দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৬৯-’৭০ সালের দিকে এ চিত্র পুরোপুরি উল্টে যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা নাই–বা বললাম। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান বা অধিবাসীরা ১৮৭২ সালের শুমারি থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এক শতাব্দী ধরেই সমকক্ষতার লড়াইয়ের প্যারাডাইমের মধ্যে ছিল; প্রথমে বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে, পরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে।
বাংলাদেশ নিয়ে আমার আশাবাদের উৎসের কথা বলতে চাই। ১৯৭২ সালেও আমরা মনে করেছি, অনেক বড় কিছু অর্জনের জন্যই বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, ’৭৬ থেকে ’৮১ সালের মাৎস্যন্যায়, পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো এত সব রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও আমাদের কখনো মনে হয়নি যে আমরা বড় কিছু অর্জন করতে পারব না। এ আশার উৎস মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের আগের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের চর্চা।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বা আমাদের সংবিধানের মূল আদর্শগুলো রাতারাতি আসেনি। আমার দেখা নয়া চীন বইয়ে তরুণ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ সর্বস্তরে চীনের মতো না হলে তো দেশ-জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা কেন অবাক হব? সমকক্ষতার লড়াইয়ের পরে আসে আদর্শের নির্মাণের বিষয়টি। আদর্শের নির্মাণের পেছনেও একটি বড় ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা ছিল। এর পেছনে অর্থনীতিবিদ, কবি, রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতির সংগঠকদের ধারাবাহিক অবদান ছিল। আদর্শ নির্মাণের দীর্ঘ পরম্পরায় আমাদের সংবিধানের চারটি স্তম্ভ এসেছে।
সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারণা এ দেশে রাতারাতি আসেনি। আদর্শের নির্মাণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আগের এবং পরবর্তী ইতিহাসের বড় অর্জন। সেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের একটা প্যারাডাইম খুব সচেতনভাবে বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই এটা বলেছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের ১৯৪৯ সালের ঘোষণা ও কর্মসূচিতে প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বার্তা আছে। ’৬৪ সালের পুনরজ্জীবিত আওয়ামী লীগে, ’৬৭ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় ঘোষণা কর্মসূচিতে, ’৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে,’৭১ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের একাধিক ভাষণে এর উল্লেখ আছে।
তবে বাস্তবতা এভাবে এগোয় না। আমরা শুধু পরিকল্পনার জগতে বাস করি না, বরং আমরা সত্যিকার অর্থেই সামাজিক এবং শ্রেণিস্বার্থতাড়িত। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের জাতীয়তাবাদেও আমরা দুটি প্রবণতা দেখতে পাব—একটি রক্ষণশীল, আরেকটি প্রগতিশীল। রক্ষণশীল প্রবণতাটি এলিট বা ধনিক শ্রেণির ব্যবসা-শিল্প ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বিকাশের সঙ্গে জড়িত। ব্যক্তিগত স্বার্থ অনেক সময় জাতিগত স্বার্থের সঙ্গে মিলে যায়। অন্যটি কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র, মেহনতি মানুষের আন্দোলনের ধারা। ভাষা আন্দোলনের পর থেকে একাত্তর পর্যন্ত এই ধারারই প্রাধান্য ছিল। ১৯৬০-এর দশক থেকে আইয়ুব খানের সময়ে একটা শিল্প-বুর্জোয়া, আমলা ও ধনিক শ্রেণি তৈরি করার প্রবণতা দেখা যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদেরও আমলে নিয়েছিল। ঘোষণা ও কর্মসূচিগুলো অনুসরণ করলে মনে হবে, কোথাও কোথাও এটা বামপন্থার দিকে চলে যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো জায়গায় মধ্যপন্থার দিকে থাকার চেষ্টা হচ্ছে। রাজনৈতিক অবস্থা আর বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপের ওপর ভিত্তি করে এ দুইয়ের মধ্যে সচেতন একটা সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা যায়।
জাতীয়তাবাদের এই দুই প্রবণতাকেই আওয়ামী লীগ ধারণ করেছিল। একটা সময়, বিশেষ করে ছয় দফা ভালো করে পড়ে দেখলে দেখা যাবে যে এর মধ্যে পরিষ্কারভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিসক্যাল ফেডারেলিজমের কথা আছে। বোঝা যায়, একটা প্রাগ্রসর চেতনা থেকে এটা লেখা হয়েছে। ’৭২ সালের সংবিধান বিতর্কে জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল প্রবণতাটি জয়ী হয় এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণা চলে আসে। ধনিক শ্রেণি যাতে কোনোভাবেই প্রভাবশালী হয়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, এই মর্মে স্পষ্ট একটা অবস্থান ছিল।
প্রশ্ন হলো, ১৯৬০-এর দশকে মাত্র ৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত যত বড় বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারল, এখনকার মধ্যবিত্ত ৩০ শতাংশ হয়েও কেন সাম্য বা স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সুবিধাবাদিতার প্রবণতা থাকে। আবার সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পরার্থপরতারও প্রবণতা থাকে। ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত পরার্থপর হওয়ার বড় কারণ হলো সেটা কেবল অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না, এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাও ছিল। আমাদের ৩০ শতাংশ অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত বৈশ্বিক বা অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বুদ্ধিজীবিতার উপাদান অনুপস্থিত। জ্ঞানমনস্কতার পেছনে এরা ছুটছে না, ব্যক্তিগত স্বার্থের তৎপরতাই এদের মুখ্য। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতসহ বহু দেশেই আমরা এটি দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের কাছের সমস্যা উন্নয়নের; দূরের সমস্যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার। অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, দূরের লক্ষ্য এখনই অর্জন করা যাবে না বলে তাকে ভুলে গেলে চলবে না। তাকে মনে রেখেই কাছের লক্ষ্যগুলোকে অর্জন করতে হবে। আমরা আগে সব ব্যর্থতার জন্য শ্রেণিস্বার্থকে দায়ী করতাম, এখন রাজনীতিকে করছি। কিন্তু রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার পেছনে বৃহত্তর কারণ আছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি বা সংবিধানের সমতামুখী আদর্শগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার একটা কারণ হলো আমরা এখন টাকার পেছনে ছোটা একটি সমাজে পর্যবসিত হয়েছি। এ ধরনের সমাজ কোনো রীতিনীতি-নিয়ম-রুচি মেনে চলে না। কেন আমরা একটি জ্ঞানমনস্ক সমাজে পরিণত হতে পারলাম না, সেটি গভীরভাবে ভাবা দরকার। এ জন্য হয়তো আমাদের আরও বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। এমন কিছু বেশি সময় তো পার হয়নি।
— বিনায়ক সেন: মহাপরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)