নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ২১-০৬-২০১২
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তাঁরা এ খাতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
পাশাপাশি তাঁরা এ-ও বলেছেন, দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। স্বল্প সময়ের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি চালু থাকতে পারে। তবে প্রকৃত উন্নয়নের পথে যেতে হলে দরকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আর এ জন্য সবার আগে শিক্ষার উন্নয়নে নজর দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক, শিক্ষা খাতে তিন বছর ধরেই বাজেটে বরাদ্দ কমছে।
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল বুধবার ‘অতিদারিদ্র্য নিরসন: সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ব্র্যাক অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জের সহযোগিতায় প্রথম আলো বৈঠকটির আয়োজন করে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী ও হোসেন জিল্লুর রহমান, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম নুরুন্নবী, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন, বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি সাপোর্ট প্রোগ্রামের চিফ অব পার্টি আখতার আহমেদ, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির পরিচালক শীপা হাফিজা, প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক প্রমুখ।
টেকসই নিরাপত্তা: রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, দারিদ্র্য নিরসনই মূল কথা নয়। গতানুগতিক দারিদ্র্য নিরসনের চিন্তার বাইরে গিয়ে গোটা বিষয়কে দেখা দরকার সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী এখন আর টেবিলের এক পাশে পড়ে থাকা বিষয় নয়। এ বিষয়ে গত ৩০ বছরে আমরা কী করলাম, তার হিসাব মেলানো দরকার।’ তিনি বলেন, ‘ভারত এ বিষয়ে সাংবিধানিক অধিকার তৈরির পর বাস্তবায়নের দিকে গেছে। আর আমরা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করছি।’ তিনি বলেন, খোলাবাজারে চাল বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা যাবে না।
মাহবুব হোসেন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি আরও ২০ থেকে ৩০ বছর চালিয়ে নিতে হবে। তিনি মনে করেন, এ খাতে বাজেট বরাদ্দ ঠিকই আছে। দরকার মূলত কর্মসূচিগুলোর কর্মদক্ষতা। অনেক কর্মসূচি রয়েছে ত্রাণ হিসেবে। পানিতে ডুবে গেলে মানুষের নাকটা যেমন শুধু ভেসে থাকে, অনেকটা সে রকম। এ থেকে উত্তরণ দরকার।
মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে দারিদ্র্য নিরসন হবে। সরকারের অন্য খাতগুলোকেও সমানভাবে কাজ করতে হবে।’
শীপা হাফিজা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর কোনো তথ্যভান্ডারই এখনো তৈরি হয়নি। তা ছাড়া যেসব কর্মসূচি আছে, সেগুলোতে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নীতি গ্রহণ করা দরকার আসলে ‘মানুষ’কে মাথায় রেখে, যা খুব বেশি হয় না।
আনিসুল হক বলেন, যমুনা সেতু হওয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলে। তৈরি পোশাক কারখানা, নির্মাণ শ্রমিক, ভুট্টা চাষ, পোলট্রি ইত্যাদিতে উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কর্মসূচিগুলো বেশির ভাগই প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ হলেই যেন সব শেষ হয়ে যায়। আর যেখানে যত বেশি প্রকল্প, সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবও তত বেশি।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক কারণেও কিছু কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। যেমন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’। ফলাফল কী হবে, এখনই বলা যাবে না। আবার কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেখানে তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য ঘুষ দেওয়া-নেওয়া হয়।
আখতার আহমেদ বলেন, সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
নগর দারিদ্র্য: বিনায়ক সেন বলেন, নগর দরিদ্ররা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
তবে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, নগর দরিদ্ররা গ্রামে চলে গেলে নগরের ওপর চাপ কমত, তাদের জীবনও আরও সুন্দর হতে পারত। তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কয়েক বছর আগে নগর দরিদ্রদের জন্য অস্থায়ীভাবে নগরে জমি বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিল। একে ‘সর্বনাশা প্রস্তাব’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক কষ্টে তা রোধ করা গেছে। একবার বরাদ্দ দিলে তাদের আর উচ্ছেদ করা যেত না। রাজনৈতিক হলেও নানা প্রণোদনা দিয়ে নগর দরিদ্রদের গ্রামে পাঠানোর জন্য যে ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার অনেক সুফল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শিক্ষার উন্নয়ন: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, শিক্ষা এবং একমাত্র শিক্ষার উন্নয়নই হতে পারে দারিদ্র্য নিরসনের অন্যতম উপায়। এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে তা-ই হয়েছে। তিনি বলেন, কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কর্মসংস্থানের বিশাল আয়োজন করা না গেলে কিছুই হবে না।
অথচ বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ তিন বছর ধরেই কমছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের যে ধারণা, তাতে এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না।’
আখতার আহমেদ বলেন, শিক্ষা খাতে বৃত্তিজাতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু পুষ্টির বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। অথচ শিক্ষা ও পুষ্টি—এ দুই খাতেই সমান নজর দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম বলেন, জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারলে এর চেয়ে বেশিও অর্জন করা সম্ভব।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: সব পরিকল্পনার মধ্যেই জনসংখ্যাকে রাখতে হবে বলে মনে করেন এ কে এম নুরুন্নবী। তিনি বলেন, কোনো ক্ষেত্রেই সঠিক কোনো তথ্য নেই। কারণ, সরকারি উৎসগুলোর মধ্যেই সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, জন্ম নিবন্ধনটাও কার্যকরভাবে করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
নুরুন্নবী আরও বলেন, এখন থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিতে পারলে আগামী ১০ বছরে দেশ বয়স্ক লোকের ভারে ভরে যাবে। শুরু হয়ে যাবে অরাজকতা।
কিছু পরামর্শ: হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে যায় হঠাৎ অসুখ বিসুখে পড়লে, ওষুধের খরচের কারণে। অথচ এ বিষয়ে কোনো কর্মসূচি নেই। অক্টোবর-নভেম্বরে মৌসুমি দরিদ্রদের কোনো কাজ থাকে না। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ও মানুষের কিছু করার থাকে না। তাদের জন্যও কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল একেবারে না খাওয়াটাই ছিল সমস্যা। এখন সমস্যা পুষ্টিহীনতা।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সরকারের ওপরই চাপটা বেশি। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম বিত্তশালীদের এ ব্যাপারে চাপ দেয় না। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কেন তাঁদের অনীহা বুঝতে পারছি না।’
ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ২০০১ সালের হিসাবে দেশে ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।
বিনায়ক সেন বলেন, ধনিক শ্রেণীর সম্পদের ওপর থেকে কর আদায় করে তা সহজেই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ব্যয় করা যায়।
Tag Archives: প্রথম আলো
রবীন্দ্রনাথে অবগাহন
বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ২০-০৬-২০১১
নিজের আঁকা ছবিতে তিনি রহস্যময়। সেই ছবি মঞ্চে, চারপাশের দেয়ালে। সঙ্গে উৎকীর্ণ তাঁর রচনার অংশ। রবির সেই বাণী স্পষ্ট, বাইরের ঝলমলে রবির আলোর মতোই অম্লান। তাতেই অবগাহন করে কাটল সারা বেলা, এই সময়ে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার অনুসন্ধান প্রয়াসে।
প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত ‘রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে’ শীর্ষক দুই দিনের সেমিনারের গতকাল রোববার ছিল সমাপনী। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উইন্ডি টাউন মিলনায়তনে কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এই সেমিনারে গতকালও চারটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ নানা শ্রেণীর রবীন্দ্র-অনুরাগী শ্রোতা দিনভর নিমগ্ন ছিলেন বিদগ্ধজনের নানামাত্রিক রবীন্দ্র-বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের জীবনে এখনো সত্য ও সুন্দরের ফল্গুধারার মতো বহমান, সে কথাই নানাজনের মুখে ঘুরেফিরে এসেছিল বিভিন্নভাবে। সত্য ও সুন্দরের প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারায় না।
রবীন্দ্রনাথের নাটক
সকাল ১০টায় আলোচনার পালা শুরু হয়েছিল নাটক বিষয়ে। অধ্যাপক অনুপম সেন ছিলেন সভাপতি। প্রবন্ধ পড়েন নাট্যজন আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নাট্যরচনায় ছিলেন বৈচিত্র্যসন্ধানী এবং সেই কারণে তাঁর নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। তাঁর সমগ্র নাট্যসাহিত্যে পাই ধর্মীয় ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকারও। চিরনতুন এবং চিরপ্রাসঙ্গিক।’ তিনি বিভিন্ন নাটকের সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে, নাট্যনির্দেশনা ও মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতার উল্লেখের মাধ্যমে আলোচনাকে রসগ্রাহী করে তুলেছিলেন।
পরে এ প্রসঙ্গে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেছেন, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংখ্যা ৭৮টি। স্বাধীনতার পর ৪০টি মূল নাটক এবং ৩৪টি রূপান্তরিত মিলিয়ে ৭৪টি নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে। নাটকে তিনি বিশ্বনাগরিকতাবাদী।
অভিনয়শিল্পী সারা যাকেরও রবীন্দ্রনাটক নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাঁর নাটকে আমরা লক্ষ করি, সব সময় তিনি সমাজের কোনো একটি বড় বাধা বা শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয় তুলে ধরেছেন। সে কারণে তাঁর নাটক সাধারণ দর্শকও সহজেই গ্রহণ করতে পারে। তবে সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে যদি উপস্থাপনার রাবীন্দ্রিক রীতি ভেঙে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা যায়, তবে নব নব রূপে তাঁকে আবিষ্কার করা সম্ভব।’
ড. আফসার আহমেদ বলেন, ইউরোপীয় রীতির প্রসেনিয়াম থেকে বাংলা নাটক যে বেরিয়ে এসেছে, রবীন্দ্রনাথের হাতেই তার সূচনা হয়েছিল। তিনি সংগীতকেন্দ্রিক আসরনির্ভর দেশীয় ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির আঙ্গিকে নাট্য রচনা করেছেন। তাঁর চিত্রকল্প আরোপিত নয়, দৃশ্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি করেছেন, তা সহজেই দর্শকচিত্ত স্পর্শ করেছে।
সভাপতি অনুপম সেন বলেছেন, তাঁর নাটক সাংকেতিক বা রূপকধর্মী। এই নাটকের মৌলিকতা অতুলনীয়। বিশ্বনাট্যসাহিত্যে এমন নাটক বিরল। তিনি একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী হয়েও আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাঙালিকত্বকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার সমাজের প্রতিটি মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। নাটকে সেই বিশ্বাস পরস্ফুিট করে তুলেছেন। তিনি কেবল এই সময়েই প্রাসঙ্গিক নন, তিনি কালজয়ী।
রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়
চা পানের পরে ‘রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়’ বিষয়ে দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে।
ড. আকবর আলি খান দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, তবে তিনি সেটি সামনে রেখে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা করেন। কবির পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। কারণ এ সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণার অভাব আছে। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন। জমিদার বললেই মনে হয় উৎপীড়ক। কিন্তু তিনি উৎপীড়ক নন, নিজেই উৎপীড়িত ছিলেন পীরালি বংশের কারণে। প্রায় ৩০০ বছর আগে তাঁর পূর্বপুরুষ কলকাতায় গেলেও কুলীন ব্রাহ্মণেরা তাঁদের জাতে নেননি। ব্রাহ্মণেরা তাঁদের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতেন না। বিয়ের কনে আনতে হতো পূর্ববঙ্গের পাড়াগাঁ থেকে। রবীন্দ্রনাথের জন্যই তা করা হয়েছিল। জাতিভেদের কুফল সারা জীবন ভোগ করেছেন। অন্যদিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর বড় জমিদার ছিলেন, তিনি তা ছিলেন না। বছরে তাঁর জমিদারির আয় হতো ৪৫ হাজার টাকা। সেই টাকা সংসারে ভাগ হয়ে যেত পাঁচ পরিবারে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেতন ছিল বার্ষিক ৪৮ হাজার এবং অধ্যাপকের বেতন ছিল নয় হাজার ৬০০ টাকা।’ এমন আরও অনেক তথ্য উপস্থাপন করে তিনি বলেছেন, কবির পরিবার ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই। কাজেই সাধারণ মানুষের দুরবস্থা যে তিনি জানতেন না, তা নয়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি মানুষের দুর্দশা উপলব্ধি করেছেন এবং সাহিত্যে তা তুলে ধরেছেন।
এরপর প্রাবন্ধিক বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ মার্ক্স বা গান্ধীর দৃষ্টিতে পশ্চিমকে দেখেননি। পুরো গ্রহণ বা বর্জনে তাঁর সায় ছিল না। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় চেয়েছিলেন। নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা উন্নয়ন বলতে যে ধরনের মানব উন্নয়ন, শিক্ষা, ক্ষমতায়ন—এসবের কথা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের মানবমুক্তির ভাবনাতেও তা-ই ছিল। তাঁর কথাই আজ আলোচিত হচ্ছে। তবে বর্ণবাদ বিলোপের ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি। নারীর সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ভেবেছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে হূদয় নিয়েই তিনি বেশি ভাবিত ছিলেন। অবশ্য তিনি সব ক্ষেত্রেই তাঁর কালকে অতিক্রম করে যাবেন, এমন দাবি করাও তাঁর প্রতি অবিচার করা। তাঁর কাছে আদর্শের চেয়ে মানুষ ছিল বড়। এই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি সোচ্চার ছিলেন। যেসব সমস্যার সরাসরি সমাধান তিনি দেননি, তা তাঁর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে। এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা।
আলোচনায় অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, সমাজের চেয়ে ব্যক্তিমানুষ তাঁর কাছে বড় ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তি মানুষ সমাজের অণু। এই অণুগুলো বদলালে সমাজ বদলাবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রেও পরিবর্তন আসবে। মনুষ্যত্ব অর্জনের কত পন্থা আছে, মানুষ কত উচ্চে উঠতে পারে, তিনি সেই সন্ধানই করেছেন। মনে রাখতে হবে, তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না, সমাজসংস্কারকও ছিলেন না। তিনি সংস্কারক ছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতির।
ড. মালেকা বেগম বলেন, ‘নারীবাদ মানবতাবাদের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি মানবতার কথা বলেছেন। আন্দোলনের পথে নেমে তাই আমরা তাঁর কথা বাদ দিতে পারি না। তিনি কিছু লুকোননি। সরাসরি স্পষ্ট করে বলেছেন, আমাদের সমাজে যেটার অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর বক্তব্যকে সামগ্রিক ভাবনার আলোকে নিয়ে লক্ষ করেছি, সেখানে আছে সমাজবদলের দলিল।’
অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, ‘তিনি ব্যক্তির ওপর সমষ্টির প্রাধান্য পছন্দ করেননি। তিনি ভাবতেন, মানুষ নেই তো সত্যও নেই। এই মানুষকেই তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান করার কথা বলেছেন। বিশেষত, গ্রামের মানুষের ক্ষেত্রে যেভাবে বলেছেন, রাজনীতিকদের তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।’
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া যাবে না—রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যক্তি একাকী অনেক কিছু করতে পারে না, রাষ্ট্রের সাহায্য প্রয়োজন হয়। তবে সমাজকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতেন না তিনি। তাঁর কাছে সমাজ বড়, রাষ্ট্র নয়। সমাজের অনেক অসংগতি তিনি মানেননি। মানলে সেসব নিয়ে লিখতেন না। সেই লেখায় সত্যমূল্য না থাকলে তা হয় ছলনা। তাঁর লেখা ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ কথাটি আজ প্রবাদের মতোই সত্য। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধ চলছে, কর্মহীন বেকার যুবক ছুটছে, নিষ্ফল মাথা কুটছে—এগুলো সবই সত্যি। এসবই তার মনুষ্যত্বের দায় বহন করে। এই সত্যের জন্য, এই সমাজ ভাঙার শক্তির জন্যই রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের জাতিভাবনা
দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা ছিল মিলনায়তনেই। খাবারের পর তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় এই দুই দিনের সেমিনারের আহ্বায়ক অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে।
রবীন্দ্রনাথের জাতিভাবনা নিয়ে প্রবন্ধ পড়েন ড. বিনায়ক সেন। দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এ পর্বে। প্রাবন্ধিক বলেছেন, ‘জাতি’ না বলে রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’ বলতে চেয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে ১৮৮৫-১৯১০ পর্যন্ত ছিল এই ‘নেশন’-এর প্রতি গভীর মোহ। ভাষা দিয়েই তাঁর এই মোহ শুরু হয়েছিল। তিনি নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় করে মহাজাতি গঠন করতে চেয়েছেন। এই মোহ ভেঙেছে ১৯১০-৪১ কালপর্যায়ে। তিনি তখন ‘নো নেশন’-এর পক্ষে কথা বলেছেন। প্রাচ্যে সমাজকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সমাজ গঠিত হয়। তিনি এই দুয়ের মধ্যে একটি সমন্বয় চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলেছেন ‘ট্র্যাজিক হিরো’।
আলোচনায় অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক মতপ্রকাশের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনেকবার নিন্দিত হয়েছেন। আমাদের সমাজে ভাষাগত, ধর্মীয়, স্থানীয়—বহু ধরনের ঐক্য ছিল। এই ঐক্যের বোধকে তিনি জাতীয়তাবোধ বলেছেন। উগ্র জাতীয়তা গ্রহণ করেননি। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকার লক্ষ করেছিলেন। সমন্বয়ের পথ ধরেই বাঙালিকে উন্নত হওয়ার কথা বলেছিলেন।’
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আমরা বাংলায় কথা বলি তাই আমাদের বাঙালি বলা হয়। কিন্তু বলাই যেতে পারে, ১৯৪৭ সালের পরে বাঙালি জাতি বলে আর কিছু নেই। কারণ, তারপর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। নতুন পরিস্থিতিতে আমরা লড়াই করে যে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি, সেই রবীন্দ্রনাথও অন্য রকম।’
ড. রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ জাতিসত্তার ভিতর থেকে আন্তর্জাতিকতার বিষয়টি দেখেছেন। আমরা জাতিসত্তাকে বিকশিত করছি না—এই আক্ষেপ তাঁর ছিল। “বাংলাদেশ” নামটি তাঁর রচনাতেই সবচেয়ে বেশি এসেছে।’
সভাপতি আনিসুজ্জামান বলেন, ইউরোপীয় ও ভারতীয় রাষ্ট্রভাবনায় পার্থক্য ছিল। মোগল-আফগান শাসনের সময় যে সমস্যা হয়নি, ইংরেজ শাসনামলে তা দেখা দিয়েছিল। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রে সংঘবদ্ধ সংস্থা। এর লক্ষ্য রাজনীতি ও ব্যবসা পরিচালনা। ব্যবসা বাড়াতে বাড়াতে অন্য দেশ দখল করে সংঘাতের দিকে চলে যায়। অন্যের দেশ দখল করার নীতিকে রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেননি। তিনি জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে আত্মশক্তি জোগানোর কথা বলেছেন, যাকে আজ আমরা জনগণের ক্ষমতায়ন বলছি। তবে সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি অনেক কিছুই এড়াতে পারেননি।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
শেষ অধিবেশনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিষয়ে। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অসুস্থতার কারণে আসেননি। সেটি পাঠ করেছেন মারুফা রহমান। প্রবন্ধকার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ পেশাজীবী তৈরির জন্য শিক্ষার কথা ভাবেননি। শিক্ষা কোনো গণ্ডিতে বা ছকে বাঁধা যায়—এমন কথা তাঁর ভাবনাতেই আসেনি। তাঁর কাছে পড়ানোর বিষয়, ধরন বা উপকরণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো চর্চা ও সাধনায় নিরত শিক্ষকের সহূদয় সক্রিয় সাহচর্য। তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তি ও আনন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আলোচক দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানুষকে বদলে পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
অধ্যাপক মোহীত উল আলম বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মৌলিক শিক্ষাভাবনার সঙ্গে আমাদের ভাবনা মেলে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার ভৌত পরিকাঠামোর অভাব আছে।’
অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘আমরা বৃত্তিজীবী চাই, মানুষ চাই না। শিক্ষার মূল আদর্শ হারিয়ে ফেলেছি।’
সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, সফল মানুষ হওয়ার কথা অনেকে বলেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রেনেসাঁ-মানব। তিনি জীবনের সব সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষ যেন তাঁর জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে, তেমন শিক্ষা চেয়েছিলেন।
অধিবেশন সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই দুই দিনের আটটি সেমিনারের প্রবন্ধ ও আলোচনাগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হবে। আগামী ২২ শ্রাবণ কবির প্রয়াণ দিবসে বইটি প্রকাশিত হবে।
জনগণের অবস্থা জলেপড়া পিঁপড়ের মতো
তারিখ: ০৯-০৬-২০১২
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নিরন্তর সংশয়বাদের কোনো কারণ নেই। নিরন্তর সংশয়বাদ অর্থনীতিবিদদের বস্তুনিষ্ঠতাকে ক্ষুণ্ন করে। বাজেট আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে অনেক সময় অনেকেই সংশয় ব্যক্ত করে থাকেন। এবং সেটা একসময় পাভলোভীয় মনস্তত্ত্বের ধারা অনুসারে একটি স্বভাবে পরিণত হয়। আমি বাজেটকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক কালের দুটি উদাহরণ দেব। যখন গত বছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন ২০১০-১১ অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটি বিতর্ক হয়েছিল। সংশয়বাদীরা তখন বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ কোনোভাবেই হতে পারে না; বরং এটা হবে ৬ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন চূড়ান্ত হিসাবে দেখা গেল, ২০১০-১১-অর্থবছের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশই হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি খুব সাম্প্রতিক কালের। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে। বৈদেশিক সাহায্য না আসা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকারকে উপায়ান্তর না দেখে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অনেক বেশি হারে ঋণ নিতে হয়। সংশয়বাদীরা তখন বলতে থাকেন, অচিরেই অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। যেন চারদিকের সব বাতি একে একে নিভে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরের কয়েক মাসে সংযত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি গ্রহণ করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার অনেকটাই ফিরিয়ে আনতে পারা গেছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের অর্থনীতিতে সংযত মুদ্রানীতি যে আদৌ কাজ করে, তা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। এর স্বীকৃতি মিলেছে এ মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে আবার বেশ কিছুটা স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হারও বেশ কিছুটা কমে এসেছে এবং সামগ্রিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এবং লেনদেনের ভারসাম্য বেশ কিছুটা উন্নত হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির সংশয়বাদের বিপরীতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার প্রাথমিকভাবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে, যা হয়তো চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়বে। এই ৬ দশমিক ৩ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বাদে অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। সুতরাং ঘনায়মান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার এই সাফল্য কিছুটা হলেও সবাইকে স্বীকার করতে হবে। সেটা সংশয়বাদীরা মুখে বলুন বা না-ই বলুন। বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সব সময়ই খাদের কিনার থেকে সাফল্যের সঙ্গে ফিরে আসতে পেরেছে। এটাও আমাদের অর্থনীতির উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতার আরেকটা দিক।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটকে যাঁরা রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের জন্য উচ্চাভিলাষী বলছেন, তাঁদের পক্ষে যুক্তি মেলে না। এর কারণ, গত অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যয় ও জিডিপির অনুপাত ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ, এবারও এই অনুপাত ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। তবে বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে সংগত কারণেই বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে: ক. আমাদের দেশের বাজেটের অর্থায়ন দুই দশক আগে ছিল বৈদেশিক সাহার্য্যনির্ভর, এখন তা হয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণনির্ভর; খ. এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষমতা বাড়েনি; গ. গেল অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে আরও প্রতিকূল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে—যেমন, ইউরো জোনের সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে; সিরিয়া, চাই কি ইরানকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণে আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। ঘ. কয়েক বছর ধরে কৃষি উৎপাদন প্রাকৃতিক দুর্যোগমুক্ত ছিল, এ ক্ষেত্রে মন্দভাগ্য দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে। এসব কারণে আমার মোটা দাগের অভিমত হলো, এই বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সর্বাগ্রে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ধরে রাখা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত (যখন মূল্যস্ফীতি আবার ৫-৭ শতাংশে ফিরে আসবে এবং বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা পুরোপুরি অর্জিত হবে) করার পরই কেবল উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার দিকে অগ্রসর হওয়া। প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে এনেও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা চাই। আমার ধারণা, এবারের বাজেট বক্তৃতায় একদিকে সংযত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কথা বলে গেল অর্থবছরের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার থেকে আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশে উল্লম্ফনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবানুগ নয়। এটা সম্ভবত করা হয়েছে জনতুষ্টির কথা ভেবে। অর্থমন্ত্রী এটা না করলেও পারতেন। এখানে আমার প্রধান আপত্তি দুটি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার যুক্তি ছাড়াও আরও দুটি বাড়তি উদ্বেগ এখানে রয়েছে। প্রথমত, শুধু প্রবৃদ্ধিই জীবনযাত্রার কল্যাণ বয়ে আনে না। প্রবৃদ্ধি কল্যাণ বয়ে আনবে কি না, সেটা নির্ভর করে শুধু প্রবৃদ্ধির হারের ওপর নয়, প্রবৃদ্ধির চরিত্রের ওপর। যেমন, পরিবেশ ধ্বংস করে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে চাইলে তা জনগণের অকল্যাণ বয়ে আনে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্পকে (খাল-বিল-নদী-জলাশয়, বনভূমি ইত্যাদি) উৎসাহিত করে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারের প্রস্তাব করা হলে সমাজে আয় ও সম্পদবৈষম্য দ্রুত হারে বাড়তে থাকে, যেটা বাংলাদেশে এক দশক ধরে ঘটছে। বাজেট বক্তৃতায় ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আয় ও সম্পদবৈষম্য বৃদ্ধির প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এবার আসি বাজেট থেকে জনসাধারণ কী প্রত্যাশা জানিয়েছিল এবং কী তারা পেতে যাচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে। প্রথমেই লক্ষ করার বিষয়, সেটা হলো বাজেট নিয়ে জনসাধারণের প্রত্যাশা অত্যন্ত সীমিত হয়ে আসছে। জনমানুষ হচ্ছে জলে পড়া পিঁপড়ের মতো, তারা শুধু এটুকুই আশা করে যে রাষ্ট্র তাদের ডাঙায় তুলে দেবে। তাহলে তারা নিজেরাই চলতে পারবে। তারা চাইছে দ্রব্যমূল্যের সহনীয় পরিস্থিতি। প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, না ৭ দশমিক ২ শতাংশ হলো, এ নিয়ে তাদের তেমন উদ্বিগ্ন বা বিতর্কিত হতে দেখা যায় না অর্থনীতিবিদদের মতো। দ্বিতীয়ত, এযাবৎ প্রতিটি সরকারই প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিছুটা করে দারিদ্র্য কমিয়েছে, বেশ কিছুটা মানবসম্পদ উন্নয়ন করেছে, কিন্তু তাতে সাধারণ জনগণ খুশি হয়ে পর পর দুবার কোনো রাজনৈতিক সরকারকে নির্বাচনে জয়ী করেনি। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বাধা। এর দুটি সম্ভাব্য উত্তর আমি এখানে নিবেদন করতে পারি। এক. জনসাধারণ রাজনৈতিক সরকারকে মূল্যায়ন করে প্রবৃদ্ধির জাতীয় অর্থনৈতিক সূচকে নয়, তারা জোর দেয় বেশি করে অন-অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ওপরে, যেমন: সুশাসন, মানবাধিকার, মাঠপর্যায়ের দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, রাজনীতিবিদদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ তথা তাঁদের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, শিষ্টাচার ইত্যাদি। দুই. আরেকটি বড় কারণ হতে পারে, অর্থনৈতিক সূচকে ভালো করার পরও প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো (এখানে ভালোর সংজ্ঞা হচ্ছে সৎ ও যোগ্য। যিনি নির্বাচনে টাকা ও পেশিশক্তির জোরে জয়লাভ করেন, তাঁকে এখানে ভালো প্রার্থী হিসেবে ধরা হচ্ছে না) প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয় না। তারা যাঁদের মনোনয়ন দেয়, তাঁদের একটি বড় অংশই হচ্ছেন মনোনয়ন-বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে আসা ‘খারাপ’ প্রার্থী এবং এই খারাপ প্রার্থীরা যখন জয়লাভ করেন, তাঁরা অর্থনৈতিক সুশাসন এবং মাঠপর্যায়ে বাজেটের বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। নথিপত্রে হয়তো বাজেট ঠিকই বাস্তবায়িত হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে দুর্নীতি ঢুকে পড়ে।
জনসাধারণ বাজেটের কাছে চায় পুনর্বণ্টনমূলক নীতি, বাজেটের একটি প্রধান কাজও হচ্ছে তা-ই। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, গেল বছরের বাজেটে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পত্তি যাঁদের রয়েছে, এই সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে কম, মাত্র চার হাজার; তাঁদের কাছ থেকে প্রদত্ত করের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সারচার্জ এসেছে মাত্র ৪৫-৫০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বাজেটে উচিত ছিল, বাজারের চলতি মূল্যে সম্পত্তির মূল্যায়ন করা। তা করা হলে দেখা যেত, এই সারচার্জের আওতায় অন্তত দুই থেকে তিন লাখ লোক চলে আসত, তার ফলে সারচার্জ তথা ‘প্রপার্টি ট্যাক্স’ (বাংলাদেশে এখনো কোনো প্রপার্টি ট্যাক্স চালু হয়নি, যেটা উন্নত সব দেশে রয়েছে) বাবদ হয়তো অতিরিক্ত ৬০০-৭০০ কোটি টাকা চলে আসত। এবং এই টাকা দিয়ে শহর ও গ্রামের হতদরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য সম্পদ সৃষ্টি (ব্র্যাকের টিইউপি কর্মসূচির মতো) করার উদ্যোগ নেওয়া যেত। এবারের বাজেটে আমি হতাশ হয়েছি দেখে যে ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি পুনর্বণ্টনের কোনো কর্মসূচিকে সমর্থন দেওয়া হয়নি বা এ মর্মে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সমর্থনের কথাও বলা হয়নি; বরং বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও গরিবমুখিনতা সীমাবদ্ধ থেকেছে কিছু সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির মধ্যে এবং এসব কর্মসূচিও গরিব মানুষের তাৎপর্যপূণভাবে সাহায্য করতে পারে না। কারণ, এসব কর্মসূচিতে প্রদত্ত মাসিক সুবিধার পরিমাণ এক-দেড় দিনের কৃষি-মজুরির চেয়ে কম।
সর্বশেষে বলব, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্যও আমাদের বৈদেশিক সাহায্য দরকার। এবং সে জন্য বৈদেশিক সাহায্যদাতাদের মনস্তত্ত্বও আমাদের বুঝতে হবে। গত বছর এ ক্ষেত্রে আমরা সফল হইনি। আগামী বছরে সফল হতেই হবে। নইলে বাজেটের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়ে পড়বে আবারও। দুঃখের বিষয়, এই সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষুধা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ১৬ কোটি মানুষের দেশের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ দরকার (যেমন, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোকে বাজেটের মোট ব্যয়ের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সরাসরি ‘ম্যাচিং গ্রান্ট’ হিসেবে বরাদ্দ করা), সে সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ নেই। আমি তাতে বিস্মিত হইনি। কেননা, আমরা বাস করছি পল ক্রুগম্যানের ভাষায়, এক ‘ক্রমবিলীয়মান প্রত্যাশার যুগে’।
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ। গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
তৃতীয় ইউটোপিয়ার মুখোমুখি
তারিখ: ০৪-১১-২০১১
১. উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ও ইউটোপিয়া
আমরা এক আধুনিক ইউটোপিয়ার সন্ধানে আছি। আগামী এক দশকে দেশ কোন পথ ধরে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের সীমা নেই। এর একটা বড় কারণ, জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে বিশ্বের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। তার ওপর রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিরন্তর ঝুঁকি। অব্যাহত বিশ্বমন্দা-পরিস্থিতিও আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলেছে। এ রকম একটা জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কোন পথে অগ্রসর হবে, তা চলতি উন্নয়নের ছকে নির্ণয় করা সহজ নয়। উন্নয়নের প্রচলিত পাঠ্যবইগুলো এ রকম একটি দেশের অভিজ্ঞতাকে মনে রেখে লেখা হয়নি। এ দেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ (সদ্য প্রয়াত) আবু আবদুল্লাহকে দুই দশক আগে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘১০০ বছর পর কোন ধরনের বাংলাদেশকে দেখতে চান আপনি?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘১০০ বছর পর এ দেশের কতটা ভূখণ্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাবে, সে নিয়ে আসুন, ভাবি।’ এই ভৌগোলিক উদ্বেগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শামসুর রাহমান লেখেন, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’। এটা এক অর্থে নতুন ইউটোপিয়ারই অন্বেষণ। জন্মের মুহূর্ত থেকেই বাংলাদেশ এই তালাশের মধ্যে আছে। নইলে কবির মনে হতো না যে দেশটা কী করে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো গভীর রাতে মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠছে, যার মুখে ‘শতাব্দীর গাঢ় বিশদ শ্যাওলা আর ভীষণ ফাটল, যেন বেদনার রেখা’।
ইউটোপিয়া হচ্ছে ‘ত্রুটিযুক্ত বাস্তবতার ত্রুটিমুক্ত প্রতিফলন’—এক ‘পারফেক্টেড রিয়ালিটি’। দার্শনিক মিশেল ফুকো এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেন ইউটোপিয়াকে। হাইপার-পাওয়ার নিয়ন্ত্রিত এই বৈরী বিশ্বে তীব্র অপমান ও প্রবল অস্বীকারের মধ্যে বাস করে আমরা ইউটোপিয়াকে আঁকড়ে ধরি এবং এর মাধ্যমে আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক সত্তার স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি। এই চেষ্টার আদি রূপ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইউটোপিয়া-সংক্রান্ত রচনা—ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস। সেই সূত্রে ফিউচার স্টাডিজের একটি নতুন প্রত্যয় তিনি বাংলায় আমাদের উপহার দিলেন, যার নাম ভবিষ্য-বিচার। রবীন্দ্রনাথও প্রবলভাবে আক্রান্ত ছিলেন ইউটোপিয়ায়। প্রথমে লিখলেন ‘স্বদেশী সমাজ’, তারপর নেশনের ন্যারেটিভকে প্রতিহত করতে করতে পৌঁছালেন এমন এক সমাজকল্পে, যার নাম ‘নো-নেশনের সমাজ’। বিল অ্যাশক্রফটের মতো তাত্ত্বিক মনে করেন, উপনিবেশবিরোধী ক্রিটিক্যাল ইউটোপিয়ার আদি চিন্তকদের একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যেমন ছিলেন আফ্রিকার পটভূমিতে ফ্রানস ফেনন।
‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের শেষে রবীন্দ্রনাথ প্রতীক্ষা করেন প্রাচ্যদিগন্তে নব সূর্যোদয়ের। অন্যত্র শুনতে পান ‘ঐ মহামানব আসে’—নতুন রাজনৈতিক শক্তি-সমাবেশের সম্ভাব্য আবির্ভাবের বার্তা। ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ সংগ্রহের একটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বোঝানোর জন্য ভূদেব বেছে নেন আগ্রহ-জাগানিয়া শিরোনাম—‘নেতৃপ্রতীক্ষা’। আজও আমরা এক নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমাবেশের প্রতীক্ষায় আছি। এর কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় (এবং এ দেশে) নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র ও অসহিষ্ণু গণতন্ত্রের মধ্যে ভেদরেখা ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
২. প্রজা বনাম তন্ত্র
এ দেশের সামাজিক ইতিহাসে ইউটোপিয়ার দুটো ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ আমরা অতীতে প্রত্যক্ষ করেছি। ‘প্রথম ইউটোপিয়া’ ছিল ‘পাকিস্তান’ নামক ধারণাটিকে ঘিরে। পাকিস্তান আন্দোলনে এই ভূখণ্ড প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছিল—তার মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষকবর্গের ইউটোপিয়া। পাকিস্তান ছিল তাদের চোখে এক আদর্শ রাষ্ট্র, যেখানে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক পীড়ন থেকে কৃষকের মুক্তি আসবে, তাঁদের স্বার্থের দেখভাল করবে এক নতুন সমতাবাদী রাষ্ট্র। যেখানে প্রজায় ও তন্ত্রে বিরোধ হবে না। ১৯০১-১৯৪৭ পর্বে বাংলাদেশের কৃষি খাত ‘ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি’-এর চাপে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের কৃষি খাত (ভারতের চেয়ে) উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে চলছিল। অর্থাৎ দুই অঞ্চলে ভিন্ন দুই কারণে পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। প্রবল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে উপায়ান্তরহীন হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছিল পূর্ব বাংলার গরিব বর্গাচাষি ভূমিহীন কৃষককুল। অন্যদিকে, পাকিস্তানে এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল সামন্ততান্ত্রিক শক্তি, মূলত বৃহৎ ভূস্বামী ও ধনী কৃষকেরা। ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল তাঁর স্টেট এগেইনস্ট নেশন বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রথম ইউটোপিয়াটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মলাভের কয়েক বছরের মধ্যেই কী করে ভেঙে পড়ে।
ষাটের দশকে নেশন ও ন্যাশনালিজমকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় ‘দ্বিতীয় ইউটোপিয়া’, যার পরিণতি—১৯৭১। এই আন্দোলনে ক্রিয়াশীল ছিল শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের ‘ওপরে ওঠার’ স্বাভাবিক শ্রেণী-আকাঙ্ক্ষা। তবে শুধু মধ্যবিত্তের ওপর ভর করে বিজয় সম্ভব ছিল না। ১৯৭১ সালের নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধ এক নতুন সামাজিক শক্তিতে বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে: মধ্যবিত্ত ছাপিয়ে ক্রমেই বেড়ে উঠছিল সাধারণ নিম্নবর্গ মানুষের উপস্থিতি। এ পর্যন্ত গবেষণায় স্পষ্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল গ্রামের সাধারণ মেহনতি মানুষ, যারা ছিল আধুনিক শিক্ষার বাইরে। ১৯৭১ সালের ইউটোপিয়ায় এক ভিন্নতর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কয়েকটি মৌলিক প্রতিশ্রুতিকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছিল। সেসব প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই স্বাধীনতার ৪০ বছরে প্রতিষ্ঠা পায়নি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ‘দিনবদলের পালা’ ছিল নির্বাচনী ইচ্ছাপূরণের কড়চা কেবল, যার অধিকাংশই আজ ভুলে যেতে বসেছে শাসক দল। এভাবেই দ্বিতীয় ইউটোপিয়া ভেঙে পড়েছে আজ।
৩. জ্যাক সাহেবের ফরিদপুর
আমরা বর্তমানে এক নতুন (তৃতীয়) ইউটোপিয়ার প্রাক-মুহূর্তে অবস্থান করছি। কিন্তু একে কেবল উন্নয়নবাদী প্রতর্কে বর্ণনা করা যাবে না। ‘এ দেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের স্তরে উন্নীত হবে’—এই অবস্থান আমাদের প্রগতিকে পর্যবসিত করে জিডিপির নিতান্ত সূচকে। জিডিপির পরিসংখ্যানে গরিব-মেহনতি মানুষের সামাজিক জাগরণের (মবিলিটি) আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় না।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১০ সালে ফরিদপুরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর (জেলা প্রশাসক) জে সি জ্যাক দারিদ্র্যের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা চালান। এটাই ছিল ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম দারিদ্র্য জরিপ, যার সঙ্গে আধুনিক কালের পারিবারিক আয়-ব্যয় জরিপের তুলনা চলে। ১৯১৬ সালে এই জরিপের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জ্যাক সাহেব তাঁর দ্য ইকোনমিক লাইফ অব আ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট বইটি রচনা করেন। এ বইয়ে জ্যাক দারিদ্র্যকে তিনটি সুনির্দিষ্ট স্তরে বিভাজন করেন। তাঁর হিসাব অনুযায়ী ১৯১০ সালে ফরিদপুরে ‘চরম দারিদ্র্যে’ বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৭ শতাংশ; এর ঠিক পরই ‘স্বল্প-দারিদ্র্যে’ বাস করত ২৮.২ শতাংশ; আর ৫১.১ শতাংশ ছিল ‘দারিদ্র্যসীমার ওপরে’। অর্থাৎ মোটা দাগে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ১৯১০ সালে দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিল। জ্যাকের জরিপের ৯৫ বছর পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৫ সালে যে জরিপ চালায়, তাতে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দারিদ্র্যের মধ্যে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০.৮ শতাংশে। অর্থাৎ ৯৫ বছরে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় দারিদ্র্য কমেছে মাত্র ১০ শতাংশ (শতাব্দীজুড়ে এই সূচকের বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে)।
একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমার প্রবণতা বেগবান হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ২০১০ সালের অতি সাম্প্রতিক আয়-ব্যয় জরিপেও দেখা যাচ্ছে চরম দারিদ্র্যের প্রবল উপস্থিতি। গোটা দেশের (শহর-গ্রাম মিলিয়ে) মোট ৩২ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশই হচ্ছে চরম দরিদ্র। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের বর্ধিত প্রবাহ, মাইক্রো ফাইন্যান্সের প্রসার, দ্রুত নগরায়ণ—এসব সত্ত্বেও কেন দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠী এখনো থেকে গেল চরম দারিদ্র্যে এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ থেকে গেল দারিদ্র্যের ভেতরে?
আর এসবই হিসাব করা হয়েছে সরলতম প্রয়োজনের সূচকে। যদি গণতান্ত্রিক ভোটে সবার মতামত নিয়ে আমরা দারিদ্র্যসীমা সংজ্ঞায়িত করতাম (অন্তত যে ধরনের পভার্টি-লাইন শ্রীলঙ্কায় বা লাতিন আমেরিকায় চালু, তা যদি এ দেশে ব্যবহার করা হয়), তাহলে দারিদ্র্য-প্রবণতার ক্ষেত্রে শাসকবর্গের আত্মতুষ্টির সাম্প্রতিক চিত্র অনেকখানি বদলে যেত। ‘ইকোনমিকস’ শব্দটা যার সূত্রে আমরা প্রাপ্ত, সেই অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল যা বলেছিলেন তা মোটা দাগে এই, ‘কেন সমাজের একদল মানুষ সুসংস্কৃত জীবন যাপন করবে, আর অন্য একদল মানুষ উদয়াস্ত কায়িক শ্রমে নিজেদের জীবনীশক্তি ধ্বংস করবে—এটি হচ্ছে অর্থশাস্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন।’ পাঠক, লক্ষ করবেন, প্রশ্নটা ক্যাপিটাল গ্রন্থের লেখক মার্কস করছেন না, করছেন নব্য-ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্রের প্রবক্তা প্রিন্সিপলস অব ইকোনমিকস-এর মার্শাল সাহেব।
৪. নাগরিক অধিকারের ভাষা
দারিদ্র্য, বিশেষত চরম দারিদ্র্য, এ দেশ থেকে সহজে মুছে যাবে না, বা আজ কমে এলেও কোনো আকস্মিক বা প্রত্যাশিত দুর্বিপাকে দারিদ্র্য আবারও বেড়ে যেতে পারে। এর কারণ, আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনো ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলছে না। চরম দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকরী সামাজিক নিরাপত্তা চাওয়া প্রজাকুলের পক্ষ থেকে কোনো সকাতর আবেদন নয়; এটা পাওয়া নাগরিক হিসেবে তার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।
সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, দেশে এরই মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ রকম বিচিত্রবিধ ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী’ চালু হয়েছে। এবং এ বাবদ মোট সরকারি ব্যয়ের (রাজস্ব/উন্নয়ন মিলিয়ে) প্রায় ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। মূল সমস্যাটা ধরা পড়ে মাথাপিছু বরাদ্দের হার বিবেচনায় নিলে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রী বৃত্তি, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি—এসব কর্মসূচিতে প্রতিমাসে সুবিধাভোগী-পিছু যে টাকা (৩০০ থেকে ৫০০ টাকা মাসে) দেওয়া হয়, তা কেবল দুই বা তিন দিনের কৃষিমজুরির সমান। এই অর্থ এতই নগণ্য যে একে ‘টোকেনিজম’ বা লোক দেখানো কর্মসূচি বললে অত্যুক্তি হয় না। ফলে এসব কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে দারিদ্র্যসীমা পেরোনো যায় না। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তর থেকে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের ঝরে পড়াও বন্ধ করা যায় না। মঙ্গা এলাকায় ১০০ বা ৮০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাজ করে যেটুকু আয় হয়, তাতে করে দারিদ্র্যসীমার অর্ধেক পথও পাড়ি দেওয়া যায় না। কিন্তু এসব কর্মসূচিতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়াতে গেলে বর্তমান রাজস্ব কাঠামোয় তা অর্জন করা দুরূহ। এর জন্য বিত্তবান শ্রেণীর ওপর করারোপ করে নতুন সম্পদ আহরণ করা প্রয়োজন। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের কর-রাজস্বের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ১০-১১ শতাংশ। এই হার যদি আরও ২-৩ শতাংশ বাড়ানো যেত (দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদেরই কর-জিডিপি অনুপাত সর্বনিম্নে) এবং আহরিত বাড়তি সম্পদটুকুর পুরোটাই যদি সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে আসত, তাহলে আরও দ্রুত হারে আমরা চরম দারিদ্র্য মুছে ফেলতে পারতাম। যে দেশে বণ্টনমূলক ভূমি-সংস্কার করার অবকাশ সীমিত, সে দেশে বিত্তশালী শ্রেণীর ওপর বর্ধিত করারোপের মাধ্যমেই কেবল পুনর্বণ্টনমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এখানেই তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার হতে পারত। অন্তত তাই প্রত্যাশিত ছিল ‘দিনবদলের সরকার’-এর কাছ থেকে।
কিন্তু আমরা সেদিকে অগ্রসর হইনি, বরং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে যেসব বৃহৎ বিনিয়োগকারী সমবেতভাবে দুই-তিন হাজার কোটি টাকার বেশি (অনুমানে বলছি) লাভ করেছেন, তাঁদের মুনাফার ওপর কর মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে শেয়ারবাজার যখন তেজি হয়ে উঠছিল সেই সূচনাপর্বেই। এবারের বাজেটে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারীদের ওপর ১০ শতাংশ সম্পদ-কর সারচার্জ হিসেবে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এই বাড়তি রাজস্ব (যদি আহরিত হয়ও) চরম দরিদ্রদের জন্য ব্যয়িত হবে—এই মর্মে কোনো প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত নেই। বলা হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্তমানে যা ব্যয় করা হচ্ছে, তা জিডিপির আড়াই শতাংশ এবং এই অর্থ প্রকৃত গরিবদের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, তা জানার জন্য জাতীয় পর্যায়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহায়তায় চরম দরিদ্রদের ওপর ‘ন্যাশনাল ডেটাবেইস’ তৈরি করা হবে। অথচ প্রায় একই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশে কালোটাকার মোট পরিমাণ জিডিপির ৮১ শতাংশ (সর্বোচ্চ হিসাব) অথবা ন্যূনপক্ষে ৪২ শতাংশ (সর্বনিম্ন হিসাব)। এই কালোটাকার বণ্টনের ওপর জাতীয় পর্যায়ে কোনো জরিপ নেই, নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে না। বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশে তা জানারও উপায় নেই। যেমন জানার উপায় নেই গত দুই দশকে আর্থিক খাত থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে ধনিক গোষ্ঠীর ‘লুটপাটের কাহিনি’ (আশির দশকে একতা পত্রিকায় এ নিয়ে একবার কিছু তথ্য বেরিয়েছিল)। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর দোহাই দিয়ে আজ আড়াল করে রাখা হচ্ছে গণতন্ত্রের দুই দশকে প্রাথমিক পুঁজি আহরণের ‘দ্বিতীয়’ পর্যায়কে, যা স্বৈরতন্ত্রের অধীনে ‘প্রথম’ পর্যায়ের লুণ্ঠনের চেয়ে আরও সর্বগ্রাসী লুণ্ঠনের চিত্রকে তুলে ধরতে পারত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধভাবে ভূমি দখল, জলাশয় দখল, বনজ সম্পদ দখলের মধ্য দিয়ে পুঁজি আহরণের আরও নানা সূত্র। বাংলাদেশে ‘এলিট প্রবৃদ্ধি’ নিয়ে আমরা কোনো গবেষণাই হাতে নিতে পারিনি।
দারিদ্র্য থেকে উত্থান যদি নাগরিক অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে অধিকারের ভাষাতেই ভবিষ্যতে নাগরিক সমাজকে কথা বলতে হবে। রক্ষণশীল অর্থশাস্ত্রের একটি মতে, দারিদ্র্যকে এখনো কেবল ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বের বিষয় হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। এতে সমাজ, রাষ্ট্র ভূমিকা রাখে অত্যন্ত পরোক্ষভাবে। এই মতের সঙ্গে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক অধিকার ধারণার নিরন্তর বিরোধ রয়ে গেছে। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ‘সর্বজনীনতা’র যে উত্থান আমরা এ দেশে (ও ইউরোপে) দেখেছি, এর একমাত্র যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও সর্বজনীন অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া। এর মানে দাঁড়ায়, এক দেশে দুই অর্থনীতি ও দুই সমাজ চলতে পারে না। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেখানে যা যা ঘটবে, তার শুরুর বিন্দু এই ভাবনার সূত্রে গাঁথা। একেই আমরা ‘তৃতীয় ইউটোপিয়া’ বলছি। এর সম্ভাব্য আশু কর্মসূচি হতে পারে এ রকম।
দরিদ্রদের ওপরে ওঠা নিশ্চিত করতে হলে বিশেষত বংশানুক্রমিক ধরে চলা চরম দারিদ্র্যকে দূর করতে হলে উচ্চশিক্ষায়, আধুনিক খাতের কর্মসংস্থানে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে। এক, উন্নত মানের প্রতিটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত করতে হবে এবং তার সুফল যেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণত, সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুল, সানবিমস স্কুল, হলিক্রস বা নটর ডেম কলেজের মতো এলিট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সিট তোলা থাকবে চরম দরিদ্র ও দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য। ভারতে ইতিমধ্যেই এলিট স্কুলগুলোর ২৫ শতাংশ সিট গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। এতে করে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা উন্নত শিক্ষার সুযোগ পেয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মতোই অধিক আয় ও সম্মানের পেশায় যেতে পারবে। দুই, দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা খাসজমির ওপর চরম দরিদ্র গোষ্ঠীর প্রাথমিক অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অকৃষি খাতে ব্যবহারের কারণ দেখিয়ে সরকারি খাসজমিকে বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়ার প্রথা বন্ধ করতে হবে। তিন, দেশের সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য-বিমা চালু করার অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়ে চরম দরিদ্র ও দরিদ্র পরিবারের জন্য অবিলম্বে স্বাস্থ্য-বিমা ও পুষ্টি কর্মসূচি চালু করতে হবে। চার, শুধু মঙ্গা মৌসুমে নয়, বছরের সব মৌসুমে গ্রামে কর্মনিশ্চয়তার কর্মসূচি চালু করতে হবে। পাঁচ, গরিব পরিবারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রীদের জন্য বিশেষ আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। ছয়, গ্রামে যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে, তা শহরের দরিদ্র পরিবারের জন্যও প্রসারিত করা চাই। সাত, চরম দরিদ্রদের জন্য পাইলট পর্যায়ে যেসব ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ইতিমধ্যে সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে, তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। আট, গ্রাম ও পৌরসভা এলাকার স্থানীয় সরকার কাঠামোকে আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে জোরদার করতে হবে, যাতে এসব কাঠামো জনগণের কাছে থেকে তাদের দৈনন্দিনের সমস্যা সমাধানে সরাসরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। জাতীয় বাজেটের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে বছরে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া যায়, যাতে এই অর্থ স্থানীয় সমস্যা সমাধানে ব্যবহূত হতে পারে। নয়, এসব উদ্যোগের জন্য যে বাড়তি সম্পদ জোগান করতে হবে, তার জন্য বিত্তশালী শ্রেণীর আয় ও সম্পদের ওপর বর্ধিত করারোপ করার কোনো বিকল্প নেই। অতিরিক্ত জোগানকৃত অর্থ চরম দরিদ্রদের জন্য সামাজিক তহবিল সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সম্পূরক আমদানি শুল্কের অংশ হিসেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তহবিলের জন্য ‘সারচার্জ’ বসানো হয়ে থাকে। এ রকম ব্যবস্থা আমাদের দেশেও নেওয়া যায়। দশ, মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রতিহত করার জন্য গরিব ও ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীকে সারা দেশে আরও ব্যাপক সরকারি ও এনজিও সহায়তা দিয়ে ‘লিগ্যাল এইড’ কার্যক্রম চালু করতে হবে, যাতে তারা বর্তমান নিঃসহায় অবস্থা থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারে। পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও আরও সক্রিয় আইনি প্রতিরোধ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকেও আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার পাশাপাশি গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এবং এগারো, গরিবদের জন্য যেসব সামাজিক, উন্নয়নমূলক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে—যাদের দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত—তাদের ভূমিকাকে আরও কার্যকর, স্বচ্ছ, বাধামুক্ত ও বেগবান করতে হবে। এই নতুন ‘১১ দফা’ একটি উদাহরণ মাত্র। এর সঙ্গে আরও অনেক করণীয় যুক্ত হতে হবে।
এসবই যেকোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হারে বাস্তবায়নযোগ্য স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক অধিকারের চৌহদ্দিরও সম্প্রসারণ ঘটবে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোয় ও চলতি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দরিদ্র ও চরম-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে এসব দাবির স্বীকৃতি মেলা সহজ নয়। এসব দাবির পক্ষে সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি আদায়ের এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দলনির্বিশেষে নাগরিক (রাজনৈতিক-সামাজিক) সমাবেশ-আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশে বিবদমান দুই রাজনৈতিক পরাশক্তির দৃষ্টি, অন্যদিকে নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণসাধন তাদের লক্ষ্য নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যে বসন্ত এসেছে, ভবিষ্যতে তা আমাদের দেশেও আসতে বাকি।
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক, গবেষণা পরিচালক বিআইডিএস।
কাঁটাতারের দেয়াল
বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৭-০৯-২০১১
ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা বিষয়ে গোড়া থেকেই বাংলাদেশের জনমনে তিনটি মূল অভিযোগ ক্রিয়াশীল ছিল। প্রথমত, দুই বন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর মধ্যে ভৌগোলিক কাঁটাতারের বেড়া থাকা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, দূর ঐতিহাসিক কাল থেকেই যারা প্রতিবেশী, তাদের মধ্যে মানসিক কাঁটাতারও থাকা উচিত নয়। এই কাঁটাতার যে আছে, তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতবর্ষে প্রচারিত হতে না দেওয়া। এটা দেওয়া হয় না ওপরের নির্দেশেই। তৃতীয়ত, এর আগে পানি চুক্তি, দক্ষিণ বেরুবাড়ীর বিনিময়ে তিনবিঘা করিডর দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা-ও রক্ষিত হয়নি। এমনকি সাম্প্রতিক কালে সীমান্ত হত্যা বন্ধে রাবার বুলেটের প্রতিশ্রুতিও তারা রক্ষা করেনি।
ফলে এবারও যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি পালন করবে, তার ভরসা কী? ’৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর (র্যাটিফাই) করলেও ভারতীয় পার্লামেন্ট অদ্যাবধি তা অনুস্বাক্ষর করেনি। তিনবিঘা করিডরের অধিকারের বদলে তারা দিচ্ছে কেবল ২৪ ঘণ্টা ব্যবহারের সুযোগ। এ রকম উদাহরণ অজস্র।
বাংলাদেশ সরকারের তরফে বলা হচ্ছিল, ট্রানজিট ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ভারতের চাহিদা বাংলাদেশ মেনে নিলে ভারতীয় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আমাদের পণ্যের ওপরে আরোপিত অশুল্ক সব বাধা দূর করা হবে, অথবা অভিন্ন নদীতে ন্যায্য পানির হিস্যা পাব। অতীতের অভিজ্ঞতা মনে রাখলে এ ব্যাপারে আশঙ্কা রয়েই যায়। সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি ভেস্তে গেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের জনগণ মোটেই বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হয় না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেন্দ্র-রাজ্য সরকার মিলিয়ে জটিলতার অজুহাত তুলে যেভাবে আসন্ন চুক্তিস্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গেল, তাতে কার্যত তাদের সদিচ্ছার অভাবই প্রকাশ পেয়েছে। সেই তুলনায় আমাদের সরকারি পক্ষের উপদেষ্টা ও মন্ত্রীসহ যাঁরা এ ব্যাপারে অতি উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন, তাঁদের আচরণ বাড়াবাড়িই ঠেকেছে।
কলকাতা বন্দর বাঁচানোর অজুহাতে ফারাক্কা বাঁধ করা হলেও বাঁচেনি কলকাতা বন্দর। অথচ আমাদের অনেক নদ-নদী এই বাঁধের কারণে মরে গেছে এবং আরও নদী মৃতপ্রায়। তিস্তা নদীর উজানে ব্যারাজ করা হয়েছে আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই। এখন শেষ মুহূর্তে কেন্দ্র-রাজ্যের বিরোধের কথা তুলে পানি চুক্তি না হতে পারাটা আমাদের চরমভাবে হতাশ করবে বৈকি। এই হতাশার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতেই হয়, আমরা তড়িঘড়ি করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে তাদের প্রবেশাধিকার দিতে চাই না। এ-সংক্রান্ত বিশদ কারিগরি পর্যালোচনাও করা হয়নি। বাংলাদেশের রপ্তানি ৪০ শতাংশ বাড়ায় ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতার ওপর যথেষ্ট চাপ বেড়েছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এই অবস্থায় মনমোহন সিংয়ের সফর উপলক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে আমাদের প্রয়োজন হিসাব না করেই, বন্দরগুলোর ধারণক্ষমতা আমলে না নিয়েই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর তাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। বরং উপযুক্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের পর মংলা বন্দরকেই ট্রানজিটের নৌ-কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
খেয়াল করা দরকার, সড়ক-রেল ও নৌ-ট্রানজিট আলোচনার মধ্যে ভারত শেষ মুহূর্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে, কিন্তু তিস্তা ও তিনবিঘা করিডরের সুষ্ঠু মীমাংসা থেকে তারা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বর্তমান অবস্থায়, ট্রানজিট থেকেও বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। কারণ, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর অর্থনীতি এখনো নাজুক এবং খারাপ রাস্তার কারণে তাদের দিক থেকে বড় আকারের মালামাল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহনের সুযোগও কম।
অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। মান নিয়ন্ত্রণের নামে কড়াকড়ির জন্য বাংলাদেশের শুকনো খাদ্য, হিমায়িত খাদ্য এবং তৈরি পোশাক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আমাদের ওষুধ ও চামড়াজাত পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারে নানা বাধা সৃষ্টি করেও রেখেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এটাও দেখতে হবে যে ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল দেখতে দেওয়া এবং সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে, ভারতের দিক থেকে ভৌগোলিক ও মানসিক কাঁটাতার অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রানজিট দেওয়া হবে চরম বোকামি।
বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ।
কাস্ত্রো ও মার্কেস: অর্ধশতাব্দীর সখ্যের স্মৃতিচারণা
প্রবৃদ্ধি নিয়ে একটি সাম্প্রতিক বিতর্ক
তারিখ: ১০-০৬-২০১১
বিশেষভাবে এ বছরের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাড়তি সংশয় জানানোর কোনো কারণ নেই। এ নিয়ে অবশ্য সিপিডিসহ প্রকাশ্যে সংশয় ব্যক্ত করেছেন কেউ কেউ। সবকিছুই বলা হচ্ছে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে। বাস্তবতা হলো, যাঁরা বলছেন প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭, আর যাঁরা বলছেন ৬ দশমিক ৩ বা তারও কম—উভয়ের কাছেই পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত নেই। সে উপাত্ত আসবে আরও কয়েক মাস পর, তখন পূর্ণ অর্থবছরের হিসাব পাওয়া যাবে। প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাব বর্তমানের প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে তখন বাড়তেও পারে, একই থাকতে পারে, আবার কমতেও পারে। যেমন, ২০০৯-১০-এর প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার বেশি ছিল। তা ছাড়া কেবল এ বছরেই ৬-এর অধিক প্রবৃদ্ধির হার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা তো নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫-০৬-এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৬, ২০০৬-০৭-এ ৬ দশমিক ৪, এমনকি ২০০৭-০৮-এ বিশ্বমন্দার মুখেও প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২। সে হিসাবে যে বছরে রপ্তানি বেড়েছে ৪১ শতাংশ, আমদানির বড় অংশ হচ্ছে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি, কৃষিতে বোরো ধানে বাম্পার ফলন, আমনও খারাপ হয়নি, ক্ষুদ্র ঋণ ও বাণিজ্য ঋণের সম্প্রসারণশীল প্রবাহ ব্যক্তি খাতে গিয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাক্কলিত হয়ে থাকলে এত সংশয়াপন্ন হওয়ার কোনো কারণ ঘটে কি? যা-ই হোক, আবারও বলছি, প্রবৃদ্ধির হার প্রসঙ্গে চূড়ান্ত মীমাংসা করার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বৃক্ষকে দেখতে চেয়ে অরণ্যকে যেন দেখতে ভুলে না যাই। আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের অর্থনীতিতে, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি খাতে গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বরং তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে ‘রাজনীতি হচ্ছে’ (যা কেউ কেউ বলছেন) এ রকম অভিযোগ তাই ব্যক্ত করা আমার বিচারে সংগত নয়। এতে করে বিবিএসকেও খাটো করা হয়। অথচ ভারতে সিএসও বা পাকিস্তানের এফবিএসের তুলনায় বিবিএস কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, যাঁরাই ভারতের বা পাকিস্তানের স্টেট জিডিপি বা প্রভিন্সিয়াল জিডিপি উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা জানেন। সর্বোপরি পূর্ববর্তী বছরগুলোয় (বিশেষত সুতীব্র বিশ্বমন্দার ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০-এ) অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল শ্লথতর, অর্থনীতিতে তখন অব্যবহূত ক্যাপাসিটির সৃষ্টি হয়েছিল, এ বছরে এসে তা ব্যবহূত হয়েছে (যে জন্য কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে ২০১০-১১তে) সে কারণেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে কেন যেখানে বিনিয়োগের অনুপাত তেমন একটা বাড়েনি, সেটা শুধু এ বছরের জন্যই ‘বিশেষভাবে’ বাধা হতে যাবে কেন? বিনিয়োগের অনুপাত তো ২০০২-০৩ সাল থেকেই ২৪ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। সুতরাং এই ধাঁধার রহস্য উন্মোচন করতে গেলে কার্যত ২০০২-০৩ সাল থেকেই প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যে উপাত্ত আমরা পাই, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এবং সম্যক আলোচনা করতে হবে। শুধু সংশয় প্রকাশ করে ছেড়ে দিলে চলবে না। তা ছাড়া বিনিয়োগের হিসাবও অবমূল্যায়িত হতে পারে, কেননা, এক দশক আগের তুলনায় এখন বিনিয়োগের সিংহভাগ হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এবং এই খাতে বিনিয়োগে গত এক দশকে যে পরিমাণগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে, তা এখনো পরিসংখ্যানে যথাযথভাবে ধরা পড়ছে না।
বিনিয়োগ মোটামুটি একই পর্যায়ে থাকার পরও প্রবৃদ্ধি কেন ২০০২-০৩ সালের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২০১০-১১ সালের ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে, তার অনেকগুলো ব্যাখ্যা হতে পারে। যদি আমরা হ্যারড-ডোমার সরলীকৃত দুনিয়ার মধ্যেই থাকি (যেখানে সঞ্চয় ও ভৌত বিনিয়োগই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালক), সেই নিরিখেও বলা যেতে পারে যে বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা ২০০২-২০১১ কালপর্বে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়ে থাকবে। বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার প্রধান উৎস ছিল দুটি। প্রথমত, গ্রাম থেকে শহরে দ্রুত হারে স্থানান্তরিত হয়েছে শ্রমশক্তি (২০০১ সালের ২৫ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে নগর জনসংখ্যা ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে)। এই রি-লোকেশন অ্যাফেক্টের কারণে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃ িদ্ধ পাওয়ার কথা। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আয়বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে একটা বড় কারণ হলো, গ্রামের তুলনায় শহরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি। শুধু মাত্রায় বেশি নয়, আমার অনুমান, শহরে শ্রমের উৎপাদনশীলতা গ্রামের তুলনায় আরও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। না হলে এক উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী গত এক দশকে শহরে পাড়ি জমানো সত্ত্বেও নগর-দারিদ্র্য দ্রুত হারে কমে যেত না। কেউ কেউ বলতে পারেন যে গ্রাম থেকে যারা শহরে জড়ো হয়েছে, তারা অধিকাংশই এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, সুতরাং এখানে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে সেই ধারণা কতটা যুক্তিযুক্ত? এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শহরে কর্মকাণ্ডে আগের চেয়ে অনেক গতিশীলতা এসেছে, আয় বেড়েছে এবং লক্ষণীয়ভাবে দারিদ্র্য কমেছে। নগর অর্থনীতির ‘আকর্ষণীয় ক্ষমতা’ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো।
দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অর্থনীতির ভেতরেও বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। আরও উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সেটা যেমন ঘটেছে কৃষি অর্থনীতির ভেতরে (যেমন, বাণিজ্যিক কৃষির বিস্তারে), তেমনি ঘটেছে গ্রামীণ অকৃষি অর্থনীতির ভেতরেও। এই শেষোক্ত ধারার বড় প্রমাণ হচ্ছে, গ্রামীণ অকৃষি অর্থনীতিতে পুঁজির চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। এর পরোক্ষ সমর্থন মেলে মাইক্রো-ফাইন্যান্স খাতে পুঁজির বর্ধিত জোগানের জন্য একই ব্যক্তির নানা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ (মাল্টিপল লোন) নেওয়ার প্রবণতায়। এ ধরনের ঋণের ৮০ শতাংশই নেওয়া হয়েছে আরও বেশি করে পুঁজি সংগ্রহের জন্য। তার মানে, গ্রামে মাথাপিছু পুঁজির পরিমাণ বেড়েছে এবং তা বেড়েছে আরও বেশি করে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যাওয়ার কারণে। গ্রামে এখন মজুরি-শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে এবং এক হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মজুরি-শ্রমিকের সংখ্যা গ্রামের মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। পারিবারিক শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে মজুরি-শ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কারণে গ্রামের শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। এতে করে প্রবৃদ্ধিও বাড়ার কথা বিনিয়োগের সামগ্রিক অনুপাত একরূপ থাকা সত্ত্বেও।
২০০২-২০১১ কালপর্বে প্রবৃদ্ধির উত্তরোত্তর বাড়ার পেছনে শ্রমশক্তির বর্ধিত নিয়োজনও অনেকাংশে কাজ করে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। যেসব নারী আগে ‘ঘর-গৃহস্থালির’ অর্থনীতিতে আটকে থাকতেন, তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সরাসরি শ্রমের বাজারে অংশ নিচ্ছেন। এক দশক আগেও শ্রমের বাজারে নারীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ১৫-২০ শতাংশ, এ হার এখন ৩০-৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কৃষিতে ও অকৃষিতে, ক্ষুদ্র ঋণের (ও কিছুটা বাণিজ্যিক ঋণের) সম্প্রসারণে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে এটা হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশই শ্রমঘন কাজে নিয়োজিত, ফলে বিনিয়োগের অনুপাত একই থাকলেও শুধু নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের কারণেই প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা বাড়ার কথা। এ ধারা আরও বেগবান করা গেলে (পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় এ হার ৭০-৮০ শতাংশ) এ দেশের প্রবৃদ্ধির হার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজি সঞ্চয়ের বর্ধমান প্রবণতা, শ্রমবাজারে নারীর উত্তরোত্তর অংশগ্রহণ এসব প্রবৃদ্ধির ‘সরবরাহগত’ দিককে নির্দেশ করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়ার ক্ষেত্রে ‘চাহিদাগত’ দিকও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আলোচনায় প্রায়ই আসে না সেটা হলো, এক দশক ধরে দ্রুত হারে দারিদ্র্য কমে যাওয়ার ধারা এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হারকেও বাড়িয়ে থাকবে। গোড়ার পর্বের দারিদ্র্য অবস্থা নিরসনের সঙ্গে পরবর্তী প্রবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে, সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে এটা সুস্পষ্ট। আমাদের দেশে দুই দশক ধরেই দারিদ্র্য কমছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় আমলেই কমেছে। কিন্তু দারিদ্র্য বিশেষভাবে কমেছে ২০০০-২০১০ কালপর্বে (সেটা ২০০০, ২০০৫, ২০১০ সালের দারিদ্র্য-উপাত্ত বিচার করলেই দেখা যায়)। দারিদ্র্য অব্যাহতভাবে কমার অর্থ গ্রামীণ বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্রয়ক্ষমতা এসেছে। এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে কৃষি, কৃষিজাত শিল্প, অকৃষি পণ্য ও সেবা খাতগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেছে সুদূর গ্রামাঞ্চলেও। ফলে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় উত্তরোত্তর বর্ধমান ‘অভ্যন্তরীণ ভোগ’ (ডমেস্টিক কনসাম্পশন) প্রবৃদ্ধির এক নতুন নিয়ামকে পরিণত হচ্ছে। এ কথা এক দশক আগেও অতটা খাটত না। অর্থাৎ এই নিরিখেও আমরা দেখছি যে বিনিয়োগের অনুপাত একই থাকলেও বর্ধিত ভোগের কারণেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে রপ্তানি ও প্রবাসী-আয়ের পাশাপাশি ‘স্থানীয় বাজার’-এর সম্প্রসারণ আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু আমরা কেবল হ্যারড-ডোমার দুনিয়াতেই আবদ্ধ নেই এবং শুধু সরলীকৃত হ্যারড-ডোমার সমীকরণের নিরিখেই প্রবৃদ্ধিকে বিচার করলে চলবে কেন। ভৌত বিনিয়োগ ছাড়াও প্রবৃদ্ধির আরও দুটো প্রধান নিয়ামক হলো মানব-পুঁজির (হিউম্যান ক্যাপিটাল) গঠন ও প্রযুক্তিগত বিকাশ। মানব-পুঁজি গঠনে (শিক্ষার বিস্তারে যেমন) ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার সুফল আমাদের এখন পেতে শুরু করার কথা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেসরকারি খাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। দুই দশক আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার যেখানে ছিল ৪০-৫০ শতাংশ, এখন তা ৭০-৮০ শতাংশ। গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের পাসের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও গুণগত মানকে আগের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই শ্রমশক্তির শিক্ষাগত মাত্রা বেড়েছে, আধাদক্ষ ও দক্ষ শ্রমশক্তির অনুপাত বেড়েছে, যার শুভ প্রভাব পড়তে বাধ্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সেই সূত্রে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির ওপরও।
ধীরলয়ে হলেও প্রযুক্তিগত উন্নতির বিশিষ্ট অবদান (যা ধরা পড়ে ‘টোটাল ফ্যাক্টর প্রডাক্টিভিটির পরিসংখ্যানে) বিভিন্ন খাতওয়ারি প্রবৃদ্ধির মধ্যে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। কৃষকেরা উন্নত বীজ ব্যবহার করছেন (শুধু উফশী ধান নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও); শিল্প ও নির্মাণ খাতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে; সুদূর গ্রামেও মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা বিনিয়োগ সহজতর হচ্ছে। সুতরাং প্রবৃদ্ধির হার বিচারের ক্ষেত্রে একপেশেভাবে শুধু বিনিয়োগের অনুপাতের দিকে তাকানো অসংগত।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করছে। এর প্রস্তুতি কয়েক বছর ধরেই (২০০৪-০৫ সালের পর থেকেই) চলছিল। এই কৃতিত্ব যেমন বিএনপির, তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বর্তমান সরকারের অংশেও কিছুটা বর্তায়। প্রবৃদ্ধির হার বেগবান হলে দারিদ্র্য আরও দ্রুত হারে কমে আসবে, এ নিয়েও বিতর্ক নেই। কিন্তু যে প্রশ্ন এখানে তোলা যায় সেটা হলো, প্রবৃদ্ধির চরিত্র নিয়ে। যেকোনো প্রবৃদ্ধিই সমান হারে দারিদ্র্য কমায় না। না হলে গ্রোথ কমিশনের মতো এত র্যাডিক্যাল নয় এমন কমিশনও ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ আর ‘কনভেনশনাল গ্রোথ’-এর মধ্যে পার্থক্য টানত না। বাংলাদেশের জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধির কৌশল রচনায় একটা বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করছে কি না। আমাদের আয় বাড়ছে, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে কি না পরিবেশদূষণ, পাবলিক স্পেসের (যেমন—নদী, জলাশয়, পার্ক, উন্মুক্ত ময়দান) ক্রমবিলুপ্তি এবং তীব্র যানজটের কারণে। তাই আমাদের জন্য শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়, আরও জানা প্রয়োজন ‘গ্রিন জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি কতটা হচ্ছে। পরিবেশ-বিধ্বংসী প্রবৃদ্ধি কেবল পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর তা নয়, অর্থনৈতিক সাম্যের জন্যও ক্ষতিকর। পরিবেশ ধ্বংস করে যাঁরা নতুন প্রবৃদ্ধির জন্ম দিচ্ছেন (তুরাগ নদ বা বুড়িগঙ্গা ভরাট করে নির্মাণ প্রকল্প করলে তা এক হিসেবে ‘নতুন প্রবৃদ্ধি’, অন্য হিসেবে পরিবেশের সর্বনাশ), এসব বিনিয়োগকারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সুশাসনের দুর্বলতার জন্য। এসব বিনিয়োগকারীর মুনাফার একটা বড় অংশ কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ, যা সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। এসব বিনিয়োগকারীর ওপর পরিবেশের ক্ষতি করার জন্য নিদেনপক্ষে বাড়তি কর (এনভায়রনমেন্টাল ট্যাক্স) আরোপ করা উচিত। কেননা, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির ভুক্তভোগী সবাই—ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব-নির্বিশেষে। পরিবেশ-সহনশীল বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন। বর্তমান বাজেটের ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করব ‘জনগণতান্ত্রিক’ সমন্বিত পাবলিক র্যাপিড ও মাস ট্রানজিটের গুরুত্বের কথা। আমাদের বিদ্যমান রেলপথ, জলপথ ও সড়কপথ (যা আছে তাকে ব্যবহার করে বা এর কিছুটা পরিমার্জনা করে) আমাদের নতুন করে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। যেসব ভাবনা ইতিমধ্যেই পরিবহন-অর্থনীতিবিদেরা করেছেন বৃহৎ ও মাঝারি আকারের শহরগুলোর জন্য, তা এখনই বাস্তবায়নে নিয়ে আসতে হবে। এদিকে বাজেট কিছুটা হলেও দৃষ্টি দেবে, এ আশা করছি।
ড. বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
নাজিম হিকমতের কবিতা: পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব, ঝরাপাতা
তারিখ: ০৩-০৬-২০১১
পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব
তুমি মাকড়সার মতো, ভাই আমার,
অন্ধকারের আড়ালে বেঁচে আছো
ভীতু মাকড়সার মতো।
তুমি চড়ুইয়ের মতো, ভাই আমার,
ছোট্ট ডানা মেলে এদিক-ওদিক
অস্থির চড়ুইয়ের মতো।
তুমি শামুকের মতো, ভাই আমার,
নিজের মধ্যে তৃপ্ত
গুটানো শামুকের মতো।
তুমি সব সময় এক অজানা আশঙ্কায়, ভাই আমার,
যেন কোনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে
তোমার নিত্য বসবাস।
তুমি একা নও এমন, তোমার মতন যারা
সংখ্যায় তারা পাঁচ-দশ নয়—লাখ লাখ
দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি।
তুমি ভেড়ার মতো, ভাই আমার,
কেউ তোমাকে লাঠি দেখালে
দ্রুত দলের মধ্যে ভিড়ে যাও
আর যখন ছুটতে থাকো কসাইখানার দিকে
তখনো মুখে বেশ একটা গর্বের ভাব।
এ জন্যেই বলছি, তুমি হলে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জীব
মাছেদের চেয়েও অদ্ভুত
যারা জলের বাইরের সমুদ্রকে দেখতে পায় না।
জগ জোড়া যে-অত্যাচার চলছে
তা আসলে হচ্ছে তোমারই কারণে।
আমরা যদি এখনো অভুক্ত থাকি, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ি,
রক্তে ভেসে যাই,
আমাদের যদি এরপরও আঙুলের মতো পিষে-দলে
ওরা মদিরা বানায়
তাহলে এর জন্যে দায়ী হচ্ছো
তুমি—
এ কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু এসবের অধিকাংশ দায়, ভাই আমার,
কেবল তোমার একার।
ঝরাপাতা
আমি পাতা ঝরার কথা পেয়েছি পঞ্চাশ হাজার কবিতায়
উপন্যাসে লেখায়
আমি পাতা ঝরার ছবি দেখেছি পঞ্চাশ হাজার সিনেমার দৃশ্যে
পাতা ঝরতেও দেখেছি পঞ্চাশ হাজার বার
এলোমেলো উড়তে ফিরতে পচে যেতে
আমার পায়ের তলায় করতলে আঙুলে মচমচ শব্দ তুলে
পঞ্চাশ হাজার বার ওদের মৃত্যু আমাকে দেখতে হয়েছে
তার পরও পাতা ঝরার দৃশ্যে আমি আলোড়িত না হয়ে পারি না
বিশেষ করে ওরা যখন ঝরতে থাকে বুলেভার্দে
বিশেষ করে যখন ঝরতে থাকে চেস্টনাট গাছের পাতারা
তার ওপর যদি শিশুরা ভিড় জমায় চারপাশে
তার ওপর যদি রোদ ওঠে সেদিন
কোনো বন্ধুর ভালো খবর পাই
আর সেদিন যদি বুকের অসুখটা দেখা না দ্যায়
যদি বুঝতে পারি আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে যায়নি
বিশেষ করে আমার চারপাশের মানুষকে ভালো থাকতে দেখি
ঝরা পাতার দৃশ্যে আমি আলোড়িত না হয়ে পারি না
বিশেষ করে ওরা যখন ঝরে পড়তে থাকে বুলেভার্দে
বিশেষ করে যখন ঝরতে থাকে
চেস্টনাট গাছের পাতারা
অনুবাদ: বিনায়ক সেন
নাজিম হিকমতের পৃথিবী
বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৩-০৬-২০১১
আরো দেখুন: নাজিম হিকমতের কবিতা
নির্বাসিত নাজিম
‘নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়’ এমন একটি লাইন আমাদের যৌবনের আকাশে তারকাখচিত হয়ে গিয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫২ সালে বেরুনো বইয়ের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, যদিও বেশিরভাগ কবিতাই ইংরেজি পাঠ থেকে নেওয়া, কিছু কিছু কবিতা ফরাসি থেকেও অনূদিত। ফরাসি থেকে অনুবাদের কাজে তিনি গীতা মুখোপাধ্যায় ও (পরবর্তীতে নিম্নবর্গের ইতিহাস-খ্যাত) রণজিৎ গুহের সাহায্য নিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিচারণায় পড়েছি, (১৯৫১ কি ’৫২ সালে কলকাতায়, জানি না কী করে, আমাদের বন্ধু ডেভিড কোহেনের হাতে এসেছিল নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ কবিতার ইংরেজি তর্জমা। ইংরেজি খুব উচ্চাঙ্গের নয়। তবু পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন জানা যাচ্ছে ইংরেজিতে নাজিম হিকমতের কবিতার প্রথম সংকলন বের হয় কলকাতা থেকেই—পরিচয় প্রকাশনী থেকে ১৯৫২ সালে। ইংরেজিতে এর আগে নাজিম হিকমতের কোনো কাব্য-সংকলন প্রকাশ পায়নি। কেন এ রকম একটি সংকলন আর সব জায়গা থাকতে কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতে হবে সেটাও খানিকটা রহস্যজনক। এর পেছনের কার্য-কারণ সূত্র এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।
গত শতকে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল ম্যাকার্থিবাদের দাপট। সর্বত্র কমিউনিজমের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সিনেটর ম্যাকার্থি—‘আন-আমেরিকান’ কর্মকাণ্ডের জন্য হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন একের পর এক কবি-নাট্যকার-শিল্পী-বিজ্ঞানীরা। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বাদ যাচ্ছেন না। এদের মধ্যে ছিলেন লেখক আর্থার মিলার, এলিয়া কাজান, লিলিয়ান হেলম্যান, হাওয়ার্ড ফাস্ট, ডরোথি পার্কার, ইরউইন শ, ল্যাংস্টন হিউজ, সাংবাদিক উইলিয়াম শীরার, গায়ক পিট সিগার, নোবেল-জয়ী বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং প্রমুখ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মুক্তচিন্তার নামে দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এসবের মধ্য দিয়ে কার্যত তাঁরা পরিণত হয়েছেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমর্থকে। এ রকম বৈরী পরিবেশে কমিউনিস্ট কবি নাজিম হিকমতের অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশ করা সহজ ছিল না। নাজিমের অনুবাদ যাঁরা সেদিন করেছিলেন (তাঁদের নাম যথাক্রমে নিলুফার ও রোসেট) তাঁদেরকেও ছদ্মনামের আশ্রয় নিতে হয়। ফলে অনুবাদক হিসেবে ছাপা হয় আলি ইউনূসের নাম। ‘আলি’ খুবই প্রচলিত নাম, আর ‘ইউনূস’ এসেছিল ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ইউনূস এমরে-র থেকে। অনুবাদকেরা জানতেন, দরবেশ কবিকুলের মধ্যে রুমি ছাড়া এমরের কবিতা নাজিমের খুব প্রিয় ছিল। যা হোক, অনুবাদ তো হলো, কিন্তু ছাপানো নিয়ে সমস্যা গেল না। এই সময়ে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভারত থেকে আসা কিছু শিক্ষার্থী’ (ওদের নাম এখনো জানা যায়নি এবং ওদের অধিকাংশ বাঙালি হলে বিস্ময়ের কিছু নেই) নাজিমের এই অনুবাদ হাতে পান। পড়ে তাঁরা এতই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে, এই মহার্ঘ বস্তু দ্রুত জনসমক্ষে আনার জন্য পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। এভাবেই ‘পরিচয়’ প্রকাশনী থেকে (হয়তো ডেভিড কোহেনের হাত ঘুরেই) ১৯৫২ সালে ৩৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে ‘নাজিম হিকমতের নির্বাচিত কবিতা’র প্রথম সংকলন।
যেহেতু নাজিম আজীবন কবিতা লিখেছেন তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে, তাঁর কবিতার অনুবাদ কিছুটা দেরিতে হলেও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে রুশ ভাষায়, তার পরে ফরাসিতে এবং গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি হারে ইংরেজিতে। তাঁর কবিতার পাঠকের সংখ্যা ইংরেজি-জানা বৃত্তে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, তাঁর স্বদেশীয় মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো নাজিম হিকমতও আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যের ভুবনে এখন একটি অতি প্রিয় নাম। অন্তত দশটি কাব্য-সংকলন, একাধিক জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতিচারণা ও চিঠিপত্র নিয়ে নাজিমিয়ানা এখন ইংরেজিতে অনুবাদের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়েছে। নিজের কবিতার অনুবাদ নিয়ে ১৯৬১ সালের দিকে লেখা একটি কবিতায় নাজিম লিখেছিলেন, ‘তিরিশটি-চল্লিশটি ভাষায় আমার লেখা প্রকাশিত, কিন্তু আমার তুরস্কে, আমার তুর্কি ভাষায় আমার লেখা নিষিদ্ধ।’ ১৯৫১ সালের ২৫ জুলাই তুরস্কের সরকার তাঁর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে মৃত্যুর ৪৬ বছর পর সেই নাগরিকত্ব ফিরে পান তিনি। এখন ইস্তাম্বুলের এশিয়া অংশে চালু হয়েছে নাজিমের প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে ‘পিরাইয়ে কাফ্যে’, খোলা হয়েছে নাজিম হিকমত আকাদেমি, সেখানে প্রতিদিন ভিড় করে সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ।
এক নিঃসঙ্গ বিপ্লবী
১৯০২ সালে তাঁর জন্ম তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয়। যেখানে জন্ম সেখানে কখনো আর ফিরে যাননি। বলতেন, ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না আমি।’ তারপরও ফিরে গিয়েছিলেন মস্কোতে—একবার নয়, বার তিনেক। প্রথমবার ১৯২১ সালে—মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। দ্বিতীয়বার ১৯২৮ সালে—তুরস্কের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে। তৃতীয়বার ১৯৫১ সালে—জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৬৩ সালে মস্কোতেই তাঁর মৃত্যু। ঘর থেকে প্রতিদিনের মতো বের হয়েছেন সকালের পত্রিকা আনতে, পত্রিকাটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়েন আকস্মিকভাবে। অনেক দিনের বুকের অসুখ নিয়ে এর বছর কয়েক আগেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা—‘এঞ্জাইনা প্যাক্টোরিস’। ১৯২১ সালে যখন মস্কোয় পড়তে যান তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। ১৪ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কেউ কেউ জানে উদ্ভিদ জগতের রহস্য, কেউ কেউ জানে মাছেদের ভুবন, কেউ বা জানে তারাদের নাম, আর আমি জানি সব ধরনের নিঃসঙ্গতার ভাষা।’
রেজিস দেব্রে এক সময়ে চে গুয়েভারার বলিভিয়ার অভিযানের সঙ্গী ছিলেন (এবং পরবর্তীতে হয়েছিলেন ফ্রান্সের সোশ্যালিস্ত প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর উপদেষ্টা)। তিনি নাজিমের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্যারিসে। বিশ্ব জনমতের চাপে তুরস্কের জেল থেকে তিনি সবে ছাড়া পেয়েছেন। ‘কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন কীভাবে’—এই প্রশ্নের উত্তরে নাজিম বলেছিলেন: ‘পার্টি করে মানুষ সাধারণত দুই কারণে। এক, তারা আসে মেহনতি শ্রেণীর থেকে। মেহনতি শ্রেণীর পার্টিতে খেটে-খাওয়া মানুষেরা আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। আমার পরিবার ছিল আমলাদের পরিবার (নাজিমের নানা ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর “পাশা”—সুলতানদের দরবারে এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী)। দুই, আর পার্টিতে যারা আসে, তারা আসে বুদ্ধির তাড়নায়—বই পড়ে, চিন্তা করে, মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। কিন্তু আমি এসেছিলাম হূদয়ের টানে। ১৯ বছর বয়সে যখন মস্কোয় যাই আমার একমাত্র ইচ্ছে ছিল লেনিনের সঙ্গে দেখা করব, দেখা করে বলা, “আপনার সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি আমাকে বলে দিন। আপনি কী করে বিপ্লব সমাধা করলেন তার রহস্য আমাকে বলুন।” আসলে আমার ইচ্ছে ছিল, লেনিনের কাছ থেকে এরকম কোনো গোপন চাবিকাঠি পকেটে নিয়ে আমি নিজ দেশ তুরস্কে ফিরে যাব। তারপর “বিপ্লব করে” গরিবী ঘুচাব দেশের মানুষের।’ লেনিনের সঙ্গে অবশ্য সরাসরি কখনো দেখা হয়নি নাজিমের। কিন্তু ১৯২৪ সালে লেনিন যখন মারা গেলেন তখন সেই অগণন শোক মিছিলের মধ্যে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন।
মস্কোয় থাকতেই কমিনটার্নের সংস্পর্শে গড়ে ওঠা তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নাজিমও জড়িয়ে পড়েন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুস্তফা সুফির মৃত্যু ঘটে কিছুটা রহস্যজনকভাবে দেশে ফেরার পথে সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে। লেনিনের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নাজিম ফিরে যান তুরস্কে। এরই মধ্যে তুরস্কে খেলাফতের অবসান হয়েছে, রিপাবলিক ঘোষিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মোস্তফা কামাল (পরে আতাতুর্ক অভিধা পেয়েছেন)। কমিউনিস্টদের সঙ্গে প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি নিয়ে চলছিল আতাতুর্কের রিপাবলিকান পার্টি। কিন্তু সে অবস্থা অল্প দিনেই বদলে যায়। নিষিদ্ধ হয় ‘প্রগ্রেসিভ রিপাবলিকান পার্টি’ (প্রকাশ্য সংগঠন ছিল এটি বামপন্থীদের)। কমিউনিস্ট পার্টি চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। তুরস্কে ফিরে গিয়ে নাজিম প্রকাশ্যে কাজ করেছেন প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকায়, উদ্দেশ্য—লেখালেখি। আবার গোপনে যুক্ত থেকেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে—ইস্তাম্বুলে পার্টির গোপন কংগ্রেসেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে গোপন ইশতেহার বিলির দায়ে তুরস্কের আদালত তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আত্মগোপনরত অবস্থায়। নাজিমকে আবারও দেশ ছেড়ে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রবাসে থাকাকালীনই সাধারণ ক্ষমতায় রাজবন্দীদের মামলা তুলে নেওয়া হলে এর আগেকার ১৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করা হয় নাজিমের ওপর থেকে। ১৯২৮ সালে নাজিম তুরস্কে ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন, তিন মাস জেল খেটে আবার বেরিয়ে আসেন। এর পর থেকে তুরস্কেই ছিলেন তিনি কিন্তু বিরতিহীনভাবে ‘আজ গ্রেপ্তার, কাল ছাড়া আবার পরশু গ্রেপ্তার’ এরকম চক্রের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের আতাতুর্ক শাসনের লক্ষণীয় দিক ছিল বামপন্থীদের কোণঠাসা করার পাশাপাশি আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা। য়ুরোপের অনেক দেশের আগেই ১৯৩০ সালে তুরস্কের মহিলারা পায় ভোটাধিকার, স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও পায় তারা। শরিয়াপন্থীদের সঙ্গে রিপাবলিকপন্থীদের রাজনৈতিক লড়াইও চলতে থাকে। কিন্তু নাজিমকে ক্রমাগত বিব্রত হতে হয় একের পর এক মামলায়। নাজিম নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন কি-না সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় ছিল না। গোপন বনাম প্রকাশ্যে কাজ নিয়ে পার্টি মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। নাজিম ছিলেন প্রকাশ্যে কাজের পক্ষে এবং এ কারণে ১৯৩২ সালে পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু নাজিম নিজেই ছিলেন মার্কসবাদী পার্টির জীবন্ত প্রতীক। ফলে পার্টির সদস্যপদ হারালেও তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানি মামলা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এখন জানা যাচ্ছে যে, স্বয়ং আতাতুর্ক এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুক্রু কায়া নাজিমের কবিতা গোপনে ভালোবাসতেন বলে বামপন্থী সত্ত্বেও তাঁকে দীর্ঘদিনের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে চায়নি তুরস্কের সরকার। ছোট ছোট মামলায় জড়িয়ে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই ছিল দমন-পীড়নের উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দিলে রাষ্ট্রের এই কূটকৌশলটি পরিষ্কার হবে।
১৯৩১ সালের ৬ মে নাজিম গ্রেপ্তার হন লেখার জন্য; ছাড়া পান ওই বছরের ১০ মে। ১৯৩৩ সালে ১৮ মার্চ আবার গ্রেপ্তার হন লেখার কারণে। এবার রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলী সরকারকে উৎখাত করার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দাবি করে। ওই বছরের ২৯ জুলাই ছয় মাসের কারাদণ্ড পান। ওই একই বছরের ২৭ আগস্ট তাঁকে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ব্যঙ্গ কবিতা লেখার জন্য। ১৯৩৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তাঁকে দেওয়া হয় আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড সম্পূর্ণ অন্য একটি মামলায়, যদিও সেটাও লেখারই জন্য। ১৯৩৪ সালের ৪ আগস্ট রিপবালিকের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে নাজিম আবারও সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পান। এসব ডামাডোলের মধ্যেই আবার তাঁর কয়েকটি কবিতা সরকারি অনুমোদনে কলেজের পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। ইতিমধ্যে স্পেনে শুরু হয়ে গেছে ফ্রাঙ্কোবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। এই অবস্থায় ১৯৩৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নাজিম আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে ছাড়া পান। এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সীমানার বাইরে। সুররিয়ালিস্তরা প্যারিসে তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে। কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি তাঁর কবিতার ওপরে গানের রেকর্ড বের করেছে। নাজিম নিজে বিভিন্ন নাটক লিখে মঞ্চস্থ করাচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে লিখছেন চিত্রনাট্য এমনকি ১৯৩৭ সালে নিজেই নির্মাণ করেছেন এক শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র ‘সূর্যের দিকে’ (এর আগে ইস্তাম্বুল সিম্ফনি ও বুর্মা সিম্ফনি নামে আরও দুটি তথ্যচিত্রও তাঁর পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে।) রাশিয়ায় তখন চলছে কুখ্যাত মস্কো শো-ট্রায়াল—লেনিনের সহকর্মী বুখারিন রাদেক, জিনোভিয়েভ কামেনেভদের বিরুদ্ধে। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে প্রায় একইভাবে সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য কারণ দেখিয়ে মায়াকোভস্কি-মেইয়ের হোল্ডের সহকর্মী নাজিমের বিরুদ্ধে তুরস্কেও চলছে প্রহসন-বিচার। ১৯৩৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হলেন নাজিম হিকমত। এবার তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে ২৮ বছর চার মাসের দীর্ঘ কারাদণ্ড। হয়তো আতাতুর্ক বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। কিন্তু আতাতুর্ক মারা যান ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর। ফলে ওই দণ্ডের আর রদবদল হয়নি।
নাজিমের মতো আর কোনো কবিকে বিংশ শতাব্দীতে এতো ক্ষান্তিহীন ভাবে আইনি মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয়নি, এতবার গ্রেপ্তারও করা হয়নি, সম্ভবত আর কাউকে। যদি সব কারাদণ্ডের আদেশ বহাল থাকত— ইলিয়া এরেনবুর্গ হিসাব করে বের করেছেন—তাহলে তাঁকে জেলের মধ্যে কাটাতে হতো এক দুটো বছর নয়, এক দুই দশকও নয়—মোট ৫৬ বছর। এতটাই বিপজ্জনক ছিলেন ‘সিস্টেমের জন্য’ নীলচক্ষু সোনালী চুলের কবি নাজিম হিকমত!
মায়াকোভস্কি, বোদলেয়ার ও রুমি
কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব নাজিম প্রবর্তন করেছিলেন তার জন্য তিনি অকুণ্ঠ ঋণ-স্বীকার করেছেন তিনজনের কাছে। একজন রুশ কবি (কারো কারো মতে, ‘অক্টোবর বিপ্লবের কণ্ঠস্বর’) ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। দ্বিতীয় জন, আধুনিক ফরাসী কবিতা যার হাতে জন্ম সেই কিংবদন্তীসম শার্ল বোদলেয়ার। আর তৃতীয় জন, নিজ দেশের—‘মরমী কবি’ জালালুদ্দিন রুমি। মায়াকোভস্কির প্রভাব পড়েছিল তার প্রথম দিকের কবিতায়। এ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন যে, সিঁড়ি-ভাঙা মাত্রায় মুক্ত ছন্দে নাজিমও তার কবিতার লাইন সাজিয়েছেন। মায়াকোভস্কির মতই তার কবিতায় দেখা দিত নানা অপ্রত্যাশিত বাঁক, তার কবিতার তীর্যক সুরও একই উৎস থেকে প্রাপ্ত। নাজিমের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল মায়াকোভস্কির। উভয়ে একই মঞ্চ থেকে কতবার কবিতা-পাঠ করেছেন উদাত্ত গলায়। বিশের দশকের শুরুতে মস্কো তখন হয়ে উঠছে নব-নিরীক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্র। কবিতা, নাটক, সিনেমা, উপন্যাস-সর্বত্র চলছে নতুন প্রলেতারীয় কালচারকে চিনে-নেওয়ার পালা। ১৯২১-২৪ ও পরে ১৯২৫-২৮ কালপর্বে নাজিমের কবি-জীবন এই নব-নিরীক্ষা আন্দোলনৈর পরিবেশে অগ্রসর হয়েছে।
একবার মায়াকোভস্কি ও নাজিম একই মঞ্চে কবিতা পড়বেন। হাত-পা নেড়ে মায়াকোভস্কি তাঁর কবিতা উচ্চগ্রামে পড়ে গেলেন। এরপর নাজিমের পালা। স্বভাবতই কিছুটা স্নায়ুর চাপে ছিলেন। মায়াকোভস্কি তাঁকে বললেন, ‘দ্যাখো বাপু, তুমি তো পড়বে কবিতা তুর্কি ভাষায়, এখানকার রুমী দর্শকেরা সেসবের বিন্দু-বিসর্গ জানে না। সুতরাং মনের সুখে তুমি পড়ে যাও। দেখবে প্রচুর হাত তালি পাবে।’
এরেনবুর্গ তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, মায়াকোভস্কি নয় বরং নাজিমের কবিতার নিকটতম তুলনা হতে পারে কেবল পল এলুয়ারের কবিতা। সেটা সম্ভবত এলুয়ারের ওলগার সাথে নাজিমের কবিতায় পিরাইয়ের বহুল উল্লেখের কথা ভেবে লেখা। এলুয়ার ও নাজিম উভয়েই অবিশ্রান্তভাবে নিজেদের প্রিয়তমাসুদের প্রসঙ্গ এনেছেন কবিতায়। নাজিম নিজে অবশ্য বলেছেন অন্য কথা। মায়াকোভস্কির মত কংক্রিট কিছুটা কর্কশ গদ্য-ছন্দের চেয়ে আরো অনেক মৃদু-স্বরের কবিতা তার। জেলপর্বের কবিতায় আসলেই নাজিমের স্বর অনেক খাদে নেমে গিয়েছিল—যেন নিজের কথা অন্য কারো জন্যে নয়, কেবল তার নিজের জন্যে লেখা অথবা তার প্রিয়তমার মুখোমুখি বসে স্বাগত উচ্চারণে শোনানোর জন্যে লেখা।
দেব্রে তাঁর সাক্ষাৎকারে নাজিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কার জন্যে কবিতা লেখেন, নাজিমের উত্তর ছিল সোজাসাপ্টা: ‘কবিতাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। একজন বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক, বামপন্থী, দায়বদ্ধ কবি (যে-নামেই তাকে চিহ্নিত করুন না কেন) তিনি হবেন এক সদা-সক্রিয় কবি: তিনি শুধু মানুষের হূদয়ের কথাই বলবেন না, হূদয়কে তিনি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করবেন।.. লেনিন যখন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়ের মস্কোয় মায়াকোভস্কি ও ইয়েসেনিনের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সেসময় বড় বড় জমায়েতে কবিতা পড়া হত। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমার দেশেও তো কবিরা যুগ যুগ ধরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে জনগণের সামনে কবিতা পাঠ করেছেন। জেলে যাওয়ার আগে আমিও কবিতা লিখতাম বহু শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ব বলে। পরে যখন জেলে থাকতে হল অনেক দিন ধরে, তখন থেকে আমার স্বরও নেমে যেতে থাকল। আমার শ্রোতা বলতে কেউ ছিল না, বা থাকলেও এক-দুজন মাত্র। একজনকে শোনাতে পারলেও আমার মনে হত তখন এর মধ্য দিয়েই আমি পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যেতে পারছি’।
নাজিম তার এক কবিতায় একবার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বলো, হিকমত-পুত্র, কোন শহরে তুমি মরতে চাও’? উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আমি মারা যেতে চাই ইস্তাম্বুলে, মস্কোয় এবং প্যারিসেও।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমার মৃত্যুগুলোকে আমি পৃথিবীর উপরে বীজের মত ছড়িয়ে দিয়েছি, এর কিছু পড়েছে ওদেসায়, কিছু ইস্তাম্বুলে, আর কিছু প্রাগে। সবচেয়ে যে-দেশকে আমি ভালোবাসি সেটি হচ্ছে পৃথিবী। যখন আমার সময় আসবে, আমাকে পৃথিবী দিয়ে মুড়ে দিও’। অনেক শহরের মধ্যে প্যারিস যে মাঝে-মাঝেই ঘুরে-ফিরে আসে তার কবিতায় তার একটা প্রধান কারণ ছিলেন বোদলেয়ার। ‘প্যারিস স্প্লীন’ থেকে গদ্য-ছন্দের এক নতুন সুষমা তিনি আহরণ করেছিলেন। ফরাসি ভাষায় দখল থাকায় মূলের স্বাদ নিতে বাধা হয়নি তারা নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনের নানা খুঁটিনাটি কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছিল তার কবিতায় বোদলেয়ারের প্রেরণাতেই। অন্যত্র তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমি কবিতা লিখতে শুরু করি পনেরো বছর বয়সে। ঐ সময়ে ভালোবাসা ও মৃত্যু কবিতাকে আচ্ছন্ন করে থাকে। বাবার দিক থেকে আমি একেবারেই প্রাচ্যপন্থী, আর মা’র দিক থেকে পুরোপুরি য়ুরোপীয়। আমি বোদলেয়ার দ্বারা পুরোপুরি আচ্ছন্ন দিলাম, কিন্তু আমার দেশের দরবেশ কবিকুলও আমার চৈতন্যে প্রভাব ফেলেছিলেন। আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে তৈরি’।
প্যারিসের কোন জিনিসটি সবচেয়ে ভালো লাগে? সে হচ্ছে প্যারিসই। এখানে কি তোমার দেখা হয়েছে তোমার কমরেডদের সঙ্গে? হ্যাঁ, আমি দেখেছি নামিক কামাল, জিয়া পাশা, মুস্তফা সুফি ওদের। আমি দেখেছি আমার তরুণী বয়সের মাকে—তিনি ছবি আঁঁকছেন, ফরাসিতে কথা বলছেন অনর্গল— পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী তিনি। বলো তো. প্যারিসকে কেমন দেখায়? তাকে দেখায় প্যারিস বাসীর মতো। বলো, আদমের পুত্র, এবারে বলো—তুমি কি প্যারিসকে বিশ্বাস করো, হ্যাঁ, আমি প্যারিসকে বিশ্বাস করি।’ তাঁর প্রিয় বন্ধু লুই আরাগঁ, পল এ লুয়ার, ত্রিস্তান জারা, পাবলো পিকাসো—এদের স্মৃতি প্যারিসকে ঘিরেই। এ কারণেই অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকব আরাগঁ-র কবিতায়, আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আমি বেঁচে থাকব মার্সাইয়ের ডক শ্রমিকদের মধ্যে।’ শহর নিয়ে এরকম অনর্গল প্রশস্তি-গাঁথা আর কোথাও নেই: নেরুদা করেননি তার মান্টিয়াগো নিয়ে, কার্দেনাল করেননি তাঁর মানাগুয়া নিয়ে, পুশকিন করেননি তার সেই পিটার্সবাগ নিয়ে। নাজিম নিজেও আর কোনো শহরকে নিয়ে এতটা প্রেমময় কাব্য লেখেননি।
প্রথম আলো গোলটেবিল – বৈঠক ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন
১৩ মার্চ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো:
যাঁরা অংশ নিলেন
অধ্যাপক রেহমান সোবহান – চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
হোসেন জিল্লুর রহমান – সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ড. সিদ্দিক ওসমানী – অধ্যাপক, স্কুল অব ইকোনমিকস, ইউনিভার্সিটি অব আলস্টার, ইউকে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ – সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ড. বাকী খলিলী – অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. মাহবুব হোসেন – নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক
ড. সৈয়দ এম হাশেমী – পরিচালক, ব্র্যাক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট
মোস্তফা কে মুজেরী – মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
ড. সাজ্জাদ জহির – পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
এম এম আকাশ – অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিনায়ক সেন – গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
সূচনা বক্তব্য
মতিউর রহমান – সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম – যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
মতিউর রহমান
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, দারিদ্র্যের হার এখন ৪০ শতাংশের নিচে। এখানে ক্ষুদ্রঋণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।
১৯৯০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ১৮ বছরে বাংলাদেশের প্রায় ২০ লাখ দরিদ্র পরিবার দৈনিক সোয়া এক ডলারের বেশি (প্রায় ১০০ টাকার ওপর) খরচ করার সামর্থ্য অর্জন করেছে, অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমা পার হতে পেরেছে।
নারীর আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হচ্ছে, যা একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ, সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারমুক্ত চিন্তার প্রসার এবং গ্রামাঞ্চলে মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা দূর করার একটি অন্যতম শর্ত সৃষ্টি করছে।
শুধু ঋণ প্রদানই নয়, সেই সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে ঋণের টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন সম্পর্কেও পরামর্শ দেওয়া হয়, যা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বেসরকারি সংগঠনগুলো করে থাকে। এখানেই সাধারণ ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের পার্থক্য। ক্ষুদ্রঋণ মানুষকে উৎপাদনশীল কার্যক্রমে নিয়োজিত করে, তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে।
তবে সমস্যাও আছে। সুদের হার বেশি বলে সমালোচনাও রয়েছে। সম্প্রতি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে মতবিনিময় করে সর্বোচ্চ সুদের হার ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।
ক্ষুদ্রঋণ হয়তো দারিদ্র্য চিরতরে দূর করতে পারে না, কিন্তু গরিব মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নির্মূলের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্ত সৃষ্টি করে। অনেকে দারিদ্র্যচক্র ভেঙে বেরিয়েও আসে। তা ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে।
ক্ষুদ্রঋণের সমস্যা যেমন আছে, তেমনই সম্ভাবনাও বিপুল। সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ বিতর্ক জোরেশোরে উঠতে দেখা গেছে। সবকিছুর পরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্রঋণ আমাদের দেশে সফলতা নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে এর মাধ্যমে অনেক সুনাম আমাদের অর্জিত হয়েছে।
সম্প্রতি দেশে ও বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। আজকের আলোচনায় আপনাদের বক্তব্যের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে মানুষের মনে যেসব প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবে তারা। আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেনকে অনুরোধ করব বলার জন্য।
বিনায়ক সেন
ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেন ‘গোড়ার কথা’য় ফিরে যেতে হচ্ছে? সত্যের ওপর কারও একচেটিয়া অধিকার (মনোপলি) নেই, বিশেষজ্ঞদেরও নেই। তার পরও কেন বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হওয়া, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সাম্প্রতিককালে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কতগুলো অভিযোগ শুনতে পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে গবেষণালব্ধ পেশাগত জ্ঞানের মিল খুঁজে পাওয়া ভার। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে হালকা আলোচনাই প্রধান ধারা হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। এযাবৎ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অসংখ্য গবেষণাপত্র দেশে-বিদেশে রচিত হয়েছে। সেসব গবেষণার আলোকে প্রচণ্ডভাবে নিস্পৃহ, নির্মোহ ও তলদর্শী আলোচনা করার তাগিদ থেকে আমরা আজকের এই সংলাপে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। ওপর-ভাসা ধ্যান-ধারণার ‘জনতুষ্টি জ্ঞান’ ও পেশাগত জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা এর একটি বড় লক্ষ্য। সে কারণে আমাদের সীমিত উদ্দেশ্য—ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পর্কে গবেষণাপত্রাদি থেকে আমরা যতটুকু জানি, তা যথাযথভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা। কাজটি করা গবেষক-অর্থনীতিবিদদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব।
গত ১০ বছরে উন্নত দেশগুলোয় উন্নয়ন অর্থনীতি শুধু নয়, অর্থশাস্ত্রের এমন কোনো সিরিয়াস-ধর্মী পাঠ্যবই (গ্র্যাজুয়েট ও আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে) পাওয়া যাবে না, যেখানে অন্তত একটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ নেই ক্ষুদ্রঋণের ওপর। তাত্ত্বিকভাবেই ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ও এ দেশে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণসংক্রান্ত তত্ত্বসমুদয় কোনো ভুঁইফোড় বিষয় নয়। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ক্রমে পরিপক্ব ও পরিশীলিত হলেই তা কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায় স্থান পায়।
কোনো সিরিয়াস একাডেমিক গবেষণাপত্রেই এই দাবি করা হয়নি যে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমেই কেবল দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। বরং যেটা দেখানো হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ একটি সহায়ক হাতিয়ার। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে যেটা বলা হয়েছে, তাকে কয়েকটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়।
প্রথম ভাগ: ক্ষুদ্রঋণ হচ্ছে দরিদ্রদের জন্য একটি ‘টেকসই’ ব্যাংকিং-ব্যবস্থা। ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, এটি প্রথাগত ব্যাংকিং-ব্যবস্থা যাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না, সেই জামানতবিহীন নিঃস্ব গোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিংসেবা পৌঁছে দেয়। এর থেকে প্রমাণিত হয়েছে, গরিবেরাও ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত। প্রায় দুই কোটি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে থাকে। একাধিক সংস্থা থেকে যাঁরা ঋণ নেন, তাঁদের সংখ্যা সামঞ্জস্য করে এই হিসাব করা হয়েছে। দরিদ্রদের ব্যাংকিং-চাহিদা মেটানোর একটি সাসটেইনেবল সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করাই ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। সাসটেইনেবল বা ‘টেকসই ব্যাংকিং সার্ভিস’ শব্দবন্ধের ওপর আমরা জোর দিতে চাই। ব্যবস্থাটি টেকসই এই অর্থে যে তা এনজিও, বেসরকারি ও সরকারি যেকোনো খাতেই প্রয়োগ সম্ভব এবং যেকোনো ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক পরিসরেই পরিচালিত হওয়া সম্ভব। ক্ষুদ্রঋণের ছকের আদি প্রাণপুরুষ গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বারা এই মডেল উদ্ভাবিত হলেও পরে তা যেমন বিভিন্ন এনজিও গ্রহণ করেছে, তেমনই অনুসৃত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ঋণ কার্যক্রমের ভেতরেও। বাংলাদেশে এই কার্যক্রম ক্ষুদ্রঋণের মূলধারার প্রতিষ্ঠান ‘মুনাফার ভিত্তিতে নয়’ (নট ফর প্রফিট)—এ ভিত্তিতে পরিচালনা করে আসছে। বাংলাদেশের বাইরে অন্যত্র (যথা—ভারতে বা লাতিন আমেরিকায়) ‘মুনাফার ভিত্তিতে’ (ফর প্রফিট) পরিচালিত করছে, সে রকম ব্যক্তি খাতের উদ্যোগেও ক্ষুদ্রঋণ মডেল অনুসৃত হয়েছে। চীন থেকে আমেরিকায়, তৃতীয় বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্ব—অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ফারাক থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণের মডেল চালু হয়েছে এবং সেসব কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। এটি মডেলটির ‘টেকসই’ দিকের প্রতি নির্দেশ করে।
দ্বিতীয় ভাগ: দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের অবদান। ক্ষুদ্রঋণ শুধু দরিদ্রদের জন্য টেকসই ব্যাংকিং-ব্যবস্থাই নয়, এটি দারিদ্র্য দূরীকরণেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। গত তিন দশকে বিভিন্ন গবেষণাপত্রের একটি প্রধান ঝোঁক ছিল এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা বা অবদানকে স্পষ্ট করার ওপর। ক্ষুদ্রঋণ কীভাবে অকৃষি খাতনির্ভর হয়ে পরিচালিত হচ্ছে, কীভাবে কৃষি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় তা পরিবর্তন আনছে, কীভাবে শ্রমের বাজারের ওপর প্রভাব রাখছে—এসবই এই আলোচনার অংশ। এখানে আজ যেসব বিশেষজ্ঞ সমবেত হয়েছেন, তাঁরা সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, যা আজকের আলোচনায় উঠে আসবে বলে আশা করছি। এখানে যেটা যোগ করা দরকার তা হলো, প্রথমত, ক্ষুদ্রঋণের অবদান আলোচনার জন্য শুধু দারিদ্র্যরেখাকেন্দ্রিক (পোভার্টি লাইন) ভাবনাই যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্যরেখার ওপর ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগীদের অংশ ‘কতটা পরিমাণে উঠে গেল’ সে রকম সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারের জন্য সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। এর কারণ, ক্ষুদ্রঋণ যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই প্রথমাবধি দারিদ্র্যরেখার অনেক নিচে বাস করছিলেন। ফলে ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা নিয়ে তাঁদের অনেকে দারিদ্র্যরেখা অতিক্রম করতে না পারলেও দারিদ্র্যের ভেতরে থেকেও তাঁদের আয় বা ভোগ বা সম্পদ বাড়াতে পেরেছেন। শুধু দারিদ্র্যরেখাকেন্দ্রিক ‘হেডকাউন্ট ইনডেক্স’-এর সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপে তা ধরা না-ও পড়তে পারে। এ জন্য বিভিন্ন গবেষণাপত্রে ইনকাম মবিলিটির নানা সূচক (যথা—‘পোভার্টি গ্যাপ’ সূচক এবং ‘দারিদ্র্যের তীব্রতা’ সূচক) ব্যবহূত হয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদান যথাযথভাবে পরিমাপ করার জন্য চাই একই ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা পরিবারকে কালানুক্রমে পর্যবেক্ষণ করা। অর্থাৎ চাই ‘প্যানেল ডেটা’। তা ছাড়া চাই, যারা ক্ষুদ্রঋণ পায়নি, সেসব পরিবারকেও কালানুক্রমে অনুসরণ করা অর্থাৎ দরকার যথাযথ ‘কন্ট্রোল’। এভাবেই ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগী ও সুবিধাভোগী নয় এমন পরিবারের তুলনামূলক বিচারপূর্বক উপসংহারে আসা যাবে দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ প্রকৃতপক্ষে অবদান রাখতে পেরেছে কি না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রকম কয়েকটি প্যানেল স্টাডিজের বিশ্লেষণ থেকে এটা দেখা গেছে, দারিদ্র্য দূরীকরণেও ক্ষুদ্রঋণের অবদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। মাহবুব হোসেন পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৮-২০০৭ কালপর্বে গ্রামীণ দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কমেছে। দারিদ্র্য মোট যতটুকু কমেছে, তার অন্তত এক-চতুর্থাংশ কমেছে কেবল ক্ষুদ্রঋণের কল্যাণে। আলোচকেরা নিশ্চয়ই এর ওপর আলোকপাত করবেন।
তৃতীয় ভাগ: ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষের সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। শুধু দারিদ্র্য নয়, দরিদ্রের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদানপ্রাপ্ত গবেষণাপত্রাদির অভিনিবেশের বিষয় ছিল। এ দেশে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার এক বিপুল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নারী। শুধু এই নিরিখেই নারীর সামাজিক বিকাশে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। রক্ষণশীল অনেক চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ক্ষুদ্রঋণের নারীরা ঘরের বাইরের জগতে পা ফেলতে শুরু করেছেন। এমনকি যখন নারীদের নেওয়া ঋণ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিয়ে ব্যবহার করেছেন, তাতেও গৃহে ও গৃহের বাইরে নারীদের মর্যাদা বেড়েছে, ‘ভয়েস’ ও ‘প্রভাব’ বেড়েছে তাঁদের। আশির দশকের গোড়ার দিকে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অর্ধেক ছিল নারী। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এই অংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯০ শতাংশে। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার দেখাদেখি মূলধারার অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানেও নারীকেই ক্ষুদ্রঋণের এজেন্সি বা চালিকাশক্তি হিসেবে দাঁড় করায়। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসচেতনতা বৃদ্ধিও ছিল একটি আবশ্যিক উপকরণ। এর ফলে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগী পরিবারে জন্মনিয়ন্ত্রণের হার, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার হার ও শিশুপুষ্টি বেড়েছে। কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। বাংলাদেশে আয়ের বিচারে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকায়ও (যেমন—রাজশাহী বিভাগে) এটা দেখা গেছে। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে ক্ষমতায়নের এসব প্রবণতা স্পষ্ট।
যে বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়, ক্ষুদ্রঋণে উত্তরণের (গ্র্যাজুয়েশন) বিষয়টি কীভাবে ধরতে পারি। গবেষণাপত্রাদি থেকে এটাও দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সচলতা অর্জন করে ক্রমশ একটি গোষ্ঠী ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ নিয়েছে এবং ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান (মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ) কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রথাগত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম মূলত আত্মকর্মসংস্থানমূলক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি কোনো পরিবারের একমাত্র বা প্রধান আয়ের উৎস নয়, বরং একটি ‘বাড়তি আয়ের’ উৎস কেবল। গড়পড়তায় ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ যেখানে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের (মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ) ঋণের পরিমাণ সেখানে হয়তো ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সবাই অবশ্য এই উত্তরণ ঘটাতে পারেননি। সবাই এই উত্তরণ ঘটাতে পারবেন, সেটা আশা করাও যুক্তিসংগত নয়—কেননা, সবারই সমান মাত্রার ‘এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’ অর্জনের গুণ নেই। তার পরও অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের এক হিসাবে, এ দেশের প্রায় দুই কোটি ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা পরিবারের প্রায় ৮ শতাংশ মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ ঋণ নিয়েছে। এসব মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজে যদি তিন-চারজনের কর্মসংস্থান ঘটে, তাহলেও এতে যে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, তা দেশের মোট শ্রমশক্তির ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরি কর্মসংস্থানের নিরিখেও ক্ষুদ্রঋণের উত্তরসূরি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে আমরা জানি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মজুরি শ্রমভিত্তিক কর্মসংস্থান প্রধান ভূমিকা দেশে দেশে পালন করে আসছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানের প্রবণতাকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের (এসএমই) ভূমিকাকে আরও বেগবান করে তোলা সম্ভব। আমরা আশা করছি, আজকের আলোচনায় এ বিষয়গুলোও স্থান পাবে। কোন ‘নিয়ত’ থেকে আমরা এ ধরনের বিতর্কে অংশ নেব, তা বিতর্কের বিষয়বস্তু থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা নয়।
তবে ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে কয়েকটি বিতর্ককে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষুদ্রঋণসংক্রান্ত মূল বিতর্ক দানা বাঁধছে অন্যখানে। এর মধ্যে রয়েছে এসব কার্যক্রমের সুদের হার বা সার্ভিস চার্জের প্রসঙ্গ, এসব কার্যক্রমের পরিচালনা ব্যয়ের প্রসঙ্গ, এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আন্তসম্পর্ক এবং সবশেষে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক। এসব বিতর্কে প্রবেশের আগে বিতর্কের দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রথমে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।
এক. ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নির্ণয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিচালনা ব্যয়ের প্রসঙ্গ। অনেকেই বলেছেন, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার আরও কমিয়ে আনা উচিত। যেহেতু বৃহৎ ঋণের পরিচালনার চেয়ে নিবিড় তদারকির কারণে ক্ষুদ্রঋণের পরিচালনা ব্যয় বেশি পড়ে, এতে করে সুদের হার কমানোর বিষয়টি পরিচালনা ব্যয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পরিচালনা ব্যয়ের বড় অংশ যদি সরকার ভর্তুকি দিতে রাজি হয়, তাহলে এর সুদের হার অনেকখানি, এমনকি জিরো ইন্টারেস্ট রেটের কাছাকাছি পর্যন্ত কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। এর কারণ, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, এ দেশে মূলধারার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো (গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা প্রভৃতি) পরিচালনা ব্যয়ের নিরিখে তুলনামূলকভাবে দক্ষ (ইফিশিয়েন্ট)। সুতরাং সংস্থা পর্যায়ে পরিচালনা ব্যয় কমানোর খুব একটা অবকাশ এখানে নেই। ফলে পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে এনে সুদের হার কমানোর অবকাশও এ দেশে কম, যদি না সরকার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে ভর্তুকির সহায়তা দিতে।
দুই. ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সুদের হার কিছুটা বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে মূলধারার ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিগুলো কিছুটা ‘মার্জিন’ তুলে রাখে স্বাস্থ্যবিমা, শিক্ষা এবং ঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য। যেহেতু বাংলাদেশে এখনো সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু হয়নি এবং নানা স্তরে শিক্ষার সুযোগও সবার জন্য চালু হয়নি, সেহেতু এখানে সরকারের একটি কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ছাড়া এ রকম ‘মার্জিন’ আকস্মিকভাবে উঠিয়ে নেওয়া সামাজিকভাবে অভিপ্রেত নয়।
তিন. অনেক সময় বলা হয়, বছরের পর বছর ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার পরও কেন গরিবি অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হলো না। এই যুক্তিটিও তলিয়ে দেখার। প্রথমত, আগেই বলা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র পরিবারের জন্য ‘বাড়তি আয়’-এর উৎস কেবল। এই আয় ‘বাড়তি’ হলেও গরিবদের জন্য সংকট মোচনে অত্যন্ত জরুরি এবং সময় সময় তা ক্ষুধা ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে থাকে। একে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যায় না। স্থায়িত্বশীল দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে ক্ষুদ্রঋণ এভাবে একটি ‘মঞ্চ’ (প্লাটফরম) তৈরি করে দেয়, যার ওপর দাঁড়িয়ে গরিবদের পক্ষে অন্যান্য বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও প্রতিবছর উন্নয়ন বাজেটের অধীনে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, যার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে (অন্তত খাতাপত্রে) ‘প্রত্যক্ষ দারিদ্র্য দূরীকরণ’ কর্মসূচির পেছনে। বছরের পর বছর এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও সরকারি উন্নয়ন বাজেট কেন গরিবি অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন করতে পারল না—এ প্রশ্ন সরকারের ক্ষেত্রেও উঠতে পারে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, সরকারি সামাজিক বেষ্টনী সর্বোচ্চ কেবল ১০ শতাংশ পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। লক্ষণীয়, ক্ষুদ্রঋণ খাত বাবদ বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা চক্রায়িত তহবিল হিসেবে দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ বছর বছর তা ব্যবহূত হচ্ছে; পক্ষান্তরে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় মূলত এককালীন ব্যয়। ক্ষুদ্রঋণ তহবিলের একাংশ আসছে পিকেএসএফ (সরকার) থেকে, কিছুটা আসছে দাতাদের কাছ থেকে, আর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ আসছে ঋণগ্রহীতাদের ‘নিজস্ব সঞ্চয়’ থেকে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের ক্ষেত্রে এই ‘নিজস্ব সঞ্চয়’-এর পরিমাণ তুলনামূলক আরও বেশি (প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ)। কেননা, এসব কার্যক্রম অন্যান্যের তুলনায় আরও আগে শুরু হয়েছিল। গরিবেরা যে নিজেরাও সঞ্চয় করতে পারে এবং উত্তরোত্তর তারা প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয়ে অভ্যস্ত হচ্ছে—এটা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এর জন্য কিছুটা কৃতিত্ব ক্ষুদ্রঋণ দাবি করতেই পারে। মোদ্দাকথা, ক্ষুদ্রঋণকে সরকার পরিচালিত সামাজিক বেষ্টনী-ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড় না করিয়ে পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার এখানে সুযোগ নেই—উভয়ের মধ্যে আন্তসম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা এবং উভয়ের সামর্থ্য আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পলিসি-প্রণেতাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া কাম্য।
ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প (সাবস্টিটিউট) সরকারি সামাজিক বেষ্টনী কর্মসূচি নয়। বরং মহাজনি ঋণই হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণের সাবস্টিটিউট। গবেষণাপত্রাদির একটি সাধারণ (কমন) পর্যবেক্ষণ হলো, ক্ষুদ্রঋণ যেখানে গেছে, সেখানেই তা মহাজনি ঋণের পরিধি সংকুচিত করেছে। সিডরের (২০০৭) সময় একপর্যায়ে সিডর এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার কার্যক্রমকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। পরে দেখা গেছে, এর সুযোগ নিয়েছে মহাজনি ঋণ। মাসিক সুদের হারে বিরাট পার্থক্য ছাড়াও এই দুই ব্যবস্থার অভিপ্রায়ে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চায় না যে গরিবেরা ঋণখেলাপি হোক। পক্ষান্তরে, মহাজন এটা চায়। কেননা, গরিবেরা ঋণখেলাপি হলে তারই লাভ—সে সেখানে বেগার শ্রম, আগাম শ্রম, আগাম ফসল বিক্রির সুবিধা নিতে পারবে। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণের বিরুদ্ধে যখন ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে প্রয়োজন হলে ‘চাল খুলে নেওয়া’র অভিযোগ শোনা যায়, তার পেছনে রয়েছে ঋণ-শৃঙ্খলা আরোপের তাগিদ। অন্যদিকে মহাজন নিজেই ঋণখেলাপির প্রবণতাকে উৎসাহিত করে। এ কারণে মহাজনি ঋণের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের মিল খোঁজার চেষ্টা তাত্ত্বিক বা যৌক্তিক নিরিখে অন্যায় ও অযৌক্তিক তুলনা ছাড়া কিছু নয়। এ ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট পলিসি-প্রণেতাদের দৃষ্টি আরও নির্মোহ ও আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রঋণ মডেলের প্রভাব সরকারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও শুভ প্রভাব বয়ে নিয়ে আসতে পারে। ক্ষুদ্রঋণের জামানতবিহীন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে আস্থার ওপর ভিত্তি করে, এককথায় সামাজিক পুঁজির ওপর ভিত্তি করে। প্রতিবছর ১৭ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ‘ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিল’ পরিচালিত হচ্ছে কেবল এ আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া কোনো ‘লিকেজ’ বা দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়নি। গ্রুপের সামনে, সামাজিকভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে, ঋণ দেওয়া ও আদায়ের প্রক্রিয়ায় থাকে যেমন স্বচ্ছতা, তেমনই থাকে সামাজিক চাপ ও দায়বদ্ধতা। স্বচ্ছতা, সামাজিক চাপ ও দায়বদ্ধতা এবং আস্থাই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের চালিকাশক্তি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে উন্মুক্ত সভা ডেকে কৃষিঋণ বণ্টনের যে প্রথা চালু হয়েছে, এতে করে ক্ষুদ্রঋণের থেকে স্বচ্ছতা ও সামাজিক পুঁজির ধারণার প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে করে সরকারেরই লাভ হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের ভিত্তি যে আস্থা, সেটাকে কোনোভাবেই অপপ্রচারের মাধ্যমে বা বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্রয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করা সমীচীন হবে না কোনো বিচারেই। এর সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের জনক হিসেবে এ দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির বিষয়টিও জড়িত, তা না বললেও চলে। ক্ষুদ্রঋণ যখন আবারও কাঠগড়ায়, তখন এ বিষয়ে আজকের আলোচকেরা আরও আলোকপাত করবেন সে আশা করছি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ
ক্ষুদ্রঋণ প্রচলনের আগে দরিদ্রদের জন্য আর্থিক সেবা পাওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না আমাদের দেশে। বহু মডেল হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। ক্ষুদ্রঋণ সমাজে গরিব লোকের কাছে সদর দরজার মতো। ক্ষুদ্রঋণ হলো দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য শক্তিশালী মাধ্যম, তবে এটি কখনোই একমাত্র মাধ্যম নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের দিকে লক্ষ করলে কুমিল্লা মডেলসহ বিভিন্ন মডেল (বিআরডিবি) দেখলে বোঝা যায়, সেখানে এই ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ যে আঙ্গিকে বা ব্যবস্থাপনায় করা হয়েছে, সেখানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা প্রক্রিয়া দাঁড় করিয়ে দিল গ্রামীণ ব্যাংক। আমাদের মতো এ বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে প্রতিদিন দেশের আনাচকানাচে লোকজন নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এত সুশৃঙ্খলভাবে করছে, যা অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এটি আমাদের সামাজিক মূলধন (সোশ্যাল ক্যাপিটাল)। ক্ষুদ্রঋণ বিভিন্ন দিক থেকে সমাজের ওপর প্রভাব রাখছে। যখন সার্বিকভাবে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়, তখন যারা ঋণগ্রহীতা, তাদের অবস্থা আগের থেকে কতটুকু পরিবর্তন হলো—এসব বিষয় আসে। ক্ষুদ্রঋণ সমাজের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলছে, সে প্রশ্ন তোলার আগে উপলব্ধি করা উচিত, ক্ষুদ্রঋণ না থাকলে আসলে কী হতো আমাদের সমাজে। আমি মনে করি, ক্ষুদ্রঋণ না থাকলে মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে যে নিজের ওপর আত্মনির্ভরশীলতা ও সাহস বেড়েছে, তা ব্যাহত হতো। ক্ষুদ্রঋণের কিছু প্রভাব খোলা চোখে দেখা যায়; আবার কিছু আছে উপলব্ধি করতে হয়। শুধু পরিসংখ্যান, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক দেখা যায়, যদি ক্ষুদ্রঋণকে অন্যান্য যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যদি আরও সমন্বয় করা যায়, তবে সমাজের ওপর এই ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব আরও বাড়বে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সময়ে ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (এমএফআই) ভাবছে, কমার্শিয়ালের দিকে যাবে। ক্ষুদ্রঋণকে বাড়িয়ে একটু বাণিজ্যিক দিকে যাওয়ার চিন্তাভাবনা তারা করছে। এ চিন্তাধারণাটা সমাজের ওপর ক্ষুদ্রঋণের যে ইতিবাচক প্রভাব, তা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অনেকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে কমার্শিয়ালরূপে (মুনাফার জন্য ও বাণিজ্যিকভাবে) নিয়ে আসার কথা বলছেন।
ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বলা হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না, কিন্তু বিষয়টি সঠিক নয়। ক্ষুদ্রঋণের সেবামাশুল সহনীয় পর্যায়ে আনা দরকার। এ জন্য ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে। যদিও বাংলাদেশে এর সুযোগ অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে বলতে চাই, সেখানে ক্ষুদ্রঋণের প্রকল্পের মধ্যে কমার্শিয়াল মনোভাব প্রবেশ করেছিল বলে সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ ব্যর্থ হয়েছে বলে একে দোষারোপ করা ঠিক নয়। ক্ষুদ্রঋণের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা এনে ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর মধ্যে আনা উচিত। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিবিষয়ক আন্তর্জাতিক মানক্রমে (ব্যাসেল) ক্ষুদ্রঋণকে আনার চেষ্টা চলছে। এটা ঠিক হবে না। কেননা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাপনা আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এক নয়। ক্ষুদ্রঋণে একটি সামাজিক অঙ্গীকার থাকে, আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফামুখী চেষ্টা থাকে।
ক্ষুদ্রঋণকে রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনা উচিত। তবে এই রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কটি যেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো না হয়। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি যেন ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে না রাখে, যাতে এর সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাডাম স্মিথের একটি কথা বলতে চাই, ‘টাকা টাকা বানায়’। কিছু থাকলে তবেই কিছু পাওয়া যায়। ছোট্ট একটি পুঁজি পেতে প্রাথমিক সাহস পাওয়াই সবচেয়ে কষ্ট। ক্ষুদ্রঋণকে এই ক্ষুদ্র পুঁজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
রেহমান সোবহান
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার কিছু মতামত আছে। এখন ২০১১ সালের মাঝখানে আমরা অবস্থান করছি। আশির দশকের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা এখন অনেক পরিণত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দৃঢ়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণের টাকা ফেরত নেওয়া নিয়ে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বক্তারা এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন এবং বলবেন। বর্তমান সময়ের বিতর্কের মূল ইস্যু হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের শর্তাবলি এবং ঋণের টাকা সংগ্রহে মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ড। একে ব্লাড সাকার সিনড্রোম বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণের টাকা ফেরত নেওয়ার পদ্ধতিতে জটিলতা রয়েছে। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা এখানে বেশি সুখকর নয়।
আলাপ-আলোচনার মধ্যে অনেকে ক্ষুদ্রঋণের টাকা ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের সুষম প্রয়োগ এবং নতুন বিধিনিষেধের কথা বলেছেন। আরেকটি বিতর্ক হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মালিক কারা। আমার মত যে ঋণগ্রহীতারাই হচ্ছে শেয়ারের মূল মালিক বা অংশীদার। এ ক্ষেত্রে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের কথা বলা যায়, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মুম্বাই শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর আইপিও ছাড়া হচ্ছে। আমাদের দেশের গ্রামীণ মডেল ও ব্র্যাক মডেল ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সমাজে পরিবর্তন এনেছে।
সৈয়দ এম হাশেমী
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমালোচকেরা প্রায়ই বলেন, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস পায়, তার প্রমাণ খুবই কম রয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব খুবই ক্ষীণ। তাঁদের মত হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ শিক্ষাক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য বিষয়ে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, দারিদ্র্য দূরীকরণে একক কোনো সমাধান দিতে পারে না। বরং এটি শুধু দারিদ্র্য তৈরি এবং পুনর্গঠন করে বহুভাবে। কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের বহুমাত্রিক প্রয়োগ রয়েছে। যদিও দারিদ্র্য দূরীকরণের দিক থেকে এটি সীমিত। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বাজার যদি সীমিত হয়, তাহলে তাদের দ্রব্য কে কিনবে? ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক দিকগুলোর উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব?
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হয়েছে অনেকাংশে। যদিও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার চাহিদা অনেকটা নিশ্চিত করেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ভোক্তাদের বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। তারা পূর্ববর্তী বেকার অবস্থার চেয়ে বর্তমানে ভালো অবস্থায় রয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে মানুষের অর্থ উপার্জন, নারীর ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণরূপে আনতে পারেনি। তবে এটি অনেক ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি সময়ের ব্যাপার। এটি খুব দ্রুত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সময়ের। প্রথমত, নিশ্চিত করতে হবে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো। দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের জন্য সরকারি আর্থিক সাহায্য দিতে হবে শর্ত ছাড়া। বিশ্বায়নের এই যুগে যদিও বেসরকারি তহবিল এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে তাদের আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে।
ক্ষুদ্রঋণের সমালোচকেরা এবং তাঁদের অনুসারীরা ক্ষুদ্রঋণের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে প্রশংসা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে ত্বরান্বিত করার একটি প্রক্রিয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা নিয়ে আমাদের দেশে যে কার্যক্রম রয়েছে, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ হারে সুদ গ্রহণ করছে বলে প্রায়ই অভিযোগ আসে। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনপ্রণেতা বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ রয়েছে যে তারা বেশি সুদ আদায় করে। অনেক ক্ষেত্রে ‘সুদখোর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মহাজনেরা ঐতিহাসিকভাবে দরিদ্র জনগণকে শোষণ করে আসছেন। তাদের সম্পদ, জমিজমা, এমনকি বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য করেছেন তাঁরা। এ জন্য সরকারের কাছে সুদের এই উচ্চ হার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নৈতিক দাবি করা হচ্ছে। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, আর তা হলো, দরিদ্র মানুষের ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প একমাত্র পথ হলো মহাজনি বা সুদখোরদের কাছ থেকে মাসিক ১০ শতাংশ বেশি সুদহারে ঋণ গ্রহণ করা, যা বছরে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ক্ষুদ্রঋণ শুরু বা প্রসারণের কারণ হলো, বাণিজ্যিক ব্যাংকের হার দরিদ্র মানুষের জন্য সহজলভ্য নয়।
অন্ধ্র প্রদেশে কৃষকেরা ঋণ শোধ করতে পারছেন না বলে তাঁরা আত্মহত্যা করছেন। যদিও কৃষকদের সরকারি ভর্তুকি হিসেবে সহজ শর্তে ঋণগুলো একসঙ্গে দেওয়ার ফলে সেটা তাঁদের ওপর ঋণের বোঝা হয়ে পড়ছে। কৃষি খাতে সমস্যার কারণে এসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে যাচ্ছে। তবে ভর্তুকি হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হলে সবাই পাবে না। বাণিজ্যিকীকরণের দিকে গেলেই তা সম্ভব হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও প্রযুক্তির দরকার। আর্থিক খাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার।
গরিব মানুষের যে অর্থনৈতিক চাহিদা রয়েছে তা কখনো ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করা যাবে না। আমি আজকে অসুস্থতার কারণে কাজে যেতে পারব না, কিন্তু আমার ভাতের প্রয়োজন। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। সুতরাং তাদের অবশ্যই ক্ষুদ্রঋণ প্রয়োজন পড়ে। গরিব মানুষকে এখন পর্যন্ত সব রকমের অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে পারিনি। সত্যিকার অর্থের গরিব মানুষের জীবনে কী চাহিদা তা বুঝতে হবে।
রেহমান সোবহান
বক্তারা অন্ধ্র প্রদেশের কথা উল্লেখ করেছেন। আরও আলোচনা শুরু করার আগে আমি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। আমি অন্ধ্র প্রদেশে গিয়েছিলাম সেলফ হেল্প গ্রুপ নিয়ে কাজ করার জন্য। সেখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। প্রথমটি হলো, একটি জেলায় দূরবর্তী গ্রামে ঘুরছিলাম। আমাকে যখন বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়, তখন তাদের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য আগ্রহ দেখা গেল না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাকে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়। সেখানকার গ্রামের কাজ আর নারীদের মধ্যে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচয়ই যথেষ্ট। এটা আমার জন্য একটা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। আরেকটি ঘটনা হলো, যখন আমি সেলফ হেল্প গ্রুপের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন আরেকটি প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়। তাদের ১০ মিলিয়ন সদস্য আছে। এটা অনেকটা রিটেইল ব্যাংকের মতো।
এ ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশের সরকার এনজিও গ্রুপগুলোকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে। সোসাইটি ফর দি এলিমিনেশন অব রুরাল পোভার্টির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান থাকেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এ ছাড়া অনেক সরকারি কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত। যেটা বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সর্বশেষ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যখন সরকারি পরিচালনায় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটা অনেকটা ভর্তুকি পর্যায়ের। অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কাজ করলে সেখানে আসলে ঋণ-ভর্তুকি দেওয়া হয়। যার ফলে সেখানে ইন্টারেস্ট রেট বাণিজ্যিকভাবে অনেকটা কম। ব্যাংক এখানে ঋণের সুদের হার কম হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে, দরিদ্র নারীদের উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করা যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বল্প সুদ গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠছে। যখন আমি অন্ধ্র প্রদেশে ছিলাম, আমরা একটা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের অফিস দেখেছিলাম, সেটা অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণ। যেখানে এসএইচজির সঙ্গে মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের বিশাল পার্থক্যও দেখা যায়।
সেখানে এসএইচজি একটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। কারণ, তারা মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কম সুদ নিয়ে থাকে। আমরা এখানে দেখছি, কীভাবে মাইক্রোফিন্যান্স অর্গানাইজেশন এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণের ওপর কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের এসকেএস মাইক্রোফিন্যান্সের কথা বলা যায়। যারা ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি আইপিওর মাধ্যমে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে থাকে; ভারতে এসএইচজির সফলতা অনেক বেশি। তারা ভারতের প্রায় সব গ্রামে বিস্তৃত। এ রকম মাইক্রোক্রেডিটের বৈচিত্র্যের কারণে অন্ধ্র মডেল এখন পরিচিত। এখন সব জায়গায় এসএইচজি স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে।
সিদ্দিক ওসমানী
ক্ষুদ্রঋণে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে গণমাধ্যমে কিংবা নানাভাবে, সেই বিভ্রান্তিগুলো দূর করার লক্ষ্যেই আজকের এই আলোচনা। জনসমক্ষে যাতে এই বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরা যায়, তার চেষ্টা করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যতের কিছু ইস্যু নিয়েও আমি বলব। বিভ্রান্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এত চড়া সুদ কেন? অনেকে বলেন, ক্ষুদ্রঋণ ভালো প্রক্রিয়া, কিন্তু এর সুদের হার অত্যধিক, তাঁরা কখনো বলেন না কিসের মাপকাঠিতে ক্ষুদ্রঋণে চড়া সুদ নেওয়া হয়, তার ব্যাখ্যা দেন না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেখানে ধনীদের ১২-১৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ দিচ্ছে, সেখানে গরিবেরা কেন ২৫ শতাংশ হার সুদে ঋণ নেবে। যাঁরা এ প্রশ্নটি করেন, তাঁরা কখনো ভাবেন না যখন ক্ষুদ্রঋণ ছিল না, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তো গরিব লোকদের ঋণ দেয়নি। কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার ঋণ দেয়, তবে তাদের পরিচালনা ব্যয় এত হবে যে তারা ৪০ শতাংশ হার সুদ দিয়ে সে ব্যয় বহন করতে পারবে না। সে জায়গায় একটা শূন্যতা পূরণ করেছিল সুদখোর বা মহাজনেরা। তাঁরা ১০০-১৫০ শতাংশ সুদ হারে ঋণ দিতেন। এ থেকে মুক্তির জন্য ক্ষুদ্রঋণ কাজ শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা ব্যয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করা অযৌক্তিক।
আরেকটি কথা বলা হয়, যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নেন, তাঁদের বছরের পর বছর এই ঋণের বোঝা বয়ে চলতে হয়। তাঁরা ঋণ থেকে বের হতে পারেন না। এ কারণে সমালোচকেরা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, উচ্চ সুদের হারের কারণে তাঁরা বছরের পর বছর ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাহলে যাঁরা শিল্পকারখানা কিংবা ব্যবসা করছেন, তাঁরাও তো বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যদি এসব শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা পেয়ে থাকেন, তবে কেন এসব গরিব লোক ঋণ পাওয়ার সুবিধা পাবেন না। কিন্তু যাঁরা বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে শোধ দিতে পারছেন না? অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ দিতে পারলেই তিনি আবার নতুন করে ঋণ নিতে পারেন। অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্ট, ঋণগ্রহীতারা এই সুদ বহন করেও ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন। যাঁরা নতুন ঋণ পাওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন, যাঁরা ঋণ নিচ্ছেন তাঁদের শোধ দেওয়ার যোগ্যতা কতখানি, সে তুলনায় ঋণের বোঝা কতখানি—এসব বিতর্ক নিয়ে আশির দশকে আলোচনা হয়ে গেছে। সেগুলো আমরা অনেকে ইচ্ছে করেই ভুলে থাকতে চাই। ক্ষুদ্রঋণ যেসব উৎপাদন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে, সেখানে তাঁরা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন। বিনিয়োগের রেট অব রিটার্নের সঙ্গে রেট অব ইন্টারেস্টের তুলনা করতে হবে। এ তুলনা অনেক আগেই করে দেখা গেছে, সুদের হারের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারের ফলে রিটার্নের হার অনেক বেশি। ক্ষুদ্রঋণ যাঁরা উৎপাদন খাতে ব্যবহার করছেন, তাঁদের আমরা গবেষণার জন্য প্রশ্ন করেছি, কত হারে সুদ হলে আপনাদের এ ব্যবসা লাভবান হবে। তাঁদের অধিকাংশ যে সুদের হারের কথা বলেছেন, তা বর্তমান সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সবাই তো ঋণ নিয়ে উৎপাদন খাতে ব্যবহার করছেন না। কেউ চিকিৎসা, বাড়ি তৈরি কিংবা ভোগের খাতে ব্যবহার করছেন। সব ক্ষেত্রে সরাসরি ঋণের কোনো রিটার্ন রেট আমরা পাচ্ছি না। এসব ক্ষেত্রে তার সার্বিক আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার অন্যান্য আয়-ব্যয় মিলিয়ে তাঁরা অধিকাংশ ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন।
আমরা জানি, অনেকে ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছেন। যাঁরা ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, কী কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২ শতাংশ লোক শুধু অত্যধিক সুদের হারকে দায়ী করেছেন। অধিকাংশই আর্থসামাজিক বিবিধ কারণেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কখনোই দায়ী নয়। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন কোনো গরিব মানুষ, সে জন্য আইন করা দরকার। ঋণখেলাপি বড়লোক হলে তাঁদের রক্ষার জন্য ‘দেউলিয়া আইন’ আছে। কিন্তু গরিবের জন্য সে রকম কোনো আইন নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ খেলাপি হলে এর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় ক্ষুদ্রঋণের ওপর। ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা দরকার সরকারের। পৃথিবীর সব দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার অনেক কম। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা ব্যয় কমানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
দারিদ্র্যের ওপর ক্ষুদ্রঋণ কতটুকু প্রভাব রাখতে পারছে—এ প্রসঙ্গে অনেকে যুক্তি দাঁড় করান, এত এত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হলো, কিন্তু দেশ থেকে দারিদ্র্য তো দূর হলো না। রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক উঁচু অবস্থান থেকেও এসব কথা বলা হচ্ছে। তাহলে রাজনৈতিক সরকারগুলো রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রতিবছর দারিদ্র্য দূরীকরণে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, তার সবই কি বৃথা গেছে?
দারিদ্র্য বিমোচন শুধু ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের একার দায়িত্ব নয়। প্রতিবছর সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, কই, দারিদ্র্য তো নাটকীয়ভাবে দূর হচ্ছে না। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণ না পেলে দরিদ্র মানুষ আকস্মিক বিপদ-আপদে তাঁদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে দেন। তাঁরা দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে হারিয়ে যান। অনেকে বলেন, ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবেন। তিনি কখনোই এটি বলেননি যে শুধু ক্ষুদ্রঋণ দিয়েই দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানো যাবে। তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকাণ্ড, যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি—এগুলো আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, শুধু ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করলেই হতো।
ক্ষুদ্রঋণ একটি সম্পূরক পদ্ধতি, যেটি সরকার ও অন্যান্য এনজিও দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কাজ করছে। ক্ষুদ্রঋণ যাঁরা পাচ্ছেন, সময়ের সঙ্গে তাঁদের কী পরিবর্তন হচ্ছে, আর যাঁরা ঋণ পাচ্ছেন না, তাঁদের অবস্থার কী পরিবর্তন হচ্ছে, তা তুলনা করলেই ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব বের হয়ে আসবে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের ওপর মাহবুব হোসেন এবং আবদুল বায়েসের লেখা বইটি বের হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘১৯৮৮ থেকে ২০০৮—এই ২০ বছরে যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছেন এবং যাঁরা ঋণ নেননি, তাঁদের কী পরিবর্তন হয়েছে। দেখা গেছে, দুই পক্ষেরই দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছেন, তাঁদের দারিদ্র্য কমার হার যাঁরা ঋণ নেননি তাঁদের তুলনায় অধিক।’
ক্ষুদ্রঋণ সব সময় সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। সে পরিবর্তন রাতারাতি করা সম্ভব নয়। ৭-৮ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চার-পাঁচজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। এভাবে এ খাত থেকে পল্লি অঞ্চলে ২০ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ কোন পথে যাবে, বাণিজ্যিক নাকি নিজস্ব মালিকানায়—এসব বিচারের আগে সমাজের ওপর ক্ষুদ্রঋণের প্রভাবকে স্বীকার করে নিতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা খাতে উপকৃত হচ্ছেন। যাঁরা ঋণ নেন, তাঁরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ঋণ নেন। কেউ আয় বৃদ্ধির জন্য নেন, কেউ বাড়ি ঠিক করার জন্য, কেউ বা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ঋণ নেন। যদি ক্ষুদ্রঋণ না থাকত, তবে তাঁরা তাঁদের যা সহায়-সম্বল ছিল তা-ই বিক্রি করে দারিদ্র্যের গভীর তলে হারিয়ে যেত। এসব দিক বিবেচনা করে আয়ের দিক থেকে, ভোগের দিক থেকে, সম্পদ রক্ষার দিক থেকে ক্ষুদ্রঋণের যে ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা মাথায় রেখে ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ কোন মডেলে গেলে এই ইতিবাচক প্রভাব আরও সুদৃঢ় হবে, তা ঠিক করতে হবে। আমাদের সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক দিক চিন্তা করে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা নিতে হবে।
মাহবুব হোসেন
আশির দশকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমি গবেষণা করেছি। বর্তমানে ব্র্যাকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ক্ষুদ্রঋণকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কেন দারিদ্র্য বিমোচনে নাটকীয় পরিবর্তন নেই। বাংলাদেশের তিন কোটি পরিবারের মধ্যে প্রায় দুই কোটিই ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এসেছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ১৭ হাজার কোটি টাকা মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কৃষিঋণের মাধ্যমে ১১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উন্নয়নধারার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। এই যে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষায় সুযোগ দেওয়ার ফলে সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় ড. এ আর খান একটি গবেষণা করেছিলেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল, প্রায় ৭৫ শতাংশ লোকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। আশির দশক থেকে ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন শুরু হয়। সে সময়ও আমরা দেখেছি, প্রায় ৬০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। সম্প্রতি (২০১০ সালে) পারিবারিক আয়-ব্যয়ের হিসাবে প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ পরিবার এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আমাদের আশা ছিল, হয়তো ১০ থেকে ১৫ শতাংশের নিচে দারিদ্র্যসীমা নেমে আসবে, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। শুধু ক্ষুদ্রঋণই দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করছে না। এ ছাড়া সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য। আমরা জানি, সত্তর-আশির দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৬.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আমাদের কৃষি উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টরে গরিব লোকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ সবকিছু দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাব রাখছে।
আমাদের গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটেছে। আগে যারা কৃষিতে দিনমজুরি করত, গ্রামীণ রাস্তাঘাট হওয়ার ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজ করে, তাদের আয় বৃদ্ধি করছে। এ ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এমনকি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁরাও বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সার্বিক উন্নয়নের ফলে আগে ১ শতাংশ হারে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমত, এখন দেড় শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমছে। সারা দেশে ক্ষুদ্রঋণ ছড়িয়ে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচন হলো কোথায়—এমন কথা হচ্ছে সরকারের উচ্চ মহলে। এর দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরও পড়ে। তারা যে প্রতিবছর এত টাকা খরচ করল, সেটা গেল কোথায়? দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব যেমন রয়েছে, পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবও রয়েছে। দারিদ্র্যের হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনাও আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশে বড় সাফল্য। আমরা শুধু দারিদ্র্যসীমার ওপর কতজন উঠল, সে হিসাব করি। কিন্তু কতজন মানুষের আগের অবস্থান থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সে হিসাব করলে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব বুঝতে পারব। দারিদ্র্যসীমার হিসাবমতে, মাথাপিছু প্রতিদিন আয় এক ডলার হলে, পরিবারপ্রতি পাঁচজন হিসাব করলে মাসে প্রায় ১০ থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা লাগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে। বছরে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে। আমরা যে ক্ষুদ্রঋণ গড় পাই, মাথাপিছু প্রায় ১২ হাজার টাকা। এই ১২ হাজার টাকার সঙ্গে তার বার্ষিক সুদ যদি তিন হাজার টাকাও ধরি, তবে এর দারিদ্র্যসীমা পার হতে প্রায় ২৫ বছর লাগার কথা। দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে, আস্তে আস্তে ওপরে ওঠা। অনেকে ১০-১৫ বার ঋণ নিয়ে অথবা আরও দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। আরেকটি হিসাব করা হয়, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য, সেটি হলো পোভার্টি গ্যাপ রেশিও। অর্থাৎ পোভার্টি লাইনের তুলনায় আয়ের পার্থক্য কতটুকু আছে—এ হিসাবটি যদি আমরা লক্ষ করি, তবে ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দারিদ্র্য নিরসনে বেশ ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।
ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের সুদ আদায়ের জন্য মাঠপর্যায়ে প্রায়ই জোরজবরদস্তি কিংবা অত্যাচারের কথা বলা হয়। আমরা যাঁরা উচ্চপর্যায়ে আছি, যা পছন্দ করি, তা মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত ব্র্যাকে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মীর কিংবা গ্রামীণে ২৫ হাজার কর্মীর পক্ষে বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য। ফলে ক্ষুদ্রঋণ আদায়ে মাঠকর্মীদের চাপ প্রয়োগ করার কথা অস্বীকার করা যায় না। প্রতিবছর কতটা ক্ষুদ্রঋণ বাড়ানো সম্ভব, সে হিসাবটা না করে যদি রাতারাতি ক্ষুদ্রঋণ বাড়ানোর চেষ্টা করি, তবে এ সমস্যাটা সৃষ্টি হবেই। ২০০২ সালের পর থেকে দেখেছি, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন এনজিওকে অর্থ দিয়ে, ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে আসছে। যেহেতু তারা দেখছে, ক্ষুদ্রঋণে ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ রিকভারি পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং তারা এসব এনজিও এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিচ্ছে। এর আগে লোন ফান্ডের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। আগে ইচ্ছা করলেই ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো বড় আকারে সম্প্রসারণ করতে পারত না। কেননা, লোন ফান্ড কিছুটা পিকেএসএফ কিংবা দাতা সংস্থা থেকে নিতে হতো। এর ওপর নির্ভর করত তারা কতটা সম্প্রসারণ করবে। কিন্তু বর্তমানে এই সীমাবদ্ধতা না থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, মাঠকর্মীরা বোঝেন না যে ঋণ যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা প্রকৃতভাবে ঋণ ব্যবহার করে পরিশোধ করতে পারবেন কি না। এ ছাড়া পিকেএসএফকে দিয়ে গ্রামীণ পর্যায়ে স্থানীয় ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থা হয়েছে। এতে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির ফলে একজন সদস্যকে আরেকজন নিয়ে নিচ্ছে বা ঋণে ওভারলেপিং দেখা যাচ্ছে। ফলে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে মাঠকর্মীরা চাপ প্রয়োগ করছেন। উচ্চপর্যায়ে নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তা মানছেন না। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু ব্যবসায় সফল হতে পারেন না। ফলে একবার ব্যবসায় ব্যর্থ হলে তাঁরা আর উঠে আসতে পারেন না। কারণ, তাঁরা যে অবস্থান থেকে ঋণ নেন, তাঁদের কোনো সম্ভাবনাই থাকে না আবার নতুন করে শুরু করার।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সাধারণত নেতিবাচক সংবাদ বেশি প্রচার করে। কিন্তু বাংলাদেশের দুই কোটি ঋণগ্রহীতা পরিবারের যদি ৫ শতাংশ সফল হয়, তবে ওই ১০ লাখ পরিবারের যে ভাগ্যোন্নয়ন ঘটছে, সে বিষয়গুলো কিন্তু গণমাধ্যমে সাধারণত প্রচার হয় না। অনেকেই কিন্তু নিজে আত্মনির্ভরশীল হচ্ছেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে। তাঁরা পাশাপাশি দরিদ্র সমাজে অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে এ দেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি শুরু হয়েছে। এটি লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা তাদের মূল লক্ষ্য নয়। এভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যের বিচ্যুতি হচ্ছে। কিন্তু আশির দশকে মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ। আশির দশকে সামাজিক উন্নয়নের জন্য সপ্তাহে ঋণগ্রহীতারা একত্র হয়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতেন। তাঁরা নিজেরা সচেতন হতেন। কিন্তু বর্তমানে এগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমাদের গ্রামীণ সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো তাদের মূল লক্ষ্যের দিকে নজর রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য।
এম এম আকাশ
ক্ষুদ্রঋণ যখন শুরু হলো, তখন দাতারা টাকা দিত। সুতরাং কস্ট অব ফান্ড ছিল শূন্য। সুদের হার কম ছিল। তখন শুধু ট্রানজ্যাকশন খরচ ছিল। কেউ কেউ অল্প লাভ করলে তা খরচ করত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে। মানুষ ভাবল যে এটি ভালো কাজ। মানুষ মহাজনের ঋণ থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু আস্তে আস্তে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দাতারা ফান্ড দেওয়া কমিয়ে আনে তাদের নিজস্ব সমস্যার কারণে। ড. ইউনূস অবশ্য প্রথম থেকেই বলেছেন, তিনি ব্যবসা করবেন এবং তা থেকে যতটুকু লাভ হবে, তা দিয়ে তিনি সমাজের উপকার করবেন। অর্থাৎ তাঁর সামাজিক উপকার ও আর্থিক লাভের মধ্যে তিনি ভারসাম্য রেখে এগোতে চেয়েছিলেন।
অন্য উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, যদি দাতাদের অনুদান না পাওয়া যায় এবং ব্র্যাক কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ১২ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়া হয়, তখন কস্ট অব ফান্ডই হবে শতকরা ১২ টাকা। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে ১০০ টাকা মাঠপর্যায়ে পৌঁছানোর ডেলিভারি খরচ। এই খরচের মাত্রাও নির্ভর করবে মাঠপর্যায়ে কর্মীদের কর্মদক্ষতার ওপর এবং রেট অব রিকভারি অর্থাৎ ঠিকমতো টাকা ওঠানোর ওপর। এ খরচ আরও নির্ভর করবে কর্মকর্তাদের বেতনের ওপর। এই সব কটি খরচের সঙ্গে যদি এনজিও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আনুষঙ্গিক পাজেরো গাড়ির খরচ কিংবা দেশের বাইরে ঘোরাফেরার খরচ সংযুক্ত হয়, তবে ক্ষুদ্রঋণের ডেলিভারি খরচই এনজিওভেদে ১৬ থেকে ৩০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে। তখন মোট সুদের হার বেড়ে ২৮=(১৬+১২) থেকে ৪২=(১২+৩০) শতাংশ হয়ে যাবে। যদি মাত্র ৫ শতাংশ মুনাফাও যুক্ত হয়, তাহলেও সুদের হার উচ্চ ব্যয় ও মুনাফাসহ প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে কম সুদ (২০%) নিচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। বেশির ভাগ এনজিও নিচ্ছে ৩০ শতাংশ। অবশ্য আগামী জুন থেকে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ সুদের সীমা কার্যকর করতে হবে সবাইকে।
কিছু কিছু দেশে স্টক মার্কেট থেকে টাকা নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। এদের কাছে ক্ষুদ্রঋণ একটি লোভনীয় ব্যবসা। বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষুদ্রঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে। এরা চাইছে সর্বোচ্চ মুনাফা, এসব কারণে সুদের হার অবাধে বাড়ছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা যে টাকা শোধ দিচ্ছে, তা কিস্তিতে দিচ্ছে। যার ফলে অন ব্যালান্স সব সময় ঋণদাতার কাছে অর্ধেক ফান্ড থেকে যাচ্ছে। সুতরাং ডিকলাইনিং ব্যালান্স মেথডে সুদের হার ফ্ল্যাট রেটের দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ফ্ল্যাট রেটে মেপে সুদের হার দেখানোটা ঠিক হচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো এনজিওকেও ডিকলাইনিং ব্যালান্সে সুদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের রেটের চেয়ে ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বেশি হবে, কিন্তু ট্রানজ্যাকশন কস্টের দোহাই দিয়ে যথেচ্ছা বেশি সুদের হার নিতে পারি না। সুদ যত বেশি নেব, তত আমি লাভ করব। আমি যুক্তি দেখাতে পারব, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার কিংবা সম্পদ বাড়াতে পারছি। আবার কম লাভে সন্তুষ্ট থেকে কম সুদও নিতে পারি। তা ছাড়া অতিরিক্ত লাভ দিয়ে নতুনভাবে ফান্ড করে আবার ঋণ দিতে পারি। তাতে কস্ট অব ফান্ড কমে, সুদও কমতে পারে। এগুলো আসলে যা হচ্ছে তা সর্বদা স্বচ্ছ নয়। আসলে যত দিন যাচ্ছে ততই ক্ষুদ্রঋণকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্রঋণ দাতা সংস্থাগুলোর সুদের হারের মধ্যে প্রচুর ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। এসব জায়গায় ক্ষুদ্রঋণের নিয়ন্ত্রণকারী রেগুলেটরি অথরিটিকে দেখতে হবে আসলে প্রকৃত সুদের হার কত হওয়া উচিত।
ড. ইউনূস বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক তিনি নন, গ্রামের ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারাই এর মালিক। যদি গ্রামীণ ব্যাংক সুদ বেশি নেয়, মুনাফা বেশি করে তবে তা পাবে সেই ঋণগ্রহীতারাই। সুতরাং গরিবেরাই এই লাভের অংশ পাবেন। কিন্তু অন্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো এই দাবিটুকুও করতে পারবে না। এর পরও খোদ গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানার চরিত্র কতটা ফরমাল আর কতটা অ্যাকচুয়াল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
অনেক এনজিও শুধু দরিদ্রদের জন্য কাজ করছে বললেও কেউ কেউ উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল। যদি এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে, তবে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। যদি কোনো এনজিও বলে, আমি ব্যবসা করব, সামাজিক উদ্দেশ্য আমার নেই, তবে তাকে অবশ্যই ট্যাক্স (কর) দিতে হবে। আর যদি কোনো এনজিও বলে, আমি সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রেখে কাজ করব, তবে তার কার্যপ্রক্রিয়া, সুদের হার ভিন্ন হতে হবে। তবে গ্রামীণ ব্যাংক যেমন ফান্ড সংগ্রহ করতে পারে গ্রামাঞ্চলের লোকদের কাছ থেকে, অন্যরা তা পারে না। গ্রামের একজন অসদস্য ধনী লোক গ্রামীণ ব্যাংকে টাকা ডিপোজিট করে সুদ পান, ওই আয়ের জন্য তাঁকে কোনো কর দিতে হয় না। যদি একই লোক বাণিজ্যিক বা কৃষি ব্যাংকে টাকা সঞ্চয় করতেন, তবে তাঁকে এর জন্য কর দিতে হতো। ফলে গ্রামীণ ব্যাংকে বেশি সঞ্চয় জমা হচ্ছে, তাতে তাঁর কস্ট অব ফান্ডও কম হচ্ছে, সুদও তিনি অন্যদের চেয়ে কম রাখতে পারছেন। কিন্তু এতে গ্রামে আবার অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ছাড়া আমরা দেখছি, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন অসম সুযোগ-সুবিধা কিংবা কমবেশি চাপ প্রয়োগ করা হয় কিংবা তাদের সম্পর্কে ভুল ভাবমূর্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়, সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের নিরপেক্ষ আলোচনায় বসে ঠিক করতে হবে, আসলে কে কী করতে চায় এবং কে কী করছে, তা ঠিক করে সেই অনুযায়ী একটি একক রেগুলেটরি কাঠামোর মধ্যে সবাইকে আনতে হবে। এমআরএ এই কাজটা শুরু করতে পারে।
সাজ্জাদ জহির
টেকসই ব্যাংকিং-ব্যবস্থা চালু করা এবং জামানতবিহীন ঋণসুবিধা দেওয়া। বিশেষ করে, ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফাইন্যান্স কিছুদিন আগে এই অঞ্চলের দেশগুলোর অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশের সেভিংস টু লোন রেশিও প্রায় ৫৩ শতাংশ; ভারতের ক্ষেত্রে এটি ৩ শতাংশ। এটি হচ্ছে বড় পার্থক্য। অন্ধ্র প্রদেশ নিয়ে যে প্রশ্নটি উঠেছে, এ জন্য ইকুইটির ওপর যেখানে অর্থায়ন করা হয়েছিল, সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল যে অন্ধ্র প্রদেশে কোনো সেভিংস করা যাবে না।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ ভিন্ন ধরনের। আমরা সেলফ হেল্প গ্রুপের নামে অনেক কিছু বলতে পারি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ভালো দিকগুলো নিয়ে।
আমাদের ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। ক্ষুদ্রঋণ হলো সেবা বিতরণের উদ্ভাবনী উদ্যোগ। কিন্তু এটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে না।
ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে মার্কসের পুঁজিবাদ সম্পর্কে তত্ত্বের কাঠামো যদি মনে রাখি, তবে দেখি, পিকেএসএফ যখন কথা বলছে, তখন তাদের মনে থাকে না যে তারাও কিন্তু লভ্যাংশের একটা অংশবিশেষ নিজে রেখে দিচ্ছে, যা দিয়ে তারা পুঁজি বাড়াচ্ছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন ঋণ দেয়, তখন তাদের একসঙ্গে ৫০-১০০ কোটি টাকা এককালীন ঋণ দেয়, ফলে ট্রানজ্যাকশন খরচ কম হয়। কারণ, ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কম থাকে এবং তাঁরা ব্যাংকে এসে ঋণ নেন এবং বছর শেষে ব্যাংকে এসে ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু যখন এই ৫০-১০০ কোটি টাকা ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে ১০-১২ হাজার টাকা করে ঋণ দিতে যায়, তখন অনেক লোকের সঙ্গে কাজ করতে হয়, ফলে ট্রানজ্যাকশন খরচ অনেক বেড়ে যায়। আবার টাকাটা সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তিতে সংগ্রহ করা হয়। কারণ, তাঁরা বছর শেষে একসঙ্গে ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। ফলে নিয়মিত ঋণগ্রহীতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর যে বিপুল লোকবল লাগে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের এত লোকবল দরকার হয় না। এ কারণেই ক্ষুদ্রঋণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ব্র্যাকের কথা বলি, তাদের ৩০-৩৫ হাজার কর্মচারী আছেন, তাঁদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার সংখ্যা খুবই সীমিত। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অত্যধিক, যাঁদের বেতন স্কেল সরকারি স্কেলের কাছাকাছি। আরেকটি দিক হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে চালাতে চাইলে অবশ্যই কর্মদক্ষ ব্যক্তি প্রয়োজন উচ্চপর্যায়ে। আর বর্তমান শ্রমবাজারে কর্মদক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য অবশ্যই বেশি টাকা বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
১৯৯৯ সালে আইআরপিএসপির যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য আমাদের কী করা উচিত, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা চলছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আরেক ধাপে উন্নয়নের জন্য কিংবা নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। অর্থাৎ পুঁজির বিকাশটার দিকে লক্ষ রাখা। স্ট্যাটিকভাবে ক্ষুদ্রঋণকে দেখতে যাওয়ার মানসিকতা আমাদের ক্ষতি করেছে। এ জন্য উপযুক্ত বিধি কাঠামোর দরকার, অর্থাৎ যে কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজির বিকাশকে সহযোগিতা করবে। এই জায়গায় সরকারি প্রশাসন থেকে শুরু করে দাতারাসহ সবাইকে নজর দিতে হবে।
আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতে কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে আমাদের কারও কোনো চিন্তা নেই। আমরা যাঁরা নীতিনির্ধারণ করি বা যাঁরা তা প্রয়োগ করেন, তাঁদের সীমিত জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বড় আকারে আইনি পথ বেছে নিই, সেখানে বিপদ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও আইনি পথে বেঁধে রাখতে পারিনি।
ডিপোজিটের ওপর কত হারে সুদ দিতে হবে, তাও আইনিভাবে বাঁধতে পারিনি। সেখানে আমরা কি আইনি পথটি নেব, না বিকল্প কোনো পথ আছে? সেটি হলো, পিকেএসএফ সরকারের মাধ্যমে ভর্তুকি দিতে পারে। সেখানে সরকার কোনো একটি জিনিসের সরবরাহ বাড়িয়ে বা কমিয়ে দাম ওঠানামা করাতে পারে। পিকেএসএফের মতো একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে তারা অনেক প্রভাব ফেলতে পারে ঋণবাজারে। আমি মনে করি, তার মাধ্যমে সুদের হারের ওপর প্রভাব রাখা যেত। কিন্তু তা না করে আইনি পথ নেওয়ার বিপদটা হচ্ছে, প্রতিদিনই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, আমরা তো স্ট্যাটিক অবস্থার মধ্যে নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংক এখন সঞ্চয়কারীদের ১৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে, সেখানে যদি ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়, তার সুদের হার ১৫ শতাংশের কম হবে না।
এর ওপর নির্ভর করে যদি কেউ বলে গরিব মানুষের কাছে ঋণের জোগান নিশ্চিত করব। তাহলে আইন করে ২৭ শতাংশ হারে সুদে দেওয়া অবান্তর হয়ে পড়বে। সুতরাং আইনি পদ্ধতির চেয়ে পিকেএসএফের মাধ্যমে ঋণবাজারে প্রভাব ফেলার উদ্দেশ্যটা বেশি কার্যকর হবে। যদি ক্ষুদ্রঋণকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক করে দেখতে না পারি, তবে সমস্যা হবে; প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজির বিকাশের দিকে তাকানো দরকার। অন্ধ্র প্রদেশে ভুল ধারণা করে অতিরিক্ত মাত্রায় ঋণ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে বাণিজ্যিক দিকটিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। আশির দশকে গ্রামীণ যখন ঋণ দেওয়া শুরু করল, তখন এনজিওগুলো তাদের সদস্যদের ঋণ দেওয়া শুরু করল। নব্বইয়ের দশকে পিকেএসএফ যখন আরও সম্প্রসারণ করল, তখন আরও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেল। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে অন্যান্য সেবার যে আন্তসম্পর্ক, যেটি আমাদের দেশে ঘটেছে, সেটি লক্ষণীয় বিষয়। দেখা গেছে, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক দিক আছে। পাশাপাশি সামাজিক দিকও রয়েছে। বাণিজ্যিক দিকগুলো কীভাবে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়, এই প্রয়োজনীয় বিধিকাঠামো তৈরি করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। এই জায়গায় ব্যর্থতার কারণে নানা রকমে রূপ নিতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনায় এসেছিল, আসলে সামাজিক ব্যবসা করার জন্য যদি কেউ উদ্যোগ নেয়, যে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো ডিভিডেন্ড নেয় না, সেটি আবার পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে, তবে কেন তাদের কোম্পানি হিসেবে ওপেন বুক করার পরও ৪২ শতাংশ বা ৩৭ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
যদি আইনি পথগুলো সহনশীল করা না হয়, তবে এ খাতে আমাদের যে অর্জন, তা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বহু ধরনের সেবা দেওয়ার ক্ষমতা দিন দিন কমে আসছে। উপযুক্ত বিধি-কাঠামো না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নসাধন হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
হোসেন জিল্লুর রহমান
ক্ষুদ্রঋণ একাই দারিদ্র্য বিমোচন করে ফেলবে, এটা ঠিক নয়। দারিদ্র্য বিমোচন একটি প্রক্রিয়া বা সিঁড়ি। আজকে আলোচনায় বেশ কিছু দিক উঠে এসেছে। প্রথমত, ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে কতটুকু প্রভাব রাখতে পেরেছে বা পারছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কীভাবে আরও উন্নয়ন করা এবং টেকসই করা যায় কি না। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার বিভিন্ন দিকের উন্নয়ন কীভাবে করা যায়—এসব বিষয়। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ডিসকোর্স। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে যে বিতর্ক তা শুধু নয়, আরও অন্যান্য বিতর্কের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের দিকগুলো তুলে আনা দরকার। আমাদের সামাজিক পরিবর্তন কারা নিয়ে আসবে, তাদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী। বিশেষ করে, সামাজিক উদ্যোগ তার স্বাধীনতা বা সৃষ্টিশীলতা কীভাবে দেখা হবে, নাকি আমরা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রনির্ভর কিছু চিন্তাভাবনা নিয়ে এই বিষয়গুলো দেখব।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের যে অবস্থা, সেখানে দারিদ্র্য বলতে সম্পদের অভাবই নয়, বিপন্নতাও—এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিনিয়ত গরিব মানুষ যেকোনো বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন—অসুস্থতা, গরু মরে যাওয়া, ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া, মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া। এসব বিপদ মোকাবিলার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হয় গরিব মানুষের। ফলে এসব বিপদ থেকে মুক্তির জন্য তাঁদের শেষ সম্বল বিক্রি করে সামাজিক অবস্থান থেকে আরও নিচে নামতে হয়। সুতরাং এসব বিপদ থেকে রক্ষার জন্য ক্ষুদ্রঋণ দরকার হয়। আমাদের গড় আয়ের এক-পঞ্চমাংশ অর্থ এ ধরনের হঠাৎ বিপদে খরচ হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন হলো কি না, এ প্রশ্ন বিচারে অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দারিদ্র্য থেকে বের হওয়ার মানেটা কী, তার একটা চিত্র তুলে ধরা। গতকাল দরিদ্র ছিলাম, কিন্তু আগামীকাল দরিদ্র নই—এভাবে কখনো দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। দারিদ্র্য বিমোচন একটি প্রক্রিয়া বা সিঁড়ি। একেক ধাপ পেরিয়ে ওপরে উঠতে হবে। আমরা এখন গাইবান্ধা কিংবা কয়েকটি জায়গায় শুধু মঙ্গা দেখি, কিন্তু নব্বইয়ের দশকে কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, নোয়াখালীতেও মঙ্গা দেখা যেত। মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে এ চিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে। আমরা যখন ক্ষুদ্রঋণের দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাবের কথা বলব, তখন আমাদের চিন্তা করতে হবে, দারিদ্র্য বিমোচন একটি প্রক্রিয়া, যা ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে অতিক্রম করতে হবে।
আবার ক্ষুদ্রঋণ কিছুই করতে পারেনি—উঁচু জায়গায় বসে এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সত্তরের দশকে এরিক ইয়ানসেন বই লিখেছিলেন, সেখানে বলেছিলেন, মানিকগঞ্জে দারিদ্র্যের চিত্র কোনো দিনই বদলাবে না। কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি এসে মানিকগঞ্জের দারিদ্র্য পরিস্থিতি দেখে বিস্মিত হয়েছেন। সুতরাং আমাদের সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু পরিবর্তনের মাপকাঠি পরিমাপের জন্য সূচকের বিষয়গুলো নিয়ে যখন আলোচনা করব, তখন সরাসরি প্রভাবের সূচকের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ প্রভাবের সূচকগুলো বিবেচনা করতে হবে। নব্বইয়ের দশকে একটি ডেটা সংগ্রহের সময় ঝুপড়ি একটি ক্যাটাগরি রেখেছিলাম, সেখানে ২৫ শতাংশ ছিল ঝুপড়ি। কিন্তু এখন বসতবাড়ির মধ্যে ঝুপড়ি খুঁজেই পাওয়া যাবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করছে ক্ষুদ্রঋণ। এ ধরনের উদ্যোগ বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। পল্লি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য জয় করার আস্থা বাড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের অধিকাংশই ক্ষুদ্রঋণ-প্রক্রিয়ার পটভূমি থেকে এসেছেন। ক্ষুদ্রঋণ শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয়, নানা মাত্রিক সামাজিক পরিবর্তন আনছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার লক্ষ্যগুলো পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ এত দিন শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। ক্ষুদ্রঋণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে এগুলো যুক্ত করা উচিত, যা মুহাম্মদ ইউনূসের ধারণায় অনেক আগেই ছিল।
এলজিইডি যে গ্রামীণ রাস্তার উন্নয়ন করেছে, এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টি নব্বইয়ের প্রথম দিকে বিএনপি সরকার গ্রহণ করেছিল এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ড সামাজিক নিরাপত্তা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগী চিন্তার কারণেই সম্ভব হয়েছে। আসলে গরিবেরা নিজেরাই ভালো জানে, কী করলে তারা সবচেয়ে ভালো সুযোগ পাবে। সুতরাং যেসব আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গরিবদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে তুমি এটা করতে পারবে না, এটা করো—এ ধরনের সব কটি প্রকল্পই ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ গরিবদের নিজস্ব চিন্তাধারণা পরস্ফুিটনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা দেওয়া দরকার।
মোস্তফা কে মুজেরী
আশির দশকের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তবে দেখব, যখন ক্ষুদ্রঋণ শুরু হয়েছিল, সে সময় যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির হারও কম ছিল। তখন ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব মিলিয়ে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের যে গতি, তা তেমন একটা অগ্রসর হতে পারেনি। নব্বইয়ের দশকে এসে দারিদ্র্য সম্পর্কে ধারণায় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সে পরিবর্তন শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে হয়েছে তা নয়, সে সময় আমাদের দেশে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা যায়। কৃষি ও অন্যান্য খাতে নীতিগত নানা সংস্কার তখন হয়েছিল। বিশেষ করে, গ্রামীণ অকৃষি খাতে যে প্রবৃদ্ধি, এ ধরনের বিষয়ে অগ্রগতির কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নব্বইয়ের দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে, সামাজিক খাতে যে পরিবর্তন যেমন—জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, মানব পুঁজির বিস্তৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্যান্য সেবা খাতে ব্যাপক উন্নতি দৃশ্যমান হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এসব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের সম্পর্ক যথেষ্ট ছিল। ক্ষুদ্রঋণ একটি প্যাকেজ হিসেবে ছিল আশির দশকের দিকে। তখন ঋণের সঙ্গে সঙ্গে মানব উন্নয়নের জন্য অন্যান্য সেবা পাওয়ার যে সুযোগ মাঠপর্যায়ে ছিল, যা নব্বইয়ের দশকে সামাজিক পরিবর্তনের যে সূচনা, সেখানে ক্ষুদ্রঋণের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। ২০০০ সালের পরে ঋণের বিস্তৃতি বেড়েছে। যেগুলো কম দরিদ্র এলাকা ছিল, সেসব স্থানে ২০০০ সালের পরে ক্ষুদ্রঋণ বেশি পরিমাণে গেছে। অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ কম গেছে। এ কারণে যে এলাকায় বেশি ক্ষুদ্রঋণ গেছে, সেসব এলাকায় দারিদ্র্য নিরসনে দ্রুত পরিবর্তন দেখা গেছে। চরম দরিদ্র এলাকায়ও ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আয় বৃদ্ধি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ ভূমিকা রেখেছে। ক্ষুদ্রঋণের যে মডেলগুলো আগে ছিল, সেগুলোতে কিন্তু অনেক পরিবর্তন এখন এসেছে। যেমন—অতিদরিদ্র মানুষের কাছে সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। যেমন—পিকেএসএফের প্রাইম মডেল বিভিন্ন সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে।
আজকাল ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কিংবা বিজনেস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। এগুলো ঋণগ্রহীতাদের তৈরি করছে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য। সব ঋণগ্রহীতাই যে সমানভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, তা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ, এ ক্ষেত্রে তার স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ক্ষুদ্রঋণের অনেকাংশ নির্ভর করে।
দারিদ্র্য হচ্ছে বহুমাত্রিক ধারণা। দারিদ্র্যের বহুমাত্রাকে যদি আমরা স্বীকার করি, তবে এটা স্পষ্ট যে শুধু ক্ষুদ্রঋণই আমাদের দারিদ্র্য দূর করবে, এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ, বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যা রয়েছে দারিদ্র্যের জন্য। আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমতা এনে, দারিদ্র্য দূর করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণকে শুধু ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর ফলে আমাদের সামাজিক যেসব সুফল আসছে, যেমন—নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে, সেগুলোর দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। ক্ষুদ্রঋণের একটি গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার। দারিদ্র্য বিমোচনের যেসব নীতিমালা করছি, সেখানে ক্ষুদ্রঋণকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। আমরা ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকাকে বাইরে রেখে দিচ্ছি। এ কারণে ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারত, সেটি সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষুদ্রঋণ এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। এটি ক্ষুদ্রঋণকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করছে। ক্ষুদ্রঋণ মাঠপর্যায়ে গিয়ে সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটাকে খাটো করে দেখলে হবে না।
বাকী খলিলী
বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমি চিন্তিত এই খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে কি না। গত দিনগুলোতে ক্ষুদ্রঋণ আমাদের সামাজিক পরিবর্তনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা হয়, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কতটুকু প্রভাব রাখতে পেরেছে। কিন্তু সরকার নিজেকে দারিদ্র্য বিমোচন থেকে দূরে রাখছে। আমার কাছে অবাক লাগে যখন দেখি, দারিদ্র্য বিমোচনের দায়ভার শুধু ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার সঙ্গে সরকারের ভূমিকাকে যদি সমন্বয় করা যেত, তবে আমার মনে হয় সমাজ পরিবর্তনে ক্ষুদ্রঋণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। সরকার যদি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে বসে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার সমন্বিত উদ্যোগ নিত, তবে দারিদ্র্য বিমোচন অতিদ্রুত এগিয়ে যেত।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমার হিসাবমতে, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ২৩ শতাংশের কম হওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ হলো পরিচালনা ব্যয়। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সবচেয়ে কম।
আমরা শুধু ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের ব্যর্থতার দিকগুলো তুলে ধরি, কিন্তু গরিব মানুষগুলো যে কতটুকু সঞ্চয় করেছেন, তার হিসাব কখনো দেখি না। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩১ বিলিয়ন বা ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি নিট সঞ্চয় করেছেন তাঁরা। গরিব মানুষের পক্ষে সঞ্চয় করা সম্ভব নয়, যদি তাঁরা লাভ না করতে পারেন।
প্রায়ই অভিযোগ ওঠে যে গরিব মানুষ একটি ঋণ নিয়ে অন্য আরেকটি ঋণ পরিশোধ করেন। আমরা আসলে গরিব মানুষের সম্পর্কে কী ধারণা করি যে তাঁরা বোকা? যদি তাঁরা জানেন যে একটি ঋণ নিয়ে সমস্যায় পড়বেন, তবে তাঁরা কি নতুন করে ঋণ নেবেন? সুতরাং তাঁদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা আছে বলেই ঋণ নেন। প্রশ্ন হতে পারে, কেন ঋণ ওভারলেপিং হয়েছে। আজকে আমার যে আয়, যদি কালকে বড় কোনো অসুখ হয়, তবে আমার বর্তমান অবস্থা খারাপ হবে—এটাই স্বাভাবিক। ওভারলেপিংয়ের পেছনে কয়েকটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, পূর্ববর্তী ঋণ পরিশোধ করার জন্য। দ্বিতীয়ত, বিপদ থেকে মুক্তির জন্য, তা স্বাস্থ্যগত কিংবা অর্থনৈতিক। তৃতীয়ত, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য। তবে ব্যবসা সম্প্রসারণের কারণে একাধিক প্রতিষ্ঠানে ঋণগ্রহীতাদের সদস্য হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এর হার প্রায় ৮০ শতাংশ। আর একটি ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ পরিশোধ করার হার ১৩ শতাংশ। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, গ্রামের পাকা রাস্তার পাশে কিংবা দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো একাধিক হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে অনেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারে না। আমি পাবনার বেড়া উপজেলায় একজন নারীর বাসায় গিয়েছিলাম; তিনি ২০ বছর ধরে সদস্য ছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কী করলেন এত দিনে? তিনি বললেন, তাঁর মেয়েকে মাস্টারবাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন, এ জন্য এক লাখ টাকা যৌতুক দিয়েছেন। তাঁর স্বামীর চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি এসব টাকাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সঞ্চয় করে দিয়েছেন। যদি এই টাকাগুলো তাঁর হাতে থাকত, তবে তিনি উৎপাদন খাতে লাগাতে পারলে তাঁর উন্নয়ন সম্ভব হতো। আমরা কখনো সফল ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করি না। ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, যেন এগুলো নিয়ে বিতর্ক-বিভ্রান্তি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া না হয়। সরকারকে অনুরোধ করব, এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে, যে কারণে এ খাত ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়ে।
রেহমান সোবহান
এখানে একাডেমিক পর্যায়ে অনেকে এসেছেন, কথা বলেছেন, তাঁদের মতামত দিয়েছেন। কিন্তু এখানে নন-একাডেমিক অর্থাৎ যাঁরা বাস্তবে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তাঁদের বক্তব্য বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা উচিত ছিল। একাডেমিক তত্ত্ব আর বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সব সময় কিছুটা মিল-অমিল থাকে। এ জন্য এখানে কিছু আলোচনা বাদ পড়ে যেতে পারে।
এখানে বলতে চাই, একজন পিএইচডি গবেষকের কথা বলেছেন বক্তারা, তিনি সত্তরের দশকে বিআইডিএসে গবেষণা করার সময় এমন একজন নারীর সন্ধান পেয়েছিলেন, তিনি তখন খুব গরিব ছিলেন এবং বর্তমানে তাঁর এক ছেলে বিদেশে থাকে এবং পাকা বাড়িতে থাকেন। এ রকম অনেক উদাহরণ আনা যায়, যাঁরা ক্ষুদ্রঋণের আওতায় উন্নয়নের ধারা রেখেছেন।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে যে বিশাল ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেওয়া হয় না, তা নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। প্রথাগত ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষকে ঋণ দেয় না। যেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমাজের শিকড়ে গিয়ে ঋণের ভিত্তি চালু করেছে।
ক্ষুদ্রঋণ কখনো দারিদ্র্য বিমোচন সম্পূর্ণভাবে করতে পারবে না। ক্ষুদ্রঋণ উন্নয়নে সহায়তা করার একটা উন্নত মাধ্যম। গ্রামীণ লোকজনকে সরাসরি বাজেট দিয়ে দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ লোকজনকে উন্নয়নের ধারায় আনা সম্ভব। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে এত সমালোচনা হলেও তিনি তো সমগ্র বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রচলনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত। ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে কিছুটা নীতিমালা থাকা উচিত। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। গণতন্ত্রের মূলনীতির প্রতি সম্মান রেখে ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ও কমিটির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত নয়।
প্রচলিত ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছেন না প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দরিদ্র মানুষ যাঁরা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন, তাঁদের বিদ্যমান ব্যাংকিং-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ক্ষুদ্রঋণ দিয়েই শুধু দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়, এর পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো বাজার-সুবিধাসহ অন্যান্য আর্থসামাজিক বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। আর এগুলো করার মূল দায়িত্ব সরকারের। দারিদ্র্য বিমোচনের সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ হলো একজন মানুষের দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার ন্যূনতম সুবিধা।
আব্দুল কাইয়ুম
প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষ, কুসংস্কারাচ্ছন মানুষ অগ্রসর হয়ে আসছে; ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা মানুষকে সহজে বিভ্রান্ত করে না। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দারিদ্র্য দূর করার ব্যাপারে আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি চাহিদা পূরণ হলে, নতুন চাহিদা দেখা দেয়। দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ক্রমান্বয়ে তা দূর হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আজকের আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।