বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৫৭
পূর্বে প্রকাশিতের পর
মুজিব সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই।… সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়। সেজন্য পহেলা Step, যাকে প্রথম Step বলা হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করেছি।… এক এক দেশ এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী Climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে Step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে… বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না। তা যারা করেছেন, তারা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। কারণ লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না- যেমন আন্দোলন হয় না। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে Step by step এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না… কোনোকিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-র মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’
এত দীর্ঘ উদ্ৃব্দতি দেওয়ার পেছনে আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দেখানো যে, ‘সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে গভীরভাবেই ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তত্ত্বের ‘লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না।’ গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে গেলে মানব-প্রকৃতি ও দেশজ ইতিহাস-সংস্কৃতি- ‘কাস্টম’ বিবেচেনায় নিতে হয়, এই দিকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমার উদ্দেশ্য। একে শুধু হাল আমলের Social Democracy বললে ভুল হবে, আবার প্রথাগত Soviet-style Socialism বললেও ভুল হবে। একটা পশ্চাৎপদ দেশে গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র গড়তে হলে ধাপে ধাপে Step by Step লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয় নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে। এটা বঙ্গবন্ধুর সাম্যচিন্তার একটি বিশিষ্ট দিক।
মানব-প্রকৃতি ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনার কথা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও উঠে এসেছিল স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্রের আলোচনা করতে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন (পরবর্তীকালের বঙ্গবন্ধুর মতোই) যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মডেল ‘মানব প্রকৃতি’কে পুরোপুরি অস্বীকার করে টিকতে পারবে না:
‘যে কোনো মতবাদ মানুষ সম্বন্ধীয় তার প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মানবপ্রকৃতি। এই মানবপ্রকৃতির সঙ্গে তার সামঞ্জস্য কী পরিমাণে ঘটবে, তার সিদ্ধান্ত হতে সময় লাগে। তত্ত্বটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার পূর্বে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তবুও সে সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে। কেবলমাত্র লজিক দিয়ে বা অঙ্ক কষে নয়, মানবপ্রকৃতিকে সামনে রেখে। মানুষের মধ্যে দুটো দিক আছে- একদিকে সে স্বতন্ত্র, আর একদিকে সে সকলের সঙ্গে যুক্ত। এর একটাকে বাদ দিলে যেটা বাকি থাকে, সেটা অবাস্তব।… ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যখন উৎকট স্বার্থপরতায় পৌঁছিয়ে সমাজে নানা প্রকার উৎপাত মথিত করে, তখন উপদেষ্টা বলেন, স্বার্থ থেকে স্ব-টাকে এক কোপে দাও উড়িয়ে, তা হলেই সমস্ত ঠিক চলবে। তাতে হয়তো উৎপাত কমতে পারে। কিন্তু চলা বন্ধ হওয়া অসম্ভব নয়।’
অর্থাৎ মানুষের স্বার্থ ও নিঃস্বার্থ দুই দিকের দিকে লক্ষ্য করেই নতুন ধারার সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। মানুষের স্বার্থপরতা ‘ডিমান্ড’ করে যাতে করে ব্যক্তি উদ্যোগ ও এডাম স্মিথের ‘বাজার-অর্থনীতি’ তথা ‘অদৃশ্য-হাত’ (Invisible Hand)-এর ক্রিয়াকলাপ যেন সম্পূর্ণ রুদ্ধ না হয়ে যায়। ব্যক্তি উদ্যোগের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেও সামষ্টিক কল্যাণ ও পরার্থপরতাকে লালন করা সম্ভব। প্রথম দিকটি অর্থাৎ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য রক্ষা লিবারেল ডেমোক্রেসির ‘লিবার্টি প্রিন্সিপাল’কে নির্দেশ করছে। আবার ‘উৎকট স্বার্থপরতা’ সমাজের জন্য ক্ষতিকর- সে রকম লাগামছাড়া ‘লোভ’কে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। এটি সমাজতন্ত্রের ‘সামাজিক কল্যাণ’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের’ দিকে নির্দেশ করছে।
এক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালে চীনে গিয়ে নয়াচীনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের চোখে পড়েছিল। তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে সমাজতন্ত্র’ নির্মাণের ধারণাকে বোঝার জন্য চীনের অভিজ্ঞতাকে এক মূল্যবান সূচক হিসেবে দেখতে পারি। বলা দরকার, নয়াচীনের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা শেখ মুজিব নিছক ভ্রমণ কাহিনি লেখার জন্য করেননি। এর পেছনে ছিল দেশের অবস্থার সাথে সেদিনের চীনের পরিস্থিতিকে মিলিয়ে দেখার প্রবল রাজনৈতিক তাগিদ। ১৯৫২ সালে মুজিব লিখেছেন তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনায়:
‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল, এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।… একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।’
এই যে জাতীয় ধন-সম্পদ-ক্ষমতা একটা বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে চলে যাওয়া- যাকে আমরা ইতিপূর্বে  Concentration of Economic Power বলে শনাক্ত করেছি- সেটা সার্বিক বিবেচনায় গ্রামজীবন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে উঠে আসা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কোনো তত্ত্বের সাহায্য ছাড়াই সেদিন অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া কলকাতায় পড়াশোনাকালে মেট্রোপলিটান মন ও সংবেদনশীলতা তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলে থাকবে। ফজলুল হক-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে রাজনৈতিক নৈকট্যের কারণে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ঘরানার সাথে তার অন্তরঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে উঠেছিল। ফলে ঐ তুলনামূলক তরুণ বয়সেই তার মনে কতিপয় এলিট গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক বিত্ত ও ক্ষমতার ঘনীভবন বিষয়টিকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি এবং এটি পরবর্তীতে তার সাম্যচিন্তার একটি বিশিষ্ট স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়।
এর পরপরই চলে এলো একটি অসাধারণ ‘পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’ যা Early-Mujib ও Late-Mujib-এর মধ্যে সাম্যচিন্তার যোগসূত্র স্থাপন করে দেয়। এই কথাগুলো ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের বিশ্বাসের কথা, তার মনের কথা, কাউকে শোনাবার জন্য নয়, নিজের চিন্তাকে একটি স্থায়ী উপলব্ধির কাঠামো দেওয়ার প্রয়াস, সেটি কখনোই তার মন থেকে মুছে যায়নি, আমৃত্যু যাকে তিনি লালন করেছেন। এখানে তার ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ৃব্দতি দিচ্ছি :
‘চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সকল কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদী সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।’
এই ম্যানিফেস্টো-ধারার বিবৃতিকে নিছক ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’-এর অনুবর্তী বললে বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ধারণাটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করা হয়। আবার একে প্রথাগত সোভিয়েত-চীনের ধারার সমাজতন্ত্র বললেও অন্যায় হবে। এখানেই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ বিশেষত্ব। কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাক এটা যেমন তিনি চান না, তেমনি চান না কোনো একনায়কত্বের শাসন। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আর একটা তর্কের বিষয় হচ্ছে ডিক্টেটরশিপ অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যাপারে নায়কতন্ত্র নিয়ে। কোনো বিষয়েই নায়কিয়ানা আমি পছন্দ করি নে।… একনায়কতার বিপদ আছে বিস্তর।’ মনে রাখতে হবে, তখনো ত্রিশের দশকের স্ট্যালিনীয় শুদ্ধি অভিযানগুলো শুরু হয়নি। ১৯৩৬-৩৮ পর্বের এই Purge-এর কারণে অনেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন ও ভিন্নমত প্রকাশের নীতি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে সোভিয়েত ইউনিয়নে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর প্রাথমিক আলামত তখনই আঁচ করেছিলেন :’ডিক্টেটরশিপ একটা মস্ত আপদ। সে কথা আমি মানি এবং সেই আপদের বহু অত্যাচার রাশিয়ায় আজ ঘটছে- সে কথাও আমি বিশ্বাস করি।’ নয়াচীন ভ্রমণকালে মুজিবও এটা লক্ষ্য করেছেন। ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থে তিনি বলছেন : ‘ভাত কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।’
৪. সাম্যচিন্তার অন্যান্য উৎস ও বঙ্গবন্ধু
ভাত-কাপড়ের অর্থনৈতিক অধিকার চাই, আবার চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও চাই- বঙ্গবন্ধুর এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা আরেকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর লেখায় কিছুটা ভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি হচ্ছেন প্রমথ চৌধুরী। তার বৈদগ্ধ্যের কথা এক স্তবকে বা এক প্রবন্ধে বলে শেষ করার নয়। বাংলায় আমরা যে বর্তমানে ‘শুদ্ধ চলিত’ রীতিতে গদ্য লিখি, তার উদ্ভাবক প্রমথ চৌধুরী। তাঁর সম্পাদনায় ‘সবুজপত্র’ বাংলায় শুদ্ধ চলিত রীতিতে প্রকাশিত গদ্য লেখার প্রধান বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথও তার গদ্যরীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাধু-ভাষার দাঁতভাঙা গদ্যের দেয়াল ভেঙে বাংলা ভাষাকে চলিত রীতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহসকে এক নিঃশব্দ সামাজিক বিপ্লবের সাথে তুলনা করা চলে। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রমথনাথ সবুজপত্রকে ‘যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য-সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। প্রচলিত অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষণীর মধ্যে তা সম্ভবপর হতে পারত না। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথর প্রধান কৃতিত্ব। আমি তার কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনও কুণ্ঠিত হইনি।’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বছর সাতেকের ছোট প্রমথ চৌধুরী দেশভাগের এক বছর আগে ১৯৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ ও ‘গল্পসংগ্রহ’ পড়লে বোঝা যায় কী বিপুল পরিমাণে পড়াশোনা ছিল তার। শুধু শুদ্ধ চলিত রীতির গদ্যের উদ্ভাবনেই নয়, রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কার নিয়ে তার বিশিষ্ট মত ছিল। উদাহরণত, ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজম’ প্রবন্ধে তিনি অভিন্ন ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ একচ্ছত্র দাপটের বিপরীতে ‘প্রাদেশিক জাতীয়তাবাদের’ সপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তিনি স্মরণীয়ভাবে বলেছিলেন যে, ‘বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের মূলে আছে বাঙালি জাতির স্বীয় স্বাতন্ত্র্যজ্ঞান। Self-determination of small nations-এর মতানুসারে বাঙালি-পেট্রিয়টিজমের বিশেষ সার্থকতা আছে। … বহুকে এক করবার চেষ্টা ভালো, কিন্তু একাকার করবার চেষ্টা মারাত্মক, কেননা তার উপায় হচ্ছে জবরদস্তি। … বাংলার সঙ্গে মাদ্রাজের যে প্রভেদ ইংলন্ডের সঙ্গে হল্যান্ডের সে প্রভেদ নেই, এমনকি, ফ্রান্সের সঙ্গে জর্মানিরও সে প্রভেদ নেই। তবে যে প্রাদেশিক পেট্রিয়টিজমের নাম শুনলে এক দলের পলিটিশিয়ানরা আঁতকে ওঠেন, তার কারণ তাদের বিশ্বাস ও মনোভাব জাতীয় স্বার্থপরতার পরিচয় দেয়।’ এই সমালোচনার তীর কংগ্রেসি হেজিমনির বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত। প্রমথ চৌধুরী চান প্রতিটি প্রদেশ তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ওঠে দাঁড়াক এবং যার যার স্বাতন্ত্র্য-চর্চার সফলতা লাভ করে তারা বিভিন্ন প্রদেশের বা জাতির ভেতরে ‘ঐক্য স্থাপনের’ চেষ্টা করুক। প্রমথ চৌধুরী তার কল্পনায় কার্যত স্বাধীন ভারতবর্ষকে বিভিন্ন প্রদেশভিত্তিক রাষ্ট্রের সহযোগে এক ধরনের  loose fedaration হিসেবে ভেবেছিলেন- যেখানে প্রতিটা প্রদেশ অবিভক্ত থেকে যার যার প্রাদেশিক বিশিষ্টতা নিয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্রভাবে প্রথমে উঠে দাঁড়াবে।

[ক্রমশ]

Leave a comment