পর্ব ::৩০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
Doctrine of Karma ও জন্মান্তরের চক্র বড় আকারে এসেছে এলিয়টের কাব্য-নাট্য ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’-এর ভেতরে। সেখানে প্রুফ্রকের সমুদ্রতলের পরিত্যক্ত কাঁকড়া থেকে গুবরো পোকা, মাছ, হাতি হয়ে বন-মানুষ ও মানুষে রূপান্তরের পরিক্রমা উঠে এসেছে। তার প্রকাশভঙ্গি (ফর্ম/টেকনিক) অত্যন্ত আধুনিক। আমি বিক্ষিপ্ত স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তি তুলে ধরছি :
‘I have lain on the floor of the sea and breathed/
with the breathing of the sea-anemone…/
I have lain in the soil and criticized the worm…/I have felt
The horn of the beetle, the scale of the riper, the/
Mobile hard insensitive skin of the elephant, the/
Evasive flank of the fish…/
I have seen/
Rings of light coiling downwards, descending/
To the horror of the ape…
এবারে আসি ওয়েস্ট ল্যান্ডের শেষাংশে এসে এলিয়টের আকস্মিক বৃহদারণ্যক উপনিষদের দিকে ফিরে তাকানো প্রসঙ্গে। যদিও কাব্যগ্রন্থের নাম নষ্ট পতিত জমি; কবিতাটির শেষাংশটি প্রাণিত পুনর্জাগরণ ও প্রতিকারের প্রার্থনায়। এ জন্যই কবি বেছে নিয়েছেন বৃহদারণ্যক উপনিষদ। এর অনুবাদ আমার সাধ্যের বাইরে। আমি শুধু ভাবের তর্জমাটুকু করে দিচ্ছি বেশ কিছুটা স্বাধীনতা নিয়ে। দীর্ঘ কবিতাটির শেষে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে, অচিরেই বৃষ্টি হবে। পুষ্প-পল্লবে ভরে যাবে পৃথিবীর উপত্যকা, সব খানা-খন্দক, মরুভূমি। এ রকম একটি দৃশ্যপটে প্রোথিত হচ্ছে লাইনগুলো :
‘গঙ্গা অর্ধমৃত, চারপাশের নুয়ে-পড়া পাতাগুলো কাঁপছে
বৃষ্টির প্রতীক্ষায়,
বহুদূরে হিমবাহের শিখরে
জড়ো হচ্ছে কালো মেঘ,
বাকরুদ্ধ বনভূমি
হাত-পা গুটিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষমাণ,
ঠিক তখনই বজ্র নির্ঘোষে বেজে উঠল দৈববাণী
দা
দত্তা :আমরা এতদিন কী দিয়েছি পৃথিবীকে?
ও বন্ধু আমার, বুকের মধ্যে রক্ত যেন শব্দ করে উঠল
এক মুহূর্তের জন্য, আসুন আত্মসমর্পণ করি এবারে
এই যুক্তি-তর্কের যুগ যা কখনোই দিতে পারবে না
আমাদের শোকসভায়
মাকড়সার মতো জাল বিছানো স্মৃতির কুণ্ডয়নে
যাকে কখনোই পাওয়া যাবে না
যা নেই আমাদের এই শূণ্য ঘরে
সিল-গালা ভাঙা চুক্তিপত্রের ভেতরে-
দা
দয়াধ্যাম :আমি শুনেছি সেই সবখোল চাবির কথা
সেই দরোজা একবারই খোলা যায়, কেবল একবারই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
আমরা সবাই সেই চাবির আশায় প্রহর গুনছি
প্রত্যেকে যার যার কুঠরিতে বসে চাবির কথা ভাবছি
প্রত্যেকে আবদ্ধ করে রাখছি নিজেদের নিজস্ব কুঠরিতে
কেবল রাতের বেলায় চারপাশে অস্পষ্ট ধ্বনি শোনা যায়
ভেঙে-পড়া কোরিওলেনাসের অবয়ব মুহূর্তের জন্য জেগে ওঠে
দা
দময়ত্তা :নৌকা দুলে উঠেছে
যারা পাল তুলে দাঁড় টেনে নাও বাইতে জানে
তারাই দায়িত্ব নেবে এবারে বিশ্বস্ত হাতে।
দ্যাখো, সমুদ্র শান্ত, তোমারও হৃদয়
হয়তো সাড়া দিত এভাবেই
হয়তো দুলে উঠত, যদি সেই আমন্ত্রণ একবার শুনতে পেতে
যারা সবকিছুর দায়িত্ব বুঝে নিতে জানে
যদি মুহূর্তের জন্য সমর্পিত হতে তাদের কাছে…
আমি এক ছিপ-ফেলা প্রশান্তি নিয়ে তীরে বসে আছি
আমার পিছনে বিরান প্রান্তর
আমার দেশে কি শেষটায় সত্যি সত্যি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে?
লন্ডন ব্রিজ ভেঙে পড়ছে ভেঙে পড়ছে ভেঙে পড়ছে …
আজ আমার ধ্বংসের বিপরীতে গিয়ে
এই লাইন ক’টি রাখলাম…
দত্তা। দয়াধ্যাম। দময়ত্তা।
শান্তি শান্তি শান্তি।’
এখানে এলিয়টের কথিত খ্রিষ্টীয় আত্মসমর্পণ ছাড়াও উপনিষদের ওরিয়েন্টালিজম রয়েছে স্পষ্ট করেই। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দত্তা, দয়াধ্যাম ও দময়ত্তা শব্দ তিনটি এসেছে একটি উপাখ্যানের সূত্র ধরে। প্রজাপতি ব্রহ্মা একই প্রশ্ন রেখেছিলেন মানুষ, দেবতা ও অসুরদের কাছে। ‘দা’- এই অক্ষরটি ধ্বনিত হলে তিনটি দল তার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করে। এলিয়ট যাকে বলেছেন ‘What the thunder said’, তা হচ্ছে দৈববাণী এক। একই ধ্বনি শুনে মানুষ বলেছে ‘দত্তা’ বা অন্যকে দান-দক্ষিণা করার কথা। দেবগণ বলেছেন ‘দময়ত্তা’ বা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা। আর অসুরেরা বলেছে দয়াধ্যাম বা অন্যের প্রতি সদাচারপ্রবণ ও সংবেদনশীল হওয়ার কথা। যার মধ্যে যা নেই সে বুকের মধ্যে সেই ধ্বনিই বাজতে শুনেছে। মানুষ দয়া ভুলে গেছে, তাই সে শুনেছে দান-দক্ষিণার কথা। অসুরেরা অন্যের প্রতি সদা রুষ্ট, তারা শুনেছে সংবেদনশীল হওয়ার কথা। আর দেবগণ প্রায়ই আত্মগরিমায় বিভোর থাকেন- তারা শুনেছেন আত্ম-সংবরণের উপদেশ বাণী। সমগ্র মানব জাতির জন্য এই তিনটি অর্থই- be self-controlled, be charitable and be compassionate- সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপরে দাঁড়িয়ে লেখা ওয়েস্ট ল্যান্ডের ট্র্যাজিক পরিণতির শেষে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পা বাড়াতে চেয়েছেন এলিয়ট, এবং সে কারণেই বৃহদারণ্যক উপনিষদের ওই তিনটি নীতি তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
[ক্রমশ]