অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের মাইলফলক


পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ দেবে কী দেবে না, কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাব কী পাব না; অথবা কারও সাহায্য ছাড়া আমরা নিজেরাই সেতুটা নির্মাণ করতে পারব কিনা- এমন নানা প্রশ্নমুখর বাস্তবতার দিনে ২০১২ সালে আমি বলেছিলাম, আমাদের অসাধারণ কিছু করতে হবে। আমাদের জানান দেওয়া উচিত যে, আমরা বাঙালি জাতি- আমাদের ইচ্ছে মতো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর অভ্যাসটা তোমাদের বদল করতে হবে। আমরা আর সেই আগের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাসের পাত্র হওয়া জাতি নেই। বিশ্বকে জানান দেওয়ার জন্যই হোক বা নিজেদের উন্নতির জন্যই হোক, নিজেদের শক্তি দিয়ে সেই স্বপ্টেম্নর পদ্মা সেতুটা একদিন সত্যিই বানানো সম্ভব হতে পারে- বলা যায়, এ নিয়ে আমার এক ধরনের আস্থা ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মোটা দাগে যে হিসাবগুলো সেদিন আমাদের সামনে ছিল, সেই হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে খুব সাধারণভাবেই আমার ভাবনা হয়েছিল এবং এখনও হয় যে, যাঁরা সন্দেহপ্রবণ, তাঁরা সেদিন কেন ভেবেছিলেন যে এটা আমাদের নিজেদের টাকায় করা সম্ভব নয়? আজকে আমাদের জিডিপি ৪১০ বিলিয়ন ডলার- পদ্মা সেতুর সেতু অংশের খরচ দিয়ে তাকে ভাগ করলে আসে ১ শতাংশেরও কিছুটা কম। অর্থাৎ আমরা আজকে আমাদের জিডিপি’র ১ শতাংশ খরচ করেই একটা পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারি।
২০১২ সালে এই পরিসংখ্যানগুলো হয়তো আরেকটু দুর্বল ছিল। তখনও আমাদের রপ্তানি অত বেগবান হয়নি, আমাদের রেমিট্যান্সও ততটা বেগবান ছিল না তখন, আমাদের সক্ষমতাটাও অতটা পরিস্কার হয়নি হয়তো। হয়তো সে জন্যেই আমাদের অনেকের মনে সন্দেহটা ছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাতো একটা সেতু মাত্র- এত বড় একটা দেশ, তার বৈদেশিক আয় ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে নিজের টাকায় এমন একটা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না?
আমরা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক সাহায্যের ছায়ায় ছিলাম। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে থাকলে যেমন অন্য চারাগাছগুলো বেড়ে উঠতে পারে না, তেমনি আমাদের আত্মবিশ্বাসের চারাগুলোও এতদিন বেড়ে উঠতে পারেনি। ছায়াটা সরে যেতেই আমরা দেখতে পারলাম যে আমাদের মাথার ওপরে তো দিব্যি রোদ আছে- আমরা এখন নিজেদের মতো করেই বড় হতে পারব। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক সাহায্য ছিল আমাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। সেটা কমতে কমতে আজকের দিনে এসে ১ শতাংশে পরিণত হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটা পরিসংখ্যানে ঘটলেও মনের মধ্যেতো ঘটেনি এর আগে। মনে মনে হয়তো এখনও আমরা ভাবছি যে, বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আমরা বোধ হয় চলতে পারব না, কেউ না করে দিলে কিংবা কেউ হাতে ধরে না শিখিয়ে দিলে আমরা হয়তো পারব না। কিন্তু দিন একটু একটু করে বদলে গেছে- আমাদের তরুণ প্রকৌশলী, যাঁরা পদ্মা সেতুর কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটাও দেখার মতো। তাঁরা অনেকেই এখন বলছেন যে, তাঁরা ভবিষ্যতে যেকোনো জটিল প্রকল্প সামাল দিতে পারবেন। এই আত্মনির্ভরতাগুলো একেকটা জাতি ধাপে ধাপে অর্জন করে থাকে। একের পর এক ধাপ পার হয়ে হয়ে কিংবা কিছু কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের আত্মবিশ্বাসের একটা বৃহত্তম ধাপ। তার আগে যেমন ৬-দফার মাধ্যমে দুই অর্থনীতি শীর্ষক একটা যুক্তির ধাপ আমরা পার হয়ে এসেছি, যার মাধ্যমে আমাদের ভেতর স্বাধিকার আন্দোলন করার জন্য একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এগুলোই আমাদের জাতি গঠনের একেকটা মাইলফলক। আমি মনে করি আমাদের সংবিধান আমাদের জন্য যেমন একটি মাইলফলক, পদ্মা সেতুও তেমনি একটি মাইলফলক। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আসলে এত বড় রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম- মূলত তখনই আমরা এলডিসি অতিক্রম করে গিয়েছিলাম। হিসাবে আমাদের এলডিসি অতিক্রম হয়তো আরও পরে হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে এলডিসিস্তর থেকে আমরা তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম, যখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন আমরা নিজেদের টাকাতেই এটা করতে পারব। সেতুর অর্থনৈতিক অভিঘাত এবং অন্যান্য অনেক বিশ্নেষণের চেয়েও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি ঘটনারই যেমন একটা ব্যবহারিক মূল্য থাকে, তেমনি তার একটা আত্মন্তিক মূল্যও থাকে। পদ্মা সেতুর সেই আত্মন্তিক গুরুত্বটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। একটা কঠিন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর থেকে যার মাধ্যমে আমরা একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে, নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম একটা জাতি হিসেবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি। সেখানে অনেক ঝুঁকি ছিল; এবং অনেকেই বলেছেনও যে, এই ঝুঁকি আমরা সামলাতে পারব না; কিংবা আমাদের রয়েসয়ে চলা উচিত। কেননা বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা যদি আমাদের থেকে সরে যায়, তাহলে আমাদের উন্নয়ন ধসে পড়বে, আমরা না খেয়ে মারা যাব, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, আমরা নৈরাজ্যের মধ্যে গিয়ে পড়ব ইত্যাদি। কিন্তু তেমন পরিস্থিতিতেই আমরা আশার আলো দেখেছিলাম- আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ছিল, আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল, রেমিট্যান্স বাড়ছিল। এ সমস্ত আরও অনেক কারণেই তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা ভাবতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে কিন্তু অতটাতো দুর্বল আমরা নই।
আমি সেদিন বলেছিলাম পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থানের জন্য আমাদের বাজেটে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, সেতুর প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় মুদ্রা এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমেই সংস্থান করা সম্ভব ছিল। আজকেও বলছি, স্থানীয় মুদ্রায় পদ্মা সেতুর অর্থসংস্থান করা আমাদের পক্ষে তখনও কঠিন ছিল না, এখনও কঠিন নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ সংস্থান নিয়ে খানিকটা প্রশ্নবোধকতা ছিল, এখন তা একেবারেই নেই। এখন আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের যে প্রবাহ, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের যে স্ট্রেংথ, আমাদের খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা- এ অবস্থায় দাঁড়িয়েই আমরা আজ জিডিপির মাত্র ২-৩ শতাংশ খরচ করে পদ্মা সেতুর মতো আরও দুইটা সেতু তৈরি করতে সক্ষম।

আমি মনে করি আমাদের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের একটা নির্দেশক হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। আমরা বলছি না যে, অন্যদের সাহায্য ছাড়া কিংবা বিদেশি প্রযুক্তি ছাড়া, বিদেশের সঙ্গে মেলবন্ধন ছাড়া আমরা সবকিছুই করে ফেলব- কিন্তু আমরা এটা বলছি যে, যদি কেউ নাও আসে তবুও এখন একলা চলার শক্তি আমাদের আছে। এটাতো আগে বলতে পারতাম না। এখন আমরা বলতে পারি। কেবল বলতেই পারি তা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তাকে সমর্থনও করে; আমাদের বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্য তাকে সমর্থন করে, আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি বা কৃৎকৌশলগত সামর্থ্য সেটাকে সমর্থন করে, আমাদের প্রকৌশলীরা সেটাকে সমর্থন করেন, অর্থনীতিবিদরা সেটাকে নিয়ে ভাবতে পারেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা নিয়ে আরও দূরদর্শীভাবে পথরেখা আঁকতে পারেন। এ সমস্ত বিষয়ই হচ্ছে আমাদের উন্নতির জন্য মূল্যবান উপাদান, যার মাধ্যমে মূলত একটা জাতি পরিপকস্ফ হয়ে ওঠে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশের ৫০ বছরে সংবিধান থেকে শুরু করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ- এই যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইতিহাস।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এটা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের পর্যায়। পৃথিবীর উন্নত সব দেশেরই এসব বড় ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাছাড়া আমাদের জনকল্পনাতেও আজ উন্নত যোগাযোগের চাহিদা ও স্বপ্টম্ন তৈরি হয়েছে। বলা যায়, যার একটা রূপান্তর হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের একটা নতুন জোয়ার তৈরিতে নিঃসন্দেহে এই সেতু অবদান রাখতে সক্ষম হবে। যে জোয়ার স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক শিল্পক্ষেত্রগুলোর একটা অংশ খুলনা শহরের দিকে স্থানান্তরিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা শহরটি আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম শহরে পরিণত হবার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল আমাদের জিডিপি বৃদ্ধিরই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের নতুন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ একত্র হয়ে একটা বড় ধরনের ফলাফল এনে দেবে।
সব মিলিয়ে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, এই সেতু নির্মাণের একটা ব্যবহারিক উপকারিতা আছে- সেটা আমরা ভোগ করব; সেটা আগামীতে আরও বাড়বে, সেটা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদের স্থানীয়ভাবে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে সেতুর প্রতীকী তাৎপর্য- এর আত্মন্তিক তাৎপর্য। তা হচ্ছে যে, আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। একটা বৃহৎ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের টাকায় নিজেদের সেতু নির্মাণ করেছি। এটা যখন করতে পেরেছি, তাহলে আগামীতে অবশ্যই আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব।

লেখক :অর্থনীতিবিদ মহাপরিচালক, বিআইডিএস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s