পর্ব :: ১০৮
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
‘ব্রেকফাস্ট উইথ ইভিল’ বইতে আশিস নন্দী যে ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটির’ কথা বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক ভায়োলেন্স একপর্যায়ে সামাজিক ভায়োলেন্সের স্লুইসগেট খুলে দেয়। ‘প্রাগ-আধুনিক’ যুগে সহিংসতা প্রকাশ পেত লাঠিসোটা, রড-হকিস্টিক, ছুরি-কিরিচ এসব অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। কচিৎ-কদাচিৎ ব্যবহূত হতো বন্দুক-পিস্তল ধরনের মারণাস্ত্র। সাদত হাসান মান্টো তার অনুগল্পগুলোয় পার্টিশন-রায়টের যে রক্তশীতল করে দেওয়া বিবরণী রেখে গেছেন তাতে লাঠিসোটা ছুরি-কৃপাণের ব্যবহারই ছিল চোখে পড়ার মতো। ষাটের দশকের শেষে নকশাবাড়ী আন্দোলনে ‘জোতদার খতমের’ কাজে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার জন্য। চারু মজুমদারপন্থিরা শ্রেণিশত্রুর গলা কাটার জন্য গ্রাম-এলাকায় ছুরি-কাস্তে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন- ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার পাতায় এমনটাই পরে শুনেছি। অবশ্য পরে শহর এলাকার ছাত্র-যুবকরা এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে পাইপগান ও হাতে বানানো বোমার প্রচলন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। এই ‘টেকনিক’ আমাদের দেশেও অতি-বামপন্থিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২-৭৫ সালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে এসব ‘প্রাগ-আধুনিক’ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ব্যবহূত কিছু ‘আধুনিক’ সমরাস্ত্র যেমন এসএলআর রাইফেল ও স্টেনগান এসবেরও আংশিক প্রয়োগ হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দূর থেকে নয়, একেবারে গলাকাটা দূরত্বে এসে শ্রেণিশত্রু খতমের ধারাই ছিল সহিংসতার মূল কালচার। পরবর্তী সময়ে অতি-বাম সহিংসতার সংস্কৃতি অতি-ডানপন্থিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার সময় ‘রগ কাটা’ পদ্ধতির প্রচলন হয়। পায়ের রগ কেটে প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার পদ্ধতিকে দাবি করা হয় একই সঙ্গে আতঙ্ক লাগানো এবং এফেক্টিভ পদ্ধতি হিসেবে। টেকনিক একবার উদ্ভাবিত হলে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং যে কোনো আইডিওলজি প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হলে ব্যবহূত হতে পারে।
তবে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিনির্ভর, গণ-আকারে সহিংসতার প্রথম ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সময়ে। বস্তি এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এর আগে শহরের বুকে কখনও ট্যাঙ্ক চলেনি। শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক’ ও সাঁজোয়া বাহিনী, আর গর্জে ওঠা ‘রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান’ সেদিন ‘খই ফুটিয়েছিল’ যত্রতত্র। শহরের বুকে ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান গুলি ছুড়ছে- এ দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘আধুনিক’ যুগে আমরা প্রবেশ করি। দ্বিতীয়বারের মতো এই আধুনিক সহিংসতার মুখোমুখি হই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে আবারও নামে ট্যাঙ্কের বহর (যদিও তখন জানা ছিল না যে সেগুলো গোলাবিহীন)। নামে মেশিনগান এবং ভারী মারণাস্ত্র সুসজ্জিত ঘাতক বাহিনী। প্রধান লক্ষ্য তাদের ৩২ নং সড়কের বাড়ি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে সামরিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে প্রাসাদকে লক্ষ্য করে। প্রাসাদের ভেতরে আত্মরক্ষার জন্য হাতে স্টেনগান নিয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে, এবং যুদ্ধ করতে করতেই মারা গেছেন তিনি- এ কথা আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে শুনেছি। সিআইএ এই অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল তা-ও জেনেছি। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এ রকম আকছার ঘটে থাকে, এমনটাই ভেবেছি। শুধু আয়েন্দের মতো নির্বাচিত সিভিলিয়ান শাসকের বিরুদ্ধে নয়, অনির্বাচিত সামরিক শাসকের বিরুদ্ধেও মিলিটারি ক্যু ঘটে থাকে। গত শতকের ৫০-৬০-৭০-৮০-র দশকের লাতিন রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্যু ঘটবে, এটা অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। ঠান্ডা যুদ্ধের বাহানায় তখন পিরিয়ডিক সামরিক অভ্যুত্থানকে ‘নিউ নরমাল’ হিসেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশেও এটা কী করে ঘটতে পারে?
প্রশ্নটা বোকার মতো করলাম, নাকি এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে- সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটি উদাহরণ দিই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘প্রাগ-আধুনিক’ সহিংসতার যুগে কেমন ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদের একটি স্মৃতিচারণায়। ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখা’ একটি অনুষ্ঠানে (বিআইডিএস আয়োজিত) তিনি বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে তার বিপদে পড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সাহায্য করতেন। মাসে কাদের কত সাহায্য দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে, তার হিসাব রাখার জন্য একটি লগবুক রাখতেন তোফায়েল আহমেদ (সে সময়ে তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব)। একদিন বঙ্গবন্ধু খাতাটি দেখতে চান। সেখানে লেখা ছিল মওলানা ভাসানী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের নাম। কারও নামের পাশে মাসিক ৫০০ টাকা, কারও নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা। শাহ আজিজ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন (পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হন)। ১৯৭২-৭৫ পর্বে ভাসানী তার প্রকাশিত ‘হক-কথা’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুজিব সরকারের সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন। দেশে উগ্র ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব প্রচারে ‘হক-কথার’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাহ আজিজ, ফজলুর কাদের চৌধুরী, সবুর খান সে সময়ে জেলে ছিলেন দালাল-আইনে। মোদ্দা কথা, এখনকার রাজনৈতিক কালচার অনুযায়ী এসব বিতর্কিত ও অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে নিন্দিত অনেক ‘বিরোধী’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদার সাহায্যের তালিকায়। ৫০ বা ৬০-র দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা সরকারি দল-বিরোধী দল নির্বিশেষে- এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। একই আবহাওয়াতেই বড় হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিব। এখন তিনি রাষ্ট্রনায়ক, কিন্তু সেই রাজনৈতিক আচার-সহবত বা বৃহত্তর অর্থে নৈতিকতাবোধ তিনি ভুলে যেতে পারেন না। তোফায়েল আহমেদকে একপ্রকার তিরস্কারই করলেন লগবুকে লেখা নামগুলো দেখে। ‘এভাবে কেন এদের নামের পাশে টাকার অঙ্ক লিখে রেখেছ? পুরো নাম লিখবে না। মওলানা ভাসানী না লিখে, লিখবে এম. বি; শাহ আজিজ না লিখে লিখবে এস.এ’- সাংকেতিকভাবে নামের ও সাহায্যের রেকর্ড রাখতে বললেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈতিকতার এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। সিরাজুল আলম খান ও আ স ম রবের জাসদ তার সরকারের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছিল ১৯৭২-৭৫ পর্বে। কিন্তু এর পরও সস্নেহে তিনি তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশকে নিশ্চিহ্ন করতে চাননি। সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব বা শাজাহান সিরাজকে কারাবন্দি করা হয়নি। হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা প্রকাশ্যে যেখানেই বিচরণ করতেন, সে খবর বঙ্গবন্ধু রাখতেন কিন্তু তাদের কারাবন্দি করার প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু যারা চরম বামপন্থি বা চরম ডানপন্থি দলের বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাধ্য হয়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নয়, সে আমলের বা প্রাগ-আধুনিক পলিটিক্সের যুগে প্রায় সব জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যেই ছিল। তারা অনেকটা এপিক মহাকাব্যের রথী-মহারথীদের মতো। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ, কিন্তু যুদ্ধের পরে (অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেলে) পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ-সখ্যের সম্পর্ক থাকত। ‘মহাভারত’-এর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে কুরু-পাণ্ডবরা পরস্পরের সঙ্গে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর যুদ্ধ করেছেন। সূর্যাস্তের পরে পরস্পরের শিবিরে গিয়েছেন মৃতদের প্রতি শোক-সমবেদনা জানাতে। এই নৈতিকতা বঙ্গবন্ধু ও তার যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এবং যাদের মধ্যে সেটা দেখা যেত না, তারা রাজনৈতিক মহলে দল-নির্বিশেষে নিন্দিত হতেন।
কিন্তু এসবই প্রাগ-আধুনিক রাজনৈতিক যুগের কথা। ৭৫-এর আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও তাদের প্ররোচিত বা প্রেরিত ঘাতক বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের নৈতিকতাবোধের কোনো লেশমাত্র ছিল না। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যান্ত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর গণহত্যায় কুশলী ঘাতক দলের কাছে প্রতিপক্ষ মানে শত্রুপক্ষ, আর শত্রু মানেই নিধনযোগ্য ছলে-বলে-কৌশলে। আমাদের দেশে ঘাতকরা ‘কৌশলের’ সূক্ষ্ণ আশ্রয় নেওয়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা এর চমকপ্রদ উদাহরণ।
ঘাতকদের মধ্যে পৌরাণিক নৈতিকতাবোধ না থাকলেও পুরাণের নিকৃষ্টতর উদাহরণকে তারা গ্রহণ করেছিল। ‘মহাভারতে’ মহারথী অশ্বত্থামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও রাতের অন্ধকারে শত্রু শিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পাঁচজন সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে নয়, যুদ্ধের বাইরে তা-ও নাবালক শিশুসন্তানদের হত্যা সবচেয়ে ঘৃণ্য হত্যা বা ‘ব্রহ্মহত্যার’ পর্যায়ে পড়ে। ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা অশ্বত্থামার পথকেই বেছে নিয়েছিল। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, স্ত্রী-পরিজন শিশুসন্তানকেও হত্যা করেছিল, এমনকি ভ্রূণ হত্যা করতেও তাদের বাধেনি। সেরনিয়াবত বা শেখ মনির পরিবারের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এসব হত্যা শুধু নির্মমতাই নয়, এটা সমস্ত ন্যায়নীতি ও ঔচিত্যবোধের বাইরে। এর জন্য অশ্বত্থামাকে যেমন পুরাণ অনুযায়ী অনন্তকাল ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটাতে হবে, তেমনি বাংলাদেশেও ১৫ আগস্টের প্রতিফল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বয়ে বেড়াতে হবে আরও দীর্ঘকাল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জেলহত্যার মতো পাশবিক হত্যাকাণ্ড। রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে সে রাতে যা ঘটেছিল তা অবিশ্বাস্য ও বর্ণনাতীত। মোসলেহউদ্দিনকে জেলগেটে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলেন না ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। কেননা সে উচ্চ স্বরে বলছিল যে জাতীয় ‘চার নেতাকে’ হত্যা করার জন্যই সে এসেছে জেলগেটে তার বাহিনীসহ এবং এসেছে প্রেসিডেন্টের আদেশেই! জেলার তখন বঙ্গভবনে যোগাযোগ করায় দাবির ন্যায্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ তার বইতে লিখেছেন এ বিষয়ে। তার বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামানের স্বহস্তে লিখিত জেলহত্যা রিপোর্টটি তুলে দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বরে লেখা প্রতিবেদনে বলা হয় যে চারজন সেনাসদস্যসহ ক্যাপ্টেন মোসলেহ জেলগেট পৌঁছান এবং বলেন তিনি চার বন্দি জাতীয় নেতাকে ‘গুলি করবেন’। ‘এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই।’ এই ছিল জেলারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। পরে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে প্রথমে মেজর রশিদ ও পরে প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের সঙ্গে তার কথা হয়। কর্নেল হামিদ লিখেছেন : ‘জেলগেট থেকে আইজি প্রিজন সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেলগেটে মোসলেহউদ্দিনের আগমন ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢোকার নির্দেশ দেন। হতবাক আইজি! খোদ প্রেসিডেন্ট বেআইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আইজি-ডিআইজি কী করতে পারে? ঘটনার ২১ বছর পর বর্তমানে জেলহত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি জেলখানার আইজি প্রিজনের কক্ষে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে ছিল। এতে দেখা যায় খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদ চার জাতীয় নেতাকে হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ প্রদান করেন।’
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা সহিংসতার সমস্ত নিয়মনীতি অতিক্রম করে আমাদের সমাজকে সহিংস করে তোলে। এ রকম সমাজে-রাষ্ট্রে সব ধরনের সহিংসতাকেই অনুমোদন দেওয়া সম্ভব (এরই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা করা সম্ভব হয়েছে)। এ ধরনের সহিংসতার সংস্কৃতি কোনো সমাজে একবার গেড়ে বসলে তার মূলোৎপাটন সহজ নয়। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর ঘটেছিল বলেই নির্মমতার একটি সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রজীবনেও এক দীর্ঘ অশুভ ছায়া ফেলেছিল। ১৯৭৬-৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলের শুরুর পর্যায়ে অনেকগুলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়েছিল। সেগুলোর বিচার হয়েছিল লাতিন আমেরিকার কায়দায়- সামরিক শাসন নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেনি।
[ক্রমশ]