পুনশ্চ প্যারিস

পর্ব ::৩৯

[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

২. লোহানীর স্বীকৃতির প্রশ্ন

১৯৮৭ সালে ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যার জন্য লোহানীর ওপরে মতিউর রহমানের সঙ্গে মিলে আমি একটি পরিচিতিমূলক লেখা তৈরি করি। আশির দশকে বসে জানা সম্ভব ছিল না লোহানীর কোথায় এবং কীভাবে মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ মহাফেজখানার তরফে তখন যেটা জানানো হয়, সেটা হলো একটা ‘ওয়ান-ওয়ে টিকিট’ কেটে রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ২০০৩ সালে আলোকচিত্রী ডেভিড কিং ‘অর্ডিনারি সিটিজেনস :দ্য ভিকটিম অব স্টালিন’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। তিরিশের শুদ্ধি অভিযানের যুগে তৎকালীন সোভিয়েত পার্টির সদস্য এবং অসদস্য সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যারা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের নাম ও ছবি সংবলিত বই ছিল এটি। কিং-এর বইয়ের ১৩৫নং পাতায় হঠাৎই আবিস্কৃত হন লোহানী। যারা নেপথ্য কাহিনি জানেন না, তাদের পক্ষে বোঝা শক্ত যে, এই লোহানী আমাদেরই সিরাজগঞ্জের লোহানী। কেননা, সেখানেও তার পরিচিতি হিসেবে লেখা নিম্নরূপ :

‘১৮৯২ সালে ভারতে জন্ম। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।’

বিষণ্ণ সে পোর্ট্রেট। বোঝা যায় যে, এনকেভেদের (কেজিবির পূর্বসূরি) জেলে অত্যাচারের এক ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই যেন আর অবশিষ্ট নেই। এমনটাই লাগছে জিনোভিয়েভ-এর ছবিও। ১৯১৯ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত কমিনটার্নের চেয়ারম্যান জিনোভিয়েভ। স্টালিনের কীর্তির বিরুদ্ধাচরণের দায়ে তাকে ১৯২৭ সালে বহিস্কার করা হয়। ১৯৩৬ সালে শুদ্ধি অভিযানের প্রথম ধাপে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। ঠিক তারই দু’বছর পরে লোহানীর মৃত্যু হয়-ওই ফায়ারিং স্কোয়াডেই। জিনোভিয়েভ ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য- রাজনৈতিক মতপার্থক্য গুরুতর আকার ধারণ করেছিল ২০-এর দশকের শেষে। কিন্তু লোহানী তিরিশের দশকে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু তার মৃত্যু হলো কেন এমনভাবে? গোপেন চক্রবর্তীর মতো তিনিও তো অব্যাহতি পেয়ে যেতে পারতেন রুদ্ররোষ থেকে।

আমার অনুমান সেটা হয়নি দুই কারণে। প্রথমত, তিনি এমএন রায়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন একটা বড় সময় পর্যন্ত। ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব জাসেস’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এমএন রায়; কিন্তু প্যারিস থেকে সেটি প্রকাশ করার দায়িত্ব ছিল লোহানীরই ওপরে। প্যারিসের পাট গুটিয়ে এক সময় লোহানীকে চলে আসতে হয় মস্কোয়। ততদিনে এমএন রায়ের সঙ্গে সোভিয়েত পার্টির বিরোধ তুঙ্গে। বিশের দশকে চীনের প্রতি কমিনটার্নের নীতিনির্ধারণের নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিলেন রায়। এটা শেষ পর্যন্ত হটকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ট্রটক্সি-পন্থি ‘পারমানেন্ট রিভ্যুলিউশন’-র ধারার প্রতিও সহানুভূতি ছিল তার। ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রটস্কি রাশিয়া থেকে নির্বাসিত হন, প্রায় একই সময়ে এমএন রায়কেও কমিনটার্ন থেকে বহিস্কার করা হয়। ফলে ট্রটস্কি-এমএন রায়-লোহানী এমন একটি যোগসূত্র টানা বিচিত্র ছিল না এনকেভেদের গোয়েন্দাদের পক্ষে। বিশেষত ১৯৩৮ সালে এর দায়িত্ব যখন গিয়ে পড়ে ইয়েজভের ওপরে। ১৯৩৮-৪০ পর্বে ইয়েজভের হাতেই পরিচালিত হয় সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৩৪-৩৬ পর্বে ইয়াগোদার এনকেভেদে এবং ১৯৪০-৫৩ পর্বে বেরিয়া’র কেজিবির তুলনায় অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল ইয়েজভের এনকেভেদে। রুশ ভাষায় ইয়েজভের কাল বা ‘ইয়েজভশিনা’ নামে একটি প্রবাদবাক্যই চালু হয়ে গেছে নিষ্ঠুর শাসন বোঝাতে। ফলে এ সময়ে ট্রটস্কির বা এমএন রায়ের সঙ্গে কোনো প্রকার সুদূর বা নিকট সংশ্নিষ্টতাও লোহানীর জন্য চরম আশঙ্কার কারণ হতে পারত।

দ্বিতীয় একটি কারণও ক্রিয়াশীল ছিল। লোহানী ১৯২১ সালে মস্কোয় প্রথমবারের মতো আসার আগে বার্লিনে অবস্থান করছিলেন। বার্লিনে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটি ‘গ্রুপ’ গড়ে উঠেছিল। বার্লিনে ১৯১৬-১৮ সাল থেকেই এরা জড়ো হতে থাকেন; তার কারণ- এখানে বিপ্লব-পরিস্থিতির সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের পর ইউরোপের সবচেয়ে সফল বিপ্লবের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল বার্লিনে। এখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের সময় থেকেই। সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনালের বেশিরভাগ নেতাই ছিলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ভেতরে বিপ্লব আশঙ্কা আরও তীব্র হতে থাকে। ‘স্পাটার্ক’ গ্রুপের নেতৃত্বে চলে আসেন কার্ল লিবক্‌নেখট, রোজা লুক্সেমবার্গ। এরা অক্টোবরের বিপ্লবের ধারায় ‘বিশ্ব-বিপ্লবকে’ সম্পন্ন করার স্বপ্ন দেখতেন। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি এ রকম একটি প্রায়-সফল অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কাইজারের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন কার্ল ও রোজা দু’জনেই। এই অভ্যুত্থানের পটভূমিকায় রচিত হয়েছে আলফ্রেড ডবলিনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘বার্লিন আলেকজান্ডার প্লাজ’। বার্লিনের আলেকজান্ডার প্লাজ বা স্কয়ারের চারপাশে শ্রমজীবী মানুষের বসবাস (যেমন আমাদের একদার তেজগাঁও, টঙ্গী, ডেমরা বা হাল আমলের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল)। এই উপন্যাস কতটা মৌলিক ও চিত্তাকর্ষক তা বোঝানোর জন্য বলি যে, একে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তুলনা করেছেন জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের সঙ্গে; অন্যরা এর বর্ণনারীতির সঙ্গে প্রতিতুলনা করেছেন কাফকার বর্ণনারীতির। ২০০২ সালের এক জরিপে এই বইটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০টি বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (যা এখনও বাংলায় অনূদিত হয়নি)। এই আলেকজান্ডার প্লাজ-এর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের টানে লন্ডন ছেড়ে ১৯১৮ সালেই বার্লিনে চলে এসেছিলেন লোহানী। সেখানে এসে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের (সরোজিনী নাইডুর ভাই) বিপ্লবী গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৯ সালের কার্ল লিবক্‌নেখট ও রোজা লুক্সেমবুর্গের বিপ্লব-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এই জার্মান-গ্রুপ অন্যত্র সরে পড়তে বাধ্য হয়- প্রথমে প্যারিসে এবং পরে রাশিয়ায়। সেভাবেই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মস্কোয় আসেন লোহানী ১৯২১ সালে। তখনও তারা ‘কমিউনিস্ট’ হননি- তাদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল ব্রিটিশ-শাসন থেকে পরাধীন ভারতবর্ষকে মুক্ত করা। সে লক্ষ্যে নতুন রাশিয়ার সাহায্য কামনা করছিলেন তারা এবং সে কারণেই লেনিনের সঙ্গে তারা দেখা করতে চেয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, সে সময়ে ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভারতবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের একত্র করার জন্যই বার্লিন-কমিটির পত্তন হয়েছিল এবং বীরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ‘বার্লিন গ্রুপ’ এ লক্ষ্যেই কাজ করছিল। ১৯২১ সালে লোহানী যখন মস্কোয়, তখন তিনি তিরিশের কোঠাও পার হননি।

বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘ক্যারিশম্যাটিক’ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ‘চ্যাট্টো’ নামে সবাই ডাকত তাকে। তিরিশের যুগে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর যাদেরই ‘জার্মান কানেকশন’ ছিল তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো রাশিয়ায়। কিরভের মৃত্যুর পর শুদ্ধি অভিযানের মাত্রা বেড়ে যায়। সর্বত্র জার্মান গুপ্তচর খুঁজতে থাকে এনকেভেদে। এরই ধারাবাহিকতায় বীরেন্দ্রনাথকে জার্মান গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ তিনি ছিলেন একশো শতাংশ বিপ্লবী, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ‘লীগ এগেইনস্ট ইম্পেরিয়ালিজম’ আহূত ১৯২৭ সালের ব্রাসেলস কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন তিনি। যেখানে তরুণ নেহেরু অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩০-৩২-এর মধ্যে ‘ইনপ্রেকর’-এর পাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘অতি-বাম’ নীতির বিরুদ্ধে ২৮টির মতো প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন চীনের ভাবী প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কমিনটার্নের সেক্রেটারি-জেনারেল জর্জি ডিমিট্রভকে ১৯৩৫ সালে দুঃখ করে জানিয়ে ছিলেন যে, ‘কমিনটার্নের সক্রিয় কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’ তাকে। ত্রূক্রপস্কায়াকেও চিঠি লিখেছিলেন এই মর্মে। শেষের দিকে তার গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত। ক্লিমেন্স পাম ডাট (রজনী পাম ডাট-এর ভাই) লিখেছেন যে, চ্যাট্টোকে তিনি ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে লেনিনগ্রাদের একাডেমি অব সায়েন্সেস-এর এথনোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে ‘শেষবার দেখেছিলেন’। এহেন বীরেন্দ্রনাথকে ১৯৩৭ সালের ১৫ জুলাই গ্রেপ্তার করা হলো ‘গণশত্রু’ অভিযোগে, কেননা তিনি জার্মানদের হয়ে ‘গুপ্তচর বৃত্তি করেছেন’। এই মিথ্যে অভিযোগে ১৯৩৭ সালের ৩১ আগস্ট মৃত্যু হলো তার ফায়ারিং স্কোয়াডে। সেই তালিকায় ছিলেন আরও ১৮৪ জন; এই নির্দেশে স্বাক্ষর করেন স্তালিন, মলোটভ, ভরশিলব, জদানভ ও কাগানোভিচ। চ্যাট্টো যখন চলে গেলেন, লোহানীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, তার ওপরেও এনকেভেদে-এর করাল ছায়া নেমে আসছে। যে কোনো অনুসন্ধানে চ্যাট্টোর কর্মকাণ্ডের ইতিহাস খুঁড়লেই লোহানীর নামও চলে আসবে। সে সময়ে লোহানীকেও নজরদারির মধ্যে থাকতে হতো। চ্যাট্টোকে কমিনটার্নের কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর লোহানীকেও ক্রমশ কমিনটার্নের বলয় থেকে সরিয়ে আনা হয়। তিনি কেবল মাঝে মাঝে অনুবাদের কাজ করতেন- ব্যাপারটা এই পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি লোহানি গ্রেপ্তার হন ‘প্রতি-বিপ্লবী’ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু হয় তার। পাবনার সিরাজগঞ্জ থেকে মস্কোর লুবিয়ানকা জেল- এভাবেই নির্বাপিত হয় লোহানীর ৪৬ বছরের জীবন।

চ্যাট্টো মারা যাওয়ার প্রায় বিশ বছর পরে রাশিয়ায় সরকারি সফরে আসেন নেহেরু। তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চান তিনি। কেজিবি মহলে (ততদিনে এনকেভেদে-র নতুন নাম কেজিবি) এই নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। তারই পরিণতিতে সোভিয়েত পার্টি স্বীকার করে নেয় যে, শুদ্ধি-অভিযানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন বীরেন্দ্রনাথ। তার সঙ্গে অবনী মুখার্জীর নামও উঠে আসে। গুপ্তচরবৃত্তির সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ (Rehabilitation) করা হয় তাদের। কিন্তু সেই সনদপত্রে লোহানীর নাম ছিল না। পূর্ববঙ্গের লোহানীর কথা নেহেরুর কানে কেউ তোলেনি। শত শত অন্যায় মৃত্যুর মিছিলে লোহানীর নামও তখন সোভিয়েত নেতৃত্বের দৃষ্টি এড়িয়ে থাকবে। যদি স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী কখনও মস্কো সফরে যান, যদি তারা লোহানীর ‘মরণোত্তর পুনরুদ্ধার’ চান, তবে তারা বর্তমান রাশিয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে লোহানীর বিষয়টি তুলতে পারেন। ঠিক যেমনভাবে ভিন্ন মতাদর্শের হয়েও নেহেরু ক্রুশেভের কাছে বীরেন্দ্রনাথের হদিস জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুতিনের কাছে লোহানীর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন। তাহলে শুধু লোহানীর মরণোত্তর স্বীকৃতিই নয়, তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত বিভিন্ন বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের দেখাও মিলতে পারে রাশিয়ার স্টেট হিস্টোরি আর্কাইভ থেকে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় এটা আশা করাই যেতে পারে।

তবে বেসরকারিভাবে ‘মস্কো নিউজ’ একটি কাজ করেছিল। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে এটি প্রকাশিত হয়। সেখানে আরও কয়েকজন ভারতের বিপ্লবীদের সঙ্গে লোহানীর নামও উঠে আসে। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে তালাশ করতে গিয়ে রুশ ভাষার ইন্টারনেটে ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ (রাসত্রিয়েলনিয়ে স্পিসকি) পাই। এর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য, যেখানে লোহানী মস্কোর কোন সড়কের কোন বাড়িতে বাস করতেন এবং কোন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে সে তথ্যও দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫৭ সালেই তাকে ‘Rehabilitated’ করা হয়েছে সোভিয়েত রাষ্ট্রের তরফে- এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সংযোজন করা হয়েছে। তার মানে, সোভিয়েত বা রাশিয়ার সরকারের কাছে লোহানী তার সম্মান মরণোত্তরভাবে হলেও ফিরে পেয়েছেন। তাকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে বিস্মৃতির গর্ভ থেকে। শুধু আমাদের রাষ্ট্রের বা ইতিহাসের কাছেই তার যথাযথ পুনরুদ্ধার হয়নি। বাংলাদেশের কাছে তিনি এখনও শুধু একটি নাম, শুধুই নাম। এখানে তিনি বিস্মৃতির অতলে ধূসর হয়ে আছেন অনাদরে-অবহেলায়। ‘গুলিবিদ্ধদের তালিকা’ থেকে পুরো উদ্ৃব্দতিটি অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি :

‘লুহানী গুলাম আম্বিয়া খান।

১৮৯২ সালে জন্ম, সিরাজগঞ্জ শহরে, রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির (বলসেভিক)-এর সদস্য; সোভিয়েত রেডিও-কমিটির অনুবাদক।

বাস করতেন :মস্কো বলশই ইওঝেনস্কি পেরুলক; হাউস ১৬/৬, ফ্ল্যাট ৩৬।

গ্রেপ্তার : ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।

অভিযুক্ত :১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর (‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউ. এস. এস. আর’ কর্তৃক অভিযুক্ত); অভিযোগ : গুপ্তচরবৃত্তি।

১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু।

কবর :মস্কো অঞ্চলের (অবলান্তের) ‘কম্যুনারকা’ গোরস্তান। ১৯৫৭ সালের ৯ জুলাই ‘রি-হেভিলিটেটেড’; ‘মিলিটারি কলেজিয়াস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব দ্য ইউএসএসআর-র আদেশ বলে।’

মানুষের জীবন এমনিতেই বিস্ময়কর। বিংশ শতকের বিপ্লবীদের জীবন আরও বিস্ময়কর। [ক্রমশ]

Leave a comment