বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৫৮
পূর্বে প্রকাশিতের পর
১৯২০ সালেই প্রমথ চৌধুরী বলছেন যে স্বাতন্ত্র্য-চর্চা ফুটিয়ে তোলা গেলেই কেবল প্রদেশে-প্রদেশে, জাতিতে-জাতিতে ঐক্যের অন্যরকম সম্ভাবনা বা ভিত্তি তৈরি হবে :তখন ভারতবর্ষের নানা জাতি একাকার হবার চেষ্টা করবে না। পরস্পরের ভিতর ঐক্য স্থাপন করবার চেষ্টা করবে। আজকের দিনের কনগ্রেসি ঐক্যের সঙ্গে সে ঐক্যের আকাশপাতাল প্রভেদ হবে।… এক জেলে পাঁচজন কয়েদির মিলন আর এক সমাজের পাঁচজন স্বাধীন লোকের মিলনের ভিতর যে প্রভেদ আছে, আজকের ভারতের নানা জাতির কন্‌গ্রেসী মিলনের সঙ্গে কালকের স্বরাজ্যবাদী জাতিদের মিলনের সেই প্রভেদ থাকবে। তখন প্রাদেশিক পেট্রিয়টিজমের ভিত্তির ওপরেই বাক্যগত নয়, বস্তুগত ভারতবর্ষীয় পেট্রিয়টিজম গড়ে উঠবে।’ প্রমথের চিন্তা অনুসরণ করলে দেখা যায় যে, এক ভাষা, এক জাতি, এক রাষ্ট্র- এ রকম চিন্তাই হচ্ছে ‘সেলফডিটারমিনেশন-বিরোধী ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়ালিজম’। এই কৃত্রিম একত্ব থেকে বেরিয়ে এসে যার যার প্রাদেশিক ন্যাশনালিজমের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক-রাষ্ট্রিক বিকাশ কামনা করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। বেঁচে থাকলে শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের যুক্ত-বাংলাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে সায় থাকত তার, এটাও অনুমান করা অসঙ্গত নয়। এজন্যই তিনি নিদ্র্বিধায় বলতে পেরেছেন, ‘বাঙালির ন্যাশনালিজমের আদর্শ যে কি, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সমগ্র ভারতবাসীকে ডোরকৌপীন পরানো আমাদের আদর্শ হতে পারে না।… আমার শেষ কথা এই যে, যে দেশকে আমি অন্তরের সহিত ভালোবাসি, সে বর্তমান বাংলাও নয়, অতীত বাংলাও নয়- ভবিষ্যৎ বাংলা, অর্থাৎ যে বাংলা আমাদের হাতে ও মনে গড়ে উঠেছে।’
যদিও দেশভাগের আগে ও পরের ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে গড়িয়ে গেল। ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের মূল ভার্সনে  ‘states’ শব্দের বদলে ১৯৪৬ সালে প্রতিস্থাপিত হলো ‘state’ শব্দটি। জিন্নাহ বললেন যে, ১৯৪০-র states আসলে ছিল একটি মুদ্রণজনিত প্রমাদ- a typographical error! বাংলার কংগ্রেসি নেতারাও শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের যুক্তবঙ্গের প্রস্তাব সমর্থন করতে চাইলেন না। নেহেরু পূর্বাপর প্রাদেশিক সেলফ-ডিটারমিনেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। প্রমথ চৌধুরীর প্রদেশভিত্তিক স্বরাজ-রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শেখ মুজিব এই রাজনৈতিক পরিণতিকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন :”কাউন্সিল প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে ‘স্টেটস’ লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট’ লেখা হয় তার প্রতিবাদ করলেন; তবুও তা পাস হয়ে গেল।” এর অর্থ হলো, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে একাধিক পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল, তা আর থাকল না। কলমের এক খোঁচায় ১৯৪৬ সালের দিল্লি কনভেনশনে কেবল মাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু এ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি বললেন, ‘১৯৪০ সালে লাহোরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে, সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটা করার অধিকার আছে কি না এটা চিন্তাবিদেরা ভেবে দেখবেন।’ পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালের ২১ দফায় এবং ১৯৬৬ সালের ৬ দফায় মূল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাওয়া হয়েছিল।
এত সাতকাহনের উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে, শেখ মুজিব ও তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের সহকর্মীদের ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছুটা পিছিয়ে গিয়েই প্রমথ চৌধুরী কথিত ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের’ সাধনা করতে হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী যাকে বলেছিলেন ‘প্রাদেশিক স্বরাজ’, পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে তার রূপরেখা গোড়া থেকে দাঁড় করাতে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এই আন্দোলন ক্রমশ লাহোর প্রস্তাবের সংকীর্ণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বিকভাবে বাঙালির ন্যাশনালিজমের আদর্শকে এক রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদনের কালে সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এই জাতীয়তাবাদকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন :
“জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, অনেক মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা নাই বা দিলাম। আমি শুধু বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন- সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হল অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদও আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক-জাতি হয়েছে। অনেক দেশই আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে- তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। সেজন্য আজ বাঙালী জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালী, আমার ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’। এর মধ্যে যদি কেউ আজকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন তুলতে চান, তাহলে তাকে আমি অনুরোধ করব, মেহেরবানি করে আগুন নিয়ে খেলবেন না।”
বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই সংজ্ঞায় প্রমথ চৌধুরীর কোনো আপত্তি থাকত না। রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে সহমত হতেন। কারণ এই জাতীয়তাবাদ (প্রমথের ভাষায়) ‘আমাদের হাতে ও মনে গড়ে উঠেছে।’ এই জাতীয়তাবাদ আমাদের ‘সেলফ-রিয়ালাইজেশনের’ ফসল। এ কথাটিও প্রমথ চৌধুরীর- ‘জাতির পক্ষে একমাত্র আদর্শ হচ্ছে সেলফ-রিয়ালাইজেশন।’ কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর চিন্তায় ‘প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বরাজ-গঠন’ এই নভেল আইডিয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণই এখানে আমার একমাত্র বা প্রধান লক্ষ্য নয়। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও মধ্যপন্থার মানুষ। অবাধ পুঁজিবাদও চান না, আবার একনায়কত্ব-ভিত্তিক সমাজতন্ত্রও চান না। তিনিও অন্য এক সমাজতন্ত্র খুঁজছেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের তিন বছরের মাথাতেই প্রমথ চৌধুরী রূপক অর্থে যা লিখলেন তার সমসাময়িক তুলনা মেলা ভার। অন্তত এই উদ্ধৃতিটি বড় করে দেওয়ার দাবি রাখে :
‘একটা কথার অর্থ পরিস্কার করা দরকার, সে কথাটা হচ্ছে স্বার্থ।… এ তো হবারই কথা। আমরা যখন প্রাণী, ও প্রাণের সর্বপ্রধান চেষ্টা যখন আত্মরক্ষা করা, তখন অন্ন আমাদের চাইই চাই। আর পলিটিক্সের যত বড়ো বড়ো কথা আছে তার আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক খোলস ছাড়িয়ে নিলে কি দেখা যায় না যে, তার ভিতরকার মোটা কথা হচ্ছে অন্ন? আজকের দিনে পৃথিবীতে পলিটিক্সের দুটি বড় কথা হচ্ছে ক্যাপিটালিজম এবং বলশেভিজম, বাদবাকি আর যতরকম  ism আছে সে সবই হয় ক্যাপিটালিজম নয় বলশেভিজমের কোঠায় পড়ে। হাল পলিটিক্সের এই দুই ধর্ম এতই পরস্পরবিরোধী যে, উভয়ের মধ্যে অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে আজ জীবনমরণের যুদ্ধ চলছে। অথচ এই উভয় পলিটিক্যাল ধর্মের ভিতর একই জিনিস আছে এবং সে জিনিস হচ্ছে অন্ন। তবে মানবজাতি যে দুভাগ হয়ে পড়েছে সে ঐ অন্নের ভাগ নিয়ে। ক্যাপিটালিজমের মূল সূত্র হচ্ছে অল্প লোকের বহু অন্ন, আর বলশেভিজমের মূল সূত্র হচ্ছে, বহু লোকের যথেষ্ট অন্ন। আমার বিশ্বাস এ দুয়ের কোনোটিই টিকবে না। কেননা, ক্যাপিটালিজম ভুলে গিয়েছে যে, রুটি সকলেরই চাই, আর বলশেভিজম মনে রাখেনি  Man does not live by bread alone, অর্থাৎ, মানুষের মন বলেও একটা জিনিস আছে, অতএব, পেটের খোরাক ছাড়া মানুষের মনের খোরাকও চাই, নচেৎ মানুষ পশুর সঙ্গে নির্বিশেষ হয়ে পড়ে।’ কিছু আগেই আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধু নয়া চীনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন যে, অন্নের সাথে স্বাধীনতা না পেলে মানুষের মন ‘পাথরের মত’ শুস্ক হয়ে যায়।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে লেখা প্রবন্ধটিতে যখন পড়ি অবাধ পুঁজিবাদ ও একনায়কত্ব-ভিত্তিক সমাজতন্ত্র ‘কোনটিই টিকবে না’, তখন প্রমথের বিশ্নেষণকে প্রফেটিক মনে না হয়ে পারে না। তার মানে এই নয় যে, বলশেভিজমের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী কোনো প্রগতিশীল উপাদান খুঁজে পাননি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রায়ত বা কৃষককে জমির মালিকানা দেওয়ার প্রশ্ন উঠলেই বলশেভিজম বা সমাজতন্ত্রের হাত আবিস্কার করা হত তাতে। ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী এ বিষয়ে বলছেন :
‘দেখা গেল যে, রায়তদের শিক্ষার দাবি ও স্বাস্থ্যের দাবি সকলেই মঞ্জুর করেন, কিন্তু তাদের স্বত্বের দাবির কথা কানে ঢোকবামাত্র চমকে ওঠেন, এমন লোকের এ দেশে অভাব নেই। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অনেকে আবার প্রজার পক্ষ যারা সমর্থন করতে উদ্যত হন তাদের বুদ্ধি ও চরিত্রের উপর নানারূপ দোষারোপ করতে ক্ষণমাত্র দ্বিধা করেন না। যে প্রজার অধিকারের কথা তোলে, কারো মতে সে বলশেভিক, কারো মতে সে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শত্রু, আবার কারো মতে-বা সে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর-এক সম্প্রদায়ের মারামারি-কাটাকাটির পক্ষপাতী। এরা যদি একটু ভেবে দেখেন তা হলেই দেখতে পাবেন যে, এ সকল অপবাদ কতদূর অমূলক। প্রথমত, বলশেভিক জন্তুটি যে কি, তা তারাও জানেন না আমরাও জানি নে। জুজুর ভয় ভদ্রলোকের পক্ষে অপরকে দেখানোও যেমন অনুচিত, নিজে পাওয়াও তেমনি ছেলেমি।’
প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ লিখিত হয় ১৯১৯ সালে, আর রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে ১৯১৭ সালে। দু’বছরের মধ্যেই ‘বলশেভিক জুজুর’ আলোচনা বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে বিশেষ তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল, দেখা যাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ প্রবন্ধেই সর্বপ্রথম বাংলার কৃষকের কাছে জমি হস্তান্তর করার দাবি জানানো হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ভূমি সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছিল। যেটা বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও ‘সাম্য’ প্রবন্ধে সরাসরিভাবে বলা হয়নি আগে। সেসব লেখায় মূলত রায়তদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর ঋজু চিন্তায় এ গদ্যে স্পষ্ট করে দাবিটা তোলা হয়েছিল সেদিন। বাঙালির সাম্য-চিন্তায় তার অনন্যসাধারণ অবস্থান এতে করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে :
‘আমাদের জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে কিসের বিশেষ অভাব আছে জানেন?- স্বাধিকারের জ্ঞান। মনস্তত্ত্ববিদেরা জানেন যে, স্বত্বের জ্ঞান থেকেই মানুষের অধিকারের জ্ঞান জন্মায়।… এ দেশের কৃষকদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক লোকের জমি তার নিজস্ব সম্পত্তি। বাংলার প্রজা যদি জমি হস্তান্তর করবার, গাছ কাটবার, কোঠা বাড়ি করবার, কুয়ো খোঁড়বার অধিকার পায়, এবং সেই সঙ্গে তার জোত মৌরসী-মোকবরি হয়, তাহলে সে ইংরেজিতে যাকে বলে  peasant proprietor তাই হয়ে উঠবে। প্রজা জমির মালিক হয়ে উঠলে জাতির শক্তি ও দেশের ঐশ্বর্য যে কতদূর বেড়ে যায় তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ বর্তমান ফ্রান্স। আর প্রজাকে স্বত্বহীন ও দরিদ্র করে রাখলে তার ফল যে কী হয়, তারও জাজ্বল্যমান উদাহরণ বর্তমান রাশিয়া।’ প্রমথ চৌধুরী প্রথাগত কোনো সমাজতন্ত্রী ছিলেন না (প্রবন্ধটি যখন লেখা হয়েছে ভারতে বা বাংলায় তখনো কমিউনিস্ট পার্টি গঠিতই হয়নি)। তিনি ছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেসির পক্ষের লোক, কিন্তু ‘দ্য ল্যান্ড কোয়েশ্চনস’কে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সুতীব্র ভাষায় তিনি সামন্তবাদকে আক্রমণ করেছিলেন। খোদ কৃষকের হাতে জমির স্বত্ব দেওয়ার নীতিকে সমর্থন করেছিলেন সামাজিক ন্যায়ের তাগিদে। এজন্যে তাকে ‘বলশেভিক জুজুর’ ভয় দেখানো হলেও তিনি পিছু হটেননি। তিনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলার মতো মানুষ নন। রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলে তার অবস্থান (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদুষী কন্যা ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন)। তার কাছে উচ্চকণ্ঠের স্লোগান-তোলা সমাজতন্ত্র আশাও করতে পারি না আমরা। তার পরও তাকে বলতে হয়েছিল :
‘যারা বলশেভিজমের ভয়ে কাতর তাদের অনুরোধ করি যে, তারা বাংলার রায়তকে বাংলার  peasant proprietor করবার জন্য তৎপর হোন। যেরকম দিনকাল পড়েছে, তাতে করে মানুষকে আর দাস ও দরিদ্র করে রাখা চলবে না। প্রজাকে এসব অধিকার আমরা যদি আজ দিতে প্রস্তুত না হই তো কাল তারা তা নিতে প্রস্তুত হবে।’
[ক্রমশ]

Leave a comment