বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য

[পূর্বে প্রকাশিতের পর] [শেষ পর্ব]


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]

জবাবে শেখ মুজিব বললেন: শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক্ষায় তোমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে চাও, করো। কিন্তু আমি সে পথেই যাব না। যে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং কৃষকের সংগঠন ও চেতনার স্তর নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, সে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় কালক্ষেপ করতে আমি রাজি নই।
এক, প্রথমে পাকিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করব। দুই, এ দেশে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। তিন, সভ্য জগতে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। চার, এমন কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া উত্থাপন করতে যাচ্ছি যাতে শ্রমিক, কৃষক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মেহনতি মানুষ সকল সম্পদের মালিক হয়; রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বে সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম: উপরিউক্ত চারটি দফা যদি আদায়ই হয়, তবে সে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না, হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ধরনের একটা কিছু। কিন্তু মেহনতি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে হবে। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অবস্থান কীরূপ দাঁড়াবে সে প্রশ্নেরও বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচিতে।
জবাবে মুজিব বললেন: ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত মানুষের জন্যই তো আমাদের সংগ্রাম। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এ দেশে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে যে পারা যাবে না সে সম্পর্কে আমি সজাগ, আমি নিশ্চিত।’
এই ম্যানিফেস্টো-ধারার বিবৃতিকে নিছক ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’-এর অনুবর্তী বললে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণাটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করা হবে। আবার একে প্রথাগত সোভিয়েত-চীনের ধারার সমাজতন্ত্র বললেও অন্যায় করা হবে। উভয় বিচারই তথ্যনিষ্ঠ হবে না। এখানেই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ বিশেষত্ব। কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাক এটা যেমন তিনি চান না, তেমনি চান না কোনো একনায়কত্বের শাসন।
বর্তমান নিবন্ধ থেকে কয়েকটি প্রবণতা বেরিয়ে এসেছে– যা নিয়ে আরও কাজ করা দরকার– তা এই পর্যায়ে দাখিল করব।
১. উন্নত ধনতন্ত্রের বেশ কিছু দেশে যে ধরনের ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ পাই, বা প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে অতীতে (এবং বর্তমানে কোন কোন দেশে) যে ধরনের ‘স্টেট সোশ্যালিজম’ দেখতে হয়েছে, তার বাইরে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের প্রগতিশীল সহকর্মীদের। এ দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই তাঁদেরকে নতুন পথ খুঁজতে বাধ্য করেছিল।
২. এই নতুন পথের নাম ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’। বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশেই একে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ পথ হিসেবে। এই সংজ্ঞা বাহাত্তরের গণপরিষদের সংবিধান আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকট সহকর্মীরা বহুবার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘প্রস্তাবনা’ অংশে উল্লিখিত উদ্ধৃতি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে সবচেয়ে যথাযথ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে ধারণ করে:
‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা‒ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহুদিন থেকে। এ বিষয়ে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন কমিটমেন্ট ছিল। এ নিয়ে প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচির’ ঘোষণায় সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট সুষ্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়। এই পূর্ব-ইতিহাস জানলে বুঝতে কষ্ট হয় না কেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের দাবি সাহসের সাথে উল্লিখিত হয়েছিল। নির্বাচনের মুখে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি নিয়েই শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সমাজতন্ত্রের ধারায় সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি তোলার জন্য অসম্ভব সৎসাহস থাকা দরকার। বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রতিকূল ও বিরূপ পরিস্থিতিতে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পরোক্ষভাবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছিল:
‘আমাদের বিশ্বাস শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব। অন্যান্য অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
এই নির্বাচনী ইশতেহারেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল ‘জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলিসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা,’ তবে এ ক্ষেত্রে ‘বেসরকারি পর্যায়ে নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুবিধে’ রাখা হয়েছিল ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য। এ ছাড়া বলা হয়েছিল ‘জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার বিলুপ্তি সাধনের কথা’। পরিষ্কারভাবে অঙ্গীকার দেওয়া হয়েছিল ‘সব প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করার কথা’ এবং সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই যাতে ‘সমান অধিকার ভোগ’ করে এই প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ ছিল। অনেকের চোখেই এটি ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ জুড়ে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তরফে প্রায় নিশ্চিতভাবেই অতিরিক্ত নির্বাচনী ঝুঁকি নেওয়া, বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে। কিন্তু সমানাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্বাপর অবিচল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের প্রতি এই অঙ্গীকার আরও গভীর হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশ পরিষদের সদস্যবর্গের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহুপূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারও মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।’
৪. এই পর্যায়ে অবশ্য এটাও বলা দরকার যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণাটির ‘দুই অংশই’ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুনের ভাষণে স্পষ্ট করে এ কথা বলেছিলেন, ‘আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।’ এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুসারী–যিনি ‘লিবার্টি প্রিন্সিপালকে’ প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং যিনি ভেবেছিলেন ব্যক্তিস্বার্থকে বাদ দিলে প্রগতির চাকা রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার স্বাধীনতার পরে হঠাৎ করে বা কেবল বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালে গড়ে ওঠেনি। দেশি-বিদেশি পারিপার্শ্বিক শক্তির চাপে বা প্রভাবে এটি উদ্ভূত হয়নি। সংবিধানের চার স্তম্ভও তেমনি নিছক স্বাধীনতা পরবর্তীকালের উদ্ভাবন নয়। এর পেছনে ছিল দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরম্পরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৫. ধারাবাহিকভাবে গড়ে ওঠা এবং ক্রমাগতভাবে উচ্চারিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পেছনে প্রেরণা এসেছিল বিভিন্ন সূত্র থেকে। নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট একটি পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল ইউরোপের– বিশেষত উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের– ‘সোশ্যাল স্টেট’, ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ প্রভৃতি ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে। পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশের তখনকার দিনের অগ্রগতিও। ১৯১৭ সালের পর থেকেই সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের তরফে কম্পিটিটিভ ‘সোশ্যাল পলিসি’ গ্রহণের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ধনবাদী নানা দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারা এবং রাশিয়া, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের নানা সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রাথমিক উন্নয়ন সাফল্য এই দুটি দিকই তৃতীয় বিশ্বের সদ্য-স্বাধীন নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারেনি। সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন মুজিবের এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেক আগে থাকতেই। এ ক্ষেত্রে পঠন-পাঠনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তো ছিলই; কাজে এসেছিল প্রত্যক্ষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও। প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৯৫২ সালে তরুণ শেখ মুজিবের নয়াচীন ভ্রমণ, যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকলে কত অনায়াসে সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘সুযোগের সমতা’ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনকে নিশ্চিত করা যায়। যদিও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে মুজিব প্রশংসার পাশাপাশি নয়াচীনের সমালোচনাও করেছেন‒ বিশেষত মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্রের অভাব ঘটছে এই আশঙ্কা করে। যে রকম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্ট্যালিনের রাশিয়ায় একনায়কের ছায়া দেখতে পেয়ে।
৬. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ওপরে পরোক্ষ প্রভাব এসেছিল বাঙালির ‘সমাজতান্ত্রিক’ ঐতিহ্য ও সাম্যচিন্তার সূত্রেও। রাজনীতি-সচেতন ও সংস্কৃতিমনা শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা বাঙালির ‘প্রগতিশীল’ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিলেন এই ঐতিহ্যের দুটি প্রধান স্তম্ভ। ‘সাম্যের’ বঙ্কিম থেকে ‘লাঙলের’ সাম্যবাদী নজরুল; ‘রাশিয়ার চিঠি’ ও ‘সভ্যতার সংকটের’ রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘সুলতানার স্বপ্নের’ বেগম রোকেয়া; ‘রায়তের কথার’ প্রমথ চৌধুরী থেকে ‘শাশ্বত বঙ্গের’ কাজী আব্দুল ওদুদ বাঙালির প্রগতিশীল চিন্তার প্রবাহে একেকটি মাইলস্টোন। এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। এদের যাপিত জীবন ও লেখনীর মধ্য থেকে একটি সমৃদ্ধ উদারনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচারমুখীন ‘সমাজতান্ত্রিক’ সমাজের আদর্শ ক্রমশ স্পষ্ট অবয়ব নিয়েছিল, যা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের মানসভুবনকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে থাকবে। বিশেষত এদের প্রায় সকলের লেখনীর মধ্যেই ছিল চোখে পড়ার মতো সামন্তবিরোধী ভাবধারা, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এর ফলে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা এবং সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতার নীতি স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সম্মুখসারির ইস্যু হিসেবে চলে আসে।
এর সাথে যুক্ত করতে হয় চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। সেসব দেশ-কাঁপানো ঘটনাবলি যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ; সাতচল্লিশের দেশভাগ; পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নীতি; পঞ্চাশের দশকের নিরস্ত্রীকরণ ও বিশ্ব-শান্তি আন্দোলন; ‘বাইশ পরিবারের’ সৃষ্টি; রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ; পূর্ব বাংলার দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন; জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্য; অগণতান্ত্রিক আচরণ ও গণবিরোধী নীতি-পদক্ষেপ ইত্যাদি ছিল জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া তত্ত্বের কিছু জরুরি উপকরণ। এসবই মুজিবকে সমৃদ্ধ করেছে– পূর্বনির্ধারিতভাবে নির্দিষ্ট করেছে বাহাত্তর সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ। এসব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপাদানের বিবরণ ছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা আদলকে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তির নিরিখে ঠিক স্পষ্ট করে চেনা যায় না।
৭. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কয়েকটি মৌল বৈশিষ্ট্যকে বর্তমান প্রবন্ধে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: (ক) বিভিন্ন ধরনের মালিকানার সহাবস্থান বা ‘মিশ্র অর্থনীতি’; (খ) অর্থনৈতিক বাস্তবতাবাদ বা ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম; (গ) একচেটিয়া (মনোপলি) পুঁজির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান; (ঘ) ‘সুযোগের সমতা (ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি) ও ‘ফলাফলের সমতা’ (‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’); (ঙ) নানামাত্রিক শোষণের অবসান; (চ) তীক্ষ্ণ জোটনিরপেক্ষতা বা ‘র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’; এবং (ছ) ক্রমান্বয়বাদীতা বা গ্র্যাজুয়ালিজম। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই বিশদ বিচার-বিশ্লেষণের দাবি করে। সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায় এরা এমন কতগুলো দিক তুলে ধরেছে; যা প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মধ্যে নেই, অথবা থাকলেও নিতান্ত অসম্পূর্ণভাবে উপস্থিত।
‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে বিভিন্ন মালিকানা-সম্পর্কের একত্রে উপস্থিতি ও তার গুরুত্ব। এর অর্থ, যা কিছু সামাজিক কল্যাণ, কর্মসংস্থান ও গরিবমুখী বণ্টনের জন্য ফলদায়ী হবে সেই মালিকানা-সম্পর্ককেই জনকল্যাণের স্বার্থে স্বীকার করে নেওয়া হবে ‘পরিকল্পনা’ গ্রহণের সময়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে বা মালিকানায় থাকবে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত সকল খাত; যা সরাসরিভাবে সামষ্টিক কল্যাণের বা ‘পাবলিক গুড’-এর বণ্টনের সাথে জড়িত। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিপণন-নির্ভর ‘সমবায়ী মালিকানাকে’ উৎসাহিত করা হবে। ব্যক্তিমালিকানাকে যথাবিহিতভাবে বিকশিত হতে দেওয়া হবে, অনেক ক্ষেত্রে তাকে অগ্রাধিকারও দেওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগত পুঁজিপতি শ্রেণিকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বা প্রভাব-বিস্তার করার মতো অবস্থানে যেতে দেওয়া হবে না।
ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজমের নীতি বলছে যা কিছু জনকল্যাণের জন্য উপকারী, সেই নীতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ‘পরিকল্পনা’, ‘বাজার’ এবং ‘সামাজিক উদ্যোগের’ মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কেমন দাঁড়াবে সেটি ঠিক করবে অর্থনৈতিক প্রয়োজন, প্রশাসনিক সামর্থ্য এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক বিশ্ববাস্তবতা। অর্থাৎ কোনো পূর্বনির্ধারিত ডগমা বা আইডিওলজি নয়, বাস্তবে কোন নীতি কতটা ফলপ্রসূ সেই নিরিখে নীতিমালা নেওয়া হবে বা বদলানো হবে। দারিদ্র্য নির্মূল করা এবং সব পেশার ও জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত মানব-উন্নয়ন নিশ্চিত করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়া যথাসম্ভব গরিববান্ধব প্রবৃদ্ধি ও অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টনের জন্য বাস্তবোচিত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্ত-বিরোধিতা হবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনোমতেই অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতে কতিপয় ব্যবসা-গোষ্ঠীর একচেটিয়া রাজ বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন/কেন্দ্রীভবন হতে দেওয়া যাবে না। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র তার জাতীয়করণ নীতি, কর-রাজস্ব নীতি, মুদ্রা ও আর্থিক নীতি পরিচালিত করবে। বৃহৎ শিল্প-বাণিজ্য খাতে অনাদায়ী মন্দ ও খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ জড়ো হয়ে থাকলে সেসব উদ্যোগকে ‘মিশ্র মালিকানায়’ নিয়ে আসা সম্ভব। খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ মূল্যের শেয়ার সরকারি মালিকানায় ন্যস্ত করা যায়। প্রযুক্তিগত উন্নতিতে সকল প্রকার প্রণোদনা ও উৎসাহ দেওয়া হবে সকল শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য।
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু ‘সুযোগের সমতার’ বিধান করলেই চলবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আরও সমতামুখীন হচ্ছে কিনা সমাজ-অর্থনীতি, সেটিও দেখতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত আয়-বণ্টন নীতি গ্রহণ করতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তা সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে; সবার জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বাস্তবায়ন করতে হবে; সকলের জন্য ‘গ্রহণযোগ্য’ পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে; সবার জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; মানবপুঁজি বিকাশের মাধ্যমে উন্নত পেশা বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সুবাদে আয়-বৈষম্য বিশেষত ইন্টার-জেনারেশনাল ইনইকুয়ালিটি কমিয়ে আনতে হবে। একই সাথে সমাজের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে কালক্রমে উচ্চ আয়ের মানুষের সাথে এবং অগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমপর্যায়ে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নেবে রাষ্ট্র। এর জন্য চাই প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পদকর এবং ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ঋণ’ পাওয়ার ব্যবস্থা– সর্বস্তরের পেশা ও শ্রেণির মানুষের জন্য। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে নারীদের ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষের মধ্যে নানাবিধ বৈষম্য দূরীভূত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে কোনো ছাড় নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র ও তার বিদেশ নীতি পরিচালিত হবে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে। এই নীতি সবার সাথে বন্ধুত্বের নীতিতে বিশ্বাসী, তবে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী। এটি কোনো বহিঃশক্তির অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। এক কথায়, বিদেশ নীতি র‌্যাডিক্যাল ধারার জোটনিরপেক্ষতার অবস্থানকে অনুসরণ করবে, যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ে।
সবশেষে, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কাছের ও দূরের লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় বিধান করবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কৌশলে কোনো পূর্বনির্ধারিত ছক বা মডেল নেই। এ ক্ষেত্রে কাছের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নের আশু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা আর দূরের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, যেখানে প্রাথমিক ও মৌলিক প্রয়োজনই শুধু পূরণ হবে না, জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ বৈষয়িক ও আত্মিক উভয়বিধ বিকাশকে লালন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, সে লক্ষ্যের দিকে রাতারাতি যাওয়া সম্ভব হবে না। যেতে হবে পর্যায়ক্রমে, স্টেপ-বাই-স্টেপ, প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে অতিক্রম করে, অর্থাৎ গ্র্যাজুয়ালি। কেউ বলবেন, নিও-লিবারেল গভর্নমেন্টালিটি বা বাজার অর্থনীতির যুগে এসবই স্বপ্ন, কিন্তু এটি একটি সুন্দর ও সাহসী স্বপ্ন, যার পেছনে ছোটা চলে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা ১৯৭১ সালে এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। আজকের বাংলাদেশেও এর তাৎপর্য অস্বীকার করার নয়।

[বর্তমান প্রসঙ্গ সমাপ্ত]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য

অধ্যায়:: ১৬ [চলমান] [পূর্বে প্রকাশিতের পর]


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]

১৬.৬। র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রগতিশীল বিদেশনীতি। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি তুলনামূলকভাবে অনালোচিত দিক। এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী অবস্থান আরও মনোযোগের দাবি রাখে। ‘এ ক্ষেত্রে কারও সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ বললে পুরোটা বলা হয় না। এ জন্য বোঝা দরকার বঙ্গবন্ধুর ‘র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর মতো প্রাগ্রসর অবস্থানকে। এটিকে শুধু স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতায় গৃহীত এক কুশলী বৈদেশিক নীতি-পদক্ষেপ হিসেবে দেখলে খাটো করা হবে। এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান বঙ্গবন্ধুর মনে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছিল। এর স্পষ্ট প্রতিফলন প্রথম লক্ষ্য করা যায় ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। সেখানে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন ‘পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ শীর্ষক শান্তি-সম্মেলনে অংশ নিতে। তরুণ মুজিব তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
“অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, ‘আমরা শান্তি চাই’। কারণ, যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে– যে দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে।”
১৯৫২ সালে লেখা এটি, অথচ ২০২২-২৩ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে এর প্রাসঙ্গিকতা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়ে গেছে। কয়েকটি উদাহরণ:

১। ১৯৪৯ সালের ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ বলা হয়েছিল:
‘পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করার সমস্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানকে অংশীদার হইতে হইবে এবং শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সর্বব্যাপী বিজয় অভিযানকে জয়যুক্ত করিবার জন্য অন্যান্য জনগণতান্ত্রিক ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সর্বপ্রকার প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর আন্দোলন ও কর্মধারায় সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতা করিতে হইবে। দুনিয়ার সমস্ত জালিমদের সহিত সংগ্রাম করিয়া মজলুমদিগকে মুক্ত করাই হইবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য।’

২। নয়াচীন ভ্রমণের এক বছর পরে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ (শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত) বলা হয়েছিল:
‘তাই আওয়ামী লীগ … সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করিয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নীতির অনুকূলে শান্তি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। … শান্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়া আওয়ামী মুসলিম লীগ যুগ যুগব্যাপী মানুষের প্রতিভা ও সাধনার প্রতিভূ মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য বিশ্বধ্বংসী রণপাগল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ আজ নীতিগতভাবে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির মহান নেতা।’

৩। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিব উচ্চারণ করেন দলের বিদেশনীতি:
‘সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব, হিংসা কারও বিরুদ্ধে নহে (Friendship to all, Malice to none) আওয়ামী লীগ বৈদেশিক সম্পর্কে এই নীতিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা প্রদান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড় (static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষ (Dynamic) এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী। তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীননীতি গ্রহণে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসী।’

৪। ১৯৬৭ সালে গৃহীত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা অর্থাৎ (ম্যানিফেস্টো)’তে বলা হয়েছিল:
‘আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাস করে। সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং একনায়কত্বমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থন থাকিবে।’

৫। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল:
“পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনোমতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না এজন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হয়। আমরা ইতোমধ্যে ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ ও অন্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে, সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।”

৬। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায়-অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’
এ-ই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ‘র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।

১৬.৭। গ্র্যাজুয়ালিজম
বঙ্গবন্ধু তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আরেকটি মৌল বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। সেটির এককথায় নাম– ধাপে ধাপে চলা, পর্যায়ক্রমতা (ইংরেজিতে Gradualism)। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠার পথ এক দীর্ঘ অভিযাত্রার পথ। এখানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে নানামুখী কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কখনও বাঁয়ে, কখনও ডানে সরে এসে; কখনও দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে, কখনও দ্রুত পথ অতিক্রম করে চলতে হয়। এজন্য ‘বিশুদ্ধপন্থি’ হলে চলে না। একেই মাইকেল হ্যারিংটন (১৯৮৯) অভিহিত করেছিলেন ‘ভিশনারি গ্র্যাজুয়ালিজম’ বলে।
এজন্যই খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে (পূর্বে-উদ্ধৃত কথোপকথনে) মুজিব বলেছিলেন, ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে’ এ দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দিকে। এই যাত্রাপথে পরিকল্পনা ও বাজার-অর্থনীতি উভয়কেই আশ্রয় করতে হয়; ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সামষ্টিক জমায়েত উভয়কেই উৎসাহিত করতে হয়; স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হয়। সমাজের aspiration এবং custom-culture কে হিসেবে নিতে হয়। এর বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের প্রথম অধ্যায়ে। যেখানে দেশের উন্নয়নের ধারা বেগবান করার জন্য ‘দূরের’ সাম্যবাদী লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ‘কাছের’ উন্নয়ন-সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিটি আমি এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে ধরছি। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কতগুলো পূর্বশর্ত আলোচিত হয়েছিল।
প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিলে যথার্থই বলা হয়েছিল যে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দরকার বিদ্যমান পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন: ‘Without this assessment a country may adopt a programme which is unrealistic, either too ambitious or too modest’। বলা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পূর্বশর্তগুলোকে আগে শনাক্ত করতে হবে। যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বা প্রাগ-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের উচ্ছেদ, সেটা একলহমায় করা যাবে না: ‘Depending upon the objective conditions of the society, this may have to be done in stages’। দলিলে যথার্থই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন-বৃদ্ধির ওপরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করাই হচ্ছে আশু কর্তব্য: ‘In an underdeveloped economy such as Bangladesh, the socialist transformation of the economy must accompany the growth of productive forces. It has to be clearly understood that anything which hampers increase in productivity or growth of productive forces and dissipates the meagre resources of the country in unproductive activities and unnecessary consumption is in contradiction with the basic principles of socialism.’
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে বেগবান করে ‘productive forces’ কে আগে বিকশিত করে এবং পরে ‘production relations’-এর পরিবর্তনের কাজে হাত দেওয়া সম্ভবত এই ছিল পরিকল্পনাবিদদের মত। পরিকল্পনা দলিলে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আরও যে ফ্যাক্টরের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটি হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র গড়ার ক্যাডার’ গড়ে তোলা। পরবর্তীকালে বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু এই দিকটির প্রতি বিশেষ জোর দেন। পরিকল্পনা দলিলে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছিল, সমাজের মূল্যবোধ সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পক্ষে ব্যাপকভাবে না দাঁড়ালে কখনোই উত্তরণ সফল হবে না: ‘As long as the broad masses are unable to accept the norms of behaviour necessary for a radical transformation of society, no amount of socialist policy adopted by the government can usher in socialism.’ আর সমাজের মূল্যবোধ শুধু সরকারি আমলাদের কাজের মাধ্যমে পরিবর্তন হয় না। এখানে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রশিক্ষিত আত্মনিবেদিত ‘ক্যাডার’ হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এনজিও লিটারেচারের পরিভাষায় এই ক্যাডাররা সমাজ-পরিবর্তনের ‘এনিমেটার’ বা ‘catalytic agent’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা বলে পরিকল্পনা দলিলে মন্তব্য করা হয় যে, কাজটা সহজ নয় আদৌ: ‘Before socialism becomes a reality, the task is to educate the public about the need for social change. The cadres are the instruments through which the task is carried out. We must, however, be aware of the fact that a cadre is as likely to degenerate as any one else.’
কেন এসব সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছিল পরিকল্পনা দলিলে সেদিন? স্পষ্টতই, দলিল-প্রণেতারা কোনো কল্পলোকে বিচরণ করতে চাননি এবং মাঠ-পর্যায়ের বাস্তবতাকে পরিকল্পনার মধ্যে বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘আত্মোৎসর্গ’ করার আহ্বান শুধু সাময়িক কালের জন্য কাজ করে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতকে আগেই উদ্ধৃত করেছি যেখানে তিনি বলছেন স্বার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে অর্থনীতির চাকা একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানব-চরিত্রের স্বার্থপরতার দিক এবং সমাজ-কল্যাণে ব্রতী পরার্থপরতার দিক উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন করেই ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যে-কথা দিয়ে তাঁর পরিকল্পনা দলিলের ভূমিকা শেষ করেছিলেন তা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে: ‘Development is a slow and painful process. It means present sacrifice for future gains. It is specially painful for a country at a very low level of living such as Bangladesh where an increasing and significant reliance is to be placed on domestic resources for development. We can make the sacrifice, which is so essential for development, socially tolerable only if it is equitably shared by all.’ এটা বলেই তিনি সতর্ক করলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের: ‘The room for flexibility is so small, the ability of the socio-economic system to withstand the effects of mistakes and waste is so severely limited that in the use of scarce resources as well as in experimenting with new institutions, great caution and extreme care need to be exercised.’
কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার সমস্যা বঙ্গবন্ধু গভীরভাবেই জানতেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কী ধরনের অর্থনীতি সে সম্পর্কে বিদ্বজ্জনের ভেতরেই নানা মত চালু ছিল। সেই অস্পষ্ট আদলের সমাজতন্ত্রে কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেটারও কোনো রেডিমেড ব্লুপ্রিন্ট তার হাতে ছিল না সেদিন। তার চারপাশের বুদ্ধিজীবীরাও সেটা স্পষ্ট জানতেন না, যেমন জানতেন না (এবং এখনও বলতে গেলে প্রায় জানেন না) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীরা। শুধু জানতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করে গতিশীল উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর জানা ছিল যে, শোষণমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবেই, এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে আটকে থাকাটাই মানব-ইতিহাসের চূড়ান্ত বিধিলিপি নয়। এখানে ‘চ্যালেঞ্জটা’ এত বড় যে বারবার ‘চেষ্টা’ করা ছাড়া অন্য কোনো সহজ পথ খোলা নেই। ৪ নভেম্বরের গণপরিষদ বিতর্কের সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে তাঁর মনের কথাটি বলেছিলেন:
‘সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না– অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়। … সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই– সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান– ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয়। এক দিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই– আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’

১৭। শেষের কথা
এবার বোধ হয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। প্রথমে আসি বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতাদর্শ প্রসঙ্গে। আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছিল একটি অসাধারণ ‘পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’, যা থেকে তাঁর অর্থনৈতিক মতাদর্শের স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে-কথাগুলো এখানে তুলে ধরব তা ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের বিশ্বাসের কথা, তাঁর মনের অন্তস্তলের কথা, কাউকে শোনাবার জন্য নয়, এসব তো আদৌ প্রকাশিতব্য ছিল না। এটি নিজের চিন্তাকে কেবল একটি স্থায়ী উপলব্ধির কাঠামো দেওয়ার প্রয়াস, যেটি কখনোই তাঁর মন থেকে মুছে যায়নি, আমৃত্যু যাকে তিনি লালন করেছেন। এখানে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। প্রথমে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
“চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদী সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।”
এটিকে কাকতালীয় বিবৃতি বলে মনে করার দরকার নেই। পরবর্তীকালে, ১৯৬৪ সালের কোনো এক সময়ে শেখ মুজিবের সাথে তার কলকাতা জীবনের সতীর্থ ‘মুজিববাদ’ বইয়ের লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের বৈঠক হয়। সে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই এখানে।
‘শেখ মুজিব আমাকে বললেন : তোমরা বামপন্থিরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু করেছ, সে সংগ্রাম সম্পাদন করতে হবে আমাকেই। তাঁর মুখে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি।
আমিও হেসে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম : কীভাবে?

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য

অধ্যায়:: ১৬ [চলমান] [পূর্বে প্রকাশিতের পর]


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]

একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধতা করার তৃতীয় কারণটি রাজনৈতিক। ব্যক্তি-উদ্যোগের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে উৎসাহিত করতে হবে জনকল্যাণের স্বার্থে। কিন্তু দেখতে হবে এটি করতে গিয়ে ব্যক্তি-পুঁজি যেন ‘রাষ্ট্রের পলিসি’ নিয়ন্ত্রণ করার মতো রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে না পারে। রাজনীতি ও পলিসির রথের ঘোড়ার লাগাম থাকতে হবে রাজনীতিবিদ ও রাজ-কর্মচারীদেরই হাতে–সেখানে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়া চাই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা এক্ষেত্রে যেমন সজাগ ছিলেন, তেমনি চিন্তিতও ছিলেন এনিয়ে। সেজন্যেই ইতোমধ্যে উদ্ধৃত অংশে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎসাহ আমরা ততটুকুই দেব, যতটুকু উৎসাহ দিলে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রভাব ঘটাবার সুবিধা ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না।’ স্বাভাবিকভাবেই একচেটিয়া পুঁজি বা বৃহৎ শিল্প-মালিকদের পক্ষে এই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ আরও বেশি। একথা শুধু বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন আহমদই বলেননি, বলেছেন অন্য সাংসদরাও। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ গণপরিষদ বিতর্কে অংশ নিয়ে (১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর) বলেছিলেন, ‘সাবেক পাকিস্তানে যে সমস্যা ছিল, তা দূর করার জন্য যদি মহানবীর বাণীর শত ভাগের এক ভাগও মেনে নিত, তাহলে কুখ্যাত আদমজী, দাউদ, ইস্পাহানীর মতো লোক এদেশে জন্মলাভ করতে পারত না।’ দেখা যাচ্ছে যে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই সেদিনের গণপরিষদে ‘একচেটিয়া পুঁজির’ বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের পক্ষে সমর্থন জানানো হচ্ছিল। এজন্যেই সংবিধানের ১৩নং ধারায় বলা হয়েছিল যে, কেবল ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যেই’ ব্যক্তি মালিকানাকে অপারেট করতে দেওয়া হবে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু সমাজতন্ত্রই (প্রচলিত মডেলের তুলনায়) অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত হবে তা-ই নয়, এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকেও ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হতে হবে। সেদিনই পুঁজির অন্যায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করে তিনি প্রথম উচ্চারণ করলেন ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি। অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা আছে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাকশাল প্রবর্তনের সময় বুঝি বঙ্গবন্ধু প্রথম ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। বস্তুত এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭২ সালেই। সেদিন তিনি বলেছিলেন:
‘মানুষের একটা ধারণা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলছে দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না।
আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে– ঐ শোষকরা যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন। অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারও সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয়ই আমরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইনসিওরেন্স-কোম্পানি, কাপড়ের কল, জুট-মিল, সুগার ইন্ডাস্ট্রি– সব কিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষক-গোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’
১৬.৪। ‘সুযোগের সমতা’ ও ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এসে পড়েছিল। অন্তত সেগুলোকে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। তারপরও এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘স্বকীয়তা’ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের গণপরিষদে একটি সার্বিক সচেতনতা বিরাজ করছিল। এই স্বকীয়তাকে ঢাকা থেকে নির্বাচিত আবু মো. সুবেদ আলী প্রকাশ করেছিলেন এভাবে: ‘‘আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিপলস ক্যাপিটালিজম’ গ্রহণ করি নি। আমরা যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেটে’ও বিশ্বাস রাখিনি। একটি মাত্র দলের কর্তৃত্বে চীন ও রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র, তাও আমরা পূর্ণভাবে গ্রহণ করি নি।’’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রেরণা এসেছে। এরকম একটি প্রেরণা হচ্ছে ‘সুযোগের সমতা’। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজের সকল নাগরিকের জন্য ‘সুযোগের সমতা’ সৃষ্টি করার পাশাপাশি বাস্তবে জীবনযাত্রার মানেও যতটুকু সম্ভব সমতা আনা (যাকে বলা হয়ে থাকে– ‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’)। জাতিসংঘের এমডিজি ও এসডিজি-এর কল্যাণে ‘equality of opportunity’ কথাটি এখন বহুল প্রচলিত একটি ধারণা। কিন্তু এদেশে এটির প্রথম সচেতন ব্যবহার হয় ১৯৭২ সালেই। বাহাত্তরের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় প্রথম উচ্চারিত হয় ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি বা সুযোগের সমতার কথা। সেখানে বলা হয়েছিল: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’। এবং এর আগে ১৫নং ধারায় এই ‘সুযোগের সমতাকে’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল:
‘(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;
(গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার।’
১৮(১) ধারায় আলাদা করে পাবলিক হেলথ্ এবং নিউট্রিশন (পুষ্টির) কথাও বলা হয়েছিল: ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘পুষ্টির’ এই সংযোজন ছিল একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
দেখা যাচ্ছে, আজকের ‘সোশ্যাল প্রটেকশনের’ অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের’ কথা বলেছিল। লক্ষণীয় যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে ‘অধিকারের ভাষায়’ কথা বলা হচ্ছে‒ এই রাইটস্ বেইজড্ অ্যাপ্রোচের জন্ম হবে আরও বহু পরে।
একটি কথা এখানে যোগ করা দরকার। এই যে মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ‘অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-চিকিৎসার’ ধারা বা নির্দিষ্ট করে ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’ ১৫ ধারায় বলা হলো এগুলো এলো কোন উৎস থেকে? মার্কসের লেখাটিতে বলা ছিল যে সাম্যবাদী বিকাশের প্রথম বা নিচু পর্যায়ে বণ্টননীতি হবে নিম্নরূপ: ‘From each according to his abilities, to each according to his work’। এখানে প্রত্যেকে যেন তার সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারে, এবং কাজের পরিমাণ/গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেতে পারে–এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত।
মনে হতে পারে, এগুলো বুঝি ইউরোপীয় ‘সোশ্যাল স্টেট’ বা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর ধারণা থেকে উঠে এসেছে। হয়তো পশ্চিম ইউরোপের বা উত্তর ইউরোপের ‘সামাজিক গণতন্ত্রীরা’ এর পেছনে বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জুগিয়েছেন। আসলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু থেকে এসব দাবি ‘প্রাণের দাবি, বাঁচার দাবি’ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছিল। বিশ্বজোড়া সমাজবদলের ডাকও এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। এই প্রশ্নের একটি মীমাংসা পাই ড. কামাল হোসেনের ব্যাখ্যায়। ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর মৌলিক প্রয়োজন ও অধিকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন:
‘১৯, ২০, ২১ [ধারা]–এগুলোর ব্যাপারে কারও কোন আপত্তি নেই। কারণ, এগুলো বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধান থেকে সন্নিবেশিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে কর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়। সে সম্পর্কে ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে পাওয়া যায়। এটা সোভিয়েত সংবিধানে রয়েছে।’
এই ৩টি অনুচ্ছেদ (১৫, ১৯ ও ২০) সংবিধানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘সমাজতান্ত্রিক ধারা’। বলে রাখি, ১৯(১) ধারায় ‘সুযোগের সমতা’ এবং ১৯(২) ধারায় ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ এবং ‘নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। যদি ১৯(১) ধারায় বলা হয়ে থাকে সুযোগের সমতা (Equality of Opportunity)-এর কথা, ১৯(২) এবং ২০(১) ধারায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘Equality of Outcome’-এর প্রতি। ২০(১) ধারায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল মার্কসের ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ লেখাটির সূত্র ধরে ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্য অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ বণ্টনের নীতি। মোদ্দা কথা, ‘সুযোগের সমতা’ যার উল্লেখ আমরা পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক দর্শনে সুপ্রচুরভাবে পাই (যেমন, জন রাউলস-এর লেখায়) বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সেখান থেকে শুরু করলেও সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেখানে দুর্ভাবনা ছিল জন্মসূত্রে সমাজের বিভিন্ন নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির দুস্তর ফারাক নিয়ে। Initial conditions- এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকলে শুধু বর্তমান সময়ে ‘সুযোগের সমতার’ দাওয়াই দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য এবং সামর্থ্যের (capability) বৈষম্য দূর করা যায় না। জন্মসূত্রে ফারাকের সাথে যুক্ত করতে হয় ‘কপালের লিখন’-এর কথাও। অনেকেই আছেন, যারা বিশুদ্ধ দুর্ভাগ্যজনিত কারণে ব্যবসায় সফল হন না, অথবা আকস্মিক ট্রমার কারণে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারেন না– এককথায়, ‘সুযোগের সমতার’ সদ্ব্যবহার করতে পারেন না এক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি, শুধু ‘সুযোগের সমতা’ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। একারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীরা Equality of Opportunity-এর পাশাপাশি ‘Equality of Outcome’-এর সাংবিধানিক বিধান রেখে গেছেন। এজন্যে তারা ১৯(২) ধারায় ‘সম্পদের সুষম বণ্টন’ নীতি এবং ২০(১) ধারায় মার্কসের ‘শ্রম অনুযায়ী বণ্টন’ নীতি–এ দুই নীতিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আবার পাশাপাশি ১৫(ঘ) ধারায় আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা লাভের গ্যারান্টি দিয়ে গেছেন ‘অধিকারের ভাষা’ ব্যবহার করে।
১৬.৫। নানামাত্রিক শোষণের অবসান
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজের পঞ্চম বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক ও মানবিক গুরুত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না। এই বৈশিষ্ট্যের মূল কথা নিহিত ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্যে। ১৯৭২ সালের ৭ই জুনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের সরলতম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন (যেটা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি): ‘এ সমাজতন্ত্র হলো বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।’ এর পূর্বলেখ (geneological trail) অনুসরণ করলে বহু পেছনে চলে যাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালের ‘পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছিল: ‘আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।’ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ছিল ‘শোষণের অবসান অবশ্যই করতে হবে’ এবং তাতে বলা ছিল– ‘বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৪ নং ধারায় উল্লেখ আছে– এটি ড. আম্বেদকরের ভারতীয় সংবিধানেও নেই– ‘‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে–কৃষক ও শ্রমিককে–এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ সবশেষে উদ্ধৃতি দিতে চাই প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিল থেকে। সেখানে প্রথম পরিচ্ছেদের ১.১২ অধ্যায়ের শিরোনামই ছিল– শোষণের হ্রাসকরণ (reducing exploitation)। ব্যাখ্যায় বলা ছিল: ‘Under the prevailing objective conditions elements of exploitation can only be reduced in phases if the productive process is not to be disrupted।’ এখানে বিভিন্ন দলিল থেকে ‘শোষণহীন সমাজ’ গড়ার যে অঙ্গীকার তুলে ধরা হলো তা শুধু কথার কথা ছিল না। এই অঙ্গীকার ছিল গণমানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, ‘শোষণ’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে (সংগত কারণেই) ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামের কৃষক জনগোষ্ঠীর ওপরে সামন্তবাদী জমিদারি-জোতদারি-জায়গিরদারি শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও সকল প্রকার ‘অন-অর্থনৈতিক শোষণ’ (extra-economic exploitation) শোষণের অবসান প্রসঙ্গে। অর্থাৎ শুধু উৎপাদনকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক শ্রেণিসমূহ– যথা, শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ– তাদের ক্ষেত্রেই দৃষ্টি সীমিত থাকেনি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সকল প্রকার ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে অর্থনৈতিক ও অন-অর্থনৈতিক (সামাজিক, সাংস্কৃতিক) শোষণের অবসান অর্থে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সেটা ব্যবহৃত হয়েছে নারীর প্রতি শোষণমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির অবসানের কল্পে। আজকের যুগে সামাজিক-ধর্মীয়-ভাষাগত-জাতিগত-লিঙ্গগত শোষণ-বঞ্চনার–বৃহত্তর অর্থে, আইডেনটিটি-পলিটিক্সের ডিসকোর্সের–অন্তর্গত ন্যারেটিভ হিসেবে পড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ‘শোষণহীন সমাজ’ ধারণাটিকে। একে শুধু অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা ভাবা ভুল।
সংবিধানের ১৪নং ধারায় কৃষক-শ্রমিকের পাশাপাশি ‘জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের’ কথা উল্লেখ ছিল এবং তাদের ওপরে ‘সকল প্রকার শোষণের’ অবসানের সাংবিধানিক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদে বেশ বিতর্কও হয়েছিল সেদিন সাংসদদের মধ্যে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। লারমা চেয়েছিলেন ১৪নং ধারার ‘অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান’ করার প্রতিশ্রুতিকে আরও সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে। ১৪নং ধারার পর ১৪ক শীর্ষক একটি নতুন অনুচ্ছেদ তিনি সংযোগ করতে চেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে ছিল নিম্নোক্ত সংযোজনী:
‘১৪ অনুচ্ছেদের পর নিম্নরূপ নতুন অনুচ্ছেদটি সংযোজন করা হোক:
১৪ক। সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ও অনগ্রসর জাতিসমূহের
(ক) ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণ করা হইবে;
(খ) শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ-অধিকার দেওয়া হইবে; এবং
(গ) অগ্রসর জাতিসমূহের সহিত সমান পর্যায়ে উন্নত হইবার পরিপূর্ণ সুযোগ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা বিধান করিবেন।’
শেষ পর্যন্ত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংশোধনী-প্রস্তাব গণপরিষদে গৃহীত হলো না। অথচ ভুল শব্দের ব্যবহার (‘সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর জাতি’) সত্ত্বেও একথা তো পরিষ্কার, তিনি শুধু চেয়েছিলেন যে শুধু ‘অনগ্রসর অংশসমূহের’ ওপরে শোষণের অবসানের প্রতিশ্রুতিই নয়, সেটাকে আরও সাংবিধানিক ভাবে দৃঢ় করা হোক কংক্রিট পদক্ষেপের মাধ্যমে। সেকারণেই তিনি বলেছিলেন, (ক) অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিসংক্রান্ত ‘বিশেষ অধিকার’ সংরক্ষণ করতে হবে; এবং (খ) রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে করে কালক্রমে তারা ‘অগ্রসর’ অংশসমূহের সাথে ‘সমান পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরিপূর্ণ সুযোগ পায়’। সেদিনের আনীত সংশোধনী প্রস্তাবে ‘জাতিসমূহ’ কথাটি বাদ দিয়ে লারমার প্রস্তাবিত মূল কথাগুলো ১৪নং অনুচ্ছেদে বাড়তি অনুচ্ছেদ হিসেবে রাখলে কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না। সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদে এসব কথা তো এমনিতেই ছিল (যেমন ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে)। বরং এটা করা হলে পরবর্তীকালে সৃষ্ট জাতিগত বা নৃগোষ্ঠীগত মনঃকষ্ট তৈরি হওয়ার কোনো যৌক্তিক অবকাশই হয়তো আর থাকত না।
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য ‘শোষণহীন’ সমাজ প্রতিষ্ঠার আরেকটি অর্থ হচ্ছে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা বিধান। এটি নানা অনুচ্ছেদেই এসেছে গুরুত্বের সাথে। সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকারের’ অংশে ২৮(১) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে:
(১) ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
(২) ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টিকে শিক্ষা লাভ, বিনোদন, ‘সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা’ প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের বিষয়টি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেসম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-উপলব্ধি ছিল। এজন্যেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নিতে কালবিলম্ব করেননি বঙ্গবন্ধু। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তরুণ মুজিব লিখছেন:
“পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট” এই পুরানো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তাহা আর নয়াচীনে নাই। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিতেছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছে। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।…নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।…যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়াছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের ওপরে। নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়াছে জাতিগঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’
অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোন কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।’

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য

পর্ব :: ১৬


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলোর আলোচনার মূল বার্তা ছিল তিনটি। প্রথমত, প্রথাগত সমাজতন্ত্র ও প্রথাগত (পুঁজিবাদী) গণতন্ত্রের বাইরে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ একটি নিজস্ব অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রয়ে গেছে। মার্কসীয় ও অ-মার্কসীয় উভয় ধারার মধ্য থেকেই এটি যুক্তিতর্ক-রসদ আহরণ করেছে। বার্নস্টাইন থেকে বার্নি স্যান্ডার্স, রবীন্দ্রনাথ থেকে বঙ্গবন্ধু নানাভাবে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ প্যারাডাইম দাঁড় করাতে সাহায্য করেছেন। দ্বিতীয়ত, এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নানা দেশে নানা রূপ ধারণ করতে পারে দেশ-জাতি-ভূগোল এসব অবস্থা ভেদে। তবে বিভিন্ন সম্ভাব্য রূপ সত্ত্বেও আমরা মোটা দাগে দুটি ‘টাইপ’ আবিষ্কার করতে পারি। প্রথম ‘টাইপটি’ হচ্ছে, উন্নত ধনবাদী দেশের ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’, যার সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষে জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসডিপি)-এর দ্বারা। এই ধারার মূলে ছিল ১৮৯১ সালের ‘এরফুর্ট প্রোগ্রাম’। এই কর্মসূচি ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’-এর অন্তর্ভুক্ত ইউরোপীয় পার্টিসমূহের প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে, ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বের হয়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিসমূহ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারাকে আরও বলিষ্ঠ ও জনপ্রিয় করে তোলে, এবং এসব দেশে রাষ্ট্রক্ষমতাতেও আসতে সক্ষম হয়। এর প্রভাব পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এই পারস্পরিক প্রভাবের কারণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ব্যাপক চর্চার পাশাপাশি গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ প্রতিষ্ঠা পায়। পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের এসব দেশে কথিত সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক ধারণা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এ দুইয়ের মধ্যে অন্তিম লক্ষ্যে‒ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্যও ছিল। যা হোক, যেটা বিশেষভাবে বলা দরকার, প্রথম টাইপের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মডেল তৃতীয় বিশ্বের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক ছিল না। এর মূল কারণ, ইউরোপ ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে অবস্থার মৌলিক পার্থক্য। যেন দুই পৃথিবী দুই ‘ভিন্ন সময়ে’ বাস করছিল: একটি ছিল ‘আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেমোক্রেসি’ আর আরেকটি ছিল প্রাগ-আধুনিক পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান ‘দুর্বল গণতন্ত্র’। দুই জায়গাতেই শোষণ-বঞ্চনা, শ্রেণিভেদ-জাতিভেদ ছিল, কিন্তু সোশ্যাল কনটেস্ট, জনগণের মূল্যবোধ এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল ভিন্ন। এই শেষোক্ত পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদল কীরূপ দাঁড়াতে পারে তা নির্ধারণের দায়িত্ব এসে পড়ে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের ওপরে।
তৃতীয়ত, উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কারণে প্রথম থেকেই পুঁজিবাদ-বিরোধিতা ও সমাজতন্ত্র-অভিমুখীনতা একটি স্পষ্ট ধারা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখানে চলছিল রণজিৎ গুহ যাকে বলেছেন‒ Dominance without hegemony, কোনো প্রকার ‘সম্মতি’ আদায় করা ছাড়াই প্রত্যক্ষ নিবিড় শোষণ বা প্রভুত্ব-আরোপ। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বেগম রোকেয়া, প্রমথ চৌধুরী, নজরুল, কাজী আব্দুল ওদুদ, এমনকি পরবর্তীকালে এ দেশের প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক সমাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁরা সকলেই গণতন্ত্রও চেয়েছেন, আবার সমাজতন্ত্রও চেয়েছেন– একটির জন্য অন্যটিকে বিসর্জন দিতে রাজি হননি। বঙ্কিম লিখেছেন ‘সাম্য’; রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন (উগ্র) জাতীয়তাবাদ বিরোধী ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধত্রয়ী, ‘রাশিয়ার চিঠি’ এবং ‘সভ্যতার সংকট’; বিবেকানন্দ লিখেছেন ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র’; নজরুল সম্পাদনা করেছেন বামপন্থি পত্রিকা ‘লাঙল’, লিখেছেন ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ এবং ‘মৃত্যুক্ষুধা’ শীর্ষক রাজনৈতিক উপন্যাস, যেখানে সরাসরিভাবে সর্বহারা, রুশ বিপ্লব ও শ্রমিকশ্রেণির কথা এসেছে; প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ‘রায়তের কথা’; আবুল হুসেন লিখেছেন ‘বাংলার বলশী’; এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। রাজনীতিবিদেরাও– মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ সবাই বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই আদর্শকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উন্নত ধনবাদী দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বলা চলে না। তারা অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিচার করে বুঝেছিলেন, পশ্চিম ইউরোপের স্টাইলে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, এমনকি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ গঠন করা এ দেশের কোনো সরকারের পক্ষে আর্থিক সামর্থ্যের অভাবের কারণেই প্রায়-অসম্ভব। আবার, তারা এ-ও বুঝেছিলেন যে ভিন্নতর সামাজিক-শ্রেণি কাঠামো, রক্ষণশীল মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি মনোযোগ এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ এসবের কারণে বাংলাদেশের মতো সমাজ-পটভূমিতে চীন-সোভিয়েত স্টাইলের অথরেটিরিয়ান সোশ্যালিজমের প্রতিষ্ঠা করাও প্রায়-অসম্ভব প্রস্তাব। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নিকটবৃত্তের সহকর্মীদের জন্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র যেমন একটি সম্ভাবনার আলো দেখিয়েছিল, তেমনি ছুড়ে দিয়েছিল এক বিশাল তাত্ত্বিক ও পলিসি চ্যালেঞ্জ। এসবের প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে স্বাধীনতার আগে ও পরে শেখ মুজিবের বিভিন্ন স্টেটমেন্ট ও ভাষণ; তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ডকুমেন্টস্‌; ১৯৬৬ সালের ৬-দফা, ১৯৬৯ সালের ১১-দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ও ১৯৭২ সালের সংবিধান; প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিল; স্বাধীনতার পরে স্বল্প সময়ের মধ্যে হাতে নেওয়া প্রতিকূল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বিশ্ব-পরিস্থিতিতে গৃহীত বিভিন্ন নীতি-পদক্ষেপ। এসবের বিচারের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি ‘অবয়ব’ আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। যার তাত্ত্বিক, প্রায়োগিক ও আদর্শিক প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও সুপ্রচুরভাবেই রয়ে গেছে। এর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা অবশ্য বর্তমান প্রবন্ধের আয়ত্তের বাইরে। আমরা প্রবন্ধের এই অংশে শুধু বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রধান সাতটি বৈশিষ্ট্যের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করব।
১৬.১। মিশ্র অর্থনীতি
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো এর ‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ চরিত্র। যদিও ‘মিশ্র অর্থনীতি’ (mixed economy) শব্দটি তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ডিসকোর্সের ‘লেঙ্কিনে’ প্রবেশ করেনি– বাহাত্তর সালের গণপরিষদ বিতর্কে কদাচিৎ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে– তাহলেও পরিকল্পনাবিদদের ‘অ্যাপ্রোচ’ ছিল এটাই। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা ছিল ‘রাষ্ট্রীয়’, ‘সমবায়ী’ ও ‘ব্যক্তিমালিকানার’ কথা। একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশকে আধুনিক শিল্পোন্নত স্তরে উন্নীত করতে গেলে সচেতনভাবে বহু-গাঠনিকতাকে (multistructuralism) লালন করতে হবে। পশ্চাৎপদ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ শুধু দীর্ঘই হবে না, এটি হবে বহু-গাঠনিক কাঠামোসম্পন্ন। অর্থাৎ, এখানে যেমন থাকবে খুদে উৎপাদকদের খাত, তেমনি থাকবে সমবায়ী খাত; এর পাশাপাশি থাকবে পুঁজিবাদী খাত নানা টাইপের; আর থাকবে শক্তিশালী ও দক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত। এ সম্পর্কে লেনিন ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ নীতিমালা আলোচনার সূত্রে পথিকৃত আলোচনা করেছিলেন সেখানে থাকতে হবে শক্তিশালী ও দক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত– যেটি পরিকল্পনামতো স্ট্র্যাটেজিক খাতসমূহে বিনিয়োগ করবে এবং জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় আয়/সম্পদ পুনর্বণ্টনমূলক পদক্ষেপও নেবে। স্বাধীনতার উষালগ্নে অবাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল, তাদেরকে জাতীয়করণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। বাংলাদেশে ‘জাতীয়করণ’ নীতি যথেষ্ট কড়াকড়ি করে করা হয়; এজন্যে সংবিধানে ৪৭নং ধারা যুক্ত করা হয় যার বলে যে কোনো শিল্পকে জাতীয় স্বার্থে ‘ন্যাশনালাইজ’ করার এখতিয়ার সংসদকে দেওয়া হয়। কোনো কোর্ট বা বিচার ব্যবস্থা এই জাতীয়করণের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত না। বঙ্গবন্ধু এই কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন। কারণ, তার যৌক্তিক ভয় ছিল যে বিদেশ থেকে কলকারখানার অবাঙালি মালিকরা উচ্চ আদালতে জাতীয়করণের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন। ঠিক একই কারণে বাঙালি মালিকানাধীন ইপিআইডিসি-সমর্থিত মুষ্টিমেয় কলকারখানাকেও জাতীয়করণ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। কেননা, একে তো এদের একটি অংশ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন; তদুপরি যারা করেননি, তাদেরকে তাদের পাকিস্তান আমলের কলকারখানা রাখতে দিলে অবাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানাকে জাতীয়করণ করা যেত না, বা সেটা উচ্চ আদালতে অবধারিতভাবে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। যেহেতু ১৯৭২ সালে এ দেশের বৃহদায়তন কলকারখানার সিংহভাগই (প্রায় ৮০ শতাংশ শিল্প-পরিসম্পদ) ছিল অবাঙালি মালিকানাধীন, এই প্রশ্নে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ ছিল না সদ্য-স্বাধীন দেশের সরকারের পক্ষে। এটি বঙ্গবন্ধু ও তার নিকটতম সহকর্মীদের মনে ‘হাই-প্রায়োরিটি’ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত ছিল সেদিন। সংবিধানের খসড়া লেখার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যে দুটো বিষয়ের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেগুলো হলো জাতীয়করণ ও জাতীয়করণকৃত শিল্পের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঝুঁকির বিষয়টি (অন্যটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা দমন ও ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব)। অন্য আরেকটি বিষয়ও বঙ্গবন্ধুর তৎকালের উদ্বেগের কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে Floor Crossing নিবারণের জন্য ৭০ নম্বর ধারা। বিষয়টি জটিল। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলের তিক্ত স্মৃতি মুজিবের মনে জাগরূক ছিল। ১৯৫০-র দশকে ‘ফ্লোর ক্রসিং’-এর কারণে প্রায়ই মন্ত্রিসভা ভেঙে যেত এবং সরকারের পতন হতো। সরাসরি সম্পর্কিত নয় বলে সেটি এখানে আলোচনা করা হলো না।
আনিসুজ্জামান (২০১৫) লিখেছেন:
‘১৯৭২ সালে বাজেট-বক্তৃতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় এবং তার আগে-পরে নানা দলের ইশতেহারে কিংবা নানারকম সম্মেলনের প্রস্তাবে ব্যাংক, বীমা, চা ও পাটশিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ছিল। এ নিয়ে বড় একটা আপত্তিও শোনা যায়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন প্রধান প্রধান শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হলো, তখন ‘গেল, গেল’ রব পড়ে গেল এবং এই ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যে ভারতের স্বার্থ বা ইঙ্গিত আবিষ্কৃত হলো। সমালোচনা প্রবল হয় বাঙালি মালিকানাধীন শিল্প অধিগ্রহণ করায়। কিন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি পরিচালনাধীন ব্যাংক তার থেকে বাদ দেওয়া কিংবা পাটশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি মালিকানাধীন পাটশিল্প তার আয়ত্তের বাইরে রাখা তো সম্ভবপর ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান আমলের সরকারি উদ্যোগ এবং পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি …।’
‘গেল, গেল’ রব সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের বক্তব্য আরও খতিয়ে দেখা দরকার। সেসময়ের দৈনিক পত্রপত্রিকা (‘হলিডে’, ‘হককথা’ সহ) ঘেঁটে আমি এর সপক্ষে কোনো ‘প্রকাশিত প্রমাণ’ পাইনি। বরং ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি জাতীয়করণ কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে অতি অল্পই ‘বিরুদ্ধতা’ শনাক্ত করা যায়। জাতীয়করণ করার কারণে রাতারাতি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের চৌহদ্দি বেড়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত শক্তিশালী করা হলেও এই মডেলের সাথে ‘স্টেট-সোশ্যালিজম’ ধারার এক মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত বৃহদায়তন কলকারখানার প্রায় ১০০ শতাংশ জাতীয়করণ করে নেয়। কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ– যথা সোভিয়েত ইউনিয়নে– মাঝারি শিল্পের পুরোটাই রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পকে প্রায় পুরোপুরিভাবে ব্যক্তি খাতে রাখা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্রমশ ‘সিলিং বাড়িয়ে’ বৃহদায়তন শিল্প-বাণিজ্য খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন উদ্যোক্তা শ্রেণির পলিসি গ্রহণের মাত্রা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার মাত্রাকেও (level of entrepreneurship) বিবেচনায় নিতে হবে। রুশ গবেষক সের্গেই বারানভের মতে, পাকিস্তান আমলের শেষে বৃহদায়তন শিল্প খাতে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা একেবারেই হাতে-গোনা ছিল নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মাত্র ১৬টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপ। বাদবাকি যারা বাঙালি উদ্যোক্তা ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী বা ইন্ডেন্টার, যাদের আধুনিক কলকারখানা চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ১৯৭২ সালে। এটি বিশিষ্ট শিল্পপতি সালমান এফ রহমানও একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন।
এই ধারার ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কাছে ইচ্ছে করলেই চটজলদি বৃহদায়তন শিল্প– তা সে একদা অবাঙালি মালিকানাধীন ‘পরিত্যক্ত’ কারখানাই হোক, আর নতুন করে সরকারি ব্যাংক-অর্থায়িত শিল্পই হোক– নিঃশর্তে ছেড়ে দেওয়া যেত না। এটাই প্রধান কারণ কেন ১৯৭৬-১৯৮১ পর্বে অ-সমাজতান্ত্রিক জেনারেল জিয়ার আমলে কোনো কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়কৃত করা হয়নি– এমনকি পাকিস্তান আমলের বাঙালি মালিকানাধীন কলকারখানাগুলোও ঐ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। জিয়া চেষ্টা করেছিলেন সরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ ঢেলে নতুন শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি করার, যারা ভবিষ্যতে আধুনিক কলকারখানা চালাতে সক্ষম হবেন। এই নীতি সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৭৬-৮১ পর্বে প্রদত্ত ১০০০ কোটি টাকা শিল্পঋণের ৯০ শতাংশই আর কখনোই ব্যাংকে ফেরত আসেনি এবং সেদিনের ঋণগ্রহীতাদের ৯৬ শতাংশই ছিলেন আউটরাইট ডিফল্টার। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, ১৯৭২-৭৫ পর্বে বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণির ‘বিকাশের মাত্রা’ বিবেচনায় বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রদত্ত ‘সিলিং’ যথোপযুক্তই ছিল অর্থাৎ বেশিও ইনসেনটিভ দেওয়া হয়নি, কমও ইনসেনটিভ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাখ্যাই যথার্থ:
‘ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েছে দেখে সেটার জন্য সমাজতন্ত্রের দাবিদার একটা দল বলেছে যে, এটা সমাজতন্ত্র হয়নি, আবার আর একটা দল বলেছে যে, ব্যক্তিগত মালিকানা যা দেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি, খুব কম দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত মালিকরা বড় ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, দুই দলের কথায় যখন তাঁরা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁদের কারও কথায় কর্ণপাত না করে আমরা যেটা দিয়েছি, সেটাই তাঁদের গ্রহণ করা উচিত। কারণ, এটা সুসামঞ্জস্য হয়েছে এবং সুসমন্বিত হয়েছে।’
১৬.২। ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম
প্রথাগত সমাজতন্ত্রের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো এটি রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অর্থনৈতিক উদ্যোগকে পূর্বনির্ধারিত আদর্শের বা আইডিওলজির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে একটি প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছে।
এই প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মতো ১০০% বা ৮০-৯০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার’ অর্থনীতি না করে মালিকানা-সম্পর্কের (property relations) বিষয়টিকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত করা। কৃষিপ্রধান ও বন্যা/দুর্যোগপ্রবণ অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির অপরিসীম গুরুত্ব বঙ্গবন্ধুর নানা বক্তৃতায় সেসময়ে উঠে এসেছে। এর জন্য সবধরনের মালিকানা-সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছিল মুজিব সরকার। দ্বিতীয় কথা হলো, বিভিন্ন ধরনের মালিকানার মধ্যে ‘অনুপাত’ কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। কোনটা কখন কোন খাতে প্রাধান্য পাবে, সেই প্রশ্নটিকে কালক্রমে পরিবর্তনযোগ্য বলে ভাবা হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি-সমবায়ী খাতের মধ্যে তুলনামূলক গুরুত্ব পরিবর্তিত হবে এটাই ছিল উপলব্ধি। গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য– উদাহরণস্বরূপ বলছি– ব্যক্তিমালিকানাধীন স্ব-উদ্যোগের পাশাপাশি সমবায়ী-উদ্যোগ বা গ্রুপ-উদ্যোগ বা যৌথ-উদ্যোগের ভূমিকা সময়ের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোট কথা, বিভিন্ন মালিকানা সম্পর্কের মধ্যে রেশিও (Ratio) কী দাঁড়াবে, ‘পরিকল্পনা’ ও ‘বাজার’-এর মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কীরূপ হবে, তা খাতভেদে এবং সময়ের সাথে বদলাবে। দেশের মানুষের পছন্দ-অপছন্দও এখানে বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি বারবার এনেছেন ‘মাল্টিপারপাস’ কো-অপারেটিভের ওপরে নিরীক্ষামূলক কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে: কোনোক্রমেই জবরদস্তি করা যাবে না; ব্যাপারটা পরীক্ষামূলকভাবে সফল হলে তবেই ছড়িয়ে দেওয়া হবে; যার যার কৃষিজমি তারই মালিকানায় থাকবে। প্রথাগত সমাজতন্ত্রে এই বিষয়গুলো মানা হয় না। জবরদস্তিমূলক সমবায়ীকরণ এ কারণেই ঘটেছে নানা সমাজতান্ত্রিক দেশে, আর এর প্রতিফল উৎপাদন ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হয়েছে মারাত্মক। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে মালিকানা-সম্পর্কের বিষয়টিকে উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা ও জনকল্যাণের অধীন পলিসি-ডিসিশন হিসেবে দেখা হয়েছে। এ জন্যই আমরা বলেছি যে, ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের এই ‘বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান’ সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিদেশি অর্থনীতিবিদ-বিশেষজ্ঞদেরও নজর পড়েছিল।
শেখ মুজিবের প্রায়োগিক ও বাস্তবজ্ঞানমণ্ডিত মনের কথা যখন উঠলই, তখন আরও একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চাই। পাকিস্তানের অপশাসনের দিনগুলোর কথা মনে করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তার ‘ক্রমান্বয়ে চলার নীতি’: ‘আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বৎসর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি জানি এদের সঙ্গে মানুষ থাকতে পারে না। আমি ইম্পেশেন্ট হই না, আমি অ্যাডভেনচারিস্ট নই। আমি খোদাকে হাজের নাজের জেনে করি, চুপি চুপি, আস্তে আস্তে মুভ করি সবকিছু নিয়ে।’ এদিক থেকে দেখলে শেখ মুজিব ও দেং শিয়াও পিং-এর মধ্যে একটি প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরা দু’জনেই ছিলেন (রবিনসনের ভাষায়) ‘প্র্যাকটিক্যাল ও প্র্যাগমেটিক’ মনের মানুষ। দেং শিয়াও পিং-এর মতো মুজিবও বলতে পারতেন যে বিড়াল কালো না সাদা সেটা বড় কথা নয়, এটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা সেটাই চূড়ান্তভাবে বিচার্য। মুজিবও এ রকম উদাহরণ দিয়ে তার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছেন। ‘লার্নিং বাই ডুয়িং’-এর কথা বলেছেন তিনি: ‘কেউ করে শেখে, কেউ দেখে শেখে, আর কেউ বই পড়ে শেখে। আর সবচেয়ে যে বেশি শেখে সে করে শেখে।’ যারা আইডিওলজির চশমা পরে পৃথিবীটাকে দেখে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন মাটির কাছাকাছি থাকার কথা:
‘এদের আমি বলতাম, জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলেছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।’
প্র্যাগমেটিক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, জনকল্যাণের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া, অথবা স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থেকে সরে আসা। সেটি স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুর পূর্বাপর ‘একচেটিয়া পুঁজি’বিরোধী অবস্থানের মধ্য দিয়ে।
১৬.৩। একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে অবস্থান
পুঁজিবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ সমার্থক ধারণা নয়, যদিও পুঁজিবাদী বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে ‘মনোপলি ক্যাপিটালিজম’-এর আবির্ভাব হয়। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের তৃতীয় বৈশিষ্ট ছিল একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত ও অনমনীয় অবস্থান। কোনোভাবেই পাকিস্তান আমলের মতো ‘বাইশ পরিবারের’ হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত হতে দেওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্যারাডাইমের জন্য একটি মৌলিক ডাইলেমা। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হলো ক্রমশ পুঁজির ‘কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন’ (centralizaation and concentration of capital)। এর ফলে প্রতিটি খাতেই কমবেশি আগে-পরে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ঘটতে থাকে। বিংশ শতকের গোড়া থেকে উন্নত ধনবাদী প্রতিটি দেশে (সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ) কার্টেল, সিন্ডিকেট, করপোরেশন প্রভৃতি ‘মনোপলি ফরমেশন’ ঘটতে থাকে। এখনকার দুনিয়ায় ট্রান্সন্যাশনাল, মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশন এবং ‘বিগ বিজনেস হাউস’ ছাড়া আধুনিক পুঁজিবাদকে কল্পনাই করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব বৃহৎ করপোরেট পুঁজির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের (technological leadership) কারণে। এর প্রচলিত উদাহরণ হেনরি ফোর্ড থেকে বিল গেটস অবধি বিস্তৃত। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাড়তি মুনাফা লাভ এবং দ্রুত পুঁজি সঞ্চয়ন অবধারিত হওয়ায় বা করপোরেট পুঁজির বিষয়টাকে আর ক্রিটিক্যালি দেখা যাবে না, ব্যাপারটা এমন নয়। এখানে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অবস্থান থেকে মূল অভিযোগ তিনটি।
প্রথমত, একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণহীন বিকাশের কারণে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে সমাজে। উন্নত ধনবাদী দেশসমূহে এই লক্ষণ গত তিরিশ বছরে আরও প্রকট হয়েছে। এ সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেছেন এবং লিখছেন টমাস পিকেটি (২০১৪), ইমানুয়েল সায়েজ ও গাব্রিয়েল জুকম্যান (সায়েজ ও জুকম্যান, ২০১৯)। এদের নিজস্ব রচনা এবং যৌথভাবে লেখা ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট’ (দেখুন, আলভারেডো ও অন্যান্য, ২০১৮) এ বিষয়ে তথ্য-পরিসংখ্যান জড়ো করেছে। অর্থনীতিবিদরা এ ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী বিজনেস গ্রুপ ও করপোরেশনসমূহের মেজর শেয়ারহোল্ডার এবং ‘ম্যানেজেরিয়াল ক্লাস’-এর জন্য বর্ধিত হারে ক্যাপিট্যাল ও ইনকাম ট্যাক্সের প্রস্তাব করেছেন। আমাদের দেশেও বহুদিন ধরে সম্পদ করের (wealth tax) বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, যদিও এখনও পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে যেতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিষয়টা শুধু আয়বৈষম্যের নিরিখেও বিচার করলে চলবে না। উন্নত ধনবাদী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেসব খাতে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশের মাত্রা বেশি, সেসব খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ‘মার্কেট শেয়ার’ তত কম, এবং শেষোক্ত শিল্পে ‘মর্টালিটি রেটও’ তত বেশি। এর কারণ, বৃহৎ করপোরেট পুঁজি আইনি ও বেআইনি যে কোনোভাবেই হোক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে দেয় না। বৃহৎ পুঁজির হাউসগুলো অনেক সময় নিজেদের মধ্যে এমন কিছু প্রযুক্তিগত ও প্রোডাক্টের ফিচারগত ‘অ্যালায়েন্স’ তৈরি করে নেয়, যার ফলে ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনকারীরা স্বাধীনভাবে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। সমুদ্রে বড় মাছের পেছনে পেছনে যেমন কিছু ছোট মাছের দল ঘুরে বেড়ায়, বৃহৎ পুঁজির কাছে আনুগত্য স্বীকার করেই কেবল ক্ষুদ্র-মাঝারি পুঁজি ‘মার্কেটে টিকে থাকার’ চেষ্টা করে। এ কারণে প্রতিটি উন্নত ধনবাদী দেশেই শক্ত ধরনের ‘এন্টি-ট্রাস্ট’ আইনের প্রবর্তন করা হয়েছিল গত শতকের ৫০-৬০-এর দশকেই, কিন্তু তারপরও একচেটিয়া পুঁজির ঘনীভবনকে ঠেকানো যায়নি বেশির ভাগ দেশেই। এই সমস্যাটিকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র দৃঢ়ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করবে।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


পঞ্চমত, কমন গুড-এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য ও গণশিক্ষা ছাড়াও চলে আসবে গণপরিবহনের প্রসঙ্গ। দেশের গণপরিবহন ‘গণ’ ছাড়া চলবে তা তো হতে পারে না। উচ্চবিত্তরা চলবেন প্রাইভেট গাড়িতে; মধ্যবিত্তরা চলবেন গাড়িতে বা উবারে করে, অথবা রিকশায় চড়ে; আর গরিবরা চলবেন বাসে-টেম্পোতে করে, আর অতিদরিদ্ররা হেঁটে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মতো পরিবহন খাতেও চলছে নানামুখী ধারা। কেবল নেই তাতে প্রকৃত অর্থে গণপরিবহন, যেখানে ধনী-মধ্যবিত্ত-গরিব একসঙ্গে চলে। অথচ উন্নত দেশে ভ্রমণের প্রথম চোখে পড়ার বিষয়ই হলো সেখানকার গণপরিবহনের বিকশিত রূপ। বাসে বলুন, ট্রামে বলুন, ট্রলি বাসে বলুন, ট্রানজিট রেলে অথবা মেট্রোতে বলুন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষই একসঙ্গে চড়ছে ও চলছে। এই একই দৃশ্য আমি ছাত্রাবস্থায় মস্কো শহরে দেখেছি এবং পরবর্তীকালে কর্মজীবনের বড় অংশ যেখানে কেটেছে সেই ওয়াশিংটনে দেখেছি। অর্থাৎ সনাতনি সমাজতন্ত্র ও আধুনিকতম পুঁজিবাদে গণপরিবহনকে গুরুত্বপূর্ণ ‘কমন গুড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিভক্তি থাকবেই, কিন্তু তাই বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো প্রকট বিভক্তি থাকতেই হবে এমন কোনো কঠোর নিয়ম নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা মাত্রাতিরিক্তভাবে বিভক্ত। এই শ্রেণিবিভক্ত পরিবহন ব্যবস্থা দূর না হলে এবং প্রকৃত অর্থে সবার জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো সবার জন্য গণপরিবহন (তথা ‘সিস্টেম অব মাস ট্রানজিট’) প্রবর্তিত না হলে গণতন্ত্র সকলের জন্য অর্থবহ হবে না। এটা চলতে থাকলে ক্রমাগত যানজটে ও বায়ুদূষণে শুধু যে স্বাস্থ্যহানি ও কালক্ষেপণের অর্থনৈতিক মাশুল দিতে হবে তা-ই নয়। আমার ধারণা, উপযুক্ত গণপরিবহন না থাকার কারণে আমাদের ‘প্রাইভেট সেভিংস’ কমে যাচ্ছে (টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত যানবাহন কেনার জন্যে); শহর এলাকায় বসতি আরও বেশি ঘন হয়ে উঠছে এবং বাড়িভাড়া আরও বেশি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ছে, যার ভুক্তভোগী সবাই কম-বেশি হচ্ছেন, কিন্তু বিশেষভাবে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্নবিত্তের মানুষেরা। সমাজতন্ত্রীরা এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। প্রকৃত অর্থে সবার জন্য সুলভ ও নান্দনিক গণপরিবহন শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রেরও দাবি।

ষষ্ঠত, জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও গণপরিবহন এদের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান হচ্ছে পরিবেশসম্মত উন্নয়ন এবং নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন (শেষেরটি না বললেও চলে)। দুঃখের বিষয়, ঐতিহাসিকভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলো যখন গড়ে উঠেছিল এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল তখন পরিবেশ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে এসব দেশ পরিবেশ বিষয়ে আরও সচেতন হয়ে ওঠে এবং নানামুখী উদ্যোগ নিতে থাকে। আমাদের দেশে কী বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, কী উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নির্বাচনে পরিবেশ-সচেতনতাকে যথেষ্ট আমলে নেওয়া হয় না। নদী নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা প্রকল্পগুলোয় অনেক ক্ষেত্রেই নদীরক্ষা বা শহররক্ষার নামে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি এখন এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গেছে যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র উপন্যাসের নামের মতো চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠেছে কেবলু ‘কাঁদো, নদী কাঁদো’। নদীমাতৃক দেশে আমরা এখনও নদীভিত্তিক পরিবহন ও জনপদ গড়ে তুলতে পারিনি। নদী মরুভূমিতে হারিয়ে যায়নি, পানি উন্নয়ন পরিকল্পনার ফাঁদে পড়ে এমনকি স্মৃতি থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী নিশ্চিহ্ন, আর বেঁচে-বর্তে থাকা প্রায় অধিকাংশ নদীর শাখা-প্রশাখা মরে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত সমস্যাবলি। পরিবেশের পরিবর্তনের ঝুঁকির সঙ্গে মানানসই শহর কী করে গড়ে তোলা যাবে- এসব প্রশ্ন উঠছে। উপদ্রুত উপকূলের জনপদ ভাঙনের মুখে। বাংলাদেশ দুঃস্বপ্ন দেখে- সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ সমুদ্রের নোনাজলে তলিয়ে যাচ্ছে। একই সমস্যা দেখি বন-পাহাড় রক্ষার ক্ষেত্রেও। পাহাড় বৃক্ষহীন, বন উজাড়, পাহাড়ে নামছে ধস, বিপন্ন পশু-পাখি- তারা কার কাছে ফরিয়াদ চাইবে? সমাজতন্ত্রীরা এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।

সবশেষে বলব, বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় আয়-বৈষম্য নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের মানদণ্ডে কিছুটা বেশি। এই বৈষম্য সময়ের সঙ্গে অল্প অল্প করে বাড়ছে। এখন সেটা বেড়ে প্রায় বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বৈষম্য মাপার জিনি সূচক ১৯৭৩/৭৪ সালের ০.৩৬ থেকে ক্রমশ বেড়ে ২০১৬/১৭ সালে ০.৪৮-এ এসে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃত আয়-বৈষম্য আরও বেশি হবে, কেননা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ধনী লোকেরা বিবিএসের আয়-ব্যয় জরিপে কদাচিত অন্তর্ভুক্ত হন। শুধু আয়-বৈষম্য নয়, সম্পদ-বৈষম্যেও আমাদের অবনতি হচ্ছে। ২০১৯ সালের MICS জরিপ অনুযায়ী সারা দেশের মাত্র ৬ শতাংশ খানায় কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আছে; ৫০ শতাংশের এখনও একটি টেলিভিশন নেই; ইন্টারনেট যোগাযোগ নেই ৬২ শতাংশ গৃহে।

কেউ কেউ বলতে পারেন, দেশে যে বৈষম্য বাড়ছে এতে অতটা দুশ্চিন্তার কিছু নেই। স্বল্প-আয়ের দেশগুলোয় আয়-বৈষম্যের মাত্রা কম থাকে; এরপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় আয় বাড়তে থাকলে আয়-বৈষম্য বাড়তে থাকে; সেটি বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে এসে আবার কমতে শুরু করে। অর্থাৎ আয়ের সঙ্গে বৈষম্যের মাত্রার সম্পর্ক সরলরেখার মতো নয়। প্রথমে কম, মাঝখানে বেশি, এবং সবশেষে আবারও কম। এই প্রবণতাকে নোবেল-অর্থনৈতিক সাইমন কুজনেস্‌ প্রথম শনাক্ত করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে জরিপের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বিচার করলে বৈষম্যের কমা-বাড়া-কমার প্রবণতা আর প্রমাণিত থাকছে না। আয় বাড়লেও বৈষম্য কমার লক্ষণ নেই; এমনকি বৈষম্যের উল্লম্ম্ফনের জন্যেই ওইসব দেশে জাতীয় আয় যথাযথভাবে বাড়তে পারছে না। গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে, যেসব দেশে বৈষম্য অতি উচ্চমাত্রায় (জিনি সূচক ০.৫০-র থেকে বেশি) অবস্থান করছে, সেসব দেশে প্রবৃদ্ধি একসময় শ্নথ হয়ে আসে এবং দারিদ্র্য নিরসনের গতিও থমকে যায়। মোট কথা, জাতীয় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়-বৈষম্যও বাড়ছে-এতে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ওপরের আলোচনা থেকে এটুকু স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘কমন গুড’ তথা জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, গণপরিবহন, পরিবেশ সংবেদনশীল উন্নয়ন বিষয়ে অনেক প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে গেছে। সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে সমতামুখীন সমাজ চেয়েছিলেন তা এখনও ‘অসমাপ্ত প্রকল্প’ হিসেবেই রয়ে গেছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং আদর্শিক আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। শাসক দল আর ৫০ বছর আগেকার মতো গরিব-মধ্যবিত্তের পার্টি নয়; এটি এখন অনেক বেশি ধনিক শ্রেণিনির্ভর পার্টি। ১৯৭২-৭৫ সালে যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ছিলেন তারা এখন হয়তো উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা ধনিক শ্রেণির কাতারে। এর পেছনে খানিকটা তথ্য-প্রমাণও রয়েছে। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টে সংসদ-সদস্যের বেশিরভাগই ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মধ্য কৃষক, চিকিৎসা, শিক্ষকতা বা আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। খুব কমই ছিলেন তখন বৃহৎ ট্রেডার ও শিল্পপতি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন সংসদ সদস্যের অধিকাংশই কোনো-না-কোনো শিল্পের মালিক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। মধ্য কৃষক বা মধ্যবিত্ত ঘরের থেকে আসা সংসদ সদস্য খুবই কম (কৃষক-শ্রমিক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা সংসদ সদস্য নেই বললেই চলে)। এ তথ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের বিশ্নেষণ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সংসদ-সদস্যদের শ্রেণি-পরিচয়ে এই ধনিক-অভিমুখীনতার কারণে বিশেষ কায়েমী স্বার্থের বলয়ের দ্বারা অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এবং এই যুক্তিতে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা ও গণপরিবহনের ক্ষেত্রে নাটকীয় শুভ পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে বৈকি। বৈষম্যরোধকারী নীতিমালা গ্রহণেও সংসদ সদস্য বা নীতিপ্রণেতাদের তৎপর হতে দেখা যায় না তেমন। কররাজস্ব নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে (যেমন সম্পদ-কর বসানোর ক্ষেত্রে) অথবা সরকারি ব্যয় বরাদ্দে সামাজিক সুরক্ষার অংশ বাড়ানোর ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ‘কমিটমেন্ট’ আবশ্যক ছিল তা দৃশ্যত পরিলক্ষিত হয় না। সংসদের অধিকাংশ সদস্য উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনিক শ্রেণিভুক্ত হওয়ার কারণে গরিব শ্রেণি অভিমুখীন নীতিমালা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। শুধু তা-ই নয়, কেবল ধনিক শ্রেণির স্বার্থে নীতিমালা বা প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার (যাকে বলে ‘পলিসি ক্যাপচার’ বা ‘রেন্ট ক্যাপচার’) আশঙ্কা দেখা দেয়।

কিন্তু এই যুক্তিটা সঠিক না-ও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী ধনিক শ্রেণি বা ক্লাসিক বুর্জোয়া পরিবার-গোষ্ঠী আদিতে না থাকার কারণে ধনিক পরিবারের সংখ্যা কালক্রমে বেড়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র হাতে-গোনা কিছু পরিবারের কাছে জিম্মি হয়নি। এই যুক্তিতে যেভাবে ভারতে টাটা-বিড়লা বা পাকিস্তানে আদমজী-দাউদ কয়েকটি একচেটিয়া (মনোপলি) পরিবার শিল্প-ব্যবসা খাতে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের দেশে এখনও সেই প্রবণতা দেখা দেয়নি। বেসরকারি ব্যাংক-বীমা ও শিল্প খাতে শতাধিক বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠী বিচরণ করলেও তাদের নীতিমালা প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা সীমিত। এদের একটা বড় অংশেরই রয়েছে রপ্তানিমুখীন গার্মেন্টস শিল্প চালানোর অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ এক দশক বা দুই দশক আগেও তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদের এখনও মনোপলি বা একচেটিয়া পুঁজির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। ফলে তাদের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের তরফে (নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে) এখনও একটি আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা ‘রিলেটিভ অটোনমি’ রয়ে গেছে। সবকিছুর জন্যে তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার নেই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। এর ফলে-কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া-অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা তাদের উন্নয়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন সেসবের দ্রুতই সমাধান করা গেছে। কভিড-উত্তরকালে প্রবৃদ্ধি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্র দ্রুতই তার মীমাংসা দিতে পেরেছে। কভিড-উত্তর ইনসেনটিভ প্যাকেজের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই বেসরকারি গার্মেন্টস্‌ খাতের জন্য ব্যয়িত হয়েছে ‘ওয়েজ সাবসিডি’ হিসেবে। এর সুফল পেয়ে থাকবেন গার্মেন্টস্‌ কারখানার শ্রমিকেরা। তারপরও বলতে হয়, বেসরকারি খাতনির্ভর উন্নয়নের পথে নতুন প্রযুক্তি বা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলেও বেসরকারি মালিকদের সংগঠন বা সাধারণভাবে এদেশের পুঁজিপতি শ্রেণি নিজের গরজে এদেশের রাষ্ট্রকে একটি ‘জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে’ (‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’) পরিণত করে ফেলবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। হয় শক্ত হাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব (যেমন, বিসমার্কের জার্মানিতে ‘সোশ্যাল স্টেট’-এর ক্ষেত্রে) বা দেশের ভেতরে ‘নিচে থেকে’ গড়ে-ওঠা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন অথবা শাসক দলের ওয়েলফেয়ার স্টেটমুখী সচেতন পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ চিন্তাধারাকে একবিংশ শতাব্দীর পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করতে পারে। শুধু বেসরকারি ব্যবসায়ী শিল্পপতি-ব্যাংকারদের দিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন, সংসদ বা শ্রেণি এককভাবে এই কাজটি করতে পারবে না।

[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


সমাজতন্ত্রের অর্থ যদি হয় সামাজিক ন্যায়বিচার (সোশ্যাল জাস্টিস), আর সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থ যদি হয় ‘ন্যায়ের’ বাস্তবায়ন, তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- ন্যায় কী এবং সেই ন্যায়দর্শনের ভিত্তি কী? নিচের উদাহরণটি প্রমাণ করে, সব সময় এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। প্রায়োগিক নীতিমালা অনেক সময় ডগমাটিক হলে চলে না। অবস্থাভেদে নীতিকে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনকে আশ্রয় করে চলতে হয়। অমর্ত্য সেন একটি ছোট্ট উদাহরণের মাধ্যমে এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইতে যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের চেহারা কেমন হওয়া উচিত- তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বইতে পাত্রপাত্রীর নাম তিনি যেভাবে দিয়েছেন, এখানে আমি তা একটু বদলে দিলাম। ধরা যাক, যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের নাম আসগর, করিম ও শ্যামল। এদের মধ্যে একটি বাঁশি কে পাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসগর খুব ভালো বাঁশি বাজায়। এটা শ্যামল ও করিম উভয়েই জানে। যেহেতু এটি রাষ্ট্র থেকে দেওয়া হচ্ছে, তাই বাঁশিটা পাওয়ার অধিকার তারই। আবার করিমের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। সে কখনও এমন সুন্দর বাঁশি দেখেনি। এমন একটি বাঁশি পাওয়ার আকুতি তার মধ্যে আছে। তারও দাবি, তাকেই এটা দেওয়া হোক। আর এদের মধ্যে শ্যামলের দাবি, বাঁশি বানানো তার পিতৃপুরুষের কাজ, সে-ই এই বাঁশি বানিয়েছে। তার থেকেই রাষ্ট্র নিয়েছে, এখন দিতে চাইছে। তাই এটি তারই প্রাপ্য। এখন কার বাঁশি পাওয়া উচিত, সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে তা দেখতে চাইলে একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেক ধরনের উত্তর পাব। যিনি দক্ষতাকে সম্পদ বণ্টন বা পুনর্বণ্টনের মূল ভিত্তি বলে মনে করেন, তিনি আসগরকে বাঁশি দেওয়ার পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যারা হিতবাদী (ইউটিলিটারিয়ান) দর্শনের লোক, যাদের মধ্যে জেরেমি বেন্থাম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উদারনৈতিক বা লিবারেল দর্শনের প্রবক্তারাও পড়েন, তারা বলবেন- করিমকেই এটা দেওয়া সামাজিকভাবে ন্যায়সংগত। আবার মার্ক্সবাদীরা যুক্তি দেবেন, শ্যামলের বানানো জিনিস তাকে না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা শ্যামলেরই প্রাপ্য।
ওপরের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, সামাজিক ন্যায়ের কোনো একক বা সর্বাত্মক সংজ্ঞা নেই, যেটা দিয়ে সব রকমের বণ্টন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি। একেক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের একেক রকমের ন্যায়দর্শনের আশ্রয় নিতে হয়। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একমাত্রিক চিন্তার সুযোগ নেই। সমাজতন্ত্রের ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনের চর্চার ও অবস্থাভেদে তার বিশিষ্ট প্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন :বাঁশিটা আসগর, করিম ও শ্যামল- এই তিনজনার মধ্যে কাকে দেওয়া হবে, এই জটিল ন্যায়সংকটের পাশাপাশি আরও কয়েকটা প্রসঙ্গ অবতারণা করা যায়। বাঁশিটা কে পাবে, এর উত্তর মুলতবি থাকলেও এটা পরিস্কার যে বাঁশিটা অন্তত এমন কাউকে দেওয়া উচিত নয়, যিনি কিনা কেবল বাঁশির ‘মজুতদারী’ করেছেন। ধরা যাক, তার নাম সোহেল। অর্থাৎ তিনি আসগরের মতো দক্ষ বাঁশিবাদকও নন; করিমের মতো একটা বাঁশি হাতে পাওয়ার অভাববোধজনিত তীব্র আকুতিও তার নেই; আবার শ্যামলের মতো বাঁশিটা তিনি উৎপাদনও করেননি। তার শুধু আগ্রহ, বেশি বেশি করে বাঁশি কিনে ‘স্টক’ করে রাখা, আর দাম বেশি পেলে সেটা বিক্রি করে ‘ব্যক্তিগত মুনাফা’ বৃদ্ধি করা। মুনাফা অর্জন ছাড়া বাঁশির সুর-লহরী নিয়ে তার কোনো বাড়তি আগ্রহ নেই। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নীতি খুব পরিস্কার :আসগর, করিম বা শ্যামল যাকেই অবশেষে বাঁশিটি দেওয়া হোক না কেন, অন্তত সোহেলকে ওই বাঁশিটি দেওয়া ন্যায়সংগত হবে না। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়মীমাংসা জটিল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সোহেলের মতো লোকদের কাছে যাতে করে উত্তরোত্তর বাঁশির ঘণীভবন (কনসেন্ট্রেশন) বাড়তে না থাকে- অর্থনীতির পরিভাষায় concentration of economic power, যাতে করে সহনশীল মাত্রার মধ্যে বিরাজ করে- সেদিকে রাষ্ট্র খেয়াল রাখবে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কাছে প্রত্যাশা। ন্যায়দার্শনিক জন রাউলস আরেকটি প্রত্যাশার কথা বলেছেন। ‘টু প্রিন্সিপলস্‌ অব জাস্টিস’ নীতিতে সমাজে কতটা আয়বৈষম্য গ্রহণযোগ্য, তার একটি ফর্মুলা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের (primary goods) দরকার হয়। এই চাহিদাকে যেসব পণ্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে পড়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ‘যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর’ স্বাধীনতা, ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ প্রভৃতি। স্বাধীনতার চাহিদাকেও আমি প্রাইমারি গুডসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছি, কেননা (রাউলসের মতে) স্বাধীনতা ছাড়া শুধু অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতির সংস্থান অনেকখানি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এটা বোঝাতেই তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবন পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।’ যা হোক, রাউলসের ফর্মুলাটি হলো, সমাজের সবচেয়ে অভাবপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের ‘মৌলিক চাহিদা’ সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে (যাকে অন্যত্র তিনি ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপল’ বলেছেন)। এদের ‘মৌলিক চাহিদা’ আগে পূরণের পর সমাজে যেটুকু বৈষম্য থাকবে, তা হয়তো ‘গ্রহণযোগ্য’। সমাজতন্ত্রের ন্যায়দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মনোগ্রাহী হলেও (এ জন্যই এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে) কতগুলো সমস্যা তার পরও থেকেই যায়।
প্রথমত, এই রাউলসীয় ফর্মুলা থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে সমাজ থেকে দারিদ্র্য যদি আগে দূর যায়, তাহলে আপেক্ষিক বৈষম্য নিয়ে দুর্ভাবনার অত দরকার নেই। এটি ন্যায়ের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে, কিন্তু সমাধানটি সবার ভালো না-ও লাগতে পারে। সমাজ থেকে না হয় দারিদ্র্য মুছে গেল, তারপরও মানুষ আপেক্ষিক বৈষম্য সম্পর্কে আলাদাভাবে সংবেদনশীল। উন্নত দেশের মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলোর সিইও যে বেতন পান, সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নিচের স্তরের কর্মচারী (যিনি হয়তো দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো) পান তার চেয়েও ৪০ ভাগ কম পারিশ্রমিক। এতটা বৈষম্য সমাজে কি থাকা উচিত? এ প্রশ্নটা সমাজতন্ত্রীরা করবেন। কতটা বৈষম্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য, এটি শুধু অর্থনীতিবিদরা ঠিক করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, মৌলিক চাহিদা ও তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত যে ‘দারিদ্র্য’, তাকে আরও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে হবে। এসব চাহিদার কিছু কিছু পূরণ হবে ‘প্রাইভেট গুডস’-এর (বা বাজার থেকে অভিরুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিসপত্র বা সেবা কেনার) দ্বারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বাসস্থান এসব প্রয়োজন কি শুধু ‘প্রাইভেট গুডস’-এর বলয়ে থাকবে, নাকি সেগুলো পড়বে ‘পাবলিক গুডস’-এর বলয়ে (অথবা প্রাইভেট-পাবলিক ‘মিশ্র’ খাতে)? কানাডায়-যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য খাতকে মূলত ‘কমন গুডস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড একই পথের অনুসারী। এসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত চিকিৎসাসেবার সুযোগ সীমিত। এর অর্থ দাঁড়ায় যে এসব দেশে অসুখে ভুগলে কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বিপন্ন বোধ করেন না। কেননা, তিনি জানেন যে তার চিকিৎসাসেবার প্রায় সব দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সোভিয়েত পতনের পরও পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্য খাতকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ হিসেবেই দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিষয়টি ‘মৌলিক নীতিমালার’ অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যটি এখন ‘মৌলিক অধিকারের’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবাকে ‘কমন গুডস’-এর অংশ করা হয়নি। হালআমলের ‘ওবামা কেয়ার’-এর মাধ্যমে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবাকে কোনো কোনো গ্রুপের জন্য (যেমন- ৬৫-ঊর্ধ্ব লোকেদের জন্য) নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে রাষ্ট্রের তরফে, এটা ঠিক। কিন্তু অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবাই অধিকাংশ মানুষের জন্য এখনও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এ দেশে আমেরিকার পথে (যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মূলত ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপরে নির্ভরশীল) এগোব, নাকি যুক্তরাজ্য-রাশিয়ার পথে এগোব (যেখানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র সাধারণভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার)? এই বিতর্কটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা তুলবেন।

তৃতীয়ত, কোন পণ্য, সেবা বা প্রয়োজন কতটা পরিমাণে ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকবে, তা যুগের হাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর অর্থ, আগে থেকেই ঠিক করা যাবে না যে ক, খ, গ, ঘ খাতগুলো শুধু ব্যক্তি খাতে থাকবে; আর য, র, ল, ব খাতগুলো শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকবে। সমাজতন্ত্র মানে ১০০% রাষ্ট্রায়ত্ত খাত- এ ধরনের ধারণার বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর কালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহদায়তন শিল্প খাতে কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকলেও ক্ষুদ্র-মাঝারি খাতগুলো তখন ব্যক্তি খাতে ছিল। ক্রমে ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ইনভেস্টমেন্ট সিলিং’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত শতকের আশি-নব্বই দশকে আলোচনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সে সময়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যে প্রায় সব খাতের অর্থনৈতিক ইউনিটকেই কেবল ব্যক্তি খাতের জন্য সংরক্ষিত করা হতে থাকে। এতে করে বাধাবন্ধনহীন ব্যক্তিগত মুনাফাচালিত ও সংকীর্ণ স্বার্থের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। মুখে ব্যক্তি খাত বলা হলেও প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত করপোরেট ক্যাপিটালিজমের দিকেই ধাবিত হয়। ব্যাংক-বীমা খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিরাষ্ট্রীয়করণ ও অবাধ ঋণপ্রবাহের মাধ্যমে রাতারাতি এক বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে আশি-নব্বইয়ের দশকে এবং পরেও তা অব্যাহত থাকে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এই বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্বত্র সুফলদায়ী হয়নি। অনাদায়ী ও মন্দ ঋণের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেড়েছে তা-ই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ‘নিচে থেকে’ গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতেও ব্যর্থ হয় অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। এককথায়, আমরা সে সময়ে অতিমাত্রায় বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র- যেটি একটি জনকল্যাণধর্মী মিশ্র খাতের সমর্থক- এই বল্কগ্দাহীন মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের বিকাশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে।

চতুর্থত, বৈষম্য শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য আয়বহির্ভূত সূচকেও একে বিচার করতে হবে। রাউলস যখন দরিদ্রতমদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলেছিলেন, তিনি গরিব ও ধনীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষা একটি পাবলিক বা কমন গুড। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে প্রায় সবার জন্য সমান মানসম্পন্ন। উন্নত দেশে এসব স্তরে কোনো বৈষম্য করা হয় না। পাবলিক এডুকেশন (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সবার জন্য সমান গুণসম্পন্ন এবং অবৈতনিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এবং রাশিয়ায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণও অনেক ক্ষেত্রে অবৈতনিক- শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে সংগতি রেখে সেখানে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার’ কথা বললেও এখন পর্যন্ত একটি ‘কমন স্কুল সিস্টেম’ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যার মাধ্যমে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা গা ঘষাঘষি করে এক শ্রেণিতে পড়ালেখা করতে পারবে। এখন মাদ্রাসায় যায় মূলত অতিদরিদ্রদের ছেলেমেয়েরা; বাংলা মিডিয়াম স্কুলে যায় গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা; আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যায় উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম আরও সূক্ষ্ণ প্রভেদ করা সম্ভব। এর ফলে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন আয়ের মানুষের মধ্যে গভীর শ্রেণিবিভাজন ঘটে যায়। কমন স্কুল না থাকার জন্য সামাজিক (ঊর্ধ্বমুখী) সচলতা কমে যায়। নিচের আয়ের মানুষ ওপরের আয়ের স্তরে প্রবেশ লাভ করতে ব্যর্থ হয় প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তরের মধ্যে পাঠদানের গুণে-মানে বৈষম্যের কারণে। সংগত কারণেই এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আলোচনার একটি মুখ্য বিষয়বস্তু।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১১০
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


অর্ধ-সত্যের ভিত্তিতে ডিজইনফরমেশন ক্যামপেইন চালানোর পটভূমি গড়ে দিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঠান্ডা যুদ্ধ। ‘ঠান্ডা’ হলেও যুদ্ধের রক্তারক্তিতে সেটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়ে কম যায় না। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ওয়াশিংটন পোস্ট তড়িঘড়ি করে লিখল যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আবার সবকিছু পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে: ‘ইসলামাবাদ, পিকিং এবং ওয়াশিংটন তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করবে বলে মনে হয়।’
এই সূত্রে প্রবন্ধের লেখক লুই সিমনস্‌ মৃত্যুর কারণও নির্দিষ্ট করলেন:
‘যদিও এ অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ হিসেবে শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী শাসন, তার অযোগ্যতা এবং দুর্নীতিপরায়ণতার কথা তুলে ধরা হয়েছে, তবু প্রথম থেকেই দিল্লি-মস্কোর সঙ্গে বেশি মাখামাখির জন্য জনগণ মুজিবকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল। অতীতে যেমন দুঃখ-দুর্দশার জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যেই অর্থনৈতিক শোষণ চালু করার জন্য ভারত সরকার ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে উদ্ভূত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে ঘাত-প্রতিঘাতের জন্ম দিয়েছে, তারই ফল হচ্ছে শেখ মুজিবের পতন ও মৃত্যু।’
লুই সিমনস্‌ আরও বললেন, ‘হঠাৎ এই গতি পরিবর্তন শুধু মিসেস গান্ধীকে নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বিচলিত করতে বাধ্য। এতদিন তারা চীনকে আগলে রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে এসেছিলেন।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে বৃহৎ পরাশক্তির দ্বন্দ্ব, ভারত, চীন, পাকিস্তান ইত্যাকার শক্তির ভারসাম্যের সমীকরণ জড়িত এমনটাই ইঙ্গিত করা হলো।
এটা এখন অনেকটাই স্পেকুলেশনের বিষয় যে মুজিব-হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিক্সন প্রশাসন-সিআইএ জড়িত ছিল, কী ছিল না। মিজানুর রহমান খানের গবেষণাধর্মী বইটিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। লরেন্স লিফসুলজ্‌ তার ‘বাংলাদেশ :দ্য আনফিনিশড রিভোলিউশন’ বইতে স্পষ্ট ইংগিত করেছিলেন যে সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার আয়োজন সম্পর্কে পূর্বাপর অবগত ছিল। খোন্দকার মোশতাক আমেরিকান লবির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন বহুকাল থেকেই (অন্তত ১৯৭১ সাল থেকে তো বটেই)-একথা এখন প্রমাণিত।  Rogue States এবং Killing Hope-র লেখক উইলিয়াম ব্লুমকে আমি চিঠি লিখেছিলাম মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকা প্রসঙ্গে তিনি কিছু জানেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, মুজিব-হত্যা তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল না। তিনি তার বইয়ে মূলত লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার ওপরেই মনোনিবেশ করেছেন। পক্ষান্তরে, আমার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তিগত আলাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞরা সিআইএ-র জড়িত থাকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেননি। ঢাকায় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে অভ্যুত্থানের বিষয়টি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ন্যাপ-সিপিবির পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে অরক্ষিত থাকার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। কমরেড মণি সিংহ নিজে এ বিষয়ে বলেছিলেন, মোজাফফর আহমদও বলেছিলেন বাড়তি নিরাপত্তা গ্রহণের বিষয়ে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিংগার গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্‌স স্পষ্টত অবস্থান নিয়েছিলেন মুজিব-হত্যায় সিআইএ-র জড়িত থাকার পক্ষে। সেখানে হিচেনস সরাসরিভাবে অভিযোগটি তুলেছেন: ‘Kissinger was responsible for the killing of thousands of people, including Sheikh Mujibur Rahman’। একদিন নিশ্চয়ই এর পক্ষে বা বিপক্ষে অকাট্য প্রমাণ মিলবে। কোনো গোপন উইকিলিকসে ফাঁস হয়ে পড়বে মার্কিন প্রশাসনের আর্কাইভে লুকিয়ে থাকা, এখনও অপ্রকাশিত, কোনো দলিল-পত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনের দেশি-বিদেশি চক্রান্তের খুঁটিনাটি।
তবে মুজিব-হত্যার পরপরই যেভাবে ইং-মার্কিন মূলধারার পত্র-পত্রিকাগুলো সমস্বরে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ক্যারেকটার-এসাসিনেশনে লেগে গিয়েছিল তা আজ কিছু অবাক করে বৈকি। তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুধু ‘ডিক্টেটর’ বলে আক্রমণ করা নয়, তার পরিবারের সদস্যদের কারও কারও প্রতি কল্পিত অভিযোগ ছড়াতেও তারা সেদিন দ্বিধা করেনি। গুজবের প্রকাশ ও প্রচার করা সাধারণত সৎ সাংবাদিকতার নিয়ম-রীতিবিরুদ্ধ। প্রায় অসভ্যতার পর্যায়ে এটি পড়ে। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্‌ পত্রিকায় কেভিন রেপার্টি মুজিব সম্পর্কে কল্পিত অভিযোগ এনে লিখেছেন :’নিজের পরিবারের লোকজনের আর্থিক স্বার্থ আদায়ের প্রতি তার নজর ছিল। তিনি নিজে ঘুষ নিয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তা নেওয়ার তো তার প্রয়োজন ছিল না।…তবে অনেকেই তার ছেলেদের এবং অন্য আত্মীয়দের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।…গল্পটি সত্য না বানানো তা বিচার করতে যাওয়া অবান্তর, কারণ বহু লোক এ গল্পের সত্যতায় বিশ্বাস করে এবং এ গল্প বহু লোকের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে।’ এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের সৎ-সাংবাদিকতার নমুনা! দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করে- কখনও শেখ মনি, কখনও গাজী গোলাম মোস্তফাকে ঘিরে গাল-গল্প বানিয়ে এবং গুজব ছড়িয়ে। এর জন্য ঢাকার তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে মুজিববিদ্বেষী মনোবৃত্তিও কম দায়ী নয়। মুজিব খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না; মুজিব বুদ্ধিজীবীদের অপছন্দ করেন; মুজিব সবসময় ইনসিকিওরিটিতে ভুগতে থাকেন; মুজিব তার অহমিকাবোধে আবদ্ধ; এসব কথা পাশ্চাত্যের অনেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনর্গল লিখতে দ্বিধা করেননি। এভাবে ‘ফেইক নিউজ’ তারা তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে শুধু ‘হক-কথা’কে দায়ী করলে ভুল করা হবে। আজ তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ ‘আমার দেখা নয়াচীন’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে সেদিনের জটিল-কুটিল সমালোচক স্বভাবের ঢাকার মধ্যবিত্তদের অনেকেরই কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটছে হয়তো। তারা এখন ভাবছেন যে শেখ মুজিবকে ‘যতটা অশিক্ষিত’ বলে মনে করে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম, ততটা অশিক্ষিত তিনি নন আসলে। চিন্তাবিদ না হলেও সবকিছু নিয়েই চিন্তা করতে পারেন দেখছি! ঢাকার মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে এই অসাধুতা গত ৫০ বছর ধরে দেখে আসছি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মুজিব নাকি ইংরেজি বলতে ভুল করেছিলেন, সে নিয়ে কী হাস্য-তামাশা সেদিন মধ্যবিত্তদের ড্রইং রুমে। আজ তারাই বলছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে আমাদের তাকে বুঝতে। হি ওয়াজ আ গ্রেট, গ্রেট ম্যান।’ এই শঠতা আমাদের পীড়া দেয়। এই মধ্যবিত্তের সঙ্গে শঠতার দৌড়ে সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটেছেন সেদিনের বিদেশি সাংবাদিকেরা। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ করাই ভুল হয়েছিল এমন মন্তব্য ছিল তাদের। ১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি সংখ্যায় বোস্টন হেরাল্ড মন্তব্য করেছে:
”আরও পরিহাস এই যে, যে পাকিস্তানের উৎপীড়ন থেকে তিনি তার দেশবাসীকে মুক্ত করেছিলেন, সেই পাকিস্তান আজ অধিকতর মুক্ত এবং সমৃদ্ধ। গত সোমবার ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস্‌’ প্রকাশ করেছে যে, তিন বছর আগে পরাজয় ও অবমাননা ভোগ সত্ত্বেও পাকিস্তান আজ অপ্রত্যাশিতভাবে এশিয়া মহাদেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সজীব দেশ হিসাবে দেখা দিয়েছে। যদিও এখনও গরিব দেশ, কিন্তু পাকিস্তানে অনাহারে লোক মরছে না। তাদের জীবনযাত্রার মান বেড়ে চলেছে এবং ‘দি টাইমস্‌’ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের সরকার ধ্বংসাবশেষ কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।…পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আদর্শবাদীরা যখন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য চিৎকার করছিল, তখন আমেরিকার উচিত ছিল, পাকিস্তানকে আরও সবল সমর্থন দেওয়া।’

অবশ্য ভুট্টোর পাকিস্তানের এই প্রশংসা অচিরেই মুছে যাবে পাশ্চাত্যের সাংবাদিকবলয় থেকে। আফগানিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াইয়ে বিশ্বস্ত সাথি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন জেনারেল জিয়াউল হক। এবং ভুট্টোকে ‘হঠকারী পপুলিস্ট’ বলে ছুড়ে দেওয়া হবে অস্বীকারের খাতায়।

১৫. বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত প্রকল্প ও আজকের বাংলাদেশ
বাকশালের মাধ্যমে সমতামুখিন সমাজের স্বপ্টম্ন বাস্তবায়নের নতুন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধানে যেসব অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা বাকশালের কর্মসূচিতে ধারণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি বড় স্তম্ভ ছিল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ। সেটি বাকশালের কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বে সেভাবে আলোচনায় আসেনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ফলে বাহাত্তরের সংবিধান ও বাকশাল কর্মসূচিতে বিধৃত সমতামুখিন সমাজের সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়া হয়। শুধু ভুলে যাওয়াই নয়, অর্থনীতি-রাজনীতি চলতে থাকে এক নিষ্ঠুর অমানবিক সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাই ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সে সময়ে যারা ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর গঠন বা তার কার্যাবলির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকতেন, তাদের প্রত্যেকেই নানা ধরনের দৈহিক-মানসিক-বৈষয়িক হয়রানির শিকার হতেন। আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে নিছক বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে ১৫ আগস্টের শোকসভায় উপস্থিত থাকাকে বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্ণধাররা ভালো চোখে দেখতেন না। তা সে বিলেতেই হোক, আর তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেই হোক। মৃত বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হচ্ছে, তাকে প্রতীক রেখে তরুণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হচ্ছে এক জায়গায়, তাকে মনে রেখে তারা সমতামুখিন সমাজের কথা বলছে, এটা জিয়া-এরশাদের সামরিক সরকার আর তাদের অধীন দূতাবাসগুলোর পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হতো। যারা সেদিন সেসব গোপন বা প্রকাশ্য সভায় জড়ো হতেন ওয়াশিংটনে, লন্ডনে, মস্কোয় কিংবা ঢাকায়; তারা ঝুঁকি নিয়েই অংশ নিতেন সেখানে। তাদের নামের তালিকা চলে যেত গোয়েন্দা দপ্তরে। জীবিত মুজিবের তুলনায় মৃত মুজিবের প্রভাব প্রতিবছরেই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর নাম ক্রমশ অর্থনৈতিক সমতা, সামাজিক ন্যায় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমার্থক ধারণায় পরিণত হচ্ছিল সচেতন অথবা অসচেতনভাবে। এই যোগাযোগ সময়ের সঙ্গে আরও দৃঢ় গণভিত্তি পেয়েছে। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং সমতামুখিন আকাঙ্ক্ষার আলোচনা তাই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’? এ প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে।
সমকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে গতিধারা বিশ্নেষণের কাজটি বর্তমান লেখার আওতার বাইরে। কিন্তু কিছু প্রাথমিক মন্তব্য করা যায়। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ ধারণাটি নিয়ে সর্বস্তরে (পাঠ্যবইসহ বলছি) যতটা আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল, ততটা এ দেশে এখনও হয়নি। ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের’ বর্তমান কালের চ্যালেঞ্জ আলোচনা করার জন্য নূ্যনতম শর্ত হলোু সমাজতন্ত্রকে আগে ‘কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির অংশ হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে ঠিকই (২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে), কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে করা হয়নি। গণতন্ত্র ও মার্কেট-ইকোনমি রেখে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প হতে পারে, তা নিয়ে গভীর আলোচনার দরকার রয়েছে। স্বাধীনতা, উৎপাদন-নৈপুণ্য এবং বণ্টনগত সাম্যু এই ত্রিবিধ লক্ষ্যের মধ্যে সমীকরণ কষতে হবে এবং উন্নয়নের নানামাত্রিক ঝোঁকের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। কাজটি সহজ নয়। সামাজিক ন্যায়-দর্শনের একটি উদাহরণ দিয়ে সমস্যাটি চিহ্নিত করা যায়।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৯
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


কর্নেল হামিদ এ রকম একটি নির্মম ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন ১৯৭৭ সালের বগুড়া সেনানিবাসের বিদ্রোহকে উপলক্ষ করে। আমি সেটি তুলে ধরছি-
”এবার শুরু হলো জিয়ার শুদ্ধি অভিযান। বিদ্রোহী বিমান ও সৈনিকদের পাকড়াও করে তাদের নির্মমভাবে ঢালাও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলো। সংক্ষিপ্ত বিচারের সুবিধার্থে মার্শাল ল’ আইন করে বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হলো। এই সময় জেনারেল এরশাদ ছিলেন ডেপুটি চিফ। তারই তত্ত্বাবধানে এসব সংক্ষিপ্ত ট্রায়াল সুষ্ঠুভাবে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। শুরু হলো ত্বরিতগতিতে বিচারের নামে প্রহসনের পালা। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক শত সৈনিক ও বিমান সেনাদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। সেনা বা বিমানবাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠিত আইনকানুন এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। পাঁচটি কারাগারে একসঙ্গে ৮-১০ জন করে পর্যায়ক্রমে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাতাড়ি ফায়ারিংয়ে মারা যায় শত শত। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বহুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ঢালাওভাবে গ্রেপ্তারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে। ৩ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি রাতে সেনা ও বিমানবাহিনী ব্যারাক থেকে সৈনিকদের ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নির্যাতন ক্যাম্পে, তারা আর ফিরে আসেনি। ক্যান্টনমেন্টজুড়ে হাহাকার। কান্নার রোল। কত সৈনিক, বিমান সেনা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলল, কতজন প্রাণ হারাল, ‘গুপ্তহত্যার’ শিকার হলো, এর কোনো হিসাব নেই। বিমানবাহিনীর কার্যক্রম ক্ষমতা নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। সরকারি হিসাব মতেই শুধু দুই মাসে ফাঁসিতে লটকানো হয় ১১৪৩ জন সৈন্যকে, যার মধ্যে বিমান সেনাই ছিল ৫৫১ জন। হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া হয়নি। তারা আজও খুঁজে ফিরে তাদের প্রিয়জনকে। কোথায় যে এত লাশ গুম করা হলো, তাও এক রহস্য। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাকি অভ্যুত্থান, তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। অনেকেরই ধারণা, এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক নিধনযজ্ঞ। মধ্যরাতে সিগন্যাল লাইন্স ও কুর্মিটোলা এয়ারফোর্স ব্যারাকে কে বা কারা স্লোগান দিয়ে আহক্ষান জানিয়ে শুরু করে বিদ্রোহ, তা আজও রহস্য।
পাক-ভারতের ইতিহাসে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানে এত লোকের ফাঁসি, হত্যা, প্রাণহানি, জেল আর কখনও ঘটেনি। কী আশ্চর্য! এতবড় মর্মান্তিক ঘটনার কখনও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। কেউ দাবিও করেনি। কী বিচিত্র এই দেশ!”

আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ও তার বাকশালের শত্রুদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। অতিদক্ষিণপন্থি স্বাধীনতাবিরোধী, অতিবামপন্থি নকশাল ধারার, জাসদ-গণবাহিনী, জাতীয়করণের ফলে ক্ষিপ্ত ধনিকগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত মধ্যবিত্ত, পাকিস্তানপন্থি, চীনপন্থি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী-বিশাল একটি স্পেকট্রাম বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে সবার আগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষ, যারা কোনোমতেই বাংলাদেশের সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারে নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ইসলামিক রিপাবলিকের বদলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ঘোষণা। এর গুরুত্ব শুধু দক্ষিণপন্থি পত্রিকা ইত্তেহাদ থেকেই উচ্চারিত হয়নি, এর সঙ্গে কোরাস মিলিয়েছিল বিলেত-আমেরিকার মেইনস্ট্রিম পত্রিকারাও। কর্নেল ফারুকের বয়ান দিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্টে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ইসলামবিরোধী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল :’সবশেষে মুজিব তাহার ঈমান অর্থাৎ পবিত্র ইসলামের সাথে বেঈমানী করেন।’ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিয়্যুর ২৯ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় যা লেখা হয়েছে তার মানে দাঁড়ায় যে মুজিবের ‘সাম্প্রদায়িক’ কর্মকাণ্ডের জন্যই পাকিস্তান ভেঙে যায়। উদ্ধৃতিটির কুযুক্তিটি একটু শোনা যাক আবার :’পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের জন্য সূক্ষ্ণ পদক্ষেপ নিতে শেখ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন… তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, পাকিস্তানের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী ছিল। দেশের ভাঙনকে ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ব্যর্থ হয়েছেন এমন কোনো সদিচ্ছা দেখাতে, যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের আকস্মিক অভিযান নিবৃত্ত করতে পারত। এরপর যে ট্র্যাজেডি শুরু হলো তার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও ভুট্টো নিঃসন্দেহে দায়ী। তাহলেও বলতে হবে যে, শেখের বাগ্মিতার ফলেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও রক্তপাত শুরু হয় এবং তাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের একান্ত অনুগতরা নৃশংস অভিযান আরম্ভ করার অজুহাত পায়।’ দক্ষিণপন্থি সমালোচনার আরেকটি ধারা সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের অংশ করাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাঁড় করায়। ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এর সানডে টাইমস পত্রিকায় এন্থনি মাসকারেনহাস এরকম যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন :
‘মুজিবের পতনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশ শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামের মর্যাদার এই অবমাননা অনিশ্চয়তাসূচক প্রমাণিত হয়েছে।…এই পটভূমিতে মুজিবের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশকে আহত করেছিল। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক আহমেদ বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করে রাতারাতি জনসমর্থন লাভ করেছেন।’
বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৬ আগস্ট ১৯৭৫-এর সংখ্যায় একই অভিমত তুলে ধরেছিল। মার্টিন ওয়ালকট সেখানে লিখেছেন :”তাছাড়া আদর্শগত প্রশ্নও ছিল। মুজিব নতুন জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক মস্কোপন্থি রাজনীতিবিদকে স্থান দিয়েছিলেন, ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে প্রাচীনপন্থি মুসলমানগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, নতুন শাসকরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করেছেন।” বস্তুত, দলিল-পত্র ঘাটলে দেখা যায় যে দেশের ভেতরে ও বাইরের চরম দক্ষিণপন্থি ও চরম বামপন্থি শক্তি অবশেষে কৌশলগত একবিন্দুতে মিলিত হয়েছিল-সেটা হলো তীব্র ভারত ও রাশিয়ার বিরোধিতা। তাদের যুক্তি ছিল :বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্টে নিহত হয়েছেন তার কারণ তিনি নিজেই; তার সরকার এবং তার প্রস্তাবিত বাকশাল ব্যবস্থা ছিল ঘোরতরভাবে রুশ-ভারতপন্থি। এই ‘ডিসইনফরমেশন ওয়ার’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এনায়েতুল্লাহ খান ‘শেখ মুজিবের উত্থান পতন’ প্রবন্ধে তার ভাষায় বাংলাদেশের ‘মধ্যবিত্ত মানসের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেছেন নিল্ফেম্নাক্ত ভাবধারায়:
”বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের দুঃখী জনগণ এই অবাক প্রদর্শনীর মৌন দর্শক ছিলেন। তাদের নিঃশব্দ আর্তিতে ধ্বনিত হচ্ছিল কতিপয় লুটেরার অট্টরোল। আর তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র-যারা সমাজতন্ত্রের ছলে, মৈত্রীর ছদ্মবেশে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের আবডালে বাংলাদেশকে বৈদেশিক স্বার্থের অবারিত লীলাক্ষেত্রে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বাঙালি বুর্জোয়ার নিকৃষ্টতম মেরুদণ্ডবিহীন মুৎসুদ্দীকুল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি ধ্বংসকল্পে পরদেশী বাণিজ্যিক পুঁজির সেবা-দানের ভূমিকায় নিয়োজিত ছিল। এরই সাংগঠনিক রূপ ছিল ‘দেশপ্রেমিক'(?)দের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। এই ঐক্যজোটের নীলনকশা পরিশেষে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে রূপায়িত হয়। ফলতঃ বাংলাদেশ একদিকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাববলয়ে আবর্তিত হয় এবং অন্যদিকে পূর্ব ভারতের ধ্বংসোন্মুখ শিল্পকেন্দ্রের প্রায় ঔপনিবেশিক পশ্চাদভূমিতে পরিণত হয়। দেশের উৎপাদিকা শক্তিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করবার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীতে বিরল। অষ্টাদশ শতকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের লুটেরা বাণিজ্যিক পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সাদৃশ্য লক্ষণীয়।”
বাংলাদেশ সম্পর্কে এনায়েতুল্লাহ খানের উপসংহার ছিল যে এটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে যুগপৎ ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের’ (অর্থাৎ রুশ প্রভাববলয়ের) এবং ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদের’ ফাঁদে। মার্কিনপন্থি লিবারেল ও চীনপন্থি অতিবাম মহলে সে সময়ে এটি চালু থিসিস ছিল। এই মূল্যায়ন সমর্থন করেছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত চীনঘেঁষা বামপন্থি পত্রিকা ফ্রনটিয়ার। এর ১৯৭৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় দেখতে পাই অনুরূপ প্রচারণা :’…ভারতীয় হস্তক্ষেপের ফলে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসীন হলো তাদের মতো স্বার্থপর নেতৃত্ব কোনো দেশে সত্যিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পর আর দেখা যায়নি। দেশটি যে অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য-সহায়তা বাংলাদেশের কোনো কাজে আসেনি। আরামদায়ক বন্দিদশা থেকে শেখ মুজিব প্রত্যাবর্তনের পর দেশের অবস্থা মন্দ থেকে মন্দতর হয়েছে।’ ফ্রন্টিয়ার যে এরকম অভিমত রাখবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সমর সেন সম্পাদিত পত্রিকাটির মতাদর্শ ছিল তখনকার মাওবাদ তথা নকশালবাড়ির পথ। এজন্যেই ১৯৭৫ সালের বাকশাল প্রবর্তনকে তারা মনে করেছেন প্রকৃত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ বলে :’ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনীতি স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। এর প্রধান দিক হচ্ছে বাংলাদেশের বামপন্থি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম।’ অতিডানপন্থি ইত্তেহাদ গ্রুপ, এনায়েতুল্লাহ খানের লিবারেল সুরের হলিডে, আর অতিবামপন্থি ফ্রন্টিয়ার একই সুরে তখন কথা বলেছে। তিন ধারাই তখন মিলে যাচ্ছিল মুজিব-সরকার উৎখাতের যৌথ প্রযোজনায়। ১৯৭৪-৭৫ সালে পাশ্চাত্য থেকে প্রকাশিত মূলধারার পত্র-পত্রিকা ঘাঁটলে আজকের যুগে যেটা ‘হাইব্রিড ওয়ার’ বলে অভিহিত হচ্ছে (যেখানে প্রথাগত যুদ্ধের সঙ্গে অপপ্রচার ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ জড়িত থাকে) তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো পাওয়া যায়। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানোর জন্য পূর্ণ সত্য বা পূর্ণ মিথ্যা কোনোটিই বলার দরকার নেই। এর জন্য ‘অর্ধ-সত্য’ বলাই যথেষ্ট-তাতে করে সত্য বলার ভানও করা যায়, আবার ডিসইনফরমেশন ক্যামপেইনও দিব্যি চালানো যায়। এনায়েতুল্লাহ খান-ফ্রন্টিয়ার বলছিলেন যে মুজিব বামপন্থি বিপ্লবীদের ধ্বংস করতে চাচ্ছেন। এবার আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণ বলতে গিয়ে গার্ডিয়ান (১৬ আগস্ট ১৯৭৫) লিখল যে, বঙ্গবন্ধুকে আসলে হত্যা করা হয়েছে তার বামপন্থি বিপ্লবী আদর্শের কারণেই। উদ্ধৃতিটি মনোযোগের দাবি রাখে। প্রগতির পথে চলার একপর্যায়ে তিনি শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনীকে চটিয়ে দিয়েছিলেন-সেটাই তার নিহত হওয়ার কারণ। ‘মুজিব নিজেই দায়ী’-অন্য কাউকে এর জন্য দায়ী করা চলে না : ‘কিন্তু নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং দেশে কিছুটা প্রগতি আনার জন্য তার শেষ পদক্ষেপেই তার পতন ডেকে এনেছে। বামপন্থি আদর্শে তিনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সেনাবাহিনী তার প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল। অথচ তাদের সমর্থনেই তিনি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ অবস্থায় মুজিব নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুঁজছিলেন। তাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্য মস্কোপন্থি দলগুলোও উৎসাহ জুগিয়েছিল।’
যুক্তি হিসেবে বলা হলো যে, গ্রামে বহুমুখী সমবায় করার সমাজতান্ত্রিক নীতিই মুজিবের সর্বনাশ ডেকে এনেছে:
‘মে মাসে মুজিব ঘোষণা করলেন যে, গ্রামে গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে কৃষি সমবায় গঠন করা হবে, গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনিক পরিবর্তন করা হবে এবং জাতীয় দল গ্রাম পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। সংক্ষিপ্ত হলেও এ কর্মসূচি আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী, পেশাদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেককেই আতঙ্কিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর বামপন্থি হয়ে ওঠাই শেষ পর্যন্ত তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


‘ব্রেকফাস্ট উইথ ইভিল’ বইতে আশিস নন্দী যে ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটির’ কথা বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক ভায়োলেন্স একপর্যায়ে সামাজিক ভায়োলেন্সের স্লুইসগেট খুলে দেয়। ‘প্রাগ-আধুনিক’ যুগে সহিংসতা প্রকাশ পেত লাঠিসোটা, রড-হকিস্টিক, ছুরি-কিরিচ এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কচিৎ-কদাচিৎ ব্যবহূত হতো বন্দুক-পিস্তল ধরনের মারণাস্ত্র। সাদত হাসান মান্টো তার অনুগল্পগুলোয় পার্টিশন-রায়টের যে রক্তশীতল করে দেওয়া বিবরণী রেখে গেছেন তাতে লাঠিসোটা ছুরি-কৃপাণের ব্যবহারই ছিল চোখে পড়ার মতো। ষাটের দশকের শেষে নকশাবাড়ী আন্দোলনে ‘জোতদার খতমের’ কাজে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার জন্য। চারু মজুমদারপন্থিরা শ্রেণিশত্রুর গলা কাটার জন্য গ্রাম-এলাকায় ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার পাতায় এমনটাই পরে শুনেছি। অবশ্য পরে শহর এলাকার ছাত্র-যুবকরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে পাইপগান ও হাতে বানানো বোমার প্রচলন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। এই ‘টেকনিক’ আমাদের দেশেও অতি-বামপন্থিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২-৭৫ সালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে এসব ‘প্রাগ-আধুনিক’ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ব্যবহূত কিছু ‘আধুনিক’ সমরাস্ত্র যেমন এসএলআর রাইফেল ও স্টেনগান এসবেরও আংশিক প্রয়োগ হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দূর থেকে নয়, একেবারে গলাকাটা দূরত্বে এসে শ্রেণিশত্রু খতমের ধারাই ছিল সহিংসতার মূল কালচার। পরবর্তী সময়ে অতি-বাম সহিংসতার সংস্কৃতি অতি-ডানপন্থিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার সময় ‘রগ কাটা’ পদ্ধতির প্রচলন হয়। পায়ের রগ কেটে প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার পদ্ধতিকে দাবি করা হয় একই সঙ্গে আতঙ্ক লাগানো এবং এফেক্টিভ পদ্ধতি হিসেবে। টেকনিক একবার উদ্ভাবিত হলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং যে কোনো আইডিওলজি প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হলে ব্যবহূত হতে পারে।
তবে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণ-আকারে সহিংসতার প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়ে। বস্তি এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এর আগে শহরের বুকে কখনও ট্যাঙ্ক চলেনি। শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক’ ও সাঁজোয়া বাহিনী, আর গর্জে ওঠা ‘রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান’ সেদিন ‘খই ফুটিয়েছিল’ যত্রতত্র। শহরের বুকে ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান গুলি ছুড়ছে- এ দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘আধুনিক’ যুগে আমরা প্রবেশ করি। দ্বিতীয়বারের মতো এই আধুনিক সহিংসতার মুখোমুখি হই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে আবারও নামে ট্যাঙ্কের বহর (যদিও তখন জানা ছিল না যে সেগুলো গোলাবিহীন)। নামে মেশিনগান এবং ভারী মারণাস্ত্র সুসজ্জিত ঘাতক বাহিনী। প্রধান লক্ষ্য তাদের ৩২ নং সড়কের বাড়ি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে সামরিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে প্রাসাদকে লক্ষ্য করে। প্রাসাদের ভেতরে আত্মরক্ষার জন্য হাতে স্টেনগান নিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে, এবং যুদ্ধ করতে করতেই মারা গেছেন তিনি- এ কথা আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শুনেছি। সিআইএ এই অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল তা-ও জেনেছি। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এ রকম আকছার ঘটে থাকে, এমনটাই ভেবেছি। শুধু আয়েন্দের মতো নির্বাচিত সিভিলিয়ান শাসকের বিরুদ্ধে নয়, অনির্বাচিত সামরিক শাসকের বিরুদ্ধেও মিলিটারি ক্যু ঘটে থাকে। গত শতকের ৫০-৬০-৭০-৮০-র দশকের লাতিন রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্যু ঘটবে, এটা অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। ঠান্ডা যুদ্ধের বাহানায় তখন পিরিয়ডিক সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘নিউ নরমাল’ হিসেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশেও এটা কী করে ঘটতে পারে?

প্রশ্নটা বোকার মতো করলাম, নাকি এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে- সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি উদাহরণ দিই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘প্রাগ-আধুনিক’ সহিংসতার যুগে কেমন ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের একটি স্মৃতিচারণায়। ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা’ একটি অনুষ্ঠানে (বিআইডিএস আয়োজিত) তিনি বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে তার বিপদে পড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতেন। মাসে কাদের কত সাহায্য দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, তার হিসাব রাখার জন্য একটি লগবুক রাখতেন তোফায়েল আহমেদ (সে সময়ে তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব)। একদিন বঙ্গবন্ধু খাতাটি দেখতে চান। সেখানে লেখা ছিল মওলানা ভাসানী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের নাম। কারও নামের পাশে মাসিক ৫০০ টাকা, কারও নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা। শাহ আজিজ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন (পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হন)। ১৯৭২-৭৫ পর্বে ভাসানী তার প্রকাশিত ‘হক-কথা’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুজিব সরকারের সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন। দেশে উগ্র ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব প্রচারে ‘হক-কথার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাহ আজিজ, ফজলুর কাদের চৌধুরী, সবুর খান সে সময়ে জেলে ছিলেন দালাল-আইনে। মোদ্দা কথা, এখনকার রাজনৈতিক কালচার অনুযায়ী এসব বিতর্কিত ও অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে নিন্দিত অনেক ‘বিরোধী’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদার সাহায্যের তালিকায়। ৫০ বা ৬০-র দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা সরকারি দল-বিরোধী দল নির্বিশেষে- এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। একই আবহাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিব। এখন তিনি রাষ্ট্রনায়ক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক আচার-সহবত বা বৃহত্তর অর্থে নৈতিকতাবোধ তিনি ভুলে যেতে পারেন না। তোফায়েল আহমেদকে একপ্রকার তিরস্কারই করলেন লগবুকে লেখা নামগুলো দেখে। ‘এভাবে কেন এদের নামের পাশে টাকার অঙ্ক লিখে রেখেছ? পুরো নাম লিখবে না। মওলানা ভাসানী না লিখে, লিখবে এম. বি; শাহ আজিজ না লিখে লিখবে এস.এ’- সাংকেতিকভাবে নামের ও সাহায্যের রেকর্ড রাখতে বললেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈতিকতার এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। সিরাজুল আলম খান ও আ স ম রবের জাসদ তার সরকারের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছিল ১৯৭২-৭৫ পর্বে। কিন্তু এর পরও সস্নেহে তিনি তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশকে নিশ্চিহ্ন করতে চাননি। সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব বা শাজাহান সিরাজকে কারাবন্দি করা হয়নি। হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা প্রকাশ্যে যেখানেই বিচরণ করতেন, সে খবর বঙ্গবন্ধু রাখতেন কিন্তু তাদের কারাবন্দি করার প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু যারা চরম বামপন্থি বা চরম ডানপন্থি দলের বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাধ্য হয়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নয়, সে আমলের বা প্রাগ-আধুনিক পলিটিক্সের যুগে প্রায় সব জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যেই ছিল। তারা অনেকটা এপিক মহাকাব্যের রথী-মহারথীদের মতো। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ, কিন্তু যুদ্ধের পরে (অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেলে) পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ-সখ্যের সম্পর্ক থাকত। ‘মহাভারত’-এর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে কুরু-পাণ্ডবরা পরস্পরের সঙ্গে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর যুদ্ধ করেছেন। সূর্যাস্তের পরে পরস্পরের শিবিরে গিয়েছেন মৃতদের প্রতি শোক-সমবেদনা জানাতে। এই নৈতিকতা বঙ্গবন্ধু ও তার যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এবং যাদের মধ্যে সেটা দেখা যেত না, তারা রাজনৈতিক মহলে দল-নির্বিশেষে নিন্দিত হতেন।

কিন্তু এসবই প্রাগ-আধুনিক রাজনৈতিক যুগের কথা। ৭৫-এর আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তাদের প্ররোচিত বা প্রেরিত ঘাতক বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের নৈতিকতাবোধের কোনো লেশমাত্র ছিল না। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যান্ত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর গণহত্যায় কুশলী ঘাতক দলের কাছে প্রতিপক্ষ মানে শত্রুপক্ষ, আর শত্রু মানেই নিধনযোগ্য ছলে-বলে-কৌশলে। আমাদের দেশে ঘাতকরা ‘কৌশলের’ সূক্ষ্ণ আশ্রয় নেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা এর চমকপ্রদ উদাহরণ।
ঘাতকদের মধ্যে পৌরাণিক নৈতিকতাবোধ না থাকলেও পুরাণের নিকৃষ্টতর উদাহরণকে তারা গ্রহণ করেছিল। ‘মহাভারতে’ মহারথী অশ্বত্থামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও রাতের অন্ধকারে শত্রু শিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পাঁচজন সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে নয়, যুদ্ধের বাইরে তা-ও নাবালক শিশুসন্তানদের হত্যা সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যা বা ‘ব্রহ্মহত্যার’ পর্যায়ে পড়ে। ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা অশ্বত্থামার পথকেই বেছে নিয়েছিল। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, স্ত্রী-পরিজন শিশুসন্তানকেও হত্যা করেছিল, এমনকি ভ্রূণ হত্যা করতেও তাদের বাধেনি। সেরনিয়াবত বা শেখ মনির পরিবারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এসব হত্যা শুধু নির্মমতাই নয়, এটা সমস্ত ন্যায়নীতি ও ঔচিত্যবোধের বাইরে। এর জন্য অশ্বত্থামাকে যেমন পুরাণ অনুযায়ী অনন্তকাল ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটাতে হবে, তেমনি বাংলাদেশেও ১৫ আগস্টের প্রতিফল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বয়ে বেড়াতে হবে আরও দীর্ঘকাল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জেলহত্যার মতো পাশবিক হত্যাকাণ্ড। রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে সে রাতে যা ঘটেছিল তা অবিশ্বাস্য ও বর্ণনাতীত। মোসলেহউদ্দিনকে জেলগেটে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলেন না ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। কেননা সে উচ্চ স্বরে বলছিল যে জাতীয় ‘চার নেতাকে’ হত্যা করার জন্যই সে এসেছে জেলগেটে তার বাহিনীসহ এবং এসেছে প্রেসিডেন্টের আদেশেই! জেলার তখন বঙ্গভবনে যোগাযোগ করায় দাবির ন্যায্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ তার বইতে লিখেছেন এ বিষয়ে। তার বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামানের স্বহস্তে লিখিত জেলহত্যা রিপোর্টটি তুলে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বরে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয় যে চারজন সেনাসদস্যসহ ক্যাপ্টেন মোসলেহ জেলগেট পৌঁছান এবং বলেন তিনি চার বন্দি জাতীয় নেতাকে ‘গুলি করবেন’। ‘এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই।’ এই ছিল জেলারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। পরে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে প্রথমে মেজর রশিদ ও পরে প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়। কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘জেলগেট থেকে আইজি প্রিজন সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেলগেটে মোসলেহউদ্দিনের আগমন ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢোকার নির্দেশ দেন। হতবাক আইজি! খোদ প্রেসিডেন্ট বেআইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আইজি-ডিআইজি কী করতে পারে? ঘটনার ২১ বছর পর বর্তমানে জেলহত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে ছিল। এতে দেখা যায় খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদ চার জাতীয় নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন।’
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা সহিংসতার সমস্ত নিয়মনীতি অতিক্রম করে আমাদের সমাজকে সহিংস করে তোলে। এ রকম সমাজে-রাষ্ট্রে সব ধরনের সহিংসতাকেই অনুমোদন দেওয়া সম্ভব (এরই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছে)। এ ধরনের সহিংসতার সংস্কৃতি কোনো সমাজে একবার গেড়ে বসলে তার মূলোৎপাটন সহজ নয়। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ঘটেছিল বলেই নির্মমতার একটি সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রজীবনেও এক দীর্ঘ অশুভ ছায়া ফেলেছিল। ১৯৭৬-৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলের শুরুর পর্যায়ে অনেকগুলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়েছিল। সেগুলোর বিচার হয়েছিল লাতিন আমেরিকার কায়দায়- সামরিক শাসন নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেনি।
[ক্রমশ]

বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৭
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


স্বাধীনতার পরে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্যজোটের দরকার ছিল দেশকে প্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন। প্রথমে ত্রিদলীয় আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবি ঐক্যজোট ও পরে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তার স্বীকৃতি মেলে। অ-ধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রণী এমন অনেক দেশেই এটি দেখা গেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তি একত্র হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ায় এটা ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্নভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে এ ধরনের ঐক্যজোট হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ নানা ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যের নানা অভিব্যক্তি দেশে দেশে দেখা যায়। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্য-বিরোধের ‘ডায়ালেকটিক’ অবশ্য একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু, যা এই লেখার পরিধির বাইরে। এখানে শুধু এটাই যোগ করার যে এ দেশেও একপর্যায়ে এরকম ‘ঐক্যজোট’ বাড়ার প্রয়োজনীয়তা ঐতিহাসিকভাবেই দেখা দিয়েছিল (যার সমসাময়িক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়)। তবে ঐক্যজোটে যোগ দেওয়া মানে নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ নয়। বাকশালের মতো ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও অন্যান্য দলের নিজস্ব ‘রাজনৈতিক সত্তা’ বিলোপ হয়ে যায় না। ন্যাপ-সিপিবির নির্দেশে যারা সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবাই নিজ নিজ পার্টির নির্দেশেই সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। সবাই যে সাগ্রহে যুক্ত ছিলেন এমনও নয়-কিন্তু কমিউনিস্ট শৃঙ্খলা মেনে সেদিন তাদের তা করতে হয়েছিল। আবার, কেউ কেউ বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি বলে আহতও বোধ করেছিলেন। এ বিষয়ে সিপিবির নীতি ছিল পরিস্কার। দলটি ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে সমন্বয় করার লেনিনীয় নীতিতে পূর্বাপর অটুট ছিল। বাকশাল গঠন করার পরপরই ‘গোপন ও প্রকাশ্য কাজের সমন্বয়’ এ বিষয়টি চিঠির আকারে তৎকালীন সিপিবির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়:
‘যারা প্রকাশ্যে কাজ করেন একটা কথা খেয়াল রাখা দরকার যে একমাত্র নিজেদের বিশ্বাসভাজন লোক ছাড়া তারা কারও নিকট পার্টিগত পরিচিতি প্রকাশ করিবেন না। প্রত্যেক পার্টি সভ্যকেই কোন না কোন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত থাকিতে হয়। একমাত্র নিজেদের ইউনিটের সভ্য ছাড়া ও ঊধর্ক্ষতন কমিটির নির্দিষ্ট লোক ছাড়া এর অস্তিত্ব আর কারও নিকট প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এতে বিপদের আশংকা বাড়ে। ইউনিটের সভা গোপনেই করিতে হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেওয়া সত্ত্বেও বাইরে কাজ করার সময় তা আলাদাভাবে কার্যকরী করাই যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে ইউনিটের অস্তিত্ব ও সভ্যদের পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ অবস্থায় ইউনিট সভ্যদেরকে একে অন্যের সংগে পরিচয় আছে তাও অস্বীকার করতে হয়। পার্টির গোপন ও প্রকাশ্য কাজগুলি নিয়মমাফিক সুষ্ঠুভাবে চললে এবং তার ভিতরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন ঠিকমত হলে পার্টির অগ্রগতি ঠিকমত চলা সম্ভব হয়।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পরে কোনো একসময়ে সিপিবির উপরোক্ত চিঠিটি প্রমাণ করে বাকশালের ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলীয় রাজনৈতিক সত্তা ‘বিলোপ’ করেনি। নতুন পরিস্থিতিতে তারা শুধু তাদের কাজের ধারা বদলেছিল ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে নতুন ধারায় সমন্বয় সাধন করে। এ কথা সম্ভবত ন্যাপের সম্পর্কেও খাটে।
নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখা সম্পর্কে সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বাকশালের প্রগতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চরিত্র শনাক্ত করতে সিপিবি সেদিন ভুল করেনি- এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে বাকশাল সম্পর্কে পার্টির ইতিবাচক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে- সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে-সিপিবির হাতেলেখা একটি সার্কুলারে অভ্যুত্থান-উত্তর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রাখা হয়। এর থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিপিবির পূর্বাপর সমর্থনের দার্শনিক-রাজনৈতিক ভিত্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে তখন ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিপদসংকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সিপিবি তখন আন্ডাগ্রাউন্ডে। সে-রকম পরিস্থিতিতে বাকশালকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হলো:

‘৭ই নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মূলগতভাবে এই সরকার দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল।
১. এই সরকার দেশে পূর্ণভাবে সামরিক শাসন এবং সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখিয়াছে।

২. এই সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল নীতিসমূহকে বাতিল করিয়া দেশে পুঁজিবাদ নীতি অনুসরণ করিয়া সাম্রাজ্যবাদী খপ্পরে পড়িতেছে। দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, মাওবাদী, পাকিস্তানপন্থি প্রভৃতিরা এই সরকারের সমর্থক। এরা প্রগতিশীলদের নির্মূল করিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুসরণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদী চীন এই সরকারের দৃঢ় সমর্থক। ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ইহাদের মূল আওয়াজ। সাম্রাজ্যবাদ নহে, ভারতই ইহাদের মূল শত্রু।

৩. জাসদের সরকার বিরোধিতাসহ দেশে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করিতেছে। জাসদ ও চার নীতি পরিবর্তনকারী উগ্র দক্ষিণপন্থিদের চাপ বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা রহিয়াছে।

৪. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়া যে সাম্রাজ্যবাদী মাওবাদী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে তাহাকে পরাস্ত করিয়া বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অনুসারী একটি দেশপ্রেমিক সরকার কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য।

৫. বঙ্গবন্ধুর নীতির অনুসারী একটি দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও দক্ষ দেশপ্রেমিক সরকার কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া ‘দক্ষিণ প্রতিক্রিয়া ও উগ্র বামকে জনগণের মধ্যে হইতে বিচ্ছিন্ন করা’ এই আওয়াজের ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শিবিরের শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইতে।

৬. বঙ্গবন্ধুর আমলে জনগণের মধ্যে নানারূপ বিভ্রান্তি বিরাজ করিতেছিল। একদলীয় শাসন যে উন্নত ধরনের গণতন্ত্র ইহা জনসাধারণ বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি জনগণকে হতাশ করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের ব্যাপক অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়বাদী চেতনা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কূটকৌশল সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশবাসী ভারতের সাহায্য নিয়াছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদের চক্রান্ত প্রতিরোধে যে ভারত ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মৈত্রীর ও সাহায্যের প্রয়োজন আছে তারা তাহারা বুঝিয়া উঠে নাই। গণচেতনার এই দুর্বলতার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদ গ্রহণ করে।

৭. একমাত্র মুজিববাদী নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলকেই ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে।

৮. দেশপ্রেমিক শিবিরের রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্বন্ধে মোটামুটি সমঝোতা থাকিলেও কৌশল ও পদ্ধতির প্রশ্নে মতানৈক্য আছে। একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়িয়া তুলিতে না পারিলে শত্রুরা লাভবান হইবে।

৯. ইদানীংকার ঘটনাবলী প্রমাণ করিয়াছে যে (৭ নভেম্বরের পরে) সরকার নিরপেক্ষতার যে নীতি ঘোষণা করিয়াছে ইহা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তাহারা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা, মাওবাদ ও পাকিস্তানপন্থি শক্তিদের বিনা বাধায় কাজ করিতে দিতেছে, আর বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তিকে দমন করিতেছে।

১০. সরকার জাতীয়করণ নীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া ব্যক্তিগত পুঁজিকে অবাধভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করিয়া দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উপরে পুরাপুরি নির্ভর করিবার পথ গ্রহণ করিয়াছে।

১১. রাজনৈতিকভাবে ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন, সাম্প্রদায়িক নীতির অনুকরণ, সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির নজীরবিহীন প্রসার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম অবনতি যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোককে ভাবিত করিয়া তুলিতেছে।’

ওপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে সিপিবি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিল। বাকশাল-ব্যবস্থাকে এমনকি ‘উন্নত ধরনের গণতন্ত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। বাস্তবিকই ১৯৭৫ সালে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির এক এলায়েন্স গঠিত হয়েছিল, যা স্বাভাবিক নিয়মে অগ্রসর হলে দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারত।
বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিষ্ঠুর মৃত্যু সমাজের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। সমাজ-মনোবিদ আশিস নন্দী যাকে বলেছিলেন ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটি’ সেটি ভিন্নতর মাত্রা পায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে।
‘শাকের আহমেদ’ এই ছদ্মনামে সিপিবির একজন নেতা ‘মহান একুশের আবেদন ও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ’ প্রবন্ধে ৭৫-পরবর্তী সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে যা লিখেছিলেন তাতে করে ক্রমবর্ধমান নিষ্ঠুরতাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে তীব্র আকারে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে লেখক তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে:
আজ একদল বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নিয়ে বিদ্রূপ করছেন, যেন দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ জন শোষিত নির্যাতিত সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী প্রমুখ মেহনতি মানুষ আর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ জন শোষক ও নির্যাতকদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন যেন এই দুই অংশের মানুষের একই রকম অধিকারই হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এ কথা কে না বোঝেন যে শোষক আর শোষিত, নির্যাতনকারী আর নির্যাতিত যদি সমান অধিকার ভোগ করে তা হলে দেশ হতে কোনদিনও শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। শোষক ও নিপীড়কদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প গ্রহণ করা। গণতন্ত্রকে হত্যা করা তো নয়ই, বরং তাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্র, ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠার পথ।

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম থেকে আরম্ভ করে আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকরা প্রায় প্রতি দিনই ‘আইনের শাসন’ ‘ন্যায়ের শাসন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রব সেরনিয়াবাতের দুবছরের নাতিকে বা বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করল কিংবা ঢাকা জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী দশায় দেশের চারজন বিশিষ্ট নেতাকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করল সেই নরপশুদের কী করা হচ্ছে? তারা শুধু বহাল তবিয়তেই নেই, তাদের নিরাপত্তা ও বিলাস-ব্যসনের জন্য এই সরকার পাহারাদার এবং খোরপোষেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীরা এই সম্পর্কে কোন প্রতিবাদ বা দাবী উত্থাপন করা তো দূরের কথা, তারা এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চুপও নন, বরং তারা নানাভাবে সরকারের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনই করছেন। নিজের অরক্ষিত বাসগৃহে ডাকাতের মত ঢুকে সরল বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, শেখ মুজিবের সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূদের হত্যা, শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা, রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীর অতিথি ও চাকরদের হত্যা, জেলে আবদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখকে হত্যা-এই সকল জঘন্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডকে এরা সমর্থন করেন এবং এতে আনন্দ উল্লাসও প্রকাশ করেন।’
[ক্রমশ]