পর্ব ::১০২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এটাকেই বিপ্লব-উত্তরকালের পরিপ্রেক্ষিতে ‘উত্তরণশীল পর্ব’ বা ট্রানজিশন পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালের অভ্যুদয় সোভিয়েত-চীন দেশের মতো ‘আর্থ-সামাজিক’ বিপ্লব ছিল না ঠিক, কিন্তু ‘বিপ্লব’ ছিল সর্বার্থেই। এবং বিপ্লব হয়ে থাকলে তার একটি ‘উত্তরণশীল পর্ব’ থাকবেই, যার মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে অতিক্রম করতে হয় একটি ‘পুরোনো ব্যবস্থা’ থেকে ‘নতুন ব্যবস্থায়’ পৌঁছানোর জন্যে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টার মতোই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর রাস্তা কোন পিচঢালা মসৃণ পথ ছিল না। এতে ছিল চড়াই-উৎরাই-অপ্রত্যাশিত বন্যা ও দুর্ভিক্ষের ছোবল। এরকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিপ্লবের পরে অবস্থা বুঝে আঁকাবাঁকা পথের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তখন পিছু হটলে সাইডলাইনে থাকা তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ ভদ্রলোকেরা দুয়ো দুয়ো করে ব্যঙ্গ করতে থাকে। তারা তখন বলতে থাকে, ”খুব তো বড় মুখ করে ‘সমাজতন্ত্র’ করতে চেয়েছিলে, এখন বোঝ। সেই তো পিছু হটতে হচ্ছে তোমাদের। পাহাড়ে উঠতে চেয়েছিলে সাত-পাঁচ না ভেবে। অথচ এখন দেখছ রাস্তাটা ডেডএন্ডে আটকে গেছে। এখন তো তোমাদের ফিরে আসতে হবে নিচে। নামতে নামতে তারপরে বের করতে হবে আবার উপরে ওঠার রাস্তা। তা-ও খুঁজে পাবে কিনা তার কী গ্যারান্টি?” এরকম তির্যক তিরস্কার চারপাশ থেকে ধ্বনিত হতে থাকবে। বিপ্লবীদের পরাজয়ে যারা সবসময়ই এরকম অযাচিত উপদেশ আর তিরস্কার বাণী বর্ষণ করে থাকে। বঙ্গবন্ধুকেও ১৯৭২ সাল থেকেই এ ধরনের তিরস্কার-গঞ্জনার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছিল। মুজিব ঠিকই জানতেন যে এটা সেই দেশ যেখানে দশজন ভিলেন মিলে- ঘরে-বাইরের শত্রুরা একযোগে-যখন একজন নায়ককে পেটায়, তখন চারপাশের উৎসুক জনতা ভিড় করে তারিয়ে তারিয়ে সেদৃশ্য উপভোগ করে। এরাই সেই জনতা যারা সফল হলে মাথায় চড়িয়ে নাচতে থাকে, আর বিফল হলে মাটিতে মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করে না। মুজিব এটা জেনেও পিছু হটে অন্য রাস্তা খুঁজতে দেরি করেননি। ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ডেভেলপ-এরকম একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হতে চেয়েছেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ সূচনা করে। তার সহযোগীদের বলেও ছিলেন সেকথা।
দ্বিতীয় বিপ্লব যে উত্তরণশীল পর্বের একটি ‘সাময়িক কর্মসূচি’ ছিল এর নানা সাক্ষ্য পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি। প্রথম প্রমাণ হিসেবে শেখ হাসিনার নিজের স্মৃতিচারণাকে পেশ করতে চাই। ১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনা এ বিষয়ে লিখেছেন:
”আজ যখন আমরা জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছি তখন বার বার আব্বার কথা মনে পড়ছে। যখন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী দিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন এবং সকল রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে একই মঞ্চে সমবেত করে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। তখন একটা নতুন সিস্টেম দাঁড়ালো। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সারাজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, এখন এই পদ্ধতিতে কেন গেলেন?’
তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, একটা বিপ্লব হয়েছে। যে কোন বিপ্লবের পর সমাজে একটা বিবর্তন আসে, আমাদের সমাজেও আসবে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হবে এবং এর বিস্তৃতিও হবে-যার প্রভাব পড়বে সমাজ ব্যবস্থার উপর। কিছু মানুষ হঠাৎ করে প্রচুর টাকার মালিক হবে-সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব বাড়াতে নির্বাচন করবে শুধু টাকার জোরে; এর প্রভাব নির্বাচনের উপরও পড়বে। দেখা যাবে টাকা ও লাঠির জোরে নির্বাচন হচ্ছে। সত্যিকার সমাজসেবক বা দেশপ্রেমিক বা আদর্শবান যারা তারা এদের সাথে টাকা ও লাঠির জোরে পেরে উঠবে না। তাই এমন একটা ব্যবস্থা করতে চাই অন্তত কিছু দিনের জন্য যাতে কালো টাকা ও পেশিশক্তি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারে। একটা সাধারণ নির্বাচন যদি এভাবে হয় তাহলেই মানুষের চক্ষু খুলে যাবে আর মানুষকে কেউ ধোঁকা দিতে পারবে না। আর এ ব্যবস্থা মাত্র ৩/৪ বৎসরের জন্য; পরে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব।”
উপরের উদ্ধৃত অংশের সারাংসার নিহিত ছিল একটি বাক্যে। চতুর্থ সংশোধনী ও পরবর্তীকালে বাকশাল গঠন একটি প্রয়োজনীয় নিদান ছিল সেদিনের সমস্যা মোকাবিলায়। কিন্তু এটি ছিল সাময়িককালের জন্যে :’মাত্র ৩/৪ বৎসরের জন্য; পরে আবার আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব।’ এই একই কথা বলেছেন আমাকে প্রাক্তন আমলা ও অর্থমন্ত্রী এম. সাইদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের শেষ কয়েক মাসে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে থেকে কাজ করেছিলেন তিনি। একবার বঙ্গবন্ধুকে বাকশালের আয়ুস্কাল নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। উত্তরে বঙ্গবন্ধু কোনো কথা না বলে হাতের তিনটি আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন-‘তিন বছরের জন্য’। সাইদুজ্জামান আমাকে আরও জানান যে অবস্থা মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতি থেকে কিছুকালের জন্যে হলেও ‘সরে আসতে হবে’ (কেননা সব অথেনটিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেই এটা করতে হয়েছে) একথা বলেছিলেন খোদ ফিদেল ক্যাস্ট্রো নিজে। ক্যাস্ট্রো স্বয়ং এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলেন পরবর্তীকালে কানাডায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত (যিনি যুগপৎ কিউবারও দায়িত্বে ছিলেন) কর্নেল নুরুজ্জামানকে। তবে আইডিয়াটা শুধু ক্যাস্ট্রোর থেকেই উদ্গাত হয়েছিল তা নয়। অন্য উৎসের থেকেও পরোক্ষ সমর্থন মিলেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাময়িক পর্বের জন্য বাকশাল গঠনের বিষয়ে সমর্থন দিয়েছিল? এ বিষয়ে কিছুটা পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়। মতিউর রহমান তার ‘বাকশাল-কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রবন্ধে লিখেছেন: “এমন একটি কথা প্রচারিত আছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পেছনে বাংলাদেশের ‘মস্কোপন্থি’দের প্ররোচনা ছিল। এবং তাদের পরামর্শেই ওই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল সেদিন। এসব কিছুর পেছনে ‘সোভিয়েতের হাত’ রয়েছে, এমন কথাও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এর সমর্থনে কেউ কোনো সত্য তথ্য দিতে পারেনি। প্রচারিত এ তথ্য অসত্য।” এ প্রসংগে মতিউর রহমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের উদাহরণ দিয়েছেন। একাধিক বইয়ে মনিরুজ্জামান দাবি করেছেন, ”একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশের অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের ঢাকাস্থ দূতাবাসের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের দুজন বড় নেতাকে ‘এক দল’ করার জন্য প্রভাবিত করেছিল।” মতিউর রহমানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, ‘এসব তথ্যের সমর্থনে কোনো সূত্র বা তথ্য হাজির করেন নি তালুকদার মনিরুজ্জামান। সে জন্য তাঁর বইয়ের কোনো পাঠকের পক্ষে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ নেই।’
সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (১৯৭২-৭৫ পর্বে ডাকসুর সহসভাপতি) অবশ্য কিছুটা ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন বাকশাল প্রসংগে সোভিয়েত-দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। আমাকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, সোভিয়েতের বার্তা ছিল কিছু অস্পষ্ট। বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘এক দল’ করা যাবে না এমন কোনো কথা নেই বিপ্লবের জ্ঞানকোষে, আবার সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য এক দল ‘করতেই হবে’ এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। এই বার্তাই নাকি সোভিয়েত পার্টি তখন ভ্রাতৃপ্রতিম সিপিবিকে জানিয়েছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি সাপেক্ষে এক দল করলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না এমন একটি মনোভাব সোভিয়েত তরফ থেকে ব্যক্ত হয়েছিল-যেটি পূর্বে উল্লেখিত কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পরামর্শের সঙ্গে মিলে যায়। চুয়াত্তর সাল থেকেই এরকম একটি সার্বিক উপলব্ধি জেগেছিল যে গতানুগতিক বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সেটি যেমন জেগেছিল বঙ্গবন্ধুর মনে, তেমনি ন্যাপ-সিপিবির নেতৃত্বেও বড় অংশের মধ্যেই। সেটা হতে পারে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এবং সিপিবির রাজনৈতিক শক্তিকে একক প্ল্যাটফর্মে একত্র করার মাধ্যমে (নিজ নিজ দলের স্বতন্ত্র পরিচয় রাজনৈতিক মঞ্চের ভেতরে বাইরে অক্ষুণ্ণ রেখেই)। অথবা, প্রয়োজন বোধে, কৌশলগত কারণে দলীর স্বাতন্ত্র্য বাইরে প্রকাশ্য না করে আপাতদৃষ্টিতে ‘এক দল’ গড়ার মাধ্যমে। শেখ মুজিব নিজে ‘এক দলের’ মধ্যে এরকম ‘বিভিন্ন গ্রুপের’ সমাবেশ স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো স্মৃতিচারণা করেছেন যে বঙ্গবন্ধু তাঁকে এবং রাশেদ খান মেননকে বাকশালে যোগ দিতে বলেছিলেন। তখন তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আপনার দল তো নানা ধরনের লোকের খিচুড়ি। আপনার দলেই গাজী ভাইয়ের এক দল, মনি ভাইয়ের আরেক দল, তার মধ্যে আবার মস্কোপন্থিদের নিয়েছেন!… এবার আপনি বলেন, কোন উপদলের সঙ্গে থাকবো, মনি ভাইয়ের সঙ্গে, রাজ্জাক-তোফায়েলের সঙ্গে, না আর কারও সঙ্গে? আর তাদের অধীনে থাকবোই বা কেন?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোরা নিজেরাই একটা গ্রুপ হয়ে যা, সোজা চলে আসবি আমার কাছে, একেবারে আমার বেডরুমে!’ অর্থাৎ এক দলের বাতাবরণে বিভিন্ন গ্রুপের অস্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সম্ভবত সিপিবি’র তৎকালীন নেতৃত্বের মধ্যেও এরকম সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়ে থাকবে। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে থাকতে পারলে ভালো, নইলে নির্দিষ্ট গ্রুপ, ধারা, উপদল বা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে থেকে গিয়ে দেশকে আপাতত সংকটের খাদ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। চুয়াত্তরের মে মাসেই সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটি দেশের পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয় (মতিউর রহমানের বয়ান থেকে উদ্ধৃত করছি):
“বাংলাদেশের সমস্ত পরিস্থিতি আজ এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হইয়াছে।’ সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করে বলা হয়েছিল, ‘শাসক দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট ও সরকারের বহুবিধ দুর্বলতা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে কঠিন ও জটিল সমস্যা হিসেবে উপস্থিত হইয়াছে। দেশ অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।’ তাই স্বাধীনতা ও প্রগতির বিরোধী সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বক্তব্য তুলে ধরে যে, ‘একটি সার্বিক কর্মসূচির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রকৃত সৎ ও প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক দল ও ব্যক্তিদের লইয়া শরীক দলসমূহের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়া এমন একটি মৈত্রী জোট গড়িয়া তোলা প্রয়োজন, যে জোট ক্রমান্বয়ে সর্বস্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিবে এবং সিদ্ধান্ত কার্যকরীকরণের ক্ষেত্রেও যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ চুয়াত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের বেশ কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। এসব আলোচনা থেকে এটা জানা যায় যে, তিনি দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন। সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মতিউর রহমান আরও জানিয়েছেন যে, ‘বাকশাল’ একক দল গঠনের বিষয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের মধ্যে কিছু উৎসাহ ছিল তৎকালীন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য আমাকে বলেছিলেন। আর, কমরেড ফরহাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে এ প্রসঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের চিরকূট নিয়ে সকালে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের কাছে যাওয়া-আসা করেছি কয়েকবার। এটা পরিস্কার মনে আছে, জাসদ নেতা সিরাজুল আলম খানকে বাকশালে যোগ দিতে সম্মত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সে বৈঠক আমাদের বাসায় হয়েছিল। … সে সময়ে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। একাংশ একক দলে যোগ দেয়ার পক্ষে ছিলেন। তাদের মধ্যে অগ্রিম উৎসাহ ও আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। আরেক অংশের মতামত ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে। …এভাবেই মানুষের মধ্যে, এমনকি পার্টির ভেতরেও এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, কমিউনিস্ট পার্টি ‘বাকশাল’ গঠনে উদ্যোগী ছিল এবং ‘বাকশালের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে’।”
নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে বড় করে না দেখে দেশের বৃহত্তর তাগিদে বিভিন্ন প্রগতিশীল ধারা, উপধারা ও ব্যক্তিবর্গ সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সিপিবি-ন্যাপ তারপরও এটি মেনে নিয়েছিল পরিস্থিতির চাপে ও কৌশলগত কারণে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই দুটি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে স্বাধীনতার ও প্রগতির পক্ষের সকল শক্তিকে একত্র করার চেষ্টা করেছিল।
[ক্রমশ]
Tag Archives: কালের খেয়া
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::১০১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
শোষণমুক্ত সমাজের জন্য পূর্বাপর আকাঙ্ক্ষা এবং সে ধরনের সমাজ গড়ার জন্য একটি প্রায়োগিক ও বাস্তবোচিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একথা বলা চলে যে শেখ মুজিব পুঁথিপড়া মার্কসবাদ বা রাশিয়া-চীন-পূর্ব ইউরোপের প্রথাগত সমাজতন্ত্রের ছকের বাইরে অন্য ধরনের সমাজতন্ত্র, সমাজবাদ বা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন। ‘বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্র’ এই কথাটা মুজিব বলেছিলেন অস্টিন রবিনসনের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে। এই কথাটি তিনি আরও অনেক ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। যেখানে ঘুরে-ফিরে এসেছে ক্রমান্বয়ে চলার নীতি বা গ্রাজুয়ালিজম। দেশের মানুষের মন-মানসিকতা ও সমসাময়িক উন্নয়ন-সমস্যার সঙ্গে মানানসই অর্থনৈতিক কাঠামোয় সমতামুখী আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার তাগিদ। এক্ষেত্রে কোনো আগাম ব্লু-প্রিন্ট তার সামনে সেদিন ছিল না। সে ধরনের কোনো নকশা বা রোডম্যাপ সেদিন কেউই দিতে পারেননি। না দার্শনিকেরা, না অর্থনীতিবিদেরা, না রাজনীতিবিদেরা। যারা সেদিন সরকারের বাইরে থেকে ‘আরও সমাজতন্ত্র’, ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’, ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সমাজতন্ত্র’ এসব স্লোগান তুলে চারদিক প্রকম্পিত করছিলেন-কোনো বিশেষ দল, ব্যক্তি বা ধারার নাম না ধরেই বলছি-তারাও বস্তুতপক্ষে জানতেন না ১৯৭২-৭৫ পর্বে তারা আসলে কী চান এবং কীভাবে তাদের আরাধ্য সমাজ-অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা পাবে।
এই প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাকে। এই কালপর্বের মূল্যায়ন করা এই রচনার পরিধির বাইরে। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই ইতোপূর্বে লিখে গেছেন, যার মধ্যে প্রথমেই আসবে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের পথিকৃৎধারার গ্রন্থসমূহ-যার মধ্যে রয়েছে ‘ডেভেলপমেন্ট প্লানিং ইন বাংলাদেশ :এ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি’ (১৯৭৯); ‘মেকিং অফ এ নেশন, বাংলাদেশ :অ্যান ইকোনমিস্ট’স টেল’ (২০০৩)। অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যৌথভাবে লিখেছিলেন ‘পাবলিক এন্টারপ্রাইজ ইন অ্যান ইন্টারমিডিয়েট রিজিম :এ স্টাডি ইন দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ বাংলাদেশ’ (১৯৮০); ‘আনট্রাংকুইল রিকালেকশনস :নেশন বিল্ডিং ইন পোস্ট-লিবারেশন বাংলাদেশ’ (২০২১)। অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক আজিজুর রহমান খান ১৯৭২-৭৫ পর্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখে গেছেন যার থেকে তৎকালীন সময়ের একটি প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও বিদেশি অর্থনীতিবিদেরা সে সময়ের বাংলাদেশের উন্নয়ন-সমস্যা নিয়ে লিখে গেছেন। তাদের মধ্যে যারা বই লিখেছেন বা বই সম্পাদনা করেছেন সেই কাতারে আগে উল্লিখিত ই.এ.জি. রবিনসন ও কীথ গ্রিফিনের সম্পাদিত বই, ইউস্ত ফাল্যান্ড ও জে.আর. পারকিনসনের ‘বাংলাদেশ :দ্য টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’; ফেল্ডম্যানের ‘আনহ্যাপি ইস্ট পাকিস্তান :এ সার্ভে অফ ইন্টার-রিজিওনাল ইনইকুয়ালিটি ইন পাকিস্তান (১৯৭১); ওয়াল্টার ফেলকন ও গুস্তাভ পাপানেকের সম্পাদিত ‘ডেভেলেপমেন্ট পলিসি-দ্য পাকিস্তানি এক্সপেরিয়েন্স’ (১৯৭১), ইত্যাদি। এর সঙ্গে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে ‘প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিল’ (১৯৭৩) এবং সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অভিমত। এসবের সার-সংক্ষেপ করে একটি চমকপ্রদ পুস্তক রচিত হতে পারে, কিন্তু সেটা করা বর্তমানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু তৎকালীন কয়েকটি ইস্যুর মধ্যেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
বঙ্গবন্ধুর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচি দিয়েই আমি এই পর্বের আলোচনা শুরু করতে চাই। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাহাত্তরের সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। এর সুবাদে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় (দল হিসেবে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠিত হয় আরও কয়েক মাস পরে-১৯৭৫ সালের ৭ জুন)। এই পরিবর্তন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ২৫ জানুয়ারির ভাষণে বলেছিলেন যে, পুরো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে এবং একটি সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে দ্রুতগতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই পদ্ধতিগত পরিবর্তন তখন আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। এটা শুধু রাজনৈতিক শক্তির সুবিধের জন্য নয়-কেননা সংসদে তখন আওয়ামী লীগেরই দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মুজিব চাইলে সংসদের মাধ্যমে সেদিন ব্রুট মেজরিটি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। এটা ছিল রাষ্ট্রের সক্ষমতা-অর্জনের প্রয়োজনে এবং সমাজকে অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে একটি জরুরি উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধু ২৫ জানুয়ারির ভাষণে বারবার শাসন-পদ্ধতির ‘সাময়িক পরিবর্তনের’ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বাধ্য হয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই এটা করতে হচ্ছে- এটা সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির ভাষণে মুজিব সমাজ-রাষ্ট্রের নানা উপসর্গের কথা তুলেছেন। তার সোজা-সাপ্টা কথা-এ ব্যবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। একটি পরিবর্তন আসন্ন। হয় প্রগতিশীলেরা এই পরিবর্তন করবে, নয়তো প্রতিক্রিয়াশীলেরা পরিবর্তন আনতে চাইবে। বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই সেটা শোনা যাক।
“এই ‘করাপশন’ যারা করে, তারা কারা? আমরা ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ। আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি করাপ্ট ‘পিপ্ল’। আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে।…আজ আমি যা করেছি, তা বহু দুঃখে করতে হয়েছে। বহুদিন পর্যন্ত বিবেকের দংশনে জ্বলেছি। আপোষ করি নাই কোন অন্যায়ের সাথে। মাথা নত করি নাই কোন অন্যায়ের কাছে।…অর্থ আনবো, সেই অর্থ চুরি করে খাবে। টাকা আনবো, তা বিদেশে চালান দেবে। এ আর সহ্য করা যায় না। এসব যারা করে, বাংলার মাটি থেকে তাদের উৎখাত করতে হবে। এর জন্য আমি ওয়াদাবদ্ধ।…স্পিকার সাহেব, আজ আমাদের কি অবস্থা! আজ আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। ভিক্ষুকের জাতের কোন ইজ্জত আছে? দুনিয়ায় জীবনভর ভিক্ষা পাওয়া যায়? আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। কাজ করবো না, ফাঁকি দেব। অফিসে যাব না, ফাঁকি দেব। ফ্রি স্টাইল। কিন্তু ফ্রি স্টাইল মানে গণতন্ত্র নয়। অফিসে ১০টার সময় যাওয়ার কথা বলে ১২টার আগে যাব না। পাঁচটায় ছুটি হলে ৩টায় ফিরে আসতে হবে। কারখানায় কাজ করবো না, কিন্তু পয়সা দিতে হবে। আমাদের শ্রমিকরা খারাপ নয়। আমাদের শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। আমাদের কৃষকরাও আজকে কাজ করছে। ফুড প্রোডাকশন এগিয়ে গেছে। অথচ আমরা ব্যাঘাত সৃষ্টি করি, আমরা ষড়যন্ত্র করি। আমরাই ধোকা দেই। আমরাই লুট করে খাই। জমি দখল করে নেই। এসকল কাজ করে কারা? আমরা, এই দেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ।…কলে কারখানায়, খেত-খামারে আমাদের প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচতে পারে না। কি করে আমরা বাঁচবো, যদি ধরুন, বছরে ২০ লক্ষ টন খাবার ডেফিসিট হয়? এই তিন বৎসর পর্যন্ত গড়ে এর চেয়ে অনেক বেশি খাবার আনতে হয়েছে। প্রথম আনতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ টন। ধরুন, যদি প্রত্যেক বৎসর গড়ে ৫৪০ লক্ষ মণ খাদ্য আনতে হয় বিদেশ থেকে, কোথায় পাওয়া যাবে, কে দেবে? জাহাজ ভাড়া কোথায়? বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ টন প্রতি বছর আমাদের আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে এই তিন বৎসরে।…কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্ররা কতকাল দেবে? এদেশে মানুষ বাড়ছে। বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লোক বাড়ে। আজকে আমাদের তাই ‘পপুলেশন প্ল্যানিং’ করতে হবে। ‘পপুলেশন কন্ট্রোল’ করতে হবে। না হলে বিশ বৎসর পরে ১৫ কোটি লোক হবে যাবে। আর পঁচিশ বৎসর পরে? চুয়ান্ন হাজার স্কোয়ার মাইল জায়গায় এত লোক বাঁচতে পারবে না। যত ক্ষমতাই থাকুক, বাঁচার উপায় নাই। অতএব, ‘পপুলেশন কন্ট্রোল’ আমাদের করতেই হবে। সেজন্য ডেফিনিট স্টেপ আমাদের নিতেই হবে বাংলাদেশে।…আমরা কলোনি ছিলাম। আমরা কোন জিনিসে ‘সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট’ নই। আমরা খাবারে ‘সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট নই, কাপড়ে ‘সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট’ নই, তেলে ‘সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট’ নই, ঔষধে আমরা ‘সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট’ নই। আমাদের ‘মেটিরিয়ালস্’ কিনতে হবে। আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানিদের। আমাদের সব কিছু প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সব কিছু বিদেশ থেকে আনতে হবে। কোথায় পাবেন বৈদেশিক মুদ্রা আপনারা? ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে? ইনকাম করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।…স্পিকার সাহেব, আজকের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই। আমরা জীবনভর সংগ্রাম করেছি। কেউ যদি মনে করেন যে, জনগণের ভোটের অধিকার আমরা কেড়ে নিয়েছি, তাহলে আমি বলবো, না। আজকে এখানে যে সিস্টেম করা হয়েছে, তাতে পার্লামেন্ট-এর মেম্বাররা জনগণের দ্বারা ভোটে নির্বাচিত হবে। যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, তাঁকেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার আছে।…এই সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে, মানুষ যাতে সহজে বিচার পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার পায়। ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। ‘কলোনিয়াল পাওয়ার’ এবং রুল নিয়ে দেশ চলতে পারে না। নতুন স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মতবাদ, স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে হবে। এখানে ‘জুডিশিয়াল সিস্টেম’ এর অনেক পরিবর্তন দরকার।….জানি, আমাদের অসুবিধা আছে। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ হয় নাই। আমাদের দেশে বন্যা হয় প্রত্যেক বৎসর, সাইক্লোন হয় প্রত্যেক বৎসর, ন্যাচারাল ক্যালামিটি হয়। সে সবের বিরুদ্ধে আমাদেরই লড়তে হবে। আজ আমাদের কথা হল, শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে। আমরা এর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।…যদি আমি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলি, তাহলে মানুষ থাকি কোথায়? প্রথমেই আমাকে মনুষ্যত্ব আনতে হবে, তবে আমি মানুষ হবো। মানুষ কেন আমাকে বলা হয়। কারণ আমার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে। যখন মনুষ্যত্ব আমরা হারিয়ে ফেলি, তখন তো মানুষ থাকি না। আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি। আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব, আজ শাসনতন্ত্রের যে সংশোধন হল, তার কথা যেন সকলে ভেবে দেখেন।…আমার ক্ষমতা তো কম ছিল না। প্রাইমমিনিস্টার হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছেন। আমার টু-থার্ড’স মেজরিটি, তবু আপনারা শাসনতন্ত্র অ্যামেন্ডমেন্ট করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন।…তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি শাসনতন্ত্রের। কারণ, একটা সুষ্ঠু শাসন কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই, দিস ইজ আওয়ার সেকেন্ড রিভলিউশন। এই রিভলিউশন-এর অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এর অর্থ অত্যাচার, অবিচার নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।”
উপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতির থেকে দুটি প্রবণতা স্পষ্ট। প্রথমত, সমাজ-জীবন, রাষ্ট্র-জীবন বা অর্থনৈতিক জীবনের নানা ক্ষেত্রেই বেশ কিছু উপসর্গ দানা বাঁধছিল। এইড, বিশেষত ফুড এইড-এর ক্ষেত্রে নির্ভরতা একটা চিরস্থায়ী ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর জন্যে দরকার ছিল খাদ্য-উৎপাদন বাড়ানোর জরুরি প্রস্তুতি। তাছাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতা ও দাম-বৃদ্ধি প্রায়ই হেডলাইন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ফলে কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষও বাড়ছিল; উঠতি মধ্যবিত্তের মনেও দেখা দিচ্ছিল উদ্বেগ, এর জন্যে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল শিল্প-কারখানায় ‘উৎপাদন বাড়ানোর’ ব্যাপক আয়োজন। কৃষিতে বা শিল্পে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা সত্ত্বেও দেশের সমস্যা পর্বতাকার ধারণ করত যদি-না ‘পপুলেশন প্লানিং’কে বাস্তবায়ন করা যায়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত ছিল জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনশিক্ষার বিষয়সমূহ। ফি বছর বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলা করা বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক দুর্বিপাক-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, হঠাৎ-বিত্তের এক ক্ষুদ্র কিন্তু দাপুটে গোষ্ঠীর আবির্ভাব, দুর্নীতির বিস্তার। পুনর্গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে এই সবই প্রত্যাশিত সমস্যা। দরকার ছিল গোটা সমাজ-জাতিকে একসূত্রে বাঁধা। ব্যক্তিস্বার্থকে এক্ষেত্রে অনেকটাই বিসর্জন দিতে হয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক-সামাজিক স্বার্থে।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::১০০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
মুসলিম লীগের হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের সাথেই তিনি বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এ-ধরনের প্রস্তাবে নেহরু-প্যাটেলের কংগ্রেস এবং জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের মূল অংশ রাজি না হওয়ায় এই ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্র’ প্রকল্পটি আর এগোতে পারেনি। না পারলেও কথাগুলো মুজিবের মনে গেঁথে গিয়েছিল। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস তার ‘প্রসঙ্গ শেখ মুজিব’ বইতে এ নিয়ে লিখেছেন এভাবে:
‘শেখ মুজিবের জীবনদর্শন ও অভিধানে সাহসিকতা দুঃসাহস প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা রাগ-বিরাগ-অনুরাগ বাৎসল্য-অনুভূতি-সহানুভূতি প্রভৃতি অসংখ্য শব্দের ভিড় চোখে পড়ে। শুধু চোখে পড়ে না একটি শব্দ-নৈরাশ্য। আশ্চর্যের বিষয় সেদিনও তিনি নিরাশ হলেন না। বাংলা খণ্ডিত হবার কিছুদিন পর তিনি আমাদেরকে ডাকলেন কলকাতার এক সভায়। স্থান সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেল, পার্ক রোড। সভায় যোগদান করেন কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, শহীদুল্লা কায়সার, কে.জি. মুস্তাফা, মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, নুরুল আলম, শরফুদ্দিন আহমদ, আখলাকুর রহমান প্রমুখ সাংবাদিক ও যুব মুসলিম লীগ কর্মী। তাঁদের কেউ কেউ ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সভার আলোচনায়ও অংশ নিয়েছিলেন।
শেখ মুজিবের কথাগুলো আজও বিশেষভাবে যেন কানে বাজে…শোষকদের হাতে আমরা পরাজিত হয়েছি। কিন্তু এ পরাজয় সাময়িক। চলুন পাকিস্তানে যাই, শোষিত-নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করি। পূর্ব বাংলায় কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষকে সংগঠিত করতে হবে। শোষকদের পরাজিত করতে শোষিত জনগোষ্ঠী নিজেরাই যথেষ্ট। তারাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে নিজেদের সরকার, নিজেদের গণতন্ত্র, নিজেদের সমাজব্যবস্থা-শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। সেদিন আমার দুঃখী মানুষের মুখে ফুটবে হাসি। সোনার বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হবে শোষিতের গণতন্ত্র, শোষিত-নিপীড়িত জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার। এই তো আমরা চাই। এই আমাদের স্বপ্ন।’
‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ ও ‘শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ’ এই দুটো স্বপ্নই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মনে জাগ্রত হয়েছিল কালক্রমে। বস্তুত তার মধ্যে ক্রম-বিকাশের একটি সুস্পষ্ট ধারা দেখতে পাওয়া যায়। ঘটনাপ্রবাহের ঘাত-প্রতিঘাতে এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বিবর্তিত হচ্ছিল তার চিন্তা-চেতনা। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করেছে। তিনি সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সিস্টেমের ভালো-মন্দ বিচার করতে শুরু করেছেন খোলা মন নিয়ে। একদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সাম্যের দিকে তার দৃষ্টি কেড়েছিল। অন্যদিকে, এই ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার অভাব ও গণতন্ত্রের সমস্যা এসব তাকে পীড়া দিচ্ছিল। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে যখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তখনই তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন আওয়ামী লীগের মূল দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়েছে তখন কর্মসূচির মধ্যে প্রোথিত হয়ে গেছে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য ও আদর্শ। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে ১৯৭০-এর নির্বাচনী মেনিফ্যাস্টোতে সমাজতন্ত্রের কথা। তবে সেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সোভিয়েত ও চীন দেশের সমাজতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তি-উদ্যোগের কথাও বলছেন, গণতন্ত্রের তথা সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক (নির্বাচনী) অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলছেন। ষাটের দশকে যেন প্রতিটি বছরে তার পরিপকস্ফতা বেড়ে যাচ্ছে। তিনি প্রতিটি বছরের ব্যবধানে তার সমসাময়িকদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। এই ক্রম-পরিণতিবোধ শেখ মুজিবের বৈশিষ্ট্য এবং এর পরম্পরায় এসেছে তার চার মূলনীতি এবং ১৯৭২ সালের সংবিধান।
বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের পরিসরে সমাজতন্ত্র গড়া নিয়ে সোভিয়েত-চীনের ‘মডেল’ বা পশ্চিম ইউরোপীয় ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ ছকের বাইরে অন্যকিছু অনুসরণ করবেন এটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলে বাহাত্তরের সংবিধান গ্রহণের সময়ে ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতন্ত্র’ নির্মাণের স্বকীয় বাচনভঙ্গিতে। এ যেন মার্কসের সঙ্গে স্টুয়ার্ট মিলকে মেলানোর চেষ্টা। অথবা রাসেলের সঙ্গে লেনিনকে মেলানোর তাগিদ। কিন্তু এর অন্যবিধ স্বীকৃতিরও প্রমাণ পাই আমরা বিদেশি অর্থনীতিবিদদের লেখায়। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্স। তার বিষয়বস্তু- ‘সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা’। ১৯৭৪ সালে এই কনফারেন্সে পঠিত প্রবন্ধগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় স্মরণীয় পুস্তক ‘দ্য ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ উইদিন এ সোশ্যালিস্ট ফ্রেমওয়ার্ক’। এর সম্পাদক ছিলেন ই,এ,জি রবিনসন (অস্টিন রবিনসন) ও কীথ গ্রিফিন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের আমন্ত্রণে এই সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এতে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদেরা অংশ নেন বিআইডিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি। ফ্রান্সের ডানিয়েল থর্নার, রেনে ডুমো; ভারতের অশোক মিত্র ও অর্জুন সেনগুপ্ত; জাপানের সাবুরো ওকিতা ও আকিরা তাকাহাসি; যুক্তরাজ্যের পল স্ট্রিটেন ও মাইকেল লিপটন; যুক্তরাষ্ট্রের গুস্তাভ রানিস, ইয়ারোস্লাভ ভানেক ও হলিস চেনেরী; রাশিয়ার ভদ্মাদিমির কনদ্রাতিয়েভ ও ইলিয়া রেদকো; পোলান্ডের ইয়ান লিপিনস্কি; হাঙ্গেরির আন্দ্রিয়াস ব্রোদি; যুগোস্লাভিয়ার ব্রাঙ্কো হরবাট, আলেকসান্দার বাট প্রমুখ। এদেশের নুরুল ইসলাম, আতাহার হোসেন, এম,এন, হুদা, রেহমান সোবহান, মোশাররফ হোসেন, আনিসুর রহমান, মোজাফ্ফর আহমদ, এ.আর. খান, স্বদেশ বোস, মহীউদ্দীন আলমগীর প্রমুখ কীর্তিমান অর্থনীতিবিদ এতে অংশ নিয়েছিলেন। এরকম বিদ্বৎজনের সভা আর এদেশে (এর আগে ও পরে) অনুষ্ঠিত হয়নি বললেই চলে।
এই কনফারেন্সের শেষ দিনে দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদেরা গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন-সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। অর্থাৎ শুধু শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে তারা যাননি। গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-চিন্তা, বিশেষত সমাজতন্ত্র নিয়ে তার মূল ভাবনা সম্পর্কে জানতে-বুঝতে। অস্টিন রবিনসন এ সম্পর্কে লিখেছেন:
‘We were anxious to avoid a continuous stream of argument and recrimination as to whether it would be better for Bangladesh to adopt socialist or capitalist policies. That issue had become chose jugee–irrelevant to our discussions. All who were invited came to the conference prepared to treat it as such and we used the words `within the framework of a socialist economy’ as an essential part of the title of the conference.
It was nevertheless, very far from clear what exactly might be meant by ‘as a socialist framework’. It had been clear from the first that Bangladesh was not adopting uncritically any one of the familiar frameworks of the U.S.S.R., of Communist China, of Poland, of Romania or any other prototypes. Among ourselves we sometimes spoke of Yugoslavia as something nearer to a model. But that meant no more than that Bangladesh must be expected to work out her own compromise between a controlled economy and a price-guided economy. When on the last day of the conference we were given the opportunity of discussing the problems of developing Bangladesh with the Prime Minister, Sheik Mujibur Rahman, he was asked what was meant by Bangladesh socialism. His answer was ‘socialism as we shall practise it in Bangladesh’. This was not, as I understand it, a quick and clever repartee to a troublesome question. It was a perfectly accurate reflection of the practical and pragmatic attitude of the Bangladesh government to its problems.’
অর্থাৎ, ‘সমাজতন্ত্র’ বলতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক বলয়ে কোন ধরনের ব্যবস্থা বোঝানো হচ্ছে সে সম্পর্কে সেদিনের অর্থনীতিবিদদের কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু এটুকু তারা জানতেন যে বাংলাদেশ নির্বিচারে কোনো প্রচলিত ছককে অনুসরণ করছে না। এই প্রচলিত ছকের মধ্যে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, পোলান্ড, রুমানিয়া প্রভৃতি দেশ। নিজেদের মধ্যে যখন তারা আলাপ-আলোচনা করেছেন তখন মাঝে-মধ্যে যুগোস্লাভিয়ার মডেলের কথা উঠেছে। এর বেশি কিছু নয়। ‘নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি’ এবং ‘বাজার-অর্থনীতি’ এ দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের নিজস্ব ধারার আপস করতে হবে বাংলাদেশকে এটা অনুমান করা গিয়েছিল। কনফারেন্সের শেষ দিনে মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ‘সমাজতন্ত্র’ বলতে কী বোঝায়? তার উত্তরে মুজিব বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যে ধরনের সমাজতন্ত্র আমরা অনুশীলন করব সেটাই হবে আমাদের সমাজতন্ত্র’। এটা কোনো জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে কুশলী রাজনীতিকের দেওয়া তাৎক্ষণিক বা চতুর উত্তর ছিল না। এটা ছিল বাস্তব সমস্যার সমাধান করার জন্য ‘প্রাগমাটিক দৃষ্টিভঙ্গির’ একটি নিখুঁত প্রতিফলন। এই ছিলেন অস্টিন রবিনসনের চোখে শেখ মুজিব- একটি ‘প্রাকটিক্যাল অ্যান্ড প্রাগমাটিক এটিচুডের’ মানুষ। কোনো আদর্শের জড়ত্বে আটকে থাকা ডগমাটিক মানুষ তিনি কোনোকালেই ছিলেন না। এই জঙ্গমতা বিরল।
শেখ মুজিবের প্রায়োগিক ও বাস্তবজ্ঞানমণ্ডিত মনের কথা যখন উঠলই, তখন আরও একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই। পাকিস্তানের অপশাসনের দিনগুলোর কথা মনে করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তার ‘ক্রমান্বয়ে চলার নীতি’: ‘আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বৎসর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি জানি এদের সঙ্গে মানুষ থাকতে পারে না। আমি ইম্পেশেন্ট হই না, আমি এডভেনচারিস্ট নই। আমি খোদাকে হাজের নাজের জেনে করি, চুপি চুপি, আস্তে আস্তে, মুভ করি সব কিছু নিয়ে।’ এদিক থেকে দেখলে শেখ মুজিব ও দেং শিয়াও পিং-র মধ্যে একটি প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরা দুজনেই ছিলেন (অস্টিন রবিনসনের ভাষায়) ‘প্রাকটিক্যাল ও প্র্যাগমাটিক’ মনের মানুষ। দেং শিয়াও পিং-এর মতো মুজিবও বলতে পারতেন যে বিড়াল কালো না সাদা সেটা বড় কথা নয়, এটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা সেটাই আল্টিমেটলি বিচার্য। মুজিবও এরকম উদাহরণ দিয়ে তার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছেন। ‘লার্নিং বাই ডুইং’-এর কথা বলেছেন তিনি: ‘কেউ করে শেখে, কেউ দেখে শেখে, আর কেউ বই পড়ে শেখে। আর সবচেয়ে যে বেশি শেখে সে করে শেখে।’ যারা আইডিওলজির চশমা পরে পৃথিবীটাকে দেখে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন মাটির কাছাকাছি থাকার কথা:
“এদের আমি বলতাম, জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলেছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।”
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৯৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
পরবর্তী সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ নিয়ে বক্তব্য রাখেন-কিন্তু তিনিও লারমার ‘মানসিক ব্যবধান’ পুরোপুরি ঘোচাতে পারেননি। বরং তার কিছু কথায় বাড়তি ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে গিয়েছিল। সৈয়দ নজরুল সেদিন শুরু করেছিলেন এভাবে-
‘বাঙালী হিসাবে পরিচয় দিতে রাজী না হয়ে বাবু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই পরিষদ্-কক্ষ ত্যাগ করেন। আমরা শুধু পরিষদ্-সদস্যবৃন্দই নই- আমি মনে করি, সারা বাঙালী জাতি এতে মর্মাহত হয়েছে। আমি এটা না বললে পাছে ভুল বোঝাবুঝি হয়, সেজন্য আমি দাঁড়িয়েছি।
সেজন্য বলতে চাই, তিনি যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের প্রস্তাব উত্থাপন না করে, বাঙালী-পরিচয়ের প্রতিবাদে যাঁদের নাম করে এই পরিষদ্-কক্ষ পরিত্যাগ করে চলে গেছেন, তাঁরা বাঙালী জাতির অঙ্গ। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ৫ লক্ষ উপজাতি রয়েছে, তারা বাঙালী। তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অঙ্গ বলে আমরা মনে করি। বাবু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি বাংলা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। এ কথা স্বীকার করার পরেও কেন তিনি চলে গেলেন, তা যদি তিনি বলতেন, তাহলে আমি এই পরিষদে তার জবাব দিতে পারতাম। তাঁর অনুপস্থিতিতে বলছি বলে এ কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। ঐ পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা অধিবাসী, তাঁরা এই স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই অঙ্গ। বিশেষ করে কালকে আমাদের আইন-মন্ত্রী বলেছেন যে, তাঁদের প্রতি দীর্ঘকাল যাবৎ তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁদের সংসদীয় আইনের আওতা এবং বাইরের সভ্য জগতের আইনের আওতার বাইরে রেখে বিচ্ছিন্ন মনোভাবের সুযোগ বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা দিয়েছিল। আমরা তা চাই না, আমরা চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিকরা সারা বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের সমমর্যাদাসম্পন্ন হবে। তা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫ লক্ষ অধিবাসী বাঙালী জাতির গর্ব হিসাবে থাকবে। শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনুন্নত এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম। যদি কেউ মনে করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে অনুন্নত অবস্থা, তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে বাংলার অন্যান্য এলাকা অধিক অনুন্নত তাহলে তাঁর স্মরণ রাখা উচিত যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশ এবং বাংলাদেশে শিক্ষার হার কম। যে দেশের শিক্ষার হার কম, সে দেশ স্বভাবতই অনুন্নত হয়ে থাকে। এই অনুন্নতিই সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ত্রিশ লক্ষ বাঙালী প্রাণ দিয়েছে সেই অধিকারের সংগ্রামে এবং সেই সংগ্রামের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যে একাত্মতা অনুভব করে করে নাই, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, বাবু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আজকে যে উদ্দেশ্যে পরিষদ্-কক্ষ ত্যাগ করেছেন, তিনি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাদের জন্য তিনি সেটা করতে পারেন নাই-যদিও তিনি গর্ব করে বলে থাকেন, আমি বাঙালী। আমি বলব, যাদের ভোটে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সহযোগিতা থেকে এ হাউস বঞ্চিত হয়েছে।’
সৈয়দ নজরুল এখানে বাঙালীকে ‘রাষ্ট্র-জাতি’ হিসেবে দেখেছেন এবং এর অংশ হিসেবে পার্বতবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। লারমা-প্রসঙ্গের উপসংহারের দিকে আমরা এখন যেতে পারি। পার্বত্য-প্রশ্নে গণপরিষদের মধ্যে একাধিক প্রবণতা কাজ করছিল। একটি প্রবণতা ছিল ‘বাঙালী’ প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক এড়ানো। একই দেশে নানা জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী দাঁড়াবে তা নিয়ে ভাবিত ছিলেন সদস্যরা। বাঙালী-অবাঙালী, বাঙালীর মধ্যে বাঙালী হিন্দু-বাঙালী মুসলিম এসব সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ‘আইডেনটিটি’ ঘিরে যদি পাছে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হয়, একারণে শঙ্কিত হচ্ছিলেন তারা। পাশের দেশ ভারতে তখন চলছিল মিজো বিদ্রোহের রেশ। সদ্যস্বাধীন দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশে এরকম আশঙ্কা করা পুরোপুরি অমূলক ছিল না সেদিন। লারমা যখন ১৪ক-র পূর্বে-আলোচিত সংশোধনী প্রস্তাব আনলেন, তখন কুমিল্লা-৫ আসন থেকে নির্বাচিত সদস্য আহম্মদ আলী বলেছিলেন : ‘এখানে আমার একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য হল এই যে, যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেটা আমাদের মূল নীতির বিরুদ্ধে। আমার মনে হয়, ‘সংখ্যালঘু জাতিসমূহ’, ‘অনগ্রসর জাতিসমূহ’-এসব উক্তি যথার্থ নয়। আমরা জাতি হিসেবে বাঙালী, আমাদের জাতীয়তাবাদ বাঙালী-আমরা শুধু এইটুকুই জানি। এখানে সংখ্যালঘু জাতি এবং অনগ্রসর জাতির যে অবতারণা করা হয়েছে, এতে বরং আমাদের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে হুমকি দেখানো হয়েছে।’
লারমা কখনও পার্বত্যবাসীকে বলেছেন ‘উপজাতি’, কখনও বলেছেন ‘অনগ্রসর জাতি’। আহম্মদ আলীর বক্তব্যের ৬ দিন আগে লারমা তার সূচনা বক্তব্যে বলেছিলেন : ‘আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে আমাদের জাতির পিতা শ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধুর কাছে যুক্ত স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এই স্মারকলিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের কথা বলেছিলাম। আমাদের উপজাতিদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলাম।’ তখনই প্রতিবাদের রব উঠেছিল। জনৈক সদস্য বলেছিলেন: ‘মিস্টার লারমা একটি পৃথক স্বায়ত্তশাসিত এলাকার দাবী জানাচ্ছেন। এইভাবে এক দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর আঘাত হানা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।’
কিন্তু সবাই এতটা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। কামারুজ্জামান সাহেবের বক্তব্য ইতিপূর্বেই আমি আলোচনা করেছি। তিনি এক মহাজাতির ভেতরে নানা জাতির সহাবস্থান দেখেছেন। অর্থাৎ এক বাঙালী পরিচিতির মধ্যেই নানা জাতির বসবাস হতে পারে, নানা জাতি-উপজাতির বিকাশ হতে পারে এমন যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে, ড. কামাল হোসেন যুক্তি দেখিয়েছেন গণতান্ত্রিক সেক্যুলার কাঠামোর। বলেছেন যে বিশেষ সংরক্ষণের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে অভিন্ন নাগরিক অধিকার বোধে একত্র হতে। অনগ্রসর এলাকার বিশেষ উন্নয়ন-চাহিদা পূরণের কথাও তিনি লারমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী বলেছেন- একই বাঙালী জাতির মধ্যে বিচিত্র নৃগোষ্ঠীর মিশ্রণের কথা বা ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটির’ কথা। উদ্ধৃতিটি তাৎপর্যপূর্ণ:
‘জনাব স্পীকার সাহেব, আমার বন্ধু লারমা সাহেব যে কথা বলেছেন, আমি তার পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষেপে বিনীতভাবে তাঁকে জানাতে চাই, আমরা জানি বাঙালী জাতির কথা এবং আরও জানি যে, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বাংলাদেশের ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকায় ছড়িয়ে আছে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলার যে সংস্কৃতি, বাংলার যে সাহিত্য, বাংলার যে ইতিহাস, তা হচ্ছে বৈচিত্র্যময় এবং সেই বৈচিত্র্য আমাদের মধ্যে ঐক্য এনেছে। Unity in diversity. . আজকে ঢাকা শহরে যখন কোন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, সেখানে যাঁরা নিজেদের উপজাতীয় বলে পরিচয় দিতে চান, তাঁদের বাংলাদেশের এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংস্কৃতজ্ঞ বলে তুলে ধরা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, বাংলাদেশের চেহারায় বৈশিষ্ট্য, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে যে মহৎ ‘কোরাস্’ গীত হয়, সেই গীতই হল বাংলার সংস্কৃতি। এই কারণে বৃটিশ যুগের মতো কাউকে উপজাতীয় হিসাবে চিহ্নিত করে divide and rule policy অবলম্বন করতে চাই না এবং সেই নীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলার মানুষ সবাই এক।
এই প্রসঙ্গে আঞ্চলিকতার কথাও এসেছে। আমরা জানি, আইয়ুবের আমলে দেশের সংহতির যে সংজ্ঞা ছিল, তার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারিনি। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে, দেহের একটা অঙ্গকে আলাদা বা দুর্বল করে রেখে গোটা দেহকে সবল করা যায় না। তেমনি দেশের একটি অঙ্গকে দুর্বল করে গোটা দেশকে সবল করা যায় না।’
শেখ মুজিব গণপরিষদের ভেতরের এসব প্রবণতা জানতেন। তিনি লারমাকেও জানতেন এবং পার্বত্যবাসীর মনোকষ্টের বিষয়টিও বুঝতেন। তিনি যখন ‘বাঙালী’ বলতেন তখন তিনি বাংলার জনপদ ও তার অধিবাসীকেই মাথায় রাখতেন- যে-অধিবাসীরা পশ্চিম পাকিস্তানের ‘কলোনী-মাত্র’ ছিল। সেখানে তিনি সমতল ও পাহাড়ের সকল নৃতাত্ত্বিক ভাষাভিত্তিক জাতিকেই অন্তর্ভুক্ত করে কথাগুলো বলেছিলেন। তিনি বারবার বলেছেন, ‘অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক-জাতি হয়েছে। অনেক দেশে আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে- তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর।’ আর সেই অনুভূতির অভিন্ন ভিত্তি হলো বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ : ”বাঙালী জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালী, আমার ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’।” এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অভিন্ন অনুভূতির মধ্যে লারমাও পড়েন। এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শরিক বাংলার সবাই-বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে সমতল ও পার্বত্য এলাকার অধিবাসী সকলেই যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে একাত্তরে।
প্রকৃত পক্ষে, বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর মানে এই নয় যে পার্বত্যবাসীর অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়ানো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে মুজিব বলেছিলেন: ‘উপজাতীয় এলাকা যাতে অন্যান্য এলাকার সাথে পুরাপুরি সংযোজিত হতে পারে, তারা যাতে জীবনের সবক্ষেত্রে অপর নাগরিকদের মতোই সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, এই জন্য উপজাতীয় এলাকা উন্নয়নের ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূলীয় দ্বীপসমূহ এবং উপকূলবর্তী এলাকার বসবাসকারীরা যাতে জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেজন্যে তাদের সম্পদের সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিশেষ উদ্যোগ গৃহীত হওয়া প্রয়োজন।’ ১৯৭৩ সালে গৃহীত আওয়ামী লীগের ‘ঘোষণাপত্রে’ আলাদা করে বলা ছিল ‘পশ্চাৎপদ অঞ্চলসমূহ’-এর কথা: ‘আমাদের দেশের অবহেলিত পাহাড়ী অঞ্চলসমূহকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সমপর্যায়ে উন্নীত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হইবে। যাহাতে এইসব অঞ্চলের মানুষ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের মতই সর্বক্ষেত্রে সমভাবে সমুদয় সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করিতে পারে।’ এরকম উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। সন্দেহ নেই, লারমা বঙ্গবন্ধুর এসব প্রতিশ্রুত রূপকল্পে-যা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের আবশ্যকীয় অংশ-আস্থা রেখেছিলেন। এবং আস্থা রেখেছিলেন বলেই লারমা ও বঙ্গবন্ধু তাঁদের জীবদ্দশায় পরস্পরের হাত ছেড়ে দেননি। আগেই বলেছি, লারমা বাহাত্তরের সংবিধানে সই করেছিলেন এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাকশালেও যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও তার সহযোগীদের ওপরে নির্যাতন নেমে আসে। প্রতিবাদে তারাও গঠন করেন ‘শান্তি বাহিনী’। সামরিক শাসনামলে পার্বত্যবাসীর ওপরে যে অবিচার-নির্যাতন হয়েছিল সেকথা নিয়ে নতুন করে আর কিছু আজ যোগ করবার নেই।
১৩. ১৯৭২-৭৫: পুনর্গঠন ও দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমতাবাদী চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ক্রমাগতভাবে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যদি কিছু দূর গিয়ে দেখা যায় আর এগোনো যাচ্ছে না, পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে কোনো অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ে বা ব্যারিকেডের কারণে, তাহলে বেশির ভাগ মানুষই যা করেন হতোদ্যম হয়ে পড়েন। কিন্তু নিরাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া মুজিবের স্বভাবে ছিল না। সংকটের মুখে তিনি সবসময় নতুন পথ খুঁজতেন: এভাবে না হলে ওভাবে, সোজা পথে না হলে ঘুর পথে। ১৯৪০-এর দশকে একসময় মুজিব ‘স্বাধীন স্বার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলা’ রিপাবলিকের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে বাংলায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়। তখন সোহরাওয়ার্দী আন্দামানসহ দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে রাজবন্দিদের মুক্তি দেন, যার অধিকাংশই ছিলেন বামপন্থি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। বাংলার আসন্ন স্বাধীনতার প্রশ্নে এ পর্যায়ে আবুল হাশিম ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কমিউনিস্ট নেতা বঙ্কিম মুখার্জী ও সোমনাথ লাহিড়ী প্রমুখের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। দেশ ভাগ হলে পাকিস্তান ও ভারতের পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক সার্বভৌম বাংলার বিষয়ে তারা আলোচনা করেন। এই স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেটা মুজিব জানতেন।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৯৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
সংবিধান গ্রহণের শেষ কার্যদিবসে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্মরণীয়ভাবে বলেছিলেন (এই বক্তব্যের পরই বঙ্গবন্ধু তাঁর সমাপনী ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ান):
“মাননীয় স্পীকার, স্যার, আজকের এই শেষ দিনে আমি কিছু বক্তব্য রাখতে ইচ্ছা করে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারি। আজকে শেষ দিনে আমরা আমাদের মনের আকাঙ্ক্ষা, আমাদের মনের অভিব্যক্তি-প্রকাশের শেষ পর্যায়ে এসেছি। আজকের এই শেষ দিনে আমাদের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর যে মনের কথা, যে মনের অভিব্যক্তি, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কথা এই মহান গণপরিষদে এক পবিত্র দলিলে আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি- যে দলিলে থাকে মানুষের চলার পথের ইঙ্গিত। মানব-মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের বাস্তকব রূপ আজকে এই মহান্ গণপরিষদে আমরা দিতে যাচ্ছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, এই গণপরিষদের একজন নির্দলীয় সদস্য হিসাবে আমি যে আলোচনা করেছি এই সংবিধানের উপর, সেখানে আমার মনের যে অভিব্যক্তি, মনের যে আবেগ, মনের যে ধারণা, সেটাই আমি সরল মনে ব্যক্ত করেছি আমার বক্তব্যে- একজন সম্পূর্ণ সরল মনের মতো। সেখানে ছিল না কোন উদ্দেশ্যমূলক কথা, সেখানে ছিল দেশকে আমি যেভাবে ভালবেসেছি, যেভাবে আমার মনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি, যেভাবে আমি কোটি মানুষের একজন হয়ে দেখেছি, সেইভাবেই এই মহান্ গণপরিষদে বলেছি। মাননীয় স্পীকার, স্যার, আমি নির্দলীয় সদস্য হিসাবে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেছি এবং আমাকে মাননীয় সদস্য-সদস্যা ভাই-বোন, মাননীয় স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকার যে সময় দিয়েছিলেন কথা বলার, সেটা আমি মনে করি, এই মহান গণপরিষদে গণতান্ত্রিক অধিকারের একটা ঐতিহাসিক স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। মাননীয় স্পীকার সাহেব, আজ যে সংবিধান এই মহান্ গণপরিষদে গৃহীত হবার শেষ পর্যায়ে রয়েছে, সেই সংবিধানে বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র উত্তরণ হবে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশে। মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র হবে, দেশে অভাব থাকবে না, হাহাকার থাকবে না, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না, হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ- কিছুই থাকবে না। শুধু থাকবে মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি, মায়া, মমতা এবং তার দ্বারা এক নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। মানবতার একটা ইতিহাস থাকবে এবং তাতে লেখা থাকবে “সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই”। আমি আজ কামনা করি, তাই হোক। আসুন, শপথ করি, যেন আমাদের চেষ্টা সফল হয়, যেন শোষণহীন সমাজ বাস্তবে রূপায়িত হয়। আর যেন রাস্তায় রাস্তায় শ্নোগান না হয়, “আমাদের দাবী মানতে হবে”। আর যেন মিছিল না হয়, “আমাদের দাবী মানতে হবে”, “সংগ্রামে চলবে, সংগ্রাম চলবেই” বলে। সেই অবস্থা আর যেন না হয়। আমরা যেন আমাদের জন্মভূমি গড়ার কাজে ভাল করে মনোনিবেশ করতে পারি। আজ এই সংবিধান যাদের রক্তে এল, তাদের কথা যেন ভুলে না যাই। অতীতের ভুলের ইতিহাস, অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা, অতীতের মানব-সভ্যতা, মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার যে সংগ্রামে, আজ এই সংবিধানে তা সন্নিবেশ করে আমাদের ইতিহাস বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, যাতে আমাদের এই ইতিহাস বিশ্বের মধ্যে অনন্য হয়ে থাকতে পারে। আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাঁদেরকে, যাঁরা নিজেদের জীবন বলি দিয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন এবং এ দেশ থেকে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যে সব ভাই-বোন সেই সরকারের কঠোর নির্যাতন সহ্য করেছিল, সে সব ভাই-বোনকে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। স্বাধীনতার জন্য যে সব মা-বোন রক্ত দিল, যার জন্য আজ আমরা এই গণপরিষদে দাঁড়াতে পেরেছি, সেই মা-বোনদেরকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সেই সব বীর মুক্তি-পাগল লোকদের, যাঁরা আজ পঙ্গু হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যার জন্য তাঁরা অসীম দুঃখ-কষ্টে কালাতিপাত করেছেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ছাত্র-সমাজকে, শ্রদ্ধা নিবেদন করছি বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দকে, শ্রদ্ধা নিবেদন করছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নর-নারীকে। সর্বশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি জাতির শ্রদ্ধেয় পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর নেতৃত্বে আজ এই মহান্ গণপরিষদে কোটি কোটি মানুষের জন্য এই পবিত্র দলিল রচিত হয়েছে।”
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, এসব কথা যিনি সংবিধান গ্রহণের শেষ কার্যদিবসে বলবেন, তাকে কেন শেখ মুজিব ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলবেন। আর বললেই বা তিনি শুনবেন কেন, বা কেনই বা চূড়ান্ত সংবিধানে স্বাক্ষর করবেন? মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাকশালেও যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে এবং ‘দ্বিতীয় বিপ্লবকে’ সমর্থন করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে লেখা ছিল ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান’ করার লক্ষ্য। এতে করে পার্বত্যবাসী ও সমতলবাসী সকল উপজাতি-সম্প্রদায়কেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এক্ষেত্রে ১৪ক ধারা হিসেবে সংশোধনী যেটি এনেছিলেন তাতে সংযোজন করতে চেয়েছিলেন নিল্ফেম্নাক্ত অংশ:
‘সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ও অনগ্রসর জাতিসমূহের (ক) ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণ করা হইবে; (খ) শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ-অধিকার দেওয়া হইবে; এবং (গ) অগ্রসর জাতিসমূহের সহিত সমান পর্যায়ে উন্নীত হইবার পরিপূর্ণ সুযোগ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা বিধান করিবেন।’
কিন্তু এই সংশোধনী আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কেবল ‘মনস্তাত্ত্বিক কারণ’ ছাড়া। অন্যান্য ধারায় এসব অধিকারকে বাংলাদেশের সকল অধিবাসীর জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন, ১৯নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে অঞ্চলগত সমতা বিধানের কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে- ‘প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে (১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না,’ এবং (২) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’। এবং অবশ্যই মনে করতে হবে সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ উপধারা যেখানে স্পষ্ট করা বলা ছিল যে ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ অর্থাৎ লারমা যেটা চেয়েছিলেন সেটা অন্যভাবে অন্যান্য ধারার মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীর জন্য নিশ্চিত করা হয়েছিল। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠীর যাতে অংশগ্রহণ থাকে সেজন্য ২৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল:
‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই (ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আগে উল্লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন একটি দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন। পূর্বতন ১৯৫৬ বা ১৯৬২-এর সংবিধানে পার্বত্যবাসীর বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যে এনে সার্বিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এটি তিনি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন। পুরো উদ্ধৃতিটি প্রাসংগিক বিধায় তুলে ধরা হলো:
‘জনাব স্পীকার সাহেব, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মাননীয় সদস্য সেই এলাকা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন যে, বৃটিশ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সে এলাকার যে একটা ইতিহাস ছিল, সংবিধানে তা উল্লেখ করা হয়নি। আগে সে এলাকার ব্যাপারে যে বিশেষ বিধান ছিল, এ সংবিধানে তা নেই। আমি এ কথা স্বীকার করছি, কিন্তু সেই সঙ্গে আমি এ কথাও বলতে চাই যে, আগে সে এলাকার লোকদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছিল। এ সম্বন্ধে আমরা দেখতে পারি ভারত শাসন আইনের ৯২ ধারা। সে ইতিহাস আমরা সংবিধানে লিখিনি। ৯২ ধারায় এগুলোকে ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ বলা হত। তাতে বলা আছে:
“The executive authority of a Province extends to excluded and partially excluded areas therein, but, not withstanding anything in this Act, no Act of the Federal Legislature or of the Provincial Legislature, shall apply to an excluded area or a partially excluded area…”
আইনের কোন ‘প্রটেকশন’ তাঁদের ছিল না। কোন আইন তাঁদের সম্পর্কে করা যেত না। আরও আছে:
“Governor may make regulation for the peace and good government of any area in a Province which is for the time being an excluded area, or a partially excluded area,…”
তখন তাঁরা সংসদের আওতা থেকে সম্পূর্ণ বাইরে ছিলেন। তাঁরা আইনের আশ্রয়ের বাইরে ছিলেন। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানের ২২১ অনুচ্ছেদে এটা দেখতে পাই। তাঁদের আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করে সেখানে গভর্নরের শাসন চালু রাখার বিধান করা হয়েছিল। সংসদ তাঁদের ব্যাপারে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারতেন না। তাঁরা আদালতের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত থাকতেন। হাইকোর্টে মামলা করতে পারতেন না। ফাঁসির অর্ডার হলেও হাইকোর্টে যেতে পারতেন না। সচেতনভাবেই আমরা সেই ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দিতে চাই। কারণ, এই সব বিধানের সাহায্যে তাঁদের নানাভাবে শোষণ করা সম্ভব হয়েছিল। দুঃখজনক যে, তাঁরা শোষিত হয়েছেন, তাঁদের শোষণ করা হয়েছে। মাননীয় সদস্য সেই শোষণের কথা বলেছেন। বিশেষ বিধান থাকার ফলেই শোষণ করা সম্ভব হত। ঔপনিবেশিক শাসকরা অন্যায়ভাবে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করত, এক অংশের বিরুদ্ধে অন্য অংশকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করত। দেশের অন্যান্য নাগরিকের সমান অধিকার তাঁদের দেওয়া হয়নি। আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং তাঁদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রেখেছিল এবং আমাদের শাসন ও শোষণ করত। বিশেষ বিধান থাকার ফলেই আমাদের শোষণ করা সম্ভব হত। আজ বাংলাদেশের সব অঞ্চলের জনসাধারণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আমরা সবাই আজ এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের নাগরিক পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর বা পটুয়াখালী- এই সব এলাকার যেখানেই থাকুন না কেন, সবাই সমান মর্যাদা ভোগ করবেন। তার পরেও দেশের অনগ্রসর লোকদের জন্য বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। আমি আপনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাননীয় সদস্যের কাছে আবেদন করব, তিনি যেন অতীতের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের কথা চিরদিনের জন্য ভুলে যান। বাংলাদেশের সবাই যাতে স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারে, সেজন্য সকলে মিলে কাজ করার সময় এসেছে।’
তারপরও মানবেন্দ্র লারমার ওয়াকআউট ঠেকানো যায়নি। অনেকটা যেন অভিমান করেই তিনি সংসদ-কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরে আবার আসলেন বটে, কিন্তু দাগ, একটা দাগ, তার মনের মধ্যে থেকে গিয়েছিল।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৯৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আবুল ফজল একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ‘শেখ মুজিব :তাঁকে যেমন দেখেছি’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, কিন্তু মূল লেখাগুলো রচিত হয়েছে বেশ আগেই। লেখাগুলো স্মৃতিচারণমূলক- অনেকক্ষেত্রে ‘রোজনামচা’ থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দেওয়া। ১৯৭৬ সালের ২৬ আগস্ট একটি রোজনামচায় তিনি লিখেছেন:
‘নিঃসন্দেহে শেখ ছিলেন এ যুগের সর্বপ্রধান বাঙালী। যে সর্বপ্রধান বাঙালীকে আমরা বাঙালীরাই কি না নিজের হাতে হত্যা করলাম! আশ্চর্য, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হলো। বাঙালীকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতে কে জুগিয়েছিল সাহস? শেখ মুজিব নয় কি? বজ্রগর্ভ আর অমিত প্রেরণার উৎস ‘জয় বাংলা’ শ্নোগান কে তুলে দিয়েছিল বাঙালীর মুখে? শেখ মুজিব নয় কি? জিন্দাবাদে সে জোর, সে চেতনা, সে উদ্দীপনা কোথায়? জয় বাংলা প্রদীপ্ত শিখা, জিন্দাবাদ ধার করা এক মৃত বুলি। গ্রাম বাংলার শতকরা নব্বইজন যার অর্থই বুঝে না। এ যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালী মুসলমান শেখ মুজিব- এ কথা বল্লে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয় না। হিন্দু বাঙালীয়ানা আর মুসলমান বাঙালীয়ানায় কিছুটা পার্থক্য আছে। তাই মুসলমান কথাটা যোগ করলাম। তবে এ পার্থক্য সবসময় বিরোধমূলক নয়। শেখ মুজিবের বেলায় যেমন তা ছিল না। তাঁর সমগ্র মুসলমানিত্ব নিয়েই তিনি এক পরিপূর্ণ বাঙালী ছিলেন। এমন বাঙালী বিরল। এ বিরল বাঙালীটিকেই কি না হত্যা করা হয়েছে। আমরা নিজেরাই করেছি। এ যেন নিজের অঙ্গ নিজে ছেদন করা।’
এই অনুশোচনা ও পিতৃহত্যার গ্লানি জাতির বিবেককে প্রতি মুহূর্ত দংশন করছে এটা বারবার ওই পুস্তকে উচ্চারিত হয়েছে। এটা কাকতালীয় নয় যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানীর নাম ‘মুজিব নগর’ করা হয়েছিল- সেটা আর কারও নামে নয়, শেখ মুজিবের নামেই। অন্যত্র আবুল ফজল লিখেছেন: ‘এ স্বাধীনতার জন্য আমরা শেখ মুজিবের কাছে ঋণী। তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নাম যাদুমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে এবং অনুপস্থিতিতে যে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল তাঁকেই করা হয়েছিল সে সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করেছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে, সে সরকারের বাস্তব বা কাল্পনিক রাজধানীর নাম ‘মুজিব নগর’ হয়েছিল। অন্য নাম কারো মাথায় আসেনি।’ ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবরের রোজনামচায় তিনি আরও লিখেছেন:
‘সাম্প্রতিক ঘটনায় শেখ সাহেবের হত্যা সম্পর্কে আমি অনবরত বিবেকের একটা দংশন অনুভব করছি। এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছেন না, এ ভাবা যায় ন। আশ্চর্য, মননশীল লেখক-শিল্পীদের মধ্যেও তেমন একটা সাড়া দেখা যায়নি এ নিয়ে।… এত বড় একক ট্র্যাজিক ঘটনা তাঁরা আর কোথায় খুঁজে পাবেন লেখার জন্য?’
আবুল ফজল বারে বারে এটাই বলতে চেয়েছেন, বাঙালিদের জন্য একটি নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমি শেখ মুজিবই দিয়ে গেছেন, অথচ তাকেই আমরা কী অবহেলাই না করেছি তার মৃত্যুর পর- অনেক অনেক দিন পর্যন্ত! প্রশ্ন উঠতে পারে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গড়া ‘বাঙালিদের’ জন্য এক স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি তার মধ্যে কি ‘অন্য জাতি-উপজাতি’ও পড়েন? এ নিয়ে কিছুটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে গত তিন দশকে। সে বিষয়ে দ্রুত আলোকপাত করতে চাই।
এর আগে এ বিষয়ে ইংগিত দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে বঙ্গবন্ধুর ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলার মানুষ’ এই শব্দযুগলের মধ্যে বৃহত্তর পরিচিতির আভাস পাই। এই পরিচিতিকে (আইডেনটিটি) কেবল নিছক ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ (মেজোরিটারিয়ান) জনগোষ্ঠীর পরিচয় হিসেবে নির্দিষ্ট করা চলে না। এর মধ্যে প্রথাগত-অর্থে যারা বাঙালি তারাও আছেন, আবার যারা মাতৃভাষা হিসেবে বাঙালি নন, তারাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে ধরনের ‘মহাজাতি’ গঠনের কল্পনা করেছিলেন, শেখ মুজিবের কাছে ‘বাঙালি’ ছিল তেমনি এক মহাজাতিক প্রকল্প। যার মধ্যে বাঙালি হিন্দুরাও পড়েন, বাঙালি মুসলিমও পড়েন। কারও কারও কানে এটা কষ্টকল্পিত দাবি বলে মনে হতে পারে, সে জন্যে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নেওয়া এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেবের বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরছি। এই ভাষণের প্রেক্ষাপটটি বলি। এর একদিন আগেই নির্দলীয় সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার ‘ডিসেন্ট’ ব্যক্ত করেছেন। তিনি গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন:
‘এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এই খসড়া সংবিধানে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলের কোন কথা নাই।… পার্বত্য চট্টগ্রাম হল বিভিন্ন জাতি-সত্তার ইতিহাস। কেমন করে সেই ইতিহাস আমাদের সংবিধানের পাতায় স্থান পেল না, তা আমি ভাবতে পারি না। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে-পড়া, নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।’ এর কিছু পরে লারমা যোগ করলেন- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা ইতিহাস আছে এবং সেই ইতিহাসকে কেন এই সংবিধানে সংযোজিত করা হল না?… এই সংবিধানে মানুষের মনের কথা লেখা হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মেথর, কামার, কুমার, মাঝি-মাল্লার জন্য কোন অধিকার রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের অধিকারের কথাও সংবিধানে লেখা হয়নি।’ এর পর সভা পরদিন সকাল পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেদিনের বক্তব্য পুনরুক্তিমূলক ও আবেগ-আক্রান্ত ছিল। কিন্তু আবেগের আতিশয্যের কারণেই এই কথাগুলোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো হেতু নেই। রাজনীতিতে ‘পার্সেপশন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এটা ভেবেই তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান এর পরের দিন একটি পরিশীলিত প্রত্যুত্তর দিলেন লারমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে, ‘সংবিধানে সবকিছু লেখা থাকে না এবং সব কথা লিখেই শুধু মানুষের কল্যাণ সাধন করা যায় না। সংবিধানের পরে আসে আইন, আসে আরও অনেক কর্তব্য।’ দ্বিতীয়ত, তিনি লারমাকে ‘আঞ্চলিকতার’ কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। লারমাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন যে, ‘আমার বন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সদস্য গণপরিষদে তাঁর অঞ্চলের কথা বলেছেন। তাতে আপত্তি নাই। কথা বলা খারাপ নয়। তবে আঞ্চলিকতা পরিহার করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যে আঞ্চলিকতা মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।’
তৃতীয়ত, কামারুজ্জামান বললেন যে, জাতীয় পরিকল্পনার চৌহদ্দি গোটা বাংলাদেশ জুড়েই। সেই পরিকল্পনা পার্বত্যবাসীদের বাদ দিয়ে নয়। তাদের উন্নতির রাস্তা ঐ জাতীয় পরিকল্পনার নির্দেশিত পথেই নিহিত। তিনি বললেন, ‘কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, এই সমাজের কোনো অংশ অবহেলিত ও উপেক্ষিত হলে ক্ষমতাসীন সরকার যদি সেই অবহেলিত, উপেক্ষিত মানুষের জন্য কোন কিছু না করে, তাহলে তা হবে অন্যায়। আমরা কল্পনা করেছি সমস্ত অঞ্চলকে একটা অঞ্চল হিসাবে। তাই আগামী দিনে আমাদের [পার্বত্য] বন্ধুদের পরিস্কার নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, এই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন আঞ্চলিকতা থাকবে না। এই বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলকে একটি অঞ্চল হিসাবে পরিকল্পনা করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি সামাজিক জীব হিসেবে কল্পনা করে উন্নত করা হবে।’
চতুর্থত, লারমাকে আশ্বস্ত করে তিনি বললেন যে, ‘ইতিহাস আমরা জানি, ইতিহাস আমরা অস্বীকার করি না।’ এদিকে ‘আমাদের সুতীক্ষষ্ট দৃষ্টি আছে’ এবং এটাও ঠিক যে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন অঞ্চলের প্রতি যদি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়, তাহলে অন্যায় করা হবে’। কেননা, তাতে করে ‘সেই ব্যাধি শুধু সেই অঞ্চলেই থাকবে না- সেই ব্যাধি বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে, সারা বাংলাদেশেই ছাড়িয়ে পড়বে।’
সবশেষ, তিনি মহাজাতির মধ্যে বিভিন্ন জাতির সহাবস্থানের ইনোভেটিভ যুক্তিটি পেশ করলেন। এটি হচ্ছে ‘সেলিব্রেটিং ডাইভার্সিটির’ যুক্তি :’আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাইরাও অধিকার পাবেন। কোন অংশ হতেই তাঁরা বঞ্চিত হবেন না। বাঙালী হিসাবে আমরা বেঁচে থাকব। একটা জাতির অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে বৈচিত্র্য অনেক বেশী, মাধুর্য অনেক বেশী। এই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে শুধু এক জাতি, এক কৃষ্টি, এক সংস্কৃতি- তা নয়। বহু অঞ্চলের বহু মানুষ আছে, তাদের নিজস্ব অনেক কিছু আছে। শত বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকব। কিন্তু সর্বোপরি থাকবে আমাদের বাঙালী জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদ অক্ষুণ্ণ রেখে সেই জাতির অভ্যন্তরের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমরা সম-দৃষ্টি রেখে আমাদের জাতীয়তাবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করব।’
এর থেকে কি কোনোভাবে এই অনুমান করা চলে যে বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা পার্বত্যবাসীকে সমতলবাসী হয়ে যেতে বলেছেন, বা পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছেন? অথচ এরকমই অবাস্তব অভিযোগ তোলা হয়েছে পরবর্তীকালে কোনো কোনো মহল থেকে। এমনকি শেখ মুজিবকেও এ পরিপ্রেক্ষিতে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হননি। সেটা করা যেতেই পারে যদি তার পেছনে জোরালো যুক্তি থাকে। দুঃখের বিষয়, অতীতে এই বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দেওয়া হয়নি। যেমন, পার্বত্য ইস্যুতে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত লেখিকা তার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পন্ন পি,এইচ,ডি অভিসন্দর্ভে এই মর্মে অভিযোগ তুলেছেন যে শেখ মুজিব পাহাড়ি জনগণকে তাদের পৃথক পরিচিতি/আত্মসত্তা (আইডেনটিটি) ‘ভুলে গিয়ে বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছেন। মূল ইংরেজিতে বিবরণটি এই রকম: ‘He therefore asked the Hill people to forget about their separate identity and to become Bengalis’ এর সপক্ষে লেখিকা আমেনা মোহসীন সমর্থন হিসেবে দেখিয়েছেন একটি মাত্র তথ্যসূত্রের উৎস। সেটি হচ্ছে, অনন্ত বিহারী খীসার সঙ্গে সাক্ষাৎকার (যেটি ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে নেওয়া)। লেখিকা আমাদের জানিয়েছেন যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা। স্বাধীনতার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য বক্তৃতা-বিবৃতি বিচার করেও অনন্ত বিহারী খীসার বক্তব্যের সমর্থনে কোনো লাইন আমি অদ্যাবধি খুঁজে পাইনি। এমনকি এই মর্মে কোনো ইংগিতও পাইনি। এটি যদি শেখ মুজিবের চিন্তার একটি ‘স্তম্ভ’ হতো তাহলে কোথাও না কোথাও এর চিহ্ন (ঃৎধপব) থাকত। বরং এর বিপরীতেই তথ্য-প্রমাণের পাল্লা ভারী। শেখ মুজিব পূর্বাপর দেশের অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী ও নৃগোষ্ঠী নিয়ে তার উন্নয়ন-বাসনা ব্যক্ত করেছেন, এবং আন্তরিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ।
প্রথমত, যে সভার বরাত দিয়ে কথিত ‘বাঙালি হয়ে যেতে’ বলা হয়েছে তা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার এক মাস পরে। এর পরে ১১ এপ্রিল ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। কয়েক মাস কাজের পরে কমিটি তৎকালীন বাংলাদেশ গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধানটি উত্থাপন করে এবং অনেক আলাপ-আলোচনার পর সেটি ৪ নভেম্বর সংশোধিত হয়ে গৃহীত হয়। এখন দেখা যাক যে খসড়া সংবিধানে, গণপরিষদ বিতর্কে বা চূড়ান্তভাবে গৃহীত সংবিধানের পাঠে কোথাও পাহাড়ি জনগণকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলা হয়েছিল কিনা বা সেরকম ইংগিত দেওয়া হয়েছিল কিনা। বা কেউ সেরকম ইংগিত দিয়ে থাকলেও তা গণপরিষদের অনুমোদন পেয়েছিল কিনা। সেরকম কিছু সংবিধানে থাকলে বা গণপরিষদ বিতর্কের প্রধান সুর হয়ে দাঁড়ালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কথায় ও কাজে তা প্রতিফলিত হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু তা কি আমরা দেখতে পাই? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাহাত্তর সালের সংবিধানের গৃহীত চূড়ান্ত পাঠে সই করেছিলেন। শুধু সই করা নয়, এই সংবিধানের বিভিন্ন অধ্যায়ের সঙ্গে তিনি সহমতও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে গভীর বোঝাবুঝির কারণে তিনি আস্থা রাখতে পেরেছিলেন যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে সংবিধান তৈরি হয়েছে তারই পথরেখা ধরে লারমার স্বপ্নেরও বাস্তবায়ন ঘটবে তথা পাহাড়ি জনগণের জীবনের আমূল উন্নয়নও ঘটবে।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব :: ৯৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এ জন্যই ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়েছে তার প্রিয় গান, যেখানে রয়েছে প্রকৃতি আর প্রকৃতি : আকাশ, বাতাস, বাঁশি, বটমূল, খেলাধুলা, মায়ের কোল প্রভৃতি শব্দাবলি। অন্যান্য দেশের জাতীয় সংগীতে যেমন বাজে রণ-দুন্দুভি, জাতীয় শৌর্য-বীর্যের কথা, এখানে তেমনটা নয়। আমাদের জাতীয় সংগীত যে জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে আছে, তাতে রয়েছে স্বদেশ-জননী তথা ভূ-প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি। বঙ্গবন্ধু বলছেন যে, এই অনুভূতিটাই জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান প্রেরণা।
ইকোলজিক্যাল এই অনুভূতির পাশাপাশি রয়েছে পূর্ববাংলার জনগণের একত্র-সংগ্রামের ইতিহাস, যার কথা আমি পূর্বেই বলেছি। এই সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির অংশগ্রহণের স্মৃতি। তার একটি মর্মন্তুদ বিবরণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবরের বক্তৃতায় :
‘জনাব স্পিকার সাহেব, সত্য আজ বলতে গিয়ে দুইটা জিনিস আমার সামনে আসে। একদিকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন, আর একদিকে আমার মনে আনন্দের বান বয়ে যায়। দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন এইজন্য বলি যে, আপনারা জানেন- জনাব স্পিকার সাহেব, আপনি আমার সঙ্গে বিশ বছর থেকে রাজনীতি করছেন, অন্তত বিশ বছরের ইতিহাস আপনি জানেন যে, দীর্ঘ বিশ বছর পর্যন্ত এদেশের জনসাধারণ শাসনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে, অনেক রক্তের খেলা হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাংলার ঘরে-ঘরে আজ মাতৃহারা, পুত্রহারার আর্তনাদ। লক্ষ লক্ষ বোন আজ বিধবা। হাজার হাজার গৃহ আজ ধূলিসাৎ। কত রক্ত বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে, স্পিকার সাহেব, সে কথা চিন্তা করলে বক্তৃতা করতে আমি পারি না।’
আমি জানি না, আমাদের memory short কিনা! বাংলার মানুষ ভুলে যায় কিনা! কিন্তু এমন ইতিহাস আমরা পেয়েছি। একটা ঘটনা মনে আছে। এক ছেলেু সে আমার কর্মী। মিলিটারি তাকে ধরে বলল : ‘জয় বাংলা’ বলতে পারবি না। সে বলল : “জয় বাংলা!” তখন তার একটা হাত কেটে দেওয়া হলো। বলল : আর ‘জয় বাংলা’ বলবি? সে বলল: “জয় বাংলা!” তখন তার বাম হাতটি কেটে দেওয়া হলো। তার দুইখানা হাত কেটে দেওয়া হলেও সে বলল : “জয় বাংলা!” তার একখানা কান কেটে দিল। বলল : আর বলবি ‘জয় বাংলা’? সে বলল : “জয় বাংলা!” তার আর একখানা কান কেটে দিল। বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? ছেলেটি বলল : “জয় বাংলা!” তারপর তার একখানা পা কেটে দিল। বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? ছেলেটি বলল : “জয় বাংলা!” তার বাম পা কেটে ফেলে দিল। তখন তার জ্ঞান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাকে বলল : বলবি ‘জয় বাংলা’? সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল : “জয় বাংলা! জয় বাংলা!”
‘আমার সোনার বাংলা’ গানে প্রতিফলিত নিসর্গ-স্বদেশ-জননী নিয়ে সংবেদনবোধ বা ওপরে বর্ণিত অংশে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কাহিনি উভয়েই ‘দেশপ্রেম’-এর অনুভূতির দৃষ্টান্ত। সূক্ষ্ণভাবে দেখলে এ কথাও বলতে হয় যে, ‘দেশপ্রেম’ আর ‘জাতীয়তাবাদ’ এক নয়, কাছাকাছিও নয়। নেশন, ন্যাশনালিটি, নেশন-স্টেট ও ন্যাশনালিজমু এই চারটি ধ্যান-ধারণা একই পরিবারভুক্ত। উনিশ শতকের ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসেু নেশন-স্টেট গড়ার পর্বেু আমরা এসব ধারণার উত্থান দেখতে পাই। যখন নেশন-স্টেট ধারণার জন্মই হয়নি, তখনও দেশের মানুষের মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ ছিল। দেশচিন্তা করার জন্য কাউকে কোনো-না-কোনো জাতীয়তাবাদের আশ্রিত হতে হবে- ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। রবীন্দ্রনাথ কখনোই ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাননি। যখনই এর মুখোমুখি হয়েছেন, তখনই তিনি ন্যাশনালিজম বা নেশন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি মনে করতেন এই উপমহাদেশ কখনোই ‘নেশন’ ছিল নাুন্যাশনালিজমের পথে হাঁটেনি। প্রাচীন বা মধ্যযুগে অনেকবারই এই ভূভাগ বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং সেটা প্রতিহত করতে দেশের মানুষেরা সেকালের রাজাদের পেছনে সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেটা কোনো ন্যাশনালিজমের কারণে নয়ু নিখাদ দেশপ্রেমের কারণে। প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য ‘বাইরের শক্তি’ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশপ্রেমিকদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু দেশপ্রেম আরও বড় জাগতিক বোধ যাকে শুধু প্রতিরোধ বা যুদ্ধের ভাষায় সীমাবদ্ধ করা চলে না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় যেমন ‘গুরুমশাই, দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে’, যেখানে নৈশ পাঠশালায় মাস্টারমশাই দেশের মানচিত্র ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাচ্ছেন। দেশের মানচিত্র হচ্ছে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ, আর মানচিত্রের ভেতরের অদৃশ্য মানুষেরা হচ্ছে দেশপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ যেমন নিত্যদিনের এবং চিরকালের পরিবেশ-প্রকৃতি, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলার’ সনেটগুচ্ছ, তেমনি বাংলার নিসর্গ, নদী ও ইতিহাস। কিন্তু কোনো চিহ্ন নেই তাতে জাতীয়তাবাদের, অন্তত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ-এর অর্থে। ‘রূপসী বাংলা’ কোনো নেশন-স্টেট গড়ে তুলতে চায়নিু তবে এটা পড়তে থাকলে আমরা আবহমান বাংলা ও তার নিসর্গে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। এবং এ কারণেই কবি বলতে পারেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর মুখ খুঁজিতে চাই না আর।’ এটা দেশপ্রেমু কোনো জাতীয়তাবাদী স্টম্ফুরণ নয়। তারপরও মুজিবকে বাঙালি ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়েছে। কেননা তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে বিচরণ করছেন এবং অন্য কোনো শব্দবন্ধ তার ও তার পরিপার্শ্বের রাজনীতিকদের জানা নেই বলে। কিন্তু শব্দটি ব্যবহার করলেও তার অভিপ্রায় ভিন্ন। সে জন্যই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন জাতীয়তাবাদ মানে ‘আমার বাংলা’, ‘বাংলার মাটি’, বাংলার মানুষ’। এর বেশি কিছু তিনি দাবি করেননি। তার কাছে বাংলার মানুষই সব; এমনকি ‘বাঙালি’ এই আত্মপরিচয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘বাংলা’ শব্দটি, এবং এই বাংলায় বসবাসরত মানুষেরা। সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ এই আবহমান বাংলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট টাইম-লাইন বেঁধে দিয়েছেু বলেছে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার কথা ও তার মৌলিক চারটি আদর্শের কথা। কিন্তু জাতীয়তাবাদ এসেছে ‘জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম’-এর অধীনস্থ ধারণা হিসেবেইু কোনো আলাদা রাজনৈতিক ‘আইডিওলজি’ হিসেবে নয়। ‘National liberation struggle’ শব্দবন্ধটি জাতীয়তাবাদের আগে স্বীকৃত হয়েছে সংবিধানের Preamble-র প্রথম স্তবকেই; জাতীয়তাবাদ এসেছে কেবল এর দ্বিতীয় স্তবকে। অন্য তিনটি আদর্শু সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ এসেছে, এবং জাতীয়তাবাদের চৌহদ্দিও বেঁধে দেওয়া হয়েছে ওই তিনটি আদর্শের দ্বারা। অর্থাৎ ইচ্ছা করলেই উগ্র-জাতীয়তাবাদ বা কেবল বুলি-কপচানো বাঙালি/বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হওয়ার উপায় আর থাকছে না। কেননা, এদেশের জাতীয়তাবাদের যে-নামকরণই হোক না কেন, তাকে শেষ পর্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে অন্য তিনটি আদর্শের সাথে। স্পষ্টতই উনিশ শতকের ইউরোপীয় নেশন-স্টেট ধারণা থেকে এই জাতীয়তাবাদের পরিসর মৌলিকভাবে ভিন্নতর। ইউরোপে যখন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন সর্বজনীন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা এসব ধ্যান-ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এসব ধারণা ইউরোপে এসেছে আরও অনেক পরে। কিন্তু বাংলাদেশে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নেই সর্বাধুনিক আদর্শসমূহ স্বীকৃত হয়েছিল এবং সেসব আদর্শ উঠে এসেছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নানা পর্যায়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক দর্শন-গ্রন্থের পাতা থেকে সেসব কপি করা হয়নি- এটাই এখানে বলার কথা।
‘ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজম’ অর্থাৎ বাংলার ভূ-প্রকৃতির নৈসর্গিক অনুভূতিসঞ্জাত জাতীয়তাবাদ বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। বাঙলা-বাঙালি এই শব্দযুগলকে ঘিরে ‘অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ’ বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ ধারণার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু এর বাইরেও জাতীয়তাবাদ ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। সেটি হচ্ছে ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু এর সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে আমি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তুলে দিতে চাই। ইলিয়াস তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন :
‘জাতীয়তাবাদ আপনার মতবাদের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আপনি তো জানেন জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়? তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের প্রতি আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?’
বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন : ‘আপনি ঠিক বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউর্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরায়েলের ইহুদিবাদের মতো অতি জঘন্যরূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থি ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থি ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতো উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তার বিকাশ ধারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্রবাদ ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূলশক্তি। তারা গণতন্ত্রের শত্রু, সমাজতন্ত্রেরও শত্রু। তাদের জাতীয়তাবাদ শোষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শোষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হবার কোনো ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।’
ইলিয়াসের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল : ‘বিশ্ব সমাজকে একটি সমাজ এবং বিশ্ব মানবকে যদি একটি গোষ্ঠী ধরে নিই, তবে কি জাতীয়তাবাদের চেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ উন্নতির পর্যায়ে নয়?’
বঙ্গবন্ধু এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দিলেন : ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ এদেশের মাটিতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। তাকে নির্মূল করে তবেই এদেশের শ্রেণি চেতনার বিকাশ সাধন সম্ভবপর। আর একমাত্র শ্রেণি চেতনাই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্বশর্ত। এ দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, শ্রেণি চেতনা বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রধান অন্তরায়। আর সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার রণকৌশল হিসেবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকরী হলে, আমার বিশ্বাস, এ দেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে।’
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুজিব জাতীয়তাবাদকে অবিমিশ্র মঙ্গল হিসেবে দেখছেন না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরাধীন জাতি একসময় জাতীয়তাবাদের আশ্রয় নেয়। সেই অধস্তন জনগোষ্ঠীর লড়াকু জাতীয়তাবাদকেই ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’ বলছেন তিনি। কিন্তু বিকাশের ধারা সেখানেই থেমে থাকছে না। যখন শ্রেণিচেতনার বিকাশ হবে, তখন শোষিতের জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের রূপ নেবে। কিন্তু শ্রেণিচেতনার বিকাশ অতটা সহজসাধ্য নয় যখন কিনা ‘আইডেনটিটি পলিটিক্স’ প্রাধান্যে চলে আসে। আইডেনটিটি তথা জাত-পাত, রেস, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা যখন আবেগের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়, তখন শ্রেণিচেতনা পিছু হটতে থাকে রাজনীতির মাঠ থেকে। সে অবস্থায় ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার’ একটি রণকৌশল হতে পারে শোষিতের জাতীয়তাবাদ।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৯৫
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এজন্যেই সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ অংশে বাংলাদেশের যে-জনগণের উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ধর্ম-নির্বিশেষে আপামর মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলকেই অংগীকৃত করা হয়েছে। তাদের পরিচয় তারা সবাই বাঙালি জাতির অংশ, যারা এক নতুন পৃথিবীর রচনা করতে চলেছে, যারা জন্ম দিয়েছে এক নতুন বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের। এই জাতি-রাষ্ট্রের একটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে- ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’। ১৯০৫ সালের ‘বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ বা ১৯৪৭ সালের জিন্নাহ্র ‘টু নেশন’ভিত্তিক ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’- এই দুই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনোটারই লক্ষ্য ছিল না পূর্ববঙ্গের জনপদের সমগ্র বাঙালিকে এক পতাকা তলে একত্র করা। অথবা এর লক্ষ্য ছিল না গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা। এটি যুক্ত হয়েছে পরে- পাকিস্তান সৃষ্টির পরে প্রতিবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে- নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি হিন্দু একত্র হয়েছে। এবং এমনভাবে একত্র হয়েছে যেটি বাঙালির বিগত ‘হাজার বছরের’ জীবনযাত্রায় দেখা যায়নি। ধর্ম-জাতি-ভাষা এসব নিয়ে বিভেদ-বোধ জিইয়ে রেখে সফল জাতি-নির্মাণ করা যায় না। এসব বিভেদ-বোধ রেখে সমাজতন্ত্রের দিকে তথা সমতামুখীন সমাজের দিকেও অগ্রসর হওয়া যায় না। এখানেই সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাসংগিকতা।
এক হিসেবে ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ শব্দ দুটো সাংকেতিক শব্দ :’অসাম্প্রদায়িক’ সমাজ গড়ার কোড ওয়ার্ড। সাম্প্রদায়িকতার দিকে যখন সামাজিক দাঁড়িপাল্লার এক প্রান্ত ঝুঁকে পড়ে, তাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আনার জন্য ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ এই দুটি শব্দই যথেষ্ট। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু নানা বক্তৃতায় বাংলা, বাঙালি, বাংলার নদী, বাংলার মানুষ, বাংলার গ্রাম, বাংলার ভূপ্রকৃতি এসব অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার পেছনে জাতি-নির্মাণের চিন্তা তার মধ্যে কাজ করেছিল, কিন্তু তারও চেয়ে বেশি কাজ করেছিল অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা বিকাশের রাজনৈতিক তাগিদ। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বক্তৃতা শেষে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (ডাকসুর তৎকালীন ভিপি) যখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও শোষণহীন সমাজের পক্ষে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু তার কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটু জয় বাংলা স্লোগানটাও দিও সেলিম, অসাম্প্রদায়িকতার জন্য এটা দরকার।’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের বিরোধী ছিলেন না মুজিব, কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা তিনি বুঝতেন। তাই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত থাক’ এসব ‘বামপন্থি’ স্লোগানের পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটাও দিতে বলেছিলেন। কেননা এতে করে শ্রেণিচেতনার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনারও বিকাশ ঘটবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু শোষিত জাতির জাতীয়তাবাদ ছিল না তার জন্য, এটা ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি।
বাংলা ও বাঙালি নিয়ে শেখ মুজিব গভীরভাবে ভেবেছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম চালাতে গিয়ে। এই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিস্কার করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথও নতুনভাবে প্রতিভাত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের কাছে। ১৯৫০ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ অবধি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গান নানাভাবে ব্যবহূত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে। এই গানগুলো প্রথমে যে-প্রেক্ষিতেই রচিত হোক না কেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকের নতুনতর প্রেক্ষিতে তা অন্য অর্থ ও মাত্রা পেয়েছে এটিও লক্ষ্য করার মতো। এখানে ‘প্রেক্ষিতের’ তাৎপর্য ‘পাঠকে’ পুনর্নির্মিত করেছে: context এসে : text-র অর্থ ও ব্যবহার দুইই বদলে দিচ্ছে। একটি উদাহরণ দেব এখানে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র মঞ্চ থেকে ‘গণতন্ত্র বাঁচাও আন্দোলন’ করা হয়েছিল, যার থিম সং ছিলু’উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’। রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে পটভূমিতে রেখে বোঝানো হচ্ছিল এই বুঝি মোদি আসছেন রথে চড়ে! এর থেকে কেউ বলতে পারেন যে গানটির মধ্যে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদের প্রতি অনুরক্তি ছিল কবির, নইলে বিজেপির মঞ্চ থেকে তা ব্যবহার হলো কী করে? এরকম অদ্ভুত ও অযৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় গানটি অন্য প্রেক্ষিতেও আগে গাওয়া হয়েছে। সন্জীদা খাতুন লিখেছেন :”একাত্তরের জানুয়ারি থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত চলছিল। মুজিব-ইয়াহিয়া সংলাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক আর দ্রোহের গান চলছে। শান্ত-স্বভাবের ছাত্রী সেলিনা মালেকও গাইছে, ‘ওরে আগুন আমার ভাই’; ইফ্ফাত গাইছে, ‘যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না’; ইকবাল গাইছে, ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে’। সাবিনা-শাহনাজরাও দেশপ্রেমের গান গাইছে। আজাদ রহমান দৃপ্ত সুরের সম্মেলক গান করাচ্ছেন। রেডিওতে চলছে সমর দাসদের রক্ত গরম করা গান। রেডিওর ওই সব টেপ নিয়েই তাহের সুলতান-আশফাকুর রহমানরা সীমান্ত পার হয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারে সেই সব গান চালান।” ইকবাল আহমেদ যখন ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ওই যে তিনি ওই যে বাহির পথে’ বলে গান করছেন, তখন দর্শক-শ্রোতারা সত্যি সত্যি যেন দেখতে পাচ্ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলা এক মহানায়কের মহাযাত্রা। যেন মহাভারতের রথের চাকা নয়, এই বাংলাদেশেই রচিত হতে যাচ্ছে অন্য এক আসন্ন যুদ্ধের মহাকাব্য।
Context ভেদে কী করে : text-র অর্থ বদলে যায় সেটির আরেকটি নমুনা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’। ষাটের দশকে ও ১৯৭১ সালে গানটি অনেক বারই গাওয়া হয়েছে। কেউ তখন প্রশ্ন তোলেনি যে এসব গান ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে রচিত। বাংলা যাতে বিভক্ত না হয় তার জন্যেই এই গানগুলো আদিতে রচিত হয়েছিল। সেই যুক্তিতে এই গানগুলোকে পূর্ব বাংলার মুসলিম শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সমর্থন দেওয়ার কথা নয়। কেননা তারা তো তখন বঙ্গভঙ্গ করার পক্ষে ছিলেন। অথচ কী অনায়াসে ১৯০৫ সালের সেসব গানগুলোকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৯৫০-১৯৬০ দশকের আন্দোলন সংগ্রামে। এসব গানের ব্যবহারের প্রতিবাদ করে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরও তখন শোনা যায়নি প্রগতিবাদী জাতীয়তাবাদী শিবিরে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সবাই এই গানগুলো গেয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথকে আমরা কীভাবে সেদিন দেখেছি, তার গানকে ব্যাখ্যা করেছি বা যাকে বলে নিজেদের করে নিয়েছি (appropriate করেছি)-সেটি ছিল আমাদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, দ্বিজেন্দ্রলালও গাওয়া হয়েছে, নজরুল তো ছিলেনই পূর্বাপর। যেমন, ১৯৬৯ সালে ছায়ানট পাঁচ দিন ধরে ‘গীতোৎসব’ করেছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। এতে শেষ গান ছিল যথাক্রমে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা,’ ‘আমার সোনার বাংলা’, আর ‘দুর্গমগিরি-কান্তার-মরু’। শ্রোতাদর্শক সুদ্ধ সবাই দাঁড়িয়ে সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছিল বোধকরি সেই প্রথম।
এই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহ ও প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছিল। এমনকি যে-ভার্শানটি এখন জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হয় সেটিও অনুমোদিত হয়েছিল তাঁরই সিদ্ধান্তে! সন্জীদা খাতুনের বর্ণনায় সেই ইতিহাস শুনব আমরা:
”১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ একগুচ্ছ বাউল সুরের দেশাত্মবোধক গান লেখেন। এখন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনার প্রসঙ্গ। গানটির উৎস এবং সাংগীতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় না গিয়ে, সংশ্নিষ্ট কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করব। ১৯৫৭ সালের প্রথমার্ধে ঢাকায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাসুদ্ধ প্রাদেশিক নেতাদের এক বৈঠক হয়েছিল। সংশ্নিষ্ট সবার জন্য কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সে সভায় আমার গান গাওয়ার কথা ছিল। সেই সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে অনুরোধ পাঠান। এর তাৎপর্য তখন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের কাছে ‘সোনার বাংলা’ বিষয়ে বাঙালির আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এ দেশের নেতা। এর কিছুদিন আগে ২৩ মার্চ পূর্ববঙ্গের নাম পূর্ব পাকিস্তান করে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছিল। আঞ্চলিক স্বাধীনতার জন্য উত্তাল আন্দোলনের সময়ে বঙ্গবন্ধু সব সময় জাহিদুর রহিমকে এই গান গাওয়ার জন্য খবর পাঠাতেন। রেসকোর্সের ময়দানে তাঁর সভায় জাহিদ যে কতবার ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছে! এ গানের আবেগ বাঙালিকে আমূল নাড়া দিয়েছে। পাকিস্তানি বিরূপ প্রচারণা রবীন্দ্রসংগীত আর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছিল। জনপ্রিয় নেতার বাঙালি স্বার্থ সংরক্ষণমূলক বক্তৃতার সঙ্গে এই বাংলাপ্রীতির গান সব মানুষকে অনেকভাবে আকর্ষণ করল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাই মাঠের রাখালও স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে উঠেছে। দেশের সর্বজনের অন্তর থেকে উৎসারিত এই গান তাই হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা বাঙালির যাবতীয় আন্দোলনের শিল্পীরা ওই গান গেয়েছেন বারবার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর আর স্বরলিপি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ক্যাবিনেট ডিভিশনের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রায় দেন, যে সুর গেয়ে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, তা-ই আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর। ঘটনা এই যে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ড থেকে যে সুর শুনে শিল্পীরা গানটি তুলেছিলেন, সে সুর থেকে নিজেরাই খানিকটা সরে যান।
বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমাদের ভুলের অপরাধকে মুছে দিয়েছিল। আজও সেই সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে চলেছি আমরা।”
বাংলা ভাষা, বাঙালির সাধারণ সুখ-দুঃখের অনুভূতি, বাংলার গান, বাংলার প্রকৃতি-এই নিয়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদ। সেই জাতীয়তাবাদের মধ্যে একদিকে আছে স্বদেশবোধ-যাকে আমরা দেশপ্রেম বলি, অন্যদিকে আছে বাংলার নদী-মাঠ ভূপ্রকৃতি-যাকে আমরা ইকোলজি বা পরিবেশ-প্রকৃতি বলি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে এক-অর্থে ইকোলজিক্যাল ন্যাশনালিজম, পরিবেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। বাংলার পরিবেশ সম্পর্কে বিশেষ নৈসর্গিক অনুভূতি আছে বলেই আমরা বিশিষ্ট জাতি। এর বাইরে গিয়ে তত্ত্ব-রচনা করতে চাননি তিনি। বলেছিলেনও সেকথা :’জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি, মনীষী, অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আমার নতুন সংজ্ঞা না-ই বা দিলাম।’ কিন্তু সংজ্ঞা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতি-সম্পর্কে আসলে একটি নতুন বোধের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন-সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না।’ কিসের সেই অনুভূতি? একটি হচ্ছে বাংলার নদী-নালা মাঠ-ঘাট বিল-হাওর বাংলার গ্রাম এসব নিয়ে অভিন্ন অনুভূতি।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৯৪
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
১২. বাঙালি জাতীয়তাবাদ :কয়েকটি অবহেলিত প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের জনগণের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা আধুনিক যুগের, নেশন অর্থে ‘জাতি’- এই ধারণাটিও আধুনিক কালের। বাংলায় জাতির তিনটি অর্থ :একটি হচ্ছে বর্ণ, অন্যটি Race এবং আরেকটি হচ্ছে Nation। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “স্বীকার করিতে হইবে, বাংলায় ‘নেশন’ কথার প্রতিশব্দ নাই। চলিত ভাষায় সাধারণত জাতি বলিতে বর্ণ বুঝায়, এবং জাতি বলিতে ইংরাজিতে যাহাকে race বলে, তাহাও বুঝাইয়া থাকে। আমরা ‘জাতি’ শব্দ ইংরাজি ‘রেস’ শব্দের প্রতিশব্দের ব্যবহার করিব এবং নেশনকে নেশনই বলিব।” জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার আগেও জাতি জেগে উঠতে পারে। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক সময়ে ‘জাতি’ জেগে ওঠার চেষ্টা করে। পাকিস্তান আমলে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ক্রমে দানা বেঁধে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাজ করে গেছে পাকিস্তানি ‘রাষ্ট্র’। এটাকে বলা যায়ু ‘স্টেট অ্যাগেইনস্ট নেশন’ (শব্দবন্ধটি ঐতিহাসিক আহমেদ কামালের)। যখন কোনো জাতি ভিনদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে ওঠে, তখন সে নিজেই জন্ম দেয় এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের (নেশন-স্টেটের)। বাঙালি জাতি যেমন পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র-জাতি হচ্ছে বাঙালি জাতি, বাঙালি জাতির গড়ে ওঠার প্রধান সময় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বে। অর্থাৎ রাষ্ট্র-জাতি হিসেবে বাঙালি নেশন আধুনিকতম নেশন। এই কথাটায় কারও কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেবেু তাহলে কি বাঙালি জাতি চর্যাপদ বা প্রাক-চর্যাপদকাল থেকে চলে আসা একটি আবহমান বাঙালি জাতির অংশ নয়? এ প্রশ্নটি কিছুটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, বাঙালি জাতির ‘হাজার বছরের’ ইতিহাস। সেটা হাজার বছরের কেন, আরও প্রাচীনতম সময়েরও বলে দাবি করা যেতে পারে। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে যেমন প্রাচীন যুগের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে দাবিটা হবে বাঙালি ‘নেশনের’ ক্ষেত্রে নয়ু এই জনপদের ‘মানুষের’ ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য হবে। অভিন্ন ইতিহাস, অভিন্ন আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের স্মৃতিু এসব বৈশিষ্ট্যকে ‘নেশন’ হিসেবে দাবি করার পেছনে বড় লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নস্ট রেনাঁ। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি- এসব ঐতিহাসিক স্থানে পরিব্রাজক হিসেবে আমরা যখন জড়ো হই, আমরা তখন তার ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক কারুকার্য বা কীর্তিতে বিস্মিত হই। কিন্তু সেসব স্থানের সঙ্গে আমাদের আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও একত্র-জীবনের কোনো স্মৃতি আমরা নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাই না। ওই সব জনপদের স্মৃতি আমাদের ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক একসময়ের ধারক, কিন্তু তারা আমাদের সাম্প্রতিকতম জাতি-গঠনের ‘অংশ’ নয়। আমরা তাদের সম্পর্কে জেনেছি মূলত বইয়ের মাধ্যমে বা হয়তো কোনো সাংস্কৃতিক উপকরণের (গান, পালা, মৃৎশিল্প ইত্যাদি) মাধ্যমে। এদেরকে আমরা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান হিসেবে ধরব, কিন্তু বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞানের সূত্র এদের মধ্যে নিহিত নেই। সেই অর্থে শুধু বাঙালি জাতি বলে নয়, কোনো নেশন বা জাতিই ‘প্রাচীন’ নয়, কেননা নেশন অর্থে জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠার কালই শুরু হয়েছে কেবল ‘আধুনিক’ সময়ে। ‘আধুনিক’ বলতে ইউরোপের পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট ও শিল্পবিপ্লব-উত্তর সময়ে। ভারতের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে আরও অনেক পরেু উনিশ শতকের শেষের দিকে বা বিংশ শতকের শুরুর দশকে।
এ জন্যই রামমোহন রায়-দ্বারকানাথ ঠাকুর-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় জাতির বা নেশনের কোনো ‘স্বপ্ন’ দেখতে পাই না। এর কারণ, ‘নেশন’ এই বোধটাই তখন আমাদের মধ্যে জন্মায়নি। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যে বাঙালি নেশন ধারণ করে আছে, তার সূত্রপাত ভারতের চেয়েও আরেকটু পরেু গত শতকের চল্লিশ দশক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে যার বিস্তৃতি। সেই অর্থে আমরা নবীন বা নবীনতম জাতি। এতে আমাদের সংকুচিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর কোনো জাতিই প্রাচীন নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি তার নতুন বইতে (যার নাম The Truths and Lies of Nationalism as Narrated by Charvak) ) দেখিয়েছেন যে- ’no one, not even Indians, can claim to be part of an ancient nation’ সব জাতি-রাষ্ট্রই, সব নেশনই আধুনিককালের সৃষ্টিু কেউই প্রাচীন জাতি-রাষ্ট্র বা জাতি নয়। আমরা এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা বহুকাল ধরে বহু সাম্রাজ্যের পালাবদলের সাক্ষী হয়ে এই জনপদে বাস করছি এবং সেই অর্থে আমাদের প্রাচীন বা প্রাচীনতম শিকড় রয়ে গেছে এই বাংলার ভূপ্রকৃতির মধ্যে; কিন্তু আমরা ‘প্রাচীন জাতি’ নই। আমরা আধুনিক পোস্ট-এনলাইটেনমেন্ট কালে, আধুনিকতম ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে, সৃষ্ট একটি নবীন জাতি যে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে তার নিজের জন্য একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পেরেছে। এতে আমাদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার কিছু নেই; বরং চলতি সময়ের উপাখ্যান হিসেবে আমাদের জাতীয় জাগরণের ইতিহাস, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সফলতা এবং তার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুু এই ন্যারেটিভের দিকে সমূহ দৃষ্টি দেওয়াই হচ্ছে সঠিক রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। বাহাত্তরের সংবিধানের জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে মূল বক্তব্য সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে আহ্বান জানায়। একটু সবিস্তারে এ নিয়ে বলতে চাই।
কেন উনিশ-বিশ শতকের আগে এই উপমহাদেশের জনগণ কোনো ‘নেশন’ ছিল না, এই দাবি কারও কারও কাছে অসংগত বলে মনে হতে পারে। মৌর্য, গুপ্ত, সুলতানি আমল, মোগল, মারাঠা, নবাবি আমল এরা কি একেকটি সাম্রাজ্য, কীর্তিমান রাজ্য বা ‘ ’great state’-এর উদাহরণ নয়? নিশ্চিতভাবেই এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কেউ কেউ ‘বিশাল সাম্রাজ্য’ও স্থাপন করেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। এরা ‘সাম্রাজ্য’ ছিল, কিন্তু ‘নেশন’ ছিল না। এর কারণ, এই সাম্রাজ্যগুলো এই ভূখণ্ডের ও জনপদের অধিবাসীদের ওপরে শাসন করেছে সামরিক শক্তির জোরে এবং ‘খাজনা আদায়’ করে। এই সাম্রাজ্যগুলো ইতিহাসের নানা পর্বে যেসব রাষ্ট্রের পত্তন করেছিল, সেসব রাষ্ট্র কেবল বহিঃস্থ শক্তি হিসেবে আমাদের ওপরে প্রভুত্ব বা রাজত্ব করেছে। আমাদের ভূখণ্ডের সমাজের কাছে, সমাজের চোখে এসব রাষ্ট্র ছিল external force বহিঃস্থ শক্তি কেবল। এ জন্যই কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, রাজা যায়, রাজা আসে। এই পালাবদলে জনসমাজের কোনো দায় নেইু কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। জাতি নির্মাণ তখনই সফল হয়, যখন কিনা রাষ্ট্র তার শাসনকার্য নির্বাহ করে জনগণের ‘সম্মতিতে’। যখন জনগণ ‘উপর থেকে’ চাপিয়ে দেওয়া শাসনকে ‘নিচে থেকে’ সম্মতি (consent) দিয়ে স্বীকৃতি জানায়। নিচে থেকে সম্মতিদানের প্রক্রিয়ায় যে রাষ্ট্রের জন্ম, সেটিই কেবল সফল নেশন-স্টেটের জন্ম দিতে পারে। নিচে থেকে জেগে ওঠা জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তখন সফল জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়, যেমনটা হয়েছে আধুনিক যুগে উনিশ-বিশ শতক থেকে নানা মহাদেশে, নানা দেশের বেলায়। এককথায়, শাসনকার্য যখন জনগণের ‘সম্মতি’ ছাড়া পরিচালিত হয়ু যাকে ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘ডোমিন্যান্স উইদাউট হেজমনি’ু তখন অধীন জাতির জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় না।
এই ‘সম্মতির’ কথাটিই উচ্চারিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের ‘সম্মতি’ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর জন্যই সংবিধানের শুরুতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে এই ‘প্রস্তাবনার’ সংযোজন। কেননা, জনগণের ‘সম্মতি’ (consent) ছাড়া সাম্রাজ্য হয়, কিন্তু জাতি-রাষ্ট্র হয় না। সেই অর্থে, জনসম্মতি পায়নি বলে ১৯৪৭-৭১ পর্বে ‘পাকিস্তান’ কোনো জাতি-রাষ্ট্র হতে পারেনি। উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক ‘সাম্রাজ্য’ হিসেবে সে থেকে গেছেু অন্তত পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই প্রস্তাবনার মাধ্যমেই বাঙালি জাতির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের ‘গণপ্রজাতান্ত্রিকতা’ ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা বা রুশ বিপ্লবের মতোই এ দেশের জনগণের ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান ঘোষণা হচ্ছে এই ‘প্রস্তাবনা’। যেখানে বলা ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি, আদর্শ, মূলনীতিসংবলিত এক নতুন জাতি-রাষ্ট্রের কথা। সেই সংজ্ঞায় আবহমানকাল ধরে চলে আসা ‘হাজার বছরের’ বাঙালি জাতির কথা বলা ছিল না। বলা হয়েছিল নিকট অতীতের সংগ্রামরত পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতির কথা। পুরোটা পড়লে সন্দেহ থাকে না যে, কথা হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বে এই জনপদের অধিবাসীদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং তার মাধ্যমে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন :
“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলু জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাু যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সংগতিরক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
এতদ্দ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।”
উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটুকু ইঙ্গিত মেলে যে, বাঙালি জাতির ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামই’ এই নতুন জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ ও পরবর্তী ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল। কেউ যদি বলেন যে, এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আসলে সূচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে বা তারও আগে ১৮৫৭ বা ১৭৫৭ সালে, তা হবে অতিকথন দোষে দুষ্ট। কেননা, ওই প্রস্তাবনাতেই দ্বিতীয় স্তবকে স্পষ্ট করা হয়েছে এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চালিকাশক্তির কথা। এই মুক্তিসংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করেছিল কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শু জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গ করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী) বা যারা বঙ্গভঙ্গ না করার জন্য আন্দোলন করেছিল (মূলত বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী) এরা কেউই উপরোক্ত চার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল না। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটাই তখন পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ করা বা না-করার দলের নেতা বা তাত্ত্বিকদের মধ্যে জন্ম হয়নি। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যা ছিল তা হলো বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম ‘সম্প্রদায়ের’ মধ্যে সম্প্রদায়গত স্বার্থের লড়াই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল (হিন্দু) জমিদার বনাম (মুসলিম) কৃষকের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব, (হিন্দু) মধ্যবিত্ত বনাম (মুসলিম) মধ্যবিত্ত স্তরের অর্থনৈতিক স্বার্থ (ব্যবসা, চাকরি, জমি) সংক্রান্ত বিরোধ। এটা দুই ‘নেশনের’ মধ্যকার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল নাু তা জিন্নাহ সাহেব যাই বলুন না কেন। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি বিভক্তভাবে কোনো জাতি নির্মাণ করতে পারেনি ১৯৪৭-পূর্ব সময়ে। ১৯৪৭-এর পরে যে জাতি নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের বৈরী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তাতে বাঙালি মুসলিমের প্রধান অবদান ছিলু কেননা পূর্ববঙ্গের প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল তারা ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাগের সময়ে। কিন্তু ১৯৪৭-৭১ পর্বে বাঙালির মুসলিমের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অমুসলিম জনগোষ্ঠীও অবজেকটিভ কারণেই সহযোগী ভূমিকা পালন করেছিল। দেশভাগের পরে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিভিন্ন কারণে একটি অংশের দেশত্যাগের পরেও বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ছিল পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ (১৯৬১ সালের সেন্সাস অনুসারে)। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানের ‘মেজোরিটি’ অংশ পূর্ব বাংলার অধিবাসীু সংখ্যাগরিষ্ঠতার গাণিতিক যুক্তিটি অকাট্য বলে প্রমাণ করা গিয়েছিল কেবল এই জনপদের বাঙালি মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে একত্র করেই। জনসংখ্যার অনুপাতে অধিকতর সম্পদ বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর (কেননা তারা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ)ু এই যুক্তি কেবল তখনই খাটে, যখন ‘বাঙালি’ বলতে আমরা শুধু বাঙালি মুসলিম নয়, বাঙালি হিন্দু ও অপরাপর ধর্মাবলম্বী অংশকেও হিসেবে ধরি। এটাই হচ্ছে ১৯৪৭-৭১ পর্বের ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালি জাতিকে একত্র করার এবং পরস্পরের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করার ‘গাণিতিক ভিত্তি’।
[ক্রমশ]
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ::৯৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এক অর্থে, মওলানা ভাসানীর মধ্যে ‘দ্বৈত-সত্ত্বা’ বিরাজ করছিল। একদিকে তিনি ছিলেন সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ‘মজলুম জননেতা’। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন স্বভাবজ ধর্মগুরু- একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। এই ‘দ্বৈততা’ তাকে কৃষক-জীবনের সাথে অঙ্গীকৃত করেছিল। তিনি ছিলেন এই অর্থে (গ্রামসির ভাষ্যে) একজন ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল অব পেজেন্ট ক্লাস’। তবে দ্বৈততা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্ব ধর্মের মানুষকে সমানাধিকার দান এবং (সেই অর্থে) ধর্মনিরপেক্ষতাকে জোরেশোরে তুলে ধরার প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। ‘রবুবিয়ত’ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য বা লেখা পড়লে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। রবুবিয়ত প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই এখানে। মওলানা ভাসানীর এই উপলব্ধির রাজনৈতিক তাৎপর্যের দিকে সাম্প্রতিককালে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসল কথা হলো, ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শের ওপরে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রভাব পড়েছিল। মার্কসবাদী ও অমার্কসবাদী উভয় সূত্র থেকেই ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ গড়ার স্বপ্ন তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। ন্যাপ গঠনের সময়ে ভাসানীর দর্শনে প্রগতি পন্থার ‘মার্কসবাদী’ প্রভাবের সূত্র আগেই উল্লেখ করেছি। এবার অমার্কসবাদী সূত্রের প্রভাবের কথা বলব।
আসামের বিপ্লবী দার্শনিক আল্লামা আজাদ সোবহানীর সাথে ১৯৪৬ সালের একটি সাক্ষাতের গভীর অভিঘাত পড়েছিল মওলানা ভাসানীর ভেতরে। আগেই বলেছি, ভাসানী মুসলিম লীগ ঘরানা থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করেননি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অসহযোগ আন্দোলনের নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা হাসরত মোহানী প্রমুখের চিন্তা ও চর্চা তার জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। ভাসানী এ নিয়ে লিখেছেন, আল্লামা আজাদ সোবহানী বলিলেন, ‘তবে আজ ওয়াদা কর তুমি রাজনৈতিক জীবনে যত কলাকৌশলই নাও না কেন মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম করিয়া যাইবা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়িল ১৯৩৫ সালে আমরুহাতে ১৭ জন আলেম রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্তের কথা। মনে পড়িল মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধী প্রমুখের সাথে আমার যোগাযোগ ও ওয়াদার কথা। আমার মনে পড়িল খিলাফত আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর সাহচর্যের কথা। আমি দেখিলাম যৌবনের উচ্ছ্বাস শেষে যে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম আজ প্রৌঢ় জীবনে সেই রাজনৈতিক দর্শনের দাওয়াতই আসিয়াছে।’ এই দর্শনের বিবরণ দেওয়া সহজসাধ্য নয়। এখানে বাহাত্তরের সংবিধানের সমতাবাদী চিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আলোচনার প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর ‘পালনবাদ’ (বা অন্যত্র যাকে বলেছি ‘caring state) সেটির সাযুজ্য স্থাপন করাই আমার মূল লক্ষ্য।
পালনবাদের মূল কথা হলো যে এই জগতের কোনো কিছুই অহেতুক সৃষ্টি হয়নি। ‘সকল কিছুর অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না, সবকিছুকে বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন-পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে-রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রাব্বানিয়া। সে-রাষ্ট্রে থাকিবে স্রষ্টার পালনবাদ- মানুষের শাসনবাদ নহে।’
এই পালনবাদের প্রয়োগ ও আদর্শ হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। এই বিষয়ে মওলানা ভাসানী লিখেছেন : ‘সকল সমস্যার সমাধান হইবে মানবজাতি যদি রবুবিয়তের অর্থাৎ স্রষ্টার পালনবাদের আদর্শে হুকমত কায়েম করিতে পারে। শিক্ষা-দীক্ষা, খাওয়াপরা, ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই- মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন ভেদাভেদ নাই ঠিক তেমনি হুকুমতে রব্বানিয়ায় সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে। আজ আর কোনো সন্দেহ নাই। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে শাসন, শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া মানবজাতিকে সুখী করিতে পারে।’
এখানে দ্রষ্টব্য যে ভাসানী রবুবিয়তের আদর্শ বলতে গিয়ে যেমন পবিত্র গ্রন্থের সাক্ষ্য টেনে আনছেন, তেমনি স্মরণ করছেন ফরাসী বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের’ বাণী। ভাসানী এরপরে বলবেন ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’ উচ্ছেদের কথাও। যেটি এমনকি প্রথাগত বামপন্থিরাও (সংগত কারণেই) উচ্চারণ করেননি। মার্কস বা লেনিন কেউ সবধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ চাননি। কিন্তু ভাসানী এখানে অনেক বেশি ‘চরমপন্থি’- অন্তত ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের প্রশ্নে। তার বয়ানেই শোনা যাক :
‘আমি যখন হুকুমতে রব্বানিয়ার কথা বলি তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থি রাজনীতিবিদরাই বিরোধিতা করেন না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থি একশ্রেণির আলেম-ওলামা এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। তাই আল্লাহর নামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন বটে কিন্তু তাহাদের মতে উহা আল্লাহর নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেম-ওলামারা সবকিছুতে আল্লাহর মালিকানা মানিয়া লইয়া থাকেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না। এইভাবে হুকুমতে রব্বানিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুইটি মতবাদ রহিয়াছে ইহা আমার অনুসারীদিগকে বুঝিয়া লইতে হইবে।’
মওলানা ভাসানীর এই নিজস্ব দর্শনে বামপন্থি চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে সরলীকৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা ভুল তথ্যের প্রকাশ দেখা যায়। মার্কসীয় দর্শনে- অন্তত সমাজতন্ত্রের পর্যায়ে- ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’ বা পুুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানা অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পূর্ণ উচ্ছেদ আবশ্যিক নয়। আর ‘পার্সোনাল প্রপার্টি’ অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের তো প্রশ্নই ওঠেনি কোনদিন। প্রাইভেট প্রপার্টি অর্থে ব্যক্তিগত মালিকানা লেনিনের নিউ ইকনমিক পলিসি, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নানা পর্বে, দেং শিয়াও পিং উত্তর চীনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতায় ভালোভাবেই স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে কালক্ষেপণ করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, ‘রবুবিয়তের’ কথা বলতে গিয়ে ভাসানী শুধু একটি বিশেষ ধর্মের কথাই বলেননি। তিনি বারবার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে অনুসৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সংজ্ঞা অনুসারী- তিনি সকল ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখছেন। আমার বক্তব্যের সপক্ষে আমি ভাসানীর এপ্রিল ১৯৭৪ সালের ভাষণ থেকে নিল্ফেম্নাক্ত উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই :
‘আমি চাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েম করিয়া হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব চাহিদা পূরণ করিতে। ইহার সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নাই। তাই সকল ধর্মাবলম্বী উহার উপকারিতা ভোগ করিতে পারিবে। নিজ নিজ ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটিবে ইহাই আমার কামনা। যে-কেউ প্রশ্ন করিতে পারেন হুকুমতে রব্বানিয়া কীভাবে অমুসলমানদেরকে আপন করিয়া লইবে? যাহারা রবুবিয়তের মর্ম বুঝেন না তাহাদের এই প্রশ্ন করা খুবই স্বাভাবিক। রবুবিয়ত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া অর্থাৎ যে-দেশে রবুবিয়তের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে, কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, বিবর্তনকারী প্রভু, হিন্দুর জন্য তিনি একই বিধানে আলো-হাওয়া, ফল, পানি, বস্ত্র, খাদ্য সবই জোগাইতেছেন। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারে।’
যদি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা- যেভাবে সংবিধানে তা দেওয়া আছে- আমরা বিবেচনা করি, অর্থাৎ যেখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মের অপব্যবহার রোধ এসবকে তুলে ধরা হয়েছে- সেটি মানার জন্য নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস রেখেই সমতাবাদী সমাজ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হওয়া চলে। এর সাথে ধর্মহীনতা, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। মওলানা ভাসানীর বিশেষ ধরনের সমতাবাদী চিন্তা (তার ‘রবুবিয়তের’ তত্ত্ব সহ) এই চলার পথে সহজেই অঙ্গীকৃত হতে পারে। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ভাসানী এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর সর্বমানববোধের সাথে ইসলামী মরমি দর্শন, মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সুফিদর্শন, পরবর্তী কালের নদীয়াকেন্দ্রিক শ্রীচৈতন্য ও তৎপরবর্তী বাংলার বৃহত্তর বাউল-ফকিরি ঘরানার মূল কথা- অর্থাৎ ‘সবাইকে সমভাবে দেখা’- এর মৌলিক ঐক্যসূত্র রয়েছে। তবে ভাসানী অহিংসা-নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে গান্ধীর থেকে তিনি সুভাষ বসু, খ্রুশেভের থেকে তিনি মাওকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আজীবন বিপ্লবীদের অনুগামী। বিনা কারণে টাইম তাকে অভিহিত করেনি ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বলে।
পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথমত ও প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। মূলধারার রাজনীতিকে পুনর্গঠন করে ধাপে ধাপে তিনি প্রথমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তীতে একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভাসানীর ইসলাম বা রবুবিয়তের দর্শনের মূল সর্বমানববাদী বক্তব্যে তার আপত্তি থাকার কথা ছিল না। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সবল সমাজ গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সব ধারা ও উপধারাকেই যৌক্তিক স্থান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এইসব ধারা ও উপধারার মূল কথা হচ্ছে- সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করে সেকথা বললেন :
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ তারপরে আরো কিছু কথা বলার পরে তিনি বললেন :
‘আমি সর্বশেষ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করব, যেন এই দায়িত্ব আমরা সুচারুরূপে পালন করতে পারি। যে শহীদেরা আত্মাহুতি দিয়েছেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত সমাজের, আজকের বাংলাদেশের জনগণ আশা করে, যে সংবিধান-কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই হবে তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন। আমি আল্লাহর নিকট আবার প্রার্থনা করি, যেন বাংলাদেশের জনগণের আশা পূর্ণ হয়।…জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মওলানা তর্কবাগীশ সাহেব মোনাজাত করে দোয়া করবেন।’
এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সমাপনী বক্তব্যের শেষ ক’টি লাইন। ধর্মনিরপেক্ষতার এই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার পরও এ নিয়ে যারা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তারা অবুদ্ধির বশবর্তী হয়ে সেটা করেছেন অতীতে (এবং এখনো ইউটিউবে-ফেসবুকে সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ জুড়ে করে যাচ্ছেন)। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা এই মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন দিবারাত্রি। তাদেরকে বোঝানো শক্ত। জ্ঞানমার্গ বা যুক্তি দিয়ে সবাইকে সবকিছু বোঝানো যায় না। না বুঝতে চাওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ, শ্রেণিগত স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ থাকে। ‘আইডিওলজি’ মোহমুক্তভাবে অনেক সময় সত্যকে দেখতে দেয় না। পারস্য-যাত্রীর শেষে রবীন্দ্রনাথ এদের উদ্দেশ্য করেই একটি গদ্য-কবিতায় বলেছিলেন :
‘হায় মানুষ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং-এর পুষ্টির জন্য নয়;
যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন;
ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্রিত মানুষ জানে না
মানুষের জগৎটা যে কী, তা পশু কেমন করে জানবে।’
[ক্রমশ]