বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ৭টি বৈশিষ্ট্য

অধ্যায়:: ১৬ [চলমান] [পূর্বে প্রকাশিতের পর]


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]

১৬.৬। র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রগতিশীল বিদেশনীতি। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একটি তুলনামূলকভাবে অনালোচিত দিক। এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী অবস্থান আরও মনোযোগের দাবি রাখে। ‘এ ক্ষেত্রে কারও সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব’ বললে পুরোটা বলা হয় না। এ জন্য বোঝা দরকার বঙ্গবন্ধুর ‘র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর মতো প্রাগ্রসর অবস্থানকে। এটিকে শুধু স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতায় গৃহীত এক কুশলী বৈদেশিক নীতি-পদক্ষেপ হিসেবে দেখলে খাটো করা হবে। এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান বঙ্গবন্ধুর মনে দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছিল। এর স্পষ্ট প্রতিফলন প্রথম লক্ষ্য করা যায় ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। সেখানে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন ‘পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স’ শীর্ষক শান্তি-সম্মেলনে অংশ নিতে। তরুণ মুজিব তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
“অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, ‘আমরা শান্তি চাই’। কারণ, যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয় তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; বিশেষ করে আমার দেশে– যে দেশকে পরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কাঁচামাল চালান দিতে হয়। যে দেশের মানুষ না খেয়ে মরে, সামান্য দরকারি জিনিস জোগাড় করতে যাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, সে দেশে যুদ্ধে যে কতখানি ক্ষতি হয় তা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করলেই বুঝতে পারবেন। কোথায় ইংরেজ যুদ্ধ করছে, আর তার জন্য আমার দেশের ৪০ লক্ষ লোক শৃগাল কুকুরের মতো না খেয়ে মরেছে।”
১৯৫২ সালে লেখা এটি, অথচ ২০২২-২৩ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে এর প্রাসঙ্গিকতা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়ে গেছে। কয়েকটি উদাহরণ:

১। ১৯৪৯ সালের ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতে’ বলা হয়েছিল:
‘পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করার সমস্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানকে অংশীদার হইতে হইবে এবং শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সর্বব্যাপী বিজয় অভিযানকে জয়যুক্ত করিবার জন্য অন্যান্য জনগণতান্ত্রিক ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সর্বপ্রকার প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর আন্দোলন ও কর্মধারায় সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতা করিতে হইবে। দুনিয়ার সমস্ত জালিমদের সহিত সংগ্রাম করিয়া মজলুমদিগকে মুক্ত করাই হইবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য।’

২। নয়াচীন ভ্রমণের এক বছর পরে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের ‘সাংগঠনিক রিপোর্টে’ (শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত) বলা হয়েছিল:
‘তাই আওয়ামী লীগ … সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী জোটের সাথে সম্পর্কহীন সক্রিয় নিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করিয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ এই নীতির অনুকূলে শান্তি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। … শান্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়া আওয়ামী মুসলিম লীগ যুগ যুগব্যাপী মানুষের প্রতিভা ও সাধনার প্রতিভূ মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য বিশ্বধ্বংসী রণপাগল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ আজ নীতিগতভাবে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির মহান নেতা।’

৩। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিব উচ্চারণ করেন দলের বিদেশনীতি:
‘সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব, হিংসা কারও বিরুদ্ধে নহে (Friendship to all, Malice to none) আওয়ামী লীগ বৈদেশিক সম্পর্কে এই নীতিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ সহযোগিতা প্রদান করিবে। বৈদেশিক সম্পর্ক অনড় (static) থাকিতে পারে না। উহা সচল ও পরিবর্তন সাপেক্ষ (Dynamic) এই সত্য উপলব্ধি করিয়া আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদে বিশ্বাসী। তবে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীননীতি গ্রহণে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসী।’

৪। ১৯৬৭ সালে গৃহীত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ‘নীতি ও কর্মসূচির ঘোষণা অর্থাৎ (ম্যানিফেস্টো)’তে বলা হয়েছিল:
‘আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাস করে। সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং একনায়কত্বমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থন থাকিবে।’

৫। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল:
“পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনোমতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না এজন্য আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হয়। আমরা ইতোমধ্যে ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ ও অন্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনো জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে, সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।”

৬। বাহাত্তরের সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায়-অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’
এ-ই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ‘র‌্যাডিক্যাল নন-এলাইনমেন্ট’-এর বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।

১৬.৭। গ্র্যাজুয়ালিজম
বঙ্গবন্ধু তাঁর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আরেকটি মৌল বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। সেটির এককথায় নাম– ধাপে ধাপে চলা, পর্যায়ক্রমতা (ইংরেজিতে Gradualism)। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠার পথ এক দীর্ঘ অভিযাত্রার পথ। এখানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কারণে নানামুখী কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কখনও বাঁয়ে, কখনও ডানে সরে এসে; কখনও দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে, কখনও দ্রুত পথ অতিক্রম করে চলতে হয়। এজন্য ‘বিশুদ্ধপন্থি’ হলে চলে না। একেই মাইকেল হ্যারিংটন (১৯৮৯) অভিহিত করেছিলেন ‘ভিশনারি গ্র্যাজুয়ালিজম’ বলে।
এজন্যই খোন্দকার মো. ইলিয়াসকে (পূর্বে-উদ্ধৃত কথোপকথনে) মুজিব বলেছিলেন, ‘ধীরে ধীরে যেতে হবে, ধাপে ধাপে যেতে হবে’ এ দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দিকে। এই যাত্রাপথে পরিকল্পনা ও বাজার-অর্থনীতি উভয়কেই আশ্রয় করতে হয়; ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সামষ্টিক জমায়েত উভয়কেই উৎসাহিত করতে হয়; স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হয়। সমাজের aspiration এবং custom-culture কে হিসেবে নিতে হয়। এর বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের প্রথম অধ্যায়ে। যেখানে দেশের উন্নয়নের ধারা বেগবান করার জন্য ‘দূরের’ সাম্যবাদী লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ‘কাছের’ উন্নয়ন-সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিটি আমি এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে ধরছি। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা দলিলের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কতগুলো পূর্বশর্ত আলোচিত হয়েছিল।
প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দলিলে যথার্থই বলা হয়েছিল যে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দরকার বিদ্যমান পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন: ‘Without this assessment a country may adopt a programme which is unrealistic, either too ambitious or too modest’। বলা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পূর্বশর্তগুলোকে আগে শনাক্ত করতে হবে। যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বা প্রাগ-পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের উচ্ছেদ, সেটা একলহমায় করা যাবে না: ‘Depending upon the objective conditions of the society, this may have to be done in stages’। দলিলে যথার্থই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন-বৃদ্ধির ওপরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করাই হচ্ছে আশু কর্তব্য: ‘In an underdeveloped economy such as Bangladesh, the socialist transformation of the economy must accompany the growth of productive forces. It has to be clearly understood that anything which hampers increase in productivity or growth of productive forces and dissipates the meagre resources of the country in unproductive activities and unnecessary consumption is in contradiction with the basic principles of socialism.’
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতাকে বেগবান করে ‘productive forces’ কে আগে বিকশিত করে এবং পরে ‘production relations’-এর পরিবর্তনের কাজে হাত দেওয়া সম্ভবত এই ছিল পরিকল্পনাবিদদের মত। পরিকল্পনা দলিলে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আরও যে ফ্যাক্টরের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটি হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র গড়ার ক্যাডার’ গড়ে তোলা। পরবর্তীকালে বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু এই দিকটির প্রতি বিশেষ জোর দেন। পরিকল্পনা দলিলে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছিল, সমাজের মূল্যবোধ সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পক্ষে ব্যাপকভাবে না দাঁড়ালে কখনোই উত্তরণ সফল হবে না: ‘As long as the broad masses are unable to accept the norms of behaviour necessary for a radical transformation of society, no amount of socialist policy adopted by the government can usher in socialism.’ আর সমাজের মূল্যবোধ শুধু সরকারি আমলাদের কাজের মাধ্যমে পরিবর্তন হয় না। এখানে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রশিক্ষিত আত্মনিবেদিত ‘ক্যাডার’ হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এনজিও লিটারেচারের পরিভাষায় এই ক্যাডাররা সমাজ-পরিবর্তনের ‘এনিমেটার’ বা ‘catalytic agent’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা বলে পরিকল্পনা দলিলে মন্তব্য করা হয় যে, কাজটা সহজ নয় আদৌ: ‘Before socialism becomes a reality, the task is to educate the public about the need for social change. The cadres are the instruments through which the task is carried out. We must, however, be aware of the fact that a cadre is as likely to degenerate as any one else.’
কেন এসব সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছিল পরিকল্পনা দলিলে সেদিন? স্পষ্টতই, দলিল-প্রণেতারা কোনো কল্পলোকে বিচরণ করতে চাননি এবং মাঠ-পর্যায়ের বাস্তবতাকে পরিকল্পনার মধ্যে বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘আত্মোৎসর্গ’ করার আহ্বান শুধু সাময়িক কালের জন্য কাজ করে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মতকে আগেই উদ্ধৃত করেছি যেখানে তিনি বলছেন স্বার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে অর্থনীতির চাকা একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানব-চরিত্রের স্বার্থপরতার দিক এবং সমাজ-কল্যাণে ব্রতী পরার্থপরতার দিক উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন করেই ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যে-কথা দিয়ে তাঁর পরিকল্পনা দলিলের ভূমিকা শেষ করেছিলেন তা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে: ‘Development is a slow and painful process. It means present sacrifice for future gains. It is specially painful for a country at a very low level of living such as Bangladesh where an increasing and significant reliance is to be placed on domestic resources for development. We can make the sacrifice, which is so essential for development, socially tolerable only if it is equitably shared by all.’ এটা বলেই তিনি সতর্ক করলেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের: ‘The room for flexibility is so small, the ability of the socio-economic system to withstand the effects of mistakes and waste is so severely limited that in the use of scarce resources as well as in experimenting with new institutions, great caution and extreme care need to be exercised.’
কৃষিপ্রধান দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার সমস্যা বঙ্গবন্ধু গভীরভাবেই জানতেন। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কী ধরনের অর্থনীতি সে সম্পর্কে বিদ্বজ্জনের ভেতরেই নানা মত চালু ছিল। সেই অস্পষ্ট আদলের সমাজতন্ত্রে কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেটারও কোনো রেডিমেড ব্লুপ্রিন্ট তার হাতে ছিল না সেদিন। তার চারপাশের বুদ্ধিজীবীরাও সেটা স্পষ্ট জানতেন না, যেমন জানতেন না (এবং এখনও বলতে গেলে প্রায় জানেন না) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীরা। শুধু জানতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করে গতিশীল উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর জানা ছিল যে, শোষণমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবেই, এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে আটকে থাকাটাই মানব-ইতিহাসের চূড়ান্ত বিধিলিপি নয়। এখানে ‘চ্যালেঞ্জটা’ এত বড় যে বারবার ‘চেষ্টা’ করা ছাড়া অন্য কোনো সহজ পথ খোলা নেই। ৪ নভেম্বরের গণপরিষদ বিতর্কের সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে তাঁর মনের কথাটি বলেছিলেন:
‘সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না– অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যায়। … সমাজতন্ত্রের মূল কথা হলো শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সবকিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই– সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান– ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্যদিকে চলেছে। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয়। এক দিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা ৯ মাসে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই– আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোনো কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা process-এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।’

১৭। শেষের কথা
এবার বোধ হয় উপসংহারের দিকে যাওয়া চলে। প্রথমে আসি বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতাদর্শ প্রসঙ্গে। আমরা দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছিল একটি অসাধারণ ‘পলিটিক্যাল টেস্টামেন্ট’, যা থেকে তাঁর অর্থনৈতিক মতাদর্শের স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে-কথাগুলো এখানে তুলে ধরব তা ত্রিশোত্তীর্ণ মুজিবের বিশ্বাসের কথা, তাঁর মনের অন্তস্তলের কথা, কাউকে শোনাবার জন্য নয়, এসব তো আদৌ প্রকাশিতব্য ছিল না। এটি নিজের চিন্তাকে কেবল একটি স্থায়ী উপলব্ধির কাঠামো দেওয়ার প্রয়াস, যেটি কখনোই তাঁর মন থেকে মুছে যায়নি, আমৃত্যু যাকে তিনি লালন করেছেন। এখানে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। প্রথমে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
“চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদী সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।”
এটিকে কাকতালীয় বিবৃতি বলে মনে করার দরকার নেই। পরবর্তীকালে, ১৯৬৪ সালের কোনো এক সময়ে শেখ মুজিবের সাথে তার কলকাতা জীবনের সতীর্থ ‘মুজিববাদ’ বইয়ের লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের বৈঠক হয়। সে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘পুনরুজ্জীবিত’ আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো নিয়ে। পুরো উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই এখানে।
‘শেখ মুজিব আমাকে বললেন : তোমরা বামপন্থিরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম শুরু করেছ, সে সংগ্রাম সম্পাদন করতে হবে আমাকেই। তাঁর মুখে আত্মপ্রত্যয়ের হাসি।
আমিও হেসে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম : কীভাবে?

[ক্রমশ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s