জাকির হোসেন
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিশ্ব অর্থনীতি ছিল মন্দার কবলে। আশঙ্কা করা হয়েছিল_ মন্দার বিলম্বিত প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষত রফতানি ও রেমিট্যান্স খাত বড় ধাক্কা খাবে। এ আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়নি। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের চেষ্টার পাশাপাশি মন্দা মোকাবেলায় সরকারের সহায়কনীতি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার অর্থবছরে (২০০৮-০৯) রফতানিতে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়। পরের প্রতিটি অর্থবছরে রফতানি আগের তুলনায় বেড়েছে। বলা যায়, সরকারের চার বছরে সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। এ সময়ে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়; কমেছে দারিদ্র্য হার। কৃষি উৎপাদনে ভালো সাফল্য এসেছে।
গত চার বছরে অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। তবে শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্কের মতো একের পর এক কেলেঙ্কারি অর্থনীতির সাফল্যকে ম্লান করেছে। এ ছাড়া সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবেশের
সূচকে কিছুটা অবনতি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিরও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্থনীতির জন্য নানা সংস্কারের ব্যাপক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বেসরকারিকরণ, প্রশাসনে দক্ষতা, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংস্কার ত্বরান্বিত হয়নি।
মতামত জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মন্দা-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। এ সময়কালে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রশংসাযোগ্য। রফতানি বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের আরও অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন চীনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক। কৃষি প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটা দাগে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়নি। তারপরও জনমনে কিছু বিষয়ে অসন্তুষ্টি আছে।
কী সেই অসন্তুষ্টি_ জানতে চাইলে বিনায়ক সেন বলেন, গত দশকে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। ফলে মানুষের প্রত্যাশার চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সে চাপের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংস্কৃতি তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মানুষ দিনবদলের সরকারের কাছে আরও কিছু প্রত্যাশা করেছিল। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল, একটা কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। বিনিয়োগে বড় ধরনের অগ্রগতির কথা ছিল, যা হয়নি। বিনিয়োগের হার গত কয়েক বছরে একই রকম রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এডিপি বাস্তবায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রত্যাশিত সংস্কার হয়নি। শেয়ারবাজারে ধস, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের তহবিল লোপাটসহ কিছু বিষয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর্থিক খাতের নানা সংকট সামষ্টিক অর্থনীতিকে মাঝে মধ্যে ঝামেলায় ফেলেছে।
একের পর এক কেলেঙ্কারি :অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার শেয়ারবাজারে ধসের মাধ্যমে প্রথম বড় ধাক্কা খায়। ২০১০ সালের শেষে বড় ধরনের ধস নামে শেয়ারবাজারে। ফুলে-ফেঁপে ওঠা সূচকের ধারাবাহিক পতনে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এই ধসের পেছনে একটি প্রভাবশালী অশুভ চক্রের কারসাজি ছিল, যা পরবর্তীকালে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে। গত দুই বছরে সরকারের নানা পদক্ষেপেও শেয়ারবাজারের সংকট দূর হয়নি। বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থাবান হতে পারছেন না।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর পদ্মা সেতু নিয়ে বিপাকে পড়ে সরকার। মহাজোট সরকারের চার বছর নিয়ে সমকালের সাম্প্রতিক এক জরিপে বেশির ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে জটিলতার প্রধান দায় সরকারের।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ফলে আর্থিক খাতে সরকারের মনোযোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগের কারণে সরকার সমালোচিত হয়। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে একটি চক্র জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ করে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হলমার্কই নেয় দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এটি ছিল ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে ডেসটিনি গ্রুপও নানা কেলেঙ্কারির জন্ম দেয়। এই গ্রুপের এমডিসহ শীর্ষ কর্তারা এখন কারাগারে।
চাঙ্গা হয়নি বিনিয়োগ :জিডিপিতে বিনিয়োগের অংশ ২৪ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও একই হারে বিনিয়োগ হয়। বাংলাদেশকে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর বর্তমান অবস্থায় ওই হারে বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক হিসাবে গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ১৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ মনোভাব স্পষ্ট। সম্প্রতি খেলাপি ঋণও অনেক বেড়ে গেছে। ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যেতে পারে।
কিছু স্বস্তিকর পরিসংখ্যান :মন্দার শুরুতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে চলে যায়। এর পরের তিন বছরে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৬৭৬ ডলার। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪৮ ডলার। মন্দা-পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী ছিল। একটি অর্থবছর বাদে এ খাতে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। সরকার বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে পেরেছে। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে।
দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ কমেনি :সমকালের জরিপে প্রশ্ন ছিল_ দ্রব্যমূল্য চার বছর আগের তুলনায় এখন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে কি-না। এর উত্তরে ৫৫ শতাংশ ‘না’ বলেছেন। কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে_ এমন উত্তর দিয়েছেন ৩১ শতাংশ। চালের দাম কিছুটা কমলেও বাস্তবতা এমনই। আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৬২ শতাংশে। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে।
বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, গত এক বছরে মিনিকেট, নাজিরশাইল, আমন, পাইজাম, স্বর্ণাসহ নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের দরকারি চালের দাম কমেছে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। চাল ছাড়া অন্যান্য নিত্যপণ্য যেমন_ আটা, ডাল, সয়াবিন তেল, ডিম, মাছ, মাংস, সবজি প্রভৃতির দাম বেড়েছে।