বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত বাধা অপসারণের জন্য তারা বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্র বা লিবারেল ডেমোক্রেসির গণ্ডি ছাড়িয়ে এক র‌্যাডিকেল ধারার গণতন্ত্রের (Radical Democracy) জন্ম দিচ্ছেন। একেই বঙ্গবন্ধু অভিহিত করেছিলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলে। পরবর্তী অধ্যায়ে- বাকশালের আলোচনায়, এ নিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে উৎক্রমণের আরও কিছু উদাহরণ ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে।
যে যুক্তির বলে ভারতে ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনকে নাকচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাকে তিক্ত অভিজ্ঞতা বলেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম- সেটি ৪৭নং অনুচ্ছেদের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারত। বিদেশে বসে পরিত্যক্ত শিল্পকারখানার অবাঙালি মালিকেরা দিন গুনছিলেন কবে তারা বাংলাদেশে এসে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি পেশ করবেন ভারতীয় রায়ের যুক্তি দেখিয়ে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা এই বিপদের সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই বিপদ শুধু অবাঙালি মালিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দেশি শিল্প-মালিকদের নিয়েও উৎকণ্ঠার কারণ ছিল। এর একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাই ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণায়। তিনি লিখেছেন:’১৯৭৩ সালের শেষের দিকে মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করি। তখন জাতীয়করণকৃত জুটমিলগুলোতে সাবেক মালিকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সাবেক মালিকরা ১৮টি মিলের যাবতীয় অর্থ একই দিনে উঠিয়ে মিলগুলো দেউলিয়া করার উদ্যোগ নেন। পূর্ব রাতে এ সংবাদ নিয়ে ফরাসউদ্দিন (বঙ্গবন্ধুর পিএস এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর)-এর সাথে দেখা করে তাকে ঘটনা খুলে বলি। তিনি ডিসিকে টেলিফোন করে, ঐ সকল জুটমিলের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ব্যবস্থা করেন।’ এতে করে অ্যান্টি-ন্যাশনালাইজেশন লবির অপতৎপরতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সন্দেহ কী, এসব ঝুঁকি এড়াতেই সেদিন ৪৭নং অনুচ্ছেদের সংযোজন করতে হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে।
ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন সম্পর্কিত ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ নিয়ে আরও কিছু তথ্য যোগ করা দরকার এখানে। জাস্টিস হেদায়েতুল্লাহর ভূমিকা সম্পর্কে সৈয়দ নজরুল সেদিন যা বলেছিলেন তার সবটাই সত্য নয়। আসলে যা হয়েছিল তা ঘটনা প্রবাহের কাছাকাছি- কিন্তু খানিকটা অন্যরকম। ১৯৬৯ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ইস্তফা দিলেন। এর দু’দিনের মাথায় ঘোষিত হলো ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশনের নীতি। এই নীতির ঘোষণা পেয়ে তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জাস্টিস মো. হেদায়েতুল্লাহ (তিনি ততদিনে প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন) পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর ঠিক দু’দিন আগে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। এই অর্ডিন্যান্সে জাতীয়করণের ফলে গৃহীত ব্যাংকসমূহের মালিকদের ‘পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার প্রভিশন রাখা ছিল না। এই অধ্যাদেশকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ব্যাংক অব বরোদার মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার রুস্তম কুপার সাহেব সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করেন। এর ওপরে ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘কুপার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া :ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন কেইস’ মর্মে এক ঐতিহাসিক রায় হয়। ১১ জন বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় প্রদানে অংশগ্রহণ করেন এবং ১০ :১ রায়ে তারা অধ্যাদেশটি বহাল রাখেন। কিন্তু বহাল রাখলেও তারা কতকগুলো মন্তব্য করেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে কিছু জরুরি পরিবর্তন আনতে হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানে। যেমন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কুপারের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়নি এ কথা বলা হলেও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল যে সাধারণভাবে ‘ ‘It was not binding upon the Supreme court to reject the claim for enforcement of a shareholder’s fundamental rights, if in the process of violaton of his rights, the rights of his company were also being violated.’ ভারতীয় সংবিধানে বহুদিন পর্যন্ত জরমযঃ : Right to Property-কে 19(1)(F) ) ধারা অনুসারে ‘মৌলিক অধিকার-র অন্তর্ভুক্ত করা ছিল। পরবর্তীকালে বিশেষ করে ‘কেশবানন্দ ভারতীর’ রায়ের পরে- এই ধারাটিকে বাদ দিতে হয় ভারতীয় সংবিধান থেকে। একইভাবে আগে Article 31 অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু তা করতে গেলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হতো যার কাছ থেকে সম্পদ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তাকে। সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করেন যে, যার সম্পত্তি গ্রহণ করা হচ্ছে তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। এখানে ‘কোম্পানিকে’ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, আর ভারতীয় সম্পত্তি আইন বলে ‘কোম্পানি’ কোনো নাগরিক নয়, এবং সেহেতু কোম্পানির কোনো প্রচলিত নাগরিক অধিকার এ ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়নি। এর অর্থ- অন্য কোনো ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি জাতীয়করণ করার প্রশ্ন দেখা দেয়, তবে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কাজ বলে পরিগণিত হবে। এসব আশঙ্কা এড়ানোর জন্য ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায় থেকে 19(1)(F) ধারা বাদ দেওয়া হয়। এরকম আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয় সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে। এটাকেই ড. কামাল হোসেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের ‘তিক্ত অভিজ্ঞতা’ বলেছেন, এবং এ লক্ষ্যে বাহাত্তরের সংবিধানে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৪২(১) ধারা রেখেও ৪২(২) ধারা সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং আলাদা করে গুরুত্ব সহকারে ৪৭নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়।
ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন রায়ের সময় ভারতের সরকার পক্ষ থেকে এ যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, এ রকম জাতীয়করণ চাইলে রাষ্ট্র করতেই পারে, কেননা ‘There was an obligation upon the state to achieve a socialistic society with principles of egelitarianism’। যদিও ভারতীয় সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি যুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে, এর পরিস্কার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের ভুবনেশ্বর কংগ্রেসে। সেই কংগ্রেসে ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সোশ্যালিজম’ নামে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তৎকালীন কংগ্রেস পার্টি। তার পর থেকেই এর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্তি দেখা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার যুক্তিটি তেমন গুরুত্ব পায়নি, বরং যুক্তি দেওয়া হয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে সম্পত্তির অধিকারকে সংরক্ষণ করার প্রতি। ‘উদ্দেশ্য’ (Objective)-র বদলে জোর দেওয়া হয়েছিল ‘পরিণাম’  (Effect)-র প্রতি : ‘The court struck down the ‘object’ test and laid down the ‘effect’ test. The effect test would now look into the effect of any particular legislative Act, rather than looking at the objective with which it had been formulated. Thes, if any Act of the legislature, even at a remote stage, violated the Fundamental Rights of the citizens, then, it was liable to be struck down.’ বাংলাদেশেও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ এ রকমটাই ভেবেছেন- শুধু একটি মাত্র ক্ষেত্রকে তারা ব্যতিক্রমের তালিকায় রেখেছেন। সমাজতন্ত্রের নির্মাণের জন্য তারা প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এরকম বিষয়টি ‘মৌলিক অধিকারের’ অধ্যায়ে ৪২(২) এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে, ভারতীয় সংবিধানও 19(1)(F) এবং Article 31 বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পথই অনুসরণ করেছে। এই প্রেক্ষিতেই ড. কামাল হোসেন তার ৩০ অক্টোবরের ভাষণে বলেছিলেন ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা :
‘মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনি নিশ্চয় জানেন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের ইতিহাস। যখন তারা জমিদারি আইন সংশোধন করতে যান, তখন সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট সেটাকে নাকচ করে দেন। তারপর, তাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বলবৎ করতে হয়। … যখন ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছিল, তখনও সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দেন। … তারপর ২৬ নম্বর সংশোধনীতে এসে তারা মোটামুটি বলে দিয়েছেন যে, সংসদ আইন করে সেখানে মূলনীতি ঘোষণা করে দিতে পারবেন। মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্য এটা করা হয়েছে। এটা আদালতের বিবেচনার বাইরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের একটা সুবিধা হয়েছে এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পঁচিশ বছর পরে ভারতকে যেটা সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে করতে হয়েছে, আমরা সেটা এখনই সঙ্গে সঙ্গে করে নিতে পেরেছি।’
এখানে বলা দরকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-র কথা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সংবিধানে রয়েছে। ভারতে ১৯৬৩ সালের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘reasonable restrictions on the exercise of the right’  বিষয়টিকে আরও জোরদার করা হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটাকে আরও বেশি করে মূলনীতি সমতাবাদী লক্ষ্যের অধীনস্থ করা হয়। এই সংশোধনী বলে কোন কিছু যদি ‘egalitarian social order’ -এর মূলনীতির পরিপন্থী হয় তবে তা বাতিলযোগ্য হবে। দেশজ রাজ্যসমূহের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকে যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে এই বলে যে, এ ধরনের স্বাধীন রাজ্য ব্যবস্থা- : the concept of rulershi-সমতাবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় :’The concept of rulership, with privy purses and special privileges unrelated to any current functions and social purposes, is incompatible with an egalitarian social order’, এবং সে কারণে এসব বাড়তি সুবিধাভোগের অধিকার- তা ‘ব্যক্তিগত অধিকার’ বলে আগে ভাবা হলেও এখন থেকে প্রত্যাহূত হলো। ভারতীয় সংবিধানের এই অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল সংবিধান প্রণেতাদের কাছে। বোঝাই যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যক্তি স্বাধীনতার ডিসকোর্সের ভেতরে আবদ্ধ ছিলেন না বা থাকতে চাননি। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা সমাজতান্ত্রিক তথা সমতাবাদী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। এ দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তাদের পক্ষপাতিত্ব ছিল সমাজতন্ত্রের প্রতিই। তাজউদ্দীন আহমদও ড. কামালের মতোই- এমনকি আরও এগিয়ে গিয়ে ভেবেছেন। এজন্যই তার ৩০ অক্টোবরের বক্তৃতাতে উঠে এসেছে ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা :
‘আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্কারভাবে সমাজতন্ত্র কী, তা বলে দিয়েছে … সেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি আমরা করতে যাচ্ছি, যা এই সংবিধানে রয়েছে। … সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এই রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিকে আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা, যাতে … মৌলিক অধিকার … এতে অন্তরায় সৃষ্টি না করে। যারা প্রগতিবাদী বলে দাবি করেন, তারা সমালোচনা করছেন এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নয় বলে। আমি জানি না, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, সে পরিকল্পনা কেউ যদি দিতে পারতেন, তাহলে এই পরিষদ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন।’
এই চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেন সংবিধানের লিবার্টি প্রিন্সিপাল ও সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে একত্রিত করে ছুড়ে দিয়েছেন আরও একটি চ্যালেঞ্জ। তবে সেটা গণতন্ত্রীদের প্রতি :
‘সমাজতন্ত্রের পথে যাতে কোনোরূপ অন্তরায় সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা আমরা ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে করেছি। যুক্তিসংগত বাধানিষেধ করে মৌলিক অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর চেয়ে কম সীমাবদ্ধতা পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংবিধানে আছে বলে আমি জানি না। যদি কেউ আমাদের দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা উপকৃত হব। কেবল দুই-একটা ক্ষেত্রে দাঁড়ি-কমার কমবেশি হতে পারে। বাধানিষেধ ছাড়া কোনো দেশে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়নি, হতে পারে না।’
এ-ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ এ দুই মৌলিক মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্যতা অর্জনের ও তা গতিশীলভাবে রক্ষা করে অগ্রসর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। বাহাত্তরের সংবিধানের ঠিক এক বছর আগে দার্শনিক জন রাউলস ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন তার দিকনির্দেশকারী বই- ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’। ন্যায়ানুগ ও গরিবমুখিন সমাজের ন্যায়বাদী তত্ত্ব রচনার সময় তিনি লিবার্টি প্রিন্সিপালকে সোশ্যাল জাস্টিস তথা বণ্টনগত ন্যায় (Distributive Justice)-র প্রিন্সিপলের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৮০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য যদি দরকার হয়, গণভোটে যারা প্রতিনিধি হয়ে আসবেন, তারা আইন করে ব্যক্তি সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে পারবেন। কেনো বাধা নাই। এ জন্য রক্তক্ষয়ের দরকার নাই। বিপ্লবের দরকার নাই।… বিভিন্ন দেশে সেই সব দেশের লোকদের নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, জিডিআর, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা বলছিলাম। যে কোনো সম্পত্তি, যে কোনো পদার্থ-স্থাবর অস্থাবর যাই হোক না কেন, নেওয়া যাবে। এর চেয়ে বেশি কী করা যেতে পারে? যা চীন করেনি, রাশিয়া করেনি, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ করেনি, আমরা তা করেছি। কাজেই জনাব স্পিকার সাহেব, সমাজতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, এ কথা অত্যন্ত অমূলক। বিচার করলে সে কথা মেনে নিতে পারি না। আগেও আবেদন করেছি, আপনার মাধ্যমে আবার আবেদন করব যে, তারা [বামপন্থিরা] অযথা মানুষের মনে আশা জাগিয়ে তুলবেন না। যেটা দিতে পারবেন না, যেটা সম্ভব নয়, সেটা নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। তাতে লাভ নাই।’
আছাদুজ্জামান খানের বক্তব্যে ৪২ নং অনুচ্ছেদের কথা এসেছিল ৪৭ নং অনুচ্ছেদের পাশাপাশি। ৪২নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে ৪৭ নং অনুচ্ছেদের আংশিক বিরোধ আছে। ৪২ নং অনুচ্ছেদে যে অধিকার প্রদত্ত হয়েছে, ৪৭নং অনুচ্ছেদে সেই অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এমনকি ৪২ নং অনুচ্ছেদের ১ নং দফায় যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, এর ২ নং দফায় তাকে আবার যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের মোড়কে বাঁধা হয়েছে। যেমন ৪২ (১) ধারায় নাগরিককে ‘সম্পত্তির অধিকার’ দেওয়া হয়েছে এভাবে :’আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।’ এর পরপরই বলা হয়েছে যে, ৪২ (১) দফার অধীনে প্রণীত আইনে দেশের স্বার্থে ‘ক্ষতিপূরণসহ বা বিনা ক্ষতিপূরণে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখলের বিধান করা হইবে।’ কিন্তু ‘অনুরূপ কোন আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান করা হয় নাই বলিয়া কিংবা ক্ষতিপূরণের বিধান অপর্যাপ্ত হইয়াছে বলিয়া সেই আইন সম্পর্কে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
এই র‌্যাডিকেল সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, যদিও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবের কথা বলেছেন আছাদুজ্জামান খান, ৪২ (২) ধারায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না এই বিধান রেখে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির অধিগ্রহণের বিষয়টিকে অত্যন্ত র‌্যাডিকেল এক চেহারা দেওয়া হয়েছে। এরকম অধিগ্রহণ অক্টোবর বিপ্লবোত্তর রাশিয়া বা চীনে পুঁজিবাদী সম্পত্তির বিনা শর্তে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা  expropriation-র সঙ্গে তুলনীয়। এই আইনের পেছনে প্রচ্ছন্ন পলিটিক্যাল ইকনোমি কারণ ছিল। যেসব অবাঙালি মালিক ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর তাদের কল-কারখানা ফেলে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, যাওয়ার আগে তারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সব টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিদেশে থেকে তারা পাঁয়তারা করছিলেন সময়-সুযোগ বুঝে দেশের আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার, যাতে করে তারা তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন কল-কারখানাগুলো ফেরত পেতে পারেন, অথবা তারা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। সদ্য-স্বাধীন সরকারকে এই আশঙ্কা বিচলিত করেছিল। সেজন্যেই ৪২ (২) ধারার র‌্যাডিকেল অবতারণা এবং ৪৭ অনুচ্ছেদের সংযুক্তি বেশি করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সেদিন।
আগেই বলেছি, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে অধিকার দেওয়া হয়েছে ৪২(১) অনুচ্ছেদে। কিন্তু সেখানে ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ শর্তটি আরোপিত হয়েছিল। এই শব্দবন্ধের আরোপ করা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল সেদিনের গণপরিষদে। যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে এতে করে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের গণতন্ত্রের অংশটুকু ক্ষুণ্ণ হতে পারে। যেমন মো. আবদুল আজিজ চৌধুরী (সিলেট-২১) একটি সার্বিক মন্তব্য রাখেন এ প্রেক্ষিতে :
‘জনাব স্পিকার, এই সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ হতে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বিধানগুলোতে মানবিক মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে; কিন্তু সেই সঙ্গে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ-সংক্রান্ত শর্তাবলি সংযোজনের ফলে ভয় হয় যে, যে কোনো কথার বিরুদ্ধে, যে কোনো বক্তব্যের বিরুদ্ধে সরকার যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’
এই সাধারণ আশঙ্কার প্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন তার ৩০ শে অক্টোবর, ১৯৭২-এর ভাষণে যা বলেছিলেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং পূর্ণ উদ্ধৃতি দেওয়ার দাবি করে :
‘[বিভিন্ন] দেশের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বিধান পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে এসেছি, সেটা হল, কোন কোন দেশে দুইটা ‘অ্যাপ্রোচ’ লক্ষ্য করা যায়। একটা হল, আইন-সাপেক্ষ মৌলিক অধিকার-যেমন পূর্ব জার্মানি এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে রয়েছে যে, এ ব্যাপারে সংসদের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। সেখানে আইনের দ্বারা সবকিছু নির্ধারিত হতে পারবে। কোনো কিছুর ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ করা যাবে আইনের দ্বারা।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানবাধিকারের ঘোষণা। যেসব দেশে এই ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব দেশেও আইন-পরিষদের ক্ষমতা আছে আইন করার। কিন্তু কোন রকম যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করার এখতিয়ার একমাত্র আদালতের। কোন বাধানিষেধ যুক্তিসংগত হল কিনা, সেটা বিচার করবেন আদালত। এটার দ্বারা কিন্তু মৌলিক অধিকারের পূর্ণ রক্ষা হয়।’
এই দুটো ধারার মধ্যে ২য় ধারাটি বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে, কেননা ২য় ধারার মধ্যেই গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রক্ষাকবচ নিহিত। ১ম ধারাটিতে সংসদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়- যার ফলে ইচ্ছে করলে সংসদ অধিকার ও স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে, যেটাকে আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা যায় না। পক্ষান্তরে ২য় ধারাটিতে সংসদ ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করে’ ঠিকই, কিন্তু সেটা ‘যুক্তিসংগত হল কি হল না, সেটা বিচার করার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। এই অধিকার সুস্পষ্ট, সুনিশ্চিত। সংসদ এটা খর্ব করতে পারবেন না।’
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য ড. কামাল সেদিন সংবিধান শাস্ত্র থেকে ইংরেজিতে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলেন। সেটি শুনে নেওয়া দরকার।
‘The power to impose limitations may be looked at from another angle, which presents two possibilities. The first is that the legislature is given general, unrestricted Power to limit rights and freedom : they are simply made subject to the laws.  Such a formula depicts the right and freedoms of any higher safeguard, and renders them valueless.
The second possibility is that the legislature is empowered to limit the rights and freedoms only for certain clearly defined purposes : they are made subject to the laws in certain specified respects only. The universal declaration uses this formula; it permits limitations on rights and freedoms for the protection of four community interests. These interests are : (1) due recognition and respect for the rights and freedoms of others; (2) meeting the just requirements of (a) morality, (b) public order, and (c) the general welfare in a democratic society.’

এই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি অনুসরণ করলে- ড. কামালের মতে- ‘মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি রক্ষাব্যবস্থা দেওয়া সম্ভব হয় না।’ আর বাংলাদেশ তথা বাহাত্তরের সংবিধান সেই দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করেছে :সংসদ মৌলিক অধিকার দেওয়ার বেলায়-কোনো কোনো ক্ষেত্রে- ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করার বিধান রেখেছে বটে, কিন্তু তা যুক্তিসংগত হল কি হল না, সেটা বিচার করার এখতিয়ার কেবল সুপ্রীম কোর্টের।’ সেই এখতিয়ারে হাত দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই সংসদের। প্রায় প্রত্যেক অধিকারের ক্ষেত্রে এই বিধান করা হয়েছে (অবশ্য এ ক্ষেত্রে ড. কামালের একটি প্রধান অনুমান ছিল যে, সুপ্রীম কোর্ট হবে সংসদ ও সরকারী প্রশাসনের থেকে সম্পূর্ণ মাত্রায় হস্তক্ষেপমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান)। প্রত্যেক অধিকারের ক্ষেত্রে করা হয়েছে কেবল মাত্র ৪৭নং অনুচ্ছেদ ছাড়া। এই ৪৭নং অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে ড. কামাল বললেন :
“একটি মাত্র যে ব্যতিক্রম করেছি, সেটি হলো সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে। ‘আইন-সাপেক্ষে’ এবং ‘যুক্তিসংগত’ কথাটা সেখানে নেই। অন্য সবগুলির ব্যাপারে আমরা ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ রেখেছি। এটা করা হয়েছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সামনে রেখে। যাতে একটা ফর্মুলা বের করা যায়, তার একটা রূপরেখা আমরা দিয়েছি এই সংবিধানে। প্রত্যেক মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ থাকল কি থাকল না, তা নিয়ে তর্ক করার কোনই অবকাশ নেই। কারণ, সেটা আদালত দেখবেন। তবে সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে সংসদকে সার্বভৌম অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনসভা যা নির্ধারণ করে দেবেন, সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে আদালতের কোন এখতিয়ার থাকবে না। জাতীয়করণের প্রয়োজনে সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে এটা করতে হয়েছে। অন্যান্য দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করেছি।”
কী সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা যার জন্য ৪৭নং অনুচ্ছেদের মতো রক্ষাকবচ করতে হল? এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৯ অক্টোবরের ভাষণে। ১৯৬৯ সালে জাতীয়করণ করতে গিয়ে ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন : ‘যেদিন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ব্যাংক, ইনসিওরেন্স জাতীয়করণ করার জন্য আইন পাস করেছিল, সেদিন ভারতের সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিস জনাব হেদায়েতুল্লাহ তাকে নাকচ করেছিলেন এই বলে যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের প্রশ্নের এটা বিরোধী। সেজন্য আমাদের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ অত্যন্ত সজাগ এবং সচেতন ছিলেন বলে এই শাসনতন্ত্রের তৃতীয়ভাগে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং মৌলিক আদর্শের প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত করার আদর্শকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৪টি প্রাইভেট ব্যাংকের ‘জাতীয়করণ’ করেছিলেন। এই ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে সমগ্র ব্যাংক খাতের ৮০-৮৫ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত। এ নিয়ে মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া যায় জয়রাম রমেশের  ‘Intertwined lives : P.N. Haksar and Indira Gandhi’
বইতে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম পূর্বে উল্লেখিত ৪৭ অনুচ্ছেদের উপ-দফাগুলো কেন সংযোজিত হয়েছে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেদিন :
‘রাষ্ট্রের মূলনীতির একটা হল সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হয় এবং মৌলিক অধিকার যাতে এর পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য অত্যন্ত দূরদৃষ্টি নিয়ে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ ৪৭ অনুচ্ছেদের (১) দফার সঙ্গে (ক), (খ), (গ), (ঙ) ও (চ) উপ-দফাগুলোকে এখানে সংযোজিত করছেন।’
অর্থাৎ, ‘লিবার্টি প্রিন্সিপল’ এবং ‘সোশ্যাল জাস্টিস প্রিন্সিপলের’ সঙ্গে কখনও সংঘর্ষ বাধলে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জাস্টিস প্রিন্সিপলকে। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণার মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ দুটি ধারণাই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মধ্যে-যেমন বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে-কখনও বিরোধ দেখা দিলে প্রায়োরিটি পাবে সমাজতন্ত্রই। যেমন পেয়েছিল ৪৭ অনুচ্ছেদ-ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপরে মালিকানার মৌলিক অধিকারের গণ্ডিকে বা দাবিকে প্রয়োজনে অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই ‘র‌্যাডিকেল’ দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা করে উল্লেখ করার মতো। বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান প্রণেতাগণ সাধারণ নির্বাচনী ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্রের কথা বলছেন না।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ৭৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


নিজস্ব উদ্যোগে বা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপরে ব্যক্তিগত অধিকারের স্বীকৃতি এবং সাধারণভাবে সম্পত্তির অধিকারে স্বীকৃতি লিবারেটারিয়ান ও অন্যবিধ ‘বুর্জোয়া’ গণতান্ত্রিক ধারার চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি মৌলিক ও সার্বিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যায়। এই ধারা পুঁজিবাদের উন্মেষ পর্ব থেকে আজ পর্যন্ত চলছে। এ জন্যই পুঁজিবাদকে ব্যক্তিমালিকানানির্ভর বাজার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। সম্পত্তির অধিকার শুধু উৎপাদনের উপায় (Means of Production)-এর ক্ষেত্রেই প্রসারিত হয়নি, কোনো কোনো দেশে ও কালে তা ব্যক্তি ও সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রেই প্রসারের চেষ্টা চলেছে। মার্কিন সংবিধানের সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ট অনুসারে  ‘Right to carry guns’ একটি স্বীকৃত ধারণা, যদিও বিতর্কিত ধারণা ও মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত। মিশিগান প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে ডানপন্থি লিবারটারিয়ানরা সম্পত্তির ওপরে অধিকারের যুক্তিতে ইচ্ছেমতো প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরার অধিকার রক্ষায় সাংঘাতিকভাবে সোচ্চার (এই বিশেষ ক্ষেত্রে তালিবানদের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো)। সন্দেহ কী আমাদের দেশেও সেই সুদূর বাহাত্তর সালেই ‘সম্পত্তির অধিকার’কে একপ্রকার ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে অবশ্য পালনীয় এক নীতি হিসেবেই দেখা হবে। অন্তত এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। স্বাধীন প্রকাশভঙ্গি, বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, পেশা-বৃত্তি বা বাছাইয়ের ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ স্বাধীনতা যেমন গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করা তেমনি গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনীতি পরিচালনা করার জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ- এরকম যুক্তি দেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না, বাস্তবে বাহাত্তরের সংবিধান সে পথে এগোলো না। সম্পত্তির পূর্ণ অধিকারে বাদ সাধল ৪৭নং অনুচ্ছেদ। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বা ব্যক্তিমালিকানা সম্পর্কিত ‘বুর্জোয়া’ বা লিবারটারিয়ান অধিকার সে যে নামেই তাকে অভিহিত করি না কেন, সেখানে নিরঙ্কুশ থাকল না। ৪৭নং অনুচ্ছেদ নিয়ে সে জন্যই তুলকালাম বিতর্ক হলো বাহাত্তরের গণপরিষদে (এটি এবং পরবর্তীতে আলোচ্য ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়েই সবচেয়ে বেশি তীব্র বিতর্ক হয়েছিল সেদিন)।
কী বলেছিল ৪৭নং অনুচ্ছেদ? এতে লেখা ছিল যে, রাষ্ট্রের চার মূলনীতি কার্যকর করার জন্য সংসদ প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারেও হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এই হস্তক্ষেপের ধারাটি সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদ ‘মৌলিক অধিকার’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। অর্থাৎ এটিকে কেবল সংসদেই পরিবর্তন করা যাবে- কোনো সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে এই বিধান চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। লিবারটারিয়ানরা যদি ‘মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে’ এই যুক্তিতে সম্পত্তির স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করতে চান- আর দশটা ‘হিউম্যান রাইটস’ জাতীয় বিষয়ের মতো সেটি আইনত গ্রাহ্য করা হবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা বা অন্য কোনো ব্যক্তি অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহের কোনো একটিকে (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রকে) সমুন্নত করার স্বার্থে রাষ্ট্র যদি সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ করাকে আবশ্যিক মনে করে, তবে তাকে কোনো বিচারালয়ের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। এ জন্যেই ৪৭নং অনুচ্ছেদের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজনে জারিকৃত কোনো আইন ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে বর্ণিত কোনো গণতান্ত্রিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে বলেই তা বাতিলযোগ্য বলে গণ্য করা হবে না। আইনি ভাষায় বক্তব্যটি এভাবে পেশ করা হয়েছে : ‘সংসদ যদি স্পষ্টরূপে ঘোষণা করেন যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র-পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোনো একটিকে কার্যকর করিবার জন্য অনুরূপ বিধান করা হইল, তাহা হইলে অনুরূপ আইন এইভাগে নিশ্চয়কৃত কোনো অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য কিংবা অনুরূপ অধিকার পূরণ বা খর্ব করিতেছে, এই কারণে বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে না।’
অর্থাৎ চার মূলনীতিকে রক্ষা করার জন্য সংসদ দেশের প্রচলিত আইনে যে কোনো সংশোধনী আনতে পারবে এবং সেই সংশোধনকৃত আইনকে কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য বিচার বিভাগে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সেটা যদি গণতান্ত্রিক অধিকার বা বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ও, তাহলেও সেটা চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে থাকবে। কী সেই বিশেষ ক্ষেত্র যেখানে লিবার্টি প্রিন্সিপলকে মান্য করা হবে না দেশের চার মূল স্তম্ভকে কার্যকর করার জন্য? এর মধ্যে রয়েছে মূলত শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারবার প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তিগত মালিকানার ((Private Property) ক্ষেত্রে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের তরফে হস্তক্ষেপের অধিকার। ৪৭নং ধারায় ক্ষেত্রগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্র তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে। গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আমি নিচে উপধারাগুলোকে হুবহু তুলে দিচ্ছি :
‘(ক) কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখল কিংবা সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা;
(খ) বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ উদ্যোগসম্পন্ন একাধিক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক সংযুক্তকরণ;
(গ) অনুরূপ যে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপক, এজেন্ট ও কর্মচারীদের অধিকার এবং (যে কোনো প্রকারের) শেয়ার ও স্টকের মালিকদের ভোটাধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ;
(ঘ) খনিজদ্রব্য বা খনিজ তৈল-অনুসন্ধান বা লাভের অধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ;
(ঙ) অন্যান্য ব্যক্তিকে অংশত বা সম্পূর্ণত পরিহার করিয়া সরকার কর্তৃক বা সরকারের নিজস্ব, নিয়ন্ত্রণাধীন বা ব্যবস্থাপনাধীন কোন সংস্থা কর্তৃক যে কোন কারবার, ব্যবসায়, শিল্প বা কর্মবিভাগ-চালনা, অথবা
(চ) যে কোন সম্পত্তির স্বত্ব কিংবা পেশা, বৃত্তি, কারবার বা ব্যবসায়-সংক্রান্ত যে কোনো অধিকার কিংবা কোন সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোন বাণিজ্যিক বা শিল্পগত উদ্যোগের মালিক বা কর্মচারীদের অধিকার বিলোপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ।’
এসব খাতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য আরও বলা হয়েছে যে, এসব বিধান (বা তার সংশোধনী) ‘পূর্ণভাবে বলবৎ ও কার্যকর হইতে থাকিবে এবং অনুরূপ যে কোনো আইনের কোনো বিধান কিংবা অনুরূপ কোনো আইনের কর্তৃত্বে যাহা করা হইয়াছে বা করা হয় নাই, তাহা এই সংবিধানের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না।’ অবশ্য সংসদ আগামীতে ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের এসব বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে- এই বিধানও সেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও যোগ করা হয়েছিল যে, সম্পত্তির অধিকারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের আইনে বিধি অথবা বিধানে কোনো সংশোধনী আনতে হলে ‘সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূ্যন দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে গৃহীত না হইলে সম্মতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।’ অর্থাৎ সেটা বিল আকারে আইনি অনুমোদনের পর্যায়ে যেতে পারবে না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) সম্পত্তির ওপরে মালিকানা-অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধানে এবং হস্তক্ষেপ করার এই রাষ্ট্রীয় অধিকারকে আইনি ও সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছিল। এক কথায় বললে, ‘লিবার্টি প্রিন্সিপলের’ ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল ‘সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে’। রাষ্ট্রের মূলনীতি রক্ষার প্রয়োজনে ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকারের ‘বুর্জোয়া-গণ্ডি’কে সংকুচিত করা হয়েছিল ইচ্ছে করেই। লিবারটারিয়ানদের মানব-স্বাধীনতার (Human Freedom) বা ব্যক্তিস্বাধীনতার (ersonal Freedom) যুক্তিকে সেদিন শিরোধার্য করা হয়নি মালিকানা সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনে মালিকানা সম্পর্কে রদবদল করা যাবে- এই মৌলিক সমতাবাদী চিন্তা থেকে (কোনো কোনো মহলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও) টলানো যায়নি বঙ্গবন্ধুকে এবং তার নিকটতম সহকর্মীদের, যারা সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিলেন পূর্বাপর। লিবারটারিয়ান মানব স্বাধীনতার যুক্তিকেই শুধু অগ্রাহ্য করা হয়নি, যারা সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সামষ্টিক ইউটিলিটির সম্প্রসারণ দেখেন, সেইসব উপযোগিতাবাদী বা ইউটিলিটারিয়ান আর্গুমেন্টকেও চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা। এ জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসংবলিত সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১০ম অনুচ্ছেদে শ্রীবৃদ্ধি (Affluence, Opulence বা Growth) নয়, শ্রীবৃদ্ধির ‘পরিণামের’ ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। এবং প্রবৃদ্ধি নয়, সাম্যবাদী সমাজলাভ করাকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই চাই, কিন্তু সেরকমের প্রবৃদ্ধি চাই, যা সামাজিক ন্যায় ও শোষণমুক্তির লক্ষ্যকে ত্বরান্বিত করবে। যে কোনো প্রকারের, যেনতেন প্রকারের প্রবৃদ্ধি অর্জন বাহাত্তরের সংবিধানের মূল লক্ষ্য ছিল না। উপযোগিতাবাদী ইউটিলিটারিয়ানরা অনেক সময়ে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, ধনীদের ওপরে করারোপ করে গরিবদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাওয়া ঠিক হবে না। কেননা এতে করে উৎপাদনে বা ব্যবসায় ধনী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমে যাবে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হবে, উৎপাদনশীলতা কমবে, বেকারত্ব বাড়বে, এতে করে আখেরে ক্ষতি হবে গরিবদেরই। উপযোগিতাবাদীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের করারোপ স্পষ্টতই বিকৃতি-উৎপন্নকারী (distortionary) পদক্ষেপ। ‘বিকৃতি’-র মানে হচ্ছে- কোনো কর বসানো না হলে বিভিন্ন খাতে সম্পদ যেভাবে বিনিয়োজিত হতো, তা থেকে করারোপের কারণে এতটাই সরে আসতে হচ্ছে যে, এর ফলে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। লক্ষ্য করুন, ইউটিলিটারিয়ানরা যখন এ যুক্তি রাখছেন তারা incentive-এর ওপরে করের সম্ভাব্য কুপ্রভাবকে জোরেশোরে তুলে ধরছেন। তারা লিবের্টারিয়ানদের মতো মানব স্বাধীনতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এরকম নীতিবাদী যুক্তি প্রদর্শন করছেন না। বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তরের সংবিধানের প্রণেতাগণ লিবের্টারিয়ানদের ‘ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের’ ফলে বেইনসাফের যুক্তি যেমন মানেননি, উপযোগিতাবাদীদের ‘বিকৃতি-উৎপন্নকারী’ যুক্তিও মানতে রাজি ছিলেন না। উৎপাদনের উপায়ের ওপরে ব্যক্তিমালিকানার স্বভাবজ ‘বুর্জোয়া’ অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে ৪৭নং অনুচ্ছেদে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে গিয়ে  Freedom বা Distortion কোনো যুক্তিকেই প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না। এটা তো তাদের জানাই ছিল যে করারোপের মতোই মালিকানা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অবাধ অনুমোদন দেওয়ার অর্থ হচ্ছে হয় পুঁজিপতিদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার শামিল (যেটা লিবের্টারিয়ানদের সওয়াল জবাব ছিল), অথবা তা ছিল বাজার অর্থনীতির ‘স্বাভাবিক’ ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে বিকৃতি সৃষ্টির নামান্তর (যেটা উপযোগিতাবাদীদের সওয়াল জবাব ছিল)। এসব জেনেও তারা ৪৭ অনুচ্ছেদ রাখতে পিছু পা হননি, তার কারণ- রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি প্রধান নীতি সমাজতন্ত্র তথা সামাজিক ন্যায় ও শোষণমুক্তির প্রতিশ্রুতিকে তারা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ও বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে সেদিনের সংসদে যে আত্ম-সমর্থনমূলক বিবৃতি তারা দিয়েছিলেন, তা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তাফসির। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এখানে শুধু তুলে ধরছি।
মধ্যপন্থি রাজনৈতিক নেতা ময়মনসিংহের আছাদুজ্জামান খান ৪৭নং অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ণ সমাজতন্ত্রের দিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যাওয়ার রাস্তা দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :’আমরা রক্তের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র চাই না। বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেছেন এবং তার চার মূলনীতির মধ্যে এ কথা রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। … এখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আসবে। … যারা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে চান, তাদের বলব, সংবিধানের অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সেটা আসতে পারে। ৪২ এবং ৪৭ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান আছে। সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেওয়া চলবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রয়েছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৮

পূর্বে প্রকাশিতের পর
সংবিধানের ১০নং ধারামতে ‘শোষণমুক্ত’ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হলেও এর অর্থ উক্ত ধারায় বা অন্য কোনো ধারাতেও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা হয়নি। এটা সংবিধান প্রণেতাদের বা বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা নয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রীদের মধ্যেই ঐকমত্য আগেও ছিল না, পরেও দেখা যায় না। কালক্রমে বিশেষত সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের মাধ্যমে এটুকু অন্তত প্রতীয়মান হয়েছে যে, সমাজতন্ত্র মানে কেবল উৎপাদনের সব খাতে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা’ প্রতিষ্ঠা করা নয়। আমি বরং বলব যে, সুদূর ১৯৭২ সালে বসেই বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা সমাজতন্ত্রের প্রথাগত সংজ্ঞা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য আমরা এর আগেই উদ্ৃব্দত করেছি, যেখানে তিনি বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা নয়, ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) মালিকানাও থাকতে পারে, অবশ্যই নিয়ম-নীতির চৌহদ্দি মেনে চলাসাপেক্ষে। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ও ব্যক্তিগত (পুঁজিবাদী) মালিকানার মধ্যে সুসামঞ্জস্য থাকতে হবে এবং এ দুইয়ের পারস্পরিক অনুপাতে কালের বিচারে হ্রাসবৃদ্ধি হতে পারে। যেটাই হোক না কেন, একদিকে পুঁজিপতিদের যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে দেওয়া হবে না, আবার অন্যদিকে তাদের অন্যায় প্রভাব খাটানোর সুযোগও দেওয়া হবে না। এক ভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্রের রূপকল্প নির্মাণের জন্য তাজউদ্দীনের বক্তব্যটি পদ্ধতিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পুনরায় স্মরণযোগ্য:
‘আজকে ব্যক্তিগত মালিকানা, ব্যক্তিগত পুঁজিতে যে সংশয়ভাব দেখা দিয়েছে, তাতে শুধু এটাই আমরা বলতে পারি, আইনের বিধান মোতাবেক ব্যক্তিগত মালিককে যেটা দেওয়া হবে সেটার মালিকানা সে নিশ্চয়ই আইনের বিধান অনুযায়ী নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে। ….কিন্তু পুঁজিপতিদের তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। … ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকু দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত শোষণ, ব্যক্তিগত বঞ্চনা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। এটা পরিস্কার থাকা ভালো।’
পরবর্তীকালে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার নানা কারণের মধ্যে একটি ছিল বাজার-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে চালু না করতে পারার ব্যর্থতা। অর্থনীতির সবকিছু সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা Central Planning-র নামে ‘এক কেন্দ্র’ থেকে প্রশাসনিকভাবে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত এক পর্যায়ে সোভিয়েত ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানের রূপকারেরা এই ভুল গোড়া থেকেই পরিহার করতে পেরেছিলেন। এবং পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ের ১৩নং ধারায় রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী এবং ব্যক্তিগত মালিকানাকে যুগপৎ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে রেখে ছিলেন। এই তিনটিই ছিল সংবিধান অনুযায়ী জনগণের মালিকানার তিনটি ধরন।  Social Ownership of means of production বলতে বাহাত্তরে সংবিধানের রূপকারেরা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাকে বোঝাননি, রাষ্ট্রের মালিকানার পাশাপাশি সমবায়ী ও ব্যক্তি-মালিকানাকেও বুঝিয়েছেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের  Principles of Ownership বলতে গিয়ে ১৩নং ধারায় বলা হয়েছে, সমাজতন্ত্রের মালিকানা হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ’ : The People shall own or control the instruments and means of production and distribution, and with this end in view, ownership shall assume the following forms’- যথাক্রমে state ownership, ‘co-opertive ownership’, এবং‘private ownership’ (within such limits as may be prescribed by law) । এরকম সংজ্ঞা নিউ ইকোনমিক পলিসির লেনিনের বা সংস্কারপন্থী নিকোলাই বুখারিনের অথবা পোলিশ অর্থনীতিবিদ অস্কার ল্যাঙ্গের পছন্দ হতো তাতে আমার অন্তত সন্দেহ নেই।
সমাজতন্ত্র ও তার মধ্যে তিন ধরনের মালিকানা নিয়ে সেদিনের সংসদীয় বিতর্কে দুটি স্পষ্ট প্রবণতা দেখা যায়। একটি হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে পারে কিনা এ নিয়ে তত্ত্বগত বিতর্ক। অন্যটি হচ্ছে, এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক। প্রথম দল চাইছেন যে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তি খাত থাকুক এবং শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই নয়, একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে ব্যক্তি খাত কালক্রমে বিকাশও লাভ করুক। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও আছাদুজ্জামান খান অনেকটা এই লক্ষ্যে যুক্তির জাল বিস্তার করছিলেন। তাদের আলোচনার তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল বামধারার দল ও ভাবাদর্শের প্রতি। সংসদে যার কনক্রিট লক্ষ্যবিন্দু ছিলেন ন্যাপের সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। সংখ্যায় এরা অবশ্য ছিলেন মাইনোরিটি। অন্যদিকে, যারা বিশেষভাবে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অসম্ভব- এদের মধ্যে ছিলেন মেজোরিটি গণপরিষদ সদস্য। তারা বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ও প্রতিতুলনা টেনে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকেই ‘অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে’ বিচরণ করতে হবে এবং ‘গতিশীল ভূমিকা’ পালন করতে হবে। প্রয়োজনে এর জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এরা সে লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদের মৌলিক গুরুত্বকে জোরেশোরে তুলে ধরেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ থেকে ড. কামাল হোসেন প্রাগ্রসর সব রাজনৈতিক নেতাই- যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন দীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামে- এই ৪৭নং ধারার প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলার দাবি রাখে।
বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হয়েছে তার পরিধি বিপুল। Liberty Principle-এর ক্ষেত্রে কোনো আপস না করে জোরেশোরে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। ৩৯(১) ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, এর ‘ক’ ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং এর ‘খ’ ধারায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ২৯(১) ধারায় সরকারি নিয়োগ লাভে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ এবং ৪০ অনুচ্ছেদে যে কোনো আইনসংগত পেশা, বৃত্তিগ্রহণ, কারবার বা ব্যবসা-পরিচালনার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে। সেই সঙ্গে ৪২(১) ধারায় দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে সম্পত্তির অধিকার- ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’- প্রত্যেক নাগরিককে ‘সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা’ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পত্তির ওপর অধিকারের সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজার-অর্থনৈতিক ধারায় বিকাশের জন্যও সম্পত্তির অধিকার বা property rights একটি মৌলিক ধারণা। প্রপার্টি রাইটস-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত হচ্ছে : transaction costs-এর ধারণা। কোনো সম্পত্তির ওপরে মালিকানা প্রতিষ্ঠা, মালিকানার হাতবদল এবং মালিকানা রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত খরচকে :transaction costs বলে। যে সমাজে এই সম্পত্তি সংক্রান্ত :transaction costs  কম সেই সমাজ উৎপাদন নৈপুণ্যে আরও বেশি এগিয়ে। তবে নিকোলাস স্টার্ন দেখিয়েছেন যে,  property rights শুধু ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প, কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও সমবায়ী মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-কর্মকাণ্ডের সফল পরিচালনার জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রপার্টি রাইটস বলতে স্টার্ন মূলত তিনটি অধিকারকে বুঝিয়েছেন- এর মধ্যে রয়েছে ‘Right to Manage’, ‘Right to Income’ এবং ‘Right to Protect’। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সেই প্রতিষ্ঠানটি ঠিক মতো চলতে পারে না। সেক্ষেত্রেই আমি ৪২(১) ধারায় প্রদত্ত সম্পত্তির অধিকারকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের’ মধ্যে গণ্য করেছি- শুধু পুঁজিবাদী সম্পত্তি-অধিকারের অংশ হিসেবে দেখিনি।
উপরোক্ত গণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ৪১ নং অনুচ্ছেদের ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ ধারাও। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা মনে রেখে এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের ‘যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের’ অধিকারের কথা। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী ‘কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না’- এ কথাও ৪১(২) ধারায় আলাদা করে সংযোজিত হয়েছিল। এছাড়াও সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’-এর অধ্যায়ের ২৭নং ধারায় আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ২৮নং ধারায় ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যরোধ এবং ধর্ম-বর্ণ নারীপুরুষ নির্বিশেষে সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা স্পষ্ট করে উল্লেখিত ছিল এই সংবিধানে। এসব কিছুকেই আমরা একদিক থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার, অন্যদিক থেকে ‘সেক্যুলার’ (ধর্ম-নির্বিশেষ) অধিকার হিসেবে পাঠ করতে পারি।
উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানের প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে Libertarian ও Economic Egalitarian (তথা মার্কসবাদীরা) এক জোটে জড়ো হবেন, তা যতই এই নৈতিক সহাবস্থান তাদের রাজনীতির পক্ষে অস্বস্তিজনক হোক না কেন। কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দেখান তাদের বক্তব্যেও সপক্ষে। যেমন, মানুষ নিজে যা উৎপাদন করে তার ওপরে তার মৌলিক অধিকার রয়েছে বা মালিকানাস্বত্ব রয়েছে- এ কথা লিবারটারিয়ানরা জোরেশোরে বলে থাকেন। এজন্যই তারা মনে করে থাকেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি-অধিকারে হস্তক্ষেপ করা মানে হচ্ছে ব্যক্তিগত মৌলিক অধিকারেই (ব্যক্তিগত স্বাধীনতা) হস্তক্ষেপ করার শামিল। অন্যদিকে, ‘আমার উৎপাদনের ওপরে কেবল আমার অধিকার’- একথাটা কট্টর বামপন্থিরা বুঝে না-বুঝে বলে থাকেন।  Right to one’s labour- এটা এই ধারার প্রগতিশীলদের এক পুরোনা দাবি। (অবশ্য উৎপাদনের ফল যদি কেবল শ্রমের ফসল না হয়ে বিভিন্ন উপাদানের সমবেত অবদানের কারণে অর্জিত হয়- যেমন, Entrepreneourship, প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনী প্রতিভার কারণে- তাহলে উৎপাদনের সবটুকু ফল কেবল আমার একথা আর বলা চলে না নিঃসংশয়ভাবে।) এরকম এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ছিলেন ফার্দিনান্দ লাসাল (Lassalle)। শেষ জীবনের একটি লেখা ‘ক্রিটিক অব দ্য গথা প্রোগ্রামে’ মার্কস তৎকালীন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ফার্দিনান্দ লাসাল-এর Rights to Labour তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন। ‘শ্রমিক হিসেবে আমি যা উৎপাদন করছি তার পুরোটাই কি আমার প্রাপ্য’- এ প্রশ্ন রেখে মার্কস দেখিয়েছিলেন বাস্তবে সেই উৎপাদনের কিছু অংশ যাবে পুঁজির ক্ষয়-ক্ষতি পূরণে বা নবায়নে, কিছু অংশ যাবে নতুন বিনিয়োগে, কিছু অংশ সামাজিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অবকাঠামো প্রভৃতি Social Consumption খাতে, কিছু অংশ আপৎকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায়- মোট কথা  National Accounts-এর যাবতীয় বণ্টনের নিয়ম-নীতি নিষ্ঠার সাথে পালনের পরই কেবল যা অবশিষ্ট থাকবে তা শ্রমিকদের ‘বেতন তহবিলে’ ঢুকতে পারে (অবশ্য সেই বেতন তহবিল থেকেও একটা অংশ পেনশন জাতীয় ভবিষ্য-তহবিলের বাবদ কেটে রাখতে হবে বৈকি, শ্রমিকদেরই সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনে)। দেখা যাচ্ছে, মার্কস বণ্টনের ব্যাপারটাকে সম্যকভাবে এবং সূক্ষ্ণভাবে বিচার করেছিলেন। কিন্তু সেই সূক্ষ্ণতা অনেক সময়ই পরবর্তীকালের মার্কসবাদী আলোচনায় রক্ষিত হয়নি। এ কারণেই অমর্ত্য সেন তার ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইয়ে লিখতে পেরেছেন যে, The idea of the right to the fruits of one’s labour can unite right-wing libertarians and left-wing Marxists (no matter how uncomfortable each might be in the company of the other) এবং এটা লেখার পরপরই ফুটনোটে যোগ করেছেন যে, মার্কস এরকম কোনো মতে শামিল ছিলেন না : “As, it happens, Karl Marx himself became rather sceptical of the ‘right to one’s labour’ which he came to see as a ‘bourgeois right’, to be ultimately rejected in favour of ‘distribution according to needs’, a point of view he developed with some force in his last substantial work, The Critique of the Gotha Program.”

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৭

পূর্বে প্রকাশিতের পর
কেননা, ‘ইকুয়ালিটি অব অপরচুনিটি’ আইন, দর্শন ও রাজনীতি বিজ্ঞানের একটি বহুল-অধীত ধারণা। সুযোগ কী ও কত প্রকারের, কোন সুযোগগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সে কারণেই (সম্পদ কম থাকলে) কোন সুযোগগুলোর ক্ষেত্রে সমতা বিধান সর্বাগ্রে করা উচিত এ নিয়ে পলিটিক্যাল ও মরাল ফিলোসফারদের মধ্যে বেশ খানিকটা মতানৈক্য রয়েছে। আইনী বা আনুষ্ঠানিক সমতা  (Formal equality of opportunity) বনাম বাস্তবিক সমতা  (Substantive equality of opportunity) বা ন্যায়সঙ্গত সমতা  (Fair equality of opportunity), সুযোগের সমতা (equality of opportunity) বনাম সামর্থ্যের সমতা (capability) ইত্যাদি ভেদজ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। নৈয়ায়িক বা ন্যায়বাদী দর্শনে এসব মতপার্থক্যের ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সেসব আলোচনার বা টেক্সটের পূর্ব-ঐতিহ্য বাংলায় ইতোপূর্বে না থাকায় শুধু ‘সুযোগের সমতা’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের মাধ্যমে সাংবিধানিক (বা আইনি) লক্ষ্য পূরিত হবার নয়। এ জন্যেই আলোচনার জন্য ইংরেজি ও বাংলা পাঠ উভয়ের ওপরেই নির্ভর করেছি। কোন কনসেপ্টের গুরুত্ব মীমাংসা করার জন্য ইংরেজি পাঠের আশ্রয় নিয়েছি, যদিও উদ্ৃব্দতিগুলো থাকছে মূলত বাংলা পাঠ থেকে। আমার আশা যে, এই দ্বি-ভাষিক পাঠের মধ্য দিয়ে ভাবনার অনুবাদ-কর্ম সহজতর হবে।
রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূল নীতি’ (Fundamental Principles of State Policy) অধ্যায়ে সমাজতন্ত্রকে শুধু একটি মৌলিক আদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করা হয়নি। এর সংজ্ঞা সরাসরি কোনো ‘মার্কসীয় টেক্সট’ থেকেই গেছে বলে মনে হয়। নতুন সমাজের লক্ষ্য হচ্ছে ‘শোষণমুক্তি’ এবং এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’। সংবিধানের ১০নং ধারায় লেখা ছিল : ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ এখানে ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ বলতে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বোঝানো হয়নি। তবে রাষ্ট্রীয় খাতের যে বড় একটি অর্থনৈতিক ভূমিকা থাকবে, সেটা ছিল স্পষ্ট। উন্নয়নের পথে রাষ্ট্রের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একথা একমাত্র চরম খোলা-বাজার অনুসারী Libertarianরা ছাড়া সকলেই কমবেশি স্বীকার করে থাকেন। অনগ্রসর এলাকা, পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য রাষ্ট্রের হাত-বাড়ানো প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থার ব্যর্থতা, দুর্বলতা ও অনুপস্থিতি যে যে ক্ষেত্রে প্রকট- যেমন জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে- সেখানে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হয়। বাজারমুখীন বিনিয়োগ কর্মকাণ্ড, যেখানে ঋণাত্মক উপচেপড়া প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে (negative externalities and spillovers) সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়। পরিবেশ-দূষণ এবং পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে জনস্বার্থের রক্ষাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, যা কোনো একক বা সমবেত ব্যক্তি খাতের পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু উদ্যোগ ও নেতৃত্ব আসতে হবে রাষ্ট্রের তরফ থেকেই। এসবের বাইরেও ১৯৭২ সালের পটভূমিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে আরও কিছু বাড়তি দায়িত্ব ও চাপ নিতে হয়েছিল।
প্রথমত, বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বিকাশ চেয়েছিলেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ১৯৭২ সালে সংসদে সংবিধান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’র কল্পনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বড় কথা হলো জনকল্যাণ। এই রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র রূপে যাতে গড়তে পারি, সেই লক্ষ্য স্থির রেখে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।’ জনকল্যাণের জন্য ব্যয় নির্বাহের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় তহবিলের সংকুলান। একটি অবিকশিত কর-রাজস্ব সিস্টেমের মাধ্যমে তা সেদিন অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এর জন্য যেমন দরকার হয়ে পড়েছিল ‘নন-মার্কেট’ পন্থায় সম্পদের আহরণ, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দক্ষ ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ‘বাণিজ্যিক’ ভিত্তিতে গড়ে তোলা ও সেসব কর্মকাণ্ডকে সম্প্রসারিত করা। নন-মার্কেট পন্থায় সম্পদ আহরণের উদাহরণ হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম-ভিত্তিক নদী-পুকুর-খাল খনন, রাস্তা-ঘাট মেরামত ও নির্মাণ প্রভৃতি স্থানীয় উদ্যোগের কথা এখানে স্মরণ করা যায়। এই ডাক ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন বিভিন্ন জনসভায়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে ‘বাণিজ্যিক ভিত্তিতে’ পরিচালনা করার গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধ হয়েছিল সেদিন। এর পূর্বাপর ঐতিহাসিক উদাহরণ তৎকালীন নেতৃত্বের সামনেই ছিল। ‘মৌলিক ও ভারী শিল্পে’ তুলনামূলকভাবে পুঁজির পরিমাণ লাগে বেশি। আর এসব খাতে টার্নওভার রেট কম- মুনাফা আসে অনেক দেরি করে- ফলে এসব খাতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের পুঁজিপতিরা উৎসাহিত হয় না। এক্ষেত্রে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশের উদাহরণ তারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাছাড়া সোভিয়েতসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ‘সংস্কারও’ তারা দেখেছিলেন (কোসিগিনের রিফর্মের কথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংসদে তুলেছিলেন)।
দ্বিতীয়ত, ‘মৌলিক ও ভারী শিল্পের’ কারণ ছাড়াও সেকালের ব্যক্তি-পুঁজিবাদী খাতের দুর্বলতাও তারা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে পেছনে থেকে আর্থিক বা নৈতিক সহায়তা দানে সক্ষম বাঙালি পুঁজিবাদীদের সংখ্যা ষাটের দশকে ছিল অত্যন্ত নগণ্য। যারা ছিলেন, তাদের বেশির ভাগেরই মিল-কলকারখানা চালানোর মতো অভিজ্ঞতা বা অবিসংবাদিত দক্ষতা ছিল না। আর যাদের কিছুটা দক্ষতা ছিল, তাদের মধ্যে হিন্দু-বাঙালি পুঁজিবাদীদের অংশটি (যেমন ঢাকেশ্বরী কটন মিলের সুনীল কুমার বোস) প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের বৈরী পরিবেশে। বিশেষত ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের কারণে এদের অনেকেই অন্যত্র পুঁজি স্থানান্তরিত করতে থাকেন। সুনীল বোসকে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার করা হয় এবং কেবল ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরই তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পান। এভাবে পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে ধনিক বাঙালি ‘শিল্প বুর্জোয়া’ বসু-পরিবার স্বাধীনতার পরে শিল্প খাত থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন ও কপর্দকশূন্য হয়ে যায়। আর.পি. সাহার মতো যারা মাঝারিমানের ব্যবসায়ী পূর্ব বাংলায় রয়ে গিয়েছিলেন, তারা পূর্বাপর শিল্প খাতের সঙ্গে তেমনভাবে জড়িত ছিলেন না। ফলে, চাইলেও ১৯৭২ সালে বড় কোনো শিল্পোদ্যোগে এগিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। অন্যদিকে ১৯৩৭-৪৬ পর্বে বাংলার শাসনভার মুসলিম লীগ সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও বাঙালি মুসলিম শিল্প-পুঁজির তেমন কোনো বিকাশ ঘটেনি। বস্তুত ১৯৪৭-৭১ সময় পর্বে পাকিস্তান হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলায় তেমনভাবে বাঙালি মুসলিম শিল্প পুঁজির বিকাশ হয়নি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এসে রাজনৈতিক আনুকূল্যে ও ইপিআইডিসির সহায়তায়- বিশেষ করে পাট ও বস্ত্র খাতে- কিছু বাঙালি মুসলিম মালিকানাধীন কল-কারখানা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। রুশ গবেষক সের্গেই বারানভ ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় থেকে এই ধারার শিল্পোদ্যোক্তাদের ওপরে একটি সমীক্ষা চালান। তার হিসেবে মাঝারি বৃহৎ শিল্প খাতে বাঙালি মুসলিম মালিকানাধীন বিজনেস গ্রুপের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬। চট্টগ্রামের একে খান গ্রুপ ছাড়া সারা পাকিস্তানের পর্যায়ে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা এদের কারোরই ছিল না। এদের অধিকাংশই সেভাবে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামে প্রবলভাবে দাঁড়াননি বা দাঁড়াতে পারেননি (কেউ কেউ সরাসরি বিরোধিতাও করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কালে)। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রস্তুতের সময় আওয়ামী লীগের ভেতরে বাঙালি শিল্পপতির সমর্থক কোনো লবির প্রবল অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মূলত ‘মধ্যস্তরের’ দল হিসেবেই পরিচিত ছিল। ক্ষমতায় আসতে পারে ভেবে যেসব (উঠতি) ধনিকেরা জাতীয়তাবাদী ধারাকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে তাদের ভূমিকা আরও প্রশ্নকীর্ণ হয়ে পড়ে। অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা গোষ্ঠীর প্রায় সবাই এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এদের অনেকেরই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় এলাকাতেই কল-কারখানা ছিল। তাদের ফেলে যাওয়া সেই মিলগুলোই ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এক হিসেবে, তা ছিল ১৯৭২ সালের মোট রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের ৬০ শতাংশ পরিসম্পদের সমান।
তৃতীয়ত, অবাঙালি মালিকানাধীন ‘পরিত্যক্ত শিল্প খাত’ ও বাঙালি মালিকানাধীন ‘দুর্বল’ শিল্প খাত- এ দুটিই একমাত্র বা প্রধান কারণ ছিল না বাহাত্তরের সংবিধানের প্রতিশ্রুত শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত গড়ে তোলার পেছনে। বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা পাকিস্তানের তুলনায় এক ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের মতো বাংলাদেশেও বৃহৎ শিল্প-বুর্জোয়া বা কার্টেল-মনোপলি গড়ে উঠুক তা তারা কখনোই মনে-প্রাণে চাননি। এরকম মনোপলি পুঁজির প্রভাব বাড়তে থাকায় পূর্ব বাংলার উন্নয়ন কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল তা তারা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাজনীতিতে সামরিক স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্রের পৌনঃপুনিক লঙ্ঘনের পেছনে এই বাইশ পরিবারের পরোক্ষ প্রভাব কার্যকর ছিল পূর্বাপর। এসবও তারা তাদের অভিজ্ঞতার বলেই জানতেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সে পথেই আবার গড়াক সেটি তারা চাননি। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্য বিরাজ করেছিল সেদিন। অর্থাৎ উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের প্রধান প্রধান খাতে রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়ার পেছনে ‘বাইশ পরিবার বিরোধিতা’ ছিল একটি প্রধান মনস্তাত্ত্বিক কারণ। আমার মতে, প্রধানতম কারণ। বঙ্গবন্ধু তার নানা বক্তৃতায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন- কী স্বাধীনতার আগে, কী স্বাধীনতার পরে। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঢাকায় এক ভাষণে শেখ মুজিব বলেন :’২২ বছরের ইতিহাস, খুনের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস মীর জাফরের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস, খুবই করুণ ইতিহাস। ইতিহাস গৃহহারা সর্বহারার আর্তনাদের ইতিহাস… ২২ বছর কেটে গেল আমরা জীবন যৌবন ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি কিন্তু পেলাম কি আজ আমরা। আজকে দেশের মধ্যে গ্রামে গ্রামে হাহাকার। … আজকে ২২টি পরিবার পাকিস্তানের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়েছে। গরিব দিন দিন গরিব হয়ে গেছে। বড়লোক দিন দিন বড়লোক হয়ে যাচ্ছে।’ এর ঠিক দুই বছর পরে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ‘জাতীয়করণ’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবধারিতভাবে উঠে এলো বাইশ পরিবারের কথা :
‘শ্রমিকেরা সারা জীবন শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছেন। এগুলো জাতীয়তকরণের অর্থ হলো শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দেওয়া। আমরা শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে সমস্ত কল-কারখানা ছিল তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। … আমি এখানে আজ আর একটা কথা ঘোষণা করেছি। সরকার যেসব কারখানা জাতীয়করণ করেছেন, এখন থেকে সেগুলোর প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে দুইজন করে সদস্য থাকবেন এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বোর্ডে পাঠাবেন। এ ছাড়া বোর্ডে সরকারের এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনজন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যাই আর হোক না কেন, আদমজী, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না।’ শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, বাইশ পরিবারের মতো একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশ রুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের শক্ত ভূমিকা এবং বৃহৎ শিল্প খাতে প্রতিযোগিতা পূর্ণভাবে টিকে থাকতে সক্ষম এমন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কথা নানা প্রান্ত থেকেই বলা হচ্ছিল। কেউ বলছিলেন ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, যেমন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ যুক্তি দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে :’আজ আমাদের দেশে, অর্থাৎ সাবেক পাকিস্তানে যে সমস্যা ছিল, তা দূর করার জন্য যদি মহানবীর বাণীর শত ভাগের এক ভাগও মেনে নিত, তাহলে কুখ্যাত আদমজি, দাউদ, ইস্পাহানির মতো লোক এ দেশে জন্মলাভ করতে পারত না।’ কেউ আবার যুক্তি দিয়েছেন ইতিহাসের নিকট অভিজ্ঞতা থেকে। ড. কামাল হোসেন পরবর্তীকালে লিখেছেন এ প্রসঙ্গে :’The vision of an independent Bangladesh which had inspirad the freedon fighter, was of a society which would be free from exploitation. They were quite clear that having freed themselves from the infamous ‘22 families’ of Pakistan, they were not going to create ‘22 families’ to take their place in Bangladesh.’

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৬
পূর্বে প্রকাশিতের পর
এই কথাগুলো কিছুটা নির্দয় বিচারই বলে ঠেকবে- বিশেষত যদি আমরা সংবিধান নিয়ে ১৯৭২ সালের গণপরিষদেও নানা আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ককে সামগ্রিকভাবে মাথায় রাখি। কোনো প্রকার আন্তরিকতা বা আত্যন্তিক তাগিদ ছাড়াই শুধু নির্বাচনী জনসমর্থন আদায়ের জন্য গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছিল, এটা বিশ্বাস করা শক্ত। প্রথমত, জনসমর্থন আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রচার করা দোষের কিছু নয়। মানুষ এরকম আদর্শ সমর্থন করে কিনা তা যাচাই করার একটা বড় মাধ্যমই হচ্ছে নির্বাচন। দ্বিতীয়ত, সেদিনের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাদের অভিপ্রায় প্রকাশে আন্তরিক ছিলেন না- একে নিছক লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত বলে মনে হতে পারে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃত্বে বিশেষত বঙ্গবন্ধুর মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছিল। যার চিহ্ন বিভিন্ন দলিলপত্রের আলোচনার মধ্য দিয়ে ইতোপূর্বেই আমরা দেখেছি। ‘সত্তরের নির্বাচনের সময়েই আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো সমাজতন্ত্রের কথা বলে’- লেখকের এই বিচারটিও তথ্যগতভাবে সঠিক নয়। এবং সবশেষে, একটা রক্ষণশীল সমাজে- যেখানে ধর্মের আড়ালে সংস্কারের প্রভাব প্রবল, সেখানে সমাজতন্ত্রের কথা বললে কৃষক-মধ্যবিত্ত সমাজের ভোট বেশি করে পাওয়া যাবে, এটাও তর্কসাপেক্ষ অনুমান। রক্ষণশীলতার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সমাজে এখনও কাটেনি, তখনও ছিল। তার পরও জনগণের সামনে এনলাইটেনমেন্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন ‘সমাজতন্ত্র’ তথা সামাজিক ন্যায়ের আইডিয়া তুলে ধরতে গিয়ে ষাটের দশকের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দ্বিধাগ্রস্ত হননি। আধুনিক রাষ্ট্রের সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকে তাঁরা কোনো প্রাগ-আধুনিক ঐতিহ্যগত চিন্তার সাথে জোর করে মেলাতে বা মেশাতে চাননি। সেরকম চেষ্টা তাদের চোখের সামনেই ছিল- ‘গান্ধীবাদী’ সমাজতন্ত্র, ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’, ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’ বিভিন্ন ধারা ষাটের দশকে চলমান ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনচেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু ঐতিহ্য-রক্ষার নামে সমাজতন্ত্রের ঐতিহ্য-নিরপেক্ষ প্রগতিবাদী ধারণাকে তাঁরা অবমূল্যায়িত করতে চাননি। দুধে জল মিশিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য মোড়কে বিক্রি করতে চাননি- নির্বাচনে জয়লাভের জন্য হলেও। তাঁদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। ফলে, পাকিস্তানের পরিবেশে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জনগণকে কাছে টানার জন্য আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের কথা বলে থাকবে, নইলে তারা বামপন্থি দলগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে পারত, অধ্যাপক চৌধুরীর এই মীমাংসাও যুক্তিসিদ্ধ ঠেকে না। প্রথমত, যেখানে সমাজতন্ত্রের কথা বলে ‘নাস্তিক’ বলে অভিহিত হওয়ার বরং আশঙ্কা আছে, সে রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কেবল জনসমর্থনের তাগিদে শব্দটি প্রচার করেছিল- এই যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, ১৯৭০ সালের প্রেক্ষিতে জনতুষ্টিবাদের যুক্তিও দুর্বল, কেননা সমাজতন্ত্র তখনও গণদাবি হয়ে ওঠেনি। আর বামপন্থি দলের তরফ থেকে প্রতিযোগিতার ভয়? সেটাও আজ কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়। বিশেষত যদি মনে রাখি যে, সত্তরের নির্বাচন বয়কট করেছিল বামপন্থি বলে দাবিদার পিকিংপন্থি ভাসানী ন্যাপ। এটি ছিল মাওলানা ভাসানীর সবচেয়ে বড় এক রাজনৈতিক ভুল- ‘স্ট্রাটেজিক ব্লান্ডার’। যদিও কমরেড হায়দার আকবর খান রনো তাঁর ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে একে ভাসানীর ‘ওয়াক অভার’ দেওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। এমনও হতে পারে যে, পরবর্তী সময়ে (নব্বই বা তৎপরবর্তী) আওয়ামী লীগের ‘বুর্জোয়া’ রূপান্তর দেখে লেখক তার বিরুদ্ধ সমালোচনাকে প্রোথিত করেছেন অতীতে- ১৯৭২ সালের আওয়ামী লীগকে বিচার করার ক্ষেত্রে বা সংবিধানে বিধৃত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের Authenticity যাচাই করার ক্ষেত্রে। এই সূত্রে বলে রাখি, সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমাকে একাধিকবার আশ্বস্ত করেছেন যে, বাহাত্তরের সংবিধানের বেশকিছু ন্যায়সংগত বামপন্থি সমালোচনা সত্ত্বেও- এবং ১৯৭২-৭৫ পর্বে বাস্তবে গৃহীত কর্মসূচির তর্কাতীত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও- সমাজতন্ত্র তথা চার আদর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের আন্তরিক অভিপ্রায় নিয়ে অন্তত তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তাঁর মনে এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কমরেড সেলিম ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে স্বীকার করেন, তবে ব্যক্তিকে তার দল থেকে খুব বেশি বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না- সেটিও বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, তৃতীয় বিশ্বের একটি অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর পথ নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য সাময়িক কালের জন্য ‘একদল’ করতেই হবে, সব সমাজতন্ত্র-অভিমুখীন দেশকেই গণতন্ত্রের প্রচলিত পথ ছাড়তেই হবে- এটা আদৌ আবশ্যক নয়। আবার একদল করলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে- ব্যাপারটা তেমনও নয়। ১৯৭২-৭৫ সালে সিপিবির অভিমতও ছিল তাই। সোভিয়েত ও অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিও সেই বার্তাই দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে- তিনি এটাও আমাকে জানিয়েছেন। মোট কথা, সমাজতন্ত্র অভিমুখে দীর্ঘ পথ চলায় বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক অভিপ্রায় ও আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় ছিল না সেদিনের বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে বা বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবি মহলে (সেদিনের গণচীন, যেটি তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি বা তার স্থানীয় সমর্থক গোষ্ঠীদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র)। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের সমতামুখী সমাজের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিশেষ ধারার প্রতি মনোযোগ দেব। এই ধারাগুলোর ঘনিষ্ঠ বিচার করলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সমৃদ্ধ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ধারা সম্পর্কে তাত্ত্বিক সংশয়ের আর কোনো অবকাশ থাকে না। আজকের বাংলাদেশ যদি বঙ্গবন্ধুর সেদিনের তাত্ত্বিক উপলব্ধিতে ফিরে যেতে পারে, তবে সেটা হবে একটি বড় পাওয়া।
৯. গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারা ও উপধারা
Lost in Translation বলে একটা কথা ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত আছে। তর্জমায় অনেক ক্ষেত্রে মূল পাঠের অর্থই হারিয়ে যায়। যারা বিদেশি ভাষা থেকে কবিতা অনুবাদের কাজে জড়িত, তারা ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেন। তারপরও আমরা অনুবাদের কাজে ব্যাপৃত হই। সেটা শুধু কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত আমরা ‘অনুবাদ’ করে চলেছি- কখনও নিজের কথা অন্যকে বোঝানোর জন্যে, কখনও অন্যের কথা নিজের বোধের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ যখন উপনিবেশে আসে, তখন সে তার ভাষা-সংস্কৃতিকে যথাসাধ্য ‘অনুবাদ’ করে স্থানীয় অধিবাসীকে তার শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে তৎপর হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখনও এই অনুবাদ প্রক্রিয়ার ভেতরে আছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈঠকে, এইড গ্রুপ কনসালটেশনে, প্রবাসে কর্মসংস্থানের দেন-দরবারে প্রতিপক্ষ বুঝে আমাদের ‘অনুবাদ’ করে যেতে হয়, যাতে করে দাতা ও গৃহীতা পরস্পরকে বুঝতে পারে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমরা একেকজন জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনুবাদ-কর্মে নিয়োজিত। আমরা পারস্পরিক ‘সম্পর্কের অনুবাদ’ করে চলি নিজস্ব মূল্যবোধের কাঠামোয়। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য যেটা প্রাসঙ্গিক তা হলো বাহাত্তরের সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক। সুবিদিত যে, সংবিধানটির বাংলা পাঠই আদর্শ পাঠ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং বাংলা সংস্করণই ‘খসড়া’ হিসেবে গণপরিষদে অনুমোদনের জন্য উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানটি আদিতে আসলে বাংলায় লিখিত হয়নি। এটি প্রথমে ইংরেজিতে লিখিত হয় এবং তারপরেই কেবল বাংলায় তর্জমা করা হয়। তর্জমার পর বাংলা পাঠকেই ‘আদর্শ পাঠ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এ সিদ্ধান্ত হয় যে, যদি কোনো ধারা বা উপধারা বোঝার বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি বা ‘কনফিউশন’ দেখা দেয়, তবে বাংলা পাঠকেই চূড়ান্ত মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হবে। এ নিয়ে ড. আনিসুজ্জামান তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন :
‘ড. কামাল হোসেন এজেন্ডা পাঠালেন :বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি খসড়া তৈরি করবেন ইংরেজিতে, আমাকে তার বাংলা করে দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত বাংলাটাই গৃহীত হবে প্রামাণ্য ভাষ্য বলে। বললাম, একা পারব না, একটা দল চাই। তিনি বললেন, আপনি লোক বেছে নিন।’
আগেই বলেছি তর্জমার দলে আরও ছিলেন কবি ও অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান এবং ড. মযহারুল ইসলাম। সংবিধান তর্জমা করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আনিসুজ্জামান বর্ণনা করেছেন এভাবে :’মনে পড়ে, আইনমন্ত্রীর দপ্তরে এক দুপুরে কামাল আর আমি মুখোমুখি বসে। প্যাডের কাগজে খসখস করে কামাল লিখতে শুরু করলেন সংবিধানের প্রস্তাবনা। এক স্লিপ লেখা হলে সাদা কাগজের সঙ্গে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি অনুবাদ করতে শুরু করলাম। একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগল দেহে-মনে :এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান-রচনার কাজে হাত দিয়েছি। কামালকে বললাম, অনুবাদটা মাজাঘষা করতে হবে, বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি বললেন, মূলটারও কিছু উন্নতি ঘটাতে হবে, কাল আবার বসব একসঙ্গে। …সংবিধানের কাজে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে পনেরো দিন আমি ঢাকায় থেকেছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে… গণপরিষদ-ভবনে- পরে যা রূপান্তরিত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে- আমাকে একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটেছে। কখনও বেশি রাত হয়ে গেলে কামালের বাড়ির বসার ঘরে শুয়ে বাকি রাত যাপন করেছি। সকালে সে বাড়িতেই নাশতা করে দ্রুত চলে এসেছি গণপরিষদে।’
এক অর্থে, সংবিধানের খসড়া দুটো ভিন্ন ভাষায় সমান্তরালভাবে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু, সন্দেহ নেই, আগে ইংরেজি টেক্সট তৈরি হয়েছিল, পরে এর বাংলা তর্জমা হচ্ছিল। এ জন্যেই বাংলা পাঠকে আইনত শিরোধার্য করলেও মূল কনসেপ্ট এবং বর্ণনাগুলো যেহেতু ইংরেজিতে হচ্ছিল, এর ইংরেজি পাঠের ওপরেই সাংবিধানিক-আইনি ও দার্শনিক ‘মর্মার্থ’ অনুধাবনের জন্য জোর দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। আমার বলার কথা হলো, সংবিধানের বাংলা পাঠ তখনই সারগর্ভ পাঠ হয়ে ওঠে, যখন আমরা এর মূল ইংরেজি আদি-পাঠকে পাশাপাশি রাখি। যেন বাংলা সংবিধানের প্রতিটি লাইনের ব্যবধানে অদৃশ্য কালিতে লেখা রয়েছে এর ইংরেজি পাঠ। যেন এই ইংরেজি পাঠকে পড়ে এর শব্দগত, প্রত্যয়গত ও গঠনগত অর্থ যথাযথ অনুধাবন করার পরই বাংলা পাঠের দিকে তাকাব কেবল- ইংরেজি পাঠকে চোখের সামনে থেকে মুছে দিয়ে। একই সঙ্গে পড়া এবং মুছে দেওয়া- দেরিদীয় এই ‘Eraser’ প্রকরণ ব্যবহার করেই কেবল সংবিধানের ধারা-উপধারার মর্মার্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে। একটি উদাহরণ এই সূত্রে মনে পড়ছে। বহু বছর আগে যখন অমর্ত্য সেনের ‘জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’ বইটি হাতে এসে পড়ল, তখন সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম যে, বইটির শেষে অমর্ত্য সেনের নিজের করা একটি পরিভাষার তালিকা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই জানেন যে, বইটি অনূদিত হয়েছিল মূলের ইংরেজি থেকে বাংলায়। কিন্তু অমর্ত্য সেন অনূদিত পাঠটি মনোযোগ দিয়ে দেখে দিয়েছিলেন এবং দেখতে দেখতে বেশকিছু পরিভাষা নির্দেশ করেছিলেন। এর মধ্যে একটির কেবল উল্লেখ করি। ‘পণ্যমোহবদ্ধতা’ টার্মটি তিনি প্রস্তাব করেন মার্কসের ‘Commodity Fetishism’ ধারণাটি অনুবাদের ক্ষেত্রে। যেটা বলতে চাইছি, শুধু পণ্যমোহবদ্ধতা শুনলে আমরা বুঝতে পারব না শব্দটির দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের একটি বিশিষ্ট কনসেপ্ট ‘Commodity Fetishism’-এর রূপরেখা ফুটে উঠবে না। পণ্যমোহবদ্ধতা ভালো, কিন্তু ঋবঃরংযরংস ছাড়া সে অচল। এজন্যেই বলেছি- অনুবাদে মূলের চেহারা ঢাকা পড়ে যায় :Lost in Translation।
বাহাত্তরের সংবিধান থেকে একটি উদাহরণ এই সূত্রে মনে আসছে। শাসনতন্ত্রের ১৯(১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ কিন্তু ‘সুযোগের সমতা’ উচ্চারণে এর অর্থ সুস্পষ্ট হয় না। কেননা, ইতোপূর্বে বাংলায় ‘সুযোগের সমতা’ ধারণাটিকে কোথাও ব্যাখ্যা করা হয়নি। এর অর্থ জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এর আদি ইংরেজি পাঠে, যেখানে বলা আছে :’The state shall endeavor to ensure equality of opportunity to all citizens.’ বাংলা পাঠের অর্থ বোঝার জন্য এখানে ইংরেজি পাঠের অবশ্যই অনুগামী হতে হচ্ছে।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৫

পূর্বে প্রকাশিতের পর
মোট কথা, সমাজতন্ত্রের মধ্যে গণতন্ত্রের ‘কনটেন্ট’ আরো বাড়াতে হয়, সেটা কি বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার বিচারে, কি বাংলার মানুষের মন-মানসিকতা বিচার করে।
এসবের থেকে কিছুটা ভিন্ন যুক্তি দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের আছাদুজ্জামান খান। তার মতে, সংবিধানে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রস্তাব করা হয়েছে তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো- এর গণতান্ত্রিক ধারাসমূহকে (যথা ব্যক্তি-স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি যাকে এক কথায় বলা হয়  civil liberty) রাখা হয়েছে ‘মৌলিক অধিকারের’ অধ্যায়ে, আর সমাজতান্ত্রিক ধারাসমূহকে (যথা প্রত্যেকের ‘অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা, মজুরির নিশ্চয়তা, শিক্ষালাভের নিশ্চয়তা, চাকরির সংস্থানের নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়কে) রাখা হয়েছে ‘মূলনীতির’ অধ্যায়ে। ইচ্ছাকৃতভাবেই এগুলোকে মৌলিক অধিকারভুক্ত করা হয় নাই। কেন করা হয় নাই, তার কারণ হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে এ সমস্ত অর্থনৈতিক অধিকার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে থাকলেও এর বাস্তবায়ন হবে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের সংগতি-সামর্থ্যের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রভৃতি civil liberty তথা গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ অবিলম্বে দেওয়া সম্ভব হলে সেগুলো মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করাই অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ, এখানে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নযোগ্য বা Gradualist মতবাদ হিসেবে দেখার চেষ্টা হয়েছে। এর ‘গণতান্ত্রিক’ কনটেন্টকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘সমাজতান্ত্রিক’ কনটেন্টকে সংরক্ষণ করার দৃষ্টিকোণ যেটা বিধৃত হয়েছে সেটা দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ। গণতন্ত্রকে এখনই নিশ্চিত করতে হবে, সমাজতন্ত্র আসবে ধীরে ধীরে। এই  Gradualist অ্যাপ্রোচ মালিকানা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও সংবিধানে রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানা রাখা হয়েছে, তারপরও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে দীর্ঘকালের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানার প্রয়োজনীয়তা থেকে যাবে। চীনের সংবিধানের (অধ্যায়-২ সাধারণ নীতিমালা, ধারা-৫) উদ্ৃব্দতি দিয়ে আছাদুজ্জামান খান দেখালেন যে, সেখানে চার ধরনের মালিকানার অস্তিত্ব আছে- রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী যৌথ মালিকানা, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের একান্ত নিজস্ব মালিকানা এবং পুঁজিবাদী মালিকানা। এই শেষোক্ত মালিকানা সম্পর্কে বেশ দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। তাতে বলা ছিল :
‘The policy of the state towards capitalist industry and commerce is to use, restrict and transform them. Through control exercised by organs of state administration, leadership by the state sector of the economy, and supervision by the masses of the workers, the state makes use of the positive aspects of capitalist industry and commerce which are beneficial to national welfare and the people’s livelihood, restricts their negative aspects which are detrimental to national welfare and the people’s livelihood, and encourages and guides their transformation of state-capitalist economy, gradually replacing capitalist ownership by the whole people.’

এসবের উদ্ধৃতি দিয়ে আছাদুজ্জামান খান এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন :’আমাদের এখানেও পুঁজিবাদী শিল্প ও ব্যবসাকে প্রথমে  protect করে পর্যায়ক্রমে সেগুলোর বিলোপ সাধন করা হবে। আমরাও সেই নীতিই গ্রহণ করেছি। একেবারে তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান :’সমাজতন্ত্র পর্যায়ক্রমে করতে হবে।’ কেননা, ‘আমাদের নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা আছে।’ তা ছাড়া ‘কার্ল মার্কস যা বলেছেন, তা চিরকাল সত্য হবে- তেমন কথা আর স্বীকৃত নয়।’ এবং সে কারণেই ‘মার্কসকে সর্বত্র কপি করা হয়নি।’ এই শেষোক্ত পয়েন্টটা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :’বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ব্যবস্থার অধীনে বিভিন্ন চিন্তাধারা নিয়ে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে।’ এখানে মূল প্রশ্ন হলো, ‘আমরা সমাজতন্ত্রের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করেছি কি না?’ আছাদুজ্জামান মনে করেন, কোনো বাধার সৃষ্টি করা হয়নি। কেননা, রাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে ‘কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই’ এবং ‘গণস্বার্থে’ কোনো সম্পত্তি ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত (বা সমবায়ী) মালিকানায় নিয়ে আসতে পারেন :’সে জন্যেই আমি বলেছি যে, চীন বা অন্য কোনো দেশের চাইতে বেশি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা আমরা রেখেছি।’ বামপন্থি সমালোচকেরা (সংসদের ভেতরে ও বাইরে) খামোখাই এ নিয়ে মাঠ গরম করা বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন!
সুবিদিত যে, বাহাত্তরের সংবিধানের সবচেয়ে তীব্র ‘বামপন্থি’ সমালোচনা এসেছিল গণপরিষদ সদস্য ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর কাছ থেকে। তবে সংসদের বাইরে থেকেও Dissent এসেছিল। তাতে একটি প্রবল মত ছিল, ‘সমাজতন্ত্রের ধারা’ সংবিধানে রাখার দরকারটাই বা কী? শুধুমাত্র গণতন্ত্র থাকলেই হলো। যুক্তিটা হলো, সত্যিকারের গণতন্ত্র কোনো সমাজে কার্যকর থাকলে সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা এসব কোনোটারই আলাদাভাবে রাখা দরকার হয় না। এ রকম একটি লিবারেল যুক্তি দিয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ। ‘সত্যিকারের গণতন্ত্র’ বলতে কোন ধরনের গণতন্ত্র দরকার তা অবশ্য তিনি স্পষ্ট করেননি তার লেখায়। কিন্তু চার-স্তম্ভের বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক আদর্শকে তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন এবং উক্ত চার দফাকে সংবিধানে সংযোজন করাকে সরাসরিভাবে ভুল পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন। ‘শেখ মুজিব-নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ পার্টির সর্বাপেক্ষা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ ত্বরিত গতিতে দেশের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা’ এ কথা বলার পর এর ‘বিধানিক ত্রুটি’ কোথায় তা তিনি নির্দেশ করলেন। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থের লেখকের স্বভাবসুলভ ambiguous অবস্থান এখানেও পাওয়া যায়। একদিকে তিনি যা বলতেন, পরের মুহূর্তেই তিনি তার বিপরীতার্থক সম্ভাবনা দেখতে পেতেন। সংবিধান প্রশ্নে এসেও তার এই প্রবণতা চোখে পড়ে। একদিকে আবুল মনসুর আহমদ স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘ডেমোক্র্যাসি, সোশিয়ালিজম, ন্যাশনালিজম, সেকিউলারিজম :এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। এর সব কয়টির আমি ঘোরতর সমর্থক। শুধু এমনি সমর্থক না, মূলনীতি হিসেবেও সমর্থক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আধুনিক যুগের সব রাষ্ট্রকেই সেকিউলার ডেমোক্র্যাটিক নেশন-স্টেট হইতে হইবে।’ তার পরের বাক্যেই তিনি মত ঘুরিয়ে ফেললেন :’কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনোটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লিখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া আর বাকি সব কটিই সরকারি নীতি; রাষ্ট্রীয় নীতি নয়। দেশে ঠিকমতো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলেই আর সব ভালো কাজ নিশ্চিত হইয়া যায়।’ এই ‘ঠিকমত গণতন্ত্র’-এর স্বরূপ অবশ্য লেখক এখানেও প্রকাশ করেননি। তবে শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেই আর সমাজবাদের আলাদা উল্লেখের আবশ্যিকতা থাকে না- এ যুক্তি আজ পাশ্চাত্যের কোনো লিবারেল তাত্ত্বিকই জোর গলায় বলার সাহস পান না। দার্শনিক জন রাউলস বা অমর্ত্য সেনরা তাহলে ন্যায়পরায়ণ সমাজের কথা কেন আলাদা করে আলোচনা করবেন, বা গণতন্ত্রের পাশাপাশি ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’-এর কথা তুলবেন কেন?
যা হোক, আবুল মনসুর আহমদ সে ধরনের যুক্তি-চর্চায় গেলেন না। তিনি ‘অকাট্য প্রমাণ’ হাজির করলেন তার পরিবর্তে (পাঠক লক্ষ্য করুন যে তিনি সচেতনভাবে সমাজতন্ত্র শব্দটি এড়িয়ে ‘সমাজবাদ’ শব্দটিকে ব্যবহার করছেন) :’এই ধরনের একটি বিচ্যুতির কথা বলিয়াই আমি আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের ত্রুটির প্রমাণ দিতেছি। এটা সমাজবাদের বিধান। সমাজবাদ একটা অর্থনীতি। এটাকে সংবিধানের মূলনীতি করার কোনো দরকার ছিল না। যে কোনো গণতন্ত্রী পার্টি যদি সমাজবাদ প্রতিষ্ঠাকে তাদের পার্টি-প্রোগ্রাম রূপে গ্রহণ করেন, তবে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশের জনগণের বিপুল সমর্থন তারা পাইবেনই। তবু আওয়ামী লীগ পার্টি অনাবশ্যকভাবে সমাজবাদকে সংবিধানের মূলনীতি রূপে গ্রহণ করিয়াছেন।’ এবং এ জন্যে তিনি সাক্ষী মেনেছেন ভারতের নেতা নেহরুকে। কথাটা আংশিক সত্যি। নেহরু-আম্বেদকরের ১৯৫১ সালের সংবিধানে সরাসরি সমাজতন্ত্রের কথা মূলনীতি হিসেবে ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও ছিল না। আমরা আগেই দেখেছি, এই দুটি শব্দ ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ১৯৭৬ সালে সংযোজিত হয় মূলনীতি হিসেবে ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ অন্তত এটুকু যোগ করতে পারতেন যে, নেহরু-আম্বেদকরের মূল সংবিধানেই চৎবধসনষব-এ যুক্ত হয়েছিল ৪টি মূলনীতি :
Preamble- :
Justice (social, economic and political), (Liberty of thought, expression, belief, faith and worship), Equality (of status and of opportunity), and Fraternity (assuring  the dignity of individual)। এর মধ্যে  Liberty এবং Fraternity বাদ দিলে Justice এবং Equality সংক্রান্ত ঘোষণা দুটি ছিল সরাসরি ‘সমাজবাদ’ তথা সমতামুখীন সমাজের আকাঙ্ক্ষার সাথে সরাসরিভাবে সম্পর্কিত।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদের কিছু ত্রুটিও হয়েছে বঙ্গবন্ধুর চার-আদর্শকে নিয়ে। তার লেখায় তিনি প্রকারান্তরে দাবি করেছেন- সংবিধানে সংযোজনের আগে আওয়ামী লীগের আর কোনো মেনিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ ছিল না। ইতোপূর্বে আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি, ‘অর্থনৈতিক আদর্শ’ হিসেবে আওয়ামী লীগের দলিলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা সরাসরিভাবে সন্নিবেশিত হয়েছিল বেশ আগে থাকতেই। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি অবশ্য রাজনৈতিক vocabularyতে আসে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বক্তব্য-বিবৃতি-ভাষণে (এর আগে শুধু অসাম্প্রদায়িকতা ও কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে বৈষম্য না করার কথা ছিল)। লেখক এই মতে পৌঁছাচ্ছেন যে, বঙ্গবন্ধুর চার-আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং সংবিধানের প্রণেতারা এই দাবি করে বরং সত্যের অপলাপ করেছেন। লেখকের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমাদের সংবিধান রচয়িতারা নিজেরা ওই মহান আদর্শকে সংবিধানভুক্ত করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। তাই জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ওই ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন।’ এটা পড়লে লেখকের তথ্যনিষ্ঠা সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ না জেগে পারে না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বঙ্গবন্ধুর চার আদর্শের অবয়ব কালক্রমে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল।
আবুল মনসুর আহমদের সংবিধানের ওপর উপরোক্ত সমালোচনা এসেছিল ‘ডান দিক’ থেকে। অর্থাৎ লিবারেল বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রী দৃষ্টিকোণ থেকে। তবে, ‘বাম দিক’ থেকেও সেদিন সংবিধানের ওপরে অনেক সমালোচনা এসেছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদের ভেতরে থেকে সেসব সমালোচনার অনেকটাই উত্থাপন করেছিলেন। সংসদের বাইরে থেকে বামপন্থি দলগুলোও যার যার মতো করে সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। কোনটা রাষ্ট্রের মূলনীতি আর কোন কোন দাবি রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হবার দাবি রাখে- এ নিয়ে সেদিন জোর তর্ক-বিতর্ক উঠেছিল। তবে বামধারার অধিকাংশ সমালোচকই (আমি ন্যাপ-সিপিবি ঘরানার কথা বলছি) সেদিনের গণপরিষদের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিবর্তন বা প্রাতিষ্ঠানিক evolution-এর সাথে সাথে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গিও বদল হতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ’ বইতে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার সংশয় ব্যক্ত করেছেন এভাবে :’রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তিতে আওয়ামী লীগের যে অত্যন্ত উৎসাহ ছিল, তা মোটেই নয়।… সত্তরের নির্বাচনের সময়েই আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো সমাজতন্ত্রের কথা বলে; সমাজে শোষণ থাকবে না এবং অর্থনীতির লক্ষ্য হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখী- এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ওই লক্ষ্যে ব্যাংক-বীমা-বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীনদের কাছে জমি পৌঁছে দেওয়া, কর ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী ঘোষণাতে ছিল। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি আন্তরিক ছিল- এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। এগুলো দেওয়া হয়েছিল নিতান্ত বাধ্য হয়ে। নির্বাচনে জনগণের সমর্থন পেতে হলে জনগণের পক্ষে না বলে উপায় থাকে না। তা ছাড়া বামপন্থি দলগুলো সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে নিজেদের দিকে টেনে নেবে- এমন আশঙ্কাও ছিল।’
[ক্রমশ]https://googleads.g.doubleclick.net/pagead/ads?client=ca-pub-9442091006829624&output=html&h=250&slotname=9443271832&adk=1331586746&adf=832419000&pi=t.ma~as.9443271832&w=300&lmt=1628144762&psa=1&format=300×250&url=https%3A%2F%2Fwww.samakal.com%2Fnational-election-2018%2Farticle%2F210149669%2F%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%2599%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A7%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25A3%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%2595-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25B0%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25A7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8-%25E0%25A6%2593-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%2596%25E0%25A7%2580-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2599%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE&flash=0&wgl=1&adsid=ChAI8PWoiAYQhMehqNPvj6IvEjwAD2iaZOefh47pms1-Z9eHrb6_E-7agz-dJRdprKBDHvePmXdx3PSW_dboDZyJ9AptOOxy35t6YCGZlGI&uach=WyJXaW5kb3dzIiwiMTAuMCIsIng4NiIsIiIsIjkyLjAuNDUxNS4xMDciLFtdLG51bGwsbnVsbCxudWxsXQ..&tt_state=W3siaXNzdWVyT3JpZ2luIjoiaHR0cHM6Ly9hdHRlc3RhdGlvbi5hbmRyb2lkLmNvbSIsInN0YXRlIjo3fV0.&dt=1628144726881&bpp=1&bdt=1182&idt=403&shv=r20210802&mjsv=m202108040201&ptt=9&saldr=aa&abxe=1&cookie=ID%3D41f465110656505a-22353dcdafca0002%3AT%3D1628144727%3ART%3D1628144727%3AS%3DALNI_MYweFHM8DCHnzhgcM7jCgXB3R4IKw&prev_fmts=0x0%2C300x250%2C300x250%2C304x250%2C300x250&nras=1&correlator=2247964085113&frm=20&pv=1&ga_vid=1203111009.1628143455&ga_sid=1628144727&ga_hid=1291477603&ga_fc=0&u_tz=360&u_his=1&u_java=0&u_h=1080&u_w=1920&u_ah=1040&u_aw=1920&u_cd=24&u_nplug=3&u_nmime=4&adx=643&ady=4476&biw=1903&bih=937&scr_x=0&scr_y=745&eid=20211866%2C21067496&oid=3&pvsid=418908138783655&pem=873&ref=https%3A%2F%2Fsamakal.com%2F&eae=0&fc=1920&brdim=0%2C0%2C0%2C0%2C1920%2C0%2C1920%2C1040%2C1920%2C937&vis=1&rsz=%7Co%7CoeEbr%7C&abl=NS&pfx=0&fu=0&bc=31&ifi=4&uci=a!4&btvi=3&fsb=1&xpc=9c8dTasLvk&p=https%3A//www.samakal.com&dtd=35549

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৪

পূর্বে প্রকাশিতের পর
চীনের ১৯৪৯ সালের সংবিধানে ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্পষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের অবস্থা চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো নয়। এ জন্যই তাজউদ্দীন বলেছেন, ‘৫০ বছর আগে সোভিয়েট ইউনিয়নের মানুষ যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থার সঙ্গে আমাদের এখনকার অবস্থার তুলনা করতে হবে। ২৫ বছর আগের পূর্ব জার্মানির সঙ্গে আমাদের তুলনা করতে হবে।’ এখানকার সোভিয়েত, চীন বা পূর্ব জার্মানির সঙ্গে তুলনা করে সংবিধান তৈরি করলে চলবে না। বিপ্লবের পরপর যে বিধান ছিল এসব দেশে সেখানে তো ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল- এই হচ্ছে তাজউদ্দীনের যুক্তি। বামপন্থি দলগুলোর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি  historicism-র অনুবর্তী; শুধু যুক্তির খাতিরে না, বিশ্বাস করেন বলেই। যে সমাজ বা দেশের সঙ্গে সাংবিধানিক প্রতিতুলনা করা হবে, তাদের সঙ্গে তুলনীয় পর্যায়ে আমরা আছি কিনা, সেটাই প্রথমে দেখা দরকার :
‘কেউ যদি সোভিয়েট ইউনিয়নের ১৯৪৭ সালের সংবিধানের সঙ্গে তুলনা করে সেই পর্যায়ে আমাদের সমাজতন্ত্রের বিধান করার দাবি জানান, তাহলে আমি বলব যে, সেই সমাজের সেই পর্যায়ে আমরা আছি কিনা, আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের মানসিকতা সেই পর্যায়ে আছে কিনা, সেটা বিবেচনা করতে হবে।’
এ থেকে স্পষ্ট করে বোঝা যায় কেন বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে এক চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন, কেন বলেছিলেন যে, চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেক দূরের পথ, এর জন্যে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
চতুর্থত, সবশেষে তাজউদ্দীন এ-ও বললেন, ‘সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্রের’ কথা যাঁরা বলেন, তিনি তাদের দলে পড়েন না। কেননা, ‘সম্পূর্ণ’ বলা মানে সে আদর্শের বিকাশের গতি অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। দর্শন সম্পর্কে তার অবধানতার পরিচয় পাই এই স্তবকে :
‘সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্র বলতে কী বোঝা যায়? আমি এটুকু জানি, সমাজতান্ত্রিক দর্শন সম্বন্ধে যে-কেউ যদি বলে, এই জিনিস করলে পরে পূর্ণ সমাজতন্ত্র হয়ে যাবে, তা হলে বলতে হবে যে, ভবিষ্যতে সভ্যতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।’
অর্থাৎ পূর্ণ সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে হেগেলীয় End of Histroy প্রকল্পের মতোই সমার্থক চিন্তা। ‘পূর্ণতার’ দিকে আমরা কেবল পৌঁছানোর চেষ্টাই করে যেতে পারি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে- এর বেশি কিছু নয়। স্পষ্টতই, তাজউদ্দীন সমাজতন্ত্রের Idealized version-এ বিশ্বাসী ছিলেন না। সে জন্যেই তার সিদ্ধান্ত হলো, সংবিধানে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন মিশ্র মালিকানা সমন্বিত অর্থনীতির প্রস্তাবনাই সঠিক হয়েছে :
‘ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েছি দেখে সেটার জন্য সমাজতন্ত্র দাবিদার একটা দল বলেছেন যে, এটা সমাজতন্ত্র হয়নি, আবার আর একটা দল বলছেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যা দেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি, খুব কম দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত মালিকরা বড় ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, দুই দলের কথায় যখন তারা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন, তখন তাদের কারও কথায় কর্ণপাত না করে আমরা যেটা দিয়েছি, সেটাই তাদের গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এটা সুসামঞ্জস্য হয়েছে এবং সুসমন্বিত হয়েছে।’
সবশেষে, তাজউদ্দীন হঠকারী ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ দলে দাবিদার বলে গোষ্ঠীর প্রতি দৃষ্টি দিলেন (এই গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালীনই জাসদের জন্ম হবে)। কেন মালিকানা-প্রশ্নে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রাধান্য রেখেই ব্যক্তি খাতের নিয়ন্ত্রিত বিকাশকে উৎসাহ দিতে হবে- এর পেছনে ‘প্র্যাকটিক্যাল নেসেসিটি’ ছাড়াও জনগণের ‘পশ্চাৎপদ মানসিকতার’ দিকেও সচেতন থাকার কথা বললেন তিনি। বিপ্লব ডি-রেইলড হয়ে যেতে পারে এই হঠকারী অতি বামপন্থি শক্তি ও দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির যুগপৎ সাঁড়াশি আক্রমণে। তাজউদ্দীন বললেন :
‘জনাব স্পিকার সাহেব, আপনি জানেন, আমার সমাজের শিক্ষিত এবং তরুণ এবং অত্যন্ত আদর্শবাদী বলে পরিচিত কিছু কিছু লোক- তাদের সংখ্যা বেশি কি কম, তা নির্ণয় করা আমার পক্ষে খুব কঠিন- যে কার্যকলাপ দেখাচ্ছে, সেটা খুবই দুঃখজনক। যেখানে একটা সমাজতান্ত্রিক বিধানে স্বাভাবিকভাবে বলা যায় যে, যৌথ মালিকানা থাকবে, সেই জায়গায় একদিকে তারা প্রগতির কথা বলছে, আর একদিকে অপরের পকেট থেকে কেড়ে পর্যন্ত সম্পদ নিতে, পয়সা নিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এই যে মনোবৃত্তি, এতে আর যাই হোক, সমাজতন্ত্র যে হবে না, তাতে কোনো সন্দেহ নাই।’
এ রকম হতাশার কথা বঙ্গবন্ধুও তার ১৯৭২-৭৫ পর্বের নানা ভাষণে ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ক্ষেদোক্তি করেছিলেন। প্রথমে তিনি চিহ্নিত করলেন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ও সমমনা অন্যান্য হঠকারী অতি বামদের :
‘এক রাতের অন্ধকারে গুলি করে মারে, আর বলে রাজনীতি করে। রাতে একজন লোক শুয়ে আছে, তাকে জানালা দিয়ে গুলি করে মারল। বলে আমি বিপ্লবী। তুমি বিপ্লবী, না দাগী চোর? এদের কোনো নীতি নাই, এদের কোনো আদর্শ নাই, এদের কিছুই নাই। এরা বড় বড় কথা বলে।… হাটবাজার, চিনির দোকানে, মুরগির দোকানে, সবজির দোকানে ডাকাতি করে বিপ্লব হয় না। ঐ রণদিভের থিওরি ইট মারো, সেপাইয়ের আস্তানায় ইট মারো, ওয়ালে একটা পাথর মারো, এতে বিপ্লব হয় না।’
এই হটকারী অতি বামপন্থি শক্তির মধ্যে দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক শক্তিও প্রথম থেকেই বা একপর্যায়ে এসে মিশে গিয়েছিল। মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলে আসলে তারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে লিপ্ত ছিল। তাদের উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে বলেছিলেন :
‘যারা মনে করেন রাতের অন্ধকারে গুলি করে কিংবা রেললাইন তুলে দিয়ে টেররিজম করে বিপ্লব হয়, তারা কোথায় আছেন তারা জানেন না। … এই টেররিজম দিয়ে দেশের বিপ্লব হয় না, হয় নাই, হতে পারে না। … দুঃখের বিষয়, অনেকে এখনও টেররিজম-এ বিশ্বাস করেন। যাই হোক, ভবিষ্যতে তাদের ভুল ভাঙবে। … আর একটা জিনিস। রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক- তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। … সেই জন্যেই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আর এক মুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আর একটা হচ্ছে পশ্চিম।’
এ ছাড়াও দলের ভেতরে সুবিধালিপ্সু শক্তির অনুপ্রবেশ, দুর্নীতির প্রসার, শৃঙ্খলার স্খলন প্রভৃতি সমস্যার কথা বলেছিলেন সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু। এর থেকে বোঝা যায়, সমাজতন্ত্র গড়ার পথে বাধা কত প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত দিক থেকে আসতে পারে। এর জন্য নতুন মানুষ ও নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। নতুন মানুষ প্রয়োজন- এটা বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীনের জন্য শুধু কথার কথা নয়। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কেন রাতারাতি বা স্বল্পতম সময়ে করা যাবে না সে সম্পর্কে তাজউদ্দীনের সর্বশেষ যুক্তির দিকে এটা আবারও আমাদের ধাবিত করে। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবরের সেই ভাষণে তাজউদ্দীন তাই স্বীকারোক্তি সুরে বলে উঠেছিলেন :
‘মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত, প্রত্যেকটি মানুষ সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত কেবল আইন লিখে সুষ্ঠুভাবে আমরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। তাই আমি আবার বলছি, বারবার বলতে চাচ্ছি যে, যে সমস্ত প্রগতিশীল দল এবং দেশপ্রেমিক দল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তাদের কর্তব্য হবে আজকে সেই মানুষ গড়ে তোলা, যে মানুষ সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হবেন, যে মানুষ যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী হবেন। যে মানুষ অপরের থেকে কেড়ে নিয়ে মালিক বনে সমাজতন্ত্রবাদী হওয়ার দাবি করবেন না। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেই হোন আর যাই হোন, তিনি সেই ব্যক্তিগত পুঁজিবাদী থেকে কোনো অংশে কম দোষী হবেন না, তার চাইতে কোনো অংশেই ভালো মানুষ বলে পরিচিত হবেন না। কাজেই আজকে সেই মানুষ আমাদের সৃষ্টি করতে হবে।’
নতুন মানুষ আগে সৃষ্টি হবে, নাকি নতুন উৎপাদন সম্পর্ক আগে সৃষ্টি হবে, নাকি দুই-ই ‘দ্বান্দ্বিকভাবে’ একত্রে সৃষ্টি হবে- এটি মার্কসীয় সমাজ বদলের তত্ত্বের একটি অতি পুরাতন সমস্যা। সম্ভবত তাজউদ্দীন জানতেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন কতকগুলি বিষয়ীগত (সাবজেকটিভ) ও বস্তুগত (অবজেকটিভ) অবস্থার ওপরে নির্ভরশীল। সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের পূর্বশর্ত সম্পর্কে মার্কস যা বলেছিলেন তা ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। A Contribution to the Critique of Political Economy গ্রন্থের বিখ্যাত ‘ভূমিকায়’ মার্কস লিখেছিলেন :
‘No social order is ever developed before all the productive forces for wihch it is sufficient have been developed, and new superior relations of production never replace older ones before the material conditions for their existence have matured within the framework of the old society.’

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটিও তাই শুধু ইচ্ছাপূরণের বিষয় না হয়ে বিষয়ীগত এবং বস্তুগত পরিস্থিতির বিকাশের ওপরে নির্ভর করে গড়ে উঠবে। এমনটাই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকট সহকর্মীদের দ্বারা প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের সার্বিক আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে। তবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণার মধ্যে কতটুকু গণতন্ত্রের ওপরে জোর দেওয়া হবে, আর কতটুকু সমাজন্ত্রের ওপরে গুরুত্ব দেওয়া হবে, এ নিয়ে সেদিনের গণপরিষদের ভেতরে এবং বাইরে বেশ কিছুটা ভিন্ন মত ছিল। গণপরিষদের ভেতরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন এই বলে যে, প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশের একটা বড় ত্রুটি তার মধ্যে গণতন্ত্রকে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। যদিও সেসব দেশের সাম্প্রতিক ঝোঁক হলো রাষ্ট্রের আরও গণতন্ত্রায়নের প্রতি। এ জন্যে এসব দেশে নানা ধরনের সাংবিধানিক সংশোধনী আসছে। স্ট্যালিন আমলের সঙ্গে ক্রুশ্চেভের আমলে তুলনা করে তিনি বললেন যে, ‘কে ভুল ছিল, কে শুদ্ধ ছিল, বলব না। তবে ক্রুশ্চেভের সময় থেকে মৌলিক মানবিক অধিকার ও গণতন্ত্রকে দেওয়ার জন্য মানুষের একটা প্রচেষ্টা সোভিয়েট রাশিয়ায় চলছে এবং যা আজকে কোসিগিনকে পর্যন্ত করতে হচ্ছে। তাতে বোঝা যায় রাশিয়ায় আজ গণতন্ত্রকে গ্রহণ করার প্রচেষ্টা চলছে এবং কালের উত্তরণে এই প্রবণতা যদি এগিয়ে যায়, তাহলে এমন সময় আসতে পারে, যখন গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব।’ অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মডেল সোভিয়েতের জন্যও প্রযোজ্য। গণতন্ত্র ছাড়া সমাজতন্ত্র আখেরে কার্যকর হয় না এবং সে কারণে এসব দেশের জন্যও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রই চূড়ান্ত পরিণাম হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। তার মানে ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রের মডেলে বেশি করে গণতন্ত্রের প্রতি জোর দিতে হবে। এটাই হচ্ছে মূল যুক্তি :’সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নতুন নতুন কর্মপন্থা যারা দেবে, জনগণ তাদেরকেই ভোট দেবে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র হবে- এই আদর্শকে অবলম্বন করে যাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারে।’ এম মনসুর আলীও একইভাবে মনে করেছেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ‘সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান’। শুধু তাই নয়, সংবিধানে এর সংযোজন সারা বিশ্বেই একটি অনন্য উদাহরণ :’একমাত্র বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে এই যে গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান এবং অগ্রসর হওয়া এটা সম্ভব। কেননা, অস্বীকার করার উপায় নাই যে, যে সমাজতন্ত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটা সত্যিকারের সমাজতন্ত্র হতে পারে না। মানুষের মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, বিকাশ লাভ করে, সেই সমাজতন্ত্রই প্রকৃত সমাজতন্ত্র।’
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭৩

৩. গণতন্ত্রের হাত ধরে এই সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করা শক্ত- এটা স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে : ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশায় রয়েছেন। সংবিধানে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছে।’ কিন্তু ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা’ আর ‘গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’ এ দুটো লক্ষ্য পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠবে না তো? এই সম্ভাবনা স্বীকার করে বলা হচ্ছে : ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করতে গিয়ে আমরা যে নতুন পথে চলেছি, সে বিষয়ে আমরা সচেতন। সমাজতন্ত্রের দিকে পরিকল্পিত অগ্রগতির পথে যাতে কোনো বাধা সৃষ্টি হতে না পারে, সেজন্য সংবিধানে কয়েকটি বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে।’ এর মধ্যে একটি হলো, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে ‘সম্পত্তির অধিকারকে’ সীমাবদ্ধ করা। উদ্ৃব্দতিটি তাৎপর্যপূর্ণ :

‘সম্পত্তির অধিকার বা ব্যবসা ও বাণিজ্যের অধিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, ভূমি-সংস্কার ও অন্যান্য ব্যবস্থার পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। এই জন্যে আমরা বলেছি যে, আইন সাপেক্ষে এইসব অধিকার ভোগ করা হবে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন মনে করলে সংসদ এই সব অধিকার হরণ করতে বা সীমাবদ্ধ করতে পারবেন। সংসদ যদি সেরকম কোনো আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে আদালত তা নাকচ করতে পারবেন না। নাগরিকদের অধিকার রক্ষার পূর্ণ ক্ষমতা আদালতকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে সম্পত্তি ও ব্যবসা সংক্রান্ত যেসব আইন সংসদ তৈরি করবেন, আদালত সেগুলো নাকচ করতে পারবেন না।’

অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে এমন ধুয়া তুলে কালক্ষেপণ করা যাবে না। এখানে লিবারেল প্রিন্সিপলকে অতিক্রম করে সোস্যালিস্ট প্রিন্সিপলকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এক হিসাবে, মিলকে ছাড়িয়ে এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মার্কসের উত্তরাধিকার। এই সমাজতন্ত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ ধারণার চেয়ে স্পষ্টতই আরও বেশি কিছু। এ কথা স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৯ অক্টোবরের ভাষণে। সেই ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমার দালিলিক আলোচনাকে সমর্থন করে :

‘আমার বন্ধু যারা অনেক সময় ইতিহাসের বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করেন, তারা পর্যালোচনা করে অনেক সময় দেখতে চান না যে, যেদিন সমাজতন্ত্রের প্রোগ্রাম আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছিল, সেদিন আজকের অনেক দল শুধুমাত্র welfare state-এর প্রোগ্রাম নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে যখন আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রাম করতে করতে মানুষের অধিকার এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের পন্থাকে চিন্তা করে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম, তার পূর্ব হতেই আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম করে আসছিল।’

তারপরও গণতন্ত্রের পথ ধরে সমাজতন্ত্রে পৌঁছনো যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় ছিল অনেকের মনেই। ওই একই বক্তৃতায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন : ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব কি সম্ভব নয়, সেই বিতর্কে আমি যাব না। তবে আমরা বিশ্বাস এবং আস্থার সঙ্গে সেই পথ বেছে নিয়েছি। বেছে নিয়েছে সারা জাতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, একনায়কত্ব নয়।’ সমাজতন্ত্রের দিকে চলার পথে গণতন্ত্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা সে সম্পর্কে সাংবিধানিক ধারা সংযোজন করা দরকার এই মর্মে ড. কামাল হোসেন যে কথা ইতোপূর্বে বলেছিলেন, এবার তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি। গণতান্ত্রিক সব অধিকারই থাকবে, শুধু একটি জায়গায় ছাড়া। সেটি হলো শাসনতন্ত্রের তৃতীয় ভাগের ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ। সৈয়দ নজরুল বললেন :

‘যারা মনে করেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়, তারা যে প্রশ্নটি করেন সেটা হলো এই যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকার যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত করা অথবা সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য রাষ্ট্রের যদি যে কোনো সময় সম্পত্তির অধিকার করা অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তার প্রতি সেটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিনা… আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এই প্রশ্ন এসেছিল। যেদিন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ব্যাংক, ইনসিওরেন্স জাতীয়করণ করার জন্য আইন পাস করেছিল, সেদিন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস জনাব হেদায়েতুল্লাহ তাকে নাকচ করেছিলেন এই বলে যে, সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের প্রশ্নের এটা বিরোধী। সেজন্য আমাদের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণেতাগণ অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন ছিলেন বলে এই শাসনতন্ত্রের তৃতীয় ভাগে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রযোজিত হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং মৌলিক আদর্শের প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত করার আদর্শকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।’

গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্টের পূর্ব ইতিহাস রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের- এ কথা সেদিনের গণপরিষদের বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করেছেন তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তার বক্তব্য পরিস্কার- গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার যেমন দীর্ঘদিনের, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার প্রতিও দলটির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বহু বছর আগে থেকেই চলে আসছে। সেটা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সংগ্রামে আরও বেশি করে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু এর উৎপত্তি আরও আগে। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ঘোষণা ও কর্মসূচির আলোচনায় আমি কিছুটা আলোচনা করেছি। কিন্তু তার একটি সাক্ষ্য পাচ্ছি স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদের সেদিনের ভাষণেও। সেটি এবার শুনে নেওয়া যাক। ৩০ শে অক্টোবরের এই ভাষণে তাজউদ্দীন সংসদে বলেছিলেন :

‘অর্থনৈতিক অধিকারের কথা বলতে গেলে আজকে গর্বের সঙ্গে এই পরিষদে ঘোষণা করতে চাই, আমার দল আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের ৬, ৭, ৮ তারিখে ঢাকার গ্রিন রোডের আমবাগানে যে কাউন্সিল অধিবেশন করেছিলেন, তাতে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে পরিস্কার ভাষায় এ দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন ধাপে জাতীয়করণের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার বিধান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে গৃহীত হয়। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে এ দেশে সমাজতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন। আগে সমাজতন্ত্রের কথা মানুষ পরিস্কারভাবে বুঝত না। যারা সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল তারা মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত। সমাজতন্ত্রের কথা বললে সমাজতন্ত্রকে ধর্মের সঙ্গে জড়িত করে তাকে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হতো এবং মানুষের এক অংশকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যেত। আজকে আওয়ামী লীগ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্কারভাবে সমাজতন্ত্র কী, তা বলে দিয়েছে।’

এরপর তাজউদ্দীন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেব সমাজতন্ত্রের কথা তুললেন : ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ৪৭ অনুচ্ছেদের কথা।’ এরপর ‘প্রগতিবাদী’ সমালোচকদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন : ‘যারা প্রগতিবাদী বলে দাবি করেন, তারা সমালোচনা করছেন এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক সংবিধান নয় বলে। আমি জানি না, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, সে পরিকল্পনা কেউ যদি দিতে পারতেন, তাহলে এই পরিষদ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন। আমি সমাজতান্ত্রিক দেশের বিভিন্ন সংবিধান- ২৫ বছর আগের, ৩০ বা ৫০ বছর আগের সংবিধান দেখেছি। তাতে যে বিধান রয়েছে সে বিধান আজকে বাংলাদেশের সংবিধানের চাইতে যে উন্নত, সে কথা বলা চলে না … তবে বাস্তব ভিত্তিতে এই অবস্থায় এ দেশে সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্র করা যাবে কিনা, সেটা দেখতে হবে।’

এটা বলেই তাজউদ্দীন লক্ষ্য করেন যে, সেদিনের বাংলাদেশে সম্পূর্ণ সমাজতন্ত্র দূরে থাক, পূর্ণ গণতন্ত্রও বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন : ‘আজকে আমাদের সামনে সবচাইতে বড় যে কর্তব্য রয়েছে, সেটা হচ্ছে আমাদের সমাজের অবস্থা লক্ষ্য করা। … আজকে আমাদের সমাজের যে অবস্থা, তাতে সমাজতন্ত্র দূরের কথা- পূর্ণ গণতন্ত্রের অবস্থাও আসতে পারে না।’ তাজউদ্দীনের গোটা ভাষণে তার স্বভাবসুলভ বিশ্নেষণী মনের ছাপ আগাগোড়া ফুটে উঠেছে। প্রথমত, ‘কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে’ এবং এই লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতীকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য’ রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার- এ কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করলেন ‘সমবায় ভিত্তিতে যৌথ কৃষি খামার’ করার কথাও, কেননা এ ব্যাপারে (সমবায়ী মালিকানা স্বীকার করে নেওয়ার পর) ‘এই সংবিধানে (আর) কোনো বাধা নেই।’

তাজউদ্দীনের সেদিনের ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ব্যক্তি-পুঁজির প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার আবশ্যকতা নিয়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিখাতের মধ্যে সুসামঞ্জস্য অনুপাত থাকা দরকার এটা ব্যাখ্যা করে তিনি যা বললেন তার সরলার্থ হলো বাস্তবের নিরিখে ও কালক্রমে এই অনুপাত পরিবর্তিত হতে পারে। প্রথমত, ‘উঠতি পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমরা ব্যবস্থা করেছি’; এই উঠতি পুঁজিবাদ যাতে বিধ্বংসী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারে সেদিকে রাষ্ট্রের সজাগ দৃষ্টি থাকবে। পুরো উদ্ৃব্দতিটি প্রণিধানযোগ্য :’আজকে ব্যক্তিগত মালিকানা, ব্যক্তিগত পুঁজিতে যে সংশয়ভাব দেখা দিয়েছে, তাতে শুধু এটাই আমরা বলতে পারি, আইনের বিধান মোতাবেক ব্যক্তিগত মালিককে যেটা দেওয়া হবে, সেটার মালিকানা সে নিশ্চয়ই আইনের বিধান-অনুযায়ী নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারবে। আইনের বিধান-অনুযায়ী কোনো অবস্থাতেই অর্থনৈতিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু পুঁজিপতিদেরকে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দ্বারা সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। কাজেই, … আজকে ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকুই দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত শোষণ, ব্যক্তিগত বঞ্চনা এবং ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। এটা পরিস্কার থাকা ভালো।’

দ্বিতীয়, ব্যক্তিগত পুঁজিকে যদি নিয়ন্ত্রণে রেখেই বিকাশ করতে দেওয়া হয়, তাহলে সংবিধানে এর নিম্নসীমা-ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হলো না কেন? কেন ব্যাপারটাকে অনংঃৎধপঃ রাখা হলো কেবল ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদের ত্রিবিধ মালিকানার কথা বলে? এ বিষয়ে তাজউদ্দীনের সুচিন্তিত উত্তর হচ্ছে, পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে মাথায় রাখতে হবে :

“ব্যক্তিগত মালিকানা অবশ্য আইনের বিধান মোতাবেক হবে এবং ব্যক্তিগত মালিক যাতে করে সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, মুনাফা বৃদ্ধি করে, সম্পদ বৃদ্ধি করে তার ‘প্রফিট’ দিয়ে আমার সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থাকে বানচাল করতে না পারে, তার ব্যবস্থা আইন অবশ্যই করবে। বলা হয়েছে, তা হলো সেই বিধান সংবিধানে কেন করা হলো না? আমি আগেই বলেছি, সংবিধানে সব আইন, চুলচেরা আইন বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা যায় না, করা বাঞ্ছনীয় নয়। কতটুকু করা হবে, সেটার উচ্চসীমা, নিম্নসীমা কতটুকু থাকবে, সেগুলি সংবিধানে বেঁধে দেওয়া যায় না। ভবিষ্যৎ সংসদ সে উচ্চসীমা বা নিম্নসীমা, কোন সময় তার কতটুকু সীমা নির্ধারণ করা উচিত, তা বিবেচনা করে দেখতে পারবেন।”

অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সংসদে যারা আসবেন, তারা সে সময়ের পরিস্থিতি বিচার করে ব্যক্তিগত পুঁজির চৌহদ্দি নির্ধারণ করবেন। তবে পাকিস্তানের বাইশ পরিবারের মতো একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ যে স্বাধীন বাংলাদেশে করতে দেওয়া হবে না, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই সংবিধান প্রণেতাদের মনে।

তৃতীয়ত, অনেকে বলেছেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা রয়েছে বলে সমাজতন্ত্র আর থাকে না। এরও উত্তর দিলেন তাজউদ্দীন। তিনি দেখালেন যে, সমাজতান্ত্রিক এমন অনেক দেশ, রয়ে গেছে যেখানে ব্যক্তিমালিকানা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। যেমন- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের ৯১ অনুচ্ছেদে দেখতে পাবেন সেখানে তারা ৪ প্রকারের মালিকানা দিয়েছে।’

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৭২

পূর্বে প্রকাশিতের পর

তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আমীর-উল ইসলাম, আছাদুজ্জামান খান, আবু সাইয়িদ প্রমুখ। সংবিধান রচনা কমিটির প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। কয়েক মাসের কাজের পর ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ খসড়াটি সংসদে ‘বিল আকারে’ উত্থাপন করেন ড. কামাল হোসেন। উল্লেখ্য, ১৭ এপ্রিল থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ড্রাফটিং কমিটির ‘৭৪টি বৈঠক’ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ৮ মে’র মধ্যে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে ‘৯৮টি প্রস্তাব’ জমা পড়ে ড্রাফটিং কমিটির কাছে। অবশ্য এই ৯৮টি প্রস্তাব ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়নি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এমনকি ড্রাফটিং কমিটির সভার বিবরণীও পরবর্তীকালে পাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ৭৪টি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তথ্যে ধারণা করা যায় যে, ড্রাফটিং কমিটিতে বিভিন্ন ধারা ও উপধারার সংযোজন-বিয়োজন নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যবহার নিয়ে মতানৈক্য ঘটেছিল। শেষ পর্যন্ত যে খসড়াটি উত্থাপিত হয় তাতে ৩৪ জনের সবাই একমত হননি। খসড়াতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আপত্তি জানিয়েছিলেন মোট ৬ জন সদস্য। ১২ অক্টোবরে সংসদে উত্থাপনের পর খসড়া সংবিধানের ওপরে গণপরিষদ সদস্যদের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। এটাও জানানো দরকার যে, সংবিধানটি প্রথমে ইংরেজিতে রচনা করা হয়, এবং পরে তা বাংলায় অনুবাদ করা হয়। বস্তুত ইংরেজিতে লেখা এবং বাংলায় অনুবাদ-কর্ম পাশাপাশি চলছিলো। খসড়া সংবিধানটি সংসদে উত্থাপিত হয় বাংলা ভাষায়। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি থেকে ভাষান্তরের জন্য গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান ও কমিটির অন্য দু’জন সদস্য ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ড. মজহারুল ইসলাম। ইংরেজি থেকে অনূদিত হলেও এটা পরিস্কার হয়েছিল যে, যদি কখনও ইংরেজি পাঠের অর্থ-উদ্ধার বা ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, তবে সে ক্ষেত্রে ‘বাংলা পাঠকেই’ চূড়ান্ত পাঠ বা মানদণ্ড হিসেবে ধরা হবে। এজন্য সংবিধানের ‘বাংলা পাঠ’-এর গুরুত্ব অপরিসীম।

উত্থাপিত খসড়ার প্রতিটি ধারা-উপধারার শব্দগত, ব্যুৎপত্তিগত ও তাৎপর্যগত বিচার-বিশ্নেষণ করা হয়। বলা যায়, দীর্ঘ এক মাসব্যাপী উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই কেবল সংবিধানটি সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সৌভাগ্য ক্রমে, এই সংসদীয় বিতর্কের প্রসেডিংস পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। ভারতের সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক চলেছিল ১১৪ দিন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা চলেছিল ২৪ দিন। আপাতদৃষ্টিতে ওই তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে বিতর্ক সমাপ্ত হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল, রাষ্ট্রের মূল মূল পরামর্শ ও নীতিমালার বিষয়ে সেদিনের গণপরিষদে ব্যাপক ঐকমত্যের উপস্থিতি। এই সীমিত বিভেদের পেছনে প্রধান কারণ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত সার্বিক রাজনৈতিক উপলব্ধি যা নিয়ে সেদিন গভীর ঐকমত্য বিরাজ করছিল (যার ওপরে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিস্তৃত দালিলিক আলোচনা করা হয়েছে)।

যেহেতু আমাদের আলোচনার মূল সূত্র আবর্তিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ও সংবিধানের সমতামুখীন আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে, সেহেতু আমরা এখানে বিশেষভাবে নজর দেব কয়েকটি বিশিষ্ট সাংবিধানিক ধারার প্রতি। অর্থাৎ সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা না করে এর অর্থনৈতিক রূপকল্পের মধ্যে আমাদের মনোযোগ সীমিত থাকবে। এই অর্থনৈতিক ধারাগুলোর রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে অতীতে সেভাবে আলোচনা হয়নি। এসব ধারার বিচার-বিশ্নেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে অনেক কাছে থেকে অনুধাবন করা যায়। এক্ষেত্রে আপাতত আমার হাতের কাছে তথ্য-উৎস চারটি : ক. ড্রাফটিং কমিটির রিপোর্ট (যেটি, ১০ জুন ‘খসড়া সংবিধান’ তৈরি হওয়ার সময় একটি আলাদা ডকুমেন্ট হিসেবে প্রস্তুত করা হয়); খ. কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত খসড়া সংবিধান; গ. এই খসড়া সংবিধানের ওপরে বাহাত্তরের গণপরিষদে আলোচনার প্রসেডিংস, এবং ঘ. সংসদে অনুমোদিত চূড়ান্ত সংবিধান। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় সংবিধান সম্পর্কিত অনেক বিচার-বিশ্নেষণ নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়ে। কিন্তু সেসব খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ আমার এখনও হয়নি। তাছাড়া সেদিনের অনেক ব্যক্তিই আর জীবিত নেই। ফলে অনেক প্রাসঙ্গিক ‘ইন্টারভিউ’ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপরোক্ত তথ্য-উৎসসমূহের ঘনিষ্ঠ পাঠে বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে কয়েকটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসে।

আমার কাছে প্রথমেই যেটা চোখে পড়েছে তা হলো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য ও আদর্শে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ। সংবিধানের কাঠামোয় গণতন্ত্রের উদারনৈতিকতার নীতি (যাকে আমি বলছি- ‘লিবার্টি প্রিন্সিপল’), আর শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার নীতি (যাকে আমি বলছি- ‘সোশ্যালিস্ট প্রিন্সিপল’)- এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করার দুরূহ কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল সেদিন। এই চ্যালেঞ্জটাই বঙ্গবন্ধু সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। ড্রাফটিং কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল :

‘The Committee has also been conscious that at least in one major aspect it would be breaking new ground in making promises which would fulfill the pledge embodied in the preamble that ‘It shall be a fundamental aim of the state to realise through the democratic proces a socialist society, free from exploitation.’

অর্থাৎ শুধু চার মূলস্তম্ভকে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- সংবিধানের বিভিন্ন দফা-উপদফার মধ্যে প্রতিফলিত করাই নয় ড্রাফটিং কমিটির কাজ (সেটা তো একটা প্রাথমিক কর্তব্য বটেই)। এর সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত সাংবিধানিক নিরাপত্তা-কবচ (safe-guards) তৈরি করা। কেননা, তৃতীয় বিশ্বের পটভূমিতে এরকম গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সাংবিধানিক রূপ- অন্তত আগে থাকতেই ঠিক করে নিয়ে বা পূর্ব-নির্ধারিতভাবে-এর আগে কখনও রচিত হয়নি। এমন এক সংবিধান হতে হবে যেখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এ দুইয়ের মধ্যে কোনোটিকেই ভারসাম্যহীনভাবে ভারী করে তোলা হবে না। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করা হবে সচেতনভাবে- যাতে করে কোনো একটি আদর্শের প্রতি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গতিমুখ একপেশেভাবে ঝুঁকে না যায়।

এরকম সমন্বয়ের সমাজ তথা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারা সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াই বাস্তবে অব্যাহত রাখা যাবে কিনা আগামী দিনগুলোয়- বাহাত্তর সালেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। অবস্থার দুর্বিপাকে, দেশি-বিদেশি শত্রুর চাপে, লিডারশিপের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কারণে, বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির কারণে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে- এ বিষয়ে সংবিধান প্রণেতারা (এবং বঙ্গবন্ধু) অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তারপরও একটাকে বিসর্জন দিয়ে অন্যটিকে আঁকড়ে ধরতে চাননি তারা। কয়েকটি উদাহরণ।

খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তার সূচনা বক্তব্যে বললেন, ‘শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ- তার অর্থ মালিকবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কতর্ব্যও থাকবে।’ এখানে বলা দরকার, গান্ধী Universal Declaration of Human Rights-এর পাশাপাশি Universal Declaration of Human Duties-এর ঘোষণা চেয়েছিলেন। অধিকার ও কর্তব্য-এ দুইয়ের অন্তর্লীন যোগাযোগ স্মরণ করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সংবিধানের মূল আদর্শকে আবারও তুলে ধরলেন সংসদ সদস্যদের সামনে:

‘এবং যতদূর সম্ভব, যে শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়েছে, সেটা যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে, তা সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের আদর্শ পরিস্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিস্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এদেশ চলবে। জাতীয়তাবাদ- বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালির রক্ত দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকারকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে। যেখানে শোষণহীন সমাজ থাকবে। শোষক শ্রেণি আর কোনোদিন দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। এবং সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৫৪,০০০ বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবে না। সে জন্য অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক। আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। … কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। … এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরি হবে। এটা জনগণ চায়, জনগণ এটা বিশ্বাস করে। জনগণ এজন্য সংগ্রাম করেছে। লক্ষ লক্ষ লোক এই জন্য জীবন দিয়েছে। এই আদর্শ নিয়েই বাংলার নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।’

এর পরে ভাষণ দিতে উঠলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। সেখানে তিনি প্রথমে সমাজতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করলেন এবং পরে গণতন্ত্রকে রেখে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যা সম্পর্কে ইঙ্গিত করলেন। উদ্ৃব্দতিটি বড়, কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সেদিনের সংসদের Pulse বোঝার জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর বিশেষ বিশেষ দিকটি নিচে তুলে ধরা হলো।

১. অনুন্নত দেশের পটভূমিতে ‘সমাজতন্ত্র’ আর উন্নত পুঁজিবাদী দেশের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর মধ্যে পার্থক্য আছে : ‘আমাদের কাছে সমাজতন্ত্র বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা বুঝি এমন এক সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে জাতিকে এবং জাতীয় অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে আত্মত্যাগের প্রয়োজন, সকলে তা ভাগ করে নেবে। আবার সকলের প্রচেষ্টায় যে সম্পদ গড়ে উঠবে, তাও সকলে সুষমভাবে ভাগ করে নেবে। আমাদের সংবিধানে তাই সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র পরিচালনার একটা মূলনীতি বলে ঘোষিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মালিকানার নীতিতে বলা হয়েছে যে, প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে। আর আইন যে সীমা নির্ধারণ করবে, সেই সীমার মধ্যে সমবায়গত বা ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে।’ অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির চরিত্র হবে মালিকানা-সম্পর্কের দিক থেকে ‘মিশ্র চরিত্রের’, যদিও Mixed Economy শব্দটি সেদিন ব্যবহূত হয়নি।

২. শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানা নয়, এই সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য মানুষকে শোষণ থেকে মুক্তি দেওয়া এবং তাকে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ ও সুযোগের অধিকার দেওয়া : ‘সর্বপ্রকার শোষণ থেকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশকে মুক্তিদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ যাতে সকল নাগরিক লাভ করতে পারেন, সেই দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। সকল নাগরিক যাতে সমান সুযোগ পেতে পারেন এবং রাষ্ট্রের সর্বত্র যাতে সমান স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন লাভ করা যায়, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবেন।’ অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে নাগরিকেরা দার্শনিক জন রাউলস (Rawls) এর ভাষায় শুধু Formal Equality of Opportunity নয়, তারা Substantive Equality of Opportunity-রও অধিকারী হবেন। এর অর্থ, এটা শুধু যেনতেনভাবে পাওয়া মৌলিক সুযোগের সমতা বিধান নয়। এখানে গুণে-মানের সমতারও (Equality of Standards) কথাও থাকছে। দ্বিতীয়ত, এখানে শুধু  Equality of Opportunity বা সুযোগের সমতার মধ্যেই আলোচনা সীমিত রাখা হয়নি। Equality of Outcomes-র কথাও অনুমিত থাকছে। সুযোগের সমতার পাশাপাশি নাগরিকেরা যাতে করে সর্বত্র ‘সমান স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ লাভ করেন, রাষ্ট্র তা ‘নিশ্চিত করবে’- এটার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।

[ক্রমশ]