বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা

পর্ব ::৯৩
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]
এক অর্থে, মওলানা ভাসানীর মধ্যে ‘দ্বৈত-সত্ত্বা’ বিরাজ করছিল। একদিকে তিনি ছিলেন সামন্তবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ‘মজলুম জননেতা’। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন স্বভাবজ ধর্মগুরু- একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। এই ‘দ্বৈততা’ তাকে কৃষক-জীবনের সাথে অঙ্গীকৃত করেছিল। তিনি ছিলেন এই অর্থে (গ্রামসির ভাষ্যে) একজন ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল অব পেজেন্ট ক্লাস’। তবে দ্বৈততা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতা ও সর্ব ধর্মের মানুষকে সমানাধিকার দান এবং (সেই অর্থে) ধর্মনিরপেক্ষতাকে জোরেশোরে তুলে ধরার প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি। ‘রবুবিয়ত’ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য বা লেখা পড়লে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। রবুবিয়ত প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই এখানে। মওলানা ভাসানীর এই উপলব্ধির রাজনৈতিক তাৎপর্যের দিকে সাম্প্রতিককালে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসল কথা হলো, ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শের ওপরে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রভাব পড়েছিল। মার্কসবাদী ও অমার্কসবাদী উভয় সূত্র থেকেই ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ গড়ার স্বপ্ন তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। ন্যাপ গঠনের সময়ে ভাসানীর দর্শনে প্রগতি পন্থার ‘মার্কসবাদী’ প্রভাবের সূত্র আগেই উল্লেখ করেছি। এবার অমার্কসবাদী সূত্রের প্রভাবের কথা বলব।
আসামের বিপ্লবী দার্শনিক আল্লামা আজাদ সোবহানীর সাথে ১৯৪৬ সালের একটি সাক্ষাতের গভীর অভিঘাত পড়েছিল মওলানা ভাসানীর ভেতরে। আগেই বলেছি, ভাসানী মুসলিম লীগ ঘরানা থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করেননি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অসহযোগ আন্দোলনের নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা হাসরত মোহানী প্রমুখের চিন্তা ও চর্চা তার জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। ভাসানী এ নিয়ে লিখেছেন, আল্লামা আজাদ সোবহানী বলিলেন, ‘তবে আজ ওয়াদা কর তুমি রাজনৈতিক জীবনে যত কলাকৌশলই নাও না কেন মূলত হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের লক্ষ্যে সংগ্রাম করিয়া যাইবা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়িল ১৯৩৫ সালে আমরুহাতে ১৭ জন আলেম রাজনীতিবিদের সিদ্ধান্তের কথা। মনে পড়িল মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা হাসরত মোহানী, মওলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধী প্রমুখের সাথে আমার যোগাযোগ ও ওয়াদার কথা। আমার মনে পড়িল খিলাফত আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর সাহচর্যের কথা। আমি দেখিলাম যৌবনের উচ্ছ্বাস শেষে যে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়াছিলাম আজ প্রৌঢ় জীবনে সেই রাজনৈতিক দর্শনের দাওয়াতই আসিয়াছে।’ এই দর্শনের বিবরণ দেওয়া সহজসাধ্য নয়। এখানে বাহাত্তরের সংবিধানের সমতাবাদী চিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আলোচনার প্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানীর ‘পালনবাদ’ (বা অন্যত্র যাকে বলেছি ‘caring state) সেটির সাযুজ্য স্থাপন করাই আমার মূল লক্ষ্য।
পালনবাদের মূল কথা হলো যে এই জগতের কোনো কিছুই অহেতুক সৃষ্টি হয়নি। ‘সকল কিছুর অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না, সবকিছুকে বিশেষ উদ্দেশ্যে লালন-পালনও করিতেছেন। স্রষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে-রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রাব্বানিয়া। সে-রাষ্ট্রে থাকিবে স্রষ্টার পালনবাদ- মানুষের শাসনবাদ নহে।’
এই পালনবাদের প্রয়োগ ও আদর্শ হবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। এই বিষয়ে মওলানা ভাসানী লিখেছেন : ‘সকল সমস্যার সমাধান হইবে মানবজাতি যদি রবুবিয়তের অর্থাৎ স্রষ্টার পালনবাদের আদর্শে হুকমত কায়েম করিতে পারে। শিক্ষা-দীক্ষা, খাওয়াপরা, ইত্যাদির প্রশ্নে স্রষ্টার নিকট যেমন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি পরিচয়ের কোনো বালাই নাই- মানুষের দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার ক্ষেত্রে যেমন ভেদাভেদ নাই ঠিক তেমনি হুকুমতে রব্বানিয়ায় সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার দেওয়া হইবে। আজ আর কোনো সন্দেহ নাই। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে শাসন, শোষণ ও হানাহানি বন্ধ করিয়া মানবজাতিকে সুখী করিতে পারে।’
এখানে দ্রষ্টব্য যে ভাসানী রবুবিয়তের আদর্শ বলতে গিয়ে যেমন পবিত্র গ্রন্থের সাক্ষ্য টেনে আনছেন, তেমনি স্মরণ করছেন ফরাসী বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের’ বাণী। ভাসানী এরপরে বলবেন ‘ব্যক্তিগত মালিকানা’ উচ্ছেদের কথাও। যেটি এমনকি প্রথাগত বামপন্থিরাও (সংগত কারণেই) উচ্চারণ করেননি। মার্কস বা লেনিন কেউ সবধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ চাননি। কিন্তু ভাসানী এখানে অনেক বেশি ‘চরমপন্থি’- অন্তত ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদের প্রশ্নে। তার বয়ানেই শোনা যাক :
‘আমি যখন হুকুমতে রব্বানিয়ার কথা বলি তখন শুধু কমিউনিস্ট ও বামপন্থি রাজনীতিবিদরাই বিরোধিতা করেন না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপন্থি একশ্রেণির আলেম-ওলামা এবং ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদও প্রচণ্ড আপত্তি উত্থাপন করেন। আমি বলিয়া থাকি, সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ উহার আমানতদার মাত্র। তাই আল্লাহর নামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ প্রয়োজনের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে বণ্টন করিয়া ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করিতে হইবে। কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন বটে কিন্তু তাহাদের মতে উহা আল্লাহর নামে না হইয়া রাষ্ট্রের নামে হইতে হইবে। আলেম-ওলামারা সবকিছুতে আল্লাহর মালিকানা মানিয়া লইয়া থাকেন বটে কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কামনা করেন না। এইভাবে হুকুমতে রব্বানিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী দুইটি মতবাদ রহিয়াছে ইহা আমার অনুসারীদিগকে বুঝিয়া লইতে হইবে।’
মওলানা ভাসানীর এই নিজস্ব দর্শনে বামপন্থি চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে সরলীকৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা ভুল তথ্যের প্রকাশ দেখা যায়। মার্কসীয় দর্শনে- অন্তত সমাজতন্ত্রের পর্যায়ে- ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’ বা পুুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানা অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পূর্ণ উচ্ছেদ আবশ্যিক নয়। আর ‘পার্সোনাল প্রপার্টি’ অর্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের তো প্রশ্নই ওঠেনি কোনদিন। প্রাইভেট প্রপার্টি অর্থে ব্যক্তিগত মালিকানা লেনিনের নিউ ইকনমিক পলিসি, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নানা পর্বে, দেং শিয়াও পিং উত্তর চীনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতায় ভালোভাবেই স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে কালক্ষেপণ করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, ‘রবুবিয়তের’ কথা বলতে গিয়ে ভাসানী শুধু একটি বিশেষ ধর্মের কথাই বলেননি। তিনি বারবার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে অনুসৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সংজ্ঞা অনুসারী- তিনি সকল ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখছেন। আমার বক্তব্যের সপক্ষে আমি ভাসানীর এপ্রিল ১৯৭৪ সালের ভাষণ থেকে নিল্ফেম্নাক্ত উদ্ধৃতিটি তুলে ধরতে চাই :
‘আমি চাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েম করিয়া হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি মানুষের পার্থিব ও অপার্থিব চাহিদা পূরণ করিতে। ইহার সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নাই। তাই সকল ধর্মাবলম্বী উহার উপকারিতা ভোগ করিতে পারিবে। নিজ নিজ ধর্মীয় দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটিবে ইহাই আমার কামনা। যে-কেউ প্রশ্ন করিতে পারেন হুকুমতে রব্বানিয়া কীভাবে অমুসলমানদেরকে আপন করিয়া লইবে? যাহারা রবুবিয়তের মর্ম বুঝেন না তাহাদের এই প্রশ্ন করা খুবই স্বাভাবিক। রবুবিয়ত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল মানুষের জন্য হুকুমতে রব্বানিয়া অর্থাৎ যে-দেশে রবুবিয়তের আদর্শ রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে কায়েম হইয়াছে, কল্যাণকর বৈ কিছু নয়। মুসলমানদের জন্য যিনি রব বা পালনকর্তা, বিবর্তনকারী প্রভু, হিন্দুর জন্য তিনি একই বিধানে আলো-হাওয়া, ফল, পানি, বস্ত্র, খাদ্য সবই জোগাইতেছেন। একমাত্র রবুবিয়তের আদর্শই মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারে।’
যদি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা- যেভাবে সংবিধানে তা দেওয়া আছে- আমরা বিবেচনা করি, অর্থাৎ যেখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মের অপব্যবহার রোধ এসবকে তুলে ধরা হয়েছে- সেটি মানার জন্য নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস রেখেই সমতাবাদী সমাজ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হওয়া চলে। এর সাথে ধর্মহীনতা, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। মওলানা ভাসানীর বিশেষ ধরনের সমতাবাদী চিন্তা (তার ‘রবুবিয়তের’ তত্ত্ব সহ) এই চলার পথে সহজেই অঙ্গীকৃত হতে পারে। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ভাসানী এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর সর্বমানববোধের সাথে ইসলামী মরমি দর্শন, মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সুফিদর্শন, পরবর্তী কালের নদীয়াকেন্দ্রিক শ্রীচৈতন্য ও তৎপরবর্তী বাংলার বৃহত্তর বাউল-ফকিরি ঘরানার মূল কথা- অর্থাৎ ‘সবাইকে সমভাবে দেখা’- এর মৌলিক ঐক্যসূত্র রয়েছে। তবে ভাসানী অহিংসা-নীতিতে বিশ্বাস করতেন না। সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে গান্ধীর থেকে তিনি সুভাষ বসু, খ্রুশেভের থেকে তিনি মাওকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আজীবন বিপ্লবীদের অনুগামী। বিনা কারণে টাইম তাকে অভিহিত করেনি ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বলে।
পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথমত ও প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। মূলধারার রাজনীতিকে পুনর্গঠন করে ধাপে ধাপে তিনি প্রথমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তীতে একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ভাসানীর ইসলাম বা রবুবিয়তের দর্শনের মূল সর্বমানববাদী বক্তব্যে তার আপত্তি থাকার কথা ছিল না। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সবল সমাজ গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সব ধারা ও উপধারাকেই যৌক্তিক স্থান দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এইসব ধারা ও উপধারার মূল কথা হচ্ছে- সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করে সেকথা বললেন :
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ তারপরে আরো কিছু কথা বলার পরে তিনি বললেন :
‘আমি সর্বশেষ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করব, যেন এই দায়িত্ব আমরা সুচারুরূপে পালন করতে পারি। যে শহীদেরা আত্মাহুতি দিয়েছেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত সমাজের, আজকের বাংলাদেশের জনগণ আশা করে, যে সংবিধান-কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার মাধ্যমেই হবে তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন। আমি আল্লাহর নিকট আবার প্রার্থনা করি, যেন বাংলাদেশের জনগণের আশা পূর্ণ হয়।…জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মওলানা তর্কবাগীশ সাহেব মোনাজাত করে দোয়া করবেন।’
এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সমাপনী বক্তব্যের শেষ ক’টি লাইন। ধর্মনিরপেক্ষতার এই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার পরও এ নিয়ে যারা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তারা অবুদ্ধির বশবর্তী হয়ে সেটা করেছেন অতীতে (এবং এখনো ইউটিউবে-ফেসবুকে সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ জুড়ে করে যাচ্ছেন)। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা এই মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন দিবারাত্রি। তাদেরকে বোঝানো শক্ত। জ্ঞানমার্গ বা যুক্তি দিয়ে সবাইকে সবকিছু বোঝানো যায় না। না বুঝতে চাওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ, শ্রেণিগত স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ থাকে। ‘আইডিওলজি’ মোহমুক্তভাবে অনেক সময় সত্যকে দেখতে দেয় না। পারস্য-যাত্রীর শেষে রবীন্দ্রনাথ এদের উদ্দেশ্য করেই একটি গদ্য-কবিতায় বলেছিলেন :
‘হায় মানুষ! এই জগৎটা শুধু দৈহিক অহং-এর পুষ্টির জন্য নয়;
যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী মানুষের সন্ধান পাওয়া বড়োই কঠিন;
ভোরের পাখির সুরলহরী নিদ্রিত মানুষ জানে না
মানুষের জগৎটা যে কী, তা পশু কেমন করে জানবে।’
[ক্রমশ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s