বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৬০
 পূর্বে প্রকাশিতের পর
এই আগ্রহ বঙ্গবন্ধু এর আগেও দেখিয়েছেন। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে আনিসুর রহমানকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছেন। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন :
– ‘আপনার গ্রামের কাজ কেমন চলছে।’
আনিসুর রহমান তা নিয়ে কিছু কথা বললেন; চলে এলো রংপুর স্বনির্ভর আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কিছুক্ষণ পর মুজিব আসল কথায় আসলেন :
– ‘ডাক্তার সাহেব আমার একটা আইডিয়া এসেছে।’
-‘কী আইডিয়া?’
-‘আমি একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকি। আমি সেখানে বসে থাকবো, আর আপনি আপনার এই সব আইডিয়া বলবেন। সবাই শুনবে।’
আনিসুর রহমান দ্বিধান্বিত। তিনি এখনই এতে ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি নন। তিনি বললেন : আপনি তো জানেন এই কাজ নিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন-বিতর্ক চলছে। এ সময় আপনি এরকম বড়ো কিছু করলে সেটা ব্যাক-ফায়ার করতে পারে, যারা এর বিপক্ষে, ছাত্রদের মধ্যেই হোক, আমলাদের মধ্যেই হোক, তারা এই কাজকে এতখানি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দেখে এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে পারে। আমার মনে হয়, কাজটা আপনাআপনিই আরও এগোক? আরও পরে দেখা যাবে একে নিয়ে কী করা যায়।
আনিসুর রহমান সংশয়ে ছিলেন সেদিন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট উৎসাহিত হয়েছিলেন গ্রামের স্বনির্ভর আন্দোলন সম্পর্কে। চেয়েছিলেন একে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে আনিসুর রহমানের প্রেরণায় স্থানীয় মিঠাপুকুরের ছেলেরা ‘ধান কাটছে’ এ খবর শেখ মুজিবুরের কাছে পৌঁছেছিল। তিনি সেদিনও আনিসুর রহমানকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
– ‘শুনছি খুব গ্রামে যাচ্ছেন, কী করছেন বলেন।’
আনিসুর রহমান তাঁকে বললেন কী করছেন, কী দেখছেন- এসব। শুনে বঙ্গবন্ধুর চোখটা যেন চক চক করে উঠল। বললেন,
– “খুব ভালো কাজ। শোনেন, এটা আমার আর আপনার প্রোগ্রাম- আপনি আমার দফতরে একটা সেল খোলেন, ধরুন তার নাম হতে পারে ‘স্টুডেন্টস, মবিলাইজেশন সেল’। আপনার কিছু সাপোর্ট লাগবে- আমি আপনাকে কয়েক লাখ টাকা দেব, আর কয়েকটা জিপ ইত্যাদি। আর প্রত্যেক সপ্তাহে আমি নিজে আপনাকে দু’ঘণ্টা সময় দেব। আপনি আমাকে যে কোনো গ্রামে যেতে বলবেন আমি যাব, যেয়ে আপনার সঙ্গে কোদাল দিয়ে মাটি কাটবো। আপনাকে আর প্ল্যানিং কমিশনের অন্য কোনো কাজ করতে হবে না- এটাই হবে আপনার কাজ।”
যে কোনো কারণেই হোক, আনিসুর রহমান এত তাড়াতাড়ি এ কাজে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে জল ঢেলে তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না ওপর থেকে এ রকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করবার এখনি সময় এসেছে। ছাত্রদের খুব অল্প পার্সেন্টেজই এই উদ্যোগে নেমেছে, অন্যেরা নামেনি, এবং অনেকে এটা নিয়ে অনেক সমালোচনাও করছে। উদ্যোগটা নিজের গতিতে এগোক। কোনো পর্যায়ে যদি প্রক্রিয়াটা থেকেই কোনো রকম সাপোর্টিং কাঠামোর প্রয়োজন দেখা যায়, তাহলে আমি আপনাকে জানাবো।’ সেদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এতে নিরাশ হয়েছিলেন। খানিকটা হয়তো বিষণ্ণ : ‘প্রধানমন্ত্রী চুপ করে থাকলেন আর কিছু বললেন না।’ আমার ধারণা, গ্রামের কাজে তরুণ শিক্ষার্থীদের জড়ানো, গ্রামের মানুষদের স্বনির্ভর করা এবং এসব কাজে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে উৎসাহ দান- এসব ‘আইডিয়া’ বঙ্গবন্ধুর মাথায় স্থায়ীভাবে গেঁথে গিয়েছিল। এর অনেক কিছুই বাকশালের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় পরবর্তী সময়ে জায়গা করে নেবে।
গ্রাম-জীবনকে অর্থনীতি পলিসির ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এমনকি অর্থনীতি শিক্ষার ক্ষেত্রেও ‘পাঠ্যরূপে’ গণ্য করতে হয়, এ চিন্তা এদেশে রবীন্দ্রনাথের মনেই প্রথম এসেছিল। ১৯৩৯-এ প্রকাশিত হয় স্যার আজিজুল হকের (তিনি ছিলেন অখণ্ড বাংলার শিক্ষামন্ত্রী) বিখ্যাত বই  ‘The Man behind the Plough’ । গ্রন্থটি হাতে পেয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখলেন :(ভূঁইয়া ইকবালের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করছি)
‘এখানে তোমার ইংরেজি বইখানা- লাঙলের পিছনকার মানুষটি আমার হাতে পড়ল। বাংলাদেশের এই উপেক্ষিত অকিঞ্চনদের জীবনযাত্রার সুবিস্তীর্ণ ভূমিকাটি তুমি যে রকম বিস্তারিতভাবে বিবৃত করেছ, এমন আমি আর কোনো বইয়ে দেখিনি। তোমার নিরলংকার বাস্তব বর্ণনার ভিতর দিয়ে বাঙালি কৃষিজীবীর দুর্ভাগ্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এই বইখানি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি শিক্ষা বিভাগে পাঠ্যরূপে গণ্য করা উচিত।’
রবীন্দ্রনাথের মতোই সমবায় ও কৃষি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং সে লক্ষ্যে প্রাথমিক আয়োজনও শুরু করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাবনায় এক ভাষণে সর্বপ্রথম তিনি ‘নন-মার্কেট’ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছেন- এর ফলে সরকারের কোষাগারে কম রাজস্ব জমা পড়বে। কিন্তু রাজস্ব না পেলে সরকার চলবে কী করে? পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে- ‘একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল পায় না।’ আর ‘সাত কোটি মানুষের গাছ, যে গাছকে পথের ভিখারী করে দিয়ে গেছে।’ এই অবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে কতগুলো ক্ষেত্রে ‘নন-মার্কেট’ ভিত্তিতে ব্যাপক  Labour Mobilization করা দরকার হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু তার সোজা সহজ ভাষায় বললেন:
‘আমার কৃষক খাজনা দিবার পারে না। আমি বলে দিলাম, বকেয়া খাজনা সুদসহ সব মাফ। ২৫ বিঘা যাদের জমি আছে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত তাদের খাজনা… রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাফ হয়ে যাবে। … অন্যান্য যে ট্যাক্স আছে তা দিতে হবে, না হয় সরকার চালানো যাবে না। … সেজন্য আপনাদের কাজ করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে এই যে কুড়ালি পয়সা যদি আমার থাকত, আমি বলতাম দিলাম পয়সা, কুড়াব কুড়াল। পয়সা নাই বলে আমি বলছি। আমিও কুড়াল মারি, তোমরাও মার। ইনভেস্টমেন্ট যত রাস্তা খাল এগুলো আপনাদের কাটতে হবে। … স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার ছেলেরা কাজ না পায়। কিন্তু সময়ের প্রয়োজন।… আপনাদের সহ্য করতে হবে। কাজ করতে হবে, খাটতে হবে। আর আমি বলেছি কৃষিবিপ্লব। আমার দুনিয়ার কাছ থেকে খালি খাবার কিনতে হবে- পারব না। খাবার তৈরি করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে খাবার উৎপাদন করতে হবে। আমি জানি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু পয়সা কোথায়? চেষ্টা করতেছি। … সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রাখতে হবে। এই দায়িত্ব যেমন সরকারের, এই দায়িত্ব তেমনি জনসাধারণের।’
কৃষি বিপ্লবের চিন্তাটি বিস্তৃত জায়গা করে নেবে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিলে এবং গ্রাম-জীবনের পুনর্নির্মাণের বিষয়টিও আরও বড় পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে বাকশালের অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে। এটা ছিল বাঙালি সাম্য-চিন্তার ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি। আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখের চিন্তার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ক্ষেত্রেও সাম্যবাদ-বিরোধী ও গ্রাম-সমবায় ভিত্তিক প্রকল্পের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন উপাদান সময়ের সাথে সাথে আরও বেশি স্পষ্ট আকার নিচ্ছিল।
৫. উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান
বাঙালির সাম্য-চিন্তা ও বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হয়ে দাঁড়ায় এর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবিস্তারকারী নীতিমালার বিরুদ্ধে বাংলার প্রাগ্রসর চিন্তাবিদ ও লেখকরা বরাবর একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। এর প্রভাব পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনাতেও। ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে ডেভিড ফ্রস্টের সাথে বিখ্যাত সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার চিন্তার ওপরে কোন কোন রাষ্ট্রনায়ক সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছেন?’ উত্তরে মুজিব যাদের নাম করেছিলেন, তাদের মধ্যে লিবারেল ও সমাজতন্ত্রী উভয় গ্রুপেরই বিশ্বনেতাদের উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এক চার্চিলকে বাদ দিলে অধিকাংশই ছিলেন বর্ণবাদ, সাম্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তারা হলেন : ‘লিঙ্কন, মাও, লেনিন, চার্চিল, কেনেডি, গান্ধী, নেহেরু, এ কে ফজলুল হক, এইচ, এম সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, ড. সুকার্নো ও আতার্তুক।’ এই নামগুলো যেভাবে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারে এসেছিল, আমি সেভাবেই এখানে তুলে ধরেছি। এসব নামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদের দিকটি যেমন উন্মোচিত হয়, তেমনি তার ‘মধ্য-পন্থার’ দিকটিও সমানভাবে ফুটে ওঠে। ‘লিবারেল ডেমোক্রেসি’র পথিকদের সাথে এক নিঃশ্বাসে তিনি ‘সমাজতন্ত্রী’ ব্যক্তিত্বদেরও স্মরণ করতে ভোলেননি। তখনও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, মাও তখনও বেঁচে ছিলেন, তার পরও লিঙ্কনের পর প্রথমেই তার মনে এলো চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর কথা। এবং এর পরপরই লেনিনের কথা। গান্ধী, নেহেরু, নেতাজী, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী সবার কথা মনে করলেন, কিন্তু একবারও জিন্নাহর কথা বলেননি তিনি। বলার কথাও নয় তার। আগেই বলেছি, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন কাজ করেছে, তেমনি পুঁজিবাদের চিন্তা-ভাবনাও এখানে প্রভাব ফেলে থাকবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের কথা আলোচনার দাবি রাখে।
রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চিন্তা নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। নেপাল মজুমদার ও চিন্মোহন সেহানবীশ এ নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। প্রথাগত অর্থে বামপন্থি না হয়েও সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট না হয়েও রবীন্দ্রনাথ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অবস্থান নিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, গান ও উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘ইম্পিরিয়ালিজম’ প্রবন্ধটির প্রতি এখানে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেখানে অ-কমিউনিস্ট রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘বিলেতে ইম্পিরিয়ালিজমের একটা নেশা ধরিয়াছে। অধীন দেশ ও উপনিবেশ প্রভৃতি জড়াইয়া ইংরেজ সাম্রাজ্যকে একটি বৃহৎ উপসর্গ করিয়া তুলিবার ধ্যানে সে দেশে অনেকে নিযুক্ত আছেন। … এইরূপ বড় বড় মৎলব পৃথিবীতে অনেক সময় অনেক লোকে মনে মনে আঁটিয়াছে। এ সকল মতলব টেকে না; কিন্তু নষ্ট হইবার পূর্বে পৃথিবীতে কিছু অমঙ্গল না সাধিয়া যায় না।’
Black Lives Matter (BLM) আন্দোলন সম্প্রতি আমেরিকায় অনেক বর্ণবাদী নেতার মূর্তি অপসারণ করেছে। একইভাবে বিলেতেও বর্ণবাদী নেতা স্যার সেসিল রোডসের স্ট্যাচু অপসারণ করা হয়েছে। তার নামে বহু বছর ধরে ‘রোডস স্কলারশিপ’ দেওয়া হয়েছে দেশ-বিদেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের। অনেকে প্রশ্ন করেছেন- মূর্তি সরানোর এই ‘বাড়াবাড়ি’র দরকার ছিল কি? সেই রোডস সাহেব সম্পর্কে ১৯০৫ সালেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন :
‘যাঁহারা ইম্পিরিয়ালিজমের খেয়ালে আছেন, তাঁহারা দুর্বলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে অকাতরে নির্মম হইতে পারেন এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। পৃথিবীর নানা দিকেই তাহার দৃষ্টান্ত দেখা যাইতেছে।…ব্রিটিশ এম্পায়ারের মধ্যে এক হইয়া যাওয়াই ভারতবর্ষের পক্ষে যখন পরমার্থ লাভ, তখন সেই মহদুদ্দেশ্যে ইহাকে জাঁতায় পিষিয়া বিশিষ্ট করাই ‘হিয়ুম্যানিটি’! … সেসিল রোডস্‌ একজন ইম্পিরিয়াল বায়ুগ্রস্ত লোক ছিলেন, সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকা হইতে বোয়ারদের স্বাতন্ত্র্যলোপ করিবার জন্য তাঁহাদের দলের লোকের কিরূপ আগ্রহ ছিল, তাহা সকলেই জানেন। ব্যক্তিগত ব্যবহারে যে সকল কাজকে চৌর্য্য মিথ্যাচার বলে, যাহাকে জাল খুন ডাকাতি নাম দেয়, একটা ইজম-প্রত্যয়যুক্ত শব্দে তাহাকে শোধন করিয়া কতদূর গৌরবের বিষয় করিয়া তোলে, বিলাতি ইতিহাসের মান্য ব্যক্তিদের চরিত্র হইতে তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়।’
রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে শাপ-শাপান্ত করছেন তীব্র শব্দাবলি উচ্চারণ করে- এটা ভাবা যায়? এটা কেবল ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যদি এ কথা মনে রাখি যে রবীন্দ্রনাথ নিছক লিবারেল গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না; তিনি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তিনি গণতন্ত্রকে কমিউনিস্টদের মতো ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলেননি বটে, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষার গণতন্ত্রকে তিনি সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যবস্থা বলেই মনে করতেন। তার গণতন্ত্রের ধারণা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতাকে অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে ভেবে এসেছে। আর যতই দিন গড়িয়েছে- তার জীবনের শেষ তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে- রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা সচেতনভাবে অবাধ ধনবাদ বিরোধিতার দিকে এগিয়ে গেছে। এই কথাটা আমি বিশেষ জোরের সাথে বলতে চাই।

[ক্রমশ]

Leave a comment