বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব :: ১০৬
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]


এ রকমই ছিল বাকশাল গড়ার পটভূমি। এমনটাই আমি ভাবতে চাই। বাকশালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর মধ্যে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই প্রতিশ্রুতির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর যেটা ধূসরতম দিক সেটাও ৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনের অব্যাহত নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষিতে আজ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হয়। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে এমন কিছু প্রগতিশীল সংস্কার এটি আনতে চেয়েছিল, যা পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক যে কোনো যুগের অবাধ বাজার অর্থনীতির অন্ধ অনুসরণের মানদণ্ডে আজ নিছক ঘোষণা হিসেবেও বিস্ময়কর ঠেকে বৈকি। বাহাত্তরের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে বাকশালের কর্মসূচি শুধু ধারণই করেনি, একে বাস্তবায়ন করার কনক্রিট প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সামনে সত্যি বলতে গেলে আর কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পন্থা খোলাও ছিল না সেদিন। কী করতে পারতেন তিনি সেদিন? সিপিবি-ন্যাপের বক্তব্য ছিল দেশ বাঁচানোর জন্য একটি ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ গঠন, যেখানে এ দলগুলো আরও বেশি ‘স্বতন্ত্র’ সত্তায় বিচরণ করতে পারবে। মুজিব যে কোনো কারণেই হোক সেই পথে এগোতে চাননি। তিনি একটি নতুন দল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কথিত জাতীয় ফ্রন্টের সবাই থাকবে। বিষয়টি সেদিক থেকে দেখলে একান্তভাবেই ‘ফর্মের’ বিষয়। দেশের স্বার্থে নিজেকে বা তার হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙচুর করে নতুন ‘ফর্মের’ সন্ধান করতে হয়েছিল তাকে। এ নিয়ে তার বেদনাবোধের পরিচয় পাই ২৫ জানুয়ারির (১৯৭৫) ভাষণের একাধিক মুহূর্তে। দেশের কঠিন অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বাকশালের সম্ভাব্য ভূমিকা একটি কেবল আপৎকালীন প্রয়োজনীয়তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এক গুচ্ছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদাহরণ :
১. নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন সম্পর্কে বললেন :’সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পিকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করছে, এ কথা যেন কেউ মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে।’
২. বিরাজমান রাজনৈতিক অরাজকতা নিয়ে মন্তব্য করলেন :’বিশৃঙ্খল জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আজ যাকে arrest
করব, বলবে যে, আমি অমুক পার্টির লোক। একে arrest করব, অমুক পার্টির লোক। ওকে arrest
করব, অমুক পার্টির লোক।’
৩. দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে মুজিব বলেন, ‘বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, … এই সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে Constituent Assemblyর যারা সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেও কয়েক জনকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, আমরা যা কোনোদিন দেশে শুনি নাই, ঈদের নামাজের জামাতে, এই সংসদের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাদের হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হয়েছে তাদের, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা।’
৪. পাক-মার্কিন নীতির অনুসারী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল এবং পাক-চীন নীতির অনুসারী উগ্র বামপন্থি শক্তির দিকে (এর মধ্যে জাসদকেও আগ বাড়িয়ে রাখতে হবে) ইঙ্গিত করে মুজিব বলেন, ‘কোন রাজনৈতিক দল, যাদেরকে আমরা অধিকার দিয়েছিলাম, একটা কোনোদিন condemn তারা করেছে এদের বিরুদ্ধে? না, তারা condemn করেনি। তারা মুখে বলেছে- অধিকার চাই। তারা মিটিং করেছে, সভা করেছে। পার্টি করতে তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করেছে তারা? আমরা বলেছি, যা আমাদের সংবিধানে আছে যে, ভোটের মাধ্যমে তোমরা সরকারের পরিবর্তন করতে পার। সে ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম বাই-ইলেকশনের মাধ্যমে। বাই-ইলেকশনসমূহ আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি, জনগণ তাদের ভোট না দিলে আমরা কী করব? তখন তারা বলেছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। মুখে তারা বলেছে- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি। তারা অস্ত্র জোগাড় করেছে, সেই অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে।…আর, তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ঘরে ঢুকে শৃগাল-কুকুরের মতো মানুষকে হত্যা করেছে।’
৫. বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন :’বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা hot bed of international clique হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেওয়া হয়, এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হয়।’
৬. এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দুর্গতি। এ নিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন বঙ্গবন্ধু :’আজ সত্যি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। কারণ, আমরা কী নিয়ে শুরু করেছিলাম?…আমাদের food কিনতে হয়। আমাদের food deficit কত? আমাদের এখন নানা রকম কাজ। মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যায়। আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তার পরে বাংলাদেশে হলো draught। তারপর হলো সারা দুনিয়াজুড়ে inflation।…শুধু আমরা না, সমস্ত দুনিয়ায় যারা অনুন্নত দেশ, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আসল ভয়াবহ বন্যা। এত বড় বন্যা আমার জীবনে আমি দেখেছি কিনা, সন্দেহ। না ছিল খাবার। ৫৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং relief operation চালানো হলো।…বাঁচাতে পারলাম না সকলকে।…এখনও মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। গায়ে তাদের কাপড় নাই।’
৭. এই দুঃখী মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য সাময়িককালের জন্য হলেও কিছু নতুন পরিবর্তন আনতে হয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় :’আমি একদিন তো বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব, যে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের, এবং সেজন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে।’
৮. এটা কোনো একনায়কের কথা নয়; দেশবাসীর কাছে আবেদন করছেন তিনি। ব্যাখ্যা করছেন কেন নিজের বিরুদ্ধে তাকে যেতে হচ্ছে :’আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব। আজ আপনারা constitution সংশোধন করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন, আমার দুই-তৃতীয়াংশ majority দরকার। তা আমার আছে। মাত্র ৭ জন ছাড়া সমস্ত সদস্যই আমার। তবু আপনারা amendment করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না আমার। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না- এটা কম দুঃখ নয় আমার।’
৯. এর পরে এলো ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রসঙ্গ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘প্রথম বিপ্লব’:’তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ, একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই, This is our Second Revolution। এই Revolution আমাদের এই Revolution হবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর অর্থ :অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’
১০. সবশেষে সবাইকে আহ্বান জানালেন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে :’আমি এই হাউস থেকে, জনাব স্পিকার, আপনার মাধ্যমে দেশবাসীকে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলব, যারা দেশকে ভালোবাসেন, চারটি principleকে ভালোবাসেন- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা; এই চারটিকে, তারা আসুন, কাজ করুন। দরজা খোলা আছে। সকলকেই আহ্বান জানাচ্ছি, যারা এই মতে বিশ্বাস করেন।…দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’
যদি তার এই ডাক শুনে কেউ না-ও আসে, তাহলে একলাই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে এবং স্রোতের বিপরীতে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এ জন্যই অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনে গুনগুন করে গাইছিলেন এই ভাষণের দুই সপ্তাহ আগে- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে….’। ৬-দফার সময়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র চলাকালীন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের পর্বে, ৭ মার্চের ঘোষণায়, ২৫ মার্চের কালরাতে রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্বে আলটিমেটলি এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একাই নিতে হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন সে সময়ে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ছিল কেবল তার একার। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের পর থেকেই এটা দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো পথ তার সামনে খোলা ছিল না।
আগেই বলেছি, বাকশাল বাস্তবায়ন করার সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অভিপ্রায়টি স্পষ্টই ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন। বাকশালের গঠনতন্ত্রের প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছিল সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের চেয়েও আরও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে মানবাধিকার, স্বাধীনতা, শোষণমুক্ত, সুষম বণ্টনের ‘সাম্যভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সেখানে। এর সাম্প্রতিক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ৭ জুন, ১৯৭৫ (শনিবার) বাংলাদেশ গেজেটের সংখ্যায় বিধৃত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’:
‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত একক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ- বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, নর-নারী ও ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং মানব-সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি, মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃস্টি, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন, কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতি ও অনগ্রসর জনগণের উপর শোষণ অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ক্রমিক যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের প্রসার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান, মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিকতর কর্মসংস্থান, বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ গণমুখী সার্বজনীন সুলভ গঠনাত্মক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-স্বাস্থ্য রক্ষাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণের মৌলিক সমস্যাবলির সুসমাধান, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, বিচার-ব্যবস্থার কালোপযোগী জনকল্যাণকর পরিবর্তন সাধন এবং গণজীবনের সর্বস্তর হইতে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা- এ সকল নীতিসমূহ ও উদ্দেশ্যাবলী সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে রূপায়িত করিতে…সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিবে।’
মিথ্যে ইউটোপিয়ার কথা দেশবাসীকে সেদিন শোনাচ্ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজের একান্ত বিশ্বাসের কথাই বলছিলেন। আবারও বলছি, এটি কোনো তৃতীয় বিশ্বের একনায়কের কথা নয়। বরং সমাজ বদলের লড়াইয়ে যার সামনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন একজন ডেসপারেট মানুষের উপলব্ধি ছিল কথাগুলো :
‘আজকে আমাদের কথা কী? আমাদের শোষণহীন সামাজ গড়তে হবে। এটায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজকে থেকে নয়, আপনি মেম্বার ছিলেন প্রথম দিন থেকে, স্পিকার সাহেব। আপনি জানেন, এই দল এই সংজ্ঞা নিয়ে সংগ্রাম করেছে। কারও কাছে কোনোদিন আপস করে নাই, মাথা নত করে নাই। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি, নতুন পয়সাওয়ালা এদের কাছে আমার আত্মবিক্রয় করতে হবে? এদের অধিকারের নামে এদেরকে আমরা ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দিতে পারি না। কক্ষণও না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই, দিতে পারে না।’
বাকশাল এই একক জাতীয় রাজনৈতিক দল বা মঞ্চ কি পারত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে? আয়েন্দে কি সফল হতে পারতেন? অ-ধনবাদী বিকাশের পথে চলতে আগ্রহী এমন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ প্রশ্ন আজ তোলা যায়। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেক দূর পর্যন্ত সফল হতো। উদেশ্য পূরণ হলে আবারও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পরিচিত ছকে ফিরে যেতেন তিনি। সামগ্রিক বিষয়গত ও বিষয়ীগত ফ্যাক্টর বিচার করেই এ রকম বলা যায়।
প্রথমত, যে সময়ে বাকশালের গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় (অর্থাৎ জুন, ১৯৭৫) সে সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শুভ পরিবর্তনের চিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৯৭৩/৭৪ সালের ওপেক দেশভুক্ত জোটের সিদ্ধান্ত ও তার প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি-তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা ক্রমশ কমে আসতে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। বিদেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে থাকে। খাদ্যশস্যের দাম কমে আসতে থাকে এবং এর জোগানও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ ও ৭৪ পরপর দু’বছরের বিধ্বংসী বন্যা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ পার হয়ে দেশে প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ফলনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটা ঠিক যে, উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রযুক্তি, বিশেষত শুকনো মৌসুমের বোরো ধানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সাফল্য আসে আরেকটু পরে। উফশী ধানের অধিকাংশ জাতই উদ্ভাবিত হয় ১৯৭৫ সালের পরে। যেমন, বি.আর-১ (চান্দিনা) বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালে; বি.আর-২ (মালা) ১৯৭১ সালে; বি.আর-৩ (বিপ্লব) বেরোয় ১৯৭৩ সালে; বি.আর-৪ (ব্রিশাইল) বের হয় ১৯৭৫ সালে; বি.আর-৭ (ব্রি-বালাম) ১৯৭৭ সালে; বি.আর-৮ (আশা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-৯ (সুফলা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-১০ (প্রগতি) ও বি.আর-১১ (মুক্তা) ১৯৮০ সালে। অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উফশী ধানের প্রযুক্তিতে নতুন নতুন জাত সংযোজিত হতে থাকে, যার সূচনা কেবল বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা চলে, দু-তিন বছরের মধ্যেই দেশের খাদ্য-পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চলে আসত অবজেকটিভ নিয়মেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুফল দুঃখী মানুষের মধ্যে নিজের হাতে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। এদেশের কৃষি গবেষণার ভিত্তি গড়ে ওঠা অবধি শুধু দেখে যেতে পেরেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, শুধু অর্থনৈতিক (বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটজনিত মূল্যস্ম্ফীতি বা দেশের ভেতরে কৃষিপ্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রসার) দিক নয়, সাংগঠনিক দিক থেকেও বাকশাল দু-তিন বছরের মধ্যে একটি সক্ষমতর রাজনৈতিক মঞ্চে রূপান্তরিত হতে পারত। আমার আশাবাদের কারণ, সে সময়ে বাকশালের ভেতরে সিপিবি-ন্যাপ এ দুই প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন থেকে এক ঝাঁক সাংগঠনিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে আগ্রহী হয়ে এই সমাবেশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এবং এ রকম আরও ঘটুক, তার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিকে গড়ে ওঠা স্বল্পস্থ্থায়ী আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবির ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর মূল ব্যক্তিত্বরা বাকশালের এক মঞ্চে আবার একত্র হয়েছিলেন দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের বৃহত্তর রাজনৈতিক তাগিদে। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই দলীয় পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে এক মঞ্চে জড়ো হতে চাননি ঠিক (এ প্রসঙ্গে অচিরেই আসছি), কিন্তু এই একত্র-সমাবেশের সাংগঠনিক ফলাফল হতে পারত অভূতপূর্ব। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা আন্দোলনের মূল ভরকেন্দ্রগুলো বাকশালে ধারণ করা হয়েছিল। বাকশালের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ‘পরিচালনা কমিটি’ তথা নেতৃত্বে বামপন্থিদের লক্ষণীয় উপস্থিতি ছিল। কৃষক সংগঠন পরিচালনার জন্য ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মণি সিংহ, পীর হাবিবুর রহমান, জীতেন ঘোষ, বজলুর রহমান প্রমুখ। শ্রমিক সংগঠন পরিচালনার জন্য ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মনজুরুল আহসান খান, আবদুস সালাম খান প্রমুখ। মহিলা সংগঠনের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মালেকা বেগম, আয়শা খানম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ। যুব সংগঠনের ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম, মতিউর রহমান প্রমুখ। ছাত্র সংগঠনের ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল-আলম লেনিন, মাহবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। মনে রাখতে হবে, শুধু দু’জনের অন্তর্ভুক্তি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা) ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য ‘ক্রিয়াশীল গণপরিষদ’কে মাতিয়ে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, এতজন প্রতিভাবান বামপন্ িবুদ্ধিদীপ্ত সাংগঠনিক প্রতিভা বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা অঙ্গ সংগঠন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হলে সংগঠনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে (ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে) একটি শুভ ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা অবাস্তব ছিল না। অধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রসর হওয়া এমন অনেক দেশেই এ রকম এক দল বা এক মঞ্চ গড়ার উদাহরণ ইতোপূর্বে (ও পরে) দেখা গেছে। অর্থাৎ সাংগঠনিক দিক থেকে নিতান্ত ‘হিউম্যান রিসোর্স’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও বাকশালের সাংগঠনিক রূপরেখা ও কর্মপদ্ধতি কালক্রমে যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারত।
তৃতীয়ত, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও সংগঠন-প্রক্রিয়া বাকশালের গণভিত্তিকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করতে পারত। মহকুমা প্রশাসনকে জেলা প্রশাসনে রূপান্তর করে জেলা পর্যায়ে ক্ষমতা-কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীভবন ঘটার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিচার-ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীভবনের প্রশ্নর আলোচিত হচ্ছিল। শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীভবন নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিজ নিজ এলাকায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ‘বহুমুখী সমবায়’ গড়ে তোলার জন্য। এর বস্তুগত ভিত্তি ছিল গোটা গ্রামের ‘সোশ্যাল মোবিলাইজেশন’। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে সমতামুখী সমাজের আদর্শ ও সংগঠন সম্প্রসারিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনাও খুলে যায়।
চতুর্থত, ভাবাদর্শগত লড়াইয়ের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল বাকশাল কাঠামোয়। এর গঠনতন্ত্রের ৮ম ধারায় ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, দলের সদস্য ‘নিজের রাজনৈতিক এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট থাকিবেন, দলের প্রচারিত পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য পাঠ করিবেন এবং প্রচার করিবেন।’ সেখানেও ‘গঠনমূলক আলোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য পরিচালনা পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন’ করার কথাও বলা হয়েছিল। এসব বাক্যে বামপন্থি ভাষাভঙ্গির প্রভাব আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু বাস্তবিকই নতুন দল গড়ে নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে কথা তিনি ‘৭২ সাল থেকেই অনেক বার বলে এসেছেন। সমাজতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না- এ উপলব্ধি তার বহুবার হয়ে থাকবে।
পঞ্চমত, বাকশাল কর্মসূচি সফল হওয়ার বড় চাবিকাঠি ছিলেন মুজিব নিজেই। তিনি একাই ছিলেন এ কর্মসূচির রক্ষাকবচ। এটি বাস্তবায়নে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতিও ছিল না। পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধাচরণ করলেও তিনি প্রতিকূলতার সামনে নুয়ে পড়ার মানুষ নন। তদুপরি অনেক নেতার মধ্যেই যা দেখা যায়নি অতীতে, তার ছিল প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞান। এ কথা বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জোরের সঙ্গে বলেছেন। রাজনৈতিক কলাকৌশল, সুবিবেচনাবোধ তার ও তার অগ্রজ প্রজন্মের ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের মধ্যে টানটান ছিল। অনেক বামপন্থি নেতার তুলনায় এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে ছিলেন। বাকশালের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হচ্ছে ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে। কিন্তু কার্যত এটি ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে উপদল বা গ্রুপ গড়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না থাকলেও এর উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। হায়দার আকবর খান রনো-রাশেদ খান মেনন এদেরকে দলে আকৃষ্ট করার জন্য বলেওছিলেন সেই সম্ভাবনার কথা- সে কথা কিছু আগে আমি উল্লেখ করেছি (বলশেভিক পার্টিতেও এমন আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল)। এত তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যায় বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবির তরুণ নেতৃত্বকে বাকশালের অঙ্গ সংগঠনে সম্পৃক্ত করলে সেসব প্রতিষ্ঠান আর আগের গতানুগতিক ধারায় চলতে পারবে না- এটিও তিনি হিসাবে নিয়েছিলেন। সাংগঠনিক, আদর্শিক ও মানসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি এ দুই ধারার একত্র-সমাবেশের মধ্য দিয়ে কালক্রমে একটি নতুন ‘রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি’র বিকাশ ঘটবে দলের ভেতরেই- এটা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত ছিল না। এর মধ্য দিয়ে তার নিজেরও সত্তার প্রগতিশীল রূপান্তর ঘটতে পারত; যেমনটা ঘটেছে কিউবার কাস্ত্রো বা যুগোশ্নাভিয়ার টিটোর বেলায়। আমার কল্পনায় এ রকম সম্ভাবনা অপার্থিব বলে মনে হয় না।
আগেই বলেছি, বাকশালের গঠনতন্ত্র ও সংগঠন সম্পর্কিত উপরোক্ত বিবরণীটি নিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ জুন। এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বাকশাল গঠনের একান্ত প্রাথমিক ও অস্ম্ফুট পর্যায়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অস্ম্ফুট বলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাকশালের কোনো  causal link নেই। যে জিনিস বাস্তবায়নই হয়নি, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রশ্ন ওঠে না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল না করলেও তাকে হত্যা করা হতো। হত্যা করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল তার হত্যাকারীরা বহুদিন থেকে। এখন যে প্রায়ই বলতে শুনি, সেনাবাহিনীর ‘কিছু বিপথগামী সদস্য’ ঘটনাটি ঘটিয়েছে- সেটি নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। হত্যাকারীরা বিপথগামীপাড়ার মস্তান নয় যে হুট করে এমন কাণ্ড ঘটাবে। এর পেছনে ছিল দক্ষিণপন্থি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা। এই শক্তির অবয়ব জানা বা অন্তত অনুমান করা কঠিন নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান যারা ঘটিয়েছে, যাদের সমর্থনে বা প্রত্যক্ষ মদদে ঘটিয়েছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ বাহানায়; বাংলাদেশেও তারা সেভাবে ঘটিয়েছে। শুধু আমরা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতায় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি।
পূর্বাপর বঙ্গবন্ধুর শত্রুর অভাব ছিল না। এই শত্রুদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাকশাল কর্মসূচির আগে ও পরে এরা দেশের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় ছিল। নূহের নৌকার মতো সবাইকে ক্ষমাশীল উদারতায় জলে-ডোবা থেকে নৌকায় ওঠানোর উদারতা দেখালেও তার শত্রুদের চরিত্র-বদল হয়নি। বরং কালক্রমে তারা আরও জোটবদ্ধ হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এক জায়গায় তারা ছিল একমত- যে করেই হোক শেখ মুজিবকে উৎখাত করতে হবে। এ জন্য মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে রাজনীতিকদের খুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ কাউন্টার-রিভলিউশনের কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা থেকে শত্রুরা বিরত থাকেনি। অথচ এত ঝুঁকির কথা জেনেও বঙ্গবন্ধু নিজের সিকিউরিটি বিষয়ে ছিলেন একান্তভাবেই উদাসীন। মানুষ যে জন্তু হতে পারে- সেটা তিনি জানতেন। তাই বলে তার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ অস্ত্র উঁচিয়ে ধরতে পারে- এটি তার রাজনৈতিক কল্পনার বাইরে ছিল। যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃৃতির মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন; জেল-জুলুম অতীতে সয়েছেন; জেল থেকে বেরিয়েও এসেছেন; সে রকম মানস-আবহাওয়ায় ১৫ আগস্ট কল্পনাতীত ছিল।
[ক্রমশ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s