[পূর্বে প্রকাশিতের পর] [শেষ পর্ব]

জবাবে শেখ মুজিব বললেন: শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক্ষায় তোমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে চাও, করো। কিন্তু আমি সে পথেই যাব না। যে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং কৃষকের সংগঠন ও চেতনার স্তর নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, সে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যাশায় কালক্ষেপ করতে আমি রাজি নই।
এক, প্রথমে পাকিস্তান থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করব। দুই, এ দেশে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। তিন, সভ্য জগতে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। চার, এমন কতকগুলো অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া উত্থাপন করতে যাচ্ছি যাতে শ্রমিক, কৃষক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মেহনতি মানুষ সকল সম্পদের মালিক হয়; রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বে সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলাম: উপরিউক্ত চারটি দফা যদি আদায়ই হয়, তবে সে তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে না, হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ধরনের একটা কিছু। কিন্তু মেহনতি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য ও কর্মসূচি দিতে হবে। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অবস্থান কীরূপ দাঁড়াবে সে প্রশ্নেরও বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট জবাব থাকতে হবে সমাজতন্ত্রের কর্মসূচিতে।
জবাবে মুজিব বললেন: ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত মানুষের জন্যই তো আমাদের সংগ্রাম। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন এবং তার কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এ দেশে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে যে পারা যাবে না সে সম্পর্কে আমি সজাগ, আমি নিশ্চিত।’
এই ম্যানিফেস্টো-ধারার বিবৃতিকে নিছক ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির’ তথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’-এর অনুবর্তী বললে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ধারণাটিকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করা হবে। আবার একে প্রথাগত সোভিয়েত-চীনের ধারার সমাজতন্ত্র বললেও অন্যায় করা হবে। উভয় বিচারই তথ্যনিষ্ঠ হবে না। এখানেই তার ‘গণতন্ত্রের হাত ধরে চলা সমাজতন্ত্রের’ বিশেষত্ব। কতিপয় গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাক এটা যেমন তিনি চান না, তেমনি চান না কোনো একনায়কত্বের শাসন।
বর্তমান নিবন্ধ থেকে কয়েকটি প্রবণতা বেরিয়ে এসেছে– যা নিয়ে আরও কাজ করা দরকার– তা এই পর্যায়ে দাখিল করব।
১. উন্নত ধনতন্ত্রের বেশ কিছু দেশে যে ধরনের ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ পাই, বা প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে অতীতে (এবং বর্তমানে কোন কোন দেশে) যে ধরনের ‘স্টেট সোশ্যালিজম’ দেখতে হয়েছে, তার বাইরে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের প্রগতিশীল সহকর্মীদের। এ দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই তাঁদেরকে নতুন পথ খুঁজতে বাধ্য করেছিল।
২. এই নতুন পথের নাম ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’। বাহাত্তরের সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) অংশেই একে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ পথ হিসেবে। এই সংজ্ঞা বাহাত্তরের গণপরিষদের সংবিধান আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকট সহকর্মীরা বহুবার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘প্রস্তাবনা’ অংশে উল্লিখিত উদ্ধৃতি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে সবচেয়ে যথাযথ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে ধারণ করে:
‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা‒ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহুদিন থেকে। এ বিষয়ে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন কমিটমেন্ট ছিল। এ নিয়ে প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচির’ ঘোষণায় সমাজতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট সুষ্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়। এই পূর্ব-ইতিহাস জানলে বুঝতে কষ্ট হয় না কেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের দাবি সাহসের সাথে উল্লিখিত হয়েছিল। নির্বাচনের মুখে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি নিয়েই শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সমাজতন্ত্রের ধারায় সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি তোলার জন্য অসম্ভব সৎসাহস থাকা দরকার। বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রতিকূল ও বিরূপ পরিস্থিতিতে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পরোক্ষভাবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছিল:
‘আমাদের বিশ্বাস শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব আনা সম্ভব। অন্যান্য অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
এই নির্বাচনী ইশতেহারেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল ‘জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলিসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা,’ তবে এ ক্ষেত্রে ‘বেসরকারি পর্যায়ে নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুবিধে’ রাখা হয়েছিল ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য। এ ছাড়া বলা হয়েছিল ‘জমিদারি, জায়গিরদারি, সরদারি প্রথার বিলুপ্তি সাধনের কথা’। পরিষ্কারভাবে অঙ্গীকার দেওয়া হয়েছিল ‘সব প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করার কথা’ এবং সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই যাতে ‘সমান অধিকার ভোগ’ করে এই প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ ছিল। অনেকের চোখেই এটি ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ জুড়ে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তরফে প্রায় নিশ্চিতভাবেই অতিরিক্ত নির্বাচনী ঝুঁকি নেওয়া, বিশেষত পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে। কিন্তু সমানাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্বাপর অবিচল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের প্রতি এই অঙ্গীকার আরও গভীর হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশ পরিষদের সদস্যবর্গের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহুপূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারও মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।’
৪. এই পর্যায়ে অবশ্য এটাও বলা দরকার যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণাটির ‘দুই অংশই’ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুনের ভাষণে স্পষ্ট করে এ কথা বলেছিলেন, ‘আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।’ এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুসারী–যিনি ‘লিবার্টি প্রিন্সিপালকে’ প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং যিনি ভেবেছিলেন ব্যক্তিস্বার্থকে বাদ দিলে প্রগতির চাকা রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার স্বাধীনতার পরে হঠাৎ করে বা কেবল বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালে গড়ে ওঠেনি। দেশি-বিদেশি পারিপার্শ্বিক শক্তির চাপে বা প্রভাবে এটি উদ্ভূত হয়নি। সংবিধানের চার স্তম্ভও তেমনি নিছক স্বাধীনতা পরবর্তীকালের উদ্ভাবন নয়। এর পেছনে ছিল দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরম্পরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৫. ধারাবাহিকভাবে গড়ে ওঠা এবং ক্রমাগতভাবে উচ্চারিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পেছনে প্রেরণা এসেছিল বিভিন্ন সূত্র থেকে। নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট একটি পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল ইউরোপের– বিশেষত উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের– ‘সোশ্যাল স্টেট’, ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ প্রভৃতি ধারণার বিকাশের ক্ষেত্রে। পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক দেশের তখনকার দিনের অগ্রগতিও। ১৯১৭ সালের পর থেকেই সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের তরফে কম্পিটিটিভ ‘সোশ্যাল পলিসি’ গ্রহণের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ধনবাদী নানা দেশে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারা এবং রাশিয়া, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের নানা সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রাথমিক উন্নয়ন সাফল্য এই দুটি দিকই তৃতীয় বিশ্বের সদ্য-স্বাধীন নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারেনি। সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন মুজিবের এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেক আগে থাকতেই। এ ক্ষেত্রে পঠন-পাঠনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তো ছিলই; কাজে এসেছিল প্রত্যক্ষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও। প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৯৫২ সালে তরুণ শেখ মুজিবের নয়াচীন ভ্রমণ, যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকলে কত অনায়াসে সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘সুযোগের সমতা’ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনকে নিশ্চিত করা যায়। যদিও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে মুজিব প্রশংসার পাশাপাশি নয়াচীনের সমালোচনাও করেছেন‒ বিশেষত মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্রের অভাব ঘটছে এই আশঙ্কা করে। যে রকম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্ট্যালিনের রাশিয়ায় একনায়কের ছায়া দেখতে পেয়ে।
৬. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ওপরে পরোক্ষ প্রভাব এসেছিল বাঙালির ‘সমাজতান্ত্রিক’ ঐতিহ্য ও সাম্যচিন্তার সূত্রেও। রাজনীতি-সচেতন ও সংস্কৃতিমনা শেখ মুজিব ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা বাঙালির ‘প্রগতিশীল’ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিলেন এই ঐতিহ্যের দুটি প্রধান স্তম্ভ। ‘সাম্যের’ বঙ্কিম থেকে ‘লাঙলের’ সাম্যবাদী নজরুল; ‘রাশিয়ার চিঠি’ ও ‘সভ্যতার সংকটের’ রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘সুলতানার স্বপ্নের’ বেগম রোকেয়া; ‘রায়তের কথার’ প্রমথ চৌধুরী থেকে ‘শাশ্বত বঙ্গের’ কাজী আব্দুল ওদুদ বাঙালির প্রগতিশীল চিন্তার প্রবাহে একেকটি মাইলস্টোন। এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। এদের যাপিত জীবন ও লেখনীর মধ্য থেকে একটি সমৃদ্ধ উদারনৈতিক সামাজিক ন্যায়বিচারমুখীন ‘সমাজতান্ত্রিক’ সমাজের আদর্শ ক্রমশ স্পষ্ট অবয়ব নিয়েছিল, যা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের মানসভুবনকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে থাকবে। বিশেষত এদের প্রায় সকলের লেখনীর মধ্যেই ছিল চোখে পড়ার মতো সামন্তবিরোধী ভাবধারা, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। এর ফলে কৃষি ও কৃষকের সমস্যা এবং সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতার নীতি স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সম্মুখসারির ইস্যু হিসেবে চলে আসে।
এর সাথে যুক্ত করতে হয় চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। সেসব দেশ-কাঁপানো ঘটনাবলি যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ; সাতচল্লিশের দেশভাগ; পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নীতি; পঞ্চাশের দশকের নিরস্ত্রীকরণ ও বিশ্ব-শান্তি আন্দোলন; ‘বাইশ পরিবারের’ সৃষ্টি; রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ; পূর্ব বাংলার দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন; জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্য; অগণতান্ত্রিক আচরণ ও গণবিরোধী নীতি-পদক্ষেপ ইত্যাদি ছিল জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া তত্ত্বের কিছু জরুরি উপকরণ। এসবই মুজিবকে সমৃদ্ধ করেছে– পূর্বনির্ধারিতভাবে নির্দিষ্ট করেছে বাহাত্তর সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ। এসব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপাদানের বিবরণ ছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা আদলকে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তির নিরিখে ঠিক স্পষ্ট করে চেনা যায় না।
৭. বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কয়েকটি মৌল বৈশিষ্ট্যকে বর্তমান প্রবন্ধে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: (ক) বিভিন্ন ধরনের মালিকানার সহাবস্থান বা ‘মিশ্র অর্থনীতি’; (খ) অর্থনৈতিক বাস্তবতাবাদ বা ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজম; (গ) একচেটিয়া (মনোপলি) পুঁজির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান; (ঘ) ‘সুযোগের সমতা (ইকুয়ালিটি অব অপরচ্যুনিটি) ও ‘ফলাফলের সমতা’ (‘ইকুয়ালিটি অব আউটকাম’); (ঙ) নানামাত্রিক শোষণের অবসান; (চ) তীক্ষ্ণ জোটনিরপেক্ষতা বা ‘র্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’; এবং (ছ) ক্রমান্বয়বাদীতা বা গ্র্যাজুয়ালিজম। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই বিশদ বিচার-বিশ্লেষণের দাবি করে। সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায় এরা এমন কতগুলো দিক তুলে ধরেছে; যা প্রথাগত সমাজতন্ত্রের মধ্যে নেই, অথবা থাকলেও নিতান্ত অসম্পূর্ণভাবে উপস্থিত।
‘মিশ্র অর্থনৈতিক’ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে বিভিন্ন মালিকানা-সম্পর্কের একত্রে উপস্থিতি ও তার গুরুত্ব। এর অর্থ, যা কিছু সামাজিক কল্যাণ, কর্মসংস্থান ও গরিবমুখী বণ্টনের জন্য ফলদায়ী হবে সেই মালিকানা-সম্পর্ককেই জনকল্যাণের স্বার্থে স্বীকার করে নেওয়া হবে ‘পরিকল্পনা’ গ্রহণের সময়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে বা মালিকানায় থাকবে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত সকল খাত; যা সরাসরিভাবে সামষ্টিক কল্যাণের বা ‘পাবলিক গুড’-এর বণ্টনের সাথে জড়িত। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিপণন-নির্ভর ‘সমবায়ী মালিকানাকে’ উৎসাহিত করা হবে। ব্যক্তিমালিকানাকে যথাবিহিতভাবে বিকশিত হতে দেওয়া হবে, অনেক ক্ষেত্রে তাকে অগ্রাধিকারও দেওয়া যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগত পুঁজিপতি শ্রেণিকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বা প্রভাব-বিস্তার করার মতো অবস্থানে যেতে দেওয়া হবে না।
ইকোনমিক প্র্যাগমেটিজমের নীতি বলছে যা কিছু জনকল্যাণের জন্য উপকারী, সেই নীতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ‘পরিকল্পনা’, ‘বাজার’ এবং ‘সামাজিক উদ্যোগের’ মধ্যে তুলনামূলক ঝোঁক কেমন দাঁড়াবে সেটি ঠিক করবে অর্থনৈতিক প্রয়োজন, প্রশাসনিক সামর্থ্য এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক বিশ্ববাস্তবতা। অর্থাৎ কোনো পূর্বনির্ধারিত ডগমা বা আইডিওলজি নয়, বাস্তবে কোন নীতি কতটা ফলপ্রসূ সেই নিরিখে নীতিমালা নেওয়া হবে বা বদলানো হবে। দারিদ্র্য নির্মূল করা এবং সব পেশার ও জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত মানব-উন্নয়ন নিশ্চিত করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়া যথাসম্ভব গরিববান্ধব প্রবৃদ্ধি ও অপেক্ষাকৃত সুষম বণ্টনের জন্য বাস্তবোচিত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্ত-বিরোধিতা হবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনোমতেই অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাতে কতিপয় ব্যবসা-গোষ্ঠীর একচেটিয়া রাজ বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন/কেন্দ্রীভবন হতে দেওয়া যাবে না। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র তার জাতীয়করণ নীতি, কর-রাজস্ব নীতি, মুদ্রা ও আর্থিক নীতি পরিচালিত করবে। বৃহৎ শিল্প-বাণিজ্য খাতে অনাদায়ী মন্দ ও খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ জড়ো হয়ে থাকলে সেসব উদ্যোগকে ‘মিশ্র মালিকানায়’ নিয়ে আসা সম্ভব। খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ মূল্যের শেয়ার সরকারি মালিকানায় ন্যস্ত করা যায়। প্রযুক্তিগত উন্নতিতে সকল প্রকার প্রণোদনা ও উৎসাহ দেওয়া হবে সকল শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য।
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে শুধু ‘সুযোগের সমতার’ বিধান করলেই চলবে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আরও সমতামুখীন হচ্ছে কিনা সমাজ-অর্থনীতি, সেটিও দেখতে হবে। এর জন্য উপযুক্ত আয়-বণ্টন নীতি গ্রহণ করতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তা সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে; সবার জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বাস্তবায়ন করতে হবে; সকলের জন্য ‘গ্রহণযোগ্য’ পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে; সবার জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; মানবপুঁজি বিকাশের মাধ্যমে উন্নত পেশা বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সুবাদে আয়-বৈষম্য বিশেষত ইন্টার-জেনারেশনাল ইনইকুয়ালিটি কমিয়ে আনতে হবে। একই সাথে সমাজের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে কালক্রমে উচ্চ আয়ের মানুষের সাথে এবং অগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমপর্যায়ে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-পদক্ষেপ নেবে রাষ্ট্র। এর জন্য চাই প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পদকর এবং ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ঋণ’ পাওয়ার ব্যবস্থা– সর্বস্তরের পেশা ও শ্রেণির মানুষের জন্য। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে নারীদের ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষের মধ্যে নানাবিধ বৈষম্য দূরীভূত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ছকে কোনো ছাড় নেই।
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র ও তার বিদেশ নীতি পরিচালিত হবে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে। এই নীতি সবার সাথে বন্ধুত্বের নীতিতে বিশ্বাসী, তবে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী। এটি কোনো বহিঃশক্তির অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। এক কথায়, বিদেশ নীতি র্যাডিক্যাল ধারার জোটনিরপেক্ষতার অবস্থানকে অনুসরণ করবে, যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ে।
সবশেষে, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কাছের ও দূরের লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় বিধান করবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কৌশলে কোনো পূর্বনির্ধারিত ছক বা মডেল নেই। এ ক্ষেত্রে কাছের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নের আশু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা আর দূরের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, যেখানে প্রাথমিক ও মৌলিক প্রয়োজনই শুধু পূরণ হবে না, জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ বৈষয়িক ও আত্মিক উভয়বিধ বিকাশকে লালন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, সে লক্ষ্যের দিকে রাতারাতি যাওয়া সম্ভব হবে না। যেতে হবে পর্যায়ক্রমে, স্টেপ-বাই-স্টেপ, প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে অতিক্রম করে, অর্থাৎ গ্র্যাজুয়ালি। কেউ বলবেন, নিও-লিবারেল গভর্নমেন্টালিটি বা বাজার অর্থনীতির যুগে এসবই স্বপ্ন, কিন্তু এটি একটি সুন্দর ও সাহসী স্বপ্ন, যার পেছনে ছোটা চলে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটবৃত্তের সহকর্মীরা ১৯৭১ সালে এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। আজকের বাংলাদেশেও এর তাৎপর্য অস্বীকার করার নয়।
[বর্তমান প্রসঙ্গ সমাপ্ত]