পর্ব ::১০২
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এটাকেই বিপ্লব-উত্তরকালের পরিপ্রেক্ষিতে ‘উত্তরণশীল পর্ব’ বা ট্রানজিশন পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালের অভ্যুদয় সোভিয়েত-চীন দেশের মতো ‘আর্থ-সামাজিক’ বিপ্লব ছিল না ঠিক, কিন্তু ‘বিপ্লব’ ছিল সর্বার্থেই। এবং বিপ্লব হয়ে থাকলে তার একটি ‘উত্তরণশীল পর্ব’ থাকবেই, যার মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে অতিক্রম করতে হয় একটি ‘পুরোনো ব্যবস্থা’ থেকে ‘নতুন ব্যবস্থায়’ পৌঁছানোর জন্যে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টার মতোই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর রাস্তা কোন পিচঢালা মসৃণ পথ ছিল না। এতে ছিল চড়াই-উৎরাই-অপ্রত্যাশিত বন্যা ও দুর্ভিক্ষের ছোবল। এরকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিপ্লবের পরে অবস্থা বুঝে আঁকাবাঁকা পথের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তখন পিছু হটলে সাইডলাইনে থাকা তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ ভদ্রলোকেরা দুয়ো দুয়ো করে ব্যঙ্গ করতে থাকে। তারা তখন বলতে থাকে, ”খুব তো বড় মুখ করে ‘সমাজতন্ত্র’ করতে চেয়েছিলে, এখন বোঝ। সেই তো পিছু হটতে হচ্ছে তোমাদের। পাহাড়ে উঠতে চেয়েছিলে সাত-পাঁচ না ভেবে। অথচ এখন দেখছ রাস্তাটা ডেডএন্ডে আটকে গেছে। এখন তো তোমাদের ফিরে আসতে হবে নিচে। নামতে নামতে তারপরে বের করতে হবে আবার উপরে ওঠার রাস্তা। তা-ও খুঁজে পাবে কিনা তার কী গ্যারান্টি?” এরকম তির্যক তিরস্কার চারপাশ থেকে ধ্বনিত হতে থাকবে। বিপ্লবীদের পরাজয়ে যারা সবসময়ই এরকম অযাচিত উপদেশ আর তিরস্কার বাণী বর্ষণ করে থাকে। বঙ্গবন্ধুকেও ১৯৭২ সাল থেকেই এ ধরনের তিরস্কার-গঞ্জনার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছিল। মুজিব ঠিকই জানতেন যে এটা সেই দেশ যেখানে দশজন ভিলেন মিলে- ঘরে-বাইরের শত্রুরা একযোগে-যখন একজন নায়ককে পেটায়, তখন চারপাশের উৎসুক জনতা ভিড় করে তারিয়ে তারিয়ে সেদৃশ্য উপভোগ করে। এরাই সেই জনতা যারা সফল হলে মাথায় চড়িয়ে নাচতে থাকে, আর বিফল হলে মাটিতে মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করে না। মুজিব এটা জেনেও পিছু হটে অন্য রাস্তা খুঁজতে দেরি করেননি। ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ডেভেলপ-এরকম একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হতে চেয়েছেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ সূচনা করে। তার সহযোগীদের বলেও ছিলেন সেকথা।
দ্বিতীয় বিপ্লব যে উত্তরণশীল পর্বের একটি ‘সাময়িক কর্মসূচি’ ছিল এর নানা সাক্ষ্য পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি। প্রথম প্রমাণ হিসেবে শেখ হাসিনার নিজের স্মৃতিচারণাকে পেশ করতে চাই। ১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনা এ বিষয়ে লিখেছেন:
”আজ যখন আমরা জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছি তখন বার বার আব্বার কথা মনে পড়ছে। যখন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী দিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন এবং সকল রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে একই মঞ্চে সমবেত করে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। তখন একটা নতুন সিস্টেম দাঁড়ালো। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সারাজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, এখন এই পদ্ধতিতে কেন গেলেন?’
তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, একটা বিপ্লব হয়েছে। যে কোন বিপ্লবের পর সমাজে একটা বিবর্তন আসে, আমাদের সমাজেও আসবে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হবে এবং এর বিস্তৃতিও হবে-যার প্রভাব পড়বে সমাজ ব্যবস্থার উপর। কিছু মানুষ হঠাৎ করে প্রচুর টাকার মালিক হবে-সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব বাড়াতে নির্বাচন করবে শুধু টাকার জোরে; এর প্রভাব নির্বাচনের উপরও পড়বে। দেখা যাবে টাকা ও লাঠির জোরে নির্বাচন হচ্ছে। সত্যিকার সমাজসেবক বা দেশপ্রেমিক বা আদর্শবান যারা তারা এদের সাথে টাকা ও লাঠির জোরে পেরে উঠবে না। তাই এমন একটা ব্যবস্থা করতে চাই অন্তত কিছু দিনের জন্য যাতে কালো টাকা ও পেশিশক্তি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারে। একটা সাধারণ নির্বাচন যদি এভাবে হয় তাহলেই মানুষের চক্ষু খুলে যাবে আর মানুষকে কেউ ধোঁকা দিতে পারবে না। আর এ ব্যবস্থা মাত্র ৩/৪ বৎসরের জন্য; পরে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব।”
উপরের উদ্ধৃত অংশের সারাংসার নিহিত ছিল একটি বাক্যে। চতুর্থ সংশোধনী ও পরবর্তীকালে বাকশাল গঠন একটি প্রয়োজনীয় নিদান ছিল সেদিনের সমস্যা মোকাবিলায়। কিন্তু এটি ছিল সাময়িককালের জন্যে :’মাত্র ৩/৪ বৎসরের জন্য; পরে আবার আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব।’ এই একই কথা বলেছেন আমাকে প্রাক্তন আমলা ও অর্থমন্ত্রী এম. সাইদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের শেষ কয়েক মাসে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে থেকে কাজ করেছিলেন তিনি। একবার বঙ্গবন্ধুকে বাকশালের আয়ুস্কাল নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। উত্তরে বঙ্গবন্ধু কোনো কথা না বলে হাতের তিনটি আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন-‘তিন বছরের জন্য’। সাইদুজ্জামান আমাকে আরও জানান যে অবস্থা মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতি থেকে কিছুকালের জন্যে হলেও ‘সরে আসতে হবে’ (কেননা সব অথেনটিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেই এটা করতে হয়েছে) একথা বলেছিলেন খোদ ফিদেল ক্যাস্ট্রো নিজে। ক্যাস্ট্রো স্বয়ং এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলেন পরবর্তীকালে কানাডায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত (যিনি যুগপৎ কিউবারও দায়িত্বে ছিলেন) কর্নেল নুরুজ্জামানকে। তবে আইডিয়াটা শুধু ক্যাস্ট্রোর থেকেই উদ্গাত হয়েছিল তা নয়। অন্য উৎসের থেকেও পরোক্ষ সমর্থন মিলেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাময়িক পর্বের জন্য বাকশাল গঠনের বিষয়ে সমর্থন দিয়েছিল? এ বিষয়ে কিছুটা পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়। মতিউর রহমান তার ‘বাকশাল-কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রবন্ধে লিখেছেন: “এমন একটি কথা প্রচারিত আছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর পেছনে বাংলাদেশের ‘মস্কোপন্থি’দের প্ররোচনা ছিল। এবং তাদের পরামর্শেই ওই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছিল সেদিন। এসব কিছুর পেছনে ‘সোভিয়েতের হাত’ রয়েছে, এমন কথাও বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এর সমর্থনে কেউ কোনো সত্য তথ্য দিতে পারেনি। প্রচারিত এ তথ্য অসত্য।” এ প্রসংগে মতিউর রহমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের উদাহরণ দিয়েছেন। একাধিক বইয়ে মনিরুজ্জামান দাবি করেছেন, ”একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশের অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের ঢাকাস্থ দূতাবাসের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের দুজন বড় নেতাকে ‘এক দল’ করার জন্য প্রভাবিত করেছিল।” মতিউর রহমানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, ‘এসব তথ্যের সমর্থনে কোনো সূত্র বা তথ্য হাজির করেন নি তালুকদার মনিরুজ্জামান। সে জন্য তাঁর বইয়ের কোনো পাঠকের পক্ষে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ নেই।’
সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (১৯৭২-৭৫ পর্বে ডাকসুর সহসভাপতি) অবশ্য কিছুটা ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন বাকশাল প্রসংগে সোভিয়েত-দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। আমাকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, সোভিয়েতের বার্তা ছিল কিছু অস্পষ্ট। বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘এক দল’ করা যাবে না এমন কোনো কথা নেই বিপ্লবের জ্ঞানকোষে, আবার সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য এক দল ‘করতেই হবে’ এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। এই বার্তাই নাকি সোভিয়েত পার্টি তখন ভ্রাতৃপ্রতিম সিপিবিকে জানিয়েছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি সাপেক্ষে এক দল করলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না এমন একটি মনোভাব সোভিয়েত তরফ থেকে ব্যক্ত হয়েছিল-যেটি পূর্বে উল্লেখিত কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পরামর্শের সঙ্গে মিলে যায়। চুয়াত্তর সাল থেকেই এরকম একটি সার্বিক উপলব্ধি জেগেছিল যে গতানুগতিক বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সেটি যেমন জেগেছিল বঙ্গবন্ধুর মনে, তেমনি ন্যাপ-সিপিবির নেতৃত্বেও বড় অংশের মধ্যেই। সেটা হতে পারে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এবং সিপিবির রাজনৈতিক শক্তিকে একক প্ল্যাটফর্মে একত্র করার মাধ্যমে (নিজ নিজ দলের স্বতন্ত্র পরিচয় রাজনৈতিক মঞ্চের ভেতরে বাইরে অক্ষুণ্ণ রেখেই)। অথবা, প্রয়োজন বোধে, কৌশলগত কারণে দলীর স্বাতন্ত্র্য বাইরে প্রকাশ্য না করে আপাতদৃষ্টিতে ‘এক দল’ গড়ার মাধ্যমে। শেখ মুজিব নিজে ‘এক দলের’ মধ্যে এরকম ‘বিভিন্ন গ্রুপের’ সমাবেশ স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো স্মৃতিচারণা করেছেন যে বঙ্গবন্ধু তাঁকে এবং রাশেদ খান মেননকে বাকশালে যোগ দিতে বলেছিলেন। তখন তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আপনার দল তো নানা ধরনের লোকের খিচুড়ি। আপনার দলেই গাজী ভাইয়ের এক দল, মনি ভাইয়ের আরেক দল, তার মধ্যে আবার মস্কোপন্থিদের নিয়েছেন!… এবার আপনি বলেন, কোন উপদলের সঙ্গে থাকবো, মনি ভাইয়ের সঙ্গে, রাজ্জাক-তোফায়েলের সঙ্গে, না আর কারও সঙ্গে? আর তাদের অধীনে থাকবোই বা কেন?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোরা নিজেরাই একটা গ্রুপ হয়ে যা, সোজা চলে আসবি আমার কাছে, একেবারে আমার বেডরুমে!’ অর্থাৎ এক দলের বাতাবরণে বিভিন্ন গ্রুপের অস্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সম্ভবত সিপিবি’র তৎকালীন নেতৃত্বের মধ্যেও এরকম সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়ে থাকবে। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে থাকতে পারলে ভালো, নইলে নির্দিষ্ট গ্রুপ, ধারা, উপদল বা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে থেকে গিয়ে দেশকে আপাতত সংকটের খাদ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। চুয়াত্তরের মে মাসেই সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটি দেশের পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয় (মতিউর রহমানের বয়ান থেকে উদ্ধৃত করছি):
“বাংলাদেশের সমস্ত পরিস্থিতি আজ এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হইয়াছে।’ সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করে বলা হয়েছিল, ‘শাসক দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট ও সরকারের বহুবিধ দুর্বলতা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে কঠিন ও জটিল সমস্যা হিসেবে উপস্থিত হইয়াছে। দেশ অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।’ তাই স্বাধীনতা ও প্রগতির বিরোধী সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বক্তব্য তুলে ধরে যে, ‘একটি সার্বিক কর্মসূচির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রকৃত সৎ ও প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক দল ও ব্যক্তিদের লইয়া শরীক দলসমূহের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়া এমন একটি মৈত্রী জোট গড়িয়া তোলা প্রয়োজন, যে জোট ক্রমান্বয়ে সর্বস্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিবে এবং সিদ্ধান্ত কার্যকরীকরণের ক্ষেত্রেও যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ চুয়াত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের বেশ কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। এসব আলোচনা থেকে এটা জানা যায় যে, তিনি দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন। সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মতিউর রহমান আরও জানিয়েছেন যে, ‘বাকশাল’ একক দল গঠনের বিষয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের মধ্যে কিছু উৎসাহ ছিল তৎকালীন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য আমাকে বলেছিলেন। আর, কমরেড ফরহাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে এ প্রসঙ্গে ফরহাদ ভাইয়ের চিরকূট নিয়ে সকালে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের কাছে যাওয়া-আসা করেছি কয়েকবার। এটা পরিস্কার মনে আছে, জাসদ নেতা সিরাজুল আলম খানকে বাকশালে যোগ দিতে সম্মত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সে বৈঠক আমাদের বাসায় হয়েছিল। … সে সময়ে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। একাংশ একক দলে যোগ দেয়ার পক্ষে ছিলেন। তাদের মধ্যে অগ্রিম উৎসাহ ও আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। আরেক অংশের মতামত ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে। …এভাবেই মানুষের মধ্যে, এমনকি পার্টির ভেতরেও এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, কমিউনিস্ট পার্টি ‘বাকশাল’ গঠনে উদ্যোগী ছিল এবং ‘বাকশালের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে’।”
নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে বড় করে না দেখে দেশের বৃহত্তর তাগিদে বিভিন্ন প্রগতিশীল ধারা, উপধারা ও ব্যক্তিবর্গ সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সিপিবি-ন্যাপ তারপরও এটি মেনে নিয়েছিল পরিস্থিতির চাপে ও কৌশলগত কারণে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই দুটি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে স্বাধীনতার ও প্রগতির পক্ষের সকল শক্তিকে একত্র করার চেষ্টা করেছিল।
[ক্রমশ]