বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৫৬
 পূর্বে প্রকাশিতের পর
সেই একই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রাস্তা নাই, ঘাট নাই, রেলওয়ে ব্রিজ এখন পর্যন্ত সারতে পারি নাই, পোর্ট রাশিয়ারা সেরে দিচ্ছে একটা, রেললাইন পাকা এখনও হয় নাই। চরিত্র এত জঘন্য খারাপ হইয়া গেছে, পকেটমার ধরি, চোর ধরি। লজ্জায় মরে যাই। … পুলিশ নিয়া নকল বন্ধ করতে হয় আমার, এ কথা কার কাছে কব গিয়া।’
এ তো গেল যাদের অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে তাদের ‘লেভেলে’ বিকাশমান সমস্যার কথা। সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসের ভাষণে যারা পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন তাদের ‘লেভেলের’ সমস্যা বা সমাজ বদলের ক্ষেত্রে কমিটমেন্টের কথা পাড়লেন বঙ্গবন্ধু। সেখানেও ছাত্রলীগের সভায় দেওয়া বক্তৃতাকে স্মরণ করলেন, বললেন- সমাজতন্ত্রের পথ অত্যন্ত দীর্ঘ, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরুতে হবে :
‘পরিস্কার কথা আমার, স্যোশিয়ালিজমের যাবার [পথ], স্যোশিয়ালিজম এত সোজা না। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। সে পদক্ষেপ নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। বাধা আমাদের আসবেই। যাদের কাছ থেকে আমরা সম্পদ নিয়েছি, যারা এখানে সম্পদ ফেলে গেছে, তাদের দালালরা, বিদেশি শক্তিরা, তারা আজকে চেষ্টা করছে আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক ইকোনমির [ধারা] বানচাল করার জন্য। … [তাই বলছিলাম] স্যোশালিজমের রাস্তা এত সোজা নয়, এটা বড় কঠিন রাস্তা।… স্যোশালিজম যেখানে শুরু হয়েছে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নে আজ ৫৫ বৎসর [পার] হয়ে গেছে, স্যোশালিজম করতে পারেনি। এখনও ঘাত-প্রতিঘাতে অগ্রসর হচ্ছে, নতুন নতুন তাদের পথ জানতে হচ্ছে। এ রাস্তা সোজা রাস্তা নয়, এ রাস্তা কঠিন রাস্তা।’
নিজেকে কখনোই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘তাত্ত্বিক’ বলে ভাবেননি তিনি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রণয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন- ২১ দফা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু ২১ দফা বা ৬ দফা কোনোটাতেই সরাসরিভাবে সমাজতন্ত্র ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা ছিল না। এগুলো কালের বিবর্তনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে যুক্ত হয়েছে। এখানেও তিনি ছিলেন দীর্ঘ পথের যাত্রী- তাড়াহুড়া করে কোনো কিছু ‘উপর থেকে’ চাপিয়ে দিতে চাননি। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়তে চাননি। জনগণ তার নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ক্রমশ মুজিবের চার স্তম্ভের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে একত্রিত হয়েছে এবং সমবেত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার পূর্বে (১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর) শাসনতন্ত্রের খসড়ার কাজ বঙ্গবন্ধু শুরু করে দিয়েছিলেন তার কিছু নিকট সহকর্মীদের নিয়ে। সেখানে রাজনৈতিক নেতা, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মতামত নিয়েছেন। সেই দলিলে প্রথম বারের মতো বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রূপরেখা ফুটে উঠেছিল। সেখানে বলা ছিল ‘যথার্থ সজীব গণতন্ত্র’-এর কথা- এমন একটা গণতন্ত্র ‘যেখানে জনগণ স্বাধীনতা ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং ন্যায় ও সাম্য বিরাজ করবে।’ সেখানে আরও বলা ছিল :
‘শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প- যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথ বণ্টনের বিধান থাকবে। … আমাদের কাজ হলো গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন। সংগ্রাম ও ত্যাগ ব্যতীত দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া মিথ্যা অঙ্গীকারের শামিল।’
বিভিন্ন নেতিবাচক ধারার সমাজতন্ত্রের সমালোচনাও তিনি করেছেন। দেশের একাংশ সমাজবাদীদের মধ্যে হঠকারিতা ও পদস্খলন দেখে সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি তিরস্কার করে বলেছিলেন :
‘বুঝি না ভাই, আমি একটু কনফিউজড হয়ে যাই, আমি বুঝি না… আপনারা বড় বড় ফিলোসোফার আছেন, বড় বড় থিওরিস্ট আছেন, বড় বড় কবি আছেন, অনেক লেখাপড়া করেছেন, আপনারা বুঝতে পারেন, আমি অতখানি বুঝি না। আমি সোজা বুঝি যে, সাম্প্রদায়িক আর সমাজতন্ত্র পাশাপাশি চলতে পারে কেমন কইরা আমি জানি না, আমি শিখি নাই আমার রাজনৈতিক জীবনে।’ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর স্লোগান তুলেছিল এক হঠকারী পক্ষ, আরেক পক্ষ গণচীনের স্বীকৃতি আসেনি বলে চরম বিরুদ্ধাচরণের নীতি অবলম্বন করেছিল। সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছিল যারা তাদের সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তি মিলে যাচ্ছিল অভিন্ন স্বার্থের টানে। অন্যদিকে সোভিয়েত ‘সামাজিক সংশোধনবাদের’ বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আরেক পক্ষ পরোক্ষভাবে দেশে সন্ত্রাস-গুপ্তহত্যাকে উস্কে দিয়েছিল অতি-বামপন্থার নামে। এদেরকে লক্ষ্য করেই মুজিব বলেছিলেন সেদিন : ‘আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেছি, [কিন্তু] গণতন্ত্র অর্থ [যা ইচ্ছা বলার] লাইসেন্স নয়। আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলার সামর্থ্য কারও নাই। রাষ্ট্রীয় মূল নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো ক্ষমতা নাই। যখন শাসনতন্ত্রে আমাদের চারটা স্তম্ভ রয়েছে, [তার] বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা কখনো নাই। একদিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলবে আর আরেক দিকে গোপনে সাম্রাজ্যবাদের সাথে হাত মিলাবে।’ ছদ্ম-প্রগতিশীলরা যে দেশের শত্রু সে ব্যাপারে সতর্ক করলেন সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে এসে : ‘কমিউনিস্ট পার্টির মনোপলি আপনাদের এখন আর নেই বলে মনে হচ্ছে সবার কাছে। কারণ, এত কমিউনিস্ট, গোপনে গোপনে এত কমিউনিস্ট আর এত সোশ্যালিস্ট পার্টি আর এত প্রগ্রেসিভ পার্টি হয়ে গেছে যে মুসিবতে পড়ে গেছি আমরা। তবে আমরা এইটুকু বুঝি যে, আপনাদের সঙ্গে আমাদের নীতির মিল আছে। … আমার মনে হয় জনাব মার্কস, মার্কস বাহাদুর বোধহয় বিপদে পড়ে গেছেন। তাকে নিয়ে আপনারা আমরা [এমন] টানাটানি শুরু করে দিয়েছি যে, তার কোনো আর সীমা নাই। কত যে মার্কস পার্টি বাংলাদেশে হয়েছে তার কোনো সীমা নাই।’
বোঝাই যাচ্ছে, অনেকগুলো ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুকে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ- এসব নিয়ে লড়াই তো ছিলই। কিন্তু তার সাথে যুক্ত হয়েছিল অতি বামপন্থার অন্তর্ঘাতী তৎপরতা ও অতি-ডানপন্থি উগ্র মতবাদের সাথে বাড়তি লড়াইয়ের চাপ। গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্রের নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের সামাজিক সুস্থিরতা ও সামাজিক সহিষ্ণুতার প্রয়োজন, সে ধরনের সামাজিক পুঁজি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল, এসব শক্তির অশুভ তৎপরতার দ্বারা। ১৯১৮ সালে লেনিন গুলিবিদ্ধ হলেন এ রকমই অতি-বামপন্থি শক্তির দ্বারা; তারপর তিনি আর সম্পূর্ণ সুস্থ হননি কখনোই। ১৯২৪ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। মুজিবও ১৯৭৫ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে এক আততায়ী বাহিনীর হাতে মারা যান। আমেরিকায় একজন প্রেসিডেন্টের টার্ম চার বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনককে আমরা রাষ্ট্র চালানোর জন্য, তার আকাঙ্ক্ষার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চার বছর সময়ও দেইনি, দিতে চাইনি আমরা।
৩. রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ও বঙ্গবন্ধুর নয়াচীন
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এক জায়গায় আমরা বঙ্গবন্ধুর সামন্ততন্ত্রবিরোধী অবস্থানের সাথে বঙ্কিমের জমিদারবিরোধী অবস্থানের একটি তুলনা টেনেছি। গণতন্ত্র চাই, আবার সমাজতন্ত্রও চাই- একাধারে লিবারেল ডেমোক্রেসি ও অর্থনৈতিক সুষম বণ্টনের সামাজিক ন্যয্যতা দুই-ই আমাদের দরকার- বঙ্গবন্ধুর এই মৌলিক উপলব্ধির পেছনে বাঙালির সাম্যচিন্তার দীর্ঘ ঐতিহ্য ক্রিয়াশীল ছিল। একে শুধু ‘সাম্যচিন্তা’ বলাও যথেষ্ট নয়- এটা বাঙালির দীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম’ বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের এক সমৃদ্ধ পরম্পরা। আমার যুক্তির সপক্ষে আমি যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও কাজী আবদুল ওদুদের সাম্যচিন্তার বিশিষ্ট প্রবণতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব বঙ্গবন্ধুর চিন্তার সাথে তুলনাক্রমে।
সুবিদিত যে, রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় যান ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে, আর মুজিব চীনে যান ১৯৫২ সালের অক্টোবরে। চীনে যাওয়ার আগে প্রায় আড়াই বছর বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছে জেলে- ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় পদচারণার প্রেক্ষিতে। প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক ধারার শাসনের ভালো ও মন্দ দুটি দিকের প্রতিই তারা দৃষ্টিপাত করেছেন। রাশিয়া সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সেখানে না গেলে তার এ জন্মের ‘তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ’ থেকে যেত। সমাজতন্ত্রের পরিবেশে মধ্য এশিয়ার অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী- যাদের অধিকাংশই মুসলমান- দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছিল। রাশিয়ার সর্বত্র প্রাথমিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সাংস্কৃতিক বিনোদন-কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনের অভাব পূরণ করার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছিল। এর ফলে সেখানে আপামর জনগোষ্ঠীর ভেতরে সর্বজনীন উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠছিল এবং প্রকৃত অর্থেই এক গণশক্তির জাগরণ দেখা দিয়েছিল। এসব প্রশংসার পরে সমালোচনার কথাটিও তুললেন রবীন্দ্রনাথ। বহুল ব্যবহূত উদ্ৃব্দতিটি আরও একবার এখানে স্মরণ করতে চাই :
‘সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে মার্কসীয় অর্থনৈতিক মতটা সম্পূর্ণ গ্রাহ্য কি-না সে কথা বলবার সময় আজও আসেনি; কেননা এ মত এতদিন প্রধানত পুঁথির মধ্যেই টলে টলে বেড়াচ্ছিল। এমন বৃহৎ ক্ষেত্রে এত বড়ো সাহসের সঙ্গে ছাড়া পায়নি। যে প্রবল লোভের কাছে এই মত প্রথম থেকেই সাংঘাতিক বাধা পেত, সেই লোভকেই এরা সাংঘাতিকভাবে সরিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার ভিতর দিয়ে পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এ মতের কতটুকু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আজ নিশ্চিত কেউ বলতে পারে না। কিন্তু এ কথাটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে, রাশিয়ায় জনসাধারণ এতকাল পরে যে শিক্ষা নির্বাচিত ও প্রচুরভাবে পাচ্ছে তাতে করে তাদের মনুষ্যত্ব স্থায়ীভাবে উৎকর্ষ ও সম্মান লাভ করল।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে সুদূর ত্রিশের দশকেই স্তালিনের আমলের বলশেভিক অর্থনৈতিক মত, পরিচালনা-পদ্ধতি ও মালিকানা-সম্পর্কের প্রয়োগ এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। এই পদ্ধতি কালের বিচারে টিকবে কি-না এ নিয়ে তার মনে সংশয় ছিল- যা পরবর্তীকালে ‘স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্র’-এর পতনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। স্ট্যালিনীয় সমাজতন্ত্রের সম্পর্কে কবির প্রধান সমালোচনা ছিল এই যে, এটি মানুষের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধের বিরোধী এবং সেই সূত্রে মানবপ্রকৃতিরও বিরোধী। মানুষের মধ্যে পরার্থপরতা আছে বটে, কিন্তু স্বার্থপরতাও একটি মৌলিক দিক। এই কথাটা এসেছে লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রেরণা থেকে। অর্থনীতিতে ব্যক্তি উদ্যোগের স্বীকৃতি ছাড়া শুধু রাষ্ট্রনির্ভর উন্নয়নের পথে জনগণের মুক্তি আসবে না। রাষ্ট্রনির্ভর উদ্যোগ ও ব্যক্তিনির্ভর উদ্যোগ- এর মধ্যে কোনো একটি দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লেই বিপদ। কোনো একটি পক্ষে বেশি রং চড়ে গেলেই চিত্রকর্মটি নষ্ট হওয়ার জোগাড় হয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মধ্যে আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই- যা পরবর্তীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘পরিকল্পনা’ চাই, ‘Planned Econmic Growth’ চাই, কিন্তু তা নতুন ব্যক্তি-উদ্যোগকে বিনষ্ট করে নয়। এই চিন্তাই বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে ও প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলে ফুটে উঠেছে। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতটা জেনে আসি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
‘বলশেভিক অর্থনীতি সম্বন্ধে আমার মত কী, এ কথা অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে থাকেন। আমার ভয় এই যে, আমরা চিরদিন শাস্ত্রশাসিত পান্ডাচালিত দেশ, বিদেশের আমদানি বচনকে একেবারেই বেদবাক্য বলে মেনে নেবার দিকেই আমাদের মুগ্ধ মনের ঝোঁক। গুরুমন্ত্রের মোহ থেকে সামলিয়ে নিয়ে আমাদের বলা দরকার যে, প্রয়োগের দ্বারাই মতের বিচার হতে পারে। এখনও পরীক্ষা শেষ হয়নি।’
প্রয়োগই অর্থনৈতিক মত কার্যকর কিনা তা যাচাই করার মোক্ষম উপায়, কিন্তু এক্ষেত্রে প্রয়োগকর্তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সময় দিতে হবে বৈকি। পরীক্ষায় ভুল প্রমাণিত হলে নতুন পথের খোঁজে বেরোতে হবে- এই ছিল লেনিনের, বুখারিনের, রবীন্দ্রনাথের এবং বঙ্গবন্ধুরও মত। পরিবর্তনের ধারাতেই ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্র’কে দেখতে হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো পূর্বনির্ধারিত ‘মডেল’ ধরে বঙ্গবন্ধু অগ্রসর হতে চাননি। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধানের ওপরে চূড়ান্ত ভাষণে মুজিব তুলে ধরলেন তার গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ।
[ক্রমশ]

Leave a comment