এলিয়ট, ওরিয়েন্টালিজম ও রবীন্দ্রনাথ (Eliot, Orientalism and Tagore)

পর্ব ::২৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

লেখাটিতে এলিয়ট এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে। সাহিত্যের প্রভাবক কী- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এখানে জীবনানন্দ। শুধুমাত্র এলিয়টের উদ্ৃব্দতির অংশটুকু ইংরেজিতে রেখে বাদবাকি অংশের প্রয়োজনীয় লাইনগুলো বাংলায় বেশ কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েই তার তর্জমা করে দিচ্ছি। এতে করে সমালোচক জীবনানন্দের বিশ্বাসের জায়গাটি কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে :

‘খুব দূরবর্তীভাবে আমি হয়ত রাজনীতির ছাত্র। অর্থনীতিবিদ হতে কখনো চেষ্টা করিনি। আধুনিক বিশ্বের নানাবিধ সমস্যার অর্থবহ ও যুক্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার বিজ্ঞান হচ্ছে এই শাস্ত্র। …. আমি জানি আধুনিক জগতের রাজনৈতিক সম্পর্কজাল ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ না বুঝতে পারলে… আজকের হতাশা ও আশা কোনোটারই সঠিক পরিমাণ করা যাবে না। কেন আমরা যারা অক্ষরজীবী- তথাকথিত ‘ম্যান অব লেটার্স’- তাদেরকে বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনীতি বা অর্থনীতির মধ্যে অবগাহন করতে হবে? … এর একটি প্রধান কারণ হয়তো এই যে, আমরা কোন পৃথিবী নেই যাকে যে কোন অর্থেই একটি বাসযোগ্য সুখী ভুবন বলা যায়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকের কার্যকারণের ঘনিষ্ঠ উপলব্ধির দ্বারা আমরা এ কথা বুঝতে পারি। এটাও জানি, এই দুর্গতির থেকে সহসা পরিত্রাণের উপায় নেই। তারপরও এ দেশের বা অন্য দেশের বা সারা পৃথিবীরই সংকট জেনে এ কথা বুঝতে পারি, ভবিষ্যতের পৃথিবীর অর্থনৈতিক ভিত্তি ত্রুটিমুক্ত করেই এবং রাজনৈতিক মাৎসন্যায় দূর করেই এগোতে হবে আমাদের। এ কাজে অক্ষরজীবীদের ভূমিকা কতটুকু তা স্পষ্ট নয়। বর্তমান সমাজের ধারায় তারা অনেকটাই ‘মিস-ফিট’। হয়ত আগামীতে অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত সমাজ এলেও শিল্পী-সাহিত্যিকদেরকে প্রথমে আবদ্ধ করে রাখা হবে। বর্তমান অবস্থায় রাজনীতির সমস্যায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের জড়িয়ে পড়তেই হবে এমন কোন কথা নেই।

তাদের শুধু মনে রাখতে হবে- কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে, সর্বত্রই পলিটিক্স হচ্ছে ‘পাওয়ার-পলিটিক্স’ কেবল এবং এই পলিটিক্সই নানা ভাবে, নানা নামে, নানা ঐতিহ্যের টানে ও ভাবাদর্শের (বিভিন্ন বিরোধী তত্ত্বের সমাবেশের) ছত্রছায়ায় অর্থনীতিতে স্থান করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই রাজনীতি ও অর্থনীতি এক বৃহদাংশ মানব জাতিকে কখনো সান্ত্বনা দিয়ে, কখনো প্রতারণা করে, কখনো অনুপ্রাণিত করে, আবার কখনো সংগ্রামের ডাক দিয়ে প্ররোচিত করে যাচ্ছে।… অক্ষরজীবীরা আধুনিক সম্পর্কজালের এই মৌলিক অসুখ অনুভব করেন- এসবের কোথাও তারাও সিস্টেমের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছেন। এখান থেকে তার পরিত্রাণ নেই- পরিত্রাণ কোথাও নেই। তার কাছে মনে হতে পারে যে, সামনেই কোন পিচঢালা, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাস্তা খোলা রয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, এ রকম কোনো পন্থা আমাদের সামনে খোলা থাকবে না, অন্তত আগামী কয়েক দশকে তার সম্ভাবনা নেই।… অক্ষরজীবীরা এই অবস্থায় তার সাহিত্য-রচনায় আগামীর সুখী সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের কাহিনী রচনা করবেন, এটা আমি প্রত্যাশা করতে পারি না। আবার তারা রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে আজকের দিনের বিরতিহীন দুঃখ-দুর্শশার খুঁটিনাটি নির্মাণে ব্যাপৃত হবেন সে বাধ্যবাধকতাও তার নেই।… সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে এক ধরনের সংকট নেমে এসেছে। বিশ্ব-জোড়া উথাল-পাথালের এই সময়ে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ভালো মানের উপন্যাসকে নিকৃষ্ট মানের উপন্যাস থেকে পৃথক করার চাবিকাঠি যেন হারিয়ে ফেলেছি; রাজনীতির শ্বাসরুদ্ধকর প্রভাব থেকে উপন্যাসকে বাঁচানো যাচ্ছে না, বা কবিতাকে অর্থনৈতিক ছায়া থেকে।… এই নতুন যুগের সঙ্গে সাহিত্যকে মানিয়ে চলতে হবে ঠিক, কিন্তু অন্যান্য যোগসূত্রকে অস্বীকার না করে, যা বর্তমানের বা ভবিষ্যতের বাইরে [এবং যা সেই অর্থে হবে- চিরকালের]।… এটা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক ব্রিটিশ সাহিত্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই।’ এটা বলে জীবনানন্দ এলিয়টের ‘Triumphal march’ কবিতা থেকে একটি উদ্ৃব্দতি দিলেন :

ÔWe can wait with our stools and our sausages.
What comes first? Can you see? Tell us. It is
5,800,000 rifles and carbines,
102,000 machine guns,
28,000 trench mortars,
53,000 field and heavy guns,
I cannot tell how many projectiles, mines and fuses.

তার পরপরই জীবনানন্দের মন্তব্য হলো :”ঠিক এভাবেই যে [পরিসংখ্যান উদ্ৃব্দত করে] এখানে তাকে প্রকাশ করতে হলো সেই ভঙ্গিমাটি আমার দৃষ্টি কেড়েছে। তবে ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এবং ‘ফোর কোয়ারটেটস্‌’-এর কবিতাগুলোর বেশিরভাগ জুড়েই রয়েছে এ ধরনের বলবার ভঙ্গি। এর পেছনে রয়েছে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার তীব্র চাপ- যার ভেতরে কবিতার ‘ফিউশন’ ঘটে থাকে। এবং সেটাই আসলে দেখার বিষয়।”

এর ছয় বছর বাদে এলিয়টের প্রসঙ্গ উঠে আসে তার ‘The Three Voices of poetry’ কাব্যবিষয়ক প্রবন্ধ-গ্রন্থের আলোচনায়। এই বক্তৃতায় এলিয়ট তিন ধরনের কবিকণ্ঠের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি স্বগতোক্তিমূলক; দ্বিতীয়টি রচিত শ্রোতাদের উদ্দেশ করে; আর তৃতীয় কবিকণ্ঠটি নৈর্ব্যক্তিক ধাঁচে গড়া। তবে জীবনানন্দ বলছেন, এসবই বিশুদ্ধ বিভাগ, অনেক কবিতাই মিশ্ররীতিতে বোনা- যেখানে কবি কখনো বলছেন, ‘নেহাতই নিজের কানে-কানে বা জনান্তিকে’, আবার কখনো বলছেন নাট্যরীতিতে- কেবল ‘নিজেকে-মাত্র স্মরণ করে নয়।’ এলিয়টের বক্তব্য হচ্ছে, ‘কবিতা ত্রিস্বরা- যদিও নিজের শ্রেণি অনুযায়ী একটা প্রধান সুর বহন করে চলেছে [প্রতিটি কবি]।’

এলিয়ট সম্পর্কে জীবনানন্দের সতর্ক প্রশস্তি ছিল। সে প্রেক্ষিতে বিষ্ণু দে-র উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো। ১৯৩২ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এলিয়ট নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন বিষ্ণু দে। এমনকি ১৯৭১ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণকালে তিনি বিশেষ করে স্মরণ করেন এলিয়টের কথা : “আবার আমি স্মরণ করি এখানে টি. এস. এলিয়টকে। তার ‘ঐতিহ্য’ ও ব্যক্তিক গুণীপনা আমাকে আবার বিকাশে সাহায্য করেছিল প্রচুর।’ এলিয়ট সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র সুবিখ্যাত প্রবন্ধ তিনটি হলো- ‘টি.এস. এলিয়টের মহাপ্রস্থান’ (‘রুচি ও প্রগতি’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), ‘টমাস স্টার্নস এলিয়ট’ (‘এলোমেলো জীবন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) এবং ‘এলিয়ট প্রসঙ্গ’। এলিয়ট সম্পর্কে বিষ্ণু দে-র ঘনিষ্ঠ মনোযোগ কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। বিষ্ণু দে শুধু মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন না, মার্কসবাদ সম্পর্কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে তত্ত্ব-চিন্তা করেছিলেন। এ জন্যই যখন তিনি বলেন, ‘অজ্ঞাতসারেই এলিয়টের সমালোচনায় মার্কস অঙ্গীকৃত, তাঁর কাব্যের যুক্তিতে সাম্যবাদীর আরম্ভ, যদিও হয়ত সে-সত্য তিনি জানেন না বা মানেন না’- তাকে আমরা অযৌক্তিক দাবি বলে উড়িয়ে দিতে পারি না।

বিষ্ণু দে-র এলিয়টকে বুঝতে হলে বিষ্ণু দে-র আরাগঁকে বুঝতে হবে আগে। লুই আরাগঁ ছিলেন যুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে পুরোধা কবি, পল এলুরাবের মতোই খ্যাতিমান ও প্রগতি-পন্থার পথিক। সেই আরাগঁ একদা বলেছিলেন, ‘কাব্যের ইতিহাস তার টেক্‌নিকের ইতিহাস। যারা আমাদের নীরব করতে চায় তারা সেই শ্রেণির নিকৃষ্ট লেখক, যারা কিছুই নির্মাণ করেনি, যারা শুধু গোটা কয়েক ছক টেনে প্যাঁচ কষেই ক্ষান্ত হয়। আমি ত আজ অবধি কবিতার প্রতিটি অঙ্গ বিষয়ে না-ভেবে, আগের লেখা আর পড়া কাব্যাবলি বিষয়ে সচেতন না-হ’য়ে কোন কবিতা লিখিনি।’

[ক্রমশ]

Leave a comment