্চাত্যের কাছ থেকে হাত পেতে গ্রহণই করিনি, আমরাও পাশ্চাত্যকে দান করতে কার্পণ্য করিনি। এই ‘আমরা’ আসলে কারা? এই ‘আমরা’ এ যুগের (বা সে যুগের) পাশ্চাত্যের অন্ধ-অনুকরণপ্রিয় বাঙালি মধ্যবিত্ত সত্ত্বা নয়। দান এসেছিল আমাদের দেশের নিম্নবর্গ অন্ত্যজ শ্রেণির কাছ থেকেই। কিরশ্‌নের যেমন করে প্রভাবিত হয়েছিলেন অজন্তার গুহাচিত্রের নাম-না-জানা নিম্নবর্গের শিল্পীদের দ্বারা।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪৩

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

আগেই বলেছি, মাতিসের কাছে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ভাস্কর্যের ‘ফর্মাল’ দিকটি বেশি করে ধরা দিয়েছিল। সামঞ্জস্যহীনতা, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে স্বাভাবিক অনুপাতের ভারসাম্যকে ইচ্ছাকৃত ভেঙে ফেলা, ‘ভয়ংকর সুন্দর’কে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা- এসব শৈল্পিক প্রয়োগকে এক স্বাধীন স্বরাট শিল্পীসত্তার প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন মাতিস। ‘ফর্মের স্বাধীনতা’ সব সময়ই মাতিসের কাছে একটি মুখ্য বিবেচনা ছিল। কিন্তু ট্রকাদেরো মিউজিয়াম হঠাৎই চোখে-পড়া আফ্রিকার ভাস্কর্য পিকাসোর কাছে মনে হয়েছিল রহস্যময় এক জাদুকরী শক্তির আধার হিসেবে। ভাস্কর্য ছাড়াও মুখোশও তাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। সম্ভবত সেখানে আইভরি কোস্ট বা লাইবেরিয়ার কোনো Grebo mask দেখে থাকবেন তিনি। যদিও ট্রাইবাল আর্টকে ‘কালো-কুচ্ছিৎ’ বলে কখনও কখনও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন পিকাসো, কিন্তু সব ছাপিয়ে তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে এসব ভাস্কর্য ও মুখোশের ‘ম্যাজিক্যাল পাওয়ার’। জাদুকরী ক্ষমতা, মায়াবী আকর্ষণ, সম্মোহিত করার মতো শক্তি- এমন সব উচ্চারণই বেরিয়েছে পিকাসোর মুখ থেকে। এদিক থেকে মাতিসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পিকাসোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্রাঁসোয়া জিলোটের সঙ্গে কথোপকথনের আড়ালে স্বীকারোক্তিতে পিকাসো সেদিন যা বলেছিলেন, তা এতই তীক্ষষ্ট ও তলদর্শী, যা আমার অক্ষম অনুবাদে নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যাবে। ইংরেজি ভাষ্যেই পিকাসোর কথাটা প্রথমে শোনা যাক (জিলোট তার ‘লাইফ উইথ পিকাসো’ বইতে এ নিয়ে লিখেছেন) :

‘Men had made those masks and other subjects for a sacred purpose, a magic purpose, as a king of mediation between themselves and the unknown hostile forces that surrounded them, in order to overcome their fear and horror by giving it a form and an image. At that moment I realized that this was what painting was all about. Painting isn’t an aesthetic operation; it’s a form of magic designed as mediation between this strange, hostile world and us, a way of seizing power by giving form to our terrors as well as our desires. When I came to that realization, I knew I had found my way.’

ট্রাইবাল আর্টের মুখোমুখি হওয়ার পর পিকাসোর মনে হলো যে চিত্রকর্মের মূল উদ্দেশ্য নান্দনিক আনন্দের বিতরণ নয়। চারপাশের তৈরি জগৎ ও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের মধ্যে কোনো এক রহস্যময় উপায়ে- প্রায় জাদু-বাস্তবতার কথাই এটা- ‘সেতু স্থাপন করা’ এর লক্ষ্য। যাতে করে মানুষ তার নিঃসঙ্গতার ভয়-ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারে। আবশ্যিকভাবেই, এই সেতু অলৌকিক; এই যোগাযোগ ও বিনিময় মায়াবী, সব রকম ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু ব্যাখ্যাতীত এই বাস্তবতা বা জাদু-বাস্তবতায় পৌঁছানোই শিল্পকলার আসল লক্ষ্য। গত শতকের আশির দশকে মার্কেজের উচ্চারণে এই জাদু-বাস্তবতার অন্য এক রাজনৈতিক রূপও আমরা দেখতে পাই। এবারে শুধু আফ্রিকার সঙ্গে পাশ্চাত্যের যোগসূত্র স্থাপিত হবে তা-ই নয়, গোটা লাতিন মহাদেশের শিল্প-সাহিত্য কলম্বিয়ার মার্কেজের ও পেরুর ইয়োসার গদ্যে, চিলির নেরুদা ও আর্জেন্টিনার বোর্হেসের কবিতায়, ইকুয়েডরের গুইসামিন (Guayasamin), মেস্কিকোর তামায়ো (Rutins Tamayo) ও কিউবার লামের (Wilfredo Lam) চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে শত শত বছরের সন্ত্রাস, ভয়, জড়তা ও নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠে পাদপ্রদীপের আলোয় ঝলমল করে উঠবে সাহসের সঙ্গে।

জিলোটের সঙ্গে আলাপে সেদিন পিকাসো তার সৃষ্টিশীল পথের একটি ‘মেজর টার্নিং পয়েন্ট’-এর কথা বলেছিলেন আফ্রিকান প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের আলোচনা-সূত্রে। আফ্রিকান শিল্পীরা ইউরোপের তুলনায় ভিন্ন চোখে শিল্পমাধ্যমকে দেখেন। নিছক আনন্দ-উপভোগের জন্য নয়। ‘আর্ট ফর আর্টস সেইক’ এ ধরনের মিথ্যা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ‘প্রিমিটিভ’ আর্টিস্টরা নেই। এটাই পিকাসোর সজাগ দৃষ্টি কেড়েছিল ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে সেদিন। পিকাসোর এই চিন্তা সমসাময়িক ফ্রান্সের স্ট্রাকচারালিস্ট এনথ্রোপলজিস্ট অন্দ্রে মালরোঁ, ক্লদ লেভি-স্ট্রস প্রমুখের নৃতাত্ত্বিক চিন্তার অনুবর্তী।

কিন্তু শুধু পিকাসো নন বিশিষ্ট এ ক্ষেত্রে। আরও অনেক সহযাত্রী রয়েছেন তার সঙ্গে। রোমানিয়ান ভাস্কর কনস্তানটিন ব্রানকুসি (Brancusi), রাশান ভদ্মামিলি কান্ডিনস্কি ও মার্ক শাগালের মতো বড় একটা সময় কাটিয়ে ছিলেন প্যারিসে। তার হাতে করা বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘এডাম ও ইভ’-এর সঙ্গে আইভরি কোস্টের কুলানগো (Kulango) ট্রাইবের কোনো নাম-না-জানা শিল্পীর হাতে গড়া মূর্তির প্রচণ্ড সাদৃশ্য। অকালমৃত আমাদেও মডিলিয়ানি চিত্রকর্মের জন্যই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তার করা অল্প কয়েকটি ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ‘স্ট্যান্ডিং ন্যুড’; এর সঙ্গে পূর্বে উল্লেখকৃত গ্যাবন দেশের Fang মূর্তিটির বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জার্মান পল ক্লি-এর কথাও এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য।

পল ক্লী-র চিত্রকর্মে বিশেষ করে নর্থ আফ্রিকার লোকজ শিল্পের প্রভাব প্রবলভাবে অনুভূত হয়। উত্তর আফ্রিকা বলতে ‘মাগরেব অঞ্চল’কে বোঝানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া। যারাই পল ক্লীর চিত্রকর্মে প্রাচীন নৃগোষ্ঠীর মতো করে হাতে আঁকা ‘প্রিমিটিভ’, চিহ্ন, জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি ও নকশা দেখে ভেবেছেন এর রহস্য কী, তারা অন্তত এটুকু বুঝেছেন যে, এ জিনিস ‘ইউরোপ’ থেকে আসেনি। রেনেসাঁ-উত্তর চিত্রকলার কোনো শিল্পগত ঐতিহ্যেই এ রকম চিহ্ন বা প্রতীকের চর্চা হয়নি। এটা উঠে এসেছে আফ্রিকার লোক-শিল্পের গভীর তলদেশ থেকে। এর ‘সর্বাধুনিক পাঠের’ মিথস্ট্ক্রিয়া থেকে। ‘দ্য ম্যাজিক অব সাইনস্‌ অ্যান্ড প্যাটার্নস্‌ ইন নর্থ আফ্রিকান আর্ট’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট লিখেছে : ‘Many of (these) shapes and symbols have a marked resemblance to Neolithic Pottery found in the region. By combining signs with magical numbers or stylizing traditional symbols, contemporary artists top the unconscious to create abstract work that references the past and Present.’
এবং এ কথা বলেই তাদের মনে পড়ে যায় পল ক্লী-র কথা :’On several visits to North Africa, German artist Paul Klee was inspired by these mystical shapes and incorporated signs, number and letters into his work.’ অবশ্যই পল ক্লী-র চিত্রকর্ম আধুনিক উত্তর আফ্রিকার চিত্রশিল্পীদের প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালে, এ কথা স্বীকার করতেই হবে আমাদের। একটা সৃষ্টিকর্মের ওপরে নানা স্থান ও উৎস থেকে আলো এসে পড়তেই পারে, কিন্তু প্রভাব-সমুচয়ের বিষয়টি কেবল একতরফাভাবে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশে এসে পড়েছে বা পড়বে, বিষয়টা এমন নয়। আফ্রিকাও পিকাসো বা ক্লীর পর্যায়ের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃতদের প্রভাবিত করতে পারে। তাদেরকে শুধু বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে নয়, ‘ফর্মের’ ভাঙচুরের ক্ষেত্রে প্ররোচিত করতে পারে, এমনকি জন্ম দিতে পারে পিকাসোর কিউবিজম বা (পল ক্লী-র বেলায়) ‘মিস্টিক্যাল এবস্ট্রাকট’ পর্বের। সেই দ্বিমুখী সম্ভাবনার কথাই আবার মনে করিয়ে দেওয়া।

কুই ব্রানলি জাদুঘরে গেলে এ রকম অনেক সদৃশ্যতার কথা মনে পড়বে। ‘1906 Blast of Negro Art in Modern Art’ নামে একটি বই লিখেছেন আর্ট হিস্টোরিয়ান ণাবং ঈৎব্থযধষবঃ. আধুনিক শিল্পকর্মে কালো আফ্রিকার শিল্পকলার বিস্ম্ফোরণ। ১৯০৬ সালটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন এ ক্ষেত্রে, কেননা ওই বছরেই মার্সাইতে ‘কলোনিয়াল এক্সিবিশনের’ আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর প্রভাব এসে পড়েছিল ব্র্যাক, মাতিস, পিকাসো, মদিলিয়ানি, পল-ক্লী প্রমুখের শিল্পকর্মে বিশেষত চিত্রকলায়। কবি গীয়ম আপোলেনিয়র আইভরি কোস্টের একটি Dan মাস্ক (Dan Tankagle) কিনেছেন সেটা আবার চিরিকোর (Giorgio de Chirico) করা আপোলেনিয়রের প্রতিকৃতির ওপরে প্রভাব ফেলেছে। তানজানিয়ার মাকন্দে (Makonde) মাস্ক। নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা (Yaruba) মাস্ক, মালির দগন (Dogon) মাস্ক, কঙ্গোর কুন্ডু-গাতা (N’kundu-Ngata) নারী-মূর্তি, কদ্ধান (Kran) মাস্ক, গ্যাবনের ফ্যাং (Fang) মাস্ক, মালির বাম্বারা (Bambara) মাস্ক, লাইবেরিয়ার গ্রেব্রো (Grebo-Kron) মাস্ক, এঙ্গোলার Tschokwe মাস্ক, আঁরি রুসো থেকে শুরু করে পিকাসো দেরাঁ থেকে লেজে (Fernand Leger), ক্লী থেকে ম্যাক্স আর্নস্ট, সবাইকে বিমোহিত করেছিল। এদিক থেকে দেখলে এই ভোগের চিত্রকলায় ও ভাস্কর্যে আফ্রিকার তুলনামূলক অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আমাদের শিল্পকলায় ‘লোকজ’ শব্দটি জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে বন্দি। যামিনী রায়কে কালীঘাটের পটশিল্পের প্রভাবে দেখতে পারি বা কামরুল হাসানকে ‘পটুয়া’ বলতে আগ্রহী হয়ে উঠি- প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্টের প্রতি আমাদের উৎসাহের চৌহদ্দি ঐ পর্যন্তই। আধুনিক ভারতের বা বাংলাদেশের চিত্রকলায় ‘আফ্রিকার’ কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের দেশে আমাদের মতো করে ট্রাইবাল জীবনের ‘আধুনিক রূপায়ণ’ আছে, কিন্তু আধুনিক জীবনের ‘প্রিমিটিভ রূপায়ণ’ দুর্লভ। একজন হাল আমলের শিল্পী যখন সাঁওতাল, ম্র অথবা চকমা রমণীকে আঁকেন তখন তার লক্ষ্য থাকে আদিবাসী জীবনযাত্রার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি, পরিধানের বিশিষ্ট পোশাক বা দেহ গঠনের ভিন্নতার প্রতি। তাতে করে আধুনিক চিত্রকলার ওপরে আদিবাসী মনোজগতের, বিশ্বাসের বা সিম্বলিজমের কোনো আঁচড় পড়ে না, কোনো আলোড়ন সৃষ্টি হয় না, বা এর থেকে বলতে পারি না যে, দক্ষিণ এশিয় চিত্রকলায় ট্রাইবাল আর্টের ‘blast’ বা বিস্ম্ফোরণ হয়েছে। একজন সাঁওতাল বা মারমা রমণী হয়তো আমাদের কাছে এনথ্রোপলজিক্যাল আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু শিল্পকর্মে কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো নতুন আদর্শ বা নতুন ভাষার প্ররোচনা এতে করে সৃষ্টি হয় না। আমি যামিনী রায়ের এক্সপেরিমেন্ট অথবা ফ্রান্সিস নিউটন সুজা-র প্রিমিটিভ-প্রভাবিত চিত্রকলার কথা ভুলে যাইনি। একজন J.M.S. mari বা একজন এস. এম. সুলতান এ ভূভাগেও আছে। তারপরও বলতে হয়, যেভাবে ব্রাক-মাতিস-পিকাসো-ক্লীর কাছে ট্রাইবাল ও প্রিমিটিভ আর্ট নতুন আন্দোলন ও নতুন অভিব্যক্তির জন্ম দিল, সেভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলায় কেন প্রিমিটিভিজম ও মডার্নিজমের মধ্যে ভাবের, ভাষার এবং শুভদৃষ্টির বিনিময় হলো না, সেটা একটা ধাঁধার মতোই হয়ে থাকল।

নতুন আন্দোলন ও নতুন অভিব্যক্তি যে ট্রাইবাল ও প্রিমিটিভের গভীর তলদেশ থেকে জন্ম নিতে পারে তার জন্য ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি তাকানোর দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথেই আবার ফিরে যেতে হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু ও গগনেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বেঙ্গল পেইন্টার্স’ গ্রুপকে রবীন্দ্রনাথের খুব বেশি পছন্দ হয়নি। বেঙ্গল স্কুল খুব বেশি ‘জাতীয়তাবাদী’ ধারার শিল্পকলা বলে ঠেকেছিল তার কাছে। যেমন তিনি নৃত্যকলার জন্য খুঁজে এনেছিলেন মণিপুরি নৃত্যের ‘ফর্ম’, তেমনিভাবে চিত্রকলায় নতুন অভিব্যক্তির নিরন্তর সন্ধানে ছিলেন। তিনি মুকুল দে-কে জাপানে চিত্রকলা শেখানোর একটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন আর্ট-ফর্মের সন্ধান। কিন্তু তাতে তার মন সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এরপর নিজেই লেগে গেলেন রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে। দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে কোনোই মিল নেই, কিন্তু জার্মান প্রিমিটিভিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্টদের সাথে তার মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি এ ক্ষেত্রে মিলে গেল। ফিগারেটিভ, ল্যান্ডস্কেপ অথবা বিমূর্ত যে কোনো বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় দেখা গেল এক ভিন্ন ধরনের প্রভা, যার নিকটতম তুলনা কেবল পাওয়া যায় প্রিমিটিভ ও এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টে। [ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪২

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

পিকাসোর ‘আফ্রিকা’ দিয়েই আমি শুরু করতে চাই। যদিও পিকাসোর আগে ‘শুরুটা’ হয়েছিল। কে সূচনা করেছিলেন, সে নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে- মরিস ভদ্মামিঙ্ক (Maurice Vlamnck) এবং অন্দ্রে দেরাঁ (Andre Derain) দিয়েই। ১৯০৬ সালের শুরুর দিকে প্যারিসের একটি প্রদর্শনী থেকে দেরাঁ আফ্রিকার গ্যাবন দেশের একটি ‘ফ্যাং মুখোশ’ (Fang Mask) কেনেন। এরা দু’জনেই ছিলেন ইম্প্রেশনিজমের পরের উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ‘ফভ মুভমেন্টে’র সদস্য (Fauve painters নামে প্রসিদ্ধ)। ফরাসি ‘Fauve’
শব্দের অর্থ বন্য পশু, শিল্পকলার জগৎকে এক দানবিক শক্তি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে চেয়েছিলেন তারা; এই আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল- ১৯০৪ থেকে শুরু হয়ে ১৯১০ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত কুশীলবরা পরবর্তীকালে সেজান-পরবর্তী আধুনিক চিত্রকলার নানান দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। কে নেই এর মধ্যে? মাতিস, ব্রাক, রুয়ো (Roualt), এমনকি সামান্য কালের জন্য ‘নীল পর্বের’ পিকাসো স্বয়ং। এদের কিছু মৌলিক (অ-স্বাক্ষরিত) ‘লিথোগ্রাফ’ আমার সংগ্রহে রয়েছে। এই ফভ পর্ব যখন তুঙ্গে, তখনই আফ্রিকার ‘প্রিমিটিভ’ আর্টের প্রভাব এসে পড়ে প্যারিসের তরুণ শিল্পীদের মধ্যে। ফ্যাং মুখোশ কেনার কিছুদিনের মধ্যে মাতিস বেড়াতে যান আলজেরিয়ায়। সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন ভাস্কর্য (এবং ‘মুখোশ’) তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বস্তুত আমরা পিকাসোর ‘আফ্রিকা-পর্বের’ কথা আগে শুনেছি, কিন্তু মাতিসের আফ্রিকা-আবিস্কার প্রায় অজানা বা অচর্চিতই থেকে গেছে। ১৯০৬ সালের আলজেরিয়া ভ্রমণের পর মাতিসের আঁকার ধরনই বদলে গেল। উদ্ৃব্দতিটি তুলে দিচ্ছি : ‘Exposure to north African art, with its wealth of decorative patterns, helped him to simplify his drawing and I berate liberate color from its descriptive function. The trip also focused his attention on the arabesque an elegant, harmonies, S-shaped linear motif that plays a prominent part both in Islamic art and in the European academic tradition.’ এই প্রভাব এসে পড়েছিল মাতিসের Nude by the sea (১৯০৯) চিত্রকর্মে, যেখানে মোটা বলিষ্ঠ তুলিতে কালো রঙে দেহের অবয়ব স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এই ছবিতে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি কাঠের স্থির ভাস্কর্যের মতো- অবিকল পশ্চিম আফ্রিকার দণ্ডায়মান কালো কাঠের নারী মূর্তি। কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এ রকম অনেক নিদর্শন ছড়ানো। তবে আলজেরিয়া ভ্রমণের তুলনায় আরও বেশি স্পষ্ট করে আফ্রিকার প্রভাব অনুভূত হয় ১৯০৭ সালের চিত্রকর্মে, যার নাম ‘স্ট্যান্ডিং নুড’। এখানে ট্রাইবাল আর্ট, যেটা ছিল কাঠের বা প্রস্তর মূর্তি আবক্ষ, তাকে অনুবাদ করা হয়েছে রংতুলির ভাষায়- অয়েল পেইন্টিংয়ের ক্যানভাসে। ভাস্কর্য ও মুখোশ থেকে ক্যানভাসে স্থানান্তর- সংক্ষেপে এভাবেই হয় ট্রাইবাল প্রিমিটিভ আর্টের ইউরোপীয় আধুনিক চিত্রকলায় ‘আত্তীকরণ’। এর পেছনে একটি ছোট ইতিহাস রয়েছে। শিল্প সংগ্রাহক ও সমালোচক গেরট্রুড স্টেইন ছিলেন পিকাসো ও মাতিস দু’জনেরই বন্ধু। প্যারিসে অবস্থানকালে মার্কিন এই রমণী সমসাময়িক তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার আসরে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন- তার আতিথেয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও উষ্ণ সহায়-সমর্থনের জন্য। পিকাসো তাকে নিয়ে প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তার বিখ্যাত জ্যামিতিক ধারার ভাঙচুর ও ডি-কনস্ট্রাকশনের কিউবিক পদ্ধতিতে। মাতিস একবার গেরট্রুডের বাসায় যাওয়ার পথে এন্টিক শপ থেকে আফ্রিকার ছোট একটি স্ট্যাচু সংগ্রহ করেন। সেদিন গেরট্রুডের বাসায় উপস্থিত ছিলেন পিকাসোও। আফ্রিকার ট্রাইবাল ভাস্কর্য নিয়ে মাতিস-পিকাসোর আলাপ একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করে। মাতিস বলেন, ইউরোপীয় ভাস্কর্যে খুব বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, যাকে আঁকা হয়েছে তার বর্ণনার প্রতি, বিশেষত তার শরীরের গঠন-মাংসপেশি ইত্যাদি অনুষঙ্গের ওপরে। কিন্তু, দ্যাখো, আফ্রিকার ট্রাইবাল মূর্তিগুলোকে- মনে হচ্ছে কাঠ, পাথর বা মাটির ‘ম্যাটেরিয়াল’ যা-ই হোক না কেন, সেখান থেকে সরাসরিভাবে যেন কেটে তোলা হয়েছে এদের। শিল্পীর মেজাজ অনুযায়ী জ্যামিতিক ফর্ম, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে তুলনামূলক অনুপাত বেশ-কম করার ক্ষেত্রে বেশ স্বাধীনতা দেখতে পাই। ইউরোপীয় ভাস্কর্যে শরীর যেখানে ফিজিওলজির আঁটোসাঁটো গড়নের মধ্যে বন্দি, আফ্রিকার ভাস্কর্য সে তুলনায় অনেকটাই স্বাধীন। এই স্বাধীনতার দিকটি পিকাসো ও মাতিস উভয়েরই খুব মনে ধরেছিল। ভাস্কর্য শিল্পীর মনের ইচ্ছেকে প্রকাশ করছে- যাকে উপলক্ষ করে ভাস্কর্য গড়ে তোলা হচ্ছে, তা আর তার মুখ্য আগ্রহের বিষয়বস্তু থাকছে না। এটা দু’জনের কাছেই বিস্ময়কর আবিস্কার মনে হয়েছিল। পরবর্তীকালে Die Brucke (মানে, ‘সেতু’) আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এরিখ হেকেল, এমিল নলডে, এর্নস্ট কিরশ্‌নের প্রমুখেরা আফ্রিকার প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাবে ইউরোপীয় চিত্রকলার মধ্যে ‘এক্সপ্রেশনিজমে’র ধারা সূচনা করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা মাতিসের বিরল ভাস্কর্য (তিনি খুব বেশি ভাস্কর্যের কাজ করেননি) ‘দ্য সারপেন্টাইন’ ও কিরশনের-এর ‘দ্য ড্যান্সিং ওমেন’-এর উল্লেখ করতে পারি।

প্রিমিটিভ আর্টের প্রভাব মাতিসের শিল্পকলায় আমৃত্যু সঞ্চারিত হয়েছিল। এখন যাকে বলে ‘টেক্সটাইল আর্ট’, তারও মূল প্রেরণা এসেছিল আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকা ছাড়াও পাপুয়া নিউগিনি এবং পলিনেশীয় কাপড়ের ‘ইন্ট্রিকেট’ জ্যামিতিক ডিজাইন আধুনিক শিল্পকলাকে নাড়া দিয়ে গেছে। মাতিসের শোবার ঘরের একটা দেয়ালজুড়ে ছিল এসব দেশ থেকে সংগ্রহ করা ‘টেক্সটাইল’ শিল্পকর্ম। কাপড়ের বাহারি প্যাটার্নের নকশা মাতিস তার ক্যানভাসের চিত্রকর্মের মধ্যে প্রায়ই ব্যবহার করেছেন- অবশ্যই নিজস্ব উজ্জ্বল রঙের ফোয়ারা তুলে। ‘মাতিস ঈশ্বরের পরেই সবচেয়ে ভালো রঙের ব্যবহার করতে জানেন’- এই কথাটা পিকাসো সংগত কারণেই বলেছিলেন। সেই মাতিস আফ্রিকার ‘কুবা’ (Kuba) কাপড়ের জ্যামিতিক নকশা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, ‘I never fire of looking at even the simplest of them, and waiting for something to come to me from the mystery of their instinctive geometry… I can’t wait to sea what the tapa will reveal to meÑ for its perfection’. সাম্প্রতিক কালের উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, রতন মজুমদারের আশির দশকের সাদা-কালো ছাপচিত্রে এই প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল ‘টেক্সটাইল আর্টের’ মনোমুগ্ধকর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। অন্যবিধ প্রভাবও মাতিস নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। পল গগাঁর তাহিতি-সিরিজের চিত্রকর্মের মতো মাতিসেরও নিজস্ব স্মৃতি ছিল তাহিতি নিয়ে। ১৯৩১ সালে ষাট বছরের মাতিস তাহিতিতে বেড়াতে যান। প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ‘পলিনেশিয়া’ অঞ্চল (French Polynesia হিসেবে চিহ্নিত)। সেখান থেকে মাতিস নিয়ে আসেন নানা ধরনের পোশাক (Tapa Cloths), স্থানীয় রমণীদের পরনের স্কার্ট (Pareos) এবং অ্যাপ্লিকের কাজ করা কাপড় (স্থানীয় ভাষায় Tifaifai নামে পরিচিত)। সেইসঙ্গে এসেছিল যত রাজ্যের শঙ্খ, ঝিনুক ও প্রবাল পাথর। পলিনেশিয়া মাতিসের চিত্রকর্মকে জল ও আকাশের গন্ধ ও বর্ণ ধার দিয়েছিল- তার ট্রেডমার্ক নীল পটভূমিতে আঁকা সাদা জল, মাছ, ঝিনুক, কোরাল ও শঙ্খমালা। পরবর্তীকালে এই চিত্রকর্মগুলো রূপান্তর হবে তার মৃত্যুর আগের মাসগুলোয় করা বিখ্যাত ‘কাটআউট’ সিরিজে। নানা রঙের কাগজ কেটে মিলিয়ে মিলিয়ে বানানো একান্তভাবে তারই উদ্ভাবিত অশ্রুতপূর্ব শিল্পকর্ম। এ নিয়ে আমি সাক্ষী-সাবুদ উপস্থাপন করতে পারি এখানে। কবি ও ঔপন্যাসিক লুই আরাগঁ ‘মাতিসের তাহিতি’ প্রসঙ্গে এভাবে বলেছেন :
‘Whoever knows Matisse is constantly aware of the influence of that distant island on his thoughts… he tells of the light of Tahiti, the lagoon, the transparent water, the fish and the Corals in that undersea light which is like a second sky.’ তার ওশেনিয়া (Oceania) ও পলিনেশিয়া (Polynesia) সিরিজ এভাবেই গড়ে উঠেছিল। তাহিতি মাতিসকে দিয়েছিল শুদ্ধতম চিত্রকর হয়ে ওঠার সিঁড়ি। পলিনেশিয়ার এক দ্বীপে মাত্র তিন সপ্তাহ থেকেই তার মনে হলো তিনি যেন সেই সিঁড়ির ধাপগুলো দেখতে পাচ্ছেন। সহকর্মী চিত্রকর পিয়ের বনার্ডকে (Bonnard)
তিনি লিখলেন, ‘Just 20 days on a coral island: pure light, pure air, pure colour: diamond sapphire emerald turquoise. Fabulous fish.’ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, (এক বিষ্ণু দে-কে বাদ দিলে) পরবর্তীকালে শামসুর রাহমানের কবিতার যতিচিহ্নের মতো ক্রমাগত উল্লেখ করা হবে সেজান, মাতিস, ব্রাক ও পিকাসোর কথা। তার বিশ্বকে লাল-নীল-সবুজ নানা রঙে বর্ণিল করবেন এই Fauve চিত্রশিল্পীরা। শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিক চিত্রকলা একটি আগ্রহের থিম। সেখানে আরও যুক্ত হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পীরা :যামিনী রায় থেকে জয়নুল; শাগাল ও কান্ডিনস্কি থেকে শুরু করে মিরো ও ডালি। সেটি নিজস্ব মূল্যেই একটি পৃথক ও একান্ত মনোযোগের বিষয়, যা বর্তমান আলোচনার বাইরে থাকল।

অনাবিস্কৃত মাতিসে এশিয়া-আফ্রিকার প্রসঙ্গ প্রচ্ছন্নে থাকলেও ‘পিকাসোর আফ্রিকা’ বহুদিন ধরেই একটি চর্চিত বিষয়। সমালোচক ও সহচিত্রশিল্পীরা সবাই বলেছেন যে, কিউবিজমের পেছনে একটি প্রেরণা যেমন- বিজ্ঞান (বিশ্বের ‘ত্রিমাত্রিক’ ভিউ, যা দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসের তলদেশ থেকে ত্রিমাত্রিক অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা), তেমনি অন্য একটি উৎসাহ এসেছিল আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট-ফর্ম থেকে। আদিবাসীদের ভাস্কর্যের মধ্যে শারীরিক উপস্থাপনায় সচেতনভাবে বৈসাদৃশ্য, সামঞ্জস্যহীনতা, প্রতিতুলনা ও কর্কশতাকে (কুৎসিত নয়) প্রাধান্য দিয়ে ফর্মের সচেতন ভাঙচুর করা হয়েছে। অথচ তাতে করে নান্দনিক রসে ব্যাঘাত ঘটেনি :খাপছাড়া, কিন্তু সুন্দর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাঙচুর করে পুনর্নির্মাণ, একটি প্রচলিত শিল্পপদ্ধতিকে ভেঙে দেখার নতুন চোখ তৈরি করা (পাঠকের মনে পড়বে ‘Eye of Picasso’ গ্রন্থটি)- এটি আফ্রিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ আর্ট তাকে শিখিয়েছিল। কিন্তু পিকাসো নিজে এই ঋণ স্বীকার করতে আগ্রহী ছিলেন না। আফ্রিকার টোটেম তার সর্বাধুনিক কিউবিজমকে প্রেরণা জুগিয়েছে- এ কথা তিনি থিসিস আকারে বলতে পারতেন। কিন্তু বলেননি। এ নিয়ে তার স্ত্রী (যিনি নিজেও একজন উল্লেখ করার মতো শিল্পী) ফ্রাঁসোয়া জিলোট (Gilot) রাখঢাক না করেই প্রায় এভাবে বলেছেন, ‘যারা পিকাসোকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তারাই বুঝবেন কেন পিকাসোর মুখ দিয়ে ওই স্বীকারোক্তিটি বেরোয়নি। আসলে তিনি এ ব্যাপারে কেন, কোনো কিছুর জন্যই কারও কাছেই জীবনে কোনো ঋণ স্বীকার করতে চাননি।’ জিলোটের সঙ্গে পিকাসোর পরবর্তীকালে অবশ্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় (তার বৈষয়িক জীবনে এ রকম ছাড়াছাড়ির ঘটনা পৌনপুনিক)। ফলে এই ব্যাখ্যাকে পিকাসোর প্রতি সংবেদনশীল বলে গ্রহণ করা শক্ত।

আফ্রিকার ‘কোটা’ (Kota) ভাস্কর্যের প্রভাবে আঁকা হয়েছিল পিকাসোর বিভিন্ন চিত্রকর্ম। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘ড্যান্সার অব আভিগনন্‌’ ও ‘থ্রি উইমেন’ চিত্রকর্ম দুটি। কিউবিস্ট মোটিফে করা ‘গিটার’ও আরেকটি উদাহরণ। কীভাবে আফ্রিকার শিল্পকলার প্রতি পিকাসো আকৃষ্ট হন, সে গল্প জিলোটকে শুনিয়েছিলেন শিল্পী নিজেই। ১৯০৭ সালের শুরুতে প্যারিসের ‘ট্রকাদেরো মিউজিয়ামে’ (যেটি এথনোগ্রাফি মিউজিয়াম নামেও পরিচিত) হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ে যায় আফ্রিকা থেকে সংগৃহীত একটি মূর্তি।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪১

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

এর কোনো কোনোটিতে পুত্র দেবেন্দ্রনাথকেও যুক্ত করেছিলেন দ্বারকানাথ, অর্থাৎ আত্মজীবনীতে এসব ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। তবু সেই স্বাভাবিক সুযোগটি নিতে চাননি দেবেন্দ্রনাথ। বিস্ময়ের কারণ এখানেই শেষ নয়। দেবেন্দ্রনাথ যা-ও বা কিছু উল্লেখ করেছেন পিতার (আপেক্ষিক নীরবতা সত্ত্বেও), কিন্তু রবীন্দ্ররচনাবলির বিপুলায়তন আত্মজৈবনিক অংশে (চিঠিপত্রসহ বলছি) একবারের জন্যে হলেও কোথাও কোনো উল্লেখ নেই দ্বারকানাথের। আমি কি ভুল বললাম, বা বাড়িয়ে বললাম? এই নিস্তব্ধতার কার্যকারণ সূত্র খুঁজে পাওয়া ভার। বা খুঁজে পাওয়া গেলেও- একটা তো প্রচলিত মত আছেই যে, দ্বারকানাথ অজস্র দায়-দেনার ভার ঠাকুরবাড়ির উত্তরাধিকারীদের ওপরে দিয়ে গেছেন- এর যৌক্তিকতার পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাময় বিকাশে যে বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিকতার ছায়া দেখতে পাই, সেই ছায়া বিশালদেহী দ্বারকানাথ ঠাকুরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অবচেতন মনে তিনি অস্বীকৃত অন্যজন- তার সত্তার ‘অপর’; তার এত কাছের মানুষ হয়েও যিনি সারাজীবন দূরলোকের নক্ষত্রের মতো অজ্ঞেয় ও রহস্যময় থেকে গেলেন। কেনসাল গ্রিনের নির্জন কবরস্থানের নির্জনতম স্থানে তার মরণোত্তর ছাইভস্ম সমাহিত করে রাখা হয়েছে। সেই সমাধির পরিচয়পত্রে দ্বারকানাথের নামোল্লেখ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই, রাবীন্দ্রিক সূত্রের উল্লেখ তো নেই-ই। না কোনো গানের লাইন, বা কোনো কবিতার চরণ উৎকীর্ণ হয়ে রয়েছে দ্বারকানাথের সমাধিতে। তার মধ্যেই সেদিন চোখে পড়েছিল কে বা কারা যেন রেখে গেছে- ততক্ষণে বাসি হয়ে যাওয়া- দুটি নাম-না-জানা ফুল। বিচিত্র এ মানবজীবন ও তার পরিণতি।

৪. কুই ব্রানলি মিউজিয়াম :আফ্রিকা ও পিকাসো

গান্ধীকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আপনার মত কী?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘দ্যাট উড বি এ গুড আইডিয়া।’ পাশ্চাত্যে সভ্যতা আসলে তো ভালোই হয়। আসলে ‘ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনে’র কথাটা এখনও পর্যন্ত কেবল ‘আইডিয়ার’ পর্যায়েই রয়ে গেছে। লুভর মিউজিয়াম দেখার পর কুই ব্রানলি মিউজিয়ামে এসে এই কথাটাই বারবার মনে এলো। স্বাভাবিকভাবেই ‘মোনালিসার ছবি’ দেখার জন্যে লুভর মিউজিয়ামে পর্যটকদের হুড়াহুড়ি। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সবাইকে- একটা ছবি অতি দ্রুত সেলফিতে তুলেই বা ক্যামেরাবন্দি করেই লাইন ধরে এগিয়ে যেতে হবে পরের জনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্যে। লুভর-এ মোনালিসা ছাড়াও আরও অনেক কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে। বিশেষ করে গ্রিক রোমান আর্টের নিদর্শন ছড়ানো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার কোনো শিল্পকলা লুভর-এর মতো ‘মেইনস্ট্রিম’ মিউজিয়ামে নেই। একসময় ছিল সেগুলো- বেসমেন্টে- ‘মাইনাস-১’ ফ্লোরে। সে নিয়ে সমালোচনা ওঠায় শেষ পর্যন্ত যেসব শিল্পকলা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্যত্র। তার মধ্যে যেগুলো পাশ্চাত্যের চোখে ‘প্রিমিটিভ আর্ট’ রূপে অভিহিত, তাদের এক জায়গায় জড়ো করে তৈরি হয়েছে ‘কুই ব্রানলি’ মিউজিয়াম। প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাকের নামে হয়েছে এই জাদুঘর- তিনি এসব ‘প্রিমিটিভ আর্টের’ সংগ্রাহক ও গুণগ্রাহী ছিলেন এ কথা মনে করে।

লুভর মিউজিয়ামের সামনে পাগল-করা যে ভিড়, তার লেশমাত্র নেই কুই ব্রানলিতে। সুনসান নিস্তব্ধতা সেখানে বিরাজ করছে। টিকিট কাটার সময় বললাম, ‘অনেক আশা নিয়ে এসেছি এখানে। অনেক গল্প শুনেছি এই মিউজিয়াম নিয়ে।’ বিক্রেতা এক ফরাসি তরুণ। হেসে বললেন, ‘আমরা যারা এখানে কাজ করি, তারাও খুব গর্বিত এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে।’ আসলে এখানে না এলে ‘আধুনিক’ চিত্রকলার জন্মের ইতিহাস আড়ালেই থেকে যেত। পাশ্চাত্যের কিউবিস্ট, এক্সপ্রেশনিস্ট এবং সুররিয়ালিস্ট চিত্রকলার সূতিকাগার হলো আফ্রিকা-পলিনেশিয়া-লাতিন আমেরিকার তথাকথিত ‘প্রিমিটিভ’ বা ‘আদিম’ চিত্রকলা। এ জিনিস এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না! বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, আফ্রিকার ‘ট্রাইবাল’ আর্টের কথা। এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পানেননি পিকাসো, মাতিস, ব্রাক, পল ক্লী, মডিলিয়ানি প্রমুখ। প্রকৃতপক্ষে কে নয়? তৃতীয় বিশ্বের ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘ট্রাইবাল’ আর্টের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি কাজিমির মালেভিচ, মার্ক শাগাল, সালভাদর ডালি, এর্নস্ট কিরশ্‌নের (kirchner), এমিল নলডে (Nolde), ‘আর্ট ব্রুট’ আন্দোলনের জঁ দুবুফে (Dubuffet), এমনকি ভাসিলি কান্ডিনস্কী ও জোসেফ এলবার্স। এই প্রভাবের গভীরতা এত ব্যাপক, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে- এতসব প্রভাব বিস্তারের পরও আফ্রিকা বা পলিনেশিয়ার লোকশিল্পকে এখনও কেন ‘প্রিমিটিভ’ এবং ‘ট্রাইবাল’ আর্ট বা আর্ট-ফর্ম হিসেবে দেখা হচ্ছে? কেন এসব শিল্পকর্মকে ‘আধুনিক’ শিল্পকলার অচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে না?

এর কারণ দার্শনিক ও রাজনৈতিক। পৌলমি সাহা তার ‘এন এমপায়ার অব টাচ্‌’ বইতে যোগ করেন এক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য। ১৯৩১ সালের মে মাসে মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। এই উপলক্ষে গিরীন্দ্রশেখর বোসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান সাইকোএনালাইটেকাল সোসাইটি হাতির দাঁতের করা একটি ৯ ইঞ্চির বিষ্ণুমূর্তি তাকে উপহার দেয়। এর আগে গিরীন্দ্রশেখর এবং ফ্রয়েডের মধ্যে বিশ বছর ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটি পেয়ে ফ্রয়েড গিরীন্দ্রশেখরকে লেখেন :

যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমি এই উপহারটিকে সানন্দে ‘উপভোগ’ করব। এটি আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মনঃসমীক্ষণ ছড়িয়ে পড়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি তুলে ধরার দাবি রাখে : ‘The statuette is charming. I gave it the place of honor on my desk. As long as I can enjoy life it will recall to my mind the progress of psychoanalysis, the proud conquest it has made in foreign countries and the kind of feelings for me it has aroused in some of my contemporaries at least.’ উদ্ধৃত অংশের মধ্যে উপহার প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাপূর্ণ স্বীকৃতি আছে। কিন্তু আমার খটকা লেগেছিল ‘ঢ়ৎড়ঁফ পড়হয়ঁবংঃ’ শব্দবন্ধের ব্যবহারে। ফ্রয়েড-গিরিন্দ্রশেখরের পত্রালাপ থেকে এটা নিশ্চিত যে, বিনিময় হচ্ছিল শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে নয়। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণের বিপরীতে গিরীন্দ্রশেখর একটি ভিন্ন ধরনের মনোবীক্ষণের- তথাকথিত ‘ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রি’র সম্ভাবনা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। পাশ্চাত্যের মনঃসমীক্ষণ বিদ্যাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমীক্ষণ বিদ্যা, এটা গিরীন্দ্রশেখর মনে করতেন না। ফ্রয়েড-পরবর্তী মনঃসমীক্ষণ বিদ্যায় গিরীন্দ্রশেখরের যথাযথ স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী এ নিয়ে বেশকিছু কাল আগে একটি চমকপ্রদ শিরোনামে বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য স্যাভেজ ফ্রয়েড’। সেখানে ট্রাডিশন ও মডার্নিটিকে একই সত্তার মধ্যে বিচরণ করতে দেখা যায়। সত্যজিৎ রায় ট্রাডিশনটি প্রকাশ করেন তার সিনেমার মাধ্যমে; আর মডার্নিটিকে প্রকাশ করেন তার ‘ডিটেকটিভ’ গল্পের মাধ্যমে। কিন্তু ‘সত্তার বিভক্তি’ এখানে আমার আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে আমি শুধু লক্ষ্য করব যে, নন্দী দেখিয়েছেন, কীভাবে ফ্রয়েড পাশ্চাত্যের তথাকথিত মডার্নিটি বা সিভিলাইজেশনকে আক্রমণ করেছেন। মানবিক উদ্বেগ, অবসাদ, কামনা-বাসনা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রকারান্তরে আঘাত করেছেন বিশুদ্ধ যুক্তিবাদী এনলাইটেনমেন্টের ঐতিহ্যকে। ফ্রয়েড কখনও বেকন বা হবসের মতো মানুষকে ‘বৈজ্ঞানিক মানব’ হিসেবে দেখেননি। এ জন্যে তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে পাশ্চাত্যে। নন্দীর কথা হলো, এই একই যুক্তিতে তৃতীয় বিশ্বের বা ভারতবর্ষের ঐতিহ্য-সংলগ্নতা, কোমলচিত্ততা ও যুক্তি-রহিত মরমিবাদকে পাশ্চাত্যের চোখে ঠেকেছে বর্বর বা স্যাভেজ প্রথা বলে। এই একই যুক্তিতে গিরীন্দ্রশেখর ও তার মনোবিদ্যাকেও ‘স্যাভেজ’ বলা হবে। নন্দীর যুক্তি হচ্ছে, পাশ্চাত্যের অতিশয় বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রযুক্তি ও যুক্তির প্রভাব তার মানবিক চরিত্রে নানা উপসর্গের সৃষ্টি করেছে। ফ্রয়েড তার ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মনোবিকলন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামাজিক উপসর্গে পরিণত হচ্ছে। প্রাচ্যের বিশ্বাস-নির্ভর ঐতিহ্যকে পাশ্চাত্যের যুক্তি-নির্ভর ঐতিহ্যের একটি সমালোচনা হিসেবে দেখেছেন নন্দী। অর্থাৎ, ‘স্যাভেজ ফ্রয়েড’ এই শিরোনামের মাধ্যমে নন্দী দেখাচ্ছেন যে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকেই একমাত্র ‘সভ্যতা’ বলে জ্ঞান করা যায় না। বিশ্বাসের ঐতিহ্যের মধ্যেও ‘সভ্যতা’ আবিস্কৃত হতে পারে। কে সভ্য, আর কে অসভ্য তা ঠিক করার ভার পাশ্চাত্যকে কেউ দেয়নি। উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল আফ্রিকার অধিবাসীদের ‘স্যাভেজ’ বলেছিলেন। তাই যদি হবে, তাহলে আফ্রিকার প্রিমিটিভ ও ট্রাইবাল আর্ট পিকাসোর মতো শিল্পীর আধুনিকতম চিত্রকলাকে প্রভাবিত করে কী করে? বা পলিনেশীয় আর্ট কীভাবে আচ্ছন্ন করে পল গগাঁকে? বা নর্থ আফ্রিকা ও মেডেটেরিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতি কী করে প্রভাব বিস্তার করে সেজান ও মাতিসের ওপরে? বা পল ক্লী-র জ্যামিতির মধ্যে কী করে আমরা খুঁজে পাই সাহারা অঞ্চলের ইন্ট্রিকেট আঁকিবুঁকি? ফ্রয়েড-গিরীন্দ্রশেখরের মনোবিকলন আধো-ঘুমে আধো-জাগরণে কী করে স্থান করে নেয় সুররিয়ালিস্ট চিত্রকর্মে? আন্দ্রে ব্রেতো, ডালি, মেক্সিকোর তামায়ো (Tamayo) বা কিউবার উইলফ্রেডো লাম (Wilfred lam) এরা সবাই ‘প্রিমিটিভ’-এর কাছে ঋণী। সে ক্ষেত্রে প্রিমিটিভই তো আধুনিক চিত্রকর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাই নয় কি?

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৪০

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

ইউরোপ যা কিছু করে দেখিয়েছে তাকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, তাকে আমরা উচ্চ মূল্যায়ন করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ভারতবর্ষ যা তৈরি করেছে তাকে আমরা পরিত্যাজ্য বলে ভাবব। আমরা যেমন তোমাদের বিষয়ে করি, সেভাবে তোমরা যদি আমাদের সংগীতকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে, তাহলে দেখতে তোমাদের সংগীতে যেমন, আমাদের সংগীতেও সুরের, ছন্দের, তালের কোনো কিছুরই কমতি নেই। আর তোমরা যদি আমাদের কবিতা, আমাদের ধর্ম, আমাদের দর্শন নিয়ে চর্চা করতে তাহলে দেখতে পেতে যে তোমরা যা ভাবছ সেরকম কোনো বর্বর বা তস্কর কোনোটাই আমরা নই। আমরা ততটুকুই জানি, আমাদের কাছে ততটুকুই অজ্ঞেয়, যতটুকু তোমরা জানো বা তোমাদের কাছে যা অজ্ঞেয়। হয়তো অজ্ঞেয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা তোমাদের চেয়ে আরেকটু গভীরতর।’

দ্বারকানাথের মর্মদাহ ম্যাক্সমুলার সম্ভবত শেষ বয়সে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তা নইলে কথাগুলো এত সবিস্তারে তার স্মৃতিচারণায় তিনি উল্লেখ করার তাড়না অনুভব করবেন কেন? তার স্মৃতিচারণামূলক বইটি প্রকাশ পায় ১৮৯৯ সালে। এর পরের বছরই ম্যাক্সমুলারের মৃত্যু হয়। ততদিনে উপনিবেশের শাসন-শোষণ আরও বর্বরতর হয়েছে আফ্রিকায়, আর সূক্ষ্ণতর হয়েছে এশিয়ায় বা এই উপমহাদেশে। এক কথায়, ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসন আরও নির্দয় হয়েছে বিশ্বব্যাপী। উপনিবেশ দখলের ও ভাগবাটোয়ারার লড়াই আরও তীব্র হয়েছে ১৯০০ সালের পরবর্তী পৃথিবীতে। এ সময়েই রবীন্দ্রনাথ লিখবেন ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের প্রফেটিক পঙ্‌ক্তিমালা : ‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে / অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে/ অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী/ ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী/ তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে/ গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।’ পদ্মাপাড়ের নির্জন ভুবনে ঢুকে পড়েছে ঔপনিবেশিক রূঢ় বাস্তবতা।

দ্বারকানাথের মুখ দিয়ে যদিও বলানো হচ্ছে কিন্তু কথাগুলো ততদিনে ম্যাক্সমুলারেরও বলার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং সেই কথাগুলো তিনি বলেছেন যুধ্যমান পাশ্চাত্যকে। শুধু নিজের জানাই জানা নয়, অপরের জানাও জানা। আধুনিকতার ঐতিহ্যের প্রতি সবারই অধিকার কি প্রাচ্যের, কি পাশ্চাত্যের। শুধু পাশ্চাত্য জ্ঞানের আহরণ করবে, আর আমরা কেবল তার ক্রমাগত ভোগ করে চিরস্থায়ীভাবে ঋণী থেকে যাব- এরকম অসম-সম্পর্কে দ্বারকানাথের আস্থা ছিল না। পাশ্চাত্যকে অস্বীকার যেমন করব না, তেমনি প্রাচ্যকেও অস্বীকৃতির অপমানে থাকতে দেব না। দ্বারকানাথের ক্ষোভমিশ্রিত তিরস্কার বাণী বহুকাল পর্যন্ত শেল হয়ে বেজেছে ম্যাক্সমুলারের বুকে। তিনি শেষাবধি স্বীকার করেছেন : ‘He was not far wrong’- দ্বারকানাথ সেদিন ১৮৪৪ সালের প্যারিসে বসে তাহলে খুব একটা ভুল বলেননি!

বিত্তবৈভবের মধ্যে দিন কাটালেও দ্বারকানাথের জীবনের শেষ বছরগুলো অর্থনৈতিকভাবে সুখের ছিল না। কিন্তু পতনের দিকটি তিনি যথাসম্ভব আড়ালেই রেখেছিলেন। শুধু ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ নন, ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গেও তার সখ্য হয়েছিল। ১৮৪২ সালে যখন তিনি নিজের জাহাজে করে লন্ডনে যান, ততদিনে ইংল্যান্ডের রানী হয়েছেন তরুণী ভিক্টোরিয়া। ১৮৩৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া রানী হিসেবে অভিষিক্ত হন। ইংল্যান্ডে পা রাখার পরপরই দ্বারকানাথের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হন রানী। ২৩ বছর বয়সী সম্রাজ্ঞীর মনে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আসা বিদেশি দ্বারকানাথকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। রানী তাকে তার ব্যক্তিগত প্রতিকৃতি সম্বলিত মোড়ক উপহার দেন। তবে দুর্ভাগ্য, ১৮৪৫ সালে দ্বারকানাথের ব্যবসায় এক দুর্বিপাক নেমে আসে। ১৮৪৭ সালের স্টক মার্কেটের বিপর্যয়ের ফলে তার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। এই ১৮৪৫-৪৭ পর্বে বিশ্বজোড়াই মন্দা নেমে এসেছিল। তখনও ‘লিমিটেড কোম্পানি’ আইন প্রবর্তিত হয়নি ইউরোপে বা ভারতবর্ষে। এর ফলে অনেক উদ্যোক্তা, শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী দেউলিয়াত্ব বরণ করেন। হয়তো এই অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাবেই দ্বারকানাথ লন্ডনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং ১৮৪৬ সালে তার মৃত্যু হয়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে দ্বারকানাথ তারা বন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের স্মরণে ব্রিস্টল শহরে তার কবরের ওপরে একটি সমাধি নির্মাণ করেছিলেন। তবে তিনি নিজেও যে ইংল্যান্ডের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন- এ কথা হয়তো কখনও ভাবেননি। আমি যখন ২০১২ সালে লন্ডনের ‘কেনসাল গ্রিন’ কবরস্থানে দ্বারকানাথের সমাধি দেখতে যাই, তখন বারবার এ কথা মনে হয়েছিল আমাদের দেশের আধুনিকতার দুই পথিকৃৎ বিদেশের মাটির নির্জনেই থেকে গেলেন।

দ্বারকানাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষে আধুনিক কয়লা খনির ব্যবসা তার হাত দিয়েই শুরু; আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবসায় তিনি সেকালের বাঙালি-ভারতীয়দের মধ্যে অগ্রগণ্য; দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাষ্পচালিত স্টিমার ও আন্তঃমহাদেশীয় জাহাজ খাতেও তার স্থান সবার ওপরে। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা। সংগীতে তার অনন্যসাধারণ দখল ছিল। ভারতীয় রাগ-সংগীতের বিষয়ে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এমনও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, গণিতের ক্ষেত্রে শূন্যের অবদান যেমন যুগান্তকারী, তেমনি ‘সংগীত-রত্নাকর’-এর মতো ‘ট্রেজারি অব সিম্ম্ফোনি’ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ইতিহাসেই এক অতি বিরল সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের সংগীতকলা হয়তো প্রাচ্যের সংগীতকলার কাছেই ঋণী। দ্বারকানাথের যুক্তি আমতা আমতা করে মেনে নিচ্ছেন বা অনেকটাই স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন জার্মানির এই তরুণ সংস্কৃতজ্ঞ। ম্যাক্সমুলার বলছেন, পাশ্চাত্যকে এ রকম ঋণ স্বীকার করতে হতেই পারে একদিন। সংগীতের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়াটাও আদৌ বিচিত্র নয় : ‘In itself such a borrowing has nothing incredible in it, for we know that our figures, not excluding the naught, traveled on the same road, from the Indian to the Persians, the Arabs, the Spaniards, and the Italians’, এবং এটুকু বলে তার দ্বিধার জায়গাটুকু স্পষ্ট করছেন : “ভারতীয় সংগীতের ‘সা রে গা মা পা ধা নি’- এই সাতটি ‘নোট’ যে কালক্রমে ইতালীয় সংগীতে এসে ‘দো রে মি ফা সল লা সি’ ধারার সাতটি ‘নোটে’ পর্যবসিত হয়েছে, তার জন্য আরও ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ দিতে হবে।” যেন দ্বারকানাথকে খণ্ডন করার জন্যই বলছেন : ‘শূন্যের আবিস্কারের জন্য ওই মহান দেশটির প্রতি গণিতবিদ মাত্রেরই অপার কৃতজ্ঞতা রয়ে গেছে। শূন্যের এই আবিস্কার গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় আবিস্কারের একটি। পাশ্চাত্যের প্রতি এটা প্রাচ্যের দান, সন্দেহ নেই। তবে বিঠোফেনের সিম্ম্ফোনির পেছনে ভারতীয় [সংগীত-রত্নাকরের] দান রয়েছে কি-না তার উত্তরের জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

এই তর্কালাপের সত্য-মিথ্যা, তথ্য বা তত্ত্ব আলোচনা করা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু কথাগুলো উঠেছে দ্বারকানাথের সঙ্গে ম্যাক্সমুলারের সংগীত নিয়ে বাহাসের সূত্রে, সেটাই আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া। ম্যাক্সমুলার যখন মারা যান, তখন তার কাছে তরুণ রবীন্দ্রনাথ প্রায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তিত্ব। তার স্মৃতিচারণায় রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ নেই। অথচ তার মৃত্যুর ১৩ বছর পরেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাবেন। দ্বারকানাথের সংগীত-প্রতিভা তার কনিষ্ঠতম নাতির মধ্যে বহুগুণে লালিত হয়ে বিকশিত হবে। ম্যাক্সমুলারের অবশ্য সেই পরিচয় পাওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু দ্বারকানাথ-ম্যাক্সমুলারের আলাপের অংশবিশেষ শোনার পর রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর উত্থান আর অতটা বিস্ময়কর ঠেকে না আমাদের কাছে।

তবে একটি কথা না বললেই নয়। যে প্রসঙ্গ আগেই তোলা উচিত ছিল সম্ভবত, সেই ‘রুমের ভেতরের বড় হাতিটার’ [বিগ এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম] কথাই বেমালুম ভুলে ছিলাম। দেবেন্দ্রনাথ আত্মজীবনীতে তার বাবা দ্বারকানাথের দুই-তিনবার উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনা থেকে পিতার প্রতি উচ্ছ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় না; তবে নিষ্ঠাবান বড় ছেলের দায়িত্ববোধের একটা ছবি ফুটে ওঠে। এর বেশি কিছু নয়। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। কোন কার্য্যোপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিবার জন্য আমাকেই বাড়ী বাড়ী যাইতে হইত।’ অথবা অন্যত্র বলেছেন, ‘শৈশবকাল অবধি আমার রামমোহন রায়ের সহিত সংশ্রব। আমি তাহার স্কুলে পড়িতাম। তখন আরও ভাল স্কুল ছিল… কিন্তু আমার পিতা রামমোহন রায়ের অনুরোধে আমাকে ঐ স্কুলে দেন।’ এসব বিবরণে কচিৎ-কদাচিৎ দ্বারকানাথের প্রসঙ্গ চলে এলেও তার সঙ্গে সম্পর্কের অতিরিক্ত কোনো ঘটনা, সংলাপ বা মানবিক আদান-প্রদানের মুহূর্ত দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীতে নেই। রামমোহন রায়কে নিয়ে একটি গোটা পরিচ্ছেদ লেখা হয়েছে। তার স্বর্গত দিদিমা অলকা সুন্দরীর সঙ্গে মধুর সম্পর্কের বিবরণী তার আত্মজীবনীর শুরু; তার আধ্যাত্মিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের চমৎকার উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু কোথাও দ্বারকানাথের সশরীরী উপস্থিতি নেই। যেন তার কোনো পারিবারিক জীবন ছিল না, যেন পুরোটাই তিনি ছিলেন ‘বাইরের জগতের মানুষ’।

অথচ বহির্বিশ্ব তাকে কী চোখে দেখত তার সামান্য পরিচয় আমি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা ‘দানবীর’, ‘দয়ার সাগর’ ইত্যাদি অভিধা প্রয়োগ করি হাজী মুহম্মদ মহসীন বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে। কিন্তু অন্য সব গুণের বা অর্জনের কথা বাদ দিলেও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা দানের প্রশ্নে দ্বারকানাথের তুলনা সেকালে (এবং একালেও) খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। দ্বারকানাথ অপব্যয়ী ছিলেন না- উদ্যোক্তা ছিলেন। কিন্তু উদ্যোক্তা হয়েও সামাজিক দায়বদ্ধতা সারাজীবন নীরবেই পালন করে এসেছেন। এ নিয়ে ঢাকঢোল পেটানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথের বিলাতযাত্রার সময়ে (যেবার তিনি তরুণী সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন) তার দানশীলতার প্রশংসা করে ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকাটি যা লিখেছিল, তা আমাদের সবার জানা প্রয়োজন। পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থরক্ষা করত এবং ভারতীয়দের প্রতি সাধারণভাবে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ ও প্রচার করত। এহেন ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ যা লিখেছিল, তাতে করে দ্বারকানাথের একটি অনালোচিত দিক ফুটে ওঠে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি আমি তুলে ধরতে চাই :

‘To describe Dwarkanath’s public charities would be to enumerate every charitable institutions in Calcutta… Nor must we forget that he has taken lead in every institution, those to Christian Missionaries perhaps excepted, which has been established with a view to the improvement of the country; that he has been foremost in promoting education, more especially is fostering the Medical College, by the bestowal of prizes on the most successful students. He has not only therefore given largely but wisely.’ শেষের লাইনটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো।

কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরি- যা এখন ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’ রূপে পরিচিত- প্রতিষ্ঠায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন দ্বারকানাথ। ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের দু’জন ছাত্রকে প্রতি বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষায় পাঠানো ও পড়ানোর সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনি বহন করেন। ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটিকে ১৮৩৮ সালের মূল্যে এক লাখ টাকা [দশ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং] দান করেন তিনি; এর কাজ ছিল দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সব অন্ধ-আঁতুড়দের সাহায্য করা।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৩. কলোনিয়াল এনকাউন্টার

প্যারিসে যে-ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে এসেছিলাম তার সঙ্গে কীভাবে যেন জড়িয়ে আছে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম। ১৮৪৪ সালে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে এই প্যারিসেই দেখা হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের। ম্যাক্সমুলার তখন প্যারিসে অবস্থান করছিলেন ঋজ্ঞ্বেদের পাণ্ডুলিপি ‘প্রস্তুত করার’ কাজে। স্মর্তব্য, ঋজ্ঞ্বেদের কোনো প্রকাশিত লিপি ছিল না এর আগে। যদিও হস্তাক্ষরে লিপিবদ্ধ বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি ছিল লন্ডন, বার্লিন ও প্যারিসে। সেসব থেকে সায়নের টীকা-ভাষ্যসহ একটি গ্রহণযোগ্য প্রকাশনার উদ্যোগ নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরই ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে নিয়োগ পান ম্যাক্সমুলার- প্রায় বিশ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি পুস্তকাকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ‘দ্য সেক্রেড বুকস্‌ অব দি ইস্ট’ শিরোনামে এই গ্রন্থমালা তারই পরিণতি। এর মধ্যে বেদের চার খণ্ড ও আঠাশটি উপনিষদ বিশেষভাবে ম্যাক্সমুলারের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত। এই কাজেরই সুবাদে তরুণ ম্যাক্সমুলার প্যারিসে গিয়েছিলেন ফরাসি প্রাচ্যবিদ অধ্যাপক বার্নফের (Burnof) বক্তৃতামালা শুনতে। কলেজ দ্য ফ্রান্স (College de France)-এ এই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন বার্নফ। এই সেই কলেজ দ্য ফ্রান্স, যেখানে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পড়াবেন আলথুসার, ফুকো ও দেরিদা। এখানে শুধু যোগ করি যে, প্রফেসর বার্নফের সঙ্গে দেখা করার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও। এবং বার্নফের সূত্রেই দ্বারকানাথের সঙ্গে পরিচিত হন ম্যাক্সমুলার। এ প্রসঙ্গে ম্যাক্সমুলার লিখেছেন :

“I was then attending Professor Burnouf’s lectures at the college de France, and as the Indian visitor had brought letters of introduction to that great French savant, I too was introduced to the Indian stranger, and soon came to know him well. He was the representative of one of the greatest and richest families in India.”

এই দ্বারকানাথ-ম্যাক্সমুলারের মধ্যকার প্যারিস-সাক্ষাৎকেই আমি বলছি ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’। কথাটা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের একটি লেখা থেকে ধার করা। যেটা তিনি লিখেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদের বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনির বিশ্নেষণ করতে গিয়ে। ১৮৪৪ সালের প্রায় সুদীর্ঘ ৫০ বছর পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথ সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তাকে উপনিবেশ শাসনের কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক ধরনের ‘কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ ছাড়া অন্য কোনো অভিধায় অভিহিত করার কথা আমার মনে আসেনি। এই সাক্ষাৎকারে বাদ-প্রতিবাদ, যোগ-অভিযোগ, দ্বন্দ্ব-মধুরতা, ঐক্য ও অনৈক্য সব উপাদানকেই শনাক্ত করা যায়। উপরে যেখানে ইংরেজিতে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে এটা স্পষ্ট যে, দেখা হচ্ছে দুই স্বগোত্রীয় বা সতীর্থের মধ্যে নয়; সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে দ্বারকানাথের ‘বিদেশি’ ভাবমূর্তি- ‘দি ইন্ডিয়ান স্ট্রেঞ্জার’ উপাধি। একে বহিরাগত বা আউটসাইডার হিসেবেও অনুবাদ করা চলে। ‘আমারই মতো, কিন্তু আমাদের কেউ নয়’- এটাই হচ্ছে ম্যাক্সমুলারের চোখে দ্বারকানাথের প্রাথমিক পরিচয়। যে-ভারতবর্ষকে নিয়ে ম্যাক্সমুলার আজীবন গবেষণা করেছেন সেই ভারতবর্ষের একজন শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধির মধ্যে নিজেরই ‘অপর’ দেখছেন ম্যাক্সমুলার। দ্বারকানাথ তার কাছে একাধারে নিকটজন ও অন্যজন। এই ‘অপরায়নের’ কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, কেননা আমরা একটু পরেই দেখব, বুদ্ধিবৃত্তিতে পণ্ডিতপ্রবর ম্যাক্সমুলারের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই দ্বারকানাথ। এই ‘অপরায়নের’ মূল কারণ আসলে দুই ব্যক্তিসত্তার মধ্যে ‘ঔপনিবেশিক’ শাসক-শাসিতের ব্যবধান।

দ্বারকানাথ ঠাকুর যে কত বিষয়ে গুণান্বিত ছিলেন তা ম্যাক্সমুলারের সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকেও ফুটে ওঠে। তার ব্যবসা-বাণিজ্যে ঈর্ষণীয় সাফল্যের কথা অন্যত্র সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’-এর ২য় খণ্ডে ‘বাঙ্গালী শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণীর ইতিহাস’ প্রবন্ধে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুরকে তার আমলের শীর্ষস্থানীয় ‘বুর্জোয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। তার নিয়ন্ত্রণাধীন বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠান, উত্থান ও পতনের কিছু বিশ্নেষণও সেখানে রয়েছে। এর একটি তাৎপর্য যে, রবীন্দ্রনাথকে যারা কেবল ‘জমিদার’ (সেই অর্থে সামন্তবাদী) রবীন্দ্রনাথ হিসেবে দেখতে চান, তারা ভুল করেন। রবীন্দ্রনাথের অভ্যুদয়ের পেছনে দ্বারকানাথের ‘বুর্জোয়া’ সত্তা সক্রিয় পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে। ঠাকুরবাড়ির মডার্নিটিকে বুঝতে গেলে দ্বারকানাথের জীবন ও চিন্তাভাবনাকে আমাদের সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করতে হবে। হয়তো নতুনভাবে তার মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু এখানে আমি দ্বারকানাথের অর্থনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত দিতে বসিনি। যারা উৎসাহী তারা কৃষ্ণ কৃপালিনীর ‘দ্বারকানাথ টেগোর : আ ফরগটেন পাইওনিয়ার’ এই প্রায়-বিস্মৃত বইটি দেখতে পারেন। প্যারিসে বসে ম্যাক্সমুলার দ্বারকানাথকে- তার কাছের কিন্তু দূরভুবনের ‘অপরকে’- কীভাবে দেখছেন তার প্রতিই আমি এখানে কেবল দৃষ্টি দেব।

পরস্পর মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে দু’জনের বয়সটাও আমলে আনা প্রয়োজন। ১৮৪৪ সালে দ্বারকানাথের বয়স ছিল ৫০, আর ম্যাক্সমুলারের ২৩। ফলে আলোচনাটি সমকক্ষ সমবয়সীদের মধ্যে হয়নি। তরুণ ম্যাক্সমুলারকে উপনিবেশের প্রতি পাশ্চাত্যের আচরণ বিষয়ে বেশ কিছু কথা- কিছুটা অনুযোগ, কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই- জানিয়েছেন দ্বারকানাথ। তার নিজের জীবনে ইউরোপকে যেমনভাবে চিনেছিলেন তারই নির্যাস ছিল সেসব তিরস্কারে। এই কথাবার্তার দু’বছরের মাথায় মৃত্যু হবে দ্বারকানাথের। ফলে শুধু কথার কথা নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে দ্বারকানাথের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার ‘সার-সংক্ষেপ’ হিসেবেও একে পড়া চলে।

প্রথমেই ম্যাক্সমুলার যেটা লক্ষ্য করছেন সেটা দ্বারকানাথের বিত্তবৈভব নয়- সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, সংগীত, সমসাময়িক ইউরোপীয় পত্রপত্রিকা ও রাজনীতির ওপরে তার বিস্ময়কর দখল। সংস্কৃতজ্ঞ ম্যাক্সমুলার বলেছেন, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ ছিলেন না ঠিক, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য-সম্ভার সম্পর্কে অপরিচিত ছিলেন না।’ প্যারিসের ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রান্স (Institute de France)- যাদের আমন্ত্রণে প্যারিসে যাই এবারে- সেখানকার অধ্যাপক বার্নফ সংস্কৃত ভাগবৎ-পুরাণের একটি চমকপ্রদ ফরাসি অনুবাদ করেছিলেন। সে বইটি বার্নফ দ্বারকানাথকে উপহার দেন। বইটির একদিকে ছিল মূল সংস্কৃত পাঠ, অন্যদিকে ফরাসিতে অনুবাদ। এর ফরাসি পাতার অংশে হাত বুলাতে বুলাতে দ্বারকানাথ বলেছিলেন, ‘আহ্‌, যদি আমি ভাষাটা আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারতাম।’ ম্যাক্সমুলার বলছেন যে সংস্কৃত ভাষা নয়, ‘আরও ভালোভাবে ফরাসি ভাষা জানার জন্য’ কতটা উৎসাহ ছিল তার। ম্যাক্সমুলার আরও লিখেছেন, তিনি প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে ‘স্কলার’ ছিলেন না বা ছিলেন না তার নিজের ধর্ম বা নিজের সাহিত্য যে-ভাষায় লেখা হয়েছে সে-সম্পর্কে মনোযোগী। কিন্তু যেইমাত্র অধ্যাপক বার্নফের থেকে তিনি শুনলেন যে ম্যাক্সমুলার বেদের পাণ্ডুলিপি সংকলন করছেন প্যারিসে বসেই, অমনি তার সব মনোযোগ গিয়ে পড়ল তরুণ গবেষকের প্রতি। প্যারিসে তিনি থাকতেন সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলে। সেখানে তাকে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাতেন দ্বারকানাথ। ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্পর্কে, এর আচার-প্রথা সম্পর্কে গল্প করতেন তিনি। এতে ম্যাক্সমুলারেরও লাভ হতো। স্বয়ং ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপের সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সেই সভায় আমন্ত্রিত সব অতিথিকে রাজকীয় শাল উপহার দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। পরাধীন ভারতবর্ষের মান-সম্মান রাখার জন্যই তিনি এটা করেছিলেন। মাসে ২০০ পাউন্ডের বেতন নিয়ে কাজ করা ম্যাক্সমুলারের কাছে (যে-বেতনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীও কাজ করত না তখন) দ্বারকানাথের বৈভবপূর্ণ সাহচর্য নিশ্চয়ই অভাবনীয় ছিল। কিন্তু বিত্তবৈভব নয়, দ্বারকানাথের অন্যবিধ গুণের পর্যালোচনাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ম্যাক্সমুলারের স্মৃতিচারণায়। তবু দ্বারকানাথের অভিজাত শ্রেণিতে পদচারণার একটি উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ম্যাক্সমুলার লিখছেন :

‘Darkanath Tagore lived in a truly magnificent Oriental style while at Paris. The king, Louis Philippe, received him, nay, he honoured him, if I remember right, by his presence and that of his Court at a grand evening party. The room was hung with Indian shawls, then the height of ambition of every French lady. And what was their delight when the Indian Prince placed a shawl on the shoulders of each lady as she left the room!

দু’জনার মধ্যে আলোচনা ভালোই চলছিল ভারতীয় সাহিত্য, ধর্ম, কৃষ্টি ও সভ্যতা নিয়ে। গোল বাধল সংগীতের ক্ষেত্রে। দ্বারকানাথ পাশ্চাত্য কবিতা ও সংগীতের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে ইতালীয় ও ফরাসি সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছিল তার। ম্যাক্সমুলার লিখেছেন, ‘আমি পিয়ানো বাজাতাম, আর তিনি গান শোনাতেন। আমি দেখলাম, তার শুধু ভালো গানের গলা আছে তা-ই নয়, এ বিষয়ে তিনি খুব প্রশিক্ষিতও। গানের বিষয়ে আমাদের সম্পর্কটা খুব জমে উঠেছিল। একবার তার ইতালীয় গানের অনুরুক্তি নিয়ে প্রশংসা করার পর আমি তাকে অনুরোধ করলাম একটা খাঁটি ভারতীয় সংগীত শোনাতে। তিনি যেটা গাইলেন সেটা আসলে ভারতীয় নয়, ফার্সি একটি গান, যার মধ্যে না আছে স্টাইল, না আছে কোনো চরিত্র।’ সম্ভবত তাকে কোনো রাগপ্রধান উত্তর ভারতীয় (হিন্দুস্তানি) সংগীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তরুণ ম্যাক্সমুলার তাতে নিরস্ত হবার নন। “আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, অন্য কোনো ‘প্রকৃত’ ভারতীয় সংগীত তিনি জানেন কিনা। উত্তরে তিনি হাসলেন এবং পাশ কাটানোর মতো বললেন, ‘ও তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।’ আমি তারপরও অনুরোধ করতে থাকলে তিনি পিয়ানোতে গিয়ে বসলেন, কিছুক্ষণ গুনগুন করার পর বাজাতে শুরু করলেন এবং গান করতে লাগলেন। সত্যি বলতে কি, আমি সেদিন কিছুটা হোঁচটই খেয়েছিলাম। যা শুনলাম তাতে আমি না- পেলাম কোনো সুর, না-কোনো তাল, না-কোনো ছন্দ। সে কথা তাকে বলাতে তিনি বারবার অস্বীকারমূলক মাথা নাড়তে লাগলেন।” প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার অনৈক্যের মূল কোথায় তা জানার জন্য ম্যাক্সমুলারকে দ্বারকানাথ ঠাকুর সেদিন যা বলেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। দ্বারকানাথ তরুণ সংস্কৃতজ্ঞ ও প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সমুলারকে যা বলেছিলেন তা এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইতে উদ্ধৃত হতে পারত। দ্বারকানাথের বক্তব্য ম্যাক্সমুলারের বয়ানেই শোনা যাক এবারে :

‘তোমরা সবাই একই রকম। কোনো কিছু ঠেকলে বা সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের প্রীত না করলে, তোমরা মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নাও। আমি যখন প্রথম ইতালীয় সংগীত শুনি, আমার কাছে সেটা কোনো সংগীত বলেই মনে হয়নি। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, চেষ্টা করে গেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা আমার ভালো লাগছে বা তোমরা যাকে বলো সমজদার হওয়া সেভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। এই যেটা বললাম সেটা অন্য সব কিছুর জন্যও খাটে। তোমরা বলো যে আমাদের ধর্ম কোনো ধর্মই নয়, আমাদের কবিতা কোনো কবিতাই নয়, আমাদের দর্শন কোনো দর্শনই নয়।

[ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

২. লোহানীর স্বীকৃতির প্রশ্ন

১৯৮৭ সালে ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যার জন্য লোহানীর ওপরে মতিউর রহমানের সঙ্গে মিলে আমি একটি পরিচিতিমূলক লেখা তৈরি করি। আশির দশকে বসে জানা সম্ভব ছিল না লোহানীর কোথায় এবং কীভাবে মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ মহাফেজখানার তরফে তখন যেটা জানানো হয়, সেটা হলো একটা ‘ওয়ান-ওয়ে টিকিট’ কেটে রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ২০০৩ সালে আলোকচিত্রী ডেভিড কিং ‘অর্ডিনারি সিটিজেনস :দ্য ভিকটিম অব স্টালিন’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। তিরিশের শুদ্ধি অভিযানের যুগে তৎকালীন সোভিয়েত পার্টির সদস্য এবং অসদস্য সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যারা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের নাম ও ছবি সংবলিত বই ছিল এটি। কিং-এর বইয়ের ১৩৫নং পাতায় হঠাৎই আবিস্কৃত হন লোহানী। যারা নেপথ্য কাহিনি জানেন না, তাদের পক্ষে বোঝা শক্ত যে, এই লোহানী আমাদেরই সিরাজগঞ্জের লোহানী। কেননা, সেখানেও তার পরিচিতি হিসেবে লেখা নিম্নরূপ :

‘১৮৯২ সালে ভারতে জন্ম। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।’

বিষণ্ণ সে পোর্ট্রেট। বোঝা যায় যে, এনকেভেদের (কেজিবির পূর্বসূরি) জেলে অত্যাচারের এক ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই যেন আর অবশিষ্ট নেই। এমনটাই লাগছে জিনোভিয়েভ-এর ছবিও। ১৯১৯ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত কমিনটার্নের চেয়ারম্যান জিনোভিয়েভ। স্টালিনের কীর্তির বিরুদ্ধাচরণের দায়ে তাকে ১৯২৭ সালে বহিস্কার করা হয়। ১৯৩৬ সালে শুদ্ধি অভিযানের প্রথম ধাপে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। ঠিক তারই দু’বছর পরে লোহানীর মৃত্যু হয়-ওই ফায়ারিং স্কোয়াডেই। জিনোভিয়েভ ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য- রাজনৈতিক মতপার্থক্য গুরুতর আকার ধারণ করেছিল ২০-এর দশকের শেষে। কিন্তু লোহানী তিরিশের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু তার মৃত্যু হলো কেন এমনভাবে? গোপেন চক্রবর্তীর মতো তিনিও তো অব্যাহতি পেয়ে যেতে পারতেন রুদ্ররোষ থেকে।

আমার অনুমান সেটা হয়নি দুই কারণে। প্রথমত, তিনি এমএন রায়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন একটা বড় সময় পর্যন্ত। ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব জাসেস’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এমএন রায়; কিন্তু প্যারিস থেকে সেটি প্রকাশ করার দায়িত্ব ছিল লোহানীরই ওপরে। প্যারিসের পাট গুটিয়ে এক সময় লোহানীকে চলে আসতে হয় মস্কোয়। ততদিনে এমএন রায়ের সঙ্গে সোভিয়েত পার্টির বিরোধ তুঙ্গে। বিশের দশকে চীনের প্রতি কমিনটার্নের নীতিনির্ধারণের নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিলেন রায়। এটা শেষ পর্যন্ত হটকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ট্রটক্সি-পন্থি ‘পারমানেন্ট রিভ্যুলিউশন’-র ধারার প্রতিও সহানুভূতি ছিল তার। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রটস্কি রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হন, প্রায় একই সময়ে এমএন রায়কেও কমিনটার্ন থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে ট্রটস্কি-এমএন রায়-লোহানী এমন একটি যোগসূত্র টানা বিচিত্র ছিল না এনকেভেদের গোয়েন্দাদের পক্ষে। বিশেষত ১৯৩৮ সালে এর দায়িত্ব যখন গিয়ে পড়ে ইয়েজভের ওপরে। ১৯৩৮-৪০ পর্বে ইয়েজভের হাতেই পরিচালিত হয় সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৩৪-৩৬ পর্বে ইয়াগোদার এনকেভেদে এবং ১৯৪০-৫৩ পর্বে বেরিয়া’র কেজিবির তুলনায় অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল ইয়েজভের এনকেভেদে। রুশ ভাষায় ইয়েজভের কাল বা ‘ইয়েজভশিনা’ নামে একটি প্রবাদবাক্যই চালু হয়ে গেছে নিষ্ঠুর শাসন বোঝাতে। ফলে এ সময়ে ট্রটস্কির বা এমএন রায়ের সঙ্গে কোনো প্রকার সুদূর বা নিকট সংশ্নিষ্টতাও লোহানীর জন্য চরম আশঙ্কার কারণ হতে পারত।

দ্বিতীয় একটি কারণও ক্রিয়াশীল ছিল। লোহানী ১৯২১ সালে মস্কোয় প্রথমবারের মতো আসার আগে বার্লিনে অবস্থান করছিলেন। বার্লিনে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি ‘গ্রুপ’ গড়ে উঠেছিল। বার্লিনে ১৯১৬-১৮ সাল থেকেই এরা জড়ো হতে থাকেন; তার কারণ- এখানে বিপ্লব-পরিস্থিতির সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের পর ইউরোপের সবচেয়ে সফল বিপ্লবের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বার্লিনে। এখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের সময় থেকেই। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের বেশিরভাগ নেতাই ছিলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ভেতরে বিপ্লব আশঙ্কা আরও তীব্র হতে থাকে। ‘স্পাটার্ক’ গ্রুপের নেতৃত্বে চলে আসেন কার্ল লিবক্‌নেখট, রোজা লুক্সেমবার্গ। এরা অক্টোবরের বিপ্লবের ধারায় ‘বিশ্ব-বিপ্লবকে’ সম্পন্ন করার স্বপ্ন দেখতেন। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি এ রকম একটি প্রায়-সফল অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কাইজারের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন কার্ল ও রোজা দু’জনেই। এই অভ্যুত্থানের পটভূমিকায় রচিত হয়েছে আলফ্রেড ডবলিনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বার্লিন আলেকজান্ডার প্লাজ’। বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাজ বা স্কয়ারের চারপাশে শ্রমজীবী মানুষের বসবাস (যেমন আমাদের একদার তেজগাঁও, টঙ্গী, ডেমরা বা হাল আমলের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল)। এই উপন্যাস কতটা মৌলিক ও চিত্তাকর্ষক তা বোঝানোর জন্য বলি যে, একে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তুলনা করেছেন জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের সঙ্গে; অন্যরা এর বর্ণনারীতির সঙ্গে প্রতিতুলনা করেছেন কাফকার বর্ণনারীতির। ২০০২ সালের এক জরিপে এই বইটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০টি বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (যা এখনও বাংলায় অনূদিত হয়নি)। এই আলেকজান্ডার প্লাজ-এর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের টানে লন্ডন ছেড়ে ১৯১৮ সালেই বার্লিনে চলে এসেছিলেন লোহানী। সেখানে এসে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের (সরোজিনী নাইডুর ভাই) বিপ্লবী গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৯ সালের কার্ল লিবক্‌নেখট ও রোজা লুক্সেমবুর্গের বিপ্লব-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এই জার্মান-গ্রুপ অন্যত্র সরে পড়তে বাধ্য হয়- প্রথমে প্যারিসে এবং পরে রাশিয়ায়। সেভাবেই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মস্কোয় আসেন লোহানী ১৯২১ সালে। তখনও তারা ‘কমিউনিস্ট’ হননি- তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল ব্রিটিশ-শাসন থেকে পরাধীন ভারতবর্ষকে মুক্ত করা। সে লক্ষ্যে নতুন রাশিয়ার সাহায্য কামনা করছিলেন তারা এবং সে কারণেই লেনিনের সঙ্গে তারা দেখা করতে চেয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভারতবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের একত্র করার জন্যই বার্লিন-কমিটির পত্তন হয়েছিল এবং বীরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বার্লিন গ্রুপ’ এ লক্ষ্যেই কাজ করছিল। ১৯২১ সালে লোহানী যখন মস্কোয়, তখন তিনি তিরিশের কোঠাও পার হননি।

বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘ক্যারিশম্যাটিক’ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ‘চ্যাট্টো’ নামে সবাই ডাকত তাকে। তিরিশের যুগে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর যাদেরই ‘জার্মান কানেকশন’ ছিল তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো রাশিয়ায়। কিরভের মৃত্যুর পর শুদ্ধি অভিযানের মাত্রা বেড়ে যায়। সর্বত্র জার্মান গুপ্তচর খুঁজতে থাকে এনকেভেদে। এরই ধারাবাহিকতায় বীরেন্দ্রনাথকে জার্মান গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তিনি ছিলেন একশো শতাংশ বিপ্লবী, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ‘লীগ এগেইনস্ট ইম্পেরিয়ালিজম’ আহূত ১৯২৭ সালের ব্রাসেলস কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন তিনি। যেখানে তরুণ নেহেরু অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩০-৩২-এর মধ্যে ‘ইনপ্রেকর’-এর পাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘অতি-বাম’ নীতির বিরুদ্ধে ২৮টির মতো প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন চীনের ভাবী প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কমিনটার্নের সেক্রেটারি-জেনারেল জর্জি ডিমিট্রভকে ১৯৩৫ সালে দুঃখ করে জানিয়ে ছিলেন যে, ‘কমিনটার্নের সক্রিয় কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’ তাকে। ত্রূক্রপস্কায়াকেও চিঠি লিখেছিলেন এই মর্মে। শেষের দিকে তার গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত। ক্লিমেন্স পাম ডাট (রজনী পাম ডাট-এর ভাই) লিখেছেন যে, চ্যাট্টোকে তিনি ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে লেনিনগ্রাদের একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর এথনোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে ‘শেষবার দেখেছিলেন’। এহেন বীরেন্দ্রনাথকে ১৯৩৭ সালের ১৫ জুলাই গ্রেপ্তার করা হলো ‘গণশত্রু’ অভিযোগে, কেননা তিনি জার্মানদের হয়ে ‘গুপ্তচর বৃত্তি করেছেন’। এই মিথ্যে অভিযোগে ১৯৩৭ সালের ৩১ আগস্ট মৃত্যু হলো তার ফায়ারিং স্কোয়াডে। সেই তালিকায় ছিলেন আরও ১৮৪ জন; এই নির্দেশে স্বাক্ষর করেন স্তালিন, মলোটভ, ভরশিলব, জদানভ ও কাগানোভিচ। চ্যাট্টো যখন চলে গেলেন, লোহানীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, তার ওপরেও এনকেভেদে-এর করাল ছায়া নেমে আসছে। যে কোনো অনুসন্ধানে চ্যাট্টোর কর্মকাণ্ডের ইতিহাস খুঁড়লেই লোহানীর নামও চলে আসবে। সে সময়ে লোহানীকেও নজরদারির মধ্যে থাকতে হতো। চ্যাট্টোকে কমিনটার্নের কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর লোহানীকেও ক্রমশ কমিনটার্নের বলয় থেকে সরিয়ে আনা হয়। তিনি কেবল মাঝে মাঝে অনুবাদের কাজ করতেন- ব্যাপারটা এই পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লোহানি গ্রেপ্তার হন ‘প্রতি-বিপ্লবী’ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। পাবনার সিরাজগঞ্জ থেকে মস্কোর লুবিয়ানকা জেল- এভাবেই নির্বাপিত হয় লোহানীর ৪৬ বছরের জীবন।

চ্যাট্টো মারা যাওয়ার প্রায় বিশ বছর পরে রাশিয়ায় সরকারি সফরে আসেন নেহেরু। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চান তিনি। কেজিবি মহলে (ততদিনে এনকেভেদে-র নতুন নাম কেজিবি) এই নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। তারই পরিণতিতে সোভিয়েত পার্টি স্বীকার করে নেয় যে, শুদ্ধি-অভিযানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন বীরেন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে অবনী মুখার্জীর নামও উঠে আসে। গুপ্তচরবৃত্তির সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ (Rehabilitation) করা হয় তাদের। কিন্তু সেই সনদপত্রে লোহানীর নাম ছিল না। পূর্ববঙ্গের লোহানীর কথা নেহেরুর কানে কেউ তোলেনি। শত শত অন্যায় মৃত্যুর মিছিলে লোহানীর নামও তখন সোভিয়েত নেতৃত্বের দৃষ্টি এড়িয়ে থাকবে। যদি স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী কখনও মস্কো সফরে যান, যদি তারা লোহানীর ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ চান, তবে তারা বর্তমান রাশিয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে লোহানীর বিষয়টি তুলতে পারেন। ঠিক যেমনভাবে ভিন্ন মতাদর্শের হয়েও নেহেরু ক্রুশেভের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুতিনের কাছে লোহানীর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন। তাহলে শুধু লোহানীর মরণোত্তর স্বীকৃতিই নয়, তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের দেখাও মিলতে পারে রাশিয়ার স্টেট হিস্টোরি আর্কাইভ থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় এটা আশা করাই যেতে পারে।

তবে বেসরকারিভাবে ‘মস্কো নিউজ’ একটি কাজ করেছিল। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে এটি প্রকাশিত হয়। সেখানে আরও কয়েকজন ভারতের বিপ্লবীদের সঙ্গে লোহানীর নামও উঠে আসে। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে তালাশ করতে গিয়ে রুশ ভাষার ইন্টারনেটে ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ (রাসত্রিয়েলনিয়ে স্পিসকি) পাই। এর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য, যেখানে লোহানী মস্কোর কোন সড়কের কোন বাড়িতে বাস করতেন এবং কোন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে সে তথ্যও দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫৭ সালেই তাকে ‘Rehabilitated’ করা হয়েছে সোভিয়েত রাষ্ট্রের তরফে- এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সংযোজন করা হয়েছে। তার মানে, সোভিয়েত বা রাশিয়ার সরকারের কাছে লোহানী তার সম্মান মরণোত্তরভাবে হলেও ফিরে পেয়েছেন। তাকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে বিস্মৃতির গর্ভ থেকে। শুধু আমাদের রাষ্ট্রের বা ইতিহাসের কাছেই তার যথাযথ পুনরুদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশের কাছে তিনি এখনও শুধু একটি নাম, শুধুই নাম। এখানে তিনি বিস্মৃতির অতলে ধূসর হয়ে আছেন অনাদরে-অবহেলায়। ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ থেকে পুরো উদ্ৃব্দতিটি অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি :

‘লুহানী গুলাম আম্বিয়া খান।

১৮৯২ সালে জন্ম, সিরাজগঞ্জ শহরে, রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির (বলসেভিক)-এর সদস্য; সোভিয়েত রেডিও-কমিটির অনুবাদক।

বাস করতেন :মস্কো বলশই ইওঝেনস্কি পেরুলক; হাউস ১৬/৬, ফ্ল্যাট ৩৬।

গ্রেপ্তার : ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।

অভিযুক্ত :১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর (‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউ. এস. এস. আর’ কর্তৃক অভিযুক্ত); অভিযোগ : গুপ্তচরবৃত্তি।

১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু।

কবর :মস্কো অঞ্চলের (অবলান্তের) ‘কম্যুনারকা’ গোরস্তান। ১৯৫৭ সালের ৯ জুলাই ‘রি-হেভিলিটেটেড’; ‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউএসএসআর-র আদেশ বলে।’

মানুষের জীবন এমনিতেই বিস্ময়কর। বিংশ শতকের বিপ্লবীদের জীবন আরও বিস্ময়কর। [ক্রমশ]

পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৮

লোহানীর প্যারিস

অধ্যাপক ফিলিপ বেনোয়া আমার প্রায় সমবয়েসী। কৃত্তিবাস রামায়ণ নিয়ে মৌলিক গবেষণা রয়েছে তার। যে রামায়ণকে আমরা ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ’ বলে জানি, তার কোনো মূল পাঠ কোথাও পাওয়া যায়নি। ষোড়শ শতকের এই বাঙালি মহাকবি সম্পর্কে প্রায় কিছুই আমরা জানি না বলতে গেলে। ব্রিটিশরা এ দেশে আসার পরে শ্রীরামপুরের ডেনিশ মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় কৃত্তিবাসের রামায়ণ। সেটিই বাংলায় প্রকাশিত প্রথম বই। শুধুমাত্র এ কারণেই কৃত্তিবাস সম্পর্কে আমাদের আরেকটু উৎসাহী হওয়া দরকার। ষোড়শ শতকের পরের দুইশ’ বছরে কৃত্তিবাসের রচনার বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে পাঠের তারতম্য দেখা যায়। বেনোয়া জানালেন যে, এগুলোর মধ্যে কোনটা ‘মূল’, সেটা প্রমাণ করা কঠিন। রামায়ণের আদি-স্রষ্টা বাল্মীকির মতোই বাংলায় রামায়ণের স্রষ্টা কৃত্তিবাসের জীবন আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে অদ্যাবধি। বেনোয়া বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃত্তিবাসের রামায়ণের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্নেষণ করেছেন। তাকে প্রশ্ন করি, ‘কাশিরাম দাস নিয়ে কি কোনো কাজ হয়েছে?’ বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশিরাম দাস সম্পর্কেও কোনো গবেষণা কাজ হয়নি এখন পর্যন্ত- বেনোয়ার স্পষ্ট উত্তর। বুঝলাম, কৃত্তিবাসের রামায়ণ বা কাশিরাম দাসের মহাভারত এখনও রূপকথার জগতের মতো আমাদের স্মৃতিতে বা শ্রুতিতেই রয়ে গেছে কেবল। এখানেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য। ভারতে হিন্দুত্ব নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে চলেছে। সেখানে হিন্দুত্ববাদীরা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মসীযুদ্ধ করছেন। কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করে চলেছেন পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা। সে নিয়েও আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অন্ত নেই। আমরা যত তাড়াতাড়ি এডোয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ পড়ে প্রাচ্যবিদদের কাজগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকি, তার সিকি ভাগ কষ্টও করতে চাই না নিজেদের সাহিত্য-ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে প্রাচ্যবিদদের মতো মৌলিক গবেষণা করার পেছনে। অধ্যাপক বেনোয়াকে দুই দশক ধরে সংস্কৃত পড়তে হয়েছে, তারপর তিনি ‘প্রাচ্যবিদ’ হয়েছেন। আমার মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, মধ্যযুগের বাংলা নিয়ে ভালো গবেষণা হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে দ্রুত। কেননা ‘এখনকার গবেষকেরা কেউ কষ্ট করে সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষা শিখতে শ্রম দিতে নারাজ।’

বেনোয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল প্যারিসে মেট্রো ‘বিবিলিওতেক নাসিওনাল’-এর কাছাকাছি একটি স্থানে। প্যারিসে এসে আমাকে জানতে হচ্ছে কৃত্তিবাস ও কাশিরাম দাসের কথা। এ ধরনের আলাপ তো ঢাকাতেও উত্তরার জসীম উদ্‌দীনের মোড়ে দাঁড়িয়ে হতে পারত। বেনোয়া শুধু কৃত্তিবাসই জানেন না, তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও খবর রাখেন। কথায় কথায় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কথা উঠল। বললাম, ‘রুদ্র আর আমি একই ক্লাসে একই কলেজে একই সময়ে পড়েছি। ও ছিল আর্টসের ছাত্র, আর আমি সায়েন্সে। ওর গোড়ার দিককার কবিতাগুলো লেখা হতো যখন, তখন থেকে আমার সঙ্গে পরিচয়। ‘তখন’ শব্দকে ‘তখোন’ করে লিখত। তাই নিয়ে সমালোচনা করতাম ওকে আমরা। নিজের কবিতা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা ছিল তার। তারপরও কবি হওয়ার জন্য মাঝ-দুপুরের রৌদ্রের ভেতরে সে ঝাঁকড়া চুল নিয়ে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে গেছে ঢাকার রাস্তায়।’ শুনে হাসলেন বেনোয়া। পরিস্কার বাংলায় বললেন, ‘রুদ্রর কবিতা আমি পড়েছি। ও খুবই শক্তিশালী কবি।’

সতেরো বছর পরে প্যারিসে আসা। এখানে বসেই মার্কস রচনা করেন তার ১৮৪৪ সালের ‘ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’, যা ‘প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’ হিসেবে ছাত্রাবস্থায় জেনেছিলাম। তরুণ মার্কসের ‘মানবতাবাদী’ রচনার সারসংক্ষেপ এখানে- এই প্যারিসে বসেই। এখানেই জন্ম নিয়েছে তার বিখ্যাত ‘এলিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতাবাদ বিষয়ক তত্ত্ব। জন স্টুয়ার্ট মিলের আগে এখানেই প্রথম তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতা’ বা ফ্রিডম সম্পর্কে ভাবনা-উদ্রেককারী ইস্তেহার। এই প্যারিস তরুণ মার্কসের যেমন, তেমনি মার্কসের প্রায় সমান বয়েসী কবি শার্ল বোদলেয়ারেরও। প্যারিস মানেই বোদলেয়ারের প্যারিস- তার বিখ্যাত রচনা ‘Paris Spleen’ এই শহরকে ঘিরেই। যারা আক্রান্ত- কবিতা দীর্ঘকাল পড়েননি, তাদের উচিত বোদলেয়ারের এই ৫০টি ছোট ছোট গদ্য-কবিতার সংকলন দিয়ে নিমগ্ন-পাঠ শুরু করা। তার মৃত্যুর দু’বছর পরে ১৮৬৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়। বোদলেয়ার ১৮৪৮ সালের বিপ্লব-প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেননি। কিন্তু এর জোরালো সমর্থক ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, প্যারিস যতই আধুনিক হয়ে উঠছে ততই সেখানে বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। এই উপলব্ধি সবচেয়ে তীব্রভাবে প্রকাশিত হয় তার Le Spleen de Paris বইটিতে। বইটির শিরোনামে ‘Spleen’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ প্লীহা, তবে অ্যানাটমির এই ‘অর্গানটি’ কবির আরাধ্য বিষয় নয়। ঝঢ়ষববহ শব্দটির অন্য একটি অর্থও রয়েছে। সেটি হলো- ‘কোনো আপতিক কারণ ছাড়াই বিষণ্ণতা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণাবোধ।’ আধুনিকতার পথে সৃষ্ট বৈষম্যকে সেভাবেই দেখেছেন বোদলেয়ার। এ বইয়ের একটি কবিতার নাম ‘Eyes of the Poor’। ঝকঝকে নতুন একটি কাব্যের দিকে তাকিয়ে আছে একটি দরিদ্র পরিবার। সেটা দেখে বাক্যের ভেতরে বসা কবি বিচলিত বোধ করছেন : ‘Not only was I moved by that family of eyes, but I felt a little ashamed of our glasses and decanters, larger than our thrist….’। এ রকম বৈষম্যের পরিবেশে সুস্থির থাকা, সুস্থ থাকা কঠিন। সে জন্যই বোদলেয়ার বলছেন, যেন নিজেকেই শুনিয়ে বলছেন, ‘তোমাকে সবসময় বুঁদ হয়ে থাকতে হবে… সময় তোমার কাঁধের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এবং তুমি ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছ নিচে, মাটির দিকে; তোমাকে বুঁদ হয়ে থাকতে হবে বিরতিহীনভাবে।’ এই বিচ্ছিন্নতাবোধ বা এলিয়েনেশন মার্কসীয়। যারা অন্য বোধের চর্চা করছেন, তাদেরকে মনে রাখতে হবে, মার্কসের ‘প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট’ আর বোদলেয়ারের ‘প্যারিস স্পিল্গন’ একই সময় ও মনোভূমি থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত।

যখন সতেরো বছর আগে প্যারিসে আসি OECD-র একটি ‘ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’-এর আলোচক হিসেবে, তখন আমার মাথায় ছিল মার্কসের প্যারিস ম্যানুস্ট্ক্রিপ্ট আর বোদলেয়ারের প্যারিস। আসার আগে অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খান (স্যার) বলে দিয়েছিলেন, Louvre দেখার আগে D’orsay মিউজিয়াম দেখে আসবেন। দু’দিন থাকছেন, সে কারণেই বলছি। D’orsay-তে সব ইম্প্রেশনিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকর্ম এক জায়গায় পেয়ে যাবেন।’ অধ্যাপক খান নিজে একজন চিত্রশিল্পী; ইমপ্রেশনিজম ধারার ছবি আঁকার নিরিবিলি চর্চা করে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে। তার কথামতো সেবার D’orsay মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। একটা পুরো বিকেল সেখানে কাটিয়েছি। পুরোনো একটি রেলস্টেশনকে কীভাবে কেবল উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে ‘মিউজিয়ামে’ রূপান্তর করে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যায়, তার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা এটি। সেবার তাতেই এতটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে Louvre ও তার মোনালিসা আমার অধরাই থেকে গিয়েছিল। তার পরও এতগুলো বছর বাদে প্যারিসে আসার পরে আমার প্রথমেই মনে পড়ল ফ্রান্সের ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা বিবিলিওতেক নাসিওনালের কথাই। আমার অবচেতন মনের ভেতরেও কোথাও এর সূত্র ছিল নিশ্চয়ই। সেদিন অধ্যাপক ফিলিপ বেনোয়ারের সঙ্গে কৃত্তিবাস বিষয়ক আলাপ করতে করতে তিনি হঠাৎ আমাকে দেখালেন লাইব্রেরিটি। ‘ঐ যে দেখছেন, আধখোলা বইয়ের মতো বিল্ডিং তিনটি, ওটাই ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরি।’ আর আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল গ্যাব্রিয়েলা লোহানীর চিঠিটির কথা।

গ্যাব্রিয়েলা লোহানী ১৯২৫ সালের দিকের একটি চিঠিতে পাবনায় তার শাশুড়িকে লিখছেন প্যারিস থেকে। যার মমার্থ হলো- ‘মাজু (লোহানী) খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে একটি বইয়ের ওপরে।’ বোঝা যাচ্ছে, গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী শুধু প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি; একটি ‘বই লেখার’ কাজেও ব্যাপৃত ছিলেন সে সময়ে। তার মানে, ১৯২৪-২৫ সালে প্যারিসে অবস্থানকালেই এই লেখা তিনি শুরু করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে যখন প্রথম গ্যাব্রিয়েলার চিঠিটি পড়ি, তখনই আমার মনে হয়েছিল, এই বইটি হয়তো প্রকাশিত হয়েছে পরে এবং হয়ে থাকলে তা হয়তো বিবিলিওতেক নাসিওনালের সংগ্রহশালায় পাওয়া যেতেও পারে। স্বয়ং এমএন রায় যার সম্পর্কে তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, বিভিন্ন ভাষাভাষী লোহানীর বুদ্ধি ছিল ‘তরোয়ালের মত ধারালো’। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লোহানীর জার্মান, ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা নিয়ে তার আত্মজৈবনিক রচনা ‘যাত্রী’তে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। এমএন রায় ধারণা করেছেন যে, ১৯২১ সালে লেনিনকে পাঠানো ‘থিসিস অন ন্যাশনাল অ্যান্ড কলোনিয়াল কোয়েশ্চেনস’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ‘বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, গোলাম আম্বিয়া লোহানী ও পাণ্ডুরাঙ্গ খানখোজে’ ত্রয়ীর নাম-সংবলিত হলেও আসলে রচনাটি লোহানীরই- ওদের মধ্যে আর কারও এটা লেখার ক্ষমতা ছিল না। গঙ্গাধর অধিকারী কর্তৃক নানা খণ্ডে সম্পাদিত ‘হিস্টরি অব কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া’ বইতে লোহানীর নানা উল্লেখ রয়েছে এবং তার বিভিন্ন ইংরেজি রচনা সেখানে সংকলিতও হয়েছে। যদিও রুশ, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় লেখা তার বিভিন্ন রচনা এখনও সংকলিত হওয়ার অপেক্ষায়। এই লোহানীর জন্ম বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। শিক্ষাগ্রহণ আলিগড়ে এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে; একাধারে মার্কস, মিল, লেনিন ও কেইনস্‌ বিভিন্ন স্কুলের রচনাবলির সঙ্গে তিনি ছিলেন পরিচিত, স্তালিনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৩৮ সালের এক দিনে বুখারিনের মতো ভিন্নমতাবলম্বী অন্য কমরেডদের সঙ্গে মৃত্যু হয় তার। আমাদের দেশের মুক্তি-সংগ্রামের স্মৃতি-মিউজিয়ামের অন্তত কোনো একটি কর্নারে, কোনো একটি পাদটিকায়, কোনো একটি ব্যানারে বা বইতে তার নাম থাকার কথা ছিল। তিনিই ছিলেন, কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদেরও আগে প্রথম বাঙালি মুসলিম কম্যুনিস্ট। এবং ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অনেক আগেই তত্ত্বে-তথ্যে-মননে জ্বলজ্বল করা এক নাম। যারা ১৯২৮ সালে কমিনটার্নের ষষ্ঠ কংগ্রেসে ডি-কলোনাইজেশন প্রশ্নে অটো কুমিনিন-লোহানীর বিতর্ক পড়েছেন (অধিকারীর বইতে তা যথাবিহিতভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে) তারাই এর পাণ্ডিত্যে বিস্মিত হবেন। লোহানীর নাম, তার জীবনী এবং প্রকাশিত/অপ্রকাশিত লেখার সংকলন আমাদের স্মৃতির আড়ালে থেকে যাবে- এটা সহজে মেনে নেওয়া যায় না। কোনো স্কুলের পাঠ্যবইতে তার নাম কখনও উচ্চারিত হবে না- এটাও অপ্রত্যাশিত। লোহানীর ফরাসি স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলা লোহানী জানিয়েছিলেন, প্যারিস থেকে ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব মাসেস’ সাময়িকীটি প্রকাশের পাশাপাশি তখন একটি ‘বইয়ের ওপরেও’ কাজ করছিলেন লোহানী। তার অদেখা শাশুড়ি মাকে মিথ্যে কথা কেন বলবেন তিনি? হয়তো প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে অথবা মস্কোর ইতিহাস বিষয়ক মহাফেজখানায় তার বইটির একদিন ঠিক খোঁজ মিলবে। ঠিক যেমন আবুল হাসান ‘এপিটাফ’-এ লিখেছিলেন, ‘একদিন আকাশ আলো মিলে যায়, মেলে’; তেমনভাবেই লোহানী আমাদের ইতিহাসে-সাহিত্যে হবেন একদিন স্বতঃপ্রকাশিত।

[ক্রমশ]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৭

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

৪. অন্যান্য প্রসঙ্গ

এদোয়ার্দো গালিয়েনো ঘণ্টাখানেক বলেছিলেন সেদিন ‘পলিটিক্স অ্যান্ড প্রোজ’-এর সন্ধ্যায়। আমার থেকে-থেকে চোখ চলে যাচ্ছিল গালিয়েনোর ঢেউ খেলানো সাদা পশমের মতো চুলের দিকে। ‘মিররস’-এর অনুকরণে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কিছু লেখার পরিকল্পনা তার রয়েছে কি-না জানার জন্য প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সেটা নিশ্চয়ই সম্ভব, কিন্তু আমার পড়াশোনা কম এই এলাকা নিয়ে।’ তারপর উল্টো আমাকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন- ‘তারচে’ বরং আপনি আগ্রহ নিয়ে করুন না কেন সেটা?’ পরে অবশ্য বুঝেছি যে, কথাটা নিতান্ত বিনয়ের সৌজন্য থেকেই বলা। এই ভূখণ্ড সম্পর্কে- এমনকি বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোই জানতেন তিনি। তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘হান্টার অব স্টোরিস’ বইতে হঠাৎ পেয়ে যাই বাংলাদেশের উল্লেখ :

‘২০১২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এক ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে ১১০ জন শ্রমিক মারা যায়। এ ধরনের ঘাম-ঝরানো কারখানাতে অধিকার বা নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরের বছরের এপ্রিলে দগ্ধ হয়ে মারা যায় আরও ১ হাজার ১২৭ জন শ্রমিক আরেকটি এমনই ঘাম ঝরানো ফ্যাক্টরিতে। ইতিহাসে যেসব দাসের কথা আমরা পড়তে পাই, এরাও তেমনি আধুনিক যুগের অদৃশ্য দাস। তাদের অস্তিত্বের মতোই তাদের বেতনও দৃশ্যমান নয়। যেমন নয় দৈনিক এক ডলারে বেঁচে থাকা। যেটা প্রকাশ্যে দেখা যায় তাহলো এদেরই হাতে তৈরি করা পোশাক-সামগ্রী, তাদের গায়ে সুদৃশ্য দামের ট্যাগ লাগানো, আর যেগুলো বিক্রি হচ্ছে ওয়ালমার্ট, জেসি পেনি, সিয়ার্স, বেনটেন, এইচ অ্যান্ড এম প্রভৃতি বিপণিবিতানে।’

নায়লা কবীর অবশ্য গালিয়েনোর ‘অদৃশ্য দাস’ বলার সাথে সহমত করবেন না। নায়লা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে দীর্ঘকাল ধরে পড়াচ্ছেন। বর্তমানে ফেমিনিস্ট ইকোনমিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের সভাপতিও তিনি। বাংলাদেশের এই সুযোগ্য সন্তান শুধু বাংলাদেশের নারীদের ওপরেই মৌলিক গবেষণা করেননি। নারীবাদী অর্থনীতি বা ফেমিনিস্ট ইকোনমিক্সের ওপরে তার গবেষণা কাজের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ও পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ইংরেজিতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারেন, তেমনি বলিষ্ঠ তার লেখনী। ২০০০ সালে নায়লা কবীর একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য পাওয়ার টু চুজ’ (Power to choose)। সেখানে তার মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল যে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নারী-শ্রমিকরা ফ্যাক্টরির পরিবেশে কাজ করার সুবাদে ‘ক্ষমতায়িত হয়ে উঠেছে- অন্তত সুদূর লন্ডনে ঘরে বসে কাজ করছে এমন বাঙালি নারী-শ্রমিকদের তুলনায়। অর্থনৈতিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ- বিশেষত ঘরের বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর বিচরণ- তার জীবনমানের উন্নতি ও তাকে ‘ক্ষমতাবান’ করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; এটিই ছিল নায়লার মূল তর্ক। গালিয়েনো অবশ্য লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতার সাক্ষী, তিনি হয়তো নায়লাকে বলতেন, ‘অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নারীকে ক্ষমতাবান করে ঠিকই, কিন্তু সবই নির্ভর করছে তার দর-কষাকষির ক্ষমতার ওপরে।’ এ দেশের পোশাক-শিল্পের নারীরা এখনও সেই ক্ষমতা পুরোপুরি অর্জন করেননি তাদের ‘দেশি মালিক’ আর ‘বিদেশি ক্রেতাদের’ সঙ্গে দর-কষাকষি করার ক্ষেত্রে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরে বিদেশি ক্রেতারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স ইনিশিয়েটিভের। এতে ইমারত সুরক্ষা, অগ্নিনির্বাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা শুভ পরিবর্তন আসলেও নারী পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সামান্যই বেড়েছে। শ্রমবহির্ভূত কাজের পরিবেশেও খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।

গালিয়েনো নিজের জীবনের টুকরো-টাকরা স্মৃতি নিয়ে কিছু খণ্ডদৃশ্য লিখেছেন। তার ‘মেমরি অব ফায়ার’ বইটির শেষ খণ্ডে সামরিক শাসিত উরুগুয়ের ‘কনিষ্ঠতম রাজনৈতিক বন্দি’ সম্পর্কে একটি এন্ট্রি রয়েছে। সে ছিল পাঁচ বছরের একটি মেয়ে, তার অপরাধ ছিল একটাই :তার নাম রাখা হয়েছিল ‘মাইলাই’। ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে মার্কিন সেনা দল মাইলাই নামে গোটা একটা গ্রামকেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উরুগুয়েতে তখন চলছে প্রবল সামরিক শাসন। মাইলাই নাম উচ্চারণও তখন অপরাধ। আর সেখানে কিনা জলজ্যান্ত একটি মেয়ে- হোক না সে পাঁচ বছরের মেয়ে; এই নাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (বা পার্কে-মাঠে-কিন্ডারগার্টেনে দাপটের সঙ্গে হেসেখেলে দিন কাটাচ্ছে)। গালিয়েনো লিখেছেন যে, বইটি বেরুনোর পর অনেক বাবা-মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। তারাও তাদের নবজাতকের নাম ‘মাইলাই’ রাখতে চান। কিন্তু প্রশাসন তাতে বাগড়া দিচ্ছে। এমনকি ১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার এক মা তাকে লিখেছেন, ‘আমার মেয়েকে এখনও নথিবদ্ধ করা যায়নি।’ জন্ম ও মৃত্যুর রেজিস্ট্রি করা এখন এ দেশেও বাধ্যতামূলক। লাতিন আমেরিকায় তা আগেই চালু হয়েছিল আমাদের দেশের তুলনায়। আন-ডকুমেন্টেড থেকে গেছে তার মেয়ে অদ্যাবধি- এই ছিল পাঠিকার অভিযোগ। এসব দেশে নাম তালিকাভুক্ত করাতে গেলে সমস্যা অনেক। কোনো সেইন্টের নাম নিতে চাইলে কাজটা সহজ হয়ে যেত। কিন্তু মাইলাই তো সে রকম কোনো নাম নয়। একে পাওয়া যাবে না অভিধানে, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রির ইতোমধ্যে তালিকাবদ্ধ নামের সারিতেও এর দেখা মিলবে না। মাইলাই-এর কোনো অধিকার নেই কার্যত নিজেকে মাইলাই বলে ডাকার।

একবার চিলির সালভাদর আয়েন্দের সঙ্গে সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল গালিয়েনোর। নিজ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এক রক্তাক্ত ক্যু-তে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিহত হন আয়েন্দে। সেটাই বলতে গেলে প্রথম ‘নয়-এগারো’। এই ক্যুর পেছনে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের সরাসরি প্ররোচনা ছিল। যা হোক, গালিয়েনো যে ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন তা এর বেশ কিছুকাল আগে, তখনও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। তখন ছিল শীতের সময়। চিলির দক্ষিণের প্রদেশ পুন্টা আরেনাতে সবে বরফ পড়তে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে বাইরের তুলার মতো বরফ নেমে আসার দৃশ্য দেখতে দেখতে আয়েন্দে তার নির্বাচনী বক্তৃতার একটি খসড়া দেখালেন গালিয়েনোকে। আগামীকালই একটি বক্তৃতা দিতে হবে তাকে। বক্তৃতা যথারীতি হলো। কিন্তু গালিয়েনো খেয়াল করলেন যে, আয়েন্দের বক্তৃতায় কী করে যেন একটি নতুন লাইন ঢুকে গেছে। যেটা গতকাল রাতে পড়া খসড়ার মধ্যে ছিল না। সমবেত জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি শুনতে পেলেন আয়েন্দে বলছেন :’যেসব ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন, সেসবের জন্যে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে অর্থ রয়েছে।’ এটা কি ছিল কোনো অনিচ্ছাকৃত ভবিষ্যদ্বাণী, কে জানে!

লোর্কা নিয়েও একাধিক গল্প বলেছেন তিনি। ফ্রাংকোর স্পেনে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কার মৃত্যুর পর অনেককাল তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি। তার জনপ্রিয় নাটকগুলো নিষিদ্ধ ছিল। লোর্কার মৃত্যুর বহু বছর পরে- ফ্রাংকো তখনও জীবিত- উরুগুয়ের এক নাট্য দল গেল মাদ্রিদে। সাহস করে লোর্কার একটি নাটক মঞ্চস্থ করল তারা। নাটকের শেষে চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী কোনো হাততালি শোনা গেল না। দর্শক সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে পা দিয়ে মেঝের ওপরে এক সাথে শব্দ করতে লাগল অনেকক্ষণ। নাটকের কুশীলবরা প্রথমে বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে। এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছে দর্শকরা! তাদের অভিনয় কলাকৌশল কি সেরূপ হয়নি? তাহলে এমন ধরনের ব্যবহার কেন দর্শকদের? বহু দিন পরে কুশীলবদের একজন এদোয়ার্দো গালিয়েনোকে বুঝিয়েছিলেন যে, পা দিয়ে শব্দ কেন তুলেছিলেন মাদ্রিদের দর্শকরা? তারা লোর্কার জন্য সেই শব্দ তুলে হল প্রকম্পিত করেছিলেন সেদিন। লোর্কা, যাকে কেবল বামেদের সমর্থক এবং বৃত্তের বাইরের মানুষ হওয়ার অভিযোগে অযথা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাকে বলেছিলেন দর্শকরা- ‘ফেদেরিকো, দ্যাখো, তুমি এখনও আমাদের মধ্যে কীভাবে বেঁচে আছ।’ এই গল্পটা গালিয়েনো বর্ণনা করছিলেন মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে। সেদিনের সন্ধ্যায় গালিয়েনোর বক্তৃতা পাঠ শেষে অবাক করা কাণ্ড ঘটল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অনুষ্ঠানে সমবেত ছয় হাজার মানুষের পায়ের শব্দে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠেছিল। তারাও বলতে চেয়েছিল- ‘গালিয়েনো, তুমি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছ।’

[এই বিষয় সমাপ্ত]

এদোয়ার্দো গালিয়েনোর স্মৃতি (Memoirs of Eduardo Galeano)

পর্ব ::৩৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

স্বৈরশাসকদের নিয়ে এদোয়ার্দো গালিয়েনোর অতি-উৎসাহের কারণ দ্বি-বিধ। প্রথম কারণটি ব্যক্তিগত। তিনি ছিলেন বামপন্থি সাংবাদিক ও লেখক। যে বছর আয়েন্দের চিলিতে পিনোশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, সে বছরই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয় উরুগুয়ে নামক দেশটিতে। গালিয়েনোর জন্মভূূমি উরুগুয়েতে, সেখানেই ‘মিছিল’ বা ‘মার্চ’ [স্পেনীয় ভাষায় Marcha] পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তার খ্যাতি লাভ। এই পত্রিকায় মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতো লেখকরা নিয়মিত লিখতেন। যা হোক, উরুগুয়েতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে গালিয়েনোকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছাড়া পেয়ে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যেতে হয় তাকে। সেখানে উদ্বাস্তু জীবনের মধ্যেই ‘ক্রাইসিস’ নামে একটি বামধারার পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিন বছর না যেতেই ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনাতেও একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ডানপন্থি এই ক্যুর নেতৃত্ব দেন লে. জেনারেল ভিদেলা। ইসাবেলা পেরন-এর সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল ভিদেলা ক্ষমতায় আসেন। কথিত আছে, এই ক্যুর পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার আর্জেন্টিনার সামরিক নেতৃত্বের সাথে বেশ কয়েক বার ‘মিটিং’ করেন এবং বলেন, তাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ‘নিষ্ফ্ক্রিয় করে দেওয়া’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরোধী দলনের অভিযোগ ওঠার আগেভাগেই এ কাজটি সেরে ফেলার পরামর্শ দেন কিসিঞ্জার। এ রকম পরিস্থিতিতে আবারও দেশ ছাড়তে হয় গালিয়েনোকে। এবার তিনি পাড়ি জমান স্পেনের উদ্দেশে। এই স্পেনে বসেই তিনি লেখেন তার বিখ্যাত ট্রিলজি ‘মেমোরি অব ফায়ার’- বহ্ন্যুৎসবের স্মৃতি। আমাদের এখানে হলে হয়তো আমরা বলতাম ‘আগুন-জলের গল্প’। কেবল ১৯৮৫ সালেই গালিয়েনো ফিরতে পারেন নিজের দেশে, উরুগুয়ের রাজধানী মন্তেভিদিয়োতে। গণতন্ত্র সবে ফিরতে শুরু করেছে সেখানে। এই সেই দেশ, যেখানে কোনো মানবিক অধিকারে রীতি-নীতি মানা হয়নি। উরুগুয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদককে হেলিকপ্টারের সাথে বেঁধে এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এ রকম শুনেছি। কিন্তু গালিয়েনোর কাছে উরুগুয়ে নয়, সমগ্র লাতিন মহাদেশের পর্যায়ক্রমিক সামরিক স্বৈরশাসনের অভ্যুদয়ই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং এ কারণেই তার লেখা পত্রে স্বৈরশাসকদের প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়।

কিন্তু এর পেছনে দ্বিতীয় কারণও ছিল। যদি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা তার না-ও থাকত, তাহলেও এদোয়ার্দো গালিয়েনো সম্ভবত এভাবেই লিখতেন বা ভাবতেন। দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রবল উপস্থিতির পেছনে অনেকটি কারণ কাজ করে থাকবে। এই মহাদেশে প্রথমে কলোনিয়াল অভিযান চালায় স্পেনীয়রা (এবং পর্তুগিজরা)। মায়া, ইনকা, আজটেক প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতা অধ্যুষিত মহাদেশকে স্বর্ণখনির লোভে পদানত করার জন্য সামরিক অভিযান চালায় তারা। স্থানীয় অধিবাসীদের রাজত্বগুলো ছলে-বলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গালিয়েনো নানা অনু-গল্পে এই গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ও কাহিনী লিখেছেন। ১৫৩৩ সালে স্পেনীয় কনকুইস্তাদর বা বিজয়-পিপাসু ফ্রান্সিসকো পিসারো পেরু অধিকার করে নেন। এই যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালের ইউরোপ থেকে ‘আমদানি করা’ মহামারিতে নিহত হয় পেরুর ৯০ শতাংশ স্থানীয় জনসাধারণ, যাদের অধিকাংশই ছিল ইনকা সম্প্রদায়ভুক্ত। ইনকাদের সম্রাট আতাহুয়ালপাকে [Atahualpa] নির্মমভাবে খুন করা হয়। গালিয়েনো এই শঠতাপূর্ণ বিজয় নিয়ে লিখেছেন, আর সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে- এই পেরুর ইনকাদের থেকে ইউরোপ এবং এক পর্যায়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে আলুর চাষ। আজকে যাকে ‘মেডিকেল মারিজুয়ানা’ হিসেবে প্রচার করা হয়, তারও আদিভূমি পেরুতে।

লাতিন আমেরিকায় এই আদিম, বর্বরতম ঔপনিবেশিক অভিযানের স্মৃতি গালিয়েনো ভুলে দিতে চাননি। এর সাথে তিনি সংযুক্ত করেন পরবর্তীকালের (উনিশ-বিশ শতকের) ‘অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিস্তার। তখন আর উপনিবেশবাদ শুধু স্বর্ণখনির লোভে সীমিত নেই।

৩. সাম্রাজ্য :প্রেম নাকি প্রতারণা?

‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল’ প্রবন্ধে মার্কস এ রকম মন্তব্য করেছিলেন যে, এই শাসনের ফলে যেমন ভারতবাসীর ওপরে দুর্গতি নেমে এসেছে, তেমনি এর প্রতিক্রিয়ায় এর আবদ্ধ নিশ্চলা জীবনে সূচিত হচ্ছে প্রগতির ধারা। প্রত্যন্ত উপনিবেশে পাশ্চাত্য-আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে, ভেঙে পড়ছে তার চিরাচরিত পেছনে-টানা মূল্যবোধের প্রাচ্যীয় জগৎ। যিনি ধ্বংস করেন, তিনিই আবার সৃষ্টি করছেন। উপনিবেশে ব্রিটিশ শাসনের এই দ্বিবিধ ফলাফল যুগপৎ বিনাশী ও সৃষ্টিশীল, একাধারে ধ্বংসাত্মক ও কল্যাণকামী ভূমিকা সম্পর্কে মার্কসের মূল্যায়ন নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। এ প্রশ্নে এসে এদোয়ার্দো গালিয়েনো মার্কসকেও ছেড়ে কথা বলতেন না। মার্কস যদি বলে থাকেন যে, এযাবৎকালের ইতিহাস মূলত শ্রেণিযুদ্ধের ইতিহাস; তাহলে গালিয়েনো ভাবতেন, এযাবৎকালের ইতিহাস মূলত এক জাতির তরফে অন্য জাতির ওপর অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখানোর ইতিহাস। সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা-বলয়ের বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে। এখানে প্রেম নেই; থাকলেও তা সাময়িক; অপ্রেমই এখানে মূল সুর; প্রতারণাই এখানে চরম পরিণাম। এ জন্যই অনেকটা আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে গালিয়েনো সাম্রাজ্যের শঠতার কাহিনী একের পর এক লিখে গেছেন। এক পর্যায়ে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে বাংলার ওপরে। এই ঔপনিবেশিক গল্পের শুরু ইংলন্ডে আর শেষ ঢাকায়।

মুক্ত বাণিজ্য নামক এক রূপকথার জন্ম কীভাবে ইংলন্ডে জন্ম নিল; প্রথমে সে বয়ান করেছেন গালিয়েনো। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা প্রথম জেমস ও প্রথম চার্লসের শাসনামলে ব্রিটেনের ‘শিশু-শিল্প’কে রক্ষার জন্য নানাবিধ সংরক্ষণমূলক নীতি হাতে নেয় ইংরেজ সরকার। তারা কাঁচামাল হিসেবে পশম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়; বিলাসবহুল পোশাক তৈরিতেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বস্ত্রের ব্যবহার অপরিহার্য এ নিয়ম করে; ফ্রান্স ও হল্যান্ডের মতো দেশ থেকে শিল্পপণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের আগেও অর্থনৈতিক চিন্তা ছিল, কিন্তু তা ছিল মূলত সংরক্ষণমূলক [যাকে বলে ‘প্রোটেকশনিস্ট’] নীতিকে ঘিরে। এ রকমই একজন চিন্তক ছিলেন সপ্তদশ শতকের শুরুতে ‘রবিনসন ক্রুসো’র রচয়িতা ড্যানিয়েল ডেফো। গল্পের বই ছাড়াও অর্থনীতির নানা বিষয়ে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। এরই একটিতে তিনি বলেন, ব্রিটিশ টেক্সটাইল শিল্পকে গতিশীল করার জন্য ইংরেজ সরকারের ‘সংরক্ষণমূলক’ নীতি খুবই কার্যকর ছিল। ইংরেজ রাজারা ‘শুল্ক্কের দেয়াল’ নির্মাণ না করলে এবং স্থানীয় শিল্পকে উপযুক্ত কর-প্রণোদনা না দিলে এই শিল্পের বিকাশ সম্ভবপর ছিল না। এই বিকাশ এতটাই ত্বরান্বিত হয়েছে যে আগামী দিনে বিশ্বের প্রতিটি দেশ বা উপনিবেশ ‘ব্রিটিশ পণ্যের ওপরেই নির্ভরশীল থাকবে।’ ডেফোর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক ছিল বলতে হয়। কেননা, পরবর্তী দুশো বছর ধরে ব্রিটেন যা করে বড় হয়েছে, তারই উল্টোটা প্রয়োগ করেছে সে অন্যদের প্রতি। অবস্থানিরপেক্ষভাবে প্রচার করেছে ‘অবাধ বাণিজ্য’-এর জয়গান। জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিখ লিস্ট এটা দেখে বলেছিলেন, ‘উপরে উঠিয়ে মইটা ফেলে দিয়েছে ইংরেজরা।’ রাতের বেলায় যখন গরিব দেশগুলোর ঘুম হয় না, তখন ধনী দেশের মন্ত্রণাদাতারা মুক্ত বাণিজ্যের রূপকথা শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে থাকে।

এই রূপকথাই অন্য রকম শোনায় ঔপনিবেশিক বাংলার পটভূমিতে। গালিয়েনো লিখেছেন যে, বাংলা থেকে সুতি ও রেশমি কাপড় আমদানিতে প্রথমদিকে অতি-উচ্চ হারে শুল্ক্ক বসানো হতো। ১৬৮৫ সাল থেকে এই শুল্ক্ক বসানো হতে থাকে, এক পর্যায়ে কাপড় আমদানি প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয়। এত বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও ইংলন্ডে শিল্প-বিপ্লব শুরু হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত-বাংলার বস্ত্রশিল্প বেঁচে ছিল। ম্যানচেস্টার থেকে বস্ত্র যখন বাংলায় আসত, তখন তাতে কিন্তু আমদানি শুল্ক্ক বসানো হয়নি। কারণ ততদিনে ফ্রি-মার্কেটের তত্ত্ব রুলিং আইডিওলজি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনে। গুণগত মান ভালো থাকার জন্যে এবং স্বল্প উৎপাদন মূল্যের কারণে অসম প্রতিযোগিতার ভেতরেও অনেক দিন টিকে ছিল বাংলার বস্ত্র উৎপাদকরা। উনিশ শতকের গোড়াতে যখন ওদের ওপরে এক বিষম করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখনই কেবল ওরা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এই বি-শিল্পায়নের পরিবেশে ম্যানচেস্টারের টেক্সটাইল শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বাংলার বাজার ও ঘরে ঢুকতে থাকে। ঢাকার ওপরে এই অসম প্রতিযোগিতার ফল হয়েছিল মারাত্মক। গালিয়েনো লিখেছেন :

‘প্রবাদপ্রতিম লর্ড ক্লাইভ যে ঢাকাকে [সমৃদ্ধি-ঐশ্বর্য] লন্ডন ও ম্যানচেস্টার শহরের সাথে তুলনা করতেন, সেই শহরটি এই পর্যায়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে। পাঁচজনের মধ্যে চারজনই শহর ছেড়ে চলে যায়। তারপরও বাংলার শিল্প খাতের কেন্দ্র ছিল ঢাকা, তবে তা বস্ত্রশিল্পের জন্য নয়; আফিম উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই আফিমের অতিরিক্ত সেবন করতে গিয়েই এক সময় মৃত্যু হয় ক্লাইভের।’

অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী নিয়ে আরো অনেক গল্প আছে গালিয়েনোর ঝুলিতে। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’ বইটিকে তিনি উপনিবেশ-অভিযানের ন্যারেটিভ হিসেবে পাঠ করেছেন। এর লেখক জোনাথান সুইফট্‌-এর মনে কী ছিল, তা জানা যায় না। তবে অনেক সময় তাকে মনে হয় আসলে তিনি একজন ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ লেখক; উপনিবেশবাদবিরোধী চিন্তাবিদ। ‘গালিভার’স ট্রাভেলস’এ-র সর্বশেষ পরিচ্ছেদে কীভাবে কিছু বর্বর জলদস্যুর হাতে স্থানীয় অধিবাসীরা পরাজিত হলো এবং নেটিভদের দেশকে এক অবাধ লুণ্ঠণক্ষেত্র তথা উপনিবেশে পরিণত করা হলো, তার প্রায় পরাবাস্তববাদী বর্ণনা রয়েছে। মূলের বর্ণনাটি এতই তীক্ষষ্ট ও মর্মভেদী যে অনুবাদে তা হারিয়ে যাক সেটা আমি চাই না :

A crew of pirates goes on shore to rob and plunder, they see a harmless people, are entertained with kindness; they give the country a new name; they take formal possession of it for their king; they set up a rotten plank, or a stone, for a memorial.
Here commences a new dominion, acquired with a title by divine right. Natives are driven out or destroyed; their princes tortured to discover their gold; a free license given to all acts of inhumanity and lust, the earth reeking with the blood of its inhabitants : and this execrable crew of butchers, employed in so pious an expedition, is a modern colony, sent to convert and civilize an idolatrous and barbarous people!

সন্দেহ কি, জোনাথান সুইফটকে এক সময় ‘উন্মাদ’ বলে অভিহিত করা হবে খোদ ব্রিটেনে।

[ক্রমশ]